নয়া শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব রূপরেখা
উপরোক্ত মৌলিক কথাগুলো বলার পর এখন আমি আমার প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব রূপরেখা সবিস্তারে তুলে ধরতে চাই।

প্রাথমিক শিক্ষাঃ

সবার আগে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসঙ্গে আসা যাক। কারণ এটাই হলো শিক্ষার ভিত্তিমূল। প্রচলিম প্রাইমারী স্কুলগুলোতে যেসব বিষয় পড়ানো হয়। শিক্ষার এই স্তরে তার সবই পড়ানো যেতে পারে। সারা বিশ্বে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যেসব পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে হবে তাও কাজে লাগাতে হবে। তবে চারটে জিনিস সব পাঠ্য বিষয়ের মধ্যেই সন্নিবেশিত হতে হবে।

প্রথমতঃ শিশুর মনে এ কথাটি সর্বপ্রথম সত্য বলে বদ্ধমূল করে দিতে হবে যে, এই দুনিয়াটা আল্লাহর সাম্রাজ্য এবং তাঁরই কুদরত ও শক্তিমত্তার বহিঃপ্রকাশ। এখানে মানবজাতি আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োজিত। এখানে আমাদের কাছে যা কিছু আছে, তা সবই আল্লাহর পক্ষ হতে আমাদের কাছে বর্ণিত আমানত। এ আমানতের জন্য একদিন আমাদেরকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এ পৃথিবীতে যেদিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যাক না কেন, সর্বত্র আল্লাহর নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। এগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, একজন মহাপরাক্রান্ত শাসকের নিরংকুশ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে মহাবিশ্বে সকল জিনিস শাসিত হচ্ছে। আমরা চাই প্রাথমিক শিক্ষার জন্য শিশু যখন ভর্তি হবে, সেই সময় থেকেই প্রাইমারী স্কুলের শেষ স্তর পর্যন্ত তাকে বিশ্বজগতের সাথে এমনভাবে পরিচিত করে তুলতে হবে যেন তার প্রত্যেক পাঠে এই ধারণা-বিশ্বাস জন্মানোর উপকরণ ও উপাদান বিদ্যমান থাকে। এমনকি ‘আ’ বর্ণটি দ্বারা সে যেন আনবিক বোমা না শিখে ‘আল্লাহ’ কথাটি শিখে। এভাবে প্রথম দিন থেকেই শিশুদের মনে ইসলামী চিন্তা ও ধ্যান ধারণা জন্ম নিতে শুরু করবে এবং তাদেরকে এমনভাবে তৈরী করবে যে, শিক্ষার শেষ স্তর পর্যন্ত যখন তারা পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করবে তখনো এই মূলভিত্তি কার্যকর থাকবে।

দ্বিতীয়তঃ ইসলাম যেসব নৈতিক ধ্যান ধারণা ও মূল্যবোধ পেশ করে তা প্রত্যেক বিষয়ের পাঠ দেয়ার সময় এমন কি অংকের প্রশ্নমালার ভেতর দিয়ে পর্যন্ত নানাভাবে শিশুদের মনে বদ্ধমূল করে দিতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে যেসব জিনিস ন্যায় ও ভালো তার প্রতি মর্যাদাবোধ ও আগ্রহ শিশুদের মনে জন্মিয়ে দিতে হবে। যেসব জিনিস ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায় ও খারাপ তার প্রতি সর্বতোভাবে ঘৃণা সৃষ্টি করে তা বদ্ধমূল করে দিতে হবে। আজ যেসব মুসলমান ঘুষ, দুর্নীতি ও তহবিল তসরূপের মত অপকর্মে লিপ্ত, তারাও এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই শিক্ষা নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে এসব লোক নিজের জাতির লোকদের সাথে এহেন বেঈমানী করতে থাকে। এর কারণ হলো তাদেরকে যে শিক্ষা দেয়া হয়েছে তাতে তোতা, অজগর, ময়না, গরু, গাধা ও আনারসের সবক দেয়া হলেও আখলাক বা সচ্চরিত্রের সবক দেয়া হয় নি। আমরা চাই আমাদের ছাত্রদেরকে যে বিষয়ই পড়ানো হোক না কেন তাতে যেন চারিত্রিক শিক্ষা অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত হয়। ঘুষ, দুর্নীতি, হারাম উপায়ে উপার্জন, মিথ্যা, ধোকাবাজী, প্রতারণা, স্বার্থপরতা, আত্মম্ভরিতা, বিলাসিতা, চুরি, নকল, ভেজাল ও জাল, ওয়াদা খেলাফ, তহবিল তসরূপ, মদ্যপান, সুদখোরী, জুয়া, জুলুম, বে-ইনসাফী ও মানুষের হক নষ্ট করার কঠোর সমালোচনা ও এসবের খারাপ পরিণতি উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে তাদের মনে তীব্র ঘৃণা সৃষ্টি করে দিতে হবে। ছাত্রদের মধ্যে এমন একটা মত গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে যে, যার মধ্যে এসব নৈতিক দোষ দেখতে পাবে তাকেই যেন খারাপ দৃষ্টিতে দেখে এবং তার সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে ও প্রকাশ করে। এমন কি এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে লেখাপড়া শিখে পরবর্তী সময়ে কেউ যদি এই দোষ ত্রুটিতে আক্রান্ত হয় তাহলে তার সহপাঠীরাই যেন তাকে ভৎসর্ণা করে ও ধিক্কার দেয় এবং তার প্রশংসা ও সহযোগিতা না করে। আমরা চাই ইসলাম যেসব সৎগুণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করতে চায় সেগুলো যেন পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে এমনভাবে তুলে ধরা হয়, তার প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়, তার প্রশংসা করা হয়, তার উপকারিতা বুঝিয়ে বলা হয় যে, এইসব সৎগুণ মনুষ্যত্বের জন্য অপরিহার্য এবং মানুষের কল্যাণ এগুলোর মধ্যেই নিহিত। শিশুদের হৃদয়গ্রাহীভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, একজন মানুষের প্রকৃত গুণ বৈশিষ্ট্য কি কি এবং একজন ভালো মানুষ কেমন হয়ে থাকে। তাদেরকে সততা ও সত্যবাদিতা, আমানতদারী ও ওয়াদা পালন, ইনসাফ, ন্যায়নীতি ও সত্যপ্রীতি, সহানুভূতি ও সৌভ্রাতৃত্ব, ত্যাগ তিতিক্ষা, কর্তব্যপরায়ণতা ও আত্মসংযম, হালাল উপার্জন ও হারাম বর্জন এবং সর্বোপরি গোপন ও প্রকাশ্য সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করার শিক্ষা দিতে হবে। বাস্তব প্রশিক্ষণ দিয়েও তাদের মধ্যে এসব গুণ সৃষ্টি ও বিকাশের চেষ্টা চালাতে হবে।

তৃতীয়তঃ প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাকালেই শিশুদের মনে ইসলামের জ্ঞান ও আকীদা ও ঈমানের বিষয়গুলো বদ্ধমূল করে দিতে হবে। এ জন্য যদি আলাদাভাবে দ্বীনিয়াতের পাঠ্যসূচীর প্রয়োজন হয় তবে তা প্রণয়ন করা যেতে পারে। বরং ঈমান আকীদার বিষয়গুলো অন্যান্য বিষয়গুলোর মধ্যেও এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে যেমন দেহের সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গে প্রাণ প্রবাহ ছড়ানো থাকে। প্রত্যেক মুসলিম শিশুর মনে তাওহীদের আকীদা, আখেরাতের বিশ্বাস, কুরআনের সত্যতা এবং শিরক, কুফর ও নাস্তিকতার অসত্য ও বাতিল হওয়ার বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল করে দিতে হবে। এই শিক্ষা প্রকৃয়া এমনভাবে হতে হবে যেন শিশু মনে না করে বসে যে, তাকে জোর করে কতকগুলো কথা মানতে বাধ্য করা হচ্ছে। বরং সে বুঝবে যে এগুলোই বিশ্বজগতের সর্বাপেক্ষা যুক্তিগ্রাহ্য বাস্তবতা। এগুলো জানা ও মানা প্রত্যেক মানুষের জন্য অপরিহার্য্। আর এগুলো না মানলে মানুষের জীবন সঠিকভাবে চলতে পারে না।

চতূর্থতঃ শিশুকে ইসলামী জীবন যাপন প্রণালী শিখাতে হবে। এ পর্যায়ে দশ বছরের বালক বালিকার জন্য যা শেখা দরকার সেসব মাসলা মাসায়েল শিখিয়ে দিতে হবে। পাক পবিত্র হওয়ার নিয়ম কানুন, অযুর মাসআলা, নামায রোযার নিয়ম, হালাল হারামের সীমা, মাতা-পিতা, আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীর হক, পানাহারের নিয়ম কানুন, পোশাক পরিচ্ছদ সংক্রান্ত শরীয়তের বিধান এবং সামাজিক জীবনের শরীয়ত ও রুচিসম্পন্ন আচরণবিধিসহ যেসব বিষয় প্রত্যেক মুসলমান বালক বালিকার জানা অপরিহার্য তা যেন তাদেরকে শুধু বলাই না হয়। বরং তারা যেন ভালোমত হৃদয়ঙ্গম করে যে, মুসলমানদের জন্য এ ধরনের বিধানই থাকা প্রয়োজন। এগুলো সম্পূর্ণ সত্য এবং সুসভ্য, মার্জিত ও পবিত্র জীবন যাপনের জন্য এসব বিধান অবশ্যই মেনে চলা উচিত।

মাধ্যমিক শিক্ষাঃ

এরপর হাইস্কুলের শিক্ষার কথা ধরুন। এ স্তরে সর্বপ্রথম যেটা আমি জরুরী মনে করি তা হলো আরবী ভাষা বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো। ইসলামের মূল উৎস সম্পূর্ণভাবে আরবী ভাষায় লিখিত। কুরআনের ভাষা আরবী, হাদীসের ভাষা আরবী এবং আমাদের প্রথম শতকগুলোর প্রাচীন আলেম ও ফিকাহ বিশারদগণের যাবতীয় গ্রন্থ এবং ইসলামের ইতিহাসের সমস্ত প্রামাণ্য মৌলিক গ্রন্থ আরবী ভাষাতেই লিপিবদ্ধ। কুরআনের শুধু তরজমা পড়লে কাজ হবে না। বরং এর মূল ভাষায় সরাসরি পড়া দরকার। নতুবা ইসলামের প্রকৃত তাৎপর্য্ এবং ইসলামী মানসিকতা ‍সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য তরজমার প্রসার ঘটা দরকার যাতে জনসাধারণ জানতে পারে যে তাদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ কি? তবে শিক্ষিত লোকদের মধ্যে আরবী জানবে না এমন লোক থাকা বাঞ্চনীয় নয়। এজন্য আমরা আরবীকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে চালু করতে চাই। আমাদের মতে হাইস্কুলের শিক্ষা শেষে একজন ছাত্রের এতটা আরবী জানা উচিত যেন সে যে কোন সহজ আরবী বাক্য পড়তে ও বুঝতে পারে।

মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বিতীয় বাধ্যতামূলক বিষয় হওয়া উচিত পবিত্র কুরআন। প্রত্যেক ছাত্র ছাত্রীর অন্তত দু’পারা কুরআন শরীফ অর্থ বুঝে পড়া ম্যাট্রিক পাশ করার জন্য অপরিহার্য হওয়া উচিত। সময় বাঁচানোর জন্য হাই স্কুলের শেষ স্তরে কুরআনের মাধ্যমেই আরবী শেখানো যেতে পারে।

তৃতীয়তঃ বাধ্যতামূলক বিষয় হবে ইসলামী আকায়েদ। এই পর্যায়ে ছাত্রদেরকে ঈমান-আকীদার বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে অবহিত করতে হবে। অতঃপর ঐসব আকীদা বিশ্বাসের যুক্তি প্রমাণ কি, প্রয়োজন কি, মানুষের কর্মজীবনের সাথে তার সম্পর্ক, তা মানা না মানার কি প্রভাব কর্ম জীবনের ওপর পড়ে এবং ঐসব আকীদা-বিশ্বাসের নৈতিক ও বাস্তব চাহিদা কি, এসব কথা ছাত্রদের মন মগজে এমনভাবে বদ্ধমূল করাতে হবে যে তারা যেন ওগুলোকে বাপ দাদার ধর্মীয় বিশ্বাস হিসেবে না মানে বরং তা তার নিজস্ব মতে পরিণাত হয়।

ইসলামী আকায়িদের সাথে সাথে ইসলামী নৈতিকতার বিষয়কেও প্রাথমিক শিক্ষার চাইতে মাধ্যমিক শিক্ষায় আরো বেশী বিস্তারিতভাবে ও আরো বেশী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সহকারে বর্ণনা করতে হবে। সেই সাথে ইতিহাস থেকে দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, ইসলামের এসব নৈতিকতা বা আখলাক নিছক কাল্পনিক মতবাদ ও আদর্শ নয় বরং এ ধরনের নৈতিক চরিত্রের অধিকারী মানুষ মুসলিম সমাজে বর্তমান। এরূপ জ্ঞান দানের সাথে সাথে ছাত্রদের মধ্যে ইসলামের দৃষ্টিতে নিন্দিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা নিজেরাও সেগুলোকে খারাপ মনে করে তা থেকে দূরে থাকে এবং সমাজে ঐসব খারাপ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী লোককে মাথাচাড়া উঠবার সুযোগ না দেয়। পক্ষান্তরে ইসলাম যেসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে পছন্দনীয় ও প্রশংসনীয় মনে করে তা যেন তারাও পছন্দ করে, নিজেদের মধ্যে তার বিকাশ বৃদ্ধি ঘটায় এবং সমাজেও অনুরূপ চরিত্রের লোককে উৎসাহিত করে।

ম্যাট্রিক পর্যন্ত পৌছতে ছাত্ররা প্রায়ই যৌবনের দ্বারপ্রান্তে পৌছে যায়। এ পর্যায়ে তার ইসলামী জীবন পদ্ধতি সম্পর্কে প্রাথমিক শিক্ষার চাইতে বিস্তারিত শিক্ষা বেশী করে দরকার হয়ে পড়ে। এ পর্যায়ে পৌছে তাকে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন এবং লেনদেন ইত্যাদি সম্পর্কে যেসব বিধি-বিধান জানা দরকার একজন যুবক হিসেবে তা তাকে জানতে হবে তবে মুফতী হবার মত বিস্তারিত জানতে হবে, এমন কোন প্রয়োজন নেই। তার জানাশোনার মান এতটা অবশ্যই হতে হবে একজন মুসলমান হিসেবে জীবন যাপন করার জন্য যতটা জ্ঞান তার থাকা দরকার। আজকাল দেখা যায় উচ্চতর শিক্ষা লাভকারী ব্যক্তিরাও বিয়ে ও তালাকের সাধারণ মাসয়ালা সম্পর্কেও আদৌ জ্ঞান রাখে না। এর ফলে অনেক সময় তারা মারাত্মক ভুল করে বসেন। তারপর মাসয়ালা জিজ্ঞেস করে বেড়ান। অথবা লেনদেনের ব্যাপারে ইসলামী বিধানের মামুলী জ্ঞান আমাদের সর্বোচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিরাও রাখেন না। ফলে ইসলামী বিধান মোতাবেক চলার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেুও নিছক অজ্ঞতার কারণে ভুল করেন। এমন অবস্থার সৃষ্টি হওয়া কিছুতেই কাম্য নয়।

ইতিহাস শিক্ষার বেলায় শুধু নিজ দেশের ইতিহাস নয় বরং ইসলামের ইতিহাসও পড়া উচিত। তাদেরকে নবীদের ইতিহাসও পড়া উচিত। এতে ছাত্ররা বুঝতে পারবে, ইসলাম একটা চিরন্তন ও শ্বাশত আন্দোলন। খৃস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে আকস্মিকভাবে এর অভ্যূদয় ঘটেনি। হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও খোলাফায়ে রাশেদীন এর জীবনীও পড়া প্রয়োজন যাতে তারা মানবতার আদর্শ স্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে পরিচিত হতে পারে। খেলাফতে রাশেদার যুগ থেকে এ যাবত কালের ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে সে জানতে পারবে মুসলিম জাতি কোন কোন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় উপনীতি হয়েছে। এসব ঐতিহাসিক জ্ঞান লাভ করা অত্যন্ত জরুরী। যে জাতির তরুণ সমাজ নিজেদের অতীত ইতিহাস জানে না, তারা আপন জাতীয় কৃষ্টি ও সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারে না।

এসব শিক্ষাদানের সাথে সাথে আমরা এটাও চাই যে, হাইস্কুল পর্যায়ে ছাত্রদের হাতে কলমে ট্রেনিং দেয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হোক। ‍উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রতিটি ছাত্রকে নিয়মিত নামায পড়তে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে এবং বে-নামাযী ছাত্রকে কেউ যেন বরদাশত না করে এমন সাধারণ মত গড়ে তুলতে হবে। বিধি অনুসারে স্কুলে এমন কোন ছাত্রকে থাকতে দেয়া যাবে না যে স্কুল চলাকালে নামায পড়ে না। এরূপ কড়াকড়ি এজন্য প্রয়োজন যে, সক্রিয় ও বাস্তব ইসলামী জীবন গড়া নামায ছাড়া সম্ভবই নয়। এই ভিত্তিটিই যদি ধ্বসে পড়ে তাহলে ইসলামী জীবন প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে না। এদিক দিয়েও আপনাকে ভেবে দেখতে হবে যে, একদিকে একজন ছাত্রকে আপনি বলছেন, নামাজ ফরয। এটি আল্লাহ তায়ালাই ফরয করেছেন। অপরদিকে ফরয জানা ও মানা সত্ত্বেও সে যদি নামায না পড়ে তবে কোন দোষ ধরা হয় না। এর অর্থ দাঁড়ায়, আপনি প্রতিদিন ছাত্রকে মোনাফেকী, দায়িত্ব ফাঁকি দেয়া ও দুর্বল চরিত্রে অভ্যস্ত করেছেন। এ ধরনের শিক্ষা ও ট্রেনিং পেয়ে যারা বের হবে তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তি বলে প্রমাণিত হবে এটা কি আপনি আশা করতে পারেন? কখনো তা আশা করা যায় না। এতটা কর্তব্য ফাঁকি দেয়ার পর অন্যান্য কর্তব্যেও ফাঁকি দেয়ার মনোবৃত্তিও তার মধ্যে গড়ে উঠবে। এমতাবস্থায় ঐ ছাত্রকে ভৎসর্না না করে ঐ শিক্ষাব্যবস্থাকেই ধিক্কার দেয়া উচিত, যে শিক্ষাব্যবস্থা তাকে প্রথম দিন থেকেই শিখিয়েছিল দায়িত্ব এমন জিনিস, যাকে জেনে শুনে অবজ্ঞা করা যায়। নিজেদের তরুণ সমাজকে স্বয়ং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যহীনতার শিক্ষা দেয়ার পর কখনো এ আশা করা যায় না যে, তারা দেশ ও জাতির প্রতি আনুগত্যশীল হবে। পাঠ্যসূচীতে মহৎ গুণাবলী ও উচ্চতর আদর্শের বুলি আওড়িয়ে কি লাভ যদি সেই আদর্শ ও সেই গুণাবলীকে চরিত্রে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা না করা হয়? মনে মনে উচ্চ মূল্যবোধ পোষণ করা এবং কাজে তার বিরুদ্ধাচরণ করে যাওয়ায় ক্রমান্বয়ে মানুষের ব্যক্তিত্বই অন্তঃসারশূণ্য হয়ে যায়। এ রকম অন্তঃসারশূণ্য অসার ব্যক্তিত্ব ও দুর্বল চরিত্র নিয়ে হাজার বিদ্যা বুদ্ধি থাকলেও কোন উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দেখানো সম্ভব নয়।

সুতরাং মাধ্যমিক শিক্ষার স্তরেই যখন নতুন বংশধরগণ কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করে তখনই এক একজন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে দৃঢ় চরিত্র গড়ে তুলতে হবে। তাদের মনে একথা বদ্ধমূল করে দিতে হবে যে, তোমাদের কাজের সাথে তোমাদের জ্ঞানের সঙ্গতি রাখা প্রয়োজন। যে জিনিসকে সত্য, সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত মনে করবে তা মেনে চলো। যেটা কর্তব্য মনে করবে তা পালন করবে, যেটাকে ভাল বলে জানবে তা পালন করবে এবং যেটাকে খারাপ বলে জানবে তা বর্জন করবে।

উচ্চ শিক্ষাঃ

এবার আমি উচ্চ শিক্ষার কথা বলতে চাই। উচ্চ শিক্ষার জন্য একটা সাধারণ পাঠ্যসূচী থাকবে আর একটা থাকবে বিশেষ পাঠ্যসূচী। সাধারণ পাঠ্যসূচীটা সকল বিষয়ের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য বাধ্যতামূলক থাকবে। আর বিশেষ পাঠ্যসূচী প্রত্যেক বিষয়ের ছাত্রকে তার বিষয়ের সাথে এর সম্পর্ক ও সামঞ্জস্য অনুসারে পড়ানো হবে।

সাধারণ পাঠ্যসূচীতে আমার বিবেচনায় তিনটে বিষয় থাকা উচিতঃ

(১) পবিত্র কুরআনঃ কুরআন এমনভাবে পড়াতে হবে যেন ছাত্ররা কুরআনের শিক্ষা কি তা ভালো করে জানতে ও বুঝতে পারে এবং সেই সাথে তার আরবী ভাষাজ্ঞানও এতটা উন্নতি লাভ করবে যে, তারা যেন অনুবাদ ছাড়াই ভালভাবে বুঝতে পারে।

(২) হাদীসের একটা সংক্ষিপ্ত সংকলনঃ এতে এমন হাদীস সংকলিত হবে যা ইসলামের মূলনীতি, নৈতিক শিক্ষা এবং হযরত রাসূলুল্লাহ (সা) এর জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোকপাত করে। এ সংকলনটাও অনুবাদ ছাড়া হওয়া চাই, যাতে ছাত্র-ছাত্রীদের ইসলামী জ্ঞানের পাশাপাশি আরবী জ্ঞানেরও উৎকর্ষতা আসে।

(৩) ইসলামী জীবন পদ্ধতিঃ এটা হবে ইসলামী জীবন পদ্ধতির একটা পূর্ণাঙ্গ কাঠামো। এতে ইসলামী আকীদা বিশ্বাস হতে শুরু করে ইবাদত, আখলাক, সামাজিকতা, সভ্যতা সংস্কৃতির কাঠামো, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং যুদ্ধ ও সন্ধি পর্যন্ত ইসলামী বিধানের যাবতীয় দিক ও বিভাগ যুক্তিগ্রাহ্য ও প্রমাণাদিসহ বর্ণনা করতে হবে যাতে প্রত্যেক শিক্ষিত যুবক ইসলামকে ভালো করে বুঝতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে জীবনের যে কর্মক্ষেত্রেই এবং যে পেশাতেই তারা যাবে, ইসলামী ভাবধারা ও মূল্যবোধ এবং ইসলামের মূলনীতি ও বিধানকে অনুকরণ করে যেন কাজ করতে পারে।

বিশেষ পাঠক্রমঃ

আলাদা আলাদাভাবে এক একটা বিষয় পড়াশোনা করার জন্য এটা তৈরী করা হবে এবং তা শুধু ঐ বিষয়ের ছাত্রকেই পড়ানো হবে। যেমনঃ যেসব ছাত্র দর্শন পড়বে তাদেরকে অন্যান্য দর্শনের সাথে সাথে ইসলামী দর্শনও পড়ানো হবে। কিন্তু এ কথা মনে রাখা দরকার যে, মুসলমানরা এরিস্টটল, প্লেটো, এবং প্লেটো দর্শনবাদীদের নিকট হতে যেসব দর্শন গ্রহণ করেছে এবং সেভাবেই তাদের উৎকর্ষতা দান করেছে তা ইসলামী দর্শন নয়। আর গ্রীক দর্শন ও যুক্তিবিদ্যার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমাদের আকীদা তত্ত্বকে যে কালাম শাস্ত্র বা আকীদা তত্ত্ব প্রণয়ন করেছেন, সেটাও ইসলামী দর্শনের অন্তর্ভুক্ত নয়। মুসলিম মনীষীগণ ইসলামী আকীদা তত্ত্বকে সমকালীন দার্শনিক মতবাদসমূহের আলোকে ও তৎকালীন যুক্তিবিদ্যার ভাষায় বর্ণনা করতে গিয়েই এ শাস্ত্রের সূচনা ঘটান। এ দুটো বিষয় এখন ঐতিহাসিক স্মৃতির চেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে না। এ দুটো বিষয় অবশ্যই পড়াতে হবে। তবে দর্শনের ইতিহাসের দুটো গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবেই পড়াতে হবে যা পাশ্চাত্য গ্রন্থকারগণ সাধারণভাবে পাশ কেটে গিয়েছেন। তারা শিক্ষার্থীদের মনে এরূপ ধারণা বদ্ধমূল করতে চেয়েছেন যে, দুনিয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যা কিছু অবদান রাখা হয়েছে, ইউরোপীয়রাই রেখেছে। কিন্তু মুসলিম দার্শনিক ও কালাম শাস্ত্রবিদদের এ অবদান ‘ইসলামী দর্শন’ ছিল না এবং আজকের শিক্ষার্থীদের ঐ নামে ওটা পড়ানোও সঙ্গত নয়। পড়ানো হলে সেটা হবে চরম বিভ্রান্তিকর এবং তাদেরকে বিপথগামী করার নামান্তর। প্রকৃতপক্ষে ইসলামী দর্শন কোথাও তৈরী অবস্থায় বর্তমান নেই। ওটা আমাদের এখন নতুন করে গড়ে তুলতে হবে এবং তা দাঁড় করাতে হবে কুরআন প্রদত্ত ভিত্তির ওপর। কুরআন মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধির সীমানা চিহ্নিত করে। অপরদিকে দেখিয়ে দেয় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জিনিসগুলোর পিছনে লুকিয়ে থাকা সত্যের সন্ধান লাভের নির্মুল পথ। সে যুক্তিবিদ্যার ত্রুটিপূর্ণ যুক্তিপ্রয়োগ-রীতি বাদ দিয়ে সাধারণ বোধগম্য সহজ সরল যুক্তি প্রয়োগের রীতি শিক্ষা দেয়। সর্বোপরি সে মানুষ ও বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে একটা পূর্ণাঙ্গ মতবাদও পেশ করে। সে মতবাদের ভেতরে মানুষের মন-মগজে প্রতিনিয়ত তোলপাড়কারী যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর বিদ্যমান। এ সব তত্ত্ব ও তথ্যের ভিত্তিতে একটা নতুন যুক্তিবিদ্যা , একটা নতুন অতীন্দ্রিয় দর্শন, একাট নতুন চারিত্রিক ও নৈতিক দর্শন এবং একটা নতুন মনোবিজ্ঞান রচনা করা যায় এবং এখন তা রচনা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। দর্শনের মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে যারা আজ নতুন পুরনো দর্শনের গোলক ধাঁধায় দিশেহারা ও বিভ্রান্ত, তারা যাতে নিজেরাও ত্রুটিমুক্ত হবার সঠিক পথ খুঁজে পায় এবং জগদ্বাসীকেও আলোকজ্জল পথের সন্ধান দিতে পারে সে জন্য এই নবতর দর্শন রচনা করা আবশ্যক।

অনুরূপভাবে ইতিহাসের ছাত্রদেরকে দুনিয়ার আর যত ইতিহাসই পড়ানো হোক, ইসলামের ইতিহাসও পড়াতে হবে এবং ইতিহাসের দর্শনের অন্যন্য মতবাদের সাথে ইসলামের ইতিহাস দর্শনেরও শিক্ষা দিতে হবে। এ দুটো বিষয়ও কিছুটা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। তা না হলে এ ক্ষেত্রে যে একটা সাধারণ ভুল ধারণা আছে তার কারণে আমার বক্তব্য বুঝতে আপনাদের অসুবিধা হবে বলেই আমার আশঙ্কা। ইসলামের ইতিহাস বলতে সাধারণ মুসলিম জাতি ও দেশসমূহের ইতিহাস অথবা মুসলমানদের সভ্যতা, কৃষ্টি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের ইতিবৃত্তকে বুঝানো হয়ে থাকে। আর ইসলামী ইতিহাস দর্শনের নাম শুনতেই একজন সাধারণ ছাত্র ইবনু খালেদুনের দিকে তাকাতে আরম্ভ করে। আমি এ দুটো বিষয়ের গুরুত্ব অস্বীকার করছি না এবং এ দুটো বিষয় পড়াতে পড়ানোরও বিরোধিতা করি না। আমি শুধু এ কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, ইসলামের ইতিহাস এবং মুসলমানদের ইতিহাস সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। আর ইবনু খালেদুনের ইতিহাস দর্শনের সাথে তা ইসলামের ইতিহাস দর্শনের কোন সামান্যতম সম্পর্কও নেই।

প্রকৃতপক্ষে ইসলামের ইতিহাস বলতে যা বুঝায় তা হলো ইতিহাসের আবর্তনের বিভিন্ন স্তরে ইসলামে দীক্ষিত জাতিগুলোর ধ্যান-ধারণা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, কৃষ্টি, চরিত্র, সভ্যতা ও রাজনীতি এবং সামগ্রিকভাবে গোটা সমাজব্যবস্থায় ইসলামের যে কালজয়ী প্রভাব পড়েছে তার পর্যালোচনা। আর ঐ প্রভাবের সাথে অন্যান্য অইসলামী মতাদর্শের প্রভাব যুগে যুগে কিভাবে কতটুকু সংমিশ্রিত হয়েছে এবং সেই মিশ্রণের কি ফলাফল দেখা দিয়েছে তাও খতিয়ে দেখা ইসলামের ইতিহাসের আওতাভূক্ত। অনুরূপভাবে ইসলামের ইতিহাসের দর্শন বলতে কুরআনের ইতিহাস দর্শনই বুঝায়। কুরআন আমাদেরকে মানব জাতির ইতিহাস অধ্যয়নের জন্য একটা বিশেষ দৃষ্টিকোণের সন্ধান দেয়, এই অধ্যয়ন থেকে মতবাদ ও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য একটা বিষয়ে পথ ও পদ্ধতি নির্বাচন করে দেয় এবং মানব জাতির উত্থান পতনের কারণ বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করে। দুঃখের বিষয়, ইসলামী দর্শনের মত ইসলামী ইতিহাস ও ইতিহাস দর্শন নিয়েও আজ পর্যন্ত কোন পাঠ্য বই লেখা হয় নি। এ দুটো বিষয় নিয়ে কিছু গ্রন্থ রচনা করে শুণ্যতা পূরণের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। নচেত আমাদের ইতিহাস শিক্ষার ক্ষেত্রে এ শূণ্যতা থেকেই যাবে।

সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় যে, এর প্রতিটি শাখা সম্পর্কে একটু বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী এবং প্রতিটি শাখা সম্পর্কেই ইসলামের নিজস্ব নীতিমালা রয়েছে। সুতরাং এর প্রত্যেকটা বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার সময় ঐ বিদ্যার সাথে সংশ্লিষ্ট ইসলামী জ্ঞানদান কার অবশ্য কর্তব্য। উদাহরণ স্বরূপঃ অর্থনীতিতে ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ইসলামী রাজনৈতিক মতবাদ ও ব্যবস্থা ইত্যাদি। এরপর আসে কারিগরী বিদ্যা যথা, প্রকৌশল, চিকিৎসা ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা। এগুলোর ব্যাপারে ইসলামের কিছু বলার নেই। এতে কোন বিশেষ ইসলামী পাঠ্যসূচীর প্রয়োজনও নেই। ইতিপূর্বে যে সাধারণ পাঠ্যক্রম ও নৈতিক ট্রেনিং এর কথা আমি বলেছি, এ ক্ষেত্রে সেটাই যথেষ্ট।

বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের শিক্ষাঃ

উচ্চ শিক্ষার পর আসে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের শিক্ষাদানের কথা। এর উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানের বিশেষ কোন শাখায় পূর্ণতা ও পরিপক্কতা লাভ করা। অন্যান্য বিজ্ঞানের ও শিল্প কলার ক্ষেত্রে যেমন বিশেষজ্ঞ তৈরীর উদ্দেশ্যে শিক্ষা দানের ব্যবস্থা আছে, তেমনি কুরআন, হাদীস ও অন্যান্য ইসলামী জ্ঞানের ক্ষেত্রেও ব্যবস্থা থাকা দরকার, যাতে আমাদের মধ্যেও উচ্চমানের মুফাসসির, হাদীস বিশারদ, ফিকাহবিদ ও ইসলামী জ্ঞানে ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন লোক তৈরী হতে পারে। আমার মতে ফিকাহশাস্ত্রের শিক্ষাব্যবস্থা আইন কলেজগুলোতেই হওয়া উচিত। কারণ ইসলামী আইনই এখন আমাদের দেশের আইন হওয়া দরকার। ইসলামী আইন শিক্ষা পদ্ধতি কি হওয়া উচিত সে বিষয়ে আমি অন্য দুটো ভাষণে বিস্তারিত বক্তব্য পেশ করেছি। আমি সেই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি এখানে করবো না। এখণ থাকলো কুরআন, হাদীস ও অন্যান্য ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ তৈরী করার দায়িত্ব আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই বিশেষ ব্যবস্থাধীনে নিতে হবে। এ সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা কাঠামো এখানে পেশ করছি। আমার মতে এ উদ্দেশ্যে শিক্ষাদানের জন্য কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে। সেখানে শুধু গ্রাজুয়েট অথবা আন্ডার গ্রাজুয়েটদের ভর্তির ব্যবস্থা থাকবে।

এসব প্রতিষ্ঠানে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবেঃ

(১) আরবী সাহিত্যঃ ছাত্রদের মধ্যে আরবী ভাষার উচ্চমানের গ্রন্থাবলী পড়ার ও বুঝার যোগ্যতা ‍সৃষ্টি করতে হবে এবং আরবী ভাষায় লিখতে ও কথা বলতে পারে এমন পর্যায়ে তাদেরকে উন্নীত করতে হবে।

(২) কুরআন শিক্ষাঃ এ ক্ষেত্রে তাফসীরের মূলনীতি, তাফসীর শাস্ত্রের ইতিহাস ও এই শাস্ত্রের বিবিধ মত ও চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ছাত্রদের জ্ঞান দান করতে হবে। অতঃপর কুরআনের গবেষণামূলক ও তাত্ত্বিক অধ্যয়নের ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

(৩) হাদীস শিক্ষাঃ হাদীস শিক্ষার ক্ষেত্রে হাদীসের মূলনীতি বা উসূলে হাদীস, হাদীসের ইতিহাস এবং বিশুদ্ধতা যাচাইবাছাইয়ের বিধান পড়ানোর পর মূল গ্রন্থসমূহ এমনভাবে পড়াতে হবে যেন ছাত্ররা একদিকে হাদীস পরখ করা এবং তার বিশুদ্ধতা যাচাই বাছাই করে নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার যোগ্য হয়ে ওঠে। অপরদিকে বেশিরভাগ হাদীস সম্পর্কে মোটামুটি প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়।

(৪) ফিকাহঃ আইন কলেজসমূহে যে ভাবে ফিকাহ শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে এক্ষেত্রে ফিকাহ শিক্ষাদান তা থেকে কিছুটা ভিন্নপ্রকৃতির হবে। এক্ষেত্রে ছাত্রদেরকে শুধু ফিকাহর মূলনীতির (উসূলে ফিকাহ) ইতিহাস, ফিকাহ শাস্ত্রীয় বিভিন্ন মাযহাবের বৈশিষ্ট্যাবলী এবং কুরআন ও হাদীস হতে আইন বিধান রচনার পদ্ধতি ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হবে।

(৫) আকীদা শাস্ত্রঃ কালাম শাস্ত্র ও তার ইতিহাস এমনভাবে পড়াতে হবে যাতে ছাত্ররা জ্ঞানের এই শাখা সম্পর্কে যথার্থ পরিচয় লাভ করতে পারে এবং মুসলিম কালাম শাস্ত্রবিদদের সমগ্র জ্ঞান গবেষণা সম্পর্কে তাদের মধ্যে ব্যাপক ও গভীর ব্যুৎপত্তি জন্মে।

(৬) তুলনামূলক ধর্ম অধ্যয়নঃ এ পর্যায়ে দুনিয়ার সমস্ত বড় বড় ধর্মমতের মৌলিক শিক্ষা, প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং ইতিহাস সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দান করতে হবে। এভাবে বিশেষ পর্যায়ে শিক্ষা লাভ করে যারা বের হবে তাদের ডিগ্রীর মান কি হবে, তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই না। তবে আমি একথা বলতে চাই যে, এসব লোকদেরই আমাদের সমাজে আলেম নামে অভিহিত হওয়া উচিত। আর যেসব উচ্চতর চাকুরীতে এম.এ., পি.এইচ.ডি ডিগ্রীধারী লোকেরা নিয়োগ লাভ করে থাকেন, সেসব চাকুরীর দুয়ার এদের জন্য উন্মুক্ত হতে হবে।

অত্যাবশ্যকীয় আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাঃ

ধর্মীয় ও দুনিয়াবী শিক্ষার আলাদা আলাদা ব্যবস্থার বিলুপ্তি সাধন করে একটা একক ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার মোটামুটি চিত্র আমার উপরোক্ত আলোচনায় পেশ করা হয়েছে। এদেশে এ শিক্ষাব্যবস্থাই কায়েম হওয়া দরকার। এ আলোচনা সম্পূর্ণ নিষ্ফল হতে বাধ্য যদি প্রচলিত শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন (Overhaul) ব্যবস্থা গৃহীত না হয়।

এ পর্যায়ে সর্বপ্রথম করণীয় হলো শিক্ষানীতির দায়িত্ব এমন লোকদের হাতে দিতে হবে যারা ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী, ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে সুষ্ঠু জ্ঞানের অধিকারী এবং তা বাস্তবায়িত করতেও আগ্রহী। এ রকম লোকদের হাতেই শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন সম্ভব। যারা ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষা কি তা জানে না এবং তা বাস্তবায়নের ইচ্ছাও রাখে না তাদের দ্বারা এ কাজ সম্ভব হবে না। এ ধরনের লোক যদি শিক্ষানীতি নিয়ন্ত্রণ করে আর জনগণ একটানা রাতদিন হৈ চৈ করে এবং চাপের মুখে তাদেরকে এ কাজ করতে বাধ্য করে, তা হলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা কিছু সংস্কারের কাজ করতে থাকবে যা এখন কিছু কিছু হচ্ছে। কিন্তু এতে কোন ফল হবে না।

দ্বিতীয়তঃ মাদরাসা ও স্কুলের জন্য শিক্ষক শিক্ষিকা নির্ধারণের সময় তাদের নৈতিক চরিত্র ও ধর্মপরায়ণতাকে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার মত এমনকি তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। ভবিষ্যতের শিক্ষক ট্রেনিং এর ক্ষেত্রেও উদ্দেশ্য সামনে রেখে প্রয়োজনীয় রদবদল ও সংস্কার করতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে যার কিছুটা জ্ঞান আছে সে একথা অস্বীকার করতে পারবে না যে, শিক্ষা ব্যবস্থায় সিলেবাস ও পাঠ্যপুস্তকের চাইতে শিক্ষক এবং তার চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব অনেক বেশি গুরুত্ববহ। আকীদা-বিশ্বাস যার বিকারগ্রস্ত, নৈতিক চরিত্র যার নষ্ট, সে শিক্ষক আর যাই হোক এই নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্রদের যে নৈতিক চরিত্র ও মন-মানসিকতা আমাদের একান্ত কাম্য তার প্রশিক্ষণ দিতে সক্ষম নয়। অন্যান্য ক্ষেত্রে ভ্রষ্ট লোকদের দ্বারা যেটুকু ক্ষতি হয় তা প্রধানত বর্তমান বংশধর পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা যদি খারাপ ও ভ্রষ্ট লোকদের হাতে তা হলে তারা ভবিষ্যত বংশধরদেরও সর্বনাশ সাধন করে। ফলে ভবিষ্যতের জন্যও কোন সংস্কার সংশোধন বা কোন কল্যাণকর পরিবর্তনের আশা অবশিষ্ট থাকে না।

এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত কথা হলো, শিক্ষাঙ্গনের গোটা পরিবেশই পাল্টিয়ে তা ইসলামী আদর্শ ও ভাবধারা অনুযায়ী গড়ে তুলতে হবে। এই সহশিক্ষা, ফিরিঙ্গীপনার প্রদর্শনী, আপাদমস্তক পাশ্চাত্য সভ্যতা ও কৃষ্টির সর্বাত্মক আধিপত্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্কানুষ্ঠান ও আলোচনা এবং নির্বাচনের প্রচলিত ব্যবস্থা সব যদি এভাবেই চলতে থাকে এবং এর কোন কিছুই বদলাতে আমরা প্রস্তুত না হই তাহলে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা নিয়ে বৃথা এই গালভরা বুলি আওড়ানো আর ইসলামের এই জিকির তোলা বন্ধ করা উচিত। শিক্ষাঙ্গনে বিরাজমান পরিবেশ ইসলামের বীজ অংকুরণের সহায়ক নয়। এ প্রতিকূল পরিবেশ বহাল রেখে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের চেষ্‌টা লবণাক্ত জমিতে চাষাবাদ করে ফসল ফলানোর চেষ্টার চেয়েও আহম্মকি। একদিকে ইসলামের সুস্পষ্ট বিধান লঙ্ঘন করে যুবক যুবতীদের একসঙ্গে বসানো হচ্ছে। অপরদিকে তাদের মধ্যেই ইসলাম ও ইসলামী বিধি-বিধানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হওয়ার আশা পোষণ করা হচ্ছে। একদিকে যাবতীয় চাল চলন ও গোটা পরিবেশ দ্বারা তরুণ সমাজের মনে পাশ্চাত্য সভ্যতা, কৃষ্টি উচ্ছৃঙ্খল জীবন ধারার প্রভাব বদ্ধমূল করা হচ্ছে; অপরদিকে কেবল মুখের কথায় বা সাধু বচনের মাধ্যমে তাদেরকে জাতীয় কৃষ্টি ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করার বাসনা পোষণ করা হচ্ছে। একদিকে প্রবীণ সমাজ তরুণ শ্রেণীকে বিতর্ক অনুষ্ঠানাদিতে প্রতিনিয়ত বিবেকের ট্রেনিং দিয়ে চলেছে; অপরদিকে তারাই আবার তরুণদের কাছ হতে সততা, সত্যবাদিতা ও ন্যায়নিষ্ঠার পরাকাষ্ঠা দেখতে আগ্রহী। একদিকে ছাত্রদেরকে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জাতীয় রাজনৈতিক জীবনকে কলূষিতকারী চিরাচরিত নির্বাচনী অপকৌশলগুলি প্রয়োগে অভ্যস্ত করে তুলেছে; অপরদিকে তাদেরকেই ছাত্রজীবন শেষে একেবারে সাধু সজ্জন হিসাবে দেখবার স্বপ্ন দেখা হচ্ছে। এরূপ বৈপরীত্য কোন সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন লোকের কাজ হতে পারে না। এ ধরনের লোকদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার আগে পাগলা গারদে গিয়ে নিজেদের মাথা ঠিক করে আসা উচিত।


একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা
মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন সূচিত করার তাগিদ এখন মুসলিম জাহান জুড়ে আলোড়ন তুলেছে। মুসলিম তরুণদেরকে সারা দুনিয়ায় সঠিক ইসলামী লক্ষ্যাভিসারী নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্য করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে নতুন ধরনের ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য কয়েকটি মুসলিম দেশে ইদানীং কথাবার্তা চলছে। এ উদ্দেশ্যে এ যাবত যে কয়টি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সেগুলোর পরিকল্পনা ও কাজের ধরণ দেখে মুসলিম জাহানের চিন্তাশীল ব্যক্তিদের কেউ-ই সম্ভবত সন্তুষ্ট বলে মনে হয় না। বস্তুত এ সময় মুসলিম দুনিয়ার জন্য দারুল উলুম কিংবা শরীয়ত কলেজ ধরনের প্রাচীন আলেম সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই। আবার পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ সরবরাহকারী কোন আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়েরও সার্থকতা নেই। এখন প্রয়োজন শুধু এমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় যা দুনিয়ার জন্য ইসলামের ঝান্ডাবাহী তৈরী করতে পারে।

ইন্দোনেশিয়া হতে মরক্কো পর্যন্ত সব কটি মুসলিম দেশে বর্তমানে দু ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। একটা শিক্ষা ব্যবস্থা নিরেট পাশ্চাত্য মন-মানসিকতা ও চিন্তার অধিকারী এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা ও কৃষ্টির নিবেদিতপ্রাণ সেবক গড়ে তুলছে। এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত লোকেরাই এখন মুসলিম দেশগুলোর শাসন ক্ষমতায় আসীন। তাদের হাতেই অর্থনীতির চাবিকাঠি। রাজনীতির বাগডোর এখন তাদেরই হাতে এবং সভ্যতা ও সমাজব্যবস্থার রূপকারও তারাই। তাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ইসলাম সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ এবং পাশ্চাত্য ভাবধারার কাছে নতজানু। এ জন্য তারা সারা দুনিয়ার মুসলিম উম্মাহকে অত্যন্ত দ্রুতবেগে ইসলাম বিরোধী পথে টেনে নিয়ে চলছে। দ্বিতীয় শিক্ষাব্যবস্থা তৈরী করছে ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শী আলেম সমাজ। তারা সাধারণত পার্থিব জ্ঞান বিজ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ। মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনযাত্রার রক্ষণাবেক্ষণের কাজেই তারা ব্যস্ত। দুনিয়ার কোথাও তারা এতটা যোগ্য ও দক্ষ নন যে, সামগ্রিক জাতীয় জীবনের কান্ডারী ও চালক হতে পারেন। সব জায়গায় তারা কেবল গাড়ীর ব্রেকের কাজ করছেন। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজ মুসলিম উম্মাহর গাড়ীকে যে দ্রুততার সাথে বিপথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, সেই উদ্দাম গতিতে বাধা সৃষ্টি করা ও গতি কমানো ছাড়া আর কিছুই করার সাধ্য তাদের নেই। আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতিটি মুসলিম দেশে এই ব্রেক প্রতিনিয়ত দুর্বল হয়ে পড়ছে। শুধু তাই নয়, কোন কোন দেশে তো মাতাল ড্রাইভাররা এই ব্রেক ভেঙ্গে ফেলেছে এবং দ্বিধাহীন চিত্তে নিজ জাতিকে নাস্তিকতা ও পাপ পঙ্কিলতার দিকে অতি দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে। অবশিষ্ট মুসলিশ দেশগুলোতেও এই ব্রেক ভেঙ্গে পড়ার আগেই আমাদের এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার চিন্তা করতে হবে যার সাহায্যে যুগপৎ দ্বীন ও দুনিয়াকে বুঝার মত যোগ্য শিক্ষিত লোক তৈরী হবে। যারা এই উম্মতের গাড়ী চালক হতে পারবে এবং তারা চারিত্রিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উভয় ধরনের যোগ্যতার দিক দিয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিতদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হবে।

মুসলিম জাহানের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই প্রয়োজন পূরণ করতে পারছে না। মুসলিম জগতের সকল চিন্তাশীল ব্যক্তি আজ দিশেহারা। তারা ভাবছেন সময় থাকতে এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা যদি আজ গড়ে তোলা না যায় তাহলে মুসলিম জাতিকে সম্ভাব্য ধর্মীয় ও নৈতিক সর্বগ্রাসী ধ্বংস হতে রক্ষা করা যাবে না। এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যে উপায় উপকরণ দরকার তা কেবল সরকারই সরবরাহ করতে পারে। অথচ মুসলিম দেশসমূহের সরকারি ক্ষমতা কি ধরনের লোকদের হাতে রয়েছে তা কারো অজানা নেই। এমতাবস্থায় আমি শুধু এটুকুই করতে পারি যে, উক্ত প্রয়োজন পূরণ করার উপযুক্ত একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের যে পরিকল্পনা আমার মনে রয়েছে সেটা মুসলিম জগতের কাছে পেশ করি। হয়তো এটা চিন্তাশীল ও জ্ঞানীজনদের মনোপুত হবে এবং ‍মুসলিম সরকার এটা বাস্তবায়িত করতে এগিয়ে আসবে অথবা আল্লাহ কিছু বিত্তশালী লোকদের চিত্তকে এজন্য উদ্যোগী হওয়ার তাওফীক দিবেন।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আমার প্রস্তাবসমূহ সংক্ষেপে পেশ করছিঃ

সবার আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করতে হবে এবং সেই অনুসারে এর সমগ্র নীতি ও ব্যবস্থা তৈরী করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা কর্মচারী থাকবেন, তারাও ঐ নীতি ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কাজ করবেন। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎপরতার বিচার করবেন তারাও ঐ মাপকাঠিতে যাছাই করে দেখবে যে বিশ্ববিদ্যালয় তার লক্ষ্য অর্জনে কতখানি সফল। আমার মতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিম্নরূপ হওয়া উচিতঃ

১। এমন সুযোগ্য ও সত্যনিষ্ঠ আলেম তৈরী করবে যারা এই আধুনিক যুগে খাঁটি ইসলামী আদর্শ মোতাবেক দুনিয়ার নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে।

২। ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়ার মধ্যে এর কর্মতৎপরতা সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্যান্য বিদ্যা কেবল এ উদ্দেশ্যেই পড়ানো হবে যাতে ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের জন্য সহায়ক হয়। ঐ সব বিদ্যায় পারদর্শী ও বিশেষজ্ঞ তৈরী করার দায়িত্ব এ বিশ্ববিদ্যালয় বহন করবে।

৩। এটা অবশ্যই একটা আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া চাই। ছাত্র এবং শিক্ষকগণ সবসময় এখানেই অবস্থান করবেন।

৪। সারা দুনিয়ার মুসলিম ছাত্রের জন্য এর দরজা খোলা রাখা উচিত, যাতে সব দেশের ছাত্র এতে অবাধে ভর্তি হতে পারে।

৫। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশ এরূপ হতে হবে যেন যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাকওয়া ও উন্নত নৈতিক চরিত্র বিকশিত হয় এবং তাদের মধ্যে ইসলামী সংস্কৃতি শিকড় গেড়ে বসে। একে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব থেকে রক্ষা করতে হবে যাতে পাশ্চাত্যের কাছে পরাভূত জাতিগুলোর মাঝে আজকাল সর্বত্র যে দাসসুলভ ও পরাজিত মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে তা তাদের মধ্যেও সৃষ্টি না হয়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পাশ্চাত্য পোশাক পরিচ্ছদ নিষিদ্ধ হতে হবে। ছাত্রদের আমোদ প্রমোদ ও বিনোদনের জন্য পাশ্চাত্য ধাঁচের খেলাধুলার পরিবর্তে ঘোড় সওয়ারী, সাঁতার, চাঁদমারি, অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার, মোটর সাইকেল ও গাড়ী চালনার ট্রেনিং এবং এই জাতীয় অন্যান্য বিনোদন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এর সাথে সাথে তাদেরকে কিছু সামরিক ট্রেনিংও দিতে হবে।

৬। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষক নির্বাচন শুধু মাত্র বিদ্যার যোগ্যতার ভিত্তিতে না হওয়া চাই। সকল শিক্ষক আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তা ও মতামত এবং বাস্তব জীবনের দিক দিয়ে সৎ ও খোদাভীরু হওয়া চাই। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মুসলিম জাহানের বিভিন্ন দেশ হতে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই এর মাধ্যমে এমন সব শিক্ষক নির্বাচন করতে হবে যারা উচ্চমানের বিদ্যার যোগ্যতার অধিকারী হওয়ার সাথে সাথে চিন্তা ও আকীদা-বিশ্বাসে খাঁটি মুসলমান ও ইসলামী বিধানের যথার্থ অনুসারী হবে এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কাছে পরাজিতমনা হবে না। এমনকি আমি এটাও জরুরী মনে করি যে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা শিক্ষক হবেন তাদের পরিবারভুক্ত লোকদেরও শরীয়তের পাবন্ধ হওয়া চাই। এ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই নিয়োগদান করা উচিত হবে। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যদি ছাত্রদের সাথে এমন শিক্ষক থাকেন যাদের পরিবারে অ-ইসলামী চালচলনে অভ্যস্ত এবং যাদের ঘর হতে গানের সুর লহরী উত্থিত হয়, তাহলে সে রকম শিক্ষকের কাছ হতে ছাত্ররা ভাল শিক্ষা পাবে না।

৭। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ট্রেনিং দিয়ে তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত গুণাবলী সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবেঃ

(ক) ইসলাম ও ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি নিয়ে গর্ববোধ এবং দুনিয়ায় তাকে বিজয়ী করার দৃঢ়সংকল্প।

(খ) ইসলামী চরিত্র সৃষ্টি এবং ইসলামী বিধান মেনে চলার অভ্যাস।

(গ) ইসলামী বিধান সম্পর্কে সুগভীর জ্ঞান এবং প্রয়োজনে ইসলামী বিধান প্রণয়নের যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জন।

(ঘ) শরীয়তের বিধান নিয়ে সংকীর্ণ দলাদলি ও বিভেদ হতে দূরে থাকা।

(ঙ) লেখা, বক্তৃতা ও বিতর্কে ভালো যোগ্যতা থাকা এবং ইসলাম প্রচারের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা।

(চ) কষ্টসহিষ্ঞুতা, পরিশ্রম, চৌকশ ও সচকিত থাকার অভ্যাস এবং নিজের হাতে সব রকমের কাজ করার যোগ্যতা।

(ছ) সাংগঠনিক, প্রশাসনিক ও নেতৃত্বের যোগ্যতা।

৮। একমাত্র মাধ্যমিক স্তর উত্তীর্ণ ছাত্ররাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে। আরব দেশসমূহ হতে আগত ছাত্ররা সরাসরি ভর্তি হতে পারবে কিন্তু অনারব ছাত্ররা আরবী ভাষায় যথেষ্ট পারদর্শী না হলে তাদের জন্য এক বছরের আলাদা কোর্স ঠিক করতে হবে। এই ভাবে তাদেরকে আরবী ভাষায় লেখা বই পুস্তক পড়ে বুঝবার যোগ্য করে তোলা যাবে।

৯। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকাল হবে ৯ বছরের। প্রথম স্তরে ৪ বছর, দ্বিতীয় স্তরে ৩ বছর এবং তৃতীয় স্তরে ২ বছরের শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে।

১০। প্রথম স্তরে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো ৪ বছরের উপযোগী করে ৪ ভাগে ভাগ করে শিক্ষা দিতে হবে।

ক) ইসলামী আকায়েদঃ কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামের আকীদা কি কি এবং তার স্বপক্ষে কি কি যুক্তি প্রমাণ আছে, মুসলমানদের মধ্যে আকীদাগত বিরোধ কিভাবে ও কি ধারাক্রমে উদ্ভূত হয়েছে এবং বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে কয়টি আকীদাগত মাযহাব রয়েছে তার ব্যাখ্যাও তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। এ বিষয়গুলোর নেহায়েত বিদ্যাগত সীমায় সীমিত থাকতে হবে এবং আকীদা বিশ্বাস নিয়ে তর্ক বিতর্ক একেবারেই পরিহার করতে হবে।

খ) ইসলামী জীবন পদ্ধতিঃ এ পর্যায়ে ছাত্রদেরকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। ইসলামের মৌলিক মতবাদ ও চিন্তাধারা এই মতবাদ ও চিন্তাধারার ভিত্তিতে সে মানুষের চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব কিভাবে গঠন করে, এরপর দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন থেকে নিয়ে অর্থনীতি, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পর্যন্ত মুসলিম সমাজ জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগকে কোন কোন মূলনীতির ভিত্তিতে সংগঠিত ও বিন্যস্ত করে এবং এভাবে সমগ্র ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির রূপকাঠামোটা কি রকম দাঁড়ায় তা তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে।

গ) কুরআনঃ চার বছর সময়ের মধ্যে সমগ্র কুরআন সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ পড়িয়ে দিতে হবে। এ জন্য তাফসীরের কোন নির্দিষ্ট গ্রন্থের সাহায্য নিয়ে এমনভাবে কুরআনের দারস দেবেন যাতে ছাত্ররা কুরআনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও বক্তব্য ভালমত বুঝতে পারে এবং তাদের মন-মগজে যেসব সন্দেহ সংশয় ও প্রশ্ন জাগবে তা নিরসন করবেন।

ঘ) হাদীসঃ ছাত্রদেরকে সংক্ষেপে হাদীসের ইতিহাস, উসূলে হাদীস এবং হাদীস যে ইসলামী আইনের একটা অপরিহার্য উৎস, তা ছাত্রদেরকে যুক্তি প্রমাণসহ বুঝিয়ে দিতে হবে। এরপর হাদীসের যে কোন একটা সংকলন আগাগোড়া পড়িয়ে দিতে হবে যথা মুনতাকাল আখবার, বুলুগুল মুরাম অথবা মিশকাতুল মাসাবীহ।

ঙ) ফিকাহঃ ফিকাহ শাস্ত্রের ইতিহাস ও মূলনীতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পুস্তক পড়ানোর পর ছাত্রদেরকে ফিকাহ শাস্ত্রের শিক্ষা এমনভাবে দিতে হবে যেন, ফিকাহ শাস্ত্রবিদদের বিভিন্ন মাযহাব এবং মতসহ ফিকাহ শাস্ত্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ মাসলা মাসায়েল ছাত্ররা জানতে পারে। অতঃপর মুজতাহিদ ইমামগণ কিভাবে স্বাধীন বিচার বিবেচনার দ্বারা মূল উৎস থেকে শরীয়তের বিস্তারিত বিধি বিধান রচনা করেছেন তাও যেন তারা অবগত হয়।

চ) ইসলামের ইতিহাসঃ নবীদের ইতিহাস দিয়ে ইসলামের ইতিহাস আরম্ভ করতে হবে। বিশেষত হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীনের জীবন ইতিহাস বিস্তারিতভাবে পড়িয়ে ইসলামের সমগ্র ইতিহাসটা মোটামুটিভাবে ছাত্রদের গোচরে আনতে হবে।

ছ) সমাজ বিজ্ঞানঃ এ পর্যায়ে বিশেষভাবে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান পড়াতে হবে। এসব বিষয় পড়ানোর জন্য এমন সব অধ্যাপক নিয়োগ করতে হবে যারা শিক্ষা দেয়ার সাথে সাথে ইসলামী দৃষ্টিকোণ হতে সমালোচনা করতে পারবেন এবং পাশ্চাত্য মতবাদ ও চিন্তাধারাকে হুবহু ছাত্রদের মাথায় প্রবিষ্ট করাবেন না।

জ) বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্ম বিশেষত ইহুদীধর্ম, খৃস্টধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্ম সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান দান করার ব্যবস্থা করতে হবে।

ঝ) আধুনিক পাশ্চাত্য ধ্যান ধারণার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও তার প্রধান প্রধান শাখা, বিশেষতঃ পাশ্চাত্য গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ফ্যাসীবাদ প্রভৃতি।

ঞ) ইংরেজী, জার্মান ও ফরাসী ভাষার যে কোন একটা শেখাতে হবে।

১০। দ্বিতীয় স্তরে পাঁচটি অনুষদ থাকবে। যথাঃ তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ, কালামশাস্ত্র বা ইলমুল কালাম এবং ইতিহাস।

১১। তাফসীর অনুষদে নিম্নলিখিত বিভাগগুলো থাকবেঃ

ক) কুরআন

খ) তাফসীর শাস্ত্রের ইতিহাস, তাফসীরকারকদের বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং তাদের বৈশিষ্ট্যাবলী।

গ) কুরআনের বিভিন্ন পঠনরীতি।

ঘ) তাফসীর শাসেত্রর মূলনীতি তথা উসূলে তাফসীর।

ঙ) কুরআনের বিস্তারিত ও গভীর অধ্যয়ন।

চ) বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত কুরআনের বিরুদ্ধে যে আপত্তি ও অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তার চুলচেরা পর্যালোচনা এবং দাঁতভাঙ্গা জবাব দান।

ছ) কুরআনে বর্ণিত শরীয়তের বিধিবিধানসমূহ।

১২। হাদীস অনুষদঃ এই অনুষদে থাকবে-

ক) হাদীস সংকলেন ইতিহাস

খ) হাদীস সংক্রান্ত বিভিন্ন শাস্ত্র ও তার সকল শাখা।

গ) প্রধান হাদীস গ্রন্থসমূহের কোন একখানা গ্রন্থ বিস্তারিত সমালোচনা ও পর্যালোচনাসহ পড়িয়ে দিতে হবে যাতে ছাত্ররা মুহাদ্দিসের মত হাদীসের প্রমাণ্যতা যাছাই করার ভালো ট্রেনিং পেতে পারে।

ঘ) শীর্ষ স্থানীয় ছয়খানা বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থের সামগ্রিক মোটামুটি জ্ঞান।

ঙ) হাদীসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহলের উত্থাপিত আপত্তিসমূহের বিস্তারিত পর্যালোচনা ও তার জবাব।

১৩। ফিকাহ অনুষদঃ

এ অনুষদে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো থাকবেঃ

ক) ফিকাহ শাস্ত্রের মূলনীতি বা উসূলে ফিকাহ

খ) ফিকাহ শাস্ত্রের ইতিহাস।

গ) আধুনিক আইনতত্ত্ব বা এর দার্শনিক পটভূমি।

ঘ) রোমান ও ইরানী আইন, ইহুদী আইন, আধুনিক মানব রচিত আইন ও ইসলামী আইনের তুলনামূলক অধ্যয়ন।

ঙ) মুসলিম ফিকাহশাস্ত্রকারদের বিভিন্ন মাযহাব ও তার মূলনীতি।

চ) মূল উৎস কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সরাসরি আইন রচনার অনুশীলন।

ছ) আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের চার মাযহাবের ফিকাহ, সেই সাথে জাহেরী ফিকাহ, যায়দী ফিকাহ ও জা’ফরী ফিকাহ।

১৪। কালাম শাস্ত্র অনুষদঃ (আকীদা শাস্ত্র) এতে থাকবেঃ

ক)যুক্তি বিদ্যার মৌলতত্ত্ব।

খ)প্রাচীন ও আধুনিক দর্শন।

গ) মুসলমানদের মধ্যে কালাম শাস্ত্রের উন্মেষ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্তকার ইতিহাস এবং বাইরের ও ভেতরের প্রভাব থেকে উদ্ভূত মুসলমানদের বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্ব ও মতবাদ।

ঘ) কালাম শাস্ত্রের বিধান ও তাতে কুরআন ও সুন্নাহর অবদান।

ঙ) ইসলামের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধবাদীদের নানারকম আপত্তি ও প্রশ্নাবলীর বিস্তারিত পর্যালোচনা ও জবাব।

চ) বিভিন্ন ধর্মমতের তুলনামূলক অধ্যয়ন। বিশেষতঃ খৃস্টবাদের ইতিহাস, খ্রিষ্টানদের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও তাদের আকীদা শাস্ত্রের বিবরণ ও বিস্তারিত পর্যালোচনা।

ছ) খৃস্টান মিশনারীদের প্রচার কার্য এবং তাদের পদ্ধতি ও কৌশল।

১৫। ইসলামের ইতিহাস অনুষদঃ

ক) ইতিহাস দর্শন, ইতিহাস অধ্যয়নের উদ্দেশ্য এবং কুরআনের আলোকে ইতিহাস পড়ার নিয়ম-পদ্ধতি।

খ) ইবনে খালেদুন থেকে আজ পর্যন্ত ইতিহাস দর্শনের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের চিন্তাধারা।

গ) ইসলাম প্রতিষ্ঠার পূর্ব যুগের আরব জগত ও মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস।

ঘ) চিন্তাধারা, নৈতিকতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা, রাজনীতির বিবর্তনের আলোকে বিশ্ব নবীর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত ইসলামে ইতিহাস।

ঙ) ইসলামী পুনর্জাগরণের আন্দোলনসমূহ।

চ) মুসলিম দেশসমূহের উপর পাশ্চাত্য উপনিবেশবাদের আধিপত্যের ইতিহাস এবং তার পরিণতি ও ফলাফল।

১৬। তৃতীয় স্তরের ছাত্ররা উল্লেখিত অনুষদগুলোর কোন একটিতে কোন একটি নির্দিষ্ট দু’বছর গবেষণা করার পর একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখে দাখিল করবে এবং তা ঐ বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণ পরীক্ষা করে দেখার পর ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করবেন।

১৭। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি উঁচুমানের লাইব্রেরী থাকবে-যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখিত প্রয়োজনসমূহ পূরণের জন্য বিপুলসংখ্যক পুস্তক থাকবে।

১৮। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার বিভিন্ন স্তর ও বিভাগের জন্য যথোপযুক্ত পাঠ্য বই নির্বাচনের উদ্দেশ্যে একটি কমিটি নিয়োগ করতে হবে।

১৯। প্রয়োজনীয় বই পুস্তক রচনার জন্য একটা একাডেমী প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

নারী শিক্ষা
(নিম্নলিখিত প্রবন্ধটি মাওলানা মওদূদীর তদানীন্তন পাকিস্তান শিক্ষা কমিশনকে দেয়া সুদীর্ঘ স্মারকলিপির অংশ। প্রয়োজন ও উপযোগিতার বিচারে এর অনুবাদ করা হলো।– অনুবাদক।)।

নারীর শিক্ষা পুরুষের মতই জরুরী। নারীদের অজ্ঞ ও অনগ্রসর রেখে পৃথিবীতে কোন জাতিই উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অগ্রসর হতে পারে না। এজন্য মুসলিম পুরুষদের মত মুসলিম নারীদের শিক্ষার জন্যও যতদূর সম্ভব উন্নত ব্যবস্থা করা উচিত। এমনকি তাদের সামরিক ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা আমাদেরকে এমন সব অত্যাচারী ও আধিপত্যবাদী জাতির সাথে পাল্লা দিয়ে থাকতে হচ্ছে, যারা মানবতার কোন সীমানা লংঘনেই সংকোচবোধ করে না। খোদা না করুন, তাদের সাথে কোন যুদ্ধ বিগ্রহ বেধে গেলে তারা কি কি ধরনের বর্বরতার পরিচয় দিবে, তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। কাজেই আমাদের কর্তব্য নারীদেরকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত করা। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা মুসলিম। সুতরাং আমরা যা কিছু করবো তা যেন আমাদের ঈমানের পরিপন্থী না হয় এবং যেসব মূল্যবোধ ও সভ্যজনোচিত বিধি-নিষেধ মানতে আমরা ইসলাম কর্তৃক আদিষ্ট, তারও খেলাফ না হয়।

পাশ্চাত্য সভ্যতা ও আমাদের সভ্যতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, সে কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। এ দুটোর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য পার্থক্য এই যে, নারী যতক্ষণ পুরুষ সেজে পুরুষোচিত দায়িত্ব পালনে এগিয়ে না আসে, ততক্ষণ পাশ্চাত্য সভ্যতা নারীকে সম্মান দেয় না এবং তার কোন অধিকার স্বীকার করে না। কিন্তু আমাদের সভ্যতা ও শিক্ষা নারীকে নারী রেখেই তার যথোচিত সম্মান ও অধিকার প্রদান করে। তার উপর শুধুমাত্র সেইসব সামাজিক দায়িত্বই অর্পণ করে যা স্বয়ং প্রকৃতি তার উপর স্বাভাবিক নিয়মে অর্পণ করেছে। সুতরাং আমাদের নারীদের শিক্ষাব্যবস্থাটা তাদের স্বভাবের দাবী ও প্রয়োজন অনুসারে হতে হবে এবং পুরুষদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বনিম্নস্তর থেকে নিয়ে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত কোথাও সহশিক্ষার প্রশ্নই উঠতে পারে না।

নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে যেসব আনুষঙ্গিক সংস্কারমূলক ব্যবস্থা প্রয়োজন, তা নারীদের ক্ষেত্রে পুরুষদের অনুরূপ হওয়া দরকার। প্রাইমারী থেকে বিশেষজ্ঞীয় স্তর পর্যন্ত যেসব সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়ার কথা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, এক্ষেত্রেও তা অপরিবর্তিত থাকবে।

এ ছাড়া নারীদের শিক্ষায় এ কথাটা বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা দরকার যে, তাদের আসল ও স্বাভাবিক দায়িত্ব হলো গার্হস্থ্য জীবন পরিচালনা ও মানুষ গড়া, কৃষি খামার, কল-কারখানা, অফিস আদালত চালানো নয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কাজ হবে নারী জাতিকে একটা সাচ্চা মুসলিম জাতি গঠনের যোগ্য করে তোলা যে জাতি দুনিয়ার সামনে স্রষ্টার রচিত কল্যাণকর ও স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থার বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে।

 

………সমাপ্ত ……


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি