মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ্ সা.
নঈম সিদ্দিকী

অনুবাদ ও সম্পাদনা
আকরাম ফারুক
আবদুস শহীদ নাসিম

অধ্যায়ঃ ১
পূর্ব কথা
আগমনের উদ্দেশ্য আহ্বান এবং ঐতিহাসিক অবস্থান

'মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ্' সা. গ্রন্থখানা মুলত এই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী গবেষক ও চিন্তাবিদ নঈম সিদ্দীকির উর্দু ভাষায় রচিত 'মুহসিনে ইনসানিয়াত' এর বাংলা অনুবাদ। গ্রন্থখানা Human Benefactor শিরোনামে ইংরেজী ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে।
এ গ্রন্থখানা চিরায়ত পন্থায় রচিত রসূলুল্লাহ্ সা. - এর কোন জীবনী গ্রন্থ নয়। এ গ্রন্থে মুলত রসূলে পাক সা. যে অনুপম সমাজ বিপ্লব সংঘঠিত করেছিলেন এবং সুনিপন কারিগরের মতো যে অনন্য সাধারন মানব দল ও মানব সমাজ নির্মাণ করেছিলেন, সেই নির্মাণ কাজেরই এক অপূর্ব বিশ্লেষণধর্মী শিক্ষনীয় চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাই এটি একাধারে রসূলে পাকের সীরাত এবং ইসলামী সমাজ বিপ্লব সংঘটনের প্রতিবেদন। ইসলামী সমাজ গড়ার সাধ যারা পোষোণ করেন, এটি তাদের জন্যে খুবই উপকারী গ্রন্থ।

আগমনের উদ্দেশ্য আহ্বান এবং ঐতিহাসিক অবস্থান

মহানবী সা.- এর জীবন চরিত অধ্যনের আগে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা প্রয়োজন। যে মহান কাজটি সুসম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে বিশ্ব মানবতার এই মহোপকারী বন্ধু পৃথিবিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, এবং একটি চূড়ান্ত লক্ষ্যভেদী সংগ্রামের সফল সমাপ্তি সাধনের জন্যে গোটা জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন, সেই কাজটি কী ছিল, তা আমাদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। আসলে রসূলের সা. জীবনেতিহাস একটি আন্ত মানবীয় কর্মসূচী বাস্তবায়নের অক্লান্ত সংগ্রামের ইতিহাস। রসূলের জীবন কুরআনের শিক্ষা ও আদর্শের বাস্তব ও কর্মময় বিশ্লেষণ। রসূলের জীবন হজরত আদম আ. ইব্রাহিম আ. মুসা আ. ঈসা আ. ও অন্যান্য নবীগণ নিজ নিজ যুগে যে পবিত্র বাণীর মশাল জ্বালিয়েছিলেন সেই বাণীরই পরিপূরক। মহানবীর কাজের ধরন ও প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও তার পরিমণ্ডলের বিশালতাকে দৃষ্টিপথে না রেখে আমরা নবী জীবনকে সুসংবদ্ধ করতে পারিনা, নবী জীবনে সংঘটিত ঘটনাবলীর মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করতে পারিনা, তাঁর জীবন চরিত অধ্যয়নের প্রকৃত উদ্দেশ্য নির্ণয় করতে পারিনা এবং তাঁর জীবন চরিত থেকে যা কিছু অর্জন করা দরকার তা অর্জন করতেও পারিনা।

মানব জাতির ত্রাণকর্তা

সমগ্র মানব জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা সেখানে নানা রকমের সংস্কারকের সাক্ষাত পাই। দেখতে পাই অনেক মিষ্টভাষী অথবা অনলবর্ষী বক্তা, দার্শনিক ও চিন্তাবিদ, বিশাল সাম্রাজ্যের স্থপতি, রাজা মহারাজা ও সম্রাট, বিগ্বিজয়ী বীর, বড় বড় দল ও সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা, মানব সভ্যতার আলোড়ন সৃষ্টিকারী মহানায়ক, সমাজ কাঠামোতে বারবার তোলপাড় সৃষ্টিকারী দোর্দণ্ড প্রতাপশালী বিপ্লবী, সভ্যতার রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত নিত্য নতুন ধর্মমতের প্রবর্তক এবং নৈতিক সংস্কারক ও আইন প্রণেতা। কিন্তু যখন তাঁদের শিক্ষা, তাঁদের রেখে যাওয়া কীর্তি ও অবদান এবং তাঁদের চেষ্টা সাধনা ও তৎপরতার সার্বিক ফলাফলের দিকে দৃষ্টি দেই, তখন কোথাও কোন পূর্ণাংগ কল্যাণ ও সুফল দেখতে পাইনা। যেটুকু কল্যাণ ও সুফল চোখে পড়ে তা নিতান্তই আংশিক একপেশে ও ক্ষণস্থায়ী। সেই সুফলগুলো জীবনের কোন একটা অংশে দৃশ্যমান হয়, অতঃপর তার সাথে নানা ধরনের কুফলের মিশ্রণ ঘটে। নবীগণের ব্যক্তিত্ব ব্যতীত ইতিহাসে আর কোন উপকরণ ও উপাদান এমন দেখা যায় না, যা সমগ্র মানব সমাজকে ভেতর থেকে বদলে দিতে সক্ষম হয়েছে। মসজিদ থেকে বাজার পর্যন্ত, বিদ্যালয় থেকে আদালত পর্যন্ত এবং গৃহ থেকে রণাঙ্গণ পর্যন্ত সমগ্র সমাজ ও সভ্যতাকে আল্লাহর একই রং এ রঞ্জিত করা এবং সমগ্র মানব সমাজের ভিতর থেকে আমূল পরিবর্তন সাধন করাই ছিল মুহাম্মাদুর রসুল সাঃ -এর দাওয়াতের সাফল্য। আর তাঁর জীবনের আসল কৃতিত্ব এটাই। তার দাওয়াতে মানুষের মনমগজ বদলে গেল, চিন্তাধারা পাল্টে গেল, দৃষ্টিভঙগী বদলে গেল, রীতিপ্রথা ও আদত অভ্যাস পরিবর্তিত হয়ে গেল, অধিকার ও কর্তব্যের বণ্টন রীতি পাল্টে গেল, ন্যায় ও অন্যায় এবং হালাল ও হারামের মানদণ্ড বদলে গেল, নৈতিক মূল্যবোধের রূপান্তর ঘটালো, আইন ও সংবিধানের পরিবর্তন ঘটলো, যুদ্ধ ও সন্ধির নিয়ম কানুনের রদবদল হলো, বিয়েশাদী ও সমাজ পদ্ধতি পাল্টে গেল। মোটকথা সভ্যতার এক একটি অংগের ও এক একটি প্রতিষ্ঠানের আমূল পরিবর্তন সাধিত হলো। এই সর্বাত্মক পরিবর্তনের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত কোথাও কল্যাণ ও মংগল ছাড়া আর কিছু দৃষ্টিগোচর হয়না। এর কোন অংশেই অকল্যাণ নেই, কোন অংগনে দুষ্কৃতি নেই, নেই কোথাও কোন বিকৃতি। সর্বত্র কেবল কল্যাণ, চতুর্দিকে কেবল গঠনমূলক তৎপরতা এবং উন্নতি ও প্রগতি। প্রকৃত পক্ষে মহানবীর হাতে সাধিত হয়েছিল মানব জাতির সর্বাত্মক পুনরুত্থান ও পুনরুজ্জীবন। সত্য ও ন্যায়ের এক স্বর্ণোজ্বল প্রভাতের অভ্যুদয় ঘটিয়ে তিনি সভ্যতার আকাশকে করেছিলেন মেঘমুক্ত। তিনি উদ্বোধন করেছিলেন ঐতিহাসিক যুগের। বিশ্ব ইতিহাসে এটা এত বড় কীর্তি ও কৃতিত্ব, যার কোন নজীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
মানব জাতির ত্রাণকর্তা বিশ্বনবীর সা. আবির্ভাব ঘটেছিল এমন এক পরিস্থিতিতে, যখন সমগ্র মানবজাতি ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। কোথাও চলছিল পাশবিকতা ও হিংস্রতার যুগ। কোথাও শেরক ও পৌত্তলিকতার অভিশাপ সভ্য জীবনের সর্বনাশ সাধন করছিল। মিশর, ভারত, ব্যাবিলন, নিনোভা, গ্রিস ও চীনে সভ্যতা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। একমাত্র রোম ও পারস্যে সভ্যতার পতাকা উড়ছিল। সেই রোমক ও ইরানী সভ্যতার বাহ্যিক জাঁকজমক চোখ ঝলসে দিত। অথচ সেসব নয়ানাভিরাম প্রাসাদের অভ্যন্তরে চলতো লোমহর্ষক যুলুম ও নির্যাতন। জীবনের ক্ষতস্থান থেকে বেরুত উৎকট দুর্গন্ধ। রাজা ও সম্রাটগণ শুধু খোদার অবতারই ছিল না, বরং তারাই খোদা হয়ে জেঁকে বসেছিল। তাদের সাথে আঁতাত করে জনগণের ওপর প্রভুত্ব চালাতো ভূমি মালিক ধর্মযাজক শ্রেণী। রোম ও ইরান উভয় সাম্রাজ্যের এই নিদারুণ শোষণ নিষ্পেষণে সাধারণ মানুষ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরতে বসেছিল। তারা জনগনের কাছ থেকে মোটা মোটা দাগের কর, খাজনা, ঘুষ ও নজরানা আদায় করত। উপরন্তু তাদেরকে পশুর মতো খাটনী খাটতে বাধ্য করা হতো। অথচ এদের অভাব অভিযোগ, দুঃখ কষ্ট ও বিপদ মুসিবত নিয়ে না ছিল তাদের কোন ভাবনা, না ছিল কোন সহানুভূতি, আর না ছিল এ সবের সমাধান বা প্রতিকার। এই সব কর্তৃত্বশীল শ্রেণীর ভোগ বিলাস ও প্রকৃতিপূজা তাদের নৈতিক সত্তাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়েছিল। রাজা বাদশাহদের ক্ষমতার পালাবদল ও উত্থান-পতন, নিত্যনতুন বিজেতাদের আবির্ভাব এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধবিগ্রহের কারণে পরিস্থিতির যে সাময়িক পরিবর্তন ঘটতো, তাতেও সাধারণ মানুষের জন্য কোন মুক্তির পথ উন্মুক্ত হতোনা। প্রত্যেক পরিবর্তনের পর সাধারন মানুষ আরো বেশী করে শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হতো। যে শক্তিই ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হতো, সে সাধারণ মানুষকেই শোষণের হাতিয়ার বানিয়ে, তাদেরই রক্তকে পুঁজি করে এবং তাদের শ্রমকে কাজে লাগিয়ে নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতো এবং বিজয় ও কর্তৃত্ব অর্জনের পর সে পূর্বসুরীদের চেয়েও বড় যুলুমবাজ ও বড় শোষকে পরিণত হতো। স্বয়ং রোম ও ইরান সাম্রাজ্য দ্বয়ের মধ্যেও ক্রমাগত সংঘাত-সংঘর্ষ লেগে থাকতো। বিভিন্ন অঞ্চল কখনো এক সাম্রাজ্যের দখলে যেত কখনো আরেক সাম্রাজ্য তাকে গ্রাস করতো। কিন্তু প্রতিবার বিজয়ী শক্তি প্রজাদের কোন না কোন গোষ্ঠীকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতো। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ইরানী সাম্রাজ্যভুক্ত কোন জায়গা রোম সাম্রাজ্যের পদানত হলে সেখানকার অগ্নিকুণ্ডগুলো নিভিয়ে তদস্থলে গির্জা নির্মাণ করা হতো আবার রোম সাম্রাজ্যভুক্ত কোন জায়গা ইরানীদের দখলে গেলে সেখানকার সমস্ত গির্জা পর্যবসিত হতো অগ্নিকুন্ডে। দুনিয়ার অধিকাংশ অঞ্চল থাকতো অরাজকতার কবলে। প্রতিনিত যুদ্ধবিগ্রহ, সংঘাত সংঘর্ষ ও বিদ্রোহ সংঘটিত। ধর্মীয় উপদলগুলো পরস্পরের রক্ত ঝরাতো। আর এইসব দাংগা হাংগামায় দলিত মথিত হত মানুষের মানবিক মর্যাদা। লাঞ্ছিত ও ভূলুণ্ঠিত হতো তার মানুষত্ব। অমানুষিক পরিশ্রম করেও সে জীবনের নুন্যতম প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হতোনা। শত জুলুম নির্যাতনের মুখেও সে সামান্য প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারতোনা। চরম তিক্ত অনুভূতিও তাঁকে নীরবে হজম করতে হতো। বিবেক ও মন এমন কঠিন দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ থাকতো যে, টু শব্দটি করার স্বাধীনতাও তার থাকতো না। কি সাংঘাতিক লোহার খাঁচায় সে আবদ্ধ থাকতো এবং কত হতাশা ও ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাসে যে তার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে থাকতো, কে তার খোঁজ রাখতো। সেই লোহার খাঁচায় কুনো দিকে একটি জানালাও খোলা ছিল না এবং মানুষের সামনে ক্ষীণতম আশার আলো বয়ে আনার কোন মতবাদ বা দর্শনের একটি জোনাকীও জ্বলতনা। তার আত্মা আর্তনাদ করতো। কিন্তু কোন দিক হতে সেই আর্তনাদে কেউ সাড়া পর্যন্ত দিত না। কোন ধর্ম তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসতো না। কেননা নবীদের শিক্ষা বিকৃতি ও আপব্যবহারে অতল তলে তলিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল। ধর্মের নামে আর যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাকে ধর্মীয় মহল ব্যবসায়ের পণ্যে পরিণত করেছিলো। সমকালীন যালেম ও শোষক মহলের সাথে তারা গাঁটছড়া বেঁধে নিয়েছিল। গ্রিস দর্শনের কথাই বলুন। কনফুসিয়াস ও মনুসংহিতার কথাই বলুন কিংবা বেদ বেদান্ত, বৌদ্ধ ধর্ম বা জষ্টীনান ও সোলুনের আইনের কথাই বলুন, সবই হয়ে পড়েছিল নিষ্প্রাণ ও নিষ্ক্রীয়। কুনো দিক থেকে কোন আলোক রশ্মি দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলনা। পৃথিবীর কোথাও যখনই এমন অবস্থা হয় যে, মানুষ একটা লোহার খাঁচায় আবদ্ধ হয়ে যায় এবং কোন দিক থেকেই কোন আশার আলো পরিদৃষ্ট হয় না, তখন সমাজ ব্যবস্থায় সংকট ও অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়। [মানবজাতির এই ঐতিহাসিক অবস্থা সম্পর্কে কুরআন অতি সংক্ষেপে পর্যালোচনা করেছে, যার তুলনা খুঁজে পাওয়া যায় না : “পৃথিবীর জলভাগে ও স্থলভাগে বিপর্যয় এসেছে শুধু মানুষের কৃতকর্মের কারণে। এভাবে আল্লাহ্ তাদেরকে তাদের কিছুটা কর্মফল ভোগ করাতে চান। হয়তো তার সৎপথে ফিরে আসবে। (রুম-৪১)] তাই যখন সারা বিশ্ব জুড়ে ইতিহাসের ভয়াবহতম বীভৎসতম অরাজকতা দেখা দিল, তখন সেই অরাজকথার ঘুটঘুটে অন্ধকারে আকস্মিকভাবে জ্বলে উঠল মানবতার শ্রেষ্ঠতম বন্ধু বিশ্বনবীর আলোর মশাল। সে মশাল সমকালীন সামাজিক বিপর্যয়ের অন্ধকারের বুক চিরে চতুর্দিক করলো উদ্ভাসিত।
আরবের নিকটতম অঞ্চল রাসুল সাঃ এর প্রাথমিক কর্মক্ষেত্র। সেখানে যে কি সাংঘাতিক অবস্থা বিরাজ করছিল টা ভাবলেও গা শিউরে উঠে। আদ ও সামুদ আমলে কিংবা সাবা ও ইয়েমেনের সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবের আওতায় এক সময় খানিকটা সভ্যতার আলোকচ্ছটা যদি বা দেখা দিয়েছিল, কিন্তু তাও নিবে গিয়েছিলো বহুকাল আগে। আববের বাদবাকী অঞ্চলগুলো তখনো প্রাগ-সভ্যতার প্রগার অন্ধকারে ডুবেছিল। সভ্যতার সূর্য তখনো ওঠেনি এবং মানবজাতী আদিম জাহেলিয়াতের ঘুম থেকে তখনো জেগে ওঠেনি। চার দিকে বিরাজ করছিল প্রবল উত্তেজনা। মানুষে মানুষে সংঘাত সংঘর্ষ, যুদ্ধ ও লুটপাটের তাণ্ডব চলছিল। মদ, ব্যভিচার ও জুয়ার সমন্বয়ে জাহেলি সংস্কৃতি তুংগে উঠেছিল। কুরাইশরা শেরক ও পৌত্তলিকতাযুক্ত ধর্ম নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছিল পবিত্র কা’বার মোতাওয়াল্লিগিরীর রমরমা ব্যবসায়। ইহুদিরাও পাল্লা দিয়ে বিকৃত ধর্ম ব্যবসায়ের দোকান খুলে রেখেছিল। বাদবাকি আরবরা ডুবেছিল চিন্তার নৈরাজ্যে। মক্কা ও তায়েফের মহাজনরা সুদী ব্যবসার জাল পেতে রেখেছিল। দাস ব্যবসার অভিশপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো মহা ধুমধামের সাথে চলছিল। মোটকথা, মানুষ প্রবৃত্তির গোলামীর সর্বনিম্ন স্তরে নেমে গিয়ে হিংস্র হায়েনা ও চতুষ্পদ জন্তুর মত জীবন যাপন করছিল। [কুরআনের সূরা ফুরকানে বলা হয়েছেঃ তারা যেন পশুর মত, বরং পশুর চেয়েও বিপথগামী।”(আয়াত-৪২)] শক্তিমানরা দুর্বলদেরকে ছাগল ও ভেড়ার পালের মত নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতো। দুর্বলেরা শক্তিমানদের পদতলে লুটিয়ে থাকতো।
এহেন পরিস্তিতিতে মুহাম্মদ সাঃ আমূল ও সর্বাত্মক পরিবর্তনের আহ্বান নিয়ে একাকী ময়দানে নামলেন। এমন হতাশা ব্যঞ্জক পরিবেশে আর কেউ হলে হয়তো লোকালয় ছেড়ে পালিয়ে যেত। অতীতে অনাচারকে ঘৃণা করার মত সৎ ও সংবেদনশীল লোক যে পৃথিবীতে পাওয়া যায়নি তা নয়। বিপুল সংখ্যায় পাওয়া গেছে। কিন্তু অনাচারের মোকাবেলা করা ও প্রতিকার করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তারা নিজ নিজ জীবনের নিরাপত্তার জন্য সমাজ ও লোকালয় ছেড়ে বনে জংগলে ও পর্বতগুহায় আশ্রয় নিত এবং যোগী সন্যাসী হয়ে যেত। কিন্তু রসূল সাঃ বিপন্ন মানবতাকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে নিজের জীবন বাঁচানোর চিন্তা করেননি। বরং অন্যায় ও দুষ্কৃতির সাথে লড়াই করে সমগ্র মানব জাতির জন্য মুক্তির পথ খুলে দিয়েছিলেন। সভ্যতার নৌকার হাল ধরে তাকে সঠিক গন্তব্যের পথে চালিত করেছিলেন। রোম ও ইরানের দুই যুদ্ধমান পরাশক্তি তৎকালে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছিল, তা ভাংগার জন্য তিনি তৃতীয় শক্তিরূপে আবির্ভূত হলেন। ধীরে ধীরে এই তৃতীয় শক্তি যখন নিজ পায়ের ওপর দাঁড়ালো, তখন তা রোম ও ইরান উভয় শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করলো। উভয়ের পরাক্রমশালী নেতৃত্বকে ক্ষমতাচুত্য করলো এবং জনগণকে বিভীষিকাময় সভ্যতার খাঁচা থেকে মুক্ত করে স্বাধীন পরিবেশে বিচরণের সুযোগ করে দিল [এ সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস উল্লেখের দাবী রাখে: “আমাকে আদম সন্তানদের রকমারি যুগের মধ্য থেকে শ্রেষ্ঠ যুগে পাঠানো হয়েছে,” (বুখারী) “আল্লাহ ইসমাঈলের বংশধরের মধ্য থেকে কিনানাকে, কিনানার বংশধরের মধ্য থেকে কুরাইশকে, কুরাইশের মধ্য থেকে বনু হাশেমকে এবং বনু হাশেম থেকে আমাকে মনোনীত করেছেন” (মুসলিম) “আল্লাহ যখন জগত সৃষ্টি করেন তখন আমাকে শ্রেষ্ঠ শ্রেণীর, অতঃপর গোত্রের অতঃপর শ্রেষ্ঠ পরিবারের অন্তর্ভূক্ত করেন। তাই আমি ব্যক্তি হিসাবেও শ্রেষ্ঠ এবং পরিবার হিসাবেও শ্রেষ্ঠ”। (তিরমিযী)]। আদম সন্তানদের সামনে একটি মুক্তির পথ উন্মুক্ত হলো এবং ডাকাতদের দ্বারা পরিবেষ্টিত মানুষের কাফেলাটি উন্নতি ও সমৃদ্ধির মঞ্জিলের দিকে রওয়ানা হয়ে গেল।
মোটকথা রসূল সাঃ সমগ্র জগতবাসীর জন্য মুক্তিদূত ও ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন।

আবির্ভাবের স্থান কাল মানবীয় উপাদান

মানবজাতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য মহান আল্লাহ একদিকে যেমন রসূল সা. এর শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্বকে বাছাই করলেন, অপরদিকে তেমনি সেকালের নিকৃষ্টতম পরিস্থিতির বিরাজ করা সত্ত্বেও রাসুল সাঃ এর জন্য উৎকৃষ্টতম সময়, দাওয়াতের জন্য সবচেয়ে উপযোগী স্থান এবং প্রথম সম্বোধন করার জন্য সর্বোত্তম জাতিকেও নির্বাচিত করলেন।
সামগ্রিকভাবে দেখতে গেলে সময়টাকে এই হিসাবে সবচেয়ে উপযোগী মনে করা যায় যে, তখন গোত্রীয় সমাজ ব্যবস্থার সময় শেষ হয়ে আন্তর্জাতিকতার যুগ আসন্ন হয়ে উঠেছিলো। ইতিহাস অল্প কয়েকটা বাঁক ঘুরতেই বিজ্ঞানের যুগে পদার্পন করতে যাচ্ছিল। রসূল সাঃ এর আবির্ভাবের যুগটি ছিল আসলে উল্লিখিত দুটো যুগের মাঝে সীমানা চিহ্নিতকারী। ভবিষ্যতের ব্যপকতর ও উজ্জ্বলতর যুগের উদ্ধোধন করার জন্য পূর্ববর্তী নবীদের দাওয়াতকে পূনর্ব্যক্ত করা, তার প্রাণশক্তিকে তুলে ধরা, আল্লাহর আনুগত্য ভিত্তিক সভ্যতার ভিত্তি মজবুতভাবে স্থাপন করা এবং ইসলামের সাম্য ও ন্যায় বিচার ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাকে পূর্ণাংগভাবে উপস্থাপন করা জরুরী হয়ে পড়েছিল, যাতে করে রসূল সাঃ -এর এই কীর্তির আলোক রশ্মিতে পরবর্তী যুগগুলি আলোকিত হয়ে যেতে পারে। এই যুগটা এ হিসাবেও সবচাইতে উপযোগী ছিল যে, মানুষের সামনে আর কোন আশা ভরসার স্থল অবশিষ্ট ছিল না, তাই তাদের পক্ষে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হওয়া সহজতর ছিল।
দাওাতের স্থানের দিকে যদি দৃষ্টি দেই, তবে দেখতে পাই আরব একটা উষর মরুময় দেশ হওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন সভ্য দুনিয়ার কেন্দ্রীয় স্থানে অবস্থিত ছিল। প্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও উত্তর দিক থেকে আগত সকল বাণিজ্যিক পথগুলো আরব ভুখন্ডের সাথে এসে মিলিত হয়েছিল। বিভিন্ন দেশের মাঝে যতটা বহির্বাণিজ্য চলতো, তা আরব ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেই চলতো। আম্মান ও ইয়েমেন, সানা ও মক্কা, জেদ্দা ও ইয়াম্বু, এবং মদিনা ও দুমাতুল জান্দালের মাঝে বাণিজ্যিক কাফেলার আনাগোনা ছিল। এসব কাফেলা আরব নেতৃবৃন্দ তথা কুরাইশদের অনুমতি ও গুরুত্বপূর্ণ গোত্রগুলোর ছাড়পত্র ছাড়া নিরাপদে চলাচলই করতে পারতোনা। এভাবে আরব ভূখণ্ড, বিশেষত মক্কা, তায়েফ, মদিনা ইয়াম্বু ও দুমাতুল জান্দালের যোগাযোগ ভারত, চীন, ইরান, ইরাক, মিশর, রোম ও ইথিওপিয়ার সকল অঞ্চলের সাথে ছিল। এখানে কোন সামষ্টিক দাওয়াত ও প্রচারের কেন্দ্র অন্য যে কোন অঞ্চলের চেয়ে বেশী সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হতো। তা ছাড়া আরব বিশ্বে মক্কা ও মদিনার গুরুত্ব ছিল সর্বোচ্চ। ধর্মীয়, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে তাদের নেতৃত্ব ও কর্তিত্ব ছিল অপ্রতিরোধ্য।
আরব জাতীর সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে অনগ্রসরতা, উচ্ছৃংখলতা ও নৈরাজ্য এবং অর্থনৈতিক দুরাবস্থার দরুণ যদিও কয়েকটা সম্যসার সৃষ্টি হয়েছিলো, কিন্তু এর একটা মস্ত বড় উপকারিতাও ছিল। সেটি হলো, আরব দেশ বহিরাগত আধিপত্য থেকেও অনেকাংশে মুক্ত ছিল। তাছাড়া আভ্যন্তরীণ পর্যায়েও এমন ক্ষমতা কারো ছিল না যে, সারা দেশের উপর নিয়মতান্তিক রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এবং তারপর ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, আইন ও শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সমাজকে একটা বিশেষ কাঠামোর ওপর দাঁড় করাতে পারে। এমন ক্ষমতাবান কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী থাকলে সে ইসলামী আন্দোলনকে খতম করে দিতে পারতো, যেমন অতীতের বিভিন্ন জালেম বাদশা নবীদের দাওয়াতকে পূর্ণতার পর্যায়ে পৌঁছার আগে থামিয়ে দিত। কুরাইশদের যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল এবং তারা সর্বশক্তি নিয়ে বাধা দিয়েছেও বটে। তবে কুরাইশদের সমগ্র আরবের ওপর কোন নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছিলনা। তাদের ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক প্রভাব যতই গভীর হক না কেন তারা কখনো একটা সুসংগঠিত সরকারের বিকল্প হওয়ার মত ছিলনা।
ধর্মীয় দিক থেকে দেখলে দেখা যায়, এ ভূখণ্ডের চারদিকে পূর্ববর্তী নবীদের দাওয়াতের স্মৃতি ছিল অম্লান। সেকালের জাতীগুলোর যে পরিণতি হয়েছিলো, তার আলামতগুলিও সবার চোখের সামনে বিরাজ করতো। উত্তরে ছিল হজরত ইব্রাহিমের জন্মস্থান উর। তারই কাছে ছিল হজরত নুহ, হজরত লূত ও হজরত সালেহ আ. –এর অঞ্চল। বনী ইসরাঈলের উত্থান পতন ও ঈসা (আ)-এর দাওায়াতের স্থান ফিলিস্তীন এবং জেরুজালেমও পার্শ্বেই অবস্থিত ছিল। দক্ষিণে ছিল আ’দ ও সামুদের বাসস্থান এবং মারেব বাঁধের এলাকা ও সাবার রাজ্য। সাগরের ওপারে রয়েছে মিশর। সেখানে ইব্রাহিব ও ইসমাঈল তাওহীদের কেন্দ্রকে শক্তিশালী করেন ও সুসংহত করেন। সেখানে তাঁরা ইবাদত ও আনুগত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। আল্লাহর আনুগত্য, তাওহীদ ও মানবতার সংস্কার ও বিকাশের জন্যে এর চেয়ে উত্তম এলাকা আর কোনটা হতে পারতো? এখানে ইসলামের দাওয়াতের আওয়ায তুললে সহজেই মানুষের মনে সাবেক নবীগণের রেখে যাওয়া নিদর্শনাবলী পুনরুজ্জীবিত হয়ে দেখা দেবার মতো অবস্থা বিরাজ করছিল।
মানবীয় উপাদানও আরবে যা ছিল, তা ছিল সর্বোত্তম।এ উপাদানটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট ছিল এই যে, এর ক্ষমতা ও যোগ্যতার উৎস তখনো পর্যন্ত অব্যবহৃত ও সুরক্ষিত ছিল। রোম ও ইরানের পাশবিক সভ্যতা যেসব ধ্বংসাত্মক রোগের জন্ম দিয়েছিলো, আরবরা তা থেকে তখনো মুক্ত ছিল। তাদের মধ্যে হিংস্র জীবন যাপন পদ্ধতি জনিত দোষত্রুটি বিদ্যমান থাকলেও তার ভালো গুনাবলীও নেহাত কম ছিল না। বেদুইন হওয়ার কারণে তাদের মেজাজে ছিল স্বভাবসুলভ সরলতা। কৃত্রিমতা থেকে তারা ছিল সম্পূর্ণ মুক্ত। প্রাকৃতিক নিদর্শবলী কে তাদের খুব নিকট থেকে দেখার সুযোগ ছিল। তাই বিশ্ব চরাচরে মহাসত্যের নিদর্শনাবলী উপলব্ধি করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল। গরম আবহাওয়া, মরুঝড়ের ঝাপটা, রাত দিনের কষ্টকর সফর, ক্ষুধা ও পিপাসার অভিজ্ঞতা এবং প্রতিদিনকার হত্যা ও লুটতরাজের কারণে তাদের মধ্যে দুর্ধর্ষতা ও দুঃসাহসিকতার জন্ম হতো এবং তা বীরত্বের প্রেরণা উজ্জীবিত করার কাজে সহায়ক হতো। একটা দুনিয়া জোড়া আন্দোলন পরিচালনার কাজে যে ধরনের একদল সাহসী বীরের প্রয়োজন ছিল, তারা ঠিক তেমনি ছিল। তাদের মধ্যে দানশীলতা বিদ্যমান ছিল। এত বড় কাজ করার জন্য কৃপন ধরনের মানুষ মানানসই হতোনা। আরবদের স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। নিজেদের বংশ পরম্পরাতো বটেই এমনকি তাঁরা তাদের ঘোড়ার বংশ পরম্পরাও মুখস্ত রাখতো। একটি জীবন ব্যবস্থার নীতিমালাকে গ্রহণ করা এবং তা অন্যদের কাছে পৌঁছানোর জন্য এ ধরনের লোকেরাই সর্বোত্তম কর্মী হতে সক্ষম ছিল। তাদের মধ্যে আত্মসম্ভ্রমবোধ পুরোমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। এজন্য আত্মমর্যাদা রক্ষার কাজটি সমাধান করা তাদেরই আয়ত্বাধীন ছিল। তাদের ভাষাও ছিল একটা উচ্চমানের, বিশাল ও বিকাশমান ভাষা। সে ভাষার লালিত্য ও অলংকার অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছিল। তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের কাজে তারা সহজেই সামনে অগ্রসর হতে পারতো। অন্যদেরকে একটা বিপ্লবী বক্তব্য দ্বারা অনুপ্রাণিত করতেও তারা অধিকতর সফলকাম হতো।
আরবরা ছিল সংকল্পে দৃঢ় ও অনমনীয়। এমনকি অন্যায় পথে চললেও তারা মনের পরিপূর্ণ স্বাচ্ছন্দ্য ও বিবেকের অটুট প্রত্যয় নিয়েই চলতো। সব রকমের বাধা ও বিরোধিতা মোকাবিলা করে তারা অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেত। তবে তাদেরকে ন্যায় ও সত্যের পথে পরিচালিত করা হলে সে ক্ষেত্রেও তারা হতো অবিচল ও নির্ভীক। এ ধরণের আরো অনেক বৈশিষ্ট্য তাদের ছিল। যার ভিত্তিতে স্বীকার না করেই পারা যায়না যে, রাসূল সা. নিজে ব্যক্তিগতভাবে যেমন লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে শ্রেষ্ঠতম নেতা ও আহ্বায়ক ছিলেন, তেমনি সর্বোত্তম মানের জনশক্তিও তাকে সরবরাহ করা হয়েছিল।
শুধু তাই নয়, এই মানব সম্পদ সকল দিক দিয়ে উন্নতি ও অগ্রগতি অর্জনে ব্যাকুল ছিল। জাহেলী আরব সমাজের মেধাবী ও চিন্তাশীল লোকদের মধ্যে ধর্মীয় দিক দিয়েও অস্থিরতা ও অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠেছিল। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিবর্গ মহাসত্যের সন্ধান ও বিশ্ব বিধাতার নির্দেশনা লাভের জন্য ব্যাগ্র ও উদগ্রীব হয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিক দিক দিয়েও তাদের মধ্যে নবচেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। মক্কা ও মদীনার মত শহরগুলোতে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামো গড়ে উঠেছিল। কোন না কোন পর্যায়ের গণতান্ত্রিক চরিত্র সম্পন্ন একটা নগররাষ্ট্রের খানিকটা অগোছালো রূপরেখা তৈরী হচ্ছিল। তাছাড়া আরবের অর্থনৈতিক উপায় উপকরণের স্বল্পতার দরুণ জনসংখ্যা মরু এলাকার বাইরে সম্প্রসারিত হতে বাধ্য হচ্ছিল। চলমান সভ্যতায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে এবং নেতৃত্ব নিস্ক্রীয় হয়ে পড়লে নতুন কোন যাযাবর গোষ্ঠীকে সভ্যতার চালকের মসনতে বসানো আল্লাহর স্বতসিদ্ধ চিরাচরিত নীতি। এই নীতি অনুসারেই আল্লাহ ফেরাউনী শক্তির পতন ঘটিয়ে তার স্থলে বনী ইসরাঈলকে ক্ষমতাসীন করেছিলেন।
এসব দিক বিবেচনা করলে আরবরাই ছিল তৎকালীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জনশক্তি। মানব সমাজে একটা মৌলিক ও সর্বাত্মক বিপ্লব সংঘটিত করার জন্যে এই জনশক্তিই সবচেয়ে উপযোগী।

বিপ্লবী কালেমা

এ কথা ভাববার কোনই অবকাশ নেই যে, বিশ্বনবী সা. কোন আকীদা-বিশ্বাস, মতাদর্শ, বা পরিকল্পনা ছাড়াই সংস্কার ও বিনির্মাণের কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। তিনি নিছক একটা অস্পষ্ট চেতনা, লক্ষ্যহীন আবেগ এবং অপরিপক্ক উন্মাদনা দ্বারা তাড়িত হয়ে এ কাজ শুরু করেননি। বরং তিনি মহাবিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যের মশাল হাতে নিয়ে ময়দানে নেমেছিলেন। তিনি অত্যন্ত সংবেদনশীল মন নিয়ে বছরের পর বছর ধরে জীবনের সমস্যাবলী নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন। হেরা গুহার নির্জন প্রকোষ্ঠে দীর্ঘকাল ব্যাপী নিজের অন্তর্জগত ও বহির্জগত নিয়ে ধ্যান করেছেন। সভ্যতার কল্যাণ ও অকল্যাণ কিসে হয়, তার নীতিমালা বুঝবার জন্য তিনি অনেক মাথা ঘামিয়েছেন। কিন্তু বাস্তব পদক্ষেপ ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণ করেননি, যতক্ষণ না মহান আল্লাহ পাক তাঁর হৃদয়কে সত্যের আলোকে উদ্ভাসিত করে দিয়েছেন এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সত্য তাঁর সামনে উদঘাটিত হয়েছে। সেই শ্রেষ্ঠতম সত্য হলো, মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা ও প্রভূ আছেন এবং মানুষ তাঁরই গোলাম ও দাস। এই সত্য কলেমাই ছিল বিশ্বনবীর সূচিত বিপ্লবের বীজ। এই বীজ থেকেই জন্ম নিয়েছিলেন সৎ জীবন ও নিষ্কলুষ সভ্যতার সেই পবিত্র বৃক্ষ, যার শেকড় মাটির অনেক গভীরে উপ্ত এবং যার ডালপালা উচ্চ আকাশে বিস্তৃত।
বিশ্বনবীর ঘোষিত এই কলেমা ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিপ্লবাত্মক কলেমা। আমরা সবাই জানি, এই কলেমা হলো ‘‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’’। শাব্দিকভাবে এটা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। কিন্তু অর্থের দিক দিয়ে অত্যন্ত গভীর। ‘‘এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তিনিই একমাত্র ইলাহ’’। ইলাহ সেই শক্তি বা সত্তাকে বলা হয়, যার গোলামী করা যায়, যার জন্য মানুষ নিজেকে ও নিজের যথাসর্বস্বকে অকাতরে উৎসর্গ করতে পারে, যার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়ে উপাসনা করে, যার সর্বাত্মক প্রশংসা, গুণগান, পবিত্রতা ঘোষণা ও বন্দনা করে। যার জন্য মান্নত মনে, যার কাছে সর্ব প্রকারের কল্যাণের আশা করে, যার পাকড়াওকে ভয় করে, যার কাছে সৎকাজের পুরস্কারের আশা ও অসৎকাজের শাস্তির আশংকা করে, যাকে নিজের নিরংকুশ মালিক মোখতার মনে করে, যাকে শাসক ও আইনদাতা মানে, যার আদেশ অনুযায়ী কাজ করে ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকে, যার দেয়া নীতিমালাকে নিজের জীবনের মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করে, যার হালাল ও হারামের বিধিকে বিনা বাক্য ব্যয়ে কার্যকরী করে, যাকে নিজের জন্য হেদায়াতের উৎস মনে করে, যার ইচ্ছা ও মর্জী অনুযায়ী জীবন বিধান তৈরী করে, যার প্রিয়জনদেরকে সম্মান ও বিরোধীদেরকে প্রত্যাখ্যান করে, এবং যার সন্তুষ্টি অর্জন তার জীবনের প্রধানতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পরিণত হয়। একটি মাত্র শব্দ ইলাহের মধ্যে এই ব্যাপক তাৎপর্য নিহিত ছিল।
মানব সমাজ ইলাহ্র এই অধিকারগুলোকে এক আল্লাহর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ভাগ বাটোয়ারা করে রেখেছিল। ফলে সমাজ ও সভ্যতার বিভিন্ন স্তরে জেঁকে বসেছিল অসংখ্য ইলাহ। মানুষের নিজের প্রকৃতি ও তার কামনা বাসনা, পরিবার ও গোত্রের রসম রেওয়াজ, বর্ণ, বংশ ও জাতিগত সংঘবদ্ধতার ঐতিহ্য, জমীদার ও ধর্মযাজকদের আধিপত্য, রাজপরিবার ও পরিষদবর্গের দাম্ভিকতা, ইত্যাদি তাদের ইলাহ হয়ে বসেছিল। এসব ইলাহ্র নাম নিয়ে সমাজের এক শ্রেণী অপর শ্রেণীকে শাসন শোষণ করতো, লুটে পুটে খেত। ‘‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ (‘‘আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই’’।) কথাটা এই সমস্ত খোদার খোদায়ীর ওপর একই সাথে প্রচন্ড আঘাত হানতো। এই কলেমার উচ্চারণকারী প্রকারান্তরে এ কথাই ঘোষণা করতো যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন প্রভূত্ব আমি মানিনা, কারো কর্তৃত্ব ও আধিপত্য মানিনা, কারো রচিত আইন কানুন আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, কারো অর্জিত অতিমানবীয় অধিকার বৈধ নয়, কারো সামনে মাথা নোয়ানো হবেনা, কারো সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টি তোয়াক্কা করা হবেনা, কারো আংগুলের ইশারায় জীবন চলবেনা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সকল খোদায়ী ভেংগে চুরমার করে দেয়া হবে। বস্তুত, এই কলেমা ছিল মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা।
এই কলেমার দ্বিতীয় অংশে এই মর্মে অংগীকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যে, মানবজাতির হেদায়াত তথা মুক্তি ও কল্যাণের পথে সন্ধান দান এবং সভ্যতা ও সংস্কার সংশোধনের একমাত্র পথ হলো আল্লাহর প্রেরিত নবী ও রসূলগণের দেখানো পথ। জীবনের প্রয়োজনীয় আসল ও নির্ভুল জ্ঞানের একমাত্র উৎস হলো ওহী। এ থেকেই মানবীয় বিবেক চিন্তা করার মূলনীতি কী জানতে পারে। মুহাম্মদ সা. রিসালাতের এই ধারাবহিকতার পূর্ণতাদানকারী সর্বশেষ নবী ও রসূল। জীবনের সঠিক পথের সন্ধান তাঁর কাছ থেকেই নিতে হবে এবং তাঁর নেতৃত্বেই বিশ্ব মানবতা কল্যাণ ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম।
এই কলেমার এই গুরুত্বের কারণেই তার স্বীকৃতি ইসলাম গ্রহণের পয়লা শর্তে পরিণত হয়েছে। এই কলেমাকে মায়াযযিনগণ আযান দেয়ার সময় উচ্চ স্বরে পাঠ করে থাকে এবং তাকে শ্রেষ্ঠ যিকর বলে আখ্যায়িত ও নামাযের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মোট কথা, এ কলেমা সর্ব দিক দিয়ে ইসলামী আন্দোলনের শ্লোগানে পরিণত হয়েছে।
রসূল সা.-এর এই বিপ্লবাত্মক কলেমা যার অন্তরেই প্রবেশ করেছে, তার ভেতরে আমূল পরিবর্তন এসেছে। এ কলেমা যার জীবনেই ঢুকেছে, তার নকশা পাল্টে গেছে। এ বীজ থেকে নতুন মানুষ জন্মগ্রহণ করেছে এবং লালিত পালিত ও বিকশিত হয়েছে।

সমাজ সংস্কারে রসূল সা. এর লক্ষ্য

রসূল সা.-এর জীবনী থেকে যথার্থ উপকারিতা অর্জনের জন্য যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটার জবাব জানা জরুরী, তা হলো, রসূল সা. এর সামনে ইপ্সিত পরিবর্তনের পরিধি কতদূর এবং তাঁর কাজের মানদণ্ড কী ছিল? সমাজ ব্যবস্থায় তিনি কি কোন আংশিক পরিবর্তন চাইতেন, না সর্বাত্মক পরিবর্তন? তাঁর দাওয়াত কি নিছক ধর্মীয় ও নৈতিক সংস্কারের মধ্যে সীমিত ছিল, না রাজনৈতিক গুরুত্বসম্পন্নও ছিল? অন্য কথায়, সামাজিক পরিমণ্ডলে তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য কী ছিল?
এ প্রশ্নের জবাব খোদ কুরআনে খুব সুষ্ঠুভাবেই দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন ভংগীতে বারবার ইসলামী দাওয়াতের উদ্দেশ্য জানানো হয়েছে। এখানে আমি শুধু দুটো আয়াতের উল্লেখ করছি। এক জায়গায় সকল নবী ও রসূলকে প্রেরণের উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে এভাবেঃ
﴿لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ ۖ وَأَنزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ ۚ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ﴾
‘‘আমি আমার রসূলগণকে কেবলমাত্র এ উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছি এবং তাদের ওপর কিতাব ও মানদন্ড নাযিল করেছি, যাতে মানবজাতি ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। (সূরা আল হাদীদঃ ২৫)
কথাটা একেবারে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দেয়া হয়েছে। ইসলামের দাওয়াতের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো মানব জীবনকে ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে গড়ে তোলা এবং সমাজ ব্যবস্থায় কার্যকরভাবে ভারসাম্য ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করা। একই উদ্দেশ্যে লোহার অস্ত্র-শস্ত্র ব্যবহার করার ইংগিত আয়াতের পরবর্তী অংশে রয়েছে। অর্থাৎ ইসলামী বিধিব্যবস্থার বাস্তবায়ন, সংরক্ষণ ও বিকাশ সাধনের জন্য সামরিক শক্তিও অনিবার্য।
স্বয়ং মুহাম্মদ সা. নবী হিসাবে আবির্ভাবের উদ্দেশ্য আরো স্পষ্ট ভাষায় একাধিকবার বলা হয়েছে। যেমনঃ
﴿هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ﴾
‘‘তিনিই আল্লাহ, যিনি স্বীয় রসূলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি এই সত্য দ্বীনকে অন্য সমস্ত ধর্মমত ও জীবন ব্যবস্থার ওপর বিজয়ী করে দিতে পারেন। চাই তা মোশরেকদের কাছে যতই অপছন্দনীয় হোক না কেন।’’ (সূরা আস সফঃ ৯)
অর্থাৎ কুরাইশ ও আরবের অন্যান্য মোশরেকরা তো নিজেদের জাহেলী জীবন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবেই। জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে যে আওয়াজই তোলা হোক, তা তাদের কাছে অপসন্দ হবেই। কিন্তু এইসব পসন্দ অপসন্দের তোয়াক্কা না করে এবং তাদের বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে রসূল সা. কে ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নের কাজটা সুসম্পন্ন করতেই হবে। ইসলামের দাওয়াতের উদ্দেশ্য যদি এটা না হতো, তাহলে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, জেহাদ ও হিজরতের অবকাশ কোথা থেকে হতো? জান ও মালের কুরবানীর আহ্বান কেন জানানো হলো? কী উদ্দেশ্যে ‘‘আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও’’ এই উদাত্ত আহ্বান জানানো হলে? কী উদ্দেশ্যে ‘‘আল্লাহর দল’’ গঠিত হয়? কোন্ লক্ষ্যে শহীদদেরকে বাছাই করা হয়? বস্তুত ইসলামের দাওয়াতের উদ্দেশ্য অন্তরে বদ্ধমূল না করে কুরআন ও সীরাত এই দুটোর কোনটাই বুঝা যাবেনা।
এবার আসুন, রসূল সা.-এর জীবনেতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় পর্যালোচনা করে অনুসন্ধান চালানো যাক যে তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য কী ছিল?
রসূল সা. প্রাথমিক স্তরেই বনু হাশেম গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের একটি বৈঠক আহ্বান করেন নিজের দাওয়াত পেশ করার জন্য। সেখানে তিনি সংক্ষেপে বলেন যে, এই দাওয়াত দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ের কল্যাণ নিশ্চিত করবে। এর অনেক দিন পরে এক কুরাইশ প্রতিনিধি দলের সাথে আলোচনা করার সময় তিনি ঐ বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে বলেনঃ
(আরবি*****************************)
‘‘আমি যে দাওয়াত পেশ করছি তা যদি তোমরা গ্রহণ করে নাও, তাহলে তাতে তোমাদের দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ের কল্যাণ নিহিত রয়েছে।’’ (সীরাতে ইবনে হিশাম, প্রথম জিল্দ, পৃঃ ৩১৬)
‘দুনিয়ার কল্যাণ’ এই সহজ সরল শব্দ দুটিকে কোন আংশিক কল্যাণের অর্থে গ্রহণ করা একেবারেই অযৌক্তিক। আংশিক কল্যাণ তো প্রত্যেক দাওয়াতেই থাকে। প্রত্যেকটা খারাপ ব্যবস্থায়ও কিছু না কিছু ভালো জিনিস থাকে। আসলে দুনিয়ার কল্যাণের অর্থ হলো দুনিয়ার জীবনটা সর্বাঙ্গীন সুন্দর হওয়া। সমাজ ব্যবস্থাটা নিষ্কলুষ ও নিখুঁত হওয়া। ন্যায় বিচারের স্থায়ী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং পবিত্র ও নির্মল জীবনের অধিকারী হওয়া।
কুরাইশদের সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যাওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে আরো একবার রসূল সা. এর সাথে তাদের আলাপ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এবারেও তিনি বলেনঃ
(আরবি***************************)
‘‘একটি মাত্র কথা যদি তোমরা আমাকে দাও, তবে তা দ্বারা তোমরা সমগ্র আরব জাতির ওপর আধিপত্য লাভ করবে এবং যত অনারব জাতি পৃথিবীতে আছে তারা সব তোমাদের বশ্যতা স্বীকার করবে।’’ (সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম জিলদ, পৃঃ ৩১৬)
প্রতিটি মেলা ও হজ্জের সময় আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত বিভিন্ন গোত্রের শিবিরে শিবিরে গিয়েও তিনি এই বক্তব্য প্রত্যেক গ্রোত্রপতির কাছে রাখতেন। তাদেরকে বলতেন, ‘‘আমাকে সাথে নিয়ে চলুন। আমাকে কাজ করার সুযোগ দিন এবং আমার সাথে সহযোগিতা করুন, যেন আমি সেই বার্তাটা জনগণের কাছে স্পষ্ট করে পেশ করতে পারি, যার জন্য আমাকে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে।’’ [বনু আমের গোত্রের যারা হজ্জ করতে গিয়েছিল, তারা ফিরে এসে জানিয়েছেঃ ‘‘মুহাম্মদ (সা) আমাদেরকে অনুরোধ করেছিল আমরা যেন তার নিরাপত্তা বিধান করি, তার দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করি এবং আমাদের এলাকায় তাকে নিয়ে আসি।’’ (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় জিলদ, পৃঃ ৩৪)] এই বক্তব্য শুনে ও রসূল সা. এর আবেগ উদ্দীপনা দেখে বনু আমের গোত্রের গোত্রপতি বুখাইয়া বিন ফিরাস এত অভিভূত হলেন যে, তিনি নিজের ঘনিষ্টজনদের কাছে বললেনঃ এই যুবককে হাতে পেলে আমি সমগ্র আরবকে গ্রাস করে ফেলতে পারবো।’’ রসূল সা.-এর দাওয়াতের লক্ষ্য ও তাঁর তৎপরতার সম্ভাব্য ফলাফল এই বিচক্ষণ আরব সরদার বুঝে ফেলেছিলেন। তাই তিনি রসূলের সাথে একটা দর কষাকষি করতে চাইলেন। তিনি রসূল সা. কে জানালেন যে, তিনি একটি শর্তে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। সেটি হলো, আপনি যখন আপনার বিরোধীদের ওপর বিজয় লাভ করবেন এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবেন, তখন আপনার পরে আমরা ক্ষমতাসীন হব।’’ বুখাইরা যে অত্যন্ত দূরদর্শী ছিলেন তা অস্বীকার করার উপায় নেই। রসূল সা. যদি সংকীর্ণ অর্থে নিছক ধর্মীয় প্রচারক ও ওয়ায নসীহতকারী হতেন, এবং কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য তাঁর একেবারেই না থাকতো, তাহলে পরিষ্কার বলে দিতেন যে, আরে ভাই, আমি তো আল্লাহ ওয়ালা মানুষ। ক্ষমতার বখরা দিয়ে আমার কী কাজ? রাষ্ট্র ও সরকারের সাথে আমার কিসের সম্পর্ক? কিন্তু রসূল সা. এভাবে জবাব দেননি। তিনি বললেন”
‘‘ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আল্লাহর হাতে। ওটা তিনি যাকে দিতে চান তাকেই দেবেন।’’
এ কথা বলেই তিনি বুখায়রার শর্ত ও ক্ষমতা ভাগাভাগির বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে দিলেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় জিল্দ পৃঃ ২৩)
রাসূল সা. এর নেতৃত্বে আন্দোলন চলাকালে “আরব ও অনারবদের ওপর কর্তৃত্ব লাভ”- এর বিষয়টি এত খ্যাতি লাভ করে যে, ওটা যেন ইসলামী আন্দোলনের শ্লোগানে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। শিশুরা পর্যন্ত ওটা বলাবলি করতো। বিরোধীরা এটাকে একটা উপহাসের ব্যাপার হিসাবে গ্রহণ করেছিল। দাস ও দরিদ্র শ্রেণীর যে সব যুবক ইসলাম গ্রহন করতো এবং কুরাইশদের অত্যাচার নির্যাতনে পিষ্ট হতো, তাদেরকে দেখলেই কুরাইশরা তাদের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে দিয়ে বলতোঃ “ এই হুজুরদের কথা কি আর বলবো, এরাঁ নাকি আরব-আজমের শাসক হবেন!”
বিদ্রুপ, উপহাস, বিরোধীতা ও প্রতিরোধের মাত্রা যতই বাড়ুক, কুরাইশ গোত্রের বিচক্ষণ লোকেরা অন্তরের অন্তস্থল থেকে নির্ঘাত উপলব্ধি করছিল যে, এ আন্দোলন কোন মামুলী জিনিস নয়, বরং এর অত্যন্ত সুদূর প্রসারী ফলাফল দেখা দিতে বাধ্য। একবার মক্কার শীর্ষ স্থানীয় কুরাইশ নেতারা উতবাকে রাসুলুল্লাহর সা. সাথে আলাপ আলোচনার জন্য পাঠালো। উৎবা সরকারী পদ, ধন-সম্পদ ও দুনিয়াবী স্বার্থ সংক্রান্ত সম্ভাব্য সব রকমের লাভজনক জিনিস দেয়ার প্রলোভন দেখালো, যাতে রসূল সা. কোন রকমে এই বিপ্লবী কর্মকান্ড পরিত্যাগ করতে রাজী হয়ে যান। তবে রাসূল সা. উৎবাকে সুরা হা-মীম এর প্রথম কয়েকটি আয়াত শুনিয়ে দিলেন। এর ফলে উৎবার চেহারাই বিবর্ণ হয়ে গেল। সে গিয়ে বললোঃ এ দাওয়াত তো একটা বিরাট পরিবর্তনের ইঙ্গিতবহ। একটা বিপ্লব ঘনিয়ে আসবে এবং সমাজ জীবনের সব কিছু ওলট পালট হয়ে যাবে। তাই সে পরামর্শ দিল যে, মুহাম্মদকে (সা.) তোমরা কিছু বলো না। সে যা করছে তা করতে দাও। বাধা দিও না। আরবের জনগণ যদি তাকে মেরে ফেলে, তাহলে তোমরা তার থেকে এমনিতেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে। আর যদি সে বিজয়ী হয়, তার রাজত্ব তোমাদেরই রাজত্ব হবে, তার মর্যাদা তোমাদেরই মর্যাদা হবে, এবং তোমরা বিশ্বে সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী হবে।’ অথ্যাৎ কিনা উৎবার মত লোকও বুঝে ফেলেছিল যে, এই আন্দোলনের পশ্চাতে একটা সাম্রাজ্য লুকিয়ে রয়েছে। এবং এর পরণতি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছাড়া আর কিছু নয়। সে যখন টের পেয়েছে, তখন রাসুল সা. ও তার সংগী সাথীরা কিভাবে টের না পেয়ে থাকবেন? (সীরাতে ইবনে হিসাম, ১ম জিল্দ, পৃঃ ৩১৪)
একবার যখন মুসলমানরা প্রচন্ড সহিংসতা ও নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল, তখন রাসূল সা. –এর সাথীরা তাঁর কাছে তাদের দুঃখের কাহিনী বর্ণনা করলেন এবং ঐ অবস্থা থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য দোয়া চাইলেন। রাসূল সা. প্রথমে তো তাঁদের বুঝালেন যে, আল্লাহর দ্বীনকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে পদে পদে কঠিন বাধার সম্মুখীন হতে হয়। অতীতে যারা এ দায়িত্ব পালন করেছে তাদেরকে অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশা ভোগ করতে হয়েছে। অতঃপর পূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে তাদেরকে সুসংবাদ শুনালেন যে, “আল্লাহর কসম, এ কাজে আল্লাহ একদিন অবশ্যই চূড়ান্ত সাফল্য দান করবেন।’ অতঃপর এই সাফল্যের বর্ণনা দিয়ে বলেনঃ
“এক ব্যক্তি সম্পূর্ণ একাকী সানা থেকে হাযরামাউত পর্যন্ত সফর করবে, অথচ আল্লাহ ছাড়া আর কারো ভয়ে সে ভীত থাকবেনা।” [সীরাতে ইবনে হিসাম – প্রথম খন্ড, পৃঃ ৩১৪ (মুল আরবী পুস্তক)] অর্থাৎ পৃথিবীতে এমন এক ইনসাফপূর্ন সমাজ ও কল্যাণময় যুগ প্রতিষ্ঠিত হবে, এমন শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থা চালূ হবে যে, আজ যেখানে ডাকাতি, রাহাজানি হত্যা নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে, যেখানে মানব সন্তানকে দিনে দুপুরে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এবং প্রকাশ্যে নারীর সতীত্ব পর্যন্ত লুন্ঠিত হচ্ছে, সেখানে একজন ভ্রমণকারী সম্পূর্ণ একাকী নিশ্চিন্তে ও নির্ভয়ে যত্রতত্র ভ্রমণ করতে পারবে। কেউ তার জান মাল ও মান সম্ভ্রমকে স্পর্শ করার দুঃসাহস দেখাবে না। আর একবার রসূল সা. বলেছিলেন যে, এমন একটা যুগ প্রায় আসন্ন, যখন লোকেরা নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াই মক্কায় যাতায়াত করবে। [শিবলী নোমানঃ সীরাতুন্নবী, ২য় খন্ড, ৩ পৃষ্ঠা]
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে যেরূপ পরিষ্কার ও উজ্জল ধারনা এখানে ব্যক্ত করা হয়েছে, তা সত্যিই অতুলনীয়।
একবার রসূল সা. কা’বার চাবির রক্ষক উসমান বিন তালহাকে কা’বার দরজা খুলে দিতে অনুরোধ করলে উসমান সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলো। সে সময় দৃশ্যত চরম নৈরাজ্যজনক ও প্রতিকূল পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। তথাপি রসূল সা. বললেন, 'সেই দিন বেশি দূরে নয়, যখন এই চাবি আমাদের হাতে থাকবে এবং আমরা যাকে দিতে চাইবো দিবো। [আল মাওয়াহিবুল লাদুনীয়া, কাসতালানী, ১ম খন্ড, পৃ: ১৫৮]
আকাবা নামক স্থানে মদীনার আনসারদের কাছ থেকে যে ঐতিহাসিক অংগীকার বা বায়আত নেয়া হয়েছিল, তা অধ্যয়ন করলে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ইসলামের প্রচারজনিত বিরোধ ও সংঘাত যে কত ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী হয়, তা আনসাররাও উপলব্ধি করেছিলেন। তারা এটাও উপলব্ধি করেছিলেন যে, এই বিরোধের চূড়ান্ত ফয়সালা পরবর্তীতে যুদ্ধের ময়দানেই হবে। এই অংগীকারের মধ্য দিয়ে একদিকে আনসারগণ রাসূল সা. এর সমর্থনে প্রয়োজনে সারা বিশ্বের সাথে যুদ্ধ করার প্রতিশ্রুতিও দেন এবং নিজেদের সরদারদের ধ্বংশ ও জানমালের বিনাশকেও স্বাগত জানান। অপরদিকে রাসুল সা. এর কাছে থেকেও তারা প্রতিশ্রুতি আদায় করেন যে, আল্লাহ যখন আপনাকে বিজয়ী করবেন, তখন যেন আপনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন না। এই যে যুদ্ধের প্রতিশ্রুতি, ত্যাগ ও কুরবানীর সংকল্প এবং বিজয়ের স্বপ্ন- এ সবের মধ্যে কি রাসূলের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। [সীরাতে ইবনে হিসাম (আরবী), ২য় খন্ড, পৃ: ৫০, ৫১, যাদুল মায়াদ (আরবী) ১ম খন্ড, পৃ: ৫০,৫১]
হিজরতের জন্য যাত্রা শুরু করার আগে তাকে যে দোয়া শেখানো হয় তার শেষাংশ হলো, ”আর তোমার পক্ষ থেকে কোনো রাষ্ট্র শক্তিকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও” [সুরা বণী ইসরাঈণ, আয়াত ৮০]
এ আয়াতে তাঁকে ’সহায়ক শক্তি’ প্রার্থনা করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। অথার্ৎ এই পবিত্র মিশনের পৃষ্ঠপোষকতা ও এই মহতী লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য শাসন ক্ষমতার প্রয়োজন বিধায় শাসন ক্ষমতা প্রার্থনা করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
চাচা আবু তালেবের ওপর রাসূল সা. – এর সাফল্য ও সমর্থন পরিত্যাগ করার জন্য যখন চাপ সৃষ্টি করা হলো, তখন তিনি রসূল সা. কে বললেন, আমার জন্য সমস্যার সৃষ্টি করো না। এই সময়ে রাসূল সা. যে জবাব দেন তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ’ওরা যদি আমার ডান হাতে সূর্য আর বাম হাতে চাঁদ এনে দেয়, তবুও আমি আমার এ লক্ষ্য পরিত্যাগ করবো না।” তার জবাবের শেষ কথাটা ছিল এই- ”হয় আল্লাহ আমার এই লক্ষ্যকে বিজয়ী করবেন, নচেৎ এ কাজ করতে করতেই আমি মৃত্যু বরণ করবো।” [সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড ২৭৮]
এখানে তিনি 'বিজয়ী করবেন’ বলেছেন, 'সম্পূর্ণ করবেন’ বলেননি। 'বিজয়ী' শব্দটার মধ্যেই দ্বন্দ-সংঘাতের ধারনা বিদ্যামান। আর তাঁর শেষ বাক্যটি থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, এই দ্বন্দ-সংঘাতের তীব্রতা ছিল জীবনের ঝুকি পর্যায়ের।
হিজরতের পর আদী ইবনে হাতেম রাসূল সা.-এর কাছে এসে তার ব্যক্তিত্ব পরখ করতে লাগলেন। তিনি তারঁ দাওয়াতের ধারণা কী জানতে চেষ্টা করলেন এবং সমালোচকের দৃষ্টিতে তার চলন বলন পর্যবেক্ষন করলেন। আর এ কাজ করতে গিয়েই তার হৃদয় হয়ে পড়লো অভিভূত ও মুগ্ধ। আগন্তুকের চিন্তাধারার সাথে সংগতি রেখে তিনি তাকে জানালেন যে, ভবিষ্যতে বাবেলের সাদা ভবনগুলো ইসলামের অধীনে চলে আসবে, এখানে বিপুল ধনসম্পদ বিরাজ করবে এবং মুসলমানরা অসাধারন ক্ষমতা ও প্রতাপের অধিকারী হবে। সেই সাথে তিনি তাকে ইসলামী ইনসাফপূর্ণ সমাজব্যবস্থার এই বৈশিস্ট সম্পর্কেও অবহিত করলেন যে, অচিরেই তুমি দেখবে- এক মহিলা সুদূর কাদেসিয়া থেকে একাকী একটি উঠে সওয়ার হয়ে এই মসজিদ অভিমুখে রওনা হয়েছে এবং সম্পূর্ন নিরাপদে এখানে এসে পৌছেছে। বাহ্যত একেবারেই নিস্ব অবস্থায় হিজরতের সফরে যে নবীর দৃষ্টি সুরাকার হতে পারস্য সম্রাটের কংগন শোভা পেতে দেখেছে, তাঁর সম্পর্কে এ কথা কিভাবে বলা যায় যে, নিজের আন্দোলনের শেষ পরিনতি ও নিজের সূচিত নতুন সমাজ ব্যবস্থার চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন না? এ কথা কিভাবে কল্পনা করা সম্ভব যে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা তার উদ্দেশ্য ছিল না, তার জন্য প্রস্তুতি ও সংগ্রাম করা হয়নি এবং তা নিছক পুরস্কার হিসাবে আকস্মিকভাবে রাসূল সা. এর সংগঠন কে দেওয়া হয়েছে? বলতে চাইলে বড়জোর এতটুকু বলা যায় যে, কেবল পার্থিব স্বার্থ ও ব্যক্তিগত প্রতাপ ও পরাক্রম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি রাষ্ট্র ও সরকার কায়েম করতে চাননি। কিন্তু আল্লাহর দ্বীনকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করা, ন্যায়বিচার ও ইনসাফ কায়েম করা, মানবতার মুক্তি নিশ্চিত করা এবং সমাজ গঠনের জন্য ইসলামী রাষ্ট্র কাম্য ছিল না, একথা কেমন করে বলা যায়?
আসলে শুধু আকীদাগত ও নৈতিক বিপ্লব সাধনই রাসূল সা. এর উদ্দেশ্য ছিল না, বরং সেই সাথে পূর্ণ গুরুত্ব সহকারে রাজনৈতিক বিপ্লব সাধনও তাঁর লক্ষ্য ছিল। ব্যক্তির সংশোধনের পাশাপাশি সমাজ সংস্কারও তার কাম্য ছিল। অন্য কথায় বলা যায়, রাসূল সা. মানুষকে একটা সামষ্টিক সত্তা বা সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। এবং তার সকল সামাজিক সম্পর্ক সহ তাকে সংশোধন করতে চেয়েছিলেন। রাসূল সা. মানুষকে সমাজ থেকে বিছিন্ন করে শুধু ব্যক্তি হিসাবেও বিবেচনা করেননি। এবং তার দাওয়াতকেও মানুষের ব্যক্তিগত জীবন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখেননি। এই বিষয়টি যদি স্বরণ রাখা হয় এবং রসূল সা. এর আগমনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে যদি তার সমস্ত ব্যাপকতা সহকারে অন্তরে বদ্ধমূল করা হয়, তাহলে সীরাতের ঘটনাবলীতে পরিপূর্ণ ধারাবাহিকতা পরিলক্ষিত হবে এবং প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি পদক্ষেপ ও প্রতিটি উদ্যোগের ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। অন্যথায় সীরাতের রহস্যও উদ্ঘাটিত হবে না, এবং পবিত্র কোরআনের বক্তব্যও স্পষ্ট হবে না।

একটি দীন একটি আন্দোলন

দর্শনের গন্ডী যতখানি, চিন্তার গন্ডীও ঠিক ততখানি। জীবনের বাস্তব কর্মক্ষেত্রে এবং ইতিহাসের চড়াই উতরাই-এর সাথে দার্শনিকের কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকেনা। দার্শনিক ঘটনাবলী ও পরিস্থিতি- পরিবেশের আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন বটে; কিন্তু ঘটনাবলী ও পরিস্থিতির মোড় ঘুড়িয়ে দেয়ার জন্য কোন কার্যকর চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রামে অংশ গ্রহন করেন না। প্রচলিত সংকীর্ণ অর্থে ধর্ম বলতে যা বুঝানো হয়, তার গন্ডী আরো একটু প্রশস্ত এবং তার দৌড় আরো একটু দীর্ঘ। সে কিছু আকীদা-বিশ্বাস দেয়ার সাথে সাথে ব্যক্তিকে সমাজ থেকে আলাদা করে একটা নৈতিক শিক্ষাও দেয়। তবে ধর্মের পথ সমাজ ব্যবস্থার বাইরে-বাইরে দিয়ে অতিক্রান্ত হয়। সে দেশের রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে যেমন মাথা ঘামায়না, তেমনি সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও কোন ব্যাপক পরিবর্তন চায়না, এবং চলমান শাসনব্যবস্থাকেও চ্যালেঞ্জ করে না। ধর্মের দাওয়াত সব সময় ওয়ায নসিহত ও উপদেশ দানের পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়ে থাকে। একজন ওয়ায়েয মিষ্টি মধুর কিছু উপদেশ দিয়েই বিদায় গ্রহন করেন। তাঁর শ্রোতারা কোন সংকটজনক পরিস্থিতিতে আটকা পড়ে আছে কিনা, ইসলাম বিদ্বেষী কুচক্রী মহল কোন আপত্তিকর তৎপরতা দ্বারা তাদের মানসিকতা ও চরিত্রকে বিকৃত ও বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে কিনা, দৈনন্দিন ঘটনাবলী ও পরিস্থিতি তাদের চরিত্রে কোন বিরূপ প্রভাব ফেলেছে কিনা, তাঁর সদুপদেশের পক্ষে বা বিপক্ষে কি কি মতাদর্শ ও চিন্তাধারা কোন কোন দিক থেকে কতখানি প্রভাব ফেলছে, তাঁর দেয়া ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত পরম ধর্মপ্রান ও খোদাভীরু লোকগুলো কোন অনৈসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হয়ে আছে কিনা,- সে সব বিষয় নিয়ে তার কোন মাথাব্যাথা থাকেনা। তাঁর মধ্যে কোন সামষ্টিক লক্ষ্য থাকে না। পরিবর্তনের কোন পরিকল্পনা থাকেনা। রাজনৈতিক ও নেতাসূলভ প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টির কোন প্রয়োজন অনুভূত হয় না। জীবনের একটা ক্ষুদ্র অংশে আংশিক সততা ও ন্যায়নিষ্ঠা সৃষ্টি করার জন্য যা কিছু করা সম্ভব, তা করা হয়। তারপর অবশিষ্ট বিস্তীর্ণ ময়দানে বাতিল ও অপশক্তি মহানন্দে আপন পতাকা ওড়াতে থাকলো কিনা, তা নিয়ে তারা আর মাথা ঘামায় না।
রাসূল সা. একজন দার্শনিক ছিলেন না যে, স্রেফ উচ্চাংগের কিছু ধ্যান ধারনা পেশ করেই তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে এবং বাস্তব অবস্থা নিয়ে কোন চিন্তাভাবনা তাকে করতে হবে না। তিনি নিছক একজন ওয়ায়েযও ছিলেন না যে, সর্বব্যাপী নৈরাজ্য ও উচ্ছৃংখলতা থেকে একেবারে চোখ বুজে কেবল ব্যাক্তিগতভাবে মানুষকে সম্বোধন করবেন, মিষ্টি মধুর উপদেশ বিতরন করবেন এবং তার পরিনতি কী হতে পারে, তা আদৌ ভেবেই দেখবেন না। মানবজাতির ত্রানকর্তা এই মহামানব পরিপূর্ণ সমাজ সচেতনতা সহকারে মানব জীবনের আমূল পরিবর্তন সাধনকেই নিজের ব্রত হিসাবে গ্রহন করেন। এ জন্য তিনি সামষ্টিক জীবনকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করে, এমন প্রতিটি শক্তির সাথে পরিচিত হয়েছেন। জাহেলী সমাজ ও সভ্যতার চালক নেতৃবৃন্দের ওপর নজর রেখেছেন। যুক্তিপ্রমাণ সহকারে তাদেরকে চ্যালেঞ্জ পর্যন্ত করেছেন। ইতিহাসের ধারাবাহিকতার ওপর দৃষ্টি রেখেছেন। ঘটনা প্রবাহ ও পরিস্থিতির প্রতিটি তরঙ্গের প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন। প্রতিটি ঘটনাকে নেতাসূলভ অন্তর্দৃষ্টি ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে যাচাই ও পরখ করেছেন যে, তা কোন দিক দিয়ে সংস্কারের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক ও কোন দিক দিয়ে ক্ষতিকর? সমাজের সকল ধরনের মানুষের যোগ্যতা ও গুনাগুণ জানতে চেষ্টা করেছেন এবং তার আলোকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন যে, দাওয়াতের কাজে কখন কার কাছ থেকে কী সাহায্য আশা করা যায়। তিনি নিজের শক্তি ও গতিকে প্রতিপক্ষের শক্তি ও গতির সাথে তুলনা করতেন। প্রত্যেকটি পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় ধৈর্যের সাথে প্রহর গুনতেন। উপযুক্ত সময়টা এসে যাওয়া মাত্রই সাহসের সাথে পদক্ষেপ নিতেন। জনমতের ওঠানামা কিভাবে হয়, তা যথাযথভাবে বুঝতেন এবং বিরোধীদের প্রতিটি অপপ্রচারের মোকাবিলা করে তাদের প্রভাব খর্ব করতেন। যখন দেখলেন, ইসলাম বিরোধী কবিতা ও বক্তৃতার একটা আসর তৈরী হয়ে গেছে, তখন তার পাল্টা আসর গড়ে তুললেন ইসলামী কবি ও গণবক্তাদের দ্বারা। ইসলামী নীতিমালা কঠোরভাবে অনুসরণ করতেন বটে, তবে চোখ বুঝে নয়। বরং পরিস্থিতি ও পরিবেশের দিকে দৃষ্টি রাখতেন, সময়ের চাহিদা বুঝতেন এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করতেন। যেখানে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পাওয়া যেত, এগিয়ে যেতেন। এগিয়ে যাওয়া সমীচিন মনে না হলে অগ্রাভিযান থেকে বিরত থাকতেন। এক সাথে দুটো বিপদের সম্মুখীন হলে একটা থেকে আত্মরক্ষা করে অপরটার মোকাবিলা করতেন। সামরিক ব্যবস্থা গ্রহনের প্রয়োজন দেখা দিলে নিঃসংকোচে গ্রহন করতেন। সন্ধির সুযোগ সৃষ্টি হলে অকুন্ঠ চিত্তে সন্ধির হাত বাড়িয়ে দিতেন। সর্বোপরি, এই সব চেষ্টা সাধনায় আল্লাহর প্রতি ভক্তি ও আনুগত্য এবং নৈতিক মূল্যবোধকে শুধু সংরক্ষণই করতেন না, বরং তার ক্রমাগত উন্নয়ন ও বিকাশ সাধন করতেন। এই গোটা কার্যক্রম ও কর্মপদ্ধতিকে যদি কোরআন ও সীরাত (মুহাম্মদ সা.-এর জীবনের ইতিহাস)-এর পাতা থেকে একত্রিত করে সামনে রাখা হয়, তাহলে ব্যক্তিগত পূজা উপাসনা, জপতপ ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ প্রচলিত পরিভাষার ‘ধর্ম’এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানের আনুগত্য বোধক ‘আদ-দ্বীন’-এর পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যাবে। জানা যাবে-ওয়ায নসিহত ও বৈপ্লবিক আহবানের মধ্যে এবং ব্যক্তিগত আত্মশুদ্ধি ও সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে কি বিরাট ব্যবধান!
যেহেতু রসূল (সাঃ) একটি পূর্নাঙ্গ ও সর্বাত্মক জীবন বিধান বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন, তাই তিনি এক এক করে সেই সব ব্যক্তিকে অনুসন্ধান করেছিলেন যারা স্বভাবগতভাবে সৎ। তারপর যার হৃদয়ে সত্যের আলো জ্বলে উঠেছে, তাকেই একটা সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত করেছেন,তাকেই প্রশিক্ষণ দিয়ে দিয়েছেন, তাকে নিজের সাথে অগ্নি-পরীক্ষায় অংশীদার করেছেন। তারপর যেই স্তরে যতটুকু সংঘবদ্ধ শক্তি অর্জিত হয়েছে, তাকে আপন নেতৃত্বে বাতিল ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইতে শামিল করেছেন। এ লড়াই যেমন চলেছে চিন্তার ময়দানে তেমনি চলেছে রাজনৈতিক ময়দানে এবং সর্বশেষ রণাঙ্গনেও। রসূল (সাঃ) এর পার্শ্বে যারা সমবেত হন, তাদের কে তিনি সুফি ও দরবেশ বানিয়ে দেননি। যোগী সন্যাসী রুপে গড়ে তুলেননি, তাদের মধ্যে দুষ্কৃতি থেকে কেবল নিজেকে রক্ষা করা, বিজয়ী বাতিল শক্তির ভয়ে ভীত থাকা, এবং ক্ষমতাধর ও বিত্তশালীদের ভড়কে যাওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করেননি। তারা নির্বোধ পর্যায়ের সরল ও ছিলেন না ,নিষ্ক্রিয় পর্যায়ের দুনিয়া ত্যাগিও ছিলেন না। তারা ছিলেন নির্ভীক ও সাহসী। সচেতন ও প্রাজ্ঞ, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ও আত্ম অভিমানি, সুচতুর ও বিচক্ষণ, কর্মঠ ও নিরলস এবং অগ্রগামী ও দ্রুতগামী। তারা পাদ্রী ও সাধুদের মতন কর্মবিমুখ ছিলেন না। বরং সদা করমচঞ্চল ছিলেন ও সব রকমের সদগুণাবলী ও যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। এভাবে সর্বোত্তম স্বভাবের মানুষ গুলো উৎকৃষ্টতম প্রশিক্ষণ পেয়ে, উৎকৃষ্টতম সাংগঠনিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এবং সর্বোত্তম নেতৃত্বের অধীনে সমবেত হয়ে এক অপরাজেয় শক্তিতে পরিনত হন। এ কারনেই তারা একটি ক্ষুদ্র সংখ্যা লঘু হয়েও সমগ্র আরবের বিপুল সংখ্যা গুরু জনতাকে নিজেদের অধীনে সংঘবদ্ধ করতে সমর্থ হন। মক্কায় যখন ইসলামী সংগঠনের লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ৪০ জন, তখন মক্কা ও তার আশেপাশের গোটা জনপদে তারা এক সার্বক্ষণিক চাঞ্চল্য ও উদ্দীপনার জোয়ার সৃষ্টি করেন। এর পর বছরের পর বছর ব্যাপি ঘরে ঘরে অলিতে গলিতে সবচেয়ে বহুল আলোচিত বিষয় যদি কিছু হয়ে থাকে,তবে তা ছিল রসূল (সাঃ) ও তার সঙ্গিদের দাওয়াতি তৎপরতা। মদিনায় গিয়ে যখন ইসলামি আন্দোলনের নিশানবাহীদের সংখ্যা কয়েকশোর বেশি হয়নি, এবং অমুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, তখনই ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করা হোল। রসূল (সাঃ) ও তার ইসলামী সংগঠনের নীতি এরূপ ছিল না যে,আগে সমগ্র আরব সমাজ ইসলাম গ্রহন করুক অথবা অধিকাংশ লোকের চরিত্র সংশোধন সম্পন্ন হোক, তার পর ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেয়া যাবে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এরকম ছিল না যে আগে দাওয়াতের কাজ চলতে থাকুক, এবং চিন্তা ও আকীদা বিশ্বাসের সংস্কার ও সংশোধন হতে থাকুক। অবশেষে একদিন ইসলামী রাষ্ট্র সমাজ ব্যবস্থা আপনা আপনিই তৈরি হয়ে যাবে, অথবা পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ তায়ালা ইসলাম কে বিজয়ী করে দেবেন। সেখানে ইতিহাসের এই চিরায়ত সত্যকে অনুসরণ করা হয়েছিল যে, জনগনের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ চিরদিনই অজ্ঞ ও নিষ্ক্রিয় থাকে এবং সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশই থাকে সক্রিয়। এই সক্রিয় অংশের একভাগ সংস্কার ও বিপ্লবের দাওয়াত নিয়ে মাঠে নামে আর অপর অংশ তাতে বাধা দেয়। সমাজের সক্রিয় অংশের এই দুই ভাগের মধ্যেই চলে আসল দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। এই সংঘাতের যখন ফয়সালা হয়ে যায়, তখন জনগন আপনা আপনি সক্রিয় হয়ে উঠে। তারা জানতেন যে, জনগনের পথে যতক্ষণ কোন ভ্রষ্ট নেতৃত্ব বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,এবং তাদের জীবন কে বিকৃত করার অপচেষ্টা চলতে থাকে,অথবা অন্তত পক্ষে তাদের অজ্ঞতা ও নিষ্ক্রিয়তার অন্ধকারে ফেলে রাখে, ততক্ষণ তারা ব্যাপকভাবে কোন দাওয়াত কে গ্রহন করতেও পারে না এবং নিজেদের বাস্তব জীবনে কোন পরিবর্তন আনতেও সক্ষম হয়না। এমন কি যারা দাওয়াত কে গ্রহন করে, তাদের পক্ষেও সম্ভব হয় না যে, তারা বিকারগ্রস্থ নেতা ও শাসকদের তৈরি করা নোংরা পরিবেশে নিজেদের জীবনকে পরিপূর্নভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলবে। বরঞ্চ পরিবর্তন আনতে যদি অনেক বেশি দেরি হয়ে যায় তবে অনেক সময় সেই মান বজায় রাখাও কঠিন হয়ে দাড়ায়, যে মানে সত্যের আহবায়করা দীর্ঘদিনের চেষ্টা সাধনা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে পৌছতে পেরেছিলেন। কেননা প্রতিকূল পরিবেশ মানুষকে পেছনে ঠেলে দিতে ক্রমাগত শক্তি প্রয়োগ করে থাকে। সুতরাং কোন সামাজিক আন্দোলনের স্বাভাবিক কর্মপন্থা এতটাই হয়ে থাকে যে, সমাজের সক্রিয় অংশ থেকে সৎ স্বভাবের লোকগুলোকে বাছাই করে যত বেশি সম্ভব শক্তি সঞ্চয় করে নিতে হয়, এবং সেই শক্তিকে সংঘর্ষে নিয়োজিত করে প্রতিপক্ষের নেতৃত্বের জোর চূর্ণ করে দিতে হয়। ইতিহাস সাক্ষী যে, এযাবৎকাল সংঘঠিত প্রতিটি বিপ্লব সক্রিয় সংখ্যা লঘুদের হাতেই সংঘটিত হয়েছে। যেহেতু যে কোন সংস্কার ও গঠনমূলক আহবান সমাজের সক্রিয় অংশের মধ্যে থেকে কেবল সৎ স্বভাব সম্পন্ন লোকদেরকেই আকৃষ্ট করে থাকে, তাদের মধ্যে একটা ইতিবাচক আবেগ ও প্রেরনার সৃষ্টি করে, এবং তাদের কে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের নৈতিক বল বাড়িয়ে দেয়, তাই প্রতিপক্ষ প্রচুর শক্তি, প্রভাব প্রতিপত্তি ও ক্ষেত্র বিশেষ সংখ্যাধিক্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মোকাবেলায় পরাজিত হয়ে থাকে। এর একটা উল্লেখযোগ্য ও অকাট্য প্রমান হচ্ছে বদরের যুদ্ধ। সুতরাং যখন রসূল (সাঃ) এর চারপাশে আরবিও সমাজের সক্রিয় সৎস্বভাব সম্পন্ন লোকের এত অধিক সংখ্যা একত্রিত হয়ে গেল যে, তারা নৈতিক শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে জাহেলী নেতৃত্ব ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে লড়তে সক্ষম, তখন তিনি নিজের রাজনৈতিক লক্ষ্য অভিমুখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বিন্দুমাত্রও কুণ্ঠিত হলেন না। মক্কা বিজয়ের তাৎপর্য এটাই যে, এর মাধ্যমে জাহেলী নেতৃত্ব সম্পূর্ণরূপে উৎখাত ও বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর মাধ্যমে জনসাধারনের মাঝ থেকে সকল বাধা অপসারিত হওয়ায় তারা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে এগিয়ে আসে। ইতিহাসের একটি দৃষ্টান্তও এমন নেই যে, সত্যভ্রষ্ট নেতৃত্বের অধীনে কোন কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছাড়াই নিছক ওয়াজ-নসিহত, তাবলীগ ও ব্যক্তিগত সংশোধনমূলক কাজ দ্বারা বিপ্লব সংঘটিত হয়ে যেতে পেরেছে। নচেৎ বিগত তেরো শতাব্দীতে খেলাফতে রাশেদার পর ওয়াজ-নসিহত, তাবলীগ প্রচার এবং তা’লীম ও আত্মশুদ্ধির নামে মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ সমূহের আওতায় প্রচুর চেষ্টা সাধনা চলেছে এবং আজও আলেম, সূফী পীর মাশায়েখ মাদ্রাসা শিক্ষক ও লেখকগণ মুখ ও লেখনির মাধ্যমে এত ব্যাপক ও বিপুল পরিমান প্রচার কার্য চালিয়ে যাচ্ছেন, যা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইপ্সিত সংখ্যক লোকের আত্মশুদ্ধিও হতে পারলনা। সমাজ সংস্কারের কাজও এতটা এগুলোনা যে, এর কল্যাণে সমাজ ব্যাবস্থাটা পাল্টে যাবে এবং রসূল (সাঃ) এর বিপ্লবের পূনরাবৃত্তি হবে। পরিষ্কার বুঝা যায় যে এ যাবতকার চিন্তাধারা, কর্মপদ্ধতি ও বিপ্লবী মতাদর্শে বড় রকমের কোন খুঁত ছিল। আর সেই খুঁত এই যে, নেতৃত্ব পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘাত এড়িয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু লোককে সামগ্রিক সমাজ ব্যাবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দাওয়াত দেয়া ও সংশোধন করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। কেউ কেউ বলে যে, দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করাটা আসল লক্ষ্য ছিল না, বরং আকস্মিকভাবে আল্লাহর পুরস্কার হিসেবে এসে গিয়েছিল। কিন্তু তারা যখন এ কথাটা বলে, তখন রসূল (সাঃ) এর কৃতিত্বপূর্ণ অবদান ও প্রানান্তকর সংগ্রামের শুধু অবমূল্যায়নই করেনা, বরং কালিমা লেপন করে। একটু ভাবুন ত এই মহান ব্যক্তিত্ব কত কষ্ট করে মদীনার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকেদেরকে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে একটা সাংবিধানিক চুক্তির আওতাভুক্ত করে ফেললেন, কত কাঠখড় পুড়িয়ে মদিনার পার্শ্ববর্তী গোত্র সমূহের সাথে মিত্রতা ও সখ্যতার সম্পর্ক স্থাপন করলেন। কত দক্ষতার সাথে মুষ্টিমেয় সংখ্যক মুসলমানদেরকে নিয়ে একটা দুর্ভেদ্য সামরিক বাহিনী গড়ে তুললেন এবং নিয়মিত সামরিক টহলের ব্যাবস্থা করলেন। কত চেষ্টা সাধনা দ্বারা কোরাইশদের বানিজ্যিক পথ অবরোধ করলেন। কত দৃঢ়তার সাথে কোরাইশদের আগ্রাসী আক্রমণ প্রতিহত করলেন। কেমন চাতুর্যের সাথে ইহুদি ও মোনাফেকদের ষড়যন্ত্র নস্যাত করলেন। কত বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার সাথে হুদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করলেন। কি দুরন্ত সাহসিকতা নিয়ে ইহুদিদের যোগসাজশের সব কটি ঘাটি একে একে সমূলে উৎপাটন করলেন এবং কেমন সজাগ মস্তিষ্ক নিয়ে তিনি অসংখ্য দুর্ধর্ষ গোত্রের আঞ্চলিক বিদ্রোহের অবসান ঘটালেন। এই সব পদক্ষেপ তাঁর রাষ্ট্রনায়ক সূলভ অন্তর্দৃষ্টি ও প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক দক্ষতা ও বিচক্ষণতা ও সুণিপুন কর্মকুশলতার যে বিস্ময়কর নজীর বিদ্যমান, তা কেমন করে এই সব লোকের দৃষ্টি এড়ায়, বুঝে আসে না। এই সব কিছুকে আল্লাহর পুরস্কার বলা সম্পূর্ণ সত্য কথা। কেননা প্রত্যেক ভাল জিনিসই আল্লাহর পুরস্কার হয়ে থাকে। কিন্তু মানুষ কোন পুরস্কার তখনি পায় যখন সে তার জন্য চেষ্টা সাধনা যথাসাধ্য বুদ্ধিমত্তা ও অন্তর্দৃষ্টি সহকারে করে দেখায়। দ্বীন প্রতিষ্ঠাকে আল্লাহর পুরস্কার বলার মাধ্যমে কেউ যদি রসুল(সাঃ) এর সংগ্রাম, কঠোর পরিশ্রম, দক্ষতা, কুশলতা, প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতাকে অস্বীকার করতে চায়, তবে সে মস্ত বড় অবিচার করে। দুর্ভাগ্যবশত, রসূল (সাঃ) এর রাজনৈতিক দিকটা এত অস্পষ্ট রয়ে গেছে যে আজ তাঁর দাওয়াত ও লক্ষ্য সম্পর্কে সঠিক ধারনা পোষণ করা কঠিন হয়ে গেছে। অথচ এই দিকটা সমগ্র নবী জীবনী অধ্যয়নের সময় সামনে না থাকলে ধর্মের প্রচলিত সংকীর্ণ ধারনা ও দ্বীনের সর্বব্যাপী ধারনার মধ্যে যে বিরাট ব্যবধান রয়েছে সেটা বুঝা সম্ভব নয়। রসুল(সাঃ) একটা পুর্নাঙ্গ জীবন বিধান বা দ্বীন নিয়ে এসেছিলেন, সেই সত্য ও নির্ভুল দ্বীনের ভিত্তিতে সমগ্র জীবনের কার্যবিধি ও আচরণবিধি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, এবং আল্লাহর আইনকে বাস্তবায়িত ও কার্যকরী করতে এসেছিলেন। কাজেই আমাদের এটা উপলব্ধি করা চাই যে রসুল(সাঃ) পুর্নাঙ্গ ও সর্বাত্মক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কার ও পুনর্গঠনের আন্দোলন চালাতে এসেছিলেন। আর এই আন্দোলন চালানোর জন্য তাঁর মধ্যে ছিল সর্বোত্তম‌‍ রাষ্ট্রনায়ক সুলভ প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, মনীষা, অন্তর্দৃষ্টি এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক চেতনা ও বুদ্ধিমত্তা। অন্য কোন দিক দিয়ে যেমন রসূল (সাঃ) এর সমকক্ষ কেউ নেই, তেমনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও তাঁর সমতূল্য কেউ নেই। তিনি জীবনের প্রতিটি ব্যাপারেই যেমন অনুকরনীয় আদর্শ, তেমনি রাজনৈতিক সংগ্রাম ও চেষ্টা সাধনায়ও একমাত্র তাঁর জীবনই আদর্শ। রসুল(সাঃ) এর কীর্তি ও অবদান এই যে, তিনি সততার দাওয়াত দিয়েছেন, সত্য ও ন্যায়ের বিজয়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়েছেন এবং একটা পুর্নাঙ্গ সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। ধর্মের সীমিত ও সংকীর্ণ ধারনার মধ্যে এত বড় ও বিশাল কাজের স্থান সংকুলান হতে পারে না। সুতরাং এটা ছিল দ্বীন তথা পুর্নাঙ্গ জীবনবিধান, নিছক ধর্ম নয়। এটা ছিল এক সর্বাত্মক আন্দোলন- নিছক কোন আধ্যাত্মিক যোগ সাধনা নয়।

জীবনের অবিভাজ্য পুর্নাঙ্গতা

মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মহান আন্দোলন এক অনন্য বিপ্লব সংঘঠিত করার মাধ্যমে যে সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে, তার বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তার মূল কলেমার চেতনা ও প্রেরনা জীবনের প্রতিটি বিভাগে ও প্রতিটি ক্ষেত্রে একই ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। গোটা সমাজ ব্যবস্থায় পরিপুর্ণ একাত্মতা ও সমন্বয় বিরাজ করত। সকল প্রতিষ্ঠান ছিল এক এ রঙে রঞ্জিত ও একই ভাবধারায় উজ্জীবিত। মসজিদের চার দেয়ালের মাঝে যে আল্লাহর এবাদত করা হতো, সেই আল্লাহরই আনুগত্য করা হতো বাজারে ও ক্ষেত খামারে। যে কোরআন নামাযে পড়া হতো, সেই কোরআনেরই আইন আনুসারে মোকদ্দমার ফয়সালা হতো আদালতে। যে নৈতিক নীতিমালা সীমিত পারিবারিক পরিবেশে কার্যকর ছিল, আন্তর্জাতিক কর্মকান্ডেও অনুসৃত হতো সেই একই নীতিমালা। যে সত্য ঘোষিত হতো মসজিদ মিম্বর থেকে, সেই একই সত্য অনুসারে চলত সরকারি প্রশাসন। যে আকীদা বিশ্বাস প্রতিটি ব্যক্তির অন্তরে বদ্ধমূল করানো হতো, সেই আকীদা বিশ্বাসই কার্যকর থাকতো সামগ্রিক অবকাঠামোতে। যে চিন্তাধারা শিক্ষা ব্যবস্থায় সক্রিয় থাকতো সে অনুসারেই রূপায়িত হতো সমগ্র সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। আল্লাহর সন্তুষ্টি যেমন নামায রোযায় কাম্য থাকতো, তেমনি রনাঙ্গনেও অসি চালনা ও তীরবিদ্ধ হওয়ার সময় সক্রিয় থাকতো সেই একই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এ ছিল এমন এক সমন্বিত বিধান, যার আওতায় সমগ্র মানব জীবন একই খোদায়ী নির্দেশ দ্বারা পরিচালিত হতো। জীবনের এক এক বিভাগে এক এক রকম মূল্যবোধ ও নির্দেশ চলতনা। এ বিধানে কোন স্ববিরোধীতা ছিল না। এর এক অংশ অপর অংশের সাথে সাংঘর্ষিক ছিলনা। এর বিভিন্ন অংশে কোন জটিলতা, অস্পষ্টতা জোড়াতালি বা জগাখিচুড়ি ছিলনা। এ জন্যই এর আওতায় মানব জাতি যেরূপ দ্রুত গতিতে উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল, ইতিহাসে তা নজিরবিহীন।

বিপ্লবের প্রাণশক্তি

মানবতার সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য সম্ভবত এটা যে, ইতিহাসে যখনই কোনো ব্যক্তি ক্ষমতার মসনদে আসীন হবার সুযোগ পেয়েছে- তা সে তরবারীর বলে, ষড়যন্ত্ররের মাধ্যমে, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে, কিংবা কোন আকস্মিক ঘটনা চক্রে, যেভাবেই হোক না কেন সে নিজেকে এরূপ ভাবতে শুরু করেছে যে, সে মানুষের শুধু শাসক নয়, বরং মানুষের শিক্ষক ও সমাজের সংস্কারকও বটে। এ ধরনের স্বকল্পিত শিক্ষক ও সংস্কারকের উপর যখন শাসন ক্ষমতা ন্যাস্ত হয় তখন সে সর্বেসর্বা ও সর্বময় ভাগ্য বিধাতা হয়ে জেঁকে বসে। নিজেকে সে পৃথিবীর সেরা চিন্তাবিদ ভাবে। সে জ্ঞানের প্রতিটি উৎসের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে এবং সমাজের সর্বোত্তম সচেতন ও প্রজ্ঞাবান লোকদের দূরে সরিয়ে রেখে নির্বিচারে এমন সব পদক্ষেপ গ্রহন করে থাকে, যে তার প্রতিটি পদক্ষেপ এক একটি ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা সাব্যস্ত হয়ে থাকে। তারা সহিংস পদ্ধতিতে মানুষ কে প্রকৃত মানুষ বানাতে ও ডান্ডা মেরে সব কিছু কে ঠান্ডা করতে চায়। বিপ্লব ও সংস্কারের এই সব স্বঘোষিত দাবীদার অনেক সময় মানুষের জন্মগত স্বভাব প্রকৃতির খোঁজ খবরই রাখে না। জীবনের ভাঙ্গা গড়া কী কী কারণে অনিবার্য হয়ে উঠে, তার প্রাথমিক জ্ঞানও তাদের থাকে না। তারা কখনই জানতে চেষ্টা করে না যে, মানুষের মনুষ্যত্ব শেখানোর সঠিক পন্থা কী, বিকার ও বিভ্রান্তির উৎসটা কোথায়? তার সংশোধন ও প্রতিকারের কাজটা কোথা থেকে শুরু ও কোথায় গিয়ে শেষ হয়? তারা পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাকে কাজে না লাগিয়ে সম্পূর্ণ নতুনভাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে শুরু করে। তারা পরামর্শ ও সমালচনার দুয়ার বন্ধ করে দেয়, যাতে তাদের কোন হিতাকাংখী ও মানব প্রেমিক তাদের ধ্বংসাত্মক অভিজ্ঞতা অর্জনের পথে বাধা দিতে না পারে। সকল রোগের একটাই ধ্বন্বন্ডরি ঔষধ চিনে। সেটা হচ্ছে বলপ্রয়োগ ও সহিংসতা। অর্থাৎ কড়া কড়া আইন প্রনয়ন ও নিত্য নতুন কঠোর বিধি জারী করা। মানুষের চারপাশে গোয়েন্দা লাগিয়ে দেয়া এবং বার বার কঠোর শাস্তি দিয়ে তাদের ওপর গায়ের ঝাল ঝারা। মানবতার মুক্তিদুত বিশ্বনবী (সাঃ) যে বিপ্লব সংঘটিত করেন তার প্রানশক্তি হিংস্রতা ও বলপ্রয়োগ ছিল না, বরং হিত কামনা ও ভালবাসাই ছিল তার চালিকা শক্তি। তিনি মানুষের উপর যার পর নাই দয়ার্দ্র ছিলেন। আদম সন্তানদের প্রতি তাঁর ছিল সত্যিকার দরদ ও ভালবাসা। নিজের দাওয়াতকে তিনি এরূপ উদাহরণ দিয়ে বুঝানর চেষ্টা করেছেন যে, তোমরা পতঙ্গের মতন আগুনের গুহার দিকে এগিয়ে যাচ্ছ, আর আমি তোমাদেরকে ধরে ধরে টা থেকে বাচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ জন্যই কোরআন তাঁকে সারা বিশ্বের জন্য করুনা স্বরূপ বলে অভিহিত করেছেন। একটু ভেবে দেখুন তিনি এতবড় বিপ্লব সংঘটিত করলেন, অথচ তাতে বলপ্রয়োগ ও সহিংসতার একটি দৃষ্টান্তও খুঁজে পাওয়া যায় না। রসূল (সাঃ) যে দশ বছর মদিনায় কাটান, তার পুরটাই ছিল সাংঘাতিক রকমের জরুরী অবস্থার আওতাধীন। প্রতি মূহুর্তে আক্রমনের ভয় লেগেই থাকতো। কোরায়েশরা তিন তিনবার বড় ধরনের আক্রমন চালিয়েছে। এখানে সেখানে ছোট খাট যুদ্ধ ও সীমান্ত সংঘর্ষ তো নিত্যকার ব্যাপার হয়ে পরিনত হতে গিয়েছিল। মদিনার বাইরে বসবাসকারী বিভিন্ন গোত্র মদিনার উপর আক্রমন চালানোর জন্য নানা সময় নানা দিক থেকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো। টহল দেয়া বা উপদ্রব নির্মূল করার জন্য মদীনা থেকে ছোট ছোট সেনাদল পাঠানো হতো। রাতের বেলা সামরিক প্রহরা বসানো হতো। এক কথায় বলা যায়, সামরিক শিবিরের মতো জীবন যাপন করা হতো। তদুপুরি ইহুদী ও মোনাফেকদের নিত্য নতুন ষড়যন্ত্র জনজীবনকে করে তুলতো দুর্বিষহ। কখনো যুদ্ধ বাধানোর ষড়যন্ত্র, কখনো মুসলিম সমাজকে খন্ড বিখন্ড করা ও মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে সংঘাত লাগালোর ষড়যন্ত্র, কখনো রসূল সা; এর নেতৃত্বকে ব্যর্থ ও বিফল করার ষড়যন্ত্র এমনকি কখনো কখনো স্বয়ং রসূল সাঃ কে হত্যা করার ষড়যন্ত্রও পাকানো হতো। এর চেয়ে মারাত্মক জরুরী অবস্থা আর কি হতে পারে? কিন্তু রসূল সাঃ কখনো একনায়কসুলভ ভূমিকাও পালন করেননি। কোন জরুরী অবস্থা জারী করেননি। কোন স্বেচ্ছাচারিতামূলক বিধিও চালু করেননি। কোন ব্যক্তিকে নিরাপত্তা আইনের অধীনে কারাগারেও পাঠাননি। জরুরী অবস্থাকালীন সংক্ষিপ্ত আদালতও বসাননি। চাবুক মেরে মেরে মানুষের চামড়াও তুলেননি। কারো উপর জরিমানাও আরোপ করেননি। কোন নাগরিকের উপর আল্লাহর আইনের অতিরিক্ত বোঝাও চাপাননি। সমালোচনা ও ভিন্নমত পোষণের অধিকারও হরণ করেননি এবং কারো উপর কোন বিধি নিষেধও আরোপ করেননি। এমনকি আবদুল্লাহ বিন উবাই এর মতো ভয়ংকর কুচক্রী গৃহশত্রুর বিরুদ্ধেও তিনি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। নিজের দাওয়াতের নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও নিজের চরিত্রের পবিত্রতার উপরই তিনি পুরোপুরি নির্ভর করতেন। না কাউকে ভয়ভীতি দেখিয়েছেন, না কারো মনুষ্যত্বের উপর তাচ্ছিল্য প্রকাশ করেছেন, আর না অহংকার ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছেন। বরঞ্চ এমন লোকদের ঔদ্ধত্য ও অহংকারকে তিনি ধৈর্যের সাথে বরদাশত করেছেন, যারা বাহ্যত আস্ফালন করলেও আসলে ছিল দুর্বল ও অসহায়। এ কারনে শত্রুদের মনও তিনি অনায়াসে জয় করে ফেলতেন,সাথীরা যে কোন নতুন ও পুরাতন আইনকে স্বাগত জানাতে সদা প্রস্তুত থাকতেন এবং বিরোধীরা তাঁর সামনে নিজকে অত্যন্ত নীচ ও হীন মনে করতো। তারপর যখন তারা তাঁর সত্যবাদিতা ও নিষ্ঠার সামনে মাথা নত করে ইসলাম গ্রহণ করতো তখন তাদের মধ্যে সূচিত হতো সর্বোত্মক ও আমূল পরিবর্তন।
রসূল সাঃ এর অন্তরে যে খোদা প্রেম সক্রিয় ছিল , তারই আরেক রূপ ছিল প্রগাড় মানব প্রেম। তাঁর এই মানব প্রেমের সঠিক ধারনে লাভ করতে হলে এই কয়টি ঘটনা দ্বারাই তা লাভ করা যায়। তাহলো, মক্কাবাসী তাঁকে মদীনায় গিয়েও শান্তিতে বাস করতে দেয়নি। তারা যখন দুর্ভিক্ষ কবলিত হোল, তখন তিনি তাদেরকে খাদ্যশস্য পাঠিয়ে সাহায্য করলেন এবং পাঁচশো স্বর্ণ মুদ্রা নগদ পাঠালেন। বদরের যুদ্ধবন্দীদের ‘উহ’ ‘আহ’ শব্দ কানে যাওয়া মাত্রই তাঁর ঘুম হারাম হয়ে যাওয়া এবং তাদের বাঁধন ঢিলা করে দেয়ার ঘটনা থেকেও তাঁর মানব দরদী স্বভাব আচ করা যায়। বনু হাওয়াযেন গোত্রের ছয় হাজার যুদ্ধবন্দীকে যে মাত্র একটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রসূল সাঃ এর নির্দেশে মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল, সেটিও ছিল তাঁর মহানুভবতার জ্বলন্ত উদাহরণ। এরপরও রসূল সাঃ এর আর কোন মানব দরদী পরিচয় যদি পেতে হয়, তবে মক্কা বিজয়ের সময় তাঁর অভাবনীয় আত্মপ্রকাশ লক্ষ্য করুন। মানবতার এই মুক্তিদূত একজন পরিপূর্ণ বিজেতা হিসেবে মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে যারা বিশ বছর ধরে লড়েছে তারা তাঁর সামনে একেবারেই অসহায়ভাবে দাঁড়িয়েছিল। অন্য কেউ হলে প্রতিটি আক্রমনের প্রতিশোধ নিত। ব্যাপক গণহত্যার নির্দেশ দিত এবং রক্ত গঙ্গা বইয়ে তবে ছাড়তো। লাশের স্তূপ না ফেলে কিছুতেই যেত না। আরব সমাজের সর্বজন স্বীকৃত রীতিপ্রথার কথাই বলুন , নৈতিকতার কথাই বলুন অথবা আইন কানুনের কথাই বলুন, সব কিছুর বিচারেই মক্কাবাসী ছিল ঘোরতর অপরাধী। ধর্ম ও রাজনীতি উভয় দিক দিয়ে তাদের ন্যায্য প্রাপ্য হয়ে গিয়েছিলো প্রাণদণ্ড। কিন্তু বিজয়ের মূহুর্তে রসূল সাঃ এর হৃদয় মানবপ্রেমে বিগলিত হয়ে গেলো এবং কোরায়েশদের অত্যাচার নির্যাতনের গোটা ইতিহাসকে ক্ষমার আওতাভুক্ত করে ঘোষণা করলেনঃ
“তোমাদের বিরুদ্ধে আজ আর কোন অভিযোগ নেই। তোমরা যেতে পার। তোমরা মুক্ত ও স্বাধীন”
উপরন্তু তিনি তাদের মন জয় করতে তাদের ধন সম্পদ দান করলেন এবং তাদেরকে অপমান ও প্রত্যাখান করার পরিবর্তে বিভিন্ন দ্বায়িত্ব অর্পন করলেন ও বুকে টেনে নিলেন। রসূল সাঃ এর কাছে এটি সত্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট ছিল যে , যে বিপ্লব প্রতিশোধ নিতে আরম্ভ করে, তা আপনা থেকেই খতম হয়ে যায়। আর যে বিপ্লব ক্ষমা ও মহানুভবতা প্রয়োগ করে তা শত্রুকেও বশীভূত করে এবং প্রতিরোধকারীদেরকে সেবকে পরিণত করে।
শুধুমাত্র কোরায়েশদের বাড়াবাড়ির কারণেই রসূল সাঃ এতটুকু কঠোর পন্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হন, যাতে তাদের রক্তপিপাসু তরবারির ধার ভোতা হয়ে যায়। তারা তাঁর কাধের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার পর তিনি ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজকে সুরক্ষিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তবে মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মহানবী (সাঃ) এমন সমরনীতি ও এমন প্রতিরক্ষা কৌশল উদ্ভাবন করেন, যাতে নুন্যতম প্রাণহানি ও নুন্যতম রক্তপাত হয় এবং রণাঙ্গনেও মনুষ্যত্বের মর্যাদা সমুন্নত থাকে।
মানব প্রেমের এমন উজ্জ্বল ও ব্যাপক দৃষ্টান্ত অন্য কোন বিপ্লবে পাওয়া যায়না। রসূল সাঃ এর বিপ্লব ছিল একটা নির্ভেজাল শিক্ষামূলক বিপ্লব এবং তার ভিত্তি ছিল মানবতার কল্যাণকামিতার উপর প্রতিষ্ঠিত।

নতুন মানুষ

অসংখ্য সংস্কারমূলক ,গঠনমূলক ও বৈপ্লবিক আন্দোলনের নজীর আমাদের সামনে রয়েছে। কিন্তু এর কোন একটি আন্দোলনই মানুষকে বদলায়নি। প্রতিটি আন্দোলনই যেমন আছে তেমন রেখে শুধু বাইরের পরিবেশটা বদলাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এমন প্রতিটা পরিবর্তন মানবজীবনের সমস্যাবলী সমাধানে একেবারেই ব্যর্থ হয়ে গেছে, যা মানুষের ভিতর থেকে পরিবর্তন আনতে পারেনি। বিশ্বনবী সাঃ এর কৃতিত্বের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো, মানুষ ভিতর থেকে বদলে গিয়েছিলো। শুধু বদলে যায়নি বরং তার জীবনে সংঘটিত হয়েছিল আমূল পরিবর্তন। মানুষের আকৃতিতে যে প্রবৃত্তি পূজারী পশুরা ঘুরে বেড়াত, একটি মাত্র কলেমার প্রভাবে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। সাথে সাথে তাদের ধ্বংস স্তূপ থেকে আবির্ভূত হোল আল্লাহভক্ত একদল সৎ মানুষ। এই নতুন মানুষের চরিত্রের ঔজ্জ্বল্য দেখলে চোখ ঝলসে যায়। হযরত ওমর(রাঃ), যিনি ছিলেন মক্কার এক উচ্ছৃংখল মদখোর যুবক - তাঁর জীবনে যখন পরিবর্তন এলো তা ভেবে দেখুনতো। ফুযালার মধ্যে যখন পরিবর্তন এলো, তখন সেটাইবা কেমন অভাবনীয় পরিবর্তন ছিল ভাবুনতো! যুল বিজাইদানকে দেখুন, কিভাবে নিজের বিলাসি জীবনের মুখে পদাঘাত করে দরবেশের জীবন যাপন করতে শুরু করলেন। হযরত আবু যরকে দেখুন, কি বিপ্লবী উদ্দীপনায় উজ্জীবিত হয়ে কা’বার সামনে দাঁড়িয়ে জাহেলিয়াতকে চ্যালেঞ্জ করলেন এবং গণপিটুনি খেলেন। কা’ব ইবনে মালেক ও আবু খাসিমার অবস্থা দেখুন। লুবাইনা ও সুমাইয়ার মতো ক্রীতদাসির বৈপ্লবিক বীরত্ব ও মনোবল দেখুন। মাগের বিন মালেক আসলামি ও গামেদি গোত্রের মহিলাটির দিকে লক্ষ্য করুন। নাজ্জাশীর দরবারে জাফর তাইয়ারের বীরত্ব থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন। ইরানী সেনাপতির দরবারে রবি’ বিন আমেরের বেপরোয়া আলাপচারিতা থেকে প্রেরণা অর্জন করুন। নক্ষত্ররাজির এই সমারোহের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে ঈমানী জ্যোতিতে ঝিকমিক করছেনা?
এহেন ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়েই সেই গোটা সমাজটা গড়ে উঠেছিলো এবং এহেন নেতা কর্মীদের নিয়েই সেই সৎ ও সত্যনিষ্ঠ রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু হয়েছিল, যার প্রতিটি নির্দেশ জারি হওয়া মাত্রই বাস্তবায়িত হতো। এদিকে মদ খাওয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, ওদিকে তৎক্ষণাৎ ঠোঁটে লাগানো পানপাত্র পর্যন্ত দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে এবং উৎকৃষ্ট মানের মদের মটকা ভেঙ্গে রাজপথ ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে নারীদের মাথা ও বুক ঢাকার নির্দেশ জারি হয়েছে , ওদিকে তৎক্ষণাৎ ওড়না বানিয়ে ব্যবহার করা শুরু হয়ে গেছে। এদিকে জেহাদের ডাক এসেছে, ওদিকে সঙ্গে সঙ্গেই অল্প বয়স্ক কিশোর পর্যন্ত পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে নিজের জেহাদে যাওয়ার যোগ্যতা প্রমান করার চেষ্টা শুরু করেছে। এদিকে জেহাদের জন্য সাহায্য চাওয়া হয়েছে, ওদিকে ওসমানের ন্যায় ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পন্য বোঝাই গোটা উটের বহর এনে হাজির করেছেন, হযরত আবু বকরের ন্যায় ত্যাগী ব্যক্তিগণ গৃহের যাবতীয় সহায় সম্বল আন্দোলনের নেতার সামনে স্তূপ করে রেখে দিয়েছেন এবং এমনকি এক একজন দিন মজুর সারাদিনের শ্রমের মজুরী বাবদ প্রাপ্ত খেজুরগুলো এনে ঢেলে দিয়েছে। এদিকে মোহাজেরদের পুনর্বাসনের জন্য আনসারদের কে সাহায্যের আবেদন জানানো হয়েছে, ওদিকে তার সাথে সাথেই আনসারগণ নিজেদের ঘরবাড়ী, ক্ষেতখামার ও বাগবাগিচা আধা আধি বন্টন করে ভ্রাতৃত্বের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যখন দায়িত্বশীল পদ গুলোতে চাকুরির মনোভাবের উর্দ্ধে উঠে কাজ করার জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কর্মচারিগণ কে আহ্বান করা হয়েছে, তখন দৈনিক এক দিরহাম ভাতার বিনিময়ে প্রাদেশিক শাসনকর্তার দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। যখন যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সেনাপতির কাছে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তখন তা এমন নিখুঁত ভাবে করা হয়েছে যে, প্রত্যেক সৈনিক একটা সূচ পর্যন্ত নিজ নিজ সেনাপতির কাছে জমা দিয়েছে। ইতিহাসে এ ঘটনা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে যে, মাদায়েনের যুদ্ধলব্ধ সম্পদের একটা অমূল্য রত্ন আমের নামক একজন সিপাহীর হস্তগত হলে তিনি তার কথা ঘুনাক্ষরেও কাউকে জানতে না দিয়ে রাতের আঁধারেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গোপনে নিজ সেনাপতির কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। এই সব লোকই সেই পুত পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন, যেখানে অপরাধ ছিল অত্যন্ত বিরল ঘটনা। রসূল সাঃ এর মক্কী জীবনের পুরো এক দশকে হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র অভিযোগ আদালতে এসেছিল। এটি ছিল এমন এক নির্মল নিষ্কলুষ সমাজ, যেখানে কোন গোয়েন্দা পুলিশ নিয়োগ করা হয়নি, বরং মানুষের বিবেকই তাদের প্রহরী ও তত্বাবধায়ক রুপে নিয়োজিত ছিল। এই ছিল মুহাম্মদ সাঃ এর বিপ্লব। এ বিপ্লব শুধু বাইরের পরিবেশই বদলে দেয়নি বরং ভেতর থেকে মনমগজকেও পাল্টে দিয়েছে এবং নতুন চরিত্র গড়ে তুলেছে। তাই এই বিপ্লব ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনের সমস্ত মৌলিক ও প্রকৃত সমস্যা সমাধানে সফল হয়েছে এবং এর মাধ্যমে সমকালীন সভ্যতার সংকট থেকে মুক্তির পথ সৃষ্টি হয়।

বিশ্বনবীর অসাধারণ আত্মত্যাগ

এ বিপ্লব আরও এক দিক দিয়ে নজিরবিহীন। সেটা হোল, যিনি এই বিপ্লব সংঘটিত করেছিলেন, তিনি যদিও অবর্ণনীয় ত্যাগ ও কুরবানীর বিনিময়ে পূর্ণতা সাধন করেছিলেন, কিন্তু তিনি এর জন্য কোনও পুরষ্কার ও প্রতিদান গ্রহণ করেননি। মানবতার কল্যানের জন্য নিজের সমস্ত সহায় সম্বল অকাতরে বিলিয়ে দিলেন, অথচ তার বিনিময়ে যতটুকু প্রতিদান গ্রহণ করা যুক্তি, আইন, নৈতিকতা ও সমাজরীতি – কোন দিক দিয়েই অন্যায় বা অবৈধ হতো না ,ততটুকু ও গ্রহণ করলেন না। এতবড় কীর্তি ও অবদান রাখার পর সামান্য কিছু বিনিময় গ্রহণ করলে স্বার্থপরতার বিন্দুমাত্র কলঙ্কও তাঁকে স্পর্শ করতোনা। তবু তিনি তা গ্রহণ করলেন না। এমন ত্যাগের তুলনা কোথাও আছে কি? প্রথমে অর্থনৈতিক দিকটি বিবেচনা করা যাক। রসূল সাঃ নিজের লাভজনক ব্যবসা বানিজ্য কুরবানী করলেন, তা থেকে উপার্জিত সমস্ত পুঁজি এই মহৎ কাজের জন্য উৎসর্গ করলেন। আর যখন সাফল্যের যুগ এলো , তখন অঢের ধন সম্পদ স্বহস্তে বিলি বন্টন করলেন এবং নিজের জন্য ক্ষুধা দারিদ্র ও অনাড়ম্বর জীবন বেছে নিলেন। নিজের পরিবার পরিজনের জন্য একটু সঞ্চয় ও রেখে গেলেন না, এক টুকরো জমিও রেখে গেলেন না, তাদের কোন অর্থনৈতিক অধিকার ও প্রতিষ্ঠিত করে গেলেন না, তাদের জন্য উত্তরাধিকার সুত্রে কোন স্থায়ী ক্ষমতার গদি রেখে গেলেন না এবং চাকর নকর, পাইক পেয়াদা, রঙ বেরঙের বাহন জন্তু ও বিলাসী সামগ্রী দিয়ে বাড়ী ভরে তুললেন না।
রাজনৈতিক দিক দিয়ে দেখলে দেখা যায় , তিনি নিজের জন্য কোন অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠা করেননি, কারো বিরুদ্ধে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লংঘন করে কোন ক্ষমতা প্রয়োগ করেননি, এবং নিজের রাজনৈতিক ভাবমূর্তিকে উঁচু করে তুলে ধরার জন্য স্বৈরাচারী আইন জারি করেননি। মদীনায় সবসময় তীব্র উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করতো। ইহুদী ও মোনাফেকদের নিত্য নতুন চক্রান্তের মোকাবেলা করতে হতো। তবুও কাউকে তিনি গ্রেফতার করেননি। কারো চলাফেরার উপর বিধি নিষেধ আরোপ করেননি। ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণকারী কোন আদেশ জারি করেননি। কোন সংক্ষিপ্ত আদালত বসাননি। আর বেত্রাঘাত করেও কারো চামড়া খসাননি। বরঞ্চ মানুষকে সমালোচনা করার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছেন, ভিন্ন মতো অবলম্বনের স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং তাঁর মহৎ পরামর্শকে গ্রহণ না করারও অধিকার দিয়েছেন। এসব অধিকার কেবল কাগুজে অধিকার ছিলনা। লোকেরা এসব অধিকারকে বাস্তবে প্রয়োগ করেছে। অনেক সময় রসূল সাঃ নিজের মূল্যবান মত পরিত্যাগ করে ভিন্ন মতকে গ্রহণ করে নিয়েছেন। কাউকে কোন স্বতন্ত্র সুযোগ সুবিধা দিতে চাইলে নিজের সহযোগীদের কাছে অনুমতি চেয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে নিজের জামাই আবুল আস যুদ্ধবন্দী হয়ে এলে তার মুক্তিপণ হিসেবে যয়নব যে হার পাঠান, তা ছিল হযরত খাদিজার (রাঃ) স্মৃতি। ঐ হার ফেরত দেয়ার জন্য রসূল সাঃ সাহাবায়ে কেরামদের অনুমতি চান। অনুরূপভাবে আবুল আসের জিনিস পত্র গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সামগ্রী) হিসেবে হাজির করা হলে তাও তিনি সাহাবাদের অনুমতি নিয়ে ফেরত পাঠান। জা’রানা নামক স্থানে হোনায়েনের যুদ্ধবন্দীদেরকে মুক্ত করার আবেদন জানাতে একটি প্রতিনিধি দল এল এবং রসূল সাঃ এর দূর সম্পর্কের আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে আবেদন জানালো। ততক্ষনে যুদ্ধবন্দীদের ভাগ বাটোয়ার সম্পন্ন হয়ে গেছে। রসূল সাঃ নিজ গোত্র বনু হাশেমের অংশের বন্দিদের মুক্তি দিতে সম্মত দিলেন। কিন্তু অবশিষ্টদের সম্পর্কে বললেন যে, সাহাবাদের প্রকাশ্য সমাবেশে তোমরা আবেদন জানাও। সাহাবাগণ যখন জানতে পারলেন রসূল সাঃ নিজ গোত্রের অংশের বন্দীদেরকে ছেড়ে দিয়েছেন, তখন সবাই বন্দীদেরকে ছেড়ে দিলো। এরূপ ক্ষেত্রে তিনি কখনো চাপ প্রয়োগ বা জবরদস্তিমূলক ভাবে কাজ সম্পন্ন করতেন না।
সামাজিক ও বৈঠকি দিক দিয়ে দেখা যায়, তিনি নিজের জন্য সমানাধিকারই পছন্দ করতেন। কোন স্বতন্ত্র মর্যাদা পছন্দ করতেন না। পানাহার, পোশাক পরিচ্ছেদ ও বাসস্থানে নিজের জন্য কোন অসাধারণ বা অভিজাত সুলভ স্বাতন্ত্র সৃষ্টি করেননি। মজলিসে নিজের বসার জন্য কোন স্বতন্ত্র জায়গাও তিনি মনোনীত করেননি। লোকেরা তাঁর সামনে ভক্তি ভরে উঠে দাঁড়াক, কিংবা প্রভু বা স্যার ইত্য্যাদি বলে সম্বোধন করুক তাও তাঁর মনোপুত ছিলনা। যুদ্ধ কালে ও প্রবাসে ট্রেঞ্চ খনন ও মসজিদ নির্মানের জন্য সঙ্গীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাটি কাটা , মাটি তোলা , পাথর ভাঙ্গা ও কাঠ চেরাইয়ের কাজ তিনি স্বহস্তেই করতেন। পাওনা পরিশোধের জন্য তাঁর উপর কঠোর ভাষা প্রয়োগ করতে ঋণ দাতা যাতে কুন্ঠিত না হন, সে জন্য তাকে তিনি অনুমতি দিতেন। এমন কি প্রকাশ্য জনসমাবেশে নিজেকে প্রতিশোধ গ্রহনের জন্য উপস্থাপন করেন এবং বলেন, আমি কারো উপর কোন জুলুম করে থাকলে সে যেন এসে আমার কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করে।

আমাদের অবস্থান কোথায়?

এই ছিল রসূল সাঃ এর সূচিত মহান বিপ্লব। আমাদেরকে এই বিপ্লবেরই প্রহরী ও তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করা হয়েছে। এটি ছিল সেই মহান বাণী, যার জন্য আমাদেরকে ‘মানবজাতির’ কাছে ‘সাক্ষী’ এবং ‘মধ্যমপন্থী উম্মাহ’ বানানো হয়েছে। এ পদটা হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠ ও সর্বোচ্চ পদ। এই ছিল সেই সত্য কালেমা, যার দায়িত্ব আমাদের ঘাড়ে ন্যস্ত করা হয়েছে। ন্যস্ত করার উদ্দেশ্য রসূল সাঃ এর প্রতিনিধি হিসেবে আমরা যেন কেয়ামত পর্যন্ত মানবতার মুক্তিদূত হই। যখনই মানব জীবন সমস্যা ও সংকটে পতিত হবে এবং মানব সভ্যতা ঘোরতর অরাজকতার কবলে নিক্ষিপ্ত হবে, তখন যেন আমরা তার সহায়ক হই। কিন্তু কার্যত আমরা তা হতে পারিনি। এই সত্য কলেমার মশাল প্রজ্জ্বলিত রাখতে আমরা উদাসীনতা দেখিয়েছি এবং আমরা নিজেদের হাতেই এই সত্য বিধানের সর্বনাশ সাধন করেছি। এর ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, এ যুগের চিন্তাশীল মহল যখন বিপথগামী হতে আরম্ভ করলো, তখন আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করার যোগ্য থাকলাম না। আর আজ আমাদেরই অযোগ্যতা ও অক্ষমতার কারণে গোটা মানবজীবন সংকট ও অরাজকতার শিকার। পরস্পর বিরোধী বস্তুবাদী মতবাদ সমূহের সৃষ্ট দ্বন্দ্ব সংঘাত বিশ্ববাসীর মানসিক শান্তি বিনষ্ট করে চলেছে। বিশ্ব নেতৃত্ব আল্লাহ বিমুখ শক্তির হাতে নিবদ্ধ এবং আমরা এখন এই সব শক্তিরই মুখাপেক্ষী হয়ে গিয়েছি। প্রতিকূল অবস্থার সাথে প্রতিনিয়ত ঠোকর খেয়েও আমরা সম্বিত ফিরে পাইনি। ক্রমাগত অবমাননা ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েও আমাদের মধ্যে অনুতাপ ও অনুশোচনার সৃষ্টি হয়নি। মুসলিম বিশ্বের কলহ কোন্দল ও বিবাদ বিসম্বাদ এবং মানবতার শোচনীয় দুর্যোগ দুর্বিপাক দেখেও আমরা এই আসল করণীয় কাজটির প্রতি মনোযোগী হতে পারিনি।
আসুন বিচার বিবেচনা করে দেখি, মানব জাতি এখন ইতিহাসের কোন্ স্তর অতিক্রম করছে এবং আমাদের অবস্থানটা কোথায়?
আমি আমার ক্ষুদ্র জীবনকালে নিজেকে, নিজের সন্নিহিত পরিবেশের মানুষকে এবং গোটা দুনিয়ার মানুষকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে এক ধরণের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অস্থিরতা, সংকট ও ভীতি জনিত পরিস্থিতির শিকার দেখতে পেয়েছি। গৃহ থেকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ পর্যন্ত সর্বত্র অন্যের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ, উত্তেজনা, অবনিবনা, দ্বন্দ্ব কলহ, ও সংঘাতের পরিবেশ বিরাজ করতে দেখেছি। এই গোটা সময়টা জুড়ে আমার মনে হয়েছে যেন ইতিহাস জ্বলন্ত চুলোর ওপরের ফুটন্ত হাড়ির ন্যায় ক্রমাগত উদ্বেলিত হচ্ছে। এই হাড়িতে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ন্যায় আমিও যেন একটা ক্ষুদ্র চাল বা ডালের ন্যায় ওলট পালট হচ্ছি। আমাদের এই পৃথিবী পর পর দুটো বিশ্ব যুদ্ধে পিষ্ট হয়ে এবং অসংখ্য আঞ্চলিক যুদ্ধে দলিত মথিত হয়ে এখনো সামলে উঠতে পারেনি। অথচ আরো একটা প্রলয়ংকারী যুদ্ধের তরবারী তার মাথার ওপর ঝুলছে। এই ক্ষুদ্র সময়ে কত যে ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা চোখে পড়লো, কত যে অভ্যুত্থানের প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে যেতে দেখলাম, কত যে সম্রাজ্যের পতন ও আবির্ভাব ঘটতে দেখলাম, কত যে মতবাদের সংঘাত, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত হতে দেখলাম, কত দেশ ও অঞ্চলকে খন্ড বিখন্ড হতে এবং লক্ষ কোটি জনতাকে বাস্তুচ্যুত হতে দেখলাম,তার ইয়ত্তা নেই। খোদ এই উপমহাদেশে স্বাধীনতার ঊষালগ্নে মাথার ওপর দিয়ে রক্তের সয়লাব বয়ে যেতে দেখেছি, আর এই সয়লাবে মানুষের জানমাল সম্ভ্রম এবং মূল্যবান ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে ভেসে যেতে দেখেছি।
বিশ্বব্যাপী চলমান জড়বাদী সভ্যতার জমকালো পর্দার আড়ালে উঁকি দিয়ে দেখলে মানবতার এমন শোচনীয় দৃশ্য চোখে পড়ে যে, মানুষ মাত্রেরই আত্মা কেঁপে ওঠে। সমগ্র মানবজাতি গুটিকয় কামনা বাসনার অক্টোপাস বন্ধনে আবদ্ধ। সর্বত্র সম্পদ ও গদির জন্য যুদ্ধ চলছে। মনুষ্যত্বের নৈতিক চেতনার দীপ শিখা নিভে গেছে। নগর সভ্যতার উন্নয়নের সাথে সাথে অপরাধ অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে। মনস্তাত্বিক অস্থিরতা প্রবল হয়ে উঠেছে এবং মানসিক শান্তি একেবারেই উধাও হয়ে গেছে। মানুষের মনমগজে ও চরিত্রে এমন মৌলিক বিকৃতি জন্ম নিয়েছে যে, জীবনের কোন দিক এ ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। দর্শন থেকে সত্যের প্রাণশক্তি বেরিয়ে গেছে। আকীদা বিশ্বাস ও মতাদর্শগুলো ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। আধ্যাত্মিক মূল্যবোধগুলোর বিলুপ্তি ঘটেছে। রাষ্ট্রীয় আইন কানুনে ন্যায় বিচারের অস্তিত্ব নেই। রাজনীতিতে সেবামূলক মানসিকতার পরিবর্তে স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা ঢুকে পড়েছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে শোষক ও শোষিত নামে দুটি শ্রেণী জন্ম নিয়েছে। ললিত কলায় সৌন্দর্যের যে সব বিচিত্র প্রকাশভংগি রয়েছে, তার সবগুলোকে যৌন সুড়সুড়ি ও অরুচিকর ভাবভংগি দিয়ে ভরে তোলা হয়েছে। সভ্যতার জগতে সর্বত্র পরস্পর বিরোধিতা ও সংঘাত বিরাজ করছে এবং গোটা ইতিহাস একটা ভয়াল নাটকে পরিণত হয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তির প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিমানদের নির্বুদ্ধিতা এখনো আমাদেরকে নিদারুণ কষ্ট দিয়ে চলেছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের কত নতুন নতুন শাখা আবিস্কৃত হচ্ছে। কিন্তু এর লালিত অজ্ঞতা ও মূর্খতা আদম সন্তানকে অতিষ্ট করে তুলেছে। অঢেল ধন সম্পদ চারদিকে ছড়িয়ে আছে। অথচ মানুষ ক্ষুধা ও বঞ্চনার আযাব ভোগ করে চলেছে। হাজারো রকমের সংগঠন, রাজনৈতিক সংস্থা, আদর্শগত ঐক্য ও চুক্তিভিত্তিক বন্ধন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক নেই, আছে কেবল হিংস্র জন্তু সুলভ সম্পর্ক। বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার উন্নয়নের পক্ষে অনেক গালভরা বুলি আওড়ানো হয়। অথচ নির্যাতন ও নিপীড়নের চরম হঠকারী ও ঘৃণ্য কৌশল মানব জাতির বিরুদ্ধে আজও বাস্তবায়িত হচ্ছে। গোটা পৃথিবী আজ এক মল্লযুদ্ধের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কোথাও সাম্রাজ্যবাদ ও স্বাধীনতা প্রেমিকদের মধ্যে, কোথাও কম্যুনিজম ও পুঁজিবাদের মধ্যে, কোথাও গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে, কোথাও ব্যক্তি ও সামষ্টিকতার মধ্যে এবং প্রাচ্যবাদ ও পাশ্চাত্যবাদের মধ্যে ঘোরতর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে।
এহেন পৃথিবীতে আমরা জীবন যাপন করছি। কৃত্রিম উপগ্রহ ও ক্ষেপণাস্ত্রের এই যুগে বিজ্ঞান আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের আজ্ঞাবহ জিনের মত মানুষের এক এক ইশারায় বস্তুগত শক্তি নতুন নতুন ভান্ডার প্রতিনিয়ত সরবরাহ করে চলেছে। স্মরণাতীত কাল থেকে অর্গলবদ্ধ প্রকৃতির গুপ্ত রহস্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চাবি দিয়ে উন্মোচিত হচ্ছে। বিস্ময়কর দ্রুতগতি সম্পন্ন যানবাহন ও যোগাযোগ যন্ত্র মানুষকে স্থান ও কালের ওপর ব্যাপকতার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দিচ্ছে। আনবিক শক্তি সর্বনাশা দানবদের এক বিরাট বাহিনীকে বশীভূত করে মানুষের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখছে। তারা কেবল একটা চোখের ইশারার অপেক্ষায় রয়েছে। অপর দিকে স্বয়ং মানুষের অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যে, সে শয়তানী শক্তি ও নাশকতাবাদী শক্তি সমূহের মুঠোর মধ্যে আগের চেয়েও বেশি অসহায় অবস্থায় রয়েছে। এই শক্তিগুলো তাকে বারবার নিজেরই বিরুদ্ধে লড়াই করতে উস্কে দিয়ে আসছে। এসব শক্তি যুগে যুগে তার বড় বড় কীর্তিগুলোকে এবং তার চমকপ্রদ সভ্যতাগুলোকে স্বয়ং তারই হাত দিয়ে ধ্বংস করিয়ে ছেড়েছে।
এমন একটা কাফেলার কথা কল্পনা করুন, যে কাফেলা একটা পাহাড়ের চূড়ার ওপর শিবির স্থাপন করেছে। জমকালো শামিয়ানার নীচে তারা পাহানারে, নাচগানে ও মদ্যপানে বিভোর। অধিকন্তু তাদের কাছে বিপুল পরিমাণ বাণিজ্যিক পণ্য, নগদ অর্থ, যানবাহন ও গবাদিপশুও রয়েছে। অথচ তাদের শিবিরের মেঝের মাত্র কয়েক ফুট নীচে এক ভয়ংকর আগ্নেয়গিরি লাভা উদগীরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটু পরেই গোটা পাহাড় বিস্ফোরিত হবে এবং দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠে সব কিছুকে ভস্মীভূত করে দেবে। আমাদের বর্তমান সভ্যতার কাফেলাটির অবস্থা অনেকটা এ রকম। ইতিহাসের বর্তমান পর্যায়ে যে পাহাড়ের ওপর তার অবস্থান, তার অভ্যন্তরে সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট ও দুর্যোগের লাভার উদগীরণ আসন্ন।
অদৃষ্ট আমাদেরকে এক বিরাট বিশ্ব সংকটের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে। এ সংকট থেকে পাশ কাটিয়ে পেছনে পালানোর সুযোগ নেই। আর এ চ্যালেঞ্জের জবাব দেয়ার যোগ্যতাও বর্তমান সভ্যতার ও তার নির্মিত মানুষের নেই। নতুন কোন দর্শনেরও উদ্ভব হচ্ছে না, যা অন্তত সাময়িক সান্ত্বনার উপায় হতে পারে। কোন দিকেই কোন পথ উন্মুক্ত হবার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
অস্থিরতার এই ক্রান্তি লগ্নে আমি যখন চার দিকে দৃষ্টি দিই, তখন দেখি অন্ধকারের এক অথৈ সমুদ্র সর্বদিক থেকে আমাকে ঘেরাও করে রেখেছে। এই মহা সমুদ্রে অনেক দূরে, চৌদ্দ শো’ বছরের দূরত্বে, একটা উজ্জ্বল আলোর বিন্দু জ্বল্ জ্বল্ করতে দেখতে পাই।
এটা আর কিছু নয়-মানবতার সবচেয়ে বড় বন্ধু, সবচেয়ে বড় অনুগ্রাহক, এবং সবচেয়ে বড় ত্রাণকর্তা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীর মশাল। এটা সেই প্রদীপ যার জ্যোতিকে আমরা তাঁর উম্মাত হয়েও নিজেদের উদভ্রান্ত চিন্তা ও উচ্ছৃংখল কর্মের আবর্জনার মধ্যে হারিয়ে বসে আছি।

সীরাত অধ্যয়নের দৃষ্টিভংগি

আমার মতে, রসূল সা. এ জীবনী অধ্যয়নের উদ্দেশ্য একটাই। সেটি হলো, রসূলের সা. বাণীর মশাল আর একবার আমাদেরকে ও সমগ্র বিশ্ববাসীকে আলোকিত করুক। মানব সমাজ এ যুগের অন্ধকারের মধ্যে সেই মুক্তিরে পথের সন্ধান পাক, যেমন পেয়েছিল খৃষ্ঠীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর সংকট উত্তরণের পথ।
দুর্ভাগ্যবশত, আমরা এই ইপ্সিত দৃষ্টিভংগী ও প্রেরণা নিয়ে রসূল সা. এর জীবনী অধ্যয়ন করতে খুব কমই সফল হচ্ছি। রসূলের জীবনী থেকে জীবন যাপনের একটা পদ্ধতি খুঁজে নিয়ে তদনুসারে জীবনকে গড়ে তুলতে হবে-এরূপ মনোভাব দ্বারা আমরা উদ্বুদ্ধ হচ্ছি না; বরং এর মাঝে অন্যান্য মনোভাবে অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং তা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
এমন মুসলমানদের সংখ্যা নেহাত কম নয় যারা শুধু সওয়াব হাসিল করার জন্যই সীরাত তথা রসূলের সা. জীবনী চর্চার আগ্রহ পোষণ করে থাকে। (অবশ্য রসূল সা. এর নৈকট্য অর্জনের প্রতিটি চেষ্টাই যে আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং তার জন্য সওয়াব পাওয়ার আশা করা উচিত, তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এ ধরণের প্রতিটি চেষ্টার উদ্দেশ্য যে জীবনকে আরো সুন্দর করে সাজানোও হওয়া উচিত, তা কেমন করে অস্বীকার করা যায়?) খুবই ধুমধামের সাথে মীলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে তা এরূপ বিশ্বাসের ভিত্তিতে করা হয়ে থাকে যে, ঐ সব মাহফিলে রসূল সা. এর জ্যোতির্ময় আত্মা উপস্থিত হয় এবং ভক্তদের ভক্তি ও ভালোবাসার প্রকাশ দেখে প্রীত হয়। কোথাও মিষ্টি মন্ডা বিতরণ, কোথাও ফুলের ছড়াছড়ি, কোথাও আগরবাতি ও আতর-লোবানের মাত্রাতিরিক্ত ছড়াছড়ি, এবং কোথাও বিচিত্র আলোক সজ্জা দ্বারা উক্ত বিশ্বাসেরই অভিব্যক্তি ঘটে। মীলাদুন্নবী বা সীরাতুন্নবীর প্রতি এ ধরণের ভক্তির বাড়াবাড়িতে যে ভাবমূর্তি প্রতিফলিত হয়, তা কোন রক্তমাংসের তৈরী মানুষের ভাবমূর্তি নয়, বরং এক অতি মানবিক জ্যোতির্ময় সত্তার ভাবমূর্তি। এ সত্তার দেহের কোন ছায়া থাকেনা, তাঁর যাবতীয় কর্মকান্ড মোজেযা তথা অলৌকিক ও অতি প্রাকৃতিক, তাঁর সমস্ত কাজ ফেরেশতারা সমাধা করে, এবং তাঁর প্রতিটি জিনিস রহস্যময়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, রসূল সা. এর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মর্যাদা সমগ্র মানবজাতির চেয়ে বহুগুণ বেশি। তাঁর জীবনে অতি প্রাকৃতিক অনেক কিছু ছিল, তাঁর বহু মোজেযাও ছিল। অনেক সময় ফেরেশতারাও তাঁর সাথে নানা কর্মকান্ডে শরীক হতো। কিন্তু এ কথা মানতেই হবে যে, তাঁর এই পুণ্যময় জীবন একজন মানুষেরই জীবন। তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কারণই এই যে, মানুষ হয়েও তিনি এমন অতুলনীয় জীবনের নমুনা পেশ করেছেন। প্রাকৃতিক নিয়ম এবং সমাজ ও সভ্যতার রীতিনীতির আওতার মধ্যেই তাঁর যাবতীয় কাজ সম্পন্ন হতো। আর সাফল্যের পথের প্রতি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে কুরবানী ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হতো। সে জীবন একজন মানুষের জীবন ছিল বলেই তা আমাদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে রয়েছে এবং এই সুবাদেই তাঁর মধ্যে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় আদর্শ রয়েছে। তিনি আমাদের মত মানুষ ছিলেন বলেই তাঁর কাছ থেকে আমরা দৃঢ়তা ও সাহসিকতার শিক্ষা নিতে পারি, নীতি ও আদর্শের আনুগত্য এবং দায়িত্ব সচেতনতার শিক্ষা নিতে পারি, মানবতার সেবার প্রেরণা সঞ্চয় করতে পারি, এবং দুস্কৃতিকারী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য একটা জোরদার উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারি। রসূলের জীবনীকে যদি পুরোপুরি মোজেযায় পরিণত করা হয় এবং তাকে একটা অতিমানবিক কীর্তিতে রূপান্তরিত করা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষদের জন্য তাতে আদর্শ কী থাকবে? এ ধরণের ব্যক্তিত্বের সামনে মানুষ হতবুদ্ধি ও অভিভূত হয়ে যেতে পারে, কিন্তু নিজের মধ্যে তার কোন প্রভাব প্রতিফলিত করতে পারেনা। তার প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি ও শ্রদ্ধা পোষণ করতে পারে, কিন্তু তার অনুকরণ ও অনুসরণ করতে পারেনা। এ জন্যই দেখা যায়, যেখানে যেখানে এই বিশেষ ধরণের ভক্তির উদ্ভব হয়েছে এবং যেখানে এটা যত গভীর হতে থাকে, সেখানে বাস্তব জীবন নবীর অনুসরণ থেকে ততই মুক্ত হতে থাকে। এমনকি পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে, জঘন্যতম সামাজিক অপরাধে যারা লিপ্ত, তারা এরূপ সস্তা ভক্তি মহড়া দেখিয়ে নিজেদের অস্থির চিত্তকে এই বলে খানিকটা সান্ত্বনা দেয় যে,
‘‘আমরা যা-ই হয়ে থাকিনা কেন, তোমার প্রিয় নবীর উম্মাতের অন্তর্ভু্ক্ত।’’
অপরদিকে আমাদের সমাজে পাশ্চাত্য থেকে আসা অন্য একটা প্রবণতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে, যাকে বলা হয় ব্যক্তিপূজা। এ প্রবণতা মূলত জাতীয়তাবাদী মনোভাব ও প্রেরণা থেকে উৎসারিত। এটা এক ধরনের জাতীয় অহমবোধের প্রকাশ, যা অন্যদের সামনে নিজেদের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের প্রদর্শনী করায়। এ প্রবণতার বক্তব্য হলো, দেখ, আমাদের কাছে কত বড় বড় ব্যক্তিত্ব রয়েছে, আমাদের ইতিহাসে কত বড় বড় মর্যাদাবান নেতা অতিক্রান্ত হয়েছেন, এবং তারা অমুক অমুক স্মরণীয় কীর্তি রেখে গেছেন, যা আমাদের গৌরবজনক উত্তরাধিকার। এই প্রবণতার আলামত হলো, এগুলো সব সময় অন্তসারশূণ্য হয়ে থাকে। এর আওতায় বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের জন্ম দিবস, মৃত্যু দিবস এবং অন্যান্য স্মরণীয় দিন অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে উদযাপন করে থাক। অথচ এ দিনগুলো কোথাও ঐ সব মহান ব্যক্তিত্বের জীবন থেকে জাতির শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ এনে দেয়না। মানবতার নমুনা স্বরূপ যে সব ব্যক্তিত্বকে অত্যন্ত গর্বের সাথে তুলে ধরা হয়, তাদের নীতি ও আদর্শের কোন ছাপ উদযাপনকারীদের জীবনে দেখা যায়না এবং এরূপ ছাপ গ্রহণ করার কোন আগ্রহও পরিলক্ষিত হয়না। এই প্রবণতার অধীন রসূল সা. এর স্মৃতি জাগরুক করার জন্য যেসব উৎসবাদি পালন করা হয়, সেখানেও সব সময় একই ধরণের কথাবার্তা বলা হয়ে থাকে। অথচ বক্তা ও উদ্যোক্তাদের জীবনে তার কোন প্রভাব চোখে পড়েনা।
তৃতীয় ভ্রান্ত দৃষ্টিভংগি হলো, রসূল সা.-এর বাণীকে একটা পূর্ণাংগ জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তে অন্যান্য ধর্মের ন্যায় একটা ধর্ম মনে করা। এই দৃষ্টিভংগী দ্বারা যারা প্রভাবিত, তাদের ধারণা হলো, রসূল সা. কেবলমাত্র কিছু আকীদা বিশ্বাস, কয়েক প্রকারের আনুষ্ঠানিক এবাদত, কিছু দোয়াকালাম, কিছু নৈতিক উপদেশ এবং কিছু আইনগত নির্দেশ পৌঁছিয়ে দেয়া বা শিখিয়ে দেয়ার জন্য এসেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এমন কিছু মানুষ তৈরী করা, যারা ব্যক্তিগতভাবে মুসলমান সুলভ বেশভূষা ধারণ করবে, অথচ যেখানে যত নোংরা সমাজ ব্যবস্থাই চালু থাকনা কেন, তারা তার সর্বোত্তম কর্মী সাব্যস্ত হবে। এ ধরণের লোকেরা রসূল সা. এর কাছ থেকে শুধু নামায, রোযা, নফল কাজ, যিকির, এবং ব্যক্তিগত চরিত্র ও আচরণের শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু সামষ্টিক জীবনের ব্যাপকতর কর্মকান্ডে তারা একেবারেই নির্দ্বিধায় প্রত্যেক বাতিল শক্তির সহায়ক হয়ে যায় এবং সবধরণের অপকর্মের সাথে সহযোগিতা করে। তারা রসূল সা. এর জীবনীর পবিত্র পুস্তকের অসংখ্য সোনালী অধ্যায়কে ভুলে কেবল একটি অধ্যায়ের মধ্যে এমনভাবে মনোনিবেশ করে যে, সেখানেই তারা হারিয়ে যায়। এই গোষ্ঠটি এ যাবত রসূল সা. এর অনুকরণের যে নমুনা পেশ করেছে, তা দেখে কোন অমুসলিম তো দূরের কথা, কোন শিক্ষিত মুসলিম যুবক পর্যন্ত ভাবতে পারেনা যে, রসূল সা. তাদের নেতা হতে পারেন এবং তাঁর কাছ থেকে সাম্প্রতিকতম কঠিন সমস্যাবলীর কোন সন্তোষজনক সমাধান পাওয়া যেতে পারে। এই দৃষ্ঠিভংগিও রসূল সা.-এর সত্তার সঠিক উপলব্ধি ও তার আদর্শের অনুসরণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসব ভ্রান্ত দৃষ্ঠিভংগী টিকে থাকতে পারার একমাত্র কারণ হলো,পরিবেশ এরই অনুকূল। যে রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে আমাদের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে, তার জন্য একটা বিশেষ ধরণের মানুষ প্রয়োজন। এটা এমন একটা কারখানা, যার জন্য বিশেষ ধরণের যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। এ সমাজ ব্যবস্থা তার সদস্যদের মধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের চরিত্র দেখতে চায়। এ কার্যকলাপ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের মানসিকতা ও চরিত্র সম্পন্ন লোকদের দ্বারাই সম্পন্ন হতে পারে। অন্যকথায় বলা যায়, এখনকার বাস্তব কর্মকান্ডে মানবতার সেই মডেলের আদৌ কোন প্রয়োজন নেই, যা মুহাম্মাদ সা.-এর জীবন চরিতে প্রতিফলিত হয়। এখনকার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সেই চিন্তা ও কর্মের কোনই চাহিদা নেই, যা রসূল সা. এর জীবন থেকে গৃহীত হয়ে থাকে। বর্তমান দুনিয়ার সামষ্টিক ব্যবস্থায় যে ধরনের মন্ত্রী, আমলা, বিচারক, উকিল, নেতা, সাংবাদিক, সেনাপতি, সৈনিক, কোতোয়াল, পেয়াদা, তহশীলদার, প্রশাসন, জমিদার, কৃষক, লেখক, সাহিত্যিক এবং শ্রমিক মজুরের চাহিদা রয়েছে,তাদের মানবিক মান সেই মানুষদের মানবিক মানের সম্পূর্ণ বিপরীত, রসূল সা. যাদেরকে তৈরি করে ইতিহাসের মঞ্চে প্রদর্শন করেছিলেন। আজকের পিতামাতা ঘরে ঘরে যে সন্তান স্নেহে আদরে লালন পালন করে গড়ে তুলছে, তা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার চাহিদার আলোকেই গড়ে তুলছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পনেরো বিশ বছর ধরে যে এক কোটি মানুষ তৈরি করছে, তা চলমান সমাজের প্রয়োজন মোতাবেকই তৈরি করছে। চলমান সমাজের দাবী অনুসারেই প্রত্যেক সচেতন ব্যক্তি নিজের চরিত্র ও মানসিকতাকে একটা বিশেষ রুপ দানের কাজে সারা জীবন নিয়োজিত থাকে। এই সমাজ ব্যবস্থা যে যে জিনিসকে ভালবাসে, সেই সেই জিনিসই সমাজ তার সদস্যদের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রস্তুত করতে থাকে। আর যে যে জিনিসকে সে অপসন্দ ও ঘৃণা করে, পরিবেশের সকল উপকরণ সর্বশক্তি দিয়ে তাকে উত্খাত ও নিশ্চিহ্ন করতে সচেষ্ট থাকে। চলমান সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা যে ধরনের বুলি ভালবাসে, সে বুলি আপনা থেকেই সকলের মুখে মুখে চালু হয়ে যায়। সে যে পোষাক ভালবাসে, সে পোষাক স্বতস্ফূর্তভাবে সকলের পরিধানে শোভা পেতে থাকে। এর এক ইশারায় প্রাচীন লজ্জাশীল পরিবারের বৌ ঝিদের মুখমন্ডল থেকে পর্যন্ত নিকাব উঠে যায়। চলমান সমাজ যাকে সম্মানজনক আচরণ বলে চালাতে চায়, সেটাই সম্মানজনক বিবেচিত হয়। আর চলমান সমাজ যাকে অপসন্দ করে সেটাই বিবেচিত হয় অবাঞ্ছিত, অসম্মানজনক। যে শিল্প-কলাকে সে পসন্দ করে, সেটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে, আর যে সব কর্মকান্ডকে সে প্রত্যাখান করে, তা হয়ে যায় সবার উপেক্ষিত। এ সমাজ নিজের মূল্যবোধ নিজেই তৈরি করে এবং সকলকে তা মেনে নিতে বাধ্য করে। আর অন্যসব মূল্যবোধ ও এতিহ্য হয়ে যায় ম্রিয়মান ও নির্জীব। কিছু কিছু আত্মাভিমানী ব্যক্তি ও পরিবার পরিবেশের বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু অর্থনৈতিক বঞ্চনা সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতা ও হীনমন্যতার চাপ এত প্রবল হয়ে থাকে যে, কালক্রমে তারা নিস্তেজ হয়ে পরিবেশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে থাকে। আর তারা আত্মসমর্পণ না করলেও তাদের পরবর্তী প্রজন্ম হতোদ্যম হয়ে পড়ে। এভাবে সচেতনভাবেই হোক কিংবা অবচেতনভাবেই, গোটা পৃথিবীটাই যখন পরিবেশের দাবী অনুসারে নিজের জীবন ও চরিত্র গঠনে নিয়োজিত, তখন সেই পৃথিবী যদি রসূলের জীবনী নিয়ে হাজারো বই পুস্তকও রচনা করে এবং ওয়ায নসিহতের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও করে, তবে তাঁর সুমহান আদর্শ অনুসরণের উদ্দীপনা জনগণের মধ্যে আসবে কোথা থেকে?
প্রকৃত ব্যাপার হলো, যারা কোন অনৈসলামিক ব্যবস্থার সাথে আপোষ রফা করে নেয় এবং বাতিল শক্তির সাথে যাদের স্বার্থের ব্যাপারে সমঝোতা হয়ে যায়, তাদের জন্য রসূলের জীবনীতে কোন শিক্ষাই নেই। সীরাতের গ্রন্থাবলী পড়ে তারা হয়ত মাথা দোলাবে,মানসিক আনন্দ ও তৃপ্তি পাবে। তাদের জ্ঞানও হয়তো বাড়বে,কিন্তু রসূলের সীরাত বা জীবনীর আলোকে আপন জীবন গড়ে তোলার প্রেরণা তারা কোথা থেকে পাবে? তাদের জড়তা ও স্থবিরতা দূর হওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু আমার বক্তব্য এই যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন বৃত্তান্ত কোন সোহরাব রোস্তমের কাহিনী নয়, আরব্য উপন্যাসের উপাখ্যানও নয়, এবং কোন কিংবদন্তির নায়কের কল্পকাহিনীও নয়। তাঁর অবস্থান কখনো এত নিম্নে নয় যে,তাঁকে আমরা নিছক বিনোদনমূলক সাহিত্য চর্চা বা বিদ্যা চর্চার একটা উপকরণ বানিয়ে রাখবো। তাঁর মূল্য ও মর্যাদা এত উঁচু যে, তা আমাদেরকে নিছক মানসিক তৃপ্তি লাভের জন্য সীরাতকে ব্যবহার করার অনুমতি দেয়না। তাঁর প্রতি আমাদের প্রগাঢ় ভক্তি ও শ্রদ্ধা, তাঁর জীবনেতিহাসকে নিছক জাতীয় গৌরব বোধের বাসনা চরিতার্থ করার মাধ্যম বানাতেও আমাদেরকে বাধা দেয়।
এই সব রকমারি ভ্রান্ত দৃষ্টিভংগী আমাদের সমাজে মিলিতভাবে সক্রিয় রয়েছে এবং এগুলো আসল লক্ষে উপনীত হবার পথে অন্তরায় হয়ে রয়েছে। প্রতি বছর কত শত মীলাদুন্নবী ও সীরাতুন্নবীর সভা ও মাহফিল আমাদের দেশে অনুষ্ঠিত হয়, কে তার হিসাব রাখে? একমাত্র রবিউল আওয়াল মাসেই কত যে ওয়ায নসিহত ও বক্তৃতায় আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়, কত বইপুস্তক ও নিবন্ধ লেখা হয়, কত পত্র পত্রিকায় বিশেষ সংখ্যা এই বিষয়ে প্রকাশিত হয়, কবিরা কত বিপুল সংখ্যক কবিতা ও না’ত গযল লেখেন, গায়করা কত যে সভা-সমিতিতে কত না’ত, গযল ও কাওয়ালী গেয়ে বেড়ান, নেতৃবৃন্দ ও রাষ্ট্রনায়কদের পক্ষ থেকে কত যে বানী ও বিবৃতি প্রচারিত হয়, কত মিষ্টি বিতরণ ও কত জাঁকজমকের ভোজের আয়োজন হয় এবং তোরণ নির্মাণ ও বর্ণাঢ্য মিছিল সমাবেশের আয়োজনে কত টাকা যে খরচ হয়, কে রাখে তার হিসাব? [কোন কোন অঞ্চলে রসূল (সা) এর মীলাদ ও সীরাত উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানাদিতে আমোদ উল্লাস ও বিনোদনের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এমনকি খোলাখুলি গুনাহর কাজ এবং হাংগামা ও হট্টগোল পর্যন্ত সংঘটিত হচ্ছে। এর অর্থ হলো সমাজ নবী জীবনের শিক্ষা ও আদর্শের ঠিক বিপরীত দিকেই যাত্রা শুরু করেছে।]
কিন্তু অন্যদিকে এটাও দেখা দরকার যে,একটা মহৎউদ্দেশ্যে শক্তি ও অর্থের এই বিপুল ব্যযের সত্যিকার ফল ও স্বার্থকতা কী দাঁড়াচ্ছে? পর্যালোচনার এক পাল্লায় প্রতি বছরের এই সব তৎপরতাকে রাখুন, আর অপর পাল্লায় অর্জিত ফলাফল রেখে যাচাই করুন যে, সঠিক ফল পাওয়া যাচ্ছে কিনা? এই সব মহৎ কর্মকান্ড দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নবী জীবনের অনুকরণে আপন জীবন গড়া ও তাতে পরিবর্তন ও সংশোধন আনার সাধনায় প্রতি বছর কতজন আত্মনিয়োগ করে থাকে? এক একটা সভা সমাবেশ, এক একটা প্রবন্ধ, ও এক একটা না’ত বা গযল দ্বারা যদি মাত্র এক একজন লোকের মধ্যেও পরিবর্তন আসতো, তাহলে অনুমান করুন যে, বিগত দুই-আড়াইশো বছরে আমাদের কতখানি সুফল অর্জিত হতে পারতো। সেই ইপ্সিত সাফল্য যদি অর্জিত না হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের চেষ্টায় কোন ত্রুটি অবশ্যই রয়েছে এবং সে ত্রুটি অত্যন্ত মৌলিক ধরনের। দু:খ শুধু এজন্য নয় যে, ইপ্সিত সুফল অর্জিত হয়নি। বরং আমাদের সমাজে রসূল সা. এর আদর্শ ও কীর্তির সম্পূর্ণ পরিপন্থী এক অশুভ প্রবণতার প্রাদুর্ভাব ঘটতে দেখে বিলাপ করতে ইচ্ছা হয়। আমাদের সমাজে আজ এমন মানুষও জন্ম নিচ্ছে, যারা রসূল সা. এর আদর্শকে এ যুগের জন্য অচল ও অকার্যোপযোগী বলে আখ্যায়িত করছে। রসূল সা. এর শিক্ষা নিয়ে উপহাস করছে, সীরাত, সুন্নাহ ও হাদীসের সমগ্র ভান্ডারকে বর্জন করার আহ্বান জানাচ্ছে। এ যারা কুরআন উপস্থাপনকারীর ২৩ বছর ব্যাপী অবিস্মরণীয় আন্দোলন ও সংগ্রাম থেকে কুরআনকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছে এবং রসূল সা. এর সত্তাকে আদর্শ ও পূর্ণাংগ মানুষের একটি বাস্তব নমুনা হসাবে আমাদের দৃষ্টিপথ থেকে উধাও করে দিতে চাইছে। আরো পরিতাপের বিষয়, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, বাক স্বাধীনতা ও মুক্ত বুদ্ধি চর্চার নামে করআন ও হাদীসের প্রত্যক্ষ জ্ঞান থেকে বঞ্চিত এক শ্রেণীর ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীর পক্ষ থেকে রসূল সা. এর ব্যক্তিত্ত, আদর্শ ও অবদানকে চলমান বিকারগ্রস্ত সভ্যতার চিন্তাগত কাঠামোর সাথে সংগতিশীল প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে এবং প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব শক্তিসমূহের অভিরুচি অনুসারে রসূল সা. এর সম্পূর্ণ নতুন ভাবমূর্তি প্রস্তুত করার ধৃষ্ঠতা দেখানো হচ্ছে। আমি যতদূর পড়াশুনা ও চিন্তা গবেষণা করেছি তা থেকে আমার এই উপলদ্ধি জন্মেছে যে, আমরা সীরাত অধ্যযনের নির্ভূল মৌলিক দৃষ্টিভংগী হারিয়ে ফেলেছি এবং উপরোক্ত ভ্রান্ত দৃষ্টিভংগীই আমাদের মধ্যে সক্রিয় রয়েছে। এ জন্যই রসূল সা. এর প্রতি অগাধ ভক্তি ও ভালবাসার অসংখ্য প্রমাণ ও আলামত থাকা স্বত্তেও এবং তাঁর জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে প্রচুর চিন্তা গবেষণা চালানো সত্ত্বেও মুসলিম বিশ্বের পূর্ব গগন থেকে সেই রকম নতুন মানুষের আবির্ভাব এখনও ঘটছেনা, যার পূর্ণাংগ নমুনা রসূল সা. জগদ্বাসীকে দেখিয়েছিলেন।
রসূল সা. এর জীবন চরিত আমাদের মধ্যে তার যথার্থ প্রতিফলন ঘটাতে পারে কেবল তখনই, যখন আমরা রসূলের সমগ্র জীবন যে মহান কাজ সমাধা করা ও যে লক্ষ্য বাস্তবায়নের সর্বাত্মক সংগ্রামে উৎসর্গিত ছিল, সেই একই লক্ষ্যে একই সংগ্রামে আমাদের জীবনকেও উৎসর্গ করতে পারবো। রসূল সা. যে ধরনের ইসলামী আন্দোলন ও সংগ্রাম পরিচালনা করে গেছেন, একমাত্র সে ধরনের আন্দোলন-সংগ্রামই রসূল সা. এর অনুসারী জীবন গড়ার একমাত্র উপায়। আর সে ধরনের অনুসারী ব্যক্তিত্ব দ্বারাই নতুন করে সফল ইসলামী আন্দোলন গড়া ও পরিচালনা করা সম্ভব।
মুহাম্মদ সা. এর জীবনী নিছক জনৈক ব্যক্তির জীবনী নয়, বরং তা হচ্ছে এমন এক ঐতিহাসিক শক্তির জীবন বৃত্তান্ত, যা একজন মানুষের আকারে আবির্ভূত হয়েছিল। এটা জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এমন কোন দরবেশের কাহিনী নয়, যিনি লোকালয়ের এক প্রান্তে বসে কেবল নিজের সংশোধন ও আত্মগঠনের কাজে নিয়োজিত। বরং এ হচ্ছে এমন এক ব্যক্তির জীবন কাহিনী, যিনি ছিলেন একটা সামষ্টিক আন্দোলনের চালিকা শক্তি। এটা শুধু একজন মানুষের নয়, বরং মানুষ গড়ার এক কারিগরের জীবন কাহিনী। এ জীবন কাহিনীতে রয়েছে এক নতুন বিশ্ব নির্মাতার কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের বিস্তারিত বিবরণ। বস্তুত বিশ্বনবীর জীবনকাহিনী হেরা গুহা থেকে নিয়ে সূর গুহা পর্যন্ত, পবিত্র কা’বার চত্তর থেকে নিয়ে তায়েফের বাজার পর্যন্ত, এবং উম্মুল মুমীনীনদের কক্ষ থেকে রণাঙ্গন পর্যন্ত চতুর্দিকে বিস্তৃত। তাঁর জীবন চরিত শুধু তাঁর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং অসংখ্য ব্যক্তির জীবনকে সুষমা মন্ডিত করেছে। আবু বকর, উমর, উসমান, আলী, আম্মার, ইয়াসার, খালেদ, খয়াইলিদ, বিলাল ও সুহাইব- সকলেই এই একই সীরাত গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়। তাঁরা সবাই একই বাগানের গাছ গাছালি, যারা প্রতিটি পত্রপল্লবে এই বাগানের মালির জীবর চরিত লিপিবদ্ধ রয়েছে।
পৃথিবীর এই মহত্তম ও শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্বকে যদি জীবনী লেখাচ্ছলে নিছক একক একজন ব্যক্তি রুপে তুলে ধরা হয়, এবং জীবনী লেখার প্রচলিত পদ্ধতিতে তাঁর জীবনের প্রধান প্রধান কীর্তি, তাঁর উল্লেখযোগ্য অভিযান, এবং তাঁর স্বভাবচরিত্র ও আদত অভ্যাসের বিস্তৃত, পুংখানুপুংখ ও তারীখওয়ারি বর্ণনা দেয়া হয়, তবে এ ধরনের সীরাত লেখা দ্বারা সীরাতের সঠিক উদ্দেশ্য কখনো পূরণ হবেনা। রসূল সা. এর জীবন কোন পুষ্করিনীর স্থির পানির মতও নয় যে তার এক কিনারে দাঁড়িয়ে এক নজরেই তা পর্যবেক্ষণ করা যাবে। বরং এটা একটা বহমান নদী, যাতে বেগবান স্রোত রয়েছে, গতি ও সংঘাত রয়েছে, তরংগ ও ফেনা রয়েছে, ঝিনুক ও মুক্তা রয়েছে, এর পানির কল্যাণে মৃত ভূমি প্রাণ ফিরে পায় এবং এ নদীর রহস্য বুঝবার জন্য এর স্রোতের সাথে সাথে চলতে হয়। এ কারণে সীরাত বিষয়ক রকমারি গ্রন্থ পড়লে দূর্লভ তথ্যাবলি পাওয়া গেলেও পাঠকদের মধ্যে প্রেরণা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়না, আবেগ জাগ্রত হয়না, সাহস ও সংকল্পে নতুন উদ্যমের জোয়ার আসেনা, কাজের অভিরুচিতে নতুন উত্তাপ ও নতুন প্রেরণার উজ্জীবন ঘটেনা এবং আমাদের জীবনের স্থবিরতা ও দূর হয়না। সীরাত বিষয়ক গ্রন্থ পড়ে ক্ষণিকের জন্য হৃদয়ে ভক্তির ঢেউ হয়তো ওঠে এবং চোখে অশ্রুর বানও হয়তো ডাকে, কিন্তু আকাংখার সেই স্ফুলিংগ আমাদের হস্তগত হয়না, যার উত্তাপ একজন নি:সংগ, নিসম্বল ও আশ্রয়হীন ব্যক্তিকে শত শত বছরের পুঞ্জীভূত বাতিল সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, আর ঈমানের সেই তেজ ও তীব্রতা আমরা অর্জন করতে পারিনা, যা একজন নি:স্ব এতীমকে সমগ্র আরব অনারব বিশ্বের ভাগ্য নিয়ন্তায় পরিণত করেছিল।
আসল কথা হলো, রসূল সা. প্রচলিত পরিভাষায় সীমিত অর্থে কেবল একজন ‘অসাধারণ’ ও ‘খ্যাতনামা’ ব্যক্তিই ছিলেন না এবং তাঁর সীরাত তথা জীবন চরিত কেবল এ ধরনের কোন ‘অসাধারণ’ ও ‘খ্যাতনামা’ ব্যক্তির জীবন বৃত্তান্তই নয়, যে ধরনের জীবন চরিত খ্যাতনামা ব্যক্তিগণের জন্য লিখিত হয়ে থাকে। মহানবীর সত্তা ও ব্যক্তিত্ব এ ধরনের অসাধারণ ও খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গের চেয়ে অনেক উর্দ্ধের।
পৃথিবীতে অসাধারণ মানুষ অনেক জন্মেছে এবং জন্মে থাকে, যারা কোন ভাল শিক্ষা ও কোন গঠনমূলক চিন্তা সমাজে উপস্থাপন করে। এদেরকে অসাধারণ মানুষ বলা হয়। যারা নৈতিকতা ও আইনের বিধান নিয়ে চিন্তা গবেষণা করে তাদেরকেও মহৎ ও অসাধারণ মানুষ বলা হয়। যারা সমাজ সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেছে, তাদেরকেও অসাধারণ মানুষ বলা হয়। এই ‘অসাধারণ’ খেতাবটি সেই সব লোককেও দেয়া হয়,যারা দেশ জয় করেছে, বীরোচিত কীর্তির উত্তরাধিকার রেখে গেছে, যারা সম্রাজ্য পরিচালনা ও শাসন করেছে,যারা দারিদ্র ও অভাবের বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এবং যারা বিশ্ববাসীর সামনে ব্যক্তিগত চরিত্রের অত্যন্ত উঁচুমানের মানদন্ড স্থাপন করেছে, তাদেরকেও। কিন্তু এ ধরণের অসাধারণ ও খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের জীবনী যখন আমরা অধ্যয়ন করি, তখন সাধারণত আমরা এটাই দেখতে পাই যে, তাদের সমস্ত শক্তি সামর্থ যেন জীবনের কোন একটা ভালই চুষে খেয়ে ফেলেছে, আর বাদবাকী সবগুলো ডালপালা যেন শুকিয়ে গেছে। তাদের জীবনের একটা দিক যদি খুবই উজ্জ্বল দেখা যায়, তবে তার অন্যদিক একেবারেই অন্ধকার প্রতীয়মান হয়। একদিকে চরম বাড়াবাড়ি, অপর দিকে চরম উদাসীনতা। কিন্তু রসূল সা. এর জীবনের প্রতিটি দিক অন্যান্য দিকের সাথে পুরোপুরি ভারসাম্যপূর্ণ এবং প্রতিটি দিক একই রকম পূর্ণতা ও উৎকৃষ্টতা দ্বারাও শোভিত। যেখানে গুরু গম্ভীরতার প্রতাপ রয়েছে সেখানে সৌন্দর্যের চমকও রয়েছে। সেখানে আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি রয়েছে বৈষয়িকতার সমন্বিত অবদান। পরকালের চর্চার পাশে হাত ধরাধরি করে রয়েছে অর্থনৈতিক চিন্তাধারা। দ্বীনের সাথেই রয়েছে দুনিয়াও। এক ধরণের আত্মনিবেদিত ভাব থাকলেও সেই সাথে আত্মমর্যাদাবোধও রয়েছে অম্লান। আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীর পাশাপাশি বিরাজ করছে আল্লাহর বান্দাদের প্রতি স্নেহ মমতা ও তাদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। কঠোর সামষ্টিক শৃংখলার সাথে রয়েছে ব্যক্তির অধিকারের প্রতি সম্মানও। প্রগাঢ় ধর্মীয় চেতনা ও আবেগের সাথেই অবস্থান করছে সর্বাত্মক রাজনীতিও। জাতির নেতৃত্ব প্রদানে অষ্টপ্রহর ব্যস্ততা থাকলে ও সেই সাথে দাম্পত্য জীবনের কর্মকাণ্ডও সম্পাদিত হচ্ছে সুচারুভাবে। মজলুমদের সাহায্যের পাশাপাশি যালেমদের প্রতিরোধেরও ব্যবস্থা রয়েছে।
রসূলের জীবন চরিতরূপী এই পাঠশালা থেকে সমভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে একজন প্রশাসক, একজন শাসনকর্তা, একজন মন্ত্রী, একজন কর্মকর্তা, একজন মনিব, একজন চাকুরে, একজন ব্যবসায়ী, একজন শ্রমিক, একজন বিচারক, একজন শিক্ষক, একজন সিপাহী, একজন বক্তা, একজন নেতা, একজন সংস্কারক, একজন দার্শনিক এবং একজন সাহিত্যিকও। সেখানে একজন পিতা, একজন সহযাত্রী ও একজন প্রতিবেশীর জন্য একই রকম অনুকরণীয় আদর্শ রয়েছে। একবার কেউ যদি এই পাঠশালায় পৌঁছে যায়, তাহলে তার আর অন্য কোন পাঠশালায় যাওয়ার প্রয়োজন হয়না। মানবতার যে সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম উৎকর্ষ অর্জন করা সম্ভব, তা এই একক, ব্যক্তিত্বেই পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান। এজন্যই আমি এই ব্যক্তিকে ‘‘শ্রেষ্ঠমানুষ’’ বা ‘‘মহামানব’’ বলে আখ্যায়িত করতে বাধ্য হয়েছি। সমগ্র মানবেতিহাসে ‘‘শ্রেষ্ঠমানুষ’’ কেবল এই একজনই। তাঁকে মশাল বানিয়ে আমরা আমাদের জীবনকে উজ্জ্বল করতে পারি। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ তাঁর কাছ থেকে আলো গ্রহণ করেছে। অনেকে তাঁর কাছ থেকে জ্ঞানের ভান্ডার গড়ে তুলছে। আজ পৃথিবীর দিকে দিকে তাঁর বাণী গুঞ্জরিত হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের সভ্যতা সংস্কৃতিতে তাঁর প্রদত্ত শিক্ষার গভীর প্রভাব রয়েছে। পৃথিবীর এমন কোন মানুষ নেই, যে এই শ্রেষ্ঠ মানুষ থেকে কোন না কোন পর্যায়ে উপকৃত হয়নি। কিন্তু তাঁর দ্বারা যারা উপকৃত, তাঁরা তাঁকে চেনেনা এবং তাঁর পরিচয় জানেনা।
রসূল সা. এর ব্যক্তিত্বের পরিচয় এবং তাঁর বাণীর বিশ্বময় প্রচার ও প্রসারতাঁর প্রতিষ্ঠিত দল তথা মুসলিম জাতিরই দায়িত্ব ছিল। কিন্তু এই জাতি নিজেই তাঁর ও তাঁর বাণী থেকে অনেক দূরে পড়ে রয়েছে। মুসলমানদের কাছে রক্ষিত ধর্মগ্রন্থের পাতায় পাতায় জীবনের সকল দিক সম্পর্কেই দিকনির্দেশনা রয়েছে, কিন্তু তাদের জীবনে এই মহামানবের জীবনীর কোন প্রভাব পড়ছে বলে মনে হয়না। এই জাতির ধর্মীয় জীবনে, রাজনীতিতে, সমাজ জীবনে, নৈতিকতায়, আইন ব্যবস্থা ও সংস্কৃতিতে নবী জীবনের আদর্শের খুব কমই ছাপ অবশিষ্ট রয়েছে। যা রয়েছে তাও অনেক নতুন নতুন ছাপের সাথে মিশে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। এই জাতির সামাজিক পরিবেশ পৃথিবীর কোন একটি ক্ষুদ্রতম অংশেও এমন অবস্থায় নেই, যা দ্বারা বুঝা যায় যে তারা মুহাম্মদ (সাঃ) এর নীতি, আদর্শ, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের প্রতিনিধি। বরঞ্চ এ জাতি পৃথিবীর বিভিন্ন বিভ্রান্ত ও বাতিল ব্যবস্থার দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা চেয়ে বেড়াচ্ছে এবং প্রত্যেক প্রতিষ্ঠিত শক্তির ভয়ে নিজেদের গৌরবময় ঐতিহ্য সম্পর্কে লজ্জিত বলে মনে হয়। তারা কোরআনকে গেলাফ দিয়ে মুড়ে রসূল (সাঃ) এর সীরাতকে ফুলের তোড়া বানিয়ে তাকের ওপর তুলে রেখে দিয়েছে।
উপরন্তু মুহাম্মদ (সাঃ) কে সংকীর্ণ অর্থে একজন ধর্মীয় ও জাতীয় নেতায় পরিণত করে নিজেদেরকে একটা ধর্মীয় ও জাতীয় সম্প্রদায়ে রূপান্তরিত করেছে। এভাবে এই বিশ্ব ব্যক্তিত্বের বাণী ও জীবনাদর্শকে গোষ্ঠীগত ও সাম্প্রদায়িক একচেটিয়া সম্পত্তি বানিয়ে নিয়েছে। অথচ তিনি এসেছিলেন সমগ্র মানব জাতির নেতা হয়ে এবং সমগ্র মানব জাতির জন্য বাণী ও আদর্শ নিয়ে। তাঁর জীবনেতিহাসকে এমনভাবে উপস্থাপন করা দরকার ছিল যে, মনুষ্যত্বের একটা নমুনা ও আদর্শ। মানুষ এর ছাঁচে ঢালাই হয়ে তৈরি হলে সে নিজের ও সমগ্র মানব জাতির কল্যানের উপকরণ হতে পারে এবং রকমারি সমস্যার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে একটা পবিত্র নিষ্কলুষ ও নিষ্কণ্টক জীবন অর্জন করতে পারে। রসূল (সাঃ) এর বাণী ও জীবনাদর্শ প্রকৃত পক্ষে সূর্যের কিরণ,বৃষ্টির পানি ও বাতাসের মত সার্বজনীন কল্যাণের উৎস। অথচ আমরা তাঁকে নিজেদের অজ্ঞতার দরুণ একটা গোষ্ঠীগত বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেছি। আজ প্লেটো, সক্রেটিস, ডারউইন, মেকিয়াভেলী, মার্কস, ফ্রয়েড ও আইনস্টাইন থেকেও সকল দেশ ও সকল ধর্মের লোকদেরকে কমবেশী উপকৃত হতে ও শিক্ষা গ্রহন করতে দেখা যায়। তাদের বিরুদ্ধে কোন জাতি বা গোষ্ঠীর অন্ধ বিদ্বেষ নেই। কিন্তু মুহাম্মদ (সাঃ) এর জ্ঞান, আদর্শ ও নেতৃত্ব থেকে শিক্ষা গ্রহণে এত আপত্তি ও এত বিদ্বেষ যে,তার ইয়ত্তা নাই। লোকেরা ভাবে যে, মুহাম্মদ (সাঃ) তো মুসলমানদের নেতা। আর আমরা মুসলমানদের থেকে আলাদা এবং মুসলমানরাও আমাদের থেকে ভিন্ন জাতি। কাজেই মুসলমানদের নেতা ও পথ প্রদর্শকের সাথে আমাদের কী সম্পর্ক? দুঃখের বিষয় হলো, এরূপ ধারনা সৃষ্টিতে এবং এর এতটা অস্বাভাবিক পর্যায়ে উপনীত হওয়াতে আমাদের নিজস্ব কর্মকান্ডেরও যথেষ্ট হাত রয়েছে। সমগ্র মানবজাতির বন্ধু মুহাম্মদ (সাঃ) এর উম্মত হয়েও আমরা তাঁর অনুকরণের অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি বলেই অমুসলিম জনগনের মধ্যে এরূপ চিন্তা ধারার জন্ম নিতে পেরেছে।

পাশ্চাত্য জগতের উদ্দেশ্যে

বিশ্বনবীর জীবনকাল মানবেতিহাসের দুটো প্রধান যুগের মাঝখানে অবস্থিত। যেদিন তিনি নবী হিসেবে অধিষ্ঠিত হন, সেদিন থেকে পেছনের দিকে তাকালে আমরা সাক্ষাত পাই গোত্রবাদ, সামস্তবাদ, রাজতন্ত্র, পূর্বপুরুষ পূজা ও পৌত্তলিক সভ্যতার। আর সন্মুখের দিকে তাকালে দেখতে পাই আন্তর্জাতিক, গণতাস্ত্রিক ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার-উদ্ভাবন ভিত্তিক সভ্যতার যুগ। এই বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির উদ্বোধনটা সম্পন্ন হয়েছিল স্বয়ং রসূল (সাঃ) এর হাতেই। সেই সাথে তাঁর হাতে বিশ্বমানবকে এমন মূলনীতি দেয়া হল, যা কেয়ামত পর্যন্ত কার্যোপযোগী। এই মূলনীতির সাথে সাথে এমন মানুষ তৈরী করে দেখিয়ে দেয়া হলো, যে ভবিষ্যত দায়িত্ব গ্রহনের যোগ্য হতে পারে। তাঁর মাধ্যমে সেই অনাগত যুগের চাহিদার আলোকে আত্মা ও দেহ, নৈতিকতা ও বস্তুতান্ত্রিকতা, ভাবাবেগ ও যুক্তি-বুদ্ধি, বিশ্বাস ও কাজ, ব্যক্তি ও দলের আকাংখা এবং বিরাজমান পরিস্থিতি ও চাহিদার মাঝে অকল্পনীয় ও অলৌকিক ধরনের ভারসাম্য স্থাপিত হলো। তাঁর হাতে দুনিয়া সম্পর্কে নির্মোহ অথচ দুনিয়ার শাসনকার্য পরিচালনাকারী একটি মানবগোষ্ঠী তৈরি করা হয়েছিল। এই দল এক দিকে যেমন আল্লাহর আনুগত্যে জুড়িহীন, অপরদিকে তেমন বস্তুজগতের ওপর কার্য পরিচালনায়ও অগ্রগামী। তাঁরা একদিকে সত্যর সামনে পরম বিনয়ের সাথে মাথা নোয়ায়, অপরদিকে বাতিলের শক্তি খর্ব করার জন্য জানমালের সর্বাত্মক কুরবানী দিতেও প্রস্তুত হয়ে যায়। একদিকে তারা নিজেদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টির কাছে সোপর্দ করে দিত, অপর দিকে প্রাকৃতিক শক্তিগুলো কে বশীভূত করে কাজে লাগাতে ছিল সুদক্ষ। ইতিহাসের রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করা মাত্রই এই দল জ্ঞান বিজ্ঞানের আলো জ্বালালো, আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের দ্বারোদঘাটন করল এবং প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনের জন্য দ্রুত গতিতে তারা নতুন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালালো। তাদের সকল তৎপরতা, উন্নতি জ্ঞান বিজ্ঞানের বিস্তার, আবিষ্কার উদ্ভাবন এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির সকল কর্মকান্ডের আসল কৃতিত্ব মুহাম্মদ(সাঃ) এর ই প্রাপ্য।
পরিতাপের বিষয়, এই বুদ্ধিবৃত্তিক ও গনতান্ত্রিক সভ্যতার নিয়ন্তা পাশ্চাত্যের জাতিসমূহ মুহাম্মদ (সাঃ), তাঁর বাণী ও তাঁর আনীত জীবন ব্যবস্থাকে বুঝতে পারলনা। যে মহান ব্যক্তির কৃতিত্বপূর্ণ অবদান পাশ্চাত্যের নব উত্থানের পিছনে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে, যে সত্তা গনতন্ত্র ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মূল উদ্গাতা এবং যিনি ধর্মীয় সংষ্কার ও আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন, তাঁকে ইউরোপের বুদ্ধিদীপ্ত মানুষরা দেখতেও পেল না, বুঝতেও পারল না। এর অনেক গুলো কারণ ছিল। এ কারণ গুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা এখানে বাঞ্ছনীয় মনে করছিঃ
১। মুহাম্মদ(সাঃ) যখন নিজের বাণী নিয়ে আবির্ভূত হলেন, তখন তাঁকে ইহুদী ও খৃস্টান উভয় ধর্মের মোকাবেলা করতে হয়েছিল। এই উভয় ধর্ম তখন চরম বিকৃতি ও অবক্ষয়ের যুগ অতিবাহিত করছিল। এই উভয় জাতি ঈমান ও নৈতিকতা থেকে বঞ্চিত একটা অনুষ্ঠান সর্বস্ব কাঠামোকে ধর্মীয় পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্য সহকারে বহন করে চলছিল। উভয় জাতির মধ্যে ধর্মীয় শ্রেণী ও উপদল সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল এবং তারা পুরপুরি ধর্মব্যবসায়ের দোকান খুলে বসেছিল। সুস্থ চিন্তা ও কর্মের আসল পন্য লুন্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। বাইরে কেবল চটকদার সাইনবোর্ড লটকানো ছিল। নিজেদের উপদল ও শ্রেণীগত অস্তিত্ব বহাল রাখার কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করা হতো এবং নিজ নিজ গোষ্ঠীভুক্ত লোকজনকে ধরে রাখাই ছিল প্রত্যেক গোষ্ঠীর একমাত্র কাজ। মনুষ্যত্বের উৎকর্ষ সাধন ও সমাজের সংষ্কার কারোই কাজ ছিল না। এরূপ পরিস্থিতিতে সামগ্রিকভাবে ইহুদী ও খৃস্টানদের মানসিকতা এত বিগড়ে গিয়েছিল যে, তারা মুহম্মদ(সাঃ) এর অমূল্য ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন এবং তাঁর বাণী ও তাঁর উপস্থাপিত জীবন ব্যবস্থার পর্যালোচনা করার পরিবর্তে তাঁর বিরুদ্ধে হিংসা, বিদ্বেষ ও হঠকারিতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখাতে থাকে। তারা তাঁর দাওয়াতে প্রতিরোধ ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে থাকে। তাঁর সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাঁর কৃত গঠনমূলক কাজকে নষ্ট করে দিতে চায়। এমনকি তাঁকে হত্যা করার চক্রান্তও চালায়। তারপর নিজেদের এই সব অপকর্মের স্বাভাবিক কুফল দ্বারা নিজেদের ও বংশধরদের জীবনকে কলঙ্কিত করে। ইতিহাসের বহমান স্রোতকে তারা নোংরা মানসিকতা ও ঘৃণ্য ধ্যান-ধারনার দ্বারা নষ্ট করে এবং এই নষ্ট পানি প্রবাহিত হয়ে পরবর্তী বংশধর পর্যন্ত গড়ায়। তারা ঘৃণা ও বিদ্বেষের এক বিশাল উত্তরাধিকার পরবর্তী ইহুদি ও খৃস্টানদের জন্য রেখে যায়। মুহম্মদ (সাঃ) এর সমকালীন ইহুদী ও খৃস্টানদের এই দুষিত ভাবাবেগ জড়িত প্রতিক্রিয়া আজ পর্যন্ত তাদের উত্তরসূরীদের মনমগজে প্রতিফলিত হচ্ছে।
২। ইসলামের অভ্যূদয়ের পূর্বেকার মনুষ্যজগতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় পরিমন্ডলে খৃস্টানদের ছিল সুস্পষ্ট প্রাধান্য ও দোর্দন্ড প্রতাপ। এই প্রাধান্য ও আধিপত্যকে সম্প্রসারিত করার আকাংখারও কমতি ছিলনা তা বাস্তবায়নের জন্য পরিবেশও ছিল অনুকূল। কিন্তু ইসলামের অভ্যূদয় খৃস্টানদের চোখে একটা প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির আবির্ভাব বলে প্রতীয়মান হয়। এই শক্তি ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়ে একটি কার্যকর বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড প্রতিহিংসার দানা বাঁধে এবং তা ক্রমেই জোরদার হতে থাকে। এরপর পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ইসলামী শক্তি যখন খৃষ্টানদের হাত থেকে কার্যত ক্ষমতা ও দখলদারী ছিনিয়ে নিতে থাকে, তখন তাদের প্রতিক্রিয়া আরো তীব্র আকার ধারণ করে। ইতিহাসের মুক্তমঞ্চে সমান দুই শক্তির প্রকাশ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব নিয়ে বিচার করার পরিবর্তে খৃষ্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিহিংসা লালন করতে লাগলো, পরোক্ষভাবে এ প্রতিহিংসা ছিল স্বয়ং রসুল(সাঃ) ও ইসলামের বিরুদ্ধে। এ প্রতিহংসা ও বিদ্বেষ ক্রুসেড যুদ্ধের সময়ে চরম আকার ধারন করে। এই যুগ পর্যন্ত পৌছতে পৌছতে যেহেতু খোদ মুসলমানদের মধ্যেই অধোপতনের বীজ বোনা সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল, তাই তাদের বিশেষ বিশেষ দুর্বলতা ও ভ্রষ্টতাকে তারা ইসলাম ও রাসুলুল্লাহর ওপর আরোপ করতে লাগলো। মুসলমানদের চরিত্র ও কর্মকান্ড দ্বারা তারা রসুল (সাঃ) এর ভাবমূর্তিকে বিকৃত করার অপচেষ্টা চালাতে শুরু করলো।
৩। ইসলাম ও খৃস্টবাদের মধ্যে সংঘটিত দ্বন্দ্ব সংঘাতের এই সুদীর্ঘ যুগের প্রথমাংশে যেহেতু খৃষ্টীয় ধর্মযাজকরা খৃষ্টান জনগণকে পুরোপুরিভাবে নিজেদের মুঠোর মধ্যে পুরে রেখেছিল, আর ইসলাম এই ধর্মযাজক শ্রেণীর গোষ্ঠী স্বার্থের ওপরই আঘাত হেনেছিল, তাই এই গোষ্ঠী রসুল(সাঃ) ও তাঁর বাণী সম্পর্কে একটা মিথ্যা ধারনা সৃষ্টি করে এবং তা সর্বত্র ছড়াতে থাকে। শত শত বছরের এই অপপ্রচার পাশ্চাত্যবাসীর মন মগজকে একেবারেই বিগড়ে দেয়। এই জন্যই আজ দেখা যায়, যারা আদৌ কোন ধর্ম মানেনা এবং খৃষ্টধর্মের প্রভাবমুক্ত হয়ে চিন্তাভাবনা করে, সেই বুদ্ধিজীবীরাও যখন ইসলাম ও মুহম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করে তখন তারা আজ থেকে ছয়শো বছর আগেকার সংকীর্ণমনা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন পাদ্রীদের নীচ মানসিকতা থেকে একটুও উর্দ্ধে উঠতে পারেনা। প্রাচ্যবিদদের লেখা বইগুলোর দুচারটে পাতা ওল্টালেই দেখতে পাবেন যে তাতে কত ভ্রান্ত ও ত্রুটিপূর্ণ তথ্য কিরুপ ন্যাক্কারজনকভাবে সংযোজন করা হয়েছে এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানুষটির জীবনকে কত নির্বুদ্ধিতার সাথে চিত্রিত করা হয়েছে। দু-একটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত পাওয়া গেলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু পাশ্চাত্যবাসীর সাধারন রীতির কথাই এখানে বলা হয়েছে।
৪। বিগত দুশো বছর ছিল পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের শয়তানী যুগ। এই যুগে মুসলিম জাতি গুলো ইসলাম থেকে বিচ্যুতি, আল্লাহর অবাধ্যতা ও মুহম্মদ (সাঃ)-এর আদর্শের প্রতি আনুগত্যহীনতার শাস্তি সরূপ একে একে পুঁজিবাদী পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী লালসার শিকার হয়েছে। পাশ্চাত্যের এই সাম্রাজ্যবাদী লালসা সর্বত্র মুসলমানদের পক্ষ থেকে এক দুরন্ত প্রতিরোধের সন্মুখীন হয়। এই প্রতিরোধের পিছনে সর্বক্ষেত্রেই সক্রিয় ছিল ধর্মীয় প্রেরণা। ইসলাম তওহীদ তথা এক আল্লাহর গোলামির যে তত্ত্ব দিয়েছে তা স্বাধীনতা ও মানবীয় সাম্যের এমন শিক্ষা দেয়, যা ইসলামের অনুসারীদেরকে এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো গোলামীতে সম্মত হতেই দেয়না। এই জন্যই দেখা যায়, মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যতগুলো আন্দোলন গড়ে উঠেছে তার সবগুলোর পেছনেই ইসলামী চেতনা ও উদ্দীপনা সক্রিয়। সর্বত্রই কোন না কোন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় এবং সর্বত্রই ইসলামী শাসন ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থা পুনপ্রতিষ্ঠার উদ্দীপনা সক্রিয় লক্ষ্য করা যায়। এভাবেই মুসলিম দেশগুলোর সকল স্বাধীনতা আন্দোলনে ধর্মীয় প্রেরণাকে প্রবলভাবে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। আর এ কারণেই পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীদের মনে এই শক্তির বিরুদ্ধে নতুন করে বিদ্বেষ ও আক্রোশ সৃষ্টি হয়। কেননা এ শক্তি পদে পদে তার পথ আগলে দাঁড়িয়েছিল এবং এক দুর্জয় উদ্দীপনা সৃষ্টি করছিল। আর এই আক্রোশের বশেই মুসলমানদের ধর্মপ্রীতিকে পাগলামি বলে আখ্যায়িত করা হয় এবং “মোল্লাতন্ত্র” কে একটি ভয়ংকর আপদ হিসেবে চিত্রিত করা হয়। এর পাশাপাশি মুসলমানদের ধর্মীয় প্রেরনা এত শক্তিমান প্রমাণিত হয় যে, তা পাশ্চাত্যের কৃষ্টি ও চিন্তাধারার কাছে পরাভব মানতে তো প্রস্তুত ছিলইনা, উপরন্তু তা প্রত্যেক দেশে তার মোকাবেলা করেছে। শিক্ষা, সাহিত্য ও প্রভাব প্রতিপত্তির সকল শক্তি প্রয়োগ করেও পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ বহু বছর পর মুসলিম জাতির মধ্যে থেকে কেবল মুষ্ঠিমেয় সংখ্যক লোককেই আপন তাবেদার বানাতে পেরেছে। অতঃপর তারা এ ধরনের তাবেদার গোষ্ঠীকে সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে এবং তাদেরকে মুসলমানদের ইসলামী চেতনার বিরুদ্ধে চিন্তাগত, কৃষ্টিক ও রাজনৈতিক যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। এর ফলে ইসলাম ও রসুল(সাঃ)-এর সাথে পাশ্চাত্যের সংঘাত ক্রমেই বেড়ে গেছে।
৫। পাশ্চাত্যের জাতিগুলো যখন মুসলমানদেরকে গোলামে পরিণত করার চেষ্টায় সফল হলো, তখন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক ভাবে তাদের চেয়ে হীনতর এই মুসলমানদের কাছ থেকে জীবন পদ্ধতি ও জীবন দর্শন সংক্রান্ত শিক্ষা গ্রহন করা তাদের পক্ষে দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। একই রকম কঠিন হয়ে দাঁড়ালো ইসলামের উপস্থাপক ও প্রচারক রসূল (সাঃ)কে সম্মান করা। শুধু তাই নয়, তারা যখন মুসলমানদেরকে তাদের মানসিক গোলামিতে লিপ্ত এবং পাশ্চাত্যের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হবার যাবতীয় লক্ষণ তাদের মধ্যে প্রতিভাত দেখলো, তখন এই অবস্থাটা আরো বড় অন্তরায় সৃষ্টি করলো। তারা যখন প্রত্যক্ষ করলো যে, তাদের হাতে গড়া আধুনিকমনা মুসলমানগণ ইসলামকে পাশ্চত্যের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে পরিবর্তন ও রদবদল করে নিতে শুরু করেছে, তখন আর যায় কোথায়। ইসলাম ও রসুল (সাঃ)-এর মর্যাদা তাদের চোখে আর কমে গেল। মুসলমানদের আত্মরক্ষামূলক দৃষ্টিভংগী ইসলামের ভাবমূর্তী ও মুহম্মদ (সাঃ) এর মর্যাদার বিরাট ক্ষতি সাধন করলো।
এই পাঁচটি কারনে মুহম্মাদ(সাঃ) ও পাশ্চাত্যের মানুষের মাঝে এক বিরাট লৌহপ্রাচীর দাঁড়িয়ে গেছে।
তাই আজ পাশ্চাত্য জগত গোটা মানবজাতির মুক্তিদূত মুহাম্মদ (সাঃ) কে কেবল মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে গ্রহন করে থাকে এবং তাঁর জীবন চরিতকে বুঝবার ও বুঝাবার দৃষ্টিভংগীর পরিবর্তে বিরুদ্ধচারণ ও আপত্তি তলার মনোভাব নিয়ে অধ্যয়ন করে থাকে। পাশ্চাত্য এই মহান সত্তার যে চিত্র তাদের সাহিত্যে অংকন করেছে,তা এমন একজন মানুষের ভাবমূর্তি তুলে ধরে, যে মানসিক ভারসাম্য ও সুস্থতা থেকে বঞ্চিত, যার যাবতীয় তৎপরতা অবচেতন মনের বুদ্ধিবিভ্রাটের ফল এবং যে এক রক্তপিপাসু তরবারী হাতে নিয়ে যে দিকে অগ্রসর হয় পাইকারী গণহত্যা করতে করতে এগিয়ে যায়। গোটা বিশ্ব যাকে আপাদমস্তক করুণা বলে জানে, তাঁকে তারা একজন দুনিয়া পূজারী ও উচ্চভিলাষী আগ্রাসী হানাদারের মর্যাদা দিয়েছে এবং তাঁর আন্তরিকতাপূর্ণ অবদানকে ধোকাবাজি ছলচাতুরী নামে আখ্যায়িত করেছে। তারা এও প্রমান করার চেষ্টা করেছে যে, ইসলামী আন্দোলনে যা কিছু ভাল, তা ইহুদি ও খৃস্টানদের কাছ থেকে ধার করা জিনিস। নচেত মুহম্মদ(সাঃ)-এর মধ্যে তেমন কোন নৈতিক যোগ্যতা ছিলনা। এও প্রকাশ করা হয়েছে যে, আধ্যাত্মিকতা ও ধার্মিকতা যাবতীয় কর্মকান্ড ছিল নিছক লোক দেখানো এবং কেবল নাটকীয় কলাকৌশল দ্বারা জনগণকে বশীভূত করে স্বার্থ উদ্ধার করা হয়েছে। তারা দুনিয়ার যে কোন মানুষকে দুনিয়া পূজারী ও ধড়িবাজ বলুক, কিন্তু প্রশ্ন হলো, রসুলের সমগ্র জীবনীতে যে নিষ্পাপ ও নিষ্কলুক মহৎ চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়, তথাকথিত ঐ ধড়িবাজ ও দুনিয়া পূজারী ব্যক্তিদের সাথে তার সমন্বয় কিভাবে সম্ভব?
এছাড়া তাঁর আরো যে ঘোরতর অবিচার করা হয়, তা হলো, রসুল (সাঃ)-এর দাওয়াতের মূল বাণীকে তার শেকড় থেকে নিয়ে শাখা-প্রশাখা ও পত্রপল্লব পর্যন্ত সর্বত্র সর্বব্যাপী দৃষ্টি দিয়ে অধ্যয়ন করা হয়না। বরং এর মৌল নীতিকে না বুঝে এবং এর চিন্তাধারার মূল দর্শনের নিগুঢ় তাৎপর্য উপলব্ধি না করে তার্কিক পাদ্রীদের নিয়মানুসারে কয়েকটা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে তর্ক জুড়ে দেয়া হয়। যেমন বলা হয় যে, হযরত মুহম্মাদ (সাঃ) বহু বিবাহ বৈধ করেছেন, ধর্মের জন্য অস্ত্র ধারণ করেছেন, যুদ্ধবন্দীদেরকে দাসদাসী বানিয়েছেন, ইত্যাদি। অধ্যয়ন ও পর্যালোচনার এই একপেশে পদ্ধতিটা সব সময় বিদ্বেষপূর্ণ ও বিরুদ্ধভাবাপন্ন মানসিকতার বাহন হয়ে থাকে। এই মানসিকতা নিয়ে কোন জীবন ব্যবস্থাকে ও কোন দ্বীনকে বুঝা সম্ভব হয়না। বরং এর দ্বারা সব কিছু বুঝার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। আসল বিবেচ্য বিষয় এবং জানা ও বুঝার আসল জিনিস হলো, মূল দর্শন বা মতাদর্শ। মূল দর্শন ও মতাদর্শ কতখানি সত্য ও সঠিক, তা দ্বারা জীবনের কতটা উপকার সাধিত হয় এবং জীবনের ক্ষয়ক্ষতি কতটা রোধ ও পূরণ করা যায়, সেটাই আসল প্রণিধানযোগ্য বিষয়। এরপর এই মূলতত্ত্ব ও মতাদর্শ থেকে যে নীতিমালা তৈরী হয়, যে নীতিমালার ভিত্তিতে জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়, সেগুলোকে বিবেচনা ও পর্যালোচনা প্রয়োজন। অতঃপর এই সব নীতিমালা থেকে নির্গত খুঁটিনাটি উপবিধি বা উপধারাগুলোকে দেখতে হয় যে, ওগুলো মূল আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যশীল কিনা। এক ব্যক্তি আপনার কাছে একটা জীবন দর্শন নিয়ে এলো। আপনি সেই জীবন দর্শনটা বিবেচনা না করে এমন কতগুলো উপবিধি নিয়ে তর্ক জুড়ে দিলেন, যার ব্যাপারে আপনার সমাজে একটা বিশেষ বদ্ধমূল ধারণা বিরাজমান এবং সেই ধারনার বাইরে এসে আপনি কোন চিন্তাভাবনা করতেই পারেন না। এর ফল দাঁড়ায় এইযে, আপনি নিজেও বিভ্রান্তিতে লিপ্ত হন, এবং হাজার হাজার মানুষকেও বিভ্রান্তি ও সংকীর্ণতার মধ্যে নিক্ষেপ করেন। এক ব্যক্তি আপন সত্তার ভেতর মনুষ্যত্বের একটা নতুন পূর্ণাংগ মডেল বানিয়ে আপনার সামনে হাজির করলো। আপনি এই মডেলকে সামগ্রিকভাবে বুঝার আগে তার দুই একটা ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিলেন এবং তার বৈধতা ও ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। তা না করে যদি পুরো মডেলটাকে সামগ্রিকভাবে বুঝে নিতেন, তাহলে ঐ অংশগুলো আপনা থেকেই আপনার বুঝে আসতো। বিভিন্ন মতবাদ ও জীবন ব্যবস্থাকে বুঝার জন্য এবং ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের পর্যালোচনার জন্য পাশ্চাত্য সাধারনভাবে যে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান সম্মত পন্থা অবলম্বন করে থাকে, ইসলাম ও মুহাম্মদ সা. এর বেলায় সেই বিজ্ঞানসম্মত পন্থাটাকে একেবারেই শিকেয় তুলে রাখে। একটা বাগান সম্পর্কে কোন মত অবলম্বন বা সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য পুরো বাগানটাকে পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করতে হয়। ঐ বাগানের একটি গাছের ডাল বা পাতা বা ফল ও ফুলকে পুরো বাগান থেকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথকভাবে পর্যবেক্ষণ করলে চলেনা। তেমনিভাবে মুহাম্মাদ সা. এর জীবনী ও আদর্শরূপী বিশাল বাগানকে দেখুন এবং তার সামগ্রিক অবকাঠামোটা বুঝে নিন। তাহলে তার ভেতরকার প্রতিটি ডালপালা, প্রতিটি ফলফুল ও কুড়ি পাঁপড়িকেও আপনা আপনিই বুঝতে পারবেন। কোন মতবাদ, মতাদর্শ, আন্দোলন বা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে যদি কয়েকটা জিনিস আপনার রুচি এবং আপনার প্রিয় ঐতিহ্য ও রীতিনীতির বিরোধী হয়, তাহলে তার অর্থ এটা হতে পারেনা যে, ওখানে আর কোন ভাল জিনিস নেই, ঐ গোটা জিনিসটা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যানযোগ্য। আপনার রুচি বা পছন্দ-অপছন্দ কোন বিশ্বজোড়া বা ঐতিহাসিক মানদণ্ড নয়। এমনও হতে পারে, বরং হওয়ারই কথা যে, একটা বিশেষ মতাদর্শ, আন্দোলন বা একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব নিজের ভালো মন্দের মাপকাঠি নিজেই সাথে করে এনেছে এবং তার ভালমন্দের মানদণ্ড আপনার মানদণ্ড থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা। কাজেই সবার আগে যে জিনিসটা প্রয়োজন তা হলো, মানদণ্ড ও মাপকাঠিগুলোকে পাশাপাশি রেখে পরখ করতে হবে, এবং মানদণ্ড পরখের সাথে মূল তত্ত্ব এবং মতাদর্শের মান ও যাচাই বাছাই করতে হবে।
কুরআন, ইসলাম ও মুহাম্মাদ সা. সম্পর্কে খৃষ্টান জগত ও প্রাচ্যবিদগণ এ যাবত যে সাহিত্য তৈরী করেছেন, তা একাদিকে যেমন অজ্ঞতা ও ভুল বুঝাবুঝিতে পরিপূর্ণ, অপরদিকে তেমনি হঠকারীসুলভ একগুঁয়েমির বিষ তার শিরায় শিরায় সঞ্চালিত। এমনকি যারা উদার মনের পরিচয় দিয়ে সত্যের স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং আরো একধাপ অগ্রসর হয়ে কিছুটা প্রশংসামূলক ভাষাও ব্যবহার করেছেন, তারাও জায়গায় জায়গায় সুচতুর শব্দের আড়ালে এমন মিছরির ছুরি বসিয়ে দিয়েছেন যে, পাঠক ধোঁকাবাজির দক্ষতা দেখে স্তম্ভিত না হয়ে পারেনা। দু’চারটে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এমন অবশ্যই পাওয়া যায়, যাতে রাসুল সা. এর বাণী ও কীর্তির আন্তরিক স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে সব লেখক পাশ্চাত্যবাসীর কাছে খুব কমই কদর পেয়েছে। সাম্প্রতিককালে এ ধরনের একটি উৎকৃষ্টমানের বই প্রকাশিত হলে তাকে “মুসলিম সমর্থক” (Pro-Muhammaden) আখ্যায়িত করে পাশ্চাত্যবাসীর চোখে তার মর্যাদা খাটো করার চেষ্টা চলছে। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, মুসলিম দেশগুলোর সাথে আজকাল পাশ্চাত্যের কূটনৈতিক স্বার্থ জড়িত হওয়া উপলক্ষে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সন্তুষ্টির জন্য কত চেষ্টা তদবির যে করা হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। অথচ এ যাবতকাল রসুল সা.-এর যে অবিচারটা করা হয়েছে, তার প্রতিকারের কথা কোথাও ভেবে দেখা হয়নি।
আপনি আপনার বিবেকের রায়ের বিরুদ্ধে রসুল সা.-এর উপস্থাপিত মতাদর্শ ও জীবন ব্যবস্থাকে সমর্থন করুন-এ দাবী আপনার কাছে করা হচ্ছেনা। বিবেকের রায় না পেলে আপনি অবশ্যই দ্বিমত পোষণ করুন এবং দৃঢ়তার সাথেই করুন। যে জিনিসটা আপনার কাছে দাবী করা হচ্ছে, সেটা হলো, ইতিহাস ও জীবনী রচনার জন্য আপনার নিজেরই প্রণীত এবং সমর্থিত নীতিমালা ও মাপকাঠি লঙ্ঘন করে তথ্য বিকৃত করবেননা। এমন সূত্র থেকে বর্ণনা গ্রহন করবেন না, যা একদিকে মুসলমানদের দৃষ্টিতে সর্বসম্মতভাবে অবিশ্বাস্য ও অগ্রহণযোগ্য এবং যা ঐতিহাসিক গবেষণার সর্বস্বীকৃত মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়। আপনি একটি ঘটনার ভালো কার্যকারণগুলোকে বাদ দিয়ে তদস্থলে ইচ্ছাকৃতভাবে অবাঞ্ছিত কার্যকারণসমূহের উল্লেখ করবেননা। যুক্তি দিয়ে কথা বলুন, অসৎউদ্দেশ্য প্রণোদিত, অপমানজনক, অভদ্রোচিত, শ্লেষাত্মক ও বিদ্রুপাত্তক ভংগী অবলম্বন করবেন না।
এ আলোচনা দ্বারা আমাদের উদ্দেশ্য অপ্রীতিকর ভাবাবেগজনিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করা নয়, বরং এর উদ্দেশ্য হলো এ যাবত যে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি বিরাজ করছিল তার অবসান ঘটানো। এ উদ্দেশ্যের সফলতার পয়লা শর্ত হলো, পাশ্চাত্যকে ইসলাম কুরআন ও মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে আপন দৃষ্টিভঙ্গী স্পষ্ট করতে হবে এবং একটা নতুন গঠনমূলক মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যা কেবল পাশ্চাত্যবাসী ও মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান ঐক্যমত্যকে উপলব্ধি করা দ্বারাই সম্ভব। যে সব বিষয়ে আমাদের ঐক্যমত্য রয়েছে তা নিম্নরুপঃ
- খৃষ্টান, ইহুদী ও মুসলমান এ তিনটে জাতিই আল্লাহর ইবাদত করে এবং আখেরাতে বিশ্বাস করে। এদের সকলেরই ইবাদতের পদ্ধতিতে সাদৃশ্য রয়েছে এবং সবারই মৌলিক নৈতিক মূল্যবোধ সমান।
- এই তিনটে জাতিরই ধর্মীয় শিক্ষার উৎস ওহী এবং মুসলমানরা সকল নবী ও রসূলকে একই ধর্ম ও একই মহাসত্যের পতাকাবাহী বলে বিশ্বাস করে।
পক্ষান্তরে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে পাশ্চাত্যবাসী ও মুসলমানদের মধ্যে নিম্মলিখিত বিষয়ে ঐক্যমত্য রয়েছেঃ
- পাশ্চাত্য সভ্যতা জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির যে সব ব্যবস্থা করেছে, মুসলমানদের নির্ভেজাল ধর্মীয় দৃষ্টিভংগী সেই উন্নতির সমর্থক। ইসলামী মতাদর্শ স্বীয় সমাজ ও সভ্যতায় আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি এই বস্তুবাদকে (সীমিত পর্যায়ে) স্থান দিতে পারে, যদিও এ দিক দিয়ে পাশ্চাত্য উন্নতির উচ্চতম শিখরে আরোহণ করেছে। অন্যান্য ধর্ম যেখানে নিছক ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ, ইসলাম সেখানে একটা পূর্ণাংগ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হওয়ার কারণে অপেক্ষাকৃত উদার।
- গণতন্ত্রের যে সব মূলনীতির ভিত্তিতে পাশ্চাত্য সভ্যতা নিজেদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে গড়ে তুলেছে, মুসলমানদের চিন্তা চেতনায় তা আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। শুধু বিদ্যমান নয়, বরং ইসলামী সভ্যতাই সর্বপ্রথম সেগুলোকে পূর্ণাংগ রূপ দিয়েছে। [লেবান ও ব্রেফাল্ট অস্ফুট চিত্তে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, গনতন্ত্রের চেতনা ও প্রাণশক্তি মুসলমানদের কাছ থেকেই পাশ্চাত্যে পৌঁছেছে।] জনপ্রতিনিধিত্ব ও নির্বাচন, রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক বিষয়ে বিশেষ ও সাধারণ জনগনের সাথে পরামর্শ করা, আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার এবং এ সব বিষয়ে সকল নাগরিকের সমমর্যাদা ও সমানাধিকারকে মুসলমানরা পাশ্চাত্যের অনেক আগে বাস্তবায়িত করেছে। যদিও তা করেছে সমকালীন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখে। আন্তর্জাতিক উত্তেজনা ও অস্থিরতার নিরীখে বিবেচনা করলে এ সমস্যার সমাধানেও মুসলমানদের সহযোগিতাই পাশ্চাত্যের সংস্কারবাদীদের জন্য অধিকতর মূল্যবান। এর কারণ দুটো : প্রথমতঃ পাশ্চাত্য যদি আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে ভেবে দেখে, তাহলে দেখতে পাবে যে, বিশ্বশান্তির ব্যাপারে মুসলমানরা যতখানি সহযোগিতা করতে সক্ষম, ততখানি আর কেউ নয়। এ জাতির আকীদা বিশ্বাসে মানব প্রেমের শেকড় যত গভীরভাবে বদ্ধমূল এবং আন্তর্জাতিক ঐক্য ও সংহতির নৈতিক ভিত্তি এ জাতির মর্মমূলে যত দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত, ততটা আর কারো নয়। এ জাতির এই দুর্লভ ও অনন্য বৈশিষ্ট্যকে যদি পুরোপুরিভাবে কার্যে পরিণত হতে দেখা যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের অবসান ঘটানো সম্ভব। এক কথায় বলা যায়, ভবিষ্যতের বিশ্বরাষ্ট্র গড়ার জন্য মূল্যবোধ ও নৈতিকতার উপাদান কেবল ইসলামই পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করতে পারে।
দ্বিতীয়তঃ বস্তুবাদের দুই চরম রূপ পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র—উভয়ের প্রতিরোধ করা এবং একটা মধ্যমপন্থী ন্যায়বিচারমূলক পথে মানবজাতিকে নিয়ে আসার কাজে ইসলাম ও তার অনুসারীদের কাছ থেকেই অধিকতর কার্যকর ভূমিকা আশা করা যায়।
চিন্তা-ভাবনার জন্য এই সর্বসম্মত বিষয়গুলোকে উপস্থাপন করার পর আমরা এর আলোকে যে কথাটা বলতে চাই তা হলো, পাশ্চাত্যবাসী এখন মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে আপন দৃষ্টিভংগী বদলালে ক্ষতি কি? পাদ্রী ও ওরিয়েন্টালিস্টদের স্থাপিত বিদ্বেষের পর্দাকে ঠেলে ছিড়ে ফেলতে তাদের আপত্তি কোথায়? এ যাবত বস্তুবাদী মতবাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা ব্যাপকভাবে করা হয়েছে। এই পরীক্ষা নিরীক্ষাকে একইভাবে অব্যাহত রাখা সম্ভব নয় এবং এই বিজ্ঞ পাশ্চাত্য জনগোষ্ঠী এমন নতুন বংশধর জন্ম দিচ্ছেনা, যার আশায় বুক বেঁধে আরো কিছুদিন কাটিয়ে দেয়া যায়। অপরদিকে ইসলাম ছাড়া অন্য যে সব ধর্ম পৃথিবীতে রয়েছে, তার প্রত্যেকটিই এমন যে, ব্যক্তি জীবনের একটি ক্ষুদ্র অংশে গুটিশুটি হয়ে বসে থাকা পছন্দ করে। সেগুলো সামনে অগ্রসর হয়ে গোটা সভ্যতার লাগাম হাতে নিতে প্রস্তুত নয়। এক কথায় বলা যায়, মানবজাতি আদর্শগত দিক দিয়ে সমস্ত পুঁজি হারিয়ে একেবারেই দেউলে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটি মাত্র উৎস অবশিষ্ট রয়েছে, সেখান থেকে কিঞ্চিৎ আশার আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে। মনের দরজা বন্ধ করে দিয়ে সেই আলো থেকেও যদি বঞ্চিত হয়ে যাই, তাহলে মঙ্গল গ্রহ থেকে তো কোন পথের দিশা আসবেনা।
তাই এখনো সময় আছে যে, আমরা মুহাম্মদ সা. কে একজন ইতিহাস স্রষ্টা, আর্ত মানবতার ত্রাণকর্তা, একটি সভ্যতার দিশারী এবং একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসাবে মেনে নেই। তাঁর কাছ থেকে যে আলো আসে তার জন্য মনমগজের বাতায়ন খুলে দেই। তাঁকে বৈজ্ঞানিক পন্থায় বুঝবার চেষ্টা করি। ইসলামকে নিছক খৃস্টবাদের প্রতিদ্বন্দ্বী একটা ধর্ম হিসাবে গ্রহন করা আমাদের পক্ষে সমীচীন হবেনা, বরঞ্চ তাকে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং অনুরূপ অন্যান্য আদর্শবাদী আন্দোলনগুলোর ন্যায় একটা আন্দোলন এবং এমন একটা জীবন ব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে, যা গোটা সমাজ ও সভ্যতাকে নিজের আয়ত্বে ও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। আর মুহাম্মদ সা. কে এই আন্দোলনের নেতা ও এই সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে মেনে নিতে হবে এবং তাঁর এই কৃতিত্ব স্বীকার করে নিতে হবে যে, তিনি ইতিহাসের একটা অনন্য সাধারণ ও উজ্জ্বল যুগের উদ্বোধন করেছেন। তাঁর উপস্থাপিত আদর্শ ও মুলনীতিকে আমাদের এই হিসাবে বিবেচনা করতে হবে যে, তা একটা অত্যাধুনিক বিশ্বরাষ্ট্র পরিচালনায় কতটা সহায়ক ও অপরিহার্য। তাঁর তৈরি করা মানবতার নমুনাকে আমাদের উদ্দেশ্যে যাচাই করে দেখতে হবে যে, তা একটা আদর্শ ও নিখুঁত সভ্যতার হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি হওয়ার জন্য কতখানি মানানসই।
আজ যখন আমাদের সামনে ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজমান এবং দূর দুরান্তে কোথাও একটা স্ফুলিঙ্গ পর্যন্ত জ্বলতে দেখা যাচ্ছেনা, তখন পেছন ফিরে তাকিয়েই দেখি, রসুল সা. এর হাতে একটা মশাল জ্বলছে এবং তা বিগত চৌদ্দ শত বছর ধরে হাজারো ঝর ঝঞ্ঝায় একইভাবে জ্বলে আসছে। কেবল নিজের তৈরী করা বিভ্রান্তি ও বিদ্বেষের কারণে এ মশাল থেকে আলো গ্রহন করতে অস্বীকার করা ও চোখে পট্টি বেঁধে নেয়ার ফল কি ভালো হতে পারে? মানবজাতিকে ও মানবসভ্যতাকে এই ভয়াল অন্ধকারে ধ্বংস হয়ে যেতে দেয়া কি সমীচীন হবে? খুব ভালো করে বুঝে নেয়া দরকার যে, বিরাজমান পরিস্থিতি আমাদের সামনে কী সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে এবং আমাদের মধ্যে এ চ্যালেঞ্জের জবাব দেয়ার শক্তি আছে কিনা।
কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো, আসল অপরাধী স্বয়ং আমরাই। আমরাই রসুল সা. এর ব্যক্তিত্ব, বাণী ও কৃতিত্ব বিশ্ববাসীকেও জানতে দেইনি, নিজেরাও জানতে চেষ্টা করিনি। তাই আজ রসুল সা. কে নতুন করে পরিচিত করানোর প্রয়োজন। এ কাজতা সম্ভবত আনবিক শক্তি আবিস্কারের চেয়েও বড় ধরনের কীর্তি হবে।

এই গ্রন্থটি প্রসংগে দুটি কথা

রসুল সা. এর পবিত্র সীরাত বা জীবনীর ওপর উচ্চমানের গ্রন্থাবলী থাকা সত্ত্বেও আমি এই কঠিন কাজে নিজের অক্ষমতা সত্ত্বেও হাত দেয়ার সাহস করেছি শুধু এ জন্য যে, রসুল সা.-এর মহান সত্তা জীবনের উদ্দেশ্য উপলব্ধির একমাত্র উৎস হিসাবে আর একবার পরিচিতি লাভ করুক। রসুল সা.-এর জীবনী সম্বলিত শ্রেষ্ঠ গ্রন্থাবলীতে ঘটনা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যের সমাবেশ ঘটেছে। কিন্তু পাঠক কোথাও বর্ণনা সংক্রান্ত মতবিরোধে এবং কোথাও গভীর তাত্ত্বিক আলোচনায় আটকে যায়। কোথাও ঘটনাবলীর ধারাবাহিকতার যোগসূত্র তার কাছ থেকে ছিন্ন হয়ে যায়, কোথাও তার সামনে এমন সব খুঁটিনাটি তথ্য হাজির হয়, যার সুস্পষ্ট কোন তাৎপর্য ও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা সে পায়না। কোথাও তাত্ত্বিক ও গবেষণালব্ধ তথ্যাবলী এবং সূত্রের আধিক্য দেখে সে আঁতকে ওঠে। অথচ ভলিউম ভলিউম বই পড়েও সে নিজের সামনে একটা উচ্ছ্বসিত আন্দোলন দেখতে পায়না। রসুল সা. এর দাওয়াতের দরুন যে সংঘাতময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, তার দৃশ্য সে দেখতে পায়না। সে নিজেকে রসুল সা. এর যুগে দেখতে পায়না। সীরাতের পুস্তক পড়ে তার এরূপ অনুভূতি হয়না যে, সেও রসুল সা. এর পরিচালিত আন্দোলনের একটা উত্তাল তরংগ এবং তার চারপাশে বিরাজমান পরিবেশের নোংরামির বিরুদ্ধে লড়াই করার দায়িত্ব তার ওপরও অর্পিত। রসুল সা. এর নিয়ে আসা মহাসত্যের জ্বলন্ত মশালকে উঁচু করে রাখা এবং তার আলোকে এতটা বিকশিত করাও তার দায়িত্ব যে, সভ্যতা ও সংস্কৃতির জগতে ঐ মশাল যেন একটা প্রদীপ্ত সূর্যে পরিণত হয়। এই অভাবটা পূরণের লক্ষ্যেই এই সামান্য রচনার কাজে হাত দিয়েছি।
ইতিহাস অধ্যয়নের জন্য আমি কুরআনের দৃষ্টিভংগী অবলম্বন করেছি। আমার দৃষ্টিতে চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা পৃথিবী একটা চঞ্চল ও গতিশীল পৃথিবী। ওটা একটা বৈচিত্র্যময় ও পরিবর্তনশীল পৃথিবী। সর্বোপরি তা একটা প্রতিদন্দিতা, দ্বন্দ্ব সংঘাত, জেহাদ ও লড়াই-এর পৃথিবী। এখানে আকর্ষণ বিকর্ষণ দুইই আছে। এখানে ক্রিয়ার সাথে প্রতিক্রিয়া, ভাংগার সাথে গড়া এবং আলোর সাথে অন্ধকারও রয়েছে। এখানে রাত ও দিন পরস্পরকে ধাওয়া করছে। জীবন ও মৃত্যু, আগুন ও পানি, শীত ও বসন্ত পরস্পরের সাথে যুদ্ধরত। মোট কথা, এই পৃথিবীর যে কোণেই এবং যে জগতেই দৃষ্টি দেবেন, পরস্পর বিরোধী জিনিসগুলোকে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত দেখতে পাবেন। এই মহাবিশ্বের একটা নগণ্য ও ক্ষুদ্র জায়গায় (অর্থাৎ পৃথিবী নামক গ্রহে) মানব জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ রণক্ষেত্র অবস্থিত। আমাদের গোটা সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা একটা তরংগবিক্ষুব্ধ মহা সমুদ্র। এতে টেউ এর সাথে ঢেউ, বুদবুদের সাথে বুদবুদ ও বিন্দুর সাথে বিন্দু প্রতি মুহূর্তে টক্কর খাচ্ছে। এখানে হোক ও বাতিল, সত্য ও মিথ্যা, ন্যায় ও অন্যায়, ভালো ও মন্দ, যুলুম ও ইনসাফ, পাপ ও পুণ্যের মধ্যে প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এক দীর্ঘ লড়াই চলছে। এ লড়াই-এর বাগডোর রয়েছে রূহ তথা আত্মা এবং নফস তথা কুপ্রবৃত্তির হাতে নিবদ্ধ। এর এই দুই উৎস থেকে রকমারি চিন্তা, বিশ্বাস ও মতবাদ একের পর এক উসারিত হচ্ছে এবং বিচিত্র ধরনের চরিত্র ও পরস্পর বিরোধী স্বভাবের সামষ্টিক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটছে। প্রতিটি ধ্যান-ধারনা, আকিদা বিশ্বাস, মতবাদ মতাদর্শ, চরিত্র ও ব্যবস্থা তার ঠিক বিপরীতমুখী সহোদরকে সাথে নিয়ে ভুমিষ্ট হচ্ছে। যে শক্তিই জন্ম নিচ্ছে, সে তার বিরোধী ও বিপরীত শক্তিকে সংগে নিয়েই জন্ম নিচ্ছে। এই বিরোধ ও বৈপরিত্য থেকে এমন এক সর্বগ্রাসী সংঘাতের উদ্ভব ঘটছে, যা মানব জাতির গোটা ইতিহাসকে একটা সংগ্রামের ইতিহাসে পরিণত করেছে। এই সংগ্রামের ইতিহাস আজ আমাদেরই রক্তে লেখা ইতিহাস হিসাবে আমাদের সামনে বিদ্যমান।
মানব সভ্যতার ঊষাকাল থেকেই যুগে যুগে দেশে দেশে চলে আসছে সার্বক্ষনিক ও সর্বাত্মক লড়াই। সে লড়াই কোথাও চলছে যুক্তির অস্ত্র দিয়ে, আবার কোথাও মারণাস্ত্র দিয়ে। এ লড়াইতে মানুষ দুই পক্ষে বিভক্ত হয়ে দুটি ভূমিকা পালন করে আসছে। একদিকে সে অরাজকতা, অন্যায় ও অসত্যের পতাকাবাহী। অপরদিকে সে ন্যায়, সত্য, সততা ও কল্যাণের নিশানবরদার। কখনো সে নাশকতা ও বিকৃতির খলনায়কদের সক্রিয় তল্পিবাহক হয়ে যায়। আবার কখনো গঠনমূলক কাজের আহবায়ক ও উদ্যোক্তাদের জোরদার সমর্থক হয়ে এগিয়ে আসে। মানবজীবনকে দুঃখ দুর্দশা ও বিপদমুসিবতে জর্জরিত করার অপচেষ্টায় আদাপানি খেয়ে লেগে যায় এক ধরনের মানুষরূপী শয়তান। অপরদিকে পৃথিবীকে সুখ শান্তি ও আনন্দে ভরা জান্নাত হিসেবে ঘরে তোলার জন্য এক শ্রেণীর মানুষ নিজেদের সমস্ত সহায় সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দেয়। জীবন যুদ্ধের একদল মরণপণ সৈনিক এমনও হয়ে থাকে, যাদের হাতে মিথ্যা, যুলুম ও অনাচারের সয়লাব বয়ে যায়। আবার এক শ্রেণীর আপোষহীন মুজাহিদ সত্য, ন্যায় ও ইনসাফের বিজয় ডংকা বাজিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় হয়ে যায়।
সত্য, ন্যায় ও ইনসাফের এই লড়াকু সৈনিকরাই পৃথিবীকে কিছুটা বাসযোগ্য ও মানব জীবনকে খানিকটা উপভোগ্য বানিয়েছে। সমাজে আজ যে ক’টি জিনিষ কিছুটা সমাদর পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হচ্ছে, তা ঐ সব মহৎ ব্যক্তিরই অবদান। তারা মানুষের সামনে আদর্শ জীবন পেশ করেছে। তাঁরা আমাদের সামনে স্থাপন করেছে সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটা মানদণ্ড ও মডেল। তাঁরা আমাদেরকে উপহার দিয়েছে জীবনের সুমহান লক্ষ্য ও চমৎকার নীতিমালা। ইতিহাসের শিরায় শিরায় তারা চিরঞ্জীব ও শাশ্বত ঐতিহ্যের রক্ত সঞ্চালিত করেছে। সভ্যতার আকাশে স্থাপন করেছে নৈতিক মূল্যবোধের জ্বলজ্বল নক্ষত্ররাজি। তারা মানুষকে দিয়েছে উৎসাহ, উদ্দীপনা, সাহস ও উচ্চাভিলাষ। উদ্দেশ্য ও নীতির জন্য তারা দিয়েছে ত্যাগ, কুরবানি ও সংগ্রামের শিক্ষা। এসব মহৎ ব্যাক্তির গৌরবোজ্জল কীর্তি ও অবদানের জন্যই ইতিহাস এত মুল্যবান হয়েছে যে, তার নিদর্শনাবলী সংরক্ষণের যোগ্য বিবেচিত হয়ে থাকে এবং তা কেয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য নিত্য নতুন কর্মপ্রেরণার উৎসরূপে সমাদৃত হতে থাকবে।
তাছাড়া যখনই যুলুমবাজ ও মিথ্যাচারী অপশক্তি ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারী শাসনের অক্টোপাস বন্ধনে মানুষকে বেঁধে অসহায় করে ফেলেছে এবং মানুষ হিম্মত হারিয়ে হতাশার গভীর খাদে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তখন ইতিহাসের এই মহানায়কগণই মানব জাতির ত্রানকর্তা হয়ে এগিয়ে এসেছে। তারা ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়েছে, পতিত মানুষকে টেনে তুলেছে, কাপুরুষদেরকে বীরত্বের সঞ্জীবনী সুধা পান করিয়েছে, এবং অস্ত্র সমর্পনকারীদেরকে নতুন করে রণাঙ্গণের সামনের কাতারে দাঁড় করিয়ে নৈরাজ্যবাদী ও দুর্নীতিবাজ অপশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত করেছে। অন্য কথায় বলা যায়, এই মহানায়কগণ ইতিহাসের অচলাবস্থার অবসান ঘটিয়েছে, সভ্যতার হীমায়িত সমুদ্রের বরফ গলিয়ে দিয়েছে, চিন্তা ও কর্মের স্থবির নদীতে নতুন প্রবাহের সৃষ্টি করেছে এবং ইস্পাত কঠিন স্বৈরতন্ত্রকে উৎখাত করে মানুষের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার পুনর্বহাল করেছে, এভাবে বিশ্বমানবের কাফেলা আত্মবিকাশের সরল ও সঠিক পথ ধরে নির্বিঘ্নে এগিয়ে গেছে।
মানব সমাজের যে পূণ্যবান শ্রেণীটি পৃথিবীতে সত্য ন্যায় ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা এবং গঠন ও উন্নয়নের মহৎ কাজে অংশ নিয়েছে, তার প্রথম কাতারেই রয়েছে অনন্য মর্যাদার অধিকারী নবী ও রাসুলগন। এ ছাড়া সিদ্দিকীন (ইসলামের দাওয়াত পাওয়া মাত্রই যারা তা সর্বাস্তকরণে গ্রহণ করে), শহীদগণ ও সালেহীন তথা সৎ লোকগণ এই প্রথম কাতারের কৃতিত্বেরই অনুগামী এবং তাদেরই নেতৃত্বে কর্মরত। আর নবী ও রাসূলগণের পবিত্র কাতারটিতে যে মহান ব্যাক্তির ওপর সর্বাগ্রে অবারিত দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়, তিনি হচ্ছেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ইনি হচ্ছেন ইতিহাসের মানবতার সবচেয়ে বড় বন্ধু ও সবচেয়ে বড় উপকারী মহামানব। এই মহামানবকে যেদিক দিয়েই পর্যবেক্ষণ করুন, তাঁর রকমারি শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ব উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেবে। এই মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা দিতে দিতে বিগত চৌদ্দ শতাব্দীতে কত মানুষ যে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে, তাঁর ইয়াত্তা নেই। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আজও পর্যন্ত তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের বিবরণ পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়নি। ভবিষ্যতে কে এই কাজকে পূর্ণতা দান করতে পারবে কেউ জানেনা। এই মহৎ কাজে শুধুমাত্র অংশগ্রহণের দুর্নিবার আকাংখা অতীতের লোকেরাও পোষণ করে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও অনেকে পোষণ করবে। এই দুর্নিবার আকাংখা এক সময় আমাকেও পেয়ে বসলো। মন চাইলো রসুল সা. আর জীবনের এই দিকটা বিশেষভাবে সংক্ষেপে তুলে ধরি যে, তিনি মানবতার কল্যাণ সাধন ও পুনর্গঠনের জন্য যখন ময়দানে নামলেন তখন তাকে কি ধরনের অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হতে হলো, মানবতার এক অতুলনীয় সেবকের সেবার প্রতিদান কিভাবে সারা জীবন অন্ধ বিরোধিতা ও অত্যন্ত নিকৃষ্টমানের অসদাচরণ দ্বারা দেয়া হলো। আর অপরদিকে এত যুলুম নির্যাতন, বিরোধিতা ও অসদাচরণের তান্ডবের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হবার সময় রসুল সা. কী ধরনের চরিত্রের পরিচয় দিয়ে যেতে লাগলেন। প্রিয় নবীর এই মর্মন্তুদ জীবন কাহিনীতে সৎ লোকের শাসন প্রতিষ্ঠাকামীদের জন্যও শিক্ষণীয় রয়েছে এবং সৎ লোকের শাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম প্রতিরোধকারীদের জন্যও শিক্ষণীয় রয়েছে।
মানব ইতিহাসের এই হলো মুহাম্মদ সা. এর স্থান। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, তিনি সবচেয়ে বড় ইতিহাস স্রষ্টা ছিলেন।
মানব কল্যাণের এই সর্ববৃহৎ কাজ করার জন্য যখন রসুল সা. আবির্ভূত হলেন, তখন সকল নবী ও রসূলের ওপর বিভিন্ন যুগে যে নির্যাতন চালানো হয়েছিল, সেই সমস্ত অত্যাচার নির্যাতনকে শয়তান একত্রিত করলো এবং এই এতিম ও অসহায় যুবককে চতুর্মূখী লড়াই চালাতে বাধ্য করলো। রসূল সা. এর জীবন কাহিনীর দৃশ্য অনেকটা এ রকম, যেন ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে নৌকা বিহীন এক সাতারু পর্বত প্রমাণ ঢেউ এর সাথে ক্রমাগত লড়াই করে চলছে। সেখানে প্রচন্ড ঝড় বয়ে চলেছে এবং ঘোর কালো মেঘে আচ্ছন্ন আকাশে থেকে থেকে বিদ্যুতের চমকে চোখ ঝলসে যাচ্ছে। মেঘের গর্জনে কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। এর মধ্যে দিয়েও আপোষহীন সাঁতারু নিজের পথ ধরে ক্রমাগত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। এমন মর্মান্তিক অত্যাচার ও নির্যাতন এবং এমন আপোষহীন অদম্য সংগ্রামের উদাহরণ ইতিহাসে আর কোথাও আছে কি?
হক ও বাতিলের এবং ন্যায় ও অন্যায়ের লড়াই এর নাটক যখনই মঞ্চস্থ হয়, তাঁর মৌলিক চরিত্র সব সময় একই থাকে। সময় বদলে যায়, ভৌগলিক পরিবেশ পাল্টে যায়, এবং নায়কদের নামও পরিবর্তিত হয়ে যায়। কিন্তু তাদের নির্দিষ্ট ভূমিকা কখনো পাল্টে না। একটি ভূমিকা হয়ে থাকে দাওয়াত দাতার চরিত্র।
দ্বিতীয় চরিত্রের নায়ক থাকে সমাজের সেই নিখাদ নিষ্ঠাবান ও নিষ্কলুষ মানুষগুলো, যারা সত্য, ন্যায় ও সদাচারের আহবান শোনা মাত্রই সে আহবানকে নিজেদের সহজাত অভিরুচি দিয়েই চিনতে পারে। সে আহবানে তারা পুলকিত ও মুগ্ধ হয়, নির্দ্বিধায় ও সর্বান্তকরণে তা গ্রহন করে এবং ঐ আহবানের প্রথম অনুসারীর ভূমিকা অবলম্বন করে।
তৃতীয় ভূমিকা গ্রহন করে তারা যারা ভদ্রতার সাথে দ্বিমত পোষণ করে। তারা কথা শোনে, ও তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। কিন্তু জ্ঞান ও চেতনার অভাব এবং কিছু মনস্তাত্মিক বাধার কারণে সত্যকে বুঝতে দেরি করে ফেলে।
চতুর্থ চরিত্রের নায়ক হয়ে থাকে অত্যন্ত কট্টর ও সোচ্চার দুশমনদের গোষ্ঠী, যারা নিজেদের স্বার্থ, পদমর্যাদা ও বিকৃত আদত অভ্যাসের কারণে প্রথম দিন থেকেই চরম হঠকারী পন্থায় বিরোধিতা শুরু করে দেয়। তাদের এই বিরোধিতা উত্তরোত্তর কেবল বাড়তেই থেকে। পঞ্চম ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে দুর্বল জনসাধারণ, যারা সমাজের উচ্চতর শ্রেণীর দোর্দন্ড প্রতাপের কাছে এত অসহায় থাকে যে কোন সাহসী ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেনা। আবার মানসিকভাবেও কোন দাওয়াতের গভীরতম মর্ম উপলব্ধি করার যোগ্যতা রাখেনা। তাই তারা সাধারণত যুগ যুগ ধরে সত্যের আহবায়ক ও সত্যের শত্রুদের দ্বন্দ্ব সংঘাতে নীরব দর্শক হয়ে থাকে এবং কোন পক্ষের কী পরিণতি হয় তার অপেক্ষায় থাকে। যখন কোন এক পক্ষের জয় হয়, তখন জনতার এই প্লাবন বিজয়ী শক্তির পক্ষেই প্রবাহিত হয়। সুতরাং হোক ও বাতিলের যুদ্ধের নাটকটি দুটো চরিত্রের অভিনেতাদের ওপরই নির্ভরশীল অর্থাৎ সত্যের আহবায়ক ও তার অনুসারীদের ভূমিকা, এবং সক্রিয় ও কট্টর বিরোধীদের ভূমিকা। সত্যের দাওয়াতের নাটক মঞ্চস্থ হবে অথচ এই দুটো চরিত্রের অভিনেতারা পরস্পরের মুখোমুখি হবেনা- এটা একেবারেই অসম্ভব। আপনি সত্য ও ন্যায়ের আওয়ায তুলবেন, এর তার জবাবে অসত্য ও অন্যায়ের পক্ষাবলম্বনকারী শক্তিগুলো সমবেতভাবে রুখে দাঁড়াবেনা-এটা হতেই পারেনা। আপনি মানবতার কল্যাণ ও সেবার জন্য কাজ শুরু করবেন, আর গালিগালাজ, অপবাদ, অপপ্রচার, কুৎসা, ষড়যন্ত্র ও হিংস্রতার ভয়ংকর হাতিয়ারগুলো নিয়ে সমাজের সমস্ত অপশক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে আপনার দিকে মারমুখী হয়ে ছুটে আসবেনা – এটা অকল্পনীয়।
রসূল স.-এর বেলায়ও এটাই ঘটেছে। তিনি যদি কেবল কিছু ভালো ভালো কথা বলতেন, জনকল্যাণের বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন, নিজের পছন্দ অনুযায়ী নির্দিষ্ট পন্থায় রুকু সিজদা ইত্যাদি করে আল্লাহর ইবাদত করেই জীবন কাটাতেন, নির্জনে নিভৃতে বসে যিকির তাসবীহ করতে থাকতেন, এমনকি ভালো ভালো ওয়ায নসিহতও যদি করতে থাকতেন, পীর-মুরীদীর একটা ফের্কাও গড়ে তুলতেন, এবং নিজের অনুসারীদের নিয়ে একটা অক্ষতিকর সংঘ ইতায়দি গঠন করেও ফেলতেন, তবে সমাজ তা বরদাশত করতো। কিন্তু তিনি তো সমগ্র জীবন ব্যবস্থাই পাল্টে ফেলতে চাইছিলেন। সমাজ ও সভ্যতার গোটা ভবন নতুন করে নির্মাণ করতে চাইছিলেন। গোটা সামষ্টিক ব্যবস্থাকে ধসিয়ে দিয়ে তাকে সর্বোত্তম নকশা অনুযায়ী নতুন করে নির্মাণ করতে তিনি আদিষ্ট ছিলেন। কায়েমী স্বার্থ ও অধিকারের মধ্যে যে অন্যায় অথচ অটুট সমঝোতা তৎকালীন সমাজে গড়ে তোলা হয়েছিল, তাকে তছনছ করে দিতে উদ্যত ছিলেন। তিনি মানুষকে একটি নতুন বিশ্বাসগত ও নৈতিক কাঠামো অনুযায়ী গড়ে তোলার জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। প্রথম দিন থেকেই তিনি এই কাজেরই দাওয়াত দেন এবং জনগণ তাঁর দাওয়াতের অর্থ বুঝেছিল প্রথম দিন থেকেই। এর এই অর্থ বুঝিছিল বলেই এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া স্বরূপ দেখা দিয়েছিল জাহেলী সমাজের পাল্টা কর্মকান্ড।
সত্য ও ন্যায়ের সর্বব্যাপী আন্দোলনের বিরোধীদের পর্যালোচনা যে কোন যুগেই করা হোক, দেখা যাবে যে, তাদের নেতিবাচক কর্মকান্ডের কৌশল ও ধারাবাহিকতা সব সময় একই রকম ছিল। সর্বপ্রথম মামুলী ধরনের ঠাট্টা বিদ্রূপ করা হতো। এরপর পরবর্তী পর্যায়ে গালিগালাজ, মিথ্যা অপবাদ আরোপ, কুৎসা অপপ্রচার, এবং কলংকজনক উপাধি প্রদানের তান্ডব সৃষ্টি করা হতো। তারপর জনগনের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টির জন্য সুনির্দিষ্ট মিথ্যা প্রচারণা শুরু করা হতো। ব্যাপারটা যখন আরো বেড়ে যেত, তখন একদিকে জাতীয় স্বার্থ ও সংহতি বিপন্ন হবার দোহাই দেয়া হতো, আর অপর দিকে ধর্মীয় অজুহাতে অজ্ঞ জনসাধারণের মধ্যে উস্কানি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হতো। এরই ফাঁকে ফাঁকে যুক্তিতর্কের লড়াইও চলতো এবং প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে দাওয়াত দাতাকে নাজেহাল করার অভিযানও চলতো। যখন বুঝা গেল যে, একটা বিপজ্জনক আন্দোলন ক্রমেই জোরদার হচ্ছে, তখন প্রলোভন দ্বারা রফা করার চেষ্টা চালানো হলো। সমস্ত ফন্দি ফিকির ব্যর্থ হতে দেখে হিংস্রতার অত্যন্ত ঘৃণা পন্থা অবলম্বন করা হলো। রসুল সা. ও তাঁর সহযোগীদেরকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করা হলো। জুলুম ও নির্যাতনের চক্রান্তও কার্যকর করা হলো। এমনকি শেষ পর্যন্ত রসুল সা. –কে হত্যার ষড়যন্ত্রও করা হলো। এরপরও সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে না পারায় যুদ্ধ ঘোষণা করে সম্মুখ সমরের আহবান জানানো হলো। রসুল সা.–এর জীবনে এই পর্যায়গুলোর সবই একে একে এসেছিল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁকে প্রত্যেক পর্যায়েই গৌরবজনকভাবে সাফল্যমন্ডিত করেন। অবশেষে সমগ্র আরব রসুল সা.–এর পদতলে এসে যায়।
এ গ্রন্থে রসুল সা.-এর জীবনের ঘটনাবলীকে অত্যন্ত বিশ্বস্ত সুত্রে এবং যথাযথ ধারাবাহিকতা সহকারে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, ইতিহাসের স্থবিরতা ভংগ করে সত্য ও অসত্যের এবং কল্যাণ ও অকল্যাণের যে ভয়াবহ লড়াই রসুল সা. সংঘটিত করেন, তার দৃশ্য চোখের সামনে স্পষ্টভাবে ভেসে ওঠে। এ লড়াইতে তাঁর গোটা জীবন অতিবাহিত হয়ে যায়। আশা করি এ পুস্তক পড়ার সময় পাঠক নিজেকে রসুল সা.–এর খুবই নিকটে আছেন বলে অনুভব করবেন। ঘটনা প্রবাহকে নিজের চোখের সামনেই সংঘটিত দেখতে পাবেন এবং ইসলামী আন্দোলনের উত্তাল তরংগমালাকে নিজের কল্পনার জগতে নৃত্য করতে দেখতে পাবেন। ফলে হক ও বাতিলের এই সংঘাতের নির্বিকার ও নিরপেক্ষ দর্শক হয়ে বসে থাকতে পারবেন না। বরং তার মধ্যে ইতিবাচক চেতনার উন্মেষ ঘটবে এবং তিনি মানবেতিহাসে নিজের অবস্থান বর্তমানে কী এবং কী হওয়া উচিত, সে কথা ভেবে দেখতে বাধ্য হবেন।
আমার দৃঢ় প্রত্যাশা, এ পুস্তক থেকে সাহসিকতা ও বীরত্বের শিক্ষা অর্জন করা যাবে এবং কঠিনতম পরিস্থিতিতেও দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের প্রেরণা সঞ্চারিত হবে। অন্তরের সেই মহান ব্যক্তির প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা জন্ম নেবে, যিনি মানবতার সবচেয়ে বড় সেবক ছিলেন, এবং যিনি মানবতার সবচেয়ে বেশি উপকার সাধন করেছেন। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার অনুভুতিতে হৃদয় আপ্লুত হবে এবং তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসায় মন ভরে ওঠবে। ইসলাম এই জিনিসটাই কামনা করে। এ পুস্তক পড়ে বুঝা যাবে, আজ সত্যের যে আলোতে আমাদের অন্তরাত্মা উদ্ভাসিত, এই আলোর বাহক যিনি ছিলেন, তিনি কত কঠিন অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, কত মারাত্মক বিরোধিতার মোকাবিলা করে, কী কী ধরনের আক্রমন প্রতিহত করে এবং রক্ত ও অশ্রুর কত বড় বড় সাগর পাড়ি দিয়ে তা আমাদের কাছে পৌছাতে পেরেছেন। এ থেকে এই উপলব্ধিও আসবে যে, সত্য ও ন্যায়ের পতাকাবাহীদের পথ ও অত্যধিক কন্টকাকীর্ণ। এ পথ যখন মুহাম্মদ সা.-এর ন্যায় পুণ্যময় ব্যক্তিত্বের জন্যও কন্টকমুক্ত হয়ে কুসুমাস্তীর্ণ হয়নি, তখন তা আর কার জন্য কুসুমাস্তীর্ণ হবে? এমন আরামদায়ক সংক্ষিপ্ত পথ আর কার জন্য তৈরি হবে যে, মানুষ তার নিরাপদ কক্ষ থেকে বেরিয়ে পায়ে ধুলোও না লাগিয়ে সোজা বেহেস্তে চলে যেতে পারবে? রসুল সা. এর জীবনেতিহাসের মর্মন্তুদ কাহিনীগুলো পড়লে সেই ভুল বুঝাবুঝি দূর হয়ে যায়। নতুবা মানুষ আল্লাহর আনুগত্যকে পরম আয়েশী কাজ মনে করে নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকে। রসুল সা. এর জীবন কাহিনীর আলোকে আমাদের ভাবতে হবে যে, কুরআন হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থাবলীতে যে সব অগ্নিপরীক্ষা, বিপদ মুসিবত, বাধাবিপত্তি আঘাত ও আক্রমন একজন সত্যিকার মুমিনের জীবনে অনিবার্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা যদি আমাদের জীবনে না আসে, তা হলে আমাদের চলার পথ, এবং গন্তব্য সঠিক আছে কিনা তা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে, আমরা যাকে ইসলামের পথ মনে করছি, তা কুফর ও জাহেলিয়াতের পথ নয় তো? এ পুস্তক অধ্যয়ন করে প্রত্যেক মুসলমান আগে থেকে জানতে পারবে যে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে কোন ব্যক্তি বা দল অবিকল রসুল সা. এর দাওয়াত ও আন্দোলন নিয়ে ময়দানে নামবে এবং হুবহু রসুল সা. এর অনুসৃত কর্মপদ্ধতি অনুসরন করবে। তখন তার বিরুদ্ধে ঠাট্টা-বিদ্রূপ, অপবাদ, অপপ্রচার, কুৎসা, ষড়যন্ত্র ও যুলুম নির্যাতন হিংসাত্মক আক্রমন ইত্যাদি না হয়েই পারেনা। কেননা এগুলো এ কাজের অনিবার্য পার্থিব প্রতিদান। এ সব দুর্যোগ ও বিপদ মুসিবতের পরিপূর্ণ পরিবেশে যে কোন যুগে কর্মরত সত্যের আহ্‌বায়ককে চেনা, তার কথাকে বুঝা এবং তা মেনে নেয়া সহজ কাজ নয়। এটা কেবল সেই সব ভাগ্যবান ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব, যারা কুরআন হাদীস ও রসূলের সীরাত অধ্যয়ন করে হক ও বাতিলের চিরন্তন লড়াই এর সঠিক ধারণা আগে ভাগেই লাভ করেছে। প্রত্যেক মুসলমানের জানা উচিত, যে বাতিল শক্তি রসূল সা.-এর ন্যায় নিষ্কলুষ ও নিষ্পাপ সত্তাকে ক্ষমা করেনি, এবং যারা পরবর্তীকালে রসূল সা.-এর অনুসারী ইমাম হোসাইন, ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল, ইমাম আবু হানিফা, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী ও শাহ ওয়ালউল্লাহর ন্যায় মহান ব্যক্তিবর্গকেও অত্যাচার নির্যাতন থেকে রেহাই দেয়নি, তারা অন্য কাউকেও ছেড়ে দেবেনা। রসূল সা.-এর সীরাত অধ্যয়ন আমাদেরকে প্রত্যেক যুগে সত্যের আহ্‌বায়ক ও সত্যের শত্রুদের চরিত্রের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায়। ইসলাম ও কুফরের সংঘাতে যারা সক্রিয় থাকে, তাদের পরিচয় আমি এ পুস্তকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছি।
আমি আশা করি, রিসালাতের প্রতি ঈমান ও আমাদের বাস্তব জীবনে যে ভয়ংকর বৈপরিত্য ও স্ববিরোধিতার সৃষ্টি হয়ে গেছে, এই পুস্তক অধ্যয়নে আমরা সে সম্পর্কে সচেতন হতে পারবো। পৃথিবীতে আজ কোন একটা দেশও এমন অবশিষ্ট নেই, যেখানে রসূল সা. এর আনীত জীবন বিধান পুরোপুরি বিজয়ী ও কার্যকর। মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের জয়জয়কার, যা একাধারে প্রাচীন ও আধুনিক জাহেলিয়াতের অন্ধকারে আমাদেরকে ডুবিয়ে রেখেছে। মানসিকভাবে আমরা আপাদমস্তক জাহেলিয়াতে নিমগ্ন। অর্থনৈতিকভাবেও আমরা পর্যুদস্ত। সাংস্কৃতিকভাবেও আমরা সারা বিশ্বে ভিখারীর জাতি হিসেবে পরিচিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণের শিকার। আমাদের ঈমানের সাথে আমাদের চরিত্রের বৈসাদৃশ্যের এই বিষময় পরিণামই আমরা ভোগ করে চলেছি।
এ গ্রন্থে আমি মূলত বিশ্বনবীর দাওয়াত পুণরুজ্জীবনের আহ্‌বান জানিয়েছি। হুবহু রসূল সা. প্রদর্শিত কর্মপন্থা অনুসারে আমরা যাতে আমাদের জীবনে পরিবর্তন সূচিত করতে পারি, এবং বিশ্ব মানবতার এই মহান নেতা কোরআন ও হাদীসের নীতিমালার আলোকে যে মহানুভবতা ও সুবিচারপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন, সেই সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারি, সেটাই আমার মূল উদ্দেশ্য। আজ সেই সময় সমাগত, যখন আমাদের ও আমাদের তরুণ সমাজের পাশ্চাত্য সভ্যতার মানসিক গোলামীর বোঝা মাথার ওপর থেকে ঝেড়ে ফেলা উচিত এবং এই বস্তুবাদী যুগের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক বিদ্রোহের পতাকা উড়িয়ে দেয়া উচিত। মুহাম্মদ সা.-এর জীবনীকে পুস্তকের পাতা থেকে বের করে নতুন করে বাস্তব জীবনের পাতায় লিখে দিতে হবে। তাঁর আদর্শকে একটা সমষ্টিক ব্যবস্থার আকারে সংকলিত করতে হবে এবং মুক্তির পথ প্রদর্শনকারী সেই তৃতীয় শক্তির অবস্থানে নিয়ে আসতে হবে, যার স্থান ইতিহাসে এখনো শূণ্য রয়েছে।
দয়াময় আল্লাহ আমার এ নগণ্য চেষ্টা কবুল করুন এবং এর মহৎ উদ্দেশ্য সফল করুন।
আমীন।
নঈম সিদ্দীকী, ১লা ডিসেম্বর, ১৯৫৯।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি