হযরত আলী ইবন আবু তালিব (রা)
রাসূল (সা)-এার যুগে কোন একদিন তিনজন লোক পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এদের একজনের কাছে পাঁচটি রুটি ও সেই পরিমাণ তরকারী, দ্বিতীয় জনের কাছে তিনটি রুটি ও সমপরিমাণ তরকারী ছিল কিন্তু তৃতীয় জনের কাছে কিছুই ছিল না। পথ চলতে চলতে খাবার সময় উপস্থিত হলে তিনজন একসঙ্গে বসে খেলো। তৃতীয় জন খাবারপ এদের নিকট থেকে বিদায় হয়ে গেলো এবং যাবার সময় আটআনা পয়সা দিয়ে গেলো। কিন্তু গোল বাঁধলো ঐ পয়সা নিয়ে। প্রথম ব্যক্তি অর্থাৎ পাঁচটি রুটির মালিক বললো, যেহেতু রুটি ছিলো আমার পাঁচটি আর তোমার নিতটি সেহেতু পয়সা আমি পাবো পাঁচ আনা আর তুমি পাবে তিন আনা। দ্বিতীয় জনের দাবি আমার রুটি তিনটি আর তোমার পাঁচটি একথা সত্য, তবে যেহেতু রুটি সবাই সমান খেয়েছি সেজন্য পয়সাও সমান সমান ভাগ হবে। অর্থাৎ তুমি চার আনা আমি চার আনা। এভঅনে অনেকক্ষণ তর্কাতর্কির পর যখন কেউ কারো দাবি ছাড়লো না তখন তারা হযরত আলী (রা)-এর নিকট এসে বিচার প্রার্থনা করলো। হযরত আলী সব শুনে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে প্রথম ব্যক্তির প্রস্তাবানুযায়ী তিন আনা নিয়ে খুশী হতে বললেন। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তি গো ধরে বললো, না জনাব! আমি আপনার পক্ষ থেকেই বিচার আশা করি’। হযরত আলী তখন বললেন, ‘আমার বিচার অনুযায়ী তুমি পাবে এক আনা আর প্রথম ব্যক্তি পাবে সাত আনা’।

হযরত আলীর কথা শুনে দ্বিতীয় ব্যক্তির চক্ষুতো ছানাবড়া! তার অবাক হবার ভাব দেখে হযরত আলী বললেন, ‘বুঝলে না! তোমাদের কথানুযায়ী তোমাদের মোট রুটি ছিলো আটটি। কিন্তু তিনজন মানুষ তো আর আটটি রুটি সমান ভাগ করে খেতে পারে না। তাই প্রত্যেকটি রুটিকে যদি সমান তিনভাগে ভাগ করা হয় তাহলে আটটিতে হয় মোট চব্বিশটি টুকরা, আর প্রত্যেকের ভাগের ভাগ পড়ে আট টুকরা করে। এখঅনে তোমার রুটি ছিলো তিনটি, তাতে হয় নয়টি টুকরা। এই নয়টির মধ্যে তুমি খেয়েছো আটটি, তাতে হয় নয়টি টুকরা। এই নয়টির মধ্যে তুমি খেয়েছো আটটি, আর থাকে মাত্র একটি। অপর দিকে প্রথম ব্যক্তির পাঁচটি রুটিতে হয় পনেরটি টুকরা –সে খেয়েছে আটটি টুকরা। তাহলে বাকী থাকে সাতটি টুকরা। তাই প্রথম ব্যক্তি তার সাত টুকরার জন্য পাবে সাত আনা আর তুমি তোমার এক টুকরার জন্য পাবে এক আনা’। দেখলে তো কি সুন্দর বিচার। আর এ বিচার ক্ষমতার কারণেই রাসূল (সা) হযরত আলীকে ইয়েমেনের বিচারপতি নিযুক্ত করেছিলেন।

নাম আলী। পুরো নাম আলী ইবন আবূ তালিব। ডাক নাম ছিলো আবুল হাসান ও আবূ তুরাব। তাঁর উপাধি ছিলো হায়দার, মুরতাজা ও আসদুল্লাহ। আব্বার নাম আবূ তালিব আবদু মান্নাফ, মায়ের নাম ফাতিমা বিনতে আসাদ। ঘটনাক্রমে আব্বা আম্মা উভয়ের কুরাইশ বংশের হাশিমী শাখার লোক। সব থেকে আনন্দের কথা হলো তিন স্বয়ং নবী করীম (সা)-এর আপন চাচাত ভাই।

মহানবী (সা)-এর ত্রিশ বছর বয়সে হযরত আলী কাবা ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। হযরত আলী (রা) ছাড়া অন্য কেউই কাবা ঘরের মত জায়গায় জন্মগ্রহণ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন নি। তা’ছাড়া তাঁর যে দুটি নাম হায়দার ও আলী রাখা হয়েছিলো তাও ছিলো ব্যতিক্রমধর্মী। সত্যি বলতে কি এর পূর্বে সমগ্র আরবে এ ধরনের নাম আর কারো ছিলনা। সে জন্য আবূ তালিব এ নামকে এলহামী নাম বলে উল্লেখ করেছেন। রাসূল (সা)-এর চাচা আবূ তালিব ছিলেন দরিদ্র মানুষ। তা’ছাড়া তাঁর পরিবারের লোকসংখ্যাও ছিলো বেশী। হযরত আলী (রা)-এর বয়স যখন পাঁচ বছর আরব দেশে তখণ খাদ্যাভাব দেখা দেয়, তাই চাচার ওপর থেকে চাপ কমানোর জন্য মহানবী (সা) আলী (রা) কে নিজ দায়িত্বে নিয়ে নেন। এরপর আলী (রা) আর পিতার সংসারে ফিরে যাননি। রাসূল (সা) যখন নবূওয়ত প্রাপ্ত হন তখন আলী (রা)-এর বয়স দশ-এগার বছর হবে। আলী একদিন অবাক হয়ে দেখলেন ঘরের ভেতর রাসূল (সা) ও হযরত খাদিজা (রা) মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে আছে অর্থাৎ সিজদাহ করছেন। আলী (রা), ‘এ কি হচ্ছে জানতে চাইলে’। রাসূল (সা) বললেন, ‘এক আল্লাহর ইবাদত করছি। তোমাকে এ পথে আসার দাওয়াত দিচ্ছি’।

হযরত আলী নির্দ্বিধায় দাওয়াত কবূল করলেন।

পুরুষদের মধ্যে কে প্রথম ইসলাম কবূল করেন এ নিয়ে মতভেদ আছে। সালমান ফারসী (রা) ও ইবন আব্বাস (রা)-এর বর্ণনা মতে হযরত খাদিজা (রা)-এর পর হযরত আলী প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। তবে সবাই এ ব্যাপারে একমত যে, মহিলাদের মধ্যে উম্মুল মূ’মিনীন হযরত খাদিজাতুল কুবরা, বয়স্কদের দশ্যে হযরত আবূ বকর, দাসদের মধ্যে যায়িধ বিন হারিসা, কিশোরদের মধ্যে হযরত আলী (রা) প্রথম ইসলাম কবূল করেন।

নবুওয়তের চতুর্থ বছরে আত্মীয় স্বজনের নিকট দাওয়াদ পৌঁছানোর নির্দেশ আসলে রাসূল (সা) সাফা পর্বতের ওপর দাঁড়িয়ে, ‘হে আহলে গালেব’ বলে হাক ছাড়লেন। এ ডাকে কোরাইশগণ পর্বতের পাদদেশে একত্রিত হলো কিন্তু রাসূল (সা)-এর কথা শুনে তারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো এবং আজে বাজে কথা বলে চলে গেলো। এরপর হযরত আলীর সহযোগিতায় রাসূল (সা) নিজ বাড়িতে কিছু লোককে আপ্যায়নের জন্য দাওয়াত দিলেন। এতে আবূ লাহাব, আবূ তালিব, হযরত হামযা, হযরত আব্বাসসহ প্রায় চল্লিশজন লোক উপস্থিত ছিলেন। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে রাসূল (সা) বললেন, ‘হে আবদুল মুত্তালিবের সন্তানগণ। আমি তোমাদের জন্য সেই বস্তু নিয়ে এসেছি, যা তোমাদেরকে ইহ-পরকালের উত্তম নেয়ামতসমূহ দিয়ে ভূষিত করবে। তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি যে আমাকে এ কাজে সাহায্য করবে?’

এহেন আহবানের পরও কুরাইশ নেতৃবৃন্দ চুপ থাকলো, কেউ কোন কথা বললো না। হঠাৎ কিশোর আলী দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমি আপনাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা কম বয়সী আর রুগ্ন। তবুও আমি আপনাকে সাহায্য করবো’। একথা তিনি রাসূল (সা)-এর আহবানের প্রেক্ষিতে তিনবার বললেন। তৃতীয়বার বলার পর রাসূল (সা) বললেন, ‘তুমিই আমার ভাই এবং ওয়ারিশ হবে’। সত্যি কথা হলো এরপর সর্বাবস্থায় আলী (রা) মহানবী (সা)-এর সাহায্যকারী ছিলেন।

যতই দিন যেতে লাগলো মুসলমানদের ওপর কাফির মুশরিকদের অত্যাচার নির্যাতন বেড়ে চললো। এক পর্যায়ে নবী (সা)-এর নির্দেশে কিছু লোক হাবশায় হিযরত করলেন, পরবর্তীতে মদীনায়। নবূয়াত প্রাপ্তির তেরো বছরে আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল (সা)-এর হিজরত করার হুকুম হলো। ওদিকে কুরাইশগণ ইসলামের অগ্রযাত্রা রুখতে না পেরে খোদ রাসূল (সা) কেই হত্যার ষড়যন্ত্র করলো। ঠিক হিজরতের দিন তারা রাসূল (সা)-এর বাড়ি ঘেরাও করলো। কাফিররা সন্দেহ না করে এ জন্যে নবী (সা) হযরত আলীকে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিলেন এবং গোপনে বাড়ি থেকে সিদ্দিকে আকবরের হাত ধরে বের হয়ে গেলেন। এদিকে রাসূল (সা) কে নিরাপদে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সুযোগ দিতে পেরে শেরে খেঅদা নিশ্চিন্তে ঘুমালেন। তিনি জানতেন, যে কোন মুহুর্তে কাফেররা ঘরে ঢুকে মুহাম্মদ (সা) মনে করে এক কোপে তাকে দু’খণ্ড করে ফেলতে পারে, নির্মমভাবে তাকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু যাঁর মনে রয়েছে আল্লাহর ভয়, সে কি কখনো মানুষের ভয়ে ভীত হয়? রাসূল (সা)-এর জন্য জীবন দেয়া তো পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।

সকাল হতে না হতেই কাফেররা ঘরে ঢুকে দেখলো মুহাম্মদ (সা)এর জায়গায় শুয়ে আছে তারই ভক্ত, আপন চাচাতো ভাই আলী ইবন আবূ তালিব। নিশ্চিত শিকার হাত ছাড়া হওয়ায় কাফেরগণ ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে গেলো।

রাসূল (সা) যখন আলীকে নিজ বিছানায় রেখে যান তখন তাকে বলেন, ‘আমি চললাম। তুমি এ সমস্ত আমানত তাদের মালিকের নিকট পৌঁছে দিয়ে চলে এসো’। হযরত আল নিজেই এ ব্যাপারে বলেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনা রওয়ানা হওয়ার পূর্বে আমাকে নির্দেশ দিলেন, আমি মক্কায় থেকে যাবো এবং লোকদের যে সব আমানত তাঁর কাছে আছে তা ফেরত দেবো। এ জন্যই তো তাঁকে ‘আল-আমীন’ বলা হতো’।

আমি তিনদিন মক্কায় থাকলাম। তারপর রাসূলুল্লাহর (সা) পথ ধরে মদীনার দিকে বেরিয়ে পড়লাম। অবশেষে বানূ ‘আমর ইবন আওয়াফ যেখানে রাসূল (সা) অবস্থান করছিলেন, আমি সেখানে উপস্থিত হলাম। কুলসুম ইবন হিদামের বাড়িতে আমার আশ্রয় হলো’। রাসূল (সা) হযরত আলীকে অত্যাধিক স্নেহ করতেন কিন্তু এ ঘটনায় তিনি এতো খুশি হয়েছিলেন যে, আলী যখন মদীনায় তাঁর কাছে পৌঁছুলেন তখন তিনি তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, কপালে চুমো দিলেন, এমনকি নিজ হাতে আলীর পোষাকের ধূলোবালি ঝেড়ে দিলেন।

মাদানী জীবনে রাসূল (সা) যখন মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেন তখন এক পর্যায়ে হযরত আলী রাসূল (সা) কে বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা) আপনি আমাকে তো কারো ভাই বানাইয়ে দিলেন না’। একথা শুনে রাসূল (সা) আলীর কাঁধে একটি হাত রেখে বললেন, ‘হে আলী! দুনিয়া এবং আখিরাতে তুমিই আমার ভাই’। বুঝতেই পারছো হযরত আলী কত বড় সৌভাগ্যবান মানুষ ছিলেন। অবশ্য পরে রাসূল (সা) হযরত আলী ও সাহল বিন হুনাইফের মধ্যে ভ্রাতৃ সম্পর্ক কায়েম করে দিয়েছিলেন।

হিজরী দ্বিতীয় সনে নবী নন্দিনী খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা (রা)-এর সাথে হযরত আলী (সা) শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। স্বয়ং নবী (সা) এ বিয়ে পড়ান এবং নিজের অজুর পানি দুলহা ও দুলহীনের ওপর ছিটিয়ে দিয়ে দোয়া করেন। নবী (সা)-এর দৃষ্টিতে ফাতিমার জন্য হযরত আলীই ছিলেন উপযুক্ত পাত্র। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘যদি আল না হতো, তাহলে ফাতিমার জন্য স্বামী পাওয়া যেতো না’।

শেরে খোদা হযরত আলী একমাত্র তাবুক অভিযান ছাড়া অন্য সকল যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। বদরের যুদ্ধে যে দুটি কালো রংয়ের পতাকা মুসলমানদের ছিলো তার একটি ছিলো মহানবী (সা)-এর হাতে অপরটি হযরত আলী (রা) এর হাতে। বদরের যুদ্ধে মুসলমান সৈন্যদের জন্য উপযুক্ত স্থানও আলী নির্বাচন করেন। এ যুদ্ধে প্রথমেই উভয় পক্ষের তিনজন করে যোদ্ধা মুখোমুখি হয় –রাসূল (সা)-এর ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র আলী স্বয়ং প্রতিপক্ষ ওলীদকে আক্রমণ করে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেন। এরপর শাইবাকে হযরত উবাইদা (রা)-এর উপর আক্রমণ করতে দেখে আলী মুহুর্তের মধ্যে শাইবাকে আক্রমণ করে ধরাশায়ী করেন। এরই ফলে পুরো যুদ্ধের মোড় পাল্টে যায়। এবং মুসলশানদের জয় হয়। এরই ফলে পুরো যুদ্ধের মোড় পাল্টে যায়। এবং মুসলমানদের জয় হয়। এমনিভাবে সকল যুদ্ধে তিনি বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দেন। যার কারণেই রাসূল (সা) তাঁকে হায়ধার উপাধিতে ভূষিত করেন এবং ‘জুলফিকার’ নামক তরবারিটি উপহার দেন। সব থেকে আনন্দের কথা হলো রাসূল (সা)-এর যুগের সকল যুদ্ধেই তিনি ছিলেন মুসলমানদের নিশানবর্দার বা পতাকাবাহী। বদর যুদ্ধের কথা তো আগেই বলেছি। ওহুদের যুদ্ধে যে ক’জন মুজাহিদ রাসূল (সা) কে রক্ষা করার জন্য জানবাজী রেখে বুহ্য রচনা করেছিলেন, হযরত আলী তাদের অন্যতম।

খন্দকের যুদ্ধের প্রথমে, ‘আমর বিন আবদে উদ্দ বর্ম পরে বের হলো। সে হুংকার ছেড়ে বললো, ‘কে আমার সাথে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে? আলী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী, আমি প্রস্তুত। রাসূল (সা) বললেন, ‘এ হচ্ছে আমর তুমি বসো’। এভাবে আমর তিনবার আহবান করলো, হযরত আলীও তিনবার রাসূল (সা)-এর কাছে অনুমতি চাইলেন। শেষ বারও রাসূল (সা) বললেন, সে তো আমর। উত্তরে আলী (রা) বললেন, ‘তা হোক’। এরপর উভয়ে মুখোমুখি হলো এ সময়ে আলী একটি কবিতা আবৃতি করছিলেন। আমর খাপ থেকে তরবারী বের করেই আলী’র ঢাল এক আঘাতেই ফেড়ে ফেললো। আলীও পাল্টা আঘাতে আমরকে ধরাশায়ী করে ফেললেন। এ দৃশ্য দেখে খোদ রাসূল (সা) আনন্দে তাকবীর ধ্বনি দিয়ে ওঠেন। আমরকে নিকেশ করে আলী নিজের একটি কবিতা আবৃতি করতে করতে রাসূলের কাছে ফিরে আসেন।

খাইবার অভিযানের কথা তো তোমরা নিশ্চয় জানো। যখন হযরত আবূ বকর (রা) হযরত ওমর (রা) কিল্লাগুলি দখল করতে ব্যর্থ হলেন তখন রাসূল (সা) বললেন, ‘কাল আমি এমন এক বীরের হাতে ঝাণ্ডা তুলে দেবো, যে আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের প্রিয়পাত্র। তারই হাতে কিল্লাগুলির পতন হবে’। পরদিন সকালে সবাই জানলো এ দায়িত্বের ভার পড়েছে হযরত আলী হায়দারের ওপরে। হযরত আলী (সা) কিল্লাহর নিকটবর্তী হলে দেওয়ালের ওপর হতে জনৈক ইহুদী জিজ্ঞেস করলো, তোমার নাম কি? হযরত আলী বললেনে, আলী ইবনে আবূ তালিব। অতপর ইহুদি বললেন, আমি তওরাত কিতাবে পাঠ করেছি, এই ব্যক্তি যবরদস্ত এবং দুঃসাহসী বীর। জয় করা ছাড়া এই ব্যক্তি এই স্থান ছাড়বে না। সুতরাং তাঁকে বিনা রক্তপাতে কিল্লা ছেড়ে দিলেই ভাল হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা –ইহুদির এই সু পরামর্শ কেউ গ্রহণ করেনি।

খায়বার জয় করে ফিরলে রাসূল (সা) আলীর কপালে চুম্বন এঁকে দিয়ে বললেনৈ, ‘তোমার এ কাজে আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতাগণ খুশী হয়েছেন’।

তোমাদেরকে পূর্বেই বলেছি তাবুক যুদ্ধে আলী (রা) অংশগ্রহণ করতে পারেন নি। এর কারণ ছিলো তাবুক অভিযানকালে স্বয়ং রাসূল (সা) তাঁকে মদীনায় স্থলাভিষিক্ত করে যান। অবশ্য আলী (রা) যুদ্ধেই যেতে চেয়েছিলেন। এ সময় তিনি মহানবী (সা)-এর কাছে আরজ করেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি যাচ্ছেন, আর আমাকে নারী ও শিশুদের কাছে ছেড়ে যাচ্ছেন?’ উত্তরে রাসূল (সা) বলেন, ‘হারুণ যেমন ছিলেন মূসার, তেমনি তুমি হচ্ছো আমার প্রতিনিধি। তবে আমার পরে কোন নবী নেই’।

অষ্টম হিজরী সনে মক্কা বিজয় সংগঠিত হয়। এ সময়ে হযরত আলী মুহাজিরীনদের পতাকাবাহী ছিলেন। কাবা ঘরে প্রবেশ করে রাসূল (সা) হাজরে আসওয়াদে চুমা খেলেন এরপর মূর্তিগুলো বাইরে ফেলে দিলেন। একটি মূর্তি অপেক্ষাকৃত উচু জায়গায় থাকায় রাসূল (সা) হযরত আলীকে নিজ কাঁধে উঠিয়ে সেটা নামিয়ে ফেলেন।

নবম হিজরী সনে সিদ্দিকে আকবরকে আমীরুল হজ্ব নিযুক্ত করা হয়। পরে সূরা বারাআত নাযিল হলে কাফিরদের সাথে সম্পাদিত সকল চুক্তি বাতিলের জন্য নবী (সা) আলী (রা) কে প্রতিনিধি করে পাঠান। হযরত আলী জনসাধারণকে জানালেন, ‘এই বছরের পর হতে কোন মুশরিক হজ্জ্ব করতে পারবেনা এবং কোন ব্যক্তিই উলঙ্গ অবস্থায় কাবা ঘরে তাওয়াফ করতে পারবেনা। আর যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে কোন প্রকারের ওয়াদা করেছে সে যেন তা পূর্ণ করে।

দশম হিজরীতে রাসূল (সা) ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আলী (রা) কে ইয়েমেন পাঠান। আলী ইয়েমেন রওয়ানা হওয়ার সময় স্বয়ং রাসূলে খোদা তাঁর মাথায় পাগড়ী পরিয়ে দেন এবং দোয়া করেন। অল্প দিনের মধ্যেই ইয়েমেনবাসী ইসলাম কবুল করে। আলী (রা) যখন ইয়েমেন ছিলেন তখন তাঁকে দেখার জন্য রাসূল (সা) ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি দোয়া করেন, ‘আলীকে না দেখে যেনো আমার মৃত্যু না হয়’। বিদায় হজ্জ্বের দিন আলী ইয়েমেন থেকে এসে হাজরি হন।

রাসূল (সা)-এর ওয়াতের পর গোসল দেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন যিনি তিনি হলেন আলী (রা)।

হযরত আলী তাঁর পূর্ববর্তী তিনজন খলীফাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন। তিনি কখনই পদলোবী ছিলেন না। সে জন্যই হযরত ওসমানের শাহাদাতের পর তিনি খলীফার দায়ভার নিতে চাননি। পরে মদীনা বাসীদের চাপাচাপির কারণে তিনি খেলাফতের দায়িত্ব নিতে রাজি হন। তবে তিনি শর্ত দেন যে, তাঁর বাইয়াত প্রকাশ্যে হতে হবে। পরে মসজিদে নব্বীতে সর্বসম্মতিক্রমে তিনি খলীফা নির্বাচিত হন। মাত্র ১৫/১৬ জন বাদে সবাই তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। বিদ্রোহীরা খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য যে তিনজনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন তাঁরা হলেন হযরত তালহা, যুবাইর, ও আলী (রা)। হযরত ওমর (রা) মৃত্যুর পূর্বে খলীফা মনোনয়নের জন্য ছয়জন সাহাবীর নাম বলে যান। হযরত আলী তাঁদের অন্যতম। তিনি এ সময় আলী সম্বন্ধে মন্তব্য করেন, ‘লোকেরা যদি আলীকে খলীফা বানায়, তবে সে তাদেরকে সঠিক রাস্তায় পরিচালিত করতে পারবে’। খলীফা থাকা কালে হযরত ওমর একবার বায়তুল মাকদাস সফর করেন। এই সফরকালীন সময়ের জন্য তিনি আলীকে (রা) তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যান। মানে হযরত আলী (রা) খলীফা হওয়ার পূর্বেই দু’দুবার এ পদে স্থলাভিষিক্ত হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। পূর্বেই বলেছি তাবুক অভিযান কালে খোদ নবী (সা) তাঁকে এ দায়িত্ব দেন।

একটা জিনিস তোমাদের পরিস্কারভাবে জানা দরকার, ইসলাম প্রচারের প্রথম থেকেই মুসলশানদের ঘরে বাইরে শত্রু-রাসূল (সা)-এর যুগেই যেমন প্রকাশ্যে কাফেররা শত্রুতা করতো, তেমনি ভেতরে ভেতরে মোনাফিকরাও শত্রুতা করতো। হযরত ওসমান (রা)-এর সময় এসে মোনাফিকরা খুবই সুকৌশলে কাজ শুরু করে এবং হযরত ওসমান (রা)-এর শাহাদাতের ফলে তা আরো বিস্তৃতি লাভ করে। হযরত আলী (রা) এমনি এক দুঃখজনক পরিস্থিতিতে মুসলিম বিশ্বের খলীফা হন। খেলাফত প্রাপ্তির পরপরই তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয় হযরত ওসমান হত্যার বিচার করার জন্য। কিন্তু ঘটনা এমন ছিলো যে, হত্যাকারী কে তা সঠিক করে কেউ জানতো না। ওসমান (রা)-এর স্ত্রী নাইলা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কাউকে চিনতে পারেন নি। ফলে কাউকে সাজা দেয়া যাচ্ছিলো না। চক্রান্তকারীরা এ সুযোগটিই গ্রহণ করলে তাদের প্রচারণায় কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবাও ওসমান হত্যার বিচার দাবী করলেন। এঁদের মধ্যে হযরত আয়েশা (রা), হযরত তালহা (রা), হযরত যুবাইরের (রা)-এর মতো ব্যক্তিত্বও ছিলেন। তাঁরা হযতর আয়েশা (রা)-এর নেতৃত্বে মক্কা থেকে বসরার দিকে যাত্রা করেন, সেখানে ওসমান হত্যার বিচার দাবি কারীদের সংখ্যা ছিলো বেশী।

এহেন সংবাদে হযরত আলী (রা) সেনাদলসহ সেখানে পৌঁছান এবং দু’বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নেয়। যেহেতু উভয় পক্ষ সততার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো তাই আলাপ আলোচার পর বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়। কিন্তু চক্রান্তকারীরা এ ধরনের পরিস্থিতির পক্ষে ছিলো না। তাই তারা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রাতের আঁধারে এক পক্ষ অপর পক্ষের ওপর আক্রমণ চালায়, আর প্রচার করতে থাকে যে অপর পক্ষ সন্ধির সুযোগ নিয়ে আক্রমণ চালিয়েছে। এতে যুদ্ধ আরো ভয়াবহ রূপ নেয়। উভয় পক্ষে প্রচুর শহীদ হয়। শেষমেষ হযরত আয়েশা (রা) কে হযরত আলী (রা) বুঝাতে সক্ষম হন। তিনি মদীনায় ফিরে আসেন। কিন্তু অত্যণ্ত পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, এই ভয়াবহ যুদ্ধে আশারায়ে মুবাশশারার দু’জন সম্মানিত সদস্য হযরত তালহা (রা) ও যুবাইর (রা) শহীদ হন। এ যুদ্ধ হিজরী ৩৬ সনের জমাদিউস সানি মাসে সংঘটিত হয়। মুসলমানদের মধ্যে এটাই প্রথম আত্মঘাতি যুদ্ধ। এটাকে জংগে জামাল বা উটের যুদ্ধ বলা হয়।

হযরত আলী (রা)-এর শাসনামলে আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয় সিরিয়ার শাসনকর্তা হযরত মোয়াবিয়া (রা)-র সাথে। এ যুদ্ধকে সিফফিনের যুদ্ধ বলে। আলী (রা) মিমাংসার জন্য অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। হযরত মোয়াবিয়া (রা)-র মূল কতা ছিল হযরত ওসমানের (রা) হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত তিনি আলীকে খলীফা হিসাবে মানবেন না। আসলে তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো নিজে খলীফা হওয়া তাই তিনি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই হযরত ওসমানের রক্তমাখা জামা ও ওসমানের স্ত্রী নায়েলার কর্তিত আঙ্গুল হযরত আলীর (রা) বিরুদ্ধে জনসাধারণকে উত্তেজিত করার মানসে সিরিয়ায় প্রদর্শন করলেন। তাঁর লোকেরা এও বলে বেড়াতে লাগলো যে, ‘হযরত ওসমান (রা)-এর শাহাদাতে হযরত আলী’র (রা) সক্রিয় অংশ রয়েছে এবং হন্তারা তাঁরই আশ্রয়ে রয়েছে। সুতরাং হযরত ওসমানের (রা)-এর হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য হযরত আমীর মোয়াবিয়া (রা)-এর সাহায্য করা এবং তাঁর ডাকে সাড়া দেওয়া প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরয’।

ফলে হিজরী ৩৭ সনের সফর মাসে হযরত আলী ও হযরত মুয়াবিয়ার (রা) সৈন্যগণ সিফফীন নামক স্থানে পরস্পর মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। মুনাফিকগণ এ্টাই চাচ্ছিলো। তারা অতি উৎসাহের সাথে উভয়ে পক্ষকে নানা রকম ভাবে যুদ্ধে উৎসাহিত করে। কারণ উভয় পক্ষে ছিল গাপটি মেরে থাকা প্রচুর মুনাফিক। এই যুদ্ধে বিশিষ্ট সাহাবী আম্মার বিন ইয়াসির, খুযাইমা ইবন সাবিত, আবূ আম্মার আল মাযিনী প্রমুখ সাহাবীসহ হাজার হাজার মুসলমান শহীদ হন। প্রকাশ থাকে যে আম্মার বিন ইয়াসির সম্বন্ধে রাসূল (সা) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন,

‘আফসোস একটি বিদ্রোহী দল আম্মারকে হত্যা করবে’।

যুদ্ধে অবশ্য হযরত আলীর জিত হতে যাচ্ছিল কিন্তু মুয়াবিয়া (লা) নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে সন্ধির প্রস্তাব দিলেন। তাঁর সৈন্যরা বর্শার মাথায় কুরআন ঝুলিয়ে বলতে লাগলো, ‘এই কুরআন আমাদের দ্বন্দ্বের ফয়সালা করবে’। অতএব যুদ্ধে বিরতি ঘোষিত হলো। আসলে হযরত আলী তো সময় চাচ্ছিলেন শান্তি কিন্তু যুদ্ধবাজ মুনাফিকরা তো তাঁকে ঘরে থাকতে দেয়নি। আবূ মূসা আশয়ারী হযরত আলীর পক্ষে এবং আমর ইবনুল আস হযরত মুয়াবিয়ার পক্ষে সালিশ নিযুক্ত হলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমর ইবনুল আসের ধূর্তামীর জন্য সালিশী বোর্ড শান্তি স্থাপনে ব্যর্থ হয়। মুসলমানরা দুমাতুল জান্দাল থেকে ফিরে আসেন। তখন থেকে মুসলিম খিলাফত দু’ভাবে ভাগ হয়ে যায়।

সিফফিনের যুদ্ধের পর হযরত আলীর দল থেকে বারে হাজার লোক বের হয়ে হারুরায় চলে যায়। এরা ‘খারেজী’ নামে পরিচিত। অত্যন্ত চরম পন্থী এ দলটিকে বোঝানোর জন্য হযরত আলীর পক্ষ থেকে যথেষ্ট চেষ্টা চালানো হয় কিন্তু সবই পণ্ডশ্রম হয়। তারা প্রচার করতে থাকে দ্বীনের ব্যাপারে কাউকে হাকাম বা সালিশ মানা কুফরী কাজ। সেই অনুযায়ী হযরত আলী আবূ মূসা আশয়ারীকে সালিশ মেনে কুরআনের খেলাপ কাজ করেছেন। অতএব হযরত আলী তাঁর আনুগত্য দাবী করার বৈধতা হারিয়ে ফেলেছেন। এদের সাথেও হযরত আলী’র নাহরাওয়ান নামক স্থানে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বলা যায় এ যুদ্ধে খারেজীদের শক্তি প্রায় খতম হয়ে যায়।

নাহরাওয়ানের যুদ্ধের পর খারেজী সম্প্রদায়ের আবদুর রহমান ইবনে মুলজিম, আল বারাক ইবন আবদুল্লাহ ও আমর ইবন বকর আত তামীমী নামক তিন ব্যক্তি গোপনে এক বৈঠক করে। এ বৈঠকে তারা সিদ্ধান্ত নিয় যে আলী, মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আস এই তিনজনের কারণেই মুসলমানদের এত অশান্তি। তাই এঁদেরকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক হযরত আলীকে ইবনুল মুলজিম, মুয়াবিয়াকে আল বারাক এবং আমর ইবনুল আসকে আমর হত্যার দায়িত্ব নিলো। তারা প্রতিজ্ঞা করলো, ‘মারবে না হয় মরবে’।

কাজটির জন্য সময় বেছে নেয়া হয় ৪০ হিজরী সনের ১৭ই রমজান ফজরের ওয়াক্ত। এরপর যে যার গন্তব্যে চয়ে যায়।

অভ্যাস মত হযরত আলী নামায পড়ার জন্য মানুষ-জনকে ডাকতে ডাকতে মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন, এ সময়ে ওঁৎ পেতে থাকা পাপিষ্ট ইবনে মুলজিম তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তিনি আহত হন। আহতাবস্থায় ঐ দিনই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।

এক্ দিনে হযরত মুয়াবিয়াও একই সমেয় আহতন হন কিন্তু তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। আর আমর ইবনুল আস ঐ দিনই অসুস্থ ছিলেন তাই মসজিদে যাওয়া হয়নি। কিন্তু তাঁর পরিবর্তে ইমামতির জন্য মসজিদে যাচ্ছিলেন পুলিশ প্রধান খারেজা ইবনে হুজাফা। তাঁকেই আমর ইবনুল আস মনে করে শহীদ করা হয়।

হযরত আলী (রা) মোট চার বছর নয় মাস খিলাফতের দায়িত্বে ছিলেন। নানা জটিলতার মধ্যেও তিনি জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি ছিলেন ঐ সময়ে একজন উচ্চ শিক্ষিত মানুষ। বিচারের ক্ষেত্রে আলী’র তুলনা আলী নিজেই। হযরত ওমর (রা) বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে সর্বোত্ত ফায়সালাকরী আলী’। তাঁর সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য হযরত ওমর প্রায়ই বলতেন, ‘আলী না থাকলে ওমর হালাক হয়ে যেতো’।

আলী (রা) নিজেকে সব সময় অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মতই মনে করতেন। তিনি নিজে দরিদ্র ছিলেন কিন্তু কোন অভাবী মানুষ তার দরোজা থেকে ফিরতো না। এজন্য তাঁকে প্রায়ই সপরিবার উপোষ থাকতে হতো। তিনি অত্যন্ত সাদাসিধে মানুষ ছিলেন। সর্বদা মোটা কাপড়ের পোশাক পরতেন, তাও আবার তালি দেওয়া। তিনি অনেক সময় মাটিতেই শুয়ে কাটাতেন। একবার রাসূল (সা) তাঁকে মাটিতে শোয়া অবস্থায় দেখে ঠাট্টা করে বললেন, ‘ইয়া আবা তূরাব’। এখান থেকেই তিনি ‘আবূ তূরাব’ নামে পরিচিত হন।

হযরত আলী ছিলেন কুরআনের হাফিয। রাসূল (সা)-এর তত্ত্বাবধানেই তাঁর শিক্ষাজীবন কাটে। তিনি একজন শ্রেষ্ঠ মুফাসসির ছিলেন। তিনি খুব বড় পণ্ডিত ছিলেন। রাসূল (সা) নিজেই বলেছেন, ‘আমি জ্ঞানের নগরী আর আলী সেই নগরের প্রবেশদ্বার’। তিনি বহু হাদীস বর্ণণা করেছেন। পূর্ববর্তী খলীফাদের যুগে যাঁরা ফতোয়া দিতেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম।

হযরত আলী ছিলেন একজন বড় কবি ও সুবক্তা। তার একটি ‘দীওয়ান’ পাওয়অ গেছে। যাতে অনেকগুলি কবিতার মোট ১৪০০ শ্লোক বর্তমান। ‘নাহজুল বালাগা’ নামে তাঁর বক্তৃতার একটি সংকলন আছে।

হযরত আলী তাঁর নিজের সম্বন্ধে বলেছেন, ‘আমি যা বল ছি তা কুরআনের কাছে জিজ্ঞেস করো। আমি ঠিক বলছি কিনা। আল্লাহর কসম। এমন কোন আয়াত নেই যা আমি জানি না। তা রাতে নাজিল হয়েছে বা দিনে, যুদ্ধের ময়দানে নাজিল হয়েছে বা পর্বতের গুহায়। অর্থাৎ যেখানেই নাযিল হয়ে থাকুক না কেন, সমস্তই আমার জানা আছে’। তাঁর ব্যাপারে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেছেন, ‘খোদার কসম। রাসূল (সা)-এর পর সমস্ত এলেমকে দশভাগ করে আলীকে একাই নয়ভাগ দেওয়া হয়েছে। আর মাত্র এক দশমাংশ অপরাপর সমস্তের মধ্যে বন্টন করা হয়েছে’।

আলী (রা)-এর জীবন অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। ইমাম আহমদ (র) বলেন, ‘আলী’র (রা) মর্যাদা ও ফযীলত সম্পর্কে রাসূল (সা) থেকে যতো কথা বর্ণিত হয়েছে, অন্য কোন সাহাবী সম্পর্কে তা হয়নি’।

হযরত মুয়াবিয়া (রা) হযরত আলীর পুরাতন বন্ধু যেরার ইবন যামরার কাছে আলী (রা)-এর চরিত্র সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত দূরদর্শী, দুঃসাহসী, শক্তিশালী, ন্যায়বিচারক, প্রতিটি কথা এলেম ও হেকমতে পরিপূর্ণ, দুনিয়া ও দুনিয়ার নেয়ামতের প্রতি আন্তরিক ঘৃণা পোষণকারী, রাত্রি জাগরণে আনন্দিত, পরকালের চিন্তায় মগ্ন, ঋতু এবং যুগ পরিবর্তনের আশ্চর্যান্বিত, সাদাসিধা পোশাক পরিধানকারী, সাধারণ আহার্যে অভ্যস্ত, মানবতার দিশারী, দানবীর, গরীবদের প্রতি আন্তরিক এবং স্নেহবান, ন্যায়ের সমর্থন ও অন্যায়ের ঘোর বিরোধিতা ছিল হযরত আলী (রা)-এর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য’ অতপর মুয়াবিয়া বলেন, আল্লাহ কসম, আবুল হাসান এমনই ছিলেন’।

আসলে হযরত আলী ছিলেন, মুসলমানদের জন্য অহংকার। এ জন্যই রাসূল (সা বলেছেন, ‘একমাত্র মুমিনরা ছাড়া তোমাকে কেউ ভালবাসবেনা এবং একমাত্র মুনাফিকরা ছাড়া তোমাকে কেউ হিংসা করবে না’।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি