রোযার অধ্যায়

রোযার বিবরণ

রমজানের রোজা ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কুরআনে শুধু রোজা রাখার হুকুম দেওয়া হয়নি, বরঞ্চ রোজার নিয়ম পদ্ধতিও বলে দেওয়া হয়েছে। রমজানের মহত্ব ও বরকত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যে মাসের রোজা শরীয়ত ফরজ করেছে তার ফযিলত ও বরকত প্রথমে আমরা বর্ণনা করবো।

রমজানুল মুবারকের ফযিলত

কুরআনে রমজানের মহত্ব ও ফযিলত

কুরআন পাকে রমজানের মহত্ব ফযিলতের তিনটি কারণ বলা হয়েছেঃ

১. কুরআন নাযিল হওয়া অর্থাৎ এ মাসে কুরআন নাযিল হয়।

২. লায়লাতুল কদর। অর্থাৎ এ মাসে এমন এক রাত আছে যা মঙ্গল ও বরকতের দিক দিয়ে এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।

৩. রোজা ফরজ হওয়া। অর্থাৎ এ মাসে মুসলমানদের ওপর রোজা ফরজ হয়েছে।

এসব ফযিলতের জন্য নবী (স) এ মাসকে ********** আরবী ************বা আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং এ মাসকে সকল মাস থেকে উৎকৃষ্টতম বলেছেন। নিম্নে তার কিছু সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ দেওয়া হলোঃ

রমজানের ফযিলতের কারণ
১. কুরআন নাযিল হওয়াঃ কুরআন বলেন-********** আরবী ************

রমজান এমন এক মাস যাতে কুরআন নাযিল হয়েছে- যা সমগ্র মানব জাতির জন্য হেদায়েতস্বরূপ। যা সত্য পথ প্রদর্শনকারী, সুস্পষ্ট শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং হকও বাতিলকে সুস্পষ্ট করে উপস্থাপনকারী। (সূরা আল বাকারাঃ১৮৫)

রমজানের মহত্ব ফযিলত বুঝবার জন্য একথাই যথেষ্ট নয় যে, তার মধ্যে আল্লাহর হেদায়েতের সর্বশেষ কেতাব নাযিল করা হয়েছে। প্রকৃত ব্যাপার এই যে,মানবতা যদি হেদায়েতের উৎস থেকে বঞ্চিত হতো। তাহলে গোটা বিশ্ব প্রকৃতির অস্তিত্বের এ বিরাট কারখানাটির সূর্যের আলো ও চাঁদ তারার শুভ্র রশ্মি সত্ত্বেও লন্ড ভণ্ড হয়ে যেত।বিশ্ব প্রকৃতি তার সুনিপুণ কারুকার্য ও সৌন্দর্য সত্বেও অর্থহীন অপূর্ণ ও উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়তো। ফলে কুফর নাস্তিকতা শিরক ও সত্ত্বেও মানুষ বনের হিংস্র পশুর চেয়েও নিকৃষ্টতর হয়ে পড়তো। কুরআনও পৃথিবীতে হেদায়েতের আলোকের একমাত্র উৎস। এর থেকে যে বঞ্চিত সে সে হেদায়েত ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।

২. লাইলাতুল কদরঃ কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে যে, তা রমজান মাসে শামিল করা হয়েছে এবং তা লাইলাতুল কদরে নাযিল করা হয়েছে। তার অনিবার্য অর্থ এই যে, লাইলাতুল কদর রমজানের কোনো একটি রাত যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেনঃ রমজানের শেষ দশ বেজোড় রাতের রাতগুলোর মধ্যে লাইলাতুল কদর তালাশ কর। (বুখারী)

৩. রোজা ফরজ হওয়াঃ রোজার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের জন্য আল্লাহ তায়ালা এ মাসকে নির্ধারণ করেছেন এবং গোটা মাসের রোজা মুসলমানদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন:

********** আরবী ************ অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে তার জন্য অপরিহার্য যে সে পুরো মাস রোজা রাখবে।

রমজানের মহত্ব ও ফযিলত সম্পর্কে হাদীস

নবী (স) রমজানের মহত্ব ও ফযিলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, যখন রমজানের প্রথম রাত আসে, তখন শয়তান ও অবাধ্য জ্বিনগুলিকে শৃঙ্খল দিয়ে বেধে রাখা হয় এবং দোযখের সকল দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার কোন একটি দরজাও খোলা রাখা হয় না। জান্নাতের সকল দরজা খুলে দেওয়া হয়। তার কোনো একটি দরজাও বন্ধ করে দেওয়া হয় না। তারপর আল্লাহর একজন আহ্বানকারী বলতে থাকে। যারা কল্যাণ ও মঙ্গল চাও তারা সামনের দিকে অগ্রসর হও। যারা বদকাম পাপাচার করতে চাও তারা থাম। তারপর আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক নাফরমান বান্দা কে দোযখ থেকে রেহাই দেওয়া হয়। আর এ কাজ রমজানের প্রত্যেক রাতেই করা হয়। (তিরমিযি,ইবনে মাযাহ)

এ এমন একটি মাস যে মসে মুমিনদের রুজি বৃদ্ধি করা হয়।(মিশকাত)
রমজান মাস সকল মাসের সরদার ।(ইলমুল ফেকাহ)
এ মাসের প্রথম অংশ রহমত, দ্বিতীয় অংশ মাগফেরাত, তৃতীয় এবং শেষ অংশ জাহান্নামের আগুন থেকে রেহাই ও মুক্তি।(মিশকাত)
এ মাসে যদি কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আপন ইচ্ছায় কোন নফল নেকী করবে সে অন্যান্য মাসের ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব পাবে। আর যে একটি ফরজ আদায় করবে সে অন্যান্য মাসের সত্তরটি ফরজের সমান সওয়াবের হকদার হবে। (মিশকাত)
ইতিহাসে রমজানের মহত্ব ও গুরুত্ব

ইতিহাস এ কথার সাক্ষী যে, হক ও বাতিলের প্রথম সিদ্ধান্তকর যুদ্ধ এ মাসে হয়েছিল। এবং হক কে বাতিল থেকে আলাদা করে দেওয়ার যে দিন কে কুরআনে ইয়ামুল ফোরকান বলা হয়েছে তা ছিলো এ মাসের একটি দিন। এ দিনেই হকের প্রথম বিজয় সূচিত হয় এবং বাতিল পরাজিত হয়। ইতিহাস এ কথাও বলে যে, এ মাসেই মক্কা বিজয় হয়।এসব তথ্য সামনে রেখে চিন্তাভাবনা করুন তাহলে উপলব্ধি করবেন।

হকের হেদায়েত এ মাসেই নাযিল হয়।
ইসলামের প্রাথমিক বিজয় এ মাসেই হয়।
ইসলামের পরিপূর্ণ বিজয় এ মাসেই হয়।
এসব সত্য কে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য রমজান মাস প্রতি বছর আসে। শরীয়ত এ মাসে রোজা ফরজ করেছে, রাতের নামাজ ও তেলাওয়াতে কুরআনের ব্যবস্থা করেছে যাতে করে মুমিনের মধ্যে জেহাদের প্রাণ শক্তি নিষ্প্রাণ না হয়ে পড়ে। এবং বছরের অন্তত একবার রমজান মাসে কুরআন শুনে বা পড়ে আপন পদমর্যাদায় দায়িত্বপূর্ণ অনুভূতি সহকারে মনের মধ্যে তরজমা করতে পারে।কুরআনের নাযিল হওয়া, তার অধ্যয়ন এবং রোজার মুজাহিদ সুলভ তরবিয়ত এ জন্য যে, ইসলামের সন্তানগণ দীনকে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই জীবিত রয়েছে এবং কখনো যেন আপন দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে গাফিল না হয়।

রোজার অর্থ

রোজাকে আরবী ভাষায় সাওম বা সিয়াম বলে। তার অর্থ কোন কিছু থেকে বিরত থাকা এবং তা পরিত্যাগ করা। শরীয়তের পরিভাষায় সাওমের অর্থ

সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খানা পিনা ও যৌন ক্রিয়াকর্ম থেকে বিরত থাকা।

রোজা ফরজ হওয়ার হুকুম

হিজরতের দেড় বছর পর রমজানের রোজা মুসলমানদের ওপর ফরজ করা হয়।

********** আরবী ************

হে ঈমানদারগণ তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো। রোজা ফরজে আইন যে তা অস্বীকার করবে সে কাফের এবং বিনা ওজরে যে রাখবে না সে ফাসেক ও কঠিন গোনাহগার হবে।

রোজার গুরুত্ব

কুরআন এ সাক্ষ্য দেয় যে, সকল আসমানী শরীয়তের অধীন রোজা ফরজ ছিলো। এবং প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতের মধ্যে তা ছিল একটা অপরিহার্য অংশ।

********** আরবী ************

যেমন রোজা ফরজ করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর।

এ আয়াত শুধু একটা ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনার জন্য নয়, বরঞ্চ এ গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি তুলে ধরার জন্য যে মানুষের প্রবৃত্তির পরিশুদ্ধির সাথে রোজার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এবং তাযকিয়ায়ে নফসে তার তার একটা স্বাভাবিক অধিকার রয়েছে। বরঞ্চ এমন মনে হয় যে, তরবিয়ত ও তাযকিয়ার প্রক্রিয়া ছাড়া তা পূর্ণ হতে পারে না। অন্য কোন ইবাদত তার বিকল্প হতেই পারে না।এজন্যই রোজা সকল নবী গনের শরীয়াতে ফরজ ছিল।

রোজার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে নবী (স) বলেন যে ব্যক্তি কোন শরয়ী ওজর অথবা রোগ ছাড়া রমজানের একটি রোজা ছেড়ে দেবে যদি সে সারা জীবন ধরে রোজা রাখে তবুও তার ক্ষতি পূরন হবে না। (আহমদ, তিরমিযি, আবু দাউদ)

অর্থাৎ রমজানের রোজার মহত্ব, কল্যাণ, বরকত ও গুরুত্ব এইযে, যদি কোন উদাসীন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোন রোজা নষ্ট করে বা না রাখে, তার ফলে তার যে ক্ষতি হলো তা জীবনব্যাপী রোজা রাখলেও তার ক্ষতিপূরণ হবে না। তবে তার আইনগত কাযা হতে পারে।

রোযার উদ্দেশ্য

রোযার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া পয়দা করার ……. আরবী …… যাতে করে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া পয়দা হতে পারে। তাকওয়া আসলে এমন এক সম্পদ যা আল্লাহর মহব্বত ও ভয় থেকে পয়দা হয়। আল্লাহর সত্তার ওপর ঈমান,ও তার গুণাবলী দয়া অনুগ্রহের গভীর অনুভূতি থেকে মহব্বতের প্রেরণা সৃষ্টি হয় এবং তা অন্য গুণ রাগ, ক্ষোভ ও শাস্তিদানের ক্ষমতার ধারণা বিশ্বাস থেকে ভয়ের অনুভূতি জাগ্রত হয়। মহব্বত ও ভয়ের এ মানসিক অবস্থার নাম তাকওয়া যা সকল নেক কাজের উৎস এবং সকল পাপ কাজ থেকে বাচার সত্যিকার উপায়।

রোযা আল্লাহর সত্তার ওপরে দৃঢ় বিশ্বাস এবং তার অনুগ্রহ ও অসন্তোষের গভীর অনুভূতি সৃষ্টি করে। সারাদিন ক্রমাগত কয়েক ঘণ্টা ধরে প্রবৃত্তির একেবারে মৌলিক ও প্রয়োজনীয় দাবী পূরণ থেকে বিরত থাকার কারণে মানুষের ওপর এ প্রভাব পড়ে যে, সে চরম অক্ষম, অসহায় ও মুখাপেক্ষী হয়। সে জীবনের প্রতি মূহুর্তের জন্য আল্লাহর রহম ও করমের ভিখারি হয়। তারপর সে যখন তার জীবনকে আল্লাহর নিয়ামতে সমৃদ্ধ দেখতে পায়, তখন সে আল্লাহর মহব্বতের আবেগ উচ্ছ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয় এবং আন্তরিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর আনুগত্য ও বন্দেগীতে তৎপর হয় তখন সে নিভৃতে তার প্রবল যৌন বাসনাকে সংযত করে রাখে যেখানে আল্লাহ ছাড়া দেখার কেউ থাকে না তখন তার মনে আল্লাহর ভয় তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। ফলে তার মনের ওপর আল্লাহর মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের এমন ছাপ পড়ে যে গোনাহের চিন্তা করতেও তার শরীর কেপে ওঠে।

প্রকৃত রোযা

রোযার এ মহান উদ্দেশ্য তখনই হাসির করা যেতে পারে, যখন রোযা পূর্ণ অনুভূতির সাথে রাখা হয় এবং ঐ নিষিদ্ধ কাজ থেকে রোযাকে রক্ষা করা হয় যার প্রভাবে রোযা প্রাণ হীন হয়ে পড়ে। প্রকৃত রোযা তো তাই যার সাহায্যে মানুষ তার মন মস্তিষ্ক ও সকল যোগ্যতাকে আল্লাহর নাফরমানি থেকে বাঁচিয়ে রাখবে এবং প্রবৃত্তির চাহিদা পদদলিত করবে।

নবী (স) বলেন, তুমি যখন রোযা রাখবে তখন তোমার কর্তব্য হবে তোমার কান, চোখ, মুখ, হাত, পা এবং সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত রাখা। (কাশফুল মাহজুব)

নবী (স) আরো বলেন, যে ব্যক্তি রোযা রেখে মিথ্যা কথা বলা এবং মিথ্যা আচরণ থেকে বিরত হলো না, তার ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকার আল্লাহর কোনো প্রয়োজন ছিল না। (বুখারী)

এমন বহু রোজাদার আছে যে, রোযায় ক্ষুধা তৃষ্ণা ভোগ করা ছাড়া তাদের নেকীর পাল্লায় আর কিছু পড়ে না। (মিশকাত)

রোযার ফযিলত
নবী (স) বলেন, প্রত্যেক নেক আমলে প্রতিদান দশ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু আল্লাহ এরশাদ হচ্ছে, রোযার ব্যাপারটাই অন্য রকম। তাতো আমার জন্য নির্দিষ্ট। আমি স্বয়ং তার প্রতিদান দেব। বান্দা আমার জন্যে তার যৌনবাসনা ও খানাপিনা বন্ধ রাখে। রোযাদারের জন্যে দুটি আনন্দ, একটা হচ্ছে ইফতারের সময় যখন সে এ আবেগ উল্লাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে আল্লাহর নিয়ামত উপভোগ করতে থাকে যে, আল্লাহ তাকে একটা ফরয আদায় করার তাওফিক দান করেছেন।

দ্বিতীয় আনন্দ আপন পরওয়ারদেগারের সাথে মিলিত হওয়ায় যখন সে আল্লাহর দরবারে সাক্ষাতের অনুমতি লাভ করবে এবং দীদার লাভ করে চক্ষু শীতল করবে।

রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধি থেকেও উৎকৃষ্টতর। রোযা গোনাহ থেকে আত্মরক্ষার ঢাল স্বরূপ। তোমাদের মধ্যে কেউ রোযা রাখলে সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা ও হৈ হাংগামা থেকে দূরে থাকে। যদি কেউ গালিগালাজ করতে থাকে অথবা ঝগড়া করতে আসে, তাহলে তার মনে করা উচিত যে, সে রোযা আছে। (বুখারী, মুসলিম)

নবী (স) আরও বলেন, যে ঈমানের অনুভূতি এবং আখিরাতের সওয়াবের আশায় রোযা রাখে তা পূর্বের সব গোনাহ (সগীরা) মাপ করে দেয়া হয়। (বুখারী, মুসলিম)

রুইয়েতে হেলাল বা চাঁদ দেখার নির্দেশাবলী

১. শাবানের উনত্রিশ তারিখে রমযানের চাঁদ দেখার চেষ্টা করা মুসলমানদের ওয়াজিবে কেফায়া। (সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব যে, রমযানের চাঁদ দেখার ব্যবস্থা তারা করবে। গোটা সমাজ যদি এর গুরুত্ব অনুভব না করে এবং বিষয়টিকে অবহেলা করে তাহলে সকলেই গোনাহগার হবে) পঞ্জিকা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে রোযা রাখা এবং চাঁদ দেখা থেকে বেপরোয়া হওয়া কিছুতেই জায়েয নয়। এমনকি যারা গণনা শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ এবং নেক ও পরহেজগার, তাদেরও নিজের হিসেবের ওপর আমল করা জায়েয নয়। নবী (স) বলেন, চাঁদ দেখা রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা খতম কর। যদি ২৯ শাবান চাঁদ দেখা না যায় তাহলে শাবানের ত্রিশ দিন পূর্ণ কর। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

২. কোনো অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চাঁদ দেখা মেনে নেয়া এবং তদনুযায়ী রোযা রাখা জায়েয নয়। যেমন একটা প্রবাদ আছে যেদিনটি রজব মাসের ৪ঠা সে দিনটি রমযানের পয়লা এবং বারবার এটা পরীক্ষা করা হয়েছে।

৩. রজবের উনত্রিশ তারিখে চাঁদ দেখার চেষ্টা ও ব্যবস্থা করা মোস্তাহাব। কারণ রমযানের পয়লা তারিখ জানার জন্যে শাবানের তারিখগুলো জানা জরুরী। যেমন মনে করুন উনত্রিশ রজব চাঁদ উদয় হলো। কিন্তু লোকে তা দেখার কোনো ব্যবস্থা করেনি। তারপর ১লা শাবানকে ৩০শে রজব মনে করে হিসেব করতে থাকলো। এভাবে ৩০শে শাবান এসে গেল। কিন্তু আকাশে মেঘ অথবা ধুলাবালির কারণে চাঁদ দেখা গেল না। যেহেতু তা শাবানের ২৯ তারিখ মনে করা হচ্ছিল। এ জন্যে ১লা রমযানকে লোক ৩০শে শাবান মনে করে বসলো এর ফলে অবহেলার কারণে রমযানের একটা রোযা নষ্ট হয়ে গেল।

হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) শাবান মাসের দিনগুলো ও তারিখগুলো যেমন চিন্তা ভাবনা ও হিসেবে করে মনে রাখতেন, অন্য কোনো মাসের তারিখ এতো যত্ন সহকারে মনে রাখতেন না, তারপর তিনি রমযানের চাঁদ দেখে রোযা রাখতেন। (আবু দাউদ)

৪. যে ব্যক্তি স্বচক্ষে রমযানের চাঁদ দেখবে, তার কর্তব্য হচ্ছে বস্তির সকল লোক অথবা মুসলমানদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরকে অথবা কোনো প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দেয়া তা সে পুরুষ হোক বা নারী হোক।

৫. পশ্চিম আকাশ চাঁদ ওঠার স্থান যদি পরিষ্কার হয়, তাহলে এমন অবস্থায় শুধুমাত্র দুজন দীনদার লোকের সাক্ষ্যে রমযানের চাঁদ ওঠা প্রমাণিত হবে না আর না ঈদের চাঁদ প্রমাণিত হবে। এ অবস্থায় অন্তত এতজন লোকের সাক্ষ্য দরকার যাতে করে তাদের কথায় চাঁদ ওঠা সম্পর্কে নিশ্চয়তা লাভ করা যায়।

৬. চাঁদ ওঠার স্থান পরিষ্কার না হলে রমযানের নতুন চাদের প্রমাণের জন্যে শুধু একজনের সাক্ষ্যই যথেষ্ট তা সে পুরুষ হোক বা নারী। তবে নিম্নে শর্তে:

ক) সাক্ষ্যদাতা বালেগ, জ্ঞান সম্পন্ন এবং দীনদার মুসলমান হতে হবে।

খ) তাকে বলতে হবে যে, সে নিজ চক্ষে চাঁদ দেখেছে।

৭. আকাশ পরিষ্কার হলে ঈদের নতুন চাঁদের জন্যে একজনের সাক্ষ্য যথেষ্ট নয় সে যেমন ধরনের বিশ্বস্ত লোক হোক না কেন। ঈদের চাঁদের জন্যে প্রয়োজন দুজন দ্বীনদার মুত্তাকী পুরুষের সাক্ষ্য গ্রহণ করা অথবা একজন দ্বীনদার পুরুষ এবং দুজন দ্বীনদার নারীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা। যদি চারজন স্ত্রীলোক সাক্ষ্য দেয় যে তারা চাঁদ দেখেছে তথাপি তার দ্বারা ঈদের চাঁদ প্রমাণিত হবে না।

৮. যেখানে কোনো মুসলমান কাযী অথবা শাসক নেই, সেখানকার মুসলমানদের উচিত নিজেরাই চাঁদ দেখার ব্যবস্থা করবে, তার প্রচার করবে এবং তদনুযায়ী কাজ করবে।

৯. সারা শহরে একথা ছড়িয়ে পড়লো যে, চাঁদ দেখা গেছে, কিন্তু বহু অনুসন্ধানের পরেও এমন কোনো ব্যক্তি পাওয়া গেল না যে একথা স্বীকার করবে, সে নিজে চাঁদ দেখেছে। এ অবস্থায় চাঁদ ওঠা প্রমাণিত হবে না।

১০. যদি এমন ব্যক্তি রমযানের চাঁদ দেখেছে বলে বলা হচ্ছে যার সাক্ষ্য শরিয়তের দৃষ্টিতে জায়েয নয়। এবং সে ছাড়া আর কেউ চাঁদ দেখেনি, তাহলে তার কথায় শহর বা বস্তির লোক রোযা রাখবে না। কিন্তু সে অবশ্যই রোযা রাখবে তার রোযা রাখা ওয়াজিব। তারপর তার ত্রিশ রোযা হয়ে গেলে এবং ঈদের চাঁদ দেখা গেল না, তখন সে ৩১ রোযা করবে এবং বস্তির লোকের সাথে ঈদ করবে।

১১. কোনো কারণে কোনো জায়গায় চাঁদ দেখা গেল না এবং অন্য স্থান থেকে চাঁদ দেখার খবর এল। যদি সে খবর শরীয়াতের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হয় তাহলে তার দ্বারা রমযানের চাঁদও প্রমাণিত হবে। এবং ঈদের চাঁদও। মুসলমান দায়িত্বশীলদের প্রয়োজন হবে যে, তারা এসব খবর যাচাই করে দেখবে এবং শরীয়াত মুতাবেক যদি গ্রহণযোগ্য হয় তাহলে শহরে তার পাবলিসিটি করার এন্তেযাম করবে।

১২. দুজন নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত লোকের সাক্ষ্য দানে চাঁদ দেখা যদি প্রমাণিত হয় এবং সে অনুযায়ী লোক রোযা রাখে, কিন্তু ৩০ রোযা পুরো হওয়ার পর ঈদের চাঁদ দেখা গেল না, তাহলে ৩১শে দিনে ঈদ করবে। সেদিন রোযা জায়েয হবে না।

নতুন চাঁদ দেখার পর রোযা
হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) বলেন, নবী (স) নতুন চাঁদ দেখলে, বলতেন:

********** আরবী ************

আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, হে আল্লাহ এ চাঁদকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা, ঈমান ও ইসলামের চাঁদ হিসেবে উদিত কর। যে কাজ তোমার পছন্দনীয় এবং প্রিয় সে কাজের তাওফিক আমাদেরকে দাও। হে চাঁদ! তোমার এবং আমাদের প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ। (তিরমিযি ও দারেমী)

রোজার প্রকারভেদ ও তার হুকুম

রোজা ছয় প্রকার-যার বিস্তারিত বিবরণ ও হুকুম জানা জরুরী।

(১) ফরজ, (২) ওয়াজিব, (৩) সুন্নাত, (৪) নফল, (৫) মাকরূহ, (৬) হারাম।

১. ফরজ রোযা- বছরে শুধু রমজানের রোজা (৩০ বা ২৯চাদ অনুযায়ী) মুসলমানদের উপর ফরজ। কুরআন ও হাদীস থেকে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। মুসলিম উম্মত আর গোটা ইতিহাসে বরাবর এর উপর আমল করে এসেছে। যে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার অস্বীকার করবে সে কাফের হবে এবং ইসলাম থেকে বহিস্কৃত হবে। আর বিনা ওজরে রোজা ত্যাগ করলে ফাসেক ও কঠিন গোনাহগার হবে। রমজানের রোজা কোন কারণে বা অবহেলা করে করা না হলে তার কাযা করাও ফরজ। এ ফরজ কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়, যখনই সুযোগ হবে করতে হবে। বরঞ্চ যথা শীঘ্র করা উচিত।

২. ওয়াজিব রোজা- মানতের রোজা, কাফফারার রোজা ওয়াজিব।কোন নির্দিষ্ট দিনে রোজ রাখার মানত করলে সেই দিনে রোজা রাখা জরুরী। দিন নির্দিষ্ট না করলে যে দিন ইচ্ছা করা যয়। বিনা কারণে বিলম্ব করা ঠিক নয়।

৩. সুন্নাত রোজা- যে রোজা নবী (স) স্বয়ং করেছেন এবং করতে বলেছেন তা সুন্নাত। তা রাখার বিরাট সওয়াব রয়েছে। কিন্তু তা সুন্নাতে মুয়ক্কিদাহ নয় এবং না করলে গোনাহ হবে না। সুন্নাত রোজা নিম্নরূপ:

আশুরার রোজা।অর্থাৎ মুহররমের নয় তারিখ এবং দশ তারিখে দুটি রোজা।
আরাফার দিনের রোজা। অর্থাৎ যুলহজ্জের নয় তারিখে রোজা।
আইয়াম বীযের রোজা। অর্থাৎ চাঁদের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে রোজা।
৪. নফল রোজা- ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত বাদে সব রোজা নফল বা মোস্তাহাব। নফল রোজা এমন যে, তা নিয়মিত করলে বিরাট সওয়াব পাওয়া যায়। যেমনঃ

শাওয়াল মাসের ছটি রোজা।
সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোজা।
শাবানের ১৫ই তারিখের রোযা।
যুলহজ্জ মাসের প্রথম আট রোজা।
৫. মাকরূহ রোজা-

শুধু শনি অথবা রবিবার রোজা রাখা।
শুধু আশুরার দিন রোজা রাখা।
স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে রোজ রাখা।
মাঝে কোন দিন বাদ না দিয়ে ক্রমাগত রোজা রাখা যাকে সাওমে ভেসাল বলে।
৬. হারাম রোজা-বছরে পাঁচদিন রোজা রাখা হারাম।

ঈদুল ফিতরের দিন রোজা ।
ঈদুল আযহার নে রোজা।
আইয়ামে তাশরীকে রোজা রাখা অর্থাৎ ১১ই, ১২ই, ১৩ই যুলহাজ্জ তারিখে রোজা রাখা হারাম।
রোজার শর্তাবলী

রোজার শর্ত দুইপ্রকার:

রোজা সহীহ হওয়ার শর্ত।
রোজা ওয়াজিব হওয়ার শর্ত।
রোজা ওয়াজিব হওয়ার জন্য যেসব জিনিষের প্রয়োজন তাকে শারায়াতে সিহহাত বলে এবং হওয়ার জন্য যা প্রয়োজন তাকে শারায়াতে অযুব বলে।

রোজা ওয়াজিব হওয়ার শর্ত

১. ইসলাম।কাফেরের উপর রোজা ওয়াজিব নয়।

২. বালেগ হওয়া। নাবালেগের উপর রোজা ওয়াজিব নয়।

অবশ্যি অভ্যাস সৃষ্টি করার জন্য নাবালেগ ছেলেমেয়েদের উপর রোজা রাখতে বলা উচিৎ। যেমন নামাজ পড়বার অভ্যাস করবার তাগিদ হাদীসে করা হয়েছে। তেমনি রোজা রাখবার জন্যও প্রেরণা দেওয়া হয়েছে। যারা ক্ষুধা তৃষ্ণা সহ্য করতে পারে তাদেরকেই শুধু রোজা রাখতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ভালো নয়।

৩. রমজানের রোজা ফরজ হওয়া সম্বন্ধে জানা থাকা।

৪. মাযুর বা অক্ষম না হওয়া। অর্থাৎ এমন কোন ওজর না থাকা যাতে রোজা না থাকার অনুমতি রয়েছে, সফর, বার্ধক্য, রোগ, জিহাদ, ইত্যাদি।

রোজা সহীহ হওয়ার শর্তাবলী

১. ইসলাম। কাফেরের রোজা সহীহ নয়।

২. মহিলাদের হায়েজ নেফাস থেকে পবিত্র হওয়া।

৩. নিয়ত করা। অর্থাৎ মনে মনে রোজা রাখার ইরাদা করা। রোজা রাখার ইরাদা ছাড়া কেউ সারাদিন যদি ঐসব জিনিস থেকে বিরত থাকে যার থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। তাহলে তার রোজা হবে না।

 

রোজার ফরয
রোজার মধ্যে সুবহে সাদেক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনটি বিষয় থেকে বিরত থাকা ফরজ।

১. কিছু খাওয়া থেকে বিরত থাকা।

২. কিছু পান করা থেকে বিরত থাকা।

৩. যৌন বাসনা পূর্ণ করা থেকে বিরত থাকা।

যৌনবাসনা পূরণের মধ্যে ঐসব যৌন সম্ভোগ শামিল যার দ্বারা বীর্যপাত হয়, তা স্ত্রী সংগমের দ্বারা হোক বা যে কোন মানুষ, পশু প্রভৃতির সাথে যৌন ক্রিয়ার দ্বারা হোক। অথবা হস্তমৈথুনের দ্বারা হোক। মোটকথা এসব থেকে বিরত থাকতে হবে। অবশ্যি আপন স্ত্রীকে দেখা আদর করা, জড়িয়ে ধরা অথবা চুমু থেকে বিরত থাকা ফরজ নয়। কারণ তাতে বীর্যপাত হয় না।

রোযার সুন্নাত ও মোস্তাহাব

১. সিহরীর ব্যবস্থা করা সুন্নাত, কয়েকটি খেজুর হোক বা এক চুমুক পানি হোক।

২. সিহরীর সময় খাওয়া মোস্তাহাব।সুবহে সাদিক হতে যখন সামান্য বাকি।

৩. রোজার নিয়ত রাতেই করে নেওয়া মোস্তাহাব।

৪. ইফতার তাড়াতাড়ি করা মোস্তাহাব। অর্থাৎ সূর্য অস্ত যাওয়ার পর অথবা বিলম্ব না করা।

৫. খুরমা খেজুর অথবা পানি দিয়ে ইফতার করা মোস্তাহাব।

৬. গীবত, চোগলখুরী, মিথ্যা বল, রাগ এবং বাড়াবাড়ি না করা সুন্নাত। এ কাজ অবশ্যি অন্য সময় করাও ঠিক নয়। কিন্তু রোজার সময় তার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা বেশী করে করা উচিৎ।

কি কি কারণে রোজা নষ্ট হয়

রোযা অবস্থায় তিনটি বিষয় থেকে দূরে থাকা ফরয, যথাঃ

(১) কিছু না খাওয়া (২) কিছু পান না করা এবং (৩) যৌনবাসনা পূর্ণ না করা। এসব থেকে বিরত থাকা ফরয।

অতএব উপরোক্ত তিনটি ফরযের খেলাপ কাজ করলেই রোযা নষ্ট হয়। যেসব জিনিস রোযা নষ্ট করে তা আবার দু প্রকার। এক – যার দ্বারা শুধু কাযা ওয়াজিব হয়। দুই-যার দ্বারা কাযা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হয়।

কাফফারা ওয়াজিব হওয়া সম্পর্কে কিছু নীতিগত কথা

১. কোনো কিছু ইচ্ছা করে পেটে প্রবেশ করালে এবং তা উপকারী হওয়ার ধারণাও যদি থাকে, তা খাদ্য হোক, ঔষধ হোক অথবা এমন কাজ হোক যার আস্বাদ সংগম ক্রিয়ার মতো, তাহলে এসব অবস্থায় কাযা এবং কাফফারা দুই ওয়াজিব হয়।

২. কোনো কিছু যদি আপনা আপনি পেটের মধ্যে চলে যায়, তার উপকারী হওয়ার ধারনাও না থাকে, অথবা এমন কোনো কাজ করা হলো যার আস্বাদ সংগম ক্রিয়ার মতো নয়, তাহলে শুধু মাত্রা কাযা ওয়াজিব হবে।

৩. শুধু রমযানের রোযা নষ্ট হলেই তার কাফফারা ওয়াজিব হয়, রমযান ছাড়া অন্য রোযা নষ্ট হলে তার কাফফারা ওয়াজিব হবে না, তা ভুলক্রমে নষ্ট হোক অথবা ইচ্ছা করে নষ্ট করা হোক।

৪. রমযানের কাযা রোযা নষ্ট হলে তার কাফফারা ওয়াজিব হবে না, শুধু রমাযান মাসে রোযা নষ্ট হলে কাফফারা ওয়াজিব হবে।

৫. যাদের মধ্যে রোযা ওয়াজিব হওয়ার শর্ত পাওয়া যায় না, তাদের রোযা নষ্ট হলেও কাফফারা ওয়াজিব হবে না। যেমন, মুসাফিরের রোযা, হায়েয নেসাফ ওয়ালী মেয়েদের রোযা। যদিও মুসাফির এবং হায়েয নেফাস ওয়ালী মেয়েলোক রোযার নিয়ত সফর শুরু করার আগে এবং হায়েয নিফাস হওয়ার আগে করে থাকে।

৬. যে কোনো কাজ যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে যায়, যেমন ভুল করে কেউ কিছু খেয়ে নিলো, অথবা যৌন ক্রিয়া করলো, অথবা কুল্লি করতে হঠাৎ পানি গলার ভেতর চরে গেল, অথবা কেউ জবরদস্তি করে যৌন ক্রিয়া করালো তাহলে এসব অবস্থায় কাফফারা ওয়াজিব হবে না।

৭. যৌনক্রিয়ায় ক্রিয়াকারী এবং যার ওপর কারা হলো এ উভয়ের জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া শর্ত নয়। উভয়ের মধ্যে যে জ্ঞানসম্পন্ন এবং স্বেচ্ছায় এ কাজ করবে তার কাফফারা ওয়াজিব হবে। নারী জ্ঞানসম্পন্ন হলে কাফফারা তাকে দিতে হবে পুরুষকে নয়। আবার পুরুষ জ্ঞানসম্পন্ন হলে তাকে কাফফারা দিতে হবে, মাথা খারাপ পাগল মেয়ে মানুষের ওপর কাফফারা ওয়াজিব হবে না।

৮. কোনো মেয়েলোক নাবালক ছেলে দ্বারা যৌন ক্রিয়া করে নিলে অথবা কোনো পাগলের দ্বারা, তার ওপর কাযা ও কাফফারা দুটিই ওয়াজিব হবে।

৯. রমযানে রোযার নিয়ত ব্যতিরেকে কেউ খানা-পিনা করলে তার ওপর কাফফারা ওয়াজিব হবে না, শুধু কাযা ওয়াজিব হবে। কাফফারা তখনই ওয়াজিব যদি রোযার নিয়ত করার পর তা নষ্ট করে।

১০. কোনো সন্দেহের কারণে কেউ রোযা নষ্ট করলে কাফফারা দিতে হবে না।

যেসব ব্যাপারে শুধু রোযা কাযা করতে হবে
১. কারো বিলম্বে ঘুম ভাঙল এবং সিহরীর সময় আছে মনে করে খানা পিনা করলো। তাপর দেখলো যে ভোর হয়ে গেছে। তাহলে সে রোযার কাযা করা ওয়াজিব হবে।

২. কেউ বেলা ডোবার আগেই সূর্য ডুবেছে মনে করে ইফতার করলো। তাহলে কাযা করতে হবে।

৩. অনিচ্ছায় কোনো কিছু পেটের মধ্যে গেল, যেমন কুল্লি করতে গিয়ে গলার ভেতর পানি চলে গেল, নাকে বা কানে ওষুধ দিল তা পেটের মধ্যে গেল, পেট বা মাথার ঘায়ে ওষুধ দেয়া হলো, তা পেটে বা মাথার মধ্যে ঢুকলো এসব অবস্থায় কাযা ওয়াজিব হবে।

৪. কেউ রোযাদারকে জোর করে খাইয়ে দিল তাহলে শুধু কাযা করতে হবে।

৫. কেউ কোনো নারীর সাথে জোর করে সহবাস করলো অথবা মেয়ে মানুষ অঘোরে ঘুমচ্ছিল অথবা বেহুশ হয়ে ছিল কেউ তার সাথে সহবাস করলো, তাহলে সে মেয়েলোকটির শুধু কাযা ওয়াজিব হবে।

৬. কোনো নির্বোধ লোক কোনো মৃত নারী অথবা অল্প বয়স্ক বালিকা অথবা কোনো পশুর সাথে যৌন ক্রিয়া করলো, অথবা কাউকে ঝাপটে ধরলো, অথবা চুমো দিল অথবা হস্তমৈথুন করলো এবং এসব অবস্থায় বীর্যপাত হলো তাহলে শুধু কাযা ওয়াজিব হবে।

৭. কেউ রোযার নিয়তই করলো না কিন্তু খানাপিনা থেকে বিরত থাকলো অথবা নিয়ত করলো কিন্তু দুপুরের পর, তাহলে এমন অবস্থায় রোযা হবে না, কাযা ওয়াজিব হবে।

৮. রোযা অবস্থায় কারো মুখে চোখের পানি অথবা ঘাম ঢুকলো এবং লবণাক্ত অনুভব করলো এবং তা গিলে ফেললো, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং কাযা করতে হবে।

৯. মুখে পান রেখে কেউ ঘুমিয়ে পড়লো তারপর সুবেহ সাদেকের পর ঘুম ভাঙল, তাহলে শুধু কাযা করতে হবে, কাফফারা ওয়াজিব হবে না।

১০. রোযার মধ্যে মুখ ভরে বমি করলো, তাহলে রোযা নষ্ট হবে, কাযা করতে হবে।

১১. কেউ রোযা অবস্থায় কোনো পাথর বা লোহার টুকরো এবং এমন কোনো জিনিস খেয়ে ফেললো যা না আহার হিসেবে খায়, না ওষুধ হিসেবে, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং কাযা করতে হবে।

১২. কোনো স্ত্রীলোক রোযার মধ্যে তার গুপ্তাংগে কোনো ওষুধ বা তেল দিল, তাহলে শুধু কাযা করতে হবে।

১৩. কেউ রোযা রেখে ভুলে কিছু খেয়ে ফেললো, তারপর রোযা নষ্ট হয়েছে মনে করে ইচ্ছা করেই খানাপিনা করলো, তাহলে রোযা নষ্ট হবে, কাযা ওয়াজিব হবে, কাফফারা নয়।

১৪. কেউ রোযা রেখে কানে তৈল দিল অথবা জুলাপ নিল, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং শুধু কাযা করতে হবে।

১৫. কোনো মেয়ে মানুষ চিকিৎসা প্রভৃতির জন্যে তার আঙ্গুল লজ্জাস্থানে প্রবেশ করালো অথবা কোনো দাইয়ের দ্বারা প্রবেশ করালো তাপর সমস্ত আঙ্গুল বা তার কিছুটা বের করে পুনরায় ঢুকালো, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং কাযা ওয়াজিব হবে। আর যদি পুনরায় প্রবেশ না করায় কিন্তু আঙ্গুল কোনো কিছুতে ভিজে গেল তাহলে প্রথমবার ঢুকালেই রোযা নষ্ট হবে এবং কাযা ওয়াজিব হবে। এমনিভাবে যদি কোনো মেয়ে মানুষ তার লজ্জাস্থানে তুলা প্রভৃতি রাখে এবং সবটুকু ভেতরে ঢুকে পড়ে, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং কাযা ওয়াজিব হবে।

১৬. সহবাস ব্যতিরেকে যৌন সম্ভোগের এমন কোনো কাজ করলো যাতে সাধারণত বীর্যপাত হয়, যদি বীর্যপাত হয় তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং শুধু কাযা ওয়াজিব হবে। যেমন কেউ হস্তমৈথুন করলো, অথবা কেউ স্ত্রীর নাভিতে, উরুতে অথবা বগলে তার পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করিয়ে বীর্যপাত করলো, অথবা কোনো পশুর সাথে এ কাজ করলো, অথবা কোনো স্ত্রীলোক অন্য কোনো স্ত্রীলোকের সাথে যৌন আনন্দের চেষ্টা করলো এবং বীর্যপাত হলো, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং শুধু কাযা ওয়াজিব হবে।

১৭. মিসওয়াক করার সময় অথবা এমনিতেই দাঁতের রক্ত বেরুলো এবং রোযা থাকা অবস্থায় তা থুথুসহ গিলে ফেললো, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং কাযা ওয়াজিব হবে।কিন্তু রক্ত যদি থুথুর পরিমাণ থেকে কম হয় এবং গলায় তা অনুভব করা গেল না, তাহলে রোযা নষ্ট হবে না।

 

যে যে অবস্থায় কাযা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হয়

১. কেউ রোযার মধ্যে উত্তেজনা বসে যৌন ক্রিয়া করে বসলো, সে নারী হোক বা পুরুষ অথবা কোনো পুরুষ সমমৈথুন করলো, তাহলে কাযা কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে।

২. কোনো নারী পুরুষের শয্যা সঙ্গিনী হলো এবং পুরুষাঙ্গের মাথা তার লজ্জা স্থানে প্রবেশ করলো, এমন অবস্থায় বীর্যপাত হোক বা না হোক কাযাও ওয়াজিব হবে এবং কাফফারাও।

৩. কোনো নির্বোধ তার স্ত্রীর পাশে শয়ন করে তার পশ্চাদ্বারে তার পুরুষাঙ্গ ঢুকালো, তাহলে উভয়ের রোযা নষ্ট হবে এবং কাযা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে।

৪. কেউ রোযা রেখে এমন কিছু খেলো বা পান করলো যা খাওয়া এবং পান করা হয়, অথবা এমন জিনিস খেলো যা আহার হিসেবে ব্যবহার করা হয় না, কিন্তু ওষুধ হিসেবে খেলো, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং কাযা কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে।

৫. স্ত্রী ঘুমিয়ে আছে অথবা বেহুশ হয়ে আছে, স্বামী তার সাথে সহবাস করলো, তাহলে স্বামী বা পুরুষের কাযা ও কাফফারা ওয়াজিব হবে।

৬. কেউ এমন কিছু কাজ করলো যাতে রোযা নষ্ট হয় না। কিন্তু মনে করলো যে রোযা নষ্ট হয়েছে এবং তারপর খানাপিনা করলো, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং কাযাও করতে হবে, কাফফারাও করতে হবে।

যেমন ধরুন, কেউ সুরমা লাগালো, অথবা মাথায় তেল দিল, অথবা মেয়ে মানুষকে বুকে জড়িয়ে ধরলো অথবা চুমো দিল, তারপর মনে করলো যে রোযা নষ্ট হয়েছে এবং সে তারপর ইচ্ছা করেই খানাপিনা করলো, তাহলে এ অবস্থায় কাযা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে।

যেসব জিনিসে রোযা মাকরূহ হয়

অর্থাৎ ঐসব জিনিসের বর্ণনা যার দ্বারা রোযা নষ্ট হয় না বটে কিন্তু মাকরূহ হয়। এসব মাকরূহ তানযিহী, তাহরীমি নয়।

১. কোনো জিনিসের আস্বাদ গ্রহণ করা। তবে যদি কোনো মেয়েলোক বাধ্য হয়ে খাবার জিনিস চেখে দেখে অথবা বাজার থেকে খরিদ করার সময় এ জন্যে চেখে দেখে যে, তার স্বামী বড়ো বদমেজাজি এবং কঠোর অথবা কোনো চাকরানী তার মনিবের ভয়ে চেখে দেখে, তাহলে রোযা মাকরূহ হবে না।

২. মুখে কোনো কিছু চিবানো অথবা এমনি দিয়ে রাখা, যেমন কোনো মেয়ে মানুষ ছোটো বাচ্চাকে খাওয়াবার জন্যে মুখে নিয়ে কোনো কিছু চাবায় অথবা নরম করার জন্যে বা ঠাণ্ডা করার জন্যে মুখে রাখে তাহলে রোযা মাকরূহ হবে না। অবশ্যি বাধ্য হয়ে এসব করা জায়েয। যেমন কারো বাচ্চার খিদে পেয়েছে এবং সে শুধু সে জিনিসই খায় যা মুখে দিয়ে চিবিয়ে দিতে হয় এবং বেরোজাদার লোকও নেই, তাহলে এ অবস্থায় চিবিয়ে দিলে রোযা মাকরূহ হবে না।

৩. কোনো মেয়েলোকের ওষ্ঠ (ঠোট) মুখের মধ্যে নেয়া অথবা উলঙ্গ অবস্থায় জড়িয়ে ধরা মাকরূহ–বীর্যপাত হওয়ার ও সহবাস করার আশংকা থাক বা না থাক।

৪. রোযা রেখে এমন কোনো কাজ করা মাকরূহ যার দ্বারা শরীর এতোটা দুর্বল হয়ে পড়ে যে, রোযা ভেঙ্গে ফেলার আশংকা হয়।

৫. কুল্লি করার সময় বা নাকে পানি দেয়ার সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করা।

৬. বিনা কারণে মুখে থুথু জমা করে গিলে ফেলা।

৭. অস্থিরতা প্রকাশ করা, ঘাবড়িয়ে যাওয়া এবং মানসিক ভারসাম্যহীনতা প্রকাশ করা।

৮. গোসলের প্রয়োজন হলো এবং সুযোগও ছিল কিন্তু বিনা কারণে সুবেহ সাদেকের পর পর্যন্ত গোসল করলো না। তাহলে রোযা মাকরূহ হবে।

৯. মাজন, পেস্ট অথবা কয়লা প্রভৃতি চিবিয়ে দাঁত মাজলে রোযা মাকরূহ হবে।

১০. রোযা রেখে গীবত করলে, মিথ্যা বললে, গালিগালাজ ও মারপিট অথবা কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করলে রোযা মাকরূহ হবে।

১১. ইচ্ছা করে মুখের মধ্যে ধুয়া অথবা ধুলাবালি গ্রহণ করা মাকরূহ। আর যদি লোবান জ্বালিয়ে তার ঘ্রাণ নেয়া হয় অথবা হুক্কা, বিড়ি, সিগারেট খাওয়া হয় তাহলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে।

যেসব জিনিস রোযা মাকরূহ হয় না

১.রোযার খেয়াল নেই এমন অবস্থায় কেউ ভুলে খানাপিনা করলে এমনকি ভুলে স্ত্রীসহবাস করলে-এমনকি ভুলে একাধিকবারও করলে এবং ভুলে পেট ভরে আহার করলে রোযা নষ্ট হবে না এবং মাকরূহ হবে না।

২. রোযা অবস্থায় দিনের বেলায় যদি স্বপ্নদোষ হয় এবং গোসল ফরয হয় তথাপি রোযা মাকরূহ হবে না।

৩. দিনের বেলায় সুরমা লাগানো, তেল মাথায় দেয়া, শরীরে তেল মালিশ করা, খুশবু গ্রহণ করা জায়েয, সুরমা লাগাবার পর কাশির মধ্যে যদি সুরমার চিহ্ন দেখা যায়, তথাপি রোযা নষ্ট হবে না।

৪. স্ত্রীর সাথে শুয়ে থাকা, দেহ জড়িয়ে ধরা, চুমো দেয়া সবই জায়েয। তবে যদি বীর্যপাতের আশংকা হয় অথবা কামোত্তেজনা বশে সহবাসের আশংকা হয় তাহলে এসব মাকরূহ হবে।

৫. থুথু ফেলা ও গিলা মাকরূহ নয়।

৬. গলার মধ্যে মাছি ঢুকে পড়লো অথবা আপনা আপনি ধুলাবালি বা ধূয়া ঢুকলো তাতে রোযা মাকরূহ হবে না। তবে ইচ্ছা করে এসব পেটের মধ্যে গ্রহণ করলে রোযা নষ্ট হবে।

৭. কোনো মেয়েলোকের গুপ্তাংগ দেখার পর অথবা যৌনবাসনা মনে জাগ্রত হওয়ার পর বীর্যপাত হলে রোযা মাকরূহ হবে না।

৮. কোনো পশুর স্ত্রীলিঙ্গ স্পর্শ করার পর যদি বীর্যপাত হয় তবুও রোযা নষ্ট হবে না।

৯. পুরুষের গুপ্তাংগের ছিদ্রে তেল, পানি অথবা ঔষধ দেয়া অথবা পিচকারী দিয়ে এসব পৌঁছানো অথবা দিয়াশলাই যা সুরমাদানির কাঠি প্রবেশ করানো জায়েয এবং এতে রোযা মাকরূহ হবে না।

১০. যদি কেউ তার পশ্চাৎদ্বারে আঙ্গুলি অথবা শুকনো কাঠ ঢুকায় এবং শুকনো কাঠ ভেতরে চরে না যায় তাহলে রোযা নষ্ট হবে না।

১১. কেউ মনে করলো যে এখনো রাত আছে এবং স্ত্রীসহবাসে লিপ্ত হলো, অথবা রোযার খেয়াল নেই সহবাস শুরু করলো, তারপর হঠাৎ মনে হলো যে, সুবহে সাদেক হয়েছে অথবা রোযার কথা মনে হলো এবং সংগে সংগে স্ত্রীসহবাস থেকে বিরত হলো। স্ত্রী থেকে পৃথক হওয়ার পরও যদি বীর্যপাত হয় তবুও রোযা নষ্ট হবে না।এ বীর্যপাত স্বপ্নদোষের বীর্যপাতের মতো মনে করা হবে।

১২. কানের ভেতর পানি চলে গেলে অথবা ইচ্ছা করে দিলে রোযা মাকরূহ হবে না।

১৩. দাঁতের মধ্যে খাদ্য, গোশতের টুকরো কোনো আশ অথবা সুপারির টুকরো রয়ে গেল এবং মুখ থেকে বের করা হলো না বরঞ্চ সেখান থেকে গিলে ফেললো, এখন পরিমাণ যদি ছোলা থেকে কম হয় তাহলে রোযা নষ্ট হবে না।

১৪. অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখভরে বমি হলো- কম হোক বেশী হোক তাতে রোযা মাকরূহ হবে না।। কিছু পেটের মধ্যে আপনা আপনি ঢুকে পড়লেও রোযা মাকরূহ হবে না।

১৫. রোযা রেখে যে কোনো সময়ে মিসওয়াক করলে, তা শুকনো হোক, ভিজা হোক অথবা টাটকা হোক এমনকি নিমের তাজা মিসওয়াকের তিক্ত স্বাদ অনুভব করলেও রোযা মাকরূহ হবে না।

১৬. অধিকমাত্রা গরমে কুল্লি করা, নাকে পানি দেয়া, হাত মুখ ধোয়া, গোসল করা, ভিজে কাপড় গায়ে দেয়া মাকরূহ হবে না।

১৭. পান খাওয়ার পর ভালো করে কুল্লি ও গড়গড়া করা হয়েছে কিন্তু থুথুর মধ্যে লাল আভা দেখা যাচ্ছে তাতে রোযা মাকরূহ হবে না।

১৮. ইচ্ছা করে বমি করলে তা যদি সামান্য হয় এবং মুখ ভরে না হয় তাহলে রোযা নষ্টও হবে না, মাকরূহ হবে না।

১৯. মিসওয়াক করার সময় অথবা আপনা আপনি মুখ দিয়ে রক্ত বের হয় এবং তা যদি গিলে ফেলা হয় এবং রক্তের পরিমাণ থুথু থেকে কম হয় গলায় রক্তের স্বাদ পাওয়া না যায় তাহলে রোযা নষ্ট হবে না

রোযার নিয়তের মাসয়ালা

১. নিয়ত করার অর্থ মনে মনে এরাদা করা, মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত করা জরুরী নয়, শুধু মনের মধ্যে ইচ্ছা করাই যথেষ্ট। বরঞ্চ সেহরি খাওয়াটাই নিয়তের স্থলাভিষিক্ত। এজন্যে যে রোজার জন্যই সেহরি খাওয়া হয়। অবশ্যি যারা ঐ সময় খেতে সাধারণত অভ্যস্ত অথবা যেসব নাদান নিয়মিত সেহরি খায় কিন্তু রোজা রাখে না, তাদের জন্য নিয়ত করা জরুরী।

২. রমজানের প্রত্যেক রোজার জন্য আলাদা নিয়ত করা জরুরী। গোটা রমজানের জন্য একবার নিয়ত করা যথেষ্ট নয়।

৩. রমজানের চলতি রোজার জন্য ফরজ বলে নিয়ত কার জরুরী নয়। শুধু রোজার নিয়ত করাই যথেষ্ট। কিন্তু কোন রোগী রমজানের রোজা রাখলে সে ফজরের নিয়ত করে। কারণ তার উপর রমজানের রোজা ফরজ নয়। যদি শুধু রোজার নিয়ত করে অথবা নফল রোজার নিয়ত করে তাহলে তার রোজা রমজানের রোজা হবে না।

৪. মুসাফিরের জন্য জরুরী যে রমজানে সে যেন অন্য কোন ওয়াজিব রোজার নিয়ত না করে। যেন রমজানের ফরজ রোজার নিয়ত করে অথবা নফল রোজার নিয়ত করে তা দুরস্ত হবে না।

৫. রমজানের কাযা রোজার জন্য নির্দিষ্ট করে ফজরের নিয়ত করা জরুরী।

৬. কেউ রাতে রোজার নিয়ত করতে ভুলে গেল দিনের বেলায় মনে হলো, তাহলে তিন ধরনের রোজায় দুপুরের পূর্বে নিয়ত করলে দুরস্ত হবে।

ক. রমজানের চলন্ত রোজার জন্য।

খ.মানতের ওসব রোজার জন্য যার দিন তারিখ নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

গ. নফল রোজার জন্য।

৭. নিম্নে চার প্রকারের রোজার জন্য সূর্যাস্ত থেকে সুবহে সাদেক পর্যন্ত নিয়ত করা জরুরী। সুবহে সাদেকের পর নিয়ত করা যথেষ্ট নয়।

ক.রমজানের কাযা রোজায়।

খ. মানতের ঐসব রোজায় যার দিন তারিখ নির্দিষ্ট নয়।

গ. কাফফারার রোজায়।

ঘ. ঐসব নফল রোজার কাযায় যা শুরু করার পর কোন কারণে নষ্ট হয়েছে।

৮. রাতে রোজা রাখার নিয়ত ছিল না। সকালেও রোজা রাখার খেয়াল ছিল না, তারপর দুপুরের আগে হঠাৎ মনে পড়লো যে, রমজানের রোজা ছাড়া ঠিক নয় এবং তড়িঘড়ি করে নিয়ত করে ফেলল, তাহলে রোজা দুরস্ত হবে। কিন্তু সকালে যদি কিছু খেয়ে থাকে তাহলে তো নিয়ত করার কোনো অবকাশই রইলো না।

৯. রমযান মাসে কেউ ফরয রোযার পরিবর্তে নফল রোযার নিয়ত করলো এবং মনে করলো যে পরে ফরয রোযার কাযা করে নেবে। তথাপি সে রোযা রমযানের রোযাই হবে। নফল রোযা হবে না। এমনি নফল রোযার পরিবর্তে ওয়াজিব রোযার যদি নিয়ত করে,তথাপি রমযানের রোযা হবে। নীতিগত এক এই যে, রমযানে শুধু রমযানের ফরয রোযাই হবে,অন্য রোযা হবে না।

১০. রোযা সুবেহ সাদেক থেকে শুরু হয়। অতএব সুবেহ সাদেকের পূর্বে এ সকল কাজ জায়েয যার থেকে বিরত থাকা রোযার মধ্যে ফরয। কেউ মনে করে যে, রোযার নিয়ত করার পর কিছু খাওয়া দাওয়া করা জায়েয নয়। একথা ঠিক নয়। সুবেহ সাদেকের পূর্বে খাওয়া দাওয়া প্রভৃতি জায়েয-যদিও সূর্যাস্তের পরই পরের দিনের রোযার নিয়ত করা হয়ে থাকে।

১১. নফল রোযার নিয়ত করলে তা ওয়াজিব হয়ে যায়। সকালে নিয়ত করার পর যদিও তা ভেঙ্গে ফেলা হয় তাহলে সে রোযার কাযা ওয়াজিব হবে।

১২. কেউ রাতে এরাদা করলো যে, পরদিন রোযা রাখবে। কিন্তু সকাল হওয়ার পূর্বেই ইচ্ছা পরিবর্তন করলো এবং রোযা রাখলো না। এ অবস্থায় কাযা ওয়াজিব হবে না।

১৩. রাতে নিয়ত করলে বলবে ….. আরবী …….. আমি আগামীকাল মাহে রমযানের রোযা রাখার নিয়ত করলাম। দিনে নিয়ত করলে বলবে ………. আরবী …….. মাহে রমযানের আজকের দিনের রোযার নিয়ত করছি। কিন্তু আরবীতে নিয়ত করা জরুরী নয়, যে কোনো ভাষায় বলা যায়।


সিহরী ও ইফতার
রোযা রাখার উদ্দেশ্যে সুবেহ সাদেকের পূর্বে যে খাওয়া দাওয়া করা হয় তাকে সিহরী বলে। নবী (স) স্বয়ং সিহরীর ব্যবস্থাপনা করতেন এবং অন্যকেও সিহরী খাওয়ার তাকীদ করতেন। হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) সিহরীর সময় আমাকে বলতেন, আমার রোযা রাখার ইচ্ছা আমাকে কিছু খেতে দাও। তখন আমি তাকে কিছু খেজুর এবং এক বাটি পানি খেতে দিতাম।

নবী (স) সিহরীর তাকীদ করতে গিয়ে বলেন, সিহরী খেয়ো এজন্য যে, এতে বিরাট বরকত রয়েছে।

বরকত বলতে এই যে, দিনের কাজকর্মে এবং ইবাদাত বন্দেগীতে দুর্বলতা মনে হবে না এবং রোযা সহজ হবে।

একবার নবী (সা) বলেনঃ দিনে রোযা রাখার জন্যে সিহরী খাওয়া দ্বারা সাহায্য নাও এবং রাতের ইবাদাতের জন্যে কায়লূলা দ্বারা সাহায্য নিও।

সিহরী খাওয়া সুন্নাত। মুসলমান এবং ইহুদী নাসারাদের রোযার মধ্যে পার্থক্য এই যে, তারা সিহরী খায় না, মুসলমান খায়, ক্ষিধে না হলে কিছু মিষ্টি, অথবা দুধ অথবা পানি খেয়ে নেয়া উচিত এজন্যে সিহরী খাওয়ার মধ্যে বিরাট সাওয়াব আছে।

নবী (স) বলেন, সিহরী খাওয়া প্রত্যক্ষ বরকত। সিহরী খেতে ভুলো না, তা এক চুমুক পানি হোক না কেন। কারণ সিহরী যারা খায় তাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতাগণ তাদের জন্যে এস্তেগফার করেন।

সিহরী বিলম্বে করা

সুবহে সাদেক হতে সামান্য বাকী আছে এতোটা বিলম্ব করে সিহরী খাওয়া মুস্তাহাব।অনেকে সাবধানতার জন্যে অনেক আগে সিহরী খায়। এটা ভালো নয়। বিলম্বে খাওয়াতে সওয়াব আছে।

ইফতার তাড়াতাড়ি করা

ইফতার তাড়াতাড়ি করা মুস্তাহাব। অর্থাৎ সূর্য ডুবে যাওয়ার পর সাবধানতার জন্যে বিলম্ব করা মনাসিব নয়, বরঞ্চ তৎক্ষণাৎ ইফতার করা উচিত। এভাবে অপ্রয়োজনীয় সাবধানতার ফলে দ্বীনি মানসিকতা লোপ পায়। এটা দীনদারি নয় যে, লোক অযথা নিজেদেরকে কষ্টে ফেলবে। বরঞ্চ দীনদারি হচ্ছে এই যে, বিনা বাক্যে ব্যয়ে আল্লাহর হুকুম মেনে চলতে হবে।

নবী (স) বলেন, তিনটি বিষয় পয়গম্বরসুলভ আচরণের শামিলঃ

১. সিহরী বিলম্বে খাওয়া।

২. ইফতার তাড়াতাড়ি করা।

৩. নামাযে ডান হাত বাম হাতের ওপর রাখা।

হযরত ইবনে আবি আওফা(রা) বলেন, আমরা একবার সফরে নবী (স) এর সাথী ছিলাম। তিনি রোযা ছিলেন। যখন সূর্য দৃষ্টির আড়াল হলো তখন তিনি একজনকে বললেন, ওঠ আমার জন্যে ছাতু গুলে দাও। লোকটি বললো, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আর একটু দেরী করুন সন্ধ্যা হয়ে গেলে ভালো হয়। এরশাদ হলো- সওয়ারী থেকে নাম এবং আমাদের জন্যে ছাতু গুলে দাও। সে আবার বললো, ইয়া রাসূলুল্লাহ,এখনো দিন আছে বলে মনে হচ্ছে। আবার এরশাদ হলো- সওয়ারী থেকে নেমে পড় এবং আমাদের জন্যে ছাতু তৈরী করে দাও। তখন সে নামলো এবং সকলের জন্যে ছাতু তৈরী করলো। নবী (সা) ছাতু খেয়ে বললেন, তোমরা যখন দেখবে যে রাতের কালো ছায়া ওদিক থেকে ছেয়ে আসছে তখন রোযাদারের রোযা খোলা উচিত।(বুখারী)

নবী (স) বলেন, আল্লাহর এরশাদ হচ্ছে, আমার বান্দাদের মধ্যে সবচেয়ে ঐ বান্দাহকে আমার পছন্দ হয়, যে ইফতার তাড়াতাড়ি করে। (তিরমিযি) (অর্থাৎ সূর্য ডুবে যাওয়ার পর কিছুতেই বিলম্ব করো না।)

নবী (স) আরো বলেন, লোক ভালো অবস্থায় থাকবে যতক্ষণ তারা ইফতার তাড়াতাড়ি করতে থাকবে। (বুখারী, মুসলিম)

কোন জিনিস দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব

খেজুর এবং খুরমা দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব তা না হলে পানি দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব।নবী (স)স্বয়ং এসব দিয়ে ইফতার করতেন।

হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) মাগরিবের নামাযের পূর্বে কয়েকটি ভিজানো খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তা না হলে খুরমা দিয়ে। তাও না হলে কয়েক চুমুক পানি পান করতেন। (তিরমিযি, আবু দাউদ)

এসব জিনিস দিয়ে ইফতার করার জন্যে নবী (স) সাহাবায়ে কেরামকে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি বলতেন, তোমাদের কেউ রোযা রাখলে খেজুর দিয়ে ইফতার করবে। তা না হলে পানি দিয়ে। আসলে পানি অত্যন্ত পবিত্র। (আহমদ, তিরমিযি, আবু দাউদ)

খেজুর ছিল আরবের উপাদেয় খাদ্য এবং ধনী গরীব সকলেই তা সহজেই লাভ করতো। আর পানি তো সর্বত্র প্রচুর পাওয়া যায়। এসব দিয়ে ইফতার করার জন্যে প্রেরণা দেয়ার তাৎপর্য এই যে, উম্মত যেন কোনো কষ্ট বা অসুবিধার সম্মুখীন না হয়, সময় মতো সহজেই রোযা খুলতে পারে। পানির একটা বৈশিষ্ট্য নবী (স) বলেন যে, তা এতোটা পাক যে তার দ্বারা সবকিছু পাক করা যায়। বাহ্যিক পাক তো অনুভবই করা যায়। তার সাথে রূহানী পবিত্রতাও হয়। রোযাদার যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে সচেতন ঈমানের সাথে সারাদিন তৃষ্ণার্ত থেকে এবং সূর্যাস্তে ঠান্ডা পানি দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করে তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার মধ্যে শোকর গুজারির প্রেরণা সৃষ্টি হয় যার দ্বারা তার বাতেন বা আধ্যাত্মিক দিক আলোকিত করার সৌভাগ্য হয়।

কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে, এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা এবং অন্য কোনো জিনিস দিয়ে ইফতার করা তাকওয়ার খেলাফ মনে করা একেবারে ভুল। এমনি এ ধারণা করাও ভুল যে লবণ দিয়ে ইফতার করা বড়ো সওয়াবের কাজ।

ইফতারের দোয়া

*******আরবী*********

আয় আল্লাহ তোমার জন্য রোযা রেখেছিলাম এবং তোমার দেয়া রিযিক দিয়ে ইফতার করলাম।

ইফতারের পরের দোয়া

*******আরবী*********

পিপাসা চলে গেলে, রগ শো ঠিক হয়ে গেল এবং আল্লাহ চাইলে প্রতিদানও অবশ্যই মিলবে। (আবু দাউদ)

ইফতার করাবার সওয়াব

অন্যকে ইফতার করানোও পছন্দনীয় আমল এবং ইফতার যে করায় তাকেও ততোটা সওয়াব দেয়া হয় যতোটা দেয়া হয় রোযাদারকে। তা রোযাদারকে দু লোকমা খানা খাইয়ে দেয়া হোক অথবা একটা খেজুর দিয়েই ইফতার করানো হোক।

নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে সে রোযাদারের মতোই সওয়াব পাবে। (বায়হাকী)

সিহরী ছাড়া রোযা

রাতে সিহরীর জন্যে যদি ঘুম না ভাঙ্গে, তবুও রোযা রাখা উচিত। সিহরী খাওয়া না হলে রোযা না রাখা কাপুরুষের কাজ। সিহরী না খাওয়ার জন্যে রোযা ছেড়ে দেয়া বড় গোনাহের কাজ।

যদি কখনো দেরীতে ঘুম ভাঙ্গে এবং মনে হয় যে, রাত বাকী আছে এবং কিছু খানাপিনা করা হলো। তারপর দেখা গেল যে, সুবহে সাদেকের পর খানাপিনা করা হয়েছে। তাহলে এ অবস্থায় যদিও রোযা হবে না, তথাপি রোযাদারের মতোই থাকতে হবে কিছু পানাহার করা যাবে না।

এতো বিলম্বে যদি ঘুম ভাঙ্গে যে, সুবহে সাদেক হওয়ার সন্দেহ হয় তাহলে এমন সময় খানাপিনা মাকরূহ এবং সন্দেহ হওয়ার পর খানাপিনা গোনাহর কাজ। পরে সত্যি সত্যিই জানা গেল যে, সুবেহ সাদেক হয়েই গেছে তাহলে কাযা ওয়াজিব হবে। কিন্তু সন্দেহেই যদি থেকে যায় তাহলে কাযা ওয়াজিব হবে না। তবে সতর্কতার জন্যে কাযা করবে।


যেসব ওজরের কারণে রোযা না রাখার অনুমতি আছে
যেসব ওজরের কারণে রোযা না রাখার অনুমতি আছে তা হলো দশটি। তার বিবরণ নিম্নরূপ:

(১) সফর, (২) রোগ (৩) গর্ভধারণ (৪) স্তন্যদান (৫) ক্ষুধা তৃষ্ণার প্রাবল্য (৬) বার্ধক্য ও দুর্বলতা (৭) জীবন নাশের ভয় (৮) জেহাদ (৯) বেহুঁশ হওয়া (১০) মম্তিষ্ক বিকৃতি।

১। সফর

শরীয়াত তার যাবতীয় হুকুমের মধ্যে বান্দাহর সহজসাধ্যতার প্রতি লক্ষ্য রেখেছে। কোনো ব্যাপারেও তাকে অযথা কষ্ট ও সংকীর্ণতার সম্মুখীন করা হয়নি। বস্তুত কুরআন পাকে রোযা ফরয হওয়ার বিষয়টি ঘোষণা করতে গিয়ে মুসাফির ও রোগীর অক্ষমতার প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে এবং রোযা না রাখার অনুমতি দেয়া হয়েছে।

*******আরবী*********

অতএব তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাস পাবে তার জন্যে অপরিহার্য যে, সে যেন রোযা রাখে। আর যে ব্যক্তি রোগী অথবা সফরে আছে, সে অন্যান্য দিনে রোযা রেখে তার হিসেব পুরো করবে। (সূরা আল বাকারাঃ ১৮৫)

১. সফর যে কোনো উদ্দেশ্যেই হোক না কেন, এবং তার মধ্যে সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা থাক অথবা দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হোক, সকল অবস্থায় মুসাফিরের রোযা না রাখার অনুমতি আছে। অবশ্যই যে সফরে কোনো অসুবিধা নেই, তাতে রোযা রাখাই মুস্তাহাব যাতে করে রমযানের ফযিলত ও বরকত লাভ করা যায়। কিন্তু পেরেশানি ও অসুবিধা হলে রোযা না রাখা ভালো।

২. যদি রোযার নিয়ত করার পর অথবা রোযা শুরু হয়ে যাওয়ার পর কেউ সফরে রওয়ানা হয়। তাহলে সেদিনের রোযা কাযা জরুরী। কিন্তু রোযা ভেঙে দিলে কাফফারা দিতে হবে না।

৩. যদি কোনো মুসাফির দুপুরের আগে কোথাও মুকীম হয়ে যায় এবং ঐ সময় পর্যন্ত রোযা নষ্ট হয় এমন কোনো কাজ সে করেনি, তাহলে তার জন্যেও সেদিন রোযা রাখা জরুরী, কিন্তু রোযা নষ্ট করলে কাফফারা দিতে হবে না।

৪. যদি কোনো মুসাফির কোনো স্থানে মুকীম হওয়ার ইরাদা করে, ১৫দিনের কমই ইরাদা করুক না কেন, তথাপি তার উচিত যে, সে রোযা রাখে, এ দিনগুলোতে রোযা না রাখা মাকরূহ। আর যদি ১৫ দিন থাকার ইরাদা করে তাহরে তো রোযা না রাখা জায়েয নয়।

২। রোগ

১.যদি রোযা রাখার কারণে কোনো রোগ সৃষ্টির আশংকা হয় অথবা এ ধারণা হয় যে, ওষুধ না পাওয়ার কারণে অথবা আহার না পাওয়ার কারণে রোগ বেড়ে যাবে, অথবা যদি এ ধারণা হয় যে, স্বাস্থ্য বিলম্বে লাভ হবে তাহলে এসব অবস্থায় রোযা না রাখার অনুমতি আছে। কিন্তু জেনে রাখা দরকার যে, এমন ধারণা করার সংগত কারণ থাকতে হবে। যেমন ধরুন, কোনো নেক ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক পরামর্শ দেয় অথবা নিজের বার বার অভিজ্ঞতা হয়েছে অথবা প্রবল সম্ভাবনা থাকে। নিছক অমূলক ধারণার ভিত্তিতে রোযা না রাখা জায়েয নয়।

২. যদি কারো নিজের নিছক এ ধারণা হয় যে সম্ভবত রোযা রাখলে রোগ সৃষ্টি হবে অথবা বেড়ে যাবে যার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, অথবা কোনো অভিজ্ঞ ডাক্তার বা হেকীমের পরামর্শ নেয়া হয়নি এবং রোযা রাখা হলো না, তাহলে গোনাহগার হবে এবং তার কাফফারাও দিতে হবে।

৩. কোনো বেদীন চিকিৎসক, যে শরীয়াতের মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুভব করে না, তার পরামর্শ অনুযায়ী চলাও ঠিক নয়।

৩। গর্ভ

১. যদি কোনো স্ত্রীলোকের প্রবল ধারণা হয় যে, রোযা রাখলে তার পেটের সন্তানের ক্ষতি হবে অথবা স্বয়ং তার ক্ষতি হবে, তাহলে তার জন্যে রোযা না রাখার অনুমতি আছে।

২. যদি রোযার নিয়ত করার পর কোনো মেয়ে মানুষ জানতে পারে যে, তার গর্ভসঞ্চার হয়েছে এবং তার সুস্পষ্ট ধারণা হয় যে, রোযা রাখলে তার ক্ষতি হবে তাহলে তার জন্যে এ অনুমতি আছে যে, সে রোযা ভেঙে ফেলবে। তারপর কাযা করবে। তার কাফফারা দিতে হবে না।

৪। স্তন্যদান

১. রোযা রেখে স্তন্যদান যদি প্রবল ধারণা হয় যে, প্রসূতির ভয়ানক ক্ষতি হবে, যেমন দুধ শুকিয়ে যাবে এবং বাচ্চা ক্ষুধায় ছটফট করবে অথবা তার জীবনেই আশংকা হয়, তাহলে তার রোযা না রাখার অনুমতি আছে।

২. যদি পারিশ্রমিক দিয়ে দুধ খাওয়ানো যেতে পারে এবং বাচ্চাও যদি অন্য কারো দুধ খায়, তাহলে রোযা না রাখার দুরস্ত নয়, আর যদি বাচ্চা অন্য কারো দুধ খেতেই চায় না, তাহলে রোযা না রাখার জায়েয আছে।

৩. পারিশ্রমিক নিয়ে যে দুধ খাওয়ায়, তারও যদি এ প্রবল ধারণা হয় যে, রোযা রাখার কারণে তার বাচ্চা অথবা স্বয়ং তার ক্ষতি হবে, তাহলে সে রোযা ছেড়ে দিতে পারে।

৪. কোনো মেয়ে মানুষ ঠিক রমযানের দিনেই দুধ খাওয়ানোর কাজ শুরু করলো। ঐ দিন যদি সে রোযার নিয়তও করে থাকে তবুও তার রোযা না রাখা জায়েজ। রোযা ভাঙ্গার জন্য কাযা করতে হবে, কাফফারা ওয়াজিব হবে না।

৫। ক্ষুধা-তৃষ্ণার তীব্রতা

কোনো ব্যক্তি রোগী তো নয়, কিন্তু রোগের কারণে এতোটা দুর্বল হয়েছে যে, রোযা রাখলে পুনরায় অসুস্থ হওয়ার প্রবল আশংকা রয়েছে, তাহলে তার জন্যে রোযা না রাখার অনুমতি আছে।

৬। দুর্বলতা ও বার্ধক্য

কোনো ব্যক্তি বার্ধক্যের কারণে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার জন্যে অনুমতি আছে যে,সে রোযা রাখবে না। আর এমন ব্যক্তির সম্পর্কে এ আশা তো করা যায় না যে, সুস্থ হয়ে কাযা করবে। এজন্যে তার ওয়াজিব যে, সে রোযার ফিদিয়া দেবে তখনই দিক বা পরে। ফিদিয়ার পরিমাণ সাদকায়ে ফিতরের সমান।

৭। জীবনের আশংকা

যদি কঠোর পরিশ্রমের কারণে জীবনের আশংকা হয় অথবা কেউ যদি এ বলে বাধ্য করে যে, রোযা রাখলে তাকে মেরে ফেলবে, অথবা নিষ্ঠুরভাবে মারপিট করবে অথবা কোনো অঙ্গ কেটে দেবে, তাহলে এমন ব্যক্তির জন্যেও রোযা না রাখার অনুমতি আছে।

৮। জিহাদ

দীনের দুশমনের বিরুদ্ধে জিহাদের নিয়ত আছে এবং এ ধারণা হয় যে, রোযা রাখলে দুর্বল হয়ে পড়বে তাহলে রোযা না রাখার অনুমতি আছে।

*কার্যত জেহাদ চলছে তখনও রোযা না রাখার অনুমতি আছে।

*কার্যত জেহাদ চলছে না, কিন্তু শীঘ্রই সংঘর্ষের আশংকা রয়েছে, এমন অবস্থায়ও অনুমতি আছে।

*রোযা রাখার পর যদি এমন অবস্থার সম্মুখীন হয় তাহলেও রোযা ভেঙ্গে ফেলার অনুমতি আছে। তার জন্যে কাফফারা দিতে হবে না।

৯। হুশ না থাকা

কেউ যদি বেহুশ হয়ে যায় এবং কয়েকদিন ধরে বেহুশ থাকে, এ অবস্থায় যেসব রোযা রাখা হবে তার কাযা ওয়াজিব হবে। তবে যে রাতে সে বেহুশ হয়েছে তার পরদিন যদি তার দ্বারা এমন কোনো কাজ না হয় যার দ্বারা রোযা নষ্ট হয় এবং এটাও যদি জানা যায় যে, সে রোযার নিয়ত করেছে বা করেনি, তাহলে সেদিন তার রোযা ধরা হবে এবং তার কাযা করতে হবে না। অবশ্যই পরের দিনগুলোর কাযা করতে হবে।

১০। মস্তিষ্ক বিকৃত হওয়া

যদি কেউ পাগল হয়ে পড়ে এবং রোযা রাখতে না পারে তাহলে তার দুটি উপায় রয়েছেঃ

এক – কোনো সময়েই পাগলামি ভালো হচ্ছে না। এমন অবস্থায় রোযা বিলকুল মাফ-কাযা ফিদিয়া কিছুই দরকার নেই।

দুই – কোনো সময়ে পাগলামি ভালো হয়ে যাচ্ছে তাহলে এ অবস্থায় কাযা করতে হবে।
যেসব অবস্থায় রোযা ভাঙা জায়েয
১. হঠাৎ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছে, এমন কোনো রোগ যার ফলে জীবন বিপদাপন্ন অথবা মোটর দুর্ঘটনায় আহত, উঁচু জায়গা থেকে পড়ে অবস্থা আশংকাজনক এমন অবস্থায় রোযা ভাঙা জায়েয।

২. কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে এবং জীবনের আশংকা নেই কিন্তু আশংকা যে রোযা যদি ভাঙা না হয় তাহলে রোগ খুব বেড়ে যাবে, এমন অবস্থায় রোযা ভাঙার অনুমতি আছে।

৩. কারও এমন প্রচন্ড ক্ষুধা তৃষ্ণা লেগেছে যে, কিছু পানাহার না করলে জীবন যাওয়ার আশংকা রয়েছে, তাহলে এমন অবস্থায় রোযা ভাঙা দুরস্ত আছে।

৪. কোনো গর্ভবতী মেয়েলোকের এমন দুর্ঘটনা হলো যে, তার নিজের অথবা পেটের বাচ্চার জীবনের আশংকা হলো, এমন অবস্থায় রোযা ভাঙার এখতিয়ার আছে।

৫. কাউকে সাপে দংশন করেছে এবং তাৎক্ষনিকভাবে ওষুধ পত্রের প্রয়োজন। এমন অবস্থায় রোযা ভাঙা উচিত।

৬. দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও সাহস করে রোযা রাখা হলো। তারপর মনে হলো যে, যদি রোযা ভাঙা না হয় তাহলে জীবনের আশংকা রয়েছে, অথবা সাংঘাতিকভাবে রোগ বেড়ে যেতে পারে। এমন অবস্থায় রোযা ভাঙার অনুমতি আছে।

কাযা রোযার মাসায়েল

১. রমযানের যেসব রোযা কোনো কারণে করা হয়নি, তার কাযা আদায় করতে অযথা বিলম্ব করা উচিত নয়। যতো শীঘ্র করা যায় ততোই ভালো।

২. রমযানের রোযা হোক বা অন্য কোনো রোযা, তা ক্রমাগত করা জরুরী নয়। এটাও জরুরী নয় যে, ওজর শেষ হওয়ার সাথে সাথেই করতে হবে। সুযোগ মতো কাযা আদায় করলেই চলবে।

৩. রোযার কাযা ক্রমানুসারে করা ফরয নয়। যেমন কাযা রোযা না করেও রমযানের চলতি রোযা করা যায়।

৪. কাযা রোযা রাখার জন্যে দিন তারিখ নির্দিষ্ট করা জরুরী নয়। যতো রোযা কাযা হয়েছে তার বদলার ততোগুলো রোযা রাখতে হবে।

৫. যদি রমযানের দু বছরের রোযা কাযা পড়ে থাকে, তাহলে কোন বছরের কাযা আদায় করা হচ্ছে তা নির্দিষ্ট হওয়া জরুরী। এজন্যে এ নিয়ত করতে হবে যে, অমুক বছরের কাযা রোযা রাখা হচ্ছে।

৬. কাযা রোযা রাখার জন্যে রাতেই নিয়ত করা জরুরী। সুবেহ সাদেকের পর কাযা রোযার নিয়ত করলে তা দুরস্ত হবে না। সে রোযা নফল হয়ে যাবে। কাযা রোযা পুনরায় রাখতে হবে।

৭. রমযানের কিছু রোযা কাযা হয়ে গেল। এ কাযা রোযা রাখার সুযোগ পাওয়া গেল না এবং আর এক রমযান এসে গেল। তাহলে প্রথমে রমযানের রোযা রাখতে হবে, কাযা রোযা পরে রাখবে।

৮. কেউ সন্দেহে দিনে রমযানের রোযা রাখলো। পরে জানা গেল যে, সেদিন শাবানের ৩০ তারিখ। তাহলে এ রোযা নফল হয়ে যাবে যদিও তা মাকরূহ হবে। আর যদি সে রোযা ভেঙে ফেলা হয় তো তার কাযা ওয়াজিব হবে না।
কাফফারার মাসায়েল
রমযানের রোযা নষ্ট হয়ে গেলে তার কাফফারা এই যে, ক্রমাগত ষাট দিন রোযা রাখতে হবে। মাঝে কোনো রোযা ছুটে গেলে আবার নতুন করে ক্রমাগত ষাট রোযা রাখতে হবে। মাঝে যে রোযা ছুটে গেছে তা হিসেবের মধ্যে গণ্য হবে না।

কোনো কারণে কেউ রোযা রাখতে না পারলে ষাটজন অভাবগ্রস্তকে দু বেলা পেট ভরে খাওয়াতে হবে।

১. মেয়েদের জন্যে কাফফারা এ সুবিধা আছে যে, হায়েযের জন্যে মাঝে রোযা বাদ পড়লে ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে না। তবে হায়েয বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে রোযা শুরু করতে হবে।

২. কাফফারা রোযা রাখার সময় যদি নেফাসের অবস্থায় হয় তাহলে ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে। আবার নতুন করে ষাট রোযা রাখতে হবে।

৩. কাফফরা রোযা রাখার সময় যদি রমযান মাস এসে যায় তাহলে রমযানের রোযা রাখতে হবে। তারপর পুনরায় এক সাথে ষাট রাখতে হবে।

৪. যদি একই রমযানে একাধিক রোযা নষ্ট হয় তাহলে সব নষ্ট রোযার জন্যে একই কাফফারা ওয়াজিব হবে।

৫. কারো ওপর একটি কাফফারা ওয়াজিব হয়েছে। এ আদায় করার পূর্বে আর এক কাফফারা ওয়াজিব হলো। তাহলে দুয়ের জন্যে একই কাফফারা ওয়াজিব হবে তা এ দুটি কাফফারা দুটি রমযানের হোক না কেন। শর্ত এই যে, যৌনক্রিয়ার কারণে যদি রোযা নষ্ট না হয়ে থাকে। যৌনক্রিয়ার কারণে যতো রোযা নষ্ট হবে তার প্রত্যেকটির জন্যে আলাদা আলাদা কাফফারা ওয়াজিব হবে।

৬. ষাটজন দুঃস্থ লোকের ব্যাপারে এটা লক্ষ্য রাখতে হবে যে, তারা পূর্ণ বয়স্ক হতে হবে, ছোট বালককে খানা খাওয়ালে তার বদলায় পুনরায় বয়স্ক দুঃস্থকে খাওয়াতে হবে।

৭. খানা খাওয়ানোর পরিবর্তে খাদ্য শস্য দেয়াও জায়েয। অথবা তার মূল্যও দিয়ে দেয়া যায়।

৮. দুঃস্থদের খাওয়ানোর ব্যাপারে সাধারণ মানের খাদ্য হতে হবে- না খুব ভালো, না খারাপ।

৯. দুঃস্থদের খাওয়াবার ব্যাপারে ধারাবাহিকতা রক্ষা না করলে কোনো ক্ষতি নেই কাফফারা হয়ে যাবে।

১০. একই ব্যক্তিকে ষাটদিন খাওয়ালে সহীহ হবে না- খাদ্য শস্য বা তার মূল্য দেয়ার ব্যাপারেও তাই।

ফিদিয়া

কেউ যদি বার্ধক্যের কারণে খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে অথবা এমন কঠিন পীড়ায় ভুগছে যে, বাহ্যত সুস্থ হওয়ার আশা নেই এবং তার রোযা রাখার শক্তি নেই। এমন অবস্থায় শায়িত এ ধরনের লোকের জন্যে রোযা না রাখার অনুমতি দিয়েছে। প্রত্যেক রোযার বদলে এক একজন দুঃস্থকে ফিদিয়া দেবে। ফিদিয়ার মধ্যে খানাও খাওয়ানো যেতে পারে, পরিমাণ মতো খাদ্য শস্যও দেয়া যেতে পারে অথবা তার মূল্যও দেয়া যেতে পারে।

ফিদিয়ার পরিমাণ

একজন ফকীরকে সাদকায়ে ফিতরের পরিমাণ খাদ্য শস্য দেয়া অথবা তার মূল্য দেয়া। প্রত্যেক রোযার বদলায় দু বেলা কোনো অভাবগ্রস্তকে খানা খাওয়ানোও দুরস্ত আছে। মধ্যম ধরনের খানা খাওয়াতে হবে।

ফিদিয়ার মাসায়েল

১. ফিদিয়া আদায় করা সত্ত্বেও যদি রোগী স্বাস্থ্যবান হয়ে যায় তাহলে রোযাগুলোর কাযা ওয়াজিব হবে। যে ফিদিয়া দেয়া হয়েছে তার আলাদা সওয়াব আল্লাহ দেবেন।

২. কারো জিম্মায় কিছু কাযা রোযা আছে। মৃত্যুর সময় সে অসিয়ত করে গেল যে, তার মাল থেকে যেন ফিদিয়া দিয়ে দেয়া হয়। কাযা রোযার মোট ফিদিয়া যদি তার এ পরিত্যক্ত মালের এক তৃতীয়াংশের পরিমাণ হয় (পরিত্যক্ত মাল বলতে বুঝায় যা দাফন কাফনের ব্যয় ভার বহন এবং ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করার পর যা বাচে। তার এক তৃতীয়াংশ।) তাহলে ফিদিয়া ওয়াজিব হবে। ফিদিয়ার মূল্য যদি অধিক হয় আর এক তৃতীয়াংশের মালের পরিমাণ কম হয়, তাহলে এক তৃতীয়াংশ মালের বেশী ফিদিয়া তখন জায়েয হবে যখন ওয়ারিশগণ খুশী হয়ে রাযী হবে। নাবালেগ বাচ্চাদের অনুমতির কোনো প্রয়োজন নেই।

৩. মৃত ব্যক্তি যদি অসিয়ত করে না থাকে এবং ওয়ারিশগণ আপন ইচ্ছায় যদি ফিদিয়া আদায় করে তাহলেও দুরস্ত হবে। আশা করা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা ফিদিয়া কবুল করবেন।

৪. প্রতি ওয়াক্তের নামাযের ফিদিয়াও তাই যা রোযার ফিদিয়া। মনে রাখতে হবে দিনে পাঁচ ওয়াক্তের নামায এবং তার সাথে বেতের নামায অর্থাৎ দৈনিক ছয় নামায।

৫. মৃত্যুর সময় কেউ নামাযের জন্যে ফিদিয়া দেয়ার অসিয়ত করলে তার হুকুম রোযার ফিদিয়ার মতোই হবো।

৬. মৃত ব্যক্তি পক্ষ থেকে তার ওয়ারিশ যদি নামায পড়ে বা রোযা রাখে, তাহলে তা দুরস্ত হবে না।

৭. সামান্য অসুখের জন্যে রমযানের রোযা কাযা করা অথবা এ ধারণা করা যে পরে কাযা আদায় করবে অথবা ফিদিয়া দিয়ে মনে করবে যে, রোযার হক আদায় হয়েছে এমন মনে করা ঠিক নয়।

নবী (স) বলেন, যদি কেউ বিনা ওজরে অথবা রোগের কারণ ছাড়া একটা রোযাও ছেড়ে দেবে- সারা জীবন রোযা রাখলেও তার ক্ষতি পূরণ হবে না। (তিরমিযি, আবু দাউদ)

রোযার বিভিন্ন হুকুম ও নিয়মনীতি

১. যে ব্যক্তি কোনো কারণে রোযা রাখতে পারলো না তার জন্যে এটা জরুরী যে, সে যেন প্রকাশ্যে খানাপিনা না করে এবং বাহ্যত রোযাদারের মতো হয়ে থাকে।

২. যার মধ্যে রোযা ফরয হওয়া ও সহীহ হওয়ার সকল শর্ত পাওয়া যায়, তার রোযা যদি কোনো কারণে নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তার জন্যে ওয়াজিব যে, সে দিনে বাকী অংশ রোযাদারের মতো হয়ে থাকবে এবং খানাপিনা ও যৌনক্রিয়া থেকে বিরত থাকবে।

৩. কোনো মুসাফির যদি দুপুরের পর বাড়ী পৌঁছে অথবা কোথাও মুকীম হওয়ার এরাদা করে তাহলে দিনের বাকী অংশ রোযাদারের মতো হয়ে থাকা এবং খানাপিনা থেকে বিরত থাকা তার জন্যে মুস্তাহাব হবে। এমনিভাবে কোনো স্ত্রীলোক যদি দুপুরের পর হায়েয বা নেফাস থেকে পাক হয় তাহলে তার জন্যেও মুস্তাহাব যে, সে দিনের বাকী অংশ খানাপিনা থেকে বিরত থাকবে।

৪. যদি কেউ ইচ্ছা করে রোযা নষ্ট করে অথবা কেউ রাত আছে মনে করে সুবেহ সাদেকের পর খানা খায়, তাহলে তার জন্যে ওয়াজিব হবে সারাদিন রোযাদারের মতো কাটানো এবং খানাপিনা থেকে বিরত থাকা।

৫. দুপুরের পর যদি কোনো শিশু বালেগ হয় অথবা কেউ যদি মুসলমান হয়, তাহলে তাদের জন্যে মুস্তাহাব এই যে, তারা বাকী দিনটুকু রোযাদারের মতো কাটাবে।

৬. রোযা রাখার পর যদি কোনো মেয়ে মানুষের হায়েয শুরু হয় তাহলে রোযা নষ্ট হবে। কিন্তু তারপর তার উচিত রোযাদারের মতো খানাপিনা থেকে বিরত থাকা।
নফল রোযার ফযিলত ও মাসায়েল
শাওয়ালের ছয় রোযা

এ রোযার অনেক ফযিলত হাদীসে বয়ান করা হয়েছে। নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি রমযানের রোযা রাখলো এবং পরপর শাওয়ালের ছয় রোযা করলো, সে যেন হামেশা রোযা রাখলো। (মুসলিম, আবু দাউদ)

নবী (স) আরও বলেন, যে ব্যক্তি রমযানের রোযা রাখলো এবং তারপর শাওয়ালের ছটি রোযা রাখলো সে গোনাহ তেকে এমন পাক হলো যেন তার মা তাকে আজই প্রসব করলো। (মুসলিম, আবু দাউদ)

এটা জরুরী নয় যে, সে রোযাগুলো ঈদের পর একত্রে করতে হবে। একত্রেও করা যায় এবং মাঝে বাদ দিয়েও করা যায়।

তবে শাওয়ালের ছয় তারিখে এ রোযা শুরু করা ভালো। তবে তা জরুরী নয়। পুরো মাসের মধ্যে যখনই সুবিধা হয় করা যেতে পারে।

আশুরার দিনের রোযা

মহররমের দশ তারিখকে ইয়াওমে আশুরা বা আশুরার দিন বলে। ঐ দিনে মক্কার কুরাইশরাও রোযা রাখতো এবং কাবা ঘরে নতুন গেলাব চড়াতো। এ রোযাকে হযরত ইবরাহীম (আ ) এর প্রতি আরোপ করা হতো। নবী (স) নিজেও এ রোযা রাখতেন। তারপর যখন তিনি হিজরত করে মদীনায় এলেন তখন দেখলেন যে, ইহুদীরাও সে রোযা রাখছে। তখন তিনিও ঐ দিন রোযা রাখলেন এবং সকল সাহাবীকে রোযা রাখার তাকীদ করলেন।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, নবী (স) যখন হিজরত করে মদীনায় এলেন তখন ইহুদীদেরকে আশুরার দিনে রোযা রাখতে দেখলেন। তিনি তখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কাছে এ দিনের কি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, তোমরা এ দিনে রোযা রাখ? তারা বলল, এ বড় মহত্বপূর্ণ দিন। এ দিনে আল্লাহ হযরত মূসা (আ ) কে এবং তার জাতিকে নাজাত দান করেন ও ফেরাউন এবং তার লোক লস্করকে নিমজ্জিত করেন। এজন্যে মূসা (আ ) আল্লাহর অনুগ্রহের শোকারগুজারির জন্য ঐ দিন রোযা রাখেন। আমরাও এ জন্যে এ দিনে রোযা রাখি।

নবী (স) বলেন, মুসা (আ ) এর সাথে আমাদের সম্পর্ক তোমাদের চেয়ে বেশী। আর আমরা এ জিনিসের বেশী হকদার যে এ দিন আমরা রোযা রাখি।

তারপর নবী (স) স্বয়ং সে দিন রোযা রাখলেন এবং উম্মতকেও রোযা রাখার হুকুম দিলেন। (বুখারী, মুসলিম)

দশ তারিখের সাথে নয় তারিখ অথবা এগার তারিখ রোযা রাখা ভালো যাতে করে সেদিনের ফযীলতও লাভ করা যায় এবং ইহুদীদের সাথে সাদৃশ্যও না হয়।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, নবী (স) স্বয়ং এ রোযা রাখা শুরু করেন এবং সাহাবীদেরকেও রোযা রাখার তাকীদ করেন। তখন সাহাবীগণ আরজ করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! ঐ দিনকে তো ইহুদী-নাসারাগণ বড় দিন হিসেবে পালন করে। আমরা ঐদিনে রোযা রাখলে তো তাদের সাথে সাদৃশ্য হয়। তখন তিনি বলেন, সামনে বছর ইনশাআল্লাহ আমরা ৯ তারিখে রোযা রাখবো। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, কিন্তু সামনে বছর আসার পূর্বেই নবী (স) ইন্তেকাল করেন। (মুসলিম)

আরাফাতের দিনের রোযা

হজ্জের মাসের নয় তারিখকে ইয়াওমে আরফা বা আরাফাতের দিন বলা হয়। হাদীসে এ দিনের রোযার অনেক ফযীলতের কথা বলা হয়েছে। নবী (স)বলেন, আমি আল্লাহর সত্তা থেকে এ আশা রাখি যে, আরাফাতের দিনের রোযা আগামী বছর ও গত বছর এ উভয় বছরের কাফফারা বলে গণ্য হবে। (তিরমিযি)

আরাফার দিনের রোযার সওয়াব এক হাজার দিনের রোযার সমান। (তিরমিযি)

নবী (স)এ দিনে রোযার যত্ন নিতেন। আরাফার দিনের আগের আট দিনের রোযারও বড়ো সওয়াব আছে।

নবী (স)বলেন, যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের মত আল্লাহর নিকট কোনো দিনই এত প্রিয় নয়। এ দশ দিনের রোযা সারা বছর রোযা রাখার সমান এবং এসব রাতের নফল নামায শবে দকর এর নফরে সমান।

আইয়ামে বীযের রোযা

প্রত্যেক চাঁদ মাসের ১৩, ১৪ এবং ১৫ তারিখকে আইয়ামে বীয বলে। এ হচ্ছে শুক্লপক্ষের বিশেষ কয়েকটি দিন। এগুলোকে বলা হয় আইয়ামে বীয- (উজ্জ্বল জোস্না প্লাবিত তারিখগুলো)। নবী (স) এ দিনগুলোর রোযার বড়ো তাকীদ করতেন।

হযরত কাতাদাহ বিন মালহান (রা) বলেন, নবী (সা) আমাদেরকে তাকীদ করতেন যে, আমরা যেন চাঁদের তের, চৌদ্দ ও পনেরো তারিখে রোযা রাখি। তিনি বলতেন, এ তিন রোযা সওয়াবের দিক দিয়ে হামেশা রোযা রাখার বরাবর। (আবু দাউদ, নাসায়ী)

সোম ও বৃহস্পতিবারের রোযা

নবী (স) স্বয়ং সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন এবং সাহাবীগণকে রাখার তাকীদ করতেন। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (সা) সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন। (তিরমিযি, নাসায়ী)

উম্মতকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে নবী (সা) বলেন,সোম ও বৃহস্পতিবার আমল (আল্লাহর দরবারে) পেশ করা হয়। আমি চাই যে, যেদিন আমার আমল পেশ করা হয় সেদিন রোযা রাখি। (তিরমিযি)

একবার সাহাবীগণ নবী (স)কে সোমবার রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাবে বললেনঃ ঐদিন আমার জন্ম হয়েছিল এবং ঐদিনই আমার ওপর কুরআন নাযিল হওয়া শুরু হয়। (মুসলিম)

নফল রোযার বিভিন্ন মাসায়েল

১. নফল রোযা রাখার পর ওয়াজিব হয়ে যায়। কোনো কারণে নষ্ট হলে বা নষ্ট করলে কাযা ওয়াজিব হয়ে যায়।

২. বিনা ওজরে নফল রোযাও ভাঙা জায়েয নয়। অবশ্যই নফল রোযা ফরয রোযার তুলনায় সামান্য ওজরে ভাঙা যায়।

৩. কেউ রোযাদারকে খানার দাওয়াত করলো এবং মনে করা হলো যে, মেহমান না খেয়ে মেজবান অসন্তুষ্ট হবে অথবা সে মেহমানকে ছেড়ে খেতে রাজী হবে না অথবা না খেলে মেজবান মনে আঘাত পাবে এমন অবস্থায় রোযা ভাঙা জায়েয। কিন্তু রোযাদারের উচিত তার কাযা আদায় করা।

৪. মেয়েদের জন্যে রমযানের রোযা ছাড়া অন্য যে কোনো রোযা স্বামীর অনুমতি ছাড়া করা মাকরূহ তাহরীমি। যদি কেউ রাখে এবং তার স্বামী রোযা ভাঙতে বলে তাহলে ভেঙে দেয়া জরুরী। তারপর সে রোযার কাযাও স্বামীর অনুমতি নিয়ে করবে।

৫. যদি কেউ ঐসব দিনে রোযা রাখার মানত করে যেসব দিনে রোযা রাখা হারাম। যেমন, দু ঈদের দিন। তাহলে অন্য কোনো দিনে রাখবে।

৬. কেউ নফল রোযা রাখলো এবং তার বাড়ীতে মেহমান এলো। এখন সে যদি মেহমানের সাথে খানা না খায় তাহলে মেহমান অসন্তুষ্ট হবে। এমন অবস্থায় নফল রোযা ভাঙা জায়েয।

৭. কেউ ঈদের দিনে রোযার নিয়ত করলো এবং রোযা রাখলো। তারও উচিত রোযা ভেঙে ফেলা এবং তার কাযা করা।

৮. রমযানের এক দুদিন আগে রোযা রাখা ঠিক নয়। নবী (স)বলেন, কেউ যেন রমযানের এক দুদিন আগে রোযা না রাখে। কিন্তু যদি কেউ ঐ দিন রোযা রাখতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে রাখতে পারে। (বুখারী)
তারাবীর নামাযের বয়ান
তারাবীহ তারাবীহ শব্দের বহুবচন। তার অর্থ বিশ্রামের জন্যে একটুখানি বসা। পরিভাষায় তার অর্থ হলো রমযানুল মুবারকে রাতে যে সুন্নাত নামায পড়া হয় তার চার রাকায়াত পর পর বিশ্রামের জন্য বসা। যেহেতু ঐ বিশ রাকায়াত নামাযে পাঁচটি তারাবীহ করা হয়, সে জন্যে এ সুন্নাত নামাযকে তারাবীহ বলা হয়ে থাকে।

তারাবীর নামাযের হুকুম

তারাবীর নামায সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। নবী (স) তার বিশেষ ব্যবস্থাপনা করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা)ও। যে ব্যক্তি বিনা ওজরে তারাবীহ পরিত্যাগ করবে সে গোনাহগার হবে। এ নারী পুরুষ উভয়ের জন্যে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। তারপর এটাও মনে রাখতে হবে, তারাবীহ নামায রোযার অধীন নয়। অর্থাৎ এরূপ মনে করা ভুল যে, তারাবীহ পড়া জরুরী যদি সেদিন রোযা রাখা হয়। এ দুটি পৃথক পৃথক ইবাদত। যারা কোনো ওজর বা অক্ষমতার কারণে রোযা রাখতে পারে না। যেমন কেউ রোগী অথবা সফরে রয়েছে, অথবা রোযা রাখেনি, অথবা মেয়ে মানুষ হায়েয নেফাসের কারণে রোযা রাখেনি কিন্তু তারাবীর সময় পাক হয়ে গেছে- তাদের তারাবীহ পড়া উচিত। না পড়লে সুন্নাত পরিত্যাগ করার গোনাহ অপরিহার্য হবে।

তারাবীহ নামাযের ফযিলত

নবী (স) শাবান মাসের শেষ দিন রমযান মাসের আগমনীকে খোশ আমদেদ জানিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেনে। তিনি বলেন, এ মাসে একটি রাত এমন আছে যা এক হাজার মাস অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। এ মাসে রাতের বেলায় আল্লাহ তায়ালা তারাবীহ নামায পড়া নফল করে দিয়েছেন। (অর্থাৎ ফরয নয়, সুন্নাত। এজন্যে যে ফরযের মুকাবেলায় সুন্নাত মুস্তাহাব সবকেই নফল বলা হয়।) যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো কাজ স্বেচ্ছায় ও সন্তুষ্টি সহকারে করবে, তার প্রতিদান ও সওয়াব এতো হবে- যতোটা অন্যান্য মাসের ফরয ইবাদাতের হয়। (মিশকাত-বর্ণনাকারী সালমান ফারসী (র)। এ এক দীর্ঘ বর্ণনা। এখানে কিছুটা অংশ নকল করা হয়েছে।)

নবী (স) আর একটি হাদীসে একে মাগফেরাতের উপায় হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ যে ব্যক্তি রমযানের রাতগুলোতে ঈমানী প্রেরণা এবং আখিরাতের প্রতিদানের নিয়তে তারাবীহ নামায পড়লো, তার কৃত সকল গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে। (বুখারী, মুসলিম)

তারাবীহ নামাযের সময়

যে রাতে রমযানের চাঁদ দেখা যাবে সে রাত থেকে তারাবীহ শুরু হয়। ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা গেলে তারাবীহ বন্ধ হয়ে যায়। তারাবীহ নামাযের সময় এশার নামাযের পর থেকে শুরু হয় এবং ফজরের সময় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত থাকে। যদি কেউ এশার নামাযের পূর্বে তারাবীহ পড়ে তাহলে তারাবীহ হবে না। যদি কেউ এশার নামাযের পর তারাবীহ পড়ে এবং কোনো কারণে এশার নামায পুনরায় পড়তে হয়, তাহলে তারাবীহ পুনরায় পড়তে হবে। (দুররে মুখতার)

অবশ্যই এক তৃতীয়াংশ রাতের পর মধ্যে রাতের আগেই তারাবীর নামায পড়া মুস্তাহাব। মধ্য রাতের পর পড়া জায়েয হলেও আগেভাগে পড়ার যে নীতি তার খেলাপ হবে। (তারাবীর উৎকৃষ্ট সময় কোনটি এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আল্লামা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (র) বড়ো গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি পেশ করেন। তিনি বলেনঃ এ ব্যাপারে মতভেদ আছে যে, তারাবীর উৎকৃষ্ট সময় কোনটা। এশার সময়, না তাহাজ্জুদের সময়? উভয়ের সপক্ষে যুক্তি রয়েছে। কিন্তু বেশী আগ্রহ দেখা যায় শেষ সময়ের দিকে। কিন্তু প্রথমে সময়কে প্রাধান্য দেয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি এই যে, মুসলমানগণ সমষ্টিগতভাবে প্রথম সময়েই তারাবীহ পড়তে পারে। শেষ ময় অবলম্বন করা হলে উম্মতের বিরাট সংখ্যা গরিষ্ঠ এ সওয়াব থেকে বঞ্চিত রয়ে যাবে এবং তা বিরাট ক্ষতির বিষয় হবে। যদি কিছু নেক লোক শেষ সময়ের ফযিলত লাভের উদ্দেশ্যে প্রথম ওয়াক্তের জামাতে শরীক না হয়, তাহলে এ আশংকা হতে পারে যে, জনসাধারণ হয়তো এসব নেক লোকের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করবে অথবা তাদের জামায়াতে শরীক না হওয়ার কারণে জনসাধারণ নিজেরাই তারাবীহ পড়া ছেড়ে দেবে। অথবা ঐসব নেক রোকদেরকে তাদের তাহাজ্জুদ পড়ার ঢাক ঢোল পেটাতে হবে। (রাসায়েল ও মাসায়েল, তৃতীয় খন্ড, ২৩১ পৃঃ)

তারাবীহ নামাযের জামায়াত

নবী (স) রমযানে তিন রাত ২৩, ২৫ এবং ২৭শে রাত তারাবীহ নামায জামায়াতে পড়িয়েছেন। তারপর যখন তিনি সাহাবীদের মধ্যে বিরাট উৎসাহ উদ্দীপনা ও অনুরাগ লক্ষ্য করলেন তখন মসজিদে এলেন না। সাহাবায়ে কেরাম (রা) মনে করলেন তিনি বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। তখন তারা তার দরজায় আওয়াজ দিতে লাগলেন। তখন তিনি বলেন, আল্লাহ তোমাদের উৎসাহ উদ্দীপনায় আরও বরকত দিন। আমি এ আশংকায় বাইরে যাইনি যে, কি জানি এ নামায তোমাদের ওপর ফরয হয়ে না যায় এবং হামেশা তোমরা তা পালন করতে না পার। এ জন্যে তোমরা এ নামায ঘরেই পড়তে থাক, কারণ নফল নামায ঘরে পড়াতে বেশী সওয়াব ও বরকতের কারণ হয়। (বুখারী)

এ হাদীস থেকে এতোটুকু প্রমাণিত হয় যে, স্বয়ং নবী পাক (স) তিন রাত জামায়াতে তারাবি পড়িয়েছেন। অবশেষে দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রা) রীতিমতো তার জামায়াত কায়েম করেন এবং সাহাবায়ে কেরাম নতশিরে তা মেনে নেন। পরবর্তীকালে কোনো খলীফাই এ সুন্নাতের বিরোধিতা করেননি। এ জন্যে আলেম সমাজ এ জামায়াতকে সুন্নাতে মুয়াককাদাহ কেফায়া বলেছেন। (তারাবীর নামাযের জামায়াত সম্পর্কে এক ব্যক্তি আল্লামা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (র) কে প্রশ্ন করেন। তিনি বিশদভাবে তার জবাব দেন এবং বিষয়টির ওপর ভালোভাবে আলোচনা করেন। নিম্নে প্রশ্ন ও তার জবাব দেয়া হলোঃ

প্রশ্নঃ ওলামায়ে কেরাম সাধারণত বলে থাকেন যে, তারাবীহ আউয়াল ওয়াক্তে (এশার সাথে) পড়া ভালো এবং তারাবীহ জামায়াত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ কেফায়া। অর্থাৎ যদি কোনো মহল্লায় জামায়াতসহ তারাবীহ পড়া না হয়, তাহলে মহল্লাবাসী গোনাহগার হবে। আর যদি দুজন মিলেও মসজিদে তারাবীহ পড়ে তাহলে সকলের পক্ষ থেকে জামায়াত ত্যাগের গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। একথা কি ঠিক? যদি তাই হয়। তাহলে হযরত আবু বকর (রা) এর যামানায় কেন তা হয়নি? তাহলে সে সময়ের মুসলমানদের ওপর কি হুকুম হবে? জামায়াত সহ তারাবীহ না পড়ার কারণে তারা কি গোনাহগার ছিলেন?

জবাবঃ নবী (স) এর যামানা থেকে শুরু করে হযরত ওমর (রা) এর প্রাথমিক কার পর্যন্ত রীতিমতো এক জামায়াতে সকল লোকের তারাবীহ পড়ার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল না। বরঞ্চ লোক হয়তোবা আপন আপন ঘরে পড়তো কিংবা মসজিদে আলাদা আলাদাভাবে ছোট ছোট জামাত করে পড়তো। হযরত ওমর (রা) যা কিচু করেন তাহলো এই যে, এ বিচ্ছিন্নতা দূর করে সকলকে একটি জামায়াতের আকারে নামায পড়ার হুকুম দেন। তার জন্যে হযরত ওমর (রা) এর নিকটে এ অকাট্য যুক্তি ছিল যে, নবী (স) এর ধারাবাহিকতা একথা বলে বন্ধ করে দেন যে, তা কোনো দিন ফরয না হয়ে যায়। তারপর নবী (সা) এর অতীত হওয়ার পর এ আশংকা আর রইলো না যে, কোনো কাজের দ্বারা এ জিনিস ফরয বলে গণ্য হবে। এ জন্যে হযরত ওমর (রা) সুন্নাত হিসেবে তা জারী করেন। এ ছিল হযরত ওমর (রা) এর দীন সম্পর্কে গভীর প্রজ্ঞার এক অন্যমত উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যে, তিনি শরীয়ত প্রণেতার উদ্দেশ্যে সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যার ফলে তিনি উম্মতের মধ্যে একটা সঠিক তরীকা প্রচলিত করে দেন। সাহাবায়ে কেরাম (রা) এর মধ্যে কারো এ বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন না করা, বরঞ্চ তা নতশিরে মেনে নেয়া একথাই প্রমাণ করে যে, তিনি শরীয়াত প্রণেতার উদ্দেশ্যে সঠিকভাবেই পূরণ করেছেন যে, তাকে যেন ফরযের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া না হয়।

অন্ততপক্ষে একবার তো তার তারাবীতে শরীক না হওয়ার প্রমাণ রয়েছে। একবার তিনি আবদুর রহমান বিন আবদের সাথে বাইরে বের হয়ে মসজিদে লোকদেরকে তারাবীহ পড়তে দেখে তার প্রশংসা করেন। যার ভিত্তিতে আলেম সমাজ একথা বলেন যে, যে বস্তিতে মোটেই তারাবীর নামায জামায়াতসহ পড়া হয় না সে মহল্লায় সকল লোক গুনাহগার হবে, তাহলে এই যে, তারাবীহ ইসলামের এমন একটি সুন্নাত যা খেলাফতে রাশেদার যুগ থেকে গোটা উম্মতের মধ্য প্রচলিত আছে, ইসলামের এমন এক পদ্ধতি পরিত্যাগ করা এবং বস্তির সব লোক মিলে পরিত্যাগ করা দীন থেকে বেপরোয়া হওয়ার আলম। তা যদি মেনে নেয়া যায় তাহলে ক্রমশ তার থেকে ইসলামের সকল রীতি পদ্ধতি মিটে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।)

তারাবীহ নামাযের রাকায়াতসমূহ

সাহাবীগণের ইজমা থেকে প্রমাণিত যে, তারাবীহ নামায বিশ রাকায়াত। বিশ রাকায়াত এভাবে পড়তে হবে যে, দু দু রাকায়াতের পর সালাম ফিরাতে হবে এবং প্রত্যেক চার রাকায়াত পর বিশ্রামের জন্যে এতোটা সময় বসতে হবে যতোটা সময়ে চার রাকায়াত পড়া যায়। বিশ্রামের জন্যে এতোটুকু সময় বসা মুস্তাহাব। তবে যদি অনুভব করা হয় যে, মুক্তাদীগণ এতক্ষণ বসতে পেরেশানি বোধ করেন তাহলে ততোক্ষণ না বসা ভালো। এ ব্যাপারে মুক্তাদীদের ভাবাবেগের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত।

আহলে হাদীসের মতে আট রাকায়াত তারাবীহ পড়া সুন্নাত। তাদের মতে বিশ রাকায়াত পড়া সুন্নাত থেকে প্রমাণিত নয়।তাদের মতে অধিকাংশ রেওয়াতের আট রাকায়াতের এবং হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) এর যে রেওয়ায়েতে বিশ রাকায়াতের কথা বলা হয়েছে তা অন্যান্য হাদিসগুলোর তুলনায় দুর্বল। আল্লামা মওদূদী (র) এ বিষয়ে যে অভিমত প্রকাশ করেনে তা নিম্নে দেয়া হলোঃ

হযরত ওমর (রা) এর জামানায় যখন জামাতের সাথে তারাবী পড়ার সিলসিলা শুরু হল তখন সাহাবীগণের সর্বসম্মতিক্রমেই বিশ রাকায়াত পড়া হত। হযরত ওসমান গনী (রা) হযরত আলী (রা) এর জামানায় এ নিয়ম মেনে চলা হত। তিনজন খলীফা এ বিষয় একমত হওয়া এবং এ ব্যাপারে মতবিরোধ না করা এ কথারই প্রমাণ যে, নবী (স) এর যুগ থেকেই লোক বিশ রাকায়াত পড়তেই অভ্যস্ত। এ কারনেই ইমাম আবু হানীফা (র) এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) বিশ রাকাতের পক্ষেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এর সপক্ষে ইমাম মালেকেরও এর একটি উক্তি পাওয়া যায়। দাইদ যাহেরী (র) একে প্রমাণিত সুন্নাত বলে মেনে নিয়েছে।

হযরত ওমর বিন আবদুল আজীজ (র) এবং আবান ইবনে ওসমান বিশের পরিবর্তে ছত্রিশ রাকায়াত পড়ার নিয়ম শুরু করেন। তার কারণ এ ছিল না যে, তাদের তাহকীক ও তথ্যানুসন্ধান খোলাফায়ে রাশেদীনের তাহকীকের বিপরীত ছিল। বরঞ্চ তাদের লক্ষ ছিলো যাতে করে ছওয়াবের দিক দিয়ে মক্কার বাইরের লোক মক্কাবাসীদের সমান হতে পারে। মক্কাবাসীদের নিয়ম ছিলো এই যে, তারা তারাবীর প্রত্যেক চার রাকাআত পর কাবা ঘরের তাওয়াফ করতেন। এ দুই বুযুর্গ প্রত্যেক তাওয়াফের বদলে চার রাকায়াত পড়া শুরু করেন। এ নিয়ম যেহেতু মদীনাবাসীদের মধ্যে প্রচলিত ছিল এবং যেহেতু ইমাম মালেক মদীনাবাসীদের আমলকে সনদ মনে করতেন। সে জন্য তিনি পরবর্তীকালে বিশ রাকায়াতের স্থলে ছত্রিশ রাকায়াতের ফতোয়া দেন।

চার রাকায়াত পরপর বিশ্রামের সময় কি আমল করা যায়

তারাবীহ বা বিশ্রামের সময় ইচ্ছা করলে কেউ চুপচাপ বসেও থাকতে পারে অথবা মসবীহ পড়তে পারে এবং ইচ্ছা করলে নফল পড়তে পারে। মক্কা মুয়াযযমার লোক বসে থাকার পরিবর্তে তা্ওয়াফ করতেন। মদীনাবাসী চার রাকায়াত নফল পড়ে নিতেন। কতিপয় ফকিহ বলেন যে, তারাবীর সময় নিম্নের দোয়া পড়বেঃ

*******আরবী*********

বাদশাহ শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী আল্লাহ সকল ত্রুটি বিচ্যুতি অক্ষমতা থেকে পাক পবিত্র। পাক ও মহান সত্তা যিনি, সকল সম্মান, শ্রদ্ধা, মহত্ব, ভয়ভীতি, শক্তিমত্তা, বড়ত্ব,পরাক্রমশীলতার অধিকারী। পবিত্র সেই সত্তা, যিনি চির জীবিত, যার নিদ্রা ও মৃত্যু নেই। তিনি পাক পবিত্র ও ত্রুটি বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে । তিনি আমাদের রব এবং ফেরেশতাকুল এবং জিবরাঈলের রব প্রভু পরওয়ারদেগার। হে রব! আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত দাও।

বেতের নামাজের জামাত

শুধু রমজান মাসে বেতের নামাজ জামায়াতে পড়া প্রমাণিত আছে। রমজান ছাড়া অন্য মাসে বেতের জামায়াতে পড়া যায়েজ নেই।

*******আরবী*********

রমজান ছাড়া অন্য মাসে বেতেরের জামায়াত যায়েজ নেই। এতে মুসলিম উম্মতের ইজমা রয়েছে। (হেদায়া)

যারা একাকী নামাজ পড়লো তারাও জামায়াতে বেতেরের নামাজ পড়তে পারে। কিন্তু যারা তারাবীহ জামায়াতে পড়লো তাদের জন্য বেতের জামায়াতে পড় জরুরী। কারণ তারাবীর সুন্নাত নামাজ জামাতে পড়ার পর বেতেরের ওয়াজিব নামাজ একা পড়া দুরস্ত নয়। এটাও ঠিক নয় যে, তারাবীহ জামাতের সাথে পড়ে শুয়ে পড়বে এবং পরে তাহাজ্জুদের সাথে বেতের পড়বে।

তারাবীতে কুরআন খতম

রমজান মুবারকের পুরো মাসে একবার কুরআন পাক ক্রমানুসারে খতম করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। (ইলমুল ফেকাহ)

নবী করীম (স) প্রতি মাসে হযরত জিবরাঈল আমীন (আ ) কে পুরো কুরআন শুনিয়ে দিতেন। যে বছর তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেন, সে বছর জিবরাঈলকে তিনি দুবার কুরআন শুনিয়ে দেন। উম্মতকে তিনি এভাবে উব্ধুদ্ধ করেনঃ

রোজা ও কুরআন মুমিনের জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে হে আমার রব! আমি এ ব্যক্তিকে দিনের বেলায় খানা পিনা ও অন্যান্য সম্ভোগ থেকে বিরত রাখলাম এবং সে বিরত থাকলো। অতএব হে আমার রব! এ লোকের পক্ষে আমার সুপারিশ কবুল করো। কুরআন বলবে আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুম ও বিশ্রাম থেকে বিরত রেখেছি। এবং সে তার মিষ্টি ঘুম ছেড়ে দিয়ে তোমার দরবারে দড়িয়ে দাড়িয়ে কুরআন পড়তে থাকে। অতএব হে আমার রব! এ ব্যক্তির পক্ষে আমার সুপারিশ কবুল কর। আল্লাহ উভয়ের সুপারিশ কবুল করবেন।(মিশকাত)

সাহাবায়ে কেরাম (রা) এ সুন্নাত যত্ন সহকারে পালন করেন। হযরত ওমর (রা) তারাবীহ নামায জামায়াত সহ পড়ার এবং এতে পুরো কুরআন শুনাবার বিশেষ ব্যবস্থা করতেন। দীন থেকে সাধারণ সম্পর্কহীনতা, লোকের অলসতা ও অমনোযোগিতার কারণে এ সুন্নাত ছেড়ে দেয়া কিছুতেই ঠিক নয়। অন্তত একবার তো তারাবীর মধ্যে পুরো কুরআন শুনার এবং শুনাবার ব্যবস্থাপনা অবশ্যই করা উচিত। আর যেখানে মানুষের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা যাবে, ইবাদাত ও কুরআন তেলাওয়াত অনুরাগ দেখা যাবে এবং নিশ্চিত হওয়া যাবে যে, কুরআন পাক পূর্ণ মনোযোগ ও আদবের সাথে থেমে থেমে এমনভাবে পড়া যাবে যে, তেলাওয়াতের হক আদায় হবে, সেখানে একাধিকবার খতম করাও পছন্দনীয় কাজ বলা হয়েছে। অবশ্যই তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করা ঠিক নয়। কারণ এ অবস্থায় কুরআন তেলাওয়াতের হক আদায় করা যাবে না।

নবী (সা) এর তেলাওয়াতের ধরণ হাদীসে এরূপ বর্ণনা করা হয়েছে যে তিনি এক একটি অক্ষর সুস্পষ্ট করে এবং এক একটি আয়াত আলাদা আলাদা করে পড়তেন। তিনি উম্মতকে তারতীলের সাথে এবং থেমে থেমে তেলাওয়াত করার ফযিলত বয়ান করতে গিয়ে বলেন-কুরআন পাঠকারীদের কেয়ামতের দিন বলা হবে- তোমরা দুনিয়ায় যেভাবে থেমে থেমে খোশ এলাহানের সাথে সেজেগুজে কুরআন পড়তে ঠিক তেমনিভাবে পড় এবং প্রত্যেক আয়াতের বিনিময় এক স্তর ওপরে ওঠাতে থাক। তোমরা তেলাওয়াতের সর্বশেষ আয়াতের নিকটেই তোমার বাসস্থান পাবে। (তিরমিযি)

জরুরী হেদায়াত

যদি কোথাও নামায ও কুরআনের প্রতি অনুরাগ অসাধারণ কম হয় এবং মুক্তাদীদের অলসতা ও অবহেলার কারণে এ আশংকা হয় যে, যদি তারাবীতে পুরো কুরআন খতম করার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে তা শুধু লোকের ওপর বোঝাই হবে না, বরঞ্চ মসজিদে আসা এবং জামায়াতে নামায পড়া তারা এড়িয়ে চলতে থাকবে, এমন অবস্থায় খতমে কুরআনের ব্যবস্থা না করাই ভালো। তখন সংক্ষিপ্ত সূরা দিয়ে তারাবীহ পড়তে হবে যাতে করে তারাবীর সুন্নাত থেকে মানুষ বঞ্চিত না হয়। কিছু লোক জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে তারাবীতে কুরআন শুনা এবং শুনানোকে আসল উদ্দেশ্যে মনে করে। তারা তারাবীর নামাযে শান্ত পরিবেশ, ভারসাম্য এবং একাগ্রতার দিকে মোটেই লক্ষ্য রাখে না। এসব লোক যখন তারাবীতে গোটা কুরআন অত্যন্ত দ্রুতবেগে শুনে, তখন তারা পুনরায় না তারাবীহ পড়ার প্রতি যত্ন নেয় আর না জামায়াতে তারাবীহ পড়ার জন্যে মসজিদে আসা প্রয়োজন মনে করে। এ ধরনের চিন্তা অত্যন্ত মারাত্মক। যদি পুরো কুরআন শুনার সুযোগ না হয়, অথবা কুরআন খতম হয়ে যায়, তারপরও তারাবীর নামায এক স্থায়ী সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। এর ব্যবস্থাপনায় কখনো অবহেলা প্রদর্শন করা উচিত নয়।

তারাবীহ নামাযের বিভিন্ন মাসায়েল

১. তারাবীর নিয়ত এভাবে করবে- দু রাকায়াত সুন্নাত তারাবীর নিয়ত করছি। তারপর দু রাকায়াতের নিয়ত। এমনিভাবে দশ সালাম সহ বিশ রাকায়াত পুরো করতে হবে।

২. তারাবীর পর বেতের পড়া উৎকৃষ্ট। কিন্তু কোনো কারণে যদি তারাবীহ পড়ার পূর্বে অথবা সমস্ত তারাবীহ পড়ার পূর্বে বেতের নামায পড়া হয়, তো জায়েয হবে।

৩. যদি কোনো মুক্তাদী বিলম্বে এলো এবং তার কিছু তারাবীহ বাকী থাকতে ইমাম বেতেরের জন্য দাঁড়ালো, তাহলে তার উচিত ইমামের সাথে বেতের পড়া। তারপর বাকী তারাবীহ পরে পুরো করবে।

৪. চার রাকাআত পড়ার পর এতো সময় পর্যন্ত আরাম নেয়া মুস্তাহাব যতো সময়ে চার রাকায়াত পড়া হয়েছে। কিন্তু বেশীক্ষণ বসা যদি মুক্তাদীদের জন্যে কষ্টকর হয় তাহলে অল্প সময় বসা ভালো।

৫. যদি কেউ এশার ফরয না পড়ে তারাবীহ শরীক হয় তাহলে তার তারাবীহ দুরস্ত হবে না।

৬. কেউ যদি এশার ফরয জামায়াতে পড়লো এবং তারাবীহ জামায়াতে পড়লো না, তার জন্যেও বেতের নামায জামায়াতে পড়া দুরস্ত হবে।

৭. যদি কেউ এশার ফরয জামায়াতে পড়লো না, সেও বেতের নামায জামায়াতে পড়তে পারে।

৮. বিনা ওজরে বসে তারাবীহ পড়া মাকরূহ। অবশ্য ওজর থাকলে বসে পড়া দুরস্ত।

৯. কেউ এশার ফরয জামায়াতে পড়তে পারলো না, তার জন্যে তারাবীর নামায জামায়াতে পড়া জায়েয।

১০. ফরয ও বেতের এক ইমাম এবং তারাবীহ দ্বিতীয় কোনো ইমাম পড়াতে পারে। হযরত ওমর (রা) ফরয এবং বেতের স্বয়ং পড়াতেন এবং তারাবীহ পড়াতেন হযরত ওবাই বিন কায়াব (রা)।

১১. যদি তারাবীর কয়েক রাকায়াত কোনো কারণে নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তা পুনরায় পড়া জরুরী। তখন কুরআন পাকের ঐ অংশও পুনরায় পড়া উচিত যা নষ্ট হওয়া রাকায়াতগুলোতে পড়া হয়েছে যাতে কুরআন খতম সহীহ নামাযে হয়।

১২. তারাবীতে দ্বিতীয় রাকায়াতে বসার পরিবর্তে ইমাম দাড়িয়ে গেল, যদি তৃতীয় রাকায়াতের সেজদার পূর্বে তার মনে পড়ে যায় অথবা কোনো মুক্তাদী মনে করিয়ে দেয় তাহলে ইমামের উচিত বসে যাওয়া এবং তাশাহুদ পড়ে এক সালাম ফিরিয়ে সেজদা সাহু দেবে, তারপর নামায পুরো করে সালাম ফিরাবে। তাতে করে এ দুরাকায়াত সহীহ হবে। আর যদি তৃতীয় রাকায়াতে সেজদা করার পর মনে পড়ে তাহলে এক রাকায়াত তার সাথে মিলিয়ে চার রাকায়াত পুরো করবে। এ চার রাকায়াত দু রাকায়াতের স্থলাভিষিক্ত হবে।

১৩. যদি ইমাম দ্বিতীয় রাকায়াতে কাদার জন্যে বসে পড়ে এবং তারপর তৃতীয় রাকায়াতের জন্যে দাঁড়িয়ে যায় এবং এ অবস্থায় চার রাকায়াত পুরো করে তাহলে চার রাকায়াতই সহীহ হবে।

১৪. যারা এশার নামায জামায়াতে পড়েনি তাদের জন্যে তারাবীহ জামায়াতে পড়া দুরস্ত নয়। এজন্যে যে ফরয নামায একা পড়ে নফল নামায জামায়াতে পড়লে নফলকে ফরযের ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়। তার দুরস্ত নয়।

১৫. কেউ যদি মসজিদে এমন সময় পৌঁছে যখন এশার ফরয হয়ে গেছে তাহরে সে প্রথমে ফরয পড়বে তারপর তারাবীতে শরীক হবে। তারাবীর যেসব রাকায়াত বাদ যাবে সেগুলো হয় বিরতির সময় পড়ে নেবে অথবা জামায়াতে বেতের পড়ার পর পড়বে।

১৬. কিছু লোক এশার ফরয নামায জামায়াতে পড়ার পর তারাবীহ জামায়াত করে পড়েছে। তাদের সাথে ঐসব লোকও শরীক হতে পারে যারা ফরয জামায়াতে পড়েনি। এজন্যে যে, এরা ঐসব লোকের অনুসরণ করেছে যারা ফরয নামায জামায়াতে পড়ে তারাবীহ জামায়াতের সাথে পড়ছে।

১৭. যারা এশার নামায জামায়াতে পড়েনি একা পড়েছে তারাও ঐসব লোকের সাথে বেতেরের জামায়াতে শরীক হতে পারে যারা ফরয নামায জামায়াতে পড়ে বেতের জামায়াতে পড়ছে।

১৮. আজকাল শবীনার যেরূপ রেওয়াজ হয়ে পড়েছে তা কিছুতেই জায়েয নয়। শবীনা পাঠকারী একান্ত বেপরোয়া হয়ে দ্রুতবেগে পড়ে যায়। তার না শুদ্ধ অশুদ্ধ পড়ার কোনো চিন্তা থাকে আর না তেলাওয়াতের আদবের দিকে সে খেয়াল করে। এ ধরনের কেরায়াত থেকে প্রভাব ও হেদায়াত গ্রহণ করার কোনো অনুভূতিই হয় না। কোনো প্রকারে খতম করাই হয় পাঠকারীর উদ্দেশ্যে। তারপর মুক্তদীদের অবস্থা এই হয় যে, কয়েকজন ইমামের পেছনে দাড়িয়ে থাকে বটে, কিন্তু অধিকাংশই কয়েক রাকায়াত মাত্র ইমামের সাথে পড়ে। অনেকে পেছনে বসে বসে গল্প করে। ইমামের দ্রুত পড়ার প্রশংসা করে এবং নানান ধরনের গল্প গুজব করে। এটা সে রাতের নামায ও তেলাওয়াত নয় যা নবী (স) শিক্ষা দিয়েছেন এবং যা সুন্নাত মনে করে সাহাবায়ে কেরাম রীতিমতো পালন করতেন। এ প্রকৃতপক্ষে কুরআনের সাথে যুলুম ও বাড়াবাড়ি করা এবং তারাবীর বিদ্রূপ করা।

কুরআন বলেঃ

*******আরবী*********

এ কিতাব কল্যাণ ও বরকতের উৎস যা আমরা তোমার ওপর নাযিল করেছি যাতে লোক তার আয়াতগুলোর ওপর চিন্তা-গবেষণা করতে পারে এবং জ্ঞানীগণ তার থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। (সূরা সাদঃ২৯)

নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করলো। সে কিছুতেই কুরআন বুঝলো না। (তিরমিযি)

কুরআন বলে- যখন কুরআন পড়া হয় তখন পরিপূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তা শুনো।

১৯. তারাবীতে কুরআন পড়ার নিয়ম এই যে, কোনো এক সূরায় বিসমিল্লাহ উচ্চস্বরে পড়তে হবে। কারণ এ কুরআনের একটি আয়াত। পুরে কুরআন পাঠকারীকে বিসমিল্লাহ পড়তে হবে এবং শ্রবণকারীকে শুনতে হবে। এজন্যে হাফেযকে উচ্চস্বরে পড়তে হবে। সাধারণত কুল হু আল্লাহ এর প্রথমে বিসমিল্লাহ পড়া হয়। এটা জরুরী নয়। যে কোনো সুরার শুরুতে পড়া যায়। যে কোনো সুরার সূতে পড়া উচিত যাতে করে লোকের এ ভুল ধারণা দূর হয় যে, কুল হু আল্লাহ এ শুরুতে পড়তে হয়। যাদের মতে এ প্রত্যেক সূরায় একটি আয়াত তাদের উচিত তারাবীর নামাযে প্রত্যেক সুরার শুরুতে তা পড়বে। হানাফী মতে বিসমিল্লাহ কুরআন মজীদের একটি আয়াত। কিন্তু ইমাম শাফেয়ী এবং মক্কা ও কুফার ক্বারীগণের মতে এ প্রত্যেক সূরার একটি আয়াত।

২০. কেউ কেউ তারাবীতে তিনবার কুল হু আল্লাহু পড়ে (কেউ বলেন- কুল হু আল্লাহ তিনবার পড়া মুস্তাহাব। কিন্তু নামাযে নয়, নামাযের বাইরে) তা পড়া মাকরূহ।

২১. কুরআন খতম করার পর সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়বার কুরআন শুরু করা সুন্নাত। নবী (সা) বলেন, আল্লাহ তায়ালা এ কাজ পছন্দ করেন যে, কেউ কুরআন খতম করলে সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়বার শুরু করে ………………… পর্যন্ত পড়বে।

কুরআন তেলাওয়াতের নিয়মনীতি

১। তাহারাত পাক পবিত্রতা

কুরআন পাক আল্লাহ পাকের পবিত্র ও মহান কালাম। তাতে হাত লাগাতে এবং তেলাওয়াত করার জন্যে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা পুরোপুরি ব্যবস্থা দরকার। অযু না থাকলে অযু করা এবং গোসলের প্রয়োজন হলে গোসল করা অপরিহার্য।

*******আরবী*********

তাতে সে ব্যক্তিই হাত লাগাতে পারে যে একান্ত পাক পবিত্র। (সূরা ওয়াকিয়াঃ ৭৯)

হায়েয নেফাস ও জানাবাতের (গোসল ফরয হওয়া) অবস্থায় কুরআন শুনা তো জায়েয, কিন্তু পড়া এবং স্পর্শ করা হারাম। বিনা অযুতে পড়া জায়েয কিন্তু স্পর্শ করা ঠিক নয়। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) সকল অবস্থায় তেলাওয়াত করতেন এবং বিনা অযুতেও। কিন্তু জানাবাতের অবস্থায় কখনো তেলাওয়াত করতেন না। হযরত ওমর (রা) বলেন, হায়েয হয়েছে এমন নারী এবং গোসল ফরয হয়েছে এমন লোক কুরআন থেকে কিছুই পড়বে না। (অর্থাৎ এমন অবস্থায় কুরআন পড়া হারাম) (তিরমিযি)

২। কুরআন তেলাওয়াতের সময় নিয়ত খাটি হওয়া উচিত। তেলাওয়াতের উদ্দেশ্যে হতে হবে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং হেদায়াত চাওয়া। কুরআনের মাধ্যমে মানুষকে আকৃষ্ট করা। নিজের খোশ এলহানের ওপর গর্ব করা, নিজের দীনদারির ঢাকঢোল পেটানো, লোকে প্রশংসা করুক এমন বাসনা পোষণ করা নিকৃষ্ট ধরনের মানসিকতা। এমনিভাবে যারা মানুষ দেখানো কুরআন পড়ে অথবা দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলের জন্যে কুরআন পড়ে তারা কখনো কুরআন থেকে হেদায়াত লাভ করবে না। এস লোক কুরআন পড়া সত্ত্বেও কুরআন থেকে বহু দূরে অবস্থান করে। প্রকৃতপক্ষে যে নিকৃষ্ট ধরনের মানসিকতা, অসৎ প্রবণতা এবং অসাধু উদ্দেশ্যে পোষণ করে,তার মধ্যে কুরআনের মহত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে না কোনো অনুভূতির সঞ্চার হতে পারে, আর না কুরআনের পরিচয় ও নিগূঢ় তত্ত্ব লাভ করতে পারে।

৩। নিয়মিত পাঠ এবং একে অপরিহার্য মনে করা

কুরআন পাঠ দৈনিক নিয়মিতভাবে হওয়া উচিত। কোনো দিন বাদ না দিয়ে দৈনিক পড়া মুস্তাহাব। তেলাওয়াত যে কোনো সময়ে করা যায় কিন্তু উপযুক্ত সময় হচ্ছে সকাল বাদ ফজর। যাদেরকে আল্লাহ কুরআন হিফয করার সৌভাগ্য দিয়েছেন তাদের তো দৈনিক পড়া এজন্যে নেহায়েত জরুরী যে, না পড়লে মনে থাকবে না। আর কুরআন পাক মুখস্থ করার পর ভুলে যাওয়া কঠিন গোনাহের কাজ। নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পাক মুখস্থ করেছে, তারপর ভুলে গিয়েছে সে কেয়ামতের দিন কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্ত হবে। (বুখারী)

নবী (সা) আরও বলেন-

কুরআন সম্পর্কে চিন্তা করো, নতুবা এ তোমাদের বক্ষ থেকে বেরিয়ে যাবে। আল্লাহর কসম, রশি ঢিল করলে যেমন উট পালিয়ে যায়, ঠিক তেমনি সামান্য অবহেলা ও বেপরোয়া মনোভাবের জন্যে কুরআন বক্ষ থেকে বের হয়ে পালিয়ে যায়। (মুসলিম)

নিয়মিত তেলাওয়াতের প্রেরণা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পড়লো এবং দৈনিক নিয়মিত তেলাওয়াত করতে থাকলো, তার দৃষ্টান্ত মিশকে পরিপূর্ণ থলিয়ার মতো যার সুগন্ধি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর যে ব্যক্তি কুরআন পড়া শিখেছে কিন্তু তা তেলাওয়াত করে না তার দৃষ্টান্ত মিশকে পরিপূর্ণ বোতলের মতো যা কর্ক বা ছিপি দিয়ে বন্ধ করা আছে। (তিরমিযি)

খোশ এলহানের সাথে তেলাওয়াত করার বিরাট সওয়াব বর্ণনা করতে গিয়ে নবী (স) বলেন, কেয়ামতের দিনে কুরআন পাঠকারীদের বলা হবে, তোমরা যেমন থেমে ও খোশ এলহানে দুনিয়ায় কুরআন পড়তে তেমনি পড় এবং প্রত্যেক আয়াতের বিনিময়ে এক একটি স্তর ওপরে উঠতে থাক। তোমার ঠিকানা হবে তোমার শেষ আয়াতের নিকটে। (তিরমিযি)

রাগ-রাগিনীসহ কুরআন পাঠ মাকরূহ তাহরীমি। এর থেকে বিরত থাকতে হবে।

৪। কুরআন শুনার ব্যবস্থাপনা

উৎসাহ উদ্দীপনাসহ কুরআন শুনার ব্যবস্থাপনাও হওয়া উচিত। হযরত খালেদ বিন মাদান বলেন, কুরআন শুনার সওয়াব কুরআন পড়ার দ্বিগুণ। (দারেমী)

নবী (সা) অন্যের কুরআন পড়ার শুনতে বড়ো ভালবাসতেন। একবার তিনি হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) কে বললেন, আমাকে কুরআন পড়ে শুনাও। হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) বললেন, হুজুর আপনাকে কুরআন শুনাবো? কুরআন তো আপনার ওপরে নাযিল হয়েছে। নবী (সা)বললেন, হ্যাঁ শুনাও। কেউ পড়লে তা শুনতে আমার বড়ো ভালো লাগে। তখন হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) সূরা নিসা পড়া শুরু করলেন। যখন তিনি পড়লেন-

*******আরবী*********

চিন্তা করে দেখ, তখন কি অবস্থা হবে যখন আমরা প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষ্যদাতা নিয়ে আসব এবং তাদের ওপর তোমাকে সাক্ষ্যদাতা হিসেবে দাঁড় করাব। (সূরা আন নিসাঃ৪১)

তখন নবী (সা) বললেন, থাম, থাম।

হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, আমি দেখলাম নবী (স)এর দু চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। (বুখারী)

হযরত আবু মূসা (রা) খুব সুন্দর কুরআন পড়তেন। যখনই তার সাথে হযরত ওমর (রা) এর দেখা হতো, তিনি বলতেন, আবু মূসা, আমাকে আমার প্রভুর স্মরণ করিয়ে দাও। তখন আবু মূসা কুরআন তেলাওয়াত শুরু করতেন। (সুনানে দারেমী)

৫। চিন্তা গবেষণা

কুরআন বুঝে শুনে পড়া, তার আয়াতগুলোর ওপরে চিন্তা গবেষণা করা এবং তার দাওয়াত ও হেকমত আয়ত্ত করার অভ্যাস করা উচিত। এ সংকল্প নিয়ে তেলাওয়াত করা উচিত যে, তার আদেশগুলো মানতে হবে এবং নিষেধগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। আল্লাহর কেতাব তো এজন্যেই নাযিল হয়েছে যে, তা বুঝে শুনে পড়তে এবং তার হুকুমগুলোর ওপর আমল করতে হবে।

আল্লাহ বলেনঃ

*******আরবী*********

যে কেতাব তোমার ওপরে নাযিল করেছিলাম তা বরকতপূর্ণ যাতে করে তারা এর আয়াতগুলো ওপর চিন্তা গবেষণা করতে পারে এবং জ্ঞানীগণ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। (সূরা সাদঃ ২৯)

ফর ফর করে দ্রুত কয়েক সূরা পড়ার চেয়ে অল্প কিছু চিন্তা ভাবনা করে ও বুঝে পড়া অনেক ভালো। হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) বলেনঃ ক্বাদর এবং আল কারি’আ এর মতো ছোট ছোট সূরা বুঝে পড়া অনেক ভালো ফর ফর করে আল ইমরান এবং বাকারা পড়ার চেয়ে।

নফল নামাযে এটাও জায়েয যে, কেউ একই সূরা অথবা একই আয়াত বার বার পড়বে। তার মর্মকথা অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করবে এবং মহব্বতের সাথে বার বার পড়বে। একবার নবী (সা) একই আয়াত বারবার সারারাত পড়তে থাকনে এবং এভাবে ভোর হয়ে যায়। আয়াতটি হলো-

*******আরবী*********

হে রব! তুমি যদি তাদেরকে আযাব দাও তাহলে এরা তো তোমার বান্দাহ। আর যদি ক্ষমা করে দাও তাহলে তুমি মহাপরাক্রমশালী ও বিজ্ঞ। (সূরা আল মায়েদাঃ ১১৮)

অবশ্য কুরআনের অর্থ ও মর্ম না জেনে তেলাওয়াত করারও বিরাট সওয়াব রয়েছে কিন্তু যে তেলাওয়াতের দ্বারা অন্তরের পরিশুদ্ধি ও তাযকিয়া হয় এবং আমলে প্রেরণা সঞ্চার হয় তাহলো বুঝে শুনে পড়া।

নবী (সা) বলেনঃ লোহা যেমন পানিতে জং ধরে, তেমনি অন্তরে জং ধরে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাহলে এ জং দূর করার উপায় কি? নবী (স) বললেন, বেশী বেশী মৃত্যুতে স্মরণ করা এবং কুরআন তেলাওয়াত করা।

তাওরাতে আছে, আল্লাহ বলেন, বান্দাহ! তোমার লজ্জা করেন যে, যখন সফরে তোমার কাছে তোমার ভাইয়ের চিঠি আসে তখন তুমি থেমে যাও অথবা রাস্তা থেকে সরে গিয়ে বসে পড় এবং তার এক একটি অক্ষর পড়তে থাক ও তার ওপর চিন্তা গবেষণা কর। আর এক কেতাব (তাওরাত) হচ্ছে আমার ফরমান যা তোমার জন্যে পাঠিয়েছি যাতে করে তুমি সবসময় চিন্তা-গবেষণা করতে পার এবং তার হুকুমগুলো মেনে চলতে পার। কিন্তু তুমি এটা মানতে অস্বীকার করছো এবং তার হুকুম মেনে চলতে গড়িমসি করছ আর যদি তা পড় তো তা নিয়ে চিন্তা গবেষণা কর না। (কিমিয়ায়ে সায়াদাত)

হযরত হাসান বসরী (রা) বলেন, ইসলামের প্রথম যুগের লোকেরা পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন যে, কুরআন হচ্ছে আল্লাহর ফরমান এবং তার পক্ষ থেকে এ নাযিল হয়েছে। বস্তুত তারা রাতের বেলায় গভীর মনোনিবেশ সহকারে কুরআন তেলাওয়াত করতেন এবং দিনের বেলায় তার হুকুমগুলো মেনে চলতেন। কিন্তু তোমাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তোমরা শুধুমাত্র তার শব্দগুলো পড় এবং অক্ষরগুলোর যের যবরও দুরস্ত কর। কিন্তু আমলের দিক দিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় যে, তোমরা এ ব্যাপারে একেবারে পেছনে রয়েছ। (কিমিয়ায়ে সায়াদাত)

৬। একনিষ্ঠা ও বিনয়

পূর্ণ একাগ্রতা, আগ্রহ ও বিনয় নিষ্ঠার সাথে কেবলা মুখী হয়ে তেলাওয়াত করা উচিত। তেলাওয়াতের সময় অবহেলা করে ও বেপরোয়া হয়ে, এদিক সেদিক তাকানো, কারো সাথে কথাবার্তা বলা, এমন কোনো কাজ করা যাতে একাগ্রতা নষ্ট হয় এসব কিছুই মাকরূহ বা অবাঞ্ছিত কাজ।

৭। তাউয-তাসমিয়া

তেলাওয়াত শুরু করার সময় *******আরবী****** পড়া উচিত।মাঝে অন্য কোনো কাজের দিক মন দিলে কিংবা কারো সাথে কথাবার্তা বললে পুনরায় *****আরবী********* পড়া উচিত। নামাযের বাইরে প্রত্যেক সূরার শুরুতে পড়া *******আরবী*********মুস্তাহাব। শুধু সূরা তাওবার শুরুতে *******আরবী********* না পড়া উচিত।

৮। তেলাওয়াতের সময় কুরআন পাকের বিষয়বস্তু থেকে প্রভাব গ্রহণ এবং তা প্রকাশ করা মুস্তাহাব। (কিন্তু এ ব্যাপারে অত্যন্ত হুশিয়ার ও সজাগ থাকতে হবে। কারণ রিয়া মানুষের সকল নেক আমল বরবাদ করে দেয়।) যখন পুরস্কার এবং জান্নাতের অফুরন্ত নিয়ামতের উল্লেখ করা হয় এবং মুমিনদেরকে রহমত ও মাগফিরাতের কল্যাণ ও নাজাতের, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও দীদারের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন আনন্দিত হওয়া উচিত। আর যখন আল্লাহর রাগ ও গজব, জাহান্নামের ভয়ানক শাস্তি, জাহান্নামবাসীর আর্তনাদ প্রভৃতির উল্লেখ সম্বলিত আয়াতগুলো পড়া হবে, তখন তার ভয়ে কাদা উচিত। যদি কান্না না আসে তো কান্নার চেষ্টা করতে হবে। নবী (স) তেলাওয়াতের সময় আযাবের আয়াত পড়ে দোয়া করতেন এবং ক্ষমা করে দেয়ার আয়াত পড়লে তাসবিহ পড়তেন।

৯। আওয়াজে ভারসাম্য

তেলাওয়াত অতি উচ্চস্বরে ও অতি নিম্নস্বরে নয় বরঞ্চ উভয়ের মাঝামাঝি স্বরে পড়তে হবে যেন নিজের মনও সেদিকে আকৃষ্ট হয় এবং শ্রোতাদের শোনার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তাহলে চিন্তা-ভাবনার দিকে মন আকৃষ্ট হবে।

কুরআন বলেঃ

*******আরবী*********

এবং নামায বেশী উচ্চস্বরে পড়ো না, আর না একেবারে নিম্নস্বরে। বরঞ্চ উভয়ের মাঝামাঝি স্বর অবলম্বন করবে। (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ১১০)

১০। তাহাজ্জুদে তেলাওয়াতের বিশেষ যত্ন

তেলাওয়াত যখনই করা হোক না কেন তা প্রতিদান ও সওয়াবের বিষয় এবং হেদায়াতের কারণ হয়, কিন্তু বিশেষ করে তাহাজ্জুদ নামাযে কুরআন তেলাওয়াতের ফযিলত সবচেয়ে বেশী। আর একজন মুমিনের এটাই আকাঙ্ক্ষা হওয়া উচিত যে, সে উচ্চ থেকে উচ্চতর মর্যাদা লাভ করে। তাহাজ্জুদের মনোরম সময় রিয়া, প্রদর্শনী ও কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত; লিল্লাহিয়াত ও আল্লাহর দিকে একমুখী হওয়ার উৎকৃষ্টতম এক পরিবেশ, বিশেষ করে মানুষ যখন আল্লাহর সামনে দাড়িয়ে একনিষ্ঠা ও আন্তরিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর কালাম তেলাওয়াত করতে থাকে। নবী (স) তাহাজ্জুদে লম্বা তেলাওয়াত করতেন।

১১। কুরআন শরীফ দেখে তেলাওয়াতের বিশেষ যত্ন

নামায ছাড়া অন্য সময় কুরআন শরীফ দেখে তেলাওয়াত করলে অধিক সওয়াব ও উত্তম প্রতিদান পাওয়া যায়। একেতো তেলাওয়াত করার সওয়াব দ্বিতীয়তঃ কালামুল্লাহকে হাতে স্পর্শ করার এবং স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার সওয়াব ও বদলা। (এতকাল)

১২। ক্রমিক পদ্ধতির লক্ষ্য

কুরআনে যে ক্রমিক পদ্ধতি রয়েছে সূরাগুলো সে ক্রমানুসারে পড়া উচিত। অবশ্যই শিশুদের পাট সহজ করার জন্যে এ ক্রমিক ধারা অবলম্বন না করা পড়া জায়েয। যেমন আমপারা সূরা নাস থেকে উল্টো দিকে সূরা নাবা পর্যন্ত পড়ানো হয়। তবে কুরআন পাকের ক্রমিক পদ্ধতির খেলাপ তেলাওয়াত করা সর্বসম্মতিক্রমে নিষিদ্ধ।

১৩। মনের গভীর একাগ্রতা

অনেকে অযীফা ও যিকির আযকার গভীর একাগ্রতার সাথে করে থাকেন এবং ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেন। কিন্তু কুরআন তেলাওয়াত ততোটা একাগ্রতার সাথে করেন না। অথচ কুরআন তেলাওয়াতের চেয়ে উৎকৃষ্ট আর কোনো যিকির অযীফা হতে পারে না। এর চেয়ে ভালো তাযকিয়ার নফসের (আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির) উপায় আর কিছু হতে পারে না, কুরআনের ওপরে অন্য কোনো অযীফাকে প্রাধান্য দেয়া দীনকে ভালোভাবে উপলব্ধি না করারই ফল এবং তা গোনাহও বটে। নবী (স) বলেন, বান্দাহ তেলাওয়াতে কুরআনের মাধ্যমেই আল্লাহর বেশী নিকটবর্তী হতে পারে। (কিমিয়ায়ে সায়াদাত)

নবী (সা) বলেন, আমার উম্মতের জন্যে সবচেয়ে ভালো ইবাদাত হচ্ছে তেলাওয়াতে কুরআন।

১৪। তেলাওয়াতের পর দোয়া

তেলাওয়াতের পর নিম্নের দোয়া পড়া সুন্নাতঃ

*******আরবী*********

হে আল্লাহ!তুমি কুরআনের অসিলায় আমার ওপর রহম কর, তাকে আমার পথপ্রদর্শক, নূর, হেদায়াত ও রহমত বানিয়ে দাও। হে আল্লাহ! তার মধ্যে যা কিছু ভুলে যাই তা স্মরণ করিয়ে দাও, আর যা জানি না তা শিখিয়ে দাও এবং আমাকে তাওফিক দাও যেন রাতের কিছু অংশে এবং সকাল সন্ধ্যায় তা তেলাওয়াত করতে পারি। আর হে রাব্বুল আলামীন তুমি তাকে আমার সপক্ষে দলীল প্রমাণ বানিয়ে দাও।
সিজদায়ে তেলাওয়াতের বয়ান
সিজদায়ে তেলাওয়াতের হুকুম

কুরআন চৌদ্দটি (আহলে হাদীসের নিকটে পনেরো আয়াত। তারা সূরা হজ্জের ৭৭ আয়াতেও সিজদা করেন। শাফেয়ীদের মতেও তাই)আয়াত এমন আছে যা পড়লে বা শুনলে সিজদা করা ওয়াজিব হয়। (ইমাম আবু হানীফা ছাড়া অন্যান্যদের মতে সিজদায়ে তেলাওয়াত সুন্নাত।)তা পুরো আয়াত পড়া হোক অথবা পূর্বাপর সহ সিজদার শব্দ (ঐসব আয়াতের উপর রেখা টানা থাকে)পড়া হোক সিজদা ওয়াজিব হয়ে যাবে। একে সিজদায়ে তেলাওয়াত বলে।

নবী (স) যখন কেউ সিজদার আয়াত পড়ে সিজদা করে তখন শয়তান এক ধারে বসে বিলাপ করতে থাকে এবং বলে হয় আফসোস, আদম সন্তানদের সিজদার হুকুম দেয়া হলে তারা সিজদা করলো এবং জান্নাতের হকদার হলো। আমাকে সিজদা করার হুকুম দেয়া হলে আমি অস্বীকার করে জাহান্নামের হকদার হলাম। (মুসলিম, ইবনে মাজা)

সিজদায়ে তেলাওয়াতের স্থানগুলো

সূরা আরাফের ২০৬ আয়াত, সুরা রাদের ১৫ আয়াত, সূরা নহলের ৪৯, ৫০আয়াত, সুরা বনী ইসরাঈলের ১০৯আয়াত, সুরা মরিয়মের ৫৮ আয়াত, সূরা হজ্জের ১৮ আয়াত, সূরা ফুরকানের ৬০ আয়াত,সূরা আন নামলের ২৫-২৫ আয়াত, সূরা হা-মীম সাজদার ৩৮ আয়াত, সূরা আন নাজমের ৬২ আয়াত, সূরা ইনশিকাকের ২০-২১ আয়াত এবং সূরায়ে আলাকের ১৯ আয়াত।

সিজদায়ে তেলাওয়াতের শর্ত

সিজদায়ে তেলাওয়াতের শর্তঃ

(অর্থাৎ নামাযের যেসব শর্ত,সিজদায়ে তেলাওয়াতেরও তাই। যেসব কারণে নামায নষ্ট হয়, সেসব কারণে সিজদায়ে তেলাওয়াত নষ্ট হয়।)

১. তাহারাত

শরীক পাক হওয়া। অর্থাৎ নাজাসাতে গালীযা থেকে পাক হতে হবে। নাজাসাতে হুকমী থেকে পাক হতে হবে। অযু না থাকলে অযু করতে হবে এবং গোসলের দরকার হল গোসল করতে হবে।

পোশাক পাক হওয়া।
নামাযের স্থান পাক হওয়া।
সতর ঢাকা।
কেবলার দিকে মুখ করা।
সিজদায়ে তেলাওয়াতের নিয়ত করা।
অধিকাংশ আলেমের এ মত। কিন্তু কোনো কোনো আলেমের মতে সিজদায়ে তেলাওয়াতের জন্যে অযু থাকা জরুরী নয়। আহলে হাদীসের মতে অযুসহ সিজদায়ে তেলাওয়াত তো উত্তম কিন্তু বিনা অযুতেও জায়েয।

আল্লামা মওদূদী (র) এ সম্পর্কে নিম্নরূপ অভিমত ব্যক্ত করেনঃ

এ সিজদার জন্যে অধিকাংশ আলেম ঐসব শর্তের পক্ষে যা নামাযের শর্ত। কিন্তু যতো হাদীস সিজদায়ে তেলাওয়াত সম্পর্কে পাওয়া যায় তার মধ্যে এসব শর্তের জন্যে কোনো দলিল নেই। তার থেকে এটাই মনে হয় যে, সিজদার আয়াত শুনার পর যে যেখানে যে অবস্থায় আছে সিজদাহ করবে তা অযু থাক বা না থাক, কেবলামুখী হওয়া সম্ভব হোক বা না হোক। প্রথম যুগের মুসলমানদের মধ্যে এমন লোক পাওয়া যায় যারা এ পদ্ধতিতে আমল করেছেন। ইমাম বুখারী আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) সম্পর্কে বলেন যে, তিনি পথ চলতে চলতে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। কোথাও সিজদার আয়াত এলে ব্যাস মাথা নত করতেন। অযু থাক বা না থাক, কেবলামুখী থাকুন বা না থাকুন। এসব কারণে আমরা মনে করি যে, যদি কেউ অধিকাংশ আলেমগণের খেলাফ আমল করে তাহলে তাকে মন্দ বলা যাবে না। কারণ আলেম সাধারণের মতের সমর্থনে কোনো প্রমাণিত সুন্নাত নেই এবং প্রথম যুগে মুসলমানদের মধ্যে এমন লোকও পাওয়া যায় যাদের আমল আলেম সাধারণের মতের খেলাপ ছিল। (তাফহীমুল কুরআন, দ্বিতীয় খন্ড, সূরা আল আরাফ, টীকা ১৫৭)

সিজদার জন্যে এ নিয়ত করা শর্ত নয় যে, এ সিজদা অমুক আয়াতের। আর যদি নামাযে সিজদার আয়াত পড়ে সিজদা করা হয় তো নিয়ত শর্ত নয়।

সিজদায়ে তেলাওয়াতের নিয়ম

কেবলামুখী দাড়িয়ে সিজদায়ে তেলাওয়াতের নিয়ত করতে হবে এবং আল্লাহু আকবার বলে সিজদায় যেতে হবে। সিজদা করার পর আল্লাহু আকবার বলে উঠে দাড়াতে হবে। তাশাহুদ পড়ার ও সালাম ফেরানোর দরকার নেই।

হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) বলেন, যখন তোমরা সিজদার আয়াতে পৌছবে তখন আল্লাহ আকবার বলে সিজদায় যাবে এবং মাথা উঠাবার সময় আল্লাহু আকবার বলবে। (আবু দাউদ)

বসে বসেও সিজদায়ে তেলাওয়াত করা যায় তবে দাড়িয়ে সিজদায় যাওয়া মুস্তাহাব।

সিজদায়ে তেলাওয়াতে সুবহানা রাব্বিয়াল আলা ছাড়াও অন্য মাসনুন তসবিহ পড়া যায়। কিন্তু ফরয নামাযে সিজদায়ে তেলাওয়াত করতে হলে সুবহানা রাব্বিয়াল আলা পড়া ভালো। অবশ্যই নফল নামায অথবা নামাযের বাইরে সিজদায়ে তেলাওয়াতে যে কোনো তসবিহ পড়া যায়। যেমন নিম্নের তসবিহ পড়া যেতে পারেঃ

*******আরবী*********

আমার চেহারা সেই সত্তাকে সিজদা করছে যিনি তাকে পয়দা করেছেন এবং তার মধ্যে কান ও চোখ দিয়েছেন। এসব তারই শক্তির দ্বারা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মহত্ব ও বরকতের উৎস, যিনি সর্বোৎকৃষ্ট স্রষ্টা।

সিজদায়ে তেলাওয়াতের মাসায়েল

১. সিজদায়ে তেলাওয়াত তাদের ওপর ওয়াজিব যাদের ওপর নামায ওয়াজিব। হায়েয নেফাস হয়েছে এমন নারী এবং নাবালেগদের ওপর সিজদায়ে তেলাওয়াত ওয়াজিব নয়। এমন বেহুশ লেকের ওপরও ওয়াজিব নয় যে একদিন এক রাতের বেশী বেহুশ রয়েছে।

২. সিজদার আয়াত নামাযে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সিজদাহ ওয়াজিব হবে বিলম্বের অনুমতি নেই। নামাযের বাইরে সিজদার আয়াত পড়লে তৎক্ষণাৎ সিজদা করা ভালো। বিলম্বেও কোনো দোষ নেই। অবশ্যই বিনা কারণে বেশী বিলম্ব করা মাকরূহ।

৩.যদি নামাযে সিজদার আয়াত পড়া হয়। তাহলে এ সিজদা ঐ নামাযেই আদায় করা ওয়াজিব হবে। যদি সিজদার আয়াত পড়ে কেউ অন্য কোনো নামাযে সিজদা আদায় করে তাহলে জায়েয হবে না। যদি কেউ সিজদার আয়াত পড়ে নামাযের মধ্যে সিজদাহ করতে ভুলে যায় তাহলে তওবা এস্তেগফার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। হ্যাঁ যদি এ নামায নষ্ট হয় তাহলে নামাযের বাইরে সিজদাহ করা যাবে।

৪. কেউ নামায পড়ছে বা পড়াচ্ছে। সে যদি অন্য কারো কাছে সিজদার আয়াত শুনে, তা সে অন্য লোক নামাযেই পড়ুক অথবা নামাযের বাইরে পড়ুক, তাহলে শ্রবণকারী নামাযী বা ইমামের ওপর সিজদায়ে তেলাওয়াত ওয়াজিব হবে না।

৫. কোনো মুক্তাদী সিজদার আয়াত পড়লে, না ইমামের ওপর না মুক্তাদীর ওপর সিজদাহ ওয়াজিব হবে।

৬. কেউ ইমামের নিকটে সিজদার আয়াত শুনলো কিন্তু সে এমন সময় জামায়াতে শামিল হলো যখন সিজদাহ করে ফেলেছে। তাহলে যদি সে ঐ রাকায়াত পেয়ে যায় যে রাকায়াতে ইমাম সিজদাহ করেছে তাহলে তারও সিজদাহ হয়ে যাবে। কিন্তু পরের রাকায়াতে শামিল হলে তাকে নামাযের পর সিজদাহ করতে হবে।

৭. কেউ যদি মনে মনে সিজদার আয়াত পড়ে, মুখে না পড়ে। অথবা শুধু লেখে অথবা এক এক অক্ষর পড়ে, তাহলে সিজদা ওয়াজিব হবে না।

৮. যদি একই স্থানে সিজদার আয়াত বার বার পড়ে তাহলে একই সিজদাহ দিতে হবে। আর যদি কয়েক সিজদার আয়াত পড়ে তাহলে যতো আয়াত পড়বে ততো সিজদাহ করতে হবে। আবার এক আয়াত কয়েক স্থানে পড়লে যতো স্থানে পড়বে ততবার সিজদাহ করতে হবে।

৯। তেলাওয়াতের সময় সকল শ্রোতার যদি অযু থাক, তাহলে সিজদার আয়াত উচ্চস্বরে পড়া ভালো। কিন্তু বিনা অযুতে থাকলে অথবা সিজদাহ করার অবকাশ না থাকে, তাহলে আস্তে আস্তে পড়া ভালো এজন্যে যে, তারা অন্য সময়ে সিজদাহ করতে ভুলে যেতে পারে এবং গুনাহগার হবে।

১০. সিজদার আয়াতের আগে এবং পরের আয়াত পড়া এবং সিজদার আয়াত বাদ দেয়া অথবা পুরো সূরা পড়া এবং সিজদার শেষ আয়াত বাদ দেয়া মাকরূহ।

১১. কিছু নাদান লোক কুরআন পড়তে পড়তে সিজদার আয়াতে পৌছলে কুরআনের ওপরেই সিজদাহ করে। এভাবে সিজদা আদায় হবে না। সিজদায়ে তেলাওয়াত ঐভাবে আদায় করা উচিত যা ওপরে বলা হয়েছে।

১২. সিররী (যা আস্ত পড়া হয়) নামাযগুলোতে এমন সূরা পড়া উচিত নয় যাতে সিজদাহ আছে। এমনি জুমা ও দু ঈদের নামাযে পড়া উচিত নয় যেখানে বিরাট জামায়াত হয়। তাহলে মুক্তাদীদের সন্দেহের সৃষ্টি এবং নামায নষ্ট হবে।

শুকরানা সিজদাহ

শুনে অথবা আল্লাহর রহমতে কোনো বিরাট নিয়ামত লাভ করে অথবা কোনো ব্যাপারে সাফল্য অর্জন করে অথবা কোনো আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় অথবা কোনো বিপদ মুসিবত দূর হয়ে যায় তখন আল্লাহর ফজল ও করমের জন্যে শুকরানা সিজদাহ আদায় করা মুস্তাহাব। কিন্তু এ সিজদাহ নামাযের সাথে সাথেই না করা উচিত। নতুবা অজ্ঞ লোক একে নামাযের অংশ মনে করতে থাকবে অথবা এটা সুন্নাত মনে করে পালন করতে থাকবে। এ নামায থেকে পৃথক সিজদাহ। এজন্যে তা এমনভাবেই করা উচিত যাতে কারো কোনো সন্দেহ না থাকে। হযরত আবু বকর (রা) বলেন, নবী (স) যখন কোনো ব্যাপারে খুশী হতেন অথবা কোনো সুসংবাদ শুনতেন তখন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার জন্য সিজদাহ করতেন। (তিরমিযি)

কোনো কোনো লোক বেতরের পর দু সিজদাহ করে এবং তা সুন্নাত মনে করে এটা ভুল। সুন্নাত মনে করে তা করা ভুল এবং ত্যাগ করা উচিত।
এতেকাফের অর্থ
অভিধানে কোনো স্থানে আটকে পড়া অথবা কোনো স্থানে থেমে যাওয়াকে এতেকাফ বলে। শরীয়াতের পরিভাষায় এতেকাফের অর্থ কোনো লোকের দুনিয়ার সংস্রব, সম্বন্ধ ও বিবি বাচ্চা থেকে আলাদা হয়ে মসজিদে অবস্থান করা।

এতেকাফের মর্মকথা

এতেকাফ হচ্ছে এই যে, মানুষ দুনিয়াবি কারবার ও সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং সাংসারিক কর্ম ব্যস্ততা ও প্রবৃত্তির কামনা বাসনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চিন্তা ও কাজের শক্তি এবং যোগ্যতাকে আল্লাহর স্মরণ এবং ইবাদাতে লাগিয়ে দেবে। তারপর সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর প্রতিবেশী হয়ে পড়বে। এ কাজের দ্বারা একদিকে সে ব্যক্তি সকল প্রকার বেহুদা কথাবার্তা ও মন্দ কাজ থেকে বেচে থাকতে পারবে এবং অন্যদিকে আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক মজবুত হবে। তার নৈকট্য লাভ করবে এবং তার ইয়াদ ও ইবাদাতে মনে শান্তি লাভ করবে। কয়েকদিনের তারবিয়াতের এ আমল তার মনের ওপর এমন গভীর ছাপ ফেলবে যে, চারিদিকে দুনিয়ার রং তামাশা ও মন ভুলানো বস্তুসমূহ দেখার পরও আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত রাখতে পারবে। আল্লাহর নাফরমানি থেকে বাচতে পারবে এবং তার হুকুম পালন করে আনন্দ অনুভব করবে। এমনিভাবে সমগ্র জীবন আল্লাহর বন্দেগীতে কাটিয়ে দেবে।

এতেকাফের প্রকারভেদ

এতেকাফ তিন প্রকার ওয়াজিব, মুস্তাহাব, সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।

ওয়াজেব এতেকাফ

মানতের এতেকাফ ওয়াজিব। কেউ এমনি এতেকাফের মানত করলো অথবা কোনো শর্তসহ মানত করলো যেমন কেউ বললো, যদি আমি পরীক্ষায় পাশ করি, অথবা যদি আমার অমুক কাজ হয়ে যায় তাহলে এতেকাফ করবো। তাহলে এ এতেকাফ ওয়াজিব হবে এবং তা পূরণ করতে হবে।

মুস্তাহাব এতেকাফ

রমযানে শেষ দশদিন ব্যতিরেকে যতো এতেকাফ করা হবে তা মুস্তাহাব হবে তা রমযানের প্রথম অথবা দ্বিতীয় দশদিনে অথবা যে কোনো মাসে করা হোক।

সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ এতেকাফ

রমযানের শেষ দশ দিনে এতেকাফ করা সুন্নাত মুয়াক্কাদাহ কেফায়া। অর্থাৎ মুসলমানদের সামষ্টিকভাবে এ সুন্নাতের ব্যবস্থাপনা করা উচিত কারণ হাদীসগুলোতে এ বিষয়ে তাকীদ করা হয়েছে।

কুরআন পাকে আছেঃ

*******আরবী*********

আপন স্ত্রীদের সাথে মিলিত হইও না যখন তোমরা মসজিদে এতেকাফ থাকবে। (সূরা আল বাকারাঃ ১৮৭)

নবী (স) নিয়মিতভাবে প্রতি বছর এতেকাফ করতেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তা পালন করেন। একবার কোনো কারণে এতেকাফ করতে পারেননি বলে পরের বছর বিশদিন পর্যন্ত এতেকাফ করেন। এজন্যে মুসলমানগণ যদি সামষ্টিকভাবে এ সুন্নাত পরিত্যাগ করে তাহরে গোনাহগার হবে। যদি বস্তির কিছু লোকও এ সুন্নাত পালনের ব্যবস্থাপনা করে তাহলে, যেহেতু তা সুন্নাতে কেফায়া, এ অল্প লোকের এতেকাফ সকলের জন্যে যথেষ্ট হবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হবে যদি গোটা মুসলিম সমাজ এর থেকে বেপরোয়া হয়ে পড়ে এবং নবীর এ প্রিয় সুন্নাতটি একেবারে টিমে যাবে।

হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) প্রতি রমযানের শেষ দশদিন এতেকাফ করতেন। এ আমল তার মৃত্যু পর্যন্ত কায়েম থাকে। তার এন্তেকালের পর তার বিবিগণ এতেকাফের নিয়ম পালন করেন। (বুখারী, মুসলিম)

হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) প্রতি রমযানের শেষ দশদিন এতেকাফ করতেন। এক বছর তিনি এতেকাফ করতে পারেন নি। সে জন্যে পরের বছর বিশদিন এতেকাফ করেন। (তিরমিযি)

সবচেয়ে উৎকৃষ্ট এতেকাফ

মসজিদুল হারামে এতেকাফ করলে তা সবচেয়ে উৎকৃষ্ট এতেকাফ। তারপর মসজিদে নববীতে এবং তারপর বায়তুল মাকদেসে। তারপর উৎকৃষ্ট এতেকাফ হয় কোনো জামে মসজিদে করলে যেখানে রীতিমতো জামায়াতে নামায হয়। তারপর মহল্লার মসজিদে যেখানে জামায়াতে নামায হয়।

এতেকাফের শর্ত

এতেকাফের চারটি শর্ত রয়েছে যা ব্যতিরেকে এতেকাফ সহীহ হবে না।

১। মসজিদে অবস্থান

পুরুষের জন্যে জরুরী যে, সে মসজিদে এতেকাফ করবে তাতে পাঁচ ওয়াক্ত জামায়াতসহ নামায হোক বা না হোক। (ইমাম আবু হানিফা (র) এর নিকটে এটা জরুরী যে, যে মসজিদে জামায়াত হয় তাতে এতেকাফ করতে হবে। ইমাম মুহাম্মাদ (রা) ও ইমাম আবু ইউসুফ (র) এর মতে প্রত্যেক মসজিদেই এতেকাফ দুরস্ত হবে। সে যুগে এর ওপরেই ফতোয়া হয়।-দুরুরল মুখতার)মসজিদ ছাড়া পুরুষের এতেকাফ সহীহ হবে না।

২। নিয়ত

অন্যান্য ইবাদাতের জন্যে যেমন নিয়ত শর্ত তেমনি এতেকাফের জন্যে নিয়ত শর্ত। নিয়ত ছাড়া এতেকাফ হবে না নিয়ত ছাড়া এমনি যদি কেউ মসজিদে অবস্থান করে তাহলে এ অবস্থান এতেকাফ হবে না। তারপর এটাও ঠিক যে ইবাদাতের নিয়ত তখন মাত্রই সহীহ হতে পারে যখন নিয়তকারী মুসলমান হয়। তার জ্ঞান থাকতে হবে। বেহুশ বা পাগলের নিয়ত ধরা যাবে না।

৩। হাদীসে আকবর থেকে পাক হওয়া।

অর্থাৎ নারী পুরুষের গোসল ফরয হলে তা করে শরীর পাক করে নেবে এবং নারী হায়েয নেফাস থেকে পাক হবে।

৪। রোযা

এতেকাফ রোযা রাখাও শর্ত। অবশ্য তা শুধু ওয়াজিব এতেকাফের জন্যে। মুস্তাহাব এতেকাফের জন্য রোযা শর্ত নয়। আর সুন্নাত এতেকাফের জন্যে রোযা শর্ত এজন্য নয় যে, তাও রমযান মাসেই করতে হবে।

এতেকাফের নিয়মনীতি

১. ওয়াজিব এতেকাফ অন্ততপক্ষে একদিনের জন্যে হতে পারে। তার কম সময়ের জন্যে হবে না এজন্য ওয়াজিব এতেকাফ রোযা শর্ত।

২. ওয়াজিব এতেকাফ রোযা শর্ত বটে। কিন্তু এটা জরুরী নয় যে, সে রোযা খাস করে এতেকাফের জন্যে করতে হবে। যেমন কেউ রমযান মাসে এতেকাফের মানত করলো। তাহলে এতেকাফ সহীহ হবে। রমযানের রোযাই এতেকাফের জন্যে যথেষ্ট। অবশ্য এটা জরুরী যে এতেকাফে যে রোযা রাখা হবে তা ওয়াজিব হতে হবে, নফল নয়।

৩. ওয়াজিব এতেকাফের মুদ্দত কমপক্ষে একদিন এবং বেশী যতো ইচ্ছা হতে পারে।

৪. মুস্তাহাব এতেকাফের কম মুদ্দত নির্ধারিত নেই, কয়েক মিনিটের এতেকাফও হতে পারে।

৫. ওয়াজিব এতেকাফের জন্যে যেহেতু রোযা শর্ত সেজন্যে কেউ যদি রোযা না রাখার নিয়ত করে তবুও রোযা রাখা অপরিহার্য হবে এবং এজন্যে যদি কেউ শুধু রাতের জন্যে এতেকাফের নিয়ত করে তা অর্থহীন হবে।

৬. যদি কেউ রাত ও দিনের এতেকাফের নিয়ত করে অথবা কয়েক দিনের এতেকাফের নিয়ত করে তাহলে রাত তার মধ্যে শামিল মনে করতে হবে এবং রাতেও এতেকাফ করতে হবে। তবে যদি এক দিনের এতেকাফের মানত করা হয় তাহলে সারাদিনের এতেকাফ ওয়াজিব হবে রাতের এতেকাফ ওয়াজিব হবে না।

৭. মেয়েদের নিজ ঘরেই এতেকাফ করা উচিত। তাদের মসজিদে এতেকাফ করা মকরূহ তানযিহী। সাধারণত ঘরে যে স্থানে তারা নামায পড়ে তা পর্দা দিয়ে ঘিরে নেবে এবং এতেকাফের জন্যে তা নির্দিষ্ট করে নেবে।

৮. রমযানের শেষ দশদিনে যেহেতু এতেকাফ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ কেফায়া, এজন্যে সেটা করা উচিত যাতে বাড়ির কিছু লোক অবশ্যই এর ব্যবস্থা করতে পারে। যদি এর প্রতি অবহেলা করা হয় এবং মহল্লার কেউ যদি এতেকাফ না করে তাহলে সকলেই গোনাহগার হবে।

৯. ওয়াজিব এতেকাফ যদি কোনো কারণে নষ্ট হয়ে যায়। তাহলে তার কাযা ওয়াজিব হবে। অবশ্য সুন্নাত মুস্তাহাব এতেকাফের কাযা নেই।

এতেকাফের মসনুন সময়

এতেকাফের মসনুন সময় রমযানের ২০ তারিখ সূর্য অস্ত যাওয়ার কিছু পূর্ব থেকে শুরু হয় এবং ঈদের চাঁদ দেখার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায়। তা চাঁদ ২৯শে রমযান উদয় হোক না কেন অথবা ৩০শে রমযানে যে কোনো অবস্থায় মসনুন এতেকাফ পূর্ণ হয়ে যাবে।

এতেকাফকারী ২০শে রমযান সূর্যাস্তের পূর্বে মসজিদে পৌছবে এবং মেয়ে মানুষ হলে বাড়ীর নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাবে যা সে নামাযের জন্যে নির্দিষ্ট করে রেখেছে। ঈদের চাঁদ উদয় না হওয়া পর্যন্ত এতেকাফের স্থান থেকে বের হবে না। তবে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে, যেমন পেশাব-পায়খানা অথবা ফরয গোসল প্রভৃতি কাজে অথবা শরীয়াতের প্রয়োজন যেমন জুমার নামায প্রভৃতির জন্যে বের হওয়া জায়েয। কিন্তু প্রয়োজন পূরণের সাথে সাথেই এতেকাফের স্থানে ফিরে যেতে হবে।

ওয়াজিব এতেকাফের সময়

ওয়াজিব এতেকাফের জন্য যেহেতু রোযা শর্ত সে জন্য তার কমসে কম সময় একদিন। একদিনের কম কয়েক ঘন্টার জন্য এতেকাফের মানত অর্থহীন, কারণ রোযার সময়ই হচ্ছে সুবেহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।

মুস্তাহাব এতেকাফের সময়

নফল এতেকাফ যে কোনো সময় হতে পারে। না এর জন্যে রোযা শর্ত আর না কোনো বিশেষ মাস বা সময়। যখনই কেউ মসজিদে থাকে নফল এতেকাফের নিয়ত করতে পারে। মসজিদে যে সময়টুকুই থাকবে তার সওয়াব পাবে।

এতেকাফের সময়ে মুস্তাহাব কাজ

১. যিকির আযকার করা দীনের মাসয়ালা মাসায়েল ও এলেম কালামের উপর চিন্তা ভাবনা করা। তসবিহ তাহলিল লিপ্ত থাকা।

২. কুরআন তেলাওয়াত ও তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা।

৩. দরূদ শরীফ ও অন্যান্য যিকির করা।

৪. দীন সম্পর্কে পড়াশুনা করা ও পড়ানো।

৫. ওয়াজ ও তাবলীগ করা।

৬. দীন সম্পর্কিত বই পুস্তক রচনায় লিপ্ত থাকা।

এতেকাফের মধ্যে যেসব কাজ করা জায়েয

১. পেশাব পায়খানার জন্যে বাইরে যাওয়া জায়েয। মনে রাখতে হবে এসব প্রয়োজন এমন স্থানে পূরণ করতে হবে যা মসজিদের নিকটে হয়। মসজিদের নিকটে এমন স্থান আছে কিন্তু তা বেপর্দা অথবা অত্যন্ত নোংরা। তাহলে আপন বাড়ীতে পেশাব পায়খানার জন্যে যাওয়ার অনুমতি আছে।

২. ফরয গোসলের জন্যেও এতেকাফের স্থান থেকে বাইরে যাওয়া জায়েয। তবে মসজিদেই গোসল করার ব্যবস্থা থাকলে সেখানেই গোসল করতে হবে।

৩. খানা খাওয়ার জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া যায় যদি খানা নিয়ে আসর কোনো লোক না থাকে। খানা আনার লোক থাকলে মসজিদে খাওয়াই জরুরী।

৪. জুমা ও ঈদের নামাযের জন্যেও বাইরে যাওয়া জায়েয। আর যদি এমন মসজিদে এতেকাফ করা হয় যেখানে জামায়াত করা হয় না। তাহলে পাঞ্জেগানা নামাযের জন্যে অন্যত্র যাওয়া জায়েয।

৫. যদি কোথাও আগুন লাগে, অথবা কেউ পানিতে পড়ে ডুবে যাচ্ছে অথবা কেউ কাউকে মেরে ফেলছে অথবা মসজিদ পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয় তাহলে এসব অবস্থায় এতেকাফের স্থান থেকে বাইরে যাওয়া শুধু জায়েযই নয় বরঞ্চ জরুরী। কিন্তু এতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।

৬. কেউ যদি কোনো প্রাকৃতিক প্রয়োজনে যেমন জুমার নামাযের জন্যে বের হলো এবং এ সময়ে সে কোনো রোগীর সেবা করলো অথবা জানাযায় শরীক হলো তাহলে তাতে কোনো দোষ হবে না।

৭. যে কোনো প্রাকৃতিক অথবা শরীয়াতের প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয।

৮. জুমার নামাযের জন্যে এতটা পূর্বে যাওয়া, যাতে করে তাহিয়্যাতুল মসজিদ এবং জুমার সুন্নাতগুলো নিশ্চিন্তে পড়া যায়, জায়েয আছে। সময়ের আন্দায এতেকাফকারীর ওপর নির্ভর করে।

৯. কাউকে যদি জোর করে এতেকাফের স্থান থেকে বের করে দেয়া হয় অথবা কেউ তাকে যদি বাইরে আটক রাখে তাহলেও এতেকাফ শেষ হয়ে যাবে।

১০. যদি কাউকে কোনো ঋণদাতা বাইরে আটক করে অথবা সে ব্যক্তি নিজে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং এতেকাফের স্থানে পৌছাতে বিলম্ব হয়ে যায় তবুও এতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।

১১. যদি কেনাবেচার কোনো লোক না থাকে এবং বাড়ীতে খাবার কিছু না থাকে তাহলে প্রয়োজনমত কেনাবেচা করা এতেকাফকারীর জায়েয।

১২. আযান দেয়ার জন্যে মসজিদের বাইরে যাওয়া জায়েয।

১৩. যদি কেউ এতেকাফ করার নিয়ত করতে গিয়ে এ নিয়ত করে যে, সে জানাযার জন্যে যাবে তাহলে যাওয়া জায়েয। অন্য নিয়ত করলে তার জন্যে যাওয়া জায়েয হবে না।

১৪. এতেকাফ অবস্থায় কাউকে দীন সম্পর্কে পরামর্শ অথবা চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ দেয়া জায়েয। বিয়ে করা, ঘুমানো এবং আরাম করা জায়েয।

এতেকাফে যেসব কাজ না জায়েয

১. এতেকাফ অবস্থায় যৌনক্রিয়া করা এবং স্ত্রীকে আলিঙ্গন করা ও চুমো দেয়াতে বীর্যপাত না হলে এতেকাফ নষ্ট হবে না।

২. এতেকাফ অবস্থায় কোনো দুনিয়ার কাজে লিপ্ত হওয়া মাকরূহ তাহরিমী। বাধ্য হয়ে করলে জায়েয হবে।

৩. এতেকাফ অবস্থায় একেবারে চুপচাপ বসে থাকা মাকরূহ তাহরিমী। যিকির ফিকির, তেলাওয়াত প্রভৃতিতে লিপ্ত থাকা উচিত।

৪. মসজিদে বেচাকেনা করা। লড়াই-ঝগড়া করা, গীবত করা অথবা কোনো প্রকার বেহুদা কথা বরা মাকরূহ।

৫. কোনো প্রাকৃতিক ও শরয়ী প্রয়োজন ব্যতিরেকে মসজিদের বাইরে যাওয়া অথবা প্রাকৃতিক ও শরয়ী প্রয়োজনে বাইরে গিয়ে সেখানেই থেকে যাওয়া জায়েয নয়। তাতে এতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।
লায়লাতুল কদর
রমযানের শেষ দশদিনের মধ্যে এমন এক রাত আছে যাকে লায়লাতুল কদর এবং লায়লাতুম মুবারাকাতুন বলা হয়েছে এবং তাকে এক হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম বলা হয়েছে।

কুরআন বলেঃ

*******আরবী*********

আমরা এ কিতাবকে এর মুবারক রাতে নাযিল করেছি।

দ্বিতীয় আর এক স্থানে কুরআন বলেঃ

*******আরবী*********

অবশ্যই আমরা এ কুরআনকে লায়লাতুল কদরে নাযিল করেছি। তুমি জান, লায়লাতুল কদর কি? তা হচ্ছে এমন এক রাত যা হাজার মাস অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট। (সূরা আল কদর)

 

লায়লাতুল কদরের অর্থ

কদরের দুটি অর্থ

এক- নির্ধারণ করা, সময় নির্দিষ্ট করা ও সিদ্ধান্ত করা। অর্থাৎ লায়লাতুল কদর এমন এক রাত যে রাতে আল্লাহ প্রত্যেক বস্তুর সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করেন। তার সময় নির্দিষ্ট করেন এবং হুকুম নাযিল করেন ও প্রত্যেক বস্তুর ভাগ্য নির্ধারণ করেন।

*******আরবী*********

ঐ রাতে সকল বিষয়ের সুষ্ঠু ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয় আমাদের নির্দেশক্রমে। (সূরা দুখান)

কুরআনের অন্যত্র আছেঃ

*******আরবী*********

এ রাতে ফেরেশতাগণ এবং বিশেষ করে জিবরাঈল নাযিল হন যারা তাদের রবের নির্দেশে সকল কার্য সম্পাদনের জন্যে নীচে নেমে আসেন। (সূরা আল কদরঃ ৪)

দুই কদরের দ্বিতীয় অর্থ মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। অর্থাৎ লায়লাতুল কদর এমন এক রাত আল্লাহর নিকট যার বিরাট মহত্ব ও ফযীলত রয়েছে। তার মর্যাদা ও মহত্বের এ প্রমাণই যথেষ্ট যে, আল্লাহ সে রাতে কুরআনের মতো বিরাট নিয়ামত নাযিল করেছেন। এর চেয়ে বৃহত্তর কোনো নিয়ামত না মানুষ ধারণা করতে পারে আর না কামনা করতে পারে। এ মঙ্গল ও বরকত এবং মহত্ব ও ফযীলতের ভিত্তিতেই কুরআন তাকে এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর বলে ঘোষণা করেছে।

লায়লাতুল কদর নির্ধারণ

হাদীসগুলো থেকে জানা যায় যে, এ রমযান মাসের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে কোনো একটি অর্থাৎ ২১শে, ২৩শে, ২৫শে, ২৭শে অথবা ২৯শে রাত। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন- রমযানের শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে লায়লাতুল কদর তালাশ কর। (বুখারী)

এ রাতকে সুস্পষ্ট করে চিহ্নিত না করার তাৎপর্য এই যে, রমযানের এ শেষ দশদিনে যাতে করে যিকির ও ইবাদাতের বেশী করে ব্যবস্থাপনা করা যায়।

হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (স) রমযানের শেষ দশ দিন যিকির ও ইবাদাতের এমন ব্যবস্থা করতেন যা অন্য সময়ে করতেন না। (মুসলিম)

এ রাতে বেশী বেশী নামায বন্দেগী, যিকির, তাসবিহ ইত্যাদির প্রেরণা দান করে নবী (স) বলেন, যখন লায়লাতুল কদর আসে, তখন জিবরাঈল অন্যান্য ফেরেশতাগণের সাথে যমীনে নেমে আসেন এবং প্রত্যেক ঐ বান্দাহর জন্যে রহম ও মাগফেরাতের দোয়া করেন যে দাড়িয়ে বসে আল্লাহর ইয়াদ ও ইবাদাতে মশগুল থাকে। (বায়হাকী)

নবী (সা) আরও বলেন, লোক সকল! তোমাদের মধ্যে এমন এক রাত এসেছে যা হাজার মাস থেকেও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত রইলো সে সকল প্রকার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল এবং এ রাত থেকে যে ই বঞ্চিত থাকে যে প্রকৃতপক্ষে বঞ্চিত। (ইবনে মাজাহ)

লায়লাতুল কদরের খাস দোয়া

হযরত আয়েশা (রা) বলেন, আমি তাকে বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! যদি কোনো প্রকারে আমি জানতে পারি কোন রাতটি লায়লাতুল কদর, তাহলে কি দোয়া করবো? তার জবাবে নবী (স) বলেন, এ দোয়া পড়বে।

*******আরবী*********

আয় আল্লাহ তুমি বড়ই মাফ করেনেওয়ালা এবং বড়োই অনুগ্রহশীল। মাফ করে দেয়াই তুমি পছন্দ কর। অতএব তুমি আমার গুনাহগুলো মাফ করে দাও।

সদকায়ে ফিতরের হুকুম আহকাম

যে বছর মুসলমানদের ওপর রোযা ফরয করা হয় সে বছরই নবী (স) সদকায়ে ফিতর আদায় করার জন্যে মুসলমানদেরকে নির্দেশ দেন। আল্লাহর ফরয করা ইবাদাতগুলো বান্দাহ সকল শর্ত ও নিয়মনীতি সহ পালন করার ব্যবস্থা করে, কিন্তু জ্ঞাত অজ্ঞাতসারে তার মধ্যে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি রয়ে যায়। রোযার মধ্যে যে সব ত্রুটি বিচ্যুতি হয় তার ক্ষতিপূরণের জন্যে রমযানের শেষে সদকায়ে ফিতর শরীয়তে ওয়াজিব করে দিয়েছে। এর দ্বারা তাদের ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণও হবে এবং গরীব দুঃখী মুসলমান নিশ্চিন্ত মনে খাওয়া পরার জিনিস পত্র সংগ্রহ করে সকল মুসলমানদের সাথে ঈদের নামাযে শরীক হতে পারবে।

যেসব সচ্ছল ব্যক্তির কাছে তার প্রয়োজন পূরণের পর এতোটা সম্পদ থাকবে যার মূল্য নেসাবের পরিমাণ হয়, সে মালের ওপর যাকাত ওয়াজিব হোক বা না হোক তাকে সদকায়ে ফিতর আদায় করতে হবে। সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব।

সদকায়ে ফিতর ঈদের দু একদিন আগে দিয়ে দিলে বেশী ভালো হয় নতুবা ঈদের নামাযের পূর্বেই দিয়ে দেয়া উচিত। ঈদের নামাযের পূর্বে দেয়া মুস্তাহাব।

গম দিতে হলে এক সের তিন ছটাক- যব তার দ্বিগুণ। কারো কারো মতে গম এক সের সারে বারো ছটাক। খুরমা মুনাক্কা গমের দ্বিগুণ দিতে হবে।

সদকায়ে ফিতর ঐ লোককে দেয়া উচিত যাদেরকে যাকাত দেয়া হয়।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি