অনভিপ্রেত বিরোধ
নিষ্ঠাবান আলেমদের মধ্যে যদি কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় তাহলে এটা সাময়িকবাবে হওয়া উচিত, তা স্থায়ী ও দীর্ঘ হওয়া উচিত নয়। মতবিরোধ সৃষ্টিহ বে এবং শেষ হয়ে যাবে। যদি সে বিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে এটা যেন কোনক্রমেই অন্তরে ঘৃণা-বিদ্বেষ এবং মুসলিম সমাজে ফাটল সৃষ্টি করতে না পারে।

যদি এ ধরনের কিছঠু ঘটে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই তাতে বাইরের কোন প্রভাব থেকে থাকবে অথবা তাতে অজ্ঞতার দখল থাকবে অথবা ইন্দ্রিয় লালসার মলিনতা থাকবে অথবা এ দু’টোরই প্রভাব থাকবে। আমরা অসংখ্য মতবিরোধের মূল্যায়ন করে দেখেছি যে, এর গভীরে এমন সব জিনিস রয়েছে যা নির্মল জ্ঞান, অনুসন্ধান এবং সত্যপ্রীতির একদম পরিপন্থী।

যদি জৈবিক লালসার অপমৃত্যু ঘটত, আত্মম্ভরিত পরিসমাপ্তি ঘটত, কোন মতবাদের সমর্থন অথবা কোন মাযহাবের প্রচারের পেছনে অন্য যেসব উদ্দেশ্য থেকে থাকে তা খতম হয়ে যেত –তাহলে শত শত ফেরকা সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথেই মরে যেত, প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই ম্লান হয়ে যেত। অথবা অন্তত কিতাবের পাতায় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্য তালিকায় সীমাবদ্ধ থাকত। স্বাধীন চিন্তা ও অনুসন্ধানের ক্ষেত্রৈ মতবিরোধ হয়ে থাকে। বিভিন্ন মত সামনে আসে। কিন্তু তার শোরগোল আলোচনার বৈঠক পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। আলোচনা শেষ হওয়ার সাথে সাথে সমস্ত হট্টগোল শেষ হয়ে যায়।

জ্ঞানের প্রশস্ততা চিন্তাচেতনায় ব্যাপকতার জন্ম দেয়, সৎ উদ্দেশ্য উদার মনের অধিকারী বানায় এবং খাঁটি ঈমান উম্মাতের ঐক্য ও এককেন্দ্রীকতাকে সযত্নে সংরক্ষণ করে। অতঃপর যে দীন এই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, তার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও বিভক্তির প্রশ্ন উঠতে পারে কি?

এজন্য নবুয়াত যুগে যেসব লোক ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতার গোলাম এবং বিরোধ ও বিচ্ছিন্নতার আকাঙ্ক্ষী ছিল, আল্লাহতায়ালা তাঁর রসুলকে তাদের সাথে সম্পর্কহীন ঘোষণা করেন এবং বলে দেন, তাদের সাথে আপনারও কোন সম্পর্ক নেই এবং আপনার সাথেও তাদের কোন সম্পর্ক নেই। একদিন তাদেরকে অবশ্যই নিজেদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করার জন্য আল্লাহর কাছে উপস্থিত হতে হবে –যিনি অন্তরের অন্তস্থলের খবরও রাখেন। মহান আল্লাহর বাণীঃ

(আরবী*************************************************************************************)

যারা নিজেদের দীনকে খণ্ডবিখণ্ড করে দিয়েছে এবং দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে তাদের সাথে নিশ্চয়ই তোমার কোন সম্পর্ক নেই। তাদের ব্যাপারটি সম্পূর্ণত আল্লাহর উপরই সোপর্দ রয়েছে। তারা যা কিছু করছিল সে সম্পর্কে তিনি তাদের অবহিত করবেন।–সূরা আনআমঃ ১৫৯

তুমি প্রশ্ন তুলতে পার, মুসলমানরাও তো অসংখ্য দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে? তারা শত শত বছর ধরে এই বিরোধের আগুনে ফুঁ দিয়ে আসছে। আপনি যে মূলনীতি বর্ণনা করেছেন তা যদি মেনে নেওয়া হয়, তাহলে এদের অব্স্থাটা কি দাঁড়ায়? আমার জবাব হচ্ছে, যেসব লোক হকের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে –যদি হকের কাঁচি তাদেরকে ছেঁটে ফেলে দেয়, তাহলে এতে উদ্বেগের কোন কারণ নেই। কেননা যেসব রায় ও মতবিরোধকে কেন্দ্র করে পরবর্তী কালে যেসব ফেরকার আত্ম-প্রকাশ ঘটে –এ ধরনের মতবিরোধ ফিকহবিদ সাহাবীদের মধ্যেও বিদ্যমান ছিল। তাদের সমাজেও এর চর্চা হত ঠিকই, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে অবস্থান করে। এ কারণে তাদের সমাজ-পরিবেশে কোন সংঘাত সৃষ্টি হতে পারেনি।

আল্লাহর দীদার প্রসঙ্গ
যেমন আখেরাতে আল্লাহ তায়ালার দর্শনলাভ। অর্থাৎ আখেরাতে আল্লাহ তায়ালার দর্শন লাভ করা যাবে কি-না? এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে মুতাযিলা ও আহলে সুন্নাতের মধ্যে চরম বিরোধ চলে আসছে। উভয়ই পরস্পরের বিরুদ্ধে অনেক কাদা ছুড়েছে। জনসভা, রাস্তাঘাট ও বাজার সর্বত্রই বিরোধের সয়লাম বইয়ে দিয়েছে। অথচ এ প্রশ্নটি প্রথম যুগেও উত্থাপিত হয়েছিল। মুসলমানদের মধ্যে এ সম্পর্ক কিছুটা আলোচনাও হয়েছে। অতঃপর তা খতম হয়ে যায়। মনের আয়নায় এর কোন প্রতিফলন হয়নি। পারস্পরিক ভালবাসা ও সম্প্রীতি পূর্ববৎ কায়েম থাকে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) এবং অন্যসব সাহাবী আল্লাহর দর্শন লাভের প্রবক্তা ছিলেন। তাদের এ মতের সমর্থনে তাদের কাছে দলীল-প্রমাণও ছিল। যেমন হাদীসে এসেছেঃ

(আরবী***************************************************************************************)

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম মিরাজের রাতে তাঁর রবের দর্শন লাভ করেন।

অপরদিকে হযরত আয়েশা (রা) বলতেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম তাঁর রবকে দেখেননি। মাসরূক (রহঃ) বলেনঃ

(আরবী****************************************************************************)

আমি আয়েশা (রাঃ)-কে বললাম, হে আম্মাজান! মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম কি তাঁর রবকে দেখেছেন? তিনি বললেন, তোমার কথায় আমার শরীরে পশম কাটা দিয়ে উঠেছে। তিনটি কথা সম্পর্কে তুমি কি অবগত নও? এই তিনটি কথার কোন একটি কেউ তোমাকে বললে সে মিথ্যাবাদী। যে ব্যক্তি তোমাকে বলে, মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর প্রভুকে দেখেছেন, সে তোমাকে মিথ্যা কথা বলেছে। অতঃপর তিনি এ আয়াত পাঠ করলেনঃ

দৃষ্টিশক্তি তাঁকে আয়ত্ত করতে পারে না। বরং তিনিই সব দৃষ্টিকে আয়ত্তে রাখেন। তিনি অতীব সূক্ষ্মদর্শী এবং সবকিছু সম্পর্কে অবহিত।–সূরা আনআমঃ ১০৩

কোন মানুষের মর্যানা এই নয় যে, আল্লাহ তাঁর সামনাসামনি কথা বলবেন। এবং তাঁর কথা হয় ওহী (ইশারা)-রূপে হয়ে থাকে, অথবা পর্দার আড়াল থেকে।–সূরা শুরাঃ ৫১

আর যে ব্যক্তি তোমাকে বলে, আগামী কাল কি হবে বা না হবে তা তিনি (নবী) জানেন, তাহলে সে মিথ্যা কথা বলেছে। অতঃপর তিনি (আয়েশা) নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করেনঃ

কোন ব্যক্তিই জানে না সে আগামী কাল কি করবে এবং কোন ব্যক্তিই জানে না সে কোথায় মারা যাবে।–সূরা লোকমানঃ ৩৪

আর যে ব্যক্তি তোমাকে বলে, তিনি (নবী) কোন কথা গোপন রেখেছেন, তাহলে সে মিথ্যা কথা বলেছে। অতঃপর তিনি (আয়েশা) নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করেনঃ

হে রসূল!‍ তোমার নিকট তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে যা কিছু নাযিল করা হয়েছে তার সবটাই তুমি লোকদের কাছে পৌঁছিয়ে দাও। যদি তা না কর তাহলে তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব তুমি আদায় করলে না।সূরা মাইদাঃ ৬৭

আয়েশা (রাঃ) বলেন, কিন্তু তিনি জিবরীলকে তাঁর নিজস্ব অবয়বে দু’বার দেখেছেন। -বুখারী,কিতাবুত তাফসীর, তৌহীদ, বাদউল খালক; মুসলিম, তিরমিযী।

তিরমিযীর বর্ণনায় আরো আছেঃ

(আরবী**************************************************************************************)

(মাসরূক বলেন) আমি হেলান দিয়ে বসা ছিলেন। (তাঁর কথা শুনে) সোজা হয়ে বসে বললাম, হে উম্মুল মুমিনীন! আমাদের সুযোগ দিন এবং তাড়াহুড়া করবেন না। আল্লাহ তায়ালা কি বলেননিঃ নিশ্চয়ই মুহাম্মদ তাঁকে পুনর্বার দেখেছে –(সূরা নাজমঃ ১৩) এবং সে সেই পয়গাম বাহককে উজ্জ্বল দিগন্তে দেখেছে –(সূরা তাকবীরঃ ২৩)? আয়েশা (রাঃ) বললেন, আল্লাহর শপথ! এ ব্যাপারে আমিই সর্বপ্রথম রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করি। তিনি উত্তরে বলেন, এসব আয়াতে দেখার অর্থ হচ্ছে জিবরাঈলকে দেখা। জিবরাঈলকে যে আকৃতিতে সৃষ্টি করা হয়েছে সেই আকৃতিতে তাকে ঐ দু’বারই আমি দেখেছি। আমি তাকে আসমান থেকে অবতরণ করার সময় দেখেছি, তার দেহের পরিধি আসমান যমীনের মধ্যবর্তী স্থান ভরে ফেলেছে।

(আরবী***************************************************************************************)

আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি আপনার প্রতিপালককে দেখেছেন? তিনি বললেন, তিনি তো নূর, তাঁকে আমি কি করে দেখব? –মুসলিমঃ ঈমান, নাসাঈঃ যাকাত, ইবনে মাজাহঃ যুহদ

সাহাবাদের পরস্পর বিরোধী এই মতামতসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা কোন কঠিন কাজ নয়। এসব রায় এবং উল্লিখিত হাদীসসমূহ সাহাবাদের সামনেই ছিল। কিন্তু এ নিয়ে তাঁরা বিতর্কে লিপ্ত হয়ে সময় নষ্ট করতেন না, নিজেদের চিন্তাশক্তি ব্যয় করতেন না, সাধারণ লোকেরাও এর ঘূর্ণাবর্তে নিক্ষিপ্ত হত না এবং বিশিষ্ট লোকেরাও এ নিয়ে সংঘাতে লিপ্ত হত না। এরপর শুরু হল বিচ্ছিন্নতা ও অবনতির যুগ। বিভিন্ন ফেরকার আত্মপ্রকাশ ঘটল। তারা ফেরকাগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এসব বিরোধকে কাঁপিয়ে তুলল এবং এটাকেই নিজেদের পেশা বানিয়ে নিল।

মুমিন হত্যা প্রসঙ্গ
মুমিন ব্যক্তিকে হত্যার প্রসঙ্গটিও উদাহরণ হিসেবে আনা যায়। হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস, যায়দ ইবন সাবিত ও আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুমের মতে, যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে কোন মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা করে তার তওবা কবুল হবে না। তারা নিম্নের আয়াত নিজেদের মতে সপক্ষে দলিল হিসেবে পেশ করেনঃ

(আরবী***************************************************************************************)

যে ব্যক্তি কোন মুমিন ব্যক্তিকে স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে হত্যা করবে তার শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম, তাতে সে চিরদিন থাকবে। তার উপর আল্লাহর গযব ও অভিসম্পাত; এবং তিনি তার জন্য কঠিন শাস্তি নির্দিষ্ট করে রেখেছেন।–সূরা নিসাঃ ৯৩

হযরত সাঈদ ইবন যুবাইর (রহ) বলেন, আমি ইবন আব্বাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা করে তার তওবা কি কবুল হবে? তিনি বললে, না। আমি সূরা ফুরকানের নিম্নোক্ত আয়াত পেশ করলামঃ

(আরবী****************************************************************************************)

যারা (দয়াময় রহমানের বান্দাগণ) আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে মাবুদ ডাকে না, আল্লাহর হারাম করা কোন প্রাণকে অকারণে ধ্বংস করে না এবং যেনায় লিপ্ত হয় না। যারা এসব কাজে লিপ্ত হবে তারা নিজেদের গুনাহের প্রতিফল পাবে। কিয়ামতের দিন তাদেরকে অব্যাহত শাস্তি দেওয়া হবে এবং তাতেই তারা লাঞ্ছনা সহকারে পড়ে থাকবে, কিন্তু যারা তওবা করেছে তারা ব্যতীত।–সূরা ফুরকানঃ ৬৮-৭০

ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন, “এটা মক্কায় নাযিলকৃত আয়াত। মদীনায় নাযিল হওয়া আয়াত এটাকে মানসুখ (রহিত) করে দিয়েছে”।

এ সম্পর্কে আরো একটি মত এই যে, “ইসলাম গ্রহণের পূর্বে যেসব লোক উল্লিখিত গুনাহে লিপ্ত হয়েছে –সূরা ফুরকানের এ আয়াত তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট”।

ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং তাকে ভালভাবে বুঝে নিয়েছে, অতঃপর হত্যার অপরাধ করেছে –তার তওবা কবুল হওয়ার কোন সুযোগ নেই”।

হযরত যায়দ (রাঃ) এবং আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) থেকেও অনুরূপ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। অবশিষ্ট সব সাহাবরার মতে হত্যাকারীর জন্যও তওবার সুযোগ আছে। কেননা হত্যাকাণ্ড কুফরীর চেয়ে মারাত্মক অপরাধ তো নয়। অতএব কুফরীর গুনাহ ক্ষমার যোগ্য হলে হত্যার গুনাহ কেন ক্ষমার যোগ্য হতে পারে না? যদি কাফিরদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার দরজা খোলা থাকতে পারে, যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************************************)

হে রাসূল! এই কাফিরদের বল? এখনো যদি তারা ফিরে আসে, তাহলে যা কিছু হয়েছে তা মাফ করে দেওয়া হবে।–সূরা আনফালঃ ৩৮

তাহলে হত্যাকারীর জন্য তওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবার কোন কারণ থাকতে পারে না।

দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে পার্থক্য হওয়াটা মানুষের স্বভাবগত ব্যাপার। এতে এবং এ ধরনের অন্যান্য ব্যাপারে সাহাবীদের রায় বিভিন্ন রূপ ছিল। কিন্তু এই মতবিরোধ তাদের সামজে কোন শোরগোল সৃষ্টি করতে পারেনি। তাদের জীবনকে কলুষিত করতে পারেনি এবং এসব ব্যাপারে কখনো দীর্ঘ বিতর্কও হয়নি।

অবশ্য যখন ইলম ও ইখলাসের ঝর্ণাধারা শুকিয়ে যায়, ঈমান ও তাকওয়ার আলোকবর্তিকা নিভে যায় এবং অপরিচিত মুখ ময়দানে এসে যায় তখন মতবিরোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে।

জ্ঞান, নিষ্ঠা এবং ঈমানের সম্পর্ক যখন দুর্বল হয়ে পড়ে তখন সরকারী ক্ষমতা লিপ্সা, রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি এবং শাসকগোষ্ঠীর অসঙ্গত কার্যকলাপের অনুপ্রবেশ ঘটে। তখন জিরা গম্বুজের রূপ নেয় এবং সরিষার দানা পাহাড়ে পরিণত হয়। এ সময় কিছু লোকের এক জায়গায় বসে নিশ্চিন্ত মনে এবং গুরুত্বসহকারে চিন্তা-ভাবনা করা, কোন বিরোধের সার্বিক দিকের উপর মত বিনিময় করা আর সম্ভব হয়ে উঠে না। বরং এ সময় যুক্তি ও পাল্টা যুক্তির হাতিয়ার আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত থাকে, যে দিকেই তাকাবে, ঘৃণা-বিদ্বেষ ও অসহনশীলতার দৃশ্যই নজরে পড়বে।

এসব মতবিরোধের ভিত্তিতে মাযহাবে উৎপত্তি হয় এবং নিকৃষ্ট রাজনৈতিক চক্রান্তে তা আরো ব্যাপক হতে থাকে। অতঃপর কালের প্রবাহে এসব ফেরকার অপমৃত্যু ঘটল এবং আজ মুসলমানদের মধ্যে কোন বিরোধ অবশিষ্ট থাকল না। কিন্তু একটি বিরোধের এখনো কোন সুরাহা হয়নি এবং নিকৃষ্ট রাজনৈতিক চক্রান্ত তার সমাধান হতে দিচ্ছে না। তা হচ্ছে শিয়া-সুন্নী বিরোধ।

আকাযেদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মতবিরোধ দেখা দিয়েছে, কিন্তু তাও নির্ভাপিত হয়ে গেছে। কতগুলো খুঁটিনাটি বিষয়েও মতবিরোধ দেখা দিয়েছে, কিন্তু মুসলমানরা তার উপর কোন গুরুত্ব আরেপ করেনি। অতএব আজ যদি তুমি অনুসন্ধানে লেগে যাও যে, শেষ পর্যন্ত কোন জিনিস মুসলমানদের শিয়া-সুন্নী নামে পরস্পর বিরোধী ও শত্রুভাবাপন্ন দুটি শিবিরে বিভক্ত করে রেখেছে –তাহলে হয়রান হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হবে। কেননা তুমি মতবিরোধের বিশেষ কোন উপাদান খুঁজে পাবে না।

ধ্বংস হোক ফেরকাগত গোঁড়ামির, দলীয় স্বার্থের এবং ধোঁকাবাজ নেতৃত্বের নিচ মানসিকতার। এসব উপাদানই এই মতবিরোধের পরিসমাপ্তি হতে দিচ্ছে না। তাদের আকাংকা হচ্ছে, উম্মাতের মধ্যে এই মতভেদ আবহমান কাল ধরে চলতে থাকুক এবং এর ছত্রছায়ায় তারাও জীবিত থাকুক।

তুমি হয়ত শুনে থাকবে, ইটালীতে এককালে একটি দল এ্যানটোনিয়াস (Antoniuis) ও ক্লিওপেট্রার (Cleopatua) সমর্থন করত এবং অপর দলটি অকটোভিয়াসের (Octovius) সমর্থন করত। এটা ছিল সেই সুদূর অতীতের রাজনৈতিক খেলা। আজ যদি আবার সেই খেলা শুরু হয়ে যায়, তাহলে অতীতে যে তামাসা হয়েছে আজো তাই হবে। যে ছলচাতুরি ইতিহাসের পাতায় দাফন হয়ে আছে তা আজ আবার কাফন ছিড়ে বের হয়ে আসবে। আবার কতিপয় দলের আবির্ভাব ঘটবে –যারা এই বিশ শতকে পুরনো দিনের সেই যখমকে তাজা করে তুলবে এবং তার প্রভাবাধীনে নব্য ইটালীর প্রশাসন চালাবে। বাস্তবিকই যদি এরূপ হয় তাহলে সে জাতি সম্পর্কে তোমার সিদ্ধান্ত কি হতে পারে?

এসব লোকের উদ্দেশ্যও তাই এরা খিলাফতের প্রশ্নে মুসলমানদের নব্য বংশধরদের জটিলতার শিকারে পরিণত করতে চায়। আজ চৌদ্দশত বছর অতীত হওয়ার পরও তারা এই প্রশ্ন তুলতে চায় যে, খিলাফতের জন্য অধিকতর যোগ্য কে ছিল? তারা এই প্রশ্নের সমাধান এমন লোকদের দিয়ে করাচ্ছে যারা আপাতত এ সমস্যার সাথে পরিচিত নয়। মুসলমানরা আজ এই অনর্থক কাজ করছে। তারা নিজেদের বর্তমান জীবনের ভিত্তি অতীতের পুরোনো মতবিরোধের অবাঞ্ছিত স্মৃতি বিজড়িত আকীদা বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার উপর স্থাপন করতে চায়।

যে কুটিল রাজনীতি হাজারো জন্ম দিয়েছিল এবং নিজের কোলে লালন-পালন করেছিল তা ঐ রাজনীতির অপমৃত্যুর সাথে সাথে দুনিয়ার পাতা থেকে বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানেও বিষাক্ত রাজনীতি ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের মধ্যে ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ করছে, যেন তারা ইসলামের পতাকাবাহীদের বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত করতে পারে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারে। কিভাবে? কতগুলো অলিক ধারণা-বিশ্বাসকে পুঁজি করে।

আমি দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী সব মুসলমানকে সতর্ক করে দিতে চাই –তারা যেন কুরআন ও হাদীসের সাথে নিজেদের সম্পর্ক ছিন্ন না করে। তারা যেন স্বার্থের দাস ও লালসার প্রতিভূদের এমন সুযোগ করে না দেয় যাতে তারা মতবিরোধকে কাঁপিয়ে তুলতে পারে, নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তাদেরকে ব্যবহার করতে পারে এবং লেলিহান শিখায় আমাদের সম্পর্কের পরিচ্ছদকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধূলায় লুটিয়ে দিতে পারে। অথচ আল্লাহ তায়ালা এই সম্পর্ক অটুট রাখার জন্য জোর দিয়েছেন। আমাদের অতীত আমাদের জন্য শিক্ষা গ্রহণের পুস্তক স্বরূপ এবং বর্তমান কাল শিক্ষা গ্রহণের পুঁজি।

(আরবী***********************************************************************************)

এই ইতিহাসে অত্যন্ত শিক্ষামূলক উপদেশ রয়েছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যার অন্তর আছে অথবা যে কান লাগিয়ে মনোযোগ সহকারে শুনে।–সূরা কাফঃ ৩৭


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি