লেখকঃ আবদুল জব্বার (জ্যোতির্বিজ্ঞানী)

লেখক পরিচিতি

আবদুল জব্বার (জ্যোতির্বিজ্ঞানী)

মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (জন্ম : ১৯১৫ - মৃত্যু : জুলাই ২০, ১৯৯৩) বাংলাদেশে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার অগ্রদূত। তিনিই প্রথম বাংলায় আকাশের তারাসমূহের ছক তৈরি করেন। তার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও পরিকল্পনায়ই বাংলাদেশের প্রথম খ-গোলক নির্মিত হয়। পেশাগত জীবনে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।

 

 

জীবনী

মোহাম্মদ আবদুল জব্বার ১৯১৫ সালে পাবনা জেলার সুজানগর থানার গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অসাধারণ মেধাশক্তি ও ফলাফলের জন্য তিনি প্রাথমিক শিক্ষা থেকে একেবারে মাধ্যমিক পর্যন্ত বৃত্তি পান। ১৯৩৮ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিশুদ্ধ গণিতে অনার্সসহ এম.এস.সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেছিলেন। এরপর ১৯৩৯ সালে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করতে লন্ডন যান। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তাকে ভারত সরকারের নির্দেশেই ফিরে আসতে হয়। দেশে ফিরে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে প্রভাষক হিসেবে চাকরি করেন। এরপর যোগ দেন চট্টগ্রাম কলেজে এবং সেখান থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজে।

১৯৪৮ সালে গণিত বিভাগের প্রধান হিসেবে তৎকালীন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান বুয়েট) যোগ দেন। এখানে প্রায় পনের বছর গণিত বিভাগের প্রধান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। শিক্ষকতার জীবনের শেষদিকে এসে তিনি প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের দায়িত্ব পান। ১৯৬২ সালে আহসানউল্লাহ ইঞ্জনিয়ারিং কলেজ পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। মোহাম্মদ আবদুল জব্বার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৬৮ সালে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কল্যাণ পরিচালক পদে নিযুক্ত হন এবং এই পদ থেকেই ১৯৮০ সালে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৪ সালে আবার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের (রূপান্তরিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক এম. এ. রশীদের নামে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় ডঃ রশীদ ফাউন্ডেশন। প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ আবদুল জব্বারকেই সর্বপ্রথম 'ড. রশীদ অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল জব্বার পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৩ সালের ২০ জুলাই তারিখে মৃত্যুবরণ করেন।

শিক্ষাজীবন

জন্মস্থান পাবনা জেলার সুজানগর থানার গোপালপুর গ্রাম। দুই বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে আবদুল জব্বার ছিলেন সবার ছোট। মিয়াজান মল্লিক প্রথম জীবনে মাঝি ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি স্বাধীনভাবে ছোট ছোট ব্যবসা শুরু করেন এবং এই ব্যবসার সীমিত আয় দিয়েই সংসার চালাতেন তিনি। মিয়াজান মল্লিক তাঁর বড় ছেলে মোহাম্মদ আবিদ আলীকে প্রথমে গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করান। পাঠশালার হেডপণ্ডিত শশী ভূষণ দাস মেধাবী আবিদ আলীকে বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেন। বৃত্তি পরীক্ষায় আবিদ আলী জেলার সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম হয়ে মাসিক দুই টাকা বৃত্তি লাভ করেন এবং স্কুলে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পান। আবদুল জব্বার এবং তাঁর মেজো ভাই আকবর আলীকেও হেডপণ্ডিত পাঠশালায় বিনাবেতনে পড়ার সুযোগ দেন।

গোপালপুর পাঠশালা থেকে বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মোহাম্মদ আবদুল জব্বার নিশ্চিন্তপুর উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর ১৯৩২ সালে সাতবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসেবে লেটারসহ ম্যাট্রিক পাস করেন। একই বছর তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে আই.এসসি. ভর্তি হন। ১৯৩৪ সালে তিনি এই কলেজ থেকে গণিতে লেটারসহ কৃতিত্বের সঙ্গে আই.এসসি. পাস করেন। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মুসলমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং বৃত্তি লাভ করেন। এরপর গণিতে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে বি.এসসি. ভর্তি হন তিনি। মেজো ভাই আকবর আলীর মতো রসায়নে অনার্স নিয়ে বি.এসসি. পড়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর। কিন্তু আই.এসসি. পরীক্ষায় গণিতে লেটার পাওয়ায় প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন বিভাগের তৎকালীন প্রধান ড. কুদরত-এ-খুদার পরামর্শে তিনি গণিত বিষয়ে অনার্স পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে গণিতে অনার্সসহ বি.এসসি. পাস করেন। মাত্র অল্প কয়েক নম্বরের জন্য তিনি প্রথম বিভাগ পান নি। এরপর গণিত বিষয়ে এম.এসসি. ডিগ্রি লাভের জন্য তিনি পড়াশোনা শুরু করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনিযুক্ত জার্মান অধ্যাপক এফ. ডব্লিউ. লেভি এম.এসসি. শ্রেণিতে মডার্ন অ্যালজেবরা নামে একটি নতুন বিষয় প্রবর্তন করেন। এই নতুন বিষয়ের একমাত্র ছাত্র ছিলেন আবদুল জব্বার। ১৯৩৮ সালে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এসসি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

গবেষণা[সম্পাদনা]
এম.এসসি. পাস করার পর অধ্যাপক লেভির সুপারিশে আবদুল জব্বার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গবেষণা-বৃত্তি লাভ করেন। এ বৃত্তি নিয়ে অধ্যাপক লেভির তত্ত্বাবধানে গবেষণা কাজ শুরু করেন তিনি। একইসঙ্গে তিনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের শুদ্ধ গণিত (পিওর ম্যাথমেটিক্স) বিভাগের প্রভাষক নিযুক্ত হন। সে-সময় তৎকালীন সরকার ফরেন স্কলারশিপ চালু করেন এবং আবদুল জব্বার এই স্কলারশিপ লাভ করেন। এই স্কলারশিপ অর্জনের মধ্য দিয়ে আবদুল জব্বারের বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করে তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ এলো। শুভানুধ্যায়ী অধ্যাপক লেভির পরামর্শে আবদুল জব্বার ডি.এসসি. ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে এমএস ডিগ্রির জন্য ভর্তি হন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে অবস্থিত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে আবদুল জব্বার ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর বোম্বাই থেকে জাহাজে ওঠেন। ইউরোপে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছে। বোম্বাই থেকে তাঁদের জাহাজ ছাড়ার দুইদিন পর ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ-সময় জার্মান যুদ্ধ্বজাহাজের অতর্কিত আক্রমণের আশঙ্কায় জাহাজের যাত্রাপথ পরিবর্তন করতে হয়। সুয়েজ খাল ধরে এগুনোর পরিবর্তে তাঁদের জাহাজ পুরো আফ্রিকা ঘুরে ব্রিটেনে পৌঁছায় নির্দিষ্ট সময়ের অনেকদিন পর। বিশ্বযুদ্ধের সেই অস্থির সময়ে আবদুল জব্বার একজন অধ্যাপকের অধীনে তাঁর পড়াশোনা শুরু করেন। যুদ্ধকালীন নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এক বছর গবেষণা করে তিনি যখন পিএইচডি ডিগ্রির জন্য মনোনীত হলেন, তখনই যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধির কারণে লন্ডনের সকল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে অন্যান্য সক্ষম লোকদের মতো আবদুল জব্বারের অধ্যাপককেও বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়। আবদুল জব্বার তখন অন্য কোনো অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে তাঁর কাজ শেষ করার চেষ্টা করতে থাকেন। এসময় ব্রিটিশ সরকার সব বিদেশীকে ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে যাবার আদেশ জারি করলে আবদুল জব্বার তাঁর উচ্চশিক্ষা অসমাপ্ত রেখেই দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন।

লন্ডন থেকে ফিরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক লেভির তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু করেন। অধ্যাপকের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি গবেষণা-বৃত্তি লাভ করেন তিনি। একইসঙ্গে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অবৈতনিক লেকচারার নিযুক্ত করা হয়। গবেষণা কাজের তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক লেভির সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ক সেমিনারগুলোতে যোগ দেয়ার সুযোগ হয় তাঁর। অধ্যাপকের সঙ্গে মিলিতভাবে কয়েকটি গবেষণা-নিবন্ধও তিনি প্রকাশ করেন এসময়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবৈতনিক প্রভাষক হিসেবে নিযুক্তির সময় তাঁকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে, পদ খালি হলে তাঁকে প্রভাষকের পদে স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হবে। কিন্তু এই আশ্বাস শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে ১৯৪৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে গণিতের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। কিছুদিন পর সেখান থেকে বদলি হয়ে তিনি ফিরে আসেন প্রেসিডেন্সি কলেজে।

কর্মজীবন[সম্পাদনা]
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর আবদুল জব্বার পাকিস্তানের কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য আবেদন করেন। প্রথমে তাঁকে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর কলেজে বদলি করা হয়। কিন্তু এর পরপরই কৃষ্ণনগর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলে তাঁকে রাজশাহী কলেজে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয়। বছরখানেক এই কলেজে থাকার পর ১৯৪৮ সালে তিনি নিযুক্ত হন তৎকালীন ঢাকা আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান হিসেবে। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি এই বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন। সেই বছরই আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হলে তিনি এর রেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন এবং ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত এই পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্রকল্যাণ পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ড. এম. এ. রশীদের নামে সম্মানসূচক পদ (চেয়ার)-এর সূচনা করা হয়। মোহাম্মদ আবদুল জব্বার প্রথমবারের মতো 'ড. রশীদ অধ্যাপক' নিযুক্ত হয়ে পুনরায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন।

জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা[সম্পাদনা]
বাংলাদেশে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ এবং উপকরণ তিনিউ প্রথম সৃষ্টি করেন। ১৯৬২ - ৮২ সাল পর্যন্ত তার অঙ্কিত তারা চিত্র রাতের আকাশ নামে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হত। তার সার্বিক তত্ত্বাবধান এবং পরিকল্পনায় বাংলাদেশের প্রথম খ-গোলক (celestial globe) নির্মিত হয়। এই খ-গোলকটি বর্তমানে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশনে সংরক্ষিত আছে।

পুরস্কার ও সম্মাননা[সম্পাদনা]
বাংলা একাডেমীর ফেলো নির্বাচিত হন ১৯৮৪ সালে।
ডঃ কুদরত-ই-খুদা স্মৃতি পদক (১৯৮৫)
বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩)
একুশে পদক (১৯৮৫)
কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, অণুসন্ধিৎসু চক্র ও বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন যৌথভাবে তাকে ১৯৯০ সালে ব্রুনো পদকে ভূষিত করে।
রচনাবলী[সম্পাদনা]
বিশ্ব রহস্যে নিউটন ও আইনস্টাইন (১৯৪২)
খ-গোলক পরিচয় (১৯৬৫)
তারা পরিচিতি (১৯৬৭)
প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা (১৯৭৩)
বিশ্ব ও সৌরজগৎ (১৯৮৬)
আকাশ পট (১৯৮৯)
টেক্সট বুক অব ইন্টারমিডিয়েট স্টাটিসটিক্‌স
টেক্সট বুক অব ইন্টারমিডিয়েট ডাইনামিক্‌স
টেক্সট বুক অব ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস
টেক্সট বুক অব ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস

ঠিকানা