প্রকাশকের কথা
মুহতারাম আব্বাস আলী খান বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ। ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে তাঁর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইসলামী সাহিত্য রচনা ও অনুবাদের ক্ষেত্রেও তাঁর কলম ক্লান্তিহীন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘ইসলাম ও জাহেলিয়াতের চিরন্তন দ্বন্দ্ব’। এই গ্রন্থে লেখক সুনিপুণভাবে অতীত ও বর্তমানকালে ইসলামের সাথে জাহেলিয়াতের যে সংঘাত চলেছে ও চলছে তার চিত্র অঙ্কন করেছেন। সাথে সাথে তিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠাকামীদের করণীয়ও নির্দেশ করেছেন সুন্দরভাবে। তাঁর গ্রন্থটি ইসলাম প্রতিষ্ঠাকামীদের মূল্যবান পাথেয় গণ্য হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

ইসলাম ও জাহেলিয়াত
ইসলাম ও জাহেলিয়াত দু’টি বিপরীতমুখী বিশ্বাস, মতবাদ ও কার্যক্রম। উভয়ের পথ, লক্ষ্য ও গন্তব্য ভিন্নতর – বরং বিপরীতমুখী। অতএব উভয়ের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ স্বাভাবিক ও অনিবার্য। মানবজাতির সূচনালগ্ন এ দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম চলে আসছে এবং যতোদিন মানবজাতির অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকবে ততোদিন এ সংঘাত অব্যাহত থাকবে।

এ দু’টির একটি ভালো, অন্যটি মন্দ। একটি সত্য ও ন্যায়, অন্যটি মিথ্যা ও অন্যায়। একটি কল্যাণকর, অন্যটি অকল্যাণকর। একটি আলোক, অন্যটি অন্ধকার। একটি সৃজনশীল, অন্যটি ধ্বংসশীল। একটি বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহতায়ালার মনোনীত পথ, অন্যটি তাঁর অবাঞ্ছিত ও নিষিদ্ধ পথ। এ দু’টি পথ ও মতবাদের প্রথমটি ইসলাম, দ্বিতীয়টি জাহেলিয়াত। যা ইসলাম তা জাহেলিয়াত নয় এবং যা জাহেলিয়াত তা ইসলাম নয়।

‘জাহেলিয়াত’ শব্দটি ইসলামের বিপরীত অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইসলামের যাবতীয় পন্থা-পদ্ধতি জ্ঞানভিত্তিক। কারণ, খোদা স্বয়ং সে পন্থাপদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন এবং তিনিই যাবতীয় গূঢ় রহস্যের জ্ঞান রাখেন। পক্ষান্তরে, ইসলাম থেকে ভিন্নতর প্রত্যেক পন্থা-পদ্ধতিই জাহেলিয়াতের পন্থা-পদ্ধতি বলে গণ্য। আরবের ইসলামপূর্ব যুগকে এ অর্থে জাহেলিয়াতের যুগ বলা হতো যে, সে যুগে জ্ঞান ছাড়াই নিছক কুসংস্কার, আন্দাজ-অনুমান এবং কামনা-বাসনার ভিত্তিতেই মানুষ তার নিজের জীবনপদ্ধতি নির্ধারিত করে নিয়েছিল। এ পদ্ধতি যেখানে যে যুগেই মানুষ অবলম্বন করবে, তাকে অবশ্যই জাহেলিয়াতের কর্মপদ্ধতি বলা হবে।

মোটকথা, ইসলামের পরিভাষায় জাহেলিয়াত বলতে সেসব কর্মপদ্ধতি বোঝায় যা ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা, শিষ্টাচার ও মন-মানসিকতার পরিপন্থী। – ‘তিনিই সে মহান সত্তা যিনি তোমাদেরকে পয়দা করেছেন। অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ কাফের, কেউ মুমিন এবং আল্লাহ সবকিছু লক্ষ্য করছেন, যা তোমরা করছ’- (তাগাবুনঃ ২)।

তাফসীরকারকগণ এর চারটি মর্ম বর্ণনা করেছেন এবং চারটিই সঠিক।

এক—তিনি তোমাদের স্রষ্টা। কিন্তু তাঁর স্রষ্টা হওয়াকে কেউ অস্বীকার করে এবং কেউ এ মহাসত্য মেনে নেয়। তাই তাদেরকে যথাক্রমে কাফের ও মুমেন বলা হয়েছে।

দুই—তিনি তোমাদেরকে পয়দা করে ভালো ও মন্দ উভয় পথ দেখিয়ে দিয়েছেন এবং উভয়ের পরিণাম ফলও বলে দিয়েছেন। অতঃপর এ দু’টি পথের যে কোন একটি বেছে নেয়ার এবং সে পথে চলার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। তোমরা কুফর অবলম্বন করতে চাইলে অর্থাৎ আল্লাহর পথে চলতে অস্বীকার করতে চাইলে তা করতে পার এবং ঈমান এনে তাঁর পথে চলতে চাইলে তাও করতে পার। ঈমান ও কুফরের কোন একটি অবলম্বন করতে তিনি তোমাদেরকে বাধ্য করেন না। অতএব ঈমান ও কুফর অর্থাৎ আল্লাহর প্রভুত্ব-কর্তৃত্ব ও হুকুম-শাসন মেনে নেয়া কিংবা না নেয়া – এ উভয়ের জন্যে তোমরা স্বয়ং দায়ী। এ দু’টির যে কোন একটি গ্রহণের এখতিয়ার-স্বাধীনতা তোমাদেরকে দিয়ে তিনি তোমাদেরকে ভয়ানক পরীক্ষায় ফেলেছেন। তিনি লক্ষ্য রাখছেন যে, তোমরা তোমাদের এখতিয়ার কিভাবে ব্যবহার করছ। ‘তিনি লক্ষ্য করছেন যা তোমরা করছ’ – কথাটির মধ্যে সতর্ক করে দেয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। দু’টি বিপরীত পথে চলার যেমন স্বাধীনতা আছে, তেমনি দুই বিপরীতমুখী পরিণামফলও অবশ্যই ভোগ করতে হবে। ভালো ও মন্দ পথের পরিণাম কখনো একই রকম হতে পারে না। ভাল পরিনাম ভোগ করতে হলে ভালো পথেই চলতে হবে, এ কথা বলার কোন প্রয়োজন করে না। এখানেই মানুষের পরীক্ষা। পুরস্কার ও শাস্তির জন্যেই পরীক্ষা করা হয়। নতুবা পরীক্ষা অর্থহীন হয়ে পড়ে।

তিন—তিনি তোমাদেরকে সুস্থ-সঠিক স্বভাব-প্রকৃতির উপর পয়দা করেছেন এবং তার দাবিই এই যে, তোমরা ঈমানের পথ অবলম্বন করবে। কিন্তু সুস্থ-সঠিক স্বভাব-প্রকৃতির উপর পয়দা হওয়ার পর তোমাদের মধ্যে কেউ কুফর অবলম্বন করেছ যা তাঁর সৃষ্টির পরিপন্থী। আবার কেউ ঈমানের পথ অবলম্বন করেছ, যা তার স্বভাব-প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল।

মনে রাখতে হবে, মানুষকে পাপ-প্রবণতাহীন প্রকৃতিগত মন-মানসসহ পয়দা করা হয়েছে। অতঃপর সে সৎপথ অথবা অসৎপথ অবলম্বন করে।

উল্লেখ্য যে, দুনিয়ায় যতো নবী-রাসূল এসেছেন এবং তাঁদের যেসব আসমানী কিতাব দেয়া হয়েছে, তার কোনটিতেই মানুষকে জন্মগত পাপী বলে উল্লেখ করা হয়নি। অথচ দেড় শতাব্দী যাবত খৃস্টীয় জগত এ ধর্মীয় বিশ্বাস পোষণ করে আসছে যে, মানুষ জন্মগতভাবে পাপী। তাদে বিশ্বাস, হযরত আদম(আঃ) ও হাওয়ার পাপের পরিণাম হিসেবে মানুষের মধ্যে বংশানুক্রমিক পাপপ্রবণতা চলে আসছে। তার তাদের পাপপ্রবণতা দমিত করার চিন্তা ও চেষ্টা-চরিত না করে তার সকল দায়দায়িত্ব হযরত আদম(আঃ) ও বিবি হাওয়ার উপর চাপিয়ে দিয়ে পাপপংকিল জীবন-যাপন করার বাহান তালাশ করে নিয়েছে। এ এক মারাত্মক ভ্রান্ত চিন্তাধারা ও দর্শন এবং এটাই জাহেলিয়াত।

তবে বর্তমানে ক্যাথলিক পণ্ডিতগণ বলা শুরু করেছেন যে, বাইবেলে এ ধারণা, বিশ্বাসের কোন ভিত্তি নেই। বাইবেল গ্রন্থের প্রখ্যাত পণ্ডিত রেভারেন্ড হাবাট হাগ তার ‘Is Original Sin in Scripture?’গ্রন্থে বলেন, তৃতীয় শতক পর্যন্ত খৃস্টানদের মধ্যে এ ধরনের বিশ্বাস ছিল না যে, মানুষ জন্মগতভাবে পাপী। কিছু লোকের প্রচারণায় এ ধরনের ধারণা-বিশ্বাস যখন ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তখন দুই শতাব্দী পর্যন্ত খৃস্টান পণ্ডিতগণ এর প্রতিবাদ করতে থাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পঞ্চম শতকে সেইন্ট অগাস্টাইন তার কূটযুক্তি জালের বলে এ কথাটি খৃস্টান ধর্মের মৌলিক বিশ্বাসের মধ্যে শামিল করে দেন যে, মানবজাতি আদমের পাপের অভিশাপ উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছে। আর যিশুখৃস্টের শূলীতে জীবন দান করে কাফফারা দেয়ার ফলে মানুষের মুক্তিলাভের ব্যবস্থা করা হয়েছে – তাছাড়া আর কোন উপায় নেই। এ এক ভ্রান্ত, মনগড়া ও অযৌক্তিক অন্ধবিশ্বাস এবং জাহেলিয়াতের এ এক মারাত্মক অস্ত্র।

চার- আল্লাহ তায়ালাই তোমাদেরকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন। তোমরা ছিলে না, পরে হয়েছো। এ বিষয়টি সম্পর্কে তোমরা যদি সহজ-সরল ও নিরপেক্ষ মন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে তাহলে অবশ্যই বুঝতে পারতে যে, তোমাদের অস্তিত্বই খোদার এক বিশেষ দান যার ফলে তোমরা তোমাদের জন্যে সৃষ্ট অসংখ্য-অগণিত নিয়ামত ভোগ করতে পারছ। কিন্তু তোমাদের মধ্যে অনেকেই এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে না। এর ফলে তারা বিদ্রোহ ও পাপাচারের পথ অবলম্বন করেছে। আর কতিপয় লোক ঈমানের পথ অবলম্বন করে সঠিক ও নির্ভুল চিন্তার পরিচয় দিয়েছে।

কুরআন পাকের সূরায়ে রূমে যা কিছু বলা হয়েছে তাও বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। ‘অতএব (হে নবী ও নবীর অনুসারীগণ) একমুখী হয়ে নিজেদের সকল লক্ষ্য এ দ্বীনের প্রতি কেন্দ্রীভূত করে দাও। দাঁড়িয়ে যাও সেই প্রকৃতির উপর যার উপর মানুষকে আল্লাহ পয়দা করেছেন। আল্লাহর বানানো কাঠামো বদলানো যায় না। এই হচ্ছে একেবারে সত্য-সঠিক দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা’- (রূমঃ ৩০)।

উপরোক্ত আয়াতে নবী মুহাম্মাদ (সা) এবং মুসলমানদেরকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে- এ বাস্তবতা তোমাদের কাছে যখন সুস্পষ্ট যে, এ বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও মালিক একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই, তখন অনিবার্যরূপে তোমাদের কর্মপন্থা যা হওয়া দরকার তা হচ্ছে এই যে, তোমাদের লক্ষ্য একনিষ্ঠভাবে এ দ্বীনের প্রতি কেন্দ্রীভূত কর। এ দ্বীন হচ্ছে তা-ই যা কুরআন পেশ করছে। এ দ্বীন অনুযায়ী ইবাদত বন্দেগী, দাসত্ব, আনুগত্য লাভের অধিকারী এক ও লাশরীক আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ নেই। এ দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য কোন দিকে মুখ করো না। জীবনের জন্যে এ পথ অবলম্বন করার পর অন্য কোন পথের দিকে যেন না তাকাও। সমগ্র মানবজাতিকে এ স্বভাব-প্রকৃতির উপর পয়দা করা হয়েছে যে, এক আল্লাহ ব্যতীত তাদের কোন স্রষ্টা, কোন প্রভু, কোন মাবুদ এবং এমন কোন সত্তা নেই সত্যিকার অর্থে যার আনুগত্য করা যেতে পারে। এ স্বভাব-প্রকৃতির উপরই মানুষকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

‘আল্লাহর বানানো কাঠামো বদলানো যায় না’- বাক্যের অর্থ এই যে, খোদা মানুষকে তাঁর বান্দারূপে পয়দা করেছেন। যেন মানুষ একমাত্র তাঁরই বন্দেগী করে। সৃষ্টির এ স্বাভাবিক ধারা-প্রকৃতি কারো পক্ষে বদলানো সম্ভব নয়। এ অবস্থা থেকে ‘খোদার দাস নয়’ অবস্থায় পরিবর্তিত হওয়া সম্ভব নয়। খোদা নয় এমন কাউকে খোদা গণ্য করলে সত্যিকার অর্থে সে খোদা হয়ে যেতে পারে না। মানুষ নিজের জন্যে যত খুশি উপাস্য বানিয়ে নিক না কেন, এক খোদা ছাড়া মানুষ আর কারো বান্দাহ নয়, হতে পারে না।

এ আলোচনার সারমর্ম এই যে, আল্লাহতায়ালা একদিকে মানুষকে স্বাধীনভাবে তার নিজের জীবনপথ বেছে নেয়ার এবং তদনুযায়ী কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। অপরদিকে প্রকৃত সত্যকে তার কাছে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরছেন এবং এ সত্যকে গ্রহণ করার আহ্বান জানাচ্ছেন।

আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন বলে তাকে খুব ভালোবাসেন। তার জীবনের সকল প্রয়োজন পূরণের জন্যে অসংখ্য-অগণিত বস্তু ও দ্রব্যসম্ভার তার চারদিকের পৃথিবীতে ছড়িয়ে রেখেছেন। চন্দ্র-সূর্য-তারকারাজি, দিবারাত্রি। আলো-বাতাস, আকাশের মেঘমালা ও বারিবর্ষণ, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, গাছপালা, পশুপাখি এবং নানাবিধ আহার্য দ্রব্য- মানুষের জন্যেই তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি যে মানুষকে ভালোবাসেন এসব তারই নিদর্শন। আর মানুষকে ভালোবাসেন বলেই তিনি মানুষকে তার জীবনের সঠিক পথটি অবশ্যই বলে দেবেন। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। মানুষের দুনিয়ার স্বল্পকালীন জীবন কিভাবে সুখী ও সুন্দর হতে পারে এবং দুনিয়ার জীবনের পর পরকালীন চিরন্তন জীবনও কিভাবে সার্থক হতে পারে, তার বিধিবিধান, নিয়মকানুন ও কর্মসূচি তাকে বলে দেবেন না, এমনটি চিন্তা করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে তিনি তা বলেও দিয়েছেন। নবী-রসূলগণের মাধ্যমে তিনি মানুষকে তার পূর্ণ জীবনবিধান বলে দিয়েছেন। এটাকেই বলা হয়েছে স্বভাব-প্রকৃতিসুলভ দ্বীন যার উল্লেখ উপরে করা হলো।

মানুষকে জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক দান করে তাকে পরীক্ষা করার জন্যে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, তার জীবনের জন্যে যে কোন পথ বেছে নেয়ার এবং তদনুযায়ী স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়। সে ইচ্ছা করলে খোদার বলে দেয়া পথে চলে তার সুফল লাভ করতে পারে অথবা এ পথ পরিত্যাগ করে তার মনগড়া কোন ভ্রান্ত পথেও চলতে পারে। সে আল্লাহকে তার একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, প্রভু ও শাসক মনে করে তাঁর পরিপূর্ণ আনুগত্য করতে পারে, অথবা সে কল্পিত বহু ভ্রান্ত খোদার উপাসনাও করতে পারে। এ দু’টি পথের যে কোন একটি পথ অবলম্বন করার স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ যুগে যুগে প্রত্যেক জাতি ও কওমের কাছে নবী-রসূল পাঠিয়ে মানুষকে তার জীবনের সঠিক পথ সম্পর্কে বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সঠিক পথে চলতে যে স্বাধীনতা তাকে দেয়া হয়েছে তা খর্ব করতে চাননি, বরং সঠিক পথে চলার মঙ্গলকারিতা বর্ণনা করে তাকে সম্মত করার ও উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। অপরদিকে ভ্রান্ত পথে চলার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে অবহিত করে সে পথে চলা থেকে বিরত রাখার চেষ্টাও করা হয়েছে।

মানব ইতিহাসের এমন কোন যুগ বা সময়কাল অতীত হয়নি যখন মানুষকে খোদার পথে আহ্বান জানানোর জন্যে কোন নবী অথবা তাঁর স্থলাভিষিক্ত বিদ্যমান থাকেননি। এই যে পরম্পরা ও খোদার পথে মানুষকে আহবানের অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা এরও বিশেষ প্রয়োজন ছিল এবং এখনও রয়েছে। তার কারণ এই যে- খোদার পথ পরিহার করে অন্য যে কোন পথ অবলম্বন করলে- তা হয় প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামেরই নামান্তর। এর ফলে মানুষের জীবনে নেমে আসে নানান বিপর্যয় ও দুর্যোগ। মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্ব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সবল দুর্বলের খোদা হয়ে বসে। অসংখ্য-অগণিত মানুষ মানুষের গোলামির শৃংখলে আবদ্ধ হয়। নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী শাসকের নির্যাতন-নিষ্পেষণে মানুষের আর্তনাদ-হাহাকারে আকাশ-বাতাস ভরে যায়। মানুষের এসব নির্যাতন নিষ্পেষণের অবসান ঘটিয়ে তাদের স্বাধীনতা, সুখশান্তি ও জানমালের নিরাপত্তা বিধানের জন্যে খোদার পথে মানুষকে আহ্বান জানাবার প্রয়োজন যেম্মন অতীতে ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। এটাই আল্লাহ তায়ালার অটল নীতি। এ নীতি মেনে চলার নামই ইসলাম এবং এর বিপরীত যতোকিছু তার সমষ্টিকেই বলে জাহেলিয়াত। যা সত্য তা ইসলাম এবং মিথ্যা ও ভ্রান্তই জাহেলিয়াত।

সত্য ও মিথ্যা পরস্পর বিরোধী শক্তি
উপরের আলোচনায় এ কথা পরিষ্কার হয়েছে যে, ঈমান ও কুফর যেমন বিপরীতমুখী, ইসলাম ও জাহেলিয়াতও তেমনি বিপরীতমুখী। ইসলাম আল্লাহ তায়ালার বলে দেয়া পথ ও পন্থা এবং জীবনের এক কল্যাণমুখী কর্মসূচি। খোদাপ্রদত্ত অভ্রান্ত জ্ঞানই এর উৎসকেন্দ্র। মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেকও তা-ই সমর্থন করে এবং স্বভাব-প্রকৃতির সাথেও এ সংগতিশীল। অপরদিকে কুফর তথা অজ্ঞানতার অন্ধকার, আন্দাজ-অনুমান ও অলীক কল্পনা থেকে জাহেলিয়াত উৎসারিত। অতএব প্রথমটি সত্য ও সুন্দর, দ্বিতীয়টি মিথ্যা ও কুৎসিত। প্রথমটি আলোক, দ্বিতীয়টি অন্ধকার। এ দু’টির একটি অপরটিকে কখনোই বরদাশত করতে পারে না। তাই একটি অপরটির প্রতিদ্বন্দ্বী শিক্তি। তাদের পারস্পরিক সংঘাত-সংঘর্ষও চিরন্তন।

জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যে জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক দান করেছেন তার বদৌলতেই সে জীবশ্রেষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। এ বিশেষ গুণটি মানুষ ও অন্যান্য জীবের মধ্যে বিরাট পার্থক্য সূচিত করেছে। মানুষ তার প্রতিটি কাজের জন্যে যে স্বয়ং দায়ী, জ্ঞান-বুদ্ধি তার মধ্যে এ অনুভূতি সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে, যাকে জ্ঞান-বুদ্ধি দান করা হয়নি, তার বেলায় এ নীতি প্রযোজ্য নয়। যেমন ধরুন, উপর থেকে যদি একটি ভারি পাথর হঠাৎ স্থানচ্যুত হয়ে পতিত হয়ে কোন ব্যক্তিকে মেরে ফেলে, তাহলে পাথরটিকে কিছুতেই অপরাধী গণ্য করা যাবে না। কারণ সে একটা নিষ্প্রাণ অচেতন পদার্থ মাত্র। ঠিক এভাবে কোন একটি পশু কারো শস্যক্ষেতে প্রবেশ করে ফসল খেয়ে তছনছ করলো, তাহলে তাকেও অপরাধী বলা যাবে না। কারণ তার মধ্যে চেতনা ও অনুভূতি থাকলেও সে জ্ঞানবুদ্ধি বিবর্জিত। কিন্তু এ ধরনের কোন কাজ যদি মানুষ করে বসে, তাহলে তাকে অবশ্যই দোষী বলে গণ্য করা হবে এবং আইনের বিচারে তাকে শাস্তি পেতে হবে। কারণ তাকে চেতনা ও অনুভূতির সাথে জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেকের গুণে গুণান্বিত করা হয়েছে। এর দ্বারা সে ন্যায় ও অন্যায় উপলব্ধি করতে পারে। নিষ্প্রাণ ও অজৈব অচেতন পদার্থ এবং মানুষ ব্যতীত অন্যান্য প্রাণী উপরোক্ত গুণ ও ভালো-মন্দ নির্ণয়ের যোগ্যতা থেকে বঞ্চিত বিধায় তাদের কোন কাজের জন্যে জবাবদিহি করতে হয় না। মানুষ তার কাজের জন্যে স্বয়ং দায়ী তার কারণ এই যে, তাকে জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা ভূষিত করা হয়েছে।

জ্ঞান-বুদ্ধির সদব্যবহার
মানুষকে জ্ঞান-বুদ্ধি দান করে মহানতম মর্যাদা দেয়া হলেও সে জ্ঞানের অপব্যবহার করে। তাকে বুদ্ধি-বিবেক দান করে ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায় জেনে নেয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন করার পরও তার প্রতিটি কাজ যে বিবেকসম্পন্ন হবে তেমন কথা বলা যায় না। এর দৃষ্টান্তের অভাব নেই। বরং আমাদের চারধারে এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। যেমন ছাত্রদের কথাই ধরুন। অভিভাবকগণ তাদের সন্তানকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠান জ্ঞান ও মানবীয় গুণাবলী অর্জনের জন্যে। তার জন্যে তাঁরা তাদের শিক্ষার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করেন। বিবেকের দাবিই এই ছিল যে, প্রতিটি ছাত্র নিয়মিত পড়াশোনা করবে, তার যোগ্যতা ও মেধা অনুযায়ী যথাসম্ভব পরীক্ষায় ভাল ফল লাভ করে ভালো ছাত্র হওয়ার প্রশংসা অর্জন করবে। এ জ্ঞান, বিশ্বাস ও অনুভূতি প্রতিটি ছাত্রের মধ্যে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আমরা কি দেখি? কতিপয় ছাত্র তাদের দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করার চেষ্টা করে। আবার অনেকে তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য অবহেলা করে এমন সব গর্হিত কর্মকাণ্ডে সময় ক্ষেপণ করে যা কোন দিক দিয়েই বাঞ্ছিত নয়। মানুষ হিসেবে এ উভয় প্রকারের ছাত্র জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেকের অধিকারী। কিন্তু উভয় ধরনের ছাত্রকে একইভাবে তাদের বুদ্ধি ও বিবেককে কাজে লাগাতে দেখা যায় না। এর থেকে জানতে পারা যায় যে, সকলে তাদের বিবেকের সদ্ব্যবহার করতে পারে না।

আবার ক্ষমতাপিপাসু একদল লোক ক্ষমতা লাভের জন্যে- যে কোন হীনপন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধাবোধ করে না। তাদের মধ্যে অনেকেই উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চডিগ্রিধারীও থাকে। কিন্তু দুর্নীতি, বলপ্রয়োগ, হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাস প্রভৃতির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে তারা মানুষের প্রভু হয়ে বসে। অতঃপর মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণ করার পরিবর্তে তাদেরকে গোলামির শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য করে। এ চিত্র দুনিয়ায় বহুস্থানে অতীতেও দেখা গেছে, এখনও দেখা যাচ্ছে। লুটতরাজ, হত্যা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ, চুরি-ডাকাতি প্রভৃতি ঘটনা তো সমাজে অহরহ ঘটছে। এসব যাদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে তারা সকলেই মানুষ এবং শিক্ষিত বলে পরিচিত। জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক তাদেরও অবশ্যই থাকার কথা। কিন্তু তার সদ্ব্যবহার তারা করছে কোথায়?

দুনিয়ায় এখনও এমন কতগুলো দেশ আছে যাদেরকে অনুন্নত বলা হয়। শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর, দারিদ্র্য পীড়িত। এসব দেশে অমন ধরনের অবস্থাকে কেউ কেউ ততোটা দূষণীয় মনে করেন না। তাদের সাথে একমত হওয়ার কোন কারণ না থাকলেও সর্বদিক দিয়ে উন্নত ও সুসভ্য দেশ বলে পরিচিত দেশগুলোতে কি ঘটছে? বর্তমানে ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রকে উন্নতি ও সভ্যতার উচ্চশিখরে আরোহণকারী দেশ বলে বিবেচনা করা হয়। জ্ঞান ও সভ্যতার দীক্ষা গ্রহণের জন্যে এ দু’টি দেশে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় এ দু’টি দেশ শীর্ষস্থান অধিকার করে থাকলেও জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেকের সদ্ব্যবহারে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অপর জাতির উপর অত্যাচার অবিচারে তারা সিদ্ধহস্ত। আপন সমাজেও তারা নৈতিক অধঃপতনের অতল তলে নিমজ্জিত। ১৯৮৮ সালের ২৭শে জুনের ‘নিউজ উইকে’ প্রকাশিত একটি খবর থেকে তাদের চরম নৈতিক অবক্ষয় ও ক্রমবর্ধমান অপরাধপ্রীতি জানতে পারা যায়। খবরে বলা হয়েছে, সাত মিলিয়ন লোকের শহর লন্ডনে গতবছর (১৯৮৭) ১৯৪টি হত্যাকাণ্ড এবং ২২,৬২৬টি ভয়ানক হিংসাত্মক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ওদিকে নিউইয়র্ক শহরে ১৬৭২টি হত্যাকাণ্ড এবং ১,৪৮,৩১৩টি হিংসাত্মক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এ শুধু দু’দেশের দু’টি শহরের অবস্থা। এসব অপরাধীদের জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক কোথায় গেল?

জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক থাকাটাই যথেষ্ট নয়; তার সদ্ব্যবহারই প্রকৃত মানুষের কাজ। উপরের দৃষ্টান্তগুলো থেকে বুঝতে পারা গেল যে, সকলে তাদের জ্ঞান-বিবেকের সদ্ব্যবহার করতে পারে না। কেউ সদ্ব্যবহার করতে সমর্থ হলেও কেউ আবার ব্যর্থতার পরিচয় দেয়।

এ ব্যর্থতার কারণ কি?
এতো বড়ো মারাত্মক ভুল মানুষ করে কেন? তার মহামূল্য সম্পদ জ্ঞান-বুদ্ধির প্রতি সে এতো বড়ো জুলুম করে কেন? সামনে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে এর জবাব আমাদের অবশ্যই পেতে হবে।

প্রথম কথা এই যে, মানুষের স্বভাবজাত দু’টি বিপরীতমুখী প্রবণতা রয়েছে। একটি খোদাভীরুতা বা সুকৃতির প্রবণতা এবং অপরটি দুষ্কৃতির প্রবণতা। এ দু’টির মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ সর্বদা বিদ্যমান। উভয়টি তাদের দাবি পূরণের জন্যে মানুষকে উদ্বুদ্ধ, উত্তেজিত ও প্ররোচিত করে। সুকৃতির প্রবণতা বিজয়ী হলে মানুষ তার জ্ঞান-বুদ্ধির সদ্ব্যবহার করে সৎ কার্য সম্পাদন করে। আবার দুষ্কৃতি-প্রবণতা বিজয়ী হলে সে মানুষকে নানান পাপাচারে লিপ্ত করে।

দুষ্কৃতির প্রবণতা বিজয়ী হয় কয়েকটি কারণে। তার মৌলিক কারণগুলো নিম্নরূপ।

প্রথমটি হলো- মানুষের প্রবল কুপ্রবৃত্তি ও তার কামনা-বাসনা। এ কামনা-বাসনা এতোটা শক্তিশালী যে মানুষ সাধারণতঃ তার কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। তা দমন করার শক্তি হারিয়ে ফেললে মানুষ প্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়ে। তখন যে কোন অন্যায়, অনাচার, পাপাচার ও পশুসুলভ কাজ করতে সে মোটেও দ্বিধাবোধ করে না। সে তার প্রবৃত্তিকেই তার ‘ইলাহ’ বানিয়ে নেয় এবং নিজে পুরোপুরি প্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়ে। প্রবৃত্তির দাস হওয়ার পর ভালোমন্দের জ্ঞান তার লোপ পায়। অনেক সময় পাপকে পাপ বলে বিশ্বাস করার পরও তা থেকে দূরে থাকার শক্তি তার থাকে না। যেমন চুরি, ডাকাতি, খুন খারাবি, ব্যভিচার প্রভৃতি খারাপ মনে করা সত্ত্বেও মানুষ প্রবৃত্তির দাসত্ব করতে গিয়ে এসব পাপাচার থেকে বাঁচতে পারে না।

কুপ্রবৃত্তি সামনে অগ্রসর হয়ে মানুষকে দুনিয়াপূজারী বানিয়ে ফেলে। দুনিয়ায় ভোগ-বিলাস তখন তার জীবনের লক্ষ্য হয়ে পড়ে। কথায় বলে, তিনটি বস্তুর প্রতি মানুষের আসক্তি সর্বাধিক- অর্থ, নারী ও মাদকদ্রব্য। এ তিনটির জন্যে দুনিয়ায় যে কতশত লংকাকাণ্ড ঘটেছে, তার দৃষ্টান্তে ইতিহাস ভরপুর। দুনিয়ায় কে কত বড়ো ও শক্তিশালী হতে পারে, কে কত ধন-ঐশ্বর্যের পাহাড় গড়তে পারে, কে কত মানুষকে তার দাস বানাতে পারে, কে কত নারীর যৌবন সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে, প্রবৃত্তির দাসেরা তারই এক প্রতিযোগিতায় মেতে যায়। খোদা ও আখেরাতের ভয় যেন ক্ষণিকের জন্যে তাদের চিত্ত বিচলিত করতে না পারে, তার জন্যে মনগড়া দর্শন ও মতবাদ সৃষ্টি করা হয়েছে। খোদা বা সৃষ্টিকর্তা বলে কোন শক্তির অস্তিত্ব নেই। আখেরাত এক অবাস্তব ও গাজাঁখুরি চিন্তার ফসল। এ দুনিয়া এবং দুনিয়ার জীবনটাই সবকিছু। জীবনটা একটা বেঁচে থাকার ও টিকে থাকার সংগ্রাম- STRUGGLE FOR EXISTENCE.

এখানে যে শক্তিমান তারই টিকে থাকার, কর্তৃত্ব প্রভুত্ব করার, জীবনকে ষোলআনা উপভোগ করার অধিকার আছে। দুর্বলের বেঁচে থাকার অধিকার নেই- SURVIVAL OF THE FITTEST.

এ দর্শনে বিশ্বাসী হওয়ার পর ন্যায়-অন্যায়, বৈধ-অবৈধ, ভালো-মন্দ, দয়া-নিষ্ঠুরতার কোন প্রশ্ন মনে জাগ্রত হওয়ার কথা নয়। লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্যে যা কিছু প্রয়োজন তা-ই করা হয়। মিথ্যা, প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা, ওয়াদাভংগ, হত্যা, লুণ্ঠন, সন্ত্রাস, বলপ্রয়োগ, মিথ্যা-বানোয়াট অপবাদ প্রভৃতির সুযোগ গ্রহণ করা হয়। এসব কোন কাল্পনিক কথা নয়। এসব অতীত ও বর্তমান ইতিহাসের বাস্তব ঘটনা। জাহেলিয়াতের এ এক ভয়ংকর রূপ।

দ্বিতীয় মৌলিক কারণ হলো- জাতীয়, দলীয় ও বংশীয় গর্ব-অহংকার ও তার প্রতি অন্ধপ্রীতি। বাপদাদা ও ধর্মীয় নেতাদের, বংশানুক্রমিক চিন্তাধারা ও রীতিনীতির এবং নানাবিধ কুসংস্কারের অন্ধ অনুসরণ। এ অন্ধপ্রীতি ও অন্ধ অনুসরণ মানুষকে ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের বিচারবোধ থেকে বঞ্চিত করে। আপন জাতি, দল ও বংশের জন্যে যা ভালো ও লাভজনক- তা অন্যের জন্যে যতোই ক্ষতিকর হোক না কেন, তা-ই করার জন্যে মানুষ সর্বশক্তি প্রয়োগ করে, যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সাত বছর, তিরিশ বছর ও একশ’ বছর ব্যাপী যুদ্ধের উল্লেখ আছে। এ জাতীয় ও বংশীয় গর্ব-অহংকার ও অন্ধপ্রীতিরই কুফল। প্রাক-ইসলামী যুগে আরব ভূখণ্ডেও এ ধরনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলেছে বংশানুক্রমে। প্রবৃত্তির কামনা বাসনা পূরণ করতে গিয়ে মানুষের খুনের দরিয়া প্রবাহিত করা হয়েছে।

গায়ের জোরে অপরের ভূখণ্ড দখল এবং দুর্বল জাতিকে পদানত করার অদম্য লালসা দু’টি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত করে। জাহেলিয়াতের দানবদের দ্বারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তার প্রচণ্ড ও হিংস্র থাবা বিস্তার করে আটাশটি দেশ ও ছ’টি মহাদেশের উপর। এ যুদ্ধে এক কোটি সৈন্য ও এক কোটি বেসামরিক লোক প্রাণ হারায়। যুদ্ধজনিত দুর্ভিক্ষ, মহামারী ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আরও দু’কোটি মানুষ ধরাপৃষ্ঠ থেকে চিরতরে বিদায় হয়।

একুশ বছর পর জাহেলিয়াতের দানবদের ক্ষমতার অতৃপ্ত লালসা চরিতার্থ করার জন্যে অধিক হিংস্রতা, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ মহাযুদ্ধ পৃথিবীর প্রতিটি দেশ ও জাতিকেই যুদ্ধে কোন না কোন প্রকারে জড়িত করে ফেলে। সতেরো মিলিয়ন সৈন্য ও একচল্লিশ মিলিয়ন বেসামরিক লোক মৃত্যুর করালগ্রাসে ঢলে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহৃত অমানবিক আণবিক বোমায় জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষ পঙ্গু ও বিকলাংগ হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করে। এর চেয়ে অধিক বর্বরতা ও পাশবিকতা অতীত জাহেলিয়াতের যুগে কখনো অনুষ্ঠিত হয়নি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আধুনিক জাহেলিয়াতকে অতীত জাহেলিয়াত থেকে হিংস্রতর করেছে।

বংশানুক্রমিক ধারণা-বিশ্বাস, রীতিনীতি ও রসম-রেওয়াজ এবং ধর্মীয় নেতাদের অন্ধ অনুসৃতি এক মারাত্মক মানসিক ব্যাধি, যার পেছনে প্রবৃত্তির প্রবল প্ররোচনা কাজ করে। ইসলামের ইতিহাস এ কথার সাক্ষ্য দান করে যে, নবী-রসূলগণ যখন মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেছেন তখন তারা এই বলে প্রত্যাখ্যান করেছে যে, বংশানুক্রমে তারা এবং তাদের বাপ-দাদারা যে ধর্মীয় বিশ্বাস পোষণ করছে, যে রেওয়াজ ও রীতিনীতি আবহমান কাল থেকে তারা পালন করে আসছে, তাদের ধর্মীয় নেতারা যা কিছু বলছে, নবী তার বিপরীত কথা বলছেন। অতএব তা কিছুতেই মেনে নেয়া যেতে পারে না। এসব আলোচনা যথাস্থানে করা হবে।

ধর্মীয় নেতা ও পীর-পুরোহিতের প্রতি সীমাহীন ভক্তি-শ্রদ্ধা তাদেরকে খোদার আসনে বসিয়ে দেয়। তাদেরকে নিষ্পাপ মনে করা হয় এবং তাদের মুখ থেকে যা কিছুই বেরোয় তার সত্যাসত্য বিচার না করেই তাকে বেদবাক্য অথবা খোদার ওহীর মতো অকাট্য সত্য বলে বিশ্বাস করা হয়। আল্লাহ স্বয়ং বলেন-

‘এসব লোক তাদের আলেম-পীর-দরবেশকে আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের খোদা বানিয়ে নিয়েছে’- (তাওবাহঃ ৩১)।

হাদীসে আছে যে, হযরত আদী বিন হাতিম ঈসায়ী ছিলেন। পরে তিনি নবীর দরবারে হাজির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি নবী(সা)- কে উপরোক্ত আয়াতটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে বলেন, আলেম-পীর-দরবেশকে খোদা বানাবার যে অভিযোগ আমাদের উপর করা হয়েছে, তার অর্থ কি? নবী(সা) বলেন, এ কথা কি ঠিক নয় যে, যা কিছু এসব লোক হারাম গণ্য করতো তা তোমরা হারাম বলে মেনে নিতে এবং যা তারা হালাল গণ্য করতো তা তোমরা হালাল বলে মেনে নিতে? হযরত আদী(রা) বলেন, হ্যাঁ, তাতো আমরা অবশ্যই করতাম।

নবী(সা) বলেন, এতেই তাদেরকে খোদা বানানো হয়।

এর থেকে জানা গেল, আল্লাহর সনদ ব্যতীত যারা মানব জীবনের জন্যে হালাল হারামের সীমারেখা নির্ধারণ করে তারা প্রকৃতপক্ষে নিজেরা খোদায়ীর আসনে সমাসীন হয়। যারা তাদের এ শরীয়ত প্রণয়ন মেনে নেয়, তারা তাদেরকে খোদা বানিয়ে নেয়।

যিনি যতো বড়োই হোন না কেন, তাঁর কোন কথা বা সিদ্ধান্ত যাচাই করার মাপকাঠি আল্লাহ ও তাঁর রসূল। যে কথা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কথার বিপরীত অথবা কথার মূল ভাবধারার সাথে সামঞ্জস্যশীল নয় তা প্রত্যাখ্যানযোগ্য। এ ধারণা বিশ্বাস মানব সমাজকে বহু দলে উপদলে বিভক্ত করেছে এবং ফিৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি করেছে।

তৃতীয় মৌলিক কারণ হলো, চরম ইসলাম-বিরোধী পরিবেশ। কোন একটি দেশ, জনপদ এমনকি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অথবা ছাত্রাবাসের পরিবেশ যদি এমন হয় যে, সেখানকার সকলেই ইসলাম-বিরোধী, সেখানে শুধু ইসলাম-বিরোধী সাহিত্য ও পত্র-পত্রিকাই পরিবেশন করা হয়, ইসলাম-বিরোধী মন-মানসিকতা তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, তাহলে এমন পরিবেশে কেউ ইসলামের উপরে অবিচল থাকতে পারে না। এ পরিবেশে যুব সমাজের মন থেকে ধর্ম, খোদা ও আখেরাতের বিশ্বাসকে নড়বড়ে করার জন্যে তাদেরকে বিপরীত লিঙ্গের সাথে অবাধ মেলামেশার, গলাগলি, ঢলাঢলি করার সকল প্রকার সামগ্রীর যোগান দেয়া হয়।। এভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে চুরমার করা হয়। এর ফলে পরবর্তী কার্যক্রম তারা সহজেই এবং আগ্রহ সহকারে গ্রহণ করতে পারে। এ কথাগুলো নিছক মানসলোকের কোন কল্পিত কাহিনী নয়। রাশিয়ার মতো কমিউনিস্ট দেশগুলোতে এসব কার্যক্রমই গ্রহণ করা হয়।

তারপর রাশিয়ার বাইরে যেসব অকমিউনিস্ট দেশে কমিউনিজমের চিন্তাধারা ও আন্দোলন রপ্তানি করা হয়, সেখানে সীমিত আকারে হলেও একই কায়দায় কার্যক্রম শুরু করা হয়। কোথাও প্রকাশ্যে, কোথাও গোপনে। তবে কাজের টেকনিক, কর্মী রিক্রুট ও তাদের প্রশিক্ষণ যথারীতি চলে। যুব সমাজকে নানান ছলেবলে-কৌশলে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করা হয়। তার জন্যে রাশিয়া থেকে সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়। এভাবে ক্রমশ নতুন দেশে কমিউনিস্ট শাসন কায়েম করা হয়। তাদের ফাঁদের সর্বশেষ শিকার আফগানিস্তান।

কোথাও কমিউনিস্ট শাসন কায়েম হলে বাক-স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক স্তব্ধ হয়ে যায়। কেউ বুদ্ধির সদ্ব্যবহার করতে চাইলেও তার কোন উপায় নেই। স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় কমিউনিস্ট শাসকদের মানসিক দাসত্ব মেনে নিতে হয়।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি