সাওদা বিনত যাম‘আ (রা)
হযরত সাওদা (রা) সেই ভাগ্যবতী মহিলা যাঁকে হযরত রাসূলে কারীম (সাল-াল¬াহু ‘আলাইহি ওয়া সাল¬াম) উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজার (রা) মৃত্যুর পর বিয়ে করেন। শুধূ তাঁকে নিয়েই তিনি প্রায় তিন বছর বা তার চেয়ে কিচু বেশি সময় দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত কনের। তারপর উম্মুল মুমিননীন হযরত ‘আয়িশাকে (রা) ঘরে তুলে আনেন।

হযরত সাওদা মক্কায় বিখ্যাত কুরাইশ বংশের একটি শখা গোত্র বনু ‘আমের ইবন লুই-এর সন্তান। পিতা যাম‘আ ইবন কায়স কুরাইশ বংশীয় এবং মাতা শামূস বিত কায়স মদীনার বিখ্যাত নাজ্জার গোত্রীয়। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাদা ‘আবদুল মুত্তালিবের মা সালমাও ছিলেন এই নাজ্জার খান্দানের মেয়ে। সাওদার নান কায়স ইবন ‘আমর এবং সালমা বিনত ‘আমর ছিলেন ভাই-বোন। হযরত সাওদার ডাকনাম ছির ‘উম্মুল আসওয়াদ।

জাহিলী যুগে হযরত সাওদার প্রথম বিয়ে হয় সাকরান ইবন আমরের সাথে। সাকরান ছিরেন সাওদার চাচাতো ভাই। বিখ্যাত চার সাহাবা-সুহাইল ইবন আমর, সাহল ইবন আমর সালীত ইবন আমর ও হাতের ইবন আমর ছিলেন সাকরানের ভাই। হযরত রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নুবুওয়াত লাভের প্রথম পর্বে হযরত সাওদা ও তাঁর স্বামী সাকরান ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁরা উভয়ে প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারী ভাগ্যবান ও ভাগ্যবতী নর-নারীদের অন্তর্গত। তাঁদের উভয়ের ইসলাম গ্রহণের সময়কাল একই। কুরাইশদের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য মক্কার অসহায় মুসলিমদের প্রথম দলটি যখন হাবশায় হিজরাত করেন তখনও এই মুসলিম পরিবারটি মক্কার মাটি আকড়ে পড়ে থাকে। কিন্তু তাদের অত্যাচারে মাত্রা যখন সীমা অতিক্রম করতে লাগলো তখন মক্কার মসলিমের দ্বিতীয় একটি দল হাবশায় হিজরাতের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেন। সাওদা তাঁর স্বামীসহ এই দলটি সাথে হাবশায় হিজরাত করেন। কয়েক বছর সেখানে অবস্থানের পর আবার মক্কার ফিরে আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় হিজরাতের কিছুকাল পূর্বে সাকরান মুসলিম অবসথায় মক্কায় মারা যান। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে মক্কায় দাফন করেন।

একথাও বর্ণিত হয়েছে যে প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় দলটির সাথে স্বামীসহ তিনি হাবশায় হিজরাত করেন। আবু উবাউদাহ ও মা‘মারসহ একদল সীরাত বিশেষজ্ঞ বলেছেন, সাকরান হাবশা থেকে মক্কায় ফিরে আসেন। তারপর মুরতাদ হয়ে অথবা কৃস্টধর্ম গ্রহণ করে আবার হাবশায় ফিরে যান এবং সেখানেই মারা যান। বালাজুরী বলেন, প্রথম বর্ণনাটি সঠিক।

রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় হিজরাতের প্রায় তিন বছর পূর্বে উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজার (রা) ইনতিকালের পর তিনি হযরত সাওদাকে (রা) বিয়ে করেন।

হযরত খাদীজা (রা) ছিরেন হযরত রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রথমা এবয় প্রিয়তমা স্ত্রী। একাকীত্বের অস্থিরতায়, বিপদ-আপদের ভয়াবহতায়, এবং অত্যাচারী-উৎপীড়কের নিষ্ঠুর পৈশচিকতায় তিনি ছিলেন প্রিয় স্বামীর একান্ত সংগিনী। প্রতিটি সংকটময় মুহূর্তে সান্ত্বনা দিতেন, সমবেদনা প্রকাশ এবং পাশে থেকে সকল বাধা অতিক্রমে সাহায্য করতেন। এতমন একজন অন্তরঙ্গ স্ত্রী ও বান্দবীর তিরোধানে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দারুণ বিমর্ষ ও বেদনাহত হয়ে পড়েন। তাঁর বিচ্ছেদ ব্যথায় এত কাতর হয়ে পড়েন যে জীবনও সংকটজনক হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া খাদীজা ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সন্তানদের জননী এবং গৃহকর্ত্রী। তাঁর অনুপস্থিতিতে মাতৃহারা সন্তানদের লালন-পালন ও ঘর সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। উপরন্তু পৌত্তলিকদের জ্চালাতন ও উৎপাতের মাত্রাও বেড়ে যায়। রাসূলুল্লাহর (সাল-াল¬াহু ‘আলাইহি ওয়া সাল¬াম) এমন অবস্থা তাঁর সাহাবীদেরকে দারুণভাবে ভাবিয়ে তোলে।

‘উসমান ইবন মাজ‘উন (মৃ. হিঃ ২) একজন বড় মাপের সাহাবী। তাঁর স্ত্রী খাওলা বিনত হাকীম একদিন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট গেলেন। নানা কথার ফাঁকে এক সময় তিনি বলে ফেললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহর! আপনি আবর বিয়ে করুন! প্রশ্ন করেছেনঃ পাত্রী কে? খাওলা বললেনঃ বিধবা এবং কুমারী-দুই রকম পাত্রীই আছে। এখন আপনি যাকে পছন্দকরেন তার ব্যাপারে কথা বলা যেতে পারে। তিনি আবার জানতে চাইলেনঃ পাত্রী কে? খাওলা বললেনঃ বিধবা পাত্রী সাওদা বিনত যাম‘আল আর কুমারী পাত্রী আবু বকরের মেয়ে ‘আশিয়া’। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ এ ব্যাপারে ভূমিকা পালনের জন্য মেয়েরা অধিকতর যেগ্য।&ভাবে তিনি সম্মতি দান কনের।

রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্মতি পেলে খাওলা গেলেন সাওদার গৃহে। সাওদার পিতা তখন জীবনের প্রান্ত সীমায়। পার্থিব সকল কর্মতৎপরতা থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিয়েছেন। খাওলা তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে ‘আনঈম সাবাহান! (সুপ্রভাত) বলে জাহিলী রীতিতে সম্ভাষণ জানান।

বৃদ্ধ প্রশ্ন করেনঃ কে তুমিঃ খাওলা উত্তর দেনঃ আমি খাওলা বিনত হাকীম। বৃদ্ধ খাওলাকে স্বাগত জানিয়ে কাছে বসান। খাওলা বিষের পয়গাম পেশ করেন এভাবেঃ মুহাম্মদ ইবন আবদিল্লাহ ইবন আবদুল মুত্তলিব সাওদাকে বিয়ের প্রস্তাব করেছেন। বৃদ্ধ বলেন, এতো অভিজাত কুফু। তোমার বান্ধধবী সাওদা কি বলে? খাওয়া বলেন তার মত আছে। বৃদ্ধ সাওদাকে ডাকতে বলেন। সাওদা উপস্থিত হলে বলেনঃ আমার মেয়ে! এই মেয়ে (খাওলা) বলছে, মুহাম্মদ ইবন আবদিল্লাহ তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে তাকে পাঠিয়েছে। অভিজাত পাত্র। আমি ত৭ার সাথে তোমার বিয়ে দিতে চাই, তুমি কি রাজি? সাওদা বলেনঃ হাঁ রাজি। তখন বৃদ্ধ খাওলাকে বলেনঃ তুমি যাও, মুহাম্মদকে ডেকে আন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বরবেশে উপস্থিত হন এবং সাওদার পিতা সাওদাকেতাঁর হাতে তুলে দেন।

কোন কোন বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, বিয়ের পূর্বে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বয়ং সাওদার সাথে সরাসরি আলোচনা করেন। হাতে পারে খাওলা এ আলোচনার ব্যবস্থা করেন। ইমাম আহমাদ আবদুল্লাহ আবআসের (রা) একটি বর্ণনা সংকলন করেছেন। তনি বলেছেনঃ রাসূল (সাল-াল¬াহু ‘আলাইহি ওয়া সাল¬াম) তাঁর গোত্রের সাওদা নামের একটি মহিলাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। তিনি ছিলেন মুসীবতের বাস্তব রূপ। পাঁচ অথবা চয়টি ছেলে-মেয়ে রেখে স্বামী মারা গেছেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বললেনঃ আমার প্রস্তাবে রাজিহতে তোমার বাধা কিসের? সাওদা বললেনঃ আল্লাহর কসম! হে আল্লাহর নবী! সৃষ্টি জগতের মধ্যে আপনি আমার সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি। আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করতে আমার কোন বাধা নেই কিন্তু আমার ভয়, আমার এই সন্তানগুলি সকাল-সন্ধ্যা সর্বক্ষণ আপনাকে বিরক্ত করবে, আপনার সেবা থেকে আমাকে বিরত রাখবে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ এছাড়া আর কোন বাধা আছে? সাওদা বললেনঃ না, আর কোন বাধা নেই। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আল্লাহর তোমাকে করুণা করুন। সর্বোত্তম নারী তারা যারা উটের পিঠে পিছন দিকে চড়ে। কুরাইশদের সৎকর্মশীলা নারী তারা যারা তাদের শিশুসন্তানের প্রতি মমতাময়ী এবং স্বামীদের প্রতি যত্মশীলা।

বুকাইর ইবনল আশাজ্জ থেকে বর্ণিত হয়েছে। সাকরান সাওদাকে নিয়ে মক্কায় ফিরে এসে মারা যান। ‘ইদ্দত পালনের পর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব করেন। সাওদা বলেনঃ তুমি তোমার গোত্রের কাউকে বিয়ের কাজটি সম্পন্ন করার দায়িত্বাদও। অতঃপর সাওদা হাতেব ইবন ‘আমর আল-‘আমেরীকে দায়িত্ব দেন। তিনিই সাওদাকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বিয়ে দেন। এই হাতেব (রা) একজন মুহাজির ও বদরী ব্যক্তি।

রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বিয়েতে সাওদার ওলী কে হয়েছিলেন সে সম্পর্কে দুই রকম ধারণাপাওয়া যায়। ১. সাওদার পিতা নিজেই ওলী হয়ে মেয়ের বিয়ে দেন। ২. সালীত ইবন আমর অথবা হাতেব মতান্তরে আবু হাতেব ইবন আলর আল-‘আমেরী। কেউ কেউ বলেছেন, সাওদার পিতা সম্ভবত বার্ধক্যের ভারে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। এ কারণে হাতেব অতবা সালীতকে ওলী নিয়োগ করেছিলেন। ইবন ইসহাক বলেনঃ সালীত ও আবু হাতেব উভয়ে এই বিয়ের সময় মক্কায় ছিলেন না। ত৭ারা ছিলেন হাবশায়। সুতরাং তাঁদের ওলী হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাওদাকে চার শোর দিরহাম মাহর দান করেন।

আল-ওয়াকিদী বলেনঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সাওদার বিয়ে হয় নুবুওয়াতের দশম বছরে রমযান মাসে। যেহেতু সাওদা ও ‘আয়িশার (রা) বিয়ে কাছাকাছি সময়ে হয়েছিল, এ কারণে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায় যে, কার বিয়েটি আগে সম্পন্ন হয়েছিল। এ সম্পর্কে যত বর্ণনা আছে তা পর্যালোচনা করলে দুই রকমের ধারণা পাওয়া যায়। প্রথমতঃ খাওলা একই সাথে ‘আয়িশা ও সাওদার বিয়ের প্রস্বাব দেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুইটি প্রস্বাবেই সম্মতি দিয়ে খাওলাকে পাত্রী পক্ষের সাথে কথা বলার অনুমতি দান করেন। খাওলা প্রথমে ‘আয়িশার পরিবারের সাথে কথা বলেন এবং বিয়ের ব্যবস্থা করেন। এরপর সাওদার বিয়ের ব্যবসথা হয়। ইমাম আহমাদ ‘আয়িমার (রা) একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেনঃ সাওদা প্রথম মহিলা যাঁকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার পরে বিয়ে করেন। আর এটাই ‘আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ ইবন ‘আকীলের মত।

পক্ষান্তরে বুকাইর ইবনুল আশাজ্জের বর্ণনা মতে, খাদীজার (রা) পরে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাওদাকে বিয়ে করেন। ইবন হিববানও একথা বলেছেন। ‘আবদুল্লাহ ইবন মুসলিম বলেনঃ খাদীজার (রা) মৃত্যুর পর এবং আয়িশাকে বিয়ের আগে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নুবুওয়াতের দশম বছরে রমযান মাসে সাওদাকে বিয়ে করেন। মক্কায় তাঁকে নিয়ে ঘর করেন এবং তাঁকে নিয়ে মদীনায় হিজরাত করেন।

আবু সালমা ইবন আবদির রহমান ও ইয়াহইয়া ইবন ‘আবদির রহমান-উভয়ে বর্ণনা করেছেনঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুমতি পেয়ে খাওলা যথাক্রমে সাওদা ও আয়িশার নিকট প্রসতাব নিয়ে যান এবং তাঁদের বিয়ের ব্যবস্থা কনের। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাওদাকে নিয়ে মক্কায় ঘর-সংসার করেন। আর আয়িশার বয়স তখন মাত্র ছয় বছর। মদনায় হিজরাতের পর তাঁকে ঘরে তুলে নেন। খাদীজার পরে এবং আয়িশার পূর্বে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাওদাকেবিয়ে করেন-একথা বলেছেন ইবন ইসহাক, কাতাদাহ, আবু ‘উবাইদাহ, ইবন কুতায়বাহ্ ও আরো অনেকে।

ইবন ইসহাক রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহধর্মিণীদের ক্রমধারা এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ ১. খাদীজা, ২. সাওদা, ৩. আয়িশা, ৪. হাফসা, ৫. যয়নাব বিন্ত খুযায়মা, ৬. উম্মু হাবীবা, ৭. উম্মু সালমা, ৮. যয়নাব বিন্ত জাহাশ, ৯. জুওয়াইরিয়্যা, ১০. সাফিয়্যা, ১১. মায়নূনা (রা)।

হযরত সাওদার ভাই ‘আবদুল্লাহ ইবন যাম‘আ এই বিয়ের সময় পর্যন্ত অমুসলিম ছিলেন। বিয়ের সময় তিনি গৃহে ছিলেন না। বিয়ের কাজ শেস হওয়ার পর জানতে পেরে ক্রোধে উত্তেজনায় ফেটে পড়েন। দুঃখ ও ক্ষোভে মাথা কুটতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি একজন আদর্শ মুসলমান হয়। তিনি আমরণ তাঁর সেই দেরন আচরণের জন্য সর্বদা দুঃখ প্রকাশ করতেন। হযরত সাওদার বিয়ের সকয়কাল নিয়েও সীরাত বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একটু মতবিরোধ দেখা যায়। তাবাকাতসহ বিভিন্ন গ্রন্থ নুবুওয়াতের দশম সনের কথা বর্ণিত হয়েছে। আর যুরকানী (৩/৪৬০) অষ্টম সনের কথা লিখেছেন। মূলতঃ এই বিরোদের কারণ হলো হযরত খাদীজার (রা) মৃত্যুর সময়কাল নিয়ে মতবিরোধ।

কিছু কিছু বর্ণনায় এসেছে, হযরত সাওদা (রা) তাঁর প্রথম স্বামীর জীবদ্দশায় দুইটি স্বপ্ন দেখেন এবঙ স্বামীর নিকট বর্ণনা করলে তিনি যে তা‘বীর বা ব্যাখ্যা করেন তা সত্যে পরিণত হয়। হিশাম ইবন মুহাম্মদদের সূত্রে ইবন সা‘দ লিখেছেন, সাওদা তাঁর প্রথম স্বামী সাকরানের জীবদ্দমায় একবার স্বপ্নে দেখেলেন যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল¬াম) কাছে এসে একখানি পা তাঁর কাঁধে রাখলেন সাওদা স্বপ্ন কথা স্বামীকে জানালে তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! তুমি যদি এ স্বপ্ন দেখে থাক তাহলে আমার মৃত্যু হবে এবং রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে তোমার বিয়ে হবে।

আর একবার স্বপ্নে দেখেন, তিনি বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন। পঠাৎ আকাশ থেকে দাঁদ ভেঙ্গে তাঁর ওপর এসে পড়ে। স্বামী স্বপ্নের কথা শুনে বলেন, খুব শিগগির আমি মারা যাচ্ছি। আর আমার মৃত্যুর পর তোমার দ্বিতীয় বিয়ে হবে। সেই দিন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অল্প কিছুদিন পর মারা যান।

অধ্যাপক আহমাদ ‘আতিয়্যা ত৭ার আ্ল-কামুস আল-ইসলামী (৩/৫৫৭) গ্রন্থে কোন সূত্রের উল্লেক ছাড়াই রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাওদাকে বিয়ে করার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেনঃ সাওদা ছিলেন বয়স্কা বিধবা মহিলা। স্থুলকায় ও চলনে ছিলেন ভারী। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সয়ার হাত বাড়িয়ে দেন তাঁর বার্ধক্যে সাহায্য এবং জীবনে তিনি যে দুর্ভোগ লাভ করেছেন, তার কিছুটা লাঘবের জন্য।

হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নুবুওয়াতের এয়োদশ বচরে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করেন। মদীনায় পৌঁছে একটু স্থির হওয়ার পর যায়িদ ইবন হারিসাকে আবার মক্কায় পাঠান সাওদাসহ অন্যদের নেওয়ার জন্য। আয়িশা (রা) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় পৌঁছে যায়িদ ইবন হারিসা ও আবু রাফে‘কে দুইটি উট ও পাঁচ শো দিরহাম দিয়ে মক্কায় পাঠান। অতঃপর আমরা সকলে মদীনার দিকে বেরিয়ে পড়ি। যায়িদ ও আবু রাফে‘ মদীনায় ফিরে যান ফাতিমা, উম্মু কুলসুম, সাওদা, উম্মু আয়মান ও উসামাকে নিয়ে। দশম হিজরীর বিদায় হজ্জে হযরত সাওদা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সফরসঙ্গী ছিলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে অন্য লোকদের মুযদালাফা থেকে যাত্রার আগেই মীনায় চলে যাবার অনুমতি দান করেন। আয়িশা (রা) বলেনঃ মুযদালাফার রাতে সাওদা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট মানুষের ভীড়ের আগে মীনায় চলে যাওয়ার অনুমতি চান। সাওদা ছিলেন ভারী মহিলা। তিনি দ্রুত চলাফেরা করতে পারতেন না। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে অনুমতি দান করেন।

একদিন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহধমিণীগণ সকলে তাঁর পাশে বসা আছেন। এমন সময় একন প্রশ্ন করলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মধ্যে সর্বপ্রথম কার মৃত্যু হবে? বললেনঃ যার হাত সবচেয়ে দীর্ঘ। উপস্থিতকলের এই উক্তির সরল অর্থ বুঝলেন। ত৭ারা নিজেদের হাত মমেপ দেখলেন, সাওদার হাতসবার চেয়ে দীর্ঘ। ত৭ারা বিশআস করলেন, সাওদার মৃত্যুর হবে সাবর আগে। কিনউত যখন হযরত যয়নাব বিনত খুযায়মা সবার আগে মারা গেলেন তখন বুঝা গেল, হাত দীর্ঘ হওয়া অর্থ দানশীলতা। দান করা ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কাজ। আযওয়াকে মুতাহ্হারাত (পবিত্র স্ত্রীগণ)-এর মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম মারা যান। সাওদা তখন জীবিত।

হযরত সাওদার (রা) মৃত্যুর সময়কাল সম্পর্কে সীরাত বিশেষজ্ঞদের দারুণ মতভেদ রয়েছে্ আল-ওয়াকিদী বলেন, আমাদের নিকট এটাই সঠিক যে, হিজরী ৫৪ সনের শাওয়াল মাসে তাঁর মৃত্যু হয়। ইবনুল ইমামদ আল-হাম্বলী খলীফা হযরত মু‘য়াবিয়ার (রা) খিলাফতকারে হিজরী ৫৫ সনের মতটি সর্বাধিক সঠিক বলে মনে করেছেন। ইবনহাজার বলেন, বুখারী তাঁর তারীখে সহীহ সনেদে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত ‘উমারের (রা) খিলাফতকালের শেষদিকে তাঁর ইনতিকাল হয়। ইমাম জাহাবী জোর দিয়ে বলেছেন যে, খালীফা উমারের খিলাফতকালের শেষ দিকে তাঁর ইনতিকাল হয়। উমার (রা) শাহাদাত লাভকরেন হিজরী ২৩ সনের জিলহজ্জ মাসের শেষ দিকে। এ কারণেসাওদার্নতিকাল তারও আগে হয়ে থাকবে। বালাজুরী বলেন, হিজরী ২৩ সনে তিনি মারা যান। খলীফা উমার (রা) তাঁর জানাযার নামায পড়ান। ইবন হিবচÿান বলেন, হিজরী ৬৫ সনে তিনিমারা যান। আবার একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, খলীফা উসমারে (রা) খিলাফতকালে প্রায় আশি বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুর হয়। হযরত সাওদার (রা) সন্তান-সন্ততি সম্পর্কে অধিকাংশ সীরাত গ্রন্থকার কোন আলোচনা করেননি। তবে এতটুকু জানা যায় যে, হযরত রাসূলে পাকের সাথে বৈবাহিক জীবনে তাঁর কোন সন্তান হয়নি। প্রথম স্বামী সাকরানের পক্ষের একটি ছেলে, যার নাম ‘আবদুর রহমান’ পারস্যের জালুলার যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।

রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহধর্মিণীদের মধ্যে সাওদার চেয়ে দীর্ঘদেহী আর কেউ ছিলেন না। হযরত আয়িশা (রা) বলেছেন, যে একবার তাঁকে দেখেছে তার চোখ থেকেতিনি গোপন হতে পারতেন না। যুরকানী বর্ণনা করেছেন, তাঁর কাঠামো ছিল লম্বা। আল্লামা শিবলী নু‘মানী বলেছেন, তিনি ছিলেন স্থুলকায়। একথা ইমাম জাহাবীও বলেছেন। এ কারণে বিদায় হজ্জের সময় মানুষেল ভীড়ের আগে তিনি মুযদালাফা থেকে মীনায় চলে যাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুমতি লাভ করেছিলেন।

হযরত সাওদার (রা) সূতে মাত্র পাঁচটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তার ম¨্যধ ইমাম বুখারী মাত্র একট হাসীদ বর্ণনা করেছেন। সাহাবীদের মধ্যে ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আববাস, ইবনুল যুবাইর এবং ইয়াহইয়া ইবন আবদিল্লাহ আল-আনসারী তাঁর থেকে হাদীস শুনেছেন ও বর্ণনা করেছেন।

হিজরাতের প্রায় তিন বছর পূর্বে হযরত সাওদা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল¬াম) ঘরে আসেন। নুবুওয়াতের দশম বছরের রমযান মাস থেকে ত্রয়োদশ হিজরীর রবী‘উল আওয়াল মাস পর্যন্ত প্রায় তেরো বছর স্ত্রী হিসেবে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সান্নিধ্য ও সাহচর্য লাভের যৌভাগ্য অর্জন করেন। কিচু আগে-পরে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সাওদা ও আয়িশার বিয়ে হয়। বিয়ের পর আয়িশা (রা) প্রায় তিনবছর পিতৃগৃহে অবসআন করেন। এ সময় সাওদাই ছিলেন মূলতঃ এক গৃহিনী। এ সময় তিনি অতি সুষ্ঠুভাবে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘর-গৃহস্থালীর যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেন। মাতৃহারা কন্যা ফাতিমাসহ অন্য কন্যাদের লালন-পালনের দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নেন। সম্ভবতঃ তখন পর্যন্ত নবী পরিবারের সদস্য হযরত আলীরও তত্ত্বাবধান করেন। মোটকথা, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের এক কঠিন ও সংকটময় পর্বে হযরত সাওদা (রা) জীবন সংগিনী হিসাবে কঠিন দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে খাদীজার (রা) শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করেন।

প্রথম হিজরী সনে আয়িশা (রা) যখন স্বামীগৃহে আসেন তখন সতীন সাওদা বিদ্যমান। এ অবস্থায় একে অপরের ভাগ বসানোর কল্পনা করতে পারতেন। কিন্তু এই স্বাভাবিক অনুমানের একেবারে বিপরীত ছিল এই দুইজনের অবস্থা। তাঁদের সংসার জীবনের সবকিছু ছিল পারস্পরিক সৌহার্দ, সম্প্রীতি ও ঐক্যের। গার্হস্থ্য জীবনের অধিকাংশ বিষয়ে সাওদা ছিলেন ‘আয়িমার বান্ধবী। আয়িশা (রা) বলেনঃ সাওদা ছাান্য কোনমহিলাকে দেখে আমার এমন ইচ্ছা হয়নি যে, তার দেহে যদি আমার প্রাণটি হোত।

রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনুগত্য ও অনুসরণের ক্ষেত্রে তিনি সকল আযওয়াজে মুতাহহারাত’ (পবিত্র স্ত্রীগণ) অপেক্ষা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারিণী ছিলেন। বিদায় হজ্জে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মাহাতুল মুমিনীন’ এর (ঈমানদারদের মাতাগণ) উদ্দেশ্যে বলেন, আমার পরে তোমরা ঘরে অবস্থান করবে। হযরত সাওদা (রা) এই নির্দেশের উপর এত কঠোরভাবে আলম করেন যে, হজ্জের উদ্দেশ্যেও আর কখনও ঘর থেকে বের হননি। আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওফাতের পর তাঁর অন্য সহধর্মিণীগণ হজ্জ করতেন; কিন্তু সাওদা ও যয়নাব বিনত জাহাশ রাসূলুল্লারহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদেশ কঠোরভাবে পালন করতেন। ঘর থেক বের হতেন না। সাওদা (রা) বলতেন, আমি হজ্জ ও উমরা-দুটোই আদায় করেছি। এখন আল্লাহর নির্দেশ মত ঘরে বসে থাকবো।

হযরত রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আখলাক ও স্বভাব-চরিত্রের এক অনুপম দিক ছিল দানশীলতা। সাহাবীদের মধ্যে যিনি যত বেশি তাঁর নিকটে থাকার সুযোগ পেয়েছেন তাঁর মধ্যে এই বিশেষ গুণটির ছাপ পড়েছে অধিক। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সান্নিধ্য ও সাহচর্য্য থেকে তাঁর সহধর্মিণীগণই সর্বাধিক মাত্রায় গ্রহণের সুযোগ পেয়েছেন। এ কারণে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই বিশেষ গুণটি তাঁদের সকলের মধ্যে সাধারণভাবে পাওয়া গেলেও একমাত্র আয়িশা (রা) ছাড়া সাওদার মধ্যেই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ইবন সীরীন বর্ণনা করেছেন, একবার খলীফা হযরত ‘উমার (রা) হযরত খাওদার (রা) নিকট একটি থলি পাঠান। তিনি বহনকারীকে প্রশ্ন করেন। তলিতে কি? বললোঃ দিরহাম। থলিতে খেজুরের মত দিরহাম পাঠানো হয়-একথা বলে তক্ষণি দিরহাম মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেন।

ইছার বা নিজের উপর অন্যকে প্রাধান্য দান করাও ছিল তাঁর চরিত্রের এক উজ্জ্বল দিক। তিনি এবং আয়িশা (রা) কিচু আগে-পরে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বৈবাহিক জীবন শুরু করেন। তবে আয়িশা (রা) অপেক্ষা তাঁর বয়স ছিল বেশি। এ কারণে তাঁর জীবনে বার্ধক্য এসে যায় এবং তার মধ্যে পুরুষের প্রতি আকর্ষণে ভাটা পড়ে। তাই তিনি স্বামী রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষে নিজের ভাগের রাতটি সতীন আয়িশাকে (রা) দান করেন। এ সম্পর্কে একবার হযরত ‘আয়িশা (রা) উরওয়াকে বললেনঃ ভাতিজা! রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের জন্য তার বণিআটত রাতে অবস্থানের ব্যাপারে কাউকে কারো উপর প্রাধান্য দিতেন না।ানেক দিন এমন গেছে তিনি আমাদের সকলের নিকট এসে ঘুরে গেছেন, কোন স্ত্রীকেই স্পর্শ করেননি। শেষে সেই স্ত্রী নিকট রাত কাটিয়েছেন যার জন্য রাতটি নির্ধারিত ছিল্ সাওদা বিনত যাম’আর যখন বার্ধক্য এসে যায় এবং এই ভয় পেয়ে যান যে না জানি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে দেন, তখন তিনি বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার ভাগের রাতটি আমি আয়িশাকে (রা) দিলাম। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর এ আবেদন মঞ্জুর করেন।

এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার। হযরত সাওদার (রা) স্বামী সান্নিধ্যের সময়টুকু আয়িশাকে (রা) দান করার বিষয়টি হাসীদ ও সীরাতের গ্রন্থসমূহে এসেছে। কিন্তু তারই পাশাপাশি সীরাতের গ্রন্থসমূহে এমন কিছু বর্ণনা পাওয়া যায় যাতে দেখা যায়, সাওদার (রা) জীবনোবর্ধক্য এসে যাওয়ায় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে এক তালাক দান করেছিলেন। তারপর তাঁর বিনীত অনুরোধে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তালাক প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু মুহাদ্দিসদের নিকট বর্ণনাগুলি অতি দূর্বল বিধায় গুরুত্বহীন। আর এটাই সঠিক যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কোন স্ত্রীকে তালাক দান করেননি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের এক বিশেষ সময়ে যাঁকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেন এবং যিনি অতি দক্ষতার সাথে খাদীজার (রা) দায়িত্ব পালনকরেন, তাকে বার্ধক্যে রাসূল (সাল¬াল¬াহু ‘আলাইহি ওয়া সাল-াম) দূরে ঠেলে দেবেন, এমন কথা কেমন করে ভাবা যায়? তাই মুহাদ্দিদসগণ এসব বর্ণনায় বিশ্বাস করেননি। কোন নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রন্থেও এসব বর্ণনা স্থান পায়নি। কিন্তু তা না পেলে কি হবে? আধুনিক ইতিহাস লেখকদের অনেকে সাওদা (রা) সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল-াল¬াহু ‘আলাইহি ওয়া সাল¬াম) আদর্শ গৃহিণী হতে পারেননি।

এ সম্পর্কিত বিভিন্ন পর্যালোচনা করলে যে তথ্যটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো, সাওদার জীবনে বার্ধক্য এসে যায়। স্বামীকে তুষ্ট করতে অক্ষম হয়ে পড়েন। এদিকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একাধিক স্ত্রী বিদ্যামান ছিল। আর তিনি ছিলেন আদল ও ইনসাফের মূর্ত প্রতীক। সকল স্ত্রীকে সমান মর্যাদা দান করতেন। স্ত্রীদের জন্য যতটুকু সময় ব্যয় করতেন, তা সকলের জন্য সমানভাবে ভাগ করতেন। এভাবে সাওদাসহ আরো কয়েকজন স্ত্রী সমানভাবে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরাম ও প্রশান্তি লাভের সময়ের ভাগ পেতেন। কিন্তু মূলতঃ তাঁদের বয়সের কাণে তাঁরা রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রশান্তি দিতে অক্ষম ছিলেন। স্বেচ্ছায় নিজের অধিকার সতীন আয়িশার (রা) অনুকহলে ছেড়ে দিয়ে রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দায়মুক্ত কনে। আয়িশার (রা) একটি বর্ণনা দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হয়। তিনি বলেনঃ সাওদা বৃদ্ধা হয়ে যান। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট আমার স্থান কি এবং তিনি যে আমাকে বেশি কাছে পেতে চান, তা নি বুঝতে পারেন। তিনিভয় পেয়ে যান, যা জানি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ত৭াকে পৃথক করে দেন। তাই তিনি বলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আমার বারির দিনটি আয়িশাকে দানকরলাম। আপনি এ ব্যাপারে দায়মুক্ত। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর্ প্রস্তাব গ্রহণ করেন। হযরত সাওদা ছিলেন একটু রুক্ষ প্রকৃতির মহিলা। হযরত আয়িমার (রা) সীমাহীন শ্রদ্ধার পাত্রী ছিলেন তিনি। তা সত্ত্বেও তিনি বলেছন, সাওদা খুব দ্রুত রেগে যেতেন। পর্দার হুকুম নাযিলের পূর্ব থেকে হযরত উমার (রা) এ বিষয়ে নির্দেশ দানের জন্য প্রায়ই রাসূলুল্লারহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল¬াম) নিকট দাবী জানাতেন। যেহেতু এ ব্যাপারে আল্লারহ কোন নির্দেশ আসেনি তাই তিনি চুপ থাকতেন। সে সময় মক্কার কোন গৃহের অভ্যন্তরে পায়খানার ব্যবস্থা ছিল না। পায়খানা থাকাটা তারা শোভন মনে করতো না। সে সময় মেয়েরাও প্রাকৃতিক কর্ম সমাধার অন্য রাতের বেলা বাড়ীর বাইরে খোলা ময়দানেচলে যেত। হযরত সাওদা ছিলেন স্থুলকায় ও দীর্ঘদেহী। বহু মানুষের মধ্যেও তাকে চেনা যেত। একদিন রাতে তিনি বাইরে যাচ্ছেন। পথে উমারের দৃষ্টিতে পড়েন। তিনি চেঁচিয়ে বলে ওঠেনঃ আপনাকে আমি চিনে ফেরেছি। উমারের এমন আচরণে সাওদা যেমন লজ্জা পেলেন, তেমনি রেগেও গেলেন। ফিরে এসে উমারের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট অভিযোগ কনের। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হিজাবের আয়াত নাযিল হয়।

হিজাবের আয়াত নাযিলের কারণ সম্পর্কে দারুণ মতভেদ আছে। একটি বর্ণনা তো উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয় একটি বর্ণনা এই যে, হযরত ‘উমার (রা) রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আপনার নিকট ভালো-মন্দ সকল ধরনের লোকের সমাগম হয়। আপনি যদি তাদেরকে পর্দা করারি নির্দেশ দিতেন, ভালো হতো। ইবন জারীর তাঁর তাফসীরে মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের সাথে আহার করছিলেন। হরযত ‘ইয়শাও ভোজনে অংশীদার ছিলেন। তাঁর হাতে এক ব্যক্তি হাতের ছোঁয়া লাগে। ব্যাপারটি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে খুব খারাপ লাগে। এই ঘটনার পর হিজাবের আয়াত নাযিল হয়। তবে সাধারণভাবে একথা প্রসিদ্ধ যে, হযরত যয়নাবের (রা) ওলীমার আহার পর্ব উপলক্ষে ‘আয়াতে হিজাব’ নাযিল হয়। ইবন হাজার এই বর্ণনাগুলির সমন্বয় করেছেন এভাবেঃ হিজাবের আয়াত নাযিলের একটি কারণ ছিল। তার মধ্যে যয়নাবের ঘটনাটি ছিল সর্বশেষ। আর সেটাই আয়াতের শানে নুযুল। কারণ উক্ত আয়তের মধ্যেই ঘটনাটির প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে।

রুক্ষ স্বভাবের হলেও সাওদার (রা) মধ্যে সারল্য ভাবও ছিল। তাঁর কোন কোন কথায় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হেসে দিতেন। একদিন তিনি রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, কাল রাতে আমি আপনার সাথ নামায পড়েছি। আপনি এত দীর্ঘ সময় রুকুতে ছিলেন যে, আমার নাক দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু হয়েছে বলে মনে হয়েছিল। এ কারণে আমি দীর্ঘক্ষণ নাক চেপে ধরে রেখেছিলাম। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কথায় মৃদু হেসে দেন।

তিনি একবার ‘আয়িশা ও রাফসার (রা) সাথে যাচ্ছেন। তাঁরা একটু কৌতুক করে বললেন, আপনি কি কিছু শুনেছেন? তিনি প্রশ্ন করলেনঃ কোন বিষয়ে? তাঁরা বললেনঃ দাজ্জাল বের হয়েছে। এ কথা শুনে তিনি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। পাশেই একটি তাঁবুতে কিছু লোক আগুন পোহাচ্ছিল। তিনি হঠাৎ সেই তাঁবুর মধ্যে ঢুকে পড়েন। হযরত হাফসা ও হযরত ‘আয়িশা (রা) তাঁর কান্ড দেখে হাসতে হাসতে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট পৌঁছেন এবং তাদের কৌতুকের কথা বলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসে তাঁবুর দরজায় দাঁড়িয়ে বলেন, এখনো দাজ্জাল বের হয়নি। তখন সাওদা বেরিয়ে আসেন। গায়ে তাঁর মাকড়সার জাল গেলে ছিল, বাইরে এসে তা সাফ বলেন। অনেকের নিকট এ বর্ণনাটির সূত্র দুর্বল এবং বর্ণনাটি সন্দেহযুক্ত।

হযরত সাওদার (রা) সরলতার আরো বহু ঘটনা আছে। রাসূলাল্লাহ (সাল-াল¬াহু ‘আলাইহি ওয়া সাল¬াম) নিজের জন্য যে মধু পান হারাম করে নেন তার পিছনে ছিল দাম্পত্য জীবনের একটি মধুর ঘটনা। আর সেই ঘটনার সাথে সরলভাবে সাওদাও জড়িয়ে পড়েন বলে অনেকের ধারণা। সংক্ষেপে ঘটনাটি এই রকমঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মিস্টি পছন্দ করতেন। তিনি স্ত্রী যয়নাব বিনত জাহাশ, মতান্তরে হাফসার ঘরে গেলে মধুর শরবত পান করতেন। এতে ‘আয়িশার মনে কিছুটা ঈর্ষার সৃষ্টি হয়। তিনি চাইলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাতে সেখানে আর মধু পান না করেন। তাই সাওদার সাথে ফন্দি আঁটলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মধু পানের পর যখন তাঁদের নিকট আসবেন তখন তাঁরা প্রত্যেকেই বলবেন, আপনার পবিত্র মুখ থেকে ‘মুগফুর’-এর গন্ধ বের যাচ্ছে। এতে হয়তো রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মধু পান ছেড়ে দিবেন। কারণ, তিনি কোন রকম দুর্গন্ধ পছন্দ করেন না। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মধু পান করে যখন তাঁদের কাছে গেলেন, তাঁরা পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুসারে একই কথা বললেন। দ্রুত ফল হলো। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের জন্য মধু হারাম করে বসলেন। তখন সূরা আযত-তাহরীম-এর ১-৩ নং আয়াত নযিল হয়।

হযরত সাওদার (রা) অন্তরটি ছিল অতি কোমল। আপনজনদের দুঃখ-কষ্ট দেখে তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন। তাঁর প্রথম স্বামী সাকরান ইবন আমরের ভাউ সুহাইল ইবন ‘আমরকে বদরে বন্দী করে মদীনায় আনা হয়। চার হাজার দিরহামের বিনিময়ে তিনি মুক্তিলাভ করেন। এ সম্পর্কে ইবন ইসহাক বলেনঃ বদরের বন্দীদের যখন মদীূনায় আনা হয় তখণ সাওদা ছিলেন ‘আফসরার ছেলে ‘আউফ ও মু‘য়াওজিবের গৃহে। এটা পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার আগে। এমন সময় বদরের বন্দীদের আগমনের কথা ঘোষণা করা হলো। সাওদা বাড়ী ফিরে এস রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘইে পেলেন। হঠাৎ কক্ষের এক কোণে বন্দী আবু ইয়াযীদ সুহাইল ইবন আমরকে দেখতে পেলেন। গলার সাথে তার হাত দুটি রশি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। এ দৃশ্র দেখে তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। বলে উঠলেনঃ আবু ইয়াযীদ! তোমরা এভাবে ধরা দিলে? সম্মানের সাথে মরতে পারলে না? সাওদা বলেনঃ ঘরের মধ্য থেকে রাসূলুল্লাহর (সাল¬াল¬াহু ‘আলাইহি ওয়া সাল-াম) এ কণ্ঠস্বরে আমি সম্বিত ফিরে পাইঃ সাওদা! তুমি কি তাঁকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে বিরুদ্ধে উত্তেজিত করছো? সাওদা বলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি বআবু ইয়াযীদ সুহাইলকে এ অবস্থায় দেখে নিজেকে সামলাতে পারিনি। ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমার জন্য আল্লাহর দরবারে মাগফিরাত কামনা করুন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল¬াম) বললেনঃ আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন।

হিজরী ৮ম সনে যয়নাব বিনত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় ইনতিকাল করেন। তাঁকে গোসল দেন সাওদা, উম্মু আয়মান ও উম্মু সালামা।

হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খায়বারে সাওদার (রা) জীবিকার ব্যবস্থা করে যান। ‘আবদুর রহমান আল-আ‘রাজ মদীনায় বিভিন্ন মজলিসে বলতেনঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাওদাকে ৮০ ওয়াসাক খেজুর ও ২০ ওয়সাক গম বা যবের দ্বারা তাঁর জীবিকার ব্যবস্তা করেন।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি