হামনা বিনত জাহাশ (রা)
হযরত হামনা (রা) হযরত রাসূলে কারীমের (সা) নিকটাত্মীয়া। রাসূলুল্লাহর (সা) মুহতারামা ফুফু উমাইমা বিনত আবদিল মুত্তালিবের কন্যা। তিনি একদিকে যেমন রাসূলুল্লাহর (সা) ফুফাতো বোন, অন্যদিকে শালীও। উম্মুল মু‘মিনীন হযরত যায়নাব বিনত জাহাশের সহোদরা।[আনসাবুল আশরাফ-১/২৩১; নিসাউন মবাশশারাত বিল জান্নাহ-১/২৪৩] মদীনায় প্রেরিত রাসূলুল্লাহর (সা) প্রথম দূত ও দা‘ঈ (ইসলাম প্রচারক) প্রখ্যাত সাহাবী মুস‘আব ইবন উমাইর (রা) তাঁর প্রথম স্বামী। [জামহারাতুল আনসাব আল-আরাব-১/১৯১; তাবাকাত-৮/২৪১; আল-ইসতী‘আব-৪/২৬২]

হযরত হামনার (রা) স্বামী মুস‘আব ইবন উমাইর (রা) ছিলেন মক্কার বিত্তবান পরিবারের এক সুদর্শন যুবক। তাঁর মা খুনাস বিনত মালিকের ছিল প্রচুর সম্পদ। শৈশব থেকে তিনি প্রাচুর্যের মধ্যে বেড়ে ওঠেন। মা তাঁকে সবসময় দামী দামী পোশাক-পরিচ্ছদে সাজিয়ে রাখতো। মক্কায় তাঁর চেয়ে দামী সগন্ধি আর কেউ ব্যবহার করতো না। পায়ে পরতেন হাদরামাউতের জুতো। পরবর্তীকালে রাসূল (সা) মুস‘আবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলতেন : (আরবী*************)

“আমি মুস‘আবের চেয়ে চমত্কার জুলফী, অধিকতর কোমল চাদরের অধিকারী এবং বেশী বিলাসী মক্কায় আর কাউকে দেখিনি।“

এই যুবক যখন শুনলেন রাসূল (সা) আল-আরকাম ইবন আবিল আরকামের গৃহে অবস্থান করে গোপনে মানুষকে ইসলামের দা‘ওয়াত দিচ্ছেন তখন একদিন সেখানে হাজির হলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন। সেখান থেকে তিনি হলেন মাদরাসায়ে নববীর ছাত্র। নবীর (সা) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে লাভ করেন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্বীয় শিক্ষকের এমন আস্থা অর্জন করেন যে, তিনি তাঁকে দূত ও দা‘ঈ হিসেবে মদীনায় পাঠান। এভাবে তিনি হলেন ইসলামের ইতিহাসের প্রথম দূত ও দা‘ঈ। [নিসা‘মিন আসর আন-নুবুওয়াহ পৃ.৫০]

মক্কায় ইসলামের প্রথম পর্বে যে সকল মহিলা ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর (সা) সুহবত বা সাহচার্য লাভের গৌরব অর্জন করেন হামনা তাঁদের একজন। হামনার গোটা পরিবারই ছিলো মুসলমান। মক্কায় তাঁদের উপর কুরায়শদের অত্যাচার মাত্রাছাড়া রূপ ধারণ করলে তাঁরা নারী-পুরুষ সকলে মদীনায় হিজরাত করেন। হিজরাতকারী পুরুষরা হলেন : আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ, তাঁর ভাই আবূ আহমাদ, উকাশা ইবন মিহসান, শুজা’, উকবা, ওয়াহাবের দুই পুত্র, আরবাদ এবং নারীরা হলেন : যয়নাব বিনত জাহাশ, উম্মু হাবীবা বিনত জাহাশ, জুযামা বিন জানদাল, উম্মু কায়স বিনত মিহসান, উম্মু হাবীব বিনত ছুমামা, উমাইয়া বিনত রুকাইস, সাখবার বিনত তা‘মীম ও হামনা বিনত জাহাশ (রা)।[সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪৭২; দাররুস সাহাবা-৫৫৬]

মদীনায় আসার পর হযরত হামনা (রা) অন্য ঈমানদার মহিলাদের তম আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আত্মনিয়োগ করেন। নবী (সা) ও স্বামীর নিকট থেকে ইসলামী জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে আরো শিক্ষিত করে তোলেন। নিজের নৈতিক মান আরো উন্নত করেন। ফলে মদীনার সমাজে তাঁরা একটি সম্মানজনক মর্যাদার আসন লাভ করেন। এখানে তাঁদের কন্যা সন্তান যয়নাব বিনত মুস‘আব জন্মগ্রহণ করে। [তাবাকাত-৩/১১৬; আনসাবুল আশরাফ-১/৪৩৭]

হযরত রাসূলে কারীমের (সা) মাদানী জীবন যখন প্রতিপক্ষের সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও দ্বন্দ্ধ-সংঘাত আরম্ভ হয় তখন হামনার (রা) ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসিত ও আদর্শমানের। উহুদ যুদ্ধে হামনা (রা) আরো কিছু মুসলিম মহিলাদের সঙ্গে মুজাহিদদের সাথে যোগ দেন। সেদিন তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ যুদ্ধের একজন সৈনিক, প্রত্যক্ষদর্শী হযরত কা‘ব ইবন মালিক (রা) বলেন : “আমি উহুদের যুদ্ধের দিন উম্মু সুলাইম বিনত মিলহান ও উম্মুল মু‘মিনীন আয়িশাকে (রা) নিজ নিজ পিঠে পানির মশক ঝুলিয়ে বহন করতে দেখেছি। হামনা বিনত জাহাশকে দেখেছি তৃষ্ণার্তদের পানি পান করাতে এবং আহতদের সেবা করতে। আর উম্মু আয়মানকে দেখেছি আহতদের পানি পান করাতে।“[আল-ওয়াকিদি, আল-মাগাযী-১/২৪৯, ২৫০; দাররুস সাহাবা-৫৫৬]

উহুদ যুদ্ধে মুস‘আব ইবন উমাইর (রা) সহ সত্তরজন মুসলিম মুজাহিদ শহীদ হন। যুদ্ধ শেষে হামনা (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট যান। রাসূল (সা) তাঁকে বলেন : হামনা! হিসাব কর। হামনা : কাকে? রাসূল (সা) : তোমার মামা হামযাকে। হামযা : (আরবী**********) আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করুন, তার প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ বর্ষণ করুন এবং তাঁকে জান্নাত দান করুন!

নবী (সা) আবার বললেন : আরেকজনকে গণনা কর।

হামনা : কাকে?

নবী (সা) : তোমার স্বামী মুস‘আব ইবন উমাইরকে।

হামনা জোরে একাট চিত্কার দিয়ে বলে উঠলেন : হায় আমার দুখ!

তাঁর এ অবস্থা দেখে রাসূল (সা) মন্তব্য করেন : “নারীর হ্রদয়ে স্বামীর অবস্থান এমন এক স্থানে যা অন্য কারো জন্য নেই।“ এ মন্তব্য তখন করেন যখন তিনি দেখেন, হামনা তাঁর মামা ও ভাইয়ের মৃত্যুতে অটল কয়েছেন, কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর কথা শুনে ভেঙ্গে পড়েছেন।

রাসূল (সা) হামনাকে জিজ্ঞাস করেন : তোমার স্বামীর মৃত্যুর কথা শুনে এমন আচরণ করলে কেন? হামনা বললেন : তাঁর সন্তানদের ইয়াতীম হওয়ার কথা মনে হল এবং আমি শঙ্কিত হয়ে নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেললাম। [সীরাত ইবন হিশাম-২/৯৮; আনসাবুল আশরাফ-১/৪৩৮]

রাসূর (সা) হামনার জন্য দু‘আ করলেন, আল্লাহ যেন তাঁর সন্তানদের জন্য মুস‘আবের স্থলে ভালো কাউকে দান করেন। অতপর হামনা (রা) প্রখ্যাত সাহাবী হযরত তালহা ইবন উবাইদুল্লাহকে (রা) বিয়ে করেন। উল্লেখ্য যে, এই তালহা হলেন, জীবদ্দশায় যে দশজন জান্নাতের সুসংবাদ লাভ করেছেন তাদের অন্যতম। এই তালহার ঔরসে হামনা জন্ম দেন ছেলে মুহাম্মাদ ইবন তালহাকে। হামনার (রা) সন্তানদের প্রতি তিনি ছিলেন দারুণ স্নেহশীল। [আল-ইসাবা-২/২২১; আনসাবুল আশরাফ-১/৮৮; সুনান আবী দাউদ, হাদীস নং-১৫৯০]

উহুদ পরবর্তী যুদ্ধেসমূহে হামনা (রা) যোগদান করতে থাকেন। খায়বারেও তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সংগে যান এবং বিজয়ের পর সেখানে উত্পাদিত ফসল থেকে তিরিশ ওয়াসাক রাসূল (সা) তার জন্য নির্ধারণ করে দেন।[তাবাকাত-৮/২৪১; সীরাত ইবন হিশাম-২/৩৫২]

হযরত হামনার (রা) ছেলে মুহাম্মাদ ইবন তালহার জন্মের পর তিনি তাকে কোলে করে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট নিয়ে যান এবং আবেদন করেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! এর একটা নাম রেখে দিন। রাসূল (সা) তার মাথায় হাত বুলিয়ে নাম মুহাম্মাদ এবং ডাকনাত আবুল কাসিম রাখেন। রাশিদ ইবন হাফস আয-যুহরী বলেন, আমি সাহাবীদের ছেলেদের কেবল চারজনকে পেয়েছি যাঁদের প্রত্যেকের নাম মুহাম্মাদ এবং ডাকনাম আবুল কাসিম। তাঁর হলেন : ১. মুহাম্মাদ ইবন আবী বকর (রা), ২.মুহাম্মাদ ইবন আলী ইবন আবী তালিব (রা), ৩. মুহাম্মাদ ইবন সা‘দ ইবন আবী ওয়াক্কাস (রা), ৪. মুহাম্মাদ ইবন তালহা (রা)। [আল-ইসাবা-৩/৩৫৭]

হযরত হামনার (রা) ছেলে এই মুহাম্মাদ ইবন তালহা উত্তরকালে একজন দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত ও সত্যনিষ্ঠ আবেদ ব্যক্তিতে পরিণত হন। অতিরিক্ত সিজদাবনত থাকার কারণে তাঁর উপাধি হয় ‘সাজ্জাদ‘। হিজরী ৩৬ সনের জামাদি-উল-আওয়াল মাসে উটের যুদ্ধে পিতা তালহার সাথে শাহাদাত বরণ করেন। তালহার (রা) ঔরসে হামনা (রা) আরেকটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। তার নাম ‘ইমরান ইবন তালহা (রা)। [তাবাকাত-৫/১৬৬; জামহারাতু আনসাব আল-আরাব-১/১৩৮; আনসাবুল আশরাফ-১/৪৩৭]

হযরত হামনার (রা) মহত্ব ও মর্যাদা অনেক। তিনি হযরত নবী কারীম (সা) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর থেকে তাঁর পুত্র ইমরান ইবন তালহা বর্ণনা করেছেন। তিনি ছিলেন উম্মুল মু‘মিনীন হযরত যয়নাবের বোন। বর্ণিত হয়েছে, যয়নাবের (রা) জীবন সন্ধা ঘনিয়ে এলে বোন হামনাকে (রা) বলেন : আমি আমার কাফন প্রস্তুত করে রেখেছি। আমার মৃত্যুর পর খলীফা উমার (রা) আমার কাফন পাঠাতে পারেন। যদি পাঠান, তুমি যে কোন একটি সাদাকা করে দিও। যয়নাব (রা) মারা গেলেন। উমার (রা) পাঁচ প্রস্থ কাপড় পাঠালেন। সেই কাপড় দ্বারা তাঁকে কাফন দেওয়া হয়। আর যয়নাবের (রা) প্রস্তুতকৃত কাপড় হামনা সাদাকা করে দেন।[আনসাবুল আশরাফ-১/৪৩৫; আল-ইসাবা-৪/৩০৮] এ ঘটনা ইঙ্গিত করে যে, হযরত হামনা (রা) হিজরী ২০ (বিশ) সনের পরেও জীবিত ছিলেন। কারণ উম্মুল মু‘মিনীন হযরত যয়নাবের (রা) ইনতিকাল হয় হিজরী বিশ সনে। [নিসা‘মিন আসর আন-নুবুওয়াহ-৫৪] আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) আনুগত্যসহকারে ইবাদাত-বন্দেগীর মাধ্যমে এক প্রশংসিত জীবন-যাপন করে তিনি পরলোকে যাত্রা করেন।

উম্মুল মু‘মিনীন হযরত আয়িশার (রা) পূতপবিত্র চরিত্রে কলঙ্ক আরোপের ঘটনায় যারা বিভিন্নভাবে জড়িত পড়েছিলেন তারা হলেন আবদুল্লাহ ইবন উবায়, যায়দ ইবন রিফা‘আ, মিসতাহ ইবন উছাছা, হাসসান ইবন ছাবিত ও হামনা বিনতে জাহাশ। এদের মধ্যে প্রথম দুইজন মুনাফিক এবং অপর তিনজন মু‘মিন। মু‘মিন তিনজন নিজেদের কিছু মানবিক দুর্বলাতা ও ভ্রান্তিবশত এই ফিতনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন।[তাফহীমুল কুরআন, খণ্ড ৩, সূরা আন-নূর, পৃ.১৩৮; হায়াতুস সাহাবা-১/৫৮৮]

হযরত আয়িশার (রা) পবিত্রাতা ঘোষণা করে আল কুরআনের আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূল (সা) এদের সকলকে মিথ্যা কলঙ্ক আরোপের নির্ধারিত শাস্তি প্রদান করেন। [আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৪/১৬০; আনসাবুল আশরাফ-১/৩৪৩; হায়াতুস সাহাবা-১/৫৯০] হযরত হামনার (রা) এমন কর্মে জড়িত হওয়ার কারণ সম্পর্কে হযরত আয়িশা (রা) বলেন, যেহেতু আমার সতীনদের মধ্যে একমাত্র তাঁর বোন যয়নাব ছাড়া আর কেউ আমার সমকক্ষতার দাবীদার ছিলেন না, তাই তিনি তাঁর বোনের কল্যাণের উদ্দেশ্যে আমার প্রতিপক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং ফিতনায় জড়িয়ে পড়েন। [সীরাতু ইবন হিশাম-২/৩০০]
খানসা বিনত আমর ইবন আশ-শারীদ (রা)
হযরত খানসার আসল নাম ‘তুমাদির‘। চপল, চালাক-চোস্ত স্বাভাব ও মন কাড়া চেহেরার জন্যে খানসা নামে ডাকা হতো। খানসা অর্থ বন্যগাভী ও হরিণী। শেষ পর্যন্ত আসল নামটি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় এবং খানসা নামেই ইতিহাসে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। [সাহাবিয়াত-পৃ.১৮১] পিতার নাম ‘আমর ইবন শারীদ।তিনি ছিলেন কায়স গোত্রের সুলায়ম খান্দানের সন্তান।[উসুদুল গাবা-৫/৪৪১; আল-ইসাবা-৪/২৮৭] বানু সুলায়ম হিজায ও নাজদের উত্তরে বসবাস করতো।[ড:উমার ফাররূখ : তারিখ আল-আদাব-১/৩১৭]

দুরায়দ ইবন আস-সিম্মাহ ছিলেন প্রাচীন আরবের একজন বিখ্যাত নেতা। খানসার বিয়ের বয়স হওয়ার পর দুরায়দ একদিন দেখলেন, অতি যত্ন সহকারে খানসা তাঁর একটি উটের গায়ে ওষধ লাগালেন, তারপর নিজে পরিচ্ছন্ন হলেন। এতে ‍দুরায়দ মুগ্ধ হলেন এবং তার নিকট বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। খানসা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে : [ইবন কুতায়বা : আশ-শি‘রু ওয়াশ শু‘আরাউ-পৃ.১৬০] (আরবী* *****)

“তুমি কি দেখতে চাও যে, আমি আমার চাচাতো ভাইদেরকে এমনভাবে ত্যাগ করি যেন তারা তীরের উপরিভাগ এবং বানু জুশামের পরিত্যক্ত বৃদ্ধ?“

দৃরায়দ প্রত্যাখ্যাত হয়ে একটি কবিতা আবৃত্তি করেন, বিভিন্ন গন্থে যার কিছু অংশ সংকলিত হয়েছে। তার দুইটি পংক্তি নিম্নরূপ :[আলা-ইসাবা-৪/২৮৭] (আরবী*******************)

“হে আমার সাথী-বন্ধুগণ, তোমরা তুমাদিরকে স্বাগতম জানাও এবং আমার জন্য অপেক্ষা কর। কারণ, তোমাদের অবস্থানই আমার সম্বল। খুনাস (হরিণী) কি তোমাদের হ্রদয়কে প্রেমে পাগল করে তুলেছে এবং তার ভালোবাসায় তোমরা অসুস্থ হয়ে পড়েছো?“

দুরায়দের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর খানসা বিয়ে করেন স্বগোত্রীয় যুবক রাওয়াহা ইবন আবদির উযযাকে। তাঁর ঔরসে পুত্র শাজারা আবদুল্লাহর জন্ম হয়। কিছুদিন পর রাওয়াহা মারা গেরে তিনি মিরদাস ইবন আবী আমরকে বিয়ে করেন। এই দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে জন্মগ্রহণ করে দুই পুত্র- ইয়াযীদ ও মু‘আবিয়া এবং এক কন্যা উমরা। [আস-সুয়ূতী : দাররুল মানছুস, পৃ.১১০; আশ-শি‘রু ওয়াশ শু‘আরাউ, পৃ.১৬০]

মক্কায় যখন রিসালাত-সূর্যের উদয় হয় এবং তার কিরণে সারা বিশ্ব আলোকিত হয়ে উঠে তখন খানসার (রা) দুই চোখ বিশ্বাসের দীপ্তিতে ঝলমল করে উঠে। তিনি নিজ গোত্রের কিছু লোকের সাথে মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সা) দরবারে ছুটে যান এবং ইসলামের ঘোষণা দান করেন। এ সাক্ষাতে তিনি রাসূলুল্লাহকে (সা) স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনান। রাসূল (সা) দীর্ঘক্ষণ ধৈর্যসহকারে তাঁর আবৃত্তি শোনেন এবং তাঁর ভাষার শুদ্ধতা ও শিল্পরূপ দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে আরো শোনার আগ্রহ প্রকাশ করেন। [উসুদুল গাবা-৫/৪৪১; আল-ইসাবা-৪/৫৫০]

খানসা (রা) কবি ছিলেন। তবে তিনি কাব্য জীবনের প্রথম পর্বে মাঝে মধ্যে দুই-চারটি বয়েত (শ্লোক) রচনা করতেন। আরবের বিখ্যাত আসাদ গোত্রের সাথে তাঁর গোত্রের যে যুদ্ধ হয়, তাতে তাঁর আপন ভাই মু‘আবিয়া নিহত হন এবং সৎ ভাই সাখর প্রতিপক্ষের আবু ছাওর আল-আসাদী নামের এক ব্যক্তির নিক্ষিপ্ত নিযায় মারাত্মকভাবে আহত হন। প্রায় এক বছর যাবত সীমাহীন কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করে ভাইকে সুস্থকরে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। ক্ষত খুব মারাত্মক ছিল। প্রিয় বোনকে দুখের সাগরে ভাসিয়ে তিনি একদিন ইহলোক ত্যাগ করেন। [আল-ইসতী‘আব (আল-ইসাবার পার্শ্ব টিকা)-৪/২৯৬]

খানসা (রা) তাঁর পরলোকগত ‍দুইটি ভাইকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। বিশেষত সাখরের জ্ঞান, বুদ্ধি, ধৈর্য, বীরত্ব, দানশীলতা, সুদর্শন চেহেরা ইত্যাদি কারণে তাঁর স্থান ছিল খানসার (রা) অন্তরের অতি গভীরে। একারণে তার মৃত্যুতে তিনি সীমাহীন দুখ পান। আর সেদিন থেকেই তিনি সাখরের স্মরণে অতুলনীয় সব মরসিয়া (শোকগাঁথা) রচনা করতে থাকেন। [উসুদুল গাবা-৫/৪৪১] ইবন কুতায়বা বলেন : [আশ-শি‘রু ওয়াশ শু‘আরাউ-১৬১] (আরবী********)

“সাখরের শোকে কাঁদতে কাঁদতে তিনি অন্ধ হয়ে যান।“

সাখরকে এত গভীরভাবে ভালোবাসার একটি কারণ ছিল। খানসা (রা) বিয়ে করেছিলেন এক অমিতব্যয়ী ভদ্র যুবককে। তিনি তাঁর সকল অর্থ-সম্পদ বাজে কাজে উড়িয়ে দিয়ে নিস্ব হয়ে যান। খানসা গেলেন ভাই সাখরের নিকট স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে। কিন্তু সাখর তাঁর সম্পদের অর্ধেক বোনের হাতে তুলে দিলেন। তিনি তা নিয়ে স্বামীর ঘরে ফিরে গেলেন। উড়নচণ্ডি স্বামী অল্প দিনের মধ্যে তাও শেষ করে ফতুর হয়ে যায়। খানসা (রা) আবার গেলেন সাখরের নিকট। এবারও সাখর তাঁর সম্পদ সমান দুই ভাগ করে ভালো ভাগটি বোনকে দিয়ে দেন। [ড: উমার ফাররূখ০১/৩১৭] এভাবে সাখর তাঁর সৎ বোনের অন্তরের গভীর এক স্থায়ী আসন গড়ে তোলেন। সাখরের স্মরণে রচিত মরসিয়ায় হযরত খানসা (রা) এমন সব অন্তর গলানো শব্দ নিজের তীব্র ব্যথা-বেদনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন যা শুনে বা পাঠ করে মানুষ অস্থির না হয়ে পারে না। যে কোন লোকের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তাতে বিধৃত আবেগ-অনুভুতি সম্পর্কে প্রফেসর আর, এ, নিকলসন বলেছেন :

“it is impossible to translate the poignant and vivid emotion, the energy of passion and noble simplicity of style which distinguish the poetry of khansa.” [A literary history of the arabs-P. 126]

তার একটি মরসিয়ার কয়েকটি বয়েত নিম্নে উদ্ধৃত হলো, যাতে তার শিল্পরূপ, অলঙ্কারণ ও স্টাইল প্রত্যক্ষ করা যায়।

(আরবী**********)

“হে আমার দুই চোখ, উদার হও, কার্পণ্য করোনা । তোমরা কি দানশীল সাখরের জন্য কাঁদবে না? তোমরা কি কাঁদবে না তার মত একজন সাহসী ও সুন্দর পুরুষের জন্য? তোমরা কি কাঁদবে না তার মত একজন যুব-নেতার জন্য?

তার অসির হাতল অতি দীর্ঘ,[‘অসির হাতল দীর্ঘ‘ হওয়ার অর্থ সে ছিল দীর্ঘাকৃতির।] ছাইয়ের স্তূপ বিশালকায়। [সে ছিল খবই অতিথি সেবক। আর সে কারণে তার গৃহে ছাইয়ের বিশাল স্তূপ হয়ে গেছে] সে তার গোত্রের নেতৃত্ব তখনই দিয়েছে যখন সে ছিল অল্প বয়সী।

যখন তার গোত্র কোন সম্মান ও গৌরবময় কর্মের ‍দিকে হাত বাড়িয়েছে, সেও দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সতরাং সে সম্মান ও সৌভাগ্য নিয়েই চলে গেছে।

তুমি দেখতে পাবে যে, সম্মান ও মর্যাদা তার বাড়ীর পথ বলে দিচ্ছে। সর্বোত্তম মর্যাদও তার প্রশংসা করা উচিত বলে মনে করে।

যদি সম্মান ও আভিজাত্যের আলোচনা করা হয় তাহলে তুমি তাকে মর্যাদার চাদর গায়ে জড়ানো অবস্থায় দেখতে পাবে।।“

প্রাচীন আরবের নারীদের অভ্যাস ও প্রথা অনুযায়ী খানসা (রা) তাঁর ভাইয়ের কবরের পাশে সকাল-সন্ধ্যায় গিয়ে বসতেন, তাকে স্মরণ করে মাতম করতেন এবং স্বরচিত মরসিয়া পাঠ করতেন। সেই সব মরসিয়ার কিছু অংশ নিম্নরূপ : [সাহাবিয়াত-১৮৪]

(আরবী*******************************)

“প্রতিদিনের সূর্যোদয় আমাকে সাখরের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়। আর আমি তাকে স্মরণ করি প্রতিটি সূর্যাস্তের সময়। যদি আমার চারপাশে নিজ নিজ মৃতদের জন্য প্রচুর বিলাপকারী না থাকতো, আমি আত্মহত্যা করতাম।“ [প্রাগুক্ত]

(আরবী******************)

“ওহে সাখর, যদি তুমি আমার দুই চোখেকে কাঁদিয়ে থাক, তাতে কি হয়েছে। তুমি তো একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আমাকে হাসিয়েছো।

আমি তোমার জন্য কেঁদেছি একদল উচ্চকণ্ঠে বিলাপকারীদের মধ্যে। অথচ যারা উচ্চকণ্ঠে বিলাপ করে তাদের চেয়ে উচ্চকণ্ঠে বিলাপ করার আমিই উপযুক্ত।

তোমার জীবনকালে তোমার দ্বারা আমি বহু বিপদ-আপদ দূর করেছি। এখন এই বড় বিপদ কে দূর করবে?

যখন কোন নিহত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা খারাপ কাজ, তখন তোমার জন্য কান্নাকে আমি একটি খুবই ভালো কাজ বলে মনে করি।“

সাখরের মান ও মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন : [আশ-শি‘রু ওয়াশ-শু‘আরাউ-১৬২]

(আরবী**************)

“বড় বড় নেতৃস্থানীয় মানুষ সাখরের অনুসরণ করে থাকে। সাখর এমন একটি পাহাড় সদৃশ যার শীর্ষদেশে আগুন জ্বলছে।“

অর্থাৎ আরবের মানুষ যেমন পর্বত শীর্ষের প্রজ্জ্বলিত আগুনের আলোতে পথ খুঁজে পায়, তেমনি ভাবে সাখরের অনুসরণেও পথ পায়। সাখরের স্মরণে তিনি নিম্নের শোকগাঁথাটিও রচনা করেন : [আল-ইকদুল ফারীদ-৩/২৬৮]

আরবী*****************)

ওহে আমার চোখের কি হয়েছে, ওহে তার কী হয়েছে? সে তার জামা অশ্রু দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে। আস-শারীদের বংশধর সাখরের মৃত্যুর পর যমীন কি তার ভারমুক্ত হয়েছে? (আরবরা বলে থাকে, একজন দুসাহসী অশ্বারোহী যমীনের জন্য ভীষণ ভারী। তার মৃত্যু অথবা হত্যায় যমীন সেই ভার থেকে মুক্ত হয়) অতপর আমি একজন ধ্বংস হয়ে যাওয়া ব্যক্তির প্রতি সমবেদনা প্রাকাশের জন্য শপথ করে বসেছি। আর কন্নারত অবস্থায় প্রশ্ন করছি- তার কী হয়েছে?

সে নিজেই সকল দুখ-কষ্ট বহন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুতরাং আমার নিজের জন্য ভালো কষ্টগুলো অধিক উপযোগী।

আমি নিজেকে একটি পথ ও পন্থায় বহন করবো- হয়তো তা হবে তার বিপক্ষে অথবা পক্ষে।

একবার খানসাকে বলা হলো : আপনার দুই ভাইয়ের কিছু গুণের কথা বলুন তো। বললেন : (আরবী ***************)

“আল্লাহর কসম, সাখর ছির অতীত সময়ের একটি ঢাল এবং পাঁচহাতী নেযার বিষাক্ত লাল ফলা। আর আল্লাহর কসম, মু‘আবিয়া যেমন বক্তা, তেমনি করিত্কর্মাও।

আবার তাকে প্রশ্ন করা হলো : ‍দুই জনের মধ্যে কে বেশী উঁচু মর্যাদা ও গৌরবের অধিকারী? বললেন : আরবী**********)

“সাখর হচ্ছে শীতকালের উষ্ণতা, আর মু‘আবিয়া হচ্ছে বাতাসের শীতলতা।“ আবার প্রশ্ন করা হলো : কার ব্যথা বেশী তীব্র? বললেন : আরবী***************)

“আর সাখর, সে তো হ্রদপিণ্ডের কম্পন। আর মু‘আবিয়া হচ্ছে শরীরের জ্বর।“ তারপর তিনি নিম্নের পংক্তি দুইটি আবৃত্তি করেন : (আরবী**********************)

“তারা দুইজন হলো দুসাহসী রক্তলাল পাঞ্জাওয়ালা সিংহ, রুক্ষ্ম মেজাজ ক্রদ্ধ কালচক্রের মধ্যে দুইটি সাগর, সভা-সমাবেশে ‍দুইটি চন্দ্র, সম্মান ও মর্যাদায় অত্যুচ্চ, পাহাড়ার মত নেতা ও স্বাধীন ।“ [প্রাগুক্ত-৩/২৬৭]

এখানে উদ্ধৃত এ জাতীয় মমস্পর্শী মরসিয়া রচনা ও মন্তব্যের বদৌলতে হযরত খানসা (রা) ইসলাম পূর্ব গোটা আরবে একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী মরসিয়া রচয়িতা হিসেবে বিখ্যাত হয়ে যান।

রাসূলুল্লাহর (সা) ইনতিকালের পর হযরত খানরা (রা) মাঝে-মধ্যে উম্মুল মু‘মিনীন হযরত আয়িশার (রা) সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতে যেতেন। তিনি তত্কালীন আরবের প্রথা অনযায়ী শোকের প্রতীক হিসেবে মাথায় একটি কালো কাপড় বেঁধে রাখতেন। একবার হযরত আয়িশা (রা) তাকে বললেন, এভাবে শোকের প্রতীক ধারণ করা ইসলামে নিষেধ। রাসূলুল্লাহর (সা) ওফাতের পরে আমিও এ ধরণের কোন শোকের প্রতীক ধারণ করিনি। খানসা (রা) বললেন, নিষেধ- একথা আমার জানা ছিল না। তবে আমার এ প্রতীক ধারণ করার একটা বিশেষ কারণ আছে। আয়িশা (রা) কানণটি জানতে চাইলেন।

খানসা (রা) বললেন : আমার পিতা যার সাথে আমার বিয়ে দিয়েছিলেন, সে ছিল তার গোত্রের এক নেতা। তবে ভীষণ উড়নচণ্ডি মানুষ। তার ও আমার সকল অর্থ-সম্পদ জুয়া খেলে উড়িয়ে দেয়। আমরা যখন একেবারে সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়লাম তখন আমার ভাই সাখর তার সব অর্থ-সম্পদ সমান ভাগ করে ভালো ভাগটি আমাকে দেয়। আমার স্বামী কিছুদিনের মধ্যে তাও উড়িয়ে ফেলে। সাখর আমার দুরবস্থা দেখে দুখ প্রকাশ করে এবং আবার তার সকল সম্পদ সমান দুইভাগ করে ভালো ভাগটি আমাকে বেছে নিতে বলে। তার স্ত্রী তখন বলে উঠে, এর আগে একবার খানসাকে তোমার সম্পদের অর্ধেক দিয়েছো- তাও ভালো ভাগটি, এখনও আবার ভালো ভাগটি বেছে নিতে বলছো। তা এভাবে আর কতকাল চলবে? তার স্বামীর অবস্থা তো সেই পূর্বের মতই আছে। সে জুয়া খেলেই সব শেষ করে ফেরবে। সাখর তখন স্ত্রীকে নিম্নের বয়েত দুইটি আবৃত্তি করে শোনায় : [প্রাগুক্ত; আল-ইসাবা-৪/২৯৬]

(আরবী**********************)

“আল্লাহর কসম, আমি তাঁকে আমার সম্পদের নিকৃষ্ট অংশ ‍দিবনা। সে একজন সতী-সাধ্বী নারী, আমার জন্য হেয় ও লাঞ্ছনা যথেষ্ট। আমি মারা গেলে সে তার ওড়না আমার শোকে ফেড়ে ফেলবে এবং কেশ দিয়ে শোকের প্রতীক ফেটা বানিয়ে নিবে।“ উম্মুল মু‘মিনীন, তাই আমি তার স্মরণে শোকের এই প্রতীক ধারণ করেছি। [আশ-শিরু ওয়াশ শুয়ারাউ-১৬১]

দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমারের খিলাফতকালের কোন এক সময় খানসা (রা) গেলেন খলীফার দরবারে। তখন তার বয়স পঞ্চাশ বছর এবং তখনও তিনি মৃত ভাইয়ের জন্য শোক প্রকাশ করে চলেছেন। তার দুই চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে ঝরতে গণ্ডদেশ দাগ পড়ে যায়। খলীফা প্রশ্ন করেন : খানসা, তোমার মুখে এ কিসের দাগ? তিনি বললেন : এ আমার দুই ভাইয়ের জন্য দীর্ঘদিন কান্নার দাগ। খলীফা বললেন : তাদের জন্য এত শোক কেন, তারা তো জাহান্নামে গেছে। খানসা (রা) জবাবে দিলেন : (আরবী*********)[ড: উমার ফাররূখ-১/৩১৭]

“তাদের জন্য শোক করার এটাই বড় কারণ। পূর্বে তাদের রক্তের বদলার জন্য কাঁদতাম, আর এখন কাঁদি তাদের জাহান্নামের আগুনের জন্য“

ইবন কুতায়বার বর্ণনা মতে খানসা (রা) : আরবী*****************)[আশ-শিরু ওয়াশ শু‘আরাউ-১৬১; আল-ইকদূল ফারীদ-৩/২৬৬]

“আগে কাঁদতাম সাখরের নিহত হওয়ার জন্য। আর এখন কাঁদি তার জাহান্নামের শাস্তির কথা ভেবে।“

হযরত খানসা (রা) জাহিলী জীবন থেকে ইসলামী জীবন উত্তরণের পর আচার ও সংস্কারে এবং চিন্তা ও বিশ্বাসে একজন খাঁটি মুসলমানে পরিণত হন। নিরন্তর জিহাদই যে একজন সত্যিকার মসলমানের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য- কথাটি তিনি অনুধাবনে সক্ষম হন। আর এ জন্য তিনি তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কুরবানী করতে কুণ্ঠিত হননি।

হিজরী ষোল সনে খলীফা উমারের (রা) খিলাফতকালে সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক কাদেসিয়া যুদ্ধ। এ যু্দ্ধে বিশাল পারস্য বাহিনী অত্যন্ত সাহস ও দক্ষতার সাথে মুসলিম বাহিনীর মুকাবিল করে। উভয় পক্ষের অসংখ্য সৈনিক হতাহত হয়। হযরত খানসা (রা) তাঁর চার ছেলেকে সংগে করে এ যুদ্ধে যোগ দেন। চূড়ান্ত যুদ্ধের আগের রাতে তিনি চার ছেলেকে একত্র তাদের সামনে উত্সাহ ও উদ্দীপনামূলক যে ভাষণটি দান করেন ইতিহাসে তা সংরক্ষিত হয়েছে। আমরা তার কিছু অংশ পাঠকদের সামনে তুলে ধরলাম :[খাযানাতুল আদাব-১/৩৯৫; জামহারাতুল খুতাবিল আরাব-১/২৩১; আল-ইসাবা-৪/২৮৮]

(আরবী*********************************************)

“আমার প্রিয় সন্তানগণ! তোমরা আনুগত্য সহকারে ইসলাম গ্রহণ করেছো এবং হিজরাত করেছো স্বেচ্ছায়। সেই আল্লাহর নামের কসম-যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। নিশ্চয়ই তোমরা একজন পুরুষেরই সন্তান, যেমন তোমরা একজন নারীর সন্তান। আমি তোমাদের পিতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি, তোমাদের মাতুল কুলকে লজ্জায় ফেলিনি এবং তোমাদের বংশ ও মান-মর্যাদায় কোন রকম কলঙ্ক লেপনও করিনি। তোমরা জন, কাফিরদের বিপক্ষে জিহাদে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের জন্য কত বড় সাওয়াব নির্ধারণ করে রেখেছেন। তোমরা এ কথাটি ভালো রকম জেনে নাও যে, ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের চেয়ে পরকালের অনন্ত জীবন উত্তম। মহামহিম আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন : “হে ঈমানদারগণ! ধৈর্য ধারণ কর এবং মুকাবিলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে সামর্থ হতে পার।“ (আল-ইমরান-২০০) আগামীকাল প্রত্যুষে তোমরা শত্রু নিধনে দূরদর্শিতার সাথে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তার সাহায্য কামনা করবে।“

মায়ের অনুগত ছেলেরা কান লাগিয়ে মায়ের কথা শুনলো। রাত কেটে গেল। প্রত্যুষে তারা একসাথে আরবী কবিতার কিছু পংক্তি আওরাতে আওরাতে রণক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে গেল। [আল-কুরতুবী ও ইবন হাজার সেই সব পংক্তির অনেকগুলি তাদের গ্রন্থে সংকলন করেছেন। (আল-ইসতী‘আব-৪/২৯৬; আল-ইসাবা-৪/২৮৮)] এক পর্যায়ে তারা চূড়ান্ত রকমের বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে সকলে শাহাদাত বরণ করে। শাহাদাতের খবর মা খানসা (রা) শোনার পর যে বাক্যটি উচ্চারণ করেন তা একটু দেখার বিষয়। তিনি উচ্চারণ করেন : (আরবী***********************)[উসুদুল গাবা-৫/৪৪২; জামহারাতুল খুতাবিল আরাব-১/২৩১]

“সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি তাদেরকে শাহাদাত দান করে আমাকে সম্মানিত করেছেন। আর আমি আমার রবের নিকট আশা করি, তিনি আখিরাতে তার অনন্ত রহমতের ছায়াতলে তাদের সাথে আমাকে একত্রিত করবেন।“

যে মহিলা জাহিলী যুগে এক সৎ ভাইয়ের মৃত্যুতে সারা জীবন মরসিয়া লিখে ও শোক প্রকাশ করে গোটা আরবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন, তিনিই এভাবে একসাথে চার ছেলের শাহাদাতের খবর শুনে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞাতা প্রকাশ করেন। তাদের জন্য মাতম, শোকগাঁথা রচনা বা শোকের প্রতীক ধারণ- কোন কিছু করেছেন বলে কোন কথা জানা যায়না। ঈমান কী পরিমাণ মজবুত হলে এমন হওয়া যায়?

খলীফা হযরত উমার (রা) তাঁর ছেলেদের জীবদ্দশায় প্রত্যেকেকে এক শো দিরহাম করে ভাতা দিতেন। শাহাদাতের পরেও তাদের ভাতা হযরত খানসার (রা) নামে জারি রাখেন। তিনি আমরণ সে ভাতা গ্রহণ করেন। [আল-ইসাবা-৪/২৮৮; খাযানাতুল আদাব-১/৩৯৫, ড: উমার ফাররূখ-১/৩১৮]
কবি হিসেবে হযরত খানসার (রা) স্থান
আরবী কবিতায় প্রায় সকল অঙ্গনে খানসার (রা) বিচরণ দেখা যায়। তবে মরসিয় রচনায় তার জুড়ি মেলা ভার। আল্লামা ইবনুল আসীর লিখেছেন : আরবী **************) [উসুদুল গাবা-৫/৪৪১]

“আরবী কাব্যশাস্ত্রের পণ্ডিতরা এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, খানসার পূর্বে ও পরে তাঁর চেয়ে বড় কোন মহিলা কবির জন্ম হয়নি।“

উমাইয়্যা যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আরব কবি জারীর (মৃত্যু-১১০ হি.)। একবার তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল : আরবের শ্রেষ্ঠ কবি কে? জবাবে তিনি বলেছিলেন : আরবী**********)[দুররুল মানছুর-১১০]

“যদি খানসা থাকতেন তাহলে আমিই।“

বাশশার বিন বুরদ ছিলেন আব্বাসী যুগের একজন শ্রেষ্ঠ আরব কবি। তিনি বলেন : আমি যখন মহিলা কবিদের কবিতা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি তখন তাদের প্রত্যেকের কবিতায় একটা না একটা ত্রুটি ও দুর্বলতা প্রত্যক্ষ করি। লোকেরা প্রশ্ন করলো: খাসার কবিতারও কি একই অবস্থা? বললেন : তিনি তো পুরুষ কবিদেরও উপরে। [তাবাকাত আশ-শু‘আরাউ-২৭১]

সকল আরব কবি উমাইয়্যা যুগের লায়লা উখাইলিয়্যাকে একমাত্র খানসা (রা) ছাড়া আরব মহিলা কবিদের মাথার মুকুট জ্ঞান করেছেন। আধুনিক যুগের মিসরীয় পণ্ডিত ড: উমার ফাররূখ হযরত খানসার কাব্য প্রতিভা ও তাঁর কবিতার মূল্যায়ন করেছেন এভাবে : [তারীখ আল-আদাব আল-আরাবী-১/৩১৮]

(আরবী ******************)

“খানসা সার্বিকভাবে শ্রেষ্ট আরব কবি। তাঁর কবিতা সবই খণ্ড খণ্ড। অত্যন্ত, বিশুদ্ধ, প্রাঞ্জল, সূক্ষ্ম, শক্ত গঠন ও চমত্কার ভূমিকা সম্বলিত। তার কবিতায় গৌরব‘ গাথার প্রাধান্য অতি সামান্য। যতটুকু আমরা দেখেছি, বিশেষত তার দুই ভাইয়ের মৃত্যুতে তিনি যে দুখসহ ব্যথা পান সেজন্য মরসিয়ার প্রাধান্য অনেক বেশী। তার মরসিয়ার অর্থ স্পষ্ট, সূক্ষ্ম ও কোমল এবং আবেগ-অনুভূতির সঠিক মুখপত্র। তাতে অত্যাধিক দুখ্য ও পরিতাপ এবং দুই ভাইয়ের প্রশংসায় অতিরঞ্জন থাকা সত্ত্বেও তা বেদুঈন পদ্ধতি ও স্টইলের।“

জাহিলী যুগে সমগ্র আরবের বিভিন্ন স্থানে মেলা প্রদর্শনী ও সভা-সমাবেশ করার রীতি ছিল। এর উদ্দেশ্য হতো পরস্পর মত বিনিময়, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতা। এতে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষ অংশ গ্রহণ করতো। সমগ্র আরববাসী দূর দূরান্ত থেকে এসব মেলায় ছুটে আসতো। এর সূচনা হতো রাবীউল আউয়াল মাস থেকে। এ মাসের প্রথম দিন দুমাতুল জান্দালে বছরের প্রথম মেলা বসতো। এই মেলা শেষ করে তারা হিজরের বাজারে চলে যেত। তারপর উমানে, সেখান থেকে হাদারামাউতে। তারপর ইয়ামেনের সান‘আর আশে-পাশে কোথাও দশ, আবার কোথাও বিশ অবস্থান কারতো। এভাবে গোটা আরব ঘোরার পর হজ্জের কাছাকছি সময়ে জুলকা‘দা মাসে মক্কার কয়েক মাইল দূরে উকাজের [উকাজ: নাখলা ও তায়িফের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। সেখানে সাধারণভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের বাজার বসতো। ৫৪০ খ্রীষ্টাব্দে এ বাজারের পত্তন হয় এবং হিজরী ১২৯ সনে খারেজিদের দ্বারা লুণ্ঠিত হওয়ার সময় পর্যন্ত চালু ছিলো। (ড: আবদুল মুন‘ইম খাফাজী ও ড: সালাহ উদ্দিন আবদুত তাওয়াব : আল-হায়াত আল-আদাবিয়্যা ফী আসরায় আল-জাহেলিয়্যা ওয়া সাদরিল ইসলাম- পৃ. ২৮) তারপর খারেজীদের ভয়ে সেই যে উকাজের মেলা বন্ধ হয়ে যায়, আজ পর্যন্ত আর চালু হয় নি। উকাজের পর আরবের মাজান্না ও জুলমাযায়ের মত প্রাচীন বাজারও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। মক্কার এ জাতীয় সর্বশেষ বাজারটি ধ্বংস করা হয় ১৯৭ হিজরীতে। (আল-আযরুকী : আখবারু মক্কাহ-১২১-২২)] ] বাজারে বছরের সর্বশেষ মেলা বসতো। এ মেলাটি ছিলো আরবের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ। আরবের সকল গোত্রের লোক, বিশেষত গোত্র নেতারা এ মেলায় অবশ্যই যোগদান করতো। কোন গোত্র নেতা কোন কারণে অংশ গ্রহণ করতে না পারলে প্রতিনিধি পাঠাতো। এ মেলার অঙ্গনে আরববাসী তাদের গোত্রীয় নেতা নির্বাচন, আন্ত-গোত্র কলহের মীমাংসা, পারস্পরিক হত্যা ও সংঘাতের অবসান ইত্যাদি বিষয়ের চূড়ান্ত করতো। এই মেলায় মক্কার কুরাইশ গোত্রের সম্মান ও মর্যাদা ছিল সবার উপরে। যখন যাবতীয় বিষয়ের নিষ্পত্তি হয়ে যেত তখন প্রত্যেক গোত্রের কবিরা তাদের স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনাতো। সেসব কবিতার বিষয় হতো বীরত্ব, সাহসিকতা, দানশীলতা, অতিথি সেবা, পূর্ব-পুরুষের শৌর্য-বীর্য, গৌরব, শিকার, আনন্দ-উত্সব, খুন-খারাবি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, শান্তি-সন্ধি, প্রেম-বিরহ, শোক ইত্যাদির বর্ণনা। এখানেই নির্ধারিত হতো আরব কবিদের স্থান ও মর্যাদা।

কবি খানসাও এ সকল মেলা ও সমাবেশে অংশগ্রহণ করতেন এবং উকাজ তার মরসিয়া অপ্রতিদ্বন্দী বলে স্বীকৃতি পায়। তিনি যখন উটের উপর সাওয়ার হয়ে আসতেন তখন অন্য কবিরা তার চার পাশে ভিড় জমাতো। সবাই তার কবিতা শোনার জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকতো। এক সময় সকলকে মরসিয়া শুনিয়ে তৃপ্ত করতেন।

এ সকল মজলিসে খানসার বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের প্রতীক হিসেবে তার তাঁবুর দরজায় একটি পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হতো, আর তাতে লেখা থাকতো-(আরবী*****) কথাটি। যার অর্থ আরবের শ্রেষ্ট মরসিয়া রচয়িতা। ইবন কুতায়বা বলেন : (আরবী*******) [আশ-শিরু ওয়াশ শুয়ারাউ-১৬১; সিফাতু জাযীরাতুল আরাব-২৬৩]

তিনি এসব মৌসুমী মেলায় অবস্থান করতেন। তার হাওদাটি বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হতো। তার পিতা আমর এবং দুই ভাই- সাখর ও মুয়াবিয়ার মৃত্যুর বিপদটিকে আরববাসী খুব বড় করে দেখতো। তিনি কবিতা পাঠ করতেন, আর লোকেরা কাঁদতো।“ জাহিলী আরবে বহু বড় বড় কবি জন্মেছিলেন। আন-নাবিগা আজ-জুরইয়ানী (মৃত্যু ৬০৪ খ্রি) সেই সব বড় কবিদের একজন। তার কাব্যখ্যাতি আজও বিশ্বব্যাপী। তার আসল নাম যিয়াদ ইবন মু‘আবিয়া এবং ডাকনাম আবূ উমামা। আবূ উবায়দা তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন : (আরবী ***************) [সাহাবিয়াত-১৮৬]

“সকল কবির পুরোভগে অবস্থানকরী প্রথম স্তরের অন্যতম কবি তিনি।“ উন্নত মানের প্রচুর কবিতা রচনার কারণে তাঁকে আন-নাবিগা বলা হয়। উকাজ মেলায় কেবল তাঁরই জন্য লাল তাঁবু নির্মান করা হতো। এ ছিল একটি বিরল সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক, যা কেবল তিনি লাভ করার যোগ্য বলে ভাবা হতো। অন্য কারও জন্য এমন লাল তাঁবু নির্মান করা যেত না। এর কারণ, কাব্য ক্ষেত্রে যিনি সর্বজনমান্য, কেবল তিনিই এ মর্যাদা লাভের যোগ্য বলে বিবেচিত হতেন। ইবন কুতায়বা বলেন : (আরবী *****) [আস-শিরু ওয়াশ শু‘আরাউ-১৬০]

“আন-নাবিগার জন্য উকাজে লাল রঙ্গের চামড়ার তাঁবু টাঙ্গানো হতো। সেই তাঁবুতে কবিরা এসে তাকে কবিতা শোনাতো।“

উকাজের মেলা উপলক্ষে কবি আন-নাবিগার সভাপতিত্ব কবি সম্মেলন হতো। আরবের বড় বড় কবিগণ এ সম্মেলনে যোগ দিতেন এবং নিজ নিজ কবিতা পাঠ করে স্বীকৃতি লাভ করতেন। একবার এমনি এক সম্মেলনে তত্কালীন আরবের শ্রেষ্ঠ তিন কবি- আল-আ‘শা আবূ বাসীর, হাসসান ইবন ছাবিত ও খানসা যোগ দেন। প্রথমে আল-আ‘শা, তারপর হাসসান কবিতা পাঠ করেন। সবশেষে পাঠ করেন খানসা। তার পাঠ শেষ হলে সভাপতি আন-নাবিগা তাকে লক্ষ করে বলেন : (আরবী ***********)

“আল্লাহর কসম! এই একটু আগে যদি আবূ বাসীর আমাকে তার কবিতা না শোনাতেন তাহলে আমি বলতাম, জিন ও মানুষের মধ্যে তুমিই সর্বশ্রেষ্ঠ কবি।“

আন-নাবিগার এ মন্তব্য শুনে কবি হাসসান দারুণ ক্ষুব্দ হন। তিনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এভাবে- আল্লাহর কসম! আমি আপনার চেয়ে এবং আপনার পিতা ও পিতামহের চেয়েও বড় কবি। আন-নাবিগা হাসসানের হাত চেপে ধরে বলেন: ভাতিজা তুমি আমার এ শ্লোকটির চেয়ে ভাল কোন শ্লোক বলতে পারবে কি? (আরবী***********)

নিশ্চয় তুমি সেই রাত্রির মত, যে রাত্রি আমাকে ধারণ করে। ‍যদিও আমি ধারণা করেছি, তোমার থেকে আমার দূরত্ব অনেক ব্যাপক।“ অর্থৎ রাত্রির মত তুমি আমাকে বেষ্টন করে আছ – তা আমি যত দূরেই থাকি না কেন। তারপর তিনি খানসাকে বলেন : তাকে আবৃত্তি করে শোনাও।“খানসা তার আরো কিছু শ্লোক আবৃত্তি করেন। তারপর আন-নাবিগা মন্তব্য করেন : (আরবী ****)

“আল্লাহর কসম! আমি দুই স্তনবিশিষ্ট কাউকে তোমার চেয়ে বড় কবি দেখিনি। অর্থাৎ তোমার চেয়ে বড় কোন মহিলা কবিকে দেখিনি।“ সাথে সাথে খানসা আন-নাবিগার কথার সংশোধনী দেন এভাবে- (আরবী************)

“না, আল্লাহর কসম! দুই অণ্ডকোষধারীদের মধ্যেও না।“ অর্থাৎ কেবল নারীদের মধ্যে নয়, বরং পুরুষদের মধ্যেও আপনি আমার চেয়ে বড় কবি দেখেননি। [আবুল ফারাজ আল-ইসফাহানী : কিতাবুল আগানী-১১/৬; আশ-শিরু ওয়াশ শুয়ারাউ-১৬০]

কোন কোন বর্ণনায় এসেছে আন-নাবিগার প্রশ্নের জবাবে হাসসান তাঁর নিম্নের শ্লোকটি পাঠ করে শোনান : আরবী ********)

“আমাদের কাছে বড় বড় স্বচ্ছ ও ঝকঝকে বরতন, পূর্বাহ্ন বেলায় যা চকচক করতে থাকে। আর আমাদের তরবারিসমূহ এমন যে তার হতল থেকে ফোটা ফোটা রক্ত ঝরতে থাকে।“কবি হাসসান তাঁর শ্লোকে নিজের অতিথি সেবা এবং বীরত্ব ও সাহসিকতার কথা বলতে চেয়েছেন। কিন্তু কবি আন-নাবিগা মতান্তরে খানসা হাসসানের শ্লোকটির কঠোর সমালোচনা করে তার ত্রুটিগুলি তুলে ধরেন এবং তাঁর দাবী প্রত্যাখ্যান করেন। [কাদুমা ইবন জা‘ফার : নাকদুশ শি‘র-পৃ. ৬২; আল-আগানী-৯/৩৪০]

মোটকথা, কাব্য শক্তি ও প্রতিভার দিক দিয়ে হযরত খারসার (রা) স্থান দ্বিতীয় স্তরের তত্কালীন আরব কবিদের মধ্যে অনেক উঁচুতে। তার কবিতার একটি ‍দিওয়ান ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে বৈরুতের একটি প্রকাশনা সংস্থা সর্বপ্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করে। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে দিওয়ানটি ফরাসী ভাষায় অনুবাদ হয়। [সাহাবিয়াত-১৮৮]

হযরত খানসার (রা) মৃত্যু সন নিয়ে মতপার্থক্য আছে। একটি মতে, হযরত উসমানের (রা) খিলাফতকালের সূচনা পর্বে ‍হি : ২৪/খ্রি: ৬৪৪-৪৫ সনে তিনি মারা যান। প্রক্ষান্তরে অপর একটি মতে, হি: ৪২/খ্রি: ৬৬৩ সনের কথা এসেছে। [ড: উমার ফাররূখ-১/৩১৮]
আসমা’ বিন্‌ত ইয়াযীদ আল-আনসারিয়্যা (রা)
হযরত আসমা’ (রা) একজন মহিলা আনসারী সাহাবী। তাঁর পিতা ইয়াযীদ ইবন আস-সাকান এবং মাতা উম্মু সা‘দ ইবন যায়স ইবন মাস‘ঊদ। তাঁর স্বামী সা‘ইদ ইবন ‘আম্মারা-যিনি আবূ সা‘ঈদ আল-আনসারী নামে প্রসিদ্ধ।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা‘-২/২৯৬; আল-ইসাবা-৪/৮৯] হযরত আসমার’র ডাকনাম ছিল উম্মু সালামা, মতান্তরে উম্মু ‘আমির। তিনি মদীনায় বিখ্যাত আওস গোত্রের বানূ ‘আবদিল আশহাল শাখার সন্তান। প্রখ্যাত সাহাবী মুআয ইবন জাবালের (রা) ফুফুর কন্যা।[নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্‌-৭৮] ইবন হাজার তাঁকে মু‘আয ইবন জাবালের চাচাতো বোন বলেছেন।[আল-ইসাবা-৪/২২৫]

হযরত আসমা‘র (রা) জন্ম ও বল্যকাল সম্পর্কে বেশী কিছু তথ্য পাওয়া যায় না। তাঁর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে এতটুকু জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় হিজরাতের পর তিনি মুসলমান হন। তিনি বহুবিধ বৈশিষ্টের অধিকারিণী ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন বিশুদ্ধভাষী দারুণ বাকপটু মহিলা। বুদ্ধিমত্তা, ধর্মভীরুতা, ইবাদাত,-বন্দেগী, হাদীছ বর্ণনা ইত্যাদির জন্যও তিনি প্রসিদ্ধ। তাঁর আরো একটি বড় পরিচয় তিনি একজন বীর যোদ্ধা। মহিলাদের পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট কথা বলার জন্য তাঁকে বলা হতো – মহিলাদে মুখপাত্রী। একটি বর্ণনা মতে, তিনি আকাবর শেষ বাই‘আতে অংশগ্রহণ করেন।[হায়াতুস সাহাবা-১/৫৯৭; টীকা-৪।]

হযরত রাসূলে কারীম (সা) মদীনায় এসেছেন। একদিন সাহাবায়ে কিরাম পরিবেষ্টিত অবস্থায় বসে আছেন। এমন সময় আসমা’ এলেন এবং রাসূলুল্লাহকে (সা) সম্বোধন করে ছোট-খাট এ ভাষণটি দিলেন :

“হে আল্লাহর রাসূল! আমি একদল মুসলিম মহিলর পক্ষ থেকে তাদের কিছু কথা বলার জন্য এসেছি। আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে নারী-পুরুষ উভয় জাতির জন্য পথপ্রদর্শক করে পাঠিয়েছেন। আমরা মহিলারা আপনার উপর ঈমান এনে আপনার অনুসরী হয়েছি। কিন্তু নারী ও পুরুষের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান আমরা লক্ষ্য করি। আমরা গৃহের চৌহদ্দির মধ্যে আবদ্ধ। পুরুষের যৌন তৃপ্তি পূরণ করি এবং তাদের সন্তান ধারণ করি। আর আপনারা পুরুষরা জুম‘আ. নামাযের জামা‘আত ও জানাযায় শরী হতে পারেন। হজ্জে যান। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আপনারা আল্লাহর পথে জিহাদে চলে যান। আর আমরা তখন আপনাদের সন্তানদেরকে লালন-পালন করি, ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করি।, কাপড় তৈরীর জন্য চরকায় সূতা কাটি। আমাদের প্রশ্ন হলো, আমরা কি আপনাদে সাওয়াবের অংশীদা হবো না? আমার পিছনে যে সকল মহিলা আছেন, তাদেরও আমার মত একই বক্তব্য ও একই মত।”

রাসূল (সা) আসমা’র বক্তব্য শোনার পর সাহাবীদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন : তোমরা কি এর চেয়ে আরো সুন্দর দীন সম্পর্কে জানতে চায় এমন কোন মহিলার কথা শুনেছো? তাঁর বললেন ; আমাদের তো ধারণাই ছিল না যে, একজন এমন মহিল এমন প্রশ্ন করতে পারেন। তারপর রাসূল (সা) আসমা’কে লক্ষ্য করে বলেন : “নাবী যদি তার স্বামীর সাথে সদাচরণ করে, তার মন যুগিয়ে চলে, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছামত আনুগত্য করে এবং দাম্পত্য জীবনের দায়িত্ব-অধিকার পূরণ করে তাহলে সেও পুরুষের সমান প্রতিদান লাভ করবে। যাও, তুমি একথা তোমার পিছনে রেখে আসা অন্য নারীদেরকে বলে দাও।”

রাসূলুল্লাহর (সা) মুখ থেকে এ সুসংবাদ শুনে আসমা’ আনন্দের সাথে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ও ‘আল্লাহু আকবার’ পাঠ করতে করতে ফিরে যান।[আল-ইসতী‘আব-৪/২৩৩; উসুদুল গাবা-৫/৩৯৮; আস-সীরাহ্‌ আল-হালাবিয়্যা-১/১৪৯। আস-তূসী এ ঘটনাটি আসমা’ বিন্‌ত ‘উবায়দ আল-আনসারিয়্যার প্রতি আরোপ করেছেন। ইবন মুন্দাহ্‌ ও আবূ নু‘আয়ম এ ঘটনাটি আসমা’ বিন্‌ত ইয়াযীদ ইবন আস-সাকান ভিন্ন দুই মহিলা। ইবন ‘আবদিল বার উপরোক্ত দুজনকে একই মহিলা বলেছেন এবং তাঁর মতে এ মহিলাই রাসূলুল্লাহর (সা) সঙ্গে কথা বলেছিলেন। ইমাম আহমাদও এ রকম মত পোষণ করেছেন। (আ‘লাম আন-নিসা’ -১/৬৭; টীকা-১)]

হযরত আসমা’ যে মহিলা দলটির প্রতিনিধিত্ব করছিলেন সেই দলে তাঁর খালাও ছিলেন। তাঁর হতে সোনার চুরিড় ও আংটি ছিল। রাসূল (সা) জিজ্ঞেস করলেন : এই অলঙ্কারের যাকাত দেওয়া হয়? বললেন : না। রাসূল (সা) বললেন : তুমি কি এটা পছন্দ কর যে, আল্লাহ তোমাকে আগুনের চুড়ি ও আংটি পরান? আসমা’ তখন খালাকে বললেন : খালা, তুমি এগুলো খুলে ফেল। তিনি সঙ্গে ‍সঙ্গে সব অলঙ্কার খুলে ছুড়ে ফেলে দেন। তারপর আসমা’ বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা যদি অলঙ্কার না পরি তাহলে স্বামীদের নিকট তো গুরুত্বহীন হয়ে পড়বো। বললেন : রূপোর অলঙ্কার বানিয়ে তাতে জাফরানের রং লাগিয়ে না। সোনার চাকচিক্য দেখা যাবে। আলোচনার এ পর্যায়ে বাই‘আতের সময় হয়ে যায়। রাসূল (সা) তাঁদেরকে কয়েকটি অঙ্গীকার বাক্য পাঠ করান। এই সময় আসমা’ বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনার একটি হাত বাড়িয়ে দিন, আমরা স্পর্শ করে আমাদের এ বাই‘আত সম্পন্ন করি। রাসূল (সা) বললেন : আমি মহিলাদের সাথে করমর্দন করি না।[মুসনাদে আহমাদ-৬/৪৫৩, ৪৫৪, ৪৫৮, ৪৬ ০, ৪৬১] কোন কোন সূত্রে অলঙ্কারের ঘটনাটি খেঅদ আসমা’র বলে বর্ণিত হয়েছে।[সাহাবিয়াত ৩০২]

হযরত আসমা’ (রা) সব সময় হযরত রাসূলৈ কারীমের (সা) আশে পাশে অবস্থান করতেন। একদিন রাসূল (সা) তার সামনে দাজ্জাল প্রসঙ্গে আলোচনা করলেন। তিনি কান্না শুরু করে দিলেন। রাসূল (সা) এ অবস্থায় উঠে চলে গেলেন। ফিরে এসে দেখলেন, আসমা’ একই অবস্থায় কাঁদছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন : কাঁদছো কেন? আসমা’ বললেন : আমাদের অবস্থা এমন যে, দাসী আটা চটকাতে বসে, আর এদিকে আমাদের ক্ষিধেও পেয়ে যায়। তার খাবার তৈরী শেষ না হতেই আমরা খাবার জন্য অস্থির হয়ে পড়ি। দাজ্জালের সময় যখন অভা দেখা দেবে তখন আমরা ধৈর্য ধরবো কেমন করে? রাসূল (সা) বললেন : সেদিন তাসবীহ ও তাকবীর ক্ষুধা থেকে রক্ষা করবে। এত কান্নাকাটি ও হাহুতাশের প্রয়োজন নেই। তখন আমি যদি জীবিত থাকি, তোমাদের জন্য ঢাল হয়ে থাকবো। অন্যথায় আমার পরে আল্লাহ প্রত্যেকটি মুসলমানকে রক্ষা করবেন।[মুসনাদে আহমাদ-৬/৪৫৩]

হযরত ‘আয়িশা (রা) তাঁর পরিবারের অন্য লোকদের সাথে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করে আসার অল্প কিছদিন পর আনুষ্ঠানিকভাবে পিতৃগৃহ থেকে স্বামীগৃহে যান। এই অনুষ্ঠানে হযরত আসমা’ও ছিলেন। ‘আয়িশাকে (লা) যারা নববধূর বেশে সাজিয়েছিলেন আসমা’ তাঁদের অন্যতম। সাজগোজ শেষ হলে ‘আয়িশাকে (রা) একটি আসনে বসিয়ে স্বামী রাসূলকে (সা) সংবাদ পাঠানো হয়। তিনি এসে ‘আয়িশার (রা) পাশে বসে পড়েন। মহিলাদের সধ্য থেকে কেউ একজন এক পেয়ালা দুধ রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে দেন। তিনি সামান্য পান করে ‘আয়িশার (রা) হাতে দেন। তিনি লজ্জায় মাথা নত করে রাখেন। তখন আসমা’ ধমকের সুরে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যা দিচ্ছেন তা গ্রহণ কর। হযরত ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) হাত থেকে দুধেল পেয়ালা নিয়ে সামান্য পান করে আবার রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে ফিরিয়ে দেন। তিনি পেয়ালাটি আসমা’র হাতে তুলে দেন। পেয়ালাটির যে স্থানে রাসূল (সা) মুখ লাগিয়ে পান করেছিলেন ঠিক সেখানেই মুখ লাগিয়ে পান করার জন্য আসমা’ পেয়ালাটি ঘোরাতে থাকেন। রাসূল (সা) বলেন অন্য মহিলাদেরকেও দাও। কিন্তু উপস্থিত অন্য মহিলারা বললেন, আমাদের এখন পান করার ইচ্ছা নেই। জবাবে রাসূল (সা) বললেন : ক্ষুধার সাথে মিথ্যাও? অর্থাৎ ক্ষুধার সাথে মিথ্যাকে এক করে ফেলছো?[ প্রাগুক্ত-৬/৪৫৮, ৪৬১]

ইসলামের ইতিহাসে যে সকল বীরাঙ্গনা মুজাহিদের নাম পাওয়া যায় হযরতহ আসমা’র নামটি তাদের শীর্ষে শোভা পায়। এমনই হওয়া উচিত। কারণ, তিনি এমন এক পরিবারের সন্তান যাদের সকলে আল্লাহর রাসূলের নিরাপত্তার জন্য জীবন কুরবানী করেছিলেন। উহুদ যুদ্ধসহ রাসূলুল্লাহর (সা) মাদানী জীবনে প্রতিটি সংকটময় মুহূর্তে এই পরিবারের লোকেরা তাঁদের জীবনের বিনিময়ে আল্লাহর রাসূলের নিরাপত্তা বিধান করেছেন।

আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। উহুদ যুদ্ধের দিন সাতজন আনসার ও দুইজন কুরাইশ, মোট নয়জন মুজাহিদসহ রাসূল (সা) মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। শত্রু পক্ষের আঘাতে এক পর্যায়ে রাসূল (সা) আহত হন। তখন রাসূল (সা) তাঁর সংগের এই ক’জন ‍মুজাহিদকে লক্ষ্য করে বলেন : যে এদেরকে আমাদের থেকে দূরে তাড়িয়ে দিতে পারবে তার জন্য রয়েছে জান্নাত। অথবা তিনি একথা বলেন যে, সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে।

আনসারদের এক ব্যক্তিহ সামনে এগিয়ে গিয়ে যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। রাসূল (সা) আবারো পূর্বের মত একই কথা বললেন। এবারো একজন আনসারী এগিয়ে গেলেন এবং যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। এভাবে একে একে সাতজন আনসারীই শহীদ হলেন।[সহীহ মুসলিম : বাবু গাওওয়াতি উহুদ।] এর সপ্তম জন ছিলেন আসমা’র ভাই ‘আম্মারা ইবন ইয়াযীদ ইবন আস-সাকান। শত্রু পক্ষের আঘাতে মারাত্মক আহত হয়ে তিনি যখন পড়ে গেলেন ঠিক তখনই একদল মুজাহিদ এসে উপস্থিত হন। তারা পৌত্তলি বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের কবল থেকে আম্মারকে উদ্ধার করেন। রাসূল (সা) চেঁচিয়ে তাদেরকে বলেন : তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। রাসূল (সা) নিজের পায়ের উপর তার মাথা রেখে শুইয়ে দেন। এ অবস্থায় তার যখন মৃত্যু হলো তখন দেখা গেল তার মুখ রাসূলুল্লাহর (সা) পদযুগলের উপর। এই উহুদ যুদ্ধে আসমা’র পিতা ইয়াযীদ, আসমা’র আরেক ভাই ‘আমির এবং চাচা যিয়াদ ইবন আস-সাকান (রা) শহীদ হন।[নিসা’ মিন ‘আসর আ-নুবুওয়াহ্‌-৮০]

তাঁর পরিবারের সদস্যদের এভাবে শাহাদাত বরণে জিহাদের প্রতি আসমা’র আগ্রহ আকর্ষণ করেছেন। বাই‘আতে রিদওয়ান, মক্কা বিজয় ও খাইবর অভিযান তার মধ্যে অন্যতম। বর্ণনাকারীগণ এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, আসমা‘ (রা) হিজরী ১৫ সনে সংঘটিত ইয়রমূক যুদ্ধে যোগদান করেন এবং তাঁবুর খুঁট দিয়ে পিটিয়ে একাই নয়জন রোমান সৈন্যকে হত্যা করেন।[সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা’ -২/২৯৭; আল-ইসাবা-৪/২২৯; আ‘লাম আন-নিসা; মাজমা’ আয-হাওয়ায়িদ-৯/২৬০; হায়াতুস সাহাবা-১/৫৯৭]

হযরত আসমা’ (রা) ইসলাম গ্রহণের পর থেকে রাসূলুল্লাহর (সা) ইনতিকাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় রাসূলুল্লাহর (সা) সাহচর্য ও সান্নিধ্যে কাটান। সব সময় তাঁর আশে পাশেই থাকতেন। রাসূলুল্লাহর (সা) সেবার সামান্য সুযোগকেও হাতছাড়া করতেন না। রাসূলের (সা) সকল কথা কান লাগিয়ে শুনতেন এবং স্মরণ রাখতেন। সময়ে-অসময়ে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে জেনে নিতেন। এ কারণে আনসারী মহিলাদের মধ্যে তিনি সর্বাধিক হাদীছ বর্ণনাকারীর গৌরব অর্জন করেছেন। তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) ৮১ (একাশি) টি হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[আ‘লাম আন-নিসা’-১/৬৭; নিসা’ মিন ‘আসর-আন-নুবুওয়াহ্‌-৮০]

হযরত আসমা’ (রা) থেকে যারা হাদীছ বর্ণনা করেছেন তারা হলেন : মাহমূদ ইবন ‘আমর (তাঁর ভাগ্নে) আল-আনসারী, আবূ সুফইয়ান মাওলা ইবন আহমাদ, ‘আবদুর রহমান ইবন ছাবিত আস-সামিত আল-আনসারী, মুজাহিদ ইবন জুবায়ের, মুহাজির ইবন আবী মুসলিম ও শাহর ইবন হাওশার।

আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবন মাহা প্রভৃতি গ্রন্থে তাঁর হাদীছ সংকলিত হয়েছে।[আ‘লাম আন-নিসা’-১/৬৭; সিয়ারুস সাহাবিয়াত-১৬৬] ইমাম আল-বুখারী তাঁর “আল-আদাব আল-মুফরাদ” গ্রন্থেও সংকলন করেছেন।[নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্‌-৮১]

হযরত আসমা’ (রা) বর্ণিত হাদীছের মাধ্যমে মোটামুটি আল কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের নাযিল হওয়অর প্রেক্ষাপট, উপলক্ষ, শরী‘আতের বিভিন্ন বিধান, রাসূলুল্লাহর (সা) গুণাবলী, যুদ্ধ-বিগ্রহ, জীবন বৃত্তান্ত ইত্যাদি বিষয়গুলো জানা যায়। যেমন সূরা আল-মায়িদা নাযিল হওয়ার সম্পর্কে তিনি বলেছেন : আমি রাসূলুল্লাহর (সা) উষ্ট্রী আল-‘আদবা’র লাগাম ধরা ছিলাম। রাসূল (সা) তখন তার পিঠে বস। এমতাবস্থায় উষ্ট্রীর বাহু ভেঙ্গে চুর হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছিল।[তাফসীর ইবন কাছীর-২.২; আল-বিদয়িা ওয়ান নিহায়া-৩/২২]

জামা ছিল রাসূলের (সা) সবচেয়ে প্রিয় পোশাক। আসমা’ (রা) সেই জামার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : রাসূল্লাহর (সা) জামার হাতা ছিল হাতের কবজী পর্যন্দ।[হায়াতুস সাহাবা-২/৭০৫]

এ হাদীছটিও আসমা‘ (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এক ইহুদীর নিকট কিছু খাদ্যের বিনিময়ে রাসূলূল্লাহ (সা) তাঁর বর্মটি বন্ধক রাখা অবস্থায় ইনতিকাল করেন। হযরত রাসূলে কারীমের (সা) ইনতিকালের পর আবূ যার আল-গিফারী (রা) যে শাসকদের কঠোর সমালোচনা করবেন এবং এর জন্য যে তাঁকে বিভিন্ন স্থানে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো হবে এ বিষয়ের একটি হাদীছ তিনি বর্ণনা করেছেন।[ইবন মাজাহ (২৮৩৮); আত-তিরমিযী-(১৭৬৫); হায়াতুস সাহাবা-২/৬৭]

হাদীছ, সীরাত ও ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে মদীনার আনসারদের সহামুভবতা, উদারতা ও অন্যকে প্রাধান্য দানের গুণের অনেক কথা যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনিভাবে দাতের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর (সা) অনেক মু‘জিযা যে প্রকাশ পেয়েছিল সেকথাও এসেছে। ‘ইবন আসাকির তাঁর তারীখে আসমা’কে কেন্দ্র করে রাসূলুল্লাহর (সা) একটি মু‘জিযার কথা আসমা‘র যবানীতে বর্ণনা করেছেন। আসমা’ বলেন : আমি একদিন দেখলাম রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের মসজিদে মাগরিবের নামায আদায় করছেন। আমি ঘরে এলাম এবং কিছু হাঁড়ওয়ালা গোশ্‌ত ও রুটি নিয়ে তাঁর সামনে রেখে বললাম : আমার বাবা-মা আপনার প্রতি কুরবান হোক! এগুযলো আপনি রাতের খাবার হিসেবে খেয়ে নিন। তিনি সঙ্গীদের ডেকে বললেন : বিসমিল্লাহ বলে তোমরা খেতে শুরু কর। সেই সামান্য খাবার রাসূলুল্লাহ (সা) খেলেন, তাঁর সঙ্গীরা খেলেন এবং যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন, সবাই খেলেন। যে সত্তার হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ! সর্বমোট চল্লিশজন লোক খাওয়ার পরও আমি দেখলাম বেশীর ভাগ গোশ্‌ত ও রুটি রয়ে গেছে। তারপর রাসূল (সা) আমাদের একটি মশকে মুখ লাগিয়ে পানি পান করে বিদায় নেন। আমরা সেই মশ্‌কটি সংরক্ষণ করেছিলাম। কারো অসুখ হলে তাকে সেই মশকে পানি পান করানো হতো এবং মাঝে মাছে বরকত লাভের উদ্দেশ্যেও তাতে পান করা হতো।[নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্-৮২]

তিনি অত্যন্ত অতিথিপরায়ণা ছিলেন। একবার শাহর ইবন হাওশাব তাঁর বাড়ীতে এলেন। তাঁর সামনে খাবার উপস্থিত করা হলো। তিনি খেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। তাখন আসমা’ (রা) তাঁকে রাসূলুল্লাহর (সা) একটি ঘটনা শুনিয়ে বলেন : এখন তো নিশ্চয় আর খেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করবে না। শাহর বললেন : আম্মা! এমন ভুল হবে না।[আল-ইসতী‘আব-৩/৭২৬; মুসনাদে আহমাদ-৬/৪৫৮]

হযরত আসমা’ (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) ইনতিকালের পর মদীনা ত্যাগ করে শামে চলে যান। এ সময় ইয়ারমূক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এরপর তিনি দিমাশ্‌কে অবস্থান করে সেখানে হাদীছ বর্ণনা করতে থাকেন। একথা ইবন ‘আসাকির আবূ যুর‘আর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।

হযরত আসমা‘র (রা) মৃত্যুর সঠিক সন জানা যায় না। ‘আল্লামা আয-যাহবী (রহ) বলেছেন, তিনি ইয়াযীদ ইবন মু‘আবিয়ার (রা) শাসমকাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।[নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্-৮৩]

উল্লেখ্য যে, ইয়াযীদ ১৪ রাবী‘উল আউয়াল ৬৪হি. মৃত্যুবরণ করেন। আয-যাহাবী আরো বলেছেন, আসমা’ (রা) দিমাশ্‌কে বসবাস করেন এবং দিমাশ্‌ক বাবুস সাগীরে তাঁর কবর বিদ্যমান।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’ -২/২২০, ২৯৬] একথারই সমর্থন পাওয়া যায় ইবন কাছীরের মন্তব্যে। হিজরী ৬৯ সনে যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন, দিমাশ্‌কের বাবুস সাগীরে তাঁকে দাফন করা হয়েছে। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানের খিলাফতকালে হযরত আসমা’ ইনতিকাল করেছেন।[নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ-৮৩] তার সন্তানাদির কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
উম্মু রূমান বিন্‌ত ‘আমির (রা)
হযরত উম্মু রূমানের (রা) পরিচয় এই রকম : উম্মু রূমান বিন্‌ত আমির ইবন ‘উয়াইমির ইবন ‘আবদু শাম্‌স ইবন ‘ইত্তাব ইবন উযাইনা আল-নিনানিয়া।[উসুদুল গাবা-৫/৫৮৩; আনসাব আল-আশরাফ-১/৪০৯; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’ -২/১৩৫] ইতিহাসে নামটির দুই রকম উচ্চারণ দেখা যায়- উম্মূ রূমান ও উম্মু রাওমান। ইবন ইসহাক তাঁর আসল নাম “যায়নাব” বলেছেন, তবে অন্যরা বলেছেন ‘দা‘আদ’।[আল-ইসাবা-৪/৪৩৩; আর-রাওদ আল-আন্‌ফ-৪/১২] তিনি উম্মু রূমান ডাকনামে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ।

আরব উপ-দ্বীপের ‘আস-সারাত’ (আরবী****)[ মা‘জাম আল-বুলদান-৩/২০৪-২০৫; ।] অঞ্চলে উম্মূ রূমানের জন্ম হয় এবং সেখানে বেড়ে ওঠেন। বিয়ের বয়স হলে ‘আবদুল্লাহ নামে তাদের এক ছেলে হয়। সে ছিল ইসলামপূর্ব আল-ইয়্যাম আল-জাহিলিয়্যার যুগ। গোটা আরবে তখন অনাচার ও অশান্তি বিরাজমান। আরব উপ-দ্বীপে যতটুকু শান্তি ও নিরাপত্তা বিদ্যমান ছিল, বলা চলে তা কেবল উম্মুল কুরা মক্কা নগরীতেই ছিল।[সূরা ইবচরাহীম -৩৫] (আরবী*********)

‘ইবরাহীম যখন বলেছিল হে প্রভু! আপনি এ শহরকে শান্তি ও নিরাপত্তার শহর বানিয়ে দিন….।’ এ সম্মানিত ও গৌরবময় শহরের কেন্দ্রস্থলেই ছিল আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের ঘর কা‘বা। যুগে যুগে মানুষ এই শান্তি ও নিরাপত্তার শহরে এসে কা‘বার পাশে বসবাস করতে চেয়েছে। উম্মু রূমানের স্বামী ‘আবদুল্লাহ ইবন আল-হারিছেরও স্বপ্ন ছিল এই পবিত্র কা‘বার প্রতিবেশী হয়ে বসবাস করার। সেই স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে তিনি একদিন স্ত্রী উম্ম রূমান ও ছেলে আত-তুফাইলকে সংগে নিয়ে জন্মভূমি আস-সারাত থেকে মক্কার দিকে যাত্র করেন। মক্কায় পৌঁছে তিনি তৎকালীন আরবের নিয়ম-অনুযায়ী সেখানকার অধিবাসী আবূ বকরের সাথে চুক্তবদ্ধ হন। এভাবে তিনি আবূ বকরের আশ্রয়ে পরিবারসহ মক্কায় বসবাস শুরু করেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যে তিনি মারা যান। বিধবা উম্মু রূমান তাঁর ছেলেসহ বিদেশ-বিভূঁয়ে দারুণ অসহায় অবস্থায় পড়েন।

এই বিপদের মধ্যে উম্মু রূমান একটা আশার আলো দেখতে পান। তাঁদের আশ্রয়দাত আবূ বকর ছিলেন একজন দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, উদারতা ও দানশীলতার অধিকারী। মানুষের বিপদে তাদের পাশে দাঁড়ানো ছিল তাঁর স্বভাব। ইসলাম গ্রহণের পর মক্কার পৌত্তলিক শক্তি আবূ বকরের (রা) উপর বাড়াবাড়ি শুরু করলে তিনি দেশ ত্যাগের ইচ্ছা করেন। তখন ইবন আদ-দিগান্না কুরাইশদের তিরস্কার করে যে কয়েকটি বক্য উচ্চারণ করেন তাতে আবূ বকরের (রা) সদগুণাবলী চমৎকরভাবে বিধৃত হয়েছে। তিতিন বলেন :[ নিসা’ আসর আন-নুবুওয়াহ্‌-২৬৯-২৭০] (আরবী********)

‘এমন একটি লোককে তোমরা দেশ থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছো যে কিনা হত-দরিদ্রদের সাহায্য করে, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখে, অন্যের বোঝা বহন করে, অতিথিকে আহার করায় এবং বিপদ-আপদে মানুষকে সাহায্য করে?’ এমন ব্যক্তি তাঁর আশ্রয়ে থাকা সন্তানসহ এক অসহায় বিধবাকে দূরে ঠেলে দিতে পারেন কিভাবে? তিনি উম্মু রূমানের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তাঁকে বিয়ে করে তাঁর ছেলেসহ নিরেজ পরিবারের সাথে যুক্ত করেন। এবাবে উম্মু রূমান (রা) একটি চমৎকার ঘর ও সংসার লাভ করেন। আবূ বকরের (রা) সাথে বৈবাহিক জীবনে তিনি তাঁকে এক ছেলে ও এক মেয়ে- ‘আবদুল রহমান ও ‘আয়িশাকে (রা) উপহার দেন।[প্রাগুক্ত; নিসা’ হাওলাদার রাসূল -২৬৪] এই আয়িশা (রা) পরবর্তীকালে ‘উম্মুল মু‘মিনীন’ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।

এখানে এ বিষয়টি উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, জাহিলী যুগে আবূ বকর (রা) কুতাইলা বিন্‌ত ‘আবদিল ‘উযযা আল-‘আমিরিয়াকে বিয়ে করেন। তার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে ছেলে ‘আবদুল্লাহ ও মেয়ে আসমা’ (রা)। ইসলাম গ্রহণ না করায় কুতাইলার সাথে আবূ বকরের (রা) ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ইসলামী জীবনে আবূ বকজর বিয়ে করেন ‘আসমা’ বিন্‌ত ‘উমাইসকে (রা)। তাঁর গর্ভে জন্ম হয় ছেলে মুহাম্মাদ ইবন আবূ বকরের (রা)। তিনি হাবীবা বিন্‌ত খাদীজাকেও বিয়ে করেন এবং মেয়ে উম্মু কুলছূম মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় আবূ বকর ইনতিকাল করেন।[নিসা‘ মাবাশ্‌শারাত বিল-জান্নাহ্‌-৮৪]

ইসলাম গ্রহণ

সকল নির্ভরযোগ্য বর্ণনা দ্বারা একথা সমর্থিত যে, স্বাধীন পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম আবূ বকর সিদ্দীক (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলামের প্রচার-প্রসারে যিনি সবকিছু উজার করে বিলেয়ে দেন, স্বভাবতঃই তিনি ইসলাম গ্রহণের পর ‍মুহূর্তে নিরেজ আপনজনদের নিকট ইসলামের দা‘ওয়াত পেশ করে থাকবেন। একথা জানা যায় যে, তিনি তাঁর মা উম্মুল খায়র সালমা বিন্‌ত সাখর (রা) এর হাত ধরে রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে নিয়ে হাজির করেন। রাসূল (সা) তাঁকে ইসলামে দীক্ষিত করেন। তিনি স্ত্রী উম্মু রূমানকেও ইসলামের দাওয়াত দেন এবং তিনি ইসলাম গ্রহণকারী দলটির সদস্য হওয়ার অনন্য গৌরবের অধিকারী হন। হযরত ‘আয়িশা (রা) বলেন : [তাহযীব আল-আসমা’ ওয়াল-লুগাত-২/১৮৩]

(আরবী**********)

‘আমার পিতাকে চেনার পরই দেখেছি তাঁরা দুইজন এ দীন ধারণ করেছেন।’

ইবন সা‘দ বলেন : (আরবী*********)

‘উম্মু রূমান মক্কায় বহু আগে ইসলাম গ্রহণ করে বাই‘আত করেন এবং হিজরাতও করেন।’[তাবাকাত-৮/২৭৬]

ইসলাম গ্রহণের পর মনে-প্রাণে ইসলামের শিক্ষায় নিজেকে ও নিজের পরিবারকে গড়ে তোলাম সাধ্যমত চেষ্টা করেন। ইসলামের মহত্ব ও বাস্তব চিত্র রাসূলুল্লাহর (সা) সত্তার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেন। ইসলামী দা‘ওয়াতের প্রয়োজনে রাসূল (সা) সময়-অসময়ে আবূ বকরের (রা) গৃহে যেতেন। আল্লাহর রাসূলের (সা) এমন শুভাগমনে উম্মু রূমানসাহ বাড়ীর সকলে দারুণ খশী হতেন। নিজের সাধ্যমত এই মহান অতিথির সেবা করতেন। উম্মু রূমানের (রা) ছিল একটা স্বচ্ছ মন, একটা মমতায় ভরা অন্তর যা শক্ত ঈমানে পরিপূর্ণ ছিল। বিপদে ধৈর্য ধরার অসীম শক্তিও তাঁর মধ্যে ছিল। মক্কার দুর্বল মুসলমানদের উপর পৌত্তলিকদের নির্মম অত্যাচার দেখে তিনি ভীষণ কষ্ট পেতেন। তিনি দেখতেন রাসূল (সা) তাঁর সাহাবীদেরকে ধৈর্যের শিক্ষা দিচ্ছেন। স্বামী আবূ বকরকে (রা) দুর্বল শ্রেণীর মুসলমানদের পাশে দাঁড়াতে এবং নিজের অর্থে দাসদের ক্রয় করে মুক্ত করে দিতে দেখে তিনি আনন্দিত হতেন। তাঁর মহৎ কাজে তিনি উৎসাহ দিতেন।

তিনি ঘর গৃহস্থালীর কাজের পাশাপাশি ছেলে ‘আবদুল রহমান ও মেয়ে ‘আয়িশার (রা) তত্ত্বাবধানে অত্যধিক যত্নবান ছিলেন। আল্লাহ-ভীত এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসার উপর ছেলে-মেয়েকে গড়ে তোলাম চেষ্টা করেন। তাঁর পচ্ছিন্ন অন্তকরণ প্রথম থেকেই তাঁকে বলছিল, মেয়ে ‘আয়িশা ভবিষ্যতে ইসলামের জন্য এক বিশেষ ভূমিকা রাখবে। রাসূল (সা) সকাল-দুপুর-সন্ধা যখন তখন বাড়ীতে আসা-যাওয়অ করতেন। মাঝে মাঝে তিনি উম্মু রূমানকে ঘর-গৃহস্থালীর কর্ম সম্পাদন ও সন্তানদের লালন-পালনের ব্যাপারে দিক নির্দেশনাও দিতেন।

ছোট বেলায় ‘আয়িশা (রা) মাঝে মাঝে মাকে ক্ষেপিয়ে তুলতেন। মা মেয়েকে শাস্তিও দিতেন। রাসূল (সা) এতে কষ্ট অনভব করতেন। একবা তিনি উম্মু রূমানকে বলেন : [প্রাগুক্ত] (আরবী*****)

‘উম্মু রূমান! আপনি আয়শার সাথে ভালো আচরণ করুন এবং তার ব্যাপারে আমর কথা স্মরণে রাখুন।’

একদিন রাসূল (সা) আবূ বকরের (রা) গৃহে এসে দেখেন, দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে ‘আয়িশা (রা) কাঁদছেন। তিনি উম্মু রূমানকে বলেন : আপনি আমার কথায় গুরুত্ব দেননি। উম্মু রূমান বলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ মেয়ে আমার বিরুদ্ধে তার বাপের কাছে লাগায়। রাসূল (সা) বললেন : যা কিচু করুক না কেন তাকে কষ্ট দিবেন না।[আসহাবে রাসূলের জীবন কথা-৫/৫৭]

সন্তানদের প্রতি মায়া-মমতা, স্বামীর প্রতি গভীল ভালোবাসা ও আনুগত্য, সর্বোপরি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা উম্মু রূমান ও তাঁর পরিবারটিকে একটি আদর্শ স্থানে পরিণত করে। স্বামীর সাথে পরামর্শ ছাড়া তিনি কোন সিদ্ধান্তমূলক কাজ করতেন না। রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে কন্যা ‘আয়িশার (রা) বিয়ের পয়গামের সময় উম্মু রূমানের ভূমিকা এর উত্তম দৃষ্টান্ত।

হিজরাতের তিন বছর পূর্বে উম্মুল মা‘মিনীন হযরত খাদীজা (রা) ইনতিকাল করেন। রাসূল (সা) শোকে কাতর হয়ে পড়েন। একদিন তাঁকে বিষণ্ণ দেখে ‘উছমান ইবন মাজ‘ঊনের স্ত্রী খাওলা বিন্‌ত হাকীম (রা) বলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আবার বিয়ে করুন। রাসূল (সা) জানতে চাইলেন : কাকে? খাওলা বললেন : বিধবা ওি কুরামী দুই রকম পাত্রীই আছে, যাকে আপনার পসন্দ হয় তাঁর বিষয়ে কথা বলা যেতে পারে। রাসূল (সা) আবার জানতে চাইলেন ; তারা কারা? খাওলা বললেন ; বিধবা পাত্রীটি সাওদা বিন্‌ত যাম‘আ, আর কুমারী পাত্রীটি আবূ বকরের মেয়ে ‘আয়িশা। রাসূল (সা) বললেন : ভালো। তুমি তার সম্পর্কে কথা বলো।

হযরত খাওলা (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) সম্মতি পেয়ে আবূ বকরের বাড়ীতে যান এবং উম্মু রূমানকে (রা) অত্যন্ত আবেগের সুরে বলেন : উম্মু রূমান! আল্লাহ তা‘আলা আপনার বাড়ীতে এত খায়র ও বরকত (কল্যাণ ও সমৃদ্ধি) দান করেছেন কিসের জন্য? উম্মু রূমান বললেন : কেন, কি হয়েছে খাওলা?

খুশীতে ঝলমল চেহারায় খাওলা (রা) বললেন : রাসূলুল্লাহ (সা) ‘আয়িশার কথা বলেছেন (বিয়ের পয়গাম পাঠিয়েছেন)।

উম্মু রূমান (রা) ক্ষণিকের জন্য কি যেন ভাবলেন। আস্তে আস্তে তাঁর চহারাটি দীপ্তিমান হয়ে উঠলো। বললেন : খাওলঅ! আপনি একটু বসুন, আবূ বকর এখনই এসে পড়বেন।

আবূ বকর (রা) আসলেন। উম্মু রূমান (রা) তাঁকে বিষয়টি জানালে তিনি বললেন মুত‘ইম ইবন ‘আদী তার ছেলে জুবাইরের সাথে ‘আয়িশার বিয়ের প্রস্তাব করেছিল এবং আমি তাঁকে কথাও দিয়েছিলাম। আমি আমার অঙ্গীকার তো ভঙ্গ করতে পারবো না। আবূ বকর (রা) মুত‘ইম ইবন ‘আদীর কাছে যেয়ে বললেন : তোমার ছেলের সাথে ‘আয়িশার বিয়ের প্রস্তাব করেছিলেন। এখন তোমাদের সিদ্ধান্ত কি, বল। মুত‘ইম তাঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন। মুত‘ইমের পরিবার তখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি। এ কারণে স্ত্রী বললেন, এ মেয়ে আমাদের ঘরে এলে ছেলে ধর্মত্যাগী হয়ে যাবে। এ প্রস্তাবে আমার মত নেই। আবূ বকর (রা) মুত‘ইমের দিকে ফিরে বলেন : তোমার মত কি? মুত‘ইম বললেন : সে যা বলেছে, আমার মতও তাই। আবূ বকর (রা) বাড়ী ফিরে এসে খাওলাকে বলেন : আপনি রাসূলুল্লাহকে (সা) নিয়ে আসুন। রাসূল (সা) এলেন এবং বিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হলো।[মুসনাদে আহমাদ-৬/২১০-২১১; তাবাকাত-৮/৫৮; আয-যাহাবী : তারীখ-১/২৮০-২৮১; সিয়ারু আলাম আন-নুবালা’ -২/১৪৯] ‘আতিয়্যা (রা) এই বিয়েল বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- ‘আয়িশা (রা) অন্য মেয়েদের সাথে খেলছিলেন। তাঁর সেবিকা এসে তাঁকে নিয়ে যায় এবং আবূ বকর (রা) এসে বিয়ে পড়িয়ে দেন। এ বিয়ে যে কত অনাড়ম্বর ছিল তা অনুমান করা যায় ‘আয়িশার (রা) একটি বর্ণনা দ্বারা। তিনি বলছেন : যখন আমার বিয়ে হয়, আমি কিছুই বুঝতাম না। আমার বিয়ে হয়ে গেল। যখন মা আমাকে বাইরে যেতে বারণ করতে লাগলেন তখন বুঝলাম আমার বিয়ে হয়ে গেছে। তারপর মা আকাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেন।[তাবাকাত-৮/৫৯-৬০] মোটকথা উম্মু রূমান (রা) মেয়ে আয়িশাকে (রা) ভবিষ্যতের উম্মুল মু‘মিনীন হিসেবে, নবীগৃহের কর্ত্রী হিসেবে এরং তার ঘরে যাতে ওহী নাযিল হতে পারে সে রকম যোগ্য করে গড়ে তোলেন।

হিজরাত

রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে আবূ বকর (রা) রাতের অন্ধকারে মদীনার উদ্দেশ্যে বের হলেন। ছূর পর্বতের গুহায় তিন দিন আত্মগোপন করে থাকলেন। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় উম্মু রূমানের ঘুম দূর হয়ে গেল। একদিকে আবূ বকর (রা) ছেলে-মেয়েদের জন্য ঘরে কোন অর্থ রেখে যাননি সে দুশ্চিন্তা, অন্যদিকে প্রিয় নবী (রা) ও স্বামীর নিরাপত্তার দুর্ভাবনা। কিন্তু তিনি অন্ত্যন্ত স্থির ও অটল থেকে সকল ‍দুশ্চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) নিরাপদে মদীনায় পৌঁছার জন্য আল্লাহর দরবারে দু‘আ করতে থাকেন।

মদীনায় একটু স্থির হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কা থেকে পরিবা-পরিজনকে মদীনায় নেওয়ার জন্য যায়িদ ইবন হারিছা (রা) ও রাফিৎকে (রা) মক্কায় পাঠা। আবূ বকরও (রা) তাঁদের সাথে ‘আবদুল্লাহকে বলে পাঠান যে, সে যেন আসমা’, ‘আয়িশা ও তাঁদের মা উম্মু রূমানকে নিয়ে মদীনায় চলে আসে। এই সকল লোক যখন মক্কা থেকে যাত্রা করেন তখন তালহা ইবন ‘আবদিল্লাহ (রা) হিজরাতের উদ্দেশ্যে তাঁদের সহযাত্রী হন। আবূ রাফি’ ও যায়িদ ইবন হারিছার (রা) সংগে উম্মু কুলছূম , ফাতিমা, উম্মুল মু’মিনীন সাওদা বিন্‌ত যাম‘আ, উম্মু আয়মান ও উসামা ইবন যায়িদ (রা) এবং ‘আবদুল্লাহ ইবন আবী বকরের (রা) সংগে উম্মু রূমান, আসমা’ ও ‘আয়িশা (লা) ছিলেন।[আনসাব আল-আশরাফ-১/২৬৯-২৭০]

এই কাফেলা মক্কা থেকে যাত্রা করে যখন হিজাযের বানূ কিনানার আবাসস্থল ‘আল-বায়দ’ পৌঁছে তখন ‘আয়িশা (রা) ও তাঁর মা উম্মু রূমান (রা) যে উটের উপর ছিলেন সেটি বেয়াড়া হয়ে দ্রুতগতিতে ছুটতে থাকে। প্রতি মুহূর্তে তাঁরা আশংকা করতে থাকেন, এই বুঝি হাওদাসহ ছিটকে পড়ছেন। মেয়েদের যেমন স্বভাব, মার নিজের জানের প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপ নেই, কলিজার টুরো মেয়ে ‘আয়িশার (রা) জন্য অস্থির হয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেন। তিনি চেঁচিয়ে বলতে থাকেন: (আরবী******)

‘নতনি বউকে বাঁচাও, আমার মেয়েকে বাঁচাও!’

হযরত ‘আয়িশা (রা) বলেন, এ সময় আমি কাউকে বলতে শুনলাম : (আরব****)

উটের লাগাম ঢিলা করে দাও।’ আমি লাগাম ঢিলা করে দিলাম। আল্লাহর ইচ্ছায় উটটি শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।[আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৩/২১১; আল-ইসতী‘আব-৪/৪৩৪৩]

তাঁরা নিরাপদে ছিলেন এবং নিরাপদেই মদীনায় পৌঁছেন।

হযরত উম্মু রূমান (রা) ছেলে-মেয়েদের নিয়ে মদীনার বানূ আল-হারিছ ইবন খাযরাজের মহল্লায় অবতারণ করেন এবং সাত-আট মাস সেখানে বসবাস করেন। উল্লেখ্য যে, ‘আয়িশা (রা) মায়ের সাথে থাকেন। মক্কা থেকে আগত অধিকাংশ মুহাজিরের জন্য মদীনার আবহাওয়া অনুকূল ছিল না। বহু নারী-পুরুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবূ বকর (রা) অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবূ বকর (রা) অসুস্থ হয়ে পড়েন। মা-মেয়ের অক্লান্ত সেবায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠে। স্বামী সুস্থ্ হওয়ার পর মেয়ে ‘আয়িশা (রা) শয্যা নিলেন। তাঁর অসুস্থতা হতে মারাত্মক ছিল যে, প্রায় সব টুল পরেড় যায়।[সহীহ আল-বুখারী : বাবুল হিজরাহ্‌; তাবাকাত-৮/৬৩] মায়ের সেবায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এ সকল বিপদ-আপদ থেকে মুক্ত হওয়ার পর মা উম্মু রূমান (রা) একদিন রাসূলুল্লাহকে (সা) বললেণ : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার স্ত্রীকে ঘরে তুলে নিচ্ছেন না কেন? মাহর পরিশোধ করার মত অর্থ এখন আমার হতে নেই। আবূ বকর (রা) বললেন : আমার অর্থ গ্রহণ করুন। আমি ধার দিচ্ছি। অতঃপর রাসূল (সা) মাহরের সমপরিমাণ অর্থ আবূ বকরের (রা) নিকট থেকে ধার নিয়ে ‘আয়িশার (রা) নিকট পাঠিয়ে দেন।

হিজরী ৬ষ্ঠ সনে মুরাইসী’ যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে নবী-পরিবারকে কেন্দ্র করে মুনাফিকরা এক মারাত্মক ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। এই সফরে হযরত ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) সংগে ছিলেন। এই সফর থেকে ফেরার পথে একটি ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে একটা দুষ্টচক্র হযরত ‘আয়িশার (রা) চরিত্রে কলঙ্কজ লেপনের উদ্দেশ্যে দুর্নাম রটিয়ে দেয়। প্রায় এক মাস যাবত এই মিথ্যা দোষারোপের কথা মদীনার সমাজে উড়ে বেড়াতে থাকে। স্বয়ং নবী (সা) ও আবূ বকরের (রা) পরিবার এক দারুণ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। উম্মু রূমানের (রা) কানে মেয়ের এ অপবাদের কথা পৌঁছানের পর জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান।[আ‘লাম আন-নিসা’-১/৪৭২] কিন্তু পরক্ষণেই চেতনা ফিরে পেয়ে নিজেকে শক্ত করেন এবং সবকিছু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ছেড়ে দেন। প্রথম দিকে লোকেরা যা বলাবলি করতো তা ‘আয়িমার (রা) নিকট গোপন রাখা হয়। পরে যখন তিনি জানলেন তখন এই গোপন করার জন্য মাকে বেশ বকাবকি করেন।[নিসা হাওলার রাসূল -২৬৭] আয়িশা (রা) সফর থেকে মদীনায় ফিরে একটু অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাই মায়ের কাছে চলে যান। তারপর এই মারাত্মক সঙ্কটকালের পুরো এক মাস মায়ের কাছেই থাকেন। এ সময় উম্মু রূমানকে (রা) একজন আদর্শা মা হিসেবে মেয়ের পাশে থাকতে দেখা যায়। তিনি সব সময় মেয়েকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিতেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উপর ভরসা করার কথা বলতেন। এ সময় একদিন রাসূল (সা) ‘আয়িশার (রা) পিতৃ-গৃহে আসলেন। আবূ বকর ও উম্মু রূমান (রা) মনে করলেন আজ হয়তো কোন সিদ্ধান্তমূলক কথা হয়ে যাবে। এ কারণে তাঁরা উভয়ে কাছে এসে বসলেন। রাসূল (সা) ‘আয়িশাকে (রা) বললেন : ‘আয়িশা, তোমার সম্পর্কে এসব কথা আমার কানে পৌঁছেছে। তুমি যদি নির্দোষ হয়ে থাক তাহলে আশা করি আল্লাহ তা প্রকাশ ও প্রমাণ করে দেবেন। আর বাস্তবিকই যদি কোন গুনাহে লিপ্ত হয়ে থাক, তাহলে আল্লাহর নিকট তাওবা কর, ক্ষমা চাও। বান্দাহ যখন গুনাহ স্বীকার করে তাওবা করে, তখন আল্লাহ মাফ করে দেন।

আয়িশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহর (সা) আমার চোখের পানি শুকিয়ে গেল। পিতাকে বললাম : আপনি রাসূলে কারীমের (সা) কথার জবাব দিন। তিনি বললেন : মেয়ে! আমি জানিনা রাসূলুল্লাহকে (সা) আমি কি বলবো। আমি মাকে বললাম : আপনি রাসূলুল্লাহকে (সা) জবাব দিন। বললেন : আল্লাহর রাসূলকে (সা) কি বলবো তা আমার জনা নেই।[তাফসীর ইবন কাছীর, তাফসীর আল-কুরতুবী : সূরা আন-নূর, আল-আয়াত : ১১-২১; বুখারী-৬/১২৭; তাফসীর সূরা আন-নূর।]

এরই মধ্যে রাসূলের (সা) উপর ওহী নাযিল হওয়াকালীন অবস্থা সৃষ্টি হলো। এমনকি তীব্র শীতের মধ্যে তাঁর চেহারা মুবারক হতে ঘামের ফোঁটা টপটপ করে পড়তে লাগলো। এমন অবস্থা দেখে আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম। আমি তো পূর্ণমাত্রায় নির্ভয় ছিলাম। কিন্তু আমার পিতা আবূ বকর ও মাতা উম্মু রূমানের অবস্থা ছিল বড়ই করুণ। আল্লাহ কোন মহসত্য প্রকাশ করেন, সেই চিন্তায় তাঁরা ছিলেন অস্থির, উদ্বিগ্ন। ওহীকালীণ অবস্থা শেষ হলে রাসূলে কারীমকে (সা) খবই উৎফুল্ল দেখা গেল। তিনি হাসি মুখে প্রথম যে কথাটি বলেন তা এই : ‘আয়িশা, তোমার জন্য সুসংবাদ। আল্লাহ তোমার নির্দোষিতা ঘোষনা করে ওহী নাযিল করেছেন। অততঃপর তিনি সূরা আন-নূর এর ১১-১২ আয়াত পর্যন্ত পাঠ করে শোনান। আমার মা আমাকে বললেন : ওঠো, রাসূলুল্লাহর (সা) শুকরিয়া আদায় কর।

আদরের মেয়ে ‘আয়িশার (রা) প্রতি কলঙ্ক আরোপের ঘটনায় উম্মু রূমানের (রা) পরিববারে যে উৎকণ্ঠা ও অশান্তি ভর করে তা ওহী নাযিলের পর দূর হয়ে যায়। পূর্ব থেকেই মানুষের নিকট এই পরিবারটির যে মর্যাদা ও গুরুত্ব ছিল তা আরো শতগুণে বেড়ে যায়। মা হিসেবে উম্মু রূমানের (রা) খশীর কোন সীমা পরিসীমা ছিল না।

উম্মুল মু‘মিনীন হযরত ‘আয়িশার ঘটনায় মা উম্মু রূমানের (রা) দেহ ও মনের ‍উপর দিয়ে এক বিরাট ধকল যায়। এটি সামাল দেওয়ার পর তিনি নিজে অসুস্থা হয়ে শয্যা নেন। মেয়ে ‘আয়িশা (রা) সুস্থ করে তোলাম জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করেন। সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। হিজরী ৬ষ্ঠ সনের যিল হাজ্জ মাসে তিনি মদীনায় ইনতিকাল করেন।[আ‘লাম আন-নিসা’-১/৪৭২]

উম্মু রূমান একজন ধর্মপরায়ণ মহিলা ছিলেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) সন্তুষ্টিই উম্মু রূমান একজন ধর্মপরায়ণ মহিলা ছিলেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) সন্তুষ্টিই ছিল একমাত্র কাম্য। স্বামীর সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে তাঁকে ইসলামের সেবায় আরো বেশী সময় দানের সুযোগ করে দিতেন। একদিন স্বামী আবূ বকর (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) কয়েকজন মেহমান নিয়ে গৃহে আসলেন। তাঁদেরকে রাতে আহার করাতে হবে। কিনউত রাসূলুল্লাহর (সা) দরবার থেকে জরুরী তলব এলো। তিনি উম্মু রূমানকে (রা) বলে গেলেন, আমার ফিরতে দেরী হবে,দ তোমরা মেহমানদেরকে খেতে দিবে। কথা মত উম্মু রূমান (রা) যথাসময়ে ছেলে ‘আবদুর রহমানের দ্বারা মেহমানদের সামনে কাবার হাজির করলেন; কিন্তু তাঁরা মেজবানের অনুপস্থিতিতে খেতে অস্বীকার করলেন। গভীর রাতে আবূ বকর (রা) ফিরে এসে যখন জানলেন মেহমানগণ অভুক্ত রয়েছেন। তখন তিনি উম্মু রূমান ও ছেলে ‘আবদুর রহমানের উপর ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন। এমনকি ছেলেকে মারতে উদ্যত হলেন। শেষ পর্যন্ত মেহমানদের মধ্যস্থতায় তিনি শান্ত হন। মেহমানদের সামনে খাবার হাজির করা হয়। সকলে পেট ভর খাওয়ার পর উম্মু রূমান বলেন, যে খাবার তৈরী হয়েছিল তার তিন গুণ খাবার এখনও রয়ে গেছে। আবূ বকর (রা) সে খাবার রাসূলুল্লাহর (সা) গৃহে পাঠিয়ে দেন। (বুখারী১/৮৪, ৮৫)

তিনি একজন ‘আবিদা (ইবাদাত-বন্দেগীকারিণী) মহিলা ছিলেন। ইবাদাতের নিয়ম-পদ্ধতি স্বামী তাঁকে শিখিয়ে দিতেন। একদিন তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে চোখ বাঁকা করে এদিক ওদিক দেখছেন। আবূ বকর (রা) লক্ষ্য করে ইমন বকুনি দেন যে, তাঁর নামায ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম হয়। তারপর তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) বলতে শুনেছি :[ হায়াত আস-সাহাবা-৩/১৩৭] (আরবী*********)

‘তোমাদের কেউ যখন নামাযে দাঁড়াবে, তার দৃষ্টি স্থির রাখবে। ইহুদীদের মত এদিক ওদিক ঝোকাবে না। দৃষ্টির স্থিরতা নামাযের পূর্ণতার অংশ।

হযরত রাসূলে কারীম (সা) একদিকে শাশুড়ী হওয়া, অন্যদিকে ইসলামের সেবায় অবদানের কারণে উম্মু রূমানের (রা) প্রতি দারুণ শ্রদ্ধা। তাই মেয়ে-জামাই যখন তাঁর উপস্থিতিতে কোন কথাবার্তা বলতেন তিনি নীরবে শুনতেন। মাঝে মধ্যে মেয়ে-জামাইয়ের মিষ্টি-মধুর কলহে মধ্যস্থতাও করতেন। হযরত রাসূলে কারীম (সা) প্রায়ই প্রথমা স্ত্রী উম্মুল মু‘মিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরার (রা) আলোচনা করতেন, তাঁর নানা গুণের কথা বলতেন। এতে ‘আয়িশার (রা) নারী-প্রকৃতি ক্ষুব্ধ হয়। একদিন তিনি বলে ফেলেন, মনে হয় খাদীজা (রা) ছাড়া দুনিয়াতে আর কোন নারী নেই। আয়িশার (রা) এমন প্রতিক্রিয়ায় রাসূল (সা) বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হন। মা হিসেবে উম্মু রূমান (র) এবার সামনে আসেন। তিনি জামাইকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘আয়িশা ও আপনার কী হলো? তার বয়স অল্প, আপনার মত ব্যক্তির থেকে সে ক্ষমাই পেতে পারে।[আস-সীরাহ্‌ আল-হালাবিয়্যা-৩/৪০১]

উম্মু রূমানের (রা) পরিবার সবসময় রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট দু‘আ চাইতেন। একদিন আবূ বকর (রা) ও উম্মু রূমান (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট গেলেন। তিনি বললেন : আপনারা কি জন্য এসেছেন? তারা বললেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের সামনে আপনি ‘আয়িশার মাগফিরাত কামনা করে দু‘আ করুন। রাসূল (সা) বললেন : (আরবী****)

‘হে আল্লাহ! তুমি ‘আয়িশা বিন্‌ত আবী বকরের জাহিরী ও বাতিনী সকল গুনাহ ক্ষমা করে দাও, যাতে তার আর কোন গুনাহ্‌ না থাকে।’

এই দু‘আর পর রাসূল (সা) শ্বশুর-শাশুড়ীকে বেশ উৎফুল্ল দেখে বলেন : ‘যেনি থেকে আল্লাহ আমাকে নবী করে পাঠিয়েছেন সেদিন থেকে আজকের দিন পর্যন্ত আমার উম্মাতের সকল মুসলামানের জন্য এই দ‘আ।’[তুহফাতুস সিদ্দীক ফী ফাদয়িলি আবী বকর আস-সিদ্দীক-৯৭; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/১৫৮]

হযরত উম্মু রূমানের (রা) মৃত্যুতে মেয়ে ‘আয়িশা (রা) ও পরিবারের অন্যরা যেমন শোকাভিভূত হন, তেমনি জামাই রাসূলে কারীমও (সা) দুঃখ পান। তাঁর জীবদ্দশায় যেমন রাসূল (সা) তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন, মৃত্যুর পরও তাঁর মরদেহের প্রতি সমান শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন।

বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা) মাত্র পাঁচ ব্যক্তির কবরে নেমে তাঁদের লাল করবে শায়িত করেছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজন নারী ও দুইজন পুরুষ। মক্কায় উম্মুল মু‘নিনীন খাদীজার কররে নেমেছেন। আর মদীনায় অপর চারজনের মধ্যে উম্মু রূমান (রা) অন্যতম। বাকী‘ গোরস্তানে রাসূলে কারীম (সা) কবরে উম্মু রূমানের (রা) লাশ শায়িত করে এই দু‘আ করেন :[ আল-ইসতী‘আব-৪/৪৩১; আল-ইসাবা-৪/৪৩৩; ওয়াফা আল-ওয়াফা-৩/৮৯৭] (আরবী*****)

‘হে আল্লাহ! উম্মু রূমান তোমার এবং তোমার রাসূলের সন্তুষ্টির পথে যা কিছু সহ্য করেছে তা তোমার কাছে গোপন নেই।’

তিনি উপস্থিত লোকদের লক্ষ্য করে আরো বলেন :[তাবাকাত-৮/২৭৭; কান্‌য আল-উম্মাল-১২/১৪৬; আনসাব আল-আশরাফ-১/৪২০; আর-রাওদ আল-আন্‌ফ-৪/২১]

‘তোমাদের কেউ যদি (জান্নাতের) আয়তলোচনা হূর দেখে খুশী হতে চায় সে উম্ম রূমানকে দেখেতে পারে।’

যেহেতু (আরবী*****০) জান্নাতেই হবে, তাই রাসূলুল্লাহর (সা) এ বাণীতে বুঝা যায় উম্মু রূমান (রা) নিশ্চিত জান্নাতী হবেন। এ বাণীতে সেই সুসংবাদই দেওয়া হয়েছে।

হযরত উম্মু রূমানের (রা) সূত্রে রাসূলুল্লাহর (সা) একটি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। ইমাম বুখারী (রা) হাদীছটি সংকলন করেছেন।

উম্মু ‘আতিয়্যা বিন্‌ত আল-হারিছ (রা)
উম্মু ‘আতিয়্যা (রা) একজন আনসারী মহিলা। পিতার নাম আল-হারিছ।[তাহযীব আল-আসমা’ ওয়াল লুগাত-২/৩৬৪; তাহযীব আত-তাহযীব-১২/৪৫৫; উসুদুল গাবা-৫/৬০৩] তিনি একজন উঁচু পর্যায়ের মহিলা সাহাবী। উম্মু ‘আতিয়্যা তাঁর ডাকনাম। এ নামেই তিনি ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। আসল নাম নুসাইবা বিন্‌ত আল-হারিছ।[আল-কামূস আল-মুহীত, মাদ্দা (নাসব)] উল্লেখ্য যে, একই সাথে নুসাইবা নাম ও উম্মু ‘আতিয়্যা ডাকনামের দ্বিতীয় কোন মহিলা সাহাবীর সন্ধান পাওয়া যায় না।

সম্ভবতঃ তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় হিজরাতের আগে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ কারণে রাসূল (সা) মদীনায় আসার পর পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদের যে বাই‘আত করেন। উম্মু ‘আতিয়্যা সেই বাই‘আতের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :

রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মদীনায় আসলেন তখন আনসার মহিলাদের একটি গৃহে একত্র করলেন। তারপর সেখানে ‘উমার ইবন আল খাত্তাবকে (রা) পাঠালেন। তিনি এস দরজার অপর পাশে দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন, মহিলারাও সালামের জবাব দিলেন। তারপর বললেন : আমি রাসূলুল্লাহর (সা) প্রতিনিধি হিসেবে আপনাদে নিকট এসেছি। আমরা বললাম : রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর প্রতিনিধিকে স্বাগতম। তিনি বললেন : আপনারা একথার উপর বাই‘আত করুন যে, আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবেন না, চুরি করবেন না, ব্যভিচার করবেন না, আপনাদের সন্তানদের হত্যা করবেন না, কারো প্রতি মিথ্যা দোষারোপ করবেন না এবং কোন ভালো কাজে অবাধ্য হবেন না।

আমরা বললাম : হাঁ, আমরা মেনে নিলাম। তারপর ‘উমার (রা) দরজার বাহির থেকে তাঁর হাত বাড়িয়ে দেন এবং ঘরের ভিতরে মহিলারাও নিজ নিজ হাত সম্প্রসারিত করেন। (মূলতঃ এ হাত বাড়ানো ছিল বাই‘আতের প্রতীকস্বরূপ। কোন মহিলা ‘উমারের (রা) হাত স্পর্শ করেননি।) তারপর ‘উমার (রা) বলেন : হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন! উম্মু ‘আতিয়্যা (রা) আরো বলেন : আমাদে ঋতুবতী মহিলা ও কিশোরীদের দুই ‘ঈদের সময় ‘ঈদগাহে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়, লাশের পিছে পিছে যেতে বারণ করা হয় এবং আমাদের জুম‘আ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এদিন উম্মু ‘আতিয়্যা “দোষারোপ” ও “ভালো কাজে অবাধ্য হওয়াঃ কথা দুইটির ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করেন।[হায়াত আস-সাহাব-১/২৫১-২৫২]

হযরত রাসূলে কারীম (সা) মহিলাদের জিহাদে গমনের অনুমতি দান করেছিলেন। বাস্তবে মুহাজির আনসারদের বহু মহিলা, এমনকি রাসূলুল্লাহর (সা) বেগমদের কেই কেউ জিহাদে যোগদান করেছেন। যেমন উম্মুল মু‘মিনীন ‘আয়িশা (রা) উহদ ও বানু আল-মুসতালিক যুদ্ধে এবং উম্মুল মু‘মিনীন উম্মু সালাম (রা) খায়বার অভিযান ও মক্কা বিজয়ে অংশগ্রহণ করেন।

যুদ্ধের ময়দানে মহিলারা সাধারণতঃ সেবামূলক কর্মে, যেমন আহতদের সেবা ঔষধ খাওয়ানো খাদ্য প্রস্তুত করা পানি পান করানো ইত্যাদিতে নিয়োজিত থাকতেন। উম্মু ‘আতিয়্যাও রাসূলুল্লাহর (সা) সংগে যুদ্ধে গেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন: [আত-তাজহ আল-জামি’ লিল উসূল-৪/৩৪৪; তাবাকাত-৮/৪৫৫; আল-ইসাবা-৪/৪৫৫; আল-ইসাবা-৪/৪৫৫; আল-মাগাযী-২/৬৮৫; সীরাতু ইবন হিশাম-২/৩৪২ ](আরবী*********)

‘আমি নবীর (সা) সাথে সাতটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। তাঁদের পিছনে তাঁবুতে থেকে তাদের জন্য খাবার তৈরী করতাম, আহতদের ঔষধ পান করাতাম এবং রোগীদের সেবায় নিয়োজিত থাকতাম।’ খায়বার যুদ্ধে উম্মু ‘আতিয়্যা (রা) বিশজন মহিলার একটি দলের সাথে জিহাদের ছোয়াব লাভের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হন।

নবী পরিবারের সাথে হযরত উম্মু ‘আতিয়্যার (রা) গভীর সম্পর্ক ছিল। বিশেষদঃ উম্মুল ‍মু‘মিনীন হযরত ‘আয়িশার (রা) সাথে সম্পর্ক ছিল খবই আন্তরিক। মাঝে মধ্যে হযরত ‘আয়িশাকে (রা) হাদিয়া-তোহফা দিতেন। একদিন রাসূল (সা) ‘আয়িশা (রা) ঘর এসে জিজ্ঞেস করেন : তোমার কাছে আহার করার মতহ কোন কিছু আছে কি? ‘আয়িশা (রা) বললেন : নেই। তবে উম্মু ‘আতিয়্যা নুসাইবাকে সাদাকার ছাগলের কিছু গোশত পাঠানো হয়েছিল, তিনি আবার তা থেকে কিছু পাঠিয়েছেন। রাসূল (সা) বললেন : তা তার জায়গা মত পৌঁছে গেছে। [আল-ইসাবা-৪/৪৫৫]

হযরত রাসূলে কারীমরে (সা) কন্যাদের সাথেও হযরত উম্মু ‘আতিয়্যার (রা) সম্পর্ক ছিল। তার প্রমাণ এই যে, হিজরী অষ্টম সনের প্রথম দিকে হযরত যায়নাবের (রা) ইনতিকাল হলে উম্মু ‘আতিয়্যা (রা) তাঁকে গোসল দেন। তিনি সে বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : [মুওয়াত্তা আল-ইমাম মালিক : আল-জানায়িয; তাবাকাত-৮/৩৪, ৩৫; উসুদুল গাবা-৫/৬০৩; আয-যাহাবী : তারীক-২/৫২০ ](আরবী********)

‘যায়নাব বিন্‌ত রাসূলিল্লাহ (সা) মারা গেলে রাসূল (সা) বললেন : তোমরা তাকে বেজোড়ভাবে তিন অথবা পাঁচবার করে গোসল দিবে। শেষবার কর্পুর বা কর্পুর জাতীয় কিছু দিবে। তোমরা গোসল শেষ করে আমাকে জানাবে। আমরা তার গোসল শেষ করলে রাসূল (সা) নিজের একটি লুঙ্গি আমারদের দিয়ে বলেন : এটি তার গায়ে পেঁচিয়ে দেবে।’

রাসূলুল্লাহর (সা) আরেক কন্যা উম্মু কুলছূম (রা) ইনতিকাল করলে উম্মু ‘আতিয়্যা (রা) তঁঅকেও গোসল দেন।[আত-তাবারী : তারীখ-২/১৯২; ইবন মাজাহ, হাদীছ নং-১৪৫৮; তাবাকাত-৮/৩৮; আল-ইসাবা-৪/৪৬৬] এমনিভাবে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সময়কালে কেবল দায়িত্ব পালন করেছেন।

খিলাফতে রাশিদার সময় হযরত উম্মু ‘আতিয়্যার (রা) এক ছেলে কোন এক যুদ্ধে যান এবং মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় তাকে বসরায় আনা হয়। এ খবর পেয়ে মা উম্মু ‘আতিয়্যা (রা) খুব দ্রুত সেখানে ছুটে যান। কিন্তু তাঁর পৌঁছার একদিন পূর্বে ছেলের ইনতিকাল হয়। বসরায় বানূ খালাফ-এর প্রাসাদে ওঠেন এবং সেখান থেকে আর কোথাও যাননি। ছেলের মৃত্যুর তৃতীয় দিন সুগন্ধি আনিয়ে গায়ে মাখেন এবং বলেন :

(আরবী*******)[ সাহীহান : আত-তালাক; তাফসীর আল-খাযিন-১/২৩৯]

‘একজন নারীর তার স্বামী ছাড়া অন্য কোন মৃত ব্যক্তির জন্য তিন দিনের বেশী শোক পালন করা উচিত নয়। স্বামীর জন্য চার মাস দশ দিন শোক পালন করবে।’

তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে মেনে চলার চেষ্টা করতেন। সবসময় মৃত্যু মাতম করতে নিষেধ করা হয় তখন তিনি বলেন, অমুক খান্দানের লোক আমার নিকট এসে কান্নাকাটি করে গেছে, আমাকেও তার বদলা হিসেবে তাদের কোন মৃতের জন্য কেঁদে আসা উচিত। তাঁর এমন কথায় রাসূল (সা) নিষেধাজ্ঞার আওতা থেকে সেই খান্দানটি ব্যতিক্রম ঘোষণা করেন।[সাহীহ মুসলিম-১/৪০১; মুসনাদ -/৪০৭]

যে সকল আনসারী মহিলা তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তির অধিকারিণী ছিলেন উম্মু ‘আতিয়্যা (রা) তাদের অন্যতম।তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) বেশ কিছু হাদীছ স্মৃতিতে ধারণ ও বর্ণনা করেছেন। ইমাম আন-নাওবী (রহ) উল্লেখ করেছেন, রাসূলুল্লাহর (সা) চল্লিশটি হাদীছ উম্মু ‘আতিয়্যার (রা) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে ছয়টি বুখারী ও মুসলিম উভয়ে বর্ণনা করেছেন। তকাছাড়া একটি করে হাদীছ উভয়ের গ্রন্থে এককভাবে বর্ণনা করেছেন।[তাহযী আল-আসমা’ ওয়াল লুগাত-২/৩৬৪] সুনানে আরবা‘আতেও তাঁর হাদীছ সংকলিত হয়েছে।

সাহাবীদের মধ্যে হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) সহ বহু বিশিষ্ট তাবি‘ঈ তাঁর থেকে সেই হাদীছগুলো শুনেছেন ও বর্ণনা করেছেন। যেমন : হাফসা বিন্‌ত সীরীন (মৃ. ১০১ হি.), তাঁর ভাই মুহাম্মাদ ইবন সীরীন, ‘আবদুল মালিক ইবন ‘উমাইর, ‘আলী ইবন আল-আকমার, উম্মু শুরাহী (রহ) ও অন্যরা।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/৩১৮; তাহযীব আত-তাহযীব-১২/৪৫৫]

ইমাম আয-যাহাবী উম্মু ‘আতিয়্যাকে (রা) ফকীহ সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর নিম্নের এ বর্ণনাটির প্রতি লক্ষ্য করলেই এর সত্যতা প্রমাণিত হয়। তিনি বলেছেন : (আরবী(********)

‘আমাদেরকে জানাযার অনুসরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে কঠোরভাবে করা হযনি।’ তিনি বলতে চেয়েছেন, মহিলাদেরকে শবাধারের পিছে পিছে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে এ নিষেধাজ্ঞা অন্যান্য নিষেধাজ্ঞার মতহ তেমন কঠোর নয়। সুতরাং তা হারামের পর্যায়ে নয়, বরং মাকরূহ পর্যায়ের।[নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবাওয়াহ্‌-১২১, টীকা-১]

ইবন ‘আবদিল বার (রহ) উম্মু ‘আতিয়্যাকে (রা) বসরার অধিবাসী গণ্য করেছেন। বিখ্যাত মহিলা তাবি‘ঈ হাফসা বিন্‌ত সীরীন (রহ)ও এ,ন তদা কলেছেন।[প্রাগুক্ত] বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য দ্বারা প্রতীয়মান হয়, তিনি মদীনা ত্যাগের পর আর সেখানে ফিরে আসেননি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বসরায় থেকে যান। বসরাবাসী সাহাবায়ে কিরাম (রা), তাবি‘ঈন ও সাধারণ মানুষের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা লাভ করেন। আহ্‌লি বায়ত তথা নবী-পরিবারের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক আজীবন বহাল থাকে। হযরত আলী (রা) তাঁর গৃহে আহার করে বিশ্রাম নিতেন।[তাবাকাত-৮/৪৫৬; আল-ইসাবা-৪/৪৫৫]

বসরায় তিনি একজন ফকীহ মহিলা সাহাবী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর হাদীছের সমঝ-বুঝ, শরী‘আতের বিধান সম্পর্কে সূক্ষ্ম জ্ঞান এবং রাসূলুল্লাহর (সা) নৈকট্যের কথা জানাজানি হওয়ার পর সকল শ্রেণীর মানুষের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিতে পরিণত হন। যেহেতু তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) দুই কন্যাকে গোসল দিয়েছিলেন এবং সে কথা বর্ণনা করতেন তাই বসরায় বসবাসকারী সাহাবায়ে কিরাম এবং মুহাম্মাদ ইবন সীরীনের (রহ) মত উঁচু স্তরের ফকীহ তাবি‘ঈ তাঁর নিকট এসে মৃতের গোসল দানের নিয়ম-পদ্ধতি ও অন্যান্য বিষয়েল জ্ঞান লাভ করতেন।[আল-ইসতী‘আব-৪/৪৫২; আল-ইসাবা-৪/৪৫৫]

ধারণা করা হয় তিনি হিজরী ৭০ (সত্তর) সনের ষেশ দিকে বসরায় ইনতিকাল করেন।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’ ২/৩১৮]
যায়নাব বিন্‌ত আবী মু‘আবিয়া (রা)
সেকালে আরবে যায়নাব নামটি বেশ প্রচলিত ছিল। সীরাতের গ্রন্থাবলীতে এ নামের অনেক মহিলাকে পাওয়া যায়। বিশ্বাস ও কর্ম গুণে যে সকল যায়নাব ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন, আমাদের যায়নাবও তাঁদের একজন। তিনি বিখ্যাত ছাকীফ গোত্রের কন্যা। পিতা ‘আবদুল্লাহ আবূ মু‘আবিয়া ইবন ‘উত্তাব। স্বামী প্রখ্যাত সাহাবী হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ (রা)।[তাবাকাত-৮/২৯০; আল-ইসতী‘আব-৪/৩১০; উসুদুল গাবা-৫/৪৭০; তাহযীব আত-তাহযী-১২/৪২২]

তিনি একজন হস্তশিল্পী ছিলেন। নিজ হাতে তৈরী জিনিস বিক্রী করে নিজের ছেলে-মেয়ে ও পরিবারের জন্য ব্যয় করতেন। তিনি অন্যদের সংগে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং অন্য মহিলাদের সংগে রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে বাই‘আত করেন। খায়বার অভিযানে অংশগ্রহণ করেন।[মাজমা‘ আয-যাওয়ায়িদ -৬/১০]

যে সকল মহিলা সাহাবী (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীছ স্মৃতিতে ধারণ করে বর্ণনা করেছেন যায়নাব (রা) তাঁদের অন্যতম। তাঁর থেকে বর্ণিত হাদীছ সংখ্যা আটটি। তিনি সরাসরি রাসূল (সা) থেকে এবং স্বামী ‘আবদুল্লাহ ইবন মাস‘ঊদ ও ‘উমার ইবন আল-খাত্তাবের (রা) সূত্রে হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্‌-৭২] আর তাঁর সূত্রে এ সকল হাদীছ বর্ণনা করেছেন :

আবূ ‘উবায়দা, ‘উমার ইবন আল-হারিছ , বিসর ইবন সা‘ঈদ, ‘উবায়দ ইবন সাব্বাক, তাঁর এক ভাতিজা যার নাম জানা যায় না ও আরো অনেকে।[আল-ইসাবা-৪/৩১৩]

হযরত রাসূলে কারীম (সা) মহিলাদেরকে ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার সময় কোন রকম সুগন্ধি ব্যবহার করতে যে বারণ করেছেন তা হযরত যায়নাব (রা) বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) একদিন তাঁকে বলেন : যখন তুমি ‘ইশার নামাযের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হবে তখন সুগন্ধি স্পর্শ করবে না।[তাবাকাত-৮/২৯০; আল-ইসতী‘আব-৪/৩১০; আল-ইসাবা-৪/৩১৩;]

হযরত যায়নাবের (রা) স্বামী হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ (রা) ছিলেন একজন উঁচু স্তরের সাহাবী। হযরত রাসূলে কারীমের (সা) কথা ও কাজ অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করতেন। বিন্দুমাত্র হেরফের হওয়া কল্পনাও করতে পারতেন না। নিজের পরিবারের লোকদেরকেও তেমন ভাবে গড়ে তোলার সাধ্যমত চেষ্টা করতেন। স্ত্রী হিসেবে হযরত যায়নাব (রা) তাঁর নিকট থেকে ইসলামী বিধি-বিধান, জীবন-যাপন প্রণালীর বহু কিছু শিক্ষা লাভ করেন।

ইমাম আহমাদ (রহ) হযরত যায়নাবের (রা) একটি বর্ণনা সংকলন করেছেন। তিনি বলেন : ‘আবদুল্লাহ (স্বামী) যখন বাইরের কাজ সেরে ঘরে ফিরতেন তখন দরজায় এসে থেমে গলা খাকারি ও কাশি দিতেন, যাতে আমাদের এমন অবস্থায় দেখতে না পান যা তাঁর পছন্ত নয়। একদিন তিনি ফিরে এসে গলাখাকারি দিলেন। তখন আমার নিকট এক বৃদ্ধা বসে ‘হুমরা () রোগ থেকে নিরাময়ের উদ্দেশ্যে আমাকে ঝাড়-ফুঁক করছিল। তাড়াতাড়ি আমি তাকে খাটের তলায় ঢুকিয়ে দিলা। তিনি ঘরে ঢুকে আমার পাশে বসার পর দেখলেন আমার গলায় সুতা ঝুলছে। প্রশ্ন করলেন : এটা কি?

বললাম : এটা আমার জন্য মন্ত্র পড়ে ফুঁক দেওয়া হয়েছে। তিনি সেটা ধরে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেন। তারপর বলেন : ‘আবদুল্লাহর পরিবার-পরিজন শিরকের প্রতি মুখাপেক্ষীহীন। আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) বলতে শুনেছি : তন্ত্র-মন্ত্র, তাবিজ-কবজ ও জাদিু-টোনা হলো শিরক।

আমি তাঁকে বললাম : আপনি এমন কথা বলছেন কেন? এক সময় আমার চোখ থেকে ময়লা বের হতো এবং অমুক ইহুদীল নিকট যেতাম। সে আমর চোখে মন্ত্র পড়ে ফুঁক দিলে ভালো হয়ে যায়।

তিনি বললেন : এটা শয়তানের কাজ। সে তোমার চোখে হাত দিয়ে খোঁচাতো। সে মন্ত্র পড়ে যখন ফুঁক দিত, শয়তান খোঁচানো বন্ধ করে দিত। তোমার জন্য একথা বলাই যথেষ্ট যা নবী (সা) বলেছেন। : (আরবী****************)

‘হে মানুষের প্রতিপালক! আপনি এ বিপদ দূর করে দিন। আপনি নিরাময় দানকারী, আমাকে নিরাময় দিন। আপনার নিরাময় ছাড়া আর কোন নিরাময় নেই। এমন নিরাময় দিন যেন আর কোন রোগ না থাকে।[বুখারী ; আত-তিব্ব, বাবু রাকয়াতুন নাবিয়্যি; মুসলিম : বাবু রাকয়াতিল মারীদ; আবূ দাউদ (৩৮৮৩); ইবন মাজাহ (৩৫৩০); তাফসীর ইবন কাছীর -৪/৪৯৪]

ইসলামী ফিকাহ্‌বিদগণ বলেন, স্ত্রীর যদি যাকাত ওয়াজিব হয়, তাহলে স্বামীকে যাকাত দেওয়া উচিত। কারণ, পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্ত্রীর নয়, স্বামীর। সুতরাং অন্যকে যাকাতের অর্থ দেওয়ার চেয়ে স্বামীকে দিলে স্ত্রী অধিক ছোয়াবের অধিকারী হবে।

এ রকম ঘটনা হযরত যায়নাবের (রা) ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। একদিন তিনি রাসূলকে (সা) মহিলাদের সাদাকা করতে ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য উৎসাহ দিয়ে বক্তৃতা করতে শুনলেন। ঘরে ফিরে দান করার উদ্দেশ্যে নিজের সকল গহনা একত্র করলেন। স্বামী ‘আবদুল্লাহ ইবন মাস‘ঊদ (রা) জিজ্ঞেস করলেন : এই গহনা নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?

বললেন : এগুলো দ্বারা আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ করতে চাই।

বললেন : দাও, আমাকে ও আমার ছেলে-মেয়েদেরকে দাও, আমি এগুলো লাভের যোগ্য।[হিলায়াতুল আওলিয়া ওয়া তাবাকাত আসফিয়া-২/৬৯]

এরপরের ঘটনা ইমাম বুখারী হযরত আবূ সা‘ঈদ আল-খুদরীর (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন এভাবে :

ইবন মাস‘ঊদের স্ত্রী যায়নাব বলেন : হে আল্লাহর নবী! আপনি আজ সাদাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আমার কিছু গহনা আছে এবং তা সাদাকা করতে চাই। কিন্তু ইবন মাস‘ঊদ (স্বামী) মনে করে, অন্যদের চেয়ে তিনি ও তাঁর ছেলে তা লাভের ক্ষেতে অগ্রাধিকা পাওয়ার যোগ্য। নবী (সা) বললেন : ইবন মাসঊদ ঠিক বলেছে। তোমার সাদাকা লাভের ক্ষেত্রে তোমার স্বামী ও ছেলে অন্যদের থেকে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য।

ঘটনাটি ‘আমর ইবন আল-হারীছ থেকে এবাবে বর্ণিত হয়েছে :

যায়না, ‘আবদুল্লাহ ইবন মাস‘ঊদের (রা) স্ত্রী বলেন : রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : (আরবী************)

‘হে নারী সমাজ! তোমরা সাদাকা কর- তা তোমাদের গহনাই হোক না কেন।’

যায়নাব বলেন : একথা শুনে আমি ‘আবদুল্লাহর নিকট ফিরে এলাম। তাঁকে বললাম, আপনি একজন স্বল্প বিত্তের মানুষ। রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের সাদাকা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আপনি তাঁর নিকট যান ও জিজ্ঞেস করুন, আপনাকে সাদাকা করা জায়েয হবে কিনা। জায়েয না হলে আমি অন্যদের দিব।

আমি গেলাম। দেখলাম রাসূলুল্লাহর (সা) দরজায় আরেকজন আনসারী মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। উল্লেখ্য যেড, এই মহিলার নামও যয়নাব এবং তিনি আবূ মাস‘ঊদ আল-আনসারীর স্ত্রী। তার ও আমার উদ্দেশ্য একই। বিলাল (রা) ভিতর থেকে বেরিয়ে আসলেন। আমরা তাঁকে বললাম : আপনি একটু রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট যান এবং তাঁকে বলুলন, দরজায় দাঁড়ানো দুইজন মহিলা জানতে চাচ্ছে যে, স্বামী এবং তার ছোট ছেলে-মেয়েদের সাদাকা করা জায়েয হবে কিনা। আমরা কে তা তাঁকে বলবেন না।

বিলাল (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট গিয়ে বিষয়টি জানতে চাইলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞেস করলেন : তারা কে? বিলাল (রা) বললেন : একজন আনসারী মহিলা ও যায়না।

রাসূল (সা) আবার প্রশ্ন করলেন : কোন যায়না? বিলাল বললেন : ‘আবদুল্লাহ ইবন মাস‘ঊদের স্ত্রী। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : তারা দুইটি ছোয়াব পাবে : আত্মীয়তার এবং সাদাকার।[বুখারী : আয-যাকাত, বাবুয যাকাত ‘আলাল আকারিব; মুসলিম : আয-যাকাত, বাবু ফাদল আন-নাফাকাতি ‘আলাল আকরাবীন ওয়া আয-যাওযি ওয়া আল-আওলাদ; উসুদুল গাবা-৫/৪৭০, ৪৭১; আল-ইসাবা-৪/৩১৩]

হযরত যায়নাবের (রা) স্বামী হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন মাস‘ঊদ (রা) হিজরী ৩২ সনে ইনতিকাল করেন। অন্তিম অবস্থায় তিনি স্ত্রী ও কন্যাদের দেখাশুনা ও বিয়ে-শাদীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কিছু ক্ষমতা দিয়ে যুবায়র ইবন আল-‘আওয়াম ও ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবায়রের (র) পক্ষে একটি অসীয়ত করে যান।[তাবাকাত-৩/১৫৯] হযরত যায়নাব (রা) কখন কোথায় ইনতিকাল করেন সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ধারণ করা হয় যে, তিনি স্বামীর মৃত্যুর পর বেশ কিছুদিন জীবিত ছিলেন এবং খিলাফতে রাশিদার শেষের দিকে ইনতিকাল করেন।[নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্‌-৭৬]


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি