পূর্বকথা
ইসলাম মূলগতভাবে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্র-ব্যবস্থা।এই রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে বাস্তবে রূপদান করার সুমহান দায়িত্ব পালন করিয়াছেন খোদ ইসলামেরই মহানবী হযরত মুহাম্মাদ(স)। নবুয়্যতের সুদীর্ঘ তেইশ বৎসরে মানুষের সামষ্টিক জীবন সম্পর্কে যেসব আইন-কানুন ও বিধি-ব্যবস্থা অবতীর্ণ হইয়াছে, উহার সবকিছুকেই তিনি বাস্তবায়িত করিয়াছেন পুরাদস্তুর একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আওতায়। শাসন-প্রশাসন, আইন প্রনয়ন, সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা, বিচার কার্য সম্পাদন,রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা বিধান ইত্যাকার প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কাজই তিনি সম্পাদন করিয়াছেন সেই একই আইন-কানুন ও বিধি-ব্যবস্থার আলোকে। এইভাবে ইসলামি রাষ্ট্র-ব্যবস্থার একটি স্থায়ী বুনিয়াদ তিনি স্থাপন করিয়া গিয়াছেন নবুয়্যতের তেইশ বৎসরেই।

মহানবী(স)-র তিরোধানের পর সেই স্থায়ী বুনিয়াদের উপরই গড়িয়া উঠিয়াছে ইসলামের আদর্শ রাষ্ট্র- ব্যবস্থা­- খিলাফতে রাশেদা। হযরত আবূ বকর,হযরত উমর, হযরত উসমান,হযরত আলী(রা)- মহানবী(স)-র এই চার ঘনিষ্ঠ সহচর পরম যত্নে ও মমতায় বিন্যস্ত ও বিকশিত করিয়া তুলিয়াছেন নবুয়্যতি ধারার এই রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে। শুধু তাহাই নহে,ইহার পরিধিকে তাঁহারা সম্প্রসারিত করিয়াছেন আরব উপদ্বীপের সীমানা অতিক্রম করিয়া গোটা ইরান ও রোমান সাম্রাজ্যর বিশাল অঞ্চল জুড়িয়া। বস্তুতঃ মানব জাতির ইতিহাসে একমাত্র এই রাষ্ট্র-ব্যবস্থাই যে স্বর্ণোজ্জল অধ্যায় রচনা করিতে পারিয়াছে, তাহা অকাট্যরুপে প্রমাণিত হইয়াছে। আধুনিক রাষ্ট্র-বিজ্ঞানীরা যত চমকপ্রদ তন্ত্রমন্ত্রই উদ্ভাবন করিয়া থাকুন না কেন, মানবতার কল্যাণ সাধনে নবুয়্যতী ধারার এই খিলাফতের ন্যায় বিপুল সাফল্য কোন পদ্ধতিই আর অর্জন করিতে পারে নাই, ইহা এক ঐতিহাসিক সত্য।

দুর্ভাগ্যবশতঃনবুয়্যতী ধারার এই খিলাফত দুনিয়ার বুকে টিকিয়া ছিল মাত্র তিরিশ বৎসর। ইহার পরই রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের অভিশাপ নামিয়া আসিয়াছে গোটা মুসলিম জাতির উপর। জাহিলিয়াতের অন্ধকার যবনিকা ঢাকিয়া দিয়াছে তাহাদের সোনালি ভবিষ্যৎকে। বর্তমানে উহারই জের চলিতেছে মুসলিম জাহানের দেশে দেশে। তদুপরি সাম্প্রতিককালে ইহার সহিত যুক্ত হইয়াছে পশ্চিমের ইহুদী-খৃস্টানদের উদ্ভাবিত গনতন্ত্র নামক একটি নব্য জাহিলিয়াত। ইহার বিষময় পরিণতি গোটা মুসলিম জাহানকে আজ নিক্ষেপ করিয়াছে রাজনৈতিক সংকটের ঘূর্ণাবর্তে। আধুনিক কালের তন্ত্রমন্ত্রগুলি তাহাদের কোন সমস্যার সমাধান করা তো দূরের কথা, বরং নূতন নূতন সমস্যার জন্ম দিয়া গোটা মুসলিম সমাজকে ব্যাধিগ্রস্ত করিয়া তুলিতেছে।

এই পরিস্থিতিতে আজ মুসলিম সমাজে ইসলামের আদর্শ রাষ্ট্র-ব্যবস্থা-খিলাফতে রাশেদা সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনার প্রয়োজন অত্যন্ত তিব্রতর হইয়া উঠিয়াছে। মুসলমানদের সকল রাজনৈতিক ব্যাধির একমাত্র নিরাময় যে নবুয়্যতী ধারার খিলাফত, অন্ন কোন তন্ত্রমন্ত্র নয়- এ সত্যটি আজ মুসলিম সমাজের নিকট উদ্ভাসিত করিয়া তোলা একান্ত প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে। মহান ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক হযরত মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম(রহ) এই প্রয়োজনের তাগিদেই “খিলাফতে রাশেদা” নামক বর্তমান গ্রন্থটি রচনা করিয়াছেন। এই গ্রন্থে তিনি গতানুগতিক ধারায় ইসলামের চারি খলিফার জীবন-বৃতান্তের উপর খুব বেশি আলোকপাত করেন নাই, বরং তাঁহাদের শাসন-প্রশাসনের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ও অনুকরণীয় দিকগুলিই যথাসম্ভব বিস্তৃতরুপে তুলিয়া ধরার প্রয়াস পাইয়াছেন। এই দিক দিয়া বাংলাভাষার খিলাফতে রাশেদা সম্পর্কে ইহা একখানি অভিনব গ্রন্থ।

১৯৭৫ সন হইতে ১৯৮০ সন পর্যন্ত গ্রন্থটির দুইটি সংস্করন প্রকাশিত হওয়ার পর গ্রন্থকার নিজেই ইহার নানা অংশ ব্যাপকভাবে পরিমার্জন করিয়াছেন। বর্তমান সংস্করণে মুদ্রণ প্রমাদ্গুলির সংশোধন ছাড়াও ইহাতে অনেক প্রাসঙ্গিক তথ্য সংযোজিত হইয়াছে। ইহাতে গ্রন্থটির সৌকর্য আরো বৃদ্ধি পাইয়াছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস,গ্রন্থটির বর্তমান সংস্করণ বাংলাভাষী পাঠকদের নিকট অধিকতর সমাদৃত হইবে এবং এদেশের দিকভ্রষ্ট জনগণকে সঠিক পথ-নির্দেশ করিতে বিপুল অবদান রাখিবে।

মহান আল্লাহ গ্রন্থকারের এই দ্বীনী খেদমত কবুল করুন এবং ইহার বিনিময়ে তাঁহাকে জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান দিন, ইহাই আমাদের সানুনয় প্রার্থনা।

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

চেয়ারম্যান

মওলানা আবদুর রহীম ফাউন্ডেশন

ঢাকা জুলাই,১৯৯৫

শুরু কথা
ইসলামের পুর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যাপক অধ্যয়ন,চিন্তা-গবেষণা-পর্যালোচনা ও গ্রন্থ প্রণয়ন পর্যায়ে উহার বাস্তব রুপ দানের কাজে আত্মনিয়োগ করার প্রেরনা স্বাভাবিকভাবেই আমার মনে জাগিয়া উঠিয়াছিল।বিশেষতঃ রাসূলে কারীম(স) আল্লাহ্‌ তায়ালার সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসাবে যে আদর্শিক বিধান উপস্থাপন করিয়াছিলেন তাহা নিছক একটি আদর্শবাদেরই ব্যাপার ছিল না বরং তাহা ছিল পূর্ণ মাত্রায় একটি বাস্তব জীবন-ব্যবস্থা ও সমাজ গঠনের সফল কার্যসুচী। তিনি আল্লাহ্‌ তা’আলার নিকট হইতে যাহা কিছুই পাইয়াছেন, তাহাই তিনি বাস্তবায়িত করিয়াছেন। ইহাই ছিল তাঁহার স্বাভাবিক কর্মধারা। তিনি যখন দুনিয়া হইতে চির বিদায় লইয়া চলিয়া গেলেন, তখন একদিকে তিনি রাখিয়া গেলেন তাঁহার নিজ হস্তে পূর্ণ প্রযত্নে সংকলিত আল্লাহ্‌র বাণী-কুরআন মজিদ ও তাঁহার আজীবনের সংগ্রাম-সাধনার ফসল একটি রাষ্ট্র ও সমাজ। কুরআন ও সুন্নাত গ্রন্থাকারে আমাদের সামনে চির সমুজ্জ্বল হইয়া আছে,চিরকালই তাহা থাকিবে। তাঁহার প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সমাজের সঠিক চিত্রও রহিয়াছে ইতিহাসের পৃষ্ঠায়।তবে বাস্তবে উহার অস্তিত্ব বর্তমানে নাই বলিলেও চলে। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও সাধারণভাবে দুনিয়ার সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ও সুক্ষ চিন্তাশীল লোকদের নিকট এবং বিশেষভাবে ইসলাম ও রাসূলের প্রতি ইমানদার লোকদের নিকট রাসূলে কারীম(স)-এর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা বর্তমান কালেও প্রেরনার অন্যতম প্রধান উৎস। ইহা তাঁহাদের নিকট এখনও আদর্শিক লক্ষ্যস্থলে পরিণত হইয়া আছে এবং চিরকালই তাহা থাকিবে,ইহা সন্দেহাতীত কথা।

নবী করীম(স) যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন,তাঁহার ইন্তেকালের পর হইতে স্বয়ং তাহাঁরই ঘোষণানুযায়ী উহার নূতন নামকরণ করা হইয়াছেঃ “খিলাফতে রাশেদা”। খিলাফতে রাশেদা বাস্তবতঃতাহাই, যাহা আদর্শগতভাবে কুরআন ও সুন্নাহ বিধৃত, রাসূলে করীম(স) নিজে তাঁহার তেইশ বছরের নবুয়্যাতী জীবনে অবিশ্রান্ত সাধনা ও সংগ্রামের ফলে যে রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন করিয়া চালাইয়া গিয়াছেন, খিলাফতে রাশেদা উহারই জের-উহারই দ্বিতীয় অধ্যায়। কুরআন ও সুন্নাহ যদি বীজ হয়, তাহা হইলে “ খিলাফতে রাশেদা” উহার শাখা-প্রশাখা, পত্রপল্লব ও ফুলে ফলে সুশোভিত পুর্নাঙ্গ বৃক্ষ। আর রাসূলে করীম(স)-এর আমল হইল এই বৃক্ষের কাণ্ড বিশেষ। এই পর্যায়ে আমি ব্যাপক অধ্যয়ন ও চিন্তা-গবেষণা চালানো এবং ইহার সঠিক চিত্র বাংলা ভাষায় উদ্ভাসিত করিয়া তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহন করি- সে আজ বিশ বছর পূর্বের কথা।অতঃপর বিভিন্ন সময় যতটুকু কথা ও যেসব দিক আমার নিকট স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে, তখন ততটুকুই প্রবন্ধাকারে লিখিয়া প্রকাশ করিয়াছি।ইহা গ্রন্থরুপে প্রকাশের ব্যবস্থা হওয়ার পরও ইহার পূর্ণতা বিধানের জন্য কয়েকটি দিক সম্পর্কে আমাকে লেখনী চালাইতে হইয়াছে। ফলে “খিলাফতে রাশেদা” এক সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে লিখিত কোন গ্রন্থ হয় নাই-হইয়াছে বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন পর্যায়ে লিখিত এবং প্রকাশিত-অপ্রকাশিত রচনাবলীর সমন্বয়। তবু শেষ পর্যন্ত ইহা গ্রন্থাকারে পাঠকদের নিকট পেশ করা সম্ভব হইতেছে দেখিয়া আল্লাহ্‌ তা’আলার লাখ লাখ শোকর আদায় করিতেছি।

১৯৭৫ সনের জানুয়ারী মাসে এই গ্রন্থখানি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হইয়াছিল।অল্প সময়ের মধ্যে ইহা নিঃশেষ হইয়া যাওয়ার পর ইহার দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করা হয় ১৯৮০ সনের জুলাই মাসে।ইহা আল্লাহ্‌র অশেষ মেহেরবানী।

আশা করি আমার অন্যান্য গ্রন্থের ন্যায় এই গ্রন্থখানিও বিদগ্ধ সমাজে সমাদৃত হইবে এবং আদর্শবাদের ক্ষেত্রে এক নূতন প্রেরণার সূত্রপাত হইবে।

-মুহাম্মদ আবদুর রহীম

 

(ক)

রাসূলেকরীম(স) বলিয়াছেনঃ

**********(আরবী)

আমার পরে তোমাদের মধ্যে যাহারাই জীবিত থাকিবে, তাহারা বহু মতবিরোধ দেখিতে পাইবে। এইরুপ অবস্থায় তোমাদের কর্তব্য হইবে আমারই আদর্শ এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদুনের আদর্শ গ্রহন করা।তোমার উহা শক্তভাবে ধারন করিবে-কিছুতেই ছাড়িয়া দিবে না।(মুসনাদে আহমাদ,তিরমিযি,ইবনে মাযাহ)

(খ)

একটি দীর্ঘ হাদিসে কুদসীতে রাসূলে করীম(স)-এর পরিচয় ও প্রশংসা উল্লেখের পর তাঁহার সাহাবীদের পরিচয় স্বরূপ আল্লাহ্‌ তা’আলার এই কথাগুলি উদ্ধৃত হইয়াছেঃ

*******(আরবী)

হযরত মুহাম্মাদের উম্মত তাঁহার অন্তর্ধানের পর মহান সত্যর দিকে আহ্বান জানাইবে এবং সত্যদ্বীন সহকারে সুবিচার ও ইনসাফ করিবে। যাহারা তাহাদের সাহায্য করিবে আমি তাহাদিগকে সম্মানিত করিব।যাহারা তাহাদের জন্য দোয়া করিবে আমি তাহাদিগকে সাহায্য দিব। যাহারা তাহাদের বিরুদ্ধতা করিবে কিংবা তাহাদের উপর বিদ্রোহ করিবে, অথবা তাহাদের হাতের কোন জিনিস কাড়িয়া লইতে ইচ্ছা করিবে তাহাদিগকে চরম অকল্যাণ দ্বারা পরিবেষ্টিত করিয়া ফেলিব।প্রথমোক্ত লোকদিগকে তাহাদের নবীগণের উত্তরাধিকারী বানাইব,তাহাদিগকে আল্লাহ্‌র দিকে আহ্বানদাতা বানাইব। তাহারা সত্য ও ন্যায়ের আদেশ করিবে এবং অন্যায় ও মিথ্যা হইতে নিষেধ করিবে। তাহারা নামায কায়েম করিবে,যাকাত আদায় করিবে,ওয়াদা পূর্ণ করিবে আমি তাহাদেরপ্রথম পর্যায়ের লোকদের দ্বারা যে কল্যাণের সূচনা করিয়াছি, তাহাদের দ্বারাই সেই কল্যাণকে পরিসমাপ্ত করিব। ইহা একান্তভাবে আমারই অনুগ্রহের ব্যাপার। যাহাকে ইচ্ছা আমি তাহাকেই এই অনুগ্রহ দেই। আর প্রকৃতপক্ষে আমি মহান অনুগ্রহকারী।(ইবনে আবু হাতিম-অহব ইবনে মুনাব্বাহ হইতে ইবনে কাসীর-তাঁহার তাফসীরে।)

ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ(স) আল্লাহ্‌ তা’আলার সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসাবে দুনিয়ায় প্রেরিত হইয়াছিলেন। দুনিয়ায় তাঁহার উপর যে দায়িত্ব অর্পিত হইয়াছিল,ইসলামী পরিভাষায় সেই দায়িত্তের সরূপকে এক কথায় বলা যায়ঃ “ইক্কামতে দ্বীন”। আল্লাহ্‌র দ্বীন পুর্নাঙ্গরুপে কায়েম করাই ছিল সর্বশেষ নবীর মৌলিক দায়িত্ব। এই বাক্য হইতে স্বতঃই স্পষ্ট হইয়া উঠে যে, তিনি “দ্বীন” নিজে রচনা করেন নাই, আল্লাহ্‌র নিকট হইতে গ্রহন করিয়াছেন। এই “দ্বীন”অহীর মাধ্যমেই তাঁহার প্রতি আল্লাহ্‌র নিকট হইতে নাজিল হইয়াছে। এই হিসাবে তিনি আল্লাহ্‌র রাসূল। আল্লাহ্‌র নিকট হইতে পাওয়া “অহী” মৌলিক প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে উহার যথাযথ ব্যাখ্যা দান এবং নিজের জীবনে বাস্তব অনুসরণের মাধ্যমে উহাকে সমুদ্ভাসিত করিয়া তোলাও ছিল নবী-রাসূল হিসাবেই তাঁহার দায়িত্তের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু “ইক্কামতে দ্বীন”-এর জন্য এইটুকু কাজই যথেষ্ট ছিলনা,আল্লাহ্‌র নাজিল করা আইন-বিধানকে ব্যক্তি জীবনে ও সমাজ-সমষ্ঠির সার্বিক ক্ষেত্রে পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত করাও ছিল নবী-রাসূল হিসাবেই তাঁহার কর্তব্য। এই কারণে তাঁহাকে যে দ্বীনী দাওয়াতী প্রচেষ্টা চালাইতে হইয়াছে, তাহাই বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করিয়া একটি পুর্নাঙ্গ রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। এই হিসেবে তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা এবং উহার জনগণের একচ্ছত্র নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধান।

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র বলিতে যাহা বুঝায়,নবী করীম (স)-এর সাধনা-সংগ্রামের পরিণতিতে সেই জিনিসেরই পূর্ণ প্রতিফলন বিদ্যমান।“রাষ্ট্র” একটি রাজনৈতিক সংস্থা। মানব জীবনের প্রয়োজন পরিপূরণের উদ্দেশ্য এই সংস্থাটি গড়িয়া তোলা হয় এবং জীবনকে কল্যাণময় ও উন্নততর করিয়া তোলার জন্য ইহার অস্তিত্ব অক্ষুন্ন ও স্থায়ী করিয়া রাখা হয়।“রাষ্ট্র”মানব-শক্তির উন্নততর ফসল। যেখানে মানব জাতির একটা বিরাট সংখ্যা-সমষ্ঠি সাধারনতঃএকটা নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলের দখলদার এবং বহু সংখ্যক লোকের একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক শ্রেণীর ইচ্ছা তাহাদের সম্মিলিত শক্তির কারণে উহার বিরুদ্ধবাদীদের দমন-উদ্দেশ্য কার্যকর হইতে পারে; সেখানেই রাষ্ট্র অস্তিত্বশীল। আর সংক্ষিপ্ত ভাষায়, কোন বিশেষ ভূ-খণ্ডের রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে গড়িয়া উঠা জাতীয় সত্তাকেই বলা হয় রাষ্ট্র বা State।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রদত্ত এই সংজ্ঞাসমূহ হইতে নিম্নোক্ত চারটি জিনিসই রাষ্ট্রের মৌল উপকরণ রূপে প্রমাণিত হইয়াছেঃ(১)জনতা(population),(২)নির্দিষ্ট ভূখন্ড(Territory),(৩)সার্বভৌমত্ব(Sovereignty)এবং (৪)প্রশাসন যন্ত্র বা সরকার(Government)।

রাসূলে করীম(স)-এর মদীনায় উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত তাঁহার দায়িত্ব পালন প্রচেষ্টার যে ফসল ফলিয়ছিল, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সুক্ষাতিসুক্ষ বিচার-বিবেচনায়ও তাহাতে এই চারটি মৌল উপকরণ পূর্ণমাত্রায় বর্তমান ছিল-যদিও দৃষ্টিকোণ ও মৌল ভাবধারার দিক দিয়া উহার স্বরূপ ছিল অন্যান্য সব রাষ্ট্রবিজ্ঞান হইতে সম্পূর্ণ ভিন্নতর।

রাষ্ট্রের প্রথম ভিত্তিস্থাপন
নবী করীম(স) আল্লাহ্‌র রাসূল ও নবীরুপে মনোনীত হওয়ার পর দ্বীন-ইসলামের যে বিপ্লবাত্মক আদর্শ প্রথমে গোপনে এবং পরে প্রকাশ্য প্রচার করিতে শুরু করিয়াছিলেন, তাহাতে তদানীন্তন কুরাইশদের ধর্মমত, নৈতিক চরিত্র, অর্থ ব্যবস্থা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে প্রবল প্রতিক্রিয়া সূচিত হইয়া ছিল। সত্য কথা এই যে, ইহার দরুণ তাহাদের সর্ব প্রকার স্বার্থ ও আশা-আকাঙ্খা এক কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হইয়া পড়িয়াছিল। এই কারণে কুরাইশরা নবী করীম(স) এবং তাঁহার প্রতি ইমানদার মুসলমানদের জীবনকে দুঃসহ অত্যাচার ও নিপীড়নে জর্জরিত করিয়া তুলিয়াছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি আল্লাহ্‌ তা’আয়ালার নির্দেশানুক্রমে মক্কা ত্যাগ করিয়া মদিনায় চলিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। এই সময় নবী করীম(স) হজ্জ উদযাপন উদ্দেশ্য আগত মদিনার মুসলমানদের নিকট হইতে দুই-দুইবার আনুগত্যর “বায়’আত”১ {শব্দটির ব্যবহারিক ও পারিভাষিক অর্থ “আনুগত্যর শপথ”।} ইতিহাসে এই “বায়আত”দুইটি “প্রথম আকাবা-বায়’আত”ও “দ্বিতীয় আকাবা-বায়’আত”২{‘আকাবা’ বায়’আতের পূর্ণ বিবরণ এইরূপঃ মদীনার লোকেরা রাত্রির তৃতীয় প্রহরে ‘আকাবা’ নামক স্থানে সমবেত হইয়া রাসূলে করীম(স)-এর আগমন প্রতীক্ষায় উদগ্রীব। একটু পরেই নবী করীম(স) তাঁহার চাচা আব্বাসকে(তিনি তখন ইসলাম গ্রহন করেন নাই)সঙ্গে লইয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন।প্রথমেই আব্বাস বলিলেনঃ হে খাজরাজ গোত্রের লোকের! তোমরা ভাল করিয়াই জান, মুহাম্মদ (স) আমাদের মধ্যে অত্যন্ত সম্মানিত ও মর্যাদাবান ব্যক্তি। তাঁহার শত্রুদের হইতে আমারাই তাঁহার সংরক্ষক। কিন্তু এক্ষণে তিনি নিজেই এই শহর(মক্কা) ত্যাগ করিয়া তোমাদের সহিত মিলিত হওয়ার সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। কেননা তোমরা তাঁহাকে নিজেদের শহরে আহ্বান জানাইতেছ। তোমরা যদি তাঁহার পূর্ণ সংরক্ষনে শক্তিশালী হইয়া থাক এবং তাঁহার শত্রুদের হাত হইতে তাঁহাকে রক্ষা করার সাহস তোমাদের থাকে, তাহা হইলে তোমরা ইহা কর। অন্যথায় এখনি তোমাদের ‘না’ বলিয়া দেওয়া উচিৎ। কেননা মুহাম্মাদ এখন তো আমাদের হেফাজতে আছেন। তোমরা তাঁহাকে লইয়া গিয়া শত্রুদের হাতে ছাড়িয়া দিবে- এমনটি যেন না হয়। তাঁহারা বলিলেন, ‘আমরা আপনার কথা শুনিয়াছি। এখন সে রাসূল, আপনার বক্তব্য বলুন। আল্লাহ্‌র বিধান কিংবা আপনার নিজের সম্পর্কে আমাদের নিকট হইতে যদি কোন প্রতিশ্রুতি লইতে হয়, তবে তাহা গ্রহন করুন। ইহার পর নবী করীম(স) প্রথমে কুরআন মজিদের অংশ বিশেষ পাঠ করিলেন। আল্লাহ্‌র বন্দেগী কবুল করার এবং তাঁহার সহিত শিরক না করার শর্ত পেশ করিলেন। অতঃপর বলিলেনঃ ‘আমি তোমাদের নিকট হইতে প্রতিশ্রুতি লইতেছি যে, তোমরা আমার সাহায্য সহযোগিতা ও সমর্থন এমনভাবে করিবে,যেমন তোমরা তোমাদের স্ত্রীলোকদের ও তোমাদের সন্তানদের করিয়া থাক’। ইহার সঙ্গে সঙ্গে রাসূলে করীম(স)-এর হাত ধরিয়া তাঁহারা বলিয়া উঠলেনঃ ‘হ্যাঁ,সেই মহান সত্তার শপথ,যিনি আপনাকে সত্য-সঠিক দ্বীনসহ পাঠাইয়াছেন,আমরা এমনিভাবেই আপনার সহায়তা ও সংরক্ষণ করিব, যেমন আমরা আমাদের পরিবারবর্গের করিয়া থাকি’। অতঃপর সকলেই সমবেতভাবে বলিলেনঃ ‘আমরা প্রতিশ্রুতি দিতেছি, আমরা সর্বাবস্থায় আপনার কথা শুনিব, আপনার আনুগত্য স্বীকার করিব- দুঃখ-বিপদ,স্বাচ্ছন্দ্য-সচ্ছলতা কিংবা অভাব-অনটন যাহাই হউক না কেন আর আমরা যেখানেই থাকি না কেন, আমরা সর্বসময় ও সর্বাবস্থায় সত্য বলিব;কাহাকেও ভয় করিব না এবং কোন উৎপীড়নেরও পরোয়া করিব না।

অতঃপর তাঁহার বলিলেনঃ ‘আমাদের মনে একটা প্রশ্ন জাগিতেছে। এমন তো হইবে না যে, আল্লাহ্‌ তা’আলা যখন আপনাকে বিজয় দান করিবেন,তখন আপনি আমাদিগকে ত্যাগ করিয়া আপনার নিজের জাতির লোকদের সহিত মিলিত হইয়া যাইবেন’? ইহা শুনিয়া নবী (স) স্মিত হাসি হাসিলেন এবং বলিলেনঃ

*******(আরবী)

না,এ বিষয়ে তোমরা নিশ্চিন্ত থাক। তোমরা যাহার সহিত লড়াই করিবে,আমিও তাহাদের সহিত লড়াই করিব। তোমরা যাহাদের সহিত সন্ধি করিবে আমিও তাহাদের সহিত সন্ধি করিব। তোমাদের দায়িত্ব আমার দায়িত্ব। তোমাদের মর্যাদা-সম্ভ্রম আমার মর্যাদা ও সম্ভ্রম রুপে গণ্য হইবে। আর আমার জীবন ও মরন তোমাদের সঙ্গেই হইবে।

বস্তুতঃ আকাবায় এইরুপ কথোপকথনের মাধ্যমে প্রকারান্তরে একটি সামাজিক-সামষ্ঠিক চুক্তিই সম্পাদিত হইয়াছিল। ইহার মাধ্যমে মদিনাবাসীরা রাসূলে করীম(স)-কে নিজেদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা এবং রাষ্ট্র-কর্তারুপে যুগপৎ মানিয়া লইলেন এবং তাঁহাদের আহ্বানে তিনি মদীনায় চলিয়া গেলেন। নবী করীম(স) হইলেন তাঁহাদের একচ্ছত্র নেতা।}নামে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রহিয়াছে। এই সময় দুইজন স্ত্রীলোকসহ মদিনার আওস ও খাজরাজ নামক দুই প্রধান বিবাদমান গোত্রের মোট প্রায় ৭৫জন মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হইয়া রাসূলে করীম(স)-এর হাতে ‘বায়’আত’ গ্রহন করেন। এই বায়’আতে তাঁহারা দ্বীন- ইসলামকে পুর্নাঙ্গভাবে মানিয়া ও অনুসরণ করিয়া চলার সঙ্গে সঙ্গে নবী করীম(স)-এর সার্বিক নেতৃত্ব মানিয়া লওয়ার,তাঁহার জন্য পূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন করার এবং তাঁহার নেতৃত্বে বিরুদ্ধ পক্ষের সহিত প্রাণ-পণ যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত হওয়ার অঙ্গীকার দান করেন। শুধু তাহাই নয়, নবী করীম(স)-কে তাঁহার সঙ্গী-সাথীসহ মদীনায় যাইবার জন্য তাঁহারা আহ্বান জানান এবং সেখানে তাঁহাদিগকে বসবাসের জন্য স্থান দেওয়ার প্রতিশ্রুতিরও পুনরুল্লেখ করেন। মদীনাবাসীরা নবী করীম(স)-কে একজন ‘আশ্রয় গ্রহণকারী’(Settler-Asylum) রুপে নয়-আল্লাহ্‌র রাসূল ও প্রতিনিধি এবং তাঁহাদের সর্বাত্মক নেতা ও প্রশাসক হিসেবেই এই আহ্বান জানাইয়াছিলেন। নবী করীম(স) এই আহ্বান গ্রহন করিয়া সঙ্গিসাথী সমভিব্যহারে মদিনায় স্থানান্তরিত হওয়ার সিদ্ধান্ত ও এইখানে ঘোষণা করেন। বস্তুতঃ একটি রাষ্ট্রের দানা বাঁধিয়া উঠার মূলে সর্বপ্রথম যে সামাজিক-সামষ্ঠিক চুক্তি(Social Contract)-র অবস্থিতি প্রথম শর্ত, মদীনায় প্রতিনিধি স্থানীয় অধিবাসীদের নিকট হইতে নবী করীম(স)-এর গৃহীত আকাবার এই ‘বায়াআত’ সেই চুক্তিরই বাস্তব রূপ। প্রকৃতপক্ষে এই ‘বায়’আতে’র মাধ্যমেই ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম ভিত্তি স্থাপিত হইয়াছিল। এই ‘বায়’আত’ মক্কার এক নির্জন পর্বতগুহায় অনুষ্ঠিত হইলেও উহার জন্য স্থান(Territory)নির্দিষ্ট হইয়াছিল মদীনা। ‘মদীনা’ এই সময় হইতেই ‘মদীনাতুর-রাসূল’- রাসূলের মদীনা কিংবা ‘মদীনাতুল-ইসলাম’- ইসলামের কেন্দ্রভূমি মদীনা-নামে অভিহিত হইতে শুরু করিয়াছিল।পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি রাষ্ট্র(State)-এর সর্বশেষ সংজ্ঞায় যে কয়টি জরুরী শর্ত উল্লেখিত হইয়াছে,সেই সব কয়টিই এখানে পুরাপুরি বর্তমান মদিনার মুসলমানগণ যে ‘বায়আত’ করিয়াছিলেন এবং এই প্রসঙ্গে উভয় পক্ষে যে কথোপকথন হইয়াছিল, তাহা হইতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, নবী করীম (স)-কে তাঁহারা মদীনা গমনের আহ্বান জানাইয়া এক কঠিন বিপদের ঝুঁকি মাথায় লইয়াছিলেন।তাঁহারা ইহা অবলীলাক্রমে সহ্য করিয়া যাইতে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিলেন। অন্যকথায়, একটি ক্ষুদ্রায়তন উপশহর যেন নিজেকে নিজে সমগ্র দেশের চূরান্ত শত্রুতা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বয়কটের মুখে ঠেলিয়া দিতেছিল। অবশ্য ইহার পরিনতিও ঠিক তাহাই হইয়াছিল।

অপরদিকে মক্কাবাসীদের জন্য ও এই বায়’আত বিশেষ অর্থবহ এবং বিপজ্জনক হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। কেননা মুসলমানগণ মক্কার বাহিরে অন্য একস্থানে একত্রিত হইলেও- ইহারই মাধ্যমে একটি শক্তি, একটি রাষ্ট্ররূপে এবং মক্কাবাসীদের কুফর-শিরক, অরাজকতা-উচ্ছৃঙ্খলতার প্রতি একটা মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। অর্থাৎ মক্কাবাসীদের জন্য ইহা শুধু ধর্মীয় বিপদই নয়, ইহা একটি সুস্পষ্ট ‘রাজনৈতিক বিপদ’ হইয়া দেখা দিয়াছিল। মদিনা যেহেতু ইয়ামেন হইয়া সিরীয়া যাওয়ার বাণিজ্য পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান সেহেতু এখানে মুসলমানদের রাষ্ট্ররূপে পরিগ্রহের ফলে এই পথটি তাহাদের জন্য চিরতরে বন্ধ হইয়া যাইবার কিংবা অন্ততঃবিপদ-সঙ্কুল হইয়া পড়ার আশংকা দেখা দিয়াছিল। অথচ এই পথটি ছিল কুরাইশ ও অনন্যা বড় বড় গোত্রের লোকদের অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান যোগসূত্র। কুরাইশরা ইহার পরিণতি মর্মে মর্মে অনুধাবন করিতে পারিয়াছিল। সে কারণে তাহারা বিশ্বনবীর জীবন-প্রদীপ চিরতরে নির্বাপিত করিয়া ফেলার জন্য পূর্বাহ্ণেই ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহন করিয়াছিল।

এক কথায়, এই ‘বায়’আত’ একদিকে যেমন ছিল প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র-সংস্থার ভিত্তিপ্রস্তর, অপরদিকে ইহার মাধ্যমে একটি আদর্শিক সমাজ-সংস্থার ভিত্তিও সংস্থাপিত হইয়াছিল। বস্তুতঃ জানা ইতিহাসে(Known History) পুরাপুরি আদর্শ-ভিত্তিক রাষ্ট্র বলিতে এইটিকেই বুঝায়।

মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র
আকাবার বায়’আত অনুসারে রাসূলে করীম(স)-এর হিজরাতের সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম মদীনায় স্থানান্তরিত হইল। প্রথমে যাহা ছিল বীজ, এক্ষণে তাহাই হইল বৃক্ষ। যাহা ছিল থিওরী(Theory),এক্ষণে তাহাই হইল বাস্তব(Practical)। প্রথম যাহা ছিল নিছক মৌখিক আনুগত্যর মধ্যে সীমাবদ্ধ, এক্ষণে তাহাই দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে ও সামাজিক-সামষ্ঠিক বিষয়াদিতে অনুসৃত হইয়া শরীরী হইয়া উঠিল। মক্কায় যাহা ছিল সূচনা, মদীনায় তাহাই অগ্রগতির স্তরসমূহ অতিক্রম করিয়া ধাপে ধাপে পুর্নত্তের দিকে আগাইয়া যাইতে লাগিল।

মদীনায় পৌছিয়া নবী করীম(স) প্রথম পর্যায়েই দুইটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করিলেন। প্রথম কাজটি হইল, একটি মসজিদের ভিত্তিস্থাপন। এই মসজিদ কেবল পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ার স্থানই নয়, ইহা মুসলিম জনতার মিলন-কেন্দ্রে পরিণত হইল। এই স্থানকে কেন্দ্র করিয়াই নবী করীম(স) ইসলামের জন্য আত্মোৎসর্গীকৃত লোকদের লইয়া একটি আদর্শ-ভিত্তিক সামাজিক-সামষ্ঠিক শক্তির লালন ও বিকাশ সাধনের জন্য প্রচেষ্টা চালাইয়া যাইতে শুরু করিলেন। তিনি ইসলামের মহান আদর্শের ভিত্তিতে একটি পুর্নাঙ্গ রাষ্ট্র পরিচালনের যোগ্য নাগরিক ও কর্মী-নেতৃবাহিনী গড়িয়া তোলার সর্বাত্মক সাধনায় আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন এই মসজিদকে কেন্দ্র করিয়া। এই মসজিদই ছিল রাষ্ট্রপ্রধান ভবন,সেনাধ্যক্ষর(Supreme Commander) হেড কোয়ার্টার এবং সর্বোচ্চ প্রশাসকের কেন্দ্রীয় অফিস।

দ্বিতীয় কাজ হইল, মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃসম্পর্ক স্থাপন। ইহা ছিল কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশের বাস্তব অনুসরণ। নির্দেশটি এইঃ

*******(আরবী)

মু’মিন লোকেরা পরস্পরের ভাই; অতএব তোমরা এই ভাইদের মধ্যে পারস্পরিক সন্ধি ও কল্যাণ স্থাপন কর। আর সকলে সম্মিলিতভাবে আল্লাহ্‌কে ভয় করিয়া চল; তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হইবে বলিয়া আশা করা যায়।

ইসলাম সমগ্র বিশমানবতার অভিন্ন ভ্রাতৃত্বের পয়গাম লইয়া আসা গতিশীল ও যুগোপযোগী এক মহান বিধান। বর্ণিত ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়া রাসূলে করীম(স) সেই বিরাট বিশ্বমানবিকতারই ভিত্তি স্থাপন ও কর্ম-ধারার সূচনা করিয়াছিলেন।ইহার মাধ্যমে তিনি স্থান-কাল-ভূগলের সীমা ও ভাষার পার্থক্য এবং বংশ-রক্ত-গোত্রের বিভেদ সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করিয়া দিলেন। এই ভ্রাতৃ-সম্পর্কের কারণে স্থানীয় ও অস্থানীয় ভেদাভেদো চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। সমস্ত বৈষয়িক-বস্তুগত পার্থক্য-বিভেদ নিঃশেষ করিয়া দিয়া নবী করীম (স) এক সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের সমাজ(Society of Universal Brotherhood) গড়িয়া তুলিতে শুরু করিয়াছিলেন।

এই ভ্রাতৃপ্রতীম সমাজের ভাবধারা ছিল এই যে, এখানে কেউ ছোট নয়, কেউ বড় নয়। কেউ হীন নয়, কেউ মানী হয়। কেউ আশরাফ নয়, কেউ আতরাফ নয়। কেউ কুলীন নয়, কেউ অকুলীন নয়। এই সমাজের প্রতিটি মানুষ ইসলামের মহান আদর্শে সমান মর্যাদা ও অধিকারসম্পন্ন ভাই মাত্র। ‘মুসলমান’ ই ইহাদের একমাত্র পরিচয়। ইহা ছাড়া তাহাদের আর কোন পরিচয় নাই।

দ্বিতীয় পর্যায়ে এই ভ্রাতৃত্ববোধক নবী করীম(স) সমাজ পুনর্গঠনের ও পুনর্বাসনের একটি কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত করেন। তাহার গঠিত এই সমাজের প্রত্যেক ভাই তাহার অপর ভাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সর্ব প্রকার ত্যাগ স্বীকার করিতে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। যাহার আছে সে সেই সব কিছুই দিবে তাহাকে,যাহার সেইসব নাই। কিন্তু ইহা ‘দান’ হইবেনা-হইবেনা ‘অনুগ্রহ’।গ্রহীতা তাহা গ্রহন করিয়া দাতার প্রতি হইবেনা অনুগ্রহীত,করুণার পাত্র-লাঞ্ছিত ও অবমানিত। ইহা তাহার কর্তব্য। একজন তাহার ভাইকে কিছু দিবে, দেওয়া তাহার কর্তব্য বলিয়া। ভাই তাহা গ্রহন করিবে তাহার ভাইয়ের কর্তব্য পালনে সহযোগিতা করার মানসিকতা লইয়া। ইহারই পরিণতিতে কল্পনাতীত স্বল্প সময়ে মক্কা হইতে নিঃস্ব সর্বস্বান্ত হইয়া আসা বিপুল সংখ্যক লোকের পুনর্বাসনের কঠিন ও জটিল সমস্যার অনায়াসে সমাধান হইয়াছিল। শুধু তাহাই নয়, সামগ্রিকভাবে নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র বিপুল সচ্ছলতায় সমৃদ্ধ এবং নূতন শক্তিতে বলিয়ান হইয়া উঠিয়াছিল। প্রতিটি নাগরিকই নিজের উপার্জনের প্রেরণা ও সুযোগ লাভ করিল। ফলে কেহ কাহারও উপর ‘বোঝা’ বা নির্ভরশীল(Dependent) হইয়া থাকিল না।

তৃতীয় পর্যায়ে বিশ্লিষ্টটা ও বিশৃঙ্খলার বুক হইতে ঐক্য, সংহতি ও শৃঙ্খলা গড়িয়া তোলার কঠিন দায়িত্ব রাসূলে করীম (স)-এর সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছিল। কার্যতঃ ইহা ছিল একটা পর্বততুল্য বিরাট সমস্যা। অতিতের নবি-রাসূলগণ ও এই সমস্যাটির সমাধানে সফল হইতে পারেন নাই। কিন্তু রাসূলে করীম(স)-কে তাহাই করিতে হইয়াছে এবং তিনি তাহা করিয়াছেন অপূর্ব সাফল্য ও যোগ্যতা সহকারে। দৌর্বল্য,অক্ষমতা ও শক্তিহীনতা বুক দীর্ণ করিয়া শক্তি ও সামর্থের বিরাট বৃক্ষ গড়িয়া তোলাই ছিল তাঁহার সাধনা। পারস্পরিক বিরোধ ও বৈষম্য দূরীভূত করিয়া নিঃছিদ্র একত্বটা ও ঐক্যবদ্ধটা সৃষ্টি করাই ছিল তাঁহার লক্ষ্য। মৃত্যুর তুহীন হিম অপসারিত করিয়া জীবনের উষ্ণতা,চাঞ্চল্য ও তৎপরতা নূতন জগত নির্মাণই ছিল তাহার কর্তব্য। আল্লাহ্‌ তা’য়ালা এই দিকে ইংগিত করিয়াই বলিয়াছেনঃ

********(আরবী)

এবং আমরা আপনার সেই দুর্বহ বোঝাটি আপনার উপর হইতে নামাইয়া দিলাম,যাহা আপনার পৃষ্ঠদেশ নিচু করিয়া দিয়াছিল।

চতুর্থ পর্যায়ে তাঁহার কর্তব্য ছিল ‘বাহির সামলানো’। এ পর্যন্ত তিনি যাহা কিছু করিয়াছেন তাহাকে বলা চলে ঘর সামলানোর কাজ। কিন্তু কেবল ঘর সামলাইলেই দায়িত্ব পালন সম্পূর্ণ হয় না।ইসলামী সমাজের আভ্যন্তরীণ ঐক্য ও নিরাপত্তা বিধানের পর উহাকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত করার জন্য দুই পর্যায়ের কাজ তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছিল। একটি ছিল,ঘরের সংলগ্ন পরিমণ্ডলে অবস্থানকারী অমুসলিম ইয়াহুদি সমাজের নিত্য-নৈমিত্তিক-তথা প্রতি মুহূর্তের শত্রুতার আক্রমন হইতে ইসলামী সমাজের নিরাপত্তা বিধান। আর দ্বিতীয় কাজটি হইল, বহিঃশত্রুর সর্বাত্মক আক্রমণ হইতে ইসলামী রাষ্ট্রের এই নব নির্মিত প্রাসাদটির পুর্নাঙ্গ সংস্করণের সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহন আর সেই সঙ্গে সমগ্র বিশ্বে ইসলামের ব্যাপক প্রচারের রাজপথ উন্মুক্ত করিয়া দেওয়া।

তখনকার মদীনা শহরে এক প্রকার নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা অবস্থা বিরাজ করিতেছিল।সেখানকার আওস ও খাজরাজ এই দুইটি বড় ও প্রধান গোত্র প্রায় চারটি খণ্ডে বিভক্ত ছিল। অপর দিকে ইয়াহুদিদের দশটি গোত্র ছিল তাহাদের হইতে স্বতন্ত্র। শতশত বৎসরের শত্রুতা তাহাদিগকে পরস্পরের প্রানের দুশমন বানাইয়া দিয়াছিল।সাধারনতঃ কয়েকটি আরব গোত্র তাহাদের শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করার উদ্দেশ্য ইয়াহুদিদের সহায়তা আদায় করিয়া লইত। অপর কতিপয় আরব গোত্র অন্য কয়েকটি বিরোধী গোত্রের সাহায্য লাভ করিত। অতঃপর যে রক্তাক্ত যুদ্ধ শুরু হইয়া যাইত,তাহা বংশানুক্রমে ও শতাব্দীকাল ধরিয়া অব্যাহত থাকিত। ইহার ফলে আরবের সাধারণ মানুষের জীবনে চরম দুঃখ ও কষ্ট নামিয়া আসিত। তাহারা এই প্রাণান্তকর অবস্থা হইতে মুক্তি লাভের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাইতেছিল। এই জন্য নবী করীম(স)-এর মদীনা আগমনের প্রাক্কালে মদীনাবাসীদের একটা বিরাট অংশ আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলুলকে নিজেদের বাদশাহ ও শাসক নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত লইয়াছিল। নবী করীম(স) মদীনার জনগনের এই অবস্থা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য তিনি আকাবা বায়আত গ্রহনের পরই মদীনার বিভিন্ন গোত্রের বারো জন সদস্যকে ‘নকীব’ নিযুক্ত করিয়াছিলেন এবং এইভাবে তিনি পারস্পরিক সংঘর্ষলিপ্ত ও বিবাদমান গোত্রগুলির মধ্যে একটা মিলমিশ ও ঐক্য সৃষ্টির জন্য চেষ্টা চালাইয়াছিলেন। কিন্তু এই গোত্রবাদী সমাজের প্রতিটি গোত্রই ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন,স্ব-ব্যবস্থাপনার(Self-administration) অধিকারী এবং নিজেদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছানুবর্তী।এতদ্ব্যতীত সেখানে এই গোত্রসমূহকে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও ঐক্যবদ্ধ রাখিবার কোন প্রশাসন-ব্যবস্থা বা কার্যকর প্রতিষ্ঠান(Executive Institution)-ই ছিলনা। এতৎসত্ত্বেও নবী করীম(স) প্রেরিত ইসলাম প্রচারকদের চেষ্টায় মদীনাবাসীদের মধ্য হইতে বহু সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহন করিয়া মুসলিম সমাজের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল,যদিও তখন পর্যন্ত মদীনায় ইসলাম কোন রাজনৈতিক শক্তির মর্যাদা লাভ করিতে পারে নাই।

নবী করীম (স) মদীনায় উপস্থিত হইয়া এই অরাজক পরিস্থিতির অবসান ঘটাইবার উদ্দেশ্য একটি ঘোষণাপত্র তৈয়ার করিলেন।১ {ইতিহাসে এই ঘোষণাই ‘মদিনা-সনদ’ নামে বিধৃত।} এই ঘোষণায় মদীনা একটি ‘নগর রাষ্ট্রের’(city state) মর্যাদা পাইল। উহার ভিত্তিতে সমগ্র বিচ্ছিন্ন দো বিক্ষিপ্ত গোত্রসমূহের মধ্যে বিশেষভাবে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টির জন্য যারপরনাই চেষ্টা করা হইল।

একথা সর্বজনবিদিত যে, এই লোকেরা অতিতে কখনই কোন রাষ্ট্রশক্তির(State-power/coercive power)নিকট মাথা নত করে নাই। কোন দিনই তাহারা কেন্দ্রীয় শক্তির নিয়ম-শৃঙ্খলা ও প্রভুত্বের অধীনতা পাশে আবদ্ধ ছিল না। নবী করীম(স) এই ঘোষণাপত্রের সাহায্যে তাহাদের সকলকে একটি আইন, তথা এক আল্লাহ্‌, এক নেতৃত্ব ও একই কিবলার উপর সুসংবদ্ধ ও সুসংহত করিয়া দিলেন। ব্যক্তিগত অধিকারের দিক দিয়া মদীনা-ঘোষণা(Medina Diclaration) ছিল একটি বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপ। পূর্বে যে অধিকার এক ব্যক্তি বা একটি পরিবার কিংবা একটি গোত্র ভোগ করিত, এই ঘোষণা কার্যকর হওয়ার পর তাহা সর্বসাধারণের অধিকার রূপে সাব্যস্ত হইল। এইভাবে একদিকে গোত্রবাদমূলক নৈরাজ্যের অবসান ঘটিল এবং অপরদিকে সঠিক অর্থে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হইল।

মদীনা-চুক্তি(Medina Pact)-র ধারা অনুযায়ী সমগ্র প্রশাসনিক(Administrative),আইনগত(Legal)ও ফৌজদারি বা বিচার বিভাগীয়(Judicial) ক্ষমতা হযরত মুহাম্মাদ(স)-এর উপর অর্পিত হইয়াছিল। তবে এই ব্যাপারে বিশ্বনবী ও দুনিয়ার অন্যান্য শাসকদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান। তিনি কোন স্বেচ্ছাচারী ও দুর্বিনীত শাসক রূপে এই ব্যাপক ও সর্বময় ক্ষমতা গ্রহন করেন নাই। কোনরূপে ব্যক্তি স্বার্থ,ব্যক্তি সার্বভৌমত্ব ও ব্যক্তি আধিপত্যের একবিন্দু ধারণাও তাঁহার সম্পর্কে করা যাইতে পারেনা;বরং তাঁহার রাষ্ট্রনীতি উন্নত নৈতিক ও মানবিক আদর্শের উপর ভিত্তিশীল ছিল। তিনি নিজেকে একজন সার্বভৌম(Sovereign) হিসাবে এক মুহূর্তের তরেও চিন্তা করেন নাই, জনসমক্ষে সেভাবে নিজেকে পেশও করেন নাই। যে আইন তিনি অন্যদের উপর প্রয়োগ করিতেন, তাহা অন্যদের ন্যায় নিজের উপরও প্রয়োগযোগ্য মনে করিতেন। বস্তুত দুনিয়ার রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে ইহার কোন দৃষ্টান্ত দেখানো যাইতে পারে না।

মদীনা-চুক্তি দুইটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশ ২৩টি ধারা সমন্বিত।উহা সম্পূর্ণ মুহাজির ও আনসারদের সহিত সংশ্লিষ্ট। আর দ্বিতীয় অংশ মদীনার ইয়াহুদীদের অধিকার ও কর্তব্য-দায়িত্ব সম্পর্কিত।

এই চুক্তি অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্ব ব্যাপারে নবী করিম (স)-এর ফয়সালা ও রায়ই ছিল চূরান্ত। বিচার বিভাগীয় সর্বোচ্চ মর্যাদা ও ছিল তাহাঁরই। মুহাজির ও আনসার জনগণ তো দ্বীন-ইসলাম কবুল করার সঙ্গে সঙ্গে রাসূলে করীম(স)-কে শুধু ধর্মীয় নেতাই নয়- সমাজ-রাষ্ট্রকর্তা হিসাবেও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী রূপে স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন। কজেই এই ধরনের চুক্তিতে তাহাদের কোনরূপ আপত্তি থাকার প্রশ্নই উঠিতে পারে না। কিন্তু ইয়াহুদী সমাজ তো সমগ্র আরবের উপরই নিজেদের সাংস্কৃতিক প্রাধান্যের দাবিদার ছিল। এতৎসত্ত্বেও তাহাদের পক্ষে এইরুপ ধারা সমন্বিত চুক্তিতে সম্মত হওয়া ছিল বিশ্বনবীর রাষ্ট্রনীতির একটা বিরাট মুজিজা।

মদীনা-চুক্তির উল্লেখযোগ্য ধারাসমূহ
মদীনা-চুক্তির ধারাসমূহ বিস্তারিতভাবে উদ্ধৃত করা এখানে সম্ভবপর নয়। সংক্ষেপে উহার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ধারা এবং তৎসংক্রান্ত সাধারণ পর্যালোচনা এখানে পেশ করা যাইতেছে।

ঘোষণাপত্রের প্রথম অংশ হইতে যে রাষ্ট্ররূপ দানা বাঁধিয়া উঠে,তাহা মুহাজির,আনসার ও সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ অন্যান্য গোত্র এবং লোকদের সমন্বয়ে গঠিত। এই সমস্ত লোক সুস্পষ্ট ভাষায় নবী করীম(স)-এর নেতৃত্বে মানিয়া চলার ও তাঁহার সহিত একত্রিত হইয়া শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অঙ্গিকারবদ্ধ হইয়াছিল। নিজেদের মধ্যে শতধা-বিভক্তি ও বিভেদ থাকা সত্ত্বেও ইহারা সমগ্র বিশ্বসমাজ হইতে স্বতন্ত্র একটি একক(Unit)গড়িয়া তুলিয়াছিল।গোটা মুসলিম জনতা অধিকার ও কর্তব্যে সম্পূর্ণ অভিন্ন মর্যাদা গ্রহন করিয়াছিল। যুদ্ধ ও সন্ধি রাষ্ট্রীয় ও সামষ্ঠিক বিশয় রূপে গণ্য হইল। সামরিক দায়িত্ব সকলের জন্য অবশ্যই পালনীয় হইল। নিরাপত্তার অঙ্গীকার দেওয়ার অধিকার প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট হইল।চুক্তিবদ্ধ হওয়ার অধিকার প্রত্যেকের এবং একজনের চুক্তি সকলের জন্য বাধ্যতামূলক হইয়া গেল। ইহার ফলে রাষ্ট্রীয় সংস্থায় পূর্ণ ভ্রাতৃত্ব,সাম্য ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার এক স্বর্ণযুগ সূচীত হইল।

এই চুক্তি অনুযায়ী মক্কার কুরাইশ পক্ষাবলম্বনে বা তাহাদের কোনরূপ সাহায্য ও আশ্রয়দানের অধিকার কাহার ও থাকিল না। উপরন্তু কুরাইশদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের অগ্রাভিযানে কোন রূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি কিংবা বিরুদ্ধতা করাও কাহারও পক্ষে সম্ভব থাকিল না।

সমস্ত ব্যাপারে সর্বোচ্চ ও সর্বশেষ আদালতের মর্যাদা পাইলেন স্বয়ং হযরত মুহাম্মাদ(স)।

অতঃপর আদালতী ব্যবস্থা আর এক ব্যক্তি বা একটি গোত্রের ব্যাপার হইয়া থাকিল না,বরং ইহা একটি সামষ্ঠিক ও সামাজিক মর্যাদা লাভ করিল।গোটা বিচার বিভাগীয় ক্ষমতাই কেন্দ্রীয় মর্যাদা পাইল।ইহাও ছিল একটি বিপ্লবাত্মক সিদ্ধান্ত।এই সিদ্ধান্তের ফলে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা ও অবিমিশ্র সুবিচার সর্বত্র প্রাধান্য লাভ করিল।কোনরূপ পক্ষপাতিত্ব কিংবা স্বজন-প্রীতি বা আত্মীয়-প্রীতির সামান্য পথ ও উন্মুক্ত থাকিল না। সমস্ত মুসলমান সামগ্রিকভাবে এই জন্য দায়ী হইল যে, কেহ কাহারও উপর অত্যাচার করিতে পারিবেনা;কেহ কাহারও অধিকার হরণ করিতে পারিবেনা।

মদীনা-চুক্তির দ্বিতীয় অংশ সম্পূর্ণরূপে ইয়াহুদীদের সহিত সম্পর্কিত ছিল।সমস্ত ইয়াহুদী জনগোষ্ঠী একটি সমষ্ঠি হিসাবে ফেডারেল পদ্ধতির ‘মদীনা নগর- রাস্ত্রের’সহিত যুক্ত হইয়াছিল।প্রথম ধারাটিতে বলা হইয়াছিল যে,ইয়াহুদী ও মুসলমানরা যুক্তভাবে যদি কোন যুদ্ধ করে, তাহা হইলে প্রত্যেকেই নিজের নিজের ব্যয়ভার বহন করিবে। উভয়ই নিজেদের ধর্ম পালনে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। এভাবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাপারে ইয়াহুদীরা মুসলমানদের সমান অধিকার লাভ করিল। দেশ রক্ষার দায়িত্বে ইহারা পরস্পরের সাহায্যকারী হইল। অর্থাৎ মুসলমান যাহাদের বিরুদ্ধে লড়াই করিবে,ইয়াহুদীরাও তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে বাধ্য হইবে। মুসলমানরা যাহাদের সহিত সন্ধি করিবে,ইয়াহুদীরাও তাহাদের সহিত সন্ধি করিতে বাধ্য হইবে। এই সময় দেশরক্ষার-অর্থাৎ মদীনা নগর-রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে পরস্পরের কার্যকর সাহায্য করাও উভয়ের কর্তব্য হইবে। এই ধরনের চুক্তির ফলে প্রতিরক্ষা (Defense) ব্যাপারটিও কেন্দ্রীয় বিষয়ে গণ্য হইল।অতঃপর রাসূলে করীম(স)মুসলিম ও ইয়াহুদী সমন্বয়ে গঠিত সম্মিলিত সেনাবাহিনীর প্রধান (Head and supreme) হইলেন। ইহাই রাসূলে করীম(স)-এর আর একটি বিরাট রাজনৈতিক সাফল্য।

রাসূলে করীম(স)ইয়াহুদিদের একান্ত আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কিছুমাত্র হস্তক্ষেপ করিতেননা।ইহার ফলে তাহাদের মনে যে বিদ্বেষ ও আশঙ্কার কালোমেঘ পুঞ্জিভূত হইয়াছিল,তাহা অতি সহজেই বিলীন হইয়া গেল। তাহারা নিজেরাই সোৎসাহে নিজেদের যাবতীয় ব্যাপারে রাসূলে করীম(স)-কেই সর্বোচ্চ বিচারক হিসাবে মানিয়া ইয়াছিল।আত্মীয়তার ভিত্তিতে তাহাতে কোনরূপ প্রভাব বিস্তার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হইয়া গেল। এইভাবে জাহিলিয়াত যুগের সমস্ত বাতিল নীতির নিদর্শনাদি নিঃশেষে মুছিয়া ফেলা হইল। অবস্থা এই দাঁড়াইল যে,ইয়াহুদীরা নবী করীম(স)-কে শুধু নিজেদের প্রশাসক মানিয়াই ক্ষান্ত হইল না, সমস্ত মদীনাকে তাহারা একটি ‘হারাম’(সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত এলাকা)ও বানাইয়া লইল।ইহাও রাসূলে করীম(স)-এর রাষ্ট্রনৈতিক প্রজ্ঞা ও ধীশক্তির একটা বিরাট পরাকাষ্ঠা ছিল।( পরবর্তী সময়ে অবশ্য ইয়াহুদিরা প্রকাশ্যে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার দরুণ মদীনা হইতে শেষ পর্যন্ত নির্বাসিত হইতে বাধ্য হইয়াছিল।)

মদিনা নগর-রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও উহার সংরক্ষণ ব্যবস্থার জন্য আভ্যন্তরীণ দৃঢ়তা বিধানের সঙ্গে সঙ্গে নগরীর উপকণ্ঠে বসবাসকারী গোত্রসমূহের সহিত মিত্রতার সম্পর্ক গড়িয়া তোলাও অপরিহার্য ছিল। এই উদ্দেশ্যে নবী করীম(স) পশ্চিম অঞ্চল ও সীমান্তবর্তী জিলাসমূহ পরিভ্রমণ ও পরিদর্শন করিয়া সেখানকার গোত্রসমূহের সহিত বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করনে। ফলে এইসব গোত্র মুসলমানদের সহিত প্রতিরক্ষার ব্যাপারে মিত্র শক্তি হইয়া দাঁড়াইল।অতঃপর মদীনার চতুর্দিকের গোত্রগুলি মুসলমানদের সহিত শত্রুতা করার পরিবর্তে বিশেষ সাহায্যকারী হইয়া উঠিল।

চূড়ান্ত পদক্ষেপ
মদীনার আভ্যন্তরীণ ও পারিপার্শ্বিক দিক দিয়া পূর্ণ নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ততা লাভ করার পর নবী করীম(স) মক্কার কুরাইশদের সহিত দশ বছরের জন্য সন্ধি-চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি “হুদাইবিয়া’ নামক স্থানে সম্পাদিত হওয়ায় ইতিহাসে ইহা ‘হুদাইবিয়া সন্ধি’ নামে পরিচিত।এই চুক্তি প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের জন্য ‘ফতহুম-মুবীন’-‘সুস্পষ্ট ও সমুদ্ভাসিত বিজয়’-নামে আল্লাহ্‌র কালাম কুরআন মজীদেই অভিহিত হইয়াছে। এই সন্ধি-চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার পর নবী করীম(স) সমগ্র আরব দেশে ব্যাপক ও সর্বাত্মকভাবে ইসলাম প্রচারের অবাধ ও নির্বিঘ্ন সুযোগ লাভ করিলেন। সেই সঙ্গে ইয়াহুদীদের শক্তি কেন্দ্র খায়বর হইতেও তাহাদিগকে চিরতরে ও সমূলে উচ্ছেদ করার উপায় হইয়া গেল।খায়বরের দুর্ভেদ্য দুর্গপ্রাকার জয় করার পর নবী করীম(স) সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও রক্তপাতহীন নিয়মে মক্কা শরীফ জয় করিতে সমর্থ হইলেন। অষ্টম হিজরী সনে মক্কা বিজয়ের পর নবী করীম(স) সমগ্র আরব উপদ্বীপটিকে ইসলামের একক ও নিরংকুশ শাসনাধীনে ঐক্যবদ্ধ করিয়া লইতে সমর্থ হইলেন। এইভাবে তিনি নিজের জীবনেই ইসলামী রাষ্ট্রকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর সংস্থাপিত করিয়া দিয়াছিলে।

বলা বাহুল্য,রাসূলে করীম(স) প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্রটি নিছক একটি রাষ্ট্রমাত্র ছিল না। ইহা ছিল বাস্তবে অস্তিত্বহীন একটি আদর্শবাদের পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন।যে বীজটি আরব ভূ-খন্ডেরই একটি নির্জন স্থানে অতিশয় গোপনে উপ্ত হইয়াছিল একুশ বৎসর পূর্বে, উত্তরকালে তাহাই এক বিরাট মহীরুপে পরিণত হইয়া সমগ্র আরব দেশকে নিজের সুশীতল ছায়াতলে আনিয়া বিশ্বমানবতার জন্য চিরস্থায়ী এক আলোক কেন্দ্র(Light House)স্থাপন করিয়া দিয়াছিল। অনন্তকাল পর্যন্ত দুনিয়ার মানুষের জীবনে এই আলক-কেন্দ্র হইতে অজস্র ধারায় আলোকচ্ছটা বিচ্চুরিত হইতে থাকিবে এবং অত্যাচার-নিপীড়নে জর্জরিত দিশাহারা মানুষ উহা হইতেই মুক্তি ও কল্যাণ পথের নির্ভুল সন্ধান লাভ করিতে থাকিবে।

নবী-প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য
এইখানে নবী করীম(স) প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা আবশ্যক। সংক্ষেপে তাহাই পেশ করা যাইতেছে।

(১)নবী-প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র সামাজিক-সামষ্ঠিক চুক্তি ও প্রতিশ্রুতির(Social Contract)ভিত্তিতে গড়িয়া উথা পৃথিবীর সর্বপ্রথম রাষ্ট্র ব্যবস্থা। মানব ইতিহাসে এই ধরনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোন দৃষ্টান্ত খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। নবুয়্যাতের ত্রয়োদশ বৎসর মদীনার লোকেরা স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে নবী করীম(স)-এর হাতে যে ‘বায়’আত’ করিয়াছিলেন এবং তাঁহাকে নিজেদের ধর্মীয় নেতার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা ও শাসকও মানিয়া লইয়াছিলেন, উত্তরকালে তাহাই পূর্ণ পরিণতি লাভ করিয়াছিল একটি পূর্নাঙ্গ সর্বাত্মক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়।

(২)এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার সার্বভৌমত্বের(Sovereignty) উৎস ছিল মহান আল্লাহ্‌র সত্তা-সম্পূর্ণ নিরক্কুশভাবে।সার্বভৌমত্ব বলিতে যাহা বুঝায়,তাহাতে অন্য কাহারও-স্বয়ং নবী করীম(স)-এর কোন অংশ ছিল না। হযরত মুহাম্মাদ(স) আল্লাহ্‌র রাসূল হিসাবে কুরআনী বিধানের ভিত্তিতে আইন প্রবর্তন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করিতেন।সার্বভৌমত্বের এই প্রশ্নটিই ইসলামী রাষ্ট্র ও দুনিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্র দর্শনের মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্যের ভিত্তিপ্রস্তর। রাসূলে করীম(স) আল্লাহ্‌র নিকট হইতে ‘অহী’পাইতেন। সেই অহীই ছিল আইনের মূল সূত্র।কিন্তু সার্বভৌমত্বের অধিকার হিসাবে তিনি নিজেকে কস্মিনকালেও পেশ করেন নাই।‘অহীর’ ব্যাখ্যা তিনিই প্রদান করিতেন। কিন্তু উহার বাস্তবায়নে নিজেকে কখনো বাদ(Exempted)দেন নাই। বরঞ্ছ অহীর মাধ্যমে তাঁহার নিজের কাজের ‘ত্রুটি’ও জনগনের সম্মুখে উদঘাটিত হইয়াছে। তিনি নিজেই নিজের ‘অপরাধ’ বিচারের জন্য লোকদের নিকট নিজেকে বারবার পেশ করিয়াছে। ইহার ফলে ‘বাদশাহ’কে বা ‘সর্বোচ্চ প্রশাসক’কে আল্লাহ্‌র আসনে বসাইবার সকল ধারণা ও নীতিমালা(‘বাদশাহ কখনও ভুল করিতে পারেন না’-বাদশাহকে কখনও অভিযুক্ত করা যাইতে পারে না ইত্যাদি)সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা প্রমাণিত হইয়া গেল। ইহাতে এই সত্যও প্রতিষ্ঠিত হইল যে,আল্লাহ্‌র নিরংকুশ সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে কোন ব্যক্তি ‘বাদশাহ’ বা স্বৈরতন্ত্রী হইতে পারে না। কোন দল বা গোষ্ঠীর পক্ষেও তাহা সম্ভব নয়। মানুষকে গোলাম বানাইবার অধিকার কাহারও থাকিতে পারে না।

(৩) ইহা একটি পুর্নাঙ্গ আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র(Ideological State)।নবী করীম(স)-ই ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত শাসনতন্ত্রের(Written Constitution) ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করেন। ইহা বংশ, দেশমাতৃকা,বর্ণ,ভাষা ও নিছক অর্থনৈতিক একাত্নতা-ভিত্তিক রাষ্ট্র ছিল না। ইহা ছিল ইসলামী জীবনাদর্শের ধারক ও বাহক জাতিধর্ম নির্বিশেষে গোটা বিশ্ব মানবতাকে ইসলামের প্রতি আহ্বানকারী প্রথম রাষ্ট্র। ইসলামী আদর্শের পূর্ণ বাস্তবায়ন ও উহার সর্বাত্মক বিজয় অর্জন এবং ইহার মাধ্যমে জনগনের সার্বিক কল্যাণ বিধানই এই রাষ্ট্রের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল।

উল্লেখ্য যে, ইসলামী রাষ্ট্র পাশ্চাত্ত্যের ফ্যাসিবাদী বা তথাকথিত গণতন্ত্রবাদী রাষ্ট্রের মত স্বতঃই কোন লক্ষ্য নয়-অর্থাৎ রাষ্ট্রের জন্য রাষ্ট্র নয়;বরং একটি আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি উন্নততর ও মহত্তর লক্ষ্য অর্জনই ইহার উদ্দেশ্য। আর তাহা হইল আল্লাহ্‌ ও তাঁহার রাসূলের পরিপূর্ণ আনুগত্য এবং আল্লাহ্‌র পরম সন্তুষ্টি অর্জন।একটি ধর্মহীন(Secular) গণতান্ত্রিক বা জাতীয় রাষ্ট্র কোন উচ্চতর নৈতিক বিধানের অনুগত হয় না। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র হয় উহার সম্পূর্ণ বিপরীত। ইহাতে ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক যাবতীয় ব্যাপার আল্লাহ্‌র বিধানের ভিত্তিতে সুসম্পুন্ন হইয়া থাকে।

(৪) ইসলামে ধর্ম ও রাষ্ট্র একই জিনিসের পার্থক্যহীন দুইটি দিক মাত্র। পার্থক্য শুধু শব্দের,মূল জিনিসের বা ভাবধারা দিক দিয়া ইহাতে কোন পার্থক্য নাই।এখানে যাহা ধরম,তাহাই রাজনীতি আর যাহা রাজনীতি,তাহাতেই ধর্ম নিহিত। ইসলাম স্বতঃই এক পুর্নাঙ্গ দ্বীন। মানব জীবন ও বিশ্ব-প্রকৃতির এমন কোন দিক নাই, যে বিষয়ে ইসলামের বিধান অনুপস্থিত। রাসূলে করীম(স) একই সঙ্গে আল্লাহ্‌র প্রতিনিধি হিসাবে জীবনের সর্বদিকে ও সর্বক্ষেত্রে অবিসংবাদিত নেতা। জীবনের বিভিন্নতা ও দ্বৈততা ইসলামের পরিপন্থী। বস্তুতঃরাষ্ট্রীয় ধর্মহীনতা বা ধর্মনিরপেক্ষতা উনবিংশ শতকের পোপতন্ত্রের প্রতিক্রিয়ার ফসল। বর্তমানে ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে ইহা সম্পূর্ণরূপে অতীত।ইহার ভিত্তিতে কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বর্তমানে যুগে অসম্ভব। কেননা সংশয়বাদ,মানসিক অস্থিরতা ও স্বার্থবাদ(Utilitarianism) ছাড়া উহা বিশ্বমানবতার জন্য অন্য কোন অবদানই রাখিতে পারে নাই।

(৫) ইসলামী রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থেই একটি গণ-অধিকারসম্পন্ন এবং জনমত ভিত্তিক কার্যকর রাষ্ট্র ব্যবস্থা।এখানে সমস্ত রাষ্ট্রীয় ব্যাপার জনগণের সমর্থন ও অনুমোদনের ভিতিতেই সুসম্পন্ন হইয়া থাকে বলিয়া রাষ্ট্রীয় মৌল নীতির বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের সাথে পরামর্শ ভিন্ন কার্যকর হইতে পারে না। এই নীতি রাসূলে করীম(স) কর্তৃক পুরাপুরি অনুসৃত।

ব্যক্তি স্বাধীনতা, সাম্য ও সুবিচার গণ- অধিকারসম্পন্ন রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি বিশেষ।এইগুলির যথাযথ বাস্তবায়ন ব্যতিত গণ-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবতা ধারণাতীত। রাসূলে করীম(স) প্রতিষ্ঠিত প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাই সর্বপ্রথম মানুষের প্রকৃত আজাদী কার্যকর হয়। ইসলামের কালেমা ‘লা-ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ ঘোষণায়ই ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিপ্লবী ভাবধারা এক অপূর্ব চেতনায় বিধৃত। এক আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কাহারোই –কোন-কিছুরই-একবিন্দু গোলামী করিতে প্রস্তুত না থাকার ইহা এক বিপ্লবাত্মক ঘোষণা ছাড়া আর কিছুই নয়।

আল্লাহ্‌র নির্ধারিত সীমার মধ্যে মানুষ ইসলামী রাষ্ট্রে সম্পূর্ণ আজাদ ও স্বাধীন।এখানে প্রত্যেকরই অধিকার সুনির্দিষ্ট।কোন অবস্থায়ই কাহারও অধিকার হরণ করার কাহারও অধিকার নাই। ইসলামের সোনালি যুগে কোন ব্যক্তিকে কোন অবস্থায়ই তাঁহার মৌলিক অধিকার হইতে বঞ্ছিত করা হইত না। কাহারও ব্যক্তিগত মত প্রকাশ ও প্রচার, পেশা-গ্রহন,সভা-সম্মেলন অনুষ্ঠান বা যত্রতন্ত্র যাতায়াতে শরীয়াত-ভিত্তিক কোন কারণ ছাড়া কখনও কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা বা বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হইত না। কেননা এইরুপ করা ইসলামের দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট জুলুম ছাড়া আর কিছুই নয়। এই কারণেই রাষ্ট্রপ্রধান রাসূলে করীম(স)-র সহিত মতবিরোধ করিয়া ভিন্নতর মত প্রকাশ করার অধিকারও প্রত্যেকেরই ব্যক্তিই পাইয়াছে।

এই রাষ্ট্রের সাম্য ও সততা দুইটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। একটি আদম সন্তান হওয়া-ইহার কারণে সমস্ত মানুষই মূলগতভাবে সমান। আর দ্বিতীয় ভিত্তি ভ্রাতৃত্ব। সমস্ত মুসলমান পরস্পরের ভাই এবং সর্বতোভাবে অভিন্ন।

সুবিচার এই রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সমদৃষ্টি ও নিরপেক্ষতা এই রাষ্ট্রের স্থায়ী নীতি।নবী করীম(স) নিজে সবসময় সুবিচার নীতিকে ভিত্তি করিয়াই ফয়সালা করিতেন। তাঁহার প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে আইনের প্রয়োগ ছিল নির্বিশেষ।এমন কি,একটি বিচার কার্যের সময় ‘ফাতিমা চুরি করিলে উহার দণ্ডস্বরূপ তাঁহারও হাত কাটা যাইবে’ বলিয়া ঘোষণা করিয়া তিনি বিচার ও আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমস্ত দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মূলোৎপাটন করিয়া দিয়াছেন।

(৬)ইসলামী রাষ্ট্র সঠিক অর্থে একটি জনসেবক ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র (Welfare State)ছিল। রাসূলে করীম(স) প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্রে জনগনের কেবল আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতাই করা হইত না,ইতিবাচকভাবে গন-অধিকার আদায় করা ও জনগনের দারিদ্র্য নির্মূল করার জন্যও চেষ্টা চালান হইত।পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের মত ‘অর্থোপার্জনের প্রতিযোগিতায় পরাজিত’দের সম্পূর্ণ অসহায় করিয়া রাখা এই রাষ্ট্রে মোটেই সম্ভবপর ছিল না। সকল লোকের সম্মুখে অর্থনৈতিক সুজগ-সুবিধার দ্বার সমানভাবে উন্মুক্ত করিয়া দেওয়ার পরও পিছনে পড়িয়া থাকা লোকদের আর্থিক নিরাপত্তার পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহন করা ছিল একমাত্র এই রাষ্ট্রেরই বিশেষত্ব। শুধু অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাই নয়, জনগনের নৈতিক মান উন্নতকরণ,তাহাদের মনে আল্লাহ্‌র ভয় জাগানো এবং দ্বীন ও শরীয়াত সম্পর্কে তাহাদিগকে সুশিক্ষিত করিয়া তোলার জন্যও নিরন্ততর গুরুত্ব সহকারে চেষ্টা চলানো হইত।

(৭)এই রাষ্ট্রের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হইল আল্লাহ্‌র নিকট জবাবদিহির তিব্রতম চেতনা।যাহা কিছুই করি না কেন,ব্যক্তিগত কাজ কিংবা জাতীয়-রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন-যে ধরনেই কাজ হউক না কেন-তাহা নিজের ঘরে গোপনে করা হউক,কি প্রকাশ্য-সব কিছুর মূলেই এই চেতনাটি প্রবল হইয়া থাকে। আর এই কারনেই এ রাষ্ট্রের কোন ক্ষেত্রেই আল্লাহ্‌র নাফরমানী,গণঅধিকার হরণ এবং জুলুম-নির্যাতনের কোন একটি ঘটনাও সংঘটিত হইতে পারিত না। এই দিকটির উপর আতদূর গুরুত্ব আরোপ করা হইত যে, রাষ্ট্রপ্রধান হইতে শুরু করিয়া নিম্নতম সহকারী কর্মচারী নিয়োগে সর্বাধিক আল্লাহভীরু ব্যক্তিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হইত। ******(আরবী) ‘তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহ্‌ভীরু ব্যক্তিই তোমাদের মধ্যে আল্লাহ্‌র নিকট সর্বাধিক সম্মানার্হ’ এই মূলনীতিই ছিল এই কাজের ভিত্তি।কেননা রাষ্ট্রনেতা বা সরকারী দায়িত্বশীল লোকেরা আল্লাহ্‌ভীরু না হইলে গোটা জাতিই চরম নাফরমান হইয়া যাইবে। তাহারা নীতিবান না হইলে গোটা জাতিই দুর্নীতিপরায়ণ হইয়া যাইবে-ইহা স্বাভাবিক। রাষ্ট্রনেতা ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এবং সরকারী কর্মচারীগণ দুর্নীতিপরায়ণ না হইলে সাধারণ মানুষের পক্ষে দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়া কক্ষনই সম্ভব হইতে পারে না। এমনকি তাহার ধারণাও করা যায় না। এই কথাটি যেমন সত্য, তেমনি ইহার বিপরীত কথাটিও সত্য। বিশ্বনবী প্রতিষ্ঠিত আদর্শ রাষ্ট্রের এই বৈশিষ্ট্যসমূহ ঐতিহাসিক। ইতিহাসে এইরূপ বৈশিষ্ঠ্যের অধিকারী অন্য কোন রাষ্ট্রেরি নাম খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।

বিশ্বনবী প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র-ব্যবস্থার এই বৈশিষ্ঠ্যসমূহ সম্মুখে রাখিয়া তুলনামূলক আলোচনা করিলে প্রমাণিত হইবে যে, দুনিয়ার অন্যান্য রাস্ত্রের-তাহা রাজনৈতিক হউক কি তথাকথিত ধর্মহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র,পুজিবাদি রাষ্ট্র হউক কিংবা সমাজাতান্ত্রিক তথা কমিউনিস্ট রাষ্ট্র-কোন একটির সাথেও ইহার কোন তুলনা হয়না। একালের কোন ধরনের রাষ্ট্রই সার্বিক মানবিক কল্যাণের দিক দিয়া বিশ্ব নবী প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্রের সমতুল্য হইতে পারে না। দুনিয়ার এসব রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেসব নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং মানব-কল্যাণের যেসব বড় বড় দাবি করা হয়, উহার অবৈজ্ঞানিকতা,যুক্তিহীনতা, অমানবিকতা ও অন্তঃসারশূন্যতা বহু পূর্বেই প্রমানিত হইয়াছে। সেসবের ব্যর্থতা সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু বিশ্বনবী প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের মূলনীতি যেমন স্বভাবসিদ্ধ,তেমনি শাশ্বত,চিরন্তন।ব্যক্তি মানুষ ও মানবসমষ্ঠির প্রকৃত কল্যাণ কেবল এই ধরনের রাষ্ট্র-ব্যবস্থার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। অন্য কোন ধরনের রাষ্ট্র দ্বারাই ইহা সম্ভব হইতে পারে না।

জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ(স) এই আদর্শ রাষ্ট্রের পরিচালনা করিয়া গিয়াছেন।‘খিলাফতে রাশেদা’ এই রাষ্ট্রেরই পরবর্তী নাম, ইহারই যথার্থ উত্তরাধিকারী।

 

খিলাফতে রাশেদা
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর ইন্তেকালের পর যে চারজন প্রধান সাহাবী ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করিয়াছেন, ইতিহাসে তাহাদিগকেই “খুলাফায়ে রাশেদুন”নামে অভিহিত করা হয় এবং তাঁহাদের পরিচালিত রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকেই বলা হয় “খিলাফতে রাশেদা”। ‘খুলাফায়ে রাশেদুনে’র শাসন দীর্ঘকাল স্থায়ী না থাকিলেও বিশ্বের ইতিহাসে তাহা সর্বাধিক মর্যাদা লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছে। শুধু মুসলিম ঐতিহাসিকগণই নহেন,অমুসলিম-এমন কিন মুসলিম-দুশমন ঐতিহাসিকগণও –খুলাফায়ে রাশেদুনের শাসন আমল্কে মানব-ইতিহাসের ‘স্বর্ণ-যুগ’ বলিয়া শ্রদ্ধা জানাইতে বাধ্য হইয়াছেন। বর্তমান পর্যায়ে আমরা ‘খিলাফতে রাশেদার’ বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য ও বৈশিষ্ঠ্য সম্পর্কে আলোচনা করিব।

খিলাফত
‘খিলাফত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘প্রতিনিধিত্ব’।ইহার ব্যবহারিক অর্থ, ‘অন্য কাহারো অপসৃত হওয়ার পর তাহার স্থানে উপবেশন করা’। এই শব্দটি স্বতঃই এই কথা প্রমাণ করা যে,উহাই আসল নয়, আসলের প্রতীক মাত্র;কায়া নয় ছায়া,দর্পণের প্রতিবিম্ব।অন্য কথায় মূল পদের স্থলাভিষিক্ত হওয়ারই নাম খিলাফত। ‘ইমাম’ শব্দও এই অর্থেই ব্যবহৃত হয় এবং ‘খলীফা’ ও ‘ইমাম’ এই শব্দদ্বয় একই ব্যক্তির দুইটি স্বতন্ত্র দিককে প্রকাশ করে। পূর্ববর্তী দায়িত্বশীলের প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত হওয়ার দিক দিয়া সে খলীফা এবং সমসাময়িক যুগের জনগণের অনুসরণীয় ও সর্বাধিক গণ্যমান্য হওয়ার কারনে সে ‘ইমাম’ ও ‘নেতা’।বস্তুতঃ পয়গম্বরের স্থলাভিষিক্ত হওয়া এবং তাঁহার অন্তর্ধানের পর গোটা উম্মতের নেতৃত্ব দানকেই বলা হয় ‘খিলাফত’ ও ‘ইমামত’। নবী করীম(স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ “তোমাদের পূর্বে বনী ইসরাইল গোত্রের নবী ও পয়গম্বরগণই নেতৃত্ব দান ও রাষ্ট্র পরিচালনা করিতেন;এক পয়গম্বরের অন্তর্ধানের পর আর এক পয়গম্বর আসিয়া তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হইতেন। কিন্তু এখন(আমার পর) নবুয়্যাতির ক্রমিকধারা সম্পূর্ণ হইয়াছে(এখন আর কেহ নবী বা রাসূল হইবে না)।অতঃপর তোমাদের মধ্য হইতে খলিফাগণই অগ্রগামী হইবে”।

এই হাদিস হইতে এ কথা পরিস্ফুটিত হইয়া উঠে যে, পয়গম্বরীর প্রতিনিধিত্ব করাকেই খিলাফত বলা হয় এবং ইসলামে নবুয়্যাতের পর ইহাই সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন,শ্রদ্ধাভাজন ও পবিত্র দায়িত্বপূর্ণ পদ। এইজন্য ইসলামের ‘খলিফা’গন কুরআন ও সুন্নাতের মূলকে ভিত্তি করিয়া রাষ্ট্র পরিচালনা ও মানব-সমস্যার সমাধানের জন্য যেসব বিধান ও নির্দেশ দান করেন, তাহা অবশ্যই সর্বজনমান্য হইবে। রাসূলে করীম (স) পূর্বাহ্ণেই একথা ঘোষণা করিয়াছেনঃ ‘আমার পর আমার ‘হেদায়েতপ্রাপ্ত’ খলিফাগণকে মানিয়া চলিবে’। এই কারণেই খলীফা নির্বাচন করার সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও শাসনতান্ত্রিক জজ্ঞতা-দক্ষতার দিকে যত-না দৃষ্টি দেওয়া উচিত,তদপেক্ষা অধিক লক্ষ্য আরোপ করিতে হইবে নবীর সংস্পর্শে(কিংবা নবীর অবর্তমানে তাঁহার আদর্শ অনুসরণে) তিনি নিজেকে কতখানি পরিশুদ্ধ করিতে সক্ষম হইয়াছেন এবং তাঁহার আধ্যাত্মিক জ্ঞান-বিদ্যা ও নৈতিক বৈশিষ্ট্য কতটুকু আছে,সেই দিকে। হযরত আবূ বকর সিদ্দিক,হযরত উমর ফারুক,হযরত উসমান গনী ও হযরত আলী মুরতাজা(রা)-এই চারজনকে পর্যায়ক্রমে খলীফার পদে নির্বাচন করায় উপরোক্ত নীতির নিগূঢ় তাৎপর্য ও যথার্থতা সুপরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে।

বস্তুতঃইসলামে খিলাফতের দায়িত্ব কর্তব্য অত্যন্ত ব্যাপক ও সর্বাত্মক। যাবতীয় বৈষয়িক,ধর্মীয় ও তামাদ্দুনিক লক্ষ্য উহারই মাধ্যমে অর্জিত হইয়া থাকে।পয়গম্বরের আরব্ধ কার্যাবলীকে সচল ও প্রতিষ্ঠিত রাখা এবং সকল প্রকার সংমিশ্রণ হইতে উহার সংরক্ষণ ও উৎকর্ষ সাধন করা-এই সংক্ষিপ্ত বাক্য দ্বারাই খিলাফতের দায়িত্ব মোটামুটিভাবে ব্যাখ্যা করা যাইতে পারে।আর একটিমাত্র যুক্ত শব্দ দ্বারা ইহা বুঝাইতে হইলে বলা যায়-‘ইক্কামতে দ্বীন’।এই শব্দটিও এত ব্যাপক অর্থবোধক যে,দ্বীন ও দুনিয়ার সব রকমের কাজই উহার মধ্যে শামিল হইয়া যায়। নামায-রোযা,হজ্জ-যাকাত,আইন-কানুন,শাসন-শৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও প্রচলন-এক কথায় সমস্ত তামাদ্দুনিক ও আধ্যাত্মিক কাজ সম্পাদনই খিলাফতের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। নবী করীম(স)-এর পবিত্র জীবন এই সব মহান দায়িত্ব সম্পাদনেই অতিবাহিত হইয়াছে। তাঁহার পর যাঁহারা তাঁহার প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত হইয়াছেন,তাঁহারা নিজেদের সমগ্র জীবন এই উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্নই সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত করিয়াছেন।নবী করিম(স)-এর জীবনকাল হইতেই এইসব কাজে বিভিন্ন লোক জিম্মাদার হিসাবে নিযুক্ত ছিল। নামাযের ইমামতি করার জন্য,সাদকা ও যাকাত আদায় করার জন্য আলাদাভাবে লোক নিয়োগ করা হইয়াছিল। অন্যায় কাজের প্রতিরোধ ও ন্যায় কাজের প্রচার প্রসার এবং জনগণের পারস্পরিক বিবাদ-বিসম্বাদের নিরপেক্ষ বিচার ও ফয়সালার কাজ যোগ্যতাসম্পন্ন লোক দ্বারা সমাধা করা হইত।শত্রুর সহিত মোকাবিলা ও হইত। শত্রুর সহিত মোকাবিলা ও সৈন্য পরিচালনা এবং কুরআন শরীফ শিক্ষাদানের দায়িত্ব স্বতন্ত্র লোকের উপর অর্পিত ছিল। কিন্তু যেহেতু এই যেহেতু এই সমস্ত কাজই খিলাফতের মূল দায়িত্বের মধ্যে শামিল, সেইজন্য স্বতন্ত্রভাবে এইসব দায়িত্ব পালনের উপযোগী যোগ্যতা ও বৈশিষ্ট্য সবই এককভাবে এক খলীফার মধ্যে বর্তমান থাকা একান্তই আবশ্যকীয় ছিল। শুধু তাহাই নয়,আধ্যাত্মিক গুন-বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়া খলীফার মধ্যে নবীসুলভ শিক্ষা ও প্রজ্ঞা বলিষ্ঠভাবে বর্তমান থাকা জরুরী এবং নবী যাহাদের মধ্যে এই ধরনের আধ্যাত্মিক দক্ষতা দেখিতে পান, তাহাদিগকেই নিজের স্থলাভিষিক্ত করার কথা জীবিতাবয়স্থায়ই ইশারা-ইঙ্গিতে প্রকাশ করিয়া যান।অবশ্য অনাকাঙ্ক্ষিত বিশৃঙ্খলা,রক্তপাত ও অবস্থার পরিবর্তন খিলাফতের মূল লক্ষ্যকে চল্লিশ বৎসর পরই ব্যর্থ করিয়া দিয়াছে এবং উহার কর্তৃত্বভার এমন সব লোকের হস্তে অর্পিত হইয়াছে,যাহারা কোন দিক দিয়াই এই গুরুত্বপূর্ণ পদের যোগ্য ছিল না, একথা অবশ্যই স্বীকার্য। কিন্তু বিশ্বনবীর হেদায়েত অনুযায়ী পরবর্তী খলীফা ও শাসকদের নির্বাচন করা হইলে মানব সমাজের চেহারা সর্বতোভাবে ভিন্ন রকমের হইত,তাহাতে সন্দেহ নাই।

কুরআন ও হাদীস হইতে খলীফার যোগ্যতা-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যাহা কিছু জানা যায়, উহার দৃষ্টিতে যাচাই করিলে একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, ‘খুলাফায়ে রাশেদুন’ই ছিলেন মুসলিম জাহানের খলীফা হওয়ার সর্বাধিক উপযোগী। কুরআন হাদীসের বর্ণিত গুন-বৈশিষ্ট্য তাঁহাদের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় মওজুদ ছিল এবং সেই কারনে তাঁহারা খিলাফতকে সুষ্ঠু নীতিতে পরিচালিত করিতে পারিবে বলিয়া জনমনে পূর্ণ আস্থা বিদ্যমান ছিল।খিলাফতে রাশেদার দায়িত্ব পালনের জন্য কুরআনের দৃষ্টিতে নিম্নলিখিত গুন-বৈশিষ্ট্য অপরিহার্য মনে করা হইয়াছে। অতএব,নবী করীম(স)-এর পরে যাহাদের মধ্যেই এই গুণাবলী পরিস্ফুট হইবে,তাহারাই সর্বশ্রেষ্ঠ বলিয়া গণ্য হইবে।

(১)খলীফাকে প্রথম পর্যায়ের ‘মুহাজির’ হইতে হইবে এবং হোদাইবিয়ার সন্ধি,বদর ও তবুক যুদ্ধে শরীক ও সূরায়ে নূর অবতীর্ণ হওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন-এমন হইতে হইবে;

(২)বেহেশতবাসি হইবার সুসংবাদপ্রাপ্তদের মধ্যে গণ্য হইতে হইবে;

(৩)সিদ্দীক,শহীদ প্রভৃতি ইসলামী সমাজের উচ্চ পর্যায়ের লোকদের মধ্যে গণ্য হইতে হইবে।

(৪)নবী করীম(স)-এর কোন ব্যাবহার, কাজ বা কথা দ্বারা একথা প্রমাণিত হইতে হইবে যে,তিনি নিজে কাহাকেও খলীফা নিযুক্ত করিলে তাহাকেই নিযুক্ত করিতেন।

(৫)আল্লাহ্‌ তা’আলা রাসূলের নিকট যেসব ওয়াদা করিয়াছেন, তাহা তাঁহার সত্তা দ্বারা বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব হইতে হইবে।

(৬)তাঁহার কথা ইসলামী শরীয়াতে প্রমাণিত হইতে হইবে।

এই গুণাবলির বিচ্ছিন্নভাবে অসংখ্য সাহাবীর মধ্যে বর্তমান ছিল; কিন্তু এইগুলির পূর্ণ সমন্বয় ঘটিয়াছিল মাত্র চারজন সাহাবীর মধ্যে।ইঁহারা প্রথম পর্যায়ের মুহাজির ছিলেন,হোদাইবিয়া চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সময় ইঁহারা উপস্থিত ছিলেন;বদর,ওহোদ,তবুক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ-সংগ্রামে ইঁহারা ছিলেন অগ্রবর্তী।এইভাবে খিলাফতের যোগ্যতার জন্য অপরিহার্য গুণাবলির মধ্যে কোন একটি হইতেও ইঁহারা বঞ্চিত ছিলেন না। উপরন্তু ইঁহাদের প্রত্যেকেই সম্পর্কেই রাসূলে করীম(স)-এর সুস্পষ্ট মর্যাদাপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হইয়াছে।হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) সম্পর্কে নবী করীম (স)বলিয়াছেনঃ ‘আমার উম্মাতের মধ্যে তুমিই সর্বপ্রথম বেহেশতে প্রবেশ করিবে। ‘হাওযে-কাওসারে’ তুমিই হইবে আমার সঙ্গী;কেননা পর্বত গহ্বরে তুমিই আমার সাথী ছিলে’। হযরত উমর(রা) সম্পর্কে নবী করীম(স)-এর এই উক্তি বর্ণিত হইয়াছেঃ ‘উমরের কামনায়ই অসংখ্য আয়াত নাজিল হইয়াছে’।হযরত উস্মান(রা) সম্পর্কে রাসূল (স) বলিয়াছেনঃ ‘ফিরেশতাও যাহাকে সম্মান-শ্রদ্ধা জানায়,আমি কি তাঁহাকে সম্মান না জানাইয়া পারি?’ আরও বলিয়াছেনঃ ‘প্রত্যেক নবীরই বন্ধু থাকে,বেহেশতে উসমান হইবে আমার বন্ধু’।হযরত আলী(রা) সম্পর্কে নবী করীম(স)ইরশাদ করিয়াছেনঃ ‘তোমার সঙ্গে আমার হারুন ও মূসার ন্যায় সম্পর্ক স্থাপিত হউক, ইহা কি তুমি চাও না?আল্লাহ্‌ ও রাসূল যাহার প্রিয়পাত্র, আমি আগামীকাল তাঁহার হস্তেই ঝাণ্ডা তুলিয়া দিব’। এতব্দ্যতীত নবী করীম (স) ইহাদের গুণ-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরো অনেক মূল্যবান কথাই বলিয়াছেন।সেইসব কথা দ্বারা একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে,হযরতের দৃষ্টিতে তাঁহার অন্তর্ধানের পর ইঁহারাই ছিলেন খিলাফতের পদে নির্বাচিত হইবার সর্বাধিক উপযুক্ত এবং অধিকারী।

খিলাফতের মৌল আদর্শ
খিলাফত সম্পর্কিত আলোচনাকে গভীর ও ব্যাপকভাবে অনুধাবন করার জন্য উহার রাষ্ট্র-রূপকে যাচাই করা অত্যন্ত জরুরী। এই ব্যাপারে সর্বপ্রথম নেক চরিত্রবিশিষ্ট লোকদের প্রতিই এই ওয়াদা ঘোষিত হইয়াছে। তাই রাষ্ট্রের প্রতিটি(মুসলিম) নাগরিকই খলীফা মর্যাদাসম্পন্ন এবং খিলাফতের দায়িত্ব পালনের সমান সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকারী। এক্ষেত্রে কেবলমাত্র ব্যাক্তিগত চরিত্র,মানবীয় গুন-বৈশিষ্ট্য ও তাকওয়ার-পরহেজগারীর ভিত্তিতেই মানুষের মধ্যে পার্থক্য করা যাইবে।

তৃতীয়তঃ মানবতার ইতিহাসে যখনি আল্লাহ্‌র সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে কোন খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে সেখানেই সমাজের মধ্য হইতে কেবলমাত্র সর্বাধিক নেক ও পরহেজগার এবং উন্নত-আদর্শ চরিত্রবান লোকেরাই খলীফা হওয়ার-রাষ্ট্র পরিচালনা করার সুযোগ লাভ করিয়াছে। আর সাধারণ জনতা আল্লাহ্‌র দেওয়া মৌলিক অধিকার পূর্ণ ইনসাফ ও নিরপেক্ষভাবে ভোগ করিতে পারিয়াছে। কাহারও ক্ষেত্রে সেই অধিকারের এক বিন্দু হরণ করা কিংবা সংকুচিত করা হয় নাই,কাহারো স্বাভাবিক কর্মপথে বিন্দুমাত্র প্রতিবন্ধকতারও সৃষ্টি করা হয় নাই;বরং প্রত্যেকের স্বাভাবিক ক্ষমতা ও প্রতিভাকে আল্লাহ্‌র আইনসম্মত পন্থায় উৎকর্ষ ও ক্রমবিকাশ লাভের সুযোগ করিয়া দেওয়া হইয়াছে।

ইসলামের বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক বাক্তিই আল্লাহ্‌র নিকট জওয়াবদিহি করিতে বাধ্য। এই ব্যাপারে কাহাকেও অতি-মানবের আসনে বসাইয়া আল্লাহ্‌র সহিত শরীক করা যাইতে পারে না। ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান,খলীফা বা ‘আমিরুল মু’মিনীন’ পদে নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে প্রত্যেক মুসলিম নাগরিকেরই সমান অধিকার রহিয়াছে। এক্ষেত্রে পদপ্রার্থী হওয়ার কিংবা পদলাভের জন্য চেষ্টা করার অধিকার যেমন কাহারো নাই, তেমনি নাগরিকদের অবাধ সম্মতিতে নির্বাচিত হইলে দায়িত্ব পালনেও সকলেই বাধ্য। খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁহার মর্যাদায় শুধু এতটুকু পার্থক্য ঘটে যে,জনগন নিজ নিজ খিলাফতের মর্যাদা ও অধিকার তাঁহার হস্তে অর্পণ করিয়াছে মাত্র।কেবল সে-ই খলীফা, অন্য কেহ খলীফা নয়, ইসলামী আদর্শবাদের দৃষ্টিতে একথা কিছুমাত্র সত্য নয়। খিলাফতের শক্তি নাগরিকদের সামাজিক ও সামগ্রিক নিয়ম-শৃঙ্খলা সংরক্ষণ ও অপরিহার্য আইন-কানুন জারিকরণের দায়িত্ব পালনে সর্বতোভাবে নিয়োজিত থাকে। এই শক্তির সংহতি বিধান ও ইহাকে সুনিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য ইহা সাধারনের নির্বাচিত ও সর্বাধিক যোগ্যতম ব্যক্তির সত্তায় কেন্দ্রিভূত হওয়া আবশ্যক।

খলীফা বা ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের সময় ব্যক্তির জ্ঞান-বুদ্ধি, শিক্ষা-দীক্ষা,মন-মানস,বিচক্ষণতা ও সাংগঠনিক-যোগ্যতাই শুধু দেখিলে চলিবে না, তাহার চরিত্র কত পবিত্র,নির্ভরযোগ্য ও আস্থাভাজন,বিশেষ গুরুত্ব সহকারে তাহাও লক্ষ্য করিতে হইবে।

ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা খলীফাকে ‘মাসুম’ বা নিস্পাপ ঘোষণা করে নাই।খলীফাকে নিস্পাপ ও নির্ভুল মনে করিয়া লওয়ারও কোন যুক্তি নাই। প্রতিটি মুসলিমই তাহার কেবল সরকারী দায়িত্ব পালন ও কার্য সম্পাদন সম্পর্কেই নহে,তাহার পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন-ধারারও সমালোচনা করিতে পারে।আইনের দৃষ্টিতে তাহার মর্যাদাও হইবে সাধারণ নাগরিকের সমান।আদালতে তাহার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের করা যাইতে পারে এবং সে সাধারণ নাগরিকদের মতই বিচারকের সম্মুখে হাযির হইতে বাধ্য। সেখানে তাহাকে তথায় কোন প্রকার বিশিষ্টতা দান করা হইবে না।

খলীফার প্রতি আল্লাহ্‌র কোন অহি নাজিল হয় না; সুতরাং কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা-বাস্তবায়নের ব্যাপারে সে কোন বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার দাবি করিতে পারে না।

খলীফা কেবল নিজস্ব মত অনুসারেই কার্য সম্পাদন করিতে পারে না,জনসমর্থিত ও যোগ্য-সুদক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত মজলিসে শূরা’র(Parliament) সহিত পরামর্শ করিয়াই তাহাকে যাবতীয় কাজ সম্পাদন করিতে হইবে। মজলিসে শূরার সংখ্যাগরিষ্ঠ মত অনুসারেই সিদ্ধান্ত গ্রহন করিতে হয়,এ কথা ঠিক;কিন্তু তাহা সত্ত্বেও সংখ্যাধিক্য খিলাফতী শাসন-ব্যবস্থায় ভাল-মন্দবা করনীয়-বর্জনীয় নির্ধারণের কোন স্থায়ী মানদণ্ড নহে। তাই খলীফা কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে সংখ্যাগুরুর ফয়সালার সহিতও দ্বিমত পোষণ করিতে পারে এবং সে কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে যাহা সত্য বলিয়া প্রত্যয় করিবে,তদনুযায়ী কাজও করিতে পারে।অবশ্য এই সমগ্র ক্ষেত্রেই মুসলিম জনতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করিবেঃখলীফা সামগ্রিকভাবে কুরআন-সুন্নাহ অনুসারে কাজ করে, না নিজস্ব খেয়ালখুশী অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে।দ্বিতীয় অবস্থার খলীফা ইসলামী জনতার নিকট হইতে একবিন্দু আনুগত্য পাইবার অধিকার রাখে না,বরং তাহার পদচ্যুতির ব্যবস্থা করাই তাহাদের কর্তব্য হইয়া পড়ে। এইদিক দিয়াও পাশ্চাত্য রাষ্ট্রদর্শন ও শাসনতন্ত্রের সহিত ইসলামী রাষ্ট্রদর্শন ও খিলাফতী গণ-অধিকারবাদের মধ্যে আসমান-জমিন পার্থক্য সুস্পষ্ট।

খুলাফায়ে রাশেদুন
ইতিহাসের যে পর্যায়টি হযরত আবূ বকর সিদ্দীকের(রা) খিলাফত হইতে শুরু করিয়া হযরত আলী(রা) পর্যন্ত বিস্তৃত, ইতিহাসে তাহাই হইতাছে ‘খিলাফতে রাশেদা’র যুগ। আর ৬৩২ ঈসায়ী(১১ হিজরী) হইতে ৬৬১ ঈসায়ী (৪০ হিজরী) পর্যন্ত মুসলিম জাহানের যাঁহার রাষ্ট্রনেতা ছিনেল,তাহাদিগকেই ‘খুলাফায়ে রাশেদুন’ বলিয়া অভিহিত করা হয়।ইঁহাদের মোট সংখ্যা চার এবং ইঁহাদের খিলাফত কালের মোট মুদ্দৎ ত্রিশ বৎসর মাত্র।(অবশ্য উমার ইবনে আব্দুল আজীজ (র)ও ইসলামী খিলাফতের নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচিত ও দায়িত্ব পালনে সক্ষম হওয়ায় তিনিও ‘খুলাফায়ে রাশেদ’ রূপে গণ্য)

নবী করীম (স) যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন পর্যন্ত নবুয়্যাত,আইন প্রণয়ন,সর্ব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দান,বিচার বিভাগ ও সৈন্য বাহিনী পরিচালনা এবং দেওয়ানী সরকারের যাবতীয় দায়িত্বপূর্ণ পদ হযরতের একক ব্যক্তিসত্তায় কেন্দ্রীভূত ছিল; তিনি একাই এই সমস্ত কাজের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব করিতেন।তাঁহার ইন্তিকালের পর তাঁহার স্থলাভিষিক্ত কে হইবে, এই প্রশ্ন ইসলামী জনতার সম্মুখে অত্যন্ত প্রকট হইয়া দেখা দেয়।যেহেতু নবুয়্যাতের সমাপ্তি হইয়া গিয়াছে-অতঃপর কেহই নবী হইবেন না; কিন্তু রাসূলের স্থলাভিষিক্ত যে হইবে তাহাকে এই নবুয়্যাত ছাড়া ও নবুয়্যাত ব্যতিত আর সমস্ত দায়িত্বই পূর্বানুরুপ আঞ্জাম দিতে হইবে-এই কারনেও এই প্রশ্ন অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব সহকারে নেতৃস্থানীয় ভাবিত ও বিব্রত করিয়া তোলে।নবী করীম(স)-এর নবুয়্যাত ও স্বভাব সুলভ নেতৃপদের উত্তরাধিকারী কেহই হইতে পারে না।অন্যদিকে তাঁহার কোন পুত্র-সন্তানও জীবিত ছিলনা।থাকিলেও তাহাতে খলীফা নির্বাচন সমস্যার কোন সমাধানই হইতে পারিত না। কাজেই এই দুইটি প্রশ্ন জটিলভাবে মাথা চাড়া দিয়া উঠিয়াছিলঃ

১-খলীফা কোন পরিবার বা গোত্র হইতে হইবে?

২-খলীফা নিয়োগের পন্থা কি হইবে?

কুরআন মজীদের কোথাও খিলাফতকে কোন বংশ বা গোত্রের জন্য বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হয় নাই। হাদীসে যেখানে *****(আরবী)- ‘নেতা বা খলীফা কোরাইশদের মধ্য হইতে নিযুক্ত করিতে হইবে’ বলিয়া উল্লেখ পাওয়া যায়,সেখানেও স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ রহিয়াছেঃ

‘তোমাদের উপর কোন হাবশী গোলামও শাসক নিযুক্ত হইলে তোমারা তাহার অবশ্যই আনুগত্য করিবে’। কাজেই এতদুভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের পন্থা অনুসন্ধান করা আবশ্যক। একটু গভীর ও সুক্ষ দৃষ্টিতে চিন্তা করলেই বুঝিতে পারা যায় যে,মূলতঃএই দুইটি হাদিসই সত্য ও বাস্তব তত্ত্ব-ভিত্তিক ঘোষণা।ইসলামে খিলাফতকে কোন বংশ-গোত্র পরিবার কিংবা কোন ব্যক্তি বা শ্রেণীর জন্য বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হয় নাই, এ-কথা চিরন্তন সত্য। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সকল সময় ও অবস্থায়ই এই মূলনীতি অনুযায়ী কাজ হইতে হইবে,ইহাতে সন্দেহ নাই;কিন্তু নবী করীম (স)যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন, তাহাঁরই অব্যবহিত পড়ে উহার দায়িত্বভার পালনের জন্য কুরাইশ বংশের লোক অপেক্ষা অপর কোন বংশের লোক যে কিছুমাত্র যোগ্য বা দক্ষতাসম্পন্ন ছিল না, তাহাও এক অনস্বীকার্য ঐতিহাসিক সত্য।খিলাফতে রাশেদার ও ইহার পরবর্তী কালের ইতিহাসই এই কথার সত্যতা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে।কাজেই খিলাফতে রাশেদার চারজন খলীফাই কুরাইশ বংশের লোকদের মধ্য হইতে নির্বাচিত হওয়া সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত হইয়াছে। কেননা তাহা না হইলে তদানীন্তন আরব-সমাজের মধ্য হইতে বিশেষ যোগ্যতা ও দক্ষতা সহকারে খিলাফতের দায়িত্ব পালন করা অপর কাহারো পক্ষেই সম্ভব হইত না। কিন্তু ইহা কোন চিরন্তন ও শাশ্বত নিয়ম নহে; ‘খিলাফতে রাশেদা’র পরও খলীফার কুরাইশ বংশোদ্ভূত হওয়ার কোন শর্তই ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় স্বীকৃত নয়।১ {বলা বাহুল্য, ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও এই ধরনের কোন শর্তের কথা উল্লেখ করেন নাই।}

খলীফা নির্বাচনের বাস্তব ও সুস্পষ্ট কোন পদ্ধতি কুরআন-হাদীসে উল্লেখিত হয় নাই।মনে হয়,সেজন্য কোন বিশেষ পন্থাকে স্থায়ীভাবে স্বীকার করিয়া লওয়া এবং যুগ-কাল-স্থান-নির্বিশেষ সর্বত্র উহার অনুসরণকেই গোটা উম্মতের উপর বাধ্যতামূলকভাবে চাপাইয়া দেওয়া ইসলামের শাশ্বত বিধানের লক্ষ্য নয়। এই জন্য নির্বাচনের কোন বিশেষ পদ্ধতির(Form or Process) পরিবর্তে একটি শাশ্বত মূলনীতি পেশ করা হইয়াছে।বলা হইয়াছেঃ*****(আরবী) “ইসলামী আদর্শবাদীগণ নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে সম্পন্ন করিয়া থাকে’। আর রাষ্ট্রপ্রধান বা খলীফা নির্বাচনই যে মুসলিম সমাজে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও সামষ্ঠিক ব্যাপার এবং মুসলিম জনতার অবাধ রায় ও পরামর্শের ভিত্তিতেই যে ইহা সুসম্পন্ন হওয়া উচিত,তাহাতে কাহারো দ্বিমত থাকিতে পারে না। অতএব, জনমতের ভিত্তিতে খলীফা নির্বাচন করিতে হইবে- ইহাই হইল ইসলামী নির্বাচনের একমাত্র মূলনীতি। এই নীতিকে মুসলিম উম্মত বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিভাবে প্রয়োগ করিয়াছে ও নির্বাচন-সমস্যার সমাধান করিয়া লইয়াছে,এখন তাহাই আমাদের বিচার্য।

খুলাফায়ে রাশেদুনের নির্বাচন
খলীফা নির্বাচনের উপরোল্লেখিত মূলনীতিকে খুলাফায়ে রাশেদুনের নির্বাচনের ব্যাপারে নিম্নলিখিত রূপে প্রয়োগ করা হইয়াছেঃ

(১)নবী করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর মুসলিম উম্মতের দায়িত্বশীল নাগরিকগন ‘সকীফায়ে বনী সায়েদা’ নামক(টাউন হল কিংবা পরিষদ ভবনের সমমর্যাদাসম্পন্ন)স্থানে মিলিত হন এবং প্রকাশ্যভাবে দীর্ঘ ও বিস্তারিত আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে হযরত আবূ বকর(রা)-কে খলীফা নির্বাচিত করেন।উপস্থিত জনতা তখন-তখনি অকুণ্ঠিতভাবে তাঁহার আনুগত্যর শপথ(বায়’আত) গ্রহন করে এবং খলীফা নির্বাচিত হইয়াই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব,কর্তব্য ও নীতি-নির্ধারকমূলক ভাষণ দান করেন।

(২)হযরত উমর ফারুক(রা)-এর নির্বাচনে স্বতন্ত্র পদ্ধতি অবলম্বিত হইয়াছে।প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক(রা) তাঁহার গোটা ইসলামী জিন্দেগী ও খলীফা-জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী তথা বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বুঝিতে পারিয়াছেন যে, তাঁহার পর খলীফা হওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তি সমগ্র জাতির মধ্যে হযরত উমর(রা)অপেক্ষা দ্বিতীয় কেহ বর্তমান নাই।তাঁহার খিলাফতকালীন যাবতীয় ঘটনা ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারী ও বেসরকারী কাজে হযরত উমর(রা)নিবিড়ভাবে শরীক ছিলেন;কুরআন মজীদ সঞ্চয়ন ও গ্রন্থাবদ্ধকরণও কেবলমাত্র তাহাঁরই ঐকান্তিক আগ্রহ,চেষ্টা ও পরামর্শে সম্পন্ন হইয়াছিল।হযরত আবূ বকর(রা)নিজের অভিজ্ঞতা ও প্রধান সাহাবাদের সহিত পরামর্শক্রমে হযরত উমর ফারুক(রা)-কেই পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের জন্য মুসলিম জনতার নিকট সুপারিশ করিয়া গেলেন।মুসলিম জনসাধারন প্রথম খলীফার সুপারিশ ও নিজেদের নিরপেক্ষ ও অকুণ্ঠ রায়ের ভিত্তিতে হযরত উমর(রা) –কেই খলীফা হিসাবে নির্বাচিত করিল ও তাঁহার হস্তে বায়আত গ্রহন করিল।উমর (রা) খলীফা নির্বাচিত হইয়াই তাঁহার পূর্বসূরীর ন্যায় মুসলিম জনতাকে সম্বোধন করিয়া নীতি-নির্ধারণী ভাষণ দান করেন।

(৩)দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর(রা) যখন বুঝিতে পারিলেন যে,তাঁহার জীবন-পাত্র সম্পূর্ণ হইতে চলিয়াছে,তিনি আর বেশিক্ষন বাঁচিয়া থাকিতে পারিবেন না, তখন তিনি নিজের স্থলাভিষিক্ত ও পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। সে জন্য তিনি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র পদ্ধতি অবলম্বন করেন।তিনি ছয়জন শ্রেষ্ঠ ও নেতৃস্থানীয় সাহাবীর সমন্বয়ে একটি ‘নির্বাচনী বোর্ড’- আধুনিক পরিভাষায় ‘নির্বাচন কমিশন’-নিযুক্ত করিলেন।অন্যান্যদের ছাড়াও হযরত উসমান ও হযরত আলী(রা)ও এই বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।তাঁহার দৃষ্টিতে এই ছয় জনই খিলাফতের জন্য যোগ্য ব্যাক্তি ছিলেন। তিনি আদেশ করিলেন যে,তাঁহার অন্তর্ধানের পর তিন দিনের মধ্যেই যেন এই বোর্ড নিজেদের মধ্য হইতে সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তিকে খলীফা নির্বাচন করে।বোর্ড সুষ্টুরূপে তাহার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করে এবং এই ব্যাপারে নিকটবর্তী ও দূরবর্তী মুসলিম নাগরিকদের রায় সংগ্রহ করে।মদীনার প্রতিটি ঘরে উপস্থিত হইয়া পুরুষদের সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী লোকদেরও রায় জিজ্ঞাসা করা হয়।দূরাগত ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের নিকটও রায় জিজ্ঞাসা করিতে ত্রুটি করা হয় নাই।এইভাবে ইসলামী নাগরিকদের সর্বাধিক রায় ও আলাপ-আলোচনার পর হযরত উসমান(রা)-কেই তৃতীয় খলীফা পদে নির্বাচিত করা হয়।

(৪)তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান(রা)-এর শাহাদাতের পর মদীনার পরিবেশ ফিতনা-ফাসাদের ঘনঘটায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া পড়ে। মিশর,কুফা ও বসরার বিদ্রোহীগণ মদীনায় প্রবল তাণ্ডবের সৃষ্টি করে।তখন প্রধান সাহাবীদের অধিকাংশই সামরিক ও সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনের জন্য রাজধানীর বাহিরে অবস্থান করিতেছিলেন।এই অবস্থায় হযরত উসমান (রা)-এর শাহাদাতের পর ক্রমাগত তিন দিন পর্যন্ত খলীফার পদ শূন্য থাকে।শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর হযরত আলী(রা)-কেই খলীফা নির্বাচিত করা হয়।

এই বিশ্লেষণ হইতে একথা প্রমাণিত হয় যে, খুলাফায়ে রাশেদুনের নিয়োগ ও নির্বাচনের ব্যাপারে একই ধরনের বাহ্যিক পদ্ধতি(Form Of Election)অনুসৃত না হইলেও প্রতিটি পদ্ধতিতেই জনমতকে নির্বাচনের ভিত্তিরূপে স্বীকার করা হইয়াছে এবং কোন ক্ষেত্রেই জনমতকে উপেক্ষা করা হয় নাই।বস্তুতঃপ্রকৃত খিলাফতের ইহাই মৌলিক ভাবধারা এবং জনগণের অধিকার সংরক্ষণ ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য প্রতিটি যুগে ও অবস্থায়ই ইহা কার্যকর হওয়া একান্ত অপরিহার্য। উপরন্তু মৌলিক ভাবধারাকে যথোপযুক্ত মর্যাদা ও গুরুত্ব সহকারে রক্ষা করিয়া রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের যে কোন বাহ্যিক পদ্ধতি গ্রহন করা যাইতে পারে।কেননা ইসলামে বাহ্যিক অবয়ব ও আকার-আকৃতির বিশেষ গুরুত্ব নাই;বরং জাতীয় ও তামদ্দুনিক ব্যাপারে উহার মৌলিক ভাবধারাই হইতেছে একমাত্র লক্ষ্য রাখার বস্তু।

খিলাফতে রাশেদার বৈশিষ্ট্য
ইতিহাস দর্শনের দৃষ্টিতে খিলাফতে রাশেদার ত্রিশ বৎসরকালীন শাসন ব্যবস্থার পর্যালোচনা করিলে উহার নিন্মলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ গোটা মানব জাতিকে আকৃষ্ট ও বিমোহিত করেঃ

(১)খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলে বিশ্বনবীর পবিত্র আদর্শ উজ্জল অনির্বাণ প্রদীপে পরিণত হইয়াছিল এবং সমগ্র পরিমণ্ডলকে উহ্য নির্মল আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত করিয়া রাখিয়াছিল। খলীফাদের প্রতিটি কাজ ও চিন্তায় উহার গভীর প্রভাব বিদ্যমান ছিল।চারিজন খলীফাই বিশ্বনবীর প্রিয়পাত্র,বন্ধু ও বিশিষ্ট সহকর্মী ছিলেন।অপরাপর সাহাবীদের তুলনায় রাসূলের সাহচর্য ইঁহারাই সর্বাধিক লাভ করিয়াছিলেন।ইঁহারা ছিলেন হযরতের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত এবং তাঁহার উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত প্রাণ।একমাত্র হযরত আলী(রা) ব্যতিত আর তিনজন খলীফাই নবী করীম(স)-এর দ্বিতীয় কর্মকেন্দ্র ও শেষ শয্যাস্থল মদীনায় রাজধানী রাখিয়াই খিলাফতের প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করিয়াছিলেন।

(২)খিলাফতে রাশেদার অন্তর্ভুক্ত কোন খলীফার বংশ-গোত্র কিংবা পরিবার-ভিত্তিক অধিকার,উত্তরাধিকার বা প্রাধান্যের কোনই অবকাশ ছিল না। চারিজন খলীফা তিনটি স্বতন্ত্র পরিবার হইতে উদ্ভুত ছিলেন।বস্তুতঃইঁহারাই ছিলেন গোটা ইসলামী জনতার সর্বাপেক্ষা অধিক আস্থাভাজন।ক্রমিক পর্যায়ে ইঁহাদের নির্বাচনে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বের মৌলিক ভাবধারা কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় নাই;বরং উহাই রক্ষিত হইয়াছে সর্বতোভাবে।তখন আধুনিক কালের পদ্ধতিতে নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইলেও কেবলমাত্র তাঁহারাই যে সর্বাধিক ভোটে নির্বাচিত হইতেন,তাহাতে কোনই সন্দেহ থাকিতে পারে না।

(৩)খিলাফতে রাশেদার আমলে আইন রচনার ভিত্তি ছিল কুরআন ও সুন্নাহ।যে বিষয়ে তাহাতে কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যাইত না,সে বিষয়ে ইজতিহাদ পদ্ধতিতে রাসূলের আমলের বাস্তব দৃষ্টান্ত ও অনুরূপ ঘটনাবলির সামঞ্জস্যের প্রতি লক্ষ্য রাহিয়া ইহার সমাধান বাহির করা হইত এবং এই ব্যাপারে কুরআন ও হাদীস পারদর্শী প্রতিটি নাগরিকেরই রায় প্রকাশের সমান অধিকার স্বীকৃত ছিল।কোন বিষয়ে সকলের মতৈক্যের সৃষ্টি হইলেই,সে সম্পর্কে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হইত।ফিকাহ-শাস্রের পরিভাষায় ইহাকেই বলা হয় ইজমা। ইসলামী শরিয়াতে ইহা সর্বজনমান্য মূলনীতি বিশেষ।আর কোন বিষয়ে মতবৈষম্যের সৃষ্টি হইলে খলীফা কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে নিজস্ব রায় অকুণ্ঠিতভাবে প্রকাশ করিতেন এবং তদানুযায়ী কার্য সম্পাদন করিতেন।

(৪)খুলাফায়ে রাশেদুন অধিকাংশ ব্যাপারেই দায়িত্বশীল সাহাবীদের সহিত পরামর্শ করিতেন।সাধারণ ব্যাপারে তাঁহারাই মনোনয়ন অনুযায়ী ‘মজলিসে শুরা’র সদস্য নিযুক্ত হইতেন।কিন্তু রায়দানের অধিকার কেবলমাত্র নিযুক্ত সদস্যদের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল না।

(৫)খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলে রাজকীয় জাঁক-জমক ও শান-শকাতের কোন স্থান ছিল না।সাধারণ নাগরিকদের ন্যায় অতি সাধারণ ছিল খলীফাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা।তাঁহারা প্রকাশ্য রাজপথে একাকী চলাফেরা করিতেন;কোন দেহরক্ষী তো দূরের কথা,নামে মাত্র পাহারাদারও ছিল না।প্রতিটি মানুষই অবাধে খলীফার নিকট উপস্থিত হতে পারিত।তাহাদের ঘরবাড়ি ও সাজ-সরঞ্জাম ছিল সাধারণ পর্যায়ের।

(৬)খুলাফায়ে রাশেদুন ’ বায়তুল মাল বা রাষ্ট্রের অর্থ ভাণ্ডারকে জাতীয় সম্পদ ও আমানতের ধন মনে করিতেন।রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মঞ্জুরী ব্যতীত নিজের জন্য এক করা-ক্রান্তি পর্যন্তও কেহ খরচ করিতে পারিতেন না।এতব্দ্যতীত নিজেদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের জন্যও তাঁহারা নিজেদের ক্ষমতা ও পদাধিকার বলে বায়তুল মাল হইতে কিছুই ব্যয় করিতেন না।

(৭)তাঁহারা নিজেদেরকে জনগণের খাদেম মনে করিতেন।কোন ক্ষেত্রেই তাঁহারা নিজদগকে সাধারণ লোকদের অপেক্ষা শ্রেষ্ট ধারণা করিতেন না। তাঁহারা কেবল রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই জননেতা ছিলেন না, নামায ও হজ্ব প্রভৃতি ধর্মীয় ব্যাপারেও যথারীতি তাঁহারাই নেতৃত্ব দিতেন।

খিলাফতে রাশেদার আমলে ধর্মীয় কাজের নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় কাজের কর্তৃত্ব বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত ছিল না;বরং এই উভয় প্রকার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বই একজন খলীফার ব্যক্তি সত্তায় কেন্দ্রীভূত ও সমন্বিত হইয়াছিল।বস্তুতঃধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণ এবং ধর্মীয় কাজ ও রাষ্ট্রীয় কাজে দ্বৈতবাদ যেমন আধুনিক পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য, অনুরুপভাবে এতদুভয়ের একত্রীকরণ ও সর্বতোভাবে একমুখীকরণই ছিল খিলাফতে রাশেদার বৈশিষ্ট্য।

 

খিলাফতে রাশেদার রাশেদার রাষ্ট্র-রূপ
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পর এক ব্যক্তি তাঁহাকে ******- ‘হে আল্লাহ্‌র খলীফা’ বলিয়া সম্বোধন করিলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলিয়া উঠিলেনঃ ‘আমি আল্লাহ্‌র খলীফা নহি,আমি আল্লাহ্‌র রাসূলের খলীফা’।

ঐতিহাসিকগণ খলীফার এই উক্তিকে তাঁহার স্বভাবসুলভ অতুলনীয় বিনয় ও স্বীয় তুচ্ছতাবোধের অকাট্য প্রমাণ মনে করিয়া লইয়াছেন। কিন্তু রাষ্ট্র-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কথাটির বিশ্লেষণ করিলে ইহা হইতে ‘খিলাফতে’র গভীর তাৎপর্য সুস্পষ্ট হইয়া উঠে।বস্তুতঃপ্রাথমিক যুগে মুসলমানদের হৃদয়ে খিলাফতের যে রাষ্ট্ররূপ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছিল,হযরত আবূ বকরের এই উক্তি তাহারই সম্প্রকাশক।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর পূর্বে ও পরে কালের স্রোতে শত শত বৎসর অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে।এই সুদীর্ঘ কালের মধ্যে শত-সহস্র রাজা-বাদশাহ ও দেশ শাসক আসিয়াছে ও দুনিয়ার রঙ্গমঞ্চ হইতে বিদায় নিয়াছে। তাহাদের সম্পর্কে সমসাময়িক লোকদের ও প্রজা-সাদারণের দাবি ছিল,তাহারা ভূ-পৃষ্টে আল্লাহ্‌র স্থলাভিষিক্ত। এই কারনে তাহারা যে সম্ভ্রম-মর্যাদা ও পবিত্রতার অধিকারী, পৃথিবীর বুকে তাহা অন্য কাহারোই থাকিতে পারে না।মিশরের ফিরাউনী রাজা-বাদশাহদের আত্মাভিমান ও দাম্ভিকতা ঐতিহাসিক ব্যাপার হইয়া রহিয়াছে।একজন ফিরাউন *****(আরবী) ‘আমি তোমাদের প্রধান ও শ্রেষ্ঠ প্রভু’ বলিয়া যে দাবি করিয়াছিল, কুরআন মজিদেও তাহার উল্লেখ রহিয়াছে।দূর অতীতকাল হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রকর্তাদের অধিকাংশই এইরূপ মানসিকতার পরিচয় দিয়া আসিয়াছে। বর্তমান কালেও ইহার দৃষ্টান্ত কিছুমাত্র বিরল নহে।এই ব্যাপারে যাহা কিছু অপূর্ণতা ছিল,প্রত্যেক যুগের তোষামোদকারী ধর্মযাজক ও পুরোহিতরা তাহার সম্পূর্ণ করিয়া তুলিতে একবিন্দু ত্রুটি করে নাই।রাজা –বাদশাহ ও দেশ শাসককে তাহারা ‘পূজ্য’ ও ‘আরাধ্য’ করিয়া তুলিয়াছে যুগে যুগে, দেশে দেশে। মিসর,বেবিলন,পারস্য,ভারতবর্ষ ও অন্যান্য বহু দেশের অবস্থাই ছিল এইরূপ।এইসব দেশের অধিকাংশ রাজা-বাদশাহ ও সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি নিজেকে ধরনী তলে ‘খোদার প্রতিনিধি’ বা ‘খোদার ছায়া’ মনে করিত।তাহাদের অসহায় দরিদ্র প্রজাসাধারণও তাহাদিগকে অনুরূপ মর্যাদা দানে কিছুমাত্র ত্রুটি করিত না।

মধ্যযুগের ইউরোপেও পাদ্রীরা রাজা-বাদশাহদের ইঙ্গিতে ও নির্দেশেই তাহাদিগকে মহান,সম্মানার্হ ও পবিত্র বলিয়া উচ্চতম মর্যাদা দান করিতেও কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করিত না। এই মর্যাদা তাহারা আল্লাহ্‌র নিকট হইতে পাইয়াছে বলিয়াই পাদ্রীরা প্রচারণা চালাইত।ইহার ফলে তাহাদের ক্ষমতা হইত অপ্রতিদ্বন্দ্বী-সকল প্রশ্ন,আপত্তি ও সমালোচনার অনেক ঊর্ধ্বে, জনগণের নাগালের বাহিরে; তাহারা ‘খোদার প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি’ রূপে বিবেচিত হইত।তাহাদের মুখনিঃসৃত প্রতিটি কথাই ‘খোদার নিকট হইতে অবতীর্ণ প্রত্যাদেশ’ রূপে গণ্য হইত।তাহাদের আদেশ-নিষেধ সরাসরি আল্লাহ্‌র প্রত্যক্ষ আদেশ-নিষেধ সমতুল্য এবং অবশ্য-মান্য মনে করা হইত।এই কারনে উহা অমান্য করা,প্রত্যাখ্যান করা বা উহার প্রতি বিন্দুমাত্র অবজ্ঞা প্রদর্শন করাও মহাপাপের শামিল হইয়া যাইত এবং তাহা ছিল কার্যতঃঅসম্ভব। পঞ্চদশ শতাব্দী-এবং কোন কোন জাতিতে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত-এই অবস্থাই বিরাজিত ছিল।এই সময় পর্যন্তকার ইউরোপ যদিও জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতি ও শিল্প-কুশলতায় অনেক উন্নতি লাভ করিয়াছিল; কিন্তু অন্ধ বিশ্বাসের যে ঠুঁলি তাহাদের চক্ষুর উপর বসাইয়া দেওয়া হইয়াছিল, তাহা তখনো অপসারিত হয় নাই। উত্তরকালে ব্যক্তিক ও মানসিক স্বাধীনতা এবং সাম্যবাদের অগ্রসেনারা এইসব মানব ধ্বংসকারী ও মানবিক মর্যাদা হরণকারী রসম-রেওয়াজের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের আওয়াজ তুলিয়া আকাশ-পাতাল মথিত করেন এবং উহার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ করিতে বাধ্য হন।অবশ্য এই অভিযানে হাজার হাজার মানুষকে মহামূল্য জীবনও উৎসর্গ করিতে হইয়াছিল।

রাজা-বাদশাহদের এই পদ-পবিত্রতা ও মহাসম্মানের ভাবধারা বিশ-জাতিসমূহের মধ্যে শত শত বৎসর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।আজিকার ইউরোপ এই ভাবধারা হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছে খুব বেশি দিন হয় নাই। এই প্রেক্ষিতে প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীকি (রা)- এর উপরোক্ত ক্ষুদ্র উক্তিতে নিহিত বিনয় ও আত্ম-স্বার্থহীনতা বিচার্য। একটি লোক তাঁহাকে ‘খলিফাতুল্লাহ্’- আল্লাহ্‌র খলীফা বা আল্লাহ্‌র প্রতিনিধি বলিয়া সম্বোধন করিলে তিনি তাহা মানিয়া লইতে স্পষ্ট ভাষায় অস্বীকার করেন এবং বলেনঃ ‘আমি আল্লাহ্‌র খলীফা নহি। আমাকে রাসূলের খলীফা বলিয়া অভিহিত করতে পার’।

‘রাসূলের খলীফা’ কথাটিও কোনরূপ ব্যক্তিগত দাপট-প্রতাপ,শান-শওকাত ও শ্রেষ্ঠত্ব-বড়ত্ব বা নিরংকুশ কর্তৃত্ব প্রকাশকারী নয়।উহার মূল তাৎপর্য হইল আল্লাহ্‌র বিধানের ভিত্তিতে তাঁহারাই নির্ধারিত সীমা-সরহদের মধ্যে থাকিয়া মুসলমানদের নেতৃত্ব দান ও রাষ্ট্র পরিচালনায় রাসূলে করীম(স)-এর স্থলাভিষিক্ত বা প্রতিনিধি হওয়া মাত্র।কিন্তু যেসব বিষয়-ব্যাপার কেবলমাত্র রাসূলের জন্য নির্দিষ্ট, সেসব ক্ষেত্রে তাঁহার ‘স্থলাভিষিক্ত’ হওয়ার কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না,উহার চিন্তা বা ধারণাও ইহাতে স্থান পায় নাই।প্রথম খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পর প্রদত্ত প্রথম নীতি-নির্ধারণী ভাষণের একাংশ হইতেই তাঁহার এই কথার সত্যতা প্রতিভাত হইয়া উঠে।ভাষণের সেই অংশটি এইঃ

‘আমাকে খিলাফতের এই দায়িত্ব দেওয়া হইয়াছে বটে;কিন্তু আমি নিজেকে এই গুরুদায়িত্ব পালনের কিছুমাত্র যোগ্য মনে করি না। আল্লাহ্‌র শপথ!আমার ঐকান্তিক বাসনা ছিল,তোমাদের মধ্য হইতে অপর ব্যক্তি এই দায়িত্ব গ্রহন করিবে।এখন তোমাদের কেহ যদি মনে করে যে,রাসূলে করীম(স) যে যে কাজ করিয়াছেন সেইসব কাজও আমি করিব,তাহা হইলে মনে রাখিও, এই ধারণা বা আশার কোন ভিত্তি নাই।রাসূলে করীম(স) আল্লাহ্‌র বান্দাহ ছিলেন,ইহাতে কোন সন্দেহ নাই।কিন্তু সেই সঙ্গে আল্লাহ্‌ তা’আলা তাঁহাকে মহান নবুয়্যাত ও রিসালাতের নিয়ামত দানে ধন্য করিয়াছিলেন এবং সরবপ্রকার গুনাহ্-খাতা হইতে তাঁহাকে মুক্ত ও পবিত্র ঘোষণা করিয়াছিলেন’।

‘আমিও আল্লাহ্‌রই বান্দাহ। কিন্তু তোমাদের মধ্য হইতে কাহারও তুলনায় আমি উত্তম ব্যক্তি নহি।তোমরা আমার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিবে।যদি দেখিতে পাও,আমি আল্লাহ্‌ ও রাসূলের প্রদর্শিত পথে চলিতেছি, তাহা হইলে তোমারও আমার অনুসরণ করিতে থাকিবে।কিন্তু তোমার যদি আমাকে ‘সিরাতুল-মুস্তকীম’ হইতে বিচ্যুত ও বিভ্রান্ত দেখিতে পাও তাহা হইলে আমার ভুল ধরাইয়া দিয়া আমাকে সঠিক, সত্য ও সোজা পথে পরিচালিত করিবে’।

বলা নিষ্প্রয়োজন,হযরত রাসূলে করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) মুসলিম জনতার নেতৃত্ব ও ইসলামী রাষ্ট্র-সংস্থা পরিচালনার দায়িত্ব নিজ হইতে গ্রহন করেন নাই।উদার-উন্মুক্ত পরিবেশে প্রকাশ্য নির্বাচন এবং গণ-সন্তোষ ও সমর্থন অর্জিত হওয়ার পরই তিনি এই কাজে ব্রতী হইয়াছিলেন। আল্লাহ্‌ তা’আলা যেভাবে নিজের পক্ষ হইতে নিজের বাছাই ও মনোনয়নের মাধ্যমে হযরত মুহাম্মাদ (স)-কে নবী ও রাসূল বানাইয়াছিলেন,তেমনিভাবে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক(রা) কিংবা পরবর্তী খলিফাত্রয় আল্লাহ্‌ কর্তৃক মনোনীত হন নাই। তাহারা আল্লাহ্‌ প্রেরিতও ছিলেন না। অন্যান্য মানুষের তুলনায় তাঁহাদের আদর্শিক শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশিষ্টতা সর্বজনজ্ঞাত ও অবশ্য স্বীকৃতব্য; কিন্তু এই শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশিষ্টতা আল্লাহ্‌ কর্তৃক ঘোষিত নয়।দ্বিতীয়তঃইহা তাঁহাদের তাকওয়া পরহেজগারী সদগুণাবলীর অনিবার্য পরিণতি মাত্র।খিলাফতের কারণেও এই বিশিষ্টতা অর্জিত হয় নাই,রাসূল যেমন বিশিষ্ট হইয়াছিলেন নবুয়্যাত ও রিসালাতের কারণে।বস্তুতঃখলীফা পদ নিছক বৈষয়িক, খোদায়ী (Divine) নয়।উহার সহিত অলৌকিক ও খোদায়ীর আদেশ ও নির্দেশ দানের অধিকারী ছিলেন,যাহা আল্লাহ্‌র নাজিল করা বিধান-ভিত্তিক এবং রাসূলের উপস্থাপিত শিক্ষা ও ব্যাখ্যার সহিত সঙ্গতিপূর্ণ।আল্লাহ্‌র বিধান-পরিপন্থী ও রাসূলের শিক্ষা ও ব্যাখ্যার সহিত অসঙ্গতিপূর্ণ কোন নির্দেশ দেওয়ার কোন অধিকার যেমন তাঁহাদের ছিল না,তেমনি মুসলমান জনগণও সেই ধরনের কোন নির্দেশ মানিয়া লইতে আদৌও বাধ্য নয়। প্রথম খলীফা নিজেই তাঁহার প্রথম ভাষণে এই কথাটি সুস্পষ্ট করিয়া দিয়া বলিয়াছেনঃ********(আরবী)

আমার আনুগত্য করিতে থাকিবে যতক্ষণ আমি আল্লাহ্‌ এবং তাঁহার রাসূলের আনুগত্য করিয়া চলিতে থাকিব।কিন্তু আমি নিজেই যদি(আল্লাহ্‌ ও তাঁহার রাসূলের)নাফরমানী করি,তাহা হইলে আমার আনুগত্য করা তোমাদের কর্তব্য নয়।

পরবর্তী খলীফাদের উপাধি
হযরত আবূ বকর (রা)-এর পর হযরত উমর ফারুক(রা) খলীফা নিযুক্ত হইলেন। কিন্তু তিনি নিজে ‘খলীফায়ে রাসূল’-‘রাসূলের খলীফা’নামে অভিহিত হইতে সম্মত হইলেন না। এই বিষয়ে সমাজের লোকদের সহিত পরামর্শ করা হয়।শেষ পর্যন্ত তিনি ‘আমীরুল মু’মিনীন’- ‘মুসলিম জনগণের রাষ্ট্রনেতা ও পরিচালক’ সম্বোধনে সম্মত হইলেন।পরবর্তী খলীফাদ্বয়ও এই সম্বোধনেই ভূষিত হইয়াছেন। ‘খলীফা’ শব্দে অভিহিত হইতে তাঁহারা রাযী হন নাই এইজন্য যে,উহা মানিয়া লইলে ‘খলীফায়ে রাসূল’-‘রাসূলের খলীফা’ এইরূপ সম্বোধনে অভিহিত হইতে হইত। আর ইহার ফলে পরবর্তী খলীফার সম্বোধনে এই শব্দটির পুনরাবৃত্তি ঘটিত তিনবার কিংবা ততোধিকবার আর ইহা অত্যন্ত বিদঘুটে,অশ্রুতি মধুর,অমার্জিত এবং নিতান্তই অশোভন হইয়া পড়িত।

হযরত উমর(রা)-এর ‘খলীফায়ে রাসূল’উপাধিতে ভূষিত হওয়ার পরিবর্তে ‘আমিরুল মু’মিনীন’ নামে সম্বোধিত হইতে সম্মৎ হওয়ার মূলে আরো একটি কারন নিহিত ছিল।হযরত আবূ বকর সিদ্দিকী (রা) যখন বলিয়াছিলেন,আমি আল্লাহ্‌র খলীফা নহি,আল্লাহ্‌র রাসূলের খলীফা’, তখন শব্দটি উহার আভিধানিক অর্থে (স্থালাভিষিক্ত)ব্যবহৃত হইয়াছিল এবং লোকদিগকে পরিস্কার ভাষায় জানাইয়া দেওয়া হইয়াছিল যে, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে রাসূলে করীম(সা)-এর স্থলাভিষিক্ত হওয়াই তাঁহার একমাত্র মর্যাদা। আভিধানিক অর্থ ছাড়া অন্য কোন অর্থে তখন এই শব্দটি ব্যবহৃত হইয়া থাকিলে উহার পরিবর্তে হযরত উমর(রা)-এর ‘আমিরুল মু’মিনীন’ শব্দ ব্যবহারে সম্মত হওয়ার কোনই কারন ছিল না।

‘আমীরুল মু’মিনীন’ পরিভাষা গ্রহনের অন্তরালে আরও একটি কারণ বিদ্যমান ছিল। ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থা তখন সমগ্র আরব উপদ্বীপ ও অন্যান্য বিপুল বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এক ব্যাপক বিপ্লব সৃষ্টি করিয়াছিল। এই বিপ্লবের গতি যেমন ছিল তীব্র,তেমনি ব্যাপক ও সর্বাত্মক।সমগ্র পৃথিবীর মানুষ সে বিপ্লবের রূপ দর্শনে বিস্ময়-বিমুগ্ধ ও হতবাক হইয়াছিল। কিন্তু আল্লাহ্‌র কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতে এই পর্যায়ে কেবলমাত্র কতকগুলি মূলনীতিই দেওয়া হইয়াছিল,বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি বিধান তাহাতে ছিল না। অবশ্য কুরআনে শু’রা- পারস্পরিক পরামর্শ গ্রহণকে রাষ্ট্র-ব্যবস্থার মৌল ভিত্তি ও বাস্তব কর্মপন্থারূপে ঘোষিত হইয়াছে।আল্লাহ্‌ তা’আলা রাসূলে করীম(স) কে লক্ষ্য করিয়া বলিয়া দিয়াছেনঃ*******(আরবী) ‘হে নবী, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় যাবতীয় ব্যাপারে লোকদের সহিত পরামর্শ কর’। মুসলমানদের আচরণ পদ্ধতি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ও একস্থানে বলা হইয়াছে,******(আরবী) তাহাদের যাবতীয় জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সুসম্পন্ন হইয়া থাকে’।

এই দৃষ্টিতে খিলাফতে রাশেদার প্রত্যেক খলীফাকে যাবতীয় জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কার্যাদি কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ও ভিত্তিতে পারস্পরিক পরামর্শক্রমে সম্পন্ন করিতে হইত।এই কারণে তাঁহাদের মর্যাদা এক-একজন সেনাধ্যক্ষ হইতে ভিন্নতর কিছু ছিল না। সেনাধ্যক্ষ যুদ্ধসংক্রান্ত যাবতীয় কাজের ব্যাপারে মৌল হেদায়েত ও নির্দেশ মূল ক্ষমতাধর ব্যক্তির নিকট হইতেই লাভ করিয়া থাকে।কিন্তু যুদ্ধকালীন সৈন্য পরিচালনা(Operation) ও যুদ্ধ ময়দানের ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদি সবকিছুই সেনাধ্যক্ষকে নিজেকেই এবং নিজের একক দায়িত্বেই সম্পন্ন করিতে হয়। খিলাফতে রাশেদাকেও রাষ্ট্র ও দেশ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্য সমসাময়িক পরিস্থিতি অনুযায়ী শরীয়াতের সীমার মধ্যে থাকিয়া ও রাসূলে করীম(সা)-এর আদর্শ সম্মুখে উদ্ভাসিত রাখিয়া আদর্শবাদী জননেতাদের পরামর্শক্রমে নিজেকেই আঞ্জাম দিতে হইত।প্রথম খলীফা কোন ব্যাপারে বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে কোন বিশেষ কর্মনীতি গ্রহন করিয়া থাকিলে দ্বিতীয়,তৃতীয় বা চতুর্থ খলীফাকে ও হুবহু ঠিক সেই কর্মনীতিই গ্রহন করিতে হইবে-অবস্থা ও পরিবেশ পরিস্থিতি যতই পরিবর্তিত হউক না কেন-এমন কোন বাধ্যবাধকতা অবশ্যই ছিল না। এই কারণেই দ্বিতীয় খলীফা ‘খলীফায়ে রাসূল’ ইত্যাদি ধরনের উপাধি গ্রহনের পরিবর্তে সম্পূর্ণ নূতন এবং দায়িত্ব ও পদমর্যাদা সহিত পুরাপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ উপাধি ‘আমিরুল মু’মিনীন’ গ্রহন করাই সমীচীন মনে করিয়াছিলেন।

হযরত আবূ বকর (রা) তাঁহার খিলাফত আমলের অত্যল্প সময়ের মধ্য সমগ্র আরব দেশে যে বিপ্লবের সৃষ্টি করিয়াছিলেন, উহার প্রতি পর্যবেক্ষকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপে একথা স্পষ্ট হইয়া উঠে যে, নম্রতা, কোমলতা ও ক্ষমতাশীলতা এবং কঠোরতা ও অনমনীয়তার ক্ষেত্র ভিন্ন ভিন্ন হইয়া থাকে এবং কঠোরতার স্থানে কঠোরতা ও অনমনীয়তার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হইয়া থাকে এবং কঠোরতার স্থানে কঠোরতা ও নম্রতা-নমনীয়তার স্থানে নম্রতা-নমনীয়তা অবলম্বিত না হইলে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় পর্যায়ের কোন কাজই সুষ্ঠু ও যথার্থরূপে সম্পন্ন হইতে পারে না। শুধু হযরত আবূ বকর(রা)ই নহেন, পরবর্তী তিনজন খলীফার সাফল্য ও অসাধারণ শক্তি-সামর্থের পশ্চাতেও এ নিগূঢ় তত্ত্বই নিহিত যে, তাঁহারা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক ও নির্ভুল পদক্ষেপ গ্রহনে সম্পূর্ণ সক্ষম ছিলেন।

সমসাময়িক আরবের রাজনৈতিক ব্যবস্থা
রাসূলে করীম (স)-এর সময় আরবদেশ অসংখ্য প্রকারের ধর্মমতের লীলাক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছিল।উহার উত্তর-দক্ষিণ অংশ পরস্পর হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। একাংশের অধিবাসীদের কোন সম্পর্ক অপরাংশের জনগণের সহিত ছিল না। উভয় অংশের লোকদের সাধারণ অবস্থাও কিছুমাত্র অভিন্ন ছিল না। ইয়েমেন ইরানীদের কর্তৃত্বাধীন ছিল। খৃষ্টধর্ম ও মূর্তি পূজার ধর্ম সেখানে পাশাপাশি চলিতে ছিল। তাহাদের হেমায়ারী ভাষা কুরাইশদের ভাষা হইতে সম্পূর্ণ ভিন্নতর ছিল। উপরন্তু ইয়েমেন ছিল কয়েক শতাব্দী কাল ধরিয়া সভ্যতা ও সংস্কৃতি পাদপীঠ। পক্ষান্তরে হিজাজের লোকেরা ছিল অসভ্যতা ও যাযাবরত্তের প্রতীক।এই অঞ্চলে মক্কা,ইয়াসরীব(মদীনা) ও তায়েফ-মাত্র এই তিনটি স্থান ছিল ‘শহর’ নামে অভিহিত হওয়ার যোগ্য। আর হিজাজের বিশাল অঞ্চলের মধ্যে অবস্থান ছাড়া এই তিনটি শহরের মধ্যে পারস্পরিক কোন সম্পর্ক বা সাদৃশ্য ছিল না। অবশ্য এই শহরত্রয়ের লোকদের মধ্য আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত ছিল। কিন্তু এই তিনটি শহরের প্রশাসন ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ গোত্রবাদ ভিত্তিক এবং পরস্পরক বিচ্ছিন্ন। মক্কায় মূর্তি পূজার প্রাবল্য ও ব্যাপকতার সঙ্গে সঙ্গে খৃস্টবাদেরও আনুকূল্য ছিল। মদীনায় ইয়াহুদী গোত্রসমূহ বাহ্যতঃ পরাক্রমশালী হইলেও মূর্তি পূজারীদের সংখ্যা ছিল গরিষ্ঠ। এই বিশাল আরব উপদ্বীপে যখন তাওহীদের বাণী ধ্বনিত হইল এবং আল্লাহ্‌ তা’আলা আরবের চতুর্দিকে দ্বীন-ইসলামকে প্রসারিত করিতে চাহিলেন, তখন তিনি উহার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও সম্পূর্ণ করিয়া দিলেন। ইয়েমেন পারসিকদের দাসত্ব হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিল।তৎসঙ্গে সমস্ত বৈদেশিক প্রভাব-প্রতিপত্তি হইতেও তাহারা সম্পূর্ণ মুক্ত হইয়া গেল।মক্কা বিজয়ের পর সমগ্র আরবদেশে ইসলাম তীব্র গতিতে প্রচারিত হইতে লাগিল।হিজাজের পর অন্যান্য আরব অঞ্চলেও ইসলাম প্লাবনের মতই বিস্তার লাভ করিল।এইভাবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে সমগ্র আরব উপদ্বীপ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় লাভে ধন্য হইল। এই বিশাল অঞ্চলের সমস্ত জনতা একই আদর্শে দীক্ষিত হইয়া গেল।রাসূলে করীম(স)-এর প্রতি ঈমান এবং তাঁহার প্রচারিত দিন-ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসাবে গ্রহণের ব্যাপারে সমগ্র আরব অভিন্ন ও ঐক্যবদ্ধ হইয়া উঠিলেও প্রতিটি গোত্র নিজ নিজ স্থানে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম মর্যাদায় অভিষিক্ত ছিল। অবশ্য ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ‘রুকন’-যাকাত-মদীনার রাজধানীতে পাঠাইতে সব অঞ্চলের লোকেরাই সমানভাবে বাধ্য ছিল।

দ্বীন ও ধর্মের ঐক্য ও একত্ব আরবদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিপ্লব সৃষ্টির হিসেবে কাজ করিয়াছে।মদীনার চতুর্দিকে বসবাসকারী গোত্রসমূহ রাসূলে করিম(স)-এর সহিত মিত্রতার চুক্তি সম্পন্ন করিয়া লইয়াছিল।তিনি যখন মক্কা বিজয়ের অভিযানে যাত্রা করিলেন,তখন এইসব গোত্র চুক্তি অনুযায়ী কাফেলার সহিত শামিল হইয়াছিল।মক্কা বিজয়ের পর সেখানকার গোত্রসমূহ সাগ্রহে ইসলাম গ্রহন করিল।অতঃপর তাহারাও ইসলামের বিজয় অভিযানসমূহে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করিল।হুনাইন ও তায়েফ যুদ্ধে ইহারা যথারীতি অংশ গ্রহন করে। এইভাবে ইসলাম যখন চতুর্দিকে বিস্তার লাভ করিল, তখন নবী করীম(স) আরব গোত্রসমূহের লোকদিগকে কুরআন মজীদ ও দ্বীনী বিষয়াদি শিক্ষা দানের জন্য লোক নিযুক্ত করিয়া চতুর্দিকে পাঠাইয়া দিলেন।কুরআন শরীফ ও দ্বীন-ইসলাম শিক্ষাদানের সঙ্গে সঙ্গে যাকাত আদায়ের দায়িত্বও কর্মচারীদের উপর ন্যস্ত করা হইল।অত্যল্প সময়ে সৃষ্ট এই দ্বীনী বিপ্লবের প্রভাবে সমগ্র অঞ্চলে রাজনৈতিক বিপ্লব সৃষ্টিও অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল।দ্বীন ও ধর্মের দিক দিয়া সমগ্র আরব এক ও অভিন্ন হইয়া উঠার পর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দিক দিয়াও এক অভিন্ন সত্তা ও সংস্থায় পরিণত হওয়া ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক পরিণতি। কিন্তু আরব বেদুঈনরা এই ধরনের রাজনৈতিক বিপ্লবের সহিত কিছুমাত্র পরিচিত ছিলনা। রাসূলে করীম(স)-এর অন্তর্ধানের পর তাঁহার স্থলাভিষিক্তেরও অনুরুপভাবে আনুগত্য স্বীকার করিতে হইবে,ইহা ছিল তাহাদের চিন্তা-ভাবনার অতীত।তাহার মনে করিত,রাসূলে করীম (স) উপস্থাপিত শিক্ষা,দ্বীন ও আদর্শ তো তাহাদের মন-মগজ ও জীবনে দৃঢ়মূল হইয়া বসিয়া আছে। ইসলামের পূর্নাঙ্গ বিধান তো তাহারা পালন করিয়া চলিবেই। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দিক দিয়া তাহারা হইবে সম্পূর্ণ স্বাধীন।প্রতিটি গোত্রই পূর্বের ন্যায় বাহিরের রাষ্ট্র ও সরকারের সর্ব প্রকার প্রভাব হইতে থাকিবে সম্পূর্ণ মুক্ত ও বন্ধনহীন।

বস্তুতঃরাসূলে করীম (স)-এর অন্তর্ধানের পর আরব উপদ্বীপের দিকে দিকে যে বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলিত হয়, তাহার মূলে ছিল স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার এই অনমনীয় ভাবাধারারই প্রাবল্য। অধিকাংশ আরব গোত্রেরই অবস্থা ছিল এইরূপ। কিন্তু প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) চাহিয়াছিলেন, আরব গোত্রসমূহ রাসূলে করীম (স)-এর জীবদ্দশায় যেরূপ ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন হইয়াছিল, সেই অবস্থার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হইতে দেওয়া হইবে না। কিন্তু আরব গোত্রসমূহ তাহাদের হৃত রাজনৈতিক স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার হইবে বলিয়া মনে-প্রাণে আশা করিয়াছিল। হযরত আবূ বকর (রা) তাঁহার সাচ্চা ঈমানী শক্তির বলে বলিয়ান হইয়া আপন সংকল্পে অবিচল থাকিলেন।মুসলমান হিসাবে প্রত্যেক স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করুক এবং ইসলামের উপস্থাপিত ঐক্য ও সংহতির আদর্শ সকলেই পুরোপুরি মানিয়া চলুক, ইহাই ছিল তাঁহার আন্তরিক বাসনা।তিনি স্পষ্টতঃজানাইয়া দিলেন যে, রাসূলের জীবনকালে যাকাত, ওশর ও খারাজ বাবদ যে সম্পদ মদীনায় প্রেরিত হইত, তাহা অবশ্যই আদায় করিতে হইবে। কিন্তু আরব গোত্রসমূহ সেজন্য প্রস্তুত হইতে পারিতে ছিল না। তাহারা স্পষ্ট ভাষায় বলিতে শুরু করিল, রাসূলে করীম (স)-এর ব্যাপারে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নতর।তিনি আল্লাহ্‌র রাসূল ছিলেন।তাঁহার প্রতি অহী নাযিল হইত। তাঁহার পুর্ণাঙ্গ আনুগত্য স্বীকার করা মুসলিম মাত্রেই কর্তব্য ছিল। কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন হইয়াছে। এখন তদনুসারে রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন আনিতে হইবে। কিন্তু এই চিন্তা ও মানসিকতা কোনক্রমেই ইসলামী রাষ্ট্র সংস্থা গড়িয়া উঠার অনুকূল ছিল না।হযরত আবূ বকর (রা)প্রবল শক্তিতে এই নৈরাজ্যমূলক মানসিকতা নির্মূল করিয়া দিলেন।এই পর্যায়ে তিনি যে গভীর বিচক্ষণতাপূর্ণ ও বুদ্ধিসম্মত পন্থা গ্রহন করিয়াছিলেন, তাঁহার ফলে সমগ্র আরবদেশ একটি অভিন্ন রাষ্ট্র-সংস্থার অধীনে সুসংগঠিত ও সুসংবদ্ধ হইয়া উঠিল।তিনি দেশ শাসন,রাষ্ট্র পরিচালনা ও যুদ্ধ-সন্ধির ব্যাপারে সমগ্র গোত্রসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া লইলেন। সকল পর্যায়ের লোকদের সহিত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে পরামর্শ গ্রহণের নীতি কার্যকর করিলেন। ফলে সকল গোত্রই নিজদিগকে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনায় সমান অংশীদার মনে করিতে শুরু করিল।প্রতিটি ব্যক্তি ও গোত্র সর্বক্ষেত্রে সমান গুরুত্ব, মর্যাদা ও অধিকার লাভ করিতে পারিয়া বিপুল উৎসাহ –উদ্দিপনা সহকারে রাষ্ট্র-সংস্থার আনুগত্যে নিজেদের সোপর্দ করিল।খলীফাই ছিলেন এই আনুগত্যের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি সত্তা। তাঁহার যে কোন আদেশ ও নিষেধ পালনতাহাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য,এই ব্যাপারে তাহাদের মধ্যে আর কোন মতদ্বৈততা থাকিল না।

খিলাফতের রাষ্ট্র-রূপ
ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার আদর্শিক পরিচিতি কি?উহা কোন্ ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা? উহা কি নিরেট থিওক্রাসী(Theocracy), যেখানে কোন আল্লাহ্‌প্রিয় ব্যক্তি স্বয়ং কিংবা যাজক সম্প্রদায় শাসন কার্য পরিচালনা করেন? কিংবা উহা আধুনিক পরিভাষা অনুযায়ী একটি গণতান্ত্রিক(Democrative) অথবা কোন স্বৈরতান্ত্রিক(Autocracy) শাসন? কিংবা উহা এক ধরনের রাজতন্ত্র? এই প্রশ্ন একালের বহু চিন্তাবিদকে পর্যন্ত বিভ্রান্ত করিয়াছে। কিন্তু ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানও যাঁহাদের আছে, তাঁহারা এই ধরনের প্রশ্নে কিছুমাত্র বিচলিত হইতে পারেন না। কেননা খিলাফত যে কোনক্রমেই পোপতন্ত্র বা থিওক্রাসী ধরনের শাসন ব্যবস্থা নয়, তাহা বুঝিবার জন্য বিশেষ পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন হয় না। প্রাচীন কালের ফিরাউন কিংবা আধুনিক ইউরোপসহ দুনিয়ার অন্যান্য রাজা-বাদশাহরা যে ধরনের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করিয়াছে ও করিতেছে, খিলাফতের শাসনব্যবস্থার সহিত উহার দূরতম সম্পর্ক বা সামান্যতম সাদৃশ্যও খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।আধুনিক ধরনের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও উহাকে বলা যাইতে পারে না- যদিও সর্বজনীন মূল্যবোধ এবং জনগণের অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার সুযোগ-সুবিধা উহাতে ছিল পূর্ণমাত্রায় কার্যকর,যা পাশ্চাত্যের ধর্মহীন গনতন্ত্রে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।

কোন একজন খলিফাও নিজেকে আল্লাহ্‌ কর্তৃক মনোনীত, আল্লাহ্‌র সহিত বিশেষ সম্পর্কের অধিকারী কিংবা আল্লাহ্‌র নিকট হইতে প্রত্যক্ষ বিধান-ওহী- লাভ করার কোন দাবি কখনও করেন নাই। এইরূপ দাবি উত্থাপনকে তাঁহারা সম্পূর্ণ হারাম মনে করিতেন। কেননা প্রকৃতপক্ষেও ইহা ছিল সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। রাসূলে করীম (স)- এর ইন্তেকালের সঙ্গে সঙ্গে ওহী নাজিলের ধারা চিরতরে বন্ধ হইয়া গিয়াছে। অতঃপর দুনিয়ার মানুষের নিকট জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য মাত্র দুইটি ভিত্তিই অবশিষ্ট রহিয়াছে। একটি আল্লাহ্‌র কিতাব আর দ্বিতীয়ত রাসূলের সুন্নাত। আল্লাহ্‌ তা’আলা বিশ্ব মানবের জন্য সার্বিক ও পূর্ণাঙ্গ বিধান হিসেবে সর্বশেষ নবীর মাধ্যমে কুরআন মজীদ নাজিল করিয়াছেন। আর রাসূলে করীম (স) আল্লাহ্‌র সেই বিধানকে দৈনন্দিন কাজের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করিয়াছেন। কুরআন অনুযায়ী রাসূলে করীম (স)-এর কাজ কুরানেরই বাস্তব ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যা কুরানের ন্যায় চিরন্তন ও চির অনুসৃতব্য। খলীফা বা রাষ্ট্র চালক এই দুইটি বিধান অনুসরন করিয়া চলিতে বাধ্য। ইহাদের নির্ধারিত সীমা একবিন্দু লংঘন করার অধিকার কাহারও নাই। সাধারণ মানুষ একজন রাষ্ট্র চালককে মানিয়া চলিতে বাধ্য কেবলমাত্র এইজন্য যে, এই আনুগত্য রাষ্ট্র চালকের নিজস্ব গুণ বা অধিকারের জন্য নয়। ব্যক্তিগত গুণ-মর্যাদা বা অধিকারের কারণে কোন লোকই কাহাকেও মানিয়া চলিতে বাধ্য নয়। সে যদি আল্লাহ্‌র বিধান ও রাসূলের সুন্নাত অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করে- আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করে, তবে কেবলমাত্র এইজন্যই তাহাকে মানিয়া লইতে সকলে বাধ্য। কেননা এই আনুগত্য মূলত আলাহর আনুগত্য-আল্লাহ্‌র বিধান পালনের মাধ্যমে।প্রসঙ্গত স্মর্তব্য যে, আল্লাহ্‌র বিধান ও রাসূলের সুন্নাতের ব্যাখ্যাদানের একচেটিয়া অধিকার কাহারও নাই-এমন কি খলিফারও নয়। কুরআন-সুন্নাহর পারদর্শী যে কোন লোক উহা ব্যাখ্যাদানের অধিকারী। খলীফার এমন কোন ব্যাখ্যাও মানিয়া লওয়া যাইতে পারে না, যাহা আজ পর্যন্ত অন্য কোন বিশেষজ্ঞ কর্তৃকই স্বীকৃত হয় নাই। কাজেই কুরআন ও সুন্নাহর নামে নিজের মনগড়া বিধান চালু করা ইসলামী রাষ্ট্রশাসকের পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব হইতে পারে না। কেননা উহার অমূলকত্ত ও ভিত্তিহীনতা গোপন করার সাধ্য কাহারো নাই। খলীফার কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী কোন নির্দেশ পালন করিতে কোন লোকই বাধ্য নয়। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক(রা)-এর উপরোদ্ধৃত ভাষণসমূহে এই কথাই উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষিত হইয়াছে। পরবর্তী খলিফাগণও নিজ নিজ ভাষায় এই কথার প্রতিধ্বনি বারবার করিয়াছে।

ইসলাম নির্ধারিত এই কর্মনীতি ও রাষ্ট্র শাসন পদ্ধতি পোপতন্ত্র তো নয়ই,ইহা গনতন্ত্র, রাজতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রও নয়। কেননা পোপতন্ত্রে পাদ্রি-পুরোহিতরা আল্লাহ্‌র নামে নিজেদের মনগড়া শাসন চালায়। সে সম্পর্কে অন্য কাহারও কোন মন্তব্য করার অধিকার নাই। রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রে তো জনসাধারণ সকল প্রকার মানবিক ও মৌলিক অধিকার হইতেই সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত থাকিতে বাধ্য হয়। আর তথাকথিত গনতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে চলে দল-প্রধান বা দলের প্রভাবশালী লোকদের অথবা ক্ষমতা দখলকারী মুষ্টিমেয় কোটারীর চরম স্বেচ্ছাচারিতা। ইসলামী খিলাফতে আল্লাহ্‌র বিধান ও রাসূলের সুন্নাত মানিয়া চলার ব্যাপারে শাসক ও শাসিত, খলীফা ও জনগন সকলেই সমানভাবে বাধ্য;বরং যে ব্যক্তি এই মান্যতার দিক দিয়া অন্যদের তুলনায় অধিক অগ্রসর,সে-ই হয় এই রাষ্ট্রের খলীফা। খিলাফতের পদে নিযুক্ত হইয়া কোন ব্যক্তি কুরআন-সুন্নাহর বিধানও নিজ ইচ্চামত জারী করিতে পারে না। সেজন্য কুরআন-সুন্নাহ্ বিশেষজ্ঞদের সহিত পরামর্শ করিতে সে বাধ্য। কিন্তু পোপতন্ত্রে ধর্মযাজকরাই নিরংকুশ ক্ষমতার মালিক। তাহারা কাহারও সহিত কোন ব্যাপারে পরামর্শ করিতে বাধ্য নয়। তাহাদের কোন সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কেহ প্রশ্ন তুলিতে পারে না; বরং তাহাদের কার্যাবলীর বিরূপ সমালোচনা করার পরিণতি অপঘাতে মৃত্যুবরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। সাধারণ লোক সেখানে নিকৃষ্টতম গোলামের জীবন যাপন করিতে বাধ্য। পক্ষান্তরে ইসলামী খিলাফতে প্রত্যেকটি মানুষই স্বাধীন। সেখানে সমালোচনা করার শুধু অধিকারই দেওয়া হয় নাই, উহা প্রতিটি নাগরিকের দ্বীনী কর্তব্য বলিয়াও ঘোষিত হইয়াছে।

স্মর্তব্য যে, কুরআন ও সুন্নাহ ইসলামী খিলাফতের ভিত্তি বটে;কিন্তু উহাতে কেবলমাত্র মূলনীতি পেশ করা হইয়াছে। বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি বিষয় উল্লেখ হইতে ইচ্ছা করিয়াই বিরত থাকা হইয়াছে। কোথাও তেমন কিছু উল্লেখিত হইয়া থাকিলেও অপরিহার্য ছিল বলিয়াই তাহা করা হইয়াছে। সেখানে তাহা উল্লেখিত না হইলে কুরআন ও সুন্নাতের বাস্তবায়ন সম্ভব হইত না। ইসলামী খিলাফতের যাবতীয় কাজ সেই সব মূলনীতির ভিত্তিতে সুসম্পন্ন করা হয়। সেসব মূলনীতির ভিত্তিতে বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি বিষয় স্থির করা সর্বসাধারণ মানুষের দায়িত্ব এবং এই ব্যাপারে কাহারও একচেটিয়া অধিকার নাই। বস্তুতঃএই কারণেই ইসলামের জীবন ও রাষ্ট্রাদর্শ চিরন্তন ও শাশ্বত মূল্য লাভ করিতে পারিয়াছে।

কুরআন ও সুন্নাহ প্রদত্ত মূলনীতিসমূহ কালজয়ী।সর্বকালে সর্বাবস্থায় এবং সর্বদেশেই উহার ভিত্তিত আদর্শ মানব সমাজ গঠন করা শুধু সম্ভব নয় অবশ্য কর্তব্যও। সে সব মূলনীতি ছাড়া আদর্শ সমাজ গঠনের স্বপ্ন কোনদিনই বাস্তবায়িত হইতে পারেনা। মুসলমান যতদিন সেসব মূলনীতির ভিত্তিতে ব্যক্তি ও সমাজ গঠন করিয়াছে এবং বাস্তবে উহা অনুসরণ করিয়া চলিয়াছে, ততদিন তাহারা যে ক্রমশঃধাপে ধাপে উন্নতির দিকে ধাবিত হইয়াছে, ইতিহাসই উহার অকাট্য প্রমাণ। কিন্তু যখনি সে মূলনীতিসমূহ ব্যক্তিগত ও জাতীয় পর্যায়ে পরিত্যক্ত হইয়াছে, উহার পরিপন্থী নীতি ও আদর্শ মানিয়া চলিতে শুরু করিয়াছে,তখনি তাহাদের পতন সূচিত হইয়াছে। বর্তমান বিশ্বের মুসলমানদের বাস্তব অবস্থা ইহারই জীবন্ত সাক্ষী।

আল্লাহ্‌র কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের ব্যাখ্যাদানের একচেটিয়া অধিকার বিশেষ এক শ্রেণীকে দেওয়া হইলে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাও ‘থিওক্রাটিক বা যাযকতন্ত্রও’ হইয়া যাইত; কিন্তু ইসলামে যে পৌরোহিত্যবাদ নাই, বিশেষ এক শ্রেণীর কোন একচেটিয়া কর্তৃত্বও ইহাতে স্বীকৃত নয়, একথা সর্বজনবিদিত। এখানে প্রত্যেক ব্যক্তিই স্বীয় যোগ্যতা বলে কুরআন ও সুন্নাহ অধ্যয়ন, চিন্তা-গবেষণা, বিচার-বিবেচনা এবং ফলাফল ও সিদ্ধান্ত গ্রহন অধিকারী। এই ব্যাপারে নির্বিশেষে সকলেরই সমান অধিকার রহিয়াছে। -শুধু তাহাই নয়,এই অধিকার প্রয়োগ করার জন্য সর্বসাধারণকে স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশও দান করা হইয়াছে। কাজেই ইহার সহিত পোপতন্ত্রের(Papacy) যে দূরতম সম্পর্ক বা সাদৃশ্যও নাই, তাহা বলাই বাহুল্য।

ইসলামী খিলাফতে প্রত্যেক নাগরিককে শাসন কর্তৃপক্ষের প্রকাশ্য সমালোচনার অধিকার দেওয়া হইয়াছে। তাহাদের কাজকর্মের প্রতি তীক্ষ্ণ সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং কুরআন ও সুনাহর আলোকে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি গোচরীভূত হইলে সঙ্গে সঙ্গে উহার প্রতিবাদ করা ও উহার প্রতিকারের জন্য বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে। এই শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালকগন নিজেদের জন্য কোন বিশেষ আইন রচনা করিয়া কোন বিশেষ অধিকার ভোগ করার সুযোগ পাইতে পারে না।খিলাফতে রাশেদার আমলে কুরআন ও সুন্নাহর বিধান শক্তভাবে পালন করার ফলে ইসলামী সমাজ এই ধরনের যাবতীয় অবাঞ্চিত ও কলঙ্কজনক আচরণ হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র রহিয়াছে।তখন জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব এবং যাবতীয় অর্থ সম্পদ ছিল এক মহান আমানত। এই আমানতে বিন্দুমাত্র খিয়ানত করিলেও কিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তি ভোগ করিতে হইবে, এই বিশ্বাস প্রত্যেকের মনে ইস্পাতের ন্যায় দৃঢ়মূল হইয়াছিল।

খিলাফতে রাশেদার চারজন খলীফাই জাতি ও রাষ্ট্রের অর্পিত আমানতসমূহ অত্যন্ত সযত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করিয়াছেন,সে সবের যথাযথ ব্যয়-বণ্টন ও বিনিয়োগ নিশ্চিত করিয়াছেন এবং নিঃছিদ্র একনিষ্ঠতা, ঐকান্তিকতা, নিঃস্বার্থতা ও উচ্চমানের তাকওয়া-পরহেজগারীর বাস্তব নিদর্শন উপস্থাপিত করিয়াছেন। একালের লোকদের দৃষ্টিতে তাহা আজগুবী,অস্বাভাবিক ও অকল্পনীয় মনে হইলেও খিলাফতে রাশেদার ব্যাপারে উহাই ছিল বাস্তব সত্য। বস্তুতঃখিলাফত ও নেতৃত্ব তাঁহাদের মনে ও চরিত্রে বিন্দুমাত্র বিকৃতি ঘটাইতে পারে নাই; বরং তাহাদের তাকওয়ার মান ও মাত্রা পূর্বের তুলনায় অধিক বৃদ্ধি করিয়া দিয়াছে।জনগণের ধন-সম্পদ হইতে অন্যায় ফায়দা লাভ,ক্ষমতার অপব্যবহার এবং নিজ বংশ ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা বিধানের চিন্তা তাঁহাদের মনে-মগজে মুহূর্তের তরেও স্থান লাভ করিতে পারে নাই। খিলাফতের কঠিন দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার মুহূর্ত হইতেই তাঁহারা নিজেদের ব্যক্তিসত্তা ও বংশ-পরিবারবর্গকে বেমালুম ভুলিয়া গিয়া আল্লাহ্‌র দ্বীনের মর্যাদা রক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় কার্যাবলী সুসম্পাদনে নিজেদের সমগ্র শক্তি নিয়োজিত করিয়া ছিলেন।সর্বক্ষেত্রে ও সর্বব্যাপারে ইনসাফ ও পরিপূর্ণ সুবিচার প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁহাদের কর্মব্যস্ততার চরমতম লক্ষ্য। দুর্বল ও অভাবগ্রস্ত লোকদের সাহায্য দানের তুলনায় অধিক প্রিয় ব্যস্ততা তাঁহাদের নিকট আর কিছু ছিলনা।

যে রাষ্ট্র-ব্যবস্থা এই প্রকৃতির হয়, সেখানে স্বৈরাচার ও অত্যাচার-জুলুমের নাম-চিহ্ন পর্যন্ত থাকিতে পারে না। যে-রাষ্ট্রের কর্ণধার ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাবৃন্দ নিজদিগকে সাধারণ লোকের ঊর্ধ্বে মনে করেন না, মনে করেন সর্বসাধারণের খাদেম,উহাকে না পোপতন্ত্র বলা যাইতে পারে, না স্বৈরতন্ত্র। আধুনিক কালের তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চরিত্রের সহিতও ইহার কোন সাদৃশ্য পাওয়া যাইতে পারে না। একথা সত্য যে, বর্তমানের ন্যায় সেকালে সাধারণ বয়স্ক ভোটাধিকারের(Adult suffrage) ভিত্তিতে খলীফা চতুষ্টয় নির্বাচিত হন নাই। যে অস্থির ও অশান্তিময় পরিস্থিতিতে এক এক ব্যক্তি খলীফা পদে বরিত হইয়াছেন, তাহাতে এই ধরনের নির্বাচনের কথা কল্পনাও করা যায় না। তৎসত্ত্বেও তদানীন্তন সমাজে তাঁহারাই যে সর্বাধিক আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিলেন এবং ঐধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইলে তাঁহারাই যে নির্বাচিত হইতেন,ইহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করা যায় না।খলীফা নির্বাচনে সাধারণতঃমুহাজির ও আনসার গোত্রের লোকেরাই অংশ গ্রহন করিতেন।আরবের তৎকালীন পরিস্থিতিতে অন্যান্য গোত্রের লোকদের সহিত এ ব্যাপারে পরামর্শ গ্রহণ করারও প্রয়োজন মনে করা হইত না তবে এই নির্বাচন গোত্রীয় গোপন যোগ-সাজশেরও পরিণতি ছিল না। আনসার ও মুহাজিররা কার্যতঃতদানীন্তন আরবের প্রায় সমস্ত গোত্রের মুসলিম জনতার প্রতিনিধিস্থানীয় ছিলেন।তাঁহাদের মতই ছিল সাধারণভাবে সমস্ত আরব মুসলিম জনতার রায়। রাসূলে করিম(স)-এর কিংবা পরবর্তী খলীফাদের এক একজনের আকস্মিক অন্তর্ধানের পর যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, প্রত্যেক খলীফার নির্বাচনের মাধ্যমে তৎকালীন জরুরী পরিস্থিতিতে, অনতিবিলম্বে সেই শূন্যতা পূরণই অপরিহার্য এবং সর্বাধিক জরুরী কাজ হইয়া দেখা দিয়াছিল মুসলিম জাতির সম্মুখে।

এতৎসত্ত্বেও প্রত্যেক খলীফাই সমাজের সাধারণ আস্থাভাজন ব্যক্তিদের সহিত পরামর্শ করিয়াই রাষ্ট্র পরিচালনা করিয়াছেন। কেহই নিজের একক ও যুক্তিহীন মতের ভিত্তিতে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নাই জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারসমূহে। খলীফাদের নির্বাচনে আত্মীয়তা কিংবা বংশমর্যাদা কোন কার্য-কারণ(Factor) হইয়া দেখা দিতে পারে নাই। তাঁহাদের কেহই এই পদের জন্য প্রার্থী হন নাই। এই পকদে নিযুক্ত হওয়ার লক্ষ্যে তাঁহাদের কেহ জনমত অনুকূলে আনার কোন অভিযান চালানোর আত্মনিয়োগ করেন নাই; বরং প্রত্যেকই নিজের পরিবর্তে অন্য কোন যোগ্যতর ব্যক্তিকে নির্বাচিত করাইবার জন্য চেষ্টা চালাইয়াছেন। এই পর্যায়ে প্রথম খলীফার নির্বাচন-কালীন কথাবার্তা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় চিরদিন উজ্জ্বল হইয়া থাকার অধিকারী। কোন কোন খলীফার নির্বাচনে প্রথম দিক দিয়া কিছুটা মত-বিরোধ দেখা দিলেও উত্তরকালে সেই মতবিরোধ বা বিরুদ্ধতার কোন অস্তিত্ব দেখা যায় নাই; বরং সকলেই অন্তর দিয়া সে নির্বাচনকে মানিয়া লইয়াছেন এবং নির্বাচিত খলীফার সহিত আন্তরিক সহযোগিতা করিয়াছেন। ইসলামী নির্বাচন নীতির এই বৈশিষ্ট্য তুলনাহীন।এই সমাজে স্থায়ী সরকারপক্ষ এবং স্থায়ী বিরোধীদল(Opposition) বলিতে কিছুই ছিলনা। এখানে সকলেই মিলিতভাবে ন্যায় ও সত্যের সমর্থক ও সহযোগিতাকারী এবং সকলেই অন্যায় ও ভুলনীতির বিরোধী, প্রতিবাদকারী। খলিফাগণ জনগণের অধিকার ও রাষ্ট্রের কল্যাণে পারস্পরিক পরামর্শের গুরুত্ব কত বেশি স্বীকার করিতেন, প্রথম খলীফার প্রাথমিক ভাষণের নিম্নোদ্ধৃত কথাগুলি হইতেই তাহা সুস্পষ্ট হইয়া উঠেঃ

আমি তোমাদের শাসক নিযুক্ত হইয়াছি, কিন্তু আমি তো তোমাদের তুলনায় উত্তম নহি। আমি যদি ন্যায়পথে চলি, তাহা হইলে আমার আনুগত্য ও অনুসরণ করিবে। কিন্তু ন্যায়ের পথ হইতে যদি আমার পদস্থলন হয় ও অন্যায় পথে চলিতে শুরু করি, তাহা হইলে তোমারা আমাকে ঠিক করিয়া দিবে, সঠিক পথে চালাইবে। আমি যত দিন আল্লাহ্‌ ও তাঁহার রাসূলের আনুগত্য করিতে থাকিব, ততদিন তোমারাও আমার আনুগত্য করিতে থাকিবে;কিন্তু আমিই যদি আল্লাহ্‌ ও তাঁহার রাসূলের নাফরমানী করি, তাহা হইলে আমার আনুগত্য করা তোমাদের কর্তব্য নয়।

শাসকের সহিত জনগণের গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক এবং শাসককে সঠিক পথে পরিচালন ও সমালোচনার অধিকারের এইরূপ উদার-উদাত্ত স্বীকৃতির কোন দৃষ্টান্ত বর্তমান গনতন্ত্রবাদী যুগের তথাকথিত রাষ্ট্রসমূহের কোথাও দেখা যায় কি?খিলাফতে রাশেদার গোটা শাসন-কালই ছিল আধুনিক ভাষায় বলিতে গেলে নিতান্তই জরুরী অবস্থার যুগ(Emergency Period)ছিল। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে জনগণের মৌলিক অধিকার কখনোই হরণ করা হয় নাই। শু’রা-পরামর্শ গ্রহণ ব্যবস্থা-সব সময়ই সুষ্ঠু রূপে কার্যকর রহিয়াছে। শু’রা-পার্লামেন্ট-ভাঙ্গিয়া দিয়া বিশেষ ক্ষমতা(Special power)নিজ হাতে গ্রহণ করার অধিকার খিলাফতের ভিত্তি –কুরআন ও সুন্নাহ-কাহাকেও কোন অবস্থায়ই দেয় নাই।

খলিফাগনের দৃষ্টিতে সব মুসলমানই ছিল সমান অধিকার ও সমান মর্যাদাসম্পন্ন;বৈষয়িক মান-মর্যাদার কারণে কেহই অন্যদের উপর প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার লাভ করিতে পারিত না। প্রাক্তন মুর্তাদদের সম্পর্কে প্রথম খলীফা প্রথমে এই নির্দেশ জারী করিয়াছিলেন যে, সামরিক অভিযানসমূহে তাহাদিগকে যোগদান করিতে দেওয়া যাইবে না। কেননা তখনও তাহাদের ব্যাপারে পূর্ণ আস্থা ও নিশ্চিন্ততা লাভ করা যায় নাই। কিন্তু তাহাদের সম্পর্কে সন্দেহ ও সংশয় দূরীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাহাদিগকে ইসলামী মুজাহিদ বাহিনীর মধ্যে শামিল হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। ইরান অভিযানে তাহাদেরকে কাজে লাইগাবার জন্য হযরত উমর ফারুক(রা) কে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছিল। ইহা খিলাফতে রাশেদার উদার,নীতিনিষ্ঠ ও বিদ্বেষমুক্ত দৃষ্টিকোণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়।

আরবের রাজনৈতিক একত্ব
প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) তাঁহার অন্যান্য বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টির সাহায্যে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তিকে সুদৃঢ় করিয়া তোলেন। ইহার ফলে পরবর্তী খলিফাগণের পক্ষে সেই ভিত্তির উপর একটি বিশাল রাষ্ট্রপ্রাসাদ নির্মাণ করা এবং সমগ্র আরব উপদ্বীপকে একটি মাত্র রাজনৈতিক এককে(Unit) পরিণত করা খুবই সহজসাধ্য হয়। হযরত আবূ বকর (রা)-এর ক্ষমা,সহিষ্ণুতা ও ত্যাগ-তীতিক্ষামূলক নীতির দরুণ সমগ্র আরব উপদ্বীপকে ঐক্যবদ্ধ করার পথ সুগম হইয়াছিল। প্রথম দিকের সাময়িক বিশৃঙ্খলা প্রশমিত হওয়ার পর বিদ্রোহী-অপরাধী লোকেরা তাঁহার নিকট ক্ষমা লাভ করিয়া আন্তরিকতা সহকারে খিলাফতের আনুগত্য স্বীকার করে। শু’রা ব্যবস্থা সারাদেশের রাজনৈতিক ঐক্য ও সংহতিকে অধিকতর দৃঢ় ও শক্তিশালী করিয়া তোলে। ইহারই ফলে ইরাক ও সিরিয়া বিজয় সহজতর হইয়া যায়।

এই সময়কার আরব জনগণের চিন্তা-চেতনা ও মননশীলতা শু’রা ও গণ- অধিকারসম্পন্ন রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনুকুল হইয়াছিল। ইসলামের অভ্যুদয় ও প্রকাশ আরব দেশে ঘটিয়াছিল। ইসলামী শরীয়াত-কুরআন ও সুন্নাহ-আরবী ভাষায় সন্নিবেশিত ছিল। সর্বশেষ রাসূল আরব দেশে প্রেরিত হইয়াছিলেন। আরব-গোত্রসমূহ বেদুঈন কিংবা নগরবাসী যাহাই হউক না কেন,স্বাধীনতা ও স্বরাজের জন্য ছিল অধীর ব্যাকুল। তাহাদের নিকট ইহাপেক্ষা অধিক প্রিয় ও আকর্ষণীয় জিনিস আর কিছুই ছিল না। মরুচারীদের মধ্যে সাম্য ও সমতার ভাবধারা পুরাপুরি সংক্রমিত হইয়াছিল। ইসলামী শিক্ষা ও প্রশিক্ষন এই ভাবধারাকে অধিক স্বচ্ছতা ও পরিপক্কতা দান করে। কেননা ইসলামই প্রকৃত সাম্য ও সমতার পূর্ণাঙ্গ আদর্শ উপস্থাপন করিয়াছে। কুরআন মজীদ এই সাম্য ও সমতার বাণী উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করিয়াছে। কুরআনের ঘোষণানুযায়ী বংশ মর্যাদা বা ধন-সম্পদের আধিক্য ও প্রাচুর্যের নয়, আল্লাহ্‌র ভয় (তাকওয়া) ও আল্লাহ্‌র দ্বীন পালনই মর্যাদা ও সম্মানের মানদণ্ড। বর্তমান যুগে সর্বত্র গণতন্ত্রের জয়ধ্বনি উচ্চারিত। কিন্তু প্রকৃত মানবিক মূল্যবোধ ও ভাবধারা খিলাফতে রাশেদার আমলেই সমুজ্জ্বল প্রতিভাত হইয়াছে। মানবতা, ভ্রাতৃত্ব,প্রেম-প্রীতি,স্বাধীনতা ও সাম্য বর্তমান গণতন্ত্রের স্ফীত কণ্ঠে সমুচ্চারিত। কিন্তু ইহার প্রকৃত বাস্তবায়ন কেবলমাত্র খিলাফতে রাশেদার আমলের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দ্রষ্টব্য। ইসলামের পবিত্র শিক্ষা প্রতিটি মু’মিনকে অপর মু’মিনের একনিষ্ঠ ‘ভাই’ ও সত্যিকার কল্যাণকামী বানাইয়া দিয়াছিল। কোন লোক নিজের জন্য যাহা পছন্দ করে, অপর ভাইয়ের জন্য তাহাই পছন্দ না করা পর্যন্ত ঈমানদার হইতে পারে না-রাসূলে করীম(স)-এর ঘোষণা একটা সাধারণ ও মূল্যহীন কণ্ঠধ্বনি ছিল না। ইহা ছিল মানবাধিকারের সপক্ষে এক ঐতিহাসিক ঘোষণা। এই গভীর বুদ্ধিসম্মত ঘোষণাকে বাস্তবায়িত করিয়া তোলা না হইলে কোন রাষ্ট্রই প্রকৃত জনকল্যাণমুখী চরিত্র লাভ করিতে পারে না এবং এই ঘোষণাকে আলোক-মশালরূপে গ্রহণ করিয়া সাধারণ জনগণকে পরস্পরের কল্যাণকামী ও সহানুভূতিশীল রূপে গড়িয়া না তোলা পর্যন্ত কোন গণকল্যাণকামী রাষ্ট্রের পক্ষে বিন্দুমাত্র সাফল্য লাভ অসম্ভব। বস্তুতঃবর্তমান গণতন্ত্রবাদী রাষ্ট্রসমূহের চরম হাস্যকর ব্যর্থতা এবং খিলাফতে রাশেদার পূর্ণ সাফল্যের মূলে এই তত্ত্বই নিহিত। বলা নিষ্প্রয়োজন, রাসূলে করীম(স)-এর এবম্বিধ মহামূল্য বাণীসমূহকে ভিত্তি করিয়াই ইসলামই রাষ্ট্রের বিরাট প্রাসাদ রচনা করা হযরত আবূ বকর (রা)-এর পক্ষে সম্ভবপর হইয়াছিল। আর এই বানীসমূহের পূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করিয়া সমকালীন বিশ্বরাষ্ট্র-দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত-খিলাফতে রাশেদার মহান ব্যবস্থা পরিচালনা করিয়া সমগ্র বিশ্বকে বিস্মিত-বিমুগ্ধ করা পরবর্তী খলিফাত্রয়ের পক্ষে সম্ভবপর হইয়াছিল।

ইসলামী রাষ্ট্র-নীতির অন্তর্নিহিত শক্তি
খিলাফতে রাশেদার রাষ্ট্র-ব্যবস্থা কেবলমাত্র আরব উপদ্বীপ নামক ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ হইয়া থাকে নাই। উহা সে ভূ-খণ্ডের সীমা অতিক্রম করিয়া অত্যল্প কালের মধ্যেই বাঁধ-ভাঙা বন্যার মত চতুর্দিকের দূর দূর-অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ও সম্প্রসারিত হইয়া পড়ে। কিন্তু একটি আরব রাষ্ট্রের পক্ষে বিশাল অনারব এলাকায় সম্প্রসারিত হওয়া কি নিছক কতিপয় সামরিক অভিযানের পরিণতি ছিল? ইতিহাসের ইহা একটি জটিল প্রশ্ন। এই প্রশ্নের জবাব বিশ্লেষণ একান্তই আবশ্যক।

বস্তুতঃ ইসলাম এক সর্বজনীন বিপ্লবী বাণী লইয়া দুনিয়ার বুকে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। সে বানীর ব্যাপক প্রচার ও প্রসার এবং উহার অনুকূলে নীরব জনমত গড়িয়া উঠাই ইসলামের জয়জয়কার ও দেশের পর দেশ ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় লওয়ার এক বিস্ময়কর ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছে। এই বিজয়সমূহকে বৃক্ষের বৃন্ত-সংলগ্ন পাকা ফল এক টোকায় পাড়িয়া লওয়া কিংবা সদ্য-ভূমিষ্ঠ সন্তানের নাড়ি কাটিয়া দেওয়ার সহিত তুলনীয়। ইসলামী আদর্শবাদ প্রথমে ক্ষেত্র প্রস্তুত করিয়াছে, পথ সুগম করিয়া লইয়াছে এবং পরিণামে ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টির সব বাধা-প্রতিবন্ধকতা দূর হইয়া গিয়াছে। এই ভাবেই মুসলমানদের পক্ষে দুনিয়ার বিশাল অঞ্চলে ইসলামী রাষ্ট্রকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর গড়িয়া তোলা সম্ভবপর হইয়াছিল।

ইসলামী ইতিহাসের প্রাথমিক পর্যায় সম্পর্কে অবহিত কোন ব্যক্তির নিকটই একথা গোপন থাকিতে পারে না যে, ইসলামের মুজাহিদদের সাফল্য কোন সাময়িক বা দুর্ঘটনামূলক ব্যাপার ছিল না। এই বিজয় ছিল ঘটনা-প্রবাহের এক দীর্ঘ ধারাবাহিকতার অবিচ্ছিন্ন অংশ। মূলতঃ ইসলাম দুনিয়ায় যে বিপ্লব সৃষ্টি করিয়াছিল, তাহা ছিল অবধারিত। কেননা ইসলামের মূল আদর্শেই বিপ্লবের অগ্নিবাস্প নিহিত রহিয়াছে। এই দুর্জয় শক্তির বিস্ফোরিত হওয়া ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার।

ইসলামের মূল আকীদা- এক আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কাহাকেও মানি না, ভায় করিনা, অন্য কাহারও নিকট একবিন্দু নতি স্বীকার করি না এবং রাসূলে করীম (স)ই আল্লাহ্‌র প্রেরিত রাসূল, আমাদের একমাত্র পথনির্দেশক- এই দৃঢ় প্রত্যয়ই ইসলামকে এ বিশ্ববিজয়ী শক্তি দান করিয়াছে। আকীদা-বিশ্বাসের এই বলিষ্ঠতাই সাধারণ মানুষকে বিপ্লবী বানাইয়া দিয়াছিল। প্রকৃতপক্ষে মন ও মানসের এই স্বাধীনতা ইসলামের এক বিরাট অবদান। সেই সঙ্গে ধর্ম ও মতাদর্শের ব্যাপারে কোনরূপ বলপ্রয়োগ ছিল খিলাফতে রাশেদার সম্পূর্ণ নীতিবিরুদ্ধ। ইসলাম গ্রহণের জন্য সারা দুনিয়ার মানুষকে আহ্বান জানানো হইয়াছে বটে; কিন্তু নিজের ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তন করার জন্য ইসলাম কাহাকেও বাধ্য করে না। তবে ইসলামের আদর্শ সম্পর্কে লোকেরা গুরুত্ব সহকারে চিন্তা-বিবেচনা করিবে, দুনিয়ার অন্যান্য ধর্ম ও মতাদর্শের সহিত উহার তুলনামূলক আলোচনা ও অধ্যয়ন করিয়া উহার বৈশিষ্ট্য নিরপেক্ষভাবে স্বীকার করিবে, ইসলামের ইহা এক বলিষ্ঠ আশাও বটে। কেননা তাহা হইলে ইহা গ্রহণ না করিয়া কেহ যে থাকিতে পারিবে না, এই সম্পর্কে ইসলাম নিঃসন্দেহ। বস্তুতঃইসলাম মানব প্রকৃতির সহিত পুরাপুরি সামঞ্জস্যশীল এক পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান। সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ হিসেবে একমাত্র ইসলামকেই গ্রহণ করিতে পারে, এই বিষয়ে ইসলামের কোন সংশয় নাই।

ইসলামের মুক্তি ও স্বাধীনতার এই বিপ্লবী বাণীই দুনিয়ার অন্যান্য ধর্ম ও মতাদর্শের পক্ষে কঠিন চ্যালেঞ্জ হইয়া দেখা দিয়াছে। কেননা আকীদা-বিশ্বাস ও কর্মনীতি গ্রহণের স্বাধীনতা দেওয়া হইলে ইসলামের নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ আদর্শই যে সর্ব শ্রেণীর মানুষকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করিবে, মানুষ নিজের ভুল ধর্ম ও মতাদর্শ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ত্যাগ করিবে, ইহা ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের এক পরীক্ষিত সত্য। আর ইহার পরে দুনিয়ার অপরাপর ধর্ম ও মতাদর্শের যে অপমৃত্যু ঘটিবে, তাহা সন্দেহাতীত। ইসলামের পূর্ণাঙ্গ আদর্শ প্রচারে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে যে বাধার সৃষ্টি করা হয়, উহার মূলে একমাত্র এই কারণই নিহিত রহিয়াছে।

ইসলাম মনের স্বাধীনতা(Freedom of mind)-র যে বিপ্লবী আদর্শ দুনিয়ার সম্মুখে পেশ করিয়াছে, খিলাফতে রাশেদার আমলে তাহা পুরাপুরি কার্যকর ও বাস্তবায়িত হইয়াছে। এই আমলে বহুদেশ অধিকৃত হইয়াছে বহু জনপদ ইসলামের অধীনতা মানিয়া লইয়াছে; কিন্তু একজন লোককেও জোরপূর্বক স্বীয় ধর্মমত পরিত্যাগ করিতে বাধ্য করা হয় নাই। কাহাকেও সে জন্য প্রলোভিত করা হয় নাই। যে লোক স্বেচ্ছায় ও সোৎসাহে ইসলাম কবুল করিয়াছে, সে অন্যান্য সব মুসলমানের মতই সমান মর্যাদা ও অধিকার লাভ করিয়াছে। পক্ষান্তরে যে লোক স্বীয় পূর্বত্ন ধর্ম ও মতাদর্শে অবিচল থাকিতে চাহিয়াছে, তাহাকেও সেইরূপ থাকিবার জন্য পূর্ণ অধিকার দেওয়া হইয়াছে। সে যাহাতে নিজস্ব ধর্ম পালনের সঙ্গে সঙ্গে স্বীয় ধন-মান ও প্রানের নিরাপত্তা সহকারে বসবাস করিতে পারে, সেজন্য ইসলামী খিলাফত পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছে। বিনিময়ে তাহাদের সামর্থ্যনুযায়ী একটা বিশেষ ‘কর’(Tax) গ্রহণ করা হইয়াছে। এই কর কোন রূপ জরিমানা ছিল না। তাহাদের সার্বিক নিরাপত্তার নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রকে যে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইত, ইহা ছিল সে ব্যাপারে এক বিশেষ ধরনের চাঁদা। ইহাকে আরবী পরিভাষায় ‘জিজিয়া’বলা হয়। এই শব্দের অর্থঃ বদলা বা বিনিময়। আর বস্তুতঃ ইহা ছিল তাহার ধর্ম,ধন-মাল, মান-সম্ভ্রম ও প্রাণের নিরাপত্তা বিধানের জন্য খিলাফত কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থার বিনিময় মূল্য মাত্র। যেখানে এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব পালনে খিলাফত অক্ষম হইয়াচে,সেখানে ইহা গ্রহণ শুধু বন্ধই করা হয় নাই,পূর্ব গৃহীত করও ফেরত দেওয়া হইয়াছে। ইসলামী ইতিহাসের পৃষ্ঠায় একথা সুস্পষ্টভাবে ও স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রহিয়াছে।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর প্রতি বিশ্বাসী ও তাঁহার জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ লোকদের হাতে প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত ছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা, মৌলিক মানবীয় অধিকার, নির্বিশেষে সাম্য ও ভ্রাতৃসুলভ প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার উন্নত নীতিমালা ও আদর্শের উপর। ইহা ছিল রোমান রাজতন্ত্রবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের এক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। অন্যদিকে সাধারণ মানবীয় কল্যাণের দৃষ্টিতে আধুনিকতম তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাও উহার তুলনায় অত্যন্ত দীন-হীন। বস্তুত অনারব লোকদিগকে আরবের অধীন-অনুগত বানানো খিলাফতে রাশেদার কোন লক্ষ্য ছিল না। তদানীন্তন রোমান ও পারসিকদের নিকৃষ্টতম দাসত্ব হইতে মুক্ত করিয়া আরবদের দাসত্ব নিগড়ে উহাদিগকে বন্দী করাও ছিল না উহার উদ্দেশ্য; বরং মানুষকে সর্বপ্রকার মানবিক ও বৈষয়িক গোলামী হইতে পরিপূর্ণ মুক্তিদান, একমাত্র সৃষ্টিকর্তার বন্দেগী ও রাসূলের নেতৃত্ব স্বীকার করিয়া দ্বীন-ইসলামের মহান বিধান অনুযায়ী সম্পূর্ণ স্বাধীন পরিবেশে জীবন যাপন ও বিকাশ-বর্ধনের অবাধ-উদার ও উন্মুক্ত সুযোগ করিয়া দেওয়াই ছিল উহার যাবতীয় চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও সাধনা-সংগ্রামের চরমতম লক্ষ্য। ইসলামের সুমহান আদর্শে ঐকান্তিক বিশ্বাস এবং পরস্পরের গভীর ভ্রাতৃত্ব ও একনিষ্ঠ প্রেম-প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াই ছিল উহার একমাত্র উপায়। খিলাফতে রাশেদার আমলে বিজয়ী ও বিজিত বলিতে কোন শ্রেণী-বিভেদ ছিল না। সর্বশ্রেণী- সকল স্তর ও পর্যায়ের মানুষের সেখানে পুরাপুরি সমান অধিকার ও মর্যাদালাভে ধন্য হইয়াছিল। ভাষা,গোত্র ও অঞ্চলের ভিত্তিতে তাহাদের মধ্যে কোন পার্থক্য ও তারতম্য ছিল না। এমন কি ইরাক ও সিরিয়ার অমুসলিম এবং নাজরান ও আরবের অন্যান্য এলাকার খৃষ্টানদের মধ্যেও কোনরূপ পার্থক্য সৃষ্টি হইতে দেওয়া হয় নাই। মুসলমানগণ তাহাদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের কাজ করিতেন বটে; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও যাহারা নিজেদের পৈতৃক ধর্মে অবিচল থাকিতে চাহিত, তাহাদিগকে সেইরূপ থাকারই পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হইয়াছিল। খিলাফতে রাশেদার আমলে ধর্ম গ্রহণের ব্যাপারে কুরআনের নিম্নোদ্ধৃত ঘোষণাদ্বয় পুরামাত্রায় কার্যকর ছিলঃ

******(আরবী)

দ্বীন ও ধর্মের ব্যাপারে কোনরূপ বল প্রয়োগ বা জোরজবরদস্তির স্থান নেই।

যে লোক হেদায়েত গ্রহণ করে, উহার কল্যাণে সে নিজেই লাভ করিবে। আর যে লোক পথভ্রষ্ট হইয়া থাকিতে চাহে, উহার ক্ষতি ও অকল্যাণ তাহাকেই ভোগ করিতে হইবে। হে রাসূল আপনি লোকদিগকে বলিয়া দিন,তোমাদের পর্যন্ত সত্যের বাণী পৌঁছাইয়া দেওয়াই আমার কাজ; গ্রহণ করা বা না করা তোমাদের নিজেদের দায়িত্ব। তোমাদের হেদায়েত বা গুমরাহীর কোন দায়িত্ব আমার উপর বর্তায় না।

 

খিলাফতে রাশেদার আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা
খিলাফতে রাশেদার রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় ইসলামী সমাজ-সভ্যতা ও কৃষ্টি-তামাদ্দুনের পূর্ণ বাস্তবায়ন নিস্পন্ন হইয়াছিল।ইহা একাধারে ছিল দ্বীন-ভিত্তিক ও বৈষয়িক উন্নয়নের একমাত্র নিয়ামক রাষ্ট্র। দ্বীন-ইসলামের উপরই উহার ভিত্তি স্থাপিত ছিল এবং কুরআনের অকাট্য মূলনীতি ও রাসূলে করীম(স)- এর সুন্নাত অনুযায়ী মানবতার সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধনই ছিল উহার যাবতীয় চেষ্টা-সাধনার একমাত্র লক্ষ্য।

খিলাফতে রাশেদার আমলে কুরআন মজীদ ও সুন্নাতে রাসূল মুতাবিকই যাবতীয় আইন-কানুন প্রণয়ন করা হইত। খুলাফায়ে রাশেদুন যদি এমন কোন সমস্যা বা জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হইতেন,যাহার প্রত্যক্ষ মীমাংসা কুরআন ও হাদীস হইতে লাভ করিতে পারিতেন না, তাহা হইলে নবী করীম(স)-এর কার্যাবলীর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সম্মুখে রাখিয়া উত্তমভাবে উহার মিমাংসা করিয়া লইতেন এবং কোন দিক দিয়াই কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলের মৌলিক আদর্শ লংঘিত হইতে দিতেন না।

ইসলামের মৌলিক বিধান অনুসারে গোটা উম্মতে মুসলিমা খলীফাদের আনুগত্য স্বীকার করিয়া চলিতে বাধ্য ছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে এই মূলনীতিও সর্বাপেক্ষা সমর্থিত ছিল যে, আল্লাহ্‌ ও রাসূলের হুকুম-বিধানের বিরুদ্ধতা করিয়া কোন খলীফা বা রাষ্ট্রকর্তার আনুগত্য করা যাইতে পারে না। কুরআন-হাদীসের মূল সূত্র হইতে বাস্তব ও ব্যবহারিক জীবনের খুঁটিনাটি আইন-কানুন প্রনয়নের অধিকারের ক্ষেত্রে খলীফার কোন প্রাধান্য, বিশিষ্টতা ও অগ্রাধিকার স্বীকৃত ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে খলীফা বরং অন্যান্য সাহাবীদের নিকট কুরআন-হাদীস-ভিত্তিক রায় বা পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিতেন। এই ব্যাপারে খলীফাদের সঙ্গে দ্বিমত হওয়ারও পূর্ণ অধিকার ছিল। শুধু তাহাই নয়,খলীফাদের রায়ের ভুল-ভ্রান্তি ধরাইয়া দেওয়া এবং তাঁহাদের প্রকাশ্য সমালোচনা করার সাধারণ অধিকারও সর্বতভাবে স্বীকৃত ছিল।

জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত রায় বা সম্মতি অনুযায়ী খলীফা নির্বাচিত হইতেন। জোরপূর্বক কিংবা বংশানুক্রমিক ধারা অনুযায়ী খলীফার পদ দখল করা শুধু ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থারই খেলাফ নহে, ইসলামী বিধানের দৃষ্টিতে উহা মারাত্মক অপরাধও বটে। খুলাফায়ে রাশেদুনের মধ্যে বাদশাহী শান-শওকাত কিংবা ডিকটেটরী স্বৈরতন্ত্রের কোন অস্তিত্তই বর্তমান ছিল না। তাঁহারা নিজদিগকে নাগরিকদের সমপর্যায়ভুক্ত মনে করিতেন। একমাত্র খিলাফত ভিন্ন অন্য কোন দিক দিয়াই তাঁহাদের ও সাধারণ জনগণের মধ্যে একবিন্দু পার্থক্য ছিল না। খলীফার দরবারে সরকারী কর্মচারী ও জনসাধারণের অবাধ যাতায়াত ছিল এবং এই ব্যাপারে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতার অবকাশ ছিল না। এই কারণে জনগণের সাধারণ অবস্থা ও অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে ওয়াকিফহাল হওয়া এবং কোন প্রকার দীর্ঘসূত্রিতা ব্যতিরেকেই উহার প্রতিকার করা তাঁহাদের পক্ষে অত্যন্ত সহজ ছিল।এই কারণেই এ কথা উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করা যাইতে পারে যে, খিলাফতে রাশেদাই হইতেছে বিশ্ব- ইতিহাসে একমাত্র ও সর্বপ্রথম রাষ্ট্র, যেখানে প্রকৃত গণ-অধিকার পুরাপুরিভাবেই রক্ষিত হইয়াছে।

বিচার বিভাগ
খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলে বিবদমান দুইপক্ষের মধ্যে ইনসাফ বা ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা খলীফার অন্যতম দায়িত্ব মনে করা হইত। এইজন্য প্রথম দিকে তাঁহারা প্রায় সব বিচারকার্য নিজেরাই সম্পন্ন করিতেন। অবশ্য দূরবর্তী স্থানসমূহের জন্য নিজেদের তরফ হইতে প্রতিনিধি নিযুক্ত করিতেন। প্রথম খলীফার আমলে প্রত্যেক শহরের জন্য নিযুক্ত শাসনকর্তাই বিচার কার্য আঞ্জাম দিতেন। কিন্তু দ্বিতীয় খলীফা তাঁহার খিলাফত আমলে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র করিয়া দিয়াছিলেন। এইজন্য প্রত্যেক শহরেই স্বতন্ত্র মর্যাদাসম্পন্ন বিচারপতি বা কাজী নিয়োগ করা হইয়াছিল। বিচার বিভাগ প্রসাশন বিভাগের কর্তৃত্ব হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও স্বাধীন মর্যাদাসম্পন্ন ছিল। বিচারপতি রায়দানের ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিলেন। খলীফার পক্ষ হইতে তাঁহাদিগকে এই নির্দেশ দান করা হইত যে, তাঁহারা বিচারে যে রায়ই দান করিবেন, তাহা যেন সর্বতোভাবে কুরআন ও সুন্নাতে-রাসূলের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়। কোন দিক দিয়াই যেন উহা লংঘন করা না হয়। সংশ্লিষ্ট এলাকার শাসনকর্তা বিচারপতির উপর কোন প্রকার প্রভাব বিস্তার কিংবা প্রভুত্ব খাটাইতে পারিতেন না। কাজী বা বিচারপতি সরাসরি খলীফা কর্তৃত্ব নিযুক্ত হইতেন। সংশ্লিষ্ট শহরের শাসনকর্তাকেও অনেক সময় বিচারপতি নিয়োগের ইখতিয়ার দান করা হইত; কিন্তু তাহা ছাড়া বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হইত। চতুর্থ খলীফার প্রদত্ত একখানি নিয়োগপত্রের নিম্নোদ্ধৃত অংশ হইতে ইহার বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়। লোকদের মামলা –মুকাদ্দমা নিস্পত্তি করার জন্য এমন সম্মানিত ব্যক্তিদের নিয়োগ কর,যাহাদের রায় জনগণ অকুণ্ঠিত চিত্তে মানিয়া লইবে এবং কেহ উহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কোন সাহস বা প্রয়োজন বোধ করিবে না। তাঁহারা হইবেন সকল প্রকার লোভ-লালসা ও মোহ-মাৎসর্য হইতে পবিত্র। তাঁহারা কাহারো বিশেষ মর্যাদার কারণে সন্ত্রস্ত ও প্রভাবান্বিত হইবেন না। সকল ব্যাপারেই তাঁহাদিগকে গভীর-সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বশীল হইতে হইবে। সন্দেহ-সংশয়পূর্ণ ব্যাপারে তাঁহারা অত্যন্ত সতর্ক হইবেন। পক্ষদ্বয়ের উপস্থাপিত যুক্তিপূর্ণ প্রমাণ ও সাক্ষ্য সন্দর্শনে কিছুমাত্র ঘাবড়াইয়া যাইবেন না, প্রতিটি ব্যাপারের গভীর তলদেশে পৌঁছিবার জন্য পরিপূর্ণ সতর্কতা ও চিন্তা-গবেষণা সহকারে কাজ করিবেন। এইভাবে তাঁহারা কোন চূরান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়া গেলে তাহা পুরাপুরি দৃঢ়তা সহকারে কার্যকর করিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হইবেন না। কোন প্রকার সুপারিশ ও কোনরূপ পদ-মর্যাদাকেই তাঁহারা ফয়সালা কার্যকর করার পথে বাধা হইয়া দাঁড়াইতে দিবেন না। যদিও এই ধরনের লোকদের সংখ্যা বেশী হয় না কখনো, কিন্তু তাহা সত্ত্বেও বিচারপতিকে অবশ্যই উল্লেখিত গুণে ভূষিত হইতে হইবে। তোমরা যখন কাহাকেও বিচারপতি নিযুক্ত করিবে, তখন তাহার যথেষ্ট পরিমানে বেতন ধার্য করিবে; তাহা হইলে তাহার জীবনযাত্রা নির্বাহের দাবি তাহাকে ঘুষ লইতে বাধ্য করিবে না। উপরন্তু তোমাদের মন-মানস ও সমাজ-সম্মেলনে তাহার মর্যাদা উন্নত হওয়া বাঞ্ছনীয়, যেন তাহার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাইবার সাহস কাহারো না হয়।

বিচারকগণ ছাড়াও প্রত্যেক শহরেই ইসলামী আইন সম্পর্কে বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন একটি জনগোষ্টী সব সময়ই মওজুদ থাকিত। কোন ব্যাপারে বিচারকদের অসুবিধা বা সমস্যা দেখা দিলে ইহাদের নিকট হইতে সাহায্য গ্রহণ করা হইত।

এই সময় নবী করীম(স)-এর হাদীসসমূহ গ্রন্থাবদ্ধ ছিল না, তাহা ছিল লোকদের স্মৃতিপটে রক্ষিত। কেহ একটি হাদীস জানিত আর কাহারো স্মরণ ছিল অন্য একটি হাদীস। সমস্ত হাদীস এককভাবে বিশেষ কাহারো স্মরণ ছিল না আর ইহাই ছিল সেকালের একটি কঠিন সমস্যা। বিচারকদের সম্মুখে উপস্থিত ব্যাপারের মীমাংসা করার জন্য কোন হাদীসের প্রয়োজন হিলে তাঁহারা বিভিন্ন লোকের নিকট জিজ্ঞাসা করিতেন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাসূলে করীম(স)-এর নির্দেশ বা কর্মনীতি জানিতে চেষ্টা করিতেন। ফলে তাঁহারা রাসূলের যে হাদীসি পাইতেন, সেই অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করিতেন; কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোন হাদীস পাওয়া না গেলে ইসলামের সামগ্রিক ব্যবস্থা ও উহার ধারাকে সম্মুখে রাখিয়া তাঁহারা ইজতিহাদ করিতেন। এই কারণে অনেক সময় কোন নির্দিষ্ট ব্যাপারে বিচারকের বিভিন্ন প্রকার হইত। বিচারকদের ফয়সালাসমূহ লিপিবদ্ধ করিয়া রাখার তখনো শুরু হয় নাই। ফলে পরবর্তীকালের লোকেরা উহা হইতে কিছুমাত্র ফায়দা লাভ করিবার সুযোগ পাইত না।

এই যুগের যাবতীয় বিচার কার্য কেবলমাত্র ইজতিহাদের উপর নির্ভরশীল ছিল বলিয়া কাহারো কাহারো মনে প্রশ্ন জাগিতে পারে; কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তাহা নহে। কেবলমাত্র শরীয়াতের খুঁটিনাটি আইন জানিবার ও যুগের বিশেষ অবস্থা ও ঘটনার উপর উহাকে প্রয়োগ করার ব্যাপারেই ইজতিহাদ-নীতি ব্যবহার করা হইত। স্মর্তব্য যে,ইসলামী আইনসমূহ ছিল কতকগুলি মূলনীতির সমষ্টি; উহার খুঁটিনাটি বিধান তখনো রচিত হয় নাই। বস্তুত চিরকাল ও সমগ্র মানবতার জন্য প্রদত্ত আইন-বিধান এইরূপ হওয়াই স্বাভাবিক। কালের প্রতিটি পর্যায়ে ও পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলেই উহার বাস্তব প্রয়োগ কেবলমাত্র এই ভাবেই সম্ভব ও সহজ হইতে পারে।

বিচারক নিয়োগের পরও জনগণের ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসা করার ব্যাপারে খলীফাদের প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহনে কোন বাধা ছিল না; বরং অনেক ক্ষেত্রে তাঁহারা নিজেরাই অনেক ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসা করিতেন। সেইসব ক্ষেত্রে নিযুক্ত বিচারকগন শুধু খলীফাদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করিতেন মাত্র।

দেশরক্ষা বিভাগ
খিলাফত আমলে যুদ্ধ বা সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করার মূল ক্ষমতা খলীফার হস্তেই নিবদ্ধ থাকিত। কেননা নবী করীম (স)-এর জামানায়ও এই রীতিই কার্যকর ছিল। তিনি নিজেই সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে শাসন পরিধি যখন বিশালতর হইতে লাগিল, তখন খলীফাগণ সর্বশ্রেষ্ঠ বীর ও যোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও পৃথকভাবে সেনাধ্যক্ষের নিযুক্তি শুরু হইল। তাহাকে মানিয়া চলা স্বয়ং খলীফাকে মানিয়া চলার মতই অবশ্যই কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যুদ্ধের অবসান হইলে সামরিক ব্যাপারসমূহ পর্যবেক্ষণ ও ভবিষ্যতের জন্য তাহাদিগকে ট্রেনিং দান করিই হইত সেনাধ্যক্ষদের একমাত্র কাজ।

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)- এর খিলাফত আমলে সমগ্র সৈন্যবাহিনী অবৈতনিক ও স্বেচ্ছামূলক ছিল। কোন রেজিস্ট্রি বহিতে তাহাদের নাম লিপিবদ্ধ ছিল না। হযরত উমর ফারুক (রা)-এর খিলাফত কালেই সৈন্য বিভাগ সুষ্ঠু ও সুসংবদ্ধভাবে গঠিত হয় ও প্রতিটি সৈনিকের নাম রেজিস্ট্রিভুক্ত হয়। ইহার ফলে সৈন্যবাহিনীতে শৃঙ্খলা স্থাপিত হয়। কোন সৈনিক পলায়ন করিলে কিংবা পশ্চাতে থাকিয়া গেলে অতি সহজেই তাহা ধরা পড়িত। পলাতক সৈনিকদের জন্য তখন একটি বিশেষ ধরনের শাস্তি নির্দিষ্ট ছিল। পলাতকের নিজ মহল্লার মসজিদে তাহার নাম প্রকাশ ও প্রচার করিয়া ঘোষণা করা হইত যে,এই ব্যক্তি জিহাদের ময়দান হইতে পলাইয়া আসিয়াছে;আল্লাহ্‌র পথে আত্মদান করার ব্যাপারে সে কুণ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছে। বস্তুতঃ এতটুকু ভৎসনা আরবের জন্য মৃত্যুদণ্ড অপেক্ষাও সাংঘাতিক ছিল। কেননা সমগ্র বিশ্ব-জাতির মাঝে আরবদের যে অতুলনীয় বীরত্ব ও বিস্ময়কর সাহসিকতার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হইয়াছিল, তাহাতে কোন ব্যাক্তিকে অপৌরুষ ও ভীরুতার দায়ে অভিযুক্ত কয়া এবং প্রকাশ্যভাবে উক্তরুপে ঘোষণা দেওয়া মৃত্যু অপেক্ষাও অনেক কঠিন ব্যাপার ছিল। অতঃপর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে সমাজে মুখ দেখাইবার কোন স্থান আর অবশিষ্ট থাকিত না।

হযরত উমর(রা) সমস্ত সৈনিকদের জন্য বায়তুলমাল হইতে বেতন নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছিলেন। এই বেতনের কোন নির্দিষ্ট হার ছিলনা। ইসলামী আদর্শ অনুসরণের ক্ষেত্রে শ্রেষ্টত্ত ও প্রাধান্যই ছিল মুজাহিদদের বেতন নির্ধারণের একমাত্র মাপকাঠি। অবশ্য শেষ পর্যায়ে হযরত আলী (রা) এই পার্থক্যও খতম করিয়া দিয়া সকলের জন্য সমান মানের বেতন চালু করিয়াছিলেন।

ইসলামী বাহিনীতে প্রত্যেক দশজন সৈনিকের উপর একজন ‘প্রধান’ নিযুক্ত হইত।আরবী সামরিক পরিভাষায় তাহাকে বলা হইত ‘আরীফ’। এই আরীফদের হস্তেই সকল সৈনিকদের বেতন অর্পণ করা হইত; তাহারা অধীনস্থ সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করিয়া দিত।

সৈন্যবাহিনী সংগঠনের ব্যাপারে খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলে যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়। প্রাক-ইসলাম যুগে আরবগণ শত্রুপক্ষকে কখনো সারিবদ্ধভাবে আর কখনো বিচ্ছিন্নভাবে মুকাবিলা করার জন্য অগ্রসর হইত। প্রথমে উভয় পক্ষ হইতে এক-দুইজন বীরপুরুষ সম্মুখ-সমরে লিপ্ত হইত,তাহার পর সাধারণ হামলা পরিচালিত হইত এবং শেষ পর্যন্ত এলোমেলোভাবে আক্রমণ ও অস্ত্র পরিচালনা করা হইত। মুসলমানগণও ইসলামী জিহাদের প্রথম পর্যায়ে এই রীতিরই অনুসরণ করিতেছিলেন। কিন্তু উত্তরকালে তাহারা যখন পারস্য ও রোমানদের সুসংগঠিত সৈন্য বাহিনীর মুখামুখী হইতে আরম্ভ করিলেন, তখন তাঁহারা সুস্পষ্টরূপে বুঝিতে পারিলেন যে, আধুনিক পদ্ধতিতে এই সংগঠিত সৈন্যবাহিনী ও সমর নীতির মুকাবিলা করিতে হইলে প্রাচীন রীতি অবশ্যই পরিহার করিতে হইবে। অতঃপর তাহারা নূতনভাবে নিজেদের সৈন্যবাহিনী গড়িয়া তোলেন ও সম্পূর্ণ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করিতে শুরু করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যবাহিনীকে সুষ্ঠুরূপে সারিবদ্ধ করা হইতে লাগিল, কেহ অগ্রে বা পশ্চাতে পড়িয়া থাকিত না। গোটা সৈন্যবাহিনীকে মোটামুটি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা হইত। সকলের অগ্রবর্তী বাহিনীকে বলা হইত ‘মুকদ্দমা’, যুদ্ধের সূচনা করাই হইত ইহার দায়িত্ব। মধ্যবর্তী বাহিনীকে বলা হইত ‘কলব’, মূল সেনাধ্যক্ষ ইহাদের দ্বারাই পরিবেষ্টিত থাকিতেন। ডান পার্শ্বে স্থাপিত বাহিনীকে বলা হইত ‘মায়মানা’ এবং বাম পার্শ্বে অবস্থিত ‘মায়সারা’। আর সকলের পশ্চাতে অবস্থিত বাহিনীর নাম দেওয়া হইত ‘সাকাহ’।

যে সৈন্যবাহিনী এই পাঁচটি উপ-বাহিনীতে বিভক্ত হইত, উহাকে ‘খামীস’ বলা হইত। ইহার প্রত্যেক অংশেরই একজন করিয়া ‘আমীর’ হইতেন এবং তিনি মূল সেনাধ্যক্ষের ফরমান অনুসারে নিজ নিজ বাহিনী পরিচালনা করিতেন।অশ্বারোহী বাহিনীর আমীর হইতেন স্বতন্ত্র। পশ্চাদ্দিক সংরক্ষণের জন্য মুসলিম সৈনিকগন বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করিতেন,যেন শত্রু-সৈন্য কোন সুযোগেই পশ্চাদ্দিক হইতে তাহাদের উপর হামলা করিতে সমর্থ না হয়। নৈশকালীন আক্রমণ হইতে গোটা বাহিনীকে হেফাজত করার জন্য তাঁহারা বিশেষ ব্যবস্থা ও কর্মপন্থা গ্রহণ করিতেন। মুসলমানদের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ ছিল সর্বাধিক সুসংগঠিত ও সুসংবদ্ধভাবে সক্রিয়। সেই কারণে শত্রুদের অধিকাংশ গোপন ইচ্ছা বা পরিকল্পনা তাঁহারা পূর্বাহ্ণেই জানিতে পারিতেন।

রাজস্ব বিভাগ
হযরত উমর (রা)-এর খিলাফত কাল হইতে রাজস্ব আদায়ের জন্য স্বতন্ত্র ও স্থানীয়ভাবে লোক নিয়োগ করা হইত। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের উপর রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সাধারণতঃ অর্পণ করা হইত না। আদায়কৃত রাজস্ব খলীফার নির্দেশ অনুসারে সৈনিকদের বেতন-ভাতা ও জনকল্যাণমূলক অন্যান্য সর্বজনীন কাজকর্মে ব্যয় করা হইত। উদ্ধৃত অর্থ কেন্দ্রীয় রাজধানীতে পাঠাইয়া দেওয়া হইত।

খিলাফত আমলে দুই প্রকারের রাজস্ব ধার্য করা হইতঃ(১)স্থায়ী ও (২)অস্থায়ী। স্থায়ী রাজস্বের মধ্যে যাকাত,উশর ও জিজিয়া উল্লেখযোগ্য। পক্ষান্তরে গনিমতের মাল ছিল অস্থায়ী রাজস্ব বা রাষ্ট্রীয় আয়।

খারাজ
সাধারনতঃযুদ্ধ-জয়ের ফলে অধিকৃত দেশের যাবতীয় চাষযোগ্য জমি উহার পূর্বতন মালিকদের নিকটই থাকিতে দেওয়া হইত। অবশ্য উৎপন্ন ফসলের একটি নির্দিষ্ট অংশ রাজস্ব বাবদ আদায় করিয়া লওয়া হইত। ইহাকেই ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় ‘খারাজ’। ইহাকে ভোগ্য জমির খাজনা মনে করা যাইতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে আবার জমির পরিমাণ অনুযায়ী নির্দিষ্ট মুদ্রা কর-বাবদ ধার্য করা হইত।

উশর
যেসব জমির মালিকগণ ইসলাম কবুল করিত অথবা বিজয়ী মুসলমানরা যেসব জমির মালিকদের নিকট হতে জিজিয়া আদায় করিতেন না, সেই জমিকে বলা হয় উশরী জমি এবং উহার ফসলের এক দশমাংশ কিংবা বিশ ভাগের এক ভাগ সরকারী ব্যবস্থাপনায় আদায় কর হইত। মুসলমানগণ বল প্রয়োগ বা যুদ্ধের পরিণতিতে যেসব জমি দখল করিতেন, তাহা ‘উশরী’ জমি নামে অভিহিত হইত এবং তাহা কেবলমাত্র মুসলমানদের মধ্য বণ্টন করিয়া দেওয়া হইত। ফলে তাহা মুসলমানদেরই দখলিভুক্ত হইয়া থাকিত।

হযরত উমর (রা)- এর খিলাফতকালে যখন সিরিয়া ও ইরাক অধিকৃত হয়, তখন তিনি বিজিত জমি সম্পর্কে উপদেষ্টাদের নিকট জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন যে,উহার বিলি-ব্যবস্থা কি ভাবে কর হইবে? অধিকাংশ লোকই জমিগুলিকে মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করিয়া দেওয়ার পরামর্শ দিয়াছিলেন।

হযরত উমর (রা)বলিয়াছিলেনঃ ‘তাহা হইলে তো ভবিষত বংশধরদের হক নষ্ট করা হইবে। কেননা, বর্তমানে জমিসমূহ বণ্টন করিয়া দিলে অনাগত মানুষদের জন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকিবে না’। উহাতে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ(রা)বলিলেনঃ জমি ও দাস-দাসী তাহারাই পাইবার অধিকারী, যাহারা নিজেদের বাহুবলে দেশ জয় করিয়াছে; অন্য লোকদের তাহাতে কি অধিকার থাকিতে পারে? ইহার উত্তরে খলীফা উমর ফারুক (রা) বলিলেনঃ ‘একথা ঠিক, কিন্তু মনে রাখিও আমার পর খুববেশী দেশ জয়ের সম্ভবনা থাকিবে না বলিয়া তখন মুসলমানদের পক্ষে অধিক পরিমাণ মাল-দৌলত ও জমি লাভ করা সম্ভব হইবে না। উত্তরকালে বরং অনেক দেশজয় কল্যাণের পরিবর্তে দুর্বহ বোঝার কাজই করিবে বেশী। ইরাক ও সিরিয়ার জমি উহার মালিকদের নিকট হইতে কাড়িয়া লইয়া ও বিজিত লোকদেরকে ক্রীতদাস বানাইয়া বিজয়ী মুসলামানের মধ্যে বণ্টন করিয়া দিলে সীমান্তের সংরক্ষণ ব্যবস্থা কিরূপে কার্যকর হইবে? কেননা মুসলামানগণ তো কৃষিকাজে ব্যস্ত হইয়া পড়িবে। এতদ্ব্যতীত ইয়াতীম ও অসহায় বিধবাদের ভরণ-পোষণের কাজও অসমাপ্তিই থাকিয়া যাইবে’।

খলীফা উমর ফারুক(রা)-এর এই ভাষণ শ্রবণ করার পর সকলে একবাক্যে বলিয়া উঠিলেনঃ “আপনার মত বাস্তবিকই সঠিক ও নির্ভুল, তাহাতে সন্দেহ নাই। সীমান্তে ও শহরে যদি সৈন্যবাহিনী নিয়োজিত না থাকে, তাহা হইলে এইসব এলাকা সংরক্ষণ করার কোনই ব্যবস্থা থাকিবে না এবং ইসলামের দুশমনগণ পুনরায় এই শহরগুলির উপর আধিপত্য বিস্তার করিয়া বসিবে”।হযরত উমর বলিলেনঃ এই ব্যাপারটি তো পরিস্কার হইয়া গেল। এখন আমার এমন একটি লোকের প্রয়োজন, যিনি খারাজ নির্ধারণের জন্য সমগ্র ইরাকের জরীপ কার্য সম্পাদনের দায়িত্ব গ্রহণ করিবেন’। অতঃপর উমরান ইবন হানীফকে এই কাজে নিযুক্ত করা হইল। তিনি অত্যন্ত পরিশ্রম সহকারে এই কাজ সম্পন্ন করিলেন এবং হযরত উমর (রা)- এর শাহাদাত লাভের এক বৎসর পূর্বেই সওয়াদে কুফা হইতে আদায়কৃত খারাজের পরিমাণ এক কোটি মুদ্রা পর্যন্ত পৌঁছিয়াছিল।

সিরিয়া বিজয়ের পরও সৈনিকদের পক্ষ হইতে অধিকৃত জমি সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করিয়া দেওয়ার দাবি উত্থাপিত হয়। কিন্তু তখনও হযরত ফারুকে আজম (রা) উক্তরুপ জওয়াব দিয়া সকলকে নিরস্ত করেন। ফলে ইরাকের ন্যায় সিরিয়ার ভূমি হইতেও বিপুল পরিমাণ খারাজ সরকারী খাজাঞ্জীতে সঞ্চিত হইতে থাকে।

বস্তুতঃ বিজিত এলাকার জমিক্ষেত বিজয়ীদের মধ্যে বণ্টন না করিয়া পুরাতন বাসিন্দাদের দখলে উহা থাকিতে দেওয়া এবং তাহাদিগকে উহার চাষাবাদ করার সুযোগ দিয়া তাহাদের নিকট হইতে খারাজ আদায় করা সম্পর্কে হযরত উমর ফারুক (রা)- এর অভিমত অত্যন্ত দূরদর্শীতার পরিচায়ক ছিল। তখন এইরূপ ফয়সালা গৃহীত না হইলে মুসলিম জাতি তাহার আসল দায়িত্ব ভুলিয়া গিয়া ক্ষেত-খামার লইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়িত এবং সামরিক দক্ষতা হারাইয়া ফেলিত।দ্বিতীয়তঃসেই এলাকার সংরক্ষণকারী ও অন্যান্য দেশ ও অঞ্চলে যুদ্ধলিপ্ত ইসলামী সৈনিকদের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহেরও কোন ব্যবস্থা করা সম্ভব হইত না। আর ইহাই হইত সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ও অপূরনীয় ক্ষতি। কেননা, এই সুযোগে পারসিক ও রোমক সরদার যা নিজেদের দেশের উপর মুসলিম আধিপত্য স্থাপিত হওয়ায় দেশত্যাগ করিয়া অন্যত্র আশ্রয় লইয়াছিল তাহারা পুনরায় নিজেদের দেশ দখল করিয়া বসিতে পারিত ও মুসলমানদের উপর প্রবলভাবে আক্রমণ চালাইত।

জিযিয়া
ইসলামী খিলাফতে যিম্মিদের(অমুসলিম অনুগত নাগরিকদের) নিকট হইতে তাহাদের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরু সংরক্ষণ ও উহার নিরাপত্তার বিনিময়ে যে অর্থ গ্রহণ করা হইত, ইসলামী পরিভাষায় উহাকে ‘জিযিয়া’ বলা হয়। ইহা কেবলমাত্র বয়স্ক ও সুস্থ-সবল পুরুষদের নিকট হইতেই আদায় করা হইত। নারী,শিশু, দরিদ্র ও পঙ্গুদের উপর ইহা ধার্য করা হইত না। হযরত উমর (রা) বহু দরিদ্র যিম্মীর জন্য বায়তুলমাল হইতে বৃত্তি মঞ্জুর করিয়াছিল। ‘জিযিয়া’ ধার্য হইত ব্যক্তির আর্থিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং উহার পরিমাণ ১২ দিরহামের কম ও ২৮ দিরহাম অপেক্ষা বেশী হইত না। হযরত উমর (রা) তাহার পরবর্তী খলিফাদিগকে যিম্মীদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন, নম্র আচরণ করা, প্রতিশ্রুতি পালন ও তাহাদের জান-মাল সংরক্ষণের জন্য লড়াই করা এবং তাহাদের উপর সামর্থ্যাপেক্ষা অধিক দায়িত্ব-ভার অর্পণ না করার জন্য বিশেষভাবে উপদেশ দান করিয়াছেন।

যাকাত
খিলাফতের আমলে মুসলমানদের সকল প্রকার সঞ্চিত ধন,গৃহপালিত পশু, নগদ সম্পদ ও জমির ফসলের উপর কুরআন ও সুন্নাহ মুতাবিক যাকাত ধার্য করা হইয়াছিল। এই যাকাত রীতিমত আদায় করা হইত এবং উহার প্রাপক আটটি শ্রেণীর মধ্যে উহা বণ্টন করা হইত।

শুল্ক
মুসলিম ব্যবসায়ীগণ যখন বিদেশে নিজেদের পণ্য রফতানি করিতেন, তখন তাঁহাদের নিকট হইতে সেই দেশ এক দশমাংশ শুল্ক বাবদ আদায় করা হইত।হযরত উমর (রা) যখন ইহা জানিতে পারিলেন, তখন তিনিও ইসলামী রাজ্যে আমদানিকৃত পণ্যের উপর অনুরূপ পরিমাণ শুল্ক ধার্য করার নির্দেশ দান করিলেন। এতদ্ব্যতীত যিম্মী ব্যবসায়ীদের নিকট হইতে বিশভাগের একভাগ ও মুসলিম ব্যবসায়ীদের নিকট হইতে সমগ্র সম্পদের চল্লিশভাগের একভাগ আদায় করা হইত। তবে দুইশত দিরহামের কম মূল্যের সম্পদের উপর কিছুই ধার্য করা হইত না।

মুদ্রা
আরবদেশের ইসলামের পূর্বে স্বর্ণ ও রৌপ্যের ইরানী ও রোমীয় মুদ্রা প্রচলিত ছিল। নবী করীম(স) ও হযরত আবূ বকরল (রা)-এর খিলাফত কালেও এই মুদ্রাই চালু ছিল। ইরান বিজয়ের পর হযরত উমর(রা) দিরহামের ওজন করিবার ইচ্ছা ব্যক্ত করিয়াছিলেন। কেননা ইরানী মুদ্রায় ওজন বিভিন্ন প্রকারের হইত। মোট কথা খিলাফতে রাশেদার আমলে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রূপ বর্তমান ও কার্যকর ছিল এবং উহা কোন দিক দিয়াই পশ্চাদবর্তী ছিল না।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি