পূর্ব –কথা
ইসলামী জীবন বিধান তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে দুইটি মৌল বুনিয়াদের উপর স্থাপিতঃ একটি পবিত্র কুরআন, অপরটি রাসূলের হাদীস। পবিত্র কুরআন ইসলামের একটি মৌল কাঠামো উপস্থাপন করিয়েছে আর রাসূলের হাদীস সেই কাঠামোর উপর একটি পূর্ণাঙ্গ ইমারত গড়েয়া তুলিয়াছে। তাই ইসলামী জীবন বিধানে পবিত্র কুরআনের পরই রাসূলের হাদীসকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হইয়াছে। হাদীসেই ইসলামী জীবন-বিধানের বিস্তৃত রূপরেখার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এই কারণে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা ও মর্ম উপলদ্ধি এবং তদনুসারে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ গঠনের জন্য হাদীসের বিকল্প আর কিছুই হইতে পারে না।

পবিত্র কুরআনের শিক্ষানুসারে রাসুলে আকরাম (স)- এর জীবন ও কর্মধারা মুসলমানদের জন্য ‘উসয়ায়ে হাসানাহ’ বা সর্বোত্তম আদর্শ। মুসলমানদের জীবন. সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতির সকল অঙ্গনেই এই আদর্শের পরিধি বিস্তৃত। এই আদর্শের সঠিক ও নির্ভূল বিবরণ সংরক্ষিত রহিয়াছে হাদীসের বিশাল ভাণ্ডারে। কাজেই প্রকৃত মুসলিম রূপে জীবন যাপন ও সর্বতোভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য হাদীসের ব্যাপকতর অধ্যয়ন এবং ইহার বিশুদ্ধতা ও প্রমাণিকতা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানার্জন করা একান্তই আবশ্যক। হাদীস সম্পর্কে জ্ঞানার্জন না করা প্রকৃতপক্ষে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ থাকারই নামান্তর।

দুঃখের বিষয় যে, মুসলমানদের জীবনকে রাসূলে আকরাম (স)-এর জীবন ও কর্মধারা হইতে বিচ্ছিন্ন করা এবং ইসলামকে একটি নিস্প্রাণ ও স্থবির ধর্মে পরিণত করার লক্ষ্যে হাদীসের প্রামাণিকতা ও বিশুদ্ধতা এবং ইহার সঙ্কলন ও সংরক্ষণ সম্পর্কে একটা সন্দেহের ধূম্রজাল সৃষ্টির অপচেষ্টা চলিয়া আসিতেছে সুদীর্ঘকাল হইতে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সোনালী যুগের অবসানের পর ম’তাজেলা সম্প্রদায়ের উত্থানের মধ্য দিয়েই এই অপচেষ্টা শুরু হইয়াছে এবং পরবর্তীকালে ‘কুরআনপন্হী’র মুখোশ পরিয়া হাদীস-অবিশ্বাসীদের একটি গোষ্ঠি বিভিন্ন সময়ে মুসলমানদের মধ্যে সুকৌশলে বিভ্রান্তি সৃষ্টির এই হীন প্রয়াস চালাইয়াছে।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এই উপমহাদেশেও অনুরূপ একটি চক্রান্তকারী মহল হাদীস বিরোধী এক প্রচণ্ড অভিযান শুরু করিয়াছিল। তাহারা হাদীসের সংকলন, লিপিবদ্ধকরণ ও সংরক্ষণ সম্পর্কে নানা অবান্তর প্রশ্ন তুলিয়া ইহার প্রামাণিকতা ও বিশুদ্ধতা সম্পর্কে মুসলিম জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াইতে চাহিয়াছিল। দুঃখের বিষয় যে, তৎকালীন পাকিস্তানের দায়িত্বশীল ও প্রশাসনিক পর্যায়ের কিছু সংখ্যক উচ্চপদস্থ ব্যক্তিও সরকারী ক্ষমতার পক্ষপুটে থাকিয়া এই ষড়যন্ত্রকে ইন্ধন যোগাইয়াছিল।

এই সর্বনাশা চক্রান্তের মুকাবিলার লক্ষ্যেই এই ভূখণ্ডের বিশিষ্ট হাদীস-বিশেষজ্ঞ শায়খুল ইসলাম হযরত আল্লামা মুহাম্মদ আবদুর রহীম ষাটের দশকের প্রথমভাগে ‘হাদীস সংকলনের ইতিহাস ‘ শীর্ষক এই বিশাল গ্রন্হখানি প্রণয়ন করিয়াছেন।

প্রায় অর্ধ যুগের ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষনার ফসল এই মূল্যবান গ্রন্হে হাদীসের সংকলন, লিপিবদ্ধকরণ ও সংরক্ষণ এবং হাদীস শাস্ত্রের ইতিহাস সম্পর্কে হাদীস-বিরোধীদের সকল কূট প্রশ্নেরই তিনি বিস্তৃত ও পুংখানুপুংখ জওয়াব দিয়াছেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সহিত এতৎসম্পর্কিত যাবতীয় শোবাহ-সন্দেহের অপনোদন করিয়াছেন। আল্লাহর অশেষ শোকর যে, গ্রন্হটি ইতিমধ্যেই বাংলা ভাষায় হাদীস চর্চার ক্ষেত্রে অপরিহার্য পাঠ্যপুস্তকের মর্যাদা লাভ করিয়াছে।

বিগত ২৬ বৎসরে এই অনন্য গ্রন্হটির পাঁচটি সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে। ইহার প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছিল জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী হইতে-১৯৭০ সনে। বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পর ১৯৮০ হইতে ১৯৯২ সন পর্যন্ত ইহার তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর সৌজন্যে। প্রকাশনার এই ধারাবাহিকতা হইতে নিঃসন্দেহে গ্রন্হটির অসাধারণ জনপ্রিয়তাই প্রতিভাত হইয়াছে। এক্ষণে মওলানা আবদুর রহীম রচনাবলী প্রকাশনার দায়িত্বে নিয়োজিত ‘খায়রুন প্রকাশনী’ গ্রন্হটির সুষ্ঠ প্রকাশনা ও বাজারজাতকরণের সার্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত ইহার পূর্বোকার সংস্করণের মুদ্রণ-প্রমাদগুলি সংশোধনের জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, গ্রন্হের এই সংস্করণটি বিদগ্ধ পাঠক সমাজে অধিকতর সমাদর লাভ করিবে।

মহান আল্লাহ এই অনন্য দ্বীনী খেদমতের জন্যে গ্রন্হকারকে জান্নাতুল ফিরদৌস নসীব করুন, ইহাই আমাদের সানুনয় প্রার্থনা।

মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান

চেয়ারম্যান

মওলানা আবদুর রহীম ফাউন্ডেশন

ঢাকাঃ আগস্ট, ১৯৯৭

ভূমিকা
মানব প্রকৃতির স্বভাবতই দুইটি পরস্পর-বিরোধী ভাবাধারা বিদ্যমান। একটি অপরের আনুগত্য স্বীকার করা আর দ্বিতীয়টি অন্য লোককে নিজের অনুগত বানাইয়া লওয়া। [Instincts of submission and gregariousness] অন্য কথায়, আনুগত্য স্বীকার ও আধিপত্য বিস্তার এই দুইটি গুণই মানুষের স্বভাবগত এবং এই গুণ দুইটি মানুষের মধ্যে সাধারণত প্রায় সমান মাত্রায় বিদ্যমান। মানুষের প্রকৃতি এক দিকে যেমন তাহাকে অপর লোকের উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য উদ্যোগী করিয়া তোলে, অপর দিকে ঠিক অনুরূপভাবেই তাহাকে অপর শক্তির নিকট আনুগত্যের মস্তক অবনমিত করিতে বাধ্য করে। যে লোক দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষের উপর আধিপত্য বিস্তার করিয়া আছে, তাহাকেই দেখা যাইবে অপর কোন উচ্চতর বৃহত্তর শক্তির সম্মুখে অবনমিত মস্তকে। প্রভাব বিস্তার ও আনুগত্য স্বীকার এই উভয়বিধ ভাবধারাই মানুষের প্রকৃতি নিহিত বলিয়া মানুষ সমাজ জীবন যাপন করিতে ও বহু মানুষের সহিত মিলিত হইয়া সামাজিক দায়িত্ব পালন করিতে সক্ষম। এই ভাবধারা না থাকিল না সমাজ গড়িয়া উঠিতে পারিত, না সমাজের উপর মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইতে পারিত কোন রাষ্ট্রের প্রাসাদ।

মানব-প্রকৃতি ও মনস্তত্ত্বের গভীরতর অনুশীলনের ফলেই এই তত্ত্বের যথার্থ তাৎপর্য অনুধাবন করা সম্ভব। মানব-প্রকৃতি নিহিত এই দুই বিপরীতমূখী ভাবধারা যেমন অপ্রয়োজনীয় নয়, তেমনি নয় কোন দূষনীয়। সকল প্রকার স্বাভাবিক ভাবধারা, প্রবণতা ও আবেগ-উচ্ছাসের একটি স্বভাবসম্মত সীমা নির্দিষ্ট রহিয়াছে এবং সেই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকিলেই তাহা মানূষের জন্য কল্যাণকর হইতে পারে।

আনুগত্য ও প্রভাব বিস্তারের এই ভাবধারা কালভিত্তিক ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে বহুর সঙ্গে এক-এর সম্পর্কে-সম্বন্ধ ও যোগাযোগ সৃষ্টি করে। এই ভাবধারার প্রবাহ শুষ্ক ও স্তব্ধ হইয়া গেলে সভ্যতার অগ্রগতি ব্যাহত হইতে এবং জীবন-যন্ত্র বিকল হইয়া পড়িতে বাধ্য। দুনিয়ার কোন মতাদর্শ ও চিন্তাধারাই এই কারণে সম্পূর্ণ অভিনব ও অপূর্ব হইতে পারে না, বাহ্য দৃষ্টিতে তাহা যতই ‘আনকোরা’ ও ‘নতুন’ বলিয়া মনে হউক না কেন। বরং একটৃ সন্ধনী দৃষ্টিতে বিচার করিলেই উহার প্রত্যেকটির মূল শিকড় অতীতের গভীর তলদেশে খুজিঁয়া পাওয়া যাইবে। গবেষণা ও অনুসন্ধানের প্রতিভা সূক্ষ্ম ও ব্যাপক হইলে অতীতের অন্ধকারাচ্ছন্ন গর্তে প্রবাহমান এক চিরন্তন জীবন ঝর্ণার ফল্গুধারা লক্ষ্য করা কিছুমাত্র কঠিন নহে। বিজ্ঞানের কোন আবিষ্কারই এমন নহে, যাহার বীজ পূর্ববর্তী কোন আবিষ্কার-উদ্ভাবনীর ক্ষেত্রে হইতে সঞ্চারিত নয়। সভ্যতা সংষ্কৃতি এই উত্তুংগ প্রাসাদ আদিম প্রাচীনত্বের ধ্বংসস্তূপের উপরই দণ্ডায়ামন, তাহাতে সন্দেহ নাই।

এই কারণে দুনিয়ার কোন সংস্কৃতিবান জাতিই স্বীয় অতীতের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া দীর্ঘকাল বাচিঁয়া থাকিতে পারে না। অতীতকাল জাতিকে একটি দৃঢ় ভিত্তিই দেয় না, ভবিষ্যতের চলার পথে দান করে বহুবিধ বাস্তব অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত জ্ঞান-পাথেয়। অতীতের ভূল-ভ্রান্তি, পদস্থলন ও ঘাত –প্রতিঘান তাহাকে অধিকতর সতর্ক করিয়া তোলে। কিন্তু সেই জন্য জাতির মধ্যে নিরপেক্ষ ও উদার মননশীলতা এবং উপদেশ গ্রহণের অনুকূল মানবিক অবস্থা বর্তমান থাকা একান্তই আবশ্যক। ইতিহাস অধ্যয়নের গুরুত্ব এই দৃষ্টিতেই অনুধাবনীয়। ইহার সাহায্যে অতীতকে বর্তমানের পাশাপাশি স্হাপন করিয়া পারস্পরিক যাচাই ও তুলনা করা এবং উহা হইতে অর্জিত জ্ঞান-আলোকে অজ্ঞাত ভবিষ্যতের তিমিরাচ্ছন্ন দিগন্তকে উদ্ভাসিত করিয়া তোলা প্রত্যেক জাতির পক্ষেই সহজ।

উপরন্তু একটি জাতির ইতিহাস কেবল সেই জাতির জন্য। নয়, দুনিয়ার সকল মানব জাতির জন্যই তাহা অমূল্য সম্পদ। এই কারণে কুরআন মজীদ সংক্ষিপ্তভাবে হইলেও বহু প্রাচীন জাতির ইতিহাস উল্লেখ করে এবং সেইসব জাতির উত্থান-পতন ও কল্যাণ-অকল্যাণের মর্মস্পশী কাহিনী হইতে এক নির্ভুল ইতিহাস-দর্শন গড়িয়া তোলে। ফলে কুরআন সকল যুগের মানুষের জন্য কল্যাণ পথের দিশারী। কিন্তু ইহার কার্যকারিতা নির্ভর করে ঘটনার যথার্থতা, সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতার উপর। এই গুণাবলী সঠিকভাবে অর্জিত হইলে আজিকার মানুষও তাহা হইতে যেমন সঠিক পথের নির্দেশ লাভ করিতে পারে, তেমনি পারে ভবিষ্যতের দুর্গম পথে চলিবার বিপুল উদ্যম ও প্রেরণা লাভ করিতে।

মানুষের কল্যাণকামী ব্যক্তিদের বিভিন্ন শ্রেণী রহিয়াছে। তন্মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বাধিক উন্নতমানের কল্যাণকামী লোক হইতেছেন আল্লাহর প্রেরিত আম্বিয়ায়ে কিরাম। তাঁহারাই বিশ্বমানবতার উজ্জ্বলম আদর্শ। তাহারা সকল প্রকার পাপ-ক্রটি ও গুনাহ-নাফরমানীর কলুষতা হইতে চিরমুক্ত। তাঁহাদের চিন্তাধারা, দৃষ্টিকোণ, কথা ও কাজ-সবকিছুই সরাসরিভাবে আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। অতএব তাঁহারা সাধারণ মানুষের নিকট কেবল ভক্তি-শ্রদ্ধা পাওয়ারই যোগ্য পাত্র নহেন, আকীদা ও বিশ্বাস হইতে শুরু করিয়া জীবনের সকল পর্যায়ের সকল প্রকার কাজে ও কর্মে বাস্তবভাবে অনুসৃত হইবার যোগ্য।

সকল নবীই একই নূরানী কাফেলার অগ্রপথিক, একই মূলনীতি ও আদর্শভিত্তিক জীবন-ব্যবস্থার উদগাতা এবং প্রচারক; একই দ্বীনের প্রবর্তন। মানব-প্রকৃতিও চিরন্তনভাবে অভিন্ন ও অপরিবর্তনীয়। এই কারণে মানুষের প্রয়োজনীয় পথ-নির্দেশ এবং উহার মৌলিক ভাবধারা ও চূড়ান্ত আদর্শও অভিন্ন, চিরন্তন এবং অপরিবর্তনীয়। এই মৌলিক শাশ্বত আদর্শের নাম ‘দ্বীন’। আর দ্বীন-ইসলাম এই কারণেই বিম্ভমানবের জন্য চূড়ান্তভাবে প্রবর্তিত এক অখণ্ড জীবন বিধান। হযরত আদম (আ) হইতে শেষ নবী মুহাম্মদ (স) পর্যন্ত সকল নবীই দ্বীন ইসলামের বাহক প্রচারক ও প্রতিষ্ঠাকামী। নবী আগমনের ধারাবাহিকতায় হযরত মুহাম্মদ (স) সর্বশেষ পর্যায়। আল্লাহ তাঁহাকে যেমন সকলের শেষে প্রেরণ করিয়াছেন, তেমনি তাহাকে ধারণাতীতভাবে সামগ্রিক পূর্ণত্বও দান করিয়াছেন। মানবীয় গুণের দিক দিয়া যেমন, নবুওয়্যাতের যোগ্যতায়ও তিনি ছিলেন তেমনই এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। আল্লাহ তাহাকে উত্তরকালে সকল স্তরের ও সকল দিক ও ক্ষেত্রের জন্য উজ্জ্বলতর নিদর্শনরূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। তাঁহার প্রতি অবতীর্ণ শরীয়াত চিরকালের, সমগ্র মানুষের এবং ইহকাল-পরকাল উভয় ক্ষেত্রের সার্বিক কল্যাণ লাভের একমাত্র নিয়ামক। সময় ও স্থানের পরিধি বা আবর্তন-বিবর্তন উহাকে স্পর্শ করিতে অক্ষম। এই কারণে নবুয়্যাত তাহাতেই চূড়ান্তভাবে পরিণতি লাভ করিয়াছে। আর এই কারণেই তিনি ‘খাতামুন-নাবিয়্যীন, ‘রাহমাতুললিল আলামীন’।

পূর্বেই বলিয়াছি রাসূলে করীম (স) মানব জাতির জন্য এক পরিপূর্ণ আদর্শ। মানব জীবনের কোন একটি দিক বা একটি কাজ এমন নাই- হইতে পারে না- যে সম্পর্কে রাসূলে করীমের নিকট হইতে পথ-নির্দেশ লাভ করা যায় না। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবন, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবন, পারস্পররিক লেন-দেন, সম্পর্ক সম্বন্ধ স্থাপন, আত্মীয়তা-শক্রতা, শিক্ষাদীক্ষা, দেশ শাসন ও ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক- যুদ্ধ ও সন্ধি- সবকিছু সম্পর্কেই সুস্পষ্ট আদর্শ বিদ্যমান রহিয়াছে রাসূলে করীম (স)-এর জীবনে।

রাসূলে করীম (স) ইসলামী আদর্শ প্রচার ও উহার প্রতিষ্ঠা প্রচেষ্টার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছেন। এইজন্য তাহাকে পরিচালনা করিতে হইয়াছে এক সর্বাত্মক সাধনা, এক ক্ষমাহীন অভিযান। ইহা কোন সহজসাধ্য কাজ নহে। ইহা যদি কেবল চিন্তার সূক্ষ্ম জাল রচনা কিংবা বাণীর যাদুমন্ত্র সৃষ্টির দ্বারাই স্মভব হইত, তাহা হইলে চিন্তা ও কল্পনার নির্লিপ্ত প্রশান্তির আসনে অধরূঢ় দার্শনিকদের দ্বারাই মন ও জীবনে অনুরূপ বিপ্লব সৃষ্টি সম্ভব হইত, সম্ভব হইত মৃত জাতির পুনর্গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনার দুরূহ কাজ। এই কাজ প্রকৃতপক্ষে নিয়ন্ত্রণ ও পথ-নির্দেশের মাধ্যমেই অতিবাহিত হয় একজন নবীর জীবন। আর ‘নবুওয়্যাত’ কোন উপার্জনযোগ্য বস্তু নহে, উত্তরাধিকারসূত্রে লভ্য কোন সম্পদও ইহা নয়। ইহা একান্তভাবে আল্লাহর দান। ইহাকে যাহারা সম্পূর্ণত কিংবা আংশিক উপার্জনযোগ্য বলিয়া মনে করে, তাহারা কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণার বিপরীত ধারণা পোষণ করে। আল্লাহ তা’য়ালা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করিয়াছেনঃ

اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ النَّاسِ আল্লাহ মানুষ ও ফেরেশতাদের মধ্য হইতে নিজেই রাসূল বাছাই ও মনোনীত করেন। (সূরা আল-হাজ্জ, আয়াতঃ ৭৫)

اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ

আল্লাহ তাহার নবুওয়্যাত ও রিসালাত কোথায় কাহার প্রতি সংস্থাপন করিবেন, তাহা ততিন সকলের অপেক্ষা অধিক জানেন। (সূরা আন’আম, আয়াতঃ ১২৩)

এই কারণে নবী- আর আমাদের জন্য সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স)-ই চিরন্তন ও পরিপূর্ণ আদর্শ। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই অনুসরণীয়। তাহার মাধ্যমে যে মহান পবিত্র কিতাব-কুরআন মজীদ- আমরা লাভ করিয়াছি, তাহাও যেমন আমাদের জন্য এক অক্ষয় আদর্শ, তেমনি তাহার কথা, কাজ ও সমর্থনের সমন্বয়ে গঠিত সুন্নাতও এক চির উজ্জ্বল দীপ-শিখা। আর ইহাই হইতেছে হাদীসের দার্শনিক ভিত্তি। ইহার উপর রচিত হয় ইসলামী জীবন বিধানের সর্বকালীন প্রাসাদ।

আজ হইতে চৌদ্ধশথ বৎসর পূর্বে আরবের সরজমীনে যে সভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত হইয়াছিল, উহাতে সার্বভৌমত্যের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন আল্লাহ তা’য়ালা এবং উহার নেতৃত্বের আসনে সমাসীন ছিলেন সর্বষশষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স)। কিন্তু এই সভ্যতা যেহেতু কেবল একচি দেশ ও একটি যুগের জন্যই ছিল না, উুহা ছিল বিশ্বের সকল দেশ, সকল সমাজ ও জাতি এবং সকল যুগের নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের জন্য স্থায়ী ও কল্যাণকর, এই কারণে সভ্যতার মূল ভিত্তিদ্বয়-আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও রাসূলের নেতৃত্বকে চিরন্তন সব্যরূপে শাশ্বত ও চিরন্তন করিয়া রাখার উদ্দেশ্যে বিশ্ব মানবতার নিকট দুইটি বিকল্প ব্যবস্থা সংরক্ষিত করা হয়। এই দুইটি ব্যবস্থঅ হইতেছে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রতীক কুরআন মজীদ এবং রাসূলের একচ্ছত্র নেতৃত্বের বাস্তব রূপ ‘সুন্নাত’। এই দু্ইটির মাধ্যমে আল্লাহর বিধান রাসূলের আদর্শ তথা ইসলাম মানব সমাজে চিরন্তন সত্য ও চিরন্তন ব্যবস্থা হইয়া থাকিতে পারে, পারে দেশের সকল কালের জাতির মানুষ এই দুইটি স্থায়ী বুনিয়াদের ভিত্তিতে নতুন নতুন সমাজ ও সভ্যতা গড়িয়ে তুলিতে। এই কারণেই কুরআন মজীদ যেমন আল্লাহর বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে অক্ষুণ্ন ও অপরিবর্তিতভাবে সংরক্ষিত হইয়াছে এবং বর্তমানেও মজুদ রহিয়াছে, ঠিক অনুরূপভাবে ধ্বংস ও বিলুপ্তির করাল গ্রাস হইতে রক্ষা করিয়া রাখা হইয়াছে রাসূলে করীমের আদর্শকে-সুন্নত বা হাদীসকে।

বস্তুত দেড় সহস্র বৎসরকালীন মুসলিম জাতি ইসলামের ভিত্তি হিসাবে কুরআন মজীদের সঙ্গে সঙ্গে হাদীসকেও স্বীকার করিয়া লইয়াছে এবং এই ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে অতীতকাল হইতে কোনরূপ মতভেদ সৃষ্টি হওয়া তো দূরের কথা, কোন কালের কোন মুসলমান একবিন্দু সন্দেহ কখনো পোষণ করন নাই। উপরন্তু কোন লোক যদি এই দুইটি ভিত্তিকে এক সঙ্গে স্বীকার করিতে ও মানিয়া লইতে অসম্মতি প্রদান

করিয়াছেন, মুসলিম সমাজে তাহাকে একবিন্দু স্বীকৃতি দিতেও কান মুসলমান প্রস্তুত হন নাই।

কিন্তু বর্তমানকালে মুসলমানদের মধ্যে এমন এক শ্রেণীর মুষ্টিমেয় লোক যত্রতত্র পরিদৃষ্ট হইতেছে, যাহারা কুরআন মজীদের সঙ্গে সঙ্গে রাসূলের সুন্নাতকে ইসলামের উৎস হিসাবে মানিয়া লইতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করিতেছে। আবার এমন কিছু লোকেরও অস্তিত্ব দেখা যাইতেছে, যাহারা হাদীস যথাসময়ে ও যথাযথভাবে সংরক্ষিত হইয়াছে কিনা, সে সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করিতেছে আর এই বিষয়ে পশ্চিমা পণ্ডিতদের মিথ্যা প্রোপাগান্ডায় প্রভাবান্বিত হইয়া পড়িতেছে। ইহার ফলে মুসলিম সমাজে ইসলামী আদর্শের নিভুলতা, বিশ্বস্ততা, চিরন্তনতা সম্পর্কে কাহারো-কাহারো মনে সন্দেহের উদ্রেক না হওয়াই ছিল অস্বাভাবিক ব্যাপার। অথচ মুসলিম সমাজের ই পুনরুক্থান ও পনর্জাগরণ পর্যায়ে ইসলামী আদর্শের ভিত্তি সম্পকের্ক এইরূপ সন্দেহ বা অবিশ্বাস গোটা জাতির পক্ষেই মারাত্মক হইয়া দেখা দিতে পারে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘হাদীস সংকলনের ইতিহাস’ সম্পর্কে ঐতিহসিক বিচার বিশ্লেষণ এবং ইহার স্বপক্ষে প্রামাণিক যুক্তি ও দলিলাদির ভিত্তিতে নিরপেক্ষ গবেষণা পরিচালনা একান্তই অপরিহার্য ছিল।

আরবী এবং উর্দু সাহিত্যে এই পর্যায়ে যথেষ্ট গবেষণা করা হইয়াছে বলা চলে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে ইহার অভাব ইসলামী সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাংলাভাষীদের বিশেষ দৈন্যের প্রমাণ। এই অভাব মোচন ও দীনতা বিদূলণ করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সম্পদ বৃদ্ধি ও উন্নয় ন এবং হাদীস সম্পর্কে যাবতীয় সন্দেহ অপনোদনের উদ্দেশ্যে আমি বিগত চার বৎসরকাল ধরিয়া এই বিষয়ে ব্যাপক অধ্যাপনা ও গভীর গবেষণা চালাইয়া যে ফসল লাভ করিয়াছি, তাহাই অত্র গ্রন্হে সন্নিবেশিত করিয়া বিদগ্ধ পঠকদের সম্মুখে উপস্থাপিত করিয়াছি। ইহা আমার কোন দুঃসাহসিক পদক্ষেপ কিনা তাহা চিন্তাশীল পাঠকদেরই বিচার্য। বাংলা একাডেমীর আনুকূল্য এই বিরাট গ্রন্হ প্রথমবার মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইতেছে দেখিয়াআল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করিতেছি।

মুহাম্মদ আবদুর রহীম

১৭৩, নাখালপাড়া

মুস্তফা মনজিল

…………..১৯৬৫

نضر الله امرء سمع منا شىا

আল্লাহ ধন্য করিবেন সেই ব্যক্তিকে, যে আমার নিকট হইতে কোন কিছু শুনিল এবং উহা যেভাবে শুনিল সেই ভাবেই অপরের নিকট পৌঁছাইয়াদিল। কেননা শ্রোতার অপেক্ষা উহা যাহার নিকট পৌছায় সে-ই উহার অধিক সংরক্ষণকারী হইয়া থাকে। (তিরমিযী)

قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عليه وَسَلَّم نَضَر اللهُ عَبْدًا سَمِعَ مقَالتىْ فَحَفَظَهَا اوْوَ عَاهَا وَاَدَّها وَرَدَّهَا فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهِ اَلَى مَنْ هُوَ اَفْقَهٌ مِنْهُ- (ابو داؤد)

নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ আল্লাহ তা’য়ালা সেই লোকের মুখমণ্ডল উজ্জ্বল উদ্ভাসিত করিবেন, চিরসবুজ, চিরতাজা করিয়ারাখিবেন, যে আমার কথা শুনিয়া মুখস্থ করিয়া রাখিবে কিংবা স্মৃতিপটে সংরক্ষিত রাখিবে এবং অপর লোকের নিকট তাহা পৌঁছাইবে। জ্ঞানের বহু ধারকই প্রকৃত জ্ঞানী নহে। তবে জ্ঞানের বহু ধারক উহা এমন ব্যক্তির নিকট পৌঁছায়, যে তাহার অপেক্ষা অধিক সমঝদার। (আবূ দাউদ)

হাদীস সংকলনের ইতিহাস

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

হাদীসের সংজ্ঞা ও পরিচয়
কুরআন ও হাদীস ইসলামী জীবন-বিধানের মূল ভিত্তি। কুরআন যেখানে জীবন-ব্যবস্থার মৌলিক নীতি পেশ করে, সেখানে হাদীস হইতে লাভ করা যায় খুটিঁনাটি বিধানের বিস্তারিত বিশ্লেষণ ও কুরআনী মূলনীতি বাস্তবায়নের কার্যকর পন্হা। কুরআন ইসলামের প্রদীপ স্তম্ভ, হাদীস উহার বিচ্ছুরিত আলোর বন্যা। আলোহীন প্রদীপ যেমন অবাস্তব, হাদীসকে অগ্রাহ্য করিলে কুরআনও তেমনি অর্থহীন হইয়া যায়। কুরআনকে বলা যায় ইসলামের বিরাট বৃক্ষের মূল ও কাণ্ড; হাদীস উহার শাখা ও প্রশাখা। শাখা-প্রশাখাহীন কাণ্ড ও মূল নিষ্ফল আবর্জনা মাত্র। কুরআন যেন ইসলামের জীবন প্রসাদ রচনার পরিকল্পনাসহ ইঞ্জিনিয়ার (রাসূল) প্রেরণের নিয়ম আল্লাহর বিধান নাযিল হওয়ার প্রথম দিন হইতেই কার্যকর। কালের যে-কোন স্তরে, পরিবর্তিত অবস্থার যে-কোন পর্যায়ে মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রাসাদ রচনায় ইঞ্জিনিয়ারের (রাসূলের) ব্যাখ্যা-বিশ্লষণ, বাস্তব কর্মের নির্দেশ, পরামর্শ ও উপদেশকে কখনই উপেক্ষা করা যাইতে পারে না।

ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে কুরআন যেন হৃৎপিণ্ড, আর হাদীস এই হৃৎপিণ্ডের সহিত সংযুক্ত ধমনী। ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশাল ক্ষেত্রে এ ধমনী প্রতিনিয়ত তাজা তপ্ত শোণিত ধারা প্রবাহিত করিয়া উহার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে অব্যাহতভাবে সতেজ ও সক্রিয় করিয়া রাখে। হাদীস একদিকে যেমন কুরআনের নির্ভুল ব্যাখ্যা দান করে, অনুরূপভাবে উহা পেশ করে কুরআরে বাহক বিশ্বনবীর পবিত্র জীবন-চরিত, কর্মনীতি ও আদর্শ এবং তাঁহার কথা ও কাজ, হেদায়েত ও উপদেশের বিস্তারিত বিবরণ। এই কারণে ইসলামী জীবিন-বিধানে কুরআন মজীদের পরে পরেই এবং কুরআনের সঙ্গে সঙ্গেই হাদীসের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আল্লাহর দাসত্ব ও আনগত্য করা যেমন রাসূলের আনগত্য ও বাস্তব অনুসরণ ব্যতীত সম্ভব নয়, অনুরূপভাবে হাদীসকে বাদ দিয়া কুরআন অনুযায়ী আমল করা অসম্ভব। বস্তুর হাদীস ও হাদীস-জ্ঞান ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা ও ইসলামী জ্ঞান-গবেষণার ক্ষেত্রে এক অমূল্য ও অপরিহার্য সম্পদ। এই পর্যায়ের প্রাথমিক আলোচনা হিসাবে এখানে আমরা হাদীসের সংজ্ঞা, পরিচয় এবং উহার প্রকার ও ক্ষেত্র সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করিব।

 

হাদীস শব্দের অর্থ
কুরআনে হাদীস শব্দের ব্যবহার এবং

হাদীসের কুরআনী ভিত্তি

‘হাদীস’ শব্দের বিশ্লেষণ করিয়া ইমাম রাগব ইসফাহানী লিখিয়াছেনঃ

اًلحَدِيثُ: وَاَلْحدِيْثُ كَوْنُ اَلشَّئِ بَعَدَ اَنْ لَّمْ تَكُنْ عِرضَاً كَاَنَ تَوْ اَوْجَدْ هَرَّا وكٌلُّ كَلاَمٍ يَبْلُعُ الْانْسَانَ مِنْ جَهَةِ الْسَّمْعِ اَوِ الْوَحِىْ فِىْ يَقْظَتِهِ اَوْ مَنَامِهِ حَدِيْثٌ-

‘হাদীস’ আর ‘হুদুস’ বলিতে বুঝায় কোন একটি অস্তিত্বহীন জিনিসের অস্তিত্ব লাভ করা, তাহা কোন মৌলিক জিনিস হোক কি অমৌলিক। আর মানুষের নিকট শ্রবণেন্দ্রিয় বা ওহীর সূত্রে নিদ্রায় কিংবা জাগরণে যে কোন কথা পৌঁছায়, তাহাকেই হাদীস বলা হয়।

অন্যত্র লিখিয়াছেনঃ

شَىَّ ىُلْقَى فِىْ رَوْعٍ اَحَدٍ مِنْ جِهَةِ الْملأَ

উচ্চতর জগত হইতে একজনের অন্তর্লোকে যাহা কিছু উদ্রিক্ত হয় তাহাই হাদীস।[مفردات راغب اصفهانى صفحه]

স্বপ্নকালীন কথাবার্তাকে কুরআন মজীদে ‘হাদীস’ বলা হইয়াছে। কুরআনে হযরত ইউসুফের জবানীতে বলা হইয়াছেঃ

وَعَلَّمْتَنِي مِن تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ –

স্বপ্নের কথার ব্যাখ্যা তুমি আমাকে শিক্ষা দিয়াছ। (সুরা, ইউসূফ, আয়াত-১০১)

ইমাম রাগেব এই আয়াতের অর্থ প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

اَىْ مَا يحَدِّثُ بِهِ الأِنسَانَ فِىْ نَوْمِهِ-

অর্থাৎ লোককে স্বপ্নযোগে যে সব কথা বলা হয়।[مفردات راغب صفع]

আল্লাহ্ তা’য়ালা কুরআন মজীদকে ‘হাদীস’ নামে অভিহিত করিয়াছেন। কুরআনে বলা হইয়াছেঃ

فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ عَلَىٰ آثَارِهِمْ إِن لَّمْ يُؤْمِنُوا بِهَٰذَا الْحَدِيثِ أَسَفً ا [الكهف:٦]

তাহারা এই ‘কথা’র (কিতাব) প্রতি বিশ্বাস না করিলে, হে নবী, তুমি হয়ত নিজেকে চিন্তাক্লিষ্ট করিয়া তুলিবে।

অন্যত্র বলা হইয়াছেঃ

فَلْيَأْتُوا بِحَدِيثٍ مِّثْلِهِ إِن كَانُوا صَادِقِينَ [الطُّور:٣٤]

(তাহারা কুরআনকে আল্লাহর কিতাব না মানিলে) এইরূপ একখানি কিতাব আনিয়া পেশ করা তাহাদের কর্তব্য, যদি তাহারা সত্যবাদী হইয়া থাকে।

সূরা আয্-যুমার-এ বলা হইয়াছেঃ

اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُّتَشَابِهًا

আল্লাহ তা’য়ালা পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ কিতাবরূপে অতীব উত্তম কালাম নাযিল করিয়াছেন।

এখানে হাদীসকে কিতাব বা কালাম অর্থে ব্যবহার করা হইয়াছে।

‘হাদীস’ শব্দের অর্থ কথা বা বাণী। কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতসমূহ ইহা কথা বা বাণী অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছেঃ

*********************************

অতঃপর তাহারা কোন কথাকে বিশ্বাস করিবে?

*************************************

এবং যখন নবী তাঁহার এক স্ত্রীর নিকট গোটন একটি কথা বলিলেন।

****************************

এই কথায় তোমরা কি আশ্চর্যান্বিত হইতেছ?

এই কয়টি আয়াতেই ‘হাদীস’حديث শব্দটি ‘কথা’ বা ‘বাণী’ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। কুরআন মজীদে নতুন সংবাদ, খবর ও নূতন কথা প্রভৃতি অর্থেও এই শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। যথাঃ

******************************************************

ইবরাহীমের (নিকট আগত) সম্মানিত অতিথিদের খবর তোমার নিকট পৌঁছাইয়াছে কি?

******************************************************

মূসার খবর জানিতে পারিয়াছ কি?

******************************************************

সেই সৈনিকদের কথা জানিতে পারিয়াছ কি?

******************************************************

সব কিছু আচ্ছন্নকারী কিয়ামাতের সংবাদ তোমার নিকট আসিয়াছে কি?

******************************************************

এখন এই কথার প্রতি তোমরা উপেক্ষা প্রদর্শন করিতেছ?

এই ‘হাদীস’ শব্দ হইতে নির্গত হইয়াছে ‘তাহদীস’تحديث আর কুরআনে ইহা ব্যবহৃত হইয়াছে বর্ণনা করা, প্রকাশ করা ও কথা বলার অর্থে। যথা–

******************************************************

তুমি আল্লাহর নিয়ামতের কথা বর্ণনা করঃ

আল্লামা আবুল বাকা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

‘হাদীস’ নাম হইল কথা বলার, সংবাদ দানের। [৪**************************************************]

মোটকথা আরবী অভিধান ও কুরআনের ব্যবহারের দৃষ্টিতে ‘হাদীস’ শব্দের অর্থ কথা, বাণী, সংবাদ, খবর ও ব্যাপার, বিষয়। নবী করীম (স) আল্লাহর পয়গাম পৌঁছাইবার উদ্দেশ্যে লোকাদের সাথে কথা বলিতেন, নিজের কথার সাহায্যে ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কথা, তথ্য ও তত্ত্বের ব্যাখ্যা দিতেন, নিগূঢ় তত্থ্ব বুঝাইয়া দিতেন, বক্তৃতা ও ভাষণের মাধ্যমে আল্লাহর কিতাবের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করিতেন, এইজন্য তাহা ‘হাদীস’ নামে অভিহিত হইয়াছে।

নবী করীম (স) নিজে ইসলামের যাবতীয় হুকুম আহকাম পাণ করিয়াছেন, আল্লাহর বিধান মোতাবেক কাজ করিয়েছেন এবং নিজের আমলের সাহায্যে আল্লাহর বিধানকে বাস্তবায়িত করিয়াছেন। এই কারণে তাঁহার বিভিন্ন আমলের বিবরণকেও ‘হাদীস’ নামে অভিহিত করা হইয়াছে।

নবী করীম (স) বিশেষ যত্ন ও চেষ্টার সাহায্যে সাহাবায়ে কিরাম (রা)- কে ইসলামের উন্নত আদর্শের ভিত্তিতে তৈয়ার করিয়াছেন, তাঁহাদের চরিত্র, চিন্তা, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের উন্নত মানে গঠন করিয়াছেন। এই কারণে সাহাবায়ে কিরামের যেসব কথা ও কাজাকে নবী করীম (স) অনুমোদন করিয়াছেন, সমর্থন করিয়াছেন, অন্তত তিনি যে সবের প্রতিবাদ করেন নাই, তাহারও নাম দেওয়া হইয়াছে ‘হাদীস’।

এক কথায় রাসূলের কথা, কাজের বিবরণ ও সমর্থন-অনুমোদনকেই হাদীস বলা হয়। একটি হাদীস হইতে প্রমাণিত হয়, নবী করীম (স) নিজেই ইহাকে ‘হাদীস’ নামে অভিহিত করিয়াছেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) তাঁহার নিকট জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি কে, যে লোক কিয়ামতের দিন রাসূলের শাফা’আত লাভে ধন্য হইবে? ‘তখন নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি মনে করি, এই হাদীস সম্পর্কে তোমার পূর্বে আর কেহই আমাকে জিজ্ঞাসা করে নাই। বিশেষত এই কারণে যে, হাদীস শোনার জন্য তোমাকে সর্বাধিক চেষ্টিত ও আগ্রহান্বিত দেখিতে পাইতেছি। [৫****************************************************** ]

কুরআন মজীদ দ্বীন-ইসলামের সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ গ্রন্হ। ইহা সর্বশেষ নবীর প্রতি নাযিল হইয়াছে। রাসূলে করীম (স)-কে আল্লাহ তা’য়ালা ইসলামের নবী, ইসলামী জীবন ব্যবস্থার প্রচারক ও প্রতষ্ঠাতা এবং মানবতার পথ-প্রদর্শক ও শিক্ষকরূপে প্রেরণ করিয়াছেন। রাসূল এই মহান পবিত্র গ্রন্হ ‘কুরআন মজীদ’ আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়া লোকদেরকে শুনাইয়াছেন, বহু সংখ্যক সাহাবী তাহা সঙ্গে সঙ্গে মুখস্থ করিয়াছেন। সর্বোপরি রাসূল নিজের জীবনধারা, চিন্তা-বিশ্বাস, ও কর্ম আচরণ ও বাস্তব অনুসরণের মাধ্যমে ইসলামের মূল বিধান শিক্ষা, উপদেশ ও আদেশ-নিষেধকে বাস্তবায়িক করিয়া দেখাইয়া দিয়াছেন; অর্থাৎ একটি জাতিকে তিনি এই আদর্শের ভিত্তিতে পুরোপুরি গঠন করিয়াছেন। বস্তুত নবী করীমের মহান যিন্দেগী ছিল কুরআন মজীদের তথা ইসলামের বাস্তব রূপ, কুরআনী আদর্শের কর্মরূপ। অতএব, দ্বীন-ইসলাম সম্পর্কে রাসূলে করীমের যাবতীয় কথা, কাজ অনুমোদন ও সমর্থনকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় ‘হাদীস’।

‘হাদীস’ একটি আভিধানিক শব্দমাত্র নয়। মূলত ইহা ইসলামের একটি বিশেষ পরিভাষা। সে অনুযায়ী রাসূলে করীমের যে কথা, যে কাজের বিবরণ কিংবা কথা ও কাজের সমর্থন ও অনুমোদন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণিত, ইসলামী পরিভাষায় তাহাই ‘হাদীস’ নামে অভিহিত হয়।

‘হাদীস’কে আরবী ভাষায় ‘খবর’ ও বলা হয়। কিন্তু পার্থক্য এই যে, ‘খবর’ শব্দটি হাদীস অপেক্ষা ব্যাপক অর্থবোধক। ‘খবর’ যুগপৎভাবে হাদীস ও ইতিহাস উভয়কেই বুঝায়।[৬****************************]

নবী করীমের কথা, কাজ, সমর্থন-অনুমোদন এবং তাঁহার অবস্থার বিবরণকে ‘হাদীস’ নামে অভিহিত করা কোন মনগড়া ব্যাপার নয়। কুরআন মজীদে ইহার অকাট্য প্রমাণ বিদ্যমাণ। আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন যে নিখিল মানুষের জন্য এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামত, তাহাতে সন্দেহ নাই। কুরআন মজী এই ‘দ্বীন’কে আল্লাহর নিয়ামতরূপে ঘোষণা করা হইয়াছে এবং নিয়ামতের প্রচার ও প্রকাশ করাকে ‘তাহদীস’ (বর্ণনা করা, প্রচার ও প্রকাশ করা) বলা হইয়াছে।

আল্লাহর নিয়ামতসমূহ সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

তোমাদের প্রতি আল্লাহর দেয়া নিয়ামত স্মরণ কর এবং তোমাদিগকে নসীহত করার উদ্দেশ্যে যে কিতাব ও যে বুদ্ধি-বিচক্ষণতা অবতীর্ণ করা হইয়াছে, তাহাও স্মরণ কর।

দ্বীন-ইসলামকে পূর্ণ ও পরিণত করার প্রসঙ্গেও আল্লাহ তা’আলা উহাকে একটি নিয়ামত বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। ইরশাদ করা হইয়াছেঃ

****************************************************** (সূরা-আল মায়েদা-৩)

আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ পরিণত করিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমর (দেয়া) নিয়ামত সম্পূর্ণ ও সমাপ্ত করিয়া দিলাম।

পূর্বোক্ত আয়াতদ্বয়ে দ্বীন-ইসলাম তথা কুরআন মজীদকে সুস্পষ্ট ভাষায় ‘আল্লাহর নিয়ামত’ বলিয়া ঘোষলা করা হইয়াছে। এই নিয়ামতের বর্ণনা ও প্রকাশ করার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতেঃ

****************************************************** (সূরা- আল ফাজর-১১)

তোমরা আল্লাহর নিয়ামতের বিবরণ দাও- প্রচার ও বর্ণনা কর। [আল্লামা বায়জীদ এই আয়াতের তাফসীরে লিখিয়াছেনঃ ******************************************************

‘এখানে নিয়মিত বলিতে নবুয়্যাতে বুঝানো হইয়াছে এবং তাহদীস করা অর্থ উহার প্রচার করা।

আল্লামা আ-লুসী লিখিয়াছেনঃ

‘নিয়ামত অর্থ কুরআন’ এ কথা অনেকেই বর্ণনা করিয়াছেন।]

এই দৃষ্টিতেই হযরত মুহাম্মদ (স) নবী ও রাসূল হিসাবে যে সকল কথা বলিয়াছেন ও যে সব কাজ করিয়াছেন, তাহার ভাষাগত বিবরণকে ইসলামী পরিবাষায় বলা হইয়াছে ‘হাদীস’। শুধু তাহাই নয়, তাঁহার সম্মুখে কোন সাহাবী কোন কথা বলিলে বা কোন কাজ করিলে তাহা যদি তিনি সমর্থন অনুমোদন করিয়া থাকেন অথবা উহার কোন প্রতিবাদ না করিয়া থাকেন, তাবে উহার বিবরণও ‘হাদীস’ নামেই অভিহিত হইবে। কেনন্ নবী করীম (স) সত্য ও ন্যায়ের প্রচার, প্রতিষ্ঠা এবং সকল অন্যায় ও মিথ্যার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করার দায়িত্ব লইয়াই দুনিয়ায় আগমন করিয়াছিলেন। তাঁহার সম্মুখে কোন মিথ্যা ইসলাম বিরোধী-ইসলামী ভাবধারার বিপরীত-উক্তি বা কাজ করা হইবে আর তিনি উহার প্রতিবাদ করিবেন না- তাহা হইতে সাহাবীদের বিরত রাখিবেন না; বরং নির্বাক ও নিস্তব্ধ হইয়া থাকিবেন, এ কথা ধারণা পর্যন্ত করা যায় না। আর বস্তুতই তাহা সম্ভবও নয়।

দ্বিতীয়ত অন্যায় ও পাপ অনুষ্ঠিত হইতে দেখিয়া চুপ ও নিষ্ত্রিুয় হইয়া থাকিলে রাসূলের মূল কর্তব্যই অসম্পাদিত থাকিয়া যায়। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

(সূরা আল-মায়েদা: আয়াতঃ ৬৭) يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ ۖ وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ

হে রাসূল, তোমার আল্লাহর নিকট হইতে তোমর প্রতি যাহা নযিল হইয়াছে, তাহা যথাযথরূপে পৌঁছাইয়া দাও, যদি তাহা না কর তবে তুমি আল্লাহর রিসালত পৌঁছাবার দায়িত্বই পালন করিলে না।

ইবনে জরীর তাবারী এই পর্যায়ে ইবনে জায়েদের একটি গুরত্বপূর্ণ কথা উদ্ধৃত করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

এই কথা বলা হইত যে, নবী করীম (স) যদি ওহীর মাধ্যমে নাযিল হওয়া কোন জিনিস গোপন করিতে চাহিতেন, তবে তিনি তাঁহার নিজের ‘ক্রটি’ সম্পর্কে অবতীর্ণ সূরা ‘আবাসা ওয়া-তাওয়াল্লা’কে অবশ্যই গোপন করিতেন। [৮****************************************************** ]

বস্তুত নবী করীমের সুরক্ষীত জীবন কাহিনী অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, তিনি জীবনের সংকটপূর্ণ মুহূর্তেও নবুয়্যতের দায়িত্ব পালন করিতে এবং অহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ আল্লাহর কালামকে যথাযথরূপে লোক-সমক্ষে প্রচার করিতে বিন্দুমাত্রও ক্রটি করেন নাই। এই ব্যাপারে তিনি কখনো উপেক্ষা বা দুর্বলতাও প্রদর্শন করেন নাই। ইসলামী দাওয়াতের সূচনায় ইসলাম প্রচারের অভিযান পরিত্যাগ করিলে সেরা সুন্দরী নারী, বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ ও আরবের নিরংকুশ রাজত্ব লাভের প্রলোভনকেও তিনি অম্লান বদনে ও তীব্র ঘৃণা সহকারে প্রত্যাখ্যান করেন। [৯******************************************************] অতএব তিনি কোন মুহূর্তেই যে দ্বীন প্রচার বন্ধ করিতে পারেন নাই, অন্যায়ের প্রতিবাদ হইতে বিরত থাকেন নাই এবং কোন ভূল ও ক্রটি কাহারো মধ্যে দেখিতে পাইলে উহার সংশোধন না করিয়া নিরস্ত হন নাই, তাহাতে একবিন্দু সন্দেহ থাকিতে পারে না। এই কারণে তাঁহার নিজের কথা, কাজ এবং তিনি যে কথা বা কাঝ সমর্থন করিয়াছেন- প্রতিবাদ করেন নাই, তাহার বিবরণ ‘হাদীস’ নাম অভিহিত হইয়াছে।

রাসূলের সম্মুখে সাহাবী কোন কাজ করিলে বা কোন কথা বলিলে তিনি যদি উহার প্রতিবাদ না করিয়া থাকেন, তবে উহার শরীয়াত সম্মত হওয়া সম্পর্কে সাহাবীগণ সম্পূর্ণ একমত ছিলেন এবং হযরতের এই সমর্তন অনুমোদন ও মৌনতাবলম্বনও কোন বিষয়ে শরীয়াতের নির্দেষ জানিবার জন্য অন্যতম সূত্ররূপে গণ্য হইত। এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যাইতে পারে। হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) আল্লাহর নামে ‘হলফ’ করিয়া কোন কথা বলিলে মুহাম্মদ ইবনুল মুনকাদের আপত্তি জানাইলেন। বলিলেনঃ

******************************************************

আপনি আল্লাহর নাম করিয়া হলফ করিতেছেন?

উত্তরে তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

আমি হযরত উমরকে নবী করীম (স)- এর সম্মখে আল্লাহর নামে হলফ করিতে শুনিয়াছি, কিন্তু নবী করীম (স) তাহা অপছন্দ করেন নাই, উহার প্রতিবাদ করেন নাই।[১০********************************************]

হাদীসের সংজ্ঞাদান প্রসঙ্গে প্রামাণ্য গ্রন্হাবলী হইতে কতকগুলি উক্তি এখানে উদ্ধৃত করা যাইতেছে। ইহা হইতে বিষয়টি অধিকতর স্পষ্ট হইবে।

ইমাম সাখাভী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

অভিধানে ‘হাদীস’ (নূতন) ‘কাদীম’ (পুরাতন)-এর বিপরীত অর্থবোধক। আর মুহাদ্দিসদের পরিভাষায় (হাদীস বলিতে বুঝায়) রাসূলের কথা, কাজ, সমর্থন-অনুমোদন এবং তাঁহার গুণ; এমন কি জাগরণ ও নিদ্রাবস্থায় তাহার গতিবিধিও ইহার অন্তর্ভুক্ত।[১১****************************************************** ]

বুখারী শরীফের ভূমিকায় বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

হাদীস এমন জ্ঞান, যাহার সাহায্যে নবী করীম (স)-এর কথা, কাজ এবং তাঁহার অবস্থা জানা যায়।[১২**********]

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী ও নওয়াব সিদ্দীক হাসান লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইলমে হাদীস এমন বিশেষ জ্ঞান, যাহার সাহায্যে নবী করীম (স)- এর কথা কাজ ও অবস্থা জানিতে পারা যায়। [১৩************* রাসূলের কথা বলিতে বুঝায় ************ তাঁহার আরবী ভাষায় উচ্চারিত কথা। ইহা বিভিন্ন প্রকারের হইতে পারে। তাঁহার কাজ বলিতে বুঝায়ঃ**************************************]

মিশাকাতুল মাসাবীহ গ্রন্হের ভূমিকায় শাহ আবদূল আজীজ (র) লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

পূর্বকালের মনীষিগণ সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনের মুখের কথা ও কাজের বিবরণ এবং তাঁহাদের ফতোয়াসমূহের উপর ‘হাদীস নাম ব্যবহার করিতেন। আর দুইটি স্বতন্ত্র সূত্রে বর্ণিত একটি বিবরণকে তাঁহারা দুইটি হাদীস গণনা করিতেন। [১৪****************************************************** ]

নওয়াব সিদ্দীক হাসান (র)- ও এই কথাই বলিয়াছেন। তিনি হাদীসের সংজ্ঞাদান প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

অনুরূপভাবে সাহাবীর কথা, কাজ ও সমর্থন এবং তাবেয়ীর কথা, কাজ ও সমর্থনকেও হাদীস নামে অভিহিত করা হয়।[১৫****************************************************** ]

তবে পার্থক্য এই যে, তিনি ইহাতে তাবে-তাবেয়ীগণের কথা ও কাজের বিবরণকে ‘হাদীস’ বলেন নাই। কিন্তু সাহাবা ও তাবেয়ীগণের ন্যায় তাবে-তাবেয়ীনের কথা, কাজ ও সমর্থনের বিবরণও যে কুরআন হাদীসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং বাস্তব রূপায়ণের দৃষ্টিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় জিনিস, তাহাতে সন্দেহ নাই। হাদীস ও তাফসীরের কিতাবসমূহে এই ধরনের প্রামাণ্য যে সব কথা সাহাবী, তাবেয়ী এ তাবে-তাবেয়ীন হইতে বর্ণিত হইয়িাছে, তাহাকেও এক সঙ্গে হাদীসের পর্যায়ে গণ্য করা হইয়াছে। যদিও ঐসবের পারিভাষিক নাম বিভিন্ন। প্রসিদ্ধ হাদীসবিদ হাফেয সাখাভী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

‘অনুরূপভাবে সাহাবা তাবেয়ীন ও অন্যান্য (তাবে-তাবেয়ী) –র আ-স-র ও ফতোয়াসমূহের প্রত্যেকটিকে পূর্ববর্তী মনীষিগণ ‘হাদীস’ নামে অভিহিত করিতেন’। [১৬******]

অন্যকথায়, নবী করীম (স) সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ী এ তাবে-তাবেয়ীনের কথা, কাজ ও সমর্থনের বিবরণ যদিও মোটামুটিভাবে ‘হাদীস’ নামে অভিহিত হইয়া থাকে- কেননা এই সকলের কথা-কাজ সমর্থন একই মূল বিষয়কে কেন্দ্র করিয়াই চলিত; কিন্তু তবুও শরীয়াতী মর্যাদার দৃষ্টিতে এই সবের মধ্যে পার্থক্য থাকায় প্রত্যেকটির জন্য স্বতন্ত্র পরিভাষা নির্ধারণ করা হইয়াছে। যথা নবী করীমের কথা, কাজ ও সমর্থনকে বলা হয় ‘হাদীস’। সাহাবীদের কথা, কাজ ও সমর্থনকে বলা হয় আ-সা-র ((اثارএবং তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের কথা, কাজ ও সমর্থনের বিবরণকে বলা হয় ‘ফতোয়া’। কারণ কুরআন ও হাদীসের মূলকে ভিত্তি করিয়াই তাঁহাদের এই সব কাজ সম্পন্ন হইত। [এই তিন প্রকারের হাদীসের আরও তিনটি স্বতন্ত্র পারিভাষিক নাম রহিয়াছে; যথাঃ রাসূলের কথা, কাঝ ও সমর্থনের বিবরণকে বলা হয় মারফূ; সাহাবীদের কথা, কাজ ও সমর্থনের বিবরণকে বলা হয় মওকুফ এবং তাবেয়ীদের কথা, কাজ ও সমর্থনকে বলা হয় মকতু।

مقد مة صحيح بخارى ص -13]


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি