সা’দ ইবন মু’য়াজ (রা)
আসল নাম সা’দ, ডাকনাম আবু ’আমর, লকব বা উপাধি সায়্যিদুল আউস। মদীনার বিখ্যাত আউস গোত্রের আবদুল আশহাল শাখার সন্তান। পিতার নাম মু’য়াজ ইবন নু’মান, মাতা কাবশা মতান্তরে কুবাইশা ‘বিনতু রাফি’। প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবূ সা’ঈদ আল খুদরীর চাচাতো বোন। জাহিলী যুগেই পিতা মু’য়াজ্জের মৃত্যু হয়। তবে মাতা কাবশা হিজরাতের পরে ঈমান আনেন এবং সা’দের ইনতিকালের পরেও বহু দিন জীবিত ছিলেন। গোটা আউস গোত্রের মধ্যে আবদুল আশহাল শাখাটি ছিল সর্বাধিক অভিজাত এবং বংশানুক্রমে নেতৃত্ব ছিল তাদেরই হাতে। সা’দ ছিলেন তাঁর সময়ে একজন বড় মাপের নেতা। (দ্রঃ সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৫২, উসুদুল গাবা- ২/২৯৬, তাবাকাত- ৩/৪২০, তাহজীবুত তাহজীর- ৩/৪৮১) তাঁর জন্ম সন সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
আকাবার প্রথম বাইয়াতের পর থেকে যদিও মদীনায় ইসলামের প্রভাব পড়তে থাকে তবে তা প্রকৃতপক্ষে হযরত মুস’য়াব ইবন ’উমাইরের ব্যক্তিত্বের সাথে জড়িত ছিল। আকাবার শপথের পর মদীনাবাসীদের অনুরোধে হযরত রাসূলে কারীম সা. মুস’য়াবকে দা’ঈ-ই-ইসলামের (আহবানকারী) দায়িত্ব দিয়ে মদীনায় পাঠান। ইসলামের ইতিহাসে তিনি একজন সফল দা’ঈ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তিনি নিরলস চেষ্টার মা্ধ্যমে মদীনার প্রতিটি লোকের কানে ইসলামের দা’ওয়াত পৌঁছে দেন। হযরত মুস’য়াব মদীনায় এসে যখন ইসলামের দা’ওয়াত দিতে শুরু করলেন তখন সা’দ ইবন মু’য়াজ একজন চরম অস্বীকারকারী। তাঁর এ অবস্থা বেশী দিন থাকেনি। অনতিবিলম্বে তিনিও মুস’য়াবের দা’ওয়াতে সাড়া দেন। ইবন ইসহাক তাঁর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
একদিন আস’য়াদ ইবন যুরারা রাসূলুল্লাহর সা. প্রেরিত দা’ঈ (আহবানকারী) মুস’য়াব ইবন ’উমাইরকে সংগে করে দা’ওয়াতী কাজে বনী আবদুল আশহাল ও বনী জাফার গোত্রে গেলেন। তাঁরা ‘মারাক’ নামক একটি কুয়োর ধারে দেওয়ালের ওপর বসলেন। আর ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এমন কিছু লোক তাঁদের পাশে জড় হলেন। সা’দ ইবন মুয়াজ ও উসাইদ ইবন হুদাইর উভয়ই তখন বনী আবদুল আশহাল গোত্রের নেতা। তখনও তাঁরা মুশ্রিক বা পৌত্তলিক। উল্লেখ্য যে, সা’দ ছিলেন আস’য়াদ ইবন যুরারার খালাতো ভাই। যাই হোক, খবরটি সা’দ ও উসাইদের কানে গেল। সাথে সাথে সা’দ উসাইদকে বললেনঃ ‘তোমার বাপের সর্বনাশ হোক। তুমি এখনই এ দু’জন লোকের কাছে যাও। তারা আমাদের দুর্বল লোকদের বোকা বানাতে আমাদের বাড়ীর ওপর চড়াও হয়েছে। তাদের তাড়িয়ে দাও, এ পথ মাড়াতে নিষেধ কর। যদি ঐ দ্বিতীয় লোকটির সাথে আমার খালাতো ভাই আস’য়াদ ইবন যুরারা না থাকতো তাহলে তোমাকে পাঠাতাম না, আমি নিজেই যেতাম। তার সামনে আমার যাওয়া শোভন হবে না। ’উসাইদ অস্ত্র সজ্জিত হয়ে তাঁদের নিকট গেলেন। উল্টো ফল ফললো। তাড়াতে গিয়ে নিজেই তাঁদের কথায় প্রভাবিত হলেন এবং ইসলাম কবুল করলেন। তিনি মুস’য়াব ও আস’য়াদকে বললেনঃ ‘আমি পিছনে এমন এক ব্যক্তিকে রেখে এসেছি, যদি তিনি তোমাদের কথা শোনেন তাহলে গোত্রের একটি লোকও তোমাদের থেকে দূরে থাকবে না। আমি এখনই সা’দ ইবন মু’য়াজকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এই বলে তিনি নিজ গোত্রের দিকে ফিরে চললেন। সা’দ তখন গোত্রীয় এক আড্ডায় বসা। উসাইদকে ফিরে আসতে দেখে তিনি মন্তব্য করলেনঃ ‘আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, উসাইদ যে চেহারায় গিয়েছিল তার থেকে ভিন্ন এক চেহারা নিয়ে তোমাদের কাছে ফিরছে।’ উসাইদ কাছাকাছি এসে পৌঁছালে সা’দ জিজ্ঞেস করলেনঃ কী করেছ? উসাইদ জবাব দিলেনঃ
আমি তাদের দু’জনের সাথে কথা বলেছি, তাদের মধ্যে তেমন খারাপ কিছু দেখিনি। তবুও তাদেরকে এখানে আসতে নিষেধ করে দিয়েছি। তারাও বলেছে, তোমরা যা ভালো মনে কর, তাই হবে। তবে আমি শুনেছি, বনী হারিছার লোকেরা আস’য়াদ ইবন যুরারাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। তারা তো একথা জানে, আস’য়াদ তোমার খালাতো ভাই।’
সা’দ সাথে সাথে উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়ালেন এবং বর্শাটি হাতে তুলে নিয়ে তাঁদের দুজনের দিকে ছুটলেন। নিকটে পৌঁছে যখন তিনি দেখলেন, তাঁরা অত্যন্ত শান্ত ও স্থিরভাবে বসে আছেন তখন তিনি বুঝলেন, উসাইদ তাঁকে ঘোকা দিয়ে তাঁদের কথা শুনাতে চেয়েছে। তিনি তাঁদের দু’জনকে গালাগালি করতে করতে আস’য়াদকে বললেনঃ ‘শোন আবু উসামা! তোমার ও আমার মধ্যে যদি আত্মীয়তার সম্পর্ক না থাকতো তাহলে আমি এত কথা বলতাম না। আমরা যা পছন্দ করিনে তাই তুমি আমাদের বাড়ীর ওপর এসে করে যাচ্ছ।’ এ দিকে সা’দকে আসতে দেখে আস’য়াদ, মুসয়াবকে বলেছিলেনঃ ‘মুস’য়াব! আপনার নিকট একজন গোত্র নেতা আসছেন। এ ব্যক্তি যদি আপনার কথা মেনে নেন তাহলে গোত্রের দু’ব্যক্তিও আপনার থেকে দূরে থাকতে পারবে না।’
মুস’য়াব অত্যন্ত নরম মিযাজে সা’দকে বললেনঃ ‘আপনি কি একটু বসে আমার কথা শুনবেন? আমার কথা পসন্দ হলে, ভালো লাগলে, মানবে। আর পসন্দ না হলে, খারাপ লাগলে আমরা চলে যাব।’ সা’দ বললেনঃ ‘এ তো খুব ইনসাফের কথা।’ তিনি মাটিতে বর্শাটি গেঁড়ে বসে পড়লেন। মুস’য়াব অত্যন্ত ধীর-স্থিরভাবে তাঁর সামনে ইসলামের দা’ওয়াত পেশ করলেন, তাঁকে কুরআন পাঠ করে শোনালেন। মুস’য়াব ও আস’য়াদ দু’জনেই বর্ণনা করেছেনঃ ইসলামের দাওয়াত পেশ করার পর সা’দ কোন কথা বলার পূর্বেই আমরা তাঁর চেহারায় ইসলামের দীপ্তি লক্ষ্য করেছিলাম। ইসলামের দা’ওয়াত শোনার পর সা’দ তাঁদের কাছে জানতে চান? ‘তোমাদের এই ইসলাম, এই দ্বীনে প্রবেশ করতে হলে কি কি কাজ করতে হয়?’ তাঁরা বললেন, ‘গোসল করে পবিত্র হতে হয়, পোশাক পরিচ্ছদ করতে হয়, তারপর কালিমা শাহাদাত উচ্চারণ করে দু’রাকা’য়াত সালাত আদায় করতে হয়।’ সা’দ তাই করলেন। তারপর বর্শাটি হাতে তুলে নিয়ে উসাইদের সাথে গোত্রীয় আড্ডার দিকে রওয়ানা দিলেন।
তাঁদেরকে ফিরতে দেখে গোত্রীয় লোকেরা বলাবলি করতে লাগলোঃ ‘সা’দ যে চেহারা নিয়ে গিয়েীছলেন এখন তাঁর সেই চেহারা নেই। তাঁকে ভিন্ন এক চেহারায় দেখা যাচ্ছে।’ সা’দ নিকটে এসে গোত্রীয় লোকদের বললেনঃ ‘ওহে আবদুল আশহাল গোত্রের লোকেরা! বিভিন্ন ব্যাপারে তোমরা আমার কাজ-কর্ম কেমন দেখে থাক?’ তাঁরা সমস্বরে জবাব দিলঃ ‘আপনি আমাদের নেতা, আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম মতামতের অধিকারী ব্যক্তি এবং আমারে বিশ্বস্ত নাকীব বা দায়িত্বশীল।’ সা’দ বললেনঃ তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সা. প্রতি ঈমান আনবে তোমাদের কোন নারী-পুরুষের সাথে কথা বলা আমার জন্য হারাম।’
আস’য়াদ ও মুস’য়াব বলেনঃ ‘আল্লাহর কসম! সা’দের এই ঘোষনার পর সন্ধ্যা হতে না হতে বনী আবদুল আশহালের সকল নারী-পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করে। সা’দের ইসলাম গ্রহণের পর আস’য়াদ ও মুস’য়াব তাঁর বাড়ীতে অবস্থান করে ইসলামের দা’ওয়াত দিতে থাকেন। ফলে রাসূলুল্লাহর সা. মদীনায় হিজরাতের পূর্বে সেখানে এমন কোন বাড়ী বা গোত্র ছিল না যেখানে দুই-একজন লোক ইসলাম গ্রহণ করেনি। এরপর সা’দ ইবন মু’য়াজ ও উসাইদ ইবন হুদাইর দুইজন মিলে বনী আবদুল আশহালের মূর্তিগুলি ভাংতে শুরু করেন। (দ্রঃ তাবাকাত- ৩/৪২০, ৪২১; সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৪৩৫, ৪৩৭, ৪৭৯; আল-বিদায়া- ৩/১৫২; উসুদুল গাবা- ৩/২৯৬; হায়াতুস সাহাবা- ১/১৮৭-১৯০)
মদীনায় ইসলামের দা’ওযাত ও তাবলীগের ক্ষেত্রে হযরত সা’দের অবদান ছিল অনন্য। এই গৌরবে অন্য কোন সাহাবী তাঁর জুড়ি নেই। কারণ, একজন মানুষের ইসলাম গ্রহণের প্রভাবে গোটা গোত্রের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা শুধু তাঁর ক্ষেত্রে ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। এই কারণে রাসূল সা. বলেছেনঃ ‘আনসারদের সর্বোত্তম গৃহ বনু নাজ্জার। তারপর আবদুল আশহালের স্থান।’ হযরত সা’দ ও তাঁর গোত্রের ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি ছিল প্রথম ও দ্বিতীয় আকাবার মধ্যবর্তী সময়ে।
ইবন ’আসাকির বুখারী ও কালবী থেকে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। রাসূল সা. মক্কা থেকে হিজরাত করার পর কুরাইশরা তাঁর কোন খোঁজ-খবর পাচ্ছে না। তাঁরা কা’বার পাশে তাদের পরামর্শ গৃহে বসে আছে। এমন সময় তারা জাবালে আবূ কুবায়সের দিক থেকে একটি কবিতা আবৃত্তির কণ্ঠ শুনতে পেল। তার কিয়দাংশ নিম্নরূপঃ
‘দুই সা’দ যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে বিরুদ্ধবাদীদের ভয় থেকে মুহাম্মাদ নিরাপদ হয়ে যাবে। ওহে আউসের সা’দ, ওহে খাযরাজের সা’দ! তোমরা মুহাম্মাদের রক্ষক হয়ে যাও।’- এরূপ আরো কয়েকটি পংক্তি।
এই কবিতা শুনে কুরাইশরা বুঝতে পারে, আউস ও খাযরাজ গোত্রে রাসূলুল্লাহর সা. সাহায্যকারী দু’সা’দ হলেন- সা’দ ইবন মু’য়াজ ও সা’দ ইবন ’উবাদা। (তাহজীবে ইবন ’আসাকির- ৬/৮৯)
ইসলাম গ্রহণের কিছু দিন পর সা’দ ’উমরার উদ্দেশ্যে মক্কায় গেলেন। মক্কার বিশিষ্ট কুরাইশ নেতা উমায়্যা ইবন ইবন খালাফ ছিল তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু। সা’দ তার বাড়ীতে উঠলেন। উমাইয়্যা মদীনায় এলে সা’দের বাড়ীতে উঠতো। তিনি উমায়্যাকে বললেন, হারাম শরীফ (কা’বার আশপাশ) যখন জনশূণ্য হয় তখন আমাকে বলবে। দুপুর বেলা উমায়্যা তাঁকে সংগে করে হারামের উদ্দেশ্যে বের হলো। পথে আবূ জাহলের সাথে দেখা। সে উমায়্যাকে জিজ্ঞেস করলোঃ এ ব্যক্তি কে?
উমায়্যাঃ সা’দ ইবন মু’য়াজ।
আবূ জাহলঃ এ তো খুবই আশ্চর্য্যের বিষয় যে, তুমি একজন ধর্মত্যাগীকে আশ্রয় দিয়েছ এবং তার সাহায্যকারী হিসেবে মক্কায় দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছ। তুমি তাঁর সাথে না থাকলে তাঁর বাড়ী ফেরা কঠিন হতো।
উল্লেখ্য যে, যারা ইসলাম গ্রহণ করতো কাফিররা ধর্মত্যাগী বলতো। হযরত সা’দ সাথে সাথে আবু জাহলের সামনে একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন। বললেনঃ তুমি আমাকে বাধা দিয়েই দেখনা কেমন হয়। আমি তোমার মদীনার রাস্তা বন্ধ করে দেব।
উমায়্যা বললেনঃ সা’দ। আবুল হাকাম (আবূ জাহল) মক্কার একজন বিশিষ্ট নেতা। তার সামনে নিচু স্বরে কথা বল।
সা’দ বললেনঃ চলো যাই। আমি রাসূলের সা. নিকট শুনেছি, মুসলমানরা তোমাদেরকে হত্যা করবে। আবূ জাহল প্রশ্ন করলোঃ তারা কি মক্কায় এসে হত্যা করবে? সা’দ বললেনঃ তা আমার জানা নেই।
হিজরী ২য় সনের রাবীউল আওয়াল মাসে রাসূল সা. কুরাইশ নেতা উমায়্যা ইবন খালাফের নেতৃত্বাধীন এক’শ লোকের একটি কাফিলার সন্ধানে বের হন। ইতিহাসে এটা ‘বাওয়াত’ অভিযান নামে খ্যাত। একটি বর্ণনা মতে রাসূল সা. স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে সা’দ ইবন মু’য়াজকে মদীনায় রেখে যান। (আনসাবূল আশরাফ- ১/২৮৭)
হযরত রাসূলে কারীম সা., আবূ ’উবাইদা ইবনুল জাররাহ মতান্তরে সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাসের সাথে তাঁর মুওয়াখাত বা ভ্রাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। (তাবাকাত- ৩/৪২১; সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৫০৫)
হিজরী ২য় সনে ‘বাওয়াত’ অভিযানের পর ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ আসন্ন। হযরত সা’দের ভবিষ্যদ্বানী সত্যে পরিণত হওয়ার সময় সমাগত। মক্কার কুরাইশরা মদীনা আক্রমণের জন্য তোড়জোড় শুরু করলো। খবর পেয়ে হযরত রাসূলে কারীম সা. বদরের দিকে যাত্রা করলেন। পথিমধ্যে কুরাইশ বাহিনীর সর্বশেষ গতিবিধি অবগত হয়ে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মুহাজির ও আনসারদের সাথে পরামর্শে বসেন। মুহাজিরদের মধ্য থেকে আবু বকর, ’উমার, মিকদাদ রা. প্রমুখ সাহাবী নিজ নিজ মতামত ব্যক্ত করেন। অতঃপর রাসূল সা. আনসারদের লক্ষ্য করে বলেনঃ ‘ওহে লোকেরা, আপনারা আমাকে পরামর্শ দিন।’ সাথে সাথে সা’দ ইবন মু’য়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলেনঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! সম্ভবতঃ আপনি আমাদেরকে উদ্দেশ্য করেছেন?’ রাসূল সা. বললেনঃ ‘হা। সা’দ বললেনঃ ‘আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি, আপনাকে সত্যবাদী বলে জেনেছি, আর আমরা সাক্ষ্য দিয়েছি যে, যা কিছু আপনি নিয়ে এসেছেন তা সবই সত্য। আপনার কথা শোনার ও আপনার আনুগত্য করার আমরা অঙ্গীকার করেছি। ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার যা ইচ্ছা করুন, আমরা আপনার সাথে আছি। সেই সত্তার নামে শপথ যিনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন। যদি আপনি আমাদেরকে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন, আমরা ঝাঁপিয়ে পড়বো। আমাদের একজনও পিছনে থাকবে না। আগামী কালই আপনি আমাদেরকে নিয়ে শত্রুর সম্মুখীন হোন, আমরা তাতে ক্ষুণ্ন হবো না। যুদ্ধে আমরা দুরুন ধৈর্যশীল, শত্রুর মুকাবিলায় পরম সত্যনিষ্ঠ। আল্লাহ আমাদের থেকে আপনাকে এমন আচরণ প্রত্যক্ষ করাবেন যাতে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে। আল্লাহর ওপর ভরসা করে আমাদের সাথে নিয়ে আপনি অগ্রসর হোন।’ তিনি আরও বলেনঃ ‘আমরা তাদের মত হবো না যারা মূসাকে আ. বলেছিল, আপনিও আপনার রব যান এবং শত্রুর সাথে যুদ্ধ করুন। আর আমরা এখানে বসে থাকি। বরং আমরা বলি, আপনি ও আপনার রব যান, আমরা আপনাদের অনুসরণ করবো। হতে পারে এক উদ্দেশ্যে আপনি বেরিয়েছেন; কিন্তু আল্লাহ আর একটি করলেন। দেখুন, আল্লাহ আপনার দ্বারা কি করান।’ ঐতিহাসিকরা বলেছেন, আল্লাহ সা’দের এই কথার সমর্থনে সূরা আনফালের ৫ নং আয়াতটি নাযিল করেন। সা’দের উপরোক্ত ভাষণে রাসূল সা. ভীষণ খুশী হন। সৈন্য মোতায়েনের সময় তিনি আউস গোত্রের ঝান্ডাটি সা’দের হাতে তুলে দেন। অন্য একটি বর্ণনা মতে এ যুদ্ধে গোটা আনসার সম্প্রদায়ের পতাকা ছিল সা’দের হাতে। (দ্রঃ সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৬১৩, ৬১৫; উসুদুল গাবা- ২/২৯৯; তাবাকাত- ৩/৪২১; আল-বিদায়া- ৩/২৬২; হায়াতুস সাহাবা- ১/৪১৫)
ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন, বদর যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে সা’দ ইবন মু’য়াজ বললেনঃ ‘ইয়া নাবীয়াল্লাহ! আমরা আপনার জন্য একটি ‘আরীশ’ বা তাঁবু স্থাপন করে একটি বাহিনী মোতায়েন রাখিনা কেন? আমরা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাব। তাতে যদি আল্লাহ আমাদের সম্মান দান করেন, আমরা বিজয়ী হই, তাহলে তো আমাদের আশা পূর্ণ হলো। আর যদি এর বিপরীত কিছু ঘটে তাহলে আপনি এই বাহিনী সহ আমাদের পিছনে ছেড়ে আসা লোকদের সাথে গিয়ে মিলিত হবেন। হে আল্লাহর নবী! আমাদের যে সব লোক মদীনায় পিছনে রয়ে গেছে, আপনার প্রতি আমাদের ভালোবাসা তাদের থেকে একটুও বেশী নয়। যদি তারা বুঝতে পারতো আপনি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন, তবে তারা এভাবে পিছনে পড়ে থাকতো না। আল্লাহ তাদের দ্বারা আপনার হিফাজত করবেন। তারা আপনাকে সৎ উপদেশ দান করবে এবং আপনার সাথে শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করবে।’ এই বক্তব্যের জন্য রাসূল সা. সা’দের প্রশংসা করে তাঁর জন্য দু’আ করলেন। এভাবে রাসূলুল্লাহর সা. জন্য রণক্ষেত্রের অদূরে একটি ‘আরীশ’ নির্মিত হয় এবং তিনি সেখান থেকে বদর যুদ্ধ পরিচালনা করেন। (আল-বিদায়া- ৩/২৬৮; সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৬২০)
এই বদর যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনী যখন পরাজিত হয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে তখন মুসলিম মুজাহিদরা তাদের ধাওয়া করে ধরে ধরে বন্দী করতে শুরু করে। হযরত রাসূলে কারীম সা. তখন ‘আরীশে’ অবস্থান করছেন। তাঁর ওপর অকস্মাৎ পাল্টা আক্রমণ হতে পারে, এমন এক আশঙ্কায় সা’দ ইবন মু’য়াজ আরো কিছু আনসারী মুজাহিদকে সংগে নিয়ে অস্ত্র সজ্জিত হয়ে ‘আরীশের’ দরযায় পাহারায় নিয়োজিত হন। রাসূল সা. সা’দের চেহারায় অসন্তুষ্টির ছাপ লক্ষ্য করে বলেনঃ সা’দ! মনে হচ্ছে লোকদের কাজ তোমার পছন্দ হচ্ছে না। সা’দ বললেনঃ হাঁ। পৌত্তলিকদের সাথে এটা আমাদের প্রথম সংঘাত। তাদের পুরুষদের জীবিত রাখার চেয়ে হত্যা করাই আমার পছন্দ। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৬২৮) একটি বর্ণনা মতে, এ যুদ্ধে তিনি ’আমর ইবন ’উবাইদুল্লাহকে হত্যা করেন। এতে তাঁর একটি দাসও যোগদান করে। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৯৭, ৪৭৯)
উহুদ যুদ্ধেও তিনি যোগদান করেন। এ যুদ্ধে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. অবস্থান স্থলের পাহারায় নিয়োজিত ছিলেন। সূচনাতেই রাসূলুল্লাহর সা. ইচ্ছা ছিল মদীনার ভেতর থেকেই কাফিরদের প্রতিরোধ করার। মুনাফিক ’আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবন সুলূলেরও ছিল একই ইচ্ছা। কিন্তু কিছু নওজোয়ান মুজাহিদ যাঁরা ছিলেন শাহাদাত লাভের চরম অভিলাষী, তাঁরা মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার জন্য জিদ ধরে বসেন। যেহেতু তাঁরা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই রাসূল সা. তাঁদের মতামত মেনে নেন এবং যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হওয়ার জন্য অন্দর মহলে প্রবেশ করেন। সা’দ ইবন মু’য়াজ ও উসাইদ ইবন হুদাইর তখন বললেনঃ তোমরা রাসূলকে সা. মদীনার বাইরে যাওয়ার জন্য বাধ্য করেছ; অথচ তাঁর ওপর আসমান থেকে ওহী নাযিল হয়। তোমাদের উচিত, তোমাদের মতামত প্রত্যাহার করে নেওয়া এবং বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে রাসূলুল্লাহর সা. ওপর ছেড়ে দেওয়া। এদিকে রাসূল সা. যখন তরবারি, ঢাল, বর্ম ইত্যাদি যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তখন সবাই অনুতপ্ত হলেন। একযোগে তাঁরা বললেন, আপনার বিরুদ্ধাচারণ আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আপনার নির্দেশ আমাদের শিরোধার্য। রাসূল সা. বললেনঃ এখন আমার করার কিছুই নেই। কারণ একজন নবী অস্ত্র সজ্জিত হলে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। এই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসার কোন অবকাশ থাকে না। (তাবাকাত- ২/২৬)
উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে যুদ্ধ শুরু হলো। প্রথম দিকে মুসলিম বাহিনীর বিজয় হলেও শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষের প্রবল আক্রমণের মুখে তারা পিছু হটে গেল। দারুন একটা বিপর্যয় ঘটে গেল। এ সময় হযরত রাসূলে কারীম সা. অটল ও দৃঢ় থাকেন। অন্য যে পনেরো ব্যক্তি রাসূলে সা. পাশে অটল থাকেন তাঁদের একজন সা’দ ইবন মু’য়াজ। এই উহুদে তাঁর ভাই ’আমর ইবন মু’য়াজ শাহাদাত বরণ করেন। (তাবাকাত- ২/৩০; আনসাবুল আশরাফ- ১/৩১৮, ৩২৯)।
উহুদ যুদ্ধের পর হযরত রাসূলে কারীম সা. একদিন আনসারদের বনী আবদুল আশহাল ও জুফার গোত্রের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি শুনতে পেলেন, ঐ গোত্রদ্বয়ের মেয়েরা উহুদে শাহাদাত প্রাপ্ত তাদের লোকদের জন্য কান্নাকাটি ও মাতম করছে। দয়ার নবীর দু’টি চোখ পানিতে ভরে গেল। তিনিও কাঁদলেন। তারপর বললেনঃ ‘কিন্তু ‘হামযার’ জন্য কাঁদার তো কেউ নেই।’ সা’দ ইবন মু’য়াজ ও উসাইদ ইবন হুদাইর নিজ গোত্র বনী আবদুল আশহালে ফিরে যখন একথা শুনলেন তখন তাঁরা তাঁদের গোত্রের মহিলাদের নির্দেশ দিলেনঃ ‘তোমরা রাসূলুল্লাহর সা. বাড়ীতে যাও এবং তাঁর চাচা হামযার জন্য শোক ও মাতম কর।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৯৯)
মদীনার ইহুদী গোত্র বনী কুরায়জার নেতা কা’ব ইবন আসাদ তার গোত্রের পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে একটি মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করেছিল। খন্দক যুদ্ধের সময় সে বনী নাদার গোত্রের নেতা হুয়ায় ইবন আখতাবের কুপরামর্শ ও উস্কানিতে সেই চুক্তি ভেঙ্গে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। একথা রাসূলুল্লাহ সা. সহ মুসলমানদের কানে গেল। রাসূল সা. ঘটনার যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য আউস গোত্রের পক্ষ থেকে সা’দ ইবন মু’য়াজ ও খাযরাজ গোত্রের পক্ষ থেকে সা’দ ইবন ’উবাদাকে পাঠান। তাদের সাথে আরও যান আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা ও খাওয়াত ইবন জুবায়র। তাঁরা বনী কুরায়জায় যান এবং তাদের সাথে আলোচনা ও বাস্তব পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বুঝতে পারেন যে, বিষয়টি সত্য। তাঁরা ফিরে এসে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট তাঁদের তদন্ত ও পর্যবেক্ষণ বিপোর্ট পেশ করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২২১)
হযরত সা’দের দৃঢ়তার বহু কথা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। এমন একটি ঘটনা বালাজুরী ও ইবনুল আসীর বর্ণনা করেছেন। গাতফান গোত্রের নেতা আল-হারেস ইবন আউফ ও ’উয়ায়না ইবন হিসনের সাথে রাসূল সা. এ শর্তে সন্ধির ব্যাপারে আলোচনা করলেন যে, তাদের পক্ষ থেকে মদীনার প্রতি কোন প্রকার হুমকী থাকবে না এবং বিনিময়ে তারা মদীনায় উৎপন্ন শস্যের এক তৃতীয়াংশ লাভ করবে। এর মধ্যে হিঃ ৫ম সনে খন্দক যুদ্ধের ডামাডোলে মদীনায় দারুণ অভাব দেখা দিল। রাসূলে কারীম সা. এ সন্ধির ব্যাপারে সা’দ ইবন মু’য়াজ ও সা’দ ইবন ’উবাদার সাথে পরামর্শ করলেন। তাঁরা দু’জন বললেনঃ ‘হে আল্লাহর রাসূল। এ যদি আপনার পসন্দ হয়, আমরা তা পালন করবো। যদি আল্লাহর নির্দেশ হয় তা হলে তো অবশ্যই পালনীয়। তবে কি এটা আমাদের কথা চিন্তা করে করছেন?’ তিনি বললেনঃ ‘হ্যা, তোমাদের কথা চিন্তা করেই করছি। আমি দেখেছি, গোটা আরব এখন তোমাদের বিরুদ্ধে। আমি চেয়েছি, অন্ততঃ এর বিনিময়ে তাদের শত্রুতা কিছুদিনের জন্য বন্ধ থাকুক।’ একথা শুনে সা’দ ইবন মু’য়াজ বললেনঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! তারা ও আমরা ছিলাম এক সাথে পৌত্তলিক।
আমরা কেউ আল্লাহর ইবাদাত করতাম না, তাঁকে জানতামও না। তখনও তারা ব্যবসা উপলক্ষে এবং অতিথি হিসেবে ছাড়া আমাদের একটি খেজুরও খাওয়ার আশা করেনি। আজ আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি, আল্লাহ ইসলাম ও আপনার দ্বারা আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। আর এখন কিনা আমাদের সম্পদের একটি অংশ তাদেরকে দিতে হবে? এমন সন্ধির প্রয়োজন আমাদের নেই। আল্লাহ আমাদের ও তাদের মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা না করা পর্যন্ত শুধু তরবারি ছাড়া আর কিছুই আমরা তাদেরকে দিব না।’ রাসূল সা. তাঁর কথা মেনে নিলেন। (আল-বিদায়া- ৪/১০৪; আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৪৬, ৩৪৭)
যুদ্ধ শুরুর সময় প্রায় কাছাকাছি। সা’দ বর্ম পরে হাতে বর্শা নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে যাচ্ছেন। পথে বনী হারেছার দূর্গে তাঁর মা উম্মুল মুমিনীন হযরত ’আয়িশার রা. পাশে বসে ছিলেন। তিনি দেখলেন, তাঁর ছেলে একটি কবিতার চরণ আবৃত্তি করতে করতে চলেছে। তার একটি পংক্তি এমনঃ ‘যখন আজল এসে যায় তখন আর মৃত্যুর জন্য আপত্তি কিসের।’
মা চেঁচিয়ে বললেনঃ ‘ছেলে! তুমি তো পিছনে পড়ে গেছ, তাড়াতাড়ি যাও।’ সা’দের যে হাতে বর্শা ছিল সেই হাতটি বর্মের বাইরে বেরিয়ে ছিল। সে দিকে ইঙ্গিত করে হযরত আয়িশা বললেনঃ ‘সা’দের মা! দেখ, তার বর্মটি কত ছোট।’ যুদ্ধ ক্ষেত্রে পৌঁছার সাথে সাথে তাঁকে লক্ষ্য করে হিববান ইবন ’আবদি মান্নাফ একটি তীর ছোঁড়ে। কোন কোন বর্ণনায় হিববানের পরিবর্তে আবু উসামা অথবা খাফাজা ইবন ’আসিমের নাম এসেছে। তীরটি তাঁর হাতে লেগে মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি করে। খুশীর চোটে হিব্বান বলে ওঠে ‘আমি ’আরিকার পুত্র।’ একথা শুনে রাসূল সা., মতান্তরে সা’দ বলে ওঠেনঃ ‘দোযখের মধ্যে আল্লাহ তোমার মুখমণ্ডল ঘামে নিমজ্জিত করুন।’ উল্লেখ্য যে, ’আরাকার অর্থ ঘাম। (দ্রঃ সীরাতু ইবন হিশামঃ ২/২২৬-২২৮; উসুদুল গাবা- ২/২৯৬)
সেকালে মসজিদে নববীতে যুদ্ধে আহতদের সেবা ও চিকিৎসার জন্য একটি শিবির স্থাপন করা হয়েছিল। সম্ভবতঃ এই শিবিরের প্রতিষ্ঠা হয় উহুদ যুদ্ধের পর এবং তা ছিল রাসূলুল্লাহর সা. হুজরার নিকটে। আসলাম গোত্রের ’উফাইদা’ নাম্নী এক সেবা পরায়না সৎকর্মশীলা মহিলা ছিলেন এই শিবিরের একজন সেবিকা। তিনি আহতদের সেবা ও চিকিৎসা করতেন। রোগীর সেবা ও ক্ষত চিকিৎসায় তিনি ছিলেন অভিজ্ঞ। খন্দক যুদ্ধে সা’দ ইবন মু’য়াজ আহত হলে রাসূল সা. নির্দেশ দেনঃ ‘তোমরা সা’দকে রুফাইদার তাঁবুতে রাখ। তাহলে আমি নিকট থেকেই তার দেখাশুনা করতে পারবো।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৩৯; উসুদুল গাবা- ২/২৯৭; দায়িরা-ই-মা’রিফ-ইসলামিয়্যা, উর্দু- ১১/৩৩)
হযরত রাসূলে কারীম সা. প্রতিদিন এই শিবিরে এসে অসুস্থ সা’দের দেখাশুনা করতেন। তিনি নিজের জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়েন, তাই আল্লাহর দরবারে দু’আ করেনঃ ‘হে আল্লাহ! কুরাইশদের সাথে এ সংঘাত যদি এখনও অবশিষ্ট থাকে তবে আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন। তাদের সাথে লড়াই করার আমার খুব সাধ। কারণ, আপনার রাসূলকে তারা কষ্ট দিয়েছে, তাঁকে অস্বীকার করেছে এবং মাতৃভূমি মক্কা থেকে তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আর যদি সংঘাত শেষ হওয়ার সময় হয়ে থাকে তাহলে এই ক্ষতের দ্বারাই আমাকে শাহাদাত দান করুন। আর বনী কুরায়জার ব্যাপারে আমার চোখে প্রশান্তি না আসা পর্যন্ত আমার মরণ দিও না।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২২৭; উসুদুল গাবা- ২/২৯৬; বুখারী- ২/৫৯১) আল্লাহ পাক তাঁর দু’আর শেষ কথাটি কবুল করেন।
খন্দক যুদ্ধে কুরাইশ ও তাদের মিত্র বাহিনীর পশ্চাদপসরণের পর রাসূল সা. মদীনার যাবতীয় ফাসাদের উৎস ইহুদী গোত্র বনু কুরায়জাকে শাস্তি দানের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তারা চুক্তি ভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। এই বনী কুরায়জার সাথে প্রাচীনকাল থেকে মদীনার আউস গোত্রের মৈত্রী চুক্তি ছিল। রাসূল সা. যখন তাদেরকে শাস্তি দানের সিদ্ধান্ত নিলেন তখন আউস গোত্রের লোকেরা বললোঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের প্রতিপক্ষ খাযরাজ গোত্রের বিরুদ্ধে তারা ছিল আমাদের মিত্র। এর আগে আপনি আমাদের ভাই খাযরাজীদের মিত্র গোত্র বনী কায়নুকা’র বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তা তো আপনার জানা আছে।’ মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবন সুলুলও একই রকম কথা বললো। আসলে তারা রাসূলুল্লাহর সা. পক্ষ থেকে বনী কুরায়জার ব্যাপারে কোন কঠিন দন্ডের আশংকা করছিল। রাসূল সা. বললেনঃ ‘ওহে আউস গোত্রের লোকেরা! তোমাদের গোত্রের কেউ একজন তাদের ব্যাপারে ফায়সালা দিলে তোমরা কি তাতে খুশী হবে?’ তারা বললোঃ হ্যাঁ, খুশী হবো।’ রাসূল সা. বললেনঃ ‘তাদের ব্যাপারে সা’দ ইবন মু’য়াজ রায় দেবে।’
বনী কুরায়জার ভাগ্য নির্ধারণের জন্য রাসূল সা. এভাবে সা’দ ইবন মু’য়াজকে বিচারক নিয়োগ করলেন। সা’দ তো তখন আহত অবস্থায় দারুণ অসুস্থ। আউস গোত্রের লোকেরা উটের পিঠে গদি বসিয়ে তার ওপর সা’দকে উঠিয়ে রাসূলের সা. নিকট নিয়ে গেল। তারা সা’দকে বললোঃ ‘আবু ’আমর! আপনার মিত্রদের সাথে একটু ভালো আচরণ করবেন। সম্ভবতঃ এ জন্যই রাসূল সা. আপনাকে বিচারক মনোনীত করেছেন।’ তারা বেশী বাড়াবাড়ি শুরু করলে সা’দ বললেনঃ ‘আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন নিন্দুকের নিন্দার বিন্দুমাত্র পরোয়া সা’দের নেই।’ সা’দ যখন রাসূলের সা. নিকট পৌঁছুলেন তখন রাসূল সা. আশেপাশে বসা আনসার ও মুহাজিরদের লক্ষ্য করে বললেনঃ ‘কু মু ইলা সায়্যিদিকুম- তোমাদের নেতার সম্মানার্থে তোমরা উঠে দাঁড়াও।’ সা’দের গোত্রের লোকেরা বিচারের ক্ষেত্রে একটু নমনীয় হওয়ার জন্য যখন আবারও পীড়াপীড়ি শুরু করলো তখন তিনি বললেনঃ ‘এ ব্যাপারে তোমাদের আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার ও চুক্তি অনুসরণ করা উচিত।’ তারপর রাসূল সা. সা’দকে লক্ষ্য করে বলেনঃ ‘এই লোকেরা তোমার রায়ের অপেক্ষায় আছে।’ সা’দ বললেন, ‘আমি আমার রায় ঘোষণা করছিঃ তাদের মধ্যে যারা যুদ্ধ করার উপযুক্ত তাদেরকে হত্যা করা, তাদের নারী ও শিশুদেরকে দাস-দাসীকে পরিণত করা এবং তাদের ধন-সম্পদ বন্টন করে দেওয়া হোক।’ তাঁর এই রায় শুনে রাসূল সা. বলেনঃ ‘সাত আসমানের ওপর থেকে আল্লাহ যে ফায়সালা দিয়েছেন তুমিও ঠিক একই ফায়সালা দিয়েছ।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৩৯, ২৪০; উসুদুল গাবা- ২/২৯৭; আল-ইসাবা- ২/৩৮)
বনী কুরায়জার ব্যাপারে সা’দের রায় বাস্তবায়িত হওয়ার পর অল্প কিছু দিন তিনি জীবিত ছিলেন। একদিন রাসূল সা. নিজ হাতে তাঁর ক্ষতে সেঁক দেন। তাতে রক্ত ঝরা বন্ধ হয়ে ফুলে যায়। হঠাৎ একদিন ক্ষতটি ফেটে তীব্র বেগে রক্ত ঝরতে থাকে। ইবন ‘আব্বাস বলেনঃ যখন সা’দের ক্ষত থেকে রক্ত প্রবাহ শুরু হয় তখন রাসূল সা. দৌড়ে এসে তাঁর মাথাটি কোলের ওপর উঠিয়ে নেন। সা’দের রক্তে রাসূলের সা. চেহারা ও দাড়ি ভিজে যায়। রাসূল সা. একটি সাদা চাদর দিয়ে তাঁর দেহটি ঢেকে দেন। চাদরটি এত ছোট ছিল যে, মাথা ঢাকলে পা এবং পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে যাচ্ছিল। সা’দ ছিলেন ফর্সা মোটা মানুষ। রাসূল সা. তখন সা’দের জন্য দু’আ করেন এই বলেনঃ ‘হে আল্লাহ! সা’দ তোমার রাস্তায় জিহাদ করেছেন, তোমার নবীকে সত্য বলে বিশ্বাস করেছে এবং তাঁর পথে চলেছে। তুমি তাঁর রূহকে সর্বোত্তমভাবে কবুল কর।’ রাসূলের সা. এই দু’আ শুনে সা’দ চোখ খোলেন এবং বলেনঃ ‘আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ।’ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর রাসূল। (তাবাকাত- ৩/৪২৬; হায়াতুস সাহাবা- ২/৪৫৭)
হযরত সা’দ ইনতিকাল করলেন। ইবন ইসহাক বলেনঃ ‘সা’দ ইবন মু’য়াজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পর রাতের বেলা একটি রেশমী পাগড়ী মাথায় বেঁধে জিবরীল আ. রাসূলুল্লাহর সা. নিকট এসে বলেনঃ ‘ইয়া মুহাম্মদ! এ মৃত ব্যক্তিটি কে, যার জন্য আসমানের সবগুলি দরযা খুলে গেছে এবং ’আরশ কেঁপে উঠেছে?’ রাসূল সা. কাপড় টানতে টানতে খুব দ্রুত সা’দের নিকট গিয়ে দেখলেন, তিনি ইনতিকাল করেছেন। (তাবাকাত- ৩/৪৩২; সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৫০, ২৫১)
রাসূল সা. সা’দের মাথাটি কোলের মধ্যে নিয়ে বসে থাকলেন। তখনও তাঁর হাত থেকে রক্ত ঝরছিল। চতুর্দিক থেকে মানুষ ছুটে আসতে লাগলো। আবু বকর রা. দৌড়ে এসে লাশ দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। রাসূল সা. তাঁকে এমনটি করতে নিষেধ করলেন। ’উমার রা. কাঁদতে কাঁদতে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠ করলেন। গোটা তাঁবুতে একটি কান্নার রোল পড়ে গেল। সা’দের দুখিনী মা কাঁদতে কাঁদতে একটি কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। ’উমার রা. তাঁকে কবিতা পড়তে নিষেধ করলেন; কিন্তু রাসূল সা. বললেনঃ থাক, তাকে পড়তে দাও। অন্য বিলাপ কারিনীরা মিথ্যা বলে থাকে; কিন্তু সা’দের মা সত্য বলছে।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৫২; তাবাকাত- ৩/২২৮, ২২৯)
হযরত রাসূলে কারীম সা. সা’দের মৃত্যুর পর তাঁর বাড়ীতে যাচ্ছিলেন। সাহাবীরাও সংগে ছিলেন। তিনি এত দ্রুত চলছিলেন যে, সাহাবীরা তাঁর অনুসরণ করতে গিয়ে অক্ষম হয়ে পড়ছিলেন। একজন তো বলেই বসলেন; ‘আপনি এত দ্রুত চলছেন কেন? আমরা তো রীতিমত ক্লান্ত হয়ে পড়ছি।’ রাসূল সা. বললেনঃ ‘আমার ভয় হচ্ছে, আমাদের আগেই ফিরিশ্তারা তাকে গোসল না দিয়ে ফেলে, যেমন দিয়েছিল হানজালাকে।’ (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫৪৫)
রাসূল সা. সা’দের জানাযার সাথে গোরস্তানে গিয়েছিলেন। মুনাফিকরাও গিয়েছিল। তাঁর লাশ হালকা বোধ হচ্ছিলো। এজন্য মুনাফিকরা বলাবলি করছিল, এমন হালকা লাশ তো আমরা আর কখনও দেখিনি। সম্ভবতঃ বনী কুরায়জার ব্যাপারে সে যে রায় দিয়েছিল, এটা তারই কুফল। কথাটি রাসূলুল্লাহর সা. কানে গেলে তিনি বললেন, ‘যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর নামে শপথ! ফিরিশতাকুল তাঁর খাটিয়া বহন কেরছে।’ ইবন ’উমার রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. আরও বললেনঃ ‘নিশ্চয় এই সা’দ অতি নেক্কার বান্দা। তার জন্য আল্লাহর ’আরশ দুলে উঠেছে, আসমানের দরযাসমূহ খুলে গেছে এবং তাঁর জানাযায় এমন ৭০ হাজার ফিরিশতা যোগদান করেছে যারা এর আগে আর কখনও পৃথিবীতে আসেনি।’ (তাবাকাত- ৩/৪৩০; উসুদুল গাবা- ২/২৯৭, সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৫১)
ইবন ইসহাক জাবির থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ ‘সা’দকে দাফনের সময় আমরা রাসূলুল্লাহর সা. সাথে ছিলাম। তিনি প্রথমে, একবার জোরে ‘সুবহানাল্লাহ’ উচ্চারণ করলেন। লোকেরাও তাঁর সাথে ‘সুবহানাল্লাহ’ পড়লেন। তারপর তিনি ‘তাকবীর’ ধ্বনি দিলেন, লোকেরাও ‘তাকবীর’ দিল। লোকেরা জিজ্ঞেস করলোঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! এভাবে ‘তাসবীহ’ পড়লেন কেন? বললেনঃ এ নেক্কার লোকটির কবর বড় সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর আল্লাহ পাক প্রশস্ত করে দিয়েছেন।’ (তাবাকাত- ৩/৪৩২; সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৫১, ২৫২)
হযরত সা’দকে দাফনের পর রাসূলে কারীমকে সা. দারুণ বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। চোখ দিয়ে ক্রমাগতভাবে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। আল-ইস্তীয়াব গ্রন্থকার বলেছেনঃ ‘খন্দক যুদ্ধের একমাস এবং বনী কুরায়জার ঘটনার কয়েক রাত্রি পর হিজরী পঞ্চম সনে সা’দের ওফাত হয়।’ (টীকাঃ আল-ইসাবা- ২/২৮)
মদীনার বাকী গোরস্তানে তাঁকে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। (আল-আ’লাম- ৩/১৩৯) ইবন ইসহাক তাঁকে খন্দক যুদ্ধে বনী ’আবদিল আশহালের শাহাদাত প্রাপ্তদের মধ্যে গণ্য করেছেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৫২)
হযরত সা’দের ওফাতের ঘটনাটি ছিল ইসলামের ইতিহাসের এক অসাধারণ ঘটনা। তিনি ইসলামের খিদমতে যে অবদান রাখেন এবং তাঁর মধ্যে যে ঈমানী চেতনা বিদ্যমান ছিল, তার জন্য তাঁকে আনসারদের ‘আবু বকর’ বলে গণ্য করা হতো। ‘ইফক’ বা হযরত আয়িশার প্রতি মিথ্যা অপবাদের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একদিন রাসূল সা. ক্ষোভের সাথে বললেনঃ ‘এ আল্লাহর দুশমন (আবদুল্লাহ ইবন উবাই, মুনাফিক সর্দার) আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে এর প্রতিবিধান করতে পারে? ’সাথে সাথে সা’দ উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেনঃ ’আউস গোত্রের কেউ থাকলে আমাকে বলুন, আমরা তার গর্দান উড়িয়ে দিচ্ছি। আর যদি আমাদের ভাই খাযরাজীদের কেউ হয়, আমাদেরকে নির্দেশ দিন, আমরা আপনার নির্দেশ বাস্তবায়ন করবো।’ (শাহীরাতুন নিসা ফিল ’আলম আল-ইসলামী- ৫৯) তাঁর মৃত্যুর ঘটনাটি যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বুঝা যায় তাঁর জানাযায় ফিরিশতাদের অংশগ্রহণ এবং আল্লাহর ’আরশ কেঁপে উঠার মাধ্যমে। তাই একজন আনসারী কবি গর্ব করে বলেছিলেনঃ ‘একমাত্র সা’দ আবু ’আমরের মৃত্যু ছাড়া আর কোন মরণশীলের মৃত্যুতে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছে, এমন কথা আমরা কখনও শুনিনি।’ এমনিভাবে রাসূলুল্লাহর সা. দরবারী কবি হাস্সান ইবন সাবিতও তাঁর অনেক কবিতায় সা’দের প্রতি শ্রদ্ধা ও শোক জ্ঞাপন করেছেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৫২, ২৬৯, ২৭০, ২৭২)
হযরত সা’দ ছিলেন ফর্সা, দীর্ঘদেহী, সুদর্শন পুরুষ। মৃত্যুকালে ’আমর ও আবদুল্লাহ নামে দুই ছেলে রেখে যান। তাঁরা দু’জনই বাই’য়াতে রিদওয়ানে শরীক হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তাঁদের মা হিন্দা বিনতু সাম্মাকও ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. সম্মানিত সাহাবিয়্যা। (তাবাকাত- ৪২০, ৪৩৩)
মদীনায় ইসলামের প্রথম ভাগেই হযরত সা’দের ওফাত হয়। জীবনের মাত্র পাঁচটি বছর রাসূলুল্লাহর সা. সাহচর্য লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন। এ অল্প সময়ে তিনি হয়তো বহু হাদীস শুনে থাকবেন; কিন্তু হাদীস বর্ণনার সিলসিলা যেহেতু রাসূলুল্লাহর সা. দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার পর শুরু হয়, এ কারণে তাঁর বর্ণনা প্রচারিত হয়নি। তবে সহীহ বুখারীতে ’আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদের একটি বর্ণনা এসেছে যাতে সা’দের ’উমরার কথা আছে এবং উহুদে সা’দ ইবন রাবী’র শাহাদাতের ঘটনা প্রসঙ্গে আনাস রা. তাঁর থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। এটাও বুখারীতে এসেছে। (তাহজীব আত-তাহজীব- ৩/৪৮২)
নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে হযরত সা’দ ইবন মু’য়াজ ছিলেন অতি উঁচুমানের লোক। ’আয়িশা রা. বলেনঃ ‘রাসূলুল্লাহর সা. পরে বনী ’আবদুল আশহালে তিন ব্যক্তি থেকে উত্তম আর কেউ নেই। তাঁরা হলেনঃ সা’দ ইবন মু’য়াজ, উসাইদ ইবন হুদাইর ও ’আব্বাদ ইবন বিশর।’ (আল-ইসাবা- ২/৯৭) সা’দ নিজেই বলতেনঃ আমি একজন সাধারণ মানুষ, তবে তিনটি বিষয়ে যে পর্যন্ত পৌঁছানো উচিত, আমি সেখানে পৌঁছেছি। ১. রাসূলুল্লাহর সা. মুখ থেকে যে বাণী আমি শুনি তা সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে বলে বিশ্বাস করি। ২. নামাযের মধ্যে অন্য কোন চিন্তা আমার মনে জাগে না। ৩. মৃত ব্যক্তির জানাযার কাছে থাকলে মুনকির- নাকীরের প্রশ্নের চিন্তা ছাড়া আমার মধ্যে আর কিছু থাকে না। (টীকাঃ আল ইসতীয়াব; আল ইসাবা- ২/৩৩; তাহজীব আত তাহজীব- ৩/৪৮২)
হযরত সা’দের ’আমলের ওপর হযরত রাসূলে কারীমের সা. যে দারুণ আস্থা ছিল সে কথা একটি হাদীসে জানা যায়। হযরত ’আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সা. বলেছেনঃ ‘কবরের একটি চাপ অবশ্যই আছে। যদি কেউ এই চাপ থেকে রেহাই পেয়ে থাকে, তাহলে সে সা’দ ইবন মু’য়াজ।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৫২; তাবাকাত- ৩/২৫২; তাবাকাত- ৩/৪৩২। তাছাড়া ইমাম আহমাদ ও বায়হাকীও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
কিন্দার রাজা উকাযদারকে খালিদ ইবন ওয়ালীদ বন্দী করে মদীনায় নিয়ে এলেন। তার মূল্যবান পোশক দেখে, মতান্তরে রাসূলকে সা. উপহার দেওয়া একখানা কাপড় দেখে সাহাবীরা অভিভূত হয়ে গেলেন। তাঁদের এ অবস্থা দেখে রাসূল সা. বললেনঃ ‘তোমরা এই দেখে অবাক হচ্ছো? জান্নাতে সা’দ ইবন মু’য়াজের রুমালগুলিও এর থেকে সুন্দর হবে।’ (আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৮৩; তাবাকাত- ৩/৪৩৬; উসুদুল গাবা- ২/২৯৭; উবন হিশাম- ২/৫২৬; সহীহ বুখারী- ১/৫৩৬)
আবু সা’ঈদ আল-খুদরী রা. বলেনঃ ‘যাঁরা বাকী গোরস্তানে সা’দের কবর খুঁড়েছিল আমি তাঁদের একজন। আমরা কবরের মাটি খোঁড়ার সময় মিশকের ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। শুরাহবীল ইবন হাসানা বলেনঃ এক ব্যক্তি সা’দের কবরের মাটি থেকে এক মুঠ মাটি নিয়ে ঘরে রেখে দেয়। কিছুদিন পরে সে দেখে, তা মাটি নয়; বরং মিশ্ক। (তাবাকাত- ৩/৪৩১; হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫৯৫)

সা’দ ইবন ’উবাদা (রা)
আসল নাম সা’দ, ডাকনাম আবু কায়স ও আবু সাবিত। প্রথমটি অধিকতর প্রসিদ্ধ। (উসুদুল গাবা- ২/২৮৩) লকব বা উপাধি সায়্যিদুল খাযরাজ। মদীনার বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের ‘সায়িদাহ’ শাখার সন্তান। পিতার নাম ’উবাদা ইবন দুলাইম এবং মাতার নাম ’উমরা বিন্তু মাস’উদ। ’উমরা সাহাবিয়্যা (মহিলা সাহাবী) ছিলেন এবং হিজরী ৫ম সনে ইন্তিকাল করেন। সা’দ তখন রাসূলুল্লাহর সা. সাথে ‘দুমাতুল জান্দাল’ যুদ্ধে যোগদানের জন্য মদীনার বাইরে। মদীনায় ফিরে রাসূল সা. তাঁর মার কবরে যান এবং তাঁর জন্য দু’আ করেন। (তাবাকাত- ৩/৬১৪; আল-ইসাবা- ২/৩০)
হযরত সা’দের সম্মানিত দাদা ‘দুলাইম’ ছিলেন খাযরাজ গোত্রের সবচেয়ে বড় নেতা। তাছাড়া মদীনার জনকল্যাণমূলক কাজেও তাঁর খ্যাতি ছিল। সায়িদাহ খান্দানের সম্মান ও গৌরব মূলতঃ তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন পৌত্তলিক। দেবী ‘মানাত’- এর পূজা করতেন। এ দেবীর মূর্তি ছিল মক্কার নিকটে ‘মুসালাল্’ নামক স্থানে। তিনি প্রতি বছর সেখানে দশটি উট বলি দিতেন। তাঁর মৃত্যুর পর ’উবাদা, তারপর সা’দ ইসলাম গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত এ কাজ অব্যাহত রাখেন। ইসলামী যুগে সা’দের ছেলে কায়স পূর্ব পুরুষের ধারা বজায় রেখে উটগুলি কা’বার চত্বরে কুরবানী করতেন। একবার হযরত আবু ’উবাইদা ও হযরত ’উমার রা. কায়সকে এ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করে; কিন্তু কায়স তাঁদের কথার প্রতি মোটেও কর্ণপাত করেননি। তাঁরা কায়সের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট অভিযোগ করেন। তখন রাসূল সা. বলেনঃ কায়স তো দানশীল পরিবারের সন্তান। (আল-ইসতীয়াবঃ টীকা আল-ইসাবা- ২/৩৭)
সা’দের পিতা ’উবাদা ছিলেন পিতার যোগ্য উত্তরসূরী। পিতার মত একইভাবে জীবন কাটিয়ে ছেলে সা’দের জন্য ক্ষমতা ও নেতৃত্বের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করে যান। ছেলেকে তিনি পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলেন। ‘সা’দ’ সেই জাহিলী আরবেই ‘কামিল’ উপাধি লাভ করেন। কারণ, তৎকালীন আরবে হাতে গোনা যে ক’জন লোক আরবী লিখতে জানতো, তিনি ছিলেন তাদের একজন। তাঁর আরবী লেখা ছিল চমৎকার। তাছাড়া তিনি ছিলেন সে সময়ের আরবের একজন শ্রেষ্ঠ সাঁতারু ও দক্ষ তীরন্দাজ। আর এ বিদ্যাগুলি যারা বিশেষভাবে রফ্ত করতো আরববাসী শুধু তাদেরকেই ‘কামিল’ উপাধি দিত। (দ্রঃ তাহজীব আত-তাহজীব- ৩/৪৭৫; আল ইসাবা- ২/৩০; তাবাকাত- ৩/৬১৩)
শেষ ’আকাবার বাই’য়াতের সময় সা’দ ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত রাসূলে কারীম সা. তাঁকে বনী সায়িদার ‘নাকীব’ (দায়িত্বশীল) নিয়োগ করেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৫০; উসুদুল গাবা- ২/২৮৩) তাঁকে উঁচু স্তরের সাহাবী গণ্য করা হতো। বুখারী শরীফে তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘ওয়া কানা জা কিদামিন ফিল ইসলাম’- ইসলামে তিনি ছিলেন প্রথম স্তরের মানুষ।
’আকাবার শেষ বাই’য়াত যেভাবে সম্পন্ন হয়, আনসারদের যে সংখ্যক মানুষ তাতে অংশগ্রহণ করেন এবং যে সকল গুরুত্বপূর্ণ শর্তের ওপর তা অনুষ্ঠিত হয় তাতে তা গোপন থাকা সম্ভব ছিল না। যদিও তা রাতের অন্ধকারে গোপনে হয়েছিল। কারণ, রাসূলকে সা. নিয়ে কুরাইশদের চিন্তার অন্ত ছিল না। তারা সর্বক্ষণ তাঁর প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতো। সুতরাং রাতের যে লগ্নে রাসূল সা. ’আকাবার মদীনা থেকে আগত লোকদের নিকট থেকে বাই’য়াত গ্রহণ করেন, ঠিক সেই সময়ে; কেউ একজন মক্কার ‘জাবালে আবু কুরাইসের ওপর দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলেছিল; ‘দেখ সা’দ যদি মুসলমান হয়ে যায় তাহলে মুহাম্মাদ একেবারেই নির্ভীক হয়ে যাবে।’ (দ্রঃ উসুদুল গাবা- ২/২৮৪; আল ইসতীয়াব; আল ইসাবা- ২/৩৭)
এ আওয়ায কুরাইশদের কানে পৌঁছালেও প্রথমে তারা বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। তারা সা’দ বলতে ‘কাদায়া’ ও তামীম গোত্রের সা’দ নামের লোকগুলিকে বুঝেছিল। পরের রাতে ঐ পাহাড় থেকে আবার একটি কবিতার কিছু চরণ আবৃত্তি করতে শোনা গেল। তাতে পরিষ্কার ভাবে সা’দের নাম ও পরিচয় ছিল। কুরাইশরা দারুণ বিস্ময়ের মধ্যে পড়ে গেল। বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য তারা ‘দারুন নাদওয়া’ বা পরামর্শ গৃহে সমবেত হলো। তারা মদীনার আউস গোত্রের সর্দার আবদুল্লাহ ইবন ’উবাই ইবন সুলুলের সাথে কথা বললো, কিন্তু সে বিষয়টি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা প্রকাশ করলো। কুরাইশরা চারিদিকে গোয়েন্দা নিয়োগ করে যার যার মত বাড়ীতে ফিরে গেল। আর মদীনাবাসী মুসলমানরা ‘ইয়াজজ’- এর পথে স্বদেশ অভিমুখে যাত্রা করলো।
ইবন ইসহাক ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ ‘নাকীবগণ ’আকাবার রাতে রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাই’য়াত শেষ করে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। কেউ কেউ মক্কা ছেড়ে স্বদেশের পথ ধরলো। এদিকে বাই’য়াতের কথা লোকমুখে প্রচার হয়ে গেল। খোঁজ-খবর নিয়ে কুরাইশরা বুঝতে পারলো, ব্যাপারটি সত্য। তারা বাই’য়াতকারীদের ধরার জন্য বেরিয়ে পড়লো এবং সু’দ ইবন ’উবাদা ও আল মুনজির ইবন ’উমারকে পেয়ে গেল। তবে সা’দকে ধরতে পারলেও আল মুনজির ইবন ’উমার পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। সা’দের মাথার চুল ছিল লম্বা। তারা সেই চুল ধরে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে চললো। সা’দ বলেনঃ আল্লাহর কসম! আমি তাদের হাতে বন্দী। কুরাইশদের কয়েকজন লোক আমার কাছে আসলো। তাদের মধ্যে একজন উজ্জ্বল সুদর্শন যুবককে দেখে আমি ভাবলাম, যদি এ সম্প্রদায়ের কারও মধ্যে ভালো কিছু থাকে তাহলে হয়তো এর মধ্যেই আছে। সে ছিল সুহাইল ইবন ’আমর। কিন্তু সে আমার আশার মুখে ছাই দিয়ে কাছে এগিয়ে এসে আমার গায়ে জোরে এক ঘুষি বসিয়ে দিল। আমি তখন মনে মনে বললাম; আল্লাহর কসম! এরপর এ সম্প্রদায়ের অন্য কারও কাছে ভালো কিছু আশা করা বৃথা। একজন প্রশ্ন করলো; তুমি কি মুহাম্মাদের দীন কবুল করেছ? আমি বললাম; হাঁ, কবুল করেছি। তখন তাঁরা আমাকে দড়ি দিয়ে কষে বাঁধলো। এসময় একজন আমার উরুতে টোকা মেরে বললোঃ কুরাইশদের কারও সাথে তোমার কি কোন চুক্তি আছে? বললামঃ হাঁ আছে। মুতয়িম ইবন ’আদী ও আল-হারিস ইবন উমায়্যা যখন আমাদের আবাসভূমিতে যায়, আমি তাদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকি। সে বললোঃ তোমার বাপ নিপাত যাক। শিগগিরই তাদের নাম ধরে জোরে জোরে সাহায্য চাও। আমি তাই করলাম। লোকটি ছুটে তাদের দু’জনের কাছে গিয়ে বললোঃ কুরাইশদের কয়েক ব্যক্তি যে লোকটিকে বন্দী করে মারধোর ও অপমান করছে সে তোমাদের দু’জনের নাম ধরে ডাকছে। সে বলছে, তোমাদের সাথে নাকি তার মৈত্রী চুক্তি আছে। তারা জিজ্ঞেস করলোঃ লোকটি কে? সে বললোঃ সা’দ ইবন ’উবাদা। তারা বললোঃ সে সত্য বলেছে। তারপর মুতয়িম ইবন ’আদী ও আল হারিস ইবন উমায়্যা ছুটে এসে তাদের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করে মদীনার পথ ধরিয়ে দেয়।’
এই মুতয়িম ইবন আদী ছিলেন মক্কার এক অতি ভদ্র ও সম্মানিত ব্যক্তি। ইসলামের সূচনা পর্বে মক্কায় তিনি রাসূলকে সা. নানাভাবে সাহায্য করেছেন। আর যে ব্যক্তি তাকে খবর দিয়েছিল, সে ছিল আবুল বাখতারী ইবন হিশাম।
যাইহোক, সা’দ এভাবে বন্দী হওয়ায় মদীনা অভিমুখী আনসারদের কাফেলায় দারুণ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। তারা পরামর্শ বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়, জীবনের ঝুঁকি থাকলেও মক্কায় ফিরে সা’দের সন্ধান নিতে হবে। এর মধ্যে সা’দকে ফিরে আসতে দেখা গেল। তারা তাঁকে সংগে করে সোজা মদীনার পথ ধরলো। (দ্রঃ তারীখু ইবন ’আসাকির- ৬/৮৫, ৮৬; আনসাবুল আশরাফ- ১/২৫৪, ২৫৫; সীরাতু ইবন হিশাম- ১/১৫০, ১৫১; তাবাকাত- ১/১৫০)
সা’দের বন্দীর বিষয়টি নিয়ে কুরাইশ পক্ষের কবি দারবার ইবনুল খাত্তাব ইবন মিরদাস একটি কবিতা রচনা করে। কবি হাস্সান ইবন সাবিত তার জবাবে বড় একটি কবিতা লেখেন। তাতে সা’দের প্রশংসা ও কুরাইশদের নিন্দা করা হয়েছে। আনসাবুল আশরাফ ও সীরাতু ইবন হিশামসহ বিভিন্ন গ্রন্থে তার কিছু অংশ সংকলিত হয়েছে। (দ্রঃ আনসাবুল আশরাফ- ১/২৫৫; সীরাতু ইবন হিশাম- ১/১৫০, ১৫১)
উপরোক্ত ঘটনার কয়েক মাস পর রাসূল সা. মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করেন। এ উপলক্ষে মদীনার প্রতিটি অলি-গলিতে আনন্দ উৎসবের বন্যা বয়ে যায়। তিনি আবু আইউবের বাড়ীতে পৌঁছতেই সেখানে হাদিয়া তোহফা আসা শুরু হয়ে যায়। হযরত সা’দ তাঁর বাড়ী থেকে বড় এক পাত্র সারীদ ও ’উরাক পাঠিয়ে দেন। (তাবাকাত- ১/১৬১)
হিজরাতের কয়েক মাস পর থেকে ইসলামী আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করতে থাকে। হিজরাতের দ্বাদশ মাস সফরে হযরত রাসূলে কারীম সা. কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য ছোট্ট একটি বাহিনী নিয়ে মক্কার দিকে ‘আবওয়া’ নামক স্থানে যান। এটাকে ‘ওয়াদ্দান’ অভিযানও বলা হয়। এ বাহিনীতে কোন আনসার মুজাহিদ ছিল না। এ সময় পনেরোটি রাত রাসূল সা. মদীনার বাইরে ছিলেন। তিনি সা’দ ইবন ’উবাদাকে স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে মদীনায় রেখে যান। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৮৭; তাবাকাত- ১/৩)
হিজরী দ্বিতীয় সনে ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে হযরত সা’দের অংশ গ্রহণের ব্যাপারে সীরাত বিশেষজ্ঞদের দারুণ মতভেদ আছে। ইয়াকুব ইবন সুফইয়ান, মূসা ইবন ’উকবা, খলীফা ইবন খায়্যাত, আল ওয়াকিদী, আল মাদায়িনী, ইবনুল কালবী প্রমুখ সীরাত বিশেষজ্ঞ তাঁকে বদরী যোদ্ধা বলে উল্লেখ করেছেন। আবু আহমাদ তাঁর ‘আল কুনা’ গ্রন্থে বলেছেন, তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সাথে বদরে অংশগ্রহণ করে। (দ্রঃ উসুদুল গাবা- ২/২৮৩; আল ইসতীয়াব; আল ইসাবা- ২/৩৬; তারীখ ইবন ’আসাকির- ৬/৮৪, ৮৫) পক্ষান্তরে ইবন ইসহাক তাঁকে বদরী যোদ্ধাদের মধ্যে উল্লেখ করেননি। ইবন সা’দ ও বালাজুরী বলেনঃ সা’দ বদরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। কিন্তু যাত্রার প্রাক্কালে তাঁকে কুকুরে কামড়ায়। এ কারণে তিনি যেতে পারেননি। রাসূল সা. তাঁর সম্পর্কে বলেনঃ যদিও সা’দ বদরে হাজির হয়নি, তবে সে যাওয়ার জন্য আগ্রহী ছিল। কোন কোন বর্ণনা মতে রাসূল সা. তাঁকে বদরের গনীমতের অংশ দিয়েছিলেন। ইবন আসাকির বলেন, এটা সর্বসম্মত ও প্রমাণিত নয়। (দ্রঃ তাকরীবুত তাহজীব- ১/২৮৮; উসুদুল গাবা- ২/২৮৩, আল ইসাবা- ২/৩০; তারীখ ইবন ’আসাকির ৬৮৪, ৮৫) ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম সা’দের বদরে অংশগ্রহণের বিষয়টি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। তবে এটাই সঠিক যে, তিনি বদরে শরীক হননি। আল্লামা ইবন হাজার ’আসকিলানীর মতও এটাই। তিনি ইমাম মুসলিমের ভাষা দ্বারা নিজ মতের স্বপক্ষে খুব সূক্ষ্ণভাবে প্রমাণ গ্রহণ করেছেন। (দ্রঃ ফাতহুল বারী- ৫/২২৪)
বদর যুদ্ধ ছিল রাসূলুল্লাহর সা. জীবনের যুদ্ধগুলির মধ্যে প্রথম এবং সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। এর পূর্বে যদিও চারটি গাযওয়া ও চারটি সারিয়্যা সংঘটিত হয়েছিল, কিন্তু তাতে কোন আনসারী সৈনিক অংশগ্রহণ করেনি। এর নানা কারণ থাকতে পারে। একটি এই হতে পারে যে, ’আকাবার বাই’য়াতের সময় আনসারদের পক্ষ থেকে শুধু এ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে, যারা মদীনা আক্রমণ করবে শুধু তাদেরকেই তারা প্রতিরোধ করবে। মদীনার বাইরে কোন সংঘাত হলে সে বিষয়ে তাদের ভূমিকা কী হবে তার কোন উল্লেখ তাতে ছিল না। আরেকটি কারণ এই হতে পারে যে, রাসূল সা. প্রথমত মদীনার মূল বাসিন্দাদেরকে কুরাইশদের শত্রু হিসেবে দাঁড় করাতে চাননি।
অতএব রাসূল সা. যখন বদরে যাত্রার মত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে যাবেন তখন আনসারদের সথে পরামর্শ করা ও তাদের মতামত গ্রহণ প্রয়োজন মনে করেন। মদীনার সকল গোত্রের লোকদের একটি বৈঠকে ডাকা হলো। সেখানে যুদ্ধের বিষয়টি উঠলো। হযরত আবু বকর রা. উঠে তাঁর মতামত পেশ করলেন। হযরত ’উমার রা. কিছু বলার জন্য উঠলেন, কিন্তু রাসূল সা. তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন না। সেই বৈঠকে হযরত সা’দ ইবন ’উবাদাও ছিলেন। তিনি বুঝলেন, রাসূল সা. তাঁদের মতামত চাচ্ছেন। তিনি বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল। যার হাতে আমার জীবন, তাঁর জাতের কসম, আপনি যদি আমাদেরকে সমুদ্র অভিযানের নির্দেশ দেন, আমরা তা দলিত মথিত করে ছাড়বো। আর যদি শুকনো মাটিতে অভিযানের আদেশ দেন তাহলে ইয়ামনের ‘বারকে গিমাদ’ পর্যন্ত উট ছুটিয়ে নিয়ে যাব। (সহীহ মুসলিম- ২/৮৪; আল-বিদায়া- ৩/২৬৩; কানযুল ’উম্মাল- ৫/২৭৩; হায়াতুস সাহাবা- ১/৪২৪)
উল্লেখিত বর্ণনার ভিত্তিতে সীরাত লেখকদের অনেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, তিনি বদরে যোগদান করেছিলেন। অথচ সহীহ মুসলিমের এ বর্ণনাতেই উল্লেখ আছে সিরিয়া থেকে আবু সুফইয়ানের বণিজ্য কাফিলা আসার খবর যখন রাসূলুল্লাহ সা. পেলেন তখন তিনি পরামর্শ করেন। মূলতঃ এ বাণিজ্য কাফেলা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে রাসূল সা. মদীনা থেকে বের হন; যুদ্ধের উদ্দেশ্যে নয়। (মুসলিম- ২/৮৪) কিন্তু পরে তিনি জানতে পারেন, মক্কা থেকে কুরাইশ বাহিনী বদরের দিকে এগিয়ে আসছে। আর তখনই রাসূল সা. যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ কারণে মদীনাবাসীদের অনেকেই বুঝতে পারেননি যে, রাসূল সা. বদরে একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন। তাই তাদের অনেকে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে মদীনা থেকে বের হননি। আর তাদেরই একজন সা’দ ইবন ’উবাদা। (আনসাবূল আশরাফ- ১/২৮৮)
বদরের পর উহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মক্কার পৌত্তলিক শক্তি এমন তোড়জোড় সহকারে ধেয়ে আসে যে মদীনায় একটি ভীতির সঞ্জার হয়। গোটা মদীনায় সারা রাত পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। মদীনার কয়েকজন শ্রেষ্ঠ সন্তান যথা সা’দ ইবন মু’য়াজ, ’উসাইদ ইবন হুদাইর প্রমুখের সাথে তিনিও অস্ত্র হাতে রাসূলুল্লাহর সা. গৃহের হিফাজত দাঁড়িয়ে যান। তাঁরা সারা রাত মদীনা পাহারা দেন। শাওয়ালের ৬ তারিখ জুম’আর দিন যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। হযরত রাসূলে কারীম সা. আনসার গোত্র খাযরাজের পতাকাটি সা’দ ইবন ’উবাদার হাতে তুলে দেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৩১৪, ৩১৭) প্রস্তুতি শেষ হলে রাসূল সা. ঘোড়ায় সাওয়ার হয়ে বের হন। আউস ও খাযরাজ গোত্রের দুই নেতা সা’দ ইবন মুদয়াজ ও সা’দ ইবন ’উবাদা নিজ নিজ গোত্রের ঝান্ডা হাতে নিয়ে আগে আগে চললেন। মধ্যে রাসূল সা. এবং ডানে বাঁয়ে অন্যান্য আনসার-মুহাজির মুজাহিদগণ। এমন শান শওকাতে হযরত রাসূলে কারীমকে সা. বের হতে দেখে কাফির ও মুনাফিকরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়।
শনিবার উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে যুদ্ধ শুরু হলো। সংঘর্ষ এমন তীব্র ছিল যে, এক পর্যায়ে মুসলিম বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লো। তবে রাসুল সা. ময়দানে অটল থাকলেন। এ সময় মাত্র ১৪ ব্যক্তি নিজেদের জীবন বাজি রেখে লড়াই করেন এবং রাসূলুল্লাহর সা. সামনে থেকে কাফিরদের হটিয়ে দেন। অনেকের মতে ঐ ১৪ জনের একজন সা’দ ইবন ’উবাদা। (যারকানী- ২/৪০)
হিজরী ৫ম সনে সংঘটিত হয় বনী মুসতালিক বা মুরাইসী’র যুদ্ধ। এতে আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্রের ঝান্ডা তাঁরই হাতে অর্পণ করা হয়। (তাবাকাত, মাগাযী অধ্যায়- ৪৫) এ যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে উম্মুল মুমিনীন হযরত ’আয়িশাকে রা. কেন্দ্র করে একটি অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে। মুনাফিকরা সুযোগ পেয়ে যায়। তারা হযরত ’আয়িশার রা. চরিত্র সম্পর্কে কিছু অশোভন উক্তি করে এবং তাতে কিছু সরল মুসলমানও জড়িয়ে পড়ে। এ অপ্রত্যাশিত ঘটনায় রাসূল সা. ভীষণ কষ্ট পান এবং একটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। ইসলামের ইতিহাসে ঘটনাটি ‘ইফ্ক’ বা বানোয়াট কাহিনী নামে পরিচিত হয়েছে।
এই ‘ইফ্ক’- এর ঘটনার এক পর্যায়ে হযরত রাসূলে কারীম সা. মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলেন, আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবন সুলুল আমার পরিবারের প্রতি মিথ্যা কলঙ্ক আরোপ করেছে। এতে আমি দারুণ কষ্ট পেয়েছি। তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে এর প্রতিবিধান করতে পারে? সাথে সাথে আউস গোত্রের নেতা সা’দ ইবন মু’য়াজ বলে ওঠেন; আমি প্রস্তুত। আপনি যে হুকুম দেবেন তা পালন করবো। সে যদি আউস গোত্রের লোক হয় এখনই তার গর্দান উড়িয়ে দেওয়া হবে। আর খাযরাজ গোত্রের হলে আপনার নির্দেশ পালনের জন্য প্রস্তুত আছি। উল্লেখ্য যে প্রাচীন কাল থেকে আউস ও খাযরাজ এই দুই গোত্রের মধ্যে শত্রুতা ও রেষারেষি চলে আসছিল। প্রাক-ইসলামী যুগে তাদের মধ্যে বড় ধরনের অনেক যুদ্ধও হয়েছিল। ইসলাম তাদের সেই বৈরিতা দূর করে দেয়। তা সত্ত্বেও তাদের অন্তরে পূর্ব শত্রুতার কিছুটা রেশ বিদ্যমান ছিল। এ কারণে সা’দ ইবন মু’য়াজের কথায় খাযরাজ গোত্রের নেতা সা’দ ইবন ’উবাদা অপমান বোধ করেন। কথাটি তিনি সহজভাবে নিতে পারলেন না। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ওহে সা’দ ইবন মু’য়াজ! তুমি ঠিক বলোনি। তোমরা কক্ষনো খাযরাজকে হত্যা করতে পারবে না, তাদেরকে পরাভূত করতেও সক্ষম হবে না। যদি তোমার নিজ গোত্র আবদুল আশহালের ব্যাপারে হতো তাহলে তোমার মুখ থেকে এমন কথা বের হতো না। উসাউদ ইবন হুদাইর ছিলেন সা’দ ইবন মু’য়াজের খালাতো বা মামাতো ভাই। তিনি সা’দ ইবন ’উবাদাকে লক্ষ্য করে বললেন; আপনি এসব কী বলছেন। রাসূলুল্লাহর সা. নির্দেশ পেলে আমরা অবশ্যই তা পালন করবো। তারপর দুই গোত্র উত্তেজিতভাবে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। রাসূল সা. মিম্বরে ছিলেন। তিনি উত্তেজনা দূর করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। (ফাতহুল বারী- ৮/৩২; সহীহুল বুখারী- ৭/৩৩৫; সীয়ারে আনসার- ২/৩৩)
হিজরী ৫ম সনে খন্দক যুদ্ধের সময় মদীনার মুসলমানদের অবস্থা যখন অতি সঙ্কটজনক তখন হযরত রাসূলে কারীম সা. গাত্ফান গোত্রের দুই নেতা ’উয়াইনা ইবন হিস্ন ও আল হারিস ইবন ’আউফের সাথে একটি চুক্তি করার ইচ্ছা করলেন। তিনি তাদের সাথে এই শর্তে চুক্তি করতে চাইলেন যে, মদীনায় উৎপাদিত ফলের এক তৃতীয়াংশের বিনিময়ে তারা কুরাইশদের সাথে যোগ দিয়ে মদীনা আক্রমণ থেকে বিরত থাকবে। রাসুল সা. পরামর্শের জন্য সা’দ ইবন মু’য়াজ ও সা’দ ইবন ’উবাদাকে ডাকলেন। তাঁরা উপস্থিত হলে রাসূল সা. বললেন; আমি ’উয়াইনা ও আল হারিসকে মদীনায় উৎপাদিত ফলের এক তৃতীয়াংশ এই শর্তে দিতে চাই যে, তারা কুরাইশদের পক্ষ ত্যাগ করে ফিরে যাবে; কিন্তু তারা অর্ধেক দাবী করছে। এ ব্যাপারে তোমাদের মত কী?
সা’দ ইবন ’উবাদা বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ যদি ওহীর নির্দেশ হয় তাহলে তো দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই। আর তা যদি না হয় তাহলে তাদের দাবীর জবাব তো শুধু তরবারি। আল্লাহর কসম! আমরা তাদেরকে ফলের পরিবর্তে তরবারির ধার উপহার দেব।
রাসূল সা. বললেনঃ ‘ওহী নয়। ওহী হলে তো তোমাদের সাথে পরামর্শের কোন প্রশ্নই উঠতো না। সা’দ বললেনঃ ‘তাহলে তরবারির মাধ্যমে তাদেরকে জবাব দিতে হবে। জাহিলী যুগেও এমন অপমান আমরা চিন্তা করিনি। আর এখন তো আল্লাহ তা’য়ালা আপনার মাধ্যমে হিদায়াত দান করে আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। এখন দেব আমরা আমাদের ফসলের একাংশ তাদেরকে?’ রাসূল সা. তাঁদের দুই জনের সাথে আলোচনা করে খুব খুশী হলেন এবং তাঁদের জন্য দু’আ করলেন। তারপর সা’দ ইবন উবাদা খসড়া চুক্তি পত্রটি হাতে নিয়ে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেন। (দ্র্রঃ সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২২১-২২৩; উসুদুল গাবা- ২/২৮৪; আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৪৬, ৩৪৭; হায়াতুস সাহাবা- ২/৪৪, ৪৫) এই খন্দক যুদ্ধেও আনসারদের ঝান্ডা সা’দ ’উবাদার হাতে ছিল।
মদীনার ইহুদী গোত্র বনু নাদীরের অবরোধের সময় সা’দ ইবন উবাদা নিজ খরচে মুসলিম সৈনিকদের মধ্যে খেজুর বন্টন করেন। তেমনিভাবে বনু কুরাইজার অবরোধের সময় তিনি মুসলিম সৈনিকদের রসদপত্র সরবরাহ করেন। (দারিয়া-ই-মা’খারিফ ইসলামিয়্যা- ১১/৩২)
হিজরী ৬ষ্ঠ সনে রাসূল সা. ‘গাবা’ অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি সা’দকে ৩০০ সদস্যের একটি বাহিনীর অফিসার বানিয়ে মদীনার নিরাপত্তহার দায়িত্বে রেখে যান। ওয়াকিদী বর্ণনা করেনঃ গাবা অভিযানের সময় সা’দ ইবন ’উবাদা তাঁর গোত্রের তিন শো লোক নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. না ফেরা পর্যন্ত পাঁচ রাত্রি মদীনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। তাছাড়া রাসূল সা. যখন ‘জ্বিকারাদ’ নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন তখন সাহায্যের জন্য মদীনায় খবর পাঠান। হযরত সা’দ ইবন ’উবাদা দশটি উট বোঝাই করে খেজুর পাঠান। রাসূলুল্লাহর সা. এই বাহিনীতে সা’দের ছেলে কায়সও ছিলেন একজন অশ্বারোহী সৈনিক। তিনি পিতা প্রেরিত উট ও খেজুর যখন রাসূলুল্লাহর সা. নিকট পেশ করলেন তখন তিনি বললেনঃ হে কায়স! তোমার পিতা তোমাকে ঘোড় সওয়ার করে পাঠিয়েছেন, মুজাহিদদের শক্তিশালী করেছেন এবং শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য মদীনা পাহারা দিয়েছেন। তারপর তিনি দু’আ করেনঃ হে আল্লাহ! সা’দ ও তার পরিবার-পরিজনের ওপর রহম করুন! সা’দ ইবন ’উবাদা কতই না ভালো মানুষ। তখন খাযরাজ গোত্রের লোকেরা বলে ওঠেঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! তিনি আমাদের খান্দানের লোক, আমাদের নেতা এবং নেতার ছেলে। (তারীখে ইবন আসাকির- ৬/৮৮; তাবাকাতঃ মাগাযী- ৫৮)
হিজরী ৭ম সনে খাইবার যুদ্ধের সময় মুসলিম বাহিনীতে তিনটি ঝান্ডা ছিল। তার একটি ছিল সা’দ ইবন ’উবাদার হাতে। (তাবাকাতঃ মাগাযী- ৭৭) তাবুক যুদ্ধের সময় রাসূল সা. সাহাবায়ে কিরামের নিকট বস্তুগত সাহায্যের আবেদন জানালে অন্যদের মত সা’দ ইবন ’উবাদাও তাঁর হাতে বিপুল অর্থ তুলে দেন। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৪২১; দায়িরা-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা- ১১/৩২)
মক্কা বিজয়ের দিন খোদ রাসূলুল্লাহর সা. ঝান্ডাটি হযরত সা’দের হাতে ছিল। মুসলিম সৈনিকদের একটি দল ‘কাদায়া’র দিক দিয়ে শহরে প্রবেশ করছিল। আবু সুফইয়ান হযরত ’আব্বাসের সাথে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছিলেন। তিনি এর আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আনসারদের একটি দলের পুরোভাগে ছিলেন সা’দ ইবন ’উবাদা। তাদের দৃপ্ত ভঙ্গিতে চলা দেখে আবু সুফইয়ানের দু’ চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। তিনি ’আব্বাসকে জিজ্ঞেস করেনঃ এ কারা? আব্বাস জবাব দিলেনঃ আনসার। এদের কমান্ডার সা’দ ইবন ’উবাদা। ঝান্ডা তাঁরই হাতে।
সা’দ আবু সুফইয়ানের কাছাকাছি এসে তাঁকে লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন, ‘দেখবে আজ কেমন তুমুল যুদ্ধ হয়। আজ কা’বা হালাল (রক্তপাত বৈধ) হয়ে যাবে।’ একথা শুনে আবু সুফইয়ানের অন্তরে ভীতির সঞ্চার হয়। তিনি ’আব্বাসকে বলেন, ‘আজ তো তুমুল লড়াই হবে।’ সা’দের বাহিনী অতিক্রমের পরই রাসূলুল্লাহর সা. দলটি উপস্থিত হয়। তাঁকে দেখে আবু সুফইয়ান চেঁচিয়ে বলে উঠেনঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহর ওয়াস্তে আপনার সম্প্রদায়ের প্রতি সদয় হোন। আল্লাহ আপনাকে দয়ালু ও সৎকর্মশীল করে সৃষ্টি করেছেন। সা’দ আমাকে ভয় দেখিয়ে গেছে। আজ নাকি ঘোরতর যুদ্ধ হবে, কুরাইশদের বিনাশ ঘটবে। আবু সুফইয়ানের কথা সমর্থন করে আরও কয়েকজন একই কথা বললেন। অন্য একটি বর্ণনা মতে হযরত ’উমার সা’দের কথা শুনে তা রাসূলকে সা. অবহিত করেন। হযরত ’উসমান ও হযরত ’আবদুর রহমান ইবন ’আউফ বললেনঃ ‘আমাদের ভয় হচ্ছে, সা’দের মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে না ওঠে।’ দার্রার ইবন খাত্তাব আল-ফিহ্রী একটি কবিতা আবৃত্তিও করলেন। এক ব্যক্তি তাঁকে বললেন, রাসূলুল্লাহর সা. সামনে গিয়ে কবিতার মাধ্যমে ফরিয়াদ কর। দার্রারের সেই সব কবিতার অংশবিশেষ ‘আল-ইসতী’য়াব’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। তাঁর একটি কবিতার কয়েকটি পংক্তি নিম্নরূপঃ
‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নিকট কুরাইশরা এমন সময় আশ্রয় নিয়েছে যখন তাদের আর কোন আশ্রয় স্থল নেই, আর দুনিয়া প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও যখন তাদের জন্য শংকীর্ণ হয়ে পড়েছে এবং আসমানের আল্লাহ তাদের শত্রু হয়ে গেছে। সা’দ মক্কাবাসীদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে ফেলতে চেয়েছে।’
কবিতা শুনে রাসূল সা. বললেনঃ ‘সা’দ ঠিক বলেনি। আজ কা’বার সম্মান আরও বৃদ্ধি পাবে। তার গায়ে গিলাফ চড়ানো হবে।’ তিনি আলীকে রা. বললেন, ‘তুমি ছুটে যাও। সা’দের হাত থেকে ঝান্ডাটি নিয়ে তার ছেলে কায়সের হাতে দাও। আলী ছুটে গিয়ে ঝান্ডাটি চাইলেন। সা’দ তা দিতে অস্বীকার করে বললেন, সত্যিই যে রাসূল সা. তোমাকে পাঠিয়েছেন তার প্রমাণ কি? রাসূল সা. তাঁর পাগড়ীটি পাঠালেন। তখন সা’দ ঝান্ডাটি নিজের ছেলের হাতে তুলে দিলেন। কিন্তু যে আশঙ্কা সা’দকে নিয়ে ছিল, একই আশঙ্কা তাঁর ছেলেকে নিয়েও দেখা দিল। আবেদন জানানো হলোঃ সা’দের ছেলে কায়সের হাত থেকে ঝান্ডাটি অন্য কারও হাতে দেওয়া হোক। তখন রাসূল সা. ঝান্ডাটি নিয়ে যুবাইর ইবনুল ’আওয়ামের হাতে তুলে দেন। সহীহ বুখারীতে যে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহর সা. ঝান্ডা হযরত যুবাইর ইবনুল ’আওয়ামের হাতে ছিল, তার তাৎপর্য এটাই। (দ্রঃ সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৪০৬, ৪০৭; উসুদুল গাবা- ২/২৮৪; হায়াতুস সাহাবা- ১/১৬৯; আল-ইসতীয়াবঃ আল-ইসাবার পার্শ্ব টীকা- ২/৩৯; বুখারী- ২/৬১৩; ফাতহুল বারী- ৮/৭)
মক্কা বিজয়ের পর হুনাইন অভিযান পরিচালিত হয়। এতে খাযরাজ গোত্রের ঝান্ডা সা’দের হাতে ছিল। (তাবাকাতঃ মাগাযী- ১০৮) উল্লেখিত যুদ্ধগুলি ছাড়া রাসূলুল্লাহর সা. মদীনায় উপস্থিতির পর থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ছোট-বড় যত যুদ্ধ হয়েছে তার সবগুলিতে সা’দ অংশ গ্রহণ করেছিলেন, প্রতিটি অভিযানেই তিনি ছিলেন আনসারদের পতাকাবাহী।
হিজরী ১১ সনে হযরত রাসূলে কারীমের সা. ওফাত হয়। প্রাচীন কাল থেকে মদীনার মালিকানা ছিল আনসারদের। ইসলামের সূচনা পর্ব থেকেই তারা রাসূলকে সা. সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছিল। যে সময় ইসলামের কোন আবাসভূমি ছিল না, রাসূল সা. ব্যাকুল হয়ে একটি আশ্রয় খুঁজছিলেন, কুরাইশদের ভয়ে যখন আরবের কোন একটি গোত্র তাঁকে আশ্রয় দিতে দুঃসাহস করেনি তখন আনসারদের ৭২/৭৫ জনের একটি দল মক্কায় এসে আরব-আজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শর্তে রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাই’যাত (শপথ) করেন এবং সকল ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে রাসূলকে সা. মদীনায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান।
হযরত রাসূলে কারীমের সা. জীবনকালে যত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, তাতে জীবন ও সম্পদ কুরবানীর দিক দিয়ে আনসাররা ছিল সকলের অগ্রগামী। হযরত কাতাদা বলতেন, আরব গোত্রসমূহের মধ্যে কোন একটি গোত্র আনসারদের সমসংখ্যক শহীদ উপস্থাপন করতে পারবে না। আমি আনাসের নিকট শুনেছি, উহুদে সত্তর জন, বীরে মা’উনায় সত্তর জন এবং ইয়ামামায় সত্তর জন আনসার শাহাদাত বরণ করেন। (বুখারী- ২/৫৮৪; সীয়ারে আনসার- ২/২৭) তাছাড়া কুরআনের বহু আয়াত এবং রাসূলুল্লাহর সা. বহু হাদীসে আনসারদের অনেক ফজীলাত ও মর্যাদা ঘোষিত হয়েছে। এসব কারণে তাদের অন্তরে খিলাফতের নেতৃত্বলাভ করার আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হওয়া ছিল অতি স্বাভাবিক।
মদীনার আনসারগণ সেই প্রাচীনকাল থেকে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী দু’টি গোত্রে বিভক্ত ছিল। গোত্র দু’টি আউস ও খাযরাজ। লোকসংখ্যা ও নেতৃত্বের দিক দিয়ে খাযরাজ গোত্রটি ছিল তুলনামূলকভাবে একটু বেশী বরেণ্য। এর নেতা সা’দ ইবন ’উবাদা। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ সা. মনোনীত দ্বাদশ নাকীবের অন্যতম। অপর দিকে সা’দ ইবন মু’য়াজ ছিলেন আউস গোত্রের নেতা। তবে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. জীবনকালে উহুদ যুদ্ধের পর মদীনায় ইনতিকাল করেন। সুতরাং রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের সময় সা’দ ইবন ’উবাদা মদীনার আনসার সম্প্রদায়ের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা।
সা’দ ইবন ’উবাদার বাড়ীটি ছিল মদীনার বাজার সংলগ্ন। তাঁর ঘরের সাথেই ছিল একটি ছাউনী। এর মালিকানা ছিল খাযরাজ গোত্রের বনী সায়িদা শাখার লোকদের। এ জন্য তা ‘সাকীফা বনী সায়িদা’ নামে প্রসিদ্ধ। এটাকে আনসাররা মক্কার ‘দারুন নাদওয়ার’ মত পরামর্শ গৃহ হিসাবে ব্যবহার করতো।
হযরত রাসূলে কারীমের সা. ওফাতের খবর ছড়িয়ে পড়লে আউস ও খাযরাজ গোত্রের বিশিষ্ট আনসারগণ উক্ত সাকীফায় সমবেত হলেন। সা’দ উবন ’উবাদা তখন ভীষণ অসুস্থ। রোকেরা তাঁকেও ধরাধরি করে মঞ্চে এনে বসিয়ে দিল। তিনি বালিশে হেলান ও কাপড় মুড়ি দিয়ে বসলেন। তাদের এই সমাবেশের উদ্দেশ্য, আনসারদের মধ্য থেকেই রাসূলুল্লাহর সা. একজন খলীফা নির্বাচন। সা’দ ইবন ’উবাদা সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দিতে চাইলেন। তিনি নিকটতম লোকদের বললেন, আমার আওয়াজ হয়তো সবার কানে পৌঁছবে না। আমি যা বলবো তোমরা তা জোর গলায় সবার কানে পৌঁছে দেবে। তারপর তিনি আনসারদের মর্যাদা, কার্যাবলী, রাসূলুল্লাহর সা. সাহায্য-সহযোগিতা ইত্যাদি দিক তুলে ধরে একটি ভাষণ দান করেন। ভাষণটির সারকথা ছিল এরূপঃ
‘আনসারদের যে সম্মান এবং দীনের ক্ষেত্রে যে অগ্রগামিতা তা আরবের আর কোন গোত্রের নেই। রাসূল সা. দশ বছরের বেশী সময় ধরে নিজ গোত্রে ছিলেন, কিন্তু কেউ তাঁর কথা শোনেনি। যাঁরা শুনেছিলেন তাঁদের সংখ্যাও অতি নগণ্য। তাঁদের না ছিল রাসূলকে সা. নিরাপত্তা দানের শক্তি, আর না ছিল তাঁদের দীনের আওয়াজ বুলন্দ করার ক্ষমতা। তাঁরা নিজেদের নিরাপত্তা বিধানেই ছিল অক্ষম।
আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের সম্মানিত করতে চাইলেন। তাই তিনি তোমাদেরকে এক সাথে দু’টি উপাদান সরবরাহ করলেন। তোমরা ঈমান আনলে, রাসূল সা. ও তাঁর সাহাবাদের আশ্রয় দিলে এবং নিজেদের থেকেও আল্লাহর রাসূলকে সা. প্রিয় মনে করলেও তাঁর বিরুদ্ধেবাদীদের সাথে জিহাদ করলে। শেষ পর্যন্ত গোটা আরব ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ইসলামের বশ্যতা স্বীকার করে নেয় এবং নিকট ও দূরের সকলেই মস্তক অবনত করে দেয়। সুতরাং এই বিজিত অঞ্চলের সবটুকু তোমাদের তলোয়ারের নিকট দায়বদ্ধ।
রাসূলুল্লাহ সা. আজীবন তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন এবং ওফাতের সময় সন্তুষ্ট চিত্তে বিদায় নিয়েছেন। এ সকল কারণে এ খিলাফতের একমাত্র হকদার তোমরা এবং এ ব্যাপারে আর কেউ তোমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেনা।’
তাঁর ভাষণ শেষ হলে উপস্থিত আনসারমন্ডলী সমবেত কণ্ঠে বলে উঠলো, আপনার কথা খুবই যুক্তিসম্মত। আমাদের মতে এ পদের জন্য আপনার চেয়ে অধিকতর যোগ্য আর কেউ নেই। আমরা আপনাকেই খলীফা বানাতে চাই। তারপর নিজেদের মধ্যে আলোচনা চললো। একজন বললো, যদি মুহাজিররা মানতে অস্বীকার করে তাহলে তাদের কি জবাব দেওয়া যাবে? অন্য একজন তাকে বললো, আমরা তখন তাদেরকে বলবো, তাহলে আমীর দু’জন হবে- একজন আমাদের আর একজন তোমাদের। এছাড়া আর কিছুতেই আমরা রাজী হবো না। তার একথা শুনে সা’দ মন্তব্য করেনঃ এ হলো প্রথম দুর্বলতা। এদিকে আনসারদের এ সমাবেশের কথা হযরত ’উমারের রা. কানে পৌঁছে গেল। তিনি হযরত আবু বকরকে রা. সংগে নিয়ে সাকীফা বনী সায়িদার সমাবেশে উপস্থিত হলেন। হযরত ’উমারের রা. কঠোর প্রকৃতি আনসারদের উত্তেজিত করে তুললো। আনসারী বক্তারাও বারবাপর উত্তেজনামূলক বক্তৃতা করছিল। হযরত ’উমার রা. এবং তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি, এমন কি তরবারির ভয়-ভীতি দেখানো পর্যন্ত পৌঁছে। অবস্থা বেগতিক দেখে ধীর স্থির প্রকৃতির মানুষ হযরত আবু বকর রা. ’উমারকে রা. নিবৃত করেন এবং নিজেই এক আবেগময় ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সেই বিখ্যাত বাণী- ‘আল আয়িমম্মাতু মিন কুরাইশ’- ইমাম হবে কুরাইশদের ভিতর থেকে- উল্লেখ করেন। ভাষণ শেষ হওয়ার সাথে সাথে সমাবেশের রূপ ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। তারপর হযরত ’উমার রা. দাঁড়িয়ে আবু বকরের রা. ফজীলাত ও মর্যাদা বর্ণনা করেন। সেই বর্ণনা শুনে আনসাররা চেঁচেয়ে বলতে থাকে- ‘না’উযুবিল্লাহ আন নাতাকাদ্দামা আবা বকর’- আবু বকরের আগে যাওয়ার ব্যাপারে আমরা আল্লাহর পানাহ চাই।
’উমারের ভাষণ শেষ হওয়ার সাথে সাথে মুহাজিরদের মধ্য থেকে যথাক্রমে ’উমার, আবু ’উবাইদা এবং আনসারদের মধ্য থেকে খাযরাজ গোত্রের বাশীর ইবন সা’দ সর্বপ্রথম প্রথম আবু বকরের হাত স্পর্শ করে বা’ইয়াত (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করেন। তারপর সমবেত জনতা বা’ইয়াতের উদ্দেশ্যে একযোগে দাঁড়িয়ে গেলে লোকেরা এই বলে চেঁচাতে শুরু করে যে, সাবধান! সা’দ যেন পায়ে পিষে না যায়। একথা শুনে ’উমার রা. বললেনঃ আল্লাহ তাকে পিষে ফেলুক। এমনিতেই সা’দ নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনায় জর্জরিত হচ্ছিলেন। ’উমারের একথায় তিনি দারুণ ক্ষুব্ধ হয়ে লোকদের বললেনঃ তোমরা আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো। (দ্রঃ মুসনাদ- ১/২১; তারীখুল উম্মাহ আল-ইসলামিয়্যা- ১/১৬৮, ১৬৯; তাবারীঃ হিজরী ১১ সনের ঘটনাবলী- ১৮৪৩; বুখারী- ২/১০১০; হায়াতুস সাহাবা- ২/১২-১৮)
আল্লামা যিরিক্লী ‘ফিল বুদয়ি ওয়াত তারীখ’ (৫/১৩২) গ্রন্থের বরাতে উল্লেখ করেছেন যে, মুসলমানরা যখন আবু বকর রা. উদ্ধৃত হাদীস ‘আল-আয়িম্মাতু মিন কুরাইশ’ মেনে নিয়ে তাঁকেই খলীফা নির্বাচন করে তখন সা’দ বলেনঃ ‘লা ওয়াল্লাহ্! লা উবায়ি’উ কুরাশিয়্যাম আবাদা’- আল্লাহর কসম, না। আমি কক্ষণো কোন কুরাইশীর হাতে বা’ইয়াত করবো না। (আল-আ’লাম- ৩/১৩৫)
বেশ কিছু দিন খলীফা হযরত আবু বকর রা. তাঁকে কোন রকম ঘাঁটাঘাঁটি করলেন না। শেষে একদিন এক ব্যক্তিকে বলে পাঠালেন যে, সা’দ যেন এসে বাই’য়াত করে যান। সা’দ বাই’য়াত করতে সরাসরি অস্বীকার করলেন। হযরত ’উমার রা. খলীফাকে বললেন, তাঁর থেকে আপনি অবশ্যই বাই’য়াত নিন। সেখানে হযরত বাশীর ইবন সা’দ আল-আনসারীও ছিলেন। তিনি বললেন, একবার যখন তিনি বাই’য়াত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তখন আর কোন ভাবেই তাঁর থেকে বাই’য়াত নেওয়া যাবেনা। চাপাচাপি করলে রক্তারক্তির পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে। তিনি রুখে দাঁড়ালে তাঁর পরিবার ও বংশের লোকেরাও তাঁর পাশে এসে দাঁড়াবে। শেষ পর্যন্ত গোটা খাযরাজ গোত্রই তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে যাবে। এভাবে একটি ঘুমন্ত ফিত্না জাগিয়ে তোলা উচিত হবে না। আমার মতে তাঁকে থাকতে দিন, একটি লোক কী আর করবে? বাশীরের এ মত সবাই পছন্দ করলেন। হযরত সা’দ রা. খলীফা হযরত আবু বকরের রা. খিলাফতের শেষ পর্যন্ত মদীনায় ছিলেন। অবশেষে মদীনা ছেড়ে শামে চলে যান এবং দিমাশ্কের নিকটবর্তী- ‘হাওরান’ নামক একটি উর্বর ও সবুজ স্থান বসবাসের জন্য নির্বাচন করেন। আমরণ সেখানেই বসবাস করেন। (উসুদুল গাবা- ২/৮৪; আনসাবুল আশরাফ- ১/৫৮৯; তারীখু ইবন আসাকির- ৬/৯০)
হযরত সা’দের মদীনা ত্যাগের ব্যাপারে বর্ণিত আছে যে, হযরত ’উমার রা. খলীফা হওয়ার পর বাই’য়াত থেকে দূরে থাকার জন্য একবার তাঁকে তিরস্কার করেন। জবাবে সা’দ বলেনঃ আপনার বন্ধু আবু বকর আমার কাছে আপনার চেয়ে বেশী পছন্দনীয় ছিলেন। আল্লাহর কসম! আপনার প্রতিবেশীত্ব আমাকে অতিষ্ট করে তুলেছে। ’উমার বলেনঃ কেউ তার প্রতিবেশীকে পছন্দ না করলে দূরে সরে যেতে পারে। এরপর সা’দ কালবিলম্ব না করে শামে চলে যান। (আল-আ’লাম- ৩/১৩৫; তারীখু ইবন ’আসাকির- ৬/৮৪)
হযরত সা’দ ইবন ’উবাদার মৃত্যু সন নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। বিভিন্ন গ্রন্থে হিজরী ১১, ১৪ ও ১৫ সনের কথা উল্লেখ আছে। ইবন আসাকির হিজরী ১৪ সনটি অধিকতর নির্ভরযোগ্য মনে করেছেন। (তারীখ- ৬/৯১) আবু ’উবাইদ কাসেম ইবন সাল্লামের মথে তিনি ‘হাওরানে’ মারা যান। এবং সেখানেই দাফন করা হয়। আর দিমাশ্কের ‘আল-মুনীহা’ নামক স্থানে তাঁর যে কবরের কথা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে ইবন আসাকির তা সঠিক বলে মনে করেননি। (তারীখু ইবন আসাকির- ৬/৯১; আল-ইসতী’য়াব; টীকা আল-ইসাবা- ২/৪০; উসুদুল গাবা- ২/২৮৪)
হযরত সা’দ ইবন ’উবাদার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হন। এ হত্যা সম্পর্কে নানা রকম বর্ণনা ইতিহাসের গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়। বালাজুরী বলেনঃ সা’দ ইবন ’উবাদা শামে হিজরাত করেন এবং সেখানে নিহত হন। তিনি আবু বকরের হাতে বাই’য়াত করেননি। ’উমার রা. তাঁর কাছে একজন লোক পাঠান। তাঁকে বলে দেন তাঁকে বাই’য়াত করতে বলবে। যদি অস্বীকার করে তাহলে আল্লাহর সাহায্য কামনা করবে। লোকটি শামে গেল এবং সা’দকে ‘হাওরানের’ একটি প্রাচীর বেষ্টিত উদ্যানে পেল। সে তাঁকে বাই’য়াত করতে বললো। তিনি বললেনঃ আমি কোন কুরাইশর হাতে বাই’য়াত করবো না। লোকটি বললোঃ তাহলে আমি আপনাকে হত্যা করবো। তিনি বললেনঃ আমাকে হত্যা করলেও আমি বাই’য়াত করবো না। লোকটি তখন বললোঃ তাহলে গোটা উম্মাত যাতে ঢুকেছে আপনি কি তার বাইরে? বললেন’ বাই’য়াতের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি তাদের বাইরে।
লোকটি তখন তীর নিক্ষেপ করে তাঁকে হত্যা করে। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৫৮৯) ডঃ হামীদুল্লাহ বলেন, এটা চরমপন্থী শিয়াদের একটি মনগড়া কথা। (আনসাবুল আশরাফঃ টীকা- ১/২৫০) অন্য একটি বর্ণনা মতে, কেউ তাঁকে হত্যা করে গোসল খানায় ফেলে রাখে। বাড়ীর লোকেরা যখন দেখতে পায় তখন তাঁর প্রাণ স্পন্দন থেমে গেছে। তাঁর সারা দেহ নীল হয়ে যায়। ঘাতকের সন্ধান করেও কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। শুধু দূর থেকে ভেসে আসা কবিতার একটি চরণ আবৃত্তির শব্দ শোনা যায়, যার অর্থ এরূপঃ ‘আমরা খাযরাজ নেতা সা’দ ইবন ’উবাদাকে হত্যা করেছি। আমরা দুইটি তীর নিক্ষেপ করেছি এবং তাঁর কলিজা ভেদ করতে ভুল করিনি।’ যেহেতু ঘাতকের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি এবং শব্দ শোনা গেছে, এজন্য অনেকের ধারণা হয়েছিল যে, তাঁকে জ্বীনে হত্যা করেছে। (দ্রঃ উসুদুল গাবা- ২/২৮৫; আল-ইসতীয়াবঃ আল-ইসাবার পার্শ্ব টীকা- ২/৪০; আনসাবুল আশরাফ- ১/২৫০)
হযরত সা’দের দুই স্ত্রী ছিল- গাযিয়্যা বিনতু সা’দ ইবন খলীফা ও ফুকাইহা বিনতু ’উবায়েদ ইবন দুলাইম। ফুকাইহা ছিলেন সা’দের চাচাতো বোন। তিনি সাহাবিয়্যাও ছিলেন। গাযিয়্যার গর্ভে সা’দের তিন ছেলে সা’ঈদ, মুহাম্মাদ ও আবদুর রহমান এবং ফুকাইহার গর্ভে দুই ছেলে কায়স, সাদুস ও এক মেয়ে উমামা জন্মগ্রহণ করেন। (তাবাকাত- ৩/৬১৩; আল-ইসতীয়াবঃ আল-ইসাবার পার্শ্ব টীকা- ২/৫৩৮)
হযরত সা’দের প্রচুর বিষয় সম্পত্তি ছিল, মদীনা ত্যাগের পর সবই ছেলে মেয়েদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দেন। এক ছেলে তখন পেটে। তিনি তার অংশ দিয়ে যাননি। সে ভূমিষ্ট হওয়ার পর ’উমার রা. কায়সকে ডেকে বলেন, তুমি তোমার পিতার ভাগ বাতিল করে দাও। কারণ, মৃত্যুর পর তাঁর একটি ছেলে হয়েছে। কায়েস বললেন, আমার পিতার ভাগ ঠিক থাকবে। তবে ইচ্ছা করলে সে আমার অংশটি নিতে পারে। (আল-ইসতীয়াব- ২/৫৩৯)
হযরত সা’দের বাড়ীটি ছিল মদীনার বাজারের শেষ প্রান্তে। সেখানে একটি মসজিদ ও কয়েকটি দুর্গও ছিল। বনু হারিস পল্লীতে তাঁর আর একটি বাড়ী ছিল। (খুলাসাতুল ওফা’- ৮৮)
হযরত রাসূলে কারীমের রা. হাদীসের প্রতি সা’দ অসাধারণ গুরুত্ব দিতেন। সাহাবীদের যুগে ব্যাপকভাবে লেখালেখি শুরু হয়ে যায়। কুরআন ও লেখা হয়েছিল। তাসত্ত্বেও হাদীস লেখার ব্যাপক প্রচলন তখন হয়নি। তবে সা’দ হাদীস লিখেছিলেন। মুসনাদে ইমাম আহমাদে এ রকম একটি বর্ণনা এসেছেঃ ‘কায়স ইবন সা’দ ইবন ’উবাদা তাঁর পিতা সা’দ থেকে বর্ণনা করেছেন। তাঁরা এ হাদীসটি সা’দ ইবন ’উবাদার পুস্তক বা পুস্তকসমূহে পেয়েছেন।’ (মুসনাদ- ৫/২৮৫) হযরত সা’দ হাদীস লেখার সাথে সাথে তা শিক্ষাদানের মাধ্যমে প্রচারও করেন। একারণে তাঁর ছেলে কায়স ও সাঈদ, পৌত্র শুরাহবীল, প্রখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস আবু ’উমামা ইবন সাহ্ল, তাবে’ঈ ইবন মুসায়্যিব প্রমুখ ব্যক্তিগণ তাঁর থেকে বহু হাদীস বর্ণনা করেছেন। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ৬/৮৪)
হযরত সা’দের চরিত্রে দানশীলতার গুণটির চরম বিকাশ ঘটেছিল। ‘আসমাউর রিজাল’ শাস্ত্রকারদের প্রায় প্রত্যেকে তাঁর চরিত্র রূপায়ণ করতে গিয়ে বলেছেনঃ ‘তিনি ছিলেন অত্যন্ত দানশীল’। শুধু তিনি নন, পুরুষানুক্রমে তাঁরা ছিলেন আরবের বিখ্যাত দানশীল। তাঁর চার পুরুষ বদান্যতার জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিল। এমন গৌরব সে যুগে খুব কম লোকেরই ছিল। তার দাদা দুলাইম, পিতা ’উবাদা, পুত্র কায়স এবং তিনি নিজে- প্রত্যেকেই ছিলেন আপন আপন সময়ের বিখ্যাত জনহিতৈষী ও অতিথি সেবক। (আল-ইসতীয়াবঃ টীকা আল-ইসাবা- ২/৩৬)
তাঁর দাদার সময় আতিথেয়তা এত ব্যাপক ছিল যে, একজন ঘোষক দূর্গের চূড়ায় উঠে চিৎকার করে আহ্বান জানাতো, যারা গোশ্ত, চর্বি ও উপাদেয় খাবার খেতে চায় তারা যেন আমাদের অতিথি হয়। হযরত ’আবদুল্লাহ ইবন ’উমার রা. একবার সা’দের দুর্গের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি নাফে’কে ডেকে হাত দিয়ে ইশারা করে বলেন, এ হচ্ছে সা’দের দাদার দুর্গ। একজন ঘোষক এ দূর্গের চূড়ায় উঠে ঘোষণা করতোঃ কেউ চর্বি-গোশ্ত খেতে চাইলে দুলাইমের বাড়ীতে এসো। দুলাইম মারা গেলে তাঁর ছেলে ’উবাদার সময়েও একই রকম ঘোষনা দেওয়া হতো। সা’দের সময়ও এ ধারা অব্যাহত থাকে। আমি সা’দের ছেলে কায়সকেও একই রকম করতে দেখেছি। কায়স ছিলেন মানুষের মধ্যে সর্বাধিক দানশীল। (আল-ইসতী’য়াবঃ টীকা আল-ইসাবা- ২/৩৬-৩৭)
প্রখ্যাত তাবে’ঈ হযরত ’উরওয়া ইবন যুবাইর বলেনঃ আমি সা’দ ইবন ’উবাদাকে তাঁর দুর্গের ওপর দাঁড়িয়ে এই ঘোষণা দিতে দেখেছিঃ কেউ চর্বি ও গোশ্ত পছন্দ করলে সা’দ ইবন ’উবাদার বাড়ীতে এসো। তারপর তাঁর ছেলেকেও আমি একই রকম করতে দেখেছি। যৌবনে একদিন আমি মদীনার রাস্তায় হাঁটছি। এমন সময় ’আবদুল্লাহ ইবন ’উমার আমার পাশ দিয়ে ’আওয়ালীতে তাঁর ক্ষেত্রের দিকে যাচ্ছিলেন। আমাকে বললেনঃ বালক, দেখতো সা’দ ইবন ’উবাদার দুর্গের ওপর থেকে কেউ আহ্বান জানাচ্ছে কিনা। আমি তাকিয়ে দেখে বললামঃ না। তিনি বললেনঃ তুমি ঠিকই বলেছ। (তাবাকাত- ৩/৬১৩; হায়াতুস সাহাবা- ২/১৮৯) এমন ব্যাপক আতিথেয়তা ও দানশীলতা বনী সা’য়িদাকে মদীনার ‘হাতেম’ বানিয়ে দিয়েছিল।
ইসলাম ও হযরত রাসূলে কারীমের সা. প্রতি সা’দের বদান্যতার অনেক মুখরোচক কাহিনী বিভিন্ন গ্রন্থে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এখানে দু’একটি সত্য কাহিনী সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
হযরত রাসূলে কারীম সা. যখন হিজরাত করে মদীনায় আসলেন তখন সা’দের বাড়ী থেকে রাসূল সা. ও তাঁর পরিবারের জন্য প্রতিদিন নিয়মিত খাবার আসতো। প্রতিদিন বড় এক গামলা গোশ্ত অথবা দুধের সারীদ অথবা সিরকা ও তেল বা ঘিয়ের সালীদ আসতো, এই পাত্রটি রাসূল সা. ও তাঁর সহধর্মিনীদের গৃহে চক্কর দিত। (আল-ইসাবা- ২/৩০; তাবাকাত- ৩/৬১৪; হায়াতুস সাহাবা- ২/৭০০)
একবার সা’দ ইবন ’উবাদা হযরত রাসূলে কারীমের সা. জন্য বরতন ভর্তি রান্না করা মগজ নিয়ে আসলেন। রাসূল সা. বললেনঃ এটা কি? সা’দ বললেনঃ যিনি সত্য সহকারে আপনাকে পাঠিয়েছেন সে সত্তার নামে শপথ, আমি আজ ৪০টি তাজা-মোটা উট নহর (জবেহ) করেছি। আমার ইচ্ছা হলো আপনাকে একটু পেট ভরে মগজ খাওয়াই। রাসূল সা. খেলেন এবং তাঁর কল্যাণ কামনা করে দু’আ করলেন। (কানযুল ’উম্মাহ- ৭/৪০; হায়াতুস সাহাবা- ২/১৮৯)
সাহাবীদের ‘আসহাবে সুফ্ফা’ নামে একটি দল ছিল। যাঁরা বহু দূর-দূরান্ত থেকে ঘর-বাড়ী ছেড়ে মদীনায় এসেছিলেন। তাদের এখান আসা ও অবস্থানের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ’উলম হাসিল এবং দীনের প্রশিক্ষণ লাভ করা। রাসূল সা. তাদেরকে সচ্ছল সাহাবীদের সাথে সম্পৃক্ত করে দিতেন। অন্যরা যেখানে দুই একজন করে সাথে নিয়ে যেতেন, সেখানে হযরত সা’দ প্রতিদিন সন্ধ্যায় ৮০ জনকে আহার করানো জন্য নিয়ে যেতেন। (আল-ইসাবা- ২/৩০; কানযুল ’উম্মাল- ৫/১৯০; হায়াতুস সাহাবা- ২/১৯৬)
ইয়াহইয়া ইবন ’আবদুল ’আযীয থেকে বর্ণিত আছে। সা’দ ইবন ’উবাদা ও তাঁর ছেলে কায়স ইবন সা’দ পালাক্রমে জিহাদে যেতেন। একবার সা’দ লোকদের সাথে জিহাদে গেলেন। এদিকে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট বাইরের অনেক অতিথি এলো। সেনা শিবিরে বসে সা’দ একথা জানতে পেয়ে বললেনঃ কায়স যদি আমার ছেলে হয় তাহলে আমার দাস নিস্তাসকে ডেকে বলবে, চাবি দাও, আমি রাসূলুল্লাহর সা. প্রয়োজন মেটানোর জন্য খাবার বের করে নিই। তখন হযতো নিস্তাস বলবেঃ তোমার আব্বা চিঠি নিয়ে এসো। এতে কায়স হয়তো ক্ষেপে গিয়ে তার নামে ঘুষি মেরে চাবিটি ছিনিয়ে নেবে এবং রাসূলুল্লাহর সা. প্রয়োজন মত খাদ্য বের করে নেবে। আসলে ব্যাপারটিও তাই হয়েছে। সেবার কায়স রাসূলুল্লাহর সা. জন্য এক শো ওয়াসক খাদ্য নিয়েছিল। (হায়াতুস সাহাবা- ২/২০০)
ওয়াকিদী বলেনঃ বিদায় হজ্জের সময় একদিন হযরত রাসূলে কারীমের সা. ভারবাহী পশুটি হারিয়ে গেল। সা’দ ও কায়স সাথে সাথে একটি পশু নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. কাছে গিয়ে দেখলেন তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে। আল্লাহ তাঁর পশুটি ফিরিয়ে দিয়েছেন। সা’দ আরজ করলেন। ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা জেনেছি, আপনার পশুটি হারিয়ে গেছে। তাই এ পশুটি নিয়ে এসেছি। রাসুল সা. বললেনঃ আল্লাহ আমার বাহনটি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তোমরা এটি নিয়ে যাও। আল্লাহ তোমাদের বরকত দিন। ওহে আবু সাবিত! আমি মদীনায় আসার পর থেকে তোমরা যে সমাদর করেছ তাকি যথেষ্ট নয়? সা’দ বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের সম্পদ থেকে যা আপনি গ্রহণ করেন না তার চেয়ে যা কিছু আপনি গ্রহণ করেন তাই আমাদের নিকট অধিকতর প্রিয়। রাসুল সা. তাঁর কথা সমর্থন করে বলেনঃ আবু সাবিত! সত্য বলেছ। সুসংবাদ লও। তুমি সফলকাম হয়েছ। (তারীখু ইবন আসাকির- ৬/৮৮)
হযরত ইবন ’আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। সা’দ ইবন ’উবাদা রাসূলুল্লাহর সা. নিকট জানতে চান যে, তাঁর মা একটি মান্নত মেনেছিলেন; কিন্তু তা পূরণ না করেই মারা গেছেন। এখন তিনি কি তা পূরণ করে দেবেন? রাসূল সা. তাঁকে পুরণ করে দিতে বলেন। এমনিভাবে তাঁর মা’র পক্ষ থেকে সাদাকা করার কথা জিজ্ঞেস করলে রাসূল সা. তাঁকে বলেনঃ হাঁ তুমি তা করতে পার। তখন সা’দ রাসূলকে সা. সাক্ষী রেখে তাঁর ‘আল-মিখরাফ’ বাগিচাটি দান করার কথা ঘোষণা করেন। সা’ঈদ ইবনুল মুসায়্যিব থেকে বর্ণিত হয়েছে। সা’দ তাঁর মা’র মৃত্যুর পর একবার রাসূলকে সা. জিজ্ঞেস করেনঃ কোন সাদাকা সবচেয়ে ভালো? তিনি বলেনঃ তুমি মানুষকে পানি পান করাও।
সা’দ মদীনার মসজিদে তাঁর মায়ের নামে পানি পানের ব্যবস্থা করেন। যা বহু দিন যাবত ‘সিকায়া আলে সা’দ’ নামে প্রসিদ্ধ ছিল। একবার এক ব্যক্তি হযরত হাসানের রা. নিকট জানতে চায় যে, সা’দের মায়ের নামে যে পানির ব্যবস্থা তাতো সাদাকা। সে পানি কি আমি পান করতে পারি? হাসান রা. জবাব দিলেনঃ আবু বকর ও ’উমার যখন পান করেছেন তখন তোমার আপত্তি কিসে? (তাবাকাত- ৩/৬১৪, ৬১৫; মুসনাদে ইমাম আহমাদ- ৫/২৮৫)
‘জাতুল ফুদুল’ নামে সা’দ ইবন ’উবাদার একটি বর্ম ছিল। রাসূল সা. যে দিন বদরের উদ্দেশ্যে বের হন, সা’দ বর্মটি তাঁকে দান করেন। সেই সাথে ‘আল-আদব’ নামে একখানি তরবারিও দান করেন। এ দু’টি যুদ্ধাস্ত্র রাসূল সা. বদরে ব্যবহার করেন। এই বদরে রাসূল সা. ‘জুল-ফিকার’ তরবারিটি গনীমাত হিসাবে লাভ করেন। ওয়াকিদীর মতে ঐ তরবারিটি ছিল কাফির সৈনিক মুনাব্বিহ অথবা নাবীহ্ ইবন হাজ্জাজের। কালবীর মতে আল-আ’স ইবন মুনাব্বিহ্ ইবন হাজ্জাজের। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৫২১)
ইবন ’আসাকির হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, একবার সা’দ ইবন ’উবাদা নবী কারীমকে সা. আহারের দা’ওয়াত দিলেন। তিনি উপস্থিত হলে সা’দ খেজুর ও হাড়সহ গোশ্ত হাজির করলেন। রাসুল সা. তা খেলেন এবং এক পেয়ালা দুধও পান করলেন। শেষে বললেনঃ নেক্কার লোকেরা তোমার খাবার খেয়েছে, রোযাদাররা ইফ্তার করেছেন এবং ফিরিশ্তারা তোমাদের জন্য দু’আ করেছেন। হে আল্লাহ! সা’দ ইবন ’উবাদার পরিবার-পরিচনের ওপর রহমত বর্ষন করুন। (কানযুল ’উম্মাহ- ৫/৬৬; হায়াতুস সাহাবা- ২/১৮৯, ৩৬৪)
এভাবে হযরত সা’দের আতিথেয়তা, দানশীলতা, উদারতা ও বদান্যতার বহু কথা সীরাত গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়।
রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি হযরত সা’দের ভালোবাসার রূপ এমন ছিল যে, রাসুল সা. সম্পর্কে তাঁর গোত্রের অতি গোপন কথাটিও তিনি তাঁর নিকট পৌঁছে দিতেন। হাওয়াযিন যুদ্ধের সময় রাসুল সা. ‘তালীফে কুলুবের’ জন্য কুরাইশ বংশের নও মুসলিমদেরকে গনীমতের বড় বড় অংশ দিলেন এবং আনসারদেরকে কিছুই দিলেন না। এতে অনেক আনসার যুবক ক্ষুব্ধ হয়ে বললোঃ রাসূল সা. স্বগোত্রীয় লোকদের দিলেন এবং আমাদেরকে মাহরূম করলেন। অথচঃ আমাদের তরবারি হতে এখনো কুরাইশদের রক্ত ঝরছে। সা’দ ইবন ’উবাদা সাথে সাথে বিষয়টি জানিয়ে দিলেন। তিনি সা’দকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার মত কি? বললেনঃ আমিও আমার সম্প্রদায়ের একজন। তবে এমন কথা বলিনা। রাসুল সা. তাঁকে বললেনঃ যাও, লোকদের অমুক তাঁবুতে সমবেত কর। ঘোষণা শুনে মুহাজির ও আনসার উভয় সম্প্রদায়ের লোক উপস্থিত হলো। সা’দ শুধু আনসারদের থাকতে বলে মুহাজিরদের চলে যেতে বললেন। তারপর রাসুল সা. এসে এক আবেগময় ভাষণ দান করলেন। সে ভাষয়ের কিছু অংশ ছিল এরূপঃ তোমরা কি এতে খুশী নও যে, অন্যরা ধন-সম্পদ নিয়ে ফিরে যাক, আর তোমরা আমাকে নিয়ে ফিরবে? রাসূলুল্লাহর সা. এমন প্রশ্নে সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। সমস্বরে তারা জবাব দেয়, আপনার পরিবর্তে গোটা দুনিয়া কিছুই না। (বুখারী- ২/৬২০; মুসনাদ- ৩/৭২০; সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৪৯৮, ৪৯৯; হায়াতুস সাহাবা- ১/৩৯৮)
উহুদ যুদ্ধের সময় গোটা মদীনা একটা মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়ে। এ সময় সা’দ ইবন ’উবাদা নিজের বাড়ী ছেড়ে রাসূলুল্লাহর সা. বাড়ী পাহারা দিয়েছিলেন। হযরত রাসুলে কারীমও তাঁকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। প্রায়ই তাঁর বাড়ীতে যেতেন। সা’দের ছেলে কায়স বলেনঃ একবার রাসূল সা. আমাদের বাড়ীতে আসলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি সালাম দিলেন। সা’দ সালাম শুনে খুব নিচু স্বরে জবাব দিলেন। কায়স বললেনঃ আপনি কি রাসুলকে সা. ভিতরে আসার অনুমতি দেবেন না? সা’দ বললেনঃ দেরী কর। তাঁকে আমাদের ওপর একটু বেশী করে সালাম দেওয়ার সুযোগ দাও। রাসুল সা. তিনবার সালাম দিয়ে কোন জবাব না পেয়ে ফিরে চললেন। সা’দ তখন দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে ডাক দিয়ে বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি আপনার সালাম শুনেছি। জবাবও দিয়েছি একটু আস্তে আস্তে। আমি চেয়েছি, আপনি আমাদের ওপর একটু বেশী সালাম দিন। রাসূল সা. সা’দের সাথে আবার ফিরে আসলেন। সেদিন তিনি সা’দের বাড়ীতে আহার করে তাঁর পরিবারের সকলের জন্য দু’আ করেন। (উসুদুল গাবা- ২/২৮৩; হায়াতুস সাহাবা- ২/৪৯১, ৫১৫; ৩/৩১৪)
একবার রাসুল সা. এক দু’আয় বলেনঃ হে আল্লাহ! আনসারদের সর্বোত্তম প্রতিদান দান করুন। বিশেষ করে ’আবদুল্লাহ ইবন ’আমর ইবন হারাম ও সা’দ ইবন ’উবাদাকে।
একবার হযরত সা’দ ইবন ’উবাদা সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহর সা. বাড়ী গেলেন। তিনি সোজা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রবেশের অনুমতি চাইছেন। রাসুল সা. তাঁকে ইশারায় দূরে সরে যেতে বললেন। কিছুক্ষণ পর তিনি আমার দরজার সামনে গিয়ে অনুমতি চাইলেন। তখন রাসূল সা. বললেনঃ যখন দরজার সামনেই থাকবে, অনুমতির প্রয়োজন পড়ে না। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৫১৬)
একবার রাসূলুল্লাহ সা. যাকাত আদায়কারী হিসাবে সা’দকে নিয়োগ করলেন। একদিন রাসুল সা. তাঁর কাছে গিয়ে বললেনঃ কিয়ামতের দিন যাতে তোমাকে উট কাঁধে করে উঠতে না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। সা’দ বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি তেমন কিছু করি তাহলে সত্যি এমন হবে? তিনি বললেনঃ হাঁ। সা’দ আরজ করলেনঃ আমাকে অব্যাহতি দিন। রাসূল সা. তাঁর আবদেন মঞ্জুর করে অব্যাহতি দান করেন। (তারীখু ইবন আসাকির- ৬/৮৯; মুসনাদ- ৫/২৮৫)
একবার হযরত সা’দ অসুস্থ হলে রাসূল সা. সাহাবীদের সংগে করে তাঁকে দেখতে যান। সা’দ অচেতন ছিলেন। সাহাবীদের মধ্য থেকে নানাজনে নানারকম মন্তব্য করলেন। কেউ বললেন, শেষ হয়ে গেছে! কেউ বললেন, না এখনো দম আছে। একথা শুনে রাসুল সা. কেঁদে ফেলেন। সাথে সাথে গোটা মজলিসে কান্না শুরু হয়ে যায। (বুখারী- ২/১৭৪)
আর একবার রাসূল সা. যায়িদ ইবন সাবিতকে বাহনের পিছনে বসিয়ে অসুস্থ সা’দকে দেখতে তাঁর বাড়ী গিয়েছিলেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৬৯)
একবার রাসুল সা. সা’দকে দেখতে যাচ্ছেন। পথে মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবন সুলূল বসে ছিল। সে রাসূলকে সা. কিছু কটু কথা বললো। উপস্থিত সাহাবায়ে কিরাম উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। উভয় পক্ষের মধ্যে লড়াই শুরু হয় হয় অবস্থা। রাসূল সা. সকলকে নিবৃত্ত করলেন এবং সা’দের বাড়ী উপস্থিত হলেন। তিনি বললেনঃ সা’দ! আজ আমাকে আবু হুবাব (ইবন উবাই) যে সব কথা বলেছে তাকি শুনেছ? সা’দ আরজ করলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! তার অপরাধ ক্ষমা করে দিন। আসল কথা হলো, ইসলাম আসার পূর্বে মানুষ ধারণা করেছিল সে মদীনার বাদশাহ হবে। কিন্তু যখন আল্লাহ আপনাকে সত্য সহকারে পাঠালেন তখন তাদের সে ধারণা চুরমার হয়ে গেল। এটা হলো সেই বেদনার বহিঃপ্রকাশ। এবার রাসুল সা. তাঁর অনুরোধে ইবন উবাইকে ক্ষমা করে দেন। (বুখারী- ২/৬৫৬; হায়াতুস সাহাবা- ২/৫০৯) হযরত সা’দ যে নরম প্রকৃতির ও শান্তিপ্রিয় স্বভাবের ছিলেন উপরোক্ত ঘটনা দ্বারা তা বুঝা যায়।
ইবন ’আসাকির হযরত যায়িদ ইবন সাবিত থেকে বর্ণনা করেছেন। একদিন সা’দ ইবন ’উবাদা তাঁর ছেলেকে সংগে নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট আসলেন। সালাম বিনিময়ের পর রাসূল সা. তাঁকে বললেনঃ এখানে, এখানে। এই বলে তাঁকে ডান পাশে বসালেন। তারপর বললেনঃ মারহাবান বিল আনসার, মারহাবান বিল আনসার- আনসারদের প্রতি স্বাগতম, আনসারদের প্রতি স্বাগতম। ছেলেটি রাসূলুল্লাহর সা. সামনে দাঁড়িয়েছিল। রাসুল সা. বসতে বললেন। সে বসে পড়লো। একটু পরে তিনি তাকে কাছে আসতে বললেন। সে এগিয়ে এসে রাসূলুল্লাহর সা. হাতে ও পায়ে চুমু দিল। রাসূল সা. বললেনঃ আমিও আনসারদের একজন। সা’দ তখন বললেনঃ আল্লাহ আপনাকে সম্মানিত করুন যেমন আপনি আমাদের সম্মান দেখিয়েছেন। রাসূল সা. বললেন, আমার সম্মান দেখানো আগেই আল্লাহ তোমাদের সম্মানিত করেছেন। আমার পরে তোমরা অনেক কষ্ট ভোগ করবে। তখন সবর করবে। অবশেষে হাউজে কাওসারের নিকট আমার সাথে তোমাদের আবার সাক্ষাত হবে। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৪০৪)
হযরত সা’দের একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা মজলিস ছিল। একদিন রাসুল সা. সেখানে গিয়ে কিভাবে রাসূলের সা. ওপর দরূদ ও সালাম পেশ করতে হয় তা শিখিয়েছিলেন। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৩১৪)
হযরত সালমান আল-ফারেসী রা. ইসলাম গ্রহণের পর মনিবের হাত থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে তার সাথে একটি চুক্তি করেন। তার একটি শর্ত ছিল, তিনি মনিবকে ৩০০ (তিন শো) খেজুরের চারা লাগিয়ে দেবেন। হযরত সা’দ ইবন ’উবাদা তাঁকে ষাটটি (৬০) চারা দিয়ে সাহায্য করেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৮৭)
এক সময় হযরত রাসূলে কারীমের সা. দশটি গর্ভবতী উট ছিল। তার তিনটিই সা’দ তাঁকে দান করেন। তার একটির নাম ছিল ‘মুহরাহ্’। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৫১২)
সাফওয়ান ইবন মু’য়াত্তাল বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সা’দ ইবন ’উবাদা পরার জন্য তাঁকে কাপড় দান করেন। সেই কাপড় পরে রাসূলুল্লাহর সা. সামনে গেলে তিনি বলেনঃ যে তাকে কাপড় পরিয়েছে আল্লাহ তাকে জান্নাতের কাপড় পরাবেন। সাফওয়ান তখন বলেনঃ আমাকে সা’দ ইবন ’উবাদা কাপড় দান করেছেন। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ৬-৮৯)
হযরত ইবন ’আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে। যখন সূরা আন-নূরের ৪ নং আয়াত- ‘যারা সাধ্বী রমনীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে এবং চারজন সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদেরকে আশিটি দুর্রা লাগাবে এবং কখনো তাদের সাক্ষী গ্রহণ করবে না। তারাই ফাসিক’- নাযিল হয় তখন সা’দ ইবন ’উবাদা বলে ওঠেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! এটা এভাবে নাযিল হয়েছেন? তাঁর মধ্যে বিস্ময়ের ভাব দেখে রাসূল সা. বলেনঃ ওহে আনসারগণ! শোন, তোমাদের নেতার কথা শোন। তারা বললোঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! এটা এভাবে নাযিল হয়েছে? তাঁর মধ্যে বিস্ময়ের ভাব দেখে রাসুল সা. বলেনঃ ওহে আনসারগণ! শোন, তোমাদের নেতার কথা শোন। তারা বললোঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ তিনি একজন প্রখর আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন ব্যক্তি। আল্লাহর কসম। তিনি কুমারী ছাড়া কোন মেয়ে বিয়ে করেননি। তেমনিভাবে তাঁর তালাক দেওয়া কোন মহিলাকেও কেউ কখনো বিয়ে করত সাহস করেনি। এর একমাত্র কারণ, তাঁর তীক্ষ্ণ আত্মমর্যাদাবোধ। সা’দ বললেনঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি জানি এটি সত্য এবং আল্লাহর নিকট থেকে এসেছে। কিন্তু আমি আশ্চর্য হচ্ছি যে, একজন দুরাচারীকে আমার স্ত্রীর সাথে কুকর্ম করতে দেখেও তাকে কিছুই না বলে চারজন সাক্ষীর তালাশে বেরিয়ে যাব এবং তাকে নির্বিঘ্নে তার কুকর্ম শেষ করার সুযোগ করে দেব। আল্লাহর কসম! আমি যখন সাক্ষী নিয়ে ফিরে আসবো তখন তো তার কাজ শেষ হয়ে যাবে।’ অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, সা’দ বলেনঃ কক্ষণো না। সেই সত্তার নামে শপথ যিনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন। আমি অবশ্যই তরবারি দিয়ে তাকে হত্যা করবো। তখন রাসূল সা. আনসারদের ডেকে বলেন, শোন তোমাদের নেতার কথা শোন। সে অবশ্যই আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন লোক। তবে তার থেকেও আমি এবং আমার থেকেও আল্লাহ বেশী মর্যাদাবোধের অধিকারী। (দ্রঃ তারীখু ইবন ’আসাকির- ৬/৮৯; হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৩৮, ৬৩৯)
মালিক থেকে বর্ণিত হয়েছে। যখন আবু ’উবাইদাহ, মু’য়াজ, বিলাল ও সা’দ ইবন ’উবাদার মত প্রথম শ্রেণীর সাহাবীরা শামে গেলেন তখন সেখানে একজন খৃস্টান রাহিব (সাধক) তাদেরকে দেখে মন্তব্য করেনঃ হযরত ’ঈসার যে সকল হাওয়ারীকে (সাথী) শূলীতে চড়ানো হয়েছিল এবং করাত দিয়ে দু’ফালি করে ফেলা হয়েছিল তারাও সংগ্রামে মুহাম্মাদের সা. এ সকল সাহাবীদের সমকক্ষ ছিলেন না। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ৬/৯১)

সা’দ ইবনুর রাবী’ (রা)
সা’দ ইবনুর রাবী আল-আনসারী মদীনার খাযরাজ গোত্রের বনু আল-হারিস শাখার সন্তান। হায়সাম উল্লেখ করেছেন, ‘আবু রাবী’ তাঁর কুনিয়াত বা ডাকনাম। পিতা আর-রাবী ও মাতা হুযাইলা বিন্তু ইন্বা। সীরাত বিশেষজ্ঞরা তাঁর জন্মসন সম্পর্কে নীরব। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৪৪, তাবাকাত- ৩/৫২২, উসুদুল গাবা- ২/২৭৭)
সা’দ ইবনুর রাবী’র ইসলাম গ্রহণের সময়কাল সম্পর্কে মতভেদ দেখা যায়। আবু নু’য়াইম তাঁর ‘দালায়িল’ গ্রন্থে ’আকীল ইবন আবী তালিব ও যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন, প্রথম ’আকাবায়, যে বার ছয়জন ইয়াসরিববাসী মক্কায় রাসূলুল্লাহর হাতে সা. ইসলাম গ্রহণ করে বায়’য়াত করেন তাঁদের একজন ছিলেন সা’দ। সেই ছয় ব্যক্তি হলেনঃ ১. আস’য়াদ ইবন যুরারা ২. আবুল হায়সাম ইবন আত-তায়্যিহান ৩. আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা ৪. সা’দ ইবনুর রাবী’ ৫. আন-নু’মান ইবন হারিসা ও ৬. ’উবাদা ইবনুস সামিত। (হায়াতুস সাহাবা- ১/১০৫) পক্ষান্তরে কোন কোন বর্ণনায় বুঝা যায়, তিনি দ্বিতীয় আকাবার বারো সদস্যের অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি এই দ্বিতীয় ’আকাবায় ইসলাম গ্রহণে করেন। তৃতীয় আকাবায় তিহাত্তর মতান্তরে পঁচাত্তর জন লোকের সংগে তিনি যোগ দেন। হযরত রাসুলে কারীম সা. তাঁকে ও ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাকে তাঁদের গোত্র বনু আল-হারিস ইবনুল খাযরাজের যুগ্ম ‘নাকীব’ বা দায়িত্বশীল নিয়োগ করেন। (তারীখুল ইসলাম ওয়া তাবাকাতুল মাশাহীর ওয়াল আ’লাম- ১/১৮১, তাবাকাত- ২/৫২২, উসুদুল গাবা- ২/২২৭)
ইবন হিশাম বর্ণনা করেনঃ হযরত রাসূলে কারীম সা. কুবা থেকে যে দিন মদীনায় উপস্থিত হন, মদীনার সকল শ্রেণীর মানুষ তাঁকে স্বাগতঃ জানায়। তিনি বিভিন্ন গোত্রের ভিতর দিয়ে চলছিলেন, আর সেই গোত্রের লোকেরা তাঁর বাহনের পথ রোধ করে তাদের ওখানে অবতরণের আবেদন জানাচ্ছিল। যখন তিনি বনু আল-হারিস ইবনুল খাযরাজের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন সা’দ ইবনুর রাবী খারিজা ইবন যায়িদ ও আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা বনী হারিসার আরও কিছু লোক সংগে নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. সাওয়ারীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে ’আরজ করলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি আমাদের সংখ্যা, সাজ-সর্যঞ্জাম ও প্রতিরক্ষার দিকে আসুন। (অর্থাৎ আপনাকে সম্মানের সাথে আশ্রয় দানের মত ক্ষমতা আমাদের আছে) রাসুল সা বললেনঃ তোমরা আমার বাহনের পথ ছেড়ে দাও। সে আল্লাহর নির্দেশ প্রাপ্ত। তাঁরা সবাই পথ থেকে সরে দাঁড়ালেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৪৯৫)
যুহরী ও মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. সাদ ইবনুর রাবী ও আবদুর রহামান ইবন ’আউফের মধ্যে ভ্রাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। হযরত সা’দ তাঁর এই মুহাজির ভাইয়ের প্রতি যে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা দেখান দুনিয়ার ইতিহাসে তার কোন তুলনা পাওয়া যাবে না। অন্যান্য আনসারগণ নিজনিজ অর্থ-সম্পদ, জায়গা-জমি সবই অর্ধেক তাঁর দ্বীনী মুহাজির ভাইকে ভাগ করে দেন; কিন্তু হযরত সা’দ অর্থ-সম্পদ ছাড়াও একজন স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তার দ্বীনী ভাইকে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। আর আব্দুর রহমান যদিও সে সময় রিক্ত ও নিঃস্ব, তবে তাঁর অন্তরটি ছিল অত্যন্ত প্রশস্ত। তিনি সা’দের সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এ সম্পর্কে আনাস ইবন ’আউফ থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ সা’দ তাঁর দ্বীনি ভাইকে সংগে করে নিজ গৃহে নিয়ে যান এবং এক সাথে আহার করেন। তারপর বলেনঃ আল্লাহর নামে আপনি আমার ভাই। আপনার স্ত্রী নেই; কিন্তু আমার দুই স্ত্রী। একজনকে আমি তালাক দেব, আপনি তাঁকে বিয়ে করবেন। আব্দুর রহমান বলেনঃ আল্লাহর কসম! কক্ষনো না। সা’দ বললেনঃ আমার বাগানে চলুন, আধা-আধি ভাগ করে নিই। আব্দুর রহমান বললেনঃ না। আল্লাহ আপনার ছেলে-মেয়ে ও মাল-দৌলতে বরকত ও সমৃদ্ধি দান করুন। এসবের কোন কিছুই প্রয়োজন আমার নেই। আমাকে শুধু বাজারের পথটি একটু দেখিয়ে দিন। (আল-ইসাবা- ৩/২৬, উসুদুল গাবা- ২/২৭৮, তাবাকাত- ৩/৫২৩)
হযরত সা’দ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ যুদ্ধে তিনি বনী মাখযুমের রিফা’য়া ইবন রিফা’য়াকে হত্যা করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৭১১, তাবাকাত- ৩/৫২৩)
উহুদ যুদ্ধের প্রাক্কালে মক্কার কুরাইশরা ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু করলো। তাদের সেই সমর প্রস্তুতির খবর দিয়ে একটি চিঠি মক্কা থেকে রাসূলুল্লাহর সা. চাচা আব্বাস ইবন ‘আবদিল মুত্তালিব গোপনে মদিনায় রাসূলুল্লাহর সা. নিকট পাঠালেন। চিঠিতে তিনি তাদের প্রস্তুতির বিবরণ দিয়ে এ কথাও লিখেন যে, ‘তারা তোমাদের ওপর আপতিত হলে, তোমরা যা ভালো মনে কর তাই করবে এবং সেই জন্য প্রস্তুতি নাও।’ বনী গিফারের একটি লোক অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে কুবায় রাসূলুল্লাহর সা. হাতে চিঠিটি পৌঁছে দেয়। রাসূল সা. সর্বপ্রথম তা উবাই ইবন কা’বকে পড়তে দেন এবং গোপন রাখতে বলেন। তারপর সা’দ ইবনুর রাবী’র নিকট আসেন এবং তাঁকেও বিষয়টি অবহিত করেন। তাঁকেও কথাটি কারও নিকট ফাঁস না করার নির্দেশ দেন। রাসূল সা. চলে যাওয়ার পর সা’দের স্ত্রী সা’দকে জিজ্ঞেস করলোঃ রাসূল সা. তোমাকে কি বললেন?
সা’দঃ তোমরা মা নিপাত যাক। তোমার তা শোনার কি প্রয়োজন?
স্ত্রীঃ আমি তোমাদের সব কথা শুনেছি। এই বলে তিনি সব কথা সা’দকে শোনান। সা’দ ইন্নালিল্লাহ পাঠ করে বললেনঃ দেখছি, তুমি আমাদের কথা আঁড়ি পেতে শুনে থাক। সা’দ তাঁর স্ত্রীকে সংগে করে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট হাজির হলেন এবং সব ঘটনা খুলে বলার পর আরজ করেন ইয়া রাসূলুল্লাহরঃ আমার ভয় হচ্ছে, খবরটি হয়ত ছড়িয়ে পড়বে, আর আপনি ধারণা করবেন আমিই তা ছড়িয়েছি। রাসূল সা. বললেনঃ বিষয়টি ছেড়ে দাও। (আনসাবুল আশরাফ-১/৩১৩-৩১৪)
হিজরী তৃতীয় সনে সংঘটিত উহুদ যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁকে একদল প্রতিপক্ষ যোদ্ধা পরাস্ত করে হত্যা করে। (আল-আ’লাম- ৩/১৩৪, উসুদুল গাবা- ২/২৭৭, আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৩০) তাঁর দেহে তীর-বর্ষার মোট বারোটি আঘাত লাগে। তিনি যখন মুমূর্ষু অবস্থায় যুদ্ধের ময়দানে পড়ে আছেন তখন মালিক ইবন দুখশান তাঁর কাছে এসে জিজ্ঞেস করেনঃ মুহাম্মাদ সা. নাকি নিহত হয়েছেন, তুমি জান? সা’দ জবাব দেন, তিনি নিহত হলেও আল্লাহ চিরঞ্জীব, তাঁর মৃত্যু নেই। তুমি তোমার দ্বীনের পক্ষে জিহাদ কর। মুহাম্মাদ সা. তো তাঁর রবের বাণী ও দ্বীনের বিধি-বিধান পৌঁছানের দায়িত্ব পূর্ণরূপে পালন করে গেছেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৩২৭, তাবাকাত- ৩/৫২৩)
উহুদের যুদ্ধ মেষে হযরত রাসূলে কারীম সা. বললেনঃ কেউ সা’দ ইবনুর রাবীর খোঁজ নিয়ে আসতো। এক ব্যক্তি বললেনঃ আমি যাচ্ছি। যারকানী বলেন, লোকটি পড়ে থাকা লাশগুলির চারপাশে চক্কর দিয়ে সা’দের নাম ধরে জোরে ডাক দিলেন। কোন সাড়া পাওয়া গেলোনা। কিন্তু যখন তিনি এই কথা বলে চিৎকার করলেন যে, রাসূলুল্লাহ সা. তোমার খোঁজে আমাকে পাঠিয়েছেন। তখন ক্ষীণকণ্ঠের একটা আওয়াজ ভেসে এল; আমি মৃতদের মধ্যে। তখন তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত। শ্বাস-প্র্শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, জিহ্বাও আয়ত্তে নেই। অন্য একটি বর্ণনা মতে, লোকটি যখন তাঁর খোঁজে ঘুরাঘুরি করছে, তখন সা’দই তাঁকে ডাক দেন। যাই হোক, সেই অবস্থায় সা’দ তাঁকে বললেন, রাসূলুল্লাহকে সা. আমার সালাম পৌঁছিয়ে বলবেন, আমাকে বারোটি আঘাত করা হয়েছে। আমিও আমার হত্যাকারীকে হত্যা করেছি। আর আনসারদের বলবেন, যদি দুর্ভাগ্যবশতঃ রাসূল সা. নিহত হন, আর তোমাদের একজনও জীবিত ফিরে যাও, আল্লাহকে মুখ দেখানোর যেগ্য তোমরা থাকবে না। কারণ, ‘লাইলাতুল আকাবায়’ (আকাবার রাত্রি) তোমরা রাসূলুল্লাহর সা. জন্য জীবন উৎসর্গ করার শপথ নিয়েছিলে। কোন কোন বর্ণনায় এই ব্যক্তির নাম উবাই ইবন কা’ব বলা হয়েছে। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সা’দের পবিত্র রূহ তাঁর নশ্বর দেহ তেকে বেরিয়ে যায়। (তাবাকাত- ৩/৫২৩-২৪, আল-ইসতীয়াব- ২/৩৪, তাহজীবুল আসমা ওয়াল লুগাত- ১/২১০, আল-ইসাবা- ২/২৭)
হযরত উবাই ইবন কা’ব ফিরে এসে রাসূলুল্লাহকে সা. সা’দের অন্তিম কথাগুলো পৌঁছালে তিনি বলেন, আল্লাহ তার ওপর করুণা বর্ষণ করুন। জীবন-মরণ উভয় অবস্থায় সে আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে উপদেশ দিয়েছেন। (উসুদুল গাবা- ২৭৭) উহুদের অন্য এক শহীদ ইবন যায়িদ ও সা’দকে উহুদের প্রান্তরে একই কবরে দাফন করা হয়। খারিজা ছিলেন সম্পর্কে সা’দের চাচা।
সা’দের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই জাহিলী প্রথা অনুসারে তাঁর সকল সম্পত্তি দখল করে নেয়। সা’দ গর্ভবতী স্ত্রী ও দুই কন্যা সন্তান রেখে যান। তখনও মীরাসের (উত্তরাধিকার) আয়াত নাযিল হয়নি। জাবির ইবন আবদিল্লাহ বর্ণনা করেন। সা;দের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী একদিন তাঁর দুই কন্যাকে সংগে করে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট এসে বলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! এরা সা’দের কন্যা। ওদের পিতা উহুদে শাহাদাত বরণ করেছে। আর ওদের চাচা সকল সহায় সম্পত্তি আত্মসাৎ করে বসেছে, ওদেরকে কিছুই দেয়নি। অর্থ-সম্পদ ছাড়া ওদের বিয়ে শাদী হবে কেমন করে? রাসূল সা বললেনঃ আল্লাহ তা’য়ালা ওদের ব্যাপারে ফায়সালা দেবেন। এর পরই সূরা নিসার ১১ নং আয়াতের এই অংশটুকু নাযিল হয়ঃ ‘যদি কন্যা কেবল দুই-এর অধিক হয় তাহলে তাদের জন্য পরিত্যাক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ।’
উপরোক্ত আয়াত নাযিলৈর পর হযরত রাসুলে কারীম সা. মেয়ে দু’টির চাচাকে ডেকে নির্দেশ দেনঃ সা’দের পরিত্যাক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ তার দুই মেয়েকে, এক-অষ্টমাংশ তাদের মাকে দেওয়ার পর বাকীটা তুমি গ্রহণ কর। (আল-ইসাবা- ২/২৭, তাবাকাত- ৩/৫২৪, উসুদুল গাবা- ২/২৭৮, তাহজীবুল আসমা ওয়াল লুগাত- ১/২১০, তাছাড়া ইমাম আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিজি ও ইবন মাজা এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
হযরত রাসূলে কারীম সা. যখন সা’দের কন্যা ও স্ত্রীদের জন্য এই ফায়সালা দান করেন তখনও মাতৃগর্ভের সন্তানের কোন মীরাস বা উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয়নি। এই ঘটনার অনেক পরে গর্ভের সন্তানের মীরাস্ দেওয়ার বিধান হয়। সা’দের স্ত্রীগর্ভের সেই সন্তানটি ভূমিষ্ট হয়। তাঁর নাম রাখা হয় উম্মু সা’দ বিনতু সা’দ এবং পরবর্তীকালে তিনি যায়িদ ইবন সাবিতের স্ত্রী হন। খলীফা হযরত ’উমারের রা. খিলাফতকালে যায়িদ তাঁর স্ত্রীকে বললেন, তুমি ইচ্ছা করলে তোমার পিতার মীরাসের ব্যাপারে আমীরুল মুমিনীনের সাথে কথা বলতে পার। বর্তমানে তনি গর্ভের সন্তানদের মীরাসের অংশ দান করছেন। উম্মু সা’দ বললেনঃ আমি আমার বোনদের কাছে কিছুই দাবী করবো না। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৩৮)
সেই জাহিলী আরবে যখন লেখার খুব কম প্রচলন ছিল, হযরত সা’দ লেখা জানতেন। (তাবাকাত- ৩/৫২২, তাহজীবুল আসবা- ১/২১০) যেহেতু তিনি গোত্রীয় নেতার সন্তান ছিলেন, তাই শিক্ষার বিশেষ সুযোগ লাভ করেছিলেন এবং লেখাও শিখেছিলেন। হযরত রাসূলে কারীমের সা. মুখ থেকে শোনা কিছু হাদীসও মুখস্থ করেছিলেন। (উসুদুল গাবা- ২/২৭৮)
তাঁর ’ঈমানী জোশ ও রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি প্রবল ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছিল আকাবার বাই’য়াত, উহুদের যুদ্ধ এবং মৃত্যুর পূর্বে করে যাওয়া অসীয়াতের মধ্যে।
এই সব কারণে সাহাবায়ে কিরামের নিকট হযরত সা’দের একটা বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান ছিল। তাঁর এক কন্যা একবার হযরত আবু বকরের রা. নিকট আসলে তিনি তাঁর বসার জন্য নিজের কাপড় বিছিয়ে দেন। তা দেখে হযরত উমার রা. জিজ্ঞেস করেনঃ মেয়েটি কার? খলীফা বললেনঃ এ সেই ব্যক্তির মেয়ে- যিনি তোমার ও আমার চেয়ে উত্তম ছিলেন। আবার প্রশ্ন করলেনঃ এমন মর্যাদা কি জন্য? বললেনঃ তিনি রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় জান্নাতে পৌঁছে গেছেন আর তুমি-আমি এখনও এখানে পড়ে আছি। (আল-ইসাবা- ২/২৭)
আবু বকর আয-যুবায়রী বর্ণনা করেনঃ এক ব্যক্তি খলীফা আবু বকরের কাছে গিয়ে দেখলেন, তিনি সা’দ ইবনুর রাবীর ছোট্ট একটি মেয়েকে বুকের মধ্যে নিয়ে তার লালা মুছে দিচ্ছেন ও চুমু খাচ্ছেন। লোকটি জিজ্ঞেস করল, মেয়েটি কে? তিনি জবাব দিলেন, এ এমন এক ব্যক্তির মেয়ে যিনি তোমার ও আমার চেয়ে উত্তম। এ সা’দ ইবনুর রাবীর মেয়ে। তিনি ছিলেন ’আকাবার নাকীব, বদরের যোদ্ধা ও উহুদের শহীদ। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৯৫)

’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা)
’আবদুল্লাহ নাম। কুনিয়াত বা উপনামের ব্যাপারে মতভেদ আছে। যথাঃ আবু মুহাম্মদ, আবু রাওয়াহা অথবা আবু ’আমর। ‘শায়িরু রাসূলিল্লাহ’- ‘রাসূলুল্লাহর সা. কবি’ তাঁর উপাধি। মদীনার খাযরাজ গোত্রের বনী আল-হারিস শাখার সন্তান। পিতা রাওয়াহা ইবন সা’লাবা এবং মাতা কাবশা বিনতু ওয়াকিদ। সাহাবিয়্যা ’আমরাহ বিনতু রাওয়াহা তাঁর বোন এবং কবি সাহাবী নু’মান ইবন বাশীর তাঁর ভাগ্নে। ইতিহাসে তাঁর জন্মের সময়কাল সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তিনি জাহিলী ও ইসলামী উভয় জীবনে অতি মর্যাদাবান ব্যক্তি ছিলেন। (তাবাকাত- ৩/৫২৫, আল-আ’লাম- ৪/২১৭, তাহজীবুল আসমা ওয়াললুগাত- ১/২৬৫)
তিনি তৃতীয় আকাবায় সত্তর জন (৭০) মদীনাবাসীর সাথে অংশগ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাই’য়াত করেন এবং সা’দ ইবনুর রাবূর’র সাথে তিনিও বনু আল-হারিসার ‘নাকীব’ (দায়িত্বশীল) মনোনীত হন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৪৪৩, ৪৫৮, তাবাকাত- ৩/৫২৬, আনসাবুল আশরাফ- ১/২৫২, তারীখুল ইসলাম ও তাবাকাতুল মাশাহীর- ১/১৮১)
তবে সম্ভবতঃ তিনি এই তৃতীয় ’আকাবার পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেন। কোন কোন বর্ণনায় দেখা যায় তিনি প্রথম আকাবায় ছয়জনের সাথে ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাই’য়াত করেন। (হায়াতুস সাহাবা- ১/১০৫)
ইসলাম গ্রহণের পর মদীনায় ইসলামের তাবলীগ ও দাওয়াতের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। রাসূলুল্লাহ সা. মক্কা থেকে হিজরাত করে কুবায় উপস্থিত হলেন। তিনি যে দিন কুবা থেকে সর্বপ্রথম মদীনায় পদার্পণ করেন, সেদিন আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা, সা’দ ইবনুর রাবী ও খারিজা ইবন যায়িদ তাদের গোত্র বনু আল-হারিসার লোকদের সংগে নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. উটনীর পথরোধ করে দৌঁড়ান এবং তাঁকে তাদের গোত্রে অবতরণের বিনীত আবেদন জানান। হযরত রাসূলে কারীম সা. তাঁদের বলেন, উটনীর পথ ছেড়ে দাও। সে আল্লাহর নির্দেশমত চলছে, আল্লাহর যেখানে ইচ্ছা সেখানেই থামবে। তাঁরা পথ ছেড়ে দেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৪৯৫) হযরত রাসূলে কারীম সা. মিকদাদ ইবন আসওয়াদ আল-কিন্দীর সাথে তাঁর ভ্রাতৃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন।
বদর, উহুদ, খন্দক, হুদাইবিয়া, খাইবার, ’উমরাতুল কাদা- প্রত্যেকটি অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করেন। কেবল হিজরী চতুর্থ সনে সংঘটিত ‘বদর আস-সুগরা’ অভিযানে যোগদান করতে পারেননি। রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে মদীনায় স্বীয় স্থলাভিষিক্ত করে যান। (তাবাকাত- ৩/৫২৬, সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৪৫৮) উল্লেখ্য যে, উহুদ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় কুরাইশ নেতা আবু সুফইয়ান ইবন হারব ঘোষণা দেয় যে, এখন থেকে ঠিক এক বছরের মাথায় ‘বদর আস-সুগরা’ তে আবার তোমাদের মুখোমুখি হব। রাসূলুল্লাহ সা. ও মুসলমানরা এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে যথাসময়ে সেখানে উপস্থিত হন। কিন্তু কুরাইশরা অঙ্গীকার পালনের ব্যর্থ হয়। এই বদর আস-সুগরা- তে রাসূল সা. বাহিনীসহ আট দিন অপেক্ষা করেন। এটা হিজরী চতুর্থ সনের জ্বিলকা’দ মাসের ঘটনা। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৩৯-৩৪০)
বদর যুদ্ধের সূচনা পর্বে কুরাইশ পক্ষের বাহাদুর ’উতবা ইবন রাবীয়া’ তার ভাই শাইবা ইবন রাবীয়া ও ছেলে আল-ওয়ালীদ ইবন উতবাকে সংগে করে প্রতিপক্ষ মুসলিম বাহিনীকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান জানায়। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুসলিম বাহিনীর মধ্য থেকে ’আউফ, মুয়াওয়াজ ও আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা সর্বপ্রথম এগিয়ে যান। ’উতবা তাঁদের জিজ্ঞেস করেঃ তোমরা কারা? তাঁরা জবাব দেনঃ আনসারদের একটি দল। ’উতবা বলল, তোমাদের সাথে আমরা লড়তে চাইনা। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৬২৫)
বদরের বিজয় বার্তা দিয়ে হযরত রাসূলে কারীম সা. মদীনার চতুর্দিকে লোক পাঠান। তিনি ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাকে পাঠান মদীনার উঁচু অঞ্চলের দিকে। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৬৪২)
রাসূলুল্লাহ সা. বদর যুদ্ধেল পর মুসলমানদের হাতে বন্দী কুরাইশদের সম্পর্কে সাহাবীদের মতামত জানতে চান। তাঁদের সম্পর্কে নানাজন নানা মত প্রকাশ করেন। ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা বলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ প্রচুর জ্বালানী কাঠে পরিপূর্ণ একটি উপত্যকায় তাদেরকে জড় করে তার মধ্যে ফেলে দেওয়া হোক। তারপর আমিই সেই কাঠে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলবো। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৪২)
খন্দক যুদ্ধের সময় হযরত রাসূলে কারীম সা. আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার রচিত কবিতা বার বার আবৃত্তি করেছিলেন। তার কিছু অংশ নিম্নরূপঃ
‘‘হে আল্লাহ, তোমার সাহায্য না হলে আমরা হিদায়াত পেতাম না,
আমরা যাকাত দিতাম না, সালাত আদায় করতাম না
তুমি আমাদের ওপর প্রশান্তি নাযিল কর,
যুদ্ধে আমাদেরকে অটল রাখ।
যারা আমাদের ওপর জুলুম করেছে,
তারা বিপর্যয় সৃষ্টি করলে, আমরা অস্বীকার করবো।’’
(সীয়ারে আনসার- ২/৫৯)
এই খন্দক যুদ্ধের সময় মদীনার ইহুদী গোত্র বনু কুরাইজার নেতা কাব ইবন আসাদ রাসূলুল্লাহর সা. সাথে সম্পাদিত তাদের চুক্তি ভঙ্গ করে গোপন ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। খবরটি রাসূলুল্লাহর সা. কানে পৌঁছে। তিনি খবরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কয়েকজন লোককে কা’বের নিকট পাঠান। তাদের মধ্যে ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাও ছিলেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২২১, আসাহ আস-সীয়ার- ১৯০)
খন্দক যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহর সা. একটি মু’জিযা বা অলৌকিক কর্মকান্ডের কথা সীরাত গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে। আর তার সাথে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার নামটি উচ্চারিত হয়েছে। ঘটনাটি সংক্ষেপে এইরূপঃ
’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার ভাগ্নী তথা নু’মান ইবন বাশীরের বোন বলেনঃ একদিন আমার মা ’উমরাহ বিনতু রাওয়াহা আমাকে ডেকে আমার কাপড়ে কিছু খেজুর বেঁধে দিয়ে বললেনঃ এগুলি তোমার বাবা বাশীর ও মামা ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাকে দিয়ে এস, তাঁরা দুপুরে খাবেন। আমি সেগুলি নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. পাশ দিয়ে যাচ্ছি, আর আমার বাবা ও মামাকে খোঁজ করছি। রাসূল সা. আমাকে দেখে ডাক দিলেনঃ এই মেয়ে, এদিকে এস। তোমার কাছে কি? বললামঃ খেজুর। আমার মা আমার বাবা বাশীর ইবন সা’দ ও মামা ’আবদুল্লাহর দুপুরের খাবারের জন্য পাঠিয়েছেন। বললেনঃ আমার কাছে দাও। আমি খেজুরগুলি রাসূলুল্লাহর সা. দুই হাতে ঢেলে দিলাম, কিন্তু হাত ভরলো না। তিনি কাপড় বিছাতে বললেন এবং খেজুরগুলি কাপড়ের ওপর ছড়িয়ে দিলেন; তারপর পাশের লেকটিকে বললেনঃ যাও, খন্দকবাসীদের দুপুরের খাবার খেয়ে যেতে বল। ঘোষণার পর, সবাই চেল এল এবং খাবার খেতে শুরু কর। তাঁরা খাচ্ছে, আর খেজুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকলো। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/১১৮, হায়াতুস সাহাবা- ৩/৬৩১)
ষষ্ঠ হিজরীতে হুদাইবিয়ার সন্ধি ও বাই’য়াতে রিদওয়ানেও ’আবদুল্লাহ যোগদান করেন।
আবু রাফে’র পরে উসাইর ইবন রাযিম ইহুদীকে খাইবারের শাসক নিয়োগ করা হয়েছিল। ইসলামের শত্রুতায় সে ছিল উপযুক্ত উত্তরাধিকারী। সে গাতফান গোত্রে ঘুরাঘুরি করে তাদেরকে বিদ্রাহী করে তোলে। হযরত রাসূলে কারীম সা. খবর পেয়ে ষষ্ঠ হিজরীর রমাদান মাসে তিরিশ সদস্যের একটি দলের সাথে ’আবদুল্লাহকে খাইবারে পাঠান। তিনি গোপনে উসাইর ইবন রাযিমের সকল তথ্য সংগ্রহ করে রাসূলুল্লাহকে সা. অবহিত করেন। রাসূল সা. তিরিশ সদস্যের একটি বাহিনী ’আবদুল্লাহর অধীনে ন্যস্ত করে উসাইরকে হত্যার নির্দেশ দেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৭৮)
আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা উসাইরের সাথে দেখা করে বলেন, যদি আপনি নিরাপত্তার আশ্বাস দেন তাহলে একটি কথা বলি। সে আশ্বাস দিল। ’আবদুল্লাহ বললেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন। আপনাকে খাইবারের নেতা বানানো তাঁর ইচ্ছা। তবে আপনাকে একবার মদীনায় যেতে হবে। সে প্রলোভনে পড়ে এবং তিরিশজন ইহুদীকে সংগে করে ’আবদুল্লাহর বাহিনীর সাথে চলতে শুরু করলো। পথে ’আবদুল্লাহ প্রত্যেক ইহুদীর প্রতি নজর রাখার জন্য একজন করে মুসলমান নির্দিষ্ট করে দিলেন। এতে উসাইরের মনে সন্দেহের উদ্রেক হল এবং ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলো। ধোঁকা ও প্রতারণার অপরাধে মুসলিম মুজাহিদরা খুব দ্রুত আক্রমণ চালিয়ে তাদের সকলকে হত্যা করেন। এই ঘটনার পর খাইবারের মাথাচাড়া দেওয়া বিদ্রোহ দমিত হয়। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৬১৮, সীয়ারে আনসার- ২/৬০)
পরে হযরত রাসূলুল্লাহ সা. ’আবদুল্লাহকে খাইবারে উৎপাদিত খেজুর পরিমাপকারী হিসাবে আবারও সেখানে পাঠান। কিছু লোক রাসূলুল্লাহর সা. নিকট ’আবদুল্লাহর কঠোরতার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলো। এক পর্যায়ে তারা ঘুষও দিতে চাইল। ইবন রাওয়াহা তাদেরকে বললেনঃ ওহে আল্লাহর দুশমনরা। তোমরা আমাকে হারাম খাওয়াতে চাও? আমার প্রিয় ব্যক্তির পক্ষ থেকে আমি এসেছি। আমার নিকট তোমরা বানর ও শুকর থেকেও ঘৃণিত। তোমাদের প্রতি ঘৃণা এবং তাঁর প্রতি ভালোবাসা তোমাদের ওপর কোন রকম জুলুমের দিকে নিয়ে যাবে না। একথা শুনে তারা বললঃ এমন ন্যায়পরায়ণতার ওপরই আসমান ও যমীন প্রতিষ্ঠিত। (হায়াতুস সাহাবা- ২/১০৮, আল বিদায়া- ৪/১৯৯)
হুদাইবিয়ার সন্ধি অনুযায়ী সে বছরের মূলতবী ’উমরাহ রাসূল সা. পরের বছর হিজরী সপ্তম সনে আদায় করেন। একে ‘উমরাতুল কাদা’ বা কাজা ’উমরা বলে। এই সফরে রাসূলে কারীম সা. যখন মক্কায় প্রবেশ করেন এবং উটের পিঠে বসে ‘হাজরে আসওয়াদ’ চুম্বন করেন তখন মক্কায় প্রবেশ করেন এবং উটের পিঠে বসে ‘হাজলে আসওয়াদ’ চুম্বন করেন তখন আবদুল্লাহ তার বাহনের লাগাম ধরে একটি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। কবিতাটির কিছু অংশের মর্ম নিম্নরূপঃ
ওরে কাফিরের সন্তানরা! তোরা তাঁর পথ থেকে সরে যা, তোরা পথ ছেড়ে দে। কারণ, সকল সৎকাজ তো তাঁরই সাথে। আমরা তোদের মেরেছি কুরআনের ব্যাখ্যার ওপর, যেমন মেরেছি তাঁর নাযিলের ওপর। এমন মার দিয়েছি যে, তোদের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বন্ধু ভুলে ফেলে গেছে তাঁর বন্ধুকে। প্রভু আমি তাঁর কথার ওপর ঈমান এনেছি। (তাবাকাত- ৩/৫২৬, আল ইসাবা- ২/৩০৭)
এক সময় হযরত উমার রা. ধমক দিয়ে বলেনঃ আল্লাহর হারামে ও রাসূলুল্লাহর সা. সামনে এভাবে কবিতা পাঠ? রাসূল সা. তাঁকে শান্ত করে বলেনঃ ’উমার! আমি তার কথা শুনছি। আল্লাহর কসম! কাফিরদের ওপর তার কথা তীর বর্শর চেয়েও বেশী ক্রিয়াশীল। (আল-ইসাবা- ২/৩০৭) তিনি আবদুল্লাহকে বলেনঃ তুমি এভাবে বলঃ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু, নাসারা ’আবদাহ ওয়া আ’য়ায্যা জুনদাহ, ওয়া হাযামাল আহযাবা ওয়াহদাহ’- এক আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন, তাঁর সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করেছেন এবং একাই প্রতিপক্ষের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেছেন।
’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা উপরোক্ত বাক্যগুলি আবৃত্তি করছিলেন, আর তার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে উচ্চারণ করছিলেন সমবেত মুসলিম জনমন্ডলী। তখন মক্কার উপত্যকা সমূহে সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরছিল। (সীয়ারে আনসার- ২/৬১)
হিজরী অষ্টম সনের জামাদি-ইল-আওয়াল মাসে মূতার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রাসূলুল্লাহ সা. বসরার শাসকের নিকট দূত মারফত একটি চিঠি পাঠান। পথে মূতা নামক স্থানে এক গাসসানী ব্যক্তির হাতে দূত নিহত হয়। দূতের হত্যা মূলতঃ যুদ্ধ ঘোষণার ইঙ্গিত। রাসূল সা. খবর পেয়ে যায়িদ ইবন হারিসার নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী মূতায় পাঠান। যাত্রার প্রাক্কালে হযরত রাসূলে কারীম সা. বলেনঃ যায়িদ হবে এ বাহিনীর প্রধান। সে নিহত হলে জা’ফর ইবন আবী তালিব তার স্থলাভিষিক্ত হবে। জা’ফরের পর হবে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা। আর সেও যদি নিহত হয় তাহলে মুসলমানরা আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের আমীর বানিয়ে নেবে।
বাহিনী মদীনা থেকে যাত্রার সময় হযরত রাসূলে কারীম সা. ‘সানিয়্যাতুল বিদা’ পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে তাদের বিদায় জানান। বিদায় বেলা মদীনাবাসীরা তাদেরকে বললঃ তোমরা নিরাপদে থাক এবং কামিয়াব হয়ে ফিরে এসো। আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা কাঁদতে লাগলেন। লোকেরা বললঃ কাঁদার কী আছে? তিনি বললেন, দুনিয়ার মুহাব্বতে আমি কাঁদছিনা। তিনি সূরা মারিইয়াম এর ৭১ নং আয়াত- ‘তোমাদের প্রত্যেককেই তা (পুলসিরাত) অতিক্রম করতে হবে। এটা তোমার রব-এ অনিবার্য সিদ্ধান্ত’- পাঠ করেন। তারপর তিনি বলেন, আমি কি সেই পুলসিরাত পার হতে পারবো? লোকরা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললঃ আল্লাহ তোমাকে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে আবার মিলিত করবেন। তখন তিনি স্বরচিত একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। কবিতাটির অর্থ নিম্নরূপ। ‘তবে আমি রহমানের কাছে মাগফিরাত কামনা করি, আর কামনা করি অসির অন্তরভেদী একটি আঘাত, অথবা কলিজা ও নাড়িতে পৌঁছে যায় নিযার এমন একটি খোঁচা, আমার কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রমকারী যেন বলে- হায় আল্লাহ, সে কত ভালো যোদ্ধা ও গাজী ছিল।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৭৪, ৩৭৭ হায়াতুস সাহাবা- ১/৫২৯, ৫৩০)
কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, যায়িদ ও জা’ফর বাহিনীসহ সকালে মদীনা ত্যাগ করলেন। ঘটনাক্রমে সেটা ছিল জুময়ার দিন। ’আবদুল্লাহ বললেনঃ আমি রাসূলুল্লাহর সা. সাথে জুময়ার নামায আদায় করে রওয়াহা হব। তিনি নামায আদায় করলে। রাসূল সা. নামায শেষে তাঁকে দেখে বললেনঃ সকালে তোমার সংগীদের সাথে যাওনি কেন? ’আবদুল্লাহ বললেন, আমি ইচ্ছা করেছি, আপনার সাথে জুম’য়া আদায় করে তাদের সাথে মিলিত হব। রাসূল সা. বললেন, তুমি যদি দুনিয়ার সবকিছু খরচ কর তবুও তাদের সকালে যাত্রার সাওয়াবের সমকক্ষতা অর্জন করতে পারবে না। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৪৬৩)
মদীনা থেকে শামের ‘মা’য়ান’ নামক স্থানে পৌঁছে তাঁরা জানতে পারেন যে, রোমান সম্রাট হিরাকল এক লাখ রোমান সৈন্যসহ ‘বালকা’-র ‘মাব’ নামক স্থানে অবস্থান নিয়েছে। আর তাদের সাথে যোগ দিয়েছে লাখম, জুজাম, কায়ন, বাহরা, বালী-সহ বিভিন্ন গোত্রের আরও এক লাখ লোক। এ খবর পেয়ে তাঁরা মায়ানে দুই দিন ধরে চিন্তা-ভাবনা ও পরামর্শ করেন। মুসলিম সৈনিকদের কেউ কেউ মত প্রকাশ করে যে, আমরা শত্রুপক্ষের সৈন্যসংখ্যা ও প্রস্তুতির সব খবর রাসূলকে সা. অবহিত করি। তারপর তিনি আমাদেরকে অতিরিক্ত সৈন্য দিয়ে সাহায্য করবেন অথবা অন্য কোন নির্দেশ দেবেন এবং আমরা সেই মোতাবিক কাজ করব।
আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা তখন সৈনিকদের উদ্দেশ্যে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ওহে জনমন্ডলী, এখন তোমরা শত্রুর মুখোমুখি হতে পসন্দ করছো না; অথচ তোমার সবাই শাহাদাত লাভের উদ্দেশ্যে বের হয়েছো। আমরা তো শত্রুর সাথে সংখ্যা, শক্তি ও আধিক্যের দ্বারা লড়বো না। আমরা লড়বো দ্বীনের বলে বলীয়ান হয়ে- যে দ্বীনের দ্বারা আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। তোমরা সামনে ঝাঁপিয়ে পড়। তোমাদের সামনে আছে দুইটি কল্যানের যে কোন একটি হয় বিজয়ী হবে নতুবা শাহাদাত লাভ করবে। সৈনিকরা তাঁর কথায় সায় দিয়ে বললঃ আল্লাহর কসম! ইবন রাওয়াহা ঠিক কথাই বলেছেন। তারা তাদের সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হন। আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাও একটি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতে করতে তাদের সাথে চলেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৩৭৫, আসাহ আস-সীয়ার- ২৮০)
তাঁরা ‘মা’য়ান’ ত্যাগ করে মূতায় পৌঁছে শিবির স্থাপন করেন। এখানে অমুসলিমদের সাথে এক রক্তক্ষয়ী অসম যুদ্ধ হয়। ইতিহাসে এই যুদ্ধ ‘মূতার যুদ্ধ’ নামে খ্যাত। মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা মাত্র তিনহাজার আর শত্রুবাহিনীর সংখ্যা অগণিত। (সীয়ারে আনসার- ২/৬২)
প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হল। সেনাপতি যায়িদ ইবন হারিসা যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হলেন। জা’ফর তাঁর পতাকাটি তুলে নিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনিও শাহাদাত বরণ করলেন। এবার আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা ঝান্ডা হাতে তুলে নিয়ে সামনে অগ্রসর হলেন। তিনি ছিলেন ঘোড়ার পিঠে। ঘোড়ার পিঠ থেকে নামার মুহূর্তে তাঁর মনে একটু দ্বিধার ভাব দেখা দিল। তিনি সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আপন মনে একটি কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। তার কিছু অংশ নিম্নরূপঃ
‘হে আমার প্রাণ! আমি কসম করেছি, তুমি অবশ্যই নামবে, তুমি স্বেচ্ছায় নামবে অথবা নামতে বাধ্য করা হবে। মানুষের চিৎকার ও ক্রন্দন ধ্বনি উত্থিত হচ্ছে, তোমার কী হয়েছে যে, এখনও জান্নাতকে অবজ্ঞা করছো? সেই কত দিন থেকে না এই জান্নাতের প্রত্যাশা করে আসছো, পুরানো ফুটো মশকের এক বিন্দু পানি ছাড়া তো তুমি আর কিছু নও। হে আমার প্রাণ, আজ তুমি নহত না হলেও একদিন তুমি মরবে, এই মৃত্যুর হাম্মাম এখানে উত্তপ্ত করা হচ্ছে। তুমি যা কামনা করতে এখন তোমাকে তাই দেওয়া হয়েছে, তুমি তোমার সঙ্গীদ্বয়ের কর্মপন্থা অনুসরণ করলে হিদায়াত পাবে।’
উপরোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করতে করতে তিনি ঘোড়া থেকে নেমে পড়েন। তখন তাঁর এক চাচাতো ভাই গোশতসহ একটুকরো হাড় নিয়ে এসে তার হাতে দেন। তিনি সেটা হাতে নিয়ে যেই না একটু চাটা দিয়েছেন, ঠিক তখনই প্রচণ্ড যুদ্ধের শোরগোল ভেসে এলো। ‘তুমি এখনও বেঁচে আছ’- এ কথা বলে হাতের হাড়টি ছুড়ে ফেলে দিয়ে তরবারি হাতে তুলে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শত্রুপক্ষের এক সৈনিক এমন জোরে তীর নিক্ষেপ করে যে, মুসলিম বাহিনীর মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি হয়। একটি তীর তাঁর দেহে বিদ্ধ হয়। তিনি রক্তরঞ্জিত অবস্থায় সাথীদের আহবন জানান। সাথীরা ছুটে এসে তাঁকে ঘিরে ফেলে এবং শত্রু বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। (তাবাকাত- ৩/৫২৯, সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৩৭৯, হায়াতুস সাহাবা- ১/৫৩৩, সীয়ারে আনসার- ২/৬৩, আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৮০, ২৪৪)
মূতায় অবস্থানকালে শাহাদাতের পূর্বে একদিন রাতে তিনি একটি মর্মস্পর্শী কবিতা আবৃত্তি করছিলেন। আবৃত্তি শুনে যায়িদ ইবন আরকাম কাঁদতে শুরু করেন। তিনি যায়িদের মাথার ওপর দুররা উঁচু করে ধরে বলেনঃ তোমার কী হয়েছে? আল্লাহ আমাকে শাহাদাত দান করলে তোমরা নিশ্চিন্তে ধরে ফিরে যাবে। (আল-ইসাবা- ২/৩০৭)
হযরত রাসূলে কালীম সা. ওহীর মাধ্যমে মূতার প্রতি মুহূর্তের খবর লাভ করে মদীনায় উপস্থিত লোকদের সামনে বর্ণনা করছিলেন। সহীহ বুখারীতে আনাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, মূতার খবর আসার পূর্বেই রাসূল সা. মদীনায় যায়িদ, জা’ফর ও আব্দুল্লাহর শাহাদাতের খবর দান করেন। তিনি বলেনঃ যায়িদ ঝান্ডা হাতে নেয় এবং শহীদ হয়। তারপর জা’ফর তুলে নেয়, সেও শহীদ হয়। অতঃপর আবদুল্লাহ তুলে নেয় এবং সেও শহীদ হয়। তিনি একথা বলছিলেন আর তাঁর দুই চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। (আসাহ আস-সীয়ার- ২৮১) কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, যায়িদ ও জা’ফরের শাহাদাতের খবর দেওয়ার পর রাসূল সা. একটু চুপ থাকেন। এতে আনসারদের চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়। তারা ধারণা করে যে, ’আবদুল্লাহর এমন কিছু ঘটেছে যা তাদের মনঃপূত নয়। তারপর রাসূল সা. বলেনঃ অতঃপর আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা পতাকা উঠিয়ে নেয় এবং যুদ্ধ করে শহীদ হয়। তিনি আরও বলেন, তাদের সকলকে জান্নাতে আমার কাছে আনা হয়েছে। আমি দেখলাম, তারা সোনার পালঙ্কে শুয়ে আছে। তবে ’আবদুল্লাহর পালঙ্কটি তার অন্য দুই সঙ্গীর থেকে একটু বাঁকা। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ এটা এমন কেন? বলা হলঃ তারা দুইজন দ্বিধাহীন চিত্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু আবদুল্লাহর চিত্ত দ্বিধা-সংকোচ একটি দোল খায়। তারপর সে ঝাঁপিয়ে পড়ে। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৩৮০)
মূতার তিন সেনাপতির মৃত্যুর খবর রাসূলুল্লাহর সা. নিকট পৌঁছলে তিনি উঠে দাঁড়ান এবং তাঁদের কর্মকাণ্ড বর্ণনা করে এই বলে দুআ করেনঃ আল্লাহ তুমি যায়িদকে ক্ষমা করে দাও। একথা তিনবার বলেন, তারপর বলেনঃ আল্লাহ তুমি জাফর ও আবদুল্লাহ ইবন রাওযাহাকে ক্ষমা করে দাও। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৩৪৪)
মূতায় যাওয়ার পূর্বে একবার মদীনায় অসুস্থ অবস্থায় অচেতন হয়ে পড়েন। তখন তাঁর বোন ’উমরাহ নানাভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে আরবদের প্রথা অনুযায়ী বিলাপ শুরু করেন। চেতনা ফিরে পেয়ে তিনি বোনকে বলেন, তুমি আমার সম্পর্কে অতিরঞ্জন করে যা কিছু বলছিলে, তার সবই আমার কাছ থেকে সত্যায়িত করা হচ্ছিল। এই কারণে তাঁর মৃত্যুর সময় তারই উপদেশ মত সকলে ‘সবা’ (ধৈর্য্য) অবলম্বন করে। সহীহ বুখারীতে এসেছে- তিনি যখন মারা যান তাঁর জন্য কান্নাকাটি বা বিলাপ করা হয়নি। (উসুদুল গাবা- ৩/১৪৭-১৫৯, সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৩৮০)
মূতা রওয়ানা হওয়ার সময় তাঁর স্ত্রী ও সন্তান ছিল। কিন্তু উসুদুল গাবা গ্রন্থকার বলেছেন, তিনি নিহত হন এবং কোন সন্তান রেখে যাননি। (উসুদুল গাবা- ৩/১৫৯, সীয়ারে আনসার- ২/২৬৫)
’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার স্ত্রী সম্পর্কে আল-ইসতীয়াব গ্রন্থে একটি কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। বিশেষ এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর স্ত্রী তাঁকে বলেন, তুমি যদি পাক অবস্থায় থাক তাহলে একটু কুরআন তিলাওয়াত করে শুনাও। তখন ’আবদুল্লাহ চালাকির আশ্রয় গ্রহণ করে একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। যার কিছু নিম্নরূপঃ
‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহর ওয়াদা সত্য,
কাফিরদের ঠিকানা দোযখ,
’আরশ ছিল পানির ওপর,
’আরশের ওপর ছিলেন বিশ্বের প্রতিপালক,
আর সেই আরশ বহন করে তাঁরই শক্তিশালী ফিরিশতারা।’’
তাঁর স্ত্রী কুরআনের পারদর্শী ছিলেন না। এই কারণে তিনি বিশ্বাস করেন যে, আবদুল্লাহ কুরআন থেকেই তিলাওয়াত করেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ সত্যবাদী, আমার চোখ দেখতে ভুল করেছে। আমি অহেতুক তোমাকে দোষারোপ করছি। দাসীর সাথে উপগত হওয়ার পর স্ত্রীর ক্রোধ থেকে বাঁচার জন্য হযরত আবদুল্লাহ এমন বাহানার আশ্রয় নেন। তিনি পরদিন সকালে এ ঘটনা রাসূলুল্লাহকে সা. জানালে তিনি হেসে দেন। (আল-ইসতীয়াব- ১/৩৬২, হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৫)
সামরিক দক্ষতা ছাড়াও হযরত আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার আরও অনেক যোগ্যতা ছিল। একারণে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে সমাদর করতেন। সেই জাহিলী আরবে যে মুষ্টিমেয় কিছু লোক আরবীতে লেখা জানতো, ’আবদুল্লাহ তাদের অন্যতম। ইসলাম গ্রহণের পর রাসুল সা. তাঁকে স্বীয় ‘কাতিব’ (লেখক) হিসাবে নিয়োগ করেন। তবে কখন কিভাবে তিনি লেখা শিখেছিলেন, সে সম্পর্কে ইতিহাস কিছু বলে না।
তিনি ছিলেন তৎকালীন আরবের একজন বিখ্যাত করি। ডক্টর ’উমার ফাররুখ বলেন, ’মদীনায় ইসলাম রাষ্ট্রশক্তি অর্জন করলে আরবের মুশরিকগণ আরও শংকিত হয়ে পড়ে। মক্কার পৌত্তলিক কবিগণ বিশেষতঃ ’আবদুল্লাহ ইবন আয-যিবা’রী, কা’ব ইবন যুহাইর ও আবু সুফইয়ান ইবন আল-হারিস রাসূলুল্লাহ সা. ও ইসলামের নিন্দা ও কুৎসা রটনা করে কবিতা লিখতো। তখন মদীনায় হাসসান ইবন সাবিত, ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা ও কা’ব ইবন মালিক তাদের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড়িয়ে সমুচিত জবাব দেন এবং ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরেন। মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত দু’পক্ষের এ কবিতায় যুদ্ধ চলতে থাকে। ’আবদুল্লাহ ছিলেন তাঁর যুগের ভালো কবিদের একজন। তিনি হাস্সান ও কা’বের সমপর্যায়ের কবি। জাহিলী যুগে তিনি কবি কায়েস ইবনুল খুতাইম- এর সাথে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ মূলক কবিতা লিখে প্রতিযোগিতা করতেন। আর ইসলামী যুগে রাসূলের সা. প্রশংসা এবং মুশরিক কবিদের প্রতিবাদ ও নিন্দায় কবিতা রচনা করতেন। (তারীখুল আদাব আল-আরাবী- ১/২৫৮, ২৬১, ২৬২)
জুরযী যায়দান বলেনঃ ‘মক্কার পৌত্তলিক কবিদের মধ্যে যারা মুসলমানদের নিন্দা করে কবিতা বলতো তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবন আয-যিবারী, আবু সুফইয়ান ইবন আল-হারিস ও ’আমর ইবন আল- ’আস ছিল সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। একদিন নবী সা. বললেনঃ যারা তাদের অস্ত্রের দ্বারা আল্লাহর রাসূলকে সাহায্য করেছে, জিহ্বা দিয়ে তাঁকে সাহায্য করতে তাদেরকে কিসে বিরত রেখেছে? এই কথার পর যে তিন কবি উপরোক্ত কবিদের প্রতিরোধে দাঁড়িয়ে যান তাঁরা হলেন, হাস্সান, ক’ব ও আবদুল্লাহ। রাসুল সা. মনে করতেন, এই তিন কবির কবিতা শত্রুদের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তিনি বলেছেনঃ এই তিন কবি কুরাইশদের কাছে তীরের ফলার চেয়েও বেশী শক্তিশালী। (তারীখু আদাব আল-লুগাহ আল-’আরাবিয়্যাহ- ১/১৯১)
কবি হাস্সান কুরাইশদের বংশ ও রক্তের ওপর আঘাত হানতেন, কবি কা’ব কুরাইশদের যুদ্ধ-বিগ্রহ ও অতীত ইতিহাস বর্ণনা করে তাদের দোষ-ত্রুটি তুলে ধরতেন। পক্ষান্তরে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা তাদের কুফরীর জন্য নিন্দা ও ধিক্কার দিতেন। (উসুদুল গাবা- ৪/২৪৮) আবুল ফারাজ আল-ইস্পাহানী বলেনঃ হাস্সান ও কা’ব প্রতিপক্ষ কুরাইশ কবিদের মত যুদ্ধ বিগ্রহ ও গৌরবমূলক কাজ-কর্ম নিয়ে কবিতা রচনা করতেন এবং তার মধ্যে কুরাইশদের বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি তুলে ধরতেন। আর আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহ তাদের কুফরীর জন্য ধিক্কার ও নিন্দা জানাতেন। কুরাইশদের ইসলাম গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত পূর্বোক্ত দু’জনের কবিতা ছিল তাদের নিকট ’আবদুল্লাহর কবিতা অপেক্ষা অধিকতর পীড়াদায়ক। কিন্তু যখন তারা ইসলাম গ্রহণ করে তার মর্মবাণী উপলব্ধি করলো তখন ’আবদুল্লাহর কবিতা সর্বাধিক প্রভাবশালী ও পীড়াদায়ক বলে তাদের নিকট প্রতিভাত হলো। (কিতাবুল আগানী- ৪/১৩৬)
আবদুল্লাহ ছিলেন স্বভাব কবি। উপস্থিত কবিতা রচনায় দক্ষ ছিলেন। হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াব রা. বলেনঃ তাৎক্ষণিক কবিতা বলার ক্ষেত্রে আমি ’আবদুল্লাহ অপেক্ষা অধিকতর সক্ষম আর কাউকে দেখিনি। (তাহীবুল আসমা ওয়াল লূগাত- ১/২৬৫) একদিন তিনি মসজিদে নববীতে। পূর্বেই সেখানে হযরত রাসূলে কারীম সা. একদল সাহাবীর সাথে বসে ছিলেন। তিনি ’আবদুল্লাহকে কাছে ডেকে বলেন, তুমি এখন মুশরিকদের সম্পর্কে কিছু কবিতা শোনাও।’ আবদুল্লাহ কিছু কবিতা শোনালেন। কবিতা শুনে রাসূল সা. একটু হাসি দিয়ে বলেন, আল্লাহ তোমাকে অটল রাখুন। (আল-ইসতীয়াব- ১/৩৬২, তাবাকাত- ৩/৫২৮, আল-ইসাবা- ২/৩০৭)
হযরত আবু হুরাইরা রা. ওয়াজ নসীহাতের সময় বলতেন, তোমাদের এক ভাই আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা অশ্লীল কথা বলতেন। তারপর তিনি ’আবদুল্লাহর একটি কবিতা আবৃত্তি করতেন। ইমাম আহমাদ তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে কবিতাটি সংকলটন করেছেন। (আল-ফাতহুর রাব্বানী, শরহু মুসনাদ আহমাদ- ২২/২৮৭)
’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার সব কবিতা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। তবে এখনও পঞ্চাশটি শ্লোক (verse) সীরাত ও ইতিহাসের বিভিন্ন গ্রন্থে সংরক্ষিত আছে। সীরাতু ইবন হিশামে তার অধিকাংশ পাওয়া যায়। (দারিয়া-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা (উর্দু)- ১২/৭৮০)
যখন সূরা শু’য়ারা- এর ২২৪-২২৬ নং আয়াতগুলি- ‘কবিদেরকে তারাই অনুসরণ করে যারা বিভ্রান্ত। তুমি কি দেখনা তারা উদভ্রান্ত হয়ে প্রত্যেক উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায়? এবং যা করে না তাই বলে বেড়ায়’- নাযিল হয় তখন হাস্সান, আবদুল্লাহ ও কাব এত ভীত হয়ে পড়েন যে, তাঁরা কাঁদতে কাঁদতে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট ছুটে যান। তাঁরা বলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ, এই আয়াত নাযিলের সময় আল্লাহ তো জানতেন আমরা কবি। তখন রাসূল সা. আয়াতের পরবর্তী অংশ- ‘কিন্তু তারা ব্যতীত যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, আল্লাহকে বার বার স্মরণ করে ও অত্যাচারিত হওয়ার পর প্রতিশোধ গ্রহণ করে’- পাঠ করেন এবং বলেন এই হচ্ছো তোমরা। (আল-ইসাবা- ২/৩০৭, তাবাকাত- ৩/৫২৮, হায়াতুস সাহাবা- ৩/৭৭, ১৭২)
আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা থেকে কয়েকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি হাদীসগুলি খোদ রাসূল সা. ও বিলাল থেকে বর্ণনা করেছেন। আর তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন ইবন ’আব্বাস, উসামা ইবন যায়িদ, আনাস ইবন মালিক, নু’মান ইবন বাশীর ও আবু হুরাইরা। (আল-ইসাবা- ২/৩০৬)
আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা ছিলেন একজন দুনিয়া বিরাগী ’আবিদ ও সব সময় আল্লাহকে স্মরণকারী (জাকির) ব্যক্তি। আবুদ দারদা বলেনঃ এমন কোন দিন যায়না যেদিন আমি তাঁকে স্মরণ করিনা। আমার সঙ্গে একত্র হলেই তিনি বলতেনম, এস, কিছুক্ষণের জন্য আমরা মুসলমান হয়ে যাই। তারপর বসে ‘জিকর’ শুরু করতেন। ‘জিকর’ শেষ হলে বলতেন, এটা ছিল ঈমানের মজলিস। (উসুদুল গাবা- ৩/১৫৭)
আনাস ইবন মালিক বলেন। ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার সাথে রাসূলুল্লাহর সা. কোন সাহাবীর দেখা হলে বলতেন, এস, আমরা কিছু সময়ের জন্য ঈমান আনি। একদিন এক ব্যক্তি তাঁর এমন কথায় খুব রেগে গেল। সে সোজা রাসূলুল্লাহর সা. নিকট অভিযোগ করে বললঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি কি দেখেন না, ইবন রাওয়াহা আপনার ঈমান ত্যাগ করে কিছুক্ষণের ঈমানকে পসন্দ করছে? তিনি বললেন, আল্লাহ ইবন রাওয়াহার ওপর রহম করুন। সে এমন সব মজলিস পসন্দ করে যার জন্য ফিরিশতারাও ফখর করে থাকে।
একবার তো তাঁর এমনি ধরণের আহ্বানে এক ব্যক্তি প্রতিবাদ করে বলে বসলো, কেন আমরা কি মুমিন নই? তিনি বললেনঃ হাঁ, আমরা মুমিন। তবে আমরা জিকর করবো, তাতে আমাদের ঈমান বৃদ্ধি পাবে। (আল-ফাতহুল রাব্বানী- ২২/২৮৬, হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৫)
তাঁর স্ত্রী বর্ণনা করেন, যখন তিনি ঘর থেকে বের হতেন, দুই রাকায়াত নামায আদায় করতেন। আবার ঘরে ফিরে এসে ঠিক একই রকম করতেন। এ ব্যাপারে কক্ষণও অলসতা করতেন না। (আল-ইসাবা- ২/৩০৭, হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৪৮)
একবার এক সফরে এত প্রচণ্ড গরম ছিল যে, মানুষ সূর্যের তেজ থেকে বাঁচার জন্য নিজ নিজ মাথার ওপর হাত দিয়ে রেখেছিল। এমন গরমে কে রোযা রাখে? কিন্তু তার মধ্যেও কেবল হযরত রাসূলে কারীম সা. ও ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা ‘সাওম’ পালন করেন। (সহীহ বুখারী- ১/২৬১, মুসলিম- ১/৩৫৭, হায়াতুস সাহাবা- ১/৪৭৯, তাহজীবুল আসমা ওয়াল লুগাত- ১/২৬৫)
জিহাদের প্রতি ছিল তাঁর দুর্নিবার আকর্ষণ। বদর থেকে নিয়ে মূতা পর্যন্ত যত যুদ্ধ হয়েছে তার একটিতেও তিনি অনুপস্থিত থাকেননি। রিজাল শাস্ত্রবিদরা (চরিত অভিধান) বলেছেনঃ আবদুল্লাহ সবার আগে যুদ্ধে বের হতেন এবং সবার শেষে ঘরে ফিরতেন। (আল-ইসাবা- ২/৩০৭)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. আদেশ-নিষেধ তিনি অক্ষরে পালন করতেন। একটি ঘটনায় এর সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার হযরত রাসূলে কারীম সা. মসজিদে খুতবা (ভাষণ) দিচ্ছেন। আর ইবন রাওয়াহা যাচ্ছেন মসজিদের দিকে। তিনি যখন মসজিদের বাইরের রাস্তায় এমন সময় তিনি শুনতে পেলেন রাসূল সা. বলছেন, তোমরা নিজ নিজ স্থানে বসে পড়। এই নির্দেশ ইবন রাওয়াহার কানে যেতেই সেখানে বসে পগেন। রাসূল সা. খুতবা শেষ করার পর কোন এক ব্যক্তি ইবন রাওয়াহার ব্যাপারটি তাঁকে শোনান। শুনে তিনি মন্তব্য করেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের লালসা আল্লাহ তার মধ্যে আরও বৃদ্ধি করে দিন। (আল-ইসাবা- ২/৩০৬, হায়াতুস সাহাবা- ২/৩৫৬)
হযরত আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা যেমন রাসূলকে সা. গভীরভাবে ভালোবাসতেন তেমনি রাসূল সা.-ও তাঁকে ভালোবাসতেন। একবার আবদুল্লাহ অসুখে পড়ে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। রাসূল সা. দেখতে গেলেন। তিনি দু’আ করলেঃ হে আল্লাহ, যদি তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসে থাকে তাহলে সহজে তার মরণ দাও অন্যথায় তাকে ভালো করে দাও। (আল-ইসাবা- ২/৩০৬)
উসামা ইবন যায়িদ বলেনঃ সা’দ ইবন ’উবাদা অসুস্থ হলে রাসূল সা. তাঁকে দেখার জন্য বের হলেন। আমাকেও বাহনের পিছনে বসিয়ে নিলেন। ’আবদুল্লাহ ইবন উবাই তার মুযাহিম দুর্গের ছায়ায় নিজ গোত্রের আরও কিছু লোকের সাথে বসে ছিল। রাসূল সা. মনে করলেন, কোন কথা না বলে তাদের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া শিষ্টাচারের পরিপন্থী। তাই তিনি বাহনের পিছ থেকে নামলেন এবং সালাম দিয়ে কিছুক্ষণ বসলেন। তারপর কুরআনের কিছু আয়াত তিলাওয়াত করে তাদের সকলকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। এতক্ষণ ’আবদুল্লাহ ইবন উবাই চুপ করে ছিল। রাসূলুল্লাহর সা. কথা শেষ হলে সে বললঃ দেখুন, আপনার কথা সত্য হলে বাড়ীতে গিয়ে বসে থাকুন। কেউ আপনার কাছে গেলে তাকে যত পারেন শুনাবেন। এমন অবাঞ্ছিতভাবে কোন মজলিসে উপস্থিত হয়ে কাউকে বিরক্ত করবেন না। সেখানে উপস্থিত মুসলমানদের মধ্যে ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাও ছিলেন। তিনি গর্জে উঠলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ, তার কথা কক্ষণও মানবেন না। আপনি আসবেন! আপনি আমাদের মজলিসে, ঘরে ঘরে এবং বাড়ীতে বাড়ীতে আসবেন। আমরা সেটাই পসন্দ করি। আপনার আগমণের দ্বারা আল্লাহ আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন, আমাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৫৮৭, হায়াতুস সাহাবা- ২/৫০৯)
একদিন আবদুল্লাহ তাঁর স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে কাঁদা শুরু করলেন। তাই দেখে স্ত্রীও কাঁদতে লাগলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কাঁদছো কেন? স্ত্রী বললেনঃ তোমাকে কাঁদতে দেখে আমি কাঁদছি। তখন তিনি সূরা মরিয়াম- এর ৭১ নং আয়াতটি তিলাওয়াত করে বলেন, আমি এই আয়াতটি স্মরণ করে কাঁদছি। জানিনে আমি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাব কিনা। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৪৫)
বিখ্যাত আনসারী সাহাবী আবু দারদা-র ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে আবদুল্লাহর ভূমিকাটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। জাহিলী যুগে উভয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক ছিল। ’আব্দুল্লাহর ইসলাম গ্রহণের পরও আবু দারদা মূর্তি উপাসক থেকে যান। তাঁর বাড়ীতে ছিল বিরাট এক মূর্তি। একদিন আবু দারদা বাড়ী থেকে বের হলেন, আর ঠিক সেই সময় ভিন্ন পথ দিয়ে আবদুল্লাহ বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করলেন। তিনি আবু দারদা-র স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেনঃ আবু দারদা কোথায়? স্ত্রী জবাব দিলেনঃ এই মাত্র বেরিয়ে গেলেন। আবদুল্লাহ মূর্তির ঘরে প্রবেশ করে সেখানে রক্ষিত একটি হাতুড়ী দিয়ে মূর্তিটি ভেঙ্গে চুরমার করে ফেললেন। শব্দ শুনে আবু দারদা-র স্ত্রী ছুটে গেলেন। আবদুল্লাহ কাজ শেষ করে চলে গেলেন। এ দিকে আবু দারদা-র স্ত্রী ভয়ে মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। আবু দারদা ঘরে ফিরে স্ত্রীর নিকট সব কথা শুনে প্রথমে খুব রেগে গেলেন। কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তা করলেন, যদি মূর্তির কোন ক্ষমতা থাকতো তাহলে সে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হতো। এই উপলব্ধির পর তিনি আবদুল্লাহকে সংগে করে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট যান এবং ইসলামের ঘোষণা দেন। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৩৩২, ৩৩৩)
একবার কবি হাস্সান ইবন সাবিত, একটি কবিতায় সাফওয়ান ইবন আল-মুয়াত্তাল ও তাঁর গোত্রের নিন্দা করেন। সাফওয়ান ক্ষেপে গিয়ে কবিকে মারপিট করে এবং তাঁকে দু’হাত গলার সাথে বেঁধে বনু আল-হারিসের পল্লীতে নিয়ে যায়। আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা তাকে ছাড়িয়ে দেন এবং বিষয়টি রাসূলুল্লাহকে সা. অবহিত করেন। তাদের দু’জনকেও রাসূলুল্লাহর সা. দরবারে নিয়ে আসেন। তিনি তাদের ঝগড়া মিটমাট করে দেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৩০৫)
উপরে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যসমূহের কারণে রাসূল সা. তাঁর প্রশংসায় বলেছেনঃ ‘নি’মার রাজুলু আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা’- আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা কতই না ভালো মানুষ। (আল-ইসাবা- ২/৩০৬)


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি