অধ্যায়ঃ ২

এক নজরে ব্যক্তিত্ব

যখন বুলাই তার মুখমন্ডলে দু’চোখ,
সেযেনো বর্ষামুখী মেঘে বিদ্যুতের চমক। [জাহেলী যুগের এই বিখ্যাত আরব কবি এই কবিতাটি তার এক প্রীতিভাজন ব্যক্তিত্বকে লক্ষ্য করে রচনা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে কোন এক প্রসংগে হযরত আয়েশা (রা) এটি রসূল (সা)এর ওপর যথার্থ প্রয়োগ করেন।]
- আবু কবীর হুযালী

এ চেহারা হতে পারেনা কোনো মিথ্যাবাদী লোকের।
- আবদুল্লাহ ইবনে সালাম

এক ঝলক [প্রধানতঃ শামায়েলে তিরমিযীর আলোকে রচিত।]

পৃথিবীতে যারা বড় কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, বিশেষত নবীগণ আ., তারা সর্বদাই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে থাকেন। আন্দোলনের নেতৃত্বদান এবং সভ্যতার পুননির্মাণে নেতৃত্বদানকারীদের শক্তির আসল উৎস হয়ে থাকে বিশেষ ধরণের চিন্তাধারা ও চরিত্রের সমন্বয়ে গঠিত তাঁদের ব্যক্তিসত্তা। রসূল সা.- এর ব্যক্তিত্বকে যথাযথভাবে হৃদয়ংগম করাও তাঁর সীরাত অধ্যয়নের একটা অন্যতম উদ্দেশ্য।
যেকোন ব্যক্তিত্বকে উপলব্ধি করার ব্যাপারে তার দৈহিক সৌন্দর্য অনেক সাহায্য করে। মানুষের আপাদমস্তক দেহের গঠন এবং তার অংগ প্রত্যংগের সুঠামতা দ্বারা বুঝা যায় সে মানসিক, নৈতিক ও চেতনাগত দিক দিয়ে কোন স্তরের মানুষ। বিশেষত চেহারা বা মুখমন্ডলে মানবীয় চরিত্র ও কীর্তিকলাপের সমস্ত ইতিবৃত্ত লেখা থাকে। তার ওপর একটা দৃষ্টি দিলেই আমরা ওটা কোন্‌ ধরণের মানুষের চেহারা তা আঁচ করতে পারি।
আমরা যারা পরবর্তীকালে পৃথিবীতে এসেছি, তারা এদিক দিয়ে ভাগ্যাহত যে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানুষটির অনুপম চেহারা আমাদের সামনে নেই এবং তা চর্মচক্ষু দিয়ে এ জগতে দর্শনের সুযোগও পাবনা। আমরা রসূল সা. এর দৈহিক সৌন্দর্যের যেটুকু ঝলক দেখতে পাই, তা কেবল তাঁর বাণী ও কীর্তির দর্পণেই দেখতে পাই।
রসূল সা. এর কোন প্রকৃত ছবি বা মূর্তি নেই। স্বয়ং রসূল সা. ওসব বানাতে ও রাখতে নিষেধ করেছেন। কেননা ছবি এত বিপজ্জনক জিনিস যে তা শেরকে লিপ্ত হওয়ার ঝুঁকি কোনভাবেই রোধ করেনা। রসূল সা. এর কোন ছবি যদি থাকতো, তাহলে তাকে যে কত অলৌকিক কর্মকান্ডের উৎস মনে করা হতো এবং নতুন নতুন কত মোজেযার কৃতিত্ব তাকে দেয়া হতো, তার ইয়ত্তা নেই। এর সম্মানে কত যে রং বেরং এর অনুষ্ঠানাদি অনুষ্ঠিত হতো তা কল্পনা করাও কঠিন। এমনকি তার পূজা শুরু হয়ে যাওয়ায় বিচিত্র ছিলনা। ইউরোপে রসূল সা. এর কাল্পনিক ছবি অনেক বানানো হয়েছে। কিন্তু এমন শিল্পী কে আছে যে, রসূল সা. এর চিন্তা ও কর্মের প্রতিটি দিকের সূক্ষ্ণ ব্যাপক ও পূর্ণাংগ ধারণা রাখে এবং সেই ধারণাকে রংতুলি দিয়ে পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে? কাল্পনিক ছবি আর যারই হোক, মুহাম্মদ সা. এর নয়। কোন অনুমান সর্বস্ব ব্যক্তিত্বের ছবি বানিয়ে তাকে রসূল সা. এর নামে চালিয়ে দেয়া হয়ে থাকে। এ সব ছবি তৈরী করার সময় বিন্দুমাত্র সততার পরিচয় দেয়া হয়না। ইচ্ছাকৃতভাবে এমন ছবি তৈরী করা হয়, যা দ্বারা এক দুর্বলও অসম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বের ধারণা জন্মে। সব ছবি তৈরী করার জন্য ব্যক্তিত্বের ধারণা নেয়া হয় পাশ্চাত্যেরই সেই সব বিদ্বেষপূর্ণ পুস্তকাদি থেকে, যা গোয়ার্তুমি, হঠকারিতা, বক্রচিন্তা ও অবাস্তব ধারণার ফলশ্রুতি। নবীগণ ও পূণ্যবান ব্যক্তিগণের ছবি বা চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষতি এটাই যে, তাদের আসল চরিত্র পর্দার আড়ালে হারিয়ে যেতে পারে।
কিন্তু রসূল সা. এর সাহাবাগণ ন্যূনতম শব্দের মাধ্যমে তাঁর নিখুঁত ছবি এঁকে দিয়েছেন এবং সেই বর্ণনাগুলোকে বর্ণাকারীগণ অত্যন্ত সুরক্ষিত ও অবিকৃত অবস্থায় আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। এখানে আমরা সেই শাব্দিক চিত্রগুলোকে তুলে ধরছি, যাতে পাঠকগণ এই মহামানবের চরিত্র অধ্যয়নের আগে তাঁর ব্যক্তিসত্তার একটা ঝলক দেখে নিতে পারেন। একে এক ধরণের সাক্ষাতও বলা যেতে পারে, কিংবা পরিচিতিও বলতে পারেন।
রসূল সা. এর পবিত্র মুখমন্ডল, তাঁর দৈহিক গঠন, চালচলন ও সৌন্দর্যের যে ছাপ চৌদ্দশো বছরের দূরত্ব পেরিয়ে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে তা এমন একজন মানুষের ভাবমূর্তি প্রতিফলিত করে, যিনি একাধারে অত্যন্ত উচ্চাংগের মেধাবী ও বুদ্ধিমান, সাহসী বীর, ধৈর্যশীল, আদর্শে অবিচল, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ, উদার ও মহানুভব, দাতা, দায়িত্ব সচেতন, বিনয়ী ও ভাবগম্ভীর এবং প্রিয়ভাষী ও শুদ্ধভাষী ছিলেন। আরো সঠিকভাবে বললে বলতে হয়, তাঁর দৈহিক কাঠামোতে নবুয়্যতের ছাপ অনেকটা লক্ষ্যণীয় ভাবে বিদ্যমান ছিল। তাঁর সুদর্শন দেহসৌষ্ঠব তাঁর উচ্চ মর্যাদার প্রতীক ছিল। এ প্রসংগে রসূল সা. এর একটি উক্তি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেনঃ
‘‘খোদাভীতি মানুষের চেহারাকে উজ্জ্বল ও সুন্দর করে।’’
নবুয়্যত যখন ঈমান ও খোদাভীতির সর্বোচ্চ স্তর, তখন নবীর চেহারা আলোকময় না হয়েই পারেনা।
এবার আসুন, তাঁর সূর্য জ্যোতিসম চমকপ্রদ চেহারার একটু ঝলক দেখে নেয়া যাক।

দৈহিক সৌন্দর্য

‘‘আমি রসূল সা. কে দেখেই চিনে ফেলেছিলাম। তাঁর চেহারা একজন মিথ্যাবাদীর চেহারা হতে পারেনা।’’ (আব্দুল্লাহ বিন সালাম) [ইনি ইহুদীদের একজন মস্ত বড় আলেম ছিলেন। তাঁর নাম ছিল হাসীন। রসূল সা. মদীনায় এলে ইনি তাঁকে দেখতে যান এবং দেখতে গিয়ে তার যে ধারণা জন্মে সেটাই তিনি এখানে বর্ণনা করেছেন। তিনি ঈমান আনলেন এবং তার ইসলামী নাম হলো আবদুল্লাহ। (সীরাতুল মুস্তাফা, মাওলানা ইদ্‌রীস কান্ধুলতী। প্রথম খন্ড, পৃঃ ৩৪১-৩৫০)]
‘‘আমি আমার ছেলেকে সাথে নিয়ে হাজির হলাম। লোকেরা দেখিয়ে দিল ঐ যে, আল্লাহর রসূল। কাছে গিয়ে বসা মাত্রই আমি মনে মনে বললাম, যথার্থই ইনি আল্লাহর নবী।’’-আবু রামছা তাইমী
‘‘নিশ্চিত থাকো, আমি এই ব্যক্তির পূর্ণিমা চাঁদের মত উজ্জ্বল চেহারা দেখেছি। তিনি কখনো তোমার সাথে লেনদেনে অসততা করতে পারেননা। এ ধরনের মানুষ যদি (উটের মূল্য ) না দেয়, তবে আমি নিজের কাছ থেকে দিয়ে দের।’’-জনৈক ভদ্র মহিলা। [একটি বানিজ্যিক কাফেলা এসে মদীনার উপকণ্ঠে যাত্রা বিরতি করেছিল। ঘটনাক্রমে রসূল (সাঃ) সেদিকে গিয়েছিলেন।তিনি একটা উট বাছাই করে দামদস্ত্তও ঠিক করলেন। অতপর এই বলে উটটা নিয়ে গেলেন যে,দাম পাঠিয়ে দিচ্ছি।পরে উট বিক্রেতাদের মনে খটকা লাগলো,একজন অচেনা লোককে বাকীতে উট দিয়ে কেমন কাজ করলাম।এসময় কাফেলার নেতার স্ত্রী তাদেরকে আশ্বসত্ম করার জন্য উপরোক্ত কথা বলে। এ ঘটনা ঐ কাফেলার সদস্য তারেক বিন আব্দুলস্নাহ বর্ণনা করেন।এর কিছুক্ষন পরই রসূল (সাঃ) নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশী পরিমাণে খেজুর পাঠিয়ে দিলেন।(সীরাতুন্নবী,শিবলী নুমানী,২য় খন্ড,পৃঃ ৩৮০ আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া,১ম খন্ড,পৃঃ ২৪৪।)]
‘‘আমরা এমন সূদর্শন মানুষ আর দেখিনি। আমরা ওর মুখ থেকে আলো বিকীর্ণ হতে দেখেছি।’’ -আবু কারসানার মা ও খালা। [এই মহিলাদ্বয় আবু কারসানার সাথে রসূল সাঃ এর কাছে বায়আতের (অংগীকার প্রদান) জন্য গিয়েছিলেন। ফিরতি পথে তাঁরা এই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। (আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড,পৃঃ২৫৫)]
‘‘রসূল সাঃ এর চেয়ে সূদর্শন কাউকে আমি দেখিনি। মনে হতো যেন সূর্য ঝিকমিক করছে।’’-আবু হুরায়রা
‘‘তুমি যদি রসূল সাঃ কে দেখতে, তবে তোমার মনে হতো যেন সূর্য উঠেছে।’’-রবী বিনতে মুয়াওয়ায
“ রসূল সাঃ কে যে দেখতো, সে প্রথম দৃষ্টিতেই হতভম্ব হয়ে যেতো।’’- হযরত আলী
‘‘আমি একবার জ্যোৎসণা রাতে রাসূল সাঃ কে দেখছিলাম। তিনি তখন লাল পোশাকে আবৃত ছিলেন। আমি একবার চাঁদের দিকে আর একবার তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলাম।অবশেষে আমি এই সিদ্ধামেত্ম উপনীত হলাম যে, রসূল সাঃ চাঁদের চেয়েও সুন্দর।’’-হযরত জাবের বিন সামুরা
‘‘আনন্দের সময় রসূল সাঃ এর চেহারা চাঁদের মত ঝকমক করতো।এটা দেখেই আমরা তার আনন্দ টের পেতাম। ’’-কা’ব বিন মালেক
‘‘তাঁর চেহারায় চাঁদের মত চমক ছিল।’’-হিন্দ বিন আবি হালা

মুখমণ্ডল
‘‘পূর্ণিমার চাঁদের মত গোলাকার।’’-বারা বিন আযিব
‘‘তাঁর মুখমণ্ডল পুরোপুরি গোলাকার ছিলনা।তবে প্রায় গোলাকার।’’-হযরত আলী
‘‘প্রশস্ত কপাল, বাঁকানো, চিকন ও ঘন ভ্রু, উভয় ভ্রু আলাদা, উভয় ভ্রুর মাঝখানে একটা উঁচু রগ ছিল, রাগান্বিত হলে এই রগ স্পষ্ট হয়ে উঠতো।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা
‘‘কপালে আনন্দের চিহ্ন ফুটে উঠতো।’’-কা’ব ইবনে মালেক

বর্ণ
চুনের মত সাদাও নয়, শ্যাম বর্ণেরও নয়।গমের মত রং তবে একটু সাদাটে।’’-হযরত আনাস
‘‘লালচে সাদা।’’ -হযরত আলী
‘‘সাদা, তবে লাবন্যময়।’’ -আবুত তোফায়েল
‘‘সাদা দীপ্ত।’’- হিন্দ বিন আবি হালা
‘‘শরীরটা যেন রূপার তৈরী।’’ - হযরত আবু হুরায়রা

চোখ
‘‘কালো চোখ, লম্বা পলক।’’ -হযরত আলী
‘‘চোখের মণি কালো, দৃষ্টি আনত, চোখের কিনার দিয়ে দেখার সলজ্জ প্রবণতা।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা
‘‘চোখে সাদা অংশে লাল রেখা, লম্বা কোটর, জন্মগত সুর্ম মাখা।’’ -জাবের বিন সামুরা

নাক
‘‘খানিকটা উঁচু, তার ওপর জ্যোতির্ময় চমক-এ জন্য প্রথম দৃষ্টিতে বড় মনে হয়।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা

গাল
‘‘হালকা ও সমতল, নীচের দিকে একটু মাংসল।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা

মুখ
‘‘প্রশস্ত’’। -জাবের বিন সামুরা
‘‘প্রশস্ত’’। - হিন্দ বিন আবি হালা

দাঁত
‘‘চিকন, চকচকে। সামনের দাঁতে মোহনীয় ঔজ্জল্য।’’ -হযরত ইবনে আব্বাস
তিনি যখন কথা বলতেন,তখন দাঁত দিয়ে চমক ফুটে বেরুতো।’’ -হযরত আববাস
দাড়ি
‘‘মুখভরা ঘন দাড়ি।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা
ঘাড়
‘‘পাতলা ও লম্বা যেন মূর্তির মত সুন্দরভাবে কেটে বানানো।’’
ঘাড়ের রং চাঁদের মত উজ্জ্বল ও মনোরম।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা

মাথা
‘‘বড়-তবে সূষম মধ্যম আকৃতির।’’ - হিন্দ বিন আবি হাল

চুল
ঈষৎ কোঁকড়ানো।’’ -আবু হুরায়রা
‘‘একেবারে সোজাও নয়, খুব বেশী কোঁকড়ানোও নয়।’’ -কাতাদা
‘‘সামান্য কোঁকড়ানো’’ -হযরত আনাস
‘‘ঘন-কখনো কখনো কানের লতি পর্যমত্ম লম্বা।কখনো ঘাড় পর্যন্ত।’’ -বারা বিন আযেব
‘‘মাঝখানে দিয়ে সিথিঁ কাটা’’ -হিন্দ বিন আবি হালা
‘‘শরীরে বেশী লোম ছিলনা। বুক থেকে নাভি পর্যমত্ম লোমের চিকন রেখা।’’ -হযরত আলী ও হিন্দ বিন আবি হালা
‘‘ঘাড়, বাহু ও বুকের ওপরের অংশে সামান্য কিছু লোম।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা

সামগ্রিক দেহ কাঠামো
‘‘শরীরটা ছিল মজবুত গঠনের। অংগ প্রত্যংগের জোড়ের হাড় বড়ও শক্ত।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা
‘‘শরীর মোটা ছিলনা।’’ -হযরত আলী
‘‘শরীর বেশী লম্বাও নয়,খাটোও নয়, মধ্যম।’’ -হযরত আনাস(রাঃ)
‘‘শরীর কিছুটা লম্বা। অনেক লোকের মধ্যে দাঁড়ালে তাকে অধিকতর লম্বা মনে হতো।’’ -বারা বিন আযেব
‘‘পেট উঁচু ছিলনা।’’-উম্মে মা’বাদ
“পার্থিব সম্পদের প্রাচুর্যে লালিত লোকদের চেয়ে (ক্ষুধা ও দারিদ্র ভোগ করা সত্তেও) তরতাজা ও শক্তিশালী ছিলেন।’’ [এ ঘটনা সুবিখ্যাত যে, ওমরা করতে গিয়ে রসূল (সাঃ) একাই একশো উট হাকিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তার মধ্য থেকে ৬৩টি স্বহসেত্ম জবাই করেন। বাকীগুলো হযরত আলীর (রাঃ) হাতে অর্পণ করেন। (আল মাওয়াহেব ১ম খন্ড ৩১০ পৃষ্ঠা )]
‘‘আমি রসূল (সাঃ) এর চেয়ে শক্তিশালী আর কা্উকে দেখিনি।’’-ইবনে উমার [মক্কায় রুকানা নামক একজন পেশাদার কুস্তিগীর ছিল। একবার রসূল (সাঃ) তার সাথে দেখা করে ইসলামের দাওয়াত দিলে সে নবুয়তের প্রমাণ চায়। রসূল (সাঃ) তার রুচি অনুযায়ী তার সাথে কুস্তি লড়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তার সাথে তিনবার কুস্তি হয় এবং তিনবারই তিনি তাকে হারিয়ে দেন। এ ছাড়া আবুল আসওয়াদ জুহমীসহ আরো কয়েকজনকেও তিনি কুস্তি লড়াইতে হারিয়ে দিয়েছেন। (হাকেম, আবু দাউদ, তিরমিযী ও বায়হাকী, আল- মাওয়াহিবুল লাহন্নিয়া, প্রথম খ-,পৃঃ ৩০৩)]

কাঁধ ও বুক
‘‘বুক প্রশস্ত, বুক ও পেট সমতল।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা
‘‘বুক প্রশস্ত।’’ -বারা বিন আযেব
‘‘দুই কাঁধের মধ্যবর্তী অংশ সাধারণ মাপের চেয়ে বেশী। -হিন্দ বিন আবি হালা, বারা বিন আযেব
‘‘দুই কাঁধের মধ্যবর্তী অংশ মাংসল।’’ -হযরত আলী

হাত ও বাহু
‘‘বাহু লম্বা, হাতের তালু প্রশস্ত, আংগুলগুলো মানানসই লম্বা।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা
‘‘রেশমের পাতলা বা ঘন কাপড় বা অন্য কোন জিনিস এমন দেখিনি, যা রসূল (সাঃ) এর হাতের চেয়ে কোমল।’’-হযরত আববাস

পদযুগল
‘‘পায়ের থোড়া মাংসল ছিলনা,ছিল হালকা ও চুপসানো।’’-জাবের বিন সামুরা
“হাতের পাতা ও পায়ের পাতা মাংশল ছিল। পায়ের তলা কিঞ্চিত গভীর। পায়ের পাতা এত পাতলা যে, তাতে পানিই দাঁড়ায়না। ’’ – হিন্দ বিন আবি হালা
“পায়ের গোড়ালিতে গোস্ত খুবই কম।’’ –জাবের বিন সামুরা

একটা সামগ্রিক ছবি

যদিও রসূল (সাঃ) এর বহু সংখ্যক সাহাবী রসূল (সাঃ) সম্পর্কে অনেক চমকপ্রদ বিবরণ দিয়েছেন, কিন্তু উম্মে মা’বাদের বিবরণের কোন তুলনা নেই। সুর পর্বতের গুহা থেকে যখন রসূল (সাঃ) মদীনায় হিজরত করার জন্য রওনা দিলেন, তখন প্রথম দিনই খুযায়া গোত্রের এই মহিয়সী বৃদ্ধার বাড়ীতে যাত্রা বিরতি করেন। রসূল (সাঃ) ও তাঁর সাথীরা নিদারুণ তৃষ্ণা কাতর ছিলেন। আলস্নাহর বিশেষ মেহেরবানীতে বৃদ্ধার জরাজীর্ণ ক্ষুধার্ত বকরী এ সময় এত দুধ দিল যে,রসূল (সাঃ) ও তাঁর সাথীরা পেটপুরে খাওয়ার পর আরো খানিকটা দুধ অবশিষ্ট রইল। উম্মে মা’বাদের স্বামী বাড়ী ফিরে দুধ দেখে অবাক হয়ে গেল। সে জিজ্ঞাসা করলো, এ দুধ কোথা থেকে এল। উম্মে মা’বাদ সমসত্ম ঘটনা বর্ণনা করলো।তখন তার স্বামী বললো, এই করাইশী যুবকের আকৃতির বিবরণ দাও তো, সে সেই বহুল প্রত্যাশিত ব্যক্তি কিনা দেখি। তখন উম্মে মাবাদ চমৎকার ভাষায় তার একটি বিবরণ দিল। উম্মে মাবাদ তখন রাসূল (সাঃ) কে চিনতোনা, তার প্রতি হিংসা বিদ্বেষও পোষণ করতোনা। সে যা দেখেছে,হুবহু তা বর্ণনা করেছে। এই বর্ণনাটা আসল আরবীতে দেখে নেয়া উত্তম। [দেখুন যাদুল মায়াদ,১ম খন্ড,পৃঃ ৩০৭]। এখানে তার অনুবাদ দিচ্ছিঃ
‘‘পবিত্র ও প্রশসত্ম মুখমন্ডল,প্রিয় স্বভাব, পেট উঁচু নয়, মাথায় টাক নেই, সুদর্শন, সুন্দর, কালো ও ডাগর ডাগর চোখ, লম্বা ঘন চুল, গুরম্নগম্ভীর কণ্ঠস্বর। উঁচু ঘাড়, সুর্মা যুক্ত চোখ, চিকন ও জোড়া ভ্রম্ন, কালো কোকড়ানো চুল। নীরব গাম্ভীর্য,আন্তরিক, দূর থেকে দেখলে সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক। নিকট থেকে দেখলে অত্যন্ত মিষ্ট ও সুন্দর। মিষ্ট ভাষী, স্পষ্টভাষী, নিস্প্রয়োজন শব্দের ছড়াছড়ি থেকে মুক্ত কথাবার্তা। সমস্ত কথাবার্তা মুক্তার হারের মত পরস্পরের সাথে যুক্ত। মধ্যম ধরনের লম্বা, ফলে কেউ তাকে ঘৃণাও করেনা, তাচ্ছিল্যও করেনা। সুদর্শন, তরুন, সর্বক্ষণ সাহচর্য দানকারীদের প্রিয়জন। যখন সে কিছু বলে সবাই নীরবে শোনে, যখন সে কোন নির্দেশ দেয়, তৎক্ষণাত সবাই তা পালন করতে ছুটে যায়। সকলের সেবা লাভকারী, সকলের আনুগত্য লাভকারী, প্রয়োজনের চেয়ে স্বল্পভাষীও নয়; অমিতভাষীও নয়।’’ [যাদুল মায়াদ, ১ম খন্ড,পৃঃ ৩০৭]।

পোশাক
পোশাক দ্বারাও মানুষের ব্যক্তিত্ব প্রস্ফুটিত হয়। পোশাকের সাইজ, দৈঘ্য, প্রস্থ, রং, মান পরিচ্ছন্নতা এবং অনুরূপ অন্যান্য বিশেষত্বের পোশাক পরিহিত ব্যক্তি কেমন চরিত্র ও মানসিকতার অধিকারী তা জানিয়ে দেয়। রসূল (সাঃ) এর পোশাক সম্পর্কে তাঁর সাহাবীগণ যে তথ্য দিয়েছেন, তা থেকে রসূল (সাঃ) -এর রুচি ও মানসিকতা অনেকটা প্রকাশ পায়।
রসূল (সাঃ) আসলে পোশাক সম্পর্কে নিম্নোক্ত আয়াতের বাস্তব ব্যাখ্যা পেশ করেছেনঃ
﴿يَا بَنِي آدَمَ قَدْ أَنزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَارِي سَوْآتِكُمْ وَرِيشًا ۖ وَلِبَاسُ التَّقْوَىٰ ذَٰلِكَ خَيْرٌ ۚ ذَٰلِكَ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ﴾
‘‘হে আদম সন্তান, আমি তোমাদের জন্য তোমাদের লজ্জা স্থান আবৃতকারী এবং তোমাদেও সৌন্দর্য উৎপন্নকারী পোশাক নির্ধারণ করেছি। তবে খোদাভীতির পোশাকই উত্তম।’’ (সূরা আ’রাফঃ ২৬)
পোশাকের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য সূরা আন নহলে বর্ণিত হয়েছে এভাবেঃ
سَرَابِيلَ تَقِيكُمُ الْحَرَّ وَسَرَابِيلَ تَقِيكُم بَأْسَكُمْ
‘‘তিনি তোমাদেরকে গরম থেকে বাঁচানো ও যুদ্ধে নিরাপদে রাখার জন্য জামা ও বর্ম সরবরাহ করেছেন।’’ (সূরা আন নহল)
সুতরাং রসূল (সাঃ) এর পোশাকের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এইযে, তা লজ্জা নিবারক ছিল, সৌন্দর্য উৎপন্নকারী ছিল এবং তাকওয়া তথা খোদাভীতি ও সততার পোশাক ছিল।এতে প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থাও ছিল, চারিত্রিক নীতিমালার আনুগত্যের নিশ্চয়তাও ছিল এবং ভদ্রজনোচিত রুচির প্রতিফলনও ছিল। রসূল (সাঃ) দাম্ভিকতা, জাঁকযমক, বিলাসিতা ও লোক দেখানোর মানসিকতা কঠোরভাবে এড়িয়ে চলতেন। তিনি বলেছেনঃ
‘‘আমি আল্লাহর একজন দাস মাত্র এবং বান্দাদের উপযোগী পোশাকই পরি।’’ [আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া-১ম খ-, পৃঃ ৩২৮।] রেশম জাতীয় পোশাককে তিনি পুরূষদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছেন। একবার উপহার স্বরূপ পাওয়া রেশমী জামা পরেছিলেন। কিন্তু অস্থিরতার সাথে তৎক্ষণাত তা খুলে ফেললেন। জামা, লুংগী ও পাগড়ী বেশী দীর্ঘ হওয়া অহংকারের আলামত ছিল এবং এ ধরনের পোশাক পরার প্রথা দাম্ভিক লোকদের মধ্যে প্রচলিত ছিল বিধায় এটাকে তিনি প্রচন্ডভাবে ঘৃণা করতেন। [আবুদাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজা, তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ]।
অন্যান্য জাতির পোশাক বিশেষত তাদের ধর্মীয় যাজক শ্রেণীর নির্দিষ্ট ধরনের পোশাকের অনুকরণ করাকেও তিনি নিষিদ্ধ করেছেন। [মুসনাদে আহমাদ, আবুদাউদ]। উম্মতের স্বকীয়তা ও আত্মমর্যাদাবোধ যাতে বহাল থাকে এবং পোশাক ও ফ্যাশনের অনুকরণ করতে গিয়ে চরিত্র ও আদর্শের অনুকরণও শুরু হয়ে না যায়, সে জন্যই তিনি এরূপ নিষেধজ্ঞা আরোপ করেছেন। এ জন্য তিনি ইসলামী সংস্কৃতির আওতাধীন বেশভূষা, ফ্যাশন ও কৃষ্টি সম্পর্কে সম্পুর্ণ নতুন এক রুচির প্রচলন করেন। পোশাকে আবহাওয়াগত নিরাপত্তা, লজ্জা নিবারণ, সরলতা পরিচ্ছন্নতা ও গাম্ভভীর্য কিভাবে রক্ষা করা যায়, সে দিকে রসূল সা. বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতেন। রসূল (সাঃ) এর পোশাককে আমরা যদি সমকালীন সাংস্কৃতিক ধারা, আরবের ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক ও আবহাওয়াগত প্রয়োজন এবং প্রচলিত রীতিপ্রথার প্রেক্ষাপটে দেখি, তাহলে স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, ঐ পোশাক ছিল অত্যন্ত উঁচুমানের রুচির প্রতীক। এবারে আসুন দেখা যাক রসূল (সাঃ) এর পোশাক কেমন ছিল? [শামায়েলে তিরমিযী,যাদুল মায়াদ ও আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া দ্রষ্টব্য]।
তিনি জামা খুবই পছন্দ করতেন। জামার আসিত্মন (হাতা) বেশী চাপাও হতোনা, বেশী ঢিলাও হতোনা। মধ্যম ধরনের হতো।আসিত্মন (হাতা) কখনো কনুই পর্যমত্ম এবং কখনো কবজি পর্যমত্ম লম্বা হতো। প্রবাসে বিশেষত জেহাদেও সফরে যাওয়ার সময় যে জামা পরতেন, তার দৈর্ঘ্য ও আস্তিনের দৈর্ঘ্য অপেক্ষাকৃত কম হতো। সামনের দিকে বুকের ওপর জামার যে অংশটা থাকতো, তা আবহাওয়াগত প্রয়োজনে খোলাও রাখতেন এবং ঐ অবস্থায় নামাযও পড়তেন। জামা পরার সময় প্রথমে ডান হাত ও পরে বাম হাত ঢুকাতেন। সাহাবীগণকেও এটাই শিক্ষা দিতেন। ডান হাতের অগ্রাধিকার এবং ভালো কাজে ডান হাতের ব্যবহার রসূলের (সাঃ) শেখানো কৃষ্টির একটা গুরত্বপূর্ণ অংশ।
লুংগি সারা জীবনই ব্যবহার করতেন। এটা নাভির সামান্য নীচে রাখতেন এবং টাখনুর সামান্য ওপর পর্যন্ত পরতেন। সামনের অংশ ঈষৎ নামানো থাকতো।
পাজামা প্রথমে দেখেই পছন্দ করে ফেলেন। সাহাবীগণ ও পরতেন। একবার নিজে কিনেছিলেন। (পরেছিলেন কিনা সে ব্যাপারে মতভেদ আছে।) সেটি তাঁর পরিত্যক্ত সম্পত্তির মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল। পাজামা খরিদ করার ঘটনাটা বেশ মজার। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) কে সাথে নিয়ে রসূল(সাঃ) বাজারে গেলেন এবং পোশাক বিক্রেতাদের দোকানে উপস্থিত হলেন। চার দেরহাম দিয়ে পাজামাটা কিনলেন। বাজারে পণ্য দ্রব্যাদি মেপে দেখার জন্য একজন বিশিষ্ট ওযনকারী ছিল।তার কাছে পাজামাটা ওযন করাতে নিয়ে গেছেন এবং বললেনঃ‘‘এটি ঝুকিয়ে ওযন কর।’’(অর্থাৎ প্রকৃত ওযনের চেয়ে বেশী হয়, এমনভাবে ওযন কর।) ওযনকারী বললো,এমন কথা আমি আর কাউকে বলতে শুনিনি।হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেনঃ ‘তুমি কি তোমার নবীকে চেননা?’ লোকটি তৎক্ষণাত তাঁর হাতে চুমো খেতে এগিয়ে গেলে তিনি বাধা দিলেন এবং বললেনঃ এটা অনৈসলামিক পদ্ধতি।’’ যাহোক, তিনি পাজামাটা ওযন করিয়ে কিনে নিয়ে গেলেন।হযরত আবু হুরায়রা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কজিকি এটা পরবেন? তাঁর অবাক হওয়ার কারণ সম্ভবত এই ছিল যে, একেতো প্রাচীন অভ্যাসের এমন উলেস্নখযোগ্য পরিবর্তনে বিস্ময় বোধ হচ্ছিল। দ্বিতীয়তঃ পাজামা ছিল পারস্যদেশীয় পোশাক। অথচ রসূল (সাঃ) বিজাতীয় সবকিছু এড়িয়ে চলতেন। (অবশ্য অন্যান্য জাতির সংস্কৃতির ভালো উপাদানকে গ্রহন করতেন।) রসূল (সাঃ)বললেন ‘‘হাঁ, পরবো। স্বদেশে, বিদেশে, দিনে কিংবা রাতে-সর্বাবস্থায় পরবো। কেননা আমাকে ছতর ঢাকার আদেশ দেয়া হয়েছে এবং পায়জামার চেয়ে ভালো ছতর ঢাকা পোশাক আর কোনটাই নেই।’’। [আল মাওয়াহেবুল লাদুন্নিয়া,প্রথম খন্ড,পৃ ৩৩৬-৩৩৭]।
মাথায় পাগড়ি পরতে খুবই ভালোবাসতেন। পাগড়ি খুব বড়ও হতোনা, খুব ছোটও হতোনা। এক বর্ণনা অনুসারে পাগড়ি ৭ গজ লম্বা হতো। পাগড়ির লেজ পেছনের দিকে এক বিঘাত ছেড়ে দিতেন। কখনো কখনো রৌদ্রের তীব্রতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পাগড়ি এবং লেজ চওড়া করে মাথার ওপর ছড়িয়ে দিতেন। আবহাওয়ার প্রয়োজনে কখনো কখনো পাগড়ির শেষ বৃত্ত খুলে ঘাড়ের চার পাশে জড়িয়ে নিতেন। কখনো পাগড়ি না থাকলে একটা বড় রুমাল মাথায় বেঁধে নিতেন। [কারো কারো মতে,কেবল অসুস্থ অবস্থায়ই এরূপ করতেন, বিশেষত মাথা ধরলে ]। পরিচ্ছন্নতার খাতিরে পাগড়িকে তেলচিটা থেকে রক্ষা করার জন্য পাগড়ির নীচে চুলের ওপর একটা বিশেষ কাপড় ব্যবহার করতেন, যার আরবী নাম ‘কান্না’। আজ কালও অনেকে টুপির নীচে কাগজ বা সেলোলাইডের একটা টুকরা ব্যবহার করে থাকে। এই টুকরায় তেলচিটা লাগতো ঠিকই। কিন্তু পরিচ্ছন্নতার ব্যপারে এত সচেতন ছিলেন যে, বিভিন্ন বর্ণনা মতে এই টুকরাটাকে কেউ কখনো ময়লা দেখেনি। সাদা ছাড়া কখনো কখনো হলুদ, (খুব সম্ভবত মেটে রং বা ছাই রং) পাগড়িও পরতেন। মক্কা বিজয়ের সময় কালো পাগড়িও ব্যবহার করেছেন। পাগড়ির নীচে কাপড়ের টুপিও ব্যবহার করতেন এবং তা পছন্দ করতেন। কোন কোন বর্ণনা মতে, টুপির সাথে পাগড়ির এ ব্যবহার ইসলামী সংস্কৃতির বিশেষ স্টাইল হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং রসূল (সাঃ) এ স্টাইলকে মোশরেকদের মোকাবিলায় বিশেষ ফ্যাশন বলে ঘোষণা করেন।
পাগড়ি ছাড়া কখনো কখনো শুধু সাদা টুপিও ব্যবহার করতেন। ঘরোয়া ব্যবহারের টুপি মাথার সাথে লেগে থাকতো। আর প্রবাসে যে টুপি পরতেন তা হতো অপেক্ষাকৃত উঁচু। ঘন সেলাই করা কাপড়ের সূচাঁলো টুপিও পরতেন।
চার গজ লম্বা ও সোয়া দুগজ চওড়া চাদর পরতেন। কখনো তা গায়ে জড়িয়ে নিতেন, কখনো একপাশ সোজা বগলের মধ্য দিয়ে বের করে উল্টো কাঁধের ওপর নিয়ে রাখতেন।এই চাদও দিয়ে কখনো কখনো বসা অবস্থায় পা জড়িয়ে রাখতেন, আবার কখনো কখনো তা ভা’জ করে মাথার নীচে বালিশের মত ব্যবহার করতেন। অভিজাত সাক্ষাত প্রার্থীদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যও কখনো কখনো চাদর বিছিয়ে দিতেন। জাবারা নামক ইয়ামানী চাদর খুবই পছন্দ করতেন। এতে লাল বা সবুজ ডোরা থাকতো। একবার রসূলের (সাঃ) জন্য কালো চাদর (সম্ভবত পশমী) বানানো হয়। সেটা পরলে ঘামের জন্য দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। তাই পরিচ্ছন্নতার জন্য তা আর পরেননি।
নতুন কাপড় সাধারণত শুক্রবারে আল্লাহর প্রশংসা ও শোকর সহকারে পরতেন। পোশাকের বাড়তি সেট বানিয়ে রাখতেন না। কাপড়ে তালি লাগাতেন, মেরামত করতেন। সতর্কতার জন্য মাঝে মাঝে গৃহে তল্লাশী চালাতেন যে, সাধারণ মানুষের সাথে ওঠাবসার কারণে কোন উকুন বা ছারপোকা চলে এলো কিনা। (নামাযের জামায়াতে এবং বৈঠককাদিতে মাঝে মাঝে অপরিচ্ছন্ন লোকেরাও আসতো। এই অপরিচ্ছন্নতার সাধারণ মানও একাধারে বহু বছর চেষ্টার পরই তিনি খানিকটা উন্নত করতে পেরেছিলেন।)
একদিকে দারিদ্র ও সরলতা তাঁর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল। অপর দিকে বৈরাগ্যবাদ প্রতিরোধ করাও তাঁর দায়িত্ব ছিল।আবার কোন এক সচ্ছল ব্যক্তিকে অতি মাত্রায় গরীবের মত জীবন যাপন করতে দেখেই বললেন,‘‘আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার জীবনে তাঁর দেয়া নিয়ামতের প্রভাব প্রতিফলিত হোক-এটা ভালোবাসতেন। [তিরমিযী ও নাসায়ী]।
এই মূলনীতি অনুসারে রসূল সা. নিজে কখনো কখনো ভালো পোশাকও পরতেন। মধ্যম ও ভারসাম্যপূর্ণ পন্থায় বসা তাঁর নীতি ছিল এবং তিনি তাঁর উম্মতকে উগ্রতা ও চরম পন্থা থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। তিনি চাপা আস্তিন বিশিষ্ট রোমীয় জুব্বাও একবার পরেছিলেন। লাল ডোরা বিশিষ্ট চমকপ্রদ সেটও পরেছেন। কখনো কখনো পারস্যেও রাজকীয় তাইলাসানী জুববাও পরেছেন। [আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া]। একবার ২৭ উটনীর বিনিময়ে একসেট মূল্যবান পোশাক খরিদ করে পরেন এবং সেই অবস্থায় নামাযও পড়েন। এটা আসলে কুরআনের এই আয়াতের ব্যাখ্যা স্বরূপ ছিলঃ ‘‘বল, আল্লাহর দেয়া সৌন্দর্যোপকরণকে হারাম করেছে কে?’’(সূরা আরাফ) তবে সাধারণ নিয়ম ছিল এই যে, সরল ও অনাড়ম্বর পোশাকই তাঁর অধিকতর প্রিয় ছিল।
পোশাকের বেলায় সাদা রংই ছিল তাঁর সর্বাধিক প্রিয়। তিনি বলেছেনঃ তোমাদের জন্য আল্লাহর সামনে যাওয়ার সর্বোত্তম পোশাক সাদা পোশাক।’’ [আবু দাউদ,ইবনে মাজা]। তিনি আরো বলেছেনঃ সাদা কাপড় পর এবং সাদা কাপড় দ্বারা মৃতদের কাফন দাও। কেননা এটা অপেক্ষাকৃত পবিত্র ও পছন্দনীয়। [আহমদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ]।
সাদার পরেই তাঁর পছন্দনীয় রং ছিল সবুজ। তবে তাতে হালকা সবুজ ডোরা থাকা পছন্দ করতেন। একেবারে নির্ভেজাল লাল পোশাক খুবই অপছন্দ করতেন। (শুধু পোশাক নয়, বরং অন্যান্য জিনিসে লাল রং ক্ষেত্র বিশেষে নিষিদ্ধ করেছেন। তবে হালকা লাল রং এর ডোরাকাটা কাপড় তিনি পরতেন। অনুরূপ হালকা হলুদ (মেটে রং) এর পোশাকও পরেছেন।
রসূল (সাঃ) এর জুতা প্রচলিত আরবী কৃষ্টি অনুসারে চপ্পল বা খড়মের আকৃতি বিশিষ্ট ছিল। এর দুটো ফিতে থাকতো। একটা থাকতো পায়ের বুড়ো আংগুল ও তার পার্শববর্তী আংগুলের মাঝখানে। আর অপরটা থাকতো তার পার্শববর্তী দু’ আংগুলের মাঝে। জুতোর পশম থাকতোনা। অন্যান্য সাধারণ লোকদের জুতোর মত এটি এক বিঘত ২ আংগুল লম্বা হতো। কখনো দাঁড়িয়ে এবং কখনো বসে জুতো পরতেন। পরবার সময় প্রথমে ডান ও পরে বাম পা ঢুকাতেন। আর খোলার সময় প্রথমে বাম ও পরে ডান পা বের করতেন। মোজা পরতেন সাধারণ, মধ্যম ও উৎকৃষ্ট মানের। বাদশাহ নাজ্জাসী কালো মোজা উপহার দিয়েছিলেন। সেটি পরেছিলেন এবং তার ওপর মোসেহ করতেন। অনুরূপভাবে দিহয়া কালবীও মোজা উপহার দিয়েছিলেন এবং তিনি তা ছেড়ার আগ পর্যমত্ম পরেছেন।
রূপার আংটি ব্যবহার করেছেন।এতে রূপার ফলকও ছিল। কখনো হাবশী পাথরের ফলকও থাকতো। কোন কোন বর্ণনা মতে, লোহার আংটিতে রূপার পালিশ দেয়া থাকতো। অপর দিকে তিনি যে লোহার আংটি গহনা অপছন্দ করতেন তা সুবিদিত। আংটি সাধারণত ডান হাতেই পরতেন। তবে কখনো কখনো বাম হাতেও পরেছেন। মধ্যমা ও তর্জনী আংগুলে পরতেন না। মধ্যমার পার্শববর্তী আংগুলে পরাই পছন্দ করতেন। ফলক ওপরের দিকে নয় বরং হাতের পাতার দিকে রাখতেন। ফলকে ‘‘মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’’ খোদাই করা ছিল। এ দ্বারা তিনি চিঠিতে সিল দিতেন। ঐতিহাসিকগণের মতানুসারে এ আংটি সিলের প্রয়োজনেই বানানো হয়েছিল। রাজনৈতিক পদমর্যাদার কারণে এর প্রয়োজন ছিল অপরিহার্য।

বেশভূষা ও সাজ সজ্জা

রসূল (সাঃ) চুল খুব সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতেন। প্রচুর তেল ব্যবহার করতেন। চিরম্ননী দিতেন, সিথি কাটতেন, ঠোটের বাড়তি পশম ছেঁটে ফেলতেন, দাড়িও লম্বায় চওড়ায় কাঁচি দিয়ে সমান করে রাখতেন। সাথীদেরকেও এ ব্যাপারে প্রশিক্ষন দিতেন। যেমন, এক সাহাবীকে এলোকেশী অবস্থায় দেখে খুবই ভৎর্সনা করলেন। এক সাহাবীর দাড়ির বাড়তি চুল নিজেই ছেঁটে দেন।বললেন, যে ব্যক্তি মাথার চুল বা দাড়ি রাখবে, তার সেটা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা উচিত। কাতাদাহকে বলেছিলেন, দাড়িকে সুন্দরভাবে রাখো। [আবু দাউদ]।
এ ব্যাপারে রসূল সা. তাকীদ করেছেন এ জন্য যে, অনেক সময় ধর্মীয় শ্রেণীর লোকেরা পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে উদাসীন হয়ে যায়। বিশেষতঃ বৈরাগ্যবাদী তাসাউফের প্রবক্তরা নোংরা থাকাকে উচ্চ মর্যাদার আলামত মনে করে থাকে। এই বিভ্রান্তি তিনি দূর করার ব্যবস্থা করেন। প্রবাসে বা গৃহে যেখানেই থাকুক, সাতটা জিনিস সব সময় কাছে ও বিছানার নিকট রাখতেনঃ তেলের শিশি, চিরুনী, সুর্মাদানী(কালো সুর্মা), কাচি, মেসওয়াক, আয়না এবং এক টুকরো হালকা কাঠ।
রাত্রে শোবার সময় প্রতি চোখে তিনবার করে সুর্মা নিতেন। শেষ রাতে প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে ওযূ করতেন, পোশাক বদলাতেন, সুগন্ধী লাগাতেন। রায়হান নামক সুগন্ধী বেশী পছন্দ করতেন। মেহেন্দীর ফুলের সুগন্ধীও ভালোবাসতেন। সবচেয়ে বেশী প্রিয় ছিল মেশক ও চন্দনের সুগন্ধী।
বাড়ীতে সুগন্ধী দ্রব্যের ধুঁয়া ছড়াতেন। একটা আতরদানীতে উচ্চমানের সুগন্ধী থাকতো এবং ব্যবহৃত হতো। (কখনো কখনো হযরত আয়েশা নিজ হাতে সুগন্ধী লাগিয়ে দিতেন)। এ কথা সুপ্রসিদ্ধ যে, তিনি যে গলি দিয়ে হেঁটে যেতেন, সে গলি দীর্ঘ সময় সুবাসিত থাকতো। বাতাসই বলে দিত এখান দিয়ে একটু আগে চলে গেছেন সেই চিরবসন্তের বার্তাবাহক। কেউ সুগন্ধী দ্রব্য উপহার দিলে তা অবশ্যই গ্রহণ করতেন। কেউ যদি তাঁর সুগন্ধী উপহার গ্রহণ না করতো, তবে অসন্তুষ্ট হতেন। ইসলামী সংস্কৃতির বিশেষ অভিরুচি অনুযায়ী তিনি পুরুষদের জন্য এমন সুগন্ধী পছন্দ করতেন যার রং অদৃশ্য থাকে এবং সৌরভ চারদিকে ছড়ায়, আর মহিলাদের জন্য এমন সুগন্ধী পছন্দ করতেন, যার রং দেখা যায় এবং সৌরব ছড়ায়না।

চলাফেরা

রসূল (সাঃ) এর চলাফেরায় গাম্ভীর্য, আত্ম সম্মানবোধ, ভদ্রতা ও দায়িত্ববোধ প্রতিফলিত হতো। দৃঢ়ভাবে পা ফেলে চলতেন। অলসভাবে পা ঘসে ঘসে চলতেননা। চলার সময় দেহ থাকতো গুটানো। ডানে-বামে না তাকিয়ে পথ চলতেন। সামনের দিকে সতেজ পা তুলতেন। চলার সময় শরীর কিছুটা সামনের দিকে ঝুকে থাকতো। মনে হতো যেন ওপর থেকে নিচে নামছেন। হিন্দ বিন আবি হালার ভাষায়, ‘তাঁর চলা দেখে মনে হতো পৃথিবী তার চলার সাথে সাথে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। কখনো দ্রুত চললে পা দূরে দূরে রাখতেন। তবে সাধারণত মধ্যম গতিতে চলতেন। কিন্তু হযরত আবু হুরায়রা রাঃ ভাষায় ‘আমাদের পক্ষে তাঁর সাথে চলাই কষ্টকর হতো।’ তাঁর চলার ধরন ছিল সূরা লুকমানের ‘যমীনের ওপর দিয়ে দম্ভভরে চলোনা।’ এই নির্দেশটির বাস্তব প্রতিফলন।

কথা বার্তা

কথাবার্তা মানুষের বিশ্বাস,চরিত্র ও মর্যাদাকে পুরোপুরিভাবে উন্মোচিত করে। কথাবার্তার বিষয় ও শব্দ চয়ন, বাক্যের গঠন, স্বরের উত্থান পতন, বলার ভংগী ও বর্ণনার তেজস্বীতা এই সব কিছু বুঝিয়ে দেয় বক্তা কোন পর্যায়ের ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
রসূল (সাঃ) এর দায়িত্ব ও পদমর্যাদা এমন ছিল যে, সেই গুরুভার অন্য কারো ওপর চাপানো হলে সে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যেত এবং সে নির্জনে থাকা পছন্দ করতো। কিন্তু রসূল(সাঃ) এর অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল এই যে, একদিকে তিনি পাহাড় সমান গুরুদায়িত্ব ও চিন্তার বোঝা বয়ে বেড়াতেন এবং নানা রকম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে তাঁর সময় কাটতো। অপর দিকে লোকজনের সাথে গভীরভাবে মেলামেশা করতেন এবং দিনরাত আলাপ আলোচনাও চলতো। মেযাজে গাম্ভীর্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল হাসি তামাসা ও রসিকতা। পরস্পর বিরোধী গুণাবলীতে তাঁর বিস্ময়কর ভারসাম্য ছিল। একটা বিশ্বজোড়া আন্দোলন, পুরো একটা সাম্রাজ্যের সমস্যাবলী, একটা সমাজ ও সংগঠনের নানা জটিলতা এবং নিজের একটা বিরাট পরিবারের দায়িত্ব তাঁর জন্য পাহাড় সমান বোঝা ছিল। এই বোঝা তাঁরই কাঁধে চাপানো ছিল।ইমাম হাসান (রঃ) তাঁর মামা হিন্দ বিন আবি হালার বরাত দিয়ে বলেন, ‘রসূলুল্লাহ (সাঃ) সব সময় নানা ধরনের ব্যস্ততায় থাকতেন। নানা ধরনের সমস্যা নিয়ে কেবল ভাবতেন আর ভাবতেন। কখনো তিনি এক মুহূর্ত চিন্তামুক্ত থাকতে পারেননি। দীর্ঘ সময় ধরে চুপচাপ থাকতেন। বিনা প্রয়োজনে কথা বলতেন না। [শামায়েলে তিরমিযী, রসূল(সাঃ) এর কথা বলার ধরণ সংক্রান্ত অধ্যায়]।
কিন্তু তিনি একজন প্রচারক ও আহবায়ক এবং একটা আন্দোলনের নেতা ছিলেন। এ জন্য প্রচার, শিক্ষাদান, সংস্কার ও সংশোধন এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত তৎপরতা চালানোর জন্য জনগণের সাথে যোগাযোগ অত্যাবশ্যক ছিল। আর এই যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন মাধ্যম ছিল কথা বলা। তাই সব রকমের আলাপ আলোচনায় অংশ গ্রহণ করাও ছিল তাঁর রীতি। হযরত যায়েদ বিন ছাবেত বলেনঃ ‘যখন আমরা দুনিয়াবী বিষয়ে আলোচনা করতাম, তখন রসূল (সাঃ) তাতেও অংশ নিতেন। যখন আমরা আখেরাতের বিষয়ে কথা বলতাম, তখন তিনিও সে বিষয়ে বক্তব্য রাখতেন। আমরা যখন খানাপিনা সম্পর্কে কোন কথা বলতাম, তখন তিনিও তাতে যোগ দিতেন। কিন্তু এ সব সত্ত্বেও রসূল (সাঃ) কসম খেয়ে বলেছেন যে, আমার মুখ দিয়ে সত্য কথা ও ন্যায্য কথা ছাড়া আর কিছুই বের হয়নি। কোরআনও সাক্ষ্য দিয়েছে যে, তিনি মনগড়া কিছু বলেননা।’
কথা বলার সময় প্রতিটি শব্দ ধীরে ধীরে ও স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতেন যে, শ্রোতা তা সহজেই মুখস্ত করে ফেলতো, এমনকি শব্দগুলো বলার সাথে সাথে গণনাও করা যেত। উম্মে মা’বাদ তাঁর প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন, “তাঁর কথা যেন মুক্তোর মালা।” প্রয়োজনের চেয়ে কথা বেশীও বলতেন না, কমও বলতেন না। বেশী সংক্ষিপ্তভাবেও বলতেন না, অতিরিক্ত লম্বা করেও বলতেন না। কথার ওপর জোর দেয়া, বুঝানো এবং মুখস্থ করার সুবিধার্থে বিশেষ বিশেষ কথা ও শব্দকে তিনবার করে উচ্চারন করতেন। কোন কোন বিষয়ে স্পষ্টোক্তি সমীচীন মনে না করে আভাসে ইংগিতে কথা বলতেন। অশোভন, অশ্লীল ও নির্লজ্জ ধরনের কথাবার্তাকে ঘৃণা করতেন। কথাবার্তার সাথে সাধারণত একটি মুচকি হাসি উপহার দিতেন। আব্দুল্লাহ বিন হারিস বলেন, ‘আমি রসূল সা. এর চেয়ে বেশী মুচকি হাসতে কাউকে দেখিনি।’ এ মুচকি হাসি তাঁর গাম্ভীর্যকে কঠোরতায় পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করতো এবং সাথীদের কাছে আকর্ষণীয়তা বাড়াতো। কথা বলতে বলতে বারবার আকাশের দিকে তাকাতেন। বক্তব্য রাখার মাঝে কোন বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার জন্য হঠাৎ হেলান দেয়া অবস্থা থেকে উঠে সোজা হয়ে বসতেন এবং বিশেষ বাক্যকে বারবার উচ্চারণ করতেন। শ্রোতাদেরকে কোন বিষয়ে সাবধান করতে চাইলে কথার সাথে সাথে মাটিতে হাত দিয়ে থাপড়াতেন। কোন কথা বুঝানোর ব্যাপারে হাত ও আংগুলের ইশারা দিয়েও সাহায্য নিতেন। যেমন, দুটো জিনিসের একত্রে সমাবেশ বুঝাতে তর্জনী ও মধ্যমা আংগুলকে একত্র করে দেখাতেন। কখনোবা দুই হাতের আংগুলগুলোকে পরস্পরের মাঝে ঢুকিয়ে দিয়ে দৃঢ়তা ও একাত্মতার ধারণা স্পষ্ট করতেন। কোন জিনিস বা কোন দিকে ইশারা করতে হলে পুরো হাতকেই নাড়াতেন। কখনো হেলান দিয়ে বসে জরুরী বিষয়ে আলোচনা করার সময় ডান হাতকে বাম হাতের পিঠের ওপর রেখে আংগুল যুক্ত করে নিতেন। বিস্ময় প্রকাশ করার সময় কখনো হাতের তালু উল্টে দিতেন। কখনো ডান হাতের তালু দিয়ে বাম হাতের বুড়ো আংগুলের মধ্যমাংশের ওপর আঘাত করতেন। কখনো মাথা দোলাতেন এবং ঠোঁটকে দাঁত দিয়ে চেপে ধরতেন। আবার কখনো হাত দিয়ে উরু চাপড়াতেন।
মক্কার কুরাইশ গোত্রের এক মার্জিত ভদ্র পরিবারের এই বিশিষ্ট ব্যক্তিটি বনু সা’দ গোত্রের পরিবেশে বেড়ে উঠে আরবের সবচেয়ে নির্ভুল ভাষা তো রপ্ত করছিলেনই, তদুপরি ওহীর প্রাঞ্জল ভাষা তাঁরা বাক্যালাপের মাধুর্যকে আরো পরিশীলিত করে দিয়েছিল। বস্তুত তিনি ছিলেন আরবের সর্বাপেক্ষা সুভাষী মানুষ। রসূল সা. এর ভাষার সাহিত্যিক মান যেমন উচ্চ ও উৎকৃষ্ট ছিল, তেমনি তা ছিল সহজবোধ্য এবং সরলও। সহজবোধ্য ভাষা ব্যবহার করলেও তিনি কখনো নিচুমানের ও অশালীন শব্দ ব্যবহার করেননি, আর কোন কৃত্রিম ধরনের ভাষাও পছন্দ করতেননা। সত্য বলতে কি, রসূল সা. নিজের দাওয়াত ও নিজের লক্ষ্যের প্রয়োজনে একটা নিজস্ব ভাষা তৈরী করে নিয়েছিলেন এবং একটা স্বতন্ত্র বাচনভংগীও বানিয়ে নিয়েছিলেন। রসূল সা. এর একটি উক্তি ‘যুক্ত একটা কৌশল’ এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ছা’লাব বলেছেন যে, এটা রসূল সা. এর বিশেষ ভাষা। তিনি বহু পরিভাষা তৈরী করছেন। বহু নতুন বাগধারা, উপমা ও উদাহরণ উদ্ভাবন করেছেন। বক্তৃতার এক নতুন পদ্ধতি প্রচলন করেছেন, এবং প্রচলিত বহু শব্দ ও পদ্ধতি বর্জন করেছেন। একবার বনু নাহদ গোত্রের কয়েক ব্যক্তি এল এবং দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর সাথে আলাপ আলোচনা করলো। এই আলোচনার সময় আগন্তুকগণ অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে, ‘হে রসূলুল্লাহ, আপনি ও আমরা একই মা বাপের সন্তান এবং একই জায়গায় লালিত পালিত হয়েছি। তবুও আপনি এমন আরবীতে কথা বলেন, যার মর্মার্থ আমাদের অধিকাংশ লোকই বুঝতে পারেনা। এর রহস্যটা কী?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহ্‌ স্বয়ং আমাকে ভাষা ও সাহিত্য শিখিয়েছেন, তাই সর্বোত্তম ভাশাই শিখিয়েছেন। তাছাড়া আমি বনু সা’দ গোত্রে পালিত হয়েছি। এটাই এর রহস্য।’ একবার জনৈক সাক্ষাতপ্রার্থীর সাথে কথা বলছিলেন এবং হযরত আবু বকর গভীর মনোযোগ দিয়ে তা শুনছিলেন। তিনি জিজ্ঞাস করলেন, ‘এই লোক আপনাকে কী বলেছে এবং আপনি কী বলেছেন?’ রসূল সা. বুঝিয়ে দিলেন। অতঃপর হযরত আবু বকর বলতে লাগলেন, ‘আমি সমগ্র আরবের আনাচে কানাচে ঘুরেছি এবং আরবের শ্রেষ্ঠ বাগ্মীদের বিশুদ্ধ ও সাবলীল বক্তব্য শুনেছি। কিন্তু আপনার চেয়ে মিষ্টিমধুর কথা আর কারো মুখ থেকে শুনিনি।’ এখানেও রসূল সা. একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন যে, আল্লাহ্‌ই আমাকে ভাষা শিখিয়েছেন এবং আমি বনু সা’দ গোত্রে লালিত পালিত হয়েছি। অনুরূপভাবে একবার হযরত ওমর রা. বললেন, হে রাসূল আপনিতো কখনো আমাদের কাছ থেকে দূরে থাকেননি, তবু আপনি আমাদের সবার চেয়ে সুন্দর ও বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন কিভাবে? তিনি বললেন, ‘আমার ভাষা ইসমাঈল আ. এর ভাষা। ওটা আমি বিশেষভাবে শিখেছি। জিবরীল এ ভাষাই আমার কাছে নিয়ে এসেছে এবং আমার অন্তরে তা বদ্ধমূল করেছেন।’ অর্থাৎ রসূল সা. এর ভাষা সাধারণ আরবী ছিলনা, বরং বিশেষ নবীসুলভ ভাষা ছিল এবং তা হযরত ইসমাঈলের ভাষার অনুরূপ ছিল। আর জিবরীল যে ভাষায় কোরআন নাযিল করতেন তাও ছিল সেই নবী সুলভ ভাষা।
এখানে মনে রাখা দরকার যে, বড় বড় ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, বিশেষতঃ নবীগণ, যারা একটি বিশেষ ব্রত ও লক্ষ্য নিয়ে এসে পরিবেশের সাথে দ্বন্দ্ব সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন এবং যাদের মধ্যে সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের আবেগ বিরাজ করে, তারা যখন কথা বলেন, তখন তাতে তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের মহত্ব গভীর তাৎপর্য ফুটিয়ে তোলে, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা তার সাহিত্যিক মানকে উন্নত করে এবং তাদের চারিত্রিক শ্রেষ্ঠত্ব তাকে পবিত্রতর করে।
রসূল সা. এর অন্যতম বিশিষ্ট ছিল এই যে, তাঁকে ‘জাওয়ামিউল কামিল’ দ্বারা ভূষিত করা হয়েছিল। তিনি নিজেই বলেছেন, [মুসলিমঃ আবু হুরাইয়রা (রা)] (আমাকে ‘জাওয়ামিউল কালিম’ দেয়া হয়েছে।) রসূল সা. এর সংক্ষিপ্ততম বাক্যগুলো ব্যাপক তাৎপর্য বহন করে তাকেই বলা হয় ‘জাওয়ামিউল কালিম’। স্বল্পতম শব্দে ব্যাপকতম অর্থ বুঝানোতে রসূল সা. এর জুড়ি ছিলনা এবং একে তিনি আল্লাহ্‌র বিশেষ দান বলে গণ্য করেছেন।
এখানে তাঁর জাওয়ামিউল কালিমের কিছু উদাহরণ দেয়া যাচ্ছেঃ-
১। (*******) মানুষ যাকে ভালোবাসে, কেয়ামতের দিন তার সাথেই থাকবে।
২। (*******) মুসলিম হও শান্তিতে থাকতে পারবে। [রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নামে প্রেরিত দাওয়াত পত্রের অংশ।]
৩। (******) নিয়ত অনুসারে কাজের বিচার হবে।
৪। (******) যে কাজ করে, সে কেবল আপন নিয়ত অনুযায়ীই তার ফল পায়।
৫। (******) সন্তান যারা গৃহে ভূমিষ্ঠ হয়, তার। আর ব্যভিচারীর জন্য পাথর।
৬। (******) যুদ্ধ একটি কৌশল।
৭। (******) দেখা ও শোনা এক কথা নয়।
৮। (******) বৈঠকের জন্য বিশ্বস্ততা জরুরী।
৯। (******) খারাপ কাজ বর্জন করাও একটা ভালো কাজ।
১০। (******) জনগণের যিনি সেবা করেন, তিনিই তাদের নেতা।
১১। (******) প্রত্যেক সৌভাগ্যশালী ব্যক্তির প্রতি ঈর্ষা পোষণ করা হয়।
১২। (******) ভালো কথা বলাও সৎ কাজের শামিল।
১৩। (******) যে দয়া করেনা, সে দয়া পায়না।
সাধারণত ভাষা, বাচনভংগী ও বিষয়বস্তু দ্বারা রসূল সা. এর উক্তি চেনা যায়। হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থাবলীতে রসূল সা. এর উক্তি সমূহ মুক্তার মত উজ্জ্বল। অল্প ক’টা শব্দ, শব্দগুলোর মধ্যে চমৎকার সমন্বয়, অর্থের গভীরতা ও হৃদয়ে প্রভাব সৃষ্টিকারী আন্তরিকতা রসূল সা. এর কথায় উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট। এ সব বৈশিষ্টে সমৃদ্ধ দু’ একটা কথা উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করছিঃ
আমি তোমাদেরকে সদা সর্বদা আল্লাহ্‌কে ভয় করার উপদেশ দিচ্ছি। সামষ্টিক ব্যবস্থার জন্য নেতার আদেশ শ্রবণ ও অনুসরণের জোর আহ্বান জানাচ্ছি চাই সে নেতা কোন নিগ্রো ক্রীতদাসই হোকনা কেন। কেননা তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে বেঁচে থাকবে, তারা অসংখ্য মতভেদে লিপ্ত থাকবে। এমতাবস্থায় তোমাদের কর্তব্য আমার ও আমার সুপথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের পথ অবলম্বন করা, তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা এবং দাঁতের মাড়ি দিয়ে চেপে ধরা। সাবধান, ইসলামের মধ্যে নতুন নতুন নিয়ম চালু করা থেকে বিরত থেকো। কেননা প্রত্যেক নতুন নিয়ম বেদয়াত। আর প্রত্যেক বেদয়াত গোমরাহী।২৪ [২৪. মিশকাত- বাবুল ইতিসাম বিন কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ ]।
আমর বিন আবাসা রা. রসূল সা. এর কাছে কিছু প্রশ্ন রাখেন এবং তিনি এগুলোর খুব সংক্ষিপ্ত ও ক্ষুদ্র জবাব দেন। এই ক্ষুদ্র সংলাপটি লক্ষ্য করুন !
- এই কাজে (ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনে) প্রথম প্রথম আপনার সাথে কে কে ছিল?
- একজন স্বাধীন মানুষ (হযরত আবু বকর) এবং একজন ক্রীতদাস (হযরত যায়েদ)।
- ইসলাম কী?
- ভালো কথা বলা ও ক্ষুধার্তদের খাওয়ানো।
- ঈমান কী?
- ধৈর্য ও দানশীলতা।
- কার ইসলাম সর্বোত্তম?
- যার জিহ্বা ও হাতের বাড়াবাড়ি (অর্থাৎ মন্দ কাজ ও মন্দ কথা) থেকে মানুষ নিরাপদে থাকে।
- কার ঈমান উৎকৃষ্ট?
- যার চরিত্র ভালো তার।
- কি ধরনের নামায উত্তম?
- যে নামাযে বিনয়ের সাথে দীর্ঘ সময় দাঁড়ানো হয়।
- কি ধরনের হিজরত উত্তম?
- তোমার প্রতিপালকের অপছন্দনীয় জিনিসগুলোকে চিরতরে পরিত্যাগ করা।
- কোন জেহাদ উত্তম?
- সেই ব্যক্তির জেহাদ, যার ঘোরাও রণাঙ্গনে মারা যায় আর সে নিজেও শহীদ হয়।
- কোন সময়টা (এবাদতের জন্য) সর্বোত্তম?
- রাতের শেষ প্রহর। [মেশকাত- কিতাবুল ঈমান।]
একবার জিজ্ঞাসা করা হলো, প্রধানত কোন জিনিস মানুষের জন্য জাহান্নাম অনিবার্য করে তোলে? তিনি জবাব দিলেন, “মুখ ও লজ্জাস্থান।” [তিরমিযী- আবু হুরায়রা বর্ণিত।] মুখ দ্বারা বুঝানো হয়েছে কথা ও খাদ্য। আর লজ্জাস্থান দ্বারা বুঝানো হয়েছে অবৈধ যৌনাচার। অর্থাৎ খারাপ কথা, হারাম জীবিকা ও যৌন বিপথগামিতা মানুষের আখেরাতের ধ্বংসকারী সবচেয়ে বড় উপকরণ। অধিকাংশ যুলুম, নির্যাতন, দ্বন্দ্ব সংঘাতগুলোও এগুলো থেকেই জন্ম নেয়।
একবার হযরত আলী অনুরোধ করলেন, আপনি নিজের নীতি ব্যাখ্যা করুন। তিনি এর জবাবে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ এত অলংকার মণ্ডিত ভাষায় নিজের চিন্তাধারা, স্বভাব ও আধ্যাত্মিকতার এমন ব্যাপক চিত্র তুলে ধরলেন, যা মানুষের ভাষার ইতিহাসে এক অলৌকিক নিদর্শন। তিনি বললেনঃ
“আল্লাহ্‌র পরিচয় আমার পুঁজি, বুদ্ধি আমার দীনের মূল, ভালোবাসা আমার ভিত্তি। আকাংখা আমার বাহন, আল্লাহ্‌র স্মরণ আমার বন্ধু, আস্থা ও বিশ্বাস আমার সাথী, জ্ঞান আমার অঙ্গ, ধৈর্য আমার পোশাক, আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি আমার জন্য অতিবড় নিয়ামত, বিনয় আমার সম্মান, যোহাদ তথা পার্থিব সম্পদ নিস্পৃহতা আমার পেশা, প্রত্যয় আমার শক্তি (উচ্চারণ ভেদে অর্থ খাদ্য), সত্যবাদীতা আমার সুপারিশকারী। আনুগত্য আমার রক্ষাকবচ, জেহাদ আমার চরিত্র আর নামায আমার চক্ষু শীতলকারী।” [কাজী আইয়াযঃ আশ শিফা।]
উদাহরণ ও উপমার অনেক বিরল দৃষ্টান্ত রসূল সা. এর কথায় পাওয়া যায়। এগুলোর সাহায্যে তিনি বেদুইনদেরকে অনেক বড় বড় জিনিস বুঝিয়ে দিতেন। এখানে তার একটি উপস্থাপন করছিঃ
“আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাকে হেদায়াত ও এলমের যে পুঁজি দান করেছেন, তার উদাহরণ এরূপ, যেন পৃথিবীতে মুষলধারে বৃষ্টি হলো। তারপর পৃথিবীর যে অংশটা সবচেয়ে উর্বর, তা পানিকে খুব চুষে নিল। এর ফলে ঢলে পড়া তরুলতা সব তরতাজা হয়ে গেল এবং নতুন নতুন গাছ গাছালি জন্ম নিল। এ ছাড়া ভূমির কিছু শক্ত অংশ এমনও ছিল, যা পানিকে তার ভেতরে সঞ্চিত করে রাখলো এবং আল্লাহ তাতে মানুষের জন্য বহু উপকার নিহিত রাখছেন। তিনি তা থেকে পানি সেচ করালেন। তারপর এই পানি তিনি অন্য একটা ভুখন্ডেও বর্ষালেন যা পাথরে পরিপূর্ণ ছিল। এই মাটি পানিকে সঞ্চয় করেও রাখলোনা, নিজের ভেতরে শুষে নিয়ে উর্বরতার লক্ষণও দেখালোনা। এর একটি হলো সেই সব লোকদের উদাহরণ যারা ইসলামের জ্ঞান অর্জন করে এবং আল্লাহ আমাকে যে নির্দেশাবলী দিয়েছেন তা দ্বারা উপকৃত হয়। তারা নিজেরাও ইসলামের জ্ঞান অর্জন করে এবং অন্যদেরকেও শেখায়। দ্বিতীয় উদাহরণটা যারা আমার দাওয়াতকে এবং আমার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র পাঠানো হেদায়াতকে গ্রহণ করেনি তাদের।”
রসূল সা. এর কথা বলার নীতিকে যদি কোন শিরোনাম দিতে হয়, তবে তা কোরআনের এই বাক্য দ্বারা দেয়া চলে যে, “মানুশকে আকর্ষণীয় ভাষায় আহ্বান জানাও।” রসূল সা. এর চিত্তাকর্ষক বাক রীতিতে সরলতার ভাব নিহিত ছিল, কৃত্রিমতা থেকে তিনি থাকতেন বহুদুরে। তিনি বলেনঃ
“তোমাদের মধ্যে যারা কেয়ামতের দিন আমার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশী দূরে থাকবে তারা হলো ঐ সবলোক যারা অতিরঞ্জিত করে কথা বলে, বেশী কথা বলে এবং কথার মধ্যে দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে।”
তাছাড়া বাচালতাপূর্ণ ও অশ্লীল কথাবার্তাও তিনি খুবই অপছন্দ করতেন। তাঁর মজলিস সব সময় হাস্যোজ্জল থাকতো এবং তাঁর চেহারাই ছিল সবচেয়ে বেশী হাসিময়, যদিও কঠিন দায়িত্ব ও বিপদমুসিবতে প্রায় সর্বদাই ঘেরাও হয়ে থাকতেন।

বক্তৃতা

কথাবার্তারই একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বক্তৃতা। রসূল সা. মানব জাতির জন্য একটা বিরাট ও মূল্যবান বার্তা বয়ে এনেছিলেন এবং সে জন্য বক্তৃতা ছিল অপরিহার্য। আরবরা এমনিতেও সুবক্তা হতো। বিশেষত কুরাইশগণ হতো অসাধারণ বক্তৃতা শক্তির অধিকারী। আরব ও কুরাইশদের বক্তৃতার পরিবেশ থেকে রসূল সা. অনেক ঊর্ধে থাকতেন। নেতাসূলভ কর্তব্যের তাগিদে কখনো বক্তৃতা দেয়ার প্রয়োজন হলে তিনি কাল বিলম্ব না করেই সময়োপযোগী ভাষণ দিতেন। তখন তার জিহ্বা কখনো ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসের মত, কখনো প্রবল স্রোতধারার মত এবং কখনো ধারালো তরবারীর মত সক্রিয় হয়ে উঠতো।
তবে তিনি বেশী ঘন ঘন বক্তৃতা ও ভাষণ দেয়া থেকে বিরত থাকতেন। সমাজের প্রয়োজন ও তার সার্বিক পরিবেশ অনুসারে ভারসাম্যপূর্ণ বক্তৃতা দিতেন। মসজিদে বক্তৃতা দিলে নিজের লাঠির ওপর ভর দিয়ে দাড়াঁতেন, আর যুদ্ধের ময়দানে ভাষণ দিলে কামানের ওপর হেলান দিয়ে দাড়াঁতেন। কখনো কখনো বাহন জন্তূর পিঠের ওপর বসে ভাষণ দিতেন। বক্তৃতার সময় শরীর ডান দিকে ও বাম দিকে ঈষৎ ঝুঁকে যেত। প্রয়োজনমত হাত নাড়তেন। বক্তৃতার মধ্যে কখনো কখনো ‘যার হাতে আমার প্রাণ, বা যার হাতে মুহাম্মদের জীবন তার শপথ’ এই বলে শপথ করতেন। তাঁর মনের ভাবাবেগ তাঁর স্বরে ও চেহারায় সমভাবে প্রতিফলিত হতো এবং শ্রোতাদের ওপরও তার প্রভাব পড়তো। এই মহামানবের ভাষণ মানুষের মনকে প্রচন্ডভাবে আলোড়িত করতো। এখানে আমি শুধু দুটো উদাহরণ দেবো। হোনায়ন ও তায়েফ যুদ্ধের পর রসূল সা. যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বন্টন করার সময় কোরআনের সুস্পষ্ট বিধান মোতাবেক মাক্কার নওমুসলিম সরদারদেরকে বেশ বড় বড় অংশ দিলেন, যাতে তাদের মন আরো নরম হয় এবং তারা মহানুভবতার বন্ধন দ্বারা ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে আরো ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ হয়। আনসারগণের মধ্যে কেউ কেউ এতে তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন। তারা বললেনঃ
“রসূল সা. কুরাইশদের অনেক পুরস্কার দিলেন, আর আমাদেরকে বঞ্চিত রাখলেন। অথচ আমাদের তলোয়ার থেকে এখনো রক্তের ফোঁটা ঝরছে’’ কেউবা বললেন‍ঃ
“বিপদাপদে আমাদের কথা মনে পড়ে। কিন্তু যুদ্ধলব্ধ সম্পদ পেয়ে যায় অন্যরা।’’
এই সব কথাবার্তা রসূল সা. এর কানেও গেল। তখন একটা চামড়ার তাঁবু খাটিয়ে সেখানে আনসারদের সমবেত করা হলো। রসূল সা. তাদের জিজ্ঞাসা করলেনঃ “তোমরা কি এ সব কথা বলেছ?’’ জবাব দেয়া হলোঃ “আপনি যা শুনেছেন তা সত্যি। তবে এ সব কথা আমাদের দায়িত্বশীল লোকেরা বলেনি। কতক যুবক এ কথাগুলো বলেছে।’’ পুরো ঘটনার তদন্ত শেষে রসূল সা. নিম্নরূপ ভাষণ দিলেনঃ
‘এ কথা কি সত্য নয় যে, তোমরা প্রথমে পথভ্রষ্ট ছিলে, অতঃপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের সুপথে পরিচালিত করলেন? তোমরা কতটা বিচ্ছিন্ন ছিলে, আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন? তোমরা দরিদ্র ছিলে, আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের স্বচ্ছল বানিয়েছেন? (প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে আনসারগণ বলছিলেন, নিসন্দেহে আমাদের ওপর আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অনেক দান রয়েছে।)
‘না, তোমরা বরং জবাবে এ কথাও বলতে পারতে যে, হে মুহাম্মদ, তোমাকে যখন সবাই প্রত্যাখ্যান করেছে, আমরা তখন তোমার ওপর ঈমান এনেছি। তোমাকে যখন লোকেরা বিতাড়িত করেছে, আমরা তখন তোমাকে আশ্রয় দিয়েছি। তুমি যখন নিসম্বল অবস্থায় এসেছিলে, আমরা তখন তোমাকে সাহায্যে করেছিলাম। তোমরা যদি জবাবে এসব কথা বল, আমি অবশ্যই বলবো যে, তোমাদের কথা সত্য। কিন্তু ওহে আনসারগণ! তোমাদের কি এটা পছন্দ নয় যে, অন্য সবাই উট ছাগল ইত্যাদি নিয়ে যাক, আর তোমরা মুহাম্মদ সা. কে নিয়ে ‍বাড়ী চলে যাও? (বোখারী)
কথার চড়াই উৎরাই দেখুন, নাযুক ভাবাবেগ দ্বারা শানিত বক্তৃতার তেজ দেখুন, ভাষণের প্রাঞ্জলতা দেখুন এবং তারপর ভাবুন যে, বক্তা কিভাবে শ্রোতাদের মধ্যে ইপ্সিত প্রেরণার সঞ্চার করলেন। আনসারগণ স্বতস্ফূর্তভাবে চিৎকার করে বলে উঠলেনঃ “আমরা শুধু মুহাম্মদ সা. কে চাই, আর কিছু চাইনা।’’
দাওয়াতের সূচনা পর্বে সাফা পর্বতের ওপর থেকে প্রদত্ত ভাষণ ছাড়াও তিনি একাধিকবার কুরাইশদের সামনে ভাষণ দিয়েছেন। এই যুগের একটা ভাষণের উদ্ধৃতি লক্ষ্যণীয়ঃ
“কাফেলার পথপ্রদর্শক কখনো কাফেলাকে ভুল তথ্য জানায়না। আল্লাহর কসম, আমি যদি অন্য সকলের সাথে মিথ্যা বলতে রাযীও হয়ে যেতাম, তবুও তোমাদের সাথে মিথ্যা বলতামনা। অন্য সবাইকে যদি ধোকা দিতাম, তবুও তোমাদের ধোকা দিতামনা। সেই আল্লাহর শপথ যিনি ছাড়া আর কেউ এবাদত উপাসনা পাওয়ার যোগ্য নেই, আমি তোমাদের কাছে বিশেষভাবে এবং সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে সামগ্রিকভাবে আল্লাহর রসূল। আল্লাহর কসম, তোমরা যেমন ঘুমাও ও ঘুম থেকে জাগো, তেমনি তোমাদের মৃত্যু ও মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন সুনিশ্চিত। তোমাদের কাছ থেকে অবশ্যই তোমাদের কৃত কর্মের হিসাব নেয়া হবে এবং তোমাদেরকে ভালো কাজের ভালো প্রতিফলন ও মন্দ কাজের মন্দ পরিণাম তোমাদের ভোগ করতেই হবে। অতপর হয় চিরদিনের জন্য জান্নাত, নচেত চিরদিনের জন্য জাহান্নাম।’’
কত সরল ও সাবলীল বর্ণনাভংগী এবং কত যুক্তিপূর্ণ এবং আবেগপূর্ণ আবেদন। আহ্বায়কের হিতাকাংখা প্রতিটি শব্দের মধ্য দিয়ে নিসৃত হয়ে পড়েছে। প্রতিটি বাক্য বিশ্বাস ও প্রত্যয় দ্বারা পরিপূর্ণ। এই ক্ষুদ্র ভাষণটিতে উদাহরণও দেয়া হয়েছে। তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের মৌলিক দাওয়াত এতে পরিপূর্ণভাবে অন্তর্ভুক্ত।
রসূলের সা. আরো দুটো ঐতিহাসিক ভাষণ রয়েছে। একটা মক্কা বিজয়ের পর এবং অপরটি বিদায় হজ্জের সময় দিয়েছিলেন। এই ভাষণ দুটি একেবারেই বৈপ্লবিক প্রকৃতির এবং ঐ দুটোতে ঈমান, নৈতিকতা ও ক্ষমতা–তিনটেরই প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। বিদায় হজ্জের ভাষণ তো বলতে গেলে একটা নবযুগের উদ্ভোধনের ঘোষণা।

সাধারণ সামাজিক যোগাযোগ

সাধারণত বড় বড় কাজ যারা করেন, তারা সর্বশ্রেণীর মানুষের সাথে যোগাযোগ করার সময় পান না এবং সব দিকে মনোযোগও দিতে পারেন না। উচুঁ স্তরের লোকদের অনেকের মধ্যে নির্জনতা প্রিয় ও মেযাজের রূক্ষতার সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ দাম্ভিকতায় লিপ্ত হয়ে নিজের জন্য স্বতন্ত্র এক ভূবন তৈরী করে নেয়। কিন্তু রসূল সা. ছিলেন এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েও এবং ইতিহাসের গতি পরিবর্তনকারী কীর্তি সম্পন্ন করেও তিনি সর্বস্তরের জনগণের সাথে সার্বক্ষণিক সংযোগ বজায় রাখতেন। সমাজের ব্যক্তিবর্গের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রক্ষা করতেন। জন বিচ্ছিন্নতা, ধাম্ভিকতা বা রুক্ষতার নামগন্ধও তাঁর মধ্যে ছিলনা। আসলে তিনি যে ভ্রাতৃত্বমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, তার অপরিহার্য দাবি ছিল জনগণ নিজেদের মধ্যে গভীর পারস্পরিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকুক। একে অপরের উপকার করুক এবং একে অপরের অধিকার সম্পর্কে অবগত থাকুক। আজকের পাশ্চাত্য জগতে যে ধরণের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির জন্ম হচ্ছে, তা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এ সংস্কৃতিতে কারো সাথে কারো কোন সম্পর্কে থাকেনা। এই সম্পর্কহীনতা এখন এক মানবতা বিধ্বংসী উপকরণে পরিণত হয়েছে। আজ ‍তাই মুহাম্মদ সা. এর নেতৃত্বে এই পরিবেশটাকে পাল্টে ফেলা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আসুন, রসূল সা. কে সাধারণ সামাজিক সংযোগের প্রেক্ষাপটে পর্যবেক্ষণ করি।
তাঁর রীতি ছিল পথে যার সাথে দেখা হোক প্রথমে ছালাম দেয়া। কাউকে কোন খবর দিতে হলে সেই সাথে ছালাম পাঠাতে ভুলতেননা। তাঁর কাছে কেউ কারো ছালাম পৌঁছালে ছালামের প্রেরক ও বাহক উভয়কে পৃথক পৃথকভাবে ছালাম দিতেন। একবার এক শিশু কিশোরের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের ছালাম দিয়েছিলেন। মহিলাদের নিকট যাওয়ার সময় তাদেরকেও ছালাম দিতেন। বাড়ীতে প্রবেশকালে ও বাড়ী থেকে বেরুবার সময় পরিবার পরিজন ছালাম দিতেন। বন্ধুবান্ধবের সাথে হাতও মেলাতেন, আলিঙ্গনও করতেন। হাত মেলানোর পর অপর ব্যক্তি হাত না সরানো পযন্ত তিনি হাত সরাতেন না।
যখন বৈঠকাদিতে যেতেন, তখন সাহাবীগণ তাঁর সম্মানে উঠে দাঁড়াক, এটা পছন্দ করতেন না। বৈঠকের এক পাশেই বসে পড়তেন। ঘাড় ডিংগিয়ে ভেতরে ঢুকতেন না। তিনি বলতেনঃ ‘আল্লাহর একজন সাধারণ বান্দা যেভাবে ওঠাবসা করে, আমি ও সেভাবেই ওঠাবসা করি।’ - হযরত আয়েশা কতৃক বণিত।
নিজের হাটু সংগীদের চেয়ে আগে বাড়িয়ে বসতেননা। কেউ তাঁর কাছে এলে তাঁকে নিজের চাদর বিছিয়ে বসতে দিতেন। ‍আগন্তুক নিজে না ওঠা পর্যন্ত তিনি বৈঠক ছেড়ে উঠতেন না।
কোন বৈঠকে অবান্তর বিষয়ে আলোচনার জন্য তুলতেননা। বরং যে বিষয়ে আলোচনা চলছে, তাতেই অংশ গ্রহণ করতেন। ফজরের জামায়াতের পর বৈঠক বসতো এবং সাহাবায়ে কেরামের সাথে অনেক কথাবার্তা বলতেন। কখনো জাহেলী যুগের কাহিনী এসে গেলে তা নিয়ে বেশ হাসাহাসি হতো। [জাবের বিন সামুরা (রা) কতৃক বণিত।] সাহাবীগণ কবিতাও পড়তেন। যে বিষয়ে বৈঠকের লোকদের মুখমন্ডলে বিরক্তি ও একঘেয়েমির চিহ্ন ফুটে উঠতো, সে বিষয় পরিবর্তন করতেন। বৈঠকের প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতি মনোযোগ দিতেন, যাতে কেউ অনুভব না করে যে, তিনি তার উপর অন্য কাউকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। কথার মাঝখানে কেউ অবান্তর প্রশ্ন তুললে তার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আলোচনা চালিয়ে যেতেন এবং আলোচনা শেষ করে ঐ ব্যক্তির দিকে মনোযোগ দিতেন। আলাপরত ব্যক্তির দিক থেকে ততক্ষণ মুখ ফেরাতেন না, যতক্ষণ সে নিজে মুখ ফিরিয়ে না নেয়। কেউ কানে কানে কথা বললে সেই ব্যক্তি যতক্ষণ কথা শেষ না করে মুখ না সরায়, ততক্ষণ এক নাগাড়ে তার ‍দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে রাখতেন। নেহাৎ অন্যায় কথা না বললে কারো কথার মাঝখানে হস্তক্ষেপ করতেন না। এরূপ ক্ষেত্রে হয় ভুল ধরিয়ে দিতেন, নচেত ‍তার মুখমন্ডলে অসন্তোষের চিহ্ন ফুটে উঠতো, নয়তো উঠে চলে যেতেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করা পছন্দ করতেন না। অপ্রীতিকর বিষয়কে হয় এড়িয়ে যেতেন। নচেত আপত্তি জানানোর সাধারণ রীতি এই ছিল যে, সরাসরি নাম নিয়ে বিষয়টির উল্লেখ করতেন, বরং সাধারণভাবে ইংগিত করতেন কিংবা সামাজিকভাবে উপদেশ দিতেন। অত্যধিক বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হলে, যা কেবল ইসলামী বিষয়ের ক্ষেত্রেই সৃষ্টি হতো, বন্ধুবান্ধবকে সচেতন করার জন্য তিনি কয়েকটি পন্থা অবলম্বন করতেন। হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তাঁর কাছে এলে তার সালাম গ্রহণ করতেন না, কিংবা তার দিকে মনোযোগ দিতেন না। কোন অবাঞ্চিত লোক এসে পড়লেও ‍হাসিমুখে তাকে স্বাগত জানাতেন। একবার এমন এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এল, ‍যাকে তিনি সংশ্লিষ্ট গোত্রের নিকৃষ্টতম ব্যক্তি বলে মনে করতেন। কিন্তু তিনি তার সাথে অমায়িকভাবে কথাবাতা বললেন। এটা দেখে হযরত আয়েশা বিস্ময় প্রকাশ করলে তিনি বললেনঃ আল্লাহর কছম, যে ব্যক্তির দুর্ব্যবহারের ভয়ে লোকেরা তার সাথে মেলামেশাই বন্ধ করে দেয়, কেয়ামতের দিন সে আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি বলে গণ্য হবে। [আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া, পৃঃ ২৯১]
কারো সাথে সাক্ষাত করতে গেলে দরজার ডান দিকে বা বাম দিকে দাঁড়িয়ে নিজের উপস্থিতির কথা জানাতেন এবং ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নেওয়ার জন্য তিনবার সালাম করতেন। সালামের জবাব না পেলে কোন রকম বিরক্ত না হয়ে ফিরে যেতেন। রাতের বেলায় কারো সাথে দেখা করতে গেলে এমন আওয়াযে সালাম করতেন যেন সে জাগ্রত থাকলে শুনতে পায়, আর ঘুমিয়ে গিয়ে থাকলে তার ঘুমের ব্যাঘাত না হয়।
তাঁর শরীর বা কাপড় থেকে কেউ ধূলি বা খড়কুটা সরিয়ে দিলে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলতেনঃ ‘আল্লাহ যেন কোন অপ্রীতিকর জিনিস তোমার কাছ থেকে দূর করে দেন।’ উপহার গ্রহণ করতেন এবং পাল্টা উপহার দেয়ার কথা মনে রাখতেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেউ তাঁর দ্বারা কষ্ট পেলে তাকে প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার দিতেন এবং কখনোবা তাকে বিনিময়ে কোন উপহার দিতেন। কেউ নতুন কাপড় পরে তাঁর সামনে এলে বলতেনঃ ****** ‘চমকার, চমৎকার, যত দীঘদিন পার ব্যবহার কর এবং পুরানো হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ব্যবহার কর।’ খারাপ ব্যবহারের প্রতিশোধ খারাপ ব্যবহার দ্বারা নিতেন না। ক্ষমা করতেন। অন্যদের অপরাধ যখন ক্ষমা করতেন, তখন সেটা জানানোর জন্য প্রতীক স্বরূপ নিজের পাগড়ী পাঠিয়ে দিতেন। কেউ ডাক দিলে সব সময় ‘লাব্বাইক’ বলে ডাক শুনতেন, চাই সে নিজের পরিবারের লোক বা নিজের সাহাবীগণের মধ্য থেকে কেউ হোক না কেন।
রোগী দেখতে যেতেন যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে। শিয়রে বসে জিজ্ঞেস করতেন তুমি কেমন আছ? রুগ্ন ব্যক্তির কপালে ও ধমনীতে হাত রাখতেন। কখনোবা বুকে, পেটে ও মুখমন্ডলে সস্নেহে হাত বুলাতেন। রোগী কি খেয়েছে জিজ্ঞেস করতেন। সে কোন কিছুর প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করলে তা ক্ষতিকর না হলে এনে দিতেন। সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বলতেনঃ ‘চিন্তার কোন কারণ নেই, আল্লাহ চাহে তো অচিরেই তুমি রোগমুক্ত হবে।’ রোগ মুক্তির জন্য দোয়া করতেন। হযরত সা’দের জন্য তিনবার দোয়া করেছিলেন। মোশরেক চাচাদেরও রোগব্যাধি হলে দেখতে যেতেন। একটা রুগ্ন ইহুদী শিশুকেও তিনি দেখতে গিয়েছিলেন। (শিশুাটি পরবর্তীতে ঈমান এনেছিল)। এ কাজের জন্য কোন দিন বা সময় নিদিষ্ট থাকতো না। যখনই খবর পেতেন এবং সময় পেতেন দেখতে যেতেন।
একবার হযরত জাবেরের অসুখ হলো। রসূল সা. হযরত আবু বকরকে সাথে নিয়ে পায়ে হেটে অনেক দূর পর্যন্ত গেলেন। (মদীনার জনবসতি ছড়ানো ছিটানো ছিল।) হযরত জাবের বেহুশ অবস্থায় ছিলেন। তিনি তাঁকে দেখে ওযু করলেন, পানি ছিটিয়ে দিলেন এবং দোয়া করলেন। এতে রোগীর অবস্থার উন্নতি হতে লাগলো। এমনকি হযরত জাবের কথাবার্তা বললেন এবং নিজের সম্পত্তি সম্পর্কে মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করলেন।
তিনি এতটা মানবদরদী ছিলেন যে, এমনকি মুনাফিকদের নেতা রোগাক্রান্ত আব্দুল্লাহ বিন উবাইকেও দেখতে গিয়েছিলেন।
কেউ মারা গেলে সেখানে চলে যেতেন। মুমূর্ষ অবস্থায় খবর পেলে বা ডাকা হলে গিয়ে তাওহীদের ব্যাপারে ও আল্লাহর দিকে মনোযোগ দেয়ার ব্যাপারে নসিহত করতেন। মৃত ব্যক্তির আত্মীয় স্বজনকে সমবেদনা জ্ঞাপন করতেন, ধৈর্যরে উপদেশ দিতেন এবং চিৎকার করে কাঁদতে নিষেধ করতেন। সাদা কাপড়ে কাফন দিতে তাগিদ দিতেন এবং দাফন কাফন দ্রুত সম্পন্ন করতে বলতেন। দাফনের জন্য লাশ নিয়ে যাবার সময় সাথে সাথে যেতেন। মুসলমানদের জানাযা নিজেই পড়াতেন এবং গুনাহ মাফ করার জন্য দোয়া করতেন। কোন লাশ যেতে দেখলে তৎক্ষণাত দাঁড়িয়ে যেতেন, চাই সে লাশ কোন অমুসলিমেরই হোক না কেন। (কোন কোন বর্ণনায় রসুল সা.) বসে থাকতেন এ কথাও বলা হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন, দাঁড়ানোর রীতি রহিত হয়ে গিয়েছিল। (যাদুল মায়াদ ১৪৫ পৃঃ)। তিনি প্রতিবেশীদের উপদেশ দিতেন মৃতের পরিবারের জন্য খাবার ‍পাঠাতে। (আজকাল উল্টো মৃতের বাড়ীতে অন্যদের ভোজের আয়োজন হয়ে থাকে)। আনুষ্ঠানিক শোক সভা কয়েকদিন পর্যন্ত চলতে থাকাকে খুবই অপছন্দ করতেন।
প্রবাস থেকে ফিরে কে‌উ সাক্ষাত করতে চাইলে তার সাথে আলিঙ্গন করতেন, কখনো কখনো কপালে চুমু খেতেন। কাউকে প্রবাসে যাওয়ার সময় বিদায় জানাতে গেলে তাকে এই বলে অনুরোধ করতেনঃ দোয়া করার সময়ে আমাদের কথা মনে রেখ।
স্নেহ ও ভালোবাসার আতিশয্যে কারো কারো সাথে এত অমায়িক ও সহজ হয়ে যেতেন যে, প্রিয়জনের নাম সংক্ষেপ করে ডাকতেন। যেমন আবু হুরায়রাকে সংক্ষেপে ‘আবু হুর’ এবং হযরত আয়েশাকে কখনো কখনো ‘আয়েশ’ নামে ডাকতেন।
শিশুদের সাথে রাসূল সা. এর বড়ই মাখামাখি ছিল। শিশু দেখলেই তার মাথায় হাত বুলাতেন, আদর করতেন, দোয়া করতেন এবং একেবারে ছোট শিশু কাছে পেলে তাকে কোলে নিয়ে নিতেন। শিশুদের মন ভূলানোর জন্য চমক লাগানো কথা বলতেন। যেমন বলতেনঃ ‘টিকটিকিরা ভাই রাতে মশার চোখে ঘা মারে দাঁতে’। একবার এক নিষ্পাপ শিশুকে চুমু খেতে খেতে বলেছিলেনঃ শিশুরা আল্লাহর বাগানের ফুল। শিশুদের নাম রাখতেন। কখনো কখনো শিশুদেরকে লাইনে দাঁড় করিয়ে পুরস্কারের ভিত্তিতে দৌড়ের প্রতিযোগিতা করাতেন যে, দেখবো কে আগে আমাকে ছুঁতে পারে। শিশুরা দৌড়ে আসতো। কেউ তার পেটের ওপর আবার কেউ বুকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তো। শিশুদের সাথে হাসি তামাশা করতেন। যেমন হযরত আনাসকে কখনো কখনো আদর করে বলতেনঃ ‘ও দুই কান ওয়ালা’। হযরত আনাসের ভাই আবু উমাইরের পালিত পাখির ছানাটি মরে গেলে সে উদাস ভাবে বসেছিল। রাসূল সা. তাদের বাড়ীতে এসে ডাক দিলেনঃ ‘ও আবু উমায়ের, কোথায় তোমার নুগায়ের (পাখির শাবক)? আর এক শিশু আব্দুল্লাহ বিন বশীরের মাধ্যমে তার মা রসূল সা. কে আংগুর পাঠালেন। আব্দুল্লাহ পথেই সব আংগুর খেয়ে ফেললো। পরে যখন বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেল, তখন রসূল সা. আদরের সাথে আব্দুল্লাহর কান ধরে বললেনঃ ‘يا غدر يا غدر ওরে ধোকাবাজ, ওরে ধোকাবাজ।’ প্রবাস থেকে আসার পথে যে শিশুকে পথে দেখতেন, সওয়ারীর পিঠে পিঠে চড়িয়ে আনতেন। শিশু ছোট হলে সামনে এবং বড় হলে পেছনে বসাতেন। মৌসুমের প্রথম ফসল ফলমূল আনা হলে তা বরকতের দোয়াসহ কোন শিশুকে আগে খেতে দিতেন। তিনি মনে করতেন এই শিশু ভবিষ্যতে ইসলামী আন্দোলনের নেতা হবে।
বুড়ো মানুষদের খুবই শ্রদ্ধা করতেন। মক্কা বিজয়ের সময় হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. নিজের অন্ধ প্রবীণ পিতাকে ইসলাম গ্রহণের জন্য যখন রসূল সা. এর কাছে নিয়ে এলেন, তখন তিনি বললেনঃ ওঁকে কষ্ট দিয়েছ কেন? আমি নিজেই তাঁর কছে চলে যেতাম।
মহানুভবতার এমন চরম পরাকাষ্টা দেখাতেন যে, মদীনার আধ পাগলী গোছের এক মহিলা যখন এসে বললো, আপনার কাছে আমার কিছু কথা নিভৃতে বলার আছে, তখন তিনি বললেন, বেশ চল, অমুক গলিতে অপেক্ষা কর, আমি আসছি। তারপর সেখানে গিয়ে তার অভাব অভিযোগের কথা শুনে আসলেন এবং তার প্রতিকারও করলেন। [আল মাওয়াহিবুল লাদুনিয়া, প্রথম খন্ড, পৃঃ ২৯৫।] এ ধরনের ঘটনা আদী ইবনে হাতেমও দেখেছিলেন এবং রসূল সা. এর মহানুভবতাকে নবূয়তের আলামত হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।
রসূল সা. কত অমায়িক ছিলেন এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কত মধুর স্বভাবের পরিচয় দিতেন, হযরত আনাস রা. তার চমৎকার ছবি এঁকেছেন। তিনি বলেনঃ
‘আমি দশ বছর যাবত রসূলের সা. সেবায় নিয়োজিত থেকেছি। তিনি কখনো বিন্দুমাত্র বিরক্তি বা ক্রোধ প্রকাশ করেননি। কোন কাজ যেভাবেই করে থাকি, কখনো বলেননি, এভাবে করলে কেন? আর না করলেও কখনো বলেননি, এটা কেন করলেন না? তাঁর ভৃত্য ও চাকরানীদের সাথেও এ রকমই ব্যবহার করতেন। তিনি কাউকে কখনো প্রহার করেননি।’
হযরত আয়েশা রা. বলেন, তিনি কখনো স্ত্রী বা চাকর চাকরানীদের মারেননি। কারো কাছ থেকে ব্যক্তিগত প্রতিশোধও গ্রহণ করেননি। অবশ্য আল্লাহর পথে জেহাদ করতে গিয়ে কিংবা আল্লাহর আইন অনুযায়ী অপরাধের শাস্তি বিধান করতে গিয়ে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকলে সেটা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।

ব্যক্তিগত জীবন

সাধারণত সেই সব লোককেই নেতা বলা হয়ে থাকে, যারা সামষ্টিক জীবনের একটা কৃত্রিম আলখেল্লা পরে থাকেন, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে যেয়েই সে আলখেল্লা খুলে ফেলেন। বাইরে প্রচুর মহত্ব ও উদারতার মহড়া দেখান, কিন্তু ঘরোয়া জীবনে গিয়েই নেমে যান ইতরামির সর্বনিম্ন স্তরে। লোক সমাজে সরলতা ও বিনয়ের চরম পরাকাষ্ঠা দেখান, আর গৃহে ফিরেই বিলাসিতায় ও আরাম আয়েশে মেতে ওঠেন। সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে কোন ব্যক্তির যত বেশী ব্যবধান ও দূরুত্ব হবে, ততই যেন তার মর্যাদা হবে। অথচ রসূল সা.-এর ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবন ছিল একই রকম।
এক ব্যক্তি হযরত আয়েশা রা.কে জিজ্ঞাসা করলো, রসূল সা. ঘরোয়া জীবনে কী কী করতেন? তিনি জবাব দিলেনঃ রসূল সা. সাধারণ মানুষের মতই ছিলেন। নিজের কাপড় চোপড়ের তদারকী নিজেই করতেন। (অর্থাৎ পোকামাকড় লাগলো কিনা সেদিকে নজর রাখতেন)। ছাগলের দুধ নিজেই দোহাতেন এবং নিজের প্রয়োজনীয় কাজগুলো নিজেই করতেন। কাপড়ে তালি লাগাতে হলে নিজেই লাগাতেন, জুতো মেরামত করতেন। বোঝা বহন করতেন, পশুকে খাদ্য দিতেন। কোন ভৃত্য থাকলে তার কাজে অংশ নিতেন, যেমন তার সাথে আটা পিষতেন, কখনো একাই পরিশ্রম করতেন, বাজারে যেতে কখনো লজ্জাবোধ করতেন না। নিজেই বাজার সদাই করে আনতেন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাধারণত একখানা কাপড়ে বেধে আনতেন। কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করেছিল যে, রসূল সা. ঘরোয়া জীবনে কেমন আচরণ করতেন? হযরত আয়েশা জবাবে বলেনঃ সবচেয়ে বিনম্র স্বভাবের, হাসিমুখে প্রফুল্ল আচরণ তিনি করতেন। কেমন বিনম্র স্বভাবের ছিলেন তা বুঝা যায় এই উক্তি দ্বারা যে, ‘কখনো কোন ভৃত্যকে ধমক পর্যন্ত দেননি।’ [আল মাওয়াহিল লাদুন্নিয়া, প্রথম খন্ড, পৃঃ ২৯৩] আপন পরিবার পরিজনের সাথে সহৃদয় আচরণে রসূলুল্লাহর সা. কোন জুড়ি ছিলনা। (সহীহ মুসলিম)
একবার হযরত ইমাম হোসেনের জিজ্ঞাসার জবাবে হযরত আলী রা. বললেনঃ রসূল সা. বাড়ীতে থাকাকালে তিন ধরনের কাজে সময় কাটাতেন। কিছু সময় কাটাতেন আল্লাহর এবাদতে, কিছু সময় দিতেন পরিবার পরিজনকে এবং কিছু সময় বিশ্রামে ব্যয় করতেন। এই তিন সময় থেকেই একটা অংশ সাক্ষাত প্রার্থীদের জন্য বের করতেন। মসজিদের সাধারণ বৈঠক ছাড়াও যদি কোন বন্ধু বান্ধাব একান্ত সাক্ষাতে মিলিত হতে চাইত কিংবা যদি কোন অতিথি আসতো, অথবা যদি কেউ কোন অভাব অভিযোগ জানাতে আসতো, তবে তাদেরকে তাঁর বিশ্রামের সময় থেকে কিছু সময় দিতেন। এতে করে দেখা যায় যে, তাঁর বিশ্রামের জন্য খুব কম সময় অবশিষ্ট থাকতো। [শামায়েলে তিরমিযী, রসূল (সা) এর বিনয় ও সরলতা সংক্রান্ত অধ্যায়]
স্ত্রীদের খোরপোশ ও বিভিন্ন প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থাও তাঁকেই করতে হতো। তাছাড়া তাদের শিক্ষা দীক্ষার ব্যবস্থার ভারও তাঁরই কাঁধে ন্যস্ত ছিল। অতপর তাঁদের দ্বারাই মহিলাদের সংশোধনের কাজ চালু রাখা হতো। মহিলারা তাদের নানা সমস্যা নিয়ে আসতো এবং উম্মুল মুমিনীনগণের মাধ্যমে তার সমাধান চাইতো। তবুও তিনি বাড়ীর পরিবেশকে একদিকে যেমন নিরস ও একঘেয়ে হতে দেননি, অন্যদিকে তেমনি সেখানে কোন কৃত্রিমতার সৃষ্টি হতে দেননি। তাঁর সংসার একজন মানুষের সংসারের মতই ছিল এবং তার পরিবেশে স্বাভাবিক ভাবাবেগের জোয়ার ভাটা থাকতো। সেখানে অশ্রুও ঝরতো এবং মুচকি হাসিও দীপ্তি ছড়াতো। এমনকি কখনো কখনো কিছু ঈর্ষাকাতরতা জনিত উত্তেজনারও সৃষ্টি হয়ে যেত। উদ্বেগ ও অস্থিরতা যেমন বিরাজ করতো, তেমনি আনন্দের মূহুর্তও আসতো। রসূল সা. যখন বাড়ীতে আসতেন, তখন ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসের মতো আসতেন, এবং এক অপূর্ব প্রশান্তি ও আনন্দের হিল্লোল বয়ে যেত। কথাবার্তা হতো। কখনো কখনো গল্প বলাবলিও হতো। মজার মজার কৌতুক-রসিকতাও চলতো। যেমন হযরত আয়েশা রা. নিজের একটা ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, একবার আমি খামীরা (গোশতের কিমার সাথে আটা দিয়ে রান্না করা এক ধরনের খাদ্য) বানালাম। হযরত সওদাও রা. সেখানে ছিলেন। রসূল সা. আমাদের দুজনের মাঝখানে বসেছিলেন একটা অকৃত্রিম আন্তরিকতার পরিবেশ বিরাজ করছিল। আমি সওদাকে বললাম, খাও। সে অস্বীকার করলো। আমি আবার পিড়াপিড়ী করলাম। সে তবুও বললো, খাবোনা। আমি আরো জিদ ধরে বললাম, তোমাকে খেতেই হবে। সে এবারও খেতে রাযী হলোনা। আমি বললাম যদি না খাও, তবে আমি ঐ খামীরা তোমার মুখে মেখে দেবো। সওদা জিদ বহাল রাখলো্। আমি সত্যি সত্যি খামীরার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে এক মুঠ তুললাম এবং সওদার মুখে লেপ্টে দিলাম। রসূল সা. তা দেখে খুব হাসলেন। তিনি সওদাকে বললেন, তুমিও আয়েশার মুখে লেপ্টে দাও। উভয়ে সমান হয়ে যাক। সওদাও তৎক্ষণাত আয়েশার মুখে মেখে দিল। এবার রাসূল সা. আবারও হাসলেন। [আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া, প্রথম খন্ড, পৃঃ ২৯৬-২৯৭]
একবার আবু বকর রা. এসে দেখেন, আয়েশা রসূল সা. এর সাথে জোরে জোরে কথা বলছেন। আবু বকর রা. রেগে গিয়ে তাকে প্রহার করতে উদ্যত হলেন। রসূল সা. তাকে শান্ত করলেন এবং বললেন, আমাদের মধ্যে কোন রাগারাগি হয়নি। তবুও হযরত আবু বকর রাগ নিয়েই চলে গেলেন। তিনি যাওয়ার পর রসূল সা, হযরত আয়েশাকে তীর্যক স্বরে বললেন, দেখলে তো কিভাবে আমি তোমাকে রক্ষা করলাম?
ঘরোয়া জীবনের এই স্বাভাবিক উত্থান পতনকে কেউ কেউ ইসলামী আদর্শের চেয়ে নীচু মানের মনে করেন। বিশেষত রসূল সা. এর পারিবারিক জীবনের এমন একটা ছবি তারা অন্তরে পোষণ করেন, যেন সেখানে কতিপয় অতিমানবীয় সত্তা বাস করতো, যাদের কোন ভাবাবেগ বা কামনা বাসনা ছিলনা। অথচ সে পরিবারটাও মানুষেরই পরিবার ছিল। তাদের মধ্যে যাবতীয়, মানবীয়, ভাবাবেগ বিদ্যমান ছিল। তবে ঐ পরিবারটায় আল্লাহর নাফরমানী বা পাপের অস্তিত্ব ছিলনা। এদিক থেকে ওটা ছিল আদর্শ পরিবার। রাতের বেলা যখন রসূল সা. ঘুমাতে যেতেন, তখন পরিবার পরিজনের সাথে তাঁর সাধারণ কথাবার্তা হতো। কখনো ঘরোয়া বিষয়ে, আবার কখনো সাধারণ মুসলমানদের সমস্যাবলী নিয়ে। এমনকি কখনো কখনো গল্পও শোনাতেন। একবার তিনি হযরত আয়েশাকে উম্মে যারার গল্প বলেন। এই কাহিনীতে এগারো জন মহিলা পরস্পরের কাছে নিজ নিজ স্বামীর স্বভাব চরিত্র বর্ণনা করে। এদের মধ্যে এক মহিলা ছিল ‘উম্মে যারা’। সে তার স্বামী আবু যারা‘র মনোমুগ্ধকর চরিত্র বর্ণনা করে। সাহিত্যিক দৃষ্টিতে এটা বড়ই মজার কাহিনী। উপসংহারে রসূল সা. হযরত আয়েশাকে বলেন, উম্মে যারার জন্য আবু যারা যেমন ছিল, আমিও তোমার জন্য তেমনি। অনুরূপভাবে আর একবার কোন এক মজলিসে তিনি একটা গল্প শোনালেন। শ্রোতাদের মধ্য থেকে এক মহিলা বলে উঠলো, এতো ‘খুরাফার’ গল্পের মত। খুরাফা আরবের এক ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন, যিনি বহু সংখ্যক চমকপ্রদ কিসসা কাহিনী লিখে গেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। রসূল সা. ঐ মহিলাকে বললেন, খুরাফা কে ছিল তা জান? অতঃপর তিনি এই খোরাফা নামক খ্যাতনামা ব্যক্তির কাহিনীও শোনালেন। বনু আযরা গোত্রের এই ব্যক্তিকে জিনেরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল এবং পরে আবার ফেরত দিয়ে গিয়েছিল। [শামায়েলে তিরমিযী]।
রসূল সা. এর আজীবন এই অভ্যাস ছিল যে, রাতের শেষার্ধে প্রথম দিকে তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠে ওযূ ও মেছওয়াক করার পর তাহাজ্জুদ পড়তেন। [যাদুল মায়াদ]। কোরআন খুব ধীরে ধীরে পড়তে গিয়ে নামাযে কখনো কখনো এত দীর্ঘ কেয়াম (দাঁড়িয়ে থাকা) করতেন যে, পা ফুলে যেত। [তিরমিযীঃ ইবনুল মুসাইয়েব কর্তৃক বর্ণিত।] সাহাবাগণ তাঁর এই কষ্ট দেখে বলতেন, আল্লাহ তো আপনার আগে পাছের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। তবুও আপনি এত কষ্ট কেন করেন। রসূল সা. বললেন, তাই বলে আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হবনা? [যাদুল মায়াদ]
গৃহ ও গৃহের আসবাবপত্র সম্পর্কে রসূল সা. এর দৃষ্টিভংগী ছিল এরূপ যে, দুনিয়ার জীবনটা একজন পথিকের মত কাটানো উচিত। তিনি বলেন, আমি সেই পথিকের মত, যে কিছুক্ষণের জন্য গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করে, অতঃপর নিজের গন্তব্য স্থলের দিকে রওনা হয়ে যায়। অর্থাৎ যারা আখেরাতকে গন্তব্যস্থল রূপে গ্রহণ করে, দুনিয়ার জীবনকে কেবল কর্তব্য সম্পাদন বা পরীক্ষার অবসর মনে করে কাটিয়ে দেয়, এবং যাদের এখানে বসে উচ্চতর লক্ষ্য জান্নাত লাভের জন্য কাজ করতে হবে, তাদের বড় বড় গগনচুম্বী বাড়ীঘর বানানো, সেগুলোকে আসবাবপত্র দিয়ে ভরে তোলা, এবং প্রাণ ভরে আরাম আয়েশ উপভোগ করার সুযোগ কোথায়? এ জন্য তিনিও তাঁর সাহাবীগণ উঁচুমানের বাড়ীঘরও বানাননি। সেগুলোতে আসবাবপত্রও জমা করেননি এবং সেগুলোর সাজসজ্জা ও জাকজমক বাড়াননি। তাঁদের বাড়ীঘর উত্তম মুসাফির খানা ছিল বলা যায়। [যাদুল মায়াদ] ঐ সব বাড়ীতে শীত ও গরম থেকে আত্মরক্ষা, জীব জানোয়ার থেকে নিরাপত্তা ও পর্দাপুশিদার ভালো ব্যবস্থা ছিল। তা ছাড়া স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থাও ছিল। রসূল সা. মসজিদে নববীর সাথে সংশ্লিষ্ট ছোট ছোট কক্ষ স্বীয় স্ত্রীদের জন্য তৈরী করিয়েছিলেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ছাড়া আর কোন সাজসজ্জা তাতে ছিল না। পরিচ্ছন্নতার রুচি রসূল সা. এর এত তীব্র ছিল যে, সাহাবীদের কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন নিজ নিজ বাড়ীর আঙ্গিনা পরিষ্কার রাখে। [তিরমিযী]
তৈজসপত্রের মধ্যে কয়েকটি ছিল একেবারেই সাদা ধরনের। যেমন একটা কাচের পেয়ালা, যার ওপর লোহার পাত লাগানো ছিল। পানাহরে এটা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হতো। খাদ্য সম্ভার সঞ্চয় করা তো দূরের কথা, দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের মত খাবারও থাকতোনা। খেজুরের ছাল ভর্তি চামড়ার তোষক ছিল তাঁর বিছানা। বানের তৈরী চৌকি এবং টাটের তৈরী বিছানাও ব্যবহার করতেন। এই বিছানা দু’ভাজ করে বিছানো হতো। একবার চারভাজ করে বিছানো হলে সকাল বেলা সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, আজকে বিছানায় এমন আরামদায়ক কী ব্যবস্থা ছিল যে, আমার গাঢ় ঘুম হয়েছে এবং তাহাজ্জুদ ছুটে গেছে? যখন আসল ব্যাপারটা জানতে পারলেন, তখন বললেন, বিছানাকে আগের মতো দু’ভাজ করে রেখে দাও। মাটিতে চাটাই বিছিয়ে শোয়ার অভ্যাসও ছিল। একবার চৌকির কাঠের দাগ শরীরে দেখে রসূল সা. এর কতিপয় সাহাবী (হযরত ওমর ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ) কেঁদে ফেলেছিলেন। [শামায়েলে তিরমিযী]
আর একবার নগ্ন চৌকিতে শুয়ে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গেছে দেখে হযরত ওমরের চোখে পানি এসে গেল। রসূল সা. তাঁর চোখে তাঁর চোখে পানি আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে হযরত ওমর বললেন, রোম ও ইরানের সম্রাটরা ভোগবিলাসে মত্ত আর আপনার এই অবস্থা! রসূল সা. বললেন, ‘ওমর! তুমি কি এতে খুশী নও যে, তারা দুনিয়া নিয়ে যাক, আর আমরা আখেরাত লাভ করি?

পানাহার

রসূল সা. পানাহার রুচিটা ছিল অত্যন্ত ছিমছাম ও ভদ্রজনোচিত। তিনি গোশতের বিশেষ ভক্ত ছিলেন। সবচেয়ে বেশী পছন্দ করতেন পিঠ, উরু ও ঘাড়ের গোশত। পাশের হাড়ও তার বিশেষ প্রিয় ছিল। গোশতের ঝোলের মধ্যে রুটি টুকরো টুকরো করে ভিজিয়ে রেখে ‘ছারীদ’ নামক যে উপাদেয় আরবীয় খাবার তৈরী করা হতো, সেটাও তিনি খুবই পছন্দ করতেন। অন্যান্য প্রিয় খাবারের মধ্যে মধু, সের্কা ও মাখন ছিল অন্যতম। দুধের সাথে খেজুর খেতেও ভালোবাসতেন। (এটা একটা চমৎকার পুষ্টি খাদ্যও বটে।) মাখন মাখানো খেজুরও তাঁর কাছে একটা মজাদার খাবার ছিল। রোগীপথ্য হিসাবে ক্যলরিযু্ক্ত খাদ্য পছন্দ করতেন এবং অন্যদেরকেও খাওয়ার পরামর্শ দিতেন। প্রায়ই জবের ছাতু খেতেন। একবার বাদামের ছাতু খেতে দেয়া হলে তিনি এই বলে প্রত্যাখ্যান করলেন যে, এটা বিত্তশালীদের খাদ্য। বাড়ীতে তরকারী রান্না হলে প্রতিবেশীর জন্য একটু বেশি করে তৈরী করতে বলতেন।
পানীয় দ্রব্যের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ছিল মিষ্টি পানি এবং তা বিশেষ যত্নের সাথে দু’দিনের দূরত্ব থেকে আনানো হতো। পানি মেশানো দুধ ও মধুর শরবতও সাগ্রহে পান করতেন। মাদক নয় এমন খেজুরের নির্যাসও পছন্দীয় ছিল। মশক বা পাথরের পাত্রে পানি ঢেলে খেজুর ভেজানো হতো এবং তা এক নাগাড়ে সারা দিন ব্যবহার করতেন। কিন্তু এভাবে বেশিক্ষণ রাখা হলে মাদকতার সৃষ্টি হতে পারে, এই আশংকায় ফেলে দিতেন। আবু মালেক আশয়ারীর বণর্না ‍অনুসারে তিনি বলেছেনও যে, আমার উম্মতের কেউ কেউ মদ খাবে, কিন্তু তার নাম পাল্টে নাম রাখবে। (ইতিহাস সাক্ষী যে, পরবর্তী কালের শাসকরা ফলের নির্যাস নামে মদ খেতো।)
এক এক ব্যক্তির আলাদা আলাদাভাবে খাওয়া দাওয়া করা পছন্দ করতেন না। একত্রে বসে খাওয়ার উপদেশ দিতেন। চেয়ার টেবিলে বসে খাওয়া দাওয়া করাকে নিজের বিনয়ী স্বভাবের বিপরীত মনে করতেন। অনুরুপভাবে দস্তরখানের উপর ছোট ছোট পেয়ালা পিরিচে খাবার রাখাও নিজের রুচি বিরোধী মনে করতেন। স্বর্ণরৌপ্যের পাত্রকে একেবারেই হারাম ঘোষণা করেছেন। কাঁচ, মাটি, তামা ও কাঠের পাত্র ব্যবহার করতেন। দস্তরখানের ওপর হাত ধোয়ার পর জুতো খুলে বসতেন। ডান হাত দিয়ে নিজের সামনের দিক থেকে খাবার তুলে নিতেন। পাত্রের মাঝখানে হাত রাখতেন না। হেলান দিয়ে বসে পানাহার করার অভ্যাস ও তাঁর ছিল না। কখনো দুই হাঁটু খাড়া করে এবং কখনো আসন গেড়ে বসতেন। প্রতি গ্রাস খাবার মুখে তোলার সময় বিছমিল্লাহ পড়তেন। যে খাদ্যদ্রব্য অপছন্দ হতো কোন দোষ উল্লেখ না করেই তা বাদ দিতেন। বেশী গরম খাবার খেতেন না। কখনো কখনো রান্না করা খাবার ছুরি দিয়ে কেটে খেতেন। তবে এটা তাঁর কাছে কৃত্রিমতা ও আড়ম্বর মনে হতো এবং এটা তেমন ‍ভালবাসতেন না। [বুখারী ও মুস্লিম (আমর বিন উমাইয়া কর্তৃক বর্ণিত) আবু দাউদ ও বায়হাকী (হযরত আয়েশা কর্তৃক বর্ণিত)।] রুটি ইত্যাদি তিনি সব সময় আঙ্গুল দিয়ে ধরতেন এবং আঙ্গুলে তরকারী ইত্যাদি লাগাতে দিতেন না। কখনো কখনো ফলমূল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বা হাটা চলা করা অবস্থায় খেতেন না। দুটো ফল এক সাথেও খেতেন–যেমন এক হাতে খেজুর অপর হাতে তরমুজ ইত্যাদি। খেজুরের আটি বাম হাত দিয়ে ফেলে দিতেন। দাওয়াত কখনো ফেরত দিতেন না। যদি অন্য কে‍উ ঘটনাক্রমে তাঁর সাথে থাকতো (আলাপরত থাকার কারণে বা অন্য কোন কারণে) তবে তাকে সাথে নিয়ে যেতেন ঠিকই, কিন্তু বাড়ীওয়ালার কাছ থেকে তার জন্য অনুমতি নিতেন। কোন মেহমানকে খাওয়ালে বারবার তাকে বলতেন যে, লজ্জা শরম বাদ দিয়ে তৃপ্তি সহকারে খাও। খাবার মজলিস থেকে ভদ্রতার খাতিরে সবার শেষে উঠতেন। অন্যদের খাওয়া আগে শেষ হলে তিনি ও দ্রুত শেষ করে তাদের সাথে উঠে যেতেন। খাওয়ার শেষে হাত অবশ্যই ধুয়ে নিতেন এবং আল্লাহর শোকর আদায় এবং জীবিকা ও বাড়ীওয়ালার জন্য বরকত কামনা করে দোয়া করতেন। কোন খাবার জিনিস উপঢৌকন পেলে উপস্থিত বন্ধুদের তাতে শরীক না করে ছাড়তেন না এবং অনুপস্থিত বন্ধুদের অংশ রেখে দিতেন। খাবার মজলিসে একটি দানাও নষ্ট হয় না, এরুপ যত্নসহকারে খেতে সবাইকে প্রশিক্ষণ দিতেন। পানি খাওয়ার সময় ঢক ঢক শব্দ করতেন না এবং সাধারণত তিনবার মুখ সরিয়ে শ্বাস নিয়ে খেতেন। প্রতিবার বিছমিল্লাহ বলে আরম্ভ ও আলহামদুলিল্লাহ বলে শেষ করতেন। সাধারণত বসে পানি খাওয়াই তাঁর নিয়ম ছিল। তবে কখনো কখনো দাঁড়িয়েও পানি পান করেছেন। মজলিসে কোন পানীয় জিনিস এলে সাধারণত‍ঃ ডান দিক থেকে পরিবেশন শুরু করতেন। যেখানে একটা জিনিসের পরিবেশন শেষ হতো, সেখান থেকেই পরবতী জিনিসের পরিবেশন শুরু হতো। বেশী বয়স্ক লোকদের অগ্রাধিকার দিতেন, তবে ডান দিক থেকে শুরু করা ধারাবাহিকতায় যাদের প্রাপ্য, তাদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই ধারাবাহিকতা ভংগ করতেন। বন্ধুদের কিছু পান করালে নিজে সবার শেষে পান করতেন এবং বলতেন, ‘যে পান করায় সে সবার শেষে পান করে’। খাদ্য পানীয়ে ফু দেয়া ঘ্রাণ নেয়া অপছন্দ করতেন। মুখের দুর্গন্ধ অপছন্দীয় ছিল বিধায় কাঁচা পেয়াজ ও রশুন খাওয়া কখনো ভালবাসতেন না। খাদ্য পানীয় দ্রব্য সব সময় ঢেকে রাখার নিদেশ দিয়েছেন। নতুন কোন খাবার এলে খাওয়ার আগে তার নাম জেনে নিতেন। বিষ খাওয়ার ঘটনার পর তাঁর অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল যে, কোন অজানা লোক খানা খাওয়ালে প্রথমে এক দু’লোকমা তাকে খাওয়াতেন।
এত তীব্র রুচিবোধের পাশাপাশি বেশীর ভাগ সময় ক্ষুধা ও দারিদ্রের কষাঘাতে জজরিত থাকতেন। এ ব্যাপারে যথাস্থানে বিশদ বিবরণ দেয়া হবে। তিনি বলেছেনঃ ‘আমার খানাপিনা আল্লাহর একজন সাধারণ বান্দর মতই।’

ওঠাবসা ও শয়ন

কখনো আসন গেড়ে বসতেন, কখনো দু’হাত দিয়ে দু’উরুর চার পাশ জড়িয়ে ধরে বসতেন, আবার কখনো হাতের পরিবর্তে কাপড় (চাদর ইত্যাদি) দিয়ে জড়িয়ে রাখতেন। বসা অবস্থায় হেলান দিলে সাধারণত বাম হাতের উপর হেলান দিতেন। কোন বিষয়ে চিন্তা গবেষণা করার সময় একটা কাঠের টুকরো দিয়ে মাটি খোচাঁতে থাকতেন। সাধারণত ডান দিকে কাত হয়ে এবং ডান হাতের তালুর উপর ডান গাল রেখে শুতেন। কখনো কখনো চিত হয়ে ও শুতেন এবং পায়ের উপর পা রাখতেন। তবে সতরের দিকে কঠোরভাবে লক্ষ্য রাখতেন। উপুড় হয়ে শোয়া তীব্রভাবে অপছন্দ করতেন এবং সবাইকে তা থেকে বারণ করতেন। এমন অন্ধকার ঘরে শোয়া পছন্দ করতেন না যেখানে বাতি জ্বালানো হয়নি। খোলা ছাদে শোয়া ভাল মনে করতেন না। ওযু করে ঘুমানোর অভ্যাস ছিল এবং ঘুমানোর আগে বিভিন্ন দোয়া ছাড়াও সূরা ইখলাস, সূরা নাস ও সূরা ফালাক পড়ে শরীরে ফুঁক দিয়ে নিতেন। ঘুমন্ত অবস্থায় মৃদু নাক ডাকার শব্দ বেরুতো। রাত্রে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিলে পবিত্রতা অর্জনের পর হাতমুখ অবশ্যই ধুয়ে নিতেন। ঘুমানোর জন্য আলাদা লুংগী ছিল। গায়ের জামা খুলে ঝুলিয়ে রাখতেন।

মানবীয় প্রয়োজন

প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের জন্য সেকালে পায়খানার প্রথা না থাকায় তিনি মাঠে জংগলে চলে যেতেন। সাধারণত এত দূরে চলে যেতেন যে চোখের আড়াল হয়ে যেতেন। কখনো কখনো দু’মাইল পযন্ত চলে যেতেন। এজন্য এমন নরম মাটি খুজতেন, যাতে ছিটে না আসে। প্রয়োজন পূরণের জায়গায় প্রথমে বাম পা ও পরে ডান পা রাখতেন। বসার সময় ভূমির অতি নিকটে গিয়েই কাপড় খুলতেন। কোন টিলা বা গাছ ইত্যাদির আড়ালেই বসতেন। এ সময় পায়ে জুতো ও মাথায় আচ্ছাদন নিয়েই বেরুতেন। কেবলার দিকে মুখ বা পিঠ দিয়ে বসতেন না। প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের সময় হাতের আংটি খুলে নিতেন। (কারণ ‍তাতে আল্লাহ ও রসূলের সা. নাম খোদিত ছিল।) সব সময় বাম হাত দিয়ে শৌচক্রিয়া সম্পন্ন করতেন। প্রয়োজনের জায়গা থেকে বেরুবার সময় প্রথমে ডান পা ও পরে বাম পা ফেলতেন।
গোছলের জন্য পর্দাকে অপরিহার্য গণ্য করেছিলেন। ঘরে গোছল করলে কাপড়ের পর্দা টানিয়ে নিতেন। বৃষ্টিতে গোছল করলে মাথায় লুংগি বেঁধে নিতেন। হাঁচি দেয়ার সময় স্বল্প শব্দ করতেন এবং হাত বা কাপড় মুখে চেপে নিতেন।

প্রবাস

প্রবাসে বা সফরে রওনা হবার জন্য বৃহস্পতিবারটা অধিক পছন্দ করতেন। বাহনকে দ্রুত চালাতেন। বিরতিস্থল থেকে সকাল বেলা যাত্রা করাটাই তাঁর অভ্যাস ছিল। প্রবাসকালে যে সব সামষ্টিক কাজ থাকতো, ‍তাতে অবশ্যই অংশগ্রহণ করতেন। একবার রান্নার আয়োজন ছিল। সঙ্গীরা যখন নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নিল, তখন তিনিও জ্বালানী কাঠ সংগ্রহের দায়িত্বে ঘাড়ে নিলেন। সবাই বললো, আপনার কষ্ট করার দরকার নাই। আমরাই যথেষ্ট। তিনি বললেন, আমি তোমাদের মধ্যে পৃথক মর্যাদা নিয়ে বসে থাকা পছন্দ করি না। [আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া (১ম খন্ড, পৃঃ ২৯৪)] ভ্রমণকালে পালাক্রমে কোন কোন পদাতিক সহযাত্রীকে নিজ ‍বাহনে আরোহণ করাতেন। রাতের বেলা প্রবাস থেকে ফেরা পছন্দ করতেন না। ফিরলে সোজা বাড়ীতে যাওয়ার পরিবর্তে আগে মসজিদে গিয়ে নফল নামাজ পড়ে নিতেন। বাড়ীতে খবর পৌঁছার পর বাড়ীতে যেতেন।

আবেগ ও অনুভূতি

আবেগ ও অনুভূতির কথা বাদ দিয়ে আমরা মানবতার কথা ভাবতে পারি না। রসূল সা. এর মধ্যেও মানবীয় অনুভূতি সর্বোত্তম পর্যায়ে বিদ্যামান ছিল। তিনি ছিলেন তীব্র অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ। আনন্দে আনন্দিত ও দুঃখ বেদনায় ব্যথিত হতেন।
যারা সারা দুনিয়ার দুঃখশোকে মুহ্যমান হন, কিন্তু পরিবারের দুঃখশোকে পাষাণ ও নিরুদ্বেগ থাকেন, সেই সব তথাকথিত মহামানবদের কাতারে তিনি শামিল ছিলেননা। মহিয়ষী জীবন সংগিনীদের প্রতি তাঁর আন্তরিক ভালবাসা ছিল। হযরত আয়েশা রা. সাথে একই পাত্রে পানি পান করতেন। আনসারদের মেয়েদেরকে ডেকে আনাতেন তারঁ স্ত্রীদের সাথে খেলা করার জন্য। নিগ্রোদের ক্রীড়া নৈপুন্য দেখতে দেখতে হযরত আয়েশা রা. এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, রসূল সা. এর কাঁধের উপর ভর দিয়ে দেখছিলেন। এরপরও তিনি যখন আয়েশাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এখন কি তোমার তৃপ্তি হয়েছে? তখন হযরত আয়েশা বললেন, ‘না আরো দেখবো’। এভাবে দীঘ সময় ধরে এ অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। [আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া (১ম খন্ড, পৃঃ ২৯৬)।] হযরত সাফিয়া রা. কে উটের ওপর আরোহণ করানোর জন্য তিনি নিজের হাঁটু এগিয়ে দেন এবং সেই হাঁটুর উপর দাঁড়িয়ে সাফিয়া রা. উটে আরোহণ করেন। একবার উষ্ট্রী পা পিছলে পড়ে গেলে রসূল সা. এবং হযরত সাফিয়া মাটিতে পড়ে যান। হযরত আবু তালহা সাথে ছিলেন। তিনি রসূল সা. এর কাছে ছুটে গেলে তিনি বললেন, আগে মহিলাকে উদ্ধার কর। একবার কাফেলার তত্ত্বাবধায়ক উটগুলোকে দ্রুত চালালে রসূল সা. বললেন, ‘সাবধান, কাঁচের পাত্রে রয়েছে কাঁচের পাত্র। একটু ধীরে, সাবধান।’ [বুখারী ও মুসলিম, (কাঁচের পাত্র দ্বারা নারীদের বুঝিয়েছেন)।] এই ভালবাসার কারণেই একবার মধু না খাওয়ার কসম খেয়ে ফেলেছিলেন। এবং সে জন্য ‘হালাল জিনিসকে হারাম করোনা’ বলে কুরআনে তাঁকে ভৎসনা করা হয়েছিল। [পাশ্চাত্যের লেখকরা রসূল (সা) এর এই পবিত্র ও নির্মল দাম্পত্য জীবনের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। অথচ তাদের সভ্যতায় সর্বাপেক্ষা দায়িত্বশীল ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন যে কয়জন মানুষ জন্মেছে, তারা শুধু যে ঘরোয়া জীবনেই পংকিলতার পর্যায়ে পৌঁছেনি বরং এই পরিমন্ডলের বাইরেও তারা জঘন্য কলংকময় জীবন যাপন করে থাকেন। রসূল (সা) এর বৈশিষ্ট্য ছিল, তাঁর সমস্ত আবেগ অনুভূতি ও কামনাবাসনা নিজের স্ত্রীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং তাও ছিল পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতায় সুষমামন্ডিত। তিনি প্রকৃতির দাবীগুলোকে শালীনতার সীমার মধ্যে রেখে অধিকতর সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন এবং দাম্পত্য প্রেমের এক পরিশীলিত রীতির পত্তন করেন।]
নিজের সন্তানদের প্রতিও রসূল সা. এর স্নেহ মমতা ছিল অত্যন্ত গভীর। হযরত ইবরাহীমকে মদীনার উপকন্ঠে এক কামার পরিবারের ধাই এর কাছে দুধ খাওয়াতে দিয়েছিলেন। তাকে দেখতে অনেক দূরে হেটে চলে যেতেন। ধূয়ায় আচ্ছন্ন ঘরে বসতেন এবং ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করতেন। হযরত ফাতেমা রা. এলে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা করতেন। কখনো কখনো নিজে যেতেন। নিজের অবস্থা বলতেন এবং তাঁর অবস্থা শুনতেন। তাঁর দু’ছেলে ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেন রা. কে অত্যধিক স্নেহ করতেন। তাদের কোলে নিতেন, ঘাড়ে ওঠাতেন এবং নিজে ঘোড়া সেজে পিঠে চড়াতেন। নামাযের সময়ও তাদের ঘাড়ে উঠতে দিতেন। একবার হযরত আকরা বিন হাবিস তাঁকে হযরত হাসানকে চুমু খেতে দেখে অবাক হয়ে বললেন, আমার তো দশটা ছেলে রয়েছে। কিন্তু কাউকেও এভাবে আদর করিনি। অথচ আপনি চুমু খান। রসূল সা. বললেন, যে দয়া স্নেহ করেনা সে দয়া স্নেহ পায়না।
ছেলে ইবরাহীম যখন মারা গেল, তখন শোকে তাঁর চোখ ছলছল করে উঠলো। আরো এক মেয়ে তাঁর সামনেই মারা গেল। চাকরানী উম্মে আইমান চিৎকার করে কাদঁতে লাগলো। রসূল সা. তাকে নিষেধ করলেন। সে বললো, আপনি ও তো কাদঁছেন। রসূল সা. বললেন, এভাবে (নিঃশব্দে বা মৃদু শব্দে) কাঁদা নিষিদ্ধ নয়। মনের যে কোমলতা ও মমত্বের কারণে এই (মৃদু) কান্ন‍া আসে, সেটা আল্লাহর রহমত স্বরুপ। তাঁর মেয়ে উম্মে কুলসুমের কবরে যখন দাঁড়ান, তখনও তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। হযরত উসমান বিন মাযউনের লাশের সামনেও তাঁর চোখ অশ্রু সজল ছিল। তিনি তাঁর কপালে চুমু খেয়েছিলেন। [আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া, প্রথম খন্ড, পৃঃ ২৯৭]। নিজের কান্নার স্বরূপ বর্ণনা করে তিনি বললেন, ‘চোখ অশ্রুসজল, হৃদয় মর্মাহত, কিন্তু তবুও আমরা মুখ দিয়ে এমন কোন কথা উচ্চারণ করবোনা, যা আল্লাহ পছন্দ করেন না। দুঃখ শোকের সময় প্রায়ই পড়তেন حسبنا الله ونعم الوكيل উচ্চশব্দে কখনো কাঁদতেন না, কেবল দীর্ঘ শ্বাস ছাড়তেন এবং বুকের মধ্য থেকে হাড়িতে সিদ্ধ হওয়ার শব্দের মত শব্দ বেরুতো।
এহেন দরদী হৃদয় যখন আল্লাহর কাছে কোন আকুতি জানাতো তখন সে সময়েও চোখের পাতায় অশ্রু মুক্তার মত চিক চিক করতো। একবার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদকে কোরআন তেলাওয়াতের অনুরোধ করলেন। তিনি যখন সুরা নিসার এই আয়াত পর্যন্ত পৌঁছলেনঃ ‘যখন আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্য থেকে একজন সাক্ষী হাজির করবো এবং তোমাকে এদের ওপর সাক্ষী বানাবো তখন কী উপায় হবে?’ এ সময় রসূলের সা. চোখ দিয়ে অশ্রুর স্রোত বয়ে গেল। [অধিকাংশ ঘটনা শামায়েলে তিরমিযী থেকে সংকলিত]
সমগ্র মানব জাতির প্রতি এবং বিশেষত মুসলিম জামায়াতের সদস্যদের প্রতি রসূল সা. এর যে গভীর স্নেহ মমতা ও সহানুভূতি ছিল, তাঁর হৃদয়ের এই কোমলতাই ছিল তাঁর উৎস। এত কোমল হৃদয় এবং এত আবেগ ভরা মন নিয়েও রসূল সা. কঠিন বিপদ মুসিবতে যে ধৈয ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন, সেটা সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার।

রসিকতা

আমি আগেই বলেছি, রসূল সা. সদা হাসিমুখ ছিলেন। তিনি বলেছেন‍ঃ ‘তোমর ভাই-এর দিকে মুচকি হাসি নিয়ে তাকানোটাও একটা সৎ কাজ।’ রসূল সা. এর সম্পর্কে এ কথাও বর্ণিত হয়েছে যে, ‘তিনি অত্যন্ত হাসিমুখ ও সদাপ্রফুল্ল ছিলেন।’
পৃথিবীতে বড় বড় কীর্তি সম্পাদনকারী ব্যক্তিগণের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো, তাঁরা জীবনের কঠিন দায়িত্বের বোঝাকে নিজেদের মুচকি হাসির সাহায্যে সহনীয় করে নেন। এবং সাথীদের হৃদয়ের গভীরে নিজেদের আসন প্রতিষ্ঠিত করে নেন। তিনি এমন অকৃত্রিম রসিকতা করতেন যে, তাঁর সাথীদের হৃদয়ে তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসা বদ্ধমূল হয়ে যেত।’ তিনি হাস্য কৌতুকের মাধ্যমে মজলিসে আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলতেন। তবে সব সময় ভারসাম্য বজায় থাকতো। কথাবার্তায় রসিকতার মাত্রা থাকতো খাদ্যে লবণের মাত্রার সমান। তাতে কোন অন্যায় ও অসত্য কথাও আসতোনা, তা দ্বারা কারো মনে কষ্ট ও দেয়া হতো না এবং কেউ অট্টহাসিতে ফেটেও পড়তোনা। সামান্য মুচকি হাসির সৃষ্টি করতো, যাতে শুধু দাঁত বের হতো মুখগহ্বর বা কন্ঠনালি দেখা যেতনা।
একবার হযরত আবু হুরায়রা অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনি দেখি আমাদের সাথে রসিকতাও করেন!’ রসূল সা. বললেনঃ হাঁ, তা করি। তবে আমি কোন অন্যায় ও অসত্য কথা বলিনা।’
এখানে আমরা রসূল সা.এর কিছু রসিকতার নমুনা তুলে ধরছি, যা হাদীসের গ্রন্থাবলীতে সংরক্ষিত রয়েছেঃ [অধিকাংশ ঘটনা শামায়েল তিরমিযী থেকে সংকলিত]
জনৈক ভিক্ষুক তাঁর কাছে একটা বাহক উট চাইল। রসূল সা. বললেনঃ আমি তোমাকে একটি উটনীর বাচ্চা দেবো। ভিক্ষুক অবাক হয়ে বললো, ‘আমি ওটা দিয়ে কি করবো? রসূল সা. বললেন, ‘প্রত্যেক উটই কোন না কোন উটনীর বাচ্চা হয়ে থাকে।
এক বুড়ি এসে বললো, ‘আমার জন্য দোয়া করুন যেন আল্লাহ আমাকে জান্নাত দান করেন।’রসূল সা. রসিকতা করে বললেনঃ‘কোন বুড়ি জান্নাতে যেতে পারবেনা।’বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে চলে যেতে উদ্যত হলো। রসূল সা. উপস্থিত লোকদের বললেন, ‘ওকে বলো যে, আল্লাহ ওকে বুড়ি অবস্থায় নয় বরং যুবতী বানিয়ে জান্নাতে নেবেন। আল্লাহ বলেছেন, আমি জান্নাতের নারীদের নতুন করে সৃষ্টি করবো,তাদেরকে কুমারী সমবয়সী যুবতী বানাবো।’ মোট কথা জান্নাতে গমনকারীনীদের আল্লাহ নব যৌবন দান করবেন।
যাহের বা যোহায়ের নামক এক বেদুইনের সাথে রসূল সা. এর সখ্য ছিল। তিনি তাঁর এই বেদুইন বন্ধুকে শহর সংক্রান্ত কাজে সাহায্য করতেন এবং বেদুইন রসূল সা. কে গ্রাম সংক্রান্ত কাজে সাহায্য করতো। কখনো কখনো সে আন্তরিক আবেগ সহকারে উপহার দিত। রসূল সা.অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে ঐ উপহারের দাম দিয়ে দিতেন। তিনিবলতেন, যাহের গ্রামে আমাদের প্রতিনিধি এবং আমরা শহরে তার প্রতিনিধি। এই যাহের একদিন বাজারে নিজের কিছু পন্য বিক্রি করছিল। রসূল সা.পেছন থেকে চুপিসারে যেয়ে তার চোখ চেপে ধরলেন এবং বললেন, বলতো আমি কে। বেদুইন প্রথমেতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। পরক্ষনেই বুঝতে পেরে আনন্দের আতিশয্যে রসূল সা. এর বুকের সাথে মাথা ঘষতে লাগলেন। অতপর রসূল সা. রসিকতা করে বললেন, এই দাসটা কে কিনবে? যাহের বললো, হে রসুলুল্লাহ, আমার মত অকর্মন্য দাসকে যে কিনবে,সেই ঠকবে। রসূল সা. বললেন, আল্লাহর চোখে তুমি অকর্মন্য নও।
একবার এক মজলিশে খেজুর খাওয়া হলো। রসূল সা. রসিকতা করে খেজুরের আটি বের করে হযরত আলীর সামনে রাখতে লাগলেন। অবশেষে আটির স্তুপ দেখিয়ে বললেন,তুমি তো অনেক খেজুর খেয়েছো দেখছি। হযরত আলী বললেন, আমি আটি সুদ্ধ খেজুর খাইনি।
খন্দক যুদ্ধের সময় একটা ঘটনায় রসূল সা. এত হেসেছিলেন যে, তাঁর মাড়ির দাঁত পর্যন্ত দেখা গিয়েছিল। আমেরের পিতা সাঈদ তীর নিক্ষেপ করেছিলেন। শত্রুপক্ষের জনৈক যোদ্ধা তীরের আক্রমনের লক্ষ্য ছিল। সে খুবই ত্বরিত গতিতে ঢাল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলতো,তাই সা’দের তীর কোনমতেই তাকে বিদ্ধ করতে সক্ষম হচ্ছিলনা। শেষবারে পুণরায় সা’দ তীর ধনুক নিয়ে প্রস্তুত হয়ে গেলেন এবং সুযোগ খুঁজতে থাকলেন। শত্রু সৈন্যটি যেই ঢালের বাইরে মাথা বের করেছে,আর যায় কোথায়। সা’দের তীর সোজা তার কপালে গিয়ে বিঁধলো,সে এমন যোরে মাথা ঘুরে পড়লো যে, তার ঠ্যাং দুটো ওপরের দিকে উঠে গেল।
পরবর্তীকালের লোকেরা তাঁর এ ধরনের রসিকতার কথা শুনে অবাক হয়ে যেত। কেননা একেতো ধর্মের সাথে সবসময় একধরনের নিরস জীবনের ধারনা যুক্ত থাকতো এবং খোদাভীরু লোকদের কাঁদো কাঁদো মুখ ও সুক্ষ কঠিন মেজাজ থাকার কথা সবার জানা ছিল। তদুপুরি রসুল সা. এর সার্বক্ষনিক এবাদত মুখিতা, খোদাভীরুতা ও অসাধারণ দায়িত্বসচেতনতার বিষয়টি লক্ষ্য রাখলে একথা বুঝাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায় যে, এ ধরনের একজন অসাধারন মানুষ আপন জীবন কাঠামোতে এমন কৌতুক ও হাস্যরসের অবকাশ কিভাবে সৃষ্টি করলেন। হযরত ইবনে ওমরকে রা. জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে রসূল সা. এর সাথীরা কি হাসতেন? তিনি বললেন, ’হ্যাঁ হাসতেন।অথচ তাদের অন্তরে পাহাড়ের চেয়ে বড় ও মজবুত ঈমান ছিল। (অর্থ্যাৎ কৌতুক ও রসিকতা ঈমান ও খোদভীতির প্রতিকূল নয়।) তাঁরা তীর নিক্ষেপের প্রশিক্ষন নিতে গিয়ে ছুটোছুটি করতেন আর পরস্পর হেসে লুটুপুটি খেতেন। (কাতাদার বর্ণনা)
একথা আগেই উল্লেখ করেছি যে, ফজরের নামাজের পর নিয়মিত বৈঠক হতো, তাতে জাহেলী যুগের প্রসঙ্গ উঠতো এবং সাহাবী গনের সাথে সাথে রসূল সা. ও খুব হাসতেন। শিশুদের সাথে ও স্ত্রীদের সাথে তিনি যে হাস্য কৌতুক করতেন তা ও ইতিপূর্বে আলোচনা করে এসেছি।

বিনোদন

ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংগ হলো (বৈধ সীমার মধ্যে) বিনোদন। রসিকতার ন্যায় এ অংশটা ও যদি বিলুপ্ত হয়ে যায়,তাহলে জীবন একটা বোঝা হয়ে উঠবে। যে জীবন ব্যাবস্থায় বিনোদনের স্থান নেই, তা কোন সমাজ বেশী দিন বহন করতে পারেনা। রসূল সা. কিছু কিছু বিনোদন ভালবাসতেন এবং বৈধ সীমার মধ্যে এর ব্যবস্থা করতেন।
ব্যাক্তিগত ভাবে তাঁর বাগানে ভ্রমনের শখছিল। কখনো একা আবার কখনো সাথীদের নিয়ে বাগানে যেতেনে এবং সেখানে বৈঠকাদিও করতেন।
সাঁতারকাটা ও তাঁর সখের অন্তর্ভূক্ত ছিল। বন্ধুবান্ধবের সাথে কখনো কখনো পুকুরে সাঁতার কাটতেন।এজন্য দু’জনের এক একটা জোড় গঠন করতেন। প্রত্যেক জোড় দূর থেকে সাঁতরে পরস্পরের দিকে আসতো। একবার রসূল সা. হযরত আবু বকরকে নিজের সাঁতারের সাথী মনোনীত করেছিলেন।
কিছুদিন বিরতির পর বৃষ্টি হলে লুংগি বেঁধে ফোয়ারায় গোসল করতেন। কখনো কখনো চিত্তবিনোদনের লক্ষ্যে কোন কূয়ার মুখে বসে ভেতরে পা ঝুলিয়ে রাখতেন। [শামায়েলে তিরমিযী]
দৌড় ও তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগীতার আয়োজন করতেন এবং নিজে পূর্ণ আগ্রহ নিয়ে শরীক হতেন। এরূপ পরিস্থিতিতে প্রচুর হাসাহাসি ও হতো।
উৎসবাদিতে ঢোল বাজানো ও শিশু মেয়েদের গান গাওয়া পছন্দ করতেন। একবার ঈদের দিন দুটো মেয়ে হযরত আয়েশার কাছে গান গাইছিল। রসূল সা. তার কাছেই শায়িত ছিলেন। হযরত আবুবকর এসে এই দৃশ্য দেখে ধমক দিয়ে উঠলেন যে, আল্লাহর রসূলের বাড়িতে এসব শয়তানী কান্ড কারখানা কেন? একথা শুনে রসূল সা. বললেন, ওদেরকে গাইতে দাও। [মুসলিম, হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত]
বিয়ে শাদীর সময় ও ঢোল বাজাতে উৎসাহ দিয়েছেন। (হযরত আয়েশা ও মুহাম্মদ বিন হাতে আল জুহমীর বর্ণনা) হযরত আয়েশা বলেন, আমার কাছে জনৈক আনসারীর মেয়ে থাকতো। আমি তার বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলাম। বিয়ের সময় রসূল সা. বললেন, ‘আয়েশা তুমি গানের ব্যবস্থা করলেনা? আনসার গোত্র তো গান পছন্দ করে।’ অন্য এক বর্ণনায় (সম্ভবত এই ঘটনা প্রসঙ্গেই) রয়েছে যে, রসূল সা. বলেছেন, ‘তোমরা কনের সাথে একজন গায়ককে পাঠালে ভাল করতে।সে গাইত, আমরা তোমার কাছে এসেছি, কাজেই তোমরা সুখী হও, আমরা ও সুখী হই। এ ধরনেরই এক বিয়ের অনুষ্ঠানে ছোট ছোট মেয়েরা গান গাইছিল। হযরত আমের বিন সা’দ কতিপয় শ্রোতাকে আপত্তি জানিয়ে বললেন, ‘হে রসূলের সাহাবীগন,হে বদরের যোদ্ধাগন!তোমাদের সামনে এসব কর্মকান্ড হচ্ছে? উপস্থিত সাহাবীগন জবাব দিলেন, ‘তোমার ইচ্ছা হলে বসে শোন,নচেত চলে যাও। আল্লাহর রসূল আমাদেরকে এর অনুমতি দিয়েছেন।’
বিনোদনের উপায় হিসেবে রসূল সা.কবিতার প্রতি ও আগ্রহ দেখিয়েছেন। তবে আরবে যে ভাবে কবিতার পুজা করা হতো, তা তিনি এড়িয়ে চলতেন। ওহীর সুমিষ্ট সুরের তীব্র আকর্ষন তাকে কবিতার প্রতি আকৃষ্ট করার তেমন সুযোগ দিতনা। কিন্তু কবিতার রুচি থেকে তিনি একদম বঞ্চিত ও ছিলেননা। বক্তব্যের দিক দিয়ে ভাল কবিতার যথেষ্ট কদর করতেন। বরঞ্চ বলা যায় যে, রসূল সা. সমাজকে এদিক দিয়ে এক নতুন রুচি দিয়েছেন এবং বাছ বিচারের এক নতুন মানদন্ড নির্ধারন করেছেন। হযরত জাবের বিন সামুরা বলেন, আমি রসূল সা. এর উপস্থিতিতে একশোর বেশী বৈঠকে যোগদান করেছি। এসব বৈঠকে জাহেলী যুগের কিচ্ছা কাহিনী যেমন বলা হতো তেমনি সাহাবীগন কবিতা ও পাঠ করতেন। একবার আরব কবি লাবীদের কবিতার নিম্নের চরন দুটির তিনি প্রশংসা করলেনঃ (আরবী***********)
‘সতর্ক হয়ে যাও, আল্লাহ ছাড়া সবকিছুই ধংসশীল,দুনিয়ার সমস্ত নিয়ামত একদিন বিলীন হয়ে যাবে।’
একবার প্রবাসে থাকাকালে হযরত শরীদকে অনুরোধ করে কবি উমাইয়া ইবনে আবিসসালাতের একশোটা কবিতা পড়িয়ে শোনান। পরে মন্তব্য করেন,এই ব্যক্তি ইসলাম গ্রহনের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। কোন কোন সময় তিনি নিজে ও, বিশেষত যুদ্ধের ময়দানে, স্বতস্ফূর্তভাবে ও বিনা ইচ্ছায় কবিতার মত করে কথা বলতেন। ইসলামের শত্রুরা ইসলামের বিরুদ্ধে নিন্দা সূচক যেসব কবিতা পাঠ করতো, হযরত হাসসান ও কা’ব বিন মালেককে দিয়ে তার জবাব কবিতা রচনা করাতেন। কখনো কখনো হযরত হাসসানকে নিজের মিম্বরে বসিয়ে কবিতা পাঠ করাতেন এবং বলতেন, ‘এ কবিতা শত্রুর বিরূদ্ধে তীরের চেয়ে ও কঠোর।’ তিনি একথা ও বলেছেন, ‘মুমিন তরবারী দিয়ে যেমন জেহাদ করে, তেমনি মুখ দিয়ে ও জেহাদ করে।’ আমি কবিতা, সাহিত্য ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক বিষয়ে আলাদা একটা প্রবন্ধের মাধ্যমে বিষদ ভাবে আলোচনা করে দেখাতে চাই,রসূল সা. মানুষের রুচিকে কেমন গঠনমূলক কাজে ব্যবহার করতেন।

কয়েকটি চমৎকার অভিরুচি

এ পর্যায়ে রসূল সা.এর এমন কিছু আদত অভ্যাস ও অভিরুচির উল্লেখ করতে চাই, যা অন্য কোন শিরোনামের আওতায় আনা হয়নি।
কোন জিনিস দেয়া ও নেয়ার কাজ ডান হাত দিয়েই সম্পন্ন করতেন। চিঠি লিখতে হলে প্রথমে বিছমিল্লাহ লেখাতেন। তারপর প্রেরকের নাম ও তার নিচে যাকে চিঠি লেখা হচ্ছে তার নাম থাকতো।
তিনি কল্পনা বিলাসিতা থেকে মুক্ত ছিলেন এবং কোন ‘শুভলক্ষন’ বা ‘অশুভলক্ষনে’ বিশ্বাস করতেননা। তবে ব্যক্তি ও স্থানের ভাল অর্থবোধক ও শ্রুতি মধুর নাম পছন্দ করতেন। খারাপ নাম পছন্দ করতেননা। বিশেষত সফরে যাত্রা বিরতির জন্য এমন জায়গা নির্ধারন করতেন। যার নাম আনন্দ বরকত বা সাফল্যের অর্থসূচক। অনুরূপভাবে, যে ব্যাক্তির নাম ঝগড়া, লড়াই বা ক্ষতির অর্থবোধক,তাকে কোন কাজ সোপর্দ করতেননা। যাদের নামের অর্থে আনন্দ বা সাফল্য ইত্যাদি আছে,তাদেরকেই কাজের দায়িত্ব অর্পণ করতেন। বহুনাম তিনি পাল্টে দিয়েছেন।
-বাহক জন্তুর মধ্যে ঘোড়াই বেশী প্রিয় ছিল। বলতেন, ঘোড়ার মধ্যে কেয়ামত পর্যন্ত কল্যান ও বরকত নিহিত রয়েছে। ঘোড়ার চোখ,মুখ ও নাকের বিশেষ যত্ন নিতেন এবং নিজে হাতে পরিষ্কার করতেন।
- হৈ চৈ ও হাঙ্গামা পছন্দ করতেননা। সব কাজে ধীরস্থির থাকা, নিয়ম শৃংখলা ও সময়ানুবর্তিতা ভালোবাসতেন। এমনকি নামাজ সম্বন্ধে ও বলেছেন যে, দৌড়াদৌড়ি করে এসনা। শান্তশিষ্ট ও ধীরস্থিরভাবে এস। আরাফার দিন অনেক হৈ-চৈ হলে তিনি নিজের ছড়ি উচিয়ে শান্ত থাকা ও শৃংখালা মেনে চলার নির্দেশ দেন এবং বলেন তাড়াহুড়োয় কোন পূণ্য নেই। [বুখারী ও মুসলিম]

স্বভাব চরিত্র

রসূল সা. এর আখলাক বা স্বভাব চরিত্র ও নৈতিকতার বিবরণ কোন উপশিরোনামে দেয়া সম্ভব নয়। কেননা তার গোটা জিবনইতো সৎ চরিত্রের নামান্তর। হযরত আয়েশা বলেছিলেনঃ ‘কোরআনই ছিল তার চরিত্র। হযরত আনাস ইবনে মালেক বলেনঃ ‘তিনি সবার চেয়ে ন্যায়পরায়ণ, দানশীল ও বীর ছিলেন।’
সবার চেয়ে ন্যায়পরায়ণ ছিলেন এভাবে যে,সারাজীবনে ও কাওকে কষ্ট দেননি, (আল্লাহর হুকুম অনুসারে যা দিয়েছেন, তা বাদে)এবং অন্যদের অত্যাচারের কোন প্রতিশোধ নেননি। সবাইকে ক্ষমা করেছেন, এমনকি মক্কা ও তায়েফের নজীরবিহীন অত্যাচারকারীদেরকেও এবং সকল মোনাফেক ও দুর্বৃত্তকেও। সবচেয়ে দানশীল ছিলেন এভাবে যে, হযরত জাবের রা. বলেন, রসূলুল্লাহর কাছে যে যা-ই চেয়েছে, তিনি তা দিতে অস্বীকার করেননি। হাতে থাকলে তৎক্ষণাত দিতেন, কখনো অন্যের কাছ থেকে ধার করে দিতেন, আর না থাকলে পরে আসতে বলতেন অথবা চুপ থাকতেন। সবার চেয়ে বীর ছিলেন, একথার প্রমাণ হিসেবে আপাতত এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, সত্য আদর্শ নিয়ে একবোরেই একাকী মাঠে নেমেছিলেন এবং সমগ্রদেশ বাসীর বিরোধীতা ও অত্যাচারের মুখে ও অটল থেকেছিলেন। কখনো কোন কঠিনতম যুদ্ধের মুখে ও ভীতি বা দুর্বলতা প্রকাশ করেননি। সূর পর্বতের গুহায়ই হোক কিংবা ওহুদ ও হুনায়েনের রণাঙ্গনেই হোক, সবত্র অবিচল প্রত্যয় ও বিশ্বাসের পরিচয় দিয়েছেন।

 


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি