পীর ধরা কি ফরয?
আরো অগ্রসর হয়ে এক ধরনের অর্ধ আলিম পীর ধরা ফরয বলে দাবি করতে শুরু করেন। এজন্যে তারা দলীল হিসেবে পেশ করেন কুরআন মজীদের সে অসীলার আয়াতকে। তাঁরা বলেন ‘অসীলা’ ধরার হুকুমতো আল্লাহই দিয়েছেন কুরআন মজীদে- আর সে অসীলাই হলো পীর। অতএব পীর ধরা ফরয প্রমাণিত হলো। অথচ ইতিপূর্বে আমরা এ অসীলার আয়াতের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছি। প্রায় দশ বারো খানা প্রাচীন ও প্রামাণিক তাফসীরের উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছি যে, আল্লাহ তা‘আলা যে ‘অসীলা’ তালাশ করতে আদেশ করেছেন তার মানে কখনো ‘পীর’ নয়, পীর ধরলেই সেই অসীলার সন্ধানের আদেশ পাওয়া যায়না। তাছাড়া প্রখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য আরবী অভিধানের উদ্ধৃতি দিয়েও দেখিয়েছি যে, ‘অসীলা” শব্দের অর্থ ‘পীর’ কেউ করেননি। মাওলানা আশরাফ আলী থানভী(রহ) মরহুম এ যুগের সর্বজনমান্য বড় তাসাউফপন্থী আলিম।কিন্তু তিনিও অসীলা শব্দের অর্থ পীর করেননি করেছেন ‘নৈকট্য’। সেজন্য তাঁর লেখা কুরআনের তরজমা দেখা আবশ্যক। বরং তিনি বলেছেন যে, জাহিল লোকেরাই এ আয়াত থেকে পীর ধরা ফরয প্রমাণ করতে চাইছে, অন্য কেউ নয়।

তাঁদের আর একটি দলীল হলো কুরআনের এই আয়াতঃ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ [٩:١١٩]

– হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদী লোকদের সঙ্গী হও।(আত তাওবাঃ119)।

এ আয়াত পেশ করে পীরবাদীরা বলতে চান যে, সাদেকীন বলতে তাদেরই বোঝানো হয়েছে এবং তাদের নিকট মুরীদ হয়ে তাদের সোহবত ইখতিয়ার করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অথচ দুনিয়ার কোনো লোকই এবং প্রথমকাল হতে শুরু করে বর্তমানকালের তাফসীরকারকদের মধ্যে কেউই এ থেকে পীরের নিকট মুরীদ হওয়ার আদেশ বুঝেননি, বুঝতে পারেনওনা। যদি কেউ তা বুঝতে চায়, তবে তা হচ্ছে নিজের মর্জি মত কুরআনকে ব্যবহার করা, নিজের পক্ষ সমর্থনে খামখেয়ালীভাবে কুরআনকে ব্যবহার করা। আর এ হচ্ছে অতি বড় অপরাধ- এত বড় অপরাধ যে, সুস্পষ্ট কুফরও এর সমতুল্য হতে পারেনা।

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ইবনে আব্বাস(রা) লিখেছেন-সাদেকীন বলতে বোঝায় সে সব লোককে, যারা ঈমান এবং আল্লাহ ও রাসূলের সাথে করা আনুগত্যের ওয়াদা পূরণে সত্যবাদী প্রমাণিত হয়েছে।

এছাড়া একে সাধারণ অর্থেও ব্যবহার করা যায়। তখন এর অর্থ হবেঃ এমন সব লোক, যারা দ্বীন পালনে নিয়্যত, মুখের কথা ও আমল-সব দিক দিয়েই সত্যবাদী প্রমাণিত হয়েছে।

আল্লামা ইবনে কাসীর এ আয়াতের তাফসীরে লিখেছেনঃ সত্যবাদী হও, সত্যকে অবলম্বন করো, তাহলে তোমরা সত্যের ধারক হতে পারবে এবং ধ্বংস হতে বাঁচতে পারবে। তা তোমাদের কাজকর্মে সহজতা এনে দেবে।

আল্লামা তালুসীর মতে এর অর্থ হতে পারে বিশেষভাবে তারাও- যারা মুসলিম বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদেরকে উচ্চ স্থানে আটকে রেখেছিল।

এতে করে গোটা আয়াতের অর্থ হবেঃ তারা তিনজন যেমন ভাবে সত্য কথা বলেছিলেন, সত্যবাদিতা ও খালিস নিয়্যতে, তোমরাও তেমনি হও।(ইমামুল মোফাসসেরীন আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ আল-আনসারী আল কুরতুবী তাঁর সুবিখ্যাত তাফসীরে এ আয়াতের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন; কিন্তু তাতে পীর ধরা বোঝায় ও পীরের সঙ্গ গ্রহণের নির্দেশ হয়েছে বল উল্লেখ করেননি)।

কুরআন মজীদের অপর এক আয়াতে সাদেকীন শব্দের সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আয়াতটি এইঃ

আরবী(**********)

-সেসব ফকীর গরীব মুজাহিরদের জন্যে, যারা তাদের ঘর-বাড়ি থেকে বহিষ্কৃত এবং ধন-মাল থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তারা আল্লাহর নিকট থেকে অনুগ্রহ ও সন্তোষ পেতে চায়। আর তারা আল্লাহ ও রাসূলের সাহায্য করে। প্রকৃতপক্ষে এরাই সাদেকীন, সত্যবাদী।

এখানে ‘সাদেকীন’ বা সত্যবাদী লোকদের পরিচয় দিয়ে বলা হয়েছে যে, তারা দ্বীন ইসলামের কারণে ঘর-বাড়ি থেকে বহিষ্কৃত, ধন-মাল থেকে বঞ্চিত, তাঁরা সব সময় আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তোষ পেতে চায় এবং সেজন্য তারা সবসময় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাহায্য কামনা করে দ্বীন কায়েম করার ব্যাপারে। এতো কোনো পীরের পরিচয় নয়।

আমি মনে করি, এ পর্যায়ের লোকই বোঝা যেতে পারে সাদেকীন শব্দ থেকে। নাফে বলেছেন যে, যে তিনজন লোক তাবুক যুদ্ধে মুজাহিদীন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন তাদের কথাই বলা হয়েছে এখানে। এছাড়া নবী করীম(স) এবং তাঁর সাহাবীগণও এর অর্থ হতে পারেন, বলেছেন ইবনে উমর(রা)। সাঈদ ইবনে জুবায়ের বলেছেন যে, এ আয়াতে ‘সাদেকীন’ বলতে বোঝানো হয়েছে হযরত আবু বকর সিদ্দীক ও হযরত উমর ফারূক(রা)কে। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, সাদেকীন অর্থ পীর, আর এ আয়াতে পীর ধরার নির্দেশ দেয়া হয়েছে-এ কথা বলা হচ্ছে কোন দলীলের ভিত্তিতে।

পীর মুরীদী সম্পর্কে মুজাদ্দিদে আলফেসানীর বক্তব্য
এ সম্পর্কে আমরা বেশি শুনতে চাইব মুজাদ্দিদে আলফেসানী শায়খ আহমদ সরহিন্দীর নিকট থেকে, জানতে চাইব তাঁর মতামত। কেননা পাক-ভারতে একদিকে তিনি যেমন তাসাউফ বা ইলমে মারিফাতের গোড়া তেমনি আকবরী ‘দ্বীনি-ইলাহী’ ফিতনা ও ইসলামের দুশমনির সয়লাবের মুখে তিনি প্রকৃত দ্বীন ইসলামকে জাগিয়ে তুলেছেন। কাজেই তাসাউফ সম্পর্কে তাঁর মতামত ‘আপনি আমি বা সে’ এর তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মত পেশ করা এজন্যও বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে, এ দেশের পীরের সাধারণত তাঁকেই সব পীরের গোড়া বলে দাবি করে থাকেন।

শরীয়ত ও মারিফাত পর্যায়ে তিনি তাঁর ‘মকতুবাত’ এ লিখেছেন-

কাল কিয়ামতের দিন শরীয়ত সম্পর্কেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, তাসাউফ সম্পর্কে কিছূই জিজ্ঞাসা করা হবেনা। জান্নাতে যাওয়া ও জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়া শরীয়তের বিধান পালনের উপর নির্ভরশীল। নবী-রাসূলগণ-যাঁরা গোটা সৃষ্টিলোকের মাঝে সর্বোত্তম-শরীয়ত কবুল করারই দাওয়াত দিয়েছেন, পরকালীন নাজাতের জন্য শরীয়তই একমাত্র উপায় বলে ঘোষণা করেছেন। এ মহান মানবদের দুনিয়ায় আগমনের উদ্দেশ্যই হলো শরীয়তের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা। সবচেয়ে বড় নেকীর কাজ হলো শরীয়তকে চালু করা। এবং শরীয়তের বিধানসমূহের মধ্যে একটি হুকুমকে হলেও জিন্দা করা বিশেষ করে এমন সময় যখন ইসলামের নিদর্শনসমূহ ধ্বংস হয়ে গেছে। কোটি কোটি টাকা আল্লাহর পথে খরচ করাও শরীয়তের কোনো একটি মাসালাকে রেয়াজ দেয়ার সওয়াবের সমান হতে পারেনা।

মুজাদ্দিদে আলফেসানী(রহ) এ পর্যায়ে আরো একটি প্রশ্নের বিশদ ও স্পষ্ট জবাব দিয়েছেন। সাধারণ্যে প্রচলিত মত জাহিল পীরেরা ও তাদের মুরীদেরা প্রচার করে বেড়ায় যে, শরীয়ত হচ্ছে দ্বীনের বাইরের দিকের চামড়া, আর আসল মগজ হচ্ছে তরীকত বা মারিফাত। একথা বলে যারা শরীয়তের আলিম, কিন্তু তরীকত, মারিফাত ইত্যাদির ধার ধারেননা, শরীয়তকেই যথেষ্ট মনে করেন-তাঁদের ফাসিক ও বিদয়াতী ইত্যাদি বলে অভিহিত করে, তাঁদের সমালোচনা করে এবং তাঁদের দোষ গেয়ে বেড়ায়। এর জবাবে মুজাদ্দেদি আলফেসানীর-যিনি এদেশের প্রকৃত মারিফাতেরও গোড়া-তাঁর দাঁতভাঙ্গা জবাব শুনুন।

তিনি বলেছেনঃ শরীয়তের তিনটি অংশ রয়েছে। ইলম(শরীয়তকে জানা), আমল(শরীয়ত অনুযায়ী কাজ) এবং ইখলাস(নিষ্ঠা)। তরীকত ও হাকীকত উভয়ই শরীয়তের এই তৃতীয় অংশ-ইসলামের পরিপূরক হিসেবে শরীয়তের খাদেম মাত্র। এটিই আসল কথা, কিন্তু সকলে এতদূর বুঝতে সক্ষম হয়না। অধিকাংশ আলেম লোক কল্পনার সুখ স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। আর বেহুদা অর্থহীন ও অকাজের কথাবার্তা বলাই যথেষ্ট মনে করে। এ লোকেরা শরীয়তের প্রতিপালন সম্পর্কে কি জানে, কি বুঝবে! তরীকতের হাকীকতই বা এরা কি বুঝবে! এরা শরীয়তকে চামড়া বা বাইরের জিনিস মনে করে বসে আছে আর হাকীকতকে মনে করছে মূল, মগজ ও আসল। আসল ব্যাপার কি, তা এরা আদৌ বুঝতে পারছেনা। সুফী লোকদের-পীরদের বেহুদা অর্থহীন কথাবার্তা নিয়ে অহমিকায় নিমগ্ন রয়েছে এবং মারিফাতের ‘আহওয়াল’ ও ‘মাকামাত’ এর মধ্যে পাগল হয়ে ঘুরে মরছে তারা। আল্লাহ তা‘আলা এ লোকদেরকে সঠিক পথে হেদায়াত করুন এ দোয়া করি।

শরীয়ত ও মারিফাতকে যারা দুটো জিনিস মনে করে নিয়েছে এবং তরীকতের অর্থহীন অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তায় যারা নিমগ্ন হয়েছে, মোজাদ্দেদি আলফেসানী(রহ) তাদেরকে জাহিল ও বিভ্রান্ত লোক বলে অভিহিত করেছেন। মুজাদ্দিদে আলফেসানীর এ কথা যে সম্পূর্ণ সত্য ও একান্তই নির্ভূল, তাতে অন্তত শরীয়তের আলিমদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। বস্তুত শরীয়তের আলিম ও জাহিল পীর ও তাদের অন্ধ মুরীদদের মাঝে মতভেদ শুরু থেকেই চলে এসেছে। শরীয়ত এর আলিমগণ ইসলামী শরীয়ত আর তরীকতের বিভক্তিকে কোনোদিনই সমর্থন করেননি, চিরদিনই এর বিরোধিতা করেছেন-এ জিনিসকে দ্বীন ইসলামের বাইরে থেকে আমদানি করা এক মারাত্মক বিদয়াত বলে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু আজ জাহিল পীরেরা নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থের জন্য এবং শরীয়ত পালন ও কায়েমের দায়িত্বপূর্ণ কাজ থেকে দূরে খানকা শরীফের চার দেয়ালের মধ্যে সহজ ও সস্তা সুন্নাত পালনের অভিনয় করার জন্য শরীয়ত থেকে বিচ্ছিন্ন ‘তরীকত’ নামের এক নতুন বস্তু প্রচলন করেছে। এরূপ অবস্থায় কার কথা বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে গ্রহণ করা যাবে? আলিমদের, না সূফী ও পীরদের? এর জবাব দিয়েছেন মুজাদ্দেদি আলফেসানী(রহ)। তিনি বলেছেনঃ জেনে রাখা ভালো, যে বিষয়ে সূফী, পীর ও শরীয়তের আলিমদের মাঝে মতভেদ হয়, ভালোভাবে চিন্তা ও অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে যে, সে বিষয়ে আলিমদের মত-ই হক। এর কারণ এই যে, আলিমগণ নবী রাসূলগণের অনুসরণ করার মাধ্যমে নব্যুয়তের গভীর মাহাত্ম এবং তদলব্ধ ইলম লাভ করতে পেরেছেন। আর সূফী পীরদের দৃষ্টি বেলায়েতের কালিমাত ও তত্ত্বকথার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।

পীরদের মুরীদ বানানো ব্যবসার সবচেয়ে বড় মূলধন হচ্ছে কাশফ ও ইলহামের দোহাই। পীরেরা যখন বলে আমার কাশফ হয়েছে-ইলহামযোগে আমি একথা জানতে পেরেছি’-তখন জাহিল মুরীদান ভক্তিতে গদগদ হয়ে কদমবুসি করতে শুরু করে। কিন্তু এসব জিনিস যে পীর মুরীদীর ব্যবসা চালাবার জন্য হয়, তা বুঝবার ক্ষমতা এই মূর্খ পীরদের নেই। ‘ইলহাম’ হতে পারে, কাশফও হয়, হয় আল্লাহর মেহেরবানীতে। যদি কেউ তা লাভ করে তাহলে অন্য লোকদের তা না বলে আল্লাহর শোকর আদায় করা উচিত। কিন্তু জাহিল পীরেরা শরীয়তের ধার ধারেনা। তারা ইলহামের দোহাই দিয়ে জায়েয-নাজায়েয, হালাল-হারাম ও ফরয ওয়াজিব ঠিক করে ফেলে। আর অন্ধ মুরীদরা তাই মাথা পেতে নেয়, শরীয়তের হুকুমের প্রতি তাকাবার খেয়ালও জাগেনা। এ সম্পর্কে মুজাদ্দেদি আলফেসানীর কথাই আমাদেরকে নির্ভূল পথ-নির্দেশ করতে পারে। তিনি বলেছেনঃ

কিয়াস ও ইজতিহাদ শরীয়তের মূলনীতিসমূহের মধ্যে অন্যতম। তা মেনে চলার জন্য আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে।কিন্তু কাশফ ও ইলহাম মেনে নেয়ার কোনো নির্দেশ আমাদেরকে দেয়া হয়নি। উপরন্তু ইলহাম অপর লোকের বিরুদ্ধে দলীল নয়। ইজতিহাদ মুকাল্লীদ এর জন্য দলীল(মেনে চলতে বাধ্য)। অতএব মুজতাহিদ আলিমদের মেনে চলাই উচিত এবং তাঁদের মতের ভিত্তিতে দ্বীনের নীতি তালাশ করা কর্তব্য। আর সূফীরা মুজতাহিদ আলিমদের মতের বিপরীত যা কিছু বলে বা দাবি করে, তা মেনে চলা কিছুতেই উচিত নয়।

সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, পীর ও জাহিল লোক নিজেরা যেমন সাধারণত জাহিল হয়ে থাকে, মুরীদদেরকেও তেমনি জাহিল করে রাখতে চায় এবং তাদের দ্বীন-ইসলাম ও ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে কুরআন হাদীস সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার জন্য কখনো হেদায়াত দেয়না। পীর কিবলা মুরীদকে মুরাকাবা করতে বলবে, আল্লাহর যিকির করতে বলবে এবং হাযার বার করে ‘বানানো দুরুদ শরীফের অজীফা’ পড়তে বলবে; কিন্তু আল্লাহর কালাম দ্বীন ইসলামের মূল উৎস কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করতে, তার তরজমা ও তাফসীর বুঝতে এবং আল্লাহর কথার সাথে গভীরভাবে পরিচিত হতে কখনোই বলবেনা। বস্তুত এ এক আশ্চর্যের ব্যাপার। কিন্তু মুজাদ্দিদে আলফেসানী(রহ) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ

অধিক জরুরী নসীহত হলো এই যে, কুরআন শরীফের অধ্যয়নে ও পড়াশোনায় কোনোরূপ ত্রুটি করবেনা। আপনার সমস্ত সময় যদি এই অধ্যয়নে ব্যয় হয়ে যায় যায় তাহলে ভালো। যিকির ও মুরাকাবার কোনো লাভ করবেননা।

মোগলদের ইসলাম বিরোধী শাসন আমলে মুজাদ্দিদে আলফেসানী যখন দ্বীন ইসলাম প্রচার এবং বাতিলের প্রতিবাদ শুরু করেন, তখন বাতিল পীরেরা তাঁর এ কাজের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। তিনি তখন স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন যে, এ বাতিলপন্থী পীরদের উৎখাত এবং তাসাউফের সংশোধন না হলে দ্বীন-ইসলামকে সঠিকভাবে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা যাবেনা। এজন্য তিনি তাসাউফের অনেকখানি সংশোধনও করেছেন, মুক্ত করেছেন তাকে বাতিল চিন্তা ও তরীকা থেকে।

আসল কথা হলো, পীরবাদ মোটেই ইসলামী জিনিস নয়। ইসলামের আলোকোজ্জ্বল পরিবেশে তার প্রচলন হয়নি। তার উন্মেষই হয়েছে ইসলামের পতন যুগে। অবশ্য ইসলামের অনেক মনীষীও ইলমে তাসাউফের মাধ্যমে জনগণকে দ্বীন ইসলামের দিকে নিয়ে আসতে চেষ্টা করেছেন; কিন্তু পীরবাদে যে মূল দোষত্রুটি ছিল, তার বীজ রয়েই গেছে এবং তা সৃষ্টি করেছে একটি বিষবৃক্ষ। বর্তমানে তাই এক বিরাট বৃক্ষে পরিণত হয়ে জনগণকে চরমভাবে বিভ্রান্ত করেছে, বিষাক্ত করেছে জনগণের আকীদা ও আমলকে। দ্বীন ইসলামের মূল সুন্নাতকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এ বাতিল পীরবারে মূলোৎপাটন আজও অপরিহার্য্ , যেমন অপরিহার্য্ ছিল মোজাদ্দিদে আলফেসানীর জীবনকালে।

পীরবাদ বা বায়‘আত গ্রহণ রীতি
বর্তমান পীর মুরীদী ক্ষেত্রে মুরীদকে বায়’আত করা, মুরীদের নিকট হতে বায়’আত গ্রহণ এবং মুরীদের পক্ষে পীরের নিকট বায়’আত করা এক মৌলিক ব্যাপার। বস্তুত বায়’আত করা সুন্নাত মোতাবিক কাজ বটে; কিন্তু পীর-মুরীদীর বায়’আত সম্পূর্ণ বিদয়াত, যেমন বিদয়াত স্বয়ং পীর-মুরীদী।

‘বায়’আত’ আরবী শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ হলো ক্রয় বা বিক্রয় করা। এ শব্দটি বললেই দুটি পক্ষের কথা মনে জাগে। একপক্ষ বায়’আত করে আর অপরপক্ষ বায়’আত কবুল করে। একজন বিক্রেতা, অপরজন ক্রেতা। এই ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারটি বড়ই সঙ্গীন। ইসলামে এর স্থান কোথায়, কি এর প্রকৃত ব্যাপার এবং সে ক্ষেত্রে সু্ন্নাত তরীকাই বা কি তা আমাদের বিস্তারিত জানতে হবে।

‘বায়’আত’, শব্দের ব্যাখ্যাদান প্রসঙ্গে ইমাম রাগেব ইসফাহানী লিখেছেনঃ

যখন কেউ কোনো সার্বভৌমত্বের আনুগত্য স্বীকার করে তাকে মেনে চলার স্বীকৃতি দেয়, তখন এ কাজকে বলা হয় ‘বায়’আত’ করা বা পারস্পরিক বায়’আত গ্রহণ। আর এ থেকেই বলা হয়ঃ সে সার্বভৌমের নিকট বায়’আত করেছে বা দুজন পারস্পরিক বায়’আত করেছে।

কুরআন মজীদে আল্লাহ তা’আলা রাসূল(সা) এর নিকট সাহাবাদের বায়’আত করার কথা উল্লেখ করেছেন নানা জায়গায়। প্রথমত যেসব লোক প্রথম ঈমান এনে ইসলাম কবুল করতো, তারা রাসূলের নিকট বায়’আত করতো, রাসূল তাদের নিকট বায়’আত কবুল করতেন। সূরা আল ফতহুর আয়াতে হুদায়বিয়ার গৃহীত ‘বায়’আতের’ উল্লেখ প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ

إِنَّ الَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ اللَّهَ يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ ۚ فَمَن نَّكَثَ فَإِنَّمَا يَنكُثُ عَلَىٰ نَفْسِهِ ۖ وَمَنْ أَوْفَىٰ بِمَا عَاهَدَ عَلَيْهُ اللَّهَ فَسَيُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا [٤٨:١٠]

-হে নবী, যারা তোমার নিকট বায়’আত করে তারা আসলে বায়’আত করে আল্লাহরই নিকটে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর সংস্থাপিত। অতঃপর যেই এই এ বায়’আত ভঙ্গ করে, এ বায়’আত ভঙ্গের ক্ষতি তার নিজের ওপরই চাপবে। আর যে তা পুরো করবে, যা সে আল্লাহর সাথে ওয়াদা করছে, তাকে অবশ্যই বিরাট প্রতিফল দেয়া হবে।

এ আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, বায়’আত ইসলামী জীবনধারার এক মৌল ব্যাপার। কিন্তু সে বায়’আত রাসূলের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় স্বয়ং আল্লাহর সাথে এবং সে বায়’আত হলো খালিস ও পূর্ণাঙ্গভাবে আল্লাহর দাসত্ব কবুল করার বায়’আত, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে চলার বায়’আত, আল্লাহর পথে তাঁর দ্বীন কায়েমের লক্ষ্যে আত্মদানের বায়’আত, জিহাদে শরীক হওয়ার বায়’আত।

এ হলো সাধারণ পর্যায়ে বায়’আত। এ পর্যায়ের আর এক বায়’আতের কথা উল্লেখ হয়েছে, যা রাসূলে করীম(স) গ্রহণ করতেন মুমিন মহিলাদের নিকট থেকে।

সূরা মুমতাহিনায় বলা হয়েছেঃ

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا جَاءَكَ الْمُؤْمِنَاتُ يُبَايِعْنَكَ عَلَىٰ أَن لَّا يُشْرِكْنَ بِاللَّهِ شَيْئًا وَلَا يَسْرِقْنَ وَلَا يَزْنِينَ وَلَا يَقْتُلْنَ أَوْلَادَهُنَّ وَلَا يَأْتِينَ بِبُهْتَانٍ يَفْتَرِينَهُ بَيْنَ أَيْدِيهِنَّ وَأَرْجُلِهِنَّ وَلَا يَعْصِينَكَ فِي مَعْرُوفٍ ۙ فَبَايِعْهُنَّ وَاسْتَغْفِرْ لَهُنَّ اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ [٦٠:١٢]

–হে নবী, মুমিন মহিলারা যদি তোমার নিকট এসে বায়’আত করে এসব কথার ওপর যে, তারা আল্লাহর সাথে একবিন্দু শিরক করবেনা, তারা চুরি করবেনা, তারা যিনা-ব্যভিচার করবেনা, তারা তাদের সন্তান হত্যা করবেনা, তারা প্রকাশ্যভাবে মিথ্যামিথ্যি কোনো অমূলক কাজের দোষ কারো ওপর আরোপ করবেনা, আর তারা ভালো পরিচিত কাজে তোমার নাফরমানী করবেনা, তাহলে তুমি তাদের নিকট থেকে এ বায়’আত গ্রহণ করো, আর আল্লাহর নিকট তাদের জন্যে মাগফিরাতের দো’আ করো, আল্লাহ নিশ্চিতই বড় ক্ষমাশীল এবং অতীব করুণাময়। (মুমতাহিনাঃ১২)

এ আয়াত স্পষ্ট বলে দিচ্ছে যে, নবী করীম(স) কি কি বিষয়ে মুসলিম মেয়েদের নিকট থেকে বায়’আত গ্রহণ করেছেন। বিষয়গুলো যে ইসলামী ঈমান ও আমলের একেবারে মৌলিক,- কবীরা গুনাহ না করার প্রতিশ্রুতিতেই যে বায়’আত গ্রহণ করা হয়েছে-তা স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে। কাজেই সু্ন্নাত অনুযায়ী ‘বায়’আত’ হলো শুধু তাই, যা এসব বিষয়ে এবং এ ধরনের মৌলিক বিষয়েই করা হবে বা গ্রহণ করা হবে। এক কথায়, ইসলামের হুকুম আহকাম পুরোপুরি পালন করার এবং শরীয়তের বরখেলাপ কোনো কাজ না করার ওয়াদা দিয়ে ও নিয়ে-ই যে বায়’আত করা বা গ্রহণ করা হয় তা-ই হলো সুন্নাত মোতাবিক বায়’আত। এরূপ বায়’আত গ্রহণই সুন্নাত হতে পারে অন্য কোনোরূপ বায়’আত নয়।

দ্বিতীয়, বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতি ও প্রয়োজন অনুসারে নবী করীম(স) মুসলমানদের নিকট হতে বায়’আত গ্রহণ করেছেন। এ পর্যায়েরই বায়’আত হলো বায়’আতে রেজওয়ান। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ

لَّقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا [٤٨:١٨]

–যেসব মু’মিন লোক গাছের তলায় বসে হে নবী! তোমার নিকট বায়’আত করেছিল, আল্লাহ তাদের প্রতি রাজি ও খুশি হয়েছেন। তাদের মনের আবেগ ও দরদের ভাবধারা তিনি ভালোভাবেই জেনেছিলেন এবং তাদের প্রতি পরম গভীর শান্তি নাযিল করেছিলেন এবং নিকটতর বিজয় দানেও তাদের ভূষিত করেছিলেন।(আল ফাতহঃ১৮)

হাদীস থেকে প্রমাণিত যে, এরূপ বায়’আত করার জন্য নবী করীম(স) সমস্ত সাহাবীদের আহবান করেছিলেন। এই বায়’আত সম্পর্কে তখনকার লোকেরা বলতোঃ নবী করীম (স) তো লোকদের নিকট হতে মৃত্যু কবুল করার বায়’আত গ্রহণ করেছিলেন।

আর হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ বলেনঃ

নবী করীম(স) ঠিক মৃত্যু কবুলের জন্য বায়’আত গ্রহণ করেননি। বরং আমরা বায়’আত গ্রহণ করেছি এর ওপর যে, আমরা কেউ-ই যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাবনা। ফলে লোকেরা বায়’আত করেছিল এবং উপস্থিত লোকদের মধ্য থেকে কেবল বনী সালমা গোত্র সরদার জা্দ্দ ইবনে কায়স ছাড়া কেউই পালিয়ে যায়নি।(তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৪র্থ খন্ড)।

‘বায়’আতে রেজওয়ান’ যে কঠিন মুহুর্তে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং কি গুরুতর ব্যাপার নিয়ে তা গ্রহণ করা হয়েছিল, এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট জানা গেল। অনুরূপভাবে জিহাদের ক্ষেত্রেও নবী করীম(স) বায়’আত গ্রহণ করতেন।

হযরত আনাস ইবনে মালিক(রা) বলেনঃ আনসার লোকেরা বলতো-আমরা খন্দকের দিন নবীর নিকট জিহাদের জন্য বায়’আত করেছি, যদ্দিন আমরা বেঁচে থাকব তদ্দিনের জন্য।

অন্য হাদীস থেকে এ প্রমাণও পাওয়া যায় যে, নবী করীম(স) সাধারণভাবে আনুগত্যের বায়’আতও গ্রহণ করতেন এবং লোকেরা তা করতো। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর(রা) বলেনঃ আরবী(********)

-আমরা রাসূলে করীম (স) এর নিকট শোনা ও মেনে চলার(আনুগত্য করার জন্য) বায়’আত করতাম। রাসূল(স) সে বায়’আত গ্রহণ করতেন। তবে এ বায়’আতে নবী করীম(স) আমাদেরকে ‘যতদূর আমাদের ক্ষমতা কুলায়’ বলে একটি শর্ত আরোপ করেছেন।

রাসূল (স) এর জামানায় এই ছিল তাৎপর্য্ ও ব্যবহার। পরবর্তীকালে সাহাবীদের যুগেও এই বায়’আত ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু তা হয়েছে শুধু রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে খলীফার আনুগত্য করার শপথ বা প্রতিশ্রুতি দেয়ার জন্য। যেমন নবী করীম(স) এর ইন্তিকালের পর খলীফা নির্বাচনী সভায় হযরত উমর ফারূক(রা) সর্বপ্রথম বায়’আত করলেন হযরত আবু বকর(রা) এর হাতে।

এ সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছেঃ আরবী (*********)

-হযরত উমর আবু বকরকে লক্ষ্য করে বললেনঃ না, আমরা তো আপনার হাতে বায়’আত করবো, আপনিই আমাদের সরদার, আমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি এবং নবী করীমের নিকট আমাদের অপেক্ষা সর্বাধিক প্রিয় লোক। অতঃপর উমর ফারূক (রা) তাঁর হাত ধরলেন এবং বায়’আত করলেন, আর সেই সঙ্গে উপস্থিত সব লোকই বায়’আত করলো।

এ ঘটনা থেকে একথা প্রমাণিত হচ্ছে যে, বায়’আত করা এবং বায়’আত গ্রহণ করা মুসলিম সমাজে একটি সুন্নাত হিসেবেই চালু রয়েছে। নবী করীম (স) এর পরেও কিন্তু সে বায়’আত ছিল হয় জিহাদে যোগদান করার জন্য, না হয় রাষ্ট্রীয় আনুগত্য প্রকাশের জন্য।

কিন্তু পীর মুরীদীর ক্ষেত্রে- চিশতীয়া, নকশবন্দীয়া মুজাদ্দিদীয়া ও মুহাম্মদীয়া তরীকায় ফকীর-হাকীরের হাতে বায়’আত নেয়ার বর্তমানে প্রচলিত এই সিলসিলা এল কোথ্থেকে, এ বায়’আতের সাথে নবী করীম(স) ও সাহাবাদের বায়’আতের সম্পর্ক কি?-মিল কোথায়? আসলে এ হচ্ছে একটি ভালো কাজকে খারাপ উদ্দেশ্যে ও খারাপ ক্ষেত্রে ব্যবহার করার মতো ব্যাপার। কাজটা ভালো, কিন্তু তা খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এ কারণেই পীর মুরীদীর ক্ষেত্রে হাতে হাতে কিংবা পাগড়ী ধরে অথবা পাগড়ী ধরা লোকের গায়ে গা মিলিয়ে বায়’আত করা, বায়’আত করা নানা তরীকায় মুরাকাবা করার জন্য-সম্পূর্ণ বিদয়াত। আরো বড় বিদয়াত হলো কুরআন বাদ দিয়ে মুরীদ ও পীরের ‘দালায়েলুল খয়রাত’ নামে এক বানানো দুরুদ সম্বলিত কিতাবের তিলাওয়াতে মশগুল হওয়া। মনে হয় এর তিলাওয়াত যেন একেবারে ফরয। কিন্তু শরীয়তে কুরআন ছাড়া আর কিছু তিলাওয়াত করা বড় সওয়াবের কাজ মনে করা, কুরআন অপেক্ষা অন্য কোনো মানবীয় কিতাবকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করা সুস্পষ্টরূপে এক বড় বিদয়াত।

শুধু তা-ই নয়, বায়’আত শব্দের আভিধানিক অর্থ বিক্রয় করা। যে লোকই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ পড়েছে ও বিশ্বাস করেছে, সে তো নিজেকে আল্লাহর নিকট বিক্রয় করেই দিয়েছে, সে নতুন করে নিজেকে কোনো পীরের নিকট বিক্রয় করতে পারে কোন অধিকারে?

আল্লাহ ঘোষণা করেছেনঃ

إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَىٰ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ

–নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের নিকট হতে তাদের জান ও মালকে ক্রয় করে নিয়েছেন এ শর্তে যে, তিনি এর বিনিময়ে জান্নাত লাভ করবেন।(আত তাওবাঃ১১১)

(এ আয়াত অনুযায়ী ক্রেতা হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ, বিক্রেতা হচ্ছে মুমিন ব্যক্তি। বিক্রয়ের জিনিসগুলো হলো মুমিন ব্যক্তির নিজ সত্তা এবং তার মূল্য হচ্ছে জান্নাত দানের ওয়াদা। এ ক্রয়-বিক্রয় যথারীতি সম্পন্ন হয়ে গেছে, যখনই একজন লোক সচেতন মনে পড়ছেঃ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।)

কাজেই আল্লাহর নিকট জান মাল বিক্রয় করার পর তা যদি কোনো পীরের হাতে পুনরায় বিক্রয় (বায়’আত) করে তবে তা হবে অনধিকার চর্চা, সুস্পষ্ট শিরক।

(উপরন্তু আল্লাহ ও রাসূলের নিকট বায়’আত করার উদ্দেশ্য যে দ্বীনের জন্য জিহাদ করা, তা আয়াতের পরবর্তী শব্দগুলোতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। অথচ পীরদের নিকট বায়’আত করার উদ্দেশ্য হলো চোখ বন্ধ করে মুরাকাবা মুশাহিদা করা, যিকির করা, কল্পনার জগতে উড়ে বেড়ানো। এ ধরনের বায়’আতের মধ্যে আসমান জমীনের পার্থক্য।)

কিন্তু তা সত্ত্বেও সায়্যিদ আহমদ শহীদ কোনো পীর-মুরীদী করেছিলেন তা বলিষ্ঠভাবে প্রমাণিত নয়। বরং তাঁর প্রামাণ্য জীবনী গ্রন্থে এই কথাগুলো বলিষ্ঠভাবে উদ্ধৃত পাওয়া যায়।

তিনি যখন দিল্লীতে অবস্থানকারী শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভীর সুযোগ্য পুত্র এবং কুরআন-হাদীস ও সমসাময়িক যুগের সকল সূক্ষ্ম জ্ঞান বিজ্ঞানে পারদর্শী শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভীর নিকট মৌখিকভাবে কুরআন হাদীসের শিক্ষা লাভ করে বেরেলী ফিরে আসলেন, তখন তিনি নিজের বাসগৃহে বসবাস না করে মসজিদে অবস্থান গ্রহণ করলেন এবং কুরআন হাদীসের ভিত্তিতে জনগণকে ওয়াজনসীহত করতে শুরু করলেন। তখন বিপুল সংখ্যক জনতা তাঁর হাতে বায়’আত করে তাঁর মুরীদ হওযার প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করলো এবং তাঁকে সেজন্য বাধ্য করতে চেষ্টা করতে লাগলো। তিনি মুরীদ বানাতে স্পষ্ট ভাষায় অস্বীকার করলেন এবং বললেন-মুসলমানদের পক্ষে আল্লাহ ও তাঁর রাসূরের মুরীদ হওয়াই যথেষ্ট। মিথ্যা বলবেনা, ধোঁকা দিবেনা, নিজের স্বার্থের খাতিরে অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবেনা-এটাই তোমাদের প্রতি নসীহত। তোমরা যদিও কারো মুরীদ হলে এবং তারপরেও এসব কাজ করতে থাকলে, তাহলে সে মুরীদী তোমাকে কোনো ফায়দা দিবেনা। আর যদি নেক নিয়্যতে এসব নেক আমল পাবন্দীর সাথে করলে তাহলে তোমাকে কারো নিকট মুরীদ হবার প্রয়োজন হবেনা। তখন তোমরা নিজেরাই নিজেদের পীর হবে এবং স্বীয় বিদ্রোহী নফসকে তোমাদের মুরীদ বানিয়ে দিবে। তোমরা তোমাদের নফসের নিকট হতে বায়’আত গ্রহণ করো, যেন তা কোনোদিনই শয়তানী ওয়াসওয়াসার অনুসরণকারী না হয়। পরকালের নাজাত পাওয়ার এটাই হচ্ছে যথেষ্ট পন্থা।

বস্তুত নবী করীম(স) এর বায়’আত গ্রহণের অন্তর্নিহিত মৌল ভাবধারার সাথে সায়্যিদ আহমদ শহীদের উপরোক্ত কথাগুলোর যে মিল রয়েছে তা সহজেই বুঝতে পারা যায় । তিনি স্বভাবতই পীর মুরীদী পছন্দ করতেননা। লোকেরা তাঁর সম্মুখে মাথা নত করে বসে থাকবে ও তাঁর তাজীম করবে, তাঁর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা জাহির করবে তা তিনি খুবই অপছন্দ করতেন। তাই এসব কিছু প্রত্যাখ্যান করে তিনি সেনাবাহিনীতে চাকরী গ্রহণ করে বহু দূরে চলে যান। উত্তরকালে তিনি জিহাদের জন্য যে বায়’আত গ্রহণ করতেন তা অনস্বীকার্য্।

গদীনশীন হওয়ার বিদয়াত
এ পর্যায়ে আর একটি বড় প্রশ্ন হলো এই যে, পীর-মুরীদীর ক্ষেত্রে এই যে, ‘গদিনশীন পীর’ হওয়ার প্রখা চালু রয়েছে ইসলামী শরীয়তে এর কোনো ভিত্তি আছে কি? কোনো মতে একজন লোক যদি একবার পীর নামে খ্যাত হতে পারলো, অমনি তাঁর বড় পুত্র অবশ্যই তাঁর গদীনশীন হবে। কিন্তু পীরের গদী কোনটি, যার ওপর বড় সাহেব ‘নশীন’ হন? পীর কি জমিদার যে, তার মৃত্যুর পর তার বড় পুত্র বাবার স্থলে জমিদার হয়ে বসবে? পীর-মুরীদী কি কোনো রাজা প্রজার ব্যাপার-পীর সাহেব রাজা বাদশাহ এবং মুরীদরা তার প্রজা, আর সে রাজার অন্তর্ধানের পর অমনি তার বড় পুত্র সিংহাসনে আসীন হয়ে বসবে? না পীর কোনো বড় দোকানদার যে, তার মরে যাওয়ার পরে সে দোকানদারের গদীর মালিক হয়ে বসবে তার বড় ছেলে? …এর কোনটি? এর মধ্যে যা-ই হোক, এর কোনোটির সাথে যে ইসলামের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক্ নেই, তা তো স্পষ্ট কথা। ইসলামে নেই কোনো জমিদারী. বাদশাহী; নেই দ্বীন নিয়ে এখানে কোনো দোকানদারী ব্যবসা চালাবার অবকাশ।

শুধু তা্-ই নয়, কেউ পীর বলে খ্যাত হলে অমনি তার ছেলেরা ‘শাহ’ বলে অভিহিত হতে শুরু করে। ‘শাহ’ মানে বাদশাহ। পীরের ছেলেকে ‘শাহ’ বা ‘বাদশাহ’ বলার এই মানে হতে পারে যে, পীর সাহেব নিজে একজন বাদশাহ; আর তার ছেলেরা খুঁদে বাদশাহ-বাদশাহজাদা। বুড়ো বাদশাহর চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ছেলেদের মধ্যে যে বড়, সে অমনি পীর-গদীনশীন হয়ে বসবে, আর অমনি তার পুত্রেরা পূর্বানুরূপ শাহ উপাধিতে ভূষিত হতে শুরু করবে। এই চিরন্তন নিয়ম আবহমান কাল হতে চলে আসছে, এর ব্যতিক্রম দেখা যায়নি কখনো, কোনো ক্ষেত্রেই।

এ থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারা যায় যে, পীর মুরীদী প্রথাটাই একটা জাহিলিয়াতের প্রথা। অন্তত এ কথাটাতো পরিষ্কার যে, এটা প্রচলিত হয়েছে এমন এক যুগে, যখন সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রচন্ড বাদশাহী প্রথা প্রতিষ্ঠিত ছিল। সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ সর্বাত্মক ব্যবস্থার প্রভাব নিতান্ত ধর্মীয় ক্ষেত্রেও এমন প্রচন্ড হয়ে পড়েছিল যে, ধর্মীয় নেতৃত্বকেও অনুরূপ এক বাদশাহী মনে করা হয়েছে। বাদশাহীর ন্যায় ‘বাদশাহের ছেলে বাদশাহ হবে’ এই নীতি অনুযায়ী ‘পীরের ছেলেও পীর হবে’ এ ধারণাও বদ্ধমূল করে নেয়া হয়েছে।

বাদশাহর ছেলেকে বলা হয়-শাহজাদা-এ ঠিক শাব্দিক অর্থেই সঠিক প্রয়োগ(ইংরেজীতে বলা হয় Prince), পীরের ছেলেকেও তাই শাহ বলা হতে লাগলো-কৃত্রিম অর্থে। কেননা পীরও আসলে বাদশাহ নয়। আর তার ছেলেও নয় বাদশাহজাদা। এখানে মজার ব্যাপার এই যে, পীরের ছেলেরাই সবকিছু, তারাই শাহ নামে অভিহিত হয়, তাদের মধ্যে যে বড় সেই হয় গদীনশীন। কিন্তু বেচারী মেয়েদের কোনো অধিকার স্বীকৃত নয়, না মেয়েদের সন্তানের কোনো অধিকার সেখানে স্বীকৃত। সব কিছুই চলে পীরের ছেলে পীর, তার ছেলে পীর এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ধারায়। এই ধারা কখনো পীরের কন্যাদের দিকে প্রবাহিত হয়না। ঠিক বাদশাহী সিস্টেমও তাই। সেখানে গদী-তথা রাজতখতের ওপর একমাত্র অধিকার ছেলেদের, সব ছেলে নয়, কেবল মাত্র বড় ছেলের আর তার বংশধরদের। মুসলমানদের মাঝে যে বাদশাহী সিস্টেম রয়েছে, তাতে অনেক সময় দেখা যায় বড় ছেলে বাদশাহ হয়ে গেলে ছোট ভাই বা অন্য কেউ-‘অলী আহমদ’ হয়। তার মানে এ বাদশাহর পর তার ছেলে নয়, তার ভাই-ই হবে গদীনশীন। কিন্তু পীর মুরীদীর ক্ষেত্রে এ বাদশাহী সিস্টেম এতদূর বিকৃতরূপ লাভ করেছে যে. এখানে বড় ছেলেই সব। বড় ছেলে একবার গদীনশীন হয়ে বসতে পারলে সে-ই হর্তা কর্তা বিধাতা। সে পিতার কেবল গদী-ই দখল করেনা, পিতার মুরীদরা সব তার মুরীদে পরিণত হয়ে যায় আপনা আপনিভাবে। যেমন জমিদার বা রাজার প্রজারা আপনা আপনি তার ছেলেরও প্রজা হয়ে যায়। আর বিত্ত সম্পত্তি কিছু থাকলে তারও একমাত্র ভোগদখলকারী হয় এই বড় সাহেব, যিনি গদীনশীন হয়ে বসেন। ছোট ভাই কেউ থাকলে তারা হয় চরম অসহায়, উপেক্ষিত, বঞ্চিত এবং পিতার বিশাল মুরীদ মহল হতে বিতাড়িত।

কিন্তু প্রশ্ন এই যে, এসব কথা কি ধর্মীয়? হতে পারে ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্মের এ-ই নীতি। সেখানে ব্রাক্ষ্মণের বড় পুত্র অবশ্যই ব্রাক্ষ্মণ হবে, আর সে আপনা আপনি পেয়ে যাবে পিতার জযমানদের। এতদিন তারা ছিল বুড়ো ব্রাক্ষ্মণের জযমান আর এখন হবে তারা এই ব্রাক্ষ্মণ-পুত্র- ব্রাক্ষ্মণের জযমান। তবে কি এই ব্রাক্ষ্মণপ্রথা হরফে হরফে মুসলিম সমাজেও চালু হয়ে গেছে।

এ সম্পর্কে কারোরই এক বিন্দু সন্দেহও থাকতে পারেনা যে, এ প্রথার সাথে ইসলামের কোনোই সম্পর্ক নেই। এ প্রথা কিছুমাত্র ইসলামী নয়। ইসলামে গদীনশীন হওয়ার কোনো অবকাশ নেই, নেই শাহ হওয়ার কোনো সুযোগ। ছোট ভাই এবং বোনদের অধিকার হরণ করে একাই সব কিছু গ্রাস করে নেয়ার এ ব্যবস্থা ইসলামে আদৌ সমর্থিত হতে পারেনা।

ইসলাম আমরা পেয়েছি হযরত মুহাম্মদ(স) এর নিকট থেকে। তিনি ইসলামকে শুধু মৌখিক নসীহতের মাধ্যমেই পেশ করেননি, তিনি তাঁর বাস্তব জীবন দিয়ে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ আদর্শকে বাস্তবায়িত ও সমাজে প্রতিফলিত করে গেছেন। তিনি তেইশ বছরের সাধনা ও সংগ্রামের ফলে কায়েম করে গেছেন এক বিরাট রাষ্ট্র। কিন্তু তাঁর ইন্তিকালের পর তাঁর বংশে চললোনা নব্যুয়তের ধারা, না হলো কেউ গদীনশীন নবী। তিনি যে রাষ্ট্র কায়েম করে গেলেন, তাতেও কায়েম করা হলোনা তাঁর বংশের লোকদের কর্তৃত্ব। বরং মুসলমানেরা স্বাধীনভাবে নিজেদের মধ্য থেকে ইসলামের বিধান অনুযায়ী সর্বাধিক মুত্তাকী ব্যক্তিকে খলীফা নির্বাচিত করে নিলেন। সে খলীফা না হলো তাঁর প্রিয়তমা কন্যা ফাতিমা, না তাঁর জামাতা, না তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় নাতি দৌহিত্ররা। নব্যুয়তের ধারাও চললোনা তাঁর বংশে। এমনি তাঁর সম্মানিত জামাতাদেরও কেউ এ সূত্রে রাসূল পরবর্তী খলীফা হলেননা। উত্তরকালে তাঁদের কেউ খলীফা হলেও তা রাসূলের জামাতা হওয়ার কারণে নয়, তা হয়েছেন তদানীন্তন সমাজের তাঁদের নৈতিক অবস্থান ও যোগ্যতার বৈশিষ্ট্যের কারণে। এ-ই ইসলামী ব্যবস্থা। এখানে বংশানুক্রমিকতা সম্পূর্ণ অচল। এ পীর মুরীদী রাসূলে করীম(স) থেকেই যদি চলে এসে থাকে-যেমন দাবি করা হচ্ছে, তাহলে এখানে গদীনশীন, ‘শাহ’ হওয়ার প্রথা এল কোথ্থেকে? রাসূলের জীবনে ও তাঁর কায়েম করা সমাজে তো এর নাম নিশানাও দেখা যায়না। খুলাফায়ে রাশেদুন এর সময়েও ছিলনা খলীফার ছেলে খলীফা হয়ে বসার প্রথা। বরং তাঁরা প্রত্যেকেই এ বংশানুক্রমিকতার প্রতিবাদ করেছেন। কোনো খলীফার ছেলেই খলীফা হতে পারেনি-না হযরত আবু বকরের, না উমর ফারূকের, না উসমান জিন্নুরাইনের, না আলী হায়দার(রা) এর। তাহলে প্রমাণিত হলো যে, এ প্রথা রাসূল(স) এর নিকট হতে গ্রহণ করা হয়নি। অতএব তা সুন্নাত নয়, তা স্পষ্ট বিদয়াত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এ বিদয়াতী প্রথায় গদীপ্রাপ্ত লোকেরাই সমাজে নিজেদেরকে পেশ করেছে সুন্নাতের বড় পায়রবী করনেওয়ালা- সুন্নাতের বড় ধারক বাহকরূপে। তার দৃষ্টিতে তিনি ছাড়া আর কেউই নাকি হক পথে নেই। অথচ সম্পূর্ণ ‘বিদয়াতী’ সিস্টেমে ‘গদীনশীন’ হয়ে নিজেকে ‘আহলে সুন্নাত’ হিসাবে পেশ করা এবং সুন্নাতের বড় অনুসারী হওয়ার দাবি করা বিদয়াত, বিদয়াতের নির্লজ্জ দৃষ্টতা ছাড়া আর কিছু নয়।

এখানেই শেষ নয়, এ গদীনশিন যদি জনমতের ভিত্তিতে ও উপযুক্ততার কারণে হতো, তাহলেও তার কোনো না কোনো দৃষ্টান্ত সলফে সালেহীনে হয়ত বা পাওয়া যেত। কিন্তু এখানে কোনো জনমতের স্থান নেই, যোগ্যতা অযোগ্যতার বিচার নেই। ব্যস বড় ছেলে হওয়াই গদী পাওয়ার অধিকারী হওয়ার জন্য বড় দলীল। এর ফলে এ গদীনশিন হয়ে গেছে এক ন্যক্কারজনক ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ। পীরের মৃত্যুর পর তাঁর মুরীদান খলীফার মাঝে সবচেয়ে মুত্তাকী কোন লোক সত্যি পরবর্তী পীর হওয়ার সর্বাধিক উপযুক্ত, সে বিচার করা হয়না এখানে এবং সুন্নাত তরীকা মতো সবচেয়ে বেশি মুত্তাকী ও যোগ্য ব্যক্তিকে গদীনশিন করার কোনো প্রবণতাই এখানে পরিলক্ষিত হয়না। সে রকম লোককে নিজেদের মধ্যেও তালাশ করে বের করা হয়না। এখানে স্থায়ীভাবে ধরে নেয়া হয়-স্বয়ং পীর সাহেব ও জানেন, জানে মুরীদরা, জানে সাধারণ মানুষ যে হুযুরের বড় ছেলেই হবে পরবর্তী পীর, গদীনশিন। সে ছেলে লেখাপড়া কিছু জানুক আর না-ই জানুক, নৈতিক চরিত্র তার যতই খারাপ হোক, জ্ঞান বুদ্ধিতে সে যতই বুদ্ধু হোক, সেই হবে পরবর্তী পীর। আর মরহুম পীরের মতোই যোগ্যতাসম্পন্ন লোক সে দরবারে অন্য কেউ থাকলেও তাকে সেখানে কোনো স্থান দেয়া হবেনা। শুধু তা-ই নয়, সে যোগ্য ও অধিক মুত্তাকী ব্যক্তিকেও বরং মুরীদ হতে হবে সে অযোগ্য অ-আলীম-মানে জাহিল, চরিত্রহীন ও বুদ্ধু গদীনশিন পীরের। নতুবা সে দরবারে তার কোনো স্থান হবেনা, সেখানে থেকে অনতিবিলম্বে বিতাড়িত হতে হবে।

এ যে তথাকথিত জমিদারতন্ত্র, রাজতন্ত্র, আর ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ প্রভৃতি জাহিলিয়াতের সব পদ্ধতিকেও ছাড়িয়ে গেছে। এর সাথে ইসলামের সুন্নাতের দূরতম সম্পর্কও থাকতে পারে কি?

কোনোরূপ সম্পর্ক থাকতে পারেনা। শুধু তা-ই নয়, এই পীর ও তার মুরীদরা- এ পীরের সমর্থকরা-হাদীয়া তোহফা ও টাকা পয়সা যারা দেয়, তারা সকলেই রাসূল(স) এর ঘোষণা অনুযায়ী আল্লাহর নিকট অভিশপ্ত। হযরত আলী(রা) বর্ণিত হাদীসে রাসূলে করীম(স) এর চারটি কথার তৃতীয় কথা হচ্ছেঃ আরবী(*******)

-আল্লাহ তা‘আলা অভিশপ্ত করেছেন সেই ব্যক্তিকে যে বিদয়াতকারীকে বা বিদয়াতপন্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, সম্মান করেছে ও সাহায্য সহযোগিতা দিয়েছে।


পীর মুরীদী সম্পর্কে আমার চূড়ান্ত কথা
পীর মুরীদী সম্পর্কে আমি উপরে যা কিছুই লিখেছি, পাঠক মহোদয় লক্ষ্য করলে স্বীকার করবেন যে, আমি নিজস্ব মনগড়া কোনো কথা লিখিনি। তা যেমন কুরআন, সুন্নাত ও সর্বজনমান্য মনীষীবৃন্দের কথার দলীলের ভিত্তিতে লিখেছি তেমনি এ পর্যায়ে আমার নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতাও রয়েছে।

কিন্তু সে অভিজ্ঞতা শুধু বিদয়াতী পীর সম্পর্কে বা পীর মুরীদী বিদয়াত হওয়া সম্পর্কেই নয়, এর বিপরীত এ অভিজ্ঞতাও আমার রয়েছে যে, সিলসিলার ও পীরের মৃত্যুর পর গদীনশিন হওয়ার পরও কেউ কেউ এমন আছেন, যিনি পীর মুরীদকে বিদয়াত ও নিছক ব্যবসায়ীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকার থেকে টেনে বাইরে নিয়ে এসে তাকে ঠিক ওস্তাদ-শাগরীদ, শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক কার্য্ত স্থাপন করেছেন। মারিফাত চর্চাকে শরীয়তের ভিত্তিতে পুনর্গঠিত করেছেন। শরীয়তের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে মারিফাতের শিক্ষাদানের কাজ করেছেন এবং এই গোটা তৎপরতার সঙ্গে জিহাদের সম্পর্ক স্থাপন করে দ্বীনী বিপ্লবের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন। তা দেখে দিল খুশিতে ভরে গেছে এবং মনে আশা জেগেছে যে, আল্লাহর নাযিল করা ও সর্বশেষ নবী রাসূল হযরত মুহাম্মাদ(স) এর প্রচারিত ও কায়েম করা দ্বীন হয়ত এখানে কায়েম হবে। মূলত খিলাফাতে রাশেদার অবসানের পর প্রথম দিকে দ্বীন কায়েমের যেসব চেষ্টা প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল, তা দ্বীনভিত্তিক মারিফাত ও জিহাদের বিপ্লবী ভাবধারা সমন্বিত ছিল, যাঁর ধ্বংসাবশেষ রূপ বর্তমান ব্যবসামূলক বিদয়াতপন্থী পীর-মুরীদী। বর্তমান অবস্থার আমূল পরিবর্তন করে সেই আসল ও আদর্শবাদভিত্তিক উস্তাদ-শাগরিদমূলক জন-সংগঠনের মাধ্যমে দ্বীন কায়েমের জন্য দ্বীন ও শরীয়তের, মারিফাত ও জিহাদের সমন্বয় নতুন করে কায়েম করাই বর্তমান মরণাপন্ন মুসলিম সমাজকে রক্ষা করা ও দ্বীনের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করার একমাত্র উপায়। ধর্মহীন রাজনীতি, রাজনীতিহীন ধর্ম- উপরন্তু দ্বীনের শুষ্ক তাত্ত্বিকতা দ্বীন কায়েমের পথে বড় বাঁধা। দ্বীন-ইসলামের নির্ভূল তত্ত্বকে হৃদয়ের ঈমানী আবেগে সঞ্জীবিত করে জিহাদী কার্য্ক্রমের মাধ্যমেই পীর-মুরীদীর পুনর্গঠন হওয়া আবশ্যক।

মানত মানায় শিরক এর বিদয়াত
কোনো কিছুর জন্য কোনো কাজ করার বা কোনো কিছু দেয়ার মানত মানার সুযোগ ইসলামে রয়েছে। এ মানতকে আরবী ভাষায় বলা হয় নজর। আর ‘নজর’ এর অর্থ ইমাম রাগেব লিখেছেনঃ

-মানত বলা হয় এরূপ কাজকে যে, কোনো কিছু ঘটবার জন্য তুমি নিজের ওপর এমন কোনো কাজ করার দায়িত্ব গ্রহণ করবে-ওয়াজিব করে নেবে- যা আসলে তোমার ওপর ওয়াজিব নয়। যেমন বলা হয়ঃ আমি আল্লাহর জন্যে একাজ করার মানত করেছি।

ইবনুল আরাবীন মানত এর সংজ্ঞাদান প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ

-কোনো কাজ করার বাধ্যবাধকতা নিজের ওপর নিজের কথার সাহায্যে চাপিয়ে নেয়া, যে কাজ হবে একান্তভাবে আল্লাহর ফরমাবরদারীমূলক এবং যা দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ হতে পারে।

তাফসীরে আবুস সউদে লিখিত হয়েছেঃ

-মানত হচ্ছে মনকে কোনো কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করা এবং তাকে বাধ্যতামূলকভাবে সম্পন্ন করা।

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ

-আমাদের মতের লোকেরা বলেছেনঃ ইবাদত বা দান খয়রাতের কিছু নিজের ওপর অতিরিক্তভাবে জায়েয করে নেয়াকেই মানত বলা হয়। কুরআন মজীদে এ মানত মানার কথা বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা আল বাকারার ২৭০ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ

وَمَا أَنفَقْتُم مِّن نَّفَقَةٍ أَوْ نَذَرْتُم مِّن نَّذْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُهُ ۗ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ [٢:٢٧٠]

-তোমরা যা কিছু খরচ করো বা মানত মানো, আল্লাহ তার সবকিছুই জানেন। আর জালিমদের জন্য সাহায্যকারী নেই। (আল বাকারাঃ২৭০)।

তাসীরে মাজহারীতে এ আয়াতে ব্যাখ্যা লিখা হয়েছে এভাবেঃ মানত হচ্ছে এই যে, তোমরা আল্লাহর জন্য করবে বলে কোনো কাজ নিজের জন্য বাধ্যতামূলক করে নিবে শর্তাধীন কিংবা বিনাশর্তে।

এ আয়াত ও তাফসীরের উদ্ধৃতি স্পষ্ট বলে দেয় যে, মানত হতে হবে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য। যে মানত হবে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যে, কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী কেবল তাই জায়েয; যে মানত খালিসভাবে আল্লাহর জন্য নয়, তা কুরআনের দৃষ্টিতে কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়। কুরআনের যে ধরনের মানত সমর্থিত, তাঁর দৃষ্টান্ত হচ্ছে ইমরান-স্ত্রীর মানত।

সূরা আল ইমরানে ৩৫ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ

إِذْ قَالَتِ امْرَأَتُ عِمْرَانَ رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِي بَطْنِي مُحَرَّرًا فَتَقَبَّلْ مِنِّي ۖ

–ইমরান স্ত্রী বললেনঃ হে আল্লাহ! আমার গর্ভে যে সন্তান রয়েছে তা আমি তোমারই জন্য মানত করলাম, তাকে দুনিয়ার ঝামেলা থেকে মুক্ত করবে, অতএব তুমি আমার এ মানত কবুল করো। (আল ইমরানঃ৩৫)।

ইমরান স্ত্রীর মানত ছিল একান্তভাবেই আল্লাহরই জন্য। সে মানতে এ দুনিয়ার কোনো স্বার্থলাভ লক্ষ্য ছিলনা, তাতে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করা হয়নি। মানত যে কেবল আল্লাহর জন্যই মানতে হয়-এ আয়াতে তার স্পষ্ট পথ নির্দেশ রয়েছে। ইমরান-স্ত্রীর কথা ‘তোমারই জন্য মানত করেছি’ তা স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে। আর একটি দৃষ্টান্ত হলো সূরা মরীয়মের ২৬নং আয়াত। আল্লাহ তা‘আলা নিজেই মরিয়মকে লক্ষ্য করে বলেছেনঃ

فَقُولِي إِنِّي نَذَرْتُ لِلرَّحْمَٰنِ صَوْمًا

–অতএব তুমি বলো আমি আল্লাহর জন্যই রোযা মানত করলাম। (মরিয়মঃ ২৬)

আল্লাহ নিজেই শিক্ষা দিলেন এ আয়াতের মাধ্যমে যে, মানত কেবল আল্লাহর জন্যই মানতে হবে, অন্য কারো জন্য অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়।

এ পর্যায়ে কুরআন থেকে আরো ‍দুটো আয়াতাংশ উদ্ধৃত করা যাচ্ছে। একটি হলোঃ তারা যেন তাদের মানতসমূহ পুরো করে।

আর রাসূলের সাহাবীদের প্রশংসা করে কুরআনে বলা হয়েছেঃ তারা মানত পুরা করে।

এ ছাড়া আরো বহু আয়াত রয়েছে কুরআনে, যাতে আল্লাহর সাথে করা ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি পূরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর মানত যেহেতু আল্লাহর সাথেই করা এক বিশেষ ধরনের ওয়াদা, সে জন্যে মানত অবশ্যই পূরণ করতে হবে।

কুরআন, হাদীস ও ফিকাহ এর দৃষ্টিতে মানত মানার ব্যাপারে বুনিয়াদী শর্ত হলো এই যে, তা মানতে হবে একান্তভাবে আল্লাহর জন্যে, আল্লাহর সন্তোষ বিধানের জন্য। যে মানত আল্লাহর সন্তোষ বিধানের জন্য করা হয়নি, তা মূলতই মানত নয়। তা পূরণ করাও ওয়াজিব নয়। উপরন্তু সে মানত হবে এমন কাজ করার, যে কাজ আল্লাহর আনুগত্যমূলক, যা আল্লাহর নাফরমানীর কোনো কাজ নয়।

হাদীসে এ কথা স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। আবু দাউদের কিতাবে উদ্ধৃত হয়েছে-হযরত ইবনে আমর বর্ণনা করেছেনঃ আমি রাসূল(স)কে বলতে শুনেছিঃ আরবী (*********)

-যে মানত দ্বারা আল্লাহর সন্তোষ লাভ করতে চাওয়া হয়নি, তা মূলতই মানত নয়।

অথবা এর তরজমা হবে, ‘মানত শুধু তাই যা থেকে আল্লাহর সন্তোষ লাভ করতে চাওয়া হয়েছে।’

ইমাম আহমদ মুসনাদে এবং তিবরানী বর্ণনা করেছেনঃ

নবী করীম(স) এক কঠিন গরমের দিনে লোকদের সামনে ভাষণ দিচ্ছিলেন। এ সময় একটি লোককে (সম্ভবত কোনো মরুবাসীকে) রোদের খরতাপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন- কি ব্যাপার; তোমাকে রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি কেন? লোকটি বললো, ‘আমি মানত করেছি আপনার ভাষণ শেষ না হওয়া পর্য্ন্ত রোদে দাঁড়িয়ে থাকবো।’ তখন নবী করীম(স) বললেন-আরবী (******)

-তুমি বসো, এটাতো কোনো মানত হলোনা। মানত তো শুধু তাই, যা করে আল্লাহর সন্তোষ হাসিল করা উদ্দেশ্য হবে।

এ মর্মের বহু সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সে সবগুলো থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, মানত এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তোষ লাভ; ব্যক্তির কোনো বৈষয়িক স্বার্থের লাভ নয়, নয় আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সন্তোষ লাভ, আর যে মানত সেরূপ হবেনা, তা মানতই নয়, তা আদায় করাও কর্তব্য নয়।

মানত কেবল আল্লাহর সন্তোষ লাভ করার উদ্দেশ্যেই হলে চলবেনা, তা হতে হবে এমন কাজের মানত, যে কাজ মূলতই আল্লাহর আনুগত্যমূলক। যে কাজ আল্লাহর আনুগত্যমূলক নয়, তা করার মানত করা হলেও তা মানত বলে গণ্য হবেনা, তা পূরণ করাও হবেনা ওয়াজিব। হাদীসে তার ভুঁড়ি ভুঁড়ি প্রমাণ রয়েছে। হযরত ইমরান ইবনে হুসায়েন(রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে-নবী করীম(স) বলেছেনঃ

-মানত দু’প্রকারের হয়। যে মানত আল্লাহর আনুগত্যের কোনো কাজের হবে, তা আল্লাহর জন্য বটে এবং তাই পূরণ করতে হবে। আর যে মানত আল্লাহর নাফরমানীমূলক কাজের মাধ্যমে হবে, তা হবে শয়তানের উদ্দেশ্যে। তা পূরণ করার কোনো দায়িত্ব নেই। কর্তব্যও নয়।

বুখারী শরীফে এমন কিছু হাদীসের উল্লেখ রয়েছে, যা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, ইসলামে এই মানত মানার কাজের কিছুমাত্র উৎসাহ দেয়া হয়নি। কথায় কথায় মানত মানার যে রোগ দেখা যায় অশিক্ষিত লোকদের মধ্যে এবং যে মানত মানার ইসলামী পদ্ধতি জানা না থাকার কারণে লোকেরা এক্ষেত্রে নানা প্রকার শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়ে, রাসূলে করীম(স) একে কিছুমাত্র উৎসাহিত করেননি, এবং তিনি একে সম্পূর্ণ অর্থহীন কাজ বলে ঘোষণা করেছেন। হযরত ইবনে উমর(রা) বলেনঃ

-তোমরা কি লোকদেরকে মানত মানা থেকে নিষেধ করোনা? অথচ নবী করীম(স) বলেছেনঃ মানত মানায় না কিছু আসে, না কিছু যায়(বা মানত কিছু এগিয়েও দেয়না, কিছু পিছিয়েও দেয়না)। এতে বরং শুধু এতটুকু কাজ হয় যে, এর ফলে কৃপণের কিছু ধন খরচ হয়ে যায় মাত্র।

হযরত আবু হুরায়রা(রা) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম(স) ইরশাদ করেছেনঃ মানত মানব সন্তানকে কোনো ফায়দাই দেয়না। দেয় শুধু তাই, যা তার তকদীরে লিখিত হয়েছে। বরং মানত মানুষকে তার তকদীরের দিকেই নিয়ে যায়। অতঃপর কৃপণ ব্যক্তির হাত থেকে আল্লাহ কিছু খরচ করান। তার ফলে সে আমাকে(আল্লাহকে)এমন কিছু দেয়, যা এর পূর্বে সে কখনো দেয়নি।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমরের যে হাদীসটি মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, তাতে মানত মানা থেকে রাসূল করীম(স) স্পষ্ট বাণী উচ্চারণ করেছেন।

ইরশাদ হয়েছেঃ আরবী(******)

-একদিন নবী করীম (স) আমাদের মানত মানা থেকে নিষেধ করেছিলেন। বলছিলেন, মানত কোনো কিছু থেকেই ফিরাতে পারেনা, তাতে শুধু কৃপণের কিছু অর্থ ব্যয় হয় মাত্র।

অপর এক হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছেঃ মানত মানা থেকে রাসূলে করীম(স) নিষেধ করেছেন। অপর বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ তোমরা মানত মানবেনা। কেননা এ মানত এক বিন্দু তকদীর বদলাতে বা ফিরাতে পারেনা।

এই হাদীস কয়টি থেকে বোঝা যায়, ইসলামে মানত মানার রীতি পছন্দনীয় নয়, বরং তা রাসূলের সুন্নাতের সম্পূর্ণ বিপরীত এক বিশেষ ধরনের বিদয়াত। আরো স্পষ্ট বলা যায়, টাকা পয়সা বা ধন সম্পদের মানত করা সম্পূর্ণ হারাম, তা যে কোনো উদ্দেশ্যেই করা হোকনা কেন? ইমাম মুহাম্মদ ইসমাইল আল-কাহলানী আস সানয়ানী লিখেছেন তাই লিখেছেনঃ

-মানত মানাকে হারাম বলা, এ কথাতো হাদীস থেকেই প্রমাণিত। এ হারাম হওয়ার কথা আরো শক্ত হয় এজন্য যে, মানত মানা থেকে নিষেধ করতে গিয়ে তার কারণ দর্শানো হয়েছে এই যে, এতে কোনো কল্যাণই আসেনা। তাতে যে অর্থ ব্যয় হয়, তা তো অযথা বিনষ্ট করা হয়। আর অর্থ বিনষ্ট করা হারাম। অতএব ধন মাল দেয়ার মানত মানাও হারাম।

অধিকাংশ শাফেয়ী ও মালেকী মাযহাবের লোকের বিশ্বাস, মানত মানা মাকরূহ। হাম্বলী মাযহাবেও একে মাকরূহ তাহরীম মনে করা হয়েছে। এর কারণ বলা হয়েছে এই যে, মানত কখনো আল্লাহর জন্য খালেস হয়না। তাতে ‘কোনো না কোনো বিনিময়’ লাভ লক্ষ্যভূত থাকে। অনেক সময় মানত মানা হয়; কিন্তু তা পূরণ করা কঠিন হয় বলে তা অপূরণীয়ই থেকে যায়। আল্লামা কাযী ইয়াজ বলেছেনঃ “মানত তাকদীরের ওপর জয়ী হতে চায় আর জাহিল লোকেরা মনে করে যে, মানত করলে তাকদীর ফিরে যাবে।” ইমাম তিরমিযী এবং কোনো কোনো সাহাবীও মানত মানাকে মাকরূহ মনে করতেন বলে উল্লেখ করেছেন। আর আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক লিখেছেনঃ মানত –তা আল্লাহর হুকুমবরদারীরই হোক কি নাফরমানীর- উভয় ক্ষেত্রে অবশ্য মাকরূহ হবে।

আর মাকরূহ মানে এসব ক্ষেত্রে মাকরূহ তাহরীম। ইবনুল আরাবী লিখেছেন-‘মানত মানা দো’আর সাদৃশ্য, তাতে তাকদীর ফিরে যায়না।” এ-ই হচ্ছে তকদীর। অথচ দো’আ করাকে পছন্দ করা হয়েছে, কিন্তু মানত মানতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা মানত উপস্থিত ইবাদত। তাতে সোজাসুজি বান্দার মন মগজ আল্লাহর দিকেই ঝুঁকে পড়ে। তা হয় বিনয়া্বনত, কাতর, উৎসর্গীত আল্লাহরই সমীপে। কিন্তু মানত মানায় উপস্থিত কোনো ইবাদত দেখা যায়না; বরং তাতে সরাসরি আল্লাহর পরিবর্তে সেই মানতের ওপরই নির্ভরতা দেখা দেয়। আর তা-ই শিরক পর্য্ন্ত পৌছায়।

এই প্রেক্ষিতে দেখা যায় যে, বর্তমানে সাধারণভাবে জনগণের মাঝে এবং এক শ্রেণীর জাহিল পীরের মুরীদরেদ মধ্যে কথায় কথায় মানত মানার যে হিড়িক পড়ে গেছে এবং ওয়ায-নসীহতে মানত মানার যে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে, তা আর যা-ই হোক ইসলামের আদর্শ নয়, নয় রাসূলের প্রতিষ্ঠিত সুন্নাত বরং তা স্পষ্টভাবে বিদয়াত। এ বিদয়াত-ই কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিরক এ পরিণত হয়ে যায়। শিরক হয় তখন, যখন মানত মানা হয় কোনো মরা পীরের কবরের নামে। কেননা এসব ক্ষেত্রে ‘আল্লাহর ওয়াস্তে’ যতই মানত মানা হোকনা কেন, আসলে তা ‘আল্লাহর ওয়াস্তে’ থাকেনা। তার সামনে পীর, মাদ্রাসা ইত্যাদি-ই থাকে প্রবল হয়ে এবং মনে করা হয়, এদরে এমন কিছু বিশেষত্ব আছে, আছে এমন কিছু অলৌকিক ক্ষমতা, যার কারণে সে এ মানতের দরুন উপস্থিত বিপদ থেকে উদ্ধার লাভ করতে পারবে; কিংবা তা বাঞ্চিত কোনো সুবিধা লাভ করিয়ে দিতে পারবে। আর ইসলামের দৃষ্টিতে এ-ই হচ্ছে সুস্পষ্ট শিরক। এ ধরনের মানত মানায় আল্লাহকে রাখা হয় পেছনে, আর যার নামে মানত করা হয়, সেই হয় মুখ্য। মনে ঐকান্তিক সম্পর্ক তারই সাথে স্থাপিত হয়, তাকে খুশি করাই হয় আসল লক্ষ্য। কাজেই এই জিনিস আল্লাহর নিষেধ এবং তা আল্লাহর বাণীঃ

فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَندَاد ا

–‘কাউকেই আল্লাহর সমতুল্য ও প্রতিদ্বন্ধী বানিওনা’(আল বাকারাঃ২২) এর বিপরীত হয়ে যায়।

এ ধরনের মানত মানা যে হারাম তাতে কোনো মুসলমানেরই কি এক বিন্দু সন্দেহ থাকতে পারে?

পূর্বোক্ত হাদীস হতে অবশ্য এ কথাও জানা যায় যে, মানত যদি খালেসভাবে কেবল মাত্র আল্লাহর জন্যেই হয়, তবে তা পূরণ করতে হবে এবং তা জায়েয। কিন্তু দুঃখের বিষয়, জায়েয নিয়মে খালেসভাবে মানত মানা খুব কম লোকের পক্ষেই সম্ভব হয়ে থাকে। তাই টাকা পয়সা খরচ করার বা কোনো মাল দেয়ার মানত মানা না মানাই তওহীদবাদী লোকদের জন্য নিরাপদ পথ। যদি মানত মানতেই হয়, তবে যেন নামায রোযা, আল্লাহর ঘরের হ্জ্জ ইত্যাদি ধরনের কোনো কাজের মানত মানা হয়। কেননা তাতে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ-ই বান্দার সামনে আসেনা- আসার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ধন-মালের যে মানত মানা হয় তাতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু বা অন্য কারো প্রতিই মন বেশি করে ঝুঁকে পড়ে, বিশেষ করে এক শ্রেণীর শোষক জাহিল অর্থলোভী গদীনশিন পীর যখন মানত মানার এক জাল বিস্তার করে দিয়েছে সমস্ত সমাজের ওপর, তখন মূর্খ লোকেরা ও অজ্ঞ লোকেরা এ জালে সহজেই ধরা পড়ে যেতে পারে, নিমজ্জিত হতে পারে কঠিন শিরক এর অন্ধ গহবরে। এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা দরকার যে, যদি কোনো বিশেষ জায়গার বিশেষ লোকদের জন্যে টাকা পয়সা বা কোনো মাল খরচ করার মানত করা হয়, তবে সে টাকা ইত্যাদি সেখানেই খরচ করতে হবে ইসলামে এমন কোনো জরুরী শর্ত নেই।

হানাফী ফিকহের কিতাবে লিখিত হয়েছে-

কেউ যদি বলে, অমুক দিন আল্লাহর নামে কিছু দান করা আমার ওপর ওয়াজিব কিংবা বলে অমুক স্থানের মিসকীনদের জন্য কিছু সদকা দেয়া ওয়াজিব, তাহলে দিন ও স্থানের কয়েদ পালন করা জরুরী হবেনা।

অর্থাৎ, যে কোনো দিন ও যে কোনো স্থানের গরীবদের মধ্যে দান করলেই মানত পূরণ হয়ে যাবে।

কবর যিয়ারত বিদয়াত
ইসলামে কবর যিয়ারত করা জায়েয ও সুন্নাত সমর্থিত। কিন্তু বর্তমানে কবর বিশেষ করে পীর অলী বলে কথিত লোকদের কবরকে কেন্দ্র করে দীর্ঘকাল ধরে যা কিছু হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ বিদয়াত, ইসলাম বিরোধী এবং সুস্পষ্ট শিরক, তাতে কোনো সন্দেহই থাকতে পারেনা।

কবর যিয়ারত সম্পর্কিত হাদীসসমূহ থেকে জানা যায়, ইসলামের প্রাথমিক যুগে কবর যিয়ারত করার অনুমতি ছিলনা। পরে সে অনুমতি দেয়া হয়। এ পর্যায়ে নবী করীম(স) এর একটি কথাই বড় দলীল। তিনি বলেছেনঃ আরবী(******)

-আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু এখন বলছি তোমরা কবর যিয়ারত করো।

অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ আরবী(*******)

-তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কবর যিয়ারত করতে চায়, তবে সে তা করতে পারে। কেননা কবর যিয়ারত মানুষকে পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

ইমাম নবয়ী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ সকলেই এ ব্যাপারে একমত যে, কবর যিয়ারত করা মুসলমানদের জন্য সুন্নাত সমর্থিত।

হযরত আনাস(রা) বর্ণিত হাদীসে এ ব্যাপারে আরো একটি বিস্তারিত কথা বলা হয়েছে। নবী করীম(স) বলেছেনঃ আরবী(********)

-আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে প্রথমে নিষেধ করেছিলাম কিন্তু পরে আমার নিকট স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এ কবর যিয়ারতে মন নরম হয়, চোখে পানি আসে এবং পরকালকে স্মরণ করিয়ে দেয়। অতএব তোমরা কবর যিয়ারত করো। কিন্তু তা করতে গিয়ে তোমরা অশ্লীল, গর্হিত ও বাজে কথাবার্তা বলোনা।

ইবনুল হাজার আল আসকালানী লিখেছেনঃ অশ্লীল কথা এবং অবাঞ্চনীয় অতিরিক্ত কথাবার্তা অর্থাৎ অশ্লীল, অপ্রয়োজনীয় ও অবাঞ্চনীয় কথাবার্তা কবরস্থানে বেশি করে বলা নিষিদ্ধ।

হযরত ইবনে আব্বাস(রা) বলেছেন-রাসূলে করীম(স) অভিশাপ বর্ষণ করেছেন কবর যিয়ারতকারী মেয়েলোকদের ওপর এবং তাদের ওপরও, যারা কবরের ওপর মসজিদ, গুম্বদ বা কোব্বা ইত্যাদি নির্মাণ করে।

হযরত আয়েশা(রা) তাঁর মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় বলেছিলেন-আল্লাহ তা‘আলা লানত করেছেন ইহুদী ও খৃস্টানদের ওপর এজন্য যে, তারা তাদের নবী-রাসূলের কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে।

আর গুম্বদ বা কোব্বা নিষিদ্ধের কারণ হচ্ছে- তাতে করে ধন মালের অপচয় হয়, কারো কোনো উপকার সাধিত হয়না। আর কবরস্থানে মসজিদ বানান হলে কবরের প্রতি অধিক সম্মান প্রদর্শন করা হয়। তা থেকে বিরত রাখাই এ নিষেধের উদ্দেশ্য।

অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ আরবী(***********)

-কবর যিয়ারতকারী মেয়েলোক এবং তার ওপর যারা বাতি জ্বালায় তাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলা অভিশাপ করেছেন।

আর একটি হাদীসে বলা হয়েছে এভাবে-আরবী(********)

-কবরকে পাকা-পোক্ত ও শক্ত করে বানাতে, তার ওপর কোনোরূপ নির্মাণ কাজ করতে, তার ওপর বসতে এবং তার ওপর কোনো কিছু লিখতে নবী করীম(স) সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করেছেন।

নবী করীমের ফরমান অনুযায়ী বলা যায় যে, কবরকে কেন্দ্র করে এসব কাজ করা মহা অন্যায়, অবাঞ্জনীয়। আর যারা একাজ করে তারা নিকৃষ্টতম লোক। নবী করীম(স) নিজে নিজের সম্পর্কে দো‘আ করেছেন এই বলেঃ আরবী(*********)

-হে আল্লাহ! তুমি আমার কবরকে কোনো পূজ্যমূর্তি বানিয়ে দিওনা। বস্তুত যে জাতি তাদের নবী রাসূলের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে, তাদের ওপর আল্লাহর গজব তীব্র হয়ে উঠছে।

এ হাদীসের তাৎপর্য্ সুস্পষ্ট। কবরের দিকে মুখ ফিরিয়ে সিজদা করা, কবরকে কিবলার দিকে রেখে নামাজ পড়া শরীয়তে সুস্পষ্ট হারাম। হযরত জুনদুব ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম(স) মুসলমানদের লক্ষ্য করে ইরশাদ করেছেনঃ আরবী(*********)

-সাবধান হও, তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা নবী-রাসূল ও নেক লোকদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছিল। তোমরা কিন্তু সাবধান হবে, তোমরা কখনো কবরকে মসজিদ বানাবেনা। আমি এ থেকে তোমাদের স্পষ্ট নিষেধ করছি।

কবরকে কেন্দ্র করে যে ওরশ ও মেলা অনুষ্ঠিত হয় তা ইসলামে নিষিদ্ধ। হযরত আবু হুরায়রা(রা) বলেনঃ আরবী(*********)

-রাসূলে করীম (স) কে বলতে শুনেছিঃ তোমরা তোমাদের ঘরকে কবরস্থানে পরিণত করোনা(অন্তত নফল নামায নিজেদের ঘরেই পড়বে)। আমার কবর কেন্দ্রে মেলা বসাবেনা, তোমরা আমার প্রতি দুরুদ পাঠাবে। যেখানে থেকেই তোমরা দুরুদ পাঠাওনা কেন, তা অবশ্যই আমার নিকট পৌছবে।

এ কারণেই কবরকে কোনো স্পষ্ট ও উন্নত স্থানরূপে নির্মিত করতেও নিষেধ করা হয়েছে। নবী করীম(স) হযরত আলী(রা) কে এ দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন-আরবী(*********)

-সব মূর্তি চুরমার করে দিবে এবং সব উচ্চ ও উন্নত কবর ভেঙ্গে সমান ও মাটির সাথে একাকার করে দিবে। এ থেকে যেন কোনো প্রতিকৃতি ও কোনো কবর রক্ষা না পায়। (হাদীসটি সহীস মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত। এর বর্ণনাকারী আবুল হাইয়্যাজ আল আমাদী। হযরত আলী(রা) তাঁকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-রাসূল(স) আমাকে যে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, আমি ও কি তোমাকে সে দায়িত্ব দিয়ে পাঠাবোনা? খলীফাতুল মুসলিমীন হিসেবেই হযরত আলী(রা) তাঁকে এই দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন।)

এসব কয়টি হাদীস থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে কবর যিয়ারত করা সাধারণ মুসলমানদের জন্যই নিষিদ্ধ ছিলো। নিষেধের কারণ এখানে স্পষ্ট বলা হয়নি। তবে অন্যান্য কারণের মধ্যে এও একটি বড় কারণ অবশ্যই ছিল যে, কবর পূজা জাহিলিয়াতের জমানায় একটি মুশরিকী কাজ হিসেবে আরব সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। মুসলমান হওয়ার পরও কবর যিয়ারতের ব্যাপক সুযোগ থাকলে তওহীদবাদী এ মানুষের পক্ষে কবর পূজার শিরক এ নিমজ্জিত হয়ে পড়ার বড় বেশি আশংকা ছিল। কিন্তু পরে যখন ইসলামী আকীদার ব্যাপক প্রচার ও বিপুল সংখ্যক লোকের মন-মগজে তা দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়, পূর্ণ বাস্তবায়িত হয় ইসলামী জীবনাদর্শ, তখন কবর যিয়ারতের অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু সে অনুমতি কেবল পুরুষদের জন্য, মেয়েদের তা থেকে বাদ দিয় রাখা হয়। শুধু তা-ই নয়, কবর যিয়ারত করতে মেয়েদের যাওয়ার ব্যাপারটিকে ইসলামের দৃষ্টিতে অভিশাপের কাজ বলে ঘোষণা করা হয়।

এ পর্যায়ে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী লিখেছেনঃ আরবী(********)

-আমি বলছি, শুরুতে কবর যিয়ারত নিষিদ্ধ ছিল। কেননা তা কবর পূজার দ্বার খুলে দিত। কিন্তু পরে যখন ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হলো এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর ইবাদত হারাম হওয়ার ব্যাপারে তাদের মন-মগজ স্থির বিশ্বাসী হলো, তখন কবর যিয়ারত করার অনুমতি দেয়া হয়।

অবশ্য মেয়েলোকদের কবর যিয়ারত করতে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো কোনো ফিকাহবিদ সামান্য ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাঁরা এক দিকে নিষেধ ও অপর দিকে অনুমতি- এ দুয়ের মাঝে সামঞ্জস্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে বলেছেন- নেককার লোকদের কবর যিয়ারত করে বরকত লাভ করা বৃদ্ধা মেয়েলোকদের জন্য জায়েয, তাতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু যুবতী মেয়েলোকদের পক্ষে মাকরূহ তাহরীম।

কবর যিয়ারত করতে অনুমতি দেয়ার কারণ হাদীসে বলা হয়েছে-তাতে মানুষের মন নরম হয়, চোখে পানি আসে এবং পরকালের কথা মনে আসে। মনে আসে, কবরস্থ সব লোকই একদিন তাদেরই মতো জীবিত ছিল। কিন্তু আজ দুনিয়ার বুকে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। এমনিভাবে তাদেরও সব মানুষেরই এরূপ পরিণতি দেখা দিবে। এ থেকে কারোরই রেহাই নেই। এতে করে যিয়ারতকারীর মনে পরকালের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের এক প্রয়োজনীয় ভাবধারা জাগে। আর ইসলামে তা বিশেষভাবে কাম্য।

কিন্তু কবর নির্মাণ সম্পর্কে এ হাদীসসমূহে দু’টো কড়া নিষেধ উদ্ধৃত হয়েছে। একটি এই যে, কবরস্থানে মসজিদ নির্মাণ করা চলবেনা। কেননা তা করা হলে মানুষ মসজিদের মতো কবরের প্রতিও ভক্তিভাজন হয়ে পড়তে পারে, কবরের প্রতি দেখাতে পারে আন্তরিক সম্মান ও শ্রদ্ধা। আর এ জিনিসই হলো শিরক এর উৎস। কবরগাহে মসজিদ বানানোর প্রচলন মুসলিম সমাজে দীর্ঘদিন থেকে চালু হয়ে আছে। অলী-আল্লাহ বলে কথিত কোনো লোকের কবর এখন কোথাও পাওয়া যাবেনা, যার নিকট মসজিদ নির্মাণ করা হয়নি। আর এসব কবরস্থানই শিরক ও বিদয়াতের লীলাকেন্দ্র হয়ে রয়েছে। বহু শত রকমের বিদয়াত মুসলিম সমাজে এখান থেকেই বিস্তার লাভ করেছে। বস্তুত এসব হচ্ছে ইসলামের তওহীদী আকীদায় শিরক এর বিদয়াতের অনুপ্রবেশ।

হাদীস অনুযায়ী কবরের ওপর কোনো কিছু নির্মাণ করাই হারাম। ইমাম শাওকানী পূর্বোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

-এ হাদীসে এ কথার দলীল পাওয়া গেল যে, কবরের ওপর কোনো কিছু নির্মাণ করাই হারাম।

শুধু তা-ই নয়, কবরের ওপর কিছু লিখাও হারাম। তিরমিযী শরীফে বর্ণিত হাদীসে অন্যান্য কথার সাথে এ বাক্যাংশটুকুও রয়েছে। -কবরের ওপর কিছু লেখাও নিষেধ।

অর্থাৎ কবরে মৃত ব্যক্তির নাম, জন্ম ও মৃত্যুর সন-তারিখ কিংবা কোনো মর্সিয়া বা শোক গাঁথা লেখা নিষিদ্ধ। শরীয়তে নাম লেখা আর অন্য কিছুই লেখা হারাম হওয়ার ব্যাপারে পার্থক্য করা হয়নি।

মাওলানা ইদরীস কান্দেলভী এ সম্পর্কে ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ এ কথার দু’টো অর্থ হতে পারেঃ একটি হচ্ছে কবরের ওপর ইট পাথর দিয়ে কোনো নির্মাণ কাজ করা কিংবা এ পর্যায়ের অন্য কোনো কাজ আর দ্বিতীয় হচ্ছে, কবরের ওপর কোনো চাঁদর, তাবু ইত্যাদি টানিয়ে দেয়া। আর এ দু’ধরনের কাজই নিষিদ্ধ। প্রথমটি নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ আগেই বলা হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি এজন্য যে, তাও প্রথমটির মতই নিষ্ফল, অর্থহীন কাজ। এতে অর্থের অপচয় হয় আর তা হচ্ছে জাহিলিয়াতের লোকদের কাজ।

জনসাধারণ শরীয়তের মূল বিধানের সাথে পরিচিত নয় বলে তারা সব অলী-আল্লাহ বলে পরিচিত লোকদের কবরের কোব্বা নির্মিত ও তার প্রত্যেকটির ওপর নাম ও অন্যান্য জিনিস লিখিত দেখে মনে করে যে, এ বুঝি শরীয়ত সম্মত কাজ, অন্তত এতে শরীয়তে কোনো দোষ নেই। অথচ তা সবই ইসলামে নিষিদ্ধ। হাদীসে এ পর্যায়ে বিপুল সংখ্যক কথা রাসূলে করীম(স) থেকে বর্ণিত এবং কিতাবসমূহে উদ্ধৃতি হয়েছে। এসব হাদীস সম্পর্কে ইমাম হাকিম লিখেছেনঃ

-কবরের ওপর কোনো কিছু লিখতে নিষেধ করা হয়েছে যে হাদীসে তার সবকটিই বিলকুল সহীহ। কিন্তু তদনুযায়ী আমল করা হচ্ছেনা। কেননা সর্বত্র মুসলিম ইমামদের কবরের ওপর কিছু না কিছু লিখিত দেখা যায়। পরবর্তী লোকেরা পূর্ববর্তী লোকদের কাছে এসব শিখছে (ও জায়েয বলে মনে করছে)।

আসলে এ আমল না নবী করীম(স) থেকে প্রমাণিত না সাহাবীদের থেকে। পরবর্তীকালের লোকেরাই উদ্যোক্তা। কিন্তু তারা ছিল এমন লোক যাদের কথা বা কাজ শরীয়তে দলীলরূপে গৃহীত নয়। এ পর্যায়ে ইমাম যাহবী লিখেছেন-ইমাম হাকিমের উপরোক্ত কথা কোনো কাজের কথা নয়। আসলে কোনো সাহাবীই উক্ত নিষিদ্ধ কাজটি করেননি। এ হচ্ছে উত্তরকালের উদ্ভাবিত একটি কাজ-বিদয়াত। কোনো কোনো তাবেয়ী এবং তাদের পরবর্তীকালের লোকেরাই উদ্ভাবন করেছেন। নবী করীম(স) এর এ নিষেধ তাঁদের নিকট পৌছায়নি।

আর পাক ভারতে প্রখ্যাত মনীষী কাযী সানাউল্ল্যাহ পানিপত্তি লিখেছেনঃ

-আউলিয়াগণের কবর প্রসঙ্গে তাদের কবরকে উন্নত করা, তার ওপর গম্বুজ নির্মাণ, ওরস অনুষ্ঠান করা, চেরাগ বাতি জ্বালানো সম্পূর্ণ বিদয়াত। এর মাঝে কতগুলো হারাম মাকরুহ(তাহরীম)। নবী করীম(স) যারা কবরে বাতি জ্বালায় ও মানত করে তাদের ওপর লা‘নত করেছেন। বলেছেন-না আমার কবরের ওপর উৎসব পালন করবে, না তাকে সেজদার স্থান বানাবে, না এরূপ কোনো মসজিদে নামায পড়বে। না কোনো নির্দিষ্ট তারিখে সেখানে একত্রিত হবে। নবী করীম(স) হযরত আলী(রা) কে পাঠিয়েছিলেন এ নির্দেশ দিয়ে যে, উঁচু কবর ভেঙ্গে সমান করে দেবে এবং প্রতিকৃতি যেখানেই পাবে মুছে দিবে।

সহীহ হাদীসে প্রমাণ রয়েছে, নেককার অলী লোকদের কবরস্থানে মসজিদ নির্মাণ করা সাধারণ ও মূর্খ লোকদের একটি চিরন্তন স্বভাব। হযরত আয়েশা(রা) বলেনঃ নবী করীম(স) যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত, তখন তাঁর স্ত্রী মারিয়া আবিসিনিয়ায় তার দেখা গীর্জার কথা রাসূল(স) এর নিকট উল্লেখ করেন। সে সময় উম্মে সালমা ও উম্মে হাবীবা(রা)ও উল্লেখ করেন তাঁদের দেখা সে গীর্জাসমূহের সৌন্দর্য্ ও তাতে রক্ষিত সব ছবি ও প্রতিকৃতির কথা। এসব কথা শুনে নবী করীম(স) মাথা ওপরে তুললেন এবং বললেনঃ আরবী(********)

-এসব ছবি ও প্রতিকৃতির ইতিহাস হলো এই যে, তাদের মধ্য থেকে কোনো নেককার(আমাদের ভাষায় কোনো পীর বা অলী-আল্লাহ বলে কথিত) ব্যক্তি যখন মরে গেছেন, তখন তার কবরের ওপর তারা মসজিদ নির্মাণ করেছে। অতঃপর তার মধ্যে এসব ছবি ও প্রতিকৃতি সংস্থাপিত করেছে। আসলে এরা হলো আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম লোক।

এ হাদীসও প্রমাণ করে যে, কারো কবরকে কেন্দ্র করে মসজিদ নির্মাণ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। কেননা আশংকা রয়েছে, সাধারণ লোকেরা কবরের সাথে সেরূপ ব্যবহারই করবে, যা করছে এসব অভিশপ্ত যেমনে করবে।

বস্তুত বর্তমানকালেও কোনো নামকরা বা খ্যাতনামা ‘অলী’(?)আলিম বা খ্যাতনামা পীরের মাজার খুব কমই দেখা যাবে, যার ওপর কোনো গুম্বদ বা কোব্বা নির্মিত হয়নি। নাম ও জন্ম-মৃত্যুর তারিখ এবং তৎসহ মর্সিয়া গাঁথা লেখা হয়নি। এসব কাজ যেমন হাদীসের স্পষ্ট বরখেলাপ, তেমনি তওহীদী আকীদারও সম্পূর্ণ পরিপন্থী। রাসূলে করীম(স) ইসলামের মৌল ভাবধারা তওহীদী আকীদার সুষ্ঠ হেফাজতের জন্যই এ সব কাজ করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু রাসূলের এ সুস্পষ্ট নিষেধ নির্ভয়ে অমান্য করে পীর অলী-আল্লাহ বলে কথিত লোকদের, রাজনৈতিক নেতাদের ও প্রখ্যাত ব্যক্তিদের কবরের ওপর বানান হয়েছে ও হচ্ছে কুম্বদ, কোব্বা, স্মৃতি, মিনার প্রভৃতি আর তার ওপর লেখা হচ্ছে তাদের নাম, জন্ম-মৃত্যুর তারিখ ও শ্রদ্ধাঞ্জলী বা মর্সিয়া গাঁথা। কিন্তু এগুলো যে বিদয়াত এবং ইসলামের সম্পূর্ণ খেলাফ কাজ তাতে কোনো ঈমানদার মানুষেরই একবিন্দু সন্দেহ থাকতে পারেনা।

ওপরের দলীলভিত্তিক আলোচনা থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিতে হলো যে, কবর উঁচু করা, তার ওপর কোব্বা নির্মাণ করা, মসজিদ বা নামায পড়ার স্থান নির্ধারণ, তাকে সর্বসাধারণের যিয়ারতগাহে পরিণত করা-কবরের পাশ্বে লোকদের দাঁড়ানোর জন্য ব্যালকনি তৈরি করা-এই সবই অত্যন্ত ও সুস্পষ্ট নিষিদ্ধ কাজ। এই ব্যাপারে রাসূলে করীম(স) কখনও অভিশাপ বর্ষণ করেছেন সেই লোকদের ওপর যারা এসব করে।

আবার কখনও তিনি বলেছেন- আরবী(*****)

-সেই লোকদের ওপর আল্লাহর গজব অত্যন্ত তীব্র ও প্রচন্ড হয়ে এসেছে যারা তাদের নবী-রাসূলগণের কবরসমূহকে মসজিদ বানিয়েছে।

তাই কখনও তিনি নিজেই ঐ কাজ যারা করে তাদের ওপর আল্লাহর গজব তীব্র ও কঠিন হয়ে বর্ষিত হওয়ার জন্য দো’আ করেছেন। সহীহ হাদীসেই তার উল্লেখ রয়েছে।

আবার কখনও তিনি সেই ধরনের সব কবর কোব্বা ইত্যাদি ধ্বংস করার জন্য দায়িত্ব দিয়ে লোক পাঠিয়েছেন। কখনও তিনি এই কাজকে ইয়াহুদী ও খ্রীস্টানদের কাজ বলে অভিহিত করেছেন। কখনও বলেছেনঃ তোমরা আমার কবরকে মূর্তি বানিয়ে অনুরূপ আচরণ করোনা। আবার কখনও বলেছেন-আরবী(******)

-তোমরা আমার কবরকে ঈদের ন্যায় উৎসবের কেন্দ্র বানিওনা।

অর্থাৎ এমন একটি মৌসুম বা সময় নির্ধারণ করে সেই সময় আবার কবরস্থানে লোকজন একত্রিত করে উৎসব করোনা। যেমন করে কবর পূজারীরা করে থাকে। তথায় তারা নানা অনুষ্ঠান পালন করে। কবরে অবস্থান গ্রহণ করে। ওরা আসলেও কার্য্ত আল্লাহর ইবাদত সম্পূর্ণ পরিহার করে কবর বা কবরস্থ ব্যক্তির ইবাদতে মেতে যায়। নবী করীম(স) এইসবকে তীব্র ভাষায় ও অত্যন্ত কঠোরতা সহকারে প্রতিরোধ করেছেন। আর আজ তাঁরই উম্মাহ হওয়ার দাবিদার অলী-আল্লাহ, পীর শায়খ, ইত্যাদির ছদ্মাবরণ ধরে মানুষকে কবর পূজারী বানাচ্ছে। কোথাও কোথাও আল্লাহকে হটিয়ে নিজেরাই মানুষের মা‘বুদ হয়ে বসেছে। সেখানে-তাদের প্রতি মুরীদরা-ভক্তরা-সেই ভক্তি শ্রদ্ধা ও আচার আচরণ করে, যা একান্তভাবে আল্লাহরই প্রাপ্য।

এ শুধু বিদয়াত নয়, এ হচ্ছে প্রচন্ড শিরক। তওহীদী ইসলামের দোহাই দিয়ে শিরক এর পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে এমন দরগাহ মুসলিম দুনিয়ার সর্বত্রই বিরাজ করছে।

কবর জিয়ারতের নিয়ম
ইমাম নববী লিখেছেনঃ‘যিয়ারতকারীর কর্তব্য কবরস্থানে উপস্থিত হয়ে প্রথমে সালাম করবে এবং কবরস্থ সকলের রূহের প্রতি মাগফিরাত রহমত নাযিল হওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট দো’আ করবে।’ এই সালাম ও দো’আ তা-ই হওয়া উচিত, যা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া কুরআনের আয়াত-সূরা বা রাসূল(স) থেকে বর্ণিত দো’আও পাঠ করা যেতে পারে।

ইমাম শাফেয়ী ও তাঁর সব সঙ্গী সাথী মনীষীবৃন্দ সর্বসম্মতভাবে এ নিয়মেরই উল্লেখ করেছেন। ইমাম আবুল হাসান মুহাম্মদ ইবনে মরযুক জাফরানী একজন মুহাক্কিক ফকীহ ছিলেন। তিনি বলেছেনঃ কবরকে হাত দ্বারা জড়িয়ে ধরবেনা, স্পর্শ করবেনা, কবরকে চুমু দেবেনা, কবর জিয়ারতের সুন্নাতী নিয়ম এই।

আবুল হাসান আরো বলেছেনঃ কবর ধরা, স্পর্শ করা ও তাকে চুমু দেয়া-যা বর্তমানকালের সাধারণ মানুষ করছে-নিঃসন্দেহে বিদয়াত, শরীয়তে নিষিদ্ধ, ঘৃণিত। তা পরিহার করা এবং যে তা করে তাকে এ থেকে বিরত রাখা একান্তই কর্তব্য।

আবু মুসা এবং খোরাসানের সুবিজ্ঞ ফিকহবিদরা বলেছেন যে, কবর স্পর্শ করা, চুমু দেয়া খ্রীস্টানদের অভ্যাস। মুসলমানদের জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেননা নির্ভূলভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, কবরের প্রতি কোনোরূপ তা’জীম দেখানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

হাফিজ ইবনে কায়্যিম লিখেছেন, নবী করীম(স)কবর যিয়ারত করতেন, করতেন কবরস্থ লোকদের জন্য দো’আ করার উদ্দেশ্যে, তাদের প্রতি দয়া দেখাবার জন্য ও তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ইস্তিগফার করার উদ্দেশ্যে।

অতঃপর লিখেছেনঃ এরূপ যিয়ারত করাকেই রাসূলে করীম(স) তাঁর উম্মতের জন্য সুন্নাত করে পেশ করেছেন এবং এ-ই তাদের জন্য শরীয়তী পন্থা ও নিয়ম করে দিয়েছেন।

কবরস্থানে উপস্থিত হয়ে মুসলমানরা কি বলবে এবং কি করবে, শরীয়তে তারও নির্দেশ রয়েছে। হাফেজ ইবনে কাইয়্যেম লিখেছেনঃ আরবী(*******)

-মুসলমান যখন কবর যিয়ারত করবে, তখন বলবেঃ আসসালামু আলাইকুম, হে কবরস্থানবাসী মুমিন মুসলমানগণ, আমরাও আল্লাহ চাইলে তোমাদের সাথে মিলিত হবো। এখন তোমাদের জন্য ও আমাদের নিজেদের জন্য আল্লাহর নিকট কল্যাণ ও শান্তি কামনা করছি।

অতঃপর তিনি লিখছেনঃ মুশরিকরা কিন্তু এরূপ করতে অস্বীকার করছে। তারা কবরস্থানে শিরক করে, আল্লাহর সামনে মৃত লোকদের নাম নিয়েই দোহাই দেয়, তাদের অসীলা বানায় ও তাদের নামে কসম করে। মৃত লোকদের নিকট নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য দো’আ করে, সাহায্য প্রার্থনা করে, তার দিকে তাওয়াজ্জুহ করে। আর এসব করে তারা রাসূলের হেদায়াতের বিরুদ্ধতা করে। কেননা রাসূলের হেদায়াত তো হলো তওহীদ এবং মৃত লোকদের প্রতি দয়া প্রদর্শন। আর মুশরিকদের পন্থা হলো শিরক এবং নিজেদের ও মৃত লোকদের প্রতি যাবতীয় অন্যায় চালিয়ে দেয়া।

আজমীর শরীফে খাজা মঈনউদ্দীন চিশতীর কবরে তাঁকে লক্ষ্য করে যে দো’আ করা হয়, তাতে খাজা বাবাকে ঠিক আল্লাহর আসনেই বসানো হয়(নাউজুবিল্লাহ)।

তাতে বলা হয়ঃ আল্লাহকে মাহবুব কি তুরবত কা তামাচ্ছুক শায়মা সোওদা কী আজমাত কা তামাচ্ছুক, আপনে দরওয়াজা সে নেয়ামত বখশে দিজিয়ে। -এই বিশ্বসংসারের পালনকর্তা আল্লাহর তুমি প্রিয় বান্দা। আল্লাহ তোমার কথা শোনেন। তাই আজ সন্ধ্যা বেলায় তোমার দুটি অবোধ সন্তান তোমার দরবারে হাযির হয়েছে। বাবা তুমি এদের বিদ্যা দাও, বুদ্ধি দাও, অর্থ-যশ-খ্যাতি প্রতিপত্তি দাও।

…… তোমার অপার করুণাধারার মতো এদের জীবনে যেন প্রেম নীতি অনন্তকালের জন্য অটুট থাকে। বাবা আমার। খাজা সাহেব আমার অন্ধের যষ্টির মতো তুমিই এদের একমাত্র ভরসা, তুমিই এদের অন্ধকারের আলো, সব বিপদের একমাত্র সহায়।

তুমি দুনিয়ার বাদশাহ, গরীবের একমাত্র পালনকর্তা, তোমার নামে ডুবে যাওয়া মানুষ ভেসে উঠে, অন্ধকার দুঃখের মহাসাগর হাসতে হাসতে পার হয়।

বলা হয়ঃ কোনো ভয় নেই, কোনো চিন্তা নেই, বাবা আপনাদের খুশী করাবেনই। বাবা বড় স্নেহপরায়ণ। যে ছেলেমেয়েরা এখানে ছুটে আসে বাবা তাদের দুঃখ দেখে সহ্য করতে পারেননা।

………..কাল আবার আসবেন। বাবা খুশী হবেন। (নাউজুবিল্লাহ)।

মৃত ব্যক্তির দাফন কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর মৃতের মাগফিরাত চেয়ে দো’আ করা রাসূলে করীমের আমল থেকে জায়েয বলে প্রমাণিত।

হাদীসে বর্ণিত হয়েছেঃ আরবী(********)

-নবী করীম(স) যখন মৃত ব্যক্তির দাফনের কাজ সম্পন্ন করতেন তখন সেখানে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং লোকদের বলতেনঃ তোমরা তোমাদের এই ভাইয়ের জন্য মাগফিরাতের দো’আ করো। কবরে সে যেন দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত ও স্থির হয়ে থাকতে পারে, সে জন্যে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করো। কেননা এখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

মনে রাখতে হবে, এ হলো দাফন কাজ সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর দো’আ করা। এ তো সম্পূর্ণ জায়েয। কিন্তু বর্তমানে সাধারণ প্রচলনে দেখা যায়, এ দিকে জানাযার নামায পড়া হলো, আর অমনি কিছু একটা পড়ে দো’আ করার জন্য হাত তোলা হলো। অথচ ইসলামী শরীয়তে এ কাজ মাকরূহ! তৃতীয় শতকের ফকীহ ইমাম আবু বকর ইবনে হামীদ(রহ)বলেনঃ জানাযা নামাযের পরই আলাদা করে দো’আ করা মাকরূহ(তাহরীম)।

শামসুল আয়েম্মা হাওয়ানী ও শায়খুল ইসলাম আল্লামা মগদী বলেনঃ জানাযা নামাযের পরে দো’আর জন্য কেউই দাঁড়াবেনা।

এমনিভাবে ফতোয়ার সিরাজিয়া(১ম খন্ড,১৪পৃ.), জামউর রমুজ(১ম খন্ড,১৭৪পৃ.),বহরুর রায়েক (২য় খন্ড, ১৮৩ পৃ.) প্রভৃতি গ্রন্থে এ কথা লিখিত রয়েছে।

মুল্লা আলী আল কারী বলেনঃ জানাযা নামায পড়া হয়ে যাওয়ার পরই মৃতের জন্য দো’আ করবেনা। কেননা এতে মূল জানাযা নামাযের ওপর অতিরিক্ত কিছু করার মতো হয়।

তাহলে প্রমাণিত হলো যে, যিয়ারতের জন্য গিয়ে কবরস্থ লোকদের কল্যাণের জন্য দো’আ করা ছাড়া মুমিন মুসলমান যিয়ারতকারীর আর কিছু করার নেই, নেই অন্য কোনো কাজ করার মতো, নেই কোনো কথা বলবার মতো। এ দৃষ্টিতে স্পষ্ট বোঝা যায়, কবরস্থানে গিয়ে মুসলমানরা বর্তমানে যা কিছু করছে, তা শুধু বিদয়াতই নয়, শিরকও। অনুরূপভাবে “আল্লাহ তা’আলা সর্বশক্তির উৎস” এই ইয়াকীন ও বিশ্বাস অন্তরে বজায় রেখে কোনো মাখলুকের নিকট বা জীবিত অবস্থায় বা মৃত্যুর পর- কোনো কিছুরই অলৌকিক ধরনের কাজের সাহায্য চাওয়াও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ শিরক এবং মুসলিম সমাজে তার প্রচলন তওহীদী আকীদার বিরুদ্ধে শিরকের বিদয়াত।

কুরআন তিলাওয়াত তো কুরআন হাদীস উভয়ের ভিত্তিতেই অত্যন্ত সওয়াবের কাজ বলে প্রমাণিত। কবরের নিকট বসে কুরআন তিলাওয়াতেও বাহ্যত কোনো দোষ দেখা যায়না। কিন্তু এ পর্যায়ে ফিকাহ এর কিতাবে বলা হয়েছেঃ কবরের নিকট কুরআন পাঠ করার ব্যাপারে ফিকহবিদদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। ইমাম শাফেয়ী ও মুহাম্মদ ইবনে হাসান বলেছেন, তা পড়া মুস্তাহাব। এতে মৃত ব্যক্তি কুরআনের সোহবতের বরকত পেতে পারে। কাযী ইয়াজ ও মালিকী মাযহাবের ক্বিরানী উভয়ই তাঁদের সাথে একমত। কিন্তু ইমাম মালিক ও ইমাম আবু হানীফা(রহ) এ কাজকে মাকরূহ মনে করছেন। কেননা এ কাজের সমর্থনে সুন্নাতের কোনো দলীল পাওয়া যায়নি।

মৃত লোকদের নিকট সাহায্য চাওয়া বিদয়াত
যারা মরে গেছে-তাঁরা অলী-ই হোন, আর নবী-ই হউন তাদের নিকট জীবিত লোকদের কোনোরূপ সাহায্য প্রার্থনা করা- বিদয়াতীদের ভাষায় যাদের বলা হয় ইস্তেমদাদে রূহানী-সুস্পষ্ট বিদয়াত।

প্রকৃতপক্ষে সাহায্য বা ক্ষতি কোনো কিছু করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই নেই। এজন্যই কুরআন মজীদে আল্লাহ তা‘আলা কেবল তাঁরই নিকট সাহায্য চাওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন নানাভাবে। সূরায়ে ফাতিহা যা মূলত একটি দোয়ারই সূরা, তাতে বন্দেগী যেমন একমাত্র আল্লাহরই করার কখা বলা হয়েছে, তেমনি সাহায্যও একমাত্র আল্লাহরই কাছে চাইতে শেখান হয়েছে। বলা হয়েছেঃ আরবী(*********)

-হে আল্লাহ! আমরা কেবল তোমারই বন্দেগী করি, কেবল তোমারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি।

এ আয়াত যেমন বন্দেগী, দাসত্ব ও আইন পালনকে কেবলমাত্র আল্লাহর সাথে খাস করে দেয়ার নির্দেশ দেয়, তেমনি যাবতীয় বিষয়ে ও ব্যাপারে সব রকমের সাহায্য প্রার্থনাও কেবল আল্লাহরই নিকট করা যেতে পারে কিংবা করা উচিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ইমাম রাযীর ভাষায়- হে আল্লাহ, আর কারো নিকটই আমি কোনো প্রকারের সাহায্য চাইনা। কেননা তুমি ছাড়া আর যার কাছেই সাহায্য চাইব, তার পক্ষে আমার কোনোরূপ সাহায্য করা আদৌ সম্ভব নয়-তোমার সাহায্য ছাড়া। তাহলে তোমার সাহায্য ছাড়া অপর কারো পক্ষেই আমার কোনোরূপ সাহায্য করা যখন আদৌ সম্ভব নয়, তখন আমি তোমাকে ছাড়া অপর কারো নিকট সাহায্যই চাইবোই বা কেন? মাঝখানের এই মধ্যস্থতা মেনে নেয়ার এবং তোমাকে বাদ দিয়ে তার নিকট ধর্ণা দেয়ার কিই বা দরকার থাকতে পারে?

তাছাড়া নবী করীম(স) এর বাণী এ পর্যায়ে আমাদের যে পথ নির্দেশ করে তাওতো এই যে, সাহায্য কেবল আল্লাহরই নিকট চাইতে হবে। অন্য কারো নিকট নয়। নবী করীম(স) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রা) কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-

তুমি যদি কোনো প্রার্থনা করতে চাও তো, আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করো। আর যদি তুমি কোনো সাহায্যই চাও, তাহলে সাহায্য চাইবে আল্লাহর নিকট।

আর আসল ব্যাপারই যখন এই, তখন যাবতীয় ব্যাপারে কেবল আল্লাহরই নিকট সাহায্য চাওয়া কর্তব্য। অপর কারো নিকট সাহায্য চাওয়াতো চরম বোকামী; চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতা, নীচতা ও হীনতা।

বিশেষ করে মরে যাওয়া লোকদের নিকট সাহায্য চাওয়াতো আরো বেশি মারাত্মক। দুনিয়ায় জীবিত থাকা অবস্থায় বৈষয়িক বিষয়ে সাহায্য চাওয়ার তো একটা মূল্য আছে। আছে বৈষয়িক তাৎপর্য্, তা নিষিদ্ধও নয়; কিন্তু মরে যাওয়া লোকদের নিকট সাহায্য চাওয়ার কি অর্থ হতে পারে। কবরস্থ লোকেরা কি দুনিয়ার লোকদের ফরিয়াদ শুনতে পায়, শুনতে পেলেও তাদের কিছু করার ক্ষমতা আছে কি? তারা যে শুনতে পায়না, তাতো কুরআনের ঘোষণা থেকেই প্রমাণিত। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে বলেছেনঃ আরবী(******)

-তুমি মরে যাওয়া লোকদের কোনো কথা শোনাতে পারবেনা।

অন্যত্র বলেছেনঃ আরবী(********)

-নিশ্চয়ই তুমি হে নবী! মরে যাওয়া লোকদের কোনো কথা শোনাতে পারবেনা।

মরে যাওয়া লোকদের সম্পর্কে যদি এই ধারণা হয় যে, তারা মরে যাওয়ার পর এতদূর ক্ষমতাশালী থাকে যে, সেখানেও তারা যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে; আর এসব কিছুই করতে পারে অলৌকিকভাবে; তাহলে এতে তাকে আল্লাহর সমতুল্য-আল্লাহর সমান-ক্ষমতাশালী হওয়ার ধারণা করার শামিল। আর এ ধারণা যে শিরক তাতে আর কোনো সন্দেহ থাকতে পারেনা।

ইমাম বগভী লিখেছেনঃ সাহায্য প্রার্থনাতো এক প্রকারের ইবাদত। ইবাদত বলা হয় বিনয় ও হীনতা জ্ঞান সহকারে করাকে। আর বান্দাকে বান্দা বলাই হয় আল্লাহর মুকাবিলায় তার এই বিনয়, বাধ্যতা ও হীনতার কারণে।

-যে লোক নবী রাসূল ও নেককার লোকদের কবর যিয়ারত করতে গিয়ে তাদের কবরে গিয়ে নামায পড়বে এবং সেখানে বসে দো’আ করবে, কবরস্থ লোকদের কাছে নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রার্থনা করবে-মুসলিম আলিমদের মধ্যে কারো মতেই এ কাজ আদৌ জায়েয নয়। কেননা ইবাদত, প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রার্থনা এবং সাহায্য চাওয়া এসব এক আল্লাহরই হক (কেবল তাঁরই নিকট চাওয়া যেতে পারে, অন্য কারো নিকট নয়)।

নবী করীম(স)এর এ পর্যায়েরই এক দীর্ঘ হাদীসের শেষাংশে বলা হয়েছেঃ আরবী(*******)

-জেনে রাখো, সমস্ত মানুষও যদি একত্রিত হয়ে তোমার কোনো উপকার করতে চায়, তবে তারা তা করতে পারবেনা ততটুকু ছাড়া, যা আল্লাহ নির্দিষ্ট করে তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। অনুরূপভাবে সমস্ত মানুষও যদি তোমার একবিন্দু ক্ষতি করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়, তবুও তারা কিছুই করতে পারবেনা কেবল ততটুকুই ছাড়া, যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। বস্তুত কলমতো তুলে নেয়া হয়েছে, কাগজের কালিও শুকিয়ে গেছে।

অর্থাৎ আল্লাহর বিধান মতো যা হওয়ার তা হবেই এবং শুধু তা-ই হবে, অন্য কিছু হবেনা, হতে পারেনা। কারো তেমন কিছু করার একবিন্দু ক্ষমতা নেই। কাজেই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট-সে মৃত নবী রাসূল আর অলী পীর গাওস কুতুব-ই হোকনা কেন- কোনো কিছু চাওয়ার কোনো অর্থই হতে পারেনা। বরং তা হবে সুস্পষ্ট শিরক-শিরক এর বিদয়াত।

মক্কা শরীফের মুফতী আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ মীর গনী আল হানাফীর নিকট নিম্নোক্ত বিষয়ে ফতোয়া চাওয়া হয়ঃ

মরে যাওয়া লোকদের নিকট মান সম্মান লাভ, রিযিকের প্রাচূর্য্ ও সন্তান লাভেল জন্য জীবিত লোকদের সাহায্য চাওয়া সম্পর্কে আলিম সমাজের কি বক্তব্য? কবরস্থানে গিয়ে এ কথা বলাঃ ‘হে কবরস্থ লোকেরা, তোমরা আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট দো’আ করো; আমাদের গরিবী দূর করার, রিযিকের প্রাচূর্য্, বেশি সন্তান হওয়া, আমাদের রোগীদের নিরাময়তা এবং উভয় জগতে আমাদের কল্যাণ হওয়ার জন্য। কেননা তোমরা ‘সলফে সালেহীন’, তোমাদের দো’আ আল্লাহর নিকট কবুল হয়।” মৃত ব্যক্তিদের নিকট এরূপভাবে সাহায্য চাওয়া কি জায়েয? কুরআন, সুন্নাহ ও মুজতাহিদদের মতের ভিত্তিতে এর জবাব দিন।

জবাবে মুফতি সাহেব যে ফতোয়া দেন, তার সারকথা হলোঃ নবী অলীদের নিকট ফরিয়াদ করা যায়; কিন্তু প্রশ্নের উল্লেখিত বিষয় ও স্থানে তা করা শরীয়তে বিধিবদ্ধ নয়। এই ফতোয়ায় তদানীন্তন বহু সংখ্যক আলেম সম্মতিসূচক স্বাক্ষর দেন।

মাওলানা রশীদ আহমদ গংগুহী(রহ) অপর এক প্রশ্নের জওয়াবে লিখেছেনঃ শায়খ আবদুল কাদের জিলানী(রহ) গায়েব জানেন এবং স্বতন্ত্র ও স্বশক্তিতে দুনিয়ার ওপর তাশাররূফ(ক্ষমতা প্রয়োগ)করতে পারেন বলে বিশ্বাস করলে সুস্পষ্ট শিরক হবে। এ পর্যায়ে তিনি প্রথমত উল্লেখ করেছেন কুরআনের আয়াত। আরবী(******)

-গায়েব জগতের চাবিসমূহ আল্লাহরই হাতে নিবদ্ধ, তা তিনি ছাড়া আর কেউ জানেননা।

পরে বাজ্জাজীয়া প্রভৃতি ফতোয়ার কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেনঃ

মাশায়িখ-তথা পীর বুযুর্গদের রূহ হাযির হয় এবং তারা সব কিছু জানে বলে যে বিশ্বাস করবে সে কাফির হয়ে যাবে।

উক্ত কিতাবে এ কথাও লিখিত হয়েছে-যে ব্যক্তি মনে করে মৃত ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া নিজেই যাবতীয় বিষয়ে ও ব্যাপারে কর্তৃত্ব চালায়, আর এরূপ আকীদা ও বিশ্বাস যার হবে, সে কাফির হয়ে যাবে। (বাহরুর রায়েখ গ্রন্থেও এমন উল্লেখ রয়েছে, মিয়াত মাসায়েল গ্রন্থ)।

মওলানা শাহ মুহাম্মদ ইসহাকের ছাত্র মওলানা নওয়াব কুতুবুদ্দীন খান কবরস্থ লোকদের নিকট সাহায্য চাওয়া জায়েয কিনা এমন এরূপ এক প্রশ্নের জবাবে লিখেছেনঃ

-কবরস্থ লোকদের নিকট সাহায্য চাওয়া, তা যে প্রকারেরই হোকনা কেন জায়েয নয়। শায়খ আবদুল হক মিশকাতের আরবী শরাহ এ লিখেছেনঃ নবী ও আম্বিায়া ছাড়া কবরস্থ অন্য লোকদের নিকট কোনোরূপ সাহায্য চাওয়া-ইস্তেমদাদে রূহানী করা-বহুসংখ্যক ফকীহ নাজায়েয বলেছেন। তাতা বলেছেনঃ মৃতদের জন্য দো’আ করা, তাদের জন্যে আল্লাহর নিকট মাগফেরাত চাওয়া, দো’আ ও কুরআন তিলাওয়াত করে তাদের কোনোরূপ ফায়দা পৌছানো ছাড়া কবর যিয়ারতে আর কোনো কিছুই করণীয় নেই।

এ পর্যায়ে একটি ধোঁকা হচ্ছে এই যে, আল্লাহর নামে আল্লাহর ওয়াস্তে কোনো অলীর রূহের নিকট কিছু প্রার্থনা করাকে জায়েয মনে করা হচ্ছে এবং এতে কোনো দোষ আছে বলে মনে করা হচ্ছেনা। মনে করা হচ্ছে যে, তাকে শুধু অসীলা হিসেবেই গ্রহণ করা হচ্ছে আর এরূপ অসীলা গ্রহণে কোনো দোষ নেই।

কিন্তু এ বাস্তবিকই একটি ধোঁকা যার ফলে অনেক নিষ্ঠাবান তওহীদবাদী মুসলমানও অজ্ঞাতসারে পরিষ্কার শিরক এর মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কোনো কিছু প্রার্থনা করার সময় আল্লাহ ছাড়া আর কারো নাম করা হলে হয় তার অর্থ এই হবে যে, আসলে চাওয়া হচ্ছে অন্য ব্যক্তির নিকট- আল্লাহর নিকট চাইলে আল্লাহ তা দিবেন কিনা কিংবা শুধু আল্লাহর তা দেয়ার ক্ষমতা আছে কিনা। আর এ দু’টো দিক দিয়েই ব্যাপারটি পুরো শিরক এর মধ্যে গণ্য হয়ে যায়।

শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী এ পর্যায়ে লিখেছেনঃ

-শিরক হওয়ার ধারণা হয় যে সব ক্ষেত্রে, তার মধ্যে এ ও একটি যে, লোকেরা আল্লাহ ছাড়া অপরের নিকট রোগীর রোগ সারা ও গরীবকে ধন দেয়া প্রভৃতি প্রয়োজন পূরণের জন্য দো’আ করে, তাদের জন্য মানত মানে, এসব মানত হতে নিজেদের কামনা পূরণ হওয়ার আশা পোষণ করে তাদের নামে তিলাওয়াত করে বরকত লাভের আশায়। এ জন্যে আল্লাহ লোকদের ওপর ওয়াযিব করে দিয়েছেন যে, তারা নামাযে বলবেঃ “হে আল্লাহ! আমরা কেবল তোমারই বন্দেগী করি, কেবল তোমারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি।” আল্লাহ আরো বলেছেনঃ আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেই ডাকবেনা। এ ডাকা নিষিদ্ধ হওয়ার অর্থ শুধু ইবাদত করা থেকে নিষিদ্ধ নয়-যা কোনো কোনো তাফসীরকারক মনে করেন। বরং এর অর্থ হচ্ছে অন্য কারো নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা নিষেধ।

কেননা আল্লাহ অপর আয়াতে বলেছেনঃ “কেবল আল্লাহকেই ডাকবে। ফলে তোমরা যা চাও, তিনি তা তোমাদের জন্য খুলে দিবেন।”

মিথ্যা প্রচারের বাতুলতা
কবর পূজা ও রূহানী ইস্তিমদাদে বিশ্বাসী লোকেরা তাদের মতের সমর্থনে একটি কথাকে দলীল হিসেবে পেশ করে। কথাটি এইঃ আরবী(******)

-তোমরা যখন দুনিয়ার কাজ কর্মে খুব কাতর ও দিশেহারা হয়ে পড়বে, তখন তোমরা কবরবাসীদের নিকট সাহায্য চাইবে।

এ কথাটিকে তারা হাদীস হিসেবে চালিয়ে দেয়। আসলে এটা হাদীস নয়, এটাকে হাদীস বলা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। বিশেষজ্ঞগণ এ কথাটি সম্পর্কে লিখেছেনঃ বিশেষজ্ঞগণ সম্পূর্ণ একমত হয়ে বলেছেন যে, এ কথাটি সম্পূর্ণ মনগড়া, মিথ্যা।

আর শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী এ কথাটি সম্পর্কে লিখেছেনঃ হাদীস বলে চালানো এ কথাটি মুজাবির(পেশকার খাদেমদের)নিজেদের মনগড়া কথা। তারা নযর-নিয়াজ লাভের উদ্দেশ্যে নিজেদের এ কথাটি মিথ্যামিথ্যি নবী করীমের নামে চালিয়ে দিয়েছে।

আসলে এ কথাটি কোনো হাদীসই নয়। মুহাদ্দিস এবং মূহাক্কিক সূফীগণও একে মনগড়া ও রচিত কথা বলে ঘোষণা করেছেন। বস্তুত আকীদার ব্যাপারে এ রকম বানানো কথাকে দলীল হিসেবে পেশ করার কারণ হলো চরম অজ্ঞতা ও মূর্খতা।

সূরা আল বাকারার আয়াতঃ فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَندَادًا وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ

এর তাফসীরে শাহ আবদুল আযীয(রহ) বিভিন্ন রকম ও প্রকারের ‘প্রতিদ্বন্ধীর’ উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে চতূর্থ রকম হলো কবর পূজারীদের বানানো প্রতিদ্বন্ধী। তাদের সম্পর্কে এখানে লিখেছেনঃ পীর পুজারী লোকেরা বলেঃ বুযুর্গ লোকেরা খুব বেশি বেশি রিয়াজত ও সাধনা মুজাহিদা করে বলে তাদের দো’আ ও সুপারিশ আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয় বিধায় এ দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর তাদের রূহে অসীম শক্তি ও বিশালতার সৃষ্টি হয়। তাদের শেকেল-সুরতকে যদি বরজাখ বানান্ হয় কিংবা তার বৈঠকখানায় ও কবরস্থানে আজিজী ইনকেসারীর সাথে সেজদা করা হয়, তাহলে তাদের রূহ জ্ঞানের বিশালতার কারণে তা জানতে পারে এবং দুনিয়া আখিরাতে সিজদাকারীর কল্যাণের জন্য তারা সুপারিশ করে। (নাউজুবিল্লাহ)।

এ থেকে বোঝা গেল, এ ধরনের ইস্তিমদাদ ও কবরপূজাকে শাহ আবদুল আজীজ(রহ) সুস্পষ্টরূপে আল্লাহর প্রতিদ্বন্ধী গ্রহণ করা মনে করেন। আর এ গ্রহণ করাই হলো শিরক-যা কুরআনে সুস্পষ্ট নিষিদ্ধ।

আল্লাহ ও বান্দার মাঝে এ ধরনের অসীলা ধরা ও সুপারিশ হাসিল করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে যদি কেউ মনে করেন, তবে সে আল্লাহর সম্পর্কে বদনামী করেছে। আল্লামা ইবনে কাইয়্যেম লিখেছেনঃ যে মনে করবে যে, আল্লাহর সন্তান আছে কিংবা তাঁর কোনো শরীক আছে বা তাঁর অনুমতি ছাড়াই কেউ তাঁর নিকট শাফায়াত করতে পারে অথবা সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে এমন কোনো মাধ্যম রয়েছে, যা সৃষ্টির প্রয়োজনের কথা আল্লাহর নিকট পেশ করে কিংবা আল্লাহ ছাড়া এমন কতক অলী-আল্লাহও রয়েছে, যারা আল্লাহ ও সেই লোকদের মাঝে অসীলা ও নৈকট্যের কাজ করবে এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্যে তাদের নিকট তারা দো’আ করে, তাদের ভয় করে চলে, আর তাদের কাছ থেকে অনেক কিছুর আশা করে- এই যার আকীদা হবে, সে তো আল্লাহ সম্পর্কে অত্যন্ত জঘন্য ও খারাপ ধারণা পোষণ করলো।

কাজী সানাউল্লাহ পানিপত্তী(র) হানাফী মাযহাবের বড় আলিম এবং তাসাউফপন্থী মনীষী ছিলেন। কুরআন-হাদীসে গভীর পান্ডিত্য থাকার কারণে তিনি সর্বমহলেই সম্মানার্হ ও শ্রদ্ধেয় ছিলেন। তিনি কুরআনের আয়াতঃ إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ عِبَادٌ أَمْثَالُكُمْ ۖ

-তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে আর যাদের ডাকো, তারা তো তোমাদের মতোই দাসানুদাস মাত্র।

এ সম্পর্কে লিখেছেন-এ আয়াত বিশেষভাবে কেবলমাত্র মূর্তি পূজারীদের জন্য নয়, বরং

مِن دُونِ اللَّهِ আল্লাহ ছাড়া সাধারণভাবে আর যে কেউ-ই হোকনা কেন, সে-ই এর মধ্যে শামিল এবং তাকে ডাকলেই সুস্পষ্ট শিরক হবে। কেননা ওদের যে ডাকা হচ্ছে, মানুষের কোনো একটি প্রয়োজন পূরণ করার ওদের কি ক্ষমতা আছে? কেউ যদি বলে যে, এ আয়াত কাফিরদের জন্য প্রযোজ্য, কেননা তারাই মূর্তিগুলোকে স্মরণ করে থাকে, তা হলে বলবো

دُونِ اللَّهِ শব্দটি সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত কোনো বিশেষ জিনিস যে বোঝায়না, তা-ই একথা স্বীকৃতব্য নয়।

বস্তুত কুরআন ও হাদীস থেকে মুশরিকী আকীদা ও আমলের অনুকূলে দলীল পেশ করা বড়ই আশ্চর্যের বিষয়। আরও আশ্চর্যের বিষয় যে সব মনীষী আজীবন শিরক বিদয়াতের বিরুদ্ধে কলম চালিয়েছেন, বাস্তবভাবে অভিযান চালিয়েছে, তাঁদেরই কোনো কোনো কথা পূর্বাপর সম্পর্ক ছিন্ন করে শিরক বিদয়াতের সমর্থনে চালিয়ে দিতে চেষ্টা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তাঁদের এই ধোঁকাবাজি অভিজ্ঞ মহলে ধরা পড়ে যেতে পারে- এতটুকু ভয়ও এই বিদয়াতপন্থী ও বিদয়াত প্রচারকদের মনে জাগেনা। মনে হয়, বিদয়াত ছাড়া তাদের মন মগজে আর কিছু নেই। বিদয়াতেই তাদের রুচি, বিদয়াতই তাদের পেশা যেমন এক শ্রেণীর পোকার রুচি কেবল ময়লা ও আবর্জনায়! আল্লাহ এদের হেদায়াত করুন।

কুরআনের আয়াত দিয়ে ধোঁকাবাজি
আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সাহায্য চাওয়া জায়েয নয়; বরং তা শিরক। পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে তা কুরআন হাদীস ও ফিকাহর অকাট্য দলীলের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এই আলোচনার শেষ ভাগে পীর পোরস্ত আলিমদের তিনটি দলীল সম্পর্কে সংক্ষেপে দুটি কথা না বললে ভুল অপনোদন এবং বাতিলের প্রতিবাদ সম্পূর্ণ হবেনা।

উক্ত আলিম সাহেবদের আল্লাহ ছাড়া অন্য শক্তির নিকট-জীবিত বা মৃত অলী-আল্লাহর নিকট ইস্তেমদাদ ও সাহায্য চাওয়া জায়েয। আর তা প্রমাণের জন্য তারা কুরআন মজীদ থেকে তিনটি আয়াত পেশ করে থাকেন। প্রথম আয়াত হলো সূরা ছফ এর।

مَنْ أَنصَارِي إِلَى اللَّهِ ۖ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ نَحْنُ أَنصَارُ اللَّهِ ۖ

-হযরত ঈসা (আ) বললেনঃ আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে আমার সহায়ক কে হবে? শিষ্যগণ বললো-আমরাই আল্লাহর কাজে আপনার সহায়ক। (আছ ছফঃ১৪)

আর দ্বিতীয় আয়াতটি হলো সূরা আল কাহাফ এর।

قَالَ مَا مَكَّنِّي فِيهِ رَبِّي خَيْرٌ فَأَعِينُونِي بِقُوَّةٍ أَجْعَلْ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ رَدْمًا [١٨:٩٥]

-তোমাদের আর্থিক সাহায্য দেয়ার জরুরত নেই, কেননা আমার প্রভু আমাকে যে ধন সম্পদ দান করেছেন তা-ই যথেষ্ট; তবে তোমরা আমাকে দৈহিক সাহায্য করতে পার। তাহলে আমি তোমাদের ও তাদের মাঝে এক দৃঢ় প্রাচীর নির্মাণ করে দেবো।(আল কাহাফঃ৯৫)

আর তৃতীয় আয়াত হলো সূরা ইউসুফ এর। আয়াতটি এইঃ

اذْكُرْنِي عِندَ رَبِّكَ فَأَنسَاهُ الشَّيْطَانُ ذِكْرَ رَبِّهِ فَلَبِثَ فِي السِّجْنِ بِضْعَ سِنِينَ [١٢:٤٢]

–তোমার প্রভুর(আজিজ মিসর) নিকট আমার কথা উল্লেখ করবে। কিন্তু শয়তান তাকে তার প্রভুর নিকট তার কথার উল্লেখ করতে ভুলিয়ে দিলো। ফলে ইউসুফ(আ)আরও কয়েক বৎসর কারাগারেই রইলো।

এই তিনটি আয়াত পেশ করে পীর-পোরস্ত আলিম নামধারী লোকেরা বলতে চান যে, যেভাবে হযরত ঈসা(আ)হাওয়ারী লোকদের নিকট সাহায্য চেয়েছিলেন, যেভাবে জুলকারনাইন জনগণের কাছে বলেছিলেন বাঁধ বাধার ব্যাপারে তোমরা শক্তি দিয়ে আমাকে সাহায্য করো এবং যেভাবে হযরত ইউসুফ(আ) কারাগার থেকে মুক্তিলাভের জন্য মুক্তিপ্রাপ্ত সাথীকে বাদশাহর নিকট সুপারিশ করতে বলেছিলেন, অনুরূপভাবে কোনো বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে কিংবা বৈষয়িক মুক্তি লাভের আশায় যে কোনো জীবিত বা মৃত অলী আল্লাহর নিকট দো’আ প্রার্থনা করা যায় তা সম্পূর্ণ জায়েয। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে কথাটি প্রমাণ করার জন্য কুরআন মজীদের উক্ত তিনটি আয়াত পেশ করা হয়, তা এর কোনো একটি আয়াত থেকেও প্রমাণিত হয়না। প্রত্যেকটি আয়াতকে ভিত্তি করে বিচার বিবেচনা করলেই আমার এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হবে। মনে রাখা আবশ্যক যে, আলোচনা হচ্ছে ‘ইস্তেমদাদে রূহানী’ ‘আধ্যাত্মিক উপায়ে সাহায্য পাওয়ার জন্য কারো নিকট দো’আ করা’ সম্পর্কে। আহলে সুন্নাত আল জামা’আতের আকীদা হলো এই যে, এ ধরনের সাহায্য প্রার্থনা একমাত্র আল্লাহরই নিকট করা যেতে পারে। কেননা এ ধরনের সাহায্য দানের ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই-থাকতে পারেনা। আর আল্লাহ তা’আলার সুস্পষ্ট নির্দেশ এই যে, এ ধরনের অবস্থায় কেবল আল্লাহর নিকট সাহায্য চাইতে হবে। তওহীদী আকীদাও তাই। অন্য কারো নিকট সাহায্য চাইলে তা আকীদার দিক দিয়ে হবে শিরক এবং তওহীদী আকীদায় তাই হবে বিদয়াত। এ প্রেক্ষিতে আয়াত তিনটি যাচাই করলে দেখা যাবে যে, এর কোনোটিতেই এ পর্যায়ের সাহায্য চাওয়ার কথা নেই। সূরা ছফ এর প্রথমোক্ত আয়াতে হযরত ঈসা(আ) এর যে সাহায্য চাওয়ার কথা বলা হয়েছে ‘আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে আমার সহায়ক কে হবে?’ এ কথা বলে, সে সাহায্য তো কোনো ব্যক্তির বিপদে পড়ে চাওয়া সাহায্য নয়। হযরত ঈসা(আ) কোনো বিপদে পড়ে হাওয়াকারীদের সাহায্য চাননি। সাহায্য চাননি নিজের কোনো কাজের ব্যাপারে। কোনো আধ্যাত্মিক উপায়ে সাহায্য করার জন্যে ফরিয়াদ করা হয়নি এখানে। কুরআনের আয়াত مَنْ أَنصَارِي إِلَى اللَّهِ‘আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কে আমার সহায়ক হবে’ কথাটিই প্রমাণ করে সে সাহায্য চাওয়ার মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর দ্বীন প্রচার ও কায়েম করার ব্যাপারে কাজ করার জন্য এগিয়ে আসতে তাদের আহবান জানানো হয়েছে মাত্র। কেননা দ্বীন কায়েমের জন্য চেষ্টা করা কেবলমাত্র ঈসা(আ) এরই দায়িত্ব ছিলনা, অন্য সব মুসলমানেরও দায়িত্ব ছিল। আয়াতটির সূচনাইতো হয়েছে আল্লাহর সাহায্যকারী হওয়ার নির্দেশ দিয়ে।

বলা হয়েছেঃ হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হও।

এখন বাস্তবভাবে আল্লাহর সাহায্য কাজে আহবান করাতো নবীরই দায়িত্ব। হযরত ঈসা(আ) তো সে দায়িত্বই পালন করেছেন এই সাহায্য চেয়ে। এ কারণেই আল্লামা আলূসী সহ সব মু’তাবার তাফসীরেই এই আয়াতের তাফসীর করা হয়েছে এভাবেঃ

অর্থাৎ আল্লাহর সাহায্যের উদ্দেশ্য নিয়ে কে আমার সৈন্য হতে রাজি আছে? এতো কোনো আধ্যাত্মিক উপায়ে সাহায্য করতে বলার কথা নয়। এ তো হচ্ছে নবীর নব্যুয়তী দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে সাহায্য করার আহবান। এ কাজ নবীর নিজের কোনো কাজ নয়। এ হচ্ছে সোজাসুজি ও সরাসরি আল্লাহর সাহায্যের কাজ। এর বড় প্রমাণ রয়েছে খোদ কুরআনের এ সূরাতেই উল্লিখিত তাদের জবাবে।তারা অগ্রসর হয়ে এসেছে ঈসা(আ) এর সাহায্যে নয়, আল্লাহর সাহায্য করার কাজে। তাই তারা বলেছেন- نَحْنُ أَنصَارُ اللَّهِ–আমরাই আল্লাহর সাহায্যকারী।আল্লামা আলুসী এখানেই লিখেছেনঃ আমার সাহায্য বলার মানে দুই শরীকের কাজকে একজনের পক্ষে অপরজনের কাজ বলা। আর যখন, এরা দুপক্ষই সমানভাবে আল্লাহর সাহায্য কাজে শরীক হয়েছে, তখন উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হলো এবং এ কথা বলাকে সহীহ সাব্যস্ত করে দিলো।

অতএব স্পষ্ট হয়ে গেল যে, হযরত ঈসা(আ) কোনো অলৌকিক কাজ করার ব্যাপারে কোনো মৃত ব্যক্তির নিকট সাহায্য চাননি। তাঁর কথার সার হলোঃ বাঁধ বাঁধতে হবে, টাকা পয়সা আমার আছে। তোমরা বাস্তবভাবে সাহায্য করে আমার এ কাজে সাহায্য করো। এ হচ্ছে বৈষয়িক কাজে নিতান্ত বাস্তবভাবে কাজের সহযোগিতা করতে বলা। আর এ জগততো বাস্তব কার্য্কারণের জগত। এ জগতে এ ধরনের পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতা চাওয়া বা পাওয়া কিছুতেই কোনো আধ্যাত্মিক সাহায্যের ব্যাপার নয়।এ হলো মানুষের সামাজিক জীবনের জন্য অপরিহার্য্ ব্যাপার, যা সম্পূর্ণ জায়েয। তাই ইমাম ইবনে কাসীর এ আয়াতের তাফসীরে লিখেছেনঃ

-“অর্থাৎ আল্লাহ আমাকে রাজত্ব ও আধিপত্য যা দিয়েছেন, তা তোমাদের জন্য সব কিছুই থেকে উত্তম। কিন্তু তোমরা আমাকে শক্তি দিয়ে সাহায্য করো অর্থাৎ কাজ করে ও নির্মাণ কাজের জিনিসপত্র দিয়ে।”

আর তৃতীয় আয়াতটিও একটি বৈষয়িক তদবীর সংক্রান্ত ব্যাপার। হযরত ইউসুফ(আ) দীর্ঘদিন বিনাবিচারে আটক হয়ে পড়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, বাদশাহ হয়তো তাঁর কথা ভুলেই গেছে। অতএব তিনি সহবন্দীর রেহাই পেয়ে জেল থেকে চলে যাওয়ার সময় বলে দিলেন যে, আমার কথা তোমার প্রভুর নিকট বলবে। এও যদি কোনো আধ্যাত্মিক সাহায্য চাওয়ার পর্যায়ের কাজ হয়ে থাকে তা হলে তো বলতে হবে যে, নবীও অ-নবীর নিকট অলৌকিক উপায়ে সাহায্য চাইতে পারেন। কিন্তু তা যে একজন নবীর পক্ষে কতখানি অপমানকর তা বলাই বাহুল্য।(এই পর্যায়ে ইমাম ইবনে কাসীর একটি হাদীস উদ্ধৃতি করেছিলেন। হাদীসটি এইঃ নবী করীম(স) বলেছেনঃ হযরত ইউসুফ(আ) এই যে কথাটি বলেছিলেন, অর্থাৎ তিনি যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট মুক্তি কামনা করেছিলেন, তা না করলে তিনি যতদিন জেলে ছিলেন ততদিন থাকতেননা। পরে ইবনে কাসীর লিখেছেন- এ হাদীসটি সাংঘাতিকভাবে যয়ীফ, অগ্রহণযোগ্য।) সবচেয়ে বড় কথা, একজন নবী অলৌকিক বা আধ্যাত্মিক উপায়ে(?) সাহায্য চাইলেন, আর শয়তান তা ভুলিয়ে দিলো, তার মুক্তির প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিলো! এরূপ কথা পীর-পোরস্তারাই বিশ্বাস করতে পারে, কোনো তওহীদবাদী আহলে সুন্নাত ব্যক্তি এরূপ বিশ্বাসকে মনের দূরতম কোণেও স্থান দিতে প্রস্তুত হতে পারেনা।

মোটকথা, এ কয়টি আয়াত দিয়ে পীর-পোরস্তরা যা প্রমাণ করতে চাইছে তা আদৌ প্রমাণিত হয়না। হয় শুধু ধোঁকাবাজি করা।

এই পর্যায়ে কুরআনের নিম্নোদ্ধৃত আয়াতটি আমাদের অবশ্যই সবসময় স্মরণে রাখতে হবে।

আরবী(********)

-আল্লাহ ছাড়া আর যারা যারা আছে তারা তো তোমাদের কোনো উপকারও করতে পারেনা, ক্ষতিও না-তাই তাকে আদৌ ডাকবেনা। যদি ডাকো তাহলে তুমি জালিমদের মধ্যে গণ্য হয়ে যাবে।

মানুষ কাউকে ডাকে তাঁর কাছ হতে উপকার পাওয়ার আশায় অথবা কোনো ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য। আর উপকার ও ক্ষতি যে করতে পারেনা তাকে ডেকে কি লাভ হবে। তা করার নিরংকুশ ক্ষমতা তো একমাত্র আল্লাহর, অতএব ডাকতে হবে সর্বাবস্থায়, সব কিছুর জন্য একমাত্র তাঁকেই। পানাহ বা আশ্রয় চাওয়া কেবল তাঁরই নিকট সম্ভব। কেননা পানাহ বা আশ্রয় দেয়ার একবিন্দু ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই নেই। তাই আল্লাহ নিজেই নির্দেশ দিয়েছেন-পানাহ বা আশ্রয় চাও কেবল সেই এক আল্লাহর নিকট।

কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বিদেশ সফর
কবর যিয়ারত করা জায়েয কিন্তু তা করতে হবে শরীয়তসম্মতভাবে। কবরস্থানে গিয়ে যেমন শরীয়তবিরোধী কোনো কাজ করা যাবেনা, কোনো অবাঞ্চিত কথাও বলা যাবেনা; তেমনি কোনো নবী বা অলী বা কোনো নেককার লোকের কবর যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে বিদেশ সফরও জায়েয নয়। এ পর্যায়ে সর্বপ্রথম দলীল হচ্ছে নবী করীম(স) এর তীব্র ও জোরদার নিষেধ বাণী।

তিনি ইরশাদ করেছেনঃ আরবী(******)

- আল্লাহর নৈকট্য লাভ মূলক সফর কেবল তিনটি মসজিদ যিয়ারতের জন্য করা যাবে, তা হলো মসজিদে হারাম(কাবা ঘর), মসজিদে নববী, এবং মসজিদে আকসা। এছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে অপর কোনো স্থানের জন্য সফর করা যাবেনা।

ইমাম নববী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ এ হাদীস উক্ত তিনটি মসজিদের এবং সে মসজিদ ত্রয়ের জন্য সফর করার ফযীলত প্রমাণ করেছে। কেননা সর্বশ্রেণীর আলিমের মতে এর মানে হচ্ছে এই যে, মসজিদত্রয় ছাড়া অন্য কোনো মসজিদের জন্য সফর করার কোনো ফযীলত নেই।

ইমাম নববী হাদীসের ব্যাখ্যায় অন্যত্র লিখেছেনঃ এ তিনটি হচ্ছে নবীগণের মসজিদ। এতে নামায পড়ার ফযীলত অনেক বেশি অন্যান্য মসজিদের তুলনায়।

অতএব তাতে নামায পড়া ও ইবাদত করার নিয়্যতেই সফর করা যাবে। তাতে আল্লাহ ছাড়া অপর কারো ইবাদতের জন্য সফর করা যাবেনা। কেননা মসজিদে হারামের দিকে সফর করা মানত করা হলে তার হ্জ্জ বা উমরা করার উদ্দেশ্যে তা পূরণ করা কর্তব্য। আর শেষোক্ত মসজিদদ্বয়ের সফর মানত করা হলে ইমাম শাফেয়ীর একটি কথা হচ্ছে এই যে, এ দুয়ের নিয়্যতে সফর করা মুস্তাহাব; ওয়াজিব নয়। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, সে মানত পূরণ করা ওয়াজিব হবে। আর অনেক আলিমই এই মত পোষণ করেন। অতঃপর তিনি লিখেছেনঃ

-এ তিনটি মসজিদ ছাড়া অপর কোনো মসজিদের জন্য সফর মানত করা হলে তা পূরণ করা ওয়াজিব নয় এবং মানতই শুদ্ধ হবেনা। এ মত আমাদের এবং সমগ্র আলিমদের। অবশ্য মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম মালিকী ভিন্নমত পোষণ করেন।

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেঃ হাদীসের শব্দ ‘শাদ্দুর রীহাল’ মানে বিদেশ সফর করা। অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্য লাভের নিয়্যত ও উদ্দেশ্যে এ তিনটি মসজিদ ছাড়া অপর কোনো স্থানের জন্যে সফর করবেনা। কেননা এ তিনটি মসজিদিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সম্মানার্হ্ এ কারণে যে, এ ছাড়া অপর সব মসজিদই মর্যাদায় সমান। অতএব যে কোনো মসজিদেই নামায পড়া হোকনা কেন, সবখানেই একই রকম সওয়াব পাওয়া যাবে। কিন্তু এ তিনটি মসজিদের সম্মান ভিন্ন রকম। এ হাদীসের অর্থ হলো, কোনো বিশেষ জায়গার নিয়্যত করে সেজন্যে সফর করবেনা। কিন্তু সেখানে যদি লেখাপড়া শেখা ইত্যাদির কোনো প্রয়োজন থাকে, তাহলে সে কথা স্বতন্ত্র। হাদীসের বাহ্যিক অর্থ তো এই যে, এই তিনটি স্থান ছাড়া অপর কোনো জায়গায় সফরই করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেউ বলেছেন এ তিনটি মসজিদ ছাড়া অপর কোনো স্থানে সফরের মানত করা হলে তা পূরণ করা ওয়াজিব হবেনা। এ মানতই মানত বলে গণ্য হবেনা, তা পূরণ করাও ওয়াজিব হবেনা। এ মানতই মানত বলে গণ্য হবেনা, তা পূরণ করা জরুরী হবেনা। আর ‘অলী’ ও নেককার লোকদের বা পবিত্র স্থানসমূহ সফর করা সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হারাম।

মনে রাখতে হবে, এখানে শুধু যিয়ারত করতে নিষেধ করা হয়নি, তা আলোচ্যও নয় এখানে। বরং এ নিষেধ হচ্ছে শুধু এ উদ্দেশ্যে বিদেশ সফর করা সম্পর্কে। রাসূলের এ হাদীসই হচ্ছে সুন্নাত এবং এই সুন্নাত অনুযায়ীই আমল করেছেন সাহাবায়ে কিরাম। এমন কি, কোনো কোনো বর্ণনামতে শুধু রাসূলের কবর যিয়ারতের জন্য সফর করার কাজও তাঁরা করেননি এবং তা তাঁরা করা পছন্দও করেননি। এ পর্যায়ে প্রমাণ হিসেবে নিম্নোক্ত কথা দুটি উল্লেখ করা যেতে পারেঃ

সব সাহাবী- যেমন মুয়ায, আবু ওবায়দা, উবাদা ইবনে সামিত এবং আবুদ দারদা প্রমুখ-এঁদের কেউ দুনিয়ার একটি কবরগাহেরও যিয়ারত করবার উদ্দেশ্যে সফর করেছেন বলে জানা যায়নি।

এমন কি, সাহাবায়ে কিরাম(রা)শুধু কোনো নবীর মাযার যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে সফর করেছেন বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়না। বলা হয়েছেঃ হযরত আবু বকর, উমর, উসমান, আলী(রা) এবং তাঁদের পরবর্তী লোকদের যুগ শেষ হওয়া পর্য্ন্ত কোনো সাহাবীই কোনো নবী বা নেক ব্যক্তির কবর যিয়ারতের জন্য সফর করে বিদেশ যাননি।

এই পর্যায়ে সর্বজনমান্য ভারতীয় মনীষী শাহওয়ারী মুহাদ্দিসে দিহলভী যা কিছু লিখেছেন, তা উল্লেখ করে আমাদের এ সম্পর্কিত বক্তব্য শেষ করছি। মুয়াত্তা ইমাম মালিক গ্রন্থে এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়; হযরত আবু হুরায়রা(রা)বলেনঃ আমি বুসরা ইবনে আবূ গিফারীর সঙ্গে সাক্ষাত করলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ কোথ্থেকে এসেছ? বললামঃ ‘তুর’ থেকে। তিনি বললেন-তুরের দিকে যাওয়ার পূর্বে যদি তোমার সাথে আমার একবার সাক্ষাত হতো, তাহলে তোমার আর যাওয়া হতোনা। কেননা, নবী করীম(স) কে আমি বলতে শুনেছিঃ তোমরা মসজিদে হারাম, আমার মসজিদ এবং মসজিদে ইলীয়া বা বায়তুল মুকাদ্দাস- এই তিনটি মসজিদ ছাড়া আর কোনো মসজিদের জন্য সফরের আয়োজন করবেনা।

শাহ ওয়ালী উল্লাহ(রা) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোনো জায়গার জন্য আল্লাহর নৈকট্য (বা সওয়াব) লাভের নিয়্যতে সফর করা এবং কোনো জায়গাকে এ জন্যে নির্দিষ্ট করে নেয়া নিষিদ্ধ।

এর কারণ বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেনঃ সম্ভবত এ নিষেধের মূল লক্ষ্য হলো লোকদেরকে সে কাজ হতে বিরত রাখা, যা জাহিলিয়াতের জামানার লোকেরা করতো। যেমন-তারা নিজেদের ইচ্ছেমত এক একটি তাজীমের স্থান আবিষ্কার ও নির্দিষ্ট করে নিত।

তিনি এ হাদীসের ভিত্তিতে আরো লিখেছেনঃ আমি বলবো জাহিলিয়াতের যুগের লোকেরা বিভিন্ন কল্পনার ভিত্তিতে বিভিন্ন জায়গাকে তাজীমের জায়গা বলে মনে করতো, তার যিয়ারত করতো, তা থেকে বরকত হাসিল করতো। তাতে করে মূল দ্বীন-ই বিকৃত হয়ে যেত, আর হতো নানা বিপর্য্য়। এ কারণে আলোচ্য হাদীস দ্বারা নবী করীম(স) এ বিপর্য্য়ের পথ বন্ধ করে দিলেন, যেন ইসলামী সুন্নাতী আদর্শ ও নিদর্শনাদি গায়র ইসলামী আদর্শের সাথে মিলে মিশে একাকার না হয়ে যায় এবং তা গায়রুল্লাহর ইবাদতের পন্থা উদ্ভাবনের কারণ রূপে গৃহীত না হয়। আমার মতে হক কথা হলো এই যে কবর, কোনো অলী আল্লাহর ইবাদতের জায়গা ও ‘তুর’-এ সবাই সমানভাবে এই নিষেধের মধ্যে গণ্য।

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা কস্তলানী লিখেছেনঃ

-এ তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য সব জায়গায় যাওয়ার জন্য সফর করা-যেমন নেককার লোকদের জীবিত থাকা বা মরে যাওয়ার পর তাদের জিয়ারতের জন্য যাওয়া, সেখানে ইবাদত করা বা সেখান থেকে বরকত লাভের উদ্দেশ্যে যাওয়া- এ সম্পর্কে আবু মুহাম্মদ জুয়েনী বলেন যে, বাহ্যত হাদীস অনুযায়ী আমল করা হলে এসব হারাম হবে। কাযী হুসাইন, কাযী ইয়াজ ও অন্যান্য মনীষীও এই মত-ই গ্রহণ করেছেন। তবে শাফেয়ী মাজহাবের ঈমামুল হারামইন প্রমুখের মতে এ কাজ জায়েয।(বলাবাহুল্য, একদিকে জায়েয অপরদিকে হারাম)। হারাম থেকে বাঁচার জন্য এ জায়েয মত গ্রহণ করা যেতে পারেনা।

মুল্লা আলী আল কারী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ কোনো কোনো আলিম এ হাদীসের দলীল দিয়ে বলেছেন যে, বরকতের জায়গা এবং আলিম ও নেককার লোক (অলী-পীর-দরবেশ) এর কবর যিয়ারতের জন্য সফর করা নিষিদ্ধ।

উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দিহলভী(রহ) লিখেছেনঃ হজ্জের সফরের সমান কিংবা তার চাইতেও ভাল ও উত্তম সফর মনে করে, হজ্জের ইহরাম বাঁধার মত জেনে শুনে বা না জেনে ইহরাম বাঁধে- এ কাজ কিছুতেই করা উচিত নয়।

সহীহ হাদীস, উহার ব্যাখ্যা এবং ইসলামের বিশেষজ্ঞ সলফে সালেহীনের পূর্বোদ্ধৃত মূল্যবান বাণীসমূহের ভিত্তিতে এ কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, কবর বা নির্দিষ্ট কোনো স্থানকে নিজেদের ইচ্ছেমতো পবিত্র বরকতওয়ালা বা শরীফ ইত্যাদি মনে করা, তা যিয়ারত করার জন্য এবং কবরস্থ অলী পীর দরবেশ এর নিকট প্রার্থনা করা বা তাকে অসীলা করার জন্য বিদেশ সফর করা এবং সেখান থেকে বরকত হাসীল করতে চাওয়া- এ সবই জাহিলিয়াতের জমানার মুশরিক লোকদের কাজ, এ কাজ দ্বীন-ইসলামের সম্পূর্ণ খেলাফ। এতে যেমন আকীদার খারাবী দেয়া দেয়, তেমনি আমলেরও। এ কারণে নবী করীম(স) এ ধরনের কাজ করতে এ হাদীস মারফত চিরদিনের জন্য নিষেধ করে দিয়েছেন। অতএব বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় স্বকপোল কল্পিত মনগড়া পীর বা অলী দরবেশের কবরকে কেন্দ্র করে যা কিছু করা হচ্ছে, আজমীর শরীফে, বাগদাদ শরীফ, দাতাগঞ্জবখশ, শর্ষিণা শরীফ, মাইজভান্ডার আর সুরেশ্বর শরীফ প্রভৃতি স্থানে যে ওরস ও অন্যান্য অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় এবং দলে দলে মূর্খ মুরীদরা একত্রিত হয় মরা পীরের কবর হতে ফায়েজ নেয়ার উদ্দেশ্যে- তা সবই রাসূলের নির্দেশের সম্পূর্ণ খেলাফ, সুন্নাতের বিপরীত- এক স্পষ্ট বিদয়াত। আর পীর ভক্তির তীব্রতা ও আতিশয্যের কারণে অনেক ক্ষেত্রে তা-ই শিরক এ পরিণত হয়।

এমন কি, মক্কায় কাবা ঘরের হজ্জ করতে গিয়ে মদীনায় যাওয়া যারা বাধ্যতামূলক মনে করেন, তাদের উচিত মসজিদে নববীতে নামায পড়ার নিয়্যতে সফর করবে, শুধু রাসূলে করীমের কবরে সালাম করার উদ্দেশ্যে সফর করা উচিত নয়।

এ সব অকাট্য দলীলের মুকাবিলায় বিদয়াতীদের কথাবার্তা পেশ করে পীর-মুরীদী মহাশূণ্যে মিলিয়ে যেতে দেরী নেই মোটেও।

আল্লাহ এই বিদয়াতীদের হেদায়াত করুন।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি