রাসুলুল্লাহ সাঃ, কুরআন এবং সত্যের সাক্ষ্যদান
আরবী***

৫১। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরের উপরে থাকা অবস্থায় আমাকে বললেন- “আমাকে কুরআন পড়ে শুনাও”। আমি আরজ করলাম, আমি আপনাকে কুরআন পাঠ করে শুনাবো? অথচ তা আপনার উপরই নাযিল হচ্ছে, তিনি বললেন- “আমি অপরের মুখে কুরআন তেলাওয়াত শুনতে চাই”। অতএব আমি সূরা নিসা তেলাওয়াত করতে থাকলাম। যখন আমি এই আয়াতে পৌছলাম- “আমি যখন প্রত্যেক উম্মাতের মধ্য থেকে একজন করে সাক্ষী হাযির করবো এবং এই সমস্ত সম্পর্কে- তোমাকে ( হে মুহাম্মাদ ) সাক্ষী হিসেবে পেশ করবো তখন তারা কি করবে ” তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম বললেন- “আচ্ছা যথেষ্ট হয়েছে”। হঠাৎ আমার দৃষ্টি তাঁর চেহারায় পতিত হলে আমি দেখলাম- তাঁর দুচোখ দিয়ে আশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ————- ( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়্যুত প্রাপ্তির পরে এই দুনিয়ায় যতো লোক এসেছে তারা সবাই তাঁর উম্মত। যদি তারা তাঁর উপর ঈমান এনে থাকে তাহলে এক অর্থে তারা তাঁর উম্মত। আর যদি তারা ঈমান না এনে থাকে তাহলে তারা অন্য অর্থে তাঁর উম্মত। কেননা, প্রথমত- যেসব লোক তাঁর উপর ঈমান এনে থাকবে তারা তাঁর উম্মত। দ্বিতীয়ত- যেসব লোকের কাছে তাঁকে নবী হিসেবে পাঠানো হয়েছে তাঁরাও তাঁর উম্মত। রাসুলুল্লাহকে ( সাঃ ) যেহেতু সমস্ত মানব জাতির কাছে নবী হিসেবে পাঠানো হয়েছে, এজন্য তাঁর নবুয়্যত প্রাপ্তি থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত যতো লোকের আবির্ভাব হবে তারা সবাই তাঁর উম্মত।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের মুখে সূরা নিসার আয়াত শুনে আশ্রুসজল হয়ে পড়লেন কেন? এ ব্যাপারটি গভীরভাবে চিন্তা করুন।

আখেরাতে যখন আল্লাহর আদালতে সব জাতিকে উপস্থিত করা হবে এবং প্রত্যেক জাতির উপর নিজ নিজ নবীকে সাক্ষী হিসেবে দাড় করানো হবে- তিনি তখন সাক্ষী দেবেন, আমি আল্লাহ তায়ালার নির্দেশসমূহ তাঁদের কাছে যথাযথভাবে পৌছে দিয়েছি। তখনই তাঁদের বিরুদ্ধে হুজ্জাত ( পূর্ণাংগ প্রমান ) সম্পন্ন হবে। নবীর পক্ষ থেকে যদি এ ব্যাপারে কন ত্রুটি থেকে গিয়ে থাকে ( আল্লাহ না করুন ) তাহলে তিনি আল্লাহর বানী পূর্ণরূপে পৌছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করার সাক্ষী দিতে পারেন না। নবী যদি এই সাক্ষ্য না দিতে পারেন ( যদিও এরূপ হবে না ) তাহলে তাঁর উম্মাতগন দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবে এবং মোকদ্দমার সাক্ষ্যও খতম হয়ে যাবে।

নিজের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কঠোর অনুভূতি ছিল। নবী ( সাঃ ) যখন উল্লেখিত আয়াত শুনলেন তখন এই অনুভূতির ফলশ্রুতিতেই তাঁর দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। তিনি কতবড় দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন যে, আজ থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যতো মানুষের আবির্ভাব হবে- তাঁর মাধ্যমেই তাঁদের উপর আল্লাহর হুজ্জাত ( চূড়ান্ত প্রমান ) পূর্ণ হবে। এই অনুভুতিই তাঁকে অস্থির করে রেখেছিল। তিনি সব সময়ই ভাবতেন, এই হুজ্জাত পুরা করার ক্ষেত্রে আমার যদি সামান্য পরিমান ত্রুটিও থেকে যায় তাহলে এই উম্মতকে গ্রেফতার করার পরিবর্তে আমাকেই পাকড়াও করা হবে।

গভীরভাবে চিন্তা করুন, এর চেয়ে বড় যিম্মাদারী কি কোন মানুষের হতে পারে? আর এর চেয়েও কি কোন গুরুত্বপূর্ণ পদ হতে পারে যে, সেই যুগ থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত গোটা মানব জাতির সামনে আল্লাহ তায়ালার হুজ্জাত পুরা করার দায়িত্ব এককভাবে এক ব্যক্তির উপর পড়বে। কার্যত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই গুরুত্বপূর্ণ পদেই সমাসীন ছিলেন। এই কঠিন যিম্মাদারীর অনুভুতিই তাঁর কোমরকে নুজ করে দিত। এমনকি আল্লাহ তায়ালা তাঁকে শান্তনা দেয়ার জন্য এই আয়াত নাযিল করেন-

“আমি কি আপনার উপর থেকে সে বোঝা নামিয়ে রাখিনি যা আপনার কোমর ভেঙ্গে দিচ্ছিল?”

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিকে এই মহান এবং কঠিন দায়িত্বের অনুভূতি রাখতেন, অপরদিকে এটা সব সময় তাঁকে অস্থির করে রাখতো, আমি যাদের হেদায়াতের পথে ডাকছি তারা কেন তা থেকে দূরে স্বরে যাচ্ছে- এবং কেনই বা তারা নিজেদের জন্য একটি ভয়াবহ পরিনতি নির্দিষ্ট করে নিচ্ছে? যেমন কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে-

“আপনি মনে হয় এই চিন্তায়ই নিজের জীবনটাকে শেষ করে দেবেন যে, এরা কেন ঈমান আনছে না? ” ( সূরা আশ শুয়ারা, আয়াত- ৩ )

এ কারনেই তিনি যখন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদকে এই আয়াত ( সূরা নিসা ) পাঠ করতে শুনলেন তখন তাঁর দুচোখ থেকে আশ্রু গড়িয়ে পড়লো এবং তিনি বললেন, আচ্ছা হয়েছে, আর নয়, থেমে যাও। এখন আর সামনে অগ্রসর হতে হবে না।

কুরআনী ইলমের বরকতে উবাই ইবনে কা’বের মর্যাদা
আরবী***

৫২। হযরত আনাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উবাই ইবনে কা’বকে বললেন- আল্লাহ তায়ালা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আমি যেন তোমাকে কুরআন পাঠ করে শুনাই। উবাই ( রাঃ ) বলেন, আল্লাহ তায়ালা কি আমার নাম উল্লেখ করে আপনাকে একথা বলেছেন? তিনি বললেন- হ্যাঁ। উবাই ( রাঃ ) পুনরায় বললেন- সত্যিই কি মহাবিশ্বের প্রতিপালকের দরবারে আমার সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে? তিনি বললেন- হ্যাঁ। আনাস ( রাঃ ) বলেন- একথা শুনে উবাই ইবনে কা’বের দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। অপর এক বর্ণনায় আছে, আল্লাহ তায়ালা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আমি যেন তোমাকে “লাম ইয়াকুনিল্লাযিনা কাফারু” সূরা পাঠ করে শুনাই। উবাই ( রাঃ ) বললেন- আল্লাহ তায়ালা কি আমার নাম উল্লেখ করে আপনাকে একথা বলেছেন? তিনি বললেন- হ্যাঁ। এতে উবাই ইবনে কা’ব ( আবেগাপ্লুত হয়ে ) কেদে দিলেন। –( বুখারী ও মুসলিম )

হযরত উবাই ইবনে কা’বের এমন কি বিশেষত্ব ছিল যার ভিত্তিতে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এতো উচ্চ স্থান, এতো বড় সম্মান ও পদমর্যাদা দান করলেন? হাদীস সমূহের বর্ণনায় এসেছে- হযরত উবাই ইবনে কা’ব সাহাবাদের মধ্যে কুরআনের জ্ঞানে সর্বাধিক পারদর্শী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা যে অসংখ্য পন্থায় সাহাবাদের প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করেন তাঁর মধ্যে একটি ছিল, যে সাহাবীর মধ্যে কোন বিশেষ প্রতিভা এবং অসাধারন যোগ্যতার সমাবেশ ঘটতো- আল্লাহ তায়ালা তাঁর সাথে বিশেষ ব্যবহার করতেন। যাতে এই বিশেষ যোগ্যতা ও প্রতিভার বিকাশ এবং লালন ঘটতে পারে এবং তাঁর শৌর্য-বীর্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। এজন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হেদায়াত দান করা হয়েছে, আপনি উবাই ইবনে কা’বকে কুরআন পাঠ করে শুনান। হযরত উবাই ইবনে কা’ব এটা জানতে পেরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললেন, আল্লাহু আকবর, আমার এই মর্যাদা যে, আল্লাহ তায়ালার দরবারে আমার নাম নিয়ে আমার উল্লেখ করা হয়েছে।

আপনি এ থেকে অনুমান করতে পারেন, সাহাবাদের অন্তরে কুরআন মাজীদের প্রতি কি ধরনের মহব্বত ও আকর্ষণ ছিল। তাঁদের কতো সম্মান ও মর্যাদা ছিল যে, তারা আল্লাহ তায়ালার নজরে পড়েছেন এবং আল্লাহ তায়ালা তাঁদের সাথে বিশেষ আচরন করেছেন।
কুরআনকে শত্রুর এলাকায় নিয়ে যেও না
আরবী***

৫৩। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন সাথে নিয়ে শত্রু এলাকায় সফর করতে নিষেধ করেছেন। —– ( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

মুসলিমের অপর বর্ণনায় আছে, কুরআন শরীফ সাথে নিয়ে দুশমনদের এলাকায় যেও না কেননা শত্রুর হাতে পড়ে যাওয়া সম্পর্কে আনি নিরাপদ মনে করি না।

মোট কথা যে এলাকায় কুরআন নিয়ে গেলে তাঁর অসম্মান হওয়ার আশংকা আছে সেখানে যেনে শুনে কুরআন নিয়ে যাওয়া ঠিক নয়।

আসহাবে সুফফার ফযিলত
আরবী***

৫৪। হযরত আবু সাঈদ খুদরী ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একদিন দুর্বল ( গরীব ও নিঃস্ব ) মুহাজিরদের একটি দলের সামনে বসা ছিলাম। তারা নিজেদের লজ্জা নিবারনের জন্য পরস্পর লেগে বসেছিল। কেননা এসময় তাঁদের কাছে সম্পূর্ণ শরীর ঢাকার মতো কাপর ছিল না। এই মুহাজিরদের মধ্যেকার একজন কারী আমাদের কুরআন তেলাওয়াত করে শুনাচ্ছিলেন। এমন সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাশরীফ আনলেন এবং আমাদের দলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি যখন দাঁড়িয়ে গেলেন তখন কুরআন পাঠকারী চুপ হয় গেলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সালাম দিলেন। অতঃপর তিনি বললেন- তোমরা কি করছিলে? আমরা আরজ করলাম, আমরা আল্লাহর কিতাব শুনছিলাম। তিনি বললেন- মহান আল্লাহর জন্য যাবতীয় প্রশংসা যিনি আমার উম্মতের মধ্যে এমন লোকদের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন যাদের সম্পর্কে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমি যেন তাঁদের সঙ্গী হয়ে ধৈর্য ধারন করি। আবু সাঈদ ( রাঃ) বলেন, তিনি আমাদের মাঝে এমনভাবে বসে গেলেন যে, আমাদের এবং তাঁর মাঝে কোন পার্থক্য থাকলো না। ( মনে হচ্ছিলো তিনি আমাদের মধ্যেকারই একজন বিশেষ কেউ নন )। অতপর তিনি হাতের ইশারায় বললেন- এরূপ বস। অতঃপর তারা বৃত্তাকারে বসে গেলেন এবং তাঁদের সবার চেহারা তাঁর সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেলো। অতঃপর তিনি বললেন- নিঃস্ব মুহাজিরদের জামায়াত, তোমরা পূর্ণাংগ নূরের সুসংবাদ গ্রহন করো, যা তোমরা কিয়ামতের দিন লাভ করেবে। তোমরা ধনীদের চেয়ে অর্ধদিন আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আখেরাতের অর্ধদিন দুনিয়ার পাঁচশো বছরের সমান। ———-( আবু দাউদ )

দুর্বল মুহাজির বলতে বৃদ্ধ অথবা শারিরীক দিক থেকে দুর্বল এমন লোকদের বুঝানো হয় নি, বরং এর অর্থও হচ্ছে নিতান্ত গরীব এবং আর্থিক অনটনে জর্জরিত। অর্থাৎ যেসব মুহাজির কোন অর্থ-সম্পদ ছাড়াই শুধু এক কাপড়ে নিজেদের ঘরবাড়ি পরিত্যাগ করে চলে আসছিলেন। তাঁদের কাছে না ছিল পরনের কাপড়, না ছিল খাবার সামগ্রী, আর না ছিল মাথা গোঁজার ঠাই। কিন্তু আল্লাহর দীনের সাথে তাঁদের সংশ্রব এবং কুরআনের প্রতি তাঁদের আকর্ষণ এমনই ছিল যে, অবসর বসে থেকে অনর্থক কথাবার্তায় সময় কাটানোর পরিবর্তে তারা আল্লাহর কালাম শুনতেন এবং শুনাতেন।

এ স্থানে ভালো করে বুঝে নিতে হবে যে, কুরআন মাজীদে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একথা কেন বলা হয়েছিলো, তাঁদের সাথে ধৈর্য ধারন করো এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লালালহু আলাহি ওয়া সাল্লাম এজন্য আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন কেন? একথা কুরআন মাজীদের এমন স্থানে বলা হয়েছে, যেখানে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসুলকে পথ নির্দেশ দান করেছেন যে- মক্কার এই বড় বড় সর্দার এবং ধনিক শ্রেনীর লোকেরা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করার কোন পরোয়াই করবে না। এবং কখনো এ চিন্তায়ও লেগে যাবে না যে- তাঁদের কেউ যদি তোমার দলে ভিড়ে যেত তাহলে তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি ও ব্যক্তিত্বের উসিলায় এ দীনের প্রসার ঘটতো বরং তাঁর পরিবর্তে যেসব দরিদ্র লোক এবং কাংগাল কিন্তু ঈমান গ্রহন করে তোমার কাছে এসেছে- তুমি তাঁদের নিত্য সাথী হয়ে তাঁদের সাথে ধৈর্য ধারন করো, তাঁদের সুখ-দুঃখের ভাগী হয়ে যাও এবং তাঁদের সাহচর্যে আশ্বস্ত থাকো।

***সূরা কাহাফে মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন-

“হে নবী, তোমার দলকে এই লোকদের সংস্পর্শে স্থিতিশীল রাখো যারা নিজেদের প্রতিপালকের সন্তোষ লাভের সন্ধানী হয়ে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁকে ডাকে। আর তাঁদের দিক থেকে কখনো অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। তুমি কি দুনিয়ার চাকচিক্য ও জাকজমক পছন্দ করো? এমন কোন ব্যক্তির আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমি স্মরণশুন্য করে দিয়েছি এবং যে লোক নিজের নফসের খাহেশের অনুসরন করে চলার নীতি গ্রহন করেছে, আর যার কর্মনীতি সীমা লংঘনমুলক। পরিস্কার বলে দাও, এই মহাসত্য এসেছে তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে। এখন যার ইচ্ছা তা মান্য করবে আর যার ইচ্ছা তা অমান্য করবে, অস্বীকার করবে।”—( আয়াত নং ২৮, ২৯ )

কোন ব্যক্তি যখন আল্লাহর দীনের প্রচারের জন্য বের হয়ে যায় তখন তাঁর আকংখা থাকে, প্রভাবশালী লোকেরা তাঁর ডাকে সাড়া দিক। তাহলে তাঁর আগমনে কোথাও দীনের কাজের প্রসার ঘটবে। এই অবস্থায় যখন গরীব ও দুর্বল লোকেরা, যাদের সমাজে বিশেষ কোন পদমর্যাদা নেই, এসে তাঁর আহবানে নিজের উৎসাহ প্রকাশ করে এবং এ কাজের জন্য নিজেকে পেশ করে দেয়- তখন সে চিন্তা করে এই যেসব লোকের সমাজে কোন স্থান নেই তাঁদের নিয়ে আমি কি করবো? এরা যদি ভেড়ার পালের মতোও জমা হয়ে যায় তবুও এসব গুরুত্বহীন লোকের দ্বারা দীনের আর কি প্রসার ঘটবে? দীনের জন্য কাজ করতে উদ্যোগী লোকের এরূপ চিন্তা আল্লাহ তায়ালার পছন্দনীয় নয়। এজন্য তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হেদায়াত দান করলেন যে, তিনি যেন ঈমান গ্রহণকারী সাধারন মর্যাদা সম্পন্ন গরীব লোকদের কম গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্বহীন মনে না করেন, তিনি যেন তাঁদের সাথে ধৈর্য ধারন করে থাকেন, তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন। তিনি যেন তাঁদের উপেক্ষা করে বড় বড় শেখ ও প্রতিপত্তিশীল লোকদের দলে আনার চিন্তায় বিভোর না হয়ে যান।

মক্কার কাফেরদের নেতারাও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিদ্রুপ করে বলতো- কৈ তাঁর উপর তো মক্কার কোন গুরুত্বপূর্ণ লোক ঈমান আনছে না, জাতির বিচক্ষন ও প্রভাবশালী লোক- যাদের কাছে লোকেরা নিজেদের যাবতীয় ব্যাপারের ফায়সালার জন্যে আসে, তাঁদের কেউই তো তাঁর সাথে নেই। এই নীচু শ্রেনীর লোকেরাই তাঁর উপর ঈমান এনেছে এবং তিনি মনে করেছেন এদের নিয়েই তিনি দুনিয়াতে আল্লাহর দ্বীন ছড়িয়ে দেবেন। তাঁদের এই বিদ্রুপের জবাবে এই কথা বুঝানো হয়েছে, যে ব্যক্তি ঈমান এনেছে সেই মূলত মূল্যবান মানুষ। যে ব্যক্তি ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করেছে সে না জ্ঞানী হতে পারে আর না কোন নেতা বা শেখ হতে পারে। আজ যদিও কোন ব্যক্তি শেখ হয়ে আছে কিন্তু আগামীকাল তাঁর এই শেখগীরি খতম হয়ে যাবে এবং এই মর্যাদাহীন, দুঃস্থ গরীব লোকেরাই তাঁদের গদি উলটিয়ে দেবে। এ জন্য বলা হয়েছে, যেসব লোক তোমার দলে এসে গেছে তাঁদের সাথে ধৈর্য ধারন করো এবং তাঁদের দিক থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিও না।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এই দুর্দশাগ্রস্ত মুহাজিরদের দেখলেন যে, তারা কতটা আগ্রহ ও ভালবাসার সাথে কুরআন পড়া শুনছেন তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া তিনি এমন লোকদের আমার সঙ্গী করেছেন যাদের সাথে আমাকেও সবর করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ জন্য শুকরিয়া আদায় করলেন যে, তাঁর সাথে এমন লোকেরা এসে গেছে যাদের মধ্যে এই যোগ্যতা বর্তমান রয়েছে এবং তারা এতটা মজবুত ঈমানের অধিকারী যে আল্লাহর দীনের খাতিরে নিজেদের বাড়িঘর, সন্তান-সন্তুতি সব কিছু ছেড়ে চলে এসেছে।

অতপর নবী সাল্লালালহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মুহাজিরদের সুসংবাদ দিলেন যে, তারা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ নূরের অধিকারী হবে এবং তারা সম্পদশালী লোকদের চেয়ে পাঁচশো বছর আগে বেহেশতে প্রবেশ করবেন। অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের শান্তনার বানী শুনিয়ে দিলেন, আল্লাহর দীনের খাতিরে তোমরা যে দুঃখ কষ্ট ভোগ করছ, যে ভয়-ভীতির মধ্যে তোমাদের জীবন যাপন করতে হচ্ছে, যে জন্য তোমরা তোমাদের নিজেদের বাড়িঘর ত্যাগ করেছো এবং দুঃখ-দারিদ্রকে আরাম-আয়েশের উপর অগ্রাধিকার দিয়েছ- এর বিনিময়ে তোমাদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে যে, তোমরা কিয়ামতের দ্বীন পরিপূর্ণ নূরের অধিকারী হবে এবং ধনী লোকদের অর্ধদিন আগে বেহেশতে প্রবেশের সৌভাগ্য লাভ করবে। কিয়ামতের অর্ধদিন দুনিয়ার পাঁচশো বছরের সমান।

আখেরাতের অর্ধদিন এবং এটা দুনিয়ার পাঁচশো বছরের সমান হওয়ার তাৎপর্য কোন ব্যক্তিই নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না। ঐ জগতের সময়ের মানদণ্ড এই দুনিয়ার চেয়ে ভিন্নতর এবং প্রতিটি জগতেই সময়ের মানদণ্ড ভিন্নরূপ- একথা হৃদয়ঙ্গম করানোর জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সময়ের উল্লেখ করেছেন। এ জন্য এর খোঁজখবর ও অযথা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে লিপ্ত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। একথা সেখানে গিয়েই জানা যাবে সেখানকার সময় এবং কালের অর্থ কি এবং এর মানদণ্ডই বা কি?

সুমধুর স্বরে কুরআন পাঠ করো
৫৫। হযরত বারাআ ইবনে আযেব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমরা সর্বাধিক সুমধুর স্বরে কুরআন পাঠ করো। ( আহমাদ, আবু দাউদ, দারেমী )

অর্থাৎ যতদূর সম্ভব সুন্দর উচ্চারন ভঙ্গিতে এবং মার্জিত আওয়াজে কুরআন শরীফ পাঠ করো। এমন অমার্জিত পন্থায় পাঠ করোনা যার ফলে অন্তর কুরআনের দিকে ধাবিত হওয়ার পরিবর্তে আরো দূরে চলে যায়।

কুরআন পড়া শিখে তা ভুলে যাওয়া বড়ই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার
আরবী***

৫৬। হযরত সা’দ ইবনে উ’বাদা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ পড়ার পর তা ভুলে যায়- সে কিয়ামতের দিন কুষ্ঠ অবস্থায় আল্লাহর সামনে হাযির হবে। —-( আবু দাউদ, দারেমী )

হাদীস বিশারদগণ বর্ণনা করেছেন যে, এ হাদীসে কুষ্ঠ হওয়ার অর্থ শুধু দৈহিকভাবে কুষ্ঠ হওয়া নয়, বরং একথা প্রবাদ বাক্য হিসাবে বলা হয়েছে এবং এর অর্থ হচ্ছে সম্পূর্ণ অসহায়। যেমন আমরা বলে থাকি, মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। মূলত মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েনি। বরং মানুষের ঘাড়ে কঠিন বিপদ এসে চাপলেই এরূপ বলা হয়। অনুরূপভাবে আরবী ভাষায় কারো অসহায়ত্ব প্রকাশ করার জন্য বলা হয়ে থাকে- তাঁর হাত কাঁটা। ইতিপূর্বে একটি হাদীসে এসেছে, “আল কুরআনু হুজ্জাতুন লাকা আও আলাইকা”। অর্থাৎ কুরআন তোমার পক্ষে প্রমান হবে বা বিপক্ষে প্রমান হয়ে দাঁড়াবে। এখন এমন এক ব্যক্তির কথা চিন্তা করুন যার ঈমান আছে এবং সেই ঈমানের ভিত্তিতে সে কুরআন পাঠ করেছে কিন্তু তা পড়ার পর ফের ভুলে গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাঁর কাছে এমন কোন প্রমান অবশিষ্ট আছে যা সে আল্লাহর দরবারে পেশ করবে? কুরআন ভুলে যাওয়ার পর তো তাঁর প্রমান তাঁর হাত থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন তাঁর কাছে এমন কোন জিনিস নেই যা সে নিজের নির্দোষিতার স্বপক্ষে পেশ করবে। এ হচ্ছে সেই অসহায় অবস্থা- কিয়ামতের দিন সে যাতে লিপ্ত হবে। এটা এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন সে হাত কাটা অবস্থায় উঠবে।

তিনদিনের কম সময়ে কুরআন খতম করোনা
আরবী***

৫৭। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করেছে সে কুরআন বুঝেনি। —–( তিরমিযি, আবু দাউদ, দারেমী )

অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যদি তিন দিনের কম সময়ের মধ্যে গোটা কুরআন খতম করে ফেলে তাহলে প্রশ্ন জাগে যে, সে কুরআনের কি বুঝল? এ জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ হচ্ছে- কমপক্ষে তিন দিনে কুরআন খতম করো। এর চেয়ে অধিক সময় নিয়ে কুরআন খতম করতে পারলে তা আরো ভালো, কিন্তু এর কম সময় নয়। কেননা যদি কোন ব্যক্তি দৈনিক দশপারা কুরআন মধ্যম গতির চেয়েও দ্রুত পাঠ করে তাহলে সে এ অবস্থায় কুরআনের কিছুই বুঝতে পারবে না।

প্রকাশ্যে অথবা নিরবে কুরআন পড়ার দৃষ্টান্ত
আরবী***

৫৮। হযরত উকবা ইবনে আমের ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি প্রকাশ্য আওয়াজে কুরআন পাঠ করে সে ঐ ব্যক্তির মতো যে প্রকাশ্যে দান- খয়রাত করে। আর যে ব্যক্তি নিরবে কুরআন পাঠ করে সে গোপনে দান- খয়রাতকারীর সাথে তুল্য। –( তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসাঈ )

অর্থাৎ নিজ নিজ স্থানে উভয় পন্থায়ই কুরআন পাঠ করার সওয়াবও লাভ হয় এবং উপকারও হয়। কোন ব্যক্তি যদি প্রকাশ্যে দান খয়রাত করে তাহলে অন্যদের উপরও তাঁর প্রভাব পড়তে পারে এবং তাদেরও দানখয়রাত করার দিকে মনোনিবেশ বাড়তে পারে। তাঁদের অন্তরেও আল্লাহর রাস্তায় দানখয়রাত করার আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে। অপরদিকে কোন ব্যক্তি যদি গোপনে দানখয়রাত করে তাহলে তাঁর মধ্যে নিষ্ঠা এবং ঐকান্তিকতা সৃষ্টি হয় এবং সে রিয়াকারী বা প্রদর্শনেচ্ছা থেকে নিরাপদ থাকতে পারে। কুরআন পাঠ করার মধ্যে ফায়দা হচ্ছে এই যে, আল্লাহর বান্দাদের পর্যন্ত এর শিক্ষা পৌছে যায় এবং লোকদের মাঝে কুরআন পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে অস্পষ্ট আওয়াজে বা গোপনে কুরআন পড়ার ফায়দা হচ্ছে এই যে, এভাবে কোন ব্যক্তি ইখলাছ ও নিষ্ঠা সহকারে এবং প্রদর্শনেচ্ছা মুক্ত হয়ে আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্য কুরআন পাঠ করতে পারে এবং এর মধ্যে অন্য কোনরূপ আবেগের সংমিশ্রণ ঘটতে পারে না।

কুরআনের উপর কার ঈমান গ্রহণযোগ্য
৫৯। হযরত সুহাইব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে কুরআনের হারাম করা জিনিসকে হালাল করে নিয়েছে- সে কুরআনের উপর ঈমান আনেনি। ————- ( তিরমিযি )

কুরআন যে আল্লাহর কালাম- এর উপর ঈমান আনা এবং কুরআনে হারাম ঘোষিত জিনিসকে হালাল বানানো— এ দুইটি জিনিস একত্রে জমা হতে পারে না। কুরআন এমন একটি গ্রন্থ যা মানুষের কাছে কতিপয় গ্রহন করার এবং কতিপয় জিনিস পরিত্যাগ করার দাবী করে। যে ব্যক্তি কুরআনের হারামকৃত জিনিসকে হালাল করে নিয়েছে এবং সে কুরআনকে বাস্তবিকই আল্লাহর কিতাব বলে স্বীকার করে—তাঁর জীবন যাপন থেকে এর কোন প্রমান পাওয়া যায় না—তাঁর কুরআন মানার দাবী করার এবং তা পাঠ করার ফায়দা কি আছে?

নবী ( সাঃ ) এর কিরআত পাঠের ধরন
আরবী***

৬০। হযরত ইয়া’লা ইবনে মামলাক ( তাবেয়ী ) থেকে বর্ণিত। তিনি উম্মে সালামাকে জিজ্ঞেস করলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে কিরআত পাঠ করতেন? তখন উম্মে সালামা এমনভাবে কুরআন পাঠ করে শুনালেন যাতে প্রতিটি শব্দ আলাদাভাবে কানে আসলো। —— ( তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসাঈ )

অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুব দ্রুত গতিতে কুরআন পাঠ করতেন না, বরং তিনি এমনভাবে কুরআন পাঠ করতেন যে, লোকেরা প্রতিটি অক্ষর পরিস্কার শুনতে পেতো। সামনের হাদীসে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা আসবে।

আরবী****

৬১। হযরত উম্মে সালমা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম টুকরা টুকরা করে কুরআন পাঠ করতেন ( অর্থাৎ প্রতিটি বাক্য পৃথক পৃথক করে পড়তেন- অতঃপর থামতেন। ) —- ( তিরমিযি )

এখানে আরো পরিষ্কারভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্রুত গতিতে বা তাড়াহুড়া করে কুরআন পাঠ করতেন না। অর্থাৎ তিনি একই নিঃশ্বাসে “আলহামদু লিল্লাহ থেকে অলাদ দয়াল্লিন” পর্যন্ত পড়ে ফেলতেন না। বরং প্রতিটি বাক্যের শেষে বিরতি দিতেন।

কতিপয় লোক কুরআনকে দুনিয়া লাভের উপায় বানিয়ে নেবে
আরবী***

৬২। হযরত যাবের ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘর থেকে বের হয়ে আমাদের কাছে আসলেন। আমরা তখন বসে কুরআন পাঠ করছিলাম। আমাদের মাঝে আরবী ভাষী লোকও ছিল এবং অনারব লোকও ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের কুরআন পাঠ শুনে বললেন- পড়ে যাও, তোমাদের সকলের পাঠই সুন্দর। অচিরেই এমন একদল লোকের আবির্ভাব হবে যারা খুবই শুদ্ধভাবে এমন ভঙ্গিতে কুরআন পাঠ করবে যেভাবে তীর লক্ষ্য ভেদ করার জন্য সোজা করা হয় কিন্তু এর দ্বারা তাঁদের পার্থিব স্বার্থ লাভই হবে উদ্দেশ্য, আখেরাত লাভ তাঁদের উদ্দেশ্য নয়। ———- ( আবু দাউদ, বায়হাকী )

যাবের ( রাঃ ) এই যে বললেন, আমাদের মাঝে আরবী ভাষী লোকও ছিল এবং ভিন্ন ভাষাভাষী লোকও ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সবাইকে বললেন, পড়ে যাও, সবাই সঠিক পড়ছ—তিনি একথা বলে বুঝাতে চাচ্ছেন যে, যেহেতু এই জামায়াতে বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায় ও গোত্রের লোক ছিল এজন্য তাঁদের পাঠের ধরণও পৃথক পৃথক ছিল। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের সকলের পাঠের সৌন্দর্য বর্ণনা করলেন। বাহ্যত তাঁদের প্রত্যেক ব্যক্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন পন্থায় সঠিক উচ্চারনে এবং সঠিক ভঙ্গিতে কুরআন পাঠকারী ছিলেন না। আর প্রত্যেক ব্যক্তির কণ্ঠও সুমধুর ছিল না। তাছাড়া তাঁদের কারো কারো ভাষা ও উচ্চারন ভংগির মধ্যে ত্রুটিও থাকতে পারে। এজন্য তাঁদের কুরআন পাঠের পদ্ধতি ও ভংগির মধ্যে পার্থক্য বর্তমান থাকাও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের দেখে বললেন, তোমরা সকলেই সঠিকভাবে পাঠ করছ এবং তোমরা এই উদ্দেশ্যে কুরআন পাঠ করছ যে, তোমরা দুনিয়াতে তদানুযায়ী জীবন যাপন করবে। এজন্য তোমরা সঠিক অর্থে কুরআন পাঠ করার হক আদায় করছ, তোমাদের পাঠ সম্পূর্ণ ঠিক আছে। চাই তোমরা উন্নত পর্যায়ের তাজবীদ শাস্ত্র জানো বা নাই জানো এবং কিরআত পাঠের নীতিমালা সঠিক এবং উত্তম পন্থায় তা পাঠ করে থাক বা না থাকো। এমন একটি সময় আসবে যখন কুরআন ঠিকই পড়া হবে, তা সঠিক কায়দা-কানুন এবং তাজবীদে শাস্ত্রের উত্তম নীতিমালা অনুযায়ী সঠিকভাবে পড়া হবে—যেমন লক্ষ্যবস্তু ভেদ করার জন্য তীর সোজা করা হয়। কিন্তু তাঁদের এ পাঠের উদ্দেশ্য হবে সামান্য পার্থিব স্বার্থ লাভ করা, আখেরাত লাভ করা তাঁদের উদ্দেশ্য হবে না। অতএব তাঁদের এই পাঠ মোটেই কোন কাজে আসবে না। অবশ্য তোমাদের এই পাঠ একজন সাধারন গ্রাম্য লোকের পাঠের মতো যতই নিম্নমানের হোক না কেন—তাই কাজে আসবে। মূলত এই পাঠই আল্লাহ তায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য ও পছন্দনীয় হবে। সুতরাং তোমাদের সকলের কুরআন পড়াই সুন্দর।

গান ও বিলাপের সুরে কুরআন পাঠ করোনা
আরবী***

৬৩। হযরত হুজাইফা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমরা আরবদের স্বরে এবং সুরে কুরআন পাঠ করো। কিন্তু সাবধান, আহলে ইশক এবং দুই আহলে কিতাব ( ইহুদী-খ্রিস্টান ) সম্প্রদায়ের স্বরে এবং সুরে মতো নয়। অচিরেই আমার পরে এমন একদল লোকের আগমন ঘটবে যারা গানের সুরে বা বিলাপের সুরে কুরআন পাঠ করবে। কুরআন তাঁদের কণ্ঠনালীর নীচে পৌছবে না। তাঁদের অন্তর দুনিয়ার প্রতি মহগ্রস্ত হয়ে থাকবে এবং যারা তাঁদের পদ্ধতিকে অনুসরন করবে তাদের অন্তরও। — ( বায়হাকীর শুয়াবুল ঈমান )

আরবী স্বরে এবং আরবী সুরে কুরআন পাঠ করার তাকীদ করার অর্থ এই নয় যে, অনারব লোকেরাও আরবদের সুরে এবং স্বরে কুরআন পাঠ করবে। মূলত একথার দ্বারা যা বুঝানো উদ্দেশ্য তা হচ্ছে- কোন আরব যখন কুরআন পাঠ করে সে এমনভাবে পাঠ করে যেমন আমরা আমাদের ভাষায় কোন বই পড়ে থাকি। উদাহরণ স্বরূপ, আপনি যখন নিজের ভাষায় কোন বই পড়েন তখন আপনি তা ইনিয়ে বিনিয়ে এবং গানের সুরে পাঠ করেন না। বরং নিজের ভাষার বই পুস্তক যেভাবে পাঠ করার নিয়ম সেভাবেই পাঠ করেন। অনুরূপভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার অর্থ হচ্ছে- কুরআন এমন সহজ সরল ও স্বভাবগত পন্থায় পাঠ করবে যেভাবে একজন আরবী ভাষী ব্যক্তি তা পাঠ করে থাকে। ইতপুরবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই বানী উল্লেখিত হয়েছে- “কুরআনকে তোমাদের উত্তম স্বরে সৌন্দর্যমণ্ডিত করো”। অতএব বুঝা যাচ্ছে উত্তম সুরে পড়া এবং আরববাসীদের মতো সাদাসিধাভাবে কুরআন পাঠ করার অর্থ একই। কেননা সাদাসিদাভাবে কুরআন পড়ার অর্থ এই নয় যে, কোন ব্যক্তি বেমানানভাবে এবং ভয়ংকর শব্দে কুরআন পাঠ করবে।

অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- সাবধান, আহলে ইশকের স্বরে কুরআন পাঠ করো না। অর্থাৎ গায়করা যেভাবে মানুষকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে- অনুরূপভাবে কুরআন পাঠ করো না।

অতঃপর তিনি বলেছেন, অচিরেই এমন লোকের আগমন ঘটবে যারা কুরআনকে গানের সুরে পড়বে অথবা স্ত্রীলোকদের মতো বিলাপের সুরে পড়বে। কিন্তু এই পড়া তাঁদের কণ্ঠনালীর নিচে নামবে না। অর্থাৎ তাঁদের অন্তর পর্যন্ত কুরআনের আবেদন পৌছবেনা। শুধু তাই নয়, বরং তাঁদের অন্তঃকরণ দুনিয়াবী চিন্তায় লিপ্ত থাকবে। এবং তাঁদের অন্তঃকরনও যারা তাঁদের পাঠ শুনে দোল খেতে থাকে আর বলে সুবহানাল্লাহ।

নবী ( সাঃ ) এ ধরনের কুরআন পাঠকারী এবং তা শুনে মাথা দোলানো ব্যক্তিদের এ জন্য সতর্ক করেছেন যে, এই কুরআন কোন কবিতার বই নয় যে, বসে বসে তা শুনবে এবং প্রশংসার স্তবক বর্ষণ করবে আর মারহাবা মারহাবা প্রতিধ্বনি তুল্বে। বর্তমানে আমাদের এখানে কুরআন পাঠের মজলিশে যেমনটা হচ্ছে। কখনো কখনো তো এসব মাহফিলের অবস্থা এমন হয়ে দাড়ায় যেন কবিতার আসর বসছে আর কি? এই পন্থা ত্রুটি মুক্ত নয়।
সুমধুর সুরে কুরআন পাঠ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে
আরবী***

৬৪। হযরত বারাআ ইবনে আযেব (রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়আ সাল্লামকে বলতে শুনেছি- তোমরা নিজেদের উত্তম কণ্ঠস্বর দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্য মণ্ডিত করো। কেননা সুমধুর স্বর কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। ———— ( দারেমী )

এ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি হাদীস এসেছে। কোনটিতে যদি গানের সুরে কুরআন পড়তে বাঁধা দেয়া হয়েছে তাহলে অপরটিতে তা সুমধুর কণ্ঠে পাঠ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে জানআ গেলো, গানের সুরে পড়া এবং সুমিষ্ট আওয়াজে পড়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, একটি পসন্দনীয় আর অপরটি অপসন্দনীয়।

সুকণ্ঠে কুরআন পড়ার অর্থ কি
আরবী***

৬৫। হযরত তাউস ইয়েমেনী মুরসাল হিসেবে বর্ণনা করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল, কোন ব্যক্তি কুরআনকে উত্তম স্বরে উত্তম পন্থায় পাঠকারী? তিনি বললেন- যে ব্যক্তির কুরআন পাঠ শুনে তোমার এমন ধারনা হবে যে, আল্লাহকে ভয় করছে। ——— ( দারেমী )

দেখুন, এখানে সুকণ্ঠে কুরআন পাঠ করার অর্থকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে পরিস্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি যখন বললেন- কুরআনকে সুমধুর আওয়াজ দ্বারা সৌন্দর্য মণ্ডিত করো এবং তা সুমিষ্ট স্বরে পাঠ করো, কিন্তু গানের সুরে পড়না- তখন লোকেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, সুমিষ্ট স্বরে কুরআন পাঠ করার অর্থ কি? এরপর তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন- কুরআনকে এমন ভঙ্গীতে পাঠ করো যেন শ্রোতা স্বয়ং অনুভব করতে পারে যে, তুমি খদাকে ভয় করছ। খোদার ভয়শূন্য হয়ে মানুষ যখন কুরআন পাঠ করে তখন তাঁর অবস্থা ভিন্নরূপ হয়ে থাকে। আর যে ব্যক্তি কুরআনকে হৃদয়ঙ্গম করে এবং খোদার ভয় জাগ্রত রেখে পাঠ করে তাঁর অবস্থা হবে অন্যরকম। যে প্রতিটি জিনিসের প্রভাবকে গ্রহন করে কুরআন পাঠ করে। তাঁর পাঠের ধরন এবং মুখের ভংগি থেকেই তাঁর এই খোদাভীতির প্রকাশ ঘটে।

কুরআনকে পরকালীন মুক্তির উপায় বানাও
আরবী***

৬৬। হযরত আবীদাহ মুলাইকী ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ হে আহলে কুরআন, ( কুরআন পাঠকারীগণ) কুরআনকে কখনো বালিশ বানাবে না, বরং দিনরাত তা পাঠ করবে। যেভাবে পাঠ করলে এর হক আদায় হয়- সেভাবে পাঠ করবে। তা প্রকাশ্যভাবে এবং সুললিত কণ্ঠে পাঠ করবে। এর মধ্যে যেসব বিষয় আলোচিত হয়েছে তা নিয়ে গভীরভাবে চিনাত- ভাবনা করবে। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে। তাঁর সওয়াব দ্রুত লাভ করার চেষ্টা করোনা। কেননা এর সওয়াব ( আখেরাতে ) অবশ্যই পাওয়া যাবে। –( বায়হাকী )

বলা হয়েছে- ‘কুরআনকে বালিশে পরিনত করো না’। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, মানুষ যেভাবে বালিশের উপর মাথা রেখে শোয়ার জন্য লম্বা হয়ে পড়ে যায়—অনুরূপভাবে কুরআনকে বালিশের বিকল্প বানিয়ে তাঁর উপর মাথা রেখে শুয়ে যেও না। বরং এর অর্থ পরবর্তী বাক্য থেকে পরিস্কার হয়ে যায়। অর্থাৎ কুরআনের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়ো না। এরূপ অবস্থা যেন না হয় যে, নিজের কাছে কুরআন মওজুদ রয়েছে। কিন্তু নিজেই অলসতায় ডুবে রয়েছে এবং কখনো দৃষ্টি উত্তোলন করে এর প্রতি তাকায় না এবং এ থেকে পথ নির্দেশ ল্যাব করার চেষ্টাও করে না। অতঃপর বলা হয়েছে- ‘এই দুনিয়ায়ই কুরআনের সওয়াব দ্রুত লাভ করার চেষ্টা করোনা। যদিও এর সওয়াব নিশ্চিতই রয়েছে এবং অবশ্যই তা পাওয়া যাবে।’ অর্থাৎ এই দুনিয়ায় এর সওয়াব তুমি না-ও পেতে পারো বরং এর উল্টো কোথাও তুমি এর কারনে শত্রুর কঠোরতার শিকার হয়ে যেতে পারো। কিন্তু এর সওয়াব অবশ্যই রয়েছে—যা অবশ্যই আখেরাতে পাওয়া যাবে। পার্থিব জীবনেও কখনো না কখনো এর সওয়াব মিলে যেতে পারে। কিন্তু তোমরা তা পার্থিব সওয়াব লাভের জন্য পড়ো না বরং আখেরাতের সওয়াব লাভের জন্য পাঠ করো।

প্রাথমিক পর্যায়ে আঞ্চলিক উচ্চারনে কুরআন পাঠের অনুমতি ছিল
আরবী***

৬৭। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি হিশাম ইবনে হাকীম ইবনে হিযামকে ( রাঃ ) সূরা ফুরকান পাঠ করতে শুনলাম। কিন্তু আমার পাঠের সাথে তাঁর পাঠের গড়মিল লক্ষ্য করলাম। অথচ স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে এ সূরাটি শিখিয়েছেন। অতএব, আমি তাঁর উপরে ঝাপিয়ে পড়তে উদ্ধত হলাম। কিন্তু ( ধৈর্য ধারন করলাম এবং ) তাঁকে অবকাশ দিলাম। সে তাঁর কিরআত শেষ করলো। অতঃপর আমি তাঁর চাদর ধরে টানতে টানতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে গেলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমি তাঁকে সূরা ফুরকান পাঠ করতে শুনলাম। আপনি এ সূরাটি আমাকে যেভাবে শিখিয়েছেন সে তা অন্যভাবে পাঠ করেছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- তাঁকে ছেড়ে দাও। অতপর তিনি হিশামকে বললেন- পড়। সুতরাং আমি তাঁকে যেভাবে পাঠ করতে শুনেছিলাম ঠিক সেভাবেই সে তা পাঠ করলো। অতপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এরূপই নাযিল হয়েছে। অতপর তিনি আমাকে বললেন- কুরআন সাত হরফে নাযিল করা হয়েছে। অতএব যেভাবে পাঠ করা সহজ সেভাবেই তা পাঠ করো। —– (বুখারী ও মুসলিম )

‘সাত হরফে’ অর্থ- সাত ধরনের উচ্চারন ভঙ্গি অথবা সাত ধরনের ভাষাগত বৈশিষ্ট্য। আরবী ভাষায় আঞ্চলিক শব্দের পার্থক্য একটি প্রসিদ্ধ বিষয়। আরবের বিভিন্ন গোত্র ও এলাকার ভাষার মধ্যে বিশেষ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এই পার্থক্যের ধরন এমন নয় যে, তাতে ভাষার মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এই পার্থক্যের ধরন এমন নয় যে, তাতে ভাষার মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য সূচীত হয়। স্থানীয় বাক্যরীতি, উচ্চারন-ভঙ্গি, ভাষাগত বৈশিষ্ট্য এবং ভাষাগত অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য বিদ্যমান থাকা সত্যেও ভাষার মৌলিক ধাঁচ এক ও অভিন্ন। ভাষার স্থানীয় ঢং এবং পার্থক্যের দৃষ্টান্ত আপনারা এখানেও পেয়ে থাকবেন। সুতরাং আপনি যদি পাঞ্জাবের বিভিন্ন এলাকায় যান তাহলে দেখতে পাবেন এর প্রতিটি জেলা বরং একই জেলার বিভিন্ন অংশে ভাষার বিভিন্নতা রয়েছে। উর্দু ভাষারও একই অবস্থা। পেশোয়ার থেকে মাদ্রাজ পর্যন্ত চলে যান, মাদ্রাজ থেকে তাঁর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত চলে যান। উর্দুভাষীগণ একই বিষয় প্রকাশ করার জন্য বিভিন্ন বাক্যরীতি, উচ্চারন ভঙ্গি, প্রবাদ বাক্য ইত্যাদি ব্যবহার করে। দিল্লি, হাদ্রাবাদ, দাক্ষিণাত্য এবং পাঞ্জাবে একই উর্দু ভাষার বিশেষ পার্থক্য বিদ্যমান। বাংলা ভাষার অবস্থাও তদ্রূপ। একই বিষয়বস্তু প্রকাশ করার জন্য কলিকাতা, গোহাটি এবং ঢাকার বাক্যরীতি ও উচ্চারন ভঙ্গির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

আরবের আঞ্চলিক ভাষায়ও অনুরূপ পার্থক্য বিদ্যমান ছিল এবং বর্তমানেও আছে। আরবের উপদ্বীপে আপনি ইয়েমেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত অথবা ইয়েমেন থেকে ইরাক পর্যন্ত ভ্রমন করেন। তাঁদের উচ্চারন ভঙ্গি এবং বাক্যরীতির মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করে থাকবেন। এই বিষয়বস্তু আরবের এক এলাকার এক পদ্ধতিতে প্রকাশ করা হয়, আবার অন্য এলাকায় ভিন্নরূপে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এই পার্থক্যের কারনে অর্থের কোন পরিবর্তন ঘটে না। সুতরাং এই হাদীসে সাত হরফ বলতে এই উচ্চারন ভঙ্গি, বর্ণনা ভঙ্গি ইত্যাদির পার্থক্য বুঝানো হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কুরআন শরীফ যদিও বা কুরাইশদের মধ্যে প্রচলিত বাক্যরীতিতে নাযিল হয়েছে, কিন্তু আরববাসীদের স্থানীয় উচ্চারন ভঙ্গি এবং বাক্যরীতিতে তা পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। একজন আরবী ভাষী লোক যখন কুরআন পাঠ করে তখন ভাষার স্থানীয় পার্থক্য বর্তমান থাকা সত্যেও অর্থ ও বিষয়বস্তুর মধ্যে এমন কোন পরিবর্তন সূচীত হয় না। হারাম জিনিস হালাল হয়ে যাওয়া অথবা হালাল জিনিস হারাম হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তৌহিদের বিষয়বস্তু শেরেকী বিষয়বস্তুতে পরিনত হতে পারে না ।

কুরআন যতক্ষন আরবের বাইরে ছড়ায় নি এবং আরবরাই এর পাঠক ছিল এই অনুমতি কেবল সেই যুগ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে এই অনুমতি ও সুবিধা রহিত করে দেয়া হয়। বিভিন্ন উচ্চারন ভঙ্গিতে কুরআন পাঠ করার অনুমতি কেন দেয়া হল তাও বুঝে নেয়া দরকার। এর কারন ছিল এই যে, তৎকালীন সময়ে লিখিত আকারে কুরআনের প্রচার হচ্ছিলো না। আরবের লোকেরা লেখাপড়াই জানতো না। অবস্থা এরূপ ছিল যে, কুরআন নাযিল হওয়ার সময় হাতে গনা মাত্র কয়েকজন লেখাপড়া জানা লোক ছিল। আরবে লেখাপড়ার যা কিছু রেওয়াজ ছিল তা ইসলামের আগমনের পরেই হয়েছে। সুতরাং এযুগের লোকেরা মুখে মুখে কুরআন শুনে তা মুখস্ত করে নিতো। যেহেতু তাঁদের মাতৃভাষা ছিল আরবী, এজন্য কুরআন মুখস্ত করতে এবং মুখস্ত রাখতে তাঁদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। একজন আরব যখন কুরআন শুনত তখন পুরা বিসয়বস্তুই তাঁর মুখস্ত হয়ে যেত। এরপর সে যখন অন্যদের কাছে তা বর্ণনা করতো তখন ভাষার স্থানীয় পার্থক্যের কারনে তাঁর বর্ণনার মধ্যে অনুরূপ ধরনের উচ্চারনগত পরিবর্তন হয়ে যেত। এতে মূল বিষয়বস্তুর মধ্যে কোন পার্থক্য সূচীত হতো না। স্থানীয় বাক্যরীতি অনুযায়ী তারা যেভাবে পাঠ করতো বিষয়বস্তু সেভাবে বর্ণিত হতো। এর ভিত্তিতে সেই যুগে আরবদের জন্য নিজ নিজ এলাকার উচ্চারন ভঙ্গি এবং বাক্যরীতি অনুযায়ী কুরআন পাঠ করার সুযোগ রাখা হয়েছিলো।

হযরত উমর ( রাঃ ) যেহেতু মনে করেছিলেন, তিনি যেভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কুরআন শুনেছেন–ঠিক সেভাবেই প্রত্যেকের তা পাঠ করা উচিৎ। এজন্য তিনি যখন হিশাম ( রাঃ ) কে ভিন্ন পদ্ধতিতে কুরআন পাঠ করতে শুনলেন তখন আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না। তিনি যতো সময় ধরে পাঠ করতে থাকলেন, উমর ( রাঃ ) নিজ স্থানে ততক্ষন অস্থির অবস্থায় কাটাতে থাকেন। এদিকে তিনি কুরআন পাঠ শেষ করলেন, ওদিকে উমর তাঁর চাদর টেনে ধরলেন এবং তাঁকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এনে উপস্থিত করলেন। এখন দেখুন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেজাজে কি ধরনের ধৈর্য, বিনয়, সহনশীলতা ও গাম্ভীর্য ছিল। তিনি একান্তই প্রশান্ত মনে তাঁর কথা শুনলেন। তারপর অত্যন্ত বিচক্ষনতার সাথে বুঝালেন যে, তোমরা উভয়ে যেভাবে কুরআন পাঠ করো তা সঠিক এবং নির্ভুল। আল্লাহ তায়ালা দুই ভাবেই তা পাঠ করার অনুমতি দিয়েছেন।

দীনী ব্যাপারে মতবিরোধের সীমা এবং সৌজন্যবোধ
আরবী***

৬৮। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি এক ব্যক্তিকে কুরআন পাঠ করতে শুনলাম। এর পূর্বে আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভিন্নভাবে কুরআন পড়তে শুনেছি। আমি তাঁকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে আসলাম এবং তাঁকে জানালাম ( এই ব্যক্তি ভিন্ন পন্থায় কুরআন পাঠ করছে )। আমি অনুভব করলাম, কথাটা তাঁর মনপুত হল না। তিনি বললেন- তোমরা উভয়ে ঠিকভাবে পাঠ করেছো। পরস্পর মতবিরোধ করো না। কেননা তোমাদের পূর্বে যেসব জাতি ধংস হয়েছে। তারা এই মতবিরোধের কারনেই ধংস হয়েছে। —– ( সহীহ বুখারী )

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবনে মাসউদকে বুঝালেন যে, মতবিরোধ যদি এমন পর্যায়ের হয় যে, তাতে শিক্ষা বা হুকুম পরিবর্তিত হয় না—তাহলে এধরনের মতবিরোধ সহ্য করতে হবে। যদি তা না করে তাহলে আপশে মাথা ফাটাফাটিতে লিপ্ত হয়ে পড়বে। এভাবে উম্মতের মাঝে বিচ্ছিন্নতা এবং বিপর্যয়ের দরজা খুলে যাবে। কিন্তু যেখানে দীনের মূলনীতি অথবা দীনের কোন হুকুম পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে—সেখানে মতবিরোধ না করাই বরং অপরাধ। কেননা এরূপ ক্ষেত্রে মতবিরোধ না করার অর্থ হচ্ছে— দীনের মধ্যে তাহরিফকে ( বিকৃতি ) কবুল করে নেয়া। এটা আরেক ধরনের বিপর্যয় যার দরজা বন্ধ করে দেয়া স্বয়ং দীনের খাতিরেই প্রয়োজন।

অবিচল ঈমানের অধিকারী সাহাবী
নবীর প্রিয় পাত্র খোদার অনুগৃহীত

আরবী****

৬৯। হযরত উবাই ইবনে কা’ব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ( একদিন ) আমি মসজিদে নববীতে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে নামায পড়তে লাগলো। সে নামাযের মধ্যে এমনভাবে কিরআত পাঠ করলো যে, আমার কাছে আশ্চর্যজনক মনে হল। অতপর আরো এক ব্যক্তি আসলো। সে এমনভাবে কিরআত পাঠ করলো যে, প্রথম ব্যক্তির কিরআত থেকে তা ভিন্নতর ছিল। আমরা নামায শেষ করে সবাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গেলাম। আমি বললাম, এই ব্যক্তি এমনভাবে কিরআত পড়েছে যা আমার কাযহে সঠিক মনে হয়নি। আর এই দ্বিতীয় ব্যক্তিও ভিন্ন ধরনের কিরআত পাঠ করেছে ( এটা কেমন ব্যাপার )? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের উভয়কে ( নিজ নিজ পন্থায় ) কুরআন পাঠ করার নির্দেশ দিলেন। অতএব তারা কুরআন পাঠ করলো। তিনি উভয়ের পাঠকে সঠিক বললেন। এতে আমার অন্তরে মিথ্যার এমন কুমন্ত্রনার উদ্রেক হল যা জাহেলী যুগেও কখনো আমার মনে জাগেনি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন আমার এ অবস্থা লক্ষ্য করলেন, তিনি আমার বুকে সজোরে হাত মারলেন, ( মিয়া, চেতন হও, কি চিন্তা করছ? )। তিনি হাত মারতেই আমি যেন ঘামে ভেসে গেলাম, আমার বুক যেন চৌচির হয়ে গেলো এবং ভয়ের চোটে আমার মনে হল যেন আমি স্বয়ং আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছি। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন- হে উবাই, আমার কাছে যখন কুরআন পাঠানো হয় তখন আমাকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, আমি যেন তা এক হরফে ( একই উচ্চারন ভঙ্গিতে ) পাঠ করি ( এবং সেটি ছিল কুরাইশদের উচ্চারন ভংগি )। আমি প্রতি উত্তরে বললাম, আমার উম্মতের সাথে নমনীয় ব্যবহার করা হোক। অতপর আআমকে দ্বিতীয়বার বলা হল, দুই হরফে কুরআন পাঠ করতে পারো। আমি প্রতি উত্তরে আরজ করলাম, আমার উম্মতের সাথে নরম ব্যবহার করা হোক। তৃতীয় বারের জবাবে বলা হল, আচ্ছা কুরআনকে সাত রকমের ( আঞ্চলিক ) উচ্চারন ভঙ্গিতে পাঠ করতে পারো। আরো বলা হল, তুমি যতবার আবেদন করেছো ততবারই জবাব দেয়া হয়েছে। এছাড়াও তোমাকে তিনটি দোয়া করারও অধিকার দেয়া হল, তুমি তা এখন করতে পারো ( এবং তা কবুল করা হবে ) এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি আরজ করলাম, “হে আল্লাহ, আমার উম্মতকে মাফ করে দিন, হে আল্লাহ, আমার উম্মতকে মাফ করে দিন ”। আর তৃতীয় দোয়াটি আমি সেদিনের জন্য রেখে দিয়েছি যেদিন সমস্ত সৃষ্টিকুল আমার শাফায়াত লাভের আশায় চেয়ে থাকবে—এমনকি ইবরাহীমও ( আঃ )। ———- ( সহীহ মুসলিম )

হযরত উবাই ইবনে কা’ব ( রাঃ ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেহায়েত উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবী ছিলেন। তিনি প্রবীন এবং প্রাজ্ঞ সাহাবাদের মধ্যে গণ্য ছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবাদের প্রত্যেকের সম্পর্কে জানতেন যে, কার মধ্যে কি যোগ্যতা এবং কামালিয়াত রয়েছে। হযরত উবাই ইবনে কা’বের কামালিয়াত ছিল এই যে, তাঁকে কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী মনে করা হতো। এই উবাই ইবনে কা’বের সামনেই এমন ঘতাওনা ঘটলো যে, দুই ব্যক্তি ভিন্ন দুই পন্থায় কুরআন পাঠ করলো যা তাঁর জানামতে সঠিক ছিল না। তিনি তাঁদের উভয়কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাযির করলেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের উভয়ের পাঠকেই সঠিক বলে স্বীকৃতি দিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর অন্তরে এক কঠিন এবং মারাত্মক অসওয়াসার ( বিভ্রান্তি ) উদ্রেক হয়। তা এতই মারাত্মক ছিল যে, তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, জাহেলী যুগেও এতো জঘন্য বিভ্রান্তি আমার মনের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি যা এসময় আমার মধ্যে উদয় হয়েছিলো। তাঁর মনে যে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছিলো তা হচ্ছে- এই কুরআন কি খোদার তরফ থেক এসেছে না কোন মানুষের রচিত জিনিস—যা পাঠ করার ব্যাপারে এ ধরনের অবাধ স্বাধীনতা দেয়া হচ্ছে।

অনুমান করুন, এই হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী এ ধরনের একজন সুউচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবীর মনে এ ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এ থেকে জানা গেল যে, সাহাবায়ে কেরামগনও মূলত মানুষই ছিলেন, ফেরেশতা ছিলেন না এবং মানবীয় গুনাবলী থেকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র ও মুক্ত ছিলেন না। তাঁদের কামালিয়াত ছিল এই যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্যে থেকে কোন মানুষ যতটা উত্তম ফায়দা উঠাতে পারে তা তারা উঠিয়েছেন। তাঁর প্রশিক্ষনের আওতায় সাহাবাদের এমন একটি দল তৈরি হয়ছিল যে, মানব জাতির ইতিহাসে কখনো এ ধরনের মানুষ দেখা যায় নি। কিন্তু তা সত্যেও তারা তো মানুষই ছিলেন। এজন্য যখন এমন একটি ব্যাপার সামনে আসলো যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া আল্লাম ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় দুই ব্যক্তির কুরআন পাঠ শুনছেন আবার দুটোকেই সহীহ বলে স্বীকৃতি দিচ্ছেন, তখন হঠাৎ করে ঐ সাহাবীর মনে এমন খেয়াল আসলো যার উল্লেখ আলোচ্য হাদীসে রয়েছে।

এখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি দেখুন। মুখমন্দলের অবস্থা দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর মনে কি সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। সাথে সাথে তিনি তাঁকে সাবধান এবং সতর্ক করার জন্য তাঁর বুকে হাত মারলেন, মিয়া, সচেতন হও। কি চিন্তায় মগ্ন হয়েছ?

একথাও বুঝে নেয়া দরকার যে, মনের মধ্যে অসওয়াসা সৃষ্টি হলেই মানুষ কাফের হয়ে যায় না এবং গুনাহগারও হয় না। অসওয়াসা এমন এক মারাত্মক জিনিস যে, আল্লাহ তায়ালা যদি তা থেকে বাঁচিয়ে রাখেন তাহলে বাঁচার উপায় আছে, অন্নথায় কোন মানুষই তা থেকে বেঁচে থাকতে পারে না। হাদীস সমূহের বর্ণনায় এসেছে, সাহাবাগন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাযির হয়ে আরজ করতেন, হে আল্লাহর রাসুল, কখনো কখনো আমাদের মনের মধ্যে এমন সংশয় সৃষ্টি হয় যে, তাতে আমাদের মনে হয় আমাদের পরিনতি খারাপ হয়ে গেছে। আমাদের আখেরাত নষ্ট হয়ে গেছে। একথার পরিপ্রেক্ষিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আসল ব্যাপার তা নয় যে, তোমাদের মনে অসওয়াসা আসবে না। বরং আসল ব্যাপার হচ্ছে তা এসে তোমাদের মনে যেন স্থায়ী হতে না পারে। কোন খারাপ ধারনা মনের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে তা শেষে হয়ে গেলে আল্লাহ তায়ালার দরবারে এজন্য পাকড়াও করা হবে না। কিন্তু যদি নিকৃষ্ট খেয়াল আসার পর তোমরা এটাকে নিজেদের মনে স্থান দাও এবং এর পোষকতা করতে থাকো, তাহলে এটা এমন জিনিস যা মানুষকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে থাকে।

হযরত উবাই ইবনে কা’বের মনের মধ্যে একটি ঘৃণ্য এবং বিপর্যয়কর অসওয়াসা সৃষ্টি হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাথে সাথেই অনুভব করলেন যে, তাঁর মনে এই অসওয়াসা এসেছে। এজন্যে তিনি তাঁর বুকে চপেটাঘাত করলেন। তিনি চপেটাঘাত করতেই উবাই ( রাঃ ) সংবিত ফিরে পেলেন এবং সাথে সাথে তিনি অনুভব করতে পারলেন যে, আমার মনে কতো নিকৃষ্ট অসওয়াসা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি স্বয়ং বর্ণনা করেছেন, এটা অনুভব করতেই আমার মনের মধ্যে এমন কম্পন সৃষ্টি হল, মনে হল আল্লাহ তায়ালা আমার সামনে উপস্থিত এবং ভয়ের চোটে আমার ঘাম ছুটে গেলো।

তাঁর এই দ্রুত প্রতিক্রিয়া মূলত তাঁর অবিচল ঈমান এবং পূর্ণতার আলামত বহন করে। তাঁর ঈমান যদি এই পর্যায়ের শক্তিশালী না হতো তাহলে তাঁর মধ্যে এরূপ কঠিন অবস্থার সৃষ্টি হতো না।

কোন ব্যক্তির ঈমান যদি মজবুত হয় এবং তাঁর অন্তরে কোন খারাপ অসওয়াসা আসে তাহলে সে কেপে যাবে এবং সে দ্রুত নিজের ভ্রান্তি বুঝতে পারবে। কিন্তু কোন ব্যক্তির ঈমানে যদি বক্রতা থেকে থাকে তাহলে তাঁর অন্তরে খারাপ অসওয়াসা আসবে এবং তা তাঁর ঈমানকে কিছুটা ধাক্কা দিয়ে চলে যাবে। অতপর সে নিজের ঈমানের দুর্বলতার কারনে এ ব্যাপারে বেপরোয়া হয়ে যাবে। অতপর সেই কুমন্ত্রনা আবারো তাঁর মনে জাগ্রত হবে এবং তাঁর ঈমানকে আর একটা নাড়া দিয়ে চলে যাবে। এমনকি একসময় তাঁর পুরা ঈমানকেই নড়বড় করে দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু মজবুত এবং সবল ঈমানের অধিকারী ব্যক্তির অবস্থা এরূপ হয় না। সে কুমন্ত্রনা জাগ্রত হওয়ার সাথে সাথে সতর্ক হয়ে যায়। হযরত উবাই ইবনে কা’বের ( রাঃ ) প্রতিক্রিয়া সেকথারই সাক্ষ্য বহন করে। হযরত উবাই ইবনে কা’বের ( রাঃ ) সতর্ক হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বুঝানোর পর পরিস্কার করে বললেন, প্রথমে কুরআন মাজীদ যখন নাযিল হয় তখন তা কুরাইশদের মধ্যে প্রচলিত বাক্যরীতি ও উচ্চারন ভংগি অনুযায়ী নাযিল হয়। এটা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরও মাতৃভাষা ছিল। কিন্তু তিনি নিজে আল্লাহ তায়ালার দরবারে আবেদন করলেন যেন তা অনুরূপ উচ্চারন ভংগিতেও পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয়। আবেদনের ভাষা ছিল নিম্নরুপঃ “হাব্বেন আলা উম্মাতি—– আমার উম্মাতের সাথে নম্র ব্যবহার করুন।” তাঁর অনুভূতি ছিল, আমার মাতৃভাষা সাড়া আরবে প্রচলিত ভাষা নয়, বরং বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী গোত্র সমূহের মধ্যে কিছুটা স্থানীয় বাক্যরীতিরও উচ্চারন প্রচলিত রয়েছে। এজন্য সব লোকের জন্য যদি কেবল কুরাইশদের মধ্যে প্রচলিত ভাষার রীতি অনুযায়ী কুরআন পাঠ করা বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয় তাহলে তারা কঠিন পরিক্ষায় নিমজ্জিত হবে। তাই তিনি আল্লাহ তায়ালার দরবারে আরজ করলেন, আমার উম্মতের প্রতি নম্রতা প্রদর্শন করা হোক। সুতরাং প্রথম আবেদনের জবাবে দুই রকম বাক্যরীতি ও উচ্চারন ভঙ্গিতে কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেয়া হল।

নিজ বান্দার সাথে আল্লাহ তায়ালার ব্যবহারও আশ্চর্যজনক। প্রথম দফা দরখাস্তের জবাবে সাত রকম পন্থায় কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয় নি। অথচ সাত রকম পন্থায় পাঠ করতে দেয়ার ইচ্ছাই ছিল। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দফা আবেদন করার অপেক্ষা করলেন। এভাবে একদিকে মনে হয়, রাসুলুল্লাহকে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য ছিল যে, নবী হিসাবে তাঁর মধ্যে নিজের দায়িত্ব পালনের কতটা অনুভূতি রয়েছে। এজন্য প্রথমে একক ভংগিতেই কুরআন নাযিল করা হয়। কিন্তু যেহেতু তাঁর মনে এই অনুভূতি জাগ্রত ছিল যে, আরবের লোকদের হেদায়াত করাই আমার সর্ব প্রথম দায়িত্ব। আর আরবদের ভাষায় স্থানীয় পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। যদি কুরআন মাজীদের একটি মাত্র অঞ্চলের বাক্যরীতি অনুযায়ী পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয় তাহলে লোকেরা কঠিন বিপদে পড়ে যাবে। তাই তিনি আল্লাহ তায়ালার দরবারে আরজ করলেন, আমার উম্মতের সাথে নরম ব্যবহার করা হোক। জবাবে দুই আঞ্চলিক রীতিতে তা পাঠ করার অনুমতি দেয়া হল। তিনি পুনরায় আরজ করলেন, আমার উম্মতের সাথে আরো নম্র ব্যবহার করা হোক। এভাবে তাঁর দুই দফা আবেদন করার পর সাত রীতিতে কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেয়া হল। এরপর আল্লাহ তায়ালা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, যেহেতু তুমি আমার কাছে তিনবার দরখাস্ত করেছো এবং আমি তিনবারই জবাব দিয়েছি—এজন্য এখন তোমাকে আমার কাছে অতিরিক্ত তিনটি দোয়া করার অনুমতি সেয়া হল। পরম দয়ালু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দান করার এই ধরন আপনি লক্ষ্য করুন। এ জিনিসটিকেই তিনি কুরআন মাজীদে বলেছেন-

“রহমাতী অয়াসিয়াত কুল্লা শাইয়েন—— আমার অনুগ্রহ প্রতিটি সৃষ্টির উপর প্রসারিত হয়ে আছে।” ( সূরা আরাফ ; ১৫৬ )

এই হচ্ছে রহমতের ধরন যে, তুমি যেহেতু তোমার উম্মতের সাথে নম্র ব্যবহার করার জন্যে আমার কছে তিনবার আবেদন করেছে—তাই তোমার দায়িত্ব পালনের এ পদ্ধতি আমার পছন্দ হয়েছে। এজন্য তোমাকে এখন আরো তিনটি আবেদন করার অধিকার দেয়া হল। আমি তা অবশ্যই কবুল করবো।

এখন দেখুন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুইবার দোয়া করে তৃতীয় বারের দোয়াটি আখেরাতের জন্য হাতে রেখে দিয়েছেন। অন্য দুটি দোয়াও তিনি কোন পার্থিব স্বার্থ, ধন-দৌলত এবং ক্ষমতা ও কৃতিত্ব হাসিল করার জন্য করেন নি। বরং তিনি দোয়া করলেন, আমার উম্মতের সাথে ক্ষমা সুন্দর ব্যবহার করা হোক। তিনি বলেছেন- “ইগফিরলি উম্মাতি—— আমার উম্মাতকে ক্ষমা করুন।” আরবী ‘মাগফিরাত’ শব্দের আসল অর্থ হচ্ছে ক্ষমা করা, অপরাধ উপেক্ষা করা, অপরাধ দেখেও না দেখা ইত্যাদি। ‘মিগফার’ বলা হয় এমন শিরস্ত্রানকে যা মাথাকে ঢেকে রাখে, গোপন করে রাখে। সুতরাং ‘ইগফিরলি উম্মাতি’- বাক্যাংশের অর্থ হচ্ছে- আমার উম্মাতের সাথে ক্ষমা, নম্রতা ও উদারতা পূর্ণ ব্যবহার করা হোক।

এরকম ব্যবহার তো হচ্ছে এই যে, কোন ব্যক্তি অপরাধ করলো এবং দ্রুত তাঁকে শাস্তি দেয়া হল। আরেক রকম ব্যবহার হচ্ছে এই যে, আপনি অপরাধ করেছেন আর আপনার অপরাধকে উপেক্ষা করা হচ্ছে এবং আপনাকে সতর্ক হওয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। আপনি পুনরায় অপরাধ করছেন এবং আপনাকে সংযত হওয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এভাবে পুনঃ পুনঃ আপনার অপরাধ উপেক্ষা করে আপনাকে সংশোধনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। আপনি যেন শেষ পর্যন্ত সংশোধন হতে পারেন এবং নিজেকে সংযত করতে পারেন।

ঘটনা হচ্ছে, মুসলমান যে জাতির নাম—তাঁদের কাছে আল্লাহ তায়ালার সর্বশেষ কালাম কুরআন মাজীদ অবিকল মওজুদ রয়েছে। এর মধ্যে আজ পর্যন্ত কোন প্রকার রদবদল হতে পারেনি। আবার মুসলমানরাই সেই জাতি যাদের কাছে মহানবী ( সাঃ ) এর সীরাত, তাঁর বানী এবং তাঁর পথনির্দেশ অবিকল ও অপরিবর্তিত অবস্থায় সম্পূর্ণ সংরক্ষিত আছে। তাঁদের খুব জানা আছে হক কি এবং বাতিল কাকে বলে। তারা এও জানে যে, আমাদের কাছে আমাদের প্রতিপালকের দাবী কি। আমাদের প্রিয় নবী ( সাঃ ) কোন পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। এ ধরনের একটি জাতি যদি ব্যক্তিগতভাবে অথবা সামস্টিগতভাবে নাফরমানী বা অসাদাচরন করে বসে কিন্তু তা সত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালা তাঁদের ডলে- পিষে শেষ করে না দেন— তাহলে এটা তাঁর সীমাহীন রহমত, বিরাট ক্ষমা এবং অনুগ্রহ ছাড়া আর কি? এক ধরনের অপরাধ তো হচ্ছে- অপরাধী জানতেই পারেনা যে, সে অপরাধ করেছে এবং সে আবারো অপরাধ করে বসলো। এ অবস্থায় সে এক ধরনের নম্র ব্যবহার পাওয়ার উপযোগী। কিন্তু এক ব্যক্তির জানা আছে আইন কি? এই আইনের দৃষ্টিতে কোন জিনিসটি অপরাধ তা তাঁর জানা আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে আইন ভঙ্গ করে। এর অর্থ হচ্ছে- এই ব্যক্তি কঠোর শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত। বর্তমান কালের মুসলমানদের দৃষ্টান্ত হল এটাই। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখুন আজ তের- চৌদ্দশত বছরে আল্লাহ তায়ালার ব্যাপক শাস্তি আজ পর্যন্ত মুসলমানদের উপর নাযিল হয়নি। যদিও কোন কোন স্থানে পরীক্ষামুলক ভাবে বিপর্যয় এসেছে তবে অন্য স্থান সামলিয়ে নিয়েছে। এতো সেই দোয়ারই ফল যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালার দরবারে আবেদন করেছিলেন- আমার উম্মতকে ক্ষমা করুন, তাঁদের অপরাধ উপেক্ষা করুন, তাঁদের সাথে কঠোরতা না করুন। সুতরাং তাঁর সেই দোয়া বাস্তবিকই কবুল হয়েছে।

এখানে একথাও ভালো করে বুঝে নেয়া দরকার যে, ‘ইগফির লি উম্মাতি’ বাক্যের দ্বারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কখনো উদ্দেশ্য এই ছিল না যে, আমার উম্মত যে কোন ধরনের খারাপ কাজই করুক না কেন তা সবই ক্ষমা করে দেয়া হবে। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তির নিজের কাধে বকরী বহন করে নিয়ে আসবে তা ভ্যা ভ্যা করতে থাকবে। সে আমাকে দাকবে – ইয়া রাসুলুল্লাহ, ইয়া রাসুলুল্লাহ।। — আমি তাঁকে কি জবাব দেব? আমি বলব- এখন আমি তোমার কোন উপকারে আসবো না। কারন পূর্বেই আমি তোমার কাছে খোদার বিধান পৌছে দিয়েছি।” অর্থাৎ তোমরা যদি এমন অপরাধ করে আসো যার শাস্তি অবশ্যই পাওয়া উচিৎ— তাহলে তোমরা আমার শাফায়াত লাভের অধিকারী হতে পারবে না। কিয়ামতের দিনের শাফায়াতের অর্থ এই নয় যে, সে যেহেতু আমার লোক, সুতরাং দুনিয়াতে জুলুম- অত্যাচার করেই আসুক না কেন জনগনের অধিকার আত্মসাৎ করেই আসুক না কেন কিন্তু তাঁকে ক্ষমা করিয়ে দেয়া হবে। আর অন্যরা জুলুম করলে তাঁদের গ্রেফতার করা হবে। কিয়ামতের দিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফায়াতের অর্থ কখনো এটা নয়।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি