‘আমরা কাউকে রাজস্ব দেবার মত অবনত হতে পারিনা’
সমগ্র আরব উপদিপের বাছাই করা সৈনিকদল এক যোগে পঙ্গপালের মত ছুটে আসছে মদীনা মনোয়ারার দিকে। ওরা চারদিক থেকে একসাথে মদীনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষুদ্র ইসলামী সক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়।
মদীনা অক্ষার জন্য তিন হাজার মুসলমান মহানবীর (সা) নেতৃত্বে মদীনা শহর ঘিরে খন্দক কাটছে। শত্রুরা ছুটে আসছে। হাতে সময় নেই। নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিজনকে দীর্ঘ ৫ গজ গভীর খন্দক খনন করতে হবে। শীতকাল। বরফজমা ঠান্ডা রাতেও তাই অবিরাম কাজ চলছে। তিনদিন থেকে খাওয়া নেই। পেট পিঠে লেগে গেছে। ক্লান্ত-শ্রান্ত সবাই। কিন্তু মুখে তাদের প্রশান্ত হাসি। ছোখ থেকে তাদের ভক্তি ও আনুগত্যের পবিত্র জ্যোতি যেন ঠিকরে পড়ছে। ভক্তি গদ গদ কন্ঠে তারা গাইছে,
“আমরা সেই দল যারা মুহাম্মাদের (সা) হাতে শপথ গ্রহন করেছে জিহাদের, যতক্ষন তারা জীবিত থাকবে।”
মহানবীও (সা) খন্দক কাটছেন। তাঁর পেটও পিঠে লাগা। পাথর বাঁধা পেটে। ভক্ত সাহাবীরা তাঁ সাহায্য করতে চাইছেন। তিনি প্রশান্ত হাসিতে ফিরিয়ে দিচ্ছেন তাদেরঃ তোমরা তোমাদের দায়িত্ব পালন করগে।
তিন হাজার সাহাবীর অবিরাম শ্রমে ২০ দিনে খন্দক কাটা শেষ হলো। শত্রুরা এসে গেছে। অশান্ত, আদিগন্ত সাগর উর্মির মতো তারা এসে ঘিরে ফেলল মদীনাকে। মদীনার ছান-আ পর্বতকে পেছনে আর খন্দককে সামনে রেখে সৈন্য সমাবেশ করলেন মহানবী (সা)।
সমগ্র আরব বাহিনী তিনটি বাহিনীতে বিভক্ত হয়ে মদীনা বেষ্টন করল। উমাইয়া ইবন হিছন ফুজারীর নেতৃত্বে গাতফান বাহিনী, তুলাইহার নেতৃত্বে আসাদ বাহিনী এবং আবু সুফিয়ান ইবন হারবের নেতৃত্বে অবশিষ্ট বাহিনী।
অবরধ চলছে দিনের পর দিন ধরে। মদীনার তিন দিক ঘিরে দাঁড়ানো আরব বাহিনীর তর্জন গর্জনে মদীনার ভূমিও যেন কাঁপছে। স্বয়ং আল্লাহ এ সময়কার দৃশ্য সম্পর্কে বলেছেনঃ “উপর নীচ সব দিক থেকেই শত্রু যখন তোমাদের উপর আপতিত হলো, যা দেখে তোমাদের চক্ষু স্থির হয়ে গেল, ত্রাসে যখন প্রান ওষ্ঠাগত হবার উপক্রম হলো, আর তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের ধারণা করতে লাগলে, তখন মুসলমানদের উপর কঠিন পরীক্ষার সময় এল এবং তাদেরকে সাংঘাতিক রকমের একটি দোদুল্যমান অবস্থায় ফেলে দেওয়া হলো।”(সুরা আল-আহযাব)
অবরোধের তিব্রতা এবং শত্রু বাহিনীর জৌলুস ও আষ্ফালন দেখে মহানবীও (সা) চিন্তিত হয়ে পড়লেন। চিন্তিত হলেন এই ভেবে, যদি মদীনার আনসারদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। যদি তারা হতাশ হয়ে পড়ে। মহানবী (সা) এই চরম সংকট মুহূর্তে তাই আনসাদের সর্দার হযরত সা’দ ইবন উবাদা এবং সা’দ ইবন মুয়াযকে ডাকলেন। ডেকে তাদের মতামতের জন্য বললেন, “মদীনার উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ দেবার প্রতিশ্রুতি করে আমরা গাতফান বাহিনীকে আরব বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারি।” আনসার সর্দারদ্বয় শান্তভাবে মহানবীর (সা) প্রস্তাব শুনলেন। শুনে ধীর কণ্ঠে আরয করলেন, “এটা যদি আল্লাহর হুকুম হয়, তাহলে অস্বীকার করার উপায় নেই। আর যদি রায় বা ব্যক্তিগত অভিমত হয় তাহলে আমাদের নিবেদনঃ ইসলাম আমাদেরকে যে মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে, তা নিয়ে আমরা কাউকে রাজস্ব দেবার মত অবনত হতে পারি না।”
মহানবী (সা) আশস্ত হলেন। নিশ্চিত হলেন। এই উন্নত শির বাহিনীর কাছে শত্রু পক্ষের বিশাল শক্তি বুদ্বুদের মত মিশে যাবে।

খন্দকের এক শহীদ
খন্দক যুদ্ধ তখন শুরু হয়ে গেছে। মদীনা আউস গোত্রাধিপতি সা'দ ইবন মায়াজ যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হয়ে রণাঙ্গনে যাচ্ছেন। বনু হারেসার দুর্গের পাশ দিয়ে যাবার সময় দুর্গের উপরে উপবিষ্ট সা'দের মা বললেন, "বাছা, তুমি তো পিছনে পড়ে গেছ, যাও তাড়াতাড়ি।"
যুদ্ধকালে মারাত্নকভাবে তীরবিদ্ধ হলেন মায়াজ। যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হলোনা। মহানবী (সা) তাঁকে তাড়াতাড়ি মসজিদের সন্নিকটবর্তী এক তাঁবুতে নিয়ে এলেন। মায়াজ আর যুদ্ধে যেতে পারলেন না। তাঁর অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে লাগলো। কিন্তু নিজের দিকে তাঁর কোন খেয়াল নেই, তাঁর বড় চিন্তা, ইসলামের শত্রুর বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করতে পারছেন না। আর একটি চিন্তা তার মনকে আকুল করে তুলছিল, তিনি যদি এ আঘাতে মারাই যান, তাহলে ইসলাম বৈরী কুরাইশদের চরম শিক্ষা দেয়ার ঘোরতর যুদ্ধগুলোতে তিনি আর শরীক থাকতে পারবেন না। মায়াজ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানালেন, "হে আল্লাহ, কুরাইশদের সাথে যদি যুদ্ধ অবশিষ্ট থাকে তাহলে আমাকে জীবিত রাখুন। তাদের সাথে যুদ্ধ করতে আমার খুব সাধ জাগে, কারণ তারা আপনার রাসূলকে কষ্ট দিয়েছে, তাঁর প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছে এবং মক্কা থেকে বহিষ্কার করে দিয়েছে। আর যদি কোন যুদ্ধ না থাকে, তবে এ আঘাতেই যেন আমার শাহাদাত লাভ হয়।" খন্দক যুদ্ধের পর কুরাইশদের সাথে প্রকৃত অর্থে আর কোন যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। মক্কা বিজয়ের সময় ছোট খাট সংঘর্ষ ছাড়া বড় রকমের কোন যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি।
খন্দক যুদ্ধ শেষ হলো, হযরত মায়াজ আর সেরে উঠলেন না। শাহাদাতের দিকে তিনি এগিয়ে চললেন। মসজিদে নববীর তাঁবুতেই তখনও তিনি থাকেন। শাহাদাতের পরম মুহূর্ত একদিন ঘনিয়ে এল তাঁর। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন হযরত মায়াজ। সংবাদ পেয়ে মহানবী (সা) ছুটে এসে মায়াজের মাথা কোলে তুলে নিলেন। সৌম্য শান্ত, পরম ধৈর্যের প্রতীক আবু বকর (রা) তাঁর মৃতদেহের পেশে এসে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, "আমার কোমর ভেংগে গেছে।" মহানবী (সা) আবু বকরকে (রা) সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, "এরূপ কথা বলা চলে না, আবু বকর।" সিংহ হৃদয় হযরত উমার (রা) মায়াজের পাশে বসে অঝোরে কাঁদছিলেন। সংবাদ শুনে মায়াজের মা ছুটে এলেন। তাঁর চোখে অশ্রু, কিন্তু মুখে তিনি বললেন, "বীরত্ব, ধৈর্য ও দৃঢ়তার মধ্য দিয়ে সা'দ সৌভাগ্যশালী হয়েছে।"

উমার ইবনে ইয়াসিরের নামায
নবী (সা) কোন এক যুদ্ধ থেকে ফিরছিলেন। এক পাহাড়ী এলাকায় এসে সন্ধ্যা হলো। পাহাড়ের এই উপত্যকায় রাত্রি কাটাবেন বলে তিনি মনস্থ করলেন। তিনি পাহাড় থেকে কিঞ্চিত দূরে সমতল উপত্যকায় তাঁবু খাটাতে নির্দেশ দিলেন।
রাত্রিবাসের সব ব্যবস্থা সম্পন্ন হলে তিনি সাহাবাদের জিজ্ঞেস করলেন, "কাফিলা ও সৈন্যদলের পাহারায় আজ কাদের রাখা যাবে?"অমনি একজন মুহাজির ও একজন আনসার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, "এ দায়িত্ব আজকের রাতের জন্য আমাদের দিন।" মহানবী(সা) তাতক্ষণাৎ সন্তুষ্টচিত্তে তাদের আবেদন মঞ্জুর করলেন। তিনি তাদের নির্দেশ দিলেন, “পাহাড়ের ঐ এলাকা দিয়ে শত্রু আসবার ভয় আছে, ঐখানে গিয়ে তোমরা দুজন পাহাড়া দাও।”
মুহাজিরের নাম ছিল আবদুল্লাহ ইবন বাশার আর আনসার ব্যক্তির নাম ছিল উমার ইবন ইয়াসির। মহানবী (সা) এর নির্দেশ মোতাবিক তাঁরা দুজন পাহাড়ের নির্দিষ্ট জায়গায় চলে গেলেন। আতঃপর আনসার মুহাজির ব্যক্তিকে বললেন, “আমরা এক সংগে না জেগে বরং পালা করে পাহাড়া দিই। রাতকে দু’ভাগ করে একাংশে তুমি জাগবে অপর অংশে জাগব আমি। এতে করে দু’জন এক সংগে ঘুমিয়ে পড়ার ভয় থাকবে না।”
এই চুক্তি অনুসারে রাতের প্রথম অংশের জন্য মুহাজির আব্দুল্লাহ ইবন বাশার ঘুমালেন। আর পাহাড়ায় বসলেন আনসার উমার ইবন ইয়াসির। পাশে আব্দুল্লাহ ঘুমোচ্ছেন। ইয়াসির বসেছিলেন পাহাড়ায়। শুধু শুধু বসে বসে আর কাহাতক সময় কাটানো যায়। অলসভাবে সময় কাটাতে ভাল লাগছিলনা তাঁর। কাজেই অযু করে নামাযে দাঁড়ালেন। এমন সময় পাহাড়ের ওপাশ থেকে আসা শত্রুদের একজনের নজরে পড়ে গেলেন তিনি। এক ব্যক্তিকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আর কেউ আছে কিনা তা পরখ ক্করার জন্য আনসারকে লক্ষ্য করে সে তীর ছুড়লো। পরপর দু’টি তীর গিয়ে তাঁর পাশে পড়ল। কিন্তু আনসার অচল আটল ভ্রুক্ষেপহীন। তৃতীয় তীর গিয়ে ইয়াসিরের পায়ে বিদ্ধ হলো। ইয়াসির তবু অচঞ্চল। এই ভাবে পরপর কয়েকটি তীর এসে তাঁর পায়ে বিঁধল। ইয়াসির তীর গুলো গাঁ থেকে খুলে ফেলে রুকু-সিজদাসহ নামায শেষ করলেন। নামায শেষ করে ইয়াসির আবদুল্লাহকে ডেকে তুললেন। আব্দুল্লাহ তারাতারি উঠে দাঁড়ালেন। দূরে পাহাড়ের এ পাশে দাঁড়ানো শত্রু একজনের স্থলে দুজনকে দেখে মনে করলো, নিশ্চয় আরও লোক পাহাড়ায় আছে। এই ভেবে আর সামনে বাড়তে সাহস পেলো না। পালিয়ে গেল। আব্দুল্লাহ জেগে উঠে ইয়াসিরের রক্তাক্ত দেহের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কেন তুমি আমাকে আগেই জাগাওনি?”
আনসার উমার ইবন ইয়াসির বললেন, “আমি নামাযে সূরা কাহাফ পড়ছিলাম। সুরাটা শেষ না করে রুকু দিতে মন চাইছিল না। কিন্তু ভাবলাম, তীর খেয়ে যদি মরে যাই, তাহলে মহানবীর (সা) এর দায়িত্ব পালন করা হবে না। তাই তাড়াতাড়ি রুকু সিজদা করে নামায শেষ করেছি। এ ভয় যদি না থাকত তাহলে মরে গেলেও সূরাটি খতম না করে আমি রুকুতে যেতাম না।”

বাবলা তলার শপথ
৬ষ্ঠ হিজরীর জিল্কদ মাস। হজ্জযাত্রার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে আরবের দিকে দিকে। এই মাস থেকে আগামী তিন মাস মক্কাভূতে যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধ থাকবে, ভুলে থাকবে মানুষ তাদের দ্বেষ-দ্বন্দের কথা। এই উপলক্ষে মহানবী (সা) মক্কায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ঘোষনা করে দিলেন তাঁর সিদ্ধান্তের কথা। আনন্দ আর উৎসাহের বন্যা বয়ে গেল মদীনায়।
নির্দিষ্ট দিন এলো। যাত্রা করলেন মহানবী (সা)। তিনি তাঁর প্রিয় উট কাসওয়ার পিঠে সমাসীন। সাথে চৌদ্দশ’ সাহাবা। যোদ্ধা নয়, তীর্থযাত্রীর বেশ তাদের। সঙ্গে কুরবানির ৭০টি উট। ছয় বছর আগে মদীনায় প্রবেশ করার পর এই প্রথম তিনি যাত্রা করলেন মক্কার উদ্দেশ্যে কাবা’র পথে।
তিনি মক্কার সন্নিকটবর্তী ‘আসফান’ নামক স্থানে পৌঁছে শুনতে পেলেন, কুরাইশরা যুদ্ধের জন্য এগিয়ে আসছে। কিন্তু মহানবী (সা) তো কোন যুদ্ধের জন্য আসেননি। তিনি সোজাসুজি কুরাইশদের সম্মুক্ষিন না হয়ে অন্য পথ ধরে মক্কার এক মঞ্জিলদূরে হুদাইবিয়া নামক গ্রামে উপস্থিত। স্থানীয় ‘খোজা’ গোত্রের দল নেতা বুদাইলের কাছ থেকে তিনি জানতে পারলেন যে, কুরাইশরা তাঁকে কিছুতেই মক্কা প্রবেশ করতে দিবেনা। প্রয়োজন হলে যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত তারা। মহানবী (সা) বুদাইলকে মক্কায় পাঠিয়ে কুরাইশদেরকে তাঁর শান্তি কামিতা ও আগমনের উদ্দেশ্যে কথা জানালেন। কিন্তু ফল কিছুই হলোনা। মুসল্মান্দের পর্যবেক্ষণের জন্য ‘ওবওয়া’ ও “বেদওয়া” গোত্রের দলনেতাসহ কয়েক ব্যক্তি হুদাইবিয়া গ্রামে এলো। তারাও গিয়ে মহানবীর (সা) সদিচ্ছা সম্পর্কে কুরাইশদেরকে অবহিত করল। কিন্তু তাদের গোঁ দূর হলোনা। মহানবী (সা) তাঁর সদিচ্ছার নিদর্শন হিসেবে তার প্রিয় উট কাসোয়ার পিঠে খিরাশ নামক সাহাবীকে মক্কায় পাঠালেন। কিন্তু তাঁর এ শুভেচ্ছার তারা জবাব দিল মহানবী (সা) উটের ক্ষতি সাধন করে। আর কয়েকটি গোত্রের হস্তক্ষেপে ‘খিরাশ’ কোন রকম প্রাণ নিয়ে ফিরে এলেন হুদাইবিয়ায়।
অবশেষে মহানবী (সা) হযরত উসমানকে কুরাইশদের সাথে কথা বলার জন্য মক্কায় পাঠালেন। আলোচনার ফলাফল জানার জন্য মুসলমানরা হযরত উসমানের আগমণ পথের দিকে চেয়ে রইলেন-গড়িয়ে গেল ঘন্টার পর ঘন্টা। কিন্তু হযরত উসমানের দেখা নেই-দিগন্ত বিস্তৃত শূণ্য মরুপথ নির্জন পড়ে আছে সামনে। উদ্বেগ ও আশংকা ছড়িয়ে পড়ল গোটা কাফিলায়। এমন সময় খবর এলঃ হযরত উসমান নিহত হয়েছেন।
শোকের বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল প্রতিটি মুসল্মানের হৃদয়তন্ত্রীতে। বিশিষ্ট সাহাবী মহানবীর (সা) জামাতা, ইসলামের আতন্ত্র সৈনিক হজরত উসমানের শোকে মুহ্যমান মুসলমানদের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গেলঃ এ তো উসমানের হত্যা নয়- সত্যের হত্যা। সত্য ও মিথ্যার চিরন্তন বিরোধেরই এ একটা আংশিক প্রকাশ মাত্র। কেন তারা এ আঘাতকে নীরবে সহ্য করে যাবে? উত্তেজনা ও শপথের দৃপ্ত হয়ে উঠলো প্রতিটি মুসলমান।
মহানবীর (সা) দৃঢ় কণ্ঠ ধ্বনিত হলঃ “আমাদের অবশ্যই উসমানের রক্তের বদলা নিতে হবে।” মহানবীর (সা) এ উক্তি হুদাইবিয়ার উপস্থিত ১৪০০ বিশ্বাসীর হহৃদয়কে আত্মোৎসর্গের প্রেরণায় আকুল করে তুলল।
মহানবী (সা) একটি বাবলা গাছের নীচে গিয়ে বসলেন। দৃপ্ত শপথে দৃঢ় ১৪০০ সৈনিক একে একে মহানবীর (সা) হাতা হাত রেখে শপথ নিলেন, “হযরত উসমান হত্যার বদলা আমরা নেব। আমরা মরে যাব, তবু লড়াইয়ের মাঠ থেকে পিছু হটব না।”
শত্রু দেশে শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় ১৪০০ মুজাহিদ। যুদ্ধের কোন অস্ত্রশস্ত্রই তাঁদের কাছে নেই, আছে শুধু আত্মরক্ষার জন্য একটি করে তরবারি। তবু শত্রুর মুকাবিলা ও অন্যায়ের প্রতিকারেরই শপথ নিলেন তাঁরা। তাঁদের এ শপথের নির্ভরতা ছিল অস্ত্রের উপর নয়-ঈমানের উপর, ঈমানী শক্তির উপর। আর ঈমানের শক্তি অস্ত্র বলের চাইতে বহুগুণে শক্তিশালী, বাবলা গাছের সেই শপথ তা ক্ষণকাল পরেই প্রমাণ করে দিল। প্রমান করে দিল, অন্যায়ের প্রতিরোধ আর ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় মুসলমানরা যদি আত্মোৎসর্গিত হয়, তাহলে আল্লাহর সাহায্য কত দ্রুত নেমে আসে।
মুসলমানদের শপথের কথা যথা সময়ে মক্কায় পৌঁছল।কুরাইশ বিবেক এবার চঞ্চল হয়ে উঠল। মুসলমানদের প্রয়োজনীয় যুদ্ধাস্ত্র না থাকলেও এবং তারা নগণ্য সংখ্যক হলেও তাদের ভীষন শপথের কথা কুরাইশদের ভীত করে তুলল। তারা মুসলমানদের শৌর্চ-বীর্য দেখেছে। জেনেছে তারা মুসলমানরা না মেরে মারা যায় না। সুতরাং তারা তাদের ভুল সংশোধন করল। বন্দীদশা থেকে ছেরে দিল উসমানকে। তার সাথে সাথে বাড়িয়ে দিল সন্ধির হাত মুসলমানদের কাছে। মহাসবীর (সা) সাথে হুদাইবিয়া গ্রামে এসে সাক্ষাত করল কুরাইশ প্রতিনিধিরা।
বারবার প্রতিনিধি প্রেরণ এবং পুনঃপুনঃ অনুরোধ কুরাইশদের যে যুদ্ধতৃষ্ণা মেটাতে পারেনি, পারেনি তাদের যে বিবেক বোধ জাগ্রত করতে, ঈমান দীপ্ত বাবলাতলার শপথ তা সম্ভব করে দিল।

নীতিই উর্ধে স্থান পেলো
মক্কার কিছু দূরে হুদাইবিয়া গ্রাম। বিরাট এক বৈঠক বসেছে। বৈঠকে রয়েছেন মহানবী (সা) এবং উল্লেখযোগ্য সব সাহাবি। মুশরিক কুরাইশদের পক্ষ থেকে রয়েছে কয়েকজন প্রভাবশালী সরদার। হুদাইবিয়ার শর্তাবলী চুড়ান্ত হয়েছে। কিন্তু তখনও লিখা শুরু হয়নি। এমন সময় মক্কা থেকে আবু জান্দাল এসে সেখানে হাজির হলো। তার হাতে পায়ে শিকল। সারা গায়ে তার নির্যাতনের চিহ্ন। মুসলমান হওয়ার অপ্রাধে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল। পুনরায় পৌত্তলিক ধর্মে তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য তার আত্মীয়-স্বজন তার উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে। কতদিন আর নির্যাতন সইবে সে। মুক্তির আশায় সে পাগল হয়ে উঠেছিল। এই সময় সে জানতে পারে, মহানবীর (সা) তাঁর চৌদ্দশ’ সাহাবাসহ হুদাইবিয়া পর্যন্ত এসে যাত্রা বিরতি করেছেন। অনেক আশা তার মনে, একবার কোন ক্রমে যদি মহানবীর (সা) কাছে গিয়ে সে পৌঁছতে পারে, তাহলেই তার জীবনে এসে যাবে চির মুক্তির সুবহে সাদিক। আবু জান্দাল হুদাইবিয়ার সে বৈঠকে হাজির হয়ে মহানবীকে (সা) তার সব কথা জানিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করলো। আবু জান্দালের নির্যাতনের কাহিনী শুনে উপস্থিত মুসলমানদের মনে বেদনার তরংগ বয়ে গেল।
আবু জান্দাল হুদাইবিয়ার বৈঠকে পৌঁছার পর পরই আবু জান্দালের পিতা সুহাইল তার মুখে কয়েক্তি চপোটঘাত করল এবং আবু জান্দাল্কে তার হাতে ফিরিয়ে দেবার জন্য মহানবীর (সা) কাছে দাবী জানাল। সে বলল, ‘হুদাইবিয়া সন্ধির শর্তানুসারে আবু জান্দালকে আপনারা রাখতে পারেন না। তাকে আপনারা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য।’ (হুদাইবিয়ার সন্ধির একতি শর্ত ছিল, মক্কার কোন লোক মুসলমান হয়ে কিংবা অন্যভাবে মুসলমানদের আশ্রয়ে গেলে তাকে মক্কাবাসীদের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে)।
সুহাইলের কথা শুনে মহানবী (সা) বললেন, ‘সন্ধি এখন লিখিত হয়নি, স্বাক্ষর তো হয়ইনি। সুতরাং এর শর্ত এই মূহূর্তে মেনে নেয়া কি খুবই জরুরী?’
সুহাইল কিন্তু নাছোড় বান্দা। সে বলল, ‘সন্ধি লিখিত ও স্বাক্ষরিত না হলেও কথা তো পাকাপাকি হয়ে গেছে। সুতরাং আবু জান্দালকে আমি অবশ্যই ফিরে পাব।’
মহানবী (সা) সুহাইলের কথার জবাব দিলেন না। সুহাইলের কথা যে অমূলক নয়, তা তিনি জানেন। যা উভয় পক্ষে স্বীকৃত ও নির্দিষ্ট হয়ে গেছে, তা অস্বীকার করা যায় না। চিন্তিত হলেন তিনি। মহানবীকে (সা) নীরব থাকতে দেখে মুসলমানরাও আশংকিত হয়ে পড়লেন। কি জানি, তাদের এক ভাইকে নাকি আবার কাফিরদের হাতে ফিরিয়ে দিতে হয়। মহানবী (সা) আত্যন্ত নরম ভাষায় আবু জান্দালকে ফেরত না চাইবার জন্য সুহাইলকে অনুরোধ জানালেন। কিন্তু মহানবীর (সা) বিনীত প্রার্থনাতেও সুহাইলের মন গলল না।
মহানবীর (সা) সামনে তখন উভয় সংকট। একদিকে সন্ধির শর্ত রক্ষা, অন্যদিকে একজন মুসলমানকে কাফিরদের হাতে ফেরত না দেয়া। সন্ধির শর্ত যেহেতু আগেই নির্ধারিত হয়েছে, তাই সন্ধির শর্ত পালনই তাঁর কাছে বড় হয়ে উঠল। আবু জান্দাল যখন বুঝল যে, তাকে পুনরায় কাফিরদের হাতে ফিড়িয়ে দেয়া হবে, তখন সে করুণ ভাবে কেঁদে উঠল। বলল, “আমি মুসলমান হয়ে আপনাদের কাছে আশ্রয় নিলাম। আর আপনারা আমাকে ফির্যে দিচ্ছেন। কত অত্যাচার, কত যন্ত্রনা যে আমাকে ভোগ করতে হয়, তাতো আপনারা জানেন না।”
আবু জান্দালের কথা শুনে উপস্থিত প্রতিটি মুসলমানদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। মন তাদের বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চায়, না আমাদের ভাইকে আমরা ফিরিয়ে দেবনা। দরকার হলে, তাকে রক্ষার জন্য যে কোন পরিস্থির মোকাবিলা করব। কিন্তু মহানবীর (সা) সৌম্য শান্ত ভাবনার গভীরে নিমজ্জিত মুখের দিকে চেয়ে তারা কিছুই বলতে পারলেন না।
ব্যথা-বেদনার রাজপথ বেয়ে আবু জান্দাল্কে বিদায় দেবার সময় মহানবী (সা) তাকে সান্তনা দিয়ে বললেন, “আবু জান্দাল, আল্লাহর নামে ধৈর্য ধর, আল্লাহই তোমার মুক্তির ব্যবশ্তা করে দেবেন।” চোখ মুছে আবু জান্দাল আবার ফিরে চলল মক্কায়। ন্যায়-বিচার ও স্বীকৃত নীতিবোধকে এ ভাবেই মুসলমানরা সব সময় সবার উর্ধে স্থান দিয়েছেন।

পরাজিত হুনাইনের বিজয়ের ডাকঃ হে বৃক্ষতলে শপথকারীগণ
মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী হুমাইমের পার্বত্য অঞ্চল আওতাস। আরবের বিখ্যাত হাওয়াযেন ও সাকিফ গোত্র তাদের অন্যান্য মিত্রসহ বিরাট এক বাহিনী নিয়ে সেখানে এসে শিবির গেড়েছে। তারা চায়, মক্কা জয়ী ইসলামী শক্তির উপরে শেষ এবং চূড়ান্ত আঘাত হানতে। তারা সাথে করে নিয়ে এসেছে তাদের নারী, শিশু এবং বৃদ্ধদেরকেও। উদ্দেশ্য, এদের বিপদ ও ভবিষ্যত চিন্তা করে যাতে কেউ যুদ্ধের ময়দান পরিত্যাগ না করে। হাওয়াযেন ও সাকিফ গোত্রের বিখ্যাত তিরন্দাজরা গিরিপথ ও গিরিখাতগুলোতে গোপন অবস্থান গ্রহন করেছে।
অষ্টম হিজরী। শাওয়াল মাস। মহানবীর (সা) নেতৃত্বে ১২ হাজার সৈন্যের মুস্লিম বাহিনী হাওয়াযেন ও সাকিফ বাহিনীর মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। মহানবীর নেতৃত্ব দিলেন। মুসলিম বাহিনীতে সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী নও মুস্লিম ছাড়াও প্রায় দু'হাজারের মত এমন লোক শামিল ছিল যারা তখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি। বিশেষ করে মুসলিম সৈন্যদলের অগ্রবর্তী বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন খালিদ ইবন ওয়ালিদ। তাঁর অধীনের অধিকাংশই ছিল অতিমাত্রায় উৎসাহী নব্য দীক্ষিত তরুণের দল। সুসজ্জিত ও বিশাল মুসলিম বাহিনীর মনে সেদিন এমন একটি ভাবের সৃষ্টি হলোঃ 'আজ আমাদের সাথে যুদ্ধে জয়ী হয় এমন সাধ্য কার?'
যুদ্ধ শুরু হলো। হাওয়াযেনদের তীর বৃষ্টি গোটা প্রান্তরকে ছেয়ে ফেলল। অগ্রবর্তী বাহিনীতে বিশৃংখলা সংক্রামক আকারে ছড়িয়ে পড়ল গোটা বাহিনীতে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সবাই ছুটে পালাতে লাগল। সমগ্র যুদ্ধের ময়দানে শুধু এক ব্যক্তি তাঁর জায়গায় স্থির ও অটল ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি মহানবী (সা)। ময়দানের এক প্রান্তে তখন হযরত উমার (রা)। তলোয়ার থেকে একজন কাফিরের রক্ত মুছতে মুছতে আবু কাতাদাহ (রা) তাঁর সমীপবর্তী হয়ে বললেন, "মুসলমানদের অবস্থা কি?" সিংহ হৃদয় হযরত উমার (রা) অবনত মুখে শান্ত কন্ঠে বললেন, "এটাই আল্লাহর ফয়সালা ছিল।"
বৃষ্টির অবিরাম ধারার মত তীর ছিটে আসছে। এই তীরবৃষ্টির মধ্যে যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে আছেন মহানবী (সা)। তিনি চারদিকে চোখ ফিরিয়ে দেখলেনঃ শূণ্য মাঠ, কেউ কোথাও নেই। তিনি ধীরে ধীরে দক্ষিন দিকে চোখ ফিরালেন। তাঁর দরাজকন্ঠে ধ্বনিত হলোঃ ‘হে আনসারবৃন্দ!’ সঙ্গে সঙ্গে সে শূণ্য প্রান্তর পেরিয়ে উত্তর এলঃ ‘আমরা উপস্থিত আছি।’ মহানবী (সা) বাম দিকে তাকিয়ে সেই একই আহবান জানালেন। দক্ষিনের সে উত্তর এল বাম দিক থেকেও। এর পর মহানবি (সা) তাঁর বাহন থেকে নেমে পড়লেন। মহানবীর (সা) নির্দেশে হযরত আব্বাসের (রা) সুউচ্চকন্ঠে ধ্বনিত হলো, “হে আনসারবৃন্দ! হে বৃক্ষতলে শপথকারীগন।”
এই মর্মস্পর্শী আহবান কর্ণকুহরে পৌছাবার সাথে সাথে ঝড়ের বেগে মুসলিম সৈন্যদল যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে এল। সর্বাগ্রে পৌছার আকাঙ্ক্ষায় এমন ভিড় জমে গেল যে, অনেকের পক্ষে ঘোড়ায় চড়ে আসা সম্ভব হলো না। তারা ঘোড়া ফেলে রেখে আবার অনেকে শরীরটাকে হালকা করার জন্য গায়ের বর্ম ছুড়ে ফেলে দিয়ে পাগল প্রায় ছুটে এল যুদ্ধক্ষেত্রে। অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যায় কিছু নিখাদ হয়ে ফিরে আসা মুসলিম বাহিনী বদর, উহুদ ও খন্দকের সেই রূপ আবার ফিরে পেল। মুহূর্তে ঘুরে গেল যুদ্ধের মোড়। সমগ্র আরবের অদ্বিতীয় দুর্ধর্ষ তীরন্দাজ হাওয়াযেন ও সাকিফদের তীরের প্রাচীরও আর মুসলমানদের অগ্রগতি রোধ করতে পারলো না। সাকীফ গোত্রের প্রধান সেনানায়ক উসমান ইবন আবদুল্লাহ নিহত হলো। শত্রুপক্ষ রণে ভংগ দিয়ে পালাল। যারা পালাতে পারল না তারা বন্দী হলো। এই হুনাইনের যুদ্ধে ছ’হাজার শত্রু বন্দী হল এবং চব্বিশ হাজার উট, চল্লিশ হাজার ছাগ-ছাগী ও চার হাজার উকিয়া চান্দী মুসলমানদের হাতে এসে পড়ল।


জিরানা শিবিরের বন্দী মুক্তি
তায়েফের সন্নিকটবর্তী জিরানা লোকালয়। হুনাইন যুদ্ধের ছ’হাজার বন্দী এখনও জিরানার মুসলিম শিবিরে বন্দী। তায়েফের অবরোধ শেষ করে মহানবী (সাঃ) ফিরে এলেন জিরানার শিবিরে।
জিরানায় যারা বন্দী ছিল সবাই হওয়াযেন গোত্রের লোক। হাওয়াযেন গোত্রের একটি শাখা বনু সা’দ। এই বনু সা’দ মহানবীর (সাঃ) দুধমাতা হালিমার কবিলা। এদের সাথেই হেসে-খেলে মহানবীর (সাঃ) শিশুকালের ৫টি বছর কেটেছে।বনু সা’দ কবিলার লোকেরাও হাওয়াযিনদের সাথে বন্দী ছিল জিরানায়।
মহানবী (সাঃ) জিরানায় ফিরে এলে হাওয়াযেনদের একটি সম্মানিত প্রতিনিধিদল মহানবী (সাঃ) এর সাথে এসে দেখা করলেন। প্রতিনিধি দলের নেতা যুহাইর ইবন সা’দ মহানবী (সাঃ) এর কাছে এসে আরজ করলেন, “যারা বন্দী শিবিরে অবস্থান করছে, তাদের মধ্যে আপনার ফুফু ও খালাও রয়েছেন। আল্লাহুর কসম, যদি আরবের সুলতানদের মধ্য থেকে কেউ আমার বংশের দুধ পান করতেন, তাহলে তাঁর কাছে আমাদের অনেক আকাংখা আবদার থাকতো। আর আপনার কাছ থেকে আমরা আরও বেশী আশা রাখি।”
মহানবী (সাঃ) সাগ্রহে তাদের কথা শুনলেন। বোধ হয় তাঁর মন ছুটে গেল সুদূর অতীতের এক দৃশ্যে। ভেসে উঠল তাঁর চোখে, হাওয়াযেনদের উপত্যকা ও প্রান্তর ভূমি। ফুফু-খালা যারা বন্দী তাদের স্নেহ তাঁকে কতইনা শান্তির স্নিগ্ধ পরশ বুলেয়েছে। কিন্তু তিনি তো কোন রাজা নন, কিংবা নন কোন ডিক্টেটর অথবা স্বেচ্ছাচারী সম্রাট। সব মুসলমানের স্বার্থ ও মতামত যে বন্দিমুক্তির সাথে জড়িত সে বন্দীদের তো তিনি তাঁর একার ইচ্ছায় ছেড়ে দিতে পারেন না। এ অধিকার সকলের, সকলের সামনে এটা পেশ করা দরকার। মহানবী (সা) শান্ত স্নিগ্ধ কন্ঠে বললেন, “ ‘যুহাইর’ ! যুদ্ধ বন্দীদের উপর আবদুল মুত্তালিবের বংশধরদের অধিকার যতটুকু, তা আমি এই মুহুর্তে ত্যাগ করছি। আর অন্যান্য সকল যুদ্ধ বন্দীর মুক্তির জন্য যোহরের নামাযের পর সমবেত মুসলমানদের কাছে আবেদন কর।”
সে দিনই যোহরের নামাযের পর হাওয়াযেনদের প্রতিনিধি দলটি এসে মুসলমানদের সামনে দাঁড়াল। আবেদন জানাল তারা বন্দীদের মুক্তির জন্য আগের মত করেই। মহানবী (সাঃ) ঠিক আগের মত করেই বললেন, “আমি আমার কবিলার লোকেদের অধিকার রাখি, আমি তাদের দাবী পরিত্যাগ করছি। আর মুসলমানদের সকলের কাছে বন্দীর মুক্তির জন্য সুফারিশ করছি।” সমবেত আনসার ও মুহাজির সবাই এক বাক্যে বলে উঠল, “আপনার কবিলার মত আমদের অধিকারও আপনার উপর অর্পিত হলো।” এরপর মহানবী (সাঃ) ছ’হাজার বন্দীর সকলকেই মুক্তি দিলেন। মহানবী (সাঃ) ইচ্ছা করলেই সব বন্দীকে আগেই নিজের ইচ্ছায় মুক্তি দিতে পারতেন। কেউই প্রতিবাদ করতোনা। কিংবা অসন্তুষ্টও হতো না কেউ। কিন্তু সব যুগে সব মানুষের আদর্শ মহানবী (সাঃ) তা করেননি।মুসলমানদের শাসক, অধিনায়ক যাঁরা তাঁরা মুসলমানদেরই একজন হবেন, তাঁর অধিকারের সীমাও সকলের চেয়ে বেশী কিছু হবে না, এ উজ্জল শিক্ষাই চিরন্তন করে রাখলেন তিনি পৃথিবীতে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি