উম্মুল ফাদল বিনত আল-হারিছ (রা)
উম্মুল ফাদল লুবাবা আল-কুবরা, যিনি শুধু উম্মুল ফাদল নামেই পরিচিত। আরবের রীতি অনুযায়ী বড় ছেলে আল-ফাদল ইবন ‘আব্বাসের নামে উপনাম ধারণ করেন। তাঁর পিতা আল-হারিছ ইবন হুযন আল-হিলালী এবং মাতা হিন্দ বিত ‘আওফ আল-কিনানিয়্যা। এই হিন্দ খাওলা নামেও পরিচিত।[তাবাকাত-৮/২৭৭; আল-ইসী‘আব-৪/৩৯৮] রাসূলুল্লাহর (সা) মুহতারাম চাচা হযরত ‘আব্বাস ইবন ‘আবদিল মুত্তালিব (রা) তাঁকে বিয়ে করেন। সুতরাং উম্মুল ফাদল রাসূলুল্লাহর (সা) একজন গর্বিত চাচী। হযরত ‘আব্বাসের ছেলে-মেয়ে : আল-ফাদল, ‘আবদুল্লাহ, উবাইদুল্লাহ, মা‘বাদ, কুসাম, ‘আবদুর রহমান ও উম্মু হাবীবের গর্ভধারিনী মা। ইমাম জা জাহাবী বলেছেন : ‘তিনি হযরত আব্বাসের (রা) ছয়জন মহান পুত্রের জননী’।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/৩১৪; আনসাব আল-আশরাফ-১/৪৪৭] ‘আরব কবি ‘আবদুল্লাহ ইবন ইয়াযীদ আল-হিলালী বলেছেন : ‘উম্মুল ফাদলের গর্ভের ছয় সন্তানের মত কোন সন্তান আরবের কোন মহিয়ষী নারী জন্মদান করেননি।’[তাবাকাত-৮/২৭৭; আল-ইসতী‘আব, আল ইসাবার পার্শ্বটীকা-৪/৩৯৯]

তাঁর অনেকগুলো সহোদর, বৈপিত্রেয় ও বৈমাত্রেয় ভাই-বোন ছিলেন, যাঁদের অনেকে বিভিন্ন দিক দিয়ে ইতিহাসে খ্যাতহ হয়ে আছেন। যেমন মায়মূনা বিনত আল-হারিছ- যিনি লুবাবা আ-সুগরা নামে পরিচিত, প্রখ্যাত সাহাবী ও সেনানায়ক খালিদ ইবন আল ওয়ালিদের (রা) গর্বিত মা। ‘আযযা বিনত আল-হারিছ ও হুযাইলা-বিনত আল-হারিছ। শেষোক্ত তিনজন তাঁর বৈমাত্রের বোন। আর মাহমিয়্যা ইবন জাযাআ আয-যুবাইদী, সুলমা, আসমা’ ও সালামা- সবাই তাঁর বৈপিত্রেয় ভাই-বোন।[উসুদুল গাবা-৫/৫৩৯] সুতরাং দেখা গেল, তিনি উম্মুল মু‘মিনীন মায়মূনার আপন বোন ও সেনাপতি খালিদ ইবন আল-ওয়ালীদের খালা। বোন সালমা ছিলেন হযরত হামযার (রা) স্ত্রী, এবং আসমা ছিলেন হযরত ‘আলীর (রা) ভাই প্রখ্যাত সেনানায়ক ও শহীদ সাহাবী হযরত জা‘ফর ইবন আবী তালিবের (রা) স্ত্রী। জা‘ফারের শাহাদাতের পর প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) হন তাঁর দ্বিতীয় স্বামী। হযরত আবু বকরের (রা) ইনতিকালের পর হযরত ‘আলী (রা) হন তাঁর তৃতীয় স্বামী। উম্মুল ফাদলের মা এদিক দিয়ে সৌভাগ্যবতী যে, তৎকালীন আরবের শ্রেষ্ঠ ঘরের সর্বোত্তম সন্তানদেরকে কন্যাদের বর হিসেবে লাভ করেন। আর এ সৌভাগ্যের ব্যাপারে অন্য কোন নারী তাঁর সমকক্ষ নেই।[তাবাকাত-৮/২৭৮; আল-ইসী‘আব-৪/৩৯৯]

তিনি মক্কায় ইসলামী দা‘ওয়াতের প্রথম ভাগে মুসলমান হন। বর্ণিত হয়েছে, তিনি মক্কার প্রথম মহিলা যিনি হযরত খাদীজার (রা) পরে ইসলাম গ্রহণ করেন।[তাবাকাত-৮/২৭৭] তবে আল-ইসাবা গ্রন্থে একথাও বলা হয়েভে যে, তিনি হিজরাতের পূর্বে মুসলমান হন।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/৩১৫]তবে মুহাদ্দিঝগণ এ বর্ণনাটিকে দুর্বল এবং প্রথমোক্ত বর্ণনাটিকে সঠিক বলেছেন। [সাহাবিয়াত-১৭৪] ইমাম জাহাবী তাঁকে প্রথম পর্বের মুসলমান বলেছেন।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/৩১৫]

রাসূলুল্লাহর (সা) খাদেম আবু রাফে‘ বলেছেন, আমি ছিলাম ‘আব্বাসের দাস। আমাদের আহলি বায়তের মধ্যে ইসলাম প্রবেশ করে। ‘আব্বাস ও উম্মুল ফাদল ইসলাম গ্রহণ করেন। [হায়াহতুস সাহাবা-৩৪/৫৩০ ১১. তাবাকাত-৮/২৭৮] এটাই সঠিক ওয ‘আব্বাস প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তা গোপন রাখেন।

মক্কার আদি পর্বের মুসলমান হলেও স্বামী হযরত ‘আব্বাসের (রা) মদীনায় হিজরাতের পূর্ব পর্যন্ত শত প্রতিকূলতার মধ্যেও মক্কার মাটি আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকেন। হযরত ‘আব্বাস (রা) অনেক দেরীতে ইসলামের ঘোষণা দেন এবং একেবারে শেষের দিকে মদীনায় হিজরাত করেন। আর তখনেই উম্মুল ফাদল (রা) তাঁর সন্তানদের সহ মদীনায় হিজরাত করেন। তই তাঁর ছেলে হযরত ‘আবদুল্লাহর ইবন ‘আব্বাস (রা) পরবর্তীকালে সূরা আন-নিসার ৭৫ নং আয়াতটি তিলাওয়াত করে বলতেন, এ আয়াতে যে দুর্বল নারী ও শিশুদের পক্ষে যুদ্ধ করতে বলা হয়েছে, আমার মা ও আমি হলাম সেই নারী ও শিশু।[সহীহ আল-বুখারী, কিতাবুত তাফসীর, সূরা আন-নিসা’] আয়াতটির মর্ম এরূপ : ‘আর তোমাদের কি হলো যে, তোমরা আল্লাহর রাহে লড়াই করছো না দুর্বল সেই পুরুষ, নারী ও শিশুদের পক্ষে যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এই জনপদ থেকে নিষ্কৃতি দান কর; এখানকার অধিবাসীরা যে অত্যাচারী!’ হাদীছ দ্বারা বুঝা যায় তাঁরা হযরত ‘আব্বাসের (রা) আগে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং! হিজরাত করতে অক্ষম ছিলেন। একথা বলেছেন ইমাম আজ-জাহাবী।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/৩১৫]

রাসূলুল্লাহ (সা) উম্মুল ফাদল সহ তাঁর অন্য বোনদেরকে ঈমানদার বলে ঘোষণা দান করেছেন। একবার রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে মায়মূনা, উম্মুল ফাদল, লুবাবা সুগরা, হুযাইলা, ‘আযযা, আসমা ও সালমা- এই বোনদের নাম আলোছনা করা হলো। রাসূল (সা) বললেন : এই সকল বোন মু‘মিনা বা ঈমানদার।[তাবাকাত-৮/২৭৮; আল-ইসতী‘আব-৪/৪০১] রাসূলুল্লাহর (সা) জীবনের কিছু কিছু ঘটনা দ্বারা জানা যায়, তিনি চাচী উম্মুল ফাদলকে যেমন ভালোবাসতেন, তেমনি গুরুত্বও দিতেন। চাচীও তাঁকে খুবই আদর করতেন। রাসূল (সা) প্রায়ই চাচীকে দেখার জন্যে তাঁর গৃহে যেতেন এবং দুপুরে কিছুক্ষণ সেখানে বিশ্রাম নিতেন।[তাবাকাত/৮/২৭৭; উসুদল গাবা-৫/৫৩৯]

আল-আজলাহ যায়দ ইবন আলী ইবন হুসায়নের সূত্রে বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) নবুওয়াত লাভের পর একমাত্র উম্মুল ফাদল ছাড়া অন্য কোন মহিলার কোলে মাথা রাখেননি এবং তা রাখা তাঁর জন্যে বৈধও ছিল না। উম্মুল ফাদল রাসূলুল্লাহর (সা) মাথা নিজের কোলের উপর রেখে সাফ করে দিতেন এবং চোখে সুরমা লাগিয়ে দিতেন। একদিন তিনি যখন সুরমা লাগাচ্ছেন, তখন হঠাৎ তাঁর চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি রাসূলুল্লাহর (সা) গণ্ডে পড়ে। তিনি মাথা উঁচু করে জিজ্ঞেস সরেন : কি হয়েছে? উম্মুল ফাদল বলেন : আল্লাহ আপনাকে মৃত্যু দান করবেন। যদি এ নেতৃত্ব ও ক্ষমতা আমাদের মধ্যে থাকে অথবা অন্যদের হাতে চলে যায় তাহলে আমাদের মধ্যে কে আপনার স্থলাভিষিক্ত হবে তা যদি বলে যেতেন। রাসূল (সা) বললেন : আমার পরে তোমরা হবে ক্ষমতাহীন, দুর্বল।[তাবাকাত/৮/২৭৮] ইমাম আহমাদের বর্ণনায় জানা যায়, রাসূলুল্লাহর (সা) অন্তিম রোগ শয্যায় এ ঘটনাটি ঘটে।[হায়াতুস সাহাবা-২/৩৩৭ ]

বিদায় হজ্জে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে উম্মুল ফাদলও হজ্জ করেন। আরাফাতে অবস্থানের দিন রাসূলুল্লাহ (সা) রোযা অবস্থায় আছেন কিনা, সে ব্যাপারে সাহাবীরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলেন্ এক পর্যায়ে তাঁরা তাঁদের সে দ্বিধার কথা উম্মুল ফাদলের নিকট প্রকাশ করেন। উম্মুল ফাদল বিষয়টি নিশ্চিত হবার জন্য এক পেয়ালা ‍দুধ রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে পেশ করেন এবং তিনি তা পান করেন। এভাবে তাঁদের সব দ্বিধা-সঙশয় দূর হয়ে যায়।[তাবাকাত/৮/২৭৯;]

হযরত উম্মুল ফাদল (রা) একদিন রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট বললেন, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আপনার দেহের একটি অঙ্গ আমার ঘরে আছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : স্বপ্নের তাবীর ইনশাআল্লাহ ভালো। ফাতিমার একটি পুত্র সন্তান হবে এবং আপনি তাকে দুধ পান করাবেন। এভাবে আপনি হবেন তার তত্ত্বাধায়িকা। ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়য় হযরত ফাতিমা হযরত হুসাইনকে (রা( জন্ম দেন এবং উম্মুল ফাদল (রা) তাঁকে দুধও পান করান। একদিন তিনি হুসাইনকে কোলে করে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকাট আনেন। শিশু হুসাইন নানার কোলে পেশাব করে দেন। উম্মূল ফাদল তাঁকে ধমক দিয়ে বলেন, তুমি রাসূলুল্লাহর (সা) কোলে পেশাব করে দিয়েছো? রাসূল (সা) বলেন : আপনি সন্তানকে ধমক দিয়ে আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন। তারপর পানি দিয়ে পেশাব ধোয় হয়।[প্রাগুক্ত]

হযরত উম্মুল ফাদল (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) রাসূলুল্লাহর (সা) তিরিশটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। একথা ইমাম জাহাবী মুসনাদে বাকী ইবন মুখাল্লাদের সূত্রে উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে একটি মাত্র হাদীছ মুত্তাফাক ‘আলাইহি, ইমাম বুখারী এবং তিনটি ইমাম মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/৩১৫; দ্র. বুখারী-২/২০৪, ৪/২০৬; মুসলিম, হাদীস নং৪৬২, ১১২৩, ১৪৫১;]

উম্মুল ফাদল থেকে যাঁরা হাদীছ বর্ণনা করেছেন তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হলেন : ‘আবদুল্লাহ, তাম্মাম, আনস ইবন মালিক, ‘আবদুল্লাহ ইবন হারিছ, ‘উমাইর, কুরাইব ও ফাবূস।[উসুদুল গাবা-৫/৫৪০]

হযরত উম্মুল ফাদল একজন উঁচু স্তরের ‘আবিদ এবং দুনিয়ার প্রতি নির্মোহ মহিলা ছিলেন। প্রতি সোম ও বুধবার রোযা রাখা তাঁর অভ্যাস ছিল। একথা তাঁর সুযোগ্য ছেলে মহান সাহাবী হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস (রা) বলেছেন।[তাবাকাত -৮/২৭৮; সিয়ারু সাহাবিয়াত-১১৭] তৃতীয় খলীফা হযরত ‘উছমানের (রা) খিলাফতকালে তিনি ইনতিকাল করেন। তখন তাঁর স্বামী হযরত আব্বাস (রা) জীবিত ছিলেন। হযরত ‘উছমান (রা) জানাযার নামায পড়ান।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/৩১৫ সিয়ারুস সাহাবিয়াত-১১৭]
সাফিয়্যা (রা) বিনত ‘আবদিল মুত্তালিব
হযরত সাফিয়্যা (রা) ও হযরত রাসূলে কারীমের (সা) বংশ ও পূর্বপুরষি এক ও অভিন্ন। কারণ হযরত সাফিয়্যা (রা) ‘আবদুল মুত্তালিবের কন্যা এবং রাসূলুল্লাহর (স) ফুফু। অন্যদিকে রাসূলুল্লাহর (সা) মায়ের সৎ বোন হালা বিনত ওয়াহাব ছিলেন সাফিয়্যার মা। সুতরাং এ দিক দিয়ে সাফি্য়্যার মা রাসূলূল্লাহর (সা) খালা।[উসুদুল গাবা-৫/৮৯২; আল-ইসাবা-৪/৩৪৮] উহুদের শহীদ সায়্যিদুশ শুহাদা হযরত হামযা (রা) তাঁর ভাই। দুইজন একই মায়ের সন্তান।[হাতজীবুল আসমা‘ ওয়াল লুগাত-১/৩৪৯]

জাহিলী যুগে আবু সুফইয়ান ইবন হারবের ভাই হারিছ ইবন হারবের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তার ঔরসে এক ছেলের জন্ম হয়। হারিছের মৃত্যুর পর ‘আওয়াম ইবন খুওয়াইলিদের সাথে দ্বিতীয় বিয়ে হয় এবং এখানে যুবাইর, সায়িব ও ‘আবদুল কা‘বা- এ তিন ছেলের মা হন।[তাবাকাত-৮/৪২] উল্লেখ্য যে এই ‘আওয়াম ছিলেন উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা‘র (রা) ভাই। অতএব দেখা যাচ্ছে তিনি ‘আশারা মুবাশশারার অন্যতম সদস্য হযরত যুবাইর ইবনুল ‘আওয়ামের গর্বিত মা এবং জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ ও স্বৈাচারী ইয়াযীদের বাহিনীর হাতে শাহাদাত প্রাপ্ত প্রখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন যুবাইরের দাদী।

হযরত সাফিয়্যা (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহর (সা) ফুফুদের ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতপার্থক্য আছে। একমাত্র তাঁর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মত কোন দ্বিমত নেই। ইবন সা‘দ আরওয়া, ‘আতিকা ও অন্য ফুফুদের ইসলাম গ্রহণের কথা বলেছেন। তবে সত্য এই যে, একমাত্র সাফিয়্যা ছাড়া অন্যরা ইসলাম গ্রহণ করেননি। ইবনুল আছীর একথাই বলেছেন।[উসুদুল গাবা ৫/৪৯২; তাহজীবুল আসমা‘ ওয়ললুগাত-১/৩৪৯,] তাঁর হিজরাত সম্পর্কে শুধু এতটুকু জান যায় যে, তিনি স্বামী ‘আওয়ামের সাথে মদীনায় হিজরাত করেন। ইবন সা‘দ শুধু এতটুকু বলেছেন : [তাবাকাত-৮] (আরবী*****) ‘তিনি মদীনায় হিজরাত করেন।’

হযরত ‘আয়িশা (রা) বলেন, মক্কায় যখন রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এ আয়াত (আরবী*******) [সূরা আশ-শু‘আরা’ -২১৪] নাযিল হয় তখন তিনি দাঁড়িয়ে এভাবে সম্বোধন করেন : [সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৭১]

-‘হে ফাতিমা বিনত মুহাম্মাদ, হে সাফিয়্যা বিনত ‘আবদিল মুত্তালিব, হে ‘আবদুল মুত্তালিবের বংশধরেরা, আমি আল্লাহর কাছে তোমাদের ব্যাপারে কিছুই করতে পারবো না। তোমরা আমার ধন-সম্পদ থেকে যা- খুশি চাইতে পার।’

তিনি কয়েকটি জিহাদে অংশগ্রহণ করেন। উহুদ যুদ্ধে মহিলাদেরকে কবি হাসসান ইবন ছাবিতের (রা) ফারে’ দুর্গে নিরাপত্তার জন্যে রেখে যান। এই ফারে‘ দুর্গকে ‘উতুম’ দুর্গও বলা হতো। তাঁদের সাথে হযরত হাসসানও ছিলেন। এই মহিলাদের মধ্যে হযরত সাফিয়্যাও ছিলেন। একদিন এক ইহুদীকে তিনি দুর্গের আশে-পাশে ঘুর ঘুর করতে দেখলেন। তিনি প্রমাদ গুণলেন, যদি সে মহিলাদের অবস্থান জেনে যায় ভীষণ বিপদ আসতে পারে। কারণ, রাসূষ (সা) তাঁর বহিনীসহ তখন জিহাদের ময়দানে অবস্থান করছেন। হযরত সাফিয়্যা (রা) বিপদের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে হাসসানকে বললেন, এই ইহুদীকে হত্যা কর। তা না হলে সে আমাদের অবস্থানের কথা অন্য ইহুদীরেদকে জানিয়ে দেবে। হাসসান (রা) বললেন, আপনার জানা আছে, আমার নিকট এর কোন প্রতিকার নেই। আমার যদি সেই সাহস থাকতো তাহলে আমি রাসূলুল্লাগর (সা) সাথেই থাকতাম। সাফিয়্যা তখন নিজেই তাঁবুর একটি খুঁটি হাতে নিয়ে ইহুদীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করেন। তারপা হাসসানকে (রা) বলেন, যাও, এবার তার সঙ্গের জিনিসগুলি নিযে এসো। যেহেতু আমি নারী, আর সে পুরুষ, তাই একাজটি আমার দ্বারা হবে না। এ কাজটি তোমাকে করতে হবে। হাসসান বললেন, ঐ জিনিসের প্রয়োজন নেই।[তাবাকাত-৮/৪১; কানযুল ‘উম্মাল-৭/৯৯; সীরাতু ইবন হিশাম-২/২২৮; আল-আগানী-৪/১৬৪; আল-বিদায়া-৪/১০৮]

অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে। সাফিয়্যা (রা) লোকটিকে হত্যার পর মাথাটি কেটে হাসসানকে বলেন, ধর, এটা দুর্গের নীচে ইহুদীদের মধ্যে ফেলে এসো। তিনি বললেন : এ আমার কাজ নয়্ অতঃপর সাফিয়্যা নিজেই মাথাটি ইহুদীদের মধ্যে ছুঁড়ে মারেন। আর ভয়ে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে সাফিয়্যা (রা) বলতেন : (আরবী*********)

‘আমিই প্রথম মহিলা যে একজন পুরুষকে হত্যা করেছে।’ একথা উরওয়া বর্ণনা করেছেন।[উহুদ যুদ্ধ হয খন্দক যুদ্ধের পূর্বে। এই উহুদ যুদ্ধেও হযরত সাফিয়্যা অংশগ্রহণ করেন এবং সাহসিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এই যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুসলমানরা কুরাইশ বাহিনীর আক্রমণে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে এবং পালাতে থাকে। তখন মূলত এক রকম পরাজয়ই ঘটে গিয়েছিল। তখন হযরত সাফিয়্যা (রা) হাতে একটি নিযা নিয়ে রণক্ষেত্র থেকে পলায়নপর সৈনিকদের যাকে সামনে পাচ্ছিলেন, পিটাচ্ছিলেন, আর উত্তেজিত কণ্ঠে বলছিলেন- তোমরা রাসূলুল্লাহকে (সা) ফেলে পালাচ্ছো? এ অবস্থা তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) দৃষ্টিতে পড়েন। রাসূল (সা) যুবাইরকে বলেন, তিনি যেন হামযার লাশ দেখতে না পান। কারণ, কুরায়শরা লাশের সাথে অমানবিক আচরণ করে। কেটে-কুটে তারা লাশ বিকৃত করে ফেলে। ভাইয়ের লাশের এমন বিভৎস অবস্থা দেখে তিনি ধৈর্যহারা হয়ে পড়তে পারেন, এমন চিন্তা করেই রাসূল (সা) যুবাইরকে এ নির্দেশ দেন। রাসূলুল্লাহর (সা) নির্দেশ মত যুবাইর (রা) মার নিকট এসে বলেন, মা, রাসূল (সা) আপনাকে ফিরে যাবার জন্য বলছেন। জবাবে তিনি বলেন, আমি জেনেছি, আমার ভাইয়ের লাশ বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। আল্লাহ জানেন, আমার ভাইয়ের লাশের সাথে এমন আচরণ আমার মোটেও পছন্দ নয়, তবুও আমি অবশ্যই ধৈর্য ধারণ করবো। ইনশাআল্লাহ নিজেকে নিয়র্ত্রণে রাখবো। মায়ের এসব কথা যুবাইর (রা) রাসূলকে (সা) জানালেন। তারপর তিনি সাফিয়্যাকে (রা) ভাইয়ের লাশের কাছে যাবার অনুমতি দান করেন। হযরত সাফিয়্যা ভাইয়ের লাশের নিকট যান এবং দেহের টুকরো টুকরো অংশগুলি দেখেন। নিজেকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখেন। মুখে শুধু (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্ন ইলাইহি রাজি‘উন) উচ্চারণ করে তাঁর মাগফিরাত কামনা করে দু‘আ করতে থাকেন। তিনি চলে যাবার পর রাসূল (সা) হযরত হামযার (রা) লাশদাফনের নির্দেশ দান করেন।[তাবাকাত-৮/৪২; উসুদুল গাবা-৫/৪৯২]

রাসূল (সা) সেদিন বলেছিলেন, যদি সাফিয়্যার কষ্ট না হতো এবং আমার পরে একটা রীতিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা না থাকতো তাহলে হামযার লাশ এভাবে ময়দানে ফেলে রাখতাম। পশু-পাখীতে খেয়ে ফেলতো।[সীরাতু ইবন হিশাম-২/৯৫]

হযরত সাফিয়্যার (রা) জীবিকার জন্যে রাসূল (সা) খাইবার বিজয়ের পর সেখানে উৎপাদিত ফসল থেকে বাৎসরিক চল্লিশ ওয়াসক শস্য নির্ধারণ করে দেন।[তাবাকাত-৮/৪১]

হযরত ‘উমারের (রা) খিলাফতকালে হিজরী ২০ সনে ৭৩ (তয়াত্তর) বছর বয়সে মদীনায় ইনতিকাল করেন। বাকী’ গোরস্তানে মুগীরা ইবন শু‘বার আঙ্গিনায় অজুখানার পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। অনেকে বলেছেন, তাঁর থেকে রাসূলুল্লাহর (সা) বেশ কিছু বর্ণিত হয়েছে।[প্রাগুক্ত-৮/৪২; তাহজীবুল আসমা’ ওয়াললুগাত-১/৩৪৯; আল-ইস্তীআব (আল-ইসাবার পার্শ্ব টীকা-৪/৩৪৫] একথা সঠিক নয়।

কাব্য প্রতিভা

হযরত সাফিয়া (রা) কুরায়শ গোত্রে হাশিমী শাখার একজন মহিলা কবি এব একজন সুবাষিণী মহিলা। জিহাদ ও অন্যান্য সৎকর্মের জন্যেও খ্যাতি অর্জন করেন। আরবী ভাষাকে বেশ ভালো মতই আয়ত্তে আনেন। তাঁর মুখ থেকে অবাধ গতিতে কবিতার শ্লোক বের হতো। সেই সব শ্লোক হতো চমৎকার ভাব বিশিষ্ট, প্রঞ্জল ও সাবলীল; কোমল, সত্য ও সঠিক আবেগ-অনুভূতি এবং চমৎকার বীরত্ব ও সাহসিকতায় পরিপূর্ণ। বর্ণিত হয়েছে, তিনি যখন তাঁর ছোট্ট শিশু সন্তান আয-যুবায়রকে কোলে নিয়ে দোলাতেন তখন তাঁর মুখ থেকে বীরত্ব ব্যাঞ্জক শ্লোক অবাধে বের হতে থাকতো।[সিয়ারু আলাম আনা-নুবালা-১/৪৫]

ইতিহাস ও সীরাতের (চরিত অভিধান) গ্রন্থসমূহে হযরত সাফিয়্যা (রা) যে সকল কবিতার সংরক্ষিত দেখা যায় তাতে তিনি যে আবরের একজন বড় মহিলা কবি ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিশেষতঃ মরসিয়া রচনায় তাঁর সাফল্য লক্ষ্য করার মত। এ কারণে অনেকে তাকে (আরবী****) বা ‘কুরায়শ বংশের খানসা’ অভিধায় ভূষিত করেন।[নিসা’ মিন ‘আসরিন নুবুওয়াহ্-৪১৯]

আল্লামা সুয়ূতী ‘আদ-দুররুল মানছুর’ গ্রন্থে বলেছেন :[ আদ-দুরারুল মানছুর-২৬১]

‘তিনি একজন বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী কবি ছিলেন। কথা, কর্মে, সম্মান-মর্যাদা ও বংশ গৌরবে তিনি গোটা আরববাসীর নিকট বিশেষ বৈশিষ্টের অধিকারিণী ছিলেন।’

আব্দুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর সাফিয়্যা (রা) তাঁর বোনদের ও বানু হাশিমের মেয়েদের সমবেত করে একটি শোক অনুষ্ঠানের মত করেন। সেই অনুষ্ঠানে অনেক মহিলা স্বরচিত মরসিয়া পাঠ করেন। বিভিন্ন গ্রন্থে সেই মরসিয়াটি সংকলিত হয়েছে।[দ্রষ্টব্য :সীরাত ইবন হিশাম- ১/১৬৯-১৭৪]

তার দুটি শ্লোক নিম্নরূপ : (আরবী*************************)

উঁচু ভূমির এক ব্যক্তির জন্যে রাত্রিকালীন

বিলাপকারিণীর আওয়াজে আমি জেগে উঠি

অতঃপর আমার দু‘গণ্ড বেয়ে এমনভাবে অশ্রু গড়িয়ে

পড়লো যেমন ঢালু স্থান থেকে মতি গড়িয়ে পড়ে।

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ইনতিকালের পর তিনি একটি শোকগাঁথা রচনা করেন। তার কিছু অংশ বিভিন্ন গ্রন্থে দেখা যা। তার কয়েকটি শ্লোক এখানে তুলে ধরা হলো :[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৭১; দ্রষ্টব্য : হায়াতুস সাহাবা-৩/৩৪৭-৩৪৮](আরবী*****)

‘হে আমার চক্ষু! অশ্রু বর্ষণ ও রাত্রি জাগরণের

ব্যাপারে বদান্যতা দেখাও। একজন সর্বোত্তম মৃত,

হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তির জন্যে বিলাপ কর

প্রচণ্ড দুঃখ- বেদনা সহকারে মুহাম্মাদ আল-মুসতাফার

স্মেরণে বিলাপ কর। যে দুঃখ-বেদনা অন্তরে মিলে

মিশে একাকার হয়ে তাকে ঠেস দিয়ে বসানো

রোগগ্র্ত ব্যক্তির মত করে দিয়েছে।

আমার জীবন আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল-

যখন তাঁর সেই নির্ধারিত মৃত্যু এসে যায়,

যা একটি মহা সম্মানিত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে।

তিনি ছিলেন মানু্যের প্রতি কোমল,

দয়ালু ও সর্বোত্তম পথ প্রদর্শক।

জীবন ও মৃত্যু- সর্বাসস্থায় আল্লাহ তাঁর প্রতি সদয় থাকুন

এবং সেই চিরন্তন দিনে আল্লাহ তাঁকে দান করুন জান্নাত।’

হযরত রাসূলে কারী (সা)- এর স্মরণে রচিত আরেকটি শোকগাঁথার কয়েকটি শ্লোক নিম্নরূপ :[শা’ইরাতুল ‘আরাব-২০২-২০৫] (আরবী**********)

‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি ছিলেন আমাদের আশা-ভরসা। আপনি ছিলেন আমাদের সাথ সদাচরণকারী এবং ছিলেন না কঠোর।

আপনি ছিলেন দয়ালু, পথের দিশারী ও শিক্ষক। যে কোন বিলাপকারীর আজ আপনার জন্যে আমার মা, খালা, চাচা, মামা এবং আমার জীবন ও ধন-সম্পদ সবই উৎসর্গ হোক।

মানব জাতির প্রতিপালক যদি আমাদের নবীকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখতেন, আমরা সৌভাগ্যবান হতাম। কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্ত তো পূর্বেই হয়ে আছে।

আপনার সম্মানে আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার প্রতি সালাম বর্ষিত হোক! আর সন্তুষ্টচিত্তে আপনি চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করুন।’

উহুদ যুদ্ধে যখন মুসলিম সৈনিকরা বিপর্যস্ত অবস্থায় রাসূল (সা) থেকে দূরে ছিটকে পড়ে তখন হযরত সাফিয়্যা যে সাহসের পরিচয় দেন তা পূর্বেই আলোচনা করেছি। সে সময় তিনি হামযার (রা) স্মরণে একটি কবিতাও রচনা করেন। তাতে একটি চিত্র তুলে ধরেন তার একটি বয়েত নিম্নরূপ :[আল-ইসাবা-৪/৩৪৯] (আরবী*******)

‘আর আপনার উপর এমন একটি দিন এসেছে- যে দিনের সূর্য অন্ধকার হয়ে গেছে, অথচ তা ছিল আলোকোজ্জ্বল।’
উম্মু আয়মান বারাকা (রা)
রাসূলুল্লাহর (সা) আযাদকৃত দাসী উম্মু আয়মান। তাঁর ভালো নাম ‘বারাকা’। হাবশী কন্যা। পিতার নাম সা‘লাবা ইবন ‘আমর। রাসূলুল্লাহর (সা) সম্মানিত পিতা ‘আবদুল্লাহর মতান্তরে মাতা আমিনার দাসী ছিলেন।[আনসাবুল আশরাফ-১/৯৬,] উত্তরাধিকার সূত্রে রাসূল (সা) তাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২২৩,] তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) ধাত্রী ছিলেন। রাসূলুল্লা্হকে (সা) কোলে-কাঁখে করে যাঁরা বড় করেন, তিনি তাঁদের একজন।[আনসাবুল আশরাফ-১/৯৬, ৪৭৬,] রাসূলুল্লাহর (সা) সাতটি ছাগী ছিল, উম্মু আয়মান সেগুলো চরাতেন।[প্রাগুক্ত১/৫১৩,]

রাসূলুল্লাহর (সা) বয়স যখন ছয় বছর তখন মা আমিনা তাঁকে সংগে করে মদীনায় যান স্বামীর কবর যিয়ারতের জন্য। এ সফরে সাথে ছিলেন ‘আবদুল মুত্তালিব ও উম্মু আয়মান।[প্রাগুক্ত-১/৯৪]

‘উবাইদ ইবন ‘আমর আল-খাজরাজী ইয়াছরিব থেকে মক্কায় এসে বসবাস করতে থাকেন। এখানে তিনি ‍উম্মু আয়মানের (সা) পরিবারে ফিরে আসেন। বালাজুরী বলেন, ‘উবাইদের সাথে উম্মু আয়মানের এ বিয়ে হয় জাহিলী যুগে। রাসূলুল্লাহর (সা) সংসারে তিনি বিধবা অবস্থায় জীবনের অনেকগুলো দিন কাটিয়ে দেন। অতঃপর রাসূল (সা) একদিন মক্কায় তাঁর সাহাবীদের বললেন : ‘তোমাদের কেউ যদি জান্নাতের অধিকারিণী কোন মহিলাকে বিয়ে করতে চায় সে যেন উম্মু আয়মানকে বিয়ে করেন।’ অতঃপর রাসূলুল্লাহর (সা) পালিত পুত্র এবং অতি প্রীতিভাজন যায়দ ইবন হারিছ তাঁকে বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করলে রাসূল (সা) নিজেই উদ্যোগী হয়ে তাঁর সাথে আয়মানের বিয়ে দেন। যায়দের ঘরে পরবর্তীকালের বিখ্যাত সেনানায়ক উসামার জন্ম হয়। প্রথম স্বামীর ঘরের সন্তান আয়মানের নাম অনুসারে আরবের রীতি অনুযায়ী তিনি উম্ম আয়মান উপনাম গ্রহণ করেন এবং এ নামেই ইতিহাসে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। তাঁর আসল নাম ‘বারাকাৎ। এই আয়মান মুসলমান হন এবং হুনাইন যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।[প্রাগুক্ত-১/৪৭২-৪৭৩; তাবাকাত-৮/২২৪; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২২৪]

উম্মু আয়মান (রা) ইসলামের প্রথম পর্বেই মুসলমান হন। যেসব ব্যক্তি হাবশা ও মদীনা উভয় স্থানে হিজরতের গৌরব অর্জন করেন, তিনি তাঁদের একজন। প্রথমে হাবশায় হিজরাত করেন। তারপর মক্কায় ফিরে এসে আবার স্বামী যায়দ ইবন হারিছার সাথে মদীনায় হিজরাত করেন।[সিয়ারুস সাহবিয়াত-১১১, আনসাবুল আশরাফ-১/৩২০] তিনি উহুদ ও খায়বার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উহুদে সৈনিকদের পানি পান করানো ও আহতদের সেবার দায়িত্বে নিয়েঅজিত থাকেন।

বালাজুরী বলেন : রাসূলুল্লাহর (সা) ধাত্রী উম্মু আয়মান (রা) উহুদ যুদ্ধে আনসার মহিলাদের সাথে মুসলিম মুজাহিদদের পানি পান করাচ্ছিলেন। তাঁকে লক্ষ্য করে হিব্বান ইবন ‘আরাকা একটি তীর নিক্ষেপ করে। তীরটি তাঁর ঝালরে লাগে এবং তাঁর দেহের কিছু অংশ বেরিয়ে পড়ে। তা দেখে তীর নিক্ষেপকারী অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। অতঃপর রাসূল (সা) সা‘দ েইবন আবী ওয়াক্কাসের হাতে তীর ধরিয়ে দিয়ে বলেন : এটি মার। সা‘দ তীরটি ছুড়ে মারলেন এবং তা হিব্বানের গায়ে আদে। সাথে সাথে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং মারা যায়। তা দেখে রাসূল (সা) এমনভাবে হেসে দেন যে তাঁর দাঁত দেখা যায়।[প্রাগুক্ত-১/৩২০,]

আল-হারিছ ইবন হাতিব, ছা‘লাবা ইবন হাতিব, সাওয়াদ ইবন গাযিয়্যা, সা‘দ ইবন ‘উছমান ও আরো কয়েক ব্যক্তি উহুদের সয়দান থেকে পালিয়ে আসেন। উম্মু আয়মান তাঁদেরকে ভীষণ তিরস্কার করেন। তাঁদের মুখে ধুলো ছুড়ে মারতে লাগেন এবং তাঁদেরকে লক্ষ্য করে বলতে থাকেন : যাও, চরকা আছে, সুতা কাট।[প্রাগুক্ত-১/৩২৬,]

হযরত উম্মু আয়মান (রা) আজীবন রাসূলুল্লাহর (সা) পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। রাসূলুল্লাহর (সা) পরিবারের লোকদের সাথেই তিনি মদীনায় হিজরাত করেন।[আল-ইসাবা-৪/৪৫০; আল-ইসতী‘আব-৪/৪৫০; হায়াতুস সাহাবা-১/৩৬৯,] ‘আলী ও ফাতিমার বিয়ের সময়ও আমরা উম্মু আয়মানকে (রা) সবার আগ্রভাগে দেখি। রাসূল (সা) আদরের কন্যা ফাতিমাকে স্বামীগৃহে পাঠালেন, পরদিন সকালেই মেয়ে-জামাইকে দেখার জন্য ছুটে গেলেন জামাই বাড়ি। দরজায় টোকা দিলেন। বিয়ে বাড়িতে মহিলাদের বেশ ভির। রাসূলুল্লাহর (সা) উপস্থিতি টের পেয়ে সবাই বেশ সতর্ক হয়ে পড়েছে। উম্মু আয়মান দরাজা খুলে দিলে রাসূল (সা) তাঁকে বললেন : আমার ভাইকে ডেকে দাও। উল্লেখ্য যে, জামাই ‘আল (রা) ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) চাচাতো ভাই। উম্মু আয়মান (রা) রাতে ‘আলীর বাড়িতেই ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহকে (সা) বললেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! ‘আলীকে ভাই বলছেন কেন। সে কি আপনার মেয়ের স্বামী নয়?[ হায়াতুস সাহাবা-২/৬৬৮]

হিজরী ৮ম সনে যায়নাব বিনতু রাসূলিল্লাহর (সা) ইনতিকাল হলে অন্য মহিলাদের সাথে তাঁর গোসলে অংশগ্রহণ করেন। তার পূর্বে বদর যুদ্ধের সময় রুকাইয়্যা বিনত রাসূলিল্লাহর (সা) ইনতিকাল হলে তাঁকেও গোসল দেন উম্মু আয়মান। আল-কালবী বলেন : উম্মুল মু‘মিনীন খাদীজা (রা) মৃত্যুবরণ করলে তাঁকে গোসল দেন উম্মু আয়মান ও উম্মুল ফাদ।[আনসাবুল আশরাফ -১/৪০০, ৪০১, ৪০৬]

হযরত রাসূলে কারীম (সা) আয়মানকে যথেষ্ট সমাদর ও সম্মান করতেন। মাঝে মধ্যে মা বলেও সম্বোধন করতেন। তিনি একথাও বলতেন : ‘এই পরিবারের অবশিষ্ট ব্যক্তি।’[তাবাকাত-৮/২২৩; আল-হাকিম-৪/৬৩,] উম্মু আয়মান (রা) একটু সরল বুদ্ধির মানুষ ছিলেন। রাসূল (সা) তাঁর সাথে মাঝে মধ্যে একটু হাসি-তামাশাও করতেন। একদিন উম্মু আয়মান (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে বললেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে কোন বাহনের পিঠে চড়ার ব্যবস্থা করে দিন। রাসূল (সা) বললেন: আমি আপনাকে মাদী উটের বাচ্চার উপর চড়াবো। উম্মু আয়মান বললেন : বাচ্চা তো আমার ভার বহন করতে পারবে না। রাসূল (সা) বললেন আমি আপনাকে বাচ্চার উপরই চড়াবো। আসলে রাসূল (সা) তাঁর সাথে একটু তামাশা করছিলেন। হাদীছে এসেছে রাসূল (সা) অহেতুক কোন হাসি-তামাশা করতেন না। তার মধ্যেও সত্য নিহিত থাকতো। এক্ষেত্রে তাই। কারণ, সব উট- তা ছোট হোক বা বড়, কোন না কোন মাদী উটেরই বাচ্চা।[আল-বিদায়া-৬/৪৬; আল-আদাব আল মুফরাদ লিল বুখারী-৪১; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২২৫ ,]

হযরত উম্মু আয়মান (রা) সবগুলো আরবী বর্ণধ্বনি উচ্চারণ করতে পারেন না।[তাবাকাত-৮/২২৫] আবু জা‘ফর আল-বাকির বলেছেন, একদিন উম্মু আয়মান (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট গেলেন এবং সালাম দিতে গিয়ে উচ্চারণ করলেন এভাবে : (আরবী*****) (সালামু লা ‘আলাইকুম)। সেদিন থেকে রাসূল (সা) তাঁকে শুধু (আরবী***) আস-সালামু বরার অনুমতি দান করেন।[প্রাগুক্ত; সিয়ারা আ‘লাম আন-নুবালা-২/২২৫]

রাসূলুল্লাহ (সা) মৃত্যুবরণ করলে উম্মু আয়মান ভীষণ দুঃখ পান এবং কাঁদতে শুরু করেন। লোকেরা বললো : আপনি কাঁদছেন? জবাবে তিনি বললেন : আল্লাহর কসম, আমি জানতাম তিনি মৃত্যুবরণ করবেন। কিন্তু আমি এ জন্য কাঁদছি যে, আজ থেকে আমাদের নিকট আসমান থেকে ওহী আসা বন্ধ হয়ে গেল। আনাস (রা) থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা) উম্মু আয়মানের সাথে মাঝে মধ্যে যেমন দেখা করতেন, চলো যাই আমরাও তাঁর সাথে একটু দেখা করে আসি। তাঁরা দুইজন উম্মু আয়মানের নিকট পৌঁছলে তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। তাঁরা বললেন : আপনি কাঁদছেন কেন? আল্লাহর নিকট যা কিছু আছে তা তাঁর রাসূলের (সা) জন্য উত্তম। উম্মু আয়মান বললেন : আমি সে কথা না জেনে কাঁদছিনে। আমি কাঁদছি এ জন্য যে, আকাশ থেকে ওহী আসা বন্ধ হয়ে গেল। এ কথা মুনে আবু বকর ও ‘উমার (রা) উভয়ে কাঁদা শুরু করলেন।[সাহীহ মুসলিম; ফাদায়িলস সাহাবা (২৪৫৪); ইবন মাজা: আল-জানায়িয (১৬৩৫); কানয আল-‘উম্মাল-৪/৪৮; আল-বিদায়া-৫/২৭৪,] এমনিভাবে দ্বিতীয় খলীফা ‘উমার শাহাদাত বরণ করলে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন, “আজ ইসলাম দুর্বল হয়ে গেল।”[ সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২২৭,]

রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় হিজরাত করে আসার পর আনসারগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁদের অনেক খেজুর বাগান রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে ছেড়ে দেন। । পরবর্তীতে যখন মদীনার ইহুদী গোত্র বানু কুরায়জা ও বানু নাদীর মদীনা থেকে বিতাড়িত হয় এবং তাদের সবকিছু মুসলমানদের হাতে আসে তখন তিনি আনসারদের সেই বাগ-বাগিচা ফেরত দিতে আরম্ভ করেন। তার মধ্যে হযরত আনাসেরও (রা) কিছু ছিল। রাসূল (সা) সেই বাগান উম্মু আয়মানকে দিয়েছিলেন। হযরত আনাস (রা) যখন সেই বাগান ফেরত নেওয়ার জন্য উম্মু আয়মানের নিকট গেলেন তখন তিনি তা ফেরত দিতে অস্বীকার করেন। পরে রাসূল (সা) সেই বাগানের পরিবর্তে তাঁকে দশগুণ বেশী দান করেন।[সহীহ আল-বুখারী; আল-মাগাযী-৭/৩১৬; মুসলিম; আল-জিহাদ ও সায়র-২/৩৪১,]

রাসূলুল্লাহ (সা) একদিন উম্মু আয়মানের বাড়িতে যান। উম্মু আয়মান পান করার জন্য শরবত পেশ করেন। রাসূল (সা) রোজা অবস্থায় ছিলেন। এ কারণে পান করতে ইতস্তত: করেন। এতে উম্মু আয়মান খুব অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।[মুসলিম-২/৩৪১,] সম্ভবত তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) রোযার কথা জানতেন না। আর সে কথা প্রকাশ করা রাসূলুল্লাহ (সা) জরুরী কোন বিষয় বলেও মনে করেননি।

হযরত উম্মু আয়মান (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীছও বর্ণনা করেছেন। তাঁর সূত্রে পাঁচটি হাদীছ বর্ণিত পাওয়া যায়। [সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২২৭,] তাঁর সূত্রে যাঁরা হাদীছ বর্ণনা করেছেন তাঁদের মধ্যে আনাস ইবন মালিক, হানশ ইবন ‘আবদিল্লাহ সান‘আনী এবং আবু ইয়াযীদ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।[সাহাবিয়াত-২০০]

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাঁর প্রথম স্বামীর পক্ষে আয়মান এবং দ্বিতীয় স্বামীর পক্ষে উসামা- এই দুই ছেলে ছিল। তাঁরা দুইজনই সাহাবী ছিলেন। উসামা অতি মর্যাদাবান সাহাবী ছিলেন। রাসূলুল্লাহর (সা) অতি স্নেহের পাত্র ছিলেন। আয়মানের এক ছেলে ছিলেন হাজ্জাজ ইবন আয়মান। একদিন তিনি মসজিদে ঢুকে রুকু-সিজদা দায়সারাভাবে করে খুব তাড়াতাড়ি নামায শেষ করেন। পাশে হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘উমার (রা) বসা ছিলেন। তিনি ইবন আয়মানকে (রা) ডেকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি মনে করেছো যে, তোমার নামায হয়েছে? তোমার নামায হয়নি। যাও, আবার পড়। ইবন আয়মান চলে যাওয়ার পর ইবন ‘উমার (রা) লোকদের নিকট জিজ্ঞেস করেন এ লোকটি কে? লোকেরা বললো : হাজ্জাজ ইবন আয়মান- উম্মু আয়মানের পৌত্র। ইবন ‘উমার (রা) তখন মন্তব্য করেন : রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে দেখলে আদর করতেন।[তাবাকাত-৮/২২৫; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২২৬,]

খলীফা হযরত ‘উছমানের (রা) খিলাফতকালে হযরত উম্মু আয়মান (রা) ইনতিকাল করেন। আর ইবনুল আছীর যে বলেছেন, তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) ওফাতের পাঁচ অথবা ছয় মাস পরে ইনতিকাল করেন, তা সঠিক নয়।[তাবাকাত-৮/২২৭; সাহাবিয়াত-২০০]

উম্মু আয়মানের (রা) সাথে সম্পর্কিত একটি অলৌকিক ঘটনার কথা বিভিন্ন সীরাত গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। যেমন, তিনি যখন হিজরাত করছিলেন তখন পথিমধ্যে এক স্থানে সন্ধ্যা হলো এবং তিনি পিপাসায় কাতর হয়ে পড়লেন। ধারে কাছে কোথাও পানি ছিল না্ এমন সময আকাশ থেকে সাদা রশিতে ঝোলানো এক বালতি পানি তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালো। তিনি পেট বরে সেই পানি পান করলেন। ফল এই দাঁড়ায যে, তিনি জীবনে আর কখনো পিপাসায কাতর হননি। তিনি বলতেন, প্রচণ্ড গরমের দুপুরে রোযা অবস্থায আমার পিপাসা হয়না।[তাবাকাত-৮/২২৪; হায়াতুস সাহাবা-৩/৬১৮]

তাবারানী বর্ণনা করেছেন। একবা আল-গিফার গোত্রের একদল লোক ইসলাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এলো। এ দলটির মধ্যে জাহজাহ আল গিফারীও ছিলেন। তারা মসজিদে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে নামায আদায করলেন। নামাযে সালাম ফেরানোর পর রাসূল (সা) ঘোষণা দিলেন : মুসল্লীদের প্রত্যেকেই তার পাশের অতিথিকে সাথে করে নিয়ে যাবে। জাহজাহ আল-গিফারী বলেন : সবাই চরে গেল। মসজিদে মসজিদে কেবল আমি ও রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে গেলাম। আমি ছিলাম একজন দীর্ঘদেহী মোটা মানুষ। রাসূল (সা) রাসূল (সা) আমাকে সংগে করে তাঁর ঘরে নিয়ে গেলেন্ তারপর আমার জন্যে একটি ছাগৎীর দুধ দুইয়ে আনলেন। আমি তা এক চুমুকে শেষ করে ফেললাম। তারপর হাঁড়িতে রান্না করা খাবার আনলেন, তাও সাবাড় করে ফেললাম। এ অবস্থা দেখে উম্মু আয়মান (রা) মন্তব্য করলেন : আজ রাতে যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহকে (সা) অভুক্ত রাখলো, আল্লাহ যেন তাকে অভুক্ত রাখেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : উম্মু আয়মান, চুপ করুন। সে তার রিযিক খেয়েছে। আর আমাদের রিযিক আল্লাহর দায়িত্বে।

রাত পোহালো। পরদিন দলটির সকলে একত্র হলো। প্রত্যেকেই তার খাবারের কথা বলতে লাগলো। জাহজাহও তার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করলেন। দিন কেটে গেল। তারা রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে মাগরিবের নামায আদায় করলেন। আগের দিনের মত রাসূল (সা) একই ঘোষনা দিলেন। সবাই যার যার অতিথি সংগে করে চলে গেল। জাহজাহ বলেন, আজো আমি ও রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে গেলাম। আসলে আমার এ বিরাট বপু দেখে কেউ আমাকে নেওয়ার আগ্রহ দেখাতো না। রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে নিয়ে ঘরে গেলেন। তারপর একটি ছাগী দুইয়ে দুধ আনলেন। আমি পান করলাম এবং তাতেই পরিতৃপ্ত হলাম। আমার আজকের এ অবস্থা দেখে উম্মু আয়মান (রা) বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই কি আমাদের সেই মেহমান নয়? তিনি বললেন : হাঁ, সেই মেহমান। তবে আজ রাতে সে খেয়েছে ‍মু‘মিন খায় একটিতে।[কানয আল-‘উম্মাল-১/৯৩; আল-ইসাবা-১/২৫৩; হায়াতুস সাহাবা-২/১৯৭-১৯৮]

হযরত উম্মু আয়মান (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) জন্য খাবার তৈরী করতেন। একদিন তিনি আটা চাললেন এবং সেই চালা আটা দিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) জন্য রুটি তৈরি করলেন। রুটি দেখে রাসূল (সা) প্রশ্ন করলেন। এ কি? উম্মু আয়মান বলেন : আমাদের দেশে আমরা এরূপ রুটি তৈরি করে থাকি। তাই আপনাকে এরূপ রুটি খাওয়াতে চেয়েছি। উল্লেখ্য যে, উম্মু আয়মানের (রা) জন্মভূমি ছিল হাবশা। রাসূল (সা) বললেন : এই রুটিগুলো চেলে বের করা ভূষির সাথে মিশিয়ে দিন। তারপর চটকিয়ে আবার আটার দলা বানিয়ে ফেলুন।[আত-তারগীব ওয়াত তারহীব-৫/১৫৪; হায়াতুস সাহাবা-২/২৭৩]
উম্মু হানী বিনত আবী তালিব (রা)
ইতিহাসে তিনি উম্মু হানী- এ ডাকনামে প্রসিদ্ধ। আসল নাম ফাখতা, মতান্তরে হিন্দ। হযরত রাসূলে কারীমের মহতারাম চাচা আবূ তালিব এবং মুহতারামা চাচী ফাতিমা বিনত আসাদের কন্যা। ‘আকীল, জা‘ফার, তালিব ও ‘আলীর (রা) সহোদরা।[সীরাতু ইবন হিশাম, ২/৪২০; আ‘লাম আন-নিসা‘, ৪/১৪ আল-ইসী‘আব, ২/৭৭২, ] তাঁর শৈশব-কৈশোর জীবনের কথা তেমন কিছু জানা যায় না। তবে বিয়ে সম্পর্কে দু‘একটি বর্ণনা দেখা যায়। যেমন রাসূল (সা) নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে চাচা আবূ তালিবের নিকট উম্মে হানীর বিয়ের পয়গাম পাঠান। একই সংগ্রে হুবায়রা ইবন ‘আমর ইবন ‘আয়িয আল-মাখযূমীও পাঠান। চাচা হুবায়রার প্রস্তাব গ্রহণ করে উম্মু হানীকে তার সাথে বিয়ে দেন। নবী (সা) বললেন : ভাতিজা! আমরা তার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক করেছি। সম্মানীয়দের সমকক্ষ সম্মানীয়রাই হয়ে থাকে।[আ‘লাম আন-নিসা- ৪/১৪,] এতটুকু বর্ণনা। এর অতিরিক্ত কোন কথা কোন বর্ণনায় পাওয়া যায় না। তবে হুবায়রা ইবন ‘আমরের সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিল সে কথা বিভিন্নভাবে জানা যায়।[উসুদুল গাবা-৫/৬২৪,]

উম্মু হানী কখন ইসলাম গ্রহণ করেন সে ব্যাপারে বিভিন্ন বর্ণনার মধ্যে একটু ভিন্নতা দেখা যায়। ইমাম আয-যাহাবি বলেন :[ সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/৩১২।] (আরবী*******)

‘তাঁর ইসলাম গ্রহণ বিলম্বে হয়। তিনি মক্কা বিজয়ের দিন ইসলাম গ্রহণ করেন।’

তবে রাসূলুল্লাহর (সা) সম্পর্কিত যে সকল বর্ণনা পাওয়া যায় তার মধ্যে উম্মু হানীর (রা) একটি বর্ণনাও বিভিন্ন গ্রন্থে দেখা যা। তাতে বুঝা যায় রাসূলুল্লাহর (সা) মি‘রাজ উম্মু হানীর ঘর থেকে হয়েছিল এবং তিনি তখন একজন মুসলমান। আর এটা হিজরাতের পূর্বের ঘটনা। তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহর (সা) ইসরা’ (মক্কা থেকে বাইতুল মাকদাসে রাত্রকালীন ভ্রমণ) আমার ঘর থেকেই হয়। সে রাতে তিনি ‘ঈশার নামায আদায় করে আমার ঘরে ঘুমান। আমরাও ঘুমিয়ে পড়ি। পজরের অব্যবহিত পূর্বে তিনি আমাদের ঘুম থেকে জাগান। তারপ তিনি বলেন : উম্মু হানী! তুমি দেখেছিলে, গতরাতে আমি এই উপত্যকায় ‘ঈশার নামায আদায় করেছিলাম। তারপর আমি বাইতুল মাকদাসে যাই এবং সেখানে নামায আদায় করি। আর এখন আমি ফজরের নামায তোমাদের সাথে আদায় করলাম, যা তোমরা দেখতে পেলে। তারপর তিনি বাইরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। আমি তহাঁর চাদরের এক কোনে টেনে ধরলাম। ফলে তাঁর পেটের অংশ বেরিয়ে যায়। তখন তা মিসরীয় কিবতী ভাঁজ করা কাতান বস্ত্রের মত দেখাচ্ছিল। আমি বললাম : হে আল্লাহর নবী! একথা আর কাউকে বলবেন না। এমন কথা তারা বিশ্বাস করবে না এবং তারা আপনাকে কষ্ট দিবে। বললেন : আল্লাহর কসম! একথা আমি তাদেরকে বলবই।

আমি আমার হাবশী দাসীকে বললাম : তুমি রাসূলুল্লাহর (সা) পিছে পিছে যাও এবং শোন তিনি মানুষকে কি বলেন এবং লোকেরা তাঁকে কি বলে। রাসূলুল্লাহ (সা) বেরিয়ে গেলেন এবং মানুষকে ইরার কথা বললেন। লোকেরা শুনে তো বিস্ময়ে হতবাক! তারা বললো : মুহাম্মাদ! তোমার এ দাবীর সপক্ষে প্রমাণ কি? আমরা তো এমন কথা আর কখনো শুনিনি। বললেন : আমি অমুক উপত্যাকায় অমুক গোত্রের একটি কাফেলার পাশ দিয়ে গিয়েছি। তাদের একটি উট হারিয়ে গিয়েছিল, আমি সে উটের সন্ধান দিয়েছি। আমি তখন শাম অভিমুখী ছিলাম। তারপর আমি “দাজনান” – এ অমুক গোত্রের কাফেলাকে পেয়েছি। আমি যখন তাদের অতিক্রম করি তখন তারা ঘুমিয়ে। তাদের একটি পানির পাত্র কিছু দিয়ে ঢাকা ছিল। আমি পাত্র থেকে পানি পান করে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রেখেছি। আমার এ দাবীর প্রমাণ হলো এখন সেই কাফেলা বায়দা থেকে তান‘ঈমের বাঁকের পথে আছে। যার অগ্রভাগে রয়েছে একটি ধূসর বর্ণের উট। লোকেরা সংগে সংগে তান‘ঈমের দিকে ছুটে গেল এবং তাদেরকে দেখতে পেল। তারা তাদেরকে পাত্রে ঢাকা দেওয়া পানির কথা বললো, তারা তার সত্যতা স্বীকার করলো। আর যে কাফেলার উট হারিয়ে গিয়েছিল তারা মক্কায় ফিরে এলে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারাও কথাটি সত্য বলে স্বীকার করলো।[সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪০২-৪০৩; ইবন কাছীর, আস-সীরাহ্ আন-নাবাবিয়্যাহ্-১/২৯৫]

মক্কা বিজয়ের দিন উম্মু হানীকে ইতিহাসের দৃশ্যপটে দেখা যায়। তাঁকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা সীরাত ও ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে বর্ণিত হয়েছে। যেমন এদিন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাঁর স্বামী মক্কা থেকে পালিয়ে নাজরানের দিকে চলে যান।[আনসাবুল আশরাফ-১/৩৬২] স্ত্রী উম্মু হানীর ইসলাম গ্রহণের খবর শুনে তাঁকে তিরস্কার করে একটি কবিতা তিনি রচরা করেন। কবিতাটির কিছু অংশ সীরাতের বিভিন্ন গ্রন্থে দেখা যায়।[সীরাতু ইবন হিশাম-২/৪২০; উসুদুল গাবা-৫/৬২৮; ইবন দুরাইদ, আল-ইতিকাক-১৫২] নিম্নের চরণগুলোতে মক্কা থেকে পালিয়ে যাবার কারণ স্ত্রীর নিকট ব্যাখ্যা করেছেন ।[আ‘লাম আন-নিসা-৪/১৪] (আরবী********)

‘তোমার জীবনের শপথ! আমি ভরুতার কারণে ও হত্যার ভয়ে মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীদেরকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালিয়ে আসিনি। তবে আমি নিজের বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছি, তাতে বুঝেছি এ যুদ্ধে আমার তীর ও তরবারি যথেষ্ট নয়। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থেকেছি। কিন্তু যখন আমার অস্থান সংকীর্ণ হওয়ার ভয় করেছি তখন ফিরে এসেছি যেমন বাঘ তার শাবকের কাছে ফিরে আসে।’

অনেকে তাঁর এই ফিরে আসাকে ইসলামের দিকে ফিরে আসা বলেছেন, কিন্তু তা সঠিক নয়। কারণ, তিনি কুফরীর উপর অটল থেকে মৃত্যুবরণ করেন।

এই মক্কা বিজয়ের দিন তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) অবস্থান স্থলে যান এবং তাঁকে গোসল করে চাশতের আট রাক‘আত নামায আদায করতে দেখেন। এ দিন তিনি দু‘জন আত্মীয়কে নিজ গৃহে আশ্রয় দেন এবং সে কথা রাসূলুল্লাহকে (সা) জানালে তিনিও তাদের নিরাপত্তার ঘোষণা দেন। নিম্নে সেই বর্ণনাগুলো তুলে ধরা হলো।

মক্কা বিজয়ের দিন আল-হারিছ ইবন হিশাম উম্মু হানীর গৃহে আশ্রয় নেয়। এ সময় উম্মু হানীর ভাই ‘আলী (রা) সেখানে যান। তিনি আলীকে (রা) আল-হারিছের বিষয়টি অবহিত করেন। সঙ্গে সঙ্গে ‘আলী (রা) তাকে হত্যার উদ্যেশ্যে তরবারি হাতে তুলে নেন। উম্মু হানী তাঁকে বলেন, ভাই! আমি তাকে নিরাপত্তা দিয়েছি। কিন্তু ‘আলী (রা) তাঁর কথায় কান দিলেন না। তখন উম্মু হানী ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর দু‘হাত শক্তভাবে মুঠ করে ধরে বলেন, আল্লাহর কসম! তুমি তাকে হত্যা করতে পার না। আমি তাকে আশ্রয় দিয়েছি। ‘আলী (রা) এক পাও এগোতে পারলেন না। তাঁর হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু সক্ষম হলেন না।

এ সময় নবী (সা) উপস্থিত হলেন। উম্মু হানী (রা) বললেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি অমুককে আশ্রয় দিয়েছি, আর ‘আলী তাঁকে হত্যা করতে চায়। রাসূল (সা) বললেন, তুমি যাকে আশ্রয় দিয়েছো, আমরাও তাকে আশ্রয় দিলাম। তুমি ‘আলীর উপর রাগ করো না। কারণ, ‘আলী রাগ করলে আল্লাহ রাগান্বিত হন। তাকে ছেড়ে দাও। উম্মু হানী আলীকে ছেড়ে দেন। রাসূল (সা) বললেন : একজন নারী তোমাকে পরাভূত করেছ। আলী বললেন : আল্লাহর কসম! ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি মাটি থেকে আমার পা উঠাতেই পারলাম না। রাসূল (সা) হেসে দিলেন।[প্রাগুক্ত-৪/১৫; মুসনাদে আহমাদ-৫/২৪২]

ইবন হিশান তাঁর সীরাতে ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন এভাবে : উম্মু হানী বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মক্কার উঁচু ভূমিতে অবতরণ করলেন তখন আমার শ্বশুরের গোত্র বনূ মাখযূমের দুই ব্যক্তি আল-হারিছ ইবন হিশাম ও ‘আবদুল্লাহ ইবন আবী রাবী‘আ পালিয়ে আমার গৃহে আশ্রয় নেয়। এ সময় আমার ভাই ‘আলী এসে উপস্থিত হয় এবং তাদেরকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। আমি দরজা বন্ধ করে মক্কার উঁচু ভূমিতে রাসূলুল্লাহর নিকট (সা) ছুটে গেলাম। তিনি আমাকে স্বাগত জানিয়ে বললেন : উম্মু হানী! কি উদ্দেশ্যে এসেছো? আমি তখন ঐ দুই ব্যক্তি ও ‘আলীর বিষয়টি তাঁকে অবহিত করলাম। তিনি বললেন : তুমি যাদেরকে নিরাপত্তা দিয়েছো আমরাও তাদেরকে নিরাপত্তা দিলাম। অতএব সে তাদেরকে হত্যা করবে না।[সীরাতু ইবন হিশাম-২/৪১১; হায়াতুস সাহাবা-১/১৮২; ৩/১৪৫, ১৪৬,]

উম্মু হানী বলেছেন, আমি মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট যাই। দেখলাম তিনি গোসল করছেন এবং ফাতিমা কাপড় দিয়ে তাঁকে আড়াল করে আছেন। আমি সালাম দিলাম। তিনি প্রশ্ন করলেন। কে তুমি? বললাম : আবূ তালিবের মেয়ে উম্মু হানী। বললেন : উম্মু হানী! তোমাকে শুভেচ্ছা ও স্বাগতম! গোসল সেরে তিনি নামাযে দাঁড়ালেন। এককানা মাত্র কাপড় পরে ও গায়ে জড়িয়ে আট রাকা‘আত নামায আদায় করেন। তারপর আমি বললাম : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার সহোদর ‘আলী এক ব্যক্তিকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে যাকে আমি আশ্রয় দিয়েছি। বললেন : উম্মু হানী! তুমি যাকে আশ্রয় দিয়েছো আমরাও তাকে আশ্রয় দিলাম। সেটা ছিল চাশতের নামায।[মহীহ বুখারী-৩.৪৩; বাবু সালাতিল ফাজরি ফিস সাফর-৬/১৯৫, ১৯৬; কিতাবুল মাগাযী; বাবু মানযিলিন নাবিয়্যি ইউমাল ফাতহি; সহীহ মুসলিম (৩৩৬) বাবু সালাতিল মাসাফিরীন ওয়া কাসরিহা; বাবু ইসতিহবাবি সালাতিদ দুহা; আল-মুওয়াত্তা-১/১৫২; বাবু সালাতিদ দুহা।]

হযরত রাসূলে কারীমের (সা) প্রতি ছিল উম্মু হানীর (রা) দারুণ সম্মান ও শ্রদ্ধবোধ। মক্কা বিজয়ের সময়কালে একদিন রাসূল (সা) তাঁর গৃহে যান। উম্মু হানী (রা) তাঁকে শরবত পান করতে দিলে তিনি কিছু পান করে উম্মু হানীর দিকে এগিয়ে দেন। উম্মু হানী সেদিন নফল রোযা রেখেছিল। তিনি রোযা ভেঙ্গে রাসূলুল্লাহর (সা) পানকৃত অবশিষ্ট শরবত পান করেন। রাসূল (সা) তাঁর এভাবে রোযা ভাঙ্গার কারণ জানতে চাইলে জবাব দেন : আমি আপনার মুখ লাগানো শরবত পানের সুযোগ ছেড়ে দিতে পারি না। রাসূল (সা) তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। একবার তিনি বলেন : উম্মু হানী, বকরী গ্রহণ কর। এ অত্যন্ত বরকতের জিনিস।[মুসনাদে আহমাদ-৬/৩৪৩]

উম্মু হানীর (রা) স্বামী হুবায়রা কুফরীর উপর অটল থাকে এবং সেই অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। উম্মু হানী ইসলাম গ্রহণের পর ইসলামের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। অতঃপর রাসূল (সা) তাঁকে বিয়ের পয়গাম দেন। জবাবে উম্মু হানী বলেন : আল্লাহর কসম! আমি তো জাহেলী যুগেই আপনাকে ভালোবাসতাম। এখন ইসলামী যুগে তো সে ভালোবাসা আরো গভীর হয়েছে। তবে আমি এখন একজন বিপদগ্রস্ত নারী। আমার অনেকগুলো ছোট ছেলে-মেয়ে আছে। আমার ভয় হয় তারা আপনাকে কষ্ট দেবে। রাসূল (সা) বলেন :বাহনের পিঠে আরোহণকারিনীদের মধ্যে কুরাইশ রমণীরা উত্তম। তারা তাদের শিশুদের প্রতি সর্বাধিক মমতাময়ী এবং স্বামীদের অধিকারের ব্যাপারে অধিক যত্নশীলা।[সীরাতু ইবন হিশাম-২/৪২০; আনসাবুল আশরাফ-১/৪৫৯,]

অপর একটি বর্ণনায় একথাও এসেছে, তিনি বলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কান এবং চোখ থেকেও আপনি আমার অধিক প্রিয়। স্বামীর অধিকার অনেক বড় জিনিস। স্বামীর দিকে মনোযোগী হলে আমার নিজের এবং আমার সন্তানদের অনেক কিছু ত্যাগ করতে হবে। আর সন্তানদের দিকে মনোযোগ দিলে স্বামীর অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে। তাঁর একথা শুনে রাসূল (সা) বলেন : উটের পিঠে আরোহণকারিণীদের মধ্যে সুরাইশ রমণীরা সর্বোত্তম। তারা তাদের শিশু সন্তানদের প্রতি যেমন অধিক মমতাময়ী তেমনি স্বামীর অধিকারের প্রতিও বেশী যত্নশীলা। এরপর রাসূল (সা) বিষয়টি নিয়ে আর উচ্চ-বাচ্চ করেননি।[আল- ‘ইকদ আল-ফারীদ-৬/৮৯; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/৩১৪; আনসাব-১/৪৫৯; আ‘লাম আন-নিসা-৪/১৬]

একবার উম্মু হানী বর্ণনা করেছেন, ‘আম্মার ইবন ইয়াসির, তাঁর পিতা ইয়াসির, ভাই ‘আবদুল্লাহ দেন। [মুসনাদে আহমাদ-৬/৩৪৩]

উম্মু হানী বর্ণনা করেছেন, ‘আম্মার ইবন ইয়াসির, তাঁর পিতা ইয়াছির, ভাই আবদুল্লাহ ইবন ইয়াসির এবং মা সুমাইয়্যাকে আল্লাহর রাস্তায় থাকার কারণে শাস্তি দেওয়া হতো। একদিন তাঁদের পাশ দিয়ে রাসূল (সা) যাওয়ার সময় বলেন : ওহে ইয়াসরের পরিবার! তোমরা ধৈর্যধারণ কর। তোমাদের ঠিকানা হল জান্নাত। অতঃপর নির্যাতনে ইয়াসির মৃত্যুবরণ করেন। সুমাইয়্যা আবূ জাহলকে কঠোর ভাষায় গালমন্দ করেন। আবূ জাহল তাঁর যৌনাঙ্গে বর্শাঘাত করলে তিনিও মৃত্যুবরণ করেন। আর ‘আবদুল্লাহকে তীর নিক্ষেপ করলে তিনিও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।[আনসাবুল আশরাফ-১/১৬০]

এমনিভাবে উম্মু হানী (রা) রাসূলুল্লাহকে (সা) যেমন দেখেছিলেন তার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহর (সা) দাঁতের চেয়ে সুন্দর তাঁদ আর কারো দেখিনি। রাসূলুল্লাহর (সা) পেট দেখে ভাজ করা কাগজের কথা মনে হতো। মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহর (সা) মাথার কেশ চারটি গুচ্ছে ভাগ করা দেখেছি।[প্রাগুক্ত-১/৩৯৩] হযরত রাসূলে কারীমের (সা) ইনতিকালের পর প্রথম খলীফা আবূ বকরের (রা) নিকট নবী দুহিতা হযরত ফাতিমার পিতার উত্তরাধিকার দাবীর বিষয়টিও উম্মু হানী (রা) বর্ণনা করেছেন।[প্রাগুক্ত-১/৩৯৩]

হযরত উম্মু হানী (রা) রাসূলুল্লহর (সা) ৪৬ (ছেচল্লিশটি ) হাদীছ বর্ণনা করেছেন যা হাদীছের বিভিন্ন গ্রন্থে সংকলিত রয়েছে।[বুখারী-৬/১৯৫, ১৯৬ : বুবু আমান আন-নিসা ওয়া জাওযারিহিন্না; মুসলিম (৩৩৬) বাবু ইসতিহবাব সালাতিদ দুহা] তাঁর সূত্রে যে সকল রাবী হাদীছ বর্ণনা করেছেন তাঁদের মধ্যে বিশেষ কয়েকজন হলেন : জা‘দা, ইয়াহইয়া, হারূর, আবূ মূররা, আবূ সালিহ, আবদুল্লাহ ইবন ‘আয়্যাশ, আবদুল্লাহ ইবন আল হারিছ ইবন নাওফাল, ‘আবদুর রহমান ইবন আবী লায়লা, শা‘বী, ‘আতা, কুরাইব, মুজাহিদ, ‘উরওয়া ইবন আয-যবায়র, মুহাম্মাদ ইবন ‘উকবা প্রমুখ।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/৩১২; আ’লাম আন-নিসা-৪/১৬]

হযরত উম্মু হানীর (রা) মৃত্যুসন সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে “আল-ইসাবা ফী তাময়ীয আস-সাহাবা” গ্রন্থের বর্ণনায় জানা যায়, তিনি ‘আলীর (রা) মৃত্যুর পরও জীবিত ছিলেন।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/৩১৩] তাঁর কয়েকজন সন্তানের নাম হলো: ‘আমর, হানী, ইউসুফ ও জা‘দা। তাঁরা সকলে হযরত ‘আলীর (রা) ভাগ্নে। জা‘দাকে হযরত ‘আলী (রা) খুরাসানের ওয়ালী নিয়োগ করেছিলেন। [প্রাগুক্ত-২/৩১২,৩১৩; সাহাবিয়াত-২২৯]

হযরত উম্মু হানীর (রা) জন্য বিশেষ মর্যাদার বিষয় এই যে, হযরত রাসূলে কারীম (সা) তাঁর নিকট খাবার চেয়ে খেয়েছেন এবং প্রশংসা করেছেন। একদিন রাসূল (সা) উম্মু হানীকে বললেন : তোমার নিকট খাবার কোন কিছু আছে কি?

উম্মু হানী : কিছু শুকনো রুটির টুকরো ছাড়া আর কিছু নেই। আমি তা আপনার সামনে দিতে লজ্জা পাচ্ছি।

রাসূল (সা) বললেন : সেগুলোই নিয়ে এসো।

উম্মু হানী হাজির বরলেন। রাসূল (সা) সেগুলো টুকরো টুকরো করে লবন-পানি মিশালেন। তারপর বললেন : কিছু তরকারি আছে? উম্মু হানী বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিছু সিরকা ছাড়া আমার কাছে আর কিছু নেই। রাসূল (সা) সিরকা আনতে বললেন। তিনি রুটির টুকরোগুলোতে সিরকা মিশিয়ে আহার করলেন। তারপর আল্লাহর হামদ জ্ঞাপন করে বললেন :সিরকা অতি উত্তম তরকারি। উম্মু হানী! যে গৃহে সিরকা থাকে সে গৃহ অভাবী হয় না।[আস-সীরাতুল হালাবিয়্যাহ-৩/৪২; নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্-৩৯৮]
হালিমা আস-সা‘দিয়্যা (রা)
জাহিলী যুগে অভিজাত আরবদের মধ্যে এ প্রথা ও রীতি প্রচলিত ছিল যে, তাদের কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তারা ভিন্ন গোত্রের কোন ধাত্রীর হাতে তুলে দিত। তারা মনে করতো, এতে সন্তানের মধ্যে আভিজাত্য ও ভাষার বিশুদ্ধতা সৃষ্টি হয়। মক্কার অভিজাত লোকেরা তাদের শিশু সন্তানকে মরুবাসী বেদুঈনদের নিকট পাঠিয়ে দিত। সেখানে তারা বেদুঈন ধাত্রীদের নিকট দুধ পানের বয়সটি কাটাতো। তারা সন্তানদের জন্য স্বভাবগত বুদ্ধিমতী ও সুরুচির ধাত্রী নির্বাচন করতো। এ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ধাত্রীদের উন্নত নৈতিকতা, সুঠাম দৈহিক কাঠামো, বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল ভাষা, সামাজিক সম্মান ও অবস্থানের দিকগুলো প্রাধান্য দিত। এসব গুণ যে মহিলার মধ্যে থাকতো সেই ধাত্রী পেশায় সফল হতো।

দুগ্ধবতী শিশু সন্তানের মায়েরা মরুভূমি থেকে বিভিন্ন শহর ও জনপদে আসতো দুধ পান করাবে এমন শিশুর খোঁজে। সেখান থেকে পারিশ্রমিকের শর্তে শিশু সন্তান সংগ্রহ করে আবার মরুভূমিতে ফিরে যেত। তারা দুধ পান করানোর সাথে সাথে শিশুদেরকে বেদুঈনদের খেলাধুলা, তাঁবু স্থাপনের কলাকৌশল, আদব-আখলাক ও বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী। কারণ, আমি কুরাইশ গোত্রে জন্ম ও বানূ সা‘দে দুধ পান ও প্রতিপালিত হওয়ার কথা উল্লেখ করতেন।[সীরাতু ইবন হিশাম-১/১৬৭] তিনি সাহাবীদেরকে বলতেন : ‘আমি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী। কারণ, আমি কুরাইশ গোত্রের সন্তান এবং বানূ সা‘দ গোত্রে দুধ পান করে বেড়ে উঠেছি।’ একবার আবূ বকর সিদ্দীক (রা) বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার চেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী আর কাউকে দেখিনি। তিনি বললেন : এমনটি হতে আমার বাধা কোথায়? আমি কুরাইশ গোত্রের সন্তান এবং বানূ সা‘দে দুধ পান করেছি।[ইবন কাছীর, আস-সীরাহ্ আন-নাবাবিয়্যা-১/১১৫; আস-সীরাহ্ আল-হালাবিয়্যা-১/১৪৬]

আমাদের আলোচ্য হালীমা আস-সা‘দিয়্যা (রা) ছিলেন বানূ সা‘দ গোত্রের রাসূলুল্লাগর (সা) ভাগ্যবতী ধাত্রী তথা দুধ মা। তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে কবি শায়খ ইউসুফ আন-নাবহানী (রহ) বলেছেন :[আন-নাবহানীর “হুজ্জাতুল্লাহি ‘আলাল ‘আলামীন” গ্রন্থের সূত্রে “নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ” গ্রন্থে উদ্ধৃত। পৃ.১১] (আরবী********)

‘তাঁকে দুধ পান করান পূর্ণ সৌভাগ্যের অধিকারিণী, গোত্রসমীহের মধ্যে উজ্জ্বল চিহ্ন বিশিষ্ট গোত্রের হালীমা।

তাঁর কাছে খাদ্য ছিল অপর্যাপ্ত। অতঃপর তিনি শহরবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সচ্ছল ব্যক্তিতে পরিণত হন।

তিনি একজন সৌভাগ্যবতী। ভাগ্যগুণে যিনি একজন ভাগ্যবীতে পরিণত হন।’[সীরাতু ইবন হিশাম-১/১৬০]

এই ভাগ্যবতী মহিলা হলেন হালীমা বিনত ‘আবদিল্লাহ ইবন আল-হারিছ আস-সা‘দিয়্যা (রা)। রাসূলুল্লাহর (সা) ধাত্রী মাতা। তাঁর স্বামীর নাম আল-হারিছ ইবন ‘আবদিল ‘উযযা ইবন রিফা‘আ আস-সা‘দী। তাঁর সন্তানরা হলেন : ‘আবদুল্লাহ, উনাইসা ও খুযাইমা, মতান্তরে হুযাফা। শেষোক্তজন আশ-শায়মা নামেও পরিচিত। এঁরা সবাই আল-হারিছের ঔরসজাত সন্তান এবং রাসূলুল্লাহর (সা) দুধ ভাই ও বোন। রাসূলুল্লাহ (সা) ও ‘আবদুল্লাহ একই সাথে দুধ পান করেন। উল্লেখ্য যে, এই আল-হারিছের ডাকনাম যুওয়ায়িব ও আবূ কাবশা ছিল। [প্রাগুক্ত; আনসাবুল আশরাফ -১/৯০-৯১]

হালীমা রাসূলুল্লাহর (সা) চাচাতো ভাই আবূ সুফইয়ান ‘ইবন আল-হারিছ ইবন ‘আবদিল মুত্তালিবের ধাত্রী ও দুধ মা ছিলেন। বানূ সা‘দ গোত্রের এক মহিলা রাসূলুল্লাহর (সা) চাচা হামযা ইবন ‘আবদিল মুত্তালিবের ধাত্রী ও দুধ মা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) যখন হালীমার কাছে তখন একদিন হামযার (রা) দুধ মা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) যখন হালীমার কাছে তখন একদিন হামযার (রা) দুধ মা তাঁকে নিজের বুকের দুধ পান করান। এদিকে রাসূলুল্লাহ (সা) হালীমার নিকট যাওয়ার আগে কিছু দিন আবূ লাহাবের দাসী চুওয়াইবার দুলধ পান করেছিলেন। ছুওয়াইবা কিছুদিন হামযাকেও দুধ পান করিয়েছিলেন। তাই হামযা বানূ সা‘দ ও ছুওয়াইবা দু‘দিক দিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) দুধ ভাই।[রিজানুল মুবাশশিরূন বিল জান্নাহ-১/৭, ২/১৮৯; নিসা’ মিন আসর আন-নুবুওয়াহ পৃ. ১১; সীরাতু ইবন হিশাম-১/১৬১; টীকা নং-৬]

হালীমা রাসূলুল্লাহকে (সা) দুধ পান করিয়েছেন। এ কারণে তিনি ‍দুধ পানকারিণী হিসেবে আরবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন। রাসূলুল্লাহকে (সা) তিনি দুধের শিশু হিসেবে যেভাবে লাভ করেন তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন : সে ছিল অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষের বছর। আমি বানূ সা‘দের আরো দশজন মহিলার সাথে সাদা রঙ্গের একটি দুর্বল মাদি গাধার উপর সওয়ার হয়ে দুগ্ধপোষ্য শিশুর খোঁজে বের হলাম। আমাদের সাথে একটা বুড়ো মাদি উটও ছিল। আল্লাহর কসম! তার ওলান থেকে এক কাৎরা দুধও বের হচ্ছিল না। ক্ষিদের জ্বালায় আমাদের শিশুদের কান্নাকাটির কারণে আমরা রাতে মোটেও ঘুমোতে পারতাম না্ আমার বুকের ও আমাদের উটনীর দুথে আমার শিশু পুত্র ‘আবদুল্লাহর পেট ভরতো না। তবে আমরা বৃষ্টি ও সচ্ছলতার আশা করতাম। অবশেষে আমরা মক্কায় পৌঁছলাম। আমাদের প্রত্যেকের সামনে শিশু রাসূলুল্লাহকে (সা) উপস্থাপন করা হলো। তিনি ইয়াতীম শিশু- একথা শোনার পর কেউ আর তাঁকে নিতে আগ্রহ দেখালো না। কারণ, আমরা শিশুর পিতা-মাতার নিকট থেকে ভালো কিছু লাভের আশা করতাম। আমরা বলাবলি করতাম : শিশুটি ইয়াতীম। তার মা ও দাদা তেমন কী আর দিতে পারবে? এ কারণে আমরা তাকে অপসন্দ করলাম। এর মধ্যে দলের একমাত্র আমি ছাড়া আর সবাই স্তন্যপায়ী শিশু পেয়ে গেল। যখন আমরা আমাদের গোত্রে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম তখন আমি আমার স্বামীকে বললাম : আল্লাহর কসম! অন্যরা স্তন্যপায়ী শিশু নিয়ে ফিরবে আর আমি শূন্য হাতে ফিরবো, এ আমার মোটেই পসন্দ নয়। আমি এই হাশিমী ইয়াতীম শিশুটির নিকট যাব এবং তাকেই নিয়ে ফিরবো। তিনি বললেন : হাঁ, তুমি তাই কর। হতে পারে তার মধ্যে আমাদের জন্য বরকত ও সমৃদ্ধি রেখেছেন। অতঃপর তার বাড়ীতে গিয়ে নিয়ে এলাম।[আনসার আল-আশরাফ -১/৯৩-৯৪,]

অপর একটি বর্ণনায় এসেছে। হালীমা বলেন : আমি উপস্থিত হলে ‘আবদুল মুত্তালিব স্বাগতম জানিয়ে প্রশ্ন করেন : তুমি কে? বললাম : বানূ সা‘দের এক মহিলা। বললেন : তোমার নাম কি? বললাম : হলীমা।

‘আবদুল মুত্তালিব একটু হেসে বললেন : সাবাশ! সাবাশ! সৌভাগ্য ও বুদ্ধিমত্তা। এমন দু‘টি গুণ যার মধ্যে সে যেন সকল যুগের কল্যাণ ও চিরকালের সম্মান। আবদুল মুত্তালিব (সা‘দ) ও হালীমা (হুলম) শব্দ দু‘টির প্রতি ইঙ্গিত করে। একথা বলেন। তিনি হালীমাকে নবীর (সা) জননী আমিনার ঘরে নিয়ে যান। তাঁর নিকট থেকেই হালীমা শিশু মুহাম্মাদকে গ্রহণ করেন।[প্রাগুক্ত; আবন কাছীর, আস-সীরাহ্-১/১১২-১১৩; আয-যাহাবী, তারীখ আল-ইসলাম-১/৪৫, ৪৬] হালীমার ভাগ্য যে সুপসন্ন ছিল তা সূচনাতেই বিভিন্নভাবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। যেমন কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, হালীমা যখন আবদুল মুত্তালিবের সাথে নবীর (সা) নিকট পৌঁছেন তখন আবদুল মুত্তালিব এক অদৃশ্য কণ্ঠে নিম্নের শ্লোকগুলোর আবৃত্তি শুনতেহ পান :[নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াব।প.-১২] (আরবী*******************)

“নিশ্চয় আমিনার ছেলে মুহাম্মাদ পরম বিশ্বস্ত, সৃষ্টি জগতের মধ্যে সবচেয়ে ভালো এবং ভাদের মধ্যে উত্তম।

হালীমা ছাড়া তাঁকে অন্য কেউ দুধ পান করাবে না। সে পুণ্যবানদের জন্য কত না বিশ্বস্ত!

অশ্লীল দোষ-ত্রুটি থেকে সে মুক্ত এবং যাবতীয় পাপ ও পঙ্কিলতা থেকে পরিচছন্ন।

তুমি তাকে তার নিকট ছাড়া আর কারো নিকট সম্পর্ণ করবে না। মহাপরাক্রমশালী সত্তার নিকট থেকে এ আদেশ ও সিদ্ধান্ত এসেছে।”

নবীকে (সা) গ্রহণের সাথে সাথে হালীমা ও তাঁর স্বামীর নিকট কল্যাণ ও সমৃদ্ধি নেমে এলো। হালীমা শিশু মুহাম্মাদকে (সা) কোলে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরার সাথে সাথে তাঁর শুকনো বুক দুধে ভরে গেল। তিনি পেট ভরে পান করলেন। তারপর হালীমা তঁর নিজের শিশু সন্তান ‘আবদুল্লাহকে স্তন দিলেন, সেও পেট ভরে পান করলো। তারপর দু‘শিশুই ঘুমিয়ে পড়লো।

হালীমা ও তাঁর স্বামী দু‘জনই ক্ষধা ও পিপাসায় কাতর ছিলেন। যেহেতু তাঁদের মাদী উটটি ওলান ছিল শুকনো। তাঁরা খাবার বা দুধ পাবেন কোথায়? কিন্তু হঠাৎ করে তাদের অবস্থা বদলে গেল। এ সম্পর্কে হালীমা নিজেই বলেছেন : ‘আমার স্বামী আমাদের উষ্ট্রীটির কাছে গিয়ে দেখলেন তার ওলানটি দুধে পূর্ণ হয়ে আছে। তিনি দুধ দুইলেন এবং আমরা দু‘জন পেট ভরে পান করলাম, সে রাতটি আমরদের পরম সুখে কাটলো। সকালে স্বামী আমাকে বললেন : আল্লাহর কসম, হালীমা! জেনে রাখ, তুমি একটি কল্যাণময় শিশু গ্রহণ করেছো।

আমি বললাম : আল্লাহর কসম, আমি তাই আশা করি। তারপর আমরা আমদের পল্লীতে ফেরার জন্য বের হলাম। আমি শিশু মুহাম্মাদকে (সা) নিয়েআমার মাদী গাধাটির উপর উঠে বসলাম। কী আশ্চর্য! সেটি এত দ্রুত চলতে লাগলো যে আমাদের দলের অন্য কারো গাধা তার সাথে পেরে উঠছিল না। এক সময় আমার সঙ্গী-মহিলারা আমাকে বললো : ‍যুওয়ায়িবের মেয়ে! আচ্ছা বলতো, এটা কি তোমার সেই গাধী যার উপর সোয়ার হয়ে তুমি গিয়েছিলে? আমি বললাম : নিশ্চয়, এটা সেই গাধী। তারা বললো : আল্লাহর কসম, তাহলে অন্য কোন ব্যাপার আছে।[সীরাতু ইবন হিশাম-১/১৬৪; উসুদুল গাবা-৫/৪২৭; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৩/২৫৫]

কাফেলা বানূ সা‘দের পল্লীতে পৌঁছলো। সে বছর সেখানে অভাব ও দারিদ্র্যের একটা ছাপ সর্বত্র বিরাজমান ছিল্ হালীমা এই ইয়াতীম শিশুর বরকত ও কল্যাণ প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন। সবকিছুতেই তাদের বরকত ও সমৃদ্ধি হতে লাগলো্ তাঁর ছাগল-ভেরা শুকনো চারণভূমিতে অন্যদের ছাগল-ভেড়ার সাথে চরতে যেত। যখন ফিরতো তখন তাঁর গুলোর ওলান দুধে পূর্ণ থাকতো, কিন্তু অন্যদের গুলো যেমন যেত তেমনই ফিরতো। তাই তাঁর গোত্রের লোকেরা তাদের নিজ নিজ রাখালদেরকে বলতো : তোমারেদ কী হয়েছে, আবূ যুওয়ায়িবের মেয়ের রাখাল যেখানে তাঁর ছাগল চরায় সেখানে তোমরা চরাতে পার না? কিন্তু তা করেও তারা দেখলো, তাতে কোন লাভ হয় না।

হালীমার এভাবে দুটি বছর কেটে গেল। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতি দিনই তিনি কল্যাণ ও সমৃদ্ধি দেখেতে পেলেন। এর ভিতর দিয়ে নবীর (সা) দুধ পানের সময় সীমা পূর্ণ হয়ে গেল।

নবী (সা) এমনভাবে বেড়ে উঠলেন যা সচরাচর অন্য শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। হালীমা মনে করলেন, এখন তাঁকে মক্কায় তাঁর মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। তিনি এই শিশুর মধ্যে যে শুভ ও কল্যাণ এ দু‘বছর প্রত্যক্ষ করেছেন তাতে স্বভাবতই তাঁকে আরো কিছু দিন নিজের কাছে রাখার ইচ্ছা করতেন। তাসত্ত্বেও তিনি তাঁকে মক্কায় নিয়ে গেলেন।

মা আমিনা তাঁর প্রিয় সন্তানকে ফিরে পেয়ে দারুণ খুশী হলেন। বিশেষতঃ যখন দেখলেন, তাঁর সান্তান এমনভাবে বেড়ে উঠেছে যেন সে চার বছরের কোন শিশু। অথচ তার বয়স এখনো দু‘বছর অতিক্রম করেনি। হালীমা শিশুকে আরো কিছু দিন পল্লীতে তাঁর নিকট রাখার জন্য মা আমিনার নিকট আবদার জানালেন। মা রাজী হলেন। হালীমা উৎফুল্ল চিত্তে শিশুকে নিয়ে পল্লীতে ফিরে এলেন। শিশুটিও পল্লী প্রকৃতিতে ফিরে আসতে পেরে দারুণ খুশী। এভাবে নবী (সা) বানূ সা‘দে দ্বিতীয় বারের জন্য ফিরে এলেন। আর এখানেই তাঁর বক্ষ বিদারণের বিস্ময়কর ঘটনটি ঘটে যখন তাঁর বয়স চার অথবা পাঁচ বছর।

ইমাম মুসলিম তাঁর নিজস্ব সনদে আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) অন্য শিশুদের সাথে একদিন খেলছেন, এমন সময় জিবরীল (আ) তাঁর কাছে আসেন। তারপর তাঁকে ধরে মাটিতে চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে তাঁর বুকটি ফেঁড়ে ফেলেন। তারপ তাঁর হৃৎপিণ্ডটি (কালব) বের করে তার থেকে একটি রক্তপিণ্ড পৃথক করে বলেন : এ হলো তোমার মধ্যে শয়তানের অংশ। তারপর সেটা একটি সোনার গামলায় যমযমের পানি দিয়ে ধুইয়ে যথাস্থানে স্থাপন করেন। খেলার সঙ্গীরা এ দৃশ্য দেখে দৌড়ে তার ধাত্রী মা হালীমার কাছে যেয়ে বলে : মুহাম্মাদকে হত্যা করা হয়েছে। সবাই ছুটে আসে এবং তাঁকে বিবর্ণ অবস্থায় দেখতে পায়।[সহীহ মুসলিম-১/১০১; ইবন কাছীর, আস-সীরাহ্-১/১৩; আস-সীরাহ্ আল-হাসবিয়্যাহ্-১/১৫০; আল-বায়হাকী, দালায়িল আন-নুবুওয়াহ্-১/১৩৫]

এ ঘটনার পর হালীমা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি নবীকে (সা) তাঁর মায়ের নিকট ফিরিয়ে দেন।

ইবন ইসহাক বলেন, শিশু মুহাম্মাদকে তহাঁর মায়ের নিকট ফিরিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে কোন কোন আলিম আমাকে একথা বলেছেন যে, দুধ ছাড়ার বয় হওয়ার পর দ্বিতীয় বার যখন হালীমা (রা) মুহাম্মাদকে নিয়ে যান তখন হাবশার কিছু খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী লোক তাঁকে দেখে তাঁর পরিচয় জানতে চায় এবং তাঁকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। তারপর তারা তাঁকে তাদের দেশে, তাদের রাজার নিকট নিয়ে যেতে চায়। তারা বলে, এই শিশু ভবিষ্যতে বড় কিছু করবে। আমরা তাঁর মধ্যে সেসবের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। হালীমা ভয় পেলে, তারা হয়তো তাঁকে চুরি করে নিয়ে যেতে পারে। তাই তিনি তাঁর মায়ের নিকট ফিরিয়ে দেন[সীরাতু ইবন হিশাম-১/১৬৭,] ছয় বছর বয়স পর্যন্ত তিনি মায়ের স্নেহে লালিত-পালিত হন। তারপর মা ইনতিকাল করেন।

একটি বর্ণনা এ রকম এসেছে যে, হালীমা যখন শিশু মুহাম্মাদতে (সা) শেষ বারের মত তাঁর মায়ের নিকট নিয়ে আসছিলেন তখন মক্কার উঁচু ভূমিতে পৌঁছার পর তাঁকে হারিয়ে ফেলেন। পরে ওয়ারাকা ইবন নাওফাল ও কুরাইশ গোত্রের অন্য এক ব্যক্তি তাঁকে পান। তাঁরা দু‘জন তাঁকে নিয়ে ‘আবদুল মুত্তালিবের নিকট এসে বলেন : এই আপনার ছেলে। আমরা তাকে মক্কার উঁচু ভূমিতে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম। আমরা তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে সে বলে : আমি মুহাম্মাদ ইবন ‘আবদিল্লাহ ইবন ‘আবদিল মুত্তালিব। তাই আপনার কাছে নিয়ে এসেছি।[ইবন কাছীর, আস-সীরাহ-১/১৫,] তারপর আবদুল মুত্তালিব তাঁকে কাঁধে তুলে একটি কবিতা আবুত্তি করতে করতে কা‘বা তাওয়াফ করেন। কাবিতাটির একটি শ্লোক নিম্নরূপ :[ সীরাতু ইবন হিশাম-১/১৬৭] (আরবী********)

‘যারা পায়ের নলা ও পাতার সাহয্যে চলে, এমন প্রত্যেকের থেকে আমি তার জন্য মানুষের স্রষ্টা আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি।’

নবীকে (সা) তাঁর নিকট ফিরিয়ে দিয়ে হালীমা তাঁর জনপদে ফিরে গেলেন। বহু বছর চলে গেল। এ দিকে নবী (সা) যুবক হলেন, বিয়ে করলেন। কিন্তু মা হালীমার স্মৃতি কোন দিন ভোলেননি। তাঁর স্নেহ-মমতার কথা, লালন-পালনের কথা প্রায়ই তিনি স্ত্রী খাদীজার (রা) কাছে বলতেন। খাদীজার (রা) মনেও হালীমাকে একটু দেখার ইচ্ছা জাগতো। একবার এক অভাবের বঝর তিনি আসলেন। রাসূল (সা) তাঁকে সসম্মানে বাড়ীতে রাখলেন ও সমাদার করলেন। হালীমা অনাবৃষ্টির কথা বললেন, জীব-জন্তু মারা যাবার কথা শোনালেন এবং তীব্র অভাবের বর্ণনা দিলেন। রাসূল (সা) তাঁকে সাহায্যের ব্যাপারে খাদীজার (রা) সাথে কথা বললেন। খাদীজা (রা) অত্যন্ত সম্মানের সাথে তাঁকে চল্লিশটি ছাগল এবং পানি বহন ও এদিক ওদিক যাওয়ার জন্য একটি উট দান করেন। এ যাত্রায় হালীমা তাঁর পরিবারের লোকদের জন্য অনেক উপহার-উপঢৌকন নিয়ে যান।[আনসাবুল আশরাফ-১/৯৫; নিসা’ মুবাশশারাত বিল জান্নাহ্-১/৩২]

আল্লাহ তা‘লা যখন মুহাম্মাদকে (সা) মানবজাতির জন্য নবী ও রাসূল হিসেবে নির্বাচন করে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানানোর নির্দেশ দিলেন তখন হালীমা গ্রহণ করেন।[আস-সারাহ আল-হালাবিয়্যা-১/৩২] যে, তিনি, তছার স্বামী ও সন্তানগণ- ‘আবদুল্লাহ, আশ-শায়মা’ ও উনাইসা- সবাই ইসলাম গ্রহণ করেন। “আস-সীরাহ্ আল-হালাবিয়্যা” –র লেখক বলেন : তাঁর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে বেশীর ভাগ আলিমের কোন সন্দেহ নেই। ইবন হিব্বান একটি সহীহ হাদীছ বর্ণনা করেছেন যা দ্বারা তাঁর ইসলাম গ্রহণ প্রমাণিত হয়। হাফিজ মুগলাতায়-এর হালীমার ইসলাম গ্রহণ বিষয়ে একখানি গ্রন্থ আছে যার শিরোনাম হলো :“আত-তুহফাতুল জাসীমাহ্ ফী ইসলামি হালীমা।[নিসা মিন ’আসর আন-নুবুওয়াহ্, পৃ.১৫,]

নবী (সা) ছিলেন কোমল মনের দয়াপ্রবণ মানুষ। নিজের আশে পাশের লোকদেরকে শুধু নয়, বরং নিকট ও দূরের সবাইকে ভালোবাসতেন এবং হাদিয়া-তোহফা পাঠাতেন। আর এর থেকে তাঁর দুধ মা হালীমা বাদ পড়তে পারেন না। নবী (সা) সারা জীবন হালীমার স্নেহ-মমতার কথা মনে রেখেছেন। নবীরন (সা) অন্তরের গভীর ছিল মা হালীমার স্থান। তাই চল্লিশ বছরের বেশী বয়সেও তাঁকে “মা মা” বলে ডাকতে শোনা যায়, নিজের গায়ের চাদরটি খুলে বিছিয়ে তাঁর বসার স্থান করে দিতে দেখা যায়। শুধু তাই নয়, তাঁর ভালো-মন্দ ও অভাব-অভিযোগের কথাও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনতে দেখা যায়। আরো দেখা যায় মায়ের একান্ত অনুগত সন্তানের মত হৃষ্টচিত্তে হাসি মুখে তাঁর সাথে কথা বলতে।[আল-ইসাবা-৪/২৭৪,]

কাজী ‘আয়্যাজ “আশ-শিফা” গ্রন্থে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট হালীমা ও তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের স্থান বর্ণনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে, আবুত তুফায়ল বলেছেন : আমি আমার কিশোর বয়সে নবী (সা) “জি‘রানা[“জি‘রানা” তায়িফ ও মক্কার পথে, তবে মক্কার নিকটবর্তী স্থানের না। (তাহযূবুল আসমা‘ ওয়াল লুগাত-৩/৫৯)] নামক স্থানে একদিন গোশত বণ্টন করতে দেখেছি। সে সময় এক বেদুইন মহিলা আসলেন এবং বনীর (সা) একেবারে কাছে চলে গেলেন। নবী (সা) নিজের চাদরটি বিছিয়ে তাঁকে বসতে দিলেন। মহিলাটি বসলেন। আমি লোকদের কাছে প্রশ্ন করলাম : এই মহিলা কে? লোকেরা বললো : ইনি রাসূলুল্লাহর (সা) মা, তাঁকে দুধ পান করিয়েছেন।[আলাম আন-নিসা’ -১/২৯০]

‘উমার ইবন আস-সায়িব বর্ণনা করেছেন। একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) বসে আছেন। এমন সময় দাঁর দুধ-পিতা আসলেন। তিনি নিজের এক খণ্ড কাপড়ের এক পাশ বিছিয়ে দিলেন এবং তিনি তার উপর বসলেন। একটু পরে রাসূলুল্লাহর (সা) দুধ ভাই আবদুল্লা্হ ইবন আল-হারিছ আসলেন। রাসূল (সা) উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে সামনে বসালেন।[তাবাকাত-১/১১৪; আল-ইসী‘আব-৪/২৬২; আশ-শিফা-১/২৬০; উসুদুল গাবা-৫/৪২৮]

বালযুরী বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সা) দুধ বোন আশ-শায়মা‘ তাঁর মা হালীমার সাথে তাঁকে কোলে নিতেন এবং তাঁর সাথে খেলতেন। এই আশ-শায়মা‘ হুনায়ন যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হন। তাঁর সাথে কঠোর আচরণ করা হয়, তখন তিনি বলেন : ওহে জনগণ! আপনার জেনে রাখুন, আমি আপনাদের নবীর বোন। তাঁকে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট আনা হলে তিনি বললেন : আমি আপনার বোন। আমি আপনাকে আমার মায়ের সাথে কোলেন নিতাম, আপনি আমাকে কামড়ে দিতেন। রাসূল (সা) তাঁকে চিনতে পারেন এবং নিজের চাদর বিছিয়ে তাঁকে বসতে দেন। তাঁকে েএকটি দাস ও কেটি দাসীসহ অনেক উপহার-উপঢৌকন দিয়ে মুক্তি দেন।[আনসাবুল আশরাফ-১/৯৩,]

হযরত হালীমার (রা) মৃত্যু সম্পর্কে শায়খ আহমাদ যীনী দাহলাম বলেছেন, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, হিজরাত করেন, মদীনায় মারা যান এবং বাকী গোরস্তানে দাফন করা হয়। তাঁর কবরটি সেখানে প্রস্ধি।[নিসা‘ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্, পৃ.১৭,] তবে বালাযুরীর একটি বর্ণনায় বুঝা যায় তিনি মদীনায় হিজরাত করেননি এবং মক্কা বিজয়ের পূর্বে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। বর্ণনাটি এ রকম : মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহর (সা) যখন “আবতাহ” উপত্যকায় অবস্থান করছেন তখন তাঁর নিকট হালীমার বোন তাঁর স্বামীর বোনকে সংগে নিয়ে আসেন। তিনি রাসূলকে (সা) এক পাত্র পনীর ও একপাত্র ঘি উপহার দেন। রাসূল (সা) তাঁর নিকট হালীমার অবস্থা জানতে চান। তিনি তাঁর মৃত্যুর খবর দেন। তখন রাসূলের (সা) দু‘চোখ পানিতে ভিজে যায়। তারপর রাসূল (সা) তাঁদের অবস্থা জানতে চান। তাঁরা অভাব ও দারিদ্রের কথা জানান। রাসূল (সা) তাঁকে পরিধেয় বস্ত্র, একটি ভারবহিী পশু ও দু‘শো দিরহাম দানের নির্দেশ দেন। যাবার বেলায় তিনি নবীকে (সা) লক্ষ্য করে বলে যান : আপনি ছোট ও বড় উভয় অবস্থায় চমৎকার দায়িত্বশীল।[আনসাবুল আশরাফ, পৃ.৯১; দালায়িল আন-নুবুওয়অহ্১/১৩৩,] তিনি রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর থেকে ‘আবদুল্লাহ ইবন জা‘ফার (রা) বর্ণনা করেছেন।[আল-ইসী‘আব-৪/২৬২]
আশ-শায়মা‘ বিনত আল-হারিছ আস-সা‘দিয়্যা (রা)
আশ-শায়মা‘র আসল নাম হুযাফা, মতান্তরে জাযযামা। ডাকনাম আশ-শায়মা‘ ও আশ-শাম্মা‘। বানূ সা‘দের এক বেদুঈন মহিলা। তিনি তাঁর গোত্রে কেবল ডাকনামেই প্রসিদ্ধ ছিলেন।[আল-বায়হাকী, দালায়িল আন-নুবুওয়াহ্-১/১৩২] সম্ভবত তাঁর দেহে অতিরিক্ত তিল থাকার কারণে তিনি এ নামে আখ্যায়িত হন।[নিসা‘ মিন ‘আসর আনু-নুবুওয়াহ্- ৩৩৭, টীকা-২, আল-ইসাবা-৪/৩৩৫ ] উল্লখ্য যে, মহিলা সাহাবীদের মধ্যে আশ-শায়মা‘ নামে দ্বিতীয় কেউ নেই। তাঁর পিতা আল-হারিছ ইবন ‘আবদিল উযযা ইবন রিফা‘আ আস-সা‘দিয়্যা এবং মাতা মহানবীর (সা) দুধমাতা হযরত হালীমা আস-সা‘দিয়্যা (রা)। আশ-শায়মা‘র বড় পরিচয় তিনি মহানীবীর (সা) দুধ বোন। উল্লেখ্য যে, হযরত হালীমার (রা) সন্তান ‘আবদুল্লাহ, উনায়সা ও আশ-শায়মা‘- এ তিনজন হলেন রাসূলুল্লাহর (সা) দুধ-ভাই-বোন। আশ-শায়মা‘ তাঁর মা হালীমাকে শিশু মুহাম্মাদের (সা) প্রতিপালনে অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করেন।

হযরত হালীমা (রা) শিশু মুহাম্মাদকে (সা) দুই বছর দুধ পান ও লালন-পালনের পর মক্কায় তাঁর সম্মতিতে হযরত হালীমা (রা) তাঁর দুধ-সন্তান মুহাম্মাদকে (সা) নিয়ে আবার তাঁর গোত্রে ফিরে যান। তখন তিনি হাঁটতে শিখেছেন, দুধ-ভাই-বোনদের সাথে খেলা করতে শিখেছেন। অন্যসব বেদুঈন ছেলে-মেয়েদের মত হালীমার ছেলে-মেয়েরাও তাদের জনপদের আশে-পাশের চারণভূমিতে ছাগল-ভেড়া চরাতো্ তারা তাদের দুধ-ভাই শিশু মাহাম্মাদকেও (সা) মাঝে মধ্যে সঙ্গে নিয়ে যেত। এ সময় আশ-শায়মা‘ তাঁকে দেখাশুনা করতেন। পথ দীর্ঘ হলে, রোদের তাপ বেশী হলে তাঁকে কোলে তুলে নিতেন। মাঝে মাঝে ছেড়ে নিতেন। আবার কখনো তাঁকে নিয়ে ছায়ায় বসতেন এবং দু‘হাতে তুলে নাচাতে সুর করে নীচের চরণ দু‘টি গাইতেন :[ প্রাগুক্ত, ৪/৩৩৬; আহমাদ যীনী দাহলান, আস-সীরাহ্ আন-নাবাবিয়্যাহ্-৪/৩৬৬] (আরবী****)

‘হে আমাদের পরোয়ারদিগার! আপনি আমাদের জন্য মুহাম্মাদকে

বাঁচিয়ে রাখুন, যাতে আমরা তাঁকে একজন যুবক হিসেবে দেখতে পাই।

অতঃপর আমরা তাঁকে এমন একজন সম্মানিত নেতা হিসেবে দেখতে পাই যে, তাঁর প্রতি বিদ্বেষপোষণকারী শত্রুর মাথা নত হয়ে যাবে।

হে আল্লাহ! আপনি তাঁকে চিরস্থায়ী সম্মান ও মর্যাদা দান করুন।’

কোন কোন বর্ণনায় প্রথম শ্লোতটি এভাবে এসেছে :[ নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্-৩৩৮] (আরবী********)

‘হে আমাদের পরোয়ারদিগার! আমার বাই মাহাম্মাদকে বাঁটিয়ে রাখুন।’

কী চমৎকার দু‘আই না ছিল যার প্রতিটি কথা। আল্লাহ পাকের দরবারে সেসব দু‘আ কবুল হয়েছিল।

শিশু মুহাম্মাদের (সা) মধ্যে যে শুভ ও কল্যাণ বিদ্যমান ছিল আশ-শায়মা’ ও তাঁর পরিবারের ছোট-বড় সকল সদস্য তা প্রত্যক্ষ করতেন। তাই তাঁর প্রতি সবার তীব্র আবেগ ও ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল। মা হালীমা সবসময় তাঁকে এদিক ওদিক নিয়ে যেতে চাইলে মা তাকে বার বার সতর্ক করে দিতেন মুহাম্মাদ (সা) যেন দৃষ্টির আড়ালে মা যায়। এতেও তিনি নিশ্চিন্ত হতেন না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে দৌড়ে গিয়ে দেখে আসতেন মাহাম্মাদ (সা) কোথায় এবং কি করছে।

একদিন দুপুরে প্রচণ্ড গরমে ক্লান্ত হয়ে মা হালীমা বিশ্রাম নিচ্ছেন। একটু পরেই তিনি টের পেলেন আশ-শায়মা‘ ও মুহাম্মাদ কেউ আশে-পাশে নেই। এই প্রচণ্ড রোদে তারা কোথায় গেল? তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। খুঁজতে বের হলেন। দেখলেন বাড়ীর অদূরে আশ-শায়মা‘ মুহাম্মাদকে কোলে করে নাচাচ্ছে, আর এ গানটি গাইছে : (আরবী*****)

‘এ আমার ভাই, আমার মা তাকে প্রসব করেনি। সে আমার বাবা-চাচার বংশেরও কেউ নয়। হে আল্লাহ! তুমি তাঁকে সমৃদ্ধি দাও।’

মা হালীমা তিরস্কারের সুরে বললেন : আশ-শায়মা‘, তুমি তাঁকে নিয়ে এই রোদের মধ্যে খেলছো? আশ-শায়মা‘ বললেন : মা, আমার ভাইয়ের গায়ে রোদ লাগেনি। আমি দেখছি, মেঘ তার মাথার উপর ছায়া দান করছে। সে দাঁড়ালে মেঘ দাঁড়াচ্ছে, সে চললে মেঘও চলছে। এভাবে আমরা এখানে এসেছি। অবাক দৃষ্টিতে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন :

একথা কি ঠিক? আশ-শায়মা‘ বললেনঃ আল্লাহর কসম! সত্যি। আল্লাহর কসম! সত্যি[আস-সীরা্ আল-হালাবিয়্যাহ্-১/১৬৭, ১৬৮]

হযরত রাসূলে কারীম (সা) পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত মা হালীমার সাথে বনী সা‘দের পল্লীতে অতিবাহিত করেন। মরুভীমিতে নির্মল আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে তাদের নির্ভেজাল বিশুদ্ধ আরবী ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিও আয়ত্ত করেন। একথা তিনি পরবর্তী জীবনে অকপটে স্বীকার করতেন। তিনি বলতেন : আরবী********)

‘আসি তোমাদের সকলের চেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী, কারণ আমি কুরাইশ বংশের সন্তান এবং বানূ সা‘দে দুধ পান করে বেড়ে উঠেছি।’ তিনি প্রথম জীবনের এই পাঁচটি বছরের স্মৃতি জীবনে কোনদিন ভুলেননি। মা হালীমা, বোন আশ-শায়মা’ এবং তাঁদের পরিবারের অন্য সদস্যদের আদর-যত্ন, ও স্নেহ-বালোবাসার কথা সারা জীবন মনে রেখেছেন।

সময় গড়িয়ে চললো, সে দিনের সেই ছোট্ট শিশু মুহাম্মাদ বড় হলেন। এক সময় নবুওয়াত লাভ করলেন। মদীনায় হিজরাত করলেন। প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়লেন। হাওয়াযিন যদ্ধে মুসলিম বাহিনী বিজয়ী হলে বানূ সা‘দের আরো অনেক নারী-পুরুষ সদস্যের সাথে আশ-শায়মা‘ও মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হন। বন্দী হওয়ার সময় তিনি মুসলিম মুজাহিদদেরকে বলেন : ‘আল্লাহর কসম! তোমরা জানতে পারবে যে, আমি তোমাদের নেতার দুধ-বোন।’ কিন্তু তারা তাঁর কথা বিশ্বাস না করে তাঁকে রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে হাজির করে। আশ-শায়মা‘ বলেন। ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার দুধ-বোন। রাসূল (সা) বললেন : তোমার দাবীর সপক্ষে কোন প্রমাণ বা চিহ্ন উপস্থাপন করতে পারবে? বললেন : আমি একদিন আপনাকে পিঠে উঠিয়েছিলাম। আপনি আমাকে কামড় দিয়েছিলেন, এই তার দাগ।[ইবন হাযাম, জামহারাতু আনসাব আল-‘আরাব-১/২৬৫] রাসূল (সা) চিহ্নটি চিনতে পারলেন। তিনি একটি চাদর বিছিয়ে তার উপর তাঁকে বসালেন ও তাঁর কুশল জিজ্ঞেস করলেন। তারপর বললেন : তুমি ইচ্ছা করলে আদর-যত্ন ও সম্মানের সাথে আমার নিকট থেকে যেতে পার। আবার ইচ্ছা করলে তোমার গোত্রে ফিরে যেতে পার। আশ-শায়মা’ বললেন : আমি আমার গোত্রে ফিরে যেতে চাই। তারপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং রাসূলুল্লাহর (সা) রিসালাতে বিশ্বাস স্থাপনের ঘোষণা দেন। রাসূল (সা) মাকহূল[তাদের বংশধারা বিদ্যমান আছে। (আল-বিদায়া ওয়অন নিহায়া-৪/৩৬৩, আল-ইসাবা-৩/৪৩৫; আনসাব আল-আশরাফ-১/৯৩] নামের একটি দাস, একটি দাসী, বহু ছাগল-ভেড়া ও উট উপঢৌকনসহ তাঁকে তঁর গোত্রে পাঠিয়ে দেন।[উসুদুল গাবা-৫/৪৮৯; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া-৩/৩৬৩; তারীখ আত-তাবারী-২/১৭১; আনসাব আল-আশরাফ-১/৯৩; আ‘লাম আন নিসা’-২/৩১৭ আল-আ‘লাম -৩/১৮৪,] ইবনুল কালবী বলেন, আশ-শায়মা’ একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট আসেন এবং পরিচিতি হিসেবে তাঁর দেহে শিশুকালে রাসূলুল্লাহর (সা) দাঁতের চিহ্ন দেখান।[আনসাব আল-আশরাফ-১/৯৩]

মানবতার মহান নবী দুধ-বোন আশ-শায়মা’র প্রতিই কেবল মহানুভবতা দেখাননি, বরং তাঁর ক্ষমা ও মহানুভবতা গোটা বানূ সা‘দকে পরিবেষ্টন করে। উল্লেখ্য বানূ সা‘দ ছিল বিশাল হাওয়অযিন গোত্রের একটি শাখা গোত্র। হিজরী ৮ম সনে হুনাইন যুদ্ধে হাওয়াযিন গোত্র পরাজিত হলে তাদের ধন-সম্পদ যুদ্ধলব্ধ সম্পদ হিসেবে মুসলমানদের হাতে আসে এবং তাদের নারী ও সন্তানদেরকে বন্দী করা হয়। তখন হাওয়াযিন গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট আসে এবং তাদের আনুগত্য ও ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়। এই দলে রাসূলুল্লাহর (সা) দুধ-চাচাও ছিলেন। তারা ক্ষমা ভিক্ষা চায়, বন্দীদের মুক্তি দাবী করে এবং তাদের জব্দকৃত ধন-সম্পদ ফেরত চায়। এই দলটির মুখপাত্র যুহায়র ইবন সুরাদ উঠে দাঁড়িয়ে ভাষণ দান করেন। তার কিছু অংশ নিম্নরূপঃ (আরবী****)

‘হে আল্লাহর রাসূল! এই বন্দীদের মধ্যে আপনাকে লালন-পালনকারী আপনার চাচী, ফুফু, খালা ও কোলে-পিঠে বহনকারী রক্ষণাবেক্ষণকারীও রয়েছে। আমরা আপনাকে কোলে-পিঠে করে লালন-পালন করেছি, আমাদের স্তনের দুধ পান করিয়েছি।….. আমি আপনাকে দুগ্ধপোষ্য শিশু দেখেছি। আপনার চেয়ে ভালো কোন দুগ্ধপোষ্য শিশু আমি আর দেখিনি। আমি আপনাকে দুধ পান বন্ধ করা শিশু দেখেছি। আপনার চেয়ে ভালো দুধ পান বন্ধ করা ভালো আর কাউকে দেখিনি। তারপর দেখেছি যুবক হিসেবে। আপনার চেয়ে ভালো যুবক আর দেখিনি। আপনার মধ্যে শুভ ও কল্যাণ স্বভাব পূর্ণতা লাভ করেছে। সবকিছু সত্ত্বেও আমরা হলাম আপনার মূল, শেকড় ও গোত্র। অতএব আমাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করুন, আল্লাহ আপনার প্রতি অনুগ্রহ করবেন।’ তারপর তিনি নিম্নের এই চরণগুলো আবৃত্তি করেন। : (আরবী*********)

‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করুন। আপনি এমন এক ব্যক্তি যাঁর নিকট আমরা আশা করি ও যার অনুগ্রহের প্রতীক্ষা করি।

আপনি সে মহিলাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন যাদের দুধ পান করেছেন। যখন তাদের বিশুদ্ধ ও স্বচ্ছ দুধে আপনার মুখ পূর্ণ হয়ে গেছে।

আপনার সেই মায়েদেরকে ক্ষমা করুন যাদের দুধ পান করেছেন। নিশ্চয় ক্ষমার গুণটা সৃষ্টিজগত তা পরিধান করে।’

হযরত রাসূলে করীম (সা) তার এই মনোমুগ্ধকর বর্ণনা ও সুমিষ্ট কবিতা শুনার পর বলেন : আমার ও বাণূ ‘আবদিল মুত্তালিবের যা কিছু আছে তা সবই তোমাদের জন্য।

কুরাইশরা বলে উঠলো : আমাদের যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য।

ইবন কাছীর বলেন, এরপর রাসূল (সা) দুধ-পিতার গোত্রের সকলকে সম্মানের সাথে মুক্তি দেন।[আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৪/৩৬৩, ৩৬৪; তারীখ আত-তাবারী-২/১৭৩; ‘উয়ূন আল-আছার-২/২২৩; আস-সীরাহ্ আল-হালাবিয়্যা-১/১৭০]

হযরত আশ-শায়মা‘র (রা) জীবনের আর কোন কথা জানা যায় না। তিনি কখন, কোথায় ইন্তেকাল করেছেন তাও সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থেকে গেছে। আয-যিরিকলী হি.৮/খ্রী. ৬৩০ সনের পর তার মৃত্যু হয়েছে এমন কথা বলেছেন।[আল-আ‘লাম-৩/১৮৪]
আসমা’ বিনত আবী বকর (রা)
হযরত রাসূলে কারীমের (সা) জীবনকালের অন্তরঙ্গ বন্ধু, ওফাতের পর তাঁর প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) হযরত আসমার (রা) পিতা। মাতা কুতাইলা বিনত ‘আবদিল ‘উযযা। এই ‘আবদুল ‘উযযা ছিলেন কুরায়শ বংশের একজন বিখ্যাত সম্মানীয় নেতা। আবূ বকরের (রা) সম্মানিত পিতা আবূ কুহাফা বা আবূ ‘আতীক তাঁর পিতামহ। ‘আবদুল্লাহ ইবন আবী বকর তাঁর সহোদর ভাই ও উম্মুল মু‘মিনীন হযরত ‘আয়িশা (রা) সৎ বোন। রাসূলুল্লাহর (সা) হাওয়ারী তথা বিশেষ সাহায্যকারী যুবায়র ইবনুল ‘আওয়াম (রা) স্বামী এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে শহীদ হযরত ‘আবদুল্লাহর ইবন যুবায়র (রা) তাঁর পুত্র। হিজরাতের ২৭ (সাতাশ) বছর পূর্বে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তখন তাঁর পিতা হযরত আবূ বকর সিদ্দীকের (রা) বয়স বিশ বছরের কিছু বেশী।[তাবাকাতু ইবন সা‘দ-৮/৪৪৯; উসুদুল গাবা-৫/৩৭২; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৯৭] এ হলো হযরত আসমা‘ বিনত আবী বকরের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। তাঁর আরো কিছু পরিচয় আছে। স্বামী যুবায়র ইবন ‘আওয়াম (রা) দুনিয়াতে জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজনের অন্যতম, আর তাঁর শাশুড়ী হলেন রাসূলুল্লাহর (সা) মুহারামা ফুফু হযরত সাফিয়্যা বিনত আবদিল মুত্তালিব (রা)। উল্লেখ্য যে, তিনি আবূ বকর সিদ্দীকের (রা) জ্যেষ্ঠ সন্তান এবং ‘আয়িশার (রা) চেয়ে দশ বছরের কিছু বেশী দিনের বড়।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৮৮] বংশ ও ইসলাম উভয় দিক দিয়ে এ মহিলা সাহাবী উঁচু সম্মান ও মর্যাদার অধিকারিণী ছিলেন। বংশগত দিক দিয়ে মক্কার কুরায়শ খান্দানের তাইম শাখার সন্তান। অন্যদিকে তাঁর পিতা, পিতামহ, ভগ্রিন, শাশুড়ী, পুত্র সকলেই ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) বিশিষ্ট সাহাবী। একজন সুসলমানের এর চাইতে বেশী সম্মান, মর্যাদা ও গৌরবের বিষয় কী হতে পারে?

হযরত রাসূলে কারীম (সা) মক্কায় ইসলামী দা‘ওয়াত ও তাবলীগের কাজ শুরু করার পর তথাকার পৌত্তলিক প্রতিপক্ষ তাঁর উপর অত্যাচর-উৎপীড়ন আরম্ভ করে। দিনে দিনে এর মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা রাসূলকে (সা) হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন তিনি মক্কা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় পর্যন্ত মক্কায় যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন আবূ বকর (রা) ত৭াদের অন্যতম। তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) অতি বিশ্বস্ত ঘনিষ্টজন ছিলেন। একদিন রাতের বেলা সকলের অগোচরে চুপে চুপে আবূ বকরকে (রা) সঙ্গে করে রাসূল (সা) মক্কা থেকে বের হন এবং মক্কার উপকণ্ঠে ‘ছূর’ পর্বতের একটি গুহায় আশ্রয় নেন। এজন্য আবূ বকরকে (রা) ‘রফীকুল গার’ বা গুহার বন্ধু বলা হয়। মক্কার পৌত্তলিকরা তাঁদের খোঁজে পর্বতের এ গুহার মুখ পর্যন্ত উপস্থিত হয়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে (সা) বিশেষ ব্যবস্থায় রক্ষা করেন। এ সময় গোপনে যাঁরা তাঁদের সংগে যোগাযোগ রক্ষা ও সাহায্য করতেন হযরত আসমা (রা) তাঁদের অন্যতম। তিনি প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে একাকী বাড়ী থেকে খাবার নিয়ে গুহায় যেতেন এবং তাঁদেরকে আহার করিয়ে আবার ফিরে আসতেন।

হযরত আসমার (রা) ভাই ‘আবদুল্লাহ (রা) যিনি তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি, সারাদিন মক্কার এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি করে পৌত্তলিকদের পরামর্শ, উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত হতেন এবং রাতের আঁধারে তা রাসূলুল্লাহকে (সা) জানিয়ে আসতেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীকের (রা) বিশ্বস্ত রাখালের নাম ছিল ‘আমির। তিনি “ছূর” পর্বতের আশেপাশে ছাগল চরাতেন এবং পাল নিয়ে গুহার মুখে চলে যেতেন এবং দুধ দুইয়ে তাঁদেরকে দিয়ে আসতেন। আর এই ছাগলের পাল নিয়ে যাওয়াতে আসমা (রা) ও আবদুল্লাহর (রা) যাওয়া-আসার পদচিহ্ন মুছে যেত। ফলে পৌত্তলিকরা কোনভাবেই সন্ধান পায়নি।

মক্কার পৌত্তলিকরা আপ্রাণ চেষ্টা করেও যখন তাঁদের কোন খোঁজ পেল না তখন ঘোষণা করে দিল যে, কেউ তাঁদের সন্ধান দিতে পারলে একশো উট পুরস্কার দেওয়া হবে। এমতাবস্থায় তৃতীয় রাতে হযরত আসমা‘ তাঁদের জন্য খাবার নিয়ে গেলে রাসূল (সা) বললেন, তুমি ফিরে গিয়ে ‘আলীকে (রা) বলবে, সে যেন আগামী কাল রাতে তিনটি উট এবং একজন পথ প্রদর্শক নিয়ে এই গুহায় আসে। নির্দেশমত ‘আলী (রা) তিনটি উট ও একজন পথপ্রদর্শক নিয়ে হাজির হন। আর হযরত আসমা‘ (রা) তাঁদের দুই-তিন দিনের পাথেয় সামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হন। রাসূল (সা) দ্রুত যাত্রার প্রস্তুতি নিতে বলেন। পাথেয় সামগ্রীর পটলার ও পানির মশকের মুখ বাঁধার প্রয়োজন দেখা দিল। তাড়াহুড়োর মধ্যে হাতের কাছে কোন রশি পাওয়অ গেল না। তখন আসমা’ (রা) নিজের ‘নিতাক’ বা কোমর বন্ধনী খুলে দুই টুকরো করেন। একটি দিয়ে পাথেয় সামগ্রী ও অন্যটি দিয়ে মশকের মুখ বাঁধেন। তা দেখে রাসূলের মুখ থেকে উচ্চারিত হয় : (আরবী**********)

‘আল্লাহ যেন এই একটি ‘নিতাকের’ বিনিময়ে জান্নাতে তোমাকে দুইটি ‘নিতাক’ দান করেন।’

এভাবে তিনি ‘জাতুন নিতাকাইন’ (দুইটি কোমর বন্ধনীর অধিকারিণী) উপাধি লাভ করেন।[তাবাকাত-৮/৪৫০; আল-ইসতী‘আব-৪/২২৯; উসুদুল গাবা-৫/৩৭২ (৬৬৯৮); আল-বায়হাকী, দালায়িল আন-নুবুওয়াহ্-২/৪৭২; তাহযীবুল আসমা’ ওয়াল লুগাত-২/৫৯৭] রাসূলুল্লাহর (সা) পবিত্র মুখ থেকে উচ্চারিত এ উপাধিটি আল্লাহ কবুল করেন। আর তাই আজ প্রায় দেড় হাজার বঝর পরেও তিনি বিশ্ববাসীর নিকট এ উপাধিতে প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন।

আসমার ‘যাতুন নিকাতাইন’ উপাধি লাভের কারণ সম্পর্কে আরো কয়েকটি মত আছে। কেউ বলেছেন, তিনি একটি কোমর বন্ধনীর উপর আরেকটি কোমরবন্ধনী বাঁধতেন, তাই এ উপাধি লাভ করেছেন। কেউ বলেছেন, তাঁর দুইটি নিতাক বা কোমরবন্ধনী ছিল। একটি কোমরে বাঁধতেন, আর অন্যটি দ্বারা রাসূলুল্লাহর (সা) প্রয়োজনীয় আহার্য সামগ্রী বেঁধে গুহায় নিয়ে যেতেন। তাই তিনি এই উপাধি পেয়েছেন। উল্লেখ্য যে, কোমরবন্ধনী বাঁধা আরব নারীদের সাধারণ অভ্যাস।[নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্ -২৩৮, টীকা-১]

ইবন হাজার (র) বলেন, তিনি তাঁর নিতাকটি ছিঁড়ে দু‘টুকরো করেন। একটি দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) ও আবূ বকরের (রা) পাথেয় বাঁধেন, আর অন্যটি দ্বারা নিজের কোমর বন্ধনীর কাজ চালান। আর সেখান থেকেই তাকে বলা হতে থাকে ‘যাতুন নিতাক’ বা ‘যাতুন নিতাকাইন’ অর্থাৎ একটি কোমর বন্ধনী বা দু‘টি কোমর বন্ধনীর অধিকারিণী।[বানাত আস-সাহাবা -৫০]

‘নিতাক’ –এর এইয়টনাটি ‘ছূর’ পর্বতের গুহায় ঘটেছিল, না রাসূল (সা) ও আবূ বকরের (রা) মক্কা থেকে বের হওয়ার সময় আবূ বকরের (রা) বাড়ীতে, সে সম্পর্কে বর্ণনার ভিন্নতা দেখা যায়। ইমাম বুখারী ও ইবন ইসহাকের সীরাতের একটি বর্ণনায় বুঝা যায়, এটি মক্কায় আবূ বকরের (রা) গৃহ থেকে রাতের অন্ধকারে বের হওয়ার সময়ের ঘটনা।

যেমন একথা বর্ণিত হয়েছে যে, মক্কার মুসলামারদের আল্লাহ মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতের অনুমতি দিলে মক্কার অত্যাচারিত, নির্যাতিত মুসলমানগণ দলে দলে মক্কা ছেড়ে মদীনায় চলে যেতে থাকে। পৌত্তলিকরা তাতে বাধা দিতে আরম্ভ করলে মুসলমানরা গোপনে একাকী বা ছোট ছোট দলে মক্কা ত্যাগ করতে থাকে। সকলে হিজরাদের অতি বড় ফযীলতের কথা উপলব্ধি করতে পেছিল, তাই সেই সৌভাগ্য অর্জনের জন্য যেন পরস্পর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছিল। হযরত আবূ বকর (রা) একদিন প্রিয় নবীর (সা) নিকট গিয়ে হিজরাতের অনুমতি চাইলেন। নবী (সা) বললেন : (আরবী***** ) –এত তাড়াহুড়ো করবেন না, আল্লাহ আপনাকে একজন সঙ্গী দিবেন।’ আবূ বকর (রা) বুঝলেন, তাঁর সফরের সেই সঙ্গী হবেন খোদ নবী (সা)। আনন্দে আবূ বকরের (রা) হৃদয় মন বরে গেল। রাসূলুল্লাহর (সা) দারুল হিজরাহ মদীনায় যাবার সফসঙ্গী হবেন তিনি, এর চেয়ে বড় আনন্দের আর কী হতে পারে?

রাসূলুল্লাহর (সা) এই ইঙ্গিতময় বাণী শোনার পর আবূ বকর (রা) সে কথা তাঁর দুই কন্যা- আসমা‘ ও আয়িশাকে (রা) বলেন। তাঁরাও খুশীতে বাগবাগ হয়ে গেলেন একথা জেনে যে, তাঁদের পিতা হবেন আল্লাহর রাসূলের (সা) হিজরাতের সফরসঙ্গী। এরপর থেকে তাঁরা সেই শুভ ক্ষণটির প্রতীক্ষায় কাটাতে থাকেন।

এরপর একদিন আল্লাহ তাঁর নবীকে মদীনায় হিজরাতের অনুমতি দেন। নবী (সা) ঠিক দুপুরের সময় কুরায়শ পৌত্তলিকদের সকল প্রহরীর চোখ ফাঁকি দিযে আবূ বকরের (রা) যাচ্ছেন। আসমা’ (রা) বাড়ীর ভিতর থেকে সর্বপ্রতম তা দেখতে পান এবং দৌড়ে পিতার নিকট যেয়ে বলেন : আব্বু! এই যে রাসূলুল্লাহ (সা) মাথা-মুখ ঢেকে আমাদের বাড়ীর দিকে আসছেন। এমন সময় তো তিনি কখনও আসেন না। আবূ বকর (রা) বললেন : আমার মা-বাবা তাঁর জন্য কুরবান হোন! আল্লাহর কসম! নিশ্চয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছাড়া এ সময় তিনি আসেননি।

আবূ বকর (রা) নবীকে (সা) স্বাগত জানানোর জন্য ছুটে গেলেন। তিনি ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। আবূ বকর (রা) অনুমতি দিলে তিনি ঘরে ঢুকলেন। আবূ বকরকে (রা) বললেন : আপনার আশেপাশে যারা আছে তাদেরকে একটু বের করে দিন। সেখানে আসমা’ ও আয়িশা ছিলেন। আবূ বকর (রা) বলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! এরা আমার দুই কন্য।

নবী (সা) বললেন : আমাকে বের হওয়ার (হিজরাত করার) অনুমতি দেওয়া হয়েছ। খুশীর আতিশয্যে আবূ বকর (রা) কেঁদে দেন। বলেন! ইয়া রাসূলাল্লাহ্! সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য কি হবে? বললেন :হাঁ। ‘আয়িশা (রা) বলেন : আল্লাহর কসম! কেউ যে আনন্দের আতিশয্যে কাঁদতে পারে আমি সেই দিনের পূর্বে কখনো ভাবতে পারিনি। সেদিন আমি আবূ বকরকে কাঁদতে দেখেছি।[মুসনাদে আহমাদ-৬/৩৪৮; সাহীহ আল-বুখারী, হাদীছ নং-৩৯০৫; তাবাকাত-৮/২৫]

‘আয়িশা (রা) ‘যাতুন নিতাক’ ঘটনা সম্পর্কে আরো বলেছেন : আমরা দুই বোন তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় পাথেয় গুছাচ্ছিলাম। তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস একটি চামড়ার থলিতে ভরলাম। তারপর আসমা’ তাঁর নিতাকটি কেটে থলির মুখ বাঁধেন। আর সেখান থেকে তিনি লাভ করেন ‘যাতুন নিতাক’ উপাধি।[সাহীহ আল-বুখারী-হাদীছ নং-৩৯০৫;]

উপরের এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, হযরত আসমার (রা) ‘নিতাক’ ছিড়ে দু’ভাগ করা এবং ‘যাতুন নিতাকাইন’ উপাধি লাভ করার ঘটনাটি হযরত আবূ বকরে (রা) গৃহে ঘটে যখন রাসূষ (সা) ও আবূ বকর (রা) ‘ছূর’ পর্বতের দিকে যাত্রা করেন।

আসমার ছেলে ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রা) পরবর্তীকালে উমাইয়্যা খলীফাদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে যুদ্ধে লিপ্ত হন।ঠ তখন শামের অধিবাসীরা তাঁকে ‘যাতুন নিকাতাইন’ –এর ছেলে বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো। একথা আসমার কানে গেলে তিনি ছেলেকে বলেন : তারা তোমাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে? বললেন : হাঁ। আসমা (রা) বলেন : আল্লাহর কসম! তারা যা বলে, সত্য। এরপর হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ যখন আসমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন তখন তিনি তাঁকে বলেন: তোমরা কিভাবে আবদুল্লাহকে ‘যাতুন নিকাতাইন’ বলে অপমান করার চেষ্টা কর? হাঁ, আমার একটি মাত্র নিতাক ছিল্ আর তা মেয়েদের অবশ্যই থাকতে হয়। আর অন্য একটি নিতাক দিয়ে আমি রাসূলুল্লাহর (সা) খাদ্য সামগ্রী বেঁধেছিলাম।[আ‘লাম আন-নিসা’-১/৪৭]

বিয়ে ও ইসলাম গ্রহণ

হযরত আসমা’ (রা) হযরত আবূ বকরের (রা) জ্যেষ্ঠ সন্তান। মক্কায় ইসলামী দা‘ওয়াতের সূচনা পর্বে পুরুষদের মধ্যে আবূ বকর (রা) সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। আর এটাই স্বাভাবিক যে, তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিকট ইসলামের দা‘ওয়াত পেশ করে থাকবেন, আর তাঁরাও দা’ওয়াত কবুল করেছেন। সুতরাং ধরে নেওয়া যায়, আসমা’ (রা) সাহাবীদের সন্তানদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারিণী। আর যেহেতু তিনি হিজরাতের ২৭ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাই তাঁর বয়স তখন দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি হবে। তিনি তখন একজন কিশোরী মাত্র। ইমাম নাওবী (রা) বলেন :[ তাহযীবুল আসমা’ ওয়াল লুগাত-২/৫৯৭; বানাত আস-সাহাবা-৪০] (আরবী*******)

‘আসমা’ (রা) বহু আগে সতেরোজন মানুষের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন।’ ইবন ‘আবদিল বার (রা) বলেন :[ আল-ইসতী‘আব-১২/১৯৬;]

‘(আরবী*****)-তাঁর ইসলাম গ্রহণ ছিল মক্কায় বহু আগে।’ ইবন ‘আসাকির উল্লেখ করেছেন যে, আসমা (রা) ‘আয়িশার (রা) চেয়ে দশ বছরের বড়। তারপর তিনি মুহাজিদের ইসলাম বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছে :[ তারীখু মাদীনাতি দিমাশক, (তারাজিম আন-নিসা’)১০]

(আরবী********)

‘তারপর আরব গোত্রগুলোর কিছু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁদের অন্যতম হলেন আসমা’ বিনত আবী বকর(রা)। তিনি তখন অল্প বয়স্কা তবে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারিণী মহিলাদের ক্রমধারা এ রকম : খাদীজা, উম্মু আয়মান আল-হাবশিয়্যাহ, হযরত ‘আব্বাসের স্ত্রী উম্মুল ফাদল ও হযরত ‘উমারের (রা) বোন ফাতিমা বিনত খাত্তাব (রা)।[বানাত আস-সাহাবা-৪১]

মক্কায় যখন ইসলামের দা‘ওয়াত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, পৌত্তলিক কুরায়শদের যুলুম- নির্যাতনের মাত্রাও বেড়ে চলছে, আর রাসূলুল্লাহর (সা) নির্দেশে নির্যাতিত মুসলমানগণ মক্কা থেকে একে একে হিজরাত করছে, এমনই এক সময়ে হযরত রাসূলে কারীমের (সা) ফুফাতো ভাই যুবায়র ইবনুল ‘আওয়াম (রা) আসমাকে (রা) বিয়ের পয়গাম পাঠান।

ইসলামের প্রথম পর্বে হযরত আবূ বকরের (রা) দা‘ওয়াতে যে সকল যুবক সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন যুবায়র তাঁদের অন্যতম। ইসলাম গ্রহণের পর প্রথম পর্বের অন্য মুসলমানদের ন্যায় ইসলামের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেন। এবং প্রতিপক্ষ পৌত্তলিকদের নানা রকম যুলুম-নির্যাতন হাসিমুখে সহ্য করেন। আর তাই তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) একান্ত সাহাগ্যকারী ও অশ্বারোহী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।

যুবায়র (রা) একজন সাহসী যুবক। তিনি ‍দুনিয়ার উপর দীনকে অগ্রাধিকার দেন। পরকালীন জীবনকে পার্থিব জীবনের উপর প্রাধান্য দেন। তবে তিনি যখন আবূ বকরের (রা) মত একটি ধনাঢ্য অভিজাত পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব পাঠান তখন সম্পদের মধ্যে তাঁর একটি মাত্র ঘোড়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আবূ বকরের (রা) পরিবার এই প্রস্তাবে রাযী হয়ে যান এবং আসমা‘-যুবায়রের বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়।

আসমার চাতুরী ও কৌশল

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন নগতে তাঁর হাতে প্রায় এক লাখ দিরহাম ছিল। ইসলাম গ্রহণের পর ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং নও মুসলিমদের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য নিজের সব ধন-সম্পদ রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে তুলে দেন। এ কারণে হিজরাতের সময় তাঁর হাতে দেড় মতান্তরে পাঁচ অথবা ছয় হাজারের মত যে অর্থ ছিল তার সবগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়েন্ সন্তান-সন্ততি ও পরিবার-পরিজনকে আল্লাহর যিম্মাদারিতে ছেড়ে যান। ‘ছূর’ পর্বত থেকে রাসূল (সা) ও আবূ বকরকে (রা) বিদায় দিয়ে আসমা’ (রা) ঘরে ফিরে আসেন। আবূ বকরের (রা) পিতা আবী কুহাফা, আসমা’র দাদা- যিনি তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি, বয়সের ভারে বড় দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন এবং দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি সকালে লোকমুখে ছেলের নিরুদ্দেশের কথা শুনে ছেলের বাড়ীতে আসেন এবং অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে থাকেন, আফসোস! আবূ বকর নিজেও চলে গেল এবং সব অর্থ-সম্পদ সংগে নিয়ে ছেলে-মেয়েদেরকে বিপদে ফেলে গেল। হযরত আসমা (রা) সংগে সংগে বলে উঠলেন, না দাদা, তিনি আমাদের জন্য অনেক অর্থ রেখে গেছেন।

একথা বলে আসমা (রা) বৃদ্ধকে সান্ত্বনা দানের জন্য একটি থলিতে পাথর ভরে মুখ বেঁধে সেখানে রাখেন যেখানে আবূ বকর (রা) তাঁর সঞ্চিত অর্থ রাখতেন। তারপর সেটি একখণ্ড কাপর দিয়ে ঢেয়কে দেন। এরপর তিনি দাদার হাত ধরে সেই অর্থভাণ্ডারের নিকট নিয়ে যান এবং তাঁর একটি হাত ধরে সেই পাথর ভর্তি থলের উপর আসে করে ঘোরাতে থাকেন। বৃদ্ধ ঝাণ্ডারের যথেষ্ট অর্থ জমা আছে মনে করে আশ্বস্ত হলেন। হযরত আসমা (রা) বলেছেন, আমি কেবল তাঁকে সান্ত্বনা দানের জন্য এমনটি করেছিলাম। আল্লাহর কসম! তিনি আমাদের জন্য কোন কিছুই রেখে যাননি।[আল-ফাতহুর রাব্বানী (শারহুল মুসনাদ)-২০/২৮২; সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪৪৮; নিহায়াতুল আবির-১৬/৩৩২]

ফির‘আউনুল উম্মাহ্ আবূ জাহলের হাতের থাপ্পড়

সকাল বেলা যখন মক্কার অলি-গলিতে একথা ছড়িয়ে পড়লো যে, মুহাম্মাদ (সা) ও আবূ বকর (রা) রাতের অন্ধকারে মক্কা ছেড়ে চলে গেছেন তখন পৌত্তলিকদের যেন মাথা খারাপ হয়ে গেল। এই উম্মাতের ফির‘আউতুল্য আবূ জাহল ও মক্কার অন্যান্য পৌত্তলিক নেতৃবৃন্দ মক্কার উঁচু ও নীচু ভূমিতে অবস্থিত বানূ হাশিম ও তার শাখা গোত্রগুলোর বাড়ীঘর তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজি করতে লাগলো। অভিশপ্ত দুর্বৃত্ত আবূ জাহলের নেতৃত্বে কুরায়শদের একদল মানুষ আবূ বকরের (রা) বাড়ী ঘেরাও করে। দলটির নেতা আবূ জাহল এগিয়ে গিয়ে দরজায় টোকা দেয়। বাড়ীতে তখন আসমা’, তাঁর বোন ‘আয়িশা ও ‘আয়িশার (রা) মা উম্মুযয রূমান (রা) ছাড়া কেউ ছিলেন না। আসমা’ (রা) বলেন : আমি দরজা খুলে তাদের সামনে গেলাম। তারা বললো : আবূ বকরের মেয়ে, তোমার আব্বা কোথায়?

বললাম : আল্লাহর কসম! আমার আব্বা কোথায় তা আমি জানিনে। সাথে সাথে আবূ জাহল তার একটি হাত উঁচু করে। সে ছিল একজন নীচ প্রকৃতির দুষ্কর্মকারী। সে আমার গালে সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। আর তাতে আমার কানের দুলটি ছিটকে পড়ে।[তারীখু মদীনাতি দিমাশ্‌ক (তারাজিম আন-নিসা’)-প্র.৩]

আবূ জাহল যে কত বড় নীচ পাপাচারী ছিল তা এই ঘটনা দ্বারা কিছুটা অনুমান করা যায়। যে গৃহে এই ঘটনাটি ঘটেছিল তখন সেই গৃহে কোন পুরুষ ছিল না। আসমা’ (রা) তথন গর্ভবতী এবং তাঁর মহান স্বামী যুবায়র ইবনুল ‘আওয়াম (রা) তখন অনুপস্থিত। তিনি এ ঘটনার আগেই মদীনায় হিজরাত করেছেন।[বানাত আস-সাহাবা-৫৩] এই যুবায়ের (রা) ছিলেন তৎকালীন আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর অশ্বারোহী যোদ্ধা। তাঁর উপস্থিতিতে মক্কার কোন পাষণ্ডের এমন বুকের পাটা ছিল না যে, তাঁর স্ত্রীর দিকে চোখ উঁচু করে তাকায়, হাত উঠানো তো দূরের কথা।

হিজরাত ও মুহাজিরদের প্রথম সন্তান

হযরত নবী কারীম (সা) ও আবূ বকর সিদ্দীক (রা) মদীনা পৌঁছে নতুন স্থানের প্রাথমিক সমস্যা কাটিয়ে িএকটু স্থির হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেন যে, মক্কা থেকে মহিলাদের আনার ব্যবস্থা করতে হবে। উল্লেখ্য যে, হযরত আসমার স্বামী যুবায়র (রা) নবীর (সা) পূর্বেই মদীনায় পৌঁছে গেছেন। নবী (সা) যায়দ ইবন হারিছা (রা) ও স্বীয় দাস রাফি’কে মক্কায় পাঠালেন। আর এদিকে আবূ বকর (রা) এক ব্যক্তিকে পাঠালেন।

আবূ বকরের (রা) ছেলে ‘আবদুল্লাহ তাঁর মা, দুই বোন আসমা’ ও ‘আয়িশা এবং পরিবারের কয়েকজন মহিলাকে নিয়ে মদীনার পথ ধরেন। আসমা (রা) তখন আসন্ন প্রসবা মহিলা। মদীনার কুবা পল্লীতে পৌঁছার পর গর্ভস্থ সন্তান ‘আবদুল্লাহর জন্ম হয়।[তাবাকাত-৮/১২৩; উসুদুল গাবা-৫/৩৯২]

এ সম্পর্কে আসমার (রা) বর্ণনা এ রকম :

‘আমার তখন পূর্ণ গর্ভাবস্থা। এ অবস্থায় আমি মদীনায় পৌঁছে কুবায় ঠাঁই নিলা। তারপর আবদুল্লাহকে প্রসব করলাম। তাকে নিয়ে আমি রাসূলুল্লাহর (সা) কোলে রাখলাম। তিনি একটি খেজুর আনিয়ে চিবালেন এবং সেই থুথু তার মুখে দিলেন। এভাবে জন্মের পর রাসূলুল্লাহর (সা) থুথুই প্রথমে তার পেটে যায়।

রাসূল (সা) তার মঙ্গল ও কল্যাণ কামনা করে দু‘আও করেন।[সাহীহ আল-বুখারী-১/৫৫৫] সে ছিল মদীনার মুহাজিরদের ঘরে জন্ম নেওয়া প্রথম শিশু। মদীনার কোন মুহাজির দম্পতির কোন সন্তান না হওয়ায় লোকেরা বলাবলি করতো যে, ইহুদীরা তাদের জাদু করেছে তাই তাদের কোন সন্তান হবে না। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আবদুল্লাহ ভূমিষ্ঠ হলে মুহাজিরদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। তারা তাকবীর ধ্বনি দিয়ে ইহুদীদের অপপ্রচারের প্রতিবাদ জানায়।[সাহীহ আল-বুখারী, হাদীছ নং-৩৯০৯, ৫৪৬৭; আত-তাবারী, তারীখ আল-উমাম ওয়াল মুলুক-২.১০; পরবর্তীকালে হযরত আবদুল্লাহ (রা) হাজ্জাজের বাহিনীর হাতে শহীদ হলে শামের অধিবসীরা সে খবর শুনে আনন্দে তাকবীর ধ্বনি দেয়। সে ধ্বনি শুনে প্রখ্যাত সাহাবী হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘উমার (রা) প্রশ্ন করেন : এ তাকবীর কিসের জন্য? বলা হলো : শামের অধিবাসীরা ‘আবদুল্লাহর (রা) হত্যার খবর শুনে আনন্দে তাকবীর ধ্বনি দিচ্ছে। তিনি বললেন : যাঁরা তাঁর জন্মের কথা শুনে তাকবীর ধ্বনি দিয়েছিলেন তাঁরা এদের চেয়ে উত্তম যারা আজ তাঁর নিহত হওয়ার কথা শুনে তাকবীর দিচ্ছে। (আল-‘ইকদ আল-ফারীদ, ৪/৪১৯;ওয়াফাইয়াত আল-আ‘ইয়ান-৩/৭৩, ৭৫)] রাসূল (সা) সন্তানের নানা আবূ বকরকে (রা) নির্দেশ দেন তার দু‘কানে আযান দেওয়ার জন্য। তিনি আযান দেন। রাসূল (সা) শিশুর নাম রাখেন আবদুল্লাহ এবং কুনিয়াত বা ডাকমান রাখেন নানার ডাক নামে- আবূ বকর। পরবর্বীতে হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রা) একটু গর্বের সাথে বলতেন : (আরবী******) ‘আমি ময়ের পেটে থাকতেই হিজরাত করেছি।’ তিনি আরো বলতেন : আমার মা আমাকে পেটে নিয়ে হিজরাত করেছেন। তিনি যত ক্লান্তি ও ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করেছেন তার সবই আমিও সহ্য করেছি।[আল-ইসাবা-৫/২২৯; নাসাবু কুরায়শ-২৩৭]

হযরত আসমা’ (রা) তাঁর এই সন্তান আবদুল্লাহকে অন্তর উজার করা স্নেহ-মমতা দিয়ে লালন-পালন করেন যাতে পরবর্তীকালে ইসলামের একজন সেরা সন্তান হতে পারে। আসমার (রা) স্বপ্ন সত্যে পরিণত হয়েছে। এ পৃথিবীতে সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠায় যাঁর জীবন দান করে গেছেন তাঁদের সেই তালিকায় আসমার (রা) এই সন্তানও নিজের নামটি অন্তর্ভুক্ত করে যেতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি শিশুকে হাতের উপর দোলাতেন, আর শুভ্র-উজ্জ্বল অসির সাথে তার তুলনা করে কবিতার পংক্তি আওড়াতেন। সেই কবিতার কয়েকটি চরণ নিম্নরূপ : [আনবাউ নুজাবা’ আল-আবনা’ -৮৫; আ’লাম আন-নিসা’ -১/৪৯; বানাত আস-সাহাবা-৫৫]

(আরবী*******)

‘পিতা রাসূলুল্লাহর (সা) হওয়রী এবং নানা আবূ বকর সিদ্দীকের মাঝখানে সে হবে ধারালো চকচকে তরবারির মত শ্বেত-শুভ্র।

তার সম্পর্কে এ আমার ধারণা। আর অনেক ধারণাই বাস্তবে রূপ নেয়। আল্লাহ মর্যাদার অধিকারী, ক্ষমাতা দানের অধিকারী।

তিনি তাঁকে এমন বক্তৃতা-ভাষণে পারদর্শী করবেন যে, সে বড় বাগ্মীদেরও অক্ষম করে দিবে এবং অসহায়-অক্ষমদের বিপদাপদ দূরীভূত করবে। যখন চোখের পুত্তলীর পাশে ভ্রূ গজাবে এবং বিচ্ছিন্ন ও দলবদ্ধভাবে ঘোড়া দৌড়াবে।’

হযরত যুবায়র ইবনুল ‘আওয়ামের (রা) ঔরসে এবং আসমার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন : পুত্র আবদুল্লাহ, আল-মুনযির; ‘উরওয়াহ, ‘আসি, আল-মুহাজির এবং কন্যা খাদীজাতুল কুবরা, উম্মুল হাসান ও ‘আয়িশা।[হিলয়াতুল আওলিয়া’ -২/২৫৫।]

দৃঢ় ঈমান

ইসলামী জীবন গ্রহণ করার পর ঈমান তাঁর অন্তরে এমন দৃঢ়মূল হয় যে, শিরক ও কুফরীর সাথে বিন্দুমাত্র অপোষ করেননি। এমনকি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) অসন্তুষ্টির করণ হতে পারে চিন্তা করে নিজের অতি নিকটের অমুসলিম আপনজনদের সাথেও সম্পর্ক ছিন্ন করেন। আসমার (রা) পিতা তাঁর মাকে তালাক দিলে সেই জাহিলী যুগেই তাঁদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। আসমার গোটা পরিবার ইসলামী পরিবারে পরিণত হলো। একদিন আসমার (রা) মা তাঁর মেয়েকে দেখার জন্য আসলে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট জানতে চান, তাঁর এই মুশরিক মায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন কিনা? তখন এ আয়াত নাযিল হয় :[সূরা আল-মুমতাহিনা-৮] (আরবী********)

তখন রাসূল (সা) তাঁকে তাঁর মুশরিক মায়ের সাথে সদাচারণের নির্দেশ দিয়ে বলেন : হাঁ তোমার মায়ের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখ।[তাফসীর আল-কুরতুবী-১০/২৩৯; মুসনাদে আহমাদ-৬/৩৪৪, ৩৪৭, ৩৫৫] আমির ইবন ‘আবদিল্লাহ তাঁর পিতা ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবায়রের (রা) সূত্র বর্ণনা করেছেন : একবার কুতাইলা বিন্‌ত ‘আবদিল ‘উয্‌যা কিছু কিসমিস, ঘি, পনির ইত্যাগি উপহার নিয়ে কন্যা আসমা‘র গৃহে আসলেন। আসমা (রা) তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি তাঁকে ঘরে ঢুকতে দিলেন না। ‘আয়িশা (রা) বিষয়টি রাসূলকে (সা) অবহিত করে তাঁর মতামত জানতে চান। তখন নাযিল হয় সূরা আল-মুমতাহিনার উপরোক্ত আয়াতটি। তখন আসমা (রা) মাকে সাদরে গ্রহণ করে ঘরে নিয়ে বসান এবং তাঁর উপহার সামগ্রী গ্রহণ করেন।[মুসনাদে আহমাদ-৬/৩৪৪; দুররুল মানছূর -৮/১৩১]

হযরত আসমা (রা) ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও নিরহঙ্কারী মানুষ। সংসারে যাবতীয় কাজ নিজ হাতে করতে কোন লজ্জাবোধ করতেন না। হযরত আসমা(রা) নিজেই তাঁর স্বামী হযরত যুবায়েরের (রা) সংসারের আর্থিক অসচ্ছলতা ও দৈন্যদশা এবং সেই সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য নিজ হাতে সম্পন্ন করার কাহিনী আমাদেরকে এভাবে শুনিয়েছেন :

যুবায়র ইবনুল ‘আওয়ামের সংগে যখন আমার বিয়ে হয় তখন অর্থ-বিত্ত বলতে তাঁর কিছুই ছিল না। ছিল না কায়িক শ্রমের জন্য কোন দাস। ভীষণ হতদরিদ্র অভাবী মানুষ ছিলেন। থাকার মধ্যে ছিল শুধু একটি ঘোড়া ও একটি উট। আমি নিজেই তার রাখালী করতাম। মদীনার কেন্দ্রস্থল থেকে তিন ফারসাখ দূরে হযরত রাসূলে কারীম (সা) এক খণ্ড খেজুর বাগান যুবায়রকে দান করেছিলেন। সেখান থেকে খেজুরের বীটি কুড়িয়ে থলিতে ভরে মাথায় করে বাড়ী আনতাম। তারপর নিজ হাতে তা পিষে উট-ঘোড়াকে খাওয়াতাম। কূয়া থেকে বালতি ভরে পানি উঠিয়ে মশকে ভরে বাড়ীতে আনতাম। এছাড়া বাড়ীর যাবতীয় কাজ নিজ হাতে করতাম। যেহেতু আমি ভালো রুটি বানাতে পারতাম না, এ কারণে আচা চটকিয়ে দলা বানিয়ে রেখে দিতাম। আমাদের বাড়ীর পাশেই ছিলেন আনসারদের স্ত্রীরা। তাঁরা ছিলেন খুবই সরল ও সহজ প্রকৃতির। তাঁরা আমাদের ভীষণ ভালোবাসতেন। অন্যের কাজে সাহায্য করতে পারলে দারুণ খশী হতেন। তাঁরা আমার রুটি বানিয়ে সেঁকে দিতেন। প্রতিদিন আমাকে েএ সকল বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হতো।

প্রতিদিনের মতহ একদিন আমি বাগান থেকে খেজুরের বীচির বোঝা নিয়ে ঘরে ফিরছি, এমন সময় পথে রাসূলুল্লাহর (সা) সংগে দেখা। তাঁর সংগে তখন আরো কয়েকজন সাহাবী ছিলেন। রাসূল (সা) তাঁর উট বসিয়ে আমাকে তাঁর পিছনে বসার জন্য ডাকলেন। আমি আমার স্বামী যুবায়েরের মান-মর্যাদার কথা ভেবে লজ্জা পেলাম। তিনি আমার লজ্জা বুঝতে পেরে চলে গেলেন। আমি বাড়ৎী ফিরে একথা যুবায়রকে জানালাম। তিনি মন্তব্য করলেন, আল্লাহ জানেন তোমার এভাবে মাথায় করে বোঝা আনা রাসূলের (সা) সাথে তাঁর বাহনের পিঠে বসার চাইতে আমার নিকট বেশী পীড়াদায়ক। এ ঘটনার বেশ কিছুদিন পরে আমার পিতা আবূ বকর (রা) আমার জন্য একটি দাস পাঠান। সেই আমাকে ঘোড়ার রাখালী থেকে মুক্তি দেয় এবং সব বিপদ থেকে কিচুটা হলেও মুক্তি লাভ করি।[তাবাকাত-৮/২৫০; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৯০; মুসনাদে আহমাদ-৬/৩৫২]

দারিদ্র ও অসচ্ছলতার কারণে সাংসারিক ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে দারুণ হিসেবী ছিলেন। প্রতিটি জিনিস প্রয়োজন মত মেপে মেপে খরচ করতেন। একথা রাসূল (সা) অবগত হয়ে তাঁকে এভাবে মেপে মেপে খরচ করতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, এভাবে মেপে খরচ করবে না। অন্যথায় আল্লাহ ততটুকু পরিমাণই দিবেন। এরপর তিনি এ অভ্যাস পরিত্যাগ করেন।

জীবনের এক পর্যায়ে হযরত আসমা’ (রা) প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক হন। তবে এই প্রাচুর্য তাঁর সরল ও অনাড়ম্বর জীবনধারার উপর কোন রকম প্রবাব ফেলতে পারেনি। আমরণ মোটা কাপড় পরেছেন এবং শুকনো রুটি দ্বারা উদরপূর্তি করে একেবারে ভোগ-বিমুখভাবে জীবন কাটিয়েছেন। ইরাক বিজয়ের পর তাঁর ছেলে মুনযির যখন ঘরে ফিরলেন তখন উন্নতমানের পাতলা, মোলায়েম ও নকশা করা কিছু মহিলাদের পোশাক সংগে নিয়ে আসেন এবং সেগুলো মায়ের হাতে তুলে দেন। বয়সের কারণে তখন হযরত আসমা (রা) দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাই কাপড়গুলোর উপর হাত বুলিয়ে তার মান বুঝার চেষ্টা করেন। যখন বুঝতে পারেন এগুলো অতি উন্নত মানের তখন তা তিনতে অস্বীকৃতি জানান। মুনযির যখন মোটা কাপড় নিয়ে এলেন তখন তিনি তা গ্রহণ করেন এবং খুশী হন। তারপর বলেন : ছেলে! আমাকে মোটা কাপড়ই পরাবে।[তাবাকাত-৮/২৫০]

দানশীলতা

হযরত আসমার (রা) চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দানশীলতা। আর এ গুণটি তিনি অর্জন করেন আল্লাহর প্রতি তাঁর দৃঢ় ঈমান ও পারিবারিক ঐতিহ্য থেকে। পিতা আবূ বকরের (রা) দানশীলতার গুণটি তাঁর তিন কন্যা- আসমা’, ‘আয়িশা ও উম্মু কুলছূম (রা) পূর্ণরূপে ধারণ করেন। দানশীলতার এ গুণটি তাঁদের সত্তায় পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়। এমনকি তাঁদের সময়ে এ ক্ষেত্রে তাঁরা দৃষ্টান্তে পরিণত হন। হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রা) তাঁর মা ও খালার দানশীলতার কথা বলছেন এভাবে :[তারীখুল ইসলাম ওয়া তাবাকাত আল-মাশাহীর ওয়াল আ‘লাম-৩/১৩৫; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৯২] (আরবী********)

‘আমি আমার মা আসমা ও খালা ‘আয়িশা (রা) থেকে অধিক দানশীলা কোন নারী দেখিনি। তাঁদের দু‘জনের দান প্রকৃতির মধ্যে কিছু ভিন্নতা ছিল। খালা ‘আয়িশার স্বভাব ছিল প্রথমতঃ তিনি বিভিন্ন জিনিস একত্র করতেন। যখন দেখতেন যে যথেষ্ট পরিমাণে জমা হয়ে গেছে তখন হঠাৎ করে একদিন তা সবই বিলিয়ে দিতেন। কিন্তু আমার মা আসমার (রা) স্বভাব ছিল ভিন্নরূপ। তিনি আগামীকাল পর্যন্ত কোন জিনিস নিজের কাছে জমা করে রাখতেন না।’

সম্ভবতঃ আসমা’ (রা) এই দানশীতার ক্ষেত্রে তাঁর প্রতি রাসূলুল্লাহর (সা) উপদেশ বাণীর অনুসরণ করতেন। তিনি আসমাকে কোন জিনিস জমা করে রাখতে এবং গুনে গুনে খরচ করতে নিষেধ করেন এবং বলেন তুমি যদি এমন কর তাহলে আল্লাহ তোমার প্রতিও এমন করবেন। তোমর রুযি-রিযিকের উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। রাসূল (সা) বলেন : [ সাহীহ আল-বুখারী, ফিল হিবা (২৫৯০, ২৫৯১), ফিয যাকাত (১৪৩৩, ১৪৩৪)] (আরবী*******)

‘হে আসমা! তুমি হিসাব করো না। তাহলে আল্লাহও তোমাকে দানের ক্ষেত্রে হিসাব করবেন।’

আসমা’ (রা) বলেন : রাসূলুল্লাহর (সা) এই উপদেশ বাণীর পর থেকে আমি কী খরচ করলাম এবং কী আমার হতে এলো তা আর হিসাব করিনি। যা কিছুই আমি খরচ করেছি আল্লাহ আমাকে তা পূরণ করে দিয়েছেন।[তারীখু মাদীনাতি দিমাশ্‌ক (তারাজিম আন-নিসা’)-১৯; নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ-৩৫৭]

তিনি তাঁর ছেলে-মেয়েদের এই বলে উপদেশ দিতেন যে, তোমরা ধন-সম্পদ অন্যের সাহায্য ও উপকারের জন্য দেওয়া হয়, জমা করার জন্য নয়। তুমি তোমার অর্থ-বিত্ত আল্লাহর বন্দাদের জন্য খরচ না কর এবং কৃপণতা কর তাহলে আল্লাহও তাঁর অনুগ্র থেকে তোমাকে বঞ্চিত করবেন। তুমি যা কিছু দান করবে অথবা খরচ করবে, প্রকৃতপক্ষে তাই হবে তোমার সঞ্চয়, এ সঞ্চয় কখনো কম হবে না, অথবা নষ্টও হবে না।[তারীখু মাদীনাতি দিমাশ্‌ক-১৬; তাবাকাত-৮/৩৫৭]

হযরত আসমা’ (রা) কখনো অসুস্ঞ হলে তাঁর মালিকানার সকল দাসকে মুক্ত করে দিতেন।[তাবাকাত-৮/২৮৩] উম্মুল মু‘মিনীন হযরত ‘আয়িশা (রা) মৃত্যুকালে এক খণ্ড ভূমি রেখে যান যা উত্তরাধিকার হিসেবে আসমা’ (রা) লাভ করেন। তিনি সেই ভূমিটুকু এক লাখ দিরহামে বিক্রি করেন এবং সকল অর্থ আত্মীয় ও পরিজনদের মধ্যে বিলি করে দেন।[সহীহ আল-বুখারী, বাবু হিবাতিল ওয়াহিদ লিল জামা‘আহ্।]

হযরত আসমার (রা) স্বামী হযরত যুবায়র (রা) ছিলেন অনেকটা রূঢ় প্রকৃতির মানুষ। এ কারণে আসমা’ (রা) একবার রাসূলকে (সা) জিজ্ঞেস করেন যে, আমি কি আমার স্বামীর সম্পদ থেকে অনুমতি ছাড়াই ফকীর-মিসকীনকে কিছু দান করতে পারি? বললেন : হাঁ, করতে পার।[মুসনাদ-৬/৩৫৩]

একবার হযরত আসমার (রা) মা মদীনায় তাঁর নিকট আসেন এবং কিছু অর্থ সাহায্য চান। তিনি তাঁর অভ্যাস মত রাসূলের (সা) নিকট চুটে যান এবং জিজ্ঞেস করেন, আমার মা একজন মুশরিক (পৌত্তলিক), আমার নিকট কিছু অর্থ সাহায্য চাচ্ছেন, আমি কি তাঁকে সাহায্য করতে পারি? রাসূল (সা) বললেন : তিনি তোমার মা।[সাহাবিয়াত-১৬০] অর্থাৎ তাঁকে তুমি সাহায্য করতে পার। মুহাম্মাদ ইবন আল-মুনকাদির (মৃ. ১৩০ হি. ) যিনি একজন বড় মাপের তাবি‘ঈ ছিলেন, বলেন : ‘আসমা’ ছিলেন একজন উদারপ্রাণ দানশীল স্বভাবের মহিলা।’[তাবাকাত-৮/৩৫৩]

শাশুড়ীর সাথে ভুল বোঝাবুঝি

হযরত আসমার (রা) শাশুড়ী ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) ফুফু সাফিয়্যা বিন্‌ত ‘আবদিল মুত্তালিব (র)। তিনি একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি ছিলেন। ইসলামী জীবনে বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য খ্যাতিও অর্জন করেন। তবে স্বভাবে একটু রুক্ষতা ছিল। রেগে গেলে তা অনেকটা মাত্রা ছেড়ে যেত। এসব কারণে পুত্রবধূ আসমার (রা) সঙ্গে অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতো। আর তা নিয়ে মা ছেলের মধ্যেও মান-অভিমানের অবতারণা হতো। এ রকম একটি ঘটনা ইবন ‘আসাকির ‘উরওয়া ইবন আয-যুবায়রের সূত্রে বর্ণনা করেছেন। একবার আসমার কোন ব্যাপার নিয়ে সাফিয়্যা ও তাঁর ছেলে যুবায়রের মধ্যে ক্ষব্ধ কথাবার্তা হয়। আসমা-যুবায়রের ছোট্ট মেয়ে খাদীজা সব সময় তার দাদীর কাছে থাকতো। সে তার আব্বা-দাদীর কথা শোনে এবং তার মার কাছে গিয়ে বলে : মা, আপনি কেন দাদীকে বকেছেন? তিনি আব্বার নিকট অভিযোগহ করেছেন। কথাটি জানাজানি হয়ে গেল। সাফিয়্যা ছেলের উপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন এই ভেবে যে, তাঁর কতাটি ছেলে বউকে বলে দিয়েছে। তিনি এজন্য ছেলেকে তিরস্কার করেন। যুবায়র (রা) মাকে বললেন : মা, আমি তাকে বলিনি। এতে মা আরো ক্রুদ্ধ হলেন। ভাবলেন, ছেলে তাঁর নিকট সত্য গোপন করছে। আসলে যুবায়রও জানতেন না, আসমা’ বিষয়টি কার কাছ থেকে জেনেছেন। রাগের চোটে সাফিয়্যা (রা) তখন ছেলের প্রতি তিরস্কারমূলক বেশ কিছু শ্লোক উচ্চারণ করেন। অবশেষে বিষয়টি পরিষ্কার হলো। যুবায়র (রা) বললেন : মা, আসমাকে একথা বলেছে খাদীজা। সাফিয়্যা বললেন : তাই! যে যেন আর কখনো আমার ঘরে না আসে।[তারীখু মাদীনাতি দিমাশ্‌ক(তারাজিম আন-নিরসা’ ) পৃ. ১৭,১৮,] উল্লেখ্য যে, হযরত সাফিয়্যা (রা) আসমা-যুবয়রের (রা) সন্তানদেরকে খুবই আদর করতেন। ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবায়রকে তো কোলে করে নাচাতেন, আর সুর করে কবিতা চরণ আবৃত্তি করতেন।[বানাত আস-সাহাবা-৬২, টীকা-১]

খোদাভীত ও জ্ঞান

আল্লাহর পথে সবকিছু বিলিয়ে দেওয়া, দানশীলতা, উন্নত নৈতিকতা যেমন তাঁর চরিত্রকে মাধুর্যমণ্ডিত করেছিল তেমনিভাবে জ্ঞান, খোদাভীতি, বুদ্ধিমত্তা, ফিকহ্‌ বিষয়ে পরদর্শিতা তাঁর সত্তাকে আরো মহিয়ান করে তোলে। রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীছ বর্ণনা, জিহাদে অংশগ্রহণ এবং এ জাতীয় অন্যান্য কাজে তাঁর সমান অংশীদারিত্ব লক্ষ্য করা যায়। বিনীত ও বিনম্রভাবে ‘ইবাদাতে মশগুল থাকতেন এবং একাগ্রচিত্তে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। বিশেষ কোন আয়াত পাঠের সময় বিগলিত চিত্তে বার বার তা আওড়াতে থাকতেন। তাঁর স্বামী বর্ণনা করেছেন, একদিন আমি আসমার (র) ঘরে ঢুকে দেখি সে নামাযে দাঁড়িয়ে এ আয়াদ [সূরা আত-তূর-২৭] (আরবী*****)

‘অতঃপর আমাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করেছেন।’

পাঠ করলো। তারপর পাফ করলো আ‘উযুবিল্লাহ। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম, কিন্তু সে কাঁদছে আর আ‘উযুবিল্লাহ পাঠ করছে। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমি বাজারে গেলাম। কাজ সেরে আবার সেখানে ফিরে গিয়ে দেখলাম, তখনো সে কাঁদছে আর আ‘উযুবিল্লাহ পাঠ করছে।[হিলয়াতুল আওলিয়া-২/৫৫; আদ-দুররুল মানছূর-৭/৬৩৫]

ইবনুল জাওযী (রা) উল্লেখ করেছেন যে, সেকালে এমন একদল কুরআন পাঠক ও শ্রোতার আবির্ভাব ঘটে, যারা কুরআন পাঠ অথবা শোনার সময় অভিনব সব আচরণ করতো। যেমন : অচেতন হওয়া, পরিধেয় বস্ত্র টেনে ছিঁড়ে ফেলাা, মাথা-মুখে চড়-থাপ্পড় মারা ইত্যা। তারা মনে করতো এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর পানাহ ও আশ্রয় কামনা করছে। আর তারা মনে করতো, সর্বাধিক পরিচ্ছন্ন অন্তঃকরণ ও সর্বাধিক সৎকর্মশীল রাসূলুল্লাহর (সা) সাহাবীগণ এমন করতেন এবং তারা কেবল তাঁদেরই অনুসরণ করছে।[আল-কুস্‌সাম ওয়াল-মুযাক্কিরীন-৪০] কূফার বিখ্যাত হাফিজ হুসাইন ইবন ‘আবদুর রহমান আস-সুলামী (মৃ. ১৩৬ হি. ) বলেন : একবার আমি আসমা‘ বিনত আবী বকরকে (রা) জিজ্ঞেস করলাম, কুরআন তিলাওয়াতের সময় রাসূলুল্লাহর (সা) সাহাবীগণ কেন করতেন? বললেন : আল্লাহ যেমন তাদের বর্ণনা দিয়েছেন যে, তাদের চোখ অশ্রুপূর্ণ এবং গাত্রত্বক রোমাঞ্চিত হয়। বললাম : এখানে এমন কিছু লোক আছে যাদের সামনে কুরআন পাঠ করলে অচেতন হয়ে পড়েঃ। হযরত আসমা (রা) বললেন : (আরবী******)

‘বিতারিত শয়তান থেকে আল্লাহর পানাহ্ চাই।’[আল-বাহর আল-মুহীত-৯/১৯৬; তারীখু মাদীনাতি দিমাশ্‌ক (তারাজিম আন-নিসা’-২০)]

মূলতঃ হযরত আসমা (রা) আল-কুরআনের দু‘টি আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করেছেন যাতে কুরআন তিলাওয়াতের সময় সাহাবায়ে কিরামের অবস্থা চিত্রিত হয়েছে। সেই আয়াত দু‘টি হলো :[ সূরা আল-মায়িদা-৮৩] (আরবী******)

‘রাসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা যখন তারা শোনে তখন তারা যে সত্য উপলব্ধি করে তার জন্য তুমি তাদের চোখ বিগলিত দেখবে।’

(আরবী*****************)

‘আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন উত্তম বাণী সম্বলিত কিতাব যা সুসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যা পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করা হয়। এতে, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের গা রোমাঞ্চিত হয়, অতঃপর তাদের দেহমন বিনম্র হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে।’[সূরা আয-যুমার-২৩]

এই উম্মাতের সর্বাধিক খোদাভীরু ও পুণ্যবান মানুষ হলেন সাহাবায়ে কিরাম (রা)। তারা সরাসরি হযরত রাসূলে কারীমের (সা) নিকট থেকে ইসলামের সঠিক জ্ঞান রাভ করেন। সুতরাং তারা যা করেননি, ইবাদাতের নামে তা করা কোনভাবেই সঙ্গত নয়। একথাই হযরত আসমা’ (রা) ‘আ‘উযুবিল্লাহ’ পাঠের মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছেন। তিনি আরো বুঝাতে চেয়েছেন যে, ঐ সকল লোক যা করে তা মূলতঃ শয়তানের কাজ। সততা ও নিষ্ঠা ছিল হযরত আসমার (রা) স্বভাবগত। গোটা মানব সমাজের প্রতি ছিল তাঁর সহমর্মিতা। একবার হযরত রাসীলে কারীম (সা) সূর্য গ্রহণের নামায আদায় করছিলেন। নামায খুব দীর্য় ছিল। আসমা’ (রা) ভয় পেয়ে গেলেন এবং ক্লান্ত হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর অদূরে দাঁড়ানো দুই মহিলার উপর দৃষ্টি পড়লো। ওই দুই মহিলার একজন ছিল একটু স্থুলকায় এবং অন্যজন একটু হলকা-পাতলা ও দুর্বল। তাদের নামাযে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে তিনি সাহস ও শক্তি পেলেন। তিনি সরে পড়ার সিদ্ধান্ত পাল্টালেন এবং মনে মনে নিজেকে বললেন, তাদের চেয়েও বেশী সময় আমার দাঁড়িযে থাকা উচিত।[মুসনাতে আহমাদ-৩/৩৪৯] যে কথা সেই কাজ। নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলেন। নামাযও ছিল কয়েক ঘণ্টা দীর্ঘ। শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামাল দিতে পারেননি। জ্ঞান হারানোর উপক্রম হয় এবং মাথায় পানি ছিটানোর প্রয়োজন পড়ে।[সাহীহ আল-বুখারী-১/১৪৪]

সে যুগে হযরত আসমা (রা) বহুবিধ জ্ঞানের উৎসস্থল ছিলেন। তিনি স্বপ্নের একজন দক্ষ তা‘বীর বা ব্যাখ্যাকারিণীও ছিলেন। আল ওয়াকিদী বলেছেন :[তাহযীবুল আসমা’ ওয়াল লুগাত-২/৫৯৮]

(আরবী***************)

‘সা‘ঈদ ইবন আল-মুসায়্যিব (রহ) ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বপ্নের তা‘বীরকারী। তিনি এ জ্ঞান লাভ করেন আসমা’ বিনত আবী বকল থেকে। আর আসমা’ লাভ করেন তার পিতা আবূ বকর (রা) থেকে।’

হযরত আসমার (রা) বহু ভক্ত ও অনুসারী ছিলেন। ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে তাঁরা আসতেন তাঁর সাথে দেখা করতে। তাঁর পূতঃ পবিত্রতার ব্যাপক প্রসিদ্ধি ছিল। মানুষ আসতো তাঁর দু‘আ নিতে। বিশেষ করে বিপদ-আপদের সময় মানুষ আসতো তাঁর দ্বারা দু‘আ করাতে। কখনো কোন জ্বরে আক্রান্ত নারী তাঁর নিকট এলে তিনি তার বুকের উপর পানি ছিটিয়ে দিয়ে বলতেন, রাসূল (সা) বলেছেন : জ্বর হল জাহান্নামের আগুন, আর তোমরা তা পানি দিয়ে ঠাণ্ডা কর।[সাহীহ মুসলিম, ফিস সালামি (২২১১); বুখারী, ফিত তিব্ব (৫৭২৪)]

উম্মুল মু‘মিনীন হযরত ‘আয়িশা (রা) ইনতিকালের সময় হযরত রাসূলে কারীমের (সা) একটি জোব্বা হযরত আসমাকে (রা) দিয়ে যান। আসমার (রা) বাড়ীর কেউ অসুস্থ হলে তিনি এই জোব্বা ধোওয়া পানি তাকে পান করাতেন।[মুসলিম, ফিল-লিবানি ওয়ায যীনাতি (২০৬৯); তাবাকাত-১/৪৫৪; মুসনাদ-৬/৩৪৮]

হযরত আসমা’ (রা) কায়েকবার হজ্জ করেন। প্রথম বার আদায় করেন হযরত রাসূলে কারীমের (সা) সঙ্গে।

হাদীছ স্মৃতিতে ধারণ ও বর্ণনা

হযরত আসমা’ (রা) রাসূলে কারীমের (সা) হাদীছ স্মৃতিতে ধারণ ও বর্ণনার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কিরামের (রা) কন্যাদের অনেককে অতিক্রম করে গেছেন। তবে আবূ বকরের (রা) পরিবারের মহিলাদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন। এ ক্ষেত্রে হযরক ‘আয়িশা (রা) তাঁকে ডিঙ্গিয়ে গেছেন। যে সকল পুরুষ বা মহিলা সাহাবী থেকে এক শো’র কম হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তাদেরকে “আসহাবুল ‘আশারা” বলা হয়।

[যে সকল মহিলা সাহাবীকে ‘আসহাবুল ‘আশরা’ –এর মধ্যে গণ্য করা হয় তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন :

১. আসমা বিনত ইয়াযীদ (রা)। বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-৮১

২. মায়মূনা বিনত আল-হারিছ, উম্মুল মু’মিনীন (রা) । বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-৭৬

৩. উম্মু হাবীবা, উম্মুল মু’মিনীন (রা)। বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-৬০

৪. আসমা’ বিন্‌ত ‘উমাইস (রা)। বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-৬৫

৫. আসমা’ বিন্‌ত আবী বকর (রা)। বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-৫৮

৬. উম্মু হানী বিন্‌ত আবী তালিব (রা)। বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-৪৬

৭. ফাতিমা বিন্‌ত কায়স (রা)। বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-৩৪

৮/ উম্মুল ফাদল বিন্‌ত আল-হারিছ (রা)। বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-৩০

৯. উম্মু কায় বিন্‌ত মিহসান (রা)। বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-২৪

১০. আর-রুবায়্যি‘ বিন্‌ত মু‘আওবিয (রা)। বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-২১

(বানাত আস-সাহাবা-প্র, ৬৫; টীকা-১]

তাঁর স্বামী যুবায়র (রা)ও এই শ্রেণীর বর্ণনাকারীদের অন্তর্গত। তবে তিনি তাঁর স্বামীর চেয়ে বিশটি হাদীছ বেশী বর্ণনা করেছেন। তিনি যেখানে ৫৮(আটান্ন) টি, মতান্তরে ৫৬টি হাদীছ বর্ণনা করেছে, সেখানে তাঁর স্বামীর বর্ণিত হাদছের সংখ্যা ৩৮ (আটত্রিশ)।

হযরত আসমার বর্ণিত হাদীছ সাহীহাইনসহ সুনান ও মুসনাদের বিভিন্ন গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। ১৪ (চৌদ্দ)টি হাদীছ সাহীহ বুখারী ও সাহীহ মুসলিমে সংকলিত হয়েছে। তাছাড়া ৪ (চার)টি বুখারী এবং ৪ (চার)টি মুসলিম এককভাবে সংকলন করেছেন।[আ‘লাম আন-নসা’ -১/৪৯; আল-ইসাবা-৪/২৩০ বানাত আস-সাহাবা-৬৫, ৬৬]

হযরত আসমা’ (রা) থেকে যে সকল মানুষ হাদীছ বর্ণনা করেছেন তাঁদে মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন : তাঁর দুই ছেল- ‘আবদুল্লাহ ও‘উরওয়া, তাঁর দৌহিত্র ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘উরওয়া, তাঁর আযাদকৃত দাস ‘আবদুল্লাহ ইবন কায়সান, ইবন ‘আব্বাস, মুহাম্মাদ ইবন আল-মুনকাদির, ওয়াহাব ইবন কায়সান ও আরো অনেকে। আর মহিলাদের মধ্যে : ফাতিমা বিন্‌ত শায়বা, উম্মু কুলছূম মাওলাতুল হাজাবা ও আরো অনেকে।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৯২; তাহযীব আল-আসমা’ ওয়াল লুগাত-২/৫৯৭; তাহযীব আত-তাহযীব-১০/৪৫১]

হযরত আসমার (রা) মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল। তাছাড়া তিনি একজন বাগ্মী মহলা ছিলেন। স্বামী যুবায়র (রা) ও পুত্র আবদুল্লাহ (রা) শহাদাত বরণের পর তিনি যে মরসিয়া রচনা করেন তা বিভিন্ন গ্রন্থে দেখা যায়।[আ‘লাম আন-নিসা’ -১/৪৯]

তালাক

বিভিন্ন সীরাত গ্রন্থে হযরত যুবায়র (রা) কর্তৃক হযরত আসমা’কে (রা) তালাক দানের কথা সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। তবে কোন গ্রন্থে এর কোন কারণ উল্লেখ করা হয়নি। তবে ইবনুল আছীর সম্ভাব্য দু‘টি কারণের কথা বলেছেন। একটি এই যে, হযরত আসমা’ (রা) বার্ধক্যে পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং বয়সের কারণে দৃষ্টিশক্তিও যেতে বসেছিল।[উসুদুল গাবা-৫/৩৯৩;] আর তাই হযরত যুবায়র (রা) তাঁকে দূরে সরিয়ে দিতে চান। দ্বিতীয়টি এই যে, যে কোন কারণেই হোক দু‘জনের সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। আর তা তালাক তথা সম্পর্ক ছিন্ন করার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে। প্রথম কারণটি কোনভাবেই যুক্তিগ্রাগহ্য নয়। হযরত যুবায়র (রা) যে পর্যায়ের মানুষ তাতে কি একথা কল্পনা করা যায় যে, বার্ধক্যের কারণে বহু সন্তানের জননী স্ত্রীকে ত্যাগ করবেন? তাও আবার যখন তিনি অন্ধ হয়ে গেছেন? দ্বিতীয় যে কারণটির কথা বলা হয়েছে তা অবশ্য যুক্তিসঙ্গত। আ সে কারণে তালাক দেওয়া সম্ভব। হযরত যুবায়েরের (রা) স্বভাব ছিল একটু রুক্ষ ও কঠোর প্রকৃতির। ফলে পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং তা বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়। ইবনুল আছীরের আরেকটি বর্ণনায় একথার সমর্থন পাওয়া যায়। একবার কোন একটি কথার কারণে হযরত যুবায়র (রা) স্ত্রী হযরত আসমার (রা) উপর ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। এমনকি তা মারপিট পর্যন্ত গড়ায়। আসমা’ (রা) ছেলে আবদুল্লাহকে (রা) ডাকলেন সাহায্যের জন্য। যুবায়র (রা) তাঁকে আসতে দেখে বললেন, তুমি যদি এখানে আস তাহলে তোমার মাকে তালাক। ‘আবদুল্লাহ (রা) বললেন, আপনি আমার মাকে আপনার কসমের লক্ষ্যস্থলে পরিণত করলেন? তারপর জোর করে তিনি পিতার হাত থেকে মাকে ছাড়িয়ে আনেন। তারপর আসমা’ পৃথক হয়ে যান।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৯২; তারীখ আল-ইসলাম ওয়া তাবাকাত আল-মাসাহীর ওয়অল-আ‘লাম-৩/১৩৪] হিশাম ইবন ‘উরওয়াকে নিজের কাছে নিয়ে নে।[তাবাকাত -৮/২৫৩; উসুদুল গাবা-৫/৩৯৩] যাই হোক না কেন, তালাকের পর আসমা’ (রা) ছেলে আবদুল্লাহর (রা) নিকট চলে যান এবং সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন। হযরত ‘আবদুল্লাহ (রা) একজন বাধ্য ও অনুগত সন্তান হিসেবে আমরণ মায়ের সেবা করেন। মায়ের সন্তুষ্টিই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।

হযরত যুবায়র (রা) যে হযরত আসমার (রা) সঙ্গে কঠোর আচরন করতেন সে কথা আরো কিছু বর্ণনায় জানা যায়। যেমন আসমা’ (রা) একদিন তাঁর পিতা আবূ বকরের (রা) নিকট গিয়ে তাঁর প্রতি যুবায়রের (রা) কঠোর আচরণের অভিযোগ করলেন। আবূ বকর (রা) আসমার (রা) কথা শোনার পর প্রথমে যুবায়রের (রা) প্রশংসা করলেন এবং নানা বিষয়ে তাঁর যোগ্যতার সাক্ষ্য দিলেন। তারপর তাঁকে উপদেশ দিলেন : আমার মেয়ে! ধৈর্য ধর। একজন নারীর যদি একজন সৎ স্বামী থাকি এবং সে যদি স্ত্রীর পূর্বে মারা যায়, আর স্ত্রী যদি দ্বিতীয় বিয়ে না করে তাহলে জান্নাতে তাদের আবার মিলন হবে।[আ‘লাম আন-নিসা’ -২/৪৮; বানাত আস-সাহাবা-৫৯]

বীরত্ব ও সাহসিকতা এবং ধৈর্য ও দৃঢ়তা

প্রাচীন কাল থেকে আরব বীরত্ব ও সাহসিকতাও তাদের বিশেষ প্রকৃতি ও গুণ। এ কারণে হযত আসমা’ (রা) দানশীল হিসেবে যেমন খ্যাতি অর্জন করেছেন, তেমনি একজন সাহসী বীর মহিলা হিসেবেও প্রসিদ্ধি পেয়েছে। সা‘ঈদ ইবন আল-আসের (রা) সময় যখন মদীনার আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে এবং শহরে ব্যাপকভাবে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে তখন হযরত আসমা’ (রা) একটি সতীক্ষ্ণ খঞ্জর বালিশের নীচে রেখে ঘুমাতেন। লোকেরা এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোন চোর-বাটপাড় ও দুষ্কৃতিকারী যদি ঘরে ঢুকে যায় এবং আমার উপর হামলা করে তাহলে আমি তার পেট ফেড়ে ফেলবো।[নিসা’ হাওলার রাষূল-১৮৪] যুবায়রের (রা) সঙ্গে ছিলেন এবং বিখ্যাত ইয়ারমূক যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেন।[বানাত আস-সাহাবা-৬৯।]

হযরত আসমার (রা) পুত্র ‘আবদুল্লাহর (রা) বয়স যখন পূর্ণ যৌবনকাল তখন উমাইয়্যা খলীফাদের বিরুদ্ধাচরণ করে হিজায, মিসর, ইরাক ও কুরাসানসহ সিরিয়ার বেশীর ভাগ অঞ্চলের লোকেরা তাঁকে খলীফা বলে মেনে নেয় এবং তার হাতে বাই‘আত (আনুগত্যের শপথ) করে। উমাইয়্যা খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মু‘আবিয়া (রা) ইনতিকালের পূর্বে তাঁর তাঁর পুত্র ইয়াযীদকে খিলাফতের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে ইসলামের ইতিহাসে প্রথম রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে যান। কিন্তু ইয়াযীদের এভাবে রাজতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা গ্রহণ ও তাঁর অনৈসলামী জীবনধারা ইসলামী খিলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলের জনসাধারণ মেনে নিতে পারেনি। হযরত আবদুল্লাহও (রা) ইয়াযীদের বাই‘আত করতে অস্বীকার করেন। তিনি মক্কাকে ইসলামী খিলাপতের রাজধানী ঘোষণা দিয়ে সেখানে অবস্থান নেন। চতুর্দিক থেকে মানুষ দলে দলে এসে তাঁর হাতে বাই‘আত করতে থাকে। তিনি তাঁর নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে শাস কাজ পরিচালনা করতে থাকেন। যখন আবদুল মালিক ইবন মারওয়অন খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন তাঁর উযীর হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ হযরত ‘আবদুল্লাহকে (রা) প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বিশাল সমরশক্তি নিয়ে হিজরী ৭২ সনের ১লা যুলহিজ্জা মক্কা অবরোধ করেন। বাইরের সকল যোগাযোগ থেকে মক্কা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যা। একাধারে ছয় মাস উভয়পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলে। দীর্ঘ অবরোধের ফলে মক্কার মানুষের জীবনধারা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। হযরত ‘আবদুল্লাহর (রা) সহযোগীদের সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকে। তারা বিজয়ের কোন সম্ভাবনা না দেখে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে। তিনি তাঁর শেষ মুহূর্তের মুষ্টিমেয় কিছু অনুসারীদের নিয়ে কা‘বার হারাম শরীফে অবস্থান নেন। এখানে উমাইয়্যা সেনাবাহিনীর সাথে চুড়ান্ত সংঘরর্ষের কিছুক্ষণ পূর্বে তিনি মা আসমার (রা) সাথে শেষবারের মত সাক্ষাৎ করতে যান। হযরত আসমা (রা) তখন বার্ধক্যের ভারে জর্জরিত ও অন্ধ। হযরত আসমার (রা) ঘটনাবহুল জীবনের অনেক কথাই ইতিহাস ধরে রাখতে পারেনি। তবে মাতা-পুত্রের এই শেষ সাক্ষাতের সময় তিনি যে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, ঈমানী মজবুতী, চরম আত্মত্যাগ, আল্লাহ নির্ভরতা ও সত্যের প্রতি একনিষ্ঠতার পরিচয় দেন ইতিহাসে তা চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে। মাতা-পুত্রের সেই সংলাপটি ছিল নিম্নরূপ :

আবদুল্লাহ : মা, আস্‌-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লিহি ও বারাকাতুহু।

আসমা’ : ‘আবদুল্লাহ! ওয়া ‘আলাইকাস সালাম। হাজ্জাজ-বাহিনীর মিনজিনিক হারাম শরীফে অবস্থানরত তোমার বাহিনীল উপর পাথর নিক্ষেপ করছে, মক্কার বাড়ী-ঘর প্রকম্পিত করে তুলছে, এমন চরম মুহূর্ত তোমার আগমন কি উদ্দেশ্য?

‘আবদুল্লাহ : উদ্দেশ্য আপনার সাথে পরামর্শ।

আসমা’ : পরামর্শ! কি বিষয়ে?

‘আবদুল্লাহ : হাজ্জাজের ভয়ে অথবা প্রলোভনে আমার সঙ্গীরা আমাকে বিপদের মধ্যে ফেলে চলে গেছে, এমন কি আমার সন্তান এবং আমার পরিবারের লোকেরাও আমাকে পরিত্যাগ করেছে। এখন আমার সাথ অল্প কিছু লোক আছে। তাদের ধৈর্য ও সাহস যত বেশীই হোক না কেন দু‘ এক ঘণ্টার বেশী কোন মতেই টিকে থাকতে পারবে না। এদিকে উমাইয়্যারা প্রস্তাব পাঠাচ্ছে, আমি যদি মালিক ইবন মারওয়ানকে খলীফা বলে স্বীকার করে নিই এবং অস্ত্র ত্যাগ করে তাঁর হাতে বাই‘আত হই তাহলে পার্থিব সুখ-সম্পদের যা আমি চাইবো তাই তারা দেবে- এমতাবস্থায় আপনি আমাকে কি পরামর্শ দেন?

আসমা’ (রা) একটু উচ্চস্বরে বলেন : ব্যাপারটি একান্তই তোমার নিজের। আর তুমি তোমার নিজের সম্পর্কে বেশী জান। যদি তোমার দৃঢ় প্রত্যয় থাকে যে, তুমি হকের উপর আছ এবং মানুষকে হকের দিকে আহ্বান করছো, তাহলে যারা তোমার পতাকাতলে অটল থেকে শাহাদাত বরণ করেছে, তাদের মত তুমিও অটল থাক। আর যদি তুমি দুনিয়ার সুখ-সম্পদের প্রত্যাশী হয়ে থাক, তাহলে তুমি একজন নিকৃষ্টতম মানুষ। তুমি নিজেকে এবং তোমার লোকদের ধ্বংস করছো। পুরুষের মত যুদ্ধ কর এবং জীবনের ভয়ে কোন অপমানকে সহ্য করো না। অবমাননাকর জীবনের চেয়ে সম্মানের সাথে তরবারির আঘাত খেয়ে মৃত্যুবরণ করা অনেক শ্রেয়! তুমি শহীদ হলে খশী হবো। আর যদি এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়অর প্রত্যাশী হও তাহলে তোমার চেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ আর কে আছে? তুমি যদি এই ভেবে থাক যে, তুমি একা হয়ে গেছো এবং আত্মসমর্পন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই তাহলে এই কর্মপদ্ধতি কোন সম্মানীয় ব্যক্তির নয়। তুমি কতদিন বেঁচে থাকবে? একটি সুনাম ও সুখ্যাতি নিয়ে মর। তাহলে আমি সান্ত্বনা খুঁজে পাব।

আবদুল্লাহ : তাহলে আজ আমি নিশ্চিত নিহত হবো।

আসমা’ : স্বেচ্ছায় হাজ্জাজের নিকট আত্মসমর্পণ করবে এবং বনী উমাইয়্যার ছোকরারা তোমার মুণ্ডু নিয়ে খেলা করবে, তা থেকে যুদ্ধ করে নিহত হওয়াই উত্তম।

আবদুল্লাহ : মা, আমি নিহত হতে ভয় পাচ্ছি না। আমার ভয় হচ্ছে, তারা আমাকে নানাভাবে শাস্তি দেবে। আমার হাত-পা কেটে, অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে আমাকে বিকৃত করে ফেলবে।

আসমা’ : বেটা! নিহত হওয়ার পর মানুষের ভয়ের কিছু নেই। যবেহ করা ছাগলের চামড়া ছিলার সময় সে কষ্ট পায় না।

মায়ের একথা মুনে হযরত ‘আবদুল্লাহর (রা) মুখমণ্ডলের দীপ্তি আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তিনি বললেন : আমার কল্যাণময়ী মা, আপনার সুমহান মর্যাদা আরো কল্যাণময় হোক। এ সংকটময় মুহূর্তে আপনার মুখ থেকে কেবল একথাগুলো শোনার জন্য আমি আপনার খেদমতে হাজির হয়েছিলাম। আল্লাহ জানেন, আমি ভীত হইনি, আমি দুর্বল হইনি। তিনিই সাক্ষী, আমি যে জন্য সংগ্রাম করছি, তা কোন জাগতিক সুখ-সম্পদ ও মান-মর্যাদার প্রতি লোভ-লালসা ও ভালোবাসার কারণে নয়। বরং এ সংগ্রাম হারামকে হালাল ঘোষণা করার প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষের কারণেই। আপনি যা পছন্দ করেছেন, আমি এখন সে কাজেই যাচ্ছি। আমি শহীদ হলে আমার জন্য কোন দুঃখ করবেন না এবং আপনার সবকিছুই আল্লাহর হাতে সোপর্দ করবেন।

আসমা’ : যদি তুমি অসত্য ও অন্যায়েল উপর নিহত হও তাহলে আমি ব্যথিত হবো।

আবদুল্লাহ : আম্মা! আপনি বিশ্বাস রাখুন, আপনার এ সন্তান কখনও অন্যায়, অশ্লীল ও অশালীন কাজ করেনি, আল্লাহর আইন লংঘন করেনি, কারো বিশ্বাস ভঙ্গ করেনি, কোন মুসলমান বা যিম্মীর উপর যুলুম করেনি এবং আল্লাহর রিযামন্দী অপেক্ষা উৎকৃষ্ট কোন কিছু এ দুনিয়ায় তার কাছে নেই। একথা দ্বারা নিজেকে পবিত্র ও নিষ্পাপ বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। কারণ, আমার সম্পর্কে আল্লাহই বেশী ভালো জানেন। তারপর তিনি আকাশের দিকে মুখ উঠিয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলেন : ইলাহী, তুমি ভালো করেই জান যে, আমি আমার মাকে যা কিছু বলেছি তা কেবল তাঁকে সান্ত্বনা দানের জন্য। যাতে তিনি ামার এই অবস্থা দেখে কষ্ট না পান।

আসমা’ বললেন : – (আরবী****************)

‘সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি তাঁর ও আমার পছন্দনীয় কাজের উপর তোমাকে অটল রেখেছেন।’ আমার ছেলে! আমি আশা করি তোমার ব্যাপারে আমার ধৈর্য হবে এক অতুলনীয় ধৈর্য। তুমি আমার সামনে নিহত হলে, তা হবে আমার ছওয়াবের উপলক্ষ্য। তুমি বিজয়ী হলে তা হবে আমার জন্য আনন্দের বিষয়। এখন আল্লাহর নাম নিয়ে সামনে এগিয়ে যাও। বৎস! তুমি একটু আমার কাছে এসো, আমি শেষবারের মত একটু তোমার শরীরের গন্ধ শুকি এবং তোমাকে একটু স্পর্শ করি। কারণ, এটাই তোমার ও আমার ইহজীবনের শেষ সাক্ষাৎ।

‘আবদুল্লাহ (রা) বাঁকা হয়ে মার হাত-পা চুমুতে চুমুতে ভরে দিতে লাগলেন, আর মা ছেলের মাথা, মুখ ও কাঁধে নিজের নাক ও মুখ ঠেকিয়ে শুকতে ও চুমু দিতে লাগলেন এবং তাঁর শরীরে নিজের দু‘টি হাতের স্নেহের পরশ বুলিতে দিলেন। বিদায় বেলা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে একথা বলতে বলতে তাঁকে আবার দূরে ঠেলে দিলেন : আবদুল্লাহ! তুমি এ কী পরেছো?

-আম্মা, এ তো আমার বর্ম।

-বেটা, যারা শাহাদাতের অভিলাষী, এ তাদের পোশাক নয়।

-মা, আপনাকে খুশী করা ও আপনার হৃদয়ে প্রশান্তি দানের উদ্দেশ্যে আমি এ পোশাক পরেছি।[আসহাবে রাসূলের জীবন কথা-১/২১১-২১২]

-তুমি এটা খুলে ফেল। তোমার ব্যক্তিত্ব, তোমার সাহস এবং তোমার আক্রমণের পক্ষে উচিত কাজ হবে এনটিই। তাছাড়া এ হবে তোমার কর্মতৎপরতা, গতি ও চলাফেরার জন্যও সহজতর। এর পরিবর্তে তুমি লম্বা পাজামা পর। তাহলে তোমাকে মাটিতে ফেলে দেওয়া হলেও তোমার সতর অপ্রকাশিত থাকবে।

মায়ের কথামত ‘আবদুল্লাহ তাঁর বর্ম খুলে পাজামা পরলেন এবং একথা বলতে বলতে হারাম শরীফের দিকে যুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন : মা, আমার জন্য দু‘আ করতে ভুলবেন না-আমার নিহত হওয়ার পূর্বে ও পরে উভয় অবস্থায়।

-আল্লাহর দরবারে দু‘আ করতে আমি কখনো ভুলবো না। কেউ অসত্যের উপর যুদ্ধ করে, কিন্তু তোমার এ যুদ্ধ সত্যের জন্য। তারপর তিনি দু‘টি হাত আকাশের দিকে তুলে দু‘আ করলেন : হে আল্লাহ, রাতের অন্ধকারে মানুষ যখন গভীর ঘুমে অচেতন থাকে তখন রাত জেগে জেগে তার দীর্ঘ ইবাদাত ও উচ্চকণ্ঠে কান্নার জন্য আপনি তার উপর রহম করুন। হে আল্লহ, রোযা অবস্থায় মক্কা ও মদীনাতে মধ্যাহ্নকালীন ক্ষুধা ও পিপাসার জন্য তার উপর দয়া করুন। হে আল্লাহ! পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের জন্য তার প্রতি আপনি করুণা বর্ষণ করুন। হে আল্লাহ, আমি তাকে আপনারই নিকট সোপর্দ করেছি। তার জন্য আপনি যে ফয়সালা করবেন তাতেই আমি রাযী। এর বিনিময়ে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের প্রতিদান দান করুন।

মা হযরত আসমার (রা) কথাগুলো হযরত ‘আবদুল্লাহর (রা) অন্তরে প্রশান্তি বয়ে আনে। তিনি চলে যান এবং অত্যন্ত ধৈর্যসহকারে যুদ্ধ করে শহীদ হন। মৃত্যুর পূর্বে তাঁর মুখ থেকে নিম্নের চরণ দু‘টি উচ্চারিত হচ্ছিল : [হায়াতুস সাহাবা-১/৫৭৪; বানাত আস-সাহাবা-৭০] (আরবী***************)

আমার মা আসমা‘! আমি তিনহত হলে আমার জন্য কাঁদবেন না। আমার আভিজাত্য ও আমার দীনদারী ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আর অবশিষ্ট আছে একখানি ধারালো তরবারি যা দিয়ে আঘাত করতে করতে আমার ডান হাত দুর্বল হয়ে গেছে।’

সে দিন সূর্য অস্ত যাবার আগেই হযরত ‘আবদুল্লাহ (রা) তাঁর মহাপ্রভুর সাথে মিলিত হন। হত্যার পর হাজ্জাজ তার লাশ ঝুলিয়ে রেখেছিল। দাসীকে সংগে করে মা আসমা‘ (রা) এলন ছেলের লাশ দেখতে। দেখলেন, নীচের দিকে মুখ করে লাশ ঝুলানো রয়েছে। লাশের পাশে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত শান্ত ও দৃঢ়ভাবে বললেন : ‘ইসলামের এ অশ্বারোহীর এখনো কি অশ্বের পিঠ থেকে নামার সময় হলো না?’ জনতার ভিড় কমানোর উদ্দেশ্যে তাঁকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য হাজ্জাজ লোক পাঠায়। তিনি যেতে অস্বীকৃতি জানা। সে আবারো লোক মারফত বলে পাঠায়, এবান না এলে চুলের গোছা ধরে টেনে আনা হবে। হযরত আসমা (রা) হাজ্জাজের ভয়ে ভীত হলেন না। তার ধমকে মোটেই কান দিলেন না।

সত্য উচ্চারণ ছিল হযরত আসমার (রা) চরিত্রের উজ্জ্বলতম বৈশিষ্ট্য। হাজ্জাজের মত নরঘাতক অত্যাচারীর সামনে অত্যন্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে সত্য উচ্চারণ করেছেন। তার সামনা সামনি দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে তার অহঙ্কার চূর্ণ করে দিয়েছেন। হযরত ‘আবদুল্লাহর (রা) শাহাদাতের পর হাজ্জাজ হযরত আসমার (রা) নিকট এসে বলে : আপনার ছেলে আল্লাহর ঘরে ধর্ম বিরোধী কাজ করেছে ও নাস্তিকত প্রচার করেছে। তাই আল্লাহ তহাকে কঠিন শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করিয়েছেন।

দৃঢ় কণ্ঠে আসমা‘ (রা) জবাব দেন : তুমি মিথ্যাবাদী, আমার ছেলে নাস্তিক ছিল না। সে ছিল সাওম পালনকারী, পিতামাতার অনুগত ও বাধ্য সন্তান। তবে আমি নবী কারীমের (রা) মুখ থেকে শুনেছি, ছাকীফ বংশে একজন মিথ্যাবাদী ভণ্ড এবং একজন যালিম পয়দা হবে। মিথ্যাবাদী (আল-মুখতার আছ-ছাকাফী)-কে তো আগেই দেখেছি। আর যালিম, সে তুমিই- যাকে আমি এখন দেখছি। হযরত আসমার (রা) একথা শুনে হাজ্জাজ ভীষণ উত্তেজিত হয় এবং বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু কোন কিছু বলার সাহস হারিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।[সাহীহ মুসলিম, ফাদায়িল আস-সাহাবা, হাদীছ নং-২৫৪৫; তাবাকাত-৮/২৫৪; মুসনাদে আহমাদ-৬/৩৫১; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৯৬]

অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে। হাজ্জাজ আসমাকে (রা) লক্ষ্য করে বলে : বলুন তো আমি আল্লাহর দুশমন ‘আবদুল্লাহর সাথে কেমন ব্যবহার করেছি? আসমা’ জবাব দেন : তুমি তার দুনিয়া নষ্ট করেছো, আর সে নষ্ট করেছে তোমার আখিরাতহ। আমি শুনেছি তুমি নাকি তাকে ‘যাতুন নিতাকাইন’ তনয় বলে ঠাট্টা করেছো। আল্লাহর কসম, আমিই ‘যাতুন নিতাকাইন’। আমি একটি নিতাক দিয়ে রাসূলুল্লাহ (রা) ও আবূ বকরের (রা) খাবার বেঁধেছি। আরেকটি নিতাক আমার কোমরেই আছে।[তাবাকাত-৮/২৫৪; তারীখ আল-ইসলাম ওয়া তাবাকাত আল-মাশাহীর ওয়াল আ‘লাম-৩/১৩৬] একথাও বর্ণিত হয়েঝে যে, হাজ্জাজ আসমার (রা) নিকট এসে বলে : মা, আমীরুল মু‘মিনীন আপনার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। আপনার কোন প্রয়োজন আছে কি? আসমা’ (রা) অত্যন্ত কঠোরভাবে বলেন : আমি তোমার মা নই। আমি রাস্তার মাথায় শূলীতে ঝোলানো ব্যক্তির মা। আমার কোন প্রয়োজন নেই।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৯৪]

হযরত ‘আবদুল্লাহর (রা) শাহাদাতের পর একদিন হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘উমারকে (রা) বলা হলো : আসমা’ (রা) মসজিদের এক কোণে বসে আছেন। তিনি তাঁর দিকে একটু ঝুঁকে বললেন : এই প্রাণহীন দেহ কিছুই না। রূহ তো আল্লাহর নিকট পৌঁছে গেছে। আপনি আল্লাহকে ভয় করুন এবং ধৈর্য অবলম্বন করুন। আসমা’ বললেন : আমাকে তা করতে কিসে বারণ করেছে? নবী ইয়াহইয়া ইবন যাকারিয়ার (রা) মাথাও বনী ইসরাঈলের এক পতিতাকে উপহার দেওয়া হয়েছিল।[প্রগুক্ত-২/২৯৫; তাহযীব আল-আসমা’ ওয়াল লুগাত-২/৩৩০]

উল্লেখ্য যে, ফিলিস্তীনের শাসক হিরোডিয়ান তার ফুফু হিরোডাসকে বিয়ে করতে চাইলে ইয়াহইয়া বাধ সাথেন। কারণ, তাঁদের ধর্মে ফুফু-ভাতিজার বিয়ে সিদ্ধ ছিল না। কিন্তু কন্যা হিরোডাস ও তার মাস সম্মতি ছিল। তারা হিরোডিয়ানকে শর্ত দিল, যদি তুমি ইয়াহইয়ার মাথাটি কেটে একটি থালায় করে আমার সামনে আনতে পার তাহলে এ বিয়ে হবে। সে তাই করেছিল। হযরত আসমা’ (রা) উক্ত ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’ -২/২৯৫; টীকা-১; কাসাসুল আম্বিয়া-৩৬৯]

হযরত আবদুল্লাহর লাশ কয়েকদিন যাবত ঝোলানো অবস্থায় থাকার সময় হযরত আসমা’ (রা) আল্লাহর নিকট দু‘আ করতেন এই বলে যে, হে আল্লাহ! আবদুল্লাহর গোসল দেওয়া ও কাফন-দাফনের ব্যবস্থার না করে যেন আমার মৃত্যু না হয়। লাশ নামানোর পর আসমা’ (রা) তা চেয়ে এনে অতিকষ্টে যমযমের পানি দিয়ে গোসল দেন।[যাদুল মা‘আদ-১/১৪০; তারীখ আল-ইসলাম ওয়া তাবাকাত আল-মাশাহীর ওয়াল আ‘লাম ১/৫০৩; আল-ফাকিহী বলেন : বরকত হিসেবে মক্কাবাসীরা তাদের মৃতদের যমযমের পানি দিয়ে গোসল করাতো। (নিসা’ মুবাশ্‌শারাত ফিল জান্নাহ-২৬৬] মাংস পঁচে-গলে গিয়েছিল। আসমা (রা) নিজের ছেলের এ অবস্থা দেখেও মোটেই ভেঙ্গে পড়েননি। ধৈর্যধারণ করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন।

ইবন মুলাইকা বলেন : গোসলের দায়িত্ব যাদের উপর পড়েছিল তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। আমরা একটি অংগ ধরছিলাম, আর আমাদের হাতে সাথে চলে আসছিল। সেটি ধুয়ে আমরা কাফনের উপর রেখে আরেকটি অংগ ধরছিলাম। এভাবে আমরা তাঁর গোসল সম্পন্ন করি। তারপর তাঁর মা আসমা’ দাড়িয়ে জানাযার নামায পড়েন। মক্কার আল-মু‘আল্লাত গোরস্তানে তাঁকে দাফন করেন।[আ‘লাম আন-নিসা’ -১/৫২; বানাত আস-সাহাবা-৭১]

হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রা) হিজরী ৭৩ সনের জামাদি-উল-আওয়াল মাসের ১৭ তারিখ মঙ্গলবার শাহাদাত বরণ করেন। এর কয়েকদিন পরে হিজরী ৭৩ সনের মক্কায় হযরতহ আসম’ও (রা) ইহলোক ত্যাগ করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল একশো বছর। মুহাজির পুরুষ ও মহিলা সাহাবীদের মধ্যে তিনিই সর্বশেষে মৃত্যুবরণ করেন। সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৯৬; আ‘লাম আন-নিসা-১/৫২, ৫৩] এ দীর্ঘ জীবনে তাঁর একটি দাঁতও পড়েনি বা সামান্য বুদ্ধিভ্রষ্টতাও দেখা যায়নি। মক্কায় তাঁর ছেলে আবদুল্লাহর (রা) পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়।[বানাত আস-সাহাবা-৭২]

মৃত্যুর পূ্র্বে তিনি এই বলে অসীয়াত করে যান যে, তোমরা আমার পরিধেয় বস্ত্র সুগন্ধি কাঠ জ্বালিয়ে তাতে সেঁক দেবে, তারপর আমার দেহে খোশবু লাগাবে। আমার কাফনের কাপড়ে কোন সুগন্ধি লাগাবে না, আগুন নিয়ে লাশের অনুসরণ করবে না এবং আমাকে রাতের বেলা দাফন করবে না।[তাহ্‌যীব-আল-আসমা’ ওয়াল ‍লুগাত-২/৫৯৮]


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি