হযরত আবূ ওবাইদাহ ইবনুল জাররাহ (রা)
নাম আমের। ডাক নাম আবূ ওবাইদাহ। উপাধি আমনুল উম্মত। তিনি তাঁর আব্বা আবদুল্লাহ’র নামে পরিচিত না হয়ে দাদার নামে অর্থাৎ ইবনুল জাররাহ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তার বংশ তালিকা নিম্নরূপ –আমের ইবন আবদুল্লাহ, ইবন জাররাহ, ইবন হেলাল, ইবন উহাউব, ইবন জাররাহ, ইবন হারেস, ইবন ফেহর আল কারশী আল যোহরী। তার উর্ধতন পঞ্চম পুরুষ ফেহর-এর সাথে গিয়ে রাসূল (সা)-এর বংশের সাথে মিলিত হয়। তাঁর মা এ ফেহর বংশের মেয়ে ছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি ডাক নাম আবূ ওবাইদাহ নামেই খ্যাত হন।

যতদূর জানা যায় হযরত আবূ বকর (রা)-এর ইসলাম গ্রহেণের পরের দিনই তিনি মুসলমান হন। তিনি আবূ বকরের (রা) হাতে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। এরপর আবদুর রহমান ইবন আউফ, আল আরকাম ইবন আবিল আরাকাম, উসমান ইবন মাজউনকে সংগে নিয়ে রাসূল (সা)-এর খেদমতে হাজির হন এবং একসাথে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন।

মক্কায় মুসলমানদের বসবাস করা বিপদজনক হতে থাকলে রাসূল (সা)-এর নির্দেশে অনেকেই হাবশায় হিজরত করেন। হযরত আবূ ওবাইদাহ কোরাইশ জালিমদের অত্যাচারে দু’দুবার হাবশায় হিজরত করেন। পরবর্তীতে রাসূল (সা) মদীনায় হিজরত করলে তিনিও মদীনায় হিজরত করেন। অর্থাৎ তিনি মোট তিন তিনবার হিজরত করেন। মদীনায় হিজরতের পর রাসূল (সা) তাঁকে সা’দ ইবন মু’আযেরসাথে ভাই পাতিয়ে দেন।

হযরত আবূ ওবাইদাহ সেই ব্যক্তি যিনি ইসলামের জন্য আপন মুশরিক পিতাকে হত্যা করেন। ঘটনা এরকম, বদরের প্রান্তরে মুসলিম ও কোরাইশ মুশরিকদের সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। হযরত আবূ ওবাইদাহ বীর বিক্রমে মুশরিক কাফিরদের ওপর আগাত হেনে চলেছেন, তাঁর আঘাতের প্রচণ্ডতায় কাফিররা দিগ্বিদিক জ্ঞান হারা হয়ে পালাতে শুরু করেছে। ঠিক এ সময়ে অথবা তার পূর্ব থেকে তাঁর পিতা আবদুল্লাহ তাঁর দিকে তীর ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে এলো এবং পুত্র ওবাইদাকে হত্যা করার জন্য নানান কোশেষ করতে লাগলো। ওবাইদাহ পিতাকে এড়িয়ে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন কিন্তু পারলেন না। এক পর্যায়ে পিতা আবদুল্লাহ যখন শত্রু ও তার মধ্যে চরম বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো তখন বাধ্য হয়েই তিনি তরবারির এক কোপে পিতার দেহ থেকে মাথাটি বিচ্ছিন্ন করে দিলেন।

এরপর পরই সূরা আল মুজাদিলার এ আয়াতটি নাজিল হয়-

‘তোমরা কখনো এমনটি দেখতে পাবে না যে, আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার লোকেরা কখনো তাদের প্রতি ভালবাসা পোষণ করে যারা আল্লাহ এবং তার রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করেছে। তারা তাদের পিতা-ই হোক কিংবা তাদের পুত্র-ই হোক বা ভাই হোক অথবা তাদের গোত্রের লোক। তারা সেই লোক যাদের দিলে আল্লাহ তা’আলা ঈমান দৃঢ়মূল করে দিয়েছেন এবং নিজের তরফ হতে একটা রূহ দান করে তাদেরকে এমন সব জান্নাতে দাখিল করবেন যার নিম্নদেশে ঝর্ণাধারা প্রবহমান হবে। তাতে তাঁরা চিরদিন থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও সন্তুষ্ট হয়েছে তাঁর প্রতি। এঁরা আল্লাহর দলের লোক। জেনে রাখো, আল্লাহর দলের লোকেরাই কল্যাণ প্রাপ্ত হবে’।

একবার খৃষ্টানদের এক প্রতিনিধিদল রাসূল (সা)-এর কাছে এসে তাঁর মনোনীত একজন প্রতিনিধি তাদের সাথে দিতে বললেন। এজন্য যে, তিনি গিয়ে তাদের বিতর্কিত কিছু সম্পদের ফয়সালা করে দেবেন। একথা শুনে রাসূল (সা) তাদেরকে সন্ধ্যায় আসতে বলে বললেন, ‘আমি তোমাদের সাথে একজন দৃঢ়চেতা ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে পাঠাবো’। ওমর (রা) বলেন, ‘আমি সেদিন সকাল সকাল জোহরের নামায আদায়ের জন্য মসজিদে উপস্থিত হলাম। আর আমি এদিনের মতো আর কোন দিন নেতৃত্বের জন্য লালায়িত হইনি। এর একমাত্র কারণ আমিই যেনো হতে পারি রাসূল (সা)-এর এ প্রশংসার পাত্রটি। রাসূল (সা) আমাদের সাথে জোহরের সালাত শেষ করে ডানে বায়ে দেখতে লাগলেন। আর আমিও তাঁর দৃষ্টিতে পড়ার জন্য আমার গর্দানটি একটু উঁচু করতে লাগলাম। কিন্তু তিনি তাঁর দৃষ্টি ঘোরাতে ঘোরাতে এক সময় আবূ ওবায়দা ইবনুল জাররাহকে দেখতে পেলেন। তাঁকে ডেকে তিনি বললেন, তুমি তাদের সাথে যাও এবং সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে তাদের বিতর্কিত বিষয়টির ফয়সালা করে দাও’।

ওহুদের যুদ্ধে যে দশজন সাহাবী হযরত মুহাম্মদ (সা) কে ঘিরে ব্যূহ রচনা করেছিলেন, যাঁরা তাঁদের জান বাজি রেখে আল্লাহর নবী হেফাজতের চেষ্টা করেছিলেন, ওবায়দাহ (রা) তাদেরই একজন। যুদ্ধ শেষে যখন দেখা গেলো রাসূল (সা-এর চেহারা মোবারক যখম হয়েছে, দু’টি দাঁত শহীদ হয়েছে এবং লৌহবর্মের দু’টি বেড়ি গণ্ডদেশে ঢুকে গেছে। হযরত আবূ বকর (রা) এ দৃশ্য দেখে ছুটে এসে বেড়ি দু’টি দ্রুত খোলার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু ওবায়দাহ তাকে বাঁধা দিয়ে নিজেই রাসূল (সা) কষ্ট পান তাই তিনি দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে সাবদানে বেড়ি বের করে আনলেন। কিন্তু বেড়ি দুটো মারাত্মকভাবে ঢুকে যাওয়ার কারণে ওবায়দাহ (রা) দুটো দাঁত ভেঙ্গে যায়। রাসূল (সা)-এর প্রতি এ প্রেম দেখে হযরত আবূ বকর (রা) বললেন, ‘আবূ ওবায়দাহ সর্বোত্তম দাঁত ভাঙ্গা ব্যক্তি’।

হযরত ওবায়দা (রা) ওহুদ, খন্দক ছাড়াও বানূ কুরাইজা অভিযানেও অংশ গ্রহণ করেন। বাইয়াতে রেদওয়ানেও তিনি শরীক হন, হুদাইবিয়ার সন্ধিতে তিনি একজন স্বামী হিসাবে স্বাক্ষর করেন। সপ্তম হিজরী সনে রাসূল (সা)-এর সাথে খাইবার অভিযানেও তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং অসম্ভব বীরত্বের পরিচয় দেন। যাতুস সালাসিলে পৌঁছে হযরত আমর ইবনুল আস যখন বুঝলেন আরো সৈন্য প্রয়োজন তখন তিনি রাসূলের (সা) খেদমতে সাহায্য চেয়ে পাঠান। তখন রাসূল (সা) আবূ ওবায়দাহর নেতৃত্বে দু’শো সৈন্য আমর ইবনুল আসের সাহায্যে প্রেরণ করেন। তোমরা শুনলে বিস্মিত হবে যে, এ যোদ্ধাদের মধ্যে প্রথম খলিফা হযরত আবূ বকর ও দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রা) ছিলেন। মক্কা বিজয়, হুনাইনের যুদ্ধ, তায়েফের যুদ্ধসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক যুদ্ধেই তিনি অংশ গ্রহণ করেন। মক্কা বিজয়ের সনে আবূ ওবায়দাহর নেতৃত্বে সামুদ্রিক এলাকায় অভিযান চালানো হয়। এ অভিযানে তাদেরকে খাবার হিসাবে কিচু খেজুর দেয়া হয়েছিলো এবং তা এতো কম ছিলো যে, জন প্রতি দৈনিক মাত্র একটি খেজুর নির্ধারিত ছিলো। পরবর্তীতে অবশ্য তারা প্রকাণ্ড একটি মাছ পাওয়ায় খাদ্যাভাব দূর হয়।

রাসূল (সা)-এর ওফাতের পর খলীফা নির্বাচন নিয়ে জটিলতা দেখা দিলে হযরত আবূ বকর (রা) ওবায়দাহ (রা) কে বললেন, ‘আপনি হাত বাড়িয়ে দিন, আমি আপনার হাতে বাইয়াত করি। আমি রাসূল (সা) কে বলতে শুনেছি, ‘প্রত্যেক জাতিরই একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি আছে, তুমি এ জাতির সেই বিশ্বস্ত ব্যক্তি’। উত্তরে ওবায়দাহ বললেন, ‘আমি এমন ব্যক্তির সামনে হাত বাড়াতে পারিনা যাঁকে রাসূল (সা) আমাদের নামাযের ইমামতির আদেশ করেছেন এবং তিনি তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ইমামতি করেছেন’। হরযত আবূ ওবায়দাহর (রা) এমন দিকনির্দেশ মূলক কথার পর পরই সবাই হযরত আবূ বকরের হাতে বাইয়াত হন। পরে খলীফা নির্বাচনের জটিলতাও দূরিভূত হয়। হযরত ওমর (রা) খলীফা হলে আবূ ওবায়দা বিনা বাক্য ব্যয়ে তাঁর হাতে বাইয়াত হন।

হযরত আবূ বকর (রা) খেলাফতের তৃতীয় সনে চতুর্দিক থেকৈ শাম দেশ আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। সময়ের হিসেবে হিজরী ১৩ সন ছিল পরিকল্পনা অনুযায়ী হযরত আবূ বকর (রা) হেমসের দিকে, আবূ ওবায়দাহকে দামেস্কের দিকে, ইয়াজিদ ইবন আবূ সুফিয়ানকে জর্দানের দিকে শোরাহবিলকে এবং ফিলিস্তিনের দিকে আমর ইবনুল আসকে প্রেরণ করেন। তবে তিনি তাদেরকে বলেন, ‘আপনারা সকলে একত্র হলে আবূ ওবায়দাহ সেনাপতি হবেন’।

হিজরী ১৭ সনে হযরত ওমর (রা) দামেস্কের আমীর ও ওয়ালীর পদ থেকে হযরত খালিদ ইবন ওয়ালিদকে অপসারণ করে সেখানে আবূ ওবায়দাহকে নিয়োগ দেন। এ সিদ্ধান্ত শোনার পর খালিদ সাইফুল্লাহ দামেস্কের লোকদেরকে বলেন, তোমাদের খুশি হওয়া উচিত যে, আমীরুল উম্মত তোমাদের ওয়ালী’।

হযরত আবূ ওবায়দার নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী দামেস্ক, হিমস প্রভৃতি শহর একের পর এক জয় করেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধ তিনিই পরিচালনা করেন। সমগ্র সিরিয়া তাঁর করায়াত্বে নিয়ে আসেন। এ সময় সিরিয়ায় মারাত্মক আকারে প্লেগ রোগ দেখা দেয়। ফলে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছিলো। হযরত ওমর (রা) এ সংবাদে বিচলিত হয়ে পড়লেন। এমনকি তিনি মদিনা থেকে স্বয়ং সুরাগ নামক স্থানে উপস্থিত হলেন। হযরত ওবায়দাহ (রা) গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ খলীফাকে অভ্যর্থনা জানালেন। প্লেগের ব্যাপারে অনেক কথা বার্তার পর খলীফা হযরত ওবায়দাহকে তাঁর সাথে মদীনায় যেতে বললেন। কিন্তু ওবায়দাহ (রা) অন্যান্যদেরকে এ অবস্থায় ছেড়ে যেতে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, ‘কপালের লেখা কখনও বদলায় না। সুতরাং মুসলমানদিগকে ত্যাগ করে আমি এখান থেকে কোথাও যাওয়া ভাল মনে করছি না’।

পরবর্তীতে হযরত ওবায়দাহ (রা) প্লেগে আক্রান্ত হন। রোগের অবস্থা ক্রমাবনতির দিকে গেলে তিনি হযরত মুয়াজ ইবন জাবাল (রা) কে নামাযের ইমামতির হুকুম দেন। অতপর লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘বন্ধুগণ! এ রোগ আল্লাহর রহমত এবং রাসূল (সা)-এর দো’আ। ইতোপূর্বে অসংখ্য মুমীন মুসলমান এ রোগে বিদায় নিয়েছেন। এখন আবূ ওবায়দাও সেই পথে তাঁর প্রভুর মিলন প্রার্থী।

এরপর হযরত মুয়ায (রা) নামায শুরু করলে হযরত ওবায়দাহ (রা) ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

মুয়াজ ইবন জাবাল (রা) তাঁর কাফন দাফনের ব্যবস্থা করলেন এবং সমবেত জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘বন্ধুগণ! আজই এ ব্যক্তি আমাদেরকে নিঃসঙ্গ করে চলে গেলেন। খোদার কসম, যাঁর মতো নির্মল ও কোমল অন্তর, নিঃস্বার্থ, অহিংসুক, দূরদর্শী এবং জনগণের হিতাকাঙ্খী আমি আর দেখি নি। তাঁর আত্মার মাগফেরাতের জন্য সকলেই দোয়া করুন’।

হিজরী ১৮ সনে তিনি ইন্তেকাল করেন। এ সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল আটান্ন বছর।

হযরত ওবায়দাহ (রা)-এর লাশের জানাযা পড়ান মুয়াজ বিন জাবাল (রা)। দাফন করার সময় কবরে নামেন মুয়াজ, আমর ও দাহক। লাশ দাফনের পর হযরত মুয়াজ (রা) বলেন, ‘আবূ ওবায়দা, আল্লাহ আপনার ওপর রহম করুন। আল্লাহর কসম! আমি আপনার সম্পর্কে যতটুকু জানি কেবল ততটুকুই বলবো, অসত্য কোন কিছু বলবো না। কারণ, আমি আল্লাহর শাস্তির ভয় করি। আমার জানা মতে আপনি ছিলেন আল্লাহকে অত্যাধিক স্মরণকারী, বিনম্রভাবে যমীনের ওপর বিচরণকারী ব্যক্তিদের একজন। আর আপনি ছিলেন সেই সব ব্যক্তিদের অন্যতম যাঁরা তাঁদের রবের উদ্দেশ্যে সিজদারত ও দাঁড়ানো অবস্থায় রাত্রি অতিবাহিত করে এবং যাঁরা খরচের সময় অপচয়ও করে না, কার্পণ্যও করে না বরং মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন করে থাকে’।

হযরত আবূ ওবায়দাহ (রা) প্রায়ই পরকালের ভয়ে কান্নাকাটি করতেন। কারণ জীবনের শেষ দিকে তার সহায় সম্পদ প্রচুর হয়েছিল। এ প্রসংগে তিনি নিজেই বলেছেন, এখন দেখছি, আমার বাড়ি খাদেমে এবং আস্তাবল ঘোড়ায় ভরে গেছে। হায় আমি কিভাবে রাসূলুল্লাহকে (সা) মুখ দেখাবো? রাসূল (সা) বলেছিলেন, সেই ব্যক্তিই আমার সর্বাধিক প্রিয় হবে, যে ঠিক সেই অবস্থায় আমার সাথে মিলিত হবে যে অবস্থায় আমি তাকে ছেড়ে যাচ্ছি।

হযরত আবূ ওবায়দাহ ছিলেন, দীর্ঘাঙ্গী হালকা পাতলা গড়ন, গৌরকান্ত ও প্রজ্জ্বল মুখমণ্ডলের অধিকারী। তিনি দেখতে এতো সৌম দর্শন ছিলেন যে সবারই চোখ জুড়িয়ে যেতো। তাকে দেখার সাথে সাথে ভেতরে ভেতরে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জাগ্রত হতো। রাসূল (সা)-এর ভাষায় তিনি ছিলেন জাতির বিশ্বাস ভাজন ব্যক্তি। সর্বোপরি তিনি ছিলেন ঐ সম্মানীত দশজন সাহাবীর একজন যাঁরা পৃথিবীতে বেঁচে থাকতেই বেহেশতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন।

হযরত সাঈদ ইবন যায়িদ (রা)

‘আপনারা জেহাদ করবেন আর আমি বঞ্চিত থাকবো, আমি তা সহ্য করতে পারবো না। যে গভর্নরের পদ গ্রহণ করে আমার জেহাদকে কোরবানী দিতে হবে, আমার পক্ষে তা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং পত্র পাওয়া মাত্র অনতিবিলিম্বে অপর একজনকে আমার স্থলে প্রেরণ করুন। অতিতাড়াতাড়িই আমি আপনার খেদমতে হাজির হতে চাই’। এ ছিলো সদ্য দামেস্কের গভর্নর পদ প্রাপ্ত হযরত সাঈদ (রা)-এর অভিমত। দামেস্ক ও ইয়ারমুকের যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হযরত আবু ওবাইদাহ, হযরত সাঈদ ইবন যায়িদ (রা) কে দামেস্কের গভর্নর করে পাঠালে তিনি এ উক্তি করেন।

তাঁর নাম সাঈদ। ডাকনাম আবুল আওয়ার। আব্বার নাম যায়িদ এবং মার নাম ফাতিমা বিনতে বাজা। তাঁর বংশগত শাজরা এ রকম- সাঈদ ইবন যায়িদ, ইবন আমর, ইবন কোযাইল, ইবন আবদুল ওযযা, ইবন রিয়াহ, ইবন আবদুল্লাহ, ইবন কুরয, ইবন যারাহ, ইবন আদী, ইবন কা’ব ইবন লুওয়াই আল কারশী আল আদাভী। ঊর্ধ্বতন পুরুশ কাব ইবন লুওয়াই পর্যন্ত গিয়ে রাসূল (সা)-এর বংশের সাথে মিলিত হয়েছে।

সাঈদ (রা) সেই সৌভাগ্যবান পিতার সন্তান যিনি ইসলামের আগমনের পূর্বেই পৌত্তলিকতা ও শিরক থেকে নিজেকে হেফাজত করে তাওহীদের আলোকে আলোকিত হন। আইয়ামে জাহেলিয়াতের সেই যুগেও তিনি সকল প্রকার অশ্লীলতা ও পাপাচার থেকে নিজেকে মুক্ত রাখেন। এমন কি মুশরিকদের হাতে জবাই করা জন্তুর গোশত পর্যন্ত তিনি স্পর্শ করেন নি।

বোখারী শরীফে বর্ণিত একটা ঘটনা থেকে জানা যায় যে, নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে একদিন তানঈমের পথে ওয়াদিয়ে বালদাহ নামক স্থানে সাঈদের (রা) পিতা যায়িদের সাথে রাসূল (সা) কে খাবার দিলে তিনি খেতে অস্বীকার করেন। এরপর যায়িদকে দেয়া হলে তিনিও তা খেতে অস্বীকৃতি জানান এবং বলেন, ‘আমি তোমাদের মূর্তির জন্য যবাইকৃত খাদ্য খাইনা’।

শুধু তাই নয় তিনি দেবদেবীর নামে জন্তু জবাই করার তীব্র প্রতিবাদ পর্যন্ত করেছেন। কোন এক উৎসবের সময় যায়িদ দেখতে পান কুরাইশদের ধনী ব্যক্তি গৃহপালিত পশুকে জাকজমকের সাথে সাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের আরাধ্য দেবদেবীর সামনে বলি দেওয়ার জন্য। এ দৃশ্য দেখে তিনি কাবার দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে বললেন, ‘কুরাইশ গোত্রের লোকেরা! এ ছাগল গুলি সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ। তিনিই আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে তাদের পান করান, যমীনে ঘাস সৃষ্টি করে তাদের আহার দান করেন। আর তোমরা অন্যের নামে সেগুলি যবাই করো? আমি তোমাদেরকে একটি মূর্খ সম্প্রদায় হিসাবে দেখতে পাচ্ছি’।

যায়িদ-এর এহেন উক্তি শুনে চাচা আল খাত্তাব মানে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাবের আব্বা তাঁর গালে বসিয়ে দিল প্রচণ্ড এক থাপ্পড়। তারপর বললো, ‘তোর সর্বনাশ হোক! তোর মুখ থেকে এধরনের বাজে কথা সব সময় শুনেও সহ্য করে আসছি। সহ্যের সীমা আমাদের এখন অতিক্রম করে গেছে’। এতেও খাত্তাবের রাগ যখন পড়লনা তখন যায়িদের বিরুদ্ধে গোত্রের সহজ সরল লোকদেরকে লেলিয়ে দিলো। পরিস্থিতি এতদূর গড়ালো যে শেষ পর্যন্ত যায়িদ মক্কাতে টিকতে না পেরে হিরা গুহায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন। কিন্তু তবুও খাত্তাব খুশি হতে পারলোনা, সে একজন কুরাইশ যুবককে সর্বদা পাহারায় রাখলো –যায়িদ যেনো মক্কার প্রবেশ করতে না পারে।

অবশ্য যায়িদ গোপনে –ওসমান ইবনুল হারিস, আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ, ওরাকা ইবন নাওফিল, উমাইমা বিনতু আবদুল মুত্তালিবের সাথে মিলিত হয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আল্লাহর কসম। আপনারা নিশ্চিত ভাবে জেনে রাখুন, আপনাদের এ জাতি কোন ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নেই। তারা দ্বীনে ইবরাহীমকে বিকৃত করে ফেলেছে; তারা বিরুদ্ধাচরণ করে চলেছে। আপনারা যদি মুক্তি চান তো নিজেদের জন্য একটি দ্বীন অনুসন্ধান করুন”।

যায়িদ সেই যুগেও একজন তওহীদবাদী হওয়ার কারণে গর্ভবোধ করতেন। হযরত আয়েশা (রা)-এর বড় বোন হযরত আসমা (রা) বলেন, ‘একদিন আমি যায়িদকে কা’বা ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখেছি। তিনি বলছিলেন, ‘হে কুরাইশরা! আমি ব্যতীত তোমাদের কেউই ইবরাহীম (আঃ)-এর ধর্মাবলম্বী নও’।

তিনি যে চারজন কুরাইশকে দ্বীন অনুসন্ধানের পরামর্শ দিয়েছিলেণ তার মধ্যে ওয়ারাকা খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। অন্যরা কোন সিদ্ধানতন্তে পৌঁছাতে পারেননি। আর যায়িদ এর জীবনে ঘটলো ভিন্নতরো ঘটনা। তিনি প্রকৃত দ্বীন অনুসন্ধানের মানসে ইহুদী ও খৃষ্টান আলেমদের নিকট গেলেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি ইহুদী ও খৃষ্ট ধর্ম সম্পর্কে অবগত হলাম; কিন্তু সে ধর্মে মানসিক শান্তি পাওয়ার মতো তেমন কিছু না পেয়ে তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলাম। এক পর্যায়ে আমি শাম দেশে এসে উপস্থিত হলাম। আগেই শুনেছিলাম সেখানে একজন ‘রাহিব’ সংসার ত্যাগী ব্যক্তি আছেন, যিনি আসমানী কিতাবে অভিজ্ঞ। আমি তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে আমার কাহিনী বিবৃত করলাম। আমার কথা শুনে তিনি বললেন, ‘ওহে মক্কাবাসী ভাই, আমার মনে হচ্ছে আপনি দ্বীনে ইবরাহীম অনুসন্ধান করছেন’।

বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি তাই অনুসন্ধান করছি’।

তিনি বললেন, ‘আপনি যে দ্বীনের সন্ধান করছেন, আজকের দ্বীনেতো তা পাওয়া যায় না। তবে সত্য তো আপনার শহরে। আল্লাহ আপনার কওমের মধ্য থেকে এমন এক ব্যক্তি পাঠাবেন যিনি দ্বীনে ইবরাহীম পুনরুজ্জীবিত করবেন। আপনি যদি তাঁকে পান তো তাঁর অনুসরণ করবেন’।

যায়িদ দ্রুত ম্ককার দিকে রওনা হলেন। কিন্তু পথিমধ্যে একদল ডাকাত কর্তৃক তিনি আক্রান্ত ও নিহত হন। ফলে মহানবী (সা)-এর সাক্ষাত তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। তবে জানা যায় তিনি মৃত্যুর আগে আকাশের দিকে মুখ তুলে দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ! যদিও এ কল্যাণ থেকে আমাকে বঞ্চিত করলেন, আমার পুত্র সাঈদকে তা থেকে আপনি নিরাশ করবেন না’। যায়িদের এ দোয়া আল্লাহ পাক কবূল করেছিলেন। ইসলাম প্রচারের প্রথম ভাগে যাঁরা ইসলাম কবূল করেন হযরত সাঈদ (রা) তাঁদেরই একজন। সম্ভবত তাঁর পূণ্যাত্মা পিতা যায়িদের দোয়ার কারণেই তিনি দাওয়াত পাওয়ার সাথে সাথে বিনা বাক্য ব্যয়ে তা কবুল করেন। তখন তার বয়স ছিলো মাত্র বিশ বছর। তিনি তাঁর স্ত্রী ফাতিমা বিনতে খাত্তাবসহ ইসলাম গ্রহণ করেন। তোমরা শুনলে খুশি হবে যে, সাঈদ (রা)-এর স্ত্রী ফাতিমা ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাবের বোন। আর এই বোন ও ভগ্নীপতিকে ইসলাম গ্রহণের অপরাধে শাস্তি দিতে গিয়েই ওমর (রা) ইসলাম কবুল করেন। অর্থাৎ সাঈদ ও তাঁর স্ত্রী ফাতিমার দাওয়াতেই হযরত ওমর (রা) ইসলাম কবূল করেন।

ইসলাম কবূলের পর কাফের মুশরিকতের অত্যাচারে মক্কায় হিজরত করেন। মদীনায়র তিনি হযরত রেফায়া ইবন আবদুল মুনযের-এর মেহমান হন। পরে রাসূল (সা) সাঈদ (রা) ও হযরত রাফে ইবন যায়িদকে (রা) গুপ্তচর হিসাবে পাঠান। তাঁরা শাম দেশের সীমান্তবর্তী তুজবার নামক স্থানে কশদ জোহানীর মেহমান হন। কোরাইশ বাণিজ্য কাফেলা সীমান্ত অতিক্রম করার পর পরই গুপ্তচরদ্বয় দ্রুত মদীনার উদ্দেশ্যে রওনা হন সংবাদটি রাসূল (সা)-এর নিকট পৌঁছানোর জন্য।

কিন্তু কোরাইশ বাণিজ্য কাফেলার লোকেরা বিষয়টি কিছুটা আঁচ করতে পেরে তাদের পথ পরিবর্তন করে সমুদ্র তীরবর্তী পথ ধরে চলা শুরু করে। এই বাণিজ্য কাফেলা ও মক্কা থেকে আগত তাদের সশস্ত্র সাহায্য কারীরা একত্রিত হয়ে বদর নামক স্থানে মুসলমানদের মুখোমুখি হয়। এই যুদ্ধই ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ নামে খ্যাত। মুসলমানেরা মাত্র ৩১৩ জন সৈন্য নিয়ে ১০০০ জন কোরাইশ সৈন্যের সাথে যুদ্ধ করে এবং বিজয়ী হয় ও ৭০ জন বন্দী হয়। তোমরাশুনে খুশি হবে এ যুদ্ধেই আবূ জেহেল নিহত হয়।

হযরত সাঈদ (রা) ও হযরত তালহা (রা) যখন মদীনায় পৌঁছান, তখন বদরের যুদ্ধ শেষ করে মুসলিম গাজীগণ মদীনায় ফিরছিলেন। যদিও এ যুদ্ধে সাঈদ (রা) সরাসরি অংশ গ্রহণ করতে পারেননি, তবুও যেহেতু এ ব্যাপারেই রাসূল (সা) তাঁদেরকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। তাই বদরের যুদ্ধে প্রাপ্ত মালে গণীমতের ভাগও তাঁকে দেওয়া হয়। এমন কি রাসূল (সা) তাঁকে জেহাদের ভাগও তাঁকে দেওয়া হয়। এমন কি রাসূল(সা) তাঁকে জেহাদের সওয়াব প্রাপ্ত হওয়ারও সুসংবাদ দেন। বদর যুদ্ধ ছাড়া বাকী সকল যুদ্ধে হযরত সাঈদ (রা) অংশ গ্রহণ করেন এবং বীরত্বের পরিচয় দেন। পারস্যের কিসরা ও রোমের কায়সারের সিংহাসন পদানত করার ব্যাপারে তিনি বিরাট ভূমিকা পালন করেন। তাঁর বীরত্বের কারণেই ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হয়। ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলমান পক্ষে সৈন্য সংখ্যা ছিল ছাব্বিশ হাজার বা তার কাছাকাছি। অপরদিকে রেমানা বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল একলক্ষ বিশ হাজার। শত্রুপক্ষের এ বিশাল বাহিনী দেখে মুষ্ঠিমেয় মুসলিম সৈন্যরা যখন হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো, তখন মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি আবূ উবাইদাহ এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা পেশ করেন। এ বক্তৃতা শুনে মুসলিম বাহিনীর একজন সৈনিক বেরিয়ে এসে আবূ উবাইদাহকে বললেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ মুহুর্তে আমি আমার জীবন কুরবানী করবো’। সাঈদ (রা) বলেন, ‘আমি তাঁর কথা শুনা মাত্রই দেখতে পেলাম সে তাঁর তরবারি কোষমুক্ত করে আল্লাহর শত্রুদের সাথে সংঘর্ষের জন্য অগ্রসর হচ্ছে। এ অবস্থায় আমি দ্রুত মাটিতে লাফিয়ে পড়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে অগ্রসর হলাম। এবং আমরা বর্শা হাতে প্রস্তুত হয়ে গেলাম। শত্রুপক্ষের প্রথমযে ঘোড়সওয়ার আমাদের দিকে এগিয়ে এলো আমি তাকে আঘাত করলাম। তারপর অত্যন্ত সাহসিকতারসাথে শত্রু বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আল্লাহ তা’আলা আমার অন্তর থেকে সকল প্রকার ভয়ভীতি একেবারেই দূর করে দিলেন। অতঃপর মুসলিম বাহিনী রোমান বাহিনীর ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ চালালো এবং তাদেরকে পরাজিত করলো’।

দামেস্ক অভিযানেরকথা তো তোমাদের প্রথমেই বলেছি যে, তিনি দামস্তের গভর্নরের পদ ত্যাগ করে যুদ্ধের ময়দানে চলে আসেন। বুঝতেই পারছো তিনি ছিলেন কতবড় যোদ্ধা ও ঈমানদার মানুষ। যিনি কিতা ক্ষমতার মসনদ ত্যাগ করে নিজের জীবনকে তলোয়ারের ছায়ায় পেশ করেছেন।

হযরত সাঈদ (রা) অত্যন্ত নির্লোভ একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিলো একান্তই সাদা সিধা! আতীক নামক স্থানে তাঁর কিছু জমি ছিলো। এ জমির আয় থেকেই তিনি কোন রকম জীবন যাপন করতেন। কোন ধরনের উচ্চাকাংক্ষা তাকে কখনো স্পর্শ করেনি। তাঁর এই দরিদ্র অবস্থা দেখে শেষ বয়সে হযরত ওসমান (রা) তাঁকে কিছু জমি দান করেন।

হযরত মোয়াবিয়ার আমলে হযরত সাঈদ (রা)-এর বিরুদ্ধে আরওয়া বিনতে উওয়াইস নাম্নী এক মহিলা মদীনার গভর্ণর মারওয়ান ইবনহাকিমের দরবারে জমি জবর দখলের মামলা দায়ের করে। এ মামলাকে কেন্দ্র করে ঘটে এক শিক্ষণীয় ও মনে রাখার মতো ঘটনা।

আরওয়া নাম্নী ও মহিলা মারওয়ানের দরবারে গিয়ে বলে, ‘হযরত সাঈদ ইবন যায়িদ (রা)-এর জমি সংলগ্ন আমার ব্যক্তিগত কিছু জমি আছে। হযরত সাঈদ তা দখল করে নিয়ে নিজের জমির সাথে যোগ করেছেন। আমি এর বিচার চাই’।

মারওয়ান বিষয়টি কতটুকু ঠিক তা যাচাই করার জন্য লোক নিয়োগ করেন। সাঈদ (রা)-এর কাছে যখন বিষয়টি পেশ করা হলো তখন তিনি বললেন, আপনারা কি মনে করেন আমি তার ওপর যুলুম করেছি? অথচ আমি রাসূল (সা)-এর নিকট শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি অপরের কয়েক ইঞ্চি পরিমাণ জমিও যুলুম করে দখল করবে, কেয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির ঐ রকম সাতগুণ জমির হার তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে’। অতপর তিনি বলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! যদি এ মহিলাটি নিজের দাবীতে মিথ্যাবাদী হয় তবে সে অন্ধ হয়ে যাক এবং যে কূপ নিয়ে সে আমার সাথে ঝগড়া করছে সে কূপই তার কবর হোক’।

এর কিছুদনি পরেই সত্যিসত্যিই মহিলাটি অন্ধ হয়ে যায় এবং বিতর্কিত কূপে পড়ে সে মারা যায়। ফলে ঘটনাটি কিংবদন্তীর মত মদীনায় ছড়িয়ে পড়ে এবং লোকেরা অভিশাপ দিতে যেয়ে বলতো, ‘আল্লাহ তোমাকে অন্ধ করুন, যেমন অন্ধ করেছেন আরওয়াকে।

হযরত সাঈদ (রা) নিজেকে সকল প্রকার ঝগড়া ফাসাদ থেকে হেফাজত করেন। তাইবলে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ছাড়েননি। হযরত ওসমান (রা)-এর শাহাদাতের পর তিনি প্রায়ই কুফার জামে মসজিদে দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘তোমরা হযরত ওসমান (রা)-এর সাথে যে আচরণ করেছো তাতে যদি ওহুদের পাহাড়ও কেঁপে ওঠে,তো আশ্চর্যের কিছুই নেই।

মুগীরা ইবন শো’বা তখন কুফার গভর্নর। কোন একদিন হযরত সাঈদ (রা)-এর উপস্থিতিতে জামে মসজিদে একজন কুফাবাসী মুগীরার দিকে মুখ করে হযরত আলকে গালি দিতে থাকে। সাঈদ (রা) এহেন পরিস্তিতিতে বলে ওঠেন, ‘মুগীরা, হে মুগীরা! রাসূল (সা)-এর সাহাবীদের আপনার সামনে গালি দেওয়া হবে, আর আপনি তার প্রতিবাদ করবেন না, এ দেখতে চাই না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, রাসূল (সা) বলেছেন, ‘আবূ বকর, ওমর, ওসমান, আলী, তালহা, যুবাইর, আবদুর রহমান, সা’দ (রা) এরা সবাই জান্নাতী। আর যদি তোমরা চাও তো আমি দশম জান্নাতী ব্যক্তির নাম বলতে পারি’।

অতপর জনতার অনুরোধে তিনি বললেন, ‘দশম ব্যক্তি আমি নিজে’।

হিজরী পঞ্চাশ সনে আশারায়ে মোবাশশারার এ সম্মানিত সদস্য সত্তর বছর বয়সে আকীক উপত্যকায় নিজ বাস ভবনে ইন্তেকাল করেন। হযরত সা’দ ইবন আবীওয়াক্কাস তাঁর গোসল ও কাফনের ব্যবস্থা করেন এবং আবদুল্লাহ ইবন ওমর (রা) তাঁর জানাযার নামায পড়ান।

এরপর মদীনায় এনে তাঁকে দাফন করা হয়। হযরত সাঈদ (রা) এর জীবনী খুব বেশী জানা যায়নি। এ বুজুর্গ সাহাবা যুদ্ধ ক্ষেত্রে থাকতেন রাসূল (সা)-এর আগে এবং নামাযে থাকতেন পেছনে।

— সমাপ্ত —


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি