আবদুল্লাহ ইবন সালাম (রা)
আবদুল্লাহ (রা) নদীনার বিখ্যাত ইহুদী গোত্র বনু কায়নুকার সন্তান। তাঁর বংশধারা উপরের দিকে ইউসুফ আলাইহিস সালামে গিয়ে মিলিত হয়েছে।১ তাঁর উপনাম দুইটি: আবু ইউসুফ ও আবুল হারেস। পিতার নাম সালাম ইবন হারেস। মদীনার খাযরাজ গোত্রের একটি শাখা বনুাউফ। এই বনু ‘আউফের একটি উপ-শাখার নাম ‘কাওয়াকিল’। আবদুল্লাহ আবন সালাম প্রাচীন জাহিলী আরবের রেওয়ান অনুযায়ী এই কাওয়াকিল গোত্রের হানীফ বা চুক্তিবদ্ধ বন্ধু ছিলেন। পরবর্তীকালে রাসূলুল্লাহর (সা) সাহাবীদের মধ্যে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ও জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ব্যক্তিতে পরিণত হন।২ ইসলাম পূর্ব জাহিলী আমলে তাঁর নাম ছিল ‘হুসাইন’। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ (সা) নামটি পরিবর্তন করে আবদুল্লাহ রাখেন।৩
আবদুল্লাহ ইবন সালামের (রা) ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি হাদীস ও সীরাতের বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। এ সম্পর্কেত বিভিন্ন বর্ণনায় যে কথাগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাহলো, ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তিনি একজান ড় ইহুদী ধর্মগুরু হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাওরাতে রাসূলুল্লাহর (সা) আগমন কাল ও তাঁর পরিচয় সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে তা তাঁর জানা ছিল। অনেকের মত তিনিও শেষ নবীর প্রতীক্ষায় ছিলেন। ইবন ইসহাকের বর্ণনা মতে রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় এসে সর্বপ্রথম কুবার বনু আমর ইবন আউফ গোত্রে যখন ওঠেন তখন তিনি একটি খেজুর গাছের মাথায়। এক ব্যক্তি তাঁকে রাসূলের (সা) আগমন খবর দিলে তিনি তাড়াতাড়ি গিয়ে তাঁর সাথে প্রথস সাক্ষাৎ করেন এবং প্রথম দর্শনেই বুঝতে পারেন তিনি নবী। তারপর রাসূল (সা) যখন মদূনার মূল ভুখণ্ডে এসে আবু আইউব আল-আনসারীর গৃহে অবস্থান গ্রহণ কনের তখন আবদুলÍাহ আবার আসেন তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে। এই সাক্ষাতে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে তাঁর অনেক কথা হয়। বিভিন্ন বর্ণনায় নানা ভাবে এ সব কথা এসেছে।৪ এখানে আমরা কয়েকটি বর্ণনা তুলে ধরছি।
আবদুল্লাহ ইবন সালাম বলতেন: আমার পিতার নিকট আমি তাওরাতের পাঠ ও ব্যাখ্যা শিখেছিরাম। একদিন রাসূলুল্লাহর (সা) পরিচয়, নিদর্শন, গুণাবলী ও তাঁর কর্মকাণ্ডসম্পর্কিত একটি আয়াত তিনি পড়ালেন। তারপর বললেন: তিনি যদি হারূনের বংশধর হন তাহলে তাঁর ানুসরণ করবে, অন্যথায় নয়। তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) হিজরাতের পূর্বে মারা যান।
অতঃপর একদিন রাসূল (সা) মদীনায় আসলেন। আমি তখন বাগানে খেজুর পাড়ছিলাম আর আমার ফুফু খালেদা বিনতুল হারেস খেজুর কুড়াচ্ছিরেন। এই সময় ইহুদী গোত্র বনু নাদীরের এক ব্যক্তি চিৎকার করে বলতে লাগলো: আরবের অধিকারী ব্যক্তি আজ এসে গেছেন। একথা শুনে আমি কাঁপতে শুরু করলাম এবং জোরে তাকবীর দিলাম। আমার বৃদ্ধা ফুফু আমার এ অবস্থা দেখে বললেন: ওরে খবীছ, তোমার যা হাল হয়েছে, মুসা ইবন ইমরানও যদি আসতেন তাহলেও এর চেয়ে বেশী হতোনা। আমি বললাম: ফুফু! তিনি মুসারই ভাই এবং তাঁরই দ্বীনের ওপর আছেন। তিনি যা নিয়ে এসেছিলেন ইনিও তাই নিয়ে আসেছেন।
আমি গাছ থেকে নেমে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট গেলাম। তাঁর অবয়ব প্রত্যক্ষ করলাম এবং তাঁকে চিনলাম। আমি তাঁকে আমার পিতার কথা বললাম। আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম। পরে আমার ফুফুও ইসলাম গ্রহণ করেন।৫
আবদুল্লাহ ইবন সালাম আরো বলেন: রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় পদার্পণ করলে মানুষ তাঁর কাছে ভীড় করলো। আমিও গেলাম। আমি দেখেই বুঝলাম এই চেহারা কোন ভণ্ড-মিথ্যাবাদীর চেহারা নয়। আমি তাঁর মুখ থেকে সর্বপ্রথম এই কথাগুলি শুনলাম: ‘ওহে জনমণ্ডলী! তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও, মানুষকে আহার করাও, আত্মীয়তার সম্পর্কে অক্ষুণœ রাখ এবং রাতে মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায পড়থÑতাহলে নির্বিঘেœ জান্নাতে প্রবেশ করবে।’৬
রাসূলুল্লাহর (সা) মক্কা থেকে কুবা পৌঁছার পর আবদুল্লাহ ইবন সালামের প্রথম যে সাক্ষাৎ হয় উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা সম্ভবত সেই সাক্ষাতের কথা বলেছেন। রাসূল (সা) তিনদিন কুবায় বিশ্যাম নেওয়ার পর মদীনার মূল ভূখণ্ডের দিকে যাত্রা করেন। পথে সকলেরর অনুরোধ-উপরোধ উপেক্ষা করে আবু আইউব আল-আনসারীর গৃহে অবস্থান গ্রহণ করেন। আবদুল্লাহ ইবন সালাম এ সময় আবার রাসূলুল্লাহর (সা) খিদমতে হাজির হন। আর এ সাক্ষাতের বর্ণনা দিয়েছেন আনাস (রা)।
আনাস থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় আসার পর আবদুল্লাহ ইবন সারাম সাক্ষাৎ করতে আসেন। তিনি রাসূলুল্লাহকে (সা) লক্ষ্য করে বলেন: আমি আপনাকে এমন তিনটি প্রশ্ন করতে চাই যার উত্তর কেবল নবীরাই জানেন।৭
ক) কিয়ামতের প্রথম আলামত বা নিদর্শন কি?
খ) জান্নাতের অধিবাসীদের প্রথম খাবার কি?
গ) সন্তান পিতা অথবা মাতার সদৃশ হয় কেন?
রাসূল (সা) বললেন: এই মাত্র জিবরীল কথাগুলি আমাকে বলে গেলেন। আবদুল্লাহ ইবন সালাম বললেন: ফিরিশতাদের মধ্যে এই জিবরীলই তো ইহুদীদের দুশমন। রাসূল (সা) বললেন: কিয়ামতের প্রথম আলামত হলো, পূর্ব থেকে একটি আগুন বের হবে এবং মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে পশ্চিমে সমবেত করবে। জান্নাাতের অধিবাসীদের প্রথম খাবার হবে মাছের কলিজার অতিরিক্ত অংশ। আর সন্তানের পিতা-মাতার সাদৃশ্যের কারণ হলো, পুরুষের পানি আগে বের হলে সন্তান তার দিকে ঝুঁকবে, আর স্ত্রীর পানি আগে বের হলে সন্তান তাঁর দিকে। এ জবাব শুনে আবদুল্লাহ বললেনঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল।
এরপর আবুদল্লাহ ইবন সালাম বললেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! ইহুদীরা একটি মিথ্যাবাদী সম্প্রদায়। আমি একজন আলিম (জ্ঞানী) পিতার আলিম সন্তান। তেমনিভাবে একজন রয়িস (নেতা) পিতার রয়িস সন্তান। আপনি ইহুদীদের ডেকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করুন। তবে আমার ইসলাম গ্রহণের কথা তাদের কাছে গোপন রাখবেন। তাঁর কথা মত রাসূল (সা) ইহুদীদের ডেকে তাদের সামনে ইসলামের দা’ওয়াতে পেশ করলেন। এক পর্যায়ে তাদেরকে প্রশ্ন করলেন: তোমাদের মধ্রে আবদুল্লাহ ইবন সারাম কে? তারা বললো: তিনি তো আমাদের প্রাক্তন রয়িসের ছেলে বর্তমান রয়িস। ‘আলিম পিতার আলিম সন্তান। রাসূল (সা) বললেন: আচ্ছা, তিনি কি ইসলাম গ্রহণ করতে পারেন? তারা বললো: কক্ষণো না।
এদেিক আবুদল্লাহ ইবন সালাম তখন ঘরের এক কোণে লুকিয়ে আছেন। রাসূল (সা) তাঁকে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত কররেন। তিনি কালেমা শাহাদাত উচ্চারণ করতে করতে বেরিয়ে এসে ইহুদী সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বললেন: তোমরা আল্লাহকে একটু ভয় কর। তোমরা ভালো করেই জান এ ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর দ্বীন সত্য।
তাঁর আবেদন সত্ত্বেও ইহুদীরা ঈমান আনলো ন। বরং এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে তারা যে অপমানিত হলো তাতে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তারা আবদুল্লাহলকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলো: তুমি একজন ভণ্ড, মিথ্যাবাদী ও বিশ্বাসঘাতক। তুমি আমাদের সম্প্রদায়ের একজন নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। তোমার বাবাও ছিল একজন ইতর।
আবদুল্লাহ তখন বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি দেখলেন তো। আমি এরই ভয় পাচ্ছিলাম।৮ যখন ইহুদীরা রাসূলুল্লাহর (সা) দা’ওয়াতে প্রত্যাখ্রান করে চলে গেল তণ পবিত্র কুরআনের সূরা আল-আহক্বাফের দশম আয়াতটি নাযিল হলো।৯
আবদুল্লাহ ইবন সালামের ইসলাম গ্রহণের সময়কাল সম্পর্কে ভিন্নমতও আছে। ইমাম শা’বী থেকে বির্ণত হয়েছে। তিনি রাসূলুল্লাহর ওফাতের দুই বছর পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন।১০ ইমাম জাহাবী বলেন, এ একটি ব্যতিক্রমী ও প্রত্যাখ্রাত বর্ণনা। কারণ, সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) হিজরাত ও মদীনায় আগমনের সময় ইসলাম গ্রহণ করেন।১১ ইবন সা’দ বলেন: তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় আগমেরন পর প্রথমভাগেই ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ইহুদীদের একজন ‘হাব্র বা ধর্মগুরু।১২
বদর ও উহুদ যুদ্ধে আবদুল্লাহ ইবন সালামের যোগদানের ব্যাপারে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মত পার্থক্য আছে ইবন সা’দের মতে তিনি সর্বপ্রথম খন্দক যুদ্ধে যোগদান করেন। এ কারনে তাঁকে সাহাবীদের তৃতীয় তাবকা (স্তর) খন্দকের যোদ্ধাদের সাথে উল্লেখ করেছেন। খন্দকের পর থেকে সকল যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন।
খলীফা উমারের (রা) বাইতুল মাকদাস সফরকালে তিনি সফরসঙ্গী ছিলেন। আল-ওয়াকিদী বর্ণনা করেছেন, বায়তুল মাকদাস ও জাবিয়া বিজয়ের তিনি অন্যতম অংশীদার ছিলেন।১৩
বিদ্রোহীরা যখন খলীফা উসমানকে (রা) গৃহে অবরুদ্ধ করে হত্যার ষড়যন্ত্র করতে থাকে তখন সেই দুর্যোগময় মমুহূর্তে তিনি একদিন সাক্ষাৎ করে বলেন: আমরা সাহায্যের জন্য প্রস্তুত। এখন এভাবে আপনার ঘরে বসে থাকা ঠিক হবে না। বাইরে যেয়ে সমবেত জনতাকে বিক্ষিপ্ত করে দিন। এ কথ বলে আবদুল্লাহ নিজেই জনতার সামনে এসে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। বাষণটি বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। তার সারাংশ নিম্নরূপ:
“ওহে জনমণ্ডলী জাহিলী ’আমলে আমার নাম ছিল হুসাইন। রাসূলুল্লাহ আমার নাম দেন আবদুল্লাহ। কুরআন পাকের এ আয়াতগুলি আমার সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।
১)আর বনী ইসরাঈলের একজন সাক্ষী এর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে এতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে, আর তোমরা অহঙ্কার করছো। (সূরা আল-আহক্বাফ-১০)
২)কাফেররা বলে: আপনি রাসূল নন। বলে দিনঃ আমার ও তোমাদের মধ্যে প্রকৃষ্ট সাক্ষী হচ্ছেন আল্লাহ এবং ঐ ব্যক্তি, যার কাছে (আসমানী) গ্রন্থের জ্ঞান আছে। (সূরা রা’দ-৪৩)
আল্লাহর তরবারি এখন পর্যন্ত কোষবদ্ধ আছে এবং আপনাদের এই শহর- রাসূলুল্লাহর (সা) হিজরাত স্থলকে ফিরিশতারা তাদের আবাসভূমি বানিয়ে রেখেছেন। অতএব আপনারা আল্লাহকে ভয় করুন। তাঁকে (উসমানকে) হত্যা থেকে বিরত থাকুন। আল্লাহর কসম! যদি আপনারা তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েই থাকেন তাহলে আপনাদের প্রতিবেশী ফিরিশতাগণ মদীনরা ত্যাগ করবেন। আর এখন পর্যন্ত যে তরবারি কেষবদ্ধ আছে তা বেরিয়ে পড়বে এবং কিয়াতম পর্যন্ত তা আর কোষবদ্ধ হবে না।”
তাঁর এ ভাষণ কঠোর হৃদয় বিদ্রোহীদের ওপর কোন প্রভাব ফেরতে পারলো না। বরং এর উল্টো ফর দেখা দিল। তাদের দুভৃাগ্য ও হঠকারিতা আরো বেড়ে গেল। তারা বললোঃ “এই ইহুদী ও উসমান-দুই জনকেই হত্যা কর।”১৪
অন্য একটি বণৃনায় এসেছে। আবদুল্লাহ ইবন সালাম বলেন: ‘উসমান যখন গৃহবন্দী তখন আমি একদিন তাঁকে সালাম জানাতে গেলাম। আমি ত৭ার গৃহে প্রবশে করতেই তিনি বললেন: আমার ভাই স্বাগতম! গত রাতে আমি রাসূলুল্লাহর (সা) এই জানালা দিয়ে দেখেছি। তিনি বললেন: উসমান! তোমাকে তারা অবরুদ্ধ করেছে? বললাম: হাঁ। বরলেন: তোমাকে তারা তৃষ্ণার্ত রেখেছে? বললাম: হ্যাঁ। তারপর তিনি আমাকে একটি পানিভর্তি বালতি দিলেন। আমি পান করে পিপাসা নিবারণ করলোম। তিনি আমাকে বললেন: তুমি চাইলে তাঁদের বিরুদ্ধে তোমাকে বিজয়ী করবো। আর ইচ্ছা করলে আজ আমার সাথে ইফতার করতে পার। আমি তাঁর সাথে ইফতার করাকে বেছে নিয়েছি। তিনি সেই দিন নিহত হন।১৫
খলীফা আলী (রা) মদীনার পরিবর্তে কুফাকে রাজধানী করার সিদ্ধান্ত নিলে আবুদল্লাহ তাঁকে বলেন, “আপনি মদীনার মসজিদে রাসূলুল্লাহর (সা) মিম্বর ত্যাগ করবেন না। এটা ত্যাগ করলে আর কখনও তা যিয়ারত করতে পারবেন নরা।” আলী (রা) তখন মন্তব্য করেন “বেবচারা বড় সরল ও সৎ মানুষ।১৬
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে। আলী (রা) বলেন: আমি ঘোড়ার পিঠে উঠার জন্য যখন জিনে পা রাখছি ঠিক সেই সশয় আবুদল্লাহ ইবন সালাম আমার কাছে এসে বলেন: কোথায় যাচ্ছেন? বললামঃ ইরাক। বললেন: সেখানে গেলে আপনি তরবারির ধার লাভ করবেন। বলালম ৎ আমি আগেই একথাটি রাসূলুল্লাহকে (সা) বলতে শুনেছি।১৭
খলীফা আলী ও আলীর মু’য়াবিয়ার (রা) ঝগড়া ও বিবাদে তিনি জড়াননি। একটি কাঠের তৈরী তরবারি সঙ্গে নিয়ে এ বিবাদ থেকে সযতেœ দূরে থাকেন।১৮
সকল সীরাত বিশেষজ্ঞ একমত যে, তিনি আমীর মু’য়াবিয়ার (রা) খিলাফতকালে হিজরী ৪৩ সনে মদীনায় ইনতিকাল করেন।১৯ তিনি দুই ছেলে রেখে যান। ত৭াদের নাম ইউসুফ ও মুহাম্মদ। উভয়ের জন্ম হয় রাসূলুল্লাহর (সা) জীবদ্দশায়। ইউসুফ ছিলেন বড়। তাঁর জন্মের পর রাসূলে কারীম (সা) তাঁকে কোলে নেন, মাথায হাত রাখেন এবং ইউসুফ নাম রাখেন।২০
আবদুল্লাহর দৈনিক পঠনের তেমন বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে একথা জানা যায় যে, বার্দ্ধক্যে দুর্বলতার দরুন লাঠি নিয়ে চলাফেরা করতেন এবং প্রয়োজনে তাতে ঠেস দিতেন।২১ মুখমণ্ডলে খোদাভীতির ছাপ সর্বদা প্রতিভাত হতো।২২
আবদুল্লাহর (রা) বুকটি ভরা ছিল তাওরাত, ইনজীল, কুরআন মাজীদ ও হাদীসে নববীর জ্ঞানে। তাওরাতে তাঁর সীমাহীন পারদর্শিতা সম্পর্কে আল্লামাহ জাহাবী লিখেছেন:২৩
“আবদুল্লাহ ইবন সালাম তাঁর সময়ে মদীনায় আহলি কিতাবদের সবচেয়ে বড় ‘আলিম ছিলেন।”
ইসলাম গ্রহণের পর কুরআন ও হাদীসের প্রতি মনোযোগ দেন এবং এর জ্ঞানে সকলের আস্থা ভাজনে পরিণত হন। এর চেয়ে মর্যাদার বিয়ষ আর কি হতে পারে যে, আবু হুরাইরাহÑযিনি সাহাবীদের মধ্যে হাদীসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী পারদর্শী ছিলেন, তিনিও আবদুল্লাহর নিকট হাদীস জিজ্ঞেস করতেন। একবার আবু হুরাইরাহ গেছেন শামে। সেখানে তিনি কা’ব ইবন আহ্বারের নিকট এই হাদীসটি বর্ণনা করেন: ‘জুম’আর দিন এমন একটি মুহুর্তে আছে তখন যদি কোন বান্দাহ আল্লাহ নিকট কিচু চায় তাহলে তিনি অবশ্যই তা তাকে দান করেন।’ হাদীসটি শোনার পর কা’ব কিছুটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে থাকেন। তারপর অবম্য আবু হুরাইরার বর্ণনার সাথে একমত পোষণ করেন।
এদিকে তিনি (আবু হুরাইরাহ) মদীনায় পিরে এসে আবুদল্লাহ ইবন সালামের নিকট ঘটনাটি বর্ণনা করেন। তিনি শুনে মন্তব্য করেন: কা’ব মিথ্য বলেছে। তখন আবু হুরাইরাহ বলরেন: শেষে তিনি আমার কথা মেনে নিয়েছেন। আবদুল্লাহ বললেন: আপনি কি জানেন সেটা কোন সময়? এ প্রশ্ন শুনে আবু হুরাইরাহ তাঁর পিছু নিলেন এবং সময়টি বলার জন্য ত৭াকে ানুরোধ করতে লাগলেন। তখন আবুদল্লাহ বললেন: আসর ও মাগরিবের মাঝখানের সময়। আবু হুরাইরাহ বললেন: আসর ও মাগরিবের মাঝখানে তো কোন নামায নেই। এ কেমন করে হয়? আবদুল্লাহ বললেন: আপনার হয়তো জানা নেই যে, রাসূল (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি নামাযের প্রতীক্ষায় বসে থাকে সে যেন নামাযের মধ্যেই থাকে।২৪
হাদীসে এম পারদর্শিতা সত্ত্বেও তাঁর থেকে মাত্র পাঁচিশটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।২৫ তাঁর মুখ থেকে হাদীস শুনে যাঁরা হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁদের মধ্যে অনেক সাহাবী আছেন যেমন: আনাস ইবন মালিক, যুরারাহ ইবন আওফা, আবু হুরাইরাহ, আবদুল্লাহ ইবন মা’কিল, আবদুল্লাহ ইবন হানজালা প্রমুখ। এছাড়া ত৭ার বিশেষ কয়েকজন ছাত্রের নামঃ খারাশা ইবন আল-হুর, কায়স ইবন উবাদ, আবু সালামা ইবন আবদুর রহমান, হামযাহ ইবন ইউসুফ (পৌত্র), উমার ইবন মুহাম্মদ (পৌত্র), আওফ ইবন মালিক, আবু বুরাদাহ্ ইবন আবী মুসা, আবু সা’ঈদ আল-মুকরী, উবাদাহ্ আয-যারকী, আতা ইবন ইয়াসার, উবাইদুল্লাহ ইবন জায়শ আল-গিফারী, যুররাহ্ ইবন আওফা, ইউসুফ ও মুহাম্মদ (দুই পুত্র)।২৬
সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে আবুদল্লাহ ইবন সালামের সম্মান ও মর্যাদা ছিল অতি উঁচুতে। তিনি ছিলেন বিশিষ্ট আলিম সাহাবীদের অন্যতম। বিখ্যাত সাহাবী মু’য়াজ ইবন জাবালের অন্তিম সময় যখন ঘনিয়ে এলা তখন তাঁকে বলা হলো, আমাদেরকে কিছু উপদেরশ দিন। বললেন: আমি দুনিয়া থেকে চলে যাচ্ছি। তবে আমার সাথে ইলম বা জ্ঞান উঠে যাচ্ছে না। যে ব্যক্তি তা তালাশ করবে, সে লাভ করবে। তোমরা আবুদ দারদা, সালামান আল-ফারেসী, আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদ ও আবদুল্লাহ ইবন সালামের নিকট ইলম (জ্ঞান) তালাশ করবে। আবদুল্লাহ ছিলেন ইহুদী। পরে মুসলমান হন। আমি রাসূলুল্লাহর (সা) তাঁর সম্পর্কে বলতে শুনেছি: সে দশম জান্নাতী ব্যক্তি।২৭
সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস (রা) বলেছেন। আমি একমাত্র আবদুলÍাহ ইবন সালাম ছাড়া পৃথিবীতে বিচরণকারী কোন ব্যক্তি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহকে (সা) একথা বলতে শুনিনি: সে একজন জান্নাতের অধিকারী ব্যক্তি। তাঁরই সম্পর্কে নাযিল হয়েছে সূরা আল-আহক্বাফের ১০ নংয় আয়াতটি।২৮
মুস’য়াব ইবন সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস তাঁর পিতা সা’দ (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন: একদিন রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এক পেয়ালা সারীদ’ আনা হলো। তিনি খাওয়ার পর কিচু অবশিষ্ট থাকলো। রাসূল (সা) বললেন: এই ফাঁক দিয়ে একজন জান্নাতী ব্যক্তি প্রবেশ করবে এবঙ এই এঁটেটুকু খেয়ে ফেলবে। সা’দ বলেন: আমি আমার ভাই উমাইরকে ওজু করতে পাঠিয়েছিলাম। আমি চাচ্ছিলাম, সে এসে এঁটেটুকু খেয়ে ফেলুক। কিন্তু তাঁর আগেই আবদুল্লাহ ইবন সালাম এসে তা খেয়ে ফেলে।২৯
আবদুল্লাহ এত বড় মর্যদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও খুবই বিনয়ী ছিলেন। কেউ ত৭ার সামান্য প্রশংসা করলে ক্ষেপে যেতেন। কায়স ইবন উবাদ বলেন: আমি মদীনার মসজিদে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি আসলেন, যাঁর চেহারায় খোদাভীতির ছাপ দ্যিমান ছিল। লোকেরা হললোঃ ইনি একজন জান্নাতী ব্যক্তি। এরপর তিনি দুই রাকা’য়াত সংক্ষিপ্ত নামায আদায় করলেন। তিনি যখন মসজিদে থেকে বের হলেন, আমি তাঁকে অনুসরণ করলাম। তিনি তাঁর ঘরে ঢুকলেন, আমিও পিছনে পিছনে ঢুকলাম। আমি তাঁর সাথে কথা বলে পরিচিত হওয়ার পর বললাম: আপনি যখন মসজিদে প্রবশ করেন তখন লোকেরা এমন এমন কথা বলাবলি করছিল। তিনি বললেনঃ সুবহানাল্লাহ! কোন মানুষের এমন কথা বলা উচিত নয় যা সে জানেনা। আমি তোমাকে বলছি: আমি একটি স্বপ্ন দেখে রাসূলুল্লাহকে (সা) বললাম। স্বপ্নটি এরূর: আমি যেন একটি সবুজ উদ্যান দেখতে পেলাম। যার মঝখানে রয়েছে একটি লোহার খুঁটি। খুুঁটির গোড়া মাটিতে এবং আগা আকাশে। আগায় একটি রশি বাঁধা। আমাকে বলা হলো: খুঁটি বেয়ে উপরে ওঠো। আমি উঠে রশি ধরলাম। তখন আমাকে বলা হলো: শক্তভাবে আঁকড়ে থাক। রশিটি আমার হাতে াকা অস্থায় আমি ঘুম েেক জেগে উঠি। সকালে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে স্বপ্নটি বর্ণনা করলাম। রাসূল (সা) বললেন: উদ্যানটি হলো ইসলামের উদ্যান, আর খুঁটি হলো ইসলামের খুঁটি। আর রশি হলো ইসলামের রশি। তুমি আমরণ ইসলামের ওপর থাক।ে বর্ণনাকারী কায়স বলেন: সেই লোকটি হলেন আবদুল্লাহ ইবন সালাম।৩০
খারাশা ইবনুল হুর স্বপ্নটি একটু ভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন।৩১ অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর স্বপ্নের বিবরণ শুনে বলেন: ইসরামের শক্ত রশি আঁকড়ে থাকা অবস্থায় তোমার মৃত্যু হবে।৩২
আবদুল্লাহর (রা) বিনয়ের আরো বহু ঘটনা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। একবার তিনি লাকড়ীর একটি বোঝা মাথায় করে চলেছেন। তা দেখে লোকেরা তাঁকে বললো: এমন কাজ করা থেকে আল্লাহ আপনাকে রেহাই দিয়েছেন। তিনি বললেন: হাঁ, ঠিক। তবে আমি এ কাজের মাধ্যমে আমার অহঙ্কার ও আভিজাত্য চুরমার করতে পাই। কারণ আমি রাসূলকে (সা) বলতে শুনেছি: যার অন্তরে একটি সরিষার দানা পরিমাণ ‘কিবর’ বা অহঙ্কার থাকবে সে জান্নাতে প্রবশে করবে না।৩৩
আবদুলালাহর (রা) মধ্রে সত্য ও সততার সীমাহীন আবেগ ও শক্তি ছিল। শেষ জীবনে তিনি বলতেন, তোমাদের যদি আর একবার কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ বেঁধে যায়, আর সে সময় যদি আমার মধ্যে শক্তি না থাকে তাহলে একটি চৌকির ওপর আমাকে বসিয়ে দুই পক্ষের মাঝখানে রেখে দেবে।৩৪
আবদুল্লাহ ইবন সালাম (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। একবার সালমান আল-ফারেসী (রা) তাঁকে বললেন: ভাই! আমাদের দুইজনের মধ্যে যে আগে মারা যাব তাকে স্বপ্নে দেখার চেষ্টা করবো যে জীবিত থাকবো। আবদুল্লাহ ইবন সালাম বললেন: এটা কি সম্ভব? সালমান বললেণ: হ্যাঁ, সম্ভব। ঈমানদার ব্যক্তির রূহ মুক্ত থাকে। পৃথিবীর যেখানে ইচ্ছা যেতে পারে। আর কাফির ব্যক্তির রূহ থাকে বন্দী। সালমান মারা গেলেন। আবদুল্লাহ ইবন সালাম বলেন: একদিন আমি মধ্যরাতে ঘুমিয়ে পড়েছি। সালমান এসে আমাকে সালাম দিলেন। আমি সালামের জবাব দিয়ে বললাম: আবু আবদিল্লাহ! আপনি আপনার বাসস্থান কেমন পেয়েছেন? বললেন: ভালো। আপনি তাওয়াককুল (আল্লাহর ওপর নির্ভরতা) আঁকড়ে াকবেন। তাওয়াককুল খুব ভালো জিনিস। একাটি তিনি তিনবার বললেন। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছ। আবুদলÍাহ প্রশ্ন করলেন: আপনি কোন আমলটি সবচেয়ে ভালো পেয়েছেন? বললেন: তাওয়াককুলকে আমি বিস্ময়কর জিনিস হিসেবে পেয়েছি।৩৫
আবু বুরদাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন: একবার আমি মদীনায় গিয়ে আবদুল্লাহ ইবন সালামের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমাকে বললেন: তুমি কি আমার বাড়ীতে যাবে না? চল, তোমাকে ছাতু ও খোরমা খাওয়াবো। আমি গেলাম। তিনি আমাকে বললেন: দেখ, তোমরা এমন এক অঞ্চলে বাস কর যেখানে সুদ প্রচলিত। তোমার যদি কোন ব্যক্তির কাছে কিচু পাওনা থাকে, আর সে তোমাকে পশুর খাদ্র কিচু ভূষিও উপহার দেয়, তুমি তা নিবে না। কারণ তা সুদ হয়ে যাবে।৩৬ অন্য একটি বর্ণনায় ঘটনাটি একটু ভিন্নভাবে এসেছে।৩৭
আবুদল্লাহ ইবন সালামের (রা) শানে পবত্রি কুরআনের সূরা আল-আহক্বাফ ও সূরা আর-রাদ-এর যথাক্রমে ১০ নং ও ৪৩ নং আয়াত দুইটি ছাড়াও আরো দুইটি আয়তা নাযিল হয়েছে বলে কোন কোন মুফাসসির মত প্রকাশ করেছেন। ইবন ইসহাক ইবন আববাসের (রা) সূত্রে বণৃনা করেছেন। সূরা আলে ইমরানের ১১৩ ও ১১৪ নং আয়াত দুইটি আবদুল্লাহ ইবন সালাম ও সা’লাবা ইবন সা’ইয়ার প্রশংসায় নাযিল হয়েছে।৩৮ আল্লাহ তাঁদের প্রশংসায় বলেন:
তারা সবাই সমান নয়। আহলে কিতাবদের মধ্যে কিছু লোক এমনও আছে যারা অবিচলভাবে আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে এবং রাতের গভীরে তারা সিজদা করে। তারা আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে এবং কল্যাণকর বিষয়ের নির্দেশ দেয়, অকল্যাণ থেকে বারণ করে এবং সৎকাজের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে থাকে। আর এরাই হলো সৎকর্মশীল।
এভাবে স্বয়ং আল্লাহ পাক আবুদল্লাহ ইবন সালামের (রা) মর্যাদার সনদ দান করেছেন। তিনি কত মহান ব্যক্তি ছিলেন তা আল্লাহ তা’য়ালার এ ঘোষনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

তথ্যসূত্র:

সাহল ইবন সা’দ (রা)
তাঁর ভালো নাম সাহ্ল। ডাকনাম কয়েকটি। যেমন: আবুল ‘আব্বাস, আবু মালিক ও আবু ইয়াহইয়া। পিতার নাম সা’দ ইবন মালিক। মদীনার খাযরাজ গোত্রের বনু সায়িদার সন্তান। একজন বিখ্যাত আনসারী সাহাবী। পিতা সা’দও সাহাবী ছিলেন।১
রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় হিজরাতের পাঁচ বছর পূর্বে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর পিতা নাম রাখেন ‘হুয্ন’। রাসূল (সা) মদীনায় আসার পর পরিবর্তন করে তাঁর নাম রাখেন ‘সাহল’। একথা ইবন বিব্বান বর্ণনা করেছেন।২ হিজরাতের পূর্বেই তাঁর পিতা সা’দ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। সুতরাং তিনি মুসরমান হিসেবেই বেড়ে ওঠেন।
হযরত রাসূলে কারীমের (সা) মদীনা আগমনের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। হিজরী দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধের সময় তিনি সাত বছরের এক বালক মাত্র। যুদ্ধে তোড়জোড় চলছে, এতমন সময় তার পিতা হযরত সা’দ ইনতিকাল করেন। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। বদর যুদ্ধের পর রাসূল (সা) গনীমতের একটি অংশ তাঁর মরহুম পিতাকেও দিয়েছিলেন। কারণ, তিনি বদর যুদ্ধে যোগদানের সংকল্পন করেছিলেন।
হিজরী তৃতীয় সনে উহুদ যুদ্ধের সময় তাঁর সম বয়সী ছেলেদের সাথে মিলে মদীনার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ যুদ্ধে হযরত রাসূলে কারীম (সা) আহত হয়ে রক্তরঞ্জিত হয়েছিলেন। যখন তাঁর সেই রক্ত সাফ করা হয়েছিল, তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।৩
হিজরী পঞ্চম সনে যখন খন্দক যুদ্ধ হয় তখন তিনি ধশ বছরের বালক মাত্র। তা সত্ত্বেও তীব্র আবেগ ও উৎসাহ ভরে খন্দক খননে অংশ নেন এবং কাঁধে করে মাটি বহন করেন।৪ মোট কথা হিজরী এগারো সনে রাসূলুল্লাহর (সা) ওফাতের সময় তাঁর বয়স মাত্র। পনেরো বছর। তখনও তাঁর যুদ্ধে যাওয়ার বয়স হয়নি।
খিলাফতে রাশেদার সময় কালের তাঁর জীবনের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। হিজরী ৭৪ সনে স্বৈরাচারী ও উৎপীড়ক উমাইয়্যা শাসক হাজ্জাজ ইবন ইউসুফের রোষানলে পড়েন। হাজ্জাজ তাঁকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন: আপনি খলীফা উসমানকে সাহায্য করেননি কেন? তিনি বলেন: করেছি। হাজ্জাজ বলেন: সত্য বলছে না। এরপর তিনি অপমান ও লাঞ্ছনার প্রতীক স্বরূপ ত৭ার ঘাড়ে ছাপ মেরে দেওয়ার দির্নেশ দেণ। হাজ্জাজের এ অপকর্মের হাত থেকে হযরত আনাস ও জাবির ইবন আবদিল্লাহর মত মর্যাদাবান সাহাবীদ্বয়ও রেহাই পাননি। হাজ্জাজের এ কাজের উদ্দেশ্যে ছিল যাতে মানুষ তাঁদের থেকে দূরে াকে এবং তাঁদের কায় কান না দেয়।৫
ইমাম যুহরী বলেন: রাসূলুল্লাহর ইনতিকালের সময় সাহল ইবন সা’দের বয়স হয়েছিল ১৫ বছর। আর তিনি হিজরী ৯১ সনে মদীনায় মারা যান। ওয়াকিদীর মতে তিনি এক শো বছর জীবন লাভ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন ছিয়ানব্বই বছর বা তার চেয়ে কিছু বেশী।৬ ইবন হাজারের মতে হিজরী ৮৮ সনে তিনি যখন মারা যান তখন তাঁর বয়স ১০০ বছরের উর্দ্ধে।৭ ইবন আবী দাউদের ধারণা, তিনি ইসকান্দারিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। কাতাদা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি মিসরে মারা যান। ইবন হাজার বলেন, এ সব ধাণণা মাত্র।৮ ওয়াকিদী বলেন: একথা বর্ণিত আছে যে, মদীনায় মৃত্যুবরণকারী সর্বশেষ সাহাবী জাবির ইবন আবদিল্লাহ। তবে সঠিক এই যে, জিরী ৯১ সনে সাহল ইবন সা’দ আস-সা’য়িদী মদীনায় মৃত্যুবরণকারী সর্বশেষ সাহাবী।৯ তাঁর জীবনের শেষ ভাগে মদীনায় আর কোন সাহাবী ছিলেন না। ইসলামী খিলাফতের অন্যান্য অঞ্চলও তখন সাহাবীদের বরকত থেকে প্রায় মাহরূম হয়ে পড়েছিল। তিনি নিজেই বলতেন: আমি মারা গেলে ‘কালার রাসূল (রাসূল বলেছেন) বলার কেউ থাকবে না।
হযরত সাহল ইবন সা’দ ছিলেন খ্যাতিমান সাহাবীদের একজন। বিশিষ্ট সাহাবীদের মুত্যুর পর তিনি জনগণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। অতি আবেগ ও উৎসাহের সাথে অগণিত মানুষ হাদীস শোনার জন্য তাঁর কাছে ভীড় জমাতো।
রাসূলুল্লাহর (সা) জীবদ্দশায় যদিও তিনি অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছিলেন, বতুও বহু হাদীস শুনেছিলেন। রাসূলুল্লাহর (সা) ইনতিকালেরর পর হযরত উবাই ইবন কা’ব আসিম ইবন ‘আদী, ‘আমার ইবন আবাসা প্রমুখ খ্যামিান সাহাবীর নিকট থেকে এ শাস্ত্রে পারদর্শিতা অর্জন করেন। মারওয়ান যদিও সাহাবী ছিলেন না, তবুও তাঁর নিকট থেকে কিছু হাদীস তিনি গ্রহণ করেছেন।১০
সাহাবী ও তাবে’ঈদের অনেকেই তাঁর নিকট থেকে হাদীস শুনেছেন এবং বর্ণনাও করেছেন। তাঁদের বিশেষ কয়েকজনের মাত্র এখানে উল্লেখ করা হলো:
আবু হুরাইরা, ইবন আব্বাস, সা’ঈদ ইবন মুসায়্যিব, আবু হাযিম ইবন দাীনায, যুহরী, আবু সুহাইল সুবহী, ‘আব্বাস ইবন সাহল (ছেলে), ওয়াফা ইবন শুরাইহ হাদরামী, ইয়াহইয়া ইবন মায়মুন হাদরামী, আবদুল্লাহ ইবন আবদির রহমান ইবন আবী জুবাব, আমর ইবন জাবির হাদরামী প্রমুখ।১১
হরত সাহল ইবন সা’দ (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা সর্বমোট ১৮৮ টি। তার মধ্যে ২৮টি মুত্তাফাক আলাইহি।১২
হযরত রাসূল কারীমকে (সা) তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন। রাসূলুল্লাহর (সা) প্রতিটি কাজ ও আচার-আচরণ অনুসরণ করার চেষ্টা করতেন। রাসূল (সা) একটি কাঠোর খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন। একবার তিনি একটি মম্বরের কথা বললেন। হযরত সাহল সাথে সাথে জঙ্গলে চলে যান এবং মিম্বরের জন্য কাঠ কেটে নিয়ে আসেন।১৩ একবার তিনি নিজ হাতে রাসূলকে (সা) ‘বুদা’য়া’ কূপের পানি পান করিয়েছিলেন। একথা তিনি বর্ণনা করেছেন। উল্লেখ্য যে, এটা মদীনার একটি কূপ। মদীনাবাসীরা তাতে ময়লা-আবর্জনা ফেলতো। তবে কূপটি বড় ছিল এবং তাতে অনেক ঝর্ণা ছিল।১৪
সত্য বলা ছিল হযরত সাহলের (রা) চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তাঁর জীবদ্দশায় একবার মাওয়ান বংশের এক ব্যক্তি মদীনার আমীর হয়ে আসেন। তিনি হযরত সাহলকে (রা) ডেকে হযরত আলীকে (রা) গালি দেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি সেই শ্বৈরাচারী শাসকের নির্দেশ পালন করতে কঠোরভাবে অম্বীকার করেন। তখন সেই আমীর আদার করেন, অন্ততঃ এতটুকুই বলেন যে, ‘আবু তুরাবের ওপর আল্লাহর অভিশাপ।’ জবাবে হযরত সাহল বলেনঃ আবু তুরাব ছিল আলীর প্রিয়তম নাম। রাসূল (সা) তাঁকে এ নামে ডেকে খুশী হতেন। এরপর তিনি আলীর (রা) আবু তুরাব নাম করণের ব্যাখ্যা করে শোনালে আমীর চুপ হয়ে যান।১৫
একবার সাহল ইবন সা’দ, আবু জার, ‘উবাদা ইবনুস সামিত, আবু সা’ঈদ আল-খুদরী, মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা ও ষষ্ঠ এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে একথার ওপর বাই’য়াত করেন যে, আলÍাহর ব্যাপারে তাঁরা কোন তিরষ্কারকারীর তিরস্কারের পরোয়া করবেন না।১৬ তাঁর জীবন-ইতহিাস একথা প্রমাণ করে যে, আমরণ তিনি এ বাই’য়াতের ওপর অটল ছিলেন।
তাঁর হাদীসের দারসের মজলিসে কেউ উদাসীন বা অমনোযোগী থাকলে তিনি ভীষণ ক্ষেপে যেতেন। এ ধরনের একটি ঘটনা তাবারানী তাঁর আল-কাবীর’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। আবু হাসেম বলেন, একবার এক মজলিসে তিনি হাদীস শোনাচ্ছেন। শ্রোতাদের কেউ কেউ তখন নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছিল। িিন ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে বললেন: এদেরকে দেখে রাখ। আমার দু’চোখ রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট যা কিছু দেখেছে, দু’কান যা কিছু শুনেছে, আমি তাই এদের নিকট বর্ণনা করছি, আর এরা তা না কক্ষনো ফিরে আসবো না। আমি জানতে চাইলাম। কোথায় যাবেন? বললেন: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে বেরিয়ে যাব। বললাম: আপনার ওপর এখন তো আর জিহাদ ফরজ নয়। আপনি এখন ঘোড়ার ওপর বসতে পারেন না, তরবারি দিয়ে আঘাত করার শক্তি রাখেন না এবং তীর-বর্শাও ছুড়তে পারেন না।
বললেন: আবু হাসেম! আমি ময়দানে গিয়ে সারিতে দাঁড়িয়ে থাকবো। একটা অজানা তীর বা পাথর উড়ে এসে আমাকে আঘাত করবে এবং আল্লাাহ তাতেই আমাকে শাহাদাত দান করবেন।১৭
তথ্যসূত্র:
সাহল ইবন হুনাইফ (রা)
নাম সাহল, ডাকনাম আবু সা’দ আবু ‘আবদিল্লাহ, আবুল ওয়ালীদ ও আবু সাবেত। পিতা হুনাইফ ইবন ওয়াহিব এবং মাতা হিন্দা বিন্তু রাফে’। মদীনার আউস গোত্রের সন্তান। ক্ষিখ্যাত আনসারী বচদরী সাহাবী।১ তাঁর ভাই আব্বাদ ইবন হুনাইফ ছির মদীনার অন্যতম মুনাফিক। মসজিদে দিরার’ যারা নির্মাণ করেছিল, সে তাদের একজন।২
রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় আসার আগেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর আবদুল্লাহ ইবন জুবাইর ও তিনি রাতের অন্ধকারে সকলের অগোচরে ঘুরে ঘুরে মদীনার বিভিন্ন স্থানের বিগ্রহগুলি ভেঙ্গে ফেলতেন। কাঠের বিগ্রহগুলি ভেঙ্গে তাঁরা সেই কাঠ দরিদ্র মসুলমানদের গৃহে জ্বালানীর জন্য পৌঁছে দিতেন। হযরত আলী (রা) মদীনায় হিজরাতের পর কুবায় কুলছুম ইবন হাদামের গৃহে কিছুদিন অব্সথান করেন। তার পাশেই ছিল এক মহিলার বাড়ী। প্রতিদিন গভীর রাতে সেই বাড়ীর দরজা খোলার শব্দ তিনি শুনতে পেতেন। তারপর একজন লোকের ভিতে প্রবেশ ও বেরিয়ে যাওয়ার সাড়া পেতেন। একদিন তিনি বিষয়টি জানার জন্য মিহলাকে বিজ্ঞেস করলেন। মহিলাটি বললেন: আমি একজন বিধবা মুসলিম নারী। প্রতিদিন রাতে যিনি এখানে আসেন, তিনি সাহল ইবন হুনাইফ। তিনি রাতে গুরে ঘুরে মূর্তি ভাঙ্গেন এবং তার কাঠগুলি আমার জ্বালানীর জন্য দিয়ে যান।৩
হযরত রাসূলে কারীম (সা) মদীনায় আসর পর আলীর (সা) সাথে তাঁর দ্বীনী ভ্রীতৃ-সম্পর্ক স্থাপন করে দেন।৪
বদর, উহুদ, খন্দক সহ সকল যুদ্ধে তিনি রাসূসুল্লাহর (সা) সাথে সংশগ্রহণ করেন।৫ উহুদ যুদ্ধের বিপর্যয়ের সময় যে ১৫ জন সাহাবী জীবন বাজি রেখে রাসূসুল্লাহর (সা) সাথে ময়দানে অটল াকেন তিনি তাঁদের অন্যতম।৬ সেদিন তিনি রাসূসুল্লাহর (সা) নিকট মরণের শপ করেছিলেন। রাসূলকে (সা) সংঙ্গের লোকদের তখন বলেছিরেন, তোমরা তাকে তীর দাও, এ হচ্ছে সাহল।’ হযরত উমার (রা) পরবর্তী কালে কোন সংকট হুমূর্তে সাহল উপস্থিত াকলে তাঁকে সৌভাগ্যের প্রতীক ধরে নিয়ে বলতেন, সাহল আছে, কোন ভাবনা নেই।৭ উহুদ যুদেÍ পর হযরত আলী (রা) ফাতিমার নিকট এসে তরবারি এগিয়ে দিলে বললেন: এই লও তরবারি যা মোটেই নিন্দিত নয়।’ একা শুনে রাসূল (সা) বললেন: ‘তুমি ভালো যুদ্ধ করেছো। তবে সাহল ও আবু দুজানা-উভয়ে ভালো যুদ্ধ করেছে।’৮
হযরত আলী (রা) খলীফা নির্বাচিত হলে তিনি তিনি তাঁর পক্ষে ছিলেন। আলী (রা) যখন ইরাকে যান তখন ত৭াকে মদীনার আমীর নিয়োগ করেন।৯ এক সময় খলীফা তাঁকে ডেকে পাঠালে তিনি মদীনা ছেড়ে কূফায় চলে যান।১০ উটের যুদ্ধের পর হযরত আলী (রা) তাঁকে বসরার ওয়ালী নিয়োগ করেন।১১ সিফ্ফীন যুদ্ধের তিনি আলীর (রা) পক্ষে যোগদান করেন।১২ যুদ্ধ শেষে তিনি কূফায় চলে যান। এসময় তাঁকে ‘ফারেস’-এর আমীর নিয়োগ করা হয়।১৩ কিন্তু ততাকার অধিবাসীরা বিদ্রোহী হয়ে তাঁকে শহর থেকে তাড়িয়ে দেয়। হযরত আলী (রা) তাঁর স্থলে যিয়াদ ইবন আবীহকে তথাকার আমীর নিয়োগ করেন।১৪
মদীনা থেকে ইহুদী গোত্র বনু নাদীর বিতাড়িত হওয়ার পর তাদের তেকে আটককৃত ধন-সম্পদ রাসূল (সা) মুহাজিরদের মধ্রে বন্টন করে দেন। আনসারদের মধ্যে সাহল ইবন হুনাইফ ও আবু দুজানা সিমাক ইবন খারাশা নিজেদের চরম দারিদ্রের কথা প্রকাশ করলে রাসূল (সা) তাদেরকেও কিছু দেন।১৫ আল্লামা সুহাইলীর মতে মোট তিনজন আনসারকে বনু নাদীরের সম্পদ থেকে অংশ দেওয়া হয়েছিল।১৬
ওয়াকিদী ও আল-মাদায়িনী বলেন, সাহল ইবন হুনাইফ হিজরী ৩৮ সনে কূফায় ইনতিকাল কেরন। হযরত আলী (রা) তাঁর জানাযার নামাযের ইমামতি করেন। আবদুল্লাহ ইবন মা’কাল বলেন: আমি আলীর সাথে সাহল ইবন হুনাইফের জানাযার নামায পড়েছি। এ নামাযে তিনি ছয় তাকবীর বলরেন। কেউ একজন এর প্রতিবাদ করলে তিনি বললেন, হুনাইফ ছিরেন বদরী সাহাবী। আমি ছয় তাকবীরের দ্বারা অন্যদের ওপর বদরীদের ফজীলাতের কথা তোমাদের জানাতে চেয়েছি।১৭
মৃত্যুকালে তিনি দুই ছেলে রেখে যান। তাঁরা হলেন: আবু কউমামা আস’য়াদ ও আবদুল্লাহ। প্রথমজন রাসূলুল্লাহর জীবদ্দশায় জন্ম গ্রহণ করেন।১৮
হযরত রাসূল কারীমের (সা) মদীনায় আসার নয় মাসের মাথায় তাঁর একজন অতি প্রয় আনসারী সাহাবী আস’য়াদ ইবন যুরারা ইনতিকাল করেন। তিনি ছিলেন বাই’য়াতে আকাবার সময় মনোনীত ১২ নাকীবের নাকীবুল নুকাবা বা প্রধান নাকীব। তাঁর মৃত্যুর পর রাসূল (সা) তাঁর একটি মেয়েকে নিজ দায়িত্বে লালন-পালন করেন এবং তাঁকে এই সাহল ইবন হুনাইফের সাথে বিয়ে দেন। তাঁরই পেটে জন্মগ্রহণ করেন আবু উমামা ইবন সাহল।১৯
তিনি ছিলেন খুবই সুদর্শন ব্যক্তি। চেহারায় একটা পবিত্রতার ছাপ বিরাজমান ছিল। দৈহিক গঠন ছির অতি সুন্দর। একাবর এক যুদ্ধে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে একই বাহনের পিঠে আরোহী ছিলেন। সেখানে ছিল একটি ঝর্ণা। সেই ঝর্ণায় তিনি গোসল এ কেমন অপরূপ দেহ তার? আমি তো এমনটি আর কখনো দেখিনি।’ এতে হযরত সাহলের কুনজর লাগে। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। শরীরে ভীসণ জ্বর এসে যায়। রাসূল (সা) এর কারণ জানতে চাইলেন। লোকরা ঘটনাটি বর্ণনা করলো। তিনি তাদের কথা শুনে বললেন, মানুষ তার। ভাইয়ের শরীর অথবা ধন-সম্পদ দেখে এবং তার জন্য দু’আ করে না। এ জন্য নজর লেগে যায়। নজর সত্য।২০
আল্লামা যিরিকলী সাহীবহাইনে তাঁর থেকে বর্ণিত চল্লিশটি হাদীস সংকরিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।২১ তিনি রাসূলুল্লাহ (সা) ও যায়িদ ইবন সাবিত থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। বহু তাবে’ঙ্গ তাঁর নিকট থেকে হাদীস শুনেছেন এবং বর্ণনাও করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন:
আবু ওয়ায়িল, উবাইদ ইবন সাববাক, ‘আবদুল রহমান ইবন আবী লায়লা, ‘উবাইদুল্লাহ ইবন, ‘আবদিল্লাহ ইবন, ‘উতবা, সীরীন ইবন ‘আমার, রাবাব প্রমুখ।২২
তিনি সব সময় সকল প্রকার মতভেদ থেকে দূরে থাকতেন। সিফফীন থেকে ফিরে আসার পর ছাত্র আবু ওয়ায়িল বললেন: আমাদের কাছে কিছু ঘটনা বর্ণনা করুন। বললেন: কী বর্ণনা করবো? কঠিন সমস্যা। একটি ছিদ্র বন্ধ করলে আরেকটি খুলে যায়।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও উদ্যমী। কিন্তু মানুষ তাঁর সম্পর্কে ভিন্ন ধারণা পোষণ করতো। এ সম্পর্কে তিনি বললেতন, এ তাঁদের মতের দোষ। আমি কাপুরুষ নই। যে কাজের জন্যই আমি তলোয়ার উঠিয়েছি, তা চিরকালের জন্য সহজ করে দিয়েছি। হুদাইবিয়ার দিন লড়াই করা যদি রাসূলুল্লাহর (সা) ইচ্ছার বিরোধি না হতো, আমি সে দিনও লড়তে প্রসউত ছিলাম।২৩
তথ্যসূত্র:
নু‘মান ইবন বাশীর (রা)
সীরাতের গ্রন্থাবলীতে হযরত নু‘মানের (রা) দুইটি কুনিয়াত বা ডাকনাম পাওয়া যায়: আবূ ‘আবদিলÍাহ ও আবূ মুহাম্মদ। মদীনার বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের সন্তান। তিনি একজন আমীর, খতীব, শা‘রিয়, আলিম ও অন্যতম আনসারী সাহাবী।১ তাঁর পিতা বাশীর ইবন সা‘দও একজন বড় মাপের সাহাবী।২ তিনি বদর যুদ্ধের যোগদান করেছিলেন।৩
বাশরি ইবন সা‘দ (রা) শেষ ‘আকাবায় সত্তর, মতান্তরে পঁচাত্তর জন আনসারের সাথে রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে বাই‘য়াত করেন। বদর, উহুদসহ সকল যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে অংশগ্রহণ করেন। রাসূলে কারীমের (সা) ইনতিকালেরর পর মদীনার সাকীফা বনী সা‘য়েদাহতে খলীফা নির্বাচনের যে সমাবেশ হয় তাতে সর্ব প্রথম এই বাশরি ইবন সা‘দ আবূ বকরের (রা) হাতে বাই‘য়াতে করেন।৪ হিজরী ১২ সনে সেনাপতি খালিদ ইবন ওয়ালীদের (রা) নেতৃত্বাধীনে তিনি ভণ্ডুনবী মসায়রামা আল-কাজ্জাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে আয়নুত তামা’-এর যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।৫
নু‘মানের (রা) মায়ের নাম উমরাহ বিনত রাওয়াহা। তিনি বিখ্যাত কবি সাহাবী ও শহীদ সেনাপতি আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহান (রা) বোন।৬ তিনিও রাসূলুল্লাহর (সা) সাহাবীয়্যাত বা সাহচর্য্যরে গৌরব অর্জন করেন।
এমনই এক পবিত্র ও মহান পবিবারে নুমানের (রা) জন্ম। ইবন সা‘দ বলেন: তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) হিজরাতের চৌদ্দ মাসের মাথায় রবিউল আখের মাসে জন্মগ্রহণ করেন। এটা মদীনাবাসীদের বর্ণনা। কুফাবাসীরা অবশ্য ভিন্নতম পোষণ করেন। তাঁরা নু‘মান থেকে এমন বহু হাদীস বর্ণনা করেছেন যাতে তিনি-‘আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) বলতে শুনেছি’-বলেছেন। তারা বলেন, মদীনাবাসীরা তাঁর জন্ম সম্পর্কে যা বর্ণনা করেছেন তার থেকে িিতন বয়সে যে বড়, তার এ বর্ণনাসমূহ দ্বারা তা বুঝা যায়। বালাজউরী বলেন: হিজরী দ্বিতীয় সনে আবদুল্লাহ ইবন জুবাইর মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। আর এ সনেই জন্মগ্রহণ করেন আন-নু‘মান বাশীর। রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় আসার পর আনসারদের ঘরে জন্ম গ্রহণকারী প্রথমি শশু নু‘মান। রাসূল (সা) ত৭ার তাহনীক করেন।৮ (খেজুর বা অন্য কিছু চিবিয়ে শিশুর মুখে দেওয়াে তাহনীক’ বলে) তাঁর জন্মের ছয় মাস পরে জন্মলাভ করেন আবদুল্লাহ ইবন জুবাইর (রা)। পরবর্তীকালে তাই তিনি বলতেন, আন-নু‘মান ইবন বাশীর আমার চেয়ে ছয় মাসের বড়।৯ ইমাম বুখারীর মতে, তাঁর জন্ম হিজরাতের বছরে।১০
ইমাম জাহাবী হযরত নু‘মানের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন: তিনি হিজরী দ্বিতীয় সনে জন্মগ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহর (সা) মুখ থেকে হাদীস শুনেছেন। সীরাত বিশেষজ্ঞরা সর্বসম্মতভাবে তাঁকে শিশু সাহাবীদের মধ্যে গণ্য করেছেন।’১১
ইসলামের ইতিহাসে হিজরী দ্বিতীয় সনের একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এ বছরের গুরুতেই মক্কার কুরাইশ ও তার আশে পাশের অন্যান্য গোত্রের সাথে মদীনার মুসলমানদের সংঘাত-সংঘর্ষ ঘটতে থাকে। যার পূর্ণ প্রকাশ ঘটে বদর যুদ্ধের মাধ্যমে। এ বছর যে সকল শিশু জন্মগ্রহণ করে তাদের ওপর এই বিল্পবী সময় ও ঘটনার একটা প্রকাব হয়তো পড়ে থাকবে। এ কারণে আন নু‘মান ও আবদুল্লাহ প্রত্যেকেই পরবর্তী জীবনে বড় বড় বিপ্লবে নেতৃত্ব দান করেছেন।
নু‘মানের পিতা-পমাতা তাঁকে খুব ভারোবাসতেন। পিতা তাঁকে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট নিয়ে গিয়ে তাঁর জন্য দু’আ চাইতেন। মা তাঁকে এত বেশী ভালোবাসতেন যে, অন্য সন্তানদের বঞ্চিত করে সকল ধন-সম্পদ তাঁর নামে লিখে দিতে চাইতেন। একবার তিনি এ ব্যাপারে স্বামীর রাজী করেন এবং সাক্ষী হিসেবে রাসূলুল্লাহকে (সা) মনোনীত করেন। বাশীর (রা) ছেলে নুমানকে সঙ্গে করে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে বলেন, আপনি সাক্ষী থাকুন আমি আমার অমুক অমুক ভূমি এই ছেলেকে দান করছি। রাসূল (সা) বললেন: তুমি কি তোমার অন্য সন্তানদের অংশও এভাবে দিয়েছো? বললেন: না, দিইনি। রাসূল (সা) বললেন: তাহলে আমি তো এমন অবিচারের সাক্ষী হতে পারিনে। একথা শোনার পর বাশীল তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন।১২
হেঁটে বেড়ানোর বয়স হলে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট যেতেন। একবার তায়েফ থেকে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট কিছু আঙ্গুর এলা। তিনি নুমানের হাতে দুইটি ছড়া দিয়ে বলণেল, একটি তোমার এবং একটি তোমার মায়ের। নুমান বাড়ী ফেরার পথে দুইটি ছড়াই খেয়ে ফেরেন। বাড়ী এসে আঙ্গুরের ব্যাপারে কাউকে কিছু বললেন না। কয়েক দিন পর রাসূল (সা) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন: মাকে আঙ্গুর দিয়েছিলে? জবাব দিলেন: না। রাসূল (সা) কথন ত৭ার কানমলা দিয়ে বললেন: ওরে ঠকবাজ!১৩
সেই শৈশবকালেই নুমান নামায ও অন্যান্য ইবাদতের প্রতি মনেযোগী হন। রাসূলুল্লাহর (সা) বিভিন্ন আচরণ মনোযোগ সহকারে দেখতেন এবং স্বরণ রাখার চেষআটা করতেন। মসজিদে মিম্বরের কাছাকাছি বসে রাসূলুল্লাহর (সা) ওয়াজ-নসীহত ও বতৃতা-ভাষণ শুনতেন।১৪ একবার তিনি দাবী করে বলেন, রাসূলুল্লাহর (সা) রাত্রিকালীন নামায সম্পর্কে আমি অধিকাংশ সাহাবীদের থেকে বেশী জানি।১৫ শবে কদরে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে জেগে নামায পড়তেন।১৬
হিজরী ১১ সনের রাবী’উল আওয়াল মাসে রাসলে কারীম (সা) ইনতিকাল করেন। তখন নুমানরে বয়স মাত্র আট বছর সাত মাস। সুতরাং প্রথম ও দ্বিতীয় খলীফার সময়ে নুমানের বিশেষ কোন কর্মতৎপরতা দেখা যায় না। ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, উসমান (রা) বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী নায়িলা (রা) স্বামীর রক্তমাথা জামাসহ নুমানকে (রা) শামে পাঠান।১৭ এ ঘটনার পর থেকে তাঁকে তৎকালীন ইতিহাসের অন্যতম এক চরিত্র হিসেবে দেখা যায়।
আলীর (রা) খিলাফতকালে মুয়াবিয়ার (রা) সাথে তাঁর দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়। এই বিরোধে তিনি মুয়াবিয়ার (রা) পক্ষ অবলম্বন করেন। এটা অবাক হওয়ার মত ব্যাপার যে, গোটা আনসার সম্প্রদায়ের মধ্যে যে গুটিকয়েক লোক তখন মুয়াবিয়ার (রা) পক্ষ নেন, তিনি তাঁরে একজন। বিভিন্ন গ্রন্থে একথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, আমীর মুয়াবিয়া (রা) ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইবনুল আসীর বলেছেন: তাঁর ভালোবাসা ছিল মুয়াবিয়ার প্রতি। এ কারণে মুয়াবিয়া ও তাঁর ছেলে ইয়াযীদের প্রতি তাঁর টান ছিল।১৮ বিনিময়ে মুয়াবিয়া (রা) তাঁকে বড় বড় পদ দান করেন। আলীর (রা) পক্ষ থেকে আয়নুত তামার-এর শাসক ছিলেন মালিক ইবন কা’ব আল-আবহাবী। আমীর মুয়াবিয়ার (রা) নির্দেশে নুমান (রা) তথাকার অস্ত্র গুদামে আক্রমণ চালান।১৯
নুমান সিফফীন যুদ্ধ মুয়াবিয়ার (রা) পক্ষে যোগদান করেন।২০ ফুদালা ইবন উবাইদের পরে হিঃ ৫৩ সনে মুয়াবিয়া (রা) তাঁকে দিমাশকের কাজী নিযোগ করেন।২১ ইয়ামন মুয়াবিয়ার (রা) অধীনে এল উসমান ইবন আস সাফাফীর পরে তিনি নুমানকে (রা) তথাকার ওয়ালী নিয়োগ করেন। এ হিসাবে উমাইয়্যা রাজ বংশের পক্ষ থেকে তিনি ছিলেন ইয়ামনের তৃতীয় ওয়ালী।২২
হিজরী ৫৯ সনে মুয়াবিয়া (রা) ত৭াকে কূফায় ওয়ালী নিয়োগ করেন। প্রায় সাত মাস এই পদে অধিষ্টিত ছিরেন। মুয়াবিয়া (রা) ইনতিকালেরর পর তাঁর পুত্র ইয়াযীদ খলীফার পদে আসীন হন। তিনি ইমাম হুসাইন (রা), আবুদল্লাহ ইবন উমার (রা) ও আবদুল্লাহ ইবন মুবাইরকে (রা) তাঁর আনুগত্যের জন্য চাপ দিলেন। ইমাম হুসাইন (রা) ইয়াযীদের আনুগত্য মেনে নিতে পরিষ্কারভাবে অস্বীকৃত জানালেন। একদিকে কূফা থেকে আলীর (রা) অনুসারীদের চিঠি ইমাম হুসাইনের (রা) নিকট পৌঁছতে লাগলো। এ সকল চিঠিতে তারা ইমাম হুসাইনকে (রা) খলীফা হিসেবে মেনে নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছিল। এ কারণে। ইমাম হুসাইন (রা) অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য মুসলিম ইবন আকীলকে কূফায় পাটালেন। মুসলিম ক’ফায় পৌছলে শহরের অধিকাংশ অধিবাসী ইমামের প্রতি আস্থার ঘোষণা দিল। প্রায় বারো হাজার মানুষ মুসলিমের হাতে বাই‘য়াতে গ্রহণ করেন। নুমান (রা) তখন কূফায় ওয়াল্ ীসব খবরই তিনি পাচ্ছিলেন; কিন্তু দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিবর্তে চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করলেন।
কিন্তু যখন মুখতার ইবন উবাইদের গৃহে আলীর (রা) অনুসারীদের বৈঠক হলো এবং সিদ্ধান্ত হলো যে, ইয়াযীদের প্রতি কৃত বা ইয়াত (আনুগত্যের শপথ) ভঙ্গ করা হবে। তখন নুমান (রা) কূফায় মসজিদের মিন্বরে দাঁড়িয়ে একটি ভাষণ দান করেণ। ভাষণটির সারকথা নিুরূপ:
‘ওহে জনমগুলী! আপনারা আল্লাহকে ভয় করুন। অশান্তি ও মতভেদ সৃষ্টির ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করবেন না। কারণ, তাতে প্রাণহানি ঘটে, রক্তপাত হয় এবঙ সম্পদ লুটপাট হয়।। কেউ আগ বাড়িয়ে আমার সাথে সংঘাতে লিপ্ত না হলে আমি তার সাথে সংঘাতে বড়াবো না। কোন খারাপ কথা বরবো না, গালিগালাজ করবো না। কারো চরিত্রে অবাদ দান অথবা খারাপ ধারণা পোষণের কারণে পাকড়াও করবো না। কিন্তু আপনারা যদি বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) ভঙ্গ করে প্রকাশ্যে আমার ও ইমামের বিরুদ্ধাচরণে নামেন, তাহলে সইে আল্লাহর শপথ যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। যখক্ষণ তরবারি হাতল আমার হাতের মুঠোয় থাকবে, আমি আপনাদের মারতে থাকবো। এতে একটি লোকও যদি আমার পাশে না থাকে, বতুও আমি বিরত হবো না। তবে আমি আশা করি, আপনাদের মধ্যে বাতিলের অনুসারীদের অপেক্ষা সত্যক্ষে জানে এমন লোকের সংখ্যাই অধিক হবে।”
উক্ত সমাবেশে বনী উমাইয়্যার নিষ্ঠাবান সমর্থক ও বন্ধু আবদুল্লাহ ইবন মুসলিম উপস্থিত ছিলেন। শত্র“র প্রতি সরকারের ওয়ালীর এমন দুর্বল অবস্থান দেখে তিনি মর্মাহত হন। ক্ষোভের সাথে তিনি নু‘মানকে বলেন: ‘এ ব্যাপারে আপনার অবস্থান অতি দুর্বল। এখন কোমল হওয়ার সময় নয়; শক্রুর বিরুদ্ধে এখন আপনার কঠোর হওয়া উচিত।’ জবাবে নু‘মান বললেন:
‘আমি আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণে শক্ত হওয়ার চেয়ে তাঁর অনুগত্যে দুর্বল থাকা বেশী পছন্দ করি। আর আল্লাহ যে পর্দাটি টেনে দিয়েছেন তা ছিন্ন করা সমীচীন মনে করিনা।’ আবদুল্লাহ ইবন মুসলিম সমাবেশ থেকে ফিরে ইয়াযীদকে লিখলেন: ‘মুসলিম ইবন আকীল কূফায় ওপর আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছে। যদি আপনার ্খানকার শাসন কর্তৃত্বের প্রয়োজন থাকে তাহলে আপনার আদেশ-নিষেধ কার্যকর করতে সক্ষম হবেন। নু‘মান একজন ভীরু লোক, অথবা তিনি ইচ্ছা কইে ভীরু ও দুর্বল সেজেছেন।’ ঠিক একই সময় একই রকম চিঠি ইয়াযীদকে লেখেন আমআতরা ইবন উকবা ও উমার ইবন সা’দ ইবন আবী ওয়াককাস। এ সকল চিঠি পাওয়ার পর ইয়াযীদ কূফায় ওয়ালীর পদ থেকে নু‘মান ইবন বাশীরকে অপসারণ করে তাঁর স্থলে উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদকে নিয়োগ করেন। আর নু‘মান চলে যান শামে।২৩ এটা হিজরী ৬০ (ষাট) সনের ঘটনা।২৪
অতঃপর ইয়াযীদ তাঁকে হিমস-এর ওয়ালী নিয়োগ করেন এবং ইয়াযীদের মৃত্যু পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন। অবশ্য কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, মু‘য়াবিয়া (রা) তাঁকে কূফা থেকে সরিয়ে হিমস-এ নিয়োগ করেন।২৫
হিজরী ৬৪ সনে ইয়াযীদ ইবন মু‘য়াবিয়ার মৃত্যুর পর নু‘মান শামের অধিবাসীদেরকে আবদুল্লাহ ইবন যুবাইরের (রা) প্রতি আনুগত্যের আহবান জানান এবং তাঁর পক্ষ থেকে তিনি হিমস-এর ওয়ালী নিযুক্ত হন। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে তিনি আবদুল্লাহ ইবন যুবাইরের (রা) প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। কিন্তু পরে নিজেই খিলাফতের দাবীদার হিসেবে মানুষের বাই’য়াত গ্রহণ করতে থাকেন। কিন্তু এ বর্ণনা সঠিক নয়। কারণ, যদি এমন ঘটনা আদৌ ঘটতো তাহলে আতিহাস ও সীরাতের প্রসিদ্ধ গ্রন্থাবলীতে তা বর্ণিত হতো। কিন্তুু অধিকাংশ গ্রন্থ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব।
নু‘মানের (রা) মত আরো অনেকে শামে ইবন যুবাইয়ের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এ অবস্থা দেখে মারওয়ান শামে যান এবং একটি বাহিনী প্রস্তুত করে দাহহাক ইবন কায়সের বিরুদ্ধে পাঠান। দাহহাক ছিলেন ইবন যুবাইয়ের পক্ষ থেকে শামের কয়েকটি অঞ্চলের শাসক। নু’মান এ সংবাদ পেয়ে শুরাহবীল ইবন জুল-কিলাবার নেতৃত্বে কিছু সৈন্য দাহহাকের সাহায্যে পাঠান। মারজে রাহিত’ নামক স্থানে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং দাহহাক পরাজিত ও নিহত হন। এ সংবাদ পেয়ে নু’মান রাতের অন্ধকারে হিমস থেকে সরে পড়ার চেষ্টা করেন। মারওয়ান তাঁকে ধাওয়া করে ধরার জন্য খালিদ ইবন আদী আল-কিলা’ঈর নেতৃত্বে একদল সৈন্য পাঠান।
হিম্স-এর অদূরে বীরীন নামক এক পল্লীতে তিনি খালিদের মুখোমুখি হন। খালিদ তাঁকে হত্যা করে মাথাটি কেটে এবং পরিবার পরিজনকে বন্দী করে মারওয়ানের সামেন হাজির করে। নু‘মানের স্ত্রী তাঁর স্বামীর এমন নির্মম পরিণতি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি স্বামীর ছিন্ন মস্তকটি তাঁর কোলে দেওয়ার জন্য মারওয়ানের নিকট আবেদন জানিয়ে বলেন: এ মস্তকের হকদার আমি। আমাকেই দেওয়া হোক।
মারওয়ানের নির্দেশে লোকেরা নুমানের (রা) মাথাটি তাঁর স্ত্রীর কোলে চুড়ে মারে। এটা হিজরী-৬৫ সনের প্রথম দিকের, মতান্তরে ৬৪ সনের শেষ দিকের ঘটনা। তখন নুমানের (রা) বয়স ছিল ৬৪ বছর।২৬ ইবন হাযাম বলেন: মারওয়ান নু’মানকে হত্যার মাধ্যমে তাঁর ক্ষমতায় আরোহনকে উদ্বোধন করেন।
‘আব্বাসী আমলের প্রখ্যাত কবি আবুল আলা আল-মা’য়াররীর জন্মস্থান ‘মায়’য়াররাতুন নু’মান। স্থানটির পূর্ব নাম ছিল শুধু ‘মা’য়াররা’। নু’মান একবার সেখানে ভ্রমণে যান। তখন ত৭ার একটি ছেলে মারা যান এবং তাকে সেখানে দাফন করা হয়। সেখান থেকে স্থানটি আন-নু’মানের প্রতি আরেপ করে মা’য়ারাতুন নু’মান হিসাবে প্রসিদ্ধি পায়।২৭
নু’মানের (রা) স্ত্রী ছিলেন আরবের ‘কাল্ব’ গোত্রের মেয়ে। তাঁর সম্পর্কে একডিট আজব কথা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। তিনি এক সময় মু’য়াবিয়ার (রা) অন্দর মহলে ছিলেন।। মু’য়াবিয়া একদিন ইয়াযীদের মা মাবসূনকে বললেন, তুমি যেয়ে একবার এই মহিলাকে দেখে এসো তো। মাবসূন তাঁকে দেখে এসে বললেন, রূপ ও সৌন্দর্য্যে এ মহিলা অন্যান্য। কিন্তু তাঁর নাভরি নীটে একটি তিল আছে। এ কারণে সে তর স্বামীর ছিন্ন মস্তক নিজের কোলে ধারণ করবে।
এই মহিলাকে প্রথমে হাবীব ইবন মাসলামা বিয়ে করেন। তাঁর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে তাঁকে বিয়ে করেন। তিনি নিহত হলে স্ত্রী হিসাবে তাঁর কর্তিত মাথা কোলে ধারণ করেন। এভাবে মাবসূনের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়।২৮
নু’মান (রা) সন্তানদের মধ্যে তিনটি ছেলে মুহাম্মাদ, বাশীর ও ইয়াযীদ খ্যাতিমান হন। বহুদিন যাবত মদীনা ও বাগদাদে তাঁর বংশধারা বিদ্যমান ছিল।২৯
হাদীস ও ফিকাহ্-তে নু’মানের (রা) গভীর জ্ঞান ছিল। গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন ও অন্যান্য বাস্ততার দরুন যদিও তিনি জ্ঞান বিতরণের মহান দায়িত্ব পালন করতে পারেননি, তবে তিনি যেখানেই শাসকের দায়িত্ব নিয়ে গেছেন, সেই স্থানটি ফিকাহ ও হাদীস চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। তাঁর সামনে অসংখ্য মামলা আসেতো, তিনি স্বীয় জ্ঞান ও মেধা দ্বারা তা ফয়সালা করতেন।
রাসূলে কারীমের (সা) ইনতিকালের সময় যদিও তিনি আট বছরের বালক মাত্র, তবুও অনেক হাদীস তাঁর স্মৃতিতে সংরক্সিত ছিল। পরবর্তীকালে উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (লা) ও উমারের (লা) সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন। তাঁদের নিকট থেকে হাদীস শুনেছেন। তাছাড়া তাঁর মামা আবদুলÍাহ ইবন রাওয়াহার (রা) নিকট থেকেও বহু হাদীস শুনেছেন।৩০
হাদীস গ্রহণ ও বর্ণনার ব্যাপারে তিনি ছিরেন দারুণ সর্তক ও রক্ষণশীল। তা সত্ত্বেও তাঁর সনদে মোট ১২৪ (একশত চব্বিশ) টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তারমধ্যে পাঁচটি হাদীস বুখারী ও মুসিলিম মুত্তাফাক আলাইহি এবং বুখারী অন্য একটি ও মুসলিম অন্য চারটি হাদীস এককভাবে বর্ণনা করেছেন।৩১ তনি বিচার-পায়সালার সময় হাদীসের উদ্ভৃতি দিতেন। একবার একটি মামলার বিচারের সময় বললেন, আমি এ মামলার ফায়সালা এমনভাবে করবো যেমন ফায়সালা করেছিলেন রাসূল (সা) এক ব্যক্তির মামলার।৩২
তিনি শরী’য়াতের বিধি-বিধান সম্পর্কিত মানুষের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতেন। াধিকাংশ সময় এ জাবাব দিতেন খুবতা বা বক্ততা-ভাষণের মধ্যে। তাঁর খুবতা বা ভাষণ হতো দুই প্রকার: ধর্মীয় ও রাজনৈতিক। তিনি ছিরেন একজন অসাধারণ বাগ্মী ব্যক্তি। তাঁর ভাষণ হতো অতি বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল ভাষায়। বাচন ও প্রকাশ ভঙ্গিতে তাঁর যে নৈপুণ্য ছিল তার স্বীকৃতি দিয়েছেন সিমাক ইবন হারব এভাবে: ‘আমি যে সকল মানুষের ভাষণ শুনেছি, তাঁদের মধ্যে নু’মান ইবন বাশীর সর্বশ্রেষ্ঠ বাগ্মী বলে মনে হয়েছে।’৩৩
খুতবার মধ্যে স্তান-কাল অনুযায়ী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্জালন করতেন। যেমন, একবার তিনি খুবতার মধ্যে বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে শুনেছি। ‘শুনেছি’ বলার সাথে সাথে আঙ্গুল দিয়ে দুই কানের দিকে ইঙ্গিত করলেন।৩৪ একবার ভাষণে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা) অবস্থা বর্ণনা করেন এবাবে: ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য নিুমানের খোরমাও রাসূলুল্লাহ (সা) জুটতো না। আর এখন নানা জাতের উৎকৃষ্ট কোরমা ও মাখন ছাড়া তোমাদের রুচি হয় না।’৩৫
একবার তিনি মিম্বারে দাাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন। ভাষণে জামা’য়াতবদ্ধ জীববকে আল্লাহর রহমত এবয় বিচ্ছিন্নতাকে আল্লাহর আযাব ও অভিশাপ হিসেবে চিত্রিত করলেন। সমাবেশে প্রখ্যাত ইমাম আল-বাহিলীও উপস্থিত ছিলেন। ভাষণ শেষে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং উপস্থিত জনতাকে লক্ষ্য করে বললেন: ‘তোমাদের ওপর আস্-সাওয়াদ আল-আ’জাম’-এর অনুসরণ ফরজ।৩৬
বক্ততা-ভাষণের সময় তাঁর মুখ থেকে যাঁরা হাদীস শুনেছেন তাঁদের সংখ্যা অগণিত। ত৭ার বিশিষ্ট ছাত্রদের কয়েকজনের নাম এখানে দেওয়া হলো: শা’বী, হুমাইদ ইবন ‘আবদির রহমান, খায়সামা ইবন আবদির রহমান, সালেম ইবন আবিল জু’দ, আবু ইসহাক সুবাঈ’, আবদুর মালিক ইবন উমাইর ইয়াসী’ আল-কন্দিী, হাবীব ইবন সালেম (নু’মানের সেক্রেটারী), আবদুল্লাহর ইবন আবদিল্লাহ ইবন উতবা, উরওয়া ইবন যুবাইর, আবু কিলাবা আল-জুরমী, আবু সালামা আল-আসওয়াদ, গায়রায আবী সুফরাহ, আযহার ইবন আবদিল্লাহ, মুহাম্মাদ ইবন ুন’মান আবু সাল্লাম মামত’র প্রমুখ।৩৭
নু’মান (রা) ছিলেন একজন সাহিত্য ও কাব্যরসিক মানুষ। গদ্য সাহিত্যে যেমনতাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর পাওয়া যায়, তেমনিভাবে কাব্য সাহিত্যেও তাঁর পদচারণা দেখা যায়। তিনি অনেক কবিতা রচনা করেছেন। সীরাতের গ্রন্থসমূহে কিচু কবিতা তাঁর নামে সংকলিত হয়েছে। আল-কুরতুবী আল-ইসতী’য়াব গ্রন্থে তাঁর কিছু কবিতা তাঁর নামে সংকলিত হয়েছ। আল-কুরতুবী আল-ইসতী’য়াব গ্রন্থে তাঁর কিচু শ্লোক সংকলন করেছেন। তাঁর কবিতার এটি দিওয়াও আছে।৩৮
নু’মান (রা) বিভিন্ন ঝগড়া-বিবাদ, হৈ-হাঙ্গামা, নানা ধরনের ওলট-পালট ও বিপ্লবের সাথে জড়িত থাকা সত্ত্বেও যুলুম-অত্যাচার একেবারেই পসন্দ করতেন না। তিনি অত্যন্ত দয়ালু এবং কোমর মনের মানুষ ছিরেন। ঝগগড়া-বিবাদে কঠোরতা ও শক্তি প্রয়োগের পরিবর্তে মমতা ও ভালোসাবা দ্বারা মানুষের মন জয় করতেন। ঐতিহাসিক তাবারী বলেছেন: তিনি ছিরেন একজন বিচক্ষণ ধৈর্যশীর এবং আবেদ ব্যক্তি। যিনি মানুষকে ক্ষমা করতে ভালোবাসতেন।’
মুসলিম ইবন আকীলের ঘটনা এবং এ সম্পর্কে নু’মানের (রা) ভাষণ, যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে তাঁর সহনশীল ও উদার নীতির রূপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একবার তিনি কায়স ইবন্ াল-হায়সামকে একটি চিঠিতে লেখেন: ‘তুমি একজন দারুণ হতভাগ্য ব্যক্তি। আমরা রাসূলুল্লাহকে (সা) দেখেছি এবং ত৭ার হাদীস (বাণী) শুনেছি। আর তোমরা না তাঁকে দেখেছো, না তাঁর মুখ থেকে হাদীস মুনেছো। তিনি বলেছেন: কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে ধারাবাহিক ফেতনা-ফাসাদ দেখঅ দেবে। তখন মানুষ সকারে মুসলমান হলে সন্ধ্যা হতে না হতে আবার াকফির হয়ে যাবে। মানুষ সামান্য পার্থিক সুযোগ-সুবিধার লোভে নিজের দ্বীন বিক্রি করবে।৩৯ তবে তঁর এ কোমল ও নম্র স্বভাব ভীরুতা ও কাপুরুষতার কারণে ছিল না। তিনি যেমন ধৈর্য ও সহনশীলতার ক্ষেত্রে ছিলেন অনন্য, তেমনি ছিলেন বীরত্ব ও সাহকিতায় অতুলনীয়।
তিনি ছিলেন একজন বড় মাপের দামশীল ব্যক্তি। বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতে আপ্রাণ চেষ্টো করতেন। তিনি যখন হিমস-এর ওয়ালী তখন একবার কবি আল-আ’শ আল-হামাদানী তাঁর নিকট এসে বললেন, আমি ইয়াযীদের নিকট সাহায্যের আবেদন করেছি, কন্তিু তিনি কোন সাড়া দিলেন না। এখন এসেছি আপনার কাছে। আত্মীয়তার হক কিচু আদায় করুন। আমার ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করুন। নু’মানের (রা) হাতে তখন কোন অর্থ ছিল ন। তিনি শপথ করে বললেন, আমার কাছে কিচুই নেই। তারপর কিচু চিন্তা অর্থ ছিল না। তিনি শপথ করে বললেন, আমার কাছে কিছুই নেই। তারপর কিছু চিন্তা করে বললেন: ‘হুঁ!’ এরপর মসজিদের মিন্বরে দাঁড়িয়ে সমবেত প্রায় বিশ হাজার লোকের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। যার সারকথা নিুরূপ:৪০
ওহে জনমগুলী! আল-আ’শ আল-হামাদীনী আপনাদের এক চাচার ছেলে। অভিজাত বংশের একজন মুসলিম। তার কিছু অর্থের প্রয়োজন। আর এ উদ্দেশ্রেই সে আপনাদের নিকট এসেছে। এখন আপনাদের ইচ্ছা কি? জনতা সমস্বরে বলে উঠলো: আপনি যা বলবেন আমরা তা শুনবো। তিনি বললেন: আমার কোন নির্দেশ নেই। জনতা বললো: তাহলে আমরা এখানে উপস্থিত প্রত্যেকে এক দীনার করে দান করবো। তিনি বলনেনঃ না। দুইজনে এক দীনার করে দিন। সকলে সম্মত হলে তিনি বললেন: আমি বাইতুলমাল থেকে তাঁকে এ অর্থ দিয়ে দিচ্ছি। যখন বেতন/ভাতার অর্থ আসবে তখন সকলের কাছ থেকে উসূল করা হবে। নু’মান (রা) এভাবে ঋণগ্রন্থ আল-আ’শাকে দশ হাজার দীনার দানের ব্যবস্থা করেন। এটা আল-ইসতীয়াব গ্রন্থকারের বর্ণনা। উসুদুল গাবা গ্রন্থকার ইবনুল আসীর বলেন, চল্লিশ হাজার। কবি আল-আ’শা আল-হামাদানী এ জন্য নু’মানের (রা) প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ ছিলেন। নু’মানের (রা) প্রশংসায় তিনি একটি কবতিাও রচনা করেছেন। কবিতাটির কয়েকটি শ্লোকের অর্থ নিুরূপ:৪১
১.প্রয়োজনের সময় দানশীল নু’মান ইবন বাশীরের মত আর কাউকে পাইনি।
২.তিনি যখন কোন কথা বলেন তখন সে কথা পূর্ণ করেন। তিনি সেই ব্যক্তির মত নন যে জনগণের প্রতি ধোঁকাবাজির রশি ঝুলিয়ে দেয়।
৩.যদি তিনি একজন আনসারী না হতেন তাহলে আমি সেই ব্যক্তির মত হতাম, যে কোথাও যেয়ে কিছু না পেয়েই ফিরে আসে।
৪.আমি যখন নু’মানের অকৃতজ্ঞ হবো তখন আমার ম্যধ থেকে কৃতজ্ঞতার স্ববাব বিলীপন হয়ে যাবে। আর অকৃতজ্ঞ মানুষের মধ্যে ভালো কিছু থাকে না।
শৈশবে নু’মান (রা) যেহেতু রাসূলে কারীমের (সা) াতি সান্নিধ্রে থাকার সুযোগ পেয়েছিরেন, এ কারণ তাঁর খুঁটিনাটি অনেক আচার-আচরণের বর্ণনা দিতে সক্ষম হয়েছন। হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থসমূহে তাঁর এ ধরনের অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) রাতের ইবাদাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তাঁর দুইকানি পা ফুলে যেত।৪২ তেমনিভাবে তিনি বণৃনা করেছেন, রাসূল (সা) কিভাবে নামাযরে কাতার সোজা করতেন এবং কাতার সোজা করার প্রতি কতখানি গুরুত্ব দিতেন। তিনি বলেন: একদিন রাসূল (সা) দেখেন এক ব্যক্তি বুক কাতারের বাইরে চলে গেছে। তখন তিনি বলেন: ওহে আল্লাহর বান্দারা! হয় তোমরা তোমাদের কাতার সোজা করবে, না হয় আল্লাহ তোমারে মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করে দেবেন।৪৩
‘উম্মুল মুমিনীন আ’য়িশা (রা) ছিলেন আবু বকর সিদ্দীকের (রা) কন্যা। নু’মান (রা) বলেন: একদিন আবু বকর গেলেন মেয়ে-জামাই-এর সাথে দেখা করতে। ভিতরে ঢোকার অনুমতি চেয়ে শুনতে পেলেন রাসূলুল্লাহর (সা) কথার উপরে মেয়ে আ’য়িশার চড়া গলার কথা। তিনি ঢুকেই রাসূলুল্লাহর (সা) কথার উপরে কথা বলছো-এই বলে মেয়েকে থাপপড় মারতে উদ্যত হলেন। রাসূল (সা) দ্রুত মাঝখানে দাঁড়িয়ে আ’য়িশাকে মার থেকে বাঁচালেন। আবু বকর রাগান্বিত অবস্থায় মেয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তখন রাসূল (সা) আ’য়িশাকে বললেন: দেখলে তো, তোমাকে আমিমার থেকে বাঁচালাম? কিচুদিন পর আবু বকর আবার মেয়ে-জামাইর বাড়ী গেলেন। দেখলেন, তাঁদের স্মপর্কে স্বাভাবিক। তখন তিনি বললেন: তোমাদের শান্তির সময় তোমরা আমাকে প্রবেশের অনুমতি দাও, আবার যুদ্ধের সময়ও ানুমতিদিয়ে থাক। তখন রাসূল (সা) বলেন: আমরা এই করেছি, আমরা এই করেছি।৪৪
একদিন তিনি মিন্বরে দাঁড়িয়ে বলেন: রাসূলুল্লাহর (সা) এই মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন: যে ব্যক্তি অল্পে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনা, সে বেশীরও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে না। যে মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞাত প্রকাশ করেনা সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে না। আল্লাহর অনুগহের কথা স্বীকার করাই হচ্ছে তা প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, আর স্বীকার না করা হচ্ছে াকৃতজ্ঞতা।
এভাবে আল্লাহর রাসূলের (সা) জীবনের নানা দিক তাঁর বিভিন্ন বণৃনায় ফুটে উঠেছে।
নু’মান (রা) ইতিহাসের এক বিভ্রান্তির অধ্যায়ে মু’য়াবিয়া (রা) ও তাঁর পুত্র ইয়াযীদের পক্ষ অবলম্বন করলেও কোথাও কারো প্রতি বিন্দুমাত্র অবিচার করেছেন, এমন কোন তথ্য পাওয়া যয় না। সেত্যর ওপর যে তিনি অটল ছিলেন তার প্রামণ পাওয়া যায় আবদুল্লাহ বিন জুবাইরের (রা) প্রতি আগুগত্য প্রকাশ করে জিীভন দানের মধ্যে। কূফার মসনদ ত্যাগ করেছেন বতুও ইমাম হুসাইনের প্রতিনিধি মুসলিম ইবন আকীলের সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়াতে রাজী হননি। রাসূলে কারীমের (সা) সাহচর্যের কল্যাণে এমন উন্নত নৈতিকতার অধিকারী হতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তথ্যসূত্র:
সামুরা ইবন জুনদুব আল ফাযারী (রা)
সামুরা আল ফাযারীর (রা) অনেকগুলি কুনিয়াত বা ডাকনাম সীরাতের গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়। যথা: আবূ সাঈধ, আবূ আবদির রহমান, আবূ আবদিল্লাহ, আবূ সুলায়মান ও আবূ মুহাম্মদ।১ তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) একজন সাহাবী। ইতিহাসে তিনি একজন সাহসী নেতা হিসাবে প্রসিদ্ধ।২ ইমাম জাহাবী বলেন: তিনি ছিরেন আলিম (জ্ঞানী) সাহাবীদের একজন।৩
সামুরা (রা) মদীনার আনসার সম্প্রদায়ের সন্তান নন। মূলত তিনি বনু ফাযারার সন্তান। ইবন ইসহাক বলেন: তিনি মদীনার আনসারদের একজন হালীফ বা চুক্তিবদ্ধ বন্ধু ছিলেন।৪ তাঁর পিতা জুনদুব ইবন হিলাল আল ফাযারী ছিলেন বসরার অধিবাসী। সামুরা বসরায় জন্মগ্রহণ করেন। শিশু বয়সেই সামুরা পিতৃহারা হন। তাঁর মা তাঁকে নিয়ে মদীনায় আসেন এবং আনসারদের কাউকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ কনের। তবে শর্ত দেন, যে তাঁকে বিয়ে করবেন, সন্তান সামুরাসহ তাঁর সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণে রাজী থাকতে হবে। মুররী ইবন শায়বান ইবন সা’লবা তাঁর এ শর্ত মেনে নিয়ে ত৭াকে বিয়ে করেন। সামুরা (রা) তাঁর এই সৎ পিতা মুররী ইবন শায়বানের তত্ত্বাবধান ও øেহছায়ায় বেড়ে ওঠেন।৫
সামুরা (রা) হিজরাতের পর ইসলাম গ্রহণ করেন। যুদ্ধে যাওয়ার বয়স না হওয়ায় তিনি হিজরী দ্বিতীয় সনের বদর যুদ্ধে যোগদানের অনুমতি পাননি। উহুদ যুদ্ধের সময় আরো কিছু আনসার কিশোরের সাথে যুদ্ধে যাওয়ার আশায় রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট উপস্থিত হন। রাসূল (সা) সামুরার একজন সাথীকে নির্বাচন করেন এবং তাঁকে ফিরিয়ে দেন। তখন সামুরা বলেন: আপনি তাকে নির্বাচন করলেন এবং আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। অথচ আমি তার চেয়েও শক্তিশাল্ ীবিশ্বাস না হলে আমাদের কুস্তি লাগিয়ে দেখতে পানের। তাঁর কথা শুনে রাসূল (সা) তাঁদের দুজনের কুস্তি লাগার নির্দেশ দেন। কুস্তিতে সামুরা তাঁর প্রতিপক্ষ কিশোরকে উুঁচু করে ফেলে দেন। তাই দেখে রাসূল (সা) ত৭াকেও রণক্ষেত্রে যাওয়ার অনুমতি দান করেন।৬ ইবন হিশাম বলেন: রাসূল (সা) সামুরা ইবন জুনদুব ও রাফে’ ইবন খাদীজকে উহুদ যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। তখন তাঁদের দুইজনেরই বয়স পনেরো বছর।৭ উহুদের পর থেকে সকল যুদ্ধে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে অংশগ্রহণ করেন।
রাসূলে কারীমের (সা) জীবনকালে তিনি মদীনায় বসবাস করেন। পরে তিনি বসায় বসতি স্থাপন করে।৮ হিজরী ৫০ সনে কূফার ওয়ালী মুগীরা ইবন শু’বার (রা) মৃত্যুর পর মু’য়াবিয়া (রা) কূফার সাথে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে বসরার ইমারাতের দায়িত্বও যিয়াদ ইবন সুমাইয়্যার ওপর অর্পণ কনের। যিয়াদ সামুরাকে (রা) স্বীয় প্রতিনিধি ও সহকারী হিসাবে নিয়োগ করেন। যিয়াদ ছয় মাস করে বসরা ও কূফায় অবস্থান করতেন। সামুরাও উভয় স্থানে তাঁর অনুপস্থিতির সময় দায়িত্ব পালন করতেন। যিয়াদ বসরায় থাকলে তিনি কূফায় এবং তিনি কূফায় থাকলে সামুরা বসরায়-এভাবে।৯
যিয়াদের শাসনকাল নানা দিক দিয়ে স্বরণযোগ্য। তাঁর সময়ে শাস্তি ও নিরাপত্তার প্রতি এত অধিক গুরুত্ব দেওয়া হতো যে, কোনপ্রকার বিদ্রোহ ও বিক্ষোভ তাঁর সময়ে বসরা ও কূফায় দেখা দিতে পারেনি। খারেজী বিপ্লবপন্থীদের একটি দল, যারা পূর্ব থেকেই সোখানে বিদমান ছিল, একবার মাথা উঁচু করলে ভালোমত তাদের দমন করা হয়।
চুতর্থ খলীফা আলীর (রা) জীবদ্দশায় খারেজীদের উদ্ভাব হয়। এক সময় তারা আলীরই (রা) অনুসারী ছিল। পরে তারা অশাস্তি ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী দল হিসাবে নিজেদেরকে পরাজিত হয় এবং তাদের অনেক সাহসী যোদ্ধা মারা যায়। তবে তাদেরকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। সুযোগ পেলেই তারা মাথা উঁচু করে বিদ্রোহের পতাকা উডডীন করতো। এই উগ্রপন্থািদের হাতে বহু সাহাবীসহ অসংখ্য নিরপরাধ মুসলমানের রক্ত ঝরেছে। খলীফা আলী (রা) শাহাদাত বরণ করেন এই পথভ্রষ্ট চরমপন্থেিদর হাতে।১০ বসরা ও কূফা ছিল তাদের মূল কেন্দ্র। ুযয়াদ তাদের নির্মূল ও চিশ্চিন্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্ত সামুরার (রা) সিদ্ধান্তের সাথে মিলে যায়।১১ ইবন হাজার বলেন: সামুরা ছিলেন খারেজীদের প্রতি ভীষণ কঠোর।১২ ইতিহাস ও সীরাতের গ্রন্থসমূহে দেখা যায়, ুযয়াদ ও তাঁর ছেলে উবায়দ্ল্লুাহ বসরায় প্রায় সত্তর হাজার লোক হত্যা করেন। আর এর সাথে সামুরাও জড়িত ছিলেন।১৩ ইমাম জাহাবী বলেছেন: সামুরা (লা) বহু মানুষ হত্যা করেছেন।১৪
আমের ইবন আবী আমের বলেন: আমরা ইউনুস ইবন হাবীবের মজলিসে বসা ছিলাম। উপস্থিত লোকেরা বললো: এই যমীন যে পরিমাণ রক্ত চুষেছে পৃথিবীর আর কোন ভূ-খণ্ড তেমন চোষেনি। এখানে সত্তর হাজার মানুষ হত্যা করা হয়েছে। আমি ইউনুসকে কথাটি হত্যা কিনা তা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন: হাঁ। প্রম্ণ করা হলো: এ কাজ কারা করেছে? বললেন: যিয়াদ, তাঁর ছেরে উবায়দুল্লাহ ও সামুরা।১৫ ইমাম আল কুরতুবী বলেন: সামুরার নিকট কোন খারেজীকে আনা হলে তিনি তাকে হত্যা করতেন এবং বলতেন: আকাশের নীচে এ হচ্ছে নিকৃষ্টতম নিহত ব্যক্তি। কারণ, তারা মুসলমানদের কাপির বলে এবং মানুষের রক্ত ঝরায়।”১৬
সামুরার এমন কঠোরতার কারণে খারেজীরা ছিল তাঁর প্রতি ভীষণ ক্ষুদ্ধ। তারা সামুরাকে খারাপ জানতো। তাঁর এরূপ আচরণের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাতো। পক্সান্তরে বসরার তৎকালীন জ্ঞানী গুনীরা যাঁদের মধ্যে ইবন সীরীন ও হযরত হাসান আল বসরীর মত খ্যাতিমান লোকও আছেন, তাঁর প্রশংসা করতে। তাঁরা সামুরার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের জবাব দিতেন।১৭
ইতিহাস ও সূীরাতের গ্রন্থাবলীতে উল্লেখিত এ সকল তথ্য দেখে আজ আমাদের মনে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, সামুরার (রা) মত একজন সাহাবীর হাত মানুষের রক্তে রঞ্জিত হতে পারে কিভাবে এর উত্তরে বলা যেতে পারে, ইতিহাসের সকল তথ্য হাদীসের মত সম্পূর্ণ নির্ভুল নয়। হতে পারে তৎকালীন গোলযোগপূর্ণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ অপবাদ তাঁর প্রতি আরোপ করা হয়েছে। এমন নজীর ইতিহাসে বিরল নয়।
তাছাড়া ইতিহাসের এ অধ্যায়টি বুঝার জন্য খারেজীদের উদ্ভব, বিকাশ, তাদের দর্শন, সর্বোপরি বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি তাদের নির্মম আচরণ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঠিক ইতিহাস আমাদের জানা থাকা দরকার। তারা একটি চরমপন্থী অসংখ্যা নিরপরাধ মানুষ। নিবির্চচারে তারা হত্যা করেছে বিরুদ্ধবাদীদের। রাসূলুল্লাহর (সা) বিপুলসংখ্যাক সাহাবী তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। সামুরার (রা) মন্তব্যেও এই সত্য ফুটে উঠেছে, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাই একজন শাসক হিসেবে তাদের প্রতি নির্মম হওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। আর এ কারণ ইবন সীরীন ও হযরত হাসান আল বসরীর মত শ্রেষ্ঠ মনীষীরা তাঁকে অকুষ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করি, রাসূলুল্লাহর (সা) একজন মাহন সাহাবী অন্যায়ভাবে মানুষের রক্ত ঝরাতে পারেন না।
হিজরী ৫৩ সনে যিয়াদের মৃত্যু হলে রাষ্ট্র প্রশাসন ব্যবস্থায় কিচু পরিবর্তন হয়। বসরা এবং কূফা দুইটি স্বতন্ত্র প্রদেশের মর্যাদা লাভ করে এবং দুই প্রদেশে দুইজন ওয়ালী নিয়োগ লাভ করেন। সামুরা বসরার ওয়ালী হন এবং প্রায় একবছর এ পদে বহাল থাকেন।১৮ হিজরী ৫৪ সনে আমীর মু’য়াবিয়ার (র) নির্দেশে এ পদ থেকে তিনি অপসারিত হন।
সামুরা ইবন জুনদুবের (রা) মৃত্যু সন নিয়ে মত পার্থক্য আছে। হিজরী ৫৮, ৫৯ ও ৬০ সনের কথা বর্ণিত হয়েছে।১৯ ইবনু ইমাদ আল হাম্বলী হিজরী ৬০ সনে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।২০ তিনি বসরা না কূফায় মারা যান, সে সম্পর্কে মতভেদ আছে।২১ কেউ কেউ বলেছেন, তিনি বসরার ওয়ালী ছিলেন এবংয় কূফায় মারা যান। আবার একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি কূফায় মৃত্যুবরণকারী রাসূলুল্লাহর (সা) সর্বশেষ সাহাবী।২২
মাসুরার (রা) মৃত্যু হয় অস্বাভাবিক ভাবে। শেষ জীবনে তিনি ভীষণ ঠন্ডা অনুভব করতেন। চিকিৎসা স্বরূপ দীর্ঘদিন গরম পানিতে বসে শরীর গরম করতেন। অবশেষে এটা কালব্যাধিতে রূপ নেয়। একদিন ভীষণ ঠাণ্ডা অনুভব করতে থাকেন। তাঁর চারপাশে আগুন জ্বালিয়ে রাখা হরো; কিন্তু কোন কাজ হলো না। তিনি বললেন, আমার পেটে যে কি অবস্থা হচ্ছে, তা বুঝাবো কি করে। এমন এক অস্থিরতার মধ্যে হাঁড়ির গরম পানিতে বসতে গিয়ে টগবগ করে পুটন্ত পানিতে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন।২৩ হিলাল ইবন উমাইয়া বলেন, তিনি সেঁক দিতে গিয়ে াসতর্ক অবস্থায় আগুনে পুড়ে মারা যান। যদি এ বর্ণনা সত্য হয় তাহলে রাসূলুল্লাহর (সা) ভবিষ্যদ্বাণীর অর্থ ছির দুনিয়ার আগুন। আখেরাতের আগুন নয়।২৪ ইবন আবদিল বার বলেন, সামুরার এভাবে মৃত্যু হওয়াতে রাসূলুল্লাহর (সা) একটি ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়।
হযরত সামুরার (রা) মৃত্যু সম্পর্কে রাসূলে কারীমের (সা) একটি ভবিষ্যদ্বাণী রিজাল ও সীরাত শাস্ত্রে গ্রন্থসমূহে দেখা যায়। আনাস ইবন হাকীম আদ-দাব্বী বলেন, আমি মদীনায় ঘোরাফেরা করছিরাম। হঠাৎ আবূ হুরাইয়ার সাথে দেখা হলো। ান্য কোন কথা বলার আগেই তিনি সামুরা সম্পর্কে জিজ্ঞেস কররেন। আমি সামুরা বেঁচে থাকার খবর দিলে খুব খুশী হরেন। তারপর বললেন: আমরা দশজন এক বাড়ীতে একদিন রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে ছিরাম। এক সময় তিনি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের সবার মুখের দিকে তীক্ষèভাবে তাকারেন। তারপর দরজার দুইটি বাজু ধরে বরলেন: আখেরুকুম মাওতান ফিন নার।’Ñতোমাদের মধ্রে সর্বশেষ মৃত্যুবরণকারী আগুনে যাবে অথবা আগুনে পুড়ে মৃত্যু হবে। আমাদের সেই দশজনের আটজন মারা গেছে। বেঁচে আছি আমি ও সামুরা। এখন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণের চেয়ে আর কোন কিছু প্রিয়তর আমার কাছে নেই।২৫ কোন কোন বর্ণনায় দশজনের স্থলে তিনজনের কথা এসেছে। তারা হলেন: সামুরা, আবূ মাহজুরা ও আবূ হুরাইরা।২৬
উল্লেখিত দলটির মধ্য থেকে হযরত সামুরা যে সর্বশেষ মৃত্যুবরণ করেছেন, সে ব্যাপারে কোন দ্বিতম নেই। তবে আবূ মাহজুরা ও আবূ হুরাইয়ার (রা) মধ্যে কে আগে মারা গেছেন সে ব্যাপারে মত পার্থক্য দেখা যায়। কোন কোন বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় আবূ হুরাইরা (রা) আগে মারা গেছেন। বালাজুরী বলেন: সামুরা বসরায় এবং আবূ মাহজুরা মক্কায় জীবিত ছিলেন। তাই হিজায তেকে কেউ বসরায় গেলে াসমুরা জিজ্ঞেস করতেন আবূ মাহজুরা সম্পর্কে, আবার কেউ বসরা থেকে মক্কায় গেলে আবূ মাহজুরা জিজ্ঞেস করতেন সামুরা সম্পর্কে। এবাবে একদিন আবূ মাহজুরা মারা যান সামূরার আগে।২৭
আউস ইবন খারিদ বলেন: আমি আবূ মাহজুরার কাছে গেরে তিনি সামূরা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। আবার সামুরার কাছে গেরে তিনি আবূ মাহজুরা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন।২৮ কিন্তু পূর্বে উল্লেখিত আনাস ইবন হাকীমের বর্ণনা এবং তাউসের একটি বণৃনা দ্বারা বুঝা যায় আবূ হুরাইরার আগেই আবূ মাহজুরা মারা যান। যেমন তাউস বলেন: কেউ আবূ হুরাইরাকে ভয় দেখাতে চাইলে বলতোঃ সামুরা মারা গেছেন একথা শুনেই তিনি হঠাৎ চিৎকার দিয়ে অচেতন হয়ে পড়ে যেতেন।২৯
সামুরার (রা) সন্তানদের সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। তবে সুলায়মান ও সা’দ নামে তাঁর যে দুই ছেলে ছিল, একথা জানা যায়। তিনি ছিলেন জ্ঞানী ও অতি মর্যাদাবান সাহাবীদের একজন। রাসূলে কারীমের (সা) জীবদ্দমায় যদিও তিনি ছিলেন একজন তরুণ, তবুও রাসূলুল্লাহর (সা) অসংখ্য হাদীস স্মৃতিতে ধারণ করেন। ইমাম আল-কুরতুবী বলেন: তিনি ছিলেন বেশী পরিমাণে রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীস বর্ণনাকারী হাদীসের হাফেজদের একজন।৩০ তাহজীবুত তাহজীব গ্রন্থে বলা হয়েছে, ত৭ার বণিৃত হাদীসের লিখিত একটি কপি ত৭ার ছেলে কাছে ছিল।৩১ ইবন সীরীন বলেন, এই পুস্তিকাটি ছিল জ্ঞানের ভাণ্ডার।৩২
সামুরা (রা) হাদীস স্মৃতিতে ধরে রাখার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। স্মৃতিশক্তিও ছিল অসাধারণ যা কিছু স্মৃতিতে ধরে রাখতে চাইতেন, পারতেন। রাসূলে কারীম (সা) নামাযের মধ্রে দুইটি স্থানে চুপ থাকতেন। একটি তাকবীর তাহরীমার পরে যখন সুবহানাকা আল্লাহুম্মা’ পড়তেন। ান্যটি সূরা ফাতিহা পাঠের পর যখন আমীন’ বলতেন। এ বিষয়টি সামুরার স্মৃরণ ছির এবং তিনি তা আমলও করতেন। কিন্তু ইবরান ইবন হুসাইনের (রা) বিষযটি মনে ছিলনা। একবার সামুরা (রা) নামাযে রাসূলুল্লাহর (সা) আমলের অনুসরণ করলে ইমরান (রা) প্রতিবাদ করলেন। বিষয়টি উল্লেখ করে সঠিক তথ্য জানার জন্য মদীনার উবাই ইবন কা’বকে (রা) চিঠি লেখা হরো। জবাবে তিনি লিখলেন, সামুরা সত্য বলেছে। তাঁর ঠিকই স্মারণ আছে।৩৩
একবার ভাষণ দানকালে তিনি একটি হাদীস বর্ণনা করেন। শ্রোতাদের মধ্যে সালাবা ইবন আবআদ আল-আবদী ছিলেন। তিনি বলেন, দ্বিতীয়বার যখন সামুরা হাদীসটি বর্ণনা করেন, তখন শব্দের মধ্রে কোন তারমতম্য দেখা গলেনা।৩৪ প্রখর স্মৃতিশক্তির াধিকারী হওয়া সত্ত্বেও হাদীস বণৃায় দারুণ সতর্ক ও রক্ষণশীল ছিলেন। তিনি বলেছেন: আমি রাসূলুল্লাহর (সা) মুখ থেকে বহু কিচু শুনেছি। কিন্তু বয়ঃজ্যেষ্ঠ সাহাবীদের প্রতি আমার আদব তার সব বণৃনা থেকে আমাকে বিরত রাখে। তাঁরা আমার চেয়ে বয়সে বড়। রাসূলুল্লাহর (সা) জীবনকালে আমি ছিরাম একজন তরুণ। তা সত্ত্বেও যা কিচু শুনতাম, স্মৃতিতে ধারণ করতাম।৩৫
কখনো কখনো তিনি হাদীস বণৃনা করতেন এবং তাতে কারো মনে কোনপ্রকার সন্দেহ দেখা দিলে তিনি জবাব দিয়ে তা দূর করতেন। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর (সা) একটি মুজিযার বর্ণনা শুনে প্রশ্ন করলো: খাবার কি বেড়ে গিয়েছিল? তিনি বললেন: বিস্ময়ের কি আছে? তবে আসমান ছাড়া আ কোথা থেকে এ বৃদ্ধি ঘটেছিল?৩৬
সামুরা সরাসবি রাসূলুল্লাহ (সা) ও আবূ উবায়দাহ ইবনুল জাররাহ থেকে শোনা হাদীস র্বণনা করেছেন। বিভিন্ন গ্রন্থ তাঁর সনদে মোট ১২৩ টি (্একশত তেইশ) হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ত৭ার থেকে যাঁরা হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে বিশেষ কয়েকজন হলো:
ইমরান ইবন হুসাইন, শা’বী, ইবন আবী লায়লা, ‘আলী ইবন রাবী’য়া, ‘আবদুল্লাহ ইবন বুরাইদা, হাসান আল-বসরী, মুহাম্মাদ ইবন সীরীন, মুতরিফ ইবন শুখাইর, আবুল আলা আল-আতারাদী, কুদামা ইবন ওয়াবরা, যাযিদ ইবন উকবা, রাবী ইবন উমাইলা, হিলাল বিন লিয়াফ, আবূ নাদরা আল-আবদীম সা’লাবা ইবন আববাদ, আবূ কিলাবা আল-জারমী, সুলায়মান ইবন সামুরা।৩৭
সামুরার (রা) মধ্যে বহুবিধ চারিত্রিক সৌন্দর্য্য বিদ্যমান ছিল। মুহাম্মাদ ইবন সীরীন বলেন: তিনি ছিরেন একজন গরম আমানতদার ও সত্যভাষী ব্যক্তি। ইসলাম ও মুসলমানদেরকে প্রাণি দয়ে ভালোভাসতেন।’৩৮ রাসূলুল্লাহর (সা) অভ্যাস ও সুন্নাতের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন।৩৯
আরবে আহনাফ’ নামক এক ব্যক্তি বিশেষ একধরনেরর তরবারি তৈরী করেন, যা হানাফিয়্যা’ নামে প্রসিদ্ধ ছিল। রাসূলুল্লাহর (সা) নিকটও একখানি এই তরবারি ছিল। সামুরা (রা) তার একটি নকল তৈরী করেন। তাঁর শাগরিদদের মধ্যে মুহাম্মদ ইবন সীরীনও তার নকল তৈরী করেন।৪০
তথ্যসূত্র:
আবুল ইয়াসার কা’ব ইবন ‘আমর (রা)
মদীনার খাযরাজ গোত্রের বনু সালেমা শাখার সন্তান আবুল ইয়াসার কা’ব (রা) ইতিহাস ও সীরাতের গ্রন্থসমূহে ত৭াকে শুধু আবুল ইয়াসার অথবা কা’ব অথবা উভয় নামেই উল্লেখ করা হয়েছে। পিতা ‘আমর ইবন আব্বাস এবং মাতা নুসাইবা বিনত আযহার আল-মুররী। তিনিও বনু সালেমা গোত্রের কন্যা।১ ইমাম জাহাবী তাঁর পিতার নাম ‘উমার এবং আবুল ইয়সারকে আনসারদের অন্যতম স্তম্ভ বলে উল্লেখ করেছেন।২
আল-‘আকাবার দ্বিতীয় বাই’য়াতে (শপথ) তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং ইসলামের ঘোষণা দিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে বাই’য়াতে (আনুগত্যের শপথ) করেন। অনেকে তখন তাঁর বয়স বিশ বছর বলে উল্লেখ করেছেন।৩
ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদরসহ পরবর্তীকালের সকল যুদ্ধে রাসূলে কারীমের (সা) সাথে অংশ গ্রহণ করেছেন।৪ বদর যুদ্ধে তিনি দারুণ সাহস ও বাহাদুরী দেখান। মক্কার পৌত্তলিক বহিনীর ঝাণ্ডা ছিল প্রখ্রাত মুহাজির সাহাবী মুসয়াব ইবন উমাইরের আপন ভাই আবু ‘আযীয ইবন উমাইরের হাতে। তিনি ঝটিকা বেগে অগ্রসর হয়ে তার হাত থেকে ঝাণ্ডা ছিনিয়ে নেন এবং তাকে বন্দী করেন।৫ এ যুদ্ধে তিনি মুনাববিহ ইবন হাজ্জাজ নামক এক পৌত্তলিক সৈনিককে হত্যা করেন।৬ তাছাড়া হযরত আব্বাসকে বন্দী করে রাসূলে কারীমের (সা) সামনে হাজির করেন। রাসূল (সা) আবুল ইয়াসারের ছোট-খাট দেহ এবং আব্বাসের বিশাল দেহের প্রতি তাকিয়ে অবাক হয়ে যান। তিনি আবুল ইয়াসারকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি আব্বাসকে কেমন করে বন্দী করলে? আবুল ইয়াসার বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাঁকে বন্দী করার ব্যাপারে আমাকে এমন এক ব্যক্তি সাহায্য করেছে যাকে এর আগে বা পরে আর কখনো আমি দেখিনি। লোকটি দেখতে এমন। তাঁর কথা শুনে রাসূল (সা) বললেন: তাকে বন্দী করার ব্যাপারে কোন মহান ফিরিশতা আমাকে সাহায্য করেছেন।৭ ইমাম আহমাদ আল-বরার সূত্রে বর্ণনা করেছেন: এ ব্যক্তি আমাকে বন্দী করেনি। আমাকে ব্দী করেছে অন্য এক ব্যক্তি, যে দেখতে এমন। তাঁর কথা শুনে রাসূল (সা) বললেন: কোন ফিরিশতা তাকে সাহায্য করেছে।৮
ইবন ইসহাক বর্ণনা করেছেন। বদরের কুরাইশ বন্দীদেরকে মদীনায় স্থানান্তরের জন্য রাসূল (সা) তাদেরকে সাহাবীদের মধ্যে বন্টন করে দেন। মুস‘য়াব ইবন উমাইরের আপন ভাই আবূ আযীয ইবন উমাইর ছিরেন বন্দীদের একজন। তিনি পড়েন মুস‘য়াব ও আবুল ইয়সারের দায়িত্ব। আবুল ইয়াসারই তাকে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে বন্দী করেছিলেন। মদীনার দিকে চলার পথে মুস‘য়াব তাঁর ভাই আবু আযীযের দুই হাতশক্ত করে বাঁধার জন্য আবুল ইয়াসারকে বলেন। একথা শুনে আবূ াাযীয দুঃখের সাথে বলেন: ভাই, আমার ব্যাপারে তুমি এ কথাও বলতে পারলে? মুস‘য়াব বললেন: তুমি নও, এখন এই আবুল ইয়াসার আমার ভাই।৯ ইমাম বুখািরী তাঁর তারীখে আবুল ইয়সারের বদরে যোগদানের কথা বলেছেন। ইবন হিশাম তাঁকে বদরীদের মধ্যে গণনা করেছেন।১০ বালাজুরী বলেছেন, বদর যুদ্ধের সময় থ৭ার বয়স বত্রিশবছর ছিল।১১ কিন্তু পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিশ বছর বয়সে তিনি আকাবার দ্বিতীয় বাই‘য়াতে অংশ গ্রহণ করেন। তাহলে বদরের সময় বয়স বত্রিশ বছর হয় কি করে?
আবুল ইয়সার খায়বার যুদ্ধে যোদ দেন। তাঁর সাথে জড়িত খায়বারের একটি ঘটনা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। এ যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুসলিম বাহিনী শত্র“ বাহিনীর দুর্গ অবরোধ করে আছেন। এ সময় এক রাতে প্রতিপক্ষ জনৈক ইহুদীর এক পাল ছাপল বকরীর গোশত খাওয়াতে পারবে? আবুল ইয়সার সাথে সাথে বলে উঠলেন: আমি পারবো। একভা বলেই তিনি বকরীর পালের দিকে ছুটে গেলেন। বকরীগুরি তখন দুর্গের আভ্যন্তরে প্রবেশ করছিল। তিনি পিছন দিকের দুইটি ধরে ফেললেন এবয় তাদেরকে দুই বগলে চেপে ধরে নিয়ে এলেন। সঙ্গীরা বকরী দুইটি জবেহ করে রান্না করেছিল।১২
সিফ্ফীন ও পরবর্তী অন্যান্য ঘটনায় তিনি আলরি (রা) পক্ষে যোগদান করেছিলেন।১৩ বদরী সাহাবীদের মধ্যে তখন তিনি একাই বেঁচে।১৪
হিজরী ৫৫ সনে তিনি মদীনায় ইনতিকাল করেন। কেউ কেউ বলেছেন, বদরী সাহাবীদের মধ্যে তিনি সর্বশেষে মারা যান।১৫ শেস জীবনে তিনি খায়বারের ঘটনাটি বর্ণনা করতেন, আর রসিকতা করে বলতেন, আমার কাছ থেকে তোমরা গ্রহণ কর। সাহাবীদের মধ্যে এখন আমিই শুধু বেঁচে আছি।১৬ একথা দ্বারা তিনি শুধু বদরী সাহাবীদের কথা বুঝাতেন। মৃত্যুকালে ত৭ার বয়স হয়েছিল সত্তর বছরের উর্দ্ধে। অনেকে এক শো বিশ বছরের কথা বলেছেন। কিন্তু তা সঠিক নয়।
আবুল ইয়সারারের দেহটি ছিল স্থুল ও বেঁটে। তবে পেশী ছিল পাকানো রশির মত শক্ত। পেটটি ছিল মোটা।১৭
তিনি খুব কম হাদীস র্বণনা করতেন। তবে যা করতেন তাতে সীমাহীন সতকর্তা থাকতো। একবার উবাদাহ ইবন ওয়ালীদের নিকট রাসূলুল্লাহর (সা) দুইটি হাদীস বর্ণনা করেন। তখন তিনি নিজের চোখ ও কানের ওপর আঙ্গুল রেখে বলেন, আমার এ চোখ এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে এবং এ কান রাসূলকে (সা) বলতে শুনেছে।১৮ ইমাম মুসলিম তাঁর দুইটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। হাদীস দুইটির ক্রমিক সংখ্যা হলো ৩০০৬ ও ৩০০৭। তবে ইমাম বুখারী তাঁর কোন হাদীস বর্ণনা করেননি।১৯
তাঁর ছাত্রদের মধ্যে উবাদাহ ইবন আল-ওয়ালীদ মূসা ইবন তালহা, উমার ইবন হাকাম ইবন রাফে, হানজালা ইবন কায়স যারকী, সায়ফী-মাওলা আবূ আইউব আল-আনসারী এবং রিবা’ঈ ইবন খারাশ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।২০ তিনি ছিলেন খুবই দয়ারু ও নবম দিলে মানুষ। বনু হারামের জনৈক ব্যক্তি তাঁর নিকট কিছু ঋণী ছিলেন। একদিন তাগাদা দিতে তার বাড়ীর দরজায় গিয়ে নাম ধরে ডাক দিরেন। কিন্তু কোন সাড়া পেলেন না। মনে করলেন, লোকটি বাড়ী নেই। তিনি ফিরে আসলেন এমন সময় একটি ছোট্ট ছেলে দৌঁড়ে এলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার আব্বা কোথায়? ছেলেটি বললো, তিনি তো আমার মায়ের চৌকির নীচে লুকিয়ে আছেন। তখন তিনি চিৎকার করে বরলেন, এখন বেরিয়ে এসো। তুমি কোথায় আছ তা আমার জানা হয়ে গেছে। লোকটি বেরিয়ে এলো এবং তার অভাবের কাহনিী বর্ণনা করলো। আবুল ইয়াসারের অন্তর কোমল হয়ে গেল। লোকটির নিকট থেকে ঋণের দলিলটি চেয়ে নিয়ে লেখাগুলি কেটে দিলেন। তারপর বললেন, সম্ভব হলে পরিশোধ করবে। অন্যথায় সকল ঋণ মাফ করে দিলাম।২১
দাসী-দাসীদের সাথে তিনি সাম্য ও সমতার আচরণে বিশ্বাসী ছিলেন এবং নিজেও তা কাজে পরিণত করতেন। একদিন উবাদাহ ইবন ওয়ালীদ হাদীস শোনার জন্য তাঁর নিকট এসে দেখলেন, তাঁর দাসের সামনে এক গাদা বই। িিন নিজের এক প্রস্থ চাদর ও একটি লুঙ্গি পরে আছেন। দাসের শরীরেও একই পোশাক। উবাদাহ বললেন, চাচা, ভালো হয় পোশাক একই জাতীয় এক জোড়া করে হলে। আপনি তার লুঙ্গিটি নিয়ে নিন এবং আপনার চাদরটি তাকে দিয়ে দিন। আথবা আপনার লুঙ্গিটি তাঁকে দিয়ে তার চাদরটি আপনি নিন। আবুল ইয়সার তাঁর কথা শুনে তাঁর মাথার ওপর হাত রেখে দু’আ করলেন। তারপর বললেন: রাসূলুল্লাহর (সা) নির্দেশ হচ্ছে, তোমরা যা পরবে দাসদেরও তাই পরতে দেবে, তোমরা যা খাবে তাদেরকেও তাই খেতে দেবে।২২
ইমাম আবূ দাউদ ও নাসাঈ আবুল ইয়সারের সূত্রে রাসূলুল্লাহর (সা) একটি দু’আ বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সা) বলতেন: হে আল্লাহ! আমি ধ্বংস থেকে তোমার আশ্রয় চাই। আমি আশ্রয় চাই পতন থেকে। পানিতে ডোবা, আগুনে পুড়ে যাওয়া ও বার্দ্ধক্য থেকেও তোমার আশ্রয় চাই। আরো আশ্রয় চাই মৃত্যুর সময় শয়তানের প্ররাচনা থেকে এবং তোমার রাস্তায় জিহাদে বেরিয়ে পলায়ণপর অবস্থায় ও বিষাক্ত জীব-জন্তু, কীট-পতঙ্গের দংশনে মৃত্যু থেকে।২৩
তথ্যসূত্র:
আসিম ইবন সাবিত ইবন আবিল আকলাহ (রা)
ভারো নাম ‘আসিম, ডাকনাম আবু সুলাইমান। পিতা সাবিত ইবন আবিল আকলাহ কায়েস এবং মাতা আশ-শামুস বিনতু আবী আমীর।১ এই ’আসিম ছিলেন দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমার ইবনুল খাত্তাবের পুত্র প্রখ্যাত তাবেঈ আসিমের নানা।২ মদীনার বিখ্যাত আউস গোত্রের সন্তান।
হযরত রাসূলে কারীমের (সা) মদীনায় আগমনের পূর্বে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। সীরাত বিশেষজ্ঞগণ তাঁকে আগে-ভাগেই ইসলাম গ্রহণকারী আনসারদের একজন বলে উল্লেখ রেছেন।৩ রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় এসে হযরত আবদুল্লাহ ইবন জাহাশের সাথে তাঁর মুয়াখাতবা ভ্রাতৃসম্পর্ক গড়ে দেন।৪
হযরত আসিম বদর ও উহুদল যুদ্ধে অশংগ্রহণ করেন।৫ বদর যুদ্ধের পূবর্ েহযরত রাসূলে কারীম (সা) সকল যোদ্ধাকে একত্র করে যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে মতবিনিময় করলেন। এক পর্যায়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন: আচ্ছা, বলতো তোমরা কিভাবে লড়বে? সাথে সাথে হযরত আসিম তীর-ধুনক হাতে করে দাাঁড়িয়ে গেলেন এবং বরলেন: দু’শো হাতের ব্যবধানে হলে তীর ছুড়বো। তার চয়ে নিকটে হলে নিযা এবং তার চেয়ে আরো নিকটে হলে তরবারি দিয়ে আঘাত করবো। তাঁর একথা শুনে রাসূল (সা) বললেন: যুদ্ধের নিয়ম এটাই। আসিম যেভাবে লড়ে, তোমরা সেভাবেই লড়বে।৬
বদর যুদ্ধে মক্কার পৌত্তরিক বাহিনীর পতাকা প্রথমে তালহা ইবন আবীতালহার হাতে ছিল। হযরত আলীর হাতে সে নিহত হলে তার ভাই আবু সা’দ ইবন আবী তালহা তা তুলে নেয়। হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াককাসের হাতে সে নিহত হলে উসমান বা উসাম ইবন তালহা তা উঠিয়ে নেয়। হযরত হামযার হাতে সে নিহত হয় এবং মুসাফি ইবন তালহা সেটি তুলে নেয়। হযরত আসিম ইবন সাবিত তাকে হত্যা করেন। তারপর তার ভাই আল-জুলাস ইবন তালহা মতান্তরে কিলাব ইবন তালহা পতাকাটি তুলে ধরে। হযরত আসিম তীর মেয়ে তাকেও হত্যা করেন।৭
হযরত আসিম এই বদরে কুরাইশদের আর একজন অতি সম্মানিত ব্যক্তি উকবা ইবন আবী মুয়াইতকে হত্যা করেন। এই উকবা ছিল একজন অতি নীচ প্রকৃতি লোক। সে ছিল মককায় রাসূলুল্লাহর (সা) চরম দুশমনদের একজন। নানাভাবে রাসূলকে (সা) কষ্ট দিত। ঝুড়ি ভরে ময়লা-আবর্জনা এনে রাসূলুল্লাহর (সা) ঘরের দরজায় ফেলে রাখতো। একদিন তো রাসূল (সা) সিজদাবনত আছেন, কোথা থেকে এই নরাধম ছুটে এসে তাঁর মাথার ওপর এমনভাবে চেপে বসে যে, নবীজীর প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ে। আর একদিনের ঘটনা, নবীজী সিজদায় আছেন। এই পাষন্ড কোথা থেকে মরা ছাগলের নাড়িভুঁড়ি কাঁধে করে এসে রাসূলুল্লাহর (সা) মাথায় ঢেলে দেয়। এহেন পাপিষ্ঠ বদরে মুসরমানদের হাতে বন্দী হলো। রাসূলে কারীমের নির্দেশে হযরত আসিম তাঁকে হত্যা করেন।৮ অবশ্য ইবন হিশাম বলেন: যুহরী ও আরো অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছেন, উকবাকে হত্যা করেন হযরত আলী ইবন আবী তালিব (রা)।৯
তিনি উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ইসলামের জন্য কিভাবে জবিনকে বাজি রাখতে হয় তার একটি নজীরবিহীন দৃষ্টান্তহ তিনি এ যুদ্ধে রেখে গেছেন। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে মুসলিম বাহিনীর বিজয় হয়। কিন্তু একটি গিরিপথে রাসূল (সা) কর্তৃক মোতায়েনকৃত তীরন্দায বাহিনী রাসূলের (সা) নির্দেশ ভুরে তাদের স্থান ছেড়ে দেয় এবং গনিমাত কুড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর এই সুযোগে খালিদ ইবনুল ওয়ালিদের নেতৃত্বে একদল পৌত্তলিক সৈনিক সেই গিরিপথ দিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায়। এই আকম্মিক হামালায় বিজয়ী মুসরিম বহিনীর ওপর দারুণ বিপর্যয় নেমে আসে। মুহূর্তের মধ্যে মুসলিম বাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। তারা তাদের অধিনায়ক রাসূল (সা) থেকে দূরে ছিটকে পড়ে। এমন দুর্যোগময় মুহূর্তে পনেরো জন মুজাহিদ পাহাড়ের মত অটল হয়ে শত্র“র মুকাবিলা করেন। তাঁদেরই একজন হযরত আসিম ইবন সাবিত। এই উহুদদের দিন আট বক্তি মৃত্যুর জন্য রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে বাইয়াত করেন। তাঁরা হলেন: আলী, যুবাইর, তারহা, আবু দুজানা, আল-হারিস ইবনুস সাম্মাহ, হুবাব ইবনুল মুনজির, আসিম ইবন সাবিত ও সাহল ইবন হুনাইফ। কিন্তু সেদিন ত৭াদের কেউই মারা যাননি।১০ ইবন সা’দ বলেন: উহুদে যখন সবাই পালিযে যায় তন তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে মৃত্যুর জন্য বাইয়াত করেন।১১ তিনি ছিলেন এ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর দক্ষ তীরন্দাযদের অন্যতম।১২
এই উহুদে তিনি পৌত্তলিক বহিনীর সদস্য তালহা ইবন আবী তারহার দুই পুত্র মুসাফি’ ও আল-হারিস মতান্তরে আল-জুলাসকে হত্যা করেন। তাদের দুইজনের দেহেই তিনি অতি সার্থকভাবে তীর বিদ্ধ করেন। মারাত্মক আহত অবস্থায় উভয়কে তাদের মা সুলাফা বিনতু সা’দের কাছে আনা হয়। মা ছেলে মুসাফি’র মাথা কোলের ওপর রেখে জিজ্ঞেস করে: ববাছাধন! তোমার দেহে এমনভাবে তীর বিদ্ধ করেছে কে? সে বলে: আমি শুনতে গেলাম এক ব্যক্তি আমার প্রতি তীর ছুড়ে বলে উঠলো! এই লও, আমি ইবন আবিল আকলাহ। তখন সুলাফা কসম খায়, যদি সে কোন দিন আসিমের মাথা হাতে পায তাহলে সে তাঁর খুলিতে মদ পান করবে।১৩ আল্লাহ পাক তার এ কসম পূর্ণ করেননি।
এই উহুদে হযরত আসিম মককার আর এক াকৃতজ্ঞ দুরাচারীকে হত্যা করেন। তার নাম আবু উজ্জাহ আমর ইবন আবদিল্লাহ। এই লোকটি বদরে মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হয়। তখন সে এই বলে রাসূলুল্লাহর (সা) অনুকম্পা ভিক্ষা করে যে, একটি বড় পরিবারের ভরন-পোষণের দায়িত্ব তার কাঁধে এবং সেই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। রাসূলুল্লাহ (সা) তার প্রতি উদারতা দেখান। জীবনে সে আর কোনদিন রাসূলুল্লাহর (সা) বিরুদ্ধে ঘর থেকে বের হবে নাÑএই অঙ্গীকারের ভিত্তিতে তিনি তাকে মুক্তি দেন। এই আবু ইজ্জাহ কিন্তু উহুদ যুদ্ধের সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কুরাইশদের সাথ মককা থেকে বের হবেনা। সে তাদের বলেছিল, মুহাম্মদ আমার সাথে ভালো ব্যবহার এবং আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আমি তার প্রতিদান এভাবে দিতে পানি না। কিন্তু সে তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে পারেনি। মককার সাফওয়ান ইবন উমাইয়্যা ও উবাই ইবন খালাফের চাপচাপিতে শেষ পর্যন্ত সে তাদের সাথে উহুদে আসে যুদ্ধ করতে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এবারও সে মুসলমনাদের হাতে ধরা পড়ে। আগের মত এবারও সে রাসূলুল্লাহর (সা) অনুকম্পা ভিক্ষা করে। উত্তরে রাসূল (সা) তাকে একটি চমৎকার কথা বলেন: একজন মুমিন (বিশ্বাসী) একই গর্তের সাপ বা বিচ্ছু দ্বারা দুইবার দংশিত হতে পারে না। তুমি কি ভেবেছো, মককায় ফিরে গিয়ে তোমার লোকদের বলবে, আমি মুহাম্মদকে দুইবার ধোঁকা দিয়েছি?
ঐতিহাসিক ওয়াকিদী বুকাইর ইবন মিসমারর সূত্রে আবু ইজ্জাহর উহুদে বন্দী হওয়ার কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: মুশরিকরা উহুদ থেকে পিছনে সরে গিয়ে দিনের প্রথম ভাগে হামরাউল আসাদ নামক স্থানে অবস্থান নেয়। কিছুক্ষণ পর তারা সেখানে থেকে প্রস্থান করে। কিন্তু আবু ইজ্জাহ তখনও ঘুমিয়ে। এদিকে বেলা বেড়ে গেল। কুরাইশ বাহিনীর অনুসরণকারী মুসলিম বাহিনীর লোকেরা সেখানে এসে উপস্থিত হলো। হযরত আসিম ইবন সাবিত আবু ইজ্জাহকে সেখানে গেয়ে বন্দী করে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট হাজির করেন। রাসূল (সা) তাঁর প্রাণ ভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দিয়ে তাঁকে হত্যার নির্দেশ দেন। হযরত আসিম তার ঘাড় থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।’১৪ অবশ্য ান্য একটি বর্ণনামতে আবু ইজ্জাহর হত্যাকারী হযরত যুবাইর।১৫
হযরত আসিম (রা) হিজরী ৪র্থ সনে আর-রাজী-এর ঘটনায় হুজাইল গোত্রের লোকদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন। এই ঘটনার বর্ণনায় ইমাম বুখারী ও অন্যান্য সীরাত বিশেজ্ঞদের মধ্যে কিছুটা অমিল দেখা যায়। এখানে সংক্ষেপে তা তুলে ধরা হচ্ছে:
’আর-রাজী ছিরো হুজাইল গোত্রের একটি পানির কুপের নাম। এর পাশেই ঘটনাটি ঘটেছিল। তাই ইতিহাসে তা ইওমুল রাজী-এর ঘটনা নামে পরিচতি। ইমাম বুখারী আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সা) আসিম ইবন সাবিতের নেতৃত্বে দশ সদস্যের একটি গোয়েন্দা দল পাঠালেন। তাঁরা মদীনা থেকে যাত্রা করে উসফান ও মককার মাঝামাঝি স্থানে পৌঁছালে হুজাইল গোত্রের বনু লিহইয়ান শাখা তা টের পায়। তারা এক শো তীরান্দায লোক নিয়ে দলটির ানুসরণ মুরু করে। এক পর্যায়ে দলটি যেখানে অবস্থান করেছিলো সেখানে পৌঁছে তারা খেজুরের আঁটি কুড়িয়ে পায় এবং তা দেখে তারা নিশ্চিত হয় যে দলটি মদীনা থেকে এসেছে। আঁটি পেয়ে তারা বলাবলি করেছিলো, এতো ইয়াসরিবের খেজুর। তারা দ্রুত অনুসরণ করে দলটি ঘিরে ফেলে। শত্র“র উপস্থিতি টের পেয়ে হযরত আসিম তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে একটি উুঁচ শক্ত টিলার ওপর আশ্রায় নেন।১৬
ইমাম বুখারীর উপরোক্ত বর্ণনা থেকে একটু ভিন্নতা দেখা যায় মুহাম্মদ ইবন ইসহাক, মুসা ইবন উকবা ও উরওয়া ইবন যুবাইরের বর্ণনায়। তবে মাগাযী শাস্ত্রে মুহাম্মদ ইবন ইসহাক অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাই ইমাম শাফে’ঈ বলেছেন, কেউ মাগাযী (যুদ্ধ-বিগ্রহের কাহিনী) জানতে চাইলে তাকে মুহাম্মদ ইবন ইসহাকের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে।১৭
মুহাম্মদ ইবন ইসহাক আসিম ইবন উমার থেকে বর্ণনা করেছেন। উহুদ যুদ্ধের পর আল-আদল ও আল-কারাহ গোত্রদ্বয়ের কিছু লোক মদীনায় এসে বললো: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের কিছু লোক মুসলমান হয়েছে। আমাদের সাথে আপনার কিচু সঙ্গী পাঠান, যারা আমাদেরক দ্বীনের জ্ঞান দান করবেন, কুরআন পড়াবেন এবং ইসলামী শরীয়াত শেখাবেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের সাথে ছয় ব্যক্তিকে পাঠালেন। তাঁরা হলে: (১) মারসাদ ইবন আবী মারসাদ আল-গানাবী, (২) খালিদ ইবনুল বুকাইর আল-লাইসী, (৩) আসিম ইবন সাবিত, (৪) খুবাইব আদী, (৫) যায়িদ ইবনুল দাসহান (৬) আবদুল্লাহ ইবন তারিক। দলনেতা ছিলেন মারসাদ ইবন আবী মারসাদ। মুসা ইবন উকবাও ইবন ইসহাকের মত বর্ণনা করেছেন।১৮
ইবন ইসহাক বলেন: তাঁরা ঐ লোকগুলির সাথে যাত্রা করলেন। হিজাযের দিকে আল-হাদয়ার’ কাছাকাছি হুজাইল গোত্রের আর-রাজী’ কুপের নিকট পৌঁছালে সাথের লোকগুলি বিশ্বাস ভঙ্গ করে দলটির ওপর আক্রমণের জন্য হুজাইল গোত্রের সাহায্য চেয়ে চিৎকর শুরু করে দিল। সাথে সাথে হুজাইল গোত্রের লোকেরা অস্ত্র হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো এবং চারদিক থেকেদলটিকে ঘিরে ফেললো। এই মুষ্টিমেয় লোক তাদের সাথে লড়বার জন্য হাতিয়ার তুলে নিলো। তখন হুজাইল গোত্রের লোকেরা বললো: আল্লাহর কসম! তোমাদেরকে হত্যার উদ্দেশ্য আমাদের নেই। তবে মককাবাসীদের হাতে তোমাদেরকে তুলে দিয়ে বিনময়ে কিছু লাভ করাই আমাদের উদ্দেশ্য।১৯ আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের সাথে অঙ্গীকার করছি এবং তোমাদেরকে প্রতিশ্র“তি দিচ্ছি, আমরা তোমাদেরকে তুলে দিয়ে বিনিময়ে কিছু লাভ কাই আমাদের প্রত্যুত্তরে মারসাদ, খালিদ ও আসিম বললেন: আল্লাহর কসম! আমরা কোন মুশরিকের অঙ্গীকার ও চুক্ িকক্ষণো গ্রহণ করবো না। ইমাম বুখারী বলেন:এই সময় আসিম বলেছিলেন: আমি কাফিরের জিম্মায় যাব না। ইমাম বুখারী বলেন: এই সময় আসিম বলেছিলেন: আমি কাফিরের জিম্মায় যান না। হে আল্লাহ! আপনার নবীকে আমাদের খবর পৌঁছে দিন।২০ ইবন ইসহাক বলেন, এই সময় আসিম কেটি কবিতা পাঠ করেছিলেন, তার কয়েকটি পংক্তি নিুরূপ:২১
‘আমার কী যুক্তি থাকতে পারে, যখন আমি একজন শক্তিমান, দক্ষ তীরান্দায?
একটি ধনুকও আছে, আর তাতে আছে শক্ত ছিলো।
তার পিট থেকে উড়ে যয় লম্বা-চওড়া তীরে ফলা।:আর মৃত্যু? তাই তো সত্য, আর জীবন-তাাে মিথ্যা।
আল্লাহ যা নির্ধারণ করেন রখেছেন, তাতো আসবে,
আর মানুষ, সে তো তাঁর কাছেই ফিরে যাবে।
আমার মা হবেন নাককাটাÑ
যদিনা আমি তাদের সাথে লড়াই করি।’
এমনি ধরনের আরো কিছু পংক্তি সীরাতের গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে।২২
‘আসিম কবিতার পংক্তি উচ্চারণ করতে করতে কাফিরদের প্রতিতীর ছুড়ছিলেন। তীর শেষহয়ে গেলে বর্শার চালাতে লাগলেন। এক সময় তাও ভেঙ্গে গেলে এবার থাকলো তরবারি তাই চালালেন। শাহাদাতের ক্ষণিক পূর্বে তিনি দু’আ করলেন:
‘আমি আবু সুলাইমান! আমার মত রোকেরাই তীর নিক্ষেপ করে। এ গৌরব লাভ করেছি সম্মানিত লোকদের থেকে উত্তরাধিকার হিসেবে। শত্র“র বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মারসাদ ও খালিদ শহীদ হয়েছে।২৩
ইমাম বুখারী বলেন:অতপর আসিম সহ তাঁর সঙ্গীরা যুদ্ধে হলে। শত্র“দের তীরে বিদ্ধ হয়ে আসিম তাঁর ছয়জন সঙ্গীসহ শাহাদাত বরণ করেন। বেঁচে থাকেন খুবাইব, যায়িদ ও অন্য এজন। কাফিরদের প্রতিশ্র“তি পেয়ে তারা আত্মাসমর্পণ করলেন। হাতের মধ্যে পেয়েই কাফিররা প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করে তাঁদেরইে ধনুকের সূতা খুলে হাত-পাঁ বেঁধে ফেলে। এ েেদখে তাঁদেরে মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি বলে উঠলেন: এ হলো প্রথম ধোঁকা। একথা বলে তিনি তাদের সাথে চলতে একেবারেই অস্কীকার করলেন। তারা ানেক টানাহেঁচড়া করলো’ কিন্তু কিচুতেই তাঁকে নিতে পারলো না। শেষে কাফিররা তাঁকেও হত্যা করে। অবশিষ্ট দুইজনকেও মককায় নিয়ে হত্যাকরা হয়।২৪
হযরত আসিমকে (রা) হত্যার পর বনু হুজাইল তাঁর মাথা মককর এক মহিলা সুলাফা বিনতু সা’দÑএর কাছে বিক্রীয় সিদ্ধান্ত নিল। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আসিম উহুদ যুদ্ধে এই মহিলার দুই ছেলেকে হত্যা করেন। তাই সে কসময খেয়েছিল, যদি কখনো আসিমকে হাতের মুঠোয় পায় তাহলে তাঁর মাথার খুলিতে মদ পান করবে।২৫৫সে আরো ঘোষনা দেয়, যে ব্যক্তি তাঁর মাথা এনে দেবে তাকে একশো উট পুরস্কার দেওয়া হবে।২৬ তাছাড়া তিনি বদরে পৌত্তরিক কুরাইশদের এক বড় নেত উকবা ইবন আবী মু’য়াইতকে হত্যা করেছিলেন। এজন্য তারাও আসিমের মৃত্যুর খবর পেয়ে দারুণ খুশী হয়েছিল। তারা এই বলে উল্লাস প্রকাশ করেছিল যে, যাক, শেষ পর্যন্ত উকবার হত্যাকারীর পার্থিব জীবনের অবসান হয়েছে। তারা তাঁর দেহ আগুনে জবারিয়ে ভম্মিভূত করে তাদের পতিশোধ স্পৃহা নিবারণ করতে চেয়েছিল।২৭ কিন্তু আল্লাহ পাক তাদের কারও বাসনা পূরণ করেননি।
এদিকে হযরত আসিম মৃত্যুর পূর্বে আল্লাহর দরবারে এই বরে দু’আ করেছিলেন যে, হে আল্লাহ! কোন মুশরিক যেন আমাকে স্পর্শ না করে এবং আমিও যেন তাদের কাউকে স্পর্শ না করি। আলÍাহ পাক তাঁর দু’আ কবুল করেছিলেন। তিনি মৌমাছি বা বোলতা পাঠিয়ে কাফিরদের স্পর্শ থেকে তাঁর রক্ষা করেন। এ প্রসঙ্গে হযরত উরওয়া বলেন: মুশরিকরা তাঁর লাশের দিকে যাওয়ার উদ্যোগী হতেই কোথা থেকে এক ঝাঁক মৌমাছি এসে তাদেরকে এমনভাবে কামড়াতে শুরু করে যে, তারা দিশেহারা হয়ে পালিয়ে যায়। দিনের আলোতে তারা অকৃতকার্য হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে, রাতের আঁধারে পাশের কাছে যাবে। কিন্তু রাতের আঁধর নামতে না নামলে মুঘলধারে বৃষ্টি হয়। সে প্লাবনের প্রবল স্রোতে হযরত আসিমের লাশটি যে কোথায ভেসে যায় মুশরিকরা তন্নতন্ন করে খুঁজেও তার কোন হদিস পায়নি। ইব সা’দ বলেন: হিজরাতের ছত্রিশ মাসের মাথায় সপর মাসে আর-রাজী’র এই দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। হযরত উমার যখন শুনলেন, মেওমাছি তাঁর দেহ রক্ষা করেছে, তখন মন্তব্য করলেন: একজন বিশ্বাসী বান্দাহকে আল্লাহ হিফাজত করেছে। জীবন ও মরণ উভয় অবস্থায় আল্লাহ তাঁকে মুশরিকের স্পর্শ থেকে রক্ষা করেছেন। যেহেতু মৌমাছি তাঁকে রক্ষা করেছেন, এ কারণে ইতিহাসে তিনি হামিউদ দাার নামে পরিচিত।২৮
আর-রাজী’র এই বষাদময় ঘটনার পর হুজাইলীদের নিন্দায় মদীনার ইসলামী কবিরা সরব হয়ে ওঠেন। হাসসান ইনসাবিত আবু যায়িদ আল-আনসারী প্রমুখ কবি তাদের এ অপকর্মের নিন্দা এবং শহীদদের প্রশংসা করে কবিতা রচনা করে। সীরাতু ইবন হিশাম সহ বিভিন্ন গ্রন্থে তার কিছু সংকলিত হয়েছে।২৯ হাসসান ইবন সাবিতের একটি মরছিয়া বা শোকগাঁথার দুইটি পংক্তি নিুরূপ:
আমার জীবনের শপথ! হুজাইল ই. মুদরিক দারুণ অপরাধ করেছে, খুবাইব ও আসিমের ব্যাপারে তারা দুর্নাম কুড়িয়েছে।৩০
হযরত ইবন আক্ষাস বলেন: আর-রাজী’র খবর মদীনায় পৌঁছালে মুনাফিকরা মন্তব্য করলো, এই হতভাগ্য লোকগুলো তাদের ঘরেও থাকলো না, তাদের নেতার বাণীও পৌঁছাতে পারলো না অথবা তারা জীবনের বিনিময়ে ােন কল্যাণও লাভ করাে না। তখন আল্লাহ পাক সূরা আল-বাকারার ২০৪ নং আয়াতটি নাযিল করেনঃ৩১
আর এমন কিছু লোক আছে যাদের পার্থিব জীবনের কথাবার্তা তোমাদের চমৎকৃত করবে। আর তারা সাক্ষ্য স্থাপন করে আল্লাহকে নিজের মনের কথার ব্যাপারে। প্রকৃতপক্ষে তারা কঠিন ঝগড়াটে লোক।
হযরত আসিমের এক ছেলের নাম মুহাম্মদ। তৎকালীন আরবের বিখ্যাত কবি আল-আহওয়াস এই মুহাম্মদের পৌত্র।৩২
শত্র“ ঈমান, রাসূলুল্লাহর (সা) প্রতি গভীর মুহাব্বত, পরিচ্ছন্ন মন, অতুলনীয় সাহস ইত্যাদি গুণ হযরত আসিমের চরিত্রের উজ্জলতম দিক।
হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: মদীনার চিত্র বৈরী দুি গোত্রÑআউস ও খাযরাজ নিজ নিজ গোত্রের কৃতি সন্তানদের নাম নিয়ে গর্ব কতো। আউসবলতো, হানজালাÑযাঁকে ফিরিশতারা গোসল দিয়েছিল, সা’দ ইবন মু‘য়াজÑযাঁর মৃত্যুতে আরশ কেঁপে উঠেলিলো, আসিম ইবন সাবিত যাঁর দেহ আলÍাহ মৌমাছি দ্বারা রক্ষা করেছিলাম, মুযাইমা ইবন সাবিত যাঁর একার সাক্ষ্য দুজিনের সমানÑএাঁ সবাই আউস গোত্রের সন্তান।৩৩
তথ্যসূত্র :

আল হারেসা ইবন সুরাকা (রা)
আল হারেসা ইবনসুরাকা মদীনার বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের নাজ্জার শাখার সন্তান। পিতা সুরাকা বিন হারেস এবং মাতা রাবী বিনতু নাদার। তাঁর ডাক নাম উম্মুল হারেসা। মা রাবী ছিরেন একজন উঁচুস্তরের সাহাবী এবং সাহাবী রাসূলুল্লাহর (সা) খাদেম আনাস ইবন মালিকের আপন ফুফু।১
রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় আগমনের পূর্বেই পিতার মৃত্যু হয়। মা জীবিত ছিলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবিয়্যাতের মর্যাদা লাভের গৌরব অর্জন করেন। মায়ের সাথে ছেলেও ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূল (সা) আস-সায়িত ইবন উসমান ইবন মাজ’উনের (রা) সাথে তাঁর দ্বীনে ভ্রাতৃ সম্পর্ক কায়েম করেছেন।২
বদর যুদ্ধে যোগদান করেন। বদরে যাত্রার নির্দেশ লাভের পর তিনিই সর্বপ্রথম ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে চলতে শুরু করেন।৩ রাসূল (স) তাঁকে পর্যাবেক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে েিজর সংগে রাখেন।৪ তৃষ্ণার্ত অবস্থায় তিনি যখন একটি ঝরনয় পানি পান করছিলেন তখন হিববান ইবন আরাফাত নিক্ষিপ্ত একট তীরের আঘাতে শাহাদাত বণ করেন।৫ বর্ণিত আছে, আনসারদের মধ্যে সর্বপ্রথম শহীদ তিনি। তবে কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, তিনি উহুদ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। পূর্বোক্ত র্বণনাটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।৬
রাসূলুল্লাহর (সা) বদর থেকে মদীনায় ফিরে এলেন। আল হারেসার মা ছুটে এসে বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল হারেসাকে আমি কতখানি ভালোবাসি তা আপনি জানে। যদি সে জান্নাতের অধিকারী হয়ে থাকে তাহলে তো সবর করলাম। অন্যথায় আপনি দেখবেন আমি কি করি। রাসূলুল্লাহর (সা) বললেন: এসব তুমি বলছো কি? জান্নাতের সংখ্যা তো একটি বা দু’টি নয়। জান্নাত অনেক। আল হারেসা সর্বশ্রেষ্ঠ জান্নাত আল ফিরদাউসের অধিকারী হয়েছে।৭ এই খোশখবর শুনে মা রাবী’ আনন্দে আ্মহারা হয়ে যান। মৃদু হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে লাগেন: নাজ, নাজ ইয়া আল হারেসা-সাবাশ, সাবাশ, ওহে আল-হারেসা।৮
আল হারেসা ছিলেন দারুণ মাতৃভক্ত। উসুদুল গাবা’ গ্রনথকার লিখেছেন! তিনি ছিলেন মায়ের ভীষণ অনুগত ও বাধ্য।৯
একবার রাসূলে কারীম (সা) কেথাও যাচ্ছিরেন। পথে আল হারেসার সাথে দেখা। বললেন: হারেসা! আজ তোমারসকাল হলো কি অবস্থায়? হারেসা বললেন: এমন অবস্থায় যে আমি একজন খাঁটি মুসলমান। রাসূল (সা) বললেন: একটু ভেবে বল। প্রত্যেকটি কথার একটি গূঢ় ততত্ব থাকে। আল হারেসা আরজ কলেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! দুনিয়া থেকে মুখ পিরিয়ে নিয়েছি। রাত কাটে ইবাদাত-বন্দেগীতে এবং দিন কাটে রোযা রেখে। বর্তমান মুহূর্তে আমি যেন নিজেকে আরশের দিকে যেতে দেখতে পাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে জান্নাতীরা জান্নাতের দিকে এবং জাহান্নামীরা জাহান্নামের দিকে চলছে। তাঁর কথা শোনর পর রাসূল (সা) বললেন: আল্লাহ যে বান্দার অন্তরকে আলোকিত করেন, সে অন্তর আর আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়না। আল হারেসা আরজ করলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমার শাহাদাতের জন্য দু’আ করুন। তিনি দু’আ করলেন। সে দু’আ কবুল হয়। বদর যুদ্ধের সময় তার বাস্তবায়ন হয়। তিনি শহাদাত বণ করেন।১০
তথ্যসূত্র:
আল-হারেস ইবন আস্-সিম্মাহ্ (রা)
আল-হারেস (রা)-এর ডাকনাম সা’ঈদ। পিতা আস সিম্মাহ ইবন আমর এবং মাতা তুমাদুর বিনতু আমর। মদীনার বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের শাখার সন্তান।১
রাসূলে কারীমের (সা) মদীনায় আগমনের পূর্বে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। সবর ও ইসতিকলাল, ধৈর্য ও দূঢ়তার প্রতীক সুহাইব আল-রূমীর (রা) সাথেত৭র মুওয়াখাত বা দ্বীনী ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।২
মূসা ইবন উকবা ইবন ইসহাক ও অন্যরা তাঁকে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বলে উল্লেখ করেছেন।৩ রাসূলে কারীমের (সা) সাথে বদরে যাত্রা করেন এবং রাওহা’ নামক স্থানে যাওয়ার পর কোন কারণে দেহের ােন হাড় ভেঙ্গে গেলে রাসূল (সা) তাঁকে মদীনয় ফেরত পাঠান। তবে যুদেÍদ শেষ তাঁকে বদরের গনীমাত (যদ্ধলব্ধ সম্পদ) ও সওয়াবের আংশীদার ঘোষণা করেন।৪
উহুদ যুদ্দের এক পর্যায়ে মুসলিম বনিী যখন ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে তখন আল-হারেস দারুণ সাসের পরিচয় দেন। তিনি কুরাইশ বাহিনীর সদস্য উসমান ইবন আবদিল্লাহ ইবন আল-মুগীরা আল-মাখযুরীর বর্ম, ঢাল, তরবারি ইত্যাদি কেড়ে নিয়ে তাকেহত্যা করেন। এ খবর রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট পৌঁছলে তিনি মনতব্য করেন: সকল প্রশংসা সেই আলÍাহ যিনি তাকে এ সুযোগ দান করেছেন।৫ প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য য, আবদুলআহ ইবন জাহাশ (রা) এই উসমানকে ইতিপূর্বে নাখলায় টহলদানের সময় বন্দী করে মদীনায় নিয়ে আসেন। এরপর সে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত হয়ে আবার কুরাইশদের সাথে যোগ দেয়। উহুদে আল হারেস যখন তাকে হত্যা করছিলেন তখন উবাইদ ইবন হাজেয আল-আমেরীর দৃষ্টিগোচর হয়। সে অতর্কিত আল-হারেসের কাঁধে তরবারির প্রচণ্ড আঘাত হানে। আল-হারেস মারাত্মকভাবে আহত হন। দূর থেকে আবু দুজানাছুটে এস উবাইদ ইবন হাজেযকে আক্রমণ করে ধরাশীয়া করে ফেলেন। এরপর তাকে হত্যা করে খন্ড বিখন্ড করে ফেলেন।৬ রাসূল (সা) আল-হারেসকে নিহত উসমানের যাবতীয় সাজ-সরঞ্জাম দান করেন।
উহুদে যখন মুসলমানরা বিক্ষিপ্ত হয়ে রাসূল (সা) থেকে ছিটকে পড়ে তখনও যে কয়েক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর (সা) পাশে অটল থাকেন, আল-হারেস ইবন আস-সিম্মাহ তাঁদের অন্যতম।৭ ইবন ইসহাক বলে, উহুদরে বিপর্যয়ের সময় মুসলমানরা যখন জানলো যে, রাসূল (সা) জীবিত হআছেন এবং তাঁকে চিনতে পারাে তখনসবাই সেদিকে ছুটলো। এরপর আবু বকর, উমার আলী, তালহা, যুবাইর, আল-হারেস ইবন আস-সিম্মাহ সহ আরো কিছু মুসলমান রাসূলকে (সা) নিয়ে উপত্যকার দিকে যান।৮
উহুদের উিপত্যকায় রাসূলে কারীম (সা) সাহাবেিদর বেষ্টনীয় মধ্যে ঠেস দিয়ে বসা আছেন। এমন সময় মক্কার পৌত্তলিক নেতা উবাই ইবন খারাফ একেবারে কাছাকাছি এসে রাসূলকে (সা) সম্বোধন করে বললো: ওহে মুহাম্মদ! তুমি বেঁচে গেলে আমি বাঁচবো না। সাহাবীরা বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের কেউ একজন কিতাকে রুখবে? বললেন: না তার দরকার নেই। যখন সে আরো কাছাকাছি এলা, রাসূল (সা) আল-হাসের ইবন আস-মিম্মাহর হাতথেকে ত৭ার নিযাটি নিলেন। তারপর ুবাই ইবন খালাফের মুখোমুখি হয়ে তার গলায় সামান্য খোঁচা দিলেন। আর তাতেই সে তার অতি প্রিয় ঘোড়া থেকে লাফিয়ে পড়ে ছুটে পালালো।
ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কায়থাকতে ইবাই ইবন খালাফের সাথে দেখা হলে সে বরতো: মুহাম্মদ! আমার বিশআস ওর ওপর সোয়ার হয়েই আমি তোমাকেহত্যা করবো। রাসূল (সা) বলতেন: না, তা পারবেনা। বরং আমিি তোমাকে হত্যা করবো ইনশাআল্লাহ। রাসূল (সা) তার গলায় যে খোঁচটির দিয়েছিলেন, তা ছিল অতি সামান্য। খোঁচা খেয় সে অস্থিরভাবে স্বপক্ষীয় লোকদর নিকট দৌড়ে গিয়ে বলতে থাকে: আল্লাহ কসম! মুহাম্মদ আমাকেমেরে ফেলেছে। তার সাথীরা বললো: তোমার তো ুিই হয়নি। তুমিমনে হয় পালগ হয় গেছো। সে বললো: মুহাম্মদ মক্কায় থাকতে আমাকে বলতো: আমি তোমকে হত্যা করবো। আল্লাহর কসম! আমার প্রতি সে যদি কেবল থুথু নিক্ষেপ করতো তাতেই আমার মৃত্রু হতো।’ আল্লাহর এই দুশমন কুরাইশ কাফেলার সাথে মকআর ফেরার পথে সারাফ’ নামক স্থানে মারা যায়।৯ আসলে সে বুঝেছিল, আঘাত যত সামান্যই হোক, মুহাম্মাদের মুখ থেকে যে কথা উচ্চারিত হয়েছ তা সত্রে পরিণত হবেই।
উহুদ যুদ্ধে এক পর্যায়ে রাসূলে কারীম (সা) আল-হারেসকে জিজ্ঞেসকরলেন: তুমি কি আবদুর রমান ইবন আওফকে দেখেছো? বললেন: হাঁ ইয়া রাসূলালÍাহ! তিনি তো পাহাড়ের পাদদেশে পৌত্তরিকদের ভীড়ের মধ্যে ছিলেন। আমি তাঁর দিকে যাওয়ার জন্য মনস্থির করছিলাম। এমন সময় আপনার প্রতি আমার দৃষ্টি পড়লো। আমি এ দিকে চলে এলা। রাসূল (সা) বললেন: ফিরিশতারা তাঁর পক্ষে লড়ছে। একথা শোনার সাথে সাথে আল-হারেস ছুটে গেলেণ আবদুর রমানের দি।ে দেখলেন, ত৭ার সামনে কাফিরদের সাতটি রাশ পড়ে আছে তিনি আবদুর রহমানকে জিজ্ঞেস করলেন: এদের সকলকে কি আপনি একাই হত্যা করেছেন? আবদুর রমান বললেন: এই আরতাত ইবন আবদির শুরাইবীল এবং ওকেÑএ দু’জনকে তো আমি হত্যা করেছি। কিন্তু অন্যদের হত্যকারী আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। আল-হারেস তখন বললে: রাসূল (সা) ঠিক কথাই বলেছেন। তাবারানী এ বর্ণনাটি সংকলন।১০
উহুদ যুদ্ধে শেষ পর্যায়ে রাসূল (সা) সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আল-হাসের সংগে সংগে তাঁর খোঁজে বের হলেন। তাঁর ফিরতে দেরী হচ্ছে দেখে আলী’ (রা) তাঁকে খুঁজতে বের হলেন। আলী তখন একটি কবিতার দু’টি চরণ শুন শুন করে আবৃত্তি করছিলেন। তার অর্থ নিুরূপ:
‘প্রভু হে, আল-হাসে ইবন আস-সিম্মাহ একজন বন্ধুবৎসল এবং আমাদের মধ্যে একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি। একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে গিয়ে সে হারিয়ে গেছে। আর সে যেখানেই যায় জান্নাত তালাশ করে।:১১
ইবন হিশাম চরণ দু’টি একটু ভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। তনি একথাও বলেছেন, চরণ দু’টি আলীর নয়।১২
এরপর আলী (রা) আল হারেসের দেখা পেলেন। তাঁরা উভয়ে হামযাকে (রা) মৃ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলন এবং ফিরে এসে রাসূলকে (সা) খবর দিলেন। এদিকে কাফিরা তাঁর অন্য সঙ্গীদের হত্যা করে; ন্তিু তিনি তা জানতেন না। তিনি আমর ইবন উমাইয়্যার সাথে একটি গাছের নীচে বসে ছিলেন। হঠাৎ আকাশে শুক জতীয় পাখী দৃষ্টিগোচর হলো। তিনি বুঝত পারলেন কিছু একটা ঘটেছে। আমরকে সংগে করে সেই দিকে চললেন। দেখলেন, এক স্থানে বেশ কিছু মুসলমানের রক্তাক্ত ও ধুলিমলিন লাশ বিগলিত অবস্থায়পড়ে আছে। এদৃশ্য দেখে তিনি সঙ্গী আমরকে বললেন, এখন আমাদের উচিত মদীনায় ফিরে গিযে বিষয়টি তাঁকে জানাাে। এখল বল তোমার ইচ্ছা কি? আল-হারেস বললেন: যেখানে আল-মুনজির ইবন আমর নিহত হয়েছেন, আমি কিভাবে সেখন থেকে পালিয়ে যেতে পারি? লোকে বলবে, আল-মুনজির নিহত হয়েছেন, আর আমরা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছি। এরপর তিনি বলবে আল-মুনজির নিহত হয়েছেন আমি কিভাবে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে পারি? লোকে বলবে আল-মুনজির নিহত হয়েছেন, আর আমরা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছি। এরপর তিন আমরকে সংগে করে শত্রদের দিকে অগ্রসরন হন। প্রতিপক্ষ ছিল সুসজিজ্ত এবং সংখ্যায় অনেক। তারা বৃষ্টির মত তীর নিক্সেপ করে আল-হরেসের সারা দেহ ঝাঝরা করে ফেলে। তিনি ঘটনা স্থলেই শাহাদাতবণ করেন। ত৭ার সংগী আমর শত্র“ পক্ষের হাতে বন্দী হন। আমের ইবন আততুফাইল যখন জানতে পারে যে বন্দীআমর মুদার গোত্রের লোক তখন সে তাঁর মাথার সামনের দিকের চুল মুড়ে দিয়ে মুক্ত করে দেয়। কারণ তার মা মান্নত করেছিল যে, সে একটি বন্দী মুক্ত করবে। এভাবে আমের তার মায়ের মান্নত পূণ করে। এটা হিজরাতের ৩৬ মাসের মাথায় সফর মাসে সংঘটিত হয়।১৩
আল-হারেসের কে ছেলে সাদ সিফফীনে আলীর (রা) পক্ষে যুদ্ধগিয়ে শাহাদাত বরণ করেন। সাদের মায়ের নাম ছিল উম্মুল হাকাম খাওলা বিনতু উকবা। তাঁর অন্য একটি ছেরেন নাম আবুল জুহাইম। তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সাহচর্য লাভে ধন্য হন এবয় রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে হাদীসও বর্ণনা করেন। তাঁর মায়ের নাম উতাইলা বিনতু কা’ব। ইবন সা’দ তাঁর তাবাকাত গ্রন্থে বলেছেন, মদীনা ও বাগদাদে এখনও আল-হারেসের বংশধর বিদ্যামন আছে।১৪ আল-হারেসের মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল। বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁর কিছু শ্লোক সংকলিত হয়েছে।১৫
তথ্যসূত্র:
’উমাইর ইবন সা’দ (রা)
উমাইর ইবন সা’দ মদীনার বিখ্যাত আউস গোত্রের ভাগ-বিমুখ একজন আনসারী সাহাবী। চারিত্রিক গুণÑবৈশষ্ট্যের জন্য তিনি নাসীজু ওয়াহদিহ উপাধি লাভ। করেন। তাঁকে এ উপাধি দান করন খলীফা উমার (রা)।১
উমাইরের শৈশব কালেই পিতা সা’দ উবাইদ মারা যান। পিতার মৃত্যুর পর মা জুলাস ইবন সুওয়ায়িদকে দ্বিতীয় স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেন। মায়ের সাথে উমাইরও চলে যান জুলাসের তত্ত্বাবধানে। জুলাস তাঁকে নিজের সন্তানদের মত অত্যন্ত øেহ ও যতেœর সাথে প্রতিপালন করেন। ইবন হিশাম বলেন: এই জুলাস ও তাঁর ভাই াল-হারেস, দুইজনই ছিলেন মুনাফিক (কপট মুসলমান)।২
এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, আবু যায়িদ ছিলেন মদীনার আনসারদের বিখ্যাত চার ক্বারীর অন্যতম। তাঁর আসল নাম সা’দ ইবন উবাইদ। আর আমাদের আলোচ্য এই মহান সাহাবীর সম্মানিত পিতার নামও ছিল সা’দ ইবন উবাইদ। এ কারণে অনেক ঐতিহাসিক, বিশেষতঃ ইবন সা’দ ভুল করেছেন। তাঁরা উমাইরকে ক্বারী আবু যায়িদ সা’দ ইবন উবাইদের পুত্র বলে উল্লে করেছেন। এটা তাঁদের এক মারাত্মক ভুল। যেমন বিনুল কালবী বলেছেন: ত৭ার পিতা সা’দ ইবন উবাইদ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।৩ অথচ উভয় সা’দের মৃত্যুর সনের মধ্যে বিসম্তার ব্যবধান রয়েছে। তাাড়া ুমাইরের পিতা সা’দ ছিলেন আউস গোত্রের এবং আবু যায়িদ সা’দ ছিরেন খাযরাজ গোত্রের সন্তন। প্রখ্যাত সাহাবী আনাস ইবন মালিক বলেছেন, আবু যায়িদ সম্পর্কে তাঁর চাচা। আর এটা তো স্বীকৃত যে, আনাস খাযরাজ গোত্রের লোক। তাছাড়া আবু যায়িদ কো বংশধর রেখে যাননি।৪
উমাইরের পালক পিতা জুলাসের তত্ত্বাবধানে থাকা কালেই সম্ভবত তিি ইসলামগ্রহণ করেন। সীরাত বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সাহাবিয়্যাতের (রাসুলুল্লাহর (সা) সাহচর্য) পৌরব তো তিনি অর্জন করেছেন, তবে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে কোন যুদ্ধে যাওয়ার মর্যাদা লাভ করতে পারেননি।৫ এর কারণ হলো রাসূলুল্লাহর (সা) জীবদ্দশায় যুদ্ধে যাওয়ার বয়স তাঁর হয়নি। কোন কোনগ্রন্থকার বলেছেন, যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও জিহাদে তিনি জুলারে সহগামী হতেন। এ প্রসঙ্গ তাঁরা তাবুক যুদ্ধের একটি ঘটনা উল্লেখ করেন।৬
খলীফা উমারের (রা) খিলাফতকালে সেনাপতি আবু উবায়দার সাথে তিনি শাম অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। উমার তাঁকে শামের একটি বাহিনীর অধিনায়ক নিয়োগ করন। কিছুদিন পর তাঁকে হিমস ও দিমাশকÑএর ওয়ালী নিয়োগ করেন। উমারের (রা) ওফাত পর্যন্ত তিনি এ পদের বহাল ছিলেন। ইমাম যুহরী বলেন: সা’ঈদ ইবন আমির উবন হিজিম মৃত্যুবরণ করলে উমাইর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। উমারের নিহত হওয়া পর্যন্ত মুয়াবিয়া ও তিনি এক সাথে শামে ছিলেন। অতঃপর খলীফা সুমান উমাইরকে অপসরণ করে গোটা শাম মু’য়াবিয়ার অধীনে ন্যন্ত করেন।৭
সাফওয়ান ইবন আমর বলেন: মুয়াবিয়া গোটা শামের আমীর হিসেবে নিয়োগ লাভের পর হিমসের মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে ভষণ দেন। তাতে বলেন: ওহে হিমসবাসী! আল্লাহ তা’য়ালা সৎ ও যোগ্য আমীরদের দ্বারা আপনাদেরকে ধন্য করেছেন। আপনাদের প্রথম আমীর য়িাদইবন গানম। তিনি আমার চেয়ে ভলো লোক ছিলেন। আপনাদের দ্বিতীয় আমীর সা’ঈদ ইবন আমির। তিনিও আমার চেয়ে উত্তম ব্যক্তি। তারপর আপনাদের আমীর হলেন উমাইর। উমাইর অতি ভালো মানুষ। এখন আমি আপনাদের আমীর। আপনারা আমাকে জানবেন।৮
উমাইরের (রা) শামে থাকাকালের বেশ কিছু ঘটনা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। এখানে সংক্ষেপে কিচু তুলে ধরা হলো:
একবার কলীফা উমার (রা) একটি বাহিনীর অধিনায়ককরে তাঁকে শামে পাঠান। কিছু দিন পর খলীফার নিকট এসে বললেন: আমীরুল মুমিনীন! আমাদের অবস্থান এবং আমাদের শত্র“দের অবস্থানের মধ্যবর্তী স্থানে ‘আরাবসোস’ নামে একটি শহর আছে। এর অধিবাসীরা আমাদের গোপন তথ্য আমাদের শত্র“দের নিকট সরবরাহ করে থাকে। তার ওপর ভিত্তি করে শত্র“রা আমাদের সাথে এমন এমন আচরণ করে তাকে।
খলীফা বললেন: তুমি শহরের অধিবাসীদের শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবার প্রস্তাব দেবে। বিনিময়ে তাদেরকে একটি ছাগলের পরিবর্তে দুইটি ছাগল, একটি গরুর পরিবর্তে দুইটি গরু এবং এভাবে তাদের প্রত্যেকটি জিনিসের পরিবর্তে দুইটি জিনিস দান করবে। এ প্রস্তাব গ্রহণ করলে আমাদের প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী আমরা তাদেরকে দ্বিগুণ জিনিস দান করবো। আর এ প্রস্তাব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তাদের সাথে আমাদের যে চুক্তি আছে তা বাতিলের ঘোষণা দিয়ে এক বছর অপেক্ষা করবে।
উমাইর আরজ করলেন: হে আমীরুল মুমিনীন! আপনার এ অঙ্গিকারটি আমাকে একটু লিখিতভাবে দান করুন।
খলীফার অঙ্গিকার পত্রটি নিয়ে উমাইর শামে ফিরে গেলেন এবং আরাবসোরে’ ধ্বংস করে ফেলেছে। আরো নানা কথা তিনি শুনতে পেলেন। খলীফা তাঁর ওপর ভীষণ ক্ষেপ গেলেন। সাথে সাথে উমাইরকে মদীনায় ডেকে পাঠালেন। উমাইর মদীনায় খলীফার দরবারে হাজির হরেন। ক্ষুব্ধ খলীফা তাঁর মাথার ওপর ছড়ি ঝাঁকিয়ে বললেন: তুমি আরাবসোস’ ধ্বংস করে ফেলেছে! ‘উমাইর কোন উত্তর না দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। খলীফা দরবার থেকে উঠে ঘরে ফিরলেন। উমাইর সাক্ষাতের অনুতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং তাঁকে প্রদত্ত খলীফার অঙ্গিকার পত্রটি পাঠ করে শোনালেন। উমার মন্তব্য করলেন: আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন।৯
খলীফা উমার (রা) তঁকে হিমসের ওয়ালী পাঠালেন। এক বছরের মধ্যে তাঁর কোন খবর পেলেন না। অবশেষে তিনি কাতিবকে (সেক্রেটারী) বললেন: আমার মনে হচ্ছে সে আমাদের আস্থা নষ্ট করেছে। তুমি তাঁকে লেখ: আমার এ পত্র পৌঁছা এবং পাঠমাত্র মুসলমানদের নিকট থেকে খাজনা, যাকাত যাকিছু আদায় করেছো তা নিয়ে মদীনায় চলে আসবে।’ চিঠি পেয়ে উমাইর বিলম্ব না করে একটি চামড়ার থলিতে সামান্য কিছু পাথেয় ও পানির একটি পিয়ালা ভরে কাঁধে ঝোলালেন এবং লাঠিটি হতে নিয়ে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করলেন।
মদীনা থেকে হিমসের দূরত্ব কয়েক শে মাইল। মদীনায় যখন পৌঁছলেন তখন তাঁর মাথার চুল লম্বা হয়ে গেছে। রোদ, ধুলোবালি ও দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তিতে চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় সরাসরি খলীফার দরবারে পৌঁছে বললেন: আসসালামু আলাইকা ইয়া আমীরাল মুমিনীন!Ñআমিরুল মুমিনীন, আপনার প্রতি সালাম! খলীফা তাঁর দিকে চোখ তুলে দেবে বিষ্ময়ের সাথে প্রশ্ন করলেন: এ তোমার কী হাল হয়েছে? উমাইর বললেন: আপনি আমার আবার কি হাল দেখলেন? আমি কি সুস্থ নই? আমার ওপর কি দুনিয়াদারির ছোঁয়া লেগেছে? আমি কি দুনিয়ার শিং দুইটি ধরে টানাটানি করছি? খলীফা ধারণা করেছিলেন, ‘উমাইর হয়তো প্রচুর অর্থ-সম্পদ সাথে নিয়ে এসেছেন। তাই প্রশ্ন করলেন: হেঁটে এসেছো?
বললেন: হাঁ, হেঁটেই এসেছি।
Ñকেউ কি তোমাকে একটি বাহন দিয়ে সাহায্য করলো না?
Ñআমি কারো কাছে বাহন চাইনি, আর কেউ দেয়ওনি।
Ñ তারা খুব খারাপ মুসলমান হয়ে গেছে।
Ñ উমার! আল্লাহ আপনাকে মানুষের গীবত করতে নিষেধ করেছেন। আমি তো তাদেরকে ফজরের নামায জামায়াতে আদায় করতে দেখেছি।
খলীফা নির্দেশ দিলেন: উমাইরের নিয়োগ নবায়ন করা হোক। উমাইর বললেন: আমি আপনার অধীনে বা ভবিষ্যতে আর কারো অধীনে আর কোন দায়িত্ব পালন করবো না। কারণ, অপরাধ থেকে আমি মুক্ত থাকতে পারিনি। সেখানে খ্রীষ্টান জিম্মীকে আমি বলেছি, আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করুন। ওহে উমার আপনি কি আমাকে এমন কাজের জন্য পাঠিয়েছিলেন? অন্য সাহাবীদের মত মৃত্যুবরণ না করে বেঁচে থাকলাম এবং যেদিন থেকে আপনার সাথ কাজ করছি সেটি আমার জীবনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট দিন। এরপর তিনি খলীফার অনুমতি নিয়ে মদীনা থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি নিরিবিলি স্থানে চল যান এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। একদিন খলীফার নে যেন মনে হলো, ‘উমাইর বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। তাই তাঁকে পরীক্ষার জন্য এক শো দীনারসহ আল-হারেস নামক এক ব্যক্তিকে তাঁর কাছে পাঠালেন। যাওয়ার সময় লোকটিকে বললেন: তুমি উমাইরের কাছে একজন অতিথির ছদ্মবেশে যাবে। যদি তাঁর ওখানে পার্থিব ভোগ-বিলাসের কোন চিহ্ন দেখতে পাও তাহলে সাথে সাথে ফিরে আসবে। আর তাঁকে খুব করুণ অবস্থায় দেখলে এই এক শো দীনার তাঁকে দান করবে।
লোকটি চলে গেল। উমাইরের বাস্থানে পৌঁছে দেখলো, তিনি দেওয়ালের পাশে বসে বসে জামার ময়লা খুটে খুটে তাতে তালি লাগাচ্ছেন। লোকটি সালাম দিল। উমাইর সালামের জবাব দিলে তাকে থাকার অনুরোধ করলেন। লোকটি থেকে গেল।
উমাইর: কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
Ñমদীনা থেকে।
Ñ আমীরুল মুমিনীনকে কেমন ছেড়ে এসেছেন?
Ñ একজন সৎকর্মশীল ব্যক্তি হিসেবে।
Ñ আমীরুল মুমেনীন কি এখন আর হুদ (শরী’য়াত নির্ধারিত শাস্তি) কায়েম করেন না?
Ñতিনি তাঁর এক ছেলেকে সম্প্রতি ব্যভিচারের শাস্তি দান করেছেন। ছেলেটি মারা গেছে।
Ñআল্লাহ, তুমি উমারকে সাহায্য কর। তোমার ভালোবাসা ছাড়া তাঁর মধ্যে আর কিছু আছে বলে আমার জানা নেই।
লোকটি উমাইরর গৃহে তিন দিন অতিথি হিসেবে থাকলো। এ তিনটি দিন শুধু যবের রুটিন কিছু টুকরো চিবিয়েই তকে কাটাতে হলো। এ অবস্থা দেখে লোকটি বললো: এ কয়টি দিন তো আপনি আমাকে প্রায় অভুক্তই রেখেছেন। এরপর সে দীনারগুলি বের করে উমাইরের দিকে এগিয়ে দিল। দীনার দেখামাত্র তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন: আমার প্রয়োজন নেই।’ একথা বলে দীনারের থলিটি তিনি লোকটির দিকে ঠেলে দিলেন। এ সময় উমাইরের সহধর্মিনী বললেন: আপনার প্রয়োজন না থাকলে যাদের প্রয়োজন আছে তাদের মধ্যেবিলি করুন।’ উমাইর বললেন: এগুলির ব্যাপারে কোন কিছু করার কোন অধিকার আমার নেই।’ তখন স্ত্রী তাঁর ওড়না ছিঁড়ে কয়েকটি টুকরো করেন। তারপর দীনাগুলি ভাগ করে সেই টুকরোগুলিতে বেঁধে আশেপাশের শহীদদের সন্তানদের মধ্যে বন্টন করে দেন।
এদিকে লোকটি খলীফা উমারের নিকট ফিরে গেল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন: উমাইর দীনারগুলি কি করেছ? আমি তো জানিনে’Ñলোকটি জবাব দিল। এরর খলীফা উমার (রা) দীনারগুলিসহ ুমাইরকে আসার জন্য লিখলেন। উমাইর খলীফার দরবারে হাজির হরেন। দীনারগুলি কি করেছো?Ñখলীফা জানতে চাইলেন। বললেন: আমার া ইচ্ছা হয়েছে করেছি। তার সাথে আপনার সম্পর্ক কি? না তোমাকে বলতেই হবে’Ñখলীফা জোর দিয়ে বললেন। উমাইর বললেন: আমি সেগুলি আমার আখিলাতের প্রয়োজনে আগে পাঠিয়ে দিয়েছি। খলীফা তখণ কচু খাদ্যদ্র্য ও দুইখানা কাপড় তাঁকে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। উমাইর তখন বললেন: খাদ্যের প্রয়োজন আমার নেই। বাড়ীতে আমি দুই সা পরিমাণ যব রেখে এসেছি। সেগুলি খেতে খেতেই আল্লাহ পাক হয়তো অন্য রিযিকের ব্যবস্থা করবেন। তবে কারপড় দুইখানি নেওয়া যেতে পারে। কারণ, আসার সময় আমি দেখে এসেছি, অমুকের মায়ের কাপড় নেই। সে ন্যাংটা প্রায়। একথা বলে কাপড় দুইখানি বগলদাবা করে বাড়ীতে ফিরে আসেন। এর অল্পদিন পরেই তিনি মারা যান।১০
ঊমারের (রা) মৃত্যু সন নিয়ে সীরাত শাস্ত্র বিশেষজ্ঞদেও মধ্যে মতপার্থক্য আছে। কেউ কেউ বলেছেন, হিমসে তিনি স্থায়ী আবাসন গড়ে তোলেন। আমীর মু’য়াবিয়ার (রা) খিলাফতকালে, মতান্তরে খলীফা ‘উমার অথবা ‘ঊসমানের (রা) সময়ে সেখানেই মারা যান।১১ একটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি মদীনায় মারা যান এবং খলীফা উমার (রা) তাঁর জানাযার নামায পড়িয়েছেন।১২ অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, ‘উমাইরের মৃত্যুও খবর পেয়ে খলীফা’ উমার (রা) তাঁর জন্য শোক প্রকাশ ও মাগফিরাত কামনা করেন। তারপর তিনি মদীনার ‘বাকী’ আল-গারকাদ’ গোরস্থানে যান। তাঁকে অনুসরণ করে আরো অনেকে লক্ষ্য করে বললেন: ‘আচ্ছা, আপনারা প্রত্যেক নিজ নিজ বাসনা প্রকাশ করুণ তো।’ তখন একজন বললো, ‘আমার যদি প্রচুর ধন-সম্পদ থাকতো, তাহলে তা দিয়ে আমি এত পরিমাণ দাস মুক্ত করতাম।’ আর একজন বললো: ‘আমার দেহে যদি অদমনীয় শক্তি হতো তাহলে আমি যমযম কূপ থেকে বালতি দিয়ে পানি তুলে হাজীদেও পান করাতাম।’ এভাবে আরো অনেকে নিজ নিজ মনোবাসনা ব্যক্ত করলো। সবশেষে ‘ঊমার (রা) বললেন: ‘আমি যদি উমাইর ইবন সা’দের মত আরো যোগ্য লোক পেতাম তাহলে মুসলমানদের কাজে আমি তাদেও সাহায্য নিতাম।১৩
হিমসের ওয়ালী থাকাকালে একদিন তিনি মসজিদেও মিম্বওে দাঁড়িয়ে ভাষণ দানকালে বলেন: ‘আপনারা জেনে রাখুন, ইসলাম একটি সুরক্ষা প্রাচীর ও একটি সুদৃঢ় দ্বার বিশেষ। ইসলামের প্রাচীর হলো সত্য ও ন্যায়। প্রাচীর ফেটে গেলে এবং দ্বার ভেঙ্গে গেলে ইসলাম পরাভূত হবে। তবে শাসক যতদিন কঠোর থাকবে ইসলাম ততদিন রক্ষক থাকবে। শাসকের কঠোরতার অর্থ এই নয় যে, সে তরবারি দ্বারা হত্যাযজ্ঞ চালাবে। তার অর্থ হলো, সত্যেও সাথে ফায়সালা করবে এবং ন্যায়কে আকড়ে থাকবে।১৪’ আবদুর রহমান ও মাহমুদ নামে দুই ছেলে তিনি রেখে যান।
‘উমাইর (রা) ছিলে মর্যাদাবান ও যুহ্হাদ (পার্থিব ভোগ-বিলাসের প্রতি উদাসীন) সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম।১৫ সাহাবীদের মধ্যে সম্মান ও মর্যাদার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন অতি উঁচু স্তরের। মুফাদ্দাল আল-গাল্লাবী বলেনঃ আনসারদের মধ্যে সর্বাধিক যাহিদ (দুনিয়াবিরাগী) ব্যক্তি তিনজনঃ আবুদ দারদা, শাদ্দাদ ইবন আউস ও ‘উমাইর ইবন সা’দ।১৬ ইবন সীরীন বলেন: খলীফা ‘উমার (রা) তাঁর চারিত্রিক মাধূর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁর উপাধি দেন ‘নাসীজু ওয়াহদিহ’-সৃষ্টি; ও স্বভাব বৈশিষ্ট্যে একক ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী।১৭
‘উমাইরের ছেলে আবদুর রহমান বলেনঃ’ আবদুল্লাহ ইবন উমার আমাকে বলেছেন: সাহাবীদের মধ্যে তোমার পিতার চেয়ে ভালো মানুষ ছিল না।১৮ ইবন সুমাই হিমসে যে সকল সাহাবী গমন করেন তাঁদেও প্রথম তাবকা বা শ্রেণীতে উমাইরের নামটি উল্লেখ করেছেন।১৯
স্বভাব ও নৈতিক চরিত্রে ‘উমাইর (রা) ছিলেন আদর্শ মানের। তাকওয়া-পরহিযগারীতে তাঁর সমকক্ষ কাউকে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। তাঁর মধ্যে ছিল তীব্র ঈমানী আবেগ। শৈশব থেকেই তাঁর অন্তরে ছিল রাসূলুল্লাহর (সা) প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। রাসূলুল্লাহর (সা) প্রতি ঈমান ও ভালোবাসার ব্যাপাওে তাঁর মধ্যে কপটতর লেশমাত্র ছিল না। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তাবুক যুদ্ধেও সময়ের একটি ঘটনায়। এ সময় তাঁর পালক পিতা আল-জুলাস রাসূলুল্লাহর (সা) শানে একটি আপত্তিকর মন্তব্য করে। উমাইর সাথে সাথে বিষয়টি রাসূলুল্লাহর (সা) অবহিত করেন। অথচ আল-জুলাসের আশ্রয়েই তিনি লালিত-পালিত এবং তখনও তাঁরই আশ্রিত।২০ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি দৃঢ় ঈমান ও গভীর ভালোবাস ছিল তাঁর নিকট সব কিছুর উর্দ্ধে।
আল-জুলাসের সাথে ‘উমাইরের ঘটনাটি ইবন হিশামসহ বিভিন্ন গ্রন্থকার বর্ণনা করেছেন। তাবুক যুদ্ধে যারা যোগদান করেনি আল-জুলাস তাদেও একজন। এ সময় আল-জুলাস একদিন ‘উমাইরের উপস্থিতিতে মন্তব্য করেন: ‘এই বক্তি (মুহম্মাদ (সা) সত্যবাদী হলে আমরা হবো গাধার চেয়েও অধম।’ ‘উমাইর কথাটি শুনে বললেন: আল্লাহর কসম, আল-জুলাস! আপনি সকলের চেয়ে আমার বেশী প্রিয় ব্যক্তি। আপনার অনুগ্রহ আমার ওপর সবচেয়ে বেশী। আপনার ওপর কোন বিপদ-মুসীবত আপতিত হলে আমি কষ্ট পাই সবচেয়ে বেশী। আপনি একটি মন্তব্য করেছেন। আমি যদি বলি আপনারা গাধার চেয়েও অধম তাহলে আপনাকে লজ্জা দেওয়া হবে। আর যদি চুপ থাকি তাহলে তাতে আমার দ্বীন ধংশ হবে। দ্বিতীয়টি অপেক্ষা প্রথমটি আমার নিকট অধিকতর সহজ।
‘উমাইরের এ প্রতিবাদ আল-জুলাসকে দারুণ ক্ষুব্ধ করে। সাথে সাথে ‘উমাইরের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার অঙ্গিকার করেন। এদিকে ‘উমাইর সাথে সাথে বিষয়টি রাসূলকে (সা) অবহিত করলেন। রাসূল (সা) তাদেও দুইজনকে এক সাথে ডেকে ব্যাপারটি সম্পর্কে জুলাসকে জিজ্ঞেস করলেন। আল-জুলাস হলফ করে বললেন: ‘উমাইর আমার সম্পর্কে মিথ্যা বলেছে। সে যেমন বলেছে, আমি তেমন কিছু বলিনি। এভাবে আল-জুলাস ঘটনাটি একেবারেই অস্বীকার করলেন। কিন্তু নবী রাসূললের নিকট কোন সত্য গোপন থাকে না। ওহী ও ইলহামের মাধ্যমে তাঁরা সব কিছু জেনে যান। আল-জুলাসের ক্ষেত্রেও তাই হলো। আল্লাহ পাক ওহী নাযিল কওে তাঁর নবীকে সব কিছু জানিয়ে দিলেন। রাসূল (সা) তখন সূরা আত-তাওবার ৭৪ নং আয়তটি পাঠ করলেন।
“তারা কসম খায় যে, আমরা বলিনি, অথচ নিঃসন্দেহে তারা বলেছে কুফরী বাক্য এবং মুসলমান হবার পর অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী হয়েছে। আর তারা কামনা করেছিল এমন বস্তুর যা তারা পায়নি। আর এসব তাই পরিণতি ছিল যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাদেরকে সম্পদশালী কওে দিয়েছিলেন নিজের অনুগ্রহের মাধ্যমে।”
রাসূলে কারীম (সা) যখন আয়াতটির শেষাংশ-‘বস্তুত এরা যদি তাওবা কওে নেয়, তা হবে তাদের জন্য মঙ্গল। আর যদি তা না মানে, তাহলে তাদেরকে আজাব দেবেন আল্লাহ তা’য়ালা, বেদনাদায়ক আজাব দুনিয়া ও আখিরাত।’- পাঠ করেন তখন আল-জুলাস বলে উঠলেন, আমি তাওবা করছি। ইবন ইসহাক বলেনঃ এ ঘটনার পর আল-জুলাস সত্যিকারভাবে মুসলামন হন। তাঁর বাকী জীবনে আর কোন ত্র“টি-বিচ্যুতি দেখা যায়নি। তাওবা কবুল হওয়ার খুশীতে আল-জুলাস ‘উমাইরকে আবার নিজ তত্ত্বাবধানে ফিরিয়ে নেন। আজীবন তাঁকে প্রতিপালন করেন। আয়ত নাযিলের পর রাসূল (সা) ‘উমাইরের কান ধরে বলেন: ছেলে, তোমার এ কান ঠিক শুনেছিল। ‘উরওয়া বলেন: এ ঘটনার পর ‘উমাইরের মর্যাদা সবার উর্দ্ধে উঠে যায়।২১
‘উমাইর (রা) থেকে রাসূলল্লাহর (সা) একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যারা রাবী হলেন, ছেলে মাহমুদ, আবূ তালাহ আল-খাওলানী, আবু ইদরীস আল-খাওলানী, রাশেদ ইবন সা’দ, হাবীব ইবন ‘উবায়েদ, যুহাইর ইবন সালেম প্রমুখ।২২
তথ্যসূত্র:


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি