গোপন তথ্য সংগ্রহ ও সাধারণ শান্তি-শৃঙ্খলা
[সাধারণ কল্যাণ ও বিশেষ কল্যাণ –সরকারী কর্মচারীদের পর্যব্ক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ –শক্র সৈন্যদের তৎপরতা পর্যবেক্ষণ –বহিরাগতদের তৎপরতা ও গতিবিধি পর্যবেক্ষ।]

………………………………………………………………………………………………………………………

ইসলাম ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও আকীদা-বিশ্বাসের স্বাধীনতার প্রধান উদগাতা। মানুষের ব্যক্তিত্ব ও তার আকীদা বিশ্বাসের প্রতি ইসলামে শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ মানব সমাজের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত। অনুরূপভাবে মানুষের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা ও ব্যক্তিগত অবস্থার গোপনীয়তা ইসলামের দৃষ্টিতে দূর্ভেদ্য দুর্গ বিশেষ।

এ কারণে ইসলাম কখনই মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপারাদি –আকীদা, চিন্তা ভাবনা ও তৎপরতা বা কর্যকলাপে খোঁজ-খবর লয়ে বেড়ানোর প্রবণতাকে সমর্থন জানায় নি। এ দিকে ইঙ্গিত করেই কুরআন মজীদ স্পষ্ট ভাষায় নিষেধবাণী উচ্চারণ করেছেঃ

(আরবী**********)

এবং অপরের গোপনীয় বিষয়াদি খোঁজখুজিঁ করে বেড়িও না।

অনুরূপভাবে কারোর ভিতরকার গোপনীয বিষয়াদি যদি কেউ জানতেও পারে তখন তা জনগণের মধ্যে প্রচার করে দেয়া ও সামাজিকভাবে তাকে লজ্জিত ও লাঞ্চিত করা ইসলামে অত্যন্ত ঘৃণিত ও নিষিদ্ধ কাজ বলে ঘোষিত। এ পর্যায়ে কুরআনের বাণী হচ্ছেঃ

(আরবী******)

এবং তোমরা একে অপরের গীবত করে বেড়িও না।

এই গীবত কার্যটি অত্যধিক ঘৃণা ও পরিত্যাজ্য হওয়ার কথা বোঝাবার জন্য। এর পরই দৃষ্টান্তমূলক কথা স্বরূপ বলা হয়েছেঃ

(আরবী**********)

তোমাদের কেউ কি তার কমৃত ভাই’র গোশত খাওয়া পছন্দ করবে?….. তোমরা নিজেরাই তো এর প্রতি ঘৃণা পোষণ করে থাক।

‘লোকদের গোপন দোষ খোঁজ করে বেড়িও না’ এবং ‘তোমরা পরস্পরের দোষ গেয়ে –প্রচার করে বেড়িও না’ দুটি কথা একই আয়াতে বলে দেয়া হয়েছে। এ থেকে একটি মৌলনীতি উদঘাটিত হচ্ছে। আর তা হচ্ছে –অন্যদের গোপন তত্ত্ব-রহস্য সংরক্ষণ করা। তা জানতে চেষ্টা করাই হারাম। কুরআনের ভাষায় তা চিরদিনের তরে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।

রাসূলে করীম (স) ও বলেছেনঃ

(আরবী টীকা***********)

তোমরা মুসলমানদের নিন্দা করো না, তাদের গোপনীয়তা খুজোঁ না।

 

সাধারণ কল্যাণ ও বিশেষ কল্যাণ
একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যায়, এই নিষেধ দুটি ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। সমাজ-সমষ্টির সাথে এর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই, সামষ্টিক কল্যাণ এর দ্বারা ব্যাহত হয় না বলেই মনে করা যায়।

কিন্তু না, এ দুটো নিষিদ্ধ কাজই সংক্রামক এবং এর প্রতিক্রিয়া গোটা সমাজকে জর্জরিত করতে পারে। অন্য কথায় নিষিদ্ধ কাজ দুটির দুইটি দিক রয়েছে। একটি ব্যক্তিগত দিক আর অপরটি সামাজিক দিক। কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে তা না হলেও তেমন ক্ষতির আশংকা থাকে না। কিন্তু তা যখন সামষ্টিক রূপ পায়, তখন তা মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়! অথবা বলা যায়, ব্যীক্তগত দোষ-ক্রটি সন্ধান না করা হলেও তেমন ক্ষতি হয় না, কিন্তু সামষ্টিক ক্ষেত্রে অনেক সময় তা না করাই বরং অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াতে পারে। তখন সমষ্টির কল্যাণকে ব্যক্তির ক্ষতির উপর অগ্রাধিকার দেয়া ছাড়া কোনই উপায় থাকে না।

ইসলামী শরীয়াত মানুষের ব্যক্তিগত গোপন তথ্য জানতে চেষ্টা করতে কঠিনভাবে নিষেধ করেছে এবং ব্যক্তিগণের গীবত করাকে সুস্পষ্ট হারাম ঘোষনা করেছে। কিন্তু সামষ্টিক প্রয়োজনে যদি ব্যক্তিগণের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং কারোর অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ক্রটি বলার আবশ্যকতা দেখা দেয়, তখন তা অবশ্যই করতে হবে, তখন ব্যক্তি অধিকারের উপর সামষ্টিক প্রয়োজনকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। সে পর্যায়ে ব্যক্তিগণের দোষ খোঁজ করা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দোষ ক্রটি জনগণের মধ্যে প্রচার করে দেয়া সমষ্টির স্বার্থ রক্ষার জন্য একান্তই অপরিহার্য কর্তব্য।

বরং ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে সমষ্টির স্বার্থ –তথা অস্তিত্ব রক্ষার্থে ব্যক্তিগণের ব্যক্তিগত জীবনের প্রকৃত অবস্থা জানবার জন্য চেষ্টা করা ও সেই পর্যায়ে ব্যাপক অনুসন্ধান করা ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। কেননা রাষ্ট্র যদি ব্যক্তিগণের সঠিক অবস্থা সম্পর্কে অবহিত না থাকে, তাহলে রাষ্ট্রীয় সংরক্ষণ সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন হতে পারে না। এমনকি, এরূপ অবস্থা দেখা দেয়াও অসম্ভব নয় যে, ব্যক্তিগণের প্রবণতা, চরিত্র ও কর্মতৎপরতা সম্পর্কে সরকারের অবহিতির অভাবের দরুন রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। কেননা সমাজে এসব ব্যক্তিদের অস্তিত্ব ও অবস্থান অকল্পনীয় নয়, যারা রাষ্ট্রের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর কার্যকলাপে গোপনভাবে নিয়োজিত রয়েছে। এই লোকদের তৎপরতা যথাসময়ে বন্ধ করা না হলে তা গোটা সমাজে ও রাষ্ট্রকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে।

এরূপ অবস্থায় ইসলামী রাষ্ট্র সরকারের পক্ষে সে দেশের প্রত্যেকটি নাগরিক সম্পর্কে অবহিতি রাখা এবং তার তৎপরতা ও গতিবিধি লক্ষ্য করা যে একান্তই কর্তব্য তাতে কোনই সন্দেহ থাকতে পারে না। একথা যেমন সাধারণ সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিসম্মত, তেমনি কুরআন ও সুন্নাহর আলোকেও স্বীকৃতব্য।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, পাশ্চাত্যপন্থী রাষ্ট্র সরকারের নীতিতে জনগণকে হয়রান পেরেশান করার লক্ষ্যে বা পদে পদে তাদেরকে উত্যক্ত করে রাখার উদ্দেশ্যে এ কাজ করা যাবে না। তা করা হলে তা কুরআনের উদ্ধৃত নিষেধের আওতায় পড়বে এবং অত্যন্ত গুনাহের কাজ হবে। বরং সত্যি কথা হচ্ছে, তা করার অঘিধকার ইসলামী রাষ্ট্রের নেই।

মদীনীয় সমাজের মুনাফিকরা ইসলামের দুশমনদের পক্ষ থেকে নিয়োজিত গোয়েন্দা হিসেবে কার্যকর ছিল। তারা মুসলমানদের যাবতীয গোপন তত্ত্ব ও তথ্য সংগ্রহ করে সঙ্গোপনে শক্রদের জানিয়ে দিত। এ পর্যায়ে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ

(আরবী**********)

ওরা যদি তোমাদের সাথে যুদ্ধে গমন করত, তাহলে তোমাদের মধ্যে দোষ-ক্রটি ছাড়া আর কিছু বাড়িয়ে দিত না। ওরা তোমাদের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পূর্ণ শক্তিতে চেষ্টা চালাচ্ছে আর তোমাদের লোকদের অবস্থা এই যে, তাদের কথা বিশেষ উৎকর্ণতা সহকারে শুনতে সচেষ্ট অনেক লোকই তোমাদের মধ্যে রয়েছে। আল্লাহ্ এই জালিমদের খুব বালো করেই জানেন।

ইসলামী সমসাজের মুনাফিকদের চরিত্র ও ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর কার্যকলাপ সম্পর্কে উক্ত আয়াতে কতা বলা হয়েছে। ওরাই কাফির মুশরিক –ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করত। তারা অবস্থান করত মুসলমানদের মধ্যে; কিন্তু কাজ করত শক্রদের জন্য।

ইসলাম ও মুসলমানদের সামষ্টিক স্বার্থে ও অস্তিত্ব রক্ষার্থে নবী করীম (স) গোয়েন্দা নিযুক্ত করেছিলেন। ফলে কাফিরদের নিয়োজিত গোয়েন্দাদের ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষে ক্ষতিকর তৎপরতা ধরা পড়ে যেতে লাগল। তখন মুনাফিকরাই এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে চিৎকার করে উঠল। আল্লাহ্ তা’আলা তাদের চিৎকার বা আপত্তির জবাবে ইরশাদ করলেনঃ

(আরবী**********)

এদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা নিজেদের কথাবার্তা দ্বারা নবীকে কষ্ট দেয় এবং বলে-এই ব্যক্তি বড় কান-কথা শুনে। বল, তিনি তো তোমাদেরই বালোর জন্য এই রূপ করেন। আল্লাহর প্রতি তিনি ঈমান রাখেন এবং ঈমানদার লোকদের প্রতি বিম্বাস রাখেন। তিনি তাদের জন্য রহমত, যারা তোমাদের মধ্যে ঈমানদার। বস্তুত যারা আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট ও জ্বালা দেয়, তাদের জন্য পীড়াদায়ক আঁযাব রয়েছে।

অর্থাৎ রাসূলে করীম (স) লোকদের নিকট খরব সংগ্রহ করেন, লোকেরা তাঁকে সর্ববিষয়ে জানায়। তাঁর এই খবর শ্রবণ সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে, সত্যকে উদঘাটিত করার উদ্দেশ্যে, কোন খারাপ উদ্দেশ্যে নয়, অকারণ কারোর প্রতি সন্দেহপ্রবণ হয়েও নয়, কারোর ক্ষতি সাধনও তার লক্ষ্য নয়। আর তাঁকে খবরদাতা লোকেরা যেহেতু ঈমানদার, নিষ্ঠাবান, সেই কারণে তিনি তাদের নিকট থেকে পাওয়া খবরকে সত্য বলে বিশ্বাসও করেন। কাজেই তাঁর এই কাজ মু’মিনদের জন্য রহমত স্বরূপ। আর হে মুনাফিকরা, রাসূল (স) তোমাদের কথা শুনলেও বিম্বাস করেন না। কেননা তোমাদের প্রকৃত অবস্থা অপ্রকাশ্য ও অজ্ঞাত। উদ্ধৃত আয়াতে আল্লাহর বক্তব্য হলোঃ

রাসূলে করীম (স) কাফির শক্রদের গোপন ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রমের খবরাদি জানতে পারেন। তার মূলে তাঁর উদ্দেশ্য মুসলমানদের সামষ্টিক কল্যাণ। কাফিরদের আকস্মিক ও অতর্কিত আক্রমণ থেকে মুসলিম জনগণকে রক্ষা করাও তাঁরই অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। এজন্য মুসলিম জনগণকে সব সময় উৎকর্ণ, সতর্ক, সদা-সচেতন, জাগ্রত ও অবহিত করে রাখার জন্যই সংবাদ সংগ্রহকারী বিশেষ দায়িত্বশীর লোক নিয়োগ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল এবং তিনি তা-ই করেছিলেন।

ওহোদ যুদ্ধের পর এক সময় বনূ আসাদ গোত্র মদীনার উপর অতর্কিত আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিয়েছিল। নবী করীম (স)- এর নিয়োগকৃত সংবাদ সংগ্রহ ও সরবরাহকারিগণ সঙ্গে সঙ্গেই তাদের এই প্রস্তুতি সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করেছিলেন এবং তিনি আগে ভাগেই একটি শক্তিশালী বাহিনী তাদের মস্তক চূর্ণ করার জন্য হযরত আবু সালমা’র নেতৃত্বে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তারা অতর্কিতে তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের হতচকিত করে দিয়েছিলেন। তারা সবকিছু ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল এবং মুসলমানরা বিপুল গনীমতের মাল লাভ করেন। (তাফহীমুল কোরআন, ১২ খন্ড, পৃ-৩-৪)

অতএব ইসলামী রাষ্ট্রকেও অনুরূপ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে সংবাদ সরবরাহকারী একটা সদ্য তৎপর কার্যকর সংস্থা অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে। এক দিকে সাধারণ নাগরিকদের অভাব-অনটন-প্রয়োজন সম্পর্কে অবহিত হয়ে যথাসময়ে –অবিলম্বে –তা পূরণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং অপর দিকে ইসলামের দুশমনদের গোপন ক্ষতিকর কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিতি লাভ করে তাৎক্ষণিকভাবে তা নস্যাৎ করে দেয়ার এবং মুসলিম জনগণ ও ইসলামী রাষ্ট্রকে তার ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য এরূপ একটি সংস্থা অবশ্যই থাকতে হবে।

সেই সাথে এই সংস্থাকে আরও তিন পর্যঅয়ের কাজ করতে হবেঃ

১. ইসলামী রাষ্ট্রের সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করা, যেন তারা প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব –যা তাদের নিকট আমানত –যথাযথভাবে পালন করতে পারে ও তাতে কোনরূপ ক্রটি-বিচ্যুতি, অবজ্ঞা-অবহেলা-উপেক্ষা বা দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ না ঘটে।

২. শক্রপক্ষের সেনাবাহিনীর চলাচল ও গতিবিধি লক্ষ্য করা, যেন যথাসময়ে যে-কোন আগ্রাসনকে প্রতিরোধ না ঘটে।

৩. বিদেশী লোকদের গতিবিধি ও তৎপরতা তীক্নভাবে নজরে রাখা, যেন তারা শক্রপক্ষের জন্য কোন গোয়েন্দাগিরি করতে বা দেশের অভ্যন্তরে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে না পারে।

 

সরকারী কর্মচারীদের পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ (control)
ইসলামী রাষ্ট্রের বাস্তবতামূলক প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের কল্যাণ সাধন এবং পূর্ণ আমানতদারী ও বিশ্বস্ততা সহকারে আল্লাহর আইন-বিধানসমূহ পুরাপুর কার্যকর করা। তাই এ উদ্দেশ্যে নিয়োজিত জনগণের ধন-ভান্ডার থেকে নিয়মিত বেতন ভাতা প্রাপ্ত লোকেরা যথাযথ দাযিত্ব পারন করছে কিনা, সেদিক অবশ্যই তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, ইসলামের বিশেষ চেস্টা থাকে, সরকারী দায়িত্বপূর্ণ পদে সর্বাধিক যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের নিয়োগ, যেন জনগণ সর্বাধিক উন্নত মানের খেদমত (service) লাভ করতে পারে। ইসলামেরএ্ই লক্ষ্য পুরামাত্রায় অর্জিত হচ্ছে কিনা, কর্মচারীবৃন্দ সততা, নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা সহকারে দায়িত্ব পালন করছে কিনা, জনগণের সাথে আদর্শিক ও মানবিক আচরণ গ্রহণ করছে কিনা, তা-ও সরকারী কর্তৃপক্ষকে তীক্ষ্মভাবে দেখতে হবে। অন্যথায় ইসলামী রাষ্ট্র তার আসল লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়ে যাবে। এ কারণে নবী করীম (স) যখনই বাইরে কোথাও কোন বাহিনী প্রেরণ করতেনঃ

(আরবী******)

তখন তিনি তার সাথে এমন সব বিশ্বস্ত নভর্ভরযোগ্য লোক পাঠাতেন যারা বাহিনীর লোকদের খবরাখবর জেনে রাসূলে করীম (স)-কে জানাত।

(আরবী টীকা**************)

হযরত আলী ৯রা) খলীফাতুল মুসলিমীন হিসেবে মালিক আশতারকে লিখিত পত্রে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তিনি যেন তাঁর নিয়োজিত কর্মচারীদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য লোক নিয়োগ করেন। এ পর্যায়ে তাঁনিদের্দেশ ছিলঃ

(আরবী ***********)

সরকারী কর্মচারীদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত লোক নিয়োগ কর। তারা যদি গোপনে তাদের ব্যাপারাদি তোমাকে জানাতে থাকে, তাহলে আমানত রক্ষা ও জনগণের প্রতি দয়ার্দ্রতা প্রদর্শনে তারা সতর্ক ও সক্রিয় হবে। এদের সহযোগিতায় তুমিও রক্ষা পাবে। তোমার নিকট যদি এমন খরব পৌঁছায় যে, তারা বিশ্বাসভঙ্গের উদ্যোগ নিচ্ছে, তাহলে তোমার নিযুক্ত খবরদাতা লোকদেরকে সেজন্য সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করবে। পরে তাদের উপর শাস্তি প্রয়োগ করবে এবং তারা কাজের যে ক্ষতি সাধন করেছে, তার পূরণ করতে পারবে। পরে অপরাধীদের লাঞ্চিত করবে বিম্বাসভঙ্গের দায়ে দায়ী করে এবং একটা লজ্জা তাদের গলায় ঝুলিয়ে দেবে।

(আরবী টীকা********)

বস্তুত গোপন উপায়ে জনগণের ও সরকারী কর্মচারীদের বিশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাওয়া –অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে এবং বৈদেশিক ক্ষেত্রে অন্যান্য রাষ্ট্রের গোপন তত্ত্ব উদঘাটন করার প্রচলন প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। তবে পূর্বে এ ব্যাপারটি আধুনিক কালের মত খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বর্তমানে তো এটা একাট বৈজ্ঞানিক পর্যায়ে উন্নীত বিষয়। উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে তা একটি বিষয়রূপে গণ্য হয়ে রয়েছে।

 

শত্রু সৈন্যদের তৎপরতা পর্যবেক্ষণ
স্বয়ং নবী করীম (স) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গোয়েন্দা ব্যবস্থাকে পুরাপুরি কার্যকর করে তুলেছিলেন –বিশেষ করে শক্র পক্ষের সেনাবাহিনীর ব্যবস্থা করেছিলেন –এই ব্যবস্থার সাহায্যে যথেষ্ট কল্যাণ লাভ করেছেন। তাঁরা সামরিক বিজয়ে এই বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে, রাসূলে করীম (স)-এর যুদ্ধজয়ের ইতিহাসে তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হয়ে রয়েছে। রাসূলে করীম (স) নিয়োজিত ব্যক্তিরা গোপনে প্রতিপক্ষের তৎপরতা ও গতিবিধি যা কিছু দেখতে পেত, তার যথাযথ বিবরণ তাঁকে জানিয়ে দিত। ফলে নবী করীম (স) শত্রুর মুকবিলায় আগাম পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন এমন ভাবে যে, শক্রপক্ষ কিছুই কল্পনা করতে পারত না। তারা তাদের পদক্ষেপের পূর্বেই আকস্মিকভাবে আক্রান্ত হয়ে যেমন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত, তেমনি ইসলামী বাহিনীর নিকট পরাজিত হয়ে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ত। কুরআন মজীদের একটি সূরা’র নিম্নোদ্ধৃত শব্দগুলি সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে।

(আরবী********)

শপথ সেই (ঘোগুলির), যা হ্রেষা ধ্বনি করে দৌড়ায়, পরে *নিজেদের ক্ষুর দিয়ে) অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঝাড়ে, আর অতি প্রত্যুষকালে আকস্মিক আক্রমণ চালায় নবী করমী (স) বলেছেনঃ

(আরবী********)

১. বদর যুদ্ধে নবী করীম (স) সাহাবায়ে কিরাম (রা)-কে সঙ্গে নিয়ে মদীনা থেকে বের হয়ে পড়লেন। পথিমধ্যে এক আরব গোত্রপতির বাড়িতে অবস্থান নিলেন। তিনি কুরাইশদের সমপএর্ক খবরাখবর জানবার জন্য চেষ্টা করলেন। তিনি আরব গোত্রপতিকে কুরাইশ এবং মুহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীদের সম্পর্কে চিন্তাভারাক্রান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন। বলা বাহুল্য লোকটি রাসূলে করীম (স)- কে চিনতে পারেনি। জনাবে গোত্র প্রধান বললঃ শুনেছি, মুহাম্মদ (স) ও তাঁর সঙ্গীরা অমুক দিন মদীনা থেকে বের হয়ে এসেছেন। এই খবর সত্য হলে আজ তাঁর আমার এই স্থানে উপস্থিত হওয়ার কথা। আর এ-ও খবর পেয়েছি যে, তারাও অমুক দিন মক্কা থেকে বের হয়ে এসেছে। এ খবর সত্য হলে আজ তাদের অমুক স্থানে উপস্থিত হওয়ার কথা –সেটা ঠিক সেই স্থানই ছিল, যেখানে কুরাইশরা সেই দিন অবস্থান নিয়েছিল।

২. ‘বদর’-এ উপস্তিত হয়ে নবী করীম (স) চতুর্দিকে লোক পাঠিয়ে দিলেন কুরাইশদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর সংগ্রহের জন্য। তাঁরা দুইজন ক্রীতদাস ধরে নিয়ে এলেন। তাদের নিকট থেকে কুরাইশ বাহিনীর অবস্থান, তার লোকসংখ্যা এবং নেতৃত্বে কারা কারা রয়েছে ইত্যাদি সর্ববিষয়ে আগাম খবর পাওয়া গেল। নবী করীম (স) সাহাবায়ে কিরাম (রা)-কে বললেনঃ

(আরবী*********)

এবারে মক্কা তার কলিজার টুকরাগুলিকে তোমাদের সম্মুখে পেশ করে দিয়েছে। (আরবী টীকা*****)

মোটকথা, রাসূলে করীম (স) নিজে বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদেরকে ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষে শত্রু বাহিনীর মধ্যে ও তাদের এলাকায় গোয়েন্দাগিরির কাজে নিযুক্ত করতেন, তাদের পাঠানো খবরের ভিত্তিতে তিনি যুদ্ধের কৌশল তৈয়ার করতেন এবং শত্রু পক্ষের সব পরিকল্পনাকে ব্যর্থ ও নিস্ফল করে দিতেন।

রাসূলে করীম (স) আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা)-কে একটি গোয়েন্দা বাহিনীর নেতা বানিয়ে মক্কায় পাঠালেন। সঙ্গে একখানি মুখ বন্ধ করা পত্র দিয়ে দিলেন। বললেন, দুইদিন দুইরাত্রি পথ চলার পর এই পত্র খুলে পড়বে এবং তাতে যে নির্দেশ লেখা রয়েছে, সেই অনুযায়ী কাজ করবে। দুইদিন পথ চলার পর পত্রখানা খোলা হলে দেখা গেল, তাতে লিখিত রয়েছেঃ

(আরবী**********)

আমার এই পত্র পাঠ করার পর কিছু দূর চললেই মক্কা ও তায়েফ-এর মধ্যবর্তী নাখালা নামক স্থানে (অথবা খেজুর বাগানে) উপস্থিত হবে এবং তথায় ঘুপটি মেরে বসে থেকে কুরাইশদের সম্পর্কে খবরাখবর জানবে এবং আমাদের আগাম জানাবে। (আরবী টীকা*********)

খন্দকের যুদ্ধে কুরাইশ এবং ইয়াহুদী ও গাতফান ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নেমেছিল। এই সময় নবী করীম (স) এমন এক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন যে, তার ফলে তাদের মধ্যে অনৈক্য ও বিরোধ বেঁধে যায়। পরে তিনি হুযায়ফাতা ইবনুল-ইয়ামান (রা) কে পাঠিয়ে তাদের ভেতরকার অবস্থা জানবার ব্যবস্থা করেছিলেন। বলা বাহুল্য, রাসূলে করীম (স) গৃহীত কৌশল এক শত ভাগ সফল হয়েছিল। (আরবী টীকা********) হুযায়ফাতুল ইয়ামান (রা) কুরাইশদের ইচ্ছা, সংকল্প ও যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পর্কে নবী করীম (স) কে পূর্ণ ও বিস্তারিত খবর দিয়েছিলেন।

ঐতিহাসিকভাবে এই সত্য প্রমাণিত যে, নবী করীম (স) কর্তৃক শত্রুপক্ষ সম্পর্কে আগাম খবর জানার জন্য গৃহীত এই পন্থা ছিল তদানীন্তন আন্তর্জাতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অভিনব। সেকালের কোন রাষ্ট্রনায়ক বা সময়-অধ্যক্ষের পক্ষে ও ধরনের কোন কর্মপ্রন্থা গ্রহণের চিন্তা করাও সম্ভব হয়নি। এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় আল্লাহ এই কথায় সত্যতাঃ

(আরবী**********)

আর যারাই কেবলমাত্র আমাদের জন্য ও আমাদের দেখিয়ে দেয়া পথে জিহাদ করবে, আমরা অবশ্যই তাদেরকে আমাদের নির্ভুল পথ ও উপায় পন্থাসমূহ জানিয়ে দেব। আর বস্তুতই আল্লাহ তো কেবল তাদের সঙ্গেই রয়েছেন যারা ঐকান্তিক নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও আত্মোৎসর্গের ভাবধারাসম্পন্ন।

এই সত্যের প্রতি লক্ষ্য রেখেই চিন্তাশীল ব্যক্তিরা বলেছেনঃ একজন সদা সচেতন মেধাবী-প্রতিভাসম্পন্ন সূক্ষ্ম খবর সংগ্রহকারী লোক বিশ হাজার যোদ্ধার তুলনায় যুদ্ধের ময়দানে অধিক কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।

তাবুক যুদ্ধে রওয়ানার সময় নবী করীম (স) তাঁর লোক মারফত খবর পেয়েছিলেন যে, মদীনারই একটি বাড়িতে কিচু সংখ্যক মুনাফিক একাত্রিত হয়ে লোকদিগকে যুদ্ধযাত্রায় বিলম্ব করার জন্য উসকানী দিচ্ছে। তিনি ও খবর পাওয়ার পর হযরত তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা)-কে কতিপয় লোক সহ তথায় পাঠিয়ে দিলেন এবং সেই সভা-গৃহকে জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেণ। শেষ পর্যন্ত তা-ই করা হয়েছিল।

এ থেকেও স্পষ্ট বোঝা যায়, নবী করীম (স)-এর বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য লোক মদীনার সর্বত্র নিয়োজিত ছিল যাবতীয খবরাখবর যথাসময় তাঁর নিকট পৌঁছাবার জন্য। উক্ত ঘটনা তার ফলেই সম্ভব হয়েছিল। ফলে মদীনার ইয়াহুদীরা অত্যন্ত গোপনে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যত ষড়যন্ত্রই করেছে, তা সব আগাম খবর পেয়ে তিনি ছিন্নভিন্ন ও ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন।

খায়বর যুদ্ধে ইয়াহুদীদের সুরক্ষিত প্রাচীনতর দুর্গজয় করাও নবী করীম (স)-এর পক্ষে এই পন্থায় সাহায্যে সহজ ও সম্ভব হয়েছিল।

এই প্রেক্ষিতে চূড়ান্ত কথা হলো, ইসলাম রাষ্ট্রকে সংবাদ সংগ্রহের ব্যবস্থাকে অত্যাধুনিক সাজ-সজ্জা সহকারে প্রতিষ্টিত করতে হবে।

বহিরাগতদের তৎপরতা ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ

ইসলামী রাষ্ট্রের তৃতীয় পর্যায়ের সাধারণ শান্তিরক্ষা ও সংবাদ সংগ্রহমূলক কাজ হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে শত্রু পরীক্ষ লোকজনের আগমন, গতিবিধি ও তৎপরতা সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম সতর্কতার দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করা। কেননা দুনিয়ার কোন রাষ্ট্রই দেশের অভ্যন্তরে পঞ্চম বাহিনীর উদ্ভবকে বরদাশত করতে পারে না, পারে না সেইরূপ অবস্থার কোনরূপ সুযোগ করে দিতে। কেননা তা-ই বহু রাষ্ট্র ও সরকারের পতনের কারণ হয়ে দেখা দেয়। স্বয়ং নবী করীম (স)-ও এই নীতি অবলম্বন ও পুরাপুরি কার্যকর করেছিলেন। আর এই উপায়ে তিনি শত্রুদের বহু ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম রোধ করতে ও তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

নবী করীম (স)-এর গোটা জীবন ও তৎপরতা প্রমাণ করে যে, তিনি ও উপয়ে বহু শত্রুকে সত্য দ্বীন-ইসালের নিকট নতি স্বীকার করতে বাধ্য করেছিলেন। আর এই তৎপরতার লক্ষ্যও ছিল তাই। এর ফলে তিনি বহু রক্তপাত এড়িয়ে যেতেও সক্ষম হয়েছিলেন।

নবী করীম (স) নিজে যেসব যুদ্ধ-জিহাদে অংশ গ্রহণ করতেন কিংবা শত্রুদের মুকাবিলা করার জন্য কোন বাহিনী কোথাও পাঠাতেন, তার মূলে নিহিত উদ্দেশ্য থাকত শত্রুদের ঐক্যবদ্ধতা ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়া। তাদের ঐক্যের কাতারে ব্যাপক ভাঙ্গন ধরানো। কেননা তিনি জানতেন ইসলামের পথের সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূরীভূত হয়ে গেলে ইসলামের মর্মস্পর্শী মহাসত্যের বাণী জনগণের হৃদয়-মনকে সহজেই স্পর্শ করবে ও দ্বীন-গ্রহণ করতে তাদের আর কোন বিলম্ব হবে না।

বস্তুত কাফির শত্রুরা যখন ঐক্যশক্তি হারিয়ে ফেলে এবং ইসলাম ও মুসলমানদের উপর বিজয়ী হতে পারার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে যায়, মানুষ তখন তার স্বাভাবিক প্রবণতার দিকে প্রত্যাবর্তন করে নির্ভুল পথের সন্ধানে খুব বেশী আগ্রহী ও উদ্যোগী হয়ে পড়ে, ঠিক তখন-ই ইসলাম তাদের দিলে প্রবেশ করতে পারে। পারে তাকে টেনে এনে ইসলামী মুজাহিদদের কাতারে দাঁড় করে দিতে। এ তত্ত্বের সত্যতা ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। কেননা বহু সংখ্যক জাতি-গোত্র ও জনগোষ্ঠী ইসলামী শক্তির নিকট পরাজিত হয়ে সত্য পথ প্রাপ্তির দ্বারে উপস্থিত হয়েছে এবং সত্যকে গ্রহণ করে জীবনকে ধন্য করতেও প্রস্তুত হয়ে গেছে।

মক্কা বিজয়ের ঘটনা দ্বারা এ কথা দিনের আলোর মতই স্পষ্ট, উজ্জ্বল ও উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।

নবী করীম (স) জানতেন যে, মক্কা বিজিত হলে শত্রুদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিলে এবং জনগণ শান্ত-নির্ঝঞ্ঝাট পরিমন্ডলে গভীর সূক্ষ্ম অনাসক্ত দৃষ্টিতে চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ পেলে খুব বেশী দিন অতিবাহিত হওয়ার আগেই তারা তাদেরসুস্থ বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা দ্বীন-ইসলামের যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে পারবে এবং পরিশেষে কবুল করতেও বিলম্ব হবে না। এ কারণে তিনি মক্কার কুরাইশদের উপর বিজয়ী হবেন –এ বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলেন এবং এ সংকল্পও তাঁর ছিল যে, এ বিজয় সার্বিক হতে হবে। এ কাজ সম্ভব হতে পেরেছিল গোটা পরিকল্পনা সম্পূর্ণভাবে গোপন থাকার ও কারোরই সে বিষয়ে একটি অক্ষরও জানতে না পারার কারণে। বস্তুত রাসূলে করীম (স)-এর মক্কা আক্রমণের পরিল্পনা কোন একজন সাহাবীরও জানা ছিল না। কেবলমাত্র হযরত হাতিব ইবনে আবূ বলতায়া (রা) রাসূলে করীম (স)-এর বাস্ততা ও উদ্বিগ্নতা দেখে নিজেই আঁচ করেছিলেন এবং এবারের লক্ষ্য মক্কা হতেপ পারে বলে মনে করেছিলেন। তাঁর পরিবারবর্গ তখনও মক্কায় অবস্থান করছিল। তাদের নিরাপত্তার কোন বিগ্ন হতে পারে মনে করে মক্কাগামী এক বৃদ্ধার মাধ্যমে কুরাইশ সরদারদের নিকট লিখিত এক পত্রে এ কথা জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নবী করীম (স) যথাসময় অবহিতি লাভ করেন ও এক বাহিনী পাঠিয়ে সেই চিঠি উদ্ধার করেন। এই প্রেক্ষিতেই কুরআন মজীদের এ আয়াতটি নাযিল হয়ঃ

(আরবী******)

হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধু-পৃষ্ঠপোষক বানিয়ো না, ভালোবাসা পোষণ করে তাদেরকে (গোপন কথা) জানিয়ে দাও, অথচ ওরা অমান্য-অস্বীকার করেছে সেই মহাসত্যকে যা তোমাদের নিকট এসেছে। ওরা রাসূলকে এবং বিশেষ করে তোমাদেরকে (মক্কা থেকে) বহিস্কৃত করেছে শুধু এই অপরাধে যে, তোমরা তোমাদের রব্ব্ আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখো।

এভাবে রাসূলে করীম (স) নিজ শাসন এলাকায় শত্রুদের পক্ষে কোন গোয়েন্দাগিরি (Spying) করতে দেন নি। যখনই এই পর্যায়ে কোন কাজ হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে তিনি তা জানতে পেরে সমস্ত পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন।

ইমাম আবূ ইউসুফ লিখেছেনঃ

ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ এরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য যে, মুশরিক দেশে যাওয়ার পথসমূহে সীমান্তবর্তী সশস্ত্র রক্ষীবাহিনী থাকবে, তারা সেদিকে গমনকারী বা তথা থেকে আগমনকারী ব্যবসায়ীদের তল্লাশী চালাবে। গমনাগমনকারীদের নিকট অস্ত্র-শস্ত্র পাওয়া গেলে তা কেড়ে নেবে, কারোর নিকট প্ত্রাদি থাকলে তা পড়ে দেখবে। তাতে মুসলমানদের কোন গোপন ও অপ্রকাশনীয় তত্ত্ব বা তথ্য লিখিত থাকলে তাকে পাকড়াও করবে এবং তাকে সরকারে সোডর্দ করবে তার বিচার করার উদ্দেশ্যে।

(আরবী টীকা***********)

ইসলামী রাজ্যের যেসব লোক বিদেশী শক্তির স্বার্থে গোয়েন্দাগিরি করে, ইসলাম তাদের ব্যাপারে কঠোর নীতি অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে। অনুরূপভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন বসবাসকারী অমুসলিম নাগরিক (যিম্মী)রাও যদি বিদেশী শক্তির স্বার্থে ও তার নির্দেশে ইসলামী রাজ্যের অভ্যন্তরে কোন গোয়েন্দাগিরি করে, তাহলে যিম্মীদের নাগরিকত্ব লাভের প্রধান শর্তই ভঙ্গ করা হবে। কেননা যিম্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক হচ্ছেঃ

তারা মুসলমানদের কোনরূপ কষ্ট দেবে না, মান-সম্মান-আবরু নষ্ট করার মত কোন কাজ –যেমন মুসলিম নারীর সাথে ব্যভিচার, অন্যান্য চরিত্রহীনতার কাজ, চুরি-ডাকাতি-চিনতাই করে তাদের ধন-মাল হরণ এবং বাইরের মুশরিক-ইসলাম দুশমনদের জন্য গোয়েন্দাগিরি করা ইত্যাদি কাজ করবে না। এর কোন একটি কাজ ও করলে তাদের নাগরিকত্বের শর্ত চূর্ণ হয়ে যাবে।

(আরবী টীকা******)

যিম্মীদের জন্য এই বাধ্যবাধকতাও রয়েছে যে, তারা দেশের মুসলমানদের কোন গোপন খবর বাইরের শত্রুদের নিকট পৌঁছাবে না, তাদের গোপন প্রস্তুতি ও শক্তি-সামর্থ সম্পর্কেও তাদেরকে অবহিত করবে না। কেউ তা করলে সে তার নাগরিকত্বের শর্ত ভঙ্গ করেছে বলে ধরে নিতে হবে। তখন তার রক্ত হালাল। অতঃপর তার ব্যাপারে আল্লাহ, রাসূল ও মু’মিনদের কোন দায়িত্ব (যিম্মীদারী) থাকলো না।

(আরবী টীকা*********)

আপনি গোয়েন্দা কর্মে লিপ্ত লোকদের ফয়সালা জানতে চেয়েছেন, যাদেরকে পাকড়াও করা হবে। তারা হয় যিম্মী হবে, না হয় যুদ্ধকারী শত্রুপক্ষের লোক হবে অথবা মুসলমান হবে।

তারা যদি সামরিক প্রতিপক্ষের লোক হয় কিংবা হয় যিম্মী –যারা জিযিয়া দেয়, তারা ইয়াহুদী, কৃষ্টান ও অগ্নিপূজারী যা-ই হোক, তাদের হত্যা করতে হবে, আর যদি মুসলমানদের কেউ হয় –ইসলাম পালনে সুপরিচিত, তাহলে তাকে কঠিন যন্ত্রণার দণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদী আটকে বন্দী করতে হবে –যেন শেষ পর্যন্ত সে তওবা করতে পারে।

(আরবী টীকা***********)

বস্তুত বিদেশী শক্তির পক্ষে ইসলামের রাজ্যে গোয়েন্দাগিরি করা ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত মারাত্মক দণ্ডনীয় অপরাধরূপে গণ্য। এ বিষয়ে ইসলামে মৌল নীতিই দেয়া হয়েছে, বিস্তারিত ও খুটিনাটি আইন দেয়া হয়নি। কেননা গোয়েন্দাগিরির কোন স্থায়ী একটি মাত্র রূপ বা ধরন নেই। তা নিত্য নতুন রূপে সংঘটিত হতে পারে। তাই ইসলামের মৌলনীতির। ভিত্তিতে বিস্তারিত আইন-বিধি রচনা করার দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের উপর অর্পিত। রাসূলে করীম (স) এজন্য খবর সংগ্রহকারী লোক নিয়োগ করেছেন এবং তাদের দেয়া সংবাদের ভিত্তিতে তিনি যুদ্ধ কৌশল রচনা করেছেন, তা ঔতিহাসিকভাবেই প্রমাণিত।

ইয়াফে নামক মদীনার এক ব্যক্তির ক্রীতদাস ছিলেন হযরত জায়দ ইবনে আরকম। তাঁকে মদীনার মুনাফিকদের উপর দৃষ্টি রাখার জন্য দায়িত্বশীল নিযুক্ত করা হয়েছিল। বনু মুস্তালিক যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে প্রধান মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবেন উবাই গোপনভাবেই বলেছিলঃ ‘মদীনায় পৌঁছার পর আমাদের মধ্যকার অধিক সম্মানিত ব্যক্তি অধিক হীন ব্যক্তিকে বহিষ্কার করবে’।হযরত জায়দ তা শুনতে পেয়ে উপস্থিতভাবে তাকে যা বলার তা তো বললেনই, সঙ্গে সঙ্গে তা নবী করীম (স)-কে জানিয়ে দিলেন।

(আরবী টীকা**********)

ইসলামী রাষ্ট্রকে এজন্য লোকদেরকে বিশেষ শিক্ষা প্রশিক্ষণে তৈরী করতে ও সংশ্লিষ্ট কাজে বিশেষ দক্ষ, সাহসী ও সুকৌশলী বানাতে হবে। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, এর উপর যেমন ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নির্ভরশীল, অনুরূপভাবে মুসলিম জনগণের ইসলামী জীবন যাপন ও ইসলামী আইন-বিধানের পূর্ণ কার্যকরতাও এরই উপর নির্ভর করে। তাই এই বিভাগটিই ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য একান্তই অপরিহার্য।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি