নয়া শিক্ষাব্যবস্থার নীল নকশা
এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করার পর আমি এই ইপ্সিত শিক্ষাব্যবস্থার একটা মোটামুটি ধারণা পেশ করছি।

প্রথম বৈশিষ্ট্যঃ

এই নয়া শিক্ষাব্যবস্থায় প্রথম বৈশিষ্ট্য হবে এতে ধর্মীয় ও দুনিয়াবী শিক্ষার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব মুছে ফেলে উভয় শিক্ষাকে একক শিক্ষাব্যবস্থায় পরিণত করা।

জ্ঞান বিজ্ঞানকে ধর্মীয় ও দুনিয়াবী শিক্ষার নামে দুটো আলাদা ভাগে ভাগ করা হয়েছে মূলত দ্বীন দুনিয়া সম্পর্কে আলাদা ধ্যান ধারণা থাকার কারণেই। অথব এই ধারণাটা মূলতঃই অ-ইসলামী। ইসলামের পরিভাষায় যেটা ‘দ্বীন’ বা ‘ধর্ম’, সেটা দুনিয়ার জীবন হতে কোন আলাদা জিনিস নয়। দুনিয়াকে এ দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা যে, এটা আল্লাহর রাজ্য এবং নিজেকে আল্লাহর প্রজা মনে করে দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর নির্দেশ ও সন্তুষ্টি অনুসারে প্রতিটি কাজ করা –এটারই নাম ‘দ্বীন’। দ্বীন সম্পর্কে এই ধারণার স্বাভাবিক দাবি হলো, সমস্ত দুনিয়াবী তথা ধর্ম নিরপেক্ষ আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানকে ইসলামিক জ্ঞান বিজ্ঞানে রূপান্তরিত করা। নচেৎ কতক জ্ঞান বিজ্ঞান যদি নিছক দুনিয়াবী হয় এবং খোদার আনুগত্যের ধারণার বাইরে থাকে আর কতকগুলো জ্ঞান বিজ্ঞান যদি ইসলামী হয় এবং তা পার্থিব জ্ঞান বিজ্ঞান থেকে আলাদা ভাবে শিক্ষা দেয়া হয় তাহলে একটি শিশু তার শৈশবকাল থেকেই এমন একটি মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠবে যে, তার নিকট দ্বীন ও দুনিয়া দুটি স্বতন্ত্র জিনিস। এ কারণে এ দুটো জিনিস হবে তার দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ আলাদা বিষয় এবং এতদোভয়ের সমন্বয়ে ঘটিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ একক জীবন গঠন করা তার পক্ষে কঠিন হবে, যে জীবনে আল্লাহর দ্বীনের (তোমরা পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামে প্রবেশ কর অর্থাৎ সমস্ত জীবনে ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে রূপায়িত কর) সঠিক প্রতিফলন হবে না।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যদি কোন ব্যক্তিকে ইতিহাস, ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, জীববিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা; ভূবিদ্যা, মহাশূণ্যবিদ্যা, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং অন্য সমস্ত বিদ্যা এমনভাবে পড়ানো হয় যে, শুরু হতে শেষ পর্যন্ত কোথাও আল্লাহর নাম পর্যন্ত উচ্চারিত হয় না। বিশ্বপ্রকৃতির দশ দিগন্তে এবং মানুষের নিজ সত্তায় যত সচেতন ও অচেতন বস্তু রয়েছে সেসবকে আল্লাহর নির্দেশ হিসেবে দেখা হয় না। প্রাকৃতিক নিয়মাবলীকে মহাবিজ্ঞানী আল্লাহর রচিত বিধান হিসেবে উল্লেখ করা হয় না, ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেয়ার সময় তার পেছনে মহাপরাক্রান্ত ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর ইচ্ছা কার্যকরী থাকার কথা বলা হয় না, ফলিত বিদ্যাসমূহের কোথাও আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুসারে কৌশল প্রয়োগ করার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পোষণ করা হয় না, বাস্তব জীবনের আচার আচরণ ও কায় কারবারের আলোচনায় আল্লাহ জীবন পরিচালনার যে নিয়ম কানুন বেঁধে দিয়েছেন সে নিয়ম পদ্ধতির বর্ণনাও কোথাও থাকে না, জীবনের উৎপত্তি ইতিবৃত্তে কোথাও জীবন স্রষ্টা আল্লাহর দেয়া সূচনা ও সমাপ্তির বিবরণ সন্নিবেশিত হয় না-তা হলে এত সব বিদ্যা শেখার পর তার মন মগজে জীবন ও বিশ্বজগত সম্পর্কে যে ধারণা জন্মাবে তাতে আল্লাহর কোন স্থান থাকবে না। প্রতিটি জিনিসের সাথে তার পরিচিত ঘটবে স্রষ্টাকে বাদ দিয়েই। প্রত্যেক ব্যাপারে সে খোদা ও তাঁর সন্তুষ্টির পরোয়া না করেই নিজের পথ রচনা করে নিবে। সকল বিদ্যা হতে এই দৃষ্টিভঙ্গী অর্জন ও অর্জিত জ্ঞানের এরূপ ধারা বিন্যাস লাভের পর সে যখন অন্য একটা বিভাগে গিয়ে হঠাৎ খোদার কথা শুনবে এবং দ্বীনিয়াত বিষয়ের আওতায় যে নৈতিক শিক্ষা, শরীয়তী বিধি-নিষেধ এবং জীবনের মহত্তর লক্ষ্য শিক্ষা দেয়া হয়, তা যখন পাবে, তখন সে বুঝতেই পারবে না যে জীবন ও জগত সম্পর্কে তার অর্জিত জ্ঞান কাঠামোতে খোদা ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জিনিসকে কোথায় স্থান দেয়া যায়? প্রথমে খোদার অস্তিত্ব সম্পর্কেই তার প্রমাণ দরকার হবে। এরপর সে জানতে চাইবে যে, খোদার দেয়া পথ নির্দেশ সত্যিই তা প্রয়োজন কি না এবং তার নিকট হতে সত্যিই এসেছে কি না? এসে থাকলে তার প্রমাণ কি? এসবের প্রমাণ দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করা গেলেও তার পক্ষে দুনিয়াবী জ্ঞানের সাথে এই নতুন জিনিসের সামঞ্জস্য বিধান করা খুবই কঠিন হবে। সে যত পাকা ঈমানদারই হোক না কেন এতদসত্ত্বেও ইসলামী জীবন বিধান কখনোই তার জীবনে স্থান পাবে না-এটা হবে তার জীবনের একটা আনুসঙ্গিক বা বাড়তি ব্যাপার মাত্র।

এতসব অকল্যাণ শুধুমাত্র জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিক্ষাকে ধর্মীয় ও দুনিয়াবী এই দুই ভাগে বিভক্ত করার ফল। আর এভাবে বিভক্ত করাটা ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীর সম্পূর্ণ বরখেলাফ, সেকথা আমি ইতোপূর্বেই বলেছি। নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামী শিক্ষার জন্য কোন আলাদা পাঠক্রমের প্রয়োজন নেই। বরং গোটা শিক্ষাকেই ইসলামী শিক্ষায় পরিণত করা প্রয়োজন। প্রথম থেকেই একটি শিশুকে জগত সম্পর্কে এভাবে শিক্ষা দিতে হবে যে, সে আল্লাহর রাজত্বেরই একজন প্রজা। তার নিজ সত্তায় ও সারা বিশ্বজাহানে আল্লাহরই নিদর্শন দেখতে পায়। তার এবং দুনিয়ার প্রতিটা জিনিসের সম্পর্ক সরাসরি বিশ্ব প্রভুর সাথে-যিনি আকাশ থেকে সকল ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এ বিশ্বজগতে যেসব শক্তি ও বস্তু তার আয়ত্বাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীণ, তা সব আল্লাহই তাকে দিয়েছেন। একমাত্র আল্লাহর মর্জি অনুসারে ও তার নির্দেশিত পথে এগুলোকে ব্যবহার করতে হবে এবং এ জন্য তাকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের সামনে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী ছাড়া অন্য কোন দৃষ্টিভঙ্গীই আসাই ঠিক নয়। তবে পরবর্তী স্তরগুলোতে যাবতীয় জ্ঞান বিজ্ঞান তাকে এমনভাবে শিক্ষা দিতে হবে যে, সমস্ত তত্ত্ব ও তথ্যের বিন্যাস ও ব্যাখ্যা এবং ঘটনার পটভূমি বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ ইসলামী আদর্শের দৃষ্টিভঙ্গীতেই হবে। কিন্তু তার পাশাপাশি অন্যান্য মতবাদগুলোও যথার্থ সমালোচনা ও যাচাই বাছাই করে তুলে ধরতে হবে এবং বলে দিতে হবে যে, এগুলো পথভ্রষ্ট ও খোদার গজবে নিপতিত লোকদের রচিত মতবাদ। অনুরূপভাবে বাস্তব জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিদ্যাগুলোর প্রাথমিক পর্যায়েই ইসলামের নির্দেশিত জীবন লক্ষ্য, নৈতিক নীতিমালা এবং কর্ম পদ্ধতির শিক্ষা দেয়া চাই। তবে অন্যান্য মতাদর্শের নীতিমালা ও কর্মপদ্ধতি এমনভাবে পড়াতে হবে যে, সে গুলোর দার্শনিক ও চিন্তাগত ভিত্তি, অভীষ্ট লক্ষ্য ও কর্মপন্থা ইসলাম থেকে কতখানি ভিন্ন এবং কোন কোন দিক দিয়ে ভিন্ন তা স্পষ্ট হয়ে যায়। সকল জ্ঞান বিজ্ঞানকে ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানে রূপ দেয়ার এটাই সঠিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে শিক্ষা দিলে ইসলামী শিক্ষার জন্য যে আলাদা পাঠক্রমের প্রয়োজন হয় না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যঃ

এ শিক্ষাব্যবস্থায় দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত এই যে, এতে প্রত্যেক ছাত্রকে সব বিষয়ে শিক্ষিত করে শিক্ষা সমাপ্তির পর ‘মাওলানা’ বা ‘মুফতি’ বানিয়ে প্রত্যেককে সব বিষয়ে মতামত দেবার যে রেওয়াজ আজ পর্যন্ত চলে আসছে তার সমাপ্তি ঘটানো। এর পরিবর্তে বিশেষজ্ঞ হিসেবে শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা চালু করা বাঞ্চনীয়, যা বহু যুগের অভিজ্ঞতায় ও পরীক্ষা নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়েছে। মানুষের জ্ঞান এখন এত বেশি উন্নতি ও উৎকর্ষ লাভ করেছে এবং তার শাখা প্রশাখা এত বেরিয়েছে যে, এর সব কটা একই ব্যক্তির পক্ষে শেখা সম্ভব নয়। আর সব বিদ্যাতেই তাকে যদি মামুলি ধরনের চলনসই জ্ঞান দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে সে কোনটাতেই পারদর্শিতা ও পরিপক্কতা লাভ করতে পারবে না। এর চেয়ে বরং আট দশ বছরের পাঠক্রম এমন হওয়া উচিত যে, প্রত্যেক শিশু তার জীবন, জগত ও মানুষ সম্পর্কে মোটামুটি অপরিহার্য জ্ঞান ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীতে লাভ করতে পারে। বিশ্ব প্রকৃতি তথা বিশ্ব জগত সম্পর্কে একজন মুসলমানের যেরূপ মনোভাব ও ধ্যান ধারণা তার জন্মানো দরকার তা যেন তার জন্মে। একজন মুসলমানের জীবন যে ধাঁচের হওয়া উচিত সে নকশা যেন তার মনে বদ্ধমূল হয়ে যেতে পারে। কর্মজীবনের জন্য যেটুকু তত্ত্ব ও তথ্য একজন মানুষের প্রয়োজন, তা যেন সে লাভ করে এবং সে এই সব তত্ত্ব ও তথ্য যেন একজন খাঁটি মুসলমানের মত প্রয়োগ করতে পারে। মাতৃভাষায় তার পর্যাপ্ত দখল থাকা চাই। সেই সাথে আরবি ভাষাও ততটা শেখা চাই যেন পরবর্তী সময়ের বাড়তি লেখাপড়ায় কাজে লাগে। যে কোন একটা ইউরোপীয় ভাষাও তার এতটুকু জানা দরকার যে এই সব ভাষায় যে বিপুল জ্ঞান ভান্ডার সঞ্চিত রয়েছে তার কিছুটা আহরণ করতে পারে। এরপর বিশেষজ্ঞ হিসেবে শিক্ষার এক আলাদা পাঠক্রম থাকবে, এতে ছয় বা সাত বছরের গভীর তত্ত্বানুসন্ধানের প্রশিক্ষণ নেয়ার পর শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করবে। উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটি বিষয়ের শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করছি। এতে আমি বিশেষজ্ঞীয় শিক্ষা সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করি তা স্পষ্ট হয়ে যাবে।

দর্শন ও যুক্তি বিদ্যার জন্য একটা বিভাগ থাকবে। এ বিভাগে শিক্ষার্থীকে আগে কুরআনের দর্শন ও যুক্তি পড়ানো হবে। এতে সে জানতে পারবে মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জিনিসগুলোর নাগালের ভিতরে সত্য অনুসন্ধানের কি কি পথ আছে, মানুষের বুদ্ধি বিবেকের দৌড় কতদূর এবং তার সীমানা কি এবং শুধু যুক্তির ভিত্তিতে অনুমান করতে গিয়ে মানুষ কিভাবে সত্য ও বাস্তবতার জগত হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে আন্দাজ অনুমানের অন্ধকার জগতে হারিয়ে যায়। সে আরো জানতে পারবে যে অতীন্দ্রিয় বিষয়গুলো সম্পর্কে বাস্তবিক পক্ষে মানুষের কতখানি জ্ঞান প্রয়োজন, এই প্রয়োজনীয় জ্ঞান লাভ করার জন্য মানুষ তার পর্যবেক্ষণ ও যুক্তি প্রণালীকে কিভাবে ব্যবহার করতে পারে, কি কি অতীন্দ্রিয় বিষয় সে নির্ণয় করতে সক্ষম এবং কি কি বিষয়ে সে সংক্ষিপ্ত ও সাধারণ সিদ্ধান্তের উর্ধ্বে অগ্রসর হতে সক্ষম নয়, আর কোন স্তরে গিয়ে ঐ সংক্ষিপ্ত সিদ্ধান্তকে বিস্তারিত সিদ্ধান্তে পরিণত করা ও সাধারণ সিদ্ধান্তকে শর্তযুক্ত সিদ্ধান্তে রূপান্তরিত করার চেষ্টা ভিত্তিহীন হয়ে যায় এবং তা মানুষকে আন্দাজ অনুমানের অসীম দিগন্তে উদভ্রান্ত করে ছেড়ে দেয়। এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর সুরাহা হয়ে গেলেই দর্শনের ভিত্তি সুদৃঢ় হবে। এর পর শিক্ষার্থীকে দর্শনের ইতিহাস পড়াতে হবে। এই পর্যায়ে কুরআনী দর্শনের সাহায্যে তাকে সকল দার্শনিক মতবাদ পড়িয়ে দিতে হবে যেন সে নিজেই দেখতে পায় সত্যসন্ধানের খোদাপ্রদত্ত উপায় উপকরণকে কাজে না লাগিয়ে অথবা ভুল পন্থায় কাজে লাগিয়ে মানবজাতি কিভাবে বিভ্রান্ত হয়েছে। সে বুঝতে পারবে ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরে কিভাবে সে নিজের নাগালের বাইরের জিনিস সম্পর্কে আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তাতে জীবনে কি পরিণতি ঘটেছে। কিভাবে সে নিজেকে পঞ্চইন্দ্রিয় ও বিবেক বুদ্ধির সীমানা না জেনে তার ক্ষমতার আওতা বহির্ভূত বিষয়গুলো নির্ধারণে সময় নষ্ট করেছে। সে জানতে পারবে কোথায় হিন্দু দার্শনিকরা ভুল করেছে, কোথায় গিয়ে গ্রীক দর্শন পথভ্রষ্ট হয়েছে, কোথায় মুসলিম দার্শনিকগণ কুরআনের নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যূত হয়েছেন, বিভিন্ন মতের মুসলিম দার্শনিকগণ শত শত বছর ধরে যেসব বিষয় নিয়ে চিন্তা গবেষণা ও তত্ত্বানুসন্ধান চালিয়েছেন তার কোথায় কোথায় কুরআনের সীমা লঙ্ঘিত হয়েছে এবং কতটা হয়েছে। সে বুঝতে পারবে সূফীতত্ত্বের বিভিন্ন মতবাদের প্রবক্তাগণ সংক্ষিপ্ত বিষয়কে বিস্তারিত করার এবং শর্তহীনকে শর্তযুক্ত করার জন্য কিভাবে চেষ্টা করেছেন এবং তা কত ভ্রান্ত ছিল। জানতে পারবে ইউরোপের দার্শনিক চিন্তা কোন কোন পথ ধরে এগিয়েছে, একই সত্য সন্ধান করতে গিয়ে কত রকমারি মত ও পথের সৃষ্টি হয়েছে এবং এসব মত ও পথে হক কতখানি আর বাতিলের মিশ্রণই বা কতখানি হয়েছে এবং তা কোন কোন পথ দিয়ে এসেছে। ইউরোপে কি কি অতীন্দ্রিয় দর্শন ও ধারণা-বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়েছে, সেসব ধারণা বিশ্বাস মানুষের কাজ কর্ম ও স্বভাব চরিত্রের ওপর কি ধরনের প্রভাব বিস্তার করেছে এবং আল্লাহর কিতাবের নির্দেশ দ্বারা চালিত হলে কিভাবে বৃথা মানসিক পরিশ্রমে সময় নষ্ট করা ও ভ্রান্ত আদর্শের ভিত্তিতে জীবন গড়ার বিপদ থেকে দুনিয়াময় মানুষ রক্ষা পেতে পারতো সেকথাও তারা উপলব্ধি করতে পারবে। এসব বিষয় নিয়ে যথোচিত চিন্তা গবেষণা ও পড়াশোনার পর শিক্ষার্থী তার লব্ধ জ্ঞান লিপিবদ্ধ করবে। অতঃপর পন্ডিত ও বিদ্বান ব্যক্তিদের পর্যালোচনা ও পরীক্ষা নিরীক্ষায় সে যখন নিজ বিষয়ে পরিপক্ক সাব্যস্ত হবে তখন তাকে দর্শনে ডক্টরেট ডিগ্রী দিয়ে বিদায় করতে হবে।

আর একটা বিভাগ থাকবে ইতিহাসের। এতে কুরআনের ইতিহাস দর্শন, ইতিহাস অধ্যয়নের পদ্ধতি বিশ্লেষণ করে শিক্ষার্থীকে ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হবে, যাতে তার মন যাবতীয় সংকীর্ণতা, একদেশর্শিতা ও বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হয়ে যায়। যাতে যাবতীয় তথ্য ও তত্ত্বকে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিতে অভ্যস্ত এবং তা থেকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে সিদ্ধান্ত ও মতামত গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। সে যেন মানব জাতির ইতিবৃত্ত ও মানব সভ্যতার বিকাশ ও অগ্রগতির কাহিনী পড়ে মানুষের সফলতা ও ব্যর্থতা, সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য এবং উত্থান পতন কিভাবে আসে, সে সম্পর্কে স্থায়ী নিয়ম বিধি উদ্ভাবন করতে পারে। মানব সমাজে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কি পদ্ধতিতে ও কোন বিধি অনুসারে ঘটে তা প্রত্যেক ইতিহাসের ছাত্রকে জানতে হবে। তাকে আরো জানতে হবে কি কি গুণ মানুষকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং কি কি দোষ তার অধঃপতন ডেকে আনে। তাছাড়া তাকে চাক্ষুসভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে যে, প্রকৃতির একটা সরলরেখা কিভাবে আদিকাল হতে বর্তমান কাল পর্যন্ত সরল সোজা করে পাতা যা মানুষের উন্নতি ও সুখ সমৃদ্ধির সঠিক পথ। এই সরল পথ থেকে যে ব্যক্তি ডানে বা বামে সরে গিয়েছে তাকে হয় চপেটাঘাত খেয়ে সেই সরল পথের দিকে আসতে হয়েছে, নয়তো এমনভাবে পরিত্যক্ত হতে হয়েছে যে, কোন চিহ্ন পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে নি।

এইভাবে অধ্যয়ন করার পর ইতিহাসের ছাত্ররা যখন জানতে পারবে যে, আল্লাহর আইন কত পক্ষপাতহীন, কত নিরপেক্ষতার সাথে তিনি অতীতের জাতিসমূহের সাথে আচরণ করেছেন, তখন কোন জাতিকেই সে শত্রু বা মিত্র ভাববে না। প্রত্যেক জাতির কীর্তিকলাপে সে নিরপেক্ষ মন, আবেগমুক্ত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে সফলতা ও ব্যর্থতার চিরন্তন সার্বজনীন কষ্টিপাথরে যাছাই করে খাঁটি ও ভেজালকে আলাদা আলাদা করে দেখিয়ে দিবে। এরূপ মানসিক প্রশিক্ষণের পর তাকে ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ, পুরাকীর্তি ও মূল উৎসগুলো থেকে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সবক পুনঃ পুনঃ দিতে হবে। এভাবে তাকে এতটা দক্ষ ও পরিপক্ক করে তুলতে হবে যে, সে যেন ইসলাম বিরোধী ঐতিহাসিকদের পক্ষপাতদুষ্ট আবর্জনার স্তুপ থেকে সত্যকে খুঁজে বের করে নিজেই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মতামত পেশ করতে সক্ষম হবে।

আর একটা বিভাগ থাকা চাই সমাজ-বিজ্ঞানের। এ বিভাগের প্রথম কাজ হবে কুরআন ও হাদীসের আলোকে মানব সভ্যতার মৌলিক নীতিমালা তুলে ধরা। এরপর বিস্তারিতভাবে মৌলনীতি থেকে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় উপবিধি রচনা করে নবীদের নেতৃত্বে যে সামাজিক ও তামুদ্দিনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তার উদাহরণ পেশ করে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, ঐ মৌলনীতির (Fundamental Principles) ভিত্তিতে কিভাবে একটা সুষ্ঠ ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, রাষ্ট্র প্রশাসন ব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত রচিত হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, ঐ একই মৌল নীতিমালার ভিত্তিতে কেমন করে ঐ তামুদ্দিনিক ইমারতের আরো সম্প্রসারণ সম্ভব এবং ইজতিহাদ তথা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ চিন্তা গবেষণা দ্বারা সম্প্রসারণের কি পরিকল্পনা তৈরী করা সম্ভব তাও দেখিয়ে দিতে হবে। সমাজ বিজ্ঞানের প্রত্যেক ছাত্রের এটাও জানা দরকার যে, মানব সমাজে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশ ও উন্নতি হওয়ার কারণে যেসব নতুন শক্তির আবিষ্কার ও উদ্ভাবন ঘটে এবং সভ্যতার স্বাভাবিক বিকাশ বৃদ্ধির ফলে যে নতুন ব্যবহারিক কর্মপদ্ধতির উৎপত্তি হয়, সেগুলোকে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা তথা বিধি নিষেধের আওতায় ঐ ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় কিভাবে একান্ত করে নেয়া যায় এবং কিভাবে এগুলোকে বিকৃতির হাত হতে নিরাপদে রেখে যথাস্থানে স্থাপন করা যায়। তাতে অতীত জাতিগুলোর এবং মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস পড়িয়ে দিতে হবে যেন সে বুঝতে পারে, ইসলামের এসব তামুদ্দুনিক মৌল নীতিমালারও খোদায়ী বিধানের অনুসরণ ও লংঘন কি ফল দর্শায়। অপরদিকে তাকে আধুনিক যুগের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মতবাদ ও বাস্তব কার্যধারার সমালোচনামূলক অধ্যয়ন করতে হবে। এভাবে খোদাবিমুখ মানুষের মনগড়া মত ও পথ তার জন্য কতখানি কল্যাণকর বা ধ্বংসাত্মক তাও বুঝতে হবে।

বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার জন্য কয়েকটা আলাদা বিভাগ থাকা দরকার। এতে কুরআনের নির্দেশের আলোকে এ যাবতকালে আহরিত সমস্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য ও তত্ত্ব শুধু যে পর্যালোচনা করতে হবে তাই নয়, বরং কুরআনের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী প্রাকৃতিক নির্দেশাবলী ও বিধি-বিধানের আরো পর্যালোচনা ও উদ্ভাবনের কাজও একই দৃষ্টিকোণ থেকে হতে হবে। যদিও কুরআন বিজ্ঞান গ্রন্থ নয় এবং বিজ্ঞানের সাথে তার বিষয়বস্তুরও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই; তথাপি এ কথা সত্য যে, এ গ্রন্থের রচয়িতা যিনি বিশ্ব প্রকৃতির স্রষ্টাও তিনি। তাই তিনি তাঁর একটি গ্রন্থের বিভিন্ন জায়গায় নিজেরই আরেকটি গ্রন্থ থেকে নানা দৃষ্টান্ত ও সাক্ষ্য প্রমাণ পেশ করেছেন। এ জন্য এ কিতাব গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে বিজ্ঞানের একজন ছাত্র শুধু বিশ্ব প্রকৃতির বহু মৌলিক নিয়ম কানুন ও বিধি বিধান জানতে পারে তা-ই নয়, বরং বিজ্ঞানের প্রায় প্রত্যেকটি শাখাতেই সে একটা নির্ভুল সূচনা বিন্দু (Starting Point) এবং তত্ত্বানুসন্ধানের জন্য একটা সঠিক দিক নির্দেশনা (Direction) লাভ করে। এটি এমন একটি চাবি যার সাহায্যে তার সামনে খুলে যায় বৈজ্ঞানিক গবেষণার এক স্বচ্ছ ও সোজা রাজপথ। এই চাবির সহায়তা গ্রহণ করলে বিজ্ঞান গবেষণায় বহু জটিল সমস্যার সমাধান অল্প সময়ে সহজতর পন্থায় পাওয়া যায়। আজকের বিজ্ঞানের পথভ্রষ্টতার একটা বড় কারণ এই যে, বাস্তব ঘটনা পর্যবেক্ষণে তা নির্ভুলভাবে প্রয়োগ এবং সঠিক তথ্য উদ্ধার করে বটে, কিন্তু সংগৃহীত তথ্যাবলীর সমন্বয় ঘটিয়ে যখন সে সাধারণ নিয়ম বা মতবাদ রচনা করে তখন বিশ্ব প্রকৃতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে হোঁচট খায়। এ কারণে মানবীয় শক্তির অনেক অপচয় হয়। পরিণামে এ ভ্রান্ত মতবাদগুলোকে মানব সভ্যতার সাথে সংযুক্ত ও একাত্ম করে কর্ম জীবন সংগঠিত করতে গেলে তা গোটা সভ্যতাকে বিপর্যস্ত করার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একজন মুসলিম বিজ্ঞানী যখন কুরআনের দিক নির্দেশনার আলোকে প্রমাণিত তথ্যসমূহকে বিদ্যমান মতবাদসমূহ হতে বিচ্ছিন্ন করে নতুন করে বিন্যস্ত করবে এবং আরো তথ্য আহরণ করে তা দিয়ে শ্রেষ্ঠতর মতবাদ রচনা করবে, তখন দুনিয়াবাসী আজ যে সব বৈজ্ঞানিক বিভ্রান্তিতে লিপ্ত তা বর্জন না করে পারবে না।

যে সব জ্ঞান বিজ্ঞানকে আজকাল ইসলামী শিক্ষা বলা হয়, তার জন্যও আলাদা আলাদা বিভাগ থাকতে হবে। যেমন একটা বিভাগে থাকবে কুরআনের গবেষণামূলক অধ্যয়নের জন্য। এতে অতীতের তাফসীরকারকদের কৃত তাফসীর পর্যালোচনা করা এবং এ কাজ আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। বিভিন্ন দিক দিয়ে কুরআনী জ্ঞান বিজ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করতে চেষ্টা করতে হবে, মানুষের উদ্ভাসিত জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখার সাহায্যে কুরআনের আরো দক্ষতা ও পারদর্শিতা অর্জন করতে হবে। অনুরূপভাবে হাদীসের একটা বিভাগ থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে হাদীসবেত্তাগণ যে কাজ করে গিয়েছেন তা অধ্যয়ন করতে হবে এবং তারপর গবেষণা, সমন্বয়, সংগৃহীত জ্ঞানের সমন্বয় ও বিন্যাস এবং সিন্ধান্ত ও মতামত গ্রহণের কাজ আরো এগিয়ে নিতে হবে। ইসলামের সোনালী যুগের আরো খুঁটিনাটি তথ্য ও ঘটনা খুঁজে বের করতে হবে এবং তা থেকে এমন সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে যা এ যাবত আমাদের জানার বাইরে রয়ে গিয়েছে। ইসলামী আইন বিজ্ঞান নামে একটা বিভাগ থাকবে। কুরআনের আহকাম(আদেশ নিষেধ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসে তাত্ত্বিক ও বাস্তব ব্যাখ্যা (কওলী ও আমলী) সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেঈনদের (সাহাবাদের অব্যবহিত উত্তরপুরুষ) ইজতিহাদ বা গবেষণালব্ধ জ্ঞান, ইজতিহাদকারী ইমামদের যুক্তি প্রণালী এবং খুঁটিনাটি বিষয়ে তাঁদের যুক্তিসিদ্ধ ব্যাখ্যানুসমূহের বিস্তারিত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ অধ্যয়ণ করতে হবে। সাথে সাথে দুনিয়ার প্রাচীন ও আধুনিক জাতিসত্তাসমূহের আইন শাস্ত্র ও আইন বিজ্ঞানও গভীরভাবে পড়তে হবে। এভাবে জীবনের নিত্য পরিবর্তনশীল অবস্থা ও সমস্যাবলীর ক্ষেত্রে ইসলামী আইনের মূলনীতিসমূহ প্রয়োগ করে ফিকাহ শাস্ত্রে অতীত যুগের নির্জীব দেহে প্রাণসঞ্চার করতে হবে। এভাবে এই বিভাগসমূহের নিজস্ব অবদানগুলোই শুধু অত্যন্ত ব্যাপক ও মহৎ হবে না, বরং অন্যান্য বিভাগকেও তা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ সম্পর্কে এমন সব মূল্যবান উপকরণ ও তথ্য সরবরাহ করতে পারবে যার উপর দাঁড়িয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের নব দিগন্ত গভীর গবেষণা ও উদ্ভাবনের তরংগ সৃষ্টি করা যাবে।

তৃতীয় বৈশিষ্ট্যঃ

আমি কয়েকটি বিভাগের কথা উল্লেখ করলাম। উদ্দেশ্য হলো এর দ্বারা যেন পুরো শিক্ষা কাঠামোর বিস্তারিত ও ব্যাপক ধারণা ও নীল নকশা সহজেই পাওয়া যেতে পারে। এখন প্রস্তাবিত নয়া শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বশেষ ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করবো। সেই বৈশিষ্ট্য হলো, এতে আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার ন্যায় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যহীন শিক্ষার অস্তিত্ব থাকবে না। বরং শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের সামনে একটি স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট জীবনোদ্দেশ্য এবং তাদের চেষ্টা সাধনারও একটা চূড়ান্ত উদ্দেশ্য থাকবে। আর তা হলো খোদার আনুগত্যের আদর্শকে দুনিয়ায় বিজয়ী ও নেতৃত্বদানকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাদের সর্বাত্মক জেহাদ বা সংগ্রাম চালাতে হবে। মানব দেহের প্রতিটি শিরা উপশিরায় যেমন রক্ত প্রবাহিত হয়ে তাকে সতেজ ও কর্মতৎপর রাখে, এই শিক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্যও ঠিক সেই লক্ষ্যই পূরণ করবে। শিক্ষার্থীর ব্যক্তি জীবন, তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ ও মেলামেশায়, তাঁদের খেলাধুলা ও বিনোদন, তাদের শ্রেণীকক্ষের লেখাপড়ায় এবং গবেষণা ও অধ্যয়নের সকল তৎপরতায় জীবনের এই লক্ষ্যই সক্রিয় থাকবে। এই লক্ষ্যের আলোকেই তাদের জীবন ও জীবনের কর্মনীতি বিরচিত হবে। এই ধাঁচেই তাদের চরিত্র গড়ে তোলা হবে। মোটকথা শিক্ষা পরিবেশ এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ইসলামের এক একজন নিবেদিত প্রাণ সৈনিকে পরিণত করবে।

প্রত্যাশিত ফলাফল
এ ধরনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পেয়ে যারা তৈরী হবে তাদের ভেতর চিরাচরিত ও গতানুগতিক স্রোতধারাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার মত শক্তি থাকবে। তাদের জ্ঞানগর্ভ ও চুলচেরা সমালোচনা সব অ-ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান ও সভ্যতার ভিতে ধ্বস নামিয়ে দিবে। তাদের উদ্ভাবিত জ্ঞান বিজ্ঞান এত শক্তিশালী হবে যে, আজ যারা জাহিলিয়াতের দৃষ্টিভঙ্গী আঁকড়ে ধরে আছে, তাদেরকে তারা ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীর দিকে ফিরিয়ে আনবে। তাদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান বিজ্ঞানের সুফল ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানের মত উন্নত দেশকেও প্রভাবিত করবে এবং বিবেকবান প্রতিটি মানুষ সহাবস্থান থেকেই তাদের এই ধ্যান ধারণাকে গ্রহণ করতে ছুটে আসবে। তাদের বিরচিত জীবন দর্শন ও জীবন পদ্ধতি এমন প্রবলভাবে চিন্তা মতবাদের জগতে প্রভাব বিস্তার করবে যে, বাস্তব বিরুদ্ধ কোন জীবন দর্শনের পক্ষে অস্তিত্ব বজায় রাখাই কঠিন হয়ে যাবে। এছাড়াও শিক্ষা দ্বারা এমন চরিত্রবান ও কৃতসংকল্প লোক গড়ে উঠবে, নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের জগতে কার্যকর বিপ্লব সৃষ্টির জন্য যাদের প্রয়োজন অপরিহার্য। তারা হবে এ বিপ্লবের সুনিপুণ কৌশলী। এ বিপ্লব সৃষ্টির জন্য তাদের আগ্রহও থাকবে অদম্য। আর এ বিপ্লবী আন্দোলনকে বিশুদ্ধ ও ইসলামী প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতে পরিচালনা করার যোগ্যতাও তাদের থাকবে। অবশেষে সফলতার চূড়ান্ত স্তরে পৌছে তারা ইসলামী আদর্শ ও মূলনীতির ভিত্তিতে একটা রাষ্ট্র, একটা পূর্ণাঙ্গ সভ্যতা , কৃষ্টি ও সমাজ ব্যবস্থা সহকারে কায়েম করবে। সে রাষ্ট্রের আকৃতি ও প্রকৃতি হবে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী এবং সারা দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা ও ক্ষমতা তার থাকবে।

বাস্তব সমস্যা
এ পর্যায়ে তিনটা কঠোর বাস্তব সমস্যা সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার মনে হচ্ছে, আমার এ বক্তব্য শোনার সময়ে এ প্রশ্নগুলো আপনাদেরকে ইতোমধ্যেই বিব্রত করতে শুরু করে দিয়েছে।

 

 

 

পাঠ্যসূচী ও শিক্ষক সংগ্রহ

প্রথম প্রশ্ন হলোঃ এ শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নের উপায় কি? কারণ এই নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষাদানকারী শিক্ষকও যেমন বর্তমানে কোথাও পাওয়া যাবে না, ঠিক তেমনি এই নতুন পরিকল্পনা অনুসারে কোন একটা বিষয় শিক্ষা দেওয়ার মত বই পুস্তকও বর্তমানে কোথাও নেই। বরং একথা বললেও হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে, প্রথম শ্রেণীর ছাত্রকেও এই পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়ার জন্য কোন শিক্ষক বা পাঠ্যপুস্তক বর্তমানে পাওয়া দুষ্কর। এ প্রশ্নের উত্তর হলো, একটা ভবন নির্মাণ করতে যেমন ইট পাকানোর ভাটা তৈরী করতে হয়, তেমনি একটা নতুন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে একটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান বানানো একান্ত প্রয়োজন, যাতে বিশেষ পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের উপযুক্ত শিক্ষক তৈরি করতে পারা যায়। ইটতো এমনি এমনি পাওয়া যায় না। ভাটায় পুড়িয়ে তৈরি করে নিতে হয়। অনুরূপভাবে শিক্ষক রেডিমেড পাওয়া যাবে না, তৈরি করতে হবে। তবে প্রচলিত ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষালাভ করে এমন কিছু লোক বেরিয়েছে যারা হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর মত সহজাত ইসলামী স্বভাব চরিত্রের অধিকারী। তারা বিভিন্ন স্তরে অ-ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষালাভ করেও নিজেদের ঈমান রক্ষা করতে পেরেছেন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী ও জীবন-লক্ষ্য ইসলামী কিংবা সামান্য চেষ্টা সাধনার দ্বারাই খালেছ ইসলামী ভাবাপন্ন করা সম্ভব। জীবনের যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে তারা বিশ্বাসী, তার পথে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করার মত মনোবলও তাদের আছে। গবেষণা তথা ইজতিহাদ করার যোগ্যতাও তাদের মধ্যে বর্তমান। এ ধরনের লোকদেরকে যদি বিশেষ ধরনের নৈতিক ও মানসিক প্রশিক্ষণ দেয়া যায়, যে ধারাক্রমে তাদের মন মগজে এ যাবত বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্য পুঞ্জিভূত হয়ে আসছে যদি তা একটু কৌশলে পাল্টে দেয়া যায় এবং দৃষ্টিভঙ্গী যদি একটু ভাল করে ইসলামমুখী করা যায়, তা হলে এসব লোকই পড়াশোনা ও চিন্তা-গবেষণা দ্বারা এতটা যোগ্য ও দক্ষ হতে পারে যে, আমার প্রস্তাবিত পরিকল্পনা অনুসারে সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞানকে নতুন ধারায় বিন্যস্ত করে সংকলন করতে পারবে। অতঃপর জ্ঞান বিজ্ঞানের এই নবতর বিন্যাস ও সংকলন যখন খানিকটা সম্পন্ন হবে, তখন প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য নমুনা স্বরূপ একটা শিক্ষাঙ্গন গড়া যেতে পারে।

ছাত্র সংগ্রহঃ

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, এ জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়িত করা গেলেও তাতে ছাত্রদের আকর্ষণ করার কি একটা মোহনীয় বিষয় থাকবে যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত সভ্যতা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সেবার করার জন্য নয় বরং তার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তৈরী হয়েছে। সে শিক্ষাব্যবস্থায় যারা অংশগ্রহণ করবে তারা কিছুতেই এ আশা করতে পারে না যে, ওখান থেকে শিক্ষা লাভ করে বেরিয়ে তারা কিছু অর্থোপার্জন করতে পারবে। এমতাবস্থায় কজন লোক এমন পাওয়া যাবে যারা অর্থোপার্জনের পরোয়া না করে এমন শিক্ষা গ্রহণের জন্য এগিয়ে আসবে যে শিক্ষা শেষে পার্থিব দৃষ্টিতে কোন উজ্জল ভবিষ্যত নেই?

এর জবাব হলো, এ শিক্ষা ব্যবস্থার সত্য ও ন্যায়ের মোহিনী শক্তি ছাড়া আর কোন আকর্ষণ নেই এবং এরূপ কোন আকর্ষণের দরকার নেই। যাদের মন এদিকে আকৃষ্ট হয় না, শুধু পার্থিব ভোগ উপকরণই যাদের আকৃষ্ট করতে পারে, তাদের এদিকে আকৃষ্ট না হলেও চলবে। এ শিক্ষা যাদের প্রয়োজন নেই, এ শিক্ষাও তাদের প্রয়োজনের মুখাপেক্ষী হবে না। এর জন্য প্রয়োজন এমন সৎলোকের যারা জেনে বুঝে এই লক্ষ্যে ও এই কাজের জন্য নিজেদের ও নিজেদের সন্তানদের জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত হবে। এ ধরনের লোক একেবারেই বিরল নয়। সারা ভারতবর্ষ থেকে কি পঞ্চাশটা শিশুও এজন্য পাওয়া যাবে না? যে জাতি যুগের পর যুগ ধরে ইসলাম ইসলাম বলে আর্তনাদ করছে সে জাতি কি এ কয়টি শিশুও যোগান দিতে পারবে না! না পারলেও কিছু আসে যায় না। এরূপ হলে আল্লাহ অন্য জাতিকে এ সৌভাগ্য ও সুযোগ দান করবেন। আর যে দেশের মানুষ নিজেদের মুসলমান বলে দাবী করে তারা যদি ইসলামী শিক্ষার জন্য অল্পসংখ্যক শিশু সংগ্রহ করে দিতে না পারে তা হলেও ক্ষতি নেই। আল্লাহ এ সৌভাগ্য অন্য জাতিকে দিবেন।

অর্থ সংগ্রহের প্রশ্নঃ

সর্বশেষ প্রশ্ন হলো, এ কাজ সম্পাদনের জন্য অর্থ কোথায় পাওয়া যাবে? এর সংক্ষিপ্ত জবাব হলো, যাদের অর্থ আছে, ঈমানও আছে এবং অর্থ ব্যয় করার সঠিক খাত বুঝার মত বিবেক বুদ্ধিও আছে তাদের কাছ হতেই প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া যাবে। যারা দিন রাত ইসলামের জন্য কাতরাচ্ছে তাদের মধ্যে এমন লোকও যদি না পাওয়া যায় তাহলে আমি বলবো তাতেও কোন পরোয়া নেই। আল্লাহ তায়ালা অন্য জাতির মধ্য থেকেই এমন লোক তৈরি করে দিবেন। ইসলামের সোনালী যুগেও তো কুফর ও শিরকের ক্রোড় থেকেই এমন সব আল্লাহর বান্দার উদ্ভব ও আগমন ঘটেছিল, যাদের আর্থিক কুরবানীর বদৌলতে ইসলাম দুনিয়াতে প্রসার লাভ করেছিল। (তরজমানুল কুরআন, শাওয়াল-জিলকদ, ১৩৫৯ হিজরী)।

উচ্চ শিক্ষার ইপ্সিত মান
[মাওলানা মওদূদীর নয়া শিক্ষা ব্যবস্থা সংক্রান্ত উল্লেখিত ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার মান নির্ণয়ের লক্ষ্যে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে ১৯৪৪ সনে একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির প্রথম বৈঠক বসে ঐ বছরেরই ১৪ই আগস্ট ভারতের পাঠানকোটে। এই বৈঠকে মাওলানা তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে নমুনা স্বরূপ পাঁচটি বিষয়ের উপর শিক্ষার মান পেশ করেন। নিচে ধারাবাহিকভাবে এগুলো পেশ করা হলো।]

জ্ঞান বা বিদ্যাগত মানঃ

উচ্চ শিক্ষার ফ্যাকাল্টিগুলো নিম্নরূপ হতে পারেঃ

(১) দর্শনঃ ইতিহাস দর্শন-দর্শনশাস্ত্রে মুসলিম দার্শনিকদের বিভিন্ন মতবাদ ও চিন্তাধারা, অ-মুসলিম দার্শনিকদের বিভিন্ন মতবাদ ও চিন্তাধারা, আকীদা বা কালাম শাস্ত্র, সূফীবাদ, যুক্তিবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান, নীতিবিজ্ঞান, তাত্ত্বিকবিজ্ঞান, কুরআনের বিজ্ঞান ও তার সমর্থক হাদীস।

(২) ইতিহাসঃ ইসলামের ইতিহাস, মুসলমানদের ইতিহাস, বিশ্বের প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাস, বিপ্লবের ইতিহাস, ইতিহাস দর্শন, সমাজতত্ত্ব (Sociology) , বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিক দর্শন, পৌরবিজ্ঞান (Civics) , রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও বিশ্বের শাসনতন্ত্রসমূহ, ইসলামী ইতিহাস দর্শন ও সমাজ দর্শন এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধ্যয়ন কুরআন ও হাদীসের আলোকে।

(৩) অর্থনীতিঃ অর্থনীতি শাস্ত্র, বিভিন্ন অর্থনৈতিক মতবাদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মতাদর্শ, দুনিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, আর্থিক ক্রিয়াকান্ড (Finance) ও ব্যাংকিং ব্যবস্থ (Banking) এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ হতে কুরআন, হাদীস ও ফিকাহ অধ্যয়ন।

(৪) আইনশাস্ত্রঃ আইনের উৎপত্তির ইতিহাস, আইনের বিধান, প্রাচীন ও আধুনিক জাতিসমূহের আইন কানুন, বিচার ব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থার মূলনীতি ও তার সংগঠন। এ ক্ষেত্রে ইসলামী দৃষ্টিকোণ হতে কুরআন, হাদীস ও ইসলামী মাযহাবসমূহের আইন কানুন অধ্যয়ন করতে হবে।

(৫) ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানঃ আরবী ভাষা ও সাহিত্য। তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ, ইসলামের ব্যবহারিক আইনের ইতিহাস, মুসলিম চিন্তাধারার ইতিবৃত্ত, দুনিয়ার প্রচলিত ধর্মসমূহের তুলনামূলক অধ্যয়ন, বিশ্বের ধর্মসমূহের ইতিহাস, ধর্ম দর্শন, আধুনিক যুগের ধর্মীয় ও নৈতিক আন্দোলনসমূহ এবং পাশ্চাত্যের নাস্তিকতাবাদের ইতিহাস।

 

 

 

 

 

 

নৈতিক ও মানসিক মানঃ

উল্লেখিত বিদ্যাগত ও জ্ঞানগত মান অর্জন করার সাথে সাথে শিক্ষার্থীকে নিম্নলিখিত বুদ্ধিভিত্তিক গুণাবলীতে সজ্জিত হতে হবেঃ

(১) চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গী ও মানসিকতার দিক দিয়ে পূর্ণ ও পরিপক্ক মুসলমান হতে হবে এবং ইসলামের জন্য গোটা দুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রবল আগ্রহ পোষণ করবে।

(২) ইসলামের গভীর জ্ঞান অর্জন ও স্বাধীন চিন্তা গবেষণা করার (ইজতিহাদ) যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পন্ন হবে। দুনিয়ার বিকারগ্রস্ত সাংস্কৃতিক ও নৈতিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে তার জায়গায় একটা সুস্থ, সুন্দর ও ন্যায়সঙ্গত সাংস্কৃতিক ও নৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য যে যোগ্যতা ও প্রতিভার প্রয়োজন, তা তাদের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হতে হবে।

(৩) শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিভিত্তিক ট্রেনিং এমন উন্নতমানের হবে যে, সমসাময়িক পৃথিবী জ্ঞান বিজ্ঞানে তাদের বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

(৪) কুরআন ও হাদীসে যে সমস্ত চারিত্রিক দোষকে কাফের, ফাসেক ও মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং যাকে ঈমানের পরিপন্থী, ইসলামের বিরোধী এবং সুস্থ ও ন্যায় নীতি ভিত্তিক সমাজের জন্য অশোভন বলে অভিহিত করা হয়েছে, তা থেকে তারা হবে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। পক্ষান্তরে তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে এমন সব নৈতিক গুণাবলীর লালন ও সমাবেশ ঘটানো চাই, যা কুরআন ও হাদীসে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের, পরহেজগারদের, সত্যবাদীদের, নেককারদের, মুমিনদের, সৎকর্মশীলদের, সফলকাম ও কামিয়াব লোকদের বৈশিষ্ট্য বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

(৫) তাদের চরিত্র ও মনোবল এমন বলিষ্ঠ হবে যে, তারা দুনিয়ায় নিজের পায়ে ভর করেই দাঁড়াতে পারবে। তাদের ক্ষেত্রে প্রত্যেক কর্মক্ষেত্রেই টিকে থাকার ক্ষমতা থাকবে, কোন ক্ষেত্রেই পরাভব স্বীকার করবে না। তারা কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার পথ করে নিতে সক্ষম হবে এবং কঠোর পরিশ্রম দ্বারা যে কোন পরিবেশে নিজেদের জীবিকা উপার্জনের যোগ্যতা তাদের থাকবে।

এ হলো আমাদের পরিকল্পিত নয়া শিক্ষা ইমারতের উপরের গাঁথুন (Super Structure)। শেষ পর্য্যন্ত আমাদের এই ইমারতই নির্মাণ করতে হবে। এই বিশাল প্রাসাদকে ধরে রাখার জন্য যে মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, তাতে নিঃসন্দেহে নিম্নলিখিত বিভাগগুলোর জ্ঞানগত প্রস্তুতি অপরিহার্য হবে।

 

 

 

 

 

 

 

 


মাধ্যমিক শিক্ষার অভীষ্ট লক্ষ্য
সাধারণঃ (১) আরবী ভাষা, ইংরেজী অথবা অন্য যে কোন ইউরোপীয় ভাষায় এতটা দক্ষ বানাতে হবে যা গবেষণামূলক অধ্যয়নের জন্য যথেষ্ট হতে পারে।

(২) কুরআনের গবেষণামূলক অধ্যয়নের জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি।

(৩) উসুলে হাদীস এবং কোন সংক্ষিপ্ত হাদীস গ্রন্থের গবেষণামূলক অধ্যয়ন করার যোগ্যতা সৃষ্টি , যাতে শিক্ষার্থীর জন্য ভবিষ্যতে আরো গভীর গবেষণামূলক অধ্যয়নের পথ উন্মুক্ত হয়।

সহায়ক ও প্রাথমিক স্তরের জ্ঞান দান করতে উচ্চ শিক্ষার স্তরে গিয়ে শিক্ষার্থী যেসব বিষয়ে এগুলো নিয়ে গবেষণা করবে। যেমনঃ

(১) দর্শন বিভাগের জন্য প্রাথমিক যুক্তিবিদ্যা, প্রাথমিক দর্শন, প্রাচীন ও আধুনিক উভয়টিকেই পড়াতে হবে এবং আকীদা শাস্ত্র বা ইলমে কালামের প্রত্যেকটি বিষয়ে এক একখানা বই পড়িয়ে দিতে হবে যা এতদসংক্রান্ত পরিভাষা, বাচনভঙ্গি ও মৌলিক বিষয়াবলী জানার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। তাছাড়া মনস্তত্ব, পদার্থবিদ্যা ও ইত্যাকার প্রত্যেকটি বিষয়ে এক একখানা প্রাথমিক বই পড়াতে হবে।

(২) ইতিহাস বিভাগের জন্য পৌরবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাস সংক্রান্ত এমন একটা পাঠ্যসূচী থাকবে যা দ্বারা ছাত্ররা ইতিহাসে গবেষণা এবং সভ্যতা ও সভ্যতার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের গভীরে ঐ সব জ্ঞান বিজ্ঞানকে জানতে পারবে এবং এ বিষয় সম্পর্কে মোটামুটি ওয়াকিবহাল হবে।

(৩) অর্থনীতি বিভাগের জন্য এমন কোর্স থাকবে যা দ্বারা ছাত্ররা মানব সমাজের গঠন ও কাঠামো এবং তার মৌল সমস্যাগুলোকে প্রাথমিকভাবে বুঝতে পারবে। অতঃপর অর্থনীতি, আর্থিক লেনদেন, ব্যাংকিং এবং অর্থনৈতিক কায়-কারবার ও লেনদেনের মূলনীতি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হওয়া ছাড়াও বর্তমান যুগের অর্থব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক মতবাদসমূহ সম্পর্কে মোটামুটি অবহিত হতে পারবে।

(৪) আইন বিভাগের জন্য আইন বিজ্ঞান, ফিকাহ শাস্ত্রের মূলনীতি (উসুলে ফিকাহ), আইনের ইতিহাস ও ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রের ইতিহাস সম্পর্কে একখানা প্রাথমিক বই পড়াতে হবে এবং চারটি মাযহাবের মাসলা মাসায়েলের একটি সংক্ষিপ্ত সংকলন থাকতে হবে।

(৫) ইসলামী শিক্ষা বিভাগের জন্য আরবী ভাষার একটা অতিরিক্ত পাঠ্যসূচী থাকবে, যা মাধ্যমিক ‍শিক্ষার জন্য প্রস্তাবিত সাধারণ শিক্ষাসূচী থেকে আলাদা হবে। তা ছাড়া ফিকাহ ও ফিকাহশাস্ত্র প্রণয়নের ইতিহাস সম্পর্কে একখানা বই এবং তুলনামূলক ধর্ম অধ্যয়নের জন্য একখানা বই থাকবে যাতে বিভিন্ন ধর্মমতের উৎপত্তির ইতিহাসও সন্নিবেশিত হবে।

উল্লেখিত উচ্চতর স্তর দুটিকে সামাল দেয়ার জন্য যেখান থেকে নির্মাণ শুরু হবে তার বিস্তারিত বিবরণগুলো খুবই চিন্তাভাবনা করে তৈরি করতে হবে যেন ভিত্তি খুব মজবুত হয় এবং ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞানগত এবং নৈতিক উভয় ক্ষেত্রে সুসভ্য ও রুচিবান মানুষ এবং ইসলামী আন্দোলনের জন্য উন্নতমানের কর্মী সুলভ অত্যাবশ্যক গুণ-বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়। যে সব ছাত্র প্রাইমারী পর্যায়ে লেখাপড়া করেই ক্ষান্ত হবে তারা যেন মৌলিক মানবীয় ও ইসলামিক গুণাবলীর দিক দিয়ে অসম্পূর্ণ থেকে না যায় এতটা মৌলিক শিক্ষা ও ট্রেনিং দিয়ে ছাড়তে হবে। একটা সুসভ্য ও রুচিবান সমাজের সক্রিয় সদস্য হবার জন্য যেসব যোগ্যতা অপরিহার্য তাও যেন তাদের মধ্যে গড়ে উঠে এটা নিশ্চিত করা চাই। এ জন্য কত সময় দরকার বা একে কয়টা স্তরে ভাগ করা দরকার সেটা বিশেষজ্ঞরা স্থির করবেন। আমি শুধু এতটুকু বলবো যে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেসব গুণাবলী ও যোগ্যতা দেখতে চাই সেই কাংখিত মান সামনে রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে ঐ মানের শিক্ষার্থী তৈরীর জন্য আমাদের কত সময় এবং কি কি সাজ সরঞ্জাম দরকার হবে।

প্রাথমিক শিক্ষার প্রয়োজনীয় মান
নৈতিক শিক্ষাঃ

(১) শিষ্ঠাচার, পবিত্রতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ভালো-মন্দবোধ, সুরুচি।

(২) সচ্চরিত্র-ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে।

(৩) শৃংখলা, সভ্য ও ভদ্রোচিত এবং স্বাধীনভাবে সমাজে বসবাস করা ও কাজ করার পদ্ধতি, আত্মসমালোচনার অভ্যাস, কর্তব্যপরায়ণতা ও দায়িত্ববোধ।

(৪) উদার মানসিকতা, দৃষ্টির প্রশস্ততা, চিন্তার ব্যাপকতা, সাহসিকতা ও আত্মমর্যাদাবোধ।

(৫) সংকল্প ও ইচ্ছার দৃঢ়তা, গাম্ভীর্য ও আন্তরিকতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, প্রত্যেক ব্যাপারে কথা ও কাজের বৈপরীত্য ও কপটতা পরিহার।

(৬) সাহসিকতা, বীরত্ব, কষ্টসহিষ্ঞুতা, কর্মতৎপরতা ও সতর্কতা, সবধরনের কাজ করার যোগ্যতা, জীবনের সবদিক ও বিভাগ সম্পর্কে কিছু না কিছু জ্ঞান ও বাস্তব অভিজ্ঞতা।

(৭) ইসলামী লক্ষ্যের প্রতি অদম্য আগ্রহ এবং গভীর ইসলামী উদ্দীপনা যা অন্তরের অন্তঃস্থলে প্রোথিত এবং যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে শিশু কিশোরদের প্রতিটি চাল চলনে ও হাবভাবে।

(৮) ইসলামী ওজন ও পরিমাপক দ্বারা সব জিনিস মাপা ও ওজন করার অভ্যাস।

(৯) সাংগঠনিক ও সংঘবদ্ধ জীবনের জন্য কুরআন ও হাদীসে যেসব অত্যাবশ্যক গুণাবলীর কথা বলা হয়েছে সেসব গুণাবলী।

(১০) প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনার যোগ্যতা।

(১১) গবেষণা, অনুসন্ধান এবং চিন্তা ও পর্যবেক্ষণের অভ্যাস, চোখ কান খোলা রেখে অর্থাৎ সদা সতর্ক ও সচকিতভাবে দুনিয়ায় বাস করা, যথাযথভাবে চিন্তা ভাবনা করা, প্রমাণ ও যুক্তি দর্শানো এবং পরখ করা।

বাস্তব ট্রেনিংঃ

(১) নৌচালনা, সাঁতার, তলোয়ার ও বন্দুক চালনা, ঘোড় সওয়ারী ও সাইকেল চালনা।

(২) খন্তি-কোদাল, হাতুড়ি-বেলচা, করাত, নির্মাণ সামগ্রী ইত্যাদির ব্যবহার করতে সক্ষম হওয়া, প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান লাভ করা।

(৩) বাজার থেকে মালপত্র কেনা এবং নিঃসঙ্কোচে নিজের মালপত্র বিক্রি করার যোগ্যতা অর্জন করা।

(৪) হোস্টেল ও বাসস্থানের ব্যবস্থাপনা, কোন বড় সম্মেলনের ব্যবস্থাপনা ও কোন বড় দলের ভ্রমণের ব্যবস্থাপনার যোগ্যতা।

(৫) অফিস সংক্রান্ত কাজ কর্মে অভিজ্ঞতা অর্জন ও বাণিজ্যিক চিঠিপত্র আদানপ্রদানের অনুশীলন।

(৬) বক্তৃতা, প্রবন্ধ লেখা, প্রচার কার্য্য চালানো, আলাপ আলোচনা চালানো স্বমতে আগ্রহী করার মত কথাবার্তা বলা বা ক্যানভাস করার যোগ্যতা।

(৭) খাদ্য রান্না করা, কাপড় কাটা ও সেলাই করার কিছু যোগ্যতা থাকা।

জ্ঞানগতঃ

(১) মাতৃভাষাঃ মাতৃভাষা বিশুদ্ধভাবে লিখতে ও সব ধরনের বই পুস্তক পড়তে ও বুঝতে পারা এবং লেখা ও বক্তৃতার মাধ্যমে নিজের মনোভাব ব্যক্ত করতে সক্ষম হওয়া।

(২) প্রাথমিকভাবে আরবী এতটা শেখা যেন কুরআনের অর্থ মোটামুটি বুঝতে পারে।

(৩) ফারসী গুলিস্তাঁ ও বুস্তাঁ পড়তে পারার যোগ্যতা।

(৪) ইংরেজীর প্রাথমিক জ্ঞান ও সাধারণ জ্ঞান লাভের জন্য যেসব বিদ্যা মাতৃভাষায় পড়ানো হবে, সেসব বিদ্যার প্রাথমিক বই ইংরেজীতে পড়তে, বুঝতে ও অনুবাদ করতে পারা।

(৫) প্রাথমিক অংক শাস্ত্রঃ বুদ্ধিভিত্তিক অনুশীলন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট হতে পারে গণিত বা অংকশাস্ত্রে এতটুকু জ্ঞান থাকা।

(৬) ভূগোলঃ প্রাকৃতিক ভূগোল, গোটা পৃথিবীর মোটামুটি ভৌগলিক জ্ঞান, কুরআনিক ভূগোল ও নিজ দেশের ভৌগলিক জ্ঞান।

(৭) ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিহাসঃ নবীদের ও মুসলিম মনীষীদের জীবন কাহিনী, মাতৃভূমির প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক জ্ঞান।

(৮) ইসলামী আকীদা, আখলাক, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সুস্পষ্ট ধারণা থাকা। অন্তুর্ভুক্ত ফিকাহ সম্পর্কে অত্যাবশ্যকীয় বিস্তারিত জ্ঞান থাকা যা একজন মুসলিমের ধর্মীয় জীবনের জন্য প্রয়োজনীয়।

(৯) স্বাস্থ্য বিজ্ঞানঃ শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কাজ, শরীরবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূ-বিদ্যা-মোটকথা নিজ দেহ, সমাজ ও পরিবেশ সম্পর্কে অপরিহার্য জ্ঞান।

(১০) ড্রয়িং, স্কেল ড্রয়িংঃ মডেল ড্রয়িং, ফ্রিহ্যান্ড পেইন্টিং এ পরিচ্ছন্নতা, নির্ভুলতা, সুরুচি এবং মানচিত্র অংকন ও মানচিত্র পঠনের যোগ্যতা।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা
যারা আধুনিক শিক্ষায় অথবা মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত, তাদেরকে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীতে চারিত্রিক ও জ্ঞানগত উভয়দিক হতে তৈরী করার লক্ষ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার একটা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা প্রয়োজন। এতে দুটো সুফল মিলবে। প্রথমত ইসলামী আন্দোলন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় উচ্চ মানের কর্মী ও নেতার একটা বাহিনী অল্পদিনের মধ্যেই হস্তগত হবে।

দ্বিতীয়তঃ এই অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থায় যাদের গড়ে তোলা হবে তারাই প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার বিভাগগুলোতে শিক্ষালাভ, শিক্ষকতা ও পাঠ্যবই প্রণয়নের কাজ করতে পারবে। পরবর্তী সময়ে এই অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাকে সামান্য রদবদল করে উচ্চশিক্ষার একটা স্থায়ী বিভাগে পরিণত করা যাবে। যারা প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর এই শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাঙ্গনে অতিবাহিত করে নি, বরং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে এই দুই স্তর অতিক্রম করে এসেছে তাদেরকে উচ্চ শিক্ষার বিভাগসমূহে ভর্তি করার জন্য প্রস্তুত করা যাবে।

এই অন্তবর্তীকালীন শিক্ষার পাঠ্যসূচী, মেয়াদ ও স্তরসমূহ নির্ণয় করার কাজ আমি বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দিয়ে কেবল এই শিক্ষার মান সম্পর্কে কিছু বলেই শেষ করছি। এ শিক্ষা সমাপ্তির পর ছাত্রদের মধ্যে নিম্নবর্ণিত যোগ্যতা সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন।

প্রয়োজনীয় মানঃ

১-কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে এতটা ব্যুৎপত্তি ও দক্ষতা সৃষ্টি হওয়া দরকার যেন শিক্ষার্থীরা জীবনের বিভিন্ন সমস্যায় আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহর সুন্নাত থেকে পথনির্দেশ লাভ করতে পারে।

২-ইসলামী ফিকাহ ও আইন সম্পর্কে এতটা জ্ঞান লাভ করতে হবে যেন বিভিন্ন মাযহাবে কুরআন ও সুন্নাহর মূল উৎস থেকে যেসব মূলনীতি অনুসরণ করে শরীয়তের বিধি বিধান প্রনয়ণ করা হয়, সেসব মূলনীতি এবং তাদের যুক্তি প্রমাণ ছাত্ররা আত্মস্থ করতে পারে।

৩-প্রাচীন যুক্তিশাস্ত্র সম্পর্কে এতটা জ্ঞান লাভ করা চাই যেন ছাত্ররা প্রাচীন যুক্তি শাস্ত্রবিদদের লিখিত বই-পুস্তক পড়ে জ্ঞানোদ্ধার করতে পারে এবং আধুনিক যুক্তিশাস্ত্র সম্পর্কে এতটা জ্ঞান লাভ করা চাই যেন ছাত্ররা আধুনিক যুগের জ্ঞান বিজ্ঞানের পটভূমি ভালো করে বুঝতে পারে।

৪-সমাজ বিজ্ঞান সম্পর্কে এতটা জ্ঞান অর্জন করা চাই যেন ছাত্ররা আধুনিক যুগের সাংস্কৃতিক সমস্যাবলী এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সমালোচকের দৃষ্টিতে ভালোভাবে বুঝতে পারে।

৫-বিশ্ব ইতিহাস সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞানঃ নবুওয়াত যুগ ও খিলাফতে রাশেদার ইতিহাস এবং উপমহাদেশ ও ইউরোপের আধুনিক যুগের ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞান লাভ করতে পারে।

শিক্ষাকমিটির দ্বিতীয় বৈঠক ও গৃহীত সিদ্ধান্তঃ
১৯৪৪ সালের ১৫ ই আগষ্ট শিক্ষা কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তগুলি গৃহীত হয়ঃ

শিক্ষাকালঃ

(১) সর্বমোট শিক্ষাকাল হওয়া উচিত ১৪ বছর। এই চৌদ্দ বছর নিম্নলিখিত স্তরসমূহে বিভক্ত হবেঃ

(ক) প্রাথমিক স্তর-৮ বছর

(খ) মাধ্যমিক স্তর- ২ বছর

(গ) উচ্চ স্তর- ৪ বছর।

প্রাথমিক স্তরঃ

(২) আপাততঃ শুধুমাত্র প্রাথমিক স্তরের জন্য একটা পরীক্ষামূলক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা দরকার।

(৩) এই বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীতে ভর্তিচ্ছু ছাত্রদের বয়স ৬ থেকে ৮ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।

বিঃদ্রঃ-মধ্যবর্তী শ্রেণীগুলোতে যারা ভর্তি হবে তাদেরকে পরীক্ষামূলকভাবে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত (উর্ধ্বপক্ষে তিন মাস) বিশেষ শ্রেণীতে রাখা যেতে পারে। একজন সমবয়সী ছাত্রকে তার সহযোগী নিয়োগ করা হবে। সহযোগী তাকে শিক্ষা কেন্দ্রের পরিবেশ ও বিভিন্ন বিভাগের সাথে পরিচিত করাবে। এই সহযোগীকে যিনি তদারক করবেন তিনি ঐ নবাগত ছাত্রকেও তদারক করবেন এবং চেষ্টা করবেন যাতে সে যত শীঘ্র সম্ভব একটা শ্রেণীতে শিক্ষা গ্রহণ এবং শিক্ষা কেন্দ্রের পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার যোগ্য হয়।

(৪) এ বিদ্যালয় অবশ্যই আবাসিক হতে হবে।

(৫) ছাত্রদের শিক্ষা ও আবাসিক ব্যয় তাদের অভিভাকরাই বহন করবেন।

(৬) এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেবল মাত্র সেইসব লোকের সন্তানদের ভর্তি করা হবে যারা ইসলামী জীবন দর্শন, জীবন লক্ষ্য ও ইসলামী আন্দোলনের সমর্থক। ভর্তির সময় অভিভাবকদের নিকট থেকে এই মর্মে লিখিত অঙ্গীকার নিতে হবে যে, তারা তাদের সন্তানকে কোন ধরনের অ-ইসলামী ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সদস্য বানাবেন না বরং ইসলামের সেবার জন্যই তারা তাদের সন্তানদেরকে ওয়াকফ করেছে।

(৭) প্রাথমিক স্তরে ছাত্রদেরকে কোন পেশার জন্য তৈরী করার প্রশ্ন উঠে না। তথাপি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাস্তব ও নৈতিক প্রশিক্ষণ দ্বারা ছাত্রদের সমস্ত জন্মগত যোগ্যতা ও প্রতিভার এতটা উৎকর্ষতা এবং বিকাশ সাধনের চেষ্টা করবেন এবং তাদেরকে এতটা বাস্তব ও পর্যবেক্ষণমূলক অভিজ্ঞতা অর্জন করিয়ে দিবেন যে, আট বছরের শিক্ষা শেষ করে তারা যেন নিজেদের মধ্যে যথেষ্ট শক্তি সাহস ও মনোবল অর্জন করতে পারে। এর ফলে তারা অনুভব করবে যে, আল্লাহর এ পৃথিবীতে তাদের জন্য সর্বত্র কাজ করার এবং জীবিকা উপার্জনের সকল সুযোগ বর্তমান। তারা সে সুযোগ গ্রহণে নিজেদের সক্ষমও মনে করবে। এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা সমাপ্তকারী ছাত্রদের আর্থিক সমস্যা সমাধানের জন্য এই একটি মাত্র সমাধানই আপাতত আছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা
(১) এ পর্যায়ের শিক্ষার জন্য আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কায়েম করতে হবে।

(২) এর শিক্ষাকাল হবে ৬ বছর-দুই বছর মাধ্যমিক এবং ৪ বছর উচ্চ স্তরের জন্য।

বি.দ্র. আরবী মাদরাসাসমূহের শিক্ষা সমাপনকারী ও বিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ছাত্রদের জন্য এর চেয়েও কম সময়ে উচ্চস্তরের শিক্ষা সমাপ্ত করার সুযোগ দিতে হবে।

(৩) মাধ্যমিক স্তরে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীকে কমপক্ষে মেট্রিক (যা বর্তমানে এসএসসি) অথবা মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমিক মান সম্পন্ন হতে হবে।

(৪) ভর্তি পরীক্ষা বিশেষ করে মৌখিক পরীক্ষা সাপেক্ষে ভর্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে।

(৫) শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলনে শরীক হতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীকেই এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করতে হবে।

(৬) সমস্ত ব্যয়ভার ছাত্রদের নিজেদেরই বহন করতে হবে।

(৭) বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীর পাঠদান ও সব রকমের ব্যবস্থাপনার জন্য বিশেষজ্ঞদের কমিটি থাকবে। এই কমিটি বিস্তারিত খুঁটিনাটি ঠিক করবে।


ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা ও তার বাস্তবায়ন
(লাহোরে বরকত আলী মোহামেডান হলে ছাত্রদের এক সমাবেশে ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদীর প্রদত্ত ভাষণ। ভাষণের অংশবিশেষ অনিবার্য কারণে সামান্য রদবদল করে অনুবাদ করা হলো-অনুবাদক)।

দেশে কি ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হওয়া উচিত সে প্রশ্ন একটা মুসলিম দেশের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অবাস্তব। এটা অবিসংবাদিত ব্যাপার যে, একটা মুসলিম দেশে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থাই চালু হওয়া উচিথ। তবে কিভাবে ও কি পন্থায় ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা যায় বা কি পদ্ধতিতে শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামী রূপ দেয়া যায়, কেবলমাত্র সেই বিষয় নিয়েই চিন্তাভাবনা করা দরকার।

এ প্রসঙ্গে সর্বাগ্রে আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি বিচ্যূতিগুলো বুঝতে হবে। বর্তমানে দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে তার দোষ ত্রুটি না জানা পর্যন্ত কিভাবে তার সংস্কার ও সংশোধন করা যেতে পারে, সেটা জানা সম্ভব নয়।

আমাদের দেশে বর্তমানে দু’ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। একটা শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে আমাদের প্রাচীন পদ্ধতির মাদ্রাসাগুলোতে। সে শিক্ষা আমাদের ধর্মীয় প্রয়োজন পূরণের জন্য আলেম তৈরী করে। আর দ্বিতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চালু রয়েছে, এটা ধর্মীয় পরিমন্ডলের বাইরে গোটা দেশ ও সমাজ পরিচালনার জন্য কর্মী তৈরী করে। আমি এই উভয় শিক্ষাব্যবস্থার দোষ ত্রুটি বিশ্লেষণ করতে চাই।

প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থাঃ

আমাদের দেশে প্রচলিত প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা আজ থেকে কয়েখ শতাব্দী আগে প্রবর্তিত হয়। যখন এখানে বৃটিশ সরকার আসে এবং একটি রাজনৈতিক বিপ্লবের পর আমরা তাদের গোলামে পরিণত হই। তখন যে শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের চালু ছিল সেটা আমাদের তৎকালীন প্রয়োজন পূরণের জন্য যথেষ্ট ছিল। সেই শিক্ষাব্যবস্থায় তৎকালীন রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দরকারী সকল বিষয় পড়ানো হতো। এতে শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই ছিল না, বরং দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, সাহিত্য এবং অন্যান্য বিষয়ও ছিল। সে সময়কার সিভিল সার্ভিসের জন্য যে ধরনের বিদ্যা বুদ্ধির প্রয়োজন ছিল তা সবই পড়ানো হতো। কিন্তু যখন একটি রাজনৈতিক বিপ্লবের কারণে আমরা গোলামে পরিণত হলাম তখন সেই গোটা শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকারিতা শেষ হয়ে গেল। সেই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত লোকদের জন্য নতুন যুগের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোন স্থানই থাকলো না। নয়ার রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য যে ধরনের বিদ্যা জানা দরকার ছিল, তা ঐ শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তুর্ভুক্ত ছিল না। আর ঐ শিক্ষাব্যবস্থায় যে ধরনের বিদ্যা অন্তর্ভুক্ত ছিল, এই নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থায় সেসব বিদ্যা জানার কোন প্রয়োজন লোকদের ছিল না। তা সত্ত্বেও যেহেতু আমাদের শত শত বছরের জাতীয় উত্তরাধিকার ঐ শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং আমাদের ধর্মীয় চাহিদা ও প্রয়োজন মেটানোর জন্য কিছু উপকরণও তাতে ছিল (যদিও যথেষ্ট পরিমাণে ছিল না) তাই তৎকালে আমাদের জাতির একটা বিরাট অংশ অনুভব করল যে, ঐ শিক্ষাব্যবস্থাকে যে করেই হোক বহাল রাখতে হবে, যাতে আমরা পৈত্রিক উত্তরাধিকারের সাথে একেবারেই সম্পর্কহীন না হয়ে যাই।

এ উদ্দেশ্যেই তারা এটাকে হুবহু রাখলো। কিন্তু ক্রমান্বয়ে অবস্থায় যতই পরিবর্তন ঘটতে লাগলো ততই তার কার্যকরিতা কমতে লাগলো। কেননা ঐ শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে যারা শিক্ষা লাভ করে বের হলো সমকালীন জীবন ধারা ও তার সমস্যাবলীর সাথে তাদের কোন সংশ্রব থাকলো না। আজ যারা ঐ শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে লেখাপড়া করে বের হচ্ছে তাদের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে মসজিদে ইমামতি, মাদরাসায় শিক্ষকতা এবং জনগণকে নিজেদের প্রয়োজন উপলব্ধি করানোর জন্য নিত্য নতুন ধর্মীয় বিতর্ক তোলা। তাদের দ্বারা কিছু না কিছু উপকার আমাদের নিশ্চয়ই হয়ে থাকে। তাদের চেষ্টাতেই কুরআন ও ধর্ম সংক্রান্ত কিছু না কিছু জ্ঞান সমাজে বিস্তার লাভ করে। কিছুটা ধর্মীয় জ্ঞান ও সচেতনতা সমাজে বহাল থাকে। কিন্তু এটুকু উপকারের বিনিময়ে মুসলিম সমাজের যে ক্ষতি তাদের ধর্মীয় বিতর্কের কারণে হচ্ছে, সেটা কোন অংশে কম নয়। তারা যেমন ইসলামের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না, তেমনি বর্তমান জীবন সমস্যার উপর ইসলামের মূলনীতিগুলো প্রয়োগ করতেও সক্ষম নন। এখন তাদের মধ্যে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে দেশ ও জাতির নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতাও নেই, আবার আমাদের জাতীয় সমস্যাবলীর কোন সমাধানও তারা দিতে সক্ষম নন। মোটের ওপর একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, তাদের কারণে ইসলামের সম্মান আদৌ বাড়ছে না, বরং আরো কমছে। তাদের দ্বারা ইসলামের যে ধরনের প্রতিনিধিত্ব হচ্ছে তার কারণে আমরা জনগণকে ক্রমান্বয়ে ইসলাম থেকে দূরে সরে যেতে দেখছি এবং ইসলামের মর্যাদাও দিন দিন ক্ষুণ্ন হয়ে চলেছে। তাদের কারণে ধর্মীয় বিতর্কের এক নিরবিচ্ছিন্ন ধারা চালু হয়েছে। এ ধারার যেন আর শেষ নেই। কারণ জীবন জীবিকার প্রয়োজন তাদেরকে এসব বিতর্ক চালু রাখতে ও ক্রমে বাড়িয়ে তুলতে বাধ্য করে থাকে। এসব বিতর্ক যদি না থাকে তবে জাতি তাদের প্রয়োজনই অনুভব করবে না।

এই হলো আমাদের প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থার হাল হাকিকত। আর স্পষ্ট করে বলতে গেলে আমি বলবো এটা পুরোপুরি ধর্মীয় শিক্ষা নয়। প্রকৃতপক্ষে এটা আজ হতে আরো দুই আড়াইশো বছর আগেরকার সিভিল সার্ভিসের কোর্স হিসেবে চালু করা হয়েছিল। সে সময় ইসলামী ফিকহই ছিল দেশের কার্যকরী আইন এবং তার নির্বাহীদের জন্য ইসলামী ফিকহও তার উৎসসমূহ জানা অপরিহার্য ছিল। প্রধানত এ কারণেই এর সাথে এগুলো জুড়ে দেয়া হয়েছিল। আজ আমরা ওটাকে ধর্মীয় শিক্ষা হিসেবে মেনে নিয়ে তৃপ্তি বোধ করছি। কিন্তু এতে ধর্মীয় শিক্ষার উপাদান নিতান্তই কম। কোন আরবি মাদরাসাই এমন নেই যার পাঠ্যসূচীতে পুরো কুরআন মজীদ অন্তর্ভুক্ত আছে। এতে শুধু কয়েকটি সূরা মাত্র পড়ানো হয়। কোথাও পাঠ্যসূচীতে গোটা কুরআন মজীদ থাকলে শুধু তার অনুবাদই পড়ানো হয়। গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গীতে কুরআন মজীদ পড়ানোর পাঠ্যসূচী কোন মাদরাসাতেই নেই। হাদীসের অবস্থাও তথৈবচ। এরও যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা-যা কিনা মুহাদ্দিস হবার জন্য প্রয়োজন – কোথাও চালু নেই। হাদীস শিক্ষার যে পদ্ধতি আমাদের এসব মাদরাসায় চালু আছে তা হলো ফিকাহ কিংবা আকীদার সাথে সম্পৃক্ত কোন হাদীস পাওয়া গেলে তা নিয়ে একনাগাড়ে দুই তিন দিন ধরে বক্তৃতা দেওয়া হয়। কিন্তু যেসব হাদীস হতে দ্বীনের তাৎপর্য বুঝা যায় অথবা যেসব হাদীসে ইসলামের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা নৈতিক বিধান বর্ণিত হয়েছে, যাতে শাসনতান্ত্রিক বিষয়, বিচার ব্যবস্থা কিংবা আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে আলোকপাত করে, সেসব হাদীস এমনভাবে পড়ানো হয় যেন তাতে প্রয়োজনীয় কোন কথাই নেই। তারা এত দ্রুততার সাথে ঐ সব হাদীস অতিক্রম করে যান যে তাতে মনোযোগ দেয়ার মত কিছু আছে বলেই যেন তারা মনে করেন না। হাদীস ও কুরআনের তুলনায় ফিকাহ শাস্ত্রের দিকেই তাদের নজর বেশী। তাও বেশীরভাগ, বরং বলতে গেলে পুরোপুরিই ফিকাহ শাস্ত্রের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েই তাঁরা ব্যস্ত থাকেন। ফিকাহর ইতিহাস, তার ক্রমবিকাশ, তার বিভিন্ন মাযহাবের মৌল বৈশিষ্ট্য, এসব মাযহাবের সর্বসম্মত ও বিরোধীয় মূলনীতিসমূহ, মূলনীতির আলোকে প্রয়োজনীয় বিধি রচনায় মুজতাহিদ ইমামগণের অনুসৃত নীতিমালা ইত্যাদি যা না জানলে সত্যিকার ফকীহ হওয়াই যায় না, এসব বিষয় মাদরাসার শিক্ষায় আদৌ বর্তমান নেই। ছাত্র তো দূরের কথা শিক্ষকরাও এসব বিষয়ে ওয়াকিবহাল নন।

সুতরাং যে ধর্মীয় প্রয়োজন মেটানোর জন্য এই শিক্ষাব্যবস্থা বহাল রাখা হয়েছিল, সে লক্ষ্য অর্জনেও তারা যথেষ্ট নয়। আর পার্থিব প্রয়োজনেরতো কথাই ওঠে না। কারণ তার সাথে এর কোন সম্পর্কই নেই।

আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাঃ

এরপর বিবেচনা করা যাক বৃটিশ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার কথা। দুনিয়ায় যে শিক্ষাব্যবস্থাই চালু করা হোক, তার শুরুতেই এই মৌলিক প্রশ্নটি বিবেচনা করতে হয় যে, কি ধরনের মানুষ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এবং কোন মাপকাঠি অনুসারে মানুষ তৈরী করার উদ্দেশ্যে শিক্ষাব্যবস্থাটি প্রবর্তিত হতে যাচ্ছে। এই মৌলিক প্রশ্নের আলোকে যদি বিচার বিবেচনা করা হয় তাহলে পরিষ্কার বুঝা যাবে যে, মনুষ্যত্বের যে মাপকাঠি মুসলমানদের বেলায় প্রযোজ্য ও গ্রহণযোগ্য ব্রিটিশ সে মাপকাঠীতে বিশ্বাসী ছিল না। মুসলমানদের কৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার ও তার ‍উৎকর্ষ সাধনের জন্য কর্মী তৈরী করার উদ্দেশ্যে বৃটিশ এ শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে নি এবং তা করতেও পারে না। এমনকি তাদের মনুষ্যত্বের যে মাপকাঠিতে তারা বিশ্বাসী, সেটাও এখানে তাদের অভিপ্রেত ছিল না।

তারা নিজ দেশে নিজ জাতির জন্য যে উদ্দেশ্যে মানুষ তৈরী করে থাকে এখানে তারা সে উদ্দেশ্যে মানুষ গড়তে ইচ্ছুক ছিল না। একটা স্বাধীন দেশ চালাবার উপযুক্ত লোক তারা এখানে তৈরীই করতে চায় নি। সে ধরনের লোক তারা তাদের নিজ দেশেই কামনা করতো এ দেশে নয়। এদেশে তারা এমন লোক প্রত্যাশা করতো যারা একটি বিদেশী শাসকগোষ্ঠীকে সরকার চালাবার কাজে সাহায্য করতে পারে, যারা তাদের ভাষা জানে, যাদের সাথে তারা যোগাযোগ করতে জানে ও যেমন খুশী কাজ করতে পারে। তাদের দেশ শাসনের নীতি জানে ও বুঝে এবং তাদের উপযোগী হতে পারে, এমন লোকই তাদের প্রয়োজন ছিল। বস্তুত এটাই তাদের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়। এ জন্যই তারা এখানে এ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল।

 

খোদাহীন শিক্ষাঃ

এ শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা যত জ্ঞান বিজ্ঞান শিখিয়েছে তার মধ্যে ইসলামের নামগন্ধও ছিল না এবং থাকার কথাও নয়। খোদ ইউরোপে ঐসব জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশ যাদের হাতে রয়েছে তারা ছিল খোদাবিমুখ। সেখানকার ধর্মীয় গোষ্ঠীকে আগেই চিন্তা ও কার্যক্ষেত্র থেকে নির্বাসিত ও বিতাড়িত করা হয়েছিল। এ জন্য কি বিজ্ঞান, কি দর্শন, কি ইতিহাস, কি সমাজবিজ্ঞান সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞানই এমন সব লোকদের হাতে রচিত ও বিকশিত হয়েছে যারা পুরোপুরি নাস্তিক না হলেও অন্তত পার্থিব জীবনে তারা আল্লাহর আনুগত্যের কোন প্রয়োজন অনুভব করতো না। বৃটিশ শাসকরা তাদের সেইসব জ্ঞান বিজ্ঞান তাদের প্রণীত বই পুস্তকসহ আমাদের দেশে চালু করে এবং আজ পর্যন্ত এখানে ঐসব জিনিসই তাদের অনুসৃত পদ্ধতিতে পড়ানো হচ্ছে। এ শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে যারা শিক্ষা লাভ করেছেন তাদের মন মগজ আপনা আপনি ইসলাম থেকে, ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এবং ইসলামী নৈতিকতা ও চিন্তাধারা হতে ক্রমেই দূরে সরে গিয়েছে। এতে তাদের কোনও অপরাধও নেই এবং তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছারও কোন হাত ছিল না। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যে ব্যক্তি তার শিক্ষার সূচনা বিন্দু থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত পৃথিবী সম্পর্কে যত জ্ঞান লাভ করলো কোনটাই খোদার আনুগত্যের দৃষ্টিকোণ হতে শিখলো না, তার মন মগজে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস কিভাবে শিকড় গজাতে পারে? তার পাঠ্যপুস্তকে কোথাও আল্লাহর উল্লেখ নেই। তার ইতিহাস পুস্তকে সমগ্র জীবনকালব্যাপী মানুষকে নিজের ভাগ্য নিজেই ভাঙতে ও গড়তে দেখলো, তার দর্শন শিক্ষায় স্রষ্টাকে বাদ দিয়েই বিশ্ব জগত সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করা হলো। তার বিজ্ঞান শিক্ষায় সমগ্র বিশ্ব কারখানাকে কোন ‍প্রজ্ঞ্য নির্মাতা এবং কুশলী ব্যবস্থাপক ও পরিচালক ছাড়াই পরিচালিত বলে দেখানো হলো। আর আইন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও অন্যান্য বিদ্যার পাঠ্যক্রমে মানুষের স্রষ্টা তার জন্য কি আইন বিধান দেন সে সম্পর্কে আদৌ কোন কথাই শেখানো হলো না। বরং তার সমস্ত বিদ্যার মূল কথা দাঁড়ালো এই যে, মানুষ নিজেই নিজের জীবন ব্যবস্থা রচনা করার অধিকারী। এ ধরনের শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কখনো বলার দরকার হয় না যে, তুমি আল্লাহকে অমান্য কর। সে আপনা আপনিই আল্লাহ সম্পর্কে বেপরোয়া হয়ে যাবে। আল্লাহকে নিয়ে তার মনে কোন রকম ভাবনা চিন্তার সৃষ্টি হবে না এটাই স্বাভাবিক।

নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষাঃ

এ শিক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা আল্লাহর আনুগত্যের ধারণা এবং ইসলামী নৈতিকতার সৃষ্টিতো হয়ই না, উপরন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এই যে, এ শিক্ষা তরুণ সমাজের মাঝে মৌলিক মানবীয় গুণাবলী পর্যন্ত তৈরী করে না। অথচ এই মৌলিক মানবীয় চরিত্র ছাড়া কোন জাতি দুনিয়ায় উন্নতি করা তো দূরের কথা, বেঁচে থাকতেও পারে না। এ শিক্ষা নিয়ে যে বংশধারা গড়ে উঠেছে, তারা পাশ্চাত্য জাতিগুলোর যাবতীয় খারাপ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পুরোপুরিভাবে সজ্জিত হচ্ছে। কিন্তু তাদের উত্তম গুণাবলীর ছিটেফোঁটাও তাদের গায়ে লাগছে না। তাদের মধ্যে দায়িত্ব জ্ঞান, সার্বক্ষণিক সতর্কতা, কষ্টসহিষ্ঞুতা, সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা, দৃঢ়তা, ধৈর্য ও দৃঢ়সংকল্প, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, আত্মসংযম, উচ্চতর ব্যক্তিত্ব বা আদর্শের আনুগত্য ইত্যাকার গুণ সৃষ্টি হয় না। তারা একেবারেই ভুঁইফোড় উদ্ভিদের মত। দেখে মনেই হয় না যে তাদের কোন জাতীয় চরিত্র আছে। যত মর্যাদাপূর্ণ পদেই তারা আসীন হোক, হীন হতে হীনতর এবং নিকৃষ্ট হতে নিকৃষ্টতর দুর্নীতি ও দুষ্কর্মে লিপ্ত হতে তারা কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করে না। তাদের মধ্যে জঘন্যতম ঘুষখোর, স্বজনপ্রীতি, সুপারিশকারী ও সুপারিশ পূরণকারী, চোরাকারবারী, অবৈধ চোরাচালানী, ন্যায়-নীতি আইন কানুন ও নিয়মনীতি লংঘনকারী, কর্তব্যে অবহেলা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, মানুষের হক নষ্টকারী এবং নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থে সমগ্র জাতির স্বার্থ ও কল্যাণের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাতকারী লোক একজন দুজন নয় জীবনের প্রতিটি বিভাগ ও অংগনে রয়েছে। তারা সর্বক্ষেত্রে খুব তৎপর। বৃটিশ শাসকরা বিদায় নেয়ার পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত লোকেরাই আগলে রেখেছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এই চরিত্র বিবর্জিত লোকদের হাতে দেশের যে কি দশা হয়েছে তা আজ সবাই দেখতে পাচ্ছেন। যে নব বংশধর আজ এই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করেছে তাদের স্বভাব চরিত্র ও আচার আচরণের কথা যদি জানতে চান তবে যে কোন সময় হোটেলে, প্রমোদ কেন্দ্রে ও জাতীয় উৎসব অনুষ্ঠানাদির সময়, অলিতে গলিতে প্রকাশ্যেই দেখতে পারেন।

প্রশ্ন জাগে যে, এই শিক্ষায় আল্লাহর আনুগত্য ও ইসলামী চরিত্র তৈরী না হোক কিন্তু যে চরিত্র বৃটিশ, জার্মান, আমেরিকান ও অন্যান্য উন্নত পাশ্চাত্য জাতিগুলোর মধ্যে রয়েছে ততটুকু চরিত্রও কেন গড়ে উঠে না? তাদের মধ্যে মৌলিক মানবীয় চরিত্রটা অবশ্যই পূর্ণমাত্রায় পাওয়া যায়। অথচ আমাদের এখানে তাও নেই। তাহলে এর কারণটা কি?

আমার মতে এর কারণ হলো, মৌলিক মানবীয় চরিত্র গঠন করার পরিকল্পনা একমাত্র এমন শিক্ষাব্যবস্থাই করতে পারে যে শিক্ষাব্যবস্থা কোন স্বাধীন জাতি নিজেদের সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রবর্তন করে। একটা স্বাধীন জাতিকে আপন সভ্যতা সংস্কৃতির স্থায়িত্ব ও বিকাশ নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত দৃঢ় ও নির্ভরযোগ্য চরিত্রের কর্মী তৈরী করার কথা অবশ্যই ভাবতে হয়। বৃটিশ জাতির এরূপ চরিত্রের লোকের প্রয়োজন ছিল তাদের নিজেদের দেশে, এদেশে নয়। এদেশে বরং ইংল্যান্ডের সম্পূর্ণ বিপরীত গোলামীর মন মানসিকতাই তৈরী করা তাদের অভিপ্রেত ছিল। এখানে তারা চেয়েছিল গোলামসুলভ চরিত্র সৃষ্টি করতে, এমন চরিত্রের লোক সৃষ্টি করতে যারা নিজেদের হাতে নিজেদের দেশ জয় করে তা আপন জাতির শত্রুদের হাতে সমর্পণ করতে পারে এবং তার পরে নিজেদের দেশের প্রশাসন নিজেদের কল্যাণার্থে নয়; অন্যদের সুবিধার্থে চালাতে পারে। এ কাজের জন্য যে ধরনের চরিত্র দরকার বৃটিশ শাসকরা ঠিক সেই ধরনের চরিত্রই এখানে গঠন করতে চেয়েছিল এবং সেই চরিত্র গঠনের জন্যই তারা এখানকার শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিল। তাদের প্রণীত সেই শিক্ষানীতিই আজ পর্যন্ত হুবহু চলে আসছে। এ শিক্ষানীতি দ্বারা কেউ যদি একটা স্বাধীন দেশের উপযোগী দৃঢ় চরিত্রের লোক তৈরী হওয়ার আশা করে থাকে তবে প্রথমে তার নিজের বিবেক বুদ্ধি ঠিক আছে কি না ভেবে দেখা দরকার।

আধুনিক শিক্ষার সাথে ধর্মীয় শিক্ষার লেজুড়ঃ

উপমহাদেশে বৃটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর যখন এই শিক্ষাব্যবস্থা এখানে চালু হলো এবং সেই সাথে এই শিক্ষা যারা গ্রহণ করবে না তাদের জন্য উন্নতি ও সুখ সমৃদ্ধির সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গেল, তখন আমাদের সমাজের চিন্তাশীল জ্ঞানী লোকেরা এই ভেবে শংকিত হয়ে উঠলেন যেন আমাদের নবীন বংশধরদেরকে এই শিক্ষাব্যবস্থা হয়তো একেবারেই অমুসলমান বানিয়ে ছাড়বে। এজন্য তারা এই শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনেই নিজস্ব উদ্যোগে মাদরাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সংকল্প গ্রহণ করলেন। পরিকল্পনা নেয়া হলো, সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যা পড়ানো হয় এসব প্রতিষ্ঠানেও তাই পড়ানো হবে। ইংরেজরা তাদেরকে যে কাজের জন্য তৈরী করতে চায় সে উদ্দেশ্যেই তাদেরকে ট্রেনিং ইত্যাদি দেয়া হবে। তবে এর সাথে কিছু ধর্মীয় শিক্ষাও যুক্ত হবে যেন ছাত্ররা একেবারেই কাফির হয়ে না যায়। এটা ছিল একটা সংস্কারমূলক পরিকল্পনা। মনে করা হচ্ছিল যে, এভাবে এইসব প্রতিষ্ঠানে যেসব মুসলিম তরুণরা পড়তে আসবে তাদেরকে ইংরেজি শিক্ষার সম্ভাব্য কুফল হতে কিছুটা রক্ষা করা সম্ভব হবে। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণ হলো এবং বিচার বিবেচনা করলেও বুঝা যায় , এ ধরনের কলম লাগানোর চেষ্টা (গাছের ক্ষেত্রে সফল হলেও মানুষে ক্ষেত্রে) সফল হওয়ার নয়। জোড়াতালি দিয়ে মানুষ গড়ার এ উদ্ভট চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়ে গেল। বলা বাহুল্য স্বাভাবিক নিয়মেই এ চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কথা।

এদিকে একজন ছাত্রকে যাবতীয় দুনিয়াদারী জ্ঞান বিজ্ঞান এমনভাবে শেখানো হচ্ছে যে, সে গোটা প্রকৃতির কারখানা খোদা ছাড়াই তৈরী করেছে এবং খোদা ছাড়াই সফলভাবে চলছে বলে অনুভব করে। যে জ্ঞান সে লাভ করে তার কোথাও সে অনুভব করতে পারে না যে, এই বিশাল দুনিয়া ও এ বিরাট কর্মক্ষেত্রের কোথাও আল্লাহর রসূল ও অহীর কোন স্থান বা প্রয়োজন থাকতে পারে। সব রকমের জীবন ব্যবস্থাকে সে এই দৃষ্টিভঙ্গীতেই দেখতে শেখে। এরপর হঠাৎ তাকে ধর্মীয় শিক্ষার শ্রেণীতে নিয়ে বলা হয় যে, আল্লাহও আছেন, রাসূলও আছেন এবং অহীও আসে আর কিতাবও নাজিল হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন ভেবে দেখুন, বিশ্বজগৎ ও জীবন সম্পর্কে তার যে সামগ্রিক ধারণাটা জন্মেছে, তা থেকে তাকে আলাদা ও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে স্বতন্ত্র এই জ্ঞানটা যে তাকে দেয়া হলো, একে সে অর্জিত সামগ্রিক জ্ঞান ও ধ্যান ধারণা ও বিশ্বাসের সাথে কিভাবে খাপ খাওয়াবে এবং এটাকে সে কোথায় রাখবে? জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাকে তো খোদাহীন জ্ঞান দেয়া আছেই এবং দেয়া চলছেও। তার সাথে আলাদা করে ধর্মীয় শিক্ষার একটা পুঁটলিও দিয়ে দেয়া হলো। এখন এই পুটলি খুলে সে রোজ রোজ অন্যান্য জ্ঞানের সাথে এই ধর্মীয় জ্ঞান একটু একটু করে মিকচার করতে থাকবে এবং তাতে আপনা থেকেই তার মনে একটা ভিন্নতর ধারণা বিশ্বাস অর্থাৎ খোদায়ী ব্যবস্থাপনার ধারণা গজিয়ে উঠবে। এটা কি আশা করা যেতে পারে?

এর চেয়েও পরিতাপের ব্যাপার এই যে, মুসলিম জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে তাতেও সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মতই ধর্মহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। ছাত্র ইংরেজীতে কথা বলুক ও ইংরেজীতে পোশাক পরিধান করুক এ চেষ্টাতো করা হয়েছেই। এমনকি ইংরেজদের কৃষ্টি, তাদের চাল চলন ও আচরণ সম্পূর্ণরূপেই ছাত্রদেরকে রপ্ত করানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। খেলাধুলায়, উঠাবসায়, চালচলনে, বিতর্ক বক্তৃতায় মোট কথা সব কিছুতেই বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোন অংশেই সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হতে পিছিয়ে না থাকে তার চেষ্টা করা হয়েছে। অবিকল সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমমানের লোক এসব প্রতিষ্ঠান থেকেও বের হোক এবং কেউ যেন বলতে না পারে যে, ইংরেজী মানদন্ডের বিচারে এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া ছাত্ররা সরকারী প্রতিষ্ঠান হতে বের হওয়া ছাত্রদের চেয়ে নিম্নমানের। এ জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মুসলিম জাতির শিক্ষা ব্যবস্থার কর্ণধারদের শিক্ষার উদ্দেশ্যই যখন এই এবং এর খাতিরে সম্পূর্ণ ফিরিঙ্গিপনার পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে তখন এ ধরনের পরিবেশে ইসলামের ঐ কলম লাগানো পরগাছা চারাটা কি উপকার দর্শাতে পারে? একে তো শিক্ষাগত দিক থেকে ওটা ছিল নিতান্তই দুর্বল। অন্য কোন পাঠ্যসূচীর সাথে তার কোন সংশ্রব ও সামঞ্জস্য ছিল না। যতগুলো যুক্তি প্রমাণ আল্লাহর আনুগত্য সৃষ্টির সহায়ক হতো তা সবই খোদাহীনতা ও খোদাবিরোধী মনোভাব সৃষ্টির কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। অধিকন্তু বেসরকারী কলেজগুলোতেও সরকারী কলেজের অনুরূপ জীবন যাপনের পরিবেশ এবং বৃদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ গোটা ব্যবস্থা এমন করে তৈরী করা হয়েছে যে, তা ইসলামের দুর্বল জোড়াতালির সহায়ক হওয়ার পরিবর্তে ফিরিঙ্গিপনা ও নাস্তিকতারই উপযোগী ও অনুকূল হয়েছে। এই জোড়াতালিকে শক্তিশালী করার মত কোন একটা উপকরণও সেখানে ছিল না। বরং সব কিছুই তার প্রকৃতির বিরোধী ছিল। এতসব প্রতিকূলতা সৃষ্টি করেও আমাদের শিক্ষা কর্ণধাররা অলৌকিকভাবে ধর্মীয় জাগরণ ও ‍উদ্দীপনা সৃষ্টি, ইসলামী মূল্যবোধের উদ্ভব ও ইসলামী প্রেরণার বিকাশ ও ইসলামী চরিত্র গঠনের আশায় বিভোর ছিলেন। অথচ প্রাকৃতিক বিধান মতে এর যে অনিবার্য ফল দেখা দেয়ার কথা ছিল এবং বাস্তবে দেখা দিয়েছে, তা হলো, যেসব ছাত্রকে এই প্রণালীতে ইসলামী শিক্ষা দেয়া হয়েছে তাদের দৃষ্টিতে ইসলামের গুরুত্ব ও মর্যাদা আরো কমে গিয়েছে, তাদের ধর্মীয় অবস্থা মিশনারী কলেজ ও সরকারী কলেজের ছাত্রদের চেয়েও খারাপ হয়ে গিয়েছে। এটা তো বাস্তব সত্য যে, আজকাল কলেজগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার ঘন্টাটা সাধারণভাবে আমোদ প্রমোদ ও তামাসা উপহাসের ঘন্টা বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এর দ্বারা অন্তরে ঈমানী তেজ সৃষ্টি হওয়ার পরিবর্তে যেটুকু ঈমান ছিল তাও নিঃশেষ করার মত খেদমত হচ্ছে। নিজেরাই যখন তাদের সামনে ইসলামকে অন্যান্য পাঠ্য বিষয়ের চেয়ে নগন্য করে পেশ করছি তখন আল্লাহর তরফ থেকে কমপক্ষে এতটুকু শাস্তি না হয়ে পারে না যে, আমাদের ছেলেরা আমাদের চোখের সামনেই নাস্তিক ও ধর্মদ্রোহী হয়ে আবির্ভৃত হবে এবং যেসব শিক্ষক খোদা, রাসূল ও আখিরাতে বিশ্বাসী তাদেরকে বেওকুফ ও নির্বোধ মনে করবে।

সংস্কার সাধনের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাঃ

আজ থেকে ১৭-১৮ বছর আগে (বক্তৃতাকাল ১৯৫২) এই কুফল অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছিল। আমার মনে পড়ে, ১৯৩৪ হতে ৩৫ সালে একবার হঠাৎ চাঞ্চল্যকর একটা প্রশ্ন উঠলো যে, আমাদের বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হতে এত অধিক পরিমাণে ধর্মদ্রোহী ও নাস্তিক্যবাদের প্রচারক বের হচ্ছে কেন? বিশেষ করে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এই প্রশ্ন ছিল আরো তীব্র। সাধারণ ধারণা মতে সেখানে শতকরা নব্বই জন ছাত্র খোদাদ্রোহিতা ও নাস্তিকতায় বিশ্বাসী ছিল। বিষয়টি যখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে লাগলো এবং সারা দেশে এ সম্পর্কে লেখালেখি শুরু হলো, তখন একটা কমিটি গঠন করা হলো, ঐ কমিটি বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করলো। অবশেষে ধারণা করা হলো যে, ইসলামী শিক্ষার পরিমাণ আর একটু বাড়িয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে ঐ কমিটি কিছু সংশোধনী প্রস্তাব দিল এবং একটা নতুন পাঠক্রম প্রণয়ন করা হলো। কিন্তু সে সংশোধন কিছু মাত্র লাভজনক হলো না। ফলে আজও অবস্থা অপরিবর্তিত রয়ে গিয়েছে।

আমি তখনই অনুমান করেছিলাম এবং মাসিক তরজমানুল কুরআনে লিখেওছিলাম যে, এসব পদক্ষেপ ফলপ্রসূ হবে না। আজ আমি এ প্রসঙ্গ আবারও তুলছি এজন্য যে, আমাদের যেসব কর্তাব্যক্তিদের হাতে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করার ক্ষমতা তারা যথাসাধ্য আমাদেরকে ইসলামী শিক্ষা কায়েমের সুসংবাদ দিয়ে থাকেন। অথচ তারা পুনরায় একই ভুল করতে চলেছেন। তারাও বৃটিশ আমল থেকে চালু থাকা শিক্ষা ব্যবস্থাকে হুবহু বহাল রেখে তার আওতাধীন ইসলামী শিক্ষার আনুপাতিক পরিমাণটা একটু বাড়িয়ে দিতে চান। তাদের চিন্তা ভাবনায় এর চেয়ে বেশি কিছু নেই। এ জন্য যে কথা আমি তখন বলেছিলাম আজ আবার তার পুণরাবৃত্তি করছি।

আমার মতে একটা শিক্ষাব্যবস্থায় পরস্পর বিরোধী দুটি উপাদান অন্তর্ভুক্ত করার চেয়ে মারাত্মক ভুল কাজ আর কিছু হতে পারে না। আর তাও এমন দুটো উপাদান যা পরস্পর সাংঘর্ষিক এবং একটি আরেকটির নাসিকায় ঘুষি বর্ষণকারী। এ ধরনের মিশ্রণ শিক্ষার্থীর মন মগজকে নষ্ট করা ছাড়া আর কোন ফল দর্শাতে পারে না।

ধরে নেয়া যাক, এই ভেজাল এমনভাবে করা হলো যে, এতে ইসলামী শিক্ষার উপকরণ শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বাড়িয়ে দেয়া হলো। বাকী পঞ্চাশ ভাগ ইংরেজরা যেভাবে তৈরী করে গিয়েছে ঠিক তেমনি থাকলো। তাহলেও এর অনিবার্য ফল দাঁড়াবে এই যে, প্রত্যেক ছাত্রের মন-মগজ এক একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে। শুধুমাত্র মন-মগজ কেন, তাদের গোটা জীবনই হয়ে দাঁড়াবে রণক্ষেত্র। আর এই ইসলামী পুঁথিগত শিক্ষার পরিমাণ ৫০ ভাগ করে দেয়ার পরও শিক্ষার পরিবেশ এবং শিক্ষাঙ্গনের গোটা জীবনধারা যদি ইংরেজদের আমলের মত ফিরিঙ্গী ধাঁচেরই থেকে যায় এবং দেশের শাসন ব্যবস্থাও ইংরেজদের ভিত্তির উপরই যথারীতি বহাল থাকে তাহলে এর অনিবার্য পরিণতি দাঁড়াবে এই যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তিন ধরনের লোক বের হবে। প্রথম শ্রেণী হবে ইসলামী শিক্ষা পাওয়া সত্ত্বেও নাস্তিক ও ইসলামবিরোধী। কেননা শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলাম বিরোধী যে অংশটি রয়েছে, তার পৃষ্ঠপোষকতায় থাকবে কলেজের সার্বিক পরিবেশ। শুধু তাই নয় রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক আনুকূল্য এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক পরিবেশ হবে তাদের পুরো অনুকূলে। দ্বিতীয় শ্রেণীটা হবে ইসলামী শিক্ষার প্রভাবাধীন। তারা ইসলাম প্রিয় ও ধর্মপরায়ণ হবে। আর তৃতীয় গোষ্ঠী হবে আংশিক মুসলমান ও আংশিক অমুসলমান। ইসলাম ও কুফরীর মধ্যে তারা দ্বিধান্বিত হয়ে ঝুলতে থাকবে।

ভেজাল মিশ্রিত ব্যবস্থার এ পরিণতি অনিবার্য্। পরীক্ষা করলেই দেখতে পারেন যে, জাতির মধ্যে সত্য সত্যেই এই তিন রকমের লোক তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এরা কোন সংস্কৃতি সভ্যতা এবং কোন জীবন ব্যবস্থার বিকাশ ও লালনে একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সাথে সহযোগিতা করতে পারবে না। এখন জিজ্ঞাসা হলোঃ এ রকম বহুবিধ মানসিকতার লোক লালন পালনের একটা গারদ তৈরীর জন্যই কি একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা রচনা করা হয়ে থাকে?

বৈপ্লবিক পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তাঃ

আমাদের সত্যিই যদি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার ইচ্ছা থেকে থাকে তাহলে কেবল জোড়াতালি ও মেরামত দ্বারা কার্যসিদ্ধি হবে না, বরং সেজন্য একটা বিপ্লবী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই কথাটা উপলব্ধি করানোর জন্যই আমাদের এ আলোচনার অবতারণা। আসলে প্রচলিত দু’টো শিক্ষাকেই অর্থাৎ পুরনো ধর্মীয় শিক্ষা এবং বৃটিশ প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষাকে বাতিল করে দেয়া এখন অপরিহার্য হয়ে ‍উঠেছে। এই উভয় ব্যবস্থার পরিবর্তে একটা নতুন একক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। প্রচলিত দুটো শিক্ষাব্যবস্থার যাবতীয় দোষত্রুটি থেকে নতুন শিক্ষাব্যবস্থাকে মুক্ত হতে হবে এবং একটা মুসলিম স্বাধীন ও উন্নয়নকামী জাতি হিসেবে আমাদের যাবতীয় চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা তার আওতাভুক্ত থাকতে হবে। এই নয়া শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও তা বাস্তবায়নের পদ্ধতি এখন আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণঃ

এই নয়া শিক্ষাব্যবস্থার পরিকল্পনা প্রণয়নে সর্বপ্রথম যে জিনিসটা আমাদের ফায়সালা করা প্রয়োজন তা হলো, আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কি? কারো কারো মতে শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু জ্ঞান অর্জন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। তারা বলেন, শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে নিরপেক্ষ হওয়া দরকার যাতে শিক্ষার্থী জীবন ও জগত সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য ও তত্ত্ব, সমস্যা ও ঘটনাবলীর সম্পূর্ণ নিরাসক্ত ও বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু আমার মতে এ ধরনের নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ একমাত্র ক্যামেরার পক্ষেই সম্ভব মানুষের পক্ষে নয়। মানুষ শুধু চোখ দিয়ে দেখেই না, তার পেছনে একটা মগজও থাকে। এটা কখনোও নিষ্কিৃয় থাকে না। তার একটা দৃষ্টিভঙ্গী ও মতামত থাকে, জীবনের একটা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সে ঠিক করে সমস্যাবলী নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার একটা প্রণালী সে তৈরী করে এবং মানুষ যা কিছু শেখে, শোনে ও জানে তাকে তার ভেতরের মৌলিক চিন্তা ও ধ্যান ধারণার সাথে সামঞ্জস্যশীলতার সাথে সাজিয়ে নেয়। তারপর সেই চিন্তা ও ধ্যান ধারণার ভিত্তিতে তার জীবন পদ্ধতি গড়ে ওঠে। এই জীবন পদ্ধতিকেই আমরা সংস্কৃতি বলি। এখন আমরা যদি একটা স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, আকীদা বিশ্বাস ও উদ্দেশ্য লক্ষ্যের অধিকারী জাতি হয়ে থাকি এবং আমাদের আলাদা জীবনাদর্শ থেকে থাকে তাহলে অবশ্যই আমাদের নতুন বংশধরগণকে ঐ সংস্কৃতির রক্ষণাবেক্ষণ এবং তার বিকাশ ও উন্নয়নের যোগ্য করে গড়ে তোলা কর্তব্য। দুনিয়ার সকল জাতি এ উদ্দেশ্যেই নিজেদের স্বতন্ত্র শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে থাকে। পৃথিবীতে এমন একটা জাতিও আছে বলে আমার জানা নেই যারা আদর্শ নিরপেক্ষ কোন শিক্ষাব্যবস্থা নিজেদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছে এবং আপন নতুন বংশধরগণকে নিজ সংস্কৃতির ছাপ নেই এমন শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করছে।

অনুরূপভাবে একটা বিজাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে হুবহু গ্রহণ করেছে এবং তাতে নিজস্ব সংস্কৃতির আলোকে কোন রদবদল না করেই সে অনুসারে আপন নতুন বংশধরগণকে লেখাপড়া শিখিয়েছে এমন কোন জাতিও পৃথিবীতে কোথাও আছে বলে আমি শুনিনি। এমন বোকামী আমরা যদি আগে দুর্বলতাবশত ও নিরুপায় হয়ে করে থাকি, তাহলে এখনও তা হুবহু চালু রাখার কোন অর্থ থাকতে পারে না। এখন তো আমাদের জীবন ব্যবস্থা আমাদেরই এখতিয়ারে, কাজেই অবশ্যই আমাদের কাছে শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আমাদের জাতীয় সংষ্কৃতি তথা ইসলামের যথার্থ সেবক ও রক্ষকরূপে নতুন বংশধর তৈরী করা। তাদেরকে এমনভাবে তৈরী করতে হবে যেন তারা ইসলামকে ভাল করে বুঝে, তার ওপর খাঁটি ঈমান রাখে, ইসলামের আদর্শ ও মূলনীতিকে ভাল করে জানে, সে অনুসারে সুদৃঢ় ও নির্ভরযোগ্য চরিত্রের অধিকারী হয় এবং আমাদের সামগ্রিক জীবনের সমগ্র কর্মক্ষেত্রকে আমাদের সাংস্কৃতিক মূলনীতির ভিত্তিতে চালাতে ও তার উন্নয়ন বিধান করতে সক্ষম হয়।

ধর্ম ও দুনিয়াদারীর পার্থক্য ঘোচাতে হবেঃ

আমাদের দ্বিতীয় যে সিদ্ধান্তটি নিতে হবে তাহলো দ্বীন ও দুনিয়া অর্থাৎ ধর্মীয় জীবন ও দুনিয়াবী জীবনের পার্থক্যের অবসান ঘটাতে হবে। এ জিনিসটাকে নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় একটি আদর্শ মূলনীতি হিসেবে স্থান দিতে হবে এবং এরই ভিত্তিতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা রচনা করতে হবে। ধর্ম ও দুনিয়াদারীর পার্থক্য একটি খৃস্টবাদী কুসংস্কার। বৌদ্ধ ধর্ম, হিন্দু ধর্ম এবং যোগী ঋষীদের ধর্মেও এই কুসংষ্কার পরিলক্ষিত হয়। ইসলামের ধারণা বিশ্বাস এর সম্পূর্ণ বিপরীত। মুসলিম জাতির শিক্ষাব্যবস্থায়, সমাজব্যবস্থায় ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্ম ও দুনিয়াদারীর এ পার্থক্যকে যদি আমল দেয়া হয়, তাহলে এর চেয়ে মারাত্মক ভুল আর কিছু হতে পারে না। আমাদের একটা শিক্ষা হবে ধর্মীয় এবং একটা শিক্ষা হবে দুনিয়াবী, এটা আমাদের কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমাদের মতে, আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা একই সাথে ধর্মীয় ও দুনিয়াবী-দুই’ই হওয়া চাই। দুনিয়াবী এই হিসেবে যে, এই শিক্ষা গ্রহণ করে দুনিয়াকে বুঝবে এবং দুনিয়ার কাজ কারবার চালাবার যোগ্য হবে। আর ধর্মীয় এই হিসেবে যে, দুনিয়াকে তারা ইসলামী দৃষ্টিকোণ হতেই বুঝবে এবং ইসলামী বিধান অনুসারে দুনিয়ার যাবতীয় কাজ কারবার সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে। ইসলাম সেই ধর্ম নয়, যা মানুষকে দুনিয়ার কাজকর্ম বল্গাহীন স্বেচ্ছাচারিতার সাথে চালাতে অনুমতি দিয়ে তার সাথে শুধুমাত্র গুটিকয়েক আকীদা- বিশ্বাস ও আনুষ্ঠানিক ইবাদত উপাসনার লেজুড় লাগিয়ে রাখতে বলবে। ইসলাম জীবনের শুধু একটা লেজুড় হয়ে আগেও তুষ্ট ছিল না, আজও এভাবে থাকতে চায় না। ইসলাম মানুষের সমগ্র জীবনের জন্য পথপ্রদর্শক ও কর্মপন্থা নির্দেশক হবার দাবীদার। সে পার্থিব জীবন বহির্ভূত অতীন্দ্রিয় জগতের কথাই শুধু বলে না বরং গোটা দুনিয়াবী জীবন নিয়েই সে আলোচনা করে। ইসলাম দুনিয়াবী জীবনের প্রকৃত তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে। দুনিয়ায় মানুষের আগমনের উদ্দেশ্য কি, তার জীবনের লক্ষ্য কি, বিশ্বজগতে তার প্রকৃত অবস্থান কি এবং এই দুনিয়ায় তারা কি পন্থায়, কোন কোন মূলনীতির ভিত্তিতে কাজ করা উচিত তাও জানিয়ে দেয়। ইসলামের মতে ইহকাল হচ্ছে পরকালের কর্মক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রে যে রকম বীজ রোপন করা হবে পরকালে ঠিক তেমনি ফল পাওয়া যাবে। এই ক্ষেতে কিভাবে চাষ দিতে হবে তাও সে শিক্ষা দেয়। ‍পরকালে উত্তম ফল পেতে হলে দুনিয়ায় মানুষের কার্যপ্রণালী কি হওয়া উচিত তাও জানিয়ে দেয়। মুসলমানদের একটা শিক্ষা হবে দুনিয়াবী আর একটা হবে ইসলামী অথবা ইসলামকে একটা দুনিয়াবী শিক্ষার নেহায়েত লেজুড় বানিয়ে রাখা হবে। এ ধরনের একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা কখনো তা বরদাশত করতে পারে না। সে বরং চায় মানুষের গোটা শিক্ষাই ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীতে হোক। যে ব্যক্তি দর্শন পড়বে সে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীতেই তা পড়ুক যাতে সে একজন মুসলিম দার্শনিক হতে পারে। ইতিহাস পড়লে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীতে পড়ুক যেন সে একজন মুসলিম ঐতিহাসিক হতে পারে। যে বিজ্ঞান পড়ে সে যেন মুসলিম বিজ্ঞানী হয়ে গড়ে ওঠতে পারে। যে অর্থনীতি পড়বে সে যেন নিজ দেশের গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ইসলামী অর্থনীতির আলোকে সুগঠিত-পুনর্বিন্যস্ত করার যোগ্য হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়লে সে যেন নিজ দেশের শাসনব্যবস্থাকে ইসলামী মূলনীতির ভিত্তিতে চালাতে সক্ষম হয়। আইন পড়লে যেন ইসলামের ইনসাফ ও ন্যায়নীতির মানদন্ডে মামলা মোকদ্দমার বিচার করতে সমর্থ হবে। এভাবে ইসলাম, ধর্ম ও দুনিয়াদারীর পার্থক্য খতম করে দিয়ে পুরো শিক্ষাকেই ইসলামী শিক্ষায় পরিণত করতে চায়। এরপর আলাদা কোন ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজনই থাকে না। আজকের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ই যেমন একদিকে ইমাম, মুফতি ও আলেম তৈরি করবে, অপরদিকে সরকারি প্রশাসন চালাবার জন্য সেক্রেটারী এবং ডাইরেক্টরও সরবরাহ করবে।

চরিত্র গঠনঃ

নয়া শিক্ষা ব্যবস্থার তৃতীয় মৌলিক জিনিস হলো, এতে চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব গঠনকে পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে। শুধুমাত্র বই পুস্তক পড়ানো এবং জ্ঞান বিজ্ঞান শেখানোতে আমাদের লক্ষ্য অর্জিত হবে না। অমাদের প্রতিটি যুবকের মধ্যে ইসলামী চরিত্র, ইসলামী চিন্তা-চেতনা ও ইসলামী মানসিকতা গড়ে উঠা প্রয়োজন, চাই সে ইঞ্জিনিয়ার হোক, বৈজ্ঞানিক হোক, সমাজ বিজ্ঞানী হোক অথবা বেসামরিক প্রশাসনের কোন কর্মকর্তা হোক তার মধ্যে ইসলামী মন মগজ এবং ইসলামী চরিত্র অবশ্যই গড়ে উঠতে হবে। আমাদের শিক্ষা নীতিতে এ জিনিসটি প্রধান লক্ষ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। যে ব্যক্তির ইসলামী চরিত্র নেই, সে আর যাই হোক, আমাদের জন্য কোন কাজেরই নয়।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি