কোরআন রসূলের সর্বশ্রেষ্ঠ মোজেযা
মহান আল্লাহ ‍দুনিয়ার মানব জাতির হেদায়াতের উদ্দেশ্যে যে সব নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন তাদেরকে নবূয়ত ও রিসালাতের প্রমাণ স্বরূপ মোযেযাও দান করেছেন। ‘মোজেযা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল অপরাগ ও ক্ষমতাহীন করে দেয়া, মোকাবেলায় কাবু করে ফেলা ইত্যাদি। আর পারিভাষিক অর্থ হল নবী-রাসূলদের নিজস্ব দাবীর সমর্থনে এমন অলৌকিক ও আশ্চ* ঘটনা ঘটিয়ে দেখানো, যা পয়গাম্বর ব্যতীত অন্য কারও পক্ষে ঘটানো আদৌ সম্ভব নয়।

সাধারণ মোজেযার বাইরেও আল্লাহ তার কোন কোন রসূলকে বিশেষ মোজেযাও দান করেছিলেন। যেমন মূসার (আ) আসা (লাঠি) ও ইয়াদে বারযা (উজ্জ্বল হাত)। অর্থাৎ হযরত মূসা (আ) যখন তার লাঠিখানা মাটিতে নিক্ষেপ করতেন, তখন তা এক ভয়াবহ প্রকাণ্ড অজগরের রূপ ধারণ করে মাটিতে ছুটাছুটি করত। আবার যখন তিনি সেটি ধারণ করতেন লাঠিতে রূপান্তরিত হত। অনরূভাবে তিনি তার ডান হাত বগলে দাবিয়ে যখন বের করতেন, তখন উক্ত হাত থেকে এক বিশেষ ধরণের আলো-রশ্নি বের হয়ে চারদিক আলোকিত করে ফেলত। ইহাই । ছিল মূসার (আ) মোজেযা ‘আসা ও ইয়াদে বারযা উপরে বর্ণিত দুটি বিশেষ মোজেযা ছাড়াও হযরত মূসার (আ) দীর্ঘ জীবনে আরও বহু বিচিত্র ও অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। তন্মেধ্যে লাঠির আঘাতে লোহিত সাগরের পানিকে বিভক্ত করে ইসরাইলদের জন্য রাস্তা তৈরী করে দেয়া, পাথর খণ্ডের মধ্য হতে বনি ইসরাইলে বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করা, আসমান হতে মান্না সালওয়া (আসমানী খাদ্য) নাযিল হওয়া প্রভৃতি অন্যতম।

হযরত ঈসার (আ) জীবনেও এ ধরণের বহু অলৌকিক ঘটনার সন্ধান পাওয়া যায়, তবে তার বিশেষ মোজেযা ছিল দূরারোগ্য ব্যাধি আরোগ্য করা মৃতকে জীবিত করে কথা বলিয়ে নেয়া।

আল্লাহ তার শেষ পয়গাম্বর হযরত মুহাম্মদের (স) দ্বারাও বহু অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে অবিশ্বাসীদের সামনে তার নবুয়তের সাক্ষ্য পেশ করেছিলেন। তবে তাঁকে যে সর্বশ্রেষ্ঠ মোজেযাটি দান করা হয়েছিল সেটা আরবী ভাষায় নাযিলকৃত আল-কোরআন।

এমনিতেই দুনিয়ার সর্ব প্রধান ভাষাগুলির মধ্যে আরবী ভাষা ছিল এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তদুপরি রসূলের আবির্ভাবকালে কাব্য ‍ ও সাহিত্য চর্চার দিক থেকে আরবরা ছিল শীর্ষস্থানীয়। তারা তাদের জাতীয় আনন্দ অনুষ্ঠানাদিতে প্যান্ডেল ও মঞ্চ সাজিয়ে কাব্য-কলা ও সাহিত্য প্রতিভার প্রদর্শনী করত। উন্নত ও মার্জিত ভাষার অধিকারী এহেন একটি জাতির নিকটে আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে একজন নিরেট নিরক্ষর লোকের কাছে এমন উচ্চাংগের কালাম নাযিল করা শুরু করলেন যার ভাষা ও ভাবের সুউচ্চ মান দর্শনে সমস্ত আরব হতচকিত হয়ে গিয়েছিল। ভাষার দিক থেকে কোরআনের মোকাবিলা করা যেমন আবরদের জন্য অসম্ভব ছিল, তেমনি ভাব ও বিষয়াবলীর দিকে দিয়েও কোরআনের অনরূপ কালাম তৈরী করা তাদের জন্য সম্ভব ছিল না। কোরআন বার বার তার বিরোধীদের চ্যালেঞ্জ করেছে যে, যদি মুহম্মদের মুখনিঃসৃত কোরআন সম্পর্কে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে যে তা আল্লাহর কালাম নয় বরং মুহাম্মাদের তৈরী, তাহলে কোরআনের অনুরূপ ছোট একটি সূরা অন্তত: তোমরা তৈরী করে নিয়ে এসো।

কোরআনের এ চ্যালেঞ্জ তার অন্তর্নিহিত সুষমারাজী, দার্শনিক বিষয়মসমূহ ও জটিল বিধানবলী ইত্যাদির ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। যদি তা হত তাহলে হয়ত আরবরা বলতে পারতো আমরা তোর আর দার্শনিক নই, নীতি-শাস্ত্রও আমরা জানি না, আর জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়েই বা আমাদের মাথা ঘামাবার সময় কোথায়। কিন্তু শুধু তাতো নয়, কোরআন ভাবের শ্রেষ্ঠত্বের সাথে সাথে তার ভাষার মানের শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করে আরবসহ সারা বিশ্বকে প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ দান করেছে যে কোরআনের অনুরূপ একটি ছোট্ট সুরা অন্ততঃ তৈরী করে নিয়ে এসো। আরবী ভাষার মহাপণ্ডিত ও দিকপালরা যেভাবে ভাষাগত দিক দিয়ে কোরআনের কোন মোকাবিলা করতে পারেনি। তেমনি আরবসহ রোম-পারস্যের নীতি শাস্ত্র বিশেষজ্ঞরাও ভাবের দিক দিয়ে কোরআনের মত কোন গ্রন্থ অথবা তার অংশ বিশেষের ন্যায়ও কিছু তৈরী করতে পারেনি। ফলে ভাষা ও ভাব উভয় দিক হতেই কোরআন মহানবীর এক অত্যাশ্চ* মোজেযারূপে কিয়ামত পর্যন্ত বিরাজ করবে।

 

কোরআনের গ্রন্থবদ্বকরণ ও শ্রেণীবিন্যাস ব্যবস্থা
কোরআন অবতীর্ণের সময় কোরআনের যে অংশই যখন অবতীর্ণ হত, হুজুর (স) ওয়াহী লিপিবদ্ধকারী সাহাবাদের দ্বারা একদিকে যেমন তা লিপিবদ্ধ করিয়ে নিতেন, অন্যদিকে অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম সেটা মুখস্থ করে ফেলতেন। হুজুরের তিরোধান মুহুর্তে পূর্ণাঙ্গ কোরআন যেমন অসংখ্য সাহাবায়ে কেরামের মুখস্থ ছিল, তেমনি বেশ কয়েকজন সাহাবাদের (রা) নিকটে লিপিবদ্ধ আকারেও মওজুদ ছিল। কোরআনের কোন অংশ অবতীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাহাবাদের অনেকেই পাতলা উষ্ট্র চর্মে, মসৃণ পাথর টুকরায়, বৃক্ষপত্রে কিংবা বাকলে লিখে নিতেন। কাতিবে ওয়াহী হযরত জায়েদ ইবনে সাবেতের একটি বর্ণনা হাদীসের কিতাবে দেখা যায়। তিনি বলেছেন,

(****************)

“আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের কাছে বসে চর্ম টুকরায় কোরআন শরীফ লিখে নিতাম।” (মোসতাদরিক-ইতকান)

বোখারীর যে অংশে সাহাবাদের মর্যাদা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে, সেখানে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের একটি বর্ণনার উল্লেখ আছে যাতে তিনি বলেছেন যে, আমি নবী করীমকে (স) এ কথা বলেতে শুনেছি, “তোমরা কোরআন চার ব্যক্তির কাছ থেকে শিখে নাও। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ, সালেম, উবাই বিন কায়াব ও মায়ায ইবনে যাবাল।” (বুখারী)

বোখারীর অন্যত্র হযরত আনাসের একটি বর্ণনায় তিনি উল্লেখ করেছেন,

“নবী করীমের (স) জামানায় যে চারজন সাহাবী (বিশেষভাবে) কোরআনকে সংগ্রহ করেছিলেন তাঁরা সকলেই ছিলেন আনছার। উবাই-বিন কায়াব, মায়ায-জাবাল, আবু ছায়েদ এবং যায়েদ-ইবনে সাবেত (রা)।” (বুখারী)

মোহাদ্দিসীনরা উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এর অর্থ হল যদিও অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম কোরআন সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছিলেন। কিন্তু বিশেষ ভাবে উপরোক্ত চারজন সাহাবী কোরআনের হেফয, তেলাওয়াত, সংরক্ষণ ও সংগ্রহ ইত্যাদির ব্যাপারে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।

এভাবে তিরোধানের কেবল পরপরই হযরত আবু বককরের খিলাফতের প্রথম ‍দিকে ইয়ামামার যুদ্ধে যখন কয়েক শত হাফেজ সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন, তখন হযরত উমর (র) খলিফাতুর-রসূল হযরত আবু বককরের নিকটে এই আরজী নিয়ে হাজির হলেন যে, এখনই কোরআনের সমস্ত অংশগুলিকে ধারাবাহিকভাবে সাজিয়ে একখানা গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করা হোক। নতুবা ব্যাপকভাবে হাফেজে কোরআনের ‍দুনিয়া থেকে উঠে যাওয়ার কারণে হয়তবা কোরআনের কোন অংশ আমরা হারিয়ে ফেলতে পারি। হযরত আবু বকর প্রথমে কিছু ইতস্তত করে পরে হযরত উমরের প্রস্তাবকে অনুমোদন দিলেন এবং কাতিবে ওয়াহী হযরত জায়েদ ইবনে সাবেতকে এ পবিত্র দায়িত্বে নিয়োজিত করলেন।

ইমাম বোখারী তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ বোখারী শরীফে ******** (কোরআনের গুরুত্ব ও মর্যাদা) অংশে হযরত জায়েদ ইবনে সাবেতের মাধ্যমে নিম্নরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন,

“ইয়ামামার যুদ্ধের পর পরই আমাকে হযরত আবু বককর (রা) ডেকে পাঠালেন। আমি উপস্থিত হয়ে হযরত উমরকেও তাঁর পার্শ্বে উপবিষ্ট দেখলাম। অতঃপর হযরত আবু বককর (রা) আমাকে লক্ষ্য করে বললেন,

‘দেখ এই উমর (রা) আমার কাছে এসেছে, সে বলে ইয়ামামার যুদ্ধে অসংখ্য হাফেজে কোরআন শাহাদাত বরণ করেছেন। আর আমার আশংকা হচ্ছে; অন্যান্য যুদ্ধেও ‍যদি এইভাবে হাফেজে কোরআন শাহাদাত বরণ করহে থাকেন, তাহলে হয়তো আমরা কোরআনের কোন কোন অংশ হারিয়ে ফেলব। সুতরাং আমার অভিমত আপনি কোরআনকে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করার হুকুম ‍দিন’ আমি উমরকে জওয়াবে বললাম, যে কার রসূল (স) করেননি তা আমি কি করে করতে পারি? অতঃপর উমর আল্লাহর শপথ করে বললেন যে, অবশ্য কাজটি অত্যন্ত উত্তম ও প্রয়োজনীয়।’ উমরের (র) এই সব তর্কাতর্কী ও বাদানুবাদের মাধ্যমে আমার অন্তরেও আল্লাহ উক্ত কাজের গুরুত্বের অনুভূতি দান করলেন। আমিও উমরের সাথে একমত হয়েছি।”

বর্ণনাকারী হযরত জায়েদ ইবনে সাবেত আরওও বলেন যে, অতঃপর হযরত আবু বককর (রা) আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“তুমি যুবক ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তোমার বিরুদ্ধে আমাদের কারো কোনরূপ অভিযোগও নেই। উপরন্তু রসূলের সময় তুমি ওয়াহী লিপিবদ্ধ করার কাজে নিয়োজিত ছিলে। সুতরাং তুমিই পূর্ণাঙ্গ কোরআনকে একখানা গ্রন্থাকারে সাজিয়ে লিপিবদ্ধ কর।” (বোখারী ফাজায়েলুল কোরআন)

অতঃপর হযরত জায়েদ (রা) সাহাবায়ে কিরামের কাছে হতে এবং হুজুরের নিজের ঘরে রক্ষিত লিখিত অংশগুলিকে সংগ্রহ করে পরস্পর সাজিয়ে হাফেজ সাহাবাদের তেলাওয়াতের সাথে মিলিয়ে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করে ফেললেন।

হারেস মোহাসেবী স্বীয় গ্রন্থ (****) “ফাহসুসসনানে” বর্ণনা করেছেন,

“কোরআন লিপিবদ্ধ করা কোন অভিনব কাজ ছিল না। স্বয়ং নবী করীমই (স) কোরআন লিপিবদ্ধ করতেন। তবে উহা বিভিন্ন খন্ডাকারে ছিল। হযরত আবু বকর সিদ্দীক উহার সবগুলোকে একত্র করে গ্রন্তাকারে লিপিবদ্ধ করা হুকুম দিয়েছিলেন। এ কাজটি ছিল এ ধরনের যেমন কোরআন লিপিবদ্ধকারে কতগুলি বিক্ষিপ্ত পৃষ্ঠায় রসূলের (স) ঘরে মওজুদ ছিল। অতঃপর কোন একজন সংগ্রহকারী উহাকে সাজিয়ে সুতা দিয়ে বেঁধে ‍দিলেন যাতে কোন অংশ হারিয়ে যেতে না পারে।”

(*************)

আচ্ছাকাফাতুল ইসলামীয়া। (আল্লামা রাগেব তাব্বাখ)।

হযরত জায়েদের সংগ্রহীত ও লিখিত মাছহাফখানা প্রথম খলীফা হযরত আবু বকরের জীবদ্দশায় আমানত হিসেবে তাঁর কাছেই রক্ষিত ছিল এবং প্রয়োজনানুসারে অন্যান্যরা সেটা হতেই কপি করে উমরের নিকট তা সমর্পন করা হয়। হযরত উমরের শাহাদাতের পরে উক্ত মাছহাফ উম্মুল মুমেনীন হযরত হাফসার হেফাযতে দেয়া হয়।

কোরআনের পঠন পদ্ধতির সংস্কার
একই ভাষা-ভাষীদের সমগ্র এলাকার ভাষা এক হওয়া সত্ত্বেও তাদের বোল-চাল ও উচ্চারণ ইত্যাদিতে কিছু ব্যবধান ও ব্যতিক্রম অবশ্যই হয়ে থাকে। যেমন নদীয়া ও কুমিল্লার ভাষায় বেশ পার্থক্য দেখা যায়। যেমন দেখা যায়- খুলনা ও চিটাগাংয়ের ভাষায়। অথচ উভয় জেলার ভাষায় বাংলা।

অনুরূপভাবে গোটা আরব দেশের ভাষা আরবী হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন এলাকা ও গোত্রের ভাষা, উহার উচ্চারণ, বাচন-ভঙ্গী ও প্রয়োগে বেশ তারতম্য পরিলক্ষিত হত। হুজুর কোরয়শী বিধায় কোরআন শরীফ ‍যদিও কোরায়শী আরবীতে অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু অন্যান্য এলাকার আরবদেরকেও তাদের আঞ্চলিক আরবীতে উহা পাঠ করার ও লিপিবদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কেননা ইহাতে কোরআনের মূল অর্থ কিংবা ভাবে কোন পরিবর্তন দেখা দিত না। কিন্তু ইসলাম যখন আরবের সীমানা অতিক্রম করে আযমেও প্রসার লাভ করল, তখন পঠন পদ্ধতি ও উচ্চারণের এ ব্যবধান অনারবদের ভিতরে বিশেষ জটিলতার সৃষ্টি করেছিল। বিষয়টির দিকে তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমানের (রা) দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি ইহার গুরুত্ব বিশেষভাবে অনুধাবন করলেন। অতঃপর তিনি নিম্নে বর্ণিত উপায়ে উদ্ভুত সমস্যার সমাধান করে ফেললেন।

প্রথমত: তিনি কোরায়েশদের ভাষায় লিখিত ও রক্ষিত হযরত হাফসার মাছহাফখানা আনিয়ে উহার অনেকগুলো কপি তৈরী করালেন। অতঃপর উহার এক এক খন্ড মুসলিম সাম্রাজ্যের এক এক এলাকায় প্রেরণ করে উহা হতে সকলকে কপি করতে আদেশ দিলেন। আর অ-কোরায়েশদের ভাষায় লিখিত মাছহাবগুলিকে একেবারে নষ্ট করে দিলেন। ফলে বাচন-ভঙ্গি ও উচ্চারণের ব্যবধানটুকুও আর অবশিষ্ট থাকল না।

এ সম্পর্কে ইমাম বুখারী, বুখারী শরীফের ‘ফাজায়েলুল কোরআন’ অংশে হযরত আনাসের মাধ্যমে নিম্নলিখিত মর্মে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, “একদা হযরত হোযায়ফা-বিন আর ইয়ামান হযরত ওসমানের (রা) খেদমতে উপস্থিত হলেন। ইতিপূর্বে তিনি কেবল আরমিনিয়া বিজয়ে সামী মোজাহিদের সঙ্গে এবং আজারবাইজানের যুদ্ধে ইরাকী মোজাহিদদের সাথে অংশগ্রহণ করে এসেছিলেন, সেখানে তিনি সীমা ও ইরাকী মুসলমানদের কোরআন পাঠ পদ্ধতির বিরোধ দেখে সংকিত হয়ে পড়েছিলেন। অতঃপর তিনি যখন তৃতীয় খলিফা হযরত উসমানের খেদমতে হাজির হলেন, তখন তিনি খলিফাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমিরুল মোমেনীন, ইহুদী নাছারাদের ন্যায় আল্লাহর কিতাবে বিরোধ করারা পূর্বে আপনি এ উম্মতের কল্যাণের জন্য একটা কিছু করুন।’ এ কথা শুনে হযরত উসমান (রা) উম্মুল মুমেনীন হাফসাকে অনুরোধ করে পাঠালেন যে, হযরত আবু বকরের (রা) সংগ্রহীত গ্রন্থখানা যেন তাকে পাঠান হয়। তিনি উহা নকল করিয়ে আসল কপি আবার তাকে ফেরত দিবেন। অতঃপর হাফসা (রা) হযরত উসমানকে (রা) উক্ত পবিত্র গ্রন্থখানা দিলেন এবং উসমান (রা), হযরত জায়েদ বিন সাবেত, আব্দুল্লাহ বিন জোবায়ের, সাইয়েদ বিন আছ ও আব্দুর রহমান বিন হারিসকে (রা) তা হতে নকল করার কাজ শুরু করালেন। হযরত উসমান (রা) (হযরত জায়েদ বিন সাবেত ব্যতীত) তিনজন কোরায়শী সাহাবীদের বললেন, যদি তোমাদের সাথে জায়েদ বিন সাবেতের কোন অংশ পঠন পদ্ধতির ব্যাপারে মতবিরোধ দেখা দেয়, তাহলে উহা কোরায়েশদের ভাষায় লিখবে। কেননা কোরআন কোরায়েশদের ভাষায়ই নাযিল হয়েছে।”

উল্লেখিত সাহাবাগণ হযরত উসমানের আদেশ মোতাবেক যখন পূর্ণ গ্রন্থখানার কপি তৈরী করে ফেললেন, তখন হযরত উসমান (রা) মূল কিতাবখানা হযরত হাফসার (রা) কাছে পাঠিয়ে দিলেন এবং নকলকৃত মাছহাফের এক একখানা সাম্রাজ্যের এক এক এলাকায় পাঠিয়ে দিয়ে নির্দেশ দিলেন যে, তাঁর প্রেরিত মাছহাফ ব্যতীত অন্যান্য মাছহাফ যেখানে আছে উহা যেন নষ্ট করে ফেলা হয়। (বুখারী-ফাজায়েলুল কোরআন)

“হযরত উসমানের নকলকৃত মূল কোরআন শরীফের কপি রুশ, মিসর, সিরিয়াসহ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে আজও রক্ষিত আছে। আমাদের নিকটে বর্তমান যে কোরআন শরীফ মওজুদ রয়েছে উহাও সেই মূল সিদ্দীকী গ্রন্থের অনুরূপ যা হতে হযরত উসমান (রা) নকল করিয়ে সরকারী ব্যবস্থাপনায় রাজ্যের বিভিন্ন অংশে প্রেরণ করেছিলেন।”

গ্রন্থ সংগ্রহ ও সংরক্ষনের ব্যাপারে এর চেয়ে অধিক ত্রুটিমুক্ত, উন্নতর ও বিজ্ঞান সম্মত পন্থা আর কিছু কি হতে পারে?

কোরআনের যে বর্তমান শ্রেণীবিন্যাস ও তরতিবও কোন পরবর্তী মানুষের দেয়া নয়। বরং হযরত নবী (স) হযরত জিরাইলের (আ) নির্দেশে বর্তমান কোরআনকে সুবিন্যস্ত করেছিলেন। আর এই তরতিব অনুসারেই হুজুর (স) নিজে সাহাবায়ে কেরাম নামাযে উহা পাঠ করতেন। আর হাফেজ সাহাবাগণ অনুরূপ তরতিব মোতাবেকই কোরআন মুখস্থ করতেন।

কোরআন অল্প অল্প করে নাযিল হওয়ার কারণ
সমস্ত কোরআন মাজীদখানা একসঙ্গে অবতীর্ণ না হয়ে কেন অল্প অল্প করে দীর্ঘ তেইশ বছরে কালব্যাপী অবতীর্ণ হল। কেন আল্লাহ তওরাত, জবুর,ইঞ্জিল প্রভৃতি আসমানী কিতাবের ন্যায় কোরআন মাজীদকেও এক সংগে অবতীর্ণ করলেন না, এটাও একটি অনধাবনযোগ্য বিষয় বটে। পবিত্র কোরআনের ব্যাপারে কাফেরদের এও একটি অভিযোগ ছিল যে, কেন কোরআন মুহাম্মদের (স) উপরে একই সঙ্গে অবতীর্ণ হল না?”

কাফেরদের এ উক্তি সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন,

(************)

“আর কাফেরগণ বলে, কোরআন মুহম্মদের (স) উপরে একই সঙ্গে অবতীর্ন হল না কেন? এরূপ (বিরতি সহকারে) অবতীর্ণের মাধ্যমে আমি আপনার অন্তরকে শক্তিশালী করছি। আর আমি উহাকে বিরতি সহকারে অবতীর্ণ করেছি।” (সুরা আল-ফোরকান, আয়াত-৩২)

মানাহেহুল ইরফান ফি উলুমিল কোরআন এর লেখক আল্লামা আব্দুল আজিম স্বীয়-গ্রন্থে কোরআন অল্প অল্প করে নাযিল হওয়ার ভিতরে চারটি বিশেষ হিকমতের কথা উল্লেখ করেছেন।

১. রসূলের অন্তকে শক্তিশালী করা
অর্থাৎ স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ হতে বার বার ওয়াহী বহনকারী সম্মানিত ফিরিশতা হযরত জিবরাইল আমিনের হুজুরের কাছে আগমনে তাঁর অন্তরাত্না আধ্যাত্নিক আনন্দে পরিপূর্ণ থাকত এবং মনের পবিত্র মনিকোঠায় নিয়তই এ ধারণা বদ্ধমুল থাকত যে তাঁর উপরে আসমান থেকে অবারিত ধারে আল্লাহর অনুগ্রহ ও নিয়ামত বর্ষিত হচ্ছে। ফলে হুজুরের অন্তর-আত্না ঈমানের অলৌকিক শক্তিতে ক্রমশই শক্তিশালী হতে থাকে।

কোরআন বিরতি সহকারে অল্প অল্প করে নাযিল হওয়ার ফলে হুজুর (স) তা সাথে সাথে মুখস্থ করে ফেলতেন এবং তার অন্তরনিহিত মর্ম উপলব্ধি করে তার হিকমত সম্পর্কে বিশেষভাবে ওয়াকিফহাল হতেন। ফলে হুজুরের পবিত্র অন্তকরণ কোরআনের অভিনব ও অলৌকিক শক্তিবলে নিয়তই শক্তিশালী হতে থাকত।

২. মুসলিম উম্মতের ধারাবাহিক তরবীয়ত
অর্থাৎ নবীর নেতৃত্বে যে নতুন একটি জাতির অভ্যুদয় ঘটেছিল সেই জাতিকে ধারাবাহিক শিক্ষা ও তরবীয়তের মাধ্যমে ধাপে ধাপে অগ্রসর করিয়ে পূর্ণতার প্রান্ত সীমায় নিয়ে যাওয়া। বিরতিসহ অল্প অল্প কোরআনের অংশ নাযিলের মাধ্যমে উক্ত উদ্দেশ্য বিশেষভাবে সাধিত হয়েছিল। কেননা শরীয়তের যাবতীয় হুকুম-আহকাম যদি প্রথম ধাপেই একত্রে অবতীর্ণ হত, তাহলে হয়ত সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী নতুন লোকদের পক্ষে উহা পুরাপুরি মেনে চলার অধিকতর কষ্টসাধ্য হত। যেমন আল্লাহ বলেছেন,

(****************)

“আর আমি কোরআনকে ভাগ ভাগ করে এই জন্য অবতীর্ণ করেছি যাতে করে আপনি ইহা লোকদেরকে বিরতি সহকারে পাঠ করে শুনাতে পারেন।” (সুরা ইসরা, আয়াত-১০৬)

৩. নতুন নতুন সমস্যা সমূহের ব্যাপারে পথ প্রদর্শন
হুজুর (স) ও তাঁর আত্নোৎসর্গী সঙ্গীদের উপরে ইসলামী আন্দোলন পরিচালনার যে গুরুদায়িত্ব আল্লাহ অর্পণ করেছিলেন, উহার বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছিল এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রশ্নেরও সম্মুখীন হুজুরকে হতে হয়েছিল। উক্ত সমস্যা সমূহের সমাধান ও প্রশ্ন সমূহের জওয়াব দান প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময় কোরআনের বিভিন্ন অংশ নাযিল হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল।

যেমন একদা একজন মুসলিম মহিলা হযরত খাওলা বিনতে সায়ালাবা রসূলের দরবারে হাজির হয়ে তার স্বামী কর্তৃক তাকে জেহার করার ঘটনা বর্ণনা করে কান্নাকাটি ও হাহুতাশ করতে লাগলেন। কেননা তার কয়েকটি ছোট ছোট সন্তান সন্ততি ছিল। যদি এই সন্তানদেরকে তিনি তাঁর স্বামীর হাতে অর্পণ করেন তাহলে তাদের জীবনই বরবাদ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আবার যদি নিজের কাছে রেখে দেন, তাহলেও অন্নকষ্টে তাদের অকাল মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল। ফলে মহিলাটি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে হুজুরের সামনে কান্নাকাটি ও হাহুতাশ করতে লাগলেন।

ইসলাম পূর্বে জাহেলিয়াত যুগে জেহার দ্বারায় স্ত্রী তালাক হয়ে যেতো। [জেহার বলা হয় আপন স্ত্রীকে মোহররামাত অর্থাৎ মা, কন্যা ইত্যাদিদের সাথে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার নিয়তে তুলনা করা। যেমন কেহ ‍যদি তার স্ত্রীকে একথা বলে তুমি আমার মায়ের ন্যায়, তাহলে উহা জেহার হবে। জাহেলিয়াত যুগে আরবরা যে স্ত্রীর সাথে জেহার করত তাকে তারা চিরদিনের তরে নিজের জন্য হারাম মনে করত। ইসলাম ইহাকে অনুমোদন দেয়নি। তবে এ ধরনের অশালীন ও অসংগত আচরণের জন্য জেহারকারীর উপর কিছু কাফফারা আরোপ হয়েছে।]

মুসলিম সমাজে জেহারের সমস্যা এই প্রথম বারই দেখা দিয়েছিল। হুজুর (স) কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। ঠিক এই মুহুর্তে উহার সমাধানে নিম্নলিখিত আয়াত অবতীর্ণ হয়,

(************)

“যে মহিলাটি তার স্বামীর ব্যাপারে তোমার সাথে ঝগড়াঝাটি করছিল এবং আল্লাহর কাছে অভিযোগ পেশ করছিল। আল্লাহ তোমাদের উভয়ের কথাবার্তাই শুনে নিয়েছিলেন। আর আল্লাহ সবকিছুই শুনেন ও দেখেন। তোমাদের মধ্য হতে যারা আপন স্ত্রীর সাথে জেহার করে তাদের সে জেহারকৃত স্ত্রীরা (প্রকৃতপক্ষে) তাদের মা হয়ে যায় না। তাদের মা তো তারাই যারা তাদেরকে প্রস্রব করেছে।” (সুরা মোজাদালা, আয়াত১-২)

একদা মক্কার মুশরিকরা ইহুদীদের প্ররোচনায় হুজুরকে অপ্রস্তুত করার মানসে জুলকারনাইন সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল অথচ তখনও জুলকারনাইন সম্পর্কে হুজুরের কিছুই জানা ছিলনা। ফলে মহাবিজ্ঞানী আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে জুলকারনাইনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ওয়াহীর মারফত অবগত করিয়ে দেন।

(************)

“আর এরা আপনার নিকটে জুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। আপনি বলুন শীঘ্রই তোমাদেরকে তাঁর বর্ণনা পাঠ করে শুনাচ্ছি।” (সুরা কাহাফ, আয়াত-৮৩)


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি