বিদায় হে আমার বন্ধুঃ অন্তিম যাত্রার পথে মহানবী
বিদায় ইয়া রসূসুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম

আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পূর্ণতা লাভ করেছে, আরব জাহান এখন ইসলামের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এ সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিন্তা-চেতন, অনুভব-অনুভূতি, বাহ্যিক আচার-আচরণ ও কথা বার্তায় এমন নিদর্শ প্রকাশ পেতে লাগলো যা থেকে স্পস্টতই বুঝা যাচ্ছিলো যে, তিনি এ পৃথিবীর অধিবাসীদের শীঘ্রই বিদায় জানাবেন।

উদহরণস্বরূপ বলা হয় যে, দশম হিজরীর রমযান মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ দিন এ’তেকাফ পালন করেন অথচ অন্যান্য রমযানে পালন করতেন দশদিন। হযরত জিবরাঈল (আ.)এ বছর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সমগ্র কোরআন শরীফ দু’বার পাঠ করে শোনালেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছিলেন, আমি জানি না, সম্ভবত এ বছরের পর এই জায়গায় তোমাদের সাথে আমি আর কখনো মিলিত হতে পারব না। জামরায়ে আকাবার কাছে তিনি বলেন, আমার কাছ থেকে হজ্জ এর নিয়মাবলী শিখে নাও, কেননা আমি এ বছরের পর সম্ভবত আর কখনো হজ্জ করতে পারব না। আইয়ামে তাশরীকের মাঝামাঝি অর্থাৎ ১০,১১,১২ই যিলহজ্জের সময়ে সূরা নসর নাযিল হয়েছিলে। এরপর তিনি বুঝে ফেলেছিলেন যে, এবার দুনিয়া থেকে তার বিদায় নেয়ার পালা। এই সূরা নাযিল হওয়া মানে হচ্ছে তার মৃত্যুবরণের একটা আগাম ইত্তেলা (সংবাদ) দেয়া।

একাদশ হিজরীর সফর মাসের শুরতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহুদ প্রান্তরে গমন করেন। সেখানে তিনি শহীদানদের জন্যে এমনভাবে দোয়া করলেন যেন জীবিতরা মৃতদের কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করছে। এরপর ফিরে এস তিনি মিম্বরে বসে বললেন, আমি তোমাদরে কর্মতৎপরতার আমীর এবং তোমাদের জন্যে সাক্ষী। আল্লাহর শপথ এখন আমি আমার হাউয অর্থাৎ হাউযে কাওছার দেখতে পাচ্ছি। আমাকে সমগ্র বিশ্ব জাহান এবং এর ধন-ভান্ডারের চাবি প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহর শপথ, আমি এ আশঙ্কা পোষণ করি না যে, তোমরা আমার পরে শেরেক করবে বরং এ আশঙ্কা করছি যে, তোমরা দুনিয়ার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে।

একদিন মধ্য রাতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতুল বাকির কবরস্থানে যান এবং সেখানে মুর্দাদের জন্যে দোয়া করেন। সে দোয়ায় তিনি বলেন, হে কবরবাসীরা, তোমাদের প্রতি সালাম। মানুষ যে অবস্থায় রয়েছে তার চেয়ে তোমরা যে অবস্থায় রয়েছো তা তোমাদের জন্যে শুভ হোক। ফেতনা আঁধার রাতের অংশের মতো একের পর এক চলে আসছে। পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের চেয়ে মন্দ। এরপর কবরবাসীদরে এ সুখবর প্রদান করেন যে, আমি ও তোমাদরে সাথে এস মিলিত হবো।

অসুখের শুরু

একাদশ হিজরীর ২৯শে সফর, রোববার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতুল বাকিতে একটি জানাযায় অংশগ্রহণ করেন। ফেরার পথে মাথাব্যথা শুরু হেয় এবং উত্তাপ এতে বেড়ে যে, মাথায় বাঁধা পট্টির ওপর দিয়েও তাপ অনুভব করা গেছে। এটা ছিলো মরণ অসুখের শুরু। তিনি সেই অসুস্থ অবস্থায় এগার দিন নামায পড়ান।অসুখের মোট মেয়াদ ছিলো তের অথবা চৌদ্দ দিন।

জীবনের শেষ সপ্তাহ

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। এ সময়ে তিনি পবিত্র সহধর্মিনীদের কাছে জিজ্ঞাসা করতেন যে, আমি আগামীকাল কোথায় থাকবো? আমি আগামীকাল কোথায় থাকবো? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ জিজ্ঞাসার তাৎপর্য তাঁর সহধর্মিনীরা বুঝে ফেললেন, তাই তারা বললেন, আপনি যেখানে থাকতে ইচ্ছা করেন হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সেখানেই থাকবেন। এরপর তিনি হযরত আয়েশা (রা.)এর ঘরে স্থানান্তরিত হলেন। স্থানান্তরের সময় হযরত ফযল ইবনে আব্বাস এবং হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) প্রিয় নবীকে ভর দিয়ে নিয়ে গেলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামরে মাথায় পট্টি বাঁধা, পবিত্র চরণযুগল মাটিতে হেঁচড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় তিনি হযরত আয়েশা (রা.)-এর ঘরে স্থানান্তরিত হলেন এবং জীবনের শেষ সপ্তাহ সেখানেই কাটালেন।

হযরত আয়েশা (রা.)রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে শিক্ষা করা দোয়া সমূহ পাঠ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র দেহে ফুঁ দিতেন এবং বরকতের আশায় তাঁর পবিত্র হাত নিজের দেহে ফেরাতেন।

মৃত্যুর পাঁচদিন আগে

মৃত্যুর পাঁচদিন আগে চাহার শোম্বা অর্থাৎ বুধবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেহের উত্তাপ অস্বাভাবিক বেড়ে গেলো। এতে তাঁর কষ্ট বাড়লো। তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। এ সময় বললেন, বিভিন্ন কূপের সাত মশক পানি আমার ওপর ঢালো, আমি যেন লোকদের কাছে গিয়ে ওসিয়ত করতে পারি। এ জন্যে বসিয়ে দেয়া হলো এবং দেহে এতো পরিমাণ পানি ঢালা করা হলো যে, তিনি বললেন, ব্যস, ব্যস, অর্থাৎ আর প্রয়োজন নেই।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর কিছুটা সুস্থ বোধ করলেন এবং মসজিদে গেলেন। মাথায় পট্টি বাঁধা ছিলো। মিম্বরে আরোহণ করে বসে কিছু ভাসণ দিলেন। সাহাবায়ে কেরাম আশেপাশে সমবেত ছিলেন। তিনি বললেন, ইহুদি নাছারদের ওপর আল্লাহর লানত, কেননা তারা তাদের নবীর কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, ইহুদী নাছারাদের ওপর আল্লাহর মার, কেননা তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে।২[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৫২, মুয়াত্তা ইমাম মালেক, পৃ-৩৬০] তিনি আরো বললেন, তোমরা আমার কবরকে পূজা করার উদ্দেশ্যে মূর্তিতে পরিণত করো না।৩[মুয়াত্তা ইমাম মালেক, পৃ-৬৫]

এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদলার জন্যে নিজেকে পেশ করে বললেন, আমি যদি কারো পিঠে চাবুকের দ্বারা আঘাত করে থাকি তবে এই হচ্ছে আমার পিঠ সে যেন বদলা নিয়ে নেয়। যদি কাউকে অসম্মান করে থাকি তবে, সে যেন আমার কাছ থেকে বদলা গ্রহণ করে।

এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরের ওপর থেকে নীচে নেমে এলেন এবং যোহরের নামায পড়ালেন। এরপর তিনি পুনরায় মিম্বরে উপবেশন করলেন এবং শত্রুতা ইত্যাদি সম্পর্কে বলা কথা পুনরায় বললেন। একজন লোক বললেন, আপনার কাছে আমি তিন দেরহাম পাওনা রয়েছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফযল ইবনে আব্বাস (রা.)-কে সেই ঋণ পরিশোধের আদেশ দিলেন।

এরপর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনসারদের সম্পর্কে ওসিয়ত করলেন। তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে আনসারদের ব্যাপারে ওসিয়ত করছি, কেননা তারা আমার অন্তরও কলিজা। তারা নিজেদের যিম্মাদারী পূর্ণ করেছে কিন্তু তাদের অধিকার সমূহ বাকি রয়ে গেছে। কাজেই তাদের মধ্যেকার নেককারদের গ্রহণ করবে এবং বদকারদের ক্ষমা করবে। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, তিনি বলেন, অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, তিনি বলেন, মানুষ বাড়তে থাকবে কিন্তু আনসারদের সংখ্যা কমতে থাকবে, এমনকি তারা খাবারের লবণের পরিমাণের মত হয়ে পড়বে। কাজেই তোমাদের মধ্যেকার যারা কোন লাভজনক বা ক্ষতিকর কাজের দায়িত্ব পাবে তারা আনসারদের মধ্যেকার নেককারদের গ্রহণ করবে এবং বদকারদের ক্ষমা করবে।৪[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৫২৬]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর বরলেন, একজন বান্দাকে আল্লাহ তায়ালা এ এখতিয়ার দিয়েছেন যে, বান্দাহ ইচ্ছে করলে দুনিয়ার শান শওকত থেকে যা চাইবো আল্লাহ তায়ালা তাকে দেবেন অথবা আল্রাহর কাছে যা রয়েছে তা থেকে যা কিছু ইচ্ছা নিতে পারবে। সেই বান্দা আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তা গ্রহণ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণানা করেণ যে, একথা শোনার পর হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (রা.) কাঁদতে শুরু করলেন এবং আমি নিজের মা’বাপসহ আপনার ওপর কোরবান হচ্ছি। একথা শুনে আমরা অবাক হলাম। লেকেরা বললো, এই বুড়োকে দেখো, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো একজন বান্দা সম্পর্কে বলছিলেন যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে এখতিয়ার দিয়েছেন তা থেকে যা ইচ্ছা গ্রহণ করতে পারে অথবা আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তা থেকে যা ইচ্ছা গ্রহণ করতে পারে অথচ এই বুড়ো বলছে, আমি নিজের মা-বাপসহ আপনার ওপর কোরবান হচ্ছি। কিন্তু কয়েকদিন পরেই এটা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে, আল্লাহ তায়ালা যে বান্দাকে এখতিয়ার দিয়েছে তিনি ছিলেন স্বয়ং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সেদিন এটাও কারো বুঝতে বাকি থাকেনি যে, হযরত আবু বকর (রা.) হচ্ছেন আমাদের মধ্যেকার সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি। ৫[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৫৩৬]

এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বন্ধুত্ব এবং অর্থ সম্পদের ত্যাগ স্বীকারে আমার প্রতি সবচেয়ে বেশী এহসানা যেন রয়েছে আবু বকরের। যদি আমি আমার প্রতিপালক ব্যতিত অন্য কাউকে খলিল/বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতাম, তবে আবু বকরকে গ্রহণ করতাম। কিন্তু তার সাথে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ক বিদ্যমান। মসজিদে কোন দরজা খোলা রাখা না হয়, সকল দরজা যেন বন্ধ করা হয় শুধু আবু বকরের দরজা বন্ধ করা যাবে না। ৬[বোখারী,মুসলিম, প্রথম খন্ড, পৃ-৫১৬, মেশকাত দ্বিতীয় খন্ড, পৃ-৫৪৬-৫৫৪]

মৃত্যুর চার দিন আগে

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের চারদিন আগে বৃহস্পতিবার, তিনি খুবিই কষ্ট পাচ্ছিলেন। সেই সময় তিনি বললেন, আমি তোমাদরে একটি লিখন লিখে দিচ্ছি, এরপর তোমরা কখনো গোমরাহ হবে না। সেই সময় ঘরে কয়েকজন লোক উপস্থি ছিলেন। তাদের মধ্যে হযরত ওমর (রা.)-ও ছিলেন। তিনি বললেন, আপনি অসুখে খুবই কষ্ট পাচ্ছেন এবং আমাদের কাছে পবিত্র কোরআন রয়েছে। আমাদের জন্যে এই কেতাবই যথেষ্ট। একথা শুনে ঘরে উপস্থিত সাহাবদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলো। কেউ কেউ বললেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা লিখে দিতে চাচ্ছিলেন, তা লিখিয়ে নেয়া হোক। কেউ কেউ বলছিলেন, না দরকার নেই, হযরত ওমর (রা.) যা বলছেন, সেটাই ঠিক। মতভেদ এক সময়ে কথা কাটাকাটিতে পরিণত হলো এবং শোরগোল বেড়ে গেলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরক্ত হয়ে বললেন, তোমরা আমার কাছ থেকে উঠে যাও।৭[বোখারী ও মুসলিম, বোখারী ১ম খন্ড, পৃ-২২,৪২৭, ২য় খন্ড, পৃ-৬৩৮]

সেদিনই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনটি ব্যাপারে ওসিয়ত করলেন। প্রথমত ইহুদি, নাসার এবং মোশরেকদের জাযিরাতুল আরব থেকে বের করে দেবে। দ্বিতীয়ত আগন্তুক প্রতিনিধিদলের সাথে আমি যে রকম ব্যবহার করতাম সেই রকম ব্যবহার করবে। তৃতীয় কথাটি বর্ণনাকারী ভূলে গেছেন, সম্ভবত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরআন সুন্নাহ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা অথবা উসামা বাহিনীকে প্রেরণ করার কথা বলেছেন, অথবা তিনি বলেছিলেন, নামায এবং তোমাদের অধীনস্থ অর্থাৎ দাসদাসীদের প্রতি খেয়াল রাখবে।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসুখের তীব্রতা সত্তেও ওফাতের চারদিন আগে অর্থাৎ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সকল নামাযে নিজেই ইমামতি করেন। সেদিনের মাগরিবের নামাযেও তিনি ইমামতি করেছিলেন। সেই নামাযে তিনি সূরা

এশার সময় রোগ এতো বেড়ে গেলো যে, মসজিদে যাওয়ার শক্তি রইল না। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, লোকেরা কি নামায আদায় করে ফেলেছে? আমরা বললাম, জ্বী না হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ওরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামস বললেন, আমার জন্যে পাত্রে পানি লও। আমরা তাই করলাম। তিনি গোসল করলেন। এরপর উঠতে চাইলেন কিন্তু বেহুঁশ হয়ে গেলেন। জ্ঞান ফিরে এলে জিজ্ঞাসা করলেন, লোকেরা কি নামায আদায় করে ফেলেছে? তাঁকে জানানো হল যে, জ্বী না হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ওরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে। এরপর দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বার একই অবস্থা হলো। তিনি গোসল করলেন এবপর উঠতে চাইলেন, কিন্তু বেহুঁশ হয়ে গেলেন। এরপর তিনি হযরত আবু বকর (রা.)-কে খবর পাঠালেন, তিনি যেন নামায পড়িয়ে দেন। এরপর নবী করিমের অসুস্থতার অন্য দিনগুলোতেও হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা. নামায পড়ালেন। ৯[বোখারী ও মুসলিম। মেশকাত ১ম খন্ড, পৃ-১০২] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) সতের ওয়াক্ত নামামুরসালাত পাঠ করেন। ৮[বোখারী ও মুসলিম। মেশকাত প্রথম খন্ড, পৃ-১০২]যে ইমামতি করেছিলেন।

হযরত আয়েশা (রা.) তিন অথবা চারবার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এ মর্মে আরয করেন যে, ইমামতির দায়িত্ব হযরত আবু বকর (রা.) ব্যতিত অন্য কাউকে দেয়া হোক। তিনি ভাবছিলেন, লোকেরা হযরত আবু বকর ছিদ্কি (রা.) ব্যাপারে মন্দ ধারণ পোষণ না করুক। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিবারই সহধর্মিনীর আবেদন প্রত্যাখান করে বলেন, তোমরা সবাই ইউসুফ (আ,)-এর সাথীদের মত হয়ে গিয়েছো। ১০[হযরত ইউসুফ (আ.)-এর ঘটনায় যে সকল মহিলা আজিজ মেছেরের স্ত্রীকে অভিযুক্ত করছিল তারা দৃশ্যত এরূপ করছিল কিন্তু হযরত ইউসুফকে দেখে যখন তারা আঙ্গুল কেটে ফেলল তখন বোঝা গেল যে, ওরা সবাই হযরত ইউসুফ (আ.)-এর প্রতি নিবেদিত প্রাণ। অর্থাৎ তাদের মুখে এক মনে এক । এখানেও অবস্থা সেরকম। দৃশ্যত বলা হচ্ছির যে, হযরত আবু বকর সিদ্দিকের মন নরম,আপনার জায়গায় দাঁড়িয়ে নামায পড়াতে শুরু করলে কান্নার প্রকোপে কেরাত পাঠ করতে পারবে না। কিন্তু মনে মনে ঠিকই একথা ছিল যে, যদি খোদা না করুন রসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করেন তাহলে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-সম্পর্কে সবাই মন্দ ধারণ পোষণ করবে এবং তাকে অপয়া বলে অপবাদ দেবে। এসব কারণে হযরত আয়েশা সিদ্দিকার আবেদনের সাথে অন্যান্য নবী সহধর্মিনীরাও নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে একই আবেদন জানান। এ কারণে নবী (স.) বলেন যে, তোমরা সবাই হচ্ছো নবী ইউসুফের ভাইদের মতো।] আবু বকরকে আদেশ দাও তিন যেন নামায পড়ান।

মৃত্যুর দু’দিন আগে

শনি অথবা রোববার দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছুটা সুস্থ বোধ করলেন। দু’জন লোকের কাঁধে ভর দিয়ে যোহরের নামাযের জন্যে মসজিদে গেলেন। সে সময় হযরত আবু বক র সিদ্দিক (রা.) সাহাবাদের নামায পড়াচ্ছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখে তিনি পেছনে সরে আসতে লাগলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইশারা করলেন যে পেছনে সরে আসার দরকার নেই। যাদের কাঁধে ভর দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে এসেছিলেন তাদের বললেন, আমাকে আবু বকরের পাশে বসিয়ে দাও। এরপর তাঁকে হযরত আবু বকরের ডানপাশে বসিয়ে দেয়া হলো। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তখন নামাযে নবী করিমের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একতেদা করছিলেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে তাকবির শোনাচ্ছিলেন। ১২[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৯৮-৯৯]

মৃত্যুর আর মাত্র একদিন আগে

ওফাতের একদিন আগে রোবরাব দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সব দাস-দাসীকে মুক্ত করে দিলেন। তাঁর কাছে সে সময় সাত দিনার ছিলো, সদকা করলেন, তাঁর অস্ত্র-শস্ত্র মুসলমানদের হেবা করে দিলেন। রাতের বেলা চেরাগ জ্বালানোর জন্যে হযরত আয়েশা (রা.) এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে তেল ধার আনলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি বর্ম একজন ইহুদীর কাছে তিরিশ সাআ অর্থাৎ ৭৫ কিলো যবের বিনিময়ে বন্ধক ছিলো।

মহা জীবনের শেষ দিন

হযরত আনাস (রা.) বলেন, সেদিন ছিলো সোমবার, মুসলমানর ফযরের নামায আদায় করছিলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ইমামতির দায়িত্বে ছিলেন। হঠাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লা হযরত আয়েশা সিদ্দিকার হুজরার পর্দা সরালেন এবং সাহাবাদের কাতারবাঁধা অবস্থায় নামায আদায় করতে দেখে মৃদু হাসলেন। এদিকে হযরত আবু বকর (রা.) কিছুটা পেছনে সরে গেলেন যেন নামাযের কাতারে রসূল শামিল হতে পারে। তিনি ভেবেছিলেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শামিল হতে পারেন এবং হয়তো নামাযে আসতে চান। হযরত আনাস (রা.) বলেন, হঠাৎ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখে সাহাবারা এতো আনন্দিত হলেন যে, নামাযের মধ্যেই ফেতানায় পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো অর্থাৎ তারা নামায ছেড়ে নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শারীকিক অবস্থার খবর নিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু রসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত দিয়ে সাহাবাদের ইশারা করলেন, তারা যেন নামায পুর করেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুজরার ভেতর চলে গেয়ে পর্দা ফেলে দিলেন।

এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অন্য কোন নামাযের সময় আসেনি। দিনের শুরুতে চাশত এর নামাযের সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা (রা.)-কে কাছে ডেকে কানে কানে কিছু কথা বললেন। তা শুনে হযরত ফাতেমা যোহরা কাঁদতে লাগলেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুনরায় ফাতেমার কানে কিছু কথা বললেন, এবার হযরত ফাতেমা (রা.) হাসতে লাগলেন।

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, পরবর্তী সময়ে আমি হযরত ফাতেমাকে তাঁর কান্না ও হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, প্রথমবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, এই অসুখেই আমার মৃত্যু হবে। একথা শুনে আমি কাঁদলাম। এরপর তিনি আমাকে কানে কানে বললেন, আমার পরিবার-পরিজনের মধ্যে সর্ব প্রথম তুমিই আমার অনুসারী হয়ে পরলোকে যাবে। একথা শুনে আমি হাসলাম। ১৪[বোখারী ২য় খন্ড, পৃ-৬৩৮]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যন্ত্রণার তীব্রতা দেখে হযরত ফাতেমা (রা.)-কে এ সুসংবাদ প্রদান করেন যে, তিনি হলেন বিশ্বের সকল মহিলাদের নেত্রী।১৫[কোন কোন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, আলোচনা এবং সুসংবাদ দেয়ার এ ঘটনা নবী জীবনের শেষ দিনে নয় বরং শেষ সপ্তাহে ঘটেছিল। দেখুন, বহমতুল লিল আলামীন, ১ম খন্ড, পৃ-২৮২]

সে সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যন্ত্রণার তীব্রতা থেকে হযরত ফাতেমা (রা.) হঠাৎ বলে ফেললেন, হায় আব্বাজানের কষ্ট। একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমার আব্বার আজকের পর আর কোন কষ্ট নেই। ১৬[কোন কোন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, আলোচনা এবং সুসংবাদ দেয়ার এ ঘটনা নবী জীবনের শেষ দিনে নয় বরং শেষ সপ্তাহে ঘটেছিল। দেখুন রহমতুল লিল আলামীন, ১ম খন্ড,পৃ-২৮২]

নবী (স.) হযরত হাসান ও হোসেন (রা.) ডেকে চম্বুন করলেন এবং তাদের ব্যাপারে কল্যাণের ওসিয়ত করলেন। সহধর্মিনীদের ডাকলেন এবং তাদেরকেও ওয়ায-নসিহত করলেন।

এদিকে কষ্ট ক্রমেই বাড়ছিলো। বিষ-এর প্রভাবও প্রকাশ পাচ্ছিলো। খয়বরে তাঁকে এই বিষ খাওয়ানো হয়েছিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা (রা.)-কে বলতেন, হে আয়েশা খয়বরে আমি যে বিষ মিশ্রিত খাবার খেয়েছিলাম তার প্রতিক্রিয়ার কষ্ট সব সময় অনুভব করছি। এখন মনে হচ্ছে, সেই বিষের প্রভাব যেন আমার প্রাণের শিরা কাটা যাচ্ছে। ১৭[সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৬৩৭]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহবায়ে কেরামের উদ্দেশ্যও ওসিয়ত করেন। তাদের তিনি বলেন, ‘আস সালাত, আস সালাত অমা মালাকাত আইমানুকুম। অর্থাৎ নামায নামায এবং তোমাদের অধীনস্থ দাসদাসী।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথা কয়েকবার উচ্চারণ করলেন। ১৮[সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৬৩৭]

মৃত্যুকালীন অবস্থা

ওফাতকালীন অবস্থা শুরু হলো। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেহে ঠেস দিয়ে ধরে রাখলেন, তিনি বলেন, আল্লাহর একটি নেয়ামত আমার ওপর এই যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার ঘরে, আমার হিসেবের দিনে, আমার কোলের ওপর শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেন। নবী সাল্লাল্লাহু্ আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওফাতের সময়ে আল্লাহ তায়ালা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এবং আমার থুথু একত্রিত করেন। ঘটনা ছিলো এই যে, আবুদর রহমান ইবনে আবু বকর (রা.) এসছিলেন, সে সময় তার হাতে ছিল মেসওয়াক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার গায়ের ওপর হেলান দেয়া অবস্থায় ছিলেন। আমি লক্ষ্য করপ্রলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেসওয়াকের প্রতি তাকিয়ে আছেন। আমি বুঝলাম যে, তিনি মেসওয়া চান। বললাম আপনার জন্যে নেব কি? তিনি মাথা নেড়ে ইশারা করলেন। আমি মেসওয়াক এনে তাঁকে দিলাম। কিন্তু শক্ত অনুভুত হলো। বললাম, আপনার জন্যে নরম করে দেবো? তিনি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। আমি দাঁত দিয়ে নরম করে দিলাম। এরপর তিনি বেশ ভালোভাবে মেসওয়াক করেন। তাঁর সামনে একটি পাত্রে পানি ছিলো।তিনি হাত ভিজিয়ে চেহারা মুছুছিলেন এবং বলছিলেন, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। মৃত্যু বড় কঠিন। ১৯[সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৬৪০]

মেসওয়াক শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত অথবা আঙ্গুল তুললেন। এ সময় তাঁর দৃষ্টি ছিলো ছাদের দিকে। উভয় ঠোঁট তখন নড়ছিলো। তিনি বিড় বিড় করে কি যেন বলছিলেন। হযরত আয়েশা (রা) মুখের কাছে কান পাতলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বলছিলেন, হে আল্লাহ তায়ালা। নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও সৎ ব্যক্তি যাদের তুমি পুরস্কৃত করেছ, আমাকে তাদের দলভূক্ত কর, আমাকে ক্ষমা করে দাও। হে আল্লাহ তায়ালা আমাকে মার্জনা করো, আমার ওপর রহম করো এবং আমাকে ‘রফিকে আলায়’ পৌছে দাও। হে আল্লাহ তায়ালা! রফিকে আলা ! ২০{সহীহ বোখারী, মরযে নবী অধ্যায় এবং নবী জীবনের শেষ কথা অধ্যায়, ২য় খন্ড, পৃ-৬৩৮-৬৪১]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ কথাটি তিনবার উচ্চারণ করেন। এর পরপরই তাঁর হাত ঝুঁকে পড়লো এবং তিনি পরম প্রিয়ের সান্বিদ্ধে চলে গেলেন। ‘ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।’ অর্থাৎ আমরা সবাই আল্লাহর জন্যে এবং তাঁর কাছেই আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে।

এ ঘটনা ঘটেছিলো একাদশ হিজরীর ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার চাশত এর নামাযের শেষ সময়ে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স ছিলো তখন তেষট্টি বছর চারদিন।

চারদিকে শোকের ছায়া

হৃদয়বিদারক এ শোক সংবাদ অল্পক্ষণের মধ্যে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। মদীনার জনগণ শোকে অভিভূত হয়ে গেলেন। চারদিকে ছেয়ে গেলো শোকের কালো ছায়া। হযরত আনাস (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেদিন আমাদের মাঝে আগমন করেছিলেন সেদিনের চেয়ে সমুজ্জল দিন আমি আর কখনো দেখিনি। আর যেদিন তিনি আমদের ছেড়ে চলে গেলেন, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন আমি আর কখানো দেখিনি। ২১{দারেমী, মেশকাত, ২য় খন্ড, পৃ-৫৪৭} প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর হযরত ফাতেমা (রা.) শোকে কাতর হয়ে বললেন, ‘হায় আব্বাজান, যিনি পরওয়ারদেগারের ডাকে লাব্বায়ক বলেছিলেন। হায় আব্বাজান, যাঁর ঠিকানা হচ্ছে জান্নাতুল ফেরদাউস। হায় আব্বাজান, আমি জিবরাঈল (আ.)-কে আপনার ওফাতের খবর জানাচ্ছি।’ ২২[সহীহ বোখারী, মরযে নবী অধ্যায় ২য় খন্ড, পৃ-৬৪১]

হযরত ওমর ও হযরত আবু বকরের প্রতিক্রিয়া

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের খবর শুনে হযরত ওমর (রা.) জ্ঞানহারা হয়ে পড়লেন। তিনি দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, কিছু কিছু মোনাফেক মনে করে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাত হয়েছে, কিন্তু আসলে তাঁর ওফাত হয়নি। তিনি তাঁর প্রতিপালকের কাছে ঠিক সেইভাবে গেছেন যেভাবে হযরত মূসা ইবনে এমরান (আ.)গিয়েছিলেন। হযরত মূসা (আ .) তাঁর কওমের কাছ থেকে চল্লিশ দিন অনুপস্থিত থাকার পর পুনরায় ফিরে এসেছিলেন অথচ তাঁর ফিরে আসার আগে তাঁর স্বজাতীয়রা বলাবলি করছিলো যে, মূসা (আ .)-এর ওফাত হয়েছে। আল্লাহর শপথ, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ফিরে আসবেন এবং যারা মনে করছে তিনি মারা গেছেন তিনি তাদের হাত পা কেটে ফেলবেন। ২৩[ ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ-৬৫৫]

হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) সানহা নামক জায়গায় নিজের বাড়ীতে ছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের খবর শুনে ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত ছুটে এলেন এবং মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলেন। এরপর কাউকে কোন কথা না বলে সোজা হযরত আয়েশা (রা.)-এর ঘরে গেলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেহ মোবারক তখন ডোরাকাটা ইয়েমেনী চাদরে ঢাকা ছিলো। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) পবিত্র চেহারা থেকে চাদর সরালেন, চুম্বন করলেন এবং কাঁদলেন। এরপর বললেন, আমার মা বাবা আপনার ওপর কোরবান হোক, আল্লাহ তায়ালা আপনার জন্যে দু’টি মৃত্যু একত্রিত করবেন না। যে মুত্যু আপনার জন্যে লেখা ছিলো তা আপনার হয়েছে।

এরপর হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বাইরে এলেন। হযরত ওমর (রা.) সমবেত লোকদের সাথে কথা বলছিলেন। হযরত আবু বকর (রা.) তাঁকে বললেন, ওমর বসে পড়ো। হযরত ওমর (রা.) বসতে অস্বীকৃতি জানালেন। এদিকে সাহাবার হযরত ওমরকে ছেড়ে হযরত আবু বকর (রা.)-এর প্রতি মনোযোগী হলেন। হযরত আবু বকর (রা.) বললেন, তোমাদের মধ্যেকার যে ব্যক্তি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুজা করতো সে যেন জেনে রাখে যে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাত হয়নি। আর তোমদের মধ্যেকার যে ব্যক্তি আল্লাহর এবাদত করতো তারা যেন জেনে রাখে যে, আল্লাহ তায়ালা চিরঞ্জীব, তিনি কখনো, মৃত্যু বরণ করবেন না। পবিত্র কোরআনে আল্রাহ রব্বুল আলামীন বলেছেন, ’মোহাম্মদ কেবল রসূল মাত্র, তাঁর পূর্বে বহু রসূল গত হয়ে গেছে। সুতরাং যদি তিনি মারা যান বা নিহত হন তবে কি তোমরা পৃষ্ট প্রদর্শন করবে? এবং কেউ পৃষ্ট প্রদর্শন করলো সে কখনো আল্লাহর ক্ষতি করবে না বরং শীঘ্রই কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করবেন।’ (সূরা আলে এমরান, আয়াত ১৪৪]

মানসিক যন্ত্রণায় দিশেহারা এবং অস্থির সাহাবারা আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর বক্তব্য শুনে বিশ্বাস করলেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রকৃতই ইন্তেকাল করেছেন।

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহর শপথ, কেউ যেন জানতোই না যে, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের এই আয়াত নাযিল করে রেখেছেন। আবু বকর (রা.)-এর তেলাওয়াতের পর সবাই এই আয়াত মুখস্থ করলেন। সবার মুখে মুখে তখন এই আয়াত ফিরছিলো।

হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব (রা.) বললেন, আল্লাহর শপথ, হযরত আবু বকর (রা.)-কে শুনে আমি যেন মাটি হয়ে গেলাম। আমি দাঁড়াতে পারছিলাম না। হযরত আবু বকরকে এই আয়াত তেলাওয়াত করতে শুনে আমি মাটি ঢলে পড়ে যাচ্ছিলাম। কেননা তখন স্পষ্টতই বুঝতে পারছিলাম যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্যি সত্যি ইন্তেকাল করেছেন।২৪[সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৬৪০-৬৪১]

দাফনের প্রস্তুতি

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দাফনের জন্যে কাফন পরানোর আগেই তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনয়নের প্রশ্নে সাহাবাদের মধ্যে কিছুটা মতবিরোধে দেখা দিলো। ছাকিফা বনি সাআদায় মোহাজের ও আনসারদের মধ্যে বাদানুবাদ হলো। অবশেষে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর খেলাফতের ব্যাপারে সাবই একমত হলেন। একাজে সোমবারের বাকি দিন কেটে গেলো। রাত এসে গেলো। সবাই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পরদিন সকাল হলো, সেদিন ছিলো মঙ্গলবার। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র দেহ সেই ইয়েমেনী চাদরে আবৃত ছিলো। ঘরের লোকেরা ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

পরদিন মঙ্গলবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেহ অনাবৃত না করেই তাঁকে গোসল দেয়া হলো। যারা গোসল করিয়েছিলেন তারা হলেন হযরত আব্বাস, হযরত আলী, হযরত আব্বাসের দুই পুত্র ফযল এবং ছাকাম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মুক্ত করে দেয়া দাস শাকরান, হযরত উসামা ইবনে যায়েদ এবং আওস ইবনে খাওলা (রা.)। হযরত আব্বাস ও তাঁর দুই পুত্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাশ ফেরাচ্ছিলেন। হযরত উসামা এবং হযরত শাকরান পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন। হযরত আলী (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গোসল দিচ্ছিলেন। হযরত আওস (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিজের বুকের সাথে চেপে রাখছিলেন।

গোসল দেয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তিনখানি ইয়েমেনী সাদা চাদর দিয়ে কাফন দেয়া হয়। এতে কোর্তা এবং পাগড়ি ছিলো না। ২৫[সহী বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-১৬৯, সহীহ মুসলিম ১ম খন্ড, পৃ-৩০৬] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শুধু চাদর দিয়েই জড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোথায় দাফন করা হবে, সে সম্পর্কেও সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, সকল নবীকেই যেখানে তুলে নেয়া হয়েছে, সেই জায়গায় দাফন করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত, হওয়ার পর হযরত আবু তালহা (রা.) সেই বিছানা ওঠালেন, যে বিছানায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করেন। সেই বিছানার নীচে ব খনন করা হয়।

এরপর দশজন দশজন করে সাহাবা হুজরায় প্রবেশ করে পর্যায়ক্রমে জানাযার নামায আদায় করেন। এ নামাযে কেউ ইমাম হননি। সর্বপ্রথম বনু হাশেম গোত্রের লোকেরা নামায আদায় করেন। এরপর মোহজের এরপর আনসাররা, এরপর অন্যান্য পুরুষ এরপর মহিলা, এবং সবশেষে শিশুরা জানাযার নামায আদায় করেন।

জানাযার নামায আদায়ে মঙ্লবার পুরো দিন অতিবাহিত হয়। মঙ্লবার দিবাগত রাত্রে প্রিয় নবী মোহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মুজতবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দাফন করা হয়। তাঁর পবিত্র দেহ কবরের ভেতর রাখা হয়।

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঠিক কখন দাফন করা হয় আমরা জানতে পারিনি। তবে বুধবার রাতের মাঝামাঝি সময়ে কিছু শব্দ পেয়েছিলাম। ২৬[শেখ আব্দুল্লাহ রচিত মুখতাছার সীরাতে রসূল পৃ-৪৭১, এ ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেখুন বোখারী শরীফের মরজুন নবী অধ্যায়। আরো দেখুন ফতহুল বারী, সহীহ মুসলিম, মেশকাত। এছাড়া ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ-৬৪৯-৬৬৫, তালকীহ, পৃ-৩৮-৩৯, রহমতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড,পৃ-২৭৭-২৮৬]

নবী পরিবারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
(১) হযরত খাদিজা (রা)

হিজরতের আগে মক্কায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবার ছিলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা.)-এর সমন্বয়ে গঠিত। এই বিয়ের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স ছিল পঁচিশ এবং বিবি খাদিজার বয়স ছিলো চল্লিশ বছর। হযরত খাদিজা (রা.) ছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রথমা স্ত্রী। তাঁর জীবদ্দশায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য কোন বিয়ে করেননি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্তানদের মধ্যে হযরত ইবরাহিম ছাড়া অন্য সবাই ছিলেন বিবি খাদিজার গর্ভজাত। পুত্রদের মধ্যে কেউ জীবিত ছিলেন না। তবে কন্যারা জীবিত ছিলেন। তাঁদের নাম হচ্ছে হযরত যয়নব, হযরত রোকাইয়া, হযরত উম্মে কুলসুম এবং হযরত ফাতেমা (রা.)। যয়নবের বিয়ে হিজরতের আগে তাঁর ফুফাত ভাই হযরত আবুল আস ইবনে রবির সাথে হয়েছিলো। রোকাইয়া এবং উম্মে কুলসুমের বিয়ে পর্যায়ক্রমে হযরত ওসমান (রা.) এর সাথে হয়েছিলো। হযরত ফাতেমা (রা.)-এর বিয়ে বদর ও ওহুদ যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.)-এর সাথে হয়। তাঁদের চার সন্তান হলেন হযরত হাসান, হযরত হোসাইন, হযরত যয়নব এবং উম্মে কুলসুম (রা.)।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতের চেয়ে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অধিকারী ছিলেন।তিনি বিভিন্ন উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতে চারটি বিয়ে করার অনুমতি পান,একথা সকলেরই জানা আছে। যে সকল মহিলার সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন তাঁদের সংখ্যা ছিল এগারো। নবী (স.)-এর ইন্তেকালের সময় তাদের নয়জন জীবিত ছিলেন। দু’জন তাঁর জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন। এঁরা হচ্ছেন হযরত খাদিজা এবং উম্মুল মাসাকিন হযরত যয়নব বিনতে খোজায়মা (রা.)। এছাড়া অন্য দু’জন মহিলার সথেও তিনি বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন বলে বলা হয়ে থাকে, কিন্তু তাদের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়ে হয়েছিলো কিনা সে ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। তবে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, উল্লিখিত দু’জন মহিলাকে তাঁর কাছে রোখসত করা হয়নি। নীচে আমরা হযরত খাদিজার পর নবী সহধর্মিনীদের নাম এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পর্যায়ক্রমে তুলে ধরছি।

(২) হযরত সওদা বনতে জামআ

বিবি খাদিজা (রা.)-এর ইন্তেকালের কয়েকদিন পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের দশম বছরের শাওয়াল মাসে এ বিধবার সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। উল্লেখ্য এর আগে হযরত সওদা তাঁর চাচাতো ভাই সাকরান ইবনে আমবের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।

(৩) হযরত আয়েশা বিনতে আবু বকর (রা.)

নবুয়তের একাদশ বর্ষের শাওয়াল মাসে তাঁর সথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়ে হয়। অর্থাৎ হযরত সওদার বিয়ের এক বছর পর এবং হিজরতের দুই বছর পাঁচ মাস আগে। সে সময় হযরত আয়েশার বয়স ছিলো মাত্র ছয় বছর। হিজরতের সাত মাস পরে শওয়াল মাসের পয়লা তারিখে হযরত আয়েশাকে স্বামীর বাড়ীতে পাঠানো হয়। সে সময় নয় বছর এবং তিনি ছিলেন কুমারী। হযরত আয়েশা (রা.) ব্যতীত অন্য কোন কুমারী মেয়েকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিয়ে করেননি। হযরত আয়েশা ছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী। উম্মতে মোহাম্মদীর মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বাধিক জ্ঞান সম্পন্ন ফকীহ।

(৪) হযরত হাফসা বিনতে ওমর (রা.)

তাঁর প্রথম স্বামী ছিলেন খুনায়েস ইবনে হাযাফা সাহমি (রা.)। বদর ও ওহুদ যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তার স্বামী ইন্তেকাল করেন।এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তেসরা হিজরী সালে তাঁর সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন।

(৫)হযরত যয়নব বিনতে খোযায়মা (রা.)

তিনি ছিলেন বনু হেলাল ইবনে আমের ইবনে সাআসাআর সাথে সম্পর্কিত। গরীব মিসকিনদের প্রতি তাঁর অসামান্য মমত্ববোধ এবং ভালোবাসার কারণে তাঁকে উম্মুল মাসাকিন উপাধি প্রদান করা হয়। তিনি ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা.)-এর স্ত্রী। জঙ্গে ওহুদে উক্ত সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চতুর্থ হিজরীতে তাঁর সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। আট মাস নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী থাকার পর তিনি ইন্তেকাল করেন।

(৬) উম্মে সালমা হিন্দ বিনতে আবি উমাইয়া (রা)

তিনি আবু সালমা (রা.) এর স্ত্রী ছিলেন। চতুর্থ হিজরীর জমাদিউস সানিতে তিনি বিধবা হন। একই হিজরী সালের শওয়াল মাসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন।

(৭) যয়নব বিনতে জাহাশ ইবনে রিয়াব (রা.)

তিনি ছিলেন বনু আছাদ ইবনে খোযায়মা গোত্রের মহিলা এবং রসূলে খোদার ফুফাতো বোন। তাঁর বিয়ে প্রথমে হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.)-এর হয়েছিলো। হযরত যায়েদকে মনে করা হতো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছেলে। কিন্তু হযরত যায়েদের সাথে যয়নবের বনিবনা হয়নি, ফলে হযরত যায়েদ তাঁকে তালাক দেন। যয়নবের ইদ্দত শেষ হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা রব্বুল আলামীন এই আয়াত নাযিল করেন। ‘অতপর যায়েদ যখন যয়নবের সাথে বিয়ের সম্পর্ক ছিন্ন করলো, তখন আমি তাকে আপনার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করলাম। (সূরা আহযাব, আয়াত,৭)

এ সম্পর্কে সূরা আহযাবে আরো কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়েছে। এসব আয়াতে পালক পুত্র সম্পর্কিত বিতর্কের সুষ্ঠ ফয়সালা করে দেয়া হয়েছে। বিস্তারিত আলোচনা পরে করা হবে। হযরত যয়নবের সাথে পঞ্চম হিজরীর জিলকদ মাসে বা এর কিছু আগে রসূলের বিয়ে হয়।

(৮) যুয়াইরিয়া বিনতে হারেস (রা.)

তার পিতা ছিলেন খোযআ গোত্রের শাখা বনু মুস্তারিকের সর্দার। বনু মুস্তারিকের যুদ্ধবন্দীদের সাথে হযরত জুয়াইরিয়াকেও হাযির করা হয়। তিনি হযরত ছাবেত ইবনে কয়েস ইবনে শাম্মাস (রা.)-এর ভাগে পড়েছিলেন। হযরত ছাবেত (রা.) শর্ত সাপেক্ষে তাঁকে মুক্তি দেয়ার কথা জানান। শর্ত হিসাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানের কথা বলা হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ খবর জানার পর হযরত জুয়াইরিয়ার পক্ষে থেকে নির্ধারিত অর্থ পরিশোধ করে তার মুক্তির ব্যবস্থা করে তাকে বিয়ে করেন। এট পঞ্চম হিজরীর শাবান মাসের ঘটনা।

(৯) উম্মে হাবিবা বিনতে আবু সুফিয়ান (রা.)

তিনি ছিলেন উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাশের স্ত্রী। স্বামীর সাথে হিজ করে তিনি হাবশা অর্থাৎ আবিসিনিয়া গমন করেন। সেখানে যাওয়ার পর উবায়দুল্লাহ ধর্মান্তরিত হয়ে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন।পরে সেখানে তার মৃত্যু হয়।কিন্তু উম্মে হাবিবা নিজের ধর্ম বিশ্বাস ও হিজরতে ওপর অটল থাকেন। সপ্তম হিজরীর মহররম মাসে রসূল (স.) আমার ইবনে উমাইয়া জামিরিকে একখানি চিঠিসহ আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশির কাছে প্রেরণ করেন। সে চিঠিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে হাবিবাকে বিয়ে করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। নাজ্জাশী উম্মে হাবিবার সম্মতি সাপেক্ষে রসূল (স.) এর সাথে তার বিয়ে দেন এবং তাকে শরহাবিল ইবনে হাসানার সথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রেরণ করেন।

(১০)হযরত সফিয়া বিনত হুয়াই (রা.)

তিনি ছিলেন বনু ইসারাইল সম্প্রদায়ের এবং তিনি খয়বরে বন্দী। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে নিজের পছন্দ করায় মুক্ত করে বিয়ে করেন। সপ্তম হিজরীতে খয়বর বিজয়ের পর এ ঘটনা ঘটে।

(১১) হযরত মায়মুন বিনতে হারেস (রা.)

তিনি ছিলেন উম্মুল ফযল লোবাবা বিনতে হারেসের বোন। সপ্তম হিজরীর যিলকদ ‘মাসে ওমরায়ে কাযা’ শেষ করে এবং সঠিক কথা অনুযায়ী এহরাম থেকে হালাল হওয়ার পর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বিয়ে করেন।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লিখিত ১১জন মহিলাকে বিয়ে করেন। অন্য দু’জন মহিলা যাদেরকে তাঁর কাছে রোখসত করা হয়নি তাদের একজন বনু কেলাব গোত্রের এবং অন্যজন কেন্দাহ গোত্রের অধিবাসী ছিলেন। কেন্দহ গোত্রের এ মহিলার সাথে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়ে হয়েছিলো কিনা এবং তাঁর প্রকৃত নাম ও বংশ পরিচয় কি সে সম্পর্কে সীরাত রচয়িতাদের মধ্যে অনেক মতভেদ রয়েছে। সেসব উল্লেখ করার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

দাসীদের প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দু’জন দাসী ছিলেন। এদের একজন হচ্ছেন মারিয়া কিবতিয়া। মিসরের শাসনকর্তা মোকাওকিস তাকে উপঢৌকন হিসাবে প্রেরণ করেন। তার গর্ভ থেকে রসূল (স.) এর সন্তান হযরত ইব্রাহিম জন্ম নেন। তিনি দশম হিজরীর ২৮ অথবা ২৯শে শওয়াল মোতাবেক ৬৩২ ঈসায়ী সালের ২৭শে জানুয়ারী ইন্তেকাল করেন।

অন্য একজন দাসীর নাম ছিলো রায়হানা, তিনি বনু নাযির বা বনু কোরায়যা গোত্রের অন্তর্ভূক্ত। বনু কোরায়যা গোত্রের যুদ্ধবন্দীদের সাথে মদীনায় আসেন। রসূল (স.) রায়হানাকে পছন্দ করে পছন্দ করে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখেন। তাঁর সম্পর্কে গবেষকদের ধারণা এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে মুক্ত করে বিয়ে করেন। আল্লামা ইবনে কাইয়েম লিখেছেন যে, রায়হানাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাসী হিসাবেই রেখেছিলেন। আবু ওবায়দা লিখেছেন, উল্লিখিত দু’জন দাসী ছাড়াও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আরো দুজন দাসীও ছিলো, এদের একজন দাসীকে নবী সহধর্মিনী হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ (রা.)নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হেবা করে দেন। ১[দেখুন যাদুল মায়াদ, ১ম খন্ড, পৃ-২৯]

এখানে আমরা রসূল খোদান এর জীবনের একটি বিশেষ দিক সম্পর্কে আলোকপাত করা খুবই প্রয়োজন মনে করছি। যৌবনের এক বিরাট অংশ অর্থাৎ প্রায় তিরিশ বছরকাল তিনি মাত্র একজন স্ত্রীর সাথে অতিবাহিত করেন। তাও তিনি ছিলেন এমন এক স্ত্রী, যাকে বলা হয় প্রায় বৃদ্ধা। তার মৃত্যুর পর আরেজন বৃদ্ধা মহিলাকে বিয়ে করেন। প্রথমে হযরত খাদিজা এরপর হযরত সওদা (রা.)। এভাবে জীবন কাটানোর পর বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার পর হঠাৎ করে কি তাঁর মধ্যে যৌনশক্তি এতো বেড়ে গিয়েছিলো যে, তাকে এতোগুলো বিয়ে করতে হলো? নায়ুযুবিল্লাহ তা নয়। নবী জীবনের উল্লিতি দু’টি অধ্যায়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন কোনো মানুষই এমন অপবাদ দিতে পারবে না।আসলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশেষ বিশে উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতেই এতোগুলো বিয়ে করেছিলেন। সাধারণ বিয়ের নির্দিষ্ট সংখ্যার উদ্দেশ্যের চাইতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উদ্দেশ্য ছিলো অনেক মহৎ।

এর ব্যাখ্যা এই যে,রসূল (স.)হযরত আয়েশা এবং এবং হযরত হাফসাকে বিয়েকরে হযরত আব বকর এবং হযরত ওমরের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেছিলেন। একই ভাবে হযরত ওসমান (রা.)-এর হাতে পরপর দুই কন্যাকে তুলে দিয়ে এবং হযরত আলীর সাথে প্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমার বিয়ে দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লিখিত চারজন সাহবীর সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হন। কেননা উক্ত চারজন সাহাবী ইসলামের ক্রান্তিকালে ইসলামের সৈনিকা হিসাবে অতুলনীয় ত্যাগ-তিতিক্ষার পরিচয় দিয়েছিলেন। ইসলামের জন্যে তাঁদের সেবা ও আত্মত্যাগের ঘটনা তো সবার জানা।

আরবের নিয়ম ছিলো যে, তারা আত্মীয়তার সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। জামাতা সম্পর্ক আরবদের দৃষ্টিতে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভুমিকা পালন করে। জামাতার সাথে যুদ্ধ করাকে তার মনে করে লজ্জাজনক। এই নিয়মের করণে রসূলে খোদা বিভিন্ন গোত্রের ইসলামের প্রতি শত্রুতার শক্তি খর্ব করতে বিভি্ন গোত্রের মহিলাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, হযরত উম্মে সালমা ছিলেন বনু মাখযুম গোত্রের অধিবাসী। এই গোত্রের অধিবাসী ছিলো আবু জেহেল এবং খালেদ ইবনে ওলীদ। এই গোত্রে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পর খালেদ ইবনে ওলীদের মধ্যে ইসলামের প্রতি তেমন প্রবল শত্রুতা লক্ষ্য করা যায়নি। বরং কিছুকাল পর তিনি স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এমনিভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু সুফিয়ানের কন্যা উম্মে হাবিবাকে বিয়ে করার পর আবু সুফিয়ান ইসলামের শত্রুতা করলেও কখনো রসূলে খোদার সামনে আসেননি। হযরত যোয়াইরিয়া এবং হযরত সফিয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বিয়ে পর বনু মুস্তালেক এবং বনু গোত্র ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ছেড়ে দেয়। এই দু’টি গোত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পর এরা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না।

হযরত যোয়াইরিয়া তো তাঁর গোত্রের মধ্যে সকল মহিলার চেয়ে অধিক বরকতসম্পন্ন বলে বিবেচিত হন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বিয়ে করার পর সাহাবায়ে কেরাম উক্ত গোত্রের একশত যুদ্ধবন্দী পারিবারকে বিনাশর্তে মুক্তি দেন। তারা বলছিলেন যে, এরা তো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্বশুর পক্ষের লোক। গোত্রের লোকদের মনে এই দয়ার অসামান্য প্রভাব পড়েছিলো।

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই যে, রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি উচ্ছৃঙ্খল জাতিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মানসিক পরিশুদ্ধির ব্যবস্থা করে সভ্যতা-সংস্কৃতির আলোয় আলোকিত করার দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। ওরা ছিলো সভ্যতা-সংস্কৃতির সকল উপায় উপকরণ এবং সমাজ বিকাশের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। যে সকল নীতির ভিত্তিতে ইসলামী সমাজ গড়ে তোলা দরকার ছিলো তার ক্ষেত্রে নারা-পুরুষ ভেদাভেদ করার কোন সুযোগ ছিল না। কিন্তু ভেদাভেদমুক্ত চিন্তাধারার আলোকে মহিলাদের সরাসরি শিক্ষা দেয়াও সম্ভব ছিলো না। অথচ তাদেরকে শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা কোন অংশেই পুরুষদের চেয়ে কম ছিলো না বরং বলা যায় বেশীই ছিলো।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে এ উদ্দেশ্যের একটি পথই খোলা ছিলো, তা হচ্ছে বিভিন্ন বয়স ও যোগ্যতার মহিলাদের মনোনীত করা এবং তাদের মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বৃহত্তর উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন করা। মনোনীত মহিলাদেরকে তিনি শিক্ষা দিতে এবং মানসিক পরিশুদ্ধি ঘটাতে পারবেন। তাদের শরীয়তের হুকুম-আহকাম শেখাবেন। তাছাড়া তাদেরকে ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি এমনভাবে শিক্ষা দেবেন যাতে করে তারা গ্রাম ও শহরের যুবতী বৃদ্ধা নির্বিশেষে সকল মহিলাকে শরীয়তের বিধি-বিধান শেখাতে পারেন। ফলে মহিলাদের মধ্যে তাবলীগে দ্বীনের পূর্ণতা লাভ করবে।

এ কারণেই আমরা লক্ষ্য করি যে, দাম্পত্য জীবন তথা পারিবারিক জীবনের রীতিনীতি শিক্ষা দিতে উম্মুল মোমেনীনরা বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষত যাঁরা দীর্ঘায়ু হয়েছিলেন তার এ দায়িত্ব পালনের সুযোগ বেশী পেয়েছিলেন। যেমন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি নবী জীবনের কথা ও কাজের বর্ণনা ব্যাপকভাবে উল্লেখ করেছেন।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি বিষয় জাহেলী যুগের রীতি-নীতি নস্যাৎ করে দিয়েছিলো। আরব সমাজে এইকুসংস্কার যুগ যুগ ধরে চলে আসছিলো। নিয়ম ছিলো যে, পালকপুত্র হিসাবে কাউকে গ্রহণ করলে সে আসল পুত্রের মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করবে। এই নিয়ম আরব সমাজে এমন দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে বসেছিলো যে, তা বিলোপ করা মোটেই সহজ ছিলো না। অথচ এই নিয়ম ইসলামের বিয়ে, তালাক, সম্পত্তি আইন এবং অন্যান্য বিষয়ের সাথে ছিলো মারাত্মকভাবে সংঘাতপূর্ণ। এছাড়া জাহেলী যুগের এই কুসংস্কার এমন সব নির্লজ্জ কার্যকলাপ এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছিলো যে, সেসব থেকে সমাজদেহকে মুক্ত করা ইসলামের অন্যতম মৌলিক উদ্দেশ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। জাহেলী যুগের এই কুসংস্কার নির্মূল করার উদ্দেশ্যেই স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামীন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হযরত যয়নব বিনতে জাহশের বিয়ে করান।

উল্লেখ্য হযরত যয়নব প্রথমে হযরত যায়েদের স্ত্রী ছিলেন। আর যায়েদ ছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পালকপুত্র। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় হযরত যায়েদ স্ত্রীকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এটা ছিলো সে সময়ের কথা যখন সকল কাফের ছিলো আল্লাহর রসূলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। কাফেররা সেই সময় খন্দকের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। এদিকে পালকপুত্র বিষয়ক সমস্যা সমাধানের জন্যে আল্লাহর নির্দেশ ঘোষিত হয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধারণা করলেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি যায়েদ তার স্ত্রীকে তালাক দেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যদি যায়েদের পরিত্যক্ত স্ত্রীকে বিয়ে করতে হয় তাহলে বিধর্মীরা সুযোগা পাবে। মোনাফেক মোশরেক এবং ইহুদীরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে প্রবল প্রোপাগান্ডা শুরু করবে ও সরল প্রাণ মুসলমানদের মন বিষিয়ে তোলার চেষ্টা করবে। তাই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ চেষ্টাই করলেন যেন হযরত যায়েদ তার স্ত্রীকে তালাক না দেন। এতে যায়েদের স্ত্রীকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়ে করার প্রশ্নও উঠবে না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এটা পছন্দ করলেন না। আল্লাহ তায়ালা তার রসূলের প্রতি রুঢ় বক্তব্য সম্বলিত এই আয়াত নাযিল করলেন, ‘স্মরণ কর, আল্লাহ তায়ালা যাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং তুমিও যার প্রতি অনুগ্রহ করেছো তুমি তাকে বলছিলে, তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখো এবং আল্লাহকে ভয় করো। তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করছো আল্লাহ তায়ালা তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন, তুমি লোকভয় করছিলে, অথচ আল্লাহকে ভয় করাই তোমার পক্ষে অধিকতর সঙ্গত।’ (সূরা আহযাব, আয়াত-৩৭)

অবশেষে হযরত যায়েদ হযরত যয়নবকে তালাক দেন। এরপরে ইদ্দতকাল শেষ হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা তখন হযরত যয়নবকে বিয়ে করতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি নিজ ফয়সালা জানিয়ে দেন। আল্লাহ তায়ালা তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যে এই বিয়ে অত্যাবশ্যকীয় করেন। দেরী করার কোন অবকাশ রাখা হয়নি। পবিত্র কোরআনের বক্তব্য এরূপ, ‘অতপর যায়েদ যখন তার সাথে বিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করলো তথন আমি তাকে তোমার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করলাম যাতে মোমেনদের পোষ্যপুত্ররা নিজ স্ত্রীর সাথে বিয়ে ছিন্ন করলে সেই সব রমণীকে বিয়ে করা মোমেনদের কোন বিঘ্ন না হয়। আল্লাহর আদেশ কার্যকর হয়েই থাকে।’ (সূরা আহযাব, আয়াত-৩৭)

এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিলো এই যে, পারিতপুত্রের ব্যাপারে জাহেলী যুগের রীতিনীতি তথা বদ্ধমূল কুসংস্কারের মুলোৎপাটন। এর আগেই কোরআনের আয়াতে এই কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা ওদের ডাকো ওদের পিতৃ পরিচয়ে, আল্লাহর দৃষ্টিতে এটাই ন্যায় সঙ্গত।’ (সূরা আহযাব, আয়াত-৫)

আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেন, ‘মোহাম্মদ তোমাদের মধ্যেকার পুরুষদের কারো পিতা নন, বরং তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং খাতামুন নবী।’

এখানে একটা কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, সমাজ জীবনে কোন রেওয়াজ বদ্ধমূল হয়ে গেলে তখন শুধুমাত্র কথা দিয়ে তার মূলোউৎপাটন করা যায় না। সেই রেওয়াজের পরিবর্তন সাধনের জন্যে শুধু কথাই যথেষ্ট নয় বরং যিনি পরিবর্তন চান তাকে কাজের মাধ্যমে বাস্তব দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে হয়। এপর্যায়ে একটা উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে। হোদায়বিয়ার সন্ধির সময় মুসলামনদের পক্ষ থেকে যে তৎপরতা প্রকাশ পেয়েছিলো তার দ্বারা প্রকৃত সত্য উপলদ্ধি করা যায়। সেই সময়ে মুসলমাদের নিবেদিত চিত্ততা ছিলো বিস্ময়কর। ওরওয়া ইবনে মাসউদ ছাকাফি লক্ষ্যে করেছিলেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখের থুথু কফ মুসলমানরা মাটিতে পরতে দিচ্ছিলেন না। কেউ না কেউ হাত পেতে নিচ্ছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওযু করার সময়ে পরিত্যক্ত পানি গ্রহণের জন্যে সাহাবাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে যেতো। এই সাহাবারাই বাইয়াতে রেদোয়ানের সময় গাছের ছায়ায় মৃত্যুবরণ করা এবং পলায়ন না করার জন্যে বাইয়াত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করছিলেন, এসব সহাবাদের মধ্যে হযরত আবু বকর এবং হযরত ওমরের মতো বিশিষ্ট সহাবারাও ছিলেন। এসব সহাবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যে জীবন দেয়াও তার জন্যে বেঁচে থাকাকে সৌভাগ্য এবং সাফল্য মনে করছিলেন। অথচ হোদায়বিয়ার চুক্তি সম্পাদনের পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সহাবাদের বললেন তাদের নিজ নিজ কোরবানীর পশু যবাই করতে, তখন কেউ সাড়া দিলেন না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন ভীষণ মনোকষ্টে ভুগছিলেন। নবীপত্নী হযরত উম্মে সালমা (রা.) তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পরামর্শ দিলেন যে, আপনি নিজের কোরবানীর পশূ চুপচাপ যবাই করুন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাই করলেন। সাহাবরা তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণের জন্যে প্রতিযোগিতা শুরু করে দিলেন। তারা ছুটে গিয়ে নিজেদের কোরবানীর পশু যবাই করলেন। এঘটনা থেকে স্পষ্টতই একথা বোঝা যায় যে, প্রচলিত নিয়মের পরিবর্তন সাধনের ক্ষেত্রে কথা ও কাজের পার্থক্য কতো বেশী। আর জাহেলী যুগের প্রচলিত পালিতপুত্র বিষয়ক জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যেই আল্লাহ তায়ালা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পালিত পুত্রের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর সাথে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়ে দেন।

এ বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর মোনাফেকরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার ও প্রোপাগান্ডা চালাতে শুরু করে। তারা নানা ধরণের গুজব রটাতে থাকে । এর কিছুটা প্রভাব সরলপ্রাণ মুসলমানদের ওপরও এসে পড়ে। এ প্রোপাগান্ডাকে শক্তিশালী করতে মোনাফেকরা শরীয়তের একটি যুক্তিও খুঁজে নেয়। তারা প্রচার করে যে, ইসলাম চারটি বিয়ে বৈধ করেছে অথচ রসূল তার পালিত পুত্র যায়েদের তালকাপ্রাপ্তা স্ত্রীকে পঞ্চম স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছেন। একজন মুসলমানের জন্যে চারের বেশী গ্রহণ তো ইসলামেই বৈধ নয়। প্রচার-প্রোপাগান্ডার মূল বিষয় ছিলো এই যে, হযরত যাযেদ তো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পালিতপুত্র, নিজের পালিতপুত্রের স্ত্রীকে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করাতো নির্লর্জতাপূর্ণ ঘৃণ্য কাজ। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা সূরা আহযাবে উল্লিখিত উভয় বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করে আয়াত নাযিল করেন। সাহাবারা তখন বুঝতে পারেন যে, ইসলোমে পালিতপুত্রেরে কোন মূল্য নেই। এছাড়া আল্লাহ মহৎকোন উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতেই নিজ রসূলকে বিয়ের সংখ্যার ক্ষেত্রে ব্যাপকতা দিয়েছেন। এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অন্য কাউকে দেয়া হয়নি।

উম্মাহাতুল মোমেনীনদের সাথে প্রিয় নবী অত্যন্ত অভিজার্ত্যপূর্ণ, সম্মানজক উচ্চ পর্যায়ের এবং উন্নত জীবন যাপন করেন। নবী সহধর্মিনীরা নম্রতা, ভদ্রতা, শালীনতা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সেবা পরায়নতা, স্বামীর অধিকার পূরণ ইত্যাদি সকল বিষয়েই ছিলেন প্রশংসনীয় ভূমিকা পালনকারিণী। অথচ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বড়ই নীরস নির্বিলাস জীবন যাপন করতেন। সে জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলা অন্যদের মোটেই সহজ ছিলো না।

হযরত আনাস (রা.) বলেন, আমি জানিনা যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো ময়দার নরম রুটি খেয়েছেন। এমন করেই তিনি আল্লাহর সাথে মিলিত হয়েছেন। এছাড়া তিনি কখনো ভূনা করা বকরি চোখে দেখেননি। ২[সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৯৫৬]

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)বলেন, দুই দুই মাস কেটে যেতো, তৃতীয় মাসের চাঁদ দেখা যেতো অথচ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরের চুলোয় আগুন জ্বলতো না। হযরত ওরওয়া জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে আপনারা কি খেতেন? তিনি বললেন ব্যস, দুটি কালো জিনিস। খেজুর এবং পানি। ৩[একই পৃষ্ট, একই গ্রন্থ]

এই বিষয়ে হাদিস বহু রয়েছে। এমন কঠোর দারিদ্রতা সত্তেও নবী সহধর্মিনীদের কোন আপত্তিকর আচরণ লক্ষ্য করা যায়নি।

সহজাত স্বভাব দূর্বলতার কারণে একবা কিছু ক্রটি হয়ে পড়েছিলো। তাছাড়া এ ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধান জানিয়ে দেয়া প্রয়োজন ছিলো। একারণে এই আয়াত নাযিল হয়, ‘হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদের বলে দাও, তোমরা যদি পার্থিব জীবন ও তার ভূষণ কামন করো তবে এসো আমি তোমাদের ভোগ্য সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দিই এবং সৌজন্যের সাথে তোমাদের বিদায় দিই। আর যদি তোমরা আল্লাহ তায়ালা, তাঁর রসূল ও আখেরাতের কামনা করো তবে তোমাদের মধ্যে যার সৎকর্মশীল, আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্যে মহা প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন। ’(সূরা আহযাব, আয়াত-২৮-২৯)

নবী সহধর্মীনীরা সকলেই আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূলকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাদের শ্রেষ্ঠত্ব মর্যাদা এ থেকেই, অনুমান করা যায়, তাদের মধ্যে কেউই দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়েননি ।

সতীনদের মধ্যে যেসব ঘটনা সচরাচর প্রকাশ পায়, নবী সহধর্মীনীরা অধিক সংখ্যক হওয়া সত্তেও ওই ধরনের ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। সামান্য কিছু ঘটে থাকলেও যখন সাবধান করে দেয়া হয়েছে তখন কারো পক্ষ থেকেই প্রশ্ন তোলার মত কোন ঘটনা প্রকাশ পায়নি।সূরা তাহরীমের প্রতম পাঁচটি আয়াতে এই সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে।

পরিশেষে একথা বলা অসমীচীন হবে না যে, এখানে আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের সংখ্যা সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করি না। কেননা এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশী সোচ্চার হচ্ছে পাশ্চাত্যের অধিবাসীরা। তারা কি ধরনের জীবন যাপন করছে? দুর্ভাগ্যও তিক্ততার শিকার তারা অহরহ হচ্ছে। অবমাননাকর জীবন যাপন এবং অপরাধের মধ্যে তারা আগাগোড়া ডুবে আছে। স্ত্রীদের সংখ্যাধিক্যের নীতি থেকে মুখ ফিরিয়েও এ ব্যাপারে সমালোচনায় সোচ্চার হয়ে তারা যে দুঃখ,কষ্ট ও হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে রয়েছে , সে ব্যাপারে কি আলোচনায় কোন প্রয়োজন আছে?৪[একাধিক স্ত্রীর তুলনায় একাধিক গার্লফ্রেন্ড কি অধিক রুচিসম্মত] তাদের দুর্ভাগ্যজনক জীবন যাপন পদ্ধতি দেখেই প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রী সংখ্যাধিক্যের ইসলামী নীতি বিজ্ঞান সম্মত। জ্ঞানী, গুণী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লোকাদের জন্যে এতে রয়েছে চমৎকার মীমাংসা


তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট ও শারীরিক সৌন্দর্যঃ
রসূল সাল্লালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন চারিত্রিক বৈশিষ্ট ও শারীরিক সৌন্দার্যের অধিকারী ছিলেন, যা বলে শেষ করা যাবে না। এসব কারণে তাঁর প্রতি মন আপনা থেকেই নিবেদিত হয়ে যেতো। ফলে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং মর্যাদা বিধানে মানুষ এমন নিবেদিত চিত্ততার পরিচয় দিতো যার উদাহরণ দুনিয়ার অন্য কোন ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রেই পেশ করা সম্ভ্ নয়। তাঁর বন্ধু ও সহচররা তাঁকে প্রাণের চেয়ে বেশী ভালোবাসতেন। তারা চাইতেন যে, যদি প্রয়োজন হয় তবে নিজের মাথা কাচিয়ে দেবেন তবু রসূল সাল্লালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহ মোবারকে একটি আঁচড়ও যেন না লাগে। এ ধরণের ভালবাসার কারণ ছিলো এই যে,স্বভাবসম্মত যেসব গুণের প্রতি মনপ্রাণ উজাড় করে দেয়ার ইচ্ছা জাগে সেসব গুণের সমাবেশ তাঁর মদ্যে এতো বেশী ছিলো যে, অন্য কারো মধ্যেই সে রকম ছিলো না। নিচে আমরা বিনয়ের সাথে রসূল সাল্লালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৈান্দর্য সম্পর্কিথ সারকথা উল্লেখ করছি।

প্রিয় নবীর দৈহিক গঠন প্রকৃতি

হিজরতের সময়ে প্রিয় নবী সাল্লালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে মাবাদ খোযাইয়ার তাঁবুতে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর মদীনার পথে রওয়ান হযে যান। তাঁর চলে যাওয়ার পর উম্মে মাবাদ স্বামীর কাছে রসূল সাল্লালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে পরিচয় তুলে ধরেন তা ছিলো এরূপ। চমকানো রং, উজ্বল চেহারা, সুন্দর গঠন, সটান সোজাও নয়, আবার ঝুঁকে পড়াও নয়, অসাধারণ সৌন্দর্যের পাশাপাশি চিত্তাকর্ষক দৈহিক গঠন, সুর্মারাঙ্গা চোখ, লম্বা পলক, ঋজু কন্ঠস্বর, লম্বা ঘাড়, সাদা কালো চোখ, সুর্মাকালো তার পলক, সুক্ষ এবং পরস্পর সম্পৃক্ত ভ্রু, চমকানো কালো চুল, চুপচাপ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন,কথা বলার সময়ে আকর্ষনীয়, দূর থেকে দেখে মনে হয় সবার চেয়ে উজ্বল ও সৌন্দর্যপূর্ণ, কছে থেকে দেখে মনে হয় সুমহান এবং প্রিয় সুন্দর, কথার মিষ্টিতা, প্রকাশভঙ্গি সুস্পষ্ট, কথঅ খূব সংক্ষিপ্ত ও নয় আবার দীর্য়ায়িত ও নয়,কথা বলার সময় মনে হয় যেন, মুক্তো ঝরছে,মাঝারি উচ্চতা সম্পন্ন, বেঁটেও নয় লম্বাও নয় যে, দেখে খারাপ মনে হবে। সহচররা তাঁকে ঘিরে যদি কিছু বলে, তবে তিনি সেকথা গভীর মনযোগের সাথে শোনেন। তিনি কোন আদেশ করলে সাথে সাথে তার সে আদেশ পালন করেন, সহচররা তাঁর অত্যন্ত অনুগত এবং তাঁর প্রতি গভীর সম্মান ও শ্রদ্ধার মনোভাব পোষণ করেন, কেউ উদ্ধত ও দুর্বিনীত নয়, কেউ বাহুল্য কথাও বলেন ন। ১[যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ-৫৪]

হযরত আলী (রা.)রসূল সাল্লালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৈশিষ্ট্ বর্ণনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন যে, তিনি অস্বাভাবিক লম্বা ছিলেন ন, আবার বেঁটেও ছিলেন ন। তিনি ছিলেন মাঝারি ধরণের গঠন বৈশিষ্টসম্পন্ন। তাঁর চুল কোকড়ানো ও ছিলো না, আবার খাড়াও ছিলো না-ছিলো উভয়ের মাঝামাঝি ধরাণের ছিলো।তাঁর কপোল মাংসলও ছিলো আবার শুকনোও ছিলো না বরং উভয়ের মাঝামাঝি ধরণের ছিলো। তাঁর কপাল ছিল প্রশস্ত, গায়ের রং ছিলো গোলাপী গৌর এর মিশ্ররূপ। চোখ সুর্মারাঙ্গা লালচে, ঘন পল্বব বিশিষ্ট। বুকের ওপর নাভি থেকে হালকা চুলের রেখা, দেহের অন্য অংশ লোমশূন্য। হাত পা মংসল। চলার সময় স্পন্দিত ভঙ্তিতে পা তুলতেন। তাঁকে হেটে যেতে দেখে মনে হতে তিনি যেন ওপর থেকে নিচে যাচ্ছেন।কোন দিকে লক্ষ্য করলে পুরো মনোযোগের সাথেই লক্ষ্য করতেন। উভয় কাঁধের মাঝখানে তাঁর মোহর নবুয়ত ছিলো। তিনি ছিলেন সকল নবীর শেষ নবী। তিনি ছিলেন সর্বাধিক দানশীল। সর্বাধিক সাহসী, সর্বাধিক সত্যবাদী, সর্বাধিক অঙ্গীকার পালনকারী, সর্বাধিক কোমল প্রা ণ এবং সর্বাধিক আভিজাত্য সম্প্ন্ন। হঠাৎ করে কেউ তাঁকে দেখলে ভীতি-বিহবণ হয়ে পড়তো, পরিচিতি কেউ তাঁর সামনে গেলে ভালোবাসায় ব্যাকুল হতো। তাঁর গুণ বৈশিষ্ট বর্ণনাকারীকে বলতে হতো যে, আমি তাঁর আগে এবং তার পরে তার মতো অন্য কাউকে দেখিনি।২[ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-৪০১,৪০২ তিরমিযি শরহে তোহফাতুল আহওয়াদি, চতুর্থ খন্ড পৃ-৩০৩]

হযরত আলী (রা.)-এর অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, তাঁর মাথা ছিলো বড়, জোড়ার হাড় ছিলো ভারি, বুকের মাঝখানে লোমের হালকা রেখা ছিলো তিনি চলার সময়ে এমনভঅবে চলতেন, তখন মনে হতো কেউ যেন উঁচু থেকে নীচুতে অবতরণ করছে। ৩[ তিরমিযি , শরহে তোহফাতুল আওয়াজি, ৪র্থ খন্ড, পৃ-৩০৩]

হযরত জাবের ইবনে ছুমুরা (রা.) বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেশী ছিলো চওড়া, চোখ ছিলো লালচে, পায়ের গোড়ালী ছিলো সরু ধরণের। ৪[সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ-২৫৮]

হযরত আবু তোফায়ের বলেন, তিন ছিলে গৌর রং এর, চেহারা ছিলো মোলায়েম। তাঁর উচ্চতা ছিলো মাঝামাঝি ধরণের। ৫[সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ-২৫৮]

হযরত আনাস ইবনে মালেক বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতের তালু ছিলো প্রশস্ত, রং ছিলো চমকদার, একেবারে সাদাও ছিলো ন, একেবারে গম-এর রং ও ছিলো না। ওফাতের সময় পর্যন্ত তাঁর মাথা এবং চেহারার বিশটি চুলও সাদা হয়নি। ৬[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৫০২] শুধ কানের কয়েকটি লোম সাদা হয়েছিলো, এছাড়া মাথার কয়েকটি চুল ও সাদ হয়ে গিয়েছিলো।৭[সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ-৫০২]

হযরত আবু হোযায়ফা বলেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নীচের ঠোঁট সংলগ্ন দাড়ি সাদা দেখেছি। ৮[সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ-৫০২,৫০২]

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে বাছার (রা.) বলেন,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নীচের ঠোঁটেন সংলগ্ন দাড়িতে কয়েকটি সাদা হয়ে গিয়েছিলো।৯[ঐ পৃ-৫০২]

হযরত বারা বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মাঝারি ধরণে উচ্চতা সম্পন্ন। উভয় কাঁধের মাঝখানে দুরত্ব ছিলো। মাধার চুল ছিলো উভয় কানের লতিকা পর্যন্ত। আমি তাঁকে লাল পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখেছি। কখনো কোন জিনিস তাঁর চেয়ে অধিক সৌন্দর্যসম্পন্ন দেখেনি। ১০[ঐ পৃষ্টা ৫০২]

তিনি প্রথমে আহলে কেতাবদের মতো চুল আঁচড়াতে পছন্দ করতেন। একারণে আঁচড়ালে সিঁথি করতেন না, কিন্তু পরবর্তীতে সিঁথি করতেন।১১[ঐ পৃষ্টা ৫০২]

হযরত বারা ইবনে আযেব (রা.) বলেন, তাঁর চেহার ছিলো সবচেয়ে সুন্দর এবং তাঁর চেহারা ছিলো সকলেন চেয়ে উৎকৃষ্ট। ১২[ঐ প্রথম পৃষ্টা ৫০২ সহীহ মুসলিম ২য় খন্ড, পৃ-২৫৮]

হযরত বারা ইবনে আযেব (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারা কি তলোয়ারের মতো ছিলো? তিনি বললেন, না বরং তাঁর চেহারা ছিলো চাঁদের মতো। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চেহারা ছিলো গোলাকার। ১৩[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৫০২,সহীহ মুসলিম ২য় খন্ড, পৃ-২৫৯]

রবি বিনতে মোয়াওয়েয (রা.) বলেন, তোমরা যদি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে দেখতে, তখন মনে হতো যে, যেন উদিত সূর্যকে দেখছো। ১৪[মোসনাদে দারেমী, মেশকাত, ২য় খন্ড, পৃ-৫১৭]

হযরত জাবের ইবনে ছামুরা বলেন, এক চাঁদনী রাতে আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখছিলাম। সেই সময় তাঁর পরিধানে ছিলো লাল পোশাক। আমি একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি এবং একবার চাঁদের প্রতি তাকাচ্ছিলাম। অবশেষে আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, আমর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চাঁদের চেয়ে অধিক সুন্দর। ১৫[শামায়েলে তিরমিযি, দারেমী, মেলকাত দ্বিতীয় খন্ড, পৃ-৫১৫]

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়ে অধিক সুন্দর কোন মানুষ কিন্তু আমি দেখিনি। মনে হতো, সূর্য যেন তাঁর চেহারায় জ্বলজ্বল করছে। আমি তাঁর চেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন কাউকে দেখিনি। তিনি হাঁটতে শুরু করলে যমিন যেন তাঁর পায়ে সঙ্কচিত হয়ে আসতো। হাঁটার সময়ে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম, কিন্তু তিন থাকতেন নির্বিকার। ১৬[জামে তিরমিযি, শরহে তোহফাতুল আহওয়াযি, ৪র্থ খন্ড, পৃ-৩০৬, মেশকাত ২য় খন্ড, পৃ-৫১৮]

হযরত কা’ব ইবনে মালেক (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন খুশী হতেন, তখন তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠতো। দেখে মনে হতো যেন, এক টুকরো চাঁদ। ১৭[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৫০২]

একবার তিনি হযরত আয়েশার (রা.) কাছে অবস্থান করছিলেন্ ঘর্মাক্ত হয়ে ওঠার পর তাঁর চেহারা আরো উজ্জাল সুন্দর দেখাচ্ছিলো। এ অবস্থা দেখে হযরত আয়ো (রা.) আবু কোবায়েবের হাজলির এই কবিতা আবৃত্তি করলেন।১৮[রহমতুল লিল আলামীন, ২য় খন্ড, পৃ-১৭২]

‘তাঁর চেহারায় তাকিয়ে দেখতে পেলাম

চমকানো মেঘ যেন চমকায় অবিরাম।’

হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তাঁকে দেখে এই কবিতা আবৃত্তি করতেন।১৯[খোলাসাতুস সিয়ার পৃ-২০]

‘ভালোর পথে দেন দাওয়াত পূরণ করেন অঙ্গীকার

চতুর্দশীর চাঁদ, লুকোচুরি খেলে যেন অন্ধকার।’

হযরত ওমর (রা.) তাঁর সম্পর্কে যোহাইর-এর কবিতা আবৃত্তি করতেন। এ কবিতা হরম ইবনে ছিনাল সম্পর্কে লেখা হয়েছিলো।২০[ করতেন।১৯[খোলাসাতুস সিয়ার পৃ-২০]

‘মানুষ যদি না হতেন এই আল্লাহর প্রিয়জন

চতুর্দশীর রাত তিনি করতেন তবে রওশন।’

তিনি যখন ক্রোধান্বিত হতেন, তখন তাঁর চেহারা লাল হয়ে যেতো, মনে হতো উভয় কপালে আঙ্গুরের দান যেন নিংড়ে দেয়া হয়েছে। ২১[ মেশকাত ১ম খন্ড, পৃ-২২ তিরমিযি আরওয়াবুল কদর, ২য় খন্ড, পৃ-৩৫]

হযরর জাবের ইবনে ছামুরা বলেন,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হাসতেন মৃদু হাসতেন, তাঁর চোখ দেখে মনে হতো যেন সুর্মা লাগানো, অথচ সুর্ম লাগানো ছিলো না। ২২[ জামে তিরমিযি শরহে তোহফাতুল আহওয়াযি, ৪র্থ খন্ড, পৃ-৩০৬]

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনের দুটি দাঁত পৃথক পৃথক ছিলো । তাঁর কথঅ বলার সময় উভয় দাঁতের মদ্যে থেকে আলোকআভা বিচ্ছুরিত হতো। ২৩[তিরমিযি, মেশকাত, ২য় খন্ড, পৃ-৫১৮]

তাঁর গ্রীবা ছিলো রৌপ্যের নির্মিত পাত্রের মত পরিচ্ছন্ন, চোখের পলক ছিলো দীর্ঘ, দাড়ি ছিরো ঘন, ললাট প্রশস্ত, ভ্রু পৃথক, নাসিকা উন্নত, নাভি থেকে বক্ষ পর্যন্ত হালকা লোমের রেখা বাহুতে কিছু লোম ছিলো। পেট এবং বুক ছিলো সমান্তরাঁল, বুক প্রশস্ত, হাতের তালু প্রশস্ত। পথ চলার সময় তিনি কিছুটা ঝুঁকে পথ চলতেন।মধ্যম গতিতে তিনি পথ চলতেন। ২৪[খোলাসাতুস সিয়ার, পৃ-১৯-২০]

হযরত আনাস (রা.) বলেন, আমি এমন কোন রেশম দেখিনি, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতের তালুর চেয়ে বেশী নরম ছিলো। এমন কোন মেশক আম্বর শুকিনি যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুগন্ধির চেয়ে অধিক সুবাসিত ছিলো। ২৫[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, ৫০৩, সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ-২৫৮]

হযরত আবু যোহায়রা (রা.) বলেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাত আমার ওপর রেখেছিলাম। সেই সময় আমি অনুভব করলাম যে,অ সেই হাত বরফের চেয়ে বেশী ঠান্ডা এবং মেশকের চেয়ে বেশী খুশবুদার। ২৬[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড পৃ-৫০২

কিশোর বয়স্ক হযরত জাবের ইবনে ছামুরা (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কপালে হাত রেখেছিলেন, এতে আমি এমন শীতলতা ও সুবাস অনুভব করলাম যে, মনে হলো, তিনি তাঁর পবিত্র হাত আত্তাবের আতর দান থেকে বের করেছেন। ২৭[সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ-২৫৮]

হযরত আনাস (রা)বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘাম ছিলো মুক্তোর মতো। হযরত উম্মে সুলইম (রা.) বলেন, এই ঘমেই ছিলো সবচেয়ে উত্তম খুশবু। ২৮[সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ-২৫৬]

হযর জাবের (রা) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন রাস্তা দিয়ে পথ চলার পর অন্য কেউ সেই পথে, সেই রাস্তা দিয়ে গেলে বুঝতে পারতো যে, তিনি এ পথে দিয়ে গমন করেছিলেন। ২৯[ দায়েমী মেশকাত, ২য় খন্ড, পৃ-১৭]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উভয় কাঁধের মাঝামাঝি জায়গায় ছিলো মোহরে নবুয়ত। কবুতরের ডিমের মতো দেখতে এই মোহরে নবুয়তের রং ছিলো তাঁর দেহ বর্ণের মতো। এটি বাম কাঁধের নরম হাড়ের পাশে অবস্থিত ছিল। ৩০[সহীহ মুসলিম ২য় খন্ড, পৃ-২৫৯-২৬০]

চারিত্রিক বৈশিষ্ট

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় কথঅ বলতেন। অসঙ্কোচ, অনাড়ষ্ট, দ্ব্যর্থবোধক, অর্থপূর্ণ কথা। তিনি দূর্লভ বৈশিষ্ট এবং আরবের সকল ভাষার জ্ঞান লাভ করেছিলেন। এ কারণে তিনি যে কোন গোত্রের সাথে সেই গোত্রের ভাষা ও পরিভাষায় কথা বলতেন। বেদুইনদের মতো দৃঢ়তাব্যঞ্জক বাকভঙ্গি, সম্বোধন প্রকৃতি এবং শহরের নাগরিক জীবনের বিশুদ্ধ ভাষা ছিলো তার আয়ত্বধীন। উপরন্তু ছিলো ওহীভিত্তিক আল্লাহর সাহায্য।

সহিঞ্চুতা, ধৈর্য ও ক্ষমতাশীলতার গুণবৈশিষ্ট তার মধ্যে ছিলো। এসবই ছিলো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহপাক তেকে পাওয়া। সাধারণত সকল ধৈর্যশীল ও সহিঞ্চুতার অধিকারী মানুষের মধ্যেই কোন না কোন ক্রটি দেখা যায় কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট এমন উন্নত ও সুন্দর ছিলো যে, তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুদের উদ্যোগ আয়োজন এবং তাঁকে কষ্ট দেয়ার জন্যে দুর্বৃত্তদের তৎপরতা যতো বেড়েছে, তাঁর ধৈর্যও তাতো বেড়েছে।

হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, প্রিয় নবীকে দু’টি কাজের মধ্যে একটি বেছে নিতে বলা হলে তিনি সহজ কাজটিই নিতেন। পাপের সাথে সম্পৃক্ত কাজ থেকে তিনি দূরে থাকতেন। তিনি কখনো নিজের জন্যে কারো কাঝ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। তবে, আল্লাহর সম্মান ক্ষুণ্ন করা হলে তিনি আল্লাহর জন্যে প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন। ৩১[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৫০৩]

তিনি ক্রোধ ও দুর্বিনীত ব্যবস্থা থেকে দূরে ছিলেন। সকলের প্রতি সহজেই তিনি রাযি হয়ে যেতেন। তাঁর দান ও দয়াশীলতা পরিমাপ করা ছিলো অসম্ভব। দারিদ্রের আশঙ্কা থেকে মুক্ত মানসিকতা নিয়ে তিনি দান খায়রাত করতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সবার চেয়ে দানশীল। তাঁর দানশীলতা রমযান মাস হতে হযরত জিবরাঈল (আ.)-এর সাথে সাথে সময় অধিক বেড়ে যেতো। রমযান মাসে প্রতি রাতে হযরত জিবরাঈল (আ.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন। তিনি কল্যাণ ও দানশীলতায় পরিপূর্ণ বাতাতের চেয়ে অগ্রণী ছিলেন। ৩২[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৫১৭]

হযরত জাবের (রা.) বলেন, কখনোই এমন হয়নি যে, কেউ তাঁর কাছে কিছু চেয়েছে অথচ তিনি তা দিতে অস্মমতি জানিয়েছেন। ৩৩[সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৫১৭]

বীরত্ব ও বাহাদুরির ক্ষেত্রে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্থান ছিলো সাবর ওপরে। তিনি ছিলেন সকলেন চেয়ে শ্রেষ্ঠ বীর। কঠিন পরিস্থিতিতে বিশিষ্ট বীর পুরুষদের যখন পদস্থলন হয়ে যেতো, সেই সময়েও রসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অটল দৃঢ়তায় টিকে থাকতেন। তিনি সেই সুকঠিন সময়েও পশ্চাদপসারণ না করে সামনে এগিয়ে যেতেন। তাঁর দৃঢ়চিত্তারয় এতটুকু বিচলিত ভাব আসত না। হযরত আলী (রা.) বলেন, যে সময় যুদ্ধের বিভীষিকা দেখা যেতো এবং সুকঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো সে সময়ে আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামমের ছত্র ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করতাম। তাঁর চেয়ে বেশী দৃঢ়তার সাথে অন্য কেউ শত্রুর মোকাবেলা করতে সক্ষম হতো না। ৩৪[শাফী, কাজী আয়ায, ১ম খন্ড, পৃ-৮৯, ছেহাহ]

হযরত আনাস (রা.) বলেন, একরাতে মদীনাবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। সবাই আওয়ায় লক্ষ্য করে ছুটতে শুরু করলো্।পথে নবীজীর সাথে দেখা হলো। তিনি কোলাহল লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলেন। সেই সময় তিনি হযরত আবু তালহার (রা.) একটি ঘোড়ার খালি পিঠে সওয়ার হয়েছিলেন। তাঁর গলায় তরবারি ঝুলানো ছিলো। তিনি লোকদের বলছিলেন, ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না। ৩৫[সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ-২৫২, সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৪০৭]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সর্বাধিক লাজুক প্রকৃতির। তিনি সাধারণত মাটির দিকে দৃষ্টি রাখতেন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বললেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন পর্দানসীন কুমারী মেয়ের চেয়ে অধিক লজ্জাশীল। কোন কিছু তাঁর পছন্দ না হলে চেহারা দেখেই বোঝা যেতো। ৩৬[সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ-২৫২, সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৪০৭] কারো চেহারার প্রতি তিনি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকতেন না। দৃষ্টি নিচু রাখতেন এবং ওপরের দিকের চেয়ে নীচের দিকেই বেশী সময় তাকিয়ে থাকতেন। সাধারণত তাকানোর সময় নিচু দৃষ্টিতে তাকাতেন। লজ্জাশীলতা ও আত্মসম্মান বোধ এতো প্রবল ছিলো যে, কারো মুখের ওপর সরাসরি অপ্রিয় কথা বলতেন না। কারো ব্যাপারে কোন অপ্রিয় কথা তাঁর কাছে পৌঁছুলে সেই লোকের নাম উল্লেখ করে তাকে বিব্রত করতেন না। বরং এভাবে বলতেন যে, কিছু লোক এভাবে বলাবলি করছে। বিখ্যাত আবর কবি ফারাযদাক-এর কবিতয়ি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই বৈশিষ্ট চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

‘লজ্জাশীল তিনি তাই দৃষ্টি নত তাঁর

তাঁকে দেখে চোখের নযর নত যে সবার

তাঁর সাথে কথা বলা সম্ভব হয় তখন

অধরে তাঁর মৃদু হাসি ফোটে যখন।’

তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশী ন্যায়পরায়ন পাক পবিত্র, সত্যবাদী এবং বিশিষ্ট আমানতদার। বন্ধু শত্রু সকলেই এটা স্বীকার করতেন। নবুয়ত লাভের আগে তাঁকে ‘আল-আমিন’ উপাধি দেয়া হয়েছিলো। আইয়ামে জাহেলিয়াতে তাঁর কাছে বিচার –ফয়সালার জন্যে বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষই হাযির হতো। তিরমিযি শরীফে হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, একবার আবু জেহেল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললো, আমরা তো আপনাকে মিথ্যঅবাদী বলি না, কিন্তু আপনি যা কিছু প্রচার করছেন, তাকে মিথ্যা বলি। একথার পর আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করেন। ‘তারা তোমাকে তো মিথ্যাবাদী বলে না, বরং সীমা লংঘনকারীগণ আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করে।৩৭[মেশকাত,২য় খন্ড, পৃ-৫২১](আনআম, আয়াত-৩৩)

সম্রাট হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, সেই নবী যেসব কথা বলেন, সেই সব কথা বলার আগে তাকে মিথ্যাবাদী বলে অভিহিত করার মত কোন ঘটনা ঘটেছিলো কি? আবু সুফিয়ান বললেন, ‘না’।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন অতি বিনয়ী ও নিরহংকার। বাদশাহদের সম্মানে তাদের সেবক ও গুণগ্রাহীরা যেরকম বিনায়বনত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্মানে সাহাবাদের সেভাবে দাঁড়াতে নিষেধ করতেন। তিনি মিসকিন গরীবদের সেবা এবং ফকিরদের সাথে উঠাবসা করতেন। ক্রীতদাসদেরও নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতেন। সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে সাধারণ মানুষের মতোই বসতেন।

হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, তিনি নিজের জুতো নিজেই সেলাই করতেন। নিজের কাপড় নিজেই সেলাই করতেন। ঘরের সাধারণ কাজ কর্ম নিজের হাতে করতেন। তিনি ছিলেন অন্য সব সাধারণ মানুষের মতোই একজন মানুষ। নিজের ব্যবহৃত কাপড়ের উকুন থাকলে তিনি নিজে তা বের করতেন, নিজ হাতে বকরি দোহন করতেন, নিজের কাজ নিজেই করতেন। ৩৮[মেশকাত , ২য় খন্ড, পৃ-৫২০]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অঙ্গীকার পালনে ছিলেন অগ্রণী। তিনি আত্মীয়স্বজনের প্রতি অতিমাত্রায় খেয়াল রাখতেন। মানুষের সাথে সহৃদয়তা ও আন্তরিকতার সাথে মেলামেশা করতেন। বিনয় ও নম্রতায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তাঁর চরিত্র ছিলো অনন্য সুন্দর। অসচ্চরিত্রতার এক বিন্দুও তাঁর মধ্যে ছিলো না। স্বভাবগতভাবেই তিনি কখনো অশালীন কথা বলতেন না। অনিচ্ছাকৃতভাবেও তিনি কখনো অশালীন কথা বলেননি। কাউকে কখনো অভিশাপ দিতেন না। বাজারে গেলে উচ্ছস্বরে চিল্লাচিল্লি করতেন না। মন্দের বদলা তিনি মন্দ দিয়ে দিতেন না। বরং তিনি মন্দের জন্যে দায়ী লোককেও ক্ষমা করে দিতেন। কেউ তার পেছনে আসতে শুরু করলে তাকে পেছনে ফেলে চলে আসতেন না। পানাহারের ক্ষেত্রে দাসীবাদীদের চেয়ে নিজেকে পৃথক মনে করতেন না। তাঁর খাদেমের কাজও তিনি করে দিতেন। খাদেমের প্রতি তিনি কখনো বিরক্তি প্রকাশ করেননি। কোন কাজ করা না করা প্রসঙ্গে কখনো তাঁর খাদেমের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেননি। তিনি গরীব মিসকিনদের ভালোবাসতেন। তাদের সাথে উঠাবসা করতেন এবং জানাযায় হাযির হতেন। কোন গরীবকে তার দারিদ্রের কারণে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন না। একবার তিনি সফরে ছিলেন। সেই সময় একটি বকরি যবাই করার পরামর্শ হয়। একজন বললেন,যবাই করার দায়িত্ব আমার, অন্যজন বললেন, চামড়া ছাড়ানোর দায়িত্ব আমার। তৃতীয় জন বললেন, রান্নার দায়িত্ব আমি পালন করবো। এসব কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কাঠ সংগ্রহ করার দায়িত্ব আমি পালন করবো। সাহাবারা বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমরা আমরা আপনার কাজ করে দেবো। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাযি হলেন না। তিনি বললেন, আমি জানি, তোমরা আমার কাজ করে দেবে, কিন্তু আমি চাই না যে, আমি তোমাদের চাইতে নিজেকে পৃথক অবস্থানে রেখে স্বাতন্ত্রতা অর্জন করবো। কেননা আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের মধ্যে বন্ধুদের নিজেকে পৃথক করে প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা পছন্দ করেন না। এরপর তিনি লাকড়ি জমা করতে চলে গেলেন।৩৯[খোলাছাতুস সিয়ার, পৃ-২৩]

আসুন, এবার হেন্দ ইবনে আবু হালার যবানীতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গুণ বৈশিষ্ট শ্রবন করি। হেন্দ তাঁর এক দীর্ঘ বর্ণনায় বলেন, প্রিয় নবী গভীর চিন্তায় চিন্তিত ছিলে। সব সময় চিন্তা-ভাবনা করতেন। কথার শুরু ও শেষে সুস্পষ্ট উচ্চারণ করতেন। অস্পষ্ট উচ্চারণে কোন কথা বলতেন না। অর্থবহ দ্ব্যর্থহীন কথা বলতেন, সেই কথায় কোন বাহুল্য থকত না। তিনি ছিলেন নরম মেযাজের অধিকারী। সামান্য পরিমাণ নেয়ামত হলেও তার অমর্যদা করতেন না। কোন কিছুর নিন্দা সমালোচনা করতেন না। পানাহারের জিনিসের সমালোচনা করতেন না। সত্য ও ন্যায়ের পরিপন্থী কোন আচরণ কারো দ্বারা প্রকাশিত হরে তার প্রতি তিনি বিরক্ত হতেন। সেই লোকের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ না করা পর্যন্ত নিবৃত্ত হতেন না। তবে, তাঁর মন ছিলো উদার। নিজের জন্যে কারো ওপর ক্রদ্ধ হতেন না এবং কারো কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন না। কারো প্রতি ইশার করতে হাতের পুরো তালু ব্যবহার করতেন। বিস্ময়ের সময় হাত ওল্টাতেন। ক্রদ্ধ হলে অন্য দিকে মুখ ফেরাতেন এবং খুশী হলে দৃষ্টি নিচু করতেন। অধিকাংশ সময়েই তিনি মৃদু হাসতে। মৃদু হাসির সময় দাঁতের কিয়দংশ ঝকমক করতো।

অর্থহীন কথা থেকে বিরত থাকতেন। সাথীদের একত্রিত করে রাখার চেষ্টা করতেন, পৃথক করার চেষ্টা করতেন না। সকল সম্প্রদায়ের সম্মানিত লোকদের সম্মান করতেন। সম্মানিত লোককেই নেতা নিযুক্ত করতেন। মানুষের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকতেন।

সাহাবাদের খবরাখবর নিতেন। তাদের কুশল জিজ্ঞাসা করতেন। ভালো জিনিসের প্রশংসা এবং খারাপ জিনিসের সমালোচনা করতেন। সব বিয়য়েই মধ্যপন্থা পছন্দ করতেন। কোন বিষয়ে অমনোযোগী থাকা ছিলো তাঁর অপছন্দ। যে কোন অবস্থার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতেন। সত্য ও ন্যায় থেকে দূরে থাকা পছন্দ করতেন না। অসত্য থেকে দূরে থাকতেন। তার সন্নিকটে যারা থাকতেন, তারা ছিলেন সবচেয়ে ভালো মানুষ। ওদের মধ্যে তারাই ছিলেন তার কাছে ভালো, যারা ছিলেন পরোপকারী। তাঁর কাছে ওদের মর্যাদাই ছিলো অধিক অর্থাৎ তার দৃষ্টিতে তারাই ছিলেন সর্বোত্তম, যারা ছিলেন অন্যের দুঃখে কাতর, স্বভাবতই গম্ভীর এবং অন্যের সাহয্যকারী।

তিনি উঠতে বসতে সর্বদাই আল্লাহকে স্মরণ করতেন। তাঁর বসার জন্যে নির্ধারিত কোন জায়গা ছিলো না। কোন জনসমাবেশ গেলে যেখানে জায়গা খালি পেতেন সেখানেই বসতেন। উপস্থিত সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন। কারো মনে একথা জাগত না যে, অমুককে আমার চেয়ে বেশী মর্যাদা দেয়া হচ্ছে এবং এজন্যে তার মনে কোন ক্ষোভ বা দুঃখ সৃষ্টি হতো না। কেউ কোন প্রয়োজনে তাঁর কাছে বসলে বা দাঁড়ালে সেই লোকের প্রয়োজন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করতেন। তার ধৈর্যের কোন বিচ্যুতি দেখা যেত না। কেউ তাঁর কাছে কোন কিছু চাইলে তিনি অকাতরে দান করতেন। প্রার্থিত বস্তু প্রদান অথবা ভালো কথা বলে তাকে খুশী না করা পর্যন্ত প্রার্থীকে বিদায় করতেন না। তিনি নিজের উন্নত চরিত্র বৈশিষ্টের মাধ্যমে সবাইকে সন্তুষ্ট করতেন। তিনি ছিলেন সকলের জন্যে পিতৃতুল্য। তাঁর দৃষ্টিতে সবাই ছিলো সমান। কারো শ্রেষ্ঠত্ব বা মর্যাদার আধিক্য নির্ণিত হলে সেটা তাকওয়ার ভিত্তিতে নির্ণিত হতো। তাঁর মজলিস বা সমাবেশ ছিলো জ্ঞান, ধৈর্য, লজ্জাশীলতা ও আমানতদারীর মজলিস। সেখানে কেউ উচ্চস্বরে কথা বলতো না, কারো মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হতো না। তাকওয়ার ভিত্তিতে সকলেই সকলের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতো। বায়োজ্যেষ্ঠকে সবাই সম্মান এবং ছোটকে স্নেহ করতো। কারো কোন প্রয়োজন দেখা দিলে সেই প্রয়োজন পূরণ করা হতো। অপরিচিত লোককে অবজ্ঞা বা উপেক্ষা করা হতো না, বরং তার সাথে পরিচিত হয়ে আন্তরিকতা প্রকাশ করা হতো।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারায় সবসময় স্মিতভাব বিরাজ করতো। তিনি ছিলেন নরম মেজাযের। রুক্ষতা ছিলো তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ। বেশী জোরে কথা বলতেন না। অশালীন কোন কথা তাঁর মুখে উচ্চারিত হতো না। কারো প্রতি রুষ্ট হলেও তাকে ধমক দিয়ে কথা বলতেন না। কারো প্রশংসা করার সময়ে অতি মাত্রায় প্রশংসা করতেন না। যে জিনিসের প্রতি আগ্রহী না হতেন, সেটা সহজেই ভুলে থাকতেন। কোন ব্যাপরেই কেউ তাঁর কাছে হতাশ হতেন না। তিনটি বিষয় থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত রাখতেন। এগুলে হচ্ছে, (১) অহঙ্কার, (২) কোন জিনিসের বাহুল্য এবং (৩) অর্থহীন কথা। আর তিনটি বিষয় থেকে লোকদের নিরাপদ রাখতেন। এগুলো হচ্ছে, (১) পরের নিন্দা (২) কাউকে লজ্জা দেয়া এবং (৩) অন্যের দোষ প্রকাশ করা।

তিনি এমন কথাই শুধু মুখে আনতেন যে কথায় সওয়াব লাভের আশা থাকতো। তিনি যখন কথা বলতেন, তখন তার সাহাবীরা এমনভাবে মাথা নিচু করে বসতেন যে, দেখে মনে হতো তাদের মাথার ওপর চড়ুই পাখী বসে আছে।সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কথা শেষ করে নীরব হলে সাহাবারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতেন। কোন সাহাবী প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বাহুল্য কোন কথা বলতেন না। কোন সাহাবী প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন কথা বলতে শুরু করলে উপস্থিত অন্য সবাই মনোযোগ দিয়ে সেকথা শুনতেন। কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত নীরবতা বজায় থাকতো। যে কথা শুনে সাহাবারা হাসতেন, সে কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হাসতেন। যে কথা শুনে সাহবারা অবাক হতেন, সে কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ও অবাক হতেন। অপরিচিত লোক কথা বলার ক্ষেত্রে অসংযমী হলে নবী ধৈর্য হারাতেন না। তিনি বলতেন, কাউকে পরমুখাপেক্ষী দেখলে তার প্রয়োজন পূরণ করে দাও। ইহসানের পারিশ্রমিক ছাড়া অন্য কারো প্রশংসা কোন ব্যাপারেই তাঁর পছন্দনীয় ছিলো না। ৪০[শাফা, কাযী আয়ায, ১ম খন্ড, ১২১-১২৬ শামায়েলে তিরমিযি।]

হযরত খারেজা ইবনে যায়েদ (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মজলিসে সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদাশীল ছিলেন। পোশাক পরিধানে তিনি ছিলেন শালীন। অধিকাংশ সময় নীরবতা পালন করতেন। বিনা প্রয়োজনে কথা বলতেন না। যে ব্যক্তি অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতো, তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন তিনি যখন হাসতেন, মৃদু হাসতেন, সুস্পষ্টভাবে কথা বরতেন, ফালতু ও অপ্রয়োজনীয় কথা বলতেন না। সাহাবারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে উচ্চ স্বরে হাসতেন না, তাঁরা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপস্থিতিতে হাসি সংযত রাখতেন এবং মৃদু হাসতেন। ৪১[১৬ই রমযান ১৪০৪ হিজরী মোতাবেক ১৭ই রমযান ১৯৮৪ ইং]

মোটকথা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তুলনাহীন গুণবৈশিষ্টের অধিকারী একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ ছিলেন। রব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালা তাঁকে অতুলনীয় বৈশিষ্ট দান করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় নবীর সম্মানে বলেছেন, ‘ইন্নাকা লা আলা কুলুকিন আযীম’, অর্থাৎ নিসন্দেহে আপনি সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।

এটি ছিলো এমন তুলনাবিহীন গুন যার কারণে মানুষ তার প্রতি ছুটে আসতে। তাঁর প্রতি মানুষের মনে ভালোবাসা ছিলো বদ্ধ মূল। তাঁর নেতৃত্ব এমন অবিসম্বাদিত ছিলো যে,মানুষ ছিলো তাঁর প্রতি নিবেদিত প্রাণ।

মানবীয় গুণাবলীর সর্বোত্তম বৈশিষ্টের কারণে তাঁর স্বজাতির রুক্ষ্ণতা, একেবারে নমনীয়তায় পরিবর্তিত হয়েছিলো। পরিশেষে মানুষ দলে দলে আল্লাহর মনোনীত দ্বীনের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে ধন্য হয়েছিলো।

স্মরণ রাকতে হবে যে, ইতিপূর্বে আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে সকল গুণাবলী আলোচনা করেছিলাম সেসব ছিলো তার অসাধারণ ও অতুলনীয় গুণাবলীর সামান্য রেখাচিত্র। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর গুণাবলী এতো ব্যাপক ও বিস্তৃত ছিলো যে, সেসব গুণাবলীর আলোচনা করে শেষ করা সম্ভব নয় এবং তাঁর চরিত্র বৈশিষ্টের ব্যাপকতা ও গভীরতা নিরূপণ করাও সম্ভব নয়।

মানবেতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ নিরূপণ কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। পূর্ণতার শ্রেষ্ঠতম আদর্শ এ মহান মানুষের পরিচয় এই যে, তিনি মানবতার সর্বোচ্চ চূড়ায় সমাসীন ছিলেন। তিনি মহান রব্বুল আলামীনের পবিত্র আলোক আভায় এমনভাবে আলোকিত ছিলেন যে, কোরআনে করিমকে তাঁর চরিত্রের পরিচয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর চরিত্র বৈশিষ্ট্য ছিলো পবিত্র কোরআনেরই বাস্তব ও পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন।

‘হে আল্লাহ তায়ালা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর এবং তাঁর পরিবারর-পরিজনের ওপর তুমি শান্তি ও বরকত নাযিল করো, যেমন শান্তি ও বরকত নাযিল করেছিলে হযরত ইবরাহিম (আ.)ও তাঁর পরিবারর-পরিজনের ওপর। নিশ্চ তুমি প্রশংসা ও মর্যাদার অধিকারী।

সে ব্যক্তির জন্যে ততোটুকুই (পুরস্কার) রয়েছে যতোটুকু সে

(এ দুনিয়ায়) করে এসেছে, আবার (শাস্তিও) তার

জন্যে তাতোটুকু রয়েছে, যতোটুকু অন্যায় সে

করেছে, (অতএব) হে আমাদের মালিক,

যদি আমর কিছু ভুলে যািই , কোথায়ও

যদি আমরা কোনো ভুল করে বসি,

তার জন্যে তুমি আমাদের পাকাড়াও করো না।


সহায়ক গ্রন্থসমূহঃ যে ফুল দিয়ে গেথেছি মালা
সহায়ক গ্রন্থসমূহ

 

নাম্বার গ্রন্থের নাম লেখকের নাম মৃত্যুর সাল প্রকাশনা সংস্থা প্রকাশ কাল
১ আখবারুল কেরাম বা আখবারুল মাসজিদিল হারাম মাসজিদিল হারাম মাসজিদিল হারামআছাদি আল মক্কী ১০৬৬ হিঃ আল মাতবা সালাফেয়া বেনারস
১৩৯৬ হিঃ

২ আল আদাবুল মুফরাদ মোহাম্দ ইবনে ইসমাইল আল বোখারী ৩৫৬ হিঃ ইস্তাম্বুল ১৩০৪ হিঃ
৩ আল আলাম খাযরুদ্দিন আয যারকালি কায়রো ১৯৫৪ হিঃ
৪ আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া ইসমাইল ইবনে কাছির দামেশকী আস সায়াদা,মিশর ১৩৩২ হিঃ
৫ বুলুগুল মারাম মিন আদিল্লাতিল আহকাম আহমদ ইবনে হাজ্জার আসকালানি

৮৫৬ হিঃ কাইউমি প্রেস, কানপুর, ভারত ১৩২৩ হিঃ
৬ তারিখেআরদিলকোরআন সাইয়েদসোলাইমাননদভী ১৩৭৩হি মাআরেফপ্রেস, আযমগড় ১৯৫৫খৃঃ
৭ তারীকেইসলাম আকবরখানশাহ নয়রাবাদী মাকতাবেরহমত, দেওবন্দ
৮ তারীখুলউমামওয়ালমুলুক ইবনেজরিরআততাবারী আরহাসানাতুমিসরিয়া
৯ তারীকেওমরইববেখাত্তাব আবুলফারাহআব্দুররহমানইবনেজওযি আততওফীকআলআদিবা, মিশর
১০ তোহফাতুনআহওয়াযি আবুলআলাআবুদররহমানমোবারকপুরী

১৩৫৩হি বার্কিপ্রেস দিল্লী, ভারত ১৩৪৬হিঃ
১১ তাফসীরইবনেকাছীর ইসমাইলইবনেকাছীরদামেশকী দারুলআন্দালসবৈরত
১২ তাফহীমুল ওস্তাদসাইয়েদআবুলআলামওদূদী (রঃ) মারকাযিমাকতাবজামায়াতেইসলামী
১৩ তালকীহেফহুমেআহলিলআছার আবুলফারাযআবুদররহমানইবনেজওযি ৫৯৭হিঃ জাইয়েদবারকিপ্রেস , দিল্লী, ভার
১৪ জামেতিরমিযি আবুঈসামোহাম্মদইবনেঈসাতিরমিযি ২৭৯হিঃ মাকতাবায়েরশীদিয়া, দিল্লী, ভারত
১৫ আলজেহাদুফিলইসলম ওস্তাদসাইয়েদআবুলআলামওদূদী (রঃ) ইসলামিকপাবলিকেশন ১৯৬৭খৃঃ
১৬ খোলাছাতুসসিয়ার ইবনেআবদুল্লাহআততাবারী ৬৭৪ দিল্লীপ্রিন্ট, দিল্লীভরত
১৭ রহমাতুললিলআলামীন মোহাম্দসোলায়মানমনজুনপুরী ১৯৩০হিঃ হানিফবুকডিপো, দিল্লী, ভারত
১৮ রসূলেকরিমকিসিয়াসিজিন্দেগী ডক্টরহামিদুল্লাহপ্যারিস সালেমকোম্পানীদেওবন্দ ১৯৬৩খৃ
১৯ আররওযলউমুফ আবুলকাসেমআবদুররহমানইবনেআবদুল্রাহলোছায়লী ৫৮১হিঃ আলজায়ালিয়া, মিশর ১৩৩২হিঃ
২০ যাদুলমায়াদ হাফেজইবনেকাইয়েকম ৭৫১হিঃ আলমিসরিয়া ১৩৪৭হিঃ
২১ সফরুততাকওয়ীন
২২ সুনানেইবনেমাঝা ইবনেইয়াছিনইবনেমাজ ২৭৩হি
২৩ সুনানেআবিদাউদ আবুদাউদ ২৭৫হিঃ ১৩৭৫হিঃ
২৪
২৫ সিরাতুলহালিকিয়া ইবনেবোরহানউদ্দীন
২৬ সীরাতুলনবুবিয়াহ আবুমোহাম্মদআবুদলমালেকইবনেহিশাম ২১৮হিঃ ১৩৭৫হিঃ
২৭ শরহেশুয়ুরুসসাহাব জামালউদ্দিনেইবনেহিশামআনসারী ৭৬১হিঃ মাকতাবাআলসাজদা, মিশর
২৮ শরহেসহীহমুসলিম আবুযাকারিয়ামহিউদ্দীনইয়াহিয়ইবনেশরীফআনসারী ৬৭৬হিঃ মাকতাবরুশীদিয়া, দিল্লী ১৩৭৬হিঃ
২৯ শরহেসহীহমুসলিম আবুযাকারিয়ামহিউদ্দীনইয়াহিয়ইবনেশরীফআনসারী দ্রস্প্রাপ্য ১৩১২হিঃ

৩০ আশশাফকেতারিফেহাকিকুলমোস্তফা কাজীআয়ায মাকতাবায়েওসমানিয়, ইস্তাম্বুল ১৩১২হিঃ
৩১ সহীহবোখারী মোহাম্মদইসমাঈলবোখারী ২৫৬হিঃ মাকতাবায়েরহীমিয়া, দেওবন্দ ১৩৮৭হিঃ
৩২ সহীহমুসলিম মুসলিমইবনেহাজ্বাজআলকুশাইরি মাকতাবায়েরশীদিয়া, দিল্লী, ভারত ১৩৭৬হিঃ
৩৩ ***
৩৪ সোলহেহোদায়বিয়া মোহাম্মদআহমদবাশামিল দারুলফাকের , মিশর ১৩৯১হিঃ
৩৫ আত *** মোহাম্মদইবনেসা’দ মাতাআবআ** ১৩২২হিঃ
৩৬ আওনুলমাবুদশরহেআবুদাউদ আবুতৈয়বশামসুলহকআযিমআ
যাদী

প্রথমমুদ্রণ
৩৭ গোবওয়ায়েওহুদ মোহাম্মদআহমদবাশামিল দ্বিতীয়মুদ্রণ
৩৮ গোবওয়ারেবদরআলকোষরা মোহাম্মদআহমদবাশামিল ১৩৭৬হিঃ
৩৯ গোবওয়ায়েখায়বর মোহাম্মদআহমদবাশামিল দারুলফোকের
৪০ গোবওয়ায়েবনিকোরায়যা মোহাম্মদআহমদবাশামিল ১৩৭৬হিঃ
৪১ ফতহুলবারী আহমদইবনেআলীইবনেহজরআসকালানী ৮৫২হিঃ মাকতাবায়েসালাফিয়া
৪২ ফেকহুসসিরাত মোহাম্মদআলগাজ্জালী দারুলকেতাবআলআরবী ১৩৭০হিঃ
৪৩ তাফসীফীযিলালিলকোরআন সাইয়েদকুতুবশহীদ দারুএহইয়ায়ততুরাছুলআরাবী
এই তাফসীরর বংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছেন আল কোরআন একাডেমী লন্ডন

৪৪ আলকুরআনুলকরিম
৪৫ কালবেজাযিরাতুলআরব ফুয়াদহামযা আলমাকতবা, সালাফিয়া , মিসর ১৩৫২হিঃ
৪৬ মাযাখাছেরালআলমুবেএনহেতাতিলমুসলেমিন সাইয়েদআবুলহাসানআলীনদভী মাকতাবাদারুলআরুবা, কায়রো ১৩৮১হিঃ
৪৭ মাহাদেরাতেতারিখেআলউমামুলইসলামিয়া শায়কমোহাম্মদআলখাযরামি আলমাকতাবাতুতুজ্জারিয়া, মিসর ১৩৮২হিঃ
৪৮ মোখতাছারসীরাতেরাসূল শায়খুলইসলামমোহাম্মদইবনেআবদুলওয়াহাবনজদী ১২০৬হিঃ মাতবাসুন্নাতআলমোহা্মমদীয়া ১৩৭৫হিঃ
৪৯ মোখতাছারসীরাতেরাসূল শায়খুলইসলামমোহাম্মদইবনেআবদুলওয়াহাবনজদী ১২৪২ মাতাবায়েসালাফিয়া, মিসর ১৬৭৯হিঃ
৫০ মাদারেকুততানযিললিলনাসাফি ১৩৭৮হিঃ
৫১ মেরআতুলমাফাতেহ (২য়খন্ড) শেখওবায়দুল্লাহরহমানীমোবারকপুরী

 

নামীপ্রেস, লাখনৌ ১৩৭৮হিঃ
৫২ মরুজযযাহাব আবুলহাসানআলীমাসউদী আশশারাকাতুলইসলামিয়া
৫৩ আলমোস্তাআরা আবুআবদুল্লাহমোহাম্মদআলহাকেমনিশাপুরী দায়েরাতুরমাআরেফআলওসমানিয়া, হায়দারাবাদ
৫৪ মুসনাদেআহমাদ ইমামআহমদইবনেমোহাম্দইবনেহাম্বল ২৬৪হিঃ
৫৫ মুসনাদেদারেমী ইবনেআবদুররহমানদারেমী ২৫৫হিঃ
৫৬ মেশকাতুলমাসাবিহ ওলীউদ্দিনমোহাম্মদইবনেআবদুল্লাহআততাব্রিযী মাকাতাবায়েরহীমিয়দেওবন্দ
৫৭ মাআজেমুলবোলদান ইয়াকুআলহামুতি
৫৮ আলমাওয়াহেবুলাদুন্নিয়া আল-কাসতালানী আলমাতবায়াতুশশারফিয়া ১৩৩৬হিঃ
৫৯ মুয়াত্তাইমামমালেক ইমামমালেকইবনেআনাসআলআসবাহি ৬৯হিঃ মাকতাবায়েরহীমিয়া, দেওবন্দ
৬০ ওফাউলওফা আলীইবনেআহমদআমসামহুদী


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি