অনুবাদকের কথা
তখন মিসরে চলছিল ফেরাউনী সভ্যতা পুনর্জীবনের জঘন্য অপপ্রয়াস। ইসলামের চিহ্ন মুছে ফেলার আয়োজন চলছিল প্রতিটি ক্ষেত্রে। এমন এক সংকটময় মুহূর্তে ইখওয়ানুল মুসলেমূনের আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯২৮ সালে। আন্দোলনের পতাকা হাতে ছুটে আসেন শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আহবায়ক ইমাম হাসানুল বান্না।

আধুনিক যুগে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার যে কর্মসূচী ও কর্মকৌশল নিয়ে ইখওয়ানুল মুসলেমূন যাত্রা শুরু করেছিল, দীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিবেদিত প্রাণ কর্মীদের সে ইতিহাস জানা অত্যন্ত গুরুত্বের দাবী রাখে। ইখওয়ানুল মুসলেমূনের ওপর জুলুম নির্যাতনের যে স্টিম রোলার চালানো হয়েছে, আধুনিক যুগের অন্য আর যে কোন ইসলামী আন্দোলনে সে দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবেনা। পুরুষদের পাশাপাশি মহিলা নেতৃবৃন্দের প্রতিও চলেছে ইতিহাসের জঘন্যতম নির্যাতন ও বর্বরতা। বিনা অপরাধে হাজার হাজার মানুষকে চরম শাস্তি দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র ইখওয়ান কর্মীর আত্মীয় স্বজন হবার কারণে। তবুও ঈমানের অগ্নি পরীক্ষায় তাঁরা উতরে গেছেন। ইখওয়ানের জুলুম নির্যাতনের এ ইতিহাস আমাদের ঈমানকেও তাজা ও মজবুত করার প্রেরণা যোগাবে।

সর্বোপরি যে কারণে এ পুস্তিকাটি অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি তা হলো-দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষে ইখওয়ানের তৎপরতা ও ভূমিকার সাথে আমাদের আন্দোলনের একটা তুলনামূলক পর্যালোচনা খুঁজে পাওয়া। সামাজিক সংস্কারের লক্ষ্যে ইখওয়ান যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে দেখায় তা সত্যি আমাদের বিস্মিত করবে।

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে ইখওয়ানের আন্দোলনের যে গতিধারা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল, আমরা তার চেয়ে কতোটা অগ্রসর নাকি অনেক পিছিয়ে রয়েছি, তাও ভেবে দেখা প্রয়োজন। এছাড়া আধুনিক যুগে ইসলামী আন্দোলন কি ধরনের বাধা প্রতিবন্ধকতা ও জুলুম নির্যাতনের মুখোমুখি হতে পারে এবং তা মোকাবিলায় কি ধরনের উপকরণ, কতোটা মজবুত ঈমান ও অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজন সে সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবহিত হওয়া দরকার।

মরহুম খলিল আহমদ হামেদী অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে ইখওয়ানের আন্দোলনের একটা সুস্পষ্ট চিত্র তুলে ধরেছেন। পুস্তিকাটির মূল নামের খানিকটা পরিবর্তন করতে হয়েছে সংগত কারণেই। পাঠকরা এ থেকে সামান্য উপকৃত হলে আমাদের শ্রম সার্থক হবে। দীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জড়িত প্রত্যেকের জন্য এটি হোক প্রেরণার উৎস। আমীন।

-অনুবাদক

বিস্‌মিল্লাহির রাহমানির রাহিম

আন্দোলন পূর্ব অবস্থা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর পরই মিসর কঠিন রাজনৈতিক সংকটে নিপতিত হয়। দেশের অভ্যন্তরে নান ধরনের জাতীয় ও গোত্রীয় সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তুরস্ক জাতীয়তাবাদের পতাকাবাহী তুর্কীরা যখন খেলাফত ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করে, সে সময় তাদের এই সংস্কার কাজে আরবদের মাঝে জাতীয়তাবাদ এবং স্বাদেশিকতাবাদের অনুরাগ প্রবল হয়ে। স্বীয় ইতিহাস, রাজনৈতিক মর্যাদা এবং আজহারের জাতীয় অবস্থান এছাড়াও অপরাপর নানান কারণে মিসর আরব বিশ্বের নেতৃত্ব লাভ করেছিল। এ কারণে মিসরে জাতীয়তাবাদ ও স্বাদেশিকতাবাদের শ্লোগান যখন উত্থিত হয় তখন সাথে সাথে সমগ্র আরব দেশগুলোতে এর প্রতিধ্বনি শোনা যায়। বিভিন্ন স্বদেশী আন্দোলন ডানা মেলতে শুরু করে। সা’আদ জগলুলের (১৯২৭ মৃঃ) শ্লোগান-

(**********************আরবি**********************)

(দীন আল্লাহর এবং দেশ আমাদের সকলের) সমুন্নত হয়। মোস্তফা নাহাশ পাশার (১৯৬৪ মৃঃ) নেতৃত্বে ওয়াফদ পার্টির যাত্রা শুরু হয়। স্বদেশী আন্দোলন স্বদেশ পূজার অন্তরালে এবং তুর্কীদের খেলাফতের বিলোপ সাধনকে বাহানা বানিয়ে নাস্তিকতা, যরোয়েষ্ট্রীয়, অশ্লীল চিন্তা এবং পাশ্চাত্যপূজা) দীর্ঘ ও সুদূরপ্রসারী ফল হিসেবে আদর্শিক দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। সংস্কারবাদীদের অবস্থান ছিল বেশ মজবুত। কারণ ক্ষমতা এবং সংবাদ ও প্রচার মাধ্যমগুলো ছিল তাদের দখলে। এসবের মুকাবিলায় ইসলামী আদর্শের পতাকাবাহীরা শুধু কমজোরই ছিল না বরং যতোটুকু ছিল তাও আত্মনির্ভরশীলতা থেকে বঞ্চিত। অধিকন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষও দেশের পরিবেশকে কলুষিত করে তোলে। ওয়াফদ পার্টি ক্ষমতাসীন হলে দস্তুর পার্টির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার প্রচেষ্টায় লেগে যায়। পক্ষান্তরে দস্তুর পার্টি ক্ষমতায় এলে দেশকে ওয়াফদ পার্টির হাত থেকে পবিত্র করার ইস্যু তৈরি করে।

সেসময় আলী আব্দুর রাজ্জাকের যুগের অপমানজনক গ্রন্থ আল ইসলাম ওয়াল উসুলুল হুকুম (ইসলাম ও শাসন ব্যবস্থার মূলনীতি) প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু ছিল রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। এবং খেলাফত ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক অধিকার প্রদানের কোনো অবকাশও ইসলামে নেই। ত্বাহা হোসাইনের গ্রন্থ ফীশ শি বিল জাহিলী ও এ দ্বন্দ্ব সংকুল যুগের উৎপাদিত। যেখানে স্বয়ং কুরআন সম্পর্কে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি করা হয়। কাসিম আমীনের তাহরীরুল মারতা তে এমন নারী স্বাধীনতা দাবি করা হয় যা পাশ্চাত্যের নারীরা অবাধে ভোগ করে। চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে ইসলাম তথা অন্যান্য সকল ধর্মের প্রতি হামলা চালানো হয়। সাপ্তাহিক আসসিয়াত সংস্কারপন্থীদের মুখপত্র ছিল। এটি পক্ষপাতহীনভাবে সংস্কার, ফেরাউনী সভ্যতার পুনরুজ্জীবন এবং পাশ্চাত্যের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার দাওয়াত প্রচার করতো। দস্তুর পার্টির প্রভাবশালী নেতা আদলী ইয়েকেন, আবদুল খালেক সবুওয়ত, ইসমাঈল সিদকী, মুহাম্মদ মাহমুদ এবং লুতলী সাইয়েদ ছিল এবং পৃষ্ঠপোষক এবং তারা ইসলামের প্রতি এটির আক্রমণের উদ্যম বাড়িয়ে তুলতো। কিন্তু তার শক্তিমান সম্পাদকের মৃত্যুর (১৯২৬) পর এটিও চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সংবাদপত্রের জগতে শুধুমাত্র মুহেবুদ্দীন আলখতীব এর সাপ্তাহিক আলফাতাহ টিকে থাকে। কিন্তু এর অবস্থা এমন ছিল যে, বাদ্য শালার ভেতর গানের পাখীর আওয়াজ কেইবা শুনতে পারে।

যেমন আমি উল্লেখ করেছি দীনের অবস্থান দুর্বল এবং নেতিবাচক। এমতাবস্থায় সাইয়েদ জামালউদ্দিন আফগানীর (১৮৯৭) পর মুহাম্মদ আবদুহূ তাঁর মিশন সুসংহত করেছিলেন। কিন্তু শেখ মুহম্মদ আবদুহূ রাজনৈতিক ময়দানে ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তেমনি আবার তিনি তাঁর শিক্ষক জামালুদ্দীন আফগানীর বিপরীত ইউরোপের ব্যাপারে ভীত ছিলেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্য থেকে সাইয়েদ রশীদ রেজা (১৯৩৩) ছাড়া আর কোনো মুজাহিদ পুরুষ বেরিয়ে আসেনি। রশীদ রেজার কর্মক্ষেত্র যদিও সীমাবদ্ধ ছিল এবং তিনি তুর্কী ও আরবদের দ্বন্দ্বে আরব জাতীয়তাবাদের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তার পরে প্রয়োজনীয় আওয়াজও নিস্তব্ধ হয়ে যায় এবং মোস্তফা সাদেক রাফেয়ী ছাড়া ভোগবাদ ও ভ্রষ্টামীর এ ঝড়ের মুকাবিলায় আত্মনির্ভরশীলতার সাথে এগিয়ে আসার মতো আর কেউ ছিল না।

অবস্থা এতোটাই শোচনীয় আকার ধারণ করে যে, শুধু মিসরেই নয় বরং অধিকাংশ আরব দেশগুলোতে ফেরাউনী ও নমরূদীয় কালেমা পড়ানো শুরু হয়। নবী বংশের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ফয়সল বিন হোসাইন বলেন:

(*******************আরবী**********************)

অর্থাৎ আরব হয়েছিল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মূসা (আঃ)-এর পূর্বের আরবে পরিণত।

দামেস্ক ইউনিভার্সিটিতে প্রকাশ্যে খোদার জানাজা বের করা হয়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্বিঘ্নে ইসলাম ও মুহাম্মদ (সা:)-এর প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রূপ চলতে থাকে। রাজনৈতিক বৈঠকগুলোতে ইসলামের নাম উচ্চারণ করা অপমানিত হওয়ার শামিলে পরিণত হয়। পার্ক ও উদ্যানগুলোতে নিষ্ঠাবান মুসলমানরা নামায পড়তেও লজ্জা বোধ করে। এ পর্যন্ত অবস্থা গড়ানোর পর একসময় সত্যের মর্যাদাবোধ স্ব-মহিমায় দুলে উঠে এবং মাহমুদীয়ার এক নবযুবকের দ্বারা আল্লাহ সেই কাজ করান যা বড় বড় উলামা মাশায়েখ দ্বারাও সম্ভব হতো না। আর তিনি হলেন ইখওয়ানুল মুসলেমূনের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম হাসানুল বান্না।

হাসানুল বান্না : ব্যক্তিত্ব ও স্বরূপ
উনিশ’শ ছয় খ্রিষ্টাব্দে হাসানুল বান্না মাহমুদীয়ায় এক ইসলামী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শায়খ আহমদ আবদুর রহমান আল বান্নার পেশা ঘড়ি তৈরি করা হলেও তিনি ছিলেন একজন বড় আলেম। তিনি হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্রে গভীর জ্ঞানের অধিকারী এবং কুরআনে হাফেযও ছিলেন। [ শায়খ আহমদ আবদুর রহমান আল বান্না হাদিসের ব্যাখ্যা সম্বলিত বহু গ্রন্থ রচনা করেন। প্রাচীন অনেক গ্রন্থকেই তিনি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে সংস্কার ও সংশোধন করে প্রকাশ করেন। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রা:)-এর মুসনাদকে ফিকহী অধ্যায়ের আলোকে সম্পাদনা করেন। তিনি প্রত্যেক হাদিসের উৎস, রিজাল ও সনদের উল্লেখ এবং হাদিসের ব্যাখ্যামূলক পাদটীকা লিখেন। এ গ্রন্থের নাম হলো আল ফাতহুর রব্বানী ফী তারতীবে মুসনাদ আল ইমাম আহমদ আশশায়বানী এবং শরাহর নাম বুলূগুল আমাদী মিন আসরারিল ফাতহির রব্বানী অনুরূপ আবু দাউদ আততায়ালসীর মুসনাদের মানহাতুল মাবুদ নামে একটি শ্রেণী বিন্যাস ও ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ লেখেন। ইমাম শাফেয়ী (রাঃ)-এর মুসনাদ এবং সুনান বাদায়িউল মুসনাদ নামে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে সংকলন ও সম্পাদনার মাধ্যমে সহজবোধ্য করেন। একটি একাডেমিক কাজকে আবদুর রহমান আল বান্না সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ও একক প্রচেষ্টায় সমাধা করেছেন। ১৯৬০ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।]

আবদুর রহমান আল বান্না তাঁর সম্ভাবনাময় পুত্রকে শৈশবেই কুরআন হেফজ করান এবং দীনি ইলম চর্চার প্রতি তার মনোযোগ আকৃষ্ট করেন। গৃহশিক্ষার পাশাপাশি হাসানুল বান্না ইসমাঈলিয়ায় পরিচালিত আদদীনিয়া বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এ বিদ্যালয়টি রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হলেও দীনি তালিম ও তরবিয়াতের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। হাসানুল বান্না চৌদ্দ বছর (১৯২০) বয়সে মানহূরের টিচার্স ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি হন এবং নিজ সহপাঠীদের বিপরীত ইসলামী জীবন যাপনে ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। এরপর তাঁকে এক শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষকতার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। কিন্তু তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে কায়রো গমন করেন এবং দারুল উলূমে (বর্তমান কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। তখন দারুল উলূমকে ছোট আযহার বলা হতো। তিনি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, মনোবিদ্যা, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, রাজনীতি বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান এবং অংক শাস্ত্রের পাশাপাশি ভাষাতত্বের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেন। তাঁর শিক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি ছিল অভিনব। ১৯২৭ সালে হাসানুল বান্না দারুল উলূম থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর তাঁকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইসমাঈলিয়ার আমীরিয়া মাদ্রাসায় (সরকারী স্কুল) শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় এবং তিনি সেখানে যোগ দেন। সে সময় তাঁর বয়স ছিল একুশ বছর। ১৯৩৩ সালে তাকে ইসমাঈলিয়া থেকে কায়রো বদলী করা হয়। এরপর থেকে তিনি কায়রোতেই বসবাস করেন। ১৯৪৬ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাকুরি থেকে ইস্তফা দিয়ে নিবিষ্টচিত্তে দাওয়াত সম্প্রসারণ ও সংগঠন গড়ে তুলতে নিয়োজিত হন।

হাসনুল বান্না বিদ্বানের চেয়ে বড় দায়ী ছিলেন। আল্লাহ তাঁর দ্বারা যে খিদমত গ্রহণ করতে চেয়েছেন, পারিবারিক পরিবেশ এবং শিক্ষাদীক্ষা তাঁকে সেভাবেই সেভাবেই গড়ে উঠতে সহায়তা করে। আযহারের শিক্ষা ছাড়াও দারুল উলূমের শিক্ষা ব্যবস্থা তাঁর দায়ী সুলভ বৈশিষ্ট্যকে আলোকময় করে তুলতে বিশেষভাবে সহায়ক হয়। বিকৃত পরিবেশ, নাস্তিক্যবাদের ঝড় এবং আযহারী বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থ প্রচেষ্টা তাঁর মাঝে প্রবল উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার ঢেউ সৃষ্টি করে। আল্লাহ তাঁকে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও নির্ভীক ব্যক্তিত্ব দান করেছিলেন। কঠিন দুঃসময়েও যিনি স্বাভাবিক থাকেন। রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিচক্ষণতার ক্ষেত্রেই শুধু তিনি ঔশ্বর্যমন্ডিত ছিলেন না। বরং তাঁর মাঝে একজন দায়ীর পরিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতা বিদ্যমান ছিল। যদিও তিনি একাকী যাত্রা শুরু করেন কিন্তু একটি জাতির জীবনী শক্তি হয়ে ইসলামের পত্রপল্লবহীন উদ্যানকে অল্প সময়ের ব্যবধানে শস্য শ্যামল করে তোলেন। এ উদ্যান পানি সেঁচে উর্বর করার পরিবর্তে রক্ত সিঞ্চনের সুন্নাতকে উজ্জীবিত করেন। এছাড়া পুত পবিত্র স্বভাবের অনুরাগী লোকদের নিয়ে এমন একটি জামায়াত প্রতিষ্ঠিত করেন যা তাঁর প্রস্তাবিত রাহে জুনূন এর ওপর পূর্ণোদ্দমে গতিশীল ছিল।

আল্লাহ হাসানুল বান্নাকে দাওয়াত ও সংস্কার এবং জিহাদ ও কল্যাণের যে অনুপ্রেরণায় ধন্য করেছেন, তা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতীয়মান হয়েছিল। ইখওয়ানুল মুসলেমূন (Muslim Brotherhood) নামে নিয়মতান্ত্রিকভাবে একটি সংগঠনের কাঠামো মার্চ ১৯২৮ সালে ইসমাঈলিয়ায় নির্মিত হয়। কিন্তু এর পূর্বে হাসানুল বান্নার জীবন প্রমাণ করেছিল যে, এ ব্যক্তিত্ব কেবল মিসরেই নয় বরং সমগ্র আরব বিশ্বের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী।

ইসলামী দাওয়াতের সাথে সম্পর্ক
হাসানুল বান্না যখন আররাশাদুদ দীনিয়ার ছাত্র ছিলেন তখন একদিন তিনি মাহমুদিয়ার নদীর পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় দেখতে পেলেন নদীর পাড়ে একটি পালতোলা নৌকা দাঁড়ানো রয়েছে-যার ওপর একটি কাঠের উলঙ্গ মূর্তি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এ দৃশ্য দেখে তিনি হাসানুল বান্না ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন। সাথে সাথে তিনি স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে পুলিশ অফিসারের কাছে মূর্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন। পুলিশ অফিসার কিশোর ছাত্রটির ঈমানী চেতনায় প্রভাবিত হয়ে তৎক্ষণাৎ নৌকার মাঝির কাছে গিয়ে মাস্তুল থেকে নগ্ন মূর্তিটি নামিয়ে ফেললেন। সে সময় আররাশাদুদ দীনিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররা জমিয়তে আখলাকে আদাবিয়া নামে একটি সংগঠন গঠন করে এবং এর সভাপতি নির্বাচিত হন হাসানুল বান্না। কিন্তু এ নবীন দায়ীর উচ্চাশা এ সংসদ কিভাবে পূরণ করতে পারে? তিনি এ মাদ্রাসার বাইরে আরো একটি সংগঠন কায়েম করলেন। যার নাম জমিয়তে মানযিল মুহরিমাত (অন্যায় প্রতিরোধ সংঘ)। এ সংগঠনটি চিঠি পত্রের মাধ্যমে মানুষকে সৎ কাজের শিক্ষা দিত। কারো ব্যাপারে এ সংগঠনের কাছে যদি খবর পৌঁছে যে, সে নিষিদ্ধ ও অন্যায় কাজে লিপ্ত অথবা কোনো ফরয পালনে অবহেলা প্রদর্শন করছে, তখন সংগঠনের পক্ষ থেকে বেনামে তার কাছে চিঠি পাঠানো হয়- যা দ্বারা তাকে খোদা ও আখিরাত সম্পর্কে ভয় দেখানো হতো।

দামানহূরের টিচার্স ট্রেনিং স্কুলে যখন হাসানুল বান্না পৌঁছেন তখন তরীকায়ে হিসাফিয়ার শেখের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। তরীকায়ে হিসাফিয়ার শিষ্যরা ইশার নামাযের পর যিকরের মজলিস বসাতো। হাসানুল বান্না এ রূহানী মজলিসের দ্বারা প্রভাবিত হন এবং এ থেকে তাঁর আমর বিল মারুফ ও নেহী আনিল মুনকারের জজবা আরো পরিপুষ্টি লাভ করে। কুদরত এভাবেই তাঁর রূহানী প্রশিক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা করেন। তরীকায়ে হিসাফিয়া যদিও তাসাউফের একটি সিলসিলা ছিল কিন্তু হাসানুল বান্না এ প্রক্রিয়া থেকে শুধুমাত্র আত্মার খোরাকই গ্রহণ করেন। কেননা তার দৃষ্টিতে দীনের দাওয়াত কোনো বিশেষ পদ্ধতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার পরিবর্তে ব্যাপক ও সম্প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন। এ দাওয়াতকে জ্ঞানার্জন, প্রশিক্ষণ দান এবং জিহাদের ভিত্তি হিসেবে পরিণত করা দরকার। সে সময়টিতে অপর একজন সূফী ব্যবসায়ীর সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বেড়ে ওঠে। এ ব্যবসায়ী ব্যক্তিটি স্কুলের ছাত্রদের সপ্তাহে দশদিন পর পর একবার কবর যিয়ারতের জন্য নিয়ে যেতেন এবং সেখানে তাদেরকে নেক লোকদের জীবন কাহিনী শোনাতেন। এতে তাদের অন্তর বিগলিত ও চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যেত। তাদের ভেতর আল্লাহ-রাসূলের আনুগত্যের জোশ ও অনুপ্রেরণা উছলে উঠতো। হিসাফী ভাইদের সাথে হাসানুল বান্নার সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে গভীর হয়ে উঠে। হাসানুল বান্না তাদেরকে একত্রিত করে একটি আসর কায়েম করেন। এর নাম জমিয়তে হিসাফিয়া খাইরিয়া (হিসাফী ভাইদের সেবা সংঘ)। হাসানুল বান্না এ সংঘের সেক্রেটারী নির্বাচিত হন। এর উদ্দেশ্য ছিল দুটি। এক, উন্নত নৈতিক চরিত্র গঠনের দাওয়াত এবং নিষিদ্ধ ও গর্হিত কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি। দুই, খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রতিরোধ- যারা চিকিৎসা, উন্নয়নের প্রশিক্ষণ এবং এতিম খানার অন্তরালে খ্রিস্টবাদের প্রচার চালাচ্ছিল। তখন হাসানুল বান্নার বয়স ছিল মাত্র চৌদ্দ বছর।

কায়রোতে প্রাথমিক প্রচেষ্টা
কায়রোর দারুল উলুমে ভর্তি হবার পর একদিকে বাইরের পরিবেশ এবং অপরদিকে অভ্যন্তরীণ অনুভূতি তাঁকে অস্থির করে তোলে। অতঃপর জমিয়তে মাকারিমে আখলাক- এ সদস্য হিসেবে তিনি যোগ দেন- যা তৎকালীন কায়রোর বিপর্যয়কর পরিবেশে একমাত্র সংস্কারমূলক সংগঠন ছিল। এ সংগঠনের বৈঠকসমূহে তিনি নিয়মানুবর্তিতার সাথে অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু কায়রো বিপথে পা বাড়িয়ে নৈতিক বিপর্যয় এবং পাষ্চাত্যপনায় যেভাবে দ্রুত নিমজ্জিত হচ্ছিল হাসানুল বান্নার দৃষ্টিতে তার প্রতিকার কেবল মসজিদে ওয়াজ দ্বারাই যথেষ্ট হতে পারে না। তিনি ভাবলেন- যে লোক মসজিদে আসে না প্রকৃতপক্ষে তারই ওয়াজ নসিহতের প্রয়োজন বেশি। তারই মধ্যে দীনী এবং নৈতিক সংশোধনের চিন্তা কল্পনা সৃষ্টি হওয়া দরকার। এ উদ্দেশ্যে হাসানুল বান্না দারুল উলূম ও আযহারের ছাত্রদের সমন্বয়ে একটি দল গঠন করলেন এবং তাদেরকে কফি খানায় ও জনসমাবেশে দরস-প্রশিক্ষণ এবং ওয়াজ নসিহতের প্রতি আগ্রহী করে তুললেন। এ দলেন সদস্য হিসেবে হাসানুল বান্না নিজেও কফি খানায় গিয়ে কুরআন-হাদিসের দরস পেশ করতেন এবং বাজিখেলা, বিভিন্ন পানীয়ের প্রতি নেশা ও গল্প গুজবের ব্যাপারে মাশায়েখদের পক্ষ থেকে বার বার বিদ্রূপ ও অপবাদ আরোপ করা হয়। কিন্তু একাজ সফলতার সাথে শহর বন্দর অতিক্রম করে গ্রামেও এর প্রয়োগ শুরু হয়। এ দলেও মধ্য থেকেই একটি কমিটি গঠিত হয়- যারা দাওয়াতে ইসলামের প্রচার ও প্রসার কাজের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করতেন। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে এ দলটি অস্বাভাবিক কর্মতৎপর হয়ে উঠতো। শহর ও গ্রামগুলো তাদের কর্মক্ষেত্রে পরিণত হতো। হাসানুল বান্না এবং তার সাথীরা দাওয়াতের এ পদ্ধতি থেকে দুটি জিনিস অর্জন করেছিলেন। তা হলো, আত্মনির্ভরশীলতা এবং জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করবার অনুশীলন।

কিন্তু চূড়ান্ত বিপ্লবের পর মিশরে নাস্তিকতার যে জোয়ার শুরু হয় এবং যেভাবে প্রতিটি অনুগত যুবক এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিল, তাতে এই সীমাবদ্ধ ও দুর্বল কান্নাকাটি প্রভাবহীন হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আড়ালে এমন ধরনের সংবাদপত্র-পত্রিকা এবং সাহিত্য ও বই পুস্তকের আমদানি হতে থাকে- যার উদ্দেশ্যই ছিল দীনী চেতনাকে কমজোর করা এবং জনগণের মন থেকে দীনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসাকে নির্মূল করা। যেন স্বাধীনতাকামীদের দাবি অনুযায়ী দেশ সত্যিকার অর্থে চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতায় ভরপুর হয়ে ওঠে। হাসানুল বান্নার দৃষ্টিতে- পরিস্থিতি কোনো বড় এবং পরিপূর্ণ কাজের দাবি জানাচ্ছিল। সুতরাং তিনি উলামা ও মাশায়েখদেরকে এ কাজের প্রতি মনোযোগ দিতে আহবান জানালেন এবং দলবদ্ধভাবে দলীয় ভিত্তিতে ময়দানে অবতীর্ণ হতে উদ্বুদ্ধ করলেন। আলমানার পত্রিকার সম্পাদক সাইয়েদ রশীদ রেজার সাথে সাক্ষাত করে আল মাকতাবুস সালফিয়ার মালিক মুহিকুদ্দীন আল খতিবের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। আযহারের প্রখ্যাত আলেমে দীন শাইখ উজভীর কাছে অন্তরে ব্যাথা ব্যাকুলতার কথা ব্যক্ত করেন। শাইখ মুহাম্মদ খাজার হোসাইন শাইখূল আযহারের সামনে পরিস্থিতির ব্যাপারে অভিযোগ করেন। ফরদি উজদীর সাথে মতবিনিময় করেন। তৎকালে তিনি ছিলেন মিশরের শীর্ষস্থানীয় জ্ঞানতাপস। হাসানুল বান্না প্রত্যেকের সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাঁদেরকে ইসলামের জন্য নিবিড়ভাবে একনিষ্ঠতার সাথে কাজ করার আহবান জানান। তাঁর এই তৎপরতার ফলে এ মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং প্রথমে সাপ্তাহিক আলফাতহু প্রকাশ ও পরে জমিয়াতুশ শুব্বানুল মুসলিমীন প্রতিষ্ঠিত হয়। আল ফাতহু মুহিবুদ্দীন আলখতীরের অধীনে পরিচালিত নাস্তিক্যবাদী চিন্তার মন্দিরে জিহাদের ধ্বনি উচ্চকিত করে এবং জমিয়াতুশ শুব্বানুল মুসলিমীন ডাঃ আবদুল হামীদ সায়ীদের নেতৃত্বে নব প্রজন্মকে বিপথ থেকে উদ্ধারের দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করে। হাসানুল বান্না জমিয়াতুশ শুব্বানুল মুসলিমীনে শুধু যোগদানই নয় বরং প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হিসেবে গণ্য হন। সে সময় হাসানুল বান্না দারুল উলূমের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। দারুল উলূমের পক্ষ থেকে তাঁকে থিসিসের যে বিষয় নির্ধারণ করে দেয়া হয় তার শিরোনাম ছিল-শিক্ষা জীবন শেষ করবার পর তিনি কি করতে চান এবং এজন্য কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন? হাসানুল বান্না এর জবাবে লিখেন:

আমি দায়ী ও প্রশিক্ষক হতে চাই। দিনে বছরের অধিকাংশ সময় মিসরের নব প্রজন্মকে প্রশিক্ষণ দেবো এবং রাতের বেলা ও ছুটির দিন গুলোতে ওদের অভিভাবকদের দীনের উদ্দেশ্য বোঝানোর চেষ্টা করবো। তাদেরকে জানাবো শান্তি ও সৌভাগ্যের উৎস কোথায় এবং জীবনের সুখ ও আনন্দ কিভাবে অর্জিত হবে। এ উদ্দেশ্যে সে পথই অবলম্বন করবো- যা আমার সাধ্যের বাইরে নয়। বক্তৃতা, আলোচনা ও পারস্পরিক আলাপচারিতার দ্বারা। পুস্তক-পুস্তিকা রচনার মাধ্যমে, পথে প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে। মোটকথা, প্রতিটি আকর্ষণীয় হাতিয়ার দ্বারাই সাহায্য গ্রহণ করবো।

এই হলো সেই নওজোয়ানের জজবা, যিনি গভীর সমুদ্রে কেবল নিজ পোশাক বাঁচানোর দৃঢ় ইচ্ছাই পোষণ করেননি, বরং অন্যের পোশাক রক্ষার চিন্তাও একই সাথে করেছেন।

ইসমাঈলিয়ায় অবস্থান এবং সংগঠন প্রতিষ্ঠা
১৯২৭ সালে হাসানুল বান্না দারুল উলূমের ডিপ্লোমা লাভ করেন। এরপর তাঁকে ইসমাঈলিয়ার আমীরিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ইসমাঈলিয়া ছিল ইংরেজদের ঘাঁটি এবং সুয়েজ খাল ইংরেজ বাহিনীর দখলে ছিল। সুয়েজ কোম্পানি (যার ওপর ইংরেজ ও ফ্রান্সের ইজারাদারী প্রতিষ্ঠিত ছিল) মিসরের অর্থনৈতিক প্রাণ প্রবাহকে বশীভূত করে রাখে। মুসলমানরা ছিল ধর্মীয় গ্রুপে বিভক্ত। জনগণ ধর্মীয় ঝগড়া বিতর্কের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে মসজিদের পরিবর্তে পানশালার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এমতাবস্থায় হাসানুল বান্না ইসমাঈলিয়ার তিনটি কফিখানা নির্বাচন করে বক্তৃতা ও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে লোকদেরকে উজ্জীবিত করে তোলেন। তাদের মাঝে ইকামাতে দীনের দায়িত্বানুভূতিও জাগ্রত করেন।

১৯২৮ সালের মার্চ মাসে ইসমাঈলিয়ার একদল সম্ভ্রান্ত ও সচেতন ব্যক্তি হাসানুল বান্নার বাসায় সমবেত হন। ছয় জনের এ দলেন সদস্যদের নাম যথাক্রমে হাফেজ আবদুল হামিদ, আহমদ আলহাসরী, ফুয়াদ ইবরাহীম, আবদুর রহমান হাসাবুল্লাহ, ইসমাঈল ইজ্জ এবং যাকী আল মাগরেবী। এ লোকেরা এসেছিলেন কাজ করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে। আলাপ আলোচনা ও পারস্পরিক মত বিনিময়ের পর তারা হাসানুল বান্নাকে কাজের তত্ত্বাবধায়ক, নেতৃত্ব এবং পথ-নির্দেশনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। এছাড়া মুসলমানদের রক্ষার জন্য সম্ভাব্য সকল ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করার বায়আত গ্রহণ করেন। এ ক্ষুদ্র সংগঠনটির নাম কি হবে এ নিয়ে কথা উঠতেই হাসানুল বান্না তৎক্ষণাৎ বললেন- আমরা সবাই ইখওয়ানুল মুসলেমূন (মুসলমান ভাই)। এমনিতেই এ নামটি মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে। আর এ থেকেই এ সংগঠনটি ইখওয়ানুল মুসলেমূন নামে পরিচিত হয়ে উঠে।

সংগঠন প্রতিষ্ঠার পর হাসানুল বান্না পাঁচ বছর পর্যন্ত ইসমাঈলিয়ায় অবস্থান করেন। এরপর ১৯৩৩ সালে তিনি কায়রোতে স্থানান্তরিত হন। ইসমাঈলিয়ার পাঁচ বছর এ সংগঠন অত্যন্ত চুপে চুপে ও সতর্কতার সাথে তৎপরতা চালায়। মসজিদই ছিল সংগঠনটির মূল কেন্দ্র এবং গোটা জীবনকে ইসলামের রং এ রঙ্গিন করো-এই ছিল সংগঠনের মিশন।

ইসমাঈলিয়া ছাড়াও হাসানুল বান্না ও তাঁর সাথীরা আশপাশের অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যেও দাওয়াত প্রচারের জন্য বের হতেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে তাঁদের টার্গেট হতো নিকটবর্তী এলাকাগুলো। এছাড়া বার্ষিক ছুটির দিনগুলোতে দূর দূরান্তের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁরা ছড়িয়ে পড়তেন। দরস প্রশিক্ষণ এবং আলোচনা ও বক্তৃতা ছিল দাওয়াত প্রচারের মাধ্যম। কতিপয় মাশায়েখ এবং হিংসুটে ব্যক্তি হাসানুল বান্নাকে নিন্দা ও সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু বানায়। তবু এ প্রতিকূল অবস্থাতেও এই নীরব বন্যা বইতে থাকে। সংগঠনের লোকেরা জনসমাবেশে দরস পেশ করেন। তাওহীদ ও আখিরাত হতো তাদের বিষয়বস্তু। মতবিরোধপূর্ণ বিষয় থেকে দেশের সাধারণ অবস্থার পর্যালোচনা করা হতো। জনগণকে অভ্যন্তরীণ ও বাইরের অনিষ্ট সম্পর্কে সচেতন করে তোলা হতো। তাঁদের দাওয়াতে সাড়াদানকারীদের অধিকাংশই শ্রমজীবী মানুষের অন্তর্ভুক্ত ছিল। হাসানুল বান্নার ভাষায়, এমন কোনো গ্রাম অথবা মহল্লা নেই, যেখানে সংগঠনের কর্মীরা পৌঁছেনি। মসজিদে মসজিদে, ঘরে ঘরে এবং বিশ্রাম খানায় গিয়ে তারা দাওয়াত ছড়িয়ে দিয়েছেন।

এ পাঁচ বছরের কাজের ফলাফল হলো- দুবছরের মধ্যে আবু সবীর, পোর্ট সায়ীদ এবং বিলাহু এলাকায় শাখা কায়েম হয়। তৃতীয় বছরে সুয়েজেও এক মজবুত শাখা গঠিত হয়ে যায়। চতুর্থ বছরে দশটি শাখা কায়েম হয়। ইসমাঈলিয়ায় বালিকাদের জন্য খোলা হয় একটি বিদ্যালয়।

ইমাম হাসানুল বান্নার কায়রোর স্থানান্তরিত হওয়ায় দাওয়াতী তৎপরতা এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। এ পর্যন্ত এ ছিল এক প্রাথমিক প্রচেষ্টা। কিন্তু এরপর এটি দেশের একটি বৃহত্তর সংগঠনের মর্যাদায় উন্নীত হয়। অন্যকথায় কায়রোতে ইখওয়ানুল মুসলেমূন এর পরিচিতি একটি পূর্ণাঙ্গ আন্দোলনের রূপ লাভ করে।

আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়
প্রথম পর্যায় ছিল ১৯৩৩ সাল থেকে নিয়ে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত প্রসারিত। এ পর্যায়ে অন্দোলন একটি পূর্ণাঙ্গ রূপে আর্বিভূত হয়। দ্বিতীয় পর্যায় ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এ পর্যায়ে এ দাওয়াত প্রকাশ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে পদার্পণ করে। একটি সুসংহত শক্তি হিসেবে এটি সরকারের দৃষ্টিতে সমস্যার কারণ হয়ে দাড়ায়। সুতরাং পরীক্ষার মেঘ নেমে আসে এর মথার ওপর। তৃতীয় পর্যায় ১৯৪৫ সাল থেকে জুলাই ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত নয় বছরের অন্তর্ভুক্ত। এ পর্যায়ে একদিকে ইখওয়ানের অন্দোলন মিসরের প্রতিটি কর্নারে সম্প্রসারিত হয়। অপরদিকে এর ওপর চরম দমননীতি আরোপ করা হয়। এ পর্যায়েই ইমাম হাসানুল বান্নার শাহাদাত সংঘটিত হয়। অধ্যাপক হাসানুল হোযাইবী আন্দোলনের নতুন মুরশিদে আম নির্বাচিত হন। এরপর দেশে সেনা বিপ্লব সংঘটিত হয়। অতঃপর বিপ্লবী সরকারের হাতে ইখওয়ানকে অবৈধ ঘোষণা এবং এর নেতৃবৃন্দকে ফাঁসীর শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে এ পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। এ তিনটি পর্যায়ের সংক্ষিপ্ত কার্যবিবরণী নিম্নরূপঃ


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি