মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক
প্রত্যেক মানুষই অপরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কামনা করে। প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব এবং সহচরদের সাথে কেউ তিক্ত এবং অপ্রীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করতে চায় না। সকলেই অপরের প্রিয় পাত্র হতে ইচ্ছুক। তবে এটা কেউ কি ভেবেছে কোন দিন,মানুষের মধ্যে এ ভাবটি কেন বিরাজমান? অপরের কাছে ভাল বিবেচিত হবার জন্যে মানুষের মনে কেন এ প্রবণতা? গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, এর একাধিক কারণ রয়েছে। প্রতিটি মানুষেরই সহজাত আকাংখা হলো অন্যের কাছে উচ্চ মর্যাদা লাভ করা, তার সম্পর্কে সবার মনে উচ্চ ধারণা থাকা। অপরের দৃষ্টিকটু হওয়া সকলের নিকটই পীড়াদায়ক। কাজেই মানুষের এ প্রবণতা দীনহীন ভিক্ষুক থেকে নিয়ে শাহানশাহ্‌ রাজাধিরাজ সকলের মধ্যে দেখা যায়। দোকানদার মনে করে মানুষের সাথে তার সম্পর্ক ভালো এবং ব্যাপকতর হোক। সবাই তাকে সৎ বলে বিবেচনা করুক। এতে তার ব্যবসার উন্নতি এবং প্রসারের সম্ভাবনা রয়েছে। এমনিভাবে উকিল-মোক্তার, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, কারখানার মালিক এক কথায় মানব সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিই চায়- সমাজের মানুষের সাথে তার সম্পর্কের সীমা ব্যাপক হতে ব্যাপকতর হোক, সকলেই তার সম্বন্ধে ভালো ধারণা পোষণ করুক। বিশেষ করে যেদিন থেকে গণতান্ত্রিক অধিকার বলে এটা স্বীকৃত হয়েছে যে, দেশ এবং সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব এমন ব্যক্তিবর্গের হাতেই অর্পিত হতে হবে যাদের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের আস্থা রয়েছে সেদিন থেকেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভের প্রয়াস একটি স্বতন্ত্র আর্টে পরিণত হয়েছে। এমন অসংখ্য কৃত্রিম পন্থার উদ্ভব হয়েছে যার সাহায্যে একজন লোক সমাজে অনায়াসেই তার জনপ্রিয়তা এবং সমর্থকের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষের মধ্যে তার সম্পর্কের পরিধি ব্যাপকতর করতে সক্ষম হয়। মোটকথা, কোন সময় প্রেম-প্রীতি, অর্থসম্পদের মোহ, আবার কোন সময় মান সম্মান এবং উচ্চ মর্যাদার লালসা মানুষকে এজন্যে বাধ্য করে, যেন মানব-সমাজে তার সম্পর্ক ভালো এবং ব্যাপকতর হয় সকলেই তার সম্বন্ধে ভালো ধারণা পোষণ করে তাকে সুনজরে দেখে।

যুগ যুগ ধরে এ আকাংখা পূরণের জন্যে মানুষ প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। দাওয়াত করে অপরকে খাওয়াচ্ছে, দরিদ্রের সাহায্যের জন্য উপদেশ দিচ্ছে। নিঃসহায় নিঃসম্বলদের সমবেদনায় গদগদ কণ্ঠে বক্তৃতা দিচ্ছে। কেউ অন্নহারা বস্ত্রহারাদের ডাল-ভাতের দাবী নিয়ে কৃত্রিম মানব প্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখাচ্ছে। চাষী-মজুর,সর্বহারাদের কাতারে দাঁড়িয়ে তাদের অধিকার নিয়ে সংগ্রামের অভিনয় করছে। অতঃপর গণ-সমর্থন আদায় করে গদি দখলের পথ করে নিচ্ছে। কখনো বা আদর্শ চরিত্রের অবতার সেজে মানুষের সামনে ধরা দিয়েছে,আবার কখনো বা ক্ষমতা বহির্ভূত ব্যাপারে হাত বাড়াচ্ছে। এমনিভাবে অসংখ্য উপায়ে মানব-সমাজে জনপ্রিয়তার পথ করে নিচ্ছে। মানুষের সাথে সম্পর্কের উন্নতি এবং প্রসারের ক্ষেত্রে অনেকের উদ্দেশ্য দিবালোকের ন্যায় সকলের সামনে ধরা পড়ে; স্পষ্ট বুঝা যায় সে কি উদ্দেশ্যে এ সম্পর্কের উন্নতি এবং প্রসার কামনা করছে। আবার অনেকের ব্যাপারে ধরা না পড়লেও একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই দেখা যাবে এ সম্পর্ক স্থাপনের পিছনে তার কি মুখ্য উদ্দেশ্য রয়েছে।

এতো গেলো সম্পর্ক স্থাপন, এর উন্নতি এবং সম্প্রসারণের ইচ্ছা ও কামনার একটা দিক। আসুন, এখন একজন সত্যিকার মুমিনের জীবনে এর রূপ এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। এ ভূপৃষ্ঠে আল্লাহ্‌র কর্তৃত্ব এবং রাসূলের নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী এমন একজন মানুষের ভূমিকা এক্ষেত্রে কি রূপ পরিগ্রহ করে এবং করা উচিত। এমন এক ব্যক্তি, যে তার জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সঠিকরূপে অনুধাবন করতে পেরেছে, পার্থিব জগতের উন্নতি, মানমর্যাদা, অর্থসম্পদ অপেক্ষা আখিরাতের উন্নতির চরম কামনা যার অন্তরে শিকড় গেড়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি ও তার প্রদত্ত জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে এবং তার ওপর অটল থাকতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র অপর বান্দার কাছে তার এ জীবন বিধানের দাওয়াত পৌঁছাতে ইচ্ছুক, যে ব্যক্তি উপলব্ধি করতে পেরেছে যে,তার স্রষ্টা ও মালিক তার ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করছেন যে, মানুষকে আল্লাহ্‌র এবং রাসূলের সত্যিকার আনুগত্যের দাওয়াত দিতে হবে। এ দুনিয়ায় এমন এক পরিবেশ, এমন এক সমাজ গঠন করতে হবে যার বুনিয়াদ হবে খোদা-প্রদত্ত জীবন বিধান তথা কুরআন ও সুন্নাহ, এমন ব্যক্তির জন্যে মানুষের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ও বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অন্যান্য সকল কাজ থেকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই যে ব্যক্তি সিদ্ধান্ত করেছে যে, তাঁকে মানুষের মন-মগজ পরিবর্তন করতে হবে, তাদের চিন্তাধারাকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে, তাদের চিন্তা কল্পনার ক্ষেত্রে ভাল-মন্দের মাপকাঠি নির্ধারণ করতে হবে। এক কথায় যে ব্যক্তি ইসলামী আদর্শে বিশ্বাস করে এবং চায় যে, মানব জীবনের প্রতিটি বিভাগেই আল্লাহ্‌র অবতীর্ণ বিধানের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হোক তার জন্যে প্রথম পদক্ষেপেই মানুষের সঙ্গে নিবিড় ও ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক স্থাপন এবং একে ব্যাপকতর করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। অনুরূপভাবে মানুষের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে প্রতিবন্ধক এমন যাবতীয় বিষয় থেকেও দূরে থাকা কর্তব্য। অর্থাৎ এমন সব ব্যাপার থেকে দূরে অবস্থান করা আবশ্যক, যা মানুষের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের পরিবর্তে তিক্ততার সৃষ্টি করে।

মানুষের মধ্যে আল্লাহর দিনের দাওয়াত পৌঁছানো, আল্লাহ্‌র দ্বীনের ওপর যে কোন প্রতিকুল অবস্থা বা সংঘাতময় মুহূর্তে অটল-অবিচল থাকা, মানব জীবনের সকল পর্যায়ে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধানকে প্রতিষ্ঠিত করা, এটা শক্তি প্রয়োগ বা ভীত প্রদর্শনের কাজ নয়; অথবা কোনরূপ জাদু মন্ত্রের দ্বারাও এ কাজ সম্পন্ন হতে পারে না। দুনিয়ায় অন্যান্য কাজের সংগে এখানেই এর পার্থক্য। গায়ের জোরে গুরু হওয়া এবং কাউকে পদানত করা অনেকটা সহজ হলেও কারো অন্তঃকরণ জয় করা মস্তবড় কঠিন কাজ। কোন রাজ্যে জোরপূর্বক রাজত্ব করা এবং ধনভাণ্ডার বল প্রয়োগে হস্তগত করা এক কথা কিন্তু কারো মনের রাজ্যে রাজত্ব করা বা চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন সাধন করা, থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ব্যাপার।

একি বস্তু ব্যবহার-পদ্ধতির বিভিন্নতার দরুণ ভালোমন্দ উভয় কাজে ব্যবহৃত হয়। ধরুন, একটা তলোয়ার ডাকাতের হাতে পড়লে মানব সমাজ সস্ত্রস্ত হয়ে ওঠে, আবার আল্লাহ্‌র পথে সংগ্রামী মুঝাহিদের হাতে পরলে শান্তির প্রতীকের রূপ ধারণ করে। তেমনিভাবে মানুষের সংগে পারস্পরিক বন্ধুত্ব এবং সম্প্রীতির সম্পর্ক স্থাপনের বেলাও একই কথা প্রযোজ্য। একজন নিছক অর্থলোভী ও মর্যাদাকাংখী ব্যক্তির মানুষের সংগে সম্পর্ক বাড়ানোর এক উদ্দেশ্য হয়ে থাকে এবং সত্যের পথে আহ্বানকারী ও আল্লাহ্‌র দ্বীনের প্রচারকারীর সম্পর্ক বাড়ানোর উদ্দেশ্য হয় এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। উদ্দেশ্যের এ ভিন্নতার ফলেই আজ আমাদের কাছে একটার গুরুত্ব অন্যটার তুলনায় অনেক বেশী। সত্যের পথে আহ্বানকারীর জন্য মানুষের সংগে সম্পর্ক বৃদ্ধি গুরুত্ব বর্ণনার পড়ে এই বলে বিষয়টি শেষ করা উচিত ছিল যে দ্বীনের প্রচারকদের জন্যে মানুষের সংগে সম্পর্ক ব্যাপক এবং উন্নত করার জন্য সচেষ্ট থাকা কর্তব্য। কিন্তু কথাটি সবাই জানে সবাই বুঝে। তবু এ ব্যাপারে আরও বিশদ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। আমার মতে এ সম্পর্ক বৃদ্ধির এবং উন্নতির ক্ষেত্রে ব্যাক্তিগতভাবে কে কি ভাবে অগ্রসর হতে পারে এর একটা বাস্তব পন্থা উদ্ভাবন নিশ্চয় দ্বীনি কর্মীদের যথেষ্ট সহায়ক হবে। এর ফলে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে বহু নতুন নতুন পথ তাদের সামনে খুলে যাবে। এ উদ্দেশ্যেই আমি আলোচ্য বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে চাই।

নিজেকে সবাই ভাল মনে করে
এ ব্যাপারে আলোচনার পূর্বে মানব মনের কতিপয় দুর্বলতা সম্পর্কে অবহিত হওয়া একান্ত আবশ্যক। কারন, সঠিকরূপে রোগ নির্ণয়ের উপর উপযুক্ত চিকিৎসা নির্ভর করে।

১। স্বভাবতই প্রত্যেক ব্যাক্তি নিজের সম্পর্কে ভাল ধারণা পোষণ করে। কোন ডাকাত, চোর অথবা খুনী সকলেরই নিজের সম্পর্কে এ ধারণা রয়েছে যে সে নিরাপরাধী। কোন জেলখানায় কয়েদির সঙ্গে কিছুক্ষণ আলোচনা করলেই আপনি এ কথা বলতে বাধ্য হবেন যে হয় সকল কয়েদি পূর্ব থেকেই ঠিক করে নিয়েছে যে তারা সবাই নিজেদেরকে নিরপরাধ বলে প্রকাশ করবে, আর না হয় আপনাকে ধরে নিতে হবে- নিশ্চয় সরকার এদের উপর প্রকাশ্য অত্যাচার চালাচ্ছে। না বুঝে না শুনে এ সকল নিরপরাধ ব্যাক্তিকে কারাগারে আবদ্ধ রেখেছে। অথচ এ দুটো ধারনার মধ্যে একটিও সত্য নয়। কারণ অনুসন্ধানে সেই আগের কথায় আসতে হয় যে, মানুষ নিজের সম্পর্কে ভাল ধারণা পোষণ করে। যেমন, কোন ডাকাত আজীবন নিরপরাধ মানুষের গলায় ছুরি চালিয়েছে, নির্দয়ভাবে নিরীহ পথচারীকে হত্যা করেছে, মানুষের অর্থ-সম্পদ লুট করে নিয়েছে, সেও নিজেকে দয়ালু এবং মানুষের উপকারী বলে মনে করে। তার দৃষ্টিতে সে মনে করে, লুণ্ঠিত মালের কিছু অংশ আমি তো দীনহীন ফকির মিসকিনদের মধ্যেও দান করি এতে আর এমন কি হয়েছে? কোন হত্যাকারী হয়ত এজন্য নিজেকে নিরপরাধ বলে মনে করে থাকে যে, তার ধারণা অনুযায়ী সে নিছক আত্নরক্ষার উদ্দেশ্যে গুলি বা অস্ত্র চালিয়েছে, আর ঐ ক্ষেত্রে সে তা করতেও পারে। অনুরূপভাবে কোন চোর, এই বলে নিজেকে নিরপরাধ মনে করে যে তার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোথাও সে চাকুরী পাচ্ছেনা আর সে এতো নিষ্ঠুরও নয় যে হাত পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকবে আর তার ছেলেমেয়ে না খেয়ে ক্ষুধার তাড়নায় তারই সামনে অকাল মৃত্যুবরণ করবে। কাজেই জীবন রক্ষার তাগিদে সে অপরের ঘরে চুরি করতে বাধ্য হয়েছে।

এভাবে প্রত্যেক অপরাধী ব্যক্তি নিজের কাজকে বৈধ প্রমাণ করার জন্য বিভিন্ন বুদ্ধির আশ্রয় নিয়েছে। অপরাধীর সংগে আলোচনা করলেই দেখা যাবে নিজের সাফাই ও পবিত্রতার সপক্ষে সে কিরূপ যুক্তির অবতারণা করে। এতো গেলো সে সব লোকের কথা, যারা অপরাধী সাজা প্রাপ্ত এবং যাদের কে দুনিয়ার মানুষ অপরাধী বলে মনে করে। এ ছাড়া আরও যেসব লোক রয়েছে দৈনন্দিন জীবনের প্রতি কাজ-কারবারের মাধ্যমে যাদের সঙ্গে আমরা জড়িত, এ ক্ষেত্রে তারা কিরূপ ভূমিকা গ্রহণ করে, সে সম্বন্ধে এবার আলোচনা করা দরকার।

বড়ো ছোট যে কোন ব্যক্তির ধারণা এই যে, সে যা বলে সেটাই ঠিক এবং নির্ভুল। মানব মনে প্রথম জন্মগত দুর্বলতা হলো যে সব সময় নিজেকে নিরপরাধ বলে মনে করে এবং নিজের কাজকে মনে করে নির্ভুল।

২। আমরা দেখি একটা লোক- তা সে যত ভুলের মধ্যেই থাকুক না কেন, অন্য কেউ তার কাজে ছিদ্রান্বেষণ অথবা কোন ত্রুটি নির্দেশ করলে, তা সে কোনভাবেই বরদাশত করতে পারেনা। তাই দেখা যায়, যখনি কোন ব্যক্তির কোনরূপ ত্রুটি বা দুর্বলতা নির্দেশ করা হয় তখন ঐ ব্যক্তি রাগে ফেটে পড়ে এবং তার মধ্যে বিরোধিতার ভাব পরিলক্ষিত হয়। যত যুক্তিই তাকে দেখানো হোক না কেন, সে তার ত্রুটি এবং দুর্বলতা ঢাকার জন্য সাফাই গাইতে গিয়ে বহু রকমের যুক্তি প্রমাণ পেশ করবেই। এরও একমাত্র কারণ হলো- যেহেতু প্রত্যেকেই মনে করে যে তার মত ই নির্ভুল।

এসব দুর্বলতাকে সামনে রেখেই আপনাকে চিন্তা করতে হবে যে, সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে আপনার কিরূপ ভূমিকা গ্রহণ করা কর্তব্য। আপনি কারোর দুর্বলতা এবং ত্রুটি নির্দেশ করলেই সে আপনার কথা মেনে নেবে বা সংশোধনের জন্য এগিয়ে আসবে, এটা কিছুতেই মনে করবেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমন লোকের সংগে আপনার সাক্ষাত ঘটবে যে নিজেকে হয়ত মনে করে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত এবং তার মত এবং পথকে সে সঠিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত মনে করে হয়ত বহু যুক্তি প্রমাণও খুঁজে বের করবে। এমনকি যুক্তি সংগত কিছু উপস্থাপন না করতে পারলেও বারবার একথা বলার চেষ্টা করবে যে, আমার কথা আপনার যুক্তির তুলনায় একেবারে নির্ভুল না হলেও নেহায়েত অযৌক্তিক বলেও উড়িয়ে দিতে পারবেন না। এ অবস্থায় আপনি তাঁকে সংশোধনের যত চেষ্টাই করুন না কেন সে কিছুতেই তা গ্রহণ করবে না বরং ক্রমশঃ আপনার থেকে দূরে সরে যাবে। ফলে আপনার মধ্যে নৈরাশ্য ভাবের উদয় হবে। আপনি মনে করতে থাকবেন যে সৎ কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখতে গিয়ে মানুষের সংগে আপনার সম্পর্ক বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিঃস্বার্থ কাজে এরূপ জটিলতার সৃষ্টি সত্যিই বিরক্তিকর। কেননা, যেক্ষেত্রে আপনার একান্ত ইচ্ছা থাকে মানুষের সংগে নিকটতর এবং প্রীতিকর সম্পর্ক স্থাপন করা, যার সাহায্যে আপনি সুস্থ চিন্তার খোরাক দিতে এবং তাদের ভুল পথ থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হবেন, সে স্থলে যখন পূর্বেকার সম্পর্কটুকুও বিনষ্ট হতে থাকে, তখন নিশ্চয় আপনার মধ্যে বিরক্ত উদ্রেক হওয়াটা স্বাভাবিক। তাই দেখা যায়, কোন ব্যাক্তি দু’একবার এ ধরনের বিরক্তি অবস্থার সম্মুখীন হলে পরবর্তীতে মানুষের আস্থা হারানোর ভয়ে কোন অন্যায় বা অসৎ কাজের প্রতি দৃষ্টি পড়লেও সে দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় এবং বিরক্তিপূর্ণ স্বরে বলে থাকে, মানুষের সংগে সম্পর্ক খারাপ করে লাভ কি, এসব লোক কি কোন কথা শুনবে?

এ ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেননা, কোন মতবাদ বা আদর্শ প্রচারকারী যদি এ ভূমিকা গ্রহণ করেন, তাহলে দুনিয়ার মানুষের অন্তরে প্রতিষ্ঠিত ভাবধারার বিরোধী কোন নতুন বিষয়ই উত্থাপন করা সম্ভব হবে না। ফলে অন্যায়, অবিচার,জুলুম-অত্যাচারে জর্জরিত এ বিশ্বজাহানকে সংশোধন এবং সঠিক পথে পরিচালনার জন্য যে কোন প্রচেষ্টা, যে কোনো আন্দোলনের ধারাই চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। বরং আদর্শ প্রচারকারীকে প্রথমেই ভেবে নিতে হবে যে, কোন কর্মপন্থা অবলম্বন করলে সে মানুষের মধ্যে আস্থাভাজন হতে পারবে। অবশ্য ব্যক্তি, স্থান ও কালের সংগে সামঞ্জস্য রেখেই এ কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। কেননা, পরিবেশ এবং রুচির বিভিন্নতার দরুণ অনেক সময় একই কর্মপদ্ধতি সর্বত্র কার্যকরী হয় না। এমনিভাবে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলে এবং মানুষের হৃদয়ে স্থান করতে পারলে, তারা শুধু কানের সাহায্যেই শুনবে না সত্য প্রচারকের কথা শোনার জন্য তাদের হৃদয় মনও ব্যাকুল হয়ে উঠবে।

এখন প্রশ্ন হল, মানুষের মন জয় করার পন্থা কি? এ ব্যাপারে মজ্জাগত যে ব্যাধির কথা উপরে বর্ণিত হয়েছে, তা স্মরণ রাখাই যথেষ্ট। অর্থাৎ ছোট-বড় যত রকম অপরাধী হোক, মানুষের প্রকৃতিই হলো এই যে, সে নিজের ভুল কখনই স্বীকার করতে রাজি হয়না। প্রতিটি ভুলকে নির্ভুল প্রমাণ করার একটা না একটা যুক্তি তার থাকবেই। এমতবস্থায় আপনার প্রথন দায়িত্ব হলো সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির সংগে গভীরভাবে মেলামেশা করা এবং অকপটে তার সাথে আলাপ-আলোচনা করা।

একাধিকবার মেলামেশার মাধ্যমে আপনি তার মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকবেন। আপনাকে দেখতে হবে এ ব্যক্তির অসংখ্য দোষ ত্রুটির মধ্যেও কি কি সদগুনাবলী রয়েছে। কেননা পৃথিবীতে এমন লোক অতি বিরল, যার মধ্যে কোন সদগুণ নেই এবং শুধু অসদগুণাবলীতে সে পরিপূর্ণ। কোন ব্যক্তি যতই অসৎ চরিত্রের হোক না কেন, তার মধ্যে সৎগুণ নিশ্চয়ই কিছু থাকবে। আপনি তখন সকল দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তার সদগুণাবলীর প্রতিই লক্ষ্য করবেন এবং তার প্রশংসা করবেন। তবে এ পদ্ধতিতে সম্পর্ক স্থাপনকালে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন এটা তোষামোদ বা ছলচাতুরীর রূপ ধারণ না করে। বরং তার সদগুণাবলীর প্রশংসা আপনাকে দরদ এবং আন্তরিকতার সংগে করতে হবে, যা সত্যি সত্যি তার মধ্যে রয়েছে। আপনি সত্যি যদি আন্তরিকতার সংগে তার সদগুনাবলীর প্রশংসা করে থাকেন, তাহলে সে নিশ্চয়ই আপনার নিকট তার সব কথা অকপটে ব্যক্ত করবে এবং ক্রমশঃ আপনাকে আপনজন বলে ভাবতে শুরু করবে, আর মনে করবে একজন সত্যিকার সহানুভতিসম্পন্ন ব্যক্তিরুপে। এর কারণ হচ্ছে, মানুষ স্বভাবতঃই চায় অন্যেরা তার স্বীকৃতি দিক। প্রশংসা অর্জনের এ একান্ত বাসনা সবার মধ্যেই অল্প-বিস্তর রয়েছে। এসব বাস্তব বিষয় কে সম্মুখে রেখেই কাজ করতে হবে। স্মরণ রাখা দরকার, এমন কর্মী দ্বারা সমাজের কোনরূপ সংস্কার বা মঙ্গল সাধনের আশা করা যেতে পারে না, যে সর্বদা নিজেকে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী বলে মনে করবে আর সমালোচনা করবে অপরের যাবতীয় দোষত্রুটির।

এ ভাবে সহানুভূতি ও সদ্ব্যবহারের দ্বারা কার হৃদয় জয় করার পর আপনি মনে করতে পারেন যে, এ ব্যক্তি দ্বারা এখন কিছু সৎ কাজ করানো সম্ভব হবে। এখন যদি আপনি সহানুভুতির সংগে তার চরিত্রের এমন কোন দোষ-ত্রুটির প্রতি অঙ্গুলী নির্দেশ করেন, যা পরিহার করা তার জন্যে তেমন কিছু অসুবিধাজনক নয় তাহলে সে অনায়াসে তা সংশোধনের জনে এগিয়ে আসবে এবং আপনার যে কোন পরামর্শ বা সদুপদেশ গ্রহণ করতে মোটেই দ্বিধাবোধ করবেনা। অনুরূপভাবে তার এ সত্যোপলব্ধি এবং সংশোধনী গ্রহণ করার মনোভবেরও যদি আপনি প্রশংসা করেন তাহলে দেখতে পাবেন আরো দিগুণ উৎসাহ-প্রেরণা নিয়ে সে দিনের পর দিন সত্যের দিকে অগ্রসর হয়ে চলছে এবং ন্যয় ও সত্যকে গ্রহণ করার জন্য তার মধ্যে এক নতুন শক্তি ও প্রেরণার সৃষ্টি হচ্ছে। এমনি ভাবে ধৈর্য ও সহানুভূতির সংগে সংস্কার ও সংশোধনের কাজে এগিয়ে আসলে ইনশাআল্লাহ অল্পদিনের মধ্যেই সে ব্যক্তি সত্য পথের সন্ধান লাভ করবে। আদর্শের প্রচার এবং প্রসারের ক্ষেত্রে প্রত্যেক প্রচারককে স্মরণ রাখতে হবে যে, কারো মন-মগজকে পরিশুদ্ধ করা মোটেই ছেলে খেলা নয়। ছলচাতুরীর দ্বারা কাউকে উচ্চ মর্যাদা থেকে অপসারণ করে অপদস্ত করার জন্য একটি সাধারণ প্রতারণামূলক চালবাজীই যথেষ্ট। কিন্তু নৈতিক অধঃপতনের অতল গহ্বর থেকে হাতে ধরে মানুষকে মানবতার উচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত করতে হলে চেষ্টা সাধনার প্রয়োজন। এ জন্য সত্যিকার সহানুভূতিশীল ব্যাক্তিকে রক্ত পানি এবং মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়।

সার কথা হলোঃ আদর্শ প্রচারের ক্ষেত্রে মানুষের মনে অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করতে হলে ন্যায়সঙ্গতভাবে মানুষের চরিত্রে যে সদগুণাবলী রয়েছে, তাকে প্রথম অবলম্বন হিসেবে বেছে নিতে হবে এবং সেগুলোকে যথার্থ মর্যাদা দিতে হবে। কারো তোষামোদ করা এবং সত্যিকারের প্রশংসা করার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে। এসব বিষয়কে সর্বদাই সম্মুখে রেখে কাজ করতে হবে। কোনো মানুষের সদগুণাবলী এবং সৌন্দর্যের আলোচনা আপনার নিজের মধ্যেও এক সহানুভূতির উদ্রেক করবে। এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, সৎ কাজে আহ্বান এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখার কাজ যদি সহানুভূতির সংগে না করা হয়, তাহলে কোনো সদুপদেশ কার্যকরী হয়না। যেসব সদগুণাবলী মানুষ নিজের মধ্যে সহজেই পয়দা করতে পারে সর্বপ্রথম তাকে সেদিকেই আহবান জানাতে হবে।

মানুষের সংগে সম্পর্কোনয়নের ব্যাপারে এ পর্যন্ত বেশ কিছু প্রস্তাব আপনাদের সম্মুখে উত্থাপন করা হয়েছে। তবে সেই সঙ্গে এ বিষয়ের প্রতিও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে, যাতে প্রচারক কতৃক এমন কোনো ভূমিকা গ্রহণ না করা হয়, যার কারনে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন এবং উন্নয়নের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। সম্পর্ক সুদৃঢ় এবং ছিন্ন হওয়ায় উভয় কারণকে সম্মুখে রেখে কাজ করলে এ ব্যাপারে আরো বহু ফল লাভের আশা করা যেতে পারে। কি কি কারনে সম্পর্কোন্নয়ন বিঘ্নিত হয়, তা একটু গভীর ভাবে লক্ষ্য করলে যে কেউ উপলব্ধি করতে পারে। তবে সাধারণতঃ যে সকল কারনে সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয় তার কারণসমূহ হলো নিম্নরূপঃ

১. নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কিছু দেখেই মানুষ ক্রুদ্ধ হয়ঃ

কম বেশি এ দুর্বলতাটুকু সকলের মধ্যেই দেখা যায় যে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কিছু দেখেই মানুষ ক্রুদ্ধ হয়। বিশেষ করে ঘরের চাকর-চাকরানি, ছেলে-মেয়ে এবং নিজের ছাত্র-ছাত্রীরাই বড়দের রোষানলের শিকার হয়ে থাকে বেশী। কিন্তু সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্যান্য গুণাবলীর মত ক্রোধকেও আয়ত্তাধীন করা কর্তব্য। কথায় কথায় বদমেজাজি এবং খিটে খিটে ভাব দেখানো হলে কেউ আপনার সংস্পর্শে আসবেনা এবং আপনার সংগে মেলামেশার ইচ্ছা করবে না। ফলে খুব শীঘ্রই এ দুর্বলতার প্রতিক্রিয়া নিকটতম পরিবেশে ছড়িয়ে পড়বে এবং অবশেষে আদর্শ প্রচারে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। এরই ফলে আদর্শ প্রচার বা সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের ক্ষেত্রে এমন অনেক লোককে দেখা যায়, যারা নিজেদের বদমেজাজি এবং সদাচরণের দরুন নিজ পরিবেশে আশানুরূপ কৃতকার্য হতে পারেনা।

২.নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি অপেক্ষা অপরের দোষত্রুটির প্রতি দৃষ্টি অধিক নিবন্ধ হয়ঃ

নিখুঁত চরিত্রের অধিকারী, সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত লোকের সংখ্যা সমাজে অতি বিরল। সহকর্মী এবং দৈনন্দিন কাজে জড়িত ব্যক্তিদের সঙ্গে আদান-প্রদান এবং কাজকারবারে- যেকোন ব্যক্তিরই হোক না কেন অল্পবিস্তর ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রকাশ পাওয়া স্বাভাবিক। তবে এটা মানুষের স্বভাবজাত যে, নিজের ত্রুটি- বিচ্যুতি অপেক্ষা অপরের দোষত্রুটির প্রতিই দৃষ্টি অধিক নিবদ্ধ হয়ে থাকে। একে অপরের মধ্যে সামান্যতম দুর্বলতার সন্ধান পেলেই অমনি সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। কাজেই, যেহেতু প্রত্যেকেই নিজের সম্পর্কে ভাল ধারণা পোষণ করে থাকে, তাই একে অপরের ত্রুটি নির্দেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তার অনুভূতিতে ভীষণ আঘাত অনুভূত হয়। এ কারণে অসাবধানতার সঙ্গে কারো ত্রুটি নির্দেশ বা কোন রূপ সমালোচনা পারস্পরিক সম্পর্কের বিশেষভাবে ক্ষতি সাধন করে। এক কথায় মানুষকে সংশোধনের উদ্দেশ্য তাদের সংগে স্থাপনকালে তাদের সকল দোষত্রুটিকে উপেক্ষা করতে হবে এবং প্রথম অবস্থায় তার যাবতীয় সমালোচনা থেকে বিরত থাকতে হবে। সমালোচনা থেকে বিরত থাকার অর্থ এই নয় যে তার যাবতীয় দুর্বলতা এবং দোষত্রুটি থেকে সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টি এড়িয়ে তার সংগে সবসময়ের জন্য সম্পর্ক কায়েম করতে হবে। বরং এর অর্থ হচ্ছে, যে সকল মানুষের মধ্যে কোনরূপ দুর্বলতা বা দোষত্রুটি রয়েছে এবং সংশোধনকারীও স্বয়ং সে সম্বন্ধে জ্ঞাত আছেন, এমতবস্থায় এ বিষয়ে বারংবার আলোচনা না করা। কেননা, এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সংশোধিত হওয়ার চাইতে বিদ্রোহী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশী থাকে।

৩.মানুষকে এ ধারণা আনন্দ দেয় যে, সে যাবতীয় দুর্বলতা থেকে মুক্তঃ

মানুষকে এ ধারণা সত্যিই আনন্দ দেয় যে, সে যাবতীয় দুর্বলতা থেকে মুক্ত। অথচ কোন মানুষই এ দাবী করতে পারেনা যে, তার মধ্যে কোন প্রকার দুর্বলতা বা দোষ-ত্রুটি নেই। কিন্তু এ সত্ত্বেও মানুষ চায় যে অন্ততঃ নিজের সম্পর্কে নিজের ধারণাটুকু ভাল থাকুক। মানুষের আত্নতুষ্টি লাভের এ প্রবণতা অভিব্যক্তি বিভিন্নরুপে ঘটে অপরের দুর্বলতাকে ঘৃণা ভরে উন্নাসিকতার মাধ্যমে প্রকাশ করে, ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, কাউকে বোকা প্রমাণ করে,কারো অদূরদর্শিতা বা বুদ্ধিহীনতার দিকে ইঙ্গিত করে এবং এমন হাবভাব বা বর্ণনাভঙ্গি করে, যাতে নিজের মাহাত্ম্য এবং শ্রেষ্ঠত্ব ফুটে ওঠে। তার কারণ মানুষের এ ধরনের ভূমিকা তার মনে এক বিশেষ তৃপ্তির যোগান দেয়। এ জন্যই নিজের দুর্বলতাকে ঢাকার জন্য মানুষ অসংখ্য উপায় অবলম্বন করে। আপনি অপরকে সংশোধনের দায়িত্ব পালন করছেন। নিশ্চয়ই এটা ভাল কাজ। কিন্তু উপরোক্ত কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করলে সত্যিকার সংশোধন তো দূরের কথা, সংশোধনের পথই রুদ্ধ হয়ে যাবে এবং পারস্পরিক সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠবে। ফলে আপনার কথা শুনে মানুষের অন্তঃকরণ সিক্ত হওয়ার পরিবর্তে পাথরে পরিণত হবে এবং তারা পরিণত হবে ‘বদ্ধ তালায়’।

৪. মানুষ নিজেকে বড় এবং অপরকে ছোট মনে করাতে তৃপ্তি অনুভব করে থাকেঃ

নিজেকে বড় এবং অপরকে ছোট মনে করাতে আমরা বেশ তৃপ্তি অনুভব করে থাকি। এজন্যই অপরের অগোচরে আমরা তার দোষ ত্রুটির আলোচনা করি। অর্থাৎ কোন সময় চাপ প্রদানের ভয়ে বা ভদ্রতার খাতিরে যদি আমরা কারো সম্মুখে তার সমালোচনা করার সুযোগ না পাই, তাহলে অন্য সময় তার অগোচরে আমরা তা প্রকাশ করি কিংবা মনের এভাব এমন ভঙ্গিতে ব্যক্ত করে থাকি যাতে বাহ্যতঃ মনে হয় যেন ঐ ব্যক্তির সংশোধন অত্যধিক কাম্য ছিল; ঐ ব্যক্তির জন্যে মনে হয় বক্তা অত্যন্ত দুঃখ অনুভব করছেন। অথচ এতে আসল উদ্দেশ্য হয় সেই ব্যক্তিকে খাট করা। এভাবে অন্যের অগোচরে এমনি অথবা সহানুভূতির সুরে তার দুর্বলতার আলোচনা করে এরূপ তৃপ্তি অনুভব করা, নিজের ব্যক্তিত্বকে বড় করে দেখানোই হয় এক্ষেত্রে আসল উদ্দেশ্য। এটা কুরআন বর্ণিত ‘গীবতে’র অন্তর্ভুক্ত। গীবত থেকে বেঁচে থাকার জন্যে আল কুরআনে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সম্পর্ক বিনষ্ট করার ব্যাপারে গীবতের বিরাট প্রভাব রয়েছে। গীবতের ব্যাপারে কেবল এটাই ক্ষতিকর নয় যে, আপনি অন্যের অবর্তমানে তার দোষত্রুটি বর্ণনা করাতে তার প্রতি আপনার এবং অপরাপর স্রোতার বীতশ্রদ্ধা ভাব সৃষ্টি হবে, বরং যার গীবত করা হয়েছে, সেও এসব কথা জানতে পারলে আপনার বিরুদ্ধে তার অন্তঃকরণে ঘৃণার উদ্রেক হবে। ফলে এভাবে পারস্পরিক সম্পর্ক তো বিনষ্ট হবেই, এ ছাড়াও বহু অঘটন ঘটারও সম্ভাবনা দেখা দেবে। মানুষের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক স্থাপন করার জন্যে তাই গীবত থেকে কঠোর ভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

সমাজের মানুষের সংগে সম্পর্ক বিনষ্ট হওয়ার এ হল ক’টি বিশেষ বিশেষ কারন। একদিকে এসকল ব্যাপারে অসতর্ক থাকা এবং অপরদিকে সম্পর্কোন্নয়নের আশা পোষণ করা, এরূপ পরস্পর বিরোধী পদ্ধতিতে কিছুতেই কৃতকার্য হওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য এটা সত্য যে, উপরোল্লিখিত দোষত্রুটি থেকে সম্পূর্ণরূপে বেঁচে থাকা খুব সহজ ব্যাপার নয়, তবে এ ধারনাও ঠিক নয় যে, এ জাতীয় দুর্বলতা সংশোধনের উর্ধে। নিশ্চয়ই এ থেকে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। এ জন্যে কেবল ইচ্ছাশক্তি ও কঠোর সংকল্পেরই প্রয়োজন। মুমিনের সংশোধনের জন্য তওবাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। তওবা বলতে আমরা বুঝি আমাদের কৃত অপরাধের জন্যে অনুতাপ-অনুশোচনা দ্বারা সহজভাবে আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করা এবং ভবিষতে উক্ত গর্হিত কাজে প্রবৃত্ত না হওয়ার জন্য তার কাছে কঠোরভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া। এসবের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা চাই আমাদের সত্যিকার মালিক ও প্রভুকে সন্তুষ্ট করতে।

যে সকল দোষত্রুটির বিষয় ওপরে বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো কারোর চরিত্রে দেখা দিলে যে ক্ষতি সাধিত হয়, সেদিকে কিছুটা ইঙ্গিত ইতিপূর্বে করা হয়েছে। অর্থাৎ এতে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বিনষ্ট হয়। ফলে মানুষের নিকট দিনের দাওয়াতে পৌছানো বড় কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু যেসব মানুষের দৃষ্টি সম্পুর্ণরূপে দুনিয়ার প্রতিই নিবদ্ধ, দুনিয়ার অর্থ সম্পদ, মান-মর্যাদা, যশ-গৌরব অর্জনই যাদের জীবন চরমতম লক্ষ্য, তারাও তো এসব দোষত্রুটি এবং তার প্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচতে চায়। এ উদ্দেশ্যে তারা সব রকমের চেষ্টা চরিতও করে। এমন অনেক লোক রয়েছে যারা নেতৃত্ব ফলাবার, ব্যবসায় সম্প্রসারণ করার অথবা পার্থিব কোন মর্যাদা লাভের আশা ছাড়া জীবনের অন্য কোন উদ্দেশ্যই রাখে না, তারাও তো এসব দোষত্রুটি অপকারিতা সম্পর্কে জানে এবং এ থেকে বাঁচার জন্যে অনবরত চেষ্টা করে থাকে। এদেরকে দেখেও আমাদের শিক্ষা গ্রহণের অনেক কিছু রয়েছে। এ ধরনের লোকেরা যদি এ জাতীয় দুর্বলতা এবং দোষত্রুটি অপকারিতা থেকে বাঁচার জন্য কঠোর সংকল্প গ্রহণ করতে পারে এবং হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে যাবতীয় মন্দ স্বভাব পরিত্যাগ করে নিজেকে সম্পূর্ণ সংযত করতে পারে, তা হলে এদের চেয়েও উচ্চতর লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্যে সংগ্রামকারীদের ভূমিকা কিরূপ হওয়া উচিত, তা সহজেই অনুমেয়। যে ব্যক্তি নশ্বর জগতকে উপেক্ষা করে অনন্ত জগতের অধিকারী হওয়ার অভিলাষী, সে এ সকল দোষত্রুটি থেকে নিজেকে মুক্ত করার শপথ নিয়ে অগ্রসর হলে নিশ্চয়ই তার মধ্যে বিপুল শক্তি সঞ্চারিত হবে।

মনের ঝাল প্রকাশ করা
মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট হওয়ার বহুবিধ কারণ থাকে। এর মধ্যে মানুষের প্রকৃতিগত উত্তেজনার একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। যে কারনে এ সম্পর্ক একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। অনেক বিষয় আছে, যা অপছন্দ হবার কারনে মানুষ তার বিরুদ্ধে ইচ্ছা পুরিয়ে নানা ভাবে মনের ঝাল মিটাতে চায়। এ উদ্দেশ্যে সে বহুতর উপায় অবলম্বন করে। ক্রোধ, কটু কথা, ত্রুটি অনুসন্ধান, কারো পেছনে দোষ বর্ণনা ইত্যাদি এমন অনেক উপায় আছে, যার উদ্দেশ্য মনের ঝাল প্রকাশ করা ছাড়া কিছুই নয়। মানুষের এ জাতীয় মানসিক অবস্থাই তাকে অপরের বিরুদ্ধে অপবাদ রটাতে এবং অপরের দোষত্রুটিকে ফলাও করে প্রকাশ করতে বাধ্য করে। মোটকথা, মানুষ তার এ মানসিক প্রবণতার দরুন নানবিধ নৈতিক দুর্বলতায় জড়িত হয়ে পড়ে। মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার খাতিরে এদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে যে, কদাচিৎ নিজের ক্রোধ চরিতার্থ করার জন্যে যেন এ প্রবণতার আশ্রয় না নেয়া হয়। এ মানসিক অবস্থার উদ্ভব হলে, তার দ্বারা এমন সব কাজ অনুষ্ঠিত হয় যার ফলে মানুষের মন তার প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যকার দূরত্বও বেড়ে যায়। এ মানসিক প্রবণতাকে সংযত রাখার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে সম্মুখে রাখা হলে ‘আদর্শ’ প্রচারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট কামিয়াবির আশা করা যেতে পারে।

কারোর প্রতি দোষারোপ করা অত্যন্ত সহজ । কোন ব্যাপারে কাউকে অভিযুক্ত করতে কোন বেগ পেতে হয় না, কিন্তু নিজেকে অভিযুক্তের পর্যায়ে ফেলে বিচার করাটা অত্যন্ত দুঃসাধ্য ব্যাপার। অপরের দোষত্রুটি অনুভব করার পর সুস্থ মস্তিষ্কে নিজেকে একবার তার স্থানে রেখে অবস্থা পর্যালোচনা করুন। অবশ্য এটি হবে বীরত্বের পরিচায়ক। এমতাবস্থায় আপনি দেখতে পাবেন শতকরা আশি ভাগ অভিযোগ- যা আপনি অন্যের অপর আরোপ করেছেন, তার প্রত্যেকটারই একটা যুক্তিসংগত কারন আপনি নিজেই বের করবেন। অপরের চরিত্রের ন্যায় নিজের নিজের চরিত্রকে ‘সমালোচনার দূরবীন’ দ্বারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলে একদিকে যেমন নিজের সংশোধনের পথ সুগম হবে, তেমনি অন্যদিকে অপরের ছিদ্রান্বেষণ এবং তাকে অভিযুক্ত করার প্রবণতা থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে, যা পারস্পরিক সম্পর্ককে বিছিন্ন করে দেয়।

তবে তার মানে এই নয় যে, সমাজ-সংশোধনের সকল প্রকার কাজ থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। আর এর অর্থ এও নয় যে, যে কোনো অপকর্মকে বরদাশত করার অভ্যাস করতে হবে। বরং নিজের চরিত্রকে এমনি তুলনামূলকভাবে যাচাই করাতে সার্থকতা হচ্ছে এই যে, যখন আপনি নিজের প্রতি লক্ষ্য রেখে অপরের দোষত্রুটি বিচার করবেন তখন আপনি তার সংশোধনের জন্যে এমন পন্থাই গ্রহণ করবেন যাতে করে মনে হয় যেন আপনি নিজের সংশোধনেই এগিয়ে আসতেন। এটা স্পষ্ট কথা যে এমনি ভাবে অপরের অবস্থা সংশোধনে যে দরদ এবং আন্তরিকতা আপনার নীতিতে স্থান পাবে তার গুরুত্ব নিশ্চয় অনেক বেশী এবং এর প্রভাবও সুদূরপ্রসারী। এতে মানুষের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক সর্বদা মধুরতর থাকবে এবং সমাজ সংস্কারের সুসঙ্গত পন্থার উদ্ভব হবে। আপনার সম্মুখে রয়েছে একটা মহান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এ লক্ষ্য উপনীত হওয়ার জন্যে সর্বদাই আপনি মানুষের মনকে নিজের নিকটবর্তী করতে চান। তাই আপনি নিজের দোষত্রুটি নিজের যে কোন দুর্বলতার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে পারেন। সেগুলোর সংশোধনে এগিয়ে আসতে পারেন। কুপ্রবৃত্তি দমনে সক্ষম হতে পারেন এবং নিজের মানসিক প্রেরনাকে নিজেই পিষ্ট করতে পারেন। কিন্তু আপনার শ্রোতার অবস্থা তো আর তেমন নয়। তার সামনে নেই কোনো উন্নতর উদ্দেশ্য- লক্ষ্য। আপনার মতো তার ভেতরের মানুষটা এতোসব বাধ্যবাধকতা, নিয়ম-কানুন মেনে চলার কোনো কারন খুঁজে পায়না। কাজেই আপনার শ্রোতা থেকে থেকে এমন বহু কিছু প্রকাশ পায় যা আপনার মনঃপুত নয় এবং আপনার জন্য যথেষ্ট পীড়াদায়ক। মানুষ চায়, সে যদি কারোর সঙ্গে নম্র ও ভদ্র ব্যবহার করে, তাহলে প্রত্যুত্তরে তার সঙ্গেও সে অনুরুপ ব্যবহার করুক। সে যদি নিজের ক্রোধ ও আবেগকে সংযত রাখে, তাহলে অপরজনও যেন তার ক্রোধ-আবেগকে বে-লাগাম না করে।

অনেক লোক আছে যারা অপরকে সংশোধন করতে গিয়ে নিরাশ হয়ে এ ধরনের মন্তব্য করে থাকে যে, আমরা সবকিছু করে ফেলতে চাইলে কি হবে শ্রোতাদেরও তো এ দিকে কিছু ঝোঁক থাকা চাই। এদ্বারা তারা বলতে চায় যে, আমাদের কে যে বিষয়ে পরামার্শ দেওয়া হচ্ছে আমরা তো সে অনুপাতে কাজ করে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ; তার সঙ্গে সঙ্গে এ শর্তও তারা আরোপ করেছে যে শ্রোতাকেও সে উপদেশ গ্রহণ করার জন্যে এগিয়ে আসতে হবে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই এ ধরনের উক্তির তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারবেন।

আসল কথা হল, যাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক, তার মূলতঃ কেবল কল্পনাপ্রবণ মানুষ নয় এবং তাদের কর্মপ্রবণতাও আপনার ইচ্ছার অনুগত নয় যে আপনি যখন যা বলবেন তখন তাই হয়ে যাবে। বরং আপনাকে যা কিছু করতে হবে তা এমন সব লোকের মধ্যে করতে হবে যারা বিভিন্ন মেজাজ ও বিভিন্ন ভাবাবেগের অধিকারী। এমনও হতে পারে আপনার শ্রোতা মস্তবড় জ্ঞানী ও যুক্তিবাদী। আপনি তার কাছে অকাট্য যুক্তি পেশ করছেন না। যার ফলে আপনার শতকরা বাসনা পূর্ণ হচ্ছেনা। আপনি যেভাবে আপনার শ্রোতাকে নিজের বক্তব্য বুঝাতে চেষ্টা করেছেন সে কিছুতেই মানতে রাজী হচ্ছে না। কেননা আপনি যাদের সঙ্গে আপনি সম্পর্ক স্থাপন করেছেন তাদের মধ্যেও ভাবাবেগ আছে, গর্ব অহংকার, বিদ্বেষ ও হঠধর্মীতাও আছে। পূর্ব পুরুষদের রীতি-নীতির ওপর তারা অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন করে বসে আছে। এমতাবস্থায় আপনার যদি এমন কোনো ভূমিকা প্রকাশ পেয়ে যায় যার ফলে তাদের মনের গভীরে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসে আঘাত লাগে, তাহলে মনে করতে হবে, আপনি নিজ হাতেই নিজের সমস্ত কিছু ধ্বংস করে দিয়েছেন। আপনাকে সর্বদা এ জন্যে সতর্ক থাকতে হবে যে, আপনার থেকে যাতে কোন কাজ না ঘটতে পারে যাতে অপরের অহমিকায় আঘাত লাগে এবং তার আত্নগৌরব, পক্ষপাতিত্ব, গোঁড়ামি ইত্যাদি পশু-বৃত্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, তার বিশ্বাসগুলো প্রত্যক্ষ আঘাতের মুখোমুখি হয়।

আপনি হয়তো বর্ণিত উপদেশাবলীর ব্যবহারিক পদ্ধতি সম্পর্কে ইতস্তত করছেন যে তাহলে মানুষের মধ্যে উল্লেখিত থাকা অবস্থায় কিভাবে তার সংশোধন করা যাবে? তার অহংকার আত্নম্ভরিতার কি প্রশংসা করবো? কিংবা তার বিদ্বেষ, হঠধর্মীতা এবং যাবতীয় অন্ধ বিশ্বাসকে সঠিক বলে মেনে নেব? নিশ্চয় নয়। কেননা এটা একদিকে যেমন আদর্শ প্রচারকারীর মর্যাদার পরিপন্থী, অন্য দিকে তেমনি তার মূল লক্ষের জন্যও একান্ত ক্ষতিকর। বরং এখানে যে ব্যাপারে আপনাকে বিরত থাকার কথা বলা হচ্ছে তার মূল কথা হলঃ আপনি এমন কোন পরিস্থিতির উদ্ভব করবেননা, যাতে তাদের হীন প্রবণতা আহত হয়। মূল লক্ষে উপনীত হওয়ার ব্যাপারে কি করা উচিত বা কি উচিত নয়- এর ফয়সালা আপনাকে প্রতি পদে পদে করতে হবে। কারণ এতে আপনার ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং এ ভুলের একাধিকবার পুনারবৃত্তিও ঘটতে পারে। কিন্তু প্রতি পদে পদে যদি আপনি আপনার কাজের প্রতিক্রিয়ায় প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখে অগ্রসর হতে থাকেন, তাহলে আপনার একটা ভুল নিজের অভিজ্ঞতায় এক নতুন সংযোজনার সৃষ্টি করবে। অতঃপর আপনি যদি এসব ধারাবাহিক অভিজ্ঞতা একত্রিত করেন তাহলে তা আপনার জন্যে একান্ত উপকারী ও বাস্তব পরামর্শে পরিণত হবে। এককথায় যারা অপরের চিন্তা ধারা, মতামত এবং ভাবাবেগের ওপর প্রভাব করতে ইচ্ছুক, তাদের কে অন্যের দৃষ্টিভংগী হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা উচিত।

সমান ব্যবহার
আদর্শ প্রচার এবং সংস্কারমূলক কাজের প্রথম পরিসর হল প্রত্যেক ব্যক্তির নিকটতম পরিবেশ, যেখানে সে বসবাস করে চাকুরী করে অথবা অন্য কোনো ব্যাপারে অবস্থান করে। কিন্তু খুব কম সংখ্যক লোকই আদর্শের ব্যাপারে নিজেদের এ স্বাভাবিক পরিবেশে কৃতকার্য হতে পারে। এর একটা বিশেষ কারন রয়েছে। তা হলো এই যে প্রত্যেক ব্যক্তিরই এমন একটা গণ্ডি থাকে যেখানে সে একজন সরদার বা নেতার মর্যাদা পেয়ে থাকে, তার গৃহ স্ত্রী-পুত্র কর্মচারী, চাকর- চাকরাণী অনুসারী ভক্ত-অনুরক্ত ইত্যাদি বহু লোক তার কর্তৃত্বাধীনে থাকে। তাদের মধ্যে তার বিরাট প্রাধান্য এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। সে তাদের মধ্যে অর্থাৎ তার নেতৃত্বের প্রভাব দ্বারা কাজ করে নিতে চেষ্টা করে। প্রয়োজনবোধে জোরজবরদস্তি ও ভীতি প্রদর্শনের পথেও সে পা বাড়ায়। মোটকথা, নিজের ব্যক্তিত্ব বলে প্রতিষ্ঠিত প্রভাব প্রয়োগে সে এ ক্ষেত্রে কিছুতেই বিরত থাকতে চায় না। এরূপ ভূমিকার পরিণতি সুস্পষ্ট। কেননা মানুষের চিন্তা বিশুদ্ধিকরণ, মতের পরিবর্তন এবং কারোর ইচ্ছা শক্তিকে নিজের সপক্ষে আনা এতো সহজ ব্যাপার নয়, যে জোরজবরদস্তি বা ভীতি পরিদর্শনের মাধ্যমে করা যেতে পারে।

প্রত্যেক ব্যক্তি তা সে আপনার অধিনস্তই হোক না কেন, তার একটা ব্যক্তিত্ব আছে। আপনার স্ত্রী-পুত্র চাকর, পরিচারিকা, কর্মচারী যারা একটা বিশেষ নিয়ম শৃঙ্খলার মাধ্যমে আপনার আনুগত্য করতে বাধ্য। তাদের ব্যক্তিগত মতামতকে নিজের মতের অধীন করার ব্যাপারে কিন্তু এ বাধ্যতা যথেষ্ট নয়। কেননা তাদেরও একটা নিজস্ব ব্যক্তিত্ববোধ রয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে তাদের মতামতেরও বিরাট গুরুত্ব রয়েছে। তাদের মনের উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেবার সময় বিনা যুক্তি-প্রমাণে তারা তা মানতে প্রস্তুত হয় না। তাদেরকে সন্তোষজনক যুক্তি প্রমাণ দ্বারা বুঝিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় বিনা যুক্তিতে কোন কিছু চাপিয়ে দিতে গেলে যে ফল দাঁড়ায় এখানেও সে পরিণতি দেখা দিতে বাধ্য। কারন তাদের মধ্যেও এমন সব প্রবণতা বিদ্যমান আছে বাইরের জগতে যা আপনি সচরাচর প্রত্যক্ষ করে থাকেন। আদর্শ প্রচারের ক্ষেত্রে সত্যিই এটা একটা জটিল পর্যায়। কেননা এ স্থলে আপনার নিজের গুরুত্ব এবং ব্যক্তিত্ববোধ বর্তমান থাকে। আপনি এ ক্ষেত্রে নিজের জন্যে একটা আসন নির্ধারিত করে নিয়েছেন। সেখান থেকে নিচে অবতরণের কথা আপনি চিন্তাও করতে পারেন না। অথচ বুদ্ধি-বিবেচনার কথা হল এই যে, আপনাকে নিজের নিকটস্থ ব্যক্তিদের সংশোধনের জন্যে এমন পর্যায়ে নেমে আসতে হবে, যা এ কাজের জন্যে একান্ত আবশ্যক। এখানে এসে হয়তো আপনি এক সমস্যায় পড়ে যান। কারণ একদিকে আদর্শ প্রচারের কলা-কৌশল বজায় রাখা, অপরদিকে ব্যক্তিগত মর্যাদার প্রশ্ন। কিন্তু তবুও এ ক্ষেত্রে আপনার কাছে দ্বীনের দাবি হলো এই যে, আপনি এ জাতীয় পরিবেশে নিজেকে অন্যের সমপর্যায়ে নিয়ে আসবেন এবং সকলের সঙ্গে আন্তরিকতার সাথে কথাবার্তা বলবেন ও মেলামেশা করবেন। তাদেরকেও নিজেদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ দান করবেন যদিও উচ্চ মর্যাদাবোধ আপনাকে তা করার অনুমতি দেয় না। আদর্শ প্রচারের কৌশল এটাই চায় যে, আপনি যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে নিজের নিকটস্থ ব্যক্তিদের মনোভাব পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যাপারে যেহেতু আপনি এ ধরনের আচরণে অভ্যস্ত নন, সর্বদাই তাদের ওপর ইচ্ছায় অনিচ্ছায় আপনার মতামত চাপিয়ে আসছেন, তাই এখানেও আপনি চাইবেন যে, টু-শব্দটিও না করে নীরবে আপনার প্রাধান্যকে মেনে নিতে হবে। অথচ দ্বীনের বৃহত্তর স্বার্থের প্রশ্নে আপনার এ মনোভাব পরিহার করা অপরিহার্য। অপরের মতামত এবং ভাবাবেগের প্রতি লক্ষ্য রাখা একান্ত কর্তব্য। কিন্তু অনেকে এ কথা ভুলে গিয়ে অন্যান্য কাজকর্মের ন্যায় এ ক্ষেত্রেও এর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করতে প্রস্তুত থাকে না।

এ কয়টা বিশেষ বিশেষ কারণেই নিজের নিকটতম পরিবেশেও প্রচারক নিজেকে ‘উপেক্ষিত আগন্তুকের’ পর্যায়ে ফেলে দেয়। এতে হয়তো আপনার মনে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে যে, আদর্শ প্রচারের ক্ষেত্রে যদি উল্লেখিত উপদেশাবলী পালন করা হয় তাহলে অন্যান্য ব্যাপারে যথেষ্ট অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। কারণ গৃহকর্তা বা বড় অফিসার হিসেবে মানুষের সঙ্গে আচার-ব্যবহারে চলনে-বলনে আপনাকে এ বিশেষ একটা মেজাজ গ্রহণ করতে হবে। আবার আদর্শ তথা দ্বীনের প্রচারকল্পে আপনাকে গ্রহণ করতে হবে অন্য রকম ভংগী। এ রকম দু’মুখো নীতিকে আপনি আত্মস্থ করতে পারবেন না। সে সময় আপনার আদর্শ প্রচারের ধরন কৃত্রিমতা দোষে দুষ্ট হয়ে পড়বে। অথবা অধীনস্থ বা নিজ পরিবারের লোকদের ব্যাপারে আপনি সতর্কতা অবলম্বন করতে চাচ্ছেন তা হয়ে পড়বে অন্তঃসারশূণ্য। আপনার এ জটিলতাটি বাস্তবতাভিত্তিক তাতে সন্দেহ নেই। অবশ্য কোন ব্যক্তির জীবনে দু’মুখো নীতি কার্যকরী হতে পারে না এবং আপনিও সফলতা লাভ করতে পারবেন না, কিন্তু তবুও এখানে একটা বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করার আছে। তা হচ্ছে আপনি নিজের জীবনের যে পর্যায়ে এ ভয়ভীতি এবং বাধ্য-বাধকাতার নীতি অবলম্বন করে আছেন তা কি সত্যিই আপনার জন্যে জরুরী? এটা না হলেই কি নয়? আসলে এ ব্যাপারে আপনার পয়লা নম্বর ভুলটি হচ্ছে এখানেই। আপনি জীবনের এ অংশটিতে নিজের আসন এখানেই নির্দিষ্ট করেছেন। কিন্তু মূলতঃ আপনার এ ভূমিকা এ ক্ষেত্রেও সত্যিকার সফল বা প্রশংসনীয় কোন ভূমিকা নয়। কিন্তু এখানে অকৃতকার্যতা আপনি এ জন্যে উপলব্ধি করতে পারছেন না যে, যেহেতু যেসব লোক আপনার সংগে সংশ্লিষ্ট তারা নিজেদের বিভিন্ন প্রয়োজনের তাকিদে আপনার এ ভূমিকাকে বরদাশত করে নিতে বাধ্য হয়েছে। স্বেচ্ছায় কেউ তা করে না, বরং সব সময়ই তারা এ বাধ্যবাধকতা, এ মুরুব্বিয়ানা থেকে অব্যহতি পাওয়ার জন্যে সচেষ্ট থাকে। যখনই সুযোগ পায় তখনই এ বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়াকে নিজেদের সৌভাগ্য বলে মনে করে। লক্ষ্য করলে আপনিও তাদের এ অবস্থা অনুধাবন করতে পারবেন। কিন্তু যে পরিসরে আপনি মানুষকে সংশোধন করতে চাচ্ছেন এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তনের আশা পোষণ করছেন, সেখানে তারা এ কাজে কিছুতেই আপনার কথা শুনতে বাধ্য নয়। আপনি তাদের দ্বারা জোরজবরদস্তি কিছু করাতে চাইলেও বড় জোর এতটুকু হতে পারে যে তারা দৃশ্যতঃ আপনাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করবে কিন্তু অন্তর তাদের ‘ভেতরের মানুষটি’র কথাতেই অটল থাকবে। এ জন্যে তাদেরকে বাধ্য করার মতো কোন ক্ষমতাই আপনার নেই। সারকথা হলো, এ জাতীয় পরিবেশে কাজ করার জন্যেও আপনাকে সে সব পরামর্শকেই সম্মুখে রেখে অগ্রসর হতে হবে, যা অন্যের ক্ষেত্রে অনুসৃত হওয়ার জন্যে এ যাবত আলোচিত হয়েছে বা আরো হবে। এক কথায়, এ পরিবেশেও আপনাকে শ্রোতার মনের গতি-প্রকৃতির প্রতি লক্ষ্য রেখেকাজ করতে হবে।

হাস্যোজ্জ্বল চেহারা
মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘তোমরা হাসিমুখে যদি নিজের ভাইয়ের প্রতি তাকাও, তাও সাদকায় পরিণত হয়। ‘ হাসিমুখে একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার গুরুত্ব অপরিসীম কিন্তু অনেকেই এ সম্পর্কে অনবহিত। অনেকেরই এ কথা জানা নেই যে তার ব্যক্তিত্বে কি পরিমাণ শক্তি লুকায়িত আছে এবং তার ঈষৎ হাসির মূল্য যে কি! অপরের হৃদয়ে নিজের আসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে, সহাস্যবদনে তার সঙ্গে মিলিত হওয়াই একমাত্র পন্থা। মুখে কথা বলা অপেক্ষা সামান্যতম শুভেচ্ছামূলক হাসিরই প্রভাব অধিক হয়ে থাকে। হাস্যোজ্জ্বল চেহারা যেন প্রথম সাক্ষাতেই আগত ব্যক্তিকে এই বলে স্বাগত জানায় যে, “আমি তোমায় ভালোবাসি”। আর গম্ভীর এবং কোঁচকানো ভুরু ব্যক্তিকে দেখামাত্রই আপনি মনে করবেন যে, তার বর্তমান অবস্থা যেন আপনাকে লক্ষ্য করে বলছে, “তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। আমি তোমাকে ভালোবাসি না”। মানুষকে নিজের থেকে দূরে সরানোর জন্যে রুক্ষ এবং কর্কশ ব্যবহারই যথেষ্ট। তবে যার একান্ত ইচ্ছা মানুষের মধ্যে সদ্ভাব সৃষ্টি করা, মানুষের মনকে হাতের মুঠোর মধ্যে আনা, তার হৃদয় জয় করা এবং তার জীবনের লক্ষ্য, আদর্শ ও চিন্তাধারাকে এক মহৎ উদ্দেশ্যে আমূল পরিবর্তন করা – এমন ব্যক্তি এটা কিছুতেই পছন্দ করবে না যে তার কোনো অশোভন আচরণের দরুন মানুষ তার থেকে দূরে সরে যাক। এরূপ কোন মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সম্পর্ক স্থাপনকারী ব্যক্তির জন্যে উচিত, সর্বদা হাসিমুখে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা এবং সর্বদা ভদ্রোচিত ব্যবহার করা। মানুষের মন জয় করার জন্যে এটা সত্যিই শ্রেষ্ঠতম উপায়।

সাক্ষাতে কারো সঙ্গে হাসিমুখে মিলিত হওয়া সম্পর্কে উপরে যা কিছু বলা হয়েছে, এর মানে এ নয় যে, স্বার্থোদ্ধারকারীদের ন্যায় কৃত্রিম হাসি দ্বারা সাময়িকভাবে মানুষকে খুশি করতে হবে। এরূপ হাসিকে মানুষ স্বার্থোদ্ধারের হাতিয়ার এবং বিদ্রুপাত্মক বলেই মনে করে, যা কোন ব্যাপারে ধোকা দেয়ার জন্যেই মানুষ করে থাকে। বরং এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, সাধারণতঃ বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সাক্ষাতকালে মানুষ যেরূপ আন্তরিকতার সঙ্গে হাসিমুখে মিলিত হয়, তেমন অকৃত্রিম হাসি। এরকম স্নেহ-ভালোবাসা মিশ্রিত হাসিই অপরের মনে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে।

যে কোন প্রকার সফলতা অর্জন করতে হলেই সন্তুষ্টচিত্তে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা আবশ্যক। এমনিতেই মানুষ বহু সময় অযথা হাসিখুশিতে নষ্ট করে। তা না করে এ সময়টাকে এক মহত্তর উদ্দেশ্যে অপরের সঙ্গে হাসিখুশিতে কাটানো যেতে পারে। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অতি সহজেই আপনার প্রতি আকৃষ্ট হবে। হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে কারোর সঙ্গে মোলাকাত করার মধ্যে যে কি যাদু প্রভাব রয়েছে আদর্শের প্রচারকদের জন্যে তা একবার পরীক্ষা করে দেখা উচিত। এতে পারিবারিক জীবন অত্যন্ত আনন্দমুখর হয়। সন্তান-সন্ততিদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে এরূপ ব্যবহার হয় যথেষ্ট সহায়ক। এক কথায় অপরের মন জয় করার জন্যে এটা একটা মস্তবড় উপায়।

আর এরূপ করার যদি আপনার অভ্যাস না থাকে, তাহলে আপনি এর অভ্যাস করুন। হয়তো কোন ব্যাপারে আপনি পীড়া অনুভব করছেন এখন আপনার মধ্যে কেবল বিরক্তি বিরক্তি ভাব, সে ক্ষেত্রে এরূপ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্যে আপনাকে সচেষ্ট হওয়া উচিত। কেননা বিরক্তি অনুভব করেই বা লাভ কি এতে তো আপনার মনের অস্থিরতা যাবে না। ব্যস্ততা বা বিরক্তিভাব প্রকাশে সমস্যার আদৌ সমাধান হবে না। বরং যতই আপনি পীড়া অনুভব করবেন, ততোই আপনার মানসিক ও দৈহিক শক্তি লোপ পেতে থাকবে। ক্রমেই আপনি ধৈর্যশক্তি হারিয়ে ফেলবেন। এটা অবশ্য ঠিক যে, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কর্ম-প্রবাহে তাকে মাঝে মাঝে এমন কিছু অপ্রীতিকর এবং অবাঞ্ছিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়, যাতে সে সময় মনের স্বাভাবিকতা রক্ষা করা এক রকম অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবে মানুষ যদি প্রথমতঃ ছোট-খাটো অবাঞ্ছিত ব্যাপারে ধৈর্যের পরিচয় দিতে শেখে তাহলে তার জন্যে বিরাট বিরাট কষ্ট ও বেদনাদায়ক ব্যাপারও সহ্য করা সহজ হয়ে ওঠে।

পক্ষান্তরে সাধারণ ব্যাপারে যে ব্যক্তি খিটখিটে মেজাজের পরিচয় দিয়ে থাকে বিরাট কোন সমস্যা দেখা দিলে তো সে উন্মাদ হয়ে যাওয়ারই কথা। উন্নত চিন্তাধারা এবং উচ্চাকাংখা আপনার মনে উৎসাহ উদ্দীপনার সঞ্চার করবে। এতে কোন সাধারণ বিষয় আপনার মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলতে সক্ষম হবে না। কোন মহান লক্ষ্যাভিসারী মামুলী ব্যাপারে কোনো দিনই প্রভাবিত হবে না কারণ যেহেতু আপনি ঈমানের শক্তিতে বলীয়ান এটা আপনার দৃঢ় বিশ্বাস যে, যা কিছু হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছাতেই হচ্ছে। আপনি আল্লাহর মেহেরবানীর প্রত্যাশী। সুতরাং এই ভেবে যাবতীয় অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিতে আপনি নিজেকে স্থির ও শান্ত রাখতে সক্ষম-স্পর্শকাতরতা থেকে আপনি মুক্ত। আর এটাই ঠিক যে, সে ব্যক্তিই সুখী যার মন নিরুদ্বেগ এবং শান্ত। অতএব আপনার মত মহান আদর্শের অনুসারী ব্যক্তির মুখেও যদি স্বাভাবিকতার উর্ধে উঠে একটা মহান লক্ষ্যর খাতিরে আনন্দের ভাব প্রকাশিত না হয়, তাহলে এরূপ আশা আর কার থেকে করা যেতে পারে? খোশমেজাজ থাকলে এতে আপনারও কল্যাণ নিহিত আছে। কেননা এটাই একমাত্র সমাদৃত হওয়ার পথ। এছাড়া আপনি কারো কাছেও পৌঁছাতে পারবেন না।

চেহারা সদা হাস্যোজ্জ্বল থাকা, মৃদু মৃদু হেসে কথা বলা, হাসিমুখে কারো সঙ্গে আলাপ করা এক কথা, আর অযথা অসম্পৃক্তভাবে হি হি করা অন্য কথা। কিছু সংখ্যক লোক বিশ্রীভাবে হাসি-ঠাট্টা এবং অশোভনীয় ও দায়িত্বহীন আলাপ-আলোচনা করাকে ‘হাসিমুখে কথা বলা’ মনে করে থাকে। অপরকে ব্যঙ্গ করা, অযথা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা এবং মানুষকে পেরেশান করাই তাদের দৃষ্টিতে হাসিখুশি থাকার পদ্ধতি। কিন্তু এটা ঠিক নয়। এতে আপনি অপরের হৃদয়কে হাতের মুঠোয় আনা তো দূরের কথা, বরং আপনার থেকে আরো বেশি দূরে সরে যাবে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি