ইসলামী রাষ্ট্রচিন্তার পুনরুজ্জীবন
আমার প্রবন্ধের যে শিরোনাম তাতে আলোচনার জন্য দু’শ থেকে সোয়া দু’শ বছরের একটা দীর্ঘ সময় হাতে এসেছে । বলা হয় সতেরশো ছিয়াত্তর সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা অর্জন এবং ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে আধুনিক যুগের শুরু । তাঁর আগে আটশ বছরের একটি মধ্য যুগ ছিল, তাঁর আগে ছিল প্রাচীন যুগ । আজকের আধুনিকতার কাছে মধ্যযুগ অন্ধকারের প্রতীক । এই অন্ধকারের আগের আরো অন্ধকার বলে কথিত যে, প্রাচীন যুগ, তাতে আজকের আধুনিকতাবাদীরা কোন আলোর পরশ দেখে না । কিন্তু এই যুগেই আধুনিক এক সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছিলো, পত্তন হয়েছিলো আধুনিক এক রাষ্ট্রের । যা ছিল আদর্শিক পরিচয়ে ইসলামী রাষ্ট্র । নবুয়তের ইতিহাস ধারায় সর্বশেষ নবী ও রাসুল ( সাঃ ) এঁর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সবচেয়ে সফল ছিল এই রাষ্ট্র । সুবিচার, সুশাসন, মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সহযোগীতাসহ, সকল বিষয়ে এ ছিল ইতিহাসের স্বর্ণযুগ । কিন্তু কোথায় গেলো সেই স্বর্ণযুগ ? কেন নতুন করে আজ বলতে হচ্ছে, “আধুনিক যুগে ইসলামী রাষ্ট্রের রূপরেখা পেশ ও প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের কথা । কেন ইতিহাসকাররা লিখেন, — “The Islamic state which was originated as democratic, un-repressive and open state with its head accountable to the community of Muslims— —— was transformed into highly repressive, bureaucratic and despotic rule ? ” ( Asgar Ali Engineer =The Islamic state, Vicas publishing House pvt. Ltd, ghasiabad, India, page 45 ) এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন আমেরিকার এক ইসলাম বিষয়ক পণ্ডিত । তিনি বলেছেন, ইসলাম ক্ষমতায় ছিল খিলাফতে রাশেদা পর্যন্ত । তারপর এলো মুসলমানরা ক্ষমতায় এবং শুরু হল পতনের । ( Professor John L. Esposito দৈনিক সংগ্রামের সাথে এক সাক্ষাতকার ) পতনের এই কালে মুসলিম শাসকরা পরিবার, সমাজ ও বিচার ব্যবস্থায় ইসলামকে টিকিয়ে রাখলেন বটে, কিন্তু রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি, যুদ্ধ-শান্তি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পরিচালক হয়ে দাঁড়ালো তাঁদের স্বেচ্ছাচারিতা । মুসলমানদের এই পতন শুধু মুসলমানদেরই অন্ধকারে নিমজ্জিত করলো না, ইউরোপীয় মধ্যযুগের যে অন্ধকার তাঁর জন্যও মুসলমানদের এই পতনই দায়ী । ৭১৪ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর ফ্রান্স ও ইতালীর দিকে আগ্রসরমান সেনাপতি মুসাকে যদি দক্ষিন ফ্রান্সের পিরোনীজ পর্বতমালা থেকে ফিরিয়ে না আনা হতো এবং যদি ফিরিয়ে না আনা হতো সেনাপতি তারিককে স্পেন থেকে, তাহলে ইউরোপে আর আটশ বছরের অন্ধকারের সৃষ্টি হতো না । কর্ডোভা, মালাগা ও গ্রানাডার মতো হাজারো মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোরে যেত সেদিনের ইউরোপ ।

খিলাফতে রাশেদার পর ইসলামী আদর্শবাদ ও ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থার দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলমানদের উপরে চেপে বসলো প্রায় তেরশ বছরের দীর্ঘ এক কাল রাত । দুর্ভাগ্য এতোই মর্মান্তিক ছিল যে, এই কাল রাতে এমনকি নায়েবে নবী অধিকাংশ আলেমকেও ‘Had to suitability adjust their theories to suit the new —— condition.’ ( Asgar Ali Engineer =The Islamic state,page-88 ) তবে সব আলেম পতনের এই স্রোতে গা ভাসাননি । ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল, ইমাম ইবনে তাইমিয়া, শেখ আহমাদ শরহিন্দ- এর মতো হাজারো আলেম স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে আপোষ করেননি । এঁদের এই মহান বিদ্রোহের বুনিয়াদের উপরই আধুনিক যুগের ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা- আন্দোলনের সৌধ গড়ে উঠেছে ।

কিন্তু এরপরও আধুনিক যুগের ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে তাঁর যুগোপযোগী রূপে দেখার জন্যে অসহনীয় এক শূন্যতার মধ্য দিয়ে পথ চলতে হয়েছে দীর্ঘদিন । এমনকি ১৯৩৭ সালে আধুনিক যুগের শেষার্ধে এসেও ফ্রান্সের সমাজ বিজ্ঞানী আহমাদ রশীদ দুঃখ করে বলেন— “এখন পর্যন্ত এমন কোন বই প্রকাশিত হয়নি যাতে আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে ।’’ ( Mr. Mohammad Hamidullah, The Muslim conduct in state, 1941, page-30 ) এই শূন্যতার মধ্যেও রশীদ আহমাদ তাঁর ফরাসী ভাষার বিখ্যাত গ্রন্থে ( ‘L’ Islam et le droit des gens ) সাতজন চিন্তানায়কের কাজের উল্লেখ করেছেন, যারা ইসলামী আইনের রূপায়নে কাজ করছেন । এই সাতজনের ছয়জনই ফরাসী ভাষায় । আল্লামা মওদুদীর “আল-যিহাদ ফিল ইসলাম” ই শুধু এই বলয়ের বাইরের । এই গ্রন্থে মাওলানা মওদুদী অন্যান্য আন্তর্জাতিক বিষয়ের পাশাপাশি যুদ্ধ, শান্তি ও চুক্তি সম্পর্কিত ইসলামী আইনের বিশদ বিশ্লেষণ করেছেন । এ কথাও এখানে উল্লেখ্য যে, ইসলামী আইনের এই বিশেষ ক্ষেত্রের মতো ইসলামী রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রদান ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান তখনই অগ্রগণ্য হয়ে উঠেছিলো । নীতির প্রশ্নে অটল থাকার পরও জটিল আইনী বিষয়ে মাওলানা মওদুদী বিস্ময়করভাবে আধুনিক ও সুবিস্তারিত এবং সুবিন্যস্ত । এ রকম কথা বলেছেন উইলফ্রেড ক্যান্টয়েল স্মিথও । তাঁর ‘ Islam in Modern History ’ গ্রন্থে লিখেছেন—- “Perhaps the most significant constituent of Mawdudi’s position has been the gradual and continual . Mawdudi would appear to be much the most systematic thinker of modern Islam. One might even wonder whether his chief contribution —— has not been for good or feel his transforming of Islam into a system, or perhaps more accurately, his giving expression to a modern tendency so as to transform it.” ৫

ইসলামী আইন ও আধুনিকতার উপর এমন অদ্ভুত অথরিটিই মাওলানা মওদুদীকে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রনয়নে এবং তা বাস্তবায়নের পথ বিনির্মাণে সফল করেছে এবং এই দুই গুনের সমান সমাহার আর কারো মধ্যেই পাওয়া যায় না । আধুনিক ইতিহাসের পর্যালোচনাই তা প্রমান করবে ।

ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের আধুনিক যুগের যাত্রা শুরু দুই মহান ব্যক্তিত্ব দিয়ে । তাঁদের একজন উপমহাদেশের শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী, অন্যজন জাজিরাতুল আরবের মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব । মজার ব্যাপার হল, এই দুই মহান মনীষীর জন্ম সময় একই বছর, ১৭০৩ সালে ।

ইউরোপ আধুনিক যুগে প্রবেশের আগে ১৭৬২ সালে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী ইন্তেকাল করেন, কিন্তু তাঁর আন্দোলন আধুনিক যুগকে প্রভাবিত করেছে ব্যাপকভাবে । শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী ইসলামী রাষ্ট্রের আধুনিক কোন রূপরেখা দেননি, কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র তিনি চেয়েছিলেন । তৃতীয় পানিপথ যুদ্ধের যুদ্ধ বিজয়ী বীর আহমাদ শাহ আবদালী যখন কাবুলে ফেরত গেলেন, তখনই ভারতীয় মুসলিম রাজত্বের মহাশ্মশানে দাঁড়িয়ে শাহ ওয়ালী উল্লাহ ভারতের মুসলমানদের রক্ষার জন্যে নতুন করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন । এই লক্ষ্যে তিনি তিন দফা কর্মসূচির কথা ভেবেছিলেন । তাঁর প্রথম দফা হল লোক তৈরি করা, দ্বিতীয়তঃ তাঁদের নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তোলা এবং নাম্বার থ্রিঃ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা । এই উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি পানিপথের রণাঙ্গন থেকে দিল্লিতে তাঁর মাদ্রাসায় ফিরে গিয়েছিলেন । শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী এবং তাঁর ছেলে শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দেসে দেহলভী প্রমুখের চেষ্টায় সৈয়দ আহমাদ শহীদ ও শাহ ইসমাইল শহীদদের মতো হাজারো মুজাহিদ তৈরি হয়েছিল । তাঁদের আন্দোলনের আওতায় এসেছিলো সুদূর বাংলা থেকে আফগান সীমান্ত পর্যন্ত গোটা ভারত । একটা ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমও হয়েছিলো আফগান সীমান্তে । কিন্তু রাষ্ট্রটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হবার সুযোগ পায়নি । ব্রিটিশ, শিখ এবং অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতেই আন্দোলনের গোটা পিরিয়ড শেষ হয়ে যায় । তারা লক্ষ্যে পৌছুতে পারেননি । কিন্তু আধুনিক যুগের শুরুর লগ্নে মুসলমানদের জগত-জোড়া হতাশার ঘন অন্ধকারে প্রথম বারের মতো ইসলামী রাষ্ট্রের আকাংখা তাঁদের প্রয়াসের মধ্য দিয়েই মূর্ত হয়ে উঠেছিলো ।

জাজিরাতুল আরবে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাবের সংস্কার আন্দোলন এই তুলনায় অনেকখানি সফল হয়েছিলো । আরবের নজদ প্রদেশের তখনকার উদীয়মান শক্তি ইবনে সউদের শাসক পরিবার মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাবের সংস্কার কর্মসূচী গ্রহন করেছিলেন এবং এই পরিবারের শাসন ক্ষমতার মধ্য দিয়েই এই সংস্কার কর্মসূচী বাস্তবায়িত হয়েছিলো । এই সংস্কার কর্মসূচী আরব উপদ্বীপে তৌহিদের অথরিটি পুনর্জীবিত ও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলো । কিন্তু সার্বজনীন আকাঙ্ক্ষা মোতাবেক ইসলামী রাষ্ট্র, ইসলামের শাসনতান্ত্রিক অথরিটি সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়নি ।

এই দুই বড় সংঘবদ্ধ প্রয়াসের পর মুসলমানদের উত্থান, ইসলামের আইনী অথরিটির পুনর্জীবন এবং ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার চিন্তা নিয়ে আধুনিক যুগের বর্তমান পর্যন্ত বিশাল সময় ধরে বহু ব্যক্তি-চিন্তা-নায়কের আবির্ভাব ঘটেছে । এরা সকলেই আধুনিক যুগের ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা আন্দোলনের সাথে বিভিন্নভাবে জড়িত । এই ব্যক্তি চিন্তা নায়কদের মধ্যে প্রথমেই আসে জামাল উদ্দিন আফগানীর নাম । জন্ম তাঁর ১৮৩৮ সালে এবং ১৮৯৭ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন । মনে করা হয় আধুনিক যুগের ‘প্যান ইসলামিজম’ – এর প্রথম প্রবক্তা তিনি। W,C Smith এর মতে, জামালুদ্দিন আফগানী একই সাথে মুসলিম উম্মাহর অভ্যন্তরীণ সংস্কার এবং বাইরের হুমকি মোকাবিলার কথা চিন্তা করেছেন । তাঁর ‘প্যান ইসলামিজম’ ছিল প্রতিরক্ষার অস্ত্র । তবে জামালুদ্দিন আফগানি তখনকার সময় সামনে রেখে ইসলামী রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রনয়ন এবং এর প্রতিষ্ঠার জন্যে আন্দোলনের চাইতে স্বভূমি ভিত্তিক রাষ্ট্র- প্রতিষ্ঠার কথাই বেশী ভেবেছেন । তিনি বলেছেন,- “A People without unity and a people without history is a people without glory, and a people will lack history if authorities do not rise among them to protect and revivify the memory of historical heroes so that they may follow and emulate. All this depend on a national ( watan ), education which begins with the homeland (watan), the environment of which is ‘the homeland’.” ৭ সুতরাং ‘প্যান ইসলামিজম’- এর কথা বললেও জামালুদ্দিন আফগানী ইসলামের আইনী দিকের পুনরুজ্জীবন এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন নিয়ে সামনে এগুবার সুযোগ পাননি ।

জামালুদ্দিন আফগানীর পর মুসলিম বিশ্বের আরেকজন বড় ইসলামী চিন্তানায়ক হলেন মিশরের মুফতী মুহাম্মাদ আব্দুহ ( ১৮৪৯-১৯০৫ ) । পাশ্চাত্যের অশুভ প্রভাবের প্রতিরোধ এবং মুসলিম সমাজের সংস্কার ও উত্থানের পক্ষে তিনি কাজ করেছেন । মুফতী আব্দুহর জীবনিকার মাহমুদুল হক লিখেছেন, —“Muhammad Abduh’s Contribution as an Islamic modernist is so significant that a close study of his system of thought seems viable for a understanding of the development of modern Islamic reform movement.’’ ৮ কিন্তু এই সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে মুফতী আব্দুহ’র দৃষ্টিভঙ্গি ডিফেন্সিভ । তিনি পাশ্চাত্যের পথ ও পদ্ধতির মোকাবেলায় চলমান ইসলামী আইন ও বিধানকে যুক্তিসঙ্গত করার জন্যে এর পুনঃব্যাখ্যার প্রয়োজন মনে করতেন, যাতে পশ্চিমী প্রভাব মুসলিম সমাজে আসন গাড়তে না পারে । বস্তুত পশ্চিমি আগ্রাসনের মুখে মুফতী আব্দুহ- এর চিন্তা এতোই আচ্ছন্ন ছিল যে, আত্মরক্ষার বাইরে ইসলামী রাষ্ট্রে ব্যবস্থার রূপরেখা প্রনয়ন এবং তাঁর প্রতিষ্ঠার মতো ইতিবাচক চিন্তা তিনি মাথাতেই আনতে পারেননি । তাছাড়া তিনি রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে জামালুদ্দিন আফগানীর অনুসারী ছিলেন । তদুপরি জাগতিক অনেক ব্যাপারে তিনি পাশ্চাত্য চিন্তার প্রশংসা করতেন এবং মনে করতেন ব্যবহারিক অনেক ব্যাপারে সুন্নাহর অনুসরন করাও অপরিহার্য নয় । সন্দেহ নেই এ ধরনের চিন্তানায়করা অবস্থার চাপে আপোষবাদী হয়ে উঠতে পারেন ।

এ সময়ের আরেকজন ইসলামী চিন্তানায়ক সিরিয়ার আব্দুর রহমান কাওয়াকিবি ( ১৮৫৪-১৯০২ ) । তিনি মুফতী আব্দুহ’র মতই আধুনিক বিশ্বের সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্যে ইসলামের পুনঃব্যাখ্যার পক্ষে ছিলেন । তিনি ইসলামকে আরবদের জাতীয় ধর্ম মনে করতেন এবং চাইতেন যে, মক্কার কোন এক ব্যাক্তির আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের অধীনে ইসলামী রাষ্ট্রগুলো একটি ইসলামি ইউনাইটেড স্টেটস গঠন করুক । তিনি বাহ্যিক এই কাঠামোগত আলোচনার বাইরে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা প্রনয়ন কিংবা এর বাস্তবায়ন নিয়ে ভাবেননি। কাওয়াকিবির সময়েরই আরেকজন বড় ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন রশীদ রিজা । তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘খিলাফত ওয়া আল-ইমামাহ আল-ওজমা’ সম্পর্কে Rosenthal লিখেছেন,—-“(This work) can be considered not only as the programme of the reformist party, but also as the authoritative to politics.” ৯ এই গ্রন্থে রশিদ রিজা ইসলামী সভ্যতার বিস্তারে বংশীয় খিলাফতগুলির অবদান স্বীকার করেও তাঁদের তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং খিলাফতে রাশেদার সাথে একাত্ম হয়ে পূর্ণভাবে ইস্লামে ফিরে আসার পক্ষে । তাঁর মতে ইসলামী রাষ্ট্র শুধু মুসলমানদের জন্যে নয়, সাম্য, সুবিচার এবং সকল মানুষের সকল বৈধ আশা-আকাংখার দাবী পূরণ এবং তাঁদের স্বার্থেই বিশ্বের সকল মানুষের জন্যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রয়োজন । কিন্তু রশিদ রিজার মধ্যে যতটা আবেগের প্রকাশ ঘটেছে, ততটা বাস্তব চিন্তার সমাহার তাঁর মধ্যে ছিল না । একজোণ আলোচক এ সম্পর্কে বলেছেন—“He shows complete ignorance of modern state-taxation and finances an requirements of even a welfare state.” ১০

রশিদ রিজার মধ্যে স্ববিরোধীতারও প্রকাশ দেখা গেছে । তিনি মনে করতেন তুরস্কের পার্লামেন্ট গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলী প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্যে ইজতিহাদের দায়িত্বও পালন করতে পারে ।

আধুনিক যুগের আরেকজন বড় ইসলামী চিন্তানায়ক আলী আব্দ আল-রাজিক । ইসলামী রাষ্ট্র ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কিত তাঁর গ্রন্থের নাম ‘Al Islam wad usual al hukm’ ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কিত তাঁর চিন্তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, তাঁর মতে ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার এবং আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বার্থে ধর্ম থেকে রাজনীতি সম্পূর্ণ আলাদা হতে হবে । ইসলামের প্রতি আল-রাজিকের আন্তরিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন না তুলেও বলা যায়, জনাব রাজিক পশ্চিমী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত এবং বিভ্রান্ত হয়েছেন । ইসলামী আইনের আধুনিক ব্যাখ্যায়নের কথা জামালুদ্দিন আফগানী, মুফতী আব্দুহ, রশিদ রিজা, কাওকিবিসহ সকল চিন্তাবিদই বলেছেন, কিন্তু ইসলামকে দিধা-বিভক্তির কথা ইতোপূর্বে আর কোন বুদ্ধিজীবী এইভাবে বলেননি । এই জন্যে পশ্চিমের Rosenthal মহা খুশী হয়ে বলেছেন,—- “Ali abd al rajik comes much nearer to the truth as seen historically.” অবশ্য এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন সেই সময়কার ইসলামী চিন্তাবিদ ইমাম মুহাম্মাদ আল-গাজ্জালী । তিনি লিখেছেন,—“This separation is the result of the western imperialist influence, out to destroy Islam by isolating it from legislation.” বিষয়টাকে আরো পরিস্কার করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন——– “He ( prophet ) began as a preacher, an announcer and an warner, but ended as a judge and ruler ( hakim ) —- his messengership turned from ‘dawah to dawlah’ ( state ) .”

ইমাম গাজ্জালী ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে পৃথক করাকে বিদয়াত বলেছেন । ক্ষমতা ছাড়া ধরমকে তিনি অকার্যকর মনে করেন । তাঁর মতে ইসলামী রাষ্ট্রই মাত্র সব জিজ্ঞাসার জবাব দিতে পারে। কিন্তু তিনি আগের অনেক চিন্তানায়কের মতই তাত্ত্বিক উপস্থাপনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছেন । ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার জন্যে বাস্তবে কোন পথ তিনি তৈরি করেননি । তাছাড়া আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় রূপরেখাও তিনি সামনে নিয়ে আসেননি ।

১৯২৭ সালে ইসলামী রাষ্ট্রের একটি রূপরেখা নিয়ে আসেন সাঈদ হালিম পাশা । পাশার মতে এমন একটি পার্লামেন্ট হবে যেখানে কম্যুনিস্টরা থাকবে না, সমাজতন্ত্রীরা থাকবে না, প্রজাতন্ত্রীরা থাকবে না এবং রাজতন্ত্রীরাও থাকবে না । শুধু থাকবে স্বদিচ্ছা সম্পন্ন একই আদর্শ ও লক্ষ্যের মানুষ, যারা তাঁদের সাধ্য অনুযায়ী শরীয়তের বিধান চালু করবে । ১২

হালিম পাশার চিন্তাকে আলোচকরা সমাজ বাস্তবতার সাথে সম্পর্কহীন আকাশকুসুম এক চিন্তা বলে অভিহিত করেছেন । ব্যক্তি পর্যায়ের এসব চিন্তা-ভাবনা এবং প্রয়াসের পর শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী ও মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাবদের মতো ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সংঘবদ্ধ প্রয়াসের আবার উত্থান ঘটে ১৯২৮ সালে হাসানুল বান্নার নেতৃত্বাধীন ইখওয়ানুল মুসলিমুন ও ১৯৪১ সালে মাওলানা মওদুদীর নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামী গঠনের মধ্য দিয়ে । ইখওয়ানের ১৪ বছর পর জামায়াতে ইসলামী গঠিত হলেও মাওলানা মওদুদীর ইসলামী জীবন ব্যবস্থা ও ইসলামী আন্দোলনের উপর রচনাবলী আগের দেড় দশক ধরেই প্রকাশিত হয়ে আসছিলো । মাওলানা মওদুদীর লিখিত ইসলামী আইনী ও আন্তর্জাতিক উপস্থাপনাই প্রথম বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে । ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত রশিদ আহমদের ফরাসী গ্রন্থের উল্লেখিত তালিকায় এর প্রমান পাওয়া যায় । ইখওয়ানুল মুসলিমুন ও জামায়াতে ইসলামী দুটি সংগঠনই ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন । দুই সংগঠনের সাহিত্য থেকে তাঁদের আন্দোলনের দর্শনকে এইভাবে চিহ্নিত করা যায়———

ক। ইসলাম সামগ্রিক ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা । সুতরাং ইসলামই রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সমাজের চালিকাশক্তি ।
খ। মুসলমানদের রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে দুর্বলতা ও দেউলিয়াপনা সৃষ্টি হয়েছে মূলতঃ ইসলাম থেকে সরে আসার কারনেই ।
গ। কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার আলোকে আইন ও সমাজ সংশোধনের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা মুসলমানদের অপরিহার্য দায়িত্ব ।
ঘ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি রোদ- বৃষ্টির মতই আল্লাহর নেয়ামত । তবে আধুনিক পন্থা ও পদ্ধতিকে অবশ্যই ইসলামের মূল দর্শনের সাথে সংগতিপূর্ণ হতে হবে ।
চিন্তাগত বুনিয়াদির এই মূল নিরিখেই ইখওয়ানুল মুসলিমুন ও জামায়াতে ইসলামী সমাজ ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে । কিন্তু ইখওয়ানুল মুসলিমুন আন্দোলন হিসেবে যতো দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে, সাংগঠনিক নিয়ম- শৃঙ্খলা তাঁদের ততখানি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারেনি এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের চিন্তা, পরিকল্পনা ও কর্মসূচীগত কাজও তাঁদের সেই তুলনায় বাস্তব ও পদ্ধতিগত রূপ পায়নি । এর কারণও আছে। ইখওয়ান গঠিত হবার পর থেকেই একে ব্রিটিশ বিরোধী ও ইহুদী বিরোধী সংগ্রামে জড়িয়ে পড়তে হয় এবং সরকারের সাথেও সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয় । ১৯৪৯ সালে ইখওয়ানের নেতা হাসানুল বান্না শহীদ হন শুধু তাই নয়, পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকেই ইখওয়ান বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে । সাইয়েদ কুতুবসহ শীর্ষস্থানীয় অর্ধ ডজন নেতা ফাসিতে শহীদ হন । হাজার হাজার কর্মী কারান্তরালে চলে যায় । ইখওয়ানের সেই বিপর্যয়ের আজও শেষ হয়নি ।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বার বার রাজনৈতিক স্নগকতে পড়েছে, কিন্তু ইখওয়ানের মতো মহাসংকটের সম্মুখীন হতে হয়নি । তদুপরি জামায়াতে ইসলামীর বুদ্ধিভিত্তিক বুনিয়াদ ছিল ইখওয়ানের চেয়ে অনেক বেশি মজবুত । মাওলানা মওদুদী জামায়াতে ইসলামী গঠন করেছেন ১৯৪১ সালে, কিন্তু এর পিছনে ছিল তাঁর দেড় দশকের সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী চিন্তাগত বুনিয়াদ । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইসলাম বিষয়ক শীর্ষ বিশেষজ্ঞ John L. Esposito তাঁর ‘Islamic Revivalism’ নিবন্ধে বলেছেন,—“From the 1930s Onward, this ( Mawlana Maududi ) Journalist and Editor committed himself to an Islamic alternative to nationalism, advocating an Islamic revival based on the renewal of Islamic society through a gradual social revolution. For Maududi, the islamization of society, was a prerequisite to the establishment of a true Islamic state —- in his journal, Exegesis of the kuran ( Targumanul Quran ) and in a host of volumes such as the process of islamis revolution. First principle of Islamic state, Islamic Law and constitution and economic problem of man and its Islamic solution, Maududi asserted a self-sufficient and comprehensive blueprint of islam for political, legal, economical and social life.” ১৩

ইসলামী সাহিত্যের এই বুনিয়াদই মাওলানা মওদুদী ও জামায়াতে ইসলামীকে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে সর্বাগ্রগণ্য করে তুলেছে । এই সাহিত্য ইখোয়ানের আন্দোলনকেও প্রভাবিত করেছে । John L. Esposito ইখওয়ানের শীর্ষ বুদ্ধিজীবী শহীদ সাইয়েদ কুতুব শহিদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছেন,——–“Influenced by Hasan Al Banna and the writings of pakistan’s Mawlana Maududi, Qutubs prolific writings exemplified the tendency of the times to move from a relatively pacific view of Islam as a comprehensive alternative to western systems of government.” ১৪

বস্তুতঃ ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার রূপরেখা পেশ এবং তাঁর বাস্তবায়ন উভয় ক্ষেত্রেই অগ্রগামী ভুমিকায় রয়েছেন মাওলানা মওদুদী । তাঁর “Islamic Law and Constitution” শীর্ষক একক একটি গ্রন্থই আধুনিক একটি রাষ্ট্রের ইসলামাইজেশনের ভিত্তি হিসেবে যথেষ্ট । এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক, দ্বিতীয় অধ্যায়ে ইসলামের মতাদর্শগত দিক থেকে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও ধরন, তৃতীয় অধ্যায়ে ইসলামী রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্ব ও খিলাফতের ধারনা, ষষ্ঠ অধ্যায়ে ইসলামী রাষ্ট্রের সাংবিধানিক আইনের উৎস, সপ্তম অধ্যায়ে রাষ্ট্র, সরকার এবং নাগরিকদের মধ্যের পারস্পরিক সম্পর্ক, দায়িত্ব ও কর্তব্য, অষ্টম অধ্যায়ে ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধানের ভিত্তিসমূহ, দশম অধ্যায়ে ইসলামী রাষ্ট্রে আইন প্রণয়ন ও ইজতিহাদ, দ্বাদশ অধ্যায়ে মানবাধিকার, ত্রয়োদশ অধ্যায়ে অমুসলিমদের অধিকার, চতুর্দশ অধ্যায়ে সামাজিক সুবিচার, পঞ্চদশ অধ্যায়ে রাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ও নেতৃত্ব নির্বাচন এবং প্রতিরক্ষা, যুদ্ধ- সন্ধি, পররাষ্ট্রনীতি, নাগরিকত্ব বিষয়ক নীতি- নিরূপণ, ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে । এই গ্রন্থে ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থ সংস্থানের উৎস বিষয়ের উপর কোন অধ্যায় নেই । তবে মাওলানার সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং এবং অর্থনৈতিক সমস্যার ইসলামী সমাধান শীর্ষক গ্রন্থে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে ।

আদর্শ ও কর্মসূচী শুধু তাত্ত্বিক উপস্থাপনা নয়, আদর্শ ও কর্মসূচির বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৪১ সালে মাওলানা মওদুদী জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেন । তাঁর ইসলামী সাহিত্য এবং তাঁর সুপরিচালিত ও সুশৃঙ্খল আন্দোলন গোটা দুনিয়ায়, বিশেষ করে এই উপমহাদেশের ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে বহুদূর এগিয়ে দিয়েছে । তাঁর এই আন্দোলনের প্রভাবেই একসময় যে সব আলেমরা রাজনীতিকে হারাম জ্ঞান করতেন, তাঁরাও এখন পুরোদস্তুর রাজনীতিক । ইসলাম যে মোকাম্মাল নিযামে হায়াত, আল-কুরানের একথা এরা মাওলানা মওদুদীর কাছ থেকেই শিখেছেন । ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান গনপরিষদে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে, “অবজেক্টিভ রেজুলেশন” পাস হয়, তাঁর পেছনে মাওলানার সাহিত্য ও জামায়াতের বিরাট ভূমিকা ছিল । পরবর্তীতে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইসলামী শাসনতন্ত্রের ধারনাকে “জিরো প্লাস জিরো ইকুয়াল টু জিরো” বলে বিদ্রুপ করলে ১৯৫২ সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত আলেমদের সর্বদলীয় সম্মেলনে ইসলামী শাসনতন্ত্রের সর্বসম্মত যে ২২ দফা নীতিমালা প্রনীত হয়, তাঁর পেছনেও মাওলানা মওদুদী ও জামায়াতে ইসলামীর অবদান প্রধান ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে । ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানকে “ইসলামিক রিপাবলিক” ঘোষণা করে পার্লামেন্টে যে শাসনতন্ত্র প্রনীত হয়, তা ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ আন্দোলনের একটা সীমিত বিজয় । ১৯৬৯ সালে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে ওআইসি ( অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স ) – এর প্রতিষ্ঠা এবং ওআইসির প্লাটফর্মে ১৯৮১ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানদের সম্মেলনে তাঁদের সকলের স্বাক্ষর সম্বলিত মক্কা ঘোষণা উম্মাহ-ভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র- চিন্তার এক বিরাট বিজয়। মক্কা ঘোষণায় ‘বিশ্বাসের ঘোষণা’—অধ্যায়ের একটি অংশে বলা হয়—

“এক পরিপূর্ণ জীবনবিধান হিসেবে ইসলাম, ইসলামী আদর্শ ও ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি অনড় ও নিষ্ঠাপূর্ণ আনুগত্য এবং অনুসরণই বিরুদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে মুসলমানদের নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় গ্যারাণ্টী । ইসলামের পথই একমাত্র পথ যে পথ শক্তি, সম্মান, সমৃদ্ধি ও সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে আমাদের পরিচালিত করবে । ইসলামই শুধু মুসলিম উম্মাহকে বস্তুবাদের যন্ত্রণাদায়ক সয়লাব থেকে বাঁচিয়ে মুসলিম উম্মাহর স্বকীয়তাকে সমুন্নত এবং এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে । এবং ইসলামই মুসলিম জনতা ও তাঁদের নেতৃবৃন্দের জন্যে এক অতুল শক্তির সঞ্জীবনী সুধা । শুধু এর দ্বারাই তারা পারে তাঁদের পবিত্র স্থানগুলো মুক্ত করাসহ এই বিশ্বে তাঁদের হারানো আসন পুনরুদ্ধার করতে এবং অন্যান্য জাতির পাশে যোগ্য আসনে দাঁড়িয়ে বিশ্ব মানব জীবনে সাম্য, শক্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে ।”

মক্কা ঘোষণায় “মুসলমানরা এক জাতি” শীর্ষক অধ্যায়ের এক অংশে বলা হয়—

“ভাষা, বর্ণ, দেশ এবং এ ধরনের সব পার্থক্য সত্ত্বেও বিশ্বের সব মুসলমান একটি এক ও অখণ্ড জাতির অন্তর্ভুক্ত । একই বিশ্বাসের বন্ধনে তারা আবদ্ধ । একই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে তারা সঞ্জীবীত হয়ে একই দিকে তারা ধাবিত হচ্ছে এবং একটি মাত্র লক্ষ্যই তাঁদের সামনে । ——- সুতরাং আমাদের সংহতি জোরদার করা, বিভেদ- বিরোধের অবসাব ঘটানো এবং ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং আমাদের জন্যে চিরন্তন সুবিচারের মাপকাঠি আল্লাহর আইন ও রাসুল ( সাঃ ) এর সুন্নাহর প্রতি আমাদের বিশ্বাসের উপর ভিত্তিশীল নীতি ও বিধানের মাধ্যমে আমাদের মধ্যকার যাবতীয় বিরোধ মিটিয়ে ফেলার লক্ষ্যে সামনে এগিয়ে যাবার জন্যে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ।”

সবশেষে মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানদের একটি সম্মিলিত প্রার্থনা ও আল-কুরানের একটি আয়াতের উদ্ধৃতির মধ্যে বলা হয়—–

“আমরা করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা জানাই, তিনি আমাদেরকে সীরাতুল মুস্তাকিমের উপরে প্রতিষ্ঠিত রাখুন, আমাদের প্রচেষ্টাকে সাফল্যের স্বর্ণ মুকুটে শোভিত করুন এবং আমাদেরকে সালেহ বান্দার জীবন যাপনে তৌফিক দান করুণ । ( আল কুরআনে আপনার প্রতিশ্রুতি ) “তোমরা যারা বিশ্বাসী এবং আমলে সালেহর উপরে প্রতিষ্ঠিত আছ, তাঁদের জন্যে আল্লাহর ওয়াদা, তিনি অবশ্যই তাঁদের সফলতা দান করবেন এই পৃথিবীতে, যেমন তিনি তাঁদের পূর্ববর্তীদের সফলতা দান করেছেন এবং তিনি অবশ্যই তাঁদের জন্য তাঁদের ধর্মকে, যে ধর্মকে তিনি তাঁদের জন্যে মনোনীত করেছেন, প্রতিষ্ঠিত করবেন এবং তিনি এর বিনিময়ে তাঁদেরকে ভয় দূর করে নিরাপত্তা দান করবেন । আর যারা আমার উপাসনা করে, তারা কোন কিছুকেই আমার শরীক করে না । অতপর যারা অবিশ্বাস করবে, তারা প্রকৃতপক্ষেই দুষ্কৃতকারী ।”

মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানদের স্বাক্ষরিত এই মক্কা ঘোষণা ইসলামের ইতিহাসের এক অমূল্য দলীলই শুধু নয়, এর মধ্য দিয়ে গত দুশো বছরের, আরো বেশি বলতে গেলে গত হাজার বছরের ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিার সুদীর্ঘ আন্দোলনের আশা- আকাংখা, আবেগ- অনুভূতি, চিন্তা- চেতনা সবকিছুই সবাক হয়ে উঠেছে । আমরা এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়া, জামালুদ্দিন আফগানী, শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী, মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব, ইমাম গাজ্জালী, মুজাদ্দেদে আলফেসানী, শেখ হাসানুল বান্নাহ, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী প্রমুখ সকলেরই সরব কণ্ঠ শুনতে পাই । ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা আন্দোলনের অবিস্মরণীয় এক বেনজীর মাইলস্টোন এটা ।

ইসলামের এই শক্তিমান প্রকাশের পর শয়তানী শক্তিও শক্তভাবে মাঠে নেমেছে । নব্বই দশকের শুরুতে সোভিয়েত ব্লকের পতনের পর এক মাত্রিক পৃথিবীর একক নেতা হওয়ার সুযোগ নিয়ে এই শক্তি ইসলামের রাষ্ট্রীয় শক্তি হয়ে উঠার পথ রোধ করার জন্যে বলা যায় আজ সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে । একসময় কম্যুনিস্টরা লাশ তৈরি করে সেই লাশ নিয়ে মিছিল করে লাশের দায় প্রতিপক্ষের ঘারে চাপাত । কম্যুনিস্টদের এই কৌশল পুঁজিবাদীরা ভালোভাবেই রপ্ত করেছে । সন্ত্রাস তৈরি করে, সন্ত্রাসকে উস্কে দিয়ে তারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে । ‘টুইন টাওয়ার’ নামক লাশ মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়ে ইসলামের উত্থান রোধ করার এক মোক্ষম পথ তারা রচনা করেছে । এ পথেই তারা ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে দমন করতে চায় । ইসলামের রাষ্ট্রিক উত্থানবাদীদেরকে আজ মধ্যযুগীয় অসহনশীল, এমনকি সাম্প্রতিক কালে সভ্যতা বিরোধী এবং মানুষের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির প্রতিবন্ধক হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে । এবং এইভাবে ইসলামের উত্থানবাদীদেরকে মানবতার দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁদের নিঃশেষ করে ফেলাকে ওরা বৈধ করতে চায় । John L. Esposito এই ধরনের মার্কিনী দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতিবাদ করে বলেছেন,—–

তিনি লিখেছেন — “It is not modern technology and science that is being rejected ( by the Islamists ), but rather a competing ideology of western ideas and values. Islamic revolutionaries, like most other Muslims, do not shun modern transportation, housing, electricity, communications, or oil technology. The problem is not radio and television, but its programming. The gap is ideological, not technological or economic.” ১৪

এই সত্য কথাগুলো বলার পর তিনি মার্কিন নীতি নির্ধারকদের উপদেশ দিয়ে বলেছেন,— “American policy in the Muslim world, in short, be carried on in a context in which ideological differences between the west and Islam are recognized and, to the greatest extent possible, accepted or at least tolerated.” ১৫

জন এল এজপজিটো’র এই পরামর্শ মার্কিন নীতি নির্ধারকরা গ্রহন করলে ইসলামের রাষ্ট্রীয় উত্থানবাদীদের সাথে তাঁদের আর কোন বিরোধ থাকে না এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, এমনকি সহযোগিতাতেও তাঁদের কোন আপত্তি উঠতে পারে না ।

আজকের প্রবন্ধে আমার সর্বশেষ কথা হলো, ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার রূপরেখা আজ চূড়ান্ত রূপ লাভ করছে পাঠ্য বিষয়ের বিভিন্ন ব্রাঞ্চের দ্রুত ইসলামাইজেশনের মাধ্যমে । মাওলানা মওদুদীর ‘ইসলামিক ল’ অ্যান্ড কনস্টিটিশন’ – এর ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার রূপরেখাকে যদি আমরা ভিত্তি ধরি, তাহলে বলবো সেই ভিত্তি আজ মহীরুহে পরিনত হচ্ছে আজকের অনেক ইসলামী চিন্তানায়ক ও মুসলিম সমাজ বিজ্ঞানীর অংশগ্রহনে । অন্যদিকে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন মুসলিম বিশ্বে আজ গনরূপ পরিগ্রহ করছে । আলজেরিয়া, তুরস্ক, বাংলাদেশ, জর্ডান ও কুয়েতের নির্বাচনই তাঁর ইঙ্গিত দেয় । ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে তিনটি করনীয় বিষয়ের দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমার বক্তব্য শেষ করছি ।

একঃ ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন মূলতই বুদ্ধিভিত্তিক । লড়াইটা তাই বুদ্ধিবৃত্তির। সুতরাং অন্যান্য দিকের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতার ক্ষেত্রেও পাশ্চাত্যের সমকক্ষ হতে হবে মুসলমানদের ।

দুইঃ ইসলামের কথা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কাছে, প্রতিটি ঘরে পৌঁছাতে হবে । এ জন্য প্রয়োজন বিশ্বমানের ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাহায্য । তাঁর সাথে চাই বিশ্বমানুষের জন্য বিশ্বমানের ইসলামী সাহিত্য ।

তিনঃ শত বৈরিতা, শত প্রতিকূলতা, শত উসকানির মুখেও ইসলামী আন্দোলনকে গনতন্ত্র তথা জনমত জয়কারী দাওয়াতের পথকেই অনুসরন করে চলতে হবে ।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি