হাদীস ও সুন্নাত
হাদীসের অপর নাম হইতেছে ‘সুন্নাত’। ‘সুন্নাত শব্দের অর্থ হইল চলার পথ, কর্মের নীতি ও পদ্ধতি। ইহা ফিকাহশাস্ত্রে প্রচলিত ও উহাতে ব্যবহৃত ‘সুন্নাত’ নহে।

ইমাম রাগেব লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

‘সুন্নাতুন্নবী’ বলিতে সে পথ ও রীতি-পদ্ধতি বুঝায়, যাহা নবী করীম (স) বাছাই করিয়া লইতেন ও অবলম্বন করিয়া চলিতেন। [১৮****] ইহা কখনো ‘হাদীস’ কখনো শব্দের সমার্থকরূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। ‘তা-জুল মাছাদির’ গ্রন্হে লিখিত হইয়াছেঃ

******************************************************

‘সুন্নাত’ অর্থ পথ নির্ধারণ। ‘মুয়ায তোমাদের জন্য পথ নির্ধারণ করিয়াছেন’।

এই হাদীসে ‘সুন্নত’ শব্দ এই অর্থেই ব্যবহৃত হইয়াছে। [*********১৯]

অন্য কথায় নবী করীম (স)-এর প্রচারিত যে উচ্চতম আইন বিধান (Supreme Law) আল্লাহ তা’য়ালার মত ও মর্জি প্রমাণ করে, প্রকাশ করে, তাহাই সুন্নত। আর কুরআনের ভাষায় ****** ‘মহান আদর্শ’ বলিতে এই জিনিসকেই বুঝানো হইয়াছে।রাসূলে করীমের যে ‘মহানতম আদর্শ’ অনুসরণ করিতে আল্লাহ তা’আলা নির্দেশ দিয়াছেন, তাহা এই হাদীস হইতেই জানিতে পারা যায়। এই কারণে মুহাদ্দিসগণ- বিশেষ করিয়া শেষ পর্যায়ের মুহাদ্দিসগণ- ‘হাদীস’ ও ‘সুন্নাত’ কে একই অর্থে ব্যবহার করিয়াছেন। [২০*********] বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

‘সুন্নাত’ শব্দটি রাসূলের কথা, কাজ ও চুপ থাকা এবং সাহাবীদের কথা ও কাজ বুঝায়। [২১*********]

আল্লামা আল-জাজায়েরী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

‘সুন্নাত’ অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাসূলের নামে কথিত কথা, কাজ ও সমর্থন বুঝায়। ইহা বিশেষজ্ঞদের মতে হাদীসের সমার্থবোধক।[২২***********]

আল্লামা আবদুল আজীজ আল-হানাফী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

‘সুন্নাত’ শব্দটি দ্বারা রাসূলের কথা ও কাজ বুঝায় এবং ইহা রাসূল ও সাহাবীদের অনুসৃত বাস্তব কর্মনীতি অর্থেও ব্যবহৃত হয়। [২৩***********]

সফীউদ্দীন আল-হা’লী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

‘সুন্নাত’ বলিতে বুঝায় কুরআন ছাড়া রাসূলের সব কথা, কাজ ও সমর্থন অনুোদন। [২৪************]

এই পর্যায়ে মোট কথা হইল, ‘সুন্নাত’ শব্দটি সম্পর্ণরূপে ও সর্বতোভাবে ‘হাদীস’ শব্দের সমান নয়। কেননা ‘সুন্নাত’ হইল রাসূলের বাস্তব কর্মনীতি, আর ‘হাদীস’ বলিতে রাসূলের কাজ ছাড়াও কথা ও সমর্থন বুঝায়। [এই কারণে ইলমে হাদীসেও বলা হয়ঃ সুফিয়ান সওরী হাদীসের ইমাম, আওজায়ী সুন্নাতের ইমাম, হাদীসের ইমাম নহেন। আর মালিক ইবনে আনাস উভয়ের ইমাম। *****************]

 

হাদীসের বিষয়বস্তু
হাদীসের বিষয়বস্তু কি? কি বিষয় লইয়া উহাতে প্রধানত আলোচনা হইয়াছে? এ বিষয়ে ইলমে হাদীসের বিশেষজ্ঞ সকল মনীষীই একমত হইয়া লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইলমে হাদীসের বিষয়ব্সুত বাআলোচ্য বিষয় হইল রাসূলে করীম (স)- এর মহান সত্তা এ হিসাবে যে, তিনি আল্লাহ তা’য়ালার রাসূল।[২৬ ********************]

অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহ তা’য়ালার মনোনীত ও প্রেরীত ব্যক্তি-রাসূল হিসাবেও এই পদমর্যাদায় অীভষিক্ত থাকিয়া যাহা কিছু বলিয়াছেন, যাহা কিছু করিয়াছেন, যাহা কিছু বলার বা করার অনুমতি দিয়াছেন, সমর্থন জানাইয়াছেন তাহা এবং এ সবের মাধ্যমে রাসূলে-করীমের যে মহান সত্তা বিকশিত ও উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে তাহাই ইলমে হাদীসের বিষয়বস্তু। হাদীসে এই সব বিষয়ই আলোচিত হইয়াছে এবং হাদীস পাঠ করিলে তাহা হইতে এব বিষয়ই জানিতে পারা যায়। রাসূলে করীমের জীবনব্যাপী বলা কথা, কাজ , সমর্থন এবং সাধনা সংগ্রামের বিস্তারিত ও নির্ভরযোগ্য বিবরণও জানিবার একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য উপায় হইতেছে হাদীস।

বস্তুত হাদীস কোন সংকীর্ণ সীমাবদ্ধ, একদেশদর্শী ও ক্ষুদ্র পরিসর সম্পদ নহে। ইহা মূলতই অত্যন্ত ব্যাপক ও বিপুল ভাবধারা সমন্বিত, বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (স) এর মহান নেতৃত্বে আরবভূমিতে যে বিরাট বিপ্লবী আন্দোলন উত্থিত হইয়াছিল তাহার সম্যক ও বিস্তারিত রূপ হাদীস হইতেই সুপরিস্ফুট হইয়া উঠে। রাসূল জীবনের পূর্ণাঙ্গ কাহিনী, তাঁহার ও সাহাবায়ে কিরামের বিপ্লবাত্মক কর্মতৎপরতা, তাদনীন্তন সমাজ সভ্যতা ও আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক পরিস্থিতিতে তাঁহার ব্যাপক ও মৌলিক সংশোধনীর এবং সাধিত সংস্কারের বিবরণও হাদীসের মধ্যেই সামিল।

হাদীসের এ ব্যাপকতা অনস্বীকার্য, ইহার যথার্থতা হৃদয়ঙ্গম করাও কিছুমাত্র কঠিন নহে। পূর্বকালের মনীষিগণও হাদীসের এ ব্যাপক রূপ বুঝিতে পারিয়াছেন। ইমাম বুখারী সংকলিত হাদীসি গ্রন্হ বুখারী শরীফ নামে খ্যাত হইলেও উহার আসল ও পূর্ণাঙ্গ নাম হইলঃ

******************************************************

রাসূলে করীমের কার্যাবলী ও তাঁহার সমসাময়িক যুগের সমস্ত অবস্থা ও ব্যাপারসমূহের বিশুদ্ধ সনদযুক্ত বিবরণের ব্যাপক সংকলন। [২৭****************]

হাদীসের অধ্যয়নের উদ্দেশ্য ও সার্থকতা

হাদীস অধ্যয়নের উদ্দেশ্য কি? কি লক্ষ্য লইয়া হাদীস অধ্যয়ন করা কর্তব্য এবং উহার অধ্যয়নের সার্থকতাই বা কি, ইহাও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী প্রমুখ মনীষী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

উভয় কালের চরম কল্যাণ লাভই হইতেছে হাদীস অধ্যয়নের সার্থকতা।[২৮**********]

নওয়াব সিদ্দীক হাসান লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইহকাল ও পরকালের পরম কল্যাণ লাভই হইতেছে হাদীস অধ্যয়নের লক্ষ্য।[২৯**************]

আল্লামা কিরমানী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

‘কুরআনের পরে সকল প্রকার জ্ঞানের মধ্যে সর্বাধিক উন্নত, উত্তম এবং তথ্য ও তত্ত্বসমৃদ্ধ শ্রেষ্ঠ সম্পদ হইতেছে ইলমে হাদীস। ইহা এই কারণে যে উহার দ্বারাই আল্লাহর কালামের লক্ষ্য ও তাৎপর্য জানিতে পারা যায় এবং আল্লাহর যাবতীয় হুকুম-আহকামের উদ্দেশ্যও উহা হইতেই বুঝিতে পারা যায়। যেহেতু কুরআনের অধিকাংশই-এবং সবই-মোটামুটি ও নীতিকথা মাত্র. আর তাহা হইতে কেবল এজমালী কথাই জানিতে পারা যায়। [৩০]

মোটকথা হাদীষ হইল একটি সভ্যতার পতন এবং এক নবতর সভ্যতার অভ্যুদয়, উত্থান ও প্রতিষ্ঠালাভের ইতিহাস। এ দৃষ্টিতেই হাদীস অধ্যয়ন আবশ্যক।

হাদীসের সংজ্ঞাভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ

হাদীসের উল্লিখিত সংজ্ঞা হইতে উহার তিনটি প্রাথমিক বিভাগ সুপরিস্ফুট হইয়া উঠে। তাহা হইতেছেঃ রাসূলের মুখ নিঃসৃত কথা, তাঁহার নিজের কাজ ও আচরণ এবং তাঁহার সম্মখে অনুমোদনপ্রাপ্ত কথা ও কাজের বিবরণ। সমস্ত হাদীসই এই তিন পর্যায়ে বিভক্ত। কিন্তু উহার বাস্তব গুরুত্ব, প্রয়োগ ও ব্যবহারিক মূল্যের দৃষ্টিতে এই তিন পর্যায়ের হাদীসের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। সর্বপ্রথম স্থান হইল রাসূলের কথার-কোন বিষয়ে রাসূল যাহা নিজে বলিয়াছেন ইসলামী জীবন ব্যবস্থঅর ইহাই প্রথম উৎস। ইহাকে বলা হজয় রাসূলের ‘কাওলী হাদীস’–(*************) ‘কথামূলক হাদীস’, যাহাতে রাসূলের নিজের কোন কথা উদ্ধৃত হইয়াছে।

দ্বিতীয় ভাগে হযরতের নিজস্ব কাজ-কর্ম ও আচার-আচরণের বিবরণ। রাসূল (স) যে দ্বীন ইসলাম লইয়া আসিয়াছিলেন, বাস্তবিক পক্ষে তিনি তাহা অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করিয়াছেন, সে অনুযায়ী প্রত্যেকটি কাজ আঞ্জাম দিয়াছেন। তাঁহার কাজ ও চরিত্রের ভিতর দিয়াই ইসলামের যাবতীয় বিধিবিধান ও রীতিনীতি সুপরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। তাঁহার একটি কাজও ইসলামী শরীয়াতের বিপরীত হইতে পারে নাই। এই কারণে তাঁহার প্রতিটি কাজই ইসলামী শরীয়াতের ভিত্তিরূপে গণ্য হইবার যোগ্য। আর যো হাদীসে রাসূলের রাসূল হিসাবে করা কোন কাজের বিবরণ উল্লিখিত হইয়াছে তাহাকে বলা হয় ‘ফে’লী হাদসী’ (*******)।

আর তৃতীয় হইল রাসূলে করীম (স) এর নিকট অনুমোদন ও সমর্থনপ্রাপ্ত (সাহাবাদের০ কথা ও কাজ। কেননা পূর্বেই বলা হইয়াছে, হযরতের সম্মুখে ইসলামী শরীয়াতের বিপরীত কোন কথা বলা হইলে বা কোন কাজ করা হইলে রাসূল (স) উহার প্রতিবাদ বা নিষেধ না করিয়া পারেন নাই। এই ধরনের কোন কথা বা কাজের বিবরণ হইতেও শরীয়াতেরে দৃষ্টিভঙ্গী নিঃসন্দেহে জানিতে পারা যায়। অতএব ইসলামী শরীয়াতের ইহাও একটি উৎস। যে হাদীসে এই ধরনের কোন ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, তাহা হইতেছে ‘তাকরীরী হাদীস] (**********)।

এখানে বিষয়টি অধিকতর সুস্পষ্ট ও সহজবোধ্য করিয়া তুলিবার উদ্দেশ্যে এই তিন পর্যায়ের তিনটি হাদীস উদ্ধৃত করা যাইতেছেঃ

******************************************************

হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন; হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ ফাসিক ব্যক্তির প্রশংসা ও স্তুতি করা হইলে আল্লাহ তা’য়ালা অসন্তুষ্ট ও ক্রুব্ধ হন এবং এই কারণে আল্লাহর আরধ কাঁপিয়া উঠে। (বায়হাকী)

ইহাতে রাসূলের একটি বিশেষ কথার উল্লেখ হওয়ার কারণে ইহাকে বলা হয় ‘কাওলী হাদীস’।

******************************************************

হযরত আবূ মূসা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমি রাসূলে করীম (স)- কে মোরগের গোশত খাইতে দেখিয়াছে। (বুখারী ও মুসলিম)

এই হাদীসে রাসূলের একটি কাজের বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। এজন্য ইহা ‘ফে’লী হাদীস’।

******************************************************

হযরত ইবনে আবূ আওফা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমরা রাসূলে করীম (স)- এর সঙ্গে মিলিয়া সাতটি লড়াই করিয়াছি। আমরা তাঁহার সঙ্গে থাকিয়া জারাদ (ফড়িং জাতীয় চড়ই) খাইতাম। (বুখারী ও মুসলিম)

ইহা ‘তাকরীরী হাদীস’।

 

বিষয়বস্তুর দৃষ্টিতে হাদীসের প্রকারভেদ
বিষয়বস্তুর দৃষ্টিতে হাদীস কয়েক প্রকারের রহিয়াছে। ইমাম শাফেয়ী (র) বলিয়াছেনঃ হাদীস তিন প্রকারের। কুরআন মজীদে সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লিখিত যেসব বিষয়ে নবী করীম (স) নিজ ভাষায় ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ দান করিয়াছেন তাহা প্রথম প্র্রকারের হাদীস। কুরআন মজীদে মোটামুটি ও অবিস্তৃতভাবে অনেক আইন ও বিধানের উল্লেখ রহিয়াছে, রাসূলে করীম (স) তাহার বিস্তৃত রূপ পেশ করিয়াছেন ও উহার ব্যাখ্যা দিয়াছেন। অনেক সংক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট বিষয়কে তিনি মুসলিমদের সম্মুখে নিজ ভাষায় বিস্তারিত ও সুস্পষ্টরূপে তুলিয়া ধরিয়াছেন।ইহা দ্বিতীয় প্রকারের হাদীস। আর তৃতীয় প্রকারের হইতেছে সেসব হাদীস, যাহাতে রাসূলে করীম (স) কুরআনে অনুল্লিখিত অনেক বিষয়ের উল্লেখ করিয়াছেন। এই তিন প্রকারের হাদীস যেহেতু আল্লাহর নিকট হইতে রাসূলে করীমের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লব্ধ জ্ঞানের আকর, সে কারণে ইহা সবই কুরআনের মতই নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাস্য। [কিতাবুর রিসালা-ইমাম শাফেয়ী (র)]

এই পর্যায়ে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর আলোচনার সারাংশ নিম্নে উদ্ধৃত হইলঃ

নবী করীম (স) হইতে বর্ণিত ও হাদীস-গ্রন্হসমূহে সংকলিত হাদীসসমূহ শরীয়াতী হুকুম গ্রহণের দৃষ্টিতে দুই প্রকারের। রিসালাতের বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্য রাসূলে করীম (স) যত কথাই বলিয়াছেন, তাহা প্রথম প্রকারের। ‘রাসূল যাহা দেন তাহা গ্রহণ কর এবং যাহা হইতে নিষেধ করেন, তাহা হইতে বিরত থাক’- আয়াতটিতে এ প্রকারের হাদীস সম্পর্কেই আল্লাহর নির্দেশ ঘোষিত হইয়াছে। পরকাল ও মালাকুতী জগতের আশ্চর্যজনক বিষয়াদি ও ঘটনাবলী সম্পর্কে রাসূল (স) যাহা বলিয়াছেন, তাহাও এই প্রকারের হাদীস। এই হাদীসসমূহ ওহীর সূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান হইতে নিঃসৃত। শরীয়াতের বিধি-বিধান, ইবাদতের নিয়ম-প্রণালী এবং সমাজ ও জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থাপনার ব্যাখ্যা ও উহার পালনের জন্য উৎসাহ দান সম্পর্কিত হাদীসসমূহও এই পর্যায়ের। তবে উহা কিছু অংশ সরাসরি ওহীর সূত্রে প্রাপ্ত এবং কিছু অংশ স্বয়ং নবী করীমের ইজতিহাদ।অবশ্য নবী করীম (স)-এর রায় কখনো ভুলের উপর স্থায়ী হইয়া থাকিতে পারিত না। তাঁহার ইজতিহাদ আল্লাহর হুকুমের উপরই ভিত্তিশীল হইবে, ইহার কোন প্রয়োজন নাই। কেননা প্রায়ই এমন হইত যে, আল্লাহ তা’য়ালা তাঁহার নবীকে শরীয়াতের উদ্দেশ্য ও লক্ষ জানাইয়া দিতেন; শরীয়াত প্রণয়ন, উহার সহজতা বিধান ও আদেশ-নিষেধ নির্ধারণের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দিতেন; নবী ওহীসূত্রে জানা এই আইন ও নিয়ম অনুযায়ী ওহীর সূত্রে লব্ধ উদ্দেশ্যাবলীর ব্যাখ্যা দান করিতেন। যেসব যুক্তিপূর্ণ ও কল্যাণময় বিষয় বিনা শর্তে পেশ করিয়াছেন, যাহার কোন সময় বা সীমা নির্দিষ্ট করা হয় নাই –যেমন উন্নত ও খারাপ চরিত্র-ইহাও রিসালাতের দায়িত্ব পালন পর্যায়ের এবং ইহার অধিকাংশই ওহীর উৎস হইতে গৃহীত। তাহা এই অর্থে যে, আল্লাহ তা’য়ালা রাসূলকে সমাজ ও জনকল্যাণের নিয়ম-কানুন জানাইয়াদিয়াছেন, নবী সে নিয়ম-কানুন হইতে যুক্তি বা দলিল গ্রহণ করিয়াছেন এবং উহাকে মূলনীতি হিসাবে পেশ করিয়াছেন। আমলসমূহের ফযীলত, আমলকারীদের গুণ ও প্রশংসামূলক হাদীসও এই পর্যায়ে গণ্য। আমার মতে ইহার আধিকাংশই ওহীর সূত্রে প্রাপ্ত, আর কিছু অংশ তাঁহার ইজতিহাদের ফসল। দ্বিতীয় প্রকারের হাদীস রিসালাতের দায়িত্ব পালন পর্যায়ের নহে। রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি একজন মানুষ মাত্র, অতএব তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে আমি যখন কোন জিনিসের আদেশ করি, তখন তাহা তোমরা গ্রহণ করিও- পালন করিও। আর যদি আমার নিজের মতে কোন কাজের আদেশ করি তবে মনে রাখিও, আমি একজন মানুষ মাত্র।

এ বাণীতে রাসূলে করীম (স) দ্বিতীয় প্রকারের হাদীসের কথাই বুঝাইয়াছেন। মদীনার মুসলমানদিগকে অত্যাধিক ফসল লাভের আশায় পুরুষ খোরমা গাছের ডাল স্ত্রী খোরমা গাছের মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দিতে দেখিয়া নবী করীম (স) ‘উহা না করিলে কোন ক্ষতি হইবে না’ বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছিলেন এবং বলিয়াছিলেনঃ

******************************************************

তোমরা ইহা না করিলে সম্ভবত ভালই হইত।

কিন্তু ইহা না করার দরুন পরবর্তী বছর অত্যন্ত কম পরিমাণে ফসল উৎপন্ন হয়। তখন নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

‘আমি একটা ধারণা পোষণ করিতাম, এবং তাহাই তোমাদিগকে বলিয়াছিলাম (ধারণার ভূল হইলে) তোমরা সেজন্য দোষ ধরিও না। কিন্তু আমি যখন আল্লাহর তরফ হইতে কোন কিছু বর্ণনা করি, তখন তোমরা তাহা অবশ্যই গ্রহণ করিবে। কেননা আমি আল্লাহর সম্পর্কে কোন মিথ্যা কথা বলি না’। [এই কয়টি হাদীসই মুসলিম শরীফের ২য় খণ্ডের ২৬৪ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত হইয়াছে।

****************************************************** ]

চিকিৎসা ও দ্রব্যগুণ ইত্যাদি সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) যাহা কিছু বলিয়াছেন, তাহাও এই পর্যায়ের। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হালকা সাদা কপোল বিশিষ্ট গাঢ় কৃষ্ণ ঘোড়া তোমরা অবশ্যই রাখিবে।

ইহা রাসূলের বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের আলোকে বলা কথা।

রাসূল (স) অভ্যাসবশত যাহা করিতেন- ইবাদত হিসাবে নয় কিংবা যাহা ঘটনাবশত করিয়াছেন- ইচ্ছামূলকভাবে নয়, তাহার কোন শরীয়াতী ভিত্তি নাই। হযরত জায়েদ ইবনে সাবিত (রা)-এর নিকট একদল লোক হাদীস শ্রবণের ইচ্ছ প্রকাশ করিলৈ তিনি বলিয়াছেনঃ ‘আমি রাসূলের প্রতিবেশী ছিলাম। তাঁহার প্রতি যখন ওহী নাযিল হইত তখন আমাকে তিনি ডাকিয়া পাঠাইতেন, আমি গিয়া তাহা লিখিয়া লইতাম। তাঁহার অভ্যাস ছিল, আমরা যখন দুনিয়ার বিষয় আলোচনা করিতাম, তখন তিনিও আমাদের সাথে দুনিয়ার কথা বলিতেন। আর যখন পরকালের কথা বলিতাম, তিনিও আমাদের সাথে পরকালের কথা বলিতেন। আমরা যখন খানাপিনার কথা বলিতাম তিনিও আমাদের সাথে তাহাই বলিতেন। এখন আমি কি তোমদিগকে রাসূলের এইসব হাদীস বলিব? এ কথাটি এ প্রসঙ্গেই উল্লেখযোগ্য।

এতদ্ব্যতীত রাসূলের সময়কালীন আংশিক কল্যাণের জন্য অনেক ব্যবস্থা প্রদান করা হইয়াছিল। সমস্ত মানুষের জন্য তাহা কোন চিরন্তীন বিধান ছিল না। ইহার দৃষ্টান্ত এইঃ যেমন কোন বাদশাহ এক সৈন্যবাহিনী সজ্জিত করিয়া উহার কোন নিদর্শন ঠিক করিয়া দেয়। এই দৃষ্টিতে হযরত উমর ফারূক (রা) বলিয়াছিলেনঃ

******************************************************

রমল করার আমাদের কি প্রয়োজন? ইহা আমরা এমন এক শ্রেণীর লোকদিগকে দেখাইবার জন্য পূর্বে করিতাম, যাহাদিগকে আল্লাহ তা’য়ালা ধ্বংস করিয়াছেন।

কিন্তু পরে তিনি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন যে, ‘রমল’ করার অন্য কারণও থাকিত পারে এবং ইহা কিছুতেই পরিত্যাজ্য নহে।

যুদ্ধের বিশেষ পদ্ধতি এবং বিচার ফয়সালার বিশেষ রীতিনীতি ও ধরণ-ধাারণ সম্পর্কিত হাদীসসমূহও এই পর্যায়ের গণ্য।[হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা, ১ম খণ্ড, ১০২ পৃষ্ঠা হইতে উদ্ধৃত।]

যথাযথভাবে সত্য প্রমাণিত হইবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নাই। খেজুর গাছ সম্পর্কিত আরব দেশের প্রচলিত নিয়ম সম্পর্কে রাসূলের নিষেধবাণীও এই পর্যায়েরই কথা ছিল। ইমাম নববী এই প্রসঙ্গে আলোচনা করিতে গিয়া লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

বিশেষজ্ঞদের মতে নবীর এই কথা কোন বিষয়ে সংবাদ দানের পর্যায়ভুক্ত ছিল না; বরং ইহা তাঁহার একটি ধারণামাত্র ছিল।যেমন এই প্রসঙ্গের হাদীসসমূহে উল্লেখিত হইয়াছে। তাঁহারা ইহাও বলিয়াছেন যে, বৈষয়িক ব্যাপারে নবী করীমের মত ও ধারণা আন্যান্য মানুষের মত ও ধারণার মতই। কাজেই এইরূপ ঘটনা সংঘটিত হওয়া- অবাস্তব প্রমাণিত হওয়া- কোন অসম্ভব ব্যাপার নহে এবং ইহাতে কোন ক্রটি বা দোষের কারণ নাই।[নববী, শরহে মুসলিম ২য় খণ্ড, ২৬৪ পৃষ্ঠ]

রাসূলের ইজতিহাদ সম্পর্কে এই কথাও মনে রাখা আবশ্যক যে, যেসব বিষয়ে ওহী নাযিল হয় নাই, সে বিষয়ে রাসূলে করীম (স) ইজতিহাদ করিয়াছেন। এই ইজতিহাদ যদি নির্ভূল হইয়া থাকে, তবে আল্লাহ উহাকে প্রতিষ্ঠিত ও কার্যকর হইতে দিয়াছেন; আর যদি তাহাতে মানবীয় কোন ভূল হইয়া থাকে, তবে আল্লাহ সে বিষয়ে রাসূলকে জানাইয়া দিয়াছেন ও সতর্ক করিয়া দিয়াছেন। কাজেই রাসূলের ইজতিহাদও সুন্নাতের পর্যায়ে গণ্য। হাদীসে এ সব ইজতিহাদের বিবরণ রহিয়াছে। অতএব হাদীস ও রাসূলের ইজতিহাদে কোন মৌলিক পার্থক্য বা বিরোধ নাই।[**************]

কিন্তু দ্বীন ও শরীঅত সম্পর্কিত ব্যাপারে- আকীদা, ইবাদত, নৈতিক চরিত্র, পরকাল, সামাজিক ও তমদ্দুনিক বিষয়ে- রাসূলে করীম (স) যাহা কিছু বলিয়াছেন, তাহা সবই ওহীর উৎস হইতে গৃহীত, তাহা চিরন্তন মূল্য ও স্থায়ী গুরুত্ব স’লিত এবং তাহা কোন সময়ই বর্জনীয় নহে।[হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা, ১ম খণ্ড**********]

 

হাদীসে কুদসী
হাদীসের আর এক প্রকার রহিয়াছে, যাহাকে ‘হাদীসে কুদসী’حديث قدسى বলা হয়। ‘কুদসী’قدسى‘কুদস’قدسহইতে গঠিত ইহার অর্থ الظهر পরিত্রতা, মাহনত্ব। আল্লাহর আর এক নাম ‘কুদ্দুস’قدوس : মহান; পবিত্র। [*******]

এই ধরনের হাদীসকে ‘হাদীসে কুদসী’ বল হয় এইজন্য যে, উহার মূল কথা সরাসরিভাবে আল্লাহর নিকট হইতে প্রাপ্ত। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁহার নবীকে ‘ইলহাম’ কিংবা স্বপ্নযোগে যাহা জানাইয়া দিয়াছেন, নবী নিজ ভাষায় সে কথাটি বর্ণনা করিয়াছেন। উহা কুরআন হইতে পৃথক জিনিস। কেননা কুরআনের কথা ও ভাষা উভয়ই আল্লাহর নিকট হইতে ওহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ। প্রখ্যাত হাদীস ব্যাখ্যাতা আল্লাম মুল্লা আলী আল-কারী ‘হাদীসে কুদসী’র সংজ্ঞা দান প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

হাদীসে কুদসী সেসব হাদীস, যাহা শ্রেষ্ঠ বর্ণনাকারী পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় উজ্জ্বল পরম নির্ভরযোগ্য হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহর নিকট হইতে বর্ণনা করেন, কখনো জিব্রাঈল (আ) এর মাধ্যমে জানিয়া, কখনো সরাসরি ওহী কিংবা ইলহাম বা স্বপ্নযোগে লাভ করিয়া। যে, কোন প্রকারের ভাষার সাহায্যে ইহা প্রকাশ করার দায়িত্ব রাসূলের উপর অর্পিত হইয়া থাকে। [৩৮************]

আল্লামা আবুল বাকা তাঁহার ‘কুল্লিয়াত’ গ্রন্হে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

কুরআনের শব্দ, ভাষা, অর্থ, ভাব ও কথা সবই আল্লাহর নিকট হইতে সুস্পষ্ট ওহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ; আর ‘হাদীসে কুদসী’র শব্দ ও ভাষা রাসূলের; কিন্তু উহার অর্থ, ভাব ও কথা আল্লাহর নিকট হইতে ইলহাম কিংবা স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত।[৩৯**********]

আল্লামা তাইয়্যেবী-ও এই কথা সমর্থন করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

কুরআনের শব্দ ও ভাষা লইয়া জিব্রাঈল (আ) রাসূলে করীমের নিকট নাযিল হইয়াছেন। আর ‘হাদীসে কুদসী’র মূল কথা ইলহাম বা স্বপ্নযোগে আল্লাহ তাহা জানাইয়া দিয়াছেন। (এইজন্য হাদীসে কুদসী আল্লাহর কথারূপে পরিচিত হইয়াছে) কিন্তু এতদ্ব্যতীত অন্যান্য হাদীসকে আল্লাহর কথা বলিয়া প্রচার করেন নাই এবং তাঁহার নামেও সে সবের বর্ণনা করেন নাই।[৪০********]

কুরআন ও হাদীসে কুদসীর পার্থক্য

কুরআন ও হাদীসে কুদসীর মধ্যে যে পার্থক্য রহিয়াছে, তাহা নিম্নরূপঃ

ক) কুরআন মজীদ জিব্রাঈলের মাধ্যম ছাড়া নাযিল হয় নাই, উহার শব্দ ও ভাষা নিশ্চিতরূপে ‘লওহে মাহফুয; হইতে অবতীর্ণ। উহার বর্ণনা পরস্পরা মুতাওয়াতির, -অবিচ্ছিন্ন, নিশ্চিত ও নিঃসন্দেহ; প্রত্যেক পর্যায়ে ও প্রত্যেক যুগে।

খ) নামাযে কেবল কুরআন মজীদই পাঠ করা হয়, কুরআন ছাড়া নামায সহীহ্ হয় না, আর কুরআনের পরিবর্তে হাদীসে কুদসী পড়িলেও নামায হয় না।

গ) ‘হাদীসে কুদসী’ অপবিত্র ব্যক্তি হায়েয নিফাস সম্পন্ন নারীও স্পর্শ করিতে পারে, কিন্তু কুরআন স্পর্শ করা ইহাদের জন্য হারাম।

ঘ) হাদীসে কুদসী কুরআনের ন্যায় ‘মুজিযা’ নহে।

ঙ) হাদীসে কুদসী অমান্য করিলে লোক কাফির হইয়া যায় না- যেমন কাফির হইয়া যায় কুরআন অমান্য করিলে।[৪১***********]

শায়খ মুহাম্মদ আলী ফারুকী হাদীসকে দুই ভাগে ভাগ করিয়াছেন। এক, হাদীসে নববী- রাসূলে করীমের হাদীস; এবং দুই হাদীসে ইলাহী- আল্লাহর হাদীস। আর ইহাকেই বলা হয়, ‘হাদীসে কুদসী’। তিনি লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

‘হাদীসে কুদসী’ তাহা, যাহা নবী করীম (স) তাঁহার আল্লাহ তা’য়ালার তরফ হইতে বর্ণনা করেন, আর যাহা সেরূপ করেন না, তাহা হাদীসে নববী। [৪২************]

‘হাদীসে কুদসী’ কুরআন নয়; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও ইহাতে আল্লাহর কুদসী জগতের মনোমুগ্ধকর ঘ্রাণ মিশ্রিত রহিয়াছে। উহাও গায়েবী জগত হইতে আসা এক ‘নূর’। মাহন প্রতাপসম্পন্ন আল্লাহর দাপটপূর্ণ ভাবধারা উহাতেও পাওয়া যায়। ইহাই ‘হাদীসে কুদসী’। ইহাকে ‘ইলাহী’ বা ‘রব্বানী’ ও বলা হয়। [৪৩************]

প্রাচীনকালের হাদীস গ্রন্হাবলীতৈ হাদীসে কুদসীর বর্ণনা হয় এই ভাষায়ঃ

******************************************************

নবী করীম (স) আল্লাহর তরফ হইতে বর্ণনা করিতে গিয়া বলিয়াছেন………..

আর পরবর্তীকালের মুহাদ্দিগণ ইহা উদ্ধৃত করিয়াছেন এই্ ভাষায়ঃ

******************************************************

আল্লাহ বলিয়াছেন- যাহা নবী করীম (স) তাঁহার নিকট হইতে বর্ণনা করিয়াছেন……..।

বলা বাহুল্য, এই উভয় ধরনের কথার মূল বর্ণনাকারী একই এবং তিনি হযরত মুহাম্মদ (স)।[৪৪***********]

সনদ ও মতন
হাদীসের মূল কথাটুকু যে সূত্রে ও যে বর্ণনা পরস্পরা ধারায় গ্রন্হ সংকলনকারী পর্যন্ত পৌছিঁয়াছে, উহাকে ইলমে হাদীসের পরিভাষায় বলা হয় ‘সনদ’। উহাতে হাদীসের বর্ণনাকারীদের নাম একের পর এক সজ্জিত থাকে। এইজন্য বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

মূল হাদীস পৌছিঁবার পরস্পরা সূত্রই হইতেছে সনদ।[মুকাদ্দামা আল-হাদীস আল-মুহাদ্দিসূন, ২,৩,৪ পৃষ্ঠা।]

বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

হাদীসের সূত্র- উহার বর্ণনাকারী ব্যক্তিগণের পরস্পরাকে সনদ বলে।

******************************************************

হাদীসের মূল কথা ও উহার শব্দসমূহ হইতেছে ‘মতন’।

শায়খ আবদুল হক লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

সনদ সূত্র যে পর্যন্ত পৌছিঁয়াছে উহার পরবর্তী অংশকেই ‘মতন’ বলা হয়।

সনদ বা বর্ণনাকারীদের গুণগত পার্থক্যের দিক দিয়া হাদীসকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথম ভাগে সেই সব হাদীস, যাহা ‘হাফেযে মুতকিন’ (নির্ভূলভাবে স্মরণ রাখিতে সক্ষম হাদীসের এমন হাফেয) লোকদের মাধ্যমে বর্ণিত হইয়াছে। দ্বিতীয় সেই সব হাদীস, যাহার বর্ণনাকারী অপ্রসিদ্ধ এবং স্মরণ ও সতর্কতার মধ্যম মানের লোক। আর তৃতীয় হইতেছে সে সব হাদীস, যাহা বর্ণনা করিয়াছে দুর্বল ও গ্রহণ অযোগ্য এবং অগ্রাহ্য লোকেরা। [৪৬*****************]

হাদীসসমূহের সনদভিত্তিক বিভাগ

হাদীসের সনদ- বর্ণনা পরম্পরা ধারা যে স্তর পর্যন্ত পৌছিয়াছে ও তাহা যেভাবে পৌছিঁয়াছে, এই দৃষ্টিতে হাদীসকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করা হইয়াছে এব উহার প্রত্যেকটি ভাগেরে এক একটি পারিভাষিক নাম দেওয়া হইয়াছে। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা যাইতেছেঃ

১। মারফূঃ যেসব হাদীসের বর্ণনা পরম্পরা রাসূল (স) পর্যন্ত পৌছিঁয়াছে, যে সূত্রৈ মাধ্যমে স্বয়ং রাসূলের কোন কথা, কোন কাজ করার বিবরণ কিংবা কোন বিষয়ের অনুমোদন বর্ণিত হইয়াছে, যে সনদের ধারাবাহিকতা রাসূলে করীম (স) হইতে হাদীস গ্রন্হ সংকলনকারী পর্যন্ত সুরক্ষিত হইয়াছে এবং মাঝখান হইতে একজন বর্ণনাকারীও উহ্য হইয়া যায় নাই তাহা ‘হাদীসে মারফূ’حديث نرفوع নামে পরিচিত।

ইমাম নববী উহার সংজ্ঞা দিয়াছেন নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ

******************************************************

‘মারফূ’ সেই হাদীস, যাহা বিশেষভাবে রাসূলের কথা-তিনি ছাড়া অপর কাহারো কথা নয়-বলিয়া বর্ণিত’।[৪৭********]

ইবনে সালাহ লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

যে কথা রাসূলের, অপর কাহারো নয়-কোন সাহাবীরও নয়, তাহাই ‘হাদীসে মারফূ’ নামে পরিচিত।[৪৮********]

দৃষ্টান্ত দ্বারা ইহা স্পষ্ট বুঝিতে পারা যাইবে। যেমন কোন সাহাবী বলিলেনঃ

******************************************************

রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলে করীম (স)-কে এইরূপ বলিতে শুনিয়াছি-

এইরূপ বর্ণনাসূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহ ‘হাদীস মারফূ কাওলী’ নামে পরিচিত।

কিংবা কোন সাহাবী বলিলেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলে করীম (স)-কে এইরূপ করিতে দেখিয়াছি।

ইহা ‘হাদীসে ‘মারফূ ফে’লী’ নামে পরিচিত। কেননা ইহা সাহাবীর বর্ণনাতে নবী করীমের কোন কাজের বিবরণ পেশ করে।

বা কোন সাহাবী বলিলেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলে করীম (স)-এর উপস্থিতিতে এইরূপ কাজ করিয়াছি কিন্তু তিনি ইহার প্রতিবাদ করেন নাই।

ইহা ‘হাদীসে মারফূ ‘তাকরীরী’ নামে পরিচিত। নবী করীমের সামনে কোন কাজ করার এবং তাঁহার নিষেধ না করার কথা বলা হইয়াছে এই হাদীসে।

২। যে সব হাদীসের বর্ণনাসূত্র (সনদ) ঊর্ধ্বদিকে সাহাবী পর্যন্ত পৌছিয়েঁছে-কোন সাহাবীর কথা কিংবা কাজ বা অনুমোদন যেসব সনদসূত্রে বর্ণিত হইয়াছে, তাহা ‘হাদীসে মওকুফ’ নামে অভিহিত। ইমাম নববী ইহার সংজ্ঞা দিয়াছেন এই ভাষায়ঃ

******************************************************

যাহাতে কোন সাহাবীর কথা বা কাজ কিংবা অনুরূপ কিছু বর্ণিত হয়- তাহা পরপর মিলিত বর্ণনাকারীদের দ্বারা বর্ণিত হউক কিংবা মাঝখানে কোন বর্ণনাকারীর অনুপস্থিতি ঘটুক- তাহা ‘মওকুফ হাদীস’।

৩। যে সনদসূত্রে কোন তাবেয়ী’র কথা, কাজ বা অনুমোদন বর্ণিত হয়, তাহা ‘হাদীসে মকতু’ নামে পরিচিত। ইমাম নববী বলিয়াছেন **************** তাবেয়ী পর্যন্ত যাহার সূত্র পৌছিঁয়াছে, তাহাই ‘হাদীসে মকতু’।[৪৯**********]

৪। যেসব হাদীসের সনদে উপর হইতে নিচ পর্যন্ত ধারাবাহিকতা পূর্ণরূপে রক্ষিত হইয়াছে, কোন স্তরেই কোন বর্ণনাকারী উহ্য হয় নাই, উহাকে ‘হাদীসে মুত্তাসিল’ ********** বলা হয়।

৫। যেসব হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয় নাই, মাঝখানের কোন বর্ণনাকারী যদি উহ্য বা লুপ্ত হইয়া থাকে, তাহাকে ‘হাদীসে মুনকাতা’حديث منقطع বলা হয়। [৫০************]

হাদীস বর্ণনাকারীদের নিজস্ব গুণ-পার্থক্যের দৃষ্টিতেও হাদীসের কতকগুলো বিভাগ হইয়া থাকে এবং উহাদের প্রত্যেকটিরই এক-একটি পারিভাষিক নাম দেওয়া হয়। যথাঃ

১। যে হাদীসের বর্ণনাসূত্র ধারাবাহিক রহিয়াছে, সনদের প্রত্যেক স্তারের বর্ণনাকারীর নাম সঠিকরুপে উল্লিখিত হইয়াছে, বর্ণনাকারিগণ সর্বতোভাবে বিশ্বস্ত- সিকাহ, যাহাদের স্মরণ শক্তি অত্যন্ত প্রখর এবং যাঁহাদের সংখ্যা কোন স্তরেই মাত্র একজন হয় নাই, এইরূপ হাদীসকে পরিভাষায় ‘হাদীসে সহীহ’ ********* বলা হয়।

ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

যে হাদীসের সনদ নির্ভরযোগ্য ও সঠিকরূপে সংরক্ষণকারী বর্ণনাকরীদের সংযোজনে পরম্পরাপূর্ণ ও যাহাতে বিরল ও ক্রটিযুক্ত বর্ণনাকারী একজনও নাই, তাহাই ‘হাদীসে সহীহ’।[৫১********]

২। উপরিউক্ত সকল গুণ বর্তমান থাকার পর বর্ণনাকারীদের স্মরণ-শক্তি যদি কিছুটা দুর্বল প্রমাণিত হয়, তবে সেই হাদীসের পারিভাষিক নাম ‘হাদীসে হাসান’ (********)।

ইহার সংজ্ঞাদান প্রসঙ্গে ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

যে হাদীসের উৎস সর্বজনজ্ঞাত ও যাহার বর্ণনাকারীগণ প্রখ্যাত, তাহাই হাদীসে হাসান।[৫২**********]

৩। উপরিউক্ত সবরকমের গুণই যদি বণনাকারিদের মধ্যে কম মাত্রায় পাওয়া যায়, তবে তাহাদের বর্ণিত হাদীসকে ‘হাদীসে যয়ীফ’ *********** বলা হয়।

ইমাম নববী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

যাহাতে সহীহ্ ও হাসান হাদীসের শর্তসমূহ পাওয়া যায় না তাহাই ‘যয়ীফ হাদসী’।[৫৪*******]

বর্ণনাকারীদের সংখ্যাভিত্তিক হাদীস বিভাগ

হাদীসের বর্ণনাকারীদের সংখ্যা সকল ক্ষেত্রে একই রূপ হয় নাই। বিভিন্ন হাদীসে বর্ণনাকারীদের সংখ্যা বিভিন্ন হইয়াছে। এই দিক দিয়া হাদীসের কয়েকটি বিভাগ এবং প্রত্যেকটি বিভাগের এক একটি পারিভাষিক নাম রহিয়াছে। এইখানে এই বিভাগগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ উল্লেখ করা যাইতেছে।

১। মুতাওয়াতির (*****) যে হাদীসের সনদের সকল স্তরেই বর্ণনাকারীদের সংখ্যা এত বেশী যে, তাঁহাদের সকলের একত্রিত হইয়া মিথ্যা কথা রচনা বা বলা স্বভাবতই অসম্ভব বলিয়া মনে হয়, এইরূপ হাদীসকে ‘হাদীসে মুতাওয়াতির’ বলা হয়। যেমন হাদীস ******************** সকল আমলের মূল্যায়ন নিয়ত অনুযায়ীই হয়। এই হাদীসটি সাত শতেরও অধিক সনদসূত্রে বর্ণিত হইয়াছে।[ ৩-شرح النخبة ص মুহাদ্দিসগণ সাধারণত ‘মুতাওয়াতির’ হাদীসকে এই পারিভাষিক নামে অভিহিত করেন না। কেননা কোন হাদীসের ‘মুতাওয়াতির’ হওয়াটা সনদের আলোচনা পর্যায়ে গণ্য হয় না। তাহার কারণ এই যে, সনদশাস্ত্রে সাধারণত হাদীসের ‘সহীহ’ বা ‘যয়ীফ’ হওয়ার ব্যাপারটিই আলোচ্য- যেন হয় তদনুযায়ী আমল করা যায়, না হয় যেন উহা ত্যাগ করা যায়। উপরন্তু মুতাওয়াতির হাদীসের বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয় না। তদনুযায়ী আমল করা আলোচনা ব্যতিরেকেই ওয়াজিব। علوم الحديث ومصطله وشرح النخبة ج-3 ص- 150 ]

২। খবরে ওয়াহিদ (***********) যে হাদীসের বর্ণনাকারীদের সংখ্যা ও সনদ ‘মুতাওয়াতির’ হাদীস অপেক্ষা কিছুটা কম, তাহা ‘খবরে ওয়াহিদ’। এই ধরনের হাদীস তিন প্রকারের হইয়া থাকেঃ

ক. সাহাবীদের পরবর্তী স্তরসমূহের কোন স্তরে বর্ণনাকারীদের সংখ্যা যদি তিনজন হইতে কম না হয়, তবে তাহা ‘হাদীসে মশহুর’ (*************)।

খ. কোন স্তরেই যদি বর্ণনাকারীদের সংখ্যা দুইজনের কম না হয়, তবে তাহা ‘হাদীসে আযীয’ (**********)।

গ. কোন স্তরে যদি বর্ণনাকারীদের সংখ্যা মাত্র একজন হয়, তবে সেই হাদীস ‘ হাদীসে গরীব’ (*************) নামে পরিচিত।

 

জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল সূত্র
জ্ঞান এবং বিদ্যার অর্থই হইতেছে অজানাকে জানা। যাহা অজ্ঞাত, যাহা মানুষের জ্ঞান-সীমার বহির্ভূত, তাহা জানিয়া লওয়া এবং উহার সকল দিক সম্পর্কে অবহিত হওয়াকেই বলা হয় জ্ঞান। বস্তুর জ্ঞান ও বিদ্যা হইতেছে আলো। আলোর স্ফুরণেই অন্ধকারের অবসান। জ্ঞান ও বিদ্যা মানব-মনের অজ্ঞতার পুঞ্জীভূত অন্ধকার বিদূরিত করিয়া দেয়, অন্তঃকরণকে করে আলোকোজ্জ্বল, জ্ঞানের মহিমায় সুষমামণ্ডিত।

কিন্তু কতগুলি তত্ত্ব ও তথ্যের সমারোহই জ্ঞান নয়। নির্ভরযোগ্য ও সংশয়াতীত সূত্রে লব্ধ সত্য তত্ত্ব ও তথ্যই হইতেছে প্রকৃত জ্ঞান। যে তত্ত্ব ও তথ্য সত্যভিত্তিক নয় এবং যাহা নির্ভযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত নয়, তাহা সংশয়াপন্ মানসলোককে মেঘমুক্ত করিতে পারে না, তাহা যেমন মানুষের কোন কল্যাণ সাধন করিতে পারে না, তেমনি ‘জ্ঞান’ নামে অভিহিত হওয়ারও সম্পূর্ণ অযোগ্য। এইরূপ জ্ঞানের উপর নির্ভর করিয়াজীবন-পথে পদবিক্ষেপ করা এবং অকুন্ঠিত চিত্তে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয় না। এই জন্য এমন জ্ঞান ও বিদ্যা মানুষের জন্য প্রয়োজন, যাহা সর্বতোভাবে সত্য ও নির্ভরযোগ্য, অকাট্য ও নিশ্চিত সূত্রে প্রাপ্ত। এইরূপ জ্ঞানই মানুষের মন ও মগজকে নিঃসংশয়, দৃঢ়-নিশ্চিত ও আলোকোদ্ভাসিত করিয়া তোলে। জীবন-পথের প্রতিটি বাঁক- প্রত্যেকটি চরাই-উতরাই পর্যন্ত দৃষ্টিপথে সমুদ্ভাসিত করিয়া দেয়। এইরূপ জ্ঞান ব্যতীত আমাদের না জৈব জীবন সঠিকরূপে চলিতে পারে, না মানুষ হিসাবে দুনিয়ায় বসবাস করা সম্ভব হয়।

কিন্তু এইরূপ জ্ঞান মানুষ কোথায় পাইবে? কোন সূত্রে এইরূপ জ্ঞান লাভ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব? ইহা এক কঠিন প্রশ্ন। এই সম্পর্কে একটু গভীরভাবেই আমাদিগকে বিচার-বিবেচনা ও আলোচনা-পর্যালোচনা করিয়া দেখিতে হইবে।

নির্ভূল, অকাট্য ও নির্ভরযোগ্য জ্ঞান-অর্জনের জন্য মানুষকে স্বাভাবিকভাবেই যেসব উপায় ও সূত্র দান করা হইয়াছে, তন্মধ্যে বাহ্যিক ও প্রাথমিক সূত্র হইতেছে মানুষের পঞ্চেন্দ্রিয়। কিন্তু এই পঞ্চেন্দ্রিয় একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্তই মানুষের জন্য পরিধির সমাপ্তি। উহার বহির্ভূত কোন জ্ঞানই মানুষকে দেওয়া সাধ্যাতীত। উপরন্তু পঞ্চেন্দ্রিয় লব্ধ জ্ঞান যে সর্বতোভাবে নির্ভূল ও সম্পূর্ণ সংশয়মুক্ত, তাহা নিশ্চঢ করিয়া বলা সম্ভব নয়। ইহা মানুষকে অনেক সময় নিতান্ত ভূল তথ্য পরিবেশন করে, মানুষকে প্রতারিতও করে কখনো কখনো। মানুষ রোগাক্রান্ত হইলে তাহার রুচিবিকৃতি ঘটে, মুখ বিস্বাদ হইয়া যায়, মিষ্টি হইয়া যায় তিক্ত। দ্রুতগতিশীল রেলগাড়ীর আরোহীর দৃষ্টি প্রতারিত হয়, দুই পার্শ্বের স্থায়ীভাবে দণ্ডায়মান দৃশ্যাবলী বিপরীত দিকে দুরন্ত বেগে ধাবমান বলিয়া মনে হয়। চলমান জাহাজ মনে হয় স্থির, দণ্ডায়মান। এক বিন্দু অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সরল ঋজু-পথে তীব্র গতিতে ছুটিয়া চলিলে উহা একটি একটানা জ্বলন্ত অগ্নিরেখা বলিয়া মনে হইবে, আর বৃত্তাকারে চলিলে মনে হইবে একটি অগ্নিবৃত্ত। দূর ঊর্ধ্বলোকরে বৃহদায়তন নক্ষত্ররাশিকে ক্ষুদ্রাকায় ও মিটমিট করা ক্ষীণ দ্বীপশিখা বলিয়া মনে হওয়া একটি সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু তাহা প্রকৃত পক্ষেও কি সেইরূপ?

মানুষের জ্ঞানার্জনের দ্বিতীয় সূত্র হইতেছে অন্তর্নিহিত বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, চিন্তা-গবেষণা, যুক্তির ভিত্তিতে বিচার-বিবেচনা। ইহা মূলত প্রথম পর্যায়ের জ্ঞান-সূত্র লব্ধ তথ্যের ভিত্তিতেই জ্ঞা পরিবেশন করে। সংগৃহীত তথ্যের উপর অজনা জ্ঞানের প্রাসাদ নির্মাণ করে। আয়ত্তাধীন তথ্যবস্তু জগত হইতে সংগৃহীত হইলে উহার ভিত্তিতে লব্ধ জ্ঞান অনেকটা সন্দেহ বিমুক্ত হইতে পারে। আর বস্তু বিজ্ঞানের (Physical Science) মূল ক্ষেত্রে ইহাই। কিন্তু বস্তু-অতীত তথ্যভিত্তিক জ্ঞান নিছক ধারণা অনুমান ছাড়া আর কিছুই নয়। যাবতীয় মানব-রচিত মতাদর্শ ও দর্শন ইহারই উৎপাদন। ইহা যেমন সম্পূর্ণ সন্দেহমুক্ত নয়, তেমনি ইহাতে মতবৈষম্য সৃষ্টিরও যথেষ্ট অবকাশ বিদ্যমান। আধুনিক দার্শনিক চিন্তাধারা ও মতাদর্শ এই কারণেই চরমভাবে দুর্দশাগ্রস্ত।

বসউতু জগতের সহিত সম্পর্কহীন যে জ্ঞান, তাহার স্থান ইহার পর। ইহা যদিও বস্তু-অতীত জ্ঞান, তথাপি ইহা বস্তুনিষ্ঠ মন ও মগজের সূক্ষ্ম দর্পণের উপরই প্রতিফলিত ও প্রতিবিম্বিত হয়। প্রথম পর্যায়ের জ্ঞান যেমন প্রত্যক্ষ্যভাবে বস্তু নির্ভর, এই দ্বিতীয় পর্যায়ের জ্ঞানও তেমনি মানুষের মন ও আধ্যাত্মিক শক্তির সহিত সংশ্লিষ্ট।

এই শেষোক্ত জ্ঞানসূত্রের কয়েকটি স্তর রহিয়াছে- ফিরাসত, (Insight observation) হদস্, (Conjecture) কাশফ, ইলহাম ও ওহী। ফিরসাত অর্থ দূরদৃষ্টি অন্তদৃষ্টি- ইহা একটি স্বভাবজাত প্রতিভা। ইহার সাহায্যে যে সব কথাবার্তা বলা হয়, সাধারণ মানুষের মনে তাহা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। ইহার পর ‘হদস’। ইহা একান্তুভাবে মানস চর্চা ও মননশীলতার ফল, যাকে আরা বলি প্রজ্ঞা। কাশফ অর্থ উদঘাটন, কোন অজ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে অন্তর্লোকে জ্ঞানের স্ফূরণ হওয়াই হইল ‘কাশফ’। ইহার উত্তম দৃষ্টান্ত স্বপ্ন। তবে পার্থক্য এই যে, স্বপ্ন নিদ্রার মধ্যে সম্ভব; কিন্তু ‘কাশফ’ হয় জাগ্রত ও সচেতন অবস্থায়। ‘ইলহাম’ অর্থ, মনে কোন জ্ঞানে সঞ্চার হওয়া। কোন চেষ্ট যত্ন ব্যতীতই মানসপটে জ্ঞানের আলো জ্বলিয়া উঠা। ‘ওহী’ এই পর্যায়ের সর্বোচ্চ জ্ঞানসূত্র। লোকচক্ষুর অন্তরালে অদৃশ্য উপায়ে ব্যক্তিকে বিশেষ কোন লোকাতীত ও সন্দেহমুক্ত জ্ঞান দানই হইতেছে ‘ওহী’। জ্ঞানলাভ ও তত্ত্ব পরিবেশনের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক উপায় এবং জ্ঞান সূত্রের নির্ভরযোগ্য সর্বশেষ সীমা ইহাই।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি