তৃতীয় অধ্যায়
বিবাহ-শাদী ও পারিবারিক জীবনে হালাল-হারাম
স্বভাবগত কামনা চরিতার্থ করার ক্ষেত্রসীমা
বিবাহ
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক
জন্মনিয়ন্ত্রণ
তালাক
পিতামাতা ও সন্তানদের পারস্পরিক সম্পর্ক
স্বাভাবিক কামনা চরিতার্থ করার ক্ষেত্রসীমা
আল্লাহ্ তা’আলা দুনিয়ায় মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এ উদ্দেশ্যে যে, মানুষ এখানে আল্লাহর খিলাফতের দায়িত্ব ও দুনিয়া আবাদকরণের কর্তব্য পালন করবে। এ কাজ সুসম্পন্ন হওয়ার জন্যে মানব প্রজাতির অস্তিত্ব রক্ষা পাওয়া এবং এখানে তাদের জীবনধারা অব্যাহতভাবে চলতে থাকা একান্তই আবশ্যক। তাহলেই মানুষ এখানে চাষাবাদের কাজ করতে পারে, শিল্প-প্রতিষ্ঠান কায়েম করে নিত্য পরিবর্তনশীল প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি উৎপাদন করতে পারবে। এক কথায় পৃথিবী আবাদকরণ, মানব সমাজের প্রতিষ্ঠা বিধান এবং আল্লাহর ন্যস্ত করা দায়িত্ব সমূহ পালন করে আল্লাহর হক্ক আদায় করা সম্ভবপর হতে পারে। এই উদ্দেশ্যের বাস্তবতা বিধানের জন্যেই আল্লাহ্ তা’আলা মানুষের স্বভাবে কতগুলো মৌলিক দাবি ও কামনা-বাসনা স্পৃহা-প্রবৃত্তি সুসংহত করে জন্মগতভাবেই রেখে দিয়েছেন। এই জিনিসই ব্যক্তি ও সমষ্টি গোটা মানব প্রজাতির স্থিতি ও অব্যাহত অগ্রগতির নিমিত্ত হয়ে আছে। মানুষকে এ কাজের জন্যে বাদ্য করে দেয়া হয়েছে।
তন্মধ্যে একটি হচ্ছে খাবার গ্রহণের ইচ্ছা। মানুষ পেট ভরে খাবার গ্রহণে উদ্যোগী হয় তার স্বাভাবিক ইচ্ছার কারণেই এবং এর ফলেই জীবনে বেচেঁ থাকা তার পক্ষে সম্ভবপর হয়।
দ্বিতীয় হচ্ছে, যৌন ইচ্ছা-কামনা-বাসনা। এরই ওপর মানব প্রজাতির রক্ষা পাওয়া- বংশের ধারা অব্যাহতভাবে নির্ভর করে। মানব প্রকৃতি নিহিত এই স্পৃহা অত্যন্ত তীব্র, শক্তিশালী ও নিয়ন্ত্রণ-অযোগ্য। তার বিশেষত্ব হচ্ছে, তা প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার নিজের ইচ্ছা-বাসনা হিসেবে চরিতার্থ করতে বাধ্য করতে একান্তভাবে বাধ্যঃ
যৌন স্পৃহা পর্যায়ে মানুষের ভূমিকা
১. মানুষ হয় এ স্পৃহার লাগাম খুলে দেবে। তা যদৃচ্ছ ও যত্রতত্র চরিতার্থ করার পথে কোন নিয়ন্ত্রণ বা সংযম রক্ষা করবে না। এ জন্যে কোন দ্বীনী, নৈতিক বা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা বা নিয়ন্ত্রণকে একবিন্দু আমল দেবে না, সবকিছু লংঘন করে যাবে। এ ক্ষেত্রে একটি মত হচ্ছে, সবকিছু করা যাবে, কোন কিছুই নিষিদ্ধ নয়। এ মতের লোকেরা না কোন দ্বীন মানে, না কোন নৈতিক পবিত্রতায় তারা বিশ্বাসী। যৌন স্পৃহা চরিতার্থ করণে এ লোকেরা এই ভূমিকাই অবলম্বন করে। কিন্তু এ ভূমিকা মানুষকে পশু ও জন্তু-জানোয়ারের পর্যায়ে নিয়ে যায়। আর ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ তথা রাষ্ট্রে সর্বাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনে।
২. দ্বিতীয় ভূমিকা এই হতে পারে যে, এ স্পৃহার মুকাবিলা করা হবে, তাকে প্রবল শক্তিতে দমন করা হবে, তাকে সমূলে ধ্বংস করা হবে, যেন এ ইচ্ছাটা কখনই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। কৃচ্ছ সাধনা, বৈরাগ্যবাদ ও সবকিছু থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখার প্রবণতা যাদের, এক্ষেত্রে তারাই উপরিউক্ত ভূমিকা অবলম্বন করে। এই ভূমিকায় এ স্বভাবগত প্রবণতাটাই খতম হয়ে যায়। এ স্পৃহা চরিতার্থ করার জন্যে জন্মগতভাবেই যে ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এ স্পৃহা মানব বংশ রক্ষায় যে অবদান রাখতে সক্ষম, উক্ত ভূমিকা তার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
৩. তৃতীয় ভূমিকা এই হতে পারে যে, এ স্পৃহা চরিতার্থ করার জন্যে একটা নিয়ম ও নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করা হবে। তা এ নিয়ম ও নিয়ন্ত্রণের সীমার মধ্যে স্বাধীন ও উন্মুক্ত হবে, তাকে নির্মূলও করা হবে না, না পাগলের ন্যায় সীমালংঘনের কোন অনুমতি দেয়া হবে। আসমানী ধর্মসমূহ এই নীতিই করেছে। এ কারণে প্রায় সমস্ত ধর্মেই ব্যভিচার হারাম করা হয়েছে এবং বিবাহের সুষ্ঠু ব্যবস্থার প্রচলন করেছে। বিশেষত দ্বীন-ইসলাম মানুষের স্পৃহাকে স্বভাবগত শক্তিরূপে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তা হালাল পথে চরিতার্থ করার জন্যে পন্থা উদ্ভাবন করেছে। অবিবাহিত ও নারী সংস্পর্শ পরিহার করে চলার প্রবণতাকে নিন্দা ও নিষেধ করেছে। অপর দিকে জ্বেনা-ব্যভিচার ও তার আনুসঙ্গিক যে যে কাজ মানুষকে সে দিকে টেনে নিয়ে যায়, তা সবই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে।
বিবেচনা করে দেখলেই স্বীকার করতে হবে যে, ইসলাম অবলম্বিত নীতি ও ভূমিকাই মধ্যম ও সুবিচার ভারসাম্যপূর্ণ নীতি। কেননা বিবাহের ব্যবস্থা কার্যকর না হলে এ স্বভাবগত শক্তি মানব বংশের ধারা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে তার দায়িত্ব পালন করতে অক্ষম থেকে যেত। পক্ষান্তরে জ্বেনা-ব্যভিচার হারাম করা না হলে নারীর জন্যে কোন পুরুষের সাথে বিবাহিত হয়ে নির্দিষ্ট হয়ে থাকার ব্যবস্থা দেয়া না হলে সেই পরিবার ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারত না, যা প্রেম-প্রীতি প্রণয়-ভালবাসার লীলাকেন্দ্র হয়ে থাকে। এরূপ পরিবার সংস্থা গড়ে না উঠলে সমাজ গড়ে উঠতে পারে না। সমাজের উন্নতি অগ্রগতিরও কোন সুযোগ আসতে পারে না।
জ্বেনার কাছেও যাবে না
আমরা যখন দেখি, সমস্ত আসমানী দ্বীনই ঐক্যবদ্ধভাবে জ্বেনা-ব্যভিচারকে সম্পূর্ণরূপে হারাম করে দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষিত হয়েছে তখন আমাদের মনে এক বিন্দু বিস্ময়ের উদ্রেক হয় না। ইসলাম হচ্ছে আসমান থেকে অবতীর্ণ সর্বশেষ দ্বীন। এ ব্যাপারে তা খুব বেশি কঠোরতা অবলম্বন করেছে, নিষেধ করেছে, হারাম ঘোষণা করেছে এবং বংশ সংমিশ্রিত হওয়ার, বংশ বিনষ্ট হওয়ার, পারিবারিক ভাঙন ও বিপর্যয় সূচিত হওয়ার, পারস্পরিক শুভ সম্পর্ক বিনষ্ট হওয়ার, সংক্রামক ব্যধির প্রবাল্য সৃষ্টি হওয়ার, লালসার তীব্রতা বৃদ্ধির ও চরিত্র ধ্বংস হওয়ার সমস্ত কারণ সম্পর্কে বিশেষ সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। এ জন্যেই আল্লাহ্ তা’আলা শুধু জ্বেনা নিষেধ করেই ক্ষান্ত হন নি, তিনি বলেছেনঃ (আরবী****************)
তোমরা জ্বেনার কাছেও যাবে না। কেননা তা অতন্ত নির্লজ্জতার কাজ এবং খুবই খারাপ পথ। (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৩২)
আমরা দেখছি, ইসলাম যখন কোন কাজকে হারাম করে, তখন সেই হারাম কাজের সব ছিদ্রপথ- যে যে কাজ সেই পর্যন্ত মানুষকে পৌঁছে দেয় তা সবই বন্ধ করে হারাম ঘোষণা করে।
অতএব যেসব কাজ যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি করে, নারী বা পুরুষকে যা নৈতিক পতনের মুখে নিয়ে যায়, নির্লজ্জ কজে উদ্বুদ্ধ করে কিংবা তার কাছে পৌঁছে দেয়, সে কাজ সহজতর করে দেয়, ইসলাম সেসবই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, সম্পূর্ণ হারাম করে দিয়েছে। কেননা হারামের পথ উন্মুক্ত ও সহজসাধ্য হয়ে থাকলে সেই মূল হারাম থেকে রক্ষা পাওয়া কারো পক্ষেই সম্ভবপর হয় না। বিপর্যয় রোধ করা হয়ে যায় সম্পূর্ণ অসম্ভব।
ভিন মেয়েলোকের সাথে নিভৃতে সাক্ষাৎ হারাম
এ পর্যায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, ভিন্ মেয়েলোকের সাথে নিভৃত একাকীত্বে একত্রিত হওয়া এমতাবস্থায় যে, সে মেয়েলোকটি তার বিবাহিতা স্ত্রী নয়, মা-বোন-ফুফু-খালা প্রভৃতি মুহররমও নয়। এটা নিছক কোন অবিশ্বাসের ব্যাপার নয় বরং এরূপ অবস্থায় শয়তানী ওয়াসওয়াসায় পড়ে দুজনই চরিত্র হানিকর কাজে লিপ্ত হতে পারে। তা থেকে তাদের রক্ষা করার ব্যবস্থা এটা। মোমের সূতায় আগুন লাগালে তাপে মোম গলতে থাকাই স্বাভাবিক। দুই ভিন্ মেয়ে-পুরুষ যুবক-যুবতীর নিভৃত একাকীত্বে একত্রিত হতে পারাটাই উভয়কে পারস্পরিক আকর্ষণে একাকার করে দেয়ার অনিবার্য পরিস্থিতির উদ্ভব না হওয়াই বরং অস্বাভাবিক। কেননা তথায় তৃতীয় কেউ নেই। এ পর্যায়ে রাসূলে করীম (সা)-এর বাণী স্মরণীয়। ইরশাদ হয়েছেঃ (আরবী****************)
আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি যার ঈমান আছে সে যেন কোন নারীর সাথে এভাবে নিভৃত একাকীত্বে মিলিত না হয় যে, তথায় কোন মুহাররাম (পুরুষ বা মেয়েলোক) নেই। কেননা এরূপ সময়ে এ দুই জনের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত থাকবে শয়তান। আর শয়তানের কারসাজি তো সকলেরই জানা আছে। (মুসনাদে আহমদ)
নবীর বেগমদের সম্পর্কে কুরআন মজীদের আয়াতঃ (আরবী****************)
তোমরা যদি নবীর বেগমগণের কাছে কোন জিনিস চাও তাহলে পর্দার আড়ালে থেকে চাইবে। তোমাদের ও তাদের অন্তর পবিত্র রাখার জন্যে এ এক উত্তম ব্যবস্থা। (সূরা আহযাবঃ ৫৩)
এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে ইমাম কুরতুবী লিখেছেনঃ
এ আয়াতে সে সব ভাবধারার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা মেয়েদের জন্যে পুরুষদের মনে ও পুরুষদের জন্যে মেয়েদের মনে স্বভাবতই জেগে ওঠে অর্থাৎ ‍যদি পর্দার আড়ালে থেকে জিনিস চাওয়ার এ নীতি পালন করা হয়, তাহলে কোনরূপ সন্দেহের উদ্রেক হবে না। কেউ কোন মিথ্যা দোষারোপও করতে পারবে না। আর আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্যেও এ ব্যবস্থা অধিক সতর্কতামূলক। এ থেকে একথাও বুঝতে পারা যায় যে, গায়র মুহাররম স্ত্রী লোকের সাথে নিভৃত একাকীত্বে মিলিত হলে নিজেকে বেঁধে না রাখতে পারার আশংকাই বেশি। তাই তা এড়িয়ে চলা উত্তম। এ পর্যায়ে নিজের নৈতিক পবিত্রতা রক্ষা করাও সহজ।
এ পর্যায়ে রাসূলে করীম (সা) স্বামীর নিকটাত্মীয়দের সাথে স্ত্রীর ঘনিষ্ট মেলামেশার ব্যাপারেও সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। স্বামীর ভাই, চাচাতো ভাই ইত্যাদিই স্বামীর নিকটাত্মীয় এবং এদের সাথে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এ ক্ষেত্রে প্রায়ই উপেক্ষা অবলম্বন করতে দেখা যায় এবং পরিণতি সম্পর্কে খুব কমই চিন্তা করা হয় অথচ আপন জনের সাথে ঘনিষ্ঠতা ও ‍নিবিড় একাকীত্ব অধিকতর বিপজ্জনক। এরূপ অবস্থায় পদস্খলন হওয়াও অস্বাভাবিক বা বিরল নয়।
কেননা, ‘আপনজন’ যত সহজে স্ত্রীলোকের ঘরে প্রবেশ করতে পারে- প্রবেশ করলে কারো কিছু বলার থাকে না- সম্পূর্ণ অনাত্মীয় ও অপরিচিত জনের পক্ষে ততটা সহজ নয়।
স্ত্রীর নিজের অ-মুহাররম নিকটাত্মীয় পুরুষদের ক্ষেত্রেও এই কথা। তর চাচাতো ভাই, খালাতো-মামাতো ভাই এ পর্যায়ে গণ্য। কাজেই এদের মধ্যে কারো সাথে একাকীত্বে মিলিত হওয়া জায়েয নয়। নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেনঃ (আরবী****************)
তোমরা ভিন্ মেয়েলোকদের ঘনিষ্ঠ একাকীত্বে প্রবেশ করবে না। একজন আনসারী সাহাবী বললেনঃ হে রাসূল! আপনি স্বামীর নিকটাত্মীয়দের সম্পর্কে কি বলেন? রাসূলে করীম (সা) বললেনঃ স্বামীর নিকটাত্মীয়রা মৃত্যু সমতুল্য।
অর্থাৎ এই ঘনিষ্ট একাকীত্ব বিপদ ও ধ্বংস ডেকে আনে। গুনাহ যদি সঙ্ঘটিত হয়েই যায় তাহলে তো দ্বীনের দিক দিয়ে ধ্বংস হলো, আর স্বামী তা জানতে পেরে তাকে তালাক দিয়ে দিলে দাম্পত্য জীবনের বিপর্যয় শুরু হয়ে গেল। উপরন্তু নিকটাত্মীয়দের পরস্পরের প্রতি সন্দেহ, খারাপ ধারণা ও অনাস্থা এসে গেলে সামাজিক-সামস্টিক জীবনের সম্পর্ক-বন্ধন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। আর এ এক সর্বাত্মক বিপর্যয় সন্দেহ নেই।
সত্য কথা এই যে, ভিন্ পুরুষ নারীর নিভৃতে একাকীত্বে মিলিত হওয়ার প্রভাব শুধু মানুষে হৃদয়বেগ ও চিন্তা-ভাবনার ওপরই পড়ে না, গোটা পরিবার, স্বামী-স্ত্রী- দাম্পত্য জীবনের স্থিতি এবং তাদের পারস্পরিক গোপন কথাবার্তা ইত্যাদি সব কিছুর ওপরই তার তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। উপরন্তু তা থেকে মিথ্যা দোষারোপকারী ও বকবককারী লোকদের পক্ষে ভিত্তিহীন কথা বলার একটা বিরাট সুযোগ জুটে যায়। এ ধরনের লোকদের লক্ষ্য দাম্পত্য জীবনের স্থিতি নিয়ে আসা নয়; ভাঙন বিপর্যয় সৃষ্টি করা মাত্র।
ইবনুর আমীর বলেছেন, আরবরা যেমন বলে (আরবী****************) (সিংহই মৃত্যু), বলে, (আরবী****************) (প্রশাসক আগুল), অর্থাৎ এ দুটো জিনিসের সাথে সাক্ষাৎ মানুষের জন্যে মৃত্যু ও আগুনের সাথে সাক্ষাতের সমান; তেমনি তারা বলে (আরবী****************) (স্বামীর নিকটাত্মীয় মৃত্যু তুল্য) অর্থাৎ স্বামীর নিকটাত্মীয়দের সাথে নিভৃত মিলিত হওয়া নিতান্ত অপরিচিত-অনাত্মীয় পুরুষের সাথে নিভৃত মিলিত হওয়ার তুলনায় অধিক মারাত্মক ও বিপজ্জনক। কেননা তারা অনেক সময় স্ত্রীর মনে এমন এমন জিনিসের চাহিদা সৃষ্টি করে দেয়, যা সংগ্রহ করে দেয় স্বামী-বেচারার পক্ষে বড়ই কঠিন ও দুষ্কর হয়ে থাকে। অনেক সময় তারা খারাপ আচরণ করতে উদ্ধত হয়ে থাকে। তা ছাড়া স্বামীর আত্মীয়-স্বজন তার অনুপস্থিতিতে তার ঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তার গোপন অবস্থার তত্ত্ব জেনে যাবে, তা সে আদৌ পছন্দ করতে পারে না।
বিপরীত লিঙ্গের প্রতি লালসার দৃষ্টিতে তাকান
পুরুষ ভিন্ স্ত্রীলোকের ওপর দৃষ্টিপাত করবে কিংবা নারী ভিন্ পুরুষের প্রতি, ইসলাম এ ব্যাপারটিকে হারাম ঘোষণা করেছে। কেননা চক্ষু হৃদয়ের কুঞ্চিকা। দৃষ্টি বিপর্যয়ের আগাম সংবাদদাতা শক্তি, তা-ই জ্বেনার বার্তা বহনকারী। একজন প্রাচিন আরব কবি বলেছেনঃ (আরবী****************)
সর্বপ্রকার দুর্ঘটনার সূচনা দৃষ্টি থেকেই হয়। সামান্য ষ্ফুলিঙ্গ থেকেই সর্বগ্রাসী অগ্নিকুণ্ডলি জ্বলে উঠে।
এ কালের একজন কবি বলেছেনঃ (আরবী****************)
প্রথমে দৃষ্টি, পরে মিষ্টি স্মিত হাসি, তারপরে অভিবাদনের বিনিময়। তারপরে কথাবার্তা, তারপরে ওয়াদা প্রতিশ্রুতি আর শেষে সাক্ষাতকার।
এ করণে আল্লাহ্ তা’আলা সমস্ত মুমিন নারী-পুরুষকে পারস্পরিক চক্ষু নত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, সেই সাথে দিয়েছেন লজ্জাস্থানের পবিত্রতা সংরক্ষণ করার হুকুম। বলেছেনঃ (আরবী****************)
মুমিন পুরুষদের বল তাদের দৃষ্টি নত রাখতে ও তাদের লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করতে। এ নীতিই তাদের জন্যে পবিত্রতার। তারা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ্ খুবই অবহিত। অনুরূপভাবে ঈমানদার মহিলাদের বল তাদের দৃষ্টি নত রাখতে ও তাদের লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করতে।
এ দুটি আয়াতে নারী ও পুরুষ উভয়কেই নিজেদের দৃষ্টি নত রাখতে ও লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দৃষ্টি নত রাখার জন্যে দেয়া নির্দেশের কুরআনে উদ্ধৃত ভাষা হচ্ছেঃ (আরবী****************) অর্থাৎ গোটা দৃষ্টি নত রাখার নয়, কোন কোন দৃষ্টি নত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ পর্যায়ে কোন কোন অংশের কথা বলা হয়নি, সম্পূর্ণ ও সমগ্রভাবে সংরক্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়েছ। কেননা শরীয়তের তাই কাম্য। কিন্তু দৃষ্টির ব্যাপারটি ভিন্নতর। প্রয়োজন পূরণ, বিপদ দূরীকরণ ও কল্যাণের পথ দেখার অপরিহার্যতার জন্যে আল্লাহ্ তাতে বিশেষ নম্রতা ও উদারতা দেখিয়েছেন। কিন্তু লজ্জাস্থানের ব্যাপারে এরূপ নয়।
অতএব কোন দৃষ্টি নত রাখার অর্থ এ নয় যে, মানুষকে চোখ বন্ধ করে নিতে হবে কিংবা মাথা মাটির দিকে এমনভাবে নুইয়ে নিতে হবে যে, মাটি ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। আয়াতের বক্তব্যও তা নয়। আর তা সম্ভবপরও নয়। সূরা লুকমানের ১৯ আয়াতে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************) –এবং নিম্ন কর তোমার কোন কোন কণ্ঠধ্বনি।’ এ আয়াতে মুখ বন্ধ করে রাখতে বলা হয়নি, কণ্ঠের সব রকমের আওয়াজই যে ক্ষীণ হতে হবে এমন কথাও নয়। (আরবী****************) –এর অর্থ দৃষ্টিকে যথেচ্ছ বিচরণ করতে দেবে না, কাছাকাছি সব কিছুর ওপর দৃষ্টি পড়া বাঞ্ছনীয় নয়। কাজেই বিপরীত লিঙ্গের ওপর দৃষ্টি পড়লে- না দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করে তার সৌন্দর্য-সুদা পান করায় লিপ্ত হবে, না ঘুরে ফিরে বারে বারে তাকে দেখবে। এ-ই হচ্ছে আয়াতের আসল বক্তব্য।
রাসূল করীম (সা) হযরত আলী (রা)-কে বলেছেনঃ (আরবী****************)
হে আলী, দৃষ্টির পর দৃষ্টি ফেলবে না। তুমি প্রথমবারই দেখতে পার, তারপর দ্বিতীয় বার নয়। (আহমদ, আবূ দাঊদ, তিরমিযী)
বিপরীত লিঙ্গের ওপর লোভী কামুক দৃষ্টিতে তাকানকে চোখের জ্বেনা বলেছেন। হাদীসের ভাষায় হচ্ছেঃ (আরবী****************)
চোখদ্বয়ও ব্যভিচার করে। আর তা হচ্ছে দৃষ্টিপাত। (বুখারী)
‘দৃষ্টিপাত’ কে জ্বেনা বলেছেন এজন্যে যে, তাতেও এক প্রকারের স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ ঘটে। আর এ উপায়ে শরীয়ত-বিরোধী পন্থায় যৌন স্পৃহা চরিতার্থ করা হয়। ইনজীরে উদ্ধৃত হযরত ঈসার মুখ থেকেও অনুরূপ উক্তি রয়েছেঃ
আগে থেকে তোমাদের বলা হচ্ছিল যে, জ্বেনা করবে না, কিন্তু আমি বলছি, যে নিজ চোখ দিয়ে দেখল, সে জ্বেনা-ই করল।
এই লোভী লালসাপংকিল দৃষ্টি কেবল চারিত্রিক পবিত্রতা ও সতীত্বের জন্যেই বিপদজ্জনক নয়, মনের একনিষ্ঠতা ও হৃদয়ের শান্তি-স্বস্তির পক্ষেও তা খুবই ক্ষতিকর। কেননা তাতে মনে চরম অস্বস্তি ও অস্থিরতার সৃষ্টি হওয়া অবশ্যম্ভাবী।
লজ্জাস্থানের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ হারাম
ইসলামে দৃষ্টি নত রাখার নির্দেশ এক সাধারণ নির্দেশ। তাই লজ্জাস্থানের প্রতি দৃষ্টিপাত হলে সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নেয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। কেননা নবী করীম (সা) লজ্জাস্থানের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে নিষেধ করেছেন, তা কোন পুরুষের লজ্জাস্থান হোক কিংবা স্ত্রীলোকের, যৌন স্পৃহা সহকারে হোক কিংবা তা ছাড়াই এবং এ নির্দেশ নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যে সমানভাবে প্রযোজ্য। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
কোন পুরুষ অপর পুরুষের লজ্জাস্থানের দিকে এবং কোন নারী অপর নারীর লজ্জাস্থানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে না। এবং এক কাপড়ে কোন পুরুষ অপর পুরুষের সঙ্গে এক নারী অপর নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবে না।
পুরুষের লজ্জাস্থান বলতে বোঝায় নাভি থেকে হাটু পর্যন্তকার দেহাংশ। এ দিকে কোন পুরুষ বা মেয়েলোকের নজর দেয়া জায়েয নয়। অবশ্য ইবনে হাজম প্রমুখ কতিপয় ইমামের মতে উরু এর মধ্যে গণ্য নয়।
আর নারীর লজ্জাস্থান ভিন্ পুরুষের জন্যে মুখমণ্ডল ও দুই হাতের পাঞ্জাদ্বয় ব্যতীত সমগ্র দেহ। আর মুহাররম পুরুষের জন্যে- যেমন তার পিতা, ভাই- স্ত্রীলোকের লজ্জাস্থান সম্পর্কে আমরা পরে আলোচনা করব।
পরন্তু দেহের যে অংশ লজ্জাস্থান বলে চিহ্নিত, যার প্রতি অপর কারো দৃষ্টিপাত জায়েয নয়, তা হাত বা দেহাংশ দিয়ে স্পর্শ করাও অপরের জন্যে জায়েয নয়।
লজ্জাস্থান দেখা বা স্পর্শ করা সম্পর্কে এই যা কিছু বলা হলো তা সাধারণ অবস্থার কথা- যখন বাস্তবিকই কোন প্রয়োজন দেখা দেয় না। কিন্তু যদি সত্যিই কোন প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে তখন তা হারাম হবে না; যেমন চিকিৎসা বা রিলিফ করা কালে এ প্রয়োজন দেখা দিয়ে থাকে। আর দৃষ্টিদান জায়েয বলে যা বলা হলো, তা এ শর্তে যে, এরূপ দৃষ্টিদানে কোনরূপ বিপদ ঘটার কারণ হবে না। অন্যথায় দৃষ্টিদানের অনুমতি নকচ হয়ে যাবে। কেননা মূল পাপের পথ বন্ধ করা শরীয়তের একটা প্রধান নিয়ম।
পুরুষ বা নারীর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ
উপরে যা বলা হল তা থেকে এ কথাটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, পুরুষের লজ্জাস্থান বহির্ভূত- নাভি থেকে হাটু পর্যন্ত ছাড়া- দেহের অন্যান্য অংশের ওপর নারীর দৃষ্টি নিক্ষেপ জায়েয হবে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ তাতে কোনরূপ যৌন স্পৃহা না জাগবে বা কোন ধরনের বিপদের আশংকা না থাকবে। রাসূলে করীম (সা) হযরত আয়েশা (রা)-কে হাবশীদের প্রতি তাকানোর অনুমতি দিয়েছিলেন, তারা তাদের অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মসজিদে নববীতেই খেলা দেখাচ্ছিল। ফলে তিনি তাদের প্রতি পর্দার আড়াল থেকে তাকিয়ে দেখছিলেন। পরে তিনি নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়লে সেখান থেকে চলে গেলেন। (বুখারী, মুসলিম)
নারীর লজ্জাস্থান বহির্ভূত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ- মুখমণ্ডল ও দুই হাতের পাঞ্জার প্রতি পুরুষের তাকান জায়েয, যদি তাতে কোনরূপ যৌন লালসার সংমিশ্রণ না থাকে কিংবা পাপ সঙ্ঘটিত হওয়ার আশংকা না থাকে।
হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত হযরত আসমা বিনতে আবূ বকর (রা)- তাঁর বোন- নবী করীম (সা)-এর সম্মুখে হাযির হলেন। তার পরনে এমন পাতলা কাপড় ছিল যে, তা দিয়ে তাঁর দেহের কান্তি প্রস্ফূটিত হচ্ছিল। নবী করীম (সা) তা দেখে দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলেন এবং বললেনঃ (আরবী****************)
হে আসমা, মেয়েলোক যখন পূর্ণ বয়স্ক হয়ে যায়, তখন তার মুখমণ্ডল ও হাতের পাঞ্জাদ্বয় ব্যতীত দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কোন কিছুই দৃশ্যমান হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। (আবূ দাঊদ)
হাদীসটি যদিও সূত্রের বিচারে দুর্বল, কিন্তু এ পর্যয়ে বহু কয়টি সহীহ হাদীসে বিহদের আশংকা না থাকলে মুখমণ্ডল ও হাতের পাঞ্জাদ্বয়ের ওপর দৃষ্টিপাত জায়েয হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে বলে উক্ত হাদীসটির সে দুর্বলতা দূর হয়ে গেছে।
সারকথা হচ্ছে, পুরুষ বা নারীর লজ্জাস্থান বহির্ভূত অঙ্গের প্রতি নির্দোষ দৃষ্টিপাত জায়েয এবং হালাল। তবে বারবার তাকানো এবং সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে স্বাদ নিয়ে তাকানো জায়েয নয়। কেননা তাতেই বিপদ সঙ্ঘটিত হওয়ার আশংকা রয়েছে।
তবে যে অঙ্গ দেখা হালাল নয় তার দিকে আকস্মিকভাবে দৃষ্টি পড়ে যাওয়ায় কোন দোষ ধরা হবে না। এটা ইসলামের উদারতা। হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেনঃ (আরবী****************)
রাসূলে করীম (সা)-কে আকস্মিক দৃষ্টি পড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃ তোমার দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নাও।
অর্থাৎ সে একবারের পর দ্বিতীয়বার তাকাবে না।
নারীর সৌন্দর্য প্রকাশ সমস্যা
উপরে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়া সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে। দুটো আয়াতে এ পর্যায়ে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যে বিধান দেয়া হয়েছে। এর তৃতীয় আয়াতটিতে নারীদের জন্যে বিশেষভাবে একটি নের্দেশের উল্লেখ হয়েছে। নির্দেশটি এইঃ (আরবী****************)
তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না। তবে যা স্বতঃই প্রকাশ হয়ে পড়ে তার কথা স্বতন্ত্র। (সূরা নূরঃ ৩১)
নারীর ‘সৌন্দর্য’ বলতে সেসব জিনিসই বোঝায়, যা তাকে সৌন্দর্যমণ্ডিতা ও রূপসী বানিয়ে দেয়। এর মধ্যে মুখমণ্ডল, কেশদাম ও দৈহিক লালিমা প্রভৃতি জন্মগত সৌন্দর্য শামিল রয়েছে। যেমন রয়েছে কাপড়, অলংকার ও প্রসাধনী দ্রব্যাদি প্রভৃতি দ্বারা অর্জিত সৌন্দর্য ও রূপ-মাধুর্য। আল্লাহ্ তা’আলা পূর্বোদ্ধৃত আয়াতটিতে নারীদের নির্দেশ দিয়েছেন তাদের সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখতে, প্রকাশ হতে না দিতে। তা থেকে বাইরে থাকছে শুধু তা যা স্বতঃই প্রকাশ হয়ে পড়ে।
এই স্বতঃই প্রকাশ হয়ে পড়ে বলতে কি বোঝায়, তা নির্ধারণে বিভিন্ন তাফসীরকার বিভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।
প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ‘স্বতঃই প্রকাশ হয়ে পড়ে’ বলতে প্রয়োজনের কারণে কোনরূপ ইচ্ছা ছাড়াই যা প্রকাশ হয়ে পড়ে তা-ই কি বোঝায়? যেমন বাতাসের ঝাপটায় কোন কিছু প্রকাশ হয়ে পড়ল? অথবা তার অর্থ হবে, সাধারণত ও অভ্যাসবশত যা প্রকাশিত হয়? .....এ ব্যাপারে আসল কথা হচ্ছে প্রকাশিত হওয়া।
পূর্বকালের মনীষীদের মধ্যে অধিকাংশ লোক এ শেষোক্ত মতই পোষণ করতেন বলে বর্ণিত হয়েছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি ‘যা স্বতঃই প্রকাশ হয়ে পড়ে’ অংশের তাফসীরে বলেছেন, তা হচ্ছে চোখের সুরমা, কাজল, পাউডার, অঙ্গুরীয় প্রভৃতি। হযরত আনাস (রা) থেকেও অনুরূপ মত বর্ণিত হয়েছে।
চোখে সুরমা লাগান ও আঙ্গুলে আঙ্গুরীয় পরিধান করা মুবাহ্। সেজন্যে এ দুটো স্থানের প্রকাশ পাওয়া অনিবার্য। আর তা হচ্ছে মুখমণ্ডল ও পাঞ্জাদ্বয়। হযরত সায়ীদ ইবনে জুবাইর, আতা, আওযায়ী প্রমুখ থেকেও এরূপ মতই বর্ণিত হয়েছে।
হযরত আয়েশা ও কাতাদাহ প্রমুখ দুহাতের কংকনকেও এর মধ্যে শামিল করেছেন। যে সৌন্দর্য প্রকাশ করা নিষিদ্ধ, বাহুর সে অংশ তা থেকে বাদ পড়ে যায়। মুষ্টি থেকে অর্ধেক বাহু পর্যন্ত সীমা নির্ধারণে মতের বিভিন্নতা বিদ্যমান।
এ প্রশস্ততার বিপরীত অন্যরা সংকীর্ণতার অবতারণা করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ ও নখয়ী প্রমুখ ‘যা স্বতঃই প্রকাশিত হয়ে পড়ে’ কথাটির ব্যাখ্যায় বলেছেন, তা হচ্ছে চাদর ও কাপড়, যা দেহের বাইরে পরা হয়। কেননা তা গোপন করা ও ঢেকে রাখা সম্ভব নয়।
তবে সাহাবী ও তাবেয়ীনের অনেকে ‘যা স্বতঃই প্রকাশিত হয়ে পড়ে’ কথাটির ভিত্তিতে স্পষ্ট করে বলেছেন যে, তা হচ্ছে মুখমণ্ডল ও দুই পাঞ্জা এবং এ ছাড়া যে সৌন্দর্য থাকবে না, তা। আর আমি এ সবকেই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য বলে মনে করি। হাতের আঙ্গুরীয় ও চোখের সুরমা ইত্যাদি এর মধ্যে গণ্য।
সিঁদুর, পালিশ, পাউডারের ব্যাপারটি এ থেকে ভিন্নতর। একালের মেয়েরা এসব কপোল, ওষ্ঠাধর ও নখে ব্যবহার করে। কিন্তু তা খুব অবাঞ্ছনীয় বাড়াবাড়ি। এসব শুধু ঘরের মধ্যেই ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু অধুনা মেয়েরা ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় পুরুষদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে এসব ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এ কাজটি সম্পূর্ণ হারাম। ‘যা স্বতঃই প্রকাশিত হয়’-এর অর্থে শুধু চাদর বা বোরকা প্রভৃতি বাহ্যিক জিনিসগুলোই বোঝান হয়েছে’ মনে করা সমীচীন নয়। কেননা এসব কাপড়ের প্রকাশিত হওয়া তো একটা অতি স্বাভাবিক ব্যাপার, প্রকাশ না হয়েই পারে না। তাই তা গোপন করার কোন আদেশ হতেই পারে না। আর শুধু ‘বাতাসের ধাক্কায় যা প্রকাশিত হয়ে পড়ে’ মনে করাও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা এতে মানুষের কোন দখল নেই। কাজেই সে বিষয়ে কিছু বলা-না-বলা সমান। ঐ কথাটি দ্বারা যা সহজেই বুঝতে পারা যায়, তা হচ্ছে, যা লুকানো যায়, প্রকাশ করার ব্যাপারে এগুলো বাদ যাবে। ঈমানদার মহিলাদের জন্যে এটা একটা সুবিধা দান পর্যায়ের কথা। আর এ সুবিধাদান যে মুখমণ্ডল ও কবজিদ্বয় সম্পর্কেই থাকা উচিত, তা অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত কথা।
মুখমণ্ডল ও পাঞ্জাদ্বয় সম্পর্কে এ সুবিধাদানের যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে হবে। কেননা এ দুটো সব সময় লুকিয়ে রাখা মেয়েদের জন্যে খুবই কষ্টকর। বিশেষ করে বৈধ প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে হলে তখন যে এ দুটো অংশ প্রকাশ করা জরুরী হয়ে পড়ে তা অস্বীকার করা যায় না। যেমন বিধাবা মেয়েলোকের পক্ষে তার ইয়াতীম সন্তানদের জন্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করা এবং দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের তাদের স্বামীদের সাহায্যার্থে বাইরে বের হতে হলে মুখমণ্ডল ও কবজি উন্মুক্ত করা তো অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এরূপ অবস্থায় মুখমণ্ডল ও কবজিদ্বয় আবৃত করা হলে চলাফেরা করা বড়ই কঠিন ও কষ্ঠকর হয়ে পড়বে।
ইমাম কুরতুবী বলেছেনঃ
চেহারা ও কবজিদ্বয় সাধারণতঃ বিশেষ করে নামায, হজ্জ, উমরা প্রভৃতি ইবাদত করার সময়- খুলেই যায়। তাই ‘তবে স্বতঃই যা প্রকাশিত হয়ে পড়ে’ বলে এসব অঙ্গ আবৃত রাখার নির্দেশের বাইরে রাখা হয়েছে বলে মনে করাই অধিকতর যথার্থ কথা। হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীস এ কথাই বলে। হাদীসটি এই (পূর্বেও উদ্ধৃত হয়েছে) : (আরবী****************)
হযরত আবূ বকর (রা)-এর কন্যা আসমা নবী করীম (সা)-এর সমীপে উপস্থিত হলে- তার পরনে ছিল পাতলা কাপড়। রাসূলে করীম (সা) তাঁর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন এবং বললেনঃ হে আসমা! মেয়েলোক পূর্ণ বয়স্কা হয়ে গেলে তার দেহের মুখমণ্ডল ও কবজিদ্বয় ছাড়া আর কিছুই দৃশমান হওয়া উচিত নয়।
আল্লাহ্ তা’আলার নিম্নোক্ত কথাটি থেকেও উপরিউক্ত কথারই সমর্থন মেলেঃ (আরবী****************)
মুমিনদের বলুন, তারা যেন তাদের চোখ নিম্নমুখী রাখে। (সূরা নূরঃ ৩০)
এ থেকেই বোঝা যায় যে, মেয়েদের মুখমণ্ডল আবৃত নয়- উন্মুক্ত- বলেই পুরুষদের বলা হয়েছে চোখ নিম্নমুখী রাখতে অর্থাৎ সে মুখের দিকে তাকাবে না।
কেননা সমস্ত দেহসহ মুখমণ্ডলও যদি আবৃত থাকে তাহলে চোখ নীচু রাখতে বলার কোন অর্থ হয় না। কেননা ওখানে দেখবার মতো তো কিছুই নেই।
এতদসত্ত্বেও মুসলিম নারী তার যাবতীয় সৌন্দর্য-অলংকার লুকিয়ে রাখার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করা কর্তব্য। এমনকি মুখমণ্ডলও উন্মুক্ত করা উচিত নয়। কেননা ‍মুখমণ্ডল দেখেই তা নৈতিক বিপর্যয়ের সূচনা হয়। এ যুগে খোদাদ্রোহিতার ব্যাপক প্রচলন এ প্রয়োজনকে আরও তীব্র করে দিয়েছে। নারী-সুন্দরী রূপসী হলে তো মুখমণ্ডলকে ঢেকে রাখা ছাড়া অন্য কোন কথা চিন্তাই করা যায় না। কেননা নারী মুখের রূপ-সৌন্দর্যই পুরুষকে আকৃষ্ট করে সবচাইতে বেশি।
(আরবী****************)
এবং নিজেদের বক্ষদেশের ওপর নিজেদের দোপাট্রার আচঁল চেপে রাখেবে।
মুসলিম নারীকে তার দোপাট্টা দ্বারা তার মাথা ঢেকে রাখতে হবে, মাথার উপর আবরণ চাপিয়ে রাখবে, যে-কোন ধরনের কাপড় দ্বারা সম্ভব হোক তার বক্ষকে অবশ্যই আবৃত করে রাখবে। যেন এসব বিপদ সৃষ্টিকারী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অনাবৃত হয়ে ন যায় এবং দুষ্ট লোকদের সন্ধানী দৃষ্টি ও মৌমাছিদের লোলুপ চোখ সে সবের ওপর পড়তে না পারে।
(আরবী****************)
এবং তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না তাদের স্বামী ও পিতাদের ছাড়া অন্য কারো সামনে। (সূরা নূরঃ ৩১)
এ আদেশ মুমিন নারীদের গোপন সৌন্দর্য ভিন্ পুরুষেদের সম্মুখে প্রকাশ না করতে বরং লুকিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। এ গোপন সৌন্দর্য বলতে কান, চুল, গ্রীবা, ঘাড়, বুক, পায়ের নালা ইত্যাদি বোঝায়। ভিন্ পুরুষদের সম্মুখে মুখমণ্ডল ও পাঞ্জাদ্বয় প্রকাশ করার অনুমতি দেয়া সত্ত্বেও এ নিষেধ বাণী উচ্চারিত হওয়া খুবই গুরুত্ববহ।
বারো শ্রেণীর মানুষকে এ নিষেধবাণীর বাইরে রাখা হয়েছেঃ
১. তাদের স্বামী। অতএব স্বামীর পক্ষে স্ত্রী দেহের যে কোন অঙ্গ দেখা সম্পূর্ণ জায়েয। হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
তোমার লজ্জাস্থান তোমান স্বামী ছাড়া আর সকলের থেকে রক্ষা কর- আবৃত রাখ।
২. পিতা, দাদা, পরদাদা এর মধ্যে শামিল, তা বাবার দিক থেকে হোক কিংবা মার দিকে থেকে।
৩. স্বামীর পিতা, তার নিজের পিতার সমান।
৪. তাদের পুত্র, তাদের সন্তানের পুত্ররা- মেয়েরাও এর অন্তর্ভুক্ত।
৫. স্বামীর পুত্র- এ এক অনিবার্য ব্যাপার। তাছাড়া সে ঘরে এদের জন্যে মা স্বরূপই বটে।
৬. তাদের ভাই আপন ও সৎ-এক মা বা এক পিতার সন্তান হিসেবে।
৭. ভাইয়ের পুত্র, কেননা ফুফু-ভাতিজার মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ হারাম।
৮. বোন-পুত্র কেননা খালা-বোন পুত্রের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক চিরতরে হারাম।
৯. তাদের নারীকুল। আপন আত্মীয়া নারী-বংশের দিক দিয়ে আপন কিংবা দ্বীনের দিক দিয়ে, সকলের সাথে অবাধ সাক্ষাৎ চলতে পারে। তবে অমুসলিম নারীদের মুসলিম নারীর সৌন্দর্য দেখান জায়েয নয়। শুধু ততটুকুই দেখান যেতে পারে, যতটা ভিন্ পুরুষকে দেখান যায়।
১০. ক্রীতদাস-দাসী। কেননা ইসলাম তাদের পরিবারের অঙ্গ বানিয়ে দিয়েছে। কোন কোন ইমামের মতে এ অনুমতি কেবল দাসীদের বেলায়, দাসদের বেলায় নয়।
১১. অধীন ও প্রয়োজনহীন পুরুষ। এরা একে তো অধীন, দ্বিতীয়তঃ এদের নারীর প্রতি কোন বিশেষ আকর্ষণ নেই- হয় শারীরিক অক্ষমতার কারণে কিংবা বুদ্ধি-বিবেকের দিক দিয়ে অপরিপক্ক হওয়ার কারণে। সাধারণ বেতনভুক কর্মচারী যারা বাড়ির কাজকর্ম করে ও ঘরে আসা যাওয়া করতে বাধ্য হয়, অথচ যৌন আকর্ষণ না থাকার দরুন কোনরূপ বিপদের আশংকাও নেই।
১২. যেসব বালক এখনও নারীর লজ্জাস্থানের প্রতি কোন আকর্ষণ লাভ করে নি। ওরা বয়সে ছোট, নাবালেগ, যৌন চেতনা জাগানি এখনও। সে চেতনা জেগেছে বলে টের পেলে নারীর গোপন সৌন্দর্য তাদের সম্মুখে উন্মক্ত করা জায়েয নয়। পূর্ণ বয়স্ক না হলেও নয়।
কুরআনের আয়াতে চাচা ও মামার উল্লেখ করা হয়নি। কেননা তারা পিতার সমতুল্য। হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
চাচা পিতার সমতুল্য
নারীদের সতর
পূর্বকর্তী আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি, নারীদেহের যে যে অংশ প্রকাশ করা জায়েয নয়, তা-ই তার লজ্জাস্থান এবং তা ঢেকে রাখা ওয়াজিব, তা উন্মুক্ত রাখা সম্পূর্ণ হারাম।
অতএব ভিন্ পুরুষদের সম্মুখে এবং অমুসলিম নারীদের ক্ষেত্রেও- নারীর মুখমণ্ডল ও কবজিদ্বয় ব্যতীত সমস্ত দেহই লজ্জাস্থান- অবশ্যই আবৃত রাখতে হবে। মুখমণ্ডল ও কবজিদ্বয় যেহেতু কাজকর্ম গ্রহণ-দান ইত্যাদি কাজের জন্যে উন্মুক্ত রাখা অপরিহার্য এ কারণে তা অনাবৃত রাখা জায়েয যেনম ইমাম রাযী লিখেছেন। এ ছাড়া দেহের যে অঙ্গ উন্মুক্ত রাখা বা করা জরুরী নয়, তা ঢেকে রাখার জন্যে আদেশ করা হয়েছে। স্বভাবগতভাবে যা উন্মুক্ত রাখা হয় এবং যা প্রকাশ করার প্রয়োজন দেখা দেয় তা খুলে রাখার অনুমতি দেয় হয়েছে। কেননা ইসলামী শরীয়তের বিধান ভারসাম্যপূর্ণ, মানব কল্যাণমুখী। ইমাম রাযী লিখেছেনঃ
মুখমণ্ডল ও পাঞ্জাদ্বয় প্রকাশ করা অপরিহার্য বলে তা নারীদের গোপন অঙ্গের মধ্যে গণ্য নয় বলে সকলেই ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন। তবে পা উন্মুক্ত রাখা অপরিহার্য নয়। তাই তা নারীর গোপন অঙ্গের মধ্যে গণ্য কিনা- এ নিয়ে মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে। (আরবী****************)
সূরা নূর-এর আয়াতে যেমন বলা হয়েছে, উপরিউক্ত বারো শ্রেণীর পুরুষদের ক্ষেত্রে কান, ঘাড়, চুল, বুক, বাহুদ্বয় ও নলাদ্বয় ব্যতীত সমস্ত অঙ্গ আবৃত করে রাখতে হবে। তাদের সম্মুখে এ সব অঙ্গ প্রকাশ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে শরীয়তে। এ ছাড়া দেহের অন্যান্য অঙ্গ ও অংশ যেমন পিঠ, পেট, লিঙ্গস্থান, উরুদ্বয় প্রভৃতি স্বামী ছাড়া অপর কোন পুরুষ বা নারীর সম্মুখে উন্মুক্ত করা একেবারেই জায়েয নয়।
আয়াতের এ তাৎপর্য কয়েকজন ইমামের মতের খুবই নিকটবর্তী। মুহাররম পুরুষদের জন্যে নারীর লজ্জাস্থান শুধু নাভি ও হাটুর মধ্যবর্তী অংশ। অন্য নারীদের জন্যেও এই পর্যন্তই সীমা। কোন কোন বিশেষজ্ঞের মতে নারীর লজ্জাস্থান মুহাররম পুরুষের জন্যে শুধু এতটুকু যতটা কাম-কাজ করার সময়ও উন্মুক্ত হয় না। ঘরে কাজ-কাম করার সময় নারীদেহের যেসব অংশ সাধারণত উন্মুক্ত থাকে, মুহাররম পুরুষদের সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করাও নাজায়েয নয়।
মু’মিন নারীদের প্রতি আল্লাহর নির্দেম হচ্ছে, তারা যখন ঘরের কাজে বইরে যাবে তখন একটি বড় চাদর দ্বারা সমস্ত দেহ আবৃত করে নেবে। এর ফলে অন্যান্য কাফির ও খারপ চরিত্রের নারীদের থেকে তাদের স্বাতন্ত্র্য সকলেরই সম্মুখে প্রতিভাত হবে। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর নবীকে উম্মতের সকলকে একথা জানিয়ে দেয়ার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছেঃ (আরবী****************)
হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মুমিন নারীদের বলে দিন যে, তারা যেন তাদের দেহের ওপর চাদর ফেলে রাখে। এ এক উত্তম পন্থা। এর ফলে তাদের চেনা যাবে এবং তাদের কেউ জ্বালাতন করবে না।
(আরবী****************) বহু বচনের শব্দ। এক বচনে (আরবী****************) তার অর্থ প্রশস্ত কাপড়। এ কালের বোরকা এ পর্যায়ে পড়ে।
জাহিলিয়াতের যুগে নারীরা যখন ঘর থেকে বাইরে যেত, তখন নিজেদের কোন কোন সৌন্দর্য- বুক, ঘাড়-গলা, চুল প্রভৃতি খোলা রাখত। দুষ্ট চরিত্রের লোকেরা তাদের পিছে লেগে যেত। এ অবস্থায় এ আয়াত নাযিল হয়েছে। এতে মুমিন নারীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা তাদের চাদরের একাংশ মাথায় দিয়ে রাখে যেন দেহের এসব অংশ আবৃত হয়ে থাকে। আর বাহ্যিক চিত্র দেখে যেন তাদের পবিত্র চরিত্রের নারী বলে চেনা যায়। ফলে কোন মুনাফিক ও নির্লজ্জ পুরুষ তাদের উত্যক্ত করবে না, করার সাহস পাবে না।
আয়াতে একটি কারণ স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছে। আর তা হচ্ছে, চরিত্রহীন ও দুষ্ট লোকদের দ্বারা স্ত্রী লোকদের জ্বালাতন করা, উত্যক্ত করা, তাদের প্রতি তাকান মেয়েদের মধ্যে ভয়ের কারণ নিহিত নেই এবং তাদের প্রতি কোন অবিশ্বাসও আরোপ করা হয়নি। যদি কেউ তা মনে করেন তবে তার কোন যুক্তি নেই। কেননা উলঙ্গ সুসজ্জিতা নারী কিংবা লাস্যময়ী ও লীলায়িত ভঙ্গিমায় বিচরণশীলা নারী চিরকাল পুরুষের মনে যৌন উত্তেজনা ও লালসা-কামনার সৃষ্টি করে থাকে। মেয়েদের সাথে যারা হাতাহাতি বা হাত ধরাধরি করে, তারাই লোভাভুর ও কামনা কাতর হয়ে পড়ে।কুরআনে তাই বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
নম্র কণ্ঠস্বরে কথা বলবে না, তাহলে হৃদয়ের রোগী পুরুষ কামাতুর হয়ে হড়বে।
মুসলিম মহিলার পর্দা ও সতীত্ব রক্ষার ব্যাপারে ইসলাম বিশেষ কঠোরতা অবলম্বন করেছে। এ ব্যাপারে খুব সামান্যই উদারতা দেখান হয়েছে। যেমন বৃদ্ধ মহিলার পর্দার ব্যাপারে কিছুটা নম্রতা প্রদান প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ (আরবী****************)
বৃদ্ধা মহিলা- যারা বিয়ের আশা পোষণ করে না- তারা নিজেদের গায়ের চাদর যদি খুলে রেখে দেয়, তাহলে তদের কোন গুনাহ হবে না। তবে শর্ত এই যে, তারা সৌন্দর্য ও অলংকার প্রদর্শনকারিণী হতে পারবে না। কিন্তু তারা যদি এ ব্যাপারে সতর্কতাবলম্বন করে, তাহলে তাদের পক্ষে খুবই কল্যাণকর। আর আল্লাহ্ সব কিছুই শোনেন, সব কিছুই জানেন।
আয়াতে (আরবী****************) বলতে সেসব মহিলাকে বুঝিয়েছে, যারা বার্ধক্যজনিত কারণে অবসরপ্রাপ্ত হয়েছে, যাদের হায়েয হয় না, সন্তান হওয়ারও যাদের কোন আশা নেই। এ কারণে তারা পুনরায় বিবাহিতা হওয়ার জন্যে আকাঙ্খিত নয়। পুরুষদের প্রতিও নেই তাদের কামনা-বাসনা-আগ্রহ। পুরুষরাও তাদের প্রতি কোন আকর্ষণ বোধ করে না, এরূপ নারীর পর্দা ও লজ্জাস্থান আবৃত রাখার ব্যাপারে নিয়মকে হালকা করে দিয়েছেন। তিনি তাদের অনুমতি দিয়েছেন, এরা তাদের বাহ্যিক ও প্রকাশমান কাপড়- চাদর বা বোরকা ইত্যাদি খুলে ফেলতে পারে।
এ সুযোগটুকুও দেয়া হয়েছে শর্তাধীনে। সে শর্ত হচ্ছে, তারা লোকদের দেখানর উদ্দেশ্যে কাপড় খুলে ফেলতে পারবে না। প্রয়োজনে সুবিধা যে, এ সুযোগটা কাজে লাগাতে পারবে।
এ সুযোগ সত্ত্বেও উত্তম নীতি গ্রহণ করা সর্বপ্রকার শোবাহ-সন্দেহ থেকে মুক্ত থাকার জন্যে সতর্কতা অবলম্বন করাই তাদের জন্যে ভল।
সাধারণ গোসলখানায় নারীর প্রবেশ
নারীর পর্দা ও ইজ্জত রক্ষার উদ্ধেশ্যে ইসলাম যে কড়াকড়ি নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে রাসূলে করীম (সা) সাধারণ গোসল খানায় নারীদের প্রবেশ করা ও অন্যান্য নারীদের সামনে পরিধানের কাপড় খুলে ফেলার ব্যাপারে খুবই কড়া নিষেধবাণী উচ্চারণ করেছেন। কেননা এসব সাধারণ নারী অন্যান্য মেয়েদের দৈহিক গুণাবলী তাদের সাধারণ সভা-মজলিসে বর্ণনা করে খুবই স্বাদ গ্রহণ করতে অভ্যস্ত।
নবী করীম (সা) পুরুষদেরও কোন লুঙ্গী-গামছা না পরে, সাধারণ গোসলখানায় প্রবেশ করতে নিষেধ করেছেন। কেননা অন্যদের সামনে উলঙ্গ হওয়াটা ইসলামে আদৌ পছন্দনীয় কাজ নয়। হযরত জাবির (রা) থেকে বর্ণিত, হযরত নবী করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
যে লোক আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার, সে যেন সাধারণ গোসল খানায় লুঙ্গী ছাড়া প্রবেশ না করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার, সে যেন তার স্ত্রীকে সাধারণ গোসলখানায় প্রবেশ করতে না দেয়।
হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিতঃ (আরবী****************)
রাসূলে করীম (সা) গোসলখানায় প্রবেশ করতে প্রথমে সাধারণভাবেই নিষেধ করে দিয়েছিলেন। পরে পুরুষদের জন্য লুঙ্গীসহ প্রবেশ করার অনুমতি দিয়েছেন।
মেয়েদের জন্যে সুবিধা দান করা হয়েছে এক্ষেত্রে যে, তাদের কোন রোগের চিকিৎসা কিংবা নেফাস ইত্যাদি নিরাময়তার জন্যে গোসলখানায় প্রবেশ করতে পারে।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিতঃ (আরবী****************)
নবী করীম (সা) সাধারণ গোসলখানাসমূহ পর্যয়ে বলেছেন, তাতে পুরুষরা যেন লুঙ্গী না নিয়ে প্রবেশ না করে। আর মেয়েদের তোমরা তাতে প্রবেশ করা থেকে নিষেধ কর। তবে রোগীনী কিংবা নেফাসের স্ত্রীলোক প্রবেশ করতে পারে। (ইবনে মাযাহ, আবূ দাঊদ)
এ হাদীসের সনদে কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে। কিন্তু শরীয়তের সাধারণ বিধানে রোগীদের জন্যে যেমন অনেক সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে, অনেক ইবাদত ও ওয়াজিব কাজ করা থেকে রেহাই দান করা হয়েছে, সে দৃষ্টিতে এ হাদীসের প্রতিপাদ্য অনেকটা শক্তিশালী হয়ে উঠে। যেমন ইসলামী আইনের প্রসিদ্ধ মূলনীতি স্বরূপ বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
কোন হারাম কাজ বন্ধ করার জন্যে তার কারণ বা পথও হারাম ঘোষিত হয়ে থাকলে প্রয়োজন ও সাধারণ জনকল্যাণের প্রশ্নে তা মুবাহ হয়ে যায়।
এ দিক দিয়েও উপরিউক্ত কথার সত্যতা জানা যায়।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত হাদীসও এ কথারই সমর্থন দেয়। হাদীসটি এইঃ (আরবী****************)
নবী করীম (সা) বলেছেনঃ তোমরা ‘হাম্মাম’ নামক ঘর থেকে দূরে সরে থাকবে। সাহাবিগণ বললেনঃ ইয়া রাসূল! হাম্মাম তো ময়লা দূর করে ও রোগীকে উপকার দেয়? তখন তিনি বললেনঃ তাহলে যে-ই তাতে প্রবেশ করবে সে যেন স্বীয় লজ্জাস্থান আবৃত রাখে। (হাকেম)
এমতাবস্থায় কোন নারী যদি কোনরূপ ওযর বা প্রয়োজন ব্যতীতই তাতে প্রবেশ করে, তাহলে সে একটা হারাম কাজ করল এবং এজন্যে রাসূলে করীম (সা) যে কঠোর বাণী উচ্চারণ করেছেন, সে তার যোগ্য হলো। আবূর মুলাইছ আল-হাযালী (রা) বর্ণনা করেছেনঃ (আরবী****************)
হিমস কিংবা সিরিয়ার কিছু সংখ্যক মেয়েলোক হযরত আয়েশা (রা)-এর কাছে উপস্থিত হলো। তিনি বললেনঃ তোমরা কি সাধারণ গোসলখানায় প্রবেশ কর? আমি রাসূলে করীম (সা)-কে বলতে শুনেছি, যে নারী তার স্বামীর ঘর ছাড়া অন্য কোথাও তার কাপড় খুলে ফেলে সে তার ও তার আল্লাহর মধ্যকার পর্দাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে।
হযরত উম্মে সালমা (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
যে নারী তার নিজের ঘর ছাড়া অন্যত্র স্বীয় পরিধানের কাপড় খুলে ফেলে আল্লাহ্ তার পর্দাকে ছিন্নভিন্ন করে দেন। (আহমদ, তাবরানী, হাকেম)
সাধারণ গোসলখানায় মেয়েদের প্রবেশ পর্যায়ে ইসলামের যখন এতটা কড়াকড়ি অথচ তা চার দেওয়াল পরিবেষ্টিত ও তাতে কেবল নারীরাই প্রবেশ করে, তখন সেই নির্লজ্জ ও ভবঘুরে মেয়েদের সম্পর্কে কি বলা হবে, যারা রাস্তাঘাটে নিজেদের লজ্জাস্থান উন্মুক্ত করে বেড়ায়, মধু আহরণকারীদের লালসা উত্তেজিত করে তোলে, সমুদ্রতীরে নিজেদের দেহের প্রদর্শনী করে, লোভাতুর কামাতুর দৃষ্টিগুলোর জন্যে দর্শন স্বাদ গ্রহণের ব্যবস্থা করে ও যৌন আবেগকে উত্তেজিত করার কাজে সদা লিপ্ত থাকে?....... আসলে এরা তাদের ও মহান আল্লাহর মধ্যে রক্ষিত লজ্জা-শরমের সব আড়াল আবডালকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। পুরুষরাও এ গুনাহে সমানভাবে শরীক। কেননা তাদের তো দায়িত্বশীল ও রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করা হয়েছে নারীদের জন্যে।........হায়! পুরুষদের কাণ্ডজ্ঞান কি কোন দিনই ফিরে আসবে না?
নারীদের উলঙ্গতা-উচ্ছৃঙ্খলতা হারাম
মুসলিম নারী কাফির কিংবা জাহিলিয়াতের যুগের নারীদের থেকে স্বতন্ত্র ও ভিন্নতর চরিত্রের অধিকারিনী হয়ে থাকে। নৈতিক চরিত্র, পবিত্রতা, সতীত্ব ও লজ্জা-শরমের সভ্রম রক্ষা করাই মুসলিম নারীদের বিশেষত্ব।
পক্ষান্তরে জাহিলী নারীর চরিত্র হচ্ছে নগ্নতা-উচ্ছৃঙ্খলতা ও পুরুষদের মধ্যে যৌন উত্তেজনা জাগিয়ে তোলার দক্ষতা দেখান। কুরআনে ব্যবহৃত শব্দ (আরবী****************) অর্থঃ খুলে যাওয়া, উন্মুক্ত হওয়া প্রকাশিত হওয়া, প্রকাশিত হয়ে পড়া। সাধারণ লোকদের দেখতে পারা। এ সাদৃশ্যের কারণে আরবী ব্যবহার হচ্ছেঃ (আরবী****************)
এ জন্যে যে, আকাশমণ্ডল সুউচ্চে অবস্থিত এবং তা দৃষ্টিমানের সম্মুখে প্রকাশিত।
আল্লামা যামাখশারী বলেছেন (আরবী****************) শব্দের নিঘূঢ় তত্ত্ব হচ্ছে, যা গোপন রাখা কর্তব্য তাকে বিশেষ যত্ন ও ব্যবস্থাপনা সহকারে প্রকাশ করে দেয়া। আরবী কথন হচ্ছেঃ (আরবী****************) ‘প্রকাশমান নৌকা’- কেননা তার ওপর কোন পর্দা নেই। এ অর্থের সামঞ্জস্যের কারণে নারীর পুরুষদের জন্যে আবরনমুক্ত ও উলঙ্গ হওয়া অর্থে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কেননা এ করে নারী তার সমস্ত সৌন্দর্য ও দৈহিক লালিমা কান্তি পুরুষের সম্মুখে উন্মুক্ত করে দেয়। ইমাম যামাখশারী এ অর্থে একটা নতুন দিকে ইঙ্গিত করেছেন, তা হচ্ছে উদ্যোগ-আয়োজন করে গোপনীয় জিনিসকে প্রকাশ করে দেয়া অথচ তা গোপন করে রাখাই বাঞ্ছনীয় ছিল। দেহের বিশেষ বিশেষ অঙ্গ, অঙ্গ-প্রত্যাঙ্গের হেলানো-দোলানো, কথা বলার ও চলার বিশেষ ধরন ও ভঙ্গি বা অলংকারাদি এসব ভিন্ পুরুষের সম্মুখে প্রকাশ করাই ‘তাবাররুজ’।
এ ‘তাবাররুজ’ –এর বিভিন্ন রূপ ও ভঙ্গি রয়েছে, প্রাচীনকালের লোকেরা যেমন তা জানত, এ কালের লোকদেরও তা ভালভাবে জানা। কুরআনের নিম্নোদ্ধৃত আয়াতের তাফসীরকারগণ তার উল্লেখ করেছেনঃ (আরবী****************)
হে মেয়েরা! তোমরা তোমাদের ঘরে স্থিতি গ্রহণ করে থাক এবং প্রাচীন জাহিলিয়াতের সময়ের মতো প্রদর্শনী করে বেড়িও না।
মুজাহিদ বলেছেনঃ তখন মেয়েরা লীলায়িত ভঙ্গিতে চলাফেরা করত।
মুকাতিল বলেছেনঃ মেয়েরা তাদের ওড়না মাথার ওপর রাখত, কিন্তু শক্ত করে বাঁধত না। ফলে গলার হার, কানের বালা ও গলা-গ্রীবা উন্মুক্ত হয়ে যেত।
প্রাচীন জাহিলী যুগের এই ছিল ‘তাবাররুজ’ অর্থাৎ পুরুষদের সাথে মাখামাখি ব্যাপকভাবে হতো। চলনে বলনে বিশেষ লাস্যতা দেখা যেত। নারীর ওড়না এমনভাবে ব্যবহৃত হতো যে, তার দেহ ও অলংকারের সৌন্দর্য প্রকাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু আধুনিক জাহিলিয়াত এমন সব ভঙ্গি ও বৈচিত্র্য অর্জন করেছে যে, তাতে প্রাচীন জাহিলিয়াতকে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে।
কোন্ অবস্থায় ‘তাবাররুজ’ হয় না
নিম্নোদ্ধৃত নিয়মাবলী পালন করে চললে মুসলিম নারী ‘তাবাররুজ’ –এর সীমা ত্যাগ করে ইসলামী সভ্যতার পরিবেশে অনুপ্রবেশ করতে পারেঃ
(ক) দৃষ্টি নত রাখা- কেননা লজ্জা-শরমই হচ্ছে নারীর সবচাইতে অধিক মূল্যবান সৌন্দর্য। আর লজ্জা-শরমের বড় প্রকাশ পাওয়া যায় দৃষ্টি নত রাখার মাধ্যমে। তাই আল্লাহ্ বলেছেন এ ভাষায়ঃ (আরবী****************)
এবং বল ঈমানদার মহিলাদের, তারা যেন তাদের দৃষ্টির একাংশ নত রাখে।
(খ) পুরুষদের সাথে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা এড়িয়ে চলতে হবে- এ কালের সিনেমা হল, মিটিং-জনসভা ও হোটেল-রেস্তোরা ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস কক্ষ ও করিডোরে-কেন্টিনের ভিড়ে এ মাখামাখিটা পুরামাত্রায় লক্ষ্য করা যায়। হযরত মা’কাল ইবনে ইয়াসার (রা) রাসূলে করীম (সা)-এর বাণী বর্ণনা করেছেনঃ (আরবী****************)
যে স্ত্রীলোকটি হালাল নয়, তাকে স্পর্শ করা অপেক্ষা নিজের মাথায় লৌহ শলাকা বসিয়ে দেয়া অনেক উত্তম। (তিবরানী, বায়হাকী)
(গ) তার পোশাক-পরিচ্ছেদ ইসলামী শরীয়তের আদব-কায়দা ও নিয়ম-নীতি সম্মত হতে হবে- আর শরীয়তসম্মত পোশাক বলতে বোঝায় তা, যাতে নিম্নোদ্ধৃত গুণাবলী রয়েছেঃ
১. সমস্ত দেহ আবৃত করে, কুরআন নিজেই (আরবী****************) ‘যা স্বতঃই প্রকাশ হয়ে পড়ে’ বাদ দিয়েছে, তা ছাড়া- অর্থাৎ মুখমণ্ডল ও পাঞ্জাদ্বয় ব্যতীত সমস্ত শরীর ঢাকতে হবে।
২. কাপড়ের অভ্যন্তর থেকে দেহ বা দেহের কান্তি দৃশ্যমান হতে পারবে না। নবী করীম (সা) জানিয়ে দিয়েছেনঃ (আরবী****************)
যে সব মেয়েলোক কাপড় পরেও ন্যাংটা, পুরুষদের প্রতি আকৃষ্ট এবং পুরুষদেরও আকৃষ্টকারী, তারা জাহান্নামী, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং জান্নাতের সুঘ্রাণও কিছু পাবে না।
পোশাক পরেও যদি পোশাক পরার উদ্দেশ্য- শরীর আবৃতকরণ- অপূর্ণ থেকে যায়, কাপড় খুব পাতলা হওয়ার দরুন দেহের সব কিছুই বাইরে থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে, তাহলেই কাপড় পরেও ন্যাংটা থাকা হয়।
বনু তামীম গোত্রের কিছু সংখ্যক মেয়েলোক হযরত আয়েশা (রা)-এর কাছে উপস্থিত হয়। তাদের পরনে খুবই পাতলা কাপড় ছিল। তা দেখে হযরত আয়েশা (রা) বললেনঃ (আরবী****************)
তোমরা যদি ঈমানদার হয়ে থাক, তাহলে জেনে রাখ, এটা মুমিন মহিলাদের পোশাক নয়, যা তোমরা পরেছ।
একটি বিয়ের কনে হযরত আয়েশা (রা)-এর কাছে উপস্থিত হলো। তার পরিধানে ছিল খুবই স্বচ্ছ পাতলা কাপড়। তখন তিনি বললেনঃ (আরবী****************)
যে ব্যক্তি এ ধরনের পোষাক পরিধান করে, সে সূরা আন-নূরে বিধৃত বিধানের প্রতি ঈমান আনে নি।
৩. পোশাক এমন আটসাট হবে না, যার দরুন দেহের উচ্চ-নীচ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবই বাইরে দৃশ্যমান হয়ে উঠে, যদিও তা স্বচ্ছ পাতলা নয়। পাশ্চাত্য-সভ্যতা যে পোশাকের প্রবর্তন করেছে, তা এ পর্যায়ের বড় নিদর্শন। এ সভ্যতা দেহ ও যৌনতার পূজারী, এ সভ্যতার প্রভাবে ফ্যাশন-উদ্ভাবনকারীরা এমনভাবে কাপড় কাটে যে, স্তনদ্বয়, নিতম্ব ও উরুদ্বয় প্রভৃতি যৌনাঙ্গসমূহ দর্শকদের সম্মুখে প্রকটভাবে ভেসে উঠে। সে পোশাক এমন ঢং-এ বানান হয় যে, তাতে যৌন আবেগে আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এ ধরনের পোশাক পরিধানকারী নারীও ‘কাপড় পরা সত্ত্বেও ন্যাংটার মধ্যে গণ্য’- এ কাপড় ও পোশাক স্বচ্ছ ও পাতলা কাপড় অপেক্ষাও অনেক বেশি বিপদের আহবানকারী।
৪. পুরুষদের জন্যে নির্দিষ্ট পোশাক মেয়েরা পরবে না। যেমন কোন পাতলুন। এটা এ কালের পুরুষদের জন্যে নির্দিষ্ট বিশেষ পোশাক। কেননা নবী করীম (সা) পুরুষদের সাথে সাদৃশ্য সৃষ্টিকারী নারীদের ওপর অভিশাপ বর্ষণ করেছেন, যেমন অভিশাপ দিয়েছেন সেসব পুরুষদের ওপর যারা মেয়েদের সাথে সাদৃশ্য সৃষ্টি করে। এ জন্যেই নবী করীম (সা) মেয়েদেরকে পুরুষদের পোশাক পরতে নিষেধ করেছেন এং পুরুষদের নিষেধ করেছেন মেয়েদের পোশাক পরতে।
৫. ইয়াহূদী, খ্রিস্টান, অগ্নিপূজারী, কাফির মেয়েদের বিশেষ বিশেষ পোশাকও পরবে না। কেননা ওদের সাথে সাদৃশ্য করতে ইসলামে নিষেধ করা হয়েছে। পুরুষ ও নারীর মধ্যে যেমন পার্থক্য করতে চায় ইসলাম, তেমনি বাইরে ও অন্তরে কাফির জাতিগুলোর অন্ধ অনুসরণ করা থেকেও মুক্তি কামনা করে। এ কারণেই বহু বহু ব্যাপারে কাফিরদের বিরোধিতা করার জন্যে ইসলাম সুস্পষ্ট ভষায় নির্দেশ দিয়েছে। রাসূলে করীম (সা) নিম্নোদ্ধৃত বাণীটি এ পর্যয়েরঃ (আরবী****************)
যে লোক অপর যে-জাতির সাথে সাদৃশ্য করবে, সে তাদের মধ্যেই গণ্য হবে।
(ঘ) চলাফেরা ও কথাবার্তায় তাকে গাম্ভীর্য ও দৃঢ়তা অবলম্বন করতে হবে। তার দেহের ও মুখমণ্ডলের সমস্ত গতিবিধি ফেরানো ঘোরানোয় যৌন আবেগকে উত্তেজিত করণ থেকে পূর্ণমাত্রায় বিরত থাকতে হবে। কেননা চলাফেরা কথাবার্তায় লাস্যতা ও লীলাময়তা চরিত্রহীন কাফির মেয়েদের বিশেষত্ব, মুসলিম মহিলাদের চরিত্র নয়। আল্লাহর এ কথাটি এ পর্যায়ে পুনঃ পঠনীয়ঃ (আরবী****************)
নিম্ন নম্র কণ্ঠস্বরে কথা বলবে না, বললে অন্তরের রোগ সম্পন্ন ব্যক্তি লালায়িত হয়ে পড়বে। (সূরা আহযাবঃ ৩২)
(ঙ) সুগন্ধি, আতর-স্নো-পাউডার ইত্যাদির দ্বারা স্বীয় গোপন সৌন্দর্যের প্রতি পুরুষদের মনে আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারবে না। আল্লাহ্ বলেছেনঃ (আরবী****************)
মাটিতে পা শক্তভাবে ফেলে চলবে না, কেননা তা করা হলে যে রূপ-সৌন্দর্য-অলংকার তারা লুকিয়ে রেখেছে, তা তারা জেনে যাবে।
জাহিলিয়াতের যমানায় মেয়েরা যখন লোকদের মধ্যে চলাফেরা করত তখন তারা নিজেদের পা ঝনাৎ করে মাটিতে ফেলত। ফলে পায়ের অলংকার ঝংকার দিয়ে উঠত ও লোকেরা সে ধ্বনি শুনতে পেত। এ কারণে কুরআনে তা করতে নিষেধ করেছে। কেননা এরূপ করা হলে লালসা-কাতর পুরুষদের মনে যৌন চিন্তা-ভাবনা তীব্র হয়ে জেগে উঠবে। সে নারী সম্পর্কে সে ভাবতে শুরু করবে যে, এ নারী পুরুষদেরকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে ইচ্ছুক।
বিভিন্ন সুগন্ধি মেখে বায়ু পরিমণ্ডল ভারাক্রান্ত করে তুলে, যৌন আবেগকে উত্তেজিত করে ও পুরুষদের নিজেদের প্রতি আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করে যেসব মেয়ে, তাদের সম্পর্কেও এ কথাই প্রযোজ্য। হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
মেয়েলোক আতর-সুগন্ধি মেখে সভা-মজলিসে উপস্থিত হলে সে এই-এই অর্থাৎ জ্বেনাকারী। (আবী দাঊদ, তিরমিযী)
এই বিস্তারিত আলোচনা থেকে আমরা নিঃসন্দেহে জানতে পারলাম যে, মেয়েরা ঘরের ‘কারাগারে’ (?) বন্দী হয়ে পড়ে থাকুক এবং কবর ছাড়া আর কোন স্থানে বের হয়ে না যাক, ইসলাম সে বাধ্যবাধকতা আদৌ আরোপ করেনি। বরং নামাযের জামাতে শরীক হওয়া, জ্ঞান শিক্ষা লাভ ও অন্যান্য জৈবিক ও পারিবারিক প্রয়োজন পূরণার্থে ঘরের বাইরে যাওয়া মুসলিম মহিলাদের জন্যে সম্পূর্ণ জায়েয। সাহাবী মহিলা ও তাঁদের পরবর্তী কালের মুসলিম মহিলাগণ তা-ই করতেন। তাঁদের অনেকে যুদ্ধে শরীক হওয়ার জন্যেও বের হয়েছেন। রাসূলে করীম (সা)-এর সঙ্গেও বের হয়েছেন। তাঁর পরে খলীফা ও ইসলামী সেনাধ্যক্ষের সঙ্গেও বাইরে গেছেন। নবী করীম (সা) তাঁর বেগম হযরত সাওদা (রা)-কে বলেছেনঃ (আরবী****************)
আল্লাহ্ তোমাদের অনুমতি দিয়েছেন, তোমরা তোমাদের প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে পার। (বুখারী)
তিনি আরও বলেছেনঃ (আরবী****************)
তোমাদের কোন স্ত্রী যদি তোমাদের কাছে মসজিদে নামাযে যাওয়ার জন্যে অনুমতি চায়, তাহলে তাকে যেন নিষেধ না কর। (বুখারী)
অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
তোমরা আল্লাহর দাসীদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করবে না। (মুসলিম)
কোন কোন আলিম এ পর্যায়ে খুবই কঠোরতা করে থাকেন। তাঁদের মতে ভিন্ পুরুষ-দেহের কোন একটি অংশের ওপরও নজর দেয়া স্ত্রীলোকদের জন্যে হারাম। তাঁরা দলিল হিসেবে উম্মে সালমা (রা)-এর দাস নরহান বর্ণিত একটি হাদীস পেশ করেন। হাদীসটি হচ্ছেঃ (আরবী****************)
হযরত উম্মে সালমা ও মায়মুনার ঘরে আবদুল্লাহ্ ইবনে উম্মে মাকতুম প্রবেশ করলে নবী করীম (সা) তাদের দুজনকে বললেনঃ তোমরা পর্দা কর। তাঁরা বললেনঃ ও তো অন্ধঃ নবী করীম (সা) বললেন, তোমরা দুজনও কি অন্ধ? তোমরা দুজনও কি দেখতে পাও না?
কিন্তু বিশেষজ্ঞগণের মতে এ হাদীসটি সহীহ্ নয়। কেননা এ হাদীসের বর্ণনাকারী নরহান উম্মে সালমার দাস, তার হাদীস দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।
আর যদি হাদীসটি সহীহ হয়ও তবু বলতে হবে, এটা হচ্ছে নবী করীম (সা)-এর তাঁর বেগমদের জন্যে তাঁদের মান-মর্যাদার দৃষ্টিতে অতিরিক্ত কড়াকড়ি। পর্দার ব্যাপারে তাঁদের প্রতি রাসূলে করীমের এ কড়াকড়ি ছিল। আবূ দাঊদ প্রমুখ হাদীস বিশারদ এ দিকে ইঙ্গিতও করেছেন। কাজেই সহীহ্ প্রমাণিত হাদীসই দলিল হিসেবে অবশিষ্ট থাকল। আর তা হচ্ছেঃ (আরবী****************)
নবী করীম (সা) ফাতিমা বিনতে কায়স (রা)-কে উম্মে সুরাইকের ঘরে ইদ্দত পালনের নির্দেশ দিলেন, কিন্তু পরে তিনি এ নির্দেশ সংশোধন করে বললেনঃ ও মেয়েলোকটিকে আমার সাহাবীরা ভয় করেন। তার চাইতে বরং তুমি ইবনে উম্মে মকতুমের কাছ থেকে ইদ্দত পালন কর। কেননা সে অন্ধ ব্যক্তি। তুমি কাপড় ছাড়বে, কিন্তু সে তোমাকে দেখতে পাবে না। (কুরতুবী)
স্ত্রীর স্বামীর মেহমানদের খেদমত করা
এ পর্যন্তকার আলোচনা থেকে একথাও স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, স্বামীর উপস্থিতিতে, তার মেহমানদের খেদমতের কাজ স্ত্রী করতে পারে। তবে সেজন্য শর্ত হচ্ছে- তার পোশাক, সৌন্দর্য-অলংকার ও কথাবার্তা, চালচলন ইত্যাদি ইসলামী নিয়ম-নীতি ও সভ্যতা ভব্যতার অনুকূল হতে হবে। এমতাবস্থায় মেহমান পুরুষ তাকে (স্ত্রীকে) দেখবে এবং সেও দেখবে তাদের, এটা অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু তাতে কোন দোষ হবে না। কেননা এ ক্ষেত্রে কোন পক্ষ থেকেই কোনরূপ সীমালংঘন বা বিপদ সঙ্ঘটিত হওয়ার কোন আশংকা নেই।
হযরত সহল ইবনে সায়াদ আল-আনসারী (রা) বর্ণনা করেছেনঃ (আরবী****************)
আবূ উসাইদ সায়েদী বিবাহ উপলক্ষে নবী করীম (সা) ও তাঁর সাহাবিগণকে আহবান করলেন। এ উপলক্ষে রান্না-বান্না করে খাবার প্রস্তুত করা ও তা পেশ করার কাজ তাঁর স্ত্রী উম্মে উসাইদ সম্পন্ন করলেন। পাথরের একটি পাত্রে কিছু খেজুর রাত থেকেই ভিজাবার জন্যে রেখে দিলেন। নবী করীম (সা) খাবার খেয়ে নিলে পর তা নিজ হাতে খুলে নবী করীম (সা)-এর কাছে তা পান করার জন্যে তোহফা স্বরূপ পেশ করলেন। (বুখারী, মুসলিম)
ইবনে হাজার আল-আসকালানী যেমন বলেছেন, এ হাদীস থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, স্বামীর মেহমান ও নিমন্ত্রিত লোকদের খেদমতের জন্যে স্ত্রীর অগ্রসর হওয়া তা তাদের সামনে উপস্থিত হওয়া সম্পূর্ণ জায়েয। তবে বলাই বাহুল্য যে, তা করা যাবে যদি কোন নৈতিক বিপদের আশঙ্কা না থাকে তবে। এ সময় দেহকে পূর্ণ মাত্রায় আবৃত রাখতে হবে। এরূপ অবস্থায় স্বামীর পক্ষে স্ত্রীর দ্বারা মেহমানদের খেদমত ও খাবার পরিবেশন করার কাজ করান জায়েয। কিন্তু স্ত্রী যদি দেহ আবৃতকরণ পর্যায়ে ইসলামের ধার্য করা নিয়ন্ত্রণ ও বাধ্যবাধকতা রক্ষা না করে- বর্তমানে যেমন প্রায়শ দেখা যায়- তাহলে পুরুষদের সম্মুখে আসা স্ত্রীর জন্যে জায়েয নয়।
প্রকৃতি বিরোধী কাজ কবীরা গুনাহ
যৌন কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণের ও সংগঠনের যে পন্থা ইসলাম গ্রহণ করেছে, সেই পর্যায়ে একটি জরুরী কথা হচ্ছে, ইসলামে জ্বেনা ও তার উপায় ও কারণসমূহ যেমন হারাম, তেমনি ‘লেওয়াতাত’ বা লুত জাতি’র প্রকৃতি পরিপন্থী কাজকেও সম্পূর্ণ হারাম করে দেয়া হয়েছে।
এ জঘন্য ও বীভৎস কার্য যেমন প্রকৃতি-বিরোধী, কলঙ্ক-কালিমা লেপনকারী, পৌরুষ খর্বকারী, তেমনি নারীর অধিকার হরণের অপরাধও বটে এবং সেজন্যে তা একটা বড় জুলুম।
যে সমাজেই এ জঘন্য কাজের প্রসারতা হবে, সে সমাজের জন-জীবন চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যাবে। তারা এ কুৎসিত কাজে অভ্যস্ত হয়ে তার দাসে পরিণত হবে। তাছাড়া চরিত্র, সুস্থ রুচি ও পবিত্রতা- সব কিছুই হারিয়ে ফেলবে। এ পর্যয়ে কুরআনে বিধৃত লূত জাতির কিসসাই সঠিক জ্ঞান লাভের জন্যে যথেষ্ট। এ জাতির লোকেরা এহেন জঘন্য ও বীভৎস কাজ শুরু করে তার ব্যাপক প্রচলন করেছিল। বৈধ ও পবিত্র স্ত্রীদের তারা ত্যাগ করেছিল এবং এ হারাম কার্য অবলম্বন করেছিল। এ কারণে আল্লাহর নবী হযরত লূত (আ) তাদের বললেনঃ (আরবী****************)
দুনিয়ার মধ্যে কেবল তোমরাই এমন যে, তোমরা পুরুষদের কাছে যাও। আর তোমাদের জন্যে যে স্ত্রীদের আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন, তাদের পরিত্যাগ করছ? বরং তোমরা তো সীমালংঘনকারী লোক। (সূরা শূ’আরাঃ ১৬৫-১৬৬)
কুরআন মজীদ এ কাজকে প্রত্যাখ্যান করেছে, এ কাজকে জুলুম, বাড়াবাড়ি, মূর্খতা, বিপর্যয় ও অপরাধ বলে ঘোষণা করেছে। এটা মানব স্বভাবের চরম বিকৃতি, হেদায়েতের পথ থেকে চরম বিভ্রান্তি। নৈতিকতার চরম বিপর্যয় ও রুচির মারাত্মক অসুস্থতা। এ লোকদের পরীক্ষার জন্যে আল্লাহ্ তা’আলা মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতাদের পাঠিয়েছিলেন। এদের প্রতি জাতির জনগণ যে আচরণ গ্রহণ করেছিল, তার প্রতিশোধ স্বরূপ আল্লাহ্ তাদের ওপর কঠিন আযাব নাযিল করেন। কুরআনে তাই বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
আমাদের ফেরেশতাগণ যখন লূত-এর কাছে পৌঁছল, তাদের আগমনে সে ঘাবড়ে গেল, মনটা খারাপ হয়ে গেল। বলতে লাগল, আজ বড় বিপদের দিন। এ মেহমানদের আগমনে তার জাতির লোকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার ঘরের দিকে দৌড়ে এল। পূর্ব থেকেই তারা এরূপ দুষ্কৃতি ও জঘন্য কাজে অভ্যস্ত ছিল। লূত তাদের বললঃ ভাইরা আমার মেয়েরা রয়েছে, ওরাই তোমাদের জন্যে পবিত্রতর। আল্লাহকে অবশ্য ভয় করবে, আর আমার মেহমানদের ব্যাপারে আমাকে লজ্জিত কর না। তোমাদের মধ্যে সমঝদার ব্যক্তি কি কেউ নেই? তারা জবাবে বললঃ তোমার তো জানাই আছে যে, তোমার মেয়েদের ক্ষেত্রেও আমাদের কোন অংশ নেই। তুমি এ-ও জান যে, আমি তোমাদের শায়েস্তা করে দিতে পারতাম কিংবা কোন সুদৃড় সহায়ই হতো যার আশ্রয় আমি গ্রহণ করতাম। তখন ফেরেমতাগণ তাঁকে বললঃ হে লূত! আমরা তো তোমার আল্লাহর প্রেরিত ফেরেশতা। এ লোকেরা তোমার কোন ক্ষতিই করতে পারবে না। (সূরা হুদঃ ৭৭-৮১)
এ দুষ্কৃতি ও জঘন্য কাজ যে করবে, তাকে কি শাস্তি দেয় যেতে পারে, তা নিয়ে ফিকাহবিদদের মধ্যে বিভিন্ন মত রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে লেওয়াতাতকারীকে কি জ্বেনাকারীর দণ্ড দেয়া হবে কিংবা লেওয়াতাতকারী ও যার সাথে তা করা হয়েছে এ উভয়কে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে- হত্যা করা হবে? আর হত্যা করা হলে তাকে কি দিয়ে হত্যা করা হবে, তরবারি দ্বারা কিংবা আগুনে জ্বালিয়ে মারা হবে? অথবা উচ্চ প্রাচীরের ওপর থেকে ফেলে দিয়ে মারা হবে?
এ ধরনের অপরাধের ব্যাপারে ইসলামের এ কঠোরতাকে নির্মমতা মনে করা যেতে পারে। কিন্তু ইসলামী সমাজবে এ ধরনের পংকিল ও কদর্য কার্যকলাপ থেকে পবিত্র রাখা এরূপ কঠোর শাস্তি প্রয়োগ ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়। কেননা এ গুনাহ, সংক্রামক, ক্ষতিকর। এ গুনাহ্ সমাজে প্রচলিত হলে ধ্বংস আর ধ্বংস ছাড়া অন্য কোন পরিণতিই হতে পারে না।
হস্তমৈথুন
অনেক যুবক যৌন উত্তেজনা দমনের উদ্দেশ্যে নিজ হস্তদ্বয়ের আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। নিজ হাতের মৈথুনের সাহায্যে শুক্র নিষ্কাশন করে স্নায়ূমণ্ডলীকে শান্ত করে থাকে। অধুনা এক ‘গোপন স্বভাব’ নামে অভিহিত করা হয়।
অনেক বিশেষজ্ঞই এ কাজকে হারাম বলেছেন। ইমাম মালিক এ ব্যাপারে কুরআন মজীদের নিম্নোদ্ধৃত আয়াতকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেনঃ (আরবী****************)
আর যারা তাদের যৌন অঙ্গের সংরক্ষণ করে- তাদের স্ত্রীদের ও দাসীদের ছাড়া-তাদের প্রতি কোন তিরস্কার নেই। এর বাইরে অন্য কোন পন্থা যারাই অবলম্বন করবে, তারাই আসলে সীমালংঘনকারী। (সূরা মুমিনূনঃ ৪-৭)
ইমাম মালিকের মতে- যারা হস্তমৈথুন করে, তারা কুরআন ঘোষিত বৈধ পন্থা বাদ দিয়ে ভিন্নতর পন্থার আশ্রয় গ্রহণ করে। অতএব তা হারাম।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল থেকে বর্ণিত, তিনি শুক্রকে দেহের অপরাপর আবর্জনার মতোই এক আবর্জনা বিশেষ মনে করতেন। আর উপরিউক্ত উপায়ে তাঁর বহিস্কারকরণকে জায়েয মনে করতেন। যেমন ‘সিন্তা’ লাগান। ইমাম ইবনে হাজমও এ মত সমর্থন করেছেন। হাম্বলী মাযহাবের আলিমগণ দুই শর্তে এ কাজকে জায়েয বেলেছেন। একটি হলো, তা করা না হলে জ্বেনাকারীতে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা হওয়া আর দ্বিতীয় হচ্ছে, বিয়ে করতে অক্ষম হওয়া।
এ প্রেক্ষিতে আমরা ইমাম আহমদের মত গ্রহণ করতে পারি কেবল সে অবস্থায়, যখন যৌন উত্তেজনা অদম্য হয়ে উঠবে এবং তার দরুন জ্বেনা ব্যভিচার করে বসতে পারে এ ভয় তীব্র হয়ে উঠবে। যেমন শিক্ষারত ছাত্র ও বিদেশে কর্মরত নিঃসঙ্গ ব্যক্তি। আর তার সম্মুখে যদি বিদ্যমান থাকে যৌন উত্তেজনার অসংখ্য কারণ। এরূপ অবস্থায় যে কোন ব্যক্তির পক্ষে আত্মসংযম করে থাকা খবই কঠিন ও দুষ্কর হয়ে পড়ে। এ ধরনের ব্যক্তির পক্ষে আত্মসংযম করে থাকা খুবই কঠিন ও দুষ্কর হয়ে পড়ে। এ ধরনের ব্যক্তির পক্ষে তার যৌন উত্তেজনা দমন করার জন্যে এ উপায় অবলম্বন করা খুব বেশি দোষের হবে না। তবে তাতেও শর্ত এই যে, এ কাজে সীমা ছাড়িয়ে যাওায়া এবং এ পন্থাকে স্থায়ীভাবে গ্রহণ করা কিছুতেই জায়েয হবে না।
তবে নবী করীম (সা) বিবাহ করতে অসমর্থ মুসলিম যুবকদের সে পথ দেখিয়েছেন, তাই সর্বোত্তম পন্থা। তা হচ্ছে তার উচিত বেশি বেশি রোযা রাখা। কেননা রোযা মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে সুসংযত ও সুসংহত করে। ধৈর্য শিক্ষা দেয়, ধৈর্যধারণে অভ্যস্ত করে তোলে। রোযা মানুষের মধ্যে তাকওয়ার শক্তিকে বাড়িয়ে দেয়, আল্লাহকে হাযের-নাজের জানার ভাবধারাকে প্রবল করে তোলে। এ পর্যায়ে নবী করীম (সা)-এর বাণী হেচ্ছেঃ (আরবী****************)
হে যুবক সমাজ! তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রী সঙ্গমে সক্ষম তাদের বিয়ে করা বর্তব্য। কেননা এ বিয়ে তাকে চক্ষু নত রাখতে অভ্যস্ত করবে এবং তার যৌন অঙ্গকে পবিত্র ও সুরক্ষিত রাখবে। আর যে যুবক বিয়ে করতে অসমর্থ হবে, তার রোযা রাখা উচিত। কেননা এ রোযাই তার ঢালস্বরূপ হবে।
ইসলামে বৈরাগ্যবাদ নেই
ইসলামে যৌন উত্তেজনাকে লাগামমুক্ত ও অবাধ করে দেয়া হয়ন। কেননা তা করে দেয়া হলে তা কোন সীমা বা বাধা-বন্ধন, শর্ত-প্রতিবন্ধকতা মেনে চলতে প্রস্তুত হবে না। এ কারণেই জ্বেনা-ব্যভিচার এবং তৎসংশ্লিষ্ট ও সেদিকে টেনে নেয়ার যাবতীয় কার্যক্রমকেও হারাম করে দেয়া হয়েছে। অপরদিকে এ স্বভাবজাত প্রবণতার সাথে সাংঘর্ষিক ও তাকে সমূলে উৎখাতকারী ভাবধারাকেও ইসলাম একবিন্দু সমর্থন করেনি। এ কারণেই ইসলাম বিবাহ করার উৎসাহ দিয়েছে এবং অবিবাহিত বা চিরকুমার হয়ে থাকা কিংবা নিজেকে নপুংসক বানানোর প্রচণ্ড বিরোধিতা করে। অতএব সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোন মুসলিম পুরুষ বা নারীর বিয়ে না করে থাকা এ উদ্দেশ্যে যে, সে দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে আল্লাহর জন্যে উৎসর্গীকৃত থাকতে চায় কিংবা সম্পূর্ণ নির্ঝঞ্ঝাট একমূখিতা নিয়ে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হয়ে থাকতে চায়-আদৌ জায়েয নয়। ইসলামে এরূপ মনোভাব বা কর্মনীতির একবিন্দু সমর্থন নেই।
রাসূলে করীম (সা)-এর কোন কোন সাহাবীর মধ্যে দুনিয়া ত্যাগের প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। কিন্তু নবী করীম (সা) যখনই তা টের পেলেন, তখনই ঘোষণা করে দিলেন যে, দুনিয়া ত্যাগ করা ইসলামী জীবনধারা পরিহার ও রাসূলের সুন্নাতকে অগ্রাহ্য করার শামিল। বস্তুত এ এক খ্রিস্টানসূলভ প্রবণতা। রাসূলে করীম (সা) এ প্রবণতাকে সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী বলে ঘোষণা করলেন। আবূ কালাবা থেকে বর্ণিতঃ (আরবী****************)
কিছু সংখ্যক সাহাবী দুনিয়া ত্যাগ করার, স্ত্রী সংসর্গ বর্জন করার ও বৈরাগ্যবাদ অবলম্বন করার ইচ্ছা গ্রহণ করলেন। কিন্তু নবী করীম (সা) এ ব্যাপারটিকে খুব শক্তভাবে ধরলেন। বললেনঃ তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা দ্বীন পালনে চরম কঠোরতা ও কৃচ্ছ্রতা গ্রহণ করল, তখন আল্লাহও তাদের প্রতি কঠোরতা প্রয়োগ করলেন। এ কালের গির্জা-মঠ ও খানকাসমূহে অবস্থানকারী লোকেরা তাদেরই উত্তরাধিকারী। অতএব তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং কাউকেই তাঁর শরীক বানিও না। হজ্জ কর, উমরা কর আর সোজা ঋজু পথ অবলম্বন কর, তাহলে তোমাদের সাথে যথাযথ আচরণ করা হবে। (আব্দুর রাজ্জাক ইবনে জরির-ইবনে মুনযির)
এ হাদীসের বর্ণনাকারী বলেনঃ এ লোকদের সম্পর্কেই নিম্নোদ্ধৃত আয়াতটি নাযিল হয়েছেঃ (আরবী****************)
হে ঈমানদার লোকেরা! আল্লাহ্ তোমাদের জন্যে যেসব পবিত্র জিনিস হালাল করেছেন, তোমরা তা হারাম কর না। আর সীমালংঘন কর না কেননা আল্লাহ্ সীমালংঘনকারীদের আদৌ ভালবাসেন না। (সূরা মায়িদাঃ ৮৭)
মুজাহিদ বলেছেনঃ উসমান ইবনে মজয়ূন ও আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর প্রমুখ সাহাবী স্ত্রী সংসর্গমুক্ত জীবন যাপন করার, নিজেদের ‘খাসি’ বানানর এবং চট বস্ত্র পরিধান করার সংকল্প গ্রহণ করলেন। পূর্বোদ্ধৃত ও তৎপরবর্তী আয়াত এ পর্যায়েই নাযিল হয়েছিল।
একদল সাহাবী কবী করীম (সা)-এর ঘরে উপস্থিত হয়ে তাঁর ইবাদত-বন্দেগী সম্পর্কে তাঁর বেগমদের কাছ থেকে জানতে চেষ্টা করতে লাগলেন। তাঁরা যখন যা জানবার জেনে নিলেন, তখন তাঁদের কাছে তা খুবই স্বল্প ও অপর্যপ্ত মনে হলো। তখন তাঁরা নিজেরাই বলতে লাগলেনঃ (আরবী****************)
রাসূলে করীমের সাথে আমাদের কি তুলনা হতে পারে? আল্লাহই তাঁর আগের ও পরের সব গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। অতঃপর তাদের একজন বললঃ আমি তো সারাটিকাল ধরে রোযা রাখব, রোযা ভঙ্গ করব না। দ্বিতীয় জন বললঃ আমি সারারাত জাগ্রত থেকে ইবাদত করব, একটুও ঘুমাব না। তৃতীয় জন বললঃ আমি নারী সংসর্গ বর্জন করে চলব, কখনই বিয়ে করব না। পরে নবী করীম (সা) যখন এ সংবাদ জানতে পারলেন, তখন তিনি তাঁদের ভুল ধারণা ও তাদের অবলম্বিত নীতির বক্রতা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহ্ সম্পর্কে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি জানি, তোমাদের আপেক্ষা আমি তাঁকে ভয়ও করি বেশি। তা সত্ত্বেও আমি যেমন রাত জাগরণ করে ইবাদত করি তেমনি ঘুমাইও। আমি রোযাও থাকি, রোযা ভাঙ্গিও, আর স্ত্রী গ্রহণ করে দাম্পত্য জীবনও যাপন করছি। এই হচ্ছে আমার নীতি ও আদর্শ। অতএব যে তা পরিহার করবে, সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নয়।
হযরত সা’দ ইবনে আবূ ওয়াক্কাস (রা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
উসমান ইবনে মজয়ূন স্ত্রী সংসর্গহীন জীবন গ্রহণ করতে চাইলে রাসূলে করীম (সা) তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি যদি তাঁকে অনুমতি দিতেন তাহলে আমরা খাসি করে নপুংসক হয়ে যেতাম।
এ প্রেক্ষিতেই বিশেষজ্ঞগণ মত দিয়েছেন যে, মুসলিম মাত্রেরই বিয়ে করা ফরয। সাধ-সামর্থ্য থাকা পর্যন্ত তা পরিহার করে চলা মাত্রই জায়েয নয়। অপরদের মতে যে লোক বিয়ে করতে ইচ্ছুক এবং তা না করলে নিজের চরিত্র রক্ষার ব্যাপারে আশংকা বোধ করে তার অবশ্যই বিয়ে করা উচিত।
অভাব-অনটন রিযকের অপ্রশস্ততা বা দায়িত্ব বোঝা বহনের সাহসহীনতার কারণে বিয়ে না করা কোন মুসলমানেরই শোভা পায় না। বরং তার উচিত আল্লাহর সাহায্য ও অনুগ্রহ লাভের জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করা। কেননা যারা নিজেদের চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষার উদ্দেশ্যে বিয়ে করবে, আল্লাহ্ তাদের প্রতি অনুগ্রহ বর্ষণের ওয়াদা করেছেন। আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ (আরবী****************)
তোমাদের মধ্যকার অবিবাহিত ব্যক্তিদের এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সচ্চরিত্র, তাদের বিয়ে দাও। তারা গরীব হলে আল্লাহ্ তাঁর অনুগ্রহ দিয়ে তাদের ধনী বানিয়ে দেবেন। (সূরা নূরঃ ৩২)
রাসূলে করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
তিন ব্যক্তির সাহায্য করা আল্লাহর দায়িত্ব। তারা হচ্ছেঃ নিজ চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষার উদ্দেশ্যে বিবাহকারী, মনিবের সাথে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে মুক্তির চুক্তিকারী, যদি সে বাস্তবিকই সেই অর্থ দিতে ইচ্ছুক হয় এবং আল্লাহর পথে যোদ্ধা।
প্রস্তাবিত কনেকে দেখা
মুসলমান বিয়ে করার সংকল্প গ্রহণ করলে এবং কোন নির্দিষ্ট মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলে বিয়ে অনুষ্ঠানের পূর্বে তাকে প্রস্তাবকারীর দেখা শরীয়তসম্মত বিধান। এ দেখার কাজটা করা হলে সে বুঝে-শুনে সম্মুখে অগ্রসর হতে পারে। চোখ বন্ধ করে এ ধরনের কাজের দিকে অগ্রসর হওয়া কোনক্রমেই উচিত নয়। কেননা তাতে পরে অনুতাপ করার কারণ ঘটতে পারে ও নিজের মনেও হতাশা জাগতে পারে। এ ব্যবস্থাকে কার্যকর করা হলে তার কোন আশংকা থাকার কথা নয়।
বস্তুতঃ চোখ বা দৃষ্টি মনের প্রতিনিধিত্ব করে। ফলে দুজনের চক্ষুদ্বয়ের মিলনে দুজনের হৃদয়ে মিলন খুবই সম্ভবপর। বিয়ের পূর্বে স্বামী-স্ত্রী (বর-কনের) পরস্পরের সম্প্রীতি ও আন্তরিকতা সৃষ্টি হওয়ার আশা করা যায়, যা দাম্পত্য জীবনের স্থায়িত্বের জন্যে একান্তই অপরিহার্য।
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ (আরবী****************)
আমি রাসূলে করীম (সা)-এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। এ সময় সেখানে এক ব্যক্তি এল। সে নবী করীম (সা)-কে আনসার বংশের একটি মহিলাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত করেছেন। তখন নবী করীম (সা) জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কি তাকে দেখেছ? লোকটি বললঃ না। তখন নবী করীম (সা) জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কি তাকে দেখেছ? লোকটি বললঃ না। তখন নবী করীম (সা) বললেনঃ এখনই যাও এবং তাকে দেখে নাও। কেননা আনসার বংশের মেয়েদের চোখে কিছু একটা (ত্রুটি) থাকে।
হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি একটি মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। তখন নবী করীম (সা) বললেনঃ (আরবী****************)
তুমি আগে তাকে দেখ। কেননা এ বিয়ে-পূর্ব দর্শনে তোমাদের মধ্যে মিলমিশ স্থাপিত হওয়ার খুব বেশি সম্ভাবনা আছে। মুগীরা মেয়েটির পিতামাতার কাছে উপস্থিত হলেন এবং নবী করীম (সা) যা বলেছেন, তা তাদের জানিয়ে দিলেন। তারা ব্যাপারটিকে খুব ভাল মনে করল না। কিন্তু মেয়েটি নিজেই যখন পর্দার আড়াল থেকে এ কথা শুনতে পেল, তখন বলল, যদি রাসূলে করীম (সা)-ই দেখার জন্যে বলে থাকেন, তাহলে দেখে নিন। মুগীরা বললেনঃ মেয়েটির এ কথা শুনে আমি তাকে দেখলাম এবং তাকে বিয়ে করলাম। (আহমদ, ইবনে মাযাহ, তিরমিযী, দারেমী, ইবনে হাব্বান)
প্রস্তাবিত কনেকে কতটা দেখা যেতে পারে, নবী করীম (সা) সুস্পষ্ট ভাষায় তার কোন সীমা নির্দিষ্ট তার কোন সীমা নির্দিষ্ট করে দেননি। কিছু সংখ্যক বিশেষজ্ঞ বলেছেনঃ শুধু মুখমণ্ডল ও পাঞ্জাদ্বয় দেখা যেতে পারে। কিন্তু প্রস্তাবিত কনের ব্যাপারে তো এটা কোন বিশেষ ব্যবস্থা নয়, এটা তো অপ্রস্তাবিতা মহিলাকে দেখার ব্যাপারেও কার্যকর। বিয়ের পয়গাম না দেয়া হলেও তা দেখা জায়েয। বিয়ের পয়গাম দেয়া হলে সংশ্লিষ্ট মেয়েকে দেখার অনুমতিই প্রমাণ করে যে, সাধারণ অবস্থায় যতটা দেখা জায়েয, এ অবস্থায় তার চাইতে অনেক বেশি দেখার অনুমতি থাকা আবশ্যক এবং তা জায়েয হওয়া উচিত।
হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
তোমাদের কেউ যখন কোন মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে তখন সম্ভবপর হলে তার এমন কিছু অংশ তার দেখা উচিত, যা তাকে বিয়ে করতে উদ্বুদ্ধ করবে।
একদিকে কিছু বিশেষজ্ঞের মতে প্রস্তাবিতা কনেকে ভালভাবে দেখার অনুমতি আছে এবং অপরদিকে অপর কিছু আলিম এ ব্যাপারে খুব সংকীর্ণ দৃষ্টি রাখেন। এর মধ্যে মধ্যম মাত্রাই ভাল ও ভারসাম্যপূর্ণ। কিছু সংখ্যক বিশেষজ্ঞ এমত পোষণ করেন যে, বিয়ের প্রস্তাবদাতা পুরুষের পক্ষে প্রস্তাবিতা কনেকে দেখার এরূপ অনুমতি থাকা উচিত যে, মেয়ে যে পোশাকে তার বাপ-ভাই ও মুহাররম পুরুষদের সামনে আসা-যাওয়া করে, ঠিক সেই পোশাকেই তাকে দেখবে। শুধু তাই নয়, প্রস্তাবিতা কনের বুদ্ধি-বিবেচনা ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গুণাবলীও পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষা করে দেখার জন্যে মেয়ের একজন মুহাররম পুরুষসহ তারা এমন এক স্থানে বসবে, যেখানে মেয়ে সাধারণত যাওয়া-আসা করে। তবে শর্ত এই যে, সেই স্থানটি বৈধ ধরনের হতে হবে এবং প্রস্তাবিতা কনে শরীয়তসম্মত পোশাক পরে থাকবে। এ মতের ভিত্তি হচ্ছে উপরিউক্ত হাদীসের অংশ, যাতে বলা হয়েছেঃ তার এমন কিছু অংশ দেখা উচিত যা তাকে বিয়ে করতে উদ্বুদ্ধ করবে। (আরবী****************)
প্রস্তাবদাতা পুরুষ প্রস্তাবিতা মেয়েকে তার এবং তার ঘরের লোকদের জানিয়ে রীতিমত আনুষ্ঠানিকভাবেও দেখতে পারে; আর কাউকে কিছু না জানিয়েও দেখতে পারে। তবে বিশেষ পয়গাম দেয়ার ও বিয়ে করার বাস্তব ও দৃঢ় সংকল্প থাকা অনিবার্য শর্ত বিশেষ। হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ তাঁর স্ত্রী সম্পর্কে বলেছেনঃ আমি তাকে দেখার জন্যে গাছের তলায় লুকিয়ে ছিলাম।
হযরত মুগীরা (রা) বর্ণিত উপরোদ্ধৃত হাদীস থেকে জানা গেল, কোন মুসলিম পিতামাতা যদি কোন রসম-রেওয়াজের নামে তাদের কন্যাকে দেখা থেকে এমন ব্যক্তিকে বাধা দেয় বা দেখাতে অস্বীকার করে, যে তাকে সত্যই বিয়ে করতে ইচ্ছুক, তাহলে সেসব রসম-রেওয়াজকে অবশ্যই শরীয়তসম্মত হতে হবে, তার বিপরীত নায়। শরীয়তকে রসম-রেওয়াজ বা প্রথা-প্রচলনের অধীন করে দেয়া তো শরীয়ত লংঘনের শামিল। কিন্তু দেখার এই অনুমতির সুযোগ পেয়ে কোন যুবক ছেলে কোন যুবতীর গলায় হাত দেবে, বিয়ের প্রস্তাবের দোহাই দিয়ে এক সঙ্গে থিয়েটার-সিনেমা, খেলার মাঠ বা হাটে-বাজারে চলে যাবে ও পরিভ্রমণ করবে এবং সঙ্গে কোন মুহাররম পুরুষ থাকবে না, তা করতে দেয়া মা-বাবার পক্ষে জায়েয নয়, প্রস্তাবদাতা পুরুষটির বা প্রস্তাবিতা কনের পক্ষেও এতটা উচ্ছৃঙ্খর হওয়া কোনক্রমেই জায়েয হতে পারে না। অথচ একালের পাশ্চাত্য সভ্যতার দাসানুদাসরা মেয়ে দেখার নাম করে এ সব করে বেড়াচ্ছে।
সত্যি কথা হচ্ছে, চরম পন্থা তা ডান দিকে হোক বা বাম দিকে, ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সাথে তার কোন সামঞ্জস্যই নেই।
বিয়ের পয়গাম দেয়ার হারাম পন্থা
তালাকপ্রাপ্তা বা স্বামী-মরা স্ত্রীলোককে তার ইদ্দতের মধ্যে- ইদ্দত শেষ হওয়ার পূর্বেই-নতুন করে বিয়ের প্রস্তাব যে কোন মুসলমানের জন্যেই জায়েয নয়। কেননা ইদ্দতটা তো প্রাক্তন বিয়ের প্রতি সম্মান দেখানর উদ্দেশ্যে পালিত হয়ে থাকে। কাজেই এ ব্যাপারে কোনরূপ বাড়াবাড়ি করা কারো পক্ষেই জায়েয নয়। তবে স্বামী মরা স্ত্রীলোকটি ইদ্দত শেষে তার সাথে বিয়ে করতে আগ্রহী কিনা তা ইশারা-ইঙ্গিতে জানাবার জন্যে ইদ্দত পালনকালেই চেষ্টা করতে পারে কিন্তু প্রকাশ্যে ও স্পষ্ট ভাষায় নয়। আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেনঃ (আরবী****************)
বিয়ের পয়গাম সম্পর্কে ইশারা-ইঙ্গিতে বলা হলে তাতে তোমাদের গুনাহ হবে না।
বিয়ের একটি প্রস্তাব সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পূর্বেই তার ওপর আর একটি বিয়ের প্রস্তাব দেয়া জায়েয নয়- যদি প্রথম প্রস্তাবের কথাবার্তা সাফল্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কেননা প্রথম প্রস্তাবদাতার প্রস্তাব সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হোক, এটা তার অধিকার। এ অধিকার অবশ্যই পূরণ হতে হবে। লোকদের পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষা ও অসৌজন্যমূলক আচরণ পরিহার করে চলার জন্যেই এরূপ করা জরুরী। অন্যথায়, প্রথম প্রস্তাবদাতার অধিকার হরণ করা হবে। আর তা নিশ্চয়ই বাড়াবাড়িমূলক কার্যক্রম। কিন্তু প্রথম প্রস্তাবদাতা নিজেই যদি ইচ্ছা ত্যাগ বা প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয় অথবা নিজেই অপরকে প্রস্তাব দেয়ার অনুমতি দিয়ে দেয়, তাহলে দ্বিতীয় কারো পক্ষে প্রস্তাব দেয়ায় কোন দোষ নেই। রাসূলে করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
একজন মুমিন অপর মুমিনের ভাই। কাজেই অপর ভাইয়ের ক্রয়ের ওপর ক্রয় করা এবং অপর ভাইয়ের বিয়ের প্রস্তাবের ওপর প্রস্তাব পেশ করা জায়েয নয়।
নবী করীম (সা) আরও বলেছেনঃ (আরবী****************)
একজনের বিয়ের প্রস্তাব পরিত্যক্ত না হওয়া বা তার ওপর প্রস্তাব দেয়ার অনুমতি না দেয়ার পূর্বে অপর কারো প্রস্তাব দেয়া জায়েয নয়। (বুখারী)
কুমারী কন্যার অনুমতি, তার ওপর জোর না করা
যুবতী কুমারী কন্যা তার বিয়ের ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়ার অধিকারী। তার মতের প্রতি গুরুত্ব না দেয়া বা তার সম্মতি-অনুমতির প্রতি লক্ষ্য না রাখা তার পিতা বা অভিভাবকের জন্যে মোটেই জায়েয নয়। নবী করীম (সা) বলেনঃ (আরবী****************)
পূর্বে স্বামী পাওয়া মেয়ে তার নিজের ব্যাপারে তার অভিভাবকের অপেক্ষা বেশি অধিকার সম্পন্না। আর ‍কুমারী কন্যার কাছ থেকে তার নিজের ব্যাপারে অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে।
এক যুবতী মেয়ে নবী করীম (সা)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে জানাল যে, তার পিতা পিতার ভাইর পুত্রের সাথে তাকে বিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এ বিয়ে তার পছন্দ নয়। তখন নবী করীম (সা) এ বিষয়ে ফয়সালা করার ইখতিয়ার তাকেই দিলেন। মেয়েটি বললঃ আমার পিতা যে আত্মীয়তা করেছে সে তা কার্যকর করেছে কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আমি নারীকুলকে জানিয়ে দেব যেঃ (আরবী****************)
মেয়েদের ব্যাপারে বাপদের কিছু করার ইখতিয়ার নেই।
মেয়ের জন্যে দ্বীনদার চরিত্রবান সমমানের ছেলের কাছ থেকে বিয়ের প্রস্তাব এলে তার বিয়ে বিলম্বিত করার পিতার কোন অধিকার নেই। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
তিনটি ব্যাপার বিলম্বিত করা জায়েয নয়ঃ নামায- তার সময় হয়ে গেলে, জানাযা- লাশ উপস্থিত হলে এবং বিয়ে-যোগ্য মেয়ের বিয়ে- যদি সমান মানের প্রস্তাব পাওয়া যায়।
তিনি আরও বলেছেনঃ (আরবী****************)
যারা দ্বীনদারী ও চরিত্র তোমাদের পছন্দ মতো হবে, তার কাছে বিয়ে দাও। যদি তা না কর, তাহলে পৃথিবীতে চরম অশান্তি ও বিরাট বিপর্যয় দেখা দেবে।
মুহাররম মেয়েলোক
প্রত্যেক মুসলিম পুরুষের জন্যে নিম্নলিখিত মহিলাদের বিয়ে করা সম্পূর্ণ হারাম।
১. পিতার স্ত্রী- পিতার তালাক দেয়া স্ত্রী হোক কিংবা রেখে মরে গিয়ে থাক, উভয় অবস্থায় একই বিধান। ইসলামের পূর্ব জাহিলিয়াতের যুগে পিতার স্ত্রী বিয়ে করার প্রচলন ছিল। ইসলাম তাকে হারাম ঘোষণা করেছে। কেননা পিতার স্ত্রী তো মা সমতুল্য, পিতার সাথে তার একবার বিয়ে হয়ে যাওয়াই এ হারাম হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। কেননা সন্তানের কাছে পিতার মর্যাদা অনেক বড় ও সম্ভ্রমপূর্ণ। পুত্রের জন্যে পিতার স্ত্রী চিরতরে হারাম হওয়ার কারণে তার প্রতি সন্তানের লোভ ও লালসা করাও চূড়ান্তভাবে হারাম হয়ে গেছে। ফলে পুত্র ও পিতার স্ত্রীর মধ্যে সম্মান ও মর্যাদার সম্পর্ক চিরদিনের জন্যে স্থায়ী ও অবিচল-অপরিবর্তিত হয়ে থাকল।
২. মা- গর্ভধারিণী, দাদী-নানীও অনুরূপভাবে হারাম।
৩. কন্যা- পুত্রের কন্যা ও মেয়ের কন্যাও এর মধ্যে শামিল, এভাবে এ তালিকা যতই লম্বা হোক না কেন।
৪. ভগ্নি- আপন হোক কিংবা মার দিক দিয়ে অথবা পিতার দিক দিয়েই হোক।
৫. ফুফু- পিতার বোন, আপন হোক কিংবা অন্য যে রকমই হোক।
৬. খালা- মা’র বোন
৭. ভাইয়ের কন্যা
৮. বোনের কন্যা
ইসলামে এ সব মহিলাদের ‘মাহারিম’ বা ‘মুহাররমাত’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কেননা মুসলিম ব্যক্তির জন্যে এরা চিরকালের তরে হারাম। কোন সময় এবং কোন অবস্থাতেই তারা হালাল নয়, এদের বিয়ে করা জায়েয নয়। এ সম্পর্কের দিক দিয়ে পুরুষটিকেও ‘মুহাররম’ বলা হয়।
এ সব মেয়ে বিয়ে করা হারাম হওয়ার কারণ
ক. সুসভ্য ও সুরুচিসম্পন্ন মানুষের প্রকৃতি স্বীয় মা-বোন-কন্যাকে স্বীয় যৌন লালসা চরিতার্থ করার জন্যে ব্যবহার করতে কখখনই রাজি বা প্রস্তুত হতে পারে না। মানুষ তো দূরের কথা, কোন-কোন পশুও তা করতে প্রস্তুত হয় না। খালা ও ফুফুর প্রতিও নিজের গর্ভধারিণী মার মতোই সম্ভ্রম বোধ থাকে, থাকে তেমনি শ্রদ্ধা-ভক্তি। অনুরূপভাবে চাচা এবং মামাও যে কোন নারীর জন্যে পিতার সমতুল্য শ্রদ্ধা-ভক্তিভাজন হয়ে থকে।
খ. ইসলামী শরীয়তে এসব ‘মুহাররমাত’ সম্পর্কে অনুরূপ সিদ্ধান্ত না দিলে তাদের প্রতি যৌন লালসাবোধকে চিরতরে হারাম করা না হলে এদের পরস্পরের মধ্যে যৌন সম্পর্ক গড়ে উঠা অসম্ভব ছিল না, কেননা এদের পরস্পরের মধ্যে নিভৃত একাকীত্বে খুব বেশি মেলামেশা হয়ে থাকে স্বাভাবিক পারিবারিক জীবন যাপনের কারণে।
গ. এসব নিকট-আত্মীয়তা সম্পন্ন লোকদের পরস্পরের মধ্যে গভীর আবেগপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে থাকে, এ কারণে প্রতিটি মানুষ তাদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ করে। তাদের প্রতি গভীর-তীব্র সহানুভূতি ও হৃদয়াবেগ অনুভব করে। এ কারণে প্রেম-প্রীতি সহকারে এর বাইরের মহিলাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনই বাঞ্ছনীয়। এতে করে নতুন আত্মীয়তার সূত্রে আপনজন, আত্মীয়-স্বজনের পরিধি সমাজের মধ্যে অনেক ব্যাপক ও সম্প্রসারিত হয়ে পড়ে এবং ভালবাসা ও সহানুভূতি সম্পর্কের ক্ষেত্রও বিস্তীর্ণ হয়ে যায়। কুরআনে সেদিকে ইঙ্গিত করেই বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
এবং তোমাদের মধ্যে বন্ধুতা ও ভালবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি করে দিয়েছেন।
ঘ. এসব নিকটাত্মীয়তা সম্পন্ন লোকদের পরস্পরের মধ্যে যে স্বাভাবিক আবেগ রয়েছে, তা স্থায়ী হয়ে থাকা একান্তই জরুরী ও অপরিহার্য। তাদের মধ্যে যে স্থায়ী সম্পর্ক রয়েছে তা এ ভাবেই অটুট ও অক্ষয় হয়ে থাকেতে পারে, তা পরিপক্কতা লাভ করতে পারে। তাদের ভালবাসা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রভৃতির জন্যে সুদৃঢ় ভিত্তি রচিত হতে পারে। কিন্তু তার বিপরীত এদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার সুযোগ থাকলে এদের পরস্পরের মতদ্বৈততা হিংসা-বিদ্বেষ ও ঝগড়া-ফাসাদ হওয়া ছিল অবধারিত। আর তার ফলে পারিবারিক জীবনে আসত গভীর ভাঙন ও বিরাট বিপর্যয়। পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা ও শত্রুতা এক অনিবার্য পরিণতি হয়ে দেখা দিত।
ঙ. এসব নিকটাত্মীয়তা সম্পন্ন নারী-পুরুষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হলে তাদের যে বংশ সৃষ্টি হতো তা সর্বদিক দিয়ে দুর্বল ও অকর্মণ্য হয়ে পড়া খুবই স্বাভাবিক। কোন পরিবারে দৈহিক বা বিবেক-বুদ্ধিগত কোন দুর্বলতা বা ত্রুটি থাকলে তা বংশানুক্রমে সংক্রমিত হয়ে সেই বংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যেত।
চ. প্রত্যেক নারী তার পক্ষ সমর্থনকারী ও তার পক্ষে চেষ্টা-প্রচেষ্টাকারী পুরুষের মুখাপেক্ষী এবং তার ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। তার স্বামীর সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটলে এরূপ ব্যক্তির অপরিহার্যতা তীব্র হয়ে উঠে। তখন স্বার্থরক্ষা ও তার পক্ষ সমর্থন করার জন্যে কেউ না থাকলে নারীর অসহায়ত্ব মর্মান্তিক হয়ে পড়ে। কিন্তু তার বিয়ে যদি এসব অতি আপনজনের মধ্যে কারো সাথে হয়ে যায়, তাহলে তার পক্ষে কথা বলার কোন লোক কোথাও পাওয়া যাবে না। কেননা তখন তার আপনজনই তার প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রু হয়ে দাঁড়াবে।
দুগ্ধ সেবনের কারণে বিয়ে হারাম হওয়া
৯. শৈশবকালে যে পুরুষ ছেলে যে নারীর বুকের স্তন পান করেছে তার পক্ষে এ নারীকে বিয়ে করা সম্পূর্ণ হারাম। কেননা এ দুগ্ধ পান করানর কারণে সে তো তার মা সমতুল্য হয়ে গেল। তার দেহে যে মাংসপেশী ও অস্থিমজ্জা গড়ে উঠেছে তাতে তার বুকের দুগ্ধ গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দুগ্ধ পানের দরুন দুজনের মধ্যে মা-সন্তানের এক নতুন আবেগপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। একথা সত্য যে, অনেক সময় এ সম্পর্ক প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু ব্যক্তি অবচেতনায় তা বহুদিন পর্যন্ত বর্তমান থাকে এবং প্রয়োজনের সময় তা প্রকট হয়ে দেখা দেয়া।
দুগ্ধ পানের দরুন শরীয়তের এ বিধান কার্যকর হবে যদি তা শৈশব কালে অর্থাৎ দুই বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই- পান করা হয়। কেননা এ বয়সেই নারীর বুকের দুগ্ধ সেবন করে থাকে, তবেই শরীয়তের হুকুম কার্যকর হবে। আর তার লক্ষণ হচ্ছে এই যে, শিশুটি দুগ্ধ সেবন করতে করতে পেট ভরে যাওয়ার দরুন নিজেই পান করা ছেড়ে দেবে, স্তনের বোটা শিশুর মুখ থেকে আপনা-আপনি খসে পড়বে।
এ পাঁচবার পানের শর্তটি হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনার ভিত্তিতে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য।
১০. দুধ-বোন বিয়ে করাও হারাম। নারী যেমন পুরুষ ছেলের দুধ-মা হয়, তেমনি সেই নারীর গর্ভজাত কন্যারাও তার দুধ-বোন হবে। এ নারীর বোনেরা হবে তার দুধ খালা। অপরাপর আত্মীয়রাও তার দুধ সম্পর্কের দিক দিয়ে আত্মীয় হয়ে যাবে।
এ পর্যায়ে নবী করীম (সা)-এর হাদীস হচ্ছেঃ (আরবী****************)
বংশ সম্পর্কের দরুন যা যা হারাম, দুধ সম্পর্কের কারণেও তা তা-ই হারাম হয়ে যাবে।
বংশের আত্মীয়তার কারণে যেমন ফুফু, খালা, ভাইঝি ও ভাগ্নী বিয়ে করা হরাম, দুধ-পানের দরুনও সেই সব আত্মীয়ের সাথে বিয়ে সম্বন্ধ হারাম হয়ে যাবে।
বৈবাহিক সম্পর্কের দরুন বিয়ে হারাম
১১. স্ত্রীর মা- অর্থাৎ শাশুড়ী। তাকে বিয়ে করাও হারাম। কোন নারীর কন্যা বিয়ে করলেই সেই নারী তার জন্যে হারাম হয়ে যাবে- সে কন্যার সাথে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কার্যকর হোক আর নাই হোক, কেননা শাশুড়ি মা’র সমান।
১২. পালিতা কন্যা- অর্থাৎ যে স্ত্রীর সাথে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক কার্যকর হয়েছে, তার কন্যা স্বামীর জন্যে হারাম। যদি সে সম্পর্ক বাস্তবভাবে কার্যকর না হয়ে থাকে, তাহলে তার কন্যা বিয়ে করায় কোন দোষ নেই।
১৩. স্বীয় ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রী। পালিত পুত্রের স্ত্রী হারাম নয়। কেননা ইসলামে কোন ছেলেকে লালন-পালন করলেও সে আপন ঔরসজাত ছেলে হয়ে যায় না। জাহিলিয়াতের যুগে এ ব্যবস্থা কার্যকর ছিল, কিন্তু ইসলাম তা বাতিল করে দিয়েছে। কেননা তাতে বাস্তব ও প্রকৃত অবস্থাকে অস্বীকার করা হয়। তাতে হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল গণ্য করা হয়। আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেনঃ (আরবী****************)
তোমাদের মুখ ডাকা পুত্রকে প্রকৃত পুত্র বানিয়ে দেয়া হয়নি। কেননা তাতো শুধু তোমাদের মুখের কথা মাত্র। (সূরা আহযাবঃ ৪)
আর শুধু মুখের কথায় প্রকৃত ও বাস্তব কখনও পরিবর্তিত হয়ে যায় না। পর আপন হয়ে যায় না।
এ তিনজনের সাথে বিয়ের সম্পর্ক স্থাপন হারাম বৈবাহিকতার কারণে। বৈবাহিকতার দরুন যে আত্মীয়তা গড়ে উঠে, তাতে এ বিবাহ হারাম হওয়া একান্তই বাঞ্ছনীয়।
দুই বোনককে এক সঙ্গে স্ত্রী বানান
১৪. দুই বোনকে একসঙ্গে স্ত্রীরূপে গ্রহণ হারাম। জাহিলিয়াতের যুগে এরূপ করার ব্যাপক প্রচলন ছিল। কিন্তু ইসলাম তা হারাম করে দিয়েছে। তার কারণ, দুই বোনের পারস্পরিক আপনত্বের সম্পর্ক এরূপ অবস্থায় টিকে থাকতে পারে না। অথচ ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে এ সম্পর্ককে অটুট ও অপরিবর্তিত রাখা। কিন্তু দুই বোন যখন সতীন হয়ে দাঁড়াবে, তখন এই সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে, দু’জন দু’জনার শত্রুতে পরিণত হবে অতি স্বাভাবিকভাবেই।
কুরআন মজীদে দুই বোনকে এক সঙ্গে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করাকে স্পষ্ট ভাষায় হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। রাসূলে করীম (সা) অতিরিক্ত এই নির্দেশ দিয়েছেনঃ (আরবী****************)
একটি মেয়ে ও তার ফুফু এবং একটি মেয়ে ও তার খালাকে এক সঙ্গে স্ত্রী বানান যাবে না।
তিনি আরও বলেছেনঃ (আরবী****************)
তোমরা যদি এরূপ কাজ কর তাহলে তোমরা নিকটাত্মীয়তার সম্পর্ককে ছিন্ন করার অপরাধ করবে।
অথচ ইসলাম এই নিকটাত্মীয়তার সম্পর্ক (আরবী****************) কে অটুটু রাখতে বদ্ধপরিকর। তাহলে তাতে এমন কাজ কি করে জায়েয হতে পারে, যা এই পরিণতির সৃষ্টি করে?
পরস্ত্রী
১৫. যেসব মেয়ে কোন পুরুষের স্ত্রী হয়ে আছে এই অবস্থায় অপর কোন স্বামী গ্রহণ করা তাদের জন্যে সম্পূর্ণ হারাম।
এরূপ একজন স্ত্রীলোককে অন্য কোন পুরুষের পক্ষে বিয়ে করা জায়েয হতে পারে কেবলমাত্র দুটি অবস্থায়ঃ
ক. তার বর্তমান স্বামী হয় মরে যাবে কিংবা তালাক দেবে এবং এভাবে তার স্বামীত্ব অপমৃত্যু ও নিঃশেষ হয়ে যাবে।
খ. অতঃপর স্ত্রীলোকটির জন্যে আল্লাহ্ তা’আলা যে ইদ্দতের মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তা পূর্ণ হবে এবং পূর্ববর্তী স্বামীর প্রতি তার কর্তব্য পালিত হয়ে যাবে, তার জন্যে সংরক্ষণের ব্যবস্থা কায়েম হবে। স্ত্রীলোক গর্ভবতী হলে তার সন্তা প্রসবেই এই মেয়াদ সমাপ্ত হয়ে যাবে। সেই মেয়াদ সংক্ষিপ্ত হোক কি দীর্ঘ।
যে স্ত্রীর স্বামী মরে গেছে, তার জন্যে ইদ্দতের এ মেয়াদ হচ্ছে চার মাস দশ দিন।
আর তালাক প্রাপ্তা হলে তার ইদ্দতের মেয়াদ তিন হায়েয। তার গর্ভে কোন সন্তান নেই সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে এ মেয়াদ একান্তই জরুরী। কেননা প্রাক্তন স্বামীর কাছ থেকে তার গর্ভে সন্তান থাকার আশংকা তো রয়েছেই। কাজেই দুই ধারার বংশের সংমিশ্রণ বন্ধের জন্যে এ ইদ্দত পালন অপরিহার্য। তবে স্ত্রী যদি অল্প বয়স্কা বা হায়েয বন্ধ হয়ে যাওয়া বৃদ্ধা হয়, তাহলে তাদের ইদ্দত হচ্ছে মাত্র তিন মাস। আল্লহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ (আরবী****************)
তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীরা তিন হায়েয শুকিয়ে যাওয়ার মেয়াদ পর্যন্ত নিজেদের বিরত রাখবে। তাদের গর্ভে আল্লাহ্ যা সৃষ্টি করেছেন তাকে গোপন করা তাদের জন্যে জায়েয নয় যদি তারা আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার হয়ে থাকে। (সূরা বাকারাঃ ২২৮)
বলেছেনঃ (আরবী****************)
তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যাদের হায়েয হওয়ার আশা নেই তাদের সম্পর্কে তোমাদের মনে সন্দেহ হলে তারা তিন মাস পর্যন্ত ইদ্দত পালন করবে। তাদেরও ইদ্দত এ মেয়াদ যাদের হায়েয বন্ধ হয়েছে এবং গর্ভবতী স্ত্রীদের ইদ্দত হচ্ছে গর্ভ প্রসব।
আরও বলেছেনঃ (আরবী****************)
তোমাদের মধ্য থেকে যারা মরে যায় ও স্ত্রী রেখে যায়, সেই স্ত্রীরা চার মাস দশদিন ইদ্দত পালনে রত থাকবে। (সূরা বাকারাঃ ২৩৪)
উপরিউল্লিখিত পনের প্রকারের নারীদের বিয়ে করা ইসলামে হারাম। কুরআন মজীদের সূরা আন-নিসা’র তিনটি আয়াতে তা একসঙ্গে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই আয়াত তিনটি এইঃ (আরবী****************)
তোমাদের পিতা যে মেয়েলোক বিয়ে করেছে, তোমরা তাদের বিয়ে করো না। তার পূর্বে যা হয়ে গেছে, (তা বাদে) এটা সুস্পষ্ট নির্লজ্জতা, অত্যন্ত পাপ ও খুবই খারাপ পন্থা, সন্দেহ নেই। তোমাদের প্রতি হারাম করা হয়েছে, তোমাদের মা’দের। তোমাদের কন্যাদের, বোনদের, তোমাদের ফুফুদের, তোমাদের খালাদের, তোমাদের ভাইঝিদের, তোমাদের ভাগ্নীদের এবং তোমাদের সেসব মা, যারা তোমাদের দুধ পান করিয়েছে, আর তোমাদের দুধ-বোনদের এবং তোমাদের স্ত্রীদের মা’দের (শাশুড়ীদের),আর তোমাদের স্ত্রীদের কন্যাদের, যারা তোমাদের স্ত্রীদের কোলে লালিত এবং তোমাদের সে সব স্ত্রীদের গর্ভজাত যাদের সাথে তোমাদের স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। যদি স্বামী-সম্পর্ক স্থাপিত না হয়ে থাকে, তাহলে তাদের কন্যাদের বিয়ে করায় কোন দোষ হবে না এবং তোমাদের ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রীদের। আর তোমাদের দুই বোনকে এক সঙ্গে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করবে (তা-ও নিষিদ্ধ) তবে পূর্বে যা হয়ে গেছে, তার কথা নয়। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, দয়াবান। সে সব স্ত্রীলোকও হারাম যারা বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ রয়েছে.........। (সূরা আন-নিসাঃ ২২-২৪)
মুশরিক নারী
১৬. মুশরিক নারী বিয়ে করাও হারাম। আর মুশরিক নারী তারা যারা মূর্তি পূজা করে। প্রাচীন আরব ও ভারতীয় হিন্দু মুশরিকগণ এ পর্যায়ে গণ্য।
আল্লাহ্ তা’আলা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ (আরবী****************)
মুশরিক নারী তাওহীদী ঈমান গ্রহণ না করা পর্যন্ত তাদের বিয়ে করবে না। জেনে রাখ, ঈমানদার দাসীও মুশরিক নারীর তুলনায় অনেক ভাল, সে তোমার যতই পছন্দ ও মনলোভা হোক। তোমরা মুশরিকদের কাছে নিজেদের মেয়ে বিয়ে দেবে না, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনবে। কেননা একজন ঈমানদার দাসও মুশরিকের তুলনায় অনেক ভাল, সে তোমাদের যতই পছন্দ হোক। ওরা জাহান্নামের দিকে ডাকে আর আল্লাহ্ জান্নাত ও ক্ষমার দিকে ডাকেন তাঁর অনুমতিক্রমে।
এ আয়াত স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে যে, কোন মুসলমানের পক্ষে মুশরিক নারী বিয়ে করা জায়েয নয়। মুসলিম নারীর পক্ষেও জায়েয নয় মুশরিক পুরুষ বিয়ে করা। কেননা তাওহীদী দ্বীন ও মুশরিকী ধর্মের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। ঈমানদার লোক তো জান্নাতের দিকে মানুষকে নিয়ে যায় আর মুশরিকরা নিয়ে যায় জাহান্নামে। ওরা ঈমানদার এক আল্লাহ্, রাসূল, নবুওয়্যত, পরকালের প্রতি। আর এরা আল্লাহর সঙ্গে শিরক করে, নবুওয়্যত অস্বীকার করে এবং পরকালকে করে অবিশ্বাস।
অথচ বিয়ে হচ্ছে মনের শান্তি, স্থিতি ও বন্ধুতা সম্প্রীতির ব্যাপার। কাজেই তাতে এ দুটি পরস্পর বিরোধী ভাবধারা একত্র সমাবেশ অসম্ভব।
আহলি কিতাব নারী
কুরআন মজীদ ইয়াহূদ ও খ্রিস্টান এই দুই আহলি কিতাব সম্প্রদায়ের মেয়ে বিয়ে করার অনুমতি মুসলমানকে দিয়েছে। তাদের সাথে বিশেষ আচরণ গ্রহণ করারও নির্দেশ রয়েছে। তারা যদিও নিজেদের দ্বীনের অনেক কিছুই রদ-বদল করে ফেলেছে, তবুও তারা যে আসমানী দ্বীনের অনুসারী তা অবশ্যই মানতে হবে। তাই তাদের যবাই করা জন্তু খাওয়া যেমন মুবাহ করেছে তেমনি তাদের মেয়ে বিয়ে করাও জায়েয় ঘোষণা করছে। আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ (আরবী****************)
আহলি কিতাবের খাদ্য তোমাদের জন্যে হালাল, তোমাদের খাদ্য তাদের জন্যে হালাল। আর পবিত্র চরিত্র ও সতীত্ব সম্পন্ন মুমিন স্ত্রীলোক এবং তোমাদের পূর্বে কিতাব পাওয়া পবিত্র চরিত্র ও সতীত্ব সম্পন্ন স্ত্রী লোকও যদি তোমরা তাদের মোহরানা আদায় করে দাও, পবিত্রতা রক্ষাকারী হিসেবে, জ্বেনাকার হিসেবে নয় এবং বন্ধুতার সূত্র গ্রহণকারী হিসেবেও নয়।
অবশ্য এটা ইসলামের উদার নীতিসমূহের মধ্যে একটা বিশেষ দিক। দুনিয়ার অন্যান্য জাতি ও ধর্মসমূহে এর দৃষ্টান্ত খুব কমই পাওয়া যায়। এসব আহলি কিতাবকে কুফর ও গুমরাহ বলা সত্বেও এসব ধর্মাবলম্বী নারী নিজ নিজ ধর্মে অবিচল থেকেও মুসলমানের স্ত্রী ও তার ঘরের রানী হতে পারে বলে ইসলাম ঘোষণা করেছে। তারা হতে পারে মুসলিম ব্যক্তির মনের সান্ত্বনা, তার গোপনীতার সাক্ষী এবং তার সন্তানের মা। ইসলাম তার অনুমতি দিয়েছে, এমতাবস্থায়ও যখন ইসলামে স্ত্রীত্বের সম্পর্ক ও তার গোপন তত্ত্ব পর্যায়ে কুরআন বলেছেঃ (আরবী****************)
আল্লাহর একটি নিদর্শন হচ্ছে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদেরই মধ্যে স্ত্রী বানিয়ে দিয়েছেন, যেন তোমরা তাদের কাছে সান্ত্বনা লাভ করতে পার এবং তোমাদের মধ্যে বন্ধুতা-ভালবাসা ও দয়া-সহানুভূতি সৃষ্টি করেছেন।
এ পর্যায়ে একটি বিষয়ে সতর্ক করে দেয়া একান্তই অপরিহর্য। একজন দ্বীনদার- দ্বীনের প্রতি ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও আকর্ষণ সম্পন্ন মুসলিম সহিলা কেবলমাত্র বংশানুক্রমিক মুসলিম মহিলার তুলনায় অনেক উত্তম। রাসূলে করীম (সা) আমাদের এ কথা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেছেনঃ (আরবী****************)
দ্বীনদার নারীকে বিয়ে কর, সেই তোমার সাফল্যের কারণ হবে। (তা না করা হলে) তোমাদের হাত মাটি-মিশ্রিত হোক।
এ থেকে জানা গেল যে, যে কোন আহলি কিতাব নারীর তুলনায় যে কোন মুসলিম নারী মুসলিম পুরুষের জন্যে স্ত্রীরূপে উত্তম হতে পারে।
তাছাড়া এ ধরনের স্ত্রী গ্রহণ করা হলে তার সন্তানের ওপর তার আকীদা-বিশ্বাসের প্রভাব পড়বে এবং তাদেরও ‍বিভ্রান্ত করবে- এ আশাংকা যখন তীব্র ও নিশ্চিত, তখন দ্বীন রক্ষার উদ্দেশ্যেই এসব আশংকা থেকে রক্ষা পাওয়া ও এ ধরনের স্ত্রী গ্রহণ না করাই বাঞ্ছনীয়।
এতদ্ব্যতীত কোন দেশে যদি মুসলমানদের সংখ্যা কম থাকে, তাহলে, এরূপ অবস্থায় মুসলিম পুরুষদের আহলি কিতাব স্ত্রী গ্রহণ সম্পূর্ণ হারাম হওয়া উচিত। কেননা তখন মুসলিম পুরুষরা যদি মুসলিম মেয়েদের বাদ দিয়ে আহলি কিতাব মেয়ে বিয়ে করে, তাহলে মুসলিম নারীদের বিয়ে হওয়া সম্ভব হবে না এবং তার ফলে তারা চরমভাবে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে। কেননা তাদের বিয়ে তো অমুসলিম পুরুষদের সাথে হতে পারে না, তা জায়েয নয় বলে। তখন ওদের কেউ বিয়ে করার থাকবে না। এরূপ অবস্থা মুসলিম সমাজের পক্ষে খুবই মারাত্মক হয়ে দেখা দেবে। তাই আহলি কিতাব মেয়ে বিয়ে করা মুসলিম পুরুষের জন্যে জায়েয হলেও এরূপ অবস্থায় তার অবকাশ না রাখাই উক্ত বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র উপায় বলে বিবেচিত।
অমুসলিম পুরুষের সাথে মুসলিম নারীর বিয়ে
মুসলিম নারীকে অমুসলিম পুরুষের কাছে বিয়ে দেয়া সম্পূর্ণ রূপে হারাম, সে অমুসলিম আহলি কিতাব হোক কি অন্য কেউ। মুসলিম নারীর জন্যে তা কোন অবস্থায়ই জায়েয নয়। এ পর্যায়ে কুরআনী হুকুম পূর্বেও উদ্ধৃত হয়েছে। হুকুমটি এইঃ (আরবী****************)
তোমরা তোমাদের মেয়ে মুশরিকদের কাছে বিয়ে দেবে না, যতক্ষণ না তারা ঈমান গ্রহণ করবে।
হিজরত করে আসা মুমিন নারীদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
হিজরত করে আসা মহিলাদের তোমরা যদি মুমিন বলে জান, তাহলে তাদের কাফিরদের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিও না। কেননা এরা তাদের জন্যে হালাল নয়, তারাও হালাল নয় এদের জন্যে।
এখানে আহলি কিতাবদের বাদ দিয়ে একথা বলা হয়নি। কাজেই মুসলিম মহিলাদের কাফির মুশরিক-অমুসলিম পুরুষদের কাছে বিয়ে দেয়া হারাম হওয়ার ব্যাপারে কোন ভিন্নমতের অবকাশ নেই।
ইসলামে ইয়াহূদী-খ্রিস্টান মেয়ে বিয়ে করা জায়েয করা হয়েছে, কিন্তু মুসলিম নারীকে তাদের কাছে বিয়ে দেয়া হারাম করা হয়েছে, তার মূলে যুক্তি সঙ্গত কারণ রয়েছে। কেননা পুরুষই হয় ঘরের পরিবারের কর্তা ও নারীর ওপর কর্তৃত্বসম্পন্ন। সে-ই সব বিষয়ে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। উপরন্তু ইসলাম আহলি কিতাব স্ত্রীকে তার আকীদা-বিশ্বাসের পূর্ণ স্বাধীনতার অধিকার দিয়েছে। শরীয়তের আইন বিধানের সাহায্যে তার অধিকার সম্পর্কের সংরক্ষণও করেছে। তার মান-মর্যাদা রক্ষারও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কিন্তু ইয়াহূদী খ্রিস্টান (বা হিন্দু) ধর্ম অপর কোন ধর্মাবলম্বী স্ত্রীর কোনরূপ অধিকার মর্যাদা বা স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়নি। তার অধিকার রক্ষা করা হবে বলে কোন প্রতিশ্রুতিও পাওয়া যায় নি। এরূপ অবস্থায় ইসলাম কোন মুসলিম নারীকে অমুসলিম পুরুষের কাছে বিয়ে দেয়ার অনুমতি দিয়ে তাকে এই কঠিন বিপদে কি করে ঠেলে দিতে পারে? এই মুসলিম নারীর দ্বীনী আকীদা ও চরিত্র সংরক্ষণে নিশ্চয়তা দেয় না এমন পুরুষের কাছে তাদের সমর্পণ করার নীতি গ্রহণ করা- কিছুতেই সম্ভবপর নয়।
মূলত স্বামীর উচিত স্ত্রীর ধর্ম বিশ্বাস ও চরিত্রকে সম্মান ও মর্যাদা দেয়া। দুজনের মধ্যে উত্তম সম্পর্ক এরূপ করা হলেই রক্ষা পেতে পারে। মুসলমানরা তো ইয়াহূদী খ্রিস্টানদের- তাদের আকীদা-বিশ্বাসের অনেক মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হওয়া সত্ত্বেও আসমনী ধর্মে বিশ্বাসী বলে মনে করে। তওরাত ও ইনজীল আল্লাহর কিতাব বলে মানে। হযরত মূসা ও ঈসা (আ) আল্লাহর মহান নবী ও রাসূল ছিলেন বলেও বিশ্বাস করে। এ কারণে কোন আহলি কিতাব নারীর পক্ষে একজন মুসলিমের স্ত্রী হয়ে স্বধর্মে স্থিত হয়ে জীবন যাপন করা ও শান্তি-সুখে থাকা খুবই সম্ভবপর। কেননা সেই স্বামী তো তার (স্ত্রীর) আমলম দ্বীন, কিতাব ও নবীকে মান্য করে। শুধু তাই নয়, তাকে সত্য সঠিক না মানলে মুসলিমানের ঈমানই শুদ্ধ ও সঠিক হয় না বলেও সে জানে। কিন্তু ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের আচরণ সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা ইসলামকে আদৌ স্বীকৃতি দেয় না। ইসলামের কিতাব এবং তার রাসূলকেও তারা মানে না। তাহলে একচন ইসলামে বিশ্বাসী নারী কি করে এরূপ স্বামীর স্ত্রীত্বে সুখে-শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারে? কেননা সে তো দ্বীন ও ইসলামী ইবাদত-বন্দেগী পালন করবে এবং ইসলামের মান-মর্যাদা, তার রীতি-নীতির বাস্তবতা রক্ষা করতে চেষ্টিত হবে। শরীয়তের হারাম থেকে নিজেকে রক্ষা করবে এবং কর্তব্যগুলো পালন করবে। কিন্তু এরূপ স্বামীর অধীন থেকে তা কার্যত সম্ভবপর হবে না। কেননা তাকে তো তার অমুসলিম স্বামীর কর্তৃত্ব মেনে চলতে হবে।
এ আলোকেই মুসলিম পুরুষের জন্যে মূর্তি পূজারী মুশরিক নারী বিয়ে করাকে ইসলামে হারাম ঘোষণা করার যৌক্তিকতা বুঝতে পারা যায়। কেননা ইসলাম শিরক ও মূর্তি পূজার সম্পূর্ণ বিরোধী, তা পূর্ণমাত্রায় অস্বীকারকারী। ফলে এ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কাম্য পরম প্রীতি ও বন্ধুতা ভালবাসা গড়ে উঠা ও স্থায়ী হওয়া সম্ভব নয়।
ব্যভিচারে অভ্যস্ত নারী
ব্যভিচারে অভ্যস্থ ও বেশ্যাবৃত্তিতে লিপ্ত ও প্রকাশ্যভাবে এ পেশা অবলম্বনকারী নারী বিয়ে করা কোন ঈমানদর মুসলমানের জন্যে জায়েয নয়। হযরত মুরসাদ ইবনে আবুল মুরসাদ (রা) নবী করীম (সা)-এর কাছে এমন একটি বেশ্যাকে বিয়ে করার অনুমতি চেয়েছিলেন যার সাথে জাহিলিয়াতের যুগে তাঁর সম্পর্ক ছিল। এ মেয়েটির নাম ছিল ‘ইনাক’। এ কথা শুনে নবী করীম (সা) তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এ সময় কুরআনের আয়াত নাযিল হলঃ (আরবী****************)
ব্যভিচারকারী পুরুষ ব্যভিচারকারী বা মুশরিক নারী ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না এবং ব্যভিচারী নারীকে ব্যভিচারকারী বা মুশরিক পুরুষ ছাড়া আর কেউ বিয়ে করবে না, ঈমানদার লোকদের জন্যে এরা হারাম।
নবী করীম (সা) সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে আয়াতটি পাঠ করে শোনালেন এবং তাঁকে বললেনঃ (আরবী****************) না, তুমি তাকে বিয়ে করবে না।
তার কারণ হচ্ছে, আল্লাহ্ তা’আলা ঈমানদার পুরুষদের জন্যে ঈমানদার সচ্চরিত্র সম্পন্ন নারীদের এবং আহলি কিতাব সমাজের অনুরূপ ধরনের মেয়েদের বিয়ে করা জায়েয করে দিয়েছেন। আর তা জায়েয করা হয়েছে এই শর্তে যে, তাঁরা (আরবী****************) বিয়ে বন্ধনে গ্রহণকারী হবে জ্বেনাকারী হবে না।
কাজেই যে লোক আল্লাহর কিতাবের এ নির্দেশ অমান্য করবে, তা পালন করতে প্রস্তুত হবে না, সে তো মুশরিক। তাকে বিয়ে করতে তারই মতো আর একজন মুশরিক পুরুষই রাজি হতে পারে, কোন মুমিন তা পারে না। আর যে ব্যক্তি এ হুকুম মানল, কবুল করল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তার বিপরীত আমল করতে গিয়ে যে বিয়ে হারাম করা হয়েছে, তা করতে প্রস্তুত হলো, সে তো ব্যভিচারী হয়ে গেল।
সূরা নূর-এর উপরিউক্ত আয়াতটি উক্ত সূরার অপর একটি আয়াতের পরে উদ্ধৃত হয়েছে। সে পূর্ববর্তী আয়াতটিতে ব্যভিচারের দণ্ডের উল্লেখ করে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
ব্যভিচারকারী নারী ও পুরুষ উভয়কেই এবং প্রত্যেককেই একটি করে চাবুক মার।
এ হচ্ছে ব্যভিচারের দৈহিক দণ্ড। আর উপরে যা বলা হয়েছে তা হচ্ছে ব্যভিচারের নৈতিক ও প্রশিক্ষণমূরক দণ্ড। কেননা ব্যভিচারী নারী বা পুরুষ বিয়ে করা হারাম করে দেয়ার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন স্থানে অবস্থান করতে না দেয়া, তার জাতীয়তা অস্বীকার করা। আর বর্তমান প্রচলিত কথানুযায়ী তার অধিকারসমূহ হরণ করা- তা থেকে তাকে বঞ্চিত রাখা।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম পূর্বোক্ত আয়াতটির ব্যাখ্যাদানের পর লিখেছেনঃ
কুরআনের এ হুকুমটি যেমন সুম্পষ্ট ও অবশ্য পালনীয়, তেমনি তা বিবেক-বুদ্ধি ও প্রকৃতিসম্মতও। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর বান্দাদের জন্যে কোন চরিত্রহীন নারীর স্বামী, দয়ূস বা বন্ধু-সঙ্গী হতে সম্পূর্ণ হারাম করে দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা’আলা মানুষকে যে প্রকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন, তা-ই এরূপ কাজকে অত্যন্ত জঘন্য, দোষযুক্ত ও বীভৎস জ্ঞান করে। এ কারণেই কোন ব্যক্তিকে খুব বেশি গাল-মন্দ করতে হলে বলা হয়ঃ ‘ফাহেশা স্ত্রীর স্বামী’। এ জন্যে বাস্তবিকই এরূপ হওয়া মুসলমানের জন্যে আল্লাহ্ তা’আলা হারাম করে দিয়েছেন। এ হারাম ঘোষণায় এ কথাও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, স্ত্রীর এ পাপ স্বামীর শয্যা ও বংশকেও চরমভাবে বিপর্যস্ত করে দেবে অথচ আল্লাহ্ তা’আলা বংশধারা পরম পবিত্র ও কল্যাণময় ভিত্তির ওপর সংস্থাপিত করতে চান। এটাকে তাঁর একটি বিশেষ নিয়ম বলেও ঘোষণা করেছেন। কিন্তু জ্বেনা শুক্রকীটের সংমিশ্রণের পথ করে দেয়, বংশ সন্দেহপূর্ণ হয়ে যায়। এ জন্যে শরীয়তের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তা ব্যভিচারী নারীকে বিয়ে করা হারাম করে দিয়েছে। তবে তওবা করলে ও নিজের গর্ভধারা পবিত্র করে নিলে (অনন্ত এক হায়েয কাল অপেক্ষা করলে) ভিন্ন কথা (অর্থাৎ তখন বিয়ে করা জায়েয)। (আরবী****************)
ব্যভিচারিণীকে বিয়ে করা হারাম হওয়ার আর একটি কারণ হচ্ছে, ব্যভিচারী নারী অত্যন্ত ‘খবীস’ হয়ে থাকে। অথচ আল্লাহ্ তা’আলা বিষয়টিকে একটা বন্ধুতা-ভালবাসা-সম্প্রীতির পবিত্র বন্ধন বানিয়েছেন। বন্ধুতা প্রকৃত ভালবাসা। কোন ‘খবীস’ মেয়ে পবিত্র চরিত্রের পুরুষের প্রিয়তমা স্ত্রী হতে পারে না। স্বামীকে আরবী ভাষায় বলা হয় (আরবী****************) ‘যাওজুন’। এ শব্দটি (আরবী****************) ‘ইযদিওয়াজ’ থেকে নির্গত। আর তার অর্থ সাদৃশ্য সামঞ্জস্য সম্পন্ন হয়ে থাকে সর্বদিক দিয়ে। কিন্তু ‘খবীস’ এ ‘পবিত্র’ এ দুয়ের মাঝে পূর্ণ মাত্রায় ঘৃণ্য ও বিতৃষ্ণার ভাব প্রকট হয়ে থাকে অবধারিত। শরীয়তের দৃষ্টিতে, সাধারণ মূল্যবোধের বিচারেও, ফলে এ দুজনের মধ্যে কাম্য পারস্পরিক আন্তরিকতা ও সুগভীর প্রেম প্রণয়ন ভালবাসা ও মিলমিশ হওয়া সম্ভব নয়। তাই আল্লাহ্ তা’আলা সত্যই বলেছেনঃ (আরবী****************)
খবীস নারী খবীস পুরুষদের জন্যে এবং খবীস পুরুষ খবীস নারীদের জন্যে। আর পবিত্র চরিত্রা নারী পবিত্র চরিত্র পুরুষদের জন্যে এবং পবিত্র চরিত্র পুরুষ পবিত্র চরিত্রা নারীদের জন্যে। (সূরা নূরঃ ২৬)
সাময়িক বিয়ে
ইসলামে বিয়ে একটি সুদৃঢ় বন্ধন; একটি দুরতিক্রম্য প্রতিশ্রুতি। উভয় পক্ষ থেকে চিরদিনের একত্র জীবন যাপনের অপরিসীম আগ্রহ ও উৎসাহের ফলশ্রুতি। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মানসিক প্রশান্তি, বন্ধুতা-ভালবাসা ও দয়া-সহানুভূতির ভাবধারার স্থিতিলাভই হয় তার কাম্য। বংশের ধারা অব্যাহত রেখে মানবতার অগ্রগতিকে স্থায়িত্ব দান তার চরম লক্ষ্য। কুরআন মজীদে আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেনঃ (আরবী****************)
আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তোমাদের জন্যে জুড়ি বানিয়ে দিয়েছেন এবং তোমাদের এ জুড়ি থেকেই সন্তান-সন্ততি ও নাতিপুতি বানানর ব্যবস্থা করেছেন।
এ কারণে বিয়ে সব সময়ই স্থায়ী ভিত্তিতে হওয়া উচিত। কিন্তু সাময়িক বা অস্থায়ী বিয়ে সে রকম হয় না। তা হয় একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে একটা নির্দিষ্ট সময়কালের জন্যে। ফলে বিয়ের যে তাৎপর্য কুরআনের আলোকে উপরে বলা হলো, তা এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। রাসূলে করীম (সা) শরীয়তের বিধান পূর্ণত্ব ও স্থিতি লাভের পূর্বে এরূপ বিয়ের অনুমতি দিয়েছিলেন। এ অনুমতির ক্ষেত্রেও সময় ছিল দীর্ঘদিনের সফর ও যুদ্ধযাত্রা, কিন্তু পরে তিনি নিজেই তা চিরদিনের তরে হারাম করে দিয়েছেন।
শুরুতে এরূপ বিয়ের অনুমতি দেয়ার কারণ ছিল। তখন মানুষ জাহিলিয়াত ত্যাগ করে ইসলামের দিকে যাওয়ার একটা ক্রান্তিলগ্ন বা সন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। জাহিলিয়াতের যুগে জ্বেনা ব্যভিচার ছিল সহজ, অবাধ, সর্বপ্রকার বাধামুক্ত।
ইসলাম আগমনের পর এ লোকদেরই যখন জিহাদের জন্যে দূরদেশে দীর্ঘ দিনের জন্যে যাত্রা করতে হয়, তখন তাদের স্ত্রীদের থেকে এতদিন বিচ্ছিন্ন ও নিঃসম্পর্ক থাকা খুব কষ্টকর হয়ে দাড়াল। এদিকে নও-মুসলিমদের মধ্যে যেমন খুব শক্ত ঈমানদার লোক ছিলেন, তেমনি ছিলেন দুর্বল ঈমানদারও। বিশেষ করে দুর্বল ঈমানদার লোকদের ব্যাপারে তাদের জ্বেনায় লিপ্ত হয়ে পড়ার আশংকা তীব্র হয়ে দেখা দিল অথচ তা সর্বাধিক নির্লজ্জতার পাপ ও বীভৎস কাজ।
অপরদিকে শক্ত ঈমানদার লোকেরা নিজেদের ‘খাসি’ বানিয়ে যৌন শক্তিকে দমন করে রাখার সংকল্প গ্রহণ করলেন! এ পর্যায়ে হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
আমরা রাসূলে করীম (সা)-এর সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করতাম। এ সময় আমাদের স্ত্রীরা আমাদের সঙ্গে থাকত না। তখন আমরা বললাম, আমরা কি ‘খাসি’ হয়ে যাব? কিন্তু নবী করীম (সা) আমাদের সে কাজ করতে নিষেধ করলেন এবং কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে কাপড় ইত্যাদির বিনিময়ে বিয়েক করার অনুমতি দিলেন।
এভাবে এ সাময়িক বিয়ের অনুমতি হয়, (আরবী) ভাষায় একেই বলা হয় ‘মুতয়া’ বিয়ে। আর তা হয় দুর্বল ও শক্তিশালী ঈমানদার উভয় শ্রেণীর মুসলমানের সাময়িক কষ্ট ও সমস্যা দূর করার উদ্দেশ্যে। ইসলাম মুসলমানদের বিবাহিত ও দাম্পত্য জীবনের জন্যে শরীয়তের যে বিধান চালু করতে চেয়েছিল, এটা ছিল সেই দিকেরই একটি পদক্ষেপ। ইসলামের লক্ষ্য ছিল এমন এক বৈবাহিকও দাম্পত্য জীবন-বিধান উপস্থাপন, যা বিয়ের সকল উদ্দেশ্যকেই বাস্তবায়িত করবে। আর তা হচ্ছে চরিত্রের পবিত্রতা, সতীত্ব রক্ষা, বিবাহিত জীবনের স্থায়ীত্ব বিধান, বংশ ধারা অব্যাহত রাখা, প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা ও পারিবারিক জীবনের পরিধি বৈবাহিক সম্পর্কের সূত্রে প্রশস্ততর করা।
কুরআন যেমন করে মদ্যপান ও সুদ হারাম করায় ক্রমিক পদ্ধতি অবলম্বন করেছে-জাহিলিয়াতের যুগে এ দুটো সর্বত্র ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে ছিল-জ্বেনা হারাম করা ও লজ্জাস্থানের মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রেও অনুরূপভাবে ক্রমিক নিয়ম অবলম্বন করেছে। তাই প্রথম দিকে প্রয়োজনের দৃষ্টিতে ‘মুতয়া’ বিয়ের অনুমতি দিয়েছেন। পরে এ ধরনের বিয়েকে নবী করীম (সা) সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছেন। হযরত আলী ও বহু সাহাবীর সূত্রে এ পর্যায়ে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। হযরত মাবুরাতা আল-জুহানী থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ (আরবী****************)
তিনি নবী করীম (সা)-এর সঙ্গে মক্কা বিজয় অভিযানে গমন করেছিলেন। এ সময় তিনি তাদের অনুমতি দিয়েছিলেন মুতয়া পন্থায় স্ত্রী গ্রহণের। তিনি আরও বলেনঃ কিন্তু নবী করীম (সা) মক্কা থেকে বের হয়ে আসার পূর্বেই তা হারাম করে দেন।
তাঁরই বর্ণিত অপর একটি হাদীসের ভাষা হচ্ছেঃ (আরবী****************)
আর আল্লাহ্ তা’আলা এ বিয়েকে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্যে হারাম করে দিয়েছেন।
এক্ষণে প্রশ্ন উঠেছে, এই হারাম ঘোষণা কি একনও কার্যকর, এখনও তা অব্যাহত হয়ে আছে, যেমন মা, কন্যা বিয়ে করা চিরকালের তরে হারাম কিংবা এই হারাম করণটা কি মৃত জীব, রক্ত ও শূকর গোশত হারাম হওয়ার মতো?...... তাহলে প্রয়োজন দেখা দিলেও জ্বেনার মধ্যে পড়ার আশংকা তীব্র হলে তখন এরূপ বিয়ে মুবাহ হয়ে যাবে?
সাধারণভাবে সমস্ত সাহাবী সমাজ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ এক মত যে, ‘মুতয়া’ বিয়ে চিরতরে ও চূড়ান্তভাবে হারাম, পূর্বের সেই হারাম ঘোষণা এখনও পূর্ণ মাত্রায় কার্যকর ও অব্যাহত ও অপরিবর্তিত হয়ে আছে। শরীয়ত চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে বলে এক্ষণে তাতে এ ধরনের বিয়ের কোন অবকাশ থাকতে পারে না।
অবশ্য হযরত ইবনে আব্বাব (রা) ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, উত্তরকালেও প্রয়োজনের কারণে তা জায়েয ও মুবাহ। একজন লোক তাঁর কাছে ‘মুতয়া’ নিয়মে স্ত্রী গ্রহণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে অনুমতি দিয়েছিলেন। তাঁর গোলাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলঃ খুব শক্ত ও কঠিন ঠেকার সময়ই কি তা জায়েয? ইবনে আব্বাস (রা) বললেনঃ হ্যা।
পরবর্তীকালে তিনি নিজেই যখন জানতে পারলেন যে, লোকেরা এক্ষেত্রে বেশ বাড়াবাড়ি শুরু করেছে এবং প্রয়োজন ছাড়াও এই পন্থা অবলম্বন করছে, তখন তিনি তাঁর এই মত প্রত্যাহার করেন এবং এর সমর্থনে ফতওয়া দেয়াও বন্ধ করে দেন। (আরবী****************)
একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ
ইসলাম প্রকৃতির সাথে পুরামাত্রায় সামঞ্জস্যশীল দ্বীন। বাস্তবতার সাথে মুকাবিলা করার যোগ্যতাসম্পন্ন এক পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। তা যেমন অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি থেকে মানুষকে বিরত রাখে, তেমনি প্রয়োজনের তুলনায় কোন অসম্পূর্ণতা অক্ষমতাই তাতে নেই। একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী রাখার অনুমতি তাতে রয়েছে দেখে আমরা একথার বাস্তব প্রমাণ পাই। কেননা তা বহু মানবিক, ব্যক্তিগত ও সামাজিক গুরুতর প্রয়োজনে একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছে মুসলমানকে।
ইসলামের পূর্বে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মানুসারী জনগোষ্ঠির মধ্যে বহু সংখ্যক মেয়েলোককে এক-এক ব্যক্তির স্ত্রীত্বে গ্রহণ করার ব্যাপক প্রচলন ছিল। কোন কোন সময় তাদের সংখ্যা দশজনকেও ছাড়িয়ে যেত, একশ দুশ তিনশ পর্যন্তও পৌছে যেত এবং তাতে কোনরীপ শর্ত আরোপ করা হতো না, থাকত না কোনরূপ বাধা-বন্ধন। কিন্তু দ্বীন-ইসলাম এসে এই একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষ নিয়ম, শর্ত ও নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করেছে।
প্রথম নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে, ইসলাম একসঙ্গে ও এক সময়ে চারজন স্ত্রী গ্রহণের শেষ সীমা নির্ধারিত করেছে। গাইলান আস মাকাফী নামক এক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে। তখন তার স্ত্রীত্বে দশজন মেয়েলোক ছিল। নবী করীম (সা) তাকে বললেনঃ (আরবী****************)
তুমি এদের মধ্যে থেকে চারজন গ্রহণ কর। আর অবশিষ্টদের বিচ্ছিন্ন করে দাও।
অনুরূপভাবে ইসলাম গ্রহণকালে যার আটজন বা পাঁচজন স্ত্রী থাকত তাকেও রাসূলে করীম (সা) চারজনের অধিক রাখতে নিষেধ করে দিলেন।
তবে নবী করীম (সা)-এর নিজের এক সঙ্গে নয়জন স্ত্রী রাখার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধরনের। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে দাওয়াতী কাজের প্রয়োজন এবং তাঁর অন্তর্ধানের পর মুসলিম উম্মতের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে এরূপ করার বিশেষ অনুমতি দিয়েছিলেন।
একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের শর্ত- সুবিচার
একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি ইসলাম দিয়েছে এ শর্তে যে, ব্যক্তির নিজের দৃঢ় প্রত্যয় থাকতে হবে যে, সে তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে পূর্ণ সুবিচার রক্ষা করতে পারবে। খাওয়া-পরা-রাত যাপন করা ও ব্যয়ভার বহনের দিক দিয়ে।
যে লোক পূর্ণ সুবিচার ভারসাম্য ও সমতার মাঝে এ সব অধিকার যথাযথভাবে আদায় করতে পারবে বলে নিজের সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারী নয়, তার পক্ষে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলার বাণীঃ (আরবী****************)
যদি তোমরা সেই সুবিচার করতে পারবে না বলে ভয় পাও তাহলে মাত্র একজন স্ত্রী গ্রহণ করবে।
আর নবী করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
যে লোকের দুজন স্ত্রী এবং সে তাদের মধ্যে একজনকে অপরজনের ওপর অগ্রাধিকার দেয়, সে কিয়ামতের দিন তার পড়ে যাওয়া বা ঝুঁকে পড়া এক পার্শ্ব টানতে টানতে উপস্থিত হবে।
এ হাদীসে দুজনের একজনের প্রতি ঝুঁকে পড়া সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। এই ঝুঁকে পড়ার অর্থ অপরজনের ন্যায্য অধিকার হরণ করা, তার প্রতি অবিচার করা। নিছক মনের ঝোঁকে কোন গুনাহ্ নয়। কেননা মনের টান বা ঝোঁক এমন একটা ব্যাপার, যার ওপর কারো ইচ্ছামূলক কোন ক্ষমতা নেই। আর সেজন্যে আল্লাহ্ তা’আলা এ ব্যাপারে কাউকে পাকড়াও করেন না এবং এই ত্রুটি ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য হবে না। আল্লাহ্ নিজেই বলেছেনঃ (আরবী****************)
তোমরা শত চাইলেও তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে (আদর্শ স্থানীয় এ পূর্ণ মাত্রায়) সুবিচার ও ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হবে না। কাজেই কোন একজনের প্রতি পূর্ণ মাত্রায় ঝুঁকে পড়া পরিহার করে চল।
এ কারণেই নবী করীম (সা) সব বন্টন করতেন ও তাতে সুবিচার করতেন তাঁর বেগমদের মধ্যে এবং সেই সঙ্গে বলতেনঃ (আরবী****************)
হে আল্লাহ্ আমি আমার সাধ্যমত সুবিচারপূর্ণ বন্টন করলাম। তাই আমার সাধ্যের অতীত ও তোমার ক্ষমতাভুক্ত যে ইনসাফ তা করতে না পারার দরুন আমাকে তুমি পাকড়াও করো না।
এই সাধ্যের অতীত বলে বুঝিয়েছেনঃ মনের ঝোঁক ও টান কেবলমাত্র বিশেষভাবে একজনের প্রতি মনের মাত্রাতিরিক্ত টান- প্রেম-ভালবাসা থাকা কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়। এ ব্যাপারে মানুষ অনেক সময় অক্ষম হয়ে যায়, হয় একান্তই অসহায়।
নবী করীম (সা) যখন বিদেশ সফরে ইচ্ছা করতেন, তখন স্ত্রীদের মধ্যে যাঁর নাম কুরআনে’র মাধ্যমে জানা যেত, তকেই সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা হতেন।
একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতির যৌক্তিকতা
বস্তুত ইসলাম আল্লাহ্ তা’আলার সর্বশেষ দ্বীন, সর্বশেষ নবী ও রাসূলের মাধ্যমে অবতীর্ণ জীবন বিধান। তা এক চিরন্তন ও সর্বসাধারণ্যে প্রযোজ্য শরীয়ত উপস্থাপিত করেছে। মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কিত আইন-বিধান তাতে বিদ্যমান। সর্বকালে, সর্বযুগে ও সর্বদেশে তা প্রয়োগযোগ্য ও ‍নিশ্চিত কার্যকর। প্রতিটি মানুষই তার জীবন-সমস্যার সমাধান তা ফেকে লাভ করতে পারে। তাতে নগরবাসীর জন্যে বিধান রয়েছে, গ্রাম বা প্রান্তরবাসীর জন্যে নয় কিংবা শীতপ্রধান দেশের লোকদের জন্যে বিধান কয়েছে, গ্রীষ্মপ্রধান দেশের লোকদের প্রয়োজনাবলীর প্রতি ভ্রূক্ষেপ করা হয়নি- এ শরীয়ত তেমন নয়। অথবা এরূপও নয় যে, তাতে এককালের এক বংশের লোকদের প্রয়োজন পূরণ করা হয়েছে, অপর কোন কালের বা বংশের লোকেরা তা থেকে বিধান লাভ করতে পারে না।
বস্তুত তা যেমন ব্যক্তিদের প্রয়োজন পূরণ করে, তেমনি করে সমাজ ও সমষ্টিরও। নির্বিশেষে সমগ্র মানুষের কল্যাণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা তাতে রয়েছে।
লোকদের বিচিত্র অবস্থা লক্ষণীয়। কেউ তার বংশের ধারা অব্যাহত রাখতে ইচ্ছুক; কিন্তু তার স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তার একটিও সন্তান নেই। তার কারণ বন্ধ্যাত্ব রোগ কিংবা অন্য যা-ই হোক না কেন। এরূপ অবস্থায় সে স্ত্রীর জন্যে কি সম্মানজনক এবং সে ব্যক্তির জন্যে উত্তম পন্থা এ নয় যে, সে লোকটি তার প্রথম স্ত্রীকে নিজের সঙ্গে রেখে এবং তার প্রাপ্য যাবতীয় অধিকার যথাযথভাবে আদায় করতে থাকে আর একজন স্ত্রী গ্রহণ করবে, যেন তার সন্তান লাভের স্বাভাবিক কামনা-বাসনা পূর্ণ হতে পারে।
কোন কোন মানুষের যৌন শক্তি খুব প্রবল ও প্রচণ্ড হতে পারে। যৌন আবেগ ও উত্তেজনা তার জন্যে অদম্য হতে পারে। কিন্তু স্ত্রী সেদিক দিয়ে অনাসক্তা বা অনাগ্রহী অথবা অক্ষম কিংবা হতে পারে সে চিররুগ্না, স্বামীর দাবি পূরণে অসমর্থ। স্ত্রীর ঋতুকাল দীর্ঘতার হতে পারে, আর তার স্বামী সেজন্য দীর্ঘদিন ধৈর্য ধারণ করে থাকতে অক্ষম। এরূপ অবস্থায় কোন বালিকা বন্ধু (girl friend) গ্রহণ করার পরিবর্তে শরীয়তাসম্মতভাবে আর একটি বিয়ে করা কি তার জন্যে শোভন নয়?
অনেক সময় দেশে পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা অনেক বিশি হয়ে থাকে। বিশেষ করে জাতীয় যুদ্ধে যখন যুবকরা দলে দলে প্রাণ দান করে, তখন তো বহু মেয়েই স্বামীহারা হয়ে জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। কেননা তাদের বিয়ে করার মতো পুরুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। অনুরূপ অবস্থায় সমাজের সার্বিক কল্যাণ এবং বিশেষ করে নারী সমাজের কল্যাণ এতেই হতে পারে যে, তারা দাম্পত্য জীবন বঞ্চিত ও কুমারী বৃদ্ধা হয়ে থাকার পরিবর্তে ‘সতীন’ হয়ে থাকাকে অগ্রাধিকার দেবে। তার ফলে তারা স্ত্রীত্বের মর্যাদা ও স্বামীর প্রেম-ভালবাসা, মানসিক প্রশান্তি ও নৈতিক পবিত্রতা সহকারে জীবন অতিবাহিত করার সুযোগ লাভ করতে পারবে। হতে পারবে সন্তানের মা। এরূপ জীবনধারাই তো প্রকৃতপক্ষে তাদের প্রকৃতির প্রতিধ্বনী।
পুরুষ সংখ্যার তুলনায় অধিক সংখ্যক বিবাহক্ষম নারীদের নিম্নোক্ত তিনটি অবস্থার মধ্যে যে কোন একটি দেখা দেয়া অনিবার্যঃ
-হয় তারা জীবনভর বঞ্চনার তিক্ত বিষ পান করতে থাকবে ও এভাবেই গোটা জীবন অতিবাহিত করবে;
-অথবা তারা মুক্ত-স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী হয়ে পুরুষদের খেলার পুতুল ও লালসার ইন্ধন হয়ে জীবন নিঃশেষ করবে;
-কিংবা ব্যয়ভার বহনে সক্ষম ও শুভ আচরণ গ্রহণে আগ্রহী বিবাহিত পুরুষদের সাথে তাদের বিয়ে হওয়াকে বৈধ মনে করা হবে।
অনাসক্ত ও সুবিবেচকদের দৃষ্টিতে বিচার করলে নিঃসন্দেহে বোঝা যাবে যে, এ শেষোক্ত অবস্থাই সুবিচার ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান। সামাজিক শৃঙ্খলা ও নৈতিক স্বাস্থ্যের দৃষ্টিতেও এ ব্যবস্থাই উত্তম। আর ইসলাম এ সমাধানই পেশ করেছে মানবীয় এ জটিল সমস্যাটির। আল্লাহ্ সত্যই বলেছেনঃ (আরবী****************)
আল্লাহর প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়শীল লোকদের জন্যে আল্লাহর দেয়া বিধানের তুলনায় উত্তম বিধান আর কে দিতে পারে? (সূরা মায়িদাঃ ৫০)
ইসলামে একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতির মৌল তত্ত্ব ও প্রসঙ্গ কথা এ-ই। অথচ পাশ্চাত্য খ্রিস্টান পাদ্রীরা এটা নিয়েই মুসরমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে পৃথিবীব্যাপী ঝড় তুলেছে। কিন্তু তাদের নিজেদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তারা পুরুষদের জন্যে অসংখ্য প্রেমিক-বান্ধবী-রক্ষিতা রাখার অবাধ সুযোগ ও অনুমতি দিয়েছে এবং তাতে কোনরূপ আইন বা নৈতিকতার নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করেনি। এহেন নৈতিকতা ও ধর্মবিবর্জিত কার্যক্রমের ফল তারা লাভ করছে অসংখ্য অবৈধ অনাথ সন্তান রূপে। এর দরূন যে সামাজিক কলুষতার সৃষ্টি হয়েছে, তা অকথ্য ও দুরপনেয়। এ মহাসত্যের আলোকে কোন্ বিধানটি অধিকতর মানবিক ও কল্যাণকর পাশ্চাত্য না ইসলামের, তা অবশ্য গুরুত্ব সহকারে বিবেচ্য।
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক
কুরআন মজীদ বিয়ের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ও প্রাঞ্জলভাবে বর্ণনা করেছে। এ ভিত্তির ওপরই দাম্পত্য জীবনের প্রাসাদ রচিত হয়। যৌন উচ্ছৃঙ্খলতার পরিবর্তে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-ভালবাসা, মানসিক শান্তি ও স্বস্তি, তৃপ্তি, স্বামী স্ত্রীর-উভয়ের আত্মীয়-স্বজন ও বংশ পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসার ও সম্প্রীতির গভীর সম্পর্ক, মানবীয় সহানুভূতি, সহৃদয়তা আবেগপূর্ণ সংবেদনশীলতার পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ এবং পিতা-মাতা হিসেবে সন্তানদের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠা প্রভৃতিই হচ্ছে বৈবাহিক বন্ধনের আসল লক্ষ্য। সূরা আর-রুম-এর আয়াতে এ দিকেই ইশারা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছেঃ (আরবী****************)
এবং তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে এও একটি যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকেই জুড়ি সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা তাদের কাছে পরম শান্তি স্বস্তি লাভ করতে পার এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহৃদয়তার সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জন্যে এতে বহু চিন্তা-বিবেচনার তত্ত্ব ও বিষেয়াদি রয়েছে।
স্বামী-স্ত্রীর সংবেদনশীল সম্পর্ক
এসব লক্ষ্য এ উদ্দেশ্য ছাড়াও স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সংবেদনশীল ও দৈহিক বা যৌন সম্পর্কের দিকে কুরআন মজীদে আলোকপাত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও কুরআন মানুষকে সহজ সরল ঋজু পথ প্রদর্শন করেছে। তা অনুসরণ করে মানুষ পংকিল ও জঘন্য ভ্রান্ত পথ পরিহার করে স্বীয় স্বাভাবিক কামনা-বাসনা পূরণ করতে পারে।
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, ইয়াহূদী ও অগ্নিপূজকরা স্ত্রীর হায়েয হলে তার থেকে অনেক দূরে চলে যেত এবং এ ব্যাপারে খুবই বাড়াবাড়ি করত। আর খ্রিস্টনরা এ অবস্থায়ও স্ত্রী সঙ্গম করত। হায়েযকে তারা কিছুমাত্র পরোয়া বা ঘৃণা করত না। আর জাহিলিয়াতের লোকেরা স্ত্রীর হায়েয হলে একঙ্গে পানাহার বা উঠা-বসা ও একই শয্যায় শয়ন- এমনকি একই ঘরে বসবাস পর্যন্ত পরিহার করত। ঠিক ইয়াহূদী ও অগ্নিপূজকদের মতো।
এসব দেখে কোন মুসলিমের মনে প্রশ্ন দেখা দেয়। এরূপ অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে সংমিশ্রণের ক্ষেত্রে কি হালাল আর কি হারাম, তা তাঁরা রাসূলে করীম (সা)-এর কাছে জানতে চান। তখন নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়ঃ (আরবী****************)
লোকেরা তোমার কাছে ‘হায়েয’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। তুমি বল- তা খবেই কদর্য-পংকিল। এ অবস্থায় স্ত্রীদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাক। তাদের সাথে দৈহিক নৈকট্য করো না, যতক্ষণ না তারা পবিত্র হচ্ছে। পরে যখন তারা পবিত্র হবে, তখন তোমরা তাদের কাছে যাও যেভাবে আল্লাহ্ তোমাদের জন্যে নিয়ম করে দিয়েছেন। আল্লাহ্ তওবাকারী ও পবিত্রতাবলম্বনকারীদের পছন্দ করেন।
এ আয়াতে স্ত্রীদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার আদেশ থেকে আরবের লোকেরা মনে করে নিয়েছিল যে, ওদের সাথে বসবাসও করা যাবে না। তখন নবী করীম (সা) আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে বললেনঃ (আরবী****************)
আমি তো তোমাদের আদেশ করেছি হায়েয অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে সঙ্গম পরিহার করতে। অনারবদের ন্যায় তাদের ঘর থেকে বহিষ্কৃত করার আদেশ তো আমি দিইনি।
ইয়াহুদীরা যখন একথা জানতে পারল, তখন বললঃ এ লোকটি সব ব্যাপারে আমাদের বিরোধিতা করার সংকল্প নিয়েছে।
অতএব স্ত্রীর হায়েয অবস্থায় তার সাথে সঙ্গম করা ছাড়া- ময়লার স্থান পরিহার করে- অন্যান্যা সব ব্যাপারে তার থেকে সুখ লাভ করায় মুসলমানের পক্ষে কোন দোষ নেই। এ থেকে দেখা গেল একদিকে হায়েয অবস্থায় স্ত্রীদের ঘর থেকে বহিষ্কৃত করা এবং অপরদিকে তাদের সাথে যৌন মিলন পর্যন্ত মেলামেশা করা, এ দুই প্রান্তিক নীতির মধ্যবর্তী ভারসাম্যপূর্ণ ও সামঞ্জস্যসম্পন্ন নীতির প্রবর্তন করেছে।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান উদঘাটন করেছে, হায়েয নিষ্ক্রান্ত রক্তে এক ধরনের বিষাক্ত বস্তু থাকে, যা দেহের মধ্যে থেকে গেলে তা খুব ক্ষতিকর হয়ে দেখা দেয়। ‘হায়েয’ অবস্থায় যৌন সঙ্গম পরিহার করার তত্ত্বত উদঘাটিত হয়েছে। জানা গেছে, হায়েয অবস্থায় রক্ত জমা হওয়ার কারণে স্ত্রীলিঙ্গ সংকুচিত হয়ে থাকে। আভ্যন্তরীণ শীরা-উপশিরাসমূহ বহমান হওয়ার কারণে স্নায়ু নিচয় খুবই অস্থির ও অস্বাভাবিক অবস্থায় থাকে। কাজেই এরূপ অবস্থায় যৌন সঙ্গম হলে তার জন্যে ক্ষতিকর হয়ে দেখা দেয়। অনেক সময় হায়েয বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর তাতে স্নায়ুবিক রোগের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় যৌন অঙ্গে জ্বালানিরও উদ্ভব হয়। (ডাঃ আবদুল আযীয ইসমঈল কৃতঃ (আরবী****************) দ্রষ্টব্য)
গুহ্যদ্বার পরিহার
স্ত্রীদের সাথে দৈহিক সম্পর্ক পর্যায়ে সূরা আল-বাকারার এ আয়াতটি নাযিল হয়ঃ (আরবী****************)
স্ত্রীরা তোমাদের ক্ষেত। তাই তোমরা ক্ষেতে গমনাগমন কর যেমন তোমরা চাও। আর নিজেদের ভবিষ্যতের সামগ্রী বানাও। আল্লাহকে ভয় কর। জেনে রাখ, তোমাদের তাঁর সাথে অবশ্যই সাক্ষাৎ হতে হবে। আর ঈমানদার লোকদের সুসংবাদ শোনাও।
এ আয়াতটি নাযিল হওয়ার বিশেষ কারণ ও যৌক্তিকতা হয়েছে। শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ দিহলভী তার উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ
ইয়াহূদীরা স্ত্রী সঙ্গম পর্যায়ে কোনরূপ আল্লাহ্ প্রদত্ত নির্দেশ ছাড়াই শুধুই সংকীর্ণতার সৃষ্টি করেছিল। আর তাদের কাছাকাছি বসবাসকারী আনসার সমাজের লোকেরা তাদেরই পন্থা অনুসরণ করত। তারা বলতঃ স্ত্রীর পেছন থেকে সম্মুখে (স্ত্রীর অঙ্গে) সঙ্গম করা হলে সন্তান টেরা হয়। তখন কুরআনের এ আয়াত নাযিল হয়ঃ (আরবী****************)
তোমরা তোমাদের ক্ষেতে গমনাগমন কর যেভাবে তোমরা চাও।
অর্থাৎ সঙ্গম তো স্ত্রীর যৌন অঙ্গেই হবে- তা সম্মুখ দিক থেকে হোক কিংবা হোক বাইরের দিক অর্থাৎ পেছনের দিক থেকে। যৌন সঙ্গমের কোন বিশেষ পন্থা বা পদ্ধতির কোন সম্পর্ক নেই সামাজিক-তমদ্দুনিক বা জাতীয় ব্যাপারাদির সাথে। তার পরে ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধার ব্যাপারে তো প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই জানে। এ ব্যাপারে ইয়াহূদীদের দৃষ্টি সংকীর্ণতা তাদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মতার ফসল। এ কারণে তা প্রত্যাখ্যান করাই বাঞ্ছনীয়। (আরবী****************)
বস্তুত সঙ্গম কার্যের পদ্ধতি ও অবস্থার নির্ধারণ দ্বীন বা ধর্মের কর্ম নয়। মানুষ আল্লাহকে ভয় করবে আর আল্লাহর সাথে যে সাক্ষাৎ হবেই, একথা সে ভাল করে জেনে নেবে। এজন্যে সে গুহ্যদ্বার পরিহার করে চলবে। কেননা তা পায়খানার রাস্তা। এ কাজ তো পংকিল লেওয়াতাতের শামিল। শরীয়ত এ কারণেই তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা জরুরী মনে করেছে। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
তোমরা স্ত্রীদের গুহ্যদ্বারে সঙ্গম করো না।
যে লোক তার স্ত্রীর গুহ্যদ্বারে সঙ্গম করে, রাসূলে করীম (সা) তাকে বলেছেঃ (আরবী****************)
ছোট লেওয়াতাতকারী।
আনসার বংশের একজন মহিলা পিছনের দিক দিয়ে স্ত্রী অঙ্গে সঙ্গম করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে নবী করীম (সা) তাকে এ আয়াতটি পাঠ করে শোনালেনঃ (আরবী****************)
তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের ক্ষেত। অতএব তোমরা তোমাদের ক্ষেতে আস যেভাবেই ও যে দিক দিয়েই তোমরা চাও।
হযরত উমর (রা) জিজ্ঞেস করলেনঃ (আরবী****************)
হে রাসূল! আমি তো ধ্বংস হয়ে গেছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোন জিনিস তোমাকে ধ্বংস করল? বললেনঃ গতরাতে আমার সওয়ারীর দিক বদল হয়ে গিয়েছিল। (অর্থাৎ পিছন থেকে স্ত্রী অঙ্গে করেছি।)
একথা শুনে নবী করীম (সা) কোন জবাব দিলেন না। পরে উপরিউক্ত আয়াতটি নাযিল হয়। তার পরে নবী করীম (সা) বললেনঃ (আরবী****************)
সম্মুখ দিয়ে কর, পিছন দিয়েও করতে পার। তবে হায়েয অবস্থা ও গুহ্যদ্বার পরিহার করে চল। (আহমদ, তিরমিযী)
স্বামী-স্ত্রীর গোপন তত্ত্ব সংরক্ষণ
কুরআন মাজীদে নেককার ও পরহেযগার স্ত্রীলোকদের গুণপনা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
বিনয়ী আল্লাহ্ অপ্রকাশিত বিষয়ের সংরক্ষণকারী আল্লাহর সংরক্ষণের অধীন ও আনুকূল্যে। (সূরা নিসাঃ ৩৪)
এ আয়াতে যেসব অদৃশ্য-গোপন বিষয়াদির সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বিশেষ সম্পর্ক পর্যায়ের বিষয়-ব্যাপারাদিও তার মধ্যে রয়েছে। এসব গোপন তত্ত্বের উল্লেখ বন্ধ-বান্ধবীদের মজলিসে বৈঠকে-সভায় প্রকাশ করা নিষিদ্ধ।
হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে অতীব নিকৃষ্টতম মর্যাদার হবে সে ব্যক্তি, যে স্ত্রীর কাছ থেকে স্বীয় প্রয়োজন পূর্ণ করে এবং পরে সে গোপন কথা প্রচার করে দেয়।
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেন, নবী করীম (সা) আমাদের নামায পড়ালেন, সালাম ফিরিয়ে আমাদের দিকে মুখ করে বললেনঃ বসে থাক সকলে এবং শোন। তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কে, যে নিজের স্ত্রীর কাছে গিয়ে ঘরের দুয়ার বন্ধ করে দেয় ও পর্দা ফেলে দেয়? পরে যখন বাইরে বের হয়ে আসে তখন লোকদের বলতে থাকে, আমি আমার স্ত্রীর সাথে এই এই করেছি?
রাসূলে করীম (সা)-এর এ প্রশ্নের কেউ কোন জবাব দিল না। পরে তিনি মহিলা নামাযীদের লক্ষ্য করে বললেনঃ তোমাদের মধ্যেও কি এমন কেউ আছে যে এ ধরনের কথাবার্তা বলে? একটি যুবতী নারী নিজ হাটুর ওপর ভর করে নবী করীম (সা)-কে দেখতে ও তাঁর কথা শুনতে চেষ্টা করছিল, সে বললঃ আল্লাহর কসম, পুরুষরাও এ রকম কথাবার্তা বলে। এ কথা শুনে নবী করীম (সা) বললেনঃ (আরবী****************)
যে লোক এরূপ করে তার দৃষ্টান্ত কি তা কি তোমরা জান? তার দৃষ্টান্ত শয়তান পুরুষ শয়তান নারীর মতো, যে নিজে স্ত্রীর সাথে রাজেপথে মিলিত হয় এবং স্বীয় প্রয়োজন পূরণ করে, আর সমস্ত মানুষ চোখ খুলে এ নির্লজ্জ দৃশ্য অবলোকন করে।
এ ধনের নির্বুদ্ধিতাজনক কাজের প্রতি চরম ঘৃণা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একজন মুসলমানের জন্যে উপস্থাপিত দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। কেননা এ অত্যন্ত জঘন্য কাজ। কোন মুসলমানই শয়তান-পুরুষ শয়তান-নারী হওয়া পছন্দ করতে পারে না।
পরিবার পরিকল্পনা
মানব জাতি ও মানব বংশের স্থিতিই বিয়ে ও বিবাহিত জীবনের চরম লক্ষ্য। আর এ স্থিতিই নির্ভরশীল হচ্ছে বংশধারা প্রবাহ অব্যাহতভাবে জারী থাকার ওপর। এ কারণে ইসলাম বংশবৃদ্ধির ওপর খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং খুব বেশি পছন্দনীয় বলে ঘোষণা করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে সন্তান- ছেলেই হোক কি মেয়েই হোক- অতীব কল্যাণ ও সমৃদ্ধির উপকরণ। কিন্তু সেই সঙ্গে ইসলাম যুক্তি সঙ্গত কারণ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনের দরুন পরিবার পরিকল্পন পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে বলে মত প্রকাশ করেছে। রাসূলে করীম (সা)-এর যুগে জন্মহার প্রতিরুদ্ধ বা হ্রাস করার উদ্দেশ্যে আযল- শুক্র নিষ্ক্রমণকালে তা স্ত্রী-অঙ্গের বাইরে নিক্ষেপ- করার প্রচলন ছিল। রিসালত যুগে সাহাবিগণ এ পন্থা গ্রহণ করতেন। হযরত জাবির (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ (আরবী****************)
আমরা রাসূলে করীম (সা)-এর জীবদ্দশায় ‘আযল’ করতাম, অথচ তখন কুরআন নাযিল হচ্ছিল। অপর হাদীসের ভাষা হচ্ছেঃ (আরবী****************)
আমরা রাসূলে করীম (সা)-এর জীবদ্দশায় ‘আযল’ করতাম। এ সংবাদ তাঁর কাছে পৌছলে তিনি আমাদের এ কাজ থেকে নিষেধ করেন নি।
আর একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
এক ব্যক্তি নবী করীম (সা)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বললঃ হে রাসূল! আমর একশটি দাসী আছে, আমি তার সাথে ‘আযল’ করি এবং সে গর্ভবতী হোক- তা আমি পছন্দ করি না। আর পুরুষরা যা সাধারণত চায়, আমিও তাই চাই। ওদিকে ইয়াহূদীরা বলে বেড়াচ্ছে যে, ‘আযল’ হচ্ছে ছোটখাটো গোপন হত্যা। তখন নবী করীম (সা) বললেন, ইয়াহূদীরা মিথ্যা বলছে। আল্লাহ্ বাচ্চা জন্মাতে চাইলে তুমি তা রুখতে পার না।
রাসূলে করীম (সা)-এর এ কথাটির তাৎপর্য হচ্ছে, ‘আযল’ করা সত্ত্বেও শুক্রকীট গর্ভধারে পৌঁছে যেতে পারে এবং অজ্ঞাতসারেই গর্ভের সঞ্চার হওয়া সম্ভব।
হযরত উমর ফারূক (রা)-এর মজলিসে ‘আযল’ সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল। একজন বললেন, লোকেরা তো তাকে ‘ছোট গোপন হত্যা’ মনে করে। একথা শুনে হযরত আলী (রা) বললেনঃ ‘মওদাহ’ জীবন্ত প্রোথিত করা অর্থাৎ ‘সন্তান হত্যা’ বলা যেতে পারে তখন, যখন ভ্রূণ সাতটি পর্যায়ে অতিক্রম করে যায় অর্থাৎ মাটির নির্যাস শুক্রকীটে পরিণত হয়, পরে তা জমাটবাঁধা রক্ত রূপ লাভ করে, পরে তা হয় মাংসপিণ্ড, তার পরে অস্থিমজ্জা গড়ে উঠে, আর তার ওপর গোশত জমে। এসব পর্যায়ে অতিক্রম করেই মানবীয় আকার-আকৃতি লাভ করে। হযরত উমর (রা) বললেনঃ আপনি ঠিকই বলেছেন। আল্লাহ্ আপনাকে দীর্ঘায়ূ করুন।
কোন্ অবস্থায় পরিবার পরিবার পরিকল্পনা জায়েয
মাত্র কয়েকটি বিশেষ প্রয়োজনে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ জায়েয হতে পারে। একটি প্রয়োজন হচ্ছে, মা’র জীবন বা স্বাস্থ্যের ওপর যদি রোগ বা প্রসবকালীন সংকটের দরুন হুমকি দেখা দেয়, তাহলে এ পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে। এ সংকট বা হুমকির কথা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জানা যাবে, কিংবা কোন বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য চিকিৎসাবিদ তা বলে দেবে। আল্লাহ্ নিজেই বলেছেনঃ (আরবী****************)
তোমরা নিজেদের হাতেই নিজেদের ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না।
বলেছেনঃ (আরবী****************)
তোমরা নিজেরাই নিজেদের হত্যা করো না। আল্লাহ্ নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতি অতীব দয়াবান।
দ্বিতীয় ভিত্তি হচ্ছে, বৈষয়িক অসুবিধা, সমস্যা ও অনিশ্চয়তা-অসহায়ত্বের মধ্যে পড়ে যাওয়ার আশংকা, যার দরুন দ্বীনী সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে মনে করা হবে। যার ফলে মানুষ সন্তানাদির কারণে হারাম জিনিস গ্রহণ ও অবৈধ কাজে লিপ্ত হওয়ার পরিণতি দেখা দেবে। আল্লাহ্ বলেছেনঃ (আরবী****************)
আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি সহজতার বিধান করতে চান, তোমাদের কোন অসুবিধায় ফেলতে চান না। (সূরা বাকারাঃ ১৮৫)
(আরবী****************)
আল্লাহ্ তোমাদের ওপর সংকীর্ণ বা অসুবিধা চাপিয়ে দিতে চান না।
তৃতীয় হচ্ছে, সন্তানদের স্বাস্থ্য নষ্ট হওয়ার কিংবা তাদের সঠিক লালন-প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হওয়ার আশংকা। এ পর্যায়ে উল্লেখ্য হাদীসঃ (আরবী****************)
হযরত উসামা ইবনে যায়দ থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলে করীমের কাছে উপস্থিত হয়ে বললঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ। আমি আমার স্ত্রীর সাথে আযল করে থাকি। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি তা কেন কর? বললঃ আমি তার স্তনের ব্যাপারে আশংকা বোধ করি। তখন নবী করীম (সা) বললেনঃ ক্ষতি হওয়ার ভয় যদি যথার্থই হতো, তাহলে পারস্যবাসী ও রোমানবাসীদের ক্ষতি সাধিত হতো।
এ কথার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, নবী করীম (সা)-এর মতে ব্যক্তিদের ব্যাক্তিগত পর্যায়ে এ কাজ করা হলে সামষ্টিকভাবে গোটা উম্মতের জন্যে কোনরূপ ক্ষতিকর ছিল না। আর তা যে ক্ষতিকর নয়, তার বড় প্রমাণ এই যে, পারস্য ও রোমান জাতি এ সময় বড় শক্তিশালী সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধিকারী ছিল, তাদের তো এ কাজের দরুন কোন ক্ষতি হয়নি।
শরীয়তের দৃষ্টিতে আরও একটি প্রয়োজনের উল্লেখ করা যায়। তা হচ্ছে দুগ্ধপোষ্য শিশুর মা’র আবার গর্ভসঞ্চার হলে শিশুর পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে। কেননা তখন মা’র দুগ্ধ নষ্ট হয়ে যেতে পারে, যার ফলে শিশু দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
নাবী করীম (সা) উম্মতের জন্যে সামষ্টিকভাবে কল্যাণকর কার্যাদি করার হেদায়েত দিতেন। আর যে সব কাজের ফলে উম্মতের ক্ষতি সাধিত হওয়ার আশংকা, তা পরিহার করে চলতে বলতেন। নবী করীম (সা)-এর এ কথাটি সেই পর্যায়েরঃ (আরবী****************)
তোমরা তোমাদের সন্তানদের গোপন পন্থায় ধ্বংস করবে না। কেননা দুগ্ধপায়ী শিশুর বর্তমানে স্ত্রী সঙ্গম করলে শিশুর ক্ষতি হতে পারে।
কিন্তু নবী করীম (সা) এ কাজকে হারাম ধরে নিয়ে নিষেধ করেন নি। কেননা তাঁর সময়ে অন্যান্য জাতির লোকেরা এই পন্থা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তাতে তাদের কোন ক্ষতি হচ্ছিল না। শিশুকে দুধ খাওয়ানের কালে তদ্দরুন স্ত্রী সঙ্গম যদি চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়া হতো তাহলে তাদের স্বামীদের তাতে কষ্ট হতো। দুগ্ধ সেবনের মেয়াদকাল দুই বছর পর্যন্ত চলতে থাকে। এ সব ব্যাপারের দিকে লক্ষ্য রেখে নবী করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
দুগ্ধপায়ী শিশুর মা’র সাথে সঙ্গম করতে আমি নিষেদ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারস্য ও রোমকদের সম্পর্কে আমি জানতে পারলাম যে, তারা এ কাজ করে; কিন্তু তাতে তাদের সন্তানের কোন ক্ষতি হয় না।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম উপরিউদ্ধৃত হাদীসদ্বয়ের মাঝে সমন্বয় বিধানের জন্যে একটি বিশ্লেষণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেনঃ
নবী করীম (সা)-এর সম্মুখে দুটি দিকই ছিল। একটি হচ্ছে দুগ্ধ পোষ্য শিশুর বর্তমানে তার মা’র মাথে সঙ্গম করলে শিশুর ক্ষতি হওয়ার আশংকা। যদিও সে ক্ষতিটা হত্যা বা ধ্বংস করার পর্যায়ের নয়, তা সত্ত্বেও ক্ষতির আশংকার দরুন তিনি তা নিষেধ করেছেন। কিন্তু তা হারাম ঘোষণা করা হয়নি, পরে তিনি ‘নিমিত্ত বন্ধকরণ’ হিসেবে তা থেকে বিরত রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু তাঁর সম্মুখে অপর একটি ‍দিকও উদঘাটিত হয়। তা হচ্ছে দুদ্ধ সেবনের মেয়েদের মধ্যে সঙ্গম নিষিদ্ধ হলে যে অসুবিধা ও বিপরীত হতে পারে, এই নিমেত্ত নিষিদ্ধকরণ দ্বারা তার প্রতিরোধ করা সম্ভবপর হবে না। বিশেষ করে নব্য যুবক ও যৌন উত্তেজনাসম্পন্ন ব্যক্তিদের চরম বিপর্যয়ে পড়ে যাওয়ার প্রবল আশংকা। এ কারণে তিনি মত গ্রহণ করলেন যে, এই কল্যাণ রোধ নিমিত্তরোধের বিপর্যয়ের তুলনয় অনেক প্রবল ও অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবিদার। সেকালের দুটি বড় বড় প্রতিষ্ঠিত জাতির কর্ম পদ্ধতিও তার সম্মুখে প্রতিভাত ছিল। তারা এ কাজ পরিহার করেনি, এ সব কারণে তিনি এ কাজকে নিষিদ্ধ করেন নি।
আধুনিককালের গর্ভ বন্ধকরণের নব নব উপায় ও পন্থা উদ্ভাবিত হয়েছে। [ মনে রাখা আবশ্যক, গ্রন্থকার এখানে পরিবাব পরিকল্পনা পর্যায়ে কথা বলেছেন, জন্ম বন্ধ বা বন্ধ্যাকরণ সম্পর্কে নয়। কাজেই আধুনিক প্রক্রিয়া সমৃদ্ধ পরিবার পরিকল্পনা বা বন্ধ্যাকরণ জায়েয বলা যাবে না। বন্ধ্যাকরণ মূলতৎঃ আল্লহর সৃষ্টি পরিবর্তন করার অপরাধ। তা যে গুণাহের কাজ ও হারাম এবং তা আল্লাহর নিষিদ্ধ স্পষ্ট সন্তান হত্যার কাজ, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। তবে কেউ চরম ঠেকায় পড়ে গেলে সেকথা স্বতন্ত্র।–অনুবাদক]
তা প্রয়োগ ব্যবহার করে কল্যাণের দিকটার সংরক্ষণ সম্ভব আর রাসূলে করীম (সা) তাই চেয়েছিলেন অর্থাৎ দুগ্ধপায়ী শিশুকে ক্ষতি থেকে বাঁচানো। আর দুগ্ধ সেবনকালে স্ত্রী সঙ্গম নিষিদ্ধকরণে যে বিপর্যয় ঘটার আশংকা, তা থেকেও তিনি উম্মতকে রক্ষা করতে চেয়েছেন।
এ আলোচনার আলোকে ইবনে হাম্বলের মতে ‘আযল’ জায়েয। তবে শর্ত হচ্ছে তার স্ত্রীর অনুমতিক্রমে হতে পারে। কেননা সঙ্গম স্বাদ ও তৃপ্তিলাভ এবং সন্তান এ উভয় দিকেই তার অধিকার রয়েছে। হযরত উমর (রা) স্ত্রীর অনুমতি ব্যতিরেকে ‘আযল’ করতে নিষেধ করেছেন।
এ থেকে ইসলামের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দৃষ্টিকোণ স্পষ্ট হয়ে উঠে। নবী করীম (সা) নারীদের অধিকারের ওপর সে সময়ই এতটা গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন, যখন দুনিয়ার মানুষ নারীর অধিকার বলতে কোন বস্তুর সাথে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল।
গর্ভপাত ঘটানো
ইসলাম গর্ভনিরোধক প্রতিক্রিয়া অবলম্বন করা জায়েয করেছে ঠিক সেই অবস্থায়, যখন তার প্রয়োজন তীব্র হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও গর্ভের সঞ্চার হয়ে গেলে তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা কোন অবস্থাতেই জায়েয নয়।
ফিকাহবিদগণ এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন যে, ভ্রুণে প্রাণের সঞ্চার হয়ে যাওয়ার পর গর্ভপাত করান সম্পূর্ণ হারাম ও অপরাধ। একাজ কোন মুসলমানের জন্যেই জায়েয হতে পারে না। কেননা তা একটি জীবন্ত ও পূর্ণাঙ্গ সত্তার ওপর অমানুষিক জুলুম। এ কারণে ফিকাহবিদগণ বলেছেন, গর্ভপাত করান কালে যদি ভ্রুণ জীবন্ত প্রসূত হয়ে মরে যায় তাহলে ‘দিয়ত’- রক্তমূল্য-দিতে হবে। আর ভ্রূণ মৃত হলে জরিমানা দিতে হবে, যার পরিমাণ দিয়ত-এর অপেক্ষা কম হবে। কিন্তু তাঁরা বলেন, ভ্রূণকে বাঁচাতে গেলে মা’র জীবন নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং গর্ভপাত করান ছাড়া প্রাণ বাঁচানর আর কোন উপায় নেই- তা যদি নির্ভরযোগ্য উপায়ে জানা যায়, তাহলে তখন গর্ভপাত করান জরুরী হয়ে পড়ে। শরীয়তের সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, দুটো ক্ষতিকর ব্যাপারের দৃষ্টিতে প্রসূতির প্রাণ বাঁচানর জন্যে মা’র জীবনকে বিপদে নিক্ষেপ করা যায় না। যেহেতু মা’র জীবনই হলো আসল। তার অধিকারই অগ্রগণ্য। অতএব ভ্রুণের জীবন রক্ষার জন্যে মার জীবন কুরবান করা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় হতে পারে না।
ইমাম গাজ্জালী বলেছেনঃ
গর্ভ নিরোধ ও গর্ভপাত- এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। গর্ভ নিরোধ সন্তান হত্যার সমান কাজ নয়। কেননা সন্তান হত্যা বলা যাবে তখন যখন গর্ভে সন্তানের অস্তিত্ব লাভ করবে। গর্ভে সন্তানের অস্তিত্ব লাভের কয়েকটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম পর্যায় হচ্ছে, জরায়ুতে শুক্রকীটের স্থিতি লাভ এবং তাতে প্রাণ বা জীবন গ্রহণের যোগ্যতা হওয়া। এরূপ অবস্থায় তা বিনষ্ট করা গুনাহের কাজ। আর তাতে রূহ ফুঁকা হয়ে গেলে এবং সুস্থ পূর্ণাঙ্গ সম্পন্ন হয়ে উঠলে তখন তা বিনষ্ট করা অধিক মাত্রায় গুণাহের কারণ। আর চূড়ান্ত মাত্রার গুনাহ হচ্ছে, শিশুর জন্মের পর তাকে হত্যা করা।
(কিন্তু ইমাম গাজ্জালী একথা কি করে ভুলে গেলেন যে, শুক্রকীট বিনষ্ট করণও নিশ্চয়ই গুণাহ্ এবং তা জায়েয করা হলে দুনিয়ায় মানুষ সৃষ্টির আল্লাহর ইচ্ছাকেই সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে দেয়া যেতে পারে, আর তা কখনই জায়েয হতে পারে না। বর্তমানে সেই পন্থাই উদ্ভাবিত ও ব্যাপকভাবে অবলম্বিত হচ্ছে। মূলত পুরুষ দেহ থেকে নির্গত শুক্রকীটই হচ্ছে পুরুষের সন্তান, যা হত্যা করতে কুরআন মজীদে বার বার নিষেধ করা হয়েছে। আর তা খাদ্যাভাবের আশংকায় হলে তো এ হারাম অত্যন্ত তীব্র হয়ে যাবে।)-আনুবাদক।
স্বামী-স্ত্রীর সামাজিক অধিকার
বিবাহ একটা সুসংবদ্ধ বন্ধন, একটা সুদৃঢ় প্রতিশ্রুতি। পুরুষ ও নারীর মাঝে সুদৃঢ় বন্ধন গড়ে তোলার জন্যেই আল্লাহ্ তা’আলা এ ব্যবস্থা কার্যকর করেছেন। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর উভয়ই উভয়ের জুড়ি। ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে স্বতন্ত্র হলেও বাস্তবতার দৃষ্টিতে তারা একে অপরের জুড়ি। একজন অপরজনের প্রতিভু। প্রত্যেকেরই নিজস্ব কামনা-বাসনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পরস্পর সম্পৃক্ত, সংযোজিত।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার এ সম্পর্কের চূড়ান্ত দৃঢ়তা ও অবিচ্ছিন্নতার কথা বোঝাবার উদ্দেশ্যেই কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
স্ত্রীরা তোমাদের পোশাক, তোমরা তাদের জন্যে পোশাক।
এ আয়াতের আসল বক্তব্য হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পর সুসংবদ্ধ, পরস্পরের গোপনীয়তা আচ্ছাদনকারী, পরস্পরের সমর্থক-সাহায্যকারী এবং একজন অপরজনের জন্যে সৌন্দর্য বিধায়ক হতে হবে। অন্য কথায় প্রত্যেকেরই অপরজনের ওপর অধিকার রয়েছে। সে অধিকার পুরামাত্রায় অবশ্যই আদায় করতে হবে। এ অধিকার সম্পূর্ণ সমান, পুরুষদের প্রকৃতি অনুযায়ী তাদের দেয়া বিশেষ বিশেষ অধিকার ছাড়া আল্লাহর কথা থেকেই তা স্পষ্ট। তিনি বলেনঃ (আরবী****************)
স্ত্রীদের জন্যে রয়েছে সেসব যা আছে তাদের ওপর সুস্পষ্ট ও প্রচলিত বা সাধারণ নিয়মে। তবে পুরুষদের জন্যে তাদের ওপর একটা অগ্রাধিকার রয়েছে।
সে অগ্রাধিকারের পর্যায় হচ্ছে পরিচালক নিয়ন্ত্রক দায়িত্বশীল ও জবাবদিহি করতে বাধ্য হওয়ার। নবী করীম (সা)-কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেনঃ আমাদের ওপর আমাদের স্ত্রীদের কি অধিকার রয়েছে? জবাবে তিনি বললেনঃ (আরবী****************)
তা হচ্ছে, তাদের নিজেদের সঙ্গে খাওয়াবে, নিজেদের মতোই পরাবে। আর মুখমণ্ডলের ওপর মারবে না, তাকে খারাপ-অশ্লীল গালাগালি করবে না এবং তাকে তার ঘর ছাড়া অন্য কোথাও ছাড়বে না। (আবূ দাঊদ, ইবনে হাব্বান)
কাজেই নিজ স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ব্যাপরে ঔদাসিন্য বা উপেক্ষা দেখান কোন মুসলমানের পক্ষেই জায়েয নয়। হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
একজন লোকের গুনাহগার হওয়ার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট যে, যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত, তাদের প্রতি সে ব্যাপারে চরম উপেক্ষা দেখাবে। (আবূ দাঊদ, নিসায়ী, হাফেম)
স্ত্রীর মুখের ওপর মারার কোন অনুমতি ইসলাম দেয়নি। কেননা এ কাজ মানবীয় সম্মান ও মর্যাদা পরিপন্থী। তাতে দেহের সর্বাধিক সম্মানার্হ ও মর্যাদাসম্পন্ন অঙ্গ- দেহের সমস্ত সৌন্দর্য যেখানে কেন্দ্রীভূত- আহত ও ক্ষুণ্ণ হয়। নাফরমান ও স্বেচ্ছাচারী স্ত্রীকে প্রয়োজন মতো সুশিক্ষাদান ও গড়ে তোলার প্রশ্নে কখনও স্ত্রীকে হালকাভাবে মারাও যেতে পারে। কিন্তু তাকে কষ্ট দেয়া ও মুখমণ্ডলকে ক্ষতবিক্ষত করার মতো মারা কিছুতেই জায়েয হতে পারে না। স্ত্রীকে গালাগালি করাও জায়েয নয়। তার মনে কষ্ট দেয়া, তার জন্যে অসহনীয় কথাবার্তা বলা এমন কি তার জন্যে বদ দো’আ করা প্রভৃতিও সম্পূর্ণ নাজায়েয।
স্ত্রীর ওপর স্বামীর অধিকার পর্যায়ে নিম্নোদ্ধৃত হাদীসটি উল্লেখ্য। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
যে স্ত্রীলোক আল্লাহর প্রতি ঈমানদার, তার পক্ষে তার স্বামীর ঘরে এমন ব্যক্তিকে আসবার অনুমতি দেয়া বৈধ নয়, যাকে তার স্বামী পছন্দ করে না। স্বামীর অনুমতি ব্যতীত ঘরের বাইরে যাওয়াও তার জন্যে জায়েয নয়। এ ব্যাপারে অপর কারো কথা মান্য করাও তার উচিত নয়, স্বামীর শয্যা থেকে দূরে থাকাও নয় বাঞ্ছনীয়। স্বামী যদি অত্যাচারী হয়, তা হলে তাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্যে সাধ্যমত চেষ্টা চালাবে। তার এই খিদমত স্বামী গ্রহণ করলে তো ভালই। আল্লাহ্ তার ওযর কবুল করে নেবেন এবং তার সত্যপন্থী হওয়াটাও প্রকাশ করে দেবেন। আর স্বামী যদি রাজি না হয়, তাহলে আল্লাহর কাছে তার অক্ষমতার ওযর পৌঁছে যাবে।
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ধৈর্য ধারণ
মুসলিম স্বামী মাত্রেরই কর্তব্য তার স্ত্রীর ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করা। বিশেষ করে তার মধ্যে এমন কিছু লক্ষ্য করে যা তার পছন্দ নয়। মানুষের মধ্যে মানুষ হওয়ার কারণে যে সব দোষত্রুটি স্বাভাবিক ভাবেই থাকে আর স্ত্রীলোকদের মধ্যে নারীত্বজনিত যে সব দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়, তা সহ্য করে নিতে অভ্যস্ত হওয়া স্বামীর একান্তই কর্তব্য। অনুরূপভাবে স্ত্রীর দোষগুলোর তুলনায় তার গুণগুলো এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি অপেক্ষা ভাল ভাল দিকগুলোর প্রতিই নজর প্রকট করে রাখা বাঞ্ছনীয়। হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
কোন ঈমানদার পুরুষ যেন কোন ঈমানদার নারীকে ঘৃণা না করে। কেননা তার মধ্যে একটি ব্যাপার যদি অপছন্দনীয় থকে তাহলে অপরাপর গুণাবলী নিশ্চয়ই পছন্দনীয় পাওয়া যাবে। (মুসলিম)
আর আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ (আরবী****************)
তোমরা স্ত্রীদের সাথে ভালভাবে বসবাস ও জীবন যাপন কর (ভাল আচরণ গ্রহণ কর)। তোমরা যদি তাদের অপছন্দ কর, তাহলে অসম্ভব নয় যে আল্লাহ্ তাদের মধ্যে অনেক কিছুই ভাল ও কল্যাণ জমা করে রেখেছেন।
ইসলাম যেভাবে স্বামীকে স্ত্রীদের অপছন্দনীয় ব্যাপারাদিতে ধৈর্য ধারণ করতে ও পরম সহিষ্ণুতা দেখাতে বলেছে, অনুরূপভাবে স্ত্রীদেরও নির্দেশ দিয়েছে নিজ নিজ স্বামীকে যথাসাধ্য সন্তুষ্ট রাখার জন্যে চেষ্টা চালিয়ে যেতে এবং স্বামীকে অসন্তুষ্ট রেখে রাত যাপন না করতে। হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
তিন ব্যক্তির নামায তাদের মাথার এক বিগত উপরেও যায় না। এক ব্যক্তি সে, যে লোকদের ইমামতি করে অথচ সেই লোকেরা তাকে পছন্দ করে না। দ্বিতীয় সেই স্ত্রীলোক, যে স্বামীকে অসন্তুষ্ট অবস্থায় রেখে রাত যাপন করে। আর তৃতীয় এমন দুই ভাই যারা পরস্পরের সাথে লড়াই-ঝগড়ায় লিপ্ত। (ইবনে মাযাহ, ইবনে হাব্বান)।
স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ দেখা দিলে
পুরুষ ঘর ও পরিবারের কর্তা, পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক। তাকে এ উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তার মধ্যেই এর যোগ্যতা পাওয়া যায় বিধায় জীবন সংগ্রাম ক্ষেত্রে তার মর্যাদাও এরূপই বলে এবং মোহরানা ও খরচাদি বহনের দায়িত্ব তারই বলে এ মর্যাদায় তাকে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। অতএব তার আনুগত্য না করা ও আনুগত্য-বহির্ভূত কাজ করা, তার অবাধ্য হওয়া এবং তাকে ডিঙিয়ে যাওয়ার কোন অধিকার স্ত্রীর থাকতে পারে না। এরূপ যদি করা হয়ই তাহলে পারস্পরিক সম্পর্ক খুব খারাপ হয়ে যাওয়া অবধারিত। সংসার তরণী হাবুডুবু খাবে এবং কোন প্রকৃত মাঝির অনুপস্থিতির কারণে তা সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত হয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়।
স্বামী যখন লক্ষ্য করবে যে, স্ত্রীর পক্ষ থেকে তাকে অমান্য করা হচ্ছে, স্ত্রী তার বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে চলছে, তখন ভাল ভাল উপদেশ, যুক্তিপূর্ণ প্রাণস্পর্শী কথাবার্তা দ্বারা তাকে সংশোধন করার সাধ্যমত চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কিন্তু উপদেশ কার্যকর না হলে তাকে তার শয্যায় পরিহার ও বর্জন করতে হবে, যেন তার মধ্যে নারীসুলভ ভাবধার জাগ্রত হয় এবং শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করে ও বাধ্য-অনুগত হয়ে যায়।
এ ব্যবস্থাপনা কার্যকর না হলে তার ওপর হাত তোলা যেতে পারে। কিন্তু তাই বলে চরম মাত্রার মারধোর, নিপীড়ন ও মুখের ওপর আঘাত করা কিছুতেই চলবে না, তা সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবেই। কোন কোন স্ত্রীলোকের জন্যে হালকা ধরনের মারধোর অনেকটা কল্যাণকর ও সঞ্জীবক হয়ে দেখা দেয়। মারধোর অর্থ চাবুক বা ডান্ডা বা লাঠি দ্বারা মার নয়। নবী করীম (সা)-এর একটি উক্তি থেকে এ বিয়য়ে সুস্পষ্ট আলো পাওয়া যায়। তাঁর কোন খাদেম কোন ব্যাপারে তাঁকে রাগিয়েছিল কোন বিশেষ কাজের জন্যে। তখন তিনি বলেছিলেনঃ (আরবী****************)
কিয়ামতের দিন বদলা নেয়ার ব্যবস্থা না থাকলে আমি তোমাকে এ মিসওয়াক দ্বারাই আঘাত দিতাম। (তাবকাতে ইবনে সা’আদ)
মারধোর করাটা রাসূলে করীম (সা) আদৌ পছন্দ করেন নি। তিনি বলেছেনঃ (আরবী****************)
তোমাদের এক একজন নিজ স্ত্রীকে এমনভাবে মারধোর করে কেন, যেমন মনিব তার দাসকে মারছে? আর তারপরই সম্ভবত রাত্রিকালেই সে তার সাথে সঙ্গম করবে। (মুসনাদে আহমদ)
যারা স্ত্রীলোকদের মারধোর করে তাদের সম্পর্কে নবী করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
এ ধরনের লোক তোমাদের মধ্যে কখনও ভাল লোক বলে গণ্য হতে পারে না।
হাফেয ইবনুল হাজার লিখেছেনঃ
তোমাদের মধ্যে যারা ভাল লোক তারা কখনও নিজেদের স্ত্রীদের মারধোর করবে না রাসূলে করীম (সা)-এর এ কথা থেকে বোঝা যায় যে, স্ত্রীদের মারা মোটামুটি জায়েয বটে। তবে তার সঠিক সময় হচ্ছে তখন, যখন স্বামী তার স্ত্রীর মধ্যে যে ব্যাপারে তার আনুগত্য করা কর্তব্য সেই ব্যাপারেই আবাধ্যতা দেখতে পায়। এরূপ অবস্থায় সে তাকে বাধ্য ও আনুগত্য চাপানর উদ্দেশ্যে মারতে পারে। তবে যদি ধমক-ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদির দ্বারা কাজ চলে যায়, তহলে মারপিট অবশ্যই পরিহার করতে হবে। কেননা তাতে স্ত্রীর মনে স্বামীর প্রতি ঘৃণা তীব্র হয়ে উঠে। আর তা সম্প্রীতিপূর্ণ দাম্পত্য জীবনের পরিপন্থী। অথচ বিবাহিত জীবনের তা-ই হচ্ছে আসল লক্ষ্য কিন্তু আল্লাহর নাফরমানী সংক্রান্ত্র কোন ব্যাপারে যদি তাকে মারতে হয় তবে তা স্বতন্ত্র কথা।
নাসায়ী গ্রন্থে হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেনঃ (আরবী****************)
রাসূলে করীম (সা) তাঁর কোন বেগমকে কিংবা কোন খাদেমকে কখনই মারেন নি। অপর কাউকেও তিনি কখনও মারবার জন্যে হাত তোলেন নি। তবেত আল্লাহর পথে কিংবা আল্লাহর মর্যাদার অমর্যাদাকরণের দরুন আল্লাহরই ওয়াস্তে কাউকে শাস্তি দিয়ে থাকলে সে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যাপার। (ফাতহুলবরী ৯ খণ্ড, পৃ. ২৪৯)
কিন্তু এসব পদক্ষেপও যদি ব্যর্থ হয় ও আ-ফলপ্রসু হয়ে যায় এবং পারস্পরিক বিরোধ বৈষম্য বিস্তীর্ণ ও গভীরতর হয়ে পড়ার আশংকা দেখা দেয়, তাহলে তখনই ইসলামী সমাজের প্রভাবশালী কর্তৃত্বসম্পন্ন ও কল্যাণকামী লোকেরা তাতে হস্তক্ষেপ করে সংশোধনের জন্যে চেষ্টা চালাবে। তার পন্থা হচ্ছে, স্বামীর পক্ষ থেকে একজন ও স্ত্রীর পক্ষ থেকে একজন সালিশকারী নিয়োগ করতে হবে, যার বাস্তবিকই উভয়ের কল্যাণকামী হবে। তারা স্বামী-স্ত্রীকে মিলিত করতে ও যে বিরোধ দেখা দিয়েছে তা দূর করতে চেষ্টা করবে, তা হলে আল্লাহ্ নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে মিলমিশ সৃষ্টি করে দেবেন। এসব ব্যাপারে মহান আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছেঃ (আরবী****************)
যে সব স্ত্রী সম্পর্কে তোমরা বিদ্রোহ ও অবাধ্যতার আশংকা বোধ করবে, তাদের বোঝও- উপদেশ দাও। তোমাদের শয্যায় তাদের ত্যাগ কর এবং তাদের মার। পরে যদি তারা তোমাদের আনুগত্য করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা দোষ তালাস করে বেড়িও না। নিশ্চিত জানবে আল্লাহ্ উচ্চতর ও বড়ই মহান। আর তোমাদের পরস্পরের বিচ্ছেদের আশংকা দেখা দিলে স্বামীর আত্মীয়ের মধ্য থেকে একজন ও স্ত্রীর আত্মীয়দের মধ্য থেকে একজন সালিশ নিযুক্ত কর। এরা দুজন যদি বস্তবিকই সংশোধনের চেষ্টা প্রচেষ্টা চালায়, তাহলে আল্লাহ্ তাদের মধ্যে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করে দেবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ ও সর্ববিষয়ে অবহিত।
কেবল এরূপ অবস্থায়ই তালাক দেয়া যেতে পারে
উপরে উল্লেখিত ও বিশ্লেষণকৃত সমস্ত চেষ্টা-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেলে তারপরই প্রয়োজনের খাতিরে সর্বশেষ উপায় হিসেবে ইসলামী শরীয়ত প্রদত্ত পন্থা গ্রহণ করা স্বামীর জন্যে জায়েয হতে পারে, যেন সকল সমস্যা ও জটিলতা দূর হয়ে যায়, আর তা হচ্ছে তালাক দেয়া। ইসলাম খুব অনাগ্রহ ও অসন্তুষ্টি ভিত্তিতে এ পন্থা গ্রহণের অনুমতি দিয়েছে। তা তার কাছে পছন্দনীয় কাজ নয়, ওয়াজিব-ফরয নয়। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
আল্লাহর কাছে হালাল কার্যাবলীর মধ্যে সবচাইতে অধিক ঘৃণিত ও অপছন্দনীয় হচ্ছে তালাক।
(আরবী****************)
আল্লাহ্ তালাকের অপেক্ষা অধিক কোন না-পছন্দনীয় কাজকে হালাল করেন নি।
আর তালাক যে হালাল অথচ অপছন্দনীয় কাজ, তা এ কথায় স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, তালাক হচ্ছে একটি অনুমতি, কেবলমাত্র কঠিন প্রয়োজন ও উপায়হীন অবস্থায়ই তা প্রয়োগ করা জায়েয। পারিবারিক জীবন যখন অচল ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, স্বামী-স্ত্রীর মনে পারস্পরের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ যখন তীব্র হয়ে উঠে এবং তাদের আল্লাহ্ নির্ধারিত সীমার মধ্যে টিকে থাকা সম্ভবপর না থাকে, পারস্পরিক দাম্পত্য অধিকারও আদায় করতে না পারে, তাহলে এ পন্থা গ্রহণ ব্যতীত কোন উপায়ই থাকে না। মিলের যখন কোন উপায়ই নেই তখন বেমিলই ভাল- এ একটি সাধারণ কথা। আল্লাহ্ বলেছেনঃ (আরবী****************)
তারা দুজন যদি পরস্পর বিছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে আল্লাহ্ তাদের দুজনকেই স্বীয় প্রশস্ততার দ্বারা পরস্পর অ-বিমুখ ও অ-নির্ভরশীল বানিয়ে দেবেন।
ইসলামের পূর্বে তালাক প্রথা
তালাক কেবল ইসলাম প্রবর্তিত ব্যবস্থাই নয়। ইসলামের পূর্বে সমগ্র দুনিয়ায় তালাক ব্যবস্থার প্রচলন ছিল ব্যাপকভাবে। ‍দু একটি জাতির ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যতিক্রম দেখা যেত। স্বামী যখন স্ত্রীর ওপর রাগান্বিত হতো- কোন সঙ্গত কারণে কিংবা অসঙ্গতভাবেই, তাহলে তখন তাকে ঘর থেকে বহিষ্কৃত করত। স্ত্রী তখন স্বীয় প্রতিরক্ষা বা আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছুই বলতে বা করতে পারত না। স্বামীর কাছ থেকে কোনরূপ বিনিময় লাভ করাও তার পক্ষে সম্ভবপর হতো না। অন্য কোন প্রকারের অধিকারও স্বীকৃত ছিল না। গ্রীকদের খ্যাতি ও প্রাধানের যুগে তাদের সভ্যতার বিজয় পতাকা যখন পতপত করে উড়ত তখন তাদের সমাজেও তালাক প্রথা কোনরূপ শর্ত বা বাধা বন্ধন ব্যতীতই কার্যকর ছিল। রোমানদের সমাজে বিয়ে অনুষ্টিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তালাক গণ্য হতো। এমনকি স্বামী-স্ত্রী তালাকহীনতার শর্ত আরোপ করলেও বিচারক বিয়ে বাতিল হয়ে যাওয়ার রায় দিয়ে দিত।
রোমানদের প্রাচীন গোত্র সমূহের মতে ধর্মীয় বিয়ের ক্ষেত্রে তালাক হারাম হয়ে যেত। তবে স্বামী তার স্ত্রীর ওপর সীমাহীন কর্তৃত্ব লাভ করত। এমনকি কোন কোন অবস্থায় স্ত্রীকে হত্যা করাও তার জন্যে বৈধ হয়ে যেত। উত্তরকালে তাদের ধর্মে তালাককে নাগরিক আইনের মতোই বৈধ ঘোষণা করা হয়।
ইয়াহূদী ধর্মে তালাক
ইয়াহূদী ধর্মে স্ত্রীদের মান-মর্যাদা উন্নত করতে চেষ্টা করা হয় বটে কিন্তু তালাককে বৈধ ঘোষণা করে তার বৈধতায় বিপুল প্রশস্ততা এনে দেয়া হয়। স্ত্রীর গুনাহের অপরাধ প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার পর স্বামী ধর্মীয় দৃষ্টিতেই তালাক দিতে বাধ্য হয়ে যেত। স্বামী তার গুনাহ ক্ষমা করে দিলেও তাকে তালাক দেয়া তার জন্যে অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে পড়ত। দশ বছর কাল অতিক্রান্ত হওয়ার পরও স্ত্রীর গর্ভে সন্তান জন্ম না নিলে আইনের দৃষ্টিতেই তালাক দেয়া জরুরী বিবেচিত হতো।
খ্রিস্ট ধর্মে তালাক
খ্রিস্ট ধর্ম তালাকের ব্যাপারে সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেছে। একদিকে তা ইয়াহূদী ধর্মের বিরোধীতা করেছে। ইনজীল হযরত ইসার নামে তালাকদান কাজটিকে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছে। উপরন্তু তালাকদাতা পুরুষ ও তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর বিয়েকেও হারাম করে দিয়েছে। ইনজীল মথির বিবরণে বলা হয়েছেঃ
আর উক্ত হইয়াছিল, ‘যে কেহ আপন স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে, সে তাহাকে ত্যাগপত্র (তালাকনামা) দিউক। কিন্তু আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, যে কেহ ব্যভিচার ভিন্ন অন্য কারণে আপন স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে, সে তাহাকে ব্যভিচারিণী করে এবং যে ব্যক্তি সেই পরিত্যক্ত স্ত্রীকে বিবাহ করে, সে ব্যভিচার করে। (মথি-৫ অধ্যায়, ৩১-৩২ স্তোত্র)
মার্ক লিখিত সুসমাচারে বলা হয়েছেঃ
যে কেহ আপন স্ত্রীকে পরিত্যাগ করিয়া আমাকে বিবাহ করে, সে তাহার বিরুদ্ধে ব্যভিচার করে, আর যদি আপন স্বামীকে পরিত্যাগ করিয়া আর একজনকে বিবাহ করেম তবে সেও ব্যভিচার করে।
বাইবেলে এই হারাম করণের কারণস্বরূপ বলা হয়েছেঃ
ইশ্বর যাহার যোগ করিয়া দিয়াছেন, মনুষ্য তাহার বিয়োগ না করুক। (মথি-১৯ অধ্যায়, ৬ স্তোত্র)
এই উক্তিটি স্বতঃই সত্য ও সঠিক। কিন্তু তালাক দেয়াকে হারাম ঘোষণার ক্ষেত্রে এ উক্তির প্রয়োগ বড়ই বিস্ময়কর। আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বামী-স্ত্রীকে জুড়ে দেয়ার সহজ সরল অর্থ হচ্ছে, তিনি বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছেন। বিয়েকে তালাক দেয়ার অনুমতি দিয়ে থাকেন তবে এ বিচ্ছেদও আল্লাহরই পক্ষ থেকে হয়েছে মনে করতে হবে- যদিও বিচ্ছিন্নকরণের কার্যটি মানুষ দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট হচ্ছে, আল্লাহ্ যাকে জুড়ে দিয়েছেন তাকে বিচ্ছিন্নকারী মানুষ নয়, সেই আল্লাহই।
ব্যভিচার সঙ্ঘটিত হলে উভয়কে বিচ্ছিন্নকারী কি আল্লাহ্ নন? ব্যভিচার ছাড়া বিচ্ছিন্ন করণের কারণ আরও আছে কি?
তালাকের ব্যাপারে খ্রিস্ট ধর্মের ভিন্নমত
ইনজীল যদিও ব্যভিচার সঙ্ঘটিত হলে স্ত্রীকে তালাক দেয়া হারাম বলে না, হারাম থেকে মুক্ত ও ব্যতিক্রম করে; কিন্তু ক্যাথলিক ধর্মম এ ব্যতিক্রমের ব্যাখ্যা দিয়েছে। তারা বলে, মূলত এখানে ব্যতিক্রম (exception) কিছুই নেই। তালাক দেয়ার কোন সুযোগই কোথাও নেই। খৃষ্ট ধর্মে তালাকের কোন অস্তত্বই স্বীকৃত নয়। তবে ব্যভিচার সঙ্ঘটিত হওয়ার কারণে তালাকের ব্যাপারটির সঠিক অর্থ হচ্ছে, ব্যভিচার নিজেই বিবাহ-বন্ধনকে ছিন্ন করে দেয়। এ কারণেই ব্যভিচার সঙ্ঘটিত হলে স্বামীর কর্তব্যই হচ্ছে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করা।
প্রোটেস্টান্ট ধর্মমত এর সম্পূর্ণ বিপরীত রায় দিয়েছে। এ মতের লোকেরা বিশেষ অবস্থায় তালাক দেয়া জায়েয মনে করে। আর তা হচ্ছে স্ত্রীর ব্যভিচার করা কিংবা স্বামীর বিশ্বাসভঙ্গ করা প্রভৃতি। তাদের এ মত কিন্তু ইনজীল মথির ঘোষিত নীতির অতিরিক্ত। কিন্তু এরূপ অবস্থায় ইনজীল তালাকদাতা পুরুষ ও তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর পুনরায় বিবাহিত হওয়াকে হারাম বলেছে।
অর্থোডক্স (orthodox) ধর্মমতের অনুসারী লোকেরা মিশরে অনুষ্ঠিত তাদের ধর্মসভায় স্ত্রীর ব্যভিচারকরণ ও অন্যান্য কারণে তাকে তালাক দেয়া জায়েয ঘোষণা করেছ। ক্রমাগতভাবে তিন বছর কাল পর্যন্ত স্ত্রীর বন্ধ্যা থাকা, সংক্রামক রোগ এবং মীমাংসার আশা নেই এমন ঝগড়া-বিবাদের দীর্ঘসূত্রিতা প্রভৃতি এসব কারণের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এসব কারণ ইনজীলের ঘোষণার ওপর অতিরিক্ত। এ কারণেই এ ধর্মমতের সংরক্ষকরা অন্যদেরকে এসব কারণে তালাক দেয়া জায়েয হওয়ার মত মানিয়া নিতে পারেনি। আর এ কারণেই মিশরের খ্রিস্ট আদালতে জনৈক খ্রিস্ট স্ত্রীর স্বামীর দারিদ্রের কারণে পেশ করা তালাক প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিল। সেই সাথে এ মন্তব্য করেছিল যে, ধর্মের কোন কোন নেতা ও এ মজিলিসের সদস্যরা এমন সব কারণের ভিত্তিতে তালাক দেয়া জায়েয বলেছেন, যার কোন সনদই ইনজীলে নেই- এটা বড়ই আশ্চর্যের বিষয়।
তালাকের ব্যাপারে খ্রিস্ট ধর্মের অনুসৃত নীতির পরিণাম
তালাকের ব্যাপারে খ্রিস্ট ধর্মে প্রবর্তিত এসব নিয়ন্ত্রণ ও বাধ্যবাধকতার পরিণাম খুবই খারাপ হয়ে দেখা দিল। খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীরা নিজেদের ধর্মকে অস্বীকার করতে শুরু করে দিল। আল্লাহ্ যাকে জুড়েদিলেন, তারা তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। খ্রিস্টান পাশ্চাত্য এমন সব নাগরিক আইন (Civil code) বানাল, যার ফলে তাদের এ বাধ্যবাধকতা এড়িয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ আইনমম্মত হয়ে গেল। আমেরিকা ও অন্যান্য কয়েকটি দেশে তালাককে অবাধ ও সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাধীন কাজ বানিয়ে দেয়া হলো। কার্যত তারা ইনজীলেকেই চ্যালেঞ্জ করে বসল। তার ফল এই দেখা দিল যে, সাধারণ কার্যকারণেই লোকেরা তালাকের অস্ত্র প্রয়োগ করতে শুরু করে দিল। তার চূড়ান্ত পরিণতি স্বরূপ দাম্পত্য জীবন ও পরিবার ব্যবস্থায় যখন চরম বিপর্যয় দেখা দিল, তখন সে সমাজে সুধীদের মনে প্রশ্ন দেখা দিল যে, আমরা কোথায় যাচ্ছি? তালাক মামলার একজন প্রখ্যাত বিচারক বলতে বাধ্য হলেন যে, তাদের দেশ থেকে দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন শেষ হয়ে যেতে আর বড় দেরী নেই। অতঃপর নারী-পুরুষের মধ্যে চরম নৈরাজ্য ও অবাধ যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হবে। এক্ষণে দাম্পত্য জীবন একটা ব্যবসায়ী কোম্পানীর অবস্থা পরিগ্রহ করে গেছে। তার দুজন অংশীদার যে কোন অতি সাধারণ ও নগণ্য কারণে পারস্পরিক চুক্তি ভঙ্গ করে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থা দুনিয়ার কোন ধর্ম মতেরই অনুকূল বা তার সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। কেননা এক্ষণে কোন ধর্মবিশ্বাস তাদের জুড়ে রাখতে পারছে না। নিছক যৌন সুখ-সম্ভোগই তাদের নারী পুরুষের সম্পর্কের একমাত্র ভিত্তি হয়ে দাড়াল।
তালাক পর্যায়ে খ্রিস্ট ধর্মের স্বতন্ত্র ভূমিকা
ধর্মের শিক্ষাকে বাদ দিয়ে পারিবারিক আইনকে নাগরিক বিধিতে রপান্তরিত করার দৃষ্টান্ত খ্রিস্টান পাশ্চাত্য ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেবলমাত্র খ্রিস্টানরাই এ ক্ষেত্রে ধর্মের শিক্ষাকে মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়েছে। তার মূলে একটা কারণও প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিল। তাদের নিজেদেরই এ ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে, তালাক পর্যায়ে তাদের ধর্মের বিধিবিধান বাস্তবতার পরিপন্থী। মানব প্রকৃতি তার সাথে সামঞ্জস্য সম্পন্ন হয়। অতএব মানব জীবনে তার প্রয়োগ ঠিক নয়। (আরবী****************)
খ্রিস্ট ধর্মের শিক্ষা সাময়িক
তালাক পর্যায়ে ইনজীল কিতাবে যা কিছু বলা হয়েছে, তা যদি সঠিক ও যথার্থ হয়ও এবং প্রাথামিক যুগে তাতে কোনরূপ পরিবর্তন যদি সাধিত না-ও হয়ে থাকে, তবুও একথা স্পষ্ট যে, হযরত ঈসা (আ) কোন স্থায়ী চিরন্তন ও শাশ্বত বিধান ‍দিয়ে যান নি। তা সর্বকালের সকল মানুষের জন্যে অনুসরণীয় ও গ্রহণযোগ্য নয়। ইয়াহূদীরা আল্লাহর দেয়া সুযোগ সুবিধা ও অনুমতির ক্ষেত্রে সীমালংঘন করে গিয়েছিল। তালাকের ক্ষেত্রে তাদের এ সীমালংঘন অত্যন্ত প্রকট। হযরত ঈসা তার বিরোধিতাই করতে চেয়েছিলেন মাত্র। মথি রচিত সুসমাচারে উদ্ধৃত হয়েছেঃ ফরাসীরা যখন হযরত ঈসার পরীক্ষা নিতে চেয়েছিল, তখন তারা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলঃ
যে-সে কারণে কি আপন স্ত্রীকে পরিত্যাগ করা বিধেয়? তিনি উত্তর করিলেন, তোমরা কি পাঠ কর নাই যে, সৃষ্টিকর্তা আদিতে পুরুষ ও স্ত্রী করিয়া তাহাদিগকে নির্মাণ করিয়াছিলেন, আর বলিয়াছিলেনঃ এ কারণ মনুষ্য পিতা ও মাতাকে ত্যাগ করিয়া আপন স্ত্রীতে আসক্ত হইবে এবং সে দুজন একাঙ্গ হইবে? সুতরাং তাহারা আর দুই নয়, কিন্তু একাঙ্গ। অতএব ঈশ্বর যাহার যোগ করিয়া দিয়েছেন; মনুষ্য তাহার বিয়োগ না করুক। তাহারা তাহাকে কহিল, তবে মোশি কেন ত্যাগ পত্র দিয়া পরিত্যাগ করিবার বিধি দিয়াছেন? তিনি তাহাদিগকে কহিলেন, তোমাদের অন্তকরণ কঠিন বলিয়া মোশি তোমাদিগকে আপন স্ত্রীকে পরিত্যাগ করিবার অনুমতি দিয়াছিলেন, কিন্তু আদি হইতে এরূপ হয় নাই। আর আমি তোমাদিগকে কহিতেছি, ব্যভিচার দোষ ব্যতিরেকে যে কেহ আপন স্ত্রীকে পরিত্যাগ করিয়া অন্যকে বিবাহ করে, সে ব্যভিচার করে এবং যে ব্যক্তি সেই পরিত্যক্তা স্ত্রীকে বিবাহ করে সেও ব্যভিচার করে। (মথি লিখিত সুসমাচার-১৯ অধ্যায়, ৩-৯ স্তোত্র)
এ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, হযরত মূসা যে তালাকের অনুমতি দিয়েছিলেন, ইয়াহূদীরা তাতে যখন বাড়াবাড়ি করল, তখন হযরত মসীহ শাস্তি হিসেবে তাদের ওপর তালাককে হারাম করে দিলেন। কেবলমাত্র ব্যভিচারিণীর জন্যে তালাক থাকল। আর তা ছিল সাময়িক ব্যবস্থা। হযরত মুহাম্মাদ (সা)-এর আগমন ও সর্বাত্মক ও চিরন্তন শাশ্বত শরীয়তের প্রবর্তিত হওয়া পর্যন্তই ছিল তার আয়ুষ্কাল।
হযরত ঈসা মসীহ তালাকের এই বিধানকে চিরন্তন শরীয়তরূপে পেশ করতে চেয়েছিলেন, তা যুক্তিসঙ্গত কথা নয়। কেননা তার সঙ্গী সাথী হাওয়ারী ও শিষ্য শাগরিদরাই এই বিধানকে অচল ঘোষণা করে দিলেন। তাঁরা বলেছিলেনঃ যদি আপন স্ত্রীর সঙ্গে পুরুষের এরূপ সম্বন্ধ হয় তবে বিবাহ করা ভাল নয়। (মথি সুসমাচার-১৯ অধ্যায়, ১০ স্তোত্র)
কেননা এরূপ অবস্থায় বিয়ে করা অর্থ নিজের গলায় এমন দড়ি বাধা যার থেকে ‍মুক্তি লাভ কখনই সম্ভব নয়। পুরুষের হৃদয় স্ত্রীর দিক থেকে যতই ঘৃণাপূর্ণ ও বিদ্বেষী হোক-না-কেন এবং সে তার প্রতি যতই মনক্ষুণ্ণ হোক-না-কেন উভয়ের স্বভাব-মেজাজ ও ঝোঁক-প্রবণতায় যতই পার্থক্য থাকুক না কেন।
তালাকের ব্যাপারে ইসলামের নিয়ন্ত্রণ
তালাকের ক্ষেত্রে ইসলাম বিভিন্ন শর্ত ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। ফলে সে ক্ষেত্রটি অত্যন্ত সংর্কীণ হয়ে গেছে। উপরে যে সব উপায়ের উল্লেখ আমরা করেছি সেগুলো ব্যবহার না করে এবং বিনা কারণে তালাক দেয়া ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ। কেননা তা করা হলে শুধু স্ত্রীরই নয়, স্বামীরও খুবই ক্ষতি ও অসুবিধা হওয়া অনিবার্য। তা তার নিজের কল্যাণেরও পরীপন্থী। কাজেই এরূপ অবস্থায়স্ত্রীকে তালাক দেয়া তেমনি হারাম, যেমনি ধন-মাল বিনষ্ট করা হারাম। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
না নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, না অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বা তা হতে দেবে।
এই হাদীসের দৃষ্টিতেও বিনা কারণে অযথা তালাক দেয়া জায়েয নয়।
যারা আনন্দের আতিশয্যে খুব বেশি তালাক দেয় তাদের এ কাজ আল্লাহর পছন্দ নয়, রাসূলেরও নয়। নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেনঃ (আরবী****************)
স্বাদ আস্বাদন করে বেড়ানোর পুরুষ বা নারী আমার পছন্দ নয়।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
তালাক প্রয়োজনের কারণেই বিধিবদ্ধ করা হয়েছে।
হায়েয অবস্থায় তালাক দেয়া হারাম
তালাক দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিলেই যে-কোন সময়ই তালাক দেয়া জায়েয নয়। তার জন্যে উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করা আবশ্যক। আর শরীয়তের দৃষ্টিতে তার জন্যে উপযুক্ত সময় হচ্ছে স্ত্রীর পবিত্র অবস্থা অর্থাৎ স্ত্রী যখন হায়েয নিফাসের অবস্থায় নয় এবং এমন পবিত্র অবস্থা, যখন তার সাথে সঙ্গম করেনি। তবে স্ত্রী গর্ভবতী হলে ও তার গর্ভ প্রকাশমান হয়ে পড়লে তখন ভিন্ন কথা।
এরূপ শর্ত এ জন্যে আরোপ করা হয়েছে যে, হায়েয বা নিফাস অবস্থায় স্বামী স্ত্রীর কাছ থেকে আলাদা থাকে। স্ত্রী সঙ্গম থেকে বঞ্চিত থাকতে বাধ্য হয়। এরূপ অবস্থায় স্বামী তার প্রতি মণক্ষুণ্ণ বা ক্ষুদ্ধ থাকতে পারে। আর এ কারণেই তাকে তালাক দিতে উদ্যত হয়ে থাকতে পারে। এই সম্ভবনার কারণে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, স্বামী তালাক দেয়ার জন্যে স্ত্রীর সম্পূর্ণ পবিত্র হওয়ার অপেক্ষায় থাকবে। আর পবিত্র হওয়ার পর সঙ্গম করার পূর্বেই তালাক দিয়ে দেবে।
স্ত্রীর হায়েয অবস্থায় তালাক দেয়া যেমন হারাম, অনুরূপভাবে যে পবিত্রাবস্থায় সঙ্গম করেছে, তখন তালাক দেয়াও হারাম। কেননা স্বামী যদি জানতে পারত যে স্ত্রী গর্ভবতী হয়েছে তাহলে সে হয়ত তাকে তালাক দিতই না। গর্ভ হওয়ার কারণে স্ত্রীকে তালাক না দেয়ার সিদ্ধান্ত করাও বিচিত্র নয়।
কিন্তু স্ত্রী যখন পবিত্রাবস্থায় হবে ও তখন স্বামী তার সাথে সঙ্গম করেনি অথবা স্ত্রী গর্ভবতী হয়েছে ও সে গর্ভ প্রকাশমান হয়ে পড়ছে, এরূপ অবস্থায় তালাক দেয়ার অর্থ, স্ত্রীর প্রতি ঘৃণা প্রচণ্ড রূপ ধারণ করেছে। কাজেই এরূপ অবস্থায় তালাক দেয়ার অনুমতি আছে।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা) নবী করীমের জীবদ্দশায় তাঁর স্ত্রীকে হায়েয অবস্থায় তালাক দিয়েছিলেন। হযরত উমন (রা) এ বিষয়ে নবী করীম (সা)-কে জিজ্ঞেস কররে তিনি বললেনঃ (আরবী****************)
তাকে বল, সে যেন স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়। পরে তার পবিত্রাবস্থায় ইচ্ছা করলে যেন তালাক দেয় সঙ্গমের পূর্বেই।
এ হচ্ছে ইদ্দতের জন্যে তালাক। আল্লাহ্ তা’আলা নিম্নোদ্ধৃত আয়াতে সেই কথাই বলেছেনঃ (আরবী****************)
হে নবী! তোমরা যখন স্ত্রীদের তালাক দেবে, তখন তালাক দেবে ইদ্দত পালনের লক্ষ্যে।
তার অর্থ ‘তুহর’- স্ত্রীর পবিত্রাবস্থায় তালাক দান।
অপর একটি হাদীসে রাসূলের কথাটি এ ভাষায় উদ্ধৃত হয়েছেঃ (আরবী****************)
তাকে বল, সে তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিক। পরে পবিত্রাবস্থায় বা গর্ভবতী অবস্থায় তাকে তালাক দিক।
তবে এখানে প্রশ্ন উঠে, ‘হায়েয’ অবস্থায় তালাক দিলে তা সঙ্ঘটিত হবে কিনা? সকলের সাধারণভাবে জানা কথা হচ্ছে তালাক যখনই দিক, তা সঙ্ঘটিত হবেই। কিন্তু অসময়ে তালাক দিলে দাতা গুনাহগার হবে।
কোন কোন ফিকাহবিদ বলেছেন, অসময়ে তালাক দিলে তা সঙ্ঘটিত হবে না। কেননা আল্লাহ্ তা’আলা এ ধরনের তালাক বিধিবদ্ধ করেন নি। তার অনুমতিও দেন নি। এ কারণে এ ধরনের তালাক শরীয়তসম্মত নয়। তাহলে সে তালাককে সহীহ বলা যায় কি করে আর তা কার্যকরই বা হবে কেমন করে?
হযরত ইবনে উমর (রা)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ (আরবী****************)
যে লোক তার স্ত্রীকে ‘হায়েয’ অবস্থায় তালাক দিল, তার সম্পর্কে আপনার মত কি?...... উত্তরে তিনি প্রশ্নকারীকে তার নিজের স্ত্রীকে ‘হায়েয’ তালাক দেয়ার কাহিনী শোনালেন এবং বললেন, নবী করীম (সা) সে তালাক রদ করেছিলেন এবং তাকে তালাক গণ্যই করেন নি।
তালাকের কসম খাওয়া হারাম
‘তালাক’ কে কসম বানানো অর্থাৎ অমুক কাজ করা বা না করায় ‘তালাক হয়ে যাবে’ বলা জায়েয নয়। নিজের স্ত্রীকে ভয় দেখিয়ে বলা যে, তুই এ কাজ করলে তোকে তালাক- সম্পূর্ণ নাজায়েয। কেননা ইসলামে কসমের একটা বিশেষ ভাষা ও শব্দ আছে, তা ভিন্ন অপর কোন ভাষা বা শব্দে কসম কিরা অনুষ্টিত হয় না বা তা করার অনুমতি ইসলাম দেয়নি।
তা হচ্ছে আল্লাহর নামে কসম খাওয়া। রাসূলে করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
যে লোক আল্লাহর নাম ছাড়া অন্য কিছুর নামে কিরা করবে, সে শিরক করে।
(আরবী****************)
যে লোক কিরা বা কসম খাবে, সে যেন আল্লাহর নামে কিরা কসম করে, নতুবা যেন চুপ করে থাকে।
তালাকপ্রাপ্তা স্বামীর ঘরে ইদ্দত পালন করবে
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে তালাক প্রাপ্তা স্ত্রীর কর্তব্য তার স্বামীর ঘরে ইদ্দত পালন করা- ইদ্দতকাল অতিবাহিত করা। সে ঘর ত্যাগ করে চলে যাওয়া- বাইরে বের হওয়া হারাম। স্বামীর পক্ষেও স্ত্রীকে ইদ্দতকালে তার ঘর থেকে বহিষ্কৃত করা হারাম। কেননা ইদ্দতকালে স্বামী স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করতে পারে, তার সম্ভাবনা রয়েছে- যদি সে এক বা দুই তালাক দিয়ে থাকে। এরূপ অবস্থায় যদি ঘরে স্বামীর কাছাকাছি থাকে, তাহলে স্বামীর ক্রোধ বা অসন্তোষ দূর করার সুযোগ পাবে। আর স্বামীও তার ব্যাপারে পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ লাভ করবে।
গর্ভাধারের পবিত্রতার নিশ্চয়তা বিধান- গর্ভে সন্তান নেই, এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া, স্বামীর অধিকারের ওপর গুরুত্ব আরোপ এবং তার স্ত্রীত্বের মর্যাদা রক্ষার উদ্দেশ্যে ইদ্দত পালনের হুকুম দেয়া হয়েছে। মানব মনের অবস্থা পরিবর্তনশীল। পরিবর্তিত অবস্থায় মানুষের মনের অবস্থারও পরিবর্তন ঘটে, নতুন দৃষ্টিকোণে চিন্তা করে। ক্রোধ ও অসন্তোষ দূর হয়ে গিয়ে তথায় সন্তুষ্টি ও সম্প্রীতির উদ্রেক হওয়া কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়। আবেগে প্রবাহিত মানুষ ঠাণ্ডা মন-মেজাজে চিন্তা করতে শুরু করে। আর তার ফলে যাকে পছন্দ নয়, তাকে পছন্দও করতে পারে। স্বামীর ঘরে ইদ্দত পালনের এ বাধ্যবাধকতার তাৎপর্য খুবই ব্যাপক ও গভীর।
তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেনঃ (আরবী****************)
তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যিনি তোমাদের রব্ব। তোমারা তাদের ঘর থেকে তাদের বহিষ্কৃত করো না, তারাও যেন বের হয়ে না যায়। তবে সুস্পষ্ট প্রকাশ্য যে লোক আল্লাহর নির্দিষ্ট করা সীমা লংঘন করে, সে নিজেরই ওপর জুলুম করে। তোমরা তো জানো না, আল্লাহ্ হয়ত এর পর কোন নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব করবেন।
কিন্তু স্বামী-স্ত্রী বিছিন্ন করা যদি অপরিহার্যই হয়ে পড়ে, তা হলে দুজনের ভালভাবে ও প্রচলিত নিয়মে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া উচিত।
স্ত্রীকে কোনরূপ কষ্ট দেয়া চলবে না, মিথ্যা অভিযোগ তোলা বা দোষারোপ করা চলবে না, কারো অধিকারও হরণ করা যাবে না। আল্লাহ্ বলেছেনঃ (আরবী****************)
তাহলে ভালভাবেই তাদের রাখ অথবা ভালভাবেই তাদের বিছিন্ন করে দাও।
বলেছেনঃ (আরবী****************)
তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীদের প্রচলিত নিয়মে কিছু মালমাত্তা দিতে হবে। মুত্তাকী লোকদের ওপর এটা তাদের অধিকার এবং তা তাদের দায়িত্ব।
এক তালাকের পর আর এক তালাক
ইসলাম মুসলমানকে নিয়ম করে দিয়েছে যে, স্ত্রীকে সে তিন তালাক একবারে নয়, তিন তালাক ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেবে। তার নিয়ম হচ্ছে, যে তুহরে- পবিত্রাবস্থায়- স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করে নি, তখন এক তালাক দেবে। আর তাকে এমনি অবস্থায়ই রেখে দেবে। এভাবে থাকার মধ্য দিয়ে তার ইদ্দতকাল নিঃশেষ হয়ে যাবে। ইদ্দতকালেই স্বামী যদি তাকে রাখার সিদ্ধান্ত করে, তাহলে অতি সহজেই তাকে ফিরিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু যদি সে ফিরিয়ে না নেয়, আর এ অবস্থায়ই ইদ্দতকাল শেষ হয়ে যায়, তাহলে পরেও নতুন বিয়ের মাধ্যমে তাকে ফিরে পেতে পারবে। আর স্বামী যদি তাকে রাখার কোন প্রয়োজনই বোধ না করে, তাহলে তখন স্ত্রী আর একজনকে স্বামীত্বে বরণ করে নিতে পারবে।
প্রথমবারের তালাক দানের পর স্বামী যদি তাকে পুনরায় স্বীয় স্ত্রীত্বে ফিরিয়ে নেয়, পরে দুজনের সম্পর্ক আবার খারাপ হয়ে যায় ও মিলমিশ সৃষ্টির সব পথই রুদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে সে দ্বিতীয়বারও তালাক দিতে পারে। এই যে পন্থার উল্লেখ করা হলো, এতে এখনও স্বামীর অধিকার অবশিষ্ট থাকে যে, ইদ্দত চালাকালে সে তাকে ফিরিয়ে নেবে কিংবা ইদ্দত শেষ হয়ে যাওয়ার পর নতুন আকদ করে তাকে স্ত্রীত্বে বরণ করে নেবে।
কিন্তু দ্বিতীয়বার ফিরায়ে গ্রহণ করার পর তৃতীয়বারও যদি তালাক দেয়, তাহলে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হবে যে, এ দুজনার মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ এত তীব্র হয়ে উঠেছে যে, এদের মধ্যে মিলমিশ হওয়ার কোন আশাই নেই। এরূপ অবস্থায়- এই তৃতীয়বার তালাক দেয়ার পর স্বামী স্ত্রীকে আবার গ্রহণ করতে পারবে না। এক্ষণে সে তার জন্যে হালাল নয়, যতক্ষণ না সে অপর এক স্বামী গ্রহণ করে তার সাথে ঘর করছে। এ বিয়ে সহীহ হতে হবে, শরীয়ত মুতাবিক হতে হবে। বিয়ে লক্ষ্য হতে হবে, শুধু প্রাক্তন স্বামীর জেন্যে হালাল বানানর উদ্দেশ্যে বিয়ে হলে চলবে না।
তালাক দেয়ার এই হচ্ছে শরীয়তসম্মত নিয়ম ও পন্থা যদি কেউ এ পদ্ধতি ছাড়া অন্যভাবে- একই সময়ে এক এক করে তিন তালাক কিংবা এক বাক্যে তিন তালাক দেয়, তবে তা শরীয়ত প্রদত্ত নিয়ম ও পন্থার সম্পূর্ণ পরিপন্থী হবে। সে লোক হেদায়েতের পথ ত্যাগ করে গুমরাহীর পথ অবলম্বন করে চলেছে, সিরাতুল মুস্তাকীমকে সে হারিয়ে ফেলেছে। সহীহ্ হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলে করীম (সা) জানতে পারলেন, এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে একসঙ্গে তিন তালাক দিয়েছেন। তিনি ক্রোধে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেনঃ ( আরবি******************)
আমি তোমাদের মধ্যে বর্তমান অবস্থায়ই এ লোকটি আল্লাহর কিতাব নিয়ে তামাসা খেলছে? এক ব্যক্তি এ সময় দাঁড়িয়ে বলল, ইয়া রাসূল! এমন ব্যক্তিকে কি আমি হত্যা করব না? (নিসায়ী)
স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিলে ও নির্দিষ্ট ইদ্দতের মেয়াদ শেষ হয়ে এলে স্বামীর কর্তব্য দুটো কাজের মধ্যে যে কোন একটি করাঃ
হয় তাকে ভালভাবে ও প্রচলিত নিয়মে রেখে দেবে অর্থাৎ ভাল আচরণ ও ব্যবহার করার ও তাঁকে সংশোধন করে নেয়ার উদ্দেশ্যে ফিরিয়ে নিয়ে স্ত্রীত্বে বরণ করবে, লড়াই-ঝগড়া করার বা অকারণ কষ্ট দেয়ার কোন উদ্দেশ্য থাকবে না।
অথবা ভালভাবে ও প্রচলিত নিয়মে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করবে অর্থাৎ ইদ্দত শেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তাকে ফেলে রাখাবে। তারপর কোনরূপ ক্ষতি সাধন না করেই- এবং তার সব অধিকার আদায় করেও তাতে কোনরূপ কার্পণ্য না করে তাকে বিদায় করে দেবে।
ইদ্দতের মেয়াদ শেষ হয়ে এলে স্ত্রীকে কষ্ট ও পীড়ন দেয়া ও ইদ্দতের মেয়াদ দীর্ঘ করার উদ্দেশ্যে তাকে ফিরিয়ে নেবে এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ থেকে তাকে বঞ্চিত রাখাবে, স্বামীর জন্যে তা আদৌ জায়েয নয়।
জাহিলিয়াতের আমলে লোকেরা এরূপ আচরণ গ্রহণ করত। কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা এভাবে স্ত্রীকে কষ্ট দেয়াকে হারাম করে দিয়েছেন। তিনি এই হারাম করে দেয়ার কথা খুবই মর্মস্পর্শী ভঙ্গীতে বলেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমরা যখন স্ত্রীদের তালাক দেবে,পরে তারা তাদের ইদ্দত শেষ করে দিল তখন ভালভাবে তাদের ফিরিয়ে রাখা অথবা ভালভাবে তাদের বিদায় করে দাও। কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে তাদের আটকে রাখবে না। তাহলে তা হবে সীমালংঘন। আর যে তা করবে, সে নিজেরই ওপর জুলুম করবে। আর আল্লাহর আয়াতসমূহকে হাস্যকর ঠাট্টা বিদ্রেূপর শিকার বানিও না। আর আল্লাহর অনুগ্রহকে- যা তোমাদের ওপর তিনি করেছেন স্মরণ কর। স্মরণ কর সেই কিতাব ও হিকমতকে যা তিনি তোমাদের জন্যে নাযিল করেছেন। তিনি তো তোমাদের উপদেশে দিচ্ছেন। তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চলবে আর জেনে রাখবে, আল্লাহ্ সর্ব বিষয়ে পূর্ণ অবহিত। (সূরা বাকারাঃ ২৩১)
এ আয়াত কয়টি গভীর মনোনিবেশ সহকারে পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারি, এখানে সাতটি বাক্যাংশ, তাতে ভয় প্রদর্শনের পর ভয় প্রদর্শন, সাবধান কারণের পর সাবধানকরণ রয়েছে। উপদেশ রয়েছে, নসীহতও রয়েছে। স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে আল্লাহর নিয়ামতসমূহ। সেই সাথে বারবার ভীতির বাণীও রয়েছে এতে। বস্তুত যার হৃদয় রয়েছে, মন দিয়ে লক্ষ্য করতে যে প্রস্তুত, যে সজাগ দৃষ্টি সম্পন্ন, তার জন্যে এ আয়াত কয়টি অতীব মূল্যবান।
তালাক প্রাপ্তকে ইচ্ছামত বিয়ে করতে বাধা দেবে না
তালাকপ্রাপ্তার ইদ্দতের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে যাকে সে চাইবে, পছন্দ করবে, তাকে বিয়ে করতে তাকে বাধা দেয়া যাবে না। তার প্রাক্তন স্বামী বা তার অভিভাবক কিংবা অন্য কারোরই এ কাজ করার অধিকার নেই। শরীয়ত ও প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী প্রস্তাব দান ও নিজের মানুষের সন্তুষ্টির ভিত্তিতে বিয়ে হতে থাকলে তার ওপর আপত্তি করারও অধিকার নেই কারো। কোন কোন পুরুষ নিজ স্ত্রীকে তালাক দিয়েও তার ওপর স্বীয় কর্তৃত্ব বহাল রাখতে ও প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করতে থাকে। অপর পুরুষ সম্পর্কে তাকে ভয় দেখাতে ও তার সাথে বিয়ে হলে ভাল হবে না বলে ধমকাতে থাকে। চরম মুর্খতা, বর্বরতা ও জাহিলিয়াতের চরিত্র ছাড়া এ আর কিছুই নয়।
অনুরূপভাবে স্ত্রী যদি তার প্রাক্তন স্বামীকে পুনর্বার বিয়ে করতে- স্বামীত্বে বরণ করতে ইচ্ছুক হয়, আর ভালভাবে ও প্রচলিত নিয়মে যাদি উভয়েই রাজি হয় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাহলে অভিভাবক বা ঘরের অন্য কারোরই তাতে বাধার সৃষ্টি করা জায়েয নয়। আল্লাহ্ বলেছেনঃ সন্ধি সুলেহ করে নেয়াই কল্যাণকর।
বলেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমরা যখন তোমাদের স্ত্রীদের তালাক দিয়ে দাও আর তারা ইদ্দতের মেয়াদ পূর্ণ করে ফেলে তখন তারা তাদের ভাবী স্বামীকে বিয়ে করবে- যদি তারা প্রচলিত নিয়মে বিবাহিত হতে পরস্পর রাজি হয়ে যায়- তাতে তোমরা বাধাদান বা অসুবিধা সৃষ্টি কর না। একথা বলে উপদেশ দেয়া হচ্ছে তাদের, যাদের ঈমান রয়েছে আল্লাহর প্রতি, পরকালের প্রতি। তোমাদের জন্যে এ অতীব পবিত্র পরিচ্ছন্ন নিষ্কলুষ পন্থা। আল্লহই জানেন, তোমরা জান না। (সূরা বাকারাহঃ ২৩২)
স্বামীর প্রতি ঘৃণা সম্পন্না স্ত্রীর অধিকার
কোন স্ত্রী যদি তার স্বামীর প্রতি ঘৃণা পোষণ করে, তাকে অপছন্দ করে এবং তার সাথে মিলেমিশে একাত্ম হয়ে ঘর-কন্না করতে পারবে বলে মনে করতে না পারে, তাহলে বিনিময় মূল্য দিয়ে সে তার নিজের আযাদী ও মুক্তি ক্রয় করতে পারে। স্বামী যে মোহরানা বা উপহার-উপঢৌকন তাকে দিয়েছে তা সব- কিংবা যতটায় উভয় পক্ষ রাজি হয় তা ফিরিয়ে দিয়ে নিজেকে স্ত্রীত্বের বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারে- এ অধিকার তার রয়েছে। তবে স্বামী তার জন্যে যা কিছু ব্যয় করেছে তার অধিক কিছু তার গ্রহণ করা উচিত নয়। আল্লাহ্ নিজেই বলেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমরা যদি একথা চিন্তা করে ভয় পাও, স্বামী স্ত্রী দুজনে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা রক্ষা করে চলতে পারবে না, তাহলে স্ত্রী যা-ই বিনিময় মূল্য দিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তাতে তাদের দুজনের কোন গুনাহ হবে না। (সূরা বাকারাঃ ২২৯)
হযরত সাবিত ইবনে কায়েমের স্ত্রী রাসূলে করীম (সা)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেনঃ হে রাসূল! আমি আমার স্বামী সাবিত ইবনে কায়েমের চরিত্র ও দ্বীনদারীর দিক দিয়ে কোন দোষারোপ বা অভিযোগ করছি না। কিন্তু আসলে আমি তাকে পছন্দ করি না। নবী করীম (সা) জিজ্ঞেস করলেনঃ সে তোমাকে কি দিয়েছেল? তিনি বললেনঃ একটি বাগান। সে তালাকের বিনিময়ে সেই বাগানটি ফিরিয়ে দিতে রাজি কিনা জিজ্ঞেস কররে, সে বলল, জি হ্যাঁ। তখন নবী করীম (সা) সাবিতকে বললেনঃ ( আরবি******************)
তুমি বাগানটি ফিরিয়ে নাও এবং ওকে তালাক দিয়ে দাও।
এ পর্যয়ে মনে রাখা আবশ্যক যে, স্বামীর পক্ষ থেকে বাস্তবিকই কোন কারণ না থাকলে স্ত্রীর তালাক গ্রহণের জন্যে তাড়াহুড়া করা উচিত নয়। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)
যে মেয়েলোক কোন কারণ ব্যতিরেকেই স্বামীর কাছে তালাক চাইবে তার জন্যে জান্নাতের সুগন্ধিও হারাম হয়ে যাবে।
স্ত্রীকে জ্বালাতন করা হারাম
স্ত্রীকে এ উদ্দেশ্যে কষ্ট দেয়া যে, সে তাকে যা কিছু দিয়েছে তা ফিরিয়ে দিয়ে দিক এবং সে জন্যে তাকে জ্বালা-যন্ত্রণা দেয়া স্বামীর জন্যে সম্পূর্ণ হারাম। তবে সে যদি কোন প্রকাশ্য নির্লজ্জতার কাজ করে বসে তবে তা স্ব’তন্ত্র কথা। এ সম্পর্কেই আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমরা যা কিছু তোমাদের স্ত্রীদের দিয়েছ তার কোন অংশ ফিরিয়ে পাওয়ার উদ্দেশ্যে তোমরা তাদের কষ্ট দিও না। তবে তারা যদি কোন প্রকাশ্য নির্লজ্জতার কাজ করে, তবে তা স্বতন্ত্র কথা। (সূরা আন-নিসাঃ ১৯)
আর স্ত্রী যদি স্বামীর অপছন্দই হয় এবং সে নিজেই তাকে তালাক দিয়ে অপর কাউকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক হয়ে থাকে, তাহলে স্ত্রীর কাছ থেকে কিছুই ফেরত লওয়া জায়েয নয়। আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমরাই যদি এক স্ত্রীর স্থলে আর এক স্ত্রী গ্রহণ করার ইচ্ছা করে থাক, আর তোমরা একজনকে বিপুল পরিমাণ মালমাত্তা দিয়ে থাক, তাহলে তোমরা তা থেকে কিছুই গ্রহণ করতে পারবে না। তোমরা কি দোষারোপ করে ও সুস্পষ্টভাবে অধিকার হরণ করে তা গ্রহণ করতে চাও? আর তা তোমাদের গ্রহণ করবেই বা কি করে? অথচ তোমরা পরস্পরের কাছ থেকে দাবি আদায় করে নিয়েছ। আর তারা তোমাদের কাছ থেকে শক্ত ও কঠিন প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে।
স্ত্রী পরিত্যাগের ‘কসম খাওয়া’ হারাম
ইসলাম নরীর অধিকার আদায়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। তার একটা জ্বলন্ত প্রমাণ এই যে, স্বামী ক্রদ্ধ হয়ে স্ত্রীকে শয্যায় এত দীর্ঘ সময়ের জন্যে পরিত্যাগ করার কসম খাবে যা স্ত্রীর পক্ষে সহ্য করা বড়ই দুষ্কর, তা স্বামীর জন্যে ইসলাম সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছে। স্বামী যদি স্ত্রী থেকে আলাদা থাকার কিরা-কসম খেয়ে বসে, তাহলে তাকে মাত্র চার মাসের অবকাশ দেয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে তার ক্রোধ ঠান্ডা হয়ে যাবে বলে আশা করা যায়। তখন সে তার ইচ্ছা পরিবর্তন করতে পারে। সে যদি এ চার মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই নিজ স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে নেয়, তাহলে ইতিমধ্যে তার এ কারণে যে গুনাহ হয়েছে, আল্লাহ্ তা মাফ করে দেবেন, তার জন্যে তার প্রশস্ত দরজা উন্মুক্ত করে দেবেন। তখন তার এ কিরা কসমের কাফফারা দেয়া ওয়াজিব। কিন্তু এ সময়কাল অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার মধ্যেও সে নিজ ইচ্ছা পরিবর্তন না করে ও ‘কসম’ না ভেঙ্গে, তাহলে তার স্ত্রী তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। স্ত্রীর অধিকার আদায়ে উপেক্ষা প্রদর্শনের এ-ই উচিত শাস্তি, সন্দেহ নেই।
কোন কোন ফিকাহবিদের মতে উপরিউক্ত সময়কাল অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তালাক সঙ্ঘটিত হবে। কাযী বা প্রশাসকের কোন ফয়সালার অপেক্ষায় থাকার কোন প্রয়োজন হবে না।
আবার অপর কোন কোন ফিকাহবিদ মনে করেন, মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর ব্যাপারটি প্রশাসকের সমীপে পেশ করা জরুরী। প্রশসক তাকে দুটো পস্থার যে কোন একটি গ্রহণের সুযোগ দেবে। হয় সে নিজের ইচ্ছায় পুনর্বিবেচনা করে স্ত্রীকে বাধ্য করে নেবে নতুবা সে তাকে তালাক দেবে। দুটোর মধ্যে যেটাই তার ভাল মনে হবে, সেটাই গ্রহণ করতে পারবে।
স্ত্রীর কাছে না যাওয়ার এ ‘কসম’কে শরীয়তের পরিভাষায় বলা হয় ‘ঈলা’। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ ( আরবি******************)
যারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে সম্পর্ক না রাখার কসম খেয়ে বসে, তাদের জন্যে চার মাসের মেয়াদ দেয়া হলো। যদি তারা স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়, তাহলে আল্লাহ্ ক্ষমাশীল দয়াবান। আর যদি তালাক দেয়ারই সিদ্ধান্ত করে তাহলে আল্লাহ্ সব শোনেন, সব জানেন! (সূরা বাকারাহঃ ২২৬-২২৭)
চার মাসের সময় দেয়া হয়েছে এজন্যে যে, স্বামী যেন পুনর্বিবেচনা করার ও বুদ্ধি বিবেচনা সহকারে কাজ করার পূর্ণ সুযোগ লাভ করতে পারে। অপর দিকে একজন স্ত্রী স্বামীহীনা হয়ে খুব বেশের পক্ষে এ সময়কাল পর্যন্তই ধৈর্য ধারণ করে থাকতে পারে।
তাফসীরগণ এ পর্যায়ে হযরত উমরের একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন
এক রাতে তিনি যখন অবস্থা পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে মদীনার অলিতে-গলিতে ঘুরতে লাগলেন, তখন তিনি একটি নারীর কণ্ঠস্বর শুনতে পান। তার স্বামী জিহাদের জন্যে দূরদেশে চলে গিয়েছিল। স্বামী-বিরহে কাতর হয়ে নারী করুন কন্ঠে গাইতেছিল।
রাত দীর্ঘ হয়ে গেছে চারদিকে অন্ধকার সমাচ্ছন্ন
আর আমাকে কাঁদাচ্ছে এ কথা যে,
আমার বন্ধু আমার কাছে নেই, যার সাথে আমি
খেলা করব।
আল্লাহর নামের শপথ, যদি আল্লাহর আযাবের
ভয় না থাকত,
তাহলে, এখনই এ পালঙ্কের বাহুগুলো
নড়ে উঠত।
হযরত উমর (রা) নারীর এই ফরিয়াদ শ্রবণ করে তাঁর কন্যা হযরত হাফসা (রা)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ স্বামী বিরহে নারী কতদিন ধৈর্যধারণ করে থাকতে পারে? তিনি বললেনঃ চার মাস। তখন আমীরুল মুমিনীন নির্দেশ দিয়ে দিলেনঃ কোন ব্যক্তিকে যেন তার নিজের স্ত্রী থেকে চার মাসের অধিককাল বিচ্ছিন্ন করে রাখা না হয়।
পিতামাতা ও সন্তানদের সম্পর্ক
বংশ সংরক্ষণ
সন্তান পিতার গোপনতত্ত্ব। তার বৈশিষ্ট্যাবলীর ধারক বাহক। জীবনে তার চোখের শীতলতা, তার মৃত্যুর পর তার অস্তিত্বের ধারা রক্ষাকারী। তার স্মৃতির প্রতীক। তার ভাল-মন্দ ও বৈশিষ্টসম্পন্ন গুণাবলীর উত্তরাধিকারী, তার কলিজার টুকরা, অন্তরের গভীর গহনে অবস্থানকারী সুষমা।
এ কারণেই আল্লাহ্ জ্বেনা-ব্যভিচার হারাম করেছেন। বিয়ে ফরয করে দিয়েছেন। যেন বংশ রক্ষা পায় এবং বিভিন্ন লোকের শুক্র সংমিশ্রিত হতে না পারে। সন্তান যেন পিতাকে চিনতে পারে, পিতাও চিনতে পারে তার সন্তানদের। বিয়ের মাধ্যমেই নারী বিশেষ কোন পুরুষের জন্যে নির্দিষ্ট ও সুরক্ষিত হয়ে যায়। স্বামীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা তার জন্যে হারাম হয়ে দাঁড়ায়। বিয়ে হওয়ার পর স্বামী-স্ত্রীর ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করে, তা তার স্বামীর ঔরসজাত রূপে পরিচিত হয়। এ সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে স্বতন্ত্র ভাবে কোন প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। পিতারও ঘোষণার দরকার হয় না, মা’কে দাবি করতে হয় না এই বলে যে, আমার সন্তানের পিতা অমুক। কেননা নবী করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)
সন্তান তার, যার বিছানো শয্যায় তার জন্ম হয়েছে।
নিজ সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার করা জায়েয নয়
এসব কারণে স্ত্রী স্বামীর শয্যায় তার সাথে সঠিকভাবে বিবাহিতা হয়ে যে সন্তান প্রসব করেছে, স্বামী তার পিতৃত্ব অস্বীকার করতে পারে না। তা করা তার জন্যে জায়েয নয়। এ অস্বীকৃতি তার স্ত্রী ও সন্তান উভয়ের জন্যেই খুবই লজ্জাকর ও মারাত্মত হয়ে থাকে। কাজেই নিছক ভিত্তিহীন কুধারণা, সন্দেহ কিংবা জনশ্রুতির অনস্বীকার্য লক্ষণাদির ভিত্তিতে স্বামীর দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে যে, স্ত্রী তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তাহলে ইসলামী শরীয়ত সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব এমন ব্যক্তির কাঁধে চাপাতে চায় না, যে তাকে তার নিজের ঔরসজাত সন্তান বলে মানে না, জোরপূর্বক এ সন্তানকে তার উত্তরাধিকারী বানানও শরীয়তের নিয়ম নয়।
এক কথায় বলা যায়, ইসলামী শরীয়ত কোন স্বামীকে জীবনভর শোবা-সন্দেহের মধ্যে ফেলে রাখার পক্ষপাতী নয়। এ জটিলতা থেকে মুক্তি লাভের যে পন্থা ইসলাম উপস্থাপিত করেছে, পরিভাষায় তার নাম ‘লিয়ান’ ( আরবি******************)। অতএব যার নিজ স্ত্রী সম্পর্কে এ দৃঢ় প্রত্যয় কিংবা প্রবল ধারণা হবে যে, সে তার শয্যাকে ভিন্ পুরুষের শুক্র গ্রহণ করে কলঙ্কিত কেরেছে এবং তার গর্ভে অপর কোন পুরুষের ঔরসজাত সন্তান ধারণ করেছে, কিন্তু এ ব্যাপারের সত্যতায় কোন সাক্ষ্য পেশ করা তার কর্তব্য। বিচারক তাদের মধ্যে ‘লিয়ান’ করিয়ে দেবে। সূরা নূর-এ একথা বলা হয়েছে এ ভাষায়ঃ ( আরবি******************)
যারা নিজেদের স্ত্রীদের ওপর মিথ্যা দোষারোপ করবে এবং তাদের কাছে নিজের ছাড়া আর সাক্ষী থাকবে না, এমন ব্যক্তি সাক্ষ্য হচ্ছে এই যে, চারবার আল্লাহর নামে ‘কসম’- এই সাক্ষ্য দেবে যে, সে তার অভিযোগে সত্যবাদী। আর পঞ্চমবার বলবে যে, সে যদি মিথুক হয় তাহলে তার ওপর যেন আল্লাহর অভিশাপ হয়, আর সে স্ত্রীলোকটির শাস্তি এড়ান যায় এভাবে যে, সে বার বার আল্লাহর নামে ‘কসম’ খেয়ে এই সাক্ষ্য দেবে যে, এ পুরুষটি মিথ্যাবাদী। আর পঞ্চমবার বলবে, তার ওপর অভিশাপ হোক যদি পুরুষটি তার উত্থাপিত অভিযোগে সত্যবাদী হয়।
অতঃপর তাদের দুজনের মধ্যে চিরদিনের তরে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেয়া হবে এবং সন্তানকে মা’র সঙ্গে জুড়ে দেয়া হবে।
পালক পুত্র গ্রহণ হারাম
পিতার যেমন তার ঔরসজাত সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার করার অধিকার নেই। অনুরূপভাবে যে সন্তান তার নিজ ঔরসজাত নয়, তাঁকে নিজের পুত্র বানান ও নিজের পুত্র বলে পরিচয় দেয়া ও দাবি করারও অধিকার নেই। জাহিলিয়াতের যুগে আরবরা অপরাপর জাতির লোকদের ন্যায় পালক পুত্র রেখে যার সাথে ইচ্ছা নিজের বংশ সম্পর্ক স্থাপন করত। যাকে ইচ্ছা নিজের পুত্র বানিয়ে নিত। এ পালিত পুত্রের কর্তব্য অধিকার ঠিক আপন ঔরসজাত পুত্রদের মতই হতো। পালিত পুত্রের পিতা ও বংশধারা জানা অবস্থায়ও এরূপ পালিত পুত্র বানানো হতো।
ইসলামের আগমনকালেও এরূপ পালক পুত্র বানানর রেওয়াজ ছিল তদানীন্তন আরব সমাজে। নবী করীম (সা) যায়দ ইবনে হারিসাকে এ জাহিলিয়াতের যুগে নবুওয়্যত প্রাপ্তির পূর্বে পুত্র বানিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু ইসলাম ব্যাপারটিকে একটি অবস্তাব ও অসত্য ঘটনা রূপে দেখেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে এক ভিন্ন ও অনাত্মীয় ব্যক্তিকে নিজ বংশের লোক বানিয়ে নেয়া ঘরের মেয়েদের সাথে ঠিক মুহররম পুরুষের মতো তাকে নিভৃত একাকীত্বে থাকতে দেয়া অথচ প্রকৃতপক্ষে সে এ মর্যাদার ব্যক্তি নয় এবং এ মেয়েরা তার জন্যে মুহররম নয়।
যে লোক কাউকে পালিত পুত্র বানায়, সে তাকে নিজের উত্তরাধিকারীও বানায়। এরূপ অবস্থায় আসল নিকটাত্মীয় উত্তরাধিকারীরা সম্পত্তির অংশ পাওয়ার অধিকারী হয়েও তারা তা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। তার দরুন প্রকৃত আত্মীয়দের মনে এই মুখে-ডাকা পুত্রের প্রতি একটা গোপন ক্ষোভ ও হিংসা-প্রতিহিংসা অতি স্বাভাবিকভাবেই জেগে উঠে। তার ফলে বিবাদ বিসম্বাদ ও সম্পর্কের অবনতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। কুরআন মজীদ এসব কারণেই এ জাহিলী ব্যবস্থাকে বাতিল ও সম্পূর্ণ অকাট্য হারাম ঘোষণা করেছে। আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমাদের মুখে-ডাকা পুত্রদেরকে তিনে (আল্লাহ্) তোমাদের প্রকৃত পুত্র বানিয়ে দেন নি। এ তো তোমাদের মুখ নিঃসৃত কথা মাত্র। কিন্তু আল্লাহই তো সত্য কথা বলেন, সঠিক ও নির্ভুল পথের সন্ধান দেন। ওদের ডাক ওদের পিতাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে। আল্লাহর কাছে এটাই অধিকতর ইনসাফপূর্ণ কথা। কিন্তু ওদের পিতা যদি তোমাদের জানা না থাকে তাহলে ওরা তোমাদের দ্বীনি ভাই মাত্র। তোমাদের সাহায্যকারী বন্ধু মাত্র।
কুরআনের কথাঃ ‘এ তো তোমাদের মুখ-নিঃসৃত কথা স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছে যে, মুখ-ডাকা পুত্র বা ধর্ম-পুত্র একেবারে অন্তঃসারশূন্য কথা, এরা পাশ্চাতে সত্য ভিত্তি বলতে কিছু নেই।
বস্তুত মুখ-নিঃসৃত কথা না প্রকৃত সত্যকে বদলে দিতে পারে, না পারে বাস্তবতাকে বদলে দিতে। অনাত্মীয় ব্যক্তি এর দ্বারাই আত্মীয় হয়ে যেতে পারে না। মুখে-ডাকা পুত্র কখনও হতে পারে না প্রকৃত নিজ ঔরসজাত সন্তান। মুখ-নিঃসৃত কথা পালিত পুত্রের দেহে রগে শিরায় কোলদার লালন-পালনকারী ব্যক্তির রক্ত প্রবাহিত করে দিতে পারে না, পারে না লালন – পালনকারী ব্যক্তির অন্তরে প্রকৃত পিতার পুত্র-বাৎসল্য ও স্নেহ-মমতা সৃষ্টি করতে। অনুরূপভাবে পালিত পুত্রের অন্তরে পিতৃভক্তির ভাবধারাও সৃষ্টি করতে পারে না। তার মধ্যে এ পরিবারের দৈহিক বিবেক-বুদ্ধীগত ও মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য-বিশেষত্বও সৃষ্টি করতে সম্পূর্ণ অসমর্থ।
এ পালক পুত্র গ্রহণ ব্যবস্থার সব রূপরেখা- উত্তরাধিকার আইন, পালিত পুত্রের (তালাক প্রদত্ত) স্ত্রীকে বিয়ে করা হারাম হওয়া ইত্যাদিও সম্পূর্ণরূপে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। কুরআন মজীদে যে উত্তরাধিকার আইন উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে রক্তের-স্ত্রীত্বের প্রকৃত নিকটাত্মীয়তার নয় এমন সম্পর্কের ওপর কোন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। মীরাসে তাকে কোন অংশও দেয়া হয়নি।
( আরবি******************) রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয়রা আল্লাহর আইনে পরস্পরের কাছে অধিক অধিকার সম্পন্ন।
বিয়ে সম্পর্কে কুরআন ঘোঘণা করেছে যে, নিজ ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রীরাই হারাম-মুহাররম, মুখে ডাকা পুত্রদের স্ত্রীরা নয়।
( আরবি******************) তোমাদের ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রীরাই তোমাদের জন্যে হারাম।
কাজেই পালিত পুত্রের স্ত্রী বিয়ে করা হারাম নয়, বরং সম্পূর্ণ জায়েয। কেননা প্রকৃতপক্ষে সে এক অনাত্মীয় ব্যক্তির স্ত্রী। অতএব সে যখন তার স্ত্রীকে তালাক দেবে (কিংবা সে মরে যাবে) তখন তাকে বিয়ে করতে কোন দোষ থাকতে পারে না।
পালক-পুত্র ব্যবস্থার বাস্তবভাবে রহিতকরণ
ব্যাপারটি কিছু মাত্র সহজ ছিল না। আরব সমাজের পালক পুত্র ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ় ভিত্তিশীল। সমাজের গভীরে তার শিকড় নিবদ্ধ ছিল, লোকদের জীবনে তা গভীরভাবে সম্পর্কিত ছিল। এ কারণে আল্লাহ্ তা’আলা শুধু কথার নির্দেশ দ্বারাই এ ব্যরস্থার মূলোৎপাটন সম্ভব বলে মনে করেন নি, যথেষ্ট মনে করেন নি। তাই কথার সাথে সাথে বাস্তবভাবেও তা কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন।
আল্লাহর এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে স্বয়ং রাসূলে করীম (সা)-কেই কাজে লাগানর সিদ্ধান্ত নিলেন। যেন অতঃপর এ পর্যায়ে কোন শোবাহ সন্দেহ না থাকে, মুখে-ডাকা পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করা জায়েয হওয়া সম্পর্কে আবহমান কাল থেকে চলে আসা দ্ধিধা-সংকোচ দূর করতে হলে এছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না, যথার্থ বা যথেষ্টও হতো না। আল্লাহ্ যা হালাল করেছেন চূড়ান্তভাবে তাকে হালাল মনে করা এবং আল্লাহ্ যা হারাম করেছেন, তাকেই চূড়ান্ত ভাবে হারাম মনে করার মতো দৃঢ় ঈমান ও বিশ্বাস সৃষ্টির জন্যে এটা ছিল একটা অপরিহার্য পদক্ষেপ।
হযরত যায়দা ইবনে হারিসা রাসূলে করীমের পালিত পুত্র ছিলেন। এ জন্যে তিনি সমাজে যায়দ ইবনে মুহাম্মাদ (সা) নামে সুপরিচিতি ছিলেন। তিনি যয়নব বিনতে জাহান নাম্মী এক মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। তিনি ছিলেন নবী করীম (সা)-এর ফুফাতো বোন। যয়নবের সাথে হযরত যায়দের দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতি ঘটে। হযরত যায়দ এ বিষয়ে নবী করীম (সা)-এর কাছে বহু অভিযোগ করলেন। নবী করীম (সা) তাঁকে নানাভাবে বোঝাতে ও শিক্ষা দিতে লাগলেন। যদিও তিনি আল্লাহর জানিয়ে দেয়া সূত্রে জানতেন যে, যায়দ তাঁকে তালাক দেবেন এবং পরে তিনি নিজেই তাঁকে বিয়ে করবেন। কিন্তু মানবীয় দুর্বলতা কোন কোন মুহূর্তে দেখা দিত বলে তিনি মানুষের কুটক্তি ও দোষযুক্ত সমালোচনার ভয় করতেন। এজন্যে তিনি প্রতিবারে যখনই হযরত যায়দ অভিযোগ করতেন, তাঁকে বলতেনঃ ( আরবি******************)
হে যায়দ, তুমি তোমার স্ত্রীকে নিজের কাছেই রাখ এবং আল্লাহকে ভয় কর।
এ সময় কুরআনের যে আয়াত নাযিল হয়, তাতে রাসূলে করীম (সা)-কে ভর্ৎসনা করা হয়, বরং দীর্ঘকাল ধরে পালিত পুত্রের পরিত্যক্তা স্ত্রীকে বিয়ে করার ব্যাপারে সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণা ও কুসংস্কার দূর করার জন্যে সমাজের মুকাবিলা করতে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করা হয়। তাতে বলা হয়ঃ ( আরবি******************)
আল্লাহ্ যাকে নিয়ামত দিয়েছেন (ঈমান আনার সুযোগ দিয়ে), এবং তুমি যাকে নিয়ামত দিয়েছ (দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিয়ে), সেই যায়দকে যখন তুমি বলতে, তুমি তোমার স্ত্রীকে তোমার নিজের জন্যে রাখ এবং আল্লাহকে ভয় কর, তখন তুমি তোমার মনে সেই কথা লুকিয়ে রাখতে যা আল্লাহ্ প্রকাশ করে দেবেন। আর তুমি মানুষকে ভয় পেতে অথচ আল্লাহকেই ভয় করা উচিত সর্বাধিক। পরে যায়দ যখন তার (স্ত্রী) থেকে তার প্রয়োজন পূর্ণ করে নিল, তখন তাকে সেই (যয়নব-যায়দের স্ত্রীকেই) তোমার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলাম, যেন মুমিনদের মনে মুখে-ডাকা পুত্রদের স্ত্রীদের যখন তারা তাদের থেকে নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করে দিয়ে ছেড়ে দেবে- বিয়ে করার ব্যাপারে কোনরূপ সংকোচ বা প্রতিবন্ধকতা অবশিষ্ট না থাকে। আর আল্লাহর ফরমান তো কার্যকর হবেই। (সূরা আহযাবঃ ৩৭)
পরবর্তী আয়াতে রাসূলের একাজে যে দোষারোপ করা হয়েছে তার প্রতিরোধ করা হয়েছে এবং বলিষ্ঠভাবে বলা হয়েছে যে, একাজ সম্পূর্ণ জায়েয, এতে কোন দোষ আদপেই নেই। বলা হয়েছেঃ ( আরবি******************)
আল্লাহ্ যা ফরয করে দিয়েছেন তার জন্যে তা করায় নবীর কোন দোষ ছিল না। এই আল্লাহর নিয়ম অতীত কাল থেকে। আর আল্লাহর ফয়সালা তো পরিমাণ মতোই। যারা আল্লাহর রিসালাত যথাযথভাবে পৌঁছিয়ে দেয় এবং তাঁকেই ভয় করে আল্লাহ্ ছাড়া আর কাউকেই ভয় করে না, হিসেব লওয়ার জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট। মুহাম্মত তোমাদের পুরুষদের মধ্যের কারোরই পিতা নয়; বরং সে আল্লাহর রাসূল নবীগণের পরিসমাপ্তিকারী। আর আল্লহ্ তো সব বিষয়েই পূর্ণ মাত্রায় অবহিত।
শুধু লালন-পালনের উদ্দেশ্যে পুত্র বানানো এ পর্যন্ত যে পুত্র বানানো সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, ইসলাম তাকে বাতিল ও হারাম ঘোষণা কারেছে। তাতে এক ব্যক্তি জানে যে, পুত্র তার নয়, অপর কোন ব্যক্তির, তা সত্ত্বেও তাকে নিজের বংশ ও পরিবারের সাথে মিলিয়ে আপন করে নেয় এবং তার জন্যে আপন ঔরসজাত সন্তানের জন্যে প্রদত্ত যাবতীয় নিয়ম ও অধিকার প্রয়োগ করে। তাতে বংশের সংমিশ্রণ হয়, তার স্ত্রী বিয়ে করা হারাম হয়ে যায় এবং সে মীরাসের অংশ লাভ করে।
এছাড়া আরও এক প্রকার পুত্র বানানর রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু সে ধরনের পুত্র বানানকে ইসলাম হারাম করেনি। তা এ ভাবে হয় যে, কেউ কোন পরে পাওয়া কিংবা কোন ইয়াতীম ছেলে নিজের ঘরে নিয়ে নিল এবং তার প্রতি নিজের পুত্রের মতই স্নেহ-বাৎসল্য, আদর-যত্ন ও শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দিল, তাকে খাওয়াল, পরাল, লালন পালন করে বড় করে তুলল ঠিক নিজের সন্তানের মতোই। কিন্তু এত সব করার পরও তাকে ‘নিজের পুত্র’ বলে অবহিত করল না, আপন পুত্রের জন্যে যে যে নিয়ম ও অধিকার তাও আরোপ করল না। এ ধরনের সেবা ও কল্যাণমূলক কাজ ইসলামে খুবই প্রশংসনীয় ও পছন্দনীয়। এরূপ কাজ যে করবে, সে নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে অশেষ সওয়াব পাবে, সে জান্নাত লাভ করবে। এ পর্যায়ে রাসূলে করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)
আমি এবং ইয়াতীমের দায়িত্ব গ্রহণকারী- লালন-পালনকারী জান্নাতে এ ভাবে থাকব- এই বলে তিনি তার শাহাদাত অঙ্গুলী ও মধ্যম অঙ্গুলী দ্বারা ইঙ্গিত করে ও দুটির মধ্যে ফাঁক করে দেখালেন।
হারিয়ে যাওয়া ছেলে কেউ পেলে তাকে ইয়াতীম মনে করতে হবে। পার্থিব সম্পর্কেও এ শব্দটি ভারভাবেই প্রযোজ্য। ইসলাম তার প্রতি লক্ষ রাখার জন্যে খুব তাগিদ করেছে।
কারো যদি কোন সন্তানাদি না থাকে এবং এরূপ কোন ছেলেকে সে কোন আর্থিক উপকার করার ইচ্ছা করে, তাহলে সে তার জীবনে বেঁচে থাকা অবস্থায়ই তার ধন-মাল থেকে যা ইচ্ছা দান করতে পারে এবং মৃত্যুর পূর্বে মোট সম্পদ-সম্পত্তির একতৃতীয়াংশের মধ্যে কিছু দেয়ার অসিয়তও করে যেতে পারে।
কৃত্রিম উপায় গর্ভ সৃষ্টি
জ্বেনা-ব্যভিচার ও পালিত পুত্রকে পুত্র বানান হারাম করে দিয়ে ইসলাম বংশের মর্যাদা রক্ষা করেছে। খারাপ ভাবধারা থেকে বংশকে পবিত্র রেখেছে।
এ কারণে কৃত্রিম উপায়ে গর্ভ সঞ্চারকে ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে, যদি তা স্বামী ছাড়া অন্য কারো শুক্র দ্বারা করান হয়। এরূপ অবস্থায় তা এক ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ ও ঘৃণ্য কাজ, সন্দেহ নেই। শায়খ শালতুত এ ফতোয়া দিয়েছেন। আসলে তা নতুন ধরনের জ্বেনা ছাড়া আর কিছু নয়, কেননা উভয় কাজের প্রকৃত অবস্থা সম্পূর্ণ অভিন্ন। তার ফলও এক। আর তা হচ্ছে স্বামী নয় এমন পুরুষের শুক্রবীজ গর্ভধারে ধারণ করা। প্রাকৃতিক আইন ও শরীয়তের বিধান- উভয়ের দৃষ্টিতেই এ কাজ অত্যন্ত জঘন্য।
কৃত্রিম উপায়ে গর্ভ সৃষ্টির কাজটি বাহ্যিক দৃষ্টিতে হয়ত কোন আইন ভঙ্গকারী কাজ নয়। কিন্তু সেটা আইনের দুর্বলতা ও ত্রুটি। আসলে তা জ্বেনাই- যা ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে এমন অপরাধ, যার ওপর অপরাধীকে ‘হদ্দ’- কঠোর শাস্তি দেয়া বাঞ্ছনীয়।
গর্ভ সৃষ্টির এ অভিনব পদ্ধতি যে অত্যন্ত মারাত্মক ও জঘন্য অপরাধ, তাতে কোন সন্দেহ নেই। পরের পুত্রকে নিজের পুত্র বলা অপরাধের চাইতেও অনেক বেশি মাত্রার অপরাধ। কেননা এ উপায়ে যে সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে, তার মধ্যে দু ধরনেরই জঘন্যতা থাকবে। একটা হচ্ছে, পরের পুত্রকে নিজের পুত্র বলার জঘন্যতা। অর্থাৎ বংশে বংশের বাইরের লোককে গণ্য করা। আর দ্বিতীয় হচ্ছে চরিত্রহীনতা- জ্বেনার রূপ ধারণ। এ কাজকে না ইসলামী শরীয়ত সমর্থন করতে পারে, না কোন আইন। মনুষ্যত্বের মর্যাদা হারিয়ে পশুত্বের পর্যায়ে পৌছে যায়। তার পক্ষে সামাজিক মর্যাদার চেতনা লাভ আদৌ সম্ভবপর নয়।
প্রকৃত পিতা ছাড়া অন্য কাউকে পিতা বলা
নিজের ঔরসজাত সন্তানের পিতৃত্বকে অস্বীকার করা ইসলামে যেমন হারাম, তেমনি হারাম নিজের জন্মদাতা পিতা ছাড়া অন্য কাউকে পিতা বলা- নিজেকে অন্য কারো সন্তান বলা। নবী করীম (সা) এ কাজকে নিকৃষ্টতম কার্যাবলীর মধ্যে গণ্য কারেছেন। এর ফলে সে স্রষ্টা ও সৃষ্টি সকলেরই অভিশাপে পড়ে যায়। হযরত আলী (রা) বর্ণনা করেছেন- নবী করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)
যে লোক নিজেকে প্রকৃত পিতা ছাড়া অপর কারো সন্তান বলে প্রচার করবে কিংবা নিজের মনিব ছাড়া অপর কারো গোলাম হওয়ার কথা বলে বেড়াবে, তার ওপর আল্লাহ্ ফেরেশতা ও সমগ্র মানুষের অভিশাপ। কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তার কাছ থেকে না তওবা কবুল করবেন, না কোন বিনিময়। (বুখারী, মুসলিম)
হযরত সা’দ ইবনে আবূ ওয়াক্কাস (রা) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেনঃ ( আরবি******************)
যে লোক নিজের পিতা ছাড়া অন্য কারো পুত্র হওয়ার দাবি করবে একথা জেনে শুনে যে, সে তার পিতা নয়, তাহলে জান্নাত তার জন্যে হারাম হবে।
সন্তান হত্যা করো না
এভাবেই ইসলাম মানব বংশকে রক্ষা করে তাকে অব্যাহত ধারায় অগ্রসর করে নিতে চাইছে। এজন্যে প্রত্যেক সন্তান ও পিতামাতার পরস্পরের অধিকার আদায় করা ওয়াজিব করে দিয়েছে, সে অধিকার ততখানি, যতখানি সন্তান বা পিতা হওয়ার দিক দিয়ে উপযুক্ত ও বাঞ্ছনীয় এবং এ অধিকারসমূহ পুরামাত্রায় সংরক্ষণের জন্যে কতগুলো বিষয় উভয়ের ওপর হারাম করে দিয়েছে।
সন্তানের রয়েছে জীবনে বেঁচে থাকার অধিকার। তাই পিতামাতার কোন অধিকার নেই সন্তানের জীবন বিনষ্ট করার, তাকে হত্যা করে হোক কিংবা গোপনভাবে তার অস্তিত্ব সঞ্চারিত হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করেই হোক। জাহিলিয়াতের যুগের পিতামাতারা তাই করত। করত কন্যা সন্তান ও পুত্র সন্তান উভয়কেই। এ জন্যে আল্লাহ্ তা’আলা নির্দেশ দিয়েছেনঃ ( আরবি******************)
তোমরা দারিদ্রের ভয়ে তোমাদের সন্তান হত্যা করো না। আমি তাদের রিযিক দিই, তোমাদেরও আমিই দিচ্ছি। তাদের হত্যা করা অত্যন্ত বড় গুনাহ্ ও মারাত্মক ভুল।
( আরবি******************) জীবন্ত প্রোথিত করা কন্যাকে যখন কিয়ামতের দিন জিজ্ঞেস করা হবে কোন্ অপরাধে তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল? (সূরা তাকভীরঃ ৮-৯)
এ জঘন্য ও বীভৎস কাজের উদ্বোধক যা-ই হোক, তা অর্থনৈতিক হোক- দারিদ্র্য ও খাবারের অভাব পড়ার ভয়েই হোক- কিংবা যেমন সামাজিক লজ্জার ভয়। মেয়ে হলে তদানীন্তন আরবে লজ্জায় তাকে হত্যা করা হতো। ইসলাম এ বর্বর ও পাশবিক কাজকে সম্পূর্ণ হারাম করে দিয়েছে। কেননা এ কাজের ফলে একটি জীবনকে হত্যা করা হয়, রক্ত সম্পর্কের অধিকার বিনষ্ট হয়। দুর্বল মানব সত্তার ওপর অত্যাচার ও জুলুম অনুষ্ঠিত হয়। এ কারণে নবী করীম (সা)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ ( আরবি******************) কোন্ গুনাহটি সবচেয়ে বড় ও ভয়াবহ?
উত্তরে তিনি বলেছিলেনঃ ( আরবি******************)
তুমি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বানাবে- অথচ সেই এক আল্লাহই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর কোন্ গুনাহ বড় জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেনঃ তুমি তোমার সন্তানকে হত্যা করবে এ ভয়ে যে, সে তোমার সাথে খাওয়ায় শরীক হবে।
নবী করীম (সা) পুরুষদের ন্যায় স্ত্রীলোকদের কাছ থেকেও এ কথার ওপর বায়াআত গ্রহণ করেছেন যে, এ এক ভয়াবহ অপরাধ এবং সম্পূর্ণ হারাম। অতএব তা পরিহার করতে হবে। কুরআন মজীদে উদ্ধৃত হয়েছেঃ ( আরবি******************)
এই যে, তারা আল্লাহর সাথে এক বিন্দু শিরক করবে না, তারা চুরি করবে না, তারা জ্বেনা-ব্যভিচার করবে না এবং তারা তাদের সন্তান হত্যা করবে না। (সূরা মুমতাহিনাঃ ১২)
পিতার প্রতি সন্তানের দ্বিতীয় অধিকার হচ্ছে, পিতা তার জন্যে সুন্দর একটা নাম নির্দিষ্ট করবে। অতএব পিতার কর্তব্য সন্তানের এমন নাম না রাখা যার দরুন সে বড় হয়ে কোনরূপ লজ্জা কষ্ট পেতে পারে। দ্বিতীয়ত আল্লাহ্ ছাড়া অপর কারো বান্দা বা গোলাম হওয়ার অর্থের নামকরণও হারাম, যেমন আবদুনবী-নবীর দাস, আবদুল মসীহ্- ঈসা মসীর গোলাম ইত্যাদি।
তৃতীয়ত সন্তানের অধিকার হচ্ছে সে পুরোমাত্রার আদর-যত্ন পাবে, ভাল লালন-পালন ও খোর-পোশ পাবে। অতএব এসব ব্যাপারে কোনরূপ ঔদাসীন্য বা উপেক্ষা কিছু মাত্র জায়েয নয়। নবী করীম (সা) এ পর্যায়ে বলেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
তিনি বলেছেনঃ ( আরবি******************)
যার ওপর যাকে খাওয়ান-পরানর দায়িত্ব, সে ব্যাপারে উপেক্ষা ও অবহেলা করাই তার গুনাহগার হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। (আবূ দাঊদ, নিসায়ী, হাকেম)
( আরবি******************) আল্লাহ্ তা’আলা প্রত্যেক দায়িত্বশীলকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন- এ বিষয়ে যে, সে তার দায়িত্ব পালন করেছে, না তার প্রতি উপেক্ষা দেখিয়েছে, তা বিনষ্ট হতে দিয়েছে। এমনকি প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার পরিবারবর্গ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।
সন্তানদের মধ্যে সমতা রক্ষা
দেয়া-থোয়ার ব্যাপারে সন্তানদের মধ্যে সুষম ও পক্ষপাতহীন নীতি অবলম্বন করা, সমানভাবে স্নেহ মমতা করা ও সমানভাবে সকলের কল্যাণ কামনা পিতার কর্তব্য।
স্নেহ-বাৎসল্য, আদর-যত্ন ও দান-দক্ষিণা বিনা কারণে কাউকে অপরের অপেক্ষা অগ্রাধিকার দান- কোনরূপ বেশি-কম বা পক্ষপাতিত্ব করা সম্পূর্ণ হারাম। কেননা তাতে বঞ্চিত বা পেছনে পড়ে থাকা সন্তানদের মন প্রতিহিংসা জেগে উঠে। তাদের মনে শত্রুতা ও প্রতিহিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে পিতা ও মাতার উভয়ের সমান দায়িত্ব। নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমরা তোমাদের পুত্র সন্তানদের মধ্যে পূর্ণ ইনসাফ করবে, তোমাদের পুত্র সন্তানদের মধ্যে পূর্ণভাবে সাম্য রক্ষা করবে, তোমাদের পুত্র-সন্তানদের মধ্যে সুষম বন্টন করবে সবকিছু। (আহমদ, নিসায়ী, আবূ দাউদ)
এ হাদীসের পটভূমিতে ঘটনা রয়েছে। বশীর ইবনে সায়দুল আনসারীর স্ত্রী তার পুত্র নুমান ইবনে বশিরের জন্যে তাঁর কাছে বিশেষ ধন-মাল যেমন বাগান ও ক্রীতদাস দেবার জন্যে দাবি করে ও এই দানকে সুদৃঢ় করিয়ে দেবার ইচ্ছা করে। আর এজন্যে এই দানের ওপর রাসূলে করীম (সা)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বলেলেনঃ ( আরবি******************)
হে রাসূল! অমুকের মেয়ে (অর্থাৎ তার স্ত্রী) আমার কাছে দাবি করছে যে, আমি তার (আমার) পুত্রকে আমার ক্রীতদাস দিয়ে দেব। নবী করীম (সা) জিজ্ঞেস করলেনঃ তার কি আরও ভাই-বোন আছে? বললেনঃ হ্যাঁ। তখন তিনি বললেনঃ তাহলে তাদের প্রত্যেককেই কি এই রকম করে দেবে? বললেনঃ না। তখন নবী করীম (সা) বললেনঃ তাহলে তা কিছুতেই ভাল হবে না। আর আমি তো সত্য ও সুবিচার ছাড়া অন্য কিছুতেই সাক্ষী হতে পারব না। (মুসলিম, আহমদ, আবূ দাঊদ)
অপর বর্ণনায় রাসূলের কথার শেষ অংশ এইঃ ( আরবি******************)
আমাকে তুমি অবিচার ও হুকুমের ওপর সাক্ষী বানিও না। তোমার পুত্রদের যে অধিকার তোমার ওপর রয়েছে, তার মধ্যে এও একটি যে, তুমি তাদের মধ্যে ইনসাফপূর্ণ বন্টন করবে। যেমন তোমার অধিকার রয়েছে তাদের ওপর এবং যে, তারা তোমার খেদমত করবে। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা সন্তানদের মধ্যে ইনসাফ ও সুবিচার করবে। (বুখারী, মুসলিম, আবূ দাঊদ)
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ সন্তানদের মধ্যে ধন বন্টনে পার্থক্য করা যায় যদি তার বাস্তবিকই কোন কারণ থাকে। যেমন দুর্বিপাকে পড়ার দরুন ঠেকায় পড়ে গেছে ও অপরাপরের অপেক্ষা বেশি অসুবিধার মধ্যে পড়ে যায়।
[আল মুগনী গ্রন্থে বলা হয়েছে, কোন রোগ, প্রয়োজন, অন্ধত্ব কিংবা বেশি সংখ্যক সন্তান হওয়া বা তার জ্ঞান অর্জনে মশগুল থাকার দরুন তাকে কিছু পরিমাণ বা বিশেষ কোন জিনিস দেয়া হলে অথবা কোন ছেলে খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণে তাকে কিছু না দিলে ইমাম আহমদের মতে তা জায়েয হবে। তিনি বলেন, কোন কোন সন্তানকে বিশেষভাবে ওয়াকফ করে দেয়া প্রয়োজনের দরুন জায়েয, তাতে কোন দোষ হবে না। তবে বিনা কারণে ও বিনা প্রয়োজনে কাউকে কিছু বেশি বা বিশেষভাবে দিলে তাতে মাকরূহ হবে। দানের ব্যাপারেও এই হুকুম।]
মীরাস বন্টনে আল্লাহর আইন পালন
মীরাস বন্টনের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ইনসাফপূর্ণ নীতি অবলম্বন করতে হবে। কাজেই কোন সন্তানকে মীরাস থেকে বঞ্চিত রাখা পিতার জন্যে জায়েয নয়। কোন আত্মীয়ের উত্তরাধিকারী আত্মীয়কে কৌশল করে বঞ্চিত রাখতে চেষ্টা করাও সম্পূর্ণ হারাম কাজ। কেননা মীরাস আল্লাহর জারী করা বিধান ও ব্যবস্থা। তিনি জেনে শুনে তার সুবিচার নীতি ও বিজ্ঞতা অনুযায়ী নিজেই এ ব্যবস্থা রচনা করেছেন। তাতে প্রত্যেক পাওনাদারকেই তার পাওনা অনুযায়ী অংশ দান করেছেন এবং তিনি লোকদের সেই বিধানের ওপর অবিচল হয়ে থাকার ও তদনুযায়ী কাজ অমান্য ও লংঘন করবে, সে তো তার আল্লাহকে দোষী সাব্যস্ত করবে।
আল্লাহ্ তা’আলা কুরআন মজীদের তিনটি আয়াতে মীরাম সংক্রান্ত যাবতীয় কথা বলে দিয়েছেন। প্রথম আয়াতের শেষে বলেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমরা জান না, তোমাদের পিতা ও তোমাদের পুত্রদের মধ্যে ফায়দা ও উপকারের দিক দিয়ে তোমাদের অধিকতর নিকটবর্তী কে? এটা স্বয়ং আল্লাহরই অংশ বন্টন ও হিসসা নির্ধারণ। আর আল্লাহই হচ্ছেন সর্বজ্ঞ ও সর্বাধিক বিজ্ঞানী।
দ্বিতীয় আয়াতটির শেষে বলেছেনঃ ( আরবি******************)
কারো ক্ষতি না করেই- এটা আল্লাহর তরফ থেকে অসীয়ত। আর আল্লাহ্ সব কিছু জানেন ও পরম ধৈর্যশীল। এসব আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমা। আর যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য অনুসরণ করবে, আল্লাহ্ তাঁকে জান্নাতে দাখিল করবেন, তার পাদদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা সদ্য প্রবাহমান। তারা তথায় চিরকাল থাকবে। আর এটা বিরাট সাফল্য। আর যে লোক আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করবে ও তাঁর নির্ধারিত সীমাগুলো লংঘন করবে, তাকে এমন জাহান্নামে দাখিল করবেন, যেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর তার জন্যে লজ্জাকর অপমানকর আযাব রয়েছে।
মীরাস সংক্রান্ত তৃতীয় আয়াতের শেষে আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেনঃ ( আরবি******************)
আল্লাহ্ তোমাদের কল্যাণের জন্যে সব কিছু স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছেন, যেন তোমরা গুমরাহ হয়ে না যাও। আর আল্লাহ্ তো সব বিষয়েই পূর্ণ অবহিত।
অতএব মীরাসের যে বিধান আল্লাহ্ তা’আলা দিয়েছেন, যে লোক তার বিরোধিতা করবে, সে আল্লাহর বিস্তারিতভাবে বলে দেয়া প্রকৃত সত্য থেকে বিভ্রান্ত হয়ে গেছে। আল্লাহর নির্ধারিত সীমাকেও সে লংঘন করেছে। কাজেই তাকে আল্লহর আযাবের অপেক্ষায় থাকতে হবে। আর তা হচ্ছেঃ ( আরবি******************)
জাহান্নাম, চিরদিনই তাতে থাকবে এবং তার জন্যে আরও অপমানকর আযাব রয়েছে।
পিতামাতার সাথে সম্পর্ক ছিন্নকরণ
সন্তানের ওপর পিতামাতার বহু অধিকার রয়েছে। তাদের আনুগত্য করা, তাদের সাথে ভালভাবে কথাবার্তা বলা, তাদের প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা প্রদর্শন প্রভৃতি সন্তানদের কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। মানব প্রকৃতিই তা করার জন্য তাগিদ জানায়, সুশোভনভাবে এ সব কাজের জন্যে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। মা’র ক্ষেত্রে এই কর্তব্য অধিকতর তাগিদপূর্ণ। কেননা মা-ই তাকে গর্ভে স্থান দিয়েছে, ক্রমাগত দশ মাস কাল তাকে গর্ভে বহন করেছে, তাকে প্রসব করার মারাত্মক ও মর্মান্তিক যন্ত্রণা ভোগ করেছে, তাকে নিজের বুকের স্তন চুষিয়েছে, রক্ত পানি করা দুগ্ধ পান করিয়াছে এবং অশৈশব তার রক্ষণাবেক্ষণ ও লালন-পালন করেছে। এতে তার যে কষ্ট হয়েছে, তা কোন ভাষা দিয়ে বর্ণনা করা যায় না। আল্লাহ্ নিজেই বলেছেনঃ ( আরবি******************)
আমরা মানুষকে তাগিদ করেছি এজন্যে, যেন তারা তাদের পিতামাতার সাথে ভাল ব্যবহার করে। তার মা কষ্ট স্বীকার করে তাকে বহন করেছে, প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করেছে। আর ত্রিশ মাস কাল পর্যন্ত তাকে বহন ও দুগ্ধ পান করিয়েছে।
এক ব্যক্তি এসে রাসূলে করীম (সা)-কে জিজ্ঞেস করলঃ ( আরবি******************)
আমার সর্বোত্তম সাহায্য ও সেবা-যত্ন পাওয়ার সকলের মধ্যে সবচাইতে বেশি অধিকার কার?
জবাবে তিনি বললেনঃ তোমার মা’র। তারপর কে, তারপরে কে এবং তারপরে কে বেশি অধিকারী জিজ্ঞেসা করা হলে রাসূলে করীম (সা) প্রত্যেকবারই বললেনঃ ( আরবি******************) তোমার মা, তোমার মা, তোমার মা। তার পরের অধিকারী হচ্ছে ( আরবি******************) তোমার পিতা। (বুখারী, মুসলিম)
এ পিতামাতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা, তাদের কষ্ট দেয়া সবচাইতে বড় কাবীরা গুনাহ্ বলে নবী করীম (সা) ঘোষণা করেছেন। তাঁর ঘোষণায় এ পাপটি হচ্ছে শিরকের পর বড় গুনাহ। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)
সবচাইতে বড় কবীরা গুনাহ্ কোনটি, আমি কি তা তোমাদের জানাব না? এ প্রশ্ন নবী করীম (সা) তিনবার করলেন। সাহাবিগণ বললেনঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি অবশ্যই তা আমাদের বলবেন। তখন তিনি বললেনঃ তা হচ্ছে আল্লাহর সাথে শরীক করা এবং পিতামাতার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা।
রাসূলে করীম (সা) আরও বলেছেনঃ ( আরবি******************)
তিনজন লোক কখনই জান্নাতে যাবে না। তারা হচ্ছেঃ পিতামাতার সাথে সম্পর্কচ্ছেদকারী, খারাপ ব্যবহারকারী, যে পুরুষ নিজ স্ত্রী দ্বারা খারাপ কাজ করায় এবং পুরুষালি চাল-চলন গ্রহণকারী নারী।
তিনি অপর এক হাদীসে বলেছেনঃ ( আরবি******************)
গুনাহগুলোর মধ্যে আল্লাহ্ যতটা চান তার শাস্তি কিয়ামতের দিন পর্যন্ত বিলম্বিত করবেন। কিন্তু তিনি পিতামাতার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ, খারাপ ব্যবহার করার পাপকে মৃত্যুর পূর্বে এ জীবনেই তড়িৎ ব্যবস্থায় শাস্তিতে পরিণত করবেন।
বিশেষ করে পিতামাতা বার্ধক্যে পৌঁছলে তাদের কল্যাণ কামনার জন্যে অধিক তাগিদ করা হয়েছে। কেননা এ সময় তাদের শক্তি সামর্থ্য নিঃশেষ হয়ে যায়। তখন তাদের দৈনন্দিন ব্যাপারে অধিক লক্ষ্য দেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়, বেশি বেশি যত্ন নেয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে। এ সময় খুব দরদ সহানুভূতি ও ভক্তি-শ্রদ্ধা সহকারে যত্ন নেয়ার প্রয়োজন তীব্র হয়ে উঠে। এ কথাই আল্লহ্ বলেছেন নিম্নোদ্ধৃত আয়াতেঃ ( আরবি******************)
তোমার আল্লাহ্ ফরমান জারী করেছেন যে, তোমারা কারোরই দাসত্ব করবে না, কেবল মাত্র তাঁকে ছাড়া। আর পিতামাতার সাথে ভাল ব্যবহার আচরণ গ্রহণ করবে। তোমার কাছে তাদের একজন বা দুজনই যদি বার্ধক্যে পৌঁছে যায়, তাহলে তখন তাদের মনে কষ্ট হয় এমন কথা বলবে, না তাদের ভর্ৎসনা তিরষ্কার করবে না বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলবে। তাদের খেদমতে বিনয় ও দরদমাখা বাহু বিছিয়ে দেবে এবং বলবে, হে আল্লাহ্! তুমি এ দুজনের প্রতি রহমত কর, যেমন করে তারা আমাকে ছোট-অবস্থায় লালন-পালন করেছে।
এ আয়াতের সমর্থনে হাদীসে বলা হয়েছেঃ ( আরবি******************)
পিতামাতাকে ‘উহ’ বলার অপেক্ষাও ছোট কোন ব্যবহার পিতামাতার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ও খারাপ ব্যবহার পর্যায়ের থাকতে পারে বলে যদি আল্লাহ্ তা’আলা জানতেন, তাপলে তাও তিনি হারাম করে দিতেন।
পিতামাতাকে গালাগাল দেয়ার কারণ ঘটানোও কবীরা গুণাহ
এর চাইতেও বড় কথা হচ্ছে, নবী করীম (সা) পিতামাতাকে গালি খাওয়ানর কারণ ঘটানকেও হারাম ঘোষণা করেছেন। বরং তা হচ্ছে কবীরা গুণাহ্।
তিনি বলেছেনঃ ( আরবি******************)
পিতামাতাকে অভিশাপ দেয়াও সবচাইতে বড় কবীরা গুণাহ্। কোন বুদ্ধিমান ঈমানদার মানুষ পিতামাতাকে অভিশাপ দিতে পারে- অথচ তাদের দরুণই তার জীবন ও অস্তিত্ব লাভ সম্ভবপর হয়েছে- তা লোকদের বোধগম্য হলো না। তারা বিস্ময় সহকারে প্রশ্ন করলঃ কেমন করে একজন লোক তার পিতামাতাকে অভিশাপ দিতে পারে? জবাবে রাসূলে করীম (সা) বললেনঃ একজন অপর কারো পিতাকে গাল দেয়, সেও এর পিতাকে গাল দেয়। একজন অপর কারো মা’কে গালমন্দ বলে, সে-ও এর মা’কে গাল-মন্দ বলে- এভাবেই অভিশাপ দেয়ার কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে।
তাহলে যে লোক নিজেই তার পিতামাতাকে তাদের সম্মুখে গালাগাল করে, তার সম্পর্কে কি বলা যায়?
পিতামাতার অনুমতি ছাড়া জিহাদে যাওয়া
পিতামাতার অনুমতি ছাড়া জিহাদে চলে যাওয়াও হারাম করে দেয়া হয়েছে। কেননা ইসলামের দৃষ্টিতে পিতামাতার সন্তুষ্ঠি অধিক গুরুত্বপূর্ণ- অধিক কাম্য। তার তুলনায় জিহাদ হচ্ছে কম সফর কাজ, যদিও তাতে অনেক বেশি সওয়াব নিহিত রয়েছে, যা সারা রাত নামায পড়ে ও সারা বছর রোযা থেকেও পাওয়া যায় না।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর ইবনুল আ’স (রা) বলেছেনঃ এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (সা)-এর কাছে এসে জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার পিতামাতা জীবিত আছেন? বললেন, হ্যাঁ। তখন নবী করীম (সা) বললেনঃ ( আরবি******************)
তাহলে তুমি তাদের খেদমতে প্রাণপত করে দাও। অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (সা)-এর কাছে এসে বললেনঃ ( আরবি******************)
আমি আপনার কাছে হিজরত ও জিহাদ করার বায়’আত করব, তা করে আমি আল্লাহর কাছ থেকে সওয়াব পেতে চাই।
নবী করীম (সা) জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার পিতামাতার মধ্যে কেউ বেঁচে আছেন? বললঃ হ্যাঁ দুজনই বেঁচে আছেন। নবী করীম (সা) জিজ্ঞেস করলেনাঃ তুমি কি সত্যই আল্লাহর কাছ থেকে সওয়াব লাভ করতে চাও। বললঃ হ্যাঁ, চাই, তখন নবী করীম (সা) বললেনঃ ( আরবি******************)
তাহলে তুমি তোমার পিতা-মাতার কাছে ফিরে যাও এবং তাদের সাথে উত্তম সাহচর্য গ্রহণ কর।
অপর এক হাদীসের ভাষা এরূপঃ ( আরবি******************)
এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (সা)-এর কাছে এসে বললঃ আমি আপনার কাছে হিজরতের বায়’আত করার উদ্দেশ্যে এসেছি আর আমার পিতামাতাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় ফেলে রেখে এসেছি। একথা শুনে নবী করীম (সা) বললেনঃ তুমি তোমার পিতামাতার কাছে ফিরে যাও এবং যেমন তুমি তাঁদের কাঁদিয়েছ, তেমনি তাদের মুখে হাসি ফোটাও।
হযরত আবূ সায়ীদ (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, একজন ইয়ামেনী লোক হিজরত করে নবী করীম (সা)-এর কাছে উপস্থিত হলেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়ামেনে তোমার কেউ আছে? বললেনঃ আমার পিতামাতা রয়েছেন। নবী করীম (সা) জিজ্ঞেস করলেনঃ তাঁরা কি তোমাকে অনুমতি দিয়েছেন। বললেনঃ না। তখন নবী করীম (সা) আদেশ করলেনঃ ( আরবি******************)
তুমি তোমার পিতামাতার কাছে ফিরে যাও এবং তাদের অনুমতি চাও, যদি তারা অনুমতি দেয়, তাহলে জিহাদে যাও নতুবা তাদের খেদমতে আত্মনিয়োগ করে থাক।
মুশরিক পিতামাতার সাথে ব্যবহার
যেহেতু ইসলাম পিতামাতার ব্যাপারে খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করে এজন্যে তারা মুশরিক হলেও তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা ও তাদের প্রতি খারাপ আচরণ অবলম্বন করাকেও ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে। এমন কি তারা যদি শিরক কাজে খুব বেশি বাড়াবাড়ি করে, শিরক কাজের প্রতি আহ্বান জানায়, তার প্রচারকও হয় এবং তাদের মুসলিম পুত্রকে সেই শিরক কাজে নিয়ে যেতে চায়, তবুও তাদের সাথে কোনরূপ খারাপ ব্যবহার করা বা সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে না। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ ( আরবি******************)
তুমি শোকর কর আমার এবং তোমার পিতামাতার। ফিরে আমার কাছেই যেতে হবে। তারা দুজন যদি তোমাকে আমার সাথে শিরক করতে তোমার ওপর জোর প্রয়োগ করে, যে বিষয়ে তোমার কিছুই জানা নেই, তাহলে তাদের আনুগত্য করবে না। তবে তাদের সাথে ইহজীবনে ভাল সাহচর্য ও আচরণ অবলম্বন করবে। আর যে আমার দিকে একান্ত আত্মনিবেদিত, তুমি তার পথই অনুসরন কর। পরে আমার কাছেই তোমাদের সকলকে ফিরে আসতে হবে। তখন আমি তোমাদের জানিয়ে দেব তোমারা কি সব কাজকর্ম করছেলে? (সূরা লোকমানঃ ১৪-১৫)
এ আয়াত স্পষ্ট ভাষায় বলে দিচ্ছে যে মুশরিক পিতামাতা শিরক করতে বললে ও সেজন্যে বল প্রয়োগ করলে তাদের আনুগত্য করা বা তাদের আদেশ পালন করা যাবে না। কেননা আল্লাহর নাফরমানী হয় অপর যারই আনুগত্য করলে, তা কখনই করা যেতে পারে না। আল্লাহর সাথে শিরক করার তুলনায় বড় গুনাহ্ কি হতে পারে? কিন্তু তা সত্ত্বেও মুশরিক পিতামাতার সাথে দুনিয়ার জীবনে ভাল ব্যবহার করার আদেশ দেয়া হয়েছে। তাদের ঈমানী অবস্থা কি সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করা যাবে না বরং কেবলমাত্র আল্লাহর হুকুম বরদার নেককার লোকদের পথই অনুসরণ করতে থাকতে হবে। কেননা আল্লাহই হচ্ছেন সবচাইতে বড় হুকুমদাতা, বড় বিচারক- সেদিন যেদিন পিতামাতা সন্তানের কোন কাজে আসবে না, কোন সন্তানও কোন উপকার করতে পারবে না তার পিতামাতার।
বস্তুত উদারতা, ক্ষমাশীলতা ও ন্যায়বিচারের এ এমন এক উচ্চ উন্নত দৃষ্টান্ত, যার কোন তুলনাই দুনিয়ার অপর কোন ধর্ম কোন মতাদর্শই পেশ করতে পারবে না।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি