বিষের পরাজয় বিশ্বাসের জয়

খায়বর যুদ্ধ তখন শেষ।
এহানবী (সা) তখনও কায়বরে।
ভেতরে ভেতরে ইহুদীরা পাগল হয়ে গেছে কিছু করার জন্যে। ইহুদীদের একটা গ্রুপ সিদ্ধান্ত নিল মহানবী (সা)-কে হত্যা করার। ঠিক হলো বিষ খাওয়ানোই সবচেয়ে নিরাপদ। পরিকল্পনা অনুসারে ছাগল জবাই করে রান্না করা গোশতে তীব্র বিষ মেশানো হলো, যার ফোঁটা পরিমাণ গলাধঃকরণ করলে সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মৃত্যু ঘটবে। মহানবী (সা) ছাগলের রানের গোশত বেশী পছন্দ করতেন। সেই রানের গোশতে অধিক পরিমাণে বিষ মেশানো হলো। যয়নাব নামে সম্ভ্রান্ত বংশীয় ইহুদী মেয়ে আরও কয়েকজনকে সাথে নিয়ে মহানবী (সা)-এর কাছে এসে বলল, ‘আপনার জন্যে এই সামান্য হাদিয়া এনেছি। আপনি অনুগ্রহ করে গ্রহণ করবেন কি?’
মহানবী (সা) ধন্যবাদের সাথে হাদিয়া গ্রহণ করলেন এবং উপস্থিত সাহাবাদের সাথে নিয়ে খেতে বসলেন।
তিনি এক টুকরো গোশত খেয়েই সাহাবাদের উদ্দেশ্য দ্রুত বললেন, ‘গোশতে বিষ মোশানো আছে, খেওনা কেউ।’
কিন্তু বিশর নামের একজন সাহাবী তখন এক টুকরার কিছু অংশ গিলে ফেলেছিলেন।
সংগে সংগেই তাঁর দেহে বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। দেহ তার বিবর্ণ হয়ে যেতে লাগল। বিষের যন্ত্রণায় তিনি কাতর হয়ে পড়লেন।
মহানবী (সা) যয়নাব ও তার সাথীদের ডেকে তাদের কৃত অপরাধের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন।
যয়নাব উদ্যত কণ্ঠেই বলল, ‘আপনাকে হত্যা করার জন্যে এটা করেছি।’ আর তার সাথী ইহুদীরা ধূর্ততার সাথে বলল, ‘আমরা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম, তুমি যদি ভ- হও, তাহলে বিষ তোমার জিহ্বা স্পর্শ করার সাথে সাথে তোমার মৃত্যু ঘটবে। আর যদি সত্যিই নবি হও, তাহলে বিষ তোমার কিছু করতে পারবে না।’
চারদিকে দাঁড়ানো সাহাবীরা ইহুদীদের এই ষড়যন্ত্রে ক্রোধে তখন আগুন। তারা বলল, ‘এদের হত্যা করা অনুমতি কি আমরা পাব না?’
মহানবী (সা) তাদেরকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিলেন। তাঁর নিজের উপর অত্যাচারের প্রতিশোধ কখনও তিনি নেন না, এ জন্যে কাউকে কোন দ-ও কখনও তিনি দেন না।
যয়নাব উদ্যত কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু শীঘ্রই তার ভাবান্তর ঘটতে লাগল। সে মনে করেছিণ তখনই তাদের গর্দান চলে যাবে, হত্যা করা হবে তাদের সংগে সংগেই। সাহাবাদের প্রতি ধৈর্য ধারণের উপদেশ, প্রতিশোধ না নেবার মহানবীর কথায় সে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পড়ল। দ্বিতীয়ত, সাহাবী বিশরের চেয়ে অনেক বেশী গোশত মহানবী (সা) খেয়েছেন। কিন্তু বিশষর যেখানে মুমূর্ষু, সেখানে মহানবী সুস্থ। তাঁর ঠেঁট দু’টি বিবর্ণ হওয়া ছাড়া বিষের আর কোন প্রতিক্রিয়া তাঁর দেহে নেই। এই চিন্তা যয়নাবের মনকে ওলট-পালট করে দিল। সর্বোপরি যয়নাব যখন দেখল, তাদের হত্যা তো দূরে গ্রেফতারও করা হলো না, তখন যয়নাব আর স্থির থাকতে পারলো না। মুহূর্তে তার তার হৃদয় খেকে সব বিদ্বেষ কোথায় যেন দূর হয়ে গেল। তার জায়গায় তার হৃদয়ে থেকে সব বিদ্বেষ কোথায় যেন দূর হয়ে গেল। তার জায়গায় তার হৃদয়ে নামল মহানবীর প্রতি ভক্তি, মমতার অঢেল প্রস্রবণ। সে লুটিয়ে পড়ল মহানবীর পায়ে এবং কালেমায়ে তাইয়্যেরা পাঠ করে ইসলামে দাখিল হয়ে গেল। হত্যা করতে এসে নতুন জীবন স্থায়ী হলো না। বিষক্রিয়ার ফলে তিনদিন পরে সাহাবী বিশর-এর মৃত্যু ঘটলে হত্যার অপরাধে যয়নাবে প্রাণদন্ডে দন্ডিত হলেন।

মদীনার পথে ত্রি-রত্ন

আমর ইবনে ‘আস ছুটছেন মরু পথ ধরে মদীনার দিকে। আমর মক্কার একজন প্রথিতযমা যোদ্ধা এবং দূরদর্শী একজন রাজনীতিবিশারদ পণ্ডিত। আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাসীর দরবার থেকে হিজরতকারী মুসলমানদের ধরে আনার কঠিন কূটনৈতিক কর্মে কুরাইশরা তাকেই পাঠিয়েছিল আবিসিনিয়ায়। এই আমর আজ তাঁর বাড়ী-ঘর, সহায়-সম্পত্তি, আত্মীয়-স্বজন সব মক্কায় ফেলে দেহের পোশাকটুকু মাত্র সম্বল করে ছুটছেন মদীনায়। অনেকটা পথ এগুবার পর এক জায়গায় হঠাৎ তাঁর সাক্ষাত ঘটলো খালিদ ইবনে ওয়ালিদ ও ওসমান ইবনে তালহার সাথে। চমকে উঠলেন আমর, চমকে উঠলেন খালিদ এবং ওসমানও। উভয়পক্ষের কাছে তাদের এই সাক্ষাত যেন অকল্পনীয় এবং অনাকাক্সিক্ষত। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ এবং ওসমান ইবনে তালহা দ’জনেই আমরের মতই মক্কার বিখ্যাত ব্যক্তি। খালিদ অদ্বিতীয় বীর এবং অজেয় সেনাপতি হিসেবে আরবে পরিচিত। আর ওসমান ইবনে তালহা মক্কার মহাসম্মানিত ব্যক্তি। তিনি কা’বার প্রধান মুহাফেজ এবং বায়তুল্লাহর সকল চাবি তাঁরই জিম্মায় থাকে। এঁদের মুখোমুখি হয়ে আমর নিজের বিস্ময় কিছুটা সামলে নেবার পর খালিদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘খালিদ! কতদূর?’ খালিদ একজন নির্ভীক যোদ্ধা। কিন্তু তিনিও চমকে উঠেছিলেন আমরের অপ্রত্যাশিত দর্শনে। খালিদ জানেন না, সত্য গোপন করতে। খালিদ অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘যাচ্ছি মদীনায়। জেদের বশবর্তী হয়ে অসত্যের পূজা করতে করতে মন হাঁপিয়ে উঠেছে। আর সহ্য করতে পারছি না। তাই মদীনায় চলেছি প্রকাশ্যে সত্যকে স্বীকার করতে, আগের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে।’ বলে একটু দম নিলেন খালিদ। তারপর আমরকে লক্ষ্য করে উদাও কণ্ঠে বললেন, ‘আমর, আর কতদিন, নিশ্চয় জেনো এই ব্যক্তি (মহানবী) সত্যবাদী। তিনি নিশ্চিয় আল্লাহর নবী। আমি ও আমার সঙ্গী ওসমান এই উদ্দেশ্যেই মদীনা যাত্রা করেছি। আমরের মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। উৎসাহ-উদ্দীপনায় নেচে উঠলো মুখম-ল। বললেন আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে, আমিও তো একই উদ্দেশ্যে মদীনা যাত্রা করেছি। দুই কাফেলা এক হয়ে এক মহানন্দে ছুটলো মদীনার দিকে। ফাতহুম্ মুবিন-এর জ্বলন্ত চিত্র যেন এটা।

নববী এক মোজেজা

রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস, আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাসীর কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর পর পারস্যের সম্রাট খসরু পারভেজের দরবারে চিঠি দিয়ে দূত প্রেরণ করলেন মহানবী (সা)। মহানবীর চিঠি কোন সম্রাটের দরবারে যে অমর্যাদার শিকার হয়নি, সেটাই ঘটল পারস্যে। সম্রাট খসরু চিঠি পেয়ে ক্রোদে জ্বলে উঠলেন এবং চিঠি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। শুধু তাই নয়, ইয়ামেনে তাঁর শাসনকর্তাকে লিখে পাঠালেন,চিঠি পাওয়া মাত্র মদীনায় গিয়ে মুহাম্মাদকে গ্রেফতার করে পারস্য সম্রাটের দরবারে পাঠানো হোক। চিঠি পেয়ে ইয়ামেনের শাসনকর্তা ‘বাজান’ প্রেফতারী পরওয়ানা ও উপযুক্ত সৈন্যসহ দু’জন রাজ-কর্মচারীকে মদীনা পাঠালেন। রাজকর্মচারীদ্বয় যথাসময়ে মদীনায় মহানবীকে বললেন, স্বেচ্ছায় ত্বরিত হাজির হলে গভর্নর সাহেব তার পক্ষে ভাল সুপরিশ করতে পারেন। মহানবী (সা) তাদের সাথে কিছু কথাবার্তা বলে তাদেরকে পরদিন সকালে আসতে বললেন। পরদিন সকালে ওঁরা এলেন। মহানবী ওদের বললেন, ‘খসরু পারভেজ নিহত। তাঁর ছেলে শেরওয়াহ তাকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেছে। যাও, তোমরা ফিরে গিয়ে ‘বাজান’-কে এই সংবাদ দাও। নিশ্চয় জেন, ইসলাম শীঘ্রই খসরু পারভেজের সিংহাসনের উপর অধিকার বিস্তার করবে। আর ‘বাজান’-কে বলো, সে ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে তার পদে বহাল রাখব। রাজকর্মচারীদ্বেয় এই অবিশ্বাস্য সংবাদ শুনে স্তম্ভিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ছুটল ইয়ামেনে তাদের শাসনকর্তা ‘বাজার’-এর কাছে। ইয়ামেনের শাসনকর্তা ‘বাজান’ তাঁর কর্মচারীর কাছে সবশুনে উদ্বেগ ও বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বলল, এমন স্পষ্ট অনাবিল ভবিষ্যদ্বাণী তো বাইবেলে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এ ভবিষ্যদ্বাণী যদি সত্য হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে বুবং যে, মুহাম্মদ যথার্থই আল্লাহর নবী। ঠিক আছে কয়দিন অপেক্ষা করা যাক, পারস্য থেকে কোন খবর আসে কিনা। খুব শীঘ্রই ‘বাজান’-এর উন্মুখ অপেক্ষার অবসান ঘটল। ‘বাজান‘-এর কাছে পারস্যের নতুন সম্রাট শেরওয়াহের ফরমান এল। যাতে বলা হলো- ‘খসরুকে তার অন্যায় আচরণের জন্যে হত্যা করে আমি সিংহাসনে অধিপতি হয়েছি। ইয়ামেনবাসীকে আমার আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য করবে। আর মক্কার সেই ব্যক্তি সম্পর্কে আমার দ্বিতীয় আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত কিছু করবে না।’ ফরমান পড়ার পর আর কালবিলম্ব না করে ইয়ামেনের শাসনকর্তা ‘বাজান’ ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং অল্পকাল পরেই ছুটলেন মদীনায় মহানবীর মহাদর্শন লাভের আকূল বাসনায়। কিন্তু তাঁর বাসনা অতৃপ্তই রয়ে গেল। পথিমধ্যে তিনি শহীদ হলেন গুপ্ত ঘাতকের হাতে।

প্রথম দিগি¦জয়ী বাহিনীর প্রতি মহানবী

বাসরায় রাজার কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে দূত উমাইর ইবনে হারেসকে প্রেরণ করেন মহানবী (সা)। পথে ‘মুতা’ নামক স্থানে একজন খৃস্টান আঞ্চলিক শাসনকর্তা শুরাহবিল উমাইরকে বন্দী করে তাকে হাত-পা কেটে অশেষ কষ্ট দিয়ে হত্যা করল। শুধু ‘দূত’ হত্যাই নয়, সে লক্ষাধিক সৈন্য যোগাড় করে মদীনা আক্রমণের দুরভিসন্ধি আাঁটতে লাগল। রোম সম্রাটের কাছে কাছেও আশু সাহায্যের ঘোষণা সে পেয়ে গেল। ‘দূত’ হত্যার খবর এবং খৃস্টানদের সমরায়োজনের কথা মহানবীর কাছে পৌঁছলে মহানবী (সা) সঙ্গে সঙ্গেই তিন হাজার সৈন্যের একটা বাহিনী মুতায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। এই বাহিনীর সেনাপতির দায়িত্ব দিলেন যায়েদ ইবনে হারেসাকে। তিনি বলে দিলেন, যায়েদ নিহত হলে আলীর ভাই বীরবর জাফর সেনাপতি হবেন। আর জাফর নিহত হলে সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবেন আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। মহানবীর আশংকা শুধু আশংকা নয়, এক দেদীপ্যমান সত্য। সুতরাং বাহিনীটি যে কি ভয়াবহ এক যুদ্ধের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে তা আঁচ করা বাকী রইল না মহানবীর কথা থেকে। তাই বোধ হয় মদীনার অধিবাসীরা মদীনার বাইরে ‘বিদা উপত্যকা’ পর্যন্ত বাহিনীটির সাথে হেঁটে এল। বিদায়ের প্রাক্কালে মহানবী (সা) মুসলিম বাহিনী যাতে কোন অবস্থাতেই নীতিভ্রষ্ট না হয়, কোন বাড়াবাড়ির আশ্রয় যাতে না নেয়, আল্লাহর উপর ভয় ও ভরসাকেই যাতে সর্বাবস্থায় পাথেয় মনে করে, সে জন্যে বিদায়ী উপদেশ হিসেবে বললেন :
‘আমি তোমাদেরকে সর্বদা সদ্ব্যবহার করার উপদেশ দান করছি। আল্লাহর নামে যুদ্ধযাত্রা কর এবং সিরিয়ায় তোমাদের ও আল্লাহর শত্রুদের মুকাবিলা কর। তোমরা যে দেশে যাচ্ছ সেখানকার মাঠে সাধু-সন্ন্যাসীদেরকে নিভৃত সাধনায় মগ্ন থাকতে দেখবে। সাবধান! তাদের কাজে কোন প্রকার বিঘœ সৃষ্টি করবে না। সাবধান! একটি স্ত্রীলোক, একটি বালক বা বালিকা, একজন বৃদ্ধও যেন কোনক্রমে তোমাদের হাতে নিহত না হয়। সাবধান! শত্রুপক্ষের একটি বৃক্ষও ছেদন করবে না, একটি বাড়ীও নষ্ট করবে না।’
এই প্রথমবারের মত মুসলিমরা আরব ভূখণ্ডের বাইবে যুদ্ধযাত্রা করছে। যাদের বিরুদ্ধে তাদের এই যুদ্ধযাত্রা তারা সংখ্যা ও সজ্জায় অনেক অনেক বড়। কিন্তু তবু সৈনিকরা বুঝলে, যথেচ্ছা চলার এক ইঞ্চি সুযোগও তাদের থাকল না। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সাহায্য লাভের এই তো উপায়।

সিরিয়ার আকাশে প্রথম ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি

মুতা যুদ্ধ-যাত্রার একটি মুহূর্ত।
তিন হাজার সৈন্যেও মুসলিম বাহিনী আরব সীমান্ত অতিক্রম করে সিরিয়া প্রদেশে প্রবেশের পর জানতে পারলো, খৃস্টান শাসনকর্তা শুরাহবিল এক লাখ সৈন্যের এক সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে সিরিয়ার মা’আব স্থানে অপেক্ষা করছেন। মুসলিম বাহিনী আরও জানতে পারলো, রোম সম্রাট স্বয়ং ২ লাখ সৈন্যের একটা বাহিনী তৈরী করছেন শুরাহবিলের সাহায্যের জন্যে। অর্থাৎ গোটা খৃস্টান সাম্রাজ্যই যেন এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এ খবর পাওয়ার পর মুসলিম বাহিনীর অনেকেই পরিস্থিতি সম্পর্কে পরামর্শ করার প্রয়োজন অনুভব করল। পরামর্শ সভায় দিলেন, ‘এই নতুন পরিস্থিতি সম্পর্কে মদীনায় খবর পাঠানো হোক। এ ব্যাপারে মহানবী (সা)-এর পরামর্শ আসার পর অনুসারে কাজ করা উচিত।’ যারা এই মত প্রকাশ করলেন, তারা যুক্তি হিসেবে বললেন, ‘তিন হাজার সৈন্য নিয়ে লাখ অথবা তারও বেশী সুসজ্জিত সৈন্যের সাথে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়া সঙ্গত হবে না।’ যুক্তি খুবই শক্তিশালী। বিশেষ করে মহানবী (সা)-এর পরামর্শ নেয়ার প্রস্তাব অনেকের কাছে সঙ্গত বলে মনে হলো। কিন্তু অনেকেই এই দ্বিধাগ্রস্তকে মেনে নিতে পারলেন না। তাদেরই একজন মহামতি আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা, উঠে দাঁড়িয়ে গুরুগম্ভীর আওয়াজে তেজোদীপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘মুসলিম সৈনিকবৃন্দ, তোমরা যে সাফল্য অর্জনের জন্যে বের হয়েছিলে, আল্লাহর কসম এখন সে সাফল্যই যেন তোমাদের কাছে অবাঞ্ছিত বলে মনে হচ্ছে। তোমরা তো বের হয়েছিলে শাহাদাত হাসিলের উদ্দেশ্যে, সত্যের নামে আত্মোৎসর্গ করার জন্যে। সংখ্যার গণনা মুসলমানরা কখনই করে না, পার্থিব শক্তির তুলনা করার কাজে কখনই তারা প্রবৃত্ত হয় না, তাদের একমাত্র শক্তি আল্লাহ। সেই আল্লাহর প্রেরিত মহাসত্যকে বক্ষে ধারণ করে, সত্যের তেজে উদ্দীপ্ত হয়ে কর্তব্যের কোরবান গাহে আল্লাহর নামে হৃৎপি-ের শোণিত ঢেলে দেয়াই তো আমাদের সাফল্য। বিজয়ী হতে পারি ভাল, আর শাহাদাত যদি হয় আরও ভাল। সুতরাং এ সময় এত আলোচনা আর এই যুক্তি-পরামর্শ কিসের জন্যে?

খালিদ হলেন সেনাপতি

মুতার যুদ্ধ চলছে। এক লাখ সুসজ্জিত সৈন্যের বিরুদ্ধে তিন হাজার সৈন্যের লড়াই। সেনাপতি যায়েদ ইবনে হারেসার শাহাদাতের পর সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন জাফর ইবনে আবু তালিব। ভয়াবহ যুদ্ধের তীব্রতার মধ্যে সেনাপতি জাফর শীদ হলেন। তাঁর শাহাদাতের পর পতাকা তুলে ধরলেন আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। তিনিও শহীদ হলেন। মুসলিম পতাকা ভূলুণ্ঠিত হলো রণাঙ্গনে। পতাকা ভূলুণ্ঠিত হওয়ায় মুসলিম বাহিনীর কেন্দ্র ভেঙ্গে পড়লো। মুসলিম বাহিনীম তখন মহাবিপর্যয়কর অবস্থা। একদিকে শত্রুপক্ষের প্রবল চাপ, অন্যদিকে মুসলিম বাহিনীর সেনাপতিহীন বিশৃংখল অবস্থা। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে, গোটা যুদ্ধক্ষেত্রে দু’জন মুসলিম সৈনিকও একসাথে ছিলো না। যুদ্ধের এই অবস্থা দেখে কেউ কেউ মদীনা অভিমুখে পালানো শুরু করেছিলেন। ভয়াবহ এই দুঃসময়ে উকবা ইবনে আমের নামক একজন সাহাবী উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘পলাতক অবস্থায় নিহত হওয়া অপেক্ষা সামনে অগ্রসর হয়ে জীবন দেয়া শ্রেয়তর।’ উকবার এই চিৎকারে অনেকের চেতনা হলো, কেন্দ্রও একটা খুঁজে পেলো তারা। কিছু মুসলিম যোদ্ধা ছুটে এলো তাঁর দিকে। সামনেই তাদের মুসলিম বাহিনীর ভূলুণ্ঠিত, পদদলিত পতাকা এবং সবেগে তা বাতাসে উড়াতে উড়াতে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘কে কোথায় আছ মুসলিম বীর, এদিকে ছুটে এসো’। একজন সেনাপতি নির্বাচন করতে হবে। ছুটে এলো আরও কিছু মুসলিম সৈনিক। সাবেত এবং উপস্থিত অন্যান্য সৈনিকরা সেনাপতি হিসেবে খালিদ ইবনে। ওয়ালিদ-এর নাম প্রস্তাব করলেন। খালিদ বিনীতভাবে বললেন, ‘সাবেত, তুমি আমাদের সকলের ভক্তিভাজন, তুমিই এর উপযুক্ত পাত্র। তুমিই আমাদের সেনাপতি।’ কিন্তু দূরদর্শী সাবেত তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘খালিদ, ভাবপ্রবণতা মনোনীত করেছি। মহানবী (সা)-এর পতাকা তুমি গ্রহণ করো এবং বলো আমাদের কি করতে হবে।’ খালিদ আর অপেক্ষা করলেন না। ভক্তিভরে মহানবীর যুদ্ধ-পতাকা হাতে তুলে নিলেন। ..

যে যুদ্ধে ৮টি তরবারী ভাঙে সেনাপতির

মুতার যুদ্ধ নিয়ে উদ্বিগ্ন মহানবী (সা)।
মুতার সৈন্যদল পাঠাবার কয়েকদিন পর যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের জন্যে আবু আমের আশআরী নামক একজন সাহাবীকে তিনি পাঠালেন মুতা অঞ্চলে। তিন সেনাপতি শহীদ হওয়ার মর্মান্তিক খবর পেয়ে আবু আমের ছুটে এলেন মদীনায়। বললেন মহানবীকে, তিন সেনাপতি শহীদ হওয়ার পর খালিদ ইবনে ওয়ালিদ এখন সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। শহীদ তিন সেনাপতির মধ্যে জাফর ছিলেন মহানবী (সা)-এর চাচাতো ভাই। শহীদের আত্মীয়-স্বজনকে সান্ত¡না দিয়ে মহানবী (সা) জনসমক্ষে এসে দাঁড়ালেন। বললেন সকলকে উদ্দেশ্য করে, ‘সকলে যুদ্ধ যাত্রা কর, ভাইদের সাহায্য কর। একজন সমর্থ ব্যক্তিও যেন বাদ না পড়ে।’ যে যুদ্ধে যায়েদ, জাফর, আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার মত বীর সেনাপতি পর পর শহীদ হন সে যুদ্ধ যে কতটা ভয়বহ তা বুঝতে মদীনার কারোরই বাকী রইল না। তার উপর মহানবীর আহবান পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিল। অভূতপূর্ব এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো মদীনায়। সাহাবীরা যে যে অবস্থায় ছিল, যে যা পেল তা নিয়ে ছুটলো মুতার দিকে। কেউ হেঁটে কেউ ঘোড়ায় বা উটে চড়ে। এই যুদ্ধ-যাত্রার ক্ষেত্রে কেউ কারও অপেক্ষা করেনি। কে কার আগে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছতে পারে তারই যেন প্রতিযোগিতা। মহানবী (সা), হযরত আবু বকর (রা) এবং হযরত ওমর (রা)-একইভাবে মুতা যাত্রা করলেন। মদীনা থেকে প্রেরিত এই সাহায্যেও কি পরিমাণ যথাসময়ে মুতা যুদ্ধে খালিদ ইবনে ওয়ালিদের মুসলিম সেনাদলে শামিল হতে পেরেছিলেন, এটা বড়া কথা নয়। বড় কথা হলো মদীনা থেকে সাহায্যা পৌঁছেছিল। খৃস্টান শুরাহবিলের বাহিনীর জন্যে এটা ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক ধরলেন বড়া খবর। সেদিন রাত শেষে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ মুতা প্রান্তরে মুসলিম বাহিনীকে এমন কৌশল ছকে ছকে দাঁড় করালেন যাতে মনে হতে লাগল মদীনা থেকে অসংখ্য সৈন্য মুতায় পুরাতন সেনাদলের সাথে যোগ দিয়েছে। খৃস্টান বাহিনীকে স্তম্ভিত করল এই ঘটনা। আর সেদিন মুসলিম বাহিনীও এমনভাবে যুদ্ধ শুরু করল যেন তারা শতগুণ শক্তিতে আজ উদ্দীপ্ত। ভয়াবহ এক যুদ্ধ সংঘটিত হলো সেদিনও। অবশেষে খৃস্টান বাহিনী পিছু হটল। সেদিন প্রথমে তাদের মানসিক পরাজয় সূচিত হয়েছিল। সেই মানসিক পরাজয় ডেকে আনল যুদ্ধে তাদের এক শোচনীয় পরাভব। মুতার যুদ্ধ চলেছিল প্রায় ৭ দিন ধরে। এক খালিদ ইবনে ওয়ালিদের হাতেই ৮টি তরবারি টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধেও শেষ মুহূর্তে তিনি ব্যবহার করেছিলেন নবম তরবারী। মুতা ছিল তদানীন্তন আরব এলাকার বাইরে মুসলমানদের প্রথম যুদ্ধ এবং প্রথম বিজয়।

স্বজনের চেয়ে ওয়াদা বড়

হুদায়বিয়া সন্ধির পর দেশের ভেতরে-বাইরে ইসলামের দ্রুত বিস্তারে দিশেহারা হয়ে পড়ল কুরাইশ এবং আরবের প্রধান পৌত্তলিক গোত্রগুলো। মক্কায় কুরাইশ, তায়েফের সাকিফ এবং হোনায়েনের হাওয়াজেন ছিল আরবের প্রধান পৌত্তলিক গোত্র। তারা একযোগে চেষ্টা করে সমগ্র দক্ষিণ আরবের সব পৌত্তলিক গোত্রকে সংঘবদ্ধ করল মহানবীর মদীনার উপর শেষ আঘাত হানার জন্যে। অসুবিধাটা হয়ে দাঁড়াল মক্কায় পার্শ্ববর্তী খোজাআ গোত্র। গোত্রটি মুসলমানদের মিত্র এবং আশ্রিত। হুদায়বিয়ার সন্ধিতে একটা শর্ত ছিল যে আরবের অন্যান্য গোত্র তাদের ইচ্ছা অনুসারে কুরাইশ অথবা মুসলমান যে কোন পক্ষের মিত্র হতে পারে। সেই অনুসারে খোজআর চিরশত্রু বনি বকর কুরাইশদের সাথে যোগ দিলে বনি খোজাআ মুসলমানদের সাথে সন্ধি করে। তাছাড়া এই খোজাআ পূর্ব থেকে বরাবরই মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। কুরাইশ, হাওয়াজেন ও সাকিফ গোত্রত্রয় পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিল, মুখের সামনে থেকে খোজাআদের সরাতে হবে, নির্মূল করতে হবে। এতে হবে দুইটা কাজ। এক, গোটা দক্ষিণ আরব একমুখী হবে এবং হুদায়বিয়া সন্ধি ভঙ্গ হওয়ার ফলে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধের সুযোগ পাওয়া যাবে। বনি খোজাআদের প্রতিবেশী এবং চিরশত্রু বনি বকর গোত্রকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করল কুরাইশরা এবং উত্তেজিত করে তুলল তাদেরকে খোজাআদের বিরুদ্ধে। একদিন রাতে ঘুমন্ত খোজাআ গোত্রের উপর আপতিত হলো বনি বকরের লোকরা। তাদের সাহায্য করতে এল কুরাইশদেরও কিছু লোক। সেদিন রাতে অমানুষিক হত্যাক- অনুষ্ঠিত হলো খোজাআ পল্লীতে। বাঁচার জন্যে কিছু পুরুষ-নারী-শিশু আশ্রয় নিয়েছিল কা’বা ঘরে, যেখানে সকল মানুষ অবধ্য। কিন্তু কা’বায় আশ্রয় নিয়েও বাঁচল না তারা। আক্রমণকারীদের একজন চিৎকার করে বলল, আজ আর ঈশ্বর বলে কেউ নেই, আজ মনের সাধ মিটিয়ে শত্রু বিনাশ কর।
বনি খোজআর এই মর্মান্তিক খবর মদীনায় গিয়ে পৌঁছল। শোকাভিভূত হয়ে পড়লেন মহানবী। একদিকে খোজাআদের হত্যাকাণ্ড, অন্যদিকে কুরাইশদের জঘন্য অপরাধ দুই-ই তাকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করল। খোজাআরা তার মিত্র, আশ্রিত আর কুরাইশরা তার স্বজন। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন মহানবী (সা)। কুরাইশদেরকে তাদের সন্ধি ভঙ্গ ও হত্যাকাণ্ডের শাস্তি অবশ্যই ভোগ করতে হবে। তিনি কুরাইশদেরকে একটা সুযোগ দেয়ার জন্য দূত পাঠালেন মক্কায়। তিনি বলে পাঠালেন, অর্থ দ্বারা অন্যায় হত্যাকাণ্ডের ক্ষতিপূরণ করতে হবে, অথবা বনি বকর গোত্রের সাথে মিত্রতা পরিত্যাগ করতে হবে। কোন একটিকে তাঁদের গ্রহণ করতে হবে। কুরাইশরা সন্ধি ভঙ্গই চাচ্ছিলো। সুতরাং মহানবীর শর্ত পাবার সাথে সাথেই তারা হুদায়বিয়ার সন্ধি ভেঙ্গে গেছে বলে ঘোষণা দিলো। কুরাইশদের আচরণ মহানবী (সা)-কে খুবই ব্যথিত করলো। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মক্কা অভিযানের সিদ্ধান্ত নিলেন। সন্ধি বাতিল করার পর কুরাইশরা বুঝতে পারলো ঝোঁকের মাথায় তারা যে কাজ করেছে, তা ঠিক হয়নি। স্বয়ং আবু সুফিয়ান ছুটলেন মদীানায় বুঝিয়ে মহানবীকে নিবৃত্ত করার জন্যে। আবু সুফিয়ান আবু বকর (রা), উমর (রা), আলী (রা) সহ সকলের দ্বারস্থ হলেন সুপারিশ করার জন্য যে, হুদায়বিয়ার সন্ধি ঠিক আছে, ভেঙ্গে যায়নি। কিন্তু মহানবী কোন কথার প্রতিই কর্ণপাত করলেন না। স্বজনের চেয়ে চুক্তি বড়, ওয়াদা বড়, খোজাআদের প্রতি কৃত অন্যায়ের অবশ্যই প্রতিবিধান করতে হবে। ৮ম হিজরী ১৮ই রমযান দশ হাজার মুসলিম মুজাহিদ নিয়ে মক্কার পথে যাত্রা করলেন মহানবী (সা)।

‘ফাতহুম মুবিনে’র প্রথম বন্দী

‘ফাতহুম মুবিন’ বা মক্কা বিজয়ের মহামুহূর্হটি সমাগত। দশ হাজার মুসলিম সৈন্যে বাহিনী সেদিন গভীর রাতে মক্কার উপকণ্ঠ মাররুজ-জাহরান উপত্যকায় গিয়ে পৌঁছল এবং সেখানেই রাত যাপনের সিদ্ধান্ত নিলো। মক্কার কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান ও আরও কয়েকজন রাতে মক্কার উপকণ্ঠে পৌঁছে গেছে। মাররুজ্-জাহরান উপত্যকায় হাজার আলোর সারি দেখে স্তম্ভিত হলো আবু সুফিয়ান। রহস্য উদ্ধারের জন্যে আবু সুফিয়ানকে অতি সন্তর্পণে এগুলো ঐ উপত্যকার দিকে। হঠাৎ আবু সুফিয়ান বন্দী হয়ে গেলো হযরত উমর (রা)-এর হাতে। হযরত উমর (রা) আরও কয়েকজনকে সাথে নিয়ে পাহারা দিচ্ছিলেন মুসলিম বাহিনীর অগ্রবর্তী দিকটা। হযরত উমর (রা) আবু সুফিয়ানকে মহানবীর সামনে হাজির করে বললেন, সত্যের শত্রুদের সমূলে উৎপাটিত করার শুভমুহূর্ত সমাগত। আবু সুফিয়ান বন্দী। প্রতিশোধ গ্রহণ ও প্রতিফল দানের সময় উপস্থিত। মহানবী (সা) এ প্রসঙ্গে না গিয়ে আবু সুফিয়ানকে সন্বোধন করে বললেন, আবু সুফিয়ান, এখনও তুমি সেই করুণা-নিধান ‘ওয়াহদাহু লা-শারিকালাহু’ কে চিনতে পারোনি? আবু সুফিয়ানের বিমর্ষভাবে আমতা করে বললো, ‘তা, এখন পারছি বৈ কি। আমাদের ঠাকুর কেউ থাকলে আমাদের পানে তাকাতো।’ আবু সুফিয়ানের উত্তরে উৎসাহিত হয়ে মহানবী (সা) আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা আবু সুফিয়ান, আমি যে আল্লাহর প্রেরিত সত্য নবী, এ ব্যাপারে এখনও কি তোমার সন্দেহ আছে?’ আবু সুফিয়ান বললো, ‘এখনও কিছু কিছু সন্দেহ আছে?’ মহানবী (সা) বন্দী আবু সুফিয়ানের কথায় বিন্দুমাত্রও ক্রুদ্ধ হলেন না এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও গ্রহণ কররেন না। শুধুমাত্র মহানবী (সা) আবু সুফিয়ান যখন ফিরে যাবার জন্যে উত্যত হলেন, তখন তাকে আদেশ করলেন সকাল পর্যন্ত থেকে যেতে। মহানবী (সা) রোধ হয় চেয়েছিলেন আবু সুফিয়ান ফিরে গিয়ে গোঁট পাকাবার কোন সুযোগ না পাক।

সেনাপতি সা’আদ পদচ্যুত হলেন

মক্কার উপকণ্ঠে মাররুজ জাহরান ্পত্যাকায় ফজরের নামায পড়ে দশ হাজার সৈন্যের মুসলিম বাহিনী মক্কা প্রবেশের জন্যে যাত্রা শুরু করলেন। বিভিন্ন সেনাপতির অধীনে দলে দলে বিভক্ত হয়ে মুসলিম বাহিনী মক্কা প্রবেশের জন্যে অগ্রসর হচ্ছে। প্রত্যেক সেনাপত বহন করছেন তাঁর দলের পতাকা। তখনও সকাল হয়নি। আবু সুফিয়ান মহানবী (সা)-এর চাচা হযরত আব্বাস (রা)-এর সাথে এক টিলায় বসে তাদের সম্মুখ দিয়ে মক্কার দিকে অগ্রসরমান মুসলিম সেনাদলের শান-শওকত ও শৃংখখলা দেখছিলেন বিস্মিত চোখে। মদীনার আনসার রেজিমেন্ট তখন অগ্রসর হচ্ছিল আবু সুফিয়ানের সম্মুখ দিয়ে। আবু সুফিয়ান চিনতে পারলো না ওদের। জিজ্ঞাসা করল হযরত আব্বাস (রা)-কে, এরা কারা? আব্বাস (রা) বললেন, এটা মদীনার আনাসারদের রেজিমেন্ট। সা’আদ ইবনে উবাদা এদের সেনাপতি। তখন সেনাপতি সা’আদ ইবনে উবাদা একদম সামনে এসে পড়েছিলেন। তিনি আবু সুফিয়ানকে দেখে বললেন, ‘আজ ভীষণ সংঘর্ষের দিন, আজ কা’বার সম্ভ্রম বিনষ্ট হবে।’ শুনে তাঁর জাতির কথা ভেবে আবু সুফিয়ান আর্তনাদ করে উঠলেন। অনুরেধ করতে লাগলেন তিনি হযরত আব্বাসকে কুরইশদের সাহায্য করার জন্যে। আনসারদের পরেই ছিল মুহাজির রেজিমেন্ট। আবু সুফিয়ান দেখলেন, মুহাজির দল যাচ্ছে তার সামনে দিয়ে এবং মহানবী (সা) তাদের সাথে রয়েছেন। দেখেই আবু সুফিয়ান ছুটলেন মহানবীর কাছে। আর্তনাদ করে বললেন, “মুহাম্মাদ, তুমি কি তোমার স্বজনদের হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছে?” মহনাবী (সা) বললেন, ‘না, কখনই না।’ তখন আবু সুফিয়ান সা’আদ ইবনে উবাদার কাছে যা শুনেছিল, বলল মহানবীকে। শুনে মহানবী বললেন, ‘না, সা’আদের কথা সত্য নয়, আজ প্রেম ও করুণার দিন। আজ কা’বার সম্ভ্রম চির প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দিন।’ বলে একজন অশ্বারেহীকে কিছু নির্দেশ দিলেন মহানবী (সা)। সঙ্গে সঙ্গেই অশ্বারোহীটি ছুটল আনাসার রেজিমেন্টের দিকে। সে সেনাপতি সা’আদ ইবনে উবাদার সামনে হাজির হয়ে জানাল যে, আবু সুফিয়ানকে উপরোক্ত উক্তি করার জন্যে তাকে পদচ্যুত করা হয়েছে। সেনাপতি সা’আদ সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর হাতের পতাকা নব নিয়োজিত সেনাপতির হাতে তুলে দিয়ে পেছনে সাধারণ সৈনিকদের কাতারে এসে দাঁড়ালেন। কোন প্রশ্ন বা অসন্তুষ্টির সামান্য চহ্নিও তাঁর চোখে-মুখে ফুটে উঠল না। অশ্বারোহীকে বললেন, ‘আব সুফিয়ান, গিয়ে মক্কাবাসীকে অভয় দাও, আজ তাদের প্রতি কোনই কঠোরতা দেখানো হবে না। তুমি আমর পক্ষ থেকে ঘোষণা করে দা :
(ক) যে ব্যক্তি অস্ত্র ত্যাগ করবে তাকে অভয় দেয়া হলো।
(খ) যে ব্যক্তি কা’বায় প্রবেশ করবে, তারা নিাপদ।
(গ) যারা দরজা বন্ধ করে বাড়ীর ভেতরে অবস্থান করবে তাদের কোন ভয় নেই এবং
(ঘ) যারা আবু সুফিয়ানের গৃহে প্রবেশ করবে, তারাও নিরাপদ। মক্কাবাসীকে অভয়দানের এই চারটি শর্তের ঘোষণা মুসলিম বাহিনীর সব সৈন্য, সব সেনাপতিকে জানিয়ে দেয়া হলো। সেই সাথে মুসলিম বাহিনীকে আদেশ দেয়া হলো, মক্কায় প্রবেশের সময় বা পরে কেউই অস্থ ব্যবহার করতে পারবে না। যারা বার বার মদীনার অভিযান পরিচালনা করেছে মুসলমানদের অস্তিত্ব দুনিয়া থেকে মুছে ফেলার জন্যে, মদীনাকেও ধ্বংস করার জন্যে, তাদের জন্যেই মহানবীর এই ক্ষমা, এই মহানুভবতা। কারণ তিনি রাহমাতুল্লিল আলামীন।

মহানবীর চিঠি পড়ে কেঁদে ফেললেন মানজার

আরব উপদ্বীপের পূর্ব উপকূলে পারস্য উপসাগরের পানির উপর দাঁড়ানো বাহরাইন। বাহরাইনের শাসক তখন মানজার ইবনে ছাভী। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে মহানবী (সা.)-এর একটা চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছল। ইসলামের উত্থান ও এর গতিধারা সম্পর্কে আগে থেকেই খবর রাখছিলেন তিনি। ইয়ামেনের শাসনকর্তা ‘বাজান’-এর খবরও তাঁর কাছে ছিল। পারস্য সম্রাট মহানবী (সা)-কে ধরতে পাঠিয়ে নিজেই ধরাধাম থেকে বিদায় নিলেন, তাও তিনি জানতেন। মহানবীর চিঠি পেয়ে মানজার সঙ্গে সঙ্গেই ইসলাম গ্রহণ করলেন। বাহরাইনের আরব বাসিন্দারাও তাঁর সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করলো না। বাহরাইনের শাসক মানজার ইবনে ছাভী একে ভালোভাবে নিলেন না। শাসক যাকে ভালো মনে করা কঠিন ছিল। মানজারও কিছু প্রজার এই ওদ্ধত্য হজম করতে পারলেন না। তবে মহানবীর হুকুম ছাড়া কিছু না করার সিদ্ধান্ত তিনি নিলেন। প্রয়োজনীয় নির্দেশ লাভের জন্যে মাজার লিখলেন মহানবীর (সা) কাছে। মানজারের সিদ্ধান্ত এবং মহানবীর কাছে তাঁর লিখার বিষয়টা ইহুদী ও অগ্নিপূজকরা জানতে পারলো। তার উদ্বিগ্ন হলো তাদের ভবিষ্যত নিয়ে। যথাসময়ে মহানবী (সা)-এর চিঠি এলো মানজারের কাছে। অত্যন্ত আদবের সাথে চিঠি খুলে পড়তে লাগলেন তিনি :
“ধর্ম সম্বন্ধে কোন জোর-জবরদস্তি করা অধর্ম। যে ব্যক্তি উপদেশ গ্রহণ করে, সে তো কেবল নিজেরই কল্যাণ সাধন করে থাকে। যারা ইহুদী বা পাসিক ধর্মে থাকতে চায়, তাদেরকে যিজিয়া দিতে হবে মাত্র। এর অতিরিক্ত অন্য কোন বিষয়ে তাদের উপর তোমার আর কোন অধিকার থাকবে না।”
চিঠি পড়ে মহানবী (সা)-এর দয়া ও মহানুভবতায় কেঁদে ফেললেন মানজার। কত বড় দয়ার সাগর তিনি? বিধর্মী প্রজাদের পক্ষ হয়ে মানজারকেই তিনি শাসন করেছেন।
এই খবর ইহুদী এবং অগ্নিপূজক প্রজাদেরকেও অভিভুত করলো। এদিন তারা পারস্য সম্রাট ও তাদের কর্মচারীদের অমানুষিক অত্যাচারে একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। এক যিজিয়ার বিনিময়ে সব কর ও যুলুম থেকে রেহাই পেয়ে তারা মহানবী (সা)-এর নামে সকলে জয়ধ্বনি করতে লাগলো। ইসলাম গ্রহনের হার তাদের মধ্যে দ্রুত বেড়ে চললো।

মহানবী আবারও অভয় দিলেন

রাহমাতুল্লিল আলামীন মহানবী সা) রক্তপাত চান না। মক্কা প্রবেশেও তিনি রক্তপাত এড়াতে চাইলেন্
এ লক্ষ্যেই তিনি একটা পাহাড়ের শীর্ষে বসে চারদিকে নজর রাখলেন কোথায় কি ঘটে তা দেখার জন্যে। হাঠাৎ মক্কার এক উপত্যকা-পথে সকালের রোদে উত্তোলিত তরবারির ঝিলিক দেখতে পেলেন মহানবী (সা)। ঐ উপত্যকা পথে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীর একটা দল মক্কায় প্রবেশ করছে। মহানবী (সা) উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি খালিদকে হাজির করার নির্দেশ দিলেন কৈফিলত দেয়ার জন্যে। খালিদ হাজির হলেন। নিবেদন করলেন বিনীতিভাবে, ‘আমি আপনার আদেশ পালনে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কুরাইশদের দলটাকে কোনোভাবেই নিরস্ত্র করা যায়নি। তারা আমাদেরকে আক্রমণ করে এবং দু’জন মুসলিম সৈন্যকে হত্যা করে। তখন বাধ্য হয়ে আমাদেরকেও অস্ত্র বের করতে হয়।’ এই সময় মহানবী (সা) আরও খবর পেলেন, কুরাইশ-প্রধানরা পরামর্শ করে কুরাইশ ও অন্যান্য অনুগত গোত্রের দুর্দান্ত ও গুন্ডা শ্রেণীর বহুসংখ্যক লোকদের বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। ঠিক হয় যে, তারা সুবিধা করতে পারলে সবাই একযোগে মুসলমানদের আক্রমণ করবে। আর যদি তারা ব্যর্থ হয়, তাহলে যে অভয় তারা মহানবীর কাছ থেকে পেয়েছে, তার অধীনে তারা আত্মরক্ষা করবে।
কুরাইশদের অকারণ সৈন্য সমাবেশের মধ্যেও মহানবী এরই প্রমাণ পেলেন। কুরাইশদের এই ষড়যন্ত্র টের পেয়ে মহানবী (সা) আনসার রেজিমেন্টকে সতর্ক থাকতে এবং সকালে ছাফা পর্বতের পাদমূলে সমবেত হতে আদেশ দিলেন। মহানবী (সা) দেখাতে চাইলেন মুসলমানরা প্রস্তুত আছে, অতএব কুরাইশদের কোন ষড়যন্ত্র কাজে আসবে না। কুরাইশরাও শীঘ্র এটা বুঝতে পারলো এবং ষড়যন্ত্র বাদ দিয়ে নিজেদের ভবিষ্যত ভেবে ব্যাকুল হয়ে উঠলো।
আবু সুফিয়ান আবার ছুটলো মহানবীর (সা) কাছে। আর্তনাদ করে আবর সেই আগের মতই বলল, ‘মুহাম্মদ, কুরাইশদের এই দলকে তুমি যদি ধ্বংস কর, তাহলে আজ থেকে কুরাইশদের নাম-নিশানা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’ কুরাইশরা সর্বশেষেও যে অপরাধ করলো তাতেও মহানবী (সা) তাদের জন্যে ভয়াবহ শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারতেন। কিন্তু মহানবী (সা) তো এসেছেন মানুষকে মানুষ বানাবার জন্যে, তাদের শাস্তি দেবার জন্য নয়। মহানবী (সা) আবু সুফিয়ানকে বললেন, যাও, আবার অভয় দিলাম, তোমাদের পুনরায় ক্ষমা করলাম। যা বলেছিলাম সেই অনুসারে কাজ কর গিয়ে।

একমাত্র আল্লাহ্ই আমাদের প্রানের মালিক

মক্কা বিজয়ের পর মহানবী (সা) মক্কাবাসীর জন্যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। এরপরও কিছু পাষন্ড প্রকৃতির মানুষ মহানবী (সা)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র আটলো। এমনই এক মদ্যপ ও পাষন্ড ছিল ফুজালা ইবনে উসার। অপরাধীদের আড্ডাখানা, মদের দোকান আর বেশ্যালয়ই ছিল তার স্থান। জাত-অপরাধী ফুজালা মহানবী (সা)-কে হত্যা করার জন্যে কা’বায় পৌঁছে দেখলো, মহানবী (সা) নিবিষ্ট মনে তাওয়াফ করছেন, আল্লাহর ধ্যান ছাড়া কোনদিকে তাঁর দৃষ্টি নেই। ফুজালা একে তার জন্যে এক মহাসুযোগ বলে মনে করলো। অস্ত্রটা কাপড়ের আড়ালে রেখে অত্যন্ত সন্তর্পণে মহানবীর (সা) দিকে এগুলো ফুজালা।
ফুজালা তখন মহানবীর একেবারে কাছে পৌঁছে গেছে। মহানবী (সা) ফুজালার দিকে তাকালেন।
বললেন, ‘কে, ফুজালা নাকি?‘ অন্তরটা কেঁপে উঠলো ফুজালার। বললো সে, ‘জ্বি, কিছু না। এই আল্লাহ আল্লাহ করছি।’
মহানবী (সা) ফুজালার চোর ধরা পড়ার মতো দুর্দশাকরা অবস্থা দেখে হাসি সম্বরণ করতে পারলেন না। মধুর হেসে তিনি বললেন, ‘বেশ কথা, ফুজালা। সেই আল্লাহর কাছে ক্ষামা প্রার্থনা করো।’ ফুজালা বুঝলো তার গোপন অভিসন্ধি মহানবীর কাছে ধরা পড়ে গেছে। ফুজালা বুঝলো তার গোপন অভিসন্ধি মহানবীর কাছে ধরা পড়ে গেছে। ফুজালার অবস্থা তখন অবর্ণনীয়। ভয়, লজ্জা, অনুতাপে অভিভূত ও বিমূঢ় হয়ে পড়লো সে। বুকের ভেতর তখন তার অসহ্য তোলপাড়। বিমূঢ়, নিশ্চল ফুজালার বুকে মহানবী (সা) তাঁর ডান হাত রাখলেন। ফুজালা স্বয়ং বলেছেন, ‘মহানবীর হাতের স্পর্শ পাওয়ার সাথে সাথে আমার মনের সমস্ত চাঞল্য ও সকল অশান্তি দূর হয়ে গেলো। আমি এক স্বর্গীয় শান্তি ও মহানবীর স্পর্শে ধন্য পবিত্র দেহ ও শুদ্ধ হৃদয় নিয়ে ফুজাল ছুটলেন তার বাড়ীর দিকে। পথে দেখা হলো ফুজালার বড় আদরের, বড় গৌরবের রক্ষিত-সুন্দরীর সাথে। রক্ষিত সুন্দরী বললো, ‘প্রাণেশ্বর ফুজালা, এভাবে কোথায় ছুটছো? এসো আমার কাছে।’
ফুজালা মুহূর্তের জন্যে না দাঁড়িয়ে রক্ষিতার দিকে দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে ছুটতে ছুটতে বলতে লাগলেন, ‘একমাত্র আল্লাহই আমাদের প্রাণের মালিক, তাকেই প্রেম করো, শাস্তি পাবে। আর নয়, আল্লাহ্ ও ইসলাম আমাকে তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।’

বিশ্বজয়ী মানবতা

মক্কার আবু জাহ্ল ইসলামের প্রধানতম বৈরী ছিলো। বদর যুদ্ধে সে নিহত না হওয়া পর্যন্ত মহানবী (সা) ও ইসলামের বিরুদ্ধে অবিরাম শত্রুতা করে গেছে। আবু জাহলের পুত্র ইকরামাও তার পিতার মতই ইসলামের বৈরী ছিলো। বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। এমন কি মহানবী (সা)-এর মক্কা প্রবেশের সময় যখন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। এমন কি মহানবী (সা)-এর মক্কা প্রবেশের সময় যখন কুরাইশদের অস্ত্র হাতে না নেয়ার কথা, তখন ইকরামার নেতৃত্বেই কুরাইশদের একটা দল হত্যা করে দু’জন মুসলিম সৈনিককে।
সেই ইকরামা মক্কা বিজয়ের পর ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন।
মক্কা বিজয়ের পর তখনও মহানবী (সা) মক্কায়। একদিন ইকরামা ইবনে আবু জাহ্ল মহানবীর কাছে এলেন। বললেন অভিমান-ক্ষুব্ধ কণ্ঠে, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, মুসলমানরা আমার পিতাকে গালাগালি দিয়ে থাকে।’ খবরটা মহানবী (সা)-কে খুবই বেদনা দিল। তিনি মুসলমানদের এক সামাবেশে সকলকে সম্বোধন করে বললেন, মৃতদের গালাগালি দিয়ে জীবিতদের যন্ত্রণা দিও না। মৃতরা তাদের কর্মফল নিয়ে চলে গেছে। তাদের গালি দেয়া অনুচিত। উচিত মৃত ব্যক্তিগের জীবনের মন্দ দিকটা বাদ দিয়ে কেবল তাদের ভাল দিকটা আলোচনা করা। ইসলামের এই সভ্যতা, শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে ইসলামের এই মানবতা এবং ইসলামের এই সৌন্দর্যই মানুষের হৃদয় জয়ের মাধ্যমে বিশ্বজয় করেছিল।

‘ফাতহুম মুবিন’

মক্কা নগরী মুক্ত হয়েছে।
কা’বাঘরকে মূর্তিও ও পূজার হাত থেকে মুক্ত করা হয়েছে। মুসলমনরা মুতক্ত আল্লাহর ঘর কা’বায় প্রাণভরে একদিন একরাত তাওয়াফ করেছে। কিন্ত্র নামায তখনও হয়নি, আযান তখনও উত্থিত হয়নি কা’বায় মক্কার আকাশে। মক্কা জয়ের পর কে নামাযের সময় হলে মহানবী (সা) বেলালকে আযান দিতে বললেন। আদেশমাত্র বেলাল কা’বার একটি উচ্চস্থানে উঠে আযান দিতে শুরু করলেন। কত শতাব্দী পর কে জানে মক্কায় এই প্রথম আযান। মক্কার আকাশে-বাতাসে, প্রতিটি পাহাড় এবং পাথওে সে আযান প্রতিধ্বনিত হলো। অভূতপূর্ব আবেগে শিহরিত মুসলমানদের প্রতিটি কণ্ঠ বেলালের প্রথম তাকবির ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গেই একযোগে তাকবির দিয়ে উঠলো। বেলালের আযান এবং সম্মিলিত তাকবির ধ্বনি কিয়ামতকাল পর্যন্ত এক নতুন পৃথিবীর আগমনি সঙ্গীত হিসেবে যেন প্রতিভাত হলো। স্বাধীন সক্কায় প্রথম নামায অনূষ্ঠিত হলো। নামায শেষ হয়েছে। মহানবী (সা) উঠে দাঁড়ালেন। সারিবদ্ধ মুসলমানরা বসে। তাদের সকলের চোখ মহানবীর মুখে নিবদ্ধ। কুরাইশদের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলে সমবেত হয়েছে মহানবী (সা) কি ঘোষণা দেন তা শোনার জন্যে। মহানবী (সা) যুদ্ধকালীন সময়ে তাদের নিরাপত্তা দিয়েছেন, এখন যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পরাজিত মক্কাবাসীদের জন্যে কি ব্যবস্থা তিনি দেন তা শোনার জন্যে তারা উদগ্রীব। তাদের সকলেরই অন্তর কাঁপছে অজানা সব আশংকায়। মক্কার জীবনে মহানবীকে এমন কষ্ট নেই যা তারা দেয়নি। তারপর মদীনা গেলে সেখানেও মক্কাবাসীরা একের পর অভিযান পাঠিয়েছে মহানবীসহ মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্যে। সেই মহানবী আজ বিজয়ী। মক্কাবাসীদের সম্পর্কে তিনি কি ব্যবস্থা নেবেন?
এহনবী (সা) তাঁর ভাষণ শুরু করে বললেন।
জনমন্ডলীকে সম্বোধন করে বললেন তিনি :
“আল্লাহ্র শোকর যিনি নিজের ওয়াদা পূর্ণ করেছেন, যিনি নিজের দাসকে সাহায্য করেছেন এবং একাকী শত্রুদের যিনি পরাভূত করেছেন।”
(১) “সকলে শ্রবণ কর! অন্ধকার যুগের সমস্ত অহংকার-তা অর্থগত হোক আর শোণিতগত হোক-সমস্তই আমার এই যুগল পদতলে দলিত, সথিত ও চিরকালের তরে রহিত হয়ে গেল।
(২) অতঃপর যদি কেউ কোন ব্যক্তিকে ইচ্ছাপূর্বক হত্যা করে, তাহলে সেটা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং সে জন্য তাঁকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত কর হবে। ভ্রমজনিত নরহত্যার জন্য নিহত ব্যাক্তির উত্তরাধিকারীগণকে একশত উষ্ট্র ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা হলো। এটাও তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য হবে।
(৩) ‘হে কুরাইশ জাতি। মূর্খতা যুগের অহামিকা এবং কৌলিন্যের গর্ব আল্লাহ আমারেদর থেকে দূর করে দিয়েছেন। মানুষ সমস্তই আদম হতে আর আদম মাটি হতে তৈরী হয়েছে।‘ সকলে শ্রবণ কর, আল্লাহ বলছেন : ‘হে মানব! আমি তোমাদের সকলকেই (একই উপকরণে) স্ত্রী-পুরুষ হতে সমুৎপন্ন করেছি এবং তোমাদেরকে একমাত্র এই জন্য বিভিন্ন শাখা ও বিভিন্ন শাখা ও বিভিন্ন গোত্রে ((বিভক্ত) করেছি যে, তা দ্বারা তোমরা পরস্পরের নিকট পরিচিতি হতে পারবে (অহংকার ও অত্যাচার করার জন্য নয়)। নিশ্চয় জেনো যে, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অধিক সংযমশীল (পরহেযগার), আল্লাহর নিকট সে-ই অধিক মহৎ। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সর্বদশী।’ সকল মানুষই আদম হতে পয়দা হয়েছে। সুতরাং আদমের সন্তানগণ পরস্পর পরস্পরের ভাই এবং তার সকলেই সমান। এরপর এও বলে দেয়া হচ্ছে যে, আদম মাটি থেকে সৃষ্টি। সুতরাং মানুষকেও মাটির মত সর্বসহ, সর্বপালক ও অহংকারশূন্য হওয়া চাই।
(৪) ‘সকল প্রকার মদ ও মাদক দ্রব্যের ক্রয়-বিক্রয়, মুসলমান-অমুসমান সকলের পক্ষে নিষিদ্ধ।’
এই সাধারণ ঘোষণা দেয়ার পর মহানবী (সা) কুরাইশদের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন। সাধারণভাবে তাদের সকলকে সম্বোধন করে বললেন, ‘হে কুরাইশ জাতি, হে মক্কার অধিবাসীবৃন্দ! তোমাদের প্রতি কেমন ব্যবহার করবো বলে মনে করছো?‘
এহানবী (সা) থামতেই সমাবেশের চারদিক থেকে শতকণ্ঠে উচ্চরিত হলো : “আমরা কল্যাণের আশা করিিছ। হে আমাদের মহিমাময় ভ্রাতা, হে আমাদের মাহমাময় ভ্রাতা, হে আমাদের ভ্রাতুষ্পুত্র, তুমি আজ বিজয়ী। তুমি আজ দন্ডদানে সমর্থ। যদিও আমরা অপরাধ তবু তোমার কাছে সদয় ব্যবহার পাবার প্রত্যাশী।” তাদের কণ্ঠে থামলে মহানবী (সা)গুরু-গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “আজ তোমাদের প্রতি কোনই অভিযোগ নেই। আল্লাহ্ তোমাদের ক্ষমা করুন, তিনি দয়াময়। তোমরা সকলে মুক্ত, সকলে স্বাধীন।”

কত মূল্য মানুষের!

মক্কার আশে-পাশের অনেক বেদুইন গোত্র আগে থেকেই কুরাইশদেও বাড়াবাড়ির কারণে তাদের উপর বিক্ষুব্ধ ছিল এবং সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেছিল মুসলমানদের প্রতি। মুসলমানদের মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে কুরাইশদের দর্প চূর্ণ হবার পর এই বেদুইন গোত্রগুলো ইসলামের আরও কাছাকাছি হয়ে পড়েছিল।
মক্কা বিজয় পরবর্তী তাৎক্ষনিক কাজগুলো সম্পন্ন হবার পর মহানবী (সা) তার সাহাবীদের ছোট ছোট বিভক্ত করে পাঠালেন বেদুইন গোত্রগুলোর কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাবার জন্যে। অস্ত্র ব্যবহার ও যুদ্ধ করার অনুমতি এই দলগুলোর প্রতি ছিল না।
হঠাৎ মহানবী (সা)-এর কাছে খবর এল যে, বনি যাজিমা গোত্রের কয়েকজনকে খালিদ বিন ওয়ালিদের দল হত্যা করে ফেলেছে।
এই খবর শোনামাত্র মহানবী (সা) ব্যাকুলভাবে উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি জান, খালিদের এই কাজের সাথে আমার বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই।’ সংগে সংগেই মহানবী (সা) বিষয়টার তদন্ত করলেন। তদন্তে পরিষ্কার হলো যে, আবদুল্লাহ ইবনে হুজাইফার বলার দোষে হোত, অথবা নিজের শুনার ভুলের কারণে হোক, খালিদ একটা ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে ঐ অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন।
বনি যাজিমার লোকরাও জেনে আনন্দিত হলো যে, খালিদের কাজের সাথে মহানবীর (সা) কোন প্রকার সম্বন্ধ বা সহানুভূতি নেই। তারা আরও বুজতে পারলো যে, খালিদ ভুলক্রমেই যুদ্ধাদেশ প্রদান করেছিলেন।
এসব জেনে বনি যাজিমার লোকরা আশ্বস্ত হলো এবং তাদের মনের বিরূপতাও মিটে গেল।
ওদিকে তদন্ত শেষে মহানবী (সা) হযরত আলী (রা)-কে প্রচুর অর্থসহ বনি যাজিমার কাছে প্রেরণ করলেন তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্যে।
বনি যাজিমার লোকেরা দারুণ বিস্মিত হলো ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্যে হযরত আলীকে আসতে দেখে। যেহেতু হত্যাকান্ড ইচ্ছাকৃত নয়, ভুলক্রমে তা সংঘটিত হয়েছে, তাই ক্ষতিপূরণ নেবার কোন চিন্তাও তাদের মনে উদয় হয়নি।
হযরত আলী (রা) মহানবী (সা)-এর প্রতিনিধি হিসেবে বনি যাজিমার ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করলেন। নিয়ম অনুয়ায়ী রক্তপণ বাবদ যে অর্থ বনি যাজিমা’র প্রাপ্য হতে পারে, তার চেয়ে অনেক বেশী অর্থ হযরত আলী তাদের দিলেন। বনি যাজিমা’র কাঞেছ এ এক অকল্পনীয় দৃশ্য, অভাবনীয় এক ঘটনা। যারা আজ বিজয়ী সেই শক্তি তাদের মত এক ক্ষুদ্র গোত্রের কাছে অপরাধ না হওয়া সত্ত্বেও অপরাধ স্বীকার করে এবাবে তার ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। বনি যাজিমা পল্লীতে তখন জয়-জয়কার পড়ে গেল মহানবী (সা) এবং ইসলামের নামে।
ওদিকে মহানবীর কাছে হযরত আলী যখন ফিরে গেলেন ক্ষতিপূরণ শেষে এবং বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, ওদের যা প্রাপ্য তার চেয়ে ওদের বেশী দিয়ে ফেলেছি। মহানবী আনন্দিত কণ্ঠে বললেন, ‘ভাল করেছে, বেশ করেছে।’
তারপর মহানবী (সা) তার দুই হাত উপরে তুলে উচ্চকণ্ঠে আবার বললেন, ‘আল্লাহ, তুমি জান। খালিদের কাজের সাথে আমার কোন সম্বন্ধ নেই, আমি নিরাপরাধ।’


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি