Anti-thesis: বিরোধ, প্রতিশক্তি
বস্তজগতে নিত্যপ্রবাহিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক হচ্ছে প্রতিশক্তির দ্বন্দ্ব বা বিরোধে সম্পর্ক। বিরোধ হচ্ছে বস্তজগতের গতির মূল নিয়ামক। বিরোধ বা দ্বন্দ্বের মাধ্যমে বস্তজগতের বিকাশকে সাধারণত ইংরেজিতে থিসিস, এ্যাণ্টিথিসিস এবং সিনথেসিসরূপে প্রকাশ করা হয়। দ্বন্দ্বমান দুটি বস্তু বা অবস্থার একটিকে থিসিস এবং অপরটি এ্যাণ্টিথিসিস বলা হয়। থিসিস এবং এ্যাণ্টিথিসিসের দ্বন্দ্ব নিষ্ফলভাবে কার্যরত থাকে না। এই দ্বন্দ্ব কালক্রমে বস্তুর মধ্যে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়। এই নতুন অবস্থাকে সিনথেসিস বলা হয়। সিনথেসিসও আবার স্থায়ীভাবে থিনথেসিস থাকে না। সিনথেসিসই কালক্রমে আবার থিসিস এবং এ্যাণ্টিথিসিসের উদ্ভব ঘটায়। সূত্রটি আমরা অস্তি, নাস্তি এবং সমন্বিত অস্তিত্ব বা সমন্বস্তি বলেও প্রকাশ করতে পারি। মানব সমাজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশের পর্যায়ক্রমিক ধারাকে মাকর্সবাদীগণ দ্বন্দ্বের এই সূত্র দ্বারা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন।
Anrithesis of Mental and Physical Labour: মানসিক ও দৈহিক শ্রমের বিরোধ
শ্রমের বিভাগ কথাটি আজ অত্যান্ত সুপরিচিত। শ্রমের ক্ষেত্রে মানসিক ও দৈহিক শ্রমের বিভাগটিও পরিচিত। কিন্তু সভ্যতার আদিতে শ্রমের কোনোরূপ বিভাগই ছিল না। অনুন্নত অবস্থায় জীবন রক্ষার্থে প্রত্যেক ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় সমস্ত শ্রমই করতে হতো। কিন্তু প্রকৃতিকে অধিকতর পরিমাণে বশ করার প্রয়োজনে মানুষ একদিন শ্রম বিভাগের আবশ্যকতা বোধ করল। দৈহিক শ্রমের ক্ষেত্রে অল্প শ্রম এবং অধিক শ্রমের কাজের পার্থক্য প্রথমে শুরু হয়। এই শ্রম বিভাগের উদ্ভব ঘটে দাস সমাজে। অর্থ্যাৎ এক মানুষ অপর মানুষকে শক্তির জোরে অধীনস্থ করে নিজের স্বার্থে খাটাবার কৌশল যেদিন আবিষ্কার করেছে, সেদিন থেকে প্রভু এবং দাসের শ্রমে পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। প্রভু-শ্রেণীর শ্রম তখন থেকে দৈহিক থেকে মস্তিষ্কের ব্যবহারজনিত শ্রমে রুপান্তরিত হতে থাকে। প্রয়োজনের তাগিদে যেমন এই শ্রমবিভাগের উৎপত্তি তেমনি সমাজের অর্থনৈতিক বিকাশ এবং প্রকৃতিকে জয় করার সংগ্রামে আদিতে এ বিভাগ প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে শ্রমবিভাগ, বিশেষ করে মানসিক ও দৈহিক শ্রমের বিভাগ শ্রেণীগত এবং বংশগতভাবে অপরিবর্তনীয় হতে শুরু করায় শ্রমের বিভাগ মানুষের সামগ্রিক শক্তির বিকাশের সহায়ক না হয়ে তার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে শুরু করে। একদিকে শ্রমবিভাগের আবশ্যকতা, অপরদিকে শ্রমবিভাগের অপরিবর্তনীয়তা সমাজের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি করেছে। এই বিরোধ শ্রেণীবিরোধে রূপান্তরিত হয়ে সামাজিক বিপ্লবের উৎস হিসাবে কাজ করেছে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তবাদী দর্শন এরূপ অভিমত পোষণ করে যে, অর্থনৈতিকভাবে শ্রেণীহীন সমাজেই কেবল শ্রমবিভাগের অবাঞ্ছিত বিরোধাত্মক বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হতে পারে। এরূপ সমাজে শ্রমবিভাগের দৈহিক ও মানসিক শ্রমের কোনো অপরিবর্তনীয় বিভাগ থাকবে না। এরূপ বিভাগ বংশগতও হবে না। সমাজের ব্যক্তিমাত্রই জ্ঞান-বিজ্ঞানের কলাকৌশলের এরূপ অধিকারী হবে না, কোনো শ্রেণী শুধুমাত্র দৈহিক শ্রমে এবং অপর কোনো শ্রেণী শুধুমাত্র মানসিক অর্থ্যাৎ মস্তিষ্কের শ্রমে নিয়োজিত থাকবে না। ফলে মানসিক শ্রম এবং তার পরিফল কোনো বিশেষ শ্রেণীরই করায়ত্ত থাকবে না।
Antinomy: বিরোধী সিদ্ধান্তের সমস্যা
একই যুক্তি থেকে পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তের উদ্ভব হলে সিদ্ধান্তের সমস্যার সৃষ্টি হয়। প্লেটো, এ্যারিস্টটল, জেনো প্রমুখ প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকের রচনায় পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তমূলক দৃষ্টান্তের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। গতি এবং সংখ্যার যুক্তিতে যে পরস্পর-বিরোধীতার অবকাশ রয়েছে, দর্শিনিক জেনো তা দৃষ্টান্ত সহযোগে প্রমাণ করেন। গতি সম্পর্কে জেনোর দৃষ্টান্ত বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছে। জেনো বলেন যে, একটি তীর গতিশীল বলার অর্থ তীরটির একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে একটি নির্দিষ্ট স্থানে থাকা এবং না থাকা। তীরটি যদি একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে তবে উক্ত মুহূর্তে তীরটি গতিশীল নয়। অপরদিকে তীরটি যখন গতিময়, তখন কোনো বিশেষ মুহূর্তে কোনো বিশেষ স্থানে তার অবস্থান ঘটতে পারে না। কারণ অবস্থিতি মানে গতিশূন্যতা। ফলে অবস্থান হলে গতি থাকে না। আবার গতি থাকলে অবস্থান থাকে না। এ-যুক্তিতে দেখা যায় যে, তীরের গতি আছে বা গতিময় তীর-এর সত্যটি আমাদের পক্ষে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। আধুনিক কালে কাণ্টের দর্শনে পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তমূলক সমস্যার বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায়। পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তের পদ্ধতি দ্বারা কাণ্ট তাঁর সত্তার অজ্ঞেয়তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। কাণ্টের সত্তার অজ্ঞেয়তার মূল কথা হলো এই যে, মানুষের জ্ঞানের মাধ্যম হচ্ছে বুদ্ধি। কিন্তু ইন্দ্রিয়কে অতিক্রম করতে পারে না। অপরদিকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতাই সত্তা নয়। চরম সত্তা ইন্দ্রিয় অতিক্রান্ত অস্তিত্ব। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সেই চরমসত্তা বা বস্তুর বস্তৃত্ব অনুধাবন করার প্রচেষ্টায় বিশ্বজগৎ সসীম এবং অসীম, যা জটিল তা অ-জটিলের সংযোগ এবং কোনো কিছুই অ-জটিল নয়; বিশ্ব সংসারে মানুষ স্বাধীন; বিশ্বসংসারে মানুষ স্বাধীন নয় এবং বিশ্বের সৃষ্টির মূলে কারণ আছে; বিশ্বের সৃষ্টির মূলে কোনো কারণ নেই এরূপ পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তের উদ্ভব হয়। পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তের উপরোক্ত সমস্যায় যেটি লক্ষ রাখা আবশ্যক সে হচ্ছে এই যে, জ্ঞানের প্রক্রিয়ায় এরূপ সিদ্ধান্তের উদ্ভব কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। জ্ঞান মানুষের একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। উক্ত প্রক্রিয়ায় এক সময়ে যা সত্য অপর সময়ে তা অসত্য হয়ে যেতে পারে। সত্য এবং অ-সত্যের দ্বন্দ্বের মাধ্যমেই জ্ঞান অগ্রসর হয়। মানুষ সসীম। আবার সেই সসীম মানুষের সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, বিশ্ব অসীম। এখানে আপাতদৃষ্টিতে একটি পরস্পর-বিরোধীতার উদ্ভব ঘটছে সসীম যদি অসীমকে জানতে না পারে তা হলে ‘বিশ্ব যে অসীম’ এ কথা সে জানল কি করে; আবার সে যদি জেনেই থাকে যে, বিশ্ব অসীম তা হলে সে জ্ঞাত বিশ্বকে আর অসীম বলা যায় কেমন করে? বস্তুত মানুষ যা জেনেছে তাই তার জ্ঞাত; যা সে জানে নাই তাই অজ্ঞাত এবং অসীম। কিন্তু যা অসীম তাকে মানুষ জ্ঞাত হয়ে যে অসীম বলছে একথা যেমন সত্য নয়, তেমনি যা জ্ঞাত তাতেই জ্ঞেয় জগতের শেষ নয়; জ্ঞাত-র বাইরে রয়েছে অজ্ঞাত অর্থ্যাৎ অসীম জ্ঞানের জগৎ। সে জগৎও মানুষ ক্রমান্বয়ে জ্ঞাত হবে। এ বিচারে জ্ঞানের জগৎ সসীম এবং অসীম, উভয় কথাই সত্য। এখানে পরস্পর-বিরোধীতার সমস্যা যথার্থ নয়, বাহ্য। দর্শনের ইতিহাসে এই পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তের দৃষ্টান্ত দ্বারা অজ্ঞেয়বাদকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস বিভিন্ন যুগে দেখা গেছে। ভাববাদ যে এরূপ দৃষ্টান্ত দ্বারা চরম সত্তাকে জ্ঞানের বাইরে রাখার চেষ্টা করেছে, কাণ্টের মধ্যেই তার প্রকৃষ্টতম উদাহরণ মেলে।
Anti-Semitism: ইহুদি বিদ্বেষ
ইহুদি বিদ্বেষ প্রচণ্ডরূপ ধারণা করে হিটলারের নাজিদল শাষিত জার্মানিতে বিংশ শতকের তৃতীয় দশকে। নাজিগণ জার্মান দেশে শাসনের মূলনীতি হিসাবে আর্যজাতি তত্ত্বকে গ্রহণ করে। জার্মানগণ আর্য এবং জার্মানির অর্থনীতি শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে প্রভাবশালী সম্প্রদায় ইহুদিগণ অনার্য এবং বিশুদ্ধ জার্মানদের চাইতে হীন-এই বিদ্বেষমূলক তত্ত্বের ভিত্তিতে নাজিসরকার ইহুদির বিরুদ্ধে নানা প্রকার আইন-কানুন প্রণয়ন করতে থাকে। প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের মূলে ইহুদিরা, তারা জার্মানির অর্থনীতিক দুর্দশার কারণ, ইহুদিদের রক্ত অপবিত্র এই অভিযোগ তুলে হিটলারের সরকার জার্মানির ইহুদি সম্প্রদায়কে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতে শুরু করে। ক্রমান্বয়ে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আশঙ্কা যত ঘনীভূত হতে থাকে তত ইহুদিদের বিরুদ্ধে নির্যাতন বৃদ্ধি পেতে থাকে। সমস্ত প্রকার নাগরিক অধিকার থেকে ইহুদি সম্প্রদায়ের লোকদের বঞ্চিত করা হয়। তাদের সঙ্গে খাস জার্মানদের বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৩৯ সালে হিটলার বিভিন্ন দেশ আক্রমণ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটালে জার্মানির অভ্যন্তরে ইহুদি নির্যাতন চরম আকার গ্রহণ করে। সমস্ত ইহুদি সম্প্রদায়কে বলশেভিক বা সাম্যবাদের অনুচর আখ্যা দেওয়া হয় এবং নাজিরা ব্যাপকভাবে ইহুদিদের গ্রেপ্তার করে বন্দি নিবাসে প্রেরণ করতে থাকে এবং লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে নির্বিচারে হত্যা করে। এরুপ পরিবেশে আইনস্টাইনের ন্যায় যে সমস্ত ইহুদি বুদ্ধিজীবি, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক জার্মানি থেকে পালায়ন করে অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিতে সক্ষম হন কেবল তাঁরা এই নিধনযজ্ঞ থেকে রেহাই পান।
Apartheid: পৃথগবাসন, বর্ণবৈষম্য
দক্ষিন আফ্রিকার নগন্য শ্বেতবর্ণের স্বৈরতান্ত্রিক শাষক দল কর্তৃক সংখ্যাগুরু এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মূল কৃষ্ণবর্ণ অধিবাসীদের বিরুদ্ধে অনুসৃত প্রথগবাসনের এবং নিগ্রহের নীতি বর্ণবিদ্বেষ বলে পরিচিত। ইংরেজ ‘আপারথিড’ কথার উদ্ভব দক্ষিণ আফ্রিকায়। এর অর্থ জাতিগত পার্থক্যের ভিত্তিতে অধিবাসীদের পৃথক বাসের ব্যবস্থা করা। ইউরোপের শ্বেতবর্ণের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক আফ্রিকা মহাদেশ জোর করে দখলের সূচনায় অর্থ্যাৎ সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষশ্যের নীতি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ন্যাশনাল পার্টি নামক রাজনৈতিক দল ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণবর্ণ অধিবাসীদের বিরুদ্ধে নান প্রকার বৈষম্যমূলক বিধান প্রণয়ন করা হতে থাকে। এই সমস্ত আইন দ্বারা শেবতবর্ণের সরকার অশ্বেতকায়দের সব রকম রাজনীতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। তাদের যাতায়াতের অধিকার, জীবিকার্জনের স্বাধীনতা, ধর্মপালন এবং বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। বাণ্টুস্থান নির্বিশেষে মানুষ সমান এবং সমান সুযোগের অধিকার একথা প্রচার করা কিংবা বিশ্বাস করা দক্ষিণ আফ্রিকাতে অপরাধ বলে বিবেচিত। ১৯৫২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার অনুসৃত এই বর্ণবৈষম্যের নীতির উপর আলোচনা করা হয় এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দাজ্ঞাপক প্রস্তাব গ্রহণ করে সকল রাষ্ট্র যেন দক্ষিণ আফিকাকে আন্তর্জাতিকভাবে বর্জন করে এরূপ আহব্বানও গৃহীত হয়। কিন্তু এরূপ প্রস্তাবের কোনো বাস্তব কার্যকর ভূমিকা না থাকতে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার তার নীতির কোনো পরিবর্তন করে নি। সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহ দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও অব্যাহত রেখেছে। বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার জনসাধারণ দীর্ঘকাল যাবৎ বিভিন্ন প্রকারে সংগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। ১৯৮৫ সালে এ সংগ্রাম সাফল্যের এক ক্রান্তিলগ্নে এসে পৌছেছে, একথা বলা যায়। বর্ণবৈষম্য কেবল দক্ষিণ আফ্রিকাতেই অনুসৃত হচ্ছে না। ধনবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবৈষম্যের আবহাওয়া বিশেষ প্রকট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে নিগ্রো অধিবাসীদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ না করলেও তার দক্ষিণাঞ্চলীয় অনেকে অঙ্গরাষ্ট্রে সরকারিভাবে নিগ্রোদের বিরুদ্ধে বাসস্থান, শিক্ষা ও জীবিকায় বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রে অবশেষে নব্বই দশকের গোড়ার দিকে শ্বেতবর্ণের শাসনকারী সরকার দক্ষিণ আফ্রিকার সকল নাগরিকের ভোটদানের এবং শাসন করার অধিকার স্বীকার করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের অবসানের সম্ভাবনা দেখা দেয়।
Apriori and Apsteriori: অভিজ্ঞতা-পূর্ব এবং অভিজ্ঞতালব্ধ
ভাববাদী দর্শনের দুটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো জ্ঞান যথার্থ এবং কোনো জ্ঞান যথার্থ নয়-এই প্রশ্নে প্রাচীনকাল থেকেই শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। প্লেটো, বার্কলে, কাণ্ট প্রমুখ প্রখ্যাত ভাববাদী দার্শনিকের মতে জ্ঞান হচ্ছে দুরকম: অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা উধ্ব বা অভিজ্ঞতা-পূর্ব জ্ঞান। কিন্তু ইন্দ্রীয়ের শক্তি সীমাবদ্ধ বলে ইন্দ্রীয়লব্ধ জ্ঞান চরম সত্যের জ্ঞানদানে সক্ষম নয়। সঠিক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা-পূর্ব জ্ঞান, অর্থ্যাৎ সঠিক জ্ঞান ইন্দীয়ের মাধ্যমে অর্জিত হয় না। ফরাসি দার্শনিক দেকার্ত মনে করতেন মানুষের নিজের অস্তিত্ববোধ অভিজ্ঞতা-উধ্বজ্ঞান। যেমনি অঙ্গশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত কিংবা কোনো কিছু একই সঙ্গে সত্য এবং মিথ্যা হতে পারে না, এরূপ যৌক্তিক সিদ্ধান্তও অভিজ্ঞতালব্ধ নয়- এরা অভিজ্ঞতাঊর্ধ্ব। কাণ্ট ‘নিজ সত্তার বস্ত’ বা ‘থিং ইন ইটসেলফ’কে অজ্ঞেয় রাখার জন্য অভিজ্ঞতালব্ধ এবং অভিজ্ঞতাঊর্ধ্ব কথাকে ব্যবহার করেছেন। তাঁর মতে ইন্দ্রীয়ের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান সত্তার দৃষ্ট প্রকাশের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। এরূপ জ্ঞান সত্তার ‘নিজ সত্তার অবস্থিত বস্তুর’ যথার্থ জ্ঞান নয়। কিন্তু নিজ সত্তায় অবস্থিত বস্তুই হচ্ছে চরম সত্তা। এই চরম সত্তার জ্ঞান অভিজ্ঞতার বাইরে কেবল অনুভূতির মাধ্যমেই লাভ করা সম্ভব। কাণ্টের মতে, স্থান, কাল, কার্যকারণ, সম্পর্ক ইত্যাদি জ্ঞানসুত্রগুলি মানুষের অভিজ্ঞতাঊর্ধ্ব বোধ, অভিজ্ঞতালব্ধ নয়। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শন জ্ঞানকে অভিজ্ঞতালব্ধ এবং অভিজ্ঞতা-পূর্ব বলে পরস্পর-বিরোধী মাধ্যমে বিভক্ত করার বিরোধী। এই দর্শনের মতে জ্ঞানের একমাত্র মাধ্যম, ‘অভিজ্ঞতা-পূর্ব’ বলে জ্ঞানের কোনো মাধ্যম নেই।
Aristotle: এ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রি. পূ.)
পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিকরূপে ইতিহাসে পরিচিত। গ্রিক সম্রাট আকেজাণ্ডেরর কিশোর বয়সে এ্যারিস্টটল তাঁর শিক্ষক ছিলেন। জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের ক্ষেত্রে এ্যারিস্টটলের অবদান অতুলনীয়। প্রাচীন গ্রিক দর্শন এ্যারিস্টটলের হাতে চরম উৎকর্ষ লাভ করে। নিজের শিক্ষা জীবনে এ্যারিস্টটল প্লেটোর শিষ্য ছিলেন। কিন্তু প্লেটোর জীবিতকালেই এ্যারিস্টটল দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে প্লেটো থেকে ভিন্নতর অভিমত পোষণ করতে শুরু করেন। কিন্তু প্লেটোর জীবনকালে দুজনার মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ ঘটে নি। এতে উভয়ের মধ্যে পারস্পারিক শ্রদ্ধা এবং স্বীকৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। প্লেটোর মৃত্যুর পরে (৩৪৭ খ্রি. পূ.) এ্যারিস্টটল প্লেটোর একাডেমী পরিত্যাগ করে স্বাধীনভাবে লাইসিয়াম-এ শিক্ষাদান শুরু করেন। এ্যারিস্টটল জন্মগ্রহণ করেন মেসিডোনিয়ায় একটি নগরে। মেসিডোনিয়া এবং মেসিডোনিয়ার সম্রাট ফিলিপ ও আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে এথেন্স নগরীতে তাঁকে পরবর্তী জীবনে বিরুদ্ধতার সন্মুখীন হতে হয়। কিন্তু মেসোডোনিয়ার সাম্রাজ্য বিস্তারকেও এ্যারিস্টটল সমর্থন করেন নি। মানসিকভাবে তিনি গ্রিসের দাস প্রধান নগর-গনতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন। দাস এবং প্রভুর শ্রেণীভেদ জন্মগত বলেই তিনি মনে করতেন। কিন্তু তিনি স্বৈরতন্ত্রকে সমর্থন করেন নি। যুগের পরিপ্রেক্ষিতে এ্যারিস্টটলের চিন্তার ক্ষমতা এবং ব্যাপকতা যেরূপ বিষ্ময়কর ছিল, তেমনি তাঁর চিন্তাধারায় দাস-প্রধান গ্রিক সমাজের সীমাবদ্ধতার পরিচয়ও দুর্লভ নয়। জীবন ও জগতের এমন কোনো দিক ছিল না, যেদিকে এ্যারিস্টটল তাঁর গবেষণার দৃষ্টিকে প্রসারিত করেন নি। এ কারণে এ্যারিস্টটলকে জ্ঞানসমুদ্র বলে ষ্মরণ করা হয়।
এ্যারিস্টটলের দর্শন এবং চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রকৃতিক রহস্য ভেদে তাঁর অভিমত প্রধানত বস্তুজগৎ এবং বস্তুজগৎ সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত। নিছক কল্পনার উপর নয়। কিন্তু প্লেটোর ভাববাদী প্রভাব তিনি সম্পূর্ণরূপে অতিক্রম করতে সক্ষম হন নি। এ কারণে এ্যারিস্টটলের দর্শনে বস্তুবাদ এবং ভাববাদের মিশ্রণ দেখা যায়।
এ্যারিস্টটলের মতে বস্তুমাত্রেরই তিনটি রূপ আছে। বস্তুত্ব, আকার, গতি বা লক্ষ্য। বস্তুর বস্তুত্ব একদিকে অনড়, গতিহীন; কিন্তু অপর দিকে বস্তুর বস্তুত্বের মধ্যে বস্তুত্ব আকার, গতি এবং লক্ষ্যও নিহিত বা সুপ্ত। যা বস্তুর আকার তা বস্তুর অন্তনির্হিত বা সুপ্ত শক্তিরই প্রকাশ। কিন্তু সে জন্য বস্তুর আকার এবং বস্তুর বস্তুত্ব এক নয়। আকার বস্তু থেকে পৃথক। আকার ব্যতীত বস্তু কল্পনা করা যায় না। আকারই বস্তুকে উপলব্ধির যোগ্য করে। এ কারণে আকার অবশ্যই অধিকতর সত্য এবং চিরন্তন। বস্তুর পরিবর্তন কিংবা ক্ষয় আছে। কিন্তু আকারের পরিবর্তন বা ক্ষয় নাই। আকার অনুযায়ী বস্তুকে আমরা উপলব্ধি করি, বস্তু অনুযায়ী আকারকে নয়। আকারের এইরূপ ব্যাখ্যায় এ্যারিস্টটলীয় দর্শনের ভাববাদী বৈশিষ্ট্যটি প্রকট হয়ে দেখা দেয়। আকার থেকে এ্যারিস্টটল সমগ্র সৃষ্টির মূল শক্তি হিসাবে অতিপ্রাকৃতিক ঈশ্বরের সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছিলেন। ঈশ্বর হচ্ছে সমস্ত অস্তিত্বের গতির উৎস। কিন্তু ঈশ্বরের নিজের কোনো গতি নেই। এ্যারিস্টটলের দার্শনিক ব্যাখ্যায় সব সময় ঐক্য এবং পারস্পর্যের সাক্ষাৎ মেলে না। বস্তু থেকে আকারকে পৃথক ভাবলেও এ্যারিস্টটল অন্যত্র প্লেটোকে এই কারণে তীব্র সমালোচনা করেছেন যে, প্লেটো সাধারণ ভাবকে (মনুষ্যত্ব, পশুত্ব ইত্যাদি) বিশেষ বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেছেন। প্লেটোর সমালোচনা হিসাবে এক্ষেত্রে এ্যারিস্টটল এরূপ অভিমত পোষণ করেন যে, বিশেষ থেকে সাধারণ ভাবকে আদৌ পৃথক করা যায় না। বিশেষের মাধ্যমেই কেবল সাধারণ বা ‘নির্বিশেষ’ ভাবকে অনুধাবন করা চলে। প্লেটোর দর্শনের ক্ষেত্রে এ্যারিস্টটলের এই সমালোচনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বস্তুত এ্যারিস্টটলের উপরোক্ত সমালোচনা ভাববাদের একটি মৌলিক সমালোচনা। এই সমালোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী বস্তুবাদী দর্শন বিকাশ লাভ করে।
দেহের গবেষণা অর্থ্যাৎ চিকিৎশাস্ত্রেও এ্যারিস্টটলের অবদান ষ্মরণীয়। তিনি দেহের প্রথম রোগ নিরাময়ের জন্য অস্ত্রোপচার এবং দেহ ব্যবচ্ছেদের পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। এ্যারিস্টটলের পিতা নিজে চিকিৎসাবিদ ছিলেন। এ্যারিস্টটলের শিশুকালে তিনি মারা গেলেও চিকিৎসা-বিজ্ঞানে গবেষণার পারিবারিক ঐতিহ্য হয়তো এ্যারিস্টটলকে প্রভাবান্বিত করেছিল।
এ্যারিস্টটল যুক্তিশাস্ত্রের পিতা বলে স্বীকৃত। মানুষের চিন্তা ও তার প্রকাশকে বিশ্লেষণ করে সুশৃঙ্খলভাবে তার প্রকার নির্ধারণ ইউরোপীয় দর্শনের ক্ষেত্রে এ্যারিস্টটলই সর্বপ্রথম করেন। যুক্তির মৌলিক বিধানগুলি তিনি লিপিবদ্ধ করেন। এই বিধানগুলি প্রায় অপরিবর্তিতভাবে আজও যুক্তিশাস্ত্রে গৃহীত এবং আলোচিত হচ্ছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ এবং তুলনামূলক আলোচনার শুরুও এ্যারিস্টটলে।
সত্তা, গুণ, পরিমাণ বা সংখ্যা, সম্পর্ক, স্থান কাল, অবস্থান, করণ, অধিকরণ ইত্যাদি জ্ঞানসুত্রগুলির গভীর দার্শনিক ব্যাখ্যা এ্যারিস্টটল করেছিলেন। তাঁর সমস্ত সূত্রের অনেকগুলি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আজও প্রযুক্ত হচ্ছে। এ্যারিস্টটলের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে, তাঁর সময় পর্যন্ত বিকশিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমস্ত ক্ষেত্রকে তিনি সুসংবদ্ধ আকারে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এ্যারিস্টটল থেকেই যে-কোনো সমস্যার সুসংবদ্ধ বৈজ্ঞানিক গবেষণার সূত্রপাত হয়েছে, একথা অবিসংবাদীরূপে সত্য।
এ্যারিস্টটলের দর্শনের বস্তুবাদী এবং বৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্য মধ্যযুগের অন্ধকার ভেদ করে নতুন বৈজ্ঞানিক গবেষণার সূচনায় এক বিরাট শক্তিশালী অস্ত্র হিসাবে কাজ করেছে। মুসলিম সভ্যতার আমলেও এ্যারিস্টটলের দর্শনই মুসলিম চিন্তাবিদদের ব্যাখ্যায় কেন্দ্র হিসাবে কাজ করেছে। এ্যারিস্টটলের তত্ত্বসমূহের বিরুদ্ধবাদী বা সমর্থনকারী সমালোচনাই মুসলিম চিন্তাবিদদের আলোচনাকে ধর্মবিশ্বাসাতিরিক্ত দার্শনিক আলোচনার গুণে গুনান্বিত করেছিল। মুসলিম দার্শনিকদের নিকট থেকে ইউরোপ এ্যারিস্টটলের পরিচয় লাভ করে। মধ্যযুগে ইউরোপের গোঁড়া ধর্মবিশ্বাস এ্যারিস্টটলের দর্শনের ভাববাদী তত্ত্বকে ধর্মতত্ত্বের পরিপোষক হিসাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। এর ভিত্তিতেই মধ্যযুগীয় স্কলাসটিসিজম বা যুক্তিবাদী ধর্মতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা হয়।
মার্কসবাদী দর্শনের অন্যতম প্রবক্তা ফ্রেডারিক এঙ্গেলস এ্যারিস্টটলকে প্রাচীন জ্ঞান দর্শনের শীর্ষমণি বলে আখ্যাত করেছেন।
Associationist Psychology: অনুষঙ্গী মনোবিজ্ঞান
কোনো কিছু আমাদের ষ্মরণে জাগরিত হওয়ার কারণ কি? ‘ক’ বললেই অর্থ্যাৎ ‘ক’ ষ্মরণ করলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ‘খ’ ষ্মরণে এসে যায়, খ বললে গ। কিন্তু এর কারণ কি? এর সাধারণ উত্তর দিই আমরা এভাবে যে, শিশু বয়সে বারংবার একটা ধারাক্রমে উচ্চারণ করে আমরা এদের মুখস্থ করেছি। মুখস্থ করেছি একথা সত্য, কিন্তু মুখস্থ করায় আমাদের মনে কিংবা মস্তিষ্কে এ ব্যাপারে কি পরিবর্তন ঘটেছে যাতে ‘ক’ মনে করলেই ‘খ’ ও উদিত হয়? আমার মায়ের কথা মনে হলেও বাড়ির ছবি আমার মনে জাগরিত হয়? দর্শন এবং মনোবিজ্ঞানে এটি বেশ পুরাতন প্রশ্ন। ষ্মরণশক্তির বা ষ্মরণে পড়ার বিভিন্ন প্রকার ব্যাখ্যা বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দার্শনিক এবং মনোবিজ্ঞানী দিয়েছেন। এঁদের একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে এই যে, একটি স্টিমুলাস বা উদ্দীপক অপর একটি উদ্দীপকের নৈকট্য এবং পৌনঃপুনিকতার কারণে আমাদের মন বা মস্তিষ্কের কোষে পরস্পর সম্পর্কিত প্রতিছাপের সৃষ্টি করে। ফলে কিছুকালের ব্যবধানেও পরস্পর সম্পর্কিত উদ্দীপকগুলির প্রতিছাপের কোনো একটি ক্রিয়াশীল হলেও অপরগুলিও ক্রিয়াশীল হয়ে উঠে। ইংরেজীতে একেই এ্যাসোসিয়েশন নামে অভিহিত করা হয়। এই ব্যাখ্যার ভিত্তিতেই এ্যাসোসিয়েশনিস্ট সাইকোলজি বা অনুষঙ্গী মনোবিজ্ঞানের সৃষ্টি হয়েছে। মনের ক্রিয়াকালাপের অনুসঙ্গী ব্যাখ্যা মনোবিজ্ঞানের আধুনিক বিকাশের পূর্বে হবস, লক এবং ষ্পিনোজার দর্শনের মধ্যে পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে এই ব্যাখ্যায় ভিত্তিতে মনোবিজ্ঞানে একটি বস্তুবাদী ধারা বিকাশ লাভ করে। এই ধারাটি বিংশ শতাব্দীতে ব্যবহারবাদ বা বিহেভিয়রিজম তত্ত্বের রূপ গ্রহণ করেছে।
Attention: মনোযোগ, মনোদৃষ্টি
একটি মুহূর্তে কোনো কিছুর উপর মন কিংবা মস্তিষ্কের ক্রিয়াশীল হওয়াকে মনোযোগ বা মনোদৃষ্টি বলা হয়। মনোযোগ দুরকমের হতে পারে ইচ্ছাকৃত মনোযোগ এবং অনিচ্ছাকৃত মনোযোগ। ইচ্ছাকৃত মনোযোগের ক্ষেত্রে মন আন্তরিক কোনো উদ্দীপক বা স্টিমুলাসের কারণে একটি বিষয়ের উপর দৃষ্টি নিবেশ করতে পারে। অর্থ্যাৎ একটি বিষয় সচেতন মনের বিবেচনার সীমার মধ্যে আসতে পারে। অনিচ্ছাকৃত মনোযোগের ক্ষেত্রে কোনো উদ্দীপক তার অস্বাভাবিকতা বা বৈপরিত্য কিংবা নতুনত্ব দ্বারা ইন্দ্রীয়গুলির উপর এরূপ আঘাত হানতে পারে-যাতে মনের দৃষ্টি উদ্দীপকের উপর পড়তে বাধ্য হয়। যেমন, সাধারণভাবে যে-শব্দের মধ্যে আমি কোনো একটা মহূর্তে অবস্থান করছি, সে মহূর্তে একটি বিকট শব্দ হলে শব্দের অস্বাভাবিকতাই আমার মনকে আকৃষ্ট করবে। বলা চলে, মন বাধ্যতামূলক এই উদ্দীপকের দিকে আকৃষ্ট হবে। অসংখ্য উদ্দীপক দ্বারা আমরা সর্বদা পরিবেষ্টিত। মনুষ্যেতর প্রাণী উদ্দীপক মাত্রতেই ক্রিয়াশীল হয়ে উঠে। কেবলমাত্র মানুষই নিজের স্বার্থের বিবেচনায় অসংখ্য উদ্দীপকের কোনো একটিকে বাছাই করে তাকে তার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। যখন আমার উদ্দেশ্য হয় আমার গ্রন্থের একটি কঠিন দার্শনিক কথার অর্থ উদ্ধার করা, তখন শব্দ তরঙ্গের যথেষ্ট পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধিও আমার মনকে আকৃষ্ট না করতে পারে। ইচ্ছানুযায়ী মনোযোগ দানের ক্ষমতাকেই মনোবিজ্ঞানে ইচ্ছাকৃত মনোযোগ বলা হয়। মানুষের মন আদিতে অন্যান্য প্রাণীর মতোই উদ্দীপক মাত্ররেই দাস ছিল। যে-কোনো উদ্দীপক যখন তখন তার মনকে আকৃষ্ট করতে পারত। শত শত বছরের শ্রমের অভিজ্ঞতা এবং জীবনের তাগিদে উদ্দীপকের দাস হওয়ার চেয়ে উদ্দীপককে দাস করার ইচ্ছায় মানুষ ইচ্ছামূলক মনোযোগের ক্ষমতা নিজের মধ্যে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। মানুষের মন এবং মস্তিষ্কের ক্ষমতা আজ যেমন, তার শৈশবেও তেমন ছিল, এমন কথা ভাবা ঠিক নয়।
August Movement: আগষ্ট আন্দোলন
১৯৪২ সালের আগষ্ট মাসে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন আরম্ভ করে তা আগষ্ট আন্দোলন নামে পরিচিত।
এই শতাব্দীর বিশের দশক থেকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দাবি প্রবর হতে শুরু করে। বিশের এবং ত্রিশের দশকে বিভিন্ন প্রকার আইন অমান্য আন্দোলনের মধ্যে এবং তার চেয়েও জঙ্গী শ্রমিক-কৃষকদের জীবিকার সংঘবদ্ধ আন্দোলন এবং মধ্যবিত্তের সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমে এই স্বাধীনতার দাবির তীব্রতা প্রকাশ পেতে থাকে। কিন্তু একদিকে ব্রিটিশ সরকারের দমননীতি এবং অপরদিকে ভারতের প্রধান রাজনীতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অনৈক্যের কারণে ভারতে স্বাধীনতার আন্দোলন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়া পর্যন্ত সফলতা অর্জন করতে পারে নি। ১৯৩৯ সালে ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ক্রমান্বয়ে এই যুদ্ধ এশিয়াতে বিস্তারিত হয়। জাপান অক্ষশক্তি, অর্থ্যাৎ জার্মানি ও ইতালির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করে। মিত্রপক্ষের প্রধান শক্তি ছিল সোভিয়েত রাশিয়া, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পরাধীন ভারতও ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এই যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়ে। ১৯৪২-এ এশিয়াতে যুদ্ধের সীমানা ব্রহ্মদেশে অতিক্রম করে বাংলার নিকটে এসে পড়ে। ব্রহ্মদেশও তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন। ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী ব্রহ্মদেশ পরিত্যাগ করে পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। জাপান কলকাতা নগরী ও চট্রগ্রামের উপর বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করে। ব্রিটিশ সরকার তখন একটা সামরিক বিপর্যয়ের সষ্মুখীন। ব্রিটিশ সরকারের এই সঙ্কটকে স্বাধীনতা লাভের উত্তম সময় বিবেচনা করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের নিকট ৪২-এর আগস্ট মাসে একটি প্রস্তাব মারফত কতগুলি দাবি উত্থাপন করে। ভারতীয় জাতীয় কমিটির ওয়ার্কিং কংগ্রেসের এই প্রস্তাব আগস্ট প্রস্তাব নামে পরিচিত। প্রস্তাবটির এক অংশে সরকারের নিকট অবিলম্বে ভারতের স্বাধীনতা প্রদানের দাবি করা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, মিত্রপক্ষের যুদ্ধে জয়লাভের জন্য ভারতের স্বাধীনতা অপরিহার্য। স্বাধীন ভারতের স্বাধীন সরকারই মাত্র মিত্রপক্ষকে যুদ্ধ জয়ে উপযুক্ত রূপে সাহায্য করতে সক্ষম হবে। প্রস্তাবের অপর অংশে গান্ধীর নেতৃত্বে গণআন্দোলন শুরু করার কথাও বলা হয়েছিল। কংগ্রেস নেতৃত্বের আশা ছিল, তাদের স্বাধীনতার দাবি এবং আন্দোলনের হুমকীতে ব্রিটিশ সরকার তাদের সঙ্গে আপস আলোচনাতে সম্মত হবে। কিন্তু ভারতের জনমত তখনো জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃত্বে বিভক্ত। এই অনৈক্য ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুর্বলতা। ব্রিটিশ সরকার এই দুর্বলতাকে ভিত্তি করে কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনার পরিবর্তে দমননীতি গ্রহণ করে। আগষ্ট প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় ৮ আগষ্ট। তার পরদিনই ৯ আগষ্ট ব্রিটিশ সরকার গান্ধীসহ কংগ্রেস ওয়াকিং কমিটির নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করে।
কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারে দেশব্যাপী প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিভিন্নস্থানে আন্দোলন জঙ্গী এবং ধ্বংসাত্মক আকার গ্রহণ করে। রেল লাইন, টেলিগ্রাফ তার এবং শাসনযন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আন্দোলনকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে। মেদিনীপুরের একটি অঞ্চলে ব্রিটিশ সরকারের শাসন ব্যবস্থা অস্বীকার করে স্বাধীন সরকার স্থাপন করা হয়। কিন্তু এ সমস্ত কার্যক্রম খুব সংগঠিত ছির না। কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে এ আন্দোলন পরিচালিত হয় নি। অহিংসার নীতিতে বিশ্বাসী গান্ধী তখন কারাগারে আবদ্ধ। বিচ্ছিন্ন এবং নেতৃত্বহীন এরূপ স্বতস্ফূর্ত বিক্ষোভ ব্রিটিশ সরকারের সামরিক এবং নির্মম দমনের মুখে অধিক দিন স্থায়ী হতে পারে নি। ৪২ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই এ আন্দোলন দমিত হয়ে যায়। আগষ্ট ৯ এবং ডিসেম্বর ৩১-এর মধ্যে ৬০ হাজারের অধিক লোককে গ্রেপ্তার করা হয়; ১৮০০০ রাজনীতিক কর্মীকে ভারত রক্ষা আইনে আটক রাখা হয়; পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর গুলি বর্ষণে প্রায় এক হাজার নিহত হয়। ( দ্রষ্টব্য: রজনী পামে দত্ত: ‘ইন্ডিয়া টু ডে’)
Augustine Saint: সেণ্ট অগাস্টিন (৩৫৪-৪৩০ খ্রি.)
উত্তর আফ্রিকার হিপোতে অগাস্টিনের জন্ম। যৌবনকালে অগাস্টিন ছিলেন ধর্মীয় বিশ্বাসে প্যাগান বা প্রকৃতবাদী। কিন্তু কিশোর বয়স থেকেই তাঁর মধ্যে সত্যানুসন্ধানের প্রবল আগ্রহ প্রকাশ পেতে থাকে। অগাস্টিনের রচনার আগ্রহ এবং ক্ষমতাও ছিল অসাধারণ। তাঁর সমকালীন জীবনের ধর্মীয়, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তির জীবনের নীতিগত সমস্ত সমস্যাই তাঁর রচনাসমূহে আলোচিত হয়েছে। এই রচনার মধ্যে তাঁর ‘কনফেকশন’ বা ‘স্বীকারোক্তি’ এবং ‘সিটি ব গাড’ বা ‘ঈশ্বরের রাজ্য’ প্রসিদ্ধ। তাঁর স্বীকারোক্তির মধ্যে তাঁর যৌবনকালের আচরণ এবং বিচিত্র ধর্মীয় অভিজ্ঞতার বর্ণনা। বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসরণ এবং বিচার শেষে ৩৩ বৎসর বয়সে অগাস্টিন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। ৩৯১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে হিপোর ধর্মযাজক রূপে ঘোষণা করা হয়। খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করার পর তিনি খ্রিষ্টধর্মের একজন শক্তিশালী প্রচারক এবং রহস্যবাদী দার্শনিকরূপে জীবনযাপন করেন। দর্শনের ক্ষেত্রে অগাস্টিনের মূল কথা ছিল: বিশ্বাস ব্যতীত জ্ঞান সম্ভব নয়। তাঁর ‘ঈশ্বরের রাজ্য’ বা ‘সিটি অব গড’ খন্ডাকারে তের বছর ধরে রচিত হয়। সর্বপ্রকার সমস্যাই তিনি তাঁর এই গ্রন্থে আলোচনা করেন। ‘ঈশ্বরের রাজ্য’ এবং ‘পাপের রাজ্য’কে অগাস্টিন পুণ্য এবং পাপ; সৎ এবং অসৎ-এর দ্বন্দ্বমান জগৎরূপে কল্পনা করেন। বিশ্ব সম্পর্কে খ্রিষ্টধর্মের বিশ্বাস অগাস্টিনের ইতিহাস ব্যাখ্যার ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। ইতিহাসের এ ব্যাখ্যাকে অদৃষ্টবাদ বলা হয়। বিশ্বে যা কিছূ ঘটেছে, ঘটছে বা ঘটবে তা সবই ঈশ্বর কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত।
Auterchy: স্বশাসন, স্বয়ংসম্পূর্ণতা
Autonomy: স্বায়ত্তশাসন
অটারকী এবং অটোনমি উভয়ই গ্রিক শব্দ থেকে উদ্ভূত। গ্রিক ‘অটারকীয়া’র অর্থ স্বয়ংসম্পূর্ণতা। অর্থনীতিকভাবে কোনো রাষ্ট্র যদি এরূপ নীতি গ্রহণ করে যে, জীবনের যা কিছু প্রয়োজন সেসব রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই উৎপাদিত হবে এবং কোনো কিছুর জন্যই সে অপর রাষ্ট্রের উপর বা অপর রাষ্ট্র থেকে আমদানির উপর নির্ভর করবে না তা হলে একে অটারকী বা সয়ংসম্পূর্ণতার নীতি বলা যায়। অপরদিকে স্বায়ত্বশাসন বলতে যেমন কোনো পরাধীন জাতির পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের ইচ্ছা বুঝাতে পারে, তেমনি স্বায়ত্তশাসন দ্বারা একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্তর্ভূক্ত বিশেষ কোনো অঞ্চল বা অধিবাসীর নির্দিষ্ট পরিমাণ শাসনাধিকারকেও বুঝাতে পারে। স্বায়ত্তশাসনের বাস্তব এবং সঙ্গত দাবি পূর্ণ না হলে এবং রাষ্ট্রের কোনো প্রভাবশালী জনাংশের মধ্যে নির্যাতিত কিংবা বঞ্চিত থাকার অবিযোগে দীর্ঘদিন প্রবাহিত হতে থাকলে স্বায়ত্তশাসনের দাবি বিচ্ছিন্নতা এবং পূর্ণ স্বাধীনতার রূপ গ্রহণ করতে পারে।
Axis: অক্ষ
Axis Power: অক্ষশক্তি
অক্ষ বলতে গণিত ও জ্যোতিষ শাস্ত্রে সূর্য থেকে কোনো দূরত্বের পরিমাণ ভূগোলে পৃথিবীর গ্রহের কাল্পনিক মেরুকেন্দ্ররেখা এবং প্রাণিবিদ্যায় প্রাণীদেহের মেরুদণ্ডকে বুঝায়। কিন্তু রাজনীতিতে ‘অক্ষশক্তি’ কথাটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় প্রচারিত হয়। অক্ষশক্তি দ্বারা তখন জার্মানি, ইতালি এবং জাপান এই তিন শক্তির জোটকে বুঝান হত। শক্তির কেন্দ্র হিসাবে অক্ষ কথাটি ব্যবহার করে প্রথমে ১৯৩৬ সালে ফ্যাসিবাদী ইতালির শাসক মুসোলনী। মুসোলিনী নাকি জার্মানির হিটলারের সঙ্গে আঁতাত গঠনের কালে রোম-বার্লিন সম্পর্কের শক্তির অক্ষরেখা বলে অভিহিত করে। এই আঁতাততে তারা ইস্পাতদৃঢ় আঁতাত বলে আখ্যায়িত করে। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রগোষ্ঠীর জঙ্গীনীতির মূল লক্ষ্য সমাজতন্ত্রের ধ্বংস এবং তখনকার একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত রাশিয়াকে আক্রমণ করা। এই মূল লক্ষ্যের জন্য জার্মানি এবং ইতালি জাপানকেও সাম্যবাদবিরুদ্ধতার চুক্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। যুদ্ধের প্রথম দিকে দ্বিধা থাকলেও যুদ্ধের সংকটজনক পরিস্থিতিতে ইংল্যাণ্ড এবং মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে বৃহত্তর ঐক্যজোট গঠনে বাধ্য হয়। এই ঐক্যের ফলে অক্ষশক্তি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ১৯৪৫ সালে পরাজয় বরণে বাধ্য হয়।


B
Babeuf: বাব্যুফে (১৭৬০-১৭৯৭ খ্রি.)
ফরাসি বিপ্লবী। ১৭৯৬ সালে বাব্যুফের নেতৃত্বে ‘সমানদের ষড়যন্ত্র’ নামে একটা আন্দোলন সংঘটিত হয়। ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটিত হওয়াকে বাব্যুফ এবং তাঁর অন্যতম সাথী ডারথেকে ১৭৯৭ সালে গিলোটিনে হত্যা করা হয়। বাব্যুফে থেকে বাব্যুফবাদের জন্ম হয়। বাব্যুফ এবং তাঁর সঙ্গীরা সমগ্র ফরাসি দেশে একটি কেন্দ্র থেকে শাসনের ভিত্তিতে ‘সমানদের রিপাবলিক’ বা সমানদের একটি জাতীয় কম্যুন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন। তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক চিন্তার ক্ষেত্রে বাব্যুফবাদ প্রগতিমূলক ছিল। বাব্যুফবাদীগণ ফরাসি দেশে প্রথম সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বকে বাস্তবে বিপ্লবী আন্দোলনরূপে প্রকাশ করার চেষ্টা করেন।
Bacon, Francis: ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬ খ্রি.)
দর্শন এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রে বস্তুবাদী এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পথপ্রদর্শক।
বেকনের জ্ঞান এবং গবেষণার উৎসাহ কোনো একটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না। দর্শন, বিজ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি, আইন, সর্বক্ষেত্রেই বেকন তাঁর সৃষ্টিশীল মেননের পরিচয় দিয়েছেন। বেকনকে তাই সর্ব-বিষয়ে পারদর্শী বলা যায়। কেবল জ্ঞানের তত্ত্বগত আলোচনায় নয়, ব্যক্তিগত জীবনে ক্শমতা লাভের প্রচেষ্টায়ও তিনি ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। ইংরেজ সম্রাট প্রথম জেমস-এর রাজত্বকালে ‘লর্ড-চ্যান্সেলর’ হিসাবে নিযুক্ত হয়ে বেকন সম্রাটের শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ পদমর্যদার অধিকারী হন। একদিকে যেমন জ্ঞানের ক্ষেত্রে বেকন অন্ধবিশ্বাস এবং গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সংগ্রামী অপরদিকে ব্যক্তিগত জীবনে আত্মস্বার্থসাধনে তিনি ছিলেন বিবেকহীন।
‘নোভাম অর্গানাম’, এসেজ, এডভাঞ্চমেণ্ট অব লারনিং, ‘সাইণ্টিয়ারাম’, ‘নিউ এ্যাটলাণ্টিস’ প্রভৃতি গ্রন্থের মধ্যে ‘নোভাম অর্গানাম’ গ্রন্থের জন্যই বেকন খ্যাতি অর্জন করেন সমধিক। এই গ্রন্থের মাধ্যেই বেকনের বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক চিন্তার সুসংবদ্ধ প্রকাশ পাওয়া যায়। বেকন নিজে বৈজ্ঞানিক ছিরেন না সত্য, কিন্তু আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির তিনি যে উদগাতা ছিলেন এ সত্য অনস্বীকার্য। ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক-সামাজিক জীবনে রূপান্তর সাধিত হচ্ছিল। পুজিঁবাদের তখন প্রথম যুগ। পুজিঁবাদের বাধাহীন বিকাশের জন্য উৎপাদনের নতুনতর উপাদান অর্থ্যাৎ কলকব্জা, যন্ত্রপাতি, অস্ত্র-শস্ত্রের আবিস্কার যেরূপ আবশ্যক ছিল তেমনি আবশ্যক ছিল বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিক ভাবাদর্শের। পুঁজিবাদ এবং জ্ঞানের বিকাশকে বেকন এই ভাবদর্শ দ্বারা অবারিত করেছিলেন।
জ্ঞান অর্জনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বেকন ঘোষণা করেন যে, মানুষ জ্ঞানলাভ করবে প্রকৃতিকে জানার জন্য এবং তাতে বশ করার জন্য। এরূপ জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায় হচ্ছে পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা দ্বারা নিয়ত পরিবর্তিত বিশ্ব-প্রকৃতির পরিবর্তনের সত্যকার কারণ জানা। প্রকৃতির কার্য-কারণকে জ্ঞাত হওয়া প্রচলিত দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের অলীক জাল বুননি দ্বারা সম্ভব নয়। প্রচলিত দর্শন আর ধর্মতত্ত্বের প্রবক্তাগণ মাকড়শার মতো নিজেদের কল্পনার জাল বিস্তার করে বিশ্ব-প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে চান কিন্তু এ পথ সত্যকার জ্ঞানের পথ নয়। সত্যকার জ্ঞান শুরু হবে সন্দেহ এবং প্রশ্ন দিয়ে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে চার রকম দেবতার মূর্তিপূজা অনড় আসন গেড়ে বসে আছে। সেই অনড় মূর্তিদের ধ্বংসকারী হিসাবে নিজেকে ঘোষণা করে বেকন বলেন, মানুষের মনকে এই অপদেবতাদের প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে। বেকনের মতে এই অপদেবতা বা আইডলগুলোকে চারভাগে ভাগ করা যায়। যথা (১) জাতিগত অপদেবতা মানুষ হিসাবে মানুষের জাতিগত কুসংস্কার ও অবাস্তব ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে সেগুলিকে মানুষের জাতিগত অপদেবতা বলা যায়। মানুষ বিনা প্রশ্নে নিজের জ্ঞানের অসীমতা সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে তাকে বেকন তাঁর একটি জাতিগত কুসংস্কার বলে আখ্যায়িত করেন। প্রাকৃতিক সমস্যার বিচারের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ না হওয়ার প্রবণতাও মানুষের একটা জন্মগত সংস্কার। মানুষ কেবল তাকেই সত্য বলে স্বীকার করতে চায় যা তার আত্মস্বার্থ সাধন করে। ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকেও মানুষ এই কারণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই চরম জ্ঞান বলে মনে করে। (২) অন্ধকার বিবরের অপদেবতা হচ্ছে মানুষের মনের দ্বিতীয় অপদেবতা। প্লেটোর গুহায় বন্দি মানুষ যেমন সত্যের ছায়াকেই সত্য বলে মনে করত তেমনি সকল মানুষই ব্যক্তিগতভাবে নিজ জীবনের অন্ধকার গুহায় বন্দি। ব্যক্তিজীবনের গুহার অন্ধকারে বসে মানুষ সত্যের আসল রূপ প্রত্যক্ষ করতে পারে না। তার ছায়াকেই সত্য বলে আঁকড়ে থাকে। এই গুহা থেকে বেরিয়ে আসতেও সে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু সত্য সাধককে বিবরের এই বন্ধন ছিন্ন করতে হবে। যে তত্ত্বের প্রতি ব্যক্তির মানসিক আকর্ষণ প্রকট হয়ে ওঠে, সত্য সাধক হিসাবে তাকে সেই তত্ত্বকেই অধিক সন্দেহের চোখে দেখতে হবে। পর্যবেক্ষণ, প্রয়োগ ও পরীক্ষার মারফত তার সত্যাসত্য নির্ধারণ করতে হবে। (৩) বাজারী অপদেবতার বাধাও জ্ঞানলাভের জন্য কম নয়। ভাষার সীমাবদ্ধতাকে বেকন বাজারের অপদেবতা বা ‘আইডলস অব দি মার্কেট প্লেস’ বলে আখ্যায়িত করেন। ভাষার মারফত মানুষ ভাবের বিনিময় করে। কিন্তু ভাষার অর্থ বহনের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার জন্য এক ব্যক্তি যা বলে অপরে তা সঠিকভাবে বুঝে না। নিজের ইচ্ছামতো অপরের কথাকে সে গ্রহণ করে। তাই একই শব্দের একাধিক অর্থ। এ কারণে সঠিক জ্ঞানের জন্য সর্বপ্রথমে আবশ্যক হচ্ছে দর্শন ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সঠিক অর্থ নির্দিষ্টকরণ। (৪) থিয়েটার বা মঞ্চের অপদেবতার কারণেও আমরা বিশ্বপ্রকৃতির সঠিক জ্ঞান লাভে ব্যর্থ হই। প্রচলিত দার্শনিক তত্ত্বসমূহের বেকন মঞ্চের অপদেবতা বলেছেন। তার কারণ, মঞ্চে যেমন বাস্তবে একটা কল্পলোক তৈরি করা হয় তেমনি দার্শনিকগণ আসল সত্যকে আড়াল করে মিথ্যা জগতের পরিবেশ তৈরি করেন। তত্ত্বদ্বারা দার্শনিক জ্ঞানলাভের প্রচেষ্টায় এই প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক মতগুলোকে আমাদের ভূমিসাৎ করতে হবে। দর্শনের সমালোচনার সময়ে বেকন মধ্যযুগের ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শনকে আক্রমন করলেও প্রাচীন গ্রিসের দর্শন, বিশেষ করে ডিমোক্রিটাস এবং অন্যান্য বস্তুবাদী গ্রীক দার্শনিকদের তিনি প্রশংসা করেছেন।
এভাবে অজ্ঞানতার প্রতিভূ অপদেবদতাদের ধংধ্ব করে বেতন বৈজ্ঞানিক জ্ঞানলাভের সুত্র প্রতিষ্ঠিত করেন। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্য বেকন আরো তিনটি সূত্র উল্লেখ করেন। যথা: (১) কোনো সমস্যার সমাধান বা কারণের অনুসন্ধানে প্রথমে কারণের উপস্থিতিসূচক ঘটনাসমূহকে সংগ্রহ এবং পর্যবেক্ষণ করতে হবে; (২) দ্বিতীয়ত, উক্ত কারণের অনুপস্থিতিসূচক ঘটনাসমূহকে পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করতে হবে; (৩) তৃতীয়ত উভয় ধরনের ঘটনাকে তুলনাক্রমে বিচার করে উভয়ের পারস্পারিক সম্পর্ক এবং পরিবর্তনের ক্রম উদ্ঘাটন করতে হবে। বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানের এই তিনটি সূত্রকে ভিত্তি করে পরবর্তীকালে জন স্টুয়ার্ট মিল তার আরোহী বা ইনডাকটিভ পদ্ধতিতে মিল এ অ-মিলের যুক্ত পদ্ধতি (জয়েন্ট মেথড অব এ্যাগ্রিমেণ্ট এ্যাণ্ড ডিফারেন্স) এবং পরিবর্তনের যুক্তক্রম (মেথড অব কনকোমিট্যাণ্ট ভেরিয়েশন্স) নামক পদ্ধতি প্রবর্তন করেন।
বিখ্যাত ফরাসি লেখক ডিডেরট বেকনের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে বলেছিলেন বেকনের অবিষ্মরণীয় অবদান এই যে, মানুষের জ্ঞানের ইতিহাস রচনাও যখন সম্ভব ছিল না বেকন তখন মানুষের ভবিষ্যৎ পথকে সুনিশ্চিতভাবে নির্দিষ্ট করার ক্ষমতা দেখিয়েছেন।
রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্বে বেকন রাজতন্ত্রের সমর্থনকারী ছিলেন। তিনি সামন্ততন্ত্রের বিরোধিতা করে এককেন্দ্রীক শক্তিশালী রাজতন্ত্রের কথা প্রচার করেন। ‘নিউ এ্যাটলাণ্টিক’ গ্রন্থে তিনি এক কল্পরাজ্যের বর্ণনা করেছেন। বিজ্ঞানের ভিত্তিতে সে রাষ্ট্রের রাজকার্য সাধিত হয়। শোষক এবং শোষিতের অস্তিত্ব সত্ত্বেও বেজ্ঞানিক উপায়ের ব্যবহারে একটা রাষ্ট্র কি বিষ্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নতি লাভ করতে পারে তার চিত্র তিনি এই গ্রন্থে তুলে ধরেন।
জ্ঞানলাভের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রতিষ্ঠাকালে বস্তুজগতের যে ব্যাখ্যা বেকন উপস্থিত করেন তার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: বস্তু এবং প্রকৃতি বিভিন্ন গুণ সমন্বিত অংশসমূহের সম্মেলনের প্রকাশ। বস্তুর প্রধান লক্ষণ হচ্ছে তার গতি, যান্ত্রিক গতিকে বেকন একমাত্র গতি বলে স্বীকার করতেন না। বস্তুর অন্তরেই গতি নিহিত্ যান্ত্রিক গতিতেই কেবল বস্তু গতিবান হয় না। কিন্তু ফ্রান্সিস বেকনের দার্শনিক অভিমত ক্রটিহীন ছিন না। তাঁর দার্শনিক ব্যাখ্যায়বিভিন্ন সময়ে বস্তুবাদকে অতিক্রম করে ধর্মীয় প্রভাব প্রকট হয়েছে। তাঁর প্রবর্তিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আজ হয়তো হুবহু ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু আধুনিক ইউরোপীয় দর্শন, বিজ্ঞান এবং সামগ্রিকভাবে জ্ঞানান্বেষণের ক্ষেত্রে বেজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবর্তনের জন্য বেকন অবিষ্মরনীয় হয়ে রয়েছেন।
Bacon, Roger: রোজার বেকন (১২১৪-১২৯২ খ্রি.)
ইউরোপীয় মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, দার্শনিক এবং আধুনিক পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে প্রথম পথিকৃৎ। ষোড়শ শতকে ফ্রান্সিস বেকন দর্শন ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে নবযুগের সূচনা করেন তার বীজ বপন করেছিলেন তিনশত বছরেরও পূর্বে ত্রয়োদশ শতকে তাঁর স্বদেশবাসী রোজার বেকন। রোজার বেকন জ্ঞানের একাধিক বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। দর্শনের বস্তুবাদী চিন্তা, অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধতা এবং পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার পদ্ধতিকে বিশ্ব প্রকৃতির জ্ঞানলাভের পথ বলে ঘোষণা করার অপরাধে তাঁকে যাজক সম্প্রদায় ধর্মদ্রোহী ঘোষণা করে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার অধিকার থেকে রোজার বেকনকে বঞ্চিত করা হয়। বেকন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সাহায্যে বিবর্ধক কাচ বা ম্যাগনিফাইং গ্লাস এবং বন্দুকের জন্য এক প্রকার বারুদও আবিস্কার করেন। গ্রিক দর্শন এবং আবর জগতের দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের চিন্তারাজিকে বেকন অধ্যয়ন করেন। জ্ঞানের প্রশ্নে ধর্মযাজকের বাণীর চেয়ে গ্রিক এবং আরব দার্শনিকদের যুক্তি অধিক মূল্যবান ঘোষণা করায় যাজক সম্প্রদায় তাঁর উপর অধিকতর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাঁর দার্শনিক চিন্তাধারায় বৈজ্ঞানিক আবিস্কার এবং গ্রিক ও আরব দর্শনের দৃষ্টান্তের উল্লেখ সব কিছুই ধর্মীয় অপরাধ বলে ঘোষিত হয় এবং পোপের আদেশে তাঁকে দীর্ঘ দশ বছর যাবৎ নজরবন্দি করে রাখা হয়। এই বন্দি অবস্থায় বেকন যাতে কোনো প্রকার জ্ঞানের চর্চা করতে না পারেন, সেজন্য দীর্ঘ দশবছরই তাকে সর্বপ্রকার বই এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রাদি থেকে বঞ্চিত রাখা হয়।
রোজার বেকনের ‘ওপাস মাইউস’ নামক গ্রন্থে তাঁর বিষ্ময়কর প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়কে তিনি সাতভাগে বিভক্ত করেন, যথা: মানুষের ভ্রান্তির কারণ, দর্শন, ভাষার অধ্যয়ন, অঙ্কশাস্ত্র, চক্ষুর চিকিৎসা, পরীক্ষাসিদ্ধ বিজ্ঞান বা এক্সপেরিমেণ্টাল সায়েন্স এবং নীতিশাস্ত্র।
প্রথম ভাগের আলোচনায় রোজার বেকন বলেন যে, জ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষের ভ্রান্তির কারণ চার প্রকার, যেমন: (১) অজ্ঞানীর হুকুম স্বীকার করে তার কাছে আত্মসমর্পণ; (২) প্রচলিত প্রথার মোহ; (৩) জনপ্রিয় কুসংস্কার; এবং (৪) তথাকথিত জ্ঞানের কৌশলের আড়ালে অজ্ঞানতার প্রশ্রয়দান।
জ্ঞানের পথ হচ্ছে অভিজ্ঞতার পথ। অবশ্য অভিজ্ঞতাকে রোজার বহিঃঅভিজ্ঞতা এবং অন্তঃঅভিজ্ঞতা হিসাবে বিভক্ত করণ। ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা হচ্ছে আমাদের বহিঃঅভিজ্ঞতা। এ হচ্ছে বাস্তব জগতের অভিজ্ঞতা, মানুষের আভ্যন্তরিক অভিজ্ঞতার উৎস হচ্ছে বিধাতা। ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতার যেমন প্রয়োজন আছে তেমনি জ্ঞানের নিশ্চয়তা কেবল বিধাতার দয়াতেই সম্ভব। অভিজ্ঞতার এই ব্যাখ্যা রোজার বেকনের বস্তবাদকে ক্রটিপূর্ণ করেছে। তা সত্ত্বেও যুগের প্রেক্ষিতে রোজার বেকনের দর্শন ও বিজ্ঞান সম্পর্কীয় অভিমতসমূহ অপরিসীম তাৎপর্যপূর্ণ।
Bakunin, Mikhail Alexandrovich: বাকুনিন (১৮১৪-১৮৭৬ খ্রি.)
অভিজাত পরিবারের সন্তান বাকুনিন ছিলেন একজন পেটিবুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত চরিত্রের রুশ বিপ্লবী। নৈরাষ্ট্রবাদ বা এ্যানার্কিজম মতবাদের প্রচারকারী হিসাবেই বাকুনিন বিখ্যাত হন।
বাকুনিনের মতাদর্শে বিভিন্ন দার্শনিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাধারায় আকৃষ্ট হন। পরবর্তীকালে হেগেলের দর্শনের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার পরিবর্তে তার ভাববাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল ব্যাখ্যা গ্রহণ করেন।
সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে বাকুনিনের মতবাদ ছিল এরূপ মানুষ মূলত দুটি যন্ত্র দ্বারা নিষ্পোষিত হচ্ছে একটি রাষ্ট্রযন্ত্র অপরটি ধর্মযন্ত্র বা অলীক বিধাতার দণ্ড। রাষ্ট্রযন্ত্রের অত্যাচার থেকে মুক্তির আশ্বাসে মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাসের আশ্রয় নেয়। আসলে ধর্ম এবং রাষ্ট্র যুক্তভাবেই মানুষকে শোষণ করে। মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে এই উভয় যন্ত্রকে ধ্বংস করা। বাকুনিনের ধ্বংসমূলক এ মতের পরিপূরক কোনো গঠনমূলক মত ছিল না। তাঁর মতে রাষ্ট্রযন্ত্র বাদে মানুষ স্বাভাবিকভাবে যূথবদ্ধ হয়ে জীবন যাপন করতে সক্ষম। সে সমাজে কারুর কোনো শাসন বা খবরদারী থাকবে না। বাকুনিনের মতের একটি বিপ্লবাত্মক দিক আছে। কার্ল মার্কসও প্রচলিত রাষ্ট্র-ব্যবস্থার উচ্ছেদের কতা প্রচার করেছেন। কিন্তু প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার স্থলে সমাজতন্ত্রবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন মার্কসবাদের অপর অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার সমালোচনার ক্ষেত্রে সাদৃশ্যের কারণে মার্কস বাকুনিনকে প্রথম আন্তর্জাতিকের সদস্য হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মাকর্সবাদী চিন্তার বিরোধিতার ফলে বাকুনিন প্রথম আন্তর্জাতিক থেকে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে বহিস্কৃত হন। মাকর্স-এর সঙ্গে বাকুনিনের মতাদর্শের বিরোধের মূল কারণ ছিল মার্কস বাকুনিনকে হঠকারী বিপ্লবী বলে গণ্য করতেন।
বাকুনিন সমাজ বিপ্লবের পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে যেমন কোনো গঠনমূলক মত পোষণ করতেন না, তেমনি সমাজ বিপ্লবের জন্যও কোনো সুসংবদ্ধ সংগঠন ও আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতেন না। বাকুনিন কৃষক এবং ভবঘুরে সর্বহারাকে বিপ্লবের প্রধান শক্তি বলে বিবেচিত করতেন। কৃষক ও ভবঘুরে সর্বহারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করবে, এই ছিল বাকুনিনের বিশ্বাস। সমসাময়িক সমাজবাদী চিন্তাবিদ প্রুধোর মতামতের প্রভাবও বাকুনিনের মধ্যে লক্ষ করা যায়। ‘ফেডারিলিজম, সোস্যালিজম এ্যাণ্ড এ্যাণ্টি থিওলজিজম’ বলে লিখিত বাকুনিনের গ্রন্থে সমাজের যে পরিকল্পনা বাকুনিন প্রথমে উপস্থিত করেন, তা মূলত প্রুধোর নিকট তেকেই গৃহীত।
বাকুনিনের জীবন ঘটনাবহুল। নিজের মতাদর্শ নিয়ে তৎকালীন বিক্ষুদ্ধ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিপ্লব ও আলোড়নে একাধিকবার অংশগ্রহণ করেন।এর মধ্যে ১৮৪৮-৫০ প্রেগবিপ্লবে তাঁর অংশগ্রহণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। উক্ত ঘটনার পরে রুশদেশে প্রত্যাবর্তনকালে বাকুনিনকে গ্রেপ্তার করে রুশ সরকার সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করে। ১৮৬১ সালে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন থেকে পালায়ন করে জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে বাকুনিন আবার ইউরোপে উপস্থিত হন। রাশিয়ার নারোদনীক পন্থীগণ বাকুনিনের নৈরাষ্ট্রবাদী মতদ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিল। কার্ল মার্কস ব্যতীত ফ্রেডারিক এঙ্গেলস এবং লেলিনও বাকুনিনের নৈরাষ্ট্রবাদী মতের তীব্র সমালোচনা করেন।
Balance of Payments: লেনদেনের ভারসাম্য
কোনো দেশ যখন তার আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে একটা সমতা বজায় রাখে তখন তাকে লেনদেনের ভারসাম্য বলা হয়। লেনদেনের ভারসাম্যে প্রধান ভূমিকা পালন করে দেশ থেকৈ বিদেশে রপ্তানিকৃত দ্রব্যাদি এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত দ্রব্যাদির মূল্য। কিন্তু দ্রব্যের আমদানি-রপ্তানি ব্যতীতও একটি দেশের আমদানি খাতে ব্যয় এবং রপ্তানি খাতে আয় হতে পারে। এরূপ আয়ের উৎস হচ্ছে সাধারণত দেশের মধ্যে বিদেশী পর্যটকদের ভ্রমণাদি এবং এই উপলক্ষে পর্যটকদ কর্তৃক বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে দেশীয় মুদ্রা গ্রহণ। আবার ব্যয়ের কারণও ঘটে দেশীয় নাগরিকগণ যখন বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বিদেশে গমন করেন তখন। এ ছাড়া এক দেশের মধ্যে অপর দেশের ব্যাঙ, বীমা ইত্যাদির ব্যবস্থাপনার খাতেও একটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক মুদ্রার আয় কিংবা ব্যয় ঘটতে পারে। এ সমস্ত আয়-ব্যয় উৎপাদিত দ্রব্যাদির আমদানি কিংবা রপ্তানির ভিত্তিতে ঘটে না বলে বৈদেশিক মুদ্রার এরূপ আমদানি রপ্তানিকে অদৃশ্য আমদানি কিংবা অদৃশ্য রপ্তানি বলে অভিহিত করা হয়।
Balance of Power: শক্তির ভারসাম্য
শক্তির ভারসাম্য একটি দেশের কূটনীতির ক্ষেত্রে অনুসৃত কৌশলের ব্যাপার। একটি রাষ্ট্র যদি তার বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে এরূপ কৌশল অবলম্বন করে কিংবা করার চেষ্টা করে যাতে তার নিজের রাজনীতিক, অর্থনীতিক এবং সামরিক শক্তিকে আর কোনো রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রগোষ্ঠীয় অনুরূপ শক্তি অতিক্রম করে যেতে না পারে তা হলে এই কৌশলকে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার কৌশল বলা হয়। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে থেকে প্রথম মহাযুদ্ধ পর্যস্ত ইংরেজ সরকার ইউরোপের ক্ষেত্রে এই কূটনীতিক কৌশল অনুসরণ করে চলছিল। ইউরোপে তখন একদিকে ছিল জার্মানি, অষ্ট্রিয়া এবং ইতালির ত্রয়ী-জোট এবং অপর দিকে ছিল ইংরেজ, ফরাসি এবং রাশিয়ার ত্রয়ী-জোটের শক্তি। এই দুই জোটের পারস্পারিক লক্ষ্য ছিল যেন প্রতিপক্ষ তাকে অতিক্রম করে যেতে না পারে। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে ইউরোপে জার্মানি যখন ক্রমান্বয়ে পররাজ্য গ্রাস করে নিজ পক্ষের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে তখন ইংল্যাণ্ড তার পাল্টা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে অক্ষম হয়। এই পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার নাজিবাদী জার্মানির প্রতি তোষণনীতি অবলম্বন করে। বস্তুত প্রথম মহাযুদ্ধের পরে ১৯১৭ সালের রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্রমে বিরাট রুশদেশে ধনবাদের প্রতি-ব্যবস্থা হিসাবে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা পুরাতন ভারসাম্যব্যবস্থাকে ধনবাদী যে কোন রাষ্ট্রের নিকট অপ্রয়োজনীয় এবং অকেজো করে তোলে। এখন থেকে ধনবাদী এবং সমাজতন্ত্রী শক্তির মধ্যে ভারসাম্যের প্রশ্নটির সূচনা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত ধনবাদী ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রসমূহের বিশ্বাস ছিল যে, সমাজতন্ত্রী ব্যবস্থা ও শক্তি দীর্ঘজীবি হবে না। তারা সমাজতন্ত্রিক শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার বিষ্ময়কর বিজয়, অধিকতর দেশসমূহের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং জার্মানির মতো দুর্ধর্ষ ধনবাদী রাষ্ট্রের পরাজয় এই বিশ্বাসকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে ধনবাদী রাষ্ট্রসমূহের প্রধান শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমাজতন্ত্রকে প্রধান প্রতিপক্ষ বলে গণ্য করে তার সঙ্গে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার নীতি অনুসরণ করতে থাকে। বর্তমানে শক্তির ভারসাম্য বলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত রাশিয়ার পারস্পারিক শক্তির সমতা বুঝায়।
নব্বই-এর দশকের গোড়াতে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পতনের পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক প্রাধান্য সৃষ্টির পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে।
Basic Democracy: মৌলিক গনতন্ত্র
১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্থানের সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক ফিল্ড মার্শাল মুহম্মদ আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে দেশের পার্লামেণ্টারী শাসন-ব্যবস্থা বাতিল করেন এবং স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসনের ক্ষেত্রে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে একটি শাসন-ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এই ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য ছিল দেশের পার্লামেণ্ট, প্রাদেশিক পরিষদ এবং প্রেসিডেণ্ট নির্বাচনে পরোক্ষ নির্বাচনের পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা। এই উদ্দেশ্যে সমগ্র দেশকে নির্দিষ্ট সংখ্যক নির্বাচকমণ্ডলীতে ভাগ করা হয় জনসাধারণ এই নির্বাচকমণ্ডলী প্রেসিডেণ্টকে নির্বাচিত করত এবং যথাক্রমে জাতীয় পরিষদ এই অধিকার ব্যতীত পর্যায়ক্রমে ইউনিয়ন, থানা, জেলা ও বিভাগীয় কাউন্সিলে অংশ গ্রহণের কম বেশি অধিকার দেওয়া হয়। এক হাজার অধিবাসীর ভিত্তিতে একজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ প্রথম পর্যায়ে ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠন করত। কিন্তু পরবর্তী থানা পর্যায়ে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানগরই মাত্র থানা কাউন্সিলের সদস্য এবং থানা কাউন্সিলের সদস্যদের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণই জেলা কাউন্সিলে, আবার জেলা কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্যদের নির্বাচনে বিভাগীয় কাউন্সিলের সদস্যগণ নির্বাচিত হত। ফলে জনসাধারণের প্রত্যক্ষ ভোটদানের ক্ষমতা নির্বাচকমন্ডলীর নির্বাচনেই সীমাবদ্ধ ছিল। জাতীয় পরিষদ, প্রাদেশিক পরিষদ কিংবা প্রেসিডেণ্টের নির্বাচনে জনসাধারণের প্রত্যক্ষ অধিকার ছিল না। স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসনের ক্ষেত্রেও প্রাথমিক পর্যায়ের ইউনিয়ন কাউন্সিল ব্যতীত অপর স্তরগুলিতে ক্রমাধিক পরোক্ষ নির্বাচন এবং সীমিত অধিকারের ব্যবস্থা করা হয়। প্রেসিডেণ্ট আইয়ুব খান অভিমত পোষণ করতেন যে, দেশের জনসাধারণ পার্লামেণ্টারী গণতন্ত্রের উপযুক্ত নয়। তাঁর প্রবর্তিত ব্যবস্থাকে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নাম দিয়ে তিনি জনসাধারণকে এই বলে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিলেন যে, জনসাধারণ হচ্ছে মূল এবং সেখানে গণতন্ত্র প্রবর্তন করাই হচ্ছে মৌলিক গণতন্ত্র। এবং মৌলিক গণতন্ত্র হচ্ছে সেরা গণতন্ত্র। কার্যত মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল জনসাধারণকে দেশের জাতীয় সমস্যার আলোচনা ও সমাধানের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার একটি সুকৌশল স্বৈরতান্ত্রিক প্রচেষ্টা। স্থানীয় শাসনের ক্ষেত্রেও জনসাধারণের কোনো কার্যকর অধিকার ছিল না। প্রতিটি স্তরে আমলাতন্ত্রকে জনসাধারণের প্রতিনিধিদের উপর খবরদারির অধিকার দেওয়া হয়েছিল এবং ১৯৫৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত ইউনিয়ন ও জেলা বোর্ডের প্রতিনিধিগণ স্বায়ত্ত্বশাসনের যে অধিকার ভোগ করত সে অধিকারও মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্তায় বিলুপ্ত করা হয়। ১৯৬৯-৭০-এর গণআন্দোলনে আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন এবং কাঁর মৌরিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার বিলোপ ঘটে।
ক্ষমতায় আরোহণ করার পর জনসাধারণের রাজনৈতিক অধিকার সঙ্কুচিত করার প্রবণতা উচ্চতর শ্রেণীর শাসকদের একটি সাধঅরণ প্রবণতা। ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ ছিল এই প্রবণতারই প্রকাশ।
Basis and Supersructure: মূল ও উপরিকাঠামো
সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদের সঙ্গে তার সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রনৈতিক, ধর্মীয় এবং অন্যান্য অংশের সম্পর্কের ব্যাখ্যায় মার্কসবাদী দর্শন ‘মূল এবং উপরি-কাঠামো’ নামক দুটি শব্দ ব্যবহার করে। মার্কসবাদের মতে যে-কোনো সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদই হচ্ছে সমগ্র সমাজের মূল বুনিয়াদ। সমাজ বিকাশের যে-কোনো বিশেষ পর্যায়ে উৎপাদনের উপায় অর্থ্যাৎ জীবিকা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় হাত-পা, মস্তিস্ক এবং যন্ত্রপাতির মালিকানার ভিত্তিতে গঠিত হয় সেই পর্যায়ের অর্থনেতিক বুনিয়াদ। সংক্ষেপে একে বলা হয় ‘উৎপাদনের উপায় এবং উৎপাদনের সম্পর্ক’। উৎপাদনের উপায় এয সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত মূল বুনিয়াদের উপরই রচিত হয় সে সমাজের আইন-কানুন, নিয়ম-নিষেধ, মতামত, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি। অর্থনৈতিক বুনিয়াদের উপর রচিত এই কাঠামোকে মার্কসবাদ বহির্গঠন, উপরি-কাঠামো বা সুপার স্ট্রাকচার বলে অভিহিত করে।
অর্থনৈতিক বুনিয়াদ বা সমাজের মূল কাঠামো অনুযায়ী তার বহিঃকাঠামো গঠিত হয়। যে সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ হচ্ছে দাসের দৈহিক শ্রমের মালিকানার ভিত্তিতে প্রভুদের সম্পদ সৃষ্টি সে সমাজের বহিঃকাঠামোর মধ্যে অবশ্যই এই মূল কাঠামোর রাষ্ট্রনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অপরাপর ভাবগত প্রয়োজন প্রতিফলিত হবে। আবার মূল কাঠামোর অন্তর্নিহিত বিরোধও বহিঃকাঠামোর ভাবদর্শের ক্ষেত্রে প্রকাশ পাওয়ার চেষ্টা করবে। এই বিচারে কোনো সমাজের বহিঃকাঠামোর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ ঘটলে তার সঠিক প্রকৃতি বিচারে সে সমাজের মূল কাঠামোর বিশ্লেষণ আবশ্যক।
সমাজ বিকাশের মূল কাঠামোর পরিবর্তনের পরে উপরি-কাঠামোতে পরিবর্তন আসে। একারণে মূলকাঠামোর পরিবর্তন ব্যতীত ইচ্ছা করলেই কেউ উপরিকাঠামোতে স্থায়ী কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। সমস্ত সমাজের মূল অর্থনৈতিক কাঠামো যখন পরিবর্তিত হয়ে পুঁজির মালিকানা-ভিত্তিক নতুনতর অর্থনৈতিক বুনিয়াদ তৈরি হয়েছে তখনি সামন্ত সমাজের ভাবনা-চিন্তা, আইন-কানুন, বিশ্বাস-অবিশ্বাস বিলুপ্ত হয়ে নতুন বহিঃকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মার্কসবাদের মতে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বুনিয়াদের পরিবর্তনের মাধ্যমেই মাত্র তার পুঁজিবাদী বহির্গঠন পরিবর্তিত হয়ে সমাজবাদী বহির্গঠন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
মার্কসবাদের মূল দর্শন দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মতে সমাজের মূল কাঠামো এবং বহিঃকাঠামোর মধ্যকার সম্পর্ক কেবল একমূখী নয় এ সম্পর্কের চরিত্রও দ্বন্দ্বমূলক এবং দ্বিমূখী। কেবল যে মূল কাঠামো সমাজের বহিঃকাঠামোকে নিয়ন্ত্রিত এবং প্রভাবান্বিত করে, তাই নয়। বহিঃকাঠামো গঠিত হওয়ার পরে তার মধ্যকার বিভিন্ন সামাজিক ব্যবস্থা, আইন-কানুন, অর্থনৈতিক শ্রেণীসমূহের সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তাধারাও মূল গঠনকে প্রভাবান্বিত করে। অর্থনৈতিক বুনিয়াদের বিকাশ ও ক্রিয়াশীলতার ক্ষেত্রে তার বহিঃকাঠামোর বিভিন্ন অংশও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
একটি ভাব বস্তু বা বাস্তব অবস্থা থেকে উদ্ভূত হয়। কিন্তু একবার উদ্ভূত হলে সে ভাব বাস্তব অবস্থাকেও পরিবর্তত করতে পারে। মার্কসবাদের এ্ই অভিমতটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। মার্কসবাদের মতে ব্যক্তিগত মালিকানা-ভিত্তিক সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ বা মূল কাঠামোর সঙ্গে তার বহিঃকাঠামোর সম্পর্কের অপর দিকটি হচ্ছে বিরোধাত্মক। অর্থনৈতিক বুনিয়াদের মধ্যকার শ্রেণীগত বিরোধ বহিঃকাঠামোর মধ্যেও প্রতিফলিত হয়। কালক্রমে এই বিরোধ মূল কাঠামো পরিবর্তনের আন্দোলনের রূপ লাভ করে। একটি সমাজের সামগ্রিক কাঠামোর মূল ও বহির্ভাগের বিভাগ ও বেশিষ্ট্য স্বাভাবিক। মার্কসবাদের মত অনুযায়ী এই উভয় দিকের পারস্পারিক সম্পর্কের বিরোধাত্মক চরিত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজে আর থাকতে পারে না। কারণ সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক বুনিয়াদের শ্রেণীতে শ্রেণীতে মারাত্মক বিরোধের অবকাশ নেই। এ কারণে তার উপরি-কাঠামোর মধ্যেও আপসহীন বিরোধের উদ্ভব ঘটে না। তখন সমাজের মূল গঠন এবং বহির্গঠন সংযুক্তভাবে সমগ্র সমাজের অধিতকর অর্থনৈতিক উন্নতি এবং সুসমঞ্জস সভ্যতা বিকাশের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে।
Bastille, fall of: বাস্তিলের পতন
১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই বাস্তিলের পতন অত্যাচারী ফরাসি সম্রাটের বিরুদ্ধে জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সূচক বলে ইতিহাসে পরিগণিত হয়। বাস্তিল দুর্গ ছিল প্যারিস শহরে ফান্সের বিখ্যাত কারাগার। স্বৈরতান্ত্রিক সম্রাট এবং সামন্তবাদী শাসন ও অত্যাচারের প্রধান প্রতীক হিসাবে বাস্তিল দুর্গ জনসাধারণের মনে সর্বাধিক ঘৃণা এবং ক্রোধের সৃষ্টি করেছিল। বিপ্লব শুরু হলে প্যারিস শহরের একটি কারখানার শ্রমিকদের নেতৃত্বে বিক্ষুদ্ধ জনতা বাস্তিল দুর্গকে আক্রমণ করে এবং দুর্গের সশস্ত্র বাহিনীকে পর্যদস্ত করে দুর্গের দ্বার ভেঙ্গে ফেলে দুর্গের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। জনতার হাতে দুর্গের শাসক নিহত হয়। সমগ্র ফ্রান্সের নির্যাতনের প্রতীক হিসাবে জনতা এরপরে দুর্গকে একেবারে ভূমিসাৎ করে ফেলার জন্য তার প্রাচীরের পাথর একটি একটি করে খুলে ফেলতে আরম্ভ করে। ১৪ জুলাই বাস্তিলের পতন দিবসকে আজো ফরাসি দেশের জনসাধারণ শক্তির দিবস হিসাবে পালন করেন। বাসিবতল আক্রমণের লক্ষ্য এবং এর পতনের তাৎপর্য নিয়ে ইতিহাসের গবেষকদের মধ্যে মতের পার্থক্য আছে। অনেকে মনে করেন যে, বাস্তিল দুর্গে রাজনীতিক বন্দিদের মুক্তির জন্য জনতা বাস্তিল আক্রমণ করেছিল, একথা ঠিক নয়। আসলে জনতার প্রধঅন লক্ষ্য ছিল দুর্গের অস্ত্র দখল করা। কিন্তু একথা ঠিক যে, বাস্তিলের পতনের মধ্যে দিয়ে বিপ্লবী আক্রমণের উদ্যোগ ব্যপকতম জনসাধারণের হাতে চলে গিয়েছিল। এদিক দিয়ে ফরাসি বিপ্লবের সবচেয়ে নাটকীয় এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল বাস্তিলের পতন। এই ঘটনার পরে জনসাধারণের প্রতিনিধিদের জাতীয় পরিষদই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উৎস হয়ে দাঁড়ায়।
Behaviourism: আচরণবাদ, ব্যবহারবাদ
আধুনিক মনোবিজ্ঞানে ‘বিহেভিয়রিজম’ একটি নতুন ধারা। বাংলায় একে আচরণবাদ বা ব্যবহারবাদ বলে আখ্যায়িত করা হয়। প্রাগমেটিজম বা প্রয়োগবাদ কিংবা কার্যবাদ নামক আধুনিক দার্শনিক তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রধাণত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মনোবিজ্ঞানের আচরণবাদ তত্ত্বের বিকাশ ঘটে; এ তত্ত্বের প্রথম প্রবক্তা ছিলেন চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন বি. ওয়াটসন (১৮৭৮-১৯৫৮)। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ওয়াটনসনের পূর্বগামী হিসাবে থর্নডাইকের (১৮৭৪-১৯৪৯) উল্লেখ করা যায়। জীব-জন্তুর আচরণের উপর থর্নডাইক যে সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন ওয়াটসন তাকেই মনোবিজ্ঞানের নতুন তত্ত্বে ব্যবহার করেন।
আচরণবাদ বা ব্যবহারবাদের ক্ষেত্রে ‘আচরণ’ বা ‘ব্যবহার’ শব্দ বিশেষ অর্থ বহন করে। সাধঅরণ জীবনে ‘ব্যবহার’ বা আচরণের সঙ্গে ভালো-মন্দের একটি প্রশ্ন জড়িত থাকে। এবং ব্যবহার বা আচরণ বলতে আমরা কোনো অবস্থায় মানুষের মনের উদ্যোগে গৃহীত কোনো প্রতিক্রিয়ার কথা বুঝাই। সে দিক থেকে অনিচ্ছাকৃত বা বাধ্যতামূলক কোনো প্রতিক্রিয়াকে ব্যবহার বা আচরণ বলঅ হয় না। যেমন একটি আলপিন দিয়ে কারুর আঙুল বিদ্ধ করলে সে হাত টেনে নেয় বা বেদনার্ত চিৎকার করে ওঠে। এ প্রতিক্রিয়া সাধারণ অর্থে ব্যবহার বা আচরণ নয়। কিন্তু আচরণবাদী মনোবিজ্ঞানীর নিকট উল্লিখিত প্রতিক্রিয়াটি ব্যক্তির একটি আচরণ বা ব্যবহার।
আচরণবাদের উদ্ভব ঘটে মনসর্বস্ব কায়েমী মনোবিদ্যার প্রতিবাদ হিসাবে। এতদিন পর্যন্ত এই তত্ত্বই গৃহীত হয়ে আসছিল যে, মানুষের জীবনে মনই হচ্ছে আসল সত্তা। মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুযায়ী মানুষ পরিবেশের সঙ্গে ব্যবহার করে। কিন্তু মন অদৃশ্য এবং অস্পশ্য। এ তত্ত্বের হেরফের কিছু যে না ঘটছে তা নয়। মনের সঙ্গে দেহের সম্পর্ক স্থাপন করারও চেষ্টা হয়েছে। মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে ভুনড ঘড়ি ধরে মাপার চেষ্টা করেছেন। ডারউইন, মরগান, স্পেন্সার প্রমুখ জীববিজ্ঞানীগণও মনকে পরিবেশ-নির্ভর বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন। স্পেন্সার ব্যাক্তি বা সাধারণভাবে মানুষের জীবনকে পরিবেশের সঙ্গে ক্রমাধিকভাবে খাপ খাইয়ে চলার প্রক্রিয়া হিসাবে দেখিয়েছেন।
কিন্তু কায়েমী মনোবিদ্যার বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ আসে আচরণবাদী এবং পাভলভ-পন্থীদের পক্ষ থেকে। আচরণবাদের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াটসন ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতায় কায়েমী মনোবিদ্যার বিরুদ্ধে নিন্মোক্ত যুক্তিগুলি উপস্থিত করেন: (১) অদৃশ্য এবং অস্পশ্য মনকে চরম বলে স্বীকার করলে মনোবিদ্যা কেবল দার্শনিক তত্ত্ব হয়ে থাকবে; মনোবিদ্যা মনোবিজ্ঞানের রূপান্তরিত হতে পারবে না। কারণ মনকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা চলে না। (২) কায়েমী মনোবিদ্যার অন্তদর্শন বা ইনট্রোসপেকসন পদ্ধতি মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর পদ্ধতি নয়। এ পদ্ধতি দ্বারা শিশু কিংবা পাগল, কারুর মনের খবরই জানা সম্ভব নয়। এ পদ্ধতি ব্যক্তির জীবনকে দুর্জ্ঞেয় করে রাখে। এমনকি ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বা বুদ্ধির পরিমাপও অন্তদৃষ্টির মারফত করা সম্ভব নয়।
এই সমালোচনার ভিত্তিতে আচরণবাদ মনোবিজ্ঞানের নতুন তত্ত্ব উপস্থিত করে। ওয়াটসন বললেন, মানুষের সমস্ত প্রকার ব্যবহারের কার্যকরণ সুত্র উদ্ধার কর মানুষের উন্নততর জীবনের জন্য আবশ্যক। এ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে যদি মানুষের ব্যবহার নিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা পরিচালিত হয়। আলপিন বিদ্ধ হলে জীবন্ত ব্যক্তির দেহ বিশেষ আচরণ করতে বাধ্য। আলপিন এখানে স্টিমুলাস বা উত্তেজক। মনুষ্যেতর জীবও এরূপ ক্ষেত্রে একই ব্যবহার করে। এ উত্তেজক যখনই প্রয়োগ করা হবে, তখনি ব্যক্তি এইরূপ আপরণ করবে। মনের ইচ্ছায় আচরণের কোনো মৌলিক পার্থক্য ঘটবে না। এরূপে ব্যক্তির যে-কোনো ব্যবহারই কোনো একটি উত্তেজকের প্রয়োগে দেহের প্রতিক্রয়া বিশেষ। যে-প্রতিক্রিয়াকে মানসিক বলে বিবেচনা করা হয় বা হত, সে-আচরণকেও উত্তেজক বা উদ্দীপক প্রয়োগের প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখানো চলে। যেমন রুশ জীববিজ্ঞানী পাভলভ তাঁর কুকুরের পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, খাদ্য দেখে কুকুরের জিহ্বায় লালা নিঃসরণ কুকুরের মনের ক্রিয়া বলে মনে করা হলেও খাদ্যের বদলে একটি শব্দ দ্বারাও কুকুরের জিহ্বাকে লালাসিক্ত করা যায়। এজন্য তিনি প্রথম খাদ্যের সঙ্গে শব্দের উদ্দীপকও প্রয়োগ করতেন। পরবর্তীকালে খাদ্য বাদে কেবল শব্দের উত্তেজক কুকুরের জিহ্বা লালাসিক্ত আরম্ভ করেঅ কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, মানুষের যে-কোনো ক্রিয়াই উত্তেজকের প্রতিক্রিয়া এবং যে-কোনো প্রতিক্রিয়াকেই উত্তেজক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করা চলে। অর্থ্যাৎ উত্তেজক বা পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ব্যক্তির প্রতিক্রিয়াও নিয়ন্ত্রণ কার সম্ভব। শিশুর মধ্যে জন্মগত প্রতিক্রিয়ার সংখ্যা সামান্য। শিশু ক্রমান্বয়ে যেরূপ উত্তেজক বা পরিবেশ লাভ করে সেইরূপ প্রতিক্রিয়া দ্বারা সে গঠিত হয়। উত্তেজকের ভিত্তিতে গঠিত প্রতিক্রিয়ার বংশপরাস্পরা হওয়ার কোনো উপায় নেই।
আচরণবাদের এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে বুঝা যায় যে, আচরণবাদ মন বা চেতনার কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব স্বকিার করে না। এবং আচরণবাদকে চরম আকারে গ্রহণ করলে মানুষের ব্যবহার উত্তেজক প্রয়োগমাত্র দেহের যান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া ব্যতীত আর কিছুই নয়। একথা সত্য যে, আচরণবাদ মনোবিদ্যাকে মনোবিজ্ঞানে পরিণত করার ক্ষেত্রে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সাহসিক পদক্ষেপ। মনময় হয়ে মনোবিদ্যা এতকাল যে তত্ত্বমার্গে আবদ্ধ ছিল সেখান থেকে আচরণবাদ তাকে বাস্তব পরীক্ষাগারে এনে মানুষের শিক্ষাগত, সমাজগত, জীবিকাগত দিকগুলিকে ক্রমাধিক পরিমাণে সুনির্দিষ্ট এবং ফলপ্রসূ করে তুলেছে। তবে আচরণবাদের চরম ব্যাখ্যা অর্থ্যাৎ মানুষের ব্যবহার ‘উত্তেজক-প্রতিক্রিয়া’ ব্যতীত কিছুই নয় এবং মানুষ্যেতর জীবের সঙ্গে তার ব্যবহারের কোনো পার্থক্য নেই, এরূপ অভিমত দ্বিধাহীনভাবে গৃহীত হয় না। অনেক আচরণবাদী মানুষের জটিল ব্যবহার ব্যাখ্যার জন্য সম্প্রতিকালে ইণ্টারমিডিয়েট ভেরিয়েবলস বা ‘মধ্যবর্তী ব্যত্যয়’-রূপ ধারণাও গ্রহণ করতে শুরু করেছেন।
Bellarmine, Roberd: রবার্ট বেলারমিন (১৫৪২-১৬২১ খ্রি.)
মধ্যযুগের একজন বিখ্যাত ক্যাথলিক লেখক। ফরাসিদেশের জেসুইটপন্থী ধর্মযাজক। খ্রিষ্ট ধর্মের গির্জার শাসনে পোপের ঐশ্বরিক অধিকারের বিষয় নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বেলারমিন সরকারের প্রকার ভেদ নিয়েও আলোচনা করেন। শাসনের প্রশ্নে বেলারমিন অভিজাততন্ত্রকে নাকচ করেন। তাঁর মতে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র হচ্ছে সর্বোত্তম সরকার। কিন্তু একজন আদর্শ চরিত্রবান রাজা পাওয়া মানুষের ভাগ্যে কদাচিৎই ঘটে। সে কারণে জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান দ্বরা রাজার যদৃচ্ছা শাসনকে নিয়ন্ত্রিত করার ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। কারণ রাষ্ট্র শাসনের মূল অধিকার জনগনের। রাজার হস্তে জনসাধারণই শাসনের অধিকার ন্যস্ত করে। অর্থ্যাৎ জনগণকে শাসন করার রাজার ঐশ্বরিক অধিকারের কথা বেলারমিন অস্বীকার করেন। গীর্জা এবং রাষ্ট্রের সম্পর্কের প্রশ্নে বেলারমিন এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, গীর্জার শাসন এবং রাষ্ট্রের শাসন পরস্পর পৃথক। মানুষের লৌকিক ব্যাপারে পোপের কোনো প্রত্যক্ষ অধিকার থাকতে পারে না। পোপের অধিকার ধর্মীয় বিষয়ে সীমাবদ্ধ। তবে রাষ্ট্রের শাসক ধর্মের বিরোধী কোনো আইন প্রবর্তন করার চেষ্টা করলে পোপের অধিকার থাকবে সেরূপ আইনকে নিবৃত করার জন্য হস্তোক্ষেপ করার এবং গীর্জার অলঙ্ঘনীয়তাকে শাসক আক্রমণ করলে শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার গীর্জার থাকবে। ফরাসি আইনবিদরা বেলারমিন এরূপ হস্তক্ষেপমূলক অভিমতের তীব্র সমালোচনা করেন।
Bentham, Jeremy: জেরেমী বেনথাম (১৭৪৮-১৮৩২ খ্রি.)
অষ্টাদশ শতকের ইংল্যাণ্ডের প্রখ্যাত নীতিশাস্ত্রবিদ এবং আইনের ব্যাখ্যাতা। নীতিশাস্ত্রের ক্ষেত্রে জেরেমী বেনথামকে ইউটিলিটারিয়ানিজম বা উপযোগবাদের প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয়। নীতিশাস্ত্রের ন্যায়-অন্যায় এবং ভালো-মন্দ প্রশ্নের আলোচনা করে বেনথাম বলেন যে, নীতি বা ন্যায়ের মূলে রয়েছে কার্যের প্রয়োগ বা সার্থকতার প্রশ্ন। একটা কার্য ভালো বা ন্যায্য বলে বিবেচিত হবে তার প্রয়োগ বা সার্থকতার ভিত্তিতে। সার্থকতা কি? কোনো কাজের ফলে সৃষ্ট সুখই হচ্ছে সে কাজের সার্থকতা। ব্যক্তি যখন কোনো কাজ করে তখন সে সুখ লাভ করার জন্যই ইহার সম্পাদন করে। আকাঙ্ক্ষিত সুখ লব্ধ হলেই কাজটি সার্থক এবং ন্যায্য। সুখের পরিবর্তে দুঃখের লাভ ঘটলে ব্যক্তির কাছে সে কাজ অসার্থক। সুখের এ ব্যাখ্যা একেবারেই ব্যক্তিক। সুখের এই ব্যক্তিক ব্যাখ্যাকে হিডোনিজম বা আত্মসুখবাদ বলে প্রচার করতে চান নি। সে জন্য উপযোগ বা সুখের ব্যাখ্যাকে ব্যাপক করে তিনি সুখ বলতে সামাজিক সুখকেও বুঝাতে চেয়েছেন। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে উপযোগবাদের এই তত্ত্বকে সম্প্রসারিত করে বেনথাম বলেছেন যে, রাষ্ট্রের যে-কোনো আইন বা কার্যের সার্থকতার পরিমাপ হবে অধিকতম সুখের বিধান দ্বারা। সুখকেই কাজের সার্থকতার মাপকাঠি করা, আবার অধিক সংখ্যকের সুখ বিধানের সুপারিশের মধ্যে বেনথাম-তত্ত্বের স্ববিরোধিতা প্রকট হয়েছে। এর কারণ, বেনথাম একদিকে যেমন তৎকালীন ইংল্যাণ্ডের পুঁজিবাদী সমাজের ব্যক্তিকেন্দ্রীকতার পরিপোষক ছিলেন তেমনি অপরদিকে মানবিকতার বোধ থেকে তিনি সে সমাজের বৈষম্য এবং সুখের সামাজিক বণ্টনে ভারসাম্যহীনতাকেও অস্বীকার করতে পারেন নি। এ বিরোধিতার সমঝোতা করার জন্য বেনথাম বলেছেন যে, ব্যক্তিগত সুখ এবং সামাজিক সুখের মধ্যে আসলে বিরোধ নেই। একের সুখেই বহুর সুখ। আবার বহুর সুখেই একের সুখ। আত্মসুখ সাধনের মাধ্যমে মানুষ অপরের সুখও সাধন করতে পারে। কারণ সুখ মানে কেবল দেহের আরাম নয়। বিপন্নকে উদ্ধার করার জন্য জীবদানের মধ্যেও সুখ নিহিত আছে। আর সে সুখই উত্তম সুখ।
নিজের মানবতা বোধ থেকে বেনথাম ইংল্যাণ্ডের আইনের সংস্কারের চেষ্টা করেন। ফরাসি বিপ্লবের বৎসর ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বেনথামের ‘ফ্রাগমেণ্ট অন গভার্নমেণ্ট’ বা সরকার সংক্রান্ত মতামত উপস্থিত করেন। বেনথাম বলেন, রাষ্ট্রের যে-কোনো বিধান বা কাজের লক্ষ্য হবে সর্বাধিক সংখ্যক অধিবাসীর সর্বাধিক পরিমাণ সুখের বিধান করা। ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের কোনো কাজ ন্যায় কিংবা অন্যায় তা নির্ধারিত হবে সে কাজের ফলে সে সুখ লব্ধ হবে কিংবা বিনষ্ট হবে, তার তুলনামূলক পরিমাণ দ্বারা। রাষ্ট্রের কোনো শাস্তিমূলক বিধানের সার্থকতার মাপকাঠিও এইরূপ হবে। এ বিধান যাদের উপর প্রযুক্ত হবে তাদের সুখের পরিমাণ এর প্রয়োগে যদি বৃদ্ধি পায় তবেই এ বিধান ন্যায্য। অন্যথায় এ বিধান অন্যায্য।
তৎকালীন ইংল্যাণ্ডের রাষ্ট্রীয় বিধানের অধিকাংশই ছিল অলিখিত। আইনের বিশ্লেষণ করে বেনথাম বলেন, রাষ্ট্রের যে কোনো বিধানেরই একটি খারাপ দিক আছে। এর দ্বারা আহত ব্যক্তির সুখ বিনষ্ট হয়। কিন্তু বিনষ্ট পরিমাণের চেয়ে লব্ধ সুখের পরিমাণ অধিক হওয়া মধ্যেই এ বিধানের ন্যায্যতা নিহিত। প্রত্যেক বিধানের আরো দুটি দিক আছে। একটি তার অধিকারের দিক, অপরটি তার দায়িত্বের দিক। যেমন রাষ্ট্র, তেমনি ব্যক্তি উভয়রে ক্ষেত্রে এ সত্য। এ কারণে প্রত্যেক রাষ্ট্রীয় আইনের অধিকারও দায়িত্ব উভয় দিক সম্পর্কে নাগরিকমাত্রেরই ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। সে জন্য আইনকে বিধিবদ্ধ, প্রকাশিত এবং প্রচারিত হতে হবে।
বেনথামের নীতিশাস্ত্রীয় তত্ত্বে স্ববিরোধিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তা ছাড়া তিনি সুখের পরিমাণকে আঙ্কিক হিসাবে পরিমাপ করা যায় বলেও মনে করতেন। কিন্তু সুখের পরিমাণের এরূপ আঙ্কিক পরিমাপ সম্ভব বলে তাঁর পরবর্তী অনুসারীগণ মনে করতেন না। কন্তু স্ববিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁর নীতিতত্ত্বে একটি মানবতাবোধের পরিচয় আছে। এই বোধ থেকে তাঁর আইনের বিশ্লেষণ এবং আইন বিধিবদ্ধ করার প্রয়াস ইংল্যাণ্ডের সামাজিক অর্থনৈতিক জীবনে বহু সংস্কারের সূচনা করে।


Bergson, Henri: হেনরী বার্গসঁ (১৮৫৯-১৯৪১ খ্রি.)
আধুনিক ভাববাদের প্রখ্যাত ফরাসি প্রবক্তা। বার্গসঁ বহু গ্রন্থের রচয়িতা। এই সমস্ত গ্রন্থের মধ্যে ‘সময় এবং স্বাধীন ইচ্ছা’ এবং সৃজনশীল অভিব্যক্তি বিশ্বব্যাপী পরিচিত। উক্ত গ্রন্থ দুখানার ইংরেজী অনূদিত নাম হচ্ছে টাইম এ্যান্ড ফ্রি উইল এবং ক্রিয়েটিভ ইভোল্যুশন।
বার্গসঁর ভাবধারা জটিল এবং দুর্বোধ্য। তবে তাঁর অভিমনের মূল বলে যা স্বীকৃত সে হচ্ছে এই যে, বার্গসঁ জ্ঞানের ক্ষেত্রে যুক্তির পদ্ধতি এবং সত্যের ক্ষেত্রে বস্তুর অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। সাধারণভাবে বার্গসঁকে জীবনকাল বিস্তৃত ছিল। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধ এবং বিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ফরাসি দেশ এবং ইউরোপের বিবর্তমান সমাজের তিনি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। ধনতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার স্বর্ণযুগ অস্তমিত। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক সঙ্কট, সংঘাত, বিদ্রোহ, বিপ্লব, মহাসমর, অরাজকতা সভ্যতার শিখরে উন্নীত মানুষের জীবনে দুরারোগ্য ব্যাধি বলে বার্গসঁর মনে হয়েছে। মানুষ আত্মবিনাশকারী সংঘর্ষের নিরসন করে সুস্থ স্বাভাবিক নতুন মানব সমাজ তৈরি করতে পারে, এ জীবনবাদের উপর তাঁর আস্থা ছিল না। আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের জন্য এ এক সঙ্কটময় পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির দুটি পথ। এক, মানুষের সৃজনশীল ক্ষমতার উপর আস্থা রেখে বাস্তব সঙ্কট ও অরাজকতার কারণ দূর করে নতুন সমাজ তৈরির কার্যে এবং ভাবধারায় অংশগ্রহণ করা; দ্বিতীয় পথ হচ্ছে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এবং বস্তুর সত্যাসত্যতার প্রশ্ন তুলে চিন্তার জাল বুনে চলা। এ পথ যাঁরা আধুনিক যুগে গ্রহণ করেছেন, বার্গসঁ তাঁদের অন্যতম। অবশ্য এ পথ কেভল যে ব্যক্তিগত স্বার্থ সাধন করে, তা নয়। ক্ষয়িষ্ণু সঙ্কটগ্রস্ত ধনতান্ত্রিক সমাজের এটাই হচ্ছে অপরিহার্য দর্শন। অবাস্তব চিন্তার জালে বাস্তব সঙ্কট ও তার কারণকে আড়াল করে সে সঙ্কটের মূল রক্ষা করার প্রয়াস হচ্ছে এ দর্শনের লক্ষ্য। এ বিচারে বার্গসঁ অসাধারণ লেখনীর ক্ষমতা প্রয়োগে এক জটিল মায়ারাজ্য রচনা দ্বারা আধুনিক ধনতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকের মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
‘টাইম এ্যাণ্ড ফ্রি উইল’ পুস্তকের মধ্যে বার্গসঁ তাঁর মতামতকে অত্যন্ত জোরের সঙ্গে উপস্থিত করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান আদৌ কোনো জ্ঞান নয়। মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয় মানুষকে যে জ্ঞান দেয়, সে জ্ঞান হচ্ছে পরিমাপযোগ্য বিভাজ্য বস্তুনিচয়ের জ্ঞান। কিন্তু সত্য হচ্ছে অবিভাজ্য এবং পরিমাপের অযোগ্য। সেই অখণ্ড এবং অপরিমেয় সত্যের জ্ঞান কেবলমাত্র ইনট্যুশন অর্থাৎ উপলব্ধি বা স্বজ্ঞার মারফতই মানুষ লাভ করতে পারে, বুদ্ধি, যুক্তি এবং বাহ্যিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা আমাদের সাধারণ জ্ঞান লাভ করি। কিন্তু এ জ্ঞান অলীক। বার্গসঁর তত্ত্বকে অ-যুক্তিবাদের দর্শন বলেও অভিহিত করা হয়। বার্গসঁ তাঁর স্বজ্ঞার দৃষ্টান্ত এবং ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের অলীকতা বুঝাবার জন্য একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। কোনো ব্যক্তি তার একটি হাত রাখা অবস্থা থেকে তুলল। এই ঘটনার দুটি দিক আছে। একটি হচ্ছে হাতের মালিকের অনুভূতির দিক। এ ব্যাপারে তার অনুভূতি একটি অখণ্ড অনুভূতি। কিন্তু এই ঘটনাটিকে একজন পর্যবেক্ষক যখন দেখে তখন তার কাছ এ ঘটনা হাতের সঞ্চালন প্রক্রিয়ার কতকগুলি মুহুর্ত বা অবস্থা ব্যতীত কিছু নয়। হাত তোলার এটাই ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান। কিন্তু এ জ্ঞান এবং হাত তোলার মুহুর্তে হাতের মালিকের অখণ্ড উপলব্ধি বা স্বজ্ঞার মধ্যে আদৌ কোনো মিল বা সাদৃশ্য নেই। পদ্ধতির দিক থেকে এরা পরস্পর-বিরোধী। কেবল পদ্ধতি নয়। উভয়ের প্রদত্ত ফল বা সত্যও পরস্পর-বিরোধী। স্বজ্ঞা ব্যক্তিকে এ ক্ষেত্রে যে সত্য সম্পর্কে জ্ঞান করে, সাধারণ জ্ঞানের সত্য তার বিরোধী। একটি ঘটনার ক্ষেত্রে যা সত্য, সমগ্র বিশ্ব চরাচর অর্থাৎ জগৎ সম্পর্কে তাই সত্য। বুদ্ধি ও যুক্তি আমাদের সত্যের অলীক ধারণা দেয়। স্বজ্ঞাই কেবল অখণ্ড সত্তা হচ্চে ‘ড্যুরেশন বা স্থিতিকাল’। ‘স্থিতিকাল’ বস্তু নয়, কিন্তু স্থিতিকালই হচ্ছে সমস্ত বস্তুর মূল। স্থান, কাল, পাত্র বলে যে সমস্ত অস্তিত্বের কথা আমরা বলি, বার্গসঁর মতে সেগুলি এই স্থিতির প্রকার-ভেদ।
কেবল বস্তু নয়, বস্তুর বিকাশের প্রশ্নেও বার্গসঁ বস্তুবাদী বিকাশবাদের বিরোধিতা করেন। বিকাশের বস্তুবাদী তত্ত্ব হচ্ছে যে, বস্তু অন্তর্নিহিত বিরোধের মাদ্যমে নিয়ত পরিবর্তমান। কিন্তু ‘স্থিতিকালের’ তত্ত্ব প্রয়োগ করে বার্গসঁ বলেন যে, সমস্ত সত্তার মূলে যেমন স্থিতিকাল, তেমনি সেই স্থিতিকাল একটা প্রাণবেগে অভিব্যক্ত হচ্ছে। খণ্ডিত সত্তার ক্ষেত্রে যেমন একথা সত্য; চরম বা সমগ্র সত্তা সম্পর্কেও একথা সত্য। চরম সত্তা অভিব্যক্ত হয়ে চলেছে এবং এ অভিব্যক্তির মূলে রয়েছে একটা প্রাণাবেগ বা ‘ভাইটাল ইমপালস’। লতা, বৃক্ষ, জীব-জন্তু, সবকিছু প্রাণাবেগে অভিব্যক্ত হয়ে চলেছে। কেবল প্রাণের প্রশ্ন নয়। সপ্রাণ, অপ্রাণ, বস্তুমাত্রের ক্ষেত্রেই প্রাণাবেগ হচ্ছে অভিব্যক্তির কারণ। ‘প্রানাবেগের’ তত্ত্বের ভিত্তিতে বার্গসঁর বিকাশের অভিমত ক্রিয়েটিভ ইভোল্যুশন বা সৃজনশীল অভিব্যক্তিবাদ বলে পরিচিত।
সামাজিক প্রশ্নে বার্গসঁ ছিলেন রক্ষণশীল। সমাজের আর্থিক বৈষম্য, শ্রেণীগত শোষণ ইত্যাদি অন্যায় নয়। এগুলিও স্থিতিকালের অভিব্যক্তি এবং স্বাভাবিক ব্যাপার।

Berkeley George: জর্জ বার্কলে (১৬৮৫-১৭৫৩ খ্রি.)
খ্রিষ্টান ধর্মযাজক এবং অন্যতম ইংরেজ ভাববাদী। প্রাচীন গ্রিসের শ্রেষ্ঠ ভাববাদী দার্শনিক প্লেটো এবং আধুনিক ভাববাদী দার্শনিক কাণ্টের মধ্যবর্তী দীর্ঘ সময়ে জর্জ বার্কলের ন্যায় শক্তিশালী ভাববাদী দার্শনিক আর দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। ধর্মযাজকদের জেহাদী মনোভাব নিয়ে জর্জ বার্কলে চিন্তার জগতে বস্তুবাদী দর্শনকে নস্যাৎ করার পণ গ্রহণ করেন। মধ্যযুগের ধর্মান্ধতা ছিন্ন করে আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন ও সমাজতত্ত্ব ইংল্যাণ্ডে দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হচ্ছিল। ফান্সিস বেকনের পর্যবেক্ষণমূলক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব এবং জন লকের ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সমর্থনমূলক ভাবধারা ইংল্যাণ্ডের নতুন সমাজ-ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা দুরারোগ্য করে তুলছিল। প্রচলিত ধর্মীয় ভাবধারা বিজ্ঞান, দর্শন এবং সমাজতত্ত্বের এই অগ্রগতিতে অতিশয় বিপন্ন বোধ করেন। ধর্মীয় ভাবধারার এই সঙ্কটকালে যাজক পরিবারের সন্তান জর্জ বার্কলে ধর্মকে রক্ষা করা নিজের কর্তব্য হিসাবে গ্রহণ করেন। জর্জ বার্কলের গ্রন্থসমূহের মধ্যে ‘প্রিন্সিপলস অব হিউম্যান নলেজ’ বা ‘মানবজ্ঞানের সূত্রসমূহ’ নামক গ্রন্থ অতিশয় বিখ্যাত। এই গ্রন্থের মধ্যেই বার্কলের দর্শনের মূলকথা লিপিবদ্ধ। অথচ এ গ্রন্থ ১৭১০ অর্থাৎ বার্কলের মাত্র পঁচিশ বৎসর বয়সে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থ তাই দার্শনিক কূটতর্কে অংশগ্রহণে এবং নিজের অভিমত উপস্থাপনে তাঁর বিস্ময়কর ক্ষমতার সাক্ষ্য।
জর্জ বার্কলে তাঁর দার্শনিক অভিমত তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিক জন লকের দার্শনিক মতামতের সমালোচনা এবং জবাব হিসাবে উপস্থিত করেন। তাঁর উল্লিখিত গ্রন্থ ১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত জন লকের ‘এসে কনসারনিং হিউম্যান আণ্ডারস্ট্যাণ্ডিং’ বা মানববিজ্ঞান সম্পর্কিত নিবন্ধের সরাসরি সমালোচনা।
বস্তুজগৎ এবং বস্তুজগতের জ্ঞান সম্পর্কে জন লকের অভিমত ছিল এরূপঃ বস্তু সম্পর্কে পদার্থবিজ্ঞানের সাক্ষ্য যথার্থ। অণুর সম্মেলনেই বস্তু গঠিত। একটা যান্ত্রিক গতিতে বস্তু গতিময় হয়ে আছে। সেই যান্ত্রিক গতিতে ব্সতু গঠিত। একটা যান্ত্রিক গতিতে বস্তু গতিময় হয়ে আছে। সেই যান্ত্রিক গতিতে বস্তু যখন আমাদের ইন্দ্রিয়কে আঘাত করে তখন সে ইন্দ্রিয় সেই আঘাতজনিত অনুভূতিকে মনের মধ্যে বহন করে। এভঅবেই মনের মদ্যে বিশেষ বিশেষ বস্তু সম্পর্কে ভাবের সৃষ্টি হয়। এভাবেই সমন্বয়েই বস্তুজগৎ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার তৈরি হয়। সুতরাং জ্ঞানের মাধ্যম ভাব এবং ভাবের উৎস অভিজ্ঞতা বা বস্তু। লক অবশ্য অবিমিশ্র বস্তুবাদী অভিমত পোষন করতে পারেন নি। তিনি বস্তু সম্পর্কিত ভাবের শ্রেণীভেদ করে এক প্রকার ভাবকে মৌলিক বা বস্তুসঞ্জাত এবং অপর প্রকার ভাবকে অমৌলিক বা মনসঞ্জাত বলে অভিহিত করেছিলেন। এটা জন লকের দর্শনের দুর্বলতা।
পক্ষান্তরে জর্জ বার্কলে মনে করেন যে, বস্তুকে জ্ঞানের মূল উৎস হিসাবে গ্রহণ করলে ধর্মীয় বিধাতার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়। বস্তুই তা হলে চরম সত্তা হয়ে দাঁড়ায়। তাই তিনি জন লকের উপরোক্ত তত্ত্বকে ধর্মের দিক দিয়ে বিপজ্জনক ঘোষণা করে যুক্তির ক্ষেত্রে গ্রহণের অযোগ্য বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। বার্কলে বললেন লকের তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষ জ্ঞানের ক্ষেত্রে মনের ভঅবকে জানে। এ কথা স্বীকার্য; কিন্তু এর অধিক যখন লক বলেন যে, মনের সে ভাব মনের বাইরে মননিরপেক্ষ বস্তুর অস্তিত্বের পরিচায়ক ও প্রতিভূ, তখনি লক হাস্যকর যুক্তির অবতারণা করেন। মন আসলে ভাবের বাইরে আদৌ যেতে পারে না। মন কেবল মনের ভাবকেই জানতে পারে। আমরা যখন টেবিল, চেয়ার, কলম ইত্যাকার কথাগুলি বলি তখন এগুলি দ্বারা আমাদের এক একটি ভাবকে নির্দেশিত করি। ‘টেবিল’ কথাটি একটি টেবিল নামক ‘বস্তু’ নয়। লকের মত অনুযায়ী ‘টেবিল’ কথাটি যদি ‘টেবিল’ বস্তুর প্রতিভূ হয়, তা হলে টেবিলরূপ ভাব এবং টেবিলরূপ বস্তুর মধ্যে একটা ব্যবধান এবং পার্থক্য রয়েছে, তাকে স্বীকার করতে হয়। টেবিল কথা বা ভাব-ই যদি টেবিলরূপ বস্তু না হয়, তাহলে এ ভঅব যে টেবিলরূপ ব্সুতর যথার্থ প্রতিভূ, তার নিশ্চয়তা কোথায়? মনের ভাব ব্যতীত জ্ঞানের কোনো মাধ্যম নেই। আবার মনেরও কোনো ক্ষমতা নেই নিজের ভাবকে অতিক্রম করে বস্তু বা অমনীয় কোনো সত্তাকে স্পর্শ করার। এমন অবস্থায় যাকে আমরা বস্তু বলি যে মনের ভাব ব্যতীত কিছুই নয়। লক যদি একপ্রকার ভাবকে মন নির্ভর বলে থাকেন, তা হলে তাঁর অপর প্রকার ভাবই বা মন নির্ভর হবে না কেন? টেবিল, চেয়ার, কলমের ন্যায় প্রত্যেকটি ভাবই মন-নির্ভর। মন যখন তাদের সম্পর্কে সচেতন হয় তখনি মনের নিকট তারা অস্তিত্বশীল হয় ‘এসসি এট পারসিপি’ –‘আমি তাকে দেখি বা প্রত্যক্ষ করি, আর তাই তার অস্তিত্ব’।
বস্তুবাদের এই খণ্ডন বিজ্ঞান ও বস্তুবাদের বিকাশের সেই যুগে বুদ্ধিজীবী এবং জনসাধারণের নিকট বিশেষ জোরালো বলে মনে হয়েছিল। জন লকের দর্শনের দুর্বলতাই ছিল বার্কলের অভিমতের শক্তির মূল। বার্কলের দর্শনের উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থেকেই বোঝা যায়, এ দর্শন মনময় দর্শন। শুধু মনময় নয়, এ দর্শন ব্যক্তির মনের মধ্যে আবদ্ধ দর্শন। বার্কলে যখন বলেন, ‘আমি দেখি, তবেই সে থাকে’ তখন ভাবমাত্রই ব্যক্তির চেতনার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বার্কলে নিজেও তাঁর অভিমতনের এই সঙ্কট সম্পর্কে সচেতন হয়েছিলেন। এ পর্যন্ত তাঁর অভিমত ছিল ‘সলিপসিস্ট’ বা ব্যক্তির মনের ভাবময় দর্শন। বস্তুকে নাকচ করে মনকে চরম বলে স্বীকার করার ফরে বার্কলের দর্শন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যেখানে মানুষের সমাজ ব্যক্তির মনের বিচ্ছিন্ন স্বাধীন চিন্তার পরস্পর সংযোগহীন একটা অরাজক অবস্থা ছাড়া আর কিছু নয়। এখানে ধর্মীয় বিধাতার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না এবং যেটাকে আমি টেবিল বলে ভাবছি সেটাকে আর দশটি মনও যে কেন টেবিল বলে ভাবছে তারও হদিস মেলে না। তাঁর দর্শনকে এই সঙ্কট থেকে মনও যে কেন টেবিল বলে ভাবছে তারও হদিস মেলে না। তাঁর দর্শনকে এই সঙ্কট থেকে বাঁচাবার জন্য বার্কলে আর দুটি সূত্রের অবতারণা করেন। ১. ব্যক্তিক মনের বাইরে এক স্বাধীণ চরম মনের অস্তিত্ব আছে। সেই চরম মন হচ্ছে ধর্মীয় বিধাতা; ২. বিধাতার মনে সমস্ত ভাবই সুপ্ত অবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে। বিধাতার ইচ্ছায় তাঁর সুপ্ত ভাব ব্যক্তিমনের সক্রিয় ভাবরূপে প্রকাশিত হয়। বিধাতার মধ্যে সব ভান বিদ্যমান বলে আমরা যখন টেবিল বা চেয়ার বা কলম সম্পর্কে অচেতন থাকি, তখনও টেবিল, চেয়ার কলম অস্তিত্বহীন হয়ে যায় না। বিধাতার মনে তাদের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে; আবার বিধাতার কারণেই এক টেবিলরূপ ভাব সকলের মনেই জাগ্রত হয়; এক ভাব ভিন্নরূপে ভিন্ন ভিন্ন মনে জাগ্রত হতে পারে না। বার্কলে এরূপে তার অভিমতের ব্যাখ্যা করে মনে করেন যে, লকের বস্তুকে তিনি অস্তিত্বহীন প্রমাণ করে ভাব এবং বিধাতার অস্তিত্বকে অখণ্ডনীয় করতে সক্ষম হয়েছেন।
এই দর্শনের অনুসিদ্ধান্ত হিসাবে বার্কলে তাঁর যুগের বৈজ্ঞানিক আবিস্কারাদির সত্যকে অস্বীকার করেন এবং বিজ্ঞানের বিকাশে বাধাদানের চেষ্টা করেন। তিনি বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেন যে, বিজ্ঞানের কাজ হবে জগতের মূলে যে স্রষ্টা রয়েছে তার প্রকাশ বোঝার চেষ্টা করা; জাগতিক কার্যকারণ সম্পর্ক দ্বারা প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করা নয়। নিউটনের মহাশূন্য এবং মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্বকে তিনি ভিত্তিহীন বলে মনে করেন।
সহজবোধ্য উদাহরণ দ্বারা বার্কলে তাঁর ভাববাদকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করেছিলেন। ঊনবিংশ শতকের ‘ইমানেন্স’, ‘প্রাগমেটিজম’, ‘এমপিরিও ক্রিটিসিজম’ প্রভৃতি বিভিন্ন ভাববাদী উপধারার মধ্যে জর্জ বার্কলের মনময় দর্শনের প্রভাব লক্ষ করা যায়। মার্কসবাদী দার্শনিক ভি. আই. লেনিন তাঁর ‘এমপিরিও ক্রিটিসিজম’ গ্রন্থে বার্কলে দর্শন এবং তার আধুনিক পুনঃপ্রকাশের বিশ্লেষণ ও সমালোচনা করেন।

Berlin wall: বার্লিন প্রাচীর
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে প্রাচ্য তথা রাশিয়া এবং পাশ্চাত্য বা ইংল্যাণ্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যাণ্ডের উদ্যোগে বার্লিন শহরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে পূর্বকে পূর্ব বার্লিন আর পশ্চিম অংশকে পশ্চিম বার্লিন বলা হয়। দুই বার্লিনের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে ১৯৮৯ সনে পাশ্চাত্য শক্তির আঘাতে বার্লিন দেয়ালের পতন ঘটে।

Bernstein, Eduard: এডওয়ার্ড বার্নস্টাইন (১৮৫০-১৯৩২ খ্রি.)
জার্মান সোস্যালডিমোক্রাট। মার্কসবাদীগণ বার্নস্টাইনকে বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের বিরোধী ব্যক্তি এবং সংশোধনবাদের প্রতিষ্ঠাতা বলে গণ্য করেন। বার্নস্টাইন মার্কসবাদের মূল দর্শন, অর্থনীতি এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে নিজস্ব ব্যাখ্যা দ্বারা সংশোধন করার চেষ্টা করেন। বিপ্লবী সমাজতন্ত্রের বদলে বার্নস্টাইন বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব উপস্থিত করেন। তাঁর ‘ইভোল্যুশনারী সোস্যালিজম’ বা ‘বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্র’ নামক গ্রন্থে বার্নস্টাইন এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে ১. মার্কস পুঁজিবাদের আসন্ন পতনের যে কথা বলেছিলেন তা বাস্তবে সত্য বলে প্রমাণিত হয় নি; ২. মার্কস শ্রেণীবিরোধকে যেভাবে আপসহীন বিবেচনা করেছেন এবং পুঁজিপতি এবং সর্বহারার দুই প্রান্তে সমাজকে বিভক্ত করেছেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অব্যাহত অস্তিত্ব তাকে ভুল প্রমাণিত করেছে; ৩. পুঁজিবাদের চরিত্রে পরিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে। সমাজসংস্কারের আন্দোলনের ফলে পুঁজিবাদের শোষণমূলক চরিত্রের অনেক পরির্তন সংঘটিত হচ্ছে; ৪. চরম সংঘর্ষের বদলে ধীরে এবং ক্রমান্বয়ে সামাজিক সংস্কারের লক্ষ্য দ্বারা শ্রমিকশ্রেণী অধিকতর স্থায়ী ফল লাভ করতে পারে। বার্নস্টাইনের কাছে হেগেলের দ্বন্দ্ব এবং মার্কসের দ্বন্দ্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। মার্কসবাদের ‘সর্বহারার একনায়কত্বে’র তত্ত্বকে তিনি অস্বীকার করেন। তাঁর মতে শ্রেণীসংগ্রাম ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে একটি সমন্বিত সমাজব্যবস্থা রূপ লাভ করবে। সমাজতন্ত্রের কোনো চরম লক্ষ্য থাকার প্রয়োজনকেও বার্নস্টাইন অস্বীকার করেন। শ্রমিকশ্রেণীর লক্ষ্য হবে সমাজের সংস্কারসাধন, বিপ্লব সংঘটিত করা নয়। “চরম লক্ষ্যের কোনো মূল্য নাই। সংস্কারের চেষ্টা বা আন্দোলনই আসল বিষয়”। রাশিয়ার শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে মেনশেভিক এবং অর্থনীতিবাদী বা ইকনমিস্টদের বার্নস্টাইনের অনুসারী মনে করা হয়। প্লেখানভ এবং লেনিন তীব্রভাবে বার্নস্টাইনের সমালোচনা করেন।

Bhutbada: ভূততত্ত্ব, প্রকৃতিতত্ত্ব
ভারতীয় দর্শনের পাশ্চাত্য ভাষ্যকারগণের কেহ কেহ প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের লোকায়ত মতকে ভূতবাদ বলে আখ্যায়িত করেন। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতককে এই মতের উৎপত্তিকাল বলে অনুমান করা হয়।
‘ভূতবাদ’ আখ্যা দ্বারা জগৎ ও সৃষ্টি সম্পর্কে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনকে সংক্ষেপে চিহ্নিত করা চলে। প্রাচীন গ্রিক দর্শনের ন্যায় প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের বৈশিষ্ট্য ছিল প্রধানত জাগতিক। জীবন ও বস্তু জগতের মূলে কি আছে, এ প্রশ্নের জবাবে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের লোকায়ত শাখা এরূপ মনে করত যে, জীবন ও জগৎ হচ্ছে ‘পঞ্চ ভূতাত্ত্বক’। প্রাচীন চিন্তাবিদগণ এই পঞ্চভূতকে যথাক্রমে ক্ষিতি (পৃথিবী) অপ (পানি), তেজ (অগ্নি), মরুৎ (বায়ু) এবং ব্যোম (আকাশ) বলে অভিহিত করতেন। পঞ্চভূত বা পঞ্চমূলের আবির্ভাব সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার মত ছিল। বেদান্ত দর্শনের মতে প্রথমে আকাশ থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে পানি এবং পানি থেকে পৃথিবী, এভাবে পঞ্চভূতের আবির্ভাব হয়। এই পঞ্চভূতই হচ্ছে সমস্ত সৃষ্টির মূল উপাদান। সৃষ্টির মধ্যে যত প্রকার বা ভেদ সবই এই মৌলিক উপাদান-সমূহের বিভিন্ন প্রকার সম্মেলনের ফল। এমনকি মন বা চেতনাও সমস্ত উপাদানের একটি বিশেষ ধরনের সম্মেলনের ফলে উদ্ভূত হয়েছে। কিন্তু ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম এই পঞ্চভূতের বিশেষ এবং জটিল সম্মেলনে সৃষ্ট চেতনার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, চেতনা অপর কোনো পদার্থে চেতনা সৃষ্টি করতে না পারলেও মূল পদার্থের মিলন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে বিভিন্ন নতুন পদার্থ সৃষ্টিতে সে সক্ষম।
ভূততত্ত্বের চেয়ে ভারতীয় দর্শনের বস্তুবাদী ধারা চার্বাক দর্শন নামে অধিকতর পরিচিত। উল্লিখিত পঞ্চভূতের মধ্যে ব্যোম বা আকাশ ছাড়া অপর চারটি পদার্থের স্বীকৃতি প্রচীনতম চার্বাক দর্শনে পাওয়া যায়। সৃষ্টি ব্যতীত জ্ঞানের ক্ষেত্রেও লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের অভিমত ছিল বস্তুবাদী। চার্বাক দর্শন ইন্দ্রিয়-বহির্ভূত জ্ঞানকে অলীক বলে মনে করত। এ কারণে পরোক্ষ বা অনুমানসিদ্ধ জ্ঞান তাদের কাছে যথার্থ বলে স্বীকৃত হয় নি। ধর্মের অলৌকিক শক্তি বা বিধাতার অস্তিত্ব অনুমানের উপর নির্ভরশীল। এ জন্য চার্বাকরা অজ্ঞেয় বিধাতার অস্তিত্ব এবং আত্মার পুনর্জন্মকেও অস্বীকার করেছে।

Binet, Alfred: আলফ্রেড বাইনেট (১৮৫৭-১৯১১ খ্রি.)
ফরাসি পরীক্ষামূলক মনোবিজ্ঞানী। ফরাসি দেশে ১৮৯৫ সনে আলফ্রেড বাইনেট প্রথম ফরাসি মনোবিজ্ঞানের পত্রিকার প্রতিষ্ঠা করেন। মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর সহকর্মী সাইমনের সঙ্গে যুক্তভাবে বাইনেট শিশুর বুদ্ধি পরিমাপের একটি পদ্ধতি আবিস্কার করেন। এ কারণেই প্রধানত আলফ্রেড বাইনেট খ্যাতি অর্জন করেন। উক্ত পদ্ধতি মনোবিজ্ঞান বাইনেট পরিমাপক বা বাইনেট-সাইমন পরিমাপক নামে পরিচিত। সাধারণ মনোবিদ্যায় এ পর্যন্ত ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বুদ্ধিগত পার্থক্য এবং তার কারণের বিষয় আলোচিত হয় নি। কেবল অন্তর্দৃষ্টি বা ইনট্রোসপেকশানের মারফত এ পার্থক্যের কারণ স্থির করার উপায় ছিল না। আধুনিক শিল্প-বিপ্লবের পূর্বে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে পার্থক্যের বিষয়টি সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে এত তাৎপর্যপূর্ণ হয়েও দেখা দেয় নি। কিন্তু শিল্প-বিপ্লব একদিকে যেমন অসংখ্য মানুষকে অর্থনৈতিক জীবনের এক একটি কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত করতে শুরু করল, তেমনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রমের বিভাগ এক এক ব্যক্তির উপর উৎপাদনের প্রত্যন্ত অংশের দায়িত্ব ন্যস্ত করল। ফলে উৎপাদনের কোনো সমগ্র প্রক্রিয়ার পরিবর্তে এক একটি বিশেষ দিকে দক্ষতা অর্জন ব্যক্তির জন্য অধিকতর প্রয়োজনীয় হয়ে উঠল। সামাজিক এই পরিবশে আলফ্রেড বাইনেটের দৃষ্টি ক্রমান্বয়ে সাধারণ মনোবিদ্যা থেকে পরীক্ষামূলক মনোবিজ্ঞানের বিকাশে নিবদ্ধ হয়। একই পরিবারের পাঁচটি শিশু একই রকম বুদ্ধির পরচয় দেয় না। কি কারণে একই পরিবেশে একটি শিশু যে কাজ যেরূপ দক্ষতার সঙ্গে করতে পারে, অপর শিশু তা পারে না? এই কারণ অনুসদ্ধানেই বাইনেট তাঁর মনোবিজ্ঞানের গবেষণা নিবদ্ধ করেন। নিজের দুটি কন্যার বুদ্ধিগত পার্থক্যই তাঁর প্রথম পরীক্ষার বিষয় হয়। পরে তিনি অপ্রাপ্ত বুদ্ধির শিশুদের শিক্ষায়তনে দল হিসাবে তাঁর তত্ত্বের পরীক্ষা করেন। বাইনেটের প্রধান প্রতিপাদ্য ছিল এই যে, বুদ্ধির কোনো একক আছে। দেহের যেমন বয়স বৃদ্ধি ঘটে, তেমনি জন্ম থেকে শিশুর বুদ্ধিরও বৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু দেহে বয়সের বৃদ্ধির সঙ্গে সমতা রেখে শিশুর বয়স বৃদ্ধি না পেতে পারে এবং কোনো স্থানে এসে তার বুদ্ধির বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়েও যেতে পারে।
এই প্রতিপাদ্য প্রমাণের জন্য বাইনেট বিভিন্ন বয়সের শিশুদের জন্য ত্রিশ রকম পরীক্ষা উদ্ভাবন করেন। মৌখিক বা অ-মৌখিক ক্রিয়াগত এই পরীক্ষাগুলিকে বাইনেট খুব সহজ করার চেষ্টা করেন। তাঁর মতে এই পরীক্ষাগুলির মাধ্যমে আমরা যে-কোনো শিশুর বুদ্ধির পর্যায় স্থির করতে পারি। পরীক্ষাগুলির ফলাফলের গড়ের ভিত্তিতে শিশুর বুদ্ধির একক বার করা সম্ভব। এই একক বা নির্দেশককে ইংরেজিতে ‘ইনটেলিজেন্স কুশেণ্ট’ বলা হয় এবং সংক্ষেপে ‘আই. কিউ’ অক্ষরদ্বয় দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। বাইনেটের পদ্ধতি ক্রমান্বয়ে কেবল শিশু নয়, যে-কোনো বয়সের ব্যক্তির বুদ্ধি পরিমাপের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি হতে থাকে। ব্যক্তির বুদ্ধি পরিমাপের জন্য বাইনেট এরূপ স্থির করেন কোনো শিশু বা ব্যক্তির দেহের বয়ঃক্রমের সংখ্যাকে তার বুদ্ধির বয়সের ক্রম সংখ্যা দ্বারা ভাগ করে উক্ত ফলকে ১০০ দ্বারা গুণ করলে ব্যক্তির বুদ্ধির মান বা ‘আই. কিউ’ বার করা সম্ভব হবে। বাইনেট প্রবর্তিত পদ্ধতি হুবহু ব্যবহার করা না হলেও তাঁর পরীক্ষামূলক মনোজ্ঞানের নীতি মনোবিদ্যাকে প্রভূত পরিমাণে উন্নত করেছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সমস্যার ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি উপযুক্ত হবে এবং কোন ব্যক্তি উপযুক্ত হবে না, তা নির্ধারণের জন্য বাইনেটের পরীক্ষার নীতি ও পদ্ধতি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির বুদ্ধিগত পার্থক্য নিরূপণকে বাইনেট তাঁর মনোবিজ্ঞানের প্রধান লক্ষ্য হিসাবে স্থির করায় তাঁর অভিমতকে ডিফারেনশিয়াল সাইকোলজি বা ভেদাত্মক মনোবিজ্ঞান বলেও আখ্যায়িত করা হয়।

Biology: জীববিদ্যা, জীববিজ্ঞান
জীববিদ্যা বা জীববিজ্ঞান বলতে জীবনের বিকাশের নিয়ম এবং জীবনের প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা এবং গবেষণা বুঝায়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের চিন্তাধারায় জীবনের বিকাশগত সমস্যার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এ নিয়ে তাঁরা চিন্তা করেছেন। কিন্তু স্বাধীন, সুসংবদ্ধ এবং পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষাভিত্তিক বিজ্ঞান হিসাবে এর উদ্ভব আধুনিককালেই মাত্র ঘটেছে। ফরাসি প্রকৃতিতত্ত্ববিদ লামার্ক (১৭৪৪-১৮২৯ খ্রি.) তাঁর আলেচনায় প্রথম ‘জীববিদ্যা’ কথা ব্যবহার করেন।
জ্ঞানের ক্ষেত্রে জীববিজ্ঞানের পরিধি বিশেষ ব্যাপক। বস্তুত বর্তমানে জীববিজ্ঞান বলতে পদার্থবিজ্ঞানের ন্যায় একটিমাত্র বিজ্ঞানকে বুঝায় না। জ্ঞানের একটি দিক হিসাবে জীববিদ্যাকে দেখা হয়। যে-কোনো প্রাণীর মধ্যে জীবনের যে বিকাশ ঘটেছে তার বৈজ্ঞানিক আলোচনাই জীববিজ্ঞানের পরিধির অন্তর্ভুক্ত। এজন্য এই বৃহৎ পরিধির মধ্যে একাধিক জীবনবিষয়ক বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে। জীববিজ্ঞানের মধ্যে জুলজি বা প্রাণিবিজ্হান, বোটানি বা উদ্ভিদবিজ্ঞান, এমব্রিওলজি বা ভ্রূণবিজ্ঞান, পেলিওনটলজি বা প্রত্নজীববিজ্ঞান, মাইক্রোবাইওলজি বা জীবাণুবিজ্ঞান, জেনিটিক্স বা বংশতত্ত্ব এবং ফিজিওলজি বা দেহতত্ত্বকে অন্তর্ভুক্ত মনে করা হয়।
জীবনের পর্যবেক্ষণমূলক আলোচনা ঊনবিংশ শতকেই শুরু হয়। এই শতকের মধ্যভাগে জীবন সম্পর্কে চার্লস ডারউইনের পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা জীববিদ্যায় একটি বিপ্লব সাধন করে। ইতোপূর্বে জীবন এবং তার বিকাশ কেবল দার্শনিক তত্ত্বকথার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তখন পর্যন্ত মানুষের সাধারণ এবং ব্যাপক ধারণা ছিল যে, জীবনের শুরু থেকে মানুষ বর্তমান আকারেই ছিল। মানুষজাতি বর্তমান অবয়বে জীবনের শুরুতেই সৃষ্ট হয়েছে। ডারইউনের ক্রমবিবর্তনবাদ এবং সজীবদেহের মূল হিসাব সংখ্যাহীন জীবকোষের আবিস্কার জীবন সম্পর্কে পুরাতন বদ্ধমূল ধারণাকে আমূল পাল্টে দেয়। জীবনের বিকাশের মূল কারণকেও ডারউইন উদঘাটিত করেন। এর ফলে পূর্বকার টেলিওলজিক্যাল বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত বিকাশবাদের তত্ত্বও নস্যাৎ হয়ে যায়।
দার্শনিক তত্ত্ব যেমন বহুকাল দর্শনের পরিধির মধ্যে রেখে জীববিদ্যাকে প্রভাবিত করেছে, অপরদিকে জীববিদ্যার আধুনিক বিকাশ দর্শনকেও প্রভূত পরিমাপে প্রভাবান্বিত করেছে। বর্তমান জীবন সম্পর্কে দার্শনিক আলোচনা জীববিজ্ঞানের সিদ্ধান্তের স্বীকৃতির ভিত্তিতেই করা হয়। এ ছাড়া জীববিদ্যার বিকাশ দর্শনের জন্য আলোচনার নতুনতর সমস্যাও সৃষ্টি করেছে। এ সমস্ত সমস্যার মধ্যে জীবদেহের সামগ্রিকতার সঙ্গে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহারগত সম্পর্কের সমস্যাটি অন্যতম। জীববিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, একটি জীবনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে যে একটি পূর্ণ সত্তা বা ‘হোল’ তৈরি করে, সেই সত্তার বাইরে এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অনুরূপ ব্যবহার সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। ইংরেজিতে এই সমস্যাকে ‘Wholism’-এর সমস্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়।

Blanqui, Luis: লুই ব্লাঙ্কুই (১৮৫০-১৮৮১ খ্রি.)
ফরাসিদেশের কাল্পনিক সাম্যবাদী। ১৮৩০ এবং ১৮৪৮ এর বিপ্লবী অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেন এবং দু’বার মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। জীবনের প্রায় অর্ধভাগ তাঁর কারাগারে অথিবাহিত হয়। ব্লাঙ্কুইর উপর প্রভাব পড়েছিল অষ্টাদশ শতকের বস্তুবাদ, নিরীশ্বরবাদ, কাল্পনিক সমাজবাদ এবং বিশেষ করে বাব্যুফবাদের। তাঁর মনোভাব ছিল বিপ্লবী। কিন্তু বিপ্লব সাধনের জন্য গণআন্দোলন এবং বিপ্লবী দল গঠনের তাৎপর্য তিনি উপলব্ধি করেন নি। এ কারণে তাঁর বিপ্লবী প্রচেষ্টা অনেক ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রমূলক আঘাতে পর্যবসিত হয়েছিল।

Bodin, Jean: বোদিন বা জাঁবোদা (১৫৩০-১৫৯৬ খ্রি.)
ষোড়শ শতাব্দীর বিখ্যাত ফরাসি রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। তাঁর রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব বিশেষ আলোচিত তত্ত্ব। ষোড়শ শতাব্দীতে ফরাসিদেশ যখন শক্তিসঞ্চার করতে থাকে, এবং একটি কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা বিকাশলাভ করে, বোদিনের সার্বভৌমিক তত্ত্ব তখন রাজার একচ্ছত্র শাসনের অধিকারকে জোরদার করে। বোদিন রাষ্ট্রের উৎপত্তির প্রশ্নে পরিবারকে মূল বলে গণ্য করেন। আদিতে পরিবারসমূহের গোষ্ঠীবদ্ধতার সমাজ বিভক্ত ছিল। পারিবারিক গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহের মাধ্যমে শক্তিশালী গোষ্ঠীর জয়লাভ এবং দুর্বল গোষ্ঠীসমূহের পরাজয় এবং বশ্যতা স্বীকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে বলে বোদিন অভিমত পোষণ করেন। বোদিনের মতে রাষ্ট্রের শাসকই হচ্ছে সার্বভৌম। ঈশ্বরের বিধান এবং প্রাকৃতিক ও সামাজিক নৈতিক বিধানের বাইরে রাষ্ট্রের গানরিকদের উপর শাসকের শাসনের সার্বভৌমত্বের অপর কোনো সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে না। এই যুক্তিতে বোদিন রাজতন্ত্রকে সরকারের সর্বোত্তম প্রকার বলে বিবেচনা করেন। কারণ সার্বভৌম রাজাই নাগরিকদের জীবনে শান্তি এবং শৃঙ্খলার নিশ্চয়তা দান করতে পারে। তাঁর মতে রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক সার্বভৌমত্ব বাস্তবে শাসক রাজার মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। তা সত্ত্বেও বোদিন আবার রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এবং শাসক রাজা বা রাষ্ট্রের সরকারকে অভিন্ন বিবেচনা করেন নি। সার্বভৌমত্ব যুক্তিগতভাবে অবশ্যই রাষ্ট্রের। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রকাশ ও প্রয়োগ ঘটে যে ব্যবস্থার মাধ্যমে তা হচ্ছে সরকার। কাজেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রাজতান্ত্রিক, অভিজাততান্ত্রিক কিংবা গণতান্ত্রিক বিভিন্ন প্রকার সরকারের মাধ্যমেই প্রকাশিত হতে পারে।

Border-Line Situation: প্রান্তিক পরিস্থিতি
জাসপারস-এর অস্তিত্ববাদী তত্ত্বের একটি নীতি। জাসপারস-এর মতে ভীতি, অপরাধ, দ্বন্দ্ব, অসন্তোষ, মৃত্যু ইত্যাদি হচ্ছে মানুষের জন্য প্রান্তিক পরিস্থিতি। এগুলি মানুষের আত্মিক অভিজ্ঞতার সীমাকে চিহ্নিত করে। এরা হচ্ছে অস্তিত্বের প্রান্ত। এই প্রান্তকে অতিক্রম করে অনস্তিত্বের সূচনা। জাসপারস-এর মতে প্রান্তিক পরিস্থিতি মানুষ মাত্রের জন্য অমোঘ এবং অনিবার্য। পান্তিক পরিস্থিতি অতিক্রম করার অর্থই হচ্ছে, মানুষের অস্তিত্ব থেকে অনস্তিত্বে উৎক্রমণ। মানুষে যথার্থভাবে ন্যায়, অন্যায়, ভালো, মন্দ, সৎ-অসৎ-এর বিসংবাদের মীমাংসা করে নীতিগত সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র এই প্রান্তিক পরিস্থিতির অনিবার্যতা উপলব্ধির মাধ্যমেই গ্রহণ করতে পারে।

Bradley, F.H. : ব্রাডলে (১৮৪৬-১৯২৪ খ্রি)
ঊনবিংশ, বিংশ শতকের ব্রিটিশ ভাববাদী দার্শনিক। ব্রাডলের ‘এ্যাপিয়ারেন্স এ্যাণ্ড রিয়ালিটি’ বা ‘প্রকার ও সত্তা’ একখানি বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থ। রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রেও ব্রাডলে একজন উল্লেখযোগ্য চিন্তাবিদ। উল্লিখিত কালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক, যেমন কেয়ারড (১৮৩৫-১৯০৮), টমাস হিল গ্রিন (১৮৩৬-১৮৮২), বারনার্ড বোসানকোয়েট (১৮৪৮-১৯২৩) এঁরা ‘অক্সফোর্ড ভাববাদী’ বলে পরিচিত হন। ইতোপূর্বে ইংল্যাণ্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে এবং রাজতন্ত্রের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তি স্বাধীণতার আন্দোলনের মাধ্যমে যে চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিকাশ ঘটেছিল অক্সফোর্ড ভাববাদীদের মধ্যে তার একটা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রাধান্যের কালে যেখানে ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে মূলতই অবাঞ্ছিত বলে গণ্য করা হয়, সেখানে এই ব্রাডলে এবং উল্লিখিত চিন্তাবিদগণ ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক হস্তক্ষেপের যে প্রয়োজন রয়েছে, তার উল্লেখ করেন। এঁদের মতে মানুষ যেমন একটি নৈতিক প্রাণী এবং তার কার্যের মূল বিচার তার নীতি বা লক্ষ্যের ভিত্তিতে, রাষ্ট্রের বিচারও তার লক্ষ্যের ভিত্তিতে। রাষ্ট্রের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের নৈতিক উন্নতি সাধন। এ লক্ষ্যে ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রকে পরস্পরবিরোধী শক্তি হিসাবে বিবেচনা করা অযৌক্তিক। ব্যক্তিকে নিয়ে যেমন রাষ্ট্র এবং ব্যক্তির উন্নতিতেই রাষ্ট্রের উন্নতি, তেমনি রাষ্ট্র বা সমাজের বাইরেও ব্যক্তির কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে না। ব্রাডলে এই দৃষ্টিভঙ্গির উপর জোর প্রদান করে তার ‘এথিক্যাল স্টাডিস’ গ্রন্থে বলেন যে, নৈতিক প্রাণী হিসাবে পরিবার এবং সমাজের বাইরে ‘ব্যক্তি’ হিসাবে ব্যক্তির কোনো অস্তিত্ব নাই। পিতামাতার কাছ থেকে প্রাপ্ত দৈহিক এবং মানসিক গুণাবলী যেমন ব্যক্তির অস্তিত্বের মৌল উপাদান তেমনি যে সমাজে সে বর্দ্ধিত হয় এবং জীবন ধারণ করে সেই সমাজের ভাসা, আচার-আচরণ, সংস্কার, বিশ্বাস এবং প্রতিষ্ঠানই তার সামাজিক অস্তিত্বকে তৈরি করে। কাজেই ব্যক্তি বনাম সমাজ বা রাষ্ট্র, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এমন চরম চিন্তার কোনো বাস্তব ভিত্তি থাকতে পারে না। অক্সফোর্ড ভাববাদী বলে কথিত চিন্তাবিদদের এই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীন গ্রিক চিন্তাবিদ এ্যারিস্টটলের রাজনৈতিক চিন্তার বেশ কিছুটা পুনঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায়।

Brahe, Tycho: টাইকো ব্রাহে (১৫৪৬-১৬০১ খ্রি.)
জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ডেনমার্কের একটি অভিজাত পরিবারে জন্ম। কোপেন হেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়ন শুরু করলে ১৫৬০ সনে ২১ আগস্ট সূর্যের পূর্ণগ্রহণের দৃশ্য টাইকো ব্রাহেকে জ্যোতির্মণ্ডলের পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় আকৃষ্ট করে। এতদিন পর্যন্ত যেখানে অন্তরীক্ষের তারকামণ্ডলীকে এ্যারিস্টটলীয় তত্ত্ব অনুযায়ী অপরিবর্তনীয় মনে করা হত সেখানে টাইকো ব্রাহে তারকামণ্ডলীর পরিবর্তনকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করে এ্যারিস্টটলীয় তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করেণ। টাইকো ব্রাহের জ্যাতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় তাঁর মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে কেপলারের আবিস্কারের মূলে টাইকোর পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শের বূমিকা বৈজ্ঞানিকগণ দ্বারা আজ স্বীকৃত।

Bruno, Giordano: গিওর্দানো ব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০ খ্রি.)
ইউরোপীয় পুনর্জাগরণ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ। গিওর্দানো ব্রুনো কেবল দার্শনিক ছিলেন না। তিনি ইতালির বিখ্যাত কবি এবং নাট্যকার বলেও পরিচিত। স্বাধীন প্রবক্তা ব্রুনো খ্রিষ্টধর্মের ডমিনিকান মত পরিত্যাগ করায় গোঁড়া সাধক সম্প্রদায় তাঁকে ইনকুইজিশন বা ধর্মীয় আদালতে বিচার করে প্রথমে কারাগারে নিক্ষেপ করে। দীর্ঘ আট বছর কারাগারে নির্মম নির্যাতনের পরে ব্রুনোকে রোম শহরে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
গিওর্দানো ব্রুনো মধ্যযুগের ধর্মতত্ত্বের বিরোধী ছিলেন। তিনি রোমান ক্যাথলিক মতকে সমালোচনা করেন। জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে তাঁর অভিমত ছিল বিস্ময়কররূপে বস্তুবাদী। এই বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টি তিনি প্রাচীন গ্রিসের বস্তুবাদী দার্শনিকদের নিকট থেকেই প্রধানত লাভ করেন। তাঁর বস্তুবাদ প্যানথিজম বা সর্বপ্রাণবাদ বলে আখ্যায়িত হয়। ব্রুনো বিশ্বাস করতেন, একটা বিশ্বপ্রাণের অস্তিত্ব আছে। এই প্রাণ সর্ববস্তুতেই প্রকাশমান। ব্রুনোর মতে প্রকৃতি বা জগৎ হচ্ছে অসীম। তিনি পৃথিবী সম্পর্কে কপারনিকাসের তত্ত্বকে স্বীকার করেন। কিন্তু ব্রুনোর অভিমতে আমরা কেবলমাত্র কপারনিকাসের তত্ত্বের স্বীকৃতি পাইনে, তাঁর অভিমতে কপারনিকাসের তত্ত্বের অধিকতর বৈজ্ঞানিক বিকাশও লক্ষ করা যায়। কারণ কপারনিকাস যেখানে সূর্যকে স্থির এবং সৌরমণ্ডলকে একমাত্র মণ্ডল বলে মনে করতেন, সেখানে গিওর্দানো ব্রুনো এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, সূর্য স্থির নয় এবং সৌরমণ্ডল একমাত্র সৃষ্টিমণ্ডল নয়। তাঁর মতে মহাজগতে অসংখ্য জগতের অস্তিত্ব রয়েছে এবং সৌরমণ্ডল একমাত্র সৃষ্টিমণ্ডল নয়। তাঁর মতে মহাজগতে অসংখ্য জগতের অস্তিত্ব রয়েছে এবং পৃথিবী ছাড়া অপর জগতেও জীবন থাকা সম্ভব। ব্রুনোর পূর্বে পৃথিবী গ্রহের গঠন সম্পর্কে কোনো সুসমঞ্জস ধারণা ছিল না। ব্রুনোই বলেন যে, পৃথিবরি সর্বাঞ্চলের গঠনের মধ্যেই মাটি, পানি, বাতাস, তেজ এবং ইথারের ক্ষেত্রে সাদৃশ্য আছে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকের ন্যায় ব্রুনোও বস্তুকে গতিময় মনে করতেন। মানুষের চেতনাও বস্তু বা প্রকৃতিরই ভেদ। এ সমস্ত অভিমত ছাড়া সমগ্র প্রকৃতির গতি, মহাজগতের ঐক্য এবং অস্তিত্বের পারস্পরিক নির্ভরতা প্রভৃতি প্রশ্নেও ব্রুনোর চিন্তা ছিল বৈজ্ঞানিক।

Buddhism: বৌদ্ধবাদ
প্রাচীন ধর্মসমূহের অন্যতম ধর্ম হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম। অভিজ্ঞানপ্রাপ্ত সিদ্ধার্থ বা বুদ্ধ এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। বুদ্ধের জীবনকাল ছিল ৫৬৩-৪৮৩ খ্রি. পূ.। প্রাচীন ভারতে হিন্দু বা ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিপত্তি ছিল। বুদ্ধের অভিমত এই প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহস্বরূপ। এ কারণে হিন্দুধর্ম এবং হিন্দু সম্রাটগণ বুদ্ধের ধর্মের প্রচারকে রুদ্ধ করে দেবার চেষ্টা করেন। বুদ্ধের অনুসারীদের উপর নানাপ্রকার অত্যাচার ও নির্যাতন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্মের গোঁড়ামি, আচার-অনুষ্ঠান, ব্যাপক পশুবলি এবং অনমনীয় বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে জনমতের প্রতিধ্বনিস্বরূপ ছিল বলে বৌদ্ধধর্ম দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। শুধু ভারতে নয় –ভারতের বাইরে সিংহল, নেপাল, বার্মা, চীন এবং জাপানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারিত হয়। প্রথমে বিরোধাত্মক সম্পর্ক থাকলেও কালক্রমে ব্যাপক হিন্দুধর্ম বুদ্ধকে তার অন্যান্য অবতারের সঙ্গে নবম অবতার বলে স্বীকৃতিদান করে।
বাংলাদেশের একজন প্রাচীন বৌদ্ধ কবি রামচন্দ্র বুদ্ধকে লক্ষ্য করে যে উক্তি করেন, তাতে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্মের বিরোধের ভাবটি সুন্দররূপে প্রকাশ পেয়েছে। উক্ত কবির মতে “ব্রহ্মা অবিদ্যা দ্বারা অভিভূত; বিষ্ণু মহামায়ার আলিঙ্গন বিমুগ্ধ; শঙ্কর আশক্তিবশত পার্বতীকে নিজ দেহে ধারণ করিয়াছিলেন; কিন্তু মুনিপুঙ্গর বুদ্ধ অবিদ্যা, মায়া, আসক্তি এই সমূহ হইতে সম্পূর্ণ বিমুক্ত”।–(বিশ্বকোষ) প্রাচীন ভারতীয় সমাজের একদিকে যখন আদিম গোত্রতান্ত্রিক যৌথ সমাজ-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছিল এবং অপরদিকে সমাজের একটা অংশ তার অনড় আচার-অনুষ্ঠান এবং বর্ণাশ্রমের মাধ্যমে নিজের স্বার্থকে রক্ষা করার চেষ্টা করছিল, বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে সেইকালে। বুদ্ধ ভগবানের অস্তিত্ব, বেদের নির্ভূলতা এবং বর্ণাশ্রম প্রথাকে অস্বীকার করেন।
কিন্তু বুদ্ধ ব্রাহ্মণ্যধর্মের অসার অনুষ্ঠান এবং নির্যাতনমূলক বর্ণ প্রথার শৃঙ্খল থেকে জনসাধারণকে মুক্ত করার জন্য সামাজিক পরিবর্তনের কথা বলেন নি। জনসাধারণকে তিনি আত্মার উন্নতি সাধনের মাধ্যমে কুক্তি অর্জন করতে বলেছেন। হিন্দু ধর্মের জন্মান্তরবাদের তত্ত্বকে বুদ্ধ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে পারেন নি। তাঁর মতে আত্মা জন্মান্তর গ্রহণ করে। কিন্তু সে জন্মান্তরের ভালো-মন্দ বর্ণের মধ্যে আবদ্ধ নয়। মানুষ তার কৃতকর্মের কারণে ভালো কিংবা মন্দ জন্মগ্রহণ করে। জীবনের ভোগ বাসনা পরিত্যাগের সাধনা দ্বারাই জীবন জন্মান্তরের বন্ধন থেকে মুক্তি বা নির্বাণ লাভ করতে পারে।
বৌদ্ধধর্মে দুটি ধারা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি হীনযান ধারা, অপরটি মহাযান ধারা। হীনযান ধারাই বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীনতম এবং বুদ্ধের শিক্ষা-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠিত ধারা। হীনযান মতে বিশ্ব এবং জীবকে এক ধারায় গ্রথিত করা হত। সৃষ্টি হচ্ছে বস্তু এবং চেতনার বিবর্তন। বিবর্তিত সৃষ্টিমাত্রেরই বিশেষ বিশেষ স্বভাব আছে। এই স্বভাবই হচ্ছে সৃষ্টির ধর্ম। কোনো অস্তিত্ব বা সত্তার নির্বাণের জন্য আবশ্যক হচ্ছে তার নিজের ধর্মের বর্জন। স্বভাবের বর্জনে সত্তার সমস্ত প্রকার স্বভাব বা ধর্মরূপ শৃঙ্খল থেকে মুক্তি। এই মতের মধ্যে প্রকৃতি ও বস্তু জগতের একটা স্বীকৃতি আছে। পরবর্তীকালে মহাযান মতবাদ বুদ্ধের জীবনের নৈকট্যমূলক অভিমত বর্জন করে। মহাযান পন্থীরা বুদ্ধকে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে এবং বিবিধ অনুষ্ঠান মারফত বুদ্ধের দয়া উদ্রেকের মধ্যে মানুষের মুক্তি নিহিত বলে প্রচার করে। মহাযানপন্থীদের মতে বস্তু বা বস্তুর ধর্ম হচ্ছে অলীক বা মায়া। জগৎও মায়া। খ্রিষ্টাব্দ দ্বিতীয় শতকের বিখ্যাত বৌদ্ধ যুক্তিবিদ নাগার্জুন যুক্তির পারম্পর্যে জগৎকে মায়া বা শূন্য বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন।

Bukharin: বুখারিন (১৮৮৮১৯৩৮ খ্রি.)
রুশ বিপ্লবের একজন প্রখ্যাত রাজনৈতিক তাত্ত্বিক। কিন্তু বলশেভিক পার্টির নেতা লেনিনের সঙ্গে যেমন তাঁর ১৯১৮ সনে তত্ত্বগত মতবিরোধ ঘটে, তেমনি বিপ্লবোত্তর রাশিয়াতে স্ট্যালিনের সঙ্গে তার মতান্তর সৃষ্টি হয়। রাশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য স্টালিনের সাংগঠনিক ও তাত্ত্বিক নেতৃত্বে যে নীতি সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি গ্রহণ করে, বুখারিত পার্টির অভ্যন্তরে দক্ষিণপন্থী ভিন্ন একটি গ্রুপ গঠনের মাধ্যমে তার বিরোধিতা করেন বলে স্ট্যালিন অভিযোগ করেন। পরবর্তীকালে এই বিরোধ গ্রুপের ধ্বংসাত্মক কাজের অভিযোগে বিচার অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁর অপর সঙ্গীদের সঙ্গে বুখারিনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

Burke, Edmund: এডমাণ্ড বার্ক (১৭২৯-১৭৯৭ খ্রি.)
অষ্টাদশ শতকের ইংল্যাণ্ডের পার্লামেণ্টের বিখ্যাত বাগ্মী সদস্য এবং রাজনীতিবিদ। বার্কের রাজনৈতিক চিন্তা, বক্তৃতা এবং রচনার মধ্যে উদারনীতি এবং রক্ষণশীলতার মিশ্রণ ঘটে। ইংল্যাণ্ডের সরকার আমেরিকার উপনিবেশের উপর ট্যাক্স আরোপ করলে বার্ক উপনিবেশের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। ওয়ারেন হেস্টিংস-এর শাসনে ভারতে ব্রিটিশ শাসনে ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধেও তিনি উচ্চকণ্ঠ হন। সে সময়ে রাজনৈতিক দল হিসাবে হুইগ দল কনজারভেটিভ দলের চাইতে উদারনীতিক ছিল। বার্ক হুইগ দলের সদস্য ছিলেন। কিন্তু বার্ক তার সুপরিচিত পুস্তক ‘রিফ্লেকশানস অন ফ্রেঞ্চ রিভোল্যুশন’ বা ‘ফরাসি বিপ্লবের উপর চিন্তা’ গ্রন্থে ফরাসি বিপ্লবের তীব্র সমালোনার মাধ্যমে নিজের রক্ষণশীল মনোভাবের প্রকাশ ঘটান। বস্তুত ফরাসি বিপ্লবের বিরুদ্ধে বার্কের সমালোচনার মাধ্যমে ইংল্যাণ্ডের প্রতিষ্ঠিত বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থার একটি অংশের ফরাসি বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য সম্পর্কে আশঙ্কা এবং ভীতির প্রকাশ ঘটে। ইংল্যাণ্ডে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের বিপ্লবের উদ্যোগী ভূমিকা ইংল্যাণ্ডের পুঁজিবাদী শ্রেণী গ্রহণ করলেও অষ্টাদশ শতকের ফরাসি বিপ্লবের ‘সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার’ আওয়াজ মানুষের চিন্তায় একটা নতুন পর্যায়ের সূচনা ঘটায়। ফরাসি বিপ্লবের এই নতুন তাৎপর্যে কেবল যে ইউরোপের সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণী ও রাজতান্ত্রিক শাসকরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে তাই নয়, ইংল্যাণ্ডের বুর্জোয়া শাসকশ্রেণীও ফরাসি বিপ্লবের ‘সাম্যে’র আওয়াজে নিজেদের শ্রেণী শাসনের প্রতি আঘাতের তাৎপর্যকেও উপলব্ধি করে। এডমাণ্ড বার্ক যখন তাঁর ওজস্বিনী ভাষায় ফরাসি বিপ্লবকে আক্রমণ করে বলেন: “ফরাসি বিপ্লবীদের কাছে আমাদের শিক্ষা গ্রহণের কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা ঈশ্বরকে যেমন বয় করি, রাজাকে তেমনি সমীহ করি; আমরা পার্লামেণ্টকে যেমন ভালবাসি, সরকারকে তেমন মান্য করি; আমরা গীর্জার পুরোহিতদের যেমন ভক্তি করি, অভিজাতদের তেমনি সম্মান করি” –তখন কেবল ব্যক্তিগত আবেগ নয়, সমাজের অধিকতর বিপ্লবী বিকাশের প্রশ্নে ইংল্যাণ্ডের শাসকশ্রেণীর শ্রেণীগত উদ্বেগের প্রকাশ ঘটে।

C
Campanella, Thomas: টমাস ক্যাম্পানেলা (১৫৬৮-১৬৩৯ খ্রি.)
ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকের ইতালির দার্শনিক এবং কল্পনাবাদী চিন্তাবিদ। ১৫২৮ সনে ক্যাম্পানেলা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। ক্যাম্পানেলার চিন্তার মধ্যে অ-খ্রিষ্টীয় অভিমত, ম্যাকিয়াভেলীর বাস্তববাদ এবং খ্রিষ্টীয় ধর্মীয়ভাব –এসবের মিশ্রণ দেখা যায়। স্কলাসটিসিজম বা মধ্যযুগের ধর্মীয় যুক্তিবাদের বদলে ক্যাম্পানেলা প্রকৃতি এবং ইতিহাসের ব্যাখ্যায় শক্তি, যুক্তি এবং প্রেম এই তিন নীতি অধিকতর শ্রেয় বলে বিশ্বাস করতেন। ‘সিভিটাটিস সলিস’ নামে সংলাপের রীতিতে তিনি যে কল্পনা-রাজ্য রচনা করেন সেখানে রাজা হলো একদল নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা নির্বাচিত; রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় কাজের সেখানে সম্মিলন ঘটেছে এবং সর্বজনীন শ্রমের মাধ্যমে যে সম্পদ উৎপাদিত হচ্ছে তার মালিকাতা হচ্ছে যৌথ। কালের বিচারে ক্যাম্পানেলার এরূপ কাল্পনিক সাম্যমূলক চিন্তার সেকালে একটি প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল। মুক্তচিন্তার জন্য ক্যাম্পানেলা ধর্মান্ধ গীর্জার কোপানলে পতিত হন। ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাম্পানেলা ইতালিকে স্পেনের দখলকারী শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য একটি দেশপ্রেমিক বিদ্রোহ সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তাঁকে নির্মম নির্যাতনের পরে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ২৭ বছর ক্যাম্পানেলাকে কারাগারে বন্দি রাখা হয়। কারাগারে তিনি তাঁর ‘সিভিটাটিস সলিস’ বা ‘সূর্য নগরী’ রচনা করেন।

Capital: পুঁজি, মূলধন
১. উৎপাদনের ক্ষেত্রে পুঁজি হচ্ছে প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহের মধ্যে একটি উপাদান। সম্পদ বৃদ্ধির জন্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে জমি, যন্ত্র, শ্রম এবং পুঁজি এই চারটি উপাদান প্রধান। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ‘পুঁজি’ শব্দ দ্বারা নতুন পণ্য ক্রয়ের আর্থিক সামর্থ্য বুঝায়। এরূপ অর্থ পুঁজি বলতে কেবল টাকা নয়, মালিকের মালিকানাধীন দালানকোঠা, জমি, যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রি বুঝাতে পারে। ‘জাতীয় পুঁজি’ দ্বারা দেশের শিল্পে উৎপাদিত সমগ্র পণ্য এবং অধিকতর পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় মজুর সম্পদকে বুঝায়। মার্কসীয় অর্থনীতির ব্যাখ্যায় ‘পুঁজির আসল কাজ হলো বাড়তি পণ্য অর্থাৎ বাড়তি মূল্য সৃষ্টি করা এবং এই কাজ দিয়েই তার পরিচয়’। কাজেই ‘যে কোনো উৎপাদন যন্ত্র বা উপায় বাড়তি মূল্য তৈরির কাজে নিয়োজিত হলে তাকে আমরা বলতে পারি পুঁজি। পুঁজিকে আবার দুরকম ভাগে ভাগ করা যায় –পরিবর্তনশীল ও অপরিবর্তনশীল পুঁজি। কলমালিক তার পুঁজি দিয়ে দুরকম জিনিস কেনে; এক হচ্ছে শ্রমশক্তি, আর এক হচ্ছে সুতো, কাঁচামাল, কলকব্জা ইত্যাদি। সুতো, কাঁচামাল কলকব্জা ইত্যাদির মূল্য যত ছিল ঠিক ততটাই উৎপাদিত পণ্যের ভেতর চলে যায়, এদের মূল্যের কিছু পরিবর্তন হয় না। এই জন্য এদের বলে অপরিবর্তনশীল পুঁজি বা কনসট্যাণ্ট বা ফিক্সড ক্যাপিটাল। পুঁজির অন্যভাগ যা শ্রমশক্তির জন্য খরচ হয় তা কিন্তু পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। এই জন্য একে বলে পরিবর্তনশীল পুঁজি বা ভেরিয়েবল ক্যাপিটাল’। (নীহাররঞ্জন সরকার; ছোটদের অর্থনীতি)।
২. মার্কস-এর বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘পুঁজি’ বা ক্যাপিটাল। এই গ্রন্থে কার্লমার্কস পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে তার মৌলিক বিধান উদঘাটন করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করেন। ‘পুঁজি’র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৬৭ সালে। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর আজীবন সাথী ফ্রেডারিক এঙ্গেলস-এর সম্পাদনায় ‘পুঁজি’র দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ সালে এবং তৃতীয় খণ্ড ১৮৯৪ সালে। প্রথম খণ্ডে মার্কস পুঁজির গঠন অর্থাৎ পুঁজি কিভাবে সৃষ্টি হয়; দ্বিতীয় খণ্ডে পুঁজির সঞ্চারণ বা সারকুলেশন এবং তৃতীয় খণ্ডে তিনি সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বিশ্লেষণ করেন। চতুর্থ খণ্ডে স্থান পেয়েছে বাড়তি বা উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব। মানুষের সভ্যতার ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে মার্কস পুঁজিবাদকে একটি বিশেষ পর্যায় বলে চিহ্নিত করে তার সুবিস্তারিত বিশ্লেষণ পেশ করেছেন। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি পুঁজিবাদের উৎপত্তি বিকাশ এবং তার পরিণাম বা ধ্বংসের বিধানকে উদঘাটন করেন। মার্কস-এর ‘পুঁজি’ কেবল আর্থনীতিক বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ নয়। মার্কস-এর সামগ্রিক বিশ্বদৃষ্টি অর্থাৎ তাঁর দর্শন এই গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। বস্তুত মার্কসবাদ তথা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মূল গ্রন্থ হচ্ছে ‘পুঁজি’। মার্কস তার দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রয়োগের ভিত্তিতে মানুষের সামাজিক আর্থনীতিক বিকাশকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, পুঁজিবাদ কোনো অনড় এবং স্থায়ী অস্তিত্ব নয়। পুঁজিবাদ একটি বিকাশমান প্রক্রিয়া। এই আর্থনীতিক প্রক্রিয়া এবং তার উপর প্রতিষ্ঠিত সামাজিক কাঠামো যেমন আদিতে ছির না, তেমনি ভবিষ্যতেও এর পরিবর্তন বা রূপান্তরের মাধ্যমে নতুন অর্থনীতিক উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং সামাজিক-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। পুঁজিবাদের অভ্যন্তরে ক্রম পরিবর্তনের মাধ্যমে সেই গুণগত রূপান্তরের মুহুর্ত যে অনিবার্যবাবে অগ্রসর হয়ে আসছে তা মার্কস সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন। অন্যান্য ব্যবস্থায় যেমন, পুঁজিবাদের অভ্যন্তরেও তেমনি পরিবর্তনের মূল কারণ তার আভ্যন্তরিক বিরোধ। এই বিরোধ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্মের পর থেকে উৎপাদনের উপায়ের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা এবং উৎপাদন সম্পর্কের অনিবার্য যৌথ বা সমষ্টিগত রূপের মধ্যে জন্ম নিয়েছে এবং সে বিরোধ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে বিস্ফোরণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার একমাত্র পরিণাম হচ্ছে ‘এক্সপ্রোপ্রিয়েটিং দি এক্সপ্রোপ্রিয়েটরস’ বা ‘উচ্ছেদকের উচ্ছেদ’ অর্থাৎ উপাদনের উপায়ের উপর সমষ্টিগত মালিকানার প্রতিষ্ঠা। পরির্তনের এই ক্রম ব্যাখ্যায় মার্কস এই বিরোধের ক্রম বিকাশের প্রতিটি স্তর, সে স্তরের বৈশিষ্ট্য, তার সংকটের বিশেষ সমাধানের ভিত্তিতে নতুনতর স্তরে আগমন বিস্তারিতভাবে দেখিয়েছেন এবং পরিশেষে এই বিকাশের বিধানের উল্লেখ করে বলেছেন ‘একটি বিশেষ উৎপাদন-ব্যবস্থায়ে যে বিরোধ অন্তর্নিহিত থাকে তার ঐতিহাসিক বিকাশের মাধ্যমেই মাত্র সেই উৎপাদন-ব্যবস্থার উচ্ছেদ এবং তার স্থানে নতুন উৎপাদন-ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা সম্ভব’।

Capitalism: ধনতন্ত্র, পুঁজিবাদ
সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশেষ। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপের কয়েকটি দেশে এই সমাজ-ব্যবস্থাতর প্রথম প্রতিষ্ঠা ঘটে। মানুসের সামাজিক অর্থনৈতিক কাঠামো যে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে বিকাশলাভ করছে এটি আধুনিক চিন্তাধারার একটি স্বীকৃত সত্য। আদিতে মানুষ যেরূপ অসহায় ছিল তেমনি আবার মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ আদি সমাজে কোনো শ্রেণীগত বিভেদ ছিল না। জীবন ধারনের জন্য উন্নত থেকে উন্নততর জীবিকার উপায় আবিস্কারের প্রয়োজন এবং ইচ্ছা মানুষের সহজাত। এই প্রচেষ্টায় শ্রেণীহীন আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের সমাজ উৎপাদনের হাতিয়ারের মালিক প্রভু এবং উৎপাদনের হাতিয়ারহীন দাসের শ্রেণী সমাজে পরিণত হয়। এই দাস সমাজই আবার কালক্রমে জমির মালিকানার ভিত্তিতে সামন্তপতি এবং ভূমিহীন কৃষকের সামন্তবাদী সমাজে বিকাশ লাভ করে। সামন্তবাদী সমাজের উত্তরকালে বিজ্ঞানের উন্নতি ক্রমান্বয়ে উৎপাদনের আবিস্কার হতে শুরু করে। এ সমস্ত যন্ত্রপাতির যারা মালিক হলো তারা দেখল যে, যন্ত্রপাতি চারাবার জন্য প্রচুর সংখ্যক লোকের আবশ্যক। কিন্তু তখনো অধিকাংশ মানুষ সামন্তবাদী প্রভুর হুকমে জমির সীমানার শিকলে আবদ্ধ। তারা ভূমির মালিক নয়। ভূমির দাস। নতুন শক্তি দেখল সামন্তবাদ কেভল মানুষকেই ভূমির দাস বানিয়ে রাখে নি। তার অস্তিত্ব নতুন উৎপাদনের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভূমির মালিক এবং বূমির দাসের পারস্পরিক সম্পর্ক শোষক এবং শোষিতের। বিজ্ঞানের অগ্রগতি সামন্তবাদের পরিবর্থন অপরিহার্য করে তুলল। কৃষকের বিদ্রোহ এবং উৎপাদনের নতুন পদ্ধতির অজেয় শক্তি সামন্তবাদকে ক্রমান্বয়ে উৎসাহিত করে নতুনতর এক সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করলঃ ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। নতুন উৎপাদনী যন্ত্রের মালিক এখানে সমাজের প্রভু। যন্ত্রের মালিক নির্দিষ্ট মজুরিতে যন্ত্রহীন মানুষ দিয়ে তার যন্ত্র চালায় আর অধিক থেকে অধিকতর পরিমাণে উৎপাদন করে দ্রব্য, পণ্য যা সে দেশে-দেশান্তরে বিক্রি করতে পারে এবং বিক্রি করে অর্থ আনতে পারে, অধিক যন্ত্র তৈরি করতে পারে এবং অধিকতর সংখ্যক মজুর নিয়োগ করে অধিকতর পণ্য আবার তৈরি করতে পারে। এ এক নতুন ব্যবস্থা, নতুন সমাজ। এখানে জমির চেয়ে যন্ত্র মূল্যবান। কিন্তু এ যন্ত্র থেকে লাভ অর্জনের মূল সূত্র মজুর এবং বাঁধা মজুরিতে মালিকের জন্য তার অবাধ উৎপাদনের ক্ষমতায়। যন্ত্রের মালিকের মুনাফা আসে মজুরের মজুরির অতিরিক্ত শ্রম থেকে। এ ব্যবস্থায় উৎপাদনের সম্পর্কে হলো একদিকে যন্ত্রের ব্যক্তিগত মালিকানা, অপরদিকে বহু মজুরের যৌথক্রিয়ায় উৎপাদনের যৌথপদ্ধতি। ধনতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ প্রথমে করেন কার্ল মার্কস এবং তাঁর আজীবন সঙ্গী ফ্রেডারিক এঙ্গেলস। তাঁরা সামন্তবাদের সঙ্গে তুলনাক্রমে সমাজ বিকাশে ধনতন্ত্রবাদের অগ্রসর ভূমিকার কথা যেমন উল্লেখ করেন তেমনি এ সমাজেরও অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব এবং বৈষম্যেরও উদঘাটন করেন। যন্ত্রের ব্যক্তিগত মালিকানা এবং তাঁর উৎপাদনের যৌথ পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে এর দ্বন্দ্ব। সামাজিক ক্ষেত্রে এ দ্বন্দ্ব হচ্ছে যন্ত্রের মালিকদের শোষণ এবং যন্ত্রের মালিকদের শোষণ এবং যন্ত্রের শোষিত শ্রমিকদের দ্বন্দ্ব। এই বৈষম্য এবং দ্বন্দ্ব পরিণামে ধনতন্ত্রীদের উৎপাদনের কারণ হয়ে নতুনতম সমানতান্ত্রিক সমাজ বা উৎপাদনের উপায়ের যৌথ মালিকানা এবং যৌথ মালিকদের যৌথ উৎপাদনের নতুন ব্যভস্থা প্রবর্তণ করবে বলে মার্কসবাদীগণ বিশ্লেষণ করে দেখান। সমাজবিকাশের এই প্রক্রিয়ায় একাধিক দেশে ধনতন্ত্রবাদের স্থলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু অপরাপর দেশের প্রধান আর্থিক ব্যবস্থা এখনো ধনতান্ত্রিক।
ধনতন্ত্রের অগ্রসর ভূমিকা ইউরোপেই প্রধানত কার্যকরী হয়। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দী যখন শেষ হচ্ছে ধণতন্ত্রবাদ তখন নিজ নিজ দেশের সীমা অতিক্রম করে বিদেশকে করায়ত্ত করে নতুন সাম্রাজ্যবাদী বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে শুরু করেছে। ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতা এবং পরবর্তীকালে ধনতান্ত্রিক দেশ কিংবা ধনতান্ত্রিক গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে অধিক থেকে অধিকতর উৎপাদন এবং ক্রমাধিক মুনাফা অর্জনের প্রতিযোগিতাই হচ্ছে ধনতন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি। এ কারণেই নিজ দেশে মুনাফার বৃদ্ধি সীমিত হয়ে এলে ধনতন্ত্রবাদ অপর দেশ দখল করে মুনাফার ক্রমাধিক বৃদ্ধির প্রাণশক্তিকে জীবিত এবং সক্রিয় রাখতে চায়। ক্রমে আবার এই প্রয়াস ধনতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং বিরোধের আকার গ্রহণ করে।

Capitalism, General crisis of: পুঁজিবাদের সাধারণ সংকট
ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদের বর্তমান অবস্থার মার্কসবাদী বিশ্লেষণে ‘পুঁজিবাদের সাধারণ সংকট’ একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা। মার্কসীয় বিশ্লেষণের অনুসারীদের মতে পুঁজিবাদের গোড়াকার প্রগতিশীল ভূমিকা আর বজায় নেই। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শক্তিহীন হয়ে পড়েছে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এবং ব্যবস্থা এখনো শক্তিশালী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিদ্যমান। কিন্ত এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তেজী-মন্দার চক্র ক্রমাধিক পরিমাণে তীব্র হয়ে উঠছে। কর্মহীন বা বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমাধিক পরিমাণে লাভে পণ্য বিক্রি করতে না পারার সমস্যা বাড়ছে। কিন্তু এই সংকট থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টাও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা করছে। ব্যবস্থা মাত্রই তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে চায়। অস্তিত্ব রক্ষার এই চেষ্টা নানাভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। উৎপাদনের ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে লাভের হার বজায় রাখার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে গবেষনা চালানো হচ্ছে। নতুন নতুন যন্ত্র আবিস্কৃত হচ্ছে। পূর্বের অবাধ প্রতিযোগিতার নীতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত হচ্ছে। উৎপাদন ও লাভকে বহাল এবং বৃদ্ধি করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর বৃহৎ বা একচেটিয়া পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। জাতীয় সীমা অতিক্রমকারী বহু জাতীয় করপোরেশন বা কারটেল গঠিত হচ্ছে। সামরিক অস্ত্রপাতি উৎপাদন এবং বিভিন্ন দেশে তা বিক্রি করে লাভ অর্জনের চেষ্টা করা হচ্ছে। মানুষের শ্রমের ফসল ধ্বংসকারী সমর শিল্প তাই অতীতের চাইতে অধিক ব্যাপক এবং উন্নত হয়ে উঠছে। সমরশিল্পকে বহাল রাকা এবং বৃদ্ধি করার জন্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুদ্ধের আবহাওয়া, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহাওয়া তৈরী করার চেষ্টা হচ্ছে। এ সকল বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে বর্তমানের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। এবং এর মাধ্যমেই পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের প্রকাশ ঘটছে।
নিম্নের বিবরণটিকে এই বিষয়টির মার্কসবাদী বিশ্লেষণের একটি সংক্ষিপ্ত দৃষ্টান্ত হিসাবে বিবেচনা করা চলে।
“ব্যক্তিগত মালিকানা এবং শোষণ যার নীতি সেই বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিকাশ সম্ভাবনা আজ নিঃশেষিত। পুঁজিবাদ আজ গভীর এক সাধারণ সংকটে নিপতিত। পুঁজিবাদের মীমাংসাহীন দ্বন্দ্ব এবং তার চরিত্রগত বিধান এই সংকটকে অনিবার্য করে তুলছে। পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের অর্থ হচ্ছে, পুঁজিবাদ বিকাশের বদলে আজ ক্ষয়ের পর্যায়ে প্রবেশ করছে। এ ক্ষয় আজ বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রত্যেক দেশে, এ ক্ষয় উপর থেকে নিচে সর্বত্র বিস্তারিত। এ ক্ষয় গ্রাস করছে তার অর্থনীতি, সামাজিক ব্যবস্থা, এর আদর্শ এবং সংস্কৃতিকে। সাধারণ এই সংকটের ফলে একের পর এক, বিভিন্ন দেশ যারা পুঁজিবাদী-অক্ষ পরিত্যাগ করে সমাজতান্ত্রিক বিকাশের পথ অবলম্বন করছে তাদের নিজের অক্ষের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে পুঁজিবাদ ব্যর্থ হচ্ছে।
“পুঁজিবাদের এই সাধারণ সংকটের সূচনা ঘটে রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমে। এই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে পৃথিবীতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই একমাত্র ব্যবস্থা বলে বিদ্যমান থাকার পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। গোড়াতেও পুঁজিবাদী জগৎ সোভিয়েট সমাজবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে সামরিক আক্রমণ, অর্থনৈতিক অবরোধ, সীমাহীন অপপ্রচার, আদর্শগত ধ্বংসাত্মক কাজ প্রভৃতির মাধ্যমে সর্বপ্রকারের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু তার চেষ্টা ব্যর্থ করে সোভিয়েট সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার অব্যাহত অস্তিত্বের মাধ্যমে নতুন সমাজ ব্যবস্থার প্রাণশক্তির প্রমাণ ঘটায়।
“পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ইউরোপ ও এশিয়ার একাধিক দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমে। বর্তমানে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই একমাত্র বিশ্বব্যবস্তা নয়। তার প্রতিশক্তি হিসাবে একটি বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাও বিদ্যমান আছে।
“বর্তমানে পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের তৃতীয় পর্যায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, শান্তির ভারসাম্য আজ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে পরিবর্তিত হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক শক্তিসমূহ পৃথিবীব্যাপী বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্চে। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ অনিবার্যভাবে দুর্বল হচ্ছে।
“বর্তমান যুগে পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এই সংকট পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অর্থনীতি, রাজনীতি ও নৈতিক চরিত্র –সর্বক্ষেত্রকে গ্রাস করে সার্বিক সংকটের রূপ গ্রহণ করছে। তার বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা ১৯৩০-এর মারাত্মক মন্দার সঙ্গে তুলনীয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশ্বপুঁজিবাদের প্রধান সকল কেন্দ্রগুলিতেই এই সংকট বিস্তারিত হয়েছে। এই সংকট হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিকশিত রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া অর্থনীতির সংকট। উৎপাদনের আকস্মিক পতন ঘটছে, বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুঁজিবাদের পক্ষে কোনো দেশেরই সক্শ জনসংখ্যাকে কার্যে নিযুক্ত করার ক্ষমতা নেই। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী সত্তর দশকে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ কর্মক্ষম লোক পুরো বেকার। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র এবং উৎপাদনের উন্নততর যান্তিকীকরণ শ্রমজীবী মানুষের মঙ্গলে আসার বদলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ‘ফজলু’ বা বাহুল্য বলে বাতিল করে দিচ্ছে।
“এই অবস্থা থেকে যুক্তিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে এই যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে উৎপাদনের শক্তি বা উপায় এবং উৎপাদনের সম্পর্কের দ্বন্দ্ব এরূপ তীব্রতা লাভ করেছে। পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কে উৎপাদনী শক্তির শৃঙ্খল হয়ে থাকে রুদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করছে।
“কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সাম্রাজ্যবাদ তথা পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক শক্তি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে অস্তিত্বের লড়াই, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রসরমান দাবি এবং এক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে অপর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের নিমর্ম অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রভৃতি পুঁজিবাদের জন্য উৎপাদনের উন্নতি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বশেষ উদ্ভাবনের প্রয়োগকে অনিবার্য করে তুলছে।
“সাধারণ সংকটের এই নবতম পর্যায়ে পুঁজিবাদের অন্যান্য অন্তর্দ্বন্দ্বও তীব্রতর হয়ে উঠছে। মজুর এবং পুঁজির দ্বন্দ্বের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে কতিপয় একচেটিয়া বহুজাতিক পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান ও শক্তির সংঘাত তীব্র হচ্ছে। পুঁজিবাদী দেশসমূহের অসম অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিকাশের ফলে পুঁজিবাদ বিশ্বব্যবস্থার অভ্যন্তরেও শক্তিসমূহের জোটবদ্ধতার ক্ষেত্রে পরিবর্তণ সংঘটিত হচ্ছে। বিভিন্ন পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের গোষ্ঠীসমূহের পারস্পরিক বৈরিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে”। (ফাণ্ডামেণ্টালস অব সায়েন্টিফিক কম্যুনিজম, মস্কো, ১৯৭৭)

Categories: সূত্র, মাধ্যম
মানুষের জ্ঞান কতকগুলি মৌলিক ধারণা বা সূত্রের উপর নির্ভরশীল। এই ধারণাগুলির মধ্যে প্রধান হচ্ছে স্থান, কাল, সম্পর্ক, গুণ, পরিমাণ ইত্যাদি। এই ধারণাগুলি বাকে আমাদের পক্ষে কোনো কিছুর জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। ‘স্থান’ ধারণার উপর নির্ভর করেই আমরা একটা বস্তুকে স্থানের অন্তর্ভুক্ত করি। আমরা বলি এই বস্তুটি অমুক স্থানে আছে। কালের ধারণা থেকে আমরা বস্তু বা ঘটনার উপর কালানুক্রম আরোপ করি। এরূপ ধারণা ব্যতীত আমাদের জ্ঞানলাভ সম্ভব নয় বলে দর্শনে এদের জ্ঞানের মূলসূথ্র বা মাধ্যম বলা হয়।
জ্ঞানের জন্য যে কিছু সংখ্যক মৌল ধারণার আবশ্যক এ সত্য বিভিন্ন দেশের প্রাচীন দার্শনিকগণই জ্ঞানের প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করে আবিস্কার করেছেন। ভারতীয় বৈশেষিক দর্শন বস্তু, গুণ এবং ক্রিয়াকে জ্ঞানের মূলসূত্র বিবেচনা করেছে। গ্রিক দার্শনিক এ্যারিস্টটল জ্ঞানের এরূপ সূত্রের বিস্তৃততর বিশ্লেষণ করে এর সংখ্যা দশটি বলে স্থির করেছে। আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কাণ্ট জ্ঞানসূত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন। জ্ঞানসূত্রগুলির উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে দার্শনিকদের মধ্যে মতের পার্থক্য আছে। ভাববাদী দার্শনিকদের মতে জ্ঞানসূত্রগুলি মানুষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মারফত লাভ করে না। অভিজ্ঞতা-পূর্ব ধারণা হিসাবে মূল জ্ঞানসূত্রগুলি মানুষের মধ্যে জন্মগতভাবেই থাকে। এই ভাববাদী মতের প্রধান আধুনিক ব্যাখ্যাতা হচ্ছেন কাণ্ট। জ্ঞানের সমস্যার কাণ্টীয় বিশ্লেষণ সংক্ষেপত এরূপ মানুষ চরম সত্তাকে জানতে পারে না। মানুষ চরম সত্তার বহিঃপ্রকাশকেই মাত্র জানতে পারে। এই বহিঃপ্রকাশকে মানুষ জানে স্থান, কাল, গুণ, সম্পর্ক এরূপ মৌলসূত্রের মাধ্যমে। জ্ঞানের এই সূত্রগুলি মানুষের মনে অভিজ্ঞতা-পূর্ব ভাব হিসাবে উদ্ভুহত হয়। অভিজ্ঞতার মধ্যে এদের উদ্ভব নয়। বস্তুবাদ জ্ঞানসূত্রগুলিকে নির্বিশেষে ধারণা বলে স্বীকার করলেও অভিজ্ঞতা-পূব উদ্ভবের তত্ত্বকে অস্বীকার করে। বস্তুবাদ, বিশেষ করে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ মানুষের জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকে একটি সদা বিকাশমান দ্বন্দ্বমূলক জটিল প্রক্রিয়া বলে ব্যাখ্যা করে। বস্তু থেকে যেমন মানুষের বিকাশ, তেমনি মানুষেল সঙ্গে বস্তুর দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কের মাধ্যমেই মানুষের চেতনার বিকাশ ঘটেছে। মানুষ বস্তুর সাক্ষাৎ সম্পর্কে আসে। বিভিন্ন বস্তু তার চেতনাকে আঘাত করে করে চেতনাকে বিকশিত করে। বিকশিত সেই চেতনা একাধিক বস্তুকে তুলনা করার ক্ষমতা অর্জন করে। তাদের উপর মিল-অমিলের গুণ আরোপ করে। এমনবাবে যে সূত্রগুলি আজ মানুষের জ্ঞানের মূলসূত্র বা যে সূত্রগুলি মানুষজাতির জন্মগত এবং অভিজ্ঞতা-পূর্ব সম্পদ বলে বিবেচিত হচ্ছে সেগুলি একদিন অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই মানুষ লাভ করেছে। এরূপ মৌলসূত্র নির্দিষ্ট সংখ্যায় একদিনে সৃষ্টি হয়নি কিংবা চিরকালের জন্য এ সংখ্যার সীমাও স্থির হয়ে যায় নি। জ্ঞানের বিকাশমান প্রক্রিয়ায় মানুষ ক্রমান্বয়ে নতুনতর সূত্র অর্জন করে যাচ্ছে।


Categorical Imperative: শর্তহীন বিধান
শর্তহীন বিধান দর্শন, বিশেষ করে দার্শনিক কাণ্টের নীতি-শাস্ত্রে ব্যবহৃত একটি কথা। কাণ্টের মতে নৈতিক জীবনে যে সমস্ত বিধান কার্যকরী সেগুলিকে শর্তসাপেক্ষ এবং শর্তহীন বলে বিভক্ত করা চলে। শর্তসাপেক্ষ বিধানের নিয়ামত হচ্ছে কোনো বিশেষ আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। আমার সন্তানকে যদি আমি এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ভালবাসি যে, সেও একদিন আমার বৈষয়িক জীবনে সাহায্যকারী হবে তা হলে সন্তানের প্রতি এই ভালবাসা শর্তসাপেক্ষ ভালবাসা। ভবিষ্যতের প্রতিফলের আকাঙ্ক্ষাই আমার বর্তমানের ভালবাসার নিয়ামক। এখানে সন্তানের প্রতি ভালবাসা শর্তসাপেক্ষ বিধানেরই একটি দৃষ্টান্ত। শর্তসাপেক্ষ বিধান একটি লক্ষ্য অর্জনের উপায় মাত্র। কাণ্টের মত অনুযায়ী মানুষের নৈতিক জীবনের নিয়ামক হবে শর্তহীন বিধান। শর্তহীন বিধান দ্বারা কাণ্ট এমন একটি বিধানকে বুঝাতে চেয়েছেন যে বিধান অপর কোনো লক্ষ্য অর্জনের উপায়মাত্র নয়ে, যে-বিধান নিজেই লক্ষ্য। পিতা যদি সুখশান্তি-সম্পদ অর্থাৎ কোনো প্রকার প্রতিদানের আকাঙ্ক্ষা না করেতার সন্তানকে শুধু ভালবাসার জন্য ভালবাসতে পারে তবেই সে ভালবাসা অপর কোনো লক্ষ্যের উপায়মাত্র না হয়ে নিজেই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে। আর এরূপ ভালবাসাই হচ্ছে সন্তানের প্রতি পিতার আদর্শ ভালবাসা। অনুরূপভাবে ব্যক্তি তার সমাজ জীবনে কেবল শর্তহীন বিধান দ্বারা পরিচালিত হবে, শর্তসাপেক্ষ বিধান দ্বারা নয়। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের যে-কোন কাজের পেছনেই একটি নীতি বা লক্ষ্য থাকে। সমাজে যে বিরোধ, বৈপরিত্য বা সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় তার কারণ ব্যক্তি নিজের স্বার্থসাধনের লক্ষ্যকেই চরম মনে করে। সমাজে যে অধকার সে নিজে ভোগ করতে চায় সে অধিকার অপরের প্রাপ্য একথা সে স্মরণ করে না। কিন্তু যে অধিকার ব্যক্তি নিজে ভোগ করবে সে অধিকার অপরকেও ভোগ করতে না দেওয়ার নীতি অযৌক্তিক। মানুষ যুক্তিবাদী জীবন। তার পক্ষে অযৌক্তিক কাজ করা সম্ভব নয়। ব্যক্তি তার যে-কোন সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে এমন নীতি দ্বারা পরিচালিত হবে, যে নীতি শুধু তার নিজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়; যে নীতি সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যে নীতি সার্বিক। যে ব্যক্তি চুরি করতে যাচ্ছে তাকে বিবেচনা করতে হবে, যে চুরির অধিকার সে ভোগ করতে যাচ্ছে সে চুরির অধিকার অপর সকলেরই আছে; সে মনে করবে যে মুহুর্তে অপরের দ্রব্য সে আত্মসাৎ করছে। এরূপ চিন্তায় ব্যক্তি তার আচরণের অন্তর্নিহিত অসঙ্গতি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। যে নীতিকে সে সার্বিক নীতি হতে দিতে চায় না সে নীতিকে নিজেও পরিত্যাগ করবে। এমনিভাবে আদর্শ সঙ্গতিপূর্ণ সমাজ সৃষ্টি হবে। কাণ্ট তাঁর শর্তহীন বিধান দ্বারা এক কল্পলোক বা ইউটোপিয়া তৈরীর চেষ্টা করেছেন। শর্তহীন বিধান দ্বারা প্রত্যেক ব্যক্তি পরিচালিত হলে একটি আদর্শ সমাজের সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে ব্যক্তি কেন স্বার্থপর হয়, কেন সে নিজে যে অধিকার ভোগ করে অপরকে সে অধিকার দিতে চায় না এর কারণের কোনো বিশ্লেষণ কাণ্টের নীতিশাস্ত্রে নেই। ফলে, শর্তহীন বিধান একটি অবাস্তব ইচ্ছায় মাত্র পর্যবসিত হয়েছে। নীতিশাস্ত্র মানুষের সামাজিক আচরণের আলোচনা। বাস্তব অর্থনীতিক ও সামাজিক অবস্থাই ব্যক্তির আচরণের নিয়ামক। কোনো বিশেষ সমাজের বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে ব্যক্তির আচরণের সঙ্গতি-অসঙ্গতি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কহীনভাবে কোনো চরম আদর্শ ব্যক্তির সামনে পেশ করা নিরর্থক। কাণ্ট তাঁর নীতিশাস্ত্রে এই সত্যকে অস্বীকার করেছেন।

Catharsis: বিমোক্ষণ
পুঞ্জিভূত আবেগ বা শক্তির মাধ্যমে শক্তির আধারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া বা উপায়কে ক্যাথারসিস বা বিমোক্ষণ বলা হয়। ইংরেজী ক্যাথারসিস শব্দের মূল গ্রিক শব্দের অর্থে বিশুদ্ধকরণের ভাব যুক্ত ছিল। গ্রিক গণ তাদের সৌন্দর্যতত্ত্বে এবং সাহিত্যে এই অর্থে শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেণ। এ্যারিস্টটল ব্যক্তির উপর সঙ্গীতের প্রভাব আলোচনা করে বলছেন যে, ব্যক্তির উপর সঙ্গীতের একটি বিশুদ্ধকরণে দিক আছে। সঙ্গীতের মাধ্যমে ব্যক্তির আবেগের প্রকাশ ঘটে এবং ব্যক্তি তার ফলে আনন্দ বা স্বস্তি বোধ করে। আধুনিককালে মনোবিজ্ঞানে, বিশেষ করে মানসিক রোগ নিরাময়ের একটি উপায় হিসাবে, বিমোক্ষণের উল্লেখযোগ্য ব্যবহার দেখা যায়। মনোবিকলনের ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণের ভিত্তিতে মনোবিকলনের রোগীকে যদৃচ্ছা আবেগ প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হয়। এরূপ ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানী অনুমান করেন যে, রোগীর মনে তার অপূর্ণ কামনা বাসনা, ইচ্ছা অনিচ্ছাসঞ্জাত যে আবেগ জমা হয়ে আছে তা যে কোন প্রকারে প্রকাশের পথ পেলে রোগী আবার রোগপূর্ব স্বাভাবিক ভারসাম্য ফিরে পাবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবেগ বিমোক্ষণের এ পদ্ধতি রোগীর মনকে হালকা করে তার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। কিন্তু ব্যক্তির ভারসাম্য বিনষ্টির কারণ ব্যক্তির নিজের মধ্যে তত নয় যত তার পরিবেশ ও সমাজের মধ্যে। রোগীকে সমাজ-নিরপেক্ষ বিবেচনা করে তার মনের কথায় বা সীমাবদ্ধ আচরণে প্রকাশের সুযোগদান কোনো স্থায়ী ফল দিতে পারে না। এ কারণে বিমোক্ষণে আবেগ প্রকাশের একটি পদ্ধতি হলেও তা মনোবিকলনের ক্ষেত্রে নিরাময়ের কোনো নিশ্চিত উপায় হয়ে উঠে নি।

Catholicism: ক্যাথলিকবাদ
খ্রিষ্টান ধর্মের মধ্যে দুটি সম্প্রদায় প্রধানঃ ক্যাথলিক এবং প্রটেষ্টান্ট সম্প্রদায়। মূল খ্রিষ্টান ধর্মের আচার, আচরণ, ব্যাখ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে মত পার্থক্য থেকে এই দুই সম্প্রদায়ের উদ্ভব। ক্যাথলিক সম্প্রদায়ই গোড়াকার ধারা। প্রটেস্টান্ট সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছে পরবর্তীকালে ষোড়শ শতকে জার্মানীর মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে। ক্যাথলিকবাদ খ্রিষ্টান ধর্মের গোঁড়া মতবাদ। ক্যাথলিকবাদের বিশ্বাস পবিত্র আত্মার উৎস কেবল ঈশ্বর নয়। তার উৎস যিশুখ্রিষ্ট বা ঈশ্বরের পুত্রও। পরলোকে পারগেটরী বা পাপীদের শোধনাগারও ক্যাথলিকদের বিশ্বাসের একটি অংশ। পোপ দোষত্রুটিশূণ্য। ক্যাথলিকবাদে ধর্মযাজকদের জন্য বিবাহ এবং পারিবারিক জীবন নিষিদ্ধ। রোমের ভ্যাটিকান হচ্ছে পোপের রাজধানী। ইউরোপে মধ্যযুগে পোপতন্ত্র কেবল ধর্শের ক্ষেত্রে নয়, পার্থিব সম্পদ ও শক্তিরও এক বিপুল সাম্রাজ্য হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এখনও পৃথিবীতে খ্রিষ্টান ধর্মের মধ্যে ক্যাথরিকদের প্রভাব এবং সাংগঠনিক শক্তি প্রধান।

Causality: কার্য-কারণবাদ
দর্শন শাস্ত্রের একটি শব্দ। দুটি বস্তু বা ঘটনার মধ্যকার অনিবার্য সম্পর্ককে কার্যকারণ সম্পর্ক বলে অভিহিত করা হয়। দুটি ঘটনার যেটি পূর্বে সংঘটিত হয় তাকে কারণ এবং যেটি তার ফল হিসাবে পরে সংঘটিত হয় তাকে কার্য বলে। কার্য-কারণ সম্পর্ক দুটি ঘটনা বা বস্তুর সম্পর্ক হলেও কার্য ও কারণ হিসাবে দুটি ঘটনা বিশ্বের অপরাপর ঘটনা থেকে বিযুক্তভাবে সংঘটিত হয় না। উপলব্ধির সুবিধার জন্য আমরা দুটি ঘটনাকে অপরাপর ঘটনা থেকে বিযুক্তভাবে ভাবার চেষ্টা করি। কিন্তু আসলে যে ঘটনাকে কার্য বলে অভিহিত করা হচ্ছে সে একই সময়ে অপর ঘটনার কারণ এবং যাকে কারণ বলে অভিহিত করা হচ্ছে সে অপর ঘটনার কার্য বা ফল হিসাবে সংঘটিত হচ্ছে। বস্তুর সমগ্র বিশ্বচরাচর কার্য কারণের সামগ্রিকসূত্রে আবদ্ধ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কারণ হিসাবে হিটলারের কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু সে হিটলার জার্মানীর তৎকালীন অর্থনৈতিক-সামাজিক রাষ্ট্রীয় অবস্থারই কার্য বা ফল। আবার বিংশ শতকের ধনতন্ত্রবাদী দুনিয়ার অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণেই জার্মানীর সেই সামাজিক অর্থনৈতিক রাষ্ট্রীয় অবস্থার সৃষ্টি। তাই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কারণ কেবল হিটলার নয়। একটি কার্যের সামগ্রিক কারণ তাই একটি নির্দিষ্ট কারণের চেয়ে বৃহত্তর। কোনো ঘটনার নির্দিষ্ট কারণ তার সামগ্রিক কারণের ভিত্তিতেই উপলব্ধি করা সম্ভব। কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনে সামগ্রিক কারণ উপলব্ধি করে আমরা জীবন যাপন করি নে। একটি ঘটনার নির্দিষ্ট কারণকেই আমরা স্থির করার চেষ্টা করি।
ঘটনামাত্রেরই কারণ আছে কিংবা কারণমাত্রেরই ফলাফল আছে। কথাটা স্বতঃসিদ্ধ হলেও দর্শনে কার্যকারণের কথা একটি মৌলিক বিষয়। প্রাচীন ভারতের বৈশেষিক দর্শন থেকে শুরু করে আধুনিক ইউরোপের অজ্ঞেয়বাদী হিউমের দর্শনেও কার্যকারণের সমস্যা বিশেষ আলোনার বিষয় বলে বিবেচিত হয়েছে। অন্যান্য সমস্যার ন্যায় কার্যকারণের সমস্যার আলোচনারও দুটি ধারণা দেখা যায়। একটি হচ্ছে ভাববাদী ধারা; অপরটি বস্তুবাদী। ভাববাদী মতে ঘটনায়-ঘটনায় কিংবা বস্তুতে-বস্তুতে কার্যকারণের সম্পর্ক আমাদের মনের কল্পনার বিষয়। কার্যকারণ সম্পর্ক কোনো বস্তু বা ঘটনা নয়। সুতরাং কার্যকারণ সম্পর্ক দৃশ্য নয়। আমরা বস্তুকে দেখি, কিন্তু বস্তুতে বস্তুতে সম্পর্ককে দেখি নে। আমরা আগুণ দেখতে পারি। আমরা ধোঁয়া দেখতে পারি, কিন্তু আগুন ও ধোঁয়ার মধ্যে কার্যকারণ রয়েছে বা আগুন ধোঁয়ার কারণ এবং ধোঁয়া আগুনের কার্য বা ফল এটা আমরা দেখতে পারি নে। হিউমা এই যুক্তিতে কার্যকারণ সম্পর্কের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করতে চেয়েছেন। দার্শনিক কাণ্ট একদিকে কার্য-কারণ সম্পর্কের বাস্তবতাকে অস্বীকার করেছেন, আবার অপরদিকে তাকে আমাদের জ্ঞানের অন্যতম অপরিহার্য সূত্র বা মাধ্যম বলে আখ্যাত করেছেন। তাঁর মতে অন্যান্য মূলসূত্রের ন্যায় কার্য-কারণ সম্পর্কের ধারণা আমাদের একটি অভিজ্ঞতা-পূর্ব জন্মগত ধারণা। বস্তুবাদী দর্শন, বিশেষ আধুনিককালের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শন, কার্যকারণ সম্পর্কের ভাববাদী ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করে। এই মত অনুযায়ী মানুষের জ্ঞানলাভের পদ্ধতি হচ্ছে মানুষের সাথে বস্তুর সাক্ষাৎ সম্পর্কের অভিজ্ঞতার নিয়ত বিকাশমান প্রক্রিয়া। বাস্তব ঘটনাকে মানুষ আদিকাল থেকে প্রত্যক্ষ করেছে। মানুষ হিসাবে এই অভিজ্ঞতার পথেই ঘটনার সম্পর্কের কার্যকারণরূপ সে উপলব্ধি করেছে এবং আবিস্কার করেছে। কার্যকারণ যে, বস্তু জগতের প্রতিটি অণুর সঙ্গে অপর অণুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া-ঘটনা মানুষের কল্পনার বিষয় নয়। আর এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই হচ্ছে বস্তুর কার্যকারণ সম্পর্ক। একটি আলপিন আমার আঙুলে বিদ্ধ হয়েছে। এটি প্রত্যক্ষ ঘটনা। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়াতে আঙুল থেকে রক্ত নির্গত হচ্ছে এবং আমি ব্যথা বোধ করছি। বিশ্বচরাচরের বস্তুজগতে বস্তুতে বস্তুতে কোনো ফাঁক বা শূন্যনা নেই। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সতত সম্পর্কে বস্তু-জগৎ আবদ্ধ এবং ক্রিয়াশীল।

Chaitanya: চৈতন্য (১৪৮৫-১৫২৭ অথবা ১৫৩৪ খ্রি.)
বৈষ্ণব ধর্মের চৈতন্য সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। বাংলাদেশ শ্রী চৈতন্য বা চৈতন্যদেব বলে সুপরিচিত। বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার ১৪৮৫খ্রিষ্টাব্দে একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে চৈতন্যদেবের জন্ম হয়। কিশোর বয়সেই চৈতন্যদেব সংস্কৃত ভাষায় এবং হিন্দু ধর্মের গীতা এবং ভাবগত পুরানে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। গীতায় কৃষ্ণা বা ঈশ্বরের উপর ভক্তি স্থাপনকে মানুষের মুক্তির প্রকৃষ্টতম উপায় হিসাবে বলা হয়েছে। চৈতন্যদেব গীতার এই ভক্তিতত্ত্বে বিশেষভাবে প্রভাবিত হন।
পঁচিশ বছর বয়সে শ্রী চৈতন্য সংসার ত্যাগ করে সন্নাসব্রত অবলম্বন করেন। এই পর্যায়ে তিনি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের প্রায় সকল প্রধান ধর্ম-কেন্দ্রগুলি পরিভ্রমণ করেন এবং পরিশেষে উড়িষ্যার জগন্নাথ মন্দিরকে নিজের ধর্ম প্রচারের কেন্দ্র হিসাবে নির্দিষ্ট করেন। চৈতন্যদেবের পরলোকগমন সম্পর্কে মতভেত আছে। চৈতন্য সম্প্রদায় মনে করে, চৈতন্যদেব সমুদ্রের তরঙ্গশীর্ষে তাঁর অরাধ্য কৃষ্ণকে রাধার সঙ্গে নৃত্যরত দেখেন এবং কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের আকর্ষণে তিনি গভীর সমুদ্রে গিয়ে নিমজ্জিত হন। অপর অনেকের মত হচ্ছে শ্রী চৈতন্য ১৫৩৪ খ্রীস্টাব্দে পরলোকগমন করেন।
শ্রী চৈতন্য-প্রচারিত ধর্মের মূল কথা ভক্তিতেই মুক্তি, যুক্তি কিংবা কোনো আচার-আচরণ বা পূজায় নয়। ঈশ্বর করুণার আধার। শিশুতে, প্রেমাস্পদে এবং সর্বজীবে মায়া ও মমতারূপে তার প্রকাশ। মানুষে মানুষে জাতি বা বর্ণের কোনো পার্থক্য নেই। ঈশ্বরকে লাভ করার জন্য প্রেমময়রূপে কল্পনা করতে হবে। তাকে প্রেমাস্পদের ন্যায় ভালবাসতে হবে। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের উপাখ্যান চৈতন্যদেব তার ধর্মীয়তত্ত্ব আরোপ করেন।
শ্রী চৈতন্যের প্রবর্তিত ধর্মের একটি সামাজিক তাৎপর্য আছে। চৈতন্যদেব হিন্দু ধর্মেরই একজন ব্যাখ্যাতা। হিন্দু ধর্মের বর্ণাশ্রম প্রথা এবং ব্রাহ্মণদের একাধিপত্যের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ ধর্ম একদিন বিরাটভাবে প্রসার লাভ করেছিল। বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মের বর্ণাশ্রমপ্রথা এবং জন্মান্তরবাদ তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ছিল। বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মের বর্ণাশ্রমপ্রথা এবং জন্মান্তরবাদ তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ছিল। বৌদ্ধধর্মের প্রসারে হিন্দুধর্ম অনেকটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়। হিন্দুধর্মের মূল আচার সর্বস্বতাও অনেকের মনে হিন্দুধর্ম সম্পর্কে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি করে। শ্রী চৈতন্য হিন্দুধর্মের নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে তাকে এই দ্বিবিধ আক্রমণ থেকে রক্ষা করার প্রয়াস পান। তাঁর মন্দিরে বংশ, বর্ণ বা জাতির কোনো ভেদাভেদ থাকবে না –এ নীতি সমাজের নির্যাতিত মানুষের মনে প্রবল আবেগের সঞ্চার করে। ফলে চৈতন্যদেবের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত চৈতন্যবাদ ভারতবর্ষে বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে বাংলাদেশে নির্যাতিত শ্রেণীর মধ্যে দ্রুত প্রসার লাভ করে। বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যদেবের ভক্তিবাদ প্রেমমুলক গীতিকবিতার সৃষ্টি করে। নতুন দৃষ্টিতে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম নিয়ে বাংলার কবিগণ সাহিত্য সৃষ্টি করতে শুরু করেন। চৈতন্য অনুসারীগণ চৈতন্যদেবকেও ঈশ্বররূপে কল্পনা করে তাঁর প্রতি ভক্তি প্রকাশের জন্য তাঁর প্রশংসামূলক জীবনী রচনা করতে শুরু করেন। এর ফলে বাংলা কাব্য সাহিত্যে যে নতুন সৃষ্টির প্রাবল্য দেখা দেয়, তাকে সাহিত্যের ইতিহাসকারগণ চৈতন্যযুগ বলে আখ্যায়িত করেন।
শ্রী চৈতন্যের ধর্মতত্ত্বের দার্শনিক তাৎপর্যটি এই যে, চৈতন্যের মতে ঈশ্বর এবং তার প্রকাশের জন্য তাঁর প্রশংসামূলক জীবনী রচনা করতে শুরু করেন। এর ফলে বাংলা কাব্য সাহিত্যে যে নতুন সৃষ্টির প্রাবল্য দেখা দেয়, তাকে সাহিত্যের ইতিহাসকারগণ চৈতন্যযুগ বলে আখ্যায়িত করেন।
শ্রী চৈতন্যের ধর্মতত্ত্বের দার্শনিক তাৎপর্যটি এই যে, চৈতন্যের মতে ঈশ্বর এবং তার প্রকাশের মধ্যে একদিকে যেমন কোনো দ্বৈত ভাব নেই, তেমনি অপর দিকে ঈশ্বরের প্রকাশ এবং ঈশ্বরওএক কথা নয়। প্রাচীন বৈষ্ণব ধর্ম ঈশ্বর এবং তার প্রকাশকে দ্বৈতরূপে কল্পনা করেছে। এর উপর ভিত্তি করে বৈষ্ণব ধর্মের দ্বৈতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চৈতন্য ঈশ্বর বা চরম সত্তার সঙ্গে তার প্রকাশের দ্বৈতরূপ বা বিরোধকে অস্বীকার করেছেন। কিন্তু অপরদিকে তিনি মানুষ অর্থাৎ চরম সত্তার প্রকাশকে ভক্তির মাধ্যমে পরিণামে পরম সত্তার মধ্যে নিজের অস্তিত্ব লোপ করে দেবার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হতে বলেছেন। একদিকে দ্বৈতভাবের অস্বীকার, অপরদিকে ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বর প্রাপ্তির কথা বলার জন্য শ্রী চৈতন্যের অভিমতকে অচিন্ত্য বা অভাবনীয় ভেদাভেদ বলে ভারতীয় দর্শনে আখ্যায়িত করা হয়। চৈতন্যদেবের ভক্তিবাদ এবং মুসলিম সুফী চিন্তাবিদদের মতবাদের মধ্যে বিশেষ মিল দেখা যায়।

Chartism: চার্টিস্ট আন্দোলন, চার্টার বা অধিকার আন্দোলন (১৮৩৮-১৮৪৮)
উনিশ শতকের ইংল্যাণ্ডের গণঅধিকার অর্জনের ঐতিহাসিক একটি এন্দোলনের নাম ‘চার্টিস্ট আন্দেলন’ বা চার্টার আন্দোলন। রাজনৈতিক অধিকারসহ ১৮৩৮ এর গণঅধিকার অর্জন এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল। জনসাধারণের দাবির অন্যতম ছিল প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকার, পার্লামেন্টের নিয়মিত বার্ষিক অধিবেশন আহবান, ব্যালটের মাধ্যমে ভোটপ্রদান, পার্লামেন্টের সদস্যদের ভাতা দান, নির্বাচনী এলাকাগুলির সম আকার, পার্লামেন্টের সদস্য হওয়র জন্য বিশেষ পরিমাণ আর্থিক সঙ্গতি থাকার শর্ত বিলোপ। এই সমস্ত দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের নেতারা ১৮৩৯ সনে একটি জাতীয় কনভেনশন আহবান করেন। এবং সে কনভেনশনে পার্লামেন্টে গণসহিসহ গণদরখাস্ত পেশকরার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গণসহি সংগ্রম সরে সেই গণসহির স্তূপ বহন করে পার্লামেন্টে নিয়ে আসার চেষ্টায় পুলিশ বাধা দিলে জনসাধারণের সঙ্গে একাধিক সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। বার্মিংহামে এরূপ সংঘর্ষে ২৪ জন চার্টিষ্ট বা চার্টার আন্দোলনের কর্মী নিহত হয়। এই গণ আন্দোলন ১৮৩৮ থেকে ১৮৪৮ পর্যন্ত নানা অবস্থার মধ্য দিয়ে অব্যাহত থাকে। ১৮৩৯, ১৮৪২ এবং ১৮৪৮: তিন দফায় গণসহিসহ গণদরখাস্ত পার্লামেন্টে পেশ করা হয়। প্রতিবারই পূর্বের চেয়ে অধিকতর সংখ্যক সহি সংগৃহীত হতে থাকে। প্রথমে ১২ লক্ষ, দ্বিতীয় বারে ৩৩ লক্ষ এবং তৃতীয়বারে প্রায় ৫০ লক্ষ সহি সংগৃহীত হয়। এ সহির বোঝা এত বিরাট আকার এবং ভারী হয় যে ১৮৪২ সালে এই সহির বোঝা একটা বিরাট পাত্রে স্থাপন করে বিশজন আন্দোলনকারীকে বহন করতে হয়।
বস্তুত এত বিপুল আকারে সহি সংগ্রহ করার ঘটনা ইতিহাসে ইতোপূর্বে আর কখনো ঘটে নি। সহি সংগ্রহ উপলক্ষে আন্দোলনকারীগণ সমাজের সমস্যাসমূহ নিয়ে যে সভা, আলোচনা ইত্যাদি সংগঠিত করে তাতে শ্রমিকসহ সমাজের নিচের তলার ব্যাপকতর মানুষ আলোড়িত হয়ে ওঠে। এই আন্দোলন শ্রমিকদের দ্বারাই পরিচালিত হয় এবং আন্দোলনের ফলে শ্রমিকদের মধ্যে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের শক্তি সম্পর্কে একটি অভূতপূর্ব উপলব্ধির সৃষ্টি হয়। ১৮৪০ সনে চার্টিস্টরা একটি ঐক্যবদ্ধ চার্টিস্ট পার্টি তথা একটি শ্রমিক পার্টি গঠন করার সর্বপ্রকার চেষ্টা করে। চার্টিষ্ট আন্দোলন পুঁজিবাদী শাসনের সে যুগের ক্ষমতা ও অবস্থার পটভূমিতে বাহ্যত ব্যর্থ হলেও শ্রমজীবী মানুষের চেতনা সঞ্চারে এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল। এ কারণে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে ইংল্যাণ্ডের চার্টিস্ট আন্দোলন একটি উল্লেখযোগ্য তাৎপর্যপূর্ণ আন্দোলন

Charvake: চার্বাক
ভারতীয় দর্শনের বস্তুবাদী মতবাদ চার্বাকবাদ বলে পরিচিত। বস্তুবাদী দর্শনকে লোকায়ত দর্শনও বলা হয়। ভারতীয় দর্শনকে সাধারণত ভাববাদী বলে মনে করা হয়। কিন্তু গ্রীক দর্শনের ন্যায় ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসেও অতি প্রাচীনকাল থেকে বস্তুবাদী দর্শনের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ঋগবেদে বৃহস্পতির যে মতের উল্লেখ দেখা যায় সে মতকে ভারতীয় দর্শনের আদি বস্তুবাদী মত বলা যায়। বস্তুই হচ্ছে চরম সত্তা –ঋগবেদে বৃহস্পতি এরূপ অভিমতের উল্লেখ আছে। বৃহস্পতির এই বস্তুবাদী অভিমতের অনুসরণ করে চার্বাকবাদের উৎপত্তি ঘটে। মহাকাব্য রামায়ণে ঋষি জাবালীর উক্তির মধ্যেও বস্তুবাদী ভাব পাওয়া যায়। বার্চাকবাদী দর্শনের ভিত্তি হচ্ছে জ্ঞানতত্ত্ব। তাদের মতে জ্ঞানের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান বা প্রত্যক্ষ জ্ঞানই হচ্ছে যথার্থ জ্ঞান। প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বাইরে কোনো জ্ঞানই সংশয়মুক্ত হতে পারে না। চার্বাক দর্শনে গোড়ার দিকে ইন্দ্রিয়কে জ্ঞানের একমাত্র মাধ্যম মনে করা হত। এ কারণে চার্বাক দর্শনে প্রথমে আনুমানকে জ্ঞানের উপায় হিসাবে স্বীকার করা হয়নি। প্রত্যক্ষভাবে মানুষ কেবল বিশেষকেই জানতে পারে, নির্বিশেষকে নয়। এ জন্য যে জ্ঞান বিশেষের নয়, নির্বিশেষের সে জ্ঞানের কোনো নিশ্চযতা নেই। অনুমান হচ্ছে নির্বিশেষে জ্ঞান। কিন্তু অনুমানকে অস্বীকার করলে আমাদের জ্ঞানের পরিধি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই উপলব্ধি থেকে পরবর্তীযুগের চার্বাকবাদীগণ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের সঙ্গে অনুমানকেও জ্ঞানের একটি মাধ্যম বলে স্বীকার করেছেন। অনুমানের অস্বীকৃতির ভিত্তিতে আদি চার্বাকবাদীগণ কার্যকারণের জ্ঞানকেও অগ্রাহ্য করেন। মানুষ ঘটনাকেই শুধু প্রত্যক্ষ করতে পারে। তাদের মধ্যকার সম্বন্ধকে সে প্রত্যক্ষ করতে পারে না। ঘটনায় ঘটনায় কোনো প্রত্যক্ষ যোগ সম্পর্ক নেই। মানুষ বলে, আগুণের কারণে ধোঁয়া সৃষ্টি হয়। চার্বাক দর্শনের মতে আগুন এবং ধোঁয়া দুটি ঘটনা। মানুষ এই ঘটনা দুটিকেই প্রত্যক্ষ করতে পারে। আগুণ ও ধোঁয়ার মধ্যে কোনো সম্পর্ককে সে প্রত্যক্ষ করতে পারে না। কাজেই একটি অপরটির কারণ কিংবা ফল একথা বলার উপায় নেই। চার্বাকবাদীদের এই মতের সঙ্গে ইউরোপীয় অজ্ঞেয়বাদী দার্শনিক হিউমের কার্যকারণতত্ত্বের মিল দেখা যায়। চার্বাকবাদীগণ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ অর্থাৎ মাটি, পানি ও আগুন এবং বায়ু এই চাররকম বস্তুকে সমস্ত সৃষ্টির মূল বলে স্বীকার করেন। বস্তু থেকেই জীবনের সৃষ্টি। চেতনার কোনো দেহাতীত অস্তিত্ব নেই। মনুষ দেহ এবং তার চেতনা হচ্ছে মূল-সত্তা ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুতের যৌগিক মিশ্রণের ফল। মন বা আত্মারও কোনো দেহাতীত অস্তিত্ব নেই। দেহের মৃত্যুর সঙ্গে চেতনা বা আত্মারও মৃত্যু ঘটে। জীবন্ত দেহ মৃহ হয়ে পরিশেষে তার মূল বস্তুতে পরিণত হয়। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে আত্মার পুনর্জন্মকে সর্বকালের চার্বাকবাদীগণই অস্বীকার করেছেন। বিশ্বচরাচরের সৃষ্টি হয়েছে মূল পদার্থের আকষ্মিক সংমিশ্রণে, কোনো অতি প্রাকৃতিক স্রষ্টার কারণে নয়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো প্রত্যক্ষ জ্ঞান মানুষের নেই। ভারতীয় দর্শনের ভাববাদ যেখানে জগৎকে মায়া এবং দুঃখপূর্ণ বলে অভিহিত করেছে চার্বাকবাদীগণ সেখানে জগৎ এবং জীবনকে আশাবাদের দৃষ্টিতে দেখেছেন। চার্বাকবাদীদের মতে জগৎ কেবল দুঃখপূর্ণ নয়। জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে সুখলাভ। সুখই হচ্ছে যথার্থ উত্তম। চার্বাকবাদীদের সুখলাভের তত্ত্বকে ভাববাদীগণ বিকৃত করে তাকে কেবলমাত্র স্থূল এবং অবিমিশ্র সুখের তত্ত্ব বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি ‘ঋণং কৃত্য ঘৃতং পিবেৎ’ প্রবচনকে বিকৃতভাবে চার্বাকবাদীদের জীবনদর্শন বলে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু চার্বাকবাদীগণ অবিমিশ্র সুখের কল্পনাকে অসার বলেছেন। ‘ঋণ করেও ঘৃত’ খাবার নীতি দ্বারা চার্বাকগণ জীবনে দুঃখকে বড় না করে দুঃখের মধ্যেও জীবনকে আনন্দময় ভাবার চেষ্টা করতে বলেছেন। চার্বাকবাদীগণ সামাজিক শ্রেণীভেদকেও অস্বীকার করেছেন। ব্রাহ্মণ কিংবা চণ্ডাল সকলের দেহের রক্তের রঙই লাল, এরূপ দ্বিধাহীন সাম্যমূলক উক্তি চার্বাকবাদীগণ করেছেন। বস্তুত ভারতীয় দর্শনে চার্বাকবাদ কোনো এক বিশেষ ব্যক্তির দর্শন নয়। প্রতি যুগের কুসংস্কার এবং অজ্ঞানতার প্রতিবাদই চার্বাকবাদ। ভারতীয় দর্শনে বিভিন্ন যুগে ভাববাদী চিন্তা ধারাই প্রাধান্য লাভ করেছে। প্রধান সেই ভাবধরারা চার্বাকবাদী বা লোকায়ত চিন্তাধারাকে তার প্রতিপক্ষ মনে করে তাকে বিকৃত এবং নিষিদ্ধ করেছেন। চার্বাকবাদ কোনো প্রখ্যাত দার্শনিকের দর্শন হিসাবে স্বীকৃত না হলেও ভাববাদী ধারার আক্রমণের ভিতরে তার অস্তিত্বের প্রমাণ স্পষ্ট।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি