প্রকাশকের কথা
"বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান" পৃথিবীর বিখ্যাত একটি গ্রন্থ| গ্রন্থটি রচনা করেছেন ফ্রানসের প্রক্ষাত সার্জন, বৈজ্ঞানিক ও গবেষক ডাঃ মরিস বুকাইলি। ফরাসী ভাষায় রচিত তার”লা বাইবেল, লা কুরআন য়েট লা সাইন্স” নামক বই খানি সর্বপ্রথম ১৯৭৬ সালের মে মাসে পেরিসে প্রকাশিত হলে সঙ্গে সঙ্গে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষন করে। ইংরাজী ও আরবী সহ পৃথিবীর বহু ভাষায় অনুদিত হয়।
মহাগ্রন্থ আল কোরআন মানবতার ইহ ও পরকালীন মুক্তি ও কল্যাণের চাবিকাঠি এবং এক মাত্র নির্ভুল আসমানী কিতাব। অথচ যুগে যুগে এ সত্যকে অস্বীকার করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ চেষ্টা চলেছে প্রধানত ইহুদী ও খ্রিষ্টান পন্ডিতদের দ্বারা এবং বৈজ্ঞানিকগণ কর্তৃক।
এই বইয়ে তিনি আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে পাওয়া জ্ঞানের সঙ্গে বাইবেলের বর্ণনার সঙ্গতি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। বিজ্ঞানের এ চরম উৎকর্ষতার যুগে প্রকৃত সত্যকে যারা আবিষ্কার করতে চান এ বইটি তাদের প্রভূত উপকারে আসছে বিধায় দুনিয়া জোড়া বইটি ব্যাপকভাবে আলোচিত ও প্রশংসিত হচ্ছে। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট জনাব ওসমান গনি এ অসাধারণ গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করলে প্রথমে তা কয়েক বৎসর ধারাবাহিকভাবে মাসিক পৃথিবী পত্রিকায় ছাপা হয়। সম্প্রতি মরহুম ওসমান গনির দিতীয় মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক দোয়ার মাহফিলে সুধীবৃন্দ বইটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন যে, বইটি প্রকাশিত হলে এটি মরহুমের পরকালের নাজ্জাতের উছিলা হতে পারে এবং মৃত্যুর পরও তিনি সদকায়ে জারিয়ার সওয়াবের হকদার হতে পারেন।
এ দিকটি বিবেচনায় এনে মরহুমের সুযোগ্য সন্তান এবং পরিবার বর্গ বইটি প্রকাশে সানন্দে সম্মত হলে আল কোরআন একাডেমী বইটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
আল কোরআন একাডেমী কোরআনের শিক্ষা ও বাণী প্রচার ও প্রসার এবং মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে তা ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্শে গঠিত একটি মিশনারী সংস্থা। কোরআন কেন্দ্রীক গবেষণা এবং গবেষনার ফসল প্রকাশ ও প্রচার করাই এ সংস্থার প্রধান কাজ। ইতিমধ্যে আমাদের সহযোগিতায় প্রকাশিত হয়েছে আল কোরআন একাডেমী লন্ডনের ডাইরেক্টর হাফেজ মুনীর উদ্দীন আহমেদ রচিত”DICTIONARY OF THE HOLY QURAN",”কোরআনের অভিধান”, আল কোরআন একাডেমী ঢাকার ডাইরেক্টর আসাদ বিন হাফিজ রচিত” আল কোরআনের বিষয় অভিধান" এবং আতা সরকারের লেখা অসাধারণ কোরআন কাহিনী”সুন্দর তুমি পবিত্রতম"।
আল কোরআন একাডেমী ঢাকা কোরআনের ওপর আরো ব্যাপক কাজ করার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ইতিমধ্যে আল কোরআন একাডেমী লন্ডনের সহযোগিতায় এবং আমাদের তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিখ্যাত তাফসীর”ফি জিলালিল কোরান” অনুবাদের কাজ শুরু হয়েছে।
আল্লাহ যেন আমাদের সকল নেক মাকসুদ পূর্ণ করেন এবং এ গ্রন্থের লেখক, অনুবাদক, ও প্রকাশককে পরকালে নাজাতের হকদার করেন সকলের কাছে এ দোয়াই কামনা করি। আল্লাহ আমাদের সকলকে তার কালাম জানা, বুঝা ও সেই অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দিন।
আমীন।

ভুমিকা
তৌহিদবাদী তিনটি ধর্মেরই নিজস্ব গ্রন্থ আছে। ইহুদী হোক, খৃস্টান হোক, মুসলমান হোক, ঐ গ্রন্থই হচ্ছে তার ঈমানের বুনিয়াদ। তাদের সকলের কাছেই তাদের নিজ নিজ গ্রন্থ হচ্ছে আসমানী কালামের লিখিত রূপ। হযরত ইব্রাহীম ও হজরত মুসার কাছে ওই কালাম সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে। আর হজরত ঈসা ও হজরত মুহাম্মদ (স:) এর কাছে এসেছে অপরের মারফত। হজরত ঈসা বলেছেন, তিনি তার পিতার নাম কথা বলেছেন। আর হজরত মুহাম্মদ (স:) যে কালাম প্রচার করেছেন, তা তিনি পেয়েছেন আল্লাহর কাছ থেকে ফেরেশতা জিব্রাইলের মারফত।
ঐতিহাসিক তথ্যের নিরিখে বিচার করলে দেখা যায়, ওল্ড টেস্টামেন্ট, গসপেল, এবং কুরআন একই শ্রেণীভুক্ত। অর্থাত আসমানী কালামের লিখিত সংকলন। মুসলমানগণ এ মতবাদে বিশ্বাস করে। কিন্তু প্রধানত ইহুদী-খৃস্টান প্রভাবে প্রভাবান্বিত পাশ্চাত্যের অধিবাসীগণ কুরআনকে আসমানী কালামের মর্যাদা দিতে চায় না।
এক ধর্মের লোকেরা ওপর দুই ধর্মের গ্রন্থ সম্পর্কে যে মনোভাব পোষণ করে থাকে তা বিবেচনা করা হলে পাশ্চাত্যের ঐ মতবাদের একটি ব্যাখ্যা সম্ভবত পাওয়া যেতে পারে।
ইহুদীদের আসমানী গ্রন্থ হচ্ছে হিব্রু বাইবেল। খৃস্টানদের ওল্ড টেস্টামেন্টের সঙ্গে তার পার্থক্য হচ্ছে এই যে, ওল্ড টেস্টামেন্টে এমন কয়েকটি অধ্যায় রয়েছে, যা হিব্রু বাইবেলে ছিল না। এ পার্থক্য অবশ্য কার্যক্ষেত্রে তেমন কোনো অসুবিধার সৃষ্টি করে না। কেননা ইহুদীগণ তাদের নিজেদের কিতাবের পর আর কোন গ্রন্থ নাযিল হয়েছে বলে স্বীকার করে।
খ্রিস্টানগণ হিব্রু বাইবেলকে নিজেদের গ্রন্থ বলে মেনে নিয়েছে বটে, কিন্তু তার সঙ্গে আর ও কিছু যোগ করে নিয়েছে। তবে হজরত ঈসার বাণী প্রচারের উদ্দেশ্শে লিখিত ও প্রকাশিত সকল রচনাকে তারা গ্রহণ করেনি। খৃস্টান পাদ্রীগণ হজরত ঈসার জীবন ও শিক্ষা সম্পর্কে লিখিত অনেক গ্রন্থই বাতিল করে দিয়েছেন। নিউ টেস্টামেন্টে তারা অতি অল্পসংখ্যক রচনায় বহাল রেখেছেন। তার মধ্যে চারটি কেনোনিক গসপেলই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। খ্রিস্টানগণ হজরত ঈসা এবং তার সাহাবীদের পরবর্তীকালীন কোনো আসমানী কালামই স্বীকার করে না। সুতরাং কুরআনকেও তারা আসমানী গ্রন্থ বলে স্বীকার করে না।
কুরআন হজরত ঈসার ছয়শত বছর পরে নাযিল হয়। এ কিতাবে হিব্রু বাইবেল এবং গসপেলের অনেক তথ্যই পুনর্বর্নিত হয়েছে। কারণ কুরানে তাওরাত ও গসপেল থেকে বহু উধৃতি আছে। (তাওরাত বলতে বাইবেলের প্রথম পাচখানি গ্রন্থ, অর্থাত হজরত মুসার পঞ্চকিতাব-জেনেসিস, এক্সোডাস, লেভেটিকাস, নাম্বারস ও ডিউটারোনমি বুঝায়) । ' কুরআনের পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাবের উপর ঈমান আনার জন্য খোদ কুরআনেই মুসলমানদের উপর হুকুম আছে (সুরা-৪ আয়াত ১৩৬) । ' তাছাড়া আসমানী কালামে হজরত নুহ, হজরত ইব্রাহীম ও হজরত মুসার ন্যায় পয়গম্বরদের ভূমিকার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আর হজরত ঈসাকে একটি বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কারণ কুরানে এবং গসপেলে তার জন্মকে একটি অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তার মাতা মরিয়মকেও বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কুরআনের ১১ নম্বর সুরার নামকরণ তার নাম অনুসারে হওয়ায় এ বিশেষ মর্যাদার আভাস পাওয়া যায়।
ইসলামের এ সকল তথ্য সম্পর্কে পাশ্চাত্যের অধিবাসীগণ সাধারণত অবহিত নয়। কয়েক পুরুষ যাবত তাদের যেভাবে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয়েছে এবং ইসলাম সম্পর্কে তাদের যেভাবে অজ্ঞ করে রাখা হয়েছে তা বিবেচনা করা হলে এ অবস্থা মোটেই অসাভাবিক বলে মনে হয় না। তাদের এ অজ্ঞানতার পিছনে - এমন কি বর্তমান কালেও -”মোহামেডান ধর্ম”,”মোহামেডান জাতি” প্রভিতি শব্দের ব্যাবহারের বিরাট ভুমিকা রয়েছে। এ সকল শব্দ ও বাগধারা ব্যাবহার করে তারা এমন একটি মিথ্যা ধারণা করেছে যে, এ ধর্ম বিশ্বাস (মুহাম্মদ নামক) একজন মানুষের দ্বারা প্রচলিত হয়েছে এবং আল্লাহর (খৃস্টান ধর্মীয় অর্থে) সেখানে কোন ভুমিকা নেই। পাশ্চাত্যের অনেক সুধী ও বিজ্ঞজন এখন ইসলামের দার্শনিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক তত্ত্ব সম্পর্কে জানতে আগ্রহী, কিন্তু তারা ইসলামের খোদ আসমানী কালাম সম্পর্কে কোন খোজ-খবর নেন না। অথচ ঐ কালাম সম্পর্কে তাদের প্রথমেই খোজ নেয়া উচিত।
কোনো কোনো খৃস্টান মহলে মুসমানদের যে কি ঘৃণার চোখে দেখা হয় অনেকে তা আন্দাজ ও করতে পারেন না। এ ব্যাপারে আমার একটি ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে। একবার আমি একই বিষয়ে বাইবেল ও কুরানে বর্ণিত কাহিনীর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার শ্রোতারা এমন কি সাময়িক আলোচনার জন্য ও কুরআনের কোন বর্ণনাকে ভিত্তি হিসাবে মেনে নিতে চায়নি। তাদের ধারণা কুরআন থেকে কিছু উধৃত করার অর্থই হচ্ছে খোদ শয়তানের প্রসঙ্গে অবতারণা করা।
তবে খৃস্টান জগতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বর্তমানে কিছু পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দিতীয় ভ্যাটিকেন কাউন্সিলে আলোচিত বিষয়ের ভিত্তিতে ভ্যাটিকেন এর অখ্রিষ্টিয় বিষয়ক দফতর থেকে ফরাসী ভাষায় এক খানি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। নাম”ওরিয়েন্টেশন পোর আন ডায়ালগ এন্টার খ্রীশ্চিয়েন এত মুসলমানস” - খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে আলোচনার ভিত্তি। প্রকাশক এংকরা, রোম, তৃতীয় সংস্করণ ১৯৭০। ' এ গ্রন্থে খ্রিস্টানদের সরকারী মতবাদে সুদুর প্রসারী পরিবর্তনের আভাস রয়েছে।
মুসলমানদের সম্পর্কে খ্রিস্টানদের মনে”প্রাচীনকাল থেকে মীরাসী সুত্রে পাওয়া অযথা বিদ্বেষ ও বিরুপতায় বিকৃতি যে সেকেলে ধারণা রয়েছে”, তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এ দলীলে”মুসলমানদের প্রতি অতীতের অবিচার স্বীকার” করে নেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, এজন্য খ্রীস্টিয় শিক্ষিত পাশ্চাত্য মনোবৃত্তিই দায়ী। মুসলমানদের অদৃষ্টবাদ, বৈধতাবোধ, গোড়ামি প্রভৃতি সম্পর্কে খ্রিস্টানদের মনে এতদিন যে ভুল ধারণা ছিল, তার সমালোচনা করে গ্রন্থে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসের উপর সবিশেষ জোর দেয়া হয়েছে এবং স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে এক সরকারী সম্মেলনে গিয়ে কার্ডিনাল করেনিগ কেরর আল আযহার মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় এর বিখ্যাত মসজিদে যখন ঐ একত্বের কথা জোর দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, তখন শ্রোতাগণ কিভাবে বিস্মিত হয়েছিল। আরো স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ১৯৬৭ সালে রমজান মাসের রোজার শেষে ভ্যাটিকেন অফিস”আন্তরিক ধর্মীয় অনুভুতি সহকারে” মুসলমানদের প্রতি শুভেচ্ছা জানানোর জন্য খ্রিস্টানদের প্রতি আহবান জানিয়েছিল।
রোমান ক্যাথোলিক কিউরিয়া ও ইসলামের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্কের জন্য এ প্রাথমিক প্রচেষ্টার পর আর ও কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় এবং উভয়ের মধ্যে মত বিনিময় ও যোগাযোগের মারফত এ সম্পর্ক গভীর করে তোলা হয়। এ ঘটনাগুলি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ হলেও তেমন কোন প্রচারণা লাভ করেনি। অথচ এ সকল ঘটনা পাশ্চাত্য এ ঘটেছে এবং সেখানে সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের মত যোগাযোগের মাধ্যমের কোনই অভাব নেই।
১৯৭ সালের ২৪ এপ্রিল ভ্যাটিকানের অখৃস্টিয় দফতরের প্রেসিডেন্ট কার্ডিনাল পিগনেডোলি এক সরকারী সফরে সৌদি আরব গিয়ে বাদশাহ ফয়সলের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। কিন্তু এ গুরুত্বপূর্ণ খবরটি সংবাদপত্রের পাতায় কোনই গুরুত্ব লাভ করেনি। ফরাসী সংবাদপত্র লা মন্ডে ১৯৭৪ সালের ২৫ এপ্রিল মাত্র কয়েক লাইনে অতিশয় সংক্ষেপে এ সংবাদটি পরিবেশন করে। অথচ ঐ সাক্ষাত্কারে যা ঘটেছিল, তা খেয়াল করলে বুঝা যায় যে, সংবাদটি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঐ সাক্ষাত্কারে কার্ডিনাল হিজ হোলিনেস পপ ষষ্ঠ পলের একটি বাণী বাদশাহ ফয়সলের খেদমতে পেশ করেন। বাণীতে হিজ হোলিনেস”এক আল্লাহর উপাসনায় ইসলামী ও খ্রিস্টান বিশ্বের ঐক্যে গভীর বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসলামী দুনিয়ার প্রধান হিসাবে হিজ ম্যাজেস্টি বাদশাহ ফয়সলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।”
ছয় মাস পর ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে সৌদি আরবের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের একটি প্রতিনিধিদল সরকারী সফরে ভ্যাটিকেন গিয়ে পোপের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তখন সেখানে”ইসলামে মানুষের সাংস্কৃতিক অধিকার” বিষয়ে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে একটি আলোচনা সভা হয়। ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর ভ্যাটিকেন সংবাদপত্র”অবজারভেটর রোমানো” - র প্রথম পৃষ্ঠায় এ সভার বিবরণ বিরাট আকারে প্রকাশিত হয়। ঐ দিন ঐ একই পৃষ্ঠায় রোমে অনুষ্ঠিত বিশপদের সৈনদের সভার সমাপ্তি দিবসের বিবরণ অনেক ছোট আকারে প্রকাশিত হয়।
পরে জেনেভার গির্জাসমূহের একুমেনিকাল কাউন্সিল, এবং স্ট্রাসবর্গের লর্ড বিশপ হিজ গ্রেস এলচিন্গার সৌদি আলেমগনকে অভ্যর্থনা জানান। লর্ড বিশপ তার উপস্থিতিতে ক্যাথিড্রালের মধ্যেই জোহরের নামাজ আদায় করার জন্য তাদের অনুরোধ জানান। এ সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তা সম্ভবত একটি অসাভাবিক ঘটনা হিসাবে, ঘটনাটির গভীর ধর্মীয় তাৎপর্যের জন্য নয়। এ বিষয়ে যাদের প্রশ্ন করেছি তারা বলেছেন যে, ঘটনাটির ধর্মীয় তাৎপর্য সম্পর্কে তারা অবহিত ছিলেন না।
ইসলাম সম্পর্কে পপ ষষ্ঠ পলের এ খোলা মন ও মানসিকতা দুই ধর্মের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অতি অবশ্শই একটি অধ্যায় হয়ে থাকবে। তিনি নিজেই বলেছেন যে, তিনি”এক আল্লাহর উপাসনায় ইসলামী ও খ্রিস্টান বিশ্বের ঐক্যের প্রতি গভীর বিশ্বাসে অনুপ্রানিত হয়েছেন।” মুসলমানদের সম্পর্কে ক্যাথোলিক চার্চ প্রধানের এ অনুভুতির পুনরুল্লেখ করার প্রয়োজন আছে। প্রকাশ্য বিদ্বেষের আবহাওয়ায় লালিত হওয়ায় বহু খ্রিস্টান নীতিগত ভাবে ইসলাম সম্পর্কে যে কোন আলোচনার বিরোধী। ভ্যাটিকানের ঐ দলীলে এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। এ কারণেই ইসলাম যে আসলে কি জিনিস সে সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ রয়েছে এবং ইসলামের আসমানী কালাম হওয়া সম্পর্কে তারা আগের মতই সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করছে।
তবুও একটি তৌহিদবাদী ধর্মের আসমানী কালামের কোন বৈশিষ্ট বিচার করার সময় ওপর দুটি ধর্মের অনুরূপ বৈশিষ্টের সঙ্গে তার তুলনা করার প্রয়োজন আছে। কোন বিষয়ের সামগ্রিক বিবেচনা একদেশদর্শী বিবেচনার চেয়ে নিশ্চয়ই ভালো। তাই এ পুস্তকে তিনটি ধর্মের আসমানী কলামে বর্ণিত কতিপয় বিষয়ের তুলনামূলক আলোচনা হবে এবং তার মোকাবিলায় বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানে আবিষ্কৃত তথ্য তুলে ধরা হবে। এ প্রসঙ্গে উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তিনটি ধর্মের এখন ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কারণ তিনটি ধর্মই এখন সমানভাবে বস্তুবাদের হামলার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোন সদ্ভাব নেই, এ ধারণা ইহুদী - খ্রিস্টান প্রভাবিত দেশের মত ইসলামী দেশেও বিশেষত বৈজ্ঞানিক মহলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে। এ বিষয়টি সামগ্রিকভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হলে সুদীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন আছে।
এ পুস্তকে আমি বিষয়টির একটি মাত্র দিক তুলে ধরতে চাই। অর্থাত আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের আলোকে তিন ধর্মের আসমানী কালাম পরীক্ষা করে দেখতে চাই।
তবে এ কাজে হাত দেয়ার আগে একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করা প্রয়োজন এবং তা হচ্ছে, আসমানী কালামের বর্তমান রূপ কতখানি আসল ও খাটি? এ প্রশ্নের জবাব
পেতে হলে যে পরিবেশ পরিস্থিতিতে ঐ কালাম লিপিবদ্ধ হয়েছিল এবং যে পন্থায় ও প্রচারে তা আমাদের পর্যন্ত এসে পৌছেছে, তা ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।
পাশ্চাত্যে আসমানী কালামের পরীক্ষা নিরীক্ষা মাত্র সাম্প্রতিক কালে শুরু হয়েছে। শত শত বছর যাবত মানুষ ওল্ড টেস্টামেন্ট ও নিউ টেস্টামেন্ট বাইবেল যেভাবে পেয়েছে, সেইভাবে মেনে নিয়েছে। ঐ বাইবেল পরে তারা সমর্থন ছাড়া আর কিছুই করেনি। কারণ সামান্যতম সমালোচনাকেও তারা পাপ বলে গণ্য করেছে। পাদ্রীদের একটি সুবিধে ছিল এই যে, তারা সমগ্র বাইবেল পড়েছেন এবং অবহিত হয়েছেন। কিন্তু সাধরণ মানুষের অধিকাংশই গির্জায় গিয়ে অংশ বিশেষের পাঠ শুনেছেন মাত্র।
বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে পরীক্ষায় মূল পাঠের সমালোচনা থেকে গুরুতর সমস্যার আবিষ্কার ও প্রচার হয়েছে। ফলে কোন তথাকথিত সমালোচনা পড়তে গিয়ে প্রায়ই হতাশ হতে হয়। কারণ দেখা যায় যে, মূলের ব্যাখ্যায় কোন প্রকৃত সমস্যার সম্মুখীন হয়ে সমালোচক এমন কোন বাক্য বা অনুচ্ছেদ উধৃত করেছেন, যা দেখে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, তিনি আসল সমস্যা লুকাতে চেস্টা করেছেন। এ অবস্থায় বস্তুনিষ্ঠ বিচার ও যুক্তিসঙ্গত চিন্তা প্রয়োগ করলে দেখা যায় যে, অসম্ভাব্যতা এবং স্ববিরোধিতা আগের মতই বহাল রয়েছে। অথচ বাইবেলের এ ধরনের বাক্য বা অনুচ্ছেদকে সঠিক বলে দাবি করার জন্য প্রচেষ্টার অন্ত নেই।
এ প্রচেষ্টা চিন্তাশীল ও যুক্তিবাদী মানুষের আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। অভিজ্ঞতায় অবশ্য দেখা যায় যে, কিছু কিছু লোক এ অসম্ভাব্যতা ও স্ববিরোধিতা সনাক্ত করতে পারলেও অধিকাংশ খ্রিস্টান ধর্মীয় ব্যাপারে তাদের যুক্তি বা সঙ্গতিবোধ প্রয়োগ করে না।
ইসলাম ধর্মের কোন কোন হাদিসকে গসপেলের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। হজরত মুহাম্মদ (স:) এর কথা এবং তার কাজের বিবরণের সংকলনকে হাদিস বলা হয়ে থাকে। গসপেল ঈসার হাদীস ছাড়া অন্য কিছুই নয়। কোন কোন হাদীস হজরত মুহাম্মদ (স :) এর ইন্তিকালের বহু বছর পরে লেখা হয়েছে। একইভাবে গসপেলও লেখা হয়েছে ঈসার ইন্তিকালের বহু বছর পরে। উভয় ক্ষেত্রে অতীতের ঘটনাবলির ব্যাপারে মানুষের সাক্ষ্য বিদ্যমান রয়েছে। তবে গসপেলের ব্যাপারে একটি পার্থক্য আছে। আমরা দেখতে পাব যে, চারটি ক্যনোনিক গসপেল যারা লিখেছেন, তারা তাদের বর্ণিত ঘটনাবলির চাক্ষুস সাক্ষী ছিলেন না। এ বইয়ের শেষভাগে উল্লেখিত কিছু হাদিসের ক্ষেত্রেও এ কথা।
তবে ঐ সাদৃশ্যের সমাপ্তি কিন্তু এখানেই। কারণ কোন কোন হাদিসের সত্যতা নিয়ে আগেও আলোচনা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ গসপেলের ক্ষেত্রে গির্জার ইতিহাসের সেই গোড়ার দিকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সে সিদ্ধান্তে কেবলমাত্র চারখানি গসপেলকেই ক্যনোনিক অর্থাত সরকারী বলে ঘোষণা করা হয়। যদিও অনেক বিষয়েই ঐ চার্খানির মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে তথাপি ঐ সিদ্ধান্ত গ্রহনের পথে তা কোন বাধা হয়ে দাড়ায়নি। ঐ সিদ্ধান্তের পর অবশিষ্ট সকল গসপেল গোপন করে ফেলার হুকুম জারি করা হয়। এ কারণে তাদের বলা হয়”'এপোক্রিফা '" অর্থাত আসল নয়।
খ্রিস্টান ও ইসলামী গ্রন্থের আর একটি মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে : খ্রিস্টান ধর্মে কোন আসমানী এবং লিখিত গ্রন্থ নেই। ইসলামের কুরআন আসমানীও ও লিখিতও।
জিব্রাইল ফেরেশতার মারফত হজরত মুহাম্মদ (স:) এর নিকট নাযিল করা আসমানী কালামই হচ্ছে কুরআন। নাযিল হওয়ার পরপরই ঐ কালাম লিখে ফেলা হয়, মুসলমানগণ মুখস্ত করে ফেলে, এবং নামাজে, বিশেষত রমজান মাসের নামাযে তা তেলাওয়াত করে থাকেন। মুহাম্মদ (স:) নিজেই ঐ কালাম বিভিন্ন সুরায় বিভক্ত ও বিন্যস্ত করেন, এবং তার ইন্তিকালের পরই (১২ থেকে ২৪ বছরের সময়ের মধ্যে) খলিফা উসমানের শাসনকালে তা একখানি কিতাবের আকারে সংকলিত হয়। বর্তমানে আমরা যে কুরআনে দেখতে পাই, তা হচ্ছে ঐ সংকলিত গ্রন্থ। [আসলে এখানে একটু তথ্যে হেরফের হয়েছে। ১২ হি: সনে (৬৩৩ খ্রি) ইয়ামামার যুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার পর খলিফা আবু বকরের (রা :) নির্দেশে কুরআন শরীফ গ্রন্থাকারে সংকলন করা হয়। উসমান (রা :) তার শাসনকালে এই সংকলন্টিরই অনেকগুলি কপি তৈরী করিয়ে তা বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠান - অনুবাদক। ]
পক্ষান্তরে খ্রিস্টানদের গ্রন্থ হচ্ছে বিভিন্ন মানুষের পরোক্ষ বর্ণনার সংকলন। ঈসার জীবনের ঘটনাবলী নিজ চোখে দেখেছেন এমন কোন মানুষের বর্ণনা ওতে নেই। অথচ অনেক খৃস্টানই তাই ধারণা করে থাকেন। খৃস্টান ও ইসলামী গ্রন্থের সত্যতার বিষয়টি এখন এভাবেই ফয়সালা হয়ে গেছে।
আসমানী গ্রন্থের বর্ণনার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক তথ্যের মোকাবিলার বিষযটি সর্বদাই মানুষকে চিন্তার খোরাক যুগিয়েছে।
এক সময় ধরে নেয়া হত যে, কোন আসমানী গ্রন্থকে সত্য বলে মেনে নিতে হলে বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন। সেন্ট অগাস্টিন তার ৮২ নম্বর চিঠিতে এ নীতি আনুষ্ঠানিকভাবে কায়েম করেন। পরে আমরা এ চিটি থেকে উধৃতি দেব। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু পরিষ্কার হয়ে যায় যে, বাইবেল ও বিজ্ঞানের মধ্যে মধ্যে গরমিল রয়েছে। তখন স্থির করা হয় যে, অমন তুলনা আর করা হবে না। ফলে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয় যার ফলে আমরা আজ স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি যে, বাইবেল ও বিজ্ঞান পরস্পর বিরোধী। আমরা অবশ্য এমন কোন আসমানী কালাম মেনে নিতে পারি না, যার বিবরণ ভুল ও অসত্য। এ অসামঞ্জস্যের মীমাংসা করার একটি মাত্র উপায় আছে, আর তা হচ্ছে : বৈজ্ঞানিক তথ্যের বিরোধী বক্তব্য যে অনুচ্ছেদে আছে, তা সত্য বলে গ্রহণ না করা। কিন্তু এ সমাধান গ্রহণ করা হয়নি। তার বদলে বাইবেলই সত্য বলে সজোরে ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে পাদ্রী বিশেষজ্ঞগণ এমন একটি অবস্থান গ্রহণ করেছেন, যা বৈজ্ঞানিকের কাছে আদৌ গ্রহনযোগ্য নয়।
সেন্ট অগাস্টিন বাইবেল সম্পর্কে যা বলেছেন, সেই নীতিতে অবিচল থেকে ইসলাম সর্বদাই ধরে নিয়েছে যে, কুরআনের বর্ণনা বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। সাম্প্রতিক কালে ইসলামের অহী পুংখানুপুংখ রূপে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। কিন্তু ঐ নীতির কোন পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। পরে আমরা দেখতে পাব যে, বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বহু বিষয়ের বিবরণ কুরআনে রয়েছে। বাইবেলেও আছে, তবে বিষয়ের সংখা অত বেশি নয়। বাইবেলের ঐ অল্পসংখ্যক বিষয় বৈজ্ঞানিক তথ্যের বিরোধী। পক্ষান্তরে কুরআনের অধিক সংখ্যক বিষয় বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এদিক থেকে এ দুই কিতাবের মধ্যে কোন তুলনাই হতে পারে না। কুরআনের কোন তথ্যই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে অস্বীকার করা যায় না, আমাদের গবেষণা থেকে এ মৌলিক সত্যই বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এ বইয়ের শেষভাগে আমরা দেখতে পাব যে হাদীসের ক্ষেত্রে এ কথা খাটে না। আগেই বলা হয়েছে যে, হাদিস হচ্ছে নবী মুহাম্মদ (স:) এর কথা ও কাজের বিবরণের সংকলন এবং কুরআনের অহী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। কোন কোন হাদীসের বিবরণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য নয়। সত্যতা নির্ণয়ের জন্য খোদ কুরআনে বৈজ্ঞানিক তথ্য ও যুক্তি প্রয়োগের নীতি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, সে নীতির ভিত্তিতেই ঐ হাদিসগুলি পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে।
কোন কোন আসমানী গ্রন্থের বিবরণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য বা অগ্রহণযোগ্য হওয়ার এ ব্যাপারটি আর একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। প্রথমেই খুব জোর দিয়ে বলা দরকার যে, বৈজ্ঞানিক তথ্য বলতে এখানে কেবলমাত্র সেই বৈজ্ঞানিক তথ্যের কথায় বলা হয়েছে, যা সঠিক ও সুনির্দিষ্টভাবে প্রমানিত ও গৃহীত হয়েছে। এ মূলনীতির কথা মনে রাখলে দেখা যাবে যে, যে সকল তত্ত্কথা একদা কোন বিষয় বা বস্তুর ওপর আলোকপাতের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল, কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষনার অগ্রগতির ফলে এখন আর তেমন কোন প্রয়োজনীয়তা নেই, আমাদের বর্তমান বিবেচনা থেকে তা সম্পূর্ণরূপে বাদ দেয়া হয়েছে। এখানে আমি কেবলমাত্র সেসকল তথ্যই ব্যবহার করব, যা সকল তর্ক ও বিরোধের উর্ধে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার থেকে যদিও কেবলমাত্র অসম্পূর্ণ তথ্যই পাওয়া সম্ভব, তবুও সেই অসম্পূর্ণ তথ্যও সর্বজন গৃহীত হবে যে, ভুল করার আর কোন আশংকাই থাকবে না।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, মানুষের দুনিয়ায় আগমনের কোন আনুমানিক তারিখও বৈজ্ঞানিকরা দিতে পারেন না। তবে তারা মানুষের কর্মের এমন ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছেন, যা আমরা ঈসার জন্মের দশ হাজার বছর আগের বলে নিঃসন্দেহে মেনে নিতে পারি। সুতরাং এ বিষয়ে বাইবেলের বর্ণনাকে আমরা বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মেনে নিতে পারিনা। কারণ বাইবেলেরও জেনেসিস নামক অধ্যায়ে যে তারিখ ও বংশ-ইতিহাস দেয়া হয়েছে, তাতে মানুষের দুনিয়ায় আগমনের (অর্থাৎ আদমের সৃষ্টির) সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ঈসার জন্মের প্রায় সাইত্রিশ শত বছর আগে। আমাদের বর্তমান হিসাবের চেয়েও আরও নিখুত ও নির্ভুল তথ্য বিজ্ঞান হয়ত ভবিষ্যতে আমাদের দিতে পারবে। কিন্তু একটি বিষয় আমরা সুনিশ্চিত যে, বিজ্ঞান আমাদের কখনই বলবেনা যে, মানুষ সর্বপ্রথম ৪'৩৭৬ বছর আগে দুনিয়ায় এসেছিল। ১৯৭৫ সালের হিব্রু ক্যালেন্ডারে ঠিক ঐ কথায় বলা হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মানুষের দুনিয়ায় আগমন সম্পর্কে বাইবেলের তথ্য সম্পূর্ণ ভুল।
বিজ্ঞানের সঙ্গে এ মোকাবিলা থেকে সকল প্রকার প্রকৃত ধর্মীয় ব্যাপার বাদ দেয়া হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, আল্লাহ কিভাবে কোন প্রক্রিয়ায় মুসার কাছে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, বিজ্ঞানে তার কোন ব্যাখ্যা নেই। কোন জৈবিক পিতা ছাড়া ঈসার জন্ম হওয়ার রহস্য সম্পর্কেও একই কথা বলা যেতে পারে। কোন আসমানী গ্রন্থেও এ সকল বিষয়ের কোন বস্তুগত ব্যাখ্যা নেই। এ পুস্তকে কেবলমাত্র সে সকল বিচিত্র প্রাকৃতিক ঘটনা বিবেচনা করা হয়েছে, আসমানী গ্রন্থে যার বর্ণনা আছে এবং ছোট বড় ব্যাখ্যাও আছে। এ কথা মনে রাখলে যে বিষয়টি অতি সহজেই আমাদের নজরে পরে তা হচ্ছে এই যে, কোন একটি বিশেষ বিষয়ে কুরআনে প্রচুর তথ্য আছে এবং ঐ একই বিষয়ে ওপর দুখানি গ্রন্থে খুব কম তথ্য আছে।
আমি প্রথমে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ মন নিয়ে এবং কোনরকম পূর্ব ধারণা না নিয়েই কুরআনের অহী পরীক্ষা করি এবং আধনিক বিজ্ঞানের তথ্যের সঙ্গে কুরআনের বর্ণনার সামঞ্জস্যের দিকে নজর রাখি। কুরআনের তরজমা পরে আমি জানতে পেরেছিলাম যে, ঐ গ্রন্থে নানা প্রকার প্রাকৃতিক ঘটনা ও বিষয়বস্তুর উল্লেখ আছে। কিন্তু এ সম্পর্কে তখন আমার কোন বিস্তারিত জ্ঞান ছিল না। তারপর আমি যখন মূল আরবী ভাষায় কুরআন পড়তে ও পরীক্ষা করতে শুরু করি, তখন ঐ সকল ঘটনা ও বিষয়বস্তুর একটি তালিকা প্রস্তুত করতে থাকি। এভাবে তালিকা প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার পর সাক্ষ্য প্রমান দেখে আমি স্বীকার করতে বাধ্য হই যে, কুরআনে এমন একটি বর্ণনাও নেই, আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে যার বিরোধিতা করা যেতে পারে।
একই নিরপেক্ষ মনোভাব বজায় রেখে আমি ওল্ড টেস্টামেন্ট ও গসপেলের ক্ষেত্রেও একই ধরনের পরীক্ষা চালাই। ওল্ড টেস্টামেন্টের ক্ষেত্রে প্রথম পুস্তক জেনেসিস শেষ করার আগেই আমি দেখতে পাই যে, সেখানে এমন সব বর্ণনা রয়েছে, যা আধুনিক বিজ্ঞানের প্রমানিত তথ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত।
তারপর গসপেলে হাত দিয়েই আমি একটি গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হই। প্রথম পৃষ্ঠাতেই ঈসার বংশ তালিকা রয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে মথির (ম্যাথিউ) বর্ণনার সঙ্গে লুকের বর্ণনার সুস্পষ্ট গরমিল রয়েছে। আর একটি সমস্যা হচ্ছে এই যে, মানুষের প্রথম দুনিয়ায় আগমনের ব্যাপারে লুকের বর্ণনা আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের সম্পূর্ণ বিরোধী।
তবে আমার মনে হয়, এ সকল গরমিল, অসম্ভাব্যতা এবং অসামঞ্জস্য থেকে আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের কোন অভাবের আভাস পাওয়া যায় না। ঐ গরমিল এর ব্যাপার থেকে মানুষের দায়িত্তহীনতারই আলামত পাওয়া যায় মাত্র। মূল পাঠে কি ছিল তা এখন আর কেউ বলতে পারেনা। একইভাবে কল্পনার ভিত্তিতে কিভাবে সম্পাদনা করা হয়েছে অথবা কিভাবে অজ্ঞাতসারে অহী সংশোধন করা হয়েছে, তাও এখন আর কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে যে ব্যাপারটি এখন অতি সহজেই আমাদের নজরে পরে, তা হচ্ছে এই যে, আমরা যখন বাইবেল এর এ গরমিল ও স্ববিরোধিতা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠি, তখন বিশেষজ্ঞগণ হয় ভান করেন যে ওসব তাদের নজরে পরেনি, আর না হয় কথার মারপ্যাঁচে তারা একটি মনগড়া ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন। জন ও মথি লিখিত গসপেলের আলোচনার সময় আমি বিশেসগ্গ্দের এ সুচতুর বাক্যজালের উদাহরণ পেশ করব। অসম্ভাব্যতা ও স্ববিরোধিতাকে তারা”সমস্যা” শব্দের আড়ালে গোপন করে থাকেন। এ”সমস্যা” লুকিয়ে ফেলার প্রচেষ্টায় তারা তারা সাধরণত সফল হয়ে থাকেন। এ কারণে বহু খ্রিস্টানই ওল্ড টেস্টামেন্ট ও গসপেলের এ সকল মারাত্মক ত্রুটি সম্পর্কে আদৌ অবহিত নন। এ বইয়ের প্রথম ও দিতীয় অধ্যায়ে পাঠক এ অবস্থার সুনির্দিষ্ট উদাহরণ দেখতে পাবেন।
তৃতীয় অধ্যায়ে ওহীর ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের স্বাভাবিক প্রয়োগের দৃষ্টান্ত আছে। আধুনিক ধর্ম নিরপেক্ষ জ্ঞান প্রয়োগ করে কুরআনের কয়েকটি আয়াতের অর্থ আরো ভালোভাবে উপলব্ধ করা সম্ভব হয়েছে। এ আয়াতগুলির অর্থ এতদিন অবোধ্য না হলেও রহস্যময় ছিল। এতে অবশ্য বিস্মিত হওয়ার কিছুই নেই। কারণ ইসলামের ক্ষেত্রে ধর্ম ও বিজ্ঞান সর্বদাই সহোদর বলে গণ্য হয়েছে। সেই শুরুতেই ইসলাম বিজ্ঞান চর্চার নির্দেশ দিয়েছে এবং সে নির্দেশ পালন করার ফলেই ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণযুগে বিজ্ঞান এর যে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়, তা থেকে রেনেসার আগে পাশ্চাত্য জগতও বিশেষভাবে লাভবান হয়। আধুনিক বিজ্ঞানীক জ্ঞান কুরআনের কোন কোন আয়াতের উপর যে আলোকপাত করেছে, তার ফলে অহী ও বিজ্ঞানের পারস্পরিক মোকাবিলায় সমঝোতা ও উপলব্ধির একটি প্রসারিত দিগন্ত উন্মুক্ত হয়েছে। ব্যাখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাবে ঐ আয়াতগুলি ইতিপূর্বে অস্পষ্ট ও অবোধগম্য ছিল।

ওল্ড টেস্টামেন্ট : সাধারণ সীমানা
ওল্ড টেস্টামেন্ট এর লেখক কে? এ প্রশ্নের জবাবে ওল্ড টেস্টামেন্টের অধিকাংশ পাঠকই সম্ভবত সেই কথা বলবেন, যা তারা বাইবেলের ভূমিকায় পড়েছেন। তারা হয়ত বলবেন যে, হোলি ঘোস্টের (জিব্রাইল) প্রেরনায় মানুষে লিখে থাকলেও আসল লেখক হচ্ছেন আল্লাহ।
বাইবেলের ভুমিকা লেখক কখনও এটুকু বলেই থেমে যান। ফলে আর কোন প্রশ্নের অবকাশ থাকে না। কখনও তিনি আবার এ কথাও বলে থাকেন যে, মূল পাঠের সঙ্গে পরে হয়ত মানুষের রচনাও সংযোজিত হয়র থাকতে পারে। কিন্তু সেজন্য কোন বিতর্কমূলক অনুচ্ছেদের মূল” সত্য” পরিবর্তিত হয়নি। এবং এ”সত্য" শব্দটির ওপর বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়। গির্জা কর্তৃপক্ষ এ দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকেন। কেননা একমাত্র তারাই হোলি ঘোস্টের সহায়তায় বিশ্বাসী খ্রিস্টানদের প্রকৃত পথ দেখাতে পারেন। চতুর্থ শতাব্দীতে খ্রিস্টান পরিষদ সমূহের সম্মেলনের পর গির্জা কর্তৃপক্ষই পবিত্র গ্রন্থের তালিকা প্রকাশ করেন এবং ঐ তালিকা ফ্লোরেন্স কাউন্সিল (১৪৪১), ট্রেন্ট কাউন্সিল (১৫৪৬) ও প্রথম ভ্যাটিকেন কাউন্সিলে (১৮৭০) অনুমোদিত হয়। সে অনুমোদিত গ্রন্থগুলিই এখন ক্যানন নাম পরিচিত। বহু গবেষণা ও পর্যালোচনার পর দিতীয় ভ্যাটিকেন কাউন্সিল অতি সম্প্রতি অহী সম্পর্কে একটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করেছেন। এ কাজে তিন বছরের (১৯৬২-১৯৬৫) একাগ্রতা ও পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়েছে। অধিকাংশ পাঠক বাইবেলের আধুনিক সংস্করণের শুরুতে এ বিবরণ দেখে আশ্বস্ত হয়েছেন। বাইবেলের সত্যতা সম্পর্কে বিগত কয়েক শতাব্দী যাবত প্রদত্ত নিশ্চয়তার বর্ণনা পরে তারা নিশ্চিত ও সন্তুষ্ট হয়েছেন। এ সম্পর্কে যে কোন প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন কথা তাদের আদৌ মনে হয়নি।
পাদ্রীদের এমন অনেক রচনা আছে, যেগুলি সাধারণত সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয় না। এ রচনা পড়লে বুঝা যায়, বাইবেলের বিভিন্ন পুস্তকের সত্যতা সম্পর্কিত বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে যত জটিল বলে মনে হয়, আসলে কিন্তু তা তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল। উদাহরণ হিসাবে বাইবেলের আধুনিক ফরাসী তরজমার কথা বলা যেতে পারে। জেরুসালেমের ব্লাইবিকেল স্কুলের তত্ত্বাবধানে এ তরজমা করা হয়েছে এবং কয়েকটি খন্ডে প্রকাশিত (প্রকাশক সার্ফ, প্যারিস) হয়েছে। এ তরজমা পরীক্ষা করলে প্রকাশভঙ্গিতে একটি সুস্পষ্ট ভিন্নতা ধরা পড়ে। স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, নিউ টেস্টামেন্ট এর মত ওল্ড টেস্টামেন্টেও এমন কিছু বিতর্কমূলক প্রশ্ন আছে, ব্যাখ্যাদাতাগন যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে গোপন করেননি।
প্রফেসর এডমন্ড জ্যাকবের গ্রন্থেও আরও সুনির্দিষ্ট তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এ গ্রন্থের নাম দি ওল্ড টেস্টামেন্ট, (ফরাসী নাম লা এনাচিয়েন টেস্টামেন্ট, প্রকাশক প্রেসেস ইউনিভার্সিটেয়ার্স দা ফ্রান্স, প্যারিস) । ' সংক্ষিপ্ত অথচ খুবই নিরপেক্ষ প্রকৃতির এ গ্রন্থে একটি উত্তম বিশ্লেষনমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়।
এডমন্ড জ্যাকব বলেছেন, অনেকেই অবহিত নন যে, আদিতে একখান মাত্র নয়, কয়েকখানি বাইবেল ছিল এবং তাদের পাঠও ভিন্ন ভিন্ন ছিল। খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে তৃতীয় শতাব্দীতে হিব্রু ভাষায় কমপক্ষে তিনখানি পৃথক পৃথক পুস্তক ছিল। প্রথমখানি পরবর্তীকালে মাসরোটিক নাম অভিহিত হয়, দিতীয় খানি আংশিকভাবে গ্রীক ভাষায় অনুদিত হয় এবং তৃতীয় খানি সামারিটান গ্রন্থ আমে পরিচিত হয়। খৃস্টের জন্মের পূর্বে প্রথম শতাব্দীতে ঐ তৃতীয় খানির ভিত্তিতে ও বদলে একখানি মাত্র গ্রন্থ প্রবর্তনের একটি সুস্পষ্ট প্রবণতা দেখা দেয়। কিন্তু সেই প্রবণতা বাস্তব রূপ লাভ করে খৃস্টের জন্মের এক শতাব্দী পরে, তখনই বাইবেলের একটি মাত্র পাঠ সঠিকভাবে নির্ধারিত হয়।
ঐ তিনটি পাঠই যদি আমরা পেতাম, তাহলে তুলনা করা সহজ হয়ে যেত এবং আদি পাঠ বা মূল পাঠ যে কি ছিল, সে সম্পর্কে আমরা একটি ধারনায় উপনীত হতে পারতাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় তেমন কোন সুযোগ আমাদের সামনে নেই। ফলে অবস্থা দাড়িয়েছে এই যে, কামরান গুহায় পাওয়া ঈসার আমলের নিকটবর্তী খ্রিস্টান পূর্বকালীন সময়ের ডেড সী স্ক্রোল (বহরে লুত -এ পাওয়া লিখন), মূল পাঠের একটি ভিন্নরূপ সম্বলিত ও গাছের পাতায় লিখিত খ্রিস্টের জন্মের পরবর্তী দিতীয় শতাব্দীর টেন কমেন্ডমেন্টস (দশ ফরমান) এবং খ্রিস্টের জন্মের পরবর্তী পঞ্চম শতাব্দীর কিছু বিচ্ছিন্ন রচনা (কায়রোর পেনিজা) ছাড়া বাইবেলের যে প্রাচীনতম হিব্রু পাঠ পাওয়া যায়, তা হচ্ছে খ্রিস্টের জন্মের পরবর্তী শতাব্দীর।
সেপ্চুয়াজিন্ট সম্ভবত গ্রীক ভাষায় প্রথম অনুবাদ। খৃস্টের জন্মের পূর্বে তৃতীয় শতাব্দীতে ইহুদীগণ আলেকজান্দ্রিয়ায় এ গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থের ভিত্তিতেই নিউ টেস্টামেন্ট প্রণীত হয়। খ্রিস্টের জন্মের পরবর্তী সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত এ গ্রন্থ, সহী বলে গণ্য হয়। খ্রিস্টান জগতে যে মূল গ্রীক পাঠ সাধারনভাবে প্রচলিত আছে, তা ভ্যাটিকেন সিটিতে রক্ষিত কোডেক্স ভ্যাটিকেনাস এবং লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত কোডেক্স সিনাইটিকাস নামক পান্ডুলিপি থেকে সংকলিত। এ দুটি পান্ডুলিপি খ্রিস্টের জন্মের পরবর্তী চতুর্থ শতাব্দীর।
এ প্রসঙ্গে আরমাইক ও সিরিয়াকে (পেশিত্তা) সংস্করণের ও উল্লেখ করা যেতে পারে। তবে এগুলি অসম্পূর্ণ।
এ সকল বিভিন্ন সংস্করণ থেকে বিশেষজ্ঞগণ একখানি”মধ্যপন্থী” গ্রন্থ প্রস্তুতু করতে সক্ষম হয়েছেন। এটাকে বিভিন্ন সংস্করণের মধ্যে একটি আপোস অভিহিত করা যেতে পারে। এ ছাড়া দিভাষিক ও ত্রিভাষিক বাইবেলও রয়েছে এবং তাতে গ্রীক, ল্যাটিন, হিব্রু, সিরিয়াক, আরমাইক এবং এমনকি আরবি ভাষাও ব্যবহার করা হয়েছে। বিখ্যাত ওয়ালটন বাইবেল (লন্ডন, ১৬৫৭) এরূপ একখানি গ্রন্থ। সকল বিষয় বিবেচনার স্বার্থে আর একটি ব্যপার উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিভিন্ন মতের খ্রিস্টান গির্জায় একই গ্রন্থ অনুসরণ করা হয় না অথবা একই ভাষায় তর্জমার ব্যপারে একই ভাবধারা গ্রহণ করা হয় না। এর কারন এই যে, ভিন্ন ভিন্ন বাইবেলে ভিন্ন ভিন্ন ধারনা পোষণ করা হয়েছে এবং তা ভিন্ন ভিন্ন গির্জা গোষ্ঠীকে প্রভাবিত করেছে। তবে বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টেন্ট বিশেষজ্ঞগন দি একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশন অব দি ওল্ড টেস্টামেন্ট নামে যে গ্রন্থ রচনায় নিয়োজিত আছেন তা একক ও সমন্বিত গ্রন্থ বলে পরিগনিত হতে পারে। (ইংরাজী অনুবাদকের মন্তব্য -১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এটা প্রকাশিত হয়। প্রকাশক - লে এডিশন ডু সার্ফ এবং লে বাজারস এট লে মাজেস, প্যারিস) ।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ওল্ড টেস্টামেন্টের ক্ষেত্রে মানুষের হস্তক্ষেপ একটি বিরাট ভূমিকা পালন করছে। এক সংস্করন থেকে অপর সংস্করনে এবং এক তরজমা থেকে অপর তরজমায় স্বাভাবিকভাবে যে সকল রদবদল ও সংশোধন হয়েছে, তা থেকে সহজেই অনুমান করা যেতে পারে যে, বিগত দুই হাজার বছরেরও বেশী সময়ে ওল্ড টেস্টামেন্টের মূল একাধিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।

বাইবেলের উৎস
বইয়ের আকারে সংকলিত হওয়ার আগে বাইবেল লোকপ্রবাদ হিসাবে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল এবং সুর করে গানের মতও পাওয়া হত। অন্যান্য সকল প্রাচীন ধারণার মত এ লোক প্রবাদও সম্পূর্ণরূপে স্মৃতি -নির্ভর ছিল।
এডমন্ড জ্যাকব লিখেছেন-”প্রথম পর্যায়ে সকল জাতিই গান গেয়েছে। অন্যান্য সকল জায়গার মত ইসরাইলেও গদ্যের আগে পদ্য এসেছে। সেখানে দীর্ঘ দিন গান গাওয়া হয়েছে এবং ভালই গাওয়া হয়েছে। ইসরাইল জাতি তাদের ইতিহাসের ঘটনাবলী নিয়ে গভীর অনুভূতির সঙ্গে আনন্দ ও বেদনার গান গেয়েছে। তাদের চোখে প্রত্যেকটি ঘটনার একটি তাৎপর্য ছিল। তাই গানের মারফত তারা বিভিন্ন আকারেও প্রকাশ করেছে। তারা বিভিন্ন কারনে গান গাইত এবং এডমন্ড জ্যাকোব তার অনেকগুলি উল্লেখও করেছেন। বাইবেলেও অনেক গানের উল্লেখ আছে - খানার গান, ফসল কাটার গান, কাজের গান, কুপের গান (গণনা পুস্তক ২১ ও ১৭), বিয়ের গান ও শোকের গান। অনেক যুদ্ধের গানও আছে, তার মধ্যে ডেবোবার গান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। (বিচারকগন ৫, ১-৩২) । কেননা এ গানে খোদ ইয়াহউয়ের নির্দেশিত ও পরিচালিত বিজয়ের জয়গান করা হয়েছে (গণনা পুস্তক ১০ ও ৩৫) -” মৈত্রীশক্তি অগ্রসর হলে মুসা বল্লেন, হে ইয়াহউয়ে! জাগ্রত হউন! আপনার শত্রুগন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হউক, এবং আপনাকে জারা ঘৃণা করে তারা আপনাকে দেখামাত্র পলায়ন করুক।”
এছাড়া আরও আছে উপদেশক ও হিতোপদেশক (বুক অব প্রোভার্বস, ইতিহাস পুস্তকের প্রোভার্বস, এন্ড ম্য্যকসিমস), আশির্বানী ও অভিশাপবানী, এবং অহী পাওয়ার পর মানুষের প্রতি পয়গম্বরদের বিধান।
জ্যাকোব বলেছেন, এ সকল কথা ও কাহিনী হয় পরিবার থেকে পরিবারে প্রবাহিত হয়েছে, আর না হয় ধর্মশালা মারফত আল্লাহর বাছাই করা জাতির ইতিহাসের বিবরন হিসেবে প্রচারিত হয়েছে। তারপর ইতিহাস দ্রুত প্রবাদে পরিনত হয়েছে, যেমন হয়েছে জোথামের প্রবাদের ক্ষেত্রে (বিচারকগন ৯, ৭-১২) । এ প্রবাদে” বৃক্ষগণ তাদের একজন রাজা বাছাই ও তাকে অভিষিক্ত করতে অগ্রসর হল, এবং পরপর জলপাই গাছ, ডুমুর গাছ, দ্রাক্ষালতা ও বেতস্লতাকে অনুরোধ জানাল।” এ বর্ণনায় জ্যাকোব লক্ষ্য করলেন,”ভাল গল্প বলার উতসাহে কথকগন অপরিচিত বিষয় বা যুগের অসম্ভাব্যতা নিয়ে মাথা ঘামাননি।” এবং এ কারনে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন-”ওল্ড টেস্টামেন্টে মূসা ও প্রধানদের বিষয়ে যে বর্ণনা আছে, তা থেকে সম্ভবত ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর একটি মোটামুটি ক্রমিকতা পাওয়া যেতে পারে। কথকগন মৌলিক বর্ণনার সময় মাধুর্য ও কল্পনার সাহায্যে হয়ত এমন অনেক সচেতন চিন্তাবিদের কাছেও মানুষ ও পৃথিবী সৃষ্টির আদিকথা বলে মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে।”
একথা বিশ্বাস করার সঙ্গত কারন আছে যে, খৃস্টের জন্মের পূর্ববর্তী ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইহুদীগন যখন কেনানে বসতি স্থাপন করে, তখন প্রবাদ সংরক্ষন ও প্রচারের জন্য লেখার প্রচলন হয়েছে। কিন্তু যে বিষয়ে তখন সর্বাধিক স্থায়িত্ব আশা করা হত, সেই আইন লিখন ও সংরক্ষনের ব্যাপারে পরিপূর্ণ নির্ভুলতা ছিলনা। কারন দেখা যাচ্ছে, যে আইন আল্লাহর নিজের হাতেই লেখা বলে ধরা হয়, সেই দশ ফরমানই ওল্ড টেয়াস্টামেন্টের দুই জায়গায় দুই প্রকারে এসেছে - জোডাস (২০, ১-২১) এবং ডিউটারোনমি (৫, ১-৩০) । মূল বক্তব্য হয়ত ঠিকই আছে কিন্তু শব্দ প্রয়োগ, প্রকাশভঙ্গি ও বাগধারার পার্থক্য খুবই স্পষ্ট। তখন চিঠিপত্র, চুক্তি, বিশিষ্ট লোকদের (বিচারক, পদস্ত পৌর কর্মকর্তা) নামের তালিকা, নছবনামা এবং গনিমত ও নজরানার মালের তালিকা লিখিত আকারে রাখার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। এ সকল দলিল সংরক্ষন করার জন্য দফতরখানা গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে এ সকল দলিলের ভিত্তিতে বই রচিত হয়েছে এবং কিছু কিছু বই আমাদের পর্যন্ত ও এসে পৌছেছে। গভীরভাবে পরীক্ষা করলে দেখা যায় প্রত্যেকটি বইতে একাধিক প্রকারের রচনা ও প্রকাশভঙ্গি ব্যবহৃত হয়েছে। মনে হয় একই বইতে বিভিন্ন লেখকের রচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞ ও গবেষকগণ সম্ভবত এ বিষয়ে আলোকপাত করতে পারেন।
ওল্ড টেস্টামেন্ট প্রথমিকভাবে মৌলিক প্রবাদ ভিত্তিক হলেও বর্ণনায় অসংলগ্নতা আছে। এক অংশের সঙ্গে অপর অংশের সম্পরক নেই। সুতরাং এ গ্রন্থের গ্রন্থনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে অপর কোন সময় ও স্থানের প্রাচীন সাহিত্য সৃষ্টির আদি প্রক্রিয়ার তুলনা করে দেখা যেতে পারে।
উদাহরন স্বরূপ ফ্রাংক - রাজবংশের আমলে ফরাসী সাহিত্য প্রক্রিয়া বিবেচনা করা যেতে পারে। যুদ্ধ, বিশেষত খৃস্টান ধর্ম রক্ষার যুদ্ধ, বীরপুরুষদের বীরত্ব ও সাহসিকতা এবং অন্যান্য চাঞ্চল্যকর ঘটনার বিবরন তখনও ঐ মৌখিক প্রবাদেই সংরক্ষিত হত। ঘটনার কয়েক শতাব্দী পরেও এ সকল প্রবাদ কবি, লেখক ও ইতিহাসবিদদের অনুপ্রাণিত করেছে। এভাবে একাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে এ সকল বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রিত কাহিনীর ভিত্তিতে কাব্য ও মহাকাব্য রচনা শুরু হয়। তার মধ্যে”রোলা সঙ্গীত”-ই সবচেয়ে বিখ্যাত। সম্রাট শার্লিমেন যখন স্পেন অভিযান থেকে ফিরে আসেন, তখন রোঁলা (লা শানসন দ্যা রোঁলা) তার পশ্চাদরক্ষী বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন। এ কাব্যগাঁথায় তার জীবন, বীরত্ব, ও আত্মত্যাগের কাহিনী বর্নিত হয়েছে। আত্মত্যাগের ঘটনাটি আদৌ কল্পনা নয়। ৭৭৮ সালের ১৫ আগস্ট পর্বতবাসী বাংক উপজাতির হামলার সময় ঐ ঘটনাটি ঘটেছিল। সুতরাং কাব্যের ঐ বরননাকে বিশুদ্ধ ইতিহাস বলে মেনে নিতে রাজি হবেন না।
বাইবেল গ্রন্থনার প্রক্রিয়াও ঠিক এভাবেই সম্পন্ন হয়েছে বলে মনে হয়। যারা আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করেন না, তারা পুরো বাইবেল কেই কিংবদন্তি ও কাল্পনিক কাহিনীর সংকলন বলে মনে করেন। কিন্তু আমরা তাদের সঙ্গে একমত নই। সৃষ্টির বাস্তবতা, আল্লাহর কাছ থেকে মূসার ওপর দশ ফরমান নাযিল হওয়া এবং সোলাইমানের আমলের মত মানুষের ব্যাপারে গায়েবী হস্তক্ষেপের ঘটনায় বিশ্বাস করা খুবই সম্ভব। কিন্তু তাই বলে আমাদের বিশ্বাস সর্বাত্মক হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা অবশ্যই ধরে নিতে পারি যে, বাইবেল মারফত আমরা যা পাচ্ছি, তা মূল ঘটনার সারসংক্ষেপ মাত্র এবং যে সকল বিস্তারিত বিবরন আছে তা কঠোর সমালোচনা ও পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন আছে। কারন মূল মৌখিক প্রবাদ যখন লিখিত আকার লাভ করেছে, তখন মানুষের কল্পনা ও অলংকরন অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাননা ছিল।

ওল্ড টেস্টামেন্টের বিভিন্ন পুস্তক
ওল্ড টেস্টামেন্ট বিভিন্ন দৈর্ঘ্য, আকার ও প্রকারের রচনার একটি সংকলন। মৌখিক প্রবাদের ভিত্তিতে এগুলি নয় শতাধিক বছর যাবত বিভিন্ন ভাষায় রচিত হয়েছে। এরপর বিভিন্ন সময়ে, বহুদিন পর পর, কোন ঘটনার ভিত্তিতে অথবা কোন বিশেষ প্রয়োজনবশত অনেক রচনাই সংশোধন ও সম্পূর্ণ করা হয়েছে।
এ বিপুল রচনাবলী সম্ভবত খৃস্টের জন্মের পুরবে একাদশ শতাব্দীতে ইসরাইলী রাজবংশের রাজত্বকালের প্রথম দিকে রচিত হয়েছিল। ঐ সময় রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে অনেকেই লেখক ছিলেন। তারা বিজ্ঞ ও পণ্ডিত ছিলেন এবং তাদের ভূমিকা কেবলমাত্র লেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলনা। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে যে অসম্পূর্ণ রচনার উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রথমটি সম্ভবত এ আমলেই রচিত হয়েছে। তখন এগুলির লিখিত আকার দেয়ার একটি বিশেষ কারণও ছিল। তৎকালে বহু সঙ্গীত, কাব্যগাথা, ইয়াকুব ও মূসার নসিহত, দশ ফরমান, এবং ধর্মীয় রেওয়াজ সৃষ্টিকারী রাজকীয় হুকুমনামা সংরক্ষন করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হত। ওল্ড টেস্টামেন্টর বিভিন্ন পুস্তকে এখন এগুলির সন্ধান পাওয়া যায়। আরও কিছুদিন পরে সম্ভবত খৃস্টের জন্মের পূর্বে দশম শতাব্দীতে পেন্টাটিউকের”"ইয়াহভিষ্ট”" গ্রন্থ রচিত হয়। এ গ্রন্থে আল্লাহকে ইয়াহওয়ে নামে অভিহিত করা হয় বলে গ্রন্থের ঐ নাম রাখা হয়। মূসার নামে যে প্রথম পাঁচখানি গ্রন্থ চালু আছে, তার মূলসুত্র হচ্ছে এ গ্রন্থ। পরে তার সঙ্গে”ইলোহিষ্ট" নামক রচনা, এবং তার”স্যাকারডেটাল" সংস্করনও যোগ করা হয়। আল্লাহকে”ইলোহিম" নামে অভিহিত করায় রচনাটিকে ইলোহিষ্ট বলা হয়। আর জেরুসালেম মন্দিরের স্যাকারডোট নামক প্রচারকদের নাম অনুসারে তাদের সংস্করন্টি স্যাকারডোটাল নামে পরিচিত হয়। দক্ষিণের জুডাহ রাজ্য থেকে পাওয়া ঐ প্রাথমিক ইয়াহভিষ্ট রচনায় দুনিয়ার আদিকাল থেকে ইয়াকুব - এর ইন্তেকাল পর্যন্ত ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।
খৃস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতেই লেখক পয়গম্বরদের আবির্ভাব হয়। ইসরাইলের আমোস ও হোসিয়া নামক দুজন এবং জুডায় মিকাহ নামক একজন লেখক- পয়গম্বরের খবর পাওয়া যায়।
খৃস্টপূর্ব ৭২১ সালে সামারিয়ার পতনের ফলে ইসরাইল রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য জুডাহ রাজ্যের হাতে চলে যায়। ধর্মীয় কিংবদন্তি সংরহের কাজ এ সময় থেকে শুরু হয়। এ সময়ই ইয়াহভিষ্ট ও ইলোহিষ্টের রচনাবলী একত্রিত করে তৌরাত নামে একখানি মাত্র গ্রন্থে রূপান্তরিত করা হয়। এ সময় ডিউটারোনমিও লেখা হয়।
খৃস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে জোশিয়ার রাজত্বকালে পয়গম্বর জেরোনিয়ার আবির্ভাব হয়, কিন্তু তার বানী ও কর্মের বিবরণ লিখিত আকার লাভ করে আরও এক শতাব্দী পরে।
খৃস্টপূর্ব ৫৮৯ সালে ব্যাবিলনে প্রথম দেশান্তরিত হওয়ার পূর্বে জেকানিয়া, নাহুম ও হাবাক্কুকের গ্রন্থ লিখিত হয়। এ সময়ের পরে এজেকিয়েল তার ভবিষ্যদ্বাণী প্রচার করতে থাকেন। খৃস্টপূর্ব ৫৮৭ সালে দ্বিতীয়বার দেশান্তরিত হওয়ার কাজ শুরু হয় জেরুসালেমের পতনের সময় এবং তা খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সাল পর্যন্ত চলে।
এজেকিয়েল একজন বিখ্যাত পয়গম্বর ছিলেন। কিন্তু তাঁর গ্রন্থ বর্তমানে যে আকারে পাওয়া যায় তাঁর জীবদ্দশায় সে আকারে সাজানো ছিলনা। তাঁর ইন্তেকালের পর যে কাতিবগণ ঐ ভাবে সাজান, তারাই তাঁর আধ্যাত্মিক খলিফা বলে গণ্য হন। এ কাতিবগণ স্যাকারজোলটাল সংস্করণ নামে পরিচিত জেনেসিসের তৃতীয় সংস্করণ প্রস্তুত করেন। এ সংস্করণে জেনেসিসের একটি অধ্যায়ের অর্থাৎ পৃথিবীর আদিকাল থেকে ইয়াকুবের ইন্তেকাল পর্যন্ত সময়ের বিবরণ আছে। এভাবে তৌরাতের ইয়াহভিষ্ট ও ইলোহিষ্ট রচনার মূল পাঠের মধ্যে একটি তৃতীয় রচনার শামিল হয়ে যায়। পরে আমরা দুই থেকে চার শতাব্দী আগে লেখা কয়েকখানি গ্রন্থে এ তৃতীয় রচনার একটি কৌশলগত বৈশিষ্ট্য দেখতে পাবো। এ একই সময় ল্যামেন্টেশন্সও (বিলাপ) প্রকাশিত হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সালে সাইরাসের হুকুমে দেশান্তরিত হওয়ার অবসান ঘটে। ইহুদীরা ফিলিস্তিনে ফিরে আসে এবং জেরুসালেমের মন্দির পুননির্মাণ করা হয়। ফলে পয়গম্বর ও প্রচারকদের কাজ পুনরায় শুরু হয়। এ সময় হাজ্জাই, জাকারিয়া, মালাচি ও ডানিয়েলের গ্রন্থ এবং ইসাইয়ার তৃতীয় গ্রন্থ ও বারুচের গ্রীক ভাষায় গ্রন্থ প্রনীত হয়।
আসলে দেশান্তরের ঘটনার পরবর্তী আমলে প্রধান প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থগুলি রচিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০সালের কাছকাছি সময়ে প্রোভার্বস, পঞ্চম শতাব্দীতে জব এবং তৃতীয় শতাব্দীতে একলেজিয়াস্ট বা কোহেলেথ, সঙ অব সঙস, ক্রনিকেলস প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড এবং এজরা ও নেমোলিয়া রচিত হয়। একইভাবে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে একলোজিয়াসটিকাস বা সিরাহ্ন এবং প্রথম শতাব্দীতে বুক অব উইজডম ও বুক অব মাকাবিজ প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড লিখিত হয়। কিন্তু রুথ, ইসথার ও জোনার গ্রন্থ যে কখন লেখা হয় তা সহজে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তৌরাত ও জুডিথের গ্রন্থের ক্ষেত্রেও ঐ একই কথা বলতে হয়। যেহেতু খ্রিষ্টের জন্মের মাত্র এক শতাব্দী আগে ওল্ড টেস্টামেন্টের রচনাবলী গ্রন্থের আকারে সাজানো হয়েছে, সেহেতু এখানে যে সকল তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর পরেও সংশ্লিষ্ট রচনা গুলির পরিবর্তন পরিবর্ধন হয়ে থাকতে পারে বলে ধরে নিতে হবে। কারণ খ্রিষ্টের জন্মের এক শতাব্দীর পূর্বকালে এ রচনাগুলির অধিকাংশই কোন সঠিক বা সুনির্দিষ্ট আকার লাভ করেনি।
এভাবে আদিকাল থেকে খ্রিস্টান ধর্মের আবির্ভাব পর্যন্ত ইহুদীগণ ওল্ড টেস্টামেন্টকে তাদের ধর্মীয় ও সাহিত্যিক মিনার বলে গণ্য করেছে। এ গ্রন্থে র বিভিন্ন খন্ড, অধ্যায় ও বিভাগ খ্রিস্টপূর্ব দশম ও প্রথম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত, সমাপ্ত ও সংশোধিত হয়েছে। এটা আমার ব্যাক্তিগত অভিমত নয়। এ তথ্য এবং ঐতিহাসিক জরিপের বিবরণ আমি একখানি সর্বজন স্বীকৃত নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করেছি। গ্রন্থখানি হচ্ছে সলকয়ের ডোমিকান ফ্যাকাল্টির প্রফেসর যে পি স্যামড্রোল রচিত এনসাইক্লোপিডিয়া ইউনিভার্সালিস (প্যারিস ১৯৭৪, তৃতীয় খন্ড, ২৪৬-২৫৩ পৃষ্ঠা),”দি বাইবেল” নামক নিবন্ধ। এ সকল তথ্য উচ্চতম যোগ্যতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞগণ সত্য ও সাঠিকবলে সাব্যস্ত করেছেন। সুতরাং ওল্ড টেস্টামেন্টের বিষয়বস্তু অনুধাবন ও উপলব্ধি করার জন্য এ তথ্যগুলি মনে রাখা দরকার।
ওল্ড টেস্টামেন্টের রচনাবলীর মধ্যে অহী মিশ্রিত ছিল বলে বিশ্বাস করা র কারণ আছে। কিন্তু এখন গ্রন্থখানি আমরা যে অবস্থায় পেয়েছি, তাতে সেই অহী আর অবশিষ্ট আছে কিনা, সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কারণ আমরা আগেই দেখেছি মূল বর্ণনা অনেকবার রদবদল হয়েছে এবং অনেক লখকই হস্তক্ষেপ করেছেন। সুতরাং সহজেই ধরে নেয়া যেতে পারে যে, তারা তাদের নিজ নিজ পরিবেশ, পরিস্থিতি ও পছন্দ অনুসারে যা ভালো মনে করেছেন, শুধু সেইটুকুই অবশিষ্ট রেখেছেন এবং এখন আমাদের পর্যন্ত শুধু সেইটুকুই এসেছে।
এ সকল বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের সঙ্গে বর্তমান প্রচারিত বাইবেলের বিভিন্ন সংস্করনের ভূমিকায় প্রদত্ত বিবরণের তুলনা করা হলে দেখা যাবে যে, আসল তথ্য ও সত্য সম্পুর্ন ভিন্নভাবে পরিবেশন করা হয়েছে। বিভিন্ন গ্রন্থের রচনায় যে সকল ইতিহাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিরবতা অবলম্বন করা হয়েছে। দ্ব্যর্থবোধক হওয়ায় যে সকল বিষয় বিভ্রআন্তি সৃষ্টি করতে পারে, সেগুলি ঠিক সেভাবেই রেখে দেয়া হয়েছে। অসত্যকে সত্য বলে একটি ভূল ধারণা সৃষ্টির জন্য তথ্যের ব্যাপারটি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা হয়েছে। ’এভাবে বাইবেলের অধিকাংশ ভূমিকাতেই সত্য ও বাস্তবতা গোপন করে একটি ভিন্ন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যে সকল গ্রন্থ কয়েকবার রদবদল করা হয়েছে (যেমন পেণ্টাটিউক) সে সকল ক্ষেত্রে স্রাসরি সে কথা না বলে শুধু বলা হয়েছে যে, কিছু কিছু খুটিনাটি বিষয় পরে যোগ করা হয়েছে, কিন্তু আসলেই যেখানে দীর্ঘ ব্যাখ্যার প্রয়োজন সেখানে অতিশয় গুরুত্তপূর্ণ বিষয় সম্পর্কেও নিরবতা অবলম্বন করা হয়েছে। জনসাধারণের জন্য বিপুল সংখ্যায় মুদ্রিত ও প্রচারিত বাইবেলে এ ধরণের ভূল ও অশুদ্ধ তথ্য থাকা সত্যি দুঃখজনক।

তৌরাত বা পেন্টাটিউক
তৌরাত অর্থাৎ তোরাহ নামটি সেমেটিক। গ্রীক ভাষায় বলা হয় পেন্টাটিউক। অর্থাৎ পাচখন্ডে সমাপ্ত গ্রন্থ। পাচটি খন্ড হচ্ছে জেনোসিস, এক্সোডাস, লোভিটিকাস, নাম্বারস এবং ডিউটারোনমি। ওল্ড টেস্টামেন্টে যে উনত্রিশটি খন্ডের সংগ্রহ আছে, তাঁর মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘এ পাচটি।
এ গ্রন্থে দুনিয়া সৃষ্টির শুরু থেকে ইহুদীদের কিনানে প্রবেশ করা পর্যন্ত সময়ের বিবরণ আছে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ইহুদীদের মিসরে নির্বাসিত হওয়ার পর এবং আরো সঠিকভাবে মূসার ইন্তেকালের পর তাদের ঐ দেশ দেয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। গ্রন্থের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে ইহুদীদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের জন্য বিবিধ বিধানও দেয়া হয়েছে। এ কারণে এ গ্রন্থ ল (আইন) বা তোরাহ (তৌরাহ) নামেও অভিহিত হয়ে থাকে।
ইহুদী ও খ্রিস্টান ধর্মে মুসাকেই বহু শতাব্দী যাবত তৌরাতের লেখক বলে মান্য করা হয়েছে। এ ধারণার ভিত্তি সম্ভবত এই যে, আল্লাহ মুসাকে বললেন -” এ ঘটনা (আমালেকের পরাজয়) স্মারক হিসাবে গ্রন্থে লিখে রাখ।” (এক্সোডাস ১৭, ১৪) । অথবা মিসর থেকে ইহুদীদের বেরিয়ে যাওয়ার সময়ের ঘটনায় যেমন আছে,”মূসা তাদের রওয়ানা হওয়ার স্থান সমূহের নাম লিখে রাখলেন।” - (নাম্বারস ৩৩, ২) এবং”মূসা এ আইন লিখলেন।” (ডিউটারোনমি ৩১, ৯১) । খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকেই মূসা তৌরাতের লেখক হিসেবে গণ্য হয়ে আসছেন। আলেকজান্দ্রিয়ার ফ্লাবিয়াস জোসেফাস এবং ফিলো ঐ একই ধারণা পোষণ করেছেন।
বর্তমানে অবশ্য এ ধারণা সম্পূর্ণ বর্জন করা হয়েছে এবং সকলেই এ বিষয়ে একমত হয়েছেন। তবুও নিউ টেস্টামেন্টে আবার মূসাকেই লেখক বলে বর্ণনা করা হয়েছে। রোমানদের কাছে লেখা চিঠিতে (১০, ৫) লেভিটিকাস থেকে উধৃতি দিয়ে পল বলেছেন,” মূসা লিখেছেন, যে ব্যাক্তি আইনে বর্ণিত মতে সদাচরণ করে” ইত্যাদি। জন তাঁর গসপেলে (৫, ৪৬-৪৭) ঈসার মুখ দিয়ে বলিয়েছেন -”তোমরা যদি মূসাকে বিশ্বাস করে থাক, তাহলে আমাকেও বিশ্বাস করবে; কারণ তিনি আমার সম্পর্কে লিখে গেছেন। কিন্তু তোমরা যদি তাঁর লেখাই বিশ্বাস না কর, তাহলে আমার কথা বিশ্বাস করবে কেমন করে?” এখানে তরজমা এবং ভাব প্রকাশে সম্পাদনা, অর্থাৎ রদবদলের আলামত পাওয়া যায়। কারণ গ্রীক ভাষায় মূল বর্ণনায়,”এপিসটেউয়েট” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে অর্থাৎ কথাটি ঈসার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে। অথচ এখানে দেখানো হয়েছে যে, তিনি নিজেই বলেছেন। এটা সম্পূর্ণ ভূল। কিভাবে আমি তা ব্যাখ্যা করছি।
এ ব্যাখ্যার কাঠামো ও নজির আমি জেরুসালেমের বাইবেল স্কুলের প্রধান ফাদার দ্য ভক্স- ের কাছ থেকে নিয়েছি। তিনি ১৯৬২ সালে জেনেসিসের যে ফরাসী তরজমা করেন, তাঁর ভূমিকায় পেন্টাটিউকের একটি মূল্যবান যুক্তিপূর্ণ পরিচিতি দেন। ইভাঞ্জেলিস্টগণ মূসাকে তৌরাতের লেখক বলে যে পরিচয় দিয়ে থাকেন, তিনি তা স্বঈকার করেননি বরং বিপরীত কথাই বলেছেন। তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে,” ঈসা ও তাঁর সাহাবাগণ যে ইহুদী রেওয়াজ অনুসরণ করতেন,” তা মধ্যযুগের শেষভাগ পর্যন্ত মেনে নেয়া হত। একমাত্র যিনি এ মতবাদের ঘোর বিরোধিতা করেছেন, তিনি হচ্ছেন দ্বাদশ শতাব্দীর আবেনেজরা। তারপর ষোড়শ শতাব্দীতে কালস্টাড উল্লেখ করেন যে, মূসার পক্ষে বোধ হয় ডিউটারোনমিতে (৩৪, ১৫-১২) তাঁর নিজের ইন্তেকালের বিবরণ লিখে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি এমন কয়েকজন সমালোচকের লেখা থেকেও উধৃতি দিয়েছেন, যারা সম্পূর্ণ না হলেও তৌরাতের অংশ বিশেষ মূসার রচনা বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন। তবে এ ব্যাপারে অরেটরির ফাদার রিচার্ড সাইমনের ভূমিকাই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ণ। তিনি তাঁর”ক্রিটিকাল হিষ্ট্রি অব দি ওল্ড টেস্টামেন্ট” (হিস্টোয়ার ক্রিটিক দু ভাইয়াক্স টেস্টামেন্ট-১৬৭৮) নামক পুস্তকে তৌরাতের ঘটনাক্রমের অসঙ্গতি, একই বিষয়ের বহু পুনরাবৃত্তি, কাহিণীর সামঞ্জস্যহীনতা এবং রচনাশৈলীর বিভিন্নতা বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেছেন। এ পুস্তক প্রকাশিত হওয়ার পর সর্বত্র একটি লজ্জাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে ইতিহাসের কোন পুস্তকেই রিচার্ড সাইমনের যুক্তিধারা আর তেমন অনুসরন করা হয়নি। তখন প্রাচীন ঘটনার প্রসঙ্গে”মূসা লিখেছেন”, এ কথাই বলা হয়েছে। একটু আগে আমরা দেখেছি ঈসা নিজে নিউ টেস্টামেন্টে মূসার তৌরাত লেখার কথা সমর্থন করেছেন। ফলে একটি প্রাচীন কিংবদন্তি আরো শক্তিশালী হয়েছে। এ অবস্থায় তাঁর বিরোধিতা করা যে কত কঠিন, তা সহজেই অনুমআন করা যেতে পারে। তবে পঞ্চদশ লুইয়ের চিকিতসক জা আসটুকই সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তি দিয়ে গেছেন।
১৭৫৩ সালে তাঁর”কনজেকচার্স অন দি অরিজিনাল রাইটিংস হুইচ এপিয়ার্সই মোজেজ ইউজড টু কম্পোজ দি বুক অব জেনেসিস (কনজেকচার্স সুলে মেমোয়ার্স অরিজিনক্স ডন্টহল পরাইট ক্যু মোইজে সিয়েস্ট সারভি পোর কম্পোজার লে লিভরা দ্য লা জেনেসি)” নামক পুস্তক প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি বিশদভাবে দেখান যে, পেন্টাটিউক বা তৌরাত বহু উৎস থেকে সংগৃহীত রচনাবলীর সমষ্টি। তাঁর আগে অনেকেই হয়ত এ বিষয়টি লক্ষ্য করে থাকবেন কিন্তু তিনিি প্রথম সাহস করে কথাটি জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। তিনি উধৃতি দিয়ে দেখান যে, এমন দুটি রচনা জেনেসিসে পাশাপাশি রয়েছে, যার একটিতে আল্লাহকে ইয়াহওয়ে এবং অপরটিতে ইলোহিম নামে অভিহিত করা হয়েছে। সুতরাং এ দুটি রচনা কখনোই এক উৎসের হতে পারেনা। আইকরন (১৭৮০-৮৩) অপর চারখানি গ্রন্থের ক্ষেত্রেও একই ধরনের তথ্য আবিষ্কার করেন। তারপর ইলগেন (১৭৯৮) লক্ষ্য করেন যে, আসটুক বর্ণিত যে রচনায় আল্লাহকে ইলোহিম নামে অভিহিত করা হয়েছে, তা আসলে দু’ভাগে বিভক্ত। ফলে পেন্টাটিউকের বুনিয়াদ আক্ষরিক অর্থে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।
উনবিংশ শতাব্দীতে উৎসগুলি সম্পর্কে আরও ব্যাপক অনুসন্ধান চালানো হয়। ১৮৫৪ সালে মোট চারটি উৎস স্বীকার করে নেয়া হয়। এগুলি হচ্ছে ইয়াহভিস্ট সংস্করণ, ইলোহিস্ট সংসকরন, ডিউটারোনমি এবং স্যাকারডোটাল সংসকরন। এমনকি তাদের সময়কাল নির্ণয় করাও সম্ভব হয়ঃ
(১) ইয়াহভিস্ট সংস্করণ খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীর বলে ধ্রা হয় (জুডায় লিখিত) ।
(২) ইলোহিস্ট সংস্করণ সম্ভবত তাঁর কিছু পরবর্তী কালের (ইসরাইলে লিখিত) ।
(৩) ডিউটারোনমি সম্পর্কে কেঊ মনে করেন খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর (ই জ্যাকব) এবং কেউ মনে করেন জোশিয়ার আমলের (ফাদার দ্য ভক্স) ।
(৪) স্যাকারডোটাল সংস্করণ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর নির্বাসনের আমলের অথবা তাঁর পরের আমলের।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, পেন্টাটিউকের রচনাবলীর মেয়াদ কমপক্ষে তিন শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু সমস্যাটি আসলে আরো জটিল। ১৯৪১ সালে এ লডস দেখতে পান যে ইয়াহভিস্ট সংস্করনে তিনটি উৎস আছে। এভাবে ইলোহিস্ট সংস্করনে চারটি, ডিউটারোনমি তে ছয়টি, এবং স্যাকারডওটাল সংস্করনে নয়টি উৎস আছে। এবং ফাদার দ্য ভক্স” যে আটজন ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থকারের রচনা সংযোজিত হয়েছে” বলে উল্লেখ করেছেন, তা বাদ দিয়েই। আরও সাম্প্রতিক কালে মনে করা হচ্ছে যে,”পেন্টাটিউকের যে সকল আইন বা বিধান আছে, তাঁর অধিকাংশের সন্দানই বাইবেলের বাইরে অন্যত্র পাওয়া যায়, এবং সেগুলি আর ও আগের আমলের।” তাছাড়া”পেন্টাটিউকের দলিল অর্থাৎ রচনাবলী যে সময় ও পটভূমি থেকে এসেছে বলে ধরে নেয়া হয়ে থাকে, রচনাবলীতে বর্ণিত কাহিণিগুলি সলে তাঁর ও অনেক আগের আমলের এবং ভিন্ন পটভূমির। ফলে, কিংবদন্তি কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে, সে সম্পর্কে আগ্রহ দেখা দিয়েছে।” অর্থাৎ সমস্যাটি এমন জটিল হয়ে দাড়িয়েছে যে তাঁর আগামাথা খুজে পাওয়াই মুশকিল।
অনেকগুলি উৎস থাকার কারণে পার্থক্য যেমন এসেছে, তেমনি পুনারাবৃত্তি ও এসেছে। ফাদার দ্য ভক্স উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে, বন্যা, ইউসুফের অপহরণ ও মিসরে তাঁর তৎপরতা সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনার মধ্যে পার্থক্য ও অসামঞ্জস্য রয়েছে। তাছাড়া একই ব্যাক্তিকে ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে এবং গুরুত্তপূর্ণ ঘটনাবলীর পরস্পর বিরোধী বিবরণ দেয়া হয়েছে।
এভাবে পেন্টাটিউক বিভিন্ন উৎস ও কিংবদন্তির সংগ্রহ হলেও লেখক গণ মোটামুটিভাবে দক্ষতার সঙ্গে তা একত্রিত ও গ্রন্থিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তারা কখনও দুটি বিবরণ পাশাপাশি বসিয়ে দিয়েছেন, আবার কখন ও দুটি বিবরণ মিশিয়ে এক্টিমাত্র বিবরণ হিসাবে পেশ করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও অসম্ভাব্যতা এবং পরস্পর বিরোধিতার ব্যাপারগুলি রয়েই গেছে। ফলে আধুনিক যুগের মূল উৎসগুলিই গভীর ও বস্তুনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছে।
পেন্টাটিউক বা তৌরাতের মূল রচনা পরীক্ষা করে দেখলে অতি সহজেই মানুষের হাতের কাজ বলে ধরা যায়। ইহুদী জাতির ইতিহাসের বিভিন্ন আমলের মৌখিক কাহিনী, কিংবদন্তি, এবং পুরুষানুক্রমে রক্ষিত রচনার ভিত্তিতে এ গ্রন্থ হয়েছে। বিবরণ শুরু হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীর গোড়া থেকে একটি ইয়াহভিস্ট প্রবাদ দিয়ে, যাতে ইসরাইলের নিজস্ব তকদির বর্ণনা করা হয়েছে। এ তকদির হচ্ছে ফাদার দ্য ভক্সের ভাষায়,” মানব জাতির জন্য আল্লাহর মহাপরিকল্পনার যথাযথ স্থানে ফিরে যাওয়া।” আর শেষ হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে একটি স্যাকারডোটাল প্রবাদ দিয়ে, যাতে তারিখ এবং নসবনামা একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাব যে, স্যাকারডোটাল সংস্করনে দুনিয়ায় মানুষের আগমন, সময়ের বিবর্তনে তাঁর অবস্থান এবং সৃষ্টিপ্রবাহ সম্পর্কে যে সকল বর্ণনা আছে, আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের মোকাবেলায় তা সম্পূর্ণ ভূল। স্পষ্টতই মূলের ওপর কলম চালাতে গিয়েই এ দশা হয়েছে।
ফাদার দ্য ভক্স লিখেছেন-” এ প্রবাদের কাহিনীগুলিতে আইনগত বৈধতার প্রশ্নই প্রাধান্য পেয়েছে। যেমন সৃষ্টি সমাপ্ত করার পর রবিবারে বিশ্রাম গ্রহণ, নূহের সঙ্গে মৈত্রী, ইব্রাহীমের সঙ্গে মৈত্রী ও হাজামত, মাকপেলার গূহা খরিদ যার ফলে যাজকগণ কেনানে জমি লাভ করেন।” আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে, এ প্রবাদটির মেয়াদ ব্যাবিলনে নির্বাসন থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সালে ফিলিস্তিনে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত। সুতরাং ধর্মীয় সমস্যার সঙ্গে এখানে সম্পুর্ণ রাজনৈতিক সমস্যাও মিশে গেছে।
জেনেসিসের ক্ষেত্রে গ্রন্থখানির বিষয়বস্তু যে তিনটি উৎস থেকে সংগৃহীত হয়েছে, তা এখন সাব্যস্ত ও স্বীকৃত হয়েছে। ফাদার দ্য ভক্স তাঁর তরজমার বিশ্লেষনমূলক আলোচনায় জেনেসিসের কোন অনুচ্ছেদ কোন উৎসের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে, তাঁর একটি তালিকা দিয়েছেন। এ প্রমাণের ভিত্তিতে কোন অধ্যায়ে কোন উৎসের বিষয়বস্তু কতখানি আছে, তা প্রায় সঠিকভাবে নির্ণয় করা যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, জেনেসিসের প্রথম এগারটি অধ্যায়ে সৃষ্টিতত্ত্ব, বন্যা এবং বন্যা থেকে ইব্রাহীমের আমল পর্যন্ত সময়ের যে বিবরণ আছে তাতে দেখা যায় যে, একটি অংশ ইয়াহভিষ্ট সংস্করণ থেকে এবং তাঁর পরের অংশ স্যাকারডোটাল সংস্করণ থেকে নেয়া হয়েছে। এবং সমগ্র বিবরণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। এ প্রথম এগারটি অধ্যায়ে ইলোহিস্ট সংস্করনের কোন বিষয়বস্তু নেই। তবে ইয়াহভিস্ট ও স্যাকারডোটাল ভাষ্য যে পরস্পরের সঙ্গে মিশে গিয়েছে, তা বেশ স্পষ্টভাবেই বুঝা যায়। প্রথম পাচটি অধ্যায়ে সৃষ্টিতত্ত্ব এবং নূহের আমল পর্যন্ত বর্ণনায় দেখা যায় যে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি ইয়াহভিস্ট অনুচ্ছেদের পর একটি স্যাকারডোটাল অনুচ্ছেদ দিয়ে পর পর সাজানো হয়েছে। বন্যার বিবরণে, বিশেষত সপ্তম ও অষ্টম অধ্যায়ে এ বন্দোবস্ত আর ও ঘন ঘন করা হয়েছে ; অর্থাৎ এক ভাষ্যের একটি ছোত অনুচ্ছেদের পর অপর ভাষ্যের একটি ছোট অনুচ্ছেদ বসানো হয়েছে এবং এমনকি বাক্যের ক্ষেত্রেও এ সাজানো বন্দোবস্ত নজরে পড়ে। একটি জায়গায় দেখা যায় যে, মোট একশো লাইনের মধ্যে এভাবে সতেরবার ভাষ্য বদল করা হয়েছে। এ কারণেই আমরা যখন জেনেসিস পড়তে যাই, তখন অসম্ভাব্যতা ও অন্তর্বিরোধিতা প্রকটভাবে ধরা পড়ে। এ প্রসঙ্গে নিচের ছকটি লক্ষনীয়।
জেনেসিসের ১ থেকে ১১ অধ্যায়ে ইয়াহভিস্ট ও স্যাকারডোটাল ভাষ্যের অবসান।
* প্রথম সংখ্যাটি অধ্যায়ের নম্বর।
* ব্রাকেটের মধ্যে দ্বিতীয় সংখ্যাটি কলামের নম্বর। কলাম কখন ও দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ায় ক ও খ হিসাবে দেখানো হয়েছে।
* ই- দ্বারা ইয়াহভিস্ট এবং স-দ্বারা স্যাকারডোটাল ভাষ্য বুঝানো হয়েছে।
* উদাহরণ- ছকের প্রথম লাইনে বুঝানো হয়েছে যে, বর্তমানে প্রচলিত বাইবেলের ১নং অধ্যায়ের ১নং কলাম থেকে ২ নং অধ্যায়ের ৪-ক কলাম পর্যন্ত বিষয়বস্তু স্যাকারডোটাল ভাষ্য থেকে নেয়া হয়েছে।
অধ্যায় --- কলাম থেকে --- অধ্যায় --- কলাম --- উৎস
১ --- (১) --- ২ (৪-ক) --- স
২ --- (৪-খ) --- ৪ --- (২৬) --- ই
৫ --- (১) --- ৫ --- (৩২) --- স
৬ --- (১) --- ৬ --- (৮) --- ই
৬ --- (৯) --- ৬ --- (২২) --- স
৭ --- (১) --- ৭ --- (৫) --- ই
৭ --- (৬) --- - --- - --- স
৭ --- (৭) --- ৭ --- (১০) --- ই
৭ --- (১১) --- - --- - --- স
৭ --- (১২) --- - --- - --- ই
৭ --- (১৩) --- ৭ --- (১৬-ক) --- স
৭ --- (১৬-খ) --- ৭ --- (১৭) --- ই
৭ --- (১৮) --- ৭ --- (২১) --- স
৭ --- (২২) --- ৭ --- (২৩) --- ই
৭ --- (২৪) --- ৮ --- (২-ক) --- স
৮ --- (২-খ) --- - --- - --- ই
৮ --- (৩) --- ৮ --- (৪) --- স
৮ --- (৬) --- ৮ --- (১২) --- ই
৮ --- (১৩-ক) --- - --- - --- স
৮ --- (১৩-খ) --- - --- - --- ই
৮ --- (১৪) --- ৮ --- (১৯) --- স
৮ --- (২০) --- ৮ --- (২২) --- ই
৯ --- (১) --- ৯ --- (১৭) --- স
৯ --- (১৮) --- ৯ --- (২৭) --- ই
৯ --- (২৮) --- ১০ --- (৭) --- স
১০ --- (৮) --- ১০ --- (১৯) --- ই
১০ --- (২০) --- ১০ --- (২৩) --- স
১০ --- (২৪) --- ১০ --- (৩০) --- ই
১০ --- (৩১) --- ১০ --- (৩২) --- স
১১ --- (১) --- ১১ --- (৯) --- ই
১১ --- (১০) --- ১১ --- (৩২) --- স

মানুষ নিজের হাতেই যে কিভাবে বাইবেল সাজিয়েছে, ছক থেকে তা অতি সহজেই বুঝা যায়।

ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহ
এ গ্রন্থসমূহে আমরা ইহুদী জাতির ইতিহাস পাই। এ ইতিহাস তাদের প্রতিশ্রুত দেশে প্রবেশের সময় থেকে ব্যবিলনে নির্বাসিত হওয়ার সময় পর্যন্ত বিস্তৃত। তারা খুব সম্ভব ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে প্রতিশ্রুত দেশে প্রবেশ করে এবং খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠো শতাব্দীতে ব্যাবিলনে নির্বাসিত হয়।
এখানে”জাতীয় ঘটনা” বলে কথিত ব্যাপারটির ওপর জোর দেয়া হয়েছে এবং ঘটনাটিকে আল্লাহর ওয়াদা পূরণ বলে পেশ করা হয়েছে। বর্ণনায় অবশ্য ঐতিহাসিক সত্যতা ও নির্ভুলতা উপেক্ষা করা হয়েছে। এ কথা মনে রেখেই ই জ্যাকোব বলেছেন যে, আই ও জেরিকোর কথিত ধ্বংসের ব্যাপারে গ্রন্থের বিচার পুস্তকের (বুক অব জাজেস) মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে পারিপার্শ্বিক শত্রুদের বিরুদ্ধে মনোনীত জাতির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং তাদের জন্য আল্লাহর সমর্থন। ফাদার এবং এ লিফার ক্রামপন বাইবেলের ভূমিকায় অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠভাবে বলেছেন যে, এ গ্রন্থখানি বেশ কয়েকবার রদবদল করা হয়েছে। মূল গ্রন্থের অনেকগুলি মুখবন্ধ এবং বিভিন্ন পরিশিষ্টের সংযোজন থেকেই তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায়। ’মূল বিবরণে রুথের কাহিনীও যোগ করা হয়েছে।
স্যামুয়েলের গ্রন্থ বুক অব স্যামুয়েল এবং দুখানি রাজাবলি গ্রন্থ (বুক অব কিংস) মূলত স্যামুয়েল, সল, দাউদ ও সোলাইমানের জীবনীমূলক গ্রন্থ। ’এগুলির ঐতিহাসিক মূল্য সম্পর্কে বিতর্কের অবকাশ আছে। ঐতিহাসিক বিচারেই জ্যাকোব এসব গ্রন্থে অসংখ্য ভূল পেয়েছেন। কারণ একই ঘটনা সম্পর্কে একাধিক পরষ্পর বিরোধী বর্ণনা আছে। ’ইলিয়াস, এলিশা ও ইসাইয়া নবীর কথাও এ সকল গ্রন্থে আছে। অর্থাৎ ইতিহাসের সঙ্গে কিংবদন্তি মিশে গিয়েছে। ফাদার লিফাবারের মত অন্যান্য সমালোচকগণ অবশ্য মনে করেন যে, এ গ্রন্থগুলির”ঐতিহাসিক মূল্যের মৌলিকত্ব আছে।”
ঘটনাপঞ্জী এক ও দুই (ক্রনিকেলস ওয়ান এন্ড টু) উজাইরের গ্রন্থ (বুক অব নেহেমিয়া) খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থশতাব্দীতে ওয়াকেয়া নাবিশ (ক্রনিকেলার) নামধায়ী একই লেখকের রচিত। তিনি ঐ সময় পর্যন্ত সৃষ্টির ইতিহাস বর্ণনা করেছে, যদিও তাঁর দেয়া নসবনামায় কেবলমাত্র দাউদ পর্যন্ত হিসাব পাওয়া যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি স্যামুয়েলের গ্রন্থ থেকেই তথ্য নিয়েছেন। ই জ্যাকোব বলেছেন,”অসঙ্গতির দিকে খেয়াল না করেই তিনি হুবহু নকল করেছেন।” তবে তিনি এমন কিছু নতুন তথ্য দিয়েছেন যা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণে সঠিক বলে সাব্যস্ত হয়েছে। ই জ্যাকোব বলেছেন,”লেখক কখনও কখনও ধর্মের প্রয়োজন মোতাবেক ইতিহাস লিখেছেন। রাজা মানাসেহ বিধর্মী ও অত্যাচারী হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘদিন শান্তি ও সমৃদ্ধির রাজত্ব করেছেন। এ ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, কিছুদিন আসিরিয়ায় থাকার সময় রাজা ধর্মান্তরিত হন (ক্রনিকেলস দুই ৩৩ ১১) । কিন্তু বাইবেল অথবাঃ বাইবেল বহির্ভূত কোন গ্রন্থে এ ঘটনার কোন উল্লেখ নেই। উজাইরের গ্রন্থ এবং নেহেমিয়ার গ্রন্থও কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। বলা হয়েছে যে গ্রন্থ দুখানি অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য বিষয়ে পূর্ণ। যে আমলের ঘটনা (খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী) তাতে বর্ণিত হয়েছে সে আমলটিই ভালভাবে পরিজ্ঞাত নয় এবং ঐ আমলের বাইবেল বহির্ভুত তেমন কোন দলিলও নেই।
তোবিতের গ্রন্থ (বুক অব টোবিট), জুডিথের গ্রন্থ (বুক অব জুডিথ) এবং ইস্থারের গ্রন্থও (বুক অব ইসথার) ঐতিহাসিক গ্রন্থ বলে ধরা হয়। অথচ এ গ্রন্থগুলিতে ইতিহাসের চরম বেইজ্জত করা হয়েছে। ধর্মের প্রয়োজনে মানুষ ও জায়গার নাম বদল করা হয়েছে এবং চরিত্র ও ঘটনা সৃষ্টি করা হয়েছে। আসলে এগুলি হচ্ছে ঐতিহাসিক অসত্য ও অসম্ভাব্যতার মিশাল দেয়া (নীতিকথামূলক) কাল্পনিক কাহিনী।
মাকাবিজের গ্রন্থ (বুক অব মাকাবিজ) আবার একটু পৃথক ধরনের। এ সকল গ্রন্থে বর্ণিত ঘটনাবলী খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর। এ আমলের ঘটনাবলীর এটাই সবচেয়ে নির্ভূল বিবরণ। এ কারণে এ গ্রন্থগুলি খুবই গুরুত্তপূর্ণ।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ঐতিহাসিক নামে যে গ্রন্থগুলি শ্রেনীবদ্ধ করা হয়েছে তাঁর একখানির সঙ্গে অপর খানির কোনই মিল নেই। কোন কোন গ্রন্থে ইতিহাস সঠিকভাবে বর্ণিত হয়েছে বটে, কিন্তু কোন কোন গ্রন্থে আবার বর্ণিত হয়েছে খেয়ালখুশী মত।

নবীদের গ্রন্থ সমূহ
এ শিরোনামে আমরা সেই সকল নবীর শিক্ষার বিবরণ দেখতে পাই, ওল্ড টেস্টামেন্টে যাদের মূসা, স্যামুয়েল, ইলিয়াস ও এলিশার ন্যায় বড় নবীদের থেকে আলাদা করে শ্রেনীভূক্ত করা হয়েছে। ’ঐ বড় নবীদের শিক্ষার বিবরণ অন্যান্য গ্রন্থে আছে।
নবীদের গ্রন্থে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত ঘটনাবলীর বিবরণ আছে।
খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে আমোস, হোসিয়া, ইসাইয়া ও মিশাহ নবীর গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। আমোস নবীর গ্রন্থ সামাজিক অবিচারের নিন্দাবাদের জন্য বিখ্যাত। হোসিয়া তাঁর ধর্মীয় বিকৃতির জন্য পরিচিত। প্রকৃতি পুজারী সম্প্রদায়ের একজন সেবাদাসী অর্থাৎ পবিত্র বারবনিতাকে বিয়ে করতে বাধ্য হওয়ায় তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে দৈহিক যন্ত্রণা ভোগ করেন। এ ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, জনগণ পাপাচারী হলে আল্লাহ যেমন কষ্ট পান, কিন্তু তবুও তাদের ভালোবাসেন, এ ব্যাপারটিও ঠিক সেরকম। ’ইসাইয়া একজন রাজনৈতিক ইতিহাসের ব্যাক্তিত্ব। ’রাজা-বাদশাহগণ তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং সেইমত কাজ করেন। তিনি অতিশয় জাকজমকের সঙ্গে জীবন যাপন করেন। তাঁর নিজস্ব প্রচার কার্য ছাড়াও বিভিন্ন প্রশ্নের তিনি যে জবাব দিয়েছে, তাঁর মুরীদ্গণ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত তা প্রকাশ করেছেন। তাঁর শিক্ষায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং আল্লাহর বিচারকে ভয় করার কথা আছে। তিনি ইহুদীদের মিসর ত্যাগের পর মুক্তি লাভ এবং তাদের ফিলিস্তিনে প্রত্যাবর্তনের ঘটনাও বর্ণনা করেছেন। দ্বিটিয় ও তৃতীয় ইসাইয়ার ক্ষেত্রে তাদের নবুয়াতির কার্য যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ছিল, তা প্রায় দিবালোকের মতই স্পষ্ট। ইসাইয়ার সমসাময়িক মিশাহর শিক্ষাও মোটামুটি একই ধরনের ছিল।
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে জেফানিয়াহ, জেরেমিয়াহ, নাহুম ও হাবাক্কুক তাদের ধর্মীয় প্রচার কার্যের জন্য খ্যাতি লাভ করেন। জেরেমিয়াহ শহীদ হন এবং বারুদ তাঁর শিক্ষা ও বানী সংগ্রহ করে একত্রিত করেন। বারুদ সম্ভবত বিলাপ (ল্যামেন্টেশন) এরও লেখক।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইহুদীদের ব্যাবিলনে নির্বাসিত থাকার সময় নবীদের তৎপরতা বিশেষ ভাবে বৃদ্ধি পায়। তাদের মধ্যে ইজেকিয়েলের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ণ ছিল। তিনি তাঁর স্বধর্মীদের সান্তনা দিতেন এবং আশার বানী শুনাতেন। ওবাদিয়াহর গ্রন্থে বিজিত জেরুসালেমের দৈন্য দুর্দশা বর্ণনা করা হয়েছে।
খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সালে নির্বাসন শেষ হওয়ার পর হাজ্ঞাই ও জাকারিয়া নবীর তৎপরতা শুরু হয়। তারা মন্দির পুননির্মানের আবেদন জানান। এ পুওনির্মাণ শেষ হওয়ার পর মালাচির নামে কিছু রচনা প্রকাশিত হয়। এ রচনাগুলি ছিল মূলত আধ্যাত্মিক বিষয়ের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ।
ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লেখযোগ্য কোন পাঠ না থাকা সত্ত্বেও ইউনুসের গ্রন্থকে যে কিভাবে নবীদের গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে তাঁর কোন সঙ্গত কারণ খুজে পাওয়া যায় না। ইউনুসের গ্রন্থে যে প্রধান শিক্ষা পাওয়া যায়, তা হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছার সামনে আত্মসমর্পন করার প্রয়োজনীয়তা।
ড্যানিয়েলের গ্রন্থ তিনটি ভাষায় লিখিত। হিব্রু, গ্রীক, ও আর্মায়িক। খ্রিস্টান সমালোচকগণ মনে করেন, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, এ গ্রন্থে সুসমাচার আছে বটে, কিন্তু তা বিশৃঙ্খল ও স্ববিরোধী। এ গ্রন্থ সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর মাকাবাইয়ান আমলের। ই জ্যাকোব মনে করেন যে, নাজাতের দিন অতি নিকটে, এ কথা বলে লেখক তাঁর স্বদেশবাসীর ঈমান রক্ষা করতে চেয়েছিলেন।

কবিতা ও জ্ঞানের গ্রন্থ
এ শিরোনামে শ্রেনীবদ্ধ গ্রন্থগুলিতে প্রশ্নাতীত সাহিত্যিক সামঞ্জস্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।
এগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে সামস (প্রার্থনা সঙ্গীত) এবং তা হিব্রু কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শনও। অধিকাংশ প্রার্থনা সঙ্গীতের রচয়িতা হচ্ছেন দাউদ। অবশিষ্ট গুলি বিভিন্ন পুরোহিতের রচনা। প্রার্থনা ও উপাসনায় ব্যবহৃত এ স্নগীতের বিষয়বস্তু হচ্ছে প্রশংসা, ধ্যান, আরাধনা এবং আবেদন নিবেদন।
খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ থেকে ৫০০ সালের মধ্যে রচিত জবের (হযরত ইয়াউবের) গ্রন্থ জ্ঞান ও বিষয়ের উৎকৃষ্ট একখানি গ্রন্থ।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জেরুসালেমের পতনের পর বিলাপ (ল্যামেন্টেশনস) নামে যে গ্রন্থ রচিত হয়, তাঁর লেখক সম্ভবত জেরেমিয়াহই হবেন।
এছাড়া কয়েকখানি গ্রন্থের নাম পুনরায় উল্লেখ করা প্রয়োজন। সং অব সঙ্গস হচ্ছে ঐশীপ্রেমের রুপক সঙ্গীতের সংকলন, বুক অব প্রোভার্বস হচ্ছে সলোমন এর দরবারের অন্যান্য জ্ঞানী ব্যক্তিদের বানী সংগ্রহ এবং একলেজিয়াস্টস বাঃ কোহেলেথ হচ্ছে পার্থিব সুখ ও জ্ঞানের সারবত্ত সম্পর্কে গ্রন্থের সংকলন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন উৎস ব্যবহার করে বিভিন্ন বিষয়ে কমপক্ষে সাত শতাব্দী যাবত যা রচনা করেছেন, তা একত্রিত করে মিলিয়ে মিশিয়ে একখানিমাত্র গ্রন্থ বানানো হয়েছে। এ অবস্থায় এ গ্রন্থের একটি অংশ অপর অংশের পরিপূরকই বা হয় কেমন করে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবত এ গ্রন্থকে পূর্নাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বলেই গণ্য করা হোল কেমন করে? কিন্তু তাঁর চেয়েও বড় কথা,”এ গ্রন্থখানিকে ইহুদী ও খ্রিস্টানদেড় অহীর গ্রন্থ’’ বলে গণ্য করা হয় কোন যুক্তিতে? কোন কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে অবশ্য এ ব্যাপারে কিছু মতপার্থক্য আছে কিন্তু মূল বিষয়ে বিরোধ তেমন প্রকট নয়। অদৃশ্য বিষয়ের ধারণা প্রকাশ করা হয়েছে বলে গ্রীক ভাষায় এ গ্রন্থকে”ক্যানন” নামে অভিহিত করা হত।
এ রচনা সংগ্রহের সময় কিন্তু খৃস্টান আমলে শুরু হয়নি, হয়েছে ইহুদী আমলে। এবং প্রাথমিক কাজ সম্ভবত খৃস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতেই শুরু হয়েছিল। এ সংকলনের জন্য প্রথম পর্যায়ে কিছু গ্রন্থ বাছাই করা হয়েছিল। অবশিষ্ট গ্রন্থগুলি পরে যোগ করা হয়। তবে লক্ষনীয়, তৌরাত বাঃ পেন্টাটিউকের অন্তর্ভূক্ত পাচখানি গ্রন্থকে সর্বদাই শীর্ষ স্থান দেয়া হয়েছে। নবীদের ঘোষনা (অসদাচরণের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ শাস্তির ভবিষ্যদ্বানী) সত্যে পরিণত হওয়ার পর তাদের শিক্ষার বিবরণ মূল গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার পথে আর কোন বাঁধার সৃষ্টি হয়নি। তাদের আশার বানীর ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য।, খৃস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে নবীদের”ক্যানন” সুস্পষ্ট আকার লাভ করে।
উপাসনায় ব্যবহার করা হয় বলে সামস (প্রার্থনা সঙ্গীত) এর মত অন্যান্য গ্রন্থ ল্যামেন্টেশনস, বুক অব উইজডম ও বুক অব জবের মত গ্রন্থের সঙ্গে একীভূত করা হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে খৃস্টধর্ম ইহুদী ধর্মের সঙ্গে সংমিশিত ছিল। পরে আমরা দেখতে পাবো যে, কার্ডিনাল ডানিলোর মত আধুনিক সুপন্ডিত লেখক গণ এ সম্পর্কে ব্যাপকভাবে গবেষণা করেছেন। সাধু পলের প্রভাবে নতুন রূপ গ্রহণের আগে খৃস্টধর্ম ওল্ড টেস্টামেন্টের উত্তরাধিকার বিনা দ্বিধায় মেনে নিত। গসপেলের লেখকগণ ওল্ড টেস্টামেন্টের ধারা কঠোরভাবে মেনে চলতেন। কিন্তু পরে এপোক্রিফা (ধর্মীয় উপকথা) বর্জন করে গদপেল সংশোধন করা হলেও ওল্ড টেস্টামেন্টে তেমন কোন সংশোধন করা হয়নি। সেখানে প্রায় সবকিছুই বহাল রাখা হয়েছে।
মধ্যযুগের শেষভাগের আগে এ বিচিত্র সংকলনের বিরুদ্ধে আপত্তি করার মত সাহস অন্ততপক্ষে পাশ্চাত্য দেশে কারো ছিল না। একজনেরও না। মধ্যযুগের শেষভাগ থেকে বর্তমান যুগের শুরু পর্যন্ত সময়ে দু’একজন সমালোচককে সোচ্চার হতে দেখা যায়, কিন্তু গির্জা কর্তৃপক্ষ সর্বদাই তাদের স্তব্ধ করে দিয়েছেন। বর্তমানে অবশ্য সমালোচনামূলক রচনার কোন অভাব নেই, কিন্তু ধর্মীয় বিশেষজ্ঞগণ বহু বিষয়ে সুগভীর গবেষণা করলেও তাদের ভাষায়”অসুবিধাজনক” বিষয়গুলির গভীরে যাওয়া থেকে তারা বিরত ক্তহেকেছেন। এমনকি তারা আধুনিক জ্ঞানের আলোকে ঐগুলি পরীক্ষা করে দেখতেও আগ্রহান্বিত হননি। ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে যেখানে বাইবেলের বিবরণের সদৃশ্য আছে, সেখানে তারা সে সাদৃশ্য প্রমাণ ও সাব্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট মেহনত করেছেন, কিন্তুবাইবেলের বিবরণের সঙ্গে আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের তুলনা থেকে তারা সযত্নে দূরে থেকেছেন। কারণ তারা উপলব্ধি করেছেন যে, এরুপ তুলনা করা হলে সাধারণ মানুষ ইহুদী ও খৃস্টান ধর্মগ্রন্থের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করবে এবং প্রশ্ন উত্থাপন করবে। অথচ এ ধর্মগ্রন্থগুলি এতদিন যাবত সকল সন্দেহ ও সকল প্রশ্নের উর্ধে রয়েছে।

ওল্ড টেষ্টামেন্ট ও বিজ্ঞানঃ কতিপয় সাব্যস্ত সত্য
ওল্ড টেষ্টামেন্ট ও গসপেলে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা আধুনিক জ্ঞানলব্ধ তথ্যের বিরোধী। এ বিরোধীতা যখন বিজ্ঞানের সঙ্গে ঘটে, তখন দেখা যায় বিষয়গুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা আগেই দেখেছি যে, বাইবেলে অনেক ইতিহাসগত ভূল তথ্য রয়েছে। ইহুদী ও খৃস্টান বিশেষজ্ঞদের উল্লেখিত এরুপ কয়েকটি ভুল আমরা উধৃতও করেছি। তারা অতিশয় স্বাভাবিক কারণে ভুলগুলিকে ছোট করে দেখিয়েছেন। কারণ তাদের কাছে এটা স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে যে, ধর্মীয় লেখকগণ ধর্ম অনুসারেই ঐতিহাসিক তথ্য পেশ করেছেন এবং ধর্মের প্রয়োজন পূরণ করার জন্যই তারা ইতিহাস লিখেছেন। পরে আমরা দেখতে পাব যে, মথি (ম্যাথু) লিখিত সুসমাচারে (গসপেল) একইভাবে সত্যকে বিকৃত করা হয়েছে এবং সেই বিকৃতিকে সত্য বলে গ্রহণযোগ্য করার জন্য একই ধরনের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোন পক্ষেই এ প্রক্রিয়া মেনে নেয়া সম্ভব নয়।
যুক্তির ভিত্তিতে বিবেচনা করা হলে বহু স্ববিরোধিতা ও অসম্ভাব্যতার সন্ধান পাওয়া যাবে। একটি ঘটনার বিবরণ লিখতে গিয়ে বিভিন্ন লেখক যদি বিভিন্ন উৎসের ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে একই ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বর্ণিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এটাই একমাত্র কারণ নয় এবং কোন কোন বিশেষজ্ঞ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েও দিয়েছেন যে, একই ঘটনার একাধিক রুপান্তর করা হয়েছে, মূল বর্ণনায় পরে সংযোজন করা হয়েছে এবং প্রথমে ব্যাখ্যা লিখে পরে তাঁর জন্য মূল বর্ণনা প্রস্তুত করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরুপ তৌরাতের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, ফাদার দ্য ভক্স তাঁর জেনেসিসের তরজমার ভূমিকায় (১৩-১৪ পৃষ্ঠা) এরুপ বহু অসঙ্গতি ও স্ববিরোধিতার উল্লেখ করেছেন। পরে আমরা কয়েকটি নমুনা পেশ করব। তবে মূল বর্ণনা পড়ার পর পাঠক যদি মনে করেন যে, পঠিত বিষয় আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়, তাহলে তাকে বোধহয় খুব দোষ দেয়া যাবে না। আপাতত আমরা কয়েকটি নমুনা পেশ করছিঃ
জেনেসিসে (৬.৩) বলা হয়েছে, বন্যার ঠিক আগে আল্লাহ স্থির করলেন যে, মানূষের জীবনকাল অতঃপর একশত বিশ বছর সীমাবদ্ধ হবে-”তাহার হায়াত একশত বিশ বয়সর হইবেক।” কিন্তু পরে আবার ঐ জেনেসিসেই (১১.১১, ১০.৩২) দেখা যাচ্ছে যে, নূহের দশ জন আওলাদের হায়াত ১৪৮ থেকে ৬০০ বছর পর্যন্ত হয়েছে (পরে সংযোজিত তালিকায় ইব্রাহীম পর্যন্ত নূহের দশজন আওলাদের হায়াতে দেখুন) । এ দুটির বর্ণনায় অসঙ্গতি খুবই স্পষ্ট। কিন্তু তাঁর কারণ কি? কারণ হচ্ছে এই যে, প্রথম বর্ণনাটি (জেনেসিস ৬, ৩) খৃস্টপূর্ব দশম শতাব্দীর ইয়াহভিষ্ট গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে এবং দ্বিতীয় বর্ণনাটি (জেনেসিস ১১, ১০-৩২) নেয়া হয়েছে খৃস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর স্যাকারডোটাল সংস্করণ থেকে। এ সংস্করনটিই হচ্ছে নসবনামার মূল উৎস। প্রত্যেক পয়গম্বরের হায়াত এ নসবনামায় একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়েছে বটে কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে ব্যাপারটি অসম্ভব বলে মনে হবে।
এ জেনেসিসেই আমরা আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে অসঙ্গতির শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন দেখতে পাই। নিম্নলিখিত তিনটি গুরুত্তপূর্ণ বিষয়ে এ অসঙ্গতি রয়েছেঃ
(১) দুনিয়া সৃষ্টি এবং তাঁর বিভিন্ন পর্যায়।
(২) দুনিয়া সৃষ্টির তারিখ এবং মানুষের দুনিয়ায় আসার তারিখ।
(৩) বন্যার বিবরণ।
এখন আমরা পর পর এ তিনটি বিষয় আলোচনা করব।

দুনিয়া সৃষ্টি
ফাদার দ্য ভক্স উল্লেখ করেছেন যে, জেনেসিসের”শুরুতেই দুনিয়া সৃষ্টি সম্পর্কে পাসাপাশি দুটি বিবরণ রয়েছে।” এখন এ বিবরণ দুটি আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা, তা আমরা পর পর পরীক্ষা করে দেখব।

প্রথম বিবরণ
জেনেসিসের প্রথম অধ্যায় এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকেই এ প্রথম বিবরণ রয়েছে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, ভূল ও অসত্যের এমন সমাবেশ আর কোথাও নেই। সুতরাং প্রত্যেকটি অনুচ্ছেদ পৃথক পৃথকভাবে পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। এখানে যে উধৃতি দিয়েছি, তা বাইবেলের সংশোধিত স্ট্যান্ডার্ড সংস্করণ থেকে নেয়া হয়েছে (রিভাইজড স্ট্যান্ডার্ড ভার্সনঃ প্রকাশক-বৃটিশ এন্ড ফরেন বাইবেল সোসাইটির পক্ষে ডব্লু এম কলিনস এন্ড সন্স, ১৯৫২) ।

প্রথম অধ্যায়, শ্লোক ১-২:
"আদিতে ইশ্বর আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি করিলেন। পৃথিবী ঘোর ও শূন্য ছিল এবং অন্ধকার জলধির উপর ছিল, আর ইশ্বরের আত্মা জলের উপর অবস্থিতি করিতেছিলেন।”
বর্তমানে আমরা যাকে জ্যোতির্মন্ডল বলি, দুনিয়া সৃষ্টির আগে তা অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল বলে স্বীকার করে নেয়া সম্ভব। কিন্তু তখন পানির অস্তিত্ব ছিল বলে উল্লেখ করা নিছক কল্পনা মাত্র। পরে আমরা দেখতে পাব যে, জ্যোতির্মন্ডল গঠিত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে গ্যাস বাঃ ধোঁয়ার অস্তিত্ব ছিল বলে যথেষ্ট আভাস পাওয়া যায়। সেখানে পানি থাকার কথা সম্পূর্ণ ভুল।

শ্লোক ৩-৫:
"পরে ইশ্বর কহিলেন দীপ্তি হঊক; তাহাতে দীপ্তি হইল। তখন ইশ্বর দীপ্তি উত্তম দেখিলেন এবং ইশ্বর অন্ধকার হইতে দীপ্তি পৃথক করিলেন। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে এক (প্রথম) দিবস হইল।”
জ্যোতির্মন্ডলে যে আলোক প্রবাহিত হয়, তা তারকারাজির জটিল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল। পরে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। বাইবেলের মতেই সৃষ্টির এ পর্যায়ে তারকারাজি তখনও গঠিত হয়নি। আসলে ১৪ নং শ্লোকের আগে”দীপ্তিসমূহ” উল্লেখই করা হয়নি। ঐ শ্লোকেই চতুর্থ দিনেই আলোক সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে-”রাত্রি হইতে দিবসকে পৃথক করিবার জন্য”, এবং”পৃথিবীতে দীপ্তি দিবার জন্য।” এ বর্ণনা সঠিক। কিন্তু আলোকের কারণ যখন তিন্দিন পরে সৃষ্টি হয়েছিল, তখন প্রথম দিনে আলোকের ইয়ল্লেখ করা অযৌক্তিক। তাছাড়া সৃষ্টির প্রথম দিনেই সন্ধ্যা ও সকালের উলেখ করাও কল্পনা প্রসুত; কেননা, একমাত্র পৃথিবী সৃষ্টির হওয়ার পর এবং তাঁর নিজস্ব জ্যপ্তিস্ক সূর্যের আলোকে পৃথিবী নিজের চারিদিকে একবার পরক্রম করার পরই সন্ধ্যা ও সকাল হওয়ার ধারণা করা সম্ভব হতে পারে।

শ্লোক-৬-৮:
"পরে ইশ্বর কহিলেন, জলের মধ্যে বিতান হঊক, ও জলকে দুভাগে পৃথক করুক। ইশ্বর এরুপে বিতান করিয়া বিতানের উর্ধাস্তি জল হইতে বিতানের অধঃস্তিত জল পৃথক করিলেন। তাহাতে সেইরুপ হইল। পরে ইশ্বর বিতানের নাম আকাশ মন্ডল রাখিলেন। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে দ্বিতীয় দিবস হইল।”
এখানেও পানির সে কাহিনী আছে এবং আকাশ পানিকে দুভাগে বিভক্ত করেছে বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এ বিভক্তির ফলেই বন্যার বর্ণনা দেয়ার সময় বলা সম্ভব হয়েছে যে, উপরের পানি আকাশ অতিক্রম করে দুনিয়ায় এসে পড়েছে।
কিন্তু পানির এভাবে দুভাগে বিভক্ত হওয়ার ধারণাটি বৈজ্ঞানিক কারণে গ্রহণযোগ্য নয়।

শ্লোক ৯-১৩:
"পরে ইশ্বর কহিলেন, আকাশমন্ডলের নিচস্থ সমস্ত জল একস্থানে সংগৃহীত হউক ও স্থল সপ্রকাশ হউক; তাহাতে সেইরুপ হইল। তখন ইশ্বর স্থলের নাম ভূমি ও জলরাশির নাম সমুদ্র রাখিলেন; আর ইশ্বর দেখিলেন যে, তাহা উত্তম। পরে ইশ্বর কহিলেন, ভূমি তৃণ, বীজোৎপাদক ওষধি ও স্বজীব স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী ফলের উৎপাদক ফলবৃক্ষ ভূমির উপরে উৎপন্ন করুক; তাহাতে সেইরুপ হইল। ফলত ভূমি তৃণ, স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী বিজোৎপাদক ওষধি, ও স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী সবীজ ফলের উৎপাদক বৃক্ষ উৎপন্ন করিল; আর ইশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল উত্তম। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইতে দিবস হইল।”
পৃথিবী নিমজ্জিত থাকার সময় ক্রমে ক্রমে জমি ভেসে উঠেছিল, এ ধারণাটি বৈজ্ঞানিকভাবেই গ্রহণযোগ্য। কিন্তু সূর্য সৃষ্টি হওয়ার আগে একটি সুশৃঙ্খল লতা-গুল্ম বৃক্ষ ব্যবস্থা এবং বীজের মারফত তাঁর উৎপাদন প্রবাহ সৃষ্টি হওয়ার ধারণা আদৌ যুক্তিসংগত হতে পারে না এবং একই কারণে দিন রাত্রির বিবর্তন ব্যবস্থাও গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। উল্লেখযোগ্য যে, জেনেসিসের মতেই সূর্য চতুর্থ দিনের আগে সৃষ্টি হয়নি।

শ্লোক ১৪-১৯:
"পরে ইশ্বর কহিলেন, রাত্রি হইতে দিবসকে পৃথক করণার্থে আকাশমন্ডলের বিতানে জ্যোতির্গণ হউক, সে সমস্ত চিহ্নের জন্য, ঋতুর জন্য এবং দিবসের ও বৎসরের জন্য হউক এবং পৃথিবীতে দীপ্তি দেবার জন্য দীপ বলিয়া আকাশমন্ডলের বিতানে থাকুক; তাহাতে সেইরুপ হইল। ফলত ইশ্বর দিনের উপর কর্তৃত্ব করিতে এক মহাজ্যোতি ও রাত্রির উপরে কর্তৃত্ব করিতে তদপেক্ষা ক্ষুদ্র এক জ্যোতি, এ দুই বৃহৎ জ্যোতি এবং নক্ষত্রসমূহ নির্মাণ করিলেন। আর পৃথিবীতে দীপ্তি দিবার জন্য এবং দিবস ও রাত্রির উপরে কর্তৃত্ব করণার্থে এবং দীপ্তি হইতে অন্ধকার পৃথক করণার্থে ইশ্বর ঐ জ্যোতিসমূহকে আকাশমন্ডলের বিতানে স্থাপন করিলেন এবং ইশ্বর দেখিলেন যে, সে সকাল উত্তম। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে চতুর্থ দিবস হইল।”
এ বিবরণ মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য হলেও একটি বড় অসঙ্গতি আছে। আমরা জানি যে, পৃথিবী ও চাঁদ তাদের মূল জ্যোতিষ্ক সূর্যের খন্ডিত অংশ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ার পরে সূর্য ও চাদের সৃষ্টি হওয়ার ধারণাটি সৌরজগত সৃষ্টির সর্বজন স্বীকৃত ও সর্বত্র গৃহীত অভিমতের সম্পূর্ণ বিরোধী।

শ্লোক ২০-২৩:
"পরে ইশ্বর কহিলেন, জল নানা জাতীয় জঙ্গম প্রাণীময় হউক এবং ভূমির উর্ধে আকাশমন্ডলের বিতানে পক্ষীগণ উড়ুক। তখন ইশ্বর বৃহৎ তিমিগণের ও যে নানা জাতীয় জঙ্গম প্রানণিবর্গে জল প্রাণিময় আছে, সে সকলের এবং নানা জাতীয় পক্ষীর সৃষ্টি করিলেন। পরে ইশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল উত্তম। আর ইশ্বর সে সকলকে আশির্বাদ করিয়া কহিলেন, তোমরা প্রজাবন্ত ও বহুবংশ হও, সমুদ্রের জল পরিপূর্ণ কর এবং পৃথিবীতে পক্ষীগণের বাহুল্য হউক। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে পঞ্চম দিবস হইল।” এ অনুচ্ছেদে এমন কিছু বক্তব্য রয়েছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। বলা হয়েছে যে, সামুদ্রিক জীব ও ডানা বিশিষ্ট পাখির আগমনে প্রাণিজগতের শুরু হয়েছে। এবং এটা ঘটেছে পঞ্চম দিবসে। কিন্তু পরের শ্লোকেই বলা হয়েছে যে, পৃথিবীতে প্রাণিজগতের শুরু হয়েছে পরের দিন, অর্থাত ষষ্ঠ দিবসে। একটু পরেই আমরা ষষ্ঠ দিবসের শ্লোক উধৃত করব। সমুদ্রেই প্রাণের শুরু হয়েছে এবং সেখান থেকেই যে পৃথিবীতে প্রাণির আবাদ হয়েছে তা ঠিক, তবে এ বিষয়ে আমরা পর আলোচনা করব। আপাতত আমরা শ্লোকের বিষয়বস্তুতে সীমাবদ্ধ থাকতে চাই। জমির উপরে বসবাসকারী প্রাণী, বিশেষত দ্বিতীয় যুগের এক প্রজাতির সরীসৃপ থেকে পাখির জন্ম হয়েছে বলে ধরা হয়ে থাকে। উভয় প্রজাতির একই ধরনের কতিপয় দৈহিক বৈশিষ্টের কারণে এ অনুমান সম্ভব বলে মনে করা হয়ে থাকে। বাইবেলে কিন্তু ভূমিতে জীবের আবির্ভাবের উল্লেখ করা হয়েছে ষষ্ঠ দিবসে পাখির পরে। সুতরাং পাখির পরে ভূমিতে অন্য জীবের আবির্ভাবে এ ক্রমিকতা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

শ্লোক ২৪-৩১:
"এবং ইশ্বর কহিলেন, ভূমি নানা জাতীয় প্রাণী বর্গ, অর্থাৎ স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী গৃহী পশু, সরীসৃপ ও বন্য পশু উৎপন্ন করুক; তাহাত সেইরুপ হইল। ফলত ইশ্বর স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী বন্য পশু ও স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী গৃহী পশু ও স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী যাবতীয় ভূচর সরীসৃপ নির্মাণ করিলেন; আর ইশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল উত্তম। পরে ইশ্বর কহিলেন, আমরা আমাদের প্রতিমূর্তিতে, আমাদের সাদৃশ্যে মনুষ্য নির্মাণ করি; আর তাহারা সমুদ্রের মৎসদের উপরে, আকাশের পক্ষীদের উপরে, পশুগণের উপরে, সমস্ত পৃথিবীর উপরে ও ভূমিতে গমনশীল যাবতীয় সরীসৃপের উপরে কর্তৃত্ব করুক। পরে ইশ্বর আপনার প্রতিমূর্তিতে মনুষ্য সৃষ্টি করিলেন; ইশ্বরের প্রতিমূর্তিতেই তাহা্কে সৃষ্টি করিলেন, পুরুষ ও স্ত্রী করিয়া তাহাদিগকে সৃষ্টি করিলেন। পরে ইশ্বর তাহাদিগকে আশির্বাদ করিলেন; ইশ্বর কহিলেন, তোমরা প্রজাবন্ত ও বহুবংশ হও এবং পৃথিবী পরিপূর্ণ ও বশীভুত কর, আর সমুদ্রের মৎস্যগণের উপরে, আকাশের পক্ষীগণের উপরে এবং ভূমিতে গমনশীল যাবতীয় জীবজন্তুর উপরে কর্তৃত্ব কর। ইশ্বর আরও কহিলেন, দেখ, আমি সমস্ত ভূতলে স্থিত যাবতীয় বীজোৎপাদক ওষধি ও যাবতীয় সবজী ফলদায়ী বৃক্ষ তোমাদিগকে দিলাম, তাহা তোমাদের খাদ্য হইবে। আর ভূচর যাবতীয় পশু ও আকাশের যাবতীয় পক্ষী, ও ভুমিতে গমনশীল যাবতীয় কীট, এ সকল প্রাণীর আহারার্থে হরিৎ ওষধি দিলাম। তাহাতে সেইরুপ হইল। পরে ইশ্বর আপনার নির্মিত বস্তু সকলের প্রতি দৃষ্টি করিলেন, আর দেখ, সে সকলই অতি উত্তম। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে ষষ্ঠ দিবস হইল।”
সৃষ্টির বর্ণনা এখানেই শেষ হয়েছে। আগে যে সকল প্রাণীর কথা বলা হয়নি, লেখক এখানে তাঁর ফিরিস্তি দিয়েছে এবং মানুষ ও পশু খাদ্যেরও বিবরণ দিয়েছেন।
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, পাখির আগে অন্যান্য প্রাণীর আবির্ভাবে কথা বলা ভূল হয়েছে। অবশ্য অন্যান্য প্রাণীড় আবির্ভাবে পরে মানুষের আবির্ভাবের কথা বলা সঠিক হয়েছে। বাইবেলের প্রথম অধ্যায়ের পর দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম তিনটি শ্লোকে সৃষ্টির বর্ণনা শেষ হয়েছে এভাবেঃ

অধ্যায় ২: শ্লোক-১৩
"এরুপে আকাশমন্ডল ও পৃথিবী এবং তদুভয়স্থ সমস্ত বস্তুব্যুহ সমাপ্ত হইল। পরে ইশ্বর সপ্তম দিনে আপনার কৃতকার্য হইতে নিবৃত্ত হিলেন, সেই সপ্তম দিনে আপনার কৃত সমস্ত কার্য হইতে বিশ্রাম করিলেন। আর ইশ্বর সেই সপ্তম দিনকে আশির্বাদ করিয়া পবিত্র করিলেন, কেননা সেই দিনে ইশ্বর আপনার সৃষ্ট ও কৃত সমস্ত কার্য হইতে বিশ্রাম করিলেন।” এ বিষয়ে এখন কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন।
হিব্রু শব্দ”শাব্বাথ" তরজমার একটি রেওয়াজ মোতাবেক”তিনি বিশ্রাম করিলেন" হয়ে থাকে। এখানেও তাই হয়েছে। কিন্তু আসলে ইশ্বরের বিশ্রাম গ্রহণের ব্যাপারটি একটি কিংবদন্তি মাত্র।
এখানে উধৃত বিবরণটি বাইবেলের স্যাকারডোতাল সংস্করণ থেকে নেয়া হয়েছে। এ সংস্করনটি খৃস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে লিখিত হয়। কিন্তু তাঁর কয়েক শতাব্দী আগে লেখা ইয়াহভিষ্ট সংস্করনে ইশ্বরের বিশ্রাম গ্রহণের কোন উল্লেখ নেই। যারা বিশ্রাম দিবসের কথা লিখেছেন, তারা সাধারণ মানুষের মনে বিশ্বাস ও সম্ভ্রম সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই বলেছেন যে, খোদ ইশ্বরই ঐ দিবস প্রথমে পালন করেছেন। তাছাড়া তারা অপর ছয়টি দিনের সৃষ্টিকার্যও ক্রমিকতা সহকারে বেশ বিস্তারিতভাবেই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু বিজ্ঞানে সৃষ্টি সম্পর্কে যে সকল তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে, তাঁর ভিত্তিতে বিচার বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, তাদের ঐ ক্রমিকতা আদৌ সঠিক নয় বরং খেয়ালিপনা মাত্র।
সৃষ্টির ক্রমিক পর্যায়গুলি যে মাত্র এক সপ্তাহ সময়ের পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে, এধারণাটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ বর্তমানে আমরা সঠিকভাবেই জানতে পেরেছি যে, জ্যোতির্মন্ডল এবং পৃথিবীর গঠন পর্যায়ক্রমে বহুদিনে অর্থাৎ অনেক সময়ের মেয়াদে সম্পন্ন হয়েছে। (এই বিষয়ে কুরআনের বিবরণ আমরা পরে পরীক্ষা করব) । যদি বিশ্রাম দিনের কথা উল্লেখ না করেই সৃষ্টির বিবরণ ষষ্ঠ দিনের বিবরণেই সমাপ্ত করা হয়েছে এবং দিন গুলিকে আসল বাঃ প্রকৃত দিন মনে না করে কুরআনের বিবরণের মত সুদীর্ঘ সময় বলে ধরে নেয়ার মত সুযোগ রয়েছে তবূও বাইবেলের বিবরণ ঘটনার ক্রমিকতার অসম্ভাব্যতার কারণেই বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ওই বিবরণ কল্পিত ও বানোয়াট। সত্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে নয়, অন্য কোন উদ্দেশ্যেই এ বিবরণ রচিত ও প্রতারিত হয়েছে।

দ্বিতীয় বিবরণ
প্রথম বিবরণ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরই কোন মন্তব্য বাঃ অন্তবর্তী বক্তব্য ছড়াই জেনেসিস অর্থাৎ আদিপুস্তকে সৃষ্টির দ্বিতীয় বিবরণ শুরু হয়েছে। এখানে অবশ্য একই ধরনের আপত্তি উত্থাপিত হওয়ার সুযোগ নেই। তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, এ বিবরণট আরও তিন শতাব্দীর পুরানো এবং খুবই সংক্ষিপ্ত। এখানে পৃথিবী ও আকাশমন্ডল সৃষ্টির তুলনায় মানুষ ও তাঁর বাসোপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে বেশী সময় দেয়া হয়েছে।

অধ্যায় ২: শ্লোক ৪-৭
"যেদিন ইয়াউয়েহ ইশ্বর পৃথিবী ও আকাশমন্ডল নির্মাণ করিলেন, সেই সময় পৃথিবীতে ক্ষেত্রের কোন উদ্ভিজ্জ হইত না, আর ক্ষেত্রের কোন ওষধি উৎপন্ন হইত না। কেননা সদাপ্রভূ ইশ্বর পৃথিবীতে বৃষ্টি বর্ষাণ নাই, আর ভূমিতে কৃষিকর্ম করিতে মনুষ্য ছিলনা। তবে ভূমি হইতে বন্যা উঠিয়া সমস্ত ভূতলকে জলসিক্ত করিল। আর ইয়াউয়েহ ইশ্বর মৃত্তিকার ধূলিতে মনুষ্য নির্মাণ করিলেন এবং তাহার নাসিকায় ফু দিয়া প্রাণবায়ু প্রবেশ করাইলেন; তাহাতে মনুষ্য সজীব প্রাণী হইল।”
বর্তমান কালের বাইবেলে এ ইয়াহভিষ্ট বিবরণ পাওয়া যায়। পরে স্যাকাডোটাল বিবরণও যোগ করা হয়েছে। তবে বিবরণটি মূলত এমন সংক্ষিপ্ত ছিল কিনা, সে সম্পর্কে একটি প্রশ্ন থেকে যায়। সময়ের বিবর্তনে বিবরণটি কেতেছেটে ছোট করা হয়েছে কিনা তা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারেন না। অথবা এখন যা পাওয়া যাচ্ছে, তাই মূল বিবরণ কিনা, তাও সঠিক ভাবে জানা যায় না।
এই বিবরণে পৃথিবী ও আকাশমন্ডল নির্মাণের বিস্তারিত বর্ণনা নেই। শুধু বলা হয়েছে যে, ইশ্বর যখন মানুষ সৃষ্টি করেন, তখন পৃথিবীতে উদ্ভিজ্জ ছিল না (তখন ও বৃষ্টি হয়নি), যদিও মাটি থেকে পানি উঠে সমগ্র ভূতল সিক্ত করেছিল। তারপরই বলা হয়েছে যে, মানুষ সৃষ্টির একই সময়ে”ইশ্বর এক উদ্যান প্রস্তুত করিলেন"। সুতরাং মানুষ ও বৃক্ষলতা একই সময়ে সৃষ্টি হয়েছে। এ দুই সৃষ্টির মাঝখানে কত কোটি বছর অতিবাহিত হয়েছে, তা অবশ্য আমরা জানি না।
যাহোক, এ বিবরণের বিরুদ্ধে কেবল ঐ আপত্তিই উত্থাপন করা যায়। স্যাকারডোটাল বিবরণে মানুষ ও পৃথিবীর সৃষ্টি একই সপ্তাহে হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু ইয়াহভিষ্ট বিবরণে তেমন কিছু বলা হয়নি। ফলে এ বিবরণের বিরুদ্ধে তেমন কোন মারাত্মক আপত্তির অবকাশ নেই।

পৃথিবীর সৃষ্টি এবং সেখানে মানুষের আবির্ভাবের তারিখ
ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত তথ্যের ভিত্তিতে প্রণীত ইহুদী পঞ্জিকায় এ দুটি তারিখই সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সে হিসাব অনুসারে খৃষ্টীয় ১৯৭৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধে পৃথিবীর ৫, ৭৩৬ তম বছর শুরু হয়েছে। অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে পৃথিবীর বয়স ৫, ৭৩৬ বছরে পড়েছে। মানুষ সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবি সৃষ্টির কয়েকদিন পরে। সুতরাং মানুষের বয়সও ঐ একই দাঁড়ায়।
এ প্রসঙ্গে সামান্য একটি সংশোধনের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়। প্রাচীনকালে চান্দ্রবর্ষের ভিত্তিতে সময় গণনা করা হত, কিন্তু বর্তমানে পাশ্চাত্য জগতে সময় গণনা করা হয় সৌরবর্ষের ভিত্তিতে। হিসাব নির্ভুল করার জন্য এ সংশোধন করা প্রয়োজন, কিন্তু সংশোধন যদি না করা হয়, তাহলে হেরফের হয় শতকরা মাত্র তিনভাগ। সুতরাং হিসাব সহজ করার জন্য এ হেরফের আমরা উপেক্ষা করছি। এক হাজার বছরের হিসাব যদি তিরিশ বছর এদিক সেদিক হয়, তাহলে আমাদের মূল বক্তব্য বোধহয় খুব একটা ভূল হবে না। সুতরাং হিব্রু হিসাবের ভিত্তিতে আমরা প্রায় সঠিভাবে বলতে পারি যে, খৃষ্টের জন্মের প্রায় সাইত্রিশ শতাব্দী আগে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল।
কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান এ বিষয়ে কি বলে? এ প্রশ্নের সরাসরি কোন জবাব দেয়া কঠিন। তবে সোউরমন্ডল গঠিত হওয়া সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে একটি যুক্তিসঙ্গত হিসাবেও উপনীত হওয়া যেতে পারে। সৌরমন্ডল গঠিত হওয়ার পর থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত সারে চারশো কোটি বছর অতিবাহিত হয়েছে বলে ধরা হয়ে থাকে। সুতরাং এ সর্বজন স্বীকৃত হিসাব এবং ওল্ড টেস্টামেন্টে প্রদত্ত হিসাবের মধ্যে যে পার্থক্য আছে, তা সহজেই বের করা যেতে পারে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আমরা একটু পরে করব। তাঁর আগে আমরা বাইবেল থেকে হিসাব পাওয়ার পদ্ধতির উপর কিছুটা আলোকপাত করব।
বাইবেলের বর্ণনা গভীর মনোযোগ সহকারে পরীক্ষা করলে এ হিসাব পাওয়া যায়। জেনেসিস অর্থাৎ আদিপুস্তকে আদম থেকে ইব্রাহীম পর্যন্ত কত সময় অতিবাহিত হয়েছে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁর পরের পর্যায়ে, অর্থাৎ ইব্রাহীম থেকে খৃষ্টধর্ম শুরু হওয়ার সময় পর্যন্ত কাল সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায়, তা অপর্যাপ্ত। সুতরাং তাঁর পোষকতায় অন্যান্য তথ্যের প্রয়োজন।

আদম থেকে ইব্রাহীম
জেনেসিস বাঃ আদি পুস্তকের ৪, ৫, ১১, ২১, ও ২৫ অধ্যায়ে আদম পর্যন্ত ইব্রাহীমের সকল পূর্বপুরুষের সুনির্দিষ্ট নসবনামা দেয়া আছে। প্রত্যেকের জীবনকাল এবং পুত্রের জন্মের সময় পিতার বয়সও দেয়া আছে। সুতরাং আদম সৃষ্টির কত বছর পর কার জন্ম বা মৃত্যু হয়েছিল তা সহজেই নির্ণয় করা যেতে পারে। নীচের তালিকায় যে সকল তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে, তা জেনেসিসের স্যাকারডোটাল সংস্করণ থেকে নেয়া হয়েছে এবং একমাত্র বাইবেলেই এ তথ্য আছে। এ হিসাব থেকে দেখা যায় যে, আদমের ১, ৯৪৮ বছর পর ইব্রাহীম জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

ইব্রাহীমের নসবনামা
---- আদম সৃষ্টির পর জন্মের তারিখ --- হায়াত --- আদম সৃষ্টির পর মৃত্যুর তারিখ
১) আদম --- - ৯৩০ --- ৯৩০
সেথ --- ১৩০ --- ৯১২ --- ১০৪২
ইনোশ --- ২৩৫ --- ৯০৫ --- ১১৪০
কেনান --- ৩২৫ --- ৯১০ --- ১২৩৫
মাহালালিল --- ৩৯৫ --- ৮৯৫ --- ১২৯০
জারেদ --- ৪৬০ --- ৯৬২ --- ১৪২২
ইনোক --- ৬২২ --- ৩৬৫ --- ৯৮৭
মেথুছেলা --- ৬৮৭ --- ৯৬৯ --- ১৬৫৬
লামেক --- ৮৭৪ --- ৭৭৭ --- ১৬৫১
১০) নূহ --- ১০৫৬ --- ৯৫০ --- ২০০৬
শেম --- ১৫৫৬ --- ৬০০ --- ২১৫৬
আরফাখশাদ --- ১৬৫৮ --- ৪৩৮ --- ২০৯৬
শেলাহ --- ১৬৯৩ --- ৪৩৩ --- ২১২২
ইবার --- ১৭২৩ --- ৪৬৪ --- ২১৮৭
পেলেগ --- ১৭৫৭ --- ২৩৯ --- ১৯৯৬
রিউ --- ১৭৮৭ --- ২৩৯ --- ২০২৬
সেরুগ --- ১৮১৯ --- ২৩০ --- ২০৪৯
নাহোর --- ১৮৪৯ --- ১৪৮ --- ১৯৯৭
তেরাহ --- ১৮৭৮ --- ২০৫ --- ২৯৮৩
২০) ইবরাহীম --- ১৯৪৮ --- ১৭৫ --- ২১২৩

ইবরাহীম থেকে ঈসা
এ আমলের জন্য বাইবেল কোন সংখ্যাতাত্বিক তথ্য দেয়া হয়নি। সুতরাং ইব্রাহীম থেকে ঈসা পর্যন্ত সময় নির্ণয় করার জন্য আমাদের অন্য উৎসের সন্ধান করতে হবে। বর্তমানে ইবরাহীমের আমল মোটামুটি ভাবে ঈসার আঠার শতাব্দী আগে বলে ধরা হয়ে থাকে। জেনেসিসে ইবরাহীম ও আদমের মধ্যবর্তী সময়ের যে হিসাব পাওয়া যায়, তাঁর ভিত্তিতে হিসাব করলে দেখা যায় যে, আদম হচ্ছেন মোটামুটি ভাবে ঈসার আটত্রিশ শতাব্দীর আগের মানূষ। এ হিসাব স্পষ্টতই ভুল এবং এ ভুল আসছে বাইবেলের আদম-ইবরাহীম আমলের হিসাব থেকে। অথচ ইহুদী পঞ্জিকা এখনও এ হিসাবের উপরই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর ইহুদী পুরোহিতদের আনুমানিক হিসাব এবং আধুনিক তথ্যের মধ্যে যে অসঙ্গতি রয়েছে, তাঁর ভিত্তিতে আমরা অতি সহজেই বাইবেলের সত্যের ঐতিহ্যবাহী রক্ষকদের মুকাবিলা করতে পারি। অথচ বহু শতাব্দী যাবত তাদের এ হিসাবের ভিত্তিতেই ঈসার জীবনের প্রাচীন ঘটনাবলীর সময় নির্ণয় করা হয়েছে।
আধুনিক যুগ শুরু হওয়ার আগে বাইবেলের প্রত্যেক সংস্করণে একটি ভূমিকা জিড়ে দেয়া হত। সেখানে পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে ঐ সংস্করণের সম্পাদনার সময় ঘটনাবলীর ক্রমিকতা ব্যাখ্যা করা হত। বিভিন্ন সংস্করণে সময়ের বেশ হেরফেরও হত। উদাহরণ স্বরুপ ১৬২১ সালের ক্লিমেনটাইন ভালগেট সংস্করণে ইবরাহীমের যামানা আরও আগে বলে ধরা হয়েছে এবং পৃথিবীর সৃষ্টি মোতামুটিভাবে খৃষ্টপূর্ব চল্লিশতম শতাব্দীতে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে সপ্তদশ শতাব্দীতে কয়েকটি ভাষায় লিখিত ওয়ালটনের বাইবেলে ইব্রাহীমের পূর্বপুরুষদের যামানার বিবরণ এখানে বর্ণিত নসবনামার অনুরুপ আকারে দেয়া হয়েছে। প্রায় সকল হিসাবই এ নসবনামার সঙ্গে মিলে যায়। আধুনিক যুগের বাইবেল সম্পাদক গণ অবশ্য এ হিসাব ও ভূমিকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তারা বুঝতে পেরেছেন যে, আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে পৃথিবী সৃষ্টি আরও আগে হয়েছে বলে সাব্যস্ত হয়েছে; সুতরাং ঐ পুরানো হিসাব এখন আর কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এ সঙ্গে পাঠকদের পরিষ্কার ভাবে বলে দেয়া তাদের উচিত ছিল যে, বাইবেলের বর্ণনা অচল হয়ে গেছে এবং তাতে আসল সত্যতা নেই। কিন্তু এ কথাটি তারা বলেননি। পক্ষান্তরে কথার মারপ্যাচে তারা এমন একটি রহস্যময় আবরণ সৃষ্টি করেছেন, যার ফলে কোনরকম রদবদল ছাড়া বাইবেলের বিবরণ যেমন আছে, ঠিক সেভাবেই যেন সর্বত্র গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
এ কারণে স্যাকারডোটাল সংস্করণে বর্ণিত নসবনামা এখনও মেনে নেয়া হয়, যদিও এ বিংশ শতাব্দীতে ঐ গালগল্প ভিত্তিক হিসাব আদৌ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাঁর ভিত্তিতে দুনিয়ায় মানুষের আবির্ভাবের কোন সঠি তারিখ নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কিছুটা ইশারা ইংগিত পাওয়া যেতে পারে মাত্র। তবে আমরা প্রায় নিশ্চিতভাবেই ধরে নিতে পারি যে, পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ার একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মানুষের মত একই অবয়ব বিশিষ্ট আরও প্রাণী আছে বা থাকতে পারে। কিন্তু কর্মক্ষমতা ও বুদ্ধিবৃত্তিই মানুষকে তাদের থেকে পৃথক বলে চিহ্নিত করে থাকে। এ মানুষের যে প্রাচীনতম অস্থি এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে, তা থেকে অনুমান করা যায় যে, মানূষের আবির্ভাব লক্ষ্য লক্ষ্য বছর আগে হয়েছে।
এ অনুমানের ভিত্তি হচ্ছে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষে অস্থির সাম্প্রতিকতম আবিষ্কার। বিশেষোজ্ঞদের ভাষায় এ মানুষ ক্রো-ম্যাগনন মানূষ নামে অভিহিত। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মানুষের মত একই অবয়বের প্রাণীর বহু প্রাচীন অস্থিও আবিষ্কৃত হয়েছে বটে এবং সেগুলো স্পষ্টতই আরও আগের আমলের। কিন্তু সেগুলি আসলে মানুষেরই অস্থি কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে।
তবে জেনেসিসে মানুষের আবির্ভাবে যে সময়ের কথা বলা হয়েছে, বৈজ্ঞানিক তথ্য যে তাঁর অনেক আগের সময় নির্দেশ করে থাকে, সে সম্পর্কে কোনই সন্দেহ নেই। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বাইবেল ও আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য ও বিরোধ রয়েছে।

বন্যা ও প্লাবন
জেনেসিসের ৬ষ্ঠ, ৭ম, ও ৮ম অধ্যায়ে বন্যার বর্ণনা আছে। বর্ণনা আসলে দুটি, কিন্তু তা পাশাপাশি পেশ না করে একত্রে মিশিয়ে একটি বর্ণনার আকারে পেশ করা হয়েছে এবং মিশিয়ে ফেলার কাজটি এমন ভাবে করা হয়েছে, যাতে ক্রমিকতা ও সঙ্ঘবদ্ধতার দিক থেকে বাহ্যত একটি বর্ণনা বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। ঐ তিনটি অধ্যায়ে স্পষ্ট পরষ্পর বিরোধিতা রয়েছে। কারণ সেই একই, অর্থাৎ বিষয়বস্তু দুটি উৎস থেকে নেয়া হয়েছে। একটি ইয়াহভিষ্ট সংসকরণ, এবং অপরটি স্যাকারডোটাল সংস্করণ।
এ দুটি সংস্করণের বিবরণ থেকে অনুচ্ছেদ বা বাক্য নিয়ে একটির প অপরটি এমনভাবে বসানো হয়েছে যে, ইংরাজী অনুবাদের প্রায় একশো লাইনের মধ্যে কমপক্ষে সতর বার উৎস বদলের সন্ধান পাওয়া যায়।
যাহোক বিবরণতি মোটামুটি এরুপ - মানুষের পাপাচার সীমাহীন হয়ায় আল্লাহ অন্যান্য প্রাণিসহ তাকে ধ্বংস করতে স্থির করেন। তিনি নূহকে সতর্ক করে দেন এবং নৌকা বানাতে বলেন। ঐ নৌকায়, তিনি অন্যান্য প্রাণীসহ নূহকে তাঁর স্ত্রী, তাঁর তিন ছেলে ও তাদের স্ত্রীদের তুলে দিতে বলেন। এ জায়গা থেকে দুই বর্ণনা পার্থক্য দেখা যায়। এক বর্ণনায় (স্যাকারডোটাল) বলা হয়েছে যে, নূহকে প্রত্যেক প্রজাতির এক জোড়া প্রাণি নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ঠি পরের অনুচ্ছেদেই (ইয়াহভিষ্ট) বলা হয়েছে যে, নূহকে তথাকথিত”পবিত্র” প্রাণীর প্রত্যেক প্রজাতির সাতটি পুরুষ ও সাতটি নারী এবং”অপবিত্র" প্রাণীর প্রত্যেক প্রজাতির একটি পুরুষ ও একটি নারী নিতে বলা হয়েছিল। পরে অবশ্য বলা হয়েছে যে, নূহ আসলে প্রত্যেক প্রজাতির এক জোড়া প্রাণী সঙ্গে নিয়েছিলেন। ফাদার দ্য ভক্সের মত বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, এ অনুচ্ছেদটি ইয়াহভিষ্ট বর্ণনার একটি বিকৃত রূপ।
ইয়াহভিষ্ট অনুচ্ছেদে বৃষ্টির ফলে বন্যা হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে স্যাক্রডোটাল অনুচ্ছেদে বৃষ্টি এবং মাটি থেকে উঠে আসা পানির কথা বলা হয়েছে।
সমস্ত পৃথিবী, এমনকি পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত পানিতে ডুবে গিয়েছিল। সমস্ত প্রাণী মারা গিয়েছিল। এক বছর পর পানি সরে গেলে নৌকা আরলত পাহাড়ে ভেড়ে এবং নূহ অবতরন করেন।
উল্লেখযোগ্য যে, বন্যার মেয়াদের হিসাবেও গরমিল রয়েছে। ইয়াহভিষ্ট বর্ণনায় বলা হয়েছে চল্লিশ দিন, আর স্যাকারডোটাল বর্ণনায় আছে একশো পঞ্চাশ দিন।
নূহের জীবনের কোন পর্যায়ে বন্যা হয়েছিল, সে সম্পর্কে ইয়াহভিষ্ট বর্ণনায় কিছুই বলা হয়নি। কিন্তু স্যাকারডোটাল বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, নূহের বয়স তখন ছয়শো বছর ছিল। এ বর্ণনায় আদম ও ইবরাহীমের সঙ্গে সম্পর্ক দেখিয়ে নূহের নসবনামাও দেয়া হয়েছে। জেনেসিসে দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হিসাব করলে দেখা যায় যে, নূহ আদমের ১০৫৬ বছর পরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন (নসবনামায় দেখুন) । সুতরাং বন্যা হয়েছিল আদম সৃষ্টি হওয়ার ১৬৫৬ বছর পরে। ইবরাহীমের সম্পর্কের প্রসঙ্গে জেনেসিসে বলা হয়েছে যে, তাঁর জন্মের ২৯২ বছর আগে বন্যা হয়েছিল।
জেনেসিসের মতে বন্যার ফলে সমগ্র মানবজাতি এবং পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত প্রাণী ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পরে নূহের তিন ছেলে ও তাদের স্ত্রী গণ দুনিয়ায় মানুষের আবাদ করেন। অর্থাৎ মানবজাতি পূনর্গঠিত হয়। সুতরাং প্রায় তিন শতাব্দী পরে যখন ইবরাহীম জন্মগ্রহণ করেন, তখন মানবজাতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ে পুনর্গঠিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এত কম সময়ের মধ্যে এ পুনর্গঠন কিভাবে সম্ভব হয়েছিল? এ একটি মাত্র প্রশ্নেই এ বর্ণনার সত্যতার সম্ভাবনা বিলীন হয়ে যায়।
তাছাড়া ইতিহাস্র আধুনিক জ্ঞানের সঙ্গেও ঐ বর্ণনার কোন সঙ্গতি নেই। ইবরাহীমের জন্ম খৃষ্টপূর্ব ১৮০০ থেকে ১৮৭৫ সালের মধ্যে বলে ধরা হয়েছে। অথচ বন্যা যদি তাঁর তিনশো বছর আগে হয়ে থাকে, তাহলে তো তাঁর জন্ম খৃশটোপূর্ব একবিংশ থেকে দ্বাবিংশ শতাব্দীর মধ্যে হওয়ার কথা।
ইতিহাসের আধুনিক জ্ঞান থেকে জানা যাচ্ছে যে, দুনিয়ায় কয়েকটি এলাকায় ওই সময় সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল, এবং তাঁর ধ্বংসাবশেষ এখনও দেখতে পাওয়া যায়।
মিসরের ক্ষেত্রে ওই প্রাচীন সভ্যতা মধ্য রাজবংশের (খৃষ্টপূর্ব ২১০০ সাল) আগের আমলের। ঐ আমল মোটামুটিভাবে একাদশ রাজবংশের পূর্ববর্তী প্রথম মধ্যম আমলের সমসাময়িক। ব্যবিলনে তখন উরে তৃতীয় রাজবংশের আমল। আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি যে, এ সভ্যতা প্রবাহে কোন ছেদ পড়েনি, এবং সমগ্র মানব জাতিও ধ্বংস হয়ে যায় নি। অথচ বাইবেলে সেই কথাই বলা হয়েছে।
সুতরাং বাইবেলের এ তিনটি বর্ণনায় সত্য আছে বলে আমরা মেনে নিতে পারি না। নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে আমাদের স্বীকার করা ছাড়া উপায় থাকে না যে, বাইবেলের যে পাঠ এখন আমাদের সামনে আছে, তাঁর সঙ্গে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক নেই। এ অবস্থায় আমাদের নিজের কাছেই প্রশ্ন করতে হয় যে, আল্লাহর অক্ষে সত্য ছাড়া আর কিছু নাযিল করা কি আদৌ সম্ভব? এমন কিছু ধারণা করাও অসম্ভব যে, আল্লাহ মানুষকে যা জানিয়ে দিয়েছেন, তা কেবল অবাস্তবই নয়, পরস্পর বিরোধীও বটে। সুতরাং আমরা স্বভাবতই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, বাইবেলের মূল পাঠে বিকৃতি ঘটেছে এবং বিকৃতি মানুষের দ্বারাই ঘটেছে। মুখে মুখে এক পুরুষ থেকে আর এক পুরুষে আসার সময়, অথবা লিখিত হয়ে যাওয়ার পর তা নকল বা সম্পাদনা করার সময় এ বিকৃতি ঘটেছে। প্রায় তিনশো বছরের মধ্যে জেনেসিসের মত গ্রন্থ যখন কমপক্ষে দুইবার সম্পাদিত ও পরিমার্জিত হয়েছে বলে জানা যায়, তখন সেই কিতাবে অবাস্তবতা ও অসম্ভাব্যতা থাকা বোধহয় বিচিত্র কিছু নয়। অবশ্য এ অবাস্তবতা ও অসম্ভাব্যতা এখন আমাদের কাছে এ কারণে ধরা পড়েছে যে, আধুনিক গবেষণা ও অনুসন্ধানের ফলে পুরোপুরি না হলেও সত্যের কিয়দংশ অন্তত আমরা জানতে পারছি এবং প্রাচীন বিবরণের সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখার সুযোগ পাচ্ছি। বাইবেলের ভূল ভ্রান্তির জন্য মানুষকে দায়ী করা ছাড়া আর কোন যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা নেই এবং সম্ভবত থাকতেও পারে না। অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এইযে, ইহুদী ও খৃস্টান এ উভয় সম্প্রদায়ের অধিকাংশ ভাষ্যকারই এ যুক্তি মেনে নিতে চান না। এ ব্যাপারে তাদের নিজস্ব কোন যুক্তি ও বক্তব্য আছে। সেগুলি সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।

বাইবেলের ভ্রান্তি সম্পর্কে খৃস্টান ভাষ্যকারদের বক্তব্য
বৈজ্ঞানিক তথ্য বিচার বিবেচনায় বাইবেলে যে সকল ভ্রান্তি, অসম্ভাব্যতা, ও স্ববিরোধিতার সন্ধান পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে খৃস্টান ভাষ্যকারদের নানাবিধ বকব্য ও ব্যাখ্যা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। কোন কোন ভাষ্যকার কিছু কিছু ভুল স্বীকার করেন এবং কিছু কিছু জটিল সমস্যার সমাধান দিতে চেষ্টা করেন। কোন কোন ভাষ্যকার আবার ভুল এড়িয়ে গিয়ে মূল পাঠের বক্তব্য সমর্থন করে থাকেন। তারা অযৌক্তিক যুক্তির ধুম্রজাল বিস্তার করে সম্ভবত আশা করেন যে, যা যুক্তিসঙ্গতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, তা মানুষ সহজেই ভুলে যাবে।
ফাদার দ্য ভক্স তাঁর জেনেসিসের তরজমার ভূমিকায় এরূপ বিতর্কিত বক্তব্যের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেছেন বটে, কিন্তু অবৈধতার বদলে তিনি তাঁর বৈধতাই ব্যাখ্যা করেছেন। তবে তিনি অবশ্য প্রাচীন ঘটনাবল্লী যুক্তিসঙ্গত আকারে পুনর্গঠন করার ব্যাপারে উৎসাহ দেখাননি। তাঁর মতে”তাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস উপ্ত্যকার যে একটি বা দুটি ভয়াবহ বন্যার স্মৃতি কালক্রমে লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে বিশ্বব্যাপী বন্যার আকার ধারণ করেছে এবং সেইভাবে বাইবেলে লিখিত হয়েছে" তাঁর কোন নিজস্ব গুরুত্ব নেই। এ ঘটনার”আসল তাৎপর্য হচ্ছে মানুষের বিদ্বেষের প্রতি আল্লাহর ইনসাফ এবং সৎ মানুষের প্রতি তাঁর রহমত। বাইবেলের এ ঘটনার লেখক এ তাৎপর্যটিই সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।”
এভাবে জনপ্রিয় কিংবদন্তিকে আসমানী পবিত্রতায় অভিসিক্ত করার যৌক্তিকতা সাব্যস্ত করা হয়েছে। লেখক তাঁর ধর্মীয় শিক্ষা উদাহরণ সহকারে বুঝাতে গিয়ে কিংবদন্তি ব্যবহার করেছেন, এ যুক্তিতে ঐ কিংবদন্তিকেও মানুষের বিশ্বাসের অংশ বলে পেশ করা হয়েছে। এ ধরণের যুক্তিকে সঙ্গত বলে মেনে নেয়া হলে পবিত্র ও আল্লাহর কালাম সম্বলিত বলে অভিহিত রচনায় অবশ্য যে কোন ধরনের অসম্ভবকে অতি সহজেই সম্ভব বলে চালিয়ে দেয়া যায়। আর আল্লাহর কালামে এভাবে মানুষের হস্তক্ষেপ হয়েছে বলে যদি স্বীকার করে নেয়া হয়, তাহলে অবশ্য বাইবেলের পাঠে সকল প্রকার মানবীয় হস্তক্ষেপ ও রদবদলের একটি সঙ্গত কারণ খুজে পাওয়া যায়। ধর্মীয় উদ্দেশ্য থাকলেই যদি মূল পাঠেও রদবদল করা জায়েজ হয়ে যায়, তাহলে তো আর বলার কিছুই থাকেনা। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি যে, ষষ্ঠ শতাব্দীর স্যাকারডোটাল লেখকগণ কিভাবে তাদের খেয়ালখুশী মাফিক মূল পাঠে রদবদল করেছেন। তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও উচ্চবাচ্য করার আর কোন উপায় থাকে না।
বহু খৃস্টান ভাষ্যকার বাইবেলের বর্ণনায় ভুল, অসম্ভাব্যতার ও স্ববিরোধিতার এ কথা বলে ব্যাখ্যা করে থাকেন যে, বাইবেলের লেখক গণ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বা মানসিকতার সামাজিক পটভূমিতে তাদের চিন্তাধারা প্রকাশ করেছেন; ফলে গরমিল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এ ব্যাখ্যা থেকেই বিভিন্ন ধরনের”সাহিত্যিক স্টাইল” এর কথা চালু হয়েছে। অর্থাৎ সমস্যার একটি সর্বরোগের বটিকা খুজে পাওয়া গেছে। দুটি পাঠের মধ্যে কোন সামঞ্জস্যহীনতা পাওয়া গেলে ঐ ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক পটভূমি এবং ভিন্ন ভিন্ন স্টাইলের কথা বলেই তাঁর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এ যুক্তি অবশ্য সকলেই স্বীকার করেন না। কিন্তু তবুও তাঁর ব্যবহার ও প্রয়োগ এখনও বন্ধ হয়নি। পরে নিউ টেস্টামেন্টের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাব যে, সুস্পষ্ট স্ববিরোধিতা ব্যাখ্যা করার জন্যও ঠিক এ যুক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। যুক্তিগ্রাহ্য নয় এমন কোন বিষয়কে গ্রহণযোগ্য করার জন্য আর একটি কৌশল প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। মূল বিষয়ের চারপাশে কৈফিয়ত বা ব্যাখ্যামূলক অন্যান্য নানানবিধ বিষয়ের অবতারণা করা হয়ে থাকে। ফলে পাঠকের দৃষ্টি মূল বিষয় থেকে অন্য দিকে সরিয়ে দেয়া হয়।
কার্ডিনাল দানিয়েলো বন্যা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ঠি এ পন্থাই অবলম্বন করেছেন।”লিভিং গড" নামক পত্রিকার ফরাসী নাম”ডিউ ডিভান্ট” (নম্বর ৩৮, ১৯৭৪, পৃঃ ৯৫-১১২) প্রকাশিত”ফ্লাড ব্যাপ্টিজম জাজমেন্ট" নামক নিবন্ধে তিনি বলেন,”চার্চের প্রাচীনতম কিঙ্গবদন্তিতে বলা হয়েছে যে, বন্যার ধর্মীয় তাৎপর্যে যীশু এবং চার্চের প্রতিচ্ছবি রয়েছে। এটা সবিশেষ তাৎপর্যময় ঘটনা। সমগ্র মানবজাতির উপর একটী রায় স্বরূপ।” তারপর”অক্সিজেন" থেকে উধৃত করে তিনি তাঁর”হোমিলিজ অন ইজেকিয়েল” নামক রচনায় বলেছেন -"সমগ্র বিশ্বের জাহাজডুবি চূড়ায় রক্ষা পায়।” তারপর তিনি আট সংখ্যার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বলেছেন-"পাহাড়ের চূড়ায় আটজন মানুষ রক্ষা পায়। নূহ, তাঁর স্ত্রী এবং তাঁর তিন পুত্র ও তাদের স্ত্রীগণ। এ কারণে আট সংখ্যাটি খুবই গুরুত্বপূর্ন।” জাস্টিন তাঁর”ডায়ালগ” নামক রচনায় যে যুক্তির অবতারণা করেছেন, সেই যুক্তিকে নিজের পক্ষে প্রয়োগ করে তিনি বলেছেন-"পাহাড়ের চূড়ায় আটজন মানুষ রক্ষা পায়। যীশু যে অষ্টম দিনে মৃত অবস্থা থেকে পুনর্জীবিত হয়ে ওঠেন, ঐ আটজন আসলে তারই প্রতীক মাত্র। নূহ হচ্ছেন যীশুর প্রতিচ্ছবি। বন্যার পর তিনি প্রথম জাতকও বটে। যীশু বাস্তবে যা করেছেন, নূহ পূর্বে তাঁর আভাস দিয়েছেন মাত্র।” এ ভাবে তুলনা দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেছেন যে, নূহের
নৌকা ছিল কাঠের এবং যীশুর ক্রস ছিল কাঠের। এ সাদৃশ্য ও সাম্নজস্যের সমধিক তাৎপর্যের কারণেই নাকি বন্যার ধর্মীয় মূল্য বিশেষত বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ কার্ডিনাল সাহেব বলতে চেয়েছেন যে, যীশুর সঙ্গে যার সম্পর্ক বা সাদৃশ্য নেই, তাঁর আদৌ কোন গুরুত্ব নেই।
এ ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক তুলনা সম্পর্কে অনেক কথাই বলা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এ তুলনা একটি ভাষ্য মাত্র এবং তাও এমন একটি ঘটনা সম্পর্কে যে ঘটনা বাইবেলের ভিত্তিতে একটি বিশ্বজনীন ঘটনা বলেও প্রমানিত হয় না এবং সম্যের দিক থেকেও সঠিক বলে ধরে নিই, তাহলে আমরা বড়জোর মধ্যযুগে উপনীত হতে পারি এবং মধ্যযুগ হচ্ছে এমন একটি যুগ, যখন বাইবেল সম্পর্কে একমাত্র সমর্থনমূলক আলোচনা চাড়া আর কোন প্রকারের আলোচনাই সম্ভব ছিল না।
তবে সুখের বিষয় এই যে, ঐ নিষিদ্ধ যুগের আগেই যুক্তিসঙ্গত মনোভাব গ্রহণ করা হয়েছিল এবং তা প্রকাশও করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে সেন্ট অগাস্টিনের নাম করা যেতে পারে। তাঁর চিন্তাধারা তাঁর যুগের তুলনায় স্পষ্টতই যথেষ্ট অগ্রগামী ছিল। সে সে যুগে সেই ফাদার্স অব দি চার্চের আমলে বাইবেলের মূল পাঠ সম্পর্কিত আলোচনায় নিশ্চয়ই সমস্যা দেখা দিয়েছিল। কারণ সেন্ট অগাস্টিন তাঁর ৮২ নম্বর চিঠিতে এ ধরনের সমস্যার উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেছেন -” ক্যানোনিক গ্রন্থগুলি সম্পর্কে আমার গভীরতম শ্রদ্ধাবোধ আছে এবং আমার মনে আদৌ কোন সন্দেহ নেই যে, লেখার সময় লেখকগণ সঠিকভাবেই লিখেছেন এবং কোন ভূল করেননি। কিন্তু এ সকল গ্রন্থে আমি যখন এমন কোন বিবরণ দেখতে পাই যা বাস্তবতার বিরোধী, তখন আমার মনে আর সন্দেহ থাকে না যে, হয় আমার কপিটিতেই ভুল আছে না হয় অনুবাদক মূলের সঠিক অনুবাদ করতে পারেননি, আর না হয় নিজেই ব্যাপারটি ঠিকমত বুঝতে পারিনি। ''
ধর্মগ্রন্থে যে ভূল থাকতে পারে সেন্ট অগাস্টিন তা কল্পনাও করতে পারেননি। ধর্মগ্রন্থ নির্ভুল এ কথাই তিনি জোর দিয়ে বলেছেন। কিন্তু সত্য ও বাস্তবতার বিরোধী কোন বিবরণের মুখোমুখী তিনি ভুলের যে সকল সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করেছেন, তাঁর মধ্যে মূল লেখকের ভুলের কোন উল্লেখ নেই। একজন কৌতুহলী বিশ্বাসীর মনোভাবই এ রকম। তাঁর আমলে বাইবেল ও বিজ্ঞানের যে সকল সমস্যা দেখা দিচ্ছে, তাঁর মত অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে বিচার করলে তাঁর অধিকাংশ সমস্যাই অতি সহজেই সমাধান হয়ে যায়।
পক্ষান্তরে বর্তমান যুগের বিশেষজ্ঞগণ বাইবেলে কোন ভুল আছে বলে স্বীকারই করতে চান না। এ অভিযোগটিকে তারা আদৌ কোন আমল দেন না এবং বাইবেলে যা আছে, তাকেই সর্বশক্তি দিয়ে সমর্থন করে থাকেন। বাইবেলের বিবরণ স্পষ্টতই ইতিহাস ও বিজ্ঞানের বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও যে তা সমর্থন করা প্রয়োজন, জেনেসিসের ভূমিকায় ফাদার দ্য ভক্স তাঁর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন।” বর্তমানে ইতিহাস পাঠের জন্য যে বিধান অনুসরন করা করা হয়",
সেই বিধান মোতাবেক বাইবেলে বর্ণিত ইতিহাস পাঠ না করার জন্য তিনি আবেদন জানিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁর মতে ইতিহাস যেন ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় লেখা সম্ভব। একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, ইতিহাসে যখন ভুল বর্ণনা করা হয়, তখন তা ঐতিহাসিক উপন্যাস হয়ে দাঁড়ায়। সে ক্ষেত্রে সত্য বা তথ্য কখনও মূল বিচার্য বিষয় হয় না। অথচ ভাষ্যকারগণ তবুও বাইবেলের বিবরণের সঙ্গে ভূতাত্বিক, জীবাশ্মতাত্বিক, অথবা প্রাগৈতিহাসিক কোন তথ্য মিলিয়ে দেখতে রাজি হন না। তারা বলেন -”এই সকল কোন বিদ্যার তথ্য বা বিধানের সঙ্গে বাইবেলের মিল থাকার প্রয়োজন নেই। কেউ মিল খুজতে গেলে তা হবে অবাস্তব মুকাবিলা এবং কৃত্রিম তুলনা”
(জেনেসিসের ভূমিকা, ৩৫পৃষ্ঠা) । স্পষ্টতই জেনেসিসের যে সকল বিষয় বৈজ্ঞানিক সত্যের বিরোধী, বিশেষত প্রথম এগারটি অধ্যায়ের বিষয়বস্তর কথা মনে রেখেই এ মন্তব্য করা হয়েছে। কিন্তু ঐ বাইবেলেরই কিছু কিছু বিবরণ যখন আধুনিক অনুসন্ধানে সত্য বলে প্রমানিত হয়েছে, তখন ফাদার দ্য ভক্স আনন্দ প্রকাশ করতে বিলম্ব করেননি।” এই সকল বিবরণের সত্যতায় যারা সন্দেহ পোষণ করেছিলেন, তারা এখন দেখতে পারেন যে ইতিহাস এবং প্রাচীন প্রত্নতত্বের তথ্য থেকে তাঁর সমর্থন পাওয়া গেছে।” (জেনেসিসের ভূমিকা ৩৪ পৃষ্ঠা) ।
অর্থাৎ বিজ্ঞানে যদি বাইবেলের সমর্থন পাওয়া যায়, তাহলে তা বৈধ প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যাবে; কিন্তু সমর্থন যদি না পাওয়া যায়, তাহলে আদৌ কোন তুলনাই করা যাবে না। এ হচ্ছে ভাষ্যকার ও বিশেষজ্ঞদের যুক্তির ধারা।
আধুনিক ধর্মবিধগণ অবশ্য এ মীমাংসার অযোগ্য সমস্যার মীমাংসা করার জন্য একটি উপায় আবিষ্কার করেছেন। তারা সত্যের চিরন্তন ধারণাকেই বদলে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছেন। প্যারিস থেকে লা সেঞ্চুরিয়ান কর্তৃক ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ধর্মবিধ ও লোরেজ লিখিত”বাইবেলের সত্য কি?" (কোয়েলে এস্ট লাভেরিটে দ্য লা বাইবেল) নামক পুস্তকে এ নতুন তত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বর্তমান আলোচনার স্বল্প পরিসরে তাঁর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া সম্ভব নয়। কেবলমাত্র বিজ্ঞান সম্পর্কে ঐ নতুন তত্বে যে রায় দেয়া হয়েছে, এখানে সেইটুকুই তুলে দিলেই বোধহয় যথেষ্ট হবে -”দ্বিতীয় ভ্যাটিক্যান কাউন্সিল বাইবেলের বিবরণের সত্যতা ও অসত্যতা নির্ণয়ের বিধান দেয়া থেকে বিরত থেকেছেন। মৌলিক বিষয়গুলি বিবেচনা করে দেখলে দেখা যাবে যে এরূপ বিধান প্রণয়ন করা আদৌ সম্ভব নয়। কারণ বাইবেলের বর্ণনার সত্যতা নির্ণয়ের জন্য যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বৈধতা বা অবৈধতা নির্ণয় করতে পারে না।
স্পষ্টই সত্যে উপনীত হওয়ার উপায় হিসেবে”বৈজ্ঞনিক পদ্ধতির" বৈধতা সম্পর্কে রায় দিতে চার্চ সক্ষম নয়। কিন্তু প্রশ্ন তো এখানে তা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে প্রমানিত তথ্য সম্পর্কে, কোন তত্ব বা পদ্ধতি সম্পর্কে নয়। বাইবেলের মতে সাইত্রিশ বা আটত্রিশ শতাব্দী আগে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তা যে আদৌ সত্য নয় এটা জানার জন্য এ যুগে খুব বেশী বিদ্বান হওয়ার প্রয়োজন হয় না। আমরা জানি যে, ঐ সময় মানুষের আবির্ভাব হয়নি এবং বাইবেলের নসবনামার ভিত্তিতে ঐ হিসাবে বের করা হয়েছে, তা সন্দেহের অতীত রুপেই ভুল বলে প্রমানিত হয়েছে। লেখক লোরেজ নিশ্চয়ই এ বিষয়ে অবহিত আছেন। মূল সমস্যার মুখোমুখী যাতে না হতে হয়, সেই জন্যই তিনি বিজ্ঞান সম্পর্কে ঐ এড়িয়ে যাওয়া মন্তব্য করেছেন।
বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত বাইবেলের ভুল তথ্যের মোকাবিলায় খৃষ্টান বিশেষজ্ঞগণ যে এ ধরণের ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য করে থাকেন, এ ঘটনা থেকেই প্রমানিত হয় যে, ব্যাপারটি তাদের জন্য সত্যই অস্বস্তিকর এবং এ সঙ্গে আর একটি কথাও প্রমানিত হয়ে যায় যে বাইবেলের এ তথ্যগুলি মানুষের রচিত, কোন অহী নয়।
খৃষ্টান জগতের এ অস্বস্তি দ্বিতীয় ভ্যাটিকান কাউন্সিলেই (১৯৬২-১৯৬৫) সবচেয়ে বেশী প্রকট হয়ে দেখা দেয়। সুদীর্ঘ ইন বছর আলোচনার পর এবং পাচ বার মুসাবিদা করার পর অহী সম্পর্কে একটি ঘোষণার ব্যাপারে তারা একমত হতে সক্ষম হন। প্যারিসে লা সেঞ্চুরিয়ান কর্তৃক ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত অহী সম্পর্কিত ৪ নম্বর কন্সিলিয়ার ডকুমেন্টের ভূমিকায় হিজ গ্রেস ওয়েবার বলেছেন -” যে বেদনাদায়ক পরিস্থিতি কাউন্সিলকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছিল, অবশেষে এ ভাবে তাঁর অবসান ঘটে।”
ঐ দলীলে ওল্ড টেস্টামেন্টের অসম্পূর্ণতা (অধ্যায়-৪, পৃষ্ঠা -৫৩) ও অসঙ্গতি অকপটে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে-”যীশু খৃষ্টের নাজাত কায়েম করার আগে মানবিক পরিস্থিতিতে ওল্ড টেস্টামেন্টের গ্রন্থগুলি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। কে আল্লাহ আর কে মানুষ এবং আল্লাহ তাঁর ইনসাফ ও করুণায় মানুষের সঙ্গে কি আচরণ করে থাকেন, ঐ গ্রন্থগুলি থেকেই তা সকলে জানতে পেরেছিল। গ্রন্থগুলিতে যদিও এমন কিছু বিষয়বস্তু রয়েছে যা অসম্পূর্ণ ও অপ্রচলিত তবুও ঐ গ্রন্থগুলিই প্রকৃত আসমানী শিক্ষার বাহন ও প্রমাণ।
যে সকল বিষয়বস্তু সম্পর্কে”অসম্পূর্ণ" ও”অপ্রচলিত” বিশেষণ প্রয়োগ করা হয়েছে, সেগুলি স্পষ্টতই সমালোচনাযোগ্য এবং একদিন ঐ অনুচ্ছেদ্গুলি হয়ত বর্জনও করা হতে পারে। তবে ভবিষ্যতে যাই ঘটুক না কেন, মূলনীতিটি এখন বেশ পরিষ্কারভাবেই স্বীকার এবং ঘোষণা করা হয়েছে।
উপরে উদ্ধৃত মন্তব্যটি ভ্যাটিকান কাউন্সিলে অনুমোদিত সাধারণ ঘোষণার একটি অংশ। ঘোষণাটি ২, ৩৪৪ ভোটে গৃহীত হয়। মাত্র ৬ টি ভোট বিপক্ষে পড়ে। তবুও ঘোষণাটি পুরোপুরি সর্বসম্মত হয়েছে, এমন কথা বোধহয় বলা যায় না। আসলে ওই অনুমোদিত ঘোষণার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে খোদ হিজ গ্রেস ওয়েবার এমন একটি মন্তব্য করেছেন, যাতে মূল ঘোষণাটিই সংশোধন করে ফেলা হয়েছে। তিনি বলেছেন,”ইহুদী বাইবেলের কোন কোন গ্রন্থ সাময়িকভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে মাত্র, এবং ঐ গ্রন্থগুলিতে এমন কিছু বিষয়বস্তু আছে, যা অসম্পূর্ণ। '''
মূল দলীলে যেখানে”অপ্রচলিত" বলা হয়েছে, ব্যাখ্যায় সেখানে বলা হয়েছে”সাময়িকভাবে গ্রহণযোগ্য", কিন্তু এ দুটি কথায় কি একই অর্থ বুঝা যায়? তদুপরি ওয়েবার”ইহুদী" শব্দটি ব্যবহার করে এরূপ একটি ধারণা দিতে চেয়েছেন যে, মূল দলীলে হিব্রু বাইবেলেরই সমালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু মূল দলীলে”ইহুদী" শব্দটি আদৌ ব্যবহার করা হয়নি। আসলে অংশত অসম্পূর্ণ ও অপ্রচলিত বলে কাউন্সিলে যে গ্রন্থের সমালোচনা করা হয়েছে, তা হচ্ছে খৃষ্টানদেরই ওল্ড টেস্টামেন্ট।

উপসংহার
বাইবেল যেমন আছে ঠিক সে আকারেই তা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। কেউ এ ক্রমবিকাশ ও ক্রমপরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন থাকলে বশ্বাস করা সম্ভব হবে যে, ওল্ড টেস্টামেন্টে একই ঘটনার বিভিন্ন বিবরণ থাকতে পারে এবং স্ববিরোধিতা, ঐতিহাসিক ভ্রান্তি, অসম্ভাব্যতা ও প্রমানিত বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে অসঙ্গতিও থাকতে পারে। মানুষের রচিত একখানি প্রাচীন গ্রন্থে এরূপ ভুলভ্রান্তি থাকা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। একই সময় ও পরিবেশ -পরিস্থিতিতে লেখা অন্য যে কোন গ্রন্থেও ঐ ভুলভ্রান্তি পাওয়া যাবে।
যখন বৈজ্ঞানিক তথ্যভিত্তিক কোন প্রশ্ন উত্থাপন কোঁড়াই সম্ভব ছিলনা এবং অসম্ভাব্যতা ও স্ববিরোধিতা নির্ণয়ের একমাত্র উপায় ছিল ব্যক্তিগত সঙ্গত চিন্তা, তখনই সেন্ট অগাস্টিন বুঝতে পেরেছিলেন যে, আল্লাহ মানুষকে এমন কিছু শিক্ষা দিতে পারেন না, যে বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সুতরাং তিনি এ নীতি নির্ধারণ করেন যে, যা সত্যের বিরোধী তা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে বলে দাবী করা যেতে পারে না। এবং এ নীতির ভিত্তিতে যা বাদ দেয়ার উপযুক্ত তাঁর সবকিছুই তিনি বাইবেল থেকে বাদ দেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।
পরবর্তীকালে বাইবেলের কোন কোন অনুচ্ছেদ যখন আধুনিক জ্ঞানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে সাব্যস্ত হয়েছে, তখন কিন্তু সেই মনোভাব আর অনুসরণ করা হয়নি। সত্যকে সহজভাবে মেনে নিতে রাজী না হওয়ার এ মনোভাব ক্রমে এতই জোরদার হয়েছে যে, সত্য ও বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন ঐ অনুচ্ছেদগুলি বাইবেলে বহাল রাখার যৌক্তিকতা বর্ণনা করে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে।
দ্বিতীয় ভ্যাটিকান কাউন্সিল অবশ্য এ আপোসহীন মনোভাবের জোর অনেকখানি কমিয়ে দিয়েছে। কারণ ওল্ড টেস্টামেন্টের কোন কোন গ্রন্থ সম্পর্কে তারা এ কথা বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, ঐ গ্রন্থে এমন কিছু কিছু বিষয়বস্তু আছে যা”অসম্পূর্ণ ও অপ্রচলিত।” এখন প্রশ্ন হচ্ছে এ অভিমত কি শুধুই অভিমত থেকে যাবে, না বাইবেল থেকে ঐ অনুচ্ছেদগুলি বাদ দেয়ার জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে? আসলে কিন্তু অবস্থা দাড়াচ্ছে এই যে, যতদিন বাদ না দেয়া হচ্ছে ততদিন যাবত কিন্তু ঐ অনুচ্ছেদগুলিই”আল্লাহর কাছ থেকে আসা শিক্ষার বাহন ও প্রমাণ” হিসেবে বহাল থেকে যাচ্ছে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি