স্ত্রীর কর্তব্য ও দায়িত্ব
****************************************

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ স্বামী নিকটে উপস্থিত থাকা অবস্থায় তাহার অনুমতি ব্যতীত স্ত্রীর রোযা রাখা জায়েয নয়। স্বামীর অনুমতি ব্যতীত তাহার ঘরে স্ত্রী কাহাকেও প্রবেশের অনুমতি দিবে না। অনুমতি দেওয়া তাহার জন্য জায়েয নয়। আর স্বামীর নির্দেশ ছাড়াই স্ত্রী যে যে ব্যয় করিবে, উহার অর্ধেক স্বামীর প্রতি প্রত্যার্পিত হইবে।

(বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী)

ব্যাখ্যাঃ এই হাদীসটিতে স্ত্রীর জন্য তিনটি বিধান দেওয়া হইয়াছে। প্রথম ‘স্বামীর নিকটে উপস্থিত থাকার সময় তাহার অনুমতি ব্যতীত রোযা রাখিতে পারিবে না। রাখিলে তাহা তাহার জন্য হালাল হইবে না’।

ইহার দুইটি কথা বিশ্লেষণ সাপেক্ষ। একটি স্বামীর বিনা অনুমতিতে রোজা রাখিতে পারিবে না বলিতে বুঝাইয়াছে নফল রোযা। ফরয রোযা রাখা স্বামীর অনুমতির অপেক্ষা রাখে না। এমন কি, স্বামী নিষেধ করিলেও- কোন বিশেষ কারণ ছাড়া ফরয রোযা রাখিতে হইবে। কেননা ইহা আল্লাহর নির্দেশ। স্বামীর কথা শুনা ও পালন করা কর্তব্য আল্লাহর হুকুক পালন করার পরে, তাঁহার নাফরমানী করিয়া নয়। এই রূপ অবস্থা হইলে স্ত্রী স্পষ্ট কণ্ঠে স্বামীকে বলিয়া দিবে, আমি আল্লাহর বান্দী, তোমার নহি।

দ্বিতীয় কথা, স্বামী উপস্থিত থাকার সময় বা অবস্থায়ও অর্থাৎ স্বামী বাড়িতে ও নিকটে উপস্থিত থাকাকালে যে কোন সময় সে তাহাকে সংগমের জন্য আহবান করিতে পারে এবং তাহা করিলে সে আহবানে তাহাকে সাড়া দিতে হইবে। কিন্তু রোযাদার হইলে তাহা সম্বব হইবে না। এই কারণে স্বামীল বিনানুমতিতে রোযা রাখা স্ত্রীর জন্য জায়েয নয়। তবে পূর্বে অনুমতি লইয়া নফল রোযা রাখিলে সাধারণতঃ আশা করা যায় যে, দিনের বেলা রোযা থাকা অবস্থায় রোযা ভংগকারী কোন কাজে সে নিশ্চয়ই আহবান জানাইবে না।

আবূ দায়ূদে এই হাদীসটির ভাষা এই রূপঃ

****************************************

রমযান মাস ব্যতীত স্বামীর উপস্থিতিতে তাহার অনুমতি ছাড়া কোন স্ত্রী কক্ষণই কস্মিণকালেও রোযা রাখিবে না।

আর তিরমিযী উদ্ধৃত হাদীসের ভাষা হইলঃ

****************************************

রমযাস মাস ছাড়া কোন একটি দিনও স্বামীর উপস্থিত থাকা সময়ে তাহার অনুমতি ব্যতীত কোন স্ত্রী রোযা রাখিবে না।

‘স্বামী উপস্থিত থাকা সময়ে’ বলিয়া এই সুযোগ বাহির করা হইয়াছে যে, স্বামী বাড়িতে উপস্থিত না থাকিলে- বাহিরে সফরে চলিয়া গিয়া থাকিলে তখন নফল রোযা রাখা সম্পূর্ণ জায়েয এবং তাহাতে স্বামীর অনুমতি লওয়ার কোন প্রয়োজন হইবে না। কেননা স্বামী বাহিরে চলিয়া গিয়া থাকিলে তখন দিনের বেলা ফিরিয়া আসিয়াই সঙ্গম কাজে ডাকিবে না। ইহার সম্ভাবনাও থাকে না।

হাদীস ব্যাখ্যাকারী আল্লামা কিরমানী বলিয়াছেনঃ এখানে রোযা রাখিতে যে নিষেধ করা হইয়াছে ইহা হইতে উহা অর্থাৎ স্বামীর উপস্থিতিতে তাহার অনুমতি না লইয়া নফল রোযা রাখা হারাম হইয়া গিয়াছে। ইমাম নববী বলিয়াছেনঃ ইহা মাকরূহ। বিনানুমতিতে কোন স্ত্রী যদি রোযা রাখেই তবে এই রোযা সহীহ হইবে। তবে সে গুনাহগার হইবে। আর মুহাল্লাব বলিয়াছেন, এই নিষেধে মাকরূহ তানজীহ প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ ইহা সম্পূর্ণ হারাম করিয়া দেওয়া হয় নাই। পছন্দ করা হয় নাই এইটুকুই মাত্র। এতদসত্ত্বেও রোযা রাখা হইলে তাহাতে গুনাহগার হওয়ার কোন কারণ নাই।

দ্বিতীয় বিধান, স্বামীর অনুমতি ব্যতীত ঘরে কোন লোককে আসিবার অনুমতি দেওয়া সম্পর্কে হাদীসের ভাষা হইলঃ *************** স্ত্রী স্বামীর অনুমতি ব্যতীত কাহাকেও তাহার স্বামীর অনুমতি দিবে না, সেই মেয়ে লোককেও নয়। কেননা এইরূপ করা হইলে স্বামীর মনে মন্দ ধারণা ও খারাপ সন্দেহ সৃষ্টি হইতে পারে এবং স্বামীর মনে অপমান বোধ জাগিতে পারে। আর তাহা হইলে দাম্পত্য জীবনে চরম ভাঙ্গন ও বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। মুসলিম শরীফের বর্ণনায় এখানকার ভাষা হইল ******** ‘স্বামী বাড়িতে উপস্থিত থাকা কালে তাহার অনুমতি ছাড়া’। কিন্তু এখানেও স্বামী উপস্থিত থাকার কথাটা অবান্তরও অর্থহীন মনে হয়। কেননা ইহার দরুন অর্থ দাঁড়ায় এই যে, স্বামীর উপস্থিতিতে তাহার অনুমতি ব্যতীত কাহাকেও ঘরে আসিতে দেওয়া নিষেধ আর স্বামীর অনুপস্থিতিতে তাহার অনুমতি ব্যতীরেকে কাহাকেও ঘরে আসিতে দেওয়া জায়েয। অথচ ইহা মোটেই যথার্থ কথা নয়। স্বামীর উপস্থিতিতে কাহাকেও আসিতে দিলে যতটা অন্যায় হওয়ার আশংকা স্বমীর অনুপস্থিতিতে কাহাকেও আসিতে দিলে তাহার অপেক্ষা অনেক বেশী অন্যায়- অনেক বেশী সন্দেহের কারণ হওয়া অবশ্যম্ভাবী। স্বামী যদি জানিতে পারে- জানিতে পারা খুবই স্বাভাবিক যে, অমুককে তাহার উপস্থিতিতে ঘরে প্রবেশ করিতে দেয় না; কিন্তু তাহার অনুপস্থিতিকালে খুব আসিতে দেয়, তাহা হইলে অবস্থাটা কি দাঁড়ায়, তাহা বুঝিতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। এই কারণে স্বামীর অনুমতি ব্যতীত তাহার অনুপস্থিতি কালে তো কাহাকেও ঘরে আসিতে দেওয়া উচিত নয়- এই সময় তো আরও বেশী সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। কেননা যে ঘরে বাড়ীর মালিক অনুপস্থিত, সে ঘরে ভিন পুরুষের প্রবেশ করার নিষেধ কুরআন মজীদে এবং সহীহ হাদীসে উদ্ধৃত হইয়াছে। কিন্তু বিশেষ কোন প্রয়োজন দেখা দিলে সেই প্রয়োজন যাহার, অনুমতিক্রমে তাহার প্রবেশ করা ও প্রয়োজন পূর্ণ হওয়া মাত্র চলিয়া যাওয়ায় কোন দোষ নাই। এইরূপ সাময়িক ও আকস্মিক কারণে কাহাকেও প্রবেশ করিতে দিলে স্বামীর বিনানুমতিতে হইলেও কোন দোষ হইবে না। কেননা নিতান্ত ও আকস্মিক কাজের প্রয়োজনে ঘরে প্রবেশ করার দরকার হইয়া পড়িয়াছে বিধায় ইহার পূর্বে অনুমতি লওয়া তো সম্ভবপর নয়।

আর তৃতীয় কথা, স্বামীর আদেশ কিংবা স্বামীর কাজ ছাড়া অপর কোন কাজে অর্থ ব্যয় করিলে অর্থাৎ কোন দান খয়রাত করিলে তাহার অর্ধেক সওয়াব স্বামীকে দেওয়া হইবে। এই কথাটির সঠিক তাৎপর্য বুঝিতে পারা যায় হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত অপর একটি হাদীস হইতে। তাহা এইঃ

****************************************

স্ত্রী যদি স্বামীর উপার্জন হইতে কিচু দান-সদকা নিজস্বভাবেও স্বামীর আদেশ ব্যতিরেকে করে, তাহা হইলে স্বামী উহার অর্ধেক সওয়াব পাইবে।

ইহা হইতে একথা স্পষ্ট হয় যে, স্বামীর উপার্জনের উপর স্ত্রীর যথেষ্ট অধিকার আছে। অধিকার আছে তাহা হইতে তাহার অনুমতি ব্যতীতই দান-সদকা করার। সে দান-সাদকার সওয়াব কেবল স্ত্রীই পাইবে না, পাইবে না কেবল স্বামীই। বরং উভয়ই আধা-আধি হারে পাইবে। স্বামী পাইবে এই জন্য যে, উহা তাহারই উপার্জন। আর স্ত্রী পাইবে এই জন্য যে, সে উহা দান করিল। আবূ দায়ূদের বর্ণনার ভাষা হইলঃ

****************************************

স্ত্রী এই দান-সাদকার সওয়াবের অর্ধেক পাইবে।

কিন্তু ইমাম খাত্তাবী হাদীসের ***** কথাটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করিয়াছেন ব্যয় করা সম্পদের দৃষ্টিতে। স্ত্রী যদি স্বামীর আদেশ ব্যতীত মূল কর্তব্যের অধিক মাত্রায় ব্যয় করিয়া বসে, তবে উহার অর্ধেক পরিমাণ ক্ষতি পূরণ করিতে ও তাহা স্বামীকে আদায় করিয়া দিতে বাধ্য হইবে। কেননা উহা অতিরিক্ত ব্যয় রূপে গণ্য। আল্লাম কিরমানী বলিয়াছেন, স্ত্রী যদি স্বামীর ধন-মাল হইতে তাহার অনুমতি ব্যতীত যথা নিয়মে ও প্রচলিত পরিমাণের অধিক নিজের জন্যও ব্যয় করে তাহা হইলে নির্দিষ্ট পরিমাণের অতিরিক্ত যাহা করিবে তাহা স্বামীকে ফিরাইয়া দিতে সে বাধ্য হইবে। এই কারণে যে, তাহার জন্য যাহা নির্দিষ্ট তাহার অপেক্ষা বেশীখরচ করিয়া বসিয়াছে। ****** গ্রন্হকার বলিয়াছেন *******র অর্থ দান-সাদককার সওয়াব যতটা দাতা স্ত্রী পাইবে ততটাই পাইবে তাহার স্বামী। সওয়াব পাওয়ার ক্ষেত্রে দুইজন আধা-আধি ভাগে সমান পাইবে। ইহার দলীল হইল; নবীকরীম (স) বলিয়াছেনঃ

****************************************

ন্যায় পথ প্রদর্শকও ন্যায় কাজের কর্মীর মতই সওয়ার পাওয়ার অধিকারী।

ইহা হইতে সওয়াব পাওয়ার ব্যাপারে স্বামীতে স্ত্রীতে পূর্ণ সাম্য ও সমতা বুঝা যায়। দানটি স্বামীর ধন-মাল হইতে হইলেও দান করার পথটাতে স্ত্রী-ই দেখাইয়াছেন।

ইবনুল মুরাবিত বলিয়াছেনঃ হাদীসের এই কথাগুলিতে সেই ব্যয় সম্পর্কে বলা হইয়াছে, যাহা প্রচলিত ব্যয়ের বহির্ভূত- সাধারণ নিয়মের অতিরিক্ত। মুয়াবীয়ার স্ত্রী হিন্দার ব্যাপারে রাসূলে করীম (স) এই ফয়সালাই দিয়াছিলেন। হাদীসে বলা হইয়াছেঃ

****************************************

খাজাঞ্জী বা ক্যাশ রক্ষাকারী যাহা যাহা ব্যয় করিবে তাহাতে সে একটা সওয়াব পাইতে। স্ত্রীর জন্যও এই রূপ সওয়াব রহিয়াছে। তবে তাহা প্রচলিত নিয়মে ও পরিমাণে হইতে হইবে।

এই অর্ধেক সওয়াব তাহারই যাহা দান করার প্রচলিত নিয়মে স্ত্রীর অধিকার রহিয়াছে। কিরমানী ইহাও বলিয়াছেন যে, বুখারী বর্ণিত অপর একটি হাদীস এই কথার পরিপন্হী। সে হাদীসটি এইঃ

****************************************

স্ত্রী যদি স্বামীর উপার্জন হইতে তাহার আদেশ ব্যতীতই ব্যয় বা দান করে তাহা হইলে সেই স্বামী উহার অর্ধেক সওয়াব পাইবে।

ইহার কারণ এই যে, স্ত্রী নিজে যে পরিমাণ ব্যয় করার অধিকারী, স্বামীর মালে উহার সহিত দান করা জিনিস সংমিশ্রিত করিয়া ফেলিয়াছে। ফলে তাহাতে দুইটি অংশ দুই জনের আছে বলিয়া ধরিয়া লইতে হইবে। ইহার বিপরীত কথা এই বলা যায় যে, তাহা যদি হইয়াও থাকে, তাহা হইলেও স্ত্রী যে অতিরিক্ত পরিমাণ ব্যয় করিয়াছে উহার ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে না- যদিও স্বামী তাহার এই ব্যয়ে সন্তুষ্ট বা রাযী না হয়। উপরোক্ত ব্যাখ্যায় ইহা প্রমাণিত হয় না। হযরত ইবনে উমর ও ইবনে আব্বাস (রা) হইতে যুগপৎ ভাবে বর্ণিত হাদীস এইঃ রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ

****************************************

স্ত্রী স্বামীর ঘর হইতে তাহার অনুমতি ব্যতীত কোন দান-সদকাই করিবে না। যদি করে, তাহা হইলে উহার সওয়াব স্বামী পাইবে, আর স্ত্রীর উপর গুনাহের বোঝা চাপিবে। অনুরূপভাবে স্বামীর অনুমতি ব্যতীত একটি দিনও নফল রোযা রাখিবে না। যদি রাখে তবে সে গুনাহগার হইবে। রোযার কোন শুভ ফলই সে পাইবে না।

আর হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত অপর একটি হাদীস হইলঃ

****************************************

স্ত্রী স্বামীল ধন-মাল হইতে দান-সাদকা করিবে কিনা এই বিষয়ে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিলেন, না। তবে তাহার জন্য দেওয়া বরাদ্ধকৃত সম্পদ হইতে করিতে পারে। তাহা করিলে উহার সওয়াব স্বামী-স্ত্রী দুইজনের মধ্যে বিভক্ত হইবে। কিন্তু স্বামীরমাল হইতে স্ত্রী কিছুই ব্যয় করিবে না।

শেষে উদ্ধৃত করা এসব হাদীসের আলোকে প্রথমোদ্ধৃত হাদীসটির সঠিক তাৎর্প বুঝিতে হইবে।

(******************)

স্ত্রীর পক্ষে উত্তম ব্যক্তি
****************************************

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ মু’মিনদের মধ্যে পরিপূর্ণ ঈমানদার সেই লোক, যে লোক চরিত্রের দিকদিয়া তাহাদের মধ্যে সর্বোত্তম। আর তোমাদের যে সব লোক তাহাদের স্ত্রীদের জন্য সর্বোত্তম কল্যাণকর, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ও কল্যানময় লোক তাহারাই।

(তিরমিযী, ইবনে মাজা, মুসনাদে আহমাদ)

ব্যাখ্যাঃ হাদীসটিতে দুইটি কথা বলা হইয়াছে। প্রথম কথায় ঈমান ও চরিত্রের সম্পর্কের প্রতি ইংগিত করা হইয়াছে। দ্বিতীয় কথাটি নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক পর্যায়ের। এই দুইটি কথার মধ্যে বাহ্যতঃ কোন সম্পর্ক আছে মনে না হইলেও মূলত এই দুইটির মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান।

প্রথম কথাটি হইলঃ চরিত্রের বিচারে যে লোক সর্বোত্তম- সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী যে লোক, ঈমানের পূর্ণত্বের দিকদিয়া সেই লোক সর্বাধিক অগ্রসর- সেই অন্যান্যদের তুলনায় অধিক পূর্ণাঙ্গ ঈমানের অধিকারী। ইহার কারণ এই যে, পূর্ণাঙ্গ ঈমান সর্বোত্তম চরিত্র সৃষ্টি করে। সর্বোত্তম চরিত্র পূর্ণাঙ্গ ঈমানের ফসর। পূর্ণাঙ্গ ঈমান যেখানে বর্তমান, সর্বোত্তম চরিত্র সেখানে অবশ্যম্ভাবী। কাহারও চরিত্র মন্দ বা ক্রটিযুক্ত দেখিতে পাইলে নিঃসন্দেহে বোঝা যাইতে পারে যে, তাহার ঈমানে ক্রটি রহিয়াছে, তাহা পূর্ণাঙ্গ নয়। আর এই পূর্ণাঙ্গ ঈমান ও উন্নত উত্তম চরিত্রই নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের কল্যাণ কামনা ও মঙ্গল সাধনে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। এই তাৎপর্যের প্রেক্ষিতেই রাসূলে করীম (স)-এর দ্বিতীয় কথাটি অনুধাবনীয়।

তাই হইল তোমাদের মধ্যে যে সব লোক তাহাদের স্ত্রীদের প্রতি অধিকক কল্যাণকারী ও মংগলকারী, তাহারাই তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক উত্তম লোক। ইহার কারণ হইল, পূর্ণাঙ্গ ঈমান মানুষকে সর্বাধিকক চরিত্রবান বানায়। সর্বাধিক উত্তম চরিত্রের একটা বিশেষ বাস্তব প্রতিফলন ঘটে নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের কল্যাণ সাধনে। আর মানব সমাজের দুর্বলতম অংশ হইল নারী সমাজ। কাজেই তাহাদের কল্যাণ কামনায় ও মংগল সাধনে সেই ঈমান ও উন্নত চরিত্রের তাকীদে অধিকতর তীব্র সচেষ্টা ও সদা তৎপর হওয়া স্বাভাবিক। অন্য কথায় নারীগণকে দুর্বল ভাবিয়অ তাহাদের প্রতি যাহারা অসদাচরণ করে, দুর্ব্যবহার ও নির্যাতন নিষ্পেষণ চালায়, তাহারা পূর্ণাঙ্গ ঈমানদার নয়। পূর্ণাঙ্গ ঈমানদার নয় বলিয়াই তাহারা উত্তম চরিত্রের অধিকারী নয়, নয় ভাল মানুষ। বরং তাহারা নরাধম, পাষণ্ড।

এই পর্যায়ে হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত আর একটি হাদীস উল্লেখ্য। রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ

****************************************

তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি সে, যে লোক উত্তম ও অধিক কল্যাণ সাধক তাহার পরিবার বর্গের জন্য। আর আমি তোমাদের মধ্যে তুলনামুলকভাবে আমার পরিবার বর্গের জন্য অধিক কল্যাণকামী ও মঙ্গল সাধক।

ইহা হইতেও স্পষ্ট জানা গেল যে, কল্যাণের মর্যাদা ও উহাতে অভিষিক্ত হওয়া সম্বব তাহার পক্ষে, যে লোক নিজ পরিবার বর্গের প্রতি অন্যান্যের তুলনায় অধিক কল্যাণবহ। কেননা ব্যক্তির নিকট হইতে হাসি খুশী, উত্তম চরিত্র, আচার-আচরণ, দয়া-সহানুভূতি, কল্যাণ লাভ ও অকল্যাণ প্রতিরোধ ইত্যাদি পাওয়ার অন্যান্যদের তুলনায় বেশী অধিকারী হইতেছে তাহার পরিবারবর্গ। কাজেই কেহ যদি এইরূপ হয় তবে সেই যে সকল মানুষের তুলনায় অতীব উত্তম ব্যক্তি, তাহাতে আর সন্দেহ কি? কিন্তু ইহার বিপরীত হইলে- সে তুলনামূলকবাবে অধিক নিকৃষ্ট ব্যক্তি হইবে। বস্তুত বহু মানুষই এই আবর্তের মধ্যে পড়িয়া হাবুডুবু খাইতেছে। এমন দেখা যায়, একটি লোক তাহার পরিবার বর্গের ব্যাপারে নিকৃষ্ট আচার-আচরণ অবলম্বন করিতেছে। নিকৃষ্ট চরিত্র ও অধিক লোভী বা কৃপণ হওয়ার প্রমাণ দিতেছে; কিন্তু বাহিরের লোকদের সহিত তাহার আচার আচরণ অতিশয় মধূর, কল্যাণবহ। হাসিমূখে তাহাদিগকে বরণ করিতেছে, কথা বার্তা বলিতে ও আদর আপ্যাযন করিতেছে। এইরূপ ব্যক্তি প্রকৃত মানুষত্ব ও কল্যাণ বঞ্চিত, পথ ভ্রষ্ট।

(************)

বস্তুত রাসূলে করীম (স) এই সব বাণীর মাধ্যমে যে আদর্শ সমাজ গঠন করিতে সচেষ্ট ছিলেন, সেখানে নারী জাতি সর্বদিক দিয়াই সুখী ও মর্যাদাবতী এবং পুরুষ ও নারীর বৈধ দাম্পত্য জীবন কেন্দ্রিক পরিবার ইসলামের অধিকতর গুরুত্বের অধিকারী। রাসূলে করীম (স) আদর্শ ও উন্নত সমাজজ গঠনের জন্য উহার পূর্বে আদর্শ ও শান্তিপূর্ণ পরিবার গঠন এবং উহারও পূর্বে আদর্শ ঈমানদার চরিত্রবান ব্যক্তি- পুরুষ ও নারী তৈরী করার বাস্তব প্রক্রিয়া অবলম্বন করিয়াছিলেন।

উদ্ধৃত হাদীস সমূহ এই পর্যায়েরই পবিত্র ভাধারায় সমন্বিত।

স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার
****************************************

সুলাইমান ইবনে আমর ইবনুল আহওয়াচ হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, আমার পিতা আমর ইবনুল আহওয়াচ (রা) আমার নিকট হাদীস বর্ণনা করিয়াছেনঃ তিনি রাসূলে করীম (স)-এর সঙ্গে বিদায় হজ্জে উপস্থিত ও শরীক ছিলেন। সেই সময়ে এক ভাষণ প্রসঙ্গে রাসূলে করীম (স) সর্বপ্রথম আল্লাহর হামদ ও সানা উচ্চারণ করিলেন। অতঃপর অনেক ওয়ায ও নছীহত করিলেন। এই ভাষণেই তিনি বলিলেনঃ লোকগণ! সাবধান হও। নারীদের প্রতি তোমরা কল্যাণকামী হও এবং তাহাদের কল্যাণ প্রসঙ্গে যে নছীহত করিতেছি তাহা কবুল কর। মনে রাখিও, অবস্থা এই যে, অবস্থা এই যে, তাহারা তোমাদের হাতে বাঁধা। তোমরা তাহাদের নিকট হইতে উহা ছাড়া আর কিছুই পাইবার অধিকারী নও। তবে যদি তাহারা কোন রূপ স্পষ্ট প্রকট নির্লজ্জতার কাজ করে তাহা হইলে-। যদি তাহারা এইরূপ কিছু করে, তাহা হইলে শয্যায় তাহাদের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন কর। আর শেষ পর্যন্ত প্রয়োজন হইলে তাহাদিগকে মার- তবে জঘন্য ও বীভৎস ধরনের নয়। ইহার পর তাহারা যদি তোমাদের অনুগত হয়, তাহা হইলে তাহাদের ব্যাপারে একবিন্দু সীমালংঘন করিবে না। তোমরা জানিয়া রাখ, তোমাদের জন্য তোমাদের স্ত্রীদের উপর অধিকার আছে। আর তোমাদের স্ত্রীদেরও অধিকার আছে তোমাদের উপর। তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের যে অধিকার আছে, তাহা এই যে, তোমরা যাহাদিগকে অপছন্দ কর তাহারা তোমাদের শয্যা মাড়াইবে না। অনুরূপভাবে যাহাদিগকে তোমরা পছন্দ কর না, তাহাদিগকে তোমাদের ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি দিবে না। আরও জানিয়া লও, তোমাদের উপর তাহাদের অধিকার হইল, তাহাদের খাওয়া ও পারর ব্যাপারে তাহাদের প্রতি তোমরা অধিক মাত্রায় মহানুভবতা ও অনুগ্রহ মূলক আচরণ গ্রহণ করিবে।

(তিরমিযী, ইবনে মাজাহ।

ব্যাখ্যাঃ এই দীর্ঘ হাদীসটির আসল বক্তব্য সুস্পষ্ট। ইতিপূর্বে উদ্ধৃত এতৎসংক্রান্ত হাদীস সমূহের প্রেক্ষিতে ইহার তাৎপর্য অনুধাবন করিতে হইবে।

এই হাদীসটির একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহাতে রাসূলে করীম (স)-এর বিদায় হজ্জে দেওয়া ভাষণের অংশ উদ্ধৃত হইয়াছে এবং ইহাতে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের পারস্পরিক অধিকারের কথা একই সঙ্গে বলা হইয়াছে। শুধু তাহাই নয়, এই হাদীসটিতে স্ত্রীদের প্রতি গ্রহণীয় আচরণ পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথাও উদ্ধৃত হইয়াছে। রাসূলে করীম (স) এই পর্যায়ের কথা, শুরু করিয়াছেন এই বলিয়াঃ

****************************************

এই কথাটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে- নারী প্রকৃতির রহস্য- আলোচনায় পেশ করা হইয়াছে।

কিন্তু এই বাক্য হইতে একথা স্পষ্ট হয় যে, রাসূলে করীম (স) অতঃপর যাহা কিছু বলিয়াছেন, তাহা সবই বলিয়াছেন নারী সমাজে সঠিক মর্যাদা নির্ধারণ এবং তাহাদের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে।

নারীদের মর্যাদা বুঝাইবার জন্য প্রথমেই বলিয়াছেনঃ হে পুরুষরা! তাহারা তোমাদের নিকট বাঁধা পড়িয়াছে। তোমরা এতদ্ব্যতীত আর কোন কেরণেই তাহাদের প্রতি কড়া শাসনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে বা তাহাদের গায়ে হাত দিতে পার না যে, তাহারা কোন প্রকাশ্য অসদাচরণ ও নির্লজ্জতা মূলক কাজ করিয়া বসিবে। অর্থাৎ তাহারা তোমাদের নিকট বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইয়াছে বলিয়া এবং অসহায় ও অক্ষম দুর্বল পাইয়া তোমরা তাহাদের প্রতি কোন রূপ খারপ ব্যবহার করিতে পারনা। কেননা তাহারাও মানুষ এবং তাহাদের আত্মমর্যাদা ও সম্মান রহিয়াছে। সাধারণভাবে তাহারা তোমাদের প্রতি অতীব উত্তম মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানজনক আচরণ পাইবার অধিকারী। তবে যদি কোন সময় তাহারা কোন নির্লজ্জতামূলক অশ্লীল কাজ করিয়া বসে; তবেই তোমরা কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের অধিকারী, তাহারা পূর্বে নয়। আর তেমন কোন কাজ করিলে (কি কি কাজ করিলে তাহা ইতিপূর্বেএক হাদীসের ব্যাখ্যায় সবিস্তারে বলা হইয়াছে।) তোমরা সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে পারিবে।

এই পর্যায়ে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণের কাজ হইল, শয্যা বা বিছানায় স্ত্রীর সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করা। আর সর্বশেষে নিরূপায়ের উপায় হিসাবে তাহাদিগকে কিছুটা হালকা ধরনের দৈহিক শাসন দান। এ সম্পর্কে ব্যবহৃত শব্দ হইল ****** ইহার অর্থঃ ****** ‘অতীব কষ্ট দায়ক, সহ্যাতীত ও কঠোর নয় এমন। ইহার ফলে তাহারা যদি পথে আসে ও তোমাদের অনুগত হয়, তাহা হইলে পূর্বের সেই ব্যাপারের জের হিসাবে অতঃপর তাহাদের সহিত একবিন্দু খারাপ ব্যবহার করিতে পারিবে না। পারিবে না কোনরূপ রুঢ় কড়া কথা বলিতে বা দৈহিক কষ্ট ও পীড়ন দিতে।

ইহার পর পারস্পরিক অধিকারে কথা বলা হইয়াছে। এক বাক্যেই এই পারস্পরিক অধিকারের কথা বলিয়া দেওয়া হইয়াছে। বাক্যের প্রথম অংশে বলা হইয়াছে, তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের অধিকার আছে এবং দ্বিতীয় অংশে বলা হইয়াছে, তোমাদের উপরও তোমাদের স্ত্রীদের অধিকার আছে। যেহেতু এই কথাগুলি বলা শুরু হইয়াছিল পুরুষদের সম্বোধন করিয়া। আর ইসলামের দৃষ্টিতে পুরুষরাই সমাজে ও পরিবারের প্রধান। সামাজিক ও পারিবারিক ভাল মন্দের জন্য প্রধানত পুরুষরাই দায়ী। পুরুষরা যেমন ভাল করিতে পারে তেমনি পারে মন্দ করিতেও। রাসূলে করীম (স) তাঁহার ইসলামী সমাজ ও পরিবার গঠনের জন্য দেওয়া নীতি ও আদর্শের বাস্তবায়নের জন্য পুরুষদিগকেই দায়ীত্বশীল বানইয়া দিলেন এই ভাষণে।

স্ত্রীদের উপর পুরুষদের অধিকার পর্যায়ে এই হাদীসে মাত্র দুইটি মৌলিক কথা বলা হইয়াছে। প্রথম *************** ইহার অর্থঃ ‘কোন ভিন পুরুষকে তাহাদের সহিত কথা ব লিতে দিবে না’। বস্তুত তদানীন্তন আরব সমাজে সাধারণ প্রচলন অনুযায়ী সব পুরুষ সব মেয়েলোকের সহিতই অবাধে কথা বলিত। ইহাত সেই স্ত্রীদের স্বামীরা কোন দোষ দেখিতো না এবং ইহাতে তাহাদের মনে কোনরূপ সন্দেহ বা সংশয় জাগিত না। ইহা পর্দা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পূর্ববর্তী অবস্থা। যাহা আরব জাহিলিয়াতের সময় হইতেই চলিয়া আসিতেছিল। বাক্যটির শব্দ ******* অর্থ ‘ব্যভিচার নয়’। কেননা তাহা তো চিরন্তন হারাম। তাহাতে ******* ‘যাহাকে তোমরা পছন্দ কর না- অপছন্দ কর’ এই কথার তো কোন প্রশ্ন উঠে না। ইহার সঠিক অর্থ হইল, স্বামী পছন্দ করে না এমন কোন পুরুষ বা মেয়ে লোককে ঘরে প্রবেশ করিতে, ঘরে আসিয়া বিছানায় বসিতে ও কথাবার্তা বলার অনুমতি দিবে না। সে পুরুষ মহররম হইলেও না। তবে স্বামী নারাজ হইবে না বা আপত্তি করিবে না এমন মুহররম পুরুষ সম্পর্কে কোন নিষেধ নাই। পরবর্তী বাক্যটি ইহারই ব্যাখ্যা দেয়।

আর স্বামীদের উপর স্ত্রীদের অধিকার পর্যায়ে এখানে শুধু একটি কথাই বলা হইয়াছে। তাহা হইল, খাওয়া পরার ব্যাপারে তাহাদের প্রতি শুভ ও উদার আচরণ গ্রহণ করিতে হইবে।

বস্তুত যেখানে যাহা কিছু অধিকার, সেখানেই তাহার সেই পরিমাণ কর্তব্য। অনুরূপ ভাবে যেখানে যাহার যতটা কর্তব্য, সেখানেই তাহার ততটা অধিকার। ইহা আধুনিক সমাজ-বিজ্ঞান কর্তৃক নিজস্ব ভাবে স্বীকৃত ও ঘোষিত হইলেও মূলক ইহা শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স) কর্তৃক প্রচারিত। তাহা উক্ত কথা হইতেই সুন্দর ভাবে প্রতিভাত।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, মুসলিম শরীফে নবী করীম (স)-এর ভাষণের এই অংশটি উদ্ধৃত হইয়াছে এই ভাষায়ঃ

****************************************

তোমরা স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। কেননা তোমরা তাহাদিগকে আল্লাহর বাণী ও বিধানের ভিত্তিতে গ্রহণ করিয়াছ এবং তাহাদের স্ত্রী অঙ্গ হালাল পাইয়াছ আল্লাহরই বিধান অনুযায়ী। আর তাহাদের উপর তোমাদের এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে যে, তাহারা তোমাদের শয্যাকে এমন কাহারও দ্বারা দলিত হইতে দিবে না যাহাদিগকে তোমরা অপছন্দ কর। তাহারা যদি তাহা করে তাহা হইলে তোমরা তাহাদিগকে মারিতে পার অ-তীব্র অ-কঠোর হালকা মার। কিন্তু সর্বাবস্থায়। প্রচলিত মানে ও নিয়মে তাহাদের খোরাক-পোশাক বাসস্থান অর্থাৎ রিযিক দেওয়া তোমাদের কর্তব্য ও তোমাদের উপর তাহাদের হক-অধিকার।

বর্ণনাটি এই ভাষায় প্রথম দুইটি বাক্য অভিনব ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যবহ। তাহা হইল, পুরুষরা স্ত্রীদের গ্রহণ করে আল্লাহর কালেমার ভিত্তিতে এবং তাহাদের স্ত্রী অঙ্গ নিজেদের জন্য হালাল বানাইয়া লয় কেবলমাত্র আল্লাহর বিধান অনুযায়ী। বস্তুত পুরুষরা-স্বামীরা- এই কথা বিস্মৃত না হইলে স্ত্রীদের অধিকার হরণ ও তাহাদের মান-মর্যাদার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিতে পারিত না। আল্লাহর ভয়ে তাহাদের হৃদয়-মন মদা কম্পিত থাকাই হইত স্বাভাবিক।

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্য
****************************************

হযরত মুয়াবিয়া আল কুশাইরী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন; আমি বলিলাম, হে রাসূল আমাদের স্ত্রীদের কোন অংশ আমরা ব্যবহার করিব, আর কোন অংশ ছাড়িয়া দিব? জওয়াবে রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তুমি তোমার ক্ষেত যে ভাবে ও যেদিক দিয়াই ইচ্ছাকর আসিতে ও ব্যবহার করিতে পার। তাহাকেও খাইতে দিবে যখন তুমি খাইবে, তাহাকে পরিতে দিবে যখন তুমি পরিবে। আর তাহার মুখমণ্ডল কুৎসিত বীভৎস করিবে না, মারিবে না। (আবূ দায়ূদ)

ব্যাখ্যাঃ এই হাদীসটি বর্ণনাকারী হযরত মুয়াবীয়া আল কুশাইরী হইতে বর্ণিত। এই পর্যায়েরই আরও একটি হাদীস ইতিপূর্বৈ উদ্ধৃত হইয়াছে। এখানে উদ্ধৃত হাদীসটিতে সাহাবীর প্রশ্ন ছিল স্ত্রীর কোন অঙ্গ যৌন উদ্দেশ্য পূরণার্থে ব্যবহার করিব এবং কোন অংশ নয়। সেই সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) প্রশ্নের জওয়াবে যাহা বলার তাহাতো বলিয়াছেনই। সেই সঙ্গে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্যের কথাও বলিয়া দিয়াছেন। বস্তুত রাসূলে করীম (স)-এর কথা বলার ধরণই ছিল এই। তিনি শুধু জিজ্ঞাসিত বিষয়ের জওয়াব দিয়াই ক্ষান্ত থাকিতেন না, প্রসঙ্গত আরও যাহা বলার এবং প্রশ্নকারীর মনস্তত্বের প্রেক্ষিতে ও আনুসাঙ্গিক দায়িত্ব হিসাবে যাহা বলা তিনি জরুরী মনে করিতেন তাহাও তিনি বলিয়া দিতেন।

সাহাবী জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন শুধু একটি কথাঃ স্ত্রীর কোন অঙ্গ যৌন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিবার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিব, আর কোন অঙ্গ ব্যবার করিব না? জওয়াবে নবী করীম (স) বলিলেনঃ স্ত্রীর যৌন অঙ্গই তোমার জন্য নির্দিষ্ট ক্ষেত। এই ক্ষেত্রে চাষাবাদ করা ও সেই চাষাবাদের ফলে উহা হইতে ফসল পাইতে চাওয়া ও ফসল যাহা হয় তাহা সানন্দচিত্তে গ্রহণ করাই কৃষকের কাজ। স্ত্রীর যৌন অঙ্গে চাষাবাদ করার জন্য কোন ধরাবাঁধা নিয়ম বা পদ্ধতি নাই। কৃষকের নিকট ক্ষেতই হয় আসল লক্ষ্য। নির্দিষ্ট ক্ষেত ছাড়া সে অন্যত্র লাঙ্গল চালায় না, পরিশ্রম করে না। স্বামীর নিকট স্ত্রীর যৌন অঙ্গও ঠিক অনুরূপ সন্তানের ফসল ফলাইবার ক্ষেত বিশেষ। রাসূলে করীম (স) এই কথাটিতে কুরআন মজীদের ভাষা হুবহু অনুসৃত ও প্রতিফলিত হইয়াছে। কুরআন মজীদে বলা হইয়াছেঃ

****************************************

তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের জন্য ক্ষেত। তোমরা তোমাদের সেই ক্ষেতে গমন কর যেভাবে যে দিক দিয়াই তোমরা ইচ্ছা কর।

অর্থাৎ স্ত্রীর যৌন অঙ্গ ছাড়া তাহার দেহের অন্য কোন অঙ্গ যৌন উদ্দেশ্যে চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করা জায়েয নয়- নয় স্বাভাবিক। ইহা ছিল সাহাবীর জিজ্ঞাসিত বিষয়। আর ইহা নিছক স্বামীর অধিকার ও ভোগ সম্ভোগ সম্পর্কিত বিষয়। কিন্তু রাসূলে করীম (স) এই কথাটুকু বলিয়া ও স্বামীর অধিকারের কথাটুকু জানাইয়া দিয়াই ক্ষান্ত থাকিলেন না। তিনি সেই সঙ্গে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্যের কথাও বলিয়া দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিলেন এবং বলিলেনঃ স্ত্রীর খাওয়া পরা যথাযথ জোগাইয়া দেওয়া স্বামীর প্রধান কর্তব্য। ইহার প্রতি কোনরূপ উপেক্ষা অবহেলা প্রদর্শন এবং কেবল নিজের অধিকারটুকু যেমন ইচ্ছা আদায় করিয়া লওয়া মানবিক ও মানবোচিত কাজ হইতে পারে না। অধিকার আদায় করার সঙ্গে সঙ্গে স্বীয় কর্তব্যটুকুও যথাযথ পালন করিতে হইবে।

এই সঙ্গে আবূ দায়ূদ উদ্ধৃত ও হযরত মুয়াবীয়া আল-কুশাইরী বর্ণিত অপর একটি বর্ণনাও উল্লেখ্য। হাদীসটি এইঃ

****************************************

আমি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিলাম এবং তাঁহাকে বলিলামঃ আপনি আমাদের স্ত্রীদের ব্যাপারে কি বলেন? তিনি বলিলেনঃ তোমরা তাহাদিগকে খাইতে দিবে যাহা তোমরা খাও তাহা হইতে, তাহাদিগকে পরিতে দিবে যাহা কিছু তোমরা পরিধান কর তাহা হইতে। আর তাহাদিগকে কখনও মারধর করিবে না এবং তাহাদিগকে কখনও কুৎসিত ও বীভৎস করিবে না।

মুসনাদে আহমাদ, আবূ দায়ূদ ও ইবনে মাজাহ গ্রন্হে এই হাদীসটির ভাষা এই রূপঃ

****************************************

নবী করীম (স) কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিল, স্বামীর উপর স্ত্রীর কি অধিকার? তিনি বলিলেনঃ তুমি তাহাকে খাওয়াইবে যখন তুমি খাইবে, তাহাকে পোশাক পরিতে দিবে যেমন তুমি পরিধান করিবে। মুখমণ্ডলের উপর আঘাত হানিবে না, কুৎসিতও করিবে না, অশ্লীল গাল-মন্দ করিবে না এবং ঘরের মধ্যে ছাড়া তাহাকে ত্যাগ করিবে না- তাহার সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিবে না।

স্ত্রীর খাওয়া-পরা প্রয়োজন ও মান অনুযায়ী সংগ্রহ ও পরিবেশন করা স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং ইহা স্ত্রীর অধিকার। স্ত্রীদের আদব-কায়দা শিক্ষাদান ও শরীয়াত পালন করিয়া চলিতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে যদি কখনও কিছুটা প্রহরও করিতে হয়, তবুও সে মার-এ মুখ মণ্ডলের উপর কোন রূপ আঘাত হানিতে পারিবে না। স্ত্রীর প্রতি কোন রূপ সন্দেহ বা অসন্তুষ্টির উদ্রেক হইলে শয্যাতেই তাহার সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করা যাইবে। অর্থাৎ ঘুমাইবে যথারীতি একই শয্যায়; কিন্তু স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক স্থাপন করিবে না। স্ত্রীকে শাসন করার ইহা একটা বিশেষ নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি। তাহাকে ত্যাগ করিতে হইলে করিবে ঘরের মধ্যেই, ঘরের বাহিরে নয়, উপরোক্ত কথাটির তাৎপর্য ইহাই। ক্রোধান্ধ হইয়া না নিজে ঘর ছাড়িয়া অন্যত যাইবে, না স্ত্রীকে ঘরের বাহিরে যাইতে বাধ্য করিবে। স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণে আনিবার জন্য ইহাই সর্বশেষ পদ্ধতি। ইহার ওপাশে স্বামীর আর কিছু করিবার নাই।

একটি বর্ণনা হইতে অবশ্য জানা যায়, নবী করীম (স) তাঁহার বেগমদের সহিত সম্পর্ক ত্যাগ করিয়া তাঁহার মসজিদ সন্নিহিত হুজরায় চলিয়া গিয়াছিলেন।

আলোচ্য মূল হাদীসে স্ত্রীদের প্রতি স্বামীদের কর্তব্যের কথা সুস্পষ্ট ও বলিষ্টভাবে বলা হইয়াছে। ইমাম খাত্তাবী লিখিয়াছেনঃ স্ত্রীর খাওয়া-পরা ও যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা স্বামীর পক্ষে ওয়াজিব-একান্তই কর্তব্য। ইহার কোন উচ্চ সীমা নির্ধারিত নয়। ইহা করিতে হইবে প্রচলিত নিয়মে ও প্রচলিত মান অনুযায়ী, করিতে হইবে স্বামীর আর্থিক সামর্থ্যানুপাতে। রাসূলে করীম (স) ইহা স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকাররূপে নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন। স্বামী বাড়ীতে উপস্থিত থাকুক, আর না-ই থাকুক, সর্বাবস্থায়ই ইহার ব্যবস্থা করা স্বামীর কর্তব্য। ইহা যদি যথা সময়ে স্বামী না করে, তবে ইহা স্ত্রীর নিকট তাহার ঋণ রূপে গণ্য হইবে ও স্ত্রীকে আদায় করিয়া দেওয়া স্বামীর কর্তব্য হইবে। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর এই কর্তব্য অন্যান্য কর্তব্যের মতই গুরুত্বপূর্ণ ও অবশ্যপূরণীয়। স্বামীর নিকট হইতে স্ত্রীর এইসব পাওয়া অধিকার অন্যান্য অধিকারের মতই। স্বামীর অনুপস্থিতির দরুন সরকার কর্তৃক ইহা ধার্য হউক আর না-ই হউক, আদায় করার বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে কোনই পার্থক্য সুচিত হইবে না। ইহা স্ত্রীর পাওনা, অতএব যে ভাবেই হউক স্বামীকে ইহা অবশ্যই আদায় করিতে হইবে।

অন্যান্য হাদীসে কেবল মুখমণ্ডলের উপর মারিতে নিষেধ করা হইয়াছে। আর উপরোক্ত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ তাহাদিগকে মারিও না, মারধর করিও না। ইহা সাধারণ নিয়ম। সাধারণ অবস্থায় স্ত্রীকে কথায় কথায় মারধর করার কোন অধিকার স্বামীর নাই। ইহা নিতান্তই অমানুষিক। আর অন্যান্য হাদীসে বিশেষ অবস্থার কথা বলা হইয়াছে। সে বিশেষ অবস্থা হইল, শরীয়াতের দেওয়া অধিকারে যে যে কারণে স্ত্রীকে হালকা ধরনের মার-ধর করার অনুমতি দেওয়া হইয়াছে, তাহা। কিন্তু স্ত্রীকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করা যাইবে না কক্ষণই- কোন অবস্থায়ই। এই হাদীসে সাধারণ পুরুষ প্রকৃতির ক্রটির প্রতি ইংগিত রহিয়াছে। তাহা হইল, স্ত্রীর উপর নিজের পাওনাটুকু পুরোমাত্রায় আদায় করিয়া লওয়া; কিন্তু তাহার প্রতি স্বীয় কর্তব্য পালেন অবহেলা করা। হাদীসটিতে বলিয়া দেওয়া হইয়াছে, কেবল নিজের পাওনার কথা ভাবিলে চলিবে না, স্ত্রীর প্রতি কর্তব্যের কথাও মনে রাখিতে হইবে।

(*************************)

বিদেশ হইতে আগত স্বামীর গৃহে প্রবেশের নিয়ম
****************************************

হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, আমি নবী করীম (স) সঙ্গে একটি যুদ্ধে শরীক ছিলাম। আমরা যখন যুদ্ধ হইতে ফিরিয়া আসিলাম ও মদীনার নিকটে পৌঁছিয়া গেলাম, তখন একটি মন্হর গতির জন্তযান আরোহী হইয়া আমি তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইতে লাগিলাম। তখন পিছন হইত আর একজন জন্তুযান আরোহী লোক আসিয়া আমার সহিত মিলিত হইল। তখন আমি তাহার দিকে ফিরিলাম। সহসা দেখিলাম, আমি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট দাঁড়াইয়া রহিয়াছি। তখন তিনি আমাকে বলিলেনঃ কি ব্যাপার! তুমি খুব তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইতেছ কেন? আমি জওয়াবে বলিলামঃ আমি নব বিবাহিত, খুব অল্পদিন হয় বিবাহ করিয়াছি, তাই। নবী করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কুমারী মেয়ে বিবাহ করিয়াছ, না পূর্বে স্বামীপ্রাপ্তা মেয়ে? বলিলাম, পূর্বে স্বামীপ্রাপ্তা মেয়ে। তিনি বলিলেনঃ কুমারী মেয়ে বিবাহ করিলে না কেন? তাহা হইলে তুমি তাহার সহিত খেলা করিতে এবং সে তোমার সহিত খেলা করিত? হযতর জাবির (রা) বলেন, অতঃপর আমরা অগ্রসর হইলাম এবং মদীনায় প্রবেশ করিতে যাইতেছিলাম। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ তোমরা অপেক্ষা করিতে থাক। রাত্র হইলে অর্থাৎ এশার নামাযের সময় হইলে তখন প্রবেশ করিও। যেন বিস্রস্ত চুলধারী স্ত্রী চুল আচড়াইয়া লইতে পারে ও দীর্ঘদিন স্বামী বঞ্চিতা স্ত্রী পরিচ্ছন্নতা লাভ করিতে পারে।

(বুখারী, মুসলিম, আবূ দায়ূদ, নাসায়ী)

ব্যাখ্যাঃ এই দীর্ঘ হাদীসটিতে বহু দিন বাহিরে ও বিদেশে অতিবাহিত করিয়া ফিরিয়া আসা স্বামী স্ত্রীর নিকট যাওয়ার সৌহার্দ ও সৌহৃদ্য বৃদ্ধি কারী পন্হা বলিয়া দেওয়া হইয়াছে। হাদীসটি হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা)-এর জবানীতে বর্ণিত ও উদ্ধৃত হইয়াছে।

হযরত জাবির (রা) বিবাহ করার পর কিছু দিনের মধ্যে যুদ্ধে চলিয়া গিয়াছিলেন। ইহা ইসলামের জন্য সাহাবায়ে কেরামের অসাধারণ ত্যাগ ও তিতিক্ষার কথাই স্মরণ করাইয়া দেয়। নব বিবাহিত ব্যক্তির পক্ষে স্ত্রীকে ঘরে রাখিয়া যুদ্ধে গমন করা সাধারণত খব কম লোকের পক্ষেই সম্ভব হয়। বস্তুত সাহাবীদের এইরূপ বিরাট ত্যাট ও অতুলনীয় ধৈর্য সহিষ্ণুতার ফলেই দ্বীন ইসলাম দুনিয়ায় বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। রাসূলে করীম (স)-এর সঙ্গী সাথী এইরূপ দৃষ্টান্ত-হীন ত্যাগ তিতিক্ষার গুণে বিভূষিত ছিলেন বলিয়ই তাঁহার মিশন এত অল্প সময়ের মধ্যে সাফল্য মণ্ডিত হইতে পারিয়াছিল।

যুদ্ধ শেষে সকলের সঙ্গে হযরত জাবিরও যখন গৃহাভিমুখে ফিরিয়া আসিলেন, তখন স্বভাবতই তিনি অনতিবিলম্বে ঘরে পৌঁছিয়া যাইবার জন্য উদ্বুদ্ধ হইলেন। কেননা তাঁহার নব বিবাহিতা স্ত্রীর প্রতিও তাঁহার কর্তব্য রহিয়াছে, সে দিকে তিনি কিছুমাত্র উপেক্ষা প্রদর্শন করিতে পারেন না। বিশেষত ইহা হইতেও বৃহত্তর কর্তব্যের ডাকে সাড়া দিয়া তো ফিরিয়া আসিলেনই। কাজেই এখন আর বিলম্ব করা উচিত নয় বরং যতশীঘ্র সম্ভব স্ত্রীর সম্মুখে উপস্থিত হওয়া কর্তব্য বলিয়া মনে করিলেন। এই জন্য তিনি দ্রুত গতিতে জন্তুযান চালাইয়া যাইতে লাগিলেন। তাঁহার এই তাড়াহুড়া দেখিয়া রাসূলে করীম (স)-এর মনে প্রশ্ন জাগিয়া ছিল। তাই এই তাড়াহুড়ার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। তিনি জওয়াবে বলিলেনঃ ‘আমি বিবাহ করিয়াছি খুব বেশী দিন হয় নাই। ইহার পরই আমাকে এই যুদ্দে গমন করিতে হইয়াছিল। নবী করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ কুমারী মেয়ে বিবাহ করিয়াছ না এমন মেয়ে পূর্বে যাহার স্বামী ছিল? উত্তরে তিনি দ্বিতীয় ধরনের মেয়ে বিবাহ করার কথা জানাইলেন। এই সময় নবী করীম (স) বলিলেন, ‘তুমি কোন কুমারী মেয়ে কেন বিবাহ করিলে না? তাহা যদি করিতে, তাহা হইলে তুমি তাহাকে লইয়া খেলা করিতে পারিতে এবং সেও তোমাকে লইয়া খেলা করিতে পারিত’। এই খেলা করার অর্থ কি? পূর্বে স্বামীপ্রাপ্তা মেয়ে বিবাহ করিলে তাহার সহিত খেলা করা যায় না? রাসূলে করীম (স)-এর এই কথা হইতে বুঝা যায় যে, অবিবাহিত পুরুষের উচিত কুমারী মেয়ে বিবাহ করা। কুমারী মেয়ে বিবাহ করিলে তাহার নিকট স্বামী যে সুখ শান্তি ও প্রেম মাধুর্য লাভ করিতে পারে তাহা পূর্বে স্বামীপ্রাস্তা বিধবা তালাক দেওয়া মেয়ে বিবাহ করিলে তাহা পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কুমার ছেলে ও কুমারী মেয়ে জীবনের শুরুতে যখন প্রথমবার মিলিত হয়, তখন তাহারা পরস্পরের নিকট হইতে আনন্দ ও আন্তরিক শান্তি সুখ লাভ করিতে পারে। তাহা পূর্বে স্বামী প্রাপ্তা মেয়ের নিকট হইতে পাওয়া যাইতে পারে না। এই দুই জনার মধ্যে হৃদয় মনের গভীরতর সম্পর্ক ঐকান্তিকতা ও নিবিড় একাত্মতা সংস্থাপিত হওয়াও অনেক ক্ষেত্রে সুদৃঢ় পরাহত হইয়া পড়ে। বিশেষত এই জন্যও যে, এহেন স্ত্রী তখন পূর্ববর্তী স্বামীর কথা এবং তাহার সহিত অতিবাহিত দিন গুলির স্মৃতিচারণ করিতে ও এই দুই জন স্বামীর মাঝে তুলনা করিতে বাধ্য হয়। এই তুলনায় দ্বিতীয় স্বামী যদি কোন একটি দিক দিয়াও প্রথম স্বামীর তুলনায় নগণ্য ও হীন প্রমাণিত হয়, তাহা ছাড়া প্রথম স্বামীর প্রতি তাহার মনে প্রেম ও তীব্র আকর্ষণও থাকিতে পারে, তাহাকে হারাইয়া তাহার মনে দুঃখ ও ক্ষোভও থাকিতে পারে। তাহা হইলে তাহার পক্ষে দ্বিতীয় স্বামীকে গভীর ভাবে ভালবাসা দান সম্ভব নাও হইতে পারে। শুধু তাহাই নয়, তাহার মনে যে হাতাশা ব্যর্থতা ও খুঁতখুঁত ভাব দেখা দিবে, তাহা কেহই রোধ করিতে পারে না। ফলে এই স্বামীর জন্য তাহার ভালবাসা অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইবে।

দ্বিতীয়তঃ স্বামীর মনেও দ্বিধা-সংকোচ দেখা দেওয়া বিচিত্র নয় এই জন্য যে, আজ সে যাহাকে স্ত্রীরূপে পাইয়াছে, সে পূর্বে অন্য একজনের স্ত্রী ছিল। ছিল তাহার ভোগের পাত্রী। সে এই দেহ লইয়া অনেক খেলা খেলিয়াছে। এই কারণে সে যে গভীরতর আন্তরিকতা দিয়া একজন কুমারী মেয়েকে গ্রহণ করিতে পারিত এই স্ত্রীকে সেরূপ গ্রহণ করা তাহার পক্ষে সম্ভবপর হইবে না। সম্ভবত এই কারণেই নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

****************************************

তোমাদের উচিত কুমারী মেয়ে বিবাহ করা। কেননা তাহারাই অধিক তীব্র ও গভীরভাবে স্বামীকে ভালবাসিতে পারে এবং প্রতারণা ও ধোঁকা বাজিতেও তাহারা কম পটু হয়।

বস্তুত একবার যে মেয়ে বিবাহিতা হইয়াছ, সে তো স্ত্রীত্বের প্রশিক্ষণ পাইয়াছে, সে যদি এমন কোন ছেলেকে স্বামীরূপে পায় যাহার দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নাই, তাহাকে সে সহজেই প্রতারিত করিতে পারে। এই সব কারণেই রাসূলে করীম (স)-এর পক্ষে এ ধরনের কথা বলার প্রয়োজন দেখা দিয়াছিল এবং ইহা যে শ্বাশত- দাম্পত্য রহস্যের গভীরতর তত্ত্ব এবং এই রূপ বলা যে অন্য কোন সমাজ-দার্শনিক বা সমাজ-সংস্কারকের পক্ষে সম্ভবপর হয় নাই, তাহা বলাই বাহুল্য।

কিন্তু ইহার অর্থ এই নয় যে, বিধবা বা তালাক প্রাপ্তা মেয়েদের বিবাহই হইবে না। না, তাহাদের বিবাহ অবশ্যই হইবে এবং তাহা অনুরূপ কোন পুরুষের সঙ্গে সহজেই হইতে পারে।

হাদীসটির শেষ ভাগে বিদেশাগত স্বামীর গৃহ প্রবেশ সম্পর্কে হেদায়াত দেওয়া হইয়াছে। সে হেদায়াত এই যে, বিদেশগামীর গৃহে প্রত্যাবর্তনের সংবাদ দেওয়ার পর ঘরের স্ত্রীদের কিছুটা অবকাশ দেওয়া বাঞ্ছনীয়; যেন তাহাদের স্বামীকে সাদরে বরণ করিয়া লইবার জন্য মানসিক ও বাহ্যিকে উভয় দিকদিয়া প্রস্তুতি গ্রহণ করিতে পারে।

এই পর্যায়ে রাসূলে করীম (স) যাহা বলিয়াছেন, তাহার সারমর্ম এই যে, স্বামী বিদেশে চলিয়া গেলেও বেশী দিন বিদেশে থাকিলে গৃহ বধুরা এই সময় নিজেদের দেহ ও সাজ-সজ্জার ব্যাপারে স্বভাবতই উদাসীন হইয়া পড়ে। কেননা স্ত্রীদের সাজ-সজ্জা প্রধানত স্বামীদের সুখী করার জন্য। সেই স্বামীরাই যখন বাড়ীতে অনুপস্থিত, তখন হয়ত তাহারা গৃহের কাজকর্মে বেশী মনোযোগী হইয়া থাকে। হয়ত এই সময় তাহারা পরিচ্ছন্ন কাপড়ড় পড়ে না। মাথার চুলও আচড়ায় না। এই কারণে স্বামীর বাড়ীতে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকার পর ফিরিয়া আসিয়া হঠাৎ করিয়া গৃহে প্রবেশ করা উচিত নয়। প্রত্যাবর্তনের খবর আগাম পৌছাইয়অ দেওয়র পরও কিছুটা সময় তাহাদের প্রস্তুতির জন্য দেওয়া বাঞ্ছনীয়।

হাদীসে বলা হইয়াছে, যেন স্ত্রীরা মাথার বিসৃস্ত চুল আচড়াইয়া লইতে পারে ও নাভির নিম্নদেশে পরিস্কার ও লোমশূণ্য করিয়া লইতে পারে। ইহা যেমন স্বামীদের জন্য জরুরী, তেমনি জরুরী স্ত্রীদের জন্যও। এই কথা দ্বারা প্রকারান্তরে একথাই বলিয়া দেওয়া হইয়াছে যে, দীর্ঘদিন পর স্বামী যখন গৃহে ফিরিয়া আসে, তখন তাহাকে সাদর সম্বর্ধনা করা ও তাহার জন্য গৃহে ও নিজে দেহে পরিচ্ছন্নতার অভিযান চালানো স্ত্রীর কর্তব্যভুক্ত। এইরূপ হইলে দাম্পত্য জীবনের সুখ ও সম্প্রীতি এতই গভীর হইবে, যাহা অন্যভাবে হইতে পারে না।

(******************)

নিস্ফল স্ত্রী সঙ্গম
****************************************

হযরত উসামা ইবনে জায়দ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, একটি লোক রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিল ও বলিলঃ আমি আমার স্ত্রীর সহিত ‘নিস্ফল সঙ্গম’ করিয়া থাকি। রাসূলে করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তুমি এই রূপ কর কেন? লোকটি বলিলঃ আমি আমার স্ত্রীর সন্তান- কিংবা সন্তানগুলির- জন্য ভয় পাইতেছি। ইহা শুনিয়া নবী করিম (স) বলিলেনঃ ইহ যদি ক্ষতিকর হইত তাহা হইলে পারস্যবাসী ও রোমবাসীসেরও ক্ষতি করিত।

(মুসনাদে আহমাদ, মুসলিম)

ব্যাখ্যাঃ যে বিষয়টি লইয়া এই হাদীস, তাহা হইল ******* [***** শব্দের ইংরেজী করা হইয়াছেঃ Coitusinterruptus; স্বেচ্ছাপূর্বক রতিক্রিয়ায় ক্ষান্তি।] ‘স্ত্রী সঙ্গম করার শেষ প্রান্তে শুক্র নিষ্ক্রমণের পূর্বেই পুংলিঙ্গ বাহির টানিয়া লওয়া। তদানীন্তন আরব জাহানে এই কাজ করার প্রচলন ছিল। বহু সাহাবীও ইহা করিতেন। ইহা করা হইত শুধু এই ভয়ে যে, শুক্র স্ত্রী অঙ্গের ভিতরে নিস্কৃতি হইলে উহা জরায়ুতে গমন করিয়া গর্ভের সঞ্চার হইতে পারে। সন্তান যাহাতে না হইতে পারে, তাহাই হইল এই কাজের মূল প্রেরণা। কিন্তু সন্তান না হইবে কেন? ইহার জওয়াবে বলা যায়, ইহার নানাবিধ কারণ ছিল। কোন স্ত্রীর হয়ত খুব ঘন ঘন সন্তান হওয়ার কারণে স্বাস্থ্য নষ্ট হইয়া গিয়াছে। স্বামীর ইচ্ছা, বেশী সময় ফাঁক দিয়া সন্তান হউক। তাই এক সন্তানের জন্মের পর হয়ত ইহা করিতে শুরু করিল। কোন কোন স্বামী মনে করিত, একদুদ্ধ পোষ্য সন্তানের অবস্থিতিতে আবার গর্ভের সঞ্চার হইলে এই সন্তানের স্বাস্থ্য নষ্ট হইয়া যাইতে পারে যেমন আলোচ্য হাদীসে বলা হইয়াছে, সন্তানের ক্ষতি হওয়ার আশংকায় পিতা এইরূপ করিত। তদানীন্তন আরব সমাজে ক্রীতদাসীর সহিত সঙ্গম করার ব্যাপক রেওয়াজ ছিল। অনেকে ক্রীতদাসীর সহিত এইরূপ করিত এই ভয়ে যে, গর্ভে সন্তান জন্মিলে সে ‘উম্মে ওলাদ’ ‘সন্তানের মা’ হইয়া যাইবে। আর সন্তানের মাকে বিক্রয় করা যাইবে না। দাস-প্রথা ভিত্তিক তদানীন্তন অর্থনীতির বিচারে ইহা একটা বিশেষ ক্ষতির কারণ হইয়া দাঁড়াইত। হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) বর্ণিত ও বুখারূ মসিলম উদ্ধৃত হাদীসে এই কথাই বলা হইয়াছে।

কারণ যাহাই হউক, **** অর্থাৎ যৌন মিলনের শেষভাগে শুক্রকীট স্ত্রী অঙ্গের অভ্যন্তরে যাহাতে প্রবিষ্ট হইতে না পারে তদুদ্দেশ্যে উহা নিষ্ক্রমনের পূর্বেই পুরুষাঙ্গ বাহিরে টানিয়া লওয়া। ইহা এক প্রকারের জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া। আধুনিক বিজ্ঞান এই উদ্দেশ্যে অনেক যন্ত্র, উপায় প্রক্রিয়া ও অনেক ঔষধ ইত্যাদিত আবিস্কার করিয়াছে। একালে এই সবের দ্বারা যাহা করিতে চাওয়া হয়, তাহা মোটামুটি তাহাই। যাহা প্রাচীন কালের লোকেরা এই (*****) প্রক্রিয়ার সাহায্যে করিত। আর তাহা হইল স্ত্রীগর্ভে সন্তানের সঞ্চার না হওয়া। এই কারণে মূল হাদীসের ***** শব্দের অনুবাদ করিয়াছে নিস্ফল যৌন সঙ্গম- যে সঙ্গমে সন্তান হয় না। কিন্তু প্রশ্ন হইল, ইহা করা ইসলামী শরীয়াতের দৃষ্টিতে জায়েয কি না?

ইসলামী শরীয়াতে ইহা জায়েয কিনা, সে বিষয়ে কুরআন মজীদ হইতে কোন স্পষ্ট কথা জানা যায় নাই। তবে এই পর্যায়ের হাদীসে বুহ কথাই উদ্ধৃত হইয়াছে। এই পর্যায়ে রাসূলে করীম (স)-এর বহু কথা ও উক্তি সাহাবীগণ কর্তৃক উদ্ধৃত হইয়াছে। আমরা প্রথমে রাসূলে করীম (স)-এর সেই উক্তি সময়হ যতটা আমার পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব হইয়াছে- এক সঙ্গে পর পর সাজাইয়া পেশ করিব। অতঃপর উহার আইনগত দিক (ফিকাহ) সম্পর্কে বক্তব্য রাখিব।

হযরত জাবির (রা) বলিয়াছেনঃ

****************************************

আমরা রাসূলে করীম (স)-এর জীবদ্দশায় ‘আজল’ করিতেছিলাম। আর কুরআনও নাযিল হইতেছিল। (বুখারী, মুসলিম)

তাঁহার আর একটি উক্তি হইলঃ

****************************************

আমরা রাসূলে করীম (স)এর সময়ে ‘আজল’ করিতেছিলাম এই খবর তাঁহার নিকট পৌঁছিয়াছিলাম। কিন্তু তিনি আমাদিগকে তাহা করিতে নিষেধ করেন নাই। (মুসলিম)

হযরত জাবিরের অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছে, একটি লোক নবী করীম (স)-কে বলিলেন, ‘আমার একটি দাসী আছে। সে আমাদের সেবার কাজ করে এবং খেজুর ফসল কাটার কাজে সাহায্য করে। আর আমি তাহার সহিত সঙ্গমও করি। কিন্তু তাহার গর্ভ হউক আমি পছন্দ করি না। ইহা শুনিয়া নবী করীম (স) বলিলেনঃ

****************************************

তুমি তাহার সহিত ‘আজল’ কর- যদি তুমি চাও। তবে জানিয়া রাখ, তাহার জন্য যে সন্তান নির্দিষ্ট করা হইয়াছে, তাহা তাহার হইবেই।

(মুসনাদে আহমাদ, মুসলিম, আবূ দায়ূদ)

হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) বলিয়াছেনঃ আমরা রাসূলে করীম (স)-এর সহিত বনুল-মুস্তালিকের যুদ্ধে বাহরি হইয়া গেলাম। সেখানে আমরা কিছু সংখ্যক স্ত্রী বন্দী লাভ করিলাম। আমরা দীর্ঘ দিন পর্যন্ত স্ত্রী হইতে বিচ্ছিন্ন বলিয়া স্ত্রী সঙ্গমের ইচ্ছা আমাদের মধ্যে প্রবল হইয়া দেখা দিল। কিন্তু ইহাতে আমরা ‘আজল’ করা সমীচীন মনে করিলাম। এই বিষয়ে আমরা তাঁহার নিকট জিজ্ঞাসা করিলাম। জওয়াবে তিনি আমাদিগকে বলিলেনঃ

****************************************

আল্লাহ তা’আলা কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ সৃষ্টি করিবেন তাহাতো তিনি লিখিয়াই রাখিয়াছেন, কাজেই তোমরা যদি ইহা (*****) না কর, তাহা হইলে তোমাদের কি অসুবিধা হইবে?

(বুখারী, মুসলিম)

হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী হইতে আরও বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ

ইয়াহুদীরা বলে, ‘আজল’ ছোট আকারের নরহত্যা। ইহা শুনিয়া নবী করীম (স) বলিলেনঃ

****************************************

ইয়াহুদীরা মিথ্যা বলিয়াছে। মহান আল্লাহ যদি কোন কিছু সৃষ্টি করিতেই চাহেন তাহা হইলে উহার প্রতিরোধ করার-সাধ্য কাহারও নাই। (মুসনাদে আহমাদ, আবূ দায়ুদ)

আবূ সায়ীদ খুদরী অপর এক হাদীসে বর্ণনা করিয়াছেনঃ

****************************************

রাসূলে করীম (স) ‘আজল’ সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ ‘তুমি কি মানুষ সৃষ্টি কর? তুমি কি সন্তানকে রিযিক দাও?… উহাকে (গর্ভে) যথাস্থানেই অক্ষত রাখ ও থাকিতে দাও। মূলত ইহা তকদীর- আল্লাহর নির্ধারিত প্রকল্প ছাড়া আর কিছুই নয়।

জুযামা বিনতে ওহাব আল-আসাদীয়া বলিয়াছেনঃ আমি কিছু সংখ্যক লোক সমভিব্যাহারে রাসূলে করীম(স)-এর নিকট উপস্থিত হইলাম। সেখানে লোকেরা তাঁহার নিকট আজল’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলেন। জওয়াবে তিনি বলিয়াছেনঃ

****************************************

উহা গোপন নরহত্যা। আর ইহার কথাই বলা হইয়াখে কুরআনের এই আয়াতে (যাহা অর্থ): বিনাদোষে নিহত সন্তানকে যখন জিজ্ঞাসা করা হইবে। (মুসনাদে আহমাদ, মুসলিম)

হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলিয়াছেনঃ

****************************************

রাসূলে করীম (স) স্বাধীনা (ক্রীতদাসী নয় এমন) স্ত্রীর অনুমতি ব্যতিরেকে তাহার সহিত ‘আজল’ করিতে নিষেধ করিয়াছেন।

‘আজল’ (*****) সম্পর্কে উদ্ধৃত বহু সংখ্যক হাদীসের মধ্য হইতে বেশ কয়েকটি হাদীস উপরে উদ্ধৃত করা হইল। এই হাদীসটির প্রমাণ্যতা সম্পর্কে বলা যায়, হযরত আবূ সায়ীদ (রা) বর্ণিত হাদীসটি তিরমিযী ও নাসায়ী গ্রন্হেও উদ্ধৃত হইয়াছে। আল্লামা ইবনে হাজার আল-আসকালানী বলিয়াছেন, ইহার বর্ণনাকারীগণ সিকাহ-বিশ্বাস্য। আর মাজমাউজ্জাওয়ায়িদ গ্রন্হেও ইহা উদ্ধৃত হইয়াছে। বাজ্জার ইহা উদ্ধৃত করিয়া বলিয়াছেন, ইহার একজন বর্ণনাকারী মূসা ইবনে অরদান। তিনি সিকাহ। কিন্তু কেহ কেহ তাঁহাকে যয়ীফ বলিয়াছেন। অবশিষ্ট বর্ণনাকারী সিকাহ। হযরত জাবির (রা) বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে ইমাম তাহাভী দুঢ়তার সহিত বলিয়াছেন, উহা মনসুখ- বাতিল হইয়া গিয়াছে। কিন্তু ইবনে হাজাম ইহার বিপরীত মত প্রকাশ করিয়াছেন। হযরত উমর (রা) বর্ণিত হাদীসের সনদে ইবনে লাহইয়া একজন বর্ণনাকারী। তাঁহার সম্পর্কে অনেক আপত্তি জানানো হইয়াছে, যাহা সর্বজনবিধিত। আবদুর রাজ্জাক ও বায়হাকী হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হইতে এই বর্ণনাটি এ ভাষায় উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

****************************************

স্বাধীনা স্ত্রীর সহিত তাহার অনুমতি ছাড়া ‘আজল’ করিতে নিষেধ করিয়াছেন।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) নিজে তাঁহার ক্রীতদাসীর সহিত ‘আজল’ করিতেন বলিয়া ইবনে আবূ শাইবা বর্ণনা করিয়াছেন। বায়হাকীও এইরূপ কথা বর্ণনা করিয়াছেন হযরত ইবনে আব্বাস সম্পর্কে।

এই পর্যায়ে হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ

****************************************

এক ব্যক্তি রাসূলে করীম(স)-এর নিকট ‘আজল’ করা সম্পর্কে জিজ্ঞসা করিলেন। নবী করীম (স) বলিলেনঃ যে শুক্র হইতে সন্তান হইবে উহা যদি তুমি প্রস্তর খন্ডের উপরও নিক্ষেপ কর, তাহা হইলেও আল্লাহ তা’আলা উহা হইতে একটা সন্তান বাহির করিয়া আনিবেন।

(মুসনাদে আহমাদ, বাজ্জার, ইবনে হাব্বান)

হযরত জাবির (রা)-এর কথাঃ “আমরা ‘আজল’ করিতে ছিলাম, তখন কুরআন নায়িল হইতেছিল” বাক্যটি হইতে বুঝাইতে চাওয়া হইয়াছে যে, এই কাজ নিষিদ্ধ বা হারাম নয়। যদি তাহা হারাম হইত, তাহা হইলে হয় রাসূলে করীম (স) নিজে না হয় স্বয়ং আল্লাহর ওহীর মাধ্যমে ইহা নিষেধ করিয়া দিতেন। কিন্তু তাহা করা হয় নাই। তবে উপরোদ্ধৃত হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী রাসূলে করীম (স)-এর নিষেধ না করার কথায় একটা ফাঁক রহিয়া গিয়াছে। তাহা এই যে, যে সময়ে হযরত জাবির (রা) উক্ত উক্তিটি করিয়াছেন, সেই সময় পর্যন্ত রাসূলে করীম (স) ‘আজল’ করিতে নিষেধ করেন নাই, একথা সত্য। কিন্তু তাহার পর নিষেধ করেন নাই, এমন কথা তো উহাতে বলা হয় নাই। আর সেই সময় পর্যন্ত নিষেধ না করার তো অনেক কারণই থাকিতে পারে। হযত তখন পর্যন্ততিনি উহার ব্যাপকতা ও তীব্রতা অনুভব করেন নাই। হইতে পারে, তখন পর্যন্ত তিনি এই বিষয়ে আল্লাহর নিকট হইতে কোন জ্ঞান- কোন পথনির্দেশ পান নাই বলিয়াই নিষেধ করেন নাই। হযরত জাবির (রা) এই সব দিক ইংগিত করিয়া কথাটি বলেন নাই এবং তাঁহার বর্ণিত কথাটুকু হইতেও এই প্রশ্নের কোন উত্তর পাওয়া যায় না। ইসলামী আইনের মূলনীতি নির্ধারকগণ এক বাক্যে বলিয়াছেন, কোন সাহাবী যখন রাসূলে করীম (স)-এর সময়ে কোন কাজ করা বা না- করার কথা উল্লেখ করেন, তখন বুঝিতে হইবে, ইহা ‘মরফু’ হাদীসের সমতুল্য। কেননা এইরূপ কথা হইতে বাহ্যতঃ ইহাই বুঝা যায় যে, বনী করীম (স) উহা জানিতেন এবং তিনি উহার প্রতিবাদ করিয়াছেন কিংবা করেন নাই। বিশেষত এই কারণেও যে, সাহাবীগণ বারে বারে নানা বিষয়ে শরীয়াতের হুকুম জানিবার জন্য রাসূল (স)-এর নিকট সওয়াল করিতেন, ইহা তো জানা কথা-ই। শুধু তাহাই নয়, বহু কয়টি বর্ণনা হইতে স্পষ্ট জানা যায় যে, নবী করীম (স) সাহাবীদের এই ‘আজল’ সম্পর্কে পুরাপুরি অবহিত ছিলেন। হযরত জাবির (রা) বর্ণিত হাদীসঃ

****************************************

আমরা রাসূলে করীম(স)-এর জীবদ্দশায় আজল করিতাম ইহার সংবাদ নবী করীম (স)-এর নিকট পৌঁছিল, কিন্তু তিনি আমাদিগকে নিষেধ করেন নাই।

(মুসলিম)

হযরত জাবির বর্ণিত অপর একটি হাদীসে বলা হইয়াছে, নবী করীম (স) জৈনিক সাহাবীকে ‘আজল’ করার অনুমতি দিয়া বলিয়াছেনঃ

****************************************

তুমি ইচ্ছা করিলে ক্রীতদাসীর সহিত ‘আজল’ করিতে পার।

কিন্তু ইহা সম্পূর্ণ কথা নয়, হাদীসটি এই কথাটুকু দ্বারাই শেষ করা হয় নাই। বরং ইহার পরই এই কথা রহিয়াছেঃ

****************************************

তবে মনে রাখিও, উহার জন্য যে কয়টি সন্তান নির্দিষ্ট করা হইয়াছে, তাহা তাহার অবশ্যই হইবে।

এই সম্পূর্ণ কথা হইতে স্পষ্ট বুঝা গেল যে, নবী করীম(স) সন্তান হওয়া বন্ধ করার পর্যায়ে ‘আজল’ করাকে সম্পূর্ণ নিস্ফল ও অর্থহীন মনে করিতেন। আর এই জন্য যদি তিনি ‘আজল’ করিতে নিষেধ না-ও করিয়া থাকেন, তাহাতে কিছুই যায় আসে না।

‘আজলৱ করার অনুমতি দান সংক্রান্ত উপরোক্ত হাদীসের শেষ কথা হইল উক্ত সাহাবীই কিছু দিন পর দরবারে উপস্থিত হইয়া বলিলেন, আমি যে দাসীটির সহিত ‘আজল’ করার অনুমতি চাহিয়াছিলাম, সে গর্ভবতী হইয়াছে। ইহা শুনিয়া নবী করীম (স) বলিলেনঃ ********* আমি তো তোমাকে সেকথা পূর্বেই বলিয়াছিলাম। বস্তুত বাস্তবতার দৃষ্টিতেও প্রমাণিত হইল যে, ‘আজল’ সন্তান হওয়া বন্ধ করিতে পারে না।

‘আজলৱ সম্পর্কিত হাদীসে এখানেই শেষ হইয়া যায় নাই এই পর্যায়ের আরও হাদীস রহিয়াছে। [আধুনিক যৌন বিজ্ঞানেও বলা হইয়াছে যে, সমস্ত শুক্রকীট হইতে সন্তান হয় না এবং একটি শুক্রকীট কোনভাবে গর্ভধারে পৌঁছিতে পারিলেই তাহাতেই গর্ভ হইতে পারে এবং টেস্ট টিউবের সন্তান এই কথার সত্যতা প্রমাণ করে।]

একটি হাদীসে রাসূলে করীম (স) ‘আজল’ সম্পর্কিত প্রশ্নের জওয়াবে বলিয়াছেনঃ

****************************************

তোমরা যদি ইহা না কর তাহা হইলে তোমাদের কি অসুবিধা হয়?

বুখারী শরীফে এই বাক্যটির ভাষা হইলঃ

****************************************

‘না, এই কাজ না করাই তো তোমাদের কর্তব্য।

ইবনে শিরীন বলিয়াছেনঃ *************** ‘রাসূলের উক্ত কথাটি প্রায় নিষেধ পর্যায়ের’।

আর হাসান বসরী বলিয়াছেনঃ

****************************************

আল্লাহর শপথ, ‘আজল’ কাজের ব্যাপারে ইহা রাসূলে করীম (স)-এর তীব্র হুশিয়ারী- হুমকি ও ধমক মাত্র। অর্থাৎ কঠোর ভাষায় নিষেধ।

আল্লামা কুরতুবী বলিয়াছেন, এই মনীষীগণ হাদীসের ****- না কথাটি হইতে স্পষ্ট নিষেধই বুঝিয়াছেন। সাহাবীগণ যে বিষয়ে প্রশ্ন করিয়াছিলেন, তাহার উত্তরে **- না বলার অর্থ হইল, সেই কাজটি জায়েয নয়। তিনি সে কাজ করিতে সাহাবীগণকে নিষেধ করিয়াছেন। অর্থাৎ তিনি যেন বলিয়াছেনঃ

****************************************

তোমরা ‘আজল’ করিও না। ‘আজল’ না করাই তোমাদের কর্তব্য।

এই শেষের বাক্যাংশ প্রথম কথার না-র তাকীদ হিসবেই বলা হইয়াছে। কেহ কেহ বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স)-এর উক্ত কথাটির অর্থঃ

****************************************

এই কাজ যদি তোমরা না কর। তাহা হইলে তোমাদের কোন ক্ষতি বা অসুবিধা হইবে না।

কেননা সন্তান না হওয়ার উদ্দেশ্যে ‘আজল’ করিলে তাহাতে কোন ফায়দাই পাওয়া যাইবে না। যেহেতু সন্তান হওয়া ‘আজল’ দ্বারা বন্ধ করা সম্ভব নহে।

তিরমিযী শরীফে এই পর্যায়ে আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) হইতে যে হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহাতে বলা হইয়াছেঃ একদা রাসূলে করীম (স)-এর দরবারে আজল সম্পর্কে কথা উঠিলে নবী করীম (স) বলিলেনঃ

****************************************

তোমাদের কোন লোক এই কাজ করিবে কেন! কেননা সৃষ্টি হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সব প্রাণী বা মানব সত্তাকেই আল্লাহ তা’আলাই সৃষ্টি করিবেন।

ইবনে আবূ উমর এই হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) ‘আজল’ প্রসঙ্গে *** ****** তোমাদের কেহ এই কাজ করিবে না, বলেন নাই। ইহার অর্থ, উক্ত হাদীসটিতে ‘আজল’ করাকে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেন নাই। হ্যাঁ, নিষেধ করেন নাই, এ কথা ঠিক। কিন্তু উহার অনুমতিও দেন নাই।

উক্ত হাদীসটি বলার সময় পর্যন্ত তিনি ‘আজল’ করিতে স্পষ্টভাষায় নিষেধ করেন নাই বটে; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও এই কাজ যে তিনি সম্পূর্ণ অপছন্দ করিয়াছেন- কিছুমাত্র ভালো মনে করেন নাই তাহাতেও সন্দেহ নাই। বরং প্রথম দিকের কথা সমূহ থেকে মনে হয়, তিনি মনে করিবেন যে, এই কাজটি সম্পূর্ণ অথীহীন, নিষ্ফল। উহা করিয়া নারীর গর্ভে সন্তাতেনর অস্তিত্ব গড়িয়া উঠাকে কোন ক্রমেই বন্ধ করা যাইবে না। তাহাতে তাঁহার একবিন্দু সন্দেহ ছিল না। ইহা নিতান্ত অর্থহীন ও নিস্ফল কাজ।

ইবনে হাব্বান আহমাদ ও বাজ্জার হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণনা উদ্ধৃত করিয়াছেন, একব্যক্তি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট ‘আজল’ সম্পর্কে প্রশ্ন করিলেন। জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ যে শুক্রে সন্তান হইবে, তাহা প্রস্তর খন্ডের উপর নিক্ষেপ করিলেও তাহা হইতে আল্লাহ অবশ্যই সন্তান সৃষ্টি করিবেন।

তাবারানী ইবনে আব্বাস (রা) হইতে এবং ‘আল-আওসাত’ ইবনে মাসউদ (রা) হইতে উপরোক্ত কথার সমর্থক হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন। এই সব হাদীস হইতে নিঃসন্দেহে ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, গর্ভ নিরোধ কাজে ‘আজল’ সম্পূর্ণ ব্যর্থ ও নিস্ফল। উহা জন্মনিয়ন্ত্রণের কোন প্রক্রিয়া হিসাবে সেকালেও কার্যকর ছিল না, একালেও হইতে পারে না। বরং উহা করিয়া নিজেকেও নিজের স্ত্রীকে যৌন সঙ্গমের চূড়ান্ত স্বাদ গ্রহণের অধিকার হইতে নিতান্তই অকারণ বঞ্চিত করা হয়। এই ‘আজল’কে জায়েয প্রমাণ করিয়া যাহারা একালের জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে বৈধ বা শরীয়াত সম্মত প্রমাণ করিতে বৃথা চেষ্টা করিতেছে, তাহারা অমানু, মিথ্যাবাদী ও সুস্পষ্ট ধোঁকাবাজ ছাড়া আর কিছুই নয়।

রাসূলে করীম (স)-এর কথা, ‘আজল’ না করিলে তোমাদের কোন ক্ষতি নাই, ইহার সহজ অর্থ, আজল’ করিলে নিশ্চয়ই ক্ষতি আছে। বুঝা গেল, ‘আজল’ করিলে ক্ষতি হওয়া সুনিশ্চিত। কেননা এই কাজ করিলে কোন ক্ষতি নাই বলিবার ইচ্ছা থাকিলে তিনি বলিতেনঃ

****************************************

না তোমাদের কর্তব্য এই যে, তোমরা ইহা কর। অথবা (ইহার অর্থ) ইহা করিলে তোমাদের কোন ক্ষতির আশংকা নাই।

কিন্তু নবী করীম (স) কথাটি এভাবে ও এভাষায় বলেন নাই। অতএব হাদীস সমূহের এই বিশ্লেষণ হইতে বুঝা গেল, নবী করীম (স) এই কাজ সমর্থন করেন নাই।

ইবনে আবদুল বার বলিয়াছেন, শরীয়াত বিশেষজ্ঞগণ এ বিষয়ে সম্পূর্ণ একতম যে, স্বাধীনা স্ত্রীর সহিত এইরূপ করা তাহার অনুমতি ব্যতীত জায়েয নয়। কেননা স্বামীর সহিত সঙ্গম কাজের চূড়ান্ত তৃপ্তি লাভ তাহার অধিকার। এই অধিকার যথাযথ না পাইলে সে ইহার দাবি জানাইতে পারে। কিন্তু সঙ্গম বলিতে যাহা বুঝায় ‘আজল’ করা হইলে তাহা হয় না। ইবনে হুরাইরা বলিয়াছেন, এ ব্যাপারে ইজমা অনুষ্ঠিত হইয়াছে। শাফেয়ী মাযহাবের মতের একটা উদ্ধৃতি ভিন্নতর হইলেও উহার সুস্পষ্ট ঘোষণা হইল, স্বাধীনা স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া এই কাজ করা আদৌ জায়েয নয়। কোন ক্রীতদাসী যদি বিবাহিতা স্ত্রী হয় তাহা হইলে তাহার ব্যাপারেও একই কথা।

যে হাদীসটিতে বলা হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, ইয়াহুদীরা মিথ্যা বলিতেন, ইহা হইতে কেহকে **** জায়েয প্রমাণ করিতে চাহিয়াছে। তিরমিযী গ্রন্হেও এই হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে।

তাহাতে রাসূল (স)-এর কথাটির ভাষা এইঃ

****************************************

ইয়াহুদীরা মিথ্যা বলিয়াছে। আল্লাহ যদি সৃষ্টিই করিতে চাহেন, তাহা হইলে তাহা রদ করার ক্ষমতা কাহারও নাই।

ইহা হইতে বুঝা যায়, নবী করীম (স) ‘আজল’ কাজটিকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, নিস্ফল ও অর্থহীন মনে করিয়াছেন। ‘আজল’ করিলে সন্তান হয় না বলিয়া যাহারা মনে করে, তাহারা মিথ্যাবাদী। উহা করা হইলে কাহাকেও হত্যাও করা হয়না। কিন্তু উহা করা হইলেও আল্লাহর সৃষ্টি-ইচ্ছা কক্ষণই প্রতিহত হইবে না। আজলও করা হইবে। গর্ভেরও সঞ্চার হইবে, সন্তানও জন্মগ্রণ করিবে। তাহা কেহ বন্ধ করিতে পারিবে না্

কিন্তু এই কথাটিরও প্রতিবাদ হইয়াছে হযরত জুযামা বর্ণিত হাদীসে। তাহাতে নবী করীম (স) নিজে বলিয়াছেনঃ ******** ‘কাজটি গোপন নরহত্যা বিশেষ’। দেখা যায়, নবী করীম (স)-এর উক্তিকে কোথাও অনুমতি আছে কোথাও না করিলে দোষ নাই’ আছে। কোথাও তুমি কি সৃষ্টি কর- তুমিকি রিযিক দাও? বলিয়া ধমক আছে। আর কোথাও উহাকে স্পষ্টভাষায় গোপন নরহত্যা বলিয়া অভহিত করিয়াছেন। আর নরহত্যা- তাহা যে ভাবেই হউক- সম্পূর্ণ হারমা, উহা তো কুরআনের স্পষ্প অকাট্য ঘোষণা।

এই বিভিন্ন কথার মধ্যে কেহ কেহ সামঞ্জস্য ও সংগতি বা সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে বলিয়াছেন, ‘আজল’ করা মাকরূহ তানজীহ। বায়হাকী এই মত গ্রহণ করিয়াছেন। কেহ কেহ জুযামা’র এই হাদীসটিকে যয়ীফ ব লিতে চাহিয়াছেন শুধু এই কারনে যে, ইহা অধিক সংখ্যক বর্ণনার বিপরীত কথা। কিন্তু এই ভাবে নিতান্ত অমূলক ধারণার ভিত্তিতে সহীহ হাদীসকে রদ ও প্রত্যাখ্যান করার নীতি হাদীস শাস্ত্রবিশারদের নিকট আদৌ সমর্থণীয় নয়। জুযামা বর্ণিত হাদীসটি যে সম্পুর্ণ সহীহ তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। ইবনে হাজার আল-আসকালানী এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। আর যাহারা ইহাকে মনসূখ বা বাতিল বলিয়াছেন, তাহারা হাদীসের তারীখ জানেন না। অতএব তাঁহাদের এই রূপ উক্তি গ্রহণীয় নয়। জুযামা বর্ণিত হাদীসটিকে অনেক বিশেষজ্ঞই অগ্রাধিকার দিয়াছেন কেননা উহা সহীহ হাদীস। উহার বিপরীত কথা প্রমাণিত হয় যে সব হাদীস হইতে, সনদের দিক দিয়া তাহাতেই বরং কোন না কোন ক্রটি রহিয়াছে।

আল্লামা ইবনে হাজাম এই বিভিন্ন ধরনের হাদীসের মধ্যে সমন্বয় বিধানের জন্য বলিয়াছেনঃ জুযামা বর্ণিত হাদীসটি অনুযায়ী আমল করিতে হইবে। কেননা উহার বিপরীত কথার হাদীস সমূহ হইতে বড়জোর এতটুকু জানা যায় যে, উহা মূলত মুবাহ। ইহা প্রথম দিকের কথা। কিন্তু জুযামা বর্ণিত হাদীস আসিয়া উহাদে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করিয়া দিয়াছে। এখন যদি কেহ দাবি করে যে, প্রথমে নিষেধ করা হইয়াছিল, পরে অনুমতি দেওয়া হইয়াছে তবে এই কথা প্রমাণের জন্য তাহার উচিত অকাট্য দলীল পেশ করা। কিন্তু তাহা কেহ করিতে পারে না।

কেহ কেহ বলিয়াছেন, নবী করীম (স) ‘আজল’ করাকে ******** ‘গোপন হত্যা’ বলিয়াছেন। ইহা একটা দৃষ্টান্ত মুলক কথা। ইহাতে প্রমাণিত হয় না যে, ইহা করা সম্পূর্ণ হারাম। কিন্তু ইহা যে শরীয়াতের মূল লক্ষ্যকে ভূলিয়া যাওয়অর পরিণতি, তাহা সকলেই বুঝিতে পারেন।

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম এই পর্যায়ে বলিয়াছেনঃ নবী করীম (স) ইয়াহুদীদিগকে মিথ্যাবাদী বলিয়াছেন এই কথায় যে, তাহাদের ধারণা ছিল ‘আজল’ করিলে গর্ভের সঞ্চার হয় না। ইহা বস্তুতই মিথ্যা কথা। কেননা ইহা করিলেও গর্ভ হওয়া সম্ভব। একথা স্বয়ং নবী করীম (স) অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় বলিয়াছেন। তাঁহার কথার তাৎপর্য হইল, ইয়াহুদীরা যে মনে করিয়াছে, ‘আজল’ করিলে সন্তান জন্মিবে না ইহা সম্পূর্ণ অসত্য। আল্লাহ ইচ্ছা করিলে এতদসত্বেও সন্তান গর্ভে আসিবে ও জন্ম হইবে। আর তিনি যদি সৃষ্টি করিতে ইচ্ছা না করেন, তাহা হইলে উহা করা গোপন হত্যা হইবে না।

হযরত জুযামা’র হাদীসে ‘আজল’কে গোপন হত্যা বলা হইয়াছে এই কারণে যে, স্বামী ‘আজল’ করে গর্ভ সঞ্চার হওয়ার ভয়ে, এই কথা মনে করিয়া যে, ইহা করা হইলে সন্তান জন্মিবে না। স্বামী-স্ত্রী সঙ্গম হইবে যথারীতি এবং যৌন স্বাদ উভয়েরই আস্বাদন হইবে (যদিও চূড়ান্ত স্বাদ গ্রহণ হইবে না) অথচ সন্তান হইবে না। ইহার চাইতে সুখের বিষয় আর কি আছে! আর এই মানসিকতাই সন্তান হত্যার নামান্তর মাত্র। তবে পার্থক্য এই যে, প্রকাশ্য নর হত্যার পিছনে থাকে ইচ্ছা সংকল্প ও বাস্তব পদক্ষেপ। আর ‘আজল’-এ থাকে শুধু ইচ্ছা সংকল্প ও সামান্য কাজ। ইহার ফলে অতি গোপন পন্হায় সন্তান হওয়ার পথ বন্ধ করাই তাহর লক্ষ্য। এই লক্ষ্যের কারণেই উহাকে হাদীসে ‘গোপন হত্যা’ (***********) বলা হইয়াছে। বস্তুত হাদীস সমূহের এইরূপ সমন্বয় অত্যান্ত যুক্তিযুক্ত।

মুহাদ্দিস ইবনে হাব্বান হযরত জুযামার বর্ণিত এই হাদীসটির ভিত্তিতে ‘আজল’ করিতে নিষেধ করিয়াছেন। আর ইহার ফলে যে স্বামী-স্ত্রী সঙ্গমের চূড়ান্ত তৃপ্তি লাভ হয় না এবং ইহা আল্লারহ নিয়ামত ইহতে এক প্রকারের বঞ্চনা, উপরন্তু ইহা আত্মবঞ্চনা যেমন, স্ত্রীকেও বঞ্চিত করা হয় তেমনই, ইহাতেও কোনই সন্দেহ নাই।

(**************)

উদ্ধৃত হাদীস সমূহ লক্ষ্য করিলে দেখা যাইবে ‘আজল’ করার অনুমতি সংক্রান্ত হাদীস কেবলমাত্র একজন সাহাবী হইতে বর্ণিত। তিনি হইতেছেন হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা)। আর এই কাজের নিষেধ স্পষ্ট বা অস্পষ্ট বর্ণিত হইয়াছে নয়জন সাহাবী হইতে। এই কথা হইতেও বিষয়টি সম্পর্কে শরীয়াতের মূল লক্ষ্য প্রতিভাত হইয়া উঠে।

‘আজল’ সম্পর্কে ইমাম ইবনে হাজম বলিয়াছেন, ইহা সম্পূর্ণ হারাম। তিনি দলীল হিসাবে গ্রহণ করিয়াছেন ইমাম মুসলিম বর্ণিত নবী করীম (স)-এর উক্তি ******* ‘উহা গোপন হত্যা কাণ্ড বিশেষ’। তিনি আরও কতিপয় হাদীসের উল্লেখ করিয়াছেন, যাহার সনদ সূত্র নবী করীম(স) পর্যন্ত পৌঁছায় নাই, যাহা সাহাবীগণের উক্তিরূপে বর্ণিত। নাফে বর্ণনা করিয়াছেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) ‘আজল’ করিতেন না। তিনি বলিয়াছেনঃ

****************************************

আমার কোন সন্তান ‘আজল’ করে, জানিতে পারিলে আমি তাহাকে কঠিন শাস্তি দিব।

হাজ্জাজ ইবনুল মিনহাল হইতে বর্ণিত হযরত আলী (রা) ‘আজল’ করাকে মাকরূহ (মাকরূহ তাহরীমী) মনে করিতেন।

হযরত জাবির (রা) বর্ণিত হাদীসঃ ‘আমরা আজল করিতেছিলাম’ অথচ তখন কুরআন নায়িল হইতেছিল’ সম্পর্কে ইমাম ইবনে হাজম বলিয়াছেন, ইহা মনসুখ-বাতিল। [*******************] আর হানাফী মুহাদ্দিস ইমাম বদরুদ্দীন আইনী হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহর (রা) কথার জওয়াব দিয়াছেন এই বলিয়া, ‘আজল’এর ব্যাপারে সেই রকম অবস্থাই যেমন কবর আযাবের ক্ষেত্রে হইয়াছে। ইয়াহুদীরা বলিয়াছিলঃ *************** ‘মৃত ব্যক্তিকে কবরে আযাব দেওয়া হয়। তখন নবী করীম (স) তাহাদিগকে মিথ্যাবাদী বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন। কেননা এই সমিয় পর্যন্ত তিনি এই বিষয়ে আল্লাহর নিকট হইতে কিছুই জানিতে পারেন নাই। পরে আল্লাহই যখন তাঁহাকে জানাইয়া ছিলেন যে, কবরে আযাব হওয়ার কথা সত্য, তখন তিনি কবর আযাব হওয়ার কথার সত্যতা স্বীকার করিলেন এবং না জানিয়া বলার কারণে তিনি আল্লাহর নিকট পানাহ চাহিলেন। এখানেও সেই রকমই হইয়াছে। (অর্থাৎ তিনি না জানিতে পারা পর্যন্ত ‘আজল’ করিতে নিষেধ করেন নাই। পরে আল্লাহর নিকট হইতে জানিয়া উহা করিতে নিষেধ করিয়াছিলেন)। দ্বিতীয়, ইমাম তাহাভী যে হযরত জাবির বর্ণিত হাদীস দ্বারা হযরত জুযামা বর্ণিত হাদীস মনসুখ হইয়াছে বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন, এই কথা ঠিক হইতে পারে না। কেননা হযরত জুযামা ইসলাম কুবল করিয়াছেন দশন হিজরী সনে। কাজেই তাঁহার বর্ণিত হাদীস সর্বশেষের। অতএব তাঁহার হাদীসটিই মনসুখ করিয়াছে হযরত জাবির বর্ণিত হাদীসকে। অবশ্য কেহ কেহ এও বলিয়াছেন যে, তিনি অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পূর্বে ইসলাম কবুল করিয়াছেন। আবদুল হক বলিয়াছেন, ইহাই সহীহ কথা। (তবুও তাঁহার বর্ণিত হাদীস দ্বারা হযরত জাবির বর্ণিত হাদীসটির মনসুখ হইয়া যাওয়া ঠিকই থাকে) [************************] ইমাম ইবনুল কাইয়্যেমও লিখিয়াছেনঃ ‘আজল’ মুবাহ বা অ-নিষিদ্ধ হওয়ার কথাটি বর্ণনা হিসাবে সহীহ হইলেও উহা ‘আজল’ নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্বের বর্ণনা। পরে উহা হারাম ঘোষিত হইয়াছে। ফলে হযরত জাবির (রা) বর্ণিত হাদীস হইতে যাহা প্রমাণিত হইয়াছে তাহা নাকচ-রহিত- হইয়া গিয়াছে। [জাদুল মায়াদ, ৫ম খণ্ড, ‌১৪০-১৪৬ প্রঃ]

বুখারী শরীফের শারাহ লেখক প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ইবনে হাজার আল-আস কালানী ‘আজল’ সম্পর্কিত হাদীস সমূহের আলোচনায় লিখিয়াছেনঃ ‘ইবরাহীম ইবনে মুসা সুফিয়ান হইতে- হযরত জাবির (রা) হইতে যে হাদীসটির বর্ণনা করিয়অছেন, তাহাতে নিজ হইত এই কথাটুকু বাড়াইয়া বলিয়াছেনঃ ************** অর্থাৎ ‘আজল’ করা যদি হারাম হইত, তাহা এই বিষয়ে কুরআনের আয়াত নাযিল হইত।

ইমাম মুসলিম ইসহাক ইবনে রাহওয়াইর মুখে সুফিযান হইতে বর্ণিত হাদীসে এই কথাটি এভাবে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ

****************************************

‘আজল’ কাজে নিষেধের কিছু থাকিলে কুরআন আমাদিগকে তাহা করিতে অবশ্যই নিষেধ করিত।

ইহা হইতে স্পষ্ট হয় যে, সুফিয়ানের এই কথাটি মূল হাদীস হইত নির্গলিত তাৎপর্য হিসাবে বলা হইয়াছে। ইহা আরও প্রমাণ করে যে, তাহাদের ‘আজল’ করার কাজকে কুরআন অব্যাহত রাখিয়াছে। রাসূলে করী (স) এই কাজকে অস্বীকার বা বন্ধ করেন নাই। ইহার অর্থ হিসাবে বলা হইয়াছেঃ

****************************************

শরীয়াত রচিত হওয়ার সময়ে আমরা এই কাজ করিয়াছি। যদি ইহা হারাম হইত, তাহা হইলে শরীয়াত ইহা নিশ্চয়ই স্থায়ী থাকিতে দিত না।

কিন্তু হযরত জাবির (রা) এর এই কথা শরীয়াত রচনা কালের প্রাথমিক পর্যায়ের অথচ এই কালের মেয়াদ অন্ত দশটি বৎসর দীর্ঘ।

শাফেয়ী মাযহাবপন্হী ইমাম গাজালী ‘আজল’ জায়েয মনে করিয়াছেন। কিন্তু সেই শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী মুহাদ্দিস ইবনে হাব্বান বলিয়াছেনঃ

****************************************

হাদীসমূহ প্রমাণ করে যে, ‘আজল-এর এই কাজটি নিষিদ্ধ, এজন্য হুমকি ও ধমক দেওয়া হইয়াছে। অতএব এই কাজটি করা কখনই মুবাহ হইতে পারে না।

ইহার পর তিনি হযরত আবূ যার (রা) বর্ণিত রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটি উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

****************************************

উহাকে (শুক্রকীট) উহার হালাল অবস্থায়ই রাখিয়া দাও, হারাম হইতে উহাকে দূরে রাখ এবং উহাকে স্থিত হইত দাও। অতঃপর আল্লাহ চাহিলে উহা হইতে জীবন্ত সত্তা সৃষ্টি করিবেন, নতুবা উহাকে মারিয়া ফেলিবেন। মাঝখানে তোমার জন্য সওয়াব লেখা হইবে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ‘আজল’ করা অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশেষ করিয়া গর্ভবতী স্ত্রীর সহিত ‘আজল’ করা হইলে উহার পরিণতিতে গর্ভ বিনষ্ট হইতে পারে। কেননা এই অবস্থায় যৌন সঙ্গমে যে বীর্য স্থলিত হয়, তাহাই ভ্রূণের খাদ্য। ভ্রূণ সে খাদ্য না পাইলে উহার মৃত্যু বা দৈহিক দুর্বলতা বা অঙ্গহানি হইতে পারে। তাহাতে উহার মৃত্যু হওয়া অবশ্যম্ভাবী। রাসূলে করীম (স) হয়ত এই জন্যই ‘আজল’কে গোপন হত্যা’ বলিয়াছেন। ইহার ফলে বংশের ধারাও ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হইতে পারে। ইহাতে সন্তান জন্মের পন্হাটিই বিনষ্ট হইই যায়।

(****************)


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি