বিশ শতকে মুসলিম জাগরনের সূচনা পর্ব
বাংলা চৌদ্দ শতকের যখন শুরু ইংরেজী ১৮৯৩ সাল, ইংরেজী উনবিংশ শতকের তখনো সাত বছর বাকী । উনিশ শতকের হিন্দু- জাগরন মাত্রা এ সময় এক সিদ্ধান্তকর পর্যায়ে উপনীত । মুক্তপক্ষ বিহঙ্গের মতো তাঁদের যাত্রা তখন রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বত্র । সর্ববিধ সুযোগ সুবিধার পশরা তখন তাঁদের পায়ে আছড়ে পড়ছে । অন্যদিকে পলাশীর পরাজয়ের পর বালাকোটের বিপর্যয় ও ১৮৫৭ সালের মহা বিদ্রোহের ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে হতাশার অন্ধকারের যে যাত্রা শুরু, ইংরেজদের জাতি বিধ্বংসী শতমুখী নির্যাতন- নিষ্পেষণে মুসলমানরা পিষ্ট হবার পর তা এ সময় জমাট অন্ধকারে ঘনীভূত । উনিশ শতকের এ দুর্ভাগ্য দশা বিশ শতকের বঙ্গভঙ্গের শক ট্রিটমেন্ট ও মুসলিম লীগের পত্তন পর্যন্ত টিকেছিল ।

এ সত্ত্বেও ভুলন্ঠিত মুসলিম জাতি- সত্ত্বাকে হিন্দু জাতিদেহে বিলীন করা সম্ভব হয়নি । তথাকথিত মানবতার নামে, মনুষ্যত্বের নামে, সমন্বয়ের নামে যে ষড়যন্ত্র মুসলিম জাতিকে হিন্দু জাতিদেহে লীন করার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলো, সে ষড়যন্ত্র মুসলিম জাতিদেহের অভেদ্য বর্ম ভেদ করতে পারেনি । রাজা রামমোহন রায়ের ব্রাহ্ম ধর্ম একজন মুসলমানকেও তাঁর সাথে শামিল করতে সমর্থ হয়নি । রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সমন্বয় চিন্তার দিকে মুসলমানরা মুখ তুলেও তাকায়নি । মুসলমানরা জাগতিক সব কিছুই হারিয়েছিল, কিন্তু হারায়নি চেতনা নামক মহামূল্যবান বস্তুটি ।

দিন কারো সমান যায় না । মুসলমানদেরও গেলো না । মুসলমানদের পতনের কবরগাহে অবশেষে জীবনের চারাগাছ গজাতে শুরু করলো । যদিও তা আগের থেকে ভিন্ন প্রকৃতিতে, কিন্তু একই লক্ষ্যে মুসলিম জাতিকে আবার নিজের পায়ে উঠে দাড়াতে হবে । পতনের কবরগাহে গজিয়ে উঠা উত্থানের নতুন চারাগাছের প্রকৃতিতে যে ভিন্নতা এলো তা মুসলমানদের প্রতি ইংরেজদের অবিশ্বাস, অনাস্থা দূর এবং মুসলমানদের জন্য সুযোগ সুবিধা আদায় করার প্রয়োজনেই । সিপাহী বিদ্রোহের মাত্র ৬ বছর পর নবাব আব্দুল লতিফ কোলকাতায় প্রতিষ্ঠা করলেন ‘মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি’ । সশস্ত্র সংগ্রামত্তোর মুসলিম জাতীয় জীবনে এ ধরনের সংস্থা, সমিতি গঠন এই প্রথম । সমিতির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় কোলকাতায় নবাব আব্দুল লতিফের ১৬ নং তালতলা লেনস্থ বাড়িতে ২ ই এপ্রিল তারিখে । প্রথম এ বৈঠকে প্রথম যে প্রবন্ধ পাঠ করলেন অধ্যাপক ও মৌলভী ওয়াজির, তাতে ওয়াহাবী আন্দোলনের তীব্র সমালোচনা করা হলো । এ বিষয়টির দিকে অংগুলি সংকেত করে অনেকে বলেন, নবাব আব্দুল লতিফ এবং মোহামেডান লিটারারি সোসাইটির কাজ ছিল ইংরেজদের তোষণ । এই অভিযোগকে অসত্য বলা যাবে না, কিন্তু এটাই ছিল তখনকার বাস্তবতা । ১৯৬৯ সালে মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি যখন গঠিত হচ্ছে, তখন সারা দেশ জুড়ে ওহাবিদের ধরপাকড় করা হচ্ছে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ এবং সীমান্ত যুদ্ধে অংশগ্রহনের অপরাধে । হাজারে হাজারে মুসলমান যাচ্ছে জেলে বা আন্দামানের নির্বাসনে । ব্রিটিশের সকল ক্রোধ- আক্রোশ ও সন্দেহ সব মুসলমানদের উপরে নিপতিত । এই অবস্থায় মুসলমানদের বাচানো এবং বেঁচে থাকার মতো অধিকার আদায় করা ছিল আশু প্রয়োজন । নবাব আব্দুল লতিফ মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি গড়ে এই কাজেই হাত দিলেন । সোসাইটির মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্য সৃষ্টি, মুসলমানদের প্রতি শাসকদের অবিশ্বাস দূর, মুসলিম সমাজে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানো, সমকালীন চিন্তাধারার সপক্ষে মুসলিম জনমত গড়ে তোলা, ইত্যাদি লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করেন । বস্তুত মোহামেডান লিটারারি সোসাইটির মাধ্যমে মুসলিম রাজনীতির এক অধ্যায়ের সমাপ্তি, অন্য এক অধ্যায়ের সূচনা ঘটলো । সংগ্রাম ও অসহযোগের পথ পরিহার করে আপোষ এবং সুবিধাবাদের পথ অনুসরন করা হলো । জাতির আদর্শের বদলে জাতির ভৌত স্বার্থকে প্রধান বিবেচ্য বিষয়ে পরিনত করা হল ।

এই বিচ্চুতি সত্ত্বেও মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি বিরাট এক দুঃসময়ে মুসলিম জাতি স্বার্থকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করলো । ভারতীয় স্বার্থের সাইনবোর্ডে হিন্দুরা যখন সব অধিকার একাই কুক্ষিগত করছিলো, তখন মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি প্রথম বারের মতো মুসলিম স্বার্থকে আলাদাভাবে তুলে ধরে । মহসীন ফান্ডের টাকা লুটে পুটে খাওয়া হচ্ছিলো । যাদের জন্য এই টাকা এবং যাদের জন্য এটা বেশি প্রয়োজন, সেই মুসলমানরা মহসীন ফান্ডের টাকা পাচ্ছিলো না । নবাব আব্দুল লতিফ তাঁর অক্লান্ত চেষ্টার দ্বারা গভর্নর স্যার ক্যাম্পবলকে বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, মহসীন ফান্ডের টাকা দাতার ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহৃত হচ্ছে না । ফলস্বরূপ বাংলাদেশের ব্রিটিশ প্রশাসন ১৮৭৩ সালের ২৯ জুলাই গৃহীত এক প্রস্তাব অনুসারে মহসীন ফান্ডের টাকা শুধু মুসলমানদের জন্য ব্যয় করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করলো । তখন থেকে হুগলী কলেজ সরকারী হয়ে গেলো এবং মহসীন ফান্ডের টাকা মুসলমানদের শিক্ষার জন্য নিয়োজিত হলো । এই টাকায় হুগলী এবং কলকাতা মাদ্রাসার উন্নতি, ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহীতে মাদ্রাসা স্থাপন এবং মুসলিম ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করা হলো । সরকার ৯ টি জেলা স্কুলে আরবী এবং ফারসীর শিক্ষক রাখার নির্দেশ দিলেন । ( উপমহাদেশের রাজনীতি ও স্মরনীয় ব্যক্তিত্ব—ইয়াসমিন আহমাদ । পৃষ্ঠা নং ৭৬-৭৭ )

এতো বড় কাজ সম্ভব হয়েছিলো ব্রিটিশ প্রশাসনের সাথে নবাব আব্দুল লতিফের সুসম্পর্কের ফলেই । উল্লেখ্য, মোহামেডান লিটারারি সোসাইটির দ্বিতীয় আলোচনা সভাতেই নবাব আব্দুল লতিফ গভর্নর জেনারেল স্যার লরেন্সকে প্রধান অতিথি করে আনতে সক্ষম হন । এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ১৮৬৬ সালের ৬ই মার্চ ।

মোহামেডান লিটারারি সোসাইটির মাধ্যমে নবাব আব্দুল লতিফের চেষ্টায় জাতি হিসেবে মুসলমানরা উনিশ শতকের সত্তরের দশকেই আরও কিছু সুবিধা অর্জনে সমর্থ হল । ১৮৭১ সালের ৭ই আগস্ট ভারতের ব্রিটিশ সরকার প্রাদেশিক সরকারগুলোকে এই নির্দেশ দিলো যে, ক। সকল সরকারী বিদ্যালয় এবং কলেজে মুসলমানদের ধর্মীয় ও মাতৃভাষা শিক্ষার উৎসাহ দিতে হবে, খ। মুসলিম অধ্যুষিত জেলাসমূহে স্থাপিত ইংরেজী স্কুলগুলোতে অধিকতর যোগ্য মুসলমান শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে, গ। নিজেদের মাতৃভাষা শিক্ষা বিদ্যালয় ও ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য মুসলমানদের অধিকতর অর্থ সাহায্য প্রদান করতে হবে, ঘ। নিজেদের মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনার জন্য মুসলমানদের অধিকতর উৎসাহ দিতে হবে । ( ‘উপমহাদেশের রাজনীতি ও স্মরনীয় ব্যক্তিত্ব’—ইয়াসমিন আহমাদ । পৃষ্ঠা নং ৭৭ )

আজকের বিচারে এই পাওয়া গুলো হয়তো খুব বেশি বড় নয় কিংবা এর অন্য রাজনৈতিক ব্যাখ্যাও হতে পারে । কিন্তু যখন ব্রিটিশ শাসন বিদ্রোহী জাতি মুসলমানদের পিষে ফেলতে ব্যস্ত এবং হিন্দুরা যখন স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে মুসলমানদের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে অগ্রসর, তখনকার সেই ঘোর অমানিশার দিনগুলোতে জাতি হিসেবে মুসলমানদের এই আলাদা প্রাপ্তি মোটেই ছোট ঘটনা ছিল না । এই সিদ্ধান্তগুলোর মাধ্যমে অন্তত শিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলমানদের আলাদা জাতীয় স্বীকৃতি এবং স্বার্থ চিহ্নিত হয়েছিলো । জাতি হিসেবে মুসলমানদের স্বতন্ত্র উত্থানের ক্ষেত্রে এ ছিল এক পাতার এমন একটি চারাগাছ যা ক্রমে বহু পত্র, বহু শাখায় শোভিত হয়ে তাঁর গর্বোন্নত মাথা ঊর্ধ্বে বিস্তার করেছিলো ১৯০৬ সালে ঢাকার শাহবাগে ।

এই সময় মুসলমানদের জন্য আনন্দের আর একটা ঘটনা ঘটলো, নবাব আব্দুল লতিফ রোপিত উত্থানের চারাগাছটিতে সুবাতাস এসে লাগলো । দৃশ্যপটে এলেন সৈয়দ আমীর আলী। তিনি ১৮৭৮ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন রাজনৈতিক সংগঠন “ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন” । সময়টা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ । এর দু’বছর আগে ১৮৭৬ সালে ভারতের জাতীয়তাবাদী জাগরনের নেতা বলে কথিত সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী “ইন্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশন” প্রতিষ্ঠা করলেন আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী, কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জী প্রমুখকে সাথে নিয়ে এই ইন্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশনে যোগদানের জন্য সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী আমন্ত্রণ জানালেন সৈয়দ আমীর আলীকে । কিন্তু দূরদর্শী সৈয়দ আমীর আলী পদদলিত ও পশ্চাৎপদ মুসলমানদের জন্য পৃথক সংগঠনের কথা চিন্তা করে ইন্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশনে যোগদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে প্রতিষ্ঠা করলেন ঐ “ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন” । মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি থাকে এর প্রকৃতি ভিন্নতর হল । সোসাইটি যেখানে ব্রিটিশদের গায়ে হাত বুলিয়ে মুসলমানদের অধিকার আদায় করছিল, সেখানে “ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন” দাবী আদায়ের প্রেসার গ্রুপ হিসেবে রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো । বলা যায় নবাব আব্দুল লতিফের জাতীয় উত্থাপনের চারাগাছটি সৈয়দ আমীর আলীর হাতে এসে আরও শক্তি অর্জন করলো ।

ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশনের সামনে আশু লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো মুসলমানদের জন্য চাকুরীর একটি অংশ সংরক্ষণ, চাকুরীর শর্ত হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উপর কম গুরুত্ব প্রদান, কভেনেনটেড সার্ভিসের চাকুরীর পরীক্ষা একই সংগে অনুষ্ঠিত না করা, যে সব চাকুরী কভেনেনটেড নয় সেগুলোর জন্য কোন পরীক্ষা না নেয়া এবং মুসলমানদের শিক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করা, ইত্যাদি । ( ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন, পৃষ্ঠা- ৫৫ )

ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশনের এ দাবীগুলো ক্রমশ সুস্পষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে । সৈয়দ আমীর আলী ১৮৮৪ সালের মার্চ মাসে ভাইসরয়ের সেক্রেটারির কাছে লিখলেন, “সব থেকে বড় প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অসম বণ্টন । এটা সব থেকে বেশি অসন্তোষ এবং তিক্ততার জন্ম দিয়েছে । এবং এই অবস্থা চলতে থাকবে যে পর্যন্ত না সরকার জোরের সংগে এই নীতি নির্ধারণ করবেন যে, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় চাকুরীর অন্তত এক তৃতীয়াংশ মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে ।” ( The Emergence of Indian nationalism by Anil Seal. Page- 28 )

এই দাবী ভারতের সমগ্র অংশে ছড়িয়ে দেবার জন্যে সৈয়দ আমীর আলী ভারতের বিভিন্ন এলাকা সফর করলেন এবং এ্যাসোসিয়েশনকে সর্ব ভারতীয় রুপ দেবার জন্য এর নাম রাখলেন, “সেন্ট্রাল মোহামেডান ন্যাশনাল এসোসিয়েশন” । ১৮৮৮ সালের দিকে বাংলা, বিহার, যুক্তপ্রদেশ, পাঞ্জাব, মাদ্রাজ ও বুম্বাইয়ে এ্যাসোসিয়েশনের ৫৩ টি শাখা স্থাপিত হলো ।

১৮৮০ সাল থেকে ১৮৯২ অর্থাৎ বাংলা তের শতকের শেষ সাল পর্যন্ত অনেকগুলো ঘটনা সংগঠিত হলো । ১৮৮২ সালে মুসলমানেরা মিউনিসিপ্যালিটিতে পৃথক প্রতিনিধিত্বের অধিকার পেলো । এখন হয়তো একে খুব বড় ঘটনা বলে মনে হবে না কিন্তু সেসময় এটা ছিল পদদলিত এবং পশ্চাৎপদ মুসলমানদের জন্য একটা বড় রাজনৈতিক বিজয় । এ ছিল মুসলমানদের জাতি স্বাতন্ত্র্যের রাজনৈতিক স্বীকৃতি । হিন্দুরা এটা খুব ভালো করেই বুঝেছিল । ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হল “ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস” । যদিও বলা হতো, “ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস” হিন্দু- মুসলিম সবার, তবু কংগ্রেস নির্লজ্জভাবে মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলে মুসলমানদের পৃথক প্রতিনিধিত্বের বিরোধিতা করলো এবং যুক্ত নির্বাচন দাবী করলো । অর্থাৎ কংগ্রেস পদদলিত এবং পশ্চাৎপদ মুসলমানদের সমস্যার কোন আমলই দিতে চাইলো না । কংগ্রেসের এই ভূমিকা সম্পর্কে কোলকাতার “মোহামেডান অব্জারভার পত্রিকা” ১৮৮৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর ক্ষুব্ধ কণ্ঠে লিখলো, “সরকারী চাকুরীতে নিযুক্তির জন্য খোলাখুলিভাবে প্রতিযোগিতাকে নির্বাচনের একমাত্র উপায় হিসেবে গ্রহনের উপর জোর দেয়ার অর্থ সরকারী চাকুরী থেকে মুসলমানদের সম্পূর্ণভাবে বহিস্কার । সংখ্যালঘুদের অধিকার আছে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে কি-না সেটা দেখার এবং আমরা যুক্তিযুক্তভাবেই বলি যে, আমাদের লোকেরা যতক্ষন না পর্যন্ত শিক্ষা ও রাজনৈতিক বুদ্ধির দিক দিয়ে হিন্দুদের সমকক্ষ হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণের যথেষ্ট রক্ষাকবচ ব্যতীত সংখ্যাগুরুকে বিশেষ রাজনৈতিক সুবিধা প্রদান সংখ্যালঘুর ধ্বংসই ডেকে আনবে ।” ( The Emergence of Indian nationalism by Anil Seal. Page- ৩২ )

স্যার সৈয়দ আহমাদ “মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স” ডাকলেন ১৮৮৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর । এই সম্মেলনে তিনি মুসলমানদের জন্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের মতই স্বতন্ত্র সংগঠন করার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করলেন । ১৮৮৭ সালে স্যার সৈয়দ তাঁর বিখ্যাত লক্ষৌ বক্তৃতায় হিন্দুদের যুক্ত নির্বাচন দাবীর তীব্র বিরোধিতা করলেন । এ সময় কংগ্রেস উৎকট মুসলিম বিরোধিতা এবং উগ্র হিন্দু জাতীয়তার দিকে ঝুকে পড়লে বিপদের আশংকায় স্যার সৈয়দ ১৮৮৯ সালে “মুসলিম প্রতিরক্ষা সমিতি” গঠন করলেন ।

কিন্তু মুসলমানদের প্রতিবাদ, বিরোধিতা, ইত্যাদি কোনই কাজে আসলো না । ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস গঠনের পর আবহাওয়া যেন পাল্টে গেলো । কংগ্রেস গঠন এবং হিন্দুদের জঙ্গি উত্থানে ব্রিটিশ প্রশাসন যেন হিন্দুদের মন রক্ষায় পাগল হয়ে উঠলো । ১৮৯২ সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল এ্যাক্ট পাশ হলো । আইন পরিষদ ও স্টাটীঊটরি বডিতে পরোক্ষ প্রতিনিধিত্বের নীতি এবং যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি গৃহীত হল ।

হিন্দু জাতীয় উত্থানের গতিতে ঝড়ের বেগ সঞ্চারিত হল । ১৮৯৬ সালে শিবাজী উৎসব হিন্দু উত্থানকে মারমুখো এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত করলো । ঠিক এই সময় ১৮৯৩ সালে মারা গেলেন নবাব আব্দুল লতিফ এবং ১৮৯৮ সালে মারা গেলেন স্যার সৈয়দ আহমাদ খান । আর এ সময় সৈয়দ আমীর আলীও বিলেত মুখো হলেন । ১৯০৪ সালে তিনি বসতি স্থাপন করলেন বিলাতে । সবদিক থেকে ঘোর অন্ধকারে ডুবে গেলো মুসলমানরা । মুসলমানদের জাতীয় উত্থানের যে চারাগাছটি গজিয়ে ছিল তা পড়ে গেলো প্রচন্ড ঝড়ের কবলে । এই দুঃসহ অমানিশার মধ্যে একবছর দুইবছর করে দশটি বছর কাটিয়ে মুসলমানরা উপনীত হলো বাংলা চৌদ্দ শতকের দশম বর্ষে । চৌদ্দ শতকের দশম বর্ষ ১৯০৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর বঙ্গ বিভাগ পরিকল্পনা ঘোষিত হলো, যা আহত বাঘের মতো জাগ্রত হিংস্র করে তুললো হিন্দুদের । হিন্দুদের এই মারমুখো উত্থান মুসলমানদের জন্য শক ট্রিটমেণ্টের কাজ করলো । মুসলমানরা আত্মরক্ষার প্রয়োজন অনুভব করলো । এই প্রয়োজন থেকে গড়ে উঠলো আত্মরক্ষার এক ঐতিহাসিক দুর্গ । বাংলা চৌদ্দ শতকের শুরুতে সংগঠিত এই ঘটনা বাংলা চৌদ্দ শতককে দান করলো সুস্পষ্ট এক চরিত্র, নতুন এক গতি এবং অনন্য এক ইতিহাস । কি ছিল ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই বংগভঙ্গের ঘটনা ?

বংগভংগ আসলে নিছক কোন বঙ্গ-ভঙ্গ ছিল না । প্রশাসনিক সুবিধার জন্য লর্ড কার্জন তৎকালীন বিশাল বাংলা প্রদেশকে দুইটা ভাগ করেছিলেন । একেই খারাপ অর্থে চিত্রিত করার জন্য হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গ আখ্যায়িত করেছিলো ।

বঙ্গভঙ্গ বা এই প্রদেশ বিভাগের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ঘোষিত হলো ১৯০৩ সালে ১২ ডিসেম্বর । সরকারী গেজেট নোটইফিকেশনে ঘোষিত এ পরিকল্পনায় সংশ্লিষ্ট এলাকাসহ সম্বলপুর, গাঞ্জাম ও ভিজাগাপত্তম এজেন্সী বাংলা প্রদেশের সাথে, অন্যদিকে বাংলার চট্টগ্রাম বিভাগ, পার্বত্য ত্রিপুরা, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে আসাম প্রদেশের সাথে এবং ছোট নাগপুরকে মধ্য প্রদেশের সাথে যুক্ত করার কথা বলা হলো ।

প্রদেশ বিভাগের এই পরিকল্পনা পরে আরও সংশোধিত এবং পরিবর্তিত হলো । ১৯০৪ সালের এপ্রিলে লর্ড কার্জন যখন লন্ডন যান, তখনই তিনি বিষয়টির পুনর্বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলে গেলেন । কার্জন লন্ডন গেলে গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহন করলেন অ্যাম্পটহিল । তাঁর সময়েই বঙ্গবিভাগ পরিকল্পনা চূড়ান্ত রূপ লাভ করলো । ১৯০৪ সালের ৬ই ডিসেম্বর বংগবিভাগের নতুন পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত করা হলো । এই ডিসেম্বরেই কার্জন ফিরে এলেন লন্ডন থেকে । তিনি নতুন পরিকল্পনা গ্রহন করলেন এবং ১৯০৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ভারত সচিবের কাছে প্রেরন করলেন । ইংল্যান্ডে একটি বিশেষ কমিটি প্রস্তাবটি পরীক্ষা করে দেখার পর ১৯০৫ সালের ৯ই জুন বাংলা বিভাগকে অনুমোদন দান করলো । অনুমোদিত এ পরিকল্পনা অনুসারে বাংলার রাজশাহী বিভাগ, চট্টগ্রাম বিভাগ, ঢাকা বিভাগ, পার্বত্য ত্রিপুরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং মালদহকে চীফ কমিশনার শাসিত আসামের সাথে যুক্ত করে নতুন পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ গঠিত হলো । আর বাংলার অবশিষ্ট এলাকার সাথে সম্বলপুর উড়িষ্যার পাঁচটি এলাকা যুক্ত করে গঠিত হলো বাংলা প্রদেশ । হিন্দী ভাষা-ভাষী পাঁচটি এলাকা বাংলা প্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যুক্ত হলো গিয়ে মধ্যপ্রদেশের সাথে । ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর থেকে নতুন প্রদেশ বিভাগকে কার্যকরী করা হলো ।

প্রদেশ পুনর্গঠনের পর পূর্ব বঙ্গ এবং আসাম প্রদেশের রাজধানী হলো ঢাকা । এই নতুন প্রদেশের লোকসংখ্যা দাঁড়ালো ৩ কোটি ১০ লাখ । এর মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়ালো ১ কোটি ৮০ লাখ, হিন্দুর সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ । অন্যদিকে বাংলা প্রদেশের লোকসংখ্যা দাঁড়ালো ৫ কোটি ৪০ লাখ । এর মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ৯০ লাখে, আর হিন্দু লোকসংখ্যা হলো ৪ কোটি ২০ লাখ । কোলকাতা হলো বাংলা প্রদেশের রাজধানী । এই প্রদেশ বিভাগের ফলে জাতি হিসেবে মুসলমানরা লাভবান হলো । একদিকে ঢাকাকে তারা রাজধানী হিসেবে পেলো, অন্যদিকে ১৮৬৫৪০ বর্গমাইল বিশিষ্ট বিশাল প্রদেশে তারা সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করলো । সবচেয়ে বড় কথা হলো, মুর্শিদকুলী খান ঢাকা থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে সরিয়ে নিয়ে যাবার পর পূর্ব বাংলার প্রতি যে অবহেলা শুরু হয়েছিলো এবং ব্রিটিশ আমলে কোলকাতা কেন্দ্রীক শাসনে পূর্ব বাংলার উপর যে দুর্দিন চেপে বসেছিল, তাঁর প্রতিকারের একটা পথ হলো নতুন প্রদেশ গঠনের ফলে । সচেতন সবার কাছেই পরিস্কার ছিল, রাজধানী থীক বহু দূরের পূর্ব বাংলার প্রশাসন ব্যবস্থা ছিল দুর্বল এবং অদক্ষ আর স্বাভাবিকভাবেই কার্যকর ও সক্রিয় ছিল না । জনকল্যাণ এবং অগ্রগতির জন্য যে অর্থ এ এলাকায় ব্যয় করা হতো তা ছিল বাস্তব প্রয়োজন অপেক্ষা নিতান্তই অপ্রতুল । এমনকি এ অঞ্চলের প্রধান প্রধান সমস্যাকেও উপেক্ষা করা হতো । শিক্ষায় ছিল অবহেলিত, যোগাযোগ ও উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল অনুন্নত । কৃষকরা সাধারনত কোলকাতায় বসবাসকারী জমিদারদের এজেন্ট ও কর্মচারীদের হাতে অত্যাচারিত হতো । ব্যবসায় বাণিজ্যের দিক থেকেও এ অঞ্চল দারুনভাবে পশ্চাৎপদ হয়ে পড়ে । চট্টগ্রাম বন্দরের কোন উন্নতি না হওয়ার ফলে পূর্ব বাংলার বড় বড় নদী অঞ্চলকে ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারের জন্য যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়নি । ( বঙ্গভঙ্গ, মুনতাসির মামুন সম্পাদিত, পৃষ্ঠা- ২,৩ )

বঙ্গ বিভাগের মূলে পূর্ব বাংলার এ দুর্দশা দূরীকরণ চিন্তা যতটাই থাক, মূলত প্রশাসনিক সুবিধার জন্য নতুন প্রদেশ গঠন করা হয়েছিল ।

লর্ড কার্জন এক চিঠিতে বলেছিলেন, “যেকোনো ব্যক্তির ( প্রশাসকের ) পক্ষে বাংলার প্রশাসন পরিচালনা এক অসম্ভব ব্যাপার । ( এ অবস্থায় ) প্রশাসন যে অত্যন্ত দুরুহ ব্যাপার তা অনুধাবনের জন্য শুধু তাঁকে জেলায় যেতে হবে ।” (Curzon to Zroderiek, Feb. 17, 1904 )

সন্দেহ নেই, প্রশাসনিক সুবিধার দিকটাকে সামনে রেখেই সব বিরুদ্ধতাকে তিনি উপেক্ষা করেছিলেন । বিভিন্ন স্তরে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যখন চরম পর্যায়ে উঠে, তখনো উপদেষ্টারা লর্ড কার্জনকে পরামর্শ দেন, ‘বিভিন্ন সংস্থা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের ব্যক্তিগত স্বার্থ অপেক্ষা প্রশাসনিক স্বার্থ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ।’ (Ibetson, Note, Feb. 7, 1904 বঙ্গভঙ্গ, মুনতাসির মামুন সম্পাদিত, পৃষ্ঠা- ২,৩ )

ইবেতসন কার্জনকে বলেন, “বাংলার ( প্রশাসনিক ) স্বার্থ অনেক গুরুত্বপূর্ণ আর আসামের জন্য তা আরও গুরুত্বপূর্ণ । আমার মনে হয়, প্রশাসনিক প্রয়োজনে ( সকল স্তরের ) বিরোধিতা সত্ত্বেও এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়া উচিৎ ।” (Ibetson, Note, Feb. 7, 1904 বঙ্গভঙ্গ, মুনতাসির মামুন সম্পাদিত, পৃষ্ঠা- ২,৩ )

কিন্তু কার্জন প্রশাসন তাঁর সিদ্ধান্তের পক্ষে এ ধরনের যতো যুক্তিই দেন, একটি মহল আজও বলছে, লর্ড কার্জনের বংগবিভাগের সিদ্ধান্ত ছিল একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রনোদিত । তখনো বলা হয়েছিলো, এখনো বলা হচ্ছে যে, একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ সৃষ্টি করে ক্রমবর্ধমান হিন্দু প্রভাব ক্ষুন্ন করার মনোভাবই এর পেছনে কাজ করেছে । এই যুক্তির পক্ষে ক্রমবর্ধমান হিন্দু প্রভাব বৃদ্ধি সম্পর্কে ব্রিটিশ ভীতির দৃষ্টান্তও তারা তুলে ধরেছেন । এ ক্ষেত্রে তাঁদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হলো কার্জনের কাছে ভারত সচিব হ্যামিল্টনের একটি চিঠি । এ চিঠিতে হ্যামিল্টন লেখেন, “আমার মনে হয় আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর ভারতে আমাদের শাসনের পক্ষে সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা হয়ে যা দেখা দেবে, তা হলো পাশ্চাত্য- এর ঢঙ্গে আন্দোলন । সংগঠনের পর্যায়ক্রমিক অথবা ব্যাপক বিস্তার । আমরা যদি শিক্ষিত হিন্দুদের ভিন্নমুখী ভাবধারায় দুটি ডলে বিভক্ত করতে পারি তবে উত্তরোত্তর উচ্চশিক্ষা বিস্তারের ফলে আমাদের শাসন ব্যবস্থার বিপক্ষে প্রতিনিয়ত যে সূক্ষ্ম আঘাত আসছে তা প্রতিহত করতে পারবো ।” ( Hamilton to Curzon, September 20, 1899. Curzon papers volume-1 )

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে ‘ভ্যালেন্টিন চিরোল’ – এর রিপোর্টকে, যা তিনি লর্ড মিন্টোর কাছে পেশ করেছিলেন । ভ্যালেন্টিন চিরোল তাঁর এ রিপোর্টে বলেছেন, “এটা নিঃসন্দেহ যে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে ‘অসন্তোষ’ দানা বেঁধেছে তা প্রধানত কৃত্রিম, কিন্তু যা মূলত আমাদের ভীত- সন্ত্রস্ত করে আর যা আমার নিকট অত্যন্ত অশুভ মনে হয় তা হলো পাশ্চাত্যের প্রভাব প্রতিপত্তি, বিশেষ করে এর আত্মিক এবং নৈতিক, পার্থিব ও রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও সর্বাত্মক বিপ্লবের আন্দোলন । মাঞ্চুরিয়ায় জাপানি বিজয় নিঃসন্দেহে এ আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছে, কিন্তু এর মূল প্রোথিত আরও গভীরে । এ আন্দোলন এশিয়াব্যাপী প্রাচ্যের সব জাগরনের কোন ভারতীয় অভিব্যক্তি নয়, বরং এ আন্দোলন হল প্রধানত হিন্দু ( পুনরজাগরন ) আন্দোলন । ত্রিশ বছর পূর্বে আমি যখন ভারত এসেছিলাম তখন লক্ষ্য করেছিলাম, নতুন আশায় উদ্বেল নতুন ভারত বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে হতে চেয়েছিল ইংরেজদের চেয়েও ইংরেজ মনোভাবাপন্ন । পাশ্চাত্যের সাহিত্য ও নীতি শাস্ত্র তথা পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ও শাসন ব্যবস্থাকে তখন বিনা দ্বিধায় শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসানো হয়েছিলো। স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের আগ্রহ কমে আসার আটের দশকের ঘড়ির দোলক যেন পেছনে ফিরেছে আর নয়ের দশকে তা হিন্দু পুনরজাগরনের এক আন্দোলনের রুপ লাভ করেছে যার ফলে বেদ অনুশীলন, বানী পূজা, গনপতিমালা অনুষ্ঠান ও শিবাজী মহারাজের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন বৃদ্ধি পেয়েছে । বর্তমানে আমরা বাংলা, দাক্ষিণাত্য ও পাঞ্জাবের মত তিনটি ঝটিকা কেন্দ্রে এ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি ।” ( Valentine Chirol to Minto, May 23, 1910 )

উপরোক্ত দুটি বক্তব্যে ইংরেজদের যে উদ্বেগ- অনুভূতি, তাঁর প্রত্যেকটি কথাই সত্য । হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন মারমুখো রূপ নিয়েছিল তা ঐতিহাসিক ঘটনা । যদিও এ আন্দোলনের টার্গেট ছিল মুসলমানরা, তবে তা প্রয়োজনে ব্রিটিশ বিরোধীও হয়ে উঠতে পারে, একথা না বুঝার মতো নাবালক ইংরেজরা ছিল না । বরং দূরদর্শী ইংরেজরা পঞ্চাশ বছর পড়ে কি হতে পারে সেটা সঠিকভাবেই অনুমান করেছিলো । এ অনুমান যারা করতে পারেন, তারা বাংলা ভাগ করে এই পরিনতি ঠেকাতে চেষ্টা করবেন এ কথা বিশ্বাস করতে বলা একটা বালখিল্যতা ছাড়া আর কিছুই নয় । বাংলার হিন্দু জাতীয়তাবাদী যে জাগরন, তাঁর স্রষ্টা কি শুধু বাংলার হিন্দুরা ? তা যে নয় ইতিহাস তাঁর সাক্ষী । হিন্দুবাদী জাগরনের যিনি জনক স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী বাংলার লোক নয় । দয়ানন্দ সরস্বতীর পর, হিন্দুদের মারমুখো জাগরনের পতাকা যারা বহন করেন, সেই বাল গঙ্গাধর তীলক, লালা লাজপাত রায়, প্রমুখের কেউই বাংলাদেশের নয় । ( বাংলার সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের নেতা শ্রী অরবিন্দ বাঙ্গালী হলেও তাঁর প্রেরনা বাংলাদেশ থেকে নয় । শ্রী অরবিন্দু ‘পশ্চিম ভারতীয় এক ঠাকুরের নিকট সন্ত্রাসবাদের দীক্ষা গ্রহন করেন এবং তা বাংলায় চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন ।’ = অখন্ড ভারতের স্বপ্ন- আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা- ৭৮ , শ্রী অরবিন্দ বরোদা কলেজের অধ্যাপক থাকাকালে রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠায় উৎসর্গিত প্রান এবং মারাঠা দেশে এই আন্দোলনের নেতা দামোদর হরি চাপেকার ও বিষ্ণুহরি চাপেকার –এর কাছে বিপ্লবের দীক্ষা নেন । = স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, পৃষ্ঠা- ৫৬ )

তারা দূরবর্তী প্রদেশ পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি থেকে এসে যদি বাংলার হিন্দু মনে জাগরনের আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে থাকেন, স্বদেশী ও স্বরাজ আন্দোলন সৃষ্টি করে থাকতে পারেন, তাহলে বাংলা ভাগ হলেই হিন্দু জাগরন বন্ধ হয়ে যাবে, আসলে যারা এধরনের অবস্থা চিন্তা করেন, তাঁদের এই চিন্তাই প্রকৃতপক্ষে উদ্দেশ্য প্রণোদিত । হিন্দু বাবু- বুদ্ধিজীবীদের যুক্তিই এরা চোখ বন্ধ করে উদগীরন করতে চায় ।

লর্ড কার্জনের কয়েকটি উক্তিকেও দলিল হিসেবে সামনে এনে বলা হয় যে, বঙ্গ ভঙ্গের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল । এ ক্ষেত্রে লর্ড কার্জনের যে উক্তিটিকে সবচেয়ে বড় দলিল হিসেবে উল্লেখ করা হয়, তাতে তিনি বলেন, “যারা নিজেদের একটি জাতি ভাবছে এবং স্বপ্ন দেখছে যে, ইংরেজরা বিতাড়িত হলেই কোলকাতার গভর্নমেন্ট হাউজে একজন বাঙ্গালী বাবুকে বসানো হবে, সেই বাঙ্গালীরা তাঁদের এ স্বপ্নের ব্যতিক্রম ঘটাতে পারে এমন কোন কিছুই বরদাশত করবেনা । আজ আমরা যদি তাঁদের হৈ চৈ প্রতিরোধে দুর্বলতা প্রদর্শন করি, তাহলে বঙ্গ বিভাগ আর কোন দিনই সম্ভব হবেনা এবং এর দ্বারা এমন একটি শক্তিকে সংহত এবং শক্তিশালী করা হবে যারা ভবিষ্যতের জন্য ক্রমবর্ধমান বিপদের উৎস উঠছে আমাদের পূর্বাঞ্চলে ।” ( ১৯০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী লর্ড কার্জন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার ফেরত ট্রেনে ভারত সচিব- ব্রডরিককে এ কথাগুলো লিখেছিলেন ।)

প্রথমত কার্জনের এই কথাগুলো একটা জবাবী বক্তব্য বঙ্গ ভঙ্গের পরিকল্পনা ঘোষণার ২ মাস ৬ দিন পর লর্ড কার্জন এই কথাগুলো বলেছিলেন । বলেছেন এমন সময় যখন তিনি তাঁর পরিকল্পনার স্বপক্ষে জনমত তৈরির জন্য প্রচারে বেরিয়েছেন । বংগ ভঙ্গের পরিকল্পনা ঘোষণার পর তিনি হিন্দু জমিদার ও বুদ্ধিজীবীদের যে আক্রমনের শিকার হয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমন চালিয়েছেন তিনি এখানে । তাঁর উপর যেমন রাজনৈতিক আক্রমন হয়েছে, তিনি তেমনি তাঁর রাজনৈতিক জবাব দিয়েছেন । এ যুক্তিগুলো প্রকৃত পক্ষে বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করার যুক্তি, বংগ ভঙ্গের যুক্তি নয় । উপরের উক্তিটিতে কার্জন মূলত দুইটি কথা বলেছেন । এক। বাঙ্গালী বাবুদের টার্গেট কোলকাতার গভর্নমেন্ট হাউজ অর্থাৎ বাংলার কৃতিত্ব দখল করা এবং তাঁদের এ স্বপ্নকে তারা কোনভাবেই খন্ডিত হতে দিতে রাজি নয় ।

দুই। তাঁদের দাবীর কাছে যদি নতি স্বীকার করা হয়, তাহলে তারা আরও সংহত এবং শক্তিশালী হয়ে উঠবে । প্রথম উক্তির মধ্য দিয়ে আসলে লর্ড কার্জন প্রকৃত পক্ষে বাঙ্গালী বাবুদের বাংলার রাজা হওয়ার স্বপ্নকে বিদ্রূপ করেছেন, বাংলা ভাগ করে তাঁদের উদ্দেশ্য বানচাল করা যাবে এমন কথা তিনি বলেন নি । এমন অযৌক্তিক কথা তিনি বলতেও পারেন না । কারন বাংলা ভাগ হলেও কোলকাতার বাবুদের কোলকাতার গভর্নমেন্ট হাউজে বাস অর্থাৎ ঐ বাংলার কৃতিত্ব দখলে কোন অসুবিধা থাকতে পারে না । অতএব বাংলা ভাগ করে বাঙ্গালী বাবুদের উদ্দেশ্য বানচাল করতে পারছেন কৈ? লর্ড কার্জন তাঁর উক্তির দ্বিতীয় অংশে যে কথা বলেছেন তাঁর সার কথা এই যে, বাঙ্গালী বাবুদের দাবীর কাছে নতি স্বীকার করে তাঁদেরকে আরো সংহত এবং শক্তিশালী করা উচিৎ হবেনা । বংগ বিভাগের মাধ্যমে তাঁদেরকে দুর্বল করা যাবে এমন কথা তিনি এখানে বলেন নি । বলা কোন দিকে দিয়েই যুক্তিসংগত নয়। পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, যুক্তপ্রদেশ, বাংলা প্রভৃতি প্রদেশের হিন্দুরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, তাহলে বাংলা ভাগ হলেই বাংলার হিন্দুরা দুর্বল হয়ে পড়বে কেন ? ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর থেকে ১৯১২ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলা বিভক্ত ছিল । এই বিভক্তি হিন্দুদের ঐক্য এবং আন্দোলনে কোনই বাঁধা সৃষ্টি করেনি, সামান্য দুর্বলও তাঁদের করেনি । তাঁদের শক্তি এবং সন্ত্রাসের মুখেই ইংরেজরা নতি স্বীকার করে ও বঙ্গ ভংগ রদ ঘোষণা করে । সুতরাং হিন্দুদের জাতীয় জাগরন ও উত্থান দমন করার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই বঙ্গ ভংগ হয়েছিলো এটা একটা গাঁজাখুরি যুক্তি ছাড়া আর কিছুই নয় ।

আসল কথা হলো, বঙ্গ বিভাগ ছিল তখনকার ব্রিটিশ শাসকদের দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক চিন্তা-ভাবনার ফল । যা কার্যত শুরু হয় ১৮৫৪ সালে । এ বছর বাংলার গভর্নরের ( লেফটেন্যান্ট গভর্নর ) পদ সৃষ্টি করার সময় এ আশা পোষণ করা হয় যে, এর ফলে বাংলার প্রশাসন আরও প্রানবন্ত হয়ে উঠবে । ১৮৬৭ সালের উড়িষ্যা দুর্ভিক্ষের পর প্রনীত তদন্ত রিপোর্টে বাংলার আয়তনজনিত প্রশাসনিক দুর্বলতাকে দুর্ভিক্ষের অন্যতম কারন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় । ( Yule’s Minute, July 18.18.67, no, 1 paras . December 2, 1867 .page 115 )

বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার উইলিয়াম গ্রে লরেন্সের নিকট লিখিত এক পত্রে বলেন, “বর্তমান বাংলা সরকারের মত এমন অস্বাভাবিক ব্যবস্থা ভারতে আর আছে বলে আমি জানিনা । ভারতে আয়তনের দিক থেকে বৃহত্তম প্রশাসনিক ব্যবস্থা আর গুরুত্বের দিক থেকে সর্বপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও বাংলা সরকারের কার্যক্ষমতা বোম্বাই ও মাদ্রাজ সরকার অপেক্ষা অনেক কম এবং শ্লথ ।” ( ‘Grey to Lawrence, July 1867, John Lawrence collection. Volume- 1913 )

এইভাবেই বঙ্গ বিভাগের সুস্পষ্ট চিন্তা দানা বেধে উঠতে থাকে । উল্লেখ্য, এসময় হিন্দুদের জাতীয়তাবাদী উত্থানের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়নি । লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার উইলিয়াম গ্রে যখন এই চিঠি লিখেন, তারও ৯ বছর পর ১৮৭৬ সালে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানারজী প্রমুখ হিন্দু নেতারা ইন্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন এবং এরও ৯ বছর পর ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দুদের জাতীয় কংগ্রেস । সুতরাং হিন্দুদের উত্থান প্রতিরোধ করার জন্য বংগবিভাগ চিন্তার উদ্ভব হয়নি । এছাড়া লর্ড কার্জন গভর্নর জেনারেল হয়ে আসার ২ বছর আগে ১৮৯৬ সালে বংগবিভাগের সুস্পষ্ট প্রস্তাব প্রনীত হয় । চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার ওল্ডহ্যাম ১৮৯৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সুপারিশ করলেন যে, আসামসহ চট্টগ্রাম এবং ঢাকা বিভাগের অংশ বিশেষ নিয়ে পূর্ব বাংলা নামে নতুন প্রদেশ গঠিত হওয়া দরকার । ( Commissioner of Chittagong division to the government of Bengal. Feb, 7, 1896. No. 722, P.L 1897, Vol.-24 )

চট্টগ্রাম আথবা ঢাকাকে তিনি এ নতুন নামে নতুন প্রদেশের রাজধানী করার কথা বলেন । এবছরই নভেম্বর মাসে আসামের চীফ কমিশনার স্যার উইলিয়াম ওয়ার্ড আসামের সাথে চট্টগ্রাম বিভাগ, ঢাকা এবং ময়মনসিংহ জেলার সংযুক্তিকরণের প্রস্তাব দিলেন । ( chief Commissioner of Assam to the government of India, nov, 25, 1896, No.583, page-17,19 )

উল্লেখ্য, এর আগে ১৮৯২ সালে লুসাই অধিবেশনের সুপারিশক্রমে চট্টগ্রাম জিলা সহ লুসাই অঞ্চলকে আসামের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যা অবশ্য তখন কার্যকরী হয়নি । ( The proceedings of government of india of the foreign department, 1883E of July, 25, 1892 )

সুতরাং ইতিহাসের সাক্ষ্য হলো, গভর্নর জেনারেল হিসেবে লর্ড কার্জন আসার আগেই বংগ বিভাগ সম্পর্কে চিন্তাধারা চূড়ান্ত রুপ নিয়েছিল । লর্ড কার্জন এই চিন্তা, প্রস্তাবকে বাস্তব রূপ দিয়েছেন মাত্র । অতএব লর্ড কার্জনের বংগবিভাগ তাঁর রাজনৈতিক পরিকল্পনা থেকে উদ্ভূত একতাহ কোন দিক দিয়েই ধোপে টেকে না ।

একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, অবহেলিত পূর্ব বঙ্গের স্বার্থ সামনে রেখে প্রশাসনিক প্রয়োজনেই যদি বঙ্গ ভঙ্গ হয়ে থাকে, তাহলে পূর্ব বাংলার মুসলমানরাও এর প্রতিবাদ করেছিলেন কেন ? এ প্রশ্ন তোলার অবকাশ অবশ্যই আছে । বঙ্গ ভঙ্গ পরিকল্পনা ঘোষিত হবার পর পূর্ব বাংলা থেকে প্রতিবাদ উঠেছিলো । কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, পূর্ব বঙ্গ থেকে উত্থিত মুসলিম নামীয় প্রতিবাদগুলোর সব কটিই বঙ্গ ভঙ্গ পরিকল্পনা ঘোষণা ( ১৯০৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ) থেকে চূড়ান্ত বঙ্গ বিভাগ ঘোষণার ( ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর ) মধ্যবর্তী সময়ের । চূড়ান্ত বংগবিভাগ ঘোষণার পর এর বিরুদ্ধে কার্যত কোন মুসলিম প্রতিবাদ আমরা দেখি না । লক্ষ্য করার বিষয়, ১৯০৩ সালের বংগবিভাগ পরিকল্পনা এবং ১৯০৫ সালের বংগবিভাগ এক জিনিস ছিল না । ১৯০৩ সালের ১২ই ডিসেম্বরের পরিকল্পনার মধ্যে আপত্তির কিছু সংগত কারন ছিল । ১৯০৩ সালের পরিকল্পনায় আসামের সাথে চট্টগ্রাম বিভাগ, পার্বত্য ত্রিপুরা, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলা নিয়ে পূর্ব বাংলা প্রদেশ গঠিত হয়েছিলো । যার ফলে ঢাকা বিভাগের একটা অংশ এবং গোটা রাজশাহী বিভাগ পূর্ব বঙ্গ থেকে বাদ পড়েছিলো অর্থাৎ পূর্ববঙ্গও বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো । পূর্ব থেকে উত্থিত আপত্তির কারন ছিল এটা একটা । ১৯০৫ সালের ১২ই ডিসেম্বরের চুড়ান্ত বংগবিভাগে এই আপত্তি দূর হয়ে যায়, গোটা ঢাকা এবং রাজশাহী বিভাগ পূর্ববঙ্গের সাথে শামিল হয়ে যায় । মুসলমানরা এই চূড়ান্ত বঙ্গ বিভাগে খুশী হয় এবং একে স্বাগত জানায় ।

সবচেয়ে বড় কথা হল বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে পূর্ব বঙ্গ থেকে যেসব প্রতিবাদ উত্থিত হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর উদ্যোক্তা মুসলমানরা ছিলেন না । ‘পূর্ব বঙ্গের প্রধান হিন্দু জমিদার ও ভদ্র লোক নেতারাই এখানকার প্রতিবাদ সভাগুলোর আয়োজন করেছিলেন এবং কৌশলগত কারনে অনেক ক্ষেত্রে মুসলমানদের সভার সভাপতি বানিয়েছিলেন । ( বঙ্গভঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গে প্রতিক্রিয়া— মুনতাসির মামুন, পৃষ্ঠা-৭২ )

বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ঢাকায় প্রথম যে সভা অনুষ্ঠিত হয়, তাঁর সভাপতি ছিলেন ধানকোরার জমিদার হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী । এ সভায় বক্তৃতা করেন কালী প্রসন্ন ঘোষ বাহাদুর এবং উকিল আনন্দ চন্দ্র রায় । পরে ঢাকায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জারী রাখার লক্ষ্যে গঠিত হয় ‘জনসাধারণ সভা’ । এ ‘জনসাধারণ সভা’ গঠনের প্রেরনা শিবনাথ শাস্ত্রীর ভারত সভা । প্রধানত হিন্দু উকিলরা ছিলেন এর উদ্যোক্তা । বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে পূর্ব বঙ্গের প্রতিবাদ নিয়ে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ভূমিকা পালন করে ঢাকার সংবাদপত্র ‘ঢাকা প্রকাশ’ । তিলকে সে তাল করে প্রকাশ করতো । পত্রিকাটি ছিল হিন্দু মালিকানাধীন এবং হিন্দু উত্থানবাদীদের আড্ডা । ১৯০৩ সালের বঙ্গ বিভাগ পরিকল্পনা ঘোষণার পরপরই ‘ঢাকা প্রকাশ’ লিখলো, “ভাই বঙ্গবাসী, এই বিষম বিপ্লবকর প্রস্তাব কার্যে পরিনত হলে, বাঙ্গালী জাতির কি সর্বনাশ সংগঠিত হবে একবার তাহা নিবিষ্ট চিত্তে চিন্তা করিয়া দেখিয়াছ কি ? অতএব স্বদেশের জন্য, স্বদেশীদের জন্য, যে কোন বঙ্গ সন্তানের শ্রদ্ধা আছে তাহাদের প্রত্যেকের কর্তব্য হচ্ছে, এই প্রলয়ঙ্কর প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ করে জাতীয় অসন্তোষ চিহ্ন ভারত গভর্নমেন্টের কাছে প্রদর্শন করুন ।” ( ঢাকা প্রকাশ, ২০ ডিসেম্বর, ১৯০৩ )

এক সপ্তাহ পরেই পত্রিকাটি আবার লিখলো, “রাজ পুরুষের কুটিল কটাক্ষ দেখে ভীত হইও না । পুরুষ পরস্পরাগত পৈত্রিক সম্পত্তি ‘বাঙ্গালী’ আখ্যা রক্ষার নিমিত্ত যদি আত্মোৎসর্গে বিমুখ হও, তবে ধরা পৃষ্ঠা হতে যতো শীঘ্র তোমাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়, ততই মঙ্গল ।” ( ঢাকা প্রকাশ, ২৭ ডিসেম্বর, ১৯০৩ )

‘ঢাকা প্রকাশের’ এই কণ্ঠ পূর্ব বঙ্গের কণ্ঠ নয়, পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের কণ্ঠ তো নয়ই । ‘ঢাকা প্রকাশের’ কণ্ঠে ঢাকার কণ্ঠ নয়, কোলকাতার বাবু কণ্ঠ, শ্রুত হয়েছে সুরেন্দ্রনাথ, অরবিন্দ প্রমুখের কণ্ঠ । সুতরাং ঢাকা প্রকাশ এবং তাঁর মতো বঙ্গভঙ্গ বিরোধী কণ্ঠ রাজনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কোন দিক থেকেই পূর্ববঙ্গের সাথে যুক্ত হবার উপযুক্ত নয় ।

বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতার নামে হিন্দু মনোভাব এক যুগান্তকারী রূপ নিয়ে আবির্ভূত হল । বাংলাদেশের হিন্দু উত্থানের লক্ষ্য নিয়ে বঙ্গভঙ্গ হয়নি এটা ঐতিহাসিক সত্য, কিন্তু হিন্দুরা তাঁদের শোষণ ক্ষেত্র পূর্ববঙ্গ হারানো, পূর্ব বঙ্গে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ এবং উন্নতির সম্ভাবনা, কোলকাতার পশ্চাৎভূমি থেকে পূর্ব বঙ্গের খসে পড়া এবং রাজধানী ঢাকা ও বন্দর হিসেবে চত্তগ্রামের বিকাশ লাভকে তারা বরদাশত করতে পারেনি । পারেনি বলেই হিন্দুরা এক বাক্যে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় নেমে পড়ে । প্রথমেই মাঠে নামলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক হিসেবে পরিচিত সুরেন্দ্রনাথ ব্যানারজী । উল্লেখ্য, কোলকাতা কেন্দ্রীক ভদ্রলোক ( বাবুশ্রেনী ) ও বাংলাদেশের মধ্যবর্তী শ্রেনীর ( এই মধ্যবর্তী শ্রেনীতে কোন মুসলমান ছিল না ) জনমত গঠন এবং তাঁদের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সংগঠিত করার দায়িত্ব ও নেতৃত্ব সুরেন্দ্রনাথ নিয়েছিলেন । ( A Nation in the making by Surendronath Bnarjee, Calautta 1925 )

১৯০৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর ভারত সরকারের সচিব রিজলীর বংগবিভাগ সংক্রান্ত চিঠি প্রকাশ হবার সংগে সংগেই সুরেন্দ্রনাথ তাঁর কাগজ ‘দি বেংগলীতে লিখলেন, “বাংলাকে খণ্ডিত করনের প্রস্তাবে আমরা তীব্র বিরোধিতা করছি এবং আমরা নিশ্চিত যে গোটা দেশ একটি দেহের মতো এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে ।” ( The Bengali, December, 13, 1903 )

বাংলার জমিদার শ্রেনীর সংগঠন ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিবাদ সভা করলো ১৯০৪ সালের ১৮ই মার্চ তারিখে । এ প্রতিবাদ সভার সভাপতিত্ব করলেন উত্তর পাড়ার জমিদার, বেঙ্গল ও ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য প্যারীমোহন মুখার্জি । সভায় উপস্থিত ছিলেন নাটোরের জমিদারসহ ভুপেন্দ্রনাথ বসু, সীতানাথ রায়, অম্বিকাচরন মজুমদার, লালমোহন ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানারজী প্রমুখ শীর্ষ হিন্দু নেতৃবৃন্দ । সভায় বঙ্গ বিভাগ পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা করে ভারত- সচিবের কাছে প্রেরিত স্মারক পত্রে বলা হলো, “বাঙ্গালী জাতিকে আলাদা আলাদা অংশে বিভক্তিকরন এবং তাঁদের ঐতিহাসিক, সামাজিক ও ভাষাগত বন্ধনে ভাঙ্গন সৃষ্টি অঞ্চলের মানুষের সামাজিক, বুদ্ধিভিত্তিক ও বস্তুগত উন্নতিকে বাধাগ্রস্থ করবে ।” ( Papers Relating to Reconstitution of Bengal & Assam. London 190 )

১৯০৪ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী তারিখে বেংগল চেম্বারস অব কমার্সের অনারারী সেক্রেটারি সীতানাথ রায় বাহাদুর এবং ১৯শে মার্চ, এই সংগঠনের সেক্রেটারি ডাব্লিউ পারসন আর তাঁদের সঙ্গে ব্রিটিশ ইন্ডীয়ান এ্যাসোসিয়েশনের অনারারী সেক্রেটারি মহারাজ প্রদ্যোত কুমার কুমার ঠাকুর ১৯ শে ফেব্রুয়ারী তারিখে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে স্মারকলিপি পাঠান। এদের সাথে ভারতের শ্বেতাঙ্গ চা ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান টি এ্যাসোসিয়েশন’, ‘ক্যালকাটা বেল্ড জুট এ্যাসোসিয়েশন’, ‘ইন্ডিয়ান জুট মিলস এ্যাসোসিয়েশন’ এবং ‘ইন্ডিয়ান মাইনিং এ্যাসোসিয়েশন’- এর অ্যাসিস্টান্ট সেক্রেটারিদের চিঠিও শামিল ছিল । এভাবে কোলকাতা ভিত্তিক জমিদার, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী অর্থাৎ পাওয়ার এলিটদের সকলে একজোট হয়ে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করলো । এর সাথে যুক্ত হল প্রবল রাজনৈতিক বিরধীতাও। ১৯০৫ সালের ১০ই জানুয়ারী কোলকাতা টাউন হলে এক সম্মেলনের মাধ্যমে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করলো । এরপর রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকলো । ১৯০৫ সালের ৭ই আগস্ট মহারাজ মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কোলকাতা টাউন হলের জনসভায় ব্রিটিশ পণ্য বয়কটের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত গ্রহন করা হলো । বঙ্কিমের ‘বন্দে মাতরম’ বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলনের রনহুংকারে পরিনত হলো । ১৯০৫ সালের ২৮শে ডিসেম্বর মহালয়ার দিন কালীঘাটের বিখ্যাত কালী মন্দিরের পুজা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দলন গড়ে তোলার শপথ নেয়া হলো । ( ‘বংগভংগ’ মুনতাসির মামুন সম্পাদিত, পৃষ্ঠা- ৫৬ ) এর দুইদিন আগে ২৪ এবং ২৭শে সেপ্টেম্বরের দুটি জনসভায় সভাপতির ভাষণে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ হিসেবে বঙ্গভঙ্গের বাস্তবায়নের দিন ৬ই অক্টোবর ‘রাখী বন্ধন’ দিবস ঘোষণা করলেন । ( ‘বংগভংগ’ মুনতাসির মামুন সম্পাদিত, পৃষ্ঠা- ৫৬ )

অন্যদিকে মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গের দিনটিকে আনন্দ এবং উৎসবের দিন হিসেবে পালন করলেন । উল্লেখ্য প্রাথমিক বিভ্রান্তির পর মুসলমানরা বঙ্গ বিভাগ পরিকল্পনাকে জাতির জন্য এক মহাসুযোগ হিসেবে গ্রহন করে নেয় । ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নেতা লেয়ার হার্ডিকে লেখা নবাব সলিমুল্লাহর এক চিঠিতে মুসলমানদের মনোভাব সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে । ঐ চিঠিতে নবাব সলিমুল্লাহ লিখেছিলেন, “আমরা বঙ্গ বিভাগ সমর্থন করছি । এটা আমাদের উপকারে আসবে । এ ব্যাপারে সামান্য কোন সন্দেহও নেই বংগবিভাগ মুসলমানদের সংঘবদ্ধ করেছে এবং ফলস্বরূপ এখানে তারা গুরুত্ব লাভ করেছে । আমাদের স্বার্থকে এখানে যত্নের সাথে দেখা হবে । পুনর্গঠিত জেলা প্রশাসনের অধীনে আমাদের আমাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অগ্রগতি উৎসাহ লাভ করেছে । আগের ব্যবস্থায় এটা সম্ভব ছিল না । কারন প্রয়োজন এবং গুরুত্ব অনুসারে যে মনোযোগ লাভের প্রয়োজন ছিল, তা আগের ব্যবস্থা দিতে পারেনি ।” ( Keir Hardie and the first partition of Bengal M.K.U Mollah. Appendix B. Rajshahi University studies. Volume-3, January 1970, Page- 18 )

পূর্ব বাংলার মুসলামদের তখনকার মুখপাত্র ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ । বঙ্গভঙ্গের পক্ষ- বিপক্ষ আন্দোলনের কঠিন সময়ে তিনি জাতিকে সঠিক নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন । বঙ্গ বিভাগের প্রথম বার্ষিকী হিন্দুরা উদযাপন করলো ‘জাতীয় শোক দিবস’ পালনের মাধ্যমে । মুসলমানরা এই দিন আনন্দ উৎসব করলো বটে, কিন্তু তাঁদের কণ্ঠ ছিল দুর্বল । এই সময় একটা বড় ঘটনা ঘটলো । বঙ্গভঙ্গের পক্ষে সবচেয়ে সোচ্চার কণ্ঠ মিঃ ফুলার পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন । ফুলার হিন্দু নেতাদের তীব্রতম আন্দোলনের শিকার ছিলেন । সরকারী সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রমানে তাঁর প্রত্যয়ী প্রচেষ্টার জন্য তিনি তাঁদের চক্ষুশূলে পরিনত হলেন । আন্দোলনের সংকটাপন্ন মুহূর্তে তাঁর পদত্যাগের অর্থ ছিল আন্দোলনকারীদের জয় এবং সরকারের নতি স্বীকার । ফুলারের পদত্যাগের সরকারী সিদ্ধান্তে মুসলমানরা বিস্মিত হল এবং একে রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাব প্রসুত বলে অভিহিত করলো । ফুলারের পদত্যাগ এবং হিন্দুদের ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের কারনে মুসলমানরা সতর্ক হলো এবং বাংলা বিভাগের প্রতি কংগ্রেসের হুমকীর মোকাবেলার জন্য ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকায় একটি সম্মেলন আহবান করলেন । ( ‘বংগভংগ’ মুনতাসির মামুন সম্পাদিত, পৃষ্ঠা- ১০ )

নবাব সলিমুল্লাহর এই সম্মেলন আহবান ছিল একটা ঐতিহাসিক ঘটনা । একটা সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নিয়েই তিনি এ সম্মেলনের আহবান করেছিলেন । তাঁর পরিকল্পনা ছিল একটি ‘সর্বভারতীয় মুসলিম সংঘ’ ( The Mohamedan All India Confederacy ) প্রতিষ্ঠা । এই মুসলিম সংঘ প্রতিষ্ঠার পেছনে তাঁর উদ্দেশ্য ছিলঃ

এক। তথাকথিত জাতীয় কংগ্রেসের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিহত করা ।
দুই। মুসলমানদের উপযুক্ত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান না থাকায় যে সব মুসলিম যুবক কংগ্রেসে যোগ দিয়েছে, পরিকল্পিত প্রতিষ্ঠান গঠিত হলে তারা রাজনীতি ক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্যতা ও সামর্থ্যের পরিচয় দিতে পারবে । এবং
তিন। মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং উন্নতির কাজ করা । ( ‘উপমহাদেশের রাজনীতি ও স্মরনীয় ব্যাক্তিত্ব’ #নবাব স্যার সলিমুল্লাহ অংশ — ইয়াসমিন আহমাদ, পৃষ্ঠা- ১৬৬,১৬৭ )
নবাব সলিমুল্লাহর এ পরিকল্পনা তাঁর শত্রুরা যথাসময়েই জানতে পারল । সুরেন্দ্রনাথ ব্যানারজী প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ‘দি বেংগলী’ সলিমুল্লাহর পরিকল্পিত মুসলিম সংঘকে বিদ্রূপ করে লিখল, “মুসলমানদের সর্বভারতীয় সংঘের পরিকল্পনা আমাদেরকে পূর্বের মারাঠা সংঘ এবং বালমা সংঘের কথা স্মরন করিয়ে দিচ্ছে । যখন তোষামোদের দ্বারা উদ্দেশ্য সাধন এই প্রতিষ্ঠানের মূল মন্ত্র, তখন নবাব কি জন্য এর এরূপ যুদ্ধংদেহী নাম রেখেছেন ? ” ( The Bengalee, December 16, 1906 )

দি বেংগলী নবাব সলিমুল্লাহ পরিকল্পিত প্রতিষ্ঠানকে বিদ্রূপ করলেও এই বিদ্রুপের মধ্যে তাঁদের ভয়ের ভাবটাই মুখ্য । তাঁদের এই ভিত্তিই নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগের সঠিকতা করেছিলো ।

নবাব সলিমুল্লাহ ব্যাপক আলোচনার মাধ্যমে পরিকল্পিত প্রতিষ্ঠান গঠনের দিকে এগুচ্ছিলেন । এই ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের ব্যাপারে রাজশাহীর মুহাম্মাদ ইউসুফ, কুমিল্লার নওয়াব আলী চৌধুরী, সিলেটের মুহাম্মাদ ইয়াহিয়া, ময়মনসিংহের আব্দুল হাই আখতার, বগুড়ার খন্দকার হাফিজ উদ্দিন, ধনবাড়ীর নওয়াব আলী চৌধুরী এবং বরিশালের এ, কে ফজলুল হক প্রমুখ পূর্ব বাংলার মুসলিম নেতৃবৃন্দ নবাব সলিমুল্লাহকে ঘনিষ্ঠ সহযোগীতা দান করেন । এরা সকলেই নবাব সলিমুল্লাহর রাজনৈতিক জীবনের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন । এছাড়া ভারতের সব মুসলিম নেতৃবৃন্দকে নবাব সলিমুল্লাহ তাঁর পরিকল্পনার খসড়া পাঠিয়েছিলেন ।

১৯০৬ সালের ২৭শে ডিসেম্বর ঢাকায় সম্মেলন বসলো । সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো নবাব সলিমুল্লাহর ঢাকাস্থ শাহবাগের সুরম্য উদ্যানে । ভারতের সকল প্রদেশ ছাড়াও দেশের বাইরে থেকে প্রতিনিধি এই সম্মেলনে আসেন । প্রায় এক হাজার প্রতিনিধি এসেছিলেন সম্মেলনে । প্রতিনিধিদের মধ্যে নবাব ভিখারুল মুলক, পাতিয়ালার খলিফা মুহাম্মাদ হোসেন, মাওলানা শওকত আলী, ভূপালের মৌলভী নিযামুদ্দিন, নবাব মুহসিনুল মুলক, ডঃ জিয়াউদ্দিন আহমেদ, অমৃতসরের রাজা মুহাম্মাদ ইউসুফ শাহ প্রমুখ শীর্ষ মুসলিম নেতৃবৃন্দ ছিলেন ।

২৭শে ডিসেম্বর থেকে ৩০শে ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো । শিক্ষা সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে ঘোষণা করা হলো, মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্দেশ্যে উপস্থিত প্রতিনিধিগন এই অধিবেশন শেষে এক বিশেষ সম্মেলনে যোগ দেবেন ।

সে অনুযায়ী শাহবাগের সেই বাগানেই বিশেষ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হলো । নবাব সলিমুল্লাহর প্রস্তাবক্রমে নবাব ভিখারুল মুলক সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন । সলিমুল্লাহর ‘সর্বভারতীয় মুসলিম সংঘ’ পরিকল্পনাকে ভিত্তি করেই আলোচনা অনুষ্ঠিত হলো । শুরুতেই সম্মেলনের সভাপতি তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে বললেন, “মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার এবং স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তাঁদের একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা একান্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছে ।’ উদ্বোধনী বক্তব্য শেষে নবাব ভিখারুল মুলক নবাব সলিমুল্লাহকে তাঁর পরিকল্পনা পেশ করতে বললেন । নবাব সলিমুল্লাহ তাঁর পরিকল্পনা পেশ করতে উঠে দেশের পরিস্থিতি, মুসলমানদের জাগরন এবং বর্তমান প্রয়োজন বিষয়ে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন । তিনি তাঁর ঐতিহাসিক বক্তব্যের একাংশে বলেন, “আপনারা বহু অসুবিধা সত্ত্বেও দেশের দূর অঞ্চল থেকে এক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে মিলিত হয়েছেন । এ মুহূর্তে আমাদের জন্য অধিকতর রাজনৈতিক তৎপরতার যে বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, সে বিষয়ে আমার বিস্তারিত আলোচনার আবশ্যক নেই । দেশ এবং সম্প্রদায়ের সাথে যাদের সম্পর্ক আছে তারা অবশ্যই অনুভব করেছেন যে, আমাদের জাতীয় জীবনে নবজীবনের স্পন্দন দেখা দিয়েছে । ভারতের রাজনৈতিক জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হচ্ছে এবং যে মুসলমানদের জীবন স্পন্দন এতদিন রুদ্ধ ছিল তাঁদের মধ্যেও আজ জাগরনের সাড়া পড়েছে । বিলাতের দলীয় সরকার ভারতের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত নয় । এই কারনে যারা বেশি চিৎকার করতে পারে, তারা তাঁদের কথাই শোনে । সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমানদের স্বার্থকে উপেক্ষা করে চলেছে । মুসলমানরা শান্ত- শিষ্ট থেকে কিছুই পায়নি । তাঁদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহন আশু প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে । প্রায় দশ বছর আগে স্যার সৈয়দ আহমাদ যে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন, পূর্ব বাংলার মুসলমানদের বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতিতে সেরূপ প্রতিষ্ঠান গঠন আবশ্যক হয়ে পড়েছে । আজকের পরিস্থিতিতে তাঁদের সামনে চারটি পথ খোলা আছে,

এক। রাজনীতিতে অংশগ্রহন না করে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার কাজ সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়া ।
দুই। রাজনীতিতে নেমে হিন্দুদের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব পোষণ করা ।
তিন। হিন্দুদের জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেয়া এবং তাঁদের কার্যকলাপে নিজেদের শরীক করা । এবং
চার। মুসলমানদের নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ।
মুসলমানরা তৃতীয় পথ অনুসরন করতে পারেনা, কারন ১৮৮৭ সাল থেকে তারা কংগ্রেস থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে । মুসলমানরা দ্বিতীয় পথও অনুসরন করেনি । মুসলমানদের পরম শত্রুও বলতে পারবে না যে, মুসলমানরা অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেছে । ১৮৮৭ সাল থেকে মুসলমানরা প্রথম পথ অনুসরন করে দেখেছে, কিন্তু রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকায় তাঁদেরকে খুব অসুবিধা ভোগ করতে হচ্ছে । যুগধর্মের প্রেরনায় মুসলমানরা এক রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে । বর্তমানে মুসলমানদের জন্য সক্রিয় প্রচারনা, তাঁদের দাবী- দাওয়া এবং তাঁদের আশা- আকাঙ্ক্ষার অভিব্যক্তি ঘটানো ও তাঁদের প্রতিনিধিত্বমূলক ‘রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান’ প্রতিষ্ঠা অতি আবশ্যক হয়ে পড়েছে । মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার এবং তাঁদের স্বার্থ সংরক্ষণই তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হবে । এতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলমানদের রাজভক্তি এবং প্রতিবেশি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁদের সদ্ভাব ব্যহত হবেনা । রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মুসলমানরা প্রয়োজনমত তাঁদের দাবী-দাওয়া সরকারের কাছে উপস্থাপন করবে । ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কোন স্বার্থের ব্যাপারে কোনরূপ সংঘাতের সম্ভাবনা নেই, কিন্তু তাঁদের মুখ্য স্বার্থের ব্যাপারে মতানৈক্য দেখা দিতে পারে । মুসলমানদের পৃথক প্রতিষ্ঠান না থাকলে তাঁদের পক্ষে ন্যায্য অধিকার আদায় করা সম্ভব হবেনা ।” ( ‘উপমহাদেশের রাজনীতি ও স্মরনীয় ব্যাক্তিত্ব’ #নবাব স্যার সলিমুল্লাহ অংশ — ইয়াসমিন আহমাদ, পৃষ্ঠা- ১৬৯,১৭০,১৭১ )

এরপর নবাব সলিমুল্লাহ তাঁর প্রস্তাব উত্থাপন করলেন । হাকিম আজমল খান, জাফর আলী সহ আরও কয়েকজন প্রস্তাবটি সমর্থন করলেন । বিস্তারিত আলোচনার পর নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তগুলো গ্রহীত হলোঃ

“ঢাকায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বমূলক এই সভায় ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ নামে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রস্তাব গ্রহন করা যাচ্ছে । নিম্নবর্ণিত উদ্দেশ্য সাধন করা এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হবে ।

(১) ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি রাজভক্তি উদ্রেক করা এবং সরকারের কোন ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁদের মনে ভুল ধারনা সৃষ্টি হলে তা দূর করা ।
(২) মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার, স্বার্থরক্ষা এবং উন্নতির ব্যবস্থা করা ।
(৩) সংস্থার উপরোক্ত উদ্দেশ্যাবলী অব্যাহত রাখা এবং অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি মুসলমানদের মধ্যে যাতে বিদ্বেষ সঞ্চার না হয় তাঁর ব্যবস্থা করা ।” ( ‘উপমহাদেশের রাজনীতি ও স্মরনীয় ব্যাক্তিত্ব’ #নবাব স্যার সলিমুল্লাহ অংশ — ইয়াসমিন আহমাদ, পৃষ্ঠা- ১৭১ )
ঢাকার এই ঐতিহাসিক সম্মেলনে বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করে এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের নিন্দা করে প্রস্তাব গৃহীত হলো । নবাব ভিখারুল মুলক এবং নবাব মুহসিনুল মুলক ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের’ যুগ্ম- কর্মসচিব নির্বাচিত হলেন । গঠনতন্ত্র প্রনয়নের জন্য গঠিত হলো ৬০ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রভিশনাল কমিটি । অতপর নবাব সলিমুল্লাহ সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন ।

সম্মেলন শেষ হলো এবং সেই সাথে শুরু হলো মুসলমানদের এক ঐতিহাসিক যাত্রার । ১৮৬৩ সালে নবাব আব্দুল লতিফের হাতে ‘মোহামেডান লিটারারি সোসাইটির’ মাধ্যমে নব পর্যায়ে মুসলমানদের উত্থানের যে চারাগাছটি জন্ম লাভ করেছিলো, সে গাছটি ১৮৭৮ সালে সৈয়দ আমীর আলীর হাতে ‘ন্যাশনাল মোহামেডান এ্যাসোসিয়েশনের’ মাধ্যমে মাটিতে শেকড় প্রোথিত করে, সেই চারাগাছটিই ঢাকার শাহবাগের উদ্যানে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ এর মাধ্যমে মহীরুহের প্রকৃতি নিয়ে আকাশে মাথা তুললো ।

কংগ্রেসের মাধ্যমে এবং কংগ্রেসের আড়ালে দাঁড়িয়ে সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা যে ভয়াবহ ঝড় সৃষ্টি করেছিলো, তা থেকে মুসলমানদের বাঁচার জন্য এমন একটি মহীরুহের প্রয়োজন ছিল ।

মুসলিম লীগ গঠন হিন্দুদের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলো । কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ শুরু করলো তারা । সুরেন্দ্রনাথ ব্যানারজী সম্পাদিত ‘দি বেংগলী’ মুসলিম লীগকে ‘সলিমুল্লাহ লীগ’ এবং ‘সরকারের ভাতাভোগী’ ও ‘তাবেদারদের সমিতি’ বলে কটাক্ষ করলো । ( ‘উপমহাদেশের রাজনীতি ও স্মরনীয় ব্যাক্তিত্ব’ #— ইয়াসমিন আহমাদ, পৃষ্ঠা- ১৭২ )

বলাবাহুল্য মুসলমানদের স্বতন্ত্র উত্থানের প্রত্যেকটি পদক্ষেপই এদের দ্বারা নানা রকম কটাক্ষ ও প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছিলো । ১৮৬৩ সালের ‘মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি’ গঠন তাঁদের পছন্দ হয়নি । ১৮৮৭ সালের ‘ন্যাশনাল মোহামেডান এ্যাসোসিয়েশন’ গঠন তাঁদের পছন্দ হয়নি এবং তারা এটাকে সাংঘাতিক বক্র দৃষ্টিতে দেখেছে । ১৮৮২ এর ইন্ডিয়া কাউন্সিল এ্যাক্ট—এ মুসলমানরা মিউনিসিপ্যালিটিতে

স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্বের যে অধিকার লাভ তাঁদের মানসিক যন্ত্রনার কারন হয়েছিলো এবং তারা কংগ্রেসের মাধ্যমে আন্দোলন করে ১৮৯২ সালে তা বাতিল করে ছেড়েছিল । মুসলিম লীগ গঠনের তিন মাস আগে ১৯০৬ সালের ১লা অক্টোবর আগাখানের নেতৃত্বে নবাব মুহসিনুল মুলক বিলগ্রামী, নবাব আলী চৌধুরী, এ, কে, ফযলুল হক সহ ভারতের ৩৫ জন মুসলিম নেতা সিমলায় ভাইসরয় মিন্টোর সাথে দেখা করে মুসলমানদের পক্ষ থেকে কতগুলো সুনির্দিষ্ট দাবী পেশ করেছিলেন । ( বঙ্গভঙ্গের প্রশ্নটি সিমলা সম্মেলনে তোলা না তোলা নিয়ে মতান্তর হওয়ায় নবাব সলিমুল্লাহ সিমলা প্রতিনিধি সম্মেলনে শামিল হননি । তবে সব দাবী দাওয়ার সাথে তিনি একমত ছিলেন এবং প্রতিনিধিদল লর্ড মিন্টোর জন্য নবাব সলিমুল্লাহর এক দীর্ঘ চিঠি নিয়ে যায় । )

এ দাবীগুলোর মধ্যে ছিলো,

ক। সামরিক, বেসামরিক এবং হাইকোর্টে মুসলমানদের যথেষ্ট সংখ্যক নিয়োগ প্রদান এবং উচ্চপদগুলোতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগের ব্যবস্থা করা ।
খ। মিউনিসিপ্যালিটি, জেলা বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিশ্চয়তা প্রদান ।
গ। জনসংখ্যার অনুপাতে নয়, তাঁদের রাজনৈতিক গুরুত্বের ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাদেশিক কাউন্সিলে মুসলমানদের নির্বাচন ।
ঘ। মুসলমানরা যাতে অগুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘুতে পরিনত না হয়, তাঁর জন্যে পৃথক নির্বাচনের ভিত্তিতে যথেষ্ট সংখ্যক মুসলমানের ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে মুসলমানদের নির্বাচন করা । এবং
ঙ। একটি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সাহায্য করা, যা হবে মুসলিম ধর্মীয় এবং বুদ্ধিগত জীবনের কেন্দ্রস্বরূপ । ( History of the freedom Movement of India by Tarachand. Page-394, বদরুদ্দিন উমরের ভারতীয় আন্দোলন— পৃষ্ঠা ৮৬, ৮৭ )
মুসলমানদের এই দাবী- দাওয়া পেশকে সাংঘাতিক বিদ্বেষ দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে । একে ‘সাম্প্রদায়িক শো’ নামে অভিহিত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে এর সংগঠক নাকি ছিল ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার । ( ‘ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন’—বদরুদ্দিন উমর, পৃষ্ঠা ৮৮ )
এমনকি কংগ্রেস কর্মী শিবলী নোমানী পর্যন্ত বলেছিলেন, “আমরা সিমলা ডেপুটেশনের কোন অর্থ বুঝিনা সাম্প্রদায়িক মঞ্চে ছিল এটা সর্ব বৃহৎ শো ।” ( ‘ইতিহাস অভিধান—যোগনাথ মুখোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ২৬৩ )

অথচ সিমলা ডেপুটেশন ইতিবাচক ফল নিয়ে এসেছিলো মুসলমানদের জন্য । সিমলা ডেপুটেশনের কাছে লর্ড মিন্টো মুসলমানদের পৃথক নির্বাচন এবং প্রতিনিধিত্বকারী মেনে নেয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন । এই আশ্বাস কার্যকরী হয়েছিলো ১৯০৯ সালে মলি- মিন্টো সংস্কারের মাধ্যমে । এই সংস্কারে মুসলমানদের প্রথক নির্বাচন ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার দেয়া হয় । মুসলমানদের এইস সুবিধা লাভও হিন্দুদের প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয় । ১৯০৯ সালেই কংগ্রেস তাঁর এক প্রস্তাবে ‘মহামান্য ব্রিটিশ সম্রাটের ভারতীয় প্রজাদের মুসলিম ও অমুসলিম সংজ্ঞায় বিভক্ত করাকে অন্যায়, বিদ্বেষপ্রসূত এবং অপমানকর বলে অভিহিত করা হয় ।” ( “নেহেরু”— মাইকেল এডওয়ার্ড, পৃষ্ঠা- ৪৩। ‘স্বাধীনতার কথা’— বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা-১০৩, ১০৪ )

অর্থাৎ কংগ্রেস মুসলমানদের স্বতন্ত্র উত্থান তো দূরে থাক, জাতি হিসেবে নাম পর্যন্ত বরদাশত করতে রাজী ছিলনা । কারন এই যে, জাতি হিসেবে মুসলমানদের নাম উচ্চারিত হলে, তাঁদের অধিকারের প্রতি স্বীকৃতি নিতে হয় । কংগ্রেস তা দিতে রাজী ছিলনা । সে চাইছিল, মুসলমানরা তাঁদের স্বতন্ত্র বিসর্জন দিয়ে ভারতীয় অর্থাৎ বৃহত্তর হিন্দু জাতি দেহে লীন হয়ে যাক । বিস্ময়ের ব্যাপার, এসময় কংগ্রেসী মুসলমানরাও হিন্দুদের এই চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিল । তারা হিন্দুদের মতই বিরোধিতা করছিলো মুসলমানদের স্বতন্ত্র উত্থান প্রচেষ্টার । কংগ্রেস নেতা হিসেবে কায়েদে আযম মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর মতো লোকও মলি- মিন্টো সংস্কারের বিরোধিতা করেছিলেন । শুধু বিরোধিতা নয়, ১৯১০ সালের কংগ্রেসের এলাহাবাদ অধিবেশনের মলি-মিন্টো সংস্কারের উল্লেখিত পৃথক নির্বাচন এবং মুসলমানদের স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন ব্যবস্থার বিরোধিতা করে যে প্রস্তাব উত্থিত হয়, তাঁর উত্থাপক ছিলেন কায়েদে আযম এবং জোরালো বক্তৃতার মাধ্যমে যিনি এ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন দিয়েছিলেন তিনিও একজন মুসলিম, বিহারের জননেতা মৌলভী মাঝহারুল হক । (“নেহেরু”— মাইকেল এডওয়ার্ড, পৃষ্ঠা- ৪৩। ‘স্বাধীনতার কথা’— বিক্রমাদিত্য, পৃষ্ঠা-১০৩, ১০৪ )

অবশ্য কংগ্রেসের স্বরূপ ধরতে এবং নিজেদের ভুল বুঝতে এই সব বিজ্ঞ মুসলমানের খুব বেশি দেরি হয়নি । যে জিন্নাহ মুসলমানদের স্বতন্ত্র অধিকার অর্জনের নিন্দা করে কংগ্রসের সম্মেলনে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন, সেই জিন্নাহই মাত্র কয়েক বছর পর কংগ্রেস নেতাদের মুখের উপর ‘আপনারা কি চাননা যে, মুসলিম ভারত আপনাদের সাথে এগিয়ে যাক, সংখ্যালঘুদের কি সংখ্যাগরিষ্ঠদের দেবার মতো কিছুই নেই ? বলে অশ্রু সজল চোখে কংগ্রেস নেতাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন ।

মুসলমানদের স্বতন্ত্র উত্থানের যাত্রা ছিল সেদিন সত্যিই অত্যন্ত কঠিন । একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের প্রচণ্ড বিরোধিতা, অন্যদিকে কংগ্রেসী কিছু মুসলমানের বাঁধা । এই দুয়ের মোকাবেলা করে সামনে এগুতে হয়েছিলো উত্থানবাদী মুসলমানদের । মুসলিম লীগ গঠিত বা হলে মুসলমানদের পক্ষে এই এগুনো সম্ভব হতো না । মুসলিম লীগ সেসময় যুদ্ধক্ষেত্রের পতাকার মতো মুসলমানদের অস্তিত্ব, উপস্থিতি এবং উত্থানের কথা ঘোষণা করছিলো । নির্যাতিত মুসলমানরা জেগে উঠেছিলো, সমবেত হয়েছিলো একে কেন্দ্র করেই । কায়েদে আযম মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ অশ্রু সজল চোখে কংগ্রেস থেকে বিদায় নিয়ে এসে শক্তিশালী করেছিলেন মুসলিম লীগকেই । সবচেয়ে বড় কথা, মুসলিম লীগ গঠনের মাধ্যমে মুসলমানরা একথা সোচ্চার কণ্ঠে বলে দিয়েছিলো, ভারতে মুসলমান নামে একটা জাতি আছে যাদের অস্তিত্ব এবং দাবী অস্বীকার করা যাবেনা ।

মুসলিম লীগের প্রাথমিক বছরগুলো সংগ্রামের চেয়ে আত্মগঠনের সময় হিসেবে ব্যয়িত হল । মুসলিম লীগের প্রথম বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হল করাচীতে ১৯০৭ সালের ২৮শে ডিসেম্বর । সভাপতিত্ব করলেন বুম্বাইয়ের স্যার আদমজী । এ সম্মেলনে গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত করা হলো । এই ১৯০৮ সালেই নবাব মুহসিনুল মুলক মারা গেলেন এবং নবাব ভিখারুল মুলক আলীগড় কলেজের কর্মসচিব নিযুক্ত হওয়ায় মুসলিম লীগের কর্মসচিবের দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলেন । ১৯০৮ সালের ১৮ই মার্চ আলীগড়ে মুসলিম লীগের একটি বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । এ সম্মেলনে আগাখান লীগের স্থায়ী সভাপতি এবং সৈয়দ হোসেন বিলগ্রামী মুসলিম লীগের কর্মসচিব নির্বাচিত হলেন । সৈয়দ আমীর আলী ১৯০৮ সালের ৬ই মে লন্ডনে মুসলিম লীগের শাখা প্রতিষ্ঠা করলেন । ১৯০৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর মুসলিম লীগের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলন অমৃতসরে অনুষ্ঠিত হলো । সভাপতিত্ব করলেন সৈয়দ আলী ইমাম । এ সম্মেলনে লর্ড মরলির প্রস্তাবিত সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয় এবং প্রস্তাব গ্রহন করা হলো যে, স্থানীয় স্বায়িত্ব শাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে মুসলমানদের স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্ব এবং সরকারী চাকুরীতে মুসলমানদের নিয়োগের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে । মুসলিম লীগের তৃতীয় বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো দিল্লীতে ১৯১০ সালের ২৯শে জানুয়ারী । সভাপতিত্ব করলেন আর্কটের যুবরাজ স্যার গোলাম মাহমুদ আলী খান । সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বিলগ্রামী ভারত সচিবের ভারতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় এ সম্মেলন লীগের মহাসচিব নির্বাচিত করলো মৌলভী মুহাম্মাদ আযীয মির্জাকে । লীগের সদরদপ্তর আলীগড় থেকে লক্ষৌতে স্থানান্তরিত হলো । মুসলিম লীগের চতুর্থ বার্ষিক সম্মেলন সৈয়দ নজিবুল্লাহর সভাপতিত্বে ১৯১০ সালের ২৮শে ডিসেম্বর নাগপুরে অনুষ্ঠিত হয় । লীগের পঞ্চম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো ১৯১২ সালের ৩রা মার্চ কোলকাতায় বঙ্গভঙ্গ রদের বিস্বাদময় পরিবেশে । এতে সভাপতিত্ব করলেন ভগ্ন হৃদয় এবং ভগ্ন স্বাস্থ্য নবাব সলিমুল্লাহ । তিনি তাঁর ভাষণে বেদনার সাথে পুনরুক্তি করলেন, “বঙ্গভঙ্গ রদ পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মনে দারুন আঘাত করেছে এবং তাঁদের ঘরে ঘরে করেছে বিস্বাদের সঞ্চার ।” এই সাথে নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সরকারী ঘোষণায় সন্তোষ প্রকাশ করলেন । ( বঙ্গভঙ্গ রদের পর ১৯১২ সালের ৩১শে জানুয়ারী বড় লাট মুসলমানদের সান্ত্বনা দেবার জন্য ঢাকায় আসেন । তিনি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন এবং ২রা ফেব্রুয়ারী সরকার এক ইশতেহারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন । )

এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে হিন্দুদের বিরোধিতার তিনি তীব্র নিন্দা করলেন । নবাব সলিমুল্লাহ তাঁর ভাষণে মুসলমানদের শিক্ষার জন্য প্রচুর অর্থ বরাদ্দ, বিশেষ সুবিধা এবং ব্যবস্থাপক সভা ও স্থানীয় স্বায়িত্ব শাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের দাবী করলেন । নবাব সলিমুল্লাহর ভগ্নহৃদয় উত্থিত এই কথাগুলোকে বিদায়কালীন বেদনার্ত এক আর্তির মতো শোনাল । বঙ্গভঙ্গ রদে আহত নবাব সত্যিই বিদায় নিলেন রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে । ভগ্ন- স্বাস্থ্য সলিমুল্লাহ প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে অবসর নিলেন জীবনের অবসরও তাঁর ঘনিয়ে এলো । ১৯১৫ সালের ১৬ই জানুয়ারী তিনি ইন্তেকাল করলেন । তিনি চলে গেলেন, কিন্তু নির্যাতিত জাতিকে জাগিয়ে গেলেন ।

অনেকে মুসলিম লীগের এই প্রাথমিক পর্যায়কে ইংরেজ অনুগত অভিজাত ও জমিদার নবাব অধ্যুষিত বলে কটাক্ষ করলেন । ( ভারতীয় জাতীয় আন্দলন—-বদরুদ্দিন উমর, পৃষ্ঠা- ৯৭ )

কিন্তু ইতিহাস বলে, এর চেয়ে হাজার গুন বেশি আনুগত্য নিয়ে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা এবং বিকাশ ঘটেছিল । মুসলিম লীগ নেতৃত্ব ইংরেজের প্রতি যে আনুগত্য দেখিয়েছিল, সেটা ছিল সেই সময়ের বাস্তবতা । এই বাস্তবতা অস্বীকার করে হিন্দুদের মোকাবেলা করে মুসলমানদের সামনে এগুলো অম্ভব ছিলনা । যারা সেই সময়ের মুসলিম অভিজাত ও নবাব জমিদারদের নেতৃত্বকে কটাক্ষ করেন, তারা হয় অজ্ঞ, নয়তো এক শ্রেনীর হিন্দুর মতো বিদ্বেষ দৃষ্টিতে মুসলমানদের উত্থানের ইতিহাসকে প্রতক্ষ করেন । বাস্তবতা হলো মুসলিম অভিজাত, নবাব জমিদাররাই ছিলেন মুসলিম গনজাগরনের নেতা এবং মুসলিম জনতার কণ্ঠ । তাঁদের নেতৃত্ব ছিল স্বাভাবিক, সময়ের দাবী । এ দাবী পুরন করে তারা জাতিকে ধন্য করেছেন । আজকের পর্যালোচনায় দোষত্রুটি হয়তো আমরা খুঁজে পাব, কিন্তু তারা এগিয়ে না এলে মুসলিম লীগের মতো সংস্থা সংগঠন এবং মুসলমানদের জাতীয় উত্থান কিছুতেই হয়তো সম্ভব হতো না এবং হয়তো সম্ভব হতো না বাংলাদেশের মতো মুসলিম আবাস ভূমির প্রতিষ্ঠা ।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি