চতুর্থ অধ্যায়ঃ ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি ও লক্ষ্য
[আধুনিক বিশ্বের খ্যাতনামা মনিষী ও চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল আ’লা মুদূদী ১৯৬৬ সালের ১৭ই ডিসেম্বর পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত এক সেমিনারে ইসলামের অর্থব্যবস্থার উপর এক সারগর্ভ ভাষণ প্রদান করেন। এ পুস্তিকাটি তারই হুবহু বাংলা অনুবাদ।]
আমাকে বিশেষ কয়েকটি প্রশ্নের উপর আলোকপাত করার জন্য আহবান জানানো হয়েছে। আলোচনার পূর্বাহ্নেই আমি প্রশ্ন ক’টি আপনাদের শনিয়ে দিচ্ছি। তাতে আমার আলোচনর পরিসর সম্পর্কে আপনারা কিছুটা ধারণা লাভ করতে পারবেন।
প্রশ্নগুলো হচ্ছে:
এক : ইসলাম কি কোনো অর্থনৈতিক বিধান রচনা করেছে? করে থাকলে তার খসড়া পেশ করুন। উপরন্তু ভূমি, শ্রম, পুঁজি ও সংগণ ও খসড়ায় কোন্ ধরনের মর্যাদা লাভ করেছে?
দুই : যাকাত ও সাদকার অর্থ কি অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে ব্যয় করা যেতে পারে?
তিন : আমরা কি সুদহীন অর্থব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারি?
চার :

ইসলামের দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থার মধ্যে কোন্ ধরনের পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান?
এ প্রশ্নগুলোর প্রত্যেকটি বিস্তরিত আলোচনার জন্য বিরাট গ্রন্থের প্রয়োজন। কিন্তু সময় সংক্ষেপ হেতু এবং বিশেষ করে, আজকের আলোচনা সভায় উচ্চশিক্ষিত সমাজের নিকট আমার বক্তব্য উপস্থাপনার কারণে, এ প্রশ্নগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনাই আমি যথেষ্ট মনে করছি।

ইসলামী অর্থব্যবস্থার ধরন
প্রথম প্রশ্নের দু’টি অংশ রয়েছে। এক: ইসলাম কি কোনো অর্থনৈতিক বিধান রচনা করেছে? করে থাকেল তার খসড়া পেশ করুন। দুই: খসড়ায় ভূমি, শ্রম, পুঁজি ও সংগঠন কোণ্ ধরনের মর্যাদা লাভ করেছে? প্রশ্নের প্রথমাংশের বজাবে বলা যায়, ইলাম অবশ্যই একটি অর্থনৈতিক বিধান রচনা করেছে। তবে, ইসলাম প্রতি যুগের উপযোগী এমন একটি বিস্তারিক অর্থনৈতিক বিধান রচনা করেছ যেখানে অর্থনৈতিক বিধানের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়ের বিস্তারিত সমাধান দেয়া হয়েছে, এ অর্থে তা একটি অর্থনৈতিক বিধান নয়। বরং এ অর্থ হচ্ছে, ইসলাম আমাদেরকে এমন কিছু মূলনীতি দিয়েছে, যার ভিত্তিতে আমরা নিজেরািই প্রতি যুগের উপযোগী একটি অর্থনৈতিক বিধান রচনা করতে পারে। কুরআন ও হাদীস গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে ইসলামের একটি রীতি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হচ্ছে এই যে, ইসলাম জীবনের প্রতিটি বিভাগের একটি চৌহদ্দী নির্ধারণ করে দেয় এবং আমাদেরকে জানিয়ে দেয় যে, এই চতুঃসীমার মধ্যে থেকে তোমরা নিজেদের জীবনের এ বিভাগটি গড়ে তোল। এর বাইরে তোমরা যেতে পারোনা। তবে এই চতুঃসীমার মধ্যে থেকে তোমরা নিজেদের অবস্থা, প্রয়োজন ও অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে বিস্তরিত বিধান রচনা করতে পারো। ইসলাম এভাবেই ব্যক্তিগত জীবনক্ষেত্র থেকে শুরু করে সভ্যতা সংস্কৃতির সকল বিভাগে মানুষকে পথনির্দেশ দিয়েছে। পথনির্দেশের এই একই পদ্ধতি আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও অবলম্বিত হয়েছে। এখানেও ইসলাম আমাদেরকে কতিপয় মূলনীতি ও চতুঃসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এরই মধ্যে অবস্থান করে আমাদের নিজেদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামো বিনির্মাণে অগ্রসর হতে হবে এবং প্রত্যেক যুগ-সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে এ সম্পর্কিত যাবতীয় বিস্তারিত খুঁটিনাটি বিধান রচনা কাজ চালাতে হবে। অতীতে এভাবেই এ কাজ সম্পাদিত হয়ে এসেছে।
ইসলামী ফিকাহ গ্রন্থগুলি আলোচনা করলে দেখা যাবে, আমাদের ফকীহগণ এই চতুঃসীমার মধ্যে অবস্থান করেই স্ব স্ব যুগের বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি অর্থনৈতিক বিধান রচনা করেছিলেন। ফকীহগণ যে অর্থনৈতিক বিধান রচনা করেন, তা ইসলামের মূলনীতি থেকেই গৃহীত এবং ইসলাম নির্ধারিত চতুঃসীমার মধ্যে তার অবস্থান। সেসব খুঁটিনাটি বিধানগুলির যে অংশ আমাদের বর্তমান প্রয়োজন পূর্ণ করে, তা আমরা হুবহু গ্রহণ করে নেব; আর এ ছাড়া বর্তমানে আমাদের সামনে যেসব নতুন প্রয়োজন ও সমস্যা দেখা দিয়েছে, সেগুলির জন্য আমরা নতুন বিধান রচনা করতে পারি। তবে সেসব বিধান অবশ্যি ইসলাম প্রদত্ত মূলনীতি থেকে গৃহীত হতে হবে এবং ইসলাম নির্ধারিত চতুঃসীমার (Four Comers) মধ্যে সেগুলিকে অবস্থান করতে হবে।

ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌল উদ্দেশ্য
ইসলামের একটি অর্থনৈতিক বিধান রয়েছৈ। এ কথার অর্থ এখন সহজেই অনুধাবন করা সম্ভব হবে। এ ব্যাপারে ইসলাম আমাদেরকে যে মূলনীতি দিয়েছে তা বর্ণনা করার পূর্বেই আমি ইসলামী অর্থব্যবস্থার উদ্দেশ্যাবলী (Objectives) আলোচনা করতে চাই। এ উদ্দেশ্যাবলী সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকলে, ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি অনুধাবন করা, অবস্থা ও প্রয়োজনের সাথে সেগুলির সামঞ্জস্য বিধান করা এবং ইসলামী অর্থব্যবস্থার যথার্থ প্রাণসত্তা অনুযায়ী বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি বিধান রচনা করা সম্ভব নয়। এখানে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূলনীতিসমূহ পেশ করা হলোঃ

ক. ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণ

অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইসলাম মানুষের স্বাধীনতা সংরক্ষণের উপর প্রাথমিক গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং মানব জাতির কল্যাণার্থে যতটুকু অপরিহার্য কেবলমাত্র ততটুকু বিধি নিষেধই তার উপর আরোপ করেছ। ইসলাম মানুষের স্বাধীনতার উপর অনেক বেশী গুরুত্ব দান করেছে। এর কারণ হচ্ছে, ইসলামের বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে। এখানে সমষ্টিগত জবাবদিহির কোনো ধারণাই নেই। বরং প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের কাজের জন্য ব্যক্তিগত জবাবদিহির কোনো ধারণাই নেই। বরং প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের কাজের জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে দায়ী এবং ব্যক্তিগতভাবেই তার নিজের কাজের জবাব দিতে হবে। এ জবাবাদিহির জন্য মানুষের নিজস্ব ঝোঁকপ্রবণতা, যোগ্যতা ও নিজের ব্যক্তিগত নির্বাচন অনুযায়ী তার ব্যক্তিসত্তার উন্নয়নের সর্বাধিক সুযোগ থাকতে হবে। এজন্য ইসলাম ব্যক্তির নৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার সাথে সাথে তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রতিও গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। যেখানে ব্যক্তি-মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হরণ করা হয়, সেখানে তার নৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতাও বিলুপ্ত হয়। একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায়, যে ব্যক্তি নিজের অর্থনৈতিক ব্যাপারে অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সরকারের মুখাপেক্ষী, সে নিজস্ব কোনো স্বাধীন চিন্তা পোষণ করলেও তা কার্যকর করার স্বাধীনতা তার থাকে না। এ কারণে ইসলাম অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদেরকে যে নীতি দান করে, তর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে সর্বাধিক স্বাধীনতা দান করা হয় এবং কেবলমাত্র যথার্থ মানবিক কল্যাণের স্বার্থে যেটুকু অপরিহার্য, সে পরিমাণ বিধি নিষেধই তার উপর আরোপ করা হয়। এজন্য ইসলাম রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণমানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ভিত্তিতে সরকার প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী, জনগণ নিজেদের ইচ্ছামত এ সরকার পরিবর্তন করতে পারবে। জনগণের ইচ্ছা বা তাদের আস্থাভাজন প্রতিনিধিদের পরামর্শ অনুযায়ী সরকারের ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হবে। এ ব্যবস্থার সমালোচনা বা এ সম্পর্ক মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা জনগণের থাকবে। সরকার কোনো ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী হবেনা; বরং কুরআন ও সুন্নাহর উচ্চতর আইন ও বিধান তার জন্য ক্ষমতার যে সীমা নির্দেশ করেছে, তার মধ্যে অবস্থান করেই সে কাজ করে যাবে। উপরন্তু ইসলামে আল্লাহর পক্ষ থেকে জনগণকে স্থায়ীভাবে মৌলিক মানবধিকার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এগুলি অপহরণ করার অধিকার কারোর নেই। ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণ ও ব্যক্তিসত্তার উন্নয়ন রোধকারী কোনো প্রকার নির্যাতন ও একনায়কত্বমূলক ব্যবস্থা যাতে তার উপর চেপে বসতে না পারে, সে উদ্দেশ্যেই এসব ব্যবস্থাপনা গৃহীত হয়েছে।

খ. নৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতির সাঞ্জস্য

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, ইসলাম মানুষের নৈতিক বিকাশ ও অগ্রগতিকে মৌলিক গুরুত্ব দান করে। এ উদ্দেশ্যে সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তি যাতে স্বাধীনভাবে সৎকর্ম করার সর্বাধিক সুযোগ লাভ করে, তার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। এভাবে মানুষের জীবনে দয়া, প্রেম, বদান্যতা, সহানুভূতি, পরোপকার ও অন্যান্য নৈতিক গুণাবলী বিশেষভাবে স্থান লাভ করে। তাই অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম কেবলমা্রত আইন ও সংবিধানের উপর নির্ভর করেনা। বরং এ ব্যাপারে ঈমান, ইবাদত, শিক্ষা ও নৈতিক অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষের আভ্যন্তরীণ ও মানসিক সংস্কার সাধন, তার রুচি ও চিন্তাপদ্ধতির পরিবর্তন এবং তার মধ্যে এমন শক্তিশালী নৈতিক অনুভূতি সৃষ্টি করার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে যার সাহায্যে সে নিজে ইনসাফ ও ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে সক্ষম হয়। এ সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করার পরও কার্যসিদ্ধি না হলে, মুসলমানদের সমাজের অবশ্যই এতটুকুট প্রাণশক্তি থাকতে হবে যার ফলে সামাজিক চাপের মুখে মানুষকে ইসলামী বিধি বিধানের অনুগত রাখা সম্ভব হয়। এ ব্যবস্থা যথষ্ট প্রমাণিত না হলে, ইসলাম আইনের শক্তি ব্যবহার করে। এভাবে অবশেষে শক্তির সাহায্যে ইনসাফ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হয়। যে সমাজ ব্যবস্থা ইনসাফ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য কেবলমাত্র আইনের শক্তির উপর নির্ভরশীল হয় এবং মানুষকে আক্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখে স্বেচ্ছায় ন্যায়ের পথে চলার শক্তি তিরোহিত করে দেয়, ইসলাম সে ব্যবস্থাকে ভ্রান্ত ও ত্রুটিপূর্ণ মনে করে।

গ. সহযোগিতা, সামঞ্জস্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা

তৃতীয় কথা হচ্ছে, ইসলাম মানবিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের ধারক এবং নৈরাজ্য, দলাদলি ও সংঘর্ষের বিরোধী। তাই ইসলাম মানব সমাজকে শ্রেণীতে বিভক্ত করেনা এবং প্রকৃতিগতভাবে মানব সমাজে বিরাজিত শ্রেণীগুলিকে শ্রেণীসংগ্রামের পরিবর্তে সহানুভূতি ও সহযোগিতার পথে পরিচালিত করে। মানব সমাজ বিশ্লেষণ করলে এতে দু’ধরনের শ্রেণী দেখা যাবে। কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট নির্যাতনমূলক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অবৈধ ও অস্বাভাবিক পদ্ধতিতে এক ধরনের শ্রেণীর জন্ম দেয়; অতঃপর বলপূর্বক তাকে প্রতিষ্ঠিত রাখে। যেমন, ব্রাহ্মণ্যবাদ, জমিদারী ব্যবস্থা বা পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কৃত্রিম ও অস্বাভাবিক শ্রেণীর জন্ম দিয়েছে। ইসলাম নিজে এই ধরনের শ্রেণীর জন্ম দেয়না। এবং এগুলি টিকিয়ে রাখার পক্ষপাতীও ইসলাম নয়। বরং সামাজিক সংস্কার ও আইনগত পদ্ধতি অবলম্বন করে এগুলির বিলোপ সাধন করাই ইসলামের লক্ষ্য। প্রকৃতিগতভাবে মানবিক যোগ্যতা ও অবস্থার পার্থক্যের ভিত্তিতে দ্বিতীয় এক ধরনের শ্রেণীর উদ্ভব হয় এবং স্বাভাবিক পদ্ধতিতে তা পরিবর্তিত হতে থাকে। ইসলাম বলপূর্বক এই ধরনের শ্রেণীগুলির বিলোপ সাধন করেনা এবং এগুলিকে স্থায়ী শ্রেণীরূপ দানও করেনা বা এদের পরস্পরকে শ্রেণীসংগ্রামেও লিপ্ত করেনা। বরং ইসলামের নৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যমে এদের মধ্যে ইনসাফপূর্ণ ও ন্যায়ানুগ সহযোগিতা সৃষ্টি করে; তাদেরকে মাধ্যমে এদের মধ্যে ইনসাফপূর্ণ ও ন্যায়ানুগ সহযোগিতা সৃষ্টি করে; তাদেরকে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল, পরস্পরের সাহায্যকারী ও সহযোগী বানায় এবং শ্রেণী নির্বিশেষে সবার জন্য সমান সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা ক’রে এমন অবস্থার সৃষ্টি করে যার ফলে এ শ্রেণীগুলি স্বাভাবিকভাবেই একাত্ম পরিবর্তিত হতে থাকে।

ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি
এ তিনটি বিষয় দৃষ্টি সমক্ষে রাখার পরই এই অর্থনৈতিক মূলনীতির যথার্থ উপলব্ধি সম্ভবপর হবে। ইসলামী অর্থব্যবস্থার মৌল উদ্দেশ্যাবলী বর্ণনার পর এবার আমি এর মূলনীতিগুলি তুলে ধরবো।

ক. ব্যক্তিমালিকানা ও তার সীমারেখা

ইসলাম কতিপয় বিশেষ সীমারেখার মধ্যে ব্যক্তিমালিকানর স্বীকৃতি দেয়। ব্যক্তিমালিকানার ব্যাপারে উৎপাদন-উপকরণসমূহ ও নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদির মধ্যে অথবা শ্রমার্জিত আয় ও বিনাশ্রম প্রাপ্ত আয়ের মধ্যে কোনো প্রকার পার্থক্য করেনা। ইসলাম মানুষকে মালিকানর সাধারণ অধিকার দান করে; তবে তাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। ইসলামে এমন কোনো ধারণা নেই যার ভিত্তিতে উৎপাদন-উপকরণসমূহ ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মধ্যে পার্থ্যক্য সৃষ্টি করে উৎপাদন উপকরণসমূহকে ব্যক্তিমালিকানার আওতা বহির্ভূত এবং নিছক নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিকে এর আতওাভুক্ত করা যেতে পারে। ইসলামের দৃষ্টিতে এক ব্যস্তি যেমন বস্ত্র, পাত্র ও গৃহের আসবাবপত্রের অধিকারী হতে পারে; অনুরূপভাবে সে জমি, মেশিন ও কারখানারও মালিকানা লাভ করতে পারে। এভাবে এক ব্যক্তি যেমন নিজের প্রত্যক্ষ শ্রমার্জিত অর্থসম্পদের বৈধ অধিকারী হয়, তেমনি সে নিজের পিতা, মাতা, স্ত্রী বা স্বামীর পরিত্যক্ত সম্পত্তিরও মালিক হতে পারে এবং অংশীদারিত্বের নীতির ভিত্তিতে সে এমন উপার্জনেরও অংশীদার হতে পারে, যা তার মূলধন খাটিয়ে অন্য এক ব্যক্তি নিজের পরিশ্রমের মাধ্যমে উপার্জন করছে। ইসলাম উৎপাদন-উপকরণসমূহের মালিকানা বা নিত্য ব্যহার্য দ্রব্যাদির মালিকানা অথবা শ্রমার্জিত বা বিনাশ্রমে লব্ধ অর্থের মালিকানার মধ্যে পার্থক্য করেনা, বরং ইসলামে পার্থক্যের ভিত্তি হচ্ছে অর্থোপার্জনের উপায়সমূহের () বৈধতা বা অবৈধতা অথবা অর্থ ব্যবহারে হারাম বা হালাল পদ্ধতি। ইসলাম সমগ্র অর্থনৈতিক জীবনের নীলনকশা এমনভাবে তৈরী করেছে যাতে মানুষ কতিপয় সীমরারেখার মধ্যে অবস্থঅন করে স্বাধীনভাবে অর্থোপার্জন করতে পারে। ইতিপূর্বেই আমি বলেছি, ইসলামরে দৃষ্টিতে মানুষের স্বাধীনতার গুরুত্ব অপরিসীম এবং এ স্বাধীনতার ভিত্তিতেই সে মানবতার বিকাশ ও উন্নতির সগ্র প্রাসাদ নির্মাণ করে। মানুষের এ স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য অর্থনৈতিক উপায় উপকরণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার অধিকার দান অপরিহার্য। মানুষের ব্যক্তিমালিকানা অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে অর্থনীতির সমগ্র উপায় উপকরণের উপর সামষ্টিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করলে অনিবার্যভাবেই মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতার বিলুপ্ত হয়ে যায়। কারণ এ অবস্থা সৃষ্টি হবার পর, যে প্রতিষ্ঠানটি সমগ্র রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উপায় উপকরণসমূহ নিয়ন্ত্রণ করে, সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি তার কর্মচারীতে পরিণত হয়।

খ. সমবন্টন নয়, ইনসাফপূর্ণ বন্টন

সম্পদের সমবন্টনের (Equal distribution) পরিবর্তে ইনসাফপূর্ণ বন্টন (Equitable distribution) ইসলামী অর্থব্যবস্থার আরেকটি মূলনীতি। অর্থোপার্জনের উপায় উপাকরণসমূহ সমস্ত মানুষের মধ্যে সমানভাবে বন্টন করে দেয়া ইসলামের লক্ষ্য নয়। কুরআন মজীদ অধ্যয়ন করলে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হবে যে, আল্লাহর এই দুনিয়ায় কোথাও সমবন্টন নীতি কার্যকর নেই।
সমবন্টন মূলত অপ্রাকৃতিক ও অস্বাভাবিক। সকল মানুষের স্মৃতিশক্তি কি সমান? সব মানুষের কি সমান সৌন্দর্য, শক্তি যোগ্যতা-সম্পন্ন? একই ধরনের পরিবেশে ও অবস্থায় কি সকল মানুষের জন্ম হয়? দুনিয়ায় কাজ করার জন্য সবাই কি একই ধরনের অবস্থার সম্মুখীন হয়। এসব ব্যাপার সাম্য না থাকলে নিছক উৎপাদন-উপকরণসমূহ ও অর্থ বন্টনের ক্ষেত্রে সাম্যের অর্থ কি? কার্যত এরূপ সাম্য সম্ভব নয় এবং কৃত্রিমভাবে এর প্রচেষ্টা চললে অনিবার্যভাবে তা ব্যর্থ হবে; উপরন্তু এর পরিণামেও দেখা দেবে মারাত্মক পরিণতি। এজন্যেই ইসলাম অর্থনৈতিক উপায় উপকরণাদি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সুফলসমূহ সম-বন্টনের কথা বলেনা। বরং ইসলাম ইনসাফপূর্ণ বন্টনের দাবীদার। এ ইনসাফের জন্য ইসলাম কতিপয় নীতি নির্ধারণ করেছে।
এ প্রসঙ্গে প্রথম নীতি হচ্ছে, সম্পদ আহরণের উপকরণাদির মধ্যে ইসলাম হালাল ও হারামের পার্থক্যের সৃষ্টি করেছে। একদিকে ইসলাম ব্যক্তিকে স্বাধীন ও অবাধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে অর্থোপার্জনের অধিকার দান করে ও উপার্জিত সমুদয় সম্পদের উপর তার মালিকানা স্বীকার করে এবং অন্যদিকে অর্থোপার্জনের পদ্ধতিসমূহে হালাল ও হারামের সীমা নির্ধারণ করে। ইসলামী বিধান অনুযায়ী যে কোনো ব্যক্তি হালাল পদ্ধতিতে অর্থোপার্জনের পূর্ণ স্বাধীনতা রাখে। এজন্য সে নিজের ইচ্ছামত অর্থোপার্জনের যে কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারে এবং যে কোনো পরিমাণ অরথ উপার্জনও করতে পারে। সে তার এই উপার্জিত অরেথর বৈধ মালিক বলে স্বীকৃত হবে। তার এই বৈধ মালিকানা সীমিত করা বা তার থেকে এর অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার অধিকার কারো নেই। তবে হারাম পদ্ধতিতে একটি পয়সাও উপার্জন করার অধিকার তার নেই। হারাম পদ্ধতি অবলম্বন থেকে তাকে বলপূর্বক বিরত রাখা হবে। এ পদ্ধতিতে উপার্জিত অর্থের সে বৈধ মালক বলে স্বীকৃত হবে না। তার অপরাধের পর্যায়ানুসারে তাকে কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা তার ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত করার শাস্তি দেয়া যেতে পারে এবং এই অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থাও অবলম্বিত হবে।
ইসলামে যেসব পদ্ধতি ও উপায় উপকরণকে হারাম গণ্য করা হয়েছে সেগুলি হচ্ছে- আত্মসাৎ, ঘুষ, পরদ্রব্য গ্রাস, সরকারী কোষাগার থেকে আত্মসাৎ, চুরি, পরিমাণে কম করা, চারিত্রিক নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ব্যবসা, বেশ্যাবৃত্তি, মদ ও অন্যান্য মাদকদ্রব্যের শিল্প ও ব্যবসা, সুদ, জুয়া, ধাপ্পাবাজী এবং ব্যবসায়ের এমন সব পদ্ধতি যেখানে প্রতারণা ও চাপ প্রয়োগের ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালিত হয় অথবা যেগুলির মাধ্যমে কলহ, বিশৃংখলা ও বিভেদ সৃষ্টির পথ প্রশস্ত হয় এবং যেগুলি ইনসাফ, ন্যায়নীত ও গণস্বার্থ বিরোধী। ইসলাম আইন প্রয়োগ করে এসব পদ্ধতি ও উপায় উপকরণ ব্যবহার করার পথ রোধ করে। এ ছাড়াও ইসলাম মজুতদারী (Hoarding) নিষিদ্ধ গণ্য করে এবং যে ইজারাদারী কোনো প্রকার ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়াই অর্থ ও অর্থ উৎপাদনের উপকরণসমূহ থেকে সাধারণ লোকদের উপকৃত হবার সুযোগ ছিনিয়ে নেয়- তার পথও রুদ্ধ করে।
এ পদ্ধতি ও উপায় উপকরণগুলি বাদ দিয়ে বৈধ উপায়ে মানুষ যে সম্পদ অর্জন করে, তা হালাল উপার্জনের অন্তর্ভুক্ত। এ হালাল সম্পদ সে নিজে ভোগ করতে পারে; উপহার, দান বা অন্যবিধ পদ্ধতিতে অন্যের নিকট স্থানান্তরও করতে পারে; এমনকি, অধিক সম্পদ আহরণের জন্যও ব্যবহার করতে পারে এবং নিজের উত্তরাধিকারীদের জন্য মীরাস হিসেবেও রেখে যেতে পারে। এই বৈধ উপার্জনের উপর এমন কোনো বিধি নিষেধ আরোপিত নেই, যার সাহায্যে কোনো এক পর্যায়ে পৌছে তাকে আরো উপার্জন থেকে বিরত রাখা যেতে পারে। কোনো ব্যক্তি হালাল উপার্জনের মাধ্যমে কোটিপতি হয়ে গেলে ইসলাম তার পথে প্রতিবন্ধক হবে না। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সে ইচ্ছামত উন্নতি লাভ করতে পারে, তবে এ উন্নতি তাকে বৈধ উপায়ে লাভ করতে হবে। অবশ্যি বৈধ উপায়ে কোটিপতি হওয়া সহজসাধ্য নয়, এটা বিরল ঘটনা। কোনো অসাধারণ ব্যক্তিত্ব কখনো কখনো আল্লাহর এ অনুগ্রহ লাভ করতে পারে। নচেৎ বৈধ উপায় অবলম্বন করে কোটিপতি হবার অবকাশ কমই থাকে। কিন্তু ইসলাম কাউকে বেঁধে রাখেনা। হালাল উপায়ে সে যত অধিক সম্পদ চায় আহরণ করতে পারে। তার পথে কোনো বাধা নেই। কারণ অনর্থক বাধা নিষেধ ও প্রতিবন্ধকতার কারণে কর্মপ্রেরণা (Incentive) খতম হয়ে যায়।
এভাবে বৈধ ও হালাল উপায়ে যে সম্পদ অর্জিত হয় ইসলামে তার ব্যবহারের উপরও বিধি নিষেধ করা হয়েছে।
প্রথমত, এ সম্পদ মানুষ নিজের জন্য ব্যয়ঢ করতে পারে। এ ব্যয়কে ইসলাম এমনভাবে সংযত করে যার ফলে তা মানুষেল নিজের চরিত্র ও সমাজের জন্য কোনোক্রমেই ক্ষতিকর হতে পারে না। সে মদপান করতে পারবে না। ব্যভিচার করতে পারবেনা। জুয়াবাজীতে নিজের সম্পদ উড়িয়ে দিতে পারবেনা। নৈতিকতা বিরোধী পন্থায় বিলাসব্যসনে ব্যয় করতে পারবে না। সোনা রূপার পাত্র ব্যবহার করতে পারবেনা। এমনকি বসবাসের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জাঁকজমকের আশ্রয় নিলে তার উপর অবশ্যি বিধি নিষেধ আরোপ করা হবে।
দ্বিতীয়ত, এ সম্পদের কমবেশী কোনো অংশ মানুষ মওজুদ করে রাখতে পারে। কিন্তু ইসলাম এ প্রবণতা পছন্দ করেনা। ইসলাম মানুষের অতিরিক্ত সম্পদ মজুত রাখার পরিবর্তে বৈধ পদ্ধতিতে তাকে আবর্তিত করতে চায়। একটি বিশেষ আইন অনযায়ী ইসলাম সঞ্চিত সম্পদ থেকে যাকাত আদায় করে। ফলে এর একটা বিশেষ আইন অনুযায়ী ইসলাম এ সঞ্চিত সম্পদ থেকে যাকাত আদায় করে। ফলে এর একটা অংশ বঞ্চিত শ্রেণীর স্বার্থে ও সামিষ্টিক কল্যাণে ব্যবহৃত হতে পারে। কুরআন মজীদে যেসব কাজকে সবচেয়ে কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে, মানুষের সম্পদ মওজুদ করার প্রচেষ্টা তন্মধ্যে অন্যতম। কুরআন বলে: ‘যারা সোনা ও রূপা জমা করে তাদের সংরক্ষিত সোনা ও রূপা জাহান্নামে তাদের দাগ দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হবে।” এর কারণ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা মানুষের উপকারের জন্য অর্থসম্পদ সৃষ্ট করেছেন; কাজেই একে আটকে রেখে মানুষের উপকারের পথ রুদ্ধ করার অধিকার কারো নেই। বৈধ ও হালাল উপায়ে অর্থসম্পদ উপার্জন করুন, নিজের প্রয়োজনে তা ব্যয় করুন; অতঃপর অবশিষ্ট যা থাকে বৈধ পদ্ধতিতে আবর্তন করাতে থাকুন।
এজন্য ইসলাম মজুতদারী উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। মজুতদারীর অর্থ হচ্ছে উদ্দেশ্যমূলতভাবে নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি বাজারে সরবরাহ করে যায় এবং দাম বেড়ে যায়। ইসলামী আইন এ ধরনের কাজকে হারাম গণ্য করে। কেো ঘোরপ্যাঁচে না গিয়ে সোজাসোজি ব্যবসা চালাতে হবে। ব্যবসায়ীর নিকট বিক্রয়যোগ্য পণ্য থাকলে এবং বাজারে তার চাহিদা থাকলে, তা বিক্রয় করতে অস্বীকার করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। জেনে বুঝে নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদির অভাব সৃষ্টি করার জন্য তা বিক্রয়ের অসম্মাতি জ্ঞাপন করা অন্যায়। এটা মানুষকে ব্যবসায়ী নয় ডাকাতে পরিণত করে।
এ কারণে ইসলাম অস্বাভাবিক ধরনের ইজারাদারীরও বিরোধী। কারণ এ ধরনের ইজারাদারী সাধারণ মানুষের পক্ষে অর্থোপার্জনের উপায় উপকরণাদি ব্যবহারের পথে বাধার সৃষ্টি করে। ইসলাম অর্থোপার্জনে বিশেস বিশেষ সুযোগ সুবিধা ও উপায় উপকরণ কতিপয় ব্যক্তি, বংশ বা শ্রেণীর জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া এবং এক্ষেত্রে অন্যদের অগ্রসর হবার পথ রোধ করারেক কোনোক্রমেই বৈধ গণ্য করেনা। সমষ্টিগত স্বার্থে যে ইজারাদারী একান্ত অপরিহার্য দাড়ায় একমাত্র এই ধরনের ইজারাদারী বৈধতা ইসলামে স্বীকৃত। অন্যথায় নীতিগতভাবে ইসলাম অবাধ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা এবং সবাইকে নিজের যোগ্যতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী প্রচেষ্টা চালাবার সমান সুযোগ দেয়ার পক্ষপাতী।
অতিরিক্ত অর্থসম্পদ ব্যবহার করে যদি কোনো ব্যক্তি আরও হালাল অর্থ উপার্জন করতে চায়, তাহলে তাকে অর্থোপার্জরে জন্য ইসলাম নির্ধারিত হালাল পদ্ধততেই তা করতে হবে। আমি ইতিপূর্বে অর্থোপার্জনে যেসব হারাম পদ্ধতির বর্ণনা দিয়েছি, সেগুলি অবলম্বন করা যাবে না কোনোক্রমেই।

গ. ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার

অতঃপর ইসলাম ব্যক্তির সম্পদের উপর সমষ্টির অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে এবং এজন্য বিভিন্ন অবলম্বন করে। কুরআন মজীদে নিকট-আত্মীয়দের অধিকার বর্ণনা করা হয়েছে। এ অর্থ হচ্ছে, কোনো ব্যক্তির উপার্জিত অর্থের উপর সে ছাড়াও তার আত্মীয় স্বজনের অধিকার দেয়া হয়েছে। সমাজের কোনা ব্যক্তি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের অধিকারী হয় এবং তার আত্মীয়দের কেউ প্রয়োজনের চেয়ে কম সম্পদ উপার্জন করে, তাহলে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সে আত্মীয়কে সাহায্য করা তার সামাজিক দায়িত্ব। সমাজের প্রতিটি ব্যক্তির উপর দায়িত্ব বর্তায়। কোনো জাতির অন্তর্ভুক্ত এক একটি পরিবার যদি নিজেদের এ দায়িত্ব অনুভব করে এবং সামগ্রিকভাবে জাতির অধিকাংশ পরিবর যদি নিজেদের এ দায়িত্ব অনুভব করে এবং সামগ্রিকভাবে জাতির অধিকাংশ পরিবারকে সহায়তা দানের ব্যবস্থা করে, তাহলে বাইরের সাহায্যের মুখাপেক্ষী পরিবারের সংখ্যা হয়তো অতি অল্পই থেকে যাবে। এজন্যই কুরআন মজীদে বান্দার হকের মধ্যে সর্বপ্রথম মা, বাপ ও আত্মীয়স্বজনের হকে উল্লেখ করা হয়েছে।
অনুরূপভাবে কুরআন ব্যক্তির সম্পদের উপর তার প্রতিবেশীদের অধিকারও প্রদান করেছে। এর অর্থ হচ্ছে, প্রত্যেক পাড়ায়, মহল্লায়, অলিগলিতে তুলনামুলকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিদের উচিৎ সংশ্লিষ্ট পাড়া, মহল্লা ও গলির অসচ্ছল লোকদেরকে সহায়তা দান করা।
এই দ্বিবিধ দায়িত্বের পর কুরআন মজীদে সাহায্যের মুখাপেক্ষী বা সাহায্যপ্রার্থীকে নিজের সামর্থানুযায়ী সাহায্য করার জন্য প্রত্যেক সচ্ছল ব্যক্তির উপর দায়িত্ব অর্পণ করে।
(মানুষের ধনসম্পদে প্রার্থীত ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।) যে ব্যক্তি আপনার নিকট সাহায্য সহায়তা প্রার্থনা করে সে হচ্ছে প্রার্থী। সে দ্বারে দ্বারে ভিখ, মেগে বেড়ায় এবং ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে তাকে প্রারথ বলা যায়না। বরং যথার্থ প্রার্থ এমন ব্যক্তিকে বলা যেতে পারে, যে সত্যিকার অভাবী এবং তার অভাব পূরণের জন্য আপনার দ্বারস্থ হয়। অবশ্যি সে যথর্থ অভাবী কিনা এ ব্যপারে নিজের সল প্রকার সন্দেহ নিরসনের জন্য তার অবস্থা জানার অধিকার আপনার রয়েছে। কিন্তু সে যথার্থ অভাবী একথা আপনি যখন জানতে পারেন এবং তাকে সাহায্য দেয়ার মত প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদও যদি আপনর থকে, তাহলে জেনে রাখুন আপনার ধনসম্পদে তার অধিকার রয়ে গেছে। আর বঞ্চিত বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝায় যে আপনার নিকট সাহায চাইবে আসে না; কিন্তু সে নিজের জীবিকা সংস্থান করতে পারে না একথা আপনি জানেন। আপনার অর্থসম্পদে এহেন ব্যক্তিরও অধিকার রয়েছে।
এ অধিকারগুলো ছাড়াও ইসলাম মুসলমানদেরকে আল্লাহর পথে দান করার সাধারণ নির্দেশ দিয়ে তাদের অর্থস্পদে সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রের অধিকারও কায়েম করেছে। এর অর্থ হচ্ছে, মুসলমানকে দানশীল, উদার হৃদয়, সহানুভূতিশীল ও মানব-দরদী হতে হবে।
স্বার্থসিদ্ধির প্রবণতা পরিহর করে নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে প্রতিটি সৎকাজে এবং ইসলাম ও সমাজের বিভিন্ন প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য অর্থ ব্যয় করতে হবে। এটি একটি প্রচণ্ড শক্তিশালী নৈতিক শক্তি। ইসলাম শিক্ষা ও অনুশীলনের মাধ্যমে এবং ইসলামী সমাজে সামষ্টিক পরিবেশের সাহায্যে প্রতিটি মুসলমানের মধ্যে এ নৈতিক বল সৃষ্টি করতে চায়। এভাবে কোনো প্রকার বল প্রয়োগ ছাড়াই হৃদয়ের ঐকান্তিক ইচ্ছায় মানুষ সমাজকল্যাণে সায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করবে।

ঘ. যাকাত

এই স্বেচ্ছাপ্রণদিত দানের পর ইসলাম আর একটি দানকে অপরিহার্য করে দিয়েছে। সেটি হচ্ছে যাকাত। সঞ্চিত ও সংরক্ষিত অর্থ, ব্যবসার পণ্য, বিভিন্ন ধরনের ব্যবা, কৃষিজাত দ্রব্য ও গবাদি পশুর উপর যাকাত ধার্য করা হয়। এই যাকাতলব্ধ অর্থের সাহায্যে অর্থের সাহায্যে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনগ্রসর লোকদের সহায়তা দান করা হয়। এই দু’ধরনের ব্যয়কে নফল নামাও ও ফলয নামাযের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। নফল নাময যত ইচ্ছা পড়তে পারেন। ইচ্ছামত আত্মিক উন্নতি লাভ করতে পারেন। যত বেশী আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চান, তত বেশী নামায পড়ুন। তবে ফরয নামায অবশ্যি পড়তে হবে। আল্লাহর পথে ব্যয় করা ব্যাপারটিও এই একই পর্যয়ভুক্ত। এক প্রকার ব্যয় নফল শ্রেণীভুক্ত- নিজরে ইচ্ছামত তা করতে পারেন। কিন্তু অন্যপ্রকার ব্যয় ফরযের অন্তর্ভুক্ত। একটি বিশেষ পরিমাণের অধিক অর্থের মালিক হলে এ ব্যয় করা আপনার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
যাকাত কোনো ট্যাক্স নয়। এ ব্যাপারে কোনো প্রকার ভুল ধাণা থাকা উচিত নয়। আসলে এটি একটি ইবাদত এবং নামাযের ন্যায় ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। যাকাত ও ট্যাক্সের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। ট্যাক্স মানুষের উপর জোরপূর্বক বসানো হয়। তাই মানুষ তাকে সানন্দে গ্রহণ করে নেবে এমন কোনো কথা নেই। ট্যাক্স ধার্যকারীদের কোনো ভক্ত-অনুরক্ত হয় না। তাদের কাজের সত্যতার উপর কেউ ঈমান আনে না। তাদের চাপানো এই বোঝাকে সবাই জোরপূর্বক আদায়কৃত জরিমানা মনে করে। এই ট্যাক্সের উপর তারা নাসিকা কুঞ্চন করে। এর হাত নিষ্কৃতি লাবের জন্য তারা হাজারো বাহানা তালাশ করে। ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু এর ফলে তাদের ঈমানের মধ্যে কোনো প্রকার পার্থক্য সূচিত হয় না। এ ছাড়াও এ দু’য়ের মধ্যে নীতিগত পার্থক্য রয়েছে, তা হচ্ছে এই যে, ট্যাক্সের সাহায্যের এমনসব ব্যয় নির্বাহ করা হয় যা থেকে ট্যাক্সদাতা নিজেও লাভবান হয়। ট্যক্সের পিচনে যে মৌলিক চিন্তা কার্যকর রয়েছে তা হচ্ছে, আপনি যেসব সযোগ সুবিধার প্রয়োজন বোধ করেন এবং সরকারের মাধ্যমে যেগুলো লাভ করার ইচ্ছা পোষণ করেন, সেগুলো লাভ করার জন্য আপনার আর্থিক সামর্থানুযায়ী সরকারকে চাঁদা দিন। এ ট্যাক্স আসলে প্রার্থিতা সামষ্টিক সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে আপনার নিকট থেকে আইনের বলে গৃহীত এক ধরনের চাঁদার শামিল- এ সুযোগ সুবিধার দ্বারা সামাজের অন্যদের ন্যায় আপনিও লাভবান হন। বিপরীত পক্ষে যাকাত সুবিধার দ্বারা একটি ইবাদত মাত্র। মানুষের কোনো পার্লামেন্ট বা আইন পরিষদ যাকাত ধার্য করেনি বরং আল্লাহ নিজের ঈমান সংরক্ষণ করতে চায়, সে কখনো যাকাত ফাঁকি দেয়া বা তর থেকে নিষ্কৃতি লাভের চেষ্টা করতে পারে না। বরং তার নিকট থেকে হিসেবে নেয়া এবং যাকাত আদায় করার জন্য বাইরের কোনো শক্তি না থাকলেও সে নিজের মন ও ঈমানের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে নিজের সম্পদের যথার্থ হিসেব করে এবং তার যাকাত বের করে দেয়। উপরন্তু যেসব সামাজিক প্রয়োজন পূর্ণ হওয়ার সাথে আপনার স্বার্থ বিজড়িত এবং যেগুলি দ্বারা আপনি নিজও লাভবান হন, সেগুলো পূর্ণ করার জন্য যাকাত গ্রহণ করা হয় না, বরং এমনসব লোকের জন্য এ যাকাত গ্রহণ করা হয়, যারা কোনো কোনো ভাবে অর্থবন্টন ব্যবস্থায় নিজেদের অংশ পায়নি বা পূর্ণরূপে পায়নি এবং কোনো কারণে সাময়িক বা স্থায়ীভাবে সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়েছে। এভাবে দেখা যায় প্রকৃতি, মূলনীতি, মৌল প্রাণসত্তা ও আকার আকৃতির দিক দিয়ে যাকাত ট্যাক্স থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। দেশের পথ-ঘাট ও রেললাইন নির্মাণ, খাল খনন এবং আইন ও শাসন বিভাগ পরিচালনার জন্য এ অর্থ ব্যবহার করা হয় না। বরং কতিপয় বিশেষ হকদারের হক আদায় করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ইবাদত হিসেবে একে ফরয করা হয়েছে। এটি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতের প্রতিদান লাভ ছাড়া এর থেকে আপনি দুনিয়ার আর কোনো প্রকার লাভবান হতে পারবেন না।
অনেকে এ ভুল ধারণা পোষণ করেন যে, ইসলামের যাকাত ও খারাজ ছাড়া কোনো প্রকার ট্যাক্স নেই। অথচ রাসূলুল্লাহ (সা) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন: ‘ধনসম্পদে যাকাত ছাড়াও আর একটি হক রয়েছে।’ আসলে ইসলামী শরীয়ত যে ট্যাক্সগুলোকে অবৈধ গণ্য করেছে সেগুলো হচ্ছে কাইসার ও কিসরা এবং রাজা বাদশাহ ও আমীর উপরাহগণ কর্তৃক ধার্যকৃত ট্যাক্স, যেগুলোকে তাতরা নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করে নিয়েছিল এবং জনগণের সম্মুখে তার আয় ব্যয়ের হিসাব পেশ করা নিজেদের দায়িত্ব মনে করতো না। তবে পরামর্শ ভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিচালিত সরকার জনগণের ইচ্ছা ও পরামর্শক্রমে যেসব ট্যাক্স ধার্য করে এবং এ খাতে সংগৃহীত সমুদয় অর্থ সর্বসাধাণের উদ্দেশ্যে গঠিত সরকারী তহবিলে জমা রাখে, জনগণের পরামর্শানুযায়ী তা ব্যয় করে এবং সরকার জনগণের সম্মুখে তার হিসেব দয়ের ব্যাপারে শরীয়ত অবশ্যি কোনো বিধি নিষেধ আরোপ করেনি। ইসলামী রাষ্ট্রু প্রতিষ্ঠা পূর্বে সমাজে যদি কোনো প্রকার অস্বাভাবিক রকমের অর্থনৈতিক পার্থক্য সৃষ্টি হয়ে গিয়ে থাকে অথবা একদল লোক হারাম পদ্ধতিতে সম্পদের পাহাড় গড়ে থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে ইসলামী সরকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার পরিবর্তে ট্যাক্স বসিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারসাম্য সৃষ্টি এবং অন্যান্য ইসলামী আইন প্রয়োগ করে শাসকগণকে এমনসব একনায়কত্বূমূলত ক্ষমতা দান করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে, যেসব ক্ষমতা লাভ করার পর কোনো এক পর্যায়ে তাদের কে নিয়ন্ত্রিত করা আর সম্ভ হয় না। ফলে এর যুলমের পরিবর্তে তার চেয়ে ভয়াবহ যুল্মের প্রতিষ্ঠা হয়।

ঙ. উত্তরাধিকার আইন

এ ছাড়াও ইসলামে একটি উত্তরাধিকার আইনও রয়েছে। কোনো ব্যক্তি কমবেশী যে পরিমাণ সম্পদ সম্পত্তি রেখে মারা যাক না কেন একটি নির্দিষ্ট বিধান অনুযায়ী তাকে বিস্তৃততর ক্ষেত্রে ছড়িযে দেয়াই এর উদ্দেশ্য। সর্বপ্রথম পিতামাতা, স্ত্রী ও ছেলে মেয়েরো সম্মাত্তির অধিারী হয়, অতঃপর ভাইবোনেরা হয় উত্তরাধিকারী এবং তাদের পর হয় নিকটবর্তী আত্মীয়স্বজন। যদি কোনো ব্যক্তি মারা যায় এবং তার কোনো পর্যায়ের কোনো উত্তরাধিকারী না পাওয়া যায়, তাহলে সমগ্র জাতিই তার উত্তরাধিকারী হবে এবং তার সম্পত্তি বায়তুল মালের অন্তর্ভুক্ত হবে।
আমাদের অর্থনৈতিক জীবনের জন্য ইসলাম উল্লিখিত মূলনীতি ও চতুঃসীমা নির্ধারণ করেছে। এ চতুঃসীমার মধ্যে পুর্বোল্লেখিত মূলনীতিগুলোর ভিত্তিতে আপনার নিজেদের জন্য ইচ্ছামত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে পারেন। যুগসম্যা ও প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতি যুগে একে বিস্তারিত রূপ দান আমাদের নিজেদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের যে দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে এবং যে বিষয়গুলো অবশ্যি মেনে চলতে হবে তা হচ্ছে, আমরা অবশ্যি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ন্যায় একটি লাগামহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি না। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রের ন্যায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমগ্র উপায় উপকারণকে সমষ্টি, তথা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে আনতে পারি না। আমাদেরকে একটি চতুঃসীমার মধ্যে অবস্থান করে এমন একটি স্বাধীন ও মুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে- যেখানে মানুষের নৈতিক উন্নয়নের পথ উন্মুক্ত থাকবে, সমষ্টির কল্যাণ সাধনের জন্য মানুষকে আইনের গিড়ে বাঁধবার প্রয়োজন অতি অল্পই অনুভূত হবে, যেখানে ভ্রান্ত পদ্ধতিতে অস্বাভাবিক শ্রেণী বিভাগের অবকাশ থাকবে না এবং স্বাভাবিক শ্রেণীগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের পরিবর্তে সহযোগিতার পথ উন্মুক্ত হবে। অর্থ উৎপাদনের যেসব উপায় উপকরণকে ইসলাম গণ্য করেছে, এ ব্যবস্থায় সেসবই হারাম বিবেচিত হবে এবং যেগুলোকে ইসলাম বৈধ গণ্য করেছে একমাত্র সেগুলোই বৈধ থাকবে। বৈধ পদ্ধতিতে অর্জিত সমুদয় সম্পদরে উপর ব্যক্তির ইসলাম প্রদত্ত মালিকানা ও ব্যবহারের অধিকার স্বীকৃত হবে। সম্পদের উপর অবশ্যি যাকাত ধার্য করা হবে এবং যারা নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী তাদের নিকট থেকে অপরিহার্যরূপে যাকাত আদায় করা হবে। এছাড়া উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী মীরাস বন্টন করা হবে। সীমারেখার মধ্যে ব্যক্তিকে অর্থনৈতিক প্রচেষ্টা ও প্রতিযোগিতা চালাবার পূর্ণ সুযোগ দান করা হবে এবং তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা হবে। এ স্বাধীন ও অবাধ প্রতিযোগিতা প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে মানুষ নিজেই যদি ইনসাফ ও ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে, তাহলে আইন সেখানে অনর্থক মাথা ঘামানো প্রয়োজন বোধ করববে না। কিন্তু যদি তারা ইনসাফ ও ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত না থাকে অথবা বৈধ সীমারেখা অতিক্রম করে এবং অস্বাভাবিক ধরনের মজুতদারী প্রভৃতির পথ প্রশস্ত করতে থাকে, তাহলে তাদের মৌলিক অধিকারসমূহ হরণ করা ও স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য নয় বরং নিছক ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত রাখা এবং সীমাতিক্রম করার প্রবণতা রোধ করার জন্য আইন অবশ্যি কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
এ পর্যন্ত আলোচনায় প্রথম প্রশ্নের প্রথমাংশের জবাব শেষ হয়েছে। এবার প্রশ্নের দ্বিতীয়াংশের আলোচনায় আসুন। এখানে বলা হয়ছে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চমি, শ্রম, পুঁজি ও সংগঠন কোন্ ধরনের মর্যাদা লাভ করেছে?

শ্রম, পুঁজি ও সংগঠনের মর্যাদা
এ বিষয়ে যথার্থ জ্ঞান লাভ করার জন্য আমি আপনাদেরকে ইসলামী ফিকাহশাস্ত্রের বর্ণিত মুযারিয়াত (ভাগচাষ) ও মুদারিবাত (অংশীদার ভিত্তিক ব্যবসা) সংক্রান্ত আইনগুলো পাঠ করার পরামর্ষ দিতে চাই। আধুনিক অর্থনৈতিতে এবং অর্থনীতি সংক্রান্ত গ্রন্থসমূহে জমি, শ্রম, পুঁজি ও সংগঠনকে যে ধরনের অর্থনৈতিক উপকরণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে ইসলামী ফিকাহর পুরাতন গ্রন্থসমূহে ঠিক সেভাবে সেগুলো বিবৃত হয়নি এবং সেসব বিষয়ের উপর পৃথক পৃথক গ্রণ্থও রচিত হয়নি। ইসলামী ফিকাহর বিভিন্ন অধ্যায়ে এসব বিষয়ে আলাচিত হয়েছে, কিন্তু এগুলোর পরিভাষা বর্ণনাভংগি আধুনিক অর্থনীতির পরিভাষা ও বর্ণনাভংগি থেকে আলাদা। তবে যে ব্যক্তি পরিভাষা ও বর্ণনাভংগির দাস নয়, বরং অর্থনীতির আসল বিষয়বস্তু ও সমস্যাবলী সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী, সে অতি সহজেই ইসলামী ফিকাহর অর্থনৈতিক আলোচনার ধারা অনুধাবন করতে সক্ষম হবে। ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রে মুযারিয়াত ও মুদারিবাত সম্পর্কে যেসব বিধান লিপিবদ্ধ হয়েছে, তা পর্যালোচনা করলে জমি, শ্রম, পুঁচি ও সংগঠন সম্পর্কিত ইসলামের দৃষ্টিভংগি পুরোপুরি সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। মুযারিবাত বলতে এমন এক ধরনের কৃষিব্যবস্থা বুঝায় যেখানে এক ব্যক্তি জমির মালিক এবং অন্য এক ব্যক্তি তাতে চাষাবাদ করে। এ জমির ফসল থেকে উভয়েই অংশ লাভ করে। আর মুদারিবাত বলতে এমন এক ধরনের ব্যবসাকে বুঝায় যেখানে এক ব্যক্তির পুঁজি নিয়ে অন্য ব্যক্তি ব্যবসা চালায় এবং কারবারের মুনাফায় উভয়েই অংশীদারি হয়। লেনদেনের এ সকল ক্ষেত্রে ইসলাম যেভাবে জমি ও পুঁজির মালিক এবং চাষী ও উদ্যোক্তার অধিকার স্বীকার করেছে তা থেকে পুঁজি ও এর সঙ্গে মানুষ নিজের যে শ্রম ও সাংগঠনিক যোগ্যতা যুক্ত করে এ সবই উৎপাদনের উপাদনরূপে স্বীকৃত। এসব উপাদন তাদের কর্মক্ষমতার মাধ্যমে মুনাফায় নিজেদের অংশীদারিত্ব সৃষ্টি করে। প্রাথমিক অবস্থায় ইসলাম এসব বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে অংশীদারিত্বের সম্পর্কের ব্যাপারটি প্রচলিত রীতির উপর ছেড়ে দেয়। কারণ প্রচলিত পদ্ধতিতে মানুষ নিজেরাই যদি নিজেদের মধ্যে ইনসাফ করে সেখানে আইনের হস্তক্ষেপের কোনো প্রয়োজন থাকে না। কিন্তু যদি কোনো ব্যাপারে ইনসাফ না হয়, তাহলে অবশ্যি ইনসাফের সীমা নির্ধারণ করা আইনের দায়িত্ব হিসেবে গণ্য হবে। যেমন মনে করুন, আমি একজন জমির মালিক এবং আমি আমার জমি একজন কৃষককে বর্গা দিলাম বা আমার জমিতে এক কৃষককে পারশ্রমিকের বিনিময়ে কৃষিকাকে নিযুক্ত করলাম অথবা কাউকে জমি ঠিকে দিলাম। এসব ক্ষেত্রে যদি প্রচলিত রীতি অনুসারে ন্যায়নিষ্ঠার সাথে শর্তাবলী স্থিরীকৃত হয়, তাহলে এক্ষেত্রে আইনের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। তবে যদি এখানে কোনো বেইনসাফী হয়, তাহলে অবশ্যি সেক্ষেত্রে আইনে র হস্কক্ষেপ অপরিহার্য হবে। দেশের সংবিধানে এ উদ্দেশ্যে কৃষি সংক্রান্ত ধারা সন্নিবেশ করা যেতে পারে। ভাগাচাষী, ভূমি শ্রমিক বা ভূমি মালিক কারো স্বার্থ যাতে বিঘ্নিত না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। অনুরূপভাবে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে যতক্ষণ পুঁজির মালিক এবং ব্যবসায়ে পরিশ্রমকারী ও সংগঠনকারীর মধ্যে ন্যায়নীতি সহকারে ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পাদিত হতে থাকবে এবং কেউ কারোর হক মারার চেষ্টা করবে না বা কারের উপর অত্যাচার করবে না, ততক্ষণ আইন সেখানে হস্তক্ষেপ করবে না। তবে এসব ব্যাপারে কোনো পক্ষ যদি কোনো প্রকার বেইনসাফী করে, তাহলে সেক্ষেত্রে আেইন কেবল হস্তক্ষেপ করারই অধিকারী হবে না, বরং পুঁজি, শ্রম ও সংগঠন সবাই যাতে ব্যবসায়ের মুনাফার ন্যয়ানুগ অংশ লাভ করতে পারে সেজন্য ইনসাফপূর্ণ বিধি বিধান প্রণয়ন তার দায়িত্ব বিবেচিত হবে।

যাকাত ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন
দ্বিতীয় প্রশ্নে বলা হয়েছে, যাকাত ও সাদকাকে অর্থনৈতিক কল্যাণ ও উন্নয়নে ব্যবহার করা যায় কিনা। এ প্রশ্নের জবচাবে বলা যায়, যাকাত ও সাদকার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধন করা। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি কথা গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে, তা হচ্ছে, অর্থনৈতিক কল্যাণ ও উন্নয়ন বলতে যদি সারাদেশ ও সমগ্র জাতির কল্যাণ ও উন্নয়ন বুঝানো হয়, তাহলে এ উদ্দেশ্য যাকাত ও সাদকার ব্যবহার বৈধন নয়। যাকাতের ব্যবাহর সম্পর্কে আমি ইতিপূর্বেই আলোচনা করেছি। সমাজের কোনো ব্যক্তি যাতে তার মৌলিক মানবিক প্রয়োজন- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও সন্তানদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না থাকে, যাকাত মূলত সেদিকেই ‍দৃষ্টি রাখবে। এছাড়া যাকাতের সাহায্যে আমরা সমাজের এমন এক শ্রেণীর অর্থনৈতিক প্রয়োজন মিটাতে পারি যারা অর্থোপার্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালাবার যোগ্যতা রাখে না। এতীম শিশু, বৃদ্ধ, পঙ্গু, অক্ষম বা সাময়িকভাবে বেকার অথবা সুযোগ ও উপায় উপকরণের স্বল্পতা হেতু যারা অর্থোপার্জনের চেষ্টা করতে পারছে না এবং সামান্য সাহায্য সহায়তা লাভ করলে আত্মনির্ভরশীল হতে পারে বা যারা ঘটনাক্রমে কোনো ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হযেছে- এ ধরনের লোকদের সাহায্য সহায়তা দান করার জন্য যাকাত ধার্য করা হয়েছে। আর সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নেসর জন্য যাকাত চাড়া অন্যান্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে।

সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থা
তৃতীয় প্রশ্নে বলা হয়েছৈ, আমরা কি সুদবিহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করতে পারি। এর জবাবে বলা যায়, অবশ্যি করতে পারি। ইতিপূর্বে কয়েকশ’ বছর পর্যন্ত এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল। আর আজ যদি আপনি অন্যের অন্ধ অনুসৃতি ত্যাগ করে যথার্থই এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংকল্প নেন, তাহলে তা আদৌ কোনো কঠিন কাজ নয়। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আধুনিক বিশ্বের ন্যায় সুদের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছিল। ইসলাম এ ব্যবস্থঅর পরিবর্তন সাধন করে এবং সুদকে হারাম করে দেয়। প্রথম আরবে সুদ হারাম হয়, অতঃপর যেখানেই ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় সেখানেই সুদ হারাম হতে থাকে। সমগ্র অর্থনীতি ‍সুদ ছাড়াই চলতে থাকে। শত শত বছর ধরে এ ব্যবস্থা দুনিয়ার বুকে পরিচালিত হয়েছে এবং বর্তমানেও এর জীবনীশক্তির অভাবের কোনো কারণ দেখা যায় না। যদি আমাদের মধ্যে ইজতিহাদের শক্তি থাকে এবং আমরা ঈানী শক্তিতে বলীয়ান হই ও ইইসঙ্গে যে বস্তুকে আল্লাহ হারাম গণ্য করেছেন তাকে হারাম করার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে পারি, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আমরা আজ সুদের বিলোপ সাধন করে ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করতে পারি। আমার ‘সুদ’ গ্রন্থে আমি এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এ ব্যাপারে বিশেষ কোনো জিটিলতা নেই বলে আমি সেখানে দেখিয়েছি। বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। পুঁজি নিয়ে যারা কারবারে খাটাচ্ছে ও পরিশ্রম করছে এবং সাংগঠনিক তৎপরতা ও কার্যাদি চালিয়ে যাচ্ছে তারা মুনাফা অর্জন সফল হোক বা না হোক সেদিকে দৃষ্টি না রেখে, ঋণের আকার কারবারে পুঁজি লগ্নি করা এবং নির্ধারিত হারে মুনাফা অর্জন করার কোনো অধিকার নেই। সুদের আসল অনিষ্টকারিতা হচ্ছে যে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজের পুঁজি শিল্প-কারখানা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অথবা কৃষিফার্মে ঋণ আকারে লগ্নি করে এবং পূর্বাহ্নেই এর ‍উপরে নির্দিষ্ট হারেত মুনাফা স্থিরকৃত করে নেয়। পুঁজি লগ্নি কারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কারবারে লাভ হয়েছে। বা লোকসান হয়েছে অথবা কি পরিমাণ লাভ বা লোকসান হয়েছে তার কোনো পরোয়াই করে না। সে কেবল বছরে বঝছরে বা মাসে মাসে নির্দিষ্ট হারে মুনাফা আদায় করেই যাবে এবং এই সঙ্গে আসল ফিরে পাওয়ারও অধিাকারী হবে। এ যুল্‌ম আমারেদকে খতম করতে হবে। বিশ্বের কেউ সুদের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারেনি। এ বৈধতার কোনো কারণ পেশ করা যেতে পারে না। পক্ষান্তরে ইসলামের নীত হচ্ছে যে, আপনি ঋণ দেন, তাহলে ঋণের আকারেই তা দিতে হবে। এক্ষেত্রে কেবলমাত্র নিজের ঋণবাবদ প্রদত্ত অর্থ ফেরত নেয়ার অধিকর আপনারে থাকবে। আর যদি আপনি মুনাফা অর্জন করতে চান, তাহলে সোজাসুজি আপনাকে কারবারে অংশীদার হতে হবে এবং সেভাবেই চুক্তি করতে হবে। নিজের পুঁজি কৃষি, শিল্প, ব্যবসা যেখানেই লাগতে চান, এ শর্তে লাগন যে, তা থেকে যে মুনাফা অর্জিত হবে তা আপনি এবং উদ্যোক্তা ‍উভয়ে পূর্বনির্ধারিত হারে ভা করে নেবেন। এটি ইনসাফ ও ন্যায়নীতির দাবী এবং এভাবে অর্থনৈতিক জীবনের সমৃদ্ধি সম্ভব। সুদী পদ্ধতি খতম করে এ পদ্ধতি প্রচলনের পথে বাধা কোথায়? বর্তমানে যে পুঁজি ঋণ আকারে খাটানো হয়, তা অংশীদারী নীতির ভিত্তিতে খাটাইলে হবে। সুদের হিসেবের পরিবর্তে মুনাফার হিসেবে কষতে হবে, এ ব্যাপারে কোনো কঠিন সমস্যা দেখা যায় না। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের মধ্যে ইজতিহাদের যোগ্যতা নেই। আমরা অন্ধ অনুসৃতিতেই অভ্যস্ত। পূর্ব থেকে যা চলে আসছে, চোখ কান বন্ধ করে তা চালিয়ো যেতেই আমরা চাই। ইজতিহাদ করে ইসলামের মুলনীতির ভিত্তিতে কোনো সসমঞ্জস, বৈধ ও ইনসাফপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে আমরা প্রস্তুত নই। বেচারা আলেম ওলামাদের নিন্দা করা হয় যে, তারা তাকলীদ তথা অন্ধ অনুসরণ করে- ইজতিহাদে প্রবৃত্ত নয়। অথচ তারা নিজেরাই (পশ্চাত্য চিন্তার) অন্ধ অনুসরণ কবরে চলছে, ইজতিহাদে তারাও উদ্যোগী নয়। আমাদের রোগ এ মারাত্মক পর্যায়ে উপনীত না হলে বহু পূর্বেই এ সমস্যার সমাধান হতো।

অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার সম্পর্ক
শেষ প্রশ্নে বলা হয়েছে, ইসলামের দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থার মধ্যে কোনো পর্যায়ের সম্পর্ক রয়েছে? এ জবাবে বলা যায়, এ ব্যবস্থাগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক একটি গাছের শিকড়, কাণ্ড, শাখা প্রশাখা ও পত্রের মধ্যকার সম্পর্কের ন্যায়; আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমানের ভিত্তিতে একটি সামগ্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। নৈতিক ব্যবস্থার সৃষ্টি এখান থেকেই। ইবাদত বা প্রচলিত অর্থে ধর্মীয় ব্যবস্থাও এখন থেকেই সৃষ্টি হয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সকল ব্যবস্থার উৎসও এখানেই। এগুলো সবই একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। যদি আপনি আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান এনে থাকেন এবং কুরআনকে আল্লাহর কিতাব বলে স্বীকার করে থাকেন, তাহলে অনিবার্যভাবে ইসলাম প্রদত্ত নৈতিক আদর্শ ও নীতি অবলম্বন করতে হবে, ইসলাম প্রদত্ত নীতির ভিত্তিতে অর্থনীতির সমগ্র ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করতে হবে। যে আকীদা বিশ্বাসের ভিত্তিতে আপনি নামায পড়েন, সেই একই আকীদা বিশ্বাসের ভিত্তিতে আপনাকে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। যে দীনের বিধি-বিধান আপনার রোযা ও হজ্জ্ব নিয়ন্ত্রণ করে সে একই দীনের বিধি-বিধথান আপনার আদালত ও বাজারের জীবনও নিয়ন্ত্রিত করবে। ইসলামে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাগুলো পৃথক এককের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং এগুলো এবই ব্যবস্থার বিভিন্ন বিভাগ ও শাখা মাত্র। এগুলো একটি অপরটির সাথে সংযুক্ত এবং প্রত্যেকটি অন্যটির সাহায্যে শক্তিশারী। যেখানে তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের প্রতি ঈমানের অস্তিত্ব নেই এবং এ উৎস থেকে উৎসারিত নৈতিক বৃত্তি অনুপস্থিত, সেখানে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কোনোদিন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না এবং কোনোক্রমে প্রতিষ্ঠিত করলেও তা টিকে থাকতে পারে না। অনুরূপভাবে ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে একই কথা। আল্লাহ, রাসুল, আখেরাত ও কুরআনের প্রতি ঈমান না থাকলে এ ব্যবস্থা চলতে পারে না। কারণ ইসলাম যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা দান করেছে, তার ভিত্তি হচ্ছে; আল্লাহ বার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন শাসক, রাসূল তাঁর প্রতিনিধি, কুরআন তাঁর অবশ্য পালনীয় ফলমান এবং আমাদেরকে একদিন সর্বশক্তিমান আল্লাহর সম্মুখে আমাদের কাজের জবাবদিহি করতে হবে। ইসলামে ধর্মীয় ও নৈতিক ব্যবস্থঅর সাথে সম্পর্কহীন কোনো পৃথক এককের অধিকারী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থঅর অস্তিত্ব রয়েছে বা ইসলামের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধর্মীয় ও নৈতিক ব্যবস্থা থেকে সম্পর্কহীন থাকতে পারে, এ ধারণা সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত। যে ব্যক্তি ইসলামকে জেনে বুঝে গ্রহণ করেছে, সে কখনো এ ধারণা পোষণ করতে পারে না যে, মুসলমান থাকা অবস্থায়ই তার রাজনীতি, অর্থনীতি বা তার জীবনের কোনো বিভাদ তার ধর্ম থেকে আলাদা থাকতে পারে। সে জানে রাজনীতি, অর্থনীতি ও আইন আদালতের ক্ষেত্রে ইসলাম থেকে আলাদ থেকে বা ইসলাম চাড়া অন্য কোকনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে কেবলমাত্র ‘ধর্মীয়’ ব্যাপারে ইসলামের আনুগত্য করার নাম ইসলামী জীবন হতে পারে না।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি