পঞ্চম অধ্যায়ঃ কুরআনের আলোকে অর্থনৈতিক জীবনের কতিপয় মৌলিক নীতিমালা
[আমরা এ গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিষযের সাথে সম্পৃক্ত তাহফহীমুল কুরআনের অনেকগুলো টীকা সংযুক্ত করে দিয়েছৈ। কিন্তু অর্থনৈতিক বিষয়ে এমন কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ টীকা তাফহীমুল কুরআনে রয়েছে, যেগুলো নির্দিষ্ট কোনো অধ্যায়ে স্থান পায়নি। সেগুলো আলোচনার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যে কোনো কোনো স্থানে প্রয়োজনমত সামান্য বিয়োজন কিংবা দুয়েক বাক্য সংযোজন করা হয়েছে।]

১. ইসলামী সমাজের তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য
[[তাফহীমুল কুরআন, সূরা আন নহল, টীকা ৮৮-৮৯।]
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
“আল্লাহ আদল, ইহসান এবং সেলায়ে রেহমীর নির্দেশ দিচ্ছেন। আর ফহসা, মুনকার ও বাগী থেকে নিষেধ করেছেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছেন, যেনো তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো।” [আন নহল: ৯০]
এই সংক্ষিপ্ত বাক্যটিতে এমন তিনটি জিনিরে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেগুলোর উপর গোটা মানব সমাজে পরিশুদ্ধি ও সার্থকতা নির্ভরশীল।
এর মধ্যে পয়লা নির্দেশ হলো ‘আদল’ [সুবিচার]। দুটি স্বতন্ত্র সত্যের সমন্বয়ে আদল গঠিত। এক. মানুষের অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে ভারসাম্য ও সাদৃশ্য প্রতিষ্ঠা করা। দুই. প্রত্যেককে যথাযথভাবে তার অধিকার প্রদান করা। আমাদের ভাষায় সাধারণত ‘আদল’-এর অর্থ করা হয় ইনসাফ করা। কিন্তু অনেক সময় ইনসাফ শব্দটি ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করে। এ থেকে এ ধারণার সৃষ্টি হতে পারে যে, দুই ব্যক্তির মধ্যে তাদের অধিকার বন্টিত হতে হবে অর্ধেক অর্ধেক বা সমান সমান ভিত্তিতে। এ থেকেই ‘আদল’ মানে ধরে নেয়া হয়েছে সমবন্টন। অথচ সমবন্টন ব্যবস্তা স্বাভাবিকতার সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রকৃতপক্ষে আদল যে জিনিসের দাবি করা হচ্ছে, ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য, সমামন সমান নয়। কোনো কোনো দিক থেকে আদল সমাজে লোকদের মধ্যে অবশ্যই সমতা দাবি করে, যেমন নাগরিক অধিকার। কিন্তু আবার কোনো কোনো দিক থেকে ‘সমতা’ আদলের সম্পূর্ণ বিপরীত, যেমন পিতা-মাতা ও সন্তানের মাঝে সামাজিক ও নৈতিক সম্পর্ক এবং উন্নত ধরনের সেবা প্রদানকারী ও নিম্নমানের সেবা প্রদানকারীদেরকে সমান সমান বেতন দেয়া। তাই আল্লাহ তায়ালা এখানে যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা হলো, অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে সমতা বিধান করা নয়া, বরঞ্চ ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য রক্ষা করা। আর এই নির্দেশের দাবি হলো, প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার নৈতিক, সম্পর্কগত, অর্থনৈতিক, আইনগত, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার পূর্ণ ঈমানদারীর সাথে যথাযথভাবে প্রদান করতে হবে।
দ্বিতীয় নির্দেশ হলো ‘ইহসান’। ইহসান মানে সুন্দর ব্যবহার, হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণ, চমৎকার আচরণ, পারস্পরিক ঔদার্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, অপরকে তার অধিকারের চেয়ে বেশী দেয়া এবং নিজের অধিকারের চেয়ে কম পেয়েও সন্তুষ্ট থাকা। বসতুত ইহসান আদলের চেয়ে বেশী কিছু বুঝায়। সামাজিক জীবনে তাই ইহসানের গুরুত্ব আদলের চেয়েও বেশী। আদল যদি হয় সামাজিক জীবনের ভিত, তবে ইহসান হলো সমাজের কারুকাজ। আদল যদি সমাজকে অসন্তোষ ও তিক্ততা থেকে রক্ষা করে, তবে ইহসান তাতে সন্তোষ ও মাধুর্য এনে দেয়। কোনো সমাজের প্রত্যেক সদস্য হরহামেশা মেপেমেপে নিজের অধিকার নির্ণয় ও আদায় করে; আর অপরের অধিকার কতোটা রযেছে তা খতিয়ে নির্ধারণ করে এবং কেবল ততোটুকুই দিযে দেয়। এ ধরনের একটি কাটখোট্টা সমাজে দ্বন্দ্ব সংঘাত ঘটেনা বটে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে সে সমাজ প্রেম ভালবাসা, কৃতজ্ঞতা, মাহাত্ম্য উদারতা, ত্যাগ ও কুরবানী, নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা এবং অপরের কল্যাণ কামনার মতো মহোত্তম বৈশিষ্ট্যসমূহ হতে বঞ্চিত থেকে যায়। অথচ এই গুণ বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে ব্যক্তিজীবনে সজীবতা ও মাধুর্য সৃষ্টির এবং সমাজ জীবনে সৌন্দর্য সুষমান বিকাশের উপাদান।
তিন নম্বর নির্দেশটি হলো ‘সেলায়ে রেহমী’। এ হচ্ছে আত্মীয়দের প্রতি ইহসান করার একটি খাস পন্থা। এর অর্থ কেবল এই নয় যে, কোনো ব্যক্তি তার আত্মীয়স্বজনের সাথে শুধু ভাল ব্যবহার করবে, তাদের সুখে দুখে শরীক হবে এবং বৈধ সীমার মধ্যে তাদের সাহায্য সহযোগিতা করবে। বরং সেই সাথে এটাও এর অর্থ যে, প্রত্যেক সামর্থবান ব্যক্তি তার ধনসম্পদে নিজের ও নিজের সন্তান সন্ততির অধিকার প্রদানের সাথে সাথে স্বীয় আত্মীয় স্বজনের অধিকারও স্বীকার করে নেবে। আল্লাহর বিধান প্রত্যেক খান্দানের সচ্ছল ব্যক্তিকেএ ব্যাপারে দায়িত্বশীর বানিযেছে যে, সে তার খান্দানের লোকদেরকে অন্নহীন বস্ত্রহহীন থাকতে দেবেনা। খোদায়ী শরীয়তের দৃষ্টিতে মানব সমাজে এর চেয়ে নিকৃষ্ট কোনো অবস্থা হতে পারেনা যে, সেখানে পরিবারের এক ব্যক্তি সম্পদের প্রাচুর্যে আরাম আয়েশে কাল কাটাবে, আর সে পরিবারেরই অপর কোনো সদস্য ভাত কাপড়ের অভাবে দুর্ভোগ পোহাবে। মূলত ইসলাম পরিবারকে সমাজ সংগঠনের অতিগুরুত্বপূর্ণ অংগ মনে করে। এক্ষেত্রে ইসলাম এই নীতি ঘোষণা করেছে যে, প্রত্যেক পরিবারের দরিদ্রদের পয়লা অধিকার বর্তায় সেই পরিবারেরই সচ্ছল লোকদের উপর । এরপর তার অধিকার বর্তায় অন্যদের উপর। এ কথাটিই নবী করীম (সা) তাঁ বিভিন্ন বাণীতে সুস্পষ্টভাবে বলে গেছেন। বিভিন্ন হাদীস থেকে পরিষ্কারভাবে জানা যায়, যে কোনো ব্যক্তির উপর সর্বপ্রথম অধিকার বর্তায় তার মাতাপিতা, স্ত্রী, সন্তান সন্ততি এবং ভাই বোনের। অতঃপর তার সেইসব লোকদের অধিাকর বর্তায় যারা পরবর্তী পর্যায়ের নিকটজন। এভাবে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য নিকটতর লোকের অধিকার বর্তায়।
এই নীতির ভিত্তিতে হযরত উমর ফারুক (রা) এক এতীম শিশুর চাচাতো ভাইদের বাধ্য করেছিলেন সে এতীমের লালন পালনৈর দায়িত্ব গ্রহণ করতে। অপর একটি এতীমের ব্যাপারে ফায়সালা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, তার কোনো দুল সম্পর্কীয় আত্মীয় বর্তামান থাকলেও এর লালন পালনের দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত করতাম। যে সমাজে প্রত্যেক সদস্য (UNIT) এমননি করে নিজ আত্মীয়স্বজনের দায়িত্ব গ্রহণ করে, সেখানে কতো সুন্দর অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য, সামাজিক সুসম্পর্ক ও মাধুর্য এবং নৈতিক পবিত্রতা ও শ্রেষ্টত্ব গড়ে উঠতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
উপরে আলোচিত তিনটি কল্যাণকর কাজের প্রতিকূলে আল্লাহ তায়ালা তিনটি মন্দ কাজ থেকে বিরত থাক বলেছেন। এই মন্দু কাজগুলো ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে এবং সামাজিকভাবে গোটা সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।
প্রথমেই নিষেধ করা হয়েছে ‘ফাহ্শা’ কাজ থেকে। ফাহ্শা বলতে যাবতীয় অনর্থক, অশ্লীল ও লজ্জাকর কাজকে বুঝায়। এমন প্রতিটি মন্দ কাজই ফাহশা, যা প্রকৃতিগতভাবেই মন্দ, লজ্জাকর এবং কুশ্রী। যেমন, কৃপণতা, ব্যভিচার, নগ্নতা ও উলংগপনা, সমকামিতা, নিষিদ্ধ নারীদের বিয়ে করা, চুরি ডাকাতি, মদ্যপা, ভিক্ষাবৃত্তি গালাগাল এবং অশ্লীল কথাবার্ত বলা ইত্যাদি। একইভাবে প্রকাশ্যে, ঘোষণা দিয়ে মন্দ কাজে লিপ্ত হওয়া এবং মন্দ কাজ ছড়িয়ে দেয়াও ফাহ্শার অন্তর্ভুক্ত। যেমন, মিথ্যা প্রপাগাণ্ডা করা, অপবাদ দেয়া, গোপন অপরাধসমূহের প্রচার করা, অসৎ কর্মে সুড়সুড়ি দানকারী গল্প,নাটক ও ফিল্ম, নারীদের সাজগোজ প্রদর্শন করে প্রকাশ্যে চলাফেরা, নারীপুরুষের অবাধ মেলামেশা, মঞ্চে উঠে নারীদের নাচগান করা এবং বিভিন্ন শারীরিক ভংগিমা প্রদর্শন করা ইত্যাদি।
দ্বিতীয়ত যে কাজ থেকে নিষেধ করা হয়েছে, তা হলো মুনকার। এমন প্রতিটি মন্দ কাজই মুনকার, যাকে মানুষ স্বভাবগতভাবে মন্দ বলে জানে, সব সময় যাকে মন্দ বলে আসছে এবং আল্লাহ প্রদত্ত সকল শরীয়তে যেসব কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
তৃতীয় নিষিধ্ধ কাজ হলো ‘বাগী’। এর অর্থ হচ্ছে নিজের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া এবং অন্যদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা, চাই সে অধিকার স্রষ্টার হোক কিংবা সৃষ্টির।
এসব হচ্ছে এমন মৌলিক গুণবৈশিষ্ট্য যার উপর ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠিত। এসব ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা ব্যক্তি এবঙ রাষ্ট্র উভয়েরই দায়িত্ব। এই নির্দেশসমূহ পালন এবং নিষেধ থেকে বিরত থাকা ও রাখার জন্যে নৈতিক ও আইনগত সকল শক্তি প্রয়োগ করতে হবে।

২. নৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির ইসলামী পদ্ধতি
[তাফহীমুল কুরআন, সূরা আর রূম, টীকা ৫৭]
فَآتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ ذَلِكَ خَيْرٌ لِلَّذِينَ يُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“অতএব [হে মুমিনরা], আত্মীয়কে তার অধিকার দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরকে [তাদের অধিকার]। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়, তাদের জন্যে এটাই উত্তম পন্থা। আর এসব লোকেরাই কল্যাণ ও সফলতার অধিকারী হবে।” [সূরা আর রূম: ৩৮]
এ আয়াতে আত্মীয়, মিসকীন ও মুসাফিরকে ভিক্ষা দিতে বলা হয়নি। বলা হয়েছে তাদেরকে যা দিতে হবে, তা তাদের অধিকার। তাদেরকে অধিকার মনে করেই তাদের দাও। দেবার সময় তোমার কোণেও যেনো এরূপ কোনো চিন্তার উদয় না হয় যে, তুমি তাদের প্রতি অনুগ্রহ করছো, তুমি একজন মহামানব, দানবীর; আর সে হীন নগণ্য এবং তোমার দান খেয়েই সে জীবন ধারণ করে। বরঞ্চ তোমার মনের গভীরে একথা বদ্ধমূল করে নিতে হবে যে, ধনমালের প্রকৃত মালিক তোমাকে অধিক সম্পদ দিয়েছেন. এই অধিক সম্পদের মধ্যে কমওয়ালাদের অধিকার রয়েছে। তোমাকে পরীক্ষা করার জন্যেই এই অধিক সম্পদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ দেখতে চান, তুমি তাদের অধিকার উপলব্ধি করছো কিনা এবং তা পৌঁছে দিচ্ছো কিনা?
আল্লাহর এ বাণীর প্রকৃত মর্ম যিনি উপলব্ধি করতে পারবেন, তিনি অবশ্যি অনুভব করবেন যে, কুরআন মজীদ মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির যে পদ্ধতি নির্ধারণ করেছে, তা বাস্তবায়নের জন্যে স্বধীন সমাজ ও একটি স্বাধীন অর্থনীতি বর্তমান থাকা একান্ত অপরিহার্য। এমন কোনো সামাজিক ব্যবস্থায় এই পদ্ধতি কার্যকর করা কিছুতেই সম্ভব নয়া, যেখানে ব্যক্তিমালিকানার অধিকার রহিত করা হয়, সকল উপায় উপকরণ জাতীয়করণ করা হয় এবং জনগণের মধ্যে জীবিকা বন্টনের যাবতীয় কাজ সরকারী ব্যবস্থাপনায় আঞ্জাম দেয়া হয়। এমন ব্যবস্থায় ব্যক্তি নিজের উপর অপরের অধিকার বুঝতে ও আদায় করতে পারেনা এবং কেউ কারো কাছ থেকে কিছু গ্রহণ ও তার জন্যে কল্যাণ কামনা করতে পারেনা। একইভাবে কমিউনিজমের উপস্থাপিত সমাজব্যবস্থাও কুরআনী স্কীমের সম্পূর্ণ বিপরীত। অথচ একে ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’ এবং ‘কুরআনী প্রতিপালন ব্যবস্থা’ এত্যাদি প্রাতারণামূলন নাম দিয়ে কিছু লোক আমাদের দেশের সাধারণ মানুষকে ধোকায় ফেলতে চাইছে এবং এই ব্যবস্থাকে জোরপূর্বক কুরআনের উপর চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এ ব্যবস্থার সাথে কুরআনী দৃষ্টিভংগির দূরতম কোনো সম্পর্কও নেই। এ ব্যবস্থা কুরআনী দৃষ্টিভংগির সম্পূর্ণ খেলাফ। এ ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত নৈতিকতার লালন ও চারিত্রিক উন্নতি সাধনের পথ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। কুরআনের স্কীম তো কেবল সে সমাজেই বাস্তবায়িত হতে পারে যেখানে সমাজের মানুষ ব্যক্তিগতভাবে কিছু না কিছু সহায় সম্পদের মালিক হবে; নিজ মালিকানাধীন সহায় সম্পদের ব্যয় ব্যহারের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা লাভ করবে এবং নিজের ইচ্ছা আগ্রহ অনুযায়ী আল্লাহ ও তাঁর বান্দাহদের অধিকার নিষ্ঠার সাথে আদায় করতে পারে। এই ধরনের সমাজের ক্ষেত্রে িআশা করা যেতে পারে যে, একদিকে সেখানে মানুষের মধ্যে পরস্পরে অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা এবং তা প্রদান করার মতো মহান গুণাবলী সৃষ্টি হবে। অপরদিকে সম্পর্কে সচেতনতা এবং তা প্রদান করার মতো মহান গুণাবলী সৃষ্টি হবে। অপরদিকে যেসব লোকের সাথে এই কল্যাণমূলত আচরণ করা হবে, তাদের অন্তরেও এই কল্যাণকারী লোকদের প্রতি হৃদ্যতা, কৃতজ্ঞতা, ভালবাসা, আন্তরিকতা এবং অনুগ্রহ করার পবিত্র মনোভাব সৃষ্টি ও লালিত হবে। এভাবেই শেষ পর্যন্ত এমন একটি আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি হবে, যেখানে অন্যায়ের প্রতিরোধ আর ন্যায়ের প্রতিপালন কোনো ক্ষমতাধরের ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল হবেনা। বরঞ্চ লোকেরা নিজ থেকেই অন্তরের পবিত্রতা ও সদিচ্ছা কারণে স্বেচ্ছায় এসব দায়িত্ব পালণ করে যাবে।

৩. জীবিকার ধারণা এবং ব্যয়ের দৃষ্টিভংগি
وَلَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَى مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ وَرِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَأَبْقَى
“পার্থিব জীবনে সেইসব জাঁকজমকের প্রতি বিন্দুমাত্র দৃষ্টিও দিয়োনা, যা আমি লোকদের মধ্য থেকে বিভিন্ন জনকে দিয়ে রেখেছি। এগুলো তো তাদেরকে পরীক্ষায় ফেলার জন্য দিয়েছি। আসলে তোমার রবের দেওয়া হালাল জীবিকাই উত্তম এবং স্থায়ী।” [সূরা তোয়াহা: ১৩১]
আমরা এখানে ‘রিযক’ শব্দের অনুবাদ করেছি ‘হালাল জীবিকা’। কারণ, আল্লাহ তায়ালঅ কোথাও হারাম ধনমালকে ‘রিযকে রব’ বা ‘রবের দেওয়া জীবিকা’ বলেননি। আল্লাহ তায়ালার এব বাণীর মর্ম হলো, ফাসিক ফাজির লোকেরা অবৈধ পন্থায় সম্পদ সংগ্রহ ও সঞ্চয় করে নিজেদের জীবনে যে বাহ্যিক চাকচিক্য সৃষ্টি করে, তাকে ঈর্ষা ও লোভের দৃষ্টিতে দেখা তোমার ও তোমার সাথী ঈমানদার লোকদের কাজ নয়। বৈধ পন্থায় তোমরা যে পবিত্র জীবিকা উপার্জন কর, তা পরিমাণের দিক থেকে যতো কমই হোকনা কেন, সত্যপন্থী ও ঈমানদার ব্যক্তিদের জন্যে তা-ই উত্তম ও কল্যাণকর। আর এর মধ্যেই সেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে যা ইহজগত থেকে নিয়ে পরজগত পর্যন্ত বিস্তৃত ও স্থায়ী হবে।[তাফহীমুল কুরআন, সূরা তোয়াহা, টীকা: ১১৩]
وَاللَّهُ يَرْزُقُ مَنْ يَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ
“আল্লাহ যাকে চান অগণিত দান করেন।” [আন নূর: ৩৮]
وَيْكَأَنَّ اللَّهَ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَيَقْدِرُ
“আফসোস আমরা ভুলে গিয়েছিলাম যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা জীবিকার প্রশস্ততার দান করেন আর যাকে ইচ্ছা পরিমিত মাত্রায় দিয়ে থাকেন।” [আল কাসাস: ৮২]
অর্থাৎ জীবিকার প্রশস্ততা এবং সংকীর্ণতা যেটাই হোক না কেন, তা আল্লাহর ইচ্ছায়ই হয়ে থাকে। আর আল্লাহর ইচ্ছঅর পেছনে থাকে কল্যাণ ও মঙ্গল। কাউকে অধিক জীবিকা দানে অনিবার্য অর্থ এ নয় যে, আল্লাহ তার উপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট এবং সম্পদ দিয়ে তাকে পুরস্কৃত করছেন। অনেক সময় এমন হয় যে, কোনো ব্যক্তি আল্লাহর সাংঘাতিক অপছন্দনীয়, কিন্তু আল্লাহ তাকে বিপুল ধনসম্পদ দান করে যাচ্ছেন। অবশেষে এই ধনসম্পদই তার উপর আল্লাহর আযাব নিয়ে আসে। পক্ষান্তরে কাউকেও যদি পরিমিত দান করা হয়ে থাকে, তবে তার অনিবার্য অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ তায়ালা তার উপর অসন্তু্ট এবং স্বল্প রিযিক দিয়ে আল্লাহ তাকে সাজা দিচ্ছেন। আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়া সত্ত্বেও নেক লোকের উপর জীবিকার সংকীর্ণতা চেপে থাকতে পারে। অনেক সময় আল্লাহর রহমত হিসেবেও তাঁদের জীবিকা এরূপ সংকীর্ণ করা হতে পারে। সম্পদ দান সংক্রান্ত আল্লাহর এই নীতি অনুধাবনে ব্যর্থ হবার কারণেই বহু লোক আল্লাহর অভিশাপে নিপাতিত লোকদের প্রাচুর্যের প্রতি লোভ ও ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।[তাফহীমুল কুরআন, সূলা আল কাসাস, টীকা: ১০১]
الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَالصَّابِرِينَ عَلَى مَا أَصَابَهُمْ وَالْمُقِيمِي الصَّلَاةِ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ
“যাদের অবস্থা এমন যে, আল্লাহর কথা শুনতেই তাদের অন্তরে কেঁপে উঠে, তাদের উপর যে বিপদ আসে, তাতে তারা সবর অবলম্বন করে, সালাত কায়েম করে, আর আমরা যে জীবিকা তাদের দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় কর।” [আল হজ্জ: ৩৫]
পূর্বেই একথা বলে এসেছি যে, আল্লাহ তায়ালা কখনো হারাম এবং অপবিত্র ধনসম্পদকে তাঁর দেয়া জীবিকা বলেননি। তাই এই আয়াতের অর্থ হবেচ, যে পবিত্র জীবিকা আমরা তাদের দান করেছি, অথবা যে হালাল উপার্জনের ব্যবস্থা তাদের করে দিয়েছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে। ব্যয় শব্দ দ্বারাও এখানে সব ধরনের ব্যয়কে বুঝানো হয়নি। এখানে ব্যয়ের অর্থ হলো, নিজের এবং নিজ পরিবার পরিজনের বৈধ প্রয়োজন পূরণ করা; আত্মীয়, প্রতিবেশী এবং অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করা, কনকল্যাণকর কাজে অংশ নেয়া এবং আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করার কাজে আর্থিক কুরবানী করা। বাহুল্য ব্যয়, বিলাসিতা ও জাঁকজমকের জন্যে ব্যয় এবং লোক দেখানো ব্যয় সেই ব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়, কুরআন যাকে ‘ইনফাক’ বলেছে; বরং এ ধরনের ব্যয়কে তো কুরআন অপব্যয় বলে আখ্যায়িত করেছে। অনুরূপভাবে কৃপণতা ও সংকীর্ণ মন নিয়ে যে ব্যয়ের দ্বারা নিজের অবস্থা ও মর্যাদা অনুযায়ী প্রয়োজন পূরণ করা হয়না এবং সামর্থ্য অনুযায়ী আল্লাহর সৃষ্টির সেবা ও সাহায্যেও এগিয়ে আসা হয়না- এসব ব্যয়কে আর যাই হোক, কুরআনে বর্ণিত ‘ইনফাক’ নামে অভিহিত করা যায় না। বরং আল কুরআন একে কৃপণতা এবং মনের সংকীর্ণতা বলে অভিহিত করেছে।[তাফহীমুল কুরআন, সূলা আল হজ্জ, টীকা: ৬৬]

৪. ব্যয়ের মূলনীতি
وَمِنَ الْأَنْعَامِ حَمُولَةً وَفَرْشًا كُلُوا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ
“যেসব জিনিস থেকে খাও যা আল্লাহ তোমাদের দান করেছেন। আর শয়তানের পদাংক অনুসরণ করোনা, কেননা সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।” [সূরা আল আনআম: ১৪২]
এখানে আল্লাহ তায়ালা তিনটি কথা বলেছেন। কে. মানুষ যেসব ক্ষেত খামার, বাগবাগিচা এবং জীবজন্তুর অধিকারী তা সবই আল্লাহর দান। এই দান করার ক্ষেত্রে অপর কারো কোনো অংশ নেই। সুতরাং দানের কৃতজ্ঞতা পাবার ক্ষেত্রেও অপর কারো কোনো অংশ থাকতে পারেনা। দুই. যেহেতু এসব জিনিস আল্লাহরই দান, সেহেতু এগুলির ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কেবল আল্লাহর দেয়া আইন কানুন এবং নিয়ম কানুন এবং নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার কোনো অধিকার অপর কারো থাকতে পারেনা। আল্লাহ্ ছাড়া অপর কারো সামনে দানের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ নজরানা পেশ করা বিলকুল সীমালংঘন । আর এটাই শয়তানের পদাংশ অনুসরণ। তিন. আল্লাহ তায়ালা যেসব হালাল জিনিস মানুষের পানাহার ও ভোগ ব্যবহারের জন্যে সৃষ্টি করেছেন, অনর্থক সেগুলোকে হরাম করে বৈধ নয়। মানুষ নিজের ধারণা কল্পনার ভিত্তিতে আল্লাহর দেয়া জীবিকা ও নিয়ামতসমূহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেসব বিধি নিষেধ আরোপ করে নিয়েছে তা আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সাংঘর্ষিক। [তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আনআম. টীকা: ১১৮]
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُحَرِّمُوا طَيِّبَاتِ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ () وَكُلُوا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ حَلَالًا طَيِّبًا وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي أَنْتُمْ بِهِ مُؤْمِنُونَ
“হে ঈমানদার লোকেরা। আল্লাহ তোমাদের জন্যে যেসব পবিত্র জিনিস হালাল করেছেন, সেগুলিকে তোমরা হারাম করোনা এবং সীমালংঘন করোনা, আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের সাংঘাতিক অপছন্দ করেন। আর আল্লাহ তোমাদেরকে যে হালাল পবিত্র জীবিকা দান করেছেন, তা থেকে পানাহার কর এবং সেই মহান আল্লাহর হুকুম অমান্য করা থেকে নিজেকে সংরক্ষণ কর, যার প্রতি তোমরা ঈমান এনেছো।” [সূরা আল মায়িদা: ৮৭-৮৮]
এখানে দুটি কথা বলা হয়েছৈ। এক. মানুষ যেন হালাল হারাম নির্ধারণ করার অধিকার নিজের হাতে তুলে না নেয়। প্রকৃতপক্ষে সেটাই হালাল, যা আল্লাহ হালাল করেছেন। আর হারামও কেবল সেটাই, যা আল্লাহ হারাম করেছেন। নিজেদের ইচ্ছেমতো কোনো হালালকে যদি হারাম করা হয় তবে আল্লাহর আইন পালনকারী হবার পরিবর্তে নফসের আইন পালনকারী বলে সাব্যস্ত হতে হবে।
দুই. খৃস্টান পাদ্রী, হিন্দু সন্নাসী, বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং প্রাচ্যের সূফীদের মতো বৈরাগ্য অবলম্বন এবং ভোগ ব্যবহার পরিহারের পন্থা অবলম্বন করা যাবেনা। ধর্মীয় মানসিকতা সম্পন্ন সরল প্রকৃতির কিছু লোকদের মধ্যে সব সময়ই এ প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে যে, তাঁরা দেগ ও আত্মার অধিকার প্রদান করাকে আধ্যাত্মিক উন্নতির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক মনে করেছেন। তাদের ধারণা নিজেকে নিজে কষ্টে নিমজ্জিত করা নিজের আত্মাকে পার্থিব ভোগ ব্যবহার থেকে বঞ্চিত করা এবং পার্থিব জীবনোপকরণ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা নেকীর কাজ এবং এ পদ্ধতি অবলম্বন ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব নয়। সাহাবায়ে কিরামের মধ্যেও অনুরূপ মানসিকতার দুয়েকজন ছিলেন। একবার নবী করীম (সা) জানতে পারলেন, কয়েকজন সাহাবী এই বলে শপথ করেছেন যে, তারা সারাজীবন [প্রতিনি] রোযা রাখবেন, রাত্রে কখনো বিছানায় শোবেন না, বরং সারারাত বিনিদ্র জেগে ইবাদত করে কাটাবেন, কখনো গোশ্ত খাবেন না এং নারীদের সংস্পর্শে যাবেন না। এ সম্পর্কে নবী করীম (সা) একটি ভাষণ প্রদান করেন। তিনি বলেন: “আমাকে এরূপ করার হুকুম দেয়া হয়নি। তোমাদের উপর আত্মারও অধিকার আছে। সুতরাং কোনো কোনো দিন রোযা রাখবে এবং কোনো কোনো দিন পানাহার করবে। রাত জেগে ইবাদতও করবে আবার ঘুমাবেও। আমাকে দেখ! আমি রাত্রে ঘুমাই। আবার নামাযেও দাঁড়াই। কোনো দিন রোযা রাখি আবার কোনো দিন রোযা ছেড়ে দিই। গোশ্তও খাই, ঘিও খাই, সুতরাং যে আমার অনুসৃত নিয়ম পন্থা অপছন্দ করবে, সে আমার দলভুক্ত নয়।” অতঃপর তিনি বললেন: “এই লোকদের কি হয়েছে? কেন এরা নিজেদের জন্য নারী, উত্তম খাদ্য, সুগন্ধি, ঘুম এবং পার্থিব ভোগ ব্যবহার হারাম করে নিয়েছে? আমি তোমাদের পাদ্রী এবং সন্যাসী হবার শিক্ষা দিইনি! আমার আনীত দীনের মধ্যে নারী এবং গোশ্ত পরিহার কারার বিধান নেই। ঘরেরর কোনায় নির্জনবাসের কোনো নিয়ম নেই। আত্ময়িন্ত্রণের জন্যে এখানকার বিধান হলো রোযা রাখা। বৈরাগ্যবাদের পরিবর্তে এখানে কল্যাণ লাভের পথ হলো জিহাদ। আল্লাহর আনুগত্য দাসত্ব কর! তাঁর সাথে কাউকেও শরীক করোনা। হজ্জ এবং উমরা পালন কর। সালাত কায়েম কর। যাকাত পরিশোধ কর এবং রমযানের রোযা রাখ। তোমাদের পূর্বেকার যেসব লোক ধ্বংস হয়েছে, তারা এ কারণে ধ্বংস হযেছে যে, তারা কঠোর ব্যবহার করেছেন। গীর্জা ও খানকায় যা ঘটেছে তা তাদেরই ধ্বংসাবশেষ।”
এ প্রসংগে আরেকটি হাদীস থেকে জানা যায় নবী করীম (সা) জনৈক সাহাবী সম্পর্কে জানতে পারলেন যে, তিনি দীর্ঘদিন তার স্ত্রীর নিকট যাননি। দিনরাত ইাদতের মশগুল থাকেন। তিনি তাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি এলে রাসূল (সা) তাঁকে নির্দেশ দিলেন, এখনই তোমার স্ত্রীর কাছে যাও। সাহাবী বললেন, আমি রোযা রেখেছি। তিনি বললেন: রোযা ভেংগে ফেলো এবং যাও।
হযরত উমরের খিলাফতকালে এক মহিলা এসে অভিযোগ করলো: “আমার স্বামী প্রতিদিন রোযা রাখেন এবং সারারাত ইবাদত করেন। আমার সাথে কোন স্ংস্পর্শ রাখেন না।” হযরত উমরা (রা) বিখ্যাত তাবেয়ী কায়াব ইবনে সাওরুল আয্দীকে তাদের মামলা শুনার জন্যে নিযুক্ত করলেন তিন এই ফয়সালা প্রদান করেন যে, এই মহিলার স্বামী একাধারে তিন রাত যতো ইচ্ছা ইবাদত করতে পারে। কিন্তু চতুর্থ রাতে তাকে অবশ্যি তার স্ত্রীর কাছে আসতে হবে। এটা স্ত্রীর অধিকার।[তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল মায়িদা. টীকা: ১০৪]
এই আয়াতে ‘সীমালংঘন করা’ কথাটি ব্যাপক অর্থবোধক। হালালকে হারাম করা এবং আল্লাহ তায়ালা যেসব জিনিসকে পবিত্র বলেছেন, সেগুলোকে অপবিত্র জিনিসের মতো পরিহার করাও এক প্রকার সীমালংঘন। পবিত্র জিনিস ব্যবহারের ক্ষেত্রে অপব্যয় এবং বাহু্ল্য ব্যয়ও এক প্রকার সীমালংঘন। তাছাড়া হালালের সীমা অতিক্রম করে হারামের সীমায় প্রবেশ করাও আরেক প্রকার সীমালংঘন। এই তিন ধরনের সীমালংঘনই আল্লাহর অপছন্দনীয়। [তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল মায়িদা. টীকা: ১০৫]

৫. মিতব্যয়ের মূলনীতি
وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا () وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًا
“যারা খরচ করার সময় বাহুল্যৗ খরচ করেনা, আবার কৃপণতাও করেনা, বরঞ্চ তাদের ব্যয় এই প্রান্তিকতার মধ্যবর্তী হয়ে থাকে। তারা আল্লাহ ছাড়া অপর কোনো ইলাহকে ডাকেনা। আল্লাহর হারাম করা কোনো প্রাণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেনা। ব্যভিচারে লিপ্ত হয়না। যে-ই এ অপরাধের কাজ করবে, সে অবশ্যি তার অপরাধের প্রতিফল লাভ করবে।” [সূরা আল ফুরকান : ৬৭-৬৮]
অর্থাৎ তারা এমন নয় যে, বিলাসিতা, জুয়া খেলা, মদ্যপান, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া, মেলা মীনাবাজার এবং বিয়েশাদীদে অঢেল অর্থ ব্যয় করবে এবং নিজের অবস্থার চেয়ে অধিকা জৌলুস দেখানোর জন্যে খানাপিনা, ঘরবাড়ী, পোশাক আশক, সাজসজ্জা ও বেশভুষায় দুই হাতে অর্থ লুটাবে। পক্ষান্তরে তারা এমনও নয় , অর্থপূজারী ব্যক্তির মতো পাই পাই করে অর্থকড়ি ধনদৌলত সংগ্রহ করবে; অথচ নিজেও খাবেনা, সামর্তানুযায়ী সন্তান সন্ততির প্রয়োজনও পূরণ করবেনা এবং আন্তরিকতার সাথে কোনো কল্যাণমূলক কাজেও ব্যয় করবেনা। তৎকালীণ আরবদেশে এই দুই ধরনের লোকই ছিলো। একদিকে ছিলো সেইসব লো যারা লাগামহীনভাবে অর্থকড়ি ব্যয় করতো। এরা অর্থকড়ি ব্যয় করতো নিজেদের ভোগ বিলাসিতার জন্যে, সমাজে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার এবং স্বীয় বদান্যতা ও ধনদৌলতের ডঙ্কা বাজানোর জন্যে। অপরদিকে ছিলো সেইসব কৃপণ লোক, যাদের কৃপণতা খ্যাতি অর্জন করেছিল। খুব কম লোকই ছিলো, যারা মিতব্যয়িতার নীতি অবলম্বন কতো। এই গুটিকয়েক মিতব্যয়ী ব্যীক্তর মধ্যেও রাসূলে করীম (সা) এবং তাঁর সাথীরাই ছিলেন সর্বাধক উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
এ প্রসংগে অপব্যয় ও কৃপণতার সংজ্ঞা জেনে নেয়া দরকার।
ইসলামের দৃষ্টিতে তিনটি জিনিসকে অপব্যয় বলা হয়ঃ
এক. অবৈধ কাজে অর্থসম্পদ ব্যয করা, তা একটি পয়সাও হোকনা কেন।
দুই. বৈধ কাজে খরচ করতে গিয়ে সীমালংঘন করা, চাই তা সামর্থ্যের চেয়ে অধিক খরচ করা হোক, কিংবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধনসম্পদ নিজের ভোগবিলাস ও জাঁকজমকের জন্যে ব্যয় করা হোক।
তিন. ভালো কাজে ব্যয় করা, কিন্তু তা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য নয়, বরঞ্চ লোক দেখানো ও আত্মপ্রচারের জন্যে করা।
অপরদিকে দুটি জিনসকে কৃপণতা বলা হয়:
এক. সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও নিজের ও সন্তান সন্ততির প্রয়োজন পূরণ না করা এবং
দুই. ভাল, ন্যায় ও কল্যাণমূলক কাজে অর্থ ব্যয় না করা।
এই দুই প্রান্তিকতার মধ্যবর্তী অবস্থাই হলো মিতব্যয়। আর এটাই হলো অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রে ইসলামে নির্দেশিত পন্থা। এ সম্পর্কে নবী করীম (সা) বলেছেন: (আরবী********************)
“জীবিকার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করাই বিজ্ঞতার পরিচায়ক।” [আতমদ ও তাবরানী: আবু দারদা]

৬. অর্থনৈতিক সুবিচর
قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ قَدْ جَاءَتْكُمْ بَيِّنَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ فَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ وَلَا تَبْخَسُوا النَّاسَ أَشْيَاءَهُمْ وَلَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
“[শুয়াইব] বললো: হে আমার জাতির ভাইয়েরা! আল্লাহর দাসত্ব কর। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নাই। তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ ও পথনির্দেশনা এসেছে। সুতরাং ওজন ও পরিমাপ পূর্ণ করে দাও। লোকদের দ্রব্য সামগ্রীতে তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করোনা। সংস্কার সংশোধনের পর পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা। এতেই তোমাদের কল্যাণ নিহিত আছে, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক।” [সূরা আ’রাফ : ৮৫]
وَقَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَوْمِهِ لَئِنِ اتَّبَعْتُمْ شُعَيْبًا إِنَّكُمْ إِذًا لَخَاسِرُونَ
“তার জাতির সেসব নেতা, যারা তার আহ্বানে সাড়া দিতে অস্বীকার করলো, নিজেরা নিজেরা বলাবলি করলো। : শুয়াইবের আহ্বানে সাড়া দিলে তোমরা অবশ্যি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” [নূরা আ’রাফ : ৯০]
প্রথম আয়াত থেকে জানা যায় যে, হযরত শুয়াইব আলাইহিস সালামের জাতির মধ্যে দুটি বিরাট অন্যায় অপরাধের কাজ বর্তমান ছিলো। এর একটি হলো শিরক; আর অপরটি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতি। শুয়াইব আলাইহিস সালামের জাতির নেতারা তাঁর আহ্বানের যে জবাব দিয়েছে, তাকে ছোট করে ভাব ঠিক হবেনা। বরঞ্চ তাদের বক্তব্যে ভেবে দেখার মতো বিষয় রয়েছে। মাদইয়ানের সর্দার লীডাররা মূলত একথাই বলছিল এবং জাতির লোকদের বুঝাচ্ছিল যে, শুয়াইব যে সততা ও বিশ্বস্ততার আহাবান জানাচ্ছে এবং নৈতিকতা ও সুবিচারের যেসব সুদৃঢ় নীতিমালা অনুসরণ করতে বলছে সেগুলো মেনে নিলে তো আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো। সত্য ও সততার নীতি অনুসরণ করলে এবং খাঁটি ও অকৃত্রিম লেনদেন করলে কেমন করে আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য চলতে পারে? তাছাড়া আমআ যে বিশ্ববাণিজ্যের সবচেয়ে বড় দুটি রাজপথের চৌমাথায় বাস করছি এবং মিশর ও ইরাকের মতো বিশাল সভ্য সুসংগঠিত ও উন্নত সম্রাজ্যের সীমানায় অধিবাস করছি সে হিসেবে আমরা যদি বাণিজ্য কাফেলাসমূহকে উৎপীড়ন করা বন্ধ করে দিই এবং শান্তিপ্রিং ভালো মানুষ হযে বসি, তবেতো বর্তমান ভৌগেলিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে আমরা যেসব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করছি, সেগুলো সব খতম হয়ে যাবে এবং আশেপাশের জাতিসমূহের উপর আমাদের যে প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, তা আর অবশিষ্ট থাকবেনা। এ ধরনের চিন্তা ও আচরণ কেবল শুয়াইব আলাইহিস সালামের জাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরঞ্চ সকল যুগের বিকৃত মন ও চরিত্রের লোকেরাই সত্য, সততা ও সুবিচারের নীতিকে এরকমই বিপদজনক বলে মনে করেছে। প্রত্যেক যুগের বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ধর্মীয় কার্যক্রম মিথ্যা, অসততা এবং অর্থনৈতিকতা ছাড়া চলতে পারেনা। সর্বত্রই সত্যের দাওয়াতের বিরুদ্ধে যেসব বড় বড় অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, তন্মধ্যে এটাও একটি যে, বিশ্বের প্রচলিত পথ ও পন্থা থেকে বেরিয়ে এসে যদি এই দাওয়াতের অনুসরণ করা হয় তবে তো জাতি ধ্বংস হযে যাবে।[ তাফহীমুল কুরআন: সূরা আ’রাফ : টীকা: ৭০ ও ৭৪]


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি