তৃতীয় অধ্যায়
সাহাবীগণের পরবর্তী যুগে আইন প্রণয়ন
৯০-১০০ হিজরী নাগাদ সাহাবীগণের যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং ফিকাহ শাস্ত্রের চর্চাকারী ও ফতোয়া দানকারী তাবেঈগণের যুগ শুরু হয়। কুফায় সর্বশেষ সাহাবী ইন্তেকাল করেন ৮৬ কিংবা ৮৭ হিজরী সনে। মদিনার সর্বশেষ সাহাবী হযরত সাহল ইবনে সাদ আল সাঈদী (রাঃ) ৯১ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। বসরার সর্বশেষ সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) ৯১ হিজরী সনে (মতান্তরে ৯৩ হিজরী সনে) ইন্তেকাল করেন। দামেস্কের সর্বশেষ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) ৮৮ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন। সর্বশেষ সাহাবী আমির ইবনে ওয়াসিলাহ ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) (আবু তুয়াফেল) ১০০হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

এরপর যারা ফতোয়া প্রদানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁরা ছিলেন মাওয়ালী বা মুক্ত দাস, যাঁদের অধিকাংশই সাহাবীগণের সাথে বসবাস করেছিলেন। যেমন হযরত ইবনে উমরের (রাঃ) মুক্ত দাস হযরত নাফে (রাঃ) হযরত ইবনে আব্বাসের (রাঃ) মুক্ত দাস হযরত ইকরামা (রঃ) , মক্কার ফকীহ হযরত আতা ইবনে রাবাহ (রঃ) , ইয়ামানবাসী মানুষদের ফকীহ হযরত তাউস (রঃ) , ইয়ামামার ফকিহ ইয়াইয়া ইবনে কাছীর (রঃ) , কুফার ফকিহ হযরত ইবরাহীম আল নাখঈ (রঃ) বসরার ফকীহ হযরত হাসান আল বসরী (রঃ) এবং বসরার আরেকজন ফকিহ হযরত ইবনে সীরীন (রঃ) , খোরাসানের হযরত আতা আল খোরাসানী (রঃ) এবং আরো অনেকে। অবশ্য মদীনায় কুরাইশ বংশীয় ফকীহ হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব ছিলেন এ ক্ষেত্রে অনন্য।

সাহাবীগণের নিকট শিক্ষাপ্রাপ্ত এ সকল তাবেঈ সাহাবীগণের প্রদত্ত ফতোয়া কচিৎ পরিবর্তন করেছিলেন। সুতরাংয় তাঁরা শরীয়তের বিধান প্রণয়নে যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন তার সাথে তাঁদের পূর্বসুরীগণের অনুসৃত পদ্ধতির পার্থক্য নিরূপণ করা কষ্টসাধ্য। তথাপি এ সময়ে শরীয়তের বিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রচলিত পদ্ধতিসমূহ পূর্বের তুলনায় আরো স্পষ্টতর রূপ পরিগ্রহ করতে শুরু করেছিল।

হযরত হাসান ইবনে উবায়দুল্লাহ আল নাখঈ (রঃ) বলেন, আমি ইবরাহীম নাখঈকে (রঃ) বললাম, আমি আপনাকে যে সকল ফতোয়া দিতে শুনি তা কি আপনি অন্য আউকে দিতে শুনেছেন? তিনি বললেন, না। আমি বললাম, যা আপনি শোনেননি সে সব বিষয়ে ফতোয়া দিচ্ছেন? তিনি বললেন, আমি যা শোনারতা শুনেছি, কিন্তু যখন এমন কোন বিষয়ের সম্মুখীন হই, যা আমি আগে শুনিনি তখন আমি যে বিষয়ে আগে শুনেছি সে বিষয়ের সাথে উদ্ভূত বিষয়টির তুলনা করি এবং কিয়াস করি (বুদ্ধির সাহায্য গ্রহণ করি) (ইবনে হাজআর, আল ইসাবহ, ৪র্থ ঋন, পৃ.১১২, এবং ইবনে আবদুল বার, আল ইসতিয়াব (আল ইসাবাহ এর পাদটিকা) , পৃ.৪১৫।

এ যুগের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলো হলোঃ এ যুগে বিভিন্ন বিষয়ে আইনবিদগণের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য ঘটে। হযরত উমর বিন আবদুল আযীয (রঃ) তাঁর খেলাফতকালে নিম্নোক্ত দুটি সিদ্ধান্ত প্রদানের মাধ্যমে এ অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেনঃ

১। তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নামে প্রচলিত সকল হাদীস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করার জন্য নির্দেশ প্রদান করলেন। তদনুসারে প্রতিটি এলাকার লোকেরা সুন্নাহ সম্পর্কে যে যা জানতেন তা লিপিবদ্ধ করলেন। (ইবনে আবদুল বার, জামি বায়ান আল ইলম, ১খ, ৩৩) ।

২। তিনি বেশিরভাগ জেলায় ফতোয়া দেয়ার ক্ষমতা স্বল্পসংখ্যক নির্বাচিত লোকের মধ্যে সীমিত করে দিলেন। যেমন তিনি মিসরে এ কাজের জন্য মাত্র তিনজন লোককে মনোনীত করলেন। মজার ব্যাপার হলো, এ তিনজনের মধ্যে দুজনই ছিলেন মুক্ত দাস, যথাক্রমে ইয়াযিদ ইবনে আবু হাবিব এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আবু জাফর। তাঁদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি জাফর ইবনে রাবিয়াহ ছিলেন একজন আরব তিনজনের মধ্যে দুজন মুক্ত দাস এবং মাত্র একজন অরবকে এ কাজের জন্য নিয়োগ করার কারণ সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে খলিফা বলেছিলেন, মুক্ত দাসগণ যদি নিজেদের উন্নতি করতে পারে আর তোমরা না পার তাতে আমার ত্রুটি কোথায়? (আল মাকরিজি, খিতাত, ৪র্থ খন্ড, ১৪৩পৃঃ) । আবু বকর (রাঃ) মুহাম্মদ ইবনে আর ইবনে হাজম আল আনসারীর কাছে লিখিত এক পত্রে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) আমল সম্পর্কিত বর্ণনাগুলো লিপিবদ্ধ করার জন্য প্রদত্ত তাঁর আদেশের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি লিখেছেন, রাসূলুল্লাহর (সাঃ) হাদীস বা সুন্নাহ বা আমল যা কিছু হোক খুঁজে দেখ। তারপর ঐগুলো আমার জন্য লিখে রাখ, কারণ আমার ভয় হয় আলেমগণ দুনিয়া থেকে চলে গেলে এ সকল জ্ঞানও দুনিয়া কে বিদায় নেবে। (ইমাম বুখারী (রঃ) তাঁর সহীহ গ্রন্থে বর্ণনাকারী গনের ধারাবাহিকতা সম্পর্কে যথারীতি কোন বর্ণনা ব্যতিরেকে পত্রখানির কথা উল্লেখ করেছেন। (অর্থাৎ তালীকান মুয়াল্লাক হাদীস। ইমাম মালিক (রঃ) প্রণীত মুয়াত্তায়ও এটি বর্ণিত হয়েছে। দেখুন, আল যারকানীর টীকা, ১ম খন্ড, ১০) ।

তাবেঈগণের পরবর্তী যুগঃ মুজতাহিদ ইমামগণের যুগ
এ যুগ সম্পর্কে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (রঃ) নিম্নরুপ ভাষায় বর্ণনা করেছেন: এ যুগের ফকিহগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হাদীস, ইসলামের প্রথম যুগের বিচারকগণের রায়, সাহাবীগণ, তাবেঈ ও তৃতীয় প্রজন্মের আইন বিষয়ক পাণ্ডিত্য ইত্যাদি সব কিছুকে তাঁদের বিবেচনায় আনেন। অতঃপর তাঁদের নিজস্ব ইজতিহাদ করেন। এভাবেই তৎকালীন আইনবিদগণ গবেষণা করেছেন। মূলতঃ তাঁরা সকলেই মুসনাদ (মুসনাদঃ যে হাদীসের সনদ বা বর্ণনাকারীগণের ধারাবাহিকতা অব্যাহতভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পর্যন্ত গিয়ে পৌছেছে। ) এবং মুরসাল (মুরসালঃ যে হাদীসের সনদ বা বর্ণনাকারীগণের ধারাবাহিকতা কোন এক প্রান্তে এসে ব্যাহত হয়েছে। যেমন কোন হাদীস তাবেঈ কর্তৃক কোন তাবেঈর পক্ষে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নিকট থেকে বর্ণনা করা। বস্তুতঃ কোন তাবেঈর পক্ষে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সাথে এভাবে সম্পৃক্ত করতে পারেন যে, তিনি হয়তো হাদীসখানি অন্য কোন তাবেঈর নিকট শুনেছেন অথবা কোন একজন সাহাবীর নিকট শুনেছেন। কিন্তু যেহেতু বিজ্ঞ তাবেঈ যাঁর নিকট থেকে হাদীসখানি শুনেছেন তার বিশ্বস্ততা সম্পর্কে কোন সন্দেহ পোষণ করেননি, সেহেতু তিনি তার নাম উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি। যাই হোক পরবর্তী যুগের ফকীহ ও হাদীস বিশারদগণের কাছে মুরসাল হাদীসের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়রূপে দেখা দেয়। এ ব্যাপারে তাঁরা যে বিষয়টি বিবেচনায় এনেছিলেন তা হলোঃ এরূপ হাদীসের বর্ণনাকারীগণের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়েছে এবং যদি তাবেঈ বর্ণনাকারী তাঁর যুগের অন্য আরেকজনের নিকট থেকে হাদীসখানি শুনে থাকেন তবে সেই তাবেঈ বর্ণনাকারীর নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে কোন নিশ্চয়তা নেই। প্রাথমিক যুগের ফিকাহ ও হাদীস বিশারদগণের নিকট অবশ্য এটা কোন বড় সমস্যা ছিল না। কেননা তাঁরা তাবেঈ বর্ণনাকারীগণ এবং শুয়ুখ অর্থাৎ যাদের নিকট থেকে শুনে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁদের সকলের সম্পর্কে ভালভাবে জানতেন। ফলে ইমাম আবু হানিফা এবং মালিক (রঃ) মুরসাল হাদীস গ্রহণ করেছেন। আবার পরবর্তী দুজন ইমাম যথাক্রমে ইমাম শাফেঈ এবং আহমাদ (রঃ) মুরসাল হাদীস বর্জন করেছেন। ) অধিকন্তু তাঁরা সাহাবী ও তাবেঈগণের মতামতকে প্রমাণ হিসেবে উদ্ধৃত করার ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। এর পিছনে মূলতঃ দুটি কারণ ছিলঃ

(১) এ সকল মতামত ছিল প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) হাদীস, যা বর্ণিত হয়েছিল কোন সাহাবী বা তাবেঈ থেকে। কিন্তু তাঁরা মূল বক্তব্য বর্ণনায় তাদের পক্ষ থেকে ভুল বা কম বেশি হওয়ার আশঙ্কায় সাবধানতাবশতঃ তাতে রাসূলুল্লাহর নাম যোগ করেননি।

(২) আরেকটি কারণ এই হতে পারে যে, এ সকল মতামত সাহাবীগণ কর্তৃক মূল হাদীস অনুসারে দেয়া হয়েছে এবং সুন্নাহ সম্পর্কে তাঁদের নিজস্ব বিচারবুদ্ধি অনুসারে উপস্থাপিত হয়েছে (অর্থাৎ তা হাদীস নয়, বরং হাদীসের ভিত্তিতে প্রদত্ত অভিমত) ।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, পরবর্তী যুগে যাঁরা এসেছেন তাঁদের চাইতে সাহাবীগণ অবশ্যই উত্তম। কারণ তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে জানতেন এবং তাঁর বক্তব্য ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ব্যাপারে তাঁরা অধিকতর পারঙ্গম ছিলেন। তাই যে কল ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেরাই মতভেদ করেছেন অথবা রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কোন সহীহ হাদীসের সাথে স্পষ্টভাবে বিরোধমূলক বক্তব্য রেখেছেন সেগুলোকে ছাড়া তাঁদের মতামত বা রায়সমূহকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।

অপরদিকে দুই বা ততোধিক হাদীসের বক্তব্য পরস্পর বিরোধী হলে গবেষকগণ দুটি হাদীসেরমধ্যে কোনটি সঠিক সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সাহাবীগণের মতামত চাইতেন। যদি সাহাবীগণ বলতেন যে, একটি হাদীস রহিত করা হয়েছে অথবা শাব্দিক অর্থে গ্রহণ করা যাবে না, অথবা কোন একটি হাদীস সম্পর্কে খোলাখুলিভাবে কিছু না বলে নীরব থেকেছেন এবং উক্ত হাদীস অনুসারে আমল করেননি, তবে ধরে নেয়া হয়েছে যে, হাদীসটি কোন না কোনভাবে ত্রুটিপূর্ণ অথবা ত্রুটির কার্যকারিতা রহিত করা হয়েছে বা এর ব্যাখ্যা শাব্দিক অর্থে করা যাবে না। এভাবে মুজতাহিদ ইমামগণ তাঁদের (সাহাবীগণের) সে মতামত গ্রহণ করতেন।

কোন বিষয়ে সাহাবী এবং তাবেঈগণের স্পষ্ট বক্তব্য মতপার্থক্যের সৃষ্টি হলে ফকীহ নিজে যে এলাকায় বসবাস করতেন সেই এলাকার সাহাবী বা তাবেঈনের এবং নিজ উস্তাদের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করতেন। কারণ তাহলে বর্ণনাকারীর সাথে তার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার ফলে উক্ত সাহাবী বা তাবেঈনের যে সকল মতামত ও বক্তব্য তাঁর নিকট এসে পৌঁছেছে সেগুলোর নির্ভরযোগ্যতা নিরূপণ করতে তিনি বেশি সক্ষম হবেন। অনুরূপভাবে ফকীহ নিজে উসূলে ফিকাহ এর ক্ষেত্রে তাঁদের অনুসৃত নীতি সম্পর্কে উত্তমরূপে অবগত থাকবেন।

ইসলামী আইনের মৌল চিন্তা গোষ্ঠীর (School of Thought) মধ্যে হযরত উমর (রাঃ) , উসমান (রাঃ) , ইবনে উমর (রাঃ) , আয়েশা (রাঃ) , ইবনে আব্বাস (রাঃ) , ও যায়িদ ইবনে ছাবিত (রাঃ) এবং তাঁদের তাবেঈ অনুসারীগণের মধ্যে সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব (মৃ৯৩ হি) , উরওয়াহ ইবনে যুবায়ের (মৃ.৯৪ হি) , সালিম (মৃ১০৬হি) , আতা ইবনে ইয়াসার (মৃ.১০৩ হি) , কাসিম ইবনে মুহাম্মদ (মৃত১০৩ হি) , উবায়ুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ (মৃ:৯৯ হি) , যুহরী (মৃঃ১২৪ হি) , ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ (মৃঃ১৪৩ হি) , যায়িদ ইবনে আসলাম (মৃঃ১৩৬ হি) , এবং রাবীয়াহ আর রাঈ (মৃঃ১৩৬ হিঃ) এর মতামতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত চিন্তাধারা মদীনার মানুষের কাচে বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল। এর কারণ ছিল ইমাম মালিক (রাঃ) উপরোক্ত সাহাবী ও তাবেঈগণের শিক্ষার উপর ভিত্তি করে তাঁর আইন বিষয়ক যুক্তিসমূহ উপস্থাপন করেছিলেন।

অনুরূপভাবে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এবং তাঁর অনুসারীগণের আইন বিষয়ক মতামত, খলিফা হযরত আলী (রাঃ) , শুরায়হ (মৃঃ৭৭ হিঃ) এবং আশ শাবী (র) (মৃঃ১০৪ হিঃ) , প্রদত্ত রায়সমূহ এবং ইবরাহীম নাখঈ (মৃঃ৯৬ হিঃ) এর ফতোয়া কুফার জনগণের নিকট বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল।

এরূপ অবস্থা প্রসঙ্গে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (র) লিখেছেনঃ মৃতের ভাইগণ ও পিতামহেরমধ্যে উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রে মাসরুক (রঃ) (মৃঃ৩৬ হিঃ) যখন যায়দ ইবনে ছাবিতের মতামত অনুসরণ করলেন তখন আলকামা (মৃঃ৬২ হিঃ) তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছেন যিনি আব্দুল্লাহর (ইবনে মাসউদ) চাইতে বেশি জ্ঞানী? মাসরুক (রঃ) উত্তর দিলেন, না, তবে যায়দ ইবনে ছাবিত (রঃ) এবং মদীনার লোকেরা মৃতের ভাইগণ ও পিতামহের মধ্যে উত্তরাধিকার বণ্টন করে থাকে—-।

সুতরাং যদি কোন বিষয়ে মদীনার লোকেরা একমত হতে তখন তাবেঈর অনুসারী সে যুগের আলিমগণ তা অটলভাবে অনুসরণ করতেন। তাই ইমাম মালিক (রঃ) যখন বলেন, আমরা মদীনার লোকেরা সুন্নাহর যে সকল বিষয়ে মতভেদ করিনি সেগুলো হচ্ছে, —- তা এ অর্থেই বলেছেন। মদীনায় প্রাথমিক যুগের বেশি সংখ্যক ফিকাহবিদ কর্তৃক অনুসৃত হওয়া অথবা তাঁদের কর্তৃক আইনসম্মত ও স্পষ্ট কোন কিয়াসের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়া অথবা কুরআন ও সুন্নাহর কিছু মূল উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়া ইত্যাদি কারণে যেটি বেশি সমর্থন ও নির্ভরযোগ্যতা পেয়েছে সেটিকে গ্রহণ করতেন। এ প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে ইমাম মালিক (রঃ) বলেছেন, আমি যা শুনেছি তন্মধ্যে এটি উত্তম। পরবর্তী যুগের ফিকাহবিদগণ যদি কোন সমস্যার ব্যাপারে তাঁদের পূর্ববর্তী আলেমগণের লেখা থেকে কোন সমাধান না পেতেন তাহলে তাঁরা তাঁদের নিজস্ব আইন বিষয়ক মতামত প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ফিরে যেতেন কুরআন ও সুন্নাহর সংশ্লিষ্ট মুল উৎসে। এ যুগের গবেষকগণ তাঁদের গবেষণার বিষয়াবলী লিপিবদ্ধ করে রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত হন। সুতরাং মদীনায় ইমাম মালিক (রঃ) , মক্কায় ইবনে আবু যেব (মৃঃ১৫৮ হিঃ) , ইবনে জুরাইজ (মৃঃ১৫০হিঃ) , এবং ইবনে উয়াইনাহ (মৃঃ ১৯৬হিঃ) , কুফার আছ ছাওরী (মৃঃ১৬১হিঃ) , এবং বসরায় রাবী ইবনে সুবাইহ (মৃঃ১৬০ হিঃ) তাঁদের গবেষণার বিষয়াবলী লিপিবদ্ধ করে রাখা শুরু করলেন এবং এ ব্যাপারে তাঁরা সকলে এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন।

আব্বাসী খলিফা মানসুর হজ্জ পালন করার সময়ে ইমাম মালিক (রঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ করলেন এবং বললেন, আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি যে, আপনার লেখা কিতাবগুলো কপি প্রস্তুত করার আদেশ দেব। এরপর আমি এগুলোর একখানা করে কপি মুসলিম দুনিয়ার সকল অঞ্চলে প্রেরণ করে আলেমগণকে নির্দেশ দেব যেন তাঁরা এগুলো অনুসারে কাজ করেন এবং অন্য কোন কিতাবের অনুসরণ না করেন। ইমাম মালিক (রঃ) বললেন, হে আমীরুল মুমিনীনঃ ঐ কাজ করবেন না। ইতোমধ্যে লোকেরা বিভিন্ন ধরনের আইন বিষয়ক মতামত শুনেছে, হাদীস এবং বিভিন্ন বিবরণ শুনেছে। তাঁদের কাছে প্রথম যা পৌঁছেছে তাই তাঁরা গ্রহণ করেছে। ফলে এগুলো লোকদের মধ্যে প্রচলিত আমলসমূহের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে। প্রত্যেক নগরীর লোকেরা তাদের অনুসরণের জন্য যা ইতোমধ্যে বেছে নিয়েছে তা তাঁদের উপর ছেড়ে দিন।

একই ঘটনা খলিফা হারুনুর রশিদ প্রসঙ্গেও বর্ণনা করা হয়েছে যে, তিনি মুয়াত্তার অনুসরণ করা লোকদের জন্য বাধ্যতামূলক করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইমাম মালিক (রঃ) বলেছিলেন, ঐ কাজ করবেন না। কেননা রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সাহাবীগণ সুন্নাহর ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। সুতরাংয় তাঁদের ভিন ভিন্ন পথ এখন স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

ইমাম মালিক (রঃ) মদীনার লোকদের দ্বারা বর্ণিত রাসূলুল্লাহর (সাঃ) হাদীসের ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা বেশি অবহিত ছিলেন এবং ইমাম মালিকের (রাঃ) বর্ণনাকারীগণের ধারাবাহিকতা সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য। তিনি হযরত উমর (রাঃ) এবং আয়েশা (রাঃ) ও তাঁদের অনুসারীগণের মধ্যে সাতজন ফিকাহবিদের আইন বিষয়ক বক্তব্যসমূহ সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা বেশি অবহিত ছিলেন। হাদীসের বর্ণনা ও ফতোয়া সংক্রান্ত বিজ্ঞান মূলত ইমাম মালিক (রঃ) এবং তাঁর মতো অন্যান্য গবেষকগণের জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।

ইমাম আবু হানিফা (রঃ) মূলতঃ ইবরাহীম নাখঈ (রঃ) ও তাঁর সহকর্মীদের প্রদত্ত আইন বিষয়ক ব্যাখ্যার প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন এবং খুব কদাচিৎ তাঁদের যুক্তি বহির্ভূত যুক্তি প্রদান করেছেন। ইবরাহীমের (রঃ) পদ্ধতি অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে তিনি ছিলে অনন্য। তিনি নজীরি আইনে পুঙ্খানুপঙ্খু প্রয়োগের ক্ষেত্রেও উল্লেখিত পদ্ধতি হুবহু প্রয়োগ করতেন।

আমরা যা বলেছি সে ব্যাপারে যদি আপনি সত্যতা যাচাই করতে চান তাহলে ইবরাহীম (রঃ) এবং তাঁর অনুসারীগণের শিক্ষার সারসংক্ষেপ প্রণয়ন করুন। নিম্নোক্ত গ্রন্থসমূহে উল্লেখিত সারসংক্ষেপআপনি দেখতে পারেনঃ

মুহাম্মদ আশ শায়াবানী রচিত কিতাবুল আছার, আবদুর রাজ্জাক রচিত জামী এবং ইবনে আবু শায়বাহ রচিত মুসান্নাফ (সংকলন) । এরপর ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এর ব্যবহারিক বিষয়ে মতামতসমূহকে এর সাথে তুলনা করুন। তাহলে আপনি অবশ্যই দেখতে পাবেন যে, আবু হানিফা (রঃ) কদাচিৎ তাঁদের অনুসৃত পদ্ধতি থেকে দূরে সরেছেন এবং এমনকি দেখা যাবে যে, তাঁর মতামত এবং কুফার বিচারকগনের মতামতের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। (দেহলভী, পূর্বোক্ত, ১খ., ২০৫-৩০৮ থেকে ইচ্ছামতো সংক্ষিপ্তকরণ করা হয়েছে। )

প্রকৃতপক্ষে এখানে দেহলভীর (রঃ) মন্তব্যগুলোকে বিবেচনায় আনতে হবে। তিনি এ ব্যাপারে জোর দিতে আগ্রহী ছিলেন যে, ইমাম মালিক (রঃ) ও আবু হানিফা (রঃ) এবং তাঁদের অনুসারীগণ তাঁদের পূর্ববর্তী সাহাবা ও তাবেঈগণের মতামত কমবেশি অনুসরণ করেছেন (অর্থাৎ তাঁরা তাঁদের নিজস্ব ইজতিহাদকে অগ্রাধিকার দেননি) । এবং তাঁদের পূর্ববর্তীগণের দেয়া আইনগত সিদ্ধান্তসমূহ অস্বীকার করেননি। অবশ্য তাঁর এ উপসংহারের সাথে একমত হওয়া কঠিন।

এটা সকলেই জানেন যে, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে ফিকাহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করা হয়। প্রত্যেক ইমাম এ শাস্ত্র অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করেছেন। সুতরাং এটা দাবি করা খুব সহজ ব্যাপার নয় যে, এ সকল ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সাহাবা এবং তাবেঈগণের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে। যেমন মালিক (রঃ) আইনের উৎস (পরোক্ষ) হিসেবে মদীনার জনসাধারণ কর্তৃক অনুসৃত প্রথা ও আচরণসমূহকে গ্রহণ করেছেন এবং আবু হানিফা (রঃ) আল ইসতিহসান এবং আল উরফ পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। (এখানে গ্রন্থকার বলতে চেয়েছেন যে, এসকল পদ্ধতিগত হাতিয়ার সাহাবীগণের নিকট অজ্ঞাত ছিল, তথাপি উক্ত দুজন ইমাম এগুলোকে প্রয়োগ ও ব্যবহার করেছেন। )

উপরন্তু তাঁরা দুজনেই তাবেঈগণের প্রদত্ত ফতোয়ার উপর ভিত্তি করে তাঁদের যুক্তিসমূহ দাঁড় করাননি, বরং তাঁদের সম্পর্কে মন্তব্য করেন এই বলে যে, তাঁরা মানুষ ছিলেন (জ্ঞানের ক্ষেত্রে) এবং আমরাও মানুষ। এ ছাড়া তাঁরা তাঁদের পূর্ববর্তীগণের সাথে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন যে, হাদীসের বিশুদ্ধতা নিরূপণের ক্ষেত্রে তাঁরা প্রত্যেকেই নিজস্ব কিছু শর্তাবলী নির্ধারণ করেছিলেন। অধিকন্তু পূর্বে কখনো প্রচার হয়নি এরূপ হাদীস এবং মশহুর হাদীসের হাদীসের মর্যাদা ও এগুলোর ভিত্তিতে আইনগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁরা সাহাবীগণের সাথে মতপার্থক্য করেছেন।

যুক্তিবাদী এবং ঐতিহ্যবাহী আহলুল হাদীস এবং আহলুর রায়
যুক্তিবাদী বা আহলে রায় এবং ঐতিহ্যবাদী বা আহলে হাদীস এ দুটি ব্যতিক্রমধর্মী আইন বিষয়ক চিন্তাগোষ্ঠী সম্পর্কে বলতে গেলে সম্ভবত এ সত্যটি অধিকতর অর্থবহ হবে যদি আমরা আইনের কোন মূলনীতি ও নজীরি আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে যে মতপার্থক্যের সূচনা হয়েছিল, সেদিকে দৃষ্টিপাত করি। যদিও এটা সত্য যে, উভয় চিন্তা গোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গীগত পার্থক্যের গোড়াপত্তন হয়েছিল তাঁদের দু-পুরুষ আগে, কিন্তু আলোচ্য সময়ে ফিকাহ বিষয়ে তাঁদের মতপার্থক্য আরো স্পষ্ট হয়েছিল। এই সময় থেকে লোকেরা তাদের মতবিরোধের ভিত্তিতে আইনের উৎসসমূহ থেকে সমাধান বের করতে গিয়ে বিভিন্ন মাযহাবে দলবদ্ধ হতে শুরু করে।

ইসলামী আইনের ইতিহাস লেখকগন গুরুত্বারোপ করেন যে, আহলে রায় এর যুক্তিবাদী চিন্তাধারা মূলতঃ উমর (রাঃ) এবং আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর চিন্তাধারার সম্প্রসারিত রূপ। সাহাবীগণের মধ্যে এঁরা রায় (মতামত) পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তীকালে ইবরাহীম নাখঈ (রঃ) এর শিক্ষক এবং চাচা আলকামাহ নাখঈ (মৃঃ৬০ অথবা ৭০হিজরী) তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত হন। ইবরাহীম (রঃ) , হাম্মাদ ইবনে আবু সুলাইমানকে (মৃঃ১২০হিজরী) শিক্ষা দান করেন এবং যিনি পরবর্তী কালে আবু হানিফার (রঃ) শিক্ষক হন।

ঐ ঐতিহাসিকগণ জোর দিয়ে বলেন যে, আহলে হাদীসের ঐতিহ্যবাদী চিন্তাধারা হচ্ছে সে সকল সাহাবীর অবিচ্ছিন্ন চিন্তাধারা, যাঁরা হাদীসের মূল বাণীর (নুসূস) সাথে বিরোধ সৃষ্টির ভয়ে সাবধানতাবশতঃ মূলবাণী থেকে একটুও সরে যেতেন না। ব্যাপক অর্থে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ইবনুল খাত্তাব, আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস, যুবায়ের এবং আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস এ মতের অনুসারী ছিলেন।

বিভিন্ন কারণে আহলে হাদীসের চিন্তাধারা হিজাযে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। এর মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কারণ সম্ভবত এই যে, এ অঞ্চলে লোকদের বিপুল সংখ্যক হাদীস এবং অন্যান্য বিবরণ জানা ছিল এবং বস্তুত খিলাফতের কেন্দ্র স্থানান্তরিত হওয়ার পর এ অঞ্চলটি অধিকতর স্থিতিশীল ছিল। বেশির ভাগ রাজনৈতিক কর্মকান্ড প্রথমে দামেস্কে এবং পরে বাগদাদে স্থানান্তরিত হয়। মদীনার ইমাম সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব (মৃঃ৯৪হিঃ) এক সময় মন্তব্য করেছিলেন যে, মক্কা ও মদীনার লোকেরা হাদীস এবং ফিকাহ খুব বেশি বিস্মৃত হয়নি। কারণ তাঁরা আবু বকর (রাঃ) , ইবনে আব্বাস (রাঃ) , ইবনে উমর (রাঃ) যায়দ ইবনে ছাবিত (রাঃ) এবং আবু হুরায়রা (রাঃ) প্রমুখের ফতোয়া ও বিবরণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন। সুতরাং আইন প্রণয়নের জন্য তাঁদেরকে রায় এর অনুসরণ করতে হয়নি।

অপরদিকে আহলে রায় এর চিন্তাধারা ইরাকে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ দলের আলেমগণ চিন্তা করেছিলেন যে, শরীয়াহর আইনগত ব্যাখ্যাকে অবশ্যই যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। জনগণের সর্বোত্তম কল্যাণ বিবেচনায় আনতে হবে এবং অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য প্রজ্ঞা দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। বস্তুত এ সকল চিন্তাবিদ উল্লিখিত তাৎপর্য, আইনের অন্তর্নিহিত প্রজ্ঞা এবং এগুলোর পারম্পর্য তুলে ধরাকে তাঁদের কর্তব্য মনে করেছিলেন। যে বিশেষ প্রয়োজনে আইন জারি করা হয়েছিল, যদি সময়ের আবর্তন ও পরিস্থিতির পরিবর্তনের ফলে সে আইনের উপযোগিতা নষ্ট হয়ে যায়, তখন তা আর কোনক্রমেই বৈধ থাকতে পারে না। আর যদি কোন বৈধ থকার সমর্থনে যুক্তি আছে বলে মনে করতেন তাহলেও তাঁরা মাঝে মাঝে সেগুলোর সমর্থনে বিশ্লেষনাত্ন্যক পদ্ধতিতে যুক্তিসমূহ পেশ করতেন। এভাবে তাঁরা যুক্তি এবং কোন বিশেষ ধরনের হাদীসের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে অনেক ক্ষেত্রে যুক্তিকে আইনগত অগ্রাধিকার প্রদান করেছেন।

উমর (রাঃ) এর অনুসৃত পদ্ধতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বেশ কিছু সংখ্যক সাহাবীর সহায়তায় ইরাকে এ পদ্ধতি বিস্তৃতি লাভ করে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইবনে মাসউদ (রাঃ) , আবু মুসা আল আশয়ারী (রাঃ) , ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ) আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) , এবং ইবনে আব্বাস (রঃ) সহ আরো অনেকে। খেলাফতের কেন্দ্র ইরাকে স্থানান্তরিত হওয়া এবং আলী (রাঃ) ও তাঁর সমর্থকগণের সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করার ফলে এ পদ্ধতির আরো প্রসার ঘটে। ইরাকে শিয়া ও খারিজীদের মত সম্প্রদায়ের আবির্ভাবের ফলে প্রবল বিরোধের সূচনা হয় এবং ভুয়া হাদীস রচনা করাও এ সময় ব্যাপকতা লাভ করে। (এই উপদল আপর দলকে তাদের কাজে প্রবলভাবে বাধা দিত। তারা ইসলামের মূল ধারা থেকে সমর্থন সংগ্রহে তৎপর হয়। তারা রাসূলের (সাঃ) হাদীসে ব্যবহৃত শব্দসমূহের বিকৃত অর্থ করতো এবং তাদের নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে কিছু মনগড়া শব্দ ও ব্যাখ্যা রাসূলের (সাঃ) হাদীস বলে চালিয়ে দিত। (সম্পাদক) ) ফলে হাদীসের গ্রহণযোগ্যতা নিরূপণের জন্য ইরাকের আইনবিদগণ বিভিন্ন শর্ত আরোপে বাধ্য হন। উক্ত শর্তানুসারে ইরাকে বসবাসকারী সাহাবীগণের দেয়া স্বল্পসংখ্যক বিবরণ হাদীস হিসেবে গৃহীত হয়। কিন্তু ব্যাপক সংখ্যক আইনগত সমস্যা, বিশেষত উক্ত অঞ্চলে নজীরবিহীনভাবে বিভিন্ন আইনগত সমস্যার ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে শুধুমাত্র এ সকল নির্ভরযোগ্য হাদীসের দ্বারা সমাধা করা যাচ্ছিল না।

সুতরাং এর ফলে উম্মাহর মধ্যে যারা শিয়া অথবা খারিজীদের দলে অন্তর্ভুক্ত না থেকে আহলে হাদীস বা আহলে রায় এ দুটি দলে বিভক্ত ছিলেন, তাদের মধ্যকার বিরোধ আরো ঘনীভূত হয়।

আহলে রায়ের সমর্থকগণ আহলে হাদীসের সমর্থকগণকে এই বলে সমালোচনা করতেন যে, তাঁরা স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন এবং ফিকাহ শাস্ত্র বুঝার ক্ষমতাও তাঁদের নিতান্তই কম। অপরদিকে আহলে হাদীসেরা দাবি করতেন যে, আহলে রায় এর মতামতসমূহ মূলতঃ আন্দাজ অনুমানের বেশি কিচু নয় এবং তারা ধর্মীয় গুরুত্ব সম্পন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আবশ্যকীয় সতর্কতা অবলম্বন থেকে নিজেদেরকে দূরে রেখেছে। অথচ তা কেবল ধর্মের মূল উৎসের উপর নির্ভর করেই নিশ্চিত করা সম্ভব।

বস্তুতঃ আহলে রায় সকল মুসলমানের সাথে এ ব্যাপারে একমত পোষণ করে যে, যখন কোন ব্যক্তি সুন্নাহকে সুস্পষ্টরূপে অনুধাবন করতে সক্ষম হয় তখন সে কোন ব্যক্তিবিশেষের মতামতের সমর্থনে সুন্নাহকে অস্বীকার করতে পারেনা। তবে যে সকল বিষয়ে তাদেরকে সুন্নাহ বিরোধী বলে সমালোচনা করা হয়েছে সে সম্পর্কে তাঁদের বক্তব্য এই যে, তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোন হাদীস ছিল বলে জানতেন না বা এমন কোন একটি হাদীস সম্পর্কে জানতেন যাতে তাঁরা বর্ণনাকারীগণের কোন দুর্বলতা বা অন্য কোন ত্রুটি (এমন কোন ত্রুটি যাকে অন্যরা ক্ষতিকারক মনে করেননি) দেখতে পেয়েছেন। তাই তাঁরা ঐ হাদীসকে নিখুঁত হিসেবে বিবেচনা করেননি অথবা তারা একই বিষয়ে অন্য কোন নিখুঁত হাদীস জানতেন যা থেকে গৃহীত আইনগত তাৎপর্য অন্যান্যদের সাথে বিরোধ সৃষ্টি করেছে।

আহলে হাদিসগণ অবশ্য এ ব্যাপারে আহলে রায়ের সাথে একমত পোষণ করেন যে, মূল উৎস তথা কুরআন ও হাদীসের সরাসরি কোন নির্দেশ পাওয়া না গেলে যুক্তির আশ্রয় গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা আছে। উল্লেখিত মতৈক্য থাকা সত্বেও উভয় দলের মধ্যে বিরোধ ও উত্তেজনা প্রকট আকারে বিরাজমান থাকে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি