দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পার্থিব কল্যাণ
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এত সব ত্যাগ ও বিসর্জন আল্লাহর সন্তুষ্টি ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। এ দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার কাজটা যে শুধু পরকালের জন্য মঙ্গলজনক তা নয়, বরঞ্চ আল্লাহর বন্দেগী ও আনুগত্যের ভিত্তিতে যে সমাজ, যে তাহযিব ও তামাদ্দুন গঠিত হবে, সেখানে বিরাজ করবে পরিপূর্ণ ইনসাফ এবং জান ও মালের পূর্ণ নিরাপত্তা।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন-
(আরবী পিডিএফ ৫১ পৃষ্ঠায়****************************)
-হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কাজ হরো এই যে, তোমরা ইনসাফ ও ন্যায় নীতির ধ্বজবাহী এবং আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হয়ে যাও। (নিসাঃ ১৩৫)
কথা এখানে এতটুকু বলা হয়নি যে, “তোমরা ইনসাফ কায়েম কর”। বরঞ্চ বলা হয়েছে যে, “ইনসাফ ও ন্যায়-নীতির ধ্বজবাহী হয়ে যায়। তার অর্থ হলো মু’মিনদের কাজ শুধু ইনসাফ কায়েম করাই নয়, ইনসাফের পতাকাবাহী তাদেরকে হতে হবে। তাদেরকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এব বিশ্বব্যাপী আন্দোলনে যাতে করে নিপীড়িত মানব সমাজ থেকে জুলুম, অত্যাচার, অন্যায় ও বে-ইনসাফীর মূলোৎপাটন হয় এবং তার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয় সুখ-শান্তি, সম্প্রীতি, নিরাপত্তা ও পূর্ণ-সুবিচার।
অতঃপর এ মহৎ কাজের সাক্ষ্য দিতে হবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার নিকটে। ব্যক্তিগত বা দলীয় কোন স্বার্থে অথবা মানুষের প্রশংসা লাভের উদ্দেশ্যে যেন এ কাজ করা না হয়, তার জন্য সতর্ক বাণী রয়েছে এ আয়াতে।

বিপদে পৃষ্ঠ প্রদর্শন ঈমানের পরিপন্থী
দ্বনি প্রতিষ্ঠার কাজে যে নানারূপ বিপদের, ঝড়-ঝঞ্ঝার সম্মুখীন হতে হবে তা এক অবধারিত সত্য। এ বিপদের ঘন্টাধ্বনি শ্রবণ করে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করা যে ঈমানের পরিপন্থী সে সম্পর্কে কুরআন বলে-
(আরবী পিডিএফ ৫২ পৃষ্ঠায়****************************)
-হে মু’মিনগণ! ভালো করে জেনে রেখে দাও যে, তোমাদের মধ্যে যদি কেউ দ্বীন থেকে সরে পড়ে, তো পড়ুক। এরপরও আল্লাহ এমন বহু লোক পয়দা করবেন যারা হবে আল্লাহর প্রিয় এবং আল্লাহও তাদের প্রিয় হবেন। আর যারা মু’মিনদের প্রতি হবে উদার ও কোমল এবং কাফেরদের প্রতি হবে কঠোর এবং যারা আল্লাহর পথে চরম প্রচেষ্ঠা চালাবে। এ ব্যাপারে তারা কারো তিরস্কার, তর্ৎসনার পরোয়াই করবে না। (মায়েদাহঃ ৫৪)
দ্বীন থেকে সরে পড়ার পর ঈমানের আর কোনো প্রশ্নই থাকে না। এখন এই ঈমানহীন লোকের পরিবর্তে আল্লাহ যাদেরকে ময়দানে নিয়ে আসেন, তারা আলবৎ ঈমানদার। আল্লাহর সঙ্গে গড়ে ওঠে তাদের ভালোবাসার সম্পর্ক। তারা আল্লাহর প্রিয় হয় এবং আল্লাহ হন তাদের প্রিয়। এখন মু’মিনের পরিচয় হলো এই যে তারা মু’মিনদের প্রতি হবে কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর।
‘মু’মিনদের প্রতি কোমল’ কথার অর্থ এই যে, একজন মু’মিন অন্য কোন মু’মিনের বিরুদ্ধে কিছুতেই আপন শক্তি প্রয়োগ করবে না। তার প্রতিভা, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, যোগ্যতা, প্রভাব প্রতিপত্তি, ধন-সম্পদ, দৈহিক শক্তি প্রভৃতি কোন কিছুই মুসলমানদেরকে দমিত, উত্যক্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত করার কাজে ব্যবহৃত হবে না। মুসলমান সমাজ তাকে সর্বদা একজন কোমল প্রাণ, দয়ালু, সহানুভূতিশীল ও ধৈর্যশীল লোক হিসেবে দেখতে পাবে।
“কাফিরদের প্রতি কঠোর’ কথাটির তাৎপর্য এই যে, একজন মু’মিন ঈমানের পরিপক্কতা, একনিষ্ঠ দ্বীনদারী, আদর্শের প্রতি দৃঢ়তা, চরিত্রের অদম্য শক্তি প্রভৃতি গুণাবলীর কারণে ইসরামের শত্রুর মোকাবিলায় হবে ইস্পাত কঠিন, যাতে করে তাকে তার আপন স্থান থেকে কিছুতেই বিচ্যুত করা না যায়। সে না কারো ভয়ে-শংকিত হবে, না কারো কথায় বিগলিত হবে। প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হলে সে জীবন দিবে। কিন্তু কোনো মূল্যেই নতি স্বীকার করবে না অথবা প্রভাবিত হবে না।
ঈমানের পরিচয়ে আরও বলা হয়েছে যে, সে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য বিরামহীন সংগ্রাম করে যাবে। তার জন্য সে কারো তিরস্কার বিদ্রুপের কোন পরোয়া করবে না। না তার চলার গতিকে সে কখনো মন্দিভূত করবে।
এখন কথাটি অধিকতর সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, ঈমানের সবচেয়ে বড়ো পরিচয় হলো এই যে, আল্লাহর দ্বীনকে মানব সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিরামহীন সংগ্রাম করে যাওয়া এবং এর ফলে একজন মু’মিন যেমন আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ হয়ে পড়বে, তেমনি আল্লাহও তার কাছে হবেন সবচেয়ে প্রিয়।
বলা বাহুল্য এ সংগ্রামের ভেতর দিয়েই ঈমানের সত্যিকার পরীক্ষা হয়। এভাবে পরীক্ষার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা প্রকৃত মু’মিনদেরকেই বেছে আলাদা করে নেন এবং তাদেরই দ্বারা কাফিরদেরকে পরাভূত করেন। (আলে ইমরানঃ ১৪২)
এ সংগ্রাম ব্যতীত না ঈমানের কোন সাক্ষ্য দান করা সম্ভব হবে, আর না পরজীবনে বেহেশত লাভ করা যাবে। আল্লাহ বলেন-
(আরবী পিডিএফ ৫৩ পৃষ্ঠায়****************************)
(তোমরা কি বেহেশতে যাওয়ার আশা পোষণ করে বসে আছ, যতোক্ষণ না আল্লাহ পারলেন যে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য তোমাদের মধ্যে আল্লাহর পথে সংগ্রাম কারা করলো এবং যতোক্ষণ না আল্লাহ এ কথাও জানতে পারলেন যে, কারা অবিরাম ধৈর্য সহকারে এ পথে চললো। (আলে ইমরানঃ ১৪২)
ঈমানের প্রেরনার উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা দ্বীনের পথে চলা শুরু করেছেন, যে পথের গন্তব্যস্থান হলো দ্বীনে হকের প্রতিষ্ঠা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি, তাঁদেরকে যে প্রতি পদে পদে চরম বাধার সম্মুখীন হতে হবে, তা আগের আলোচনায় সুস্পষ্ট হয়েছে এবং ইসলামের অতীত ইতিহাসও তার সাক্ষ্য বহন করছে। এখন এ পথে যাঁরা চলেন, তাঁদের মধ্যে একজন সাধারণ মু’মিন অথবা দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের কোন কর্মী বা নেতা যদি জীবন ও ধন-সম্পদ বিপন্ন হওয়ার আশংকায় বাতিলের কাছে নতি স্বীকার করে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পরিত্যাগ করে বাতিলের সাথে সহযোগিতার আকুল আগ্রহ দেখান, তাহলে ঈমানের গণ্ডি থেকে তিনি বেরিয়ে যাবেন এবং এমন ব্যক্তিকে মুনাফিক ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না।
দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন যাঁরা করেন, তাঁদের এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। তাঁদের প্রত্যেকের এমন প্রশিক্ষণ হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং এ মুহুর্তে অগ্নি পরীক্ষার ভেতর দিয়ে অবশ্যই হতে হবে, যাতে করে কোন চরম মুহুতেৃ দ্বীন প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের কোন কর্মী জীবন ও ধন-সম্পদের নিরাপত্তার জন্য অথবা সন্তান-সন্তুতির সুখ স্বাচ্চন্দের জন্য বাতিলের কাছে আত্মসমর্পণ না করে। এ আন্দোলনের নেতৃত্ব যিনি দিবেন, তাঁকে হতে হবে অধিকতর উন্নত চরিত্রের অধিকারী। আপন জীবন, ধন-সম্পদ, স্ত্রী-পুত্র পরিজন সব কিছুকেই আল্লাহর পথে উৎসর্গ করার মনোবল ও সাহস যাঁর আছে এবং বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার নজির যিনি পেশ করেছেন, তিনিই দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পরিচালনার নেতৃত্ব দিতে পারেন। যদি দুর্বল চরিত্রের লোক নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হয়, তাহলে যে কোন চরম মুহুর্তে গোটা আন্দোলনকে নিয়ে সে নিমজ্জিত হবে এবং রেখে যাবে এক কলংকের ইতিহাস।
আশা করি এরপর বিষয়টি বুঝতে মোটেই কষ্ট হবার কথা নয়। এমনিভাবে যদি আমরা সমগ্র কুরআন পাক আলোচনা করি তাহলে জানতে পারব যে, ঈমানের দাবী শুধু ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের প্রতিষ্ঠাই নয়। ঈমানের দাবী শুধু ইসলামের পাচঁটি স্তম্ভের প্রতিষ্ঠাই নয়। ঈমানের দাবী অনুযায়ী এ হলো কাজের সূচনা মাত্র। দরজা, জানালা ও ছাদসহ অট্টালিকা নির্মাণ হলেই এ কাজের সমাপ্তি বুঝতে হবে। অনুরূপভাবে ইসরামের প্রাসাদ নির্মাণের জন্য তার সূচনা হরো পাঁচ স্তম্ভের নির্মাণ বা প্রতিষ্ঠা। এ স্তম্ভের উপরে গোটা প্রাসাদ নির্মাণ করাই ঈমানের পরবর্তী দাবী। সে সব দাবী একটি একটি করে কুরআনে বলা হয়েছে। আর এসব দাবী পরিপূর্ণরূপে পারন করেছেন আল্লাহর নবী (স) ও তাঁর প্রিয় সাহাবায়ে কিরাম (রা)। তাই ঈমানের দাবী পরিপূর্ণরূপে পালন করতে হরে একদিকে যেমন কালামে পাক গভীর মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করতে হবে, অপরদিকে নবী ও সাহাবায়ে কিরামের পবিত্র জীবনকেও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসরণ করতে হবে।

ঈমান প্রসঙ্গে হাদীসে রসূল
এখন নবীর হাদীস থেকে ঈমানের দাবী সম্পর্কে কয়েকটি দৃষ্টান্ত পেশ করে আলোচনা করতে চাই।
(আরবী পিডিএফ ৫৬ পৃষ্ঠায়****************************)
-ঈমানের বহু শাখা প্রশাখা আছে। তার মধ্যে সর্বোত্তম এই যে, তুমি আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে তোমার শাসক বা প্রভু স্বীকার করবে না। ঈমানের নিম্নতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো এই যে, রাস্তায় পথিকের কষ্টদায়ক কোন কণ্টক বড়ে থাকতে দেখলে তা সরিয়ে ফেলবে। লজ্জাশীলতাও ঈমানের একটি শাখা।
এর থেকে বুঝা গেল যে, ঈমানের নূন্যতম দাবী হলো মানুষের সকল প্রকার দুঃখ-কষ্ট দূর করার চেষ্টা করা। লজ্জাশীলতাও ঈমানের একটি দাবী।
(আরবী পিডিএফ ৫৬ পৃষ্ঠায়****************************)
মু’মিন ঐ ব্যক্তি, যার দ্বারা কারো জানমালের আশংকা হয় না।
(আরবী পিডিএফ ৫৬ পৃষ্ঠায়****************************)
“যে খোদা ও পরকালের উপর বিশ্বাস রাখে, তার উচিত মেহমানের সমাদর করা,… প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়া ….. ভালো কথা বলা।

(আরবী পিডিএফ ৫৭ পৃষ্ঠায়****************************)
-খোদার কসম ঐ ব্যক্তি মু’মিন নয়, খোদার কসম ঐ ব্যক্তি মু’মিন নয়, খোদার কসম ঐ ব্যক্তি মু’মিন নয়, যার দৌরাত্মে প্রতিবেশী শান্তিতে বসবাস করতে না পারে।

(আরবী পিডিএফ ৫৭ পৃষ্ঠায়****************************)
-যে ব্যক্তি পরিতৃপ্ত হয়ে আহার করে এবং তার প্রতিবেশলী ক্ষুধার্ত থাকে, সে ঈমানদার হতে পারে না।

(আরবী পিডিএফ ৫৭ পৃষ্ঠায়****************************)
-যার মধ্যে আমানতদার নেই, তার ঈমান নেই এবং যে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে সে বে-দ্বীন।

(আরবী পিডিএফ ৫৭ পৃষ্ঠায়****************************)
-যদি নেক কাজে তোমার আত্মতৃপ্তি এবং পাপ কাজে অনুশোচনা হয়, তাহলে তুমি একজন ঈমানদার।

(আরবী পিডিএফ ৫৭ পৃষ্ঠায়****************************)
-সর্বোৎকৃষ্ট ঈমানের পরিচয় এই যে, তোমর বন্ধুত্ব এবং শত্রুতা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য হবে। তোমার মুখে আল্লাহর যিকর জারী থাকবে। নিজের জন্য যা পছন্দ করবে অপরের জন্যও তাই করবে এবং নিজের জন্য যা অপছন্দনীয় মনে করবে অপরের জন্যও তাই করবে।
(আরবী পিডিএফ ৫৭ পৃষ্ঠায়****************************)
-শরীর ও পোশাকের পবিত্রতা ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক।

(আরবী পিডিএফ ৫৮ পৃষ্ঠায়****************************)
তোমাদের মধ্যে পরিপূর্ণ ঈমানদার ঐ ব্যক্তি যার চরিত্র সবচেয়ে ভালো এবং যে আপন পরিবারবর্গের সাথে সকলের চেয়ে ভালো ব্যবহার করে।

(আরবী পিডিএফ ৫৮ পৃষ্ঠায়****************************)
-মু’মিন ব্যক্তি কখনো বিদ্রূপকারী, অভিসম্পাৎকারী অশ্লীলভাষী এবং প্রলাভকারী হতে পারে না।

(আরবী পিডিএফ ৫৮ পৃষ্ঠায়****************************)
একজন মু’মিন সবকিছু হতে পারে। কিন্তু আত্মসাৎকারী ও মিথ্যাবাদী হতে পারে না।

(আরবী পিডিএফ ৫৮ পৃষ্ঠায়****************************)
ক্রোধাগ্নি প্রজ্জ্বলিত হবার পর যদি কেউ তা নির্বাপিত করে, কোদা তার অন্তর ঈমান এবং আত্মতৃপ্তি দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেন।

(আরবী পিডিএফ ৫৮ পৃষ্ঠায়****************************)
জ্ঞাতসারে যে ব্যক্তি কোন জালেমের সহযোগিতা করে সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যায়।
অত্যাচারী জালিমের সহযোগিতা করাকে এখানে ঈমানের পরিপন্থী বলা হয়েছে। জালিমের সহযোগিতা না করাই ঈমানের অন্যতম দাবী নয়, বরঞ্চ জালিমের জুলুমের প্রতিরোধ করা, তার বিরুদ্ধে আওয়াজ বুলন্দ করাও ঈমানের দাবী। ঈমানের দাবী কি তা উপরের আলোচনায় সুস্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করি। এখন ঈমানের দাবীসমূহ পূরণের সহজ পন্থা কি?
অবশ্যি ঈমানের দাবী পূরণ করা কাজটি মোটেই সহজ নয়। বরঞ্চ তা অত্যন্ত কঠিন। তবে একজন মু’মিন যখন ঈমানের দাবী পূরণের জন্য দৃড় সংকল্প হয় এবং তার জন্য সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত হয়, তখন তার কিছু পন্তা অবলম্বন করা প্রয়োজন হয়। এ জন্য আমাদেরকে আবার পূর্বের কথায় ফিরে যেতে হবে। অর্থাৎ শেষ নবী মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (স) কোন পন্থায় সাহাবায়ে কিরামের চরিত্র গঠন করলেন যার দ্বারা তাঁরা ঈমানের প্রতিটি দাবী পূরণ করতে পেরেছিলেন। মনে রাখতে হবে যে, ঈমান আনার সাথে সাথেই তাঁদের ঈমানের সব দাবী পূরণ হয়ে যায়নি। এ ব্যাপারে তাদের কার্যক্রম ছিল নিম্নরূপঃ
প্রথমত, ঈমান আনার সাথে সাথে তাঁরা জাহিলিয়াত তথা ইসলাম বিরোধী আকীধাহ বিশ্বাস, মতবাদ, দর্শন ও চিন্তাধারা এবং একাধিক খোদার বন্দেগী আনুগত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন। ফলে তাদের উপরে নেমে এলো অত্যাচার নিষ্পেষণ।
দ্বিতীয় পর্যায়ে তাঁরা যে সমস্যার সম্মুখীন হলেন তা হলো একদিকে ঈমানের দাবী অন্যদিকে জাহেলিয়াতের দাবী। জাহেলিয়াত জুলুম নিষ্পেষণের মাধ্যমে এ দাবী তুলে ধরলো যে ঈমান পরিত্যাগ করলেই জুলুম নিষ্পেষণ বন্ধ হবে, তাদের জীবন আবার পূর্বের মতন সুখী ও সুন্দর হবে। অর্থনৈতিক ও জান-মালের নিরাপত্তা পুনঃপ্রতিষ্টিত হবে।
পক্ষান্তরে ঈমানের দাবী ছিল, ঈমানের উপরে মজবুত ও অচল অটল হয়ে থাকা, পরিণাম তার যা কিছুই হোক না কেন? স্বয়ং নবী পাক (স)-এর এবং সাহাবীদের জীবনে আমরা তাই দেখেছি। জীবনের পদে পদে ঈমান ও জাহেলিয়াতের দুই বিপরিতমুখী দাবীর সম্মুখীন তাঁরা হয়েছেন। ঈমানের দাবতে যারা অটল রয়েছেন, তাঁরাই অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঈমানের দাবী পূর্ণ করেছেন। কতিপয় ব্যক্তি এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে মুনাফিক নামে অভিহিত হয়েছেন।

গভীরভাবে চিন্তা করার বিষয়
উপরের আলোচনায় এ কথা পরিস্কার হয়েছে যে, ঈমানের দাবী হচ্ছে তার উপর অবিচল অটল হয়ে জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর একান্ত অনুগত বা সত্যিকার মুসলমান হিসেবে জীবন যাপন করা। এ শুধু এক ব্যক্তির জন্য নয়, বরঞ্চ যারাই ইসলামের কালেমার প্রতি জেনে বুঝে ঈমান এনে মুসলমান হয়েচে তাদের সকলকে সম্মিলিতভাবে মুসলমানদের মতো জীবন যাপন করতে হবে। একাকী কারো পক্ষে জীবনের সকল ক্ষেত্রে মুসলমান হয়ে চলা কিছুতেই সম্ভব নয়। তার জন্য একটা পরিপূর্ণ ইসলামী পরিবেশ ও সমাজ ব্যবস্থার একান্ত প্রয়োজন। গোটা সংস্কৃতি ও শিল্পকলা, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন, বন্ধুত্ব-শত্রুতা, যুদ্ধ ও সন্ধি মোট কথা জীবনের সকল ক্ষেত্রের উপর ইসলামের পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে।
একটা অনৈসলামী পরিবেশ অথবা কুফরী শাসনের অধীনে কোন মুসলমানই তার ঈমানের দাবী পুরোপুরি পুরণ করতে পারবে না, যেমন কোন কমিউনিষ্ট শাসনে এ দাবী পালন করা মোটেই সম্ভব নয়, অথবা কোন কুফরী রাষ্ট্রে যতোটুকু ঈমানের দাবী পূরণ করার অনুমতি দেবে তার অধিক পালন করাও যাবে না। অথচ আল্লাহ বলেূন-

(আরবী পিডিএফ ৬০ পৃষ্ঠায়****************************)
-হে ঈমানদারগণ! তোমদের সমগ্র জীবনকে ইসলামের অধীন করে দাও এবং (জীবনের কোন অংশকে ইসলামের বাইরে রেখে) শয়তানের আনুগত্য করো না। (কারণ) সে তোমাদের সুস্পষ্ট দুশমন। (বাকারাহঃ ২০৮)
মানব জীবন অবিভাজ্য। কিন্তু কেউ যদি কৃত্রিমভাবে জীবনকে বহু ভাগে বিভক্ত করে কোন কোনটিকে ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালিত করে এবং বাকীগুলো ইসলাম বহির্ভূত করে রাখে তাহলে তাকে পূর্ণ মুসলমান বলা যাবে না। জীবনের এসব ক্ষেত্রে তাকে আল্লাহ ব্যতীত অপরের আনুগত্য করতে হবে। এটাকেই শয়তাদের বা খোদা বিরোধী শক্তির আনুগত্য বলা হয়েছে।
আল্লাহ বলেন-
(আরবী পিডিএফ ৬১ পৃষ্ঠায়****************************)
-এবং সে (মুসলমান) যেন আনুগত্য করার ব্যাপারে আপন প্রভুর (আল্লাহর) সাথে আর কাউকে অংশীদার না করে। -(কাহফঃ ১১০)
তাহলে জীবনের যে যে ক্ষেত্রে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন মতবাদ বা আদর্শের অনুসরণ করা হবে, তা হবে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করারই নামান্তর। মসজিদে আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করা হবে এবং মসজিদের বাইরে জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে, রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি, কোর্ট-কাচারী, আদালত-ফৌজদারী, কৃষিক্ষেত্রে ও কলকারখানায় আল্লহার পরিবর্তে আনুগত্য করা হবে অন্যের –একে বলা হবে পূর্ণ মুনাফিকী –ইসলামী জীবন পদ্ধতি কিছুতেই বলা যাবে না। সমগ্র জীবনকে আল্লাহর আনুগত্যে সপর্দ করার নামই ত ইসলাম। ঈমানের দাবীও ত তাই। তাহলে চিন্তা করুন একজন মুসলমান কখন এবং কিভাবে সত্যিকার মুসলমান হতে পারে।
কুফরী শাসন ব্যবস্তার অধীনে একজন মুসলমান মুসলমানী জীবন যাপন করতেই পারে না। যে দেশ, ভূখণ্ড বা জনপদে আল্লাহর শাসন কর্তৃত্বের পরিবর্তে মানুষের শাসন কর্তৃত্ব চলে, গোটা সমাজ ও সামাজিক পরিবেশ খোদাদ্রোহিতায় নিমজ্জিত থাকে। দুর্নীতি, সুদ-ঘুষ, ব্যভিচার, মদ্যপান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, সংস্কৃতির নামে নারী পুরুষের একত্র সমাবেশ, অশ্লীল নাচ-গান, জুয়া, চরিত্র ধ্বংসকারী ছায়াছবি প্রভৃতি যে সমাজের নিত্যনৈমত্তিক কর্মকাণ্ড সেখানে একজন মুসলমান কি করে তার ঈমান বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
এ সব যে শুধু অমুসরিম বা কাফির রাষ্ট্রেই চলছে তা নয়, বরঞ্চ ব্যাপক আকারে চলছে মুসলিম দেশগুলোতে ও মুসলিম সমাজে। যারা জীবনের অতি সংকীর্ণ পরিসরে নামায-রোযা ও কিছু যিকির আযকারকে শেষ সম্বল হিসেবে আপন সন্তান-সন্ততি ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ইসলাম বিরোধী মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। তাদের এ চরিত্র ও আচার-আচরণে ইসলামের কোন নাম নিশানা খুঁজে পাওয়া যাবে না। শক্তিশালী ইসলাম বিরোধী শিক্ষঅ ব্যবস্থা ও পরিবেশ যুব সমাজকে ইসলামের বিরোধী শিক্ষা ব্যবস্থা ও পরিবেশ যুব সমাজকে ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রামী মনোভাব পোষণ করতে বাধ্য করছে। এ সবের কারণ এই যে, মুসলমান একটা মিল্লাত হিসেবে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়ার ফলে এবং তাদের মধ্যে আল্লাহর পথে আত্মত্যাগ ও জিহাদী প্রেরণার পরিবর্তে পার্থিব ভোগ-বিলাসের লিপ্সা জাগ্রত হওয়ার ফলে তারা শৃগালের জাতিতে পরিণত হয়। দীর্ঘকাল ধরে গোলামির জীবন যাপন তাদেরকে ইসলামের প্রতি সন্দিহান করেন তোলে। তাদের চিন্তাধারা, মনমানসিকতা, জীবনের মুল্যবোধ, সত্য-অসত্য ও ভালো-মন্দের মানদণ্ড পরিবর্তন হয়ে যায়। মুসলমান হয়েও বিধর্মী প্রভুর মন দিয়ে চিন্তা করা শুরু করে, তাদের চোখ দিয়ে দেখতে থাকে, তাদের রঙে নিজেদের রঞ্জিত করে।
কয়েক’শ বছরের গোলামীর পর স্বাধীনতা লাভ করলেও তারা মানসিক গোলামী পরিত্যাগ করতে পারেনি, এর অনিবার্য পরিণাম দুনিয়ার জীবনেও অশেষ লাঞ্ছনা। আজ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের অবস্থঅ এই একই রকমের। আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ, অলি ও অভিভাবক মনে করে তাঁরই উপরে নির্ভরশীল না হয়ে তারা ইসলামের দুশমন বাতিল শক্তির দয়ার উপর নির্ভর হয়ে পড়েছে। তার ফলে শেষ নবী (স) কর্তৃক নির্মিত ইসলামের প্রাসাদে আগুণ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। আর সে আগুণে পুড়ে মরছে মুসলমান, ফিলিস্তিন ও লেবাননের মুসলমান, মিশর, লিবিয়া ও আলজেরিয়ার মুসলমান ও ইরাকের মুসলমান। এ আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে মরছে আফগানিস্তানের মুসলমান। অন্যান্য দেশের মুসলমানদের অবস্থাও প্রায় একই রকমের। আজ মুসলমান মুসলমানকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। মুসলমান হয়ে ইসলামের ঘরে আগুণ জ্বালাচ্ছে। মুসরিম যুব সমাজ আজ ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধাংদেহী মনোভাব পোসণ করছে। ভবিষ্যৎ বংশধরদেরকে ইসলাম বিরোধী শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার সুপরিকল্পিন ষড়যন্ত্র চলছে। সাহিত্য, সংস্কৃতি, নাচ-গান পর্ণগ্রাফ ও অশ্লীল ছায়াছবির মাধ্যমে এ ষড়যন্ত্র অবিরাম চলছে।
এ হচ্ছে মুসলিম সমাজের বেদনাদায়ক চিত্রের একটি দিক। অপর অধিকতর বেদনাদায়ক চিত্র এই যে, আপন ঘরে দাউ দাউ করে জ্বরে উঠা আগুনের লেলিহান শিখা দেখেও আমাদের মনে কোন দুশ্চিন্তার কালোমেঘ জমাট বাঁধে না। আমরা সব কিছু থেকে চক্ষু বন্ধ করে আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে মশগুল আছি। ধর্মের গতানুগতিক প্রানহীন অনুষ্ঠানাদি নিয়ে পড়ে আছি। খানকা, মাদ্রাসা যিকির-আযকার, কালেমা শিখানোর অর্থহীন মহড়া নিয়ে ব্যস্ত আছি। নবী মুস্তাফার (স) নির্মিত প্রাসাদে আগুন জ্বলছে, তা নিভানোর কোন চিন্তা ও চেষ্টা না করে তার উপরে শুধু দরুদ ও সালাম পাঠ করছি। একে নবী প্রেমের পরিচয় বলা যায় না, নবীর সাথে তাঁর প্রতিষ্ঠিত আদর্শের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতাই বলতে হবে।

বাঁচবার উপায় কি?
বাঁচতে হলে তার একটি মাত্র পথ হচ্ছে এই যে, ঈমানের ভিত্তিতে আমরা আমাদের মুসলমান নামে অভিহিত করি সে ঈমানের দাবী পূরণ করতে হবে। পূরণ করতে হলে নিম্নের কর্মসূচী মনে প্রাণে গ্রহণ করে তা কার্যকর করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে।
এক. আমাদের প্রত্যেককে আল্লাহর কুরআন ও তাঁল শেষ নবীর সুন্নাহর স্মরণাপন্ন হতে হবে। কুরআন ও সুন্নাহ থেকে নবী পাকের ও সাহাবায়ে কিরামের সীরাত থেকে ইসলামের প্রকৃত রূপ ও আকৃতি জেনে নিতে হবে। মুসলমানের পতনযুগে বাইরের চিন্তাধারা ও ভ্রান্ত দর্শন ইসলামের গায়ে জাহেলিয়াত ও আল-কুরআন যে ইসলাম পেশ করেছে, নবী পাক (স) যে ইসরাম প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেটাকে ভারো করে জেনে নিতে হবে।
দুই. আমাদের প্রত্যেককে ইসলামের মুবাল্লেগ হতে হবে। সত্যিকার ইসলাম মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। এটা সফল হবে তখন, যখন প্রত্যেক মুবাল্লিগ তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে ইসলামের মূর্ত প্রতীক হবে।
এ উদ্দেশ্যে সাধারণ ওয়ায মাহফিল থেকে বেশী ফলপ্রসু পন্থা হচ্ছে কুরআনের নির্ভরযোগ্য তাফসীর, হাদীস ও বিভিন্ন ইসলামী সাহিত্যের ব্যাপক প্রচার, ব্যক্তিগত সাক্ষাতের মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা প্রভৃতি। ইসলামের বিভিন্ন দিকের উপরে যুব সমাজের উপযোগী করে সাহিত্য রচনা ও তার প্রচার ও প্রসার।
তিন. ইসলামী শিক্ষার সাথে শিক্ষার্থীদেরকে সংগঠিত করা এবং তাদরকে ইসলামের বাস্তব প্রশিক্ষণ দিয়ে বাতিল মতবাদ ও চিন্তাধারার মুকাবিলা করার যোগ্য করে গড়ে তোলা এবং সকরে মিলে জামায়াত বদ্ধ হওয়া।
যতোদিন না এ ধরনের পরিপূর্ণ ইসলামী জ্ঞান ও চরিত্রসম্পন্ন লোক তৈরী হয়েছে, ইসলামের প্রাসাদে যে আগুন ধরেছে তা নির্বাপিত হবে না, মুসলমানদের মধ্যে যারা সকল দিক থেকে চক্ষু বন্ধ করে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ইসলামী আমল আখলাকের প্রদর্শনী করেন, এ আগুণ জ্বলতে থাকরে তাঁরাও নিজেদেরকে ও বংশধরকে এ আগুণ থেকে বাঁচাতে পারবেন না। আগুনই অবশেষে জাহান্নামের আগুনে পরিণত হব্
উপরোক্ত কর্মসূচী বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বাঁধা মুসলমানদের বিশেষ করে আলেম সমাজের অনৈক্য। ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও স্বার্থকেন্দ্রিক ছোটখাটো বিবেদ ভুরে গিয়ে ইসলামকে ও মসুলিম মিল্লাতকে বাতিলের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার জন্য ঐক্যবদ্দ হতে হবে। আলেম সমাজের অনৈক্যের কারণে খোদা না করুন একবার যতি বাতির শক্তি মজবুত হয়ে চেপে বসে তাহলে মুসলমানদের নিধন যজ্হের পয়লা শিকার আলেম সমাজই হবে –তার দৃষ্টান্ত রাশিয়ার কমিউনিষ্ট বিপ্রবের পর দেখতে পাওয়া গেছে এবং সাম্প্রতিককালে আফগানিস্তানেও দেখা গেছে। আলেম সমাজ হচ্ছে নবীর আদর্শিক ও নৈতিক উত্তরাধিকারী।
কুরআনও ঘোষণা করেছে –আলেমদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একমাত্র আল্লাহকেই ভয় করা (আরবী*****) আল্লাহর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত থেকে দুনিয়ার বুকে নবীর (আরবী*****) আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাকে অমলীন রাখার সংগ্রামই নবীর উত্তরাধিকারীর কাজ। এ কাজ অবহেলা করলে আল্লাহর কাছে কৈফিয়ত দেবার কিছুই থাকবে না।
এ দায়িত্ব যে শুধু আলেমদের তা নয়, প্রতিটি মুসলমানের। একজন মুসলমান সকল গোলামি ছিন্ন করে, সকলের শাসন ও প্রভুত্ব খতম করে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার গোলামি অবলম্বন করে তাঁরই শাসন ও প্রভুত্ব কর্তৃত্বের অধীনে নিজেকে সপর্দ করে। সে কখনো মানুষের গোলামি ও শাসন কর্তৃত্ব মেনে নিতে পারে না। আল্লাহর আইনই তার একমাত্র মেনে চলার আইন এবং নবীর নেতৃত্বের অধীনেই সে তার গোটা জবিন পরিচালিত করবে। অতএব, একজন মুসলমানের ঈমানের দাবীই হচ্ছে এই সে একমাত্র আল্লহার আইনকেই সমাজের সর্বস্তরে বাস্তবায়িত ও কার্যকর করার সংগ্রাম করবে, রসূলের (স) আদর্শ অনুযায়ী তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন গড়ে তুলবে, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত করবে। এসব করতে পারলেই তাকে যে আল্লাহ তায়ালার খলিফার মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে, তা অক্ষুণ্ণ রাকতে পারবে।
এ কথা ভালো করে স্মরণ রাখা দরকার যে, আল্লাহর খলীফা বা প্রতিনিধি হিসেবে দুনিয়ার বুকে যথাযথ দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে ধন-দৌলতের অধিকারী করেছেন, জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক দান করেছেন, লেখনী শক্তি, বাকশক্তি ও উদ্ভাবনী শক্তি দান করেছেন, বিভিন্ন পদমর্যাদায় ভূষিত করেছেন। এ সব বিভিন্ন নিয়ামত তাকে এ জন্য দেয়া হয়েছে যাতে করে সে এ সবকে আল্লাহর মর্জি মতো ব্যবহার করতে পারে। এসব সম্পদ দান করে তাকে পরীক্ষায় নিক্ষেপ করা হয়েছে। সে যদি তার ধন-দৌলত, জ্ঞান-বুদ্ধি, লেখনী ও উদ্ভাবনী শক্তি একমাত্র কোদর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তাঁরই পথে ব্যয় করে তাহরে বুঝতে হবে সে প্রতিনিধিত্বের হক আদায় করতে পেরেছে। পক্ষান্তরে এ সব সম্পদ যদি ব্যয় করা হয় পার্তিব স্বার্থ ও প্রবৃত্তির পিপাসা মেটাবার জন্য তাহলে খোদার দেয়া সম্পদ সে আত্মসাৎই করবে এবং দাতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে অপরাধী হবে।
ঈমানের দাবী ত এটাই যে, আল্লাহ মানুষকে যা কিছুই দান করেছেন –সে দানের মদ্যে রয়েছে হাত, পা, চোখ, কান, মুখ ও মন-মস্তিষ্ক, সে সব কিছুই ব্যবহার করতে হবে দাতার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। এ সব এমন কোন পথে ও এমনভাবে ব্যয় করা যাবে না যাতে দাতা অসন্তুষ্ট হন। এ সবকে আল্লাহর মর্জির বিপরীত পথে ব্যবহার করলে একদিকে তাদের উপর বড় জুলুম করা হবে এবং অপরদিকে নিজের উপরেও জুলুম করা হবে। কিয়ামতের দিন এ সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহর দরবারে অভিযোগ করবে যে তাদেরকে তাদেরও মর্জির বিপরীত এবং আল্লাহ তায়ালারও মর্জির বিপরীতে ব্যবহার করা হয়েছে। তার জন্য সে ব্যক্তিকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে যাকে এ সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে আমানত স্বরূপ দেয়া হয়েছিল।
এ তো গেল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কথা। মানুষকে ধন-সম্পদ ও জ্হান বুদ্ধিসহ স্বাধীন ইচ্চা ও কর্মশক্তি দেয়া হয়েছে তাকে পরীক্ষা করার জন্য যে এ গুলোকে সে কি তার প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী ব্যবহার করবে –না আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যবহার করবে। তার যে ঈমান যা প্রকৃতপক্ষে তার এবং আল্লাহর মদ্যে আল্লাহর দাসত্ব আনুগত্যের চুক্তি তার দাবিই হচ্ছে এই যে তাকে যা কিছুই দেয়া হয়েছে তা অন্য পথে ব্যবহার করায় তার স্বাধীনতা থাকলেও তা ব্যবহার করতে হবে আল্লহরই পথে। খলিফা বা প্রতিনিধির কাজই তাই।
মানুষকে আল্লাহ তায়ালা যমীনের উপর তাঁর খলিফা (Vice Gerent) করেই পয়দা করেছেন। খলিফার কাজই হচ্ছে তার নিয়োগকারীর মর্জি পূরণ করা, তার আইন কানুন যতাযথ পালন করা ও কার্যকর করা, নিজে আইন রচনাকারী হয়ে সবা নয়, স্বেচ্ছাচারী হওয়া নয় এবং এ ধারণা পোষণ করা নয় যে তাকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। সমগ্র প্রকৃতি রাজ্যে যেমন প্রাকৃতিক নিয়মে একমাত্র আল্লাহরই মর্জি পূরণ হচ্ছে, তাঁরই আইন মেনে চলা হচ্ছে –তেমনি মানুষের সমাজেও তাঁরই আইন চলবে, তবে তার প্রতিনিধিত্ব করবে মানুষ। মানুষকে শাসক ও আইন রচয়িতা বানানো হয়নি। প্রকৃত শাসক ও আইন প্রণেতার প্রতিনিধি বানানো হয়েছে।
অতএব, মানুষের জন্মগত দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে মানুষের সমাজে তার প্রভু স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার আইন কার্যকর করা। এ আইন অমান্য করার কারণেই মানুসের সমাজে বিপর্যয় ও ধ্বংস নেমে এসেছে। মানব জাতির ইতিহাস তার সাক্ষী।
যারা আল্লহারপ্রতি ঈমান রাকে না তারা এ সত্যটি অস্বীকার করে। কিন্তু যারা ইমান রাখে, তাদের ঈমানের অপরিহার্য দাবীই এই যে, তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রামের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার আইন কানুন সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে কার্যকর করবে, জনগণেল মধ্যে তা মেনে চলার মানসিকতা ও আগ্রহ সৃষ্টি করবে। এ কাজে তাদের শক্তি ও কর্মপ্রেরণার উৎস হবে আল্লাহর কুরআন, নবী পাকের সীরাত ও সাহাবায়ে কিরামের কর্মপদ্ধতি, বিশেষ করে খিলাফতে রাশেদার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
উপরের ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রামের মাধ্যমে যে কথা বলা হযেছে তার অর্থ এই যে, ঈমানের সকল দাবী পূরণের কাজ তথা আল্লাহর যমীনে একমাত্র আল্লাহর প্রভুত্ব-কর্তৃত্ব, আইন-শাসন কায়েম করা একাকী বিচ্ছিন্নবাবে করা কিছুতেই সম্ভব নয়। এর জন্য একটি ইসলামী জামায়াতভুক্ত হতে হবে যার উদ্দেশ্য আল্লাহর পথে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করা। কুরআন যাকে ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্রাহ’ বরা হয়েছে।
আশার বিষয় এই যে, পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই ইসলামের পুনর্জাগরণ ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্দ আন্দোলন শুরু হয়েছে। আল্লাত তায়ারা ঈমানের দাবীদার মুসলমানদেরকে এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।

— সমাপ্ত —


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি