রাফে’ ইবন মালিক ইবন’ আজলান (রা)
আবু মালিক ও আবু রিফা’য়া ডাকনাম। আসল নাম রাফে’। মদীনার বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের সন্তান। পিতা মালিক ইবন ‘আজলান।
মদীনার আনসার সম্প্রদায় একটি অতি সৌভাগ্যবান গোষ্ঠী বা দল। বিশেষতঃ সত্তর মতান্তওে পচাত্তর জনের একটি দল। তাঁদেও মধ্যে আবার আগে ইসলাম গ্রহণের দিক দিয়ে মর্যাদার তারতম্য আছে। আনসারদেও মধ্যে বনু নাজ্জার ও খাযরাজ গোত্র আগে ভাগে ইসলামের আহবানে সাড়া দানের ক্ষেত্রে প্রায় সমান সমান। তবে এ ব্যাপাওে তাঁদের সকল সম্মান, মর্যাদা ও কৌলিন্য কিন্তু তাঁদেরই দুই ব্যক্তির জন্য। সেই দুই মহান ব্যক্তি হলেন: মু’য়াজ ইবন ‘আফরা’ ও রাফে’ ইবন মালিক ইবন ‘আজলান।
রাসূলে কারীম (সা) মক্কায় ইসলামের দা’ওয়াত দিয়ে চলেছেন। বিশেষতঃ হজ্জ মওসুমে আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত লোকদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে যোগযোগ করে তাদেরকে ইসলামের দা’ওয়াত দিচ্ছেন। মক্কায় রাসূলুল্লাহর (সা) নুবুওয়াতী যিন্দেগীর এমনই এক পর্যায়ে মদীনার খাযরাজ গোত্রের ছয় ব্যক্তি ‘উমরার উদ্দেশ্যে মক্কায় গেলেন। এই ছয় সদস্যের দলটির সাথে মু’য়াজ ও রাফে’ ছিলেন। তাঁদের মক্কায় উপস্থিতির খবর পেয়ে ইসলামের দা’ওয়াত পেশ করলেন। তাঁরা ধীরস্থির ভাবে মনোযোগ সহকারে রাসূলুল্লাহর (সা) বক্তব্য শোনেন। তারপর তাঁদের মধ্য থেকে সর্বপ্রথম মু’য়াজ ও রাফে’ রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে বাই’য়াত (আনুগত্যের শপথ) করে মুসলমান হন।
তাবাকাতে ইবন সা’দা-এ বর্ণিত হয়েছে, সেইবার মদীনা থেকে মু’য়াজ ও রাফে’- কেবল এই দুই জনই গিয়েছিলেন। তাঁরা মক্কায় পৌঁছে রাসূলুল্লাহর (সা) আতœপ্রকাশের কথা শুনতে পেলেন। এক পর্যায়ে তাঁরা রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর কথা শুনলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন। সা’দ ইবন আবদুল হামীদের বর্ণনা অনুযায়ী দুইজনের মধ্যে এই রাফে’ প্রথম রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে বাই’য়াত করেন। তিনি আরো বলেন, খাযরাজ গোত্রের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। বালাজুরী বলেন: রাফে’ আনসারদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী।
ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর মদীনায় ফিরে আসলেন এবং খুব জোরেশোওে ইসলাম প্রচারের কাজে আতœনিয়োগ করলেন। ইবনুল আসীর বলেনঃ
‘যখন তাঁরা মদীনায় ফিওে এসে নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন তখন গোটা আনসার সম্প্রদায়ের মধ্যে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে এমন কোন ঘর ছিল না যেখানে রাসূলুল্লাহর (সা) চর্চা হতো না’। এর পরের বছর রাফে বারো ব্যক্তি এবং তার পরের বছর ৭০/৭৫ ব্যক্তির সাথে পর পর দুই বার মক্কায় যান এবং ঐতিহাসিক বাই’য়াতে আকাবায় অংশগ্রহণ কওে রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে বাই’য়াতে করেন। সর্বশেষ বাই’য়াতের সময় তিনি বনু যুরাইক- এর ‘নাকীব’ বা দায়িত্বশীল মনোনীত হন।
একটি বর্ণনায় এসেছে, মদীনায় কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করার পর তাঁরা সর্বসম্মতভাবে মু’য়াজ ও রাফে’কে মক্কায় পাঠান। উদ্দেশ্য, তাঁরা রাসূলুল্লাহকে (সা) অনুরোধ করবেন, তিনি যেমন মদীনায় একজন প্রচারক পাঠান, যিনি মদীনায় আল কুরআন শিক্ষা দেবেন। তাঁদেও আবেদনে সাড়া দিয়ে রাসূল (সা) মুস’য়াব ইবন ‘উমাইরকে মদীনায় পাঠান।
রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় হিজরত করে আসার পর সা’ঈদ ইবন যায়িদ ইবন ‘আমর ইবন নুফাইলের সাথে রাফে’র দ্বীনী ভ্রাতৃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা কওে দেন।
রাফে’র ইসলামী জীবনের সময়কাল খুবই স্বল্প। এ স্বল্পসময়ে মাত্র দুইটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়-বদও ও উহুদ। বদওে তাঁর যোগদানের ব্যাপারে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতপার্থক্য আছে। ইবন ইসহাক তাঁকে বদরী সাহাবীদেও মধ্যে গণ্য করেননি। মূসা ইবন ‘উকবা ইমাম ইবন শিহাব আয-যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাফে’ বদরে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ বিষয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য হলো খোদ রাফে’র মন্তব্য যা ইমাম বুখারী সংকলন করেছেন। রাফে’ বলেছেন: ‘এতে আমি খুশী নই যে, আকাবার পরিবর্তে বদরে অংশগ্রহণ করি।’ যদিও তিনি এ মন্তব্য দ্বারা তাঁর বদরের চেয়ে ‘আকাবা’র অধিক গুরত্বের কথা বুঝাতে চেয়েছেন, তবে এ দ্বারা তাঁর বদরে যোগদান না করার কথাও বুঝা যায়। ঐতিহাসিক বালাজুরী বলেন: রাসূল (সা) যখন মদীনা থেকে বদরের দিকে যাত্রা করেন তখন মদীনার অনেকের মত রাফে’ও মনে করেন, রাসূল (সা) কোন যুদ্ধে যাচ্ছেন না। আর এ কারণেই তাঁরা রাসূলুল্লাহর (সা) সঙ্গী হননি।
রাফে’ (রা) হিজরী তৃতীয় সনের উহুদ যুদ্ধে অংশ্রগ্রহণ করেছিলেন। ইসলামী যিন্দেগীর এটাই তাঁর প্রথম ও শেষ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
রাফে’ (রা) ইসলামী জীবনের সংক্ষিপ্ত সময়ে বিভিন্ন প্রকার দ্বীনী সেবা প্রদান করেন। তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান মুবাল্লিগ (প্রচারক)। সেই প্রথম পর্যায়ে মদীনায় ইসলামের প্রচার-প্রসারে তাঁর বিরাট অবদান আছে। ইসলাম গ্রহণের পর গোটা মদীনায় কিভাবে ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটানো যায়- এটাই ছিল তাঁর একমাত্র চিন্তা ও ফিকর। তাই তিনি প্রতিবছর ছুটে গেছেন মদীনা থেকে মক্কায় এবঙ গোপনে ‘আকাবায় রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে মিলিত হয়েছেন এবং জরুরী হিদায়াত ও নির্দেশ নিয়ে মদীনায় ফিরে এসছেন। আকাবার সর্বশেষ বাই’য়াতের সময় রাসূলুল্লাহ (সা) কর্তৃক নির্বাচিত দ্বাদশ নাকীবের অন্যতম নাকীব হিসাবে অর্পিত মহাদায়িত্ব সার্থকভাবে পালন করেছেন।
বর্ণিত আছে রাফে’ সবার আগে সূরা ইউসূফ মদীনায় নিয়ে আসেন। মদীনার সকল মসজিদেও পূর্বে মসজিদে বানু যুরাইকে সর্বপ্রথম কুরআন পঠিত হয়েছিল। আর সে পাঠক ছিলেন তিনি। মক্কায় রাসূরুল্লাহর (সা) হাতে বাই’য়াতের সময় যতটুকু আল কুরআন তাঁর ওপর নাযিল হয়েছিল, তিনি তা লিখে সাথে করে মদীনায় নিয়ে এসেছিলেন এবং নিজ খান্দানের সকলকে সমবেত কওে তা পাঠ কওে শুনিয়েছিলেন।
এমন একটি বর্ণনাও আছে যে, তিনি ইসলাম গ্রহণের পর মক্কায় থেকে যান। সূরা ত্বাহা নাযিল হওয়ার পর তা লিখে মদীনায় নিয়ে আসেন। মোটকথা, এমনি ধরনের আরো বহু সেবা তিনি দান করেন।
হাকেম তাঁর আল-মুসতাদরিক গ্রন্থে রাফে’ ইবন মালিকের একটি হাদীস সংকলন করেছেন। হাদীসটির বর্ণনাকারী তাঁর পৌত্র মু’য়াজ ইবন রিফা’য়া ইবন রাফে’।
তথ্যসূত্র:

যায়িদ ইবনে দাসিনা (রা)
হযরত যায়িদের (রা) পিতার নাম দাসিনা ইবনে মু’য়াবিয়া। মদীনার খাযরাজ গোত্রের ‘বনু বায়্যাদা’ শাখার সন্তান। তিনি যে কখন ইসলাম গ্রহণ করেন সে সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে তাঁর জীবনের অন্যান্য ঘটনাবলী দ্বারা বুঝা যায়, মদীনায় ইসলামী দা’ওয়াতের সূচনা পর্বেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। কারণ, তিনি বদর ও উহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে অংশগ্রহণ করেন ইসলামের গ্রহণের পর বেশী দিন এ পার্থিব জীব ভোগ করার সুযোগ পাননি। রাসূলুল্লাহর (সা) নির্দেশে দ্বীনের দা’ওয়াত ও তাবলীগের কাজ করতে গিয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন।
উহুদ যুদ্ধেও পওে, ইবনে ইসহাকের বর্ণনা মতে, আদাল ও করা গোত্রের কিছু লোক রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে আবেদন জানায়, কুরআন ও শরীয়াতের তা’লীম ও তারবিয়াত দিতে পারে এমন কিছু লোক আমাদের ওখানে পাঠান সেখানে ইসলামের প্রসার ঘটেছে। তাদের এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হযরত রাসূলে কারীম (সা), খুবাইব ইবনে আদী ও যায়িদ ইবনে দাসিনাসহ মোট ছয়জনকে সেখানে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তাঁরা মদীনা থেকে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে তাঁরা হুজাইল গোত্রের আর-রাজী’ নামক জলাশয়ের পাশে মুশরিকদের (পৌত্তলিক) দ্বারা আক্রান্ত হন। হযরত খুবাইব ও যায়িদ (রা) তাদেও হাতে বন্দী এবং অন্যরা শহীদ হন। তাঁদেও দু’জনকে হাত বেঁধে মক্কায় নিয়ে যায় এবং হুজাইল গোত্রের দু’বন্দীর বিনিময়ে তাদেরকে কুরাইশদের নিকট অর্পণ করে। সাফওয়ান ইবন উমাইয়্যা মুসলমানদের হাতে নিহত তার পিতা উমাইয়্যা ইবন খালাফের হত্যার বদলা নেওয়ার জন্য যায়িদ ইবন দাসিনাকে গ্রহণ করে পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারবে ভেবে সে দারুণ পুলকিত হয়ে ওঠে।
মক্কার পৌত্তলিকরা অনেক চিন্তা-ভাবনা ও পরামর্শেও পর সিদ্ধান্ত নিল যে, যায়িদকে ‘তানঈম’ নামক স্থানে হত্যা করা হবে। সাফওয়ানের ছিল ‘নিস্তাস’ নামে একটি দাস। সাফওয়ান তাঁদের দু’জনকে বধ্য-ভূমিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে নির্দেশ দিল। সেখানে পৌঁছার পর তাঁরা এক আজব পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। আবু সুফইয়ান যায়িদকে (রা) লক্ষ্য করে বললেন: যায়িদ, তোমাকে আল্লাহর নামে কসম করে বলছি। তুমি সত্য কথা বলবে। যদি তোমার স্থলে মুহাম্মদকে আনা হয়, তাঁকে হত্যা করা হয়, আর তুমি তোমার ঘওে নিরাপদে ফিওে যাও-তুমি কি তা পসন্দ করবে? যায়িদ (রা) ধীর-স্থিও ভাবে জবাব দিলেন: মুহাম্মদেও গায়ে কাঁটার একটি আঁচড় লাগুক আর আমি আমার পরিবারের লোকদের মধ্যে নিরাপদে অবস্থান করি- এ আমার মোটেই পছন্দ নয়।
আবু সুফইয়ান তার এ জবাব শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। অবলীলাক্রমে তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে গেল- মুহাম্মদের সঙ্গী-সাথীরা তাকে যে পরিমাণ ভালবাসে, দুনিয়ার কারো কোন বন্ধু তাকে এতখানি ভালোবাসেনা। এরপর তাদের নির্দেশ নিসতাস তাঁকে হত্যা করে। এটা হিযরী তৃতীয় মতান্তওে চতুর্থ সনের একটি মর্মান্তিক ঘটনা। কোন কোন বর্ণনায় ‘বীওে মাউনার’ ঘটনায় হযরত যায়িদ (রা) বন্দী ও শহীদ হন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে ‘গাযওয়াতুর রাজী ও বীওে মাউনা’- অধ্যায়ে ইবন ইসহাকের সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, এটা উহুদের পরের ঘটনা। তাঁর বর্ণনায় আরো বুঝা যায়, ‘আর-রাজী ও বীরে মাউনা দু’টি সম্পূর্ণ পৃথক ঘটনা। আর আর-রাজী’র ঘটনায় খুবাইবের সাথে যায়িদ মক্কায় নিহত হন।
মূসা ইবন ‘উকরা তাঁর মাগাযীতে বর্ণনা করেছেন, খুবাইব ও যায়িদকে একই দিনে হত্যা করা হয়। আর সেদিন মদীনায় রাসূলকে (সা) বলতে শুনা যায় “ওয়া আলাইকুমা আও ওয়া আলাইকাস্ সালামু।”
‘উরওয়া ও মূসা ইবন ‘উকবা বলেনঃ কুরাইশরা যায়িদকে ফাঁসিতে ঝুলানোর পূর্বে তার দেহ তীওে মেওে ঝাঝরা করে তাঁর ঈমানের দৃঢ়তা পরীক্ষা করে। কিন্তু এতে তাঁর ঈমান ও আতœসমর্পণের ইচ্ছার বৃদ্ধিই ঘটে।
ইবন ইসহাক ইবন ‘আব্বাসের (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন। ‘আর-রাজী’র’ নায়করা এমন অসহায়ভাবে নিহত হলে মদীনার মুনাফিকরা বলতে লাগলোঃ এই হতভাগাদের জন্য দুঃখ হয়, যারা এমন অসহায়ভাবে শেষ হয়ে গেল। তারা না তাদের পরিবার-পরিজনদেও মধ্যে থাকলো, আর না তারা তাদেও বন্ধুর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারলো। তখন আল্লাহ তায়ালা সূরা আল-বাকারার ২০৪ নং আয়াতটি নাযিল করেনঃ “-আর এমন কিছু লোক রয়েছে যাদের পার্থিব জীবনের কথাবার্তা তোমাকে চমৎকৃত করবে। আর তারা সাক্ষ্যস্থাপন করে আল্লাহকে নিজের মনের কথার ব্যাপারে। প্রকৃত পক্ষে তারা কঠিন ঝগড়াটে লোক।”
‘আর-রাজী’র শহীদদেও সম্পর্কে আল্লাহ পাক সূরা আল-বাকারার ২০৭ নং আয়াতটি নাযিল করেনঃ
“-আর মানুষের মধ্যে এক শ্রেণীর লোক রয়েছে, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিকল্পে নিজেদেও জানের বাজি রাখে। আল্লাহ হলেন তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত মেহেরবান।”
তথ্যসূত্র:

কায়স ইবন সা’দ ইবন’ উবাদা (রা)
হযরত কায়সের (রা) একাধিক ডাকনাম ইতিহাসে পাওয়া যায়। যেমনঃ ‘আবুল ফাদল, আবু ‘আবদিল্লাহ ও আবু আবদিল মালিক। ইবন হিব্বান ‘আবুল কাসেম নামটি উল্লেখ করেছেন। মদীনার বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের সায়িদা শাখার সম্মানিত সদস্য। একজন আনসারী সাহাবী খাযরাজ গোত্রের বিখ্যাত নেতা ও বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সা’দ ইবন উবাদা তাঁর পিতা এবং ফুকাইহা বিনতু ‘উবাইদ ইবন দুলাইম মাতা। পিতা-মাতা ছিলেন পরস্পর চাচাতো ভাই-বোন। তাঁর পূর্ব পুরুষের লোকেরা ছিলেন মদীনার বিখ্যাত জনসেবক ও শ্রেষ্ঠ নেতা। রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় হিযরতের পূর্বে হযরত কায়স ইসলাম গ্রহণ করেন।
রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে সকল যুদ্ধ ও অভিযানে হযরত কায়স অংশ গ্রহণ করেন। ইমাম যুহরী বলেন, তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) পতাকাবাহীদের অন্যতম। হিজরী ৮ম সনের ‘জায়শুল খাবাত’ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। যুদ্ধটি ছিল মুসলমানদের জন্য একটি বিরাট পরীক্ষা। ৩০০ (তিনশো) সদস্যের এক বাহিনী নিয়ে, যার মধ্যে হযরত আবু বকর ও ‘উমারও ছিলেন- আবু ‘উবায়দা উবনুল জাররাহ সমুদ্র উপকূলের দিকে অগ্রসর হন। সেখানে ১৫ (পনেরো) দিন অবস্থান করেন। সংগে নেওয়া খাদ্য-খাবার ফুরিয়ে যায়। গোটা বাহিনী প্রচন্ড খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হন। সৈনিকরা ক্ষুধার জ্বালায় গাছের ঝরা পাতা খেতে থাকেন। ‘খাবাত’ অর্থ ঝরা পাতা। যেহেতু এ বাহিনীরা সৈনিকেরা গাছের পাতা খেয়েছিলেন, একারণে এই বাহিনী ‘জায়শুল খাবাত’ বা ঝরা পাতার বাহিনী নামে ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করে। হযরত কায়স এ দুঃসময়ে তিনটি করে উট ধার নিয়ে জবেহ করেন। তিনবার মোট নয়টি উট ধার নিয়ে জবেহ করে গোটা বাহিনীর বেঁচে থাকার মত খাবারের ব্যবস্থা করেন। অতিরিক্ত ধার দেনা হয়ে যাচ্ছে দেশে অধিনায়ক আবু ‘উবায়দাহ (রা) তাঁকে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেন। একটি বর্ণনায় এসেছে, ‘জায়শুল খাবাত’ যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে হযরত আবু বকর ও হযরত ‘উমার (রা) তাঁর এমন বেপরোয়া উট জবেহ করা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলেন, যদি এ যুবককে বিরত না রাখা হয় তাহলে সে তার পিতার সকল সম্পদ নিঃশেষ করে ফেলবে। তারপর তাঁরা দু’জন বাহিনীর অন্য সদস্যদের বুঝিয়ে নিেেজদের স্বপক্ষে এনে কায়সকে উট জবেহ থেকে নিবৃত করেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে লোকেরা তাঁর এ আচরণের কথা রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট উল্লেখ করলে তিনি বললেন: দানশীলতা অবশ্যই এ বাড়ীর এক বৈশিষ্ট্য।
মক্কা বিজয় অভিযানে তিনি হযরত রাসূলে কারীমের (সা) সফরসঙ্গী ছিলেন। মক্কায় প্রবেশকালে আনসারদের ঝান্ডা প্রথমতঃ সা’দ ইবন উবাদার হাতে ছিল। এক পর্যায়ে রাসূল (সা) সেটি তার হাত নিয়ে কায়সের হাতে তুলে দেন। বিভিন্ন যুদ্ধে ঝান্ডা বহনকারী ছাড়াও রাসূলুল্লাহর (সা) জীবদ্দশাতে খিলাফতের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। এ সময় শাসন-শৃংখলার দায়িত্ব যে সকল ব্যক্তির উপর ন্যস্ত হয়, কায়স তাদের মধ্যে অন্যতম।
হযরত আনাস ইবন মালিক (রা) বলেনঃ রাসূলুল্লাহর (সা) দরবারে কায়সের মর্যাদা ছিল কোন আমীরের দরবারে পুলিশের একজন সর্বাধিনায়কের মর্যাদার মত।
হয়রত আলীর দরবারেও তাঁর বিশেষ মর্যাদা ছিল। ইবন ইউনুস বলেনঃ তিনি মিসর বিজয়ে অংশ গ্রহণ করেন এবং সেখানে বাড়ী তৈরী করেন। তারপর আলী (রা) তাঁকে মিসরের আমীর নিয়োগ করেন। হযরত মুয়াবিয়া (রা) নানাভাবে বিরুদ্ধাচরণ করেও মিসরে কোন রকম হাঙ্গামা ও অশান্তি সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হন। অবশেষে কুফাবাসীদের ক্ষেপিয়ে তুলে আলী (রা) দ্বারা তাঁকে বরখাস্ত করাতে সক্ষম হন। তাঁর স্থলে আলী (রা) মুহাম্মদ ইবন আবী বকরকে ওয়ালী নিয়োগ করেন। এ সম্পর্কে ইবন সীরীন বলেনঃ আলী (রা) কায়স ইবন সা’দকে হিজরী ৩৬ সনে মিসরের ওয়ালী নিয়োগ করেন এবং হিজরী ৩৭ সনে বরখাস্ত করেন। কারণ, আলীর (রা) বন্ধুরা তাঁকে এ কথা বুঝায় যে, কায়স মুয়াবিয়ার (রা) সাথে গোপন আঁতাত করেছে। যখন তাঁকে অপসারণ করে তার স্থলে মুহাম্মদ ইবন আবী বকরকে নিয়োগ করা হয় তখন তিনি বুঝতে পারেন যে, আলীকে (রা) বিভ্রান্ত করা হয়েছে। এরপরেও আলীর (রা) সাথে তাঁর সদ্ভাব বজায় থাকে এবং সকল ব্যাপারে আলী (রা) তাঁর সাথে পরামর্শ করতেন। মিসর শাসন করা মুহাম্মদ ইবন আবী বকরের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাঁর বিরুদ্ধে পরিচালিত আমীর মু’য়াবিয়া (রা) ও আমর ইবনুল ‘আসের (রা) কর্ম-কৌশল অশান্তির এক প্রবাহ সৃষ্টি করে। পরবর্তীকালে যা খিলাফতের বন্ধনকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়।
হযরত কায়স (রা) মিসর থেকে সোজা মদীনায় চলে আসেন। মারওয়ান তখন মদীনায়। তিনি কায়সকে ভয় দেখালে তিনি মদীনা ছেড়ে কুফায় চলে যান এবং সেখানে হযরত আলীর (রা) সাথে বসবাস করতে থাকেন।
আলীর (রা) সাথে সকল যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। সিফ্ফীন যুদ্ধের দিনগুলিতে তিনি আলীর (রা) বাহিনীর পুরোভাগে ছিলেন। এ যুদ্ধের দিনগুলিতে তিনি একটি কবিতা আবৃত্তি করতেন। তার দু’টি পংক্তি নিম্নরূপঃ
সেই ঝান্ডা যা আমরা নবীর সাথে বহন করেছি।
তখন জিব্রাইল ছিলেন আমাদের সাহায্যকারী।
আমরা সেই জাতি, যখন তারা যুদ্ধ করে
তখন দেশ বিজয় না হওয়া পর্যন্ত
তাদের তরবারি ধরা হাতটি প্রলম্বিত হতে থাকে।
এর পূর্বে তিনি উটের যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। নাহরাওয়ানের যুদ্ধে তিনি নিজের গোত্রের সকল লোকের সাথে যোগদান করেন। এ যুদ্ধের শুরুতে হযরত আলী (রা) নিয়ম অনুযায়ী প্রতিপক্ষকে শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতি আহবান জানানোর জন্য আবু আইউব আল-আনসারী ও কায়সকে (রা) খারেজী সম্প্রদায়ের নিকট পাঠান। আবদুল্লাহ ইবন সানজার খারেজীর সাথে তাঁদের আলোচনা হয়। তিনি বলেন, আলীর আনুগত্য ও অনুসরণ আমাদের মনপূত নয়। ‘উমার ইবনুল খাত্তারের (রা) মত কেউ হলে আমরা তাঁকে খলীফা বলে মানতে রাজী হতাম। জবাবে কায়স (রা) বললেন, আমাদের মধ্যে আলী ইবন আবী তালিব (রা) আছেন। আপনাদের মধ্যে তাঁর সমকক্ষ কেউ থাকলে তাঁর নাম পেশ করুন। তিনি বললেন, না, আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই। কায়স বললেন, তাহলে আপনাদের সতর্ক হওয়া উচিত। অশান্তি ও বিশৃংখলা আপনাদের অন্তরে শিকড় গেড়ে বসেছে।
হযরত কায়স (রা) সর্ব অবস্থায় আলীর (রা) একজন বিশ্বাসভাজন বন্ধু ছিলেন। হিঃ ৪০ সনে আলী (রা) শাহাদাত বরণ করেন। খিলাফতের দায়িত্ব ইমামন হাসানের (রা) ওপর অর্পিত হয়। হযরত কায়স (রা) ইমাম হাসানকে সমর্থন জানান। এদিকে আলীর (রা) শাহাদাতের খবর পেয়ে হযরত মু’য়াবিয়ার (রা) এক বাহিনী পাঠান। হযরত কায়স (রা) পাঁচ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী, যাঁদের প্রত্যেকের মাথা ছিল মুড়ানো এবং যাঁরা মৃত্যুর জন্য শপথ করেছিল- নিয়ে মু’য়াবিয়ার (রা) সিরীয় সৈন্যদের প্রতিরোধ করার জন্য ‘আনবার’ পৌছেন। আমীর মু’য়াবিয়ার বাহিনী ‘আনবার’ অবরোধ করেন। এর মধ্যে ইমাম হাসান (রা) ও মু’য়াবিয়ার মধ্যে সন্ধি হয়ে যায়। ইমাম হাসান (রা) ‘আনবার’ শহরটি মু’য়াবিয়া (রা) বাহিনীর হাতে অর্পণ করে মাদায়েনে তাঁর কাছে চলে যাওয়ার জন্য কায়সকে (রা) লেখেন।
ইমামের চিঠি পেয়ে হযরত কায়স দারুণ ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি তাঁর বাহিনীর সকল সদস্যকে একত্র করে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেনঃ তোমরা কী চাও? তোমাদের ইচ্ছা হলে আমি তোমাদেরকে সাথে নিয়ে আমরণ লড়বো। আর তোমরা যদি চাও তাহলে আমি আমীর মু’য়াবিয়ার নিকট থেকে তোমাদের জন্য আমান বা নিরাপত্তার অঙ্গীকার নিতে পারি। সৈনিকেরা বললো, আপনি আমাদের জন্য নিরপত্তার অঙ্গীকার নিন। তিনি তাই করেন এবং সহযোদ্ধাদের নিয়ে মাদায়েন চলে যান।
মাদায়েন থেকে হযরত কায়স (রা) মদীনার দিকে যাত্রা করেন। পথে মদীনা পৌছা পর্যন্ত প্রতিদিন সঙ্গীদের জন্য একটি করে নিজের উট জবেহ করতেন। মদীনায় এসে তিনি সম্পূর্ণ নির্জন বাস অবলম্ন করেন এবং আমরণ এক্যগ্রচিত্তে আল্লাহর জিকর ও ইবাদাতে মশগুল থাকেন।
খলীফা ইবন খাইয়্যাত, ওয়াকিদী ও আরো অনেকের মতে হযরত কায়স হিজরী ৬০ সনে হযরত মু’য়াবিয়ার (রা) ফিলাফতকালের শেষ দিকে মদীনায় ইনতিকাল করেন। ইবন হিব্বানের মতে তিনি মু’য়াবিয়ার ভয়ে মদীনা থেকে সরে অন্যত্র পালিয়ে থাকেন এবং হিজরী ৮৫ সনে খলীফা আবদুল মালিকের সময় মারা যান। ইবন হাজার আসকালানীর মতে প্রথমোক্ত মতটি সর্বাধিক সঠিক।
মৃত্যুর পূর্বে কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। মদীনার বহু অধিবাসী তাঁর কাছে আর্থিকভাবে ঋণী ছিল। এ কারণে ঋণগ্রস্থরা তাঁকে দেখতে আসতে লজ্জিত হচ্ছিলো। একথা বুঝতে পেরে তিনি ঘোষণা দেন, আমি আমার সকল পাওনা মাফ করে দিলাম। এ ঘোষণা ছড়িয়ে পড়তেই তাঁকে এক নজর দেখার জন্য জনতার মিছিল শুরু হয়ে যায়। লোকের প্রচন্ড ভিড়ে তার বাড়ীর সিঁড়িটি এক সময় ভেঙে পড়ে।
হযরত কায়সের (রা) এক ছেলের নাম ছিল ‘আমের। তিনি পিতা কায়সের সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেছেন। হযরত কায়স ছিলেন স্থুলকায় ও দীর্ঘ দেহী। ‘আমর ইবন দীনার বলেন: তাঁর ছিল বিশাল একটি দেহ ও ছোট্ট একটি মাথা। এত লম্বা ছিলেন যে, গাধার পিঠে সাওয়ার হলে পা মাটিতে গিযে ঠেকতে। মুখে তাঁর কখনও দাড়ি গজায়নি। আনসাররা রসিকতা করে বলতো, নিজেদের পয়সায় আমরা কায়সের জন্য কিছু পশম কিনতে চাই।
তিনি ছিলেন ‘আলিম সাহাবীদের অন্যতম। তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীদের প্রচার ও প্রসার। জীবনের কোন পর্যায়ে তিনি এ লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি। মিসরের আমীর থাকা কালেও সেখানের মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে হাদীস বর্ণনা করতেন। হাদীদের গ্রন্থসমূহে তাঁর পিতা সা’দ ইবন ‘উবাদা, ‘আবদুল্লাহ ইবন হানজালা প্রমুখ থেকে বর্ণনা করছেন। এই শেষোক্ত ব্যক্তি ছিলেন বয়সে কায়সের চেয়ে ছোট। তিনি মোট ১৬ (ষোল) টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। একথা বলেছেন ‘আল্লামা যিরিক্লী।
হযরত কায়সের নিকট থেকে বহু লোক হাদীস শুনেছেন এবং তাঁর সনদে হাদীস বর্ণনাও করেছেন। এখানে তাঁর বিখ্যাত কয়েকজন ছাত্রের নাম উল্লেখ করা হলোঃ আনাস ইবন মালিক, সা’লাবা ইবন আবী মালিক, আবু মায়সারা, ‘আবদুর রহমান ইবন আবীলায়লা, আবু ‘আম্মার আজ-জাহাবী, গুরাইব ইবন হুমাইদ হামাদানী, আশ-শা’বী, ‘আমর ইবন শুরাহবীল, ‘উরওয়া ইবন যুবাইর, মায়মূন ইবন আবী শায়ব, মুহাম্মদ ইবন আবদির রহমান ও আবু তামীম আল-জায্শানী।
হযরত কায়স ছিলেন একজন বড় মাপের চিন্তাশীল মানুষ। কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে গেলে অনেক ভবে-চিন্তে দিতেন। ইসলামের বিধি-বিধানের ব্যাপারেও তাঁর মধ্যে ছিল একটা পরিচ্ছন্ন মুক্ত চিন্তার ছাপ। যেমন একবার এক ব্যক্তি তাঁকে সাদাকাযে ফিতরার ব্যাপারে প্রশ্ন বসলো। তিনি বললেন, যাকাতের হুমুমের পূর্বে রাসূল (সা) সাদাকায়ে ফিতরের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু যাকাত ফরজ হওয়ার পর সাদাকায়ে ফিতরের নির্দেশও দেননি, আবার নিষেধও করেননি। পূর্ববর্তী নির্দেশের ভিত্তিতেই আমরা এখনও আদায করছি। হযরত রাসূলে কারীমের (সা) আখলাক ও স্বভাব বৈশিষ্ট্যের দারুণ প্রভাব পড়েছিল তাঁর ওপর। রাসূলুল্লাহর (সা) খিদমাত, পার্থিব ভোগ-বিলঅসিতার প্রতি অনীহা, তাকওয়া, দানশীলতা, চিন্তা ও অনুধ্যান, বীরত্ব ও সাহসিকতা, উদারতা, সকলকে সমানভাবে ভালোবাসা ইত্যাদি ছিল তাঁর চরিত্রের বিশেষ মাধুর্য।
হযরত রাসূলে কারীমের (সা) খিদমাত ও সুযোগ পাওয়া ছিল দ্বনি ও দুনিয়ার সৌভাগ্য। সকল সাহাবী এই সৌভাগ্য অর্জনের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা ও সাধনা করতেন। হযরত কায়সও (রা) এ গৌরব ও সৌভাগ্যের একজন অধিকারী। মুসনাদে ইমাম আহমাদে এসেছেঃ
“তাঁর পিতা তাঁকে রাসূলুল্লাহর (সা) সেবায় নিয়োগ করেন। ইমাম বুখারী তাঁর তারীখে মারয়াম ইবন আ’সয়াদের সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি কায়স ইবন সা’দকে দেখেছি। তিনি দশ বছর রাসূলুল্লাহর (সা) খিদমাত করেছেন।
হযরত রাসূলে কারীমের (সা) প্রতি ছিল তাঁর অপরিমিত ভক্তি ও শ্রদ্ধ। একদিন রাসূল (সা) গেলেন সা’দ ইবন ‘উবাদার গৃহে। ফেরার সময় হলে সা’দ নিজের একটি গাধা আনালেন এবং পিঠে একটি চাঁদর বিছালেন। রাসূল (সা) গাধার ওপরে, আর কায়স তার পাশে হাঁটতে শুরু করলেন। রাসূল (সা) তাঁকে পিছনে উঠে বসতে বললেন। কিন্তু তিনি ইতস্তত ভাব প্রকাশ করলেন। তখন রাসূল (সা) বললেন: হয় আমার বাহনের পিঠে উঠে বস, নয়তো ফিরে যাও। রাসূলুল্লাহর (সা) পাশাপাশি বসা আদবের খিলাফ মনে করলেন। তাই ফিরে গেলেন।
উদারতা ও দানশীলতা ছিল তাঁর চরিত্রে এক উজ্জ্বল দিক। আসমাউর রিজাল শাস্ত্রকারগণ তাঁর চিত্তের প্রসস্ততার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। ইবনুল আসীর বলেনঃ
“তিনি ছিলেন অন্যতম জ্ঞানী ও মর্যাদাবান সাহাবী এবং আরবের অন্যতম চালাক ও দানশীল ব্যক্তি।” এ উদারতা ও দানশীলতা ছিল একান্তই তাঁর স্বভাবগত। কিন্তু এ স্বভাব গঠনে দেশের পরিবেশ-প্রকৃতি, মাতা-পিতা ও খান্দানের স্বভাব বৈশিষ্ট্যের যে বড় প্রভাব ছিল তা অনস্বীকার্য।’ জায়শুল খাবাত’ যুদ্ধ থেকে মদীনায় ফিরে পিতার কাছে যখন সৈনিকদের অনাহার ও খাদ্যাভাবের কথা বর্ণনা করছিলেন তখন পিতা তাঁকে বললেন, তুমি উট জবেহ করে আহার করাতে পারতে। তিনি বললেন, আমি তো তাই করছি। দ্বিতীয় পর্যায়ের খাদ্যভাবের কথা বর্ণনা করলে পিতা একই কথা বলেন এবং পুত্রও একই উত্তর দিলেন। এভাবে তৃতীয় পর্যায়ের অনাহারের কথা বর্ণনা করা হলে পিতা তাঁকে একই কথা বললেন। তখন তিনি অভিযোগের সুরে বললেন, আমি তো তাই করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে বিরত রাখা হয়েছে। জাবির থেকে বর্ণিত হয়েছে, এ যুদ্ধে তিনি মোট নয়টি উট জবেহ করেছিলেন। এই ‘জায়শুল খাবাত’ যুদ্ধে হযরত আবুবকর ও হযরত ‘উমার (রা) কায়সের (রা) উট জবেহ সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন তা সা’দ ইবন ‘উবাদার (রা) কানে পৌঁছুলে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে ছুটে যান এবং তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে বলেন, ইবন আবু কুহাফা ও ইবন খাত্তাব (আবু বকর ও উ’মার) কেন আমার ছেলেকে কৃপণ বানাতে চেয়েছে- একথার জবাব আপনি দিন।
যে পিতা এমন দরিয়া দিল, তাঁর পুত্র কেমন দানশীল হতে পারেন তা সহজেই অনুমান করা যায়। উসুদুল গাবা গ্রন্থাকর বলেন: তাঁর দানশীলতা সম্পর্কে বহু কাহিনী প্রচলিত আছে। দীর্ঘ হয়ে যাবে তাই উল্লেখ করলাম না। রাসুল (সা) বলেছেনঃ দাশীলতা এ বাড়ীর এক বৈশিষ্ট্য। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা) সম্পর্কে বলেছেনঃ সে দানশীল পরিবারের সন্তান।
দারুকুতনী ইয়াহইয়া ইবন আবদিল আযীয হতে বর্ণনা করেছেন। সা’দ ইবন’ উবাদা ও তাঁর ছেলে কায়স এক বছর এক বছর করে পালাক্রমে যুদ্ধে যেতেন। একবার সা’দ যুদ্ধে গেলেন, কায়স থাকলেন বাড়ীতে। সা’দ যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে খরব পেলেন, মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট বহু অতিথি এসেছে। তিনি সাথীদের বললেন: কায়স যদি আমার ছেলে হয় তাহলে সে আমার খাদিম ‘নিসতাস’ কে বলবে: তোমার পিতার অনুমতিপত্র দেখাও। কায়স তখন তার নাকে ঘুষি মেরে চাবি ছিনিয়ে নেবে এবং রাসুলুল্লাহর (সা) প্রয়োজন মত জিনিস বের করে নেবে। বর্ণনাকারী বলেন, বাস্তবেই এমনটি ঘটেছিল। সেবার কায়স রাসূলুল্লাহর (সা) জন্য এক শো ওয়াসাক খাদ্য নিয়েছিলেন। হযরত কায়সের দানশীলতার আর একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা অসংগত হবে না। কুসাইর ইবন সাল্ত নামে এক ব্যক্তি আমীর মু’য়াবিয়ার (রা) নিকট ঋণী ছিলেন। আমীর মু’য়াবিয়া (রা) মারওয়ানকে লিখলেন, আপনি কুসাইরের বাড়ীটি খরিদ করুন। যদি সে বিক্রী করতে না চায় তাহলে আমার পাওনা টাকার তাগাদা দিন। টাকা দিয়ে দিলে ভালো, অন্যথায় তার বাড়ীটি বিক্রী করে দিন। কুসাইরকে ডেকে মারওয়ান বিষয়টি জানালেন এবং তাকে তিন দিন সময় দিলেন। বাড়ীটি বিক্রীর ইচ্ছা কুসাইরের ছিলনা। তিন টাকা দিয়ে দেওয়ারই চিন্তা করলেন। কিন্তু ত্রিশ হাজার টাকার ঘাটতি দেখা দিল। এ অর্থ কোথা থেকে স্মরণ হলো। তিনি কায়সের বাড়ী গিয়ে ত্রিশ হাজার টাকা ধার চাইলেন। কায়স টাকা ধার দিলেন। কুসাইর টাকা নিয়ে মারওয়ানের নিকট উপস্থিত হলে সব কথা মুনে তাঁর অন্তরে দয়া হলো। তিনি বাড়ী ও টাকা সবই তাঁকে ফেরত দিলেন। কুসাইর সেখান থেকে উঠে কায়সের নিকট গেলেন এবং তাঁকে ত্রিশ হাজার টাকা ফেরত দিলেন। কায়স-যা আমি একবার কাউকে দিই তা আর ফেরত নিইনা- একথা বলে টাকার বান্ডিল গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। একবার এক বৃদ্ধ কায়সের (রা) নিকট এসে তার চরম দারিদ্র ও অভাবের কথা জানিয়ে বললো, এখন আমার ঘরে কোন খাদ্য-খাবার নেই। কায়স বললেন, আপনি বাড়ী ফিরে যান। এখনই আপনার ঘরে শুধু খাবার বস্তু দেখতে পাবেন। অতঃপর তিনি বৃদ্ধার বাড়ীটি তেল, আটা, ঘি, গোশ্ত, খেজুর ইত্যাদি খাদ্য সামগ্রী দিয়ে বরে দেওয়ার নির্দেশ দেন। জুয়াইরিয়া ইবন আসমা বলেন, কায়স তাদেরকে ঋণ দিতেন ও আহার করাতেন।
তাঁর পিতা হযরত সা’দের (রা) ছিল বিপুল বিষয়-সম্পত্তি। সা’দ (রা) সিরিয়া চলে যাওয়ার সময় যাবতীয় সম্পদ ছেলে-মেয়েদের মধ্যেবণ্টন করে যান। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর আর একটি ছেলেন জন্ম হয়। তার জন্য কোন অংশ নির্ধারিত ছিল না। আবু বকর ও ‘উমার (রা) কায়সকে তাঁর পিতার বণ্টন বাতিল করে নতুন করে সকল সম্পদ বণ্টন করার পরামর্শ দিলেন। কায়স বললেন, আমার পিতা যেভাবে বণ্টন করে গেছেন সেভাবেই থাকবে। তবে আমার অংশটি আমি তাকে দিলাম।
হযরত কায়স (রা) আল্লাহর কাছে সম্পদের প্রাচুর্য চাইতেন। তিনি একথা বিশ্বাস করতেন, ভালো কিছু করতে হলে সম্পদের প্রয়োজন হয়। সম্পদ ছাড়া কিছুই হয় না। তাই তিনি প্রায়ই দু’আ করতে: ‘হে আল্লাহ, আমাকে সম্পদ দান করুন। কারণ, সম্পদ ছাড়া কোন কাজ হয় না।
সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও রাজনৈতিক কূট-কৌশলে তিনি ছিলেন তৎকালীন আরবের অন্যতম সেরা ব্যক্তি। ইবন শিহাব বলেন: অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার সময়ে গোটা আরবে কূটচাল ও কৌশল হিসেবে খ্যাত ছিলেন পাঁচ ব্যক্তি। তারা হলেন: মু’য়াবিয়া, ‘আমার ইবনুল ‘আস, কায়স, মুগীরা ও ‘আবদুল্লাহ ইবন বুদাইল। তাঁদের মধ্যে কায়স ও বুদাইল ছিলেন আলীর (রা) সাথে।
তাঁর বুদ্ধি ও চাতুর্য এমন ছিল যে, যতদিন তিনি মিসরের ওয়ালী ছিলেন ততদিন সেখানে আমীর মু’য়াবিয়া ও ‘আমর ইবনুল’ আসের (রা) যাবতীয় ষড়যন্ত্র ও কূটকৈৗশল সফল হতে দেননি। তিনি বলতেন: যদি ইসলাম না আসতো তাহলে আমি এমন ধোঁকাবাজি করতাম যে সমগ্র আরববাসীকে অক্ষম করে ছাড়তাম। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, ‘প্রতারক ও ধোঁকাবাজ দোযখী’- রাসূলুল্লাহর (সা) এ বাণী যদি আমি না শুনতাম তা হলে আমি হতাম এ উম্মাতের সর্বশ্রেষ্ট ধোঁকাবাজ। ইমাম যুহরী বলেছেন, তিনি ছিলেন আরবের শ্রেষ্ট ধূর্ত লোকদের একজন। তাঁর সমকালীন লোকেরা বলেছেন, যুদ্ধ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নির্ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী, অব্যর্থ কৌশল অবলম্বনকারী, সাহসীু বিচক্ষণ যোদ্ধা।
হযরত ‘উসমানের (রা) শাহাদতের সময়কারে খিলাফতের চতুর্দিকে যখন চরম বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি বিরাজমান তখন একদিন হাবীব মাসলামা ঘোড়ায় চলে তাঁর কাছে আসেন এবং তাঁর লক্ষ্য করে বলেন, আপনি এই ঘোড়ার পিঠে চড়–ন। এই বলে তিনি নিজের আসন থেকে একটু সরে তাঁকে সামনে বসার স্থান করে দেন। ‘রাসূল (সা) বলেছেন, বাহনের পিঠে সামনের দিকে মালিকের বসা উচিত- একথা বলে তিনি সামনে বসতে অস্বীকার করেন। বললেন, একথা আমিও জানি। তবে আপনাকে পিছনে বসিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারিনে।
হযরত কায়স (রা) ছিরেন একজন উদার ও নিরপেক্ষ ব্যক্তি। এটা তাঁর জীবনের বিভিন্ন আচরণে ফুটে উঠেছে। একবার কাদেসিয়ায় সাহল ইবন হুনাইফের সাথে বসে আছেন। এমন সময় সামনে দিয়ে একটি লাশ নিয়ে যেতে দেখলেন। মুসলমানদের রীতি অনুযায়ী তক্ষুণি মৃত ব্যক্তির সম্মানে উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। লোকেরা বললো, আপনি অহেতুক দাঁড়িয়ে গেছেন। মৃত ব্যক্তিটি তো একজন জিম্মী। কায়স (রা) বললেন, রাসূলও (সা) এ ইহুদীর লাশ দেখে উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মৃত ব্যক্তিটি একজন ইহুদী- একথা বলা হলে তিনি বলেছিলেন, কোন ক্ষতি নেই। সেও তো একটি প্রাণী।
হযরত কায়স (রা) ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) খাদেম। রাসূল (রা) তাঁকে খুবই আদর ও স্নেহ করতেন। আদর করে তাঁকে অনেক কিছু শিখাতেন। কায়স বলেন, একদিন আমি দু’রাকা’য়াত নামায শেষ করেছি। এমন সময় রাসূল (সা) আমার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় পা দিয়ে আমাকে মৃদু আঘাত করে বললেন: আমি কি তোমাকে জান্নাতের একটি প্রবেশ পথ বলে দেব না? বললাম: জ্বী, বলে দিন। বললেন: “লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লাবিল্লাহ”।
হযরত রাসূলে কারীম (সা) বাহুবার কায়সের পিতা সা’দ ইবন ‘উবাদ (রা) ও তাঁর বংশধরদের জন্য আল্লাহর নিকট দু’আ করেছেন। একবার বলেন: ‘হে আল্লাহ! আপনি সা’দ ইবন ‘উবাদা ও তার পরিবার-পরিজনদের ওপর দয়া ও করুণা বর্ষণ করুন।
হযরত কায়সের (রা) মধ্যে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি এমন রূপ ধারণ করে যে, হযরত হাসানের (রা) খিলাফত থেকে সরে দাঁড়ানোর পর একেবারেই নির্জনবাস অবলম্বন করেন। এরপর বেশীর ভাগ সময় ইবাদাত-বন্দেগীতে অতিবাহিত করেন। তিনি সব সময় ফরজ ইবাদাত সমূহ যথাযথভাবে আদায় করতেন। ‘আশূরা দিনের রোযা নফল। রমজানের রোযা ফরজ হওয়ার পূর্বে সকল সাহাবী ও রোযা রাখতেন। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর এর কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। তা সত্ত্বেও হযরত কায়স সব সময় আশূরার রোযা রাখতেন।
হযরত কায়স (রা) ছিলেন হযরত আলীর (রা) সমর্থক। আলী (রা) এবং তাঁর পরে হাসানকে (রা) তিনি খিলাফতের ব্যাপারে সত্যপন্থী মনে করতেন। তাই হাসান যখন মু’য়াবিয়ার (রা) সাথে চুক্তি করে খিলাফত থেকে সরে দাঁড়ান তখন তিনি দারুণ মনঃক্ষুণœ হন। এরপর তিনি রাজনীতির ময়দান থেকে সরে গিয়ে নির্জনবাস অবলম্বন করেন। তা সত্ত্বেও তিনি মু’য়াবিয়ার (রা) খিলাফতকে মনে প্রাণে মেনে নিয়েছেন বলে মনে হয় না। তাঁর বিভিন্ন কথা ও কাজ একথা প্রমাণ করে। এখানে একটি মাত্র ঘটনা উল্লেখ করছি যা বিভিন্ন প্রামান্য গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।
একবার রোমন সম্রাট আমীর মু’য়াবিয়াকে আরব দেশের দীর্ঘতম ব্যক্তির একটি পায়জামা পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে দূত পাঠান। মু’য়াবিয়া (রা) কায়সকে (রা) ডাকিয়ে বলেন, আমার শুধু আপনার একটি পায়জামার প্রয়োজন। তিনি সাথে সাথে উঠে এক কোণে নির্জণে গিযে পরনের পায়জামাটা খুলে হাতে করে নিয়ে এসে মু’য়াবিয়ার দিকে ছুড়ে মারেন। মু’য়াবিয়া বলেন আপনি ঘরে ফিরে গিয়েও তো পাঠিয়ে দিতে পারতেন। হযরত কায়স (রা) তখন কবিতায় মু’য়াবিয়ার (রা) কথার জবাব দেন। তাতে তাঁর প্রবল আবেগ, আকুতি ও ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। বিভিন্ন গ্রন্থে সেই কবিতার কয়েকটি চরণ সংকলিত হয়েছে। তার কয়েকটি চরণের অর্থ নিম্নরূপঃ
১.আমি এখনি পায়জামা এ জন্য দিয়েছি যে, লোকে জানুক এটা কায়সের পায়জামা, আর কায়জারের প্রতিনিধিরা সাক্ষী থাকুক।
২.তারা যাতে বলতে না পারে যে, কায়স রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে এবং এ একটি সাধারণ পায়জামা।
৩.আমি তো ইয়ামনী গোত্রের একজন নেতা। আর মানুষ তো দু’প্রকারেরই হয়- নেতা ও অনুসারী।
৪.আমার মত মানুষ তাদের জন্য ভীতিকর। তবে আমার স্বভাব ও চরিত্র মানুষের মধ্যে প্রসারিত।
অতঃপর মু’য়াবিয়া (রা) তাঁর বাহিনীর দীর্ঘতম ব্যক্তিকে বলেন সেটি পরতে। সে পায়জামাটি তার নাকের উপর ধরলে তা মাটিতে গিয়ে পড়ে। ইবনুল আসীর, আবু ‘আমরের বক্তব্যের উদ্বৃতি দিয়ে বলেছেন, মু’য়াবিয়ার দরবারে কায়সের পায়জামা বিষয়ক যে ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে তার কোন ভিত্তি নেই।
তথ্যসূত্র:
‘আবদুল্লাহ ইবন’ আমর ইবন হারাম (রা)
নাম আবু জাবির আবদুল্লাহ। পিতা ‘আমর ইবন হারাম এবং মাতা আর-রাবাব নিতু কায়স। মদীনার খাযরাজ গোত্রের বনু সুলামা শাখার সন্তন।১ রাসূলুল্লাহর (সা) বহু হাদীস বর্ণনাকারী প্রখ্যাত সাহাবী হযরত জাবিরের (রা) গার্বিত পিতা। বনু সুলামার একজন সম্মানিত নেতা ও সন্ত্রান্ত ব্যক্তি। তিনি একজন ‘আকাবী, বদরী ও উহুদের শহীদ।২ বালাজুরী বলেন: তিনি একজন আকাবী, বদরী ও নাকীব।৩
ইসলাম-পূর্ব সময়ের আরবের লোকেরা মক্কার কা’বায় গিয়ে হজ্জ ও উমরা আদায় করতো। নবুওয়াতের এয়োদশ বছরে হজ্জ মওসুমে ইয়াসরিববাসীদের পাঁচ শো সদস্েযর একটি বিরাট কাফিলা হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কায় যায়। তখন পর্যন্ত ইয়াসরিবে মুস’য়াব ইবন উমাইরের (রা) হাতে গোপনে ও প্রকাশ্যের ইসলাম গ্রহণকারীরা ছাড়াও অনেক গৌত্তলিক এ কাফেয়ার ছিল। আবদুল্লাহও ছিলেন এ কাফিলার একজন সদস্য। তিনি তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি।৪ এ সফরে তাঁর ছেলে জাবিরও সুমলমান অবস্থায় অংশগ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে আনসারী সাহাবী কা’ব ইন মালিক বলেনঃ৫ “আমরা ইয়াসবির থেকে হজ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। মক্কায় গৌছে আইয়্যামে তাশরীকের মাঝামাঝি কোন এক রাতে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথ আকাবা উপত্যকায় মিলিত হওয়ার কথা পাকাপাকি করলাম। হজ্জ শেষ করলাম এবং সাক্ষাতের নির্ধারিত রাতটিও এসে গেলে। আমাদের সংগে ছিলেন আবু জাবির আবদুল্লাহ ইন আমর। তিনি একজন নেতা ও গণ্যমান্য ব্যক্তি। তাঁকেও আমরা সফরসঙ্গী করেছিলাম। পৌত্তলিক সফলসঙ্গীদের কাছে আমরা আমাদের গ্লান-পরিকল্পনা গোপন রাখতাম। রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার কিছু আগে আমরা তাঁকে বললাম: ‘আবু জাবির! আপনি আমাদের একজন নেতা। আপনি একজন মান্যগণ্য ব্যক্তি। যে বিশ্বাস নিয়ে আপনি আছেন, তার ওপর মারা গেলে কালই জাহান্নামের আগুনে জ্বলবেন। এভাবে এক পর্যায়ে আমরা তাঁকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিলাম এবং রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে আকাবায় নির্ধারিত সাক্ষাতের সময়ের কথাও জানালাম। তিনি তক্ষুণি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং আমাদের সাথে আকাবার বা ইয়াতে শরীক হন। রাসূল (সা) তাঁকে বনু সুলামার নাকীব বা দায়িত্বশীল মনোনীত করেন।”
বালাজুরী বলেন:৬ তিনি ইসলাম গ্রহণ করার পর নিজের পরনের অপবিত্র পোশাক-পরিচ্ছদ খুলে ফেলে আল-বারা’ ইবন মা’রূরের দেওয়া দু’খানি কাপগ পরেন। আকাবার এই শেষ শপথে তাঁরা পিতা-পুত্র অংশগ্রহণের গৌরব অর্জন করেন। আবদুল্লাহ বদর যুদ্ধে যোগদান করেন। হিজরী তৃতীয় সনের উহুদ যুদ্ধেও তিনি অংশ গ্রহণ করেন এবং শাহাদাতের অনন্ত গৌরবের অধিকারী হন। এটা হিজরাতের বত্রিশ মাসের মাথায় শাওয়াল মাসের ঘটনা।৭
ইজুত যুত্থে সুরাফিবতের (কপট মুসলমান) সরদার আবদুল্লাহ ইবন উবাই মদীনার বাইরে গিয়ে কুরাইশ বাহিনীকে প্রতিরোধ করা ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে। রাসূল (সা) উহুদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে সে তার সমর্থকদের নিকট এসে বলে: তিনি আমার পরামর্শ গ্রহণ না করে তাঁর ছোকরাদের কথা শুনছেন। আমরা জােিন, কিসের অন্য আমাদের জীবন বিপন্ন করবো।’-এই বলে সে তার তিন শো সঙ্গীসহ ফিরে চললো।
এ সময় আবুদল্লাহ ইবন আমর কিচু মুসলমান সঙ্গীকে নিয়ে তার সাথে দেখা করে বলেন: ‘তোমাদের ধ্বংস হোক! তোমাদের লজ্জা করে না? তোমাদের নারীদের এবং তোমাদের আবাসভূমি রক্ষার জন্য যুদ্ধ কর।’ বিশেষতঃ মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবন উবাইকে ভীষণ তিরস্কার ও লাগমন্দ করে বলেন: ‘আল্লাহর নামে আমি তোমাদের বলছি, তোমরা তোমাদের সম্প্রদায় ও নবীকে এভাবে শক্রু সামনে ছেড়ে দিয়ে অপমান করোনা।’ উত্তরে তারা বলে: ‘আমরা যদি যুদ্ধে পারদর্শী হতাম, তোমাদের সাথে যেতাম।’ উত্তরে তারা বলেনঃ ‘আমরা যদি যুদ্ধে পরাদর্শী হতাম, তোমাদের সাথে যেতাম। এভাবে তোমাদেরকে শক্রু হাতে সমপূণ করতাম না।’ যখণ তারা রণক্ষেত্রে ফিরে যেতে কোনভাইে রাজী হলো না তখন তিনি বললেন: ‘আল্লাহ তার শক্রদের দূর করে দিন। তোমাদের হাত থেকে আল্লাহ তাঁর নবীকে রক্ষার অন্য একাই যথেষ্ট।’ এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ তা’য়ালা সূরা আলে ইমরানের ১৬৭ নং আয়াতটি নাযিল করেন।৮
উহুদ যুদ্ধের আগের দিন রাতে তিনি ছেলে জাবিরকে ডেকে বললেন: বাবা, আগামীকালের প্রথম শহীদ আমি হতে চাই। রাসূলুল্লাহর (সা) পরে তুমিই আমার সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি। আমি তোমাকে বাড়িতে রেখে যাচ্ছি। তোমার বোনদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে এবং আমার যে ঋণ আছে তা পরিশোধ করবে।৯
দিনের বেলা তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। হযরত আবদুল্লাহ দারুণ সাহবের সাথে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করলেন। তিনিই হলেন দিনের প্রথম শহীদ।১০ উসামা ইন ‘উনাইদ তাঁকে হত্যা করে।১১ বালাজুরী হত্যকারী হিসেবে সুফইয়ান ইবন আবদি শামস আস-সুলামীর নাম উল্লেখ করেছেন।১২ পৌত্তলিকরা তাঁর লাশ কেটেকুটে একেবারে বিকৃত করে ফেলে।
ফেলে জাবরি বলেন: আমার পিতার শাহাদাতের খরব শুনে ছুটে এসে দেখলাম, লাশ একটি চাদর দিয়ে ঢাকা। আমি মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে মুখে চুমু দিতে লাগলাম। রাসূল (সা) দেখলেন কিন্তু নিষেধ করলেন না। আমি কাঁদতে লাগলাম। রাসূলুল্লাহর (সা) সাহাবীরা নিষেধ করতে লাগলেন; কিন্তু রাসূল (সা) নিষেধ করলেন না। আমার ফুফু ফাতিমা বিনতু আমর কাঁদতে লাগলেন। রাসূল (সা) বললেণ: তুমি কাঁদ বা না কাঁদ লাশটি তোমরা উঠিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত ফিরিশতারা ডানা দিয়ে তাঁকে ছায়া দিতে জিজ্ঞেস করলেন। উপস্থিত লোকেরা বললো: আবদুল্লাহর বোনের।১৩
তাঁকে উহুদে দাফন করা হয়। উহুদের শহীদদেরকে দু’জন অথবা তিনজন করে এক কবরে দাফন করা হয়।১৪ জাবির বলেন: উহুদের শহীদ আমার পিতা ও মামার লাশ মদীনায় আনা হচ্ছিল। পথিমধ্রে রাসূলুল্লাহর (সা) ঘোষণা-শহীদদেরকে শাহাদাতের স্থলেই দাফন করা হবে-শুনে তাঁদেরকে আবার উহুদে ফিরিয়ে নেওয়া হয় এবং সেখানেই দাফন করা হয়। মালিক ইবন আনাস বলেন: আবদুল্লাহ ইবন আমর ও আমার ইন আল-জামুহকে একই কাফনে ও একই কবরে দাফন করা হয়।১৫ বুখারীর বর্ণনায় মামার স্থলে চাচা বর্ণিত হয়েছে।১৬ আসলে আমর ইবন আল-জামূহ আবদুল্লাহর ভাই নন; বরং ভগ্নিপতি।১৭ বনু সুলামার এক বৃদ্ধ ব্যক্তির সূত্রে ইন ইসহাক বর্ণনা করেছেন: উহুদরে লাশ দাফনের সময় রাসূল (সা) বলেন: তোমরা আমর ইবন আল-জামূহ ও আবদুল্লাহ ইবন হারামের দিকে একটু লক্ষ্য রেখ। তারা দু’জন দুনিয়াতে ছিল অকৃত্রিম বন্ধু। তাঁদেরকে একই কবরে দাফন করবে।১৮
দাফনের ছয় মাস পর হযরত জাবির পিতার লাশটি কবর থেকে তুলে অন্য একটি কবরে দাফন করেন। তখন কেবল কান ছাড়া গোটা দেহ এমন অক্ষম ছিল যে, মনে হচ্ছিলো কিছুক্ষণ আগেই তাঁকে দাফন করা হয়েছে।১৯ এর ৪৬ বছর পর লাশটি আবার কবর থেকে তোলা হয়। জার বর্ণনা করেছেন। কবরটি ছিল একটি পানির নালার ধারে। একবার প্লাবনের সময় তাতে পানি প্রবেশ করে। কবরটি খোড়া হয়। দেখা গেল, আবদুল্লাহর মুখে, সেখানে আঘাত পেয়েছিলেন তাঁর একটি হাত সেই ক্ষতের ওপর। হাতটি সরিয়ে দিলে ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরতে লাগলো। হাতটি আবার সেখানে রেখে দিলে রক্ত ঝরা বনধ হয়ে গেল। জাবির বলেন: ‘আমি দেখলাম আমার পিতা যেন কবরে ঘুমিয়ে আছেন। তাঁর দেহে কম-বেশী কোন রকম পরিবর্তন হয়নি। জাবিরকে প্রশ্ন করা হলো: তাঁর কাফনটি কেমন ছিল? বললেন: কাফনেরও কোন পরিবর্তন হয়নি। একই অবস্থায় ছিল। অথচ এর মধ্যে ৪৬টি (ছেচল্লিশ) বছর চলে গেছে।
জাবির (রা) পিতার মৃত দেহে কিছু সুগন্ধি লাগানোর পরামর্শ চাইলে সাহাবীরা অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন: তাঁদের ব্যাপারে নতুন করে আর কিছুই করবে না। তারপর অন্য এক স্থানে দাফন করা হয়।২০
হযরত আবদুল্লাহর (রা) মৃত্যুকালে ছেলে হযরত জাবির (রা) ছাড়া আরো নয়জন মেয়ে রেখে যান। তাদের মধ্যে ছয়জন ছিল অপ্রাপ্ত বয়স্ক।২১ তিনি অনেক ঋণের বোঝা রেখে যান। সহীহ বুখারীতে এর বিবরণ এসেছে। এসব ঋণ হযরত জাবির (রা) পরিশোধ করেন। হযরত জাবিরের (রা) জীনীতে আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি।২২ জাবির বলেন: আমার পিতা অনেক দেনা রেখে যান। মৃত্যুর পর আমি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে বললাম: আমার বাবা অনেক দেনা করে গেছেন। কিন্তু খেজুর আছে। আপনি চলুন যাতে পাওনাদাররা সব নিয়ে না যায়। রাসূল (সা) গেলেন এবং খেজুরের ¯তৃপের ওপর বসে পাওনাদারদেরকে ডেকে ডেকে তাদের পাওনা পরিশোধ করেন। তার পরেও সমপরিমাণ খেজুর থেকে যায়।২৩
হযরত আবদুল্লাহ ছিলেন অতি সম্মানিত ও অতি উঁচু মর্যাদার অধিকারী সাহাবীদের একজন। বনু সালামা গোত্রে ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য তিনি যে চেষ্টা ও উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং আল্লাহ রাতে যেভাবে নিজেকে বিলিয়ে দেন, খোদ রাসূলে কারীম (সা) তার স্বীকৃতি দিয়েছেন। সুনানু নাসাঈ গ্রন্থে এসেছে, রাসূল (সা) বলেছেন: আল্লাহ গোটা আনসার সম্প্রদায়কে আমাদের পক্ষ থেকে ভালো প্রতিদান দিন, বিশেষ করে আমর ইন হারামের বংশধর (আবদুল্লাহ ও তাঁর সন্তান) ও সা’দ ইবন উবাদাকে।২৪ জামে’ তিরমিজী গ্রন্থে এসেছে। উহুদের ঘটনার পর একবার রাসূল (সা) জাবিরকে মলিন ও বিমর্ষ দেখে প্রশ্ন করলেন: কি হয়েছে?
জবাব দিলেন: আব্বা শহীদ হয়েছেন এবং অনেকগুলি সন্তান রেখে গেছেন। তাদেরই চিন্তা আমাকে সর্বক্ষণ অস্থির করে রেখেন। রাসূল (সা) বলেছেন: একটি সুসংবাদ শোন, আল্লাহ আড়াল ছাড়া কারো সাথে সামনা-সামনি কথা বলেন না। কিন্তু তিনি তোমার আব্বার সাথে সামনা-সামনি কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন: আবদুল্লাহ ইবন আমর! তুমি কি পছন্দ করে? জবাবে তোমার আব্বা বলেছেন, আমার পছন্দ এই যে, আমি আবার পৃথিবীতে ফিরে যাই এবং আপনার রাস্তায় জিহাদ করে আবার শহীদ হই।২৫ আল্লাহ বলেছেন, এ হয়না। পৃথিবী থেকে যে একবার আসে যে একবার আসে সে আর ফিরে যেতে পারে না। তখন তিনি বলেছেন, তাহলে আমার সম্পর্কে কিচু ওহী পাঠান। তখণ এ আয়াতটি নাযিল হয়:
Ñযারা আল্লাহর পথে, জীবন দেয় তাদেরকে মৃত ভেবো না। বরং তারা আল্লাহর নিকট জীবিত। যাদেরকে আহার দেওয়া হয়।২৬
হযরত আবদুল্লাহর (রা) এর চেয়ে বড় গৌরব অহস্কারের আর কি আছে যে, আজ চৌদ্দ শো বছর পরেও আমরা তাঁকে স্মরণ করছি। হয়তো আরো হাজার হাজার বছর পরেও এভাবে মানুষ তাঁকে স্মরণ করবে।
তথ্যসূত্র:

‘আবদুল্লাহর ইবন’ আবদিল্লাহ ইন উবাই ইবন রাসূল (রা)
‘আবদুল্লাহর (রা) মদীনার বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের হুবলা’ শাখার সন্তান। খান্দানটি খুবই সম্মানিত। এই খান্দানের উর্ধতন এক ব্যক্তি ছিলেন সালেম। তাঁর উপাধি ছিল ‘হুবলা’। আর সেখান থেকেই এই খান্দানের নাম হয়েছে ‘হুবলা’ বলতো। সালেমের পেটটি ছিল ুব মোটা। এই কারণে তাঁকে ‘হুবলা’ বলতো। পরবর্তীকালে তাই তাঁর খান্দানের নামে পরিণত হয়।১ ‘আবদুল্লাহর (রা) মাতার নাম খাওলা বিনত আল-মুনজির। তিনি বনু নাজ্জার খান্দানের বনু মাগালা শাখার সন্তান।২
এখানে একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, আমাদের আলোচ্য ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহর (রা) পিতা রয়িসুল মুনাফিকীন’ (মুনাফিকদের নেতা)’ আবদুল্লাহর ইন উবাই ইবন সালূল। এই মুনাফিক নেতা ইতহিাসে ইন উবাই ইবন সালূল নামে প্রসিদ্ধ। জাহিলী মদীনার খাযরাজ গোত্রের সর্বাধিক সম্মানিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের অন্যতম। তার প্রভাব পতিপত্তি ও শক্তি-সামর্থের প্রমাণের জন্য এতটুকু যথেস্ট যে, ইসলাম-পূর্ব মদীনার অধিবাসীরা তাকেই তাদের রাজা বানানোর চিন্তা-ভাবনা করছিল। আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে দীর্ঘকাল দ্বন্দ্ব-সংঘাত দ্যিমান ছিল। তা সত্ত্বেও তাকে রাজা করার ব্যাপারে কারো দ্বিমত ছিল না। এমন পিতারই ছেলে আবদুল্লাহ (রা)।৩
আবদুল্লাহর (রা) পিতা এই ইন উবাই ইবন সালূল। সে বড় জ্ঞানী, বিচক্ষণ ও কূটকৌশলী ছিল। তাসত্ত্বেও ঈমানের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। রাসূলেকারীম (সা) মদীনায় এসে ইসলামী খিলাফতের ভিত্তি স্থাপন করলে ঈর্ষা ও শত্র“তার এক বিষ্ময়কর দৃশ্য তার মধ্যে দেখা যায়। ইন উবাই ও তার অনুসারী মদীনার কিছু লোক ইসলামের উত্তরোত্তর উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধিকে ঈর্ষা ও বিদ্বেষের দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। রাসূলুল্লাহর (সা) প্রভাব-প্রতিপত্তি তাদের নিকট অসহনীয় হয়ে পড়ে। তাই ইসলাম ও মুসলমানদেরকে মদীনার মাটি থেকে উৎখাতের জন্য একের পর এক নানা রকম ষড়যন্ত্র পাকাতে থাকে।
অবশেষে মুসলমানদের বিজয় ও শক্তির কাছে ইবন উবাই ও তার অনুসারীদেরকে বাহ্যতঃ মাথা নত করতে হয়। তারা কপটতার আশ্রায় নিয়ে মুসলমানদের দলে ভিড়ে যায়।তার এই দলটির সদস্যরা মুনাফিক (কপট মুসলমান) এবং সে মুনাফিকদের নেতা হিসাবে ইসলামের ইহিাসে প্রসিদ্ধ। পৃথিবীতে যত মুনাফিক জন্মাবে তাদের নেতা এই ইবন উবাই ইবন সালূল। হিজরাতের পর মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সা) ও সাহাবায়ে কিরামের (রা) ওপর যত দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-আপদ আপতিতর হয়েছে তার প্রায় প্রত্যেকটির সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই ইন উবাই ও তার দলবল কোন না কোনভাবে জড়িত ছিল। তার ও তার দলের কীর্তি-কলাপের বর্ণনার কুরআনের বহু আয়াত নাযিল হয়েছে। সূরা ‘আল-মুনাফিকুন’ তো তাদের স্বভাব-বৈশিষ্ট্যের বিবরণ।৪
কথায় বলে ফির’আউনের ঘরে মূসা বা যেখানে ফির’আউন সেখানে মূসা। এক্ষেত্রেও তাই; এহন কট্টর ইসলামের দুশমন ও চরম মুনাফিকের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন মহান সাহাবী আবদুল্লাহ (রা)। পিতার নাপাক আছর থেকে তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত থাকেন। এতবড় বুদ্ধিমান পিতা নিজের ছেলের ওপর বিন্দুমাত্র প্রভাব সক্ষম হয়নি।
এই মুনাফিক ইবন উবাই তৎকালীন আরবের একজন বিখ্যাত সাধু আবু ‘আমের আর-রাহিব-এর খালাতো ভাই। রাসূলুল্লাহর (সা) আবির্ভাবের অব্যবহিত পূর্বে আরবের যে সকল সাধু পুরুষ তাঁর শীঘ্র আগমনের কথা বলতেন এবং তাঁর ওপর ঈমান রাখতেন, এই আবু আমের তাঁদের একজন। জাহিলী আমলে তিনি পার্থিব ভোগ-বিমুখ সন্যাস ও বৈরাগ্য জীন গৃহণ করেন। ন্তিু যখন রাসূল (সা) নবী হিসেবে আত্মাপ্রকাশ করলেন তখন তিনি স্বীয় বিশ্বাস থেকে সরে গেলেন। বদরে িিন মুশরিকদের সাথে একাত্ম হয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) বিরুদ্ধে গুদ্ধ করলেন এ কারণে রাসূল (সা) তাঁকে আল-ফাসেক’ (পাপাচারী) অভিধায় চিহ্নিত করলেন।৫
রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় আসার আগেই আবদুল্লাহ (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম পূর্ব নাম ছিল আ-হুবাব। উরওয়া বলেনঃ রাসূলুল্লাহর (সা) অভ্যাস ছিল কারো খারাপ নাম শুনলে তা পরিবর্তন করে দেওয়া। একদিন িিন আল-হুবাবকে বললেন: এখন থেকে তোমার নাম হবে আবদুল্লাহ। কারণ, আল-হুবাব হচ্ছে শয়তানের নাম।৬ এভাবে পিতা-পুত্রের নাম এক হয়ে যায়।
‘আবদুল্লাহ (রা) একজন বদরী সাহাবী। রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে বদরে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে সকল যুদ্ধ ও অভিযানে তাঁর যোগদানের কথা জানা যায়।৭ তিনি উহুদেও যুদ্ধ করেন। এ যুদ্ধে তাঁর সামনের দুটি দাঁত শহীদ হয়। যুদ্ধের পর রাসূল (সা) তাঁকে বলেন, তুমি দুটি সোনার দাঁত বানিয়ে লও। একথা আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তবে ইবন মুন্দাহ উল্লেখ করেছেন যে, দাঁত নয়, বরং তাঁর নাক বিচ্ছিন্ন হয় এবং তিনি সোনার একটি নাক প্রতিস্থাপন করেন। কন্তিু এ ধারণা সঠিক নয়।৮
আবু সুফইয়ান উহুদ থেকে প্রত্যাবর্তন কালে ্ককেটি পাহাড়ের ওপর উঠে চিৎকার করে বলে: আগামী বছর বদরে আবার তোমাদের সাথে সাক্ষাতের প্রতিশ্র“তি রইলো। এ ঘোষণা শুনে রাসূল (সা) একজন সাহাবীকে বললেন: তুমি বল, হাঁ, সেখানেই তোমাদের সাথে সাক্ষাতের প্রতিশ্র“তি দিলাম।৯ ইবন ইসহাক বলেন: আবু সুফইয়ানের সাথে এ অঙ্গীকার রক্ষার জন্য রাসূল (সা) হিজরী চতুর্থ সনের শা’বান মাসে দ্বিতীয়বার বদরে উপস্থিত হন। ইতিহাসে যা বদর আল আখেরাহ নামে পরিচতি। উবন হিশাম বলেন: এ যাত্রায় রাসূল (সা) তাঁর অনুপিিস্থতিতে প্রতিনিধি হিসেবে আবদুল্লাহকে (রা) মদীনায় রেখে যান।১০
বুন আল মুসতালিক মতান্তরে তাবুক যুেদ্ধর এক পর্যায়ে উট-ঘোড়ার পানি পান করানোকে কেন্দ্র করে একজন আনসার ও একজন মুহাজির ব্যক্তির মধ্যে ঝগড়া হয়। এ ঝগড়ার এক পর্যায়ে মুনাফিক ইবন উবাই রাসূল (সা) ও মুহাজিরদের প্রতি ইঙ্গিত করে মন্তব্যÑ‘মদীনায় পৌঁছাতে পারলে আমরা অভিজাতরা ইে ইতরদেরকে বের করে দেব।’১১ একথা রাসূলুল্লাহর (সা) কানে গেলে এবং অন্যান্য মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে দারুণ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। উমার (রা) তো রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে এসে বলেই ফেললেন: যদি অনুমতি দান করেন তো এই মুনাফিকের মাথাটা ধর থেকে আলাদা করে ফেলি।’ রাসূল (সা) তাঁকে বললেন: বাদ দাও। তা করলে লোকে বলবে, মুহাম্মদ তার সঙ্গীদের হত্যা করে।:১২
আল্লাহর রাসূল (সা) ও তাঁর বহু পরীক্ষিত মুহাজির সঙ্গী-মুহাজির সঙ্গী-সহচরদের সম্পর্কে উচ্চারিত ইবন উবাইর মহাআপত্তিকর মন্তব্যটি এক সময় ছেলে আবদুল্লাহর (রা) কানে গেল। তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সামেনে হাজির হয়ে বললেন, আমার পিতা আপনাকে ‘ইতর’ বলে গালি দিয়েছেন। আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, আপনি নন, তিনিই ইতর। তারপর যে কথাটি তিনি বললেন তা অতি চমকপ্রদ ও বড় বিষ্ময়কর। বললেন, গোটা খাযরাজ গোত্রের মধ্যে আমার চেয়ে বশী পিতার বাধ্য ও অনুগত ছেলে দ্বিতীয়টি নেই। তবুও আপনি যদি তাঁকে কাতে চান তো আমাকে হুকুম দিন। আমি তার মাথাটি আপনার নিকট হাজির করছি। কিন্তু অন্য কোন মুসলমান যদি আমার পিতাকে হত্যা করে তাহলে ামার পিতর ঘাতক হবে আমার চোখের কাঁটা। আমি তাকে সহ্য করতে পারবো না। তখন হয়তো তাকে হত্যা করবো এবং একজন মুসলমান হত্যার দায়ে জাহান্নাম হবে আমার ঠিকানা। তাঁর কথা শেষ হলে রাসূলুল্লাহর (সা) বললেন: তাকে হত্যা করানোর কোন উদ্দেশ্য ও ইচ্ছা আমার নেই।১৩
‘আবদুল্লাহ (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে কথা শেষ করে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। পিতাকে আসতে দেখে উটের পিঠ থেকে নেমে অসি উঁচু করে ধরে বললেন: যতক্ষণ আপনি মুখ দিয়ে একথা উচ্চারণ না করবেনÑ‘আমি ইতর এবং মুহাম্মদ অতি সম্মানীয়ঃÑততক্ষণ এ অসি কোষবদ্ধ হবে না। আপনি এক পাও এগুতে পারবেন না। অবস্থা বেগতিক দেখেসে উচ্চারণ করলোÑ‘তোর ধ্বংস হোক! মুহাম্মদ সম্মানীয় এবং আমি ইতর।’ একটু পিছনে রাসূলে কারীম (সা) আসছিলেন। পিতা-পুত্রের সংলাপ কানে গেল। তিনি আবদুল্লাহকে নির্দেশ দিলেন: তাকে ছেড়ে দাও। আল্লাহ কসম! যতদিন সে আমাদের মধ্যে আছে আমরা তার সাথে ভালো ব্যবহার করবো।১৪ উরওয়া বলেন: হানজালা ইবন আবী আমের ও আবদুল্লাহ ইবন আবদিল্লাহÑএ দুইজনের প্রত্যেক নিজ নিজ পিতাকে হত্যার জন্য রাসূলুল্লাহর (সা) অনুমতি চেয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহর (সা) তাঁকেরকে বিরত রাখেন।১৫
তাবুক যুদ্ধ থেকে রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় ফেরার পর মুনফিক আবদুল্লাহ ইবন উবাই মারা যায়।১৬
সাহীহ হাদীস সমূহের মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মাদী এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, পবিত্র কুরআনের সূরা তাওবার আশি ও চুরাশিমত আয়াত দুটি মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবন উবাই-এর মৃত্যু ও তার জানাযা সম্পর্কে নাযির হয়েছে। আশিতম আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন: ‘তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর আর না কর (উভয় সমান)। যদি তুমি তাদের জন্য সত্তর বারও ক্ষমা প্রার্থনা কর, পথাপি কখনোই তাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। তা এজন্য যে তারা াল্লাহকে এবং তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছে।’ সাহীহাইবন (অর্থাৎ বুখারী ও মুসলিম)-এর বর্ণনা দ্বারা প্রামাণিত হয়েছে যে, তার জানাযায় রাসূল (সা) নামায পড়েন, তার কবরের পাশে দাঁড়ান এবং তার ছেলে আবদুল্লাহকে (রা) সান্ত্বনা দেন। নামায পড়ার পরই চুরাশিমত আয়াতটি নাযিল হয়। এ আয়াতে বলা হয়: আর তাদের মধ্য থকে করো মৃত্যু হলে তার ্পর কখনও নামায পড়বেনা এবং তার কবরে দাঁড়াবে ন। তারা তো আল্লাহর প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে এবং রাসূলের প্রতিও। বস্তুতঃ তারা না-ফরমান অবস্থায় মৃত্যুবরণকরছে।’ এ আয়াত নাযিলের পর রাসূলে কারীম (সা) আর ােন মুনাফিকের জানাযায় নামায পড়েননি।
রাসূলে কারীমের (সা) গায়ে তখন দুইটি জামা ছিল। আবদুল্লাহ (রা) নীচের জামাটি পসন্দ করলেন। রাসূলুল্লাহর (সা) দেহের পবিত্র ঘামতাতে লাগা ছিল। রাসূল (সা) আবদুল্লাহকে (রা) জামাটি দিয়ে বললেন, কাফন পরানো হলে আমাকে খবর দেবে, আমি জানাযায় নামায পড়াবো। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে। লাশ কবরে নামানোর পর রাসূল (সা) আসেন। কবরে নেমে লাশ হাঁটুর ওপর রেখে তাকে জামা পরান এবং পবিত্র মুখের লালা লাগনা। তারপর জানাযার নামাযের জন্য দাঁড়ান।
জানাযার নামাযে দাঁড়ালে উমার ইবন খাত্তাব (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) কপড় টেনে ধরে নিবেদন করলেন, আপনি এ মুনাফিকের জানাযা পড়ছেন, অথচ অথচ আল্লাহ আপনাকে নামায পড়তে বারণ করেছেন। রাসূল (সা) মৃদু হেসে বললেন: যাও, নিরে স্থানে গিয়ে দাঁড়াও। এরপরেও উমার (রা) যখন একটু বাড়াবাড়ি করতে লাগলেন তখন রাসূল (সা) বললেন: আল্লাহ আমাকে এখতিয়ার দিয়েছেনÑমাগফিরাতের দু’আ করবো অথবা করবো না। যদি সতÍ বারের বেশীও মাগফিরাত চাইলে সে ক্ষমা পায় তাহলে আমি তার জন্যও প্রস্তুত আছি।
অতঃপর রাসূল (সা) তার জানাযার নামায পড়েন এবং নামাযের পরেই চুরাশিতম আয়াতটি নাযিল হয়। এ অহীর মাধ্যমে উমার (রা) স্বয়ি কর্ম ও আরণের সমর্থন লাভ করেন। তিনি নিজের এমন দুঃসাহসের জন্য দারুণ বিম্ময়বোধ করেন।১৭
খলীফা আবু বকরের (রা) খিলাফতকালে আবদুল্লাহ (রা) ইয়ামামার যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। এটা হিজরী ১২ সনের রবীউল আওয়াল মাসের ঘটনা।১৮
আবদুল্লাহ ছিলেন অতি মর্যাদাবান সাহাবীদের অন্তর্ভূক্ত। আয়িশা (রা) তাঁর সম্বন্ধে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখতে জানতেন। মাঝে মাঝে অহী লেখার দায়িত্বও পালন করেছেন।১৯
আবদুল্লাহ (রা) ছিলেন মুনাফিক পিতার একজন সুসন্তান। পিতার কপটতাপূর্ণ জীবন সর্বদা তাঁকে পীড়া দিত। তিনি ভীষণ কষ্ট পেতেন।২০ বিপথগামী পিতাকে সত্য ও সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টার কোন ত্র“টি করেননি। পিতার এ বিপথগামিতা সত্ত্বেও সন্তান হিসেবে তার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে কখনও শৈথিল্য দেখাননি। ইসলামী বিধানের আওতায় থেকে সব সময় পিতার আনুগত্য করেছেন। তার মৃত্যুর পরেও মুক্তির আশায় সন্তান হিসেবে যা কিছু করার সবই করেছেন।
সথ্যসূত্র:

রাফে’ নি খাদীজ (রা)
রাফে’ (রা) হিজরাতের বারো বছর পূর্বে ৬১১ খ্রীষ্টাব্দে অন্মগ্রহণ করেন।১ তিনি মদনিার বিখ্যাত খাযরাজ, মতান্তরে আউস গোত্রের বনু আল-হারেসার সন্তান। তিপা খাদীজ ইবন রাফে’ এবং মাতা হালীমা বিনত মাসউদ। দাদার নামে তাঁর রাখা হয়।২ রাফে’-এর ডাকনাম আবূ আবদিল্লাহ। ইমাম বুখারী বলেছেন আবূ খাদজি।৩ তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) দুইজন নামকরা সাহাবী ও জহীর ও মুজাহির ইবন রাফে’-এর ভাতিজা।৪
প্রাচীন মদীনার আবদুল্লাহ আশহাল ও আল-হারেসা গোত্র দুইটি শক্তি ও সামর্থের দিক দিয়ে সমপর্যায়ের ছিল। তাদের মধ্যে ঝগড়-বিবাদ এবং পরিণতিতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সবসময় লেগেই থাকতো। উসাইদ ইবন হুদাইরের (রা) দাদাদ সিমাক ইবন রাফে’ কে এই গোত্রদ্বয়ের লোকেরা কেটি যুদ্ধে হত্যা করে এবং তার বংশের লোকদের মদীনা থেকে বিতরাড়িত করে। উসাইদের পিতা হুদাইর আল-হারেসা গোত্র অবলোধ করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেন এবং তাদেরকে পরাভূত করে খায়বারে তাড়িয়ে দেন। বনু আল-হারেস খঅয়বারে বসরাস করতে থাকে। এর মধ্যে হুদাইরের অন্তরে দয়ার সঞ্চায় হয়। তিনি বনু আল-হারেসাকে আবার মদীনায় ফিরে এসে বসবাসের অনুমতি দান করেন।
রাফে’ ইবন খাদীজের (রা) পূর্বপুরুষ এই বনু আল-হারেসার রয়িস বা নেতা ছিলেন। বাবা-চাচার মৃত্যুর পর এ নেতৃত্ব লাভ করেন রাফে’ এবং আজীবন তা হাতছাড়া হয়নি। রাসূলে কারীমের (সা) হিজরাতের সময় রাফে’ অল্পবয়স্ক এক বালকমাত্র।তা সত্ত্বেও ইসলাম তাঁর অন্তরে গভীর ছাপ ফেলেছিল। তাঁর দুই চাচা জহীর ও মুজহির তখন মুসলমান।
বদর যুদ্ধের সময় রাফে’র বয়স চৌদ্দ বছর। যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা দিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে হাজির হলেন। যুদ্ধে যাওয়ার বয়স হয়নি দেখে খান্যদের সাথে তাঁওে ফেরত দিলেন। এভাবে হযরত রাফে’ বদরের যোদ্ধা হতে পারলেন না।৫
মদীনার ছোট ছেলেদেরপ্রতিবছর রাসূলে কারীমের (সা) সামনে হাজির করা হতো।৬ তিনি তাদের মধ্য থেকে যারা যুদ্ধে যাওয়ার যোগ্য মনে করতেন তাদেরকে বাছাইকরতেন। হিজরী ৩য় সনে উহুদ যুদ্ধে মাত্রার সময় রাফে’ কে রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে আনা হয়। তখন তাঁর বয়স পনেরো বছর পূর্ণ হয়েছে। সুতরাং তিনি যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি লাভ করেন। এ সময় তাঁরই সমবয়সী সামুরা ইবন জুন্দুবের সাথে তাঁর এটি মজার ঘটনা ঘটে। রিজাল’ শাস্ত্রের প্রায় সকল গ্রন্থে ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে।
এ সম্পর্কে রাফে’ বলেন: আমি সারিতে দাঁড়িয়ে গায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে নিজেকে উঁচু করে দেখাচ্ছিলাম। রাসূলুল্লাহকে (সা) পূর্বেই বলা হয়েছিল যে, আমি একজন দক্ষ তীরন্দায়। অতঃপর রাসূল (সা) আমাকে অনুমতি দান করেন। তখন আমারই সমবয়সী সামুরা বিন জুন্দুরব তাঁর সৎ পিতা মুররী ইবন সাবিতকে বললো: রাসূল (সা) রাফে’ ইবন খাদিজকে অনুমতি দিলেন’ কিন্তু আমাকে ফেরত দিলেন। মুররী তখন বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি রাফে’ কে অনুমতি দিয়েছেন, আর আমার ছেলে সামুরাকে ফেরত দিয়েছেন। সে কিন্তু কুসিএত রাফে’ কে হারিয়ে দিতে পারে। তখন রাসূল (সা) বলেন: তোমরা দুইজনকুস্তি লাগো।’৭ এভাবে তাঁরা দুইজন কুস্তি লাগেন এবং সামুরা রাফে’ কে হােিয় দিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) অনুমতি লাভ করেন। ইবন হিশাম বলেন: দুই জনেরই বয়স তখন পনেরো বছর।৮
এই উহুদ যুদ্ধে শত্র“ পক্ষের নিক্ষিপ্ত একটি তীর রাফে’র বুকে লাগে। তীরটি হাড় ভেদ করে ভিতরে ঢুকে যায়। এ সম্পর্কে ইমাম আল-বায়হাকী বর্ণনা করেছেন। উহুদ অথবা হুনাইনের দিন রাফে’ ইবন খাদীজের বুকেতীর বিদ্ধ হয়। তাকে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট আনা হলে আরজ করলেন: হে আল্লাহ রাসূল! আমার বুক থেকে তীরটি বের কর দিন। রাসল (সা) বললেন:‘তুমি চাইলে আমি ফলসহ তীরটি বের করে দিতে পারবো। আর তুমি চাইলে আমি শুধু তরিটি বের করে আনাে এবং ফলাটি থেকে যাবে। সে ক্ষেত্রে আমি কিয়ামতর দিন সাক্ষ্য দেব যে তুমি একজন শহীদ।’ তখন রাফে’ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তাহরে তীরটিই বের করে আনুন, ফলাটি থাক। কিয়ামতের দিন আপনি আমার জন্য সাক্ষ্য দিন যে, আমি একজন শহীদ। এ অবস্থায় হযরত মু’য়াবিয়ার (রা) খিলাফতকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকেন। অবশেষে ক্ষতস্থানে পচন ধরে মৃত্যুবরণ করেন।৯
উহুদ যুদেধ কিভাবে মুসলমানদের পরাজয় হয় রাফে’ পরবর্তীকালে তা বর্ণনা করতেন। সেই বর্ণনার মধ্যে এ যুদ্ধের একটা চিত্র ফুটে ওঠে।১০
খন্দকসহ পরবর্তীকালে সকল যুদ্ধ ও অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করেন।১১ সিফফীনের যুদ্ধে তিনি আলীর (রা) পক্ষে যোগদান করেন।১২
তীরের যে আগাটি রাফে’র শরীরে ভিতরে ছিল, দীর্ঘদিন পর তা ক্ষতের সৃষ্টি করে, এবং সেই যন্ত্রণায় তিনি মারা যান। তিনি মদীনায় বসবাস করতেন এবং সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তাঁর মৃত্যুসন নিয়ে রিজাল শাসত্রবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। তবে একটি ব্যাপারে সকলে একমত যে, আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা) তাঁর জানাযার নামায পড়ান। ইমাম আল-বুখারী তাঁর তারীখে বলেছেন যে, তিনি মু’য়াবিয়ার (রা) খিলাফতকালে মারা যান। তিনি তারীখুল আওসাত গ্রন্থে হিজরী ৫০-৬০ সনের মধ্যে যাঁরা মারা গেছেন’ শিরোনামের অনুচ্ছেদে রাফে’র নামটি উল্লেখ করেছেন। আর ইবন কানে’ নির্দিষ্ট করে হিজরী ৫৯ সনের কথা বলেছেন।১৩ পক্ষান্তরে আল-ওয়াকিদী রাফে’ ইবন খাদীজের কোন কোন সন্তানের সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি হিজরী ৭৪ সনের প্রথম দিকে ৮৬ বছর বয়সে মদীনায় মারা যান।১৪ আর তখন আবদুল মালিক ইবন মারওয়ান খিরাফতের মসনদে আসীন।
একথা প্রমাণিত যে, আবদুল্লাহ ইবন উমার তাঁর জানাযার নামায পড়ান। আর এটাও স্বীকৃত যে, তিনি হিজরী ৭৪ সনের প্রথম দিকে মক্কায় ছিলেন। তাই অনেকে বলেছেন, রাফে’ ইবন খাদীজের ক্ষতে পঁচন ধরে আগেই এবং তিনি মারা যান হিজরী ৭৪ নরে ইÍ উসার সব্বা থেকে মদীনায় ফিরে আসার পর। অতবা হিজরী ৭৩ সনে মারা যান ইবন উমারের (রা) মক্কা যওয়ার আগে। ইবন উমার (রা) তাঁর সনে মারা যান। আর এটাই অধিক যুক্তিঙ্গত।১৫
মুসনাদে ইমাম আহমাদে এসেছে, তাঁকে কাফন পরিয়ে বাইরে আনা হয়েছিল এবং তাঁর ওপর একটি লাল চাদর বিছিয় দেওয়া হয়েছিল।’১৬ লাশের সাথে বিপুল সংখক লোক চলেছিল। ঘর থেকে মহিলারা কাঁদতে ও মাতম করতে করতে বের হয়েছিল। তাঁর মৃত্যু ও জানাযা সম্পর্কে অনেকবর্ণনা সীরাত ও রিজাল’ শাস্ত্রে রগ্রন্থাবলীতে ধেখা যায়। এখানে তার কয়েকটি হুবহু নকল করা হলো:
আবূ নুসরা বলেন: আমি রাফে’ ইবন খাদীরেজ জানাযায় যোগ দিয়েছিলেন। অশংগ্রহণকারীদের মধ্যে ইবন উমারও ছিলেন। মহিলারা চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলে তিনি বললেন: চুপ কর। এই বৃদ্ধের আল্লাহর আযব (শাস্তি) সহ্য করার শক্তি নেই। রাসূলুল্লাহর (সা) বলেছেন: মৃত ব্যক্তিকে তার পরিবারের লোকদের মাতম ও কান্নার জন্য আযাব দেওয়া হয়।১৭
শু’বা ইউসুফ ইবন মাহাক থেকে বর্ণনা করেছেন। ইউসুফ বলেছেন: আমি দেখেছি যে, ইবন উমার রাফে’ ইবন খাদীজের লাশবাহী খাটিয়ার সামনের দুইটি পায়া ধরে স্বীয় কাঁধে রাখেন এবং আগে আগে হেঁটে কবর পর্যন্ত পৌঁছেন। এ সময় তিনি বলেন: মৃতকে জীবিত লোকদের কাঁদার জন্য আযাব দেওয়া হয়।১৮
বিশর ইবন হারব থেকে হাম্মাদ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন: রাফে’ ইবন খাদীজ মারা গেলে ইবন উমারকে বলা হলো, রাতে পোহানো পর্যন্ত দাফন দেরী করা হোক। তাহলে শহরবাসীদেরকে জানিয়ে দেওয়া যাবে। তিনি বললেন: তোমাদের এ সিদ্ধান্ত অতি চমৎকার। কহিশাম ইবন সা’দ বর্ণনা করেছেন উসমানইবন উবাইদুল্লাহ থেকে। তিনি বলেছেন: রাফে মারা গেলে সূর্যোদয়ের পূর্বে লাশ আনা হলো জানাযার জন্য। ইবন উমার বললেন: সূর্যোদয়ের আগে তার জানাযা পড়োনা।১৯
রাফে’ ইবন খাদীরে (রা) দৈহিক গঠন ও আকৃতির তেমন বিবণ পাওয়া যায় না। এতটুকু জানা যায় যে, তিনি চিকন করে মোট রাখতেন এবং চুরে খিজাব লাগাতেন। মৃত্যুকালে তিনি দাস-দাসী, ইট ও ভূ-সম্পদ উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যান।২০
আবদুল্লাহ, রিফায়া, আবদুর রহমান, উবইদুল্লাহ, সাহল ও উবাইদÑতাঁর এই ছয় ছেলের নাম জানা যায়। আবদুল্লাহ পিতর মসজিদের ইমাম ছিলেন। উবাইদ ছিলন দাসীর পেটের সন্তান। আর অন্য ছেলেরা ছিলেন তাঁর লুবনা ও আসমা নাøী দুই স্ত্রীর পেটের সন্তান। তাঁর এই সন্তানদের বংশধারা বহুকাল যাবত মদীনা ও বাগদাদে বিদ্যমান ছিল।২১
রাফে’ (রা) রাসূল (সা) ও চাচা জহীর ইবন রাফে’ (রা) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।২২ হাদীসের গ্রন্থসমূহে তাঁর সনদে সর্বমোট ৭৮ (আটাত্তর) টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।২৩ তাঁর থেকে যাঁরা হাদীস বর্ণনা করেছেন, সেই সকল রাবীর মধ্যে সাহাবী ও তাবেঈÑউভয় শ্রেণীর ব্যক্তিরা আছেন। এখনে তাঁদের কয়েকজনের নাম দেওয়া হলো:
ইবন ‘উমার, মাহমুদ ইবন লাবীদ, সায়ব ইবন ইয়াযীদ, উসাইদ ইবন জহীর, মুজাহিদ, আতাঃ, শা’বী, ‘আবাইয়া ইবন রিফায়া’, উমরা বিনত আবদির রহমান সা’ঈদ ইবন মুনায়্যিব, নাফে’ ইবন জুবাইর, আবু সালামা ইবন আবদির রহমান, আবু আন-নাজ্জাশী, সুলায়মান ইবন ইয়াসার, ‘ঈসা, উসমান ইবন সাহ্ল হারীর ইবন আবদির রহমান ইয়াহইয়া ইবন ইসহাক সাবিত ইবন আনাস ইবন জহীর, হানজালা ইবন কায়স, নাফে’ আল-উমারী, ওয়াসি’ ইবন হিব্বান মুহাম্মদ ইবন ইয়াহইয়া ইবন হিববান, উবাইদুল্লাহ ইবন আমর ইবন উসমান প্রমুখ।২৪
রাফে’ ইবন খাদীজ (রা) ছিলেনমদীনার মুফতী সাহাবীদের অন্যতম। যিয়াদ ইবন মীনা বলেন: ইবন আব্বাস ইবন উমার আবু সা’ঈদ আল-খুদরী আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস, জাবির ইবন আবদিল্লাহ রাফে ইবন খাদীজ সালামা ইবন আকওয়া আবু ওয়াকিদ আল-লাইসী আবদুল্লাহ ইবন বুহাইনা এবং এঁদের মত রাসূলুল্লাহর (সা) আরো অনেক সাহাবী মদীনায় ফাতওয়া দিতেন এবং রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীস বর্ণনা করতেন। এ কাজ তাঁরা করতেন উসমানের (রা) মৃত্যু থেকে তাঁদের মৃত্যু পর্যন্ত।২৫ ইমাম জাহাবী বলেন: তিনি মু’য়াবিয়ার (রা) সময় ও তার পরে মদীনায় যাঁরা ফাতওয়া দিতেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।২৬ ইবন আব্বাস (রা) মারা গেলে রাফে’ ইবন খাদীজ মন্তব্য করেছিলেন: আজ এমন এক ব্যক্তি মারা গেলেন যাঁর প্রতি মাশরিক ও মাগরিবের পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সকল জ্ঞানী ব্যক্তি মুখাপেক্ষী ছিলেন।২৭ তিনি ছিলেন একজন মরুচারী মানুষ। কৃষি ও সেচকাজে ছিলেন দক্ষ।২৮
ইতা’য়াতে রাসূল ও আমর বিল মা’রূফÑরাসূলের (সা) আনুগত্য ও সৎ কাজের আদেশ করা ছিল তাঁর চরিত্র ও স্বভাবের উজ্জ্বলতম বৈশিষ্ট। একবার নু’মান আলÑআনসারীর একজন দাস জনৈক ব্যক্তির বাগান থেকে খেজুরের ছোট গাছ উপড়ে ফেলে। বিষয়টি মারওয়ানের আদালতে উত্থাপিত হয়। তিনি চুরির অপরাধ আরোপ করে হাত কাটার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলেন। তখন রাফে’ বললেন: রাসূল (সা) বলেছেন: ফলের জন্য হাত কাটা যাবেনা।২৯
একবার মারওয়ান ভাষণের মধ্যে বললেন: মক্কা হারাম। মাবেশে রাফে’ উপস্থিত ছিলেন। তিনি চেঁচিয়ে বললেন, মক্কা হারাম, তা ঠিক আছে। তবে মদীনাও হারাম। মদীনাকে রাসূল (সা) হারাম ঘোষণা করেছেন। আমার কাছে হাদীসটি লেখা আছে। তুমি চাইলে দেখতে পারি। মারওয়ান বললেন, হাঁ, হাদীসটি আমিও শুনেছি।৩০
রাসূলে কারীমের (সা) প্রতি ছিল তাঁর সীমাহীন ভক্তি, শ্রদ্দা ও ভালোবাসা। তাঁর জীবনের বহু কথা, কাজ ও আচরণে তা ফুটে উঠেছে। একবার তাঁর চাচা জহীর (রা) এসে বললেন, আজ রাসূল (সা) একটি জিনিসের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। অথচ এতে আমাদের কিছু সহজ হতো। রাফে’ (রা) সাথে সাথে বলে উঠলেন: চাচা। রাসূল (সা) যা কিছু বলেছেন তাই সত্য।৩১
একদিন তিনি স্ত্রি সম্ভোগে মগ্ন আছেন। আর ঠিক সেই সময় রাসূলে কারীম (সা) এসে ডাক দিলেন। আল্লাহর রাসূলের (সা) কষ্ঠস্বর কানে পৌঁছার সাথে সাথে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে যান এবং পাকসাফ হয়ে বেরিয়ে আসেন।৩২
রাফে’ (রা) একদিন রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট গিয়ে দেখলেন, সেখানে হাঁড়িয়ে টগবগ করে গোশত সিদ্ধ হচ্ছে। তাঁর খেতে খুব ইচ্ছে হলো। তিনি এক টুকরো মুখে দিয়ে গিলে ফেললেন। এরপর থেকে তাঁর পেটের পীড়া দেখা দিল। এক বছর পর্যন্ত ভুগতে লাগলেন। তারপর একদিন পেটের পীড়ার কথা রাসূলুল্লাহকে (সা) বললেন। তিনি রাফে’র (রা) পেটে হাত বুলিয়ে দেন। এতে তঁর সবুজ বর্ণের বমি হয়। এরপর থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান।৩৩
রাফে’ (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) বিভিন্ন সময় যে সকল দু’আ পাঠ করতেন তার কিছু কিছু বর্ণনা করেছেন। যেমন নতুন চাঁদ দেখা গেলে রাসূল (সা) যে দু’আ পড়তেন রাফে’ তা বর্ণনায় করেছেন।৩৪
হাদীস ও সীরাতের বিভিন্ন গ্রন্থে সন্ধান করলে রাফে’র (রা) জীবনের বহু ছোট ছোট কথা জানা যাবে। যা হবে একজন মুসলমানের জীবনে পথচলার জন্য আলোক বর্তিকাস্বরূপ।
তথ্যসূত্র:

আমর ইবন সাবিত ইবন ওয়াক্শ (রা)
‘আমর (রা)Ñএর উপাধি ুসাইরাম’। আর এ নামেই তিনি প্রসিদ্ধ। তিনি মদীনার আউস গোত্রের আবদুল আশহাল শাখার সন্তান। পিতার নাম সাবিত ইবন ওয়াকশ এবং মাতার নাম লায়লা মতান্তরে লুবাবা বিনত ইয়ামান। প্রখ্যাত সহাবী হুজাইফা ইবনুল ইয়ামানের (রা) বোন। উহুদের শহীদ সালাম ইবন সাবিত (রা) ‘আমরের ভাই।১
‘আমর (রা) প্রথম দিকে ইসলামের প্রতি ভীষণ বিরূপ ছিলেন। তাঁর গোত্রের প্রায় সকল নারী-পুরুষ সা’দ ইবন মু’য়াজের (রা) চেষ্টায় মুসলমান হয়ে যান। কিন্তু তখনও তিনি নিজের পুরাতন বিশ্বাস ও ধর্মের ওপর অটল থাকেন। বালাজুরী বলেন: তিি ইসলামের ব্যাপারে দারুণ সংশয়ের মধ্যে ছিলেন। উহুদের দিন ইসলাম গ্রহণ করেন এবং শহীদ হন। জীবনে কখনও নামায না পড়েও জান্নাতে প্রবেশ করেছেন।২
রাসূলে কারীম (সাঃ) যখন উহুদ যুদ্ধের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন তখন হঠাৎ করে আমরের (রা) অন্তরে সত্যের প্রতি কপ্রবল আবেগ সৃষ্টি হলো। সুানে আবী দাউদ প্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। জাহিলী আমলে তাঁর সূদী কারবার ছিল। অনেকের নিকট তাঁর বকেয়া অর্থ পাওনা ছিল। তিনি এই বকেয়া অর্থ উসূল করে ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ, ইসলাম সূদী লেনদেন নিষিদ্ধ গোষণা করেছিল। উহুদ যুদ্ধের সময় সম্ভবতঃ তাঁর বকেয়া পাওনা আদায় হয়ে গিয়েছিল। আর তখনই তিনি মুসলমান হওয়ার দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন।৩
উহুদে যাত্রার সময় উসাইরামের’ খান্দান আবদুল আশহালের লোকো সহ সকল সাহাবী রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে ছিলেন। উহুদের যোদ্ধারা চলে যাওয়ার পর মদীনার প্রতিটি মহল্লায় এটা ভয়স্কর নীরবতা নেমে আসে। উসাইরাম চারদিকে চারদিকে এমন নীরব ও নির্জন অবস্থা দেখে ঘরে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন: আমাদের খান্দানের লোকেরা কোথায় গেছে? উত্তর পেলেন: উহুদে।
যদিও তিনি তখন পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেননি। তাসত্ত্বেও যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হলেন এবং ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে উহুদের দিকে চললেন। সোজা উহুদে অবস্থানরত রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট পৌঁছে জিজ্ঞেস করলেন: আমি আগে যুদ্ধ করবো, না মুসলমান হবো? রাসূল (স) বললেন: দুইটিই করবে। আগে মুসলমান হও, পরে যুদ্ধে যাও। তিনি আরজ করলেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! জীবনে এক রাকা’য়াত নামাযও আমার পড়া হয়নি। এ অভস্থায় যদি আমি মারা যাই তাহলে আমার জন্য কি ভালো হবে? বললেন: ‘হাঁ, ভালো হবে।’ অতঃপর তিনি কালেমা পাঠ করে মুসলনান হলেন।
ইসলাম গ্রহণের পর তিনি তরবারি হাতে নিয়ে রণক্ষেত্রের দিকে চরলেন। তিনি যে ইসলাম গ্রহণ করেছেন, মুসলিম যোদ্ধাদের তা জানা ছিল না। তাই তাঁরা তাঁকে বললেন: ‘তুমি এখন থেকে ফিরে যাও। তিনি তাদেরকে বললেন: আমিও মুসলমান হয়েছি।’
যুদধ শুরু হলো। দারুণ বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে শত্র“র বিরুদ্ধে লড়লেন। শত্র“বাহিনীর ভিতরে ঢুকে পড়লে বহু আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হলে। আঘাত এত মারাত্মক ছল য, রণক্ষেত্রে নিস্তেজ হয়ে পড়ে ছিলেন, উঠারও শক্তি ছিল না। যুদ্ধ শেষে আবদুল আশহাল গোত্রের লোকেরা শহীদদের খোঁজে বের হয়ে, দেখলেন তাঁদের ইসাইরাম মৃতদের মধ্যে পড়ে আছে। শ্বাস-প্রশ্বাস তখনও চালু আছে। তারা জিজ্ঞেস করলেন: ‘তুমি এখানে এভাবে কেন? সম্ভবতঃ গোত্রের টানে এখানে এসেছো? তিনি বললেন: ‘না। আমি ইসলাম গ্রহণ করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করেছি।’
রণক্ষেত্র থেকে উঠিয়ে তাঁকে বাড়ীতে আনা হলো। গোটা খান্দানে তাঁর কথা ছড়িয়ে পড়লো। আবদুল আশহাল খান্দনের নেতা সা’দ ইবন মু’য়াজ (রা) খবর পেয়ে তাঁর বাড়ীতে ছুটে গেলেন এবং তাঁর বোনের কাছে কি ঘটেছে তা জানতে চাইলেন। মাুষের এ যাতায়াতের মধ্যেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে রাসূলে কারীম (সা) মন্তব্য করলেন: ‘আল্প শ্রমে প্রচুর বিনিময় লাভ করেছে।’ কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা) বলেছিলেন: ‘নিশ্চিত সে জান্নাতীদের অন্তর্গত।’
যেহেতু আমরের (রা) এ ঘটনাটি ছিল কিছুটা অস্বাভাবিক ধরনের। এ কারণে লোকেরা তাঁকে স্মরণ রাখর ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতেন। আবু হুরাইরা (রা) তাঁর নিষ্য-শাগরিদদেরকে প্রশ্ন করতেন: ‘সে আচ্ছা, তোমরা কি এমন কোন ব্যক্তির নাম জান যিনি জীবনে কখনও নামায আদায় করেননি, অথচ সোজা জান্নাতে চলে গেছেন?’ যখন কেউ উত্তর দিতে পারতো না তখন তিনি বলতেন: ‘তিনি আবদুল আশহালের উসাইরাম।:৪
উহুদে তাঁর ভাই সালামা ইবন সাবিত শাহাদাত বরণ করেন আু সুফইয়ান ইবন হারবের হাতে এবং তিনি নিজে আঘাতপ্রাপ্ত ও পরে শাহাদাত বরণ করেন দাররার ইবনুল খাততাবের হাতে।৫
তথ্যসূত্র:

রিফা’য়া ইবন রাফে’ইবন মলিক আয-যারকী (রা)
রিফায়া (রা)-এর ডাকনাম আবূ মু’য়াজ।১ তিনি মদীনার খাযরাজ গোত্রের ‘হুবলা’ শাখার সন্তান। পিতা রাফে’ ইবন মালিক (রা) এবং মাতা উম্মু মালিক বিন্ত উবাই ইবন সালূল। মাা মুনাফিক (কপট মুসলমান) নেতা আবদুল্লাহ ইবন উবাই-এর বোন।২
রিফায়া’র (লা) সম্মানিত পিতা রাফে’ (রা) ছিলেন খাযরাজ গোত্রের প্রথম মুসলমান। বাই’য়াতে আকাবার দুই বছর আগে পাঁচ/ছয়জন ইয়াসরিববাসীর সঙ্গে মক্কায় যান এবং ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর (সা) হতে বাই’য়াতে হন। তাঁর সম্মানিতা মাও মুসলমান হয়েছিলেন। এই মহিলার ভাই আবদুল্লাহ ইবন উবাই ছিল মদীনার কুফর ও নিফাকের কেন্দ্রবিন্দু। কিনতু তারই সহোদরা ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের উজ্জ্বল প্রদীপ স্বরূপ। রিফায়া (রা) এমনি এক মহান পারিবারে বেড়ে ওঠেন। পিতার সাথে মক্কায় যেয়ে আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াতে অংশগ্রহণ করেন এবং রাসূলুল্লাহর (সা) পবিত্র হাতে বাই’য়াত করেন। তারপর মদীনায় ফিরে আসেন।৩
সকল যুদ্ধ ও অভিযানে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে যোদ দেন। তাঁর বদরে যোগদানের কথা সাহীহ আল বুখারীর বর্ণনা দ্বারা প্রামণিত।৪ এ যুদ্ধে শত্র“ পক্ষে নিক্ষিপ্ত একটি তীর তাঁর চোখে আঘাত করে। রাসূল (সা) একটু থুথু দিয়ে দু’আ করলে তিনি সুস্থ হয়ে যান।৫ এই যুদ্ধে তাঁর অন্য দুই ভাইখাল্লাদ ও মালিক অংশগ্রহণ করেন।৬ উমাইর ইবন ওয়াহাব ছিল মক্কার কুরাইশদের এক নেতা। মক্কায় যারা রাসূলুল্লাহকে (সা) নানাভাবে কষ্ট দিত সে তাদের অন্যতম। রিফায়া বদরে তার ছেলে ওয়াহাবকে বন্দী করেন।৭
জামল ও সিফফীনের যুদ্ধে তিনি হযরত আলীর (রা) পক্ষে ছিলেন।৮ জামালের যুদ্ধে আয়িশা (রা), তালহা (রা) ও যুবাইরের (রা) যোদান বিষয়টি ভীষণ জটিল করে তোলে। রাসূলুল্লাহর (সা) চাচী াব্বাসের (রা) স্ত্রী উম্মুল ফাদল বিনত আল-হারেস মক্কা থেকে আলীকে চিঠি মারফত জানন যে, তালহা ও যুবাইর বসরায় গেছেন। এ খবর পেয়ে আলী দারুণ দুঃখ পেলেন। আক্ষেপের সুরে বললেন: তাঁদের আচরণে বিম্মিত হই। কারণ রাসূলে কারীমের ইনতিকালের পর আমরা নবী খান্দানের লোকেরা নিজেদেরকে খিলাফতের অধিক হকদার মনে করতে থাকি। আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা অন্যদেরকে খলীফা বানানো। ঝগড়া-বিবাদ ও অশান্তির কথা-বিবেচনা করে আমরা সব কিছু মেনে নিয়ে ধৈর্যধারণ করি। আল্লাহর শুকরিয়া যে, তার ফলাফল অতীব শুভ হয়েছে। এরপর লোকেরা বিদ্রোহী হয়ে খলীফা উসমানকে হত্যা করলো এবং কোন প্রকার জোর-জবরদস্তী ছাড়াই জনগণ আমাকে খলীফা নির্বাচন করলো। আমার হাতে বাই’য়াতকরীদের মধ্যে তালহা ও যুবাইরও ছিলেন। এক মাসও যেতে পারলো না, এখন তাদের সসৈন্য বসরায় যাওয়ার খর আসছে। হে আল্লাহ! আপনি এই ঝগড়া ও বিশৃংখলাকে দেখুন।
‘রিফায়া ইবন রাফে’ (রা) খলীফা আলীর (রা) ভাষণ শুনে বললেন: হে আমীরুল মুমিনীন! রাসূলুল্লাহর (সা) ইনতিকালের পর আমাদের মান-মর্যাদা ও দ্বীনের সাহায্য-সহায়তার প্রতি লক্ষ্য করে আমরা নিজেদেরকে খিলাফতের অধিক হকদার মনে করেছিলাম। তখন আপনরা রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে নিকট সম্পর্ক, ঈমানের অগ্রগামিতা এবং হিজরাত ইত্যাদির মত দুর্লভ সম্মান ও মর্যাদার দাবী করে আমাদের নিকট থেকে এক অধিকার চেয়ে নেন। আমরাও বিশআস করলাম যে, সত্য ও ন্যায়ের বাস্তবায়ন হচ্ছে, কিতাব ও সুনআহ অনুযায়ী কাজ হচ্ছে। আপনাদের দাবী আমরা মেনে নিলাম এবং খিলাফত কুরাইশদের হাতে অর্পণ করলাম। মূলতঃ আমাদের তাই করা সঙ্গত লি। এখন আপনার হাতে বাই’য়াত হওয়ার পর কিছু লোক বিপক্ষ হিসেবে দাঁড়েিয়ছে। এটা নিশ্চিত যে, আপনি তাদের থেকে উত্তম এবং আমাদের দৃষ্টিতে আপনিি অধিকতর গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। এখন বলুন, আপনি কি চান? আমরা আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় আছি।”
রিফায়া’র (া) ভাষণ শেষ হলে হাজ্জাজ ইবন গায়িয়্যা আল-আনসারী এগিয়ে বললেন: হে আমীরুল মুমিনীন! এই বিষয়টির এখন ফয়সালা করে নিন। এই পথে আমি জীবন দানের জন্য প্রস্তুত। তরপর তিনি আনসারদের সুোবধন করে বললেন: তোমরা পূর্বে যেমন রাসূলুল্লাহকে (সা) সহায্য করেছিলে, একণ তেমনি আমীরুল মুমিনীনকে সাহায্য কর। এই শেষের সাহায্য হুবহু প্রথম সাহায্যের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। যদিও প্রথম সাহায্য ছিল অধিকতর ভালো ও সম্মানীয়।৯
আলী (রা) এই বতৃতা-ভাষণের পর একটি বাহিনী নিয়ে ইরাক যান। রিফায়া’ (রা)ও সঙ্গী ছিলেন।
রিফায়া’র (রা) মৃত্য সন নিয়ে সামান্য মতপার্থক্য আছে। ইবনকানে’ বলেন: তিনি হিজরী ৪১, ৪২ অথবা ৪৩ সনে মরা যান। আর সেটা মু’য়াবিয়ার (রা) খিলাফতকালের প্রথম দিকে।১০ মৃত্যুকালে মু’য়াজ ও ইবাইদ নামে দুই ছেলে রেখে যান।
রিফায়া’ থেকে বেশ কিছু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিমে তাঁর কয়েকটি হাদীস সংকলিত হয়েছে। বুখারী তিনটি হাদীস এককভাবে বর্ণনা করেছেন।
রিফায়া’ (রা) রাসূলে কারীম (সা) ছাড়াও আবু বকর ও উবাদা ইবন সামিত থেক হাদীস শুনেছেন, আর তাঁর থেকে যাঁরা হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁদের মধ্যে ইয়াহইয়া ইবন খালিদ, আলী ইবন ইয়াহইয়া এবং ছেলে মু’য়াজ ও উবাইদ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।১১
তথ্যসূত্র:

’আবদুল্লাহ ইবন যায়িদ (রা)
’আবদুল্লাহর (রা) ডকনাম আবূ মুহাম্মদ এবং উপাধি ‘সাহিবুল আযান’। তিনি মদীনার খাযরাজ গোত্রের সন্তান। তাঁর পিতা-পিতামহের নাম বর্ণনার ক্ষেত্রে রিজাল’ শাস্ত্রবিদরা বেশ এলামেলো করে ফেলেছেন। ইবন সা’দ তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। ইবন হাজার ও মিাম আল-কুরতুবীও এই ওলট-পালটের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।১ ইবনুল ইমাদ আল-হাম্বলী তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন: তিনি একজন বদরী সাহাবী এবং যাঁকে সএপ্ন আযান দেখানো হয়েছিল।২ তিনি আকাবার দ্বিতীয় বাই’য়াতের (শপথ) একজন সদস্য। ইবন হিশাম আকাবায় বাই’য়াতকারীদের মধ্যে তাঁর নামটি উল্লেখ করে বলেছেন: তিনি বদরে যোগদান করেছেন এবং তাঁকে স্বপ্নে আযান দেখানো হয়েছিল। ইমাম জাাবীও একথা বলেছেন।৩
প্রথম হিজরী সনের আগ পর্যন্ত মানুষকে নামাযে সমবেত করার জন্য বিশেষ কোন পদ্ধতি চালু ছিল না। রাসূলে কারীম (সা) মদীনায় এসে মসজিদে নববী তৈরী কার পর নামাযের ঘোষনা দানের ব্যাপারে সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলে। তিনি বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ পেলেন। কেউ বললেন, নামাযের সময় হলে মসজিদের ওপরে একটি পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হোক। কেউ প্রস্তাব করলেন, ঘণটা বাজানো হোক। এভাবে শিঙ্গা ফুঁকানো, আগুন জ্বালানো ইত্যাদি ্রস্তাবও দেওয়া হলো। কিন্তু কান প্রস্তাই রাসূলুল্লাহর (সা) মনপূত হলো না। কারণ সেগুলো ইহুদী –নাসারাসহ কোন না কোন ধর্মাবলীম্বীদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও তখন এই ঘণ্টা জানানোর প্রস্তাবটির ওপর সকলে একমত হলেন। রাসূল (সা) এই প্রস্তাব অনুযায়ী ঘণ্টা বাজিয়ে মানুষকে নামাযে ডাকার জন্য অনুমতি দিয়ে বৈঠক শেষ করলেন।
সেদিন রাতেই আবদুল্লাহ (রা) স্বপ্নে দেখলেন যে, এক ব্যক্তি একটি ঘণ্টা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন: বিক্রী করবে? লোকটি প্রশ্ন করলো: কি করবে? তিনি বললেন: নামযের সময় বাজানো। লোকটি বললো: এর চেয়ে ভালো পদ্ধতি বলে দিচ্ছি। এই বলে আবদুল্লাহকে আযারে পদ ও বাক্যগুলি উচ্চারণ করে শিখিয়ে দিল। ঘুম থেকে জেগেই আবদুল্লাহ রাসূলুল্লাহর (সা) খিদমতে হাজরি হয়ে স্বপ্নের কথা বর্ণনা করলেন। রাসূল (সা) বললেন: এ স্বপ্নসত্য স্বপ্ন। তুমি যাও, বিলালকে শিখিয়ে দাও। সে আযান দিক। আবদুল্লাহবিলালকেস্বপ্নে প্রাপ্ত আযান শেখলেন এবং বিলাল আযান দিলেন। এটাই ছিল ইসলামের প্রথম আযান এবং এভাবে আযানের সূচনা হয়।
বিলালের (রা) কণ্ঠে আযানের ধ্বনি শুনে ‘উমার (রা) গায়ের চাদর টানতে টানতে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে এসে বললেন: আল্লাহর কসম! আমিও সবপেন এই ব্যাগুলি শুনেছিলাম। রাসূলে কারীম (সা) দুইজন মুসমানের স্বপ্নের মিলের জন্য আল্লাহ শুকরিয়া আদায় করেন।৪ আযানের পর লোকেরা নামাযের জন্য সারিবদ্ধ হলো। বিলাল (রা) ইকামাত দিতে যাবেন, এমন সময় ’আবদুল্লাহ বললেন, ইকামাত আমি বলবো।
আযনের জন্য বিলালকে (রা) নির্বাচন করার করণ হলো, আবদুল্লাহ চেয় তাঁর গলার আওয়ায ছিল বেশী বড়। সুতরাং সহীহ তিরমিযী গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সা) যখন আদুল্লাহকে বললেন, তুমি বিলালকে তোমার স্বপ্নে পাওয়া বাক্যগুলি শিখিয় দাও তখন একথাও বলেন যে, তোমার গলার আওয়ায অপেক্ষা তার গলার আওয়ায বড়।
এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, আযান যা মূলতঃ নামাযের ভূমিকা স্বরূপ এবং ইসলামে একটি বড় প্রতীক, তা ’আবদুল্লাহর (রা) মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বপ্নে অদৃশ্য থেকে আযানের শব্দ ও বাক্য লাভ, রাসূলুল্লাহ (সা) কর্তৃক তা সত্যায়ন এবং সর্ব সম্মতভাবে মুসলমানদের দ্বারা গৃহীত হওয়া-এ সবকিছুই আবদুল্লাহর (রা) জন্র এক ঈর্ষণীয় সম্মান ও মর্যাদা ছিল। আযানের প্রতিষ্ঠা ও প্রচলন সম্পর্কে এখানে আরো কিছু কথা বলা অগ্রাসঙ্গিক হবে না বলে আমরা মনে করি।
কিছু লোকের ধারণা উমার (রা) সর্বপ্রথম রাসূলকে (সা) আযানের প্রস্তাব দান করেন। সহীহ বুখারীর কেটি বর্ণনা দ্বারা এমনটিই বোঝা যায়। কিন্তু আসল ঘটনা হলো সেখানে আযানের বাক্যগুলির উল্লেখ পর্যন্ত নেই। শুধু এতটুকু আছে যে, উমার বললেন: আপনাদের মধ্য থেকে একজন রোক পাঠান যে নামাযের ঘোষণা দেবে। অতঃপর রাসূল (সা) বললেন: বিলাল ওঠো, নামাযের ঘোষণা দাও।৫
আবু দাউদের বর্ণনায় এসেছে উমার (রা) বিশ দিন পর্যন্ত স্বীয় স্বপ্নের কথা গোপন রাখেন। যখন বিলাল আযান দেন তখন তিনি নিজের সএপ্নর কথা রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট প্রকাশ করে। রাসূল (সা) বললেন, তুমি আগে কেন বলনি? উমার (রা) বললেন: আবদুল্লাহ আমার আগেই প্রকাশ করে দিয়েছে। এ কারণে আমার লজ্জা হচ্ছিল।৬
উপরোক্ত বর্ণনাটি যে উমারের (রা) স্বভাব-বৈশষ্ট্যির পরিপন্থী, সে কথা বাদ দিলেও ঘটনাটি পারিপর্শ্বিক অবস্থার সাথে মিল খায় না। কারণ, আযান সম্পর্কে যতগুলি বর্ণনা পাওয়া যায় তার মধ্যে যে বিষয়টি সকল বর্ণনায় এসেছে তা হলো, রাসূল (সা) দিনের বেলা পরামর্শ করেন। সেখানে একটি সিদ্ধান্ত গহীত হয়। ’আবদুল্লাহর (রা) হাদীস দ্বারা জানা যায়, ঘণ্টা বাজানোর ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছিল। মজলিস থেকে বাড়ী যান, রাতে স্বাপ্ন দেখেন এবং ফজরে আযান দেওয়া হয়। এই হিসাবে আবদুল্লাহর (রা) হাদীসটি বুখারী বর্ণিত ইবন উমারের (রা) হাদীসটির ব্যাখ্যা ও ভাষ্য। আবদুল্লাহ ইবন যায়িদের (রা) হাদীসটি ইমাম বুখারীর জানা ছিল। কিন্তু তাঁর নির্ধারিত শর্তের নিরীক্ষে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় সহীহ গ্রন্থে সংকলন করেননি।৭
প্রকৃতপক্ষে এইসব বর্ণনা দ্বারা কারো আগে পিছের ফয়সালা করা যায় না। সম্ভবতঃ ইমাম বুখারী এ কারণে ইচ্ছাকৃতভাবে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। তা না হলে তাবারানীর বর্ণনামতে আবু বকরও (রা) আযানের স্বাপ্ন দেখেন। ইমাম আল গাজালী আল-ওয়াসীর গ্রন্থ লিছেন দশজনেরও অধিক ব্যক্তি স্বপ্নে আযান দেখেছিলেন। শহরে তানবীহ গ্রন্থে চৌদ্দ ব্যক্তির কথা উল্লেখ আছে। তবে মুহাদ্দিসীনের নিকট এ সকল বর্ণনা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উপযুক্ত নয়। শুধুমাত্র আবদুল্লাহ ইবন যায়িদ এবং কোন ােন সনদে ইবন উমারের (রা) বর্ণনাটি সঠিক ও প্রমাণের পর্যায়ে পৌঁছে। তার মধ্যে আবদুল্লাহ ইবন যায়িদের বর্ণনাটি একাধিক সনদে এসেছে এবং সহাবীদের একটি দল এ কাহিনী বর্ণনা করেছেন।
যাই হোক আযানের স্বপ্ন যে কেউ প্রথমে দেখুন না কেন, ¯প্নটি ও তার ব্যাাখ্যা আবদুল্লাহ ইবন যায়িদের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। এ কারণে তিনি সাহিবুল আযান লকবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন।৮
এত বড় গৌরবের অধিকারি হওয়ার পরেও আরো বহু সৌভাগ্য তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল। হিজরী দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধ হয়। এতে তিনি এবং তাঁর ভাই হুয়াইরিস ইবন যায়িদ অংশগ্রহণ করেন।৯ এর পরে খন্দক, উহুদসহ যত যুদধ হয়েছে সবগুরিতে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। মক্কা বিজয় অভিযানে তিনি শরীক ছিলেন এবং বনু আল-হারেস ইবন খাযরাজের পতাকাটি ছিল তাঁর হাতে। বিদ্যায় হ্েজও তিনি অংশগ্রহণ করেন। এ সময় রাসূলে কারীম (সা) যখন ছাগল-উট বণ্টন করেছিলেন তখন তিনি নিকটে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাসূল (সা) তাঁকে কিছুই দেননি। কিন্তু তাঁর ভাগ্যে ছিল অন্য জিনিস। রাসূল (সা) মাথা ন্যাড়া ও নখ কাটার সময় তাঁকে কিছু কেশ ও নখ দান কনের। অবশিষ্ট কেশ ও নখগুলি অন্যদের মধ্যে বণ্টন করেন। এই কেশ ছিল মেহেন্দী রঞ্জিত। আবদুল্লাহর বংশধরদের মধ্যে এ কেশ ও নখ বরকতের প্রতীক হিসেবে বহুকাল রক্ষিত ছিল।১০
তাবুক অভিযান থেকে মদীনায় ফেরার পর রাসূলে কারীমের (সা) নিকট হিমইয়ার রাজন্যবর্গের পত্রসহ দূত আসে। পত্রে তাঁরা ইসলাম গ্রহণের কথা জানান। রাসূল (সা) তাঁদের পত্রের জবাব এবং তাঁদেরকে ইসলামের বিধি-বিধান শেখানো ও যাকাত-সাদকা আদায়ের জন্য মু’য়াজ ইবন জাবালের নেতৃত্বে একট প্রতিনিধিল পাঠান। এই দলটির মধ্যে আবদুল্লাহ ইবন যায়িদও ছিলেন।১১
আবদুল্লাহর (রা) ছেল মুহাম্মদ বলেন, আমার পিতা হিজরী ৩২ (বত্রিশ) সনে ৬৪ (চৌষট্টি) বছর বয়সে মদীনায় ইনতিকাল করেন। জানাযার নমায পড়ান খলীফা উসমান (রা)।১২ তবে আল-হাকেমসহ অনেকের ধারণা, তিনি উহুদে শাহাদাত বরণ করে। প্রমণ স্বরূপ তাঁরাএই ঘটনা উপস্থাপন করেন যে, একবার আবদুলÍাহর (রা) এক কন্যা উমারের (রা) নিকট এসে বরেন, আমার পিতা একজন বদরী সাহাবী এবং উহুদে শাহাদাত বণকারী। উমার (রা) বললেন, এখন তোমার দাবী কি? তারপর তিনি কিচু সাহায্য প্রাপ্তির আবেদন জানালে তিনি তা দান করেন। এটা আল-হুলইয়ার বর্ণনা। তবে মুসনাদসহ রিজাল শাস্ত্রের প্রায় সকল গ্রন্থে হিজরী ৩২ সনর বর্ণনা এসেছে। তাছাড়া উহুদে শহীদ হওয়ার কথা হাকেম বললেনও তিনি আবার আল-মুসতাদরিক গ্রন্থে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন।১৩
তাঁর সন্তানাদির মধ্যে এক ছেলে ও এক মেয়ের কথা জানা যায়। ছেলের নাম ছিল মুহাম্মাদ। তাঁর জন্ম হয় রাসূলে কারীমের (সা) জবিদ্দশায়। তিনি বলেছেন, আমার পিতা না খাটো ছিলেন না লম্বা। ত৭ার দৈহিক গঠন ছিল মধ্যমাকৃতির।১৪ তিনি আরবীতে লিখতে জানতেন।১৫
আবদুল্লাহর (রা) এক পৌত্র শির ইবন মুহাম্মাদ একার উমার ইবন আবদিল আযীযের দরবারে যান এবং নিরে পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন: আমি একজন আকাবী বদরী ব্যক্তির পৌত্র-যাঁকে সএপ্ন আযান দেখানো হয়েছিল। তখন উমার পাশে উপস্থিত শামবাসীদেরকে কবিতার একটি শ্লোক আবৃত্তি করে শোনান।১৬
ইমাম বুখারী লিখেছেন, আযান বিষয়ে তাঁর সূত্রে একটি মাত্র হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ইমাম তিরমিযীও এ কথা সমর্থন করেছেন। কিনউ হাফেজ ইবন হাজার আল-আসকালাসী তাঁর সূত্রে বর্নিত ছয়টি হাদীস পেয়েছেন এবং তা তিনি একটি পৃথক অংশে সংকলন করেছেন বল উল্লেখ করেছেন।১৭ আল্লামাহ্ জাহাবী বলেছেন, তাঁর সনদে অল্প কয়েকট হাদীস পাওয়া যায়।১৮
আবদুল্লাহর (রা) মুখ থেকে যাঁরা হাদীস শুনেছন এবং বর্ণনা করেছেন তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন: তাঁর ছেলে মুহাম্মদ, পৌত্র আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ, সা’ঈদ ইবন মুসায়্যিব, আবদুর রহমান ইবন আবী লায়লা, আবূ বকর ইবন মুহাম্মাদ ইবন আমর ইবন হাযাম প্রমুখ।১৯
অভাব ও দারিদ্রের মধ্যেও আল্লাহর রাস্তায় সবকিছু দান করা আখলাকের এক উন্নততর বৈশিষ্ট। আবদুল্লাহর (রা) বিষয় সম্পদ ছিল অতি সামান্য। যা দিয়ে তিনি পরিবরের ভারণ-পোষণ করতেন। বর্ণিত হয়েছে, একদিন তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার ইে বাগিচাটি আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) উদ্দেশ্যে সদাকা করে দিলাম এর পরেই তাঁর পিতা-মাতা রাসূলের (সা) খিদমতে হাজির হয়ে আরজ করেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই বাগিচাটির আয় দিয়েই আমরা জীবন ধারণ করি। রাসূল (সা) তখন তাঁদেরকে বাগিচাটি ফেরত দেন। কিছু দিন পর তাঁরা মরা গেলে তাঁদের দুই ছেলে এই বাগিচাটির উত্তরাধিকারী হন।২০
তথ্যসূত্র:

সাবিত ইবন কায়স (রা)
সাবিতের (রা) ডাকনাম আবু মুহাম্মাদ বা আবু ’আবদির রহমান। ‘খতীবু রাসূলিল্লাহ’ (রাসূলুল্লাহর বক্তা) তাঁর উপাধি।১ মদীনার খাযরাজ গোত্রের সন্তান। পিতা কায়স ইবন শাম্মাস। তাাত তাঈ গোত্রের কন্যা হিন্দা, মতান্তরে কাবশা বিনত ওয়াকিদ। আদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা ও উমরা বিনত রাওয়াহা তাঁর বৈপিত্রীয় ভাই-বোন।২
সাবতি (রা) ছিলেন অতি মর্যাদাবান সাহাবীদের একজন। রাসূলুল্লাহর (সা) হিজরাতের পূর্বে ইসলামগ্রহণ করেন। ইবন ইসহাক বলেন: একটি বর্ণনা মতে রাসূল (সা) আম্মার ইবন ইয়াসিরের সাথে তাঁর মুওয়াখাত বা ভ্রাতৃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন।৩
রাসূল কারীম (সা) মক্কা থেকে ইয়াসরিবে পদার্পণ করলে গোটা শহরবাসী তাঁকে বরণ করার জন্য আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। আনাস (রা) বলেন: এই উপলক্ষে সাবিত একটি ভাষণ দান করেন। ভাষণের কে পর্যায়ে তিনি বলেন: ‘আমরা আপনাকে সেই সব জিনিস থেকেরক্ষা করবো যা থেকে আমরা নিজেদের জীবন ও সন্তানদের রক্ষা করে থাকি। কিন্তু বিনিময়ে আমরা কী পাব? জবাবে রাসূল (সা) বলেন: তোমরা জান্নাত পাবে। তখন সমবেত জনতা সমন্বরে বলে ওঠে: আমরা এ বিনমিয়ে রাজি।৪
সাগাযী শাস্ত্রবিদরা সাবিতকে (রা) বদরী সাহাবীদের মধ্যে গণ্য করেননি। তবে ইবন হাজার আল-আসকিলানী তাহজীবুত তাহজীব’ গ্রন্থে তাঁকে বদরী সাহাবী বলে মত প্রকাশ করেছেন।৫ মাগযী শাস্ত্রবিদরা বলেছেন: তাঁর সর্বপ্রথম যুদধ হলো উহুদ। তারপর সকল যুদ্ধ ও অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন।৬ বাই’য়াতে রিদওয়ানেও তিনি অংশগ্রহণ করেন।৭
হিজরী ৫ম সনে মদীনার উহুদী গোত্র বনু কুরায়জার অবরোধ ও বিতাড়ন অভিযানে সাবিত (রা) অংশগ্রহণ করেন। বনু কুরায়জা অবশেষ তাদের পুরাতন বন্ধু সা’দ ইবন মু’য়াজের হাতে তাদের ভাগ্য ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। সা’ঈ ইবন মু’য়াজের বিচারে তাদের অপরাধী পুরুষদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়। ইবন সিহাক ইবন শিহাব আয-যুহরীর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। এ সময় সাবিত ইবন কায়স যান যাবীর ইবন বাত আল-কুরাজীব সাথে দেখা করতে। এ যাবীর ছিল বনু কুরায়জার এক বৃদ্ধ ইহুদী। জাহিলী আমলের বু’য়াস যুদ্ধে সাতি বন্দী হলে এই যাবীর তাঁকে ছেড়ে দেয়। এই ঋণ পরিশোধের আশায় এ বিপদের সময় সাবিত তার সমনে যান। যাবীর তখণ কে বৃদ্ধ। সে বসাবিতকে বললো: আবু আবদির রহমান, তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছো? সাবিত বললেন: আমার মত মানুষ কি আপনার মত মানুষকে ভুলতে পারে? আমি আজ এসেছি আপনার ঋণ পরিশোধের আশায়।যাবীর বললো: মহৎ ব্যক্তি মহৎ ব্যক্তিদের প্রতিদান দেয়।
এরপর সাবিত রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার ওপর যাবীরের একটি বড় অনুগ্রহ আছে। আমি তার প্রতিদান দিতে চাই। তর রক্ত আমাকে দান করুন। রাসূল (সা) তাঁর আবেদন মঞ্জুর করে বলেন: হাঁ, তাই হোক। সাবিত যাবীরের নিকট যেয়ে বলেন: রাসূল (সা) তোমাারর্ তা আমাকে দান করেছেন। আর আমি তা আমাকে ফিরিয়ে দিলাম। যাবীর বললো: এখন আমি একজন পরিবার-পরিজনহীন বৃদ্ধ, জীবন দিয়ে আমার কি হবে? সাবিত রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট ফিরে গিয়ে বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যাবীরের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে আমাকে দান করুন। রাসূল (সা) বললেন: হাঁ, তারা তোমার। সাতি যাবীরের নিকট ফিরে গিয়ে বললেন: রাসূল (সা) তোমার পরিবার-পরিজন ও সনতানদেরকে ামাকে দান করেছেন। আমি তাদের সকলকে তোমাকে দিলাম। তখন বৃদ্ধ যাবীর বললো: হিজাযের একটি পরিবার-যাদের কোন অর্থ-সম্পদ নেই, তারা বাঁচবে কেমন করে? সাবিত আবার রাসূলুল্লাহর (স) নিকট এসে তাদের অর্থ, সম্পদ চেয়ে নিলেন এবং যাবীরের নিকট ফিরে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) যে তার সকল সম্পদ ফেরত দিয়েছেন, সে কথা তাকে জানালেন।
এরপর বৃদ্ধ বললো: ওহে সাবিত! চীনা আয়নার মত যে যুবকের চেহারা, সেখানে গোত্রের সকর কুমারী মেয়ের চেহারা দেখা যে, সেই কা’ব ইবন আসাদের রিণতি কি হয়েছে? সাবিত বললো: সে তো নিহত হয়েছে। যাবীর বললো: আমাদের আনন্দ-বিপদে যে ব্যক্তি আগে আগে থাকতো, আমরা পালালে যে আমাদের রক্ষা করতো, সেই আযযাল ইবন সামায়াল এর কি দশা হয়েছে? সাবিত বললেন: সেও নিহত হয়েছে। যাবীর আবার জানতে চাইলো: মজলিস দুইটি অর্থাৎ বনু কাঃব ইবন কুরায়জা ও বনু আমর বিন কুরায়জার পরিণতি কি হয়েছে? সাবিত বললো: তাদেরকে হত্যার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যাবীর বললো: ওহে সাবিত! তোমার ওপর আমার যে অনুগ্রহা আছে, তার বিনিময়ে তুমি আমাকে আমার কাওমের পরিণতি বরণ করার সুযোগ করে দাও। আল্লাহর কসম! তাদের অবর্তমানে আমার বেঁচে থেকে ােন লাভ নেই। তাদের ছড়া শুদু জীবন নিয়ে বেঁচে থাকর ধৈর্য আমার নেই।৮
হিজরী ৬ষ্ঠ সনে বনু আল-মুসতালিক যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে শত্র“ পক্ষের নেতার কন্যা জুওয়াইরিয়্যা রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে সাক্ষাৎ করে সাহায্য প্রার্থনা করেন। রাসূল (সা) তাঁর চুক্তিকৃত সোনা পরিশোধ করে চিরদিনের জন্য তাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দেন। অতঃপর তাঁর সম্মাতিক্রমে তাঁকে বিবাহ সন্ধনে আবদ্ধ করে উম্মুল মুমিনীনের মর্যাদা দান করেন।৯
এই বনু আল-মুসতালিকের যুদ্ধের সময় ইফক বা মিথ্যা ও বানোয়াট কলঙ্ক আরোপের ঘটনা ঘটে। যা মূলতঃ উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রা) ও সাফওয়ান ইবনুল মু’য়াত্তালকে কেন্দ্র করে মুনাফিকরা রটনা করে। এই ঘটনা রাসূলে কারীম (সা) সহ গোটা মুসলিম সমাজের কিছুদিনের জন্য ভীষণ বিব্রতকর অবসথায় ফেলে। কিছু সরলপ্রাণ মুসলমানও এ মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্র্তা হয়। ইতিহাস ও রিজাল শাস্ত্রের গ্র্থসমুহে দেখা যায় শা’য়িরুর রাসূল হাসসান ইবন সাবিতও এর সাথে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় তিনি সফওয়ান ও তাঁর মুদর গোত্রের সমালোচনায় কেটি কবিতাও রচনা করেন। যখন এই ঘটনর রহস্য উম্মোচন করে কুরআনের আয়াত নাযিল হলো তখন সাফওয়ান একদিন তরবারি হাতে নিয়ে হাসসানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ সময় সাবিত ইবন কায়স পাশেই ছিলেন। তিনিদ্রু সাফওয়ানকে ধরে তাঁর হাত দুইটি গলার সাথে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলেন। এ বাধা অবস্থায় তাঁকে বনু আল-হারেস ইবনুল খাযরাজের মহল্লআয় নিয়ে যান। সেখানে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার সাথে দেখা হয়। তিনি বলেন: এ কি? সাবিত বলেন: হাসসানকে সে তরবারি দিয়ে মেরে ফেলুক তাতে কি তুমি খুশী হবে? আল্লাহর কসম! এই সাফওয়ানতো তাঁকে হত্যা করেই ফেলেছিল। আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা বললেন: তুমি যা করেছো তাকি রাসূল (সা) জেনেছেন? সাবিত বললেন: না। আবদুলÍাহ বললেন: তাহলে তুমি খুব দুঃসাহসের কা করেছো। তাকে ছেড়ে দাও। সাবিত তাকে ছেড়ে দিলেন। তারপর সবাই রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট আসলেন এবং পুরো ঘটনা তাঁকে খুলে বললেন। তারপর সবাই রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট আসলেন এবঙ পুরো ঘটনা তাঁকে খুলে বললেন। রাসূল (সা) তাঁদের মধ্যে একটা আপোষ করে দেন।১০
হিজরী নবম সনে মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট বনু তামীম গোত্রের একটি প্রতিনিধিদল আসে। বেদুঈন কালচার অনুযায়ী তারা সোজা রাসূলুল্লাহর (সা) ঘরের দরজায় এসে হাঁক দেয়: মুহাম্মদ! বাইরে আসুন।’ রাসূল (সা) বাইরে এসে তাদের সাথে আলোচনায় বসেন। এক পযৃায়ে আরবের প্রথা অনুযায়ী তারা তাদের তুখোড় বক্তা উতারিদ ইবন হাজিরকে দাঁড় করিযে দেয় তাদের সম্মান ও প্রতিপত্তির কথা রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট তুলে ধরার জন্য। উতারিদ এক দীর্ঘ ভাষণে তার গোত্রের গৌরব ও কীর্তির কথা বর্ণনা করে।তার ভাষণ শেষ হলে রাসূল (সা) তার জবাব দানের জন্য সাবিত ইবন কায়সকে নির্দেশ দেন। সবিত অতি বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল ভাষায় আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল ও ইসলামের পরিচয় তুরে ধরেন। তার ভাষণ শেষে বনু তামীমের প্রতিনিধিদল মন্তব্র কর: আমাদের বাবার শপথ! তাঁর খতীব (বক্তা) আমাদের খতীব অপেক্ষা উত্তম। রাসূল (সা) ও মুসলমানরাও তাঁর ভষণ শুনে দারুণ খুশী হন।১১
এ প্রসঙ্গে ইবন হিশাম বলেন: সাবিত দাঁড়িয়ে ভাষণ দেন। তিনি বলেন:১২ আকাশ ও পৃথিবী যে আল্লাহ সৃষ্টি, সকল প্রশংসা তাঁর। যিনি আকাশ-পৃথিবীর সবকিচু র্ধিারণ করেছেন। যাঁর কুরসী তাঁর জ্ঞানের সমান প্রশস্ত। তাঁর অনুগ্রহ ও করুণা ছাড়া কোন কিছুই হতে পারে না। এ তাঁরইকুদরাত যে, তিনি আমাদেরকে বাদশাহ বানিয়েছেন, তাঁর সর্বোত্তম সৃষ্টিকে রাসূল মনোনীত করেছেন। বংশের দিক দিয়ে তাঁকে সম্মানিত এবং সত্যবাদী করেছেন। তাঁর নিকট কিতাব নাযিল করে সৃষ্টির প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পরিপূর্ণ করেছেন। সুতরাং তিনি সৃষ্টিজগতের মধ্যে সর্বোত্তম সত্তায় পরিণত হয়েছেন। তিনি মানুষকে তাঁর প্রতি ঈমান আনার আহবানজানান। সে আহবানে সাড়া দিয়ে তাঁর কাওমের মুহাজিরগণ তাঁর প্রতি ঈমান আনেন। তাঁরা বংশগতভাবে সর্বাধিক সম্মানিত, চেহারার দিক দিয়ে সর্বাধিক সুদর্শন ও কর্মের দিক দিয়ে সর্বোত্তম মানষ। তাঁদের পরে রাসূলের আহবানে সাড়া দানকারী জনগণ আমরা। আমরা আল্লাহর আনসার এবং তাঁর রাসূলের উযীর। আমরা মানুষের বিরুদ্ধে জিহাদ করবো যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে, সে আমাদের হাত থেকে তাঁর জীবন ও ধন-সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আর যে অস্বীকার করবে তার বিরুদ্ধে আমরা চিরকাল জিহাদ করবো। তাকেহত্রা করা আমাদের জন্য খুবই সহজ। আমরা বক্তব্য এতটুকু। আমি আল্লাহর নিকট আমার নিজের এবং সকল মুসলিম নর-নারীর জন্য ক্ষমা ও ইসতিগফার কামনা করি। ওয়াসসালামু আলাইকুম।
এই হিজরী নবম সনেই মুসায়লামা আল-কাজ্জাব বনু হানীফার একদল লোক সংগে করে মদীনায় আসে। খবর পেয়ে রাসূলে কারীম (সা) সাবিত ইবন কায়সকে সংগে করে মুসায়লামার অবস্থান স্থল আল-হারিস ইবন কুরায়েরে গৃহে যান। রাসূলে কারীমের (সা) হাতে ছিল একটি ছড়ি। আরোচনর এ পর্যায়ে মুসায়লাম বললো: আপনি যদি আপনার পরে আমাকে খলীফা বানাাে প্রতিশ্র“তি দেন, তাহলে আমি আপনার অনুসারী হতে পারি। রাূল (সা) বললেন: খিলাপাত দূরে থাক, আমি আমার হাতের এই ছড়িটিও তোমাকে দেওয়ার উপযুক্ত মনে করিনে। আল্লাহ তোমার ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা হবেই। আমি তোমার পরিণতি স্বপ্নে দেখেছি। তোমার আর কো কথা থাকলে এই সাবিত আছে, তাকেই বলো। আমি যাচ্ছি।১৩
রাসূলে কারীমের (সা) ইনতিকালের পর মদনিার আনসারগণ তাদের নেতা সা’দ ইবন ক্ষাদাকে খলীফা নির্বাচিত করার উদ্দেশ্যে সকীফা বনী সা’য়েদায় সমবেত হয়। এ খবর আবু বকরের (রা) কানে পৌঁছলে তিনি ুমার (রা) ও অন্যদের সংগে নিয়ে সমাবেশে উপস্থিত হন। সেখানে ানেকের মত সাবিত ইবন কায়সও জনগণকে লক্ষ্য করে একটি ভাষক দেন। তার কিছু অংশ নিুরূপ: আম্মা বাঃদ! আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী আনসর এবং ইসলামের সৈনিক। আর আপনারা মুহাজিরগণ, একটি ছোট্ট সম্প্রদায়। এরপর কিচু লোক আমাদেরকে খিলাফত থেকে বঞ্চিত করতে চায়। এটাই আশ্চার্য় বিষয়।’ জবাবে আবু বকর (রা) বলেন: তুমি যা বলেছো, তা ঠিক। তবে খলীফা কুরাইশদের মধ্য থেকেই হতে হবে।
আবু বকর (রা) খলীফা হওয়ার পইে ভণ্ড নবী তুলাইহার বিরুদ্ধে সেনা অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ (রা)। আনসার মুজাহিদরা ছিলেন সাবিতের পরিচালনাধীন।১৪
হিজরী বারো সনে ভণ্ড নবী মুসায়লামা আল-কাজ্জাবের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান পরিচালিত হয়। সাবিত (রা)ও অভিযানে শরীফ ছিলেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুসলমানদের পরাজয় হয় এবং মুসলিম বাহিনী বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। এ সময় আনাস (রা) তাঁকে বলেন: চাচা, যা হয়েছে আপনি দেখলেন তো। সাবিত তখন সুগন্ধি মাখছিলেন। তিনি বললেন: এটা যুদেধর কোন পদ্ধতি নয়। রাসূলুল্লাহর (সা) সময় মানুষ এভাবে যুদ্ধ করতো না। হে আল্লাহ! এই লোকেরা য করেছে তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।১৫ তিনি আরও বলেন: এই সকল লোক ও তারা যার পূজারী এবং তারা যা করেছে, সব কিছুর জন্য দুঃখ হয়। এরপর যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন এবং মুসায়লামার দূর্গের ফটকে দাঁড়ানো এক সৈকিককেহত্যা করেন এবং নিজেও শাহাদাত বরণ করেন।১৬
তাঁর দেহের বর্মটি অবিকৃত অবস্থায় ছিল। একজন মুসলিম সৈনিক সেটি খুলে নেয়। এক রাতে অন্য একজন মুসরিম নৈসিক স্বপ্নে দেখেন যে, সাবিত (রা) তাকে বলছেন, অমুক মুসলমান আমার দেহ থেকে বমৃটি খুলে নিয়েছে। তুমি খালিদকে বল, তিনি যেন তর কাছ থেকে বর্মটি নিয়ে নেন এবং মদীনায় পৌঁছে আবু বকরকে বলেন: সাবিত এত পরিমাণ ঋণী আচে। এই বর্মটি বিক্রী করে তা যেন পরিশেধ করে দেন। আর আমার অমুক দাসটিও যেন মুক্ত করে দেন। খঅলিদ (রা) সেই লোকটির নিকট থেকে বর্মটি নিয়ে নেন এবং আবু বকর (া) সাবিতের অসীয়াত মত কাজ করন। এ ঘটনা সহীহ বুখারীতে সংক্ষেপে উল্লেখ আছে। তে তাবারানী আনসের (রা) সনদে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।১৭
সাবিত (রা) বেশ কয়েকজন বংশধর রেখে যান। তাঁর কে মেয়ে ছিল; কিন্তু তার নাম জানা যায় না। ছেলেদের নাম: মুহাম্মদ ইয়াহইয়া, কায়স আবদুল্লাহ, ইসমা’ঈল আবান মুহাম্মদ, ইয়াসহয়িাহ ও আবদুল্লাহ আল-হাররার দিন শাহাদাত বণ করেন।১৮ তাঁর এক পৌত্র আদী ইবন আবান কূফার একজন খ্যাতিমান মুহাদ্দিস ছিলেন।১৯
সাবিতের স্ত্রীর নাম ছিল জামীলা। তিনি ছিলেন মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবন সালূলের কন্যা। ২০ জীবনের এক পর্যায়ে সবিতের (রা সাথে তাঁর ছাড়াছাড়ি হযে যায়। ইমাম জাহাবী বলেন, সাবিত সেই ব্যক্তি যাঁর স্ত্রী জামীলা রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে অভিযোগ করে বলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আর সাবিতের সঙ্গে নেই। রাসূল (সা) বললেন: তুমি কি তার বাগান তাকে ফেরত দিতে চাও? বললেন: হাঁ। এরপর জামীলা সােিতর নিকট থেকে খুলা তলাক নেন।২১ বর্ণিত হয়েছে, এ সময় জামীলা সন্তান সম্ভাবা ছিলেন। তালাক গ্রহণের কিছু দিন পর একটি পুত্র সন্তান প্রসবকরেন। সন্তানটি কাপড়ে পেঁটিয়ে পিতা সাবিতের নিকট পাঠানো হয়। সাবিত শিশুটিকে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট নিয়ে গেলে তিনি তাহনীক করে মুহাম্মদ নাম রাখেন। পিতা তার লালন-পালনের জন্য একজন ধাত্রী নিযোগ করেন।২২
সাবিত (লা) রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর থেকে যাঁরা হাদসি বর্ণনা করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন তঁর সন্তানরা। যেমন: মুহাম্মদ, কায়স ও ইসমা’ঈল। তছাড়া আনাস ইবন মালিক, আবদুর রহমান ইবন আবী লায়লা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। সহীহ গ্রন্থে তাঁর একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।২৩
ইবন ইসহাক বলেন: সাবিত (রা) ছিলে উচ্চ কষ্ঠস্বরের অধিকারী ও বিশুদ্ধভাষী, বাগ্মী পুরুষ।২৪ মদনিার আসার সম্প্রদায় তাঁকে তাদের খতীব (বক্তা) নির্বাচন করেন। রাসূলে কারীমও (সা) তাঁকে স্বীয় দরবারে খতীবের মর্যাদা দান করেন।২৫ ইমাম আল-কুরতুবী বলেন: তিনি ছিলেন আনসারদের খতীব। পরবর্তীকালে খতীবু রাসূলিল্লাহ’ (রাসূলুল্লাহর খতীব) উপাধি লাভ করেন, যেমন হাস্সান ইবন সাবিত (রা) লাভ করেন ‘শা’য়িরু রাসূলুল্লাহ’ (রাসূলুল্লাহর (সা) কবি) উপাধি।২৬
সাবিতের (রা) চরিত্রের সুন্দরমত বৈশিষ্ট্য হলো রাসূলে পাকের (সা) প্রতি সীমাহীন শ্রদধা ও ভালোবাসা। রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে না-জানি কোন বেয়াদবী হয়ে যায়, সব সময় তিনি এ ভয়ে থাকতেন। ইমাম মুসলম আাসের (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন। যখন সূরা আল-হুজুরাত এর দ্বিতীয় আয়াত মুমিনগণ! তোমরা নীর কষ্ঠস্বরের উপর তোমাদের কষ্ঠস্বর উঁচু করো না এবঙ তোমরা একে অপরের সাথে যেরূপ উঁচু স্বরে কথা বল, তাঁর সাথে সেরূপ উঁচুস্বরে কথা বলোনা। এতে ােমাদের কর্ম নিস্ফল হয়ে যাবে এবং তোমরা টেরও যাবে না।’ নাযিল হলো তখন হযরত সাবিত ঘরের দরযা বন্ধ করে বসে থাকলেন। তিনি বলতে লাগলেন: আমি একজন জাহান্নামের মানুষ। রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট যাওয়া আসাও ছেড়ে দিলেন। একদিন রাসূল (সা) সা’দ ইবন মু’য়াজকে জিজ্ঞেস করলেন: আবু আমার! সাবিতের কি হয়েছে? সে কি অসুস্থ? সা’দ বললেন: না, সে ভালো আছে। কোন অসুবিধের কথা তো আমি জানিনে। এরপর সা’দ সাবিতের নিকট এসে রাসূলুল্লাহর (সা) কথা তাঁকে বললেন। তখন সাবিত বললেন: সূরা আল-হুজুরাতের এ আয়াত নাযিল হয়েছে। আরতোমরা তো জান আমি তোমাদের সকলের চেয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট জোরে কথা বলি। আমি জাহান্নামী হয়ে গেছি। সা’দ তাঁর একথা রাসূলুল্লাহর (সা) জানালে তিনি বললেন: না, সে জাহান্নামী নয়, সে জাননাতের অধিকারী।২৭ অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে সাবিত (রা) বলেন: আমি একজন উঁচু কষ্ঠস্বরের মানুষ। আমার ভয় হচ্ছে, আমার সব আমল বরবাদ হয় গেছে কিনা। একথা শুনে রাসূল (সা) বললেন: সাবিত, তুমি তাদের কেউ নও! শুভ ও কল্যাণের সাথে এ পৃথিবীতে তুমি বাঁচবে বেং শুভ ও কল্যাণের উপর মৃত্যু হবে।২৮
যখন সূরা আন-নিসার ৩৬তম আয়াতের এই অংশÑনিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-গর্বিতজনকে’Ñনাযিল হলো তখন সাবিত (রা) ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদতে আরম্ভ করলেন। রাসূল (সা) তাঁকে না দেখে খোঁজা লোক পাঠালেন। তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) খিদমতে হাজির হয়ে বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি সুন্দরকে ভালোবাসি। আমি পছন্দ কর আমার সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব। আমার ভয় হচ্ছে আমি এ আয়াতের আওতায় পড়ে গিয়েছি কিনা।। রাসূল (সা) বললেন: তুমি তাদের অন্তভূক্ত নও। তোমর পার্থিব জীভন হবে প্রশংসিত। আর তেমার এ জীবনের সমাপ্তি হবে শাহাদাতের মাধ্যমে এবং আখেরাতে তুমি হবে জান্নাতের অধিবাসী।২৯
সাবিতের (রা) ছেরে মুহাম্মাদ বরেন: একবার তার পিতা সাবিত রাসূলকে (সা) বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার ভয় হয়, আমি ধ্বংস হয়ে না যাই। রাসূল (সা) প্রশ্ন করলেন: কেন? সাবিত বললেণ: আমার যে কাজ করিনি তার জন্য আমাদের প্রশংসা করা হোক, এমন ইচ্ছাপোষন করতে আলÍাহ আমাদেরকে নিষেধ করেছেন। অথচ আমার মনে হয়েছে আমি প্রশংসা পছন্দ করি। আল্লাহ আমাদেরকে গর্ব ও অহঙ্কার করতে বারণ করেছেন। অথচ আমি সুন্দরকে ভালোবসি। আপার কষ্ঠস্বরের উপর আমাদের কষ্ঠস্বর উঁচু কতে আমাদেরকে বারণ করা হয়েছে। কিন্তু আমি একজন উচ্চকষ্ঠের মানুষ। তাঁর কথা শেষ হলে রাসূল (সা) বললেন: সাবিত! তুমি কি প্রংশসিত অবস্থায় জীবন যাপন, শহীদ অবস্থায় মৃ্যুবরণ এবং আখেরাতে জান্নাতে প্রবেশ করা পছন্দ কর না? সাবিত বললেন: হাঁ, করি ইয়া রাসূলাল্লাহ! সত্যি, দুনিয়াতে তাঁর জীবনট হয়েছে প্রশংসিত এবং মসায়লামা আল-কাজ্জারের সাথে যুদ্ধে তিনি শহীদ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।৩০ হযরত রাসূলে কারীম (সা) তাঁর সম্পর্কে আরো বলেছেন: সাবিত কতই না ভালো মানুষ।৩১
রাসূলে কারীম (সা) য তাঁকে কত গভীরভাবে ভালোবাসতেন তার প্রমণ পাওয়া যায় বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে। একবার সাবিত (রা) অসুখে পড়লে রাসূল (সা) তাঁকে দেখতে যান এবং তাঁর সুস্থতা কামনা করে দু’আ করেন এই বলে: ‘হে মানুষের প্রভু! আপনি সাবিত ইবন কায়সের কষ্ট দূর করে দিন।৩২
তথ্যসূত্র:

খুাইব ইন ’আদী ইবন ’আমের (লা)
খুবাইব ইবন আদী মদীনার আউস খান্দানের সন্তান। একজন আনসারী সাহাবী।১ হিজরাতের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং মুসলিম মুজাহিদদের জিনিসপত্র রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।২ এ যুদ্ধে তিনি মক্কার পৌত্তরিক আল-হারেস ইবন নাওফালকে হত্রা করেন।৩ ইবন সা’দ বলেণ, তিনি উহুদ যুদ্ধেও যোগদান করেন।৪
আল-ওয়াকিদী ও বালাজুরীর মতে হিজী চতুর্থ সনের সফর মাসে ‘আর-রাজী’র দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটে।৫ এতে রাসূলুল্লাহর (সা) কয়েকজন বিশষ্ট সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। হযরত খুবাইব (রা) সেই মহান শহীদদের অন্যতম। ঘটনাটির যেভাবে ত’ত্রপাত হয় সে সম্পর্কে দুই রকম বর্ণনা পাওয়া যায়। এখানে সংক্ষেপে তা তুল ধরা হলো।
ইবন শিহাবের সূত্রে আবূ হুরাইরা থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলে কারীম (সা) দশ সদস্য বিশিষ্ট একটি বাহিনীকে গোয়েন্দাগিরির উ্েদশ্যে মদীনা থেকে পাঠান। তাঁদের আমীর নিয়োগ করেন আসেম ইবন সাবেত আল-আনসারীকে, তাঁরা যখন হাদয়া’ (উসফান ও মক্কার মাঝামাঝি) নামক স্থানে পৌছেন তখন সেখানে বসবাসরত হুজাইল গোত্রের বনু লিহইয়ান শাখাটের পায়। তাদের প্রায় একশো দক্ষ তীরন্দায ব্যক্তি এই ক্ষুদ্র বাহিনীকে ধরার জন্য বেরিয়ে পড়ে এবং তন্ন তন্ন করে খুজতে থাকে। এক স্থানে তারা এই বাহিনীর খাওয়া খেজুরের বীটি কুড়িয়ে পেয়ে বুঝতে পারে, এটা ইয়াসরিবের খেজুর এবং যারা ইে খেজুর খেয়েে তারা ইয়াসরিবের অধিবাসী। আসেম তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে একটি নিরাপদ টিলায় আশ্রয় নেন। বনু লিহইয়ান খুঁজতে খুঁজতে তাঁদের অবস্থান জেনে যায়। তারা চারদিক থেকে তাঁদেরকে ঘিরে ফিলে এবং জীবনের নিরাপত্তর মিথ্যা প্রতিশ্র“তি দিয়ে আত্মসমর্পণের আহবান জানায়।
ইবন ইসহাক, আসিম ইবন উমার ইবন কাতাদাহ থেকে বর্ণনা করেছেন। উহুদ যুদ্ধের পর আদাল ও আল-কারা গোত্রের একটি প্রতিনিধিদল মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট আসে। তারা বলে: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের গোত্রে ইসলামের প্রাসর ঘটেছে। আপনার কিু সাহাবীকে আমাদের সংগে পাঠান যাঁরা আমাদেরকে কুরান পড়াবেন, দ্বীনের তা’লীম ও শরীয়াতের বিধিবিধান শিক্ষা দেবেন। রাসূল (সা) তাদের কথা বিশ্বাস কয়ে ছয়জন সাহাবীকে তাদের সংগে দিলেন। মদীনা থেকে রওয়ানা হয়ে তাঁরা যখন উসফান ও মক্কার মধ্যবর্তী হুজাইল গোত্রের ‘আর-রাজী’ নামক জলাশয়ের নিকট পৌঁছান তখন আদাল ও া-কারা গোত্রের ুক্ত লোকগুলি অহেতুক গলা ফাটিয়ে চিৎকার জানায়। ভাবখানা এমন দেখায় যে তারা আক্রান্ত হয়েছে। মূলতঃ তাদেরকে কোন রকম ভয়-ভীতি দেখানো হয়নি। হুজাইল গোত্রের লোকেরা তরবারি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে এবং রাসূলুল্লাহর (সা) এই গুটিকতক অসহায় সাহাবীকে ঘিরে ফেলে। তাঁরাও তরবারি কোষমুক্ত করে প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেন। শত্র“রা তখন তাঁদেরকে লক্ষ্য করে বলে: ‘তোমরাদের হত্যার কোন উদ্দেশ্য আমাদেরনেই। আমরা তোমাদের বিনিময়ে মক্কাবাসীদের নিকট থেকে শুধু ছিু সুবিধা লুটে নিতেচাই। আল্লাহর নামে আমরা অঙ্গীকার করছি, তোমাদের আমরা হত্যাকরাে। না।’ তখন দলটির তিনজন সদস্যÑমরসাদ, খালিদ ইবন ুকাইর ও আসিম ইবন সাতি (রা) বললেন: আল্লাহর কসম! তাঁরা শত্র“র বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং উপরিউক্ত তিনজনই শাহাদাত বরণ করেন।
দলটির অপর তিনজন সদস্য খুবাইব ইবন আদী, যায়িদ ইবন আদ-দাসিনা ও আবদুল্লাহ ইবন তারেক (রা) জীবনের প্রতি কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েন। তাঁরা রণেভঙ্গ দিয়ে আত্মসমর্পণ করন। কাফিররা আত্মসমর্পণকারীদেরই ধনুকের সূতা খুলে তাঁদের হাত-পা শক্ত করে বেঁধে ফেলে। তখন আবদুল্লাহ ইবন তারেক তাদের এ কাজের প্রতিবাদ করে বলেন, ‘এটা হলো তোমাদের প্রথম অঙ্গীকার ভঙ্গ। আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের সংগে যাবনা।’ অপর সঙ্গীদের উদ্দেশে বলেন, এই কাফিরদের ব্যাপারে আমার কাছে আদর্শ আছে। শত্র“রা তখন তাঁকে টানাহেঁচড়া করে নিতে থাকে। তিনি তাদের সাথে চলতে অস্বীকৃতি জানাতে থাকেন। এ অবস্থায় তাঁরা যখন মক্কার অদূরে মাররুজ জারান’ নামক স্থানে পৌঁছেন আবদুল্লাহ ইবন তারেক এক সুযোগে হাতের বন্ধন খুলে মুক্ত হয়যান এবং সাথে সাথেতরবরি উঁচিয়ে শত্রর বিরুদ্ধে রুখে দাঁনান। শত্র“রা তাঁর থেকে কেটু দুরে সরে গিয়ে তীর মেরে তাঁকে হত্যা করে। ‘মাররুজ জাহরানে’ তাঁর কবর আছে।
খুবাইব ইবন আদী ও যায়িদ ইবন আদ-দাসিনাকে নিয়ে তারা মক্কায় পৌছে। হুজাইল গোত্রের দুই ব্যক্তি মককার কুরাইশদের হাতে বন্দী ছিল। তারা এই দুই জনের বিনময়ে তাদের দুই বনদীকে মুক্ত করে।৬ তবে বিভিন্ন বর্ণনায় একথাও জানা যায় যে, বনদী বিনিময় নয়, বরয় অতি উচ্চমূল্যে তারা এই দুই জনকে মক্কার কুরাইশদের নিকট বিক্রয় করে।
খুবাইকে কে বা কারা খরীদ করেছিল সে সম্পর্কে সামান্য মতভদ আছে। একটি মতে উকবা ইবনুল হারেস তার পিতৃ হত্যার প্রতিশোধর উদ্দেশ্যে খরীর করে। অন্য একটি বর্ণনামতে, আবু ইহাব, ‘আকরামা ইবন আবী জাহল, আল-আখনাস ইবন শুরাইক, উবাইদা ইবন হাকীম ইবনলু আওকাস, উমাইয়্যা আবন আবী আসমাহ, বনুল খাদারামী সাফওয়ান ইবন উমাইয়্যা প্রমুখ সম্মিলিতভবে তাঁকে খরীদ করে বদরে নিহত তাদের প্রত্যেকের পিতর হত্যার বদলা নেওয়ার জন্য।৭ ইবন ইসহাক বলেন হারেস ইবন আমেরের বৈপিত্রীয় ভাই হুজইর ইবন আবী ইহাব আত-তামীমী খুবাইবকে খরীদ করে উকবা ইবন আল-হারেসের হাতেতুলে দেয়। যাতে সে বদরে নিহত পিতৃহত্যার বদলা হিসেবে তাঁকে হত্যা করতে পারে।৮
উল্লেখ্য যে, মদীনা থেকে রাসূল (সা) যে দলটি পাঠান তার সদস্য সংখ্যা কত ছিল এবং দলনেতাই বা কেছিলেন, সে সম্পর্কে সীরাত বিশষজঞদের কিঞ্চিৎ মতপার্থক্য আছে। বিভিন্ন বর্ণনায় দলটির সদস্য সংখ্যা য়, সাত ও দশ জনের কথা এসেছে। ইবন হিশাম পূর্বে উল্লেখিত চয় জনের নাম বর্ণনা করে মারসাদকে দলনেতা (আমীর) বলে উল্লেখ করেছেন। আবার কোন কোন বর্ণনায় আসিম ইবন সাবিতকে দলনেতা বলা হয়েছে।৯ খুবাইবকে (রা) হাতকড়া পরিয়ে উকবা ইবন হারেসের পৃহে বন্দী করে রাখা হয়।১০ মাওহাব’ নামক এক ব্যক্তিকে পাহারায় বসানো হয্ উকবার স্ত্রী আহারের সময় তাঁর হাতকড়াটি খুলে দিত।১১ বিভিন্ন বর্ণনা পর্যালোচনা করলে এই মহিলার নাম শাবিয়্যা বরে প্রতীয়মান হয়। কোন কোন বর্ণনায় যাকে হুজার ইবন আবী ইহাবের দাসীর বা কন্যা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইবন ইসহাক তঁর বক্তব্য বর্ণনা করেছেন। পরবর্তীকালে এই মহিলা মুসলমান হন।
কয়েকমাস তারা খবুইবকে বন্দী করে রাখে। পবিত্র হারাম মাসগুলি অতিবাহিত হওয়ার পর তারা তাঁকে হত্যার তোড়জোড় শুরু করে দেয়। খুবাইব তাঁকে হত্যা করা হবে একথা বুঝতে পেরে পাহারায় নিযুক্ত মাওহাবের নিকট তিনটি অনুরোধ করেন:১২
১.তাকে মিষ্টি পানি পানকরাবে।
২.তাদের দেব-দেবীর নামে জবেহকৃত জীবের পোশত খেতে দেবে না।
৩.হত্যার পূর্বে যেন তাঁকে অবহিত করে।
শেষের অনুরোধটি তিনি উকবার স্ত্রীকেও করেন। হত্যার সিদ্ধান্ত হলে সে অবহিত করে।১৩ তিনি পাক-সাফ হওয়ার জন্য তার নিকট থেকে একটি ক্ষুর চেযে নেন। খুবাইব (রা) যখন ক্ষৌরকার্য্য করছেন তখন, উকবার একটি শিশু সন্তান খেলতে খেলতে তাঁর নিকটে চলে যায়। তিনি শিশুটিকে আদর করে কোলে তুলে নেন। খুব শিগগির যাকে শূলী কাষ্ঠে চড়ানো হবে এমন বন্দীর হাতে ধারালো ক্ষুর এবং তার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে বন্দী খুবাইব বললেন, তোমার ধারণা, এই শিশুকে হত্যা করে আমি আমার রক্তের বদলা নিব। এমন কাজ কক্ষণও আমি করবো না। এমন চরিত্র আমাদের নয়।১৪ তারপর তিনি একটু রসিকতা করে বলেন, আল্লাহ এখন আমাকে তোমাদের উপর বিজয়ী করেছেন। শিশুটির মা বললো, তোমার কাছে আমি এমন আশা করিনি। একথার পর খুবাইব ক্ষুরটি মহিলার সামনে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, এই নাও, একটু মশকারা করলাম।১৫
এই মহিলার উপর খুবাইবের (রা) কথাও কর্মের ভীষণ প্রভাব পড়ে। খুবাইবের হত্যার পর তিনি মুসলমান হন। ইবন ইসহাক খুবাইব (রা) সম্পর্কে তাঁর মন্তব্র লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি বলছেন: আমি এই খুবাইবের চেয়ে ভালো কোন কয়েদী আর দেখিনি। আমি কয়েদখানার দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতাম তাঁর হাতে মানুষের মাথার আকৃতির বড় বড় আঙ্গুর। তিনি সেই আঙ্গুর খাচ্ছেন। এমন আঙ্গুর পৃথিবীর কোথাও খাওয়া হয় তা আমার জানা নেই। মক্কায় তখন আঙ্গুরের বাগানও ছিলনা। তাছাড়া তিনি তো লোহার হাতকড়া অবস্থায় বন্দী ছিলেন। এ নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট থেকে আসা রিযক (খাদ্য)।১৬
মক্কার পৌত্তলিক শক্তি খুবাইবের হত্যার বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে গ্রহণকর। হারাম শরীফের আদূরে তান’ঈন’ নামক স্থানে একটি গাছে শূলী কাঠ ঝোলানো হয়। ঢোল-শুহরত করে মককার নারী-পুরুষ, শিশু-যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের সমাবেশ ঘটানো হয়। ব্যাপারটিছিল তাদের নিকট এক মস্তবড় আনন্দ ও তামাশার। লোকেরা যখন তাঁকে উকবর গৃহ থেকে নেওয়র জন্য এলো, তিনি তাদেরকে অনুরোধ করলেন, তোমরা কেটু সময় দাও, আমি সংক্ষিপ্ত দুই রাকাঃ’য়াত নামায আদায় করে নিই। নামায দীর্ঘ করলে তোমরা বলবে, আমি মরণ ভয়ে দীর্ঘ করছি। সংক্ষিপ্ত দুই রাকা’য়াত নামায শেষ করে তিনি বধ্যভমির দিকে যাত্রা করেন। তিনি মৃত্যুর দিকে চলছেন, আর তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে:১৭
আরবী হবে
Ñহে আল্লাহ! তদের সংখ্যা তুমি গুণে রাখ, এক এক করে তাদেরকে হত্যা কর এবং তাদের কাউকে তুমি ছেড়ে দিও না।
তান’ঈনের সেই গাছের নীচে যখন পৌছলেন তখন তাঁর মুখে একটি কবিতার আবৃত্তি শোনা গেল, যার দুইটি শ্লোকের অর্থ নিুরূপ:
১.আমি যদি মুসলমান অবস্থায় নিহত হই তাহলে আমার মৃতদেহ কোন পার্শ্বে পড়ে থাকে সে ব্যাপারে আমার কোন পরোয়া নেই।
২.এ যা কিছু হচ্ছে, সবই আল্লাহর পবিত্র সত্তার প্রেমের পথে। তিনি ইচ্ছা করলে আমার খন্ড-বিখন্ড দেহের উপওে করুণা বর্ষণ করতে পারেন।
এছাড়া তাঁর জবিনের অন্তিম মুহূর্তে উচ্চারিত আরও কিচু শ্লোক বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।১৮
শূলী কাঠে ঝোলানোর পূর্বে তিনি এই দু’আও করেন: ‘হে আল্লাহ! আমরা আপনার রাসূলের বাণী পৌঁছে দিয়েছি। আপনি আমাদের সংবাদ আপনার রাসূলকে পৌঁছে দিন।’১৯
উকবা ইবন হারেস ও আবু হুরাইরা আল-আবদারী সমিমরিতভাবে তাঁকে শূলীতে চড়ায়।২০ পরবর্তীকালে উকবা ইবন হারেস খুবাইবের হত্যায় তার অংশগ্রহণের কথা অস্বীকার করে বলতেন, আমি মূলত: খুবাইবকে হত্যা করিনি। কারণ তখন কাউকে হত্যা করার মত বয়স আমার হয়নি। তাই আবু মায়সারা আমার হাতে কেটি বল্লম ধরিয়ে দেয়। তারপর বল্লমটিসহ আমার হাতটি ধরে খুবাইবের দেহে বিদ্ধ করে তাঁকে হত্যা করে। এই উকবা মুসলমান হন এবং দুধপান বিষয়ে তিনি হদীস বর্ণনা করেছেন।২১
এই বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, খুবাইবকে শূলীতে ঝুলিয়ে বল্লাম দ্বারা বিদ্ধ করা হয়েছিল। মূসা ইবন উকবার মাগাযীতে বর্ণিত হয়েছে। খুবাইব ও যায়িদ ইবন আদ-দাসিনাকে একই দিন হত্যা করা হয়। আর যে দিন তাঁদেরকে হত্যা করা হয়, সেই দিন মদীনায় রাসূলকে (সা) বলতে শোনা যায়: ‘তোমাদের দুইজনের প্রতি সালাম।’ তিনি তাঁদের হত্যার কথাটিও ঘোষনা করেন। ওহীর মাধ্যমে তিনি সবকিচু অবগত হন।২২
রাসূলে কারীম (সা) খুবাইব ও যায়িদের লাশ কাফিরদের হাত থেকে কৌশলে উদ্ধারের জন্য মদীনা থেকে কয়েকজন সহসী ও দক্ষ লোক পাঠান। তাঁরা হলেন, ‘আমর ইবন উমাইয়্যা আল-মিকদাদ ও যুববাইর। আমর বলেন, আমি খুবাইবের শূলী কাঠের কাছে গিযে তাকে মুক্ত করে একটু মাটিতে ফেলে দিলাম। তারপর নেমে এসে বহু খোঁজাখুঁজির পরও তার কোন চিহ্ন পেরাম না। যমীন যেন তাকে গিলে ফেলেছে।
পক্ষান্তরে আবু ইউসুফ কিতাবুল লাতায়িফ’ গ্রন্থে দাহহাক থেকে বর্ণনা করেছেন। নবী কারীম (সা) শূলী কাঠ থেকে খুবাইবের লাশটি নামিয়ে আনার জন্য আল-মিকদাদ ও যুবাইর ইবনুল আওয়ামকে মদীনা থেকে পাঠান। তানঈমে পৌঁছে তাঁরা দেখলেন, লাশের আশেপাশে ৪০ জন নেশাগ্রন্থ মানুষ। তারা লাশ পাহারা দিচ্ছে। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তাঁরা লাশটি নামান এবয় যুবাইর ঘোড়ার পিঠে উটান। এতক্ষণে পাহারাদাররা টের পেয়ে যায় এবং তাঁদের পিছু ধাওয়া করে। যুবাইর লাশটি ফেলে দেন এবং যমীন তা গিলে ফেলে। এ কারণে যুবাইবকে বালী ুল ারদি বলা হয়।২৩ যুবাইবের কবরটি কোথায় দুনিয়ার মানুষ কোন দিন জানতে পারেনি। মূসা ইবন ুকবা বলেছেন: অনেকের ধারণা, আমর ইবন উমাইয়্যা তাঁকে কোথাও দাফন করেছেন।
হত্যার পূর্বে পৌত্তলিকরা তাঁর মুখটি কিবলার দিকে ফেরাতে চায়নি। কিন্তু যে মুখ একবার কিবলার দিকে ফিরে যায় তাকে অন্য দিকে ফেরায় কার সাধ্য। পৌত্তলিকরা বার বার মুখটি অন্য দিকে ফেরানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।২৪
সা’ঈদ ইবন আমের আল-জামহী (রা) খুবাইবের হত্যা-অনুষ্ঠানে একজন দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সেটা ছিল তাঁর ইসলাম পূর্ব জীবন। পরবর্তীকালে তিনি মুসলমান হন। খলীফা উমার (রা) তাঁকে হিমসের গভর্ণর নিয়োগ করেন। কিছুদিনের মধ্যে হিমসবাসীরা তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ উত্থাপন করে। তার মধ্যে একটি ছিল এই রমক: সা’ঈদ ইবন আমের মাঝে মাঝে এমনভাবে অচেতন হয়ে পড়েন যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা হয়। সা’ঈদের নিকট খলীফা উমার এর কারণ জানতে চান। সা’ঈদ ইবন আমের মাঝে মাঝে এমনভাবে অচেতন হয়ে পড়েন যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা হয়। সা’ঈদের নিকট খলীফা উমার এর কারণজানতে চান। সা’ঈদ বলন আমি মক্কায় খুবাইব আল-আনসারীর শূলীতে ঝোলানোর দৃশ্য দেখেছিলাম। কুরাইশরা তাঁর দেহ থকে গোশত কেটে কেটে ফেলেছিল। তারপর তাঁকে গাছে ঝুলিয়ে জানতে চেয়েছিল! তুমি কি এটা পসন্দ করবে যে, তোমার এই স্থানে মুহাম্মদকে আনা হোক? তিনি বলেছিলেন: আমি আমার রিবার-পরিজন ও সন্তানদের মধ্যে নিরাপদে অবস্থান করি এবং তার কক্ষণো পসন্দ করিনে। আমার যখনই সেই দিনটির কথা মনে পড়ে তখন আমার মধ্যে একটা অপরাধবোধ জেগে ওঠে। আমি কেন সেদিন তাঁর সাহায্যে এগিয়ে যাইনি। যদিও আমি সেদিন পৌত্তলিক ছিলাম তবুও আমার মনে হয় আল্লাহ আমার এ অপরাধ কক্ষণো ক্ষমা করবেন না। আর তখনই আমার এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। একথা বলার পর তিনি মুহাম্মদ বলে জোরে এক চিৎকার দিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়েন।২৫
মু’য়াবিয়া (রা) পরবর্তীকালে বলতেন: খুবাইবের হত্যার অনুষ্ঠানে অন্যদের মত আমি আমার পিতা আবু সুফইয়ানের সাথে উপস্থিত ছিলাম। তিনি খুবাইবের বদ-দু’আর ভয়ে আমাকে প্রায় মাটির সাথে ঠেসে ধরে রাখেন। কারণ, তাদের বিশ্বাস ছিল, কেউ যদি কোন ব্যক্তির উপর বদ-দু’আ করে, আর সে ভয়ে জড়সড় হয়ে তার পাশে শুয়ে পড়ে তাহলে সে বদদু’আ তার উপর না পড়ে অন্যত্র পড়ে।২৬ আল-হারেস বলেন: আমি উপসিথত ছিলাম। আল্লাহর কসম! আমাদের কেউ বেঁচে থাকবে এমন ধরণা আমার ছিল না।২৭
খুবাইবের (লা) দু’আ আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছিল। যে সকল নরাধম তাঁর হত্যায় সক্রিয ভূমিকা পালন করেছিল, এক বছরের মধ্যে তাদের সবাই অতি নির্দয়ভাবে নিহত হয়।২৮
ইবন আব্বাস (রা) বলেণ: এ ঘটনার পর মদীনার মুনাফিকরা বলাবলি করতে লাগলো, এই হতভাগ্যরা তাদের পরিবার-পরিজনদের মধ্যেও থাকলো না, আবার তাদের বন্ধুর (নবী) অর্পিত দায়িত্বও পালন করতে পারলো না। তখন আল্লাহ পাক এই মুনাফিকদেরস্বরূপ তুরে ধরে সূরা আল-বাকারার ২০৪-২০৬ নং আয়াত এবং খুবাইব ইবন আদী ও তাঁর সঙ্গীদের প্রশংষায় ২০৭ নং আয়াত নাযিল করেনঃ২৯
“আর এমন কিছু লোক রয়েছে যাদের পার্থিব জীবনের কথাবার্তা মোতাকে চমৎকৃত করবে। আর তারা সাক্ষ্য স্থাপন করে আল্লাহকে নিজের মনের কথার ব্যাপারে প্রকৃতপক্ষেতারা কঠিন ঝগড়াটে লোক। (২০৪)
যখন ফিরে যায় তখন চেষ্টা করে যাতে সেখানে অকল্যাণ সৃষ্টি করতে পারে এবং শস্যক্ষেত্র ধ্বংস ও প্রাণনাশ করতে পারে। আল্লাহ ফাসাদ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা পসন্দ করেন না।২০৫
আর যখন তকে বলা হয় যে, আল্লাহকে ভয় কর, তখন তার পাপ তাকে অহঙ্কারে উদ্ধুদ্ধ করে। সুতরাং তার জন্য দোযখই যথেষ্ট। আর নিঃসন্দেহে তা হলো নিকৃষ্টতর ঠিকানা। (২০৬)
আর মানুষের মাঝে এক শ্রেীর লোক রয়েছেÑযারা আলÍাহর সন্তুষ্টিকল্পে নিজেদের জান বাজি রাখে। আল্লাহ হলেন তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত মেহেরবান (২০৭)। (সূরা আল-বাকারা)
আর-রাজী’র এই হৃদয় বিদারক ঘটনা তৎকালীন আরবের মুসলিম কবিদের রোধ ও বিবেককে ভীষণ নাড়া দেয়। কবি হাসসান সহ আরও অনেকে এই সকল শহীদের সÍণে অনেক মর্মস্পর্শী কবিতা রচনা করেছেন। তাতে একদিকে যেমন শহীদদের প্রশংসা করা হয়েছে অন্যদিকে পৌত্তলিকদের স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে। সীরাতে ইবনে হিশাম পাঠ করলে তার কিছু চিত্র পাওয়া যয়।৩০
ইবন ইসহাক আসেম থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন: খুবাইইব সর্বপ্রথম মুসলমানদের জন্য নিহত হওয়ার পূর্বে দুই রাক’য়াত নামায আদায়ের প্রথা চালু করেন। এটা তাঁরই সুননাত।৩১
ইমাম আস-সুহাইলী বলেছেন: খুবাইব ইবন আদীর আদায়কৃত দুই রাকা’য়াত নামাযকে সে তাঁরই প্রবর্তিত সুন্নাত নামায বলা হয়েছে তা এই জন্য যে, তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) জীবদ্দশায় আদায করেছেন এবং রাসূল (সা) কাজটির প্রশংসা করছেন। তাঁর পূর্ েযায়িদের জীবনের একটি বিশ্ময়কর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এ ঘটনাটিও ঘটে রাসূলে কারীমের জীবদ্ধশায়। সংক্ষেপে ঘটনাটি এই রকম:
যায়িদ ইবন হারেসা তায়েফ থেকে এই শর্তে এক ব্যক্তির একটি খচ্চর ভাড়া করেন যে, সে তাঁকে খচ্চরের পিঠে চড়িয়ে নিয়ে যাবে এবং তাঁর ইচ্ছামত জায়গায় নামিয়ে দেবে। লোকটি ত৭াকে খচ্চরের পিঠে চড়িয়ে একটি বিরান বধ্যভূমিতে নিয়ে পৌঁছে এবং হত্যা করতে উদ্যত হয়। যায়িদ তখন তাকে বলেন: আমাকে একটু সময় দিন, আমি দুই রাকা’য়াত নামায আদায় করে নিই।লোকটি বললো, ঠিক আছে, দুই রাকা’য়াত নামায আদায় কর আর ইে যে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা লাশগুলো দেখছো, তারাও তোমার মত নামায পড়েছিল। কিন্তু তাদের নামায কোন কজে আসেনি। যায়িদ আবারও: ইয়া আরহামার রাহেমীন উচ্চারণ করলেন। আবারও ঠিক একই ধ্বনি শোনা গেল এবং লোকট একই কাজ করলো। এভাবে তিনবার একই ঘটনা ঘটে। তবে তৃতীয়বার যায়িদ একজন অশ্বারোহীকে দেখতে পেলেন, যার হাতে একটি বর্শা এবং মাথায় আগুনের শিখা। সে লোকটির দেহে বর্শ ঢুকিয়ে দিয়ে হত্যা করলো। তারপর যায়িদের দিকে ফিরে বললো: তুমি প্রথমবার যখন আল্লাহকে ডাক তখন আমি ছিলাম সপ্ম আকাশে, দ্বিতীয়বার ডাকার সময় ছিলাম পৃথিবীর নিকটবর্তী আকাশে এবং তৃতীয়বার ডাকার সময তোমার কাছে এসে হাজির হয়েছি।৩২
তথ্যসূত্র:

গ্রন্থপঞ্জি:
১.আল-ইমাম আজ-জাহাবী: (ক) সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা, (বৈরুত, আল-মুওযাসসাতুর রিসালা, ৭ম সংস্করণ, ১৯৯০)
(ক) তাজকিরাতুল হুফফাজ, (বৈরুত, দারু ইহইয়া আত-তুরাস আল-ইসলালী)।
(খ) তারীকুল ইসরাম ওয়া তাবাাত আল-মাশাহীর ওয়াল আ’লাম, (কায়রো, মাকতাবাতুল কুদসী, ১৩৬৭ হিঃ।)
২.ইবন হাজার
(ক) তাহজীবুত তাহজীব, (হায়দ্রাবাদ, দায়িরাতুল মা’য়ারিফ, ১৩২৫ হিঃ।)
(খ) তাকরীবুত তাহজীব, (লাখনৌ,)
(গ) আল-ইসাবা ফী তাময়ীযিস সাহাবা, (বৈরুত, দার আল-ফিকর, ১৯৭৮)।
(ঘ) লিসানুল মীযান, (হায়দ্রাবাদ, ১৩৩১ হিঃ।)
(ঙ) ফাতহুল বরী, (মিসর, ১৩৯১ হিঃ)।
৩.ইবনুল ইমাদ আল-হাস্বলী: শাহারাতু জাহাব, (বৈরুত, আল-মাকতাব আত-তিজারী)।
৪.জামাল উদ্দীন ইউসুফ আল-মুযী: তাহজীব আল-কামাল ফী আসমা আর-রিজাল, (বৈরুত, মুওয়াসসাসাতুর রিসালা, ১ম সংস্বরণ, ১৯৮৮।)
৫.আবু ইউসুফ: কিতাবুল খিরাজ, (বৈরুত, দার আল-মা’রিফা, ১৯৭৯।)
৬.ইবন কাসীর:
(ক) আত-তাফসীর, (মিসর, দারু ইহইয়া আল-কুতুব আল-আরাবিয়্যা।)
(খ) আস-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ, (বৈরুত, দারুল কুতুব আল-ইসমিয়্যা।)
(গ) আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, (বৈরুত, মাকতাবাতুল মা’য়ারিফ।)
৭.ইবনুল জাওযী:
(ক) আ’লাম আন-মুওয়াক্কি’ঈন, (দিল্লী, আশরাফুল মাতাবি’, ১৩১৩ হিঃ।)
(খ) কিতাবুল তানবীহ ওয়াল ইশাফ, (মিসর, মাতবা’য়াতুল হাসানিয়্যা, ১৩২৩ হিঃ।)
(গ) কিতাবুল আজকিয়া, (সম্পাদনা: আবদুর রহমান ইবন আলী, ১৩০৪ হিঃ।)
(ঘ) সিফাতুস সাফওয়া, (হায়দ্রাবাদ, দয়িরাতুর মা’য়ারিফ, ১৩৫৭ হিঃ।)
৮.ইবন সা’দ: আত-তাবাকাত আল-কুবরা, (বৈরুত, দারু সাদির)।
৯.ইবন আসাকিব: মু’জামুল বুলদান, (বৈরুত, দারু ইহইয়া আত-তুরাস আল-আরাবী)।
১০. ইয়াকূত আল-হামাবী: মু’জামুল বুলদান, (বৈরুত, দারু ইহইয়া আত-তুরাস আল-আরাবী)।
১১. আবুল ফারাজ আল-ইসফাহানী: কিতাবুল আগানী, (মিসর, ১৯২৯)।
১২. ইবন হাযাম: জামহারাতু আনসাবুল আরাব, (মক্কা, দারুল মা’য়ারফ, ১৯৬২)।
১৩. ইবন খাল্লিকান: ওফায়াতুস আ’য়ান, (মিসর, মাকতাবাতু আন-নাহাদাতুল মিসরিয়্যা, ১৯৪৮।)
১৪. মুহাম্মদ আল-আলুসী: বুলুগুল আরিব ফী মারিফাতি আহওয়ালিল আরাব, (১৩১৪ হিঃ)।
১৫. ইবনুল আসীর: (ক) ইসুদল গাবা ফী মা’রিফাতিস সাহাবা, (বৈরুত, দারু ইহইয়া আত-তুরাস আল-আরাবী)।
(খ) আল-কমিল ফিত তারীখ, (বৈরুত)।
(গ) তাজরীদু আসমা আস-সাহাবা, (হায়দ্রাবাদ, দায়িরাতুল মা’য়ারিফ, ১ম সংস্বরণ, ১৩১৫)।
১৬. আল-বালাজুরী:
(ক) আনসাবুল আশরাফ, (মিসর, দারুল মা’য়ারিফ)।
(খ) ফুতুহুল বুলদান, (সির, মাতবায়াতুল মাওসূয়াত, ১৯০১)।
১৭. আয্-যিরিকলী: আল-আ’লাম, (ভৈরুত, দারুল ইলম লিল মালাঈন, ৪র্থ সংস্করণ, ১৯৭৯)।
১৮. ইবন হিশাম: আস-সীরাহ (বৈরুত)।
১৯. ইউসুফ আল-কানধালূবী: হায়াতুস সাহাবা, (দিমাশক, দারুল কালাম, ২য় সংস্করণ, ১৯৮৩)।
২০. সা’ঈদ আনসারী মাওলানা: সিয়ারে ানসার, (ভারত, ১৯৪৮)।
২১. ইবন আবদিল বার: আল-ইসতী’য়াব, (আল-ইসাবা গ্রনেথর পার্শ্বটীকা)।
২২. ইবন সাল্লাম আল-জামহী: তাবাকাত আশ শু’য়ারা, (বৈরুত, দারু কুুব আল-ইলমিয়্যা, ১ম সংস্বরণ, ১৯৮১)।
২৩. ইবন কুতায়বা: আশ-শি’রু ওয়াশ শু’য়ারাউ, (বৈরুত, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যা, ১ম সংস্করণ, ১৯৮১)।
২৪. ডঃ আবদুর রহমান আল-বাশা: সুওয়ারুন মিন হায়াতুস সাহাবা, (সৌদি আরব, ১ম সংস্বরণ)।
২৫. খালিদ মুহাম্মদ খালিদ: রিজালুন হাওলার রাসূল, (বৈরুত, দারুল ফিকর)।
২৬. ডঃ শাওকী দাঈফ: তারীখুল আদাব আরাবী, (কায়রো, দারুল মাঃয়ারিফ, ৭ম সংস্করণ)।
২৭. ডঃ উমার পারূখ: তারীখুল আদাব আল-আরাবী, (বৈরুত, দারুল ইলম লিল মালাঈন, ১৯৮৫)।
২৮. জুরযী যায়দান: তারুখু আদাবিল লুগাহ আল-আরাবিয়্যা, (বৈরুত, দারু মাকতাবাতুল হায়াত, ৩য় সংস্করণ, ১৯৭৮)।
২৯. আহমাদ আবদুর রহমান আল বান্না: বুলূগুল আমানী মিন আসরার আল-াতহির রাব্বানী, (কায়রো, দারুশ শিহাব)।
৩০. আলাউদ্দীন আলী আল-মুততাকী: কানযুল উম্মাল (বৈরুত, ম্রওয়াসসাসাতুর রিসালা, ৫ম সংস্করন, ১৯৮৫)।
৩১. ডঃ মুসতাফা আস-বিসা’ঈ: আস-সুনানহ ওয়া মাকানাতুহা ফিত তাশরীঃ আল-ইসলামী, (বৈরুত, আল-মাকতাব আল-ইসলামী, ২য় সংস্কর, ১৯৭৬)।
৩২. হাজী-খলীফা: কাশফুজ জুনূন আন আসামী আল-কুতুব ওয়াল ফুনূন, (বৈরুত, দারুল ফিক্র, ১৯৯০।
৩৩. মুহাম্মদ আল-খাদারী বেক: তারীকুল উমাম আল-ইসলামিয়া, (মিসর,্ াল-মাকতাবাতু তিজারিয়্যা আল-কুবরা, ১৯৬৯)।
৩৪. মুহাম্মদ আলী আ-সাবুনী: (ক) রাওয়ায়ি উল কুরআন, তাফসীরু আয়াতিল াহকাম মিনাল কুরআন, (বৈরুত, মুওয়াসসাসাতু মানাহিলিল ‘ইরফান, ৩য় সংস্কারণ, ১৯৮১)।
(খ) আত-তিবইয়ান ফী উলূমিল কুরআন, (বৈরুত)।
৩৫. মহিউদ্দীন ইবন শারফ আন-নাওবী: তাহজীবুল আসমা ওয়াল লুগাত, (মিসর, আত-তিবায়া’ আল-মুগীরিয়্যা)।
৩৬. ইমাম আহমাদ: আল-মুসনাদ
৩৭. াািকি
৩৮. পবিত্র কোরআনুল করীম: আনুবাদ ও সম্পাদনা: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান।
৩৯. হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থ।
৪০. দায়িরা-ই-মা’য়ারিফ সিলামিয়্যা (উর্দ্দূ)।
৪১. কুদামাহ ইন জা’ফর: নাকদুশ শি’র (বৈরুত)।
৪২. ইবন রাশীক: কিতাবুল উমদাহ, (কায়রো-১৯৪৩)।
৪৩. আবু তাম্মাম: আল-হামাসা, (বৈরুত)।
৪৪. আল-বাকিল্লানী: ই’জাযল কুরআন, (বৈরুত)।
৪৫. আল-জুরজানী: দালায়িলুল ইঃজায, (কায়রো-১৯৭৬)।
৪৬. বুটরুস আল-বুসতানী: উদাবাউল আরাব ফিল জাহিলিয়্যাতি ওয়া সাদরিল ইসলাম (বৈরুত-১৯৮৯)।
৪৭. আবদুর রউপ দানাপুরী: আসাহ আস-সীরাহ (করাচী)।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি