মাধ্যমিক শিক্ষা

মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের নিম্নবর্ণিত বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান দানের ব্যবস্থা করতে হবে।

(ক) আকায়িদঃ এ পর্যায়ে এ বিষয়টি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় জটিলতার নিরস বিস্তারিত আলোচনা পরিহার করতে হবে। এক্ষেত্রে বরং ঈমানিয়াত সহজ সরলভাবে উপস্থাপন করে শিক্ষার্থীর হৃদয়াঙ্গম করাতে হবে যা স্বাভাবিক অনুভূতি ও বুদ্ধি বিবেকের কাছে আবেদন সৃষ্টি করতে পারে। ইসলাম যেসব বিষয়ের প্রতি ঈমান সৃষ্টি করতে বলে তা আসলে বিশ্বজাহানের মৌলিক সত্য ছাড়া যে আর কিছু নয় আর এসব বিষয়গুলো যে আমাদের জীবনের সাথে অটুট বন্ধনে বাঁধা শিক্ষার্থীদের জন্য তা জানার অবকাশ সৃষ্টি করতে হবে।

(খ) ইসলামী আখলাকঃ এ বিষয়টি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কেবল নৈতিকতার তাত্ত্বিক ধারণা পেশ করলে চলবে না। বরং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবায়ে কিরামের বাস্তব জীবন থেকে এমন কিছু ঘটনা নির্বাচিত করে তুলতে হবে, যা দ্বারা শিক্ষার্থীরা একজন মুসলমানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ কি এবং একজন মুসলমানের জীবন কেমন তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।

(গ) ফিকাহ শাস্ত্রীয় বিধিমালাঃ এ বিষয়টি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আল্লাহর হক, বান্দার হক এবং ব্যক্তি-জীবনের আচরণ সম্পর্কে ইসলামী আইনের এমন কিছু প্রাথমিক এবং প্রয়োজনীয় আহকাম তুলে ধরতে হবে যা জানা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। তবে পুরনো ফিকাহ গ্রন্থসমূহের অনুসরণ করে কুপে ইঁদুর পতিত হলে কত বালতি পানি তুলে ফেলে পানি পবিত্র করতে হবে এ ধরনের টুকিটাকি ও বিস্তৃত বিষয় এতে না থাকাই উচিত। এসব বিষয়ের পরিবর্তে ইসলামী ইবাদত ও আহকাম সমূহের যৌক্তিকতা এর মূল স্পিরিট এবং এর উপযোগিতা যুক্তিসহ শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরা উচিত। তাদেরকে বরং জানার সুযোগ দেয়া উচিত যে ইসলাম ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনের জন্য কি কর্মসূচী পেশ করে এবং এই কর্মসূচী কিভাবে একটি সৎ ও নিষ্কলুষ সমাজ গঠন করে?

(ঘ) ইসলামী ইতিহাসঃ এ পর্যায়ে ইসলামী ইতিহাস শিক্ষাদানের পরিসর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবন চরিত ও সাহাবায়ে কিরামের যুগ পর্যন্ত সীমিত থাকবে। ইসলামী ইতিহাস শিক্ষাদানের লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীদেরকে নিজের আদর্শ ও জাতীয়তার উৎস সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করা এবং তাদের মনে সঠিক ইসলামী মর্যাদাবোধ সৃষ্টি করা।

(ঙ) আরবিঃ এ পর্যায়ে আরবি ভাষার নিছক প্রাথমিক জ্ঞান দান করতে হবে যা আরবি সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করবে।

(চ)কুরআনঃ কুরআন শিক্ষার ক্ষেত্রে এ স্তরে এতটুকু জ্ঞান দান করতে হবে যাতে শিক্ষার্থী কুরআন শরীফ দেখে ভালোভাবে পড়তে পারে। সহজ সরল আয়াতগুলোকে কিছুটা বুঝতে পারে এবং কয়েকটা সুরা মুখস্তও করে নিতে পারে।

 

 

 

 

 

 

 

কলেজ স্তরের শিক্ষাঃ

কলেজ স্তরে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে একটা সাধারণ পাঠ্যসূচী থাকবে যা সব শিক্ষার্থীকে পড়ানো হবে। এই পাঠ্যসূচীতে নিম্ন বর্ণিত বিষয়গুলো থাকবেঃ

(ক) আরবিঃ ‍উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে আরবি সাহিত্য সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা দান করতে হবে। কিন্তু বি.এ. বা স্নাতক পর্যায়ে গিয়ে এ বিষয়টাকে কুরআন শিক্ষার সাথে একীভূত করে নিতে হবে।

(খ) কুরআনঃ উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীকে কুরআন বুঝার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। এই স্তরে কয়েকটা বিষয় হৃদয়ঙ্গম করিয়ে নিতে হবে। তা হলো কুরআন মজীদের সুসংরক্ষিত হওয়া এবং ঐতিহাসিকভাবে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হওয়া, আল্লাহর ওহী হওয়া, সমস্ত ধর্মগ্রন্থের তুলনায় এর মর্যাদা, নজিরবিহীন বিপ্লবী শিক্ষা এবং তার প্রভাব শুধু আরবদের ওপর নয় বরং দুনিয়ার ধ্যান ধারণা ও জীবন প্রণালীর ওপর এর বাচনভঙ্গি ও যুক্তি ধারা এবং এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ও সারকথা।

বি.এ. স্তরে মূল কুরআন শিক্ষা দিতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষা পদ্ধতি হবে এমন যাতে শিক্ষার্থীরা নিজে নিজেই কুরআন মজীদ পড়ে বুঝতে চেষ্টা করবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকগণ শুধু জটিল বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করে বুঝাবেন, প্রশ্নের জবাব দেবেন এবং সন্দেহ নিরসন করবেন। যদি বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও খুঁটিনাটি আলোচনা পরিহার করা হয়, তাহলে দু’বছরের মধ্যেই অতি সহজেই পুরো কুরআন মজীদ পড়ানো সম্ভব হবে।

(গ) ইসলামী শিক্ষাঃ এ বিষয়টি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদেরকে গোটা ইসলামী জীবন বিধান সম্পর্কেই অবহিত করাতে হবে। কি কি মৌলিক ধ্যান ধারণার উপরে ইসলামের বুনিয়াদ রচিত হয়েছে, সে-সব ধ্যান ধারণার ভিত্তিতে ইসলাম আখলাক ও চরিত্র কিভাবে গঠন করে এবং এর অধীনে সমাজ জীবনে লেনদেন, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে কোন নীতিমালা অনুসারে বিন্যস্ত করে, তা অনুধাবন করাতে হবে। এর সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তি এবং সমষ্টির মধ্যে অধিকার ও কর্তব্য কিভাবে কোন দৃষ্টিকোণ হতে বর্ণিত হয়েছে, হুদুদুল্লাহ বা আল্লাহর দেয়া আদেশ নিষেধ কি এবং এই আদেশ নিষেধের মধ্যে অবস্থান করে একজন মুসলমান চিন্তা ও কাজে কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করবে, আর এই আদেশ নিষেধের গন্ডির বাইরে পদার্পণ করলে ইসলামী বিধানের উপর আর কিকি প্রতিক্রিয়া হয় এ সব বিষয় অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ও সুবিন্যস্তভাবে পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং তা চার বছরের শিক্ষা স্তরে ভারসাম্যপূর্ণভাবে বন্টন করতে হবে।

সাধারণ বাধ্যতামূলক বিষয়গুলো ছাড়াও ইসলামী বিষয়গুলোকে ভাগ করে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিশেষজ্ঞ তৈরীর কোর্সসমূহে ছড়িযে দিতে হবে এবং প্রত্যেক বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যশীল ইসলামী বিষয়কে তার অঙ্গীভূত করতে হবে। পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের সবকিছুই যথাস্থানে কল্যাণপ্রসূ। তাই এর কোনটার সাথেই ইসলামের শত্রুতা নেই। বরং আমি এতটুকু ইতিবাচক কথা বলতে চাই যে, জ্ঞানগত বাস্তবতা থাকলে ইসলাম ও পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান পরস্পরের বন্ধু। প্রকৃতপক্ষে জ্ঞান বিজ্ঞান ও ইসলামের মধ্যে কোন বৈরীতা নেই। বৈরিতা হলো ইসলাম ও পাশ্চাত্যপনার মধ্যে। জ্ঞান বিজ্ঞানের অধিকাংশ শাখায় পাশ্চাত্যবাসীরা বিশেষ কিছু মৌলিক ধারণা, স্বতঃসিদ্ধ কল্পনা, কিছু সূচনা বিন্দু (Starting Point) এবং কিছু বিশেষ দৃষ্টিকোণ পোষণ করে যা প্রকৃতপক্ষে কোন প্রমাণিত বিষয় না। বরং ঐগুলো তাদের নিছক বিশেষ মানসিকতা মাত্র। তারা জ্ঞানলব্ধ বাস্তবতাকে ঐ বিশেষ মানসিকতার ছাঁচে ঢেলে তদানুযায়ী ঐগুলোকে বিন্যস্ত করে একটি বিশেষ নীতিমালা বা আদর্শিক রূপদান করে থাকে। ইসলামের বৈরিতা ঐ বিশেষ মানসিকতার সাথে। ইসলাম বাস্তবতার দুশমন নয়। বরং এই বিশেষ ধাঁচের মানসিকতার দুশমন, জ্ঞানলব্ধ বাস্তবতাকে যে মানসিকতার আদলে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। কারণ ইসলাম একটি লক্ষ্য কেন্দ্রিক চিন্তা ভাবনা, একটি দৃষ্টিকোণ, চিন্তাধারার সূচনা বিন্দু এবং বিশেষ মানসিকতা পোষণ করে যা মৌলিক ও প্রকৃতিগত দিক থেকে পাশ্চাত্য ধাঁচের সম্পূর্ণ বিরোধী। এখন একটা কথা ভাল ভাবে বুঝে নিন। তাহলো পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের বাস্তবতাকে গ্রহণ করাটাই ইসলামের দৃষ্টিতে গোমরাহীর মূল কারণ নয়। বরং গোমরাহীর মূল কারণ হলো আপনি পাশ্চাত্যের নিকট থেকেই তাদের বিশেষ ধাঁচের মানসিকতা হুবহু গ্রহণ করেছেন। দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, আইন-কানুন, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্যান্য সব বিভাগেও আপনি নিজেই নবীন সরলমতি শিক্ষার্থীদের মন মগজে পাশ্চাত্যের মৌলিক ধ্যান ধারণা ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাদেরকে সব কিছু দেখতে শেখাচ্ছেন, পাশ্চাত্যের অনুমান নির্ভর বিষয়গুলোকে তাদের সামনে সর্ববাদী সম্মত সত্য হিসেবে পেশ করছেন, যুক্তি প্রমাণ ও যাচাই বাছাইয়ের জন্য পাশ্চাত্যবাসীদের গৃহীত সূচনাবিন্দুকেই মানদন্ড হিসেবে পেশ করছেন এবং যাবতীয় জ্ঞানলব্ধ বাস্তবতা ও সমস্যাবলীকে পাশ্চাত্যবাসী যে ভঙ্গিতে বিন্যস্ত করে থাকে আপনি ঠিক সেভাবেই বিন্যস্ত করে পাশ্চাত্যবাসীদের মন মগজে প্রবিষ্ট করে দিচ্ছেন। আর এসব কিছু করার পর আপনি চাচ্ছেন, শুধু দ্বীনিয়াত বিষয়টি তাদের মুসলমান বানিয়ে দিক। এটা কি করে সম্ভব? যে দ্বীনিয়াত বিভাগে শুধুমাত্র তাত্ত্বিক বিষয় শিক্ষা দেওয়া হয়, জ্ঞানগত বাস্তবতা ও জীবন সমস্যা সমাধানে যার কোন বাস্তব প্রয়োগ নেই। বরং এসব তাত্ত্বিক জ্ঞান যদি শিক্ষার্থী কর্তৃক লব্ধ জ্ঞানের সম্পূর্ণ বিপরীত হয় তাহলে সেই দ্বীনিয়াত বিভাগ কি করতে পারে? গোমরাহীর মূল উৎস এখানেই। যদি আপনি এই গোমরাহীর পথ রোধ করতে চান তাহলে উৎসমূখেই এর গতিপথ পাল্টিয়ে দিন এবং এমন সূচনা বিন্দু, দৃষ্টিকোণ ও মৌলিক নীতি দিয়ে শুরু করুন যা কুরআন হতে আপনি লাভ করেছেন। যখন সব রকমের লব্ধ জ্ঞান এই প্রজ্ঞা কাঠামোর অধীনে সন্নিবিষ্ট ও বিন্যস্ত হবে এবং সেই দৃষ্টিতেই গোটা বিশ্ব জাহান ও জীবন সমস্যার সমাধান করা হবে, তখনই আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুসলমান ছাত্র হবে। আর তখনই আপনি বলতে পারবেন আমরা তাদের মধ্যে ইসলামী স্পিরিট বা প্রাণ প্রবাহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি। অন্যথায় শুধু একটি বিভাগে ইসলাম আর অন্যসব বিভাগে অ-ইসলামী শিক্ষা বহাল রাখার পরিণাম এছাড়া আর কি হতে পারে যে, এখান হতে সনদপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা দর্শন ক্ষেত্রে অ-মুসলিম, রাজনীতি শিক্ষার ক্ষেত্রে অ-মুসলিম, ইতিহাস দর্শন শিক্ষার ক্ষেত্রে অ-মুসলিম এবং অর্থনীতি শিক্ষার ক্ষেত্রে অ-মুসলিম হয়ে গড়ে উঠবে। আর তাদের কাছে ইসলাম হবে নিছক কিছু আকীদা বিশ্বাস ও কিছু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ।

বিশেষ পাঠক্রম

ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের বিশেষ বিভাগগুলোকে আলাদাভাবে শিক্ষা দেয়ার দরকার নেই। এর প্রত্যেকটিকে একই ধরনের পাশ্চাত্য বিষয়ের শেষ পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া উচিত যেমন ‘ইসলামী দর্শন’ ইসলামী দার্শনিক চিন্তাধারার বিকাশে মুসলমানদের অবদান এবং ইসলামী হিকমতকে দর্শন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। ইসলামের ইতিহাস এবং ইসলামী ইতিহাসের দর্শনকে ইতিহাস বিভাগে, ইসলামী আইনের মূলনীতি এবং ফিকাহ শাস্ত্রের ব্যবহারিক কার্য্যকলাপ সংক্রান্ত অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ সমূহকে আইন বিভাগে, ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতিসমূহ ও অর্থনৈতিক লেনদেন সংক্রান্ত ফিকাহ শাস্ত্রীয় অধ্যায় সমূহকে অর্থনীতি বিভাগে এবং ইসলামী রাজনৈতিক মতবাদসমূহ, ইসলামী রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ইতিহাস এবং দুনিয়ার রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিকাশে ইসলামের অবদানকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। অন্যান্য বিষয়ও একইভাবে পাশ্চাত্য বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

গবেষণা ও ডক্টরেট বিভাগ

এই পাঠক্রমের পর ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উচ্চতর গবেষণার জন্য একটা বিশেষ বিভাগ থাকা উচিত। এ বিভাগ হতে পাশ্চাত্য বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মত উচ্চতর তাত্ত্বিক গবেষণার জন্য ডক্টরেট ডিগ্রী দেয়ার ব্যবস্থা থাকা দরকার। এ বিভাগ হতে তৈরী হবে এমন সব লোক যারা জ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে মৌলিক ও স্বাধীন প্রক্রিয়া অনুসরণের ট্রেনিং লাভ করবে। অতঃপর তারা শুধু মুসলমানদের নয় বরং ইসলামী দৃষ্টিকোণ হতে সারা দুনিয়ার তাত্ত্বিক নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে।

 

 

 

 

প্রস্তাবিত ইসলামী শিক্ষাপদ্ধতি বাস্তবায়নের পন্থা
আলোচনার দ্বিতীয় পর্যায়ে আমি নয়া শিক্ষাব্যবস্থার যে নীল নকশা পেশ করছি তা আপাতঃ দৃষ্টিতে কার্যোপযোগী বলে মনে নাও হতে পারে। কিন্তু অনেক চিন্তা গবেষণার পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, গভীর মনোনিবেশ, যথোপযুক্ত পরিশ্রম ও পর্যাপ্ত অর্থব্যয়ে এ কর্মসূচীকে ক্রমান্বয়ে কার্যকরী করা সম্ভব।

কোন একটা নতুন লক্ষ্যে উপনীতি হওয়ার জন্য প্রথম পদচারণা করা মাত্রই লক্ষ্যে উপনীত হওয়া যাবে এরূপ মনে করা কখনো উচিত নয়। আর কাজ শুরু করার জন্য তার পূ্র্ণতা সাধনের জন্য উপায় উপকরণ আগে থেকেই হাতে নিয়ে নামতে হবে এটাও জরুরী নয়। এ মুহুর্তে শুধুমাত্র ভবনের ভিত্তি স্থাপনই জরুরী এবং তার উপায় উপকরণ এখন হাতের নাগালের ভিতরই আছে। এই নীল নকশা অনুসারে নয়া শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করার মত কারিগর বর্তমান বংশধরদের মধ্যেই আছে। অতঃপর এই বংশধরদের কাছে শিক্ষা ও ট্রেনিং পেয়ে যে বংশধর তৈরি করা হবে তারা এই ভবনের দেয়াল গেঁথে তুলবে। আবার তৃতীয় বংশধররা এমন হবে যাদের হাতে ইনশাল্লাহ এর নির্মাণ কাজ পূর্ণতা লাভ করবে।

উৎকর্ষ ও পূ্র্ণতার যে স্তর কমপক্ষে তিনটা বংশধরদের অব্যাহত চেষ্টা ও পরিশ্রম দ্বারা উত্তরণ সম্ভব, তা আজই উত্তরণ সম্ভব নয়। কিন্তু তৃতীয় বংশধরদের হাতে এই কাজের পূর্ণতা লাভ নিশ্চিত করতে হলে আজই এ কাজ শুরু করা প্রয়োজন। নচেত পূর্ণতার স্তর অনেক দূরে বলে আজ এ কাজ শুরু করার যাবতীয় উপায় উপকরণ হাতে থাকা সত্ত্বেও যদি শুরু করা না হয়, তাহলে একাজ কোন কালেও সম্পন্ন হবে না।

যেহেতু এই সংস্কারমূলক পদক্ষেপের পরামর্শ আমিই দিচ্ছি, তাই এর বাস্তবায়নের উপায় ও পন্থা নির্দেশ করার দায়িত্বও আমার উপরই বর্তায়। এ জন্য আলোচনার এই অংশে আমি এই শিক্ষা পদ্ধতির বাস্তবায়ন কিভাবে শুরু করা যেতে পারে সে সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে চাই।

১-মাধ্যমিক স্কুলে ইসলামী আকীদা, আখলাক ও শরীয়তের বিধি নিষেধ সম্বলিত একটা পূর্ণাঙ্গ পাঠক্রম সম্প্রতি হায়দরাবাদের নিজাম সরকার কর্তৃক রচিত হয়েছে। তা প্রয়োজনীয় রদবদল ও সংশোধন দ্বারা কার্যোপযোগী করা যেতে পারে।

প্রাচীন পদ্ধতিতে পড়ানোর কারণে আরবী ভাষা শিক্ষা যে রকম জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে সে অবস্থা এখন আর নেই। মিশর, সিরিয়া এবং খোদ উপমহাদেশেও এখন আরবী শিক্ষার সহজতর পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে। আরবী শিক্ষার আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানগত ও বাস্তব দক্ষতা রাখেন এমন লোকদের নিয়ে একটা কোর্স তৈরি করা উচিত যাতে কুরআনকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আরবী শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হবে। এতে কুরআন শিক্ষার জন্য আলাদা সময় ব্যয় করতে হবে না। প্রথম থেকেই কুরআনের সাথে ছাত্রদের কিছুটা ঘনিষ্টতা গড়ে উঠবে।

ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে এদেশীয় ভাষায় প্রচুর বই লিখা হয়েছে। সেগুলো যোগাড় করে পড়ে দেখা দরকার। যেসব বই উপযোগী বলে মনে হবে, তা প্রাথমিক শ্রেণীগুলোতে পাঠ্য হিসেবে চালু করা যেতে পারে।

ইসলামিয়াত ও আরবী এ দুটো বিষয়ের জন্য দৈনিক মাত্র এক ঘন্টা সময় যথেষ্ট হবে। এরপর আসে ইসলামের ইতিহাসের কথা। এর জন্য কোন আলাদা সময়ের দরকার হয় না। সাধারণ ইতিহাসের পাঠ্যসূচীতে একে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এভাবে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় বড় রকমের কোন পরিবর্তনের দরকার হবে না। পরিবর্তন যেটুকু দরকার হবে তা শিক্ষাসূচী, শিক্ষা দানের পদ্ধতি এবং শিক্ষকের গুণগত মানের ক্ষেত্রে। দ্বীনিয়াতের শিক্ষা এবং শিক্ষক সম্পর্কে এ যাবত যে ধারণা পোষণ করে আসা হচ্ছে সে ধারণা ত্যাগ করতে হবে। এ যুগের ছাত্র-ছাত্রীর বুদ্ধিবৃত্তি ও মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারেন এমন শিক্ষক নিয়োগ করা চাই। তাদেরকে এই পরিবর্তিত ও উন্নত মানের শিক্ষাসূচী দিতে হবে এবং সেই সাথে শিক্ষাংগনের পরিবেশটাকে এতটা ইসলামী ভাবাপন্ন করে গড়তে হবে যে, সেখানে যেন ইসলামী ভাবধারার বীজ বপন করা হলে তার অঙ্কুরোদগম সম্ভব হয়।

২- উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের জন্য আমি যে সাধারণ পাঠ্যসূচীর প্রস্তাব দিচ্ছি তা তিনটি অংশে বিভক্ত। আরবী, কুরআন ও ইসলামী শিক্ষা। এর মধ্যে আরবীকে মাধ্যমিক স্তরে বাধ্যতামূলক ভাষার মর্যাদা দিতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোন ভাষা শিখতে চাইলে ছাত্ররা গৃহশিক্ষক রাখবে। কিন্তু কলেজে যে ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে থাকবে, সেটা ছাড়া আর কোন ভাষা যদি বাধ্যতামূলক করা হয় তবে তা একমাত্র আরবীই হওয়া উচিত। যদি পাঠক্রম ভালো হয় এবং শিক্ষক খুব অভিজ্ঞ হন তাহলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের দুই বছরেই ছাত্ররা এতটা যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হবে যে, বি.এ. ক্লাসে পৌছে কুরআনের শিক্ষা স্বয়ং কুরআনের ভাষাতেই অর্জন করতে পারবে।

কুরআন শিক্ষার জন্য তাফসীরের কিতাব দরকার হয় না। একজন উঁচু মানের অধ্যাপকই যথেষ্ট। অধ্যাপক এমন হওয়া চাই যিনি কুরআনকে গভীর মনোনিবেশ সহকারে পড়েছেন এবং নতুন পদ্ধতিতে কুরআন পড়ানো এবং বুঝানোর যোগ্যতা রাখেন। তিনি অধ্যাপনার মাধ্যমে উচ্চ মাধ্যমিক ছাত্রদের মধ্যে কুরআন বুঝাবার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা গড়ে তুলবেন। তারপর বি.এ. ক্লাসে তাদেরকে সমগ্র কুরআন শরীফ এমনভাবে পড়িয়ে দিবেন যে, তারা আরবী ভাষায়ও উন্নতি লাভ করবে আর ইসলামের তাৎপর্য্ও ভাল করে বুঝে নিবে।

‘ইসলামী শিক্ষার’ জন্য একখানা নতুন পাঠ্য বই লেখানো দরকার। এ বই এর বিষয়বস্তুর বিন্যাস কেমন হবে সে কথা আমি ইতোপূর্বে উচচ মাধ্যমিক স্তরের ইসলামী শিক্ষার পর্যায়ে বিশ্লেষণ করেছি। আমি নিজে ‘ইসলামী তাহযীব আওর উসকে উসুল ও মাবাদী’ নামে একখানা বই এ উদ্দেশ্যেই লিখেছি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উপযোগী মনে করলে এই বই তাদেরকে দিয়ে দেব।

এ বিষয়গুলো শিক্ষা দিতে কলেজের বর্তমান রুটিনে পরিবর্তনের কোন প্রয়োজন নেই। মাধ্যমিক স্তরের ভাষার জন্য বর্তমানে যেটুকু সময় বরাদ্দ আছে, আরবীর জন্য সেটুকুই যথেষ্ট হবে। কুরআন ও ইসলামী শিক্ষার জন্য বর্তমানে ধর্মীয় শিক্ষার সময়টাই পালাক্রমে ভাগ করে দিলে চলবে।

৩-উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বিশেষ ও ঐচ্ছিক শিক্ষা সূচীর ক্ষেত্রে এবং উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে আমি যে সুপারিশ করেছি তার বাস্তবায়নই সবচেয়ে জটিলতার সম্মুখীন হতে পারে। এ সমস্যা সমাধানের তিনটি পন্থা আছে যা ক্রমান্বয়ে গ্রহণ করা যেতে পারে।

ক) আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানে পারদর্শী হওয়ার পাশাপাশি কুরআন ও সুন্নাহতেও ভালো দখল রাখেন এমন অধ্যাপক খুঁজতে হবে। (এ ধরনের অধ্যাপক একেবারে দুর্লভ নয়।) পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও তথ্যাবলীকে ইসলামী মতাদর্শের আলোকে পুনর্বিন্যস্ত করতে পারেন এমন যোগ্যতা তাদের মধ্যে থাকা চাই।

খ) ইসলামী আইন দর্শন, আইন শাস্ত্রের মূলনীতি ও আইনতত্ত্ব, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে আরবী, উর্দূ, ইংরজী, জার্মান ও ফারসী ভাষায় যে সব বই পুস্তক রয়েছে, তা পর্যালোচনা করে দেখা উচিত। যে সব বই হুবহু গ্রহণ করার মত তা পাঠ্য হিসেবে নির্বাচিত করা উচিত। আর যেসব বই কিঞ্চিৎ রদবদল অথবা সংরক্ষণ করে কাজে লাগানো সম্ভব সেগুলো সেভাবে কাজে লাগাতে হবে। এ উদ্দেশ্যে বিশেষজ্ঞদের একটা গ্রুপকে নিয়োজিত করতে হবে।

গ) ‍উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো নিয়ে নতুন বই পুস্তক রচনা করার জন্য কিছু সংখ্যক ব্যুৎপত্তি সম্পন্ন লেখককে নিয়োজিত করতে হবে। বিশেষত ফিকাহ শাস্ত্র, ফিকাহ শাস্ত্রের মূলনীতি, ইসলামী অর্থনীতি, ইসলামের সমাজ বিজ্ঞান ও কুরআনে আলোচিত বিজ্ঞান দর্শন সম্পর্কে নতুন বই পুস্তক লেখা অত্যন্ত জরুরী। পুরনো গ্রন্থাবলীগুলো এখন পাঠ্যপুস্তক হিসেবে অকেজো হয়ে পড়েছে। অবশ্য গবেষকগণ ঐসব গ্রন্থে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে পারেন। কিন্তু ঐগুলো হুবহু পাঠ্য করে এ যুগের ছাত্রদের পড়ানো একেবারেই নিরর্থক। এ কথা সত্য যে, এই মুহুর্তে উল্লেখিত তিনটি পন্থার সব ক’টা প্রয়োগ করেও আমাদের উদ্দেশ্য যথাযথভাবে সিদ্ধ হবে না। আর এই সংস্কার ও পুনর্গঠনের কাজে বেশ কিছু ভুল ত্রুটি থেকে যাবে এটাও নিশ্চিত। তবে এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এটা হবে সঠিক পথের প্রথম পদক্ষেপ। এতে যে সব ত্রুটি বিচ্যূতি থেকে যাবে তা পরবর্তী বংশধরগণ শুধরে নিবে। হয়তো বা এই পূর্ণতা লাভের প্রক্রিয়ায় ৫০ বছরও লেগে যেতে পারে।

৪- ইসলামী গবেষণা বিভাগ প্রতিষ্ঠার সময় এখনো আসেনি। এর সুযোগ আসবে আরো পরে। সুতরাং এ মুহুর্তে সে সম্পর্কে কোন প্রস্তাব পেশ করা নিরর্থক।

৫- আমার সুপারিশগুলো মোটামুটিভাবে মুসলমানদের সকল ফেরকা বা মাযহাবের লোকদের জন্যই গ্রহণযোগ্য। তা সত্ত্বেও শীয়া উলামাদের মতামত নেয়া উচিত। তারা যদি শীয়া ছাত্রদের জন্য আলাদা কোন শিক্ষা পরিকল্পনা তৈরী করতে চান করতে পারেন। তবে যতদূর সম্ভব, শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র মতভেদগুলো এড়িয়ে যাওয়াই সঙ্গত। মত ও পথ নির্বিশেষ সকল মুসলমানের নতুন বংশধরদের ইসলামের সর্বসম্মত মূলনীতিগুলোর প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত।

৬-স্যার মুহাম্মদ ইয়াকুবের এই মত আমি সর্বান্তকরণে সমর্থন করি যে, বড় বড় মুসলিম পন্ডিতদেরকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর ভাষণ দেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে দাওয়াত দেয়া উচিত। সত্যি বলতে কি, আমার একান্ত বাসনা, আলীগড় শুধু ভারতবর্ষের নয় বরং সারা ভারতের মুসলিম জাহানের কেন্দ্রীয় বিদ্যাপীঠ এবং বুদ্ধিচর্চা কেন্দ্রে পরিণত হোক। ভারতবর্ষের বড় বড় জ্ঞানী গুণীগণ ছাড়াও মিশর, সিরিয়া, ইরান, তুরস্ক ও ইউরোপের মুসলিম মনীষিদেরকে মাঝে মাঝে দাওয়াত দিয়ে আনা উচিত যেন তারা তাদের মূল্যবান মতামত, চিন্তা-গবেষণা ও অভিজ্ঞতার ফল পেশ করে আমাদের ছাত্রদের চিন্তাধারাকে আলোকিত ও উজ্জীবিত করে তোলেন এবং তাদের মধ্যে নতুন প্রেরণা ও উদ্যমের সঞ্জার করেন। এ ধরনের ভাষণসমূহ পর্যাপ্ত সম্মানী দিয়ে লেখানো বাঞ্চনীয় যাতে তারা প্রচুর সময়, শ্রম ও চিন্তা গবেষণা দ্বারা লিখতে পারেন এবং এসব ভাষণ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য নয়, বরং সাধারণ শিক্ষিত লোকদের জন্যও কল্যাণকর হতে পারে।

৭-ইসলামী শিক্ষার জন্য কোন একটি মাত্র ভাষাকে নির্দিষ্ট করে নেয়া ঠিক নয়। কেননা কোন একটি ভাষাতেই ইসলামী শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণ যথেষ্ট পরিমাণে নেই। তাই আপাতত যে ভাষাতেই কোন দরকারী জিনিস পাওয়া যাবে, তাকে সে ভাষাতেই পড়িয়ে দিতে হবে। ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের শিক্ষকদের সবারই আরবী ও ইংরেজী উভয় ভাষায় ভালো জ্ঞান থাকা চাই। এ যুগে কোন একটিমাত্র ভাষাভিজ্ঞ লোক ভালো ইসলামী শিক্ষক হতে পারেন না।

আমি দীর্ঘ কয়েক বছর ব্যাপী চিন্তা গবেষণার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, শিক্ষাব্যবস্থার সর্বাত্মক পরিবর্তন সূচিত করা করা ছাড়া জাতি হিসেবে মুসলমানদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব এবং তাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার আর কোন উপায় নেই। সেই সর্বাত্বক পরিবর্তন আমার এই প্রস্তাবগুলি অনুসারেই হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। আমি জানি আমার এই চিন্তাধারাকে অনেকেই পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিতে চাইবেন। এরূপ মনে করলে আমি বিস্মিত হবো না। কেননা যাদের দৃষ্টি পশ্চাদমুখী তারা অধিকাংশ সময় সম্মুখে দৃষ্টি দানকারীদের পাগলই ভেবে থাকে। এ রকম ভাবাই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্ত যে অনিবার্য পরিণতি আমি দেখতে পাচ্ছি, তা তারাও নিজ চর্ম চোখে দেখতে পাবেন সেদিন বেশি দূরে নয়। হয়তো বা আমার জীবদ্দশাতেই। তখন তারাও এই সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবেন। কিন্তু তখন বন্যার প্রবাহ মাথার উপর দিয়ে বইতে থাকবে। পরিস্থিতি শোধরানোর সুযোগ তখন হয়তো থাকবে না।

 

 

 

 

সনদ বিতরণী সভার ভাষণ
(একবার কোন এক ইসলামিয়া কলেজের সনদ বিতরণী সভায় মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদীকে ভাষণ দেয়ার জন্য দাওয়াত দেয়া হয়। সে অনুষ্ঠানে তিনি যে বক্তব্য পেশ করেন তা সর্ব শ্রেণীর মানুষের উপকারার্থে এখানে উল্লেখ করা হলো।)

সম্মানিত অধ্যাপকবৃন্দ, সমবেত ভদ্র মন্ডলী ও প্রিয় ছাত্রগণ, আপনাদের এই সনদ বিতরণী সভায় আমি নিজে কিছু বক্তব্য পেশ করার সুযোগ পেয়ে সত্যিই অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। আমার এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নেহায়েৎ আনুষ্ঠানিকতা নয় বরং সম্পূর্ণ বাস্তব। আর গভীর আন্তরিকতা নিয়েই আমার এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। কেননা যে শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে আপনাদের এই মহতী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং যেখানে শিক্ষা লাভ করে আপনাদের উত্তীর্ণ ছাত্ররা সনদ গ্রহণ করতে চলেছে আমি তার কট্টর দুশমন। আমার এ দুশমনীর কথা আমাকে যারা চেনেন তাদের অজানা নয়। ব্যাপারটা জানা থাকা সত্ত্বেও আমাকে যখন এ অনুষ্ঠানে ভাষণ দেয়ার জন্য দাওয়াত দেয়া হয়েছে, তখন দাওয়াত দানকারীদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা বোধ করা আমার পক্ষে নিতান্তই স্বাভাবিক। যে ব্যক্তি তাদের মত ও পথের শত্রু, তার কথা শোনার মত উদারতা যাদের রয়েছে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও মর্যাদার অনুভূতিতে আমার হৃদয় মন ভরে উঠবে এটা স্বাভাবিক। বিশেষ করে আপনারা আমাকে এমন সময় ছাত্রদের সাথে কথা বলার সুযোগ দিয়েছেন যখন তারা এখান থেকে বেরিয়ে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এজন্য আমি আরো বেশি কৃতজ্ঞ।

সম্মানিত শ্রোতৃমন্ডলী, কিছুক্ষণের জন্য আপনাদের দিক হতে মুখ ফিরিয়ে আজ যারা এখান থেকে সনদ নিতে যাচ্ছেন সেই স্নেহভাজন ছাত্রদের উদ্দেশ্যে কিছু বক্তব্য পেশ করার জন্য আমাকে অনুমতি দিন। কেননা সময় কম এবং আমার অনেক কথা বলার রয়েছে।

আমার প্রিয় ছাত্র ভাইয়েরা!

আপনারা এখানে জীবনের বেশ কটি মূল্যবান বছর কাটিয়ে শিক্ষা লাভ করেছেন। এতদিন বুকভরা আশা নিয়ে আপনারা আপনাদের পরিশ্রমের ফসল হিসেবে ডিগ্রী লাভের এই শুভ মুহুর্তটার প্রতীক্ষায় ছিলেন। এই শুভ মুহুর্তে আপনাদের আবেগ অনুভূতি যে কত গভীর হতে পারে তা আমি ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারি। আর এ কারণেই আপনাদের সামনে নিজের মতামত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করতে গিয়ে আমি বিশেষভাবে দুঃখ অনুভব করছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি যে কথা সত্য বলে জানি এবং যে সম্পর্কে আপনাদেরকে এক্ষণি অবহিত করা জরুরী মনে করি, তা যদি কেবল আবেগ অনুভূতির দিকে লক্ষ্য রেখে নিছক লৌকিকতার খাতিরে না বলি তাহলে সেটা হবে আমার মারাত্মক অন্যায়। কেননা আপনারা জীবনের একটি স্তর অতিক্রম করে অন্য স্তরের দিকে এগিয়ে চলেছেন।

সত্যি বলতে কি, আমি আপনাদের এই শিক্ষাঙ্গনকে এবং বিশেষ করে এটি নয় বরং এ ধরনের অন্য সব শিক্ষাঙ্গনকেও শিক্ষাঙ্গনের পরিবর্তে বধ্যভূমি বলে মনে করি। আমার দৃষ্টিতে এখানে সত্যিই আপনাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। আর যে সনদ আপনারা লাভ করেছেন সেগুলো আসলে আপনাদের মৃত্যুর সার্টিফিকেট (Death Certificate)। হত্যাকারী নিজের ধারণায় আপনাদের মৃত্যু সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পরই এ সার্টিফিকেট আপনাদের দিতে চাচ্ছে। এরূপ সুসংগঠিত বধ্যভূমি থেকেও যদি আপনারা প্রাণ বাঁচিয়ে যেতে পারেন তবে সেটা আপনাদের সৌভাগ্য বলতে হবে। আমি এখানে এই মৃত্যু সার্টিফিকেট লাভের জন্য আপনাদেরকে অভিনন্দন জানাতে আসি নি বরং কওমের একজন সদস্য হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই আপনাদের প্রতি যে সহানুভূতি আমার রয়েছে সেই অনুভূতিই আমাকে এখানে টেনে এনেছে। কোন নির্বিচার গণহত্যায় কারো আত্মীয় স্বজন নিহত হলে সে যেমন লাশের স্তূপের ভেতর খুঁজতে থাকে কেউ এখনো প্রাণে বেঁচে আছে কিনা, আমার অবস্থাও তেমনি।

এ কথা কখনো মনে করবেন না যে, আমি অতিরঞ্জিত কিছু বলেছি। সংবাদ পত্রের পাতায় আমি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে চাই না। প্রকৃতপক্ষে এই শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে এটাই আমার দৃষ্টিভঙ্গি। আমি যদি একটু বিস্তারিতভাবে আমার এ সিদ্ধান্তে উপনীত হবার কারণ বিশ্লেষণ করি তাহলে হয়তো বা আপনারাও আমার সাথে একমত না হয়ে পারবেন না।

আপনারা সবাই জানেন যে, একটা চারাগাছকে যদি তার জন্মস্থান হতে উপড়ে নিয়ে এমন জায়গায় লাগান হয় যেখানকার আবহাওয়া, মাটি ও সমগ্র পরিবেশ তার জীবন ধারণের জন্য প্রতিকুল, তাহলে গাছটির শিকড় গজাতে সক্ষম হবে না। তবে সেই জায়গায় যদি কৃত্রিমভাবে তার আসল জন্মস্থানের অনুরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় তাহলে অবশ্য আলাদা কথা। কিন্তু প্রতিটি চারা গাছ ল্যাবরেটরীর কৃত্রিম পরিবেশ সারা জীবন পেতে পারে না। এই ব্যতিক্রমী অবস্থার কথা বাদ দিলে সাধারণভাবে এই সত্য কথাটি বলা চলে যে, কোন চারা গাছকে তার আসল জন্মস্থান থেকে উপড়ে একটা ভিন্ন ধরনের পরিবেশে নিয়ে লাগিয়ে দেয়া তাকে হত্যা করারই নামান্তর।

এবার আরেকটি দুর্ভাগা চারা গাছের কথা কল্পনা করুন। যে গাছটিকে তার জন্মস্থান হতে উৎপাটিত করা হয় নি কিংবা তার জন্মগত পরিবেশ থেকেও উচ্ছেদ করা হয় নি। তার মাটি, পানি, বাতাস ও প্রাকৃতিক পরিবেশ অপরিবর্তিতই রয়েছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক উপায়ে তার নিজের ভিতরে এমন পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে যে, নিজের জন্মস্থান থেকেও তার প্রকৃতি সেখানকার মাটি, পানি, বাতাস ও পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন ও সম্পর্কহীন হয়ে আছে। ফলে সে সেখানে শিকড় গজাতে ও সেখানকার পানি ও বাতাস থেকে খাদ্য আহরণ করতে পারছে না, আর ঐ পরিবেশে তার কলেবরও বাড়তে পারছে না। অভ্যন্তরীণ এই পরিবর্তনের ফলে চারাগাছটির অবস্থা ভিন্ন মাটি থেকে উপড়ে এনে ভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি এবং কৃত্রিমভাবে বেঁচে থাকার উপকরণ সংগ্রহ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ল্যাবরেটরীর এই কৃত্রিম পরিবেশ যদি তাকে তৈরী করে দেয়া না হয় তাহলে সে যেখানে জন্মেছে সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং অচিরেই শুকিয়ে মরে যাবে।

প্রথম কাজটি অর্থাৎ একটি চারাগাছকে তার জন্মস্থান হতে উপড়ে এনে নতুন ভিন্ন পরিবেশে রোপন করা একটি ছোটখাট জুলুম। তবে দ্বিতীয় কাজটি অর্থাৎ চারাগাছটিকে যেখানে জন্মেছে সেখানেই তার জন্য প্রতিকুল পরিবেশ সৃষ্টি করা নিঃসন্দেহে বড় রকমের জুলুম। আর যখন একটি দুটি নয় লক্ষ লক্ষ চারা গাছের ক্ষেত্রে এরূপ করা হয় এবং এত বিপুল সংখ্যক চারাগাছকে ল্যাবরেটরীর কৃত্রিম পরিবেশ যোগান দেয়াও যেখানে সম্ভব নয় তখন একে জুলুমের পরিবর্তে পাইকারী হত্যা বলা অতিরিক্ত হবে না।

আমি বাস্তব অবস্থার যে পর্যবেক্ষণ করেছি তাতে এ সিদ্ধান্তে পৌছেছি যে, এ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আপনাদের সাথেও একই আচরণ করা হচ্ছে। আপনারা ভারত ভূমির মুসলমান সমাজে জন্মগ্রহণ করেছেন। এখানকার মাটি, এই সমাজের সাংস্কৃতিক আবহাওয়া ও পরিবেশেরই উৎপন্ন ফসল আপনারা। এই মাটিতে শিকড় গজানো এবং এই আবহাওয়া থেকেই জীবনী শক্তি আহরণ করা ছাড়া আপনাদের বেড়ে ওঠা এবং ফুলে ফলে সুশোভিত হওয়ার আর কোন পথ নেই। এ পরিবেশের সাথে আপনাদের যত বেশি সখ্যতা ও সঙ্গতিশীলতা গড়ে উঠবে, ততই আপনাদের পরিপুষ্টি আসবে এবং বাগানের সৌন্দর্য সুষমা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা কি? এখানে আপনারা যে শিক্ষা ও অনুশীলন লাভ করেছেন, যে মানসিকতা আপনাদের সৃষ্টি হচ্ছে, যে ধ্যান-ধারণা, যে প্রবণতা ও ইচ্ছা আকাঙ্খা ও কামনা বাসনা আপনাদের মধ্যে লালিত হচ্ছে, যে আদব অভ্যাস, রীতি প্রথা, আচার আচরণ ও স্বভাব চরিত্র আপনাদের মধ্যে বদ্ধমূল হচ্ছে এবং যে চিন্তা পদ্ধতি ও রুচিবোধ দিয়ে এবং যে জীবনধারায় আপনাদের গড়ে তোলা হচ্ছে, সে সব কিছু মিলে এ দেশের মাটি, আবহাওয়া ও সামাজিক পরিবেশের সাথে বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক থাকতে দেয় কি? এই দেশের সেই কোটি কোটি মানুষ যাদের মধ্যে আপনাদের বাঁচতে ও মরতে হবে এবং সে দেশের সমাজ জীবনে যে কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে রয়েছে তার সাথে এখানকার চাল-চলন, কথাবার্তা, লেবাস পোশাক ও জীবন রীতির কতখানি মিল আছে? এখানকার সামাজিক পরিবেশের সাথে আপনাদের যে কতবড় গড়মিল এবং আপনাদের জন্য এই সমাজ যে কত অসঙ্গত, আর এ অসঙ্গতির যন্ত্রণাও যে কত তীব্র, সেটা অনুভব করার মত সুস্থতাও যদি আপনাদের মধ্যে থাকতে দেয়া হতো, তাহলেও সেটা সৌভাগ্যের ব্যাপার হত।

একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরো ভাল করে বুঝা যাবে। কাঁচামালের উপর কারিগরি প্রক্রিয়া চালানো হয় তা ব্যবহারের উপযোগী দ্রব্যে পরিণত করার জন্য। কিন্তু যদি কোন কাঁচামালের ওপর কারিগরী প্রক্রিয়া চালানো সত্ত্বেও তা ব্যবহারের উপযোগী না হয়, তাহলে এ কাঁচামালটাও নষ্ট হলো, আর তার ওপর ব্যয়িত কারিগরী শ্রমও বৃথা গেল। কাপড়ের ওপর দর্জির কারিগরী যোগ্যতা এজন্য প্রয়োগ করা হয়, যাতে তা শরীরে ঠিকমত লাগে। এ উদ্দেশ্য সফল না হলে কারিগর দিয়ে কাপড়কে কেবল নষ্ট করাই সার হবে। একটা জিনিসের ওপর বাবুর্চিগিরীর বিদ্যা করা হয় তাকে খাবারে পরিণত করার জন্য। কিন্তু সেটা খাবারের যোগ্য না হলে বাবুর্চি ঐ জিনিসটাকে নষ্টই করল বলতে হবে।

অনুরূপভাবে শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো সমাজে যে সব মানুষগুলো জন্ম নিলো তাদের মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা ও যোগ্যতা এখনও অপরিপক্ক ও অপরিণত অবস্থায় রয়েছে সেগুলোকে সর্বোত্তম পন্থায় লালন পালন ও পরিপুষ্ট করে যে সমাজে তারা জন্মগ্রহণ করেছে সেই সমাজের উপযোগী সার্থক সদস্য বানানো এবং ঐ সমাজের বিকাশ, কল্যাণ ও উন্নতির সহায়কে পরিণত করা। কিন্তু যে শিক্ষা ব্যক্তিকে সমাজ ও তার বাস্তব জীবন ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় সে শিক্ষা সম্পর্কে একথা বলা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না যে, তা সমাজকে গঠন করে না বরং ধ্বংস করে দেয়। শিশু-কিশোর ও তরুণরা প্রত্যেক জাতির ভবিষ্যত ভাগ্যলিপি স্বরূপ। স্বাভাবিকভাবে এসব শিশু-কিশোর ও তরুণদের আগমন ঘটে। আল্লাহর তরফ থেকে এ ভাগ্যলিপি অলিখিত পেটের আকারে এসে থাকে। জাতি নিজ হাতে ঐ পেটে তার ভবিষ্যত লিপিবদ্ধ করুক এই এখতিয়ার তাকে দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা এমন এক দুর্ভাগা জাতি যে, এই অলিখিত ভাগ্যলিপিতে নিজেদের ভবিষ্যত নিজেরা না লিখে অন্যদের হাতে তুলে দেই। এতে তারা তাদের ইচ্ছেমত যা খুশি লিখে দিক, এমনকি আমাদের মৃত্যু পরোয়ানাও যদি লিখে দেয় তবুও যেন আমাদের কিছু করার নেই।

এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হতে শিক্ষা সমাপ্ত করে যারা বেরিয়ে আসে তারা যখন নিজেদের সমাজে ফিরে যায় তখন তাদের অবস্থা হয় গায়ে দেয়ার অযোগ্য জামা কিংবা পেটে দেয়ার অযোগ্য খাবারের মত। ঐ সমাজের জন্য তারা যে উপযোগী হয় নি, সে কথা সমাজ যেমন বুঝে তেমনি তারা নিজেরাও বুঝে। ফলে সমাজ তাদেরকে নিজের কাজে লাগাতে না পেরে অগত্যা নিলামে চড়িয়ে দেয়। সদ্য পাশ করা ছাত্ররাও ভাবে, কোথাও যখন কাজ জুটছেনা তখন যেখানে হোক এবং যে দামেই হোক, বিক্রি হয়ে যাই। যে জাতি নিজের উৎকৃষ্টতম মানব সম্পদকে জুতো, কাপড় ও খাদ্যের বিনিময়ে বেচে দেয় সে জাতি যে কত বড় হতভাগা তা বাস্তবিকই ভেবে দেখার বিষয়।

আল্লাহ তায়ালা যে জনশক্তি ও মেধাশক্তি আমাদের নিজেদের কাজের জন্যই দিয়েছেন তা এখন অন্যদের কাজে লাগছে। আমাদের যুবকদের অমিততেজা দৈহিক শক্তি, তাদের মস্তিষ্কের রকমারি প্রতিভা ও বুকের এব বক্ষপিঞ্জরের মধ্যে যে শক্তি সঞ্চিত আছে তা আমাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন। কিন্তু বড়জোর তা শতকরা এক কি দুই ভাগ আমাদের কাজে লাগে। অবশিষ্ট সবটুকুই অন্যরা কিনে নিয়ে যায়। আরো মজার ব্যাপার হলো মুনাফাবিহীন বিকি কিনিকেই আমরা বিরাট সাফল্য বলে মনে করছি। এ কথা কেউ-ই উপলব্ধি করে না যে প্রকৃত পুঁজিই হলো জনশক্তি। সুতরাং তা বিক্রি করা লাভজনক নয় বরং ষোল আনাই ক্ষতিকর।

উচ্চশিক্ষা লাভ করেছে কিংবা সদ্য পাশ করে বেরিয়েছে প্রায়ই আমার এমন যুবকদের সাথে মেলামেশার সুযোগ হয়। তাদের নিকট আমি সবার আগে এটা জানতে চেষ্টা করি, তারা নিজেদের জীবনের কোন লক্ষ্য স্থির করেছে কিনা কিন্তু যখন দেখি যে, জীবনের কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য স্থির করেছে এমন যুবকের সংখ্যা হাজারে একজন পাওয়া দুষ্কর, এমন কি মানুষের জীবনের কোন লক্ষ্য আদৌ থাকা উচিত বা থাকতে পারে কিনা, সে বিষয়ে তাদের অধিকাংশেরই ধারণা পর্যন্ত নেই তখন আমার হতাশার শেষ থাকে না। জীবন লক্ষ্যের প্রশ্নকে তারা নিতান্তই দার্শনিক বা কবিসুলভ হেঁয়ালী মনে করে। পার্থিব জীবনে আমাদের কাজ কর্ম ও চেষ্টা সাধনার একটা লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকা চাই কিনা সে ব্যাপারে কার্যতঃ কোন কিছু স্থির করে নেয়ার প্রয়োজনই তারা বোধ করে না। উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত যুবকদের এই দশা দেখে আমাদের মাথা ঘুরে যায়। আমি দিশেহারা হয়ে ভাবি, যে শিক্ষা ব্যবস্থায় পনেরো বিশজনের একটানা মানসিক ও বুদ্ধিভিত্তিক অনুশীলনের পরও মানুষ নিজের শক্তি ও যোগ্যতাকে কোথায় ব্যয় করবে এবং তার চেষ্টা সাধনার উদ্দেশ্য কি হবে, তা ঠিক করার যোগ্যতাও অর্জন করে না, এমনকি জীবনের কোন লক্ষ্য আদৌ থাকার দরকার কিনা তাও উপলব্ধি করতে পারে না, সে শিক্ষা ব্যবস্থাকে কি নামে অভিহিত করা যায়। এই মনুষ্যত্বের উৎকর্ষ দানকারী না মনুষ্যত্বকে ধ্বংসকারী শিক্ষা? উদ্দেশ্যহীন জীবন যাপনতো জন্তু জানোয়ারদের কাজ। মানুষও যদি শুধু বাঁচার জন্যই বাঁচতে শেখে এবং নিজের শক্তি সামর্থ ব্যয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য প্রাণ রক্ষা ও সন্তান প্রজনন করাই বুঝে, তাহলে মানুষ ও অপরাপর জীবজন্তুর মধ্যে পার্থক্য থাকে কোথায়?

আমার এ সমালোচনার উদ্দেশ্য আপনাদের ভৎসর্না করা নয়। ভৎসর্না করা হয় অপরাধীকে। অথচ আপনারা অপরাধী নয়, আপনারা মজলুম। তাই আমি আপনাদের প্রতি সহানুভূতির মনোভাব নিয়েই এতসব কথা বলছি। আমি চাই কর্মজীবনে পদার্পণ করতে যাওয়ার প্রাক্কালে নিজেদের অবস্থাটা একবার পর্যালোচনা করে দেখুন যে, এই পর্যায়ে আপনাদের করণীয় কি? আপনারা মুসলিম উম্মতের অংশ। এ উম্মত কোন বর্ণ বা বংশগত জাতীয়তাভিত্তিক নয়। যে ব্যক্তি এর ভেতরে জন্ম নিবে সে আপনা আপনি মুসলমান বলে গণ্য হবে এমনও নয়। এটা কোন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীও নয় যে, এর সাথে কেবল সামাজিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়াই মুসলমান হওয়ার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম হলো একটা আদর্শ। মানুষের সামাজিক জীবন তার সকল দিক ও বিভাগ এই আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে উঠে। এ জাতির অন্তর্ভুক্ত যারা, তারা এর আদর্শকে বুঝবে, এর মর্ম ও তাৎপর্য উপলব্ধি করবে এবং নিজেদের সামষ্টিক জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে এই তাৎপর্যের বাস্তব ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ পদ্ধতির রূপায়ণ ঘটাবে। তবেই তাদের মুসলিম জাতীয়তা রক্ষা পাবে, নচেৎ নয়। বিশেষতঃ মুসলিম জাতির মধ্যে যারা শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবি তাদের জন্যই সবচেয়ে বেশী দরকার এই জ্ঞান বুদ্ধি ও চরিত্রের। কেননা তারাই জাতির নেতা। আপন জাতীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ছাপ শিক্ষিত সমাজের জীবনে পুরোপুরি থাকা প্রত্যেক জাতির জন্যই প্রয়োজন। কিন্তু মুসলিম জাতির জন্য এর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী। কেননা ভৌগলিক, বংশগত কিংবা ভাষাগত ভিত্তিতে এ জাতির সদস্য হওয়ার উপায় নেই। মুসলিম জাতির সদস্য হতে হলে চাই কেবল পরিপূর্ণ ও পরিপক্ক ইসলাম তথা ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস, ইসলামী আমল ও ইসলামী চরিত্র। আমাদের জাতির সদস্যগণ বিশেষত শিক্ষিত শ্রেণীর ইসলামী চিন্তা বিশ্বাস ও ইসলামী আমল আখলাকের অধিকারী ছাড়া সামগ্রিকভাবে আমাদের জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ও উন্নতি লাভ করা সম্ভব নয়। এ কারণে তাদের শিক্ষা ও অনুশীলনে যতটা ও যে ধরনের ত্রুটি ও দুর্বলতা থাকবে, আমাদের জাতীয় জীবনে তার তেমনি প্রভাব পড়া অনিবার্য। আর যদি তাদের মধ্যে ইসলামী ধ্যান জ্ঞান ও আমল আখলাক একেবারেই না থাকে তবে সেটা হবে আমাদের ধ্বংস ও মৃত্যুর পূর্বাভাস।

এটা এমন একটা বাস্তবতা যা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মুসলিম জাতির নতুন বংশধরদের শিক্ষা দীক্ষার যে ব্যবস্থা করা হয়, তা মূলত তাদেরকে জাতির নেতৃত্ব দেবার জন্য নয়, জাতিকে ধ্বংস করার জন্যই তৈরি করা হয়। এ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলিম ছাত্রদেরকে পড়ানো হয় দর্শন, অর্থনীতি, আইনশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস এবং এ ধরনের অন্যসব বিদ্যা যার চাহিদা বাজারে আছে। কিন্তু ইসলামী দর্শন, ইসলামী বিজ্ঞানের মৌলিকত্ব, ইসলামী আইন বিজ্ঞান, ইসলামের রাজনৈতিক মতবাদ এবং ইসলামের ইতিহাস ও ইতিহাস দর্শনের বিন্দু বিসর্গও তারা জানতে পারে না। এর ফল দাঁড়ায় এই যে, তাদের মন মগজে মানব জীবন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অ-ইসলামী ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায়। আর অ-ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনের প্রতিটি বিষয়কে দেখে ও ভাবে তথা দেখতে ও ভাবতে বাধ্য হয়। কেননা, ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি কখনও তাদের সামনে তুলে ধরাই হয়না। বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে ইসলামের কিছু কিছু তত্ত্ব ও তথ্য জানতে পারলেও বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় নিতান্তই ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ। এমন কি অনেক ক্ষেত্রে তা হয় কুসংস্কার এবং কাল্পনিক ও উদ্ভট ধ্যান ধারণার আধার। এসব তত্ত্ব ও তথ্য জানার ফলে তাদের মন মগজ ইসলাম থেকে আরো দূরে সরে যায়। যারা নিছক বাপ দাদার ধর্ম হবার কারণে ইসলামের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি রাখে, তারা মন মগজের দিক থেকে অমুসলিম হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও মনকে এই বলে সান্তনা দিতে থাকে যে, আমি বুঝতে না পারলেও ইসলাম নিশ্চয়ই একটা সত্য ধর্ম। আর যারা এই ভক্তি শ্রদ্ধাটুকুও হারিয়ে বসেছে, তারা ইসলামের ওপর নানা রকমের আপত্তি তুলতে এবং ক্ষেত্র বিশেষে তা নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপও করতে দ্বিধা করে না।

এ ধরনের শিক্ষার পাশাপাশি বাস্তব অনুশীলনের যে সুযোগ পাওয়া যায় তা একই রকম। যে পরিবেশে তারা থাকে এবং বাস্তব জীবনের যেসব নমুনার সাক্ষাত তারা লাভ করে, তাতে কোথাও কোন ইসলামী চরিত্র ও ইসলামী আচার আচরণের নাম নিশানাও পাওয়া যায় না। এভাবে যারা বিদ্যাগতভাবেও ইসলামের জ্ঞান পেলো না, বাস্তব অনুশীলনেও সাক্ষাত পরিচয় পেলো না, তারা তো আর ফেরেশতা নয় যে আপনা আপনি মুসলমান হয়ে গড়ে উঠবে। তাদের ওপর তো আর অহী নাযিল হয় না যে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের মনে ইসলামের জ্ঞান সৃষ্টি হবে। তারা পানি আর বাতাস থেকে তো ইসলামের জ্ঞান পেতে পারে না। কাজেই চিন্তা ও কর্মে তাদের মধ্যে যদি অ-ইসলামী ভাবধারা দেখা দেয় তবে সেটা তাদের দোষ নয়। বরং তা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাঙ্গনের দোষ। তাই আমি আবারো বলতে চাই নিজের দিব্য জ্ঞান থেকে আমি উপলব্ধি করি যে, এ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কার্যত আপনাদের জবাই করা হয় এবং সমগ্র মুসলিম জাতির কবর রচনা করা হয়। যে সমাজে আপনারা জন্মগ্রহণ করেছেন, যে সমাজ আপনাদের লেখাপড়ার খরচ যুগিয়েছে, যার ভাল মন্দের সাথে আপনার ভাল মন্দ এবং যার জীবনের সাথে আপনার জীবন এক সুতায় গাঁথা, সেই সমাজের জন্য আপনাদেরকে সম্পূর্ণ অকর্মণ্য করে দেয়া হয়েছে। এ সমাজের কল্যাণের জন্য কোন কাজ করার যোগ্য করে আপনাদেরকে তৈরী করা হয়নি। শুধু তাই নয়, বরং আপনাদেরকে সুপরিকল্পিতভাবে এমনভাবে তৈরী করা হয়েছে যে, আপনাদের ইচ্ছা না থাকলেও আপনাদের প্রতিটি কাজ মুসলিম জাতির জন্য বিপদজনক হবে। এমনকি আপনারা যদি এ জাতির কল্যাণের জন্যও কিছু করতে চান তাও হবে তার জন্য ক্ষতিকর। কেননা আপনাদেরকে মুসলিম উম্মাতের স্বভাব ধর্ম তথা ইসলাম ও তার প্রাথমিক মূলনীতিগুলো থেকে পর্যন্ত অজ্ঞ রাখা হয়েছে। আপনাদের সমগ্র বুদ্ধিভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন সম্পন্ন হয়েছে মুসলিম জাতির জাতীয় রূপরেখার সম্পূর্ণ বিপরীত বিন্দু থেকে।

নিজেদের এই অবস্থাটা যদি আপনারা বুঝতে পেরে থাকেন এবং কি বিপজ্জনক অবস্থায় পৌছিয়ে দিয়ে আপনাদেরকে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য ছেড়ে দেয়া হচ্ছে তা যদি উপলব্ধি করতে পেরে থাকেন, তাহলে আপনারা কিছু না কিছু ক্ষতিপূরণের চেষ্টা যে করবেনই, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। পুরোপুরি ক্ষতিপূরণ করা অত্যন্ত দুষ্কর। তবে আমি আপনাদেরকে তিনটে কাজ করার পরামর্শ দেবো। এ তিনটি কাজ করলে আপনাদের যথেষ্ট উপকার হবে।

প্রথমতঃ আপনারা যতটা সম্ভব আরবী ভাষা শিখতে চেষ্টা করুন। ইসলামের আসল উৎস কুরআনের ভাষা আরবী। কুরআনকে যতক্ষণ তার নিজের ভাষায় না পড়বেন, ততক্ষণ ইসলামের মূল চিন্তাধারা বুঝতে পারবেন না। আরবী ভাষার প্রাচীন জটিল পদ্ধতি এখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। নতুন পদ্ধতিতে মাত্র ছ’মাসেই কুরআন বুঝার মত আরবী শেখা সম্ভব।

দ্বিতীয়তঃ পবিত্র কুরআন, হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন কথা এবং সাহাবায়ে কিরামের জীবন চরিত্র অধ্যয়ন করা ইসলামকে বুঝবার জন্য অপরিহার্য। জীবনের বার চৌদ্দটি বছর যখন রকমারি বিষয় পড়ে নষ্ট করে দিয়েছেন, তখন যে জিনিসের উপর জাতির অস্তিত্ব নির্ভরশীল এবং যে জিনিস না জানলে আপনারা এ জাতির কোন কাজেই লাগতে পারবেন না, সে জিনিসের জন্য অন্তত অর্ধেক বা সিকিভাগ সময় ব্যয় করুন।

তৃতীয়তঃ অসম্পূর্ণ ও বিক্ষিপ্ত জ্ঞানের ভিত্তিতে ইসলাম সম্পর্কে ভালোমন্দ যে মতামতই পোষণ করে থাকুননা কেন, তা মন মগজ হতে ঝেড়ে ফেলুন। এরপর ইসলাম সম্পর্কে ধারাবাহিক ও নিয়মিতভাবে পড়াশুনা করুন। পড়াশুনার পর আপনি যে জ্ঞানই অর্জন করুন তার গুরুত্ব থাকবে। শিক্ষিত লোকদের পক্ষে কোন জিনিস সম্পর্কে ভালো করে না জেনেই একটা মত পোষণ করা কোনক্রমেই সঙ্গত নয়। আল্লাহ আপনাদেরকে সাহায্য করুন, এই দোয়া করেই আমার ভাষণ শেষ করছি।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

নয়া শিক্ষাব্যবস্থা
(১৯৪১ সালের ৫ জানুয়ারী দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামা লাখনৌর ছাত্র সমিতির অধিবেশনে এ ভাষণ দেয়া হয়)।

ভদ্র মহোদয়গণ!

আজ আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি যে এ যুগে যে জায়গায় সর্বপ্রথম ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার চিন্তা দানা বেঁধেছে, সেখানে বক্তব্য পেশ করার সুযোগ পেলাম। শুধু চিন্তা দানা বাঁধেনি, সর্বপ্রথম পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে এখানেই। এ জন্য আমি শিক্ষা সংস্কার ও সংশোধনের বিষয়টাকেই আমার আলোচ্য বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছি। এটাকে আলোচ্য বিষয় হিসেবে বেছে নেয়ার একটা বড় কারণ এই যে, আজকাল আমাদের ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংস্কারের পরিবর্তে কথাবার্তা খুব জোরেশোরেই চলছে। এ থেকে বুঝা যায়, সংস্কার প্রয়োজন যে আছে, তা বেশ অনুভব করা হচ্ছে। তবে কথাবার্তার হাবভাব থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, সংস্কার যারা চান তারা সমস্যাটা যে কি ধরনের সে সম্পর্কে তেমন পরিষ্কার ধারণা রাখেন না। তারা মনে করেন, পুরনো শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি শুধু এই যে, ওটা বড্ড সেকেলে এবং তাতে কোন কোন বিষয় অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় কম কিংবা বেশী। আধুনিক যুগের কোন কোন জরুরী বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও তারা এটাকে একটা ত্রুটি মনে করেন। এরূপ মনে করার কারণে তারা সংস্কার ও সংশোধনের আলোচনাকে খুবই সীমিত গন্ডিতে আবদ্ধ করেন। তাঁদের মতে কতকগুলো কিতাব পাঠ্যসূচী থেকে বাদ দিয়ে নতুন কতকগুলো কিতাব অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া উচিত। পাঠ্য বিষয়গুলোর মধ্যে কোনটার আনুপাতিক কমানো এবং কোনটার বাড়ানো উচিত। আর পুরনো বিষয়গুলোর সাথে সাথে ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে কিছু কিছু বই পুস্তক পড়ানো দরকার। শিক্ষাদানের পদ্ধতি এবং বিদ্যালয়সমূহের প্রশাসনিক ব্যাপারেও এই ধরনের কিছু আংশিক সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়ে থাকে। যারা একটু বেশী মাত্রায় আধুনিকমনা তাঁরা উপদেশ দেন যে, প্রত্যেক মৌলবীকে ম্যাট্রিক স্তরের ইংরেজী পড়িয়ে দাও যাতে কমপক্ষে টেলিগ্রাম পড়া ও লেখার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। কিন্তু এই যে আধুনিকতা আজ দেখানো হচ্ছে তাও বাসি হয়ে গিয়েছে। এ মনোভাব আপনাদের দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামারই সমসাময়িক। কিছু সংখ্যক মৌলবী আগের চেয়ে একটু বেশি যোগ্যতা হয়ে বেরুবে, এর চেয়ে বেশি কিছু উপকার এতে হবে না। তারা জার্মানী ও আমেরিকা সম্পর্কে কিছু কিছু কথা বলতে শিখবে। কিন্তু এই পরিবর্তনের ফলে বর্তমান দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব আলেম সমাজের হাতে এসে যাবে এরূপ কখনও হতে পারে না। যে পৃথিবী অগ্নিকুন্ডের দিকে পরিচালনাকারী নেতৃবৃন্দের পিছনে চলছে তারা যে জান্নাতের দিকে আহবানকারী নেতাদের নেতৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য হবে, তাও নয়। এরূপ ফল পেতে হলে পূর্ণাঙ্গ বিপ্লবী সংস্কারের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে এবং প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা বাতিল করে একটা নতুন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। আজকের আলোচনায় আমি সেই নয়া শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা আপনাদের সামনে পেশ করতে চাই।

জ্ঞান ও নেতৃত্বের পারস্পরিক সম্পর্ক

সর্বপ্রথম ভেবে দেখা দরকার যে দুনিয়ায় নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব কিসের উপর নির্ভরশীল? কখনো মিশর নেতৃত্বে আসীন হয় এবং সারা দুনিয়া তার পেছনে চলতে আরম্ভ করে। কখনো ব্যাবিলনের হাতে চলে যায় নেতৃত্বের চাবিকাঠি এবং সমগ্র দুনিয়া তার অনুসরণ করে। কখনো গ্রীস নেতৃত্ব লাভ করে আর সারা দুনিয়া করে তার পদানুসরণ। কখনো ইসলাম গ্রহণকারী জাতিগুলোর হাত যায় নেতৃত্বের বাগডোর এবং সারা পৃথিবী তার বশ্যতা স্বীকার করে। আবার কখনো ইউরোপ পায় কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের লাগাম আর সারা দুনিয়ার মানুষ করে তার আনুগত্য। এ সব কেন হয়? কি কারণে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব আজ একজন পায়, আবার কাল তার হাতছাড়া হয়ে অন্যের কাছে চলে যায়? এসব কি অনিয়মিত আকস্মিক ঘটনা মাত্র? না এর কোন সুনির্দিষ্ট নীতি আছে? এ বিষয় নিয়ে যত বেশি চিন্তা করা যায় ততই কেবল এ উত্তর পাওয়া যায় যে, এর একটা নির্দিষ্ট নিয়ম আছে এবং সে নিয়মটা হলো নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব সবসময় জ্ঞানের উৎসের উপর নির্ভরশীল। প্রাণী জগতে একমাত্র মানুষ জ্ঞানের কারণেই এ পৃথিবীর খলিফা হয়েছিল। তাকে চোখ, কান ও মন-মস্তিষ্ক দেয়া হয়েছে। অন্যান্য প্রাণীকে এগুলো হয় আদৌ দেয়া হয় নি, নয়তো অপেক্ষাকৃত কম দেয়া হয়েছে। এ জন্য অন্য সমস্ত সৃষ্টির ওপর মানুষকে আল্লাহর প্রতিনিধি করে দেয়া হয়েছে। এখন খোদ মানব জাতির মধ্যে যে শ্রেণী বা গোষ্ঠী জ্ঞান বা শিক্ষার গুণে অন্যদেরকে ছাড়িয়ে যাবে, তারাই সমগ্র মানব জাতির নেতা হতে পারবে। ঠিক যেমন সৃষ্টি জগতের মধ্যে মানুষ অন্য সব সৃষ্টির ওপর এই জ্ঞানের বদৌলতেই খলীফা হতে পেরেছিল।

নেতৃত্ব বন্টনের নিয়ম বা বিধি

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে, এই জ্ঞান বস্তুটা কি এবং এতে এগিয়ে বা পিছিয়ে থাকার অর্থ কি? এর জবাব হলো পবিত্র কুরআনে ‘সাম’আ শ্রবণ-শক্তি, ‘বাছার’ দৃষ্টিশক্তি ও ‘ফুয়াদ’ মন বা উপলব্ধি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং ঐ তিনটি শব্দেই এ প্রশ্নের জবাব রয়েছে। কুরআনে ঐ তিনটি শব্দ শুধু দেখা, শোনা ও চিন্তা করার অর্থে ব্যবহৃত হয় নি।

‘সাম’ আ’ বা শ্রবণ শক্তি বলে বুঝানো হয়েছে অন্যের দেয়া তথ্য সংগ্রহ করা, ‘বাছার’ বা দৃষ্টি আকর্ষণ অর্থ নিজে পর্যবেক্ষণ করে তথ্য উদ্ধার করা এবং ‘ফুয়াদ’ বা চিন্তাশক্তির অর্থ ঐ দুই মাধ্যম দ্বারা অর্জিত তথ্য সমূহের সমন্বয় সাধন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। এই তিনটি জিনিসের সমাবেশেই জ্ঞানের উৎপত্তি ঘটে যা কেবল মানুষকেই দেয়া হয়েছে। সামগ্রিকভাবে দেখতে গেলে প্রত্যেক মানুষই এ তিনটি শক্তি ব্যবহার করছে। এ কারণে পৃথিবীর যাবতীয় সৃষ্টির ওপর প্রত্যেক মানুষেরই প্রতিনিধিত্বমূলক আধিপত্য বজায় রয়েছে। একটু বিস্তারিতভাবে খতিয়ে দেখলে জানা যাবে যে, ব্যক্তিগতভাবে যেসব মানুষ এই তিনটি শক্তিকে অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহার করে, তারা পরাজিত ও পর্যুদস্ত থাকে। তারা অন্যের অধীন ও অনুগ্রহে থাকতে বাধ্য হয়। অন্যের পেছন পেছন চলাই তাদের কাজ। পক্ষান্তরে যারা এই তিনটি শক্তিকে সর্বাধিক ব্যবহার করে, তারা হয় শ্রেষ্ঠ ও পরাক্রান্ত। নেতৃত্বের বাগাডোর তাদের হাতেই এসে যায়। তবে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ করা ও হারানোর প্রাকৃতিক বিধান জানবার জন্য বিষয়টার প্রতি আরো সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিতে হবে। তা হলে দেখা যাবে, একটা গোষ্ঠী মানব জাতির নেতা হয় তখনই, যখন তারা একদিকে অতীত ও বর্তমানকালের মানুষের কাছ হতে যত বেশী তথ্য জোগাড় করে অপরদিকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আরো বেশি তথ্য সংগ্রহে নিয়োজিত থাকে, অতঃপর এই দুই রকম তথ্য সংগ্রহ করার পর তা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। তাদের পর্যবেক্ষণের নিরিখে আগের যেসব জিনিস ভুল বলে প্রমাণিত হয় তারা তার সংশোধন করে। যেগুলোর অসম্পূর্ণতা নিজের বুদ্ধি বিবেচনার আলোকে ধরা পড়ে, তাকে পূর্ণতা দান করে। আর যেসব নতুন তথ্য জানতে পারে, তা যথাসম্ভব বেশি করে কাজে লাগায়এ। এইএএই গুণাবলী যতক্ষণ ঐ গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যান্য মানবগোষ্ঠীর চেয়ে বেশি থাকে, ততক্ষণ সেই গোষ্ঠী সমগ্র মানবজাতির নেতৃত্ব দিতে থাকে। আর যে গোষ্ঠীর মধ্যে এসব গুণের সমাবেশ অপেক্ষাকৃত কম হয় তাদের জন্য আল্লাহর অকাট্য ফায়সালা হলো; তারা অন্যদের আনুগত্য করবে, অনুকরণও করবে। যদি সৌভাগ্যবশত অধীনতা থেকে বেঁচে যায়, তাহলেও অনুকরণ হতে তাদের রেহাই নেই। চাই সেটা জেনে বুঝে স্বেচ্ছায় করুক কিংবা না জেনে না বুঝে বাধ্য হয়ে করুক।

নেতৃত্বের পদে আসীন গোষ্ঠীটির উত্থানযুগ খতম হয়ে গিয়ে যখন পতনের যুগ ঘনিয়ে আসে তখন তারা ক্লান্ত হয়ে নিজেদের অতীতে অর্জিত জ্ঞানকে যথেষ্ট মনে করতে থাকে। নিজেদের পর্যবেক্ষণ দ্বারা আরো বেশি জ্ঞান অর্জন করা এবং মন মগজকে ব্যবহার করে আরো বেশি সিদ্ধান্ত গ্রহণের চেষ্টা ত্যাগ করে। তাদের সমস্ত জ্ঞানগত পুঁজি কেবল কান দিয়ে শোনা তথ্যাবলীর মধ্যেই সীমিত হয়ে যায়।

এ অবস্থায় জ্ঞান বলতে তারা শুধুমাত্র অতীতের জানা তথ্যভান্ডারকেই বোঝে। অতীতে অর্জিত জ্ঞানই যথেষ্ট, তাতে কোন কিছু যোগ করার দরকার নেই এবং অতীতে গৃহীত মতামত সমূহই সম্পূর্ণ, তাতে কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধনের প্রয়োজন নেই এই ভুল ধারণায় তারা ডুবে থাকে। এ পর্যায়ে উপনীত হয়েই এই গোষ্ঠী আপনা আপনি নেতৃত্বের আসন থেকে সরে যায়, আর সরতে না চাইলে জোর করে হটিয়ে দেয়া হয়। অতঃপর দ্বিতীয় যে গোষ্ঠীটি অধিকতর তথ্য সংগ্রহ, অধিকতর মতামত গ্রহণ এবং অধিকতর গঠনমূলক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসে, নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব তাদেরই অধিকারে আসে। তখন যারা আগে নেতা ছিল তারা নতুন নেতার অধিকারী হয়, আগে যারা স্বচ্ছ জ্ঞানের অধিকারী এবং দুনিয়ার উস্তাদ ছিল তাদেরকে প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘরে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং সেখানে বসে তারা প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা প্রদান করতে থাকে।

 

 

 

প্রচলিত ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটি

বস্তুত নেতৃত্ব দোযখগামী কিংবা বেহেশতগামী যা-ই হোকনা কেন; যারা চোখ, কান ও মন-মগজের সদ্ব্যবহার করে অন্য সমস্ত মানবগোষ্ঠীর চাইতে বেশী করবে একমাত্র তাদের অধিকারে তা আসবে, এটা মানুষের জন্য আল্লাহর নির্ধারিত অকাট্য ও শ্বাশ্বত নীতি। এ নীতিতে কোন পক্ষপাতিত্ব নেই। যে কোন মানব গোষ্ঠী এই শর্ত পূরণ করলে তারা দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ করবেই, চাই সে আল্লাহর ফরমাবরদার হোক বা না ফরমান হোক। আর এ শর্ত পূরণ না করলে তাকে হতে হবে অনুগামী। এমন কি অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরাধীন হওয়াও অবধারিত।

যে জিনিসটি আপনাদেরকে নেতৃত্বের আসন থেকে সরিয়ে দিয়েছে এবং খোদাদ্রোহী পাশ্চাত্যবাদীদের সে আসনে বসিয়েছে তা এই অসহনীয় বিধান ছাড়া আর কিছুই নয়। দীর্ঘদিন ব্যাপী আমাদের জ্ঞানের রাজ্যে বিরাজ করছিল শোচনীয় দুরবস্থা। আমাদের চোখ ও মন-মগজ ছিল সম্পূর্ণ নিষ্ক্র্রিয়। কান যেটুকু সক্রিয় ছিল তাও পুরনো জ্ঞান অর্জন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। অথচ এই সময়ে জ্ঞানের জগতে এগিয়ে গেল খোদাদ্রোহী ইউরোপবাসী। তারা কানকেও কাজে লাগালো আমাদের চেয়ে বেশি। আর চোখ ও মন মগজের কাজ আড়াইশো তিনশো বছর ধরে তারাই এককভাবে করলো। আর অনিবার্য ফল হিসেবে তারা দুনিয়ার নেতৃত্ব লাভ করলো। আর আমরা হয়ে গেলাম তাদের পদানুসারী। পরিণতি এরূপ হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। আমাদের ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্রগুলো আজও ঐ সর্বনাশা ভুলকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাচ্ছে। অথচ আজকে আমাদের এই দুর্দশা সেই ভুলেরই পরিণতি। এ সব মাদরাসায় ইলম বা বিদ্যা যেটুকু পড়ানো হয় তা শুধু প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। নাদওয়া এবং আল আজহার সংস্কারের দিকে পা বাড়ি্য়েছে সত্য কিন্তু সেটা অতীতের সাথে সাথে বর্তমান কালের জ্ঞান আহরণের কাজটাকেও কানের দায়িত্বের আওতাভুক্ত করা পর্যন্তই। চোখ আর মন মগজ আগের মতই নিষ্ক্রিয় রয়ে গিয়েছে। এই বাড়তি জ্ঞানটুকুর উপকারিতা বড়জোর এতটুকুই হতে পারে যে মুসলমানেরা আগে যেখানে খুব নিচু মানের অনুসারী ছিল সেখানে একটু উন্নতমানের অনুসারী হয়ে যাবে। কিন্তু নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব তাদের নাগালের বাইরেই থেকে যাবে। আজ পর্যন্ত যতগুলো সংস্কারমূলক পদক্ষেপ আমি দেখেছি তার সবই ভালো মানের অনুসারী তৈরি করার প্রস্তাব। নেতৃত্ব সৃষ্টির মত প্রস্তাব আজও আসে নি। অথচ দুনিয়ায় আল্লাহর অনুগত একমাত্র মানব গোষ্ঠী হিসেবে মুসলিম জাতির উপর যে দায়িত্ব বর্তায় তা পালন করতে হলে খোদাদ্রোহীদের কাছ থেকে দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসন ছিনিয়ে নেয়া ও তা দখল করা অপরিহার্য। আর সেটা করার একমাত্র উপায় হলো আমাদেরকে পুরনো জ্ঞান ভান্ডারের ওপর সন্তুষ্টি পরিত্যাগ করতে হবে। চোখ ও মন-মগজকে সক্রিয় করে তুলতে হবে এবং দুনিয়ার অন্য সব মানবগোষ্ঠীর ওপর এ ব্যাপারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে।

কি ধরনের সংস্কার প্রয়োজন?

আমি বলেছি যে, দুনিয়ায় আল্লাহর অনুগত একমাত্র মানব গোষ্ঠী হিসেবে আপনাদের (মুসলিম জাতির) উপর যে দায়িত্ব বর্তায় তা পালন করতে হলে খোদাদ্রোহীদের কাছ থেকে দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসন ছিনিয়ে নেয়া ও তা দখল করা অপরিহার্য। এ কথাটাই আমার সমগ্র আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয়। তাই আমি এ কথাটা আরো বিশ্লেষণ করবো।

নিছক একটা মানবগোষ্ঠী হিসেবে যেনতেন প্রকারের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব অর্জনই যদি কাম্য হয় তাহলে শিক্ষা সংস্কারের আদৌ কোন প্রয়োজন নেই। সোজা পথ খোলা রয়েছে। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় অথবা মিসর, ইরান ও তুরস্কের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কারিকুলাম অনুসারে শিক্ষার ময়দানে অগ্রগামী হোন এবং ইউরোপ ও আমেরিকা যে ধরনের নেতৃত্বের অধিকারী, যে ধরনের নেতৃত্বের জন্য জাপানও আজকাল প্রতিযোগিতায় নেমেছে, সেই ধরনের নেতৃত্বের জন্য প্রার্থী হয়ে যান। কিন্তু আল্লাহর অনুগত মানবগোষ্ঠী হওয়ার কারণে আপনাদের অবস্থা তা নয়। নেতৃত্ব জান্নাতের পথের দিশারী কিংবা দোযখের পথের দিশারী হোক নেতৃত্বই প্রকৃত লক্ষ্য এরূপ অবস্থায় আপনাদের নয়। ইউরোপের সাথে আপনাদের বিরোধ শুধু এজন্য নয় যে, তারা নেতৃত্বের পথ থেকে সরে থাকুক আর আমরা তাদের জায়গা দখল করে নেতা হয়ে বসি। বরং তাদের সাথে আমাদের বিরোধ হলো আদর্শ ও লক্ষ্যের। তারা দুনিয়ার ওপর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব চালাচ্ছে খোদাদ্রোহীতা ও নাফরমানীর ভিত্তিতে, আর দুনিয়াবাসীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে জাহান্নামের দিকে। পক্ষান্তরে মুসলিমরা হচ্ছে আল্লাহর ফরমাবরদার মানবগোষ্ঠী। আল্লাহর আনুগত্যই তাদের নীতির ভিত্তি। ঈমানের অনিবার্য দাবি হিসেবে তাদের উপর কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় যে, নিজেরাও যেমন জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা করবে এব বেহেশতের পথে চলবে তেমনি সমগ্র দুনিয়াবাসীকেও সেই পথে চালাবে। পাশ্চাত্যবাসীর হাত থেকে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের চাবিকাঠি ছিনিয়ে নিয়ে মুসলিম জাতির নেতৃত্ব নিজে দখল করা ছাড়া তার পক্ষে ঐ কর্তব্য পালন করা অসম্ভব। সে জন্যই পাশ্চাত্যবাসীর সাথে আামাদের বিরোধ। এ বিরোধ বর্ণ, বংশ অথবা ভৌগলিক কারণে নয়, সম্পূর্ণরূপে আদর্শিক কারণে। খোদাদ্রোহী নেতৃত্ব-চাই তা তুর্কী, ইরানী, মিশরী অথবা ভারতীয় যে জাতেরই হোক না কেন-বৃটিশ কিংবা জাপানী নেতৃত্বের মতই তাকে উৎখাত করা কর্তব্য। অনুরূপভাবে খোদামুখী নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা অবশ্য কর্তব্য-চাই তার নিশানবাহী কিংবা বৃটিশ অথবা অন্য কোন জনগোষ্ঠীর লোক হোক।

খোদাবিমুখ নেতৃত্বের পরিণামঃ

কোন নেতৃত্ব বেহেশতগামী না দোযখগামী তা নির্ভর করে ঐ নেতৃত্বের খোদামুখিতা অথবা খোদা বিমুখতার উপর। একটা খোদাবিমুখ মানবগোষ্ঠী যখন নিজেদের বুদ্ধি-বৃত্তিকে ও জ্ঞানগত তৎপরতা ও উৎকর্ষের বদৌলতে দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ করে, তখন সে বিশ্ব-জগতকে খোদাহীন ঠাওরে নিয়ে সেই দৃষ্টীভঙ্গিকেই কান ও চোখের দ্বারা অর্জিত সমস্ত তত্ত্ব ও তথ্যের সমাবেশ ও সমন্বয় ঘটায়। তারা মনে করে, মানুষের কোন দায় দায়িত্ব ও কর্তব্য নেই। দুনিয়ার যেসব জিনিস তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন, সে সবের সে নিজেই মালিক। সব কিছুর উপর তার সার্বভৌম ক্ষমতা। সেগুলোকে কিভাবে কাজে লাগাবে এবং কি উদ্দেশ্যে লাগাবে সেটা স্থির করার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা তার। তার সমস্ত চেষ্টা সাধনা ও তৎপরতার চূড়ান্ত লক্ষ্য তার প্রবৃত্তির খায়েশ চরিতার্থ করা ছাড়া আর কিছু নয়। জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানের সমন্বয় সাধন যখন এই দৃষ্টিভঙ্গিতে হয়, তখন তার ফল দাঁড়াবে এই যে, খোদাবিরোধী পথ ও প্রকৃয়ায় তত্ত্ব জ্ঞান ও পদ্ধতিগত কলা কৌশল উভয়েরই বিকাশ বৃদ্ধি ঘটে। সেই প্রক্রিয়া সারা দুনিয়ার মানুষের মন মগজকেও আচ্ছন্ন করে ফেলে। আর এ থেকেই জন্ম নেয় নিরেট জড়বাদী ও ভোগবাদী চরিত্র। এ থেকেই উদ্ভূত হয় মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের সমস্ত নীতি ও বিধি। মানুষ তার যাবতীয় শক্তি ও ক্ষমতা কোথায় কিভাবে প্রয়োগ করবে তাও নির্ণয় করে ঐ দৃষ্টিকোণ থেকেই। এক কথায়, সমগ্র মানব জীবনের প্রবাহ ঐ পথেই এগিয়ে চলে এবং তার শেষ স্তরে পৌঁছে এই দুনিয়া থেকেই জাহান্নামের আযাব শুরু হয়ে যায়। সে আযাবের নমুনা আপনারা আজ স্বচক্ষেই দেখতে পাচ্ছেন। * (ঐ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল-অনুবাদক)।

এই খোদাবিমুখ জ্ঞান বুদ্ধি ও কলা কৌশল যতদিন দুনিয়ার চিন্তাধারা, নৈতিকতা এবং সভ্যতা ও কৃষ্টির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে থাকে ততদিন খোদার অনুগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং সেই দৃষ্টীভঙ্গি প্রসূত নৈতিকতা ও সভ্যতার জন্য আকাশ ও পৃথিবীর কোথাও কোন স্থান থাকে না। মানুষের চিন্তা ভাবনা করার নিয়ম পদ্ধতি তার বিরোধী হয়ে যায়। মানুষের মেজাজ, স্বভাব প্রকৃতি ও রুচি তার বিরুদ্ধে চলে। মানুষের অর্জিত জ্ঞানের বিকৃতি বিন্যাস তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়। সমস্ত চারিত্রিক নীতিমালা এবং মূল্যমান নিরূপণের যাবতীয় মাপকাঠি তার পরিপন্থী হয়ে যায়। জীবন যাপনের রীতি নীতিতে এবং মানবিক চেষ্টা ও কর্মের সকল ময়দানে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যায। এমতাবস্থায় খোদানুগত্যের নীতির অন্তর্ভুক্ত প্রতিটা জিনিস অগ্রাহ্য ও অবাঞ্চিত সাব্যস্ত হয়। এমনকি যারা খোদানুগত্যের পথে চলার দাবী করে তারাও কার্য্ত সে পথে চলতে সক্ষম হয় না। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের স্রোত প্রবাহ তাদেরকে জবরদস্তি করে নিজ গতিপথে টেনে নিয়ে যায়। এর বিরুদ্ধে তারা যত ধস্তাধস্তিই করুক কার্য্কর কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয় না। তারা বড় জোর এতটুকু সংগ্রাম করতে পারে যে, মাথা নিচের দিকে তলিয়ে যেতে না দিয়ে কোন রকমে তা উপরমুখী রেখে ভেসে যেতে থাকবে।

চিন্তার জগতে যারা নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও আধিপত্য বিস্তার করে এবং জাগতির শক্তিগুলোকে বিজ্ঞানের শক্তি বলে করায়ত্ব করে কাজে লাগায়, তাদের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য শুধু চিন্তার জগতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, জীবনের গোটা পরিমন্ডলেই বিস্তৃত হয়। ভূ-খন্ডের উপর তার প্রগতি জন্মে। জীবন জীবিকার চাবিকাঠি তাদের অধিকারে আসে। সার্বভৌম শাসন ক্ষমতা তাদের হস্তগত হয়। এ জন্য সমাজ জীবনের সমস্ত কায়কারবার ও রীতিপ্রথা ঐ পরাক্রান্ত গোষ্ঠীটির দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব অনুসারে এবং তাদের মনোনীত নীল নকশা ও নিয়ম কানুন অনুযায়ী চলতে থাকে। এমতাবস্থায় দুনিয়ার যাবতীয় জীবন ও তার কায়কারবারে আধিপত্যশীল ঐ গোষ্ঠীটি যদি খোদার অবাধ্য হয় তাহলে তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তির অধীনে খোদার প্রতি আনুগত্যশীল কোন গোষ্ঠী সংগতি রক্ষা করে জীবন যাপন করতে পারে না। গাড়ীর ড্রাইভার যদি গাড়ী কলকাতার দিকে নিয়ে যেতে থাকে তবে যাত্রী সেই গাড়ীতে করে ঢাকায় যাবে কেমন করে? ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক তাকে গাড়ী যেখানে যাচ্ছে সেখানেই যেতে হবে। যাত্রী যদি খুব বেশী বিগড়ে যায় তাহলে বড়জোর নিজের মুখখানা ঢাকার দিকে ফিরিয়ে বসতে পারে। কিন্তু লাভ হবে না কিছুই । একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও গন্তব্য স্থানের বিপরীত ঠিকানাতে পৌঁছে যাওয়া ছাড়া তার উপায় নেই।

 

বর্তমান পরিস্থিতিঃ

প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে এই পরিস্থিতিই বিদ্যমান। মুসলিম জাতির নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব হারানোর পর ইউরোপ শিক্ষার ময়দানে অগ্রগামী হলো। অনিবার্য কিছু কারণে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী হয়ে উঠলো খোদাদ্রোহী (Theophobia)। এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই তারা সংগ্রহ করলো শ্রুতিলব্ধ জ্ঞান পুঁজি। ঐ দৃষ্টিভঙ্গীতেই প্রাকৃতিক জগতকে পর্যবেক্ষণ করে নবতর জ্ঞান অর্জন করলো। আর এই উভয় জগতের সমন্বয় ও বিন্যাস ঘটিয়ে তার নির্যাস গ্রহণ করলো একই দৃষ্টিভঙ্গীতে। মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নৈতিক নীতিমালা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের নিয়ম-বিধি ও রীতি-প্রথা এবং ব্যক্তি ও সমষ্টিগত জীবনের আচার আচরণের পদ্ধতিও ঐ দৃষ্টিভঙ্গীতেই রচনা করলো। স্বাধীন গবেষণা ও তত্ত্বানুসন্ধানের ফলে অর্জিত বৈজ্ঞানিক শক্তির প্রয়োগ ক্ষেত্রও নির্ণয় করলো তারা ঐ একই দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে। অবশেষে এই জ্ঞানের বলে বলীয়ান হয়ে যখন তারা আধিপত্য বিস্তারে অগ্রসর হলো তখন একদিকে দেশের পর দেশ এবং জাতির পর জাতি তাদের কাছে নতজানু হতে লাগল। অপরদিকে সেই জ্ঞান বিজ্ঞান, সেই মানসিকতা, সেই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, সেই চিন্তাধারা, সেই নৈতিক আচরণ পদ্ধতি, সেই সামাজিক ও তামাদ্দুনিক রীতি নীতি এক কথায় এই বিজয়ী জাতির কাছে যা কিছু ছিল সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লো। ক্রমে অবস্থা এতদূর গড়ালো যে, যে সময় একটি শিশুর বোধ-শক্তির উন্মেষ ঘটে ঠিক সে সময় থেকেই তার মন মগজ ও স্বভাব চরিত্রকে ইউরোপবাসীর মনোনীত ও পরিকল্পিত নীল নকশা অনুসারে গঠন করা শুরু হয়ে যায়। কেননা তারা বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত। পারিপার্শ্বিকতা হতে লব্ধজ্ঞান তাদেরই ধারাক্রম অনুসারে বিন্যস্ত হয় শিশুর মন মগজে। পর্যবেক্ষণের জন্য যে দৃষ্টিভঙ্গীর প্রয়োজন, তাও সে পায় সমন্বয়লব্ধ ঐ ইউরোপবাসীর কাছ থেকেই। আর মতামত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যে ট্রেনিং ও অনুশীলনের প্রয়োজন তাও তাদেরই পন্থায় অর্জিত হয়ে থাকে। হক ও বাতিল, শুদ্ধ ও অশুদ্ধ এবং গ্রহণীয় ও বর্জনীয় নিরূপনের জন্য সে তাদেরই মানদন্ডকে সহজলভ্য মনে করে। নৈতিক, আদর্শ জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং চেষ্টা সাধনা ও কাজ কর্মের যে পথ ও পন্থা তার সামনে উদ্ভাসিত হয় তাও তাদের কাছ থেকেই পাওয়া যায়। তবে আশেপাশের গোটা কারখানাকে সেই পরাক্রান্ত ইউরোপের রীতিনীতি অনুসারেই চলতে দেখে। আর এই মানসিকতা নিয়ে গড়ে ওঠার পর যখন সে কর্মজীবনে পদার্পন করতে যায়, তখন তাকে বাধ্য হয়ে ঐ কারখানারই যন্ত্রাংশ হয়ে যেতে হয়। কেননা দুনিয়ায় ঐ একটা কারখানাই চালু আছে এবং তাহলো ইউরোপীয় সভ্যতার কারখানা। এছাড়া আর কোন কারখানা চালু নেই। খোদাবিমুখ সভ্যতা ও সংস্কৃতির এই সর্বব্যাপী আধিপত্যের আওতায় খোদামুখী জীবন-দর্শন, চারিত্রিক আদর্শ ও জীবন লক্ষ্যের মন মগজে স্থান পাওয়াই কঠিন। কেননা যাবতীয় জ্ঞান বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার সমগ্র বিন্যাস প্রক্রিয়া ও বাস্তব জীবনের গোটা জীবনের গোটা গতিধারাই তার সম্পূর্ণ বিপরীত দিক থেকে ধাবমান। কিন্তু কিছু লোক যদি এমন অবস্থাতেও মন মগজে খোদায়ী বীজ ধারণ করে তথাপি আশে পাশের গোটা পরিবেশ তাদেরকে অঙ্কুরোদগমে সাহায্য করতে অস্বীকার করে। চলতি জ্ঞান বিজ্ঞান থেকে যেমন তারা সমর্থন পায় না, জীবন সংক্রান্ত তৈরী ও বাস্তব রূপ কাঠামোও যেমন তাদের সহযোগিতা করে না, তেমনি দুনিয়ার চলতি ঘটনাবলীতেও কোথাও তার স্থান হয় না। বিগত পাঁচশো বছরে মানব-জাতি যত জ্ঞান লাভ করেছে, তাকে বিন্যস্ত করা ও তার সময়লব্ধ জ্ঞান থেকে সিদ্ধান্ত ও মতামত গ্রহণের যাবতীয় কাজ খোদাবিমুখ লোকদের দ্বারাই হয়েছে। খোদার আনুগত্যের দৃষ্টিভঙ্গীতে তার বিন্যাস ও তা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজ আদৌ হয় নি। যে সব জাগতিক ও প্রাকৃতিক শক্তি এই সুদীর্ঘ সময়ে মানুষের আয়ত্বে এসেছে এবং জড় বিজ্ঞানের অধিকতর আবিষ্কার উদ্ভাবন দ্বারা যা কিছু সুফল অর্জিত হয়েছে তার দ্বারাও খোদার অনুগত লোকেরা কাজ নেয় নি। কাজ নিয়েছে কেবল খোদাদ্রোহীরা। এজন্য মানবীয় সমাজ ও সভ্যতায় এগুলোর প্রয়োগ ক্ষেত্র নির্বাচনের প্রশ্ন যখন উঠবে তখন ইউরোপীয়দের জীবন লক্ষ্য ও নৈতিক আদর্শের সাথে যা সামঞ্জস্যশীল, তাই নির্বাচিত হবে। এটাই স্বাভাবিক ও অনিবার্য। সমষ্টিগত জীবনের কার্য্কলাপ সংগঠনের জন্য পাঁচশো শতাব্দীতে যেসব আদর্শগত ফর্মূলা চিন্তা করা হয়েছে এবং যেসব বাস্তব কর্মপন্থা কার্যকরী করা হয়েছে, তাও কোন খোদানুগত মানুষের চিন্তা ও কর্মের ফসল নয়। ওগুলোর পরিকল্পনাকারী ছিল খোদাদ্রোহীদের মন মগজ এবং তা পরিচালিত হয়েছিল খোদাদ্রোহীদেরই হাতে। এ জন্য তাদের পরিকল্পনাই আজকের সকল মতবাদ ও বাস্তব অবস্থার ওপর ক্রিয়াশীল। খোদার ফরমাবরদারীর ভিত্তিতে প্রস্তুত কোন নকশা বা পরিকল্পনা কার্যকরী থাকাতো দূরের কথা, নিছক তাত্ত্বিক আদর্শ বা মতবাদের আকারেও এমন সুবিন্যস্তভাবে বর্তমান নেই যা এ যুগের অবস্থার সাথে সংগতিশীল এবং যা আজকের জীবন জিজ্ঞাসার পুরোপুরি জবাব দিতে সক্ষম।

এমতাবস্থায় খোদার আনুগত্যের বিশ্বাসী কোন ব্যক্তি যদি সংসার বৈরাগী হয়ে সমাজ সংস্কার হতে বিচ্চিন্ন হয়ে কোন নির্জন জায়গায় গিয়ে আস্তানা গাড়ে এবং পাঁচশো বছরের আগেকার অবস্থায় নিজেদেরকে নিক্ষেপ করে তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। তা না হলে আজকের দুনিয়ায় যে পরিস্থিতি, তাতে একজন মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে গেলেই তার সামনে পদে পদে কেবল সমস্যা আর সমস্যাই দেখা দেয়। অত্যন্ত আদর্শনিষ্ঠ ও খাঁটি বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও বারবার তাকে জেনেশুনে তার আদর্শের পরিপন্থী চিন্তা ও কর্মে লিপ্ত হতে হয়। নতুন জ্ঞান ও অভিনব তথ্যাবলীর সম্মুখীন হতেই সে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এসব তত্ত্ব ও তথ্যকে (Facts) এর মূল উদ্ভাবক, বিন্যস্তকারী ও সিদ্ধান্তকারীদের দৃষ্টিভঙ্গী ও সিদ্ধান্ত হতে আলাদা করা এবং স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে ভিন্নতর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা তার পক্ষে খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। এ অসুবিধার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে এইসব নতুন তথ্যের সাথে সাথে তার মূল মতবাদগুলো ও সিদ্ধান্তগুলোকেও হজম করে ফেলে। সে টেরই পায় না যে, অমৃতের সাথে সে কি পরিমাণ বিষ পান করে ফেললো। অনুরূপভাবে জীবনের বাস্তব কর্মক্ষেত্রে উপনীত হলে সে কোন্ পথ অবলম্বন করবে তা নিয়ে পড়ে যায় উভয় সংকটে। এমন বহু সামাজিক মতবদা তার মন মগজকে দখল করে বসে যা মূলত তার মনোপূত আদর্শের পরিপন্থী। মন-মগজকে দখল করে এজন্য যে, দুনিয়ার সর্বত্র ঐ মতবাদই প্রচলিত ও বিজয়ী। অনেক কার্যকর বিধি ব্যবস্থা এমন রয়েছে যাকে সে ভুল বুঝেও কেবল তার বিকল্প না পেয়ে গ্রহণ করে নিতে বাধ্য হয়। নেহায়েত নিরুপায় হয়েই অনেক ভ্রান্ত পথে পা বাড়াতে হয়।

বিপ্লবী নেতৃত্বের জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে বিপ্লব অনিবার্যঃ

আমি বর্তমান পরিস্থিতির যে বিশ্লেষণ করলাম তাতে যদি আপনারা কোন ভুলত্রুটি দেখতে পান তবে অনুগ্রহপূর্বক আমাকে জানাবেন যাতে আমি পুনর্বিবেচনা করতে পারি। কিন্তু যদি এ সিদ্ধান্ত সঠিক হয়ে থাকে তবে এ থেকে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।

১-খোদাবিমুখ নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের প্রভাবাধীন থেকে খোদামুখী ও খোদানুগত মত ও আদর্শ বেঁচে থাকতে পারে না। এই মত ও পথে যারা বিশ্বাসী তাদের আকীদা ও ঈমানের সরাসরি দাবীই হলো সেই নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বকে উৎখাত করে সেই জায়গায় পৃথিবীতে খোদানুগত নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাওয়া।

২-যে শিক্ষাব্যবস্থায় কেবল প্রাচীন ঐতিহ্যলব্ধ জ্ঞান বিজ্ঞান শেখানো হয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটানোর জন্য মানুষকে প্রস্তুত করার কোন শক্তি সেই শিক্ষার নেই। সুতরাং খোদাভীতি ও খোদার আনুগত্যের আদর্শ দুনিয়া হতে উৎখাত হতে হতে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক, এ যদি কারো কাম্য হয় তবে সে বর্তমান এই শিক্ষাব্যবস্থাকে খুশী মনে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারে। অন্যথায় এ শিক্ষা ব্যবস্থাকে বদলাতেই হবে।

৩-যে শিক্ষাব্যবস্থা সকল জ্ঞান বিজ্ঞানকে আল্লাহর অবাধ্য নেতৃত্বের রচিত ধারাক্রম অনুসারে সাজায় এবং সেই নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে গ্রহণ করে, এবং যে শিক্ষাব্যবস্থা গোমরাহী ও খোদাদ্রোহিতার পথ প্রদর্শকদের বানানো যন্ত্রের নাটবল্টু হিসেবে মানুষকে তৈরী করে, সে শিক্ষাব্যবস্থা আসলে ধর্মান্তরিত করারই পরীক্ষিত ব্যবস্থা। এ জাতীয় কোন শিক্ষাঙ্গনের ওপর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিয়া কলেজ অথবা ইসলামিয়া হাইস্কুল নামের সাইনবোর্ড টাঙ্গানোর মত ধোঁকাবাজি আর হতে পারে না। এ ধরনের শিক্ষার সাথে দ্বীনিয়াতের কিছু পাঠ্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া শতকরা ৯৫ ভাগ সম্পূর্ণ বৃথা। বাকী ৫ ভাগ স্বার্থকতা অর্জিত হলেও তা শুধুমাত্র এরূপ যে, কিছু লোক একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কুফরীর কাজে আল্লাহর নাম জপতে জপতে চলতে থাকবে।

৪-ইসলামী শিক্ষার সাথে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের লেজুড় জুড়ে দিয়ে সংস্কার সাধনের পরিকল্পনাও মানুষকে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটানোর যোগ্য করতে পারে না। কেননা আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও অন্যান্য যেসব শাস্ত্র ও বিদ্যা আজ রচিত ও সাজানো গোছানো অবস্থায় পাওয়া যায়, সেসবও খোদাদ্রোহী ও খোদাবিমুখ লোকদের গবেষণা ও তত্ত্বানুসন্ধানের ফসল। এসব বিষয়ের প্রণয়ন ধারা বিন্যাসে এর রচয়িতা ও প্রণেতাদের দৃষ্টিভঙ্গী এমন গভীরভাবে বদ্ধমূল যে, বস্তুনিষ্ঠ তথ্যসমূহকে দার্শনিক চিন্তাজাত মতবাদ ও আদর্শ হতে পৃথক করা যায় না। আর কল্পিত ধ্যান ধারণা বিশিষ্ট পক্ষপাতিত্ব, সংকীর্ণতা, প্রবৃত্তিপূজা ও ঝোঁক প্রবণতা থেকে ছাটাই বাছাইও করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় খোদানুগত দৃষ্টিভঙ্গীতে এগুলো স্বাধীনভাবে সাজানো ও বিন্যস্ত করা এবং তার ভিত্তিতে ভিন্ন মত ও পথ উদ্ভাবন করা। কি ছাত্র, কি শিক্ষক কারো পক্ষেই এটা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় যদি প্রাচীন শাস্ত্রগুলোকে তাদের প্রাচীন ধারাক্রমে এবং আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানকে প্রচলিত নির্দিষ্ট ধারাক্রমে একত্রে মিলিয়ে পড়ানো হয়, তাহলে এ দু’ পরস্পর বিরোধী শক্তির সংমিশ্রণে নানা ধরনের অদ্ভূত মিকচার তৈরী হবে। কেউ প্রাচীন শাস্ত্রসমূহের প্রভাবে অধিকতর প্রভাবিত হলে মৌলবী হয়ে যাবে। কেউবা আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে যাবে এবং এভাবে সে হবে ধর্মহীন ‘মিষ্টার’ অথবা নাস্তিক ‘কমরেড’। আবার কেউবা উভয়ের মধ্যবর্তী অবস্থান থেকে ভারসাম্যহীন হয়ে ‘না ঘরকা না ঘটকা’ হয়ে যাবে। এ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষালাভ করে উভয় শিক্ষার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে একটা বিশুদ্ধ মিকচার বানাতে পারবে এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। আর তা বানাতে পারলেও চিন্তা ও কর্মের জগতে বিপ্লব সৃষ্টি করা এবং তার গতিধারাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার মত শক্তি অর্জন করা খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার।

অবস্থার পর্যালোচনা করে আমি যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি-আমি পুনরায় বলছি, এর মধ্যে কোন ত্রুটি থাকলে আপনারা আমাকে অবহিত করুন। কিন্তু আমার সিদ্ধান্তকে যদি সঠিক বলে মনে করেন তাহলে আমি বলব নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের জগতে বিপ্লব সৃষ্টি করার একমাত্র পথ হলো, উল্লেখিত তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটা শিক্ষা ব্যবস্থা রচনা করা। সে শিক্ষাব্যবস্থা হবে প্রাথমিক স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত ঐ তিন রকম শিক্ষাব্যবস্থা হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি