সূরা ইখলাছ কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান
৩১। হযরত আবু দারদা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমাদের কেউ কি প্রতি রাতে এক তৃতীয়াংশ কুরআন শরীফ পড়তে অক্ষম? সাহাবীগন বললেন- এক রাতে এক তৃতীয়াংশ কুরআন কিভাবে পড়তে পারে? তিনি বললেন – “কুল হু আল্লাহু আহাদ, আল্লাহুস সামাদ” ( সূরা ইখলাছ ) এক তৃতীয়াংশ কুরআনের সমান। ————-( মুসলিম, ইমাম বুখারী এ হাদীসখানা হযরত আবু সাঈদ খুদরীর সুত্রে বর্ণনা করেছেন )

পুরা কুরআন শরীফে নিম্নোক্ত বিষয়বস্তু আলোচিত হয়েছেঃ

(এক), আহকাম বা আইন-কানুন, (দুই) নবীদের ঘটনাবলী অর্থাৎ ইতিহাস, (তিন), আকায়েদ বা ইসলামী বিশ্বাসের শিক্ষা- প্রশিক্ষণ। যেহেতু আকায়েদের মূল হচ্ছে তৌহিদ এবং তৌহিদকে বাদ দিলে ইসলামী আকীদার কোন অর্থই বাকী থাকে না। এজন্য সূরা ইখলাছ তৌহিদের পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা হওয়ার কারনে এটাকে এক তৃতীয়াংশের সমান সাব্যস্ত করা হয়েছে।

চিন্তা করুন, রাসুলুল্লাহ সাল্লালালহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা পদ্ধতি এবং প্রশিক্ষনের ধরন কতটা অতুলনীয় ছিল। তিনি এমন সব কথা ও বাক্যের মাধ্যমে শিক্ষা দিতেন যার ফলে শিক্ষার্থীদের মনে তা দ্রুত অংকিত হয়ে যেত এবং তাঁর মানসটে গেঁথে যেত। কোন ব্যক্তির মনে একথা দৃঢ়মূল করার জন্য অর্থাৎ সূরা ইখলাছের কি গুরুত্ব রয়েছে তা বুঝানোর জন্যে কয়েক ঘণ্টার বক্তৃতার প্রয়োজন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাত্র সামান্য কয়েকটি কথার মাধ্যমে তা বুঝিয়ে দিলেন এবং বললেন, যদি তোমরা সূরা ইখলাছ একবার পাঠ করো তাহলে এটা যেন এক তৃতীয়াংশ কুরআন পাঠ করার সমতুল্য হয়ে গেলো।

এই একটি মাত্র বাক্যে এই সুরার যে গুরুত্ব মানুষের মনে দৃঢ়মূল হয়ে যায় তা কয়েক ঘণ্টার বক্তৃতায়ও সম্ভব নয়। এটা ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশেষ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা যার মাধ্যমে তিনি সাহাবাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।

সূরা ইখলাছ আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম
আরবী****

৩২। হযরত আয়েশা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে একটি ক্ষুদ্র বাহিনীর অধিনায়ক বানিয়ে পাঠালেন। সে নিজের সঙ্গীদের নামাজ পড়ানোর সময় সূরা ইখলাছের মাধ্যমে সর্বদা কিরাত শেষ করতো। তাঁর যখন অভিযান থেকে ফিরে আসলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে একথা ব্যক্ত করলে, ত্নি বললেন- তোমরা গিয়ে জিজ্ঞেস করো সে কেন এরকম করেছে? সুতরাং তারা তাঁকে একথা জিজ্ঞেস করলো। সে বলল, এই সুরার মধ্যে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে। এজন্যে আমি এই সূরাটি পড়তে ভালোবাসি। একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- তাঁকে গিয়ে সুসংবাদ দাও আল্লাহ তায়ালাও তাঁকে ভালোবাসেন। ———– ( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

যে সামরিক অভিযানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং অংশ গ্রহন করতেন না তাঁকে সারিয়াহ বলা হতো। আর যে সামরিক অভিযানে তিনি নিজে অংশ গ্রহন করতেন তাঁকে গাযওয়া বলা হয়।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবাদের যুগে এবং পরবর্তীকালেও একটা উল্লেখযোগ্য কাল পর্যন্ত এই নিয়ম চালু ছিল যে, যে ব্যক্তি জামায়াতের আমীর হতো সে-ই দলের নামাজের ইমামতি করতো। অর্থাৎ যদি কোন ব্যক্তি কোন সামরিক অভিযানের অধিনায়ক হতো তাহলে নামাজ পড়ানোর দায়িত্ব তাঁর উপরেই থাকতো। অনুরূপভাবে কেন্দ্রে খলীফা ( ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান ) নামাযে ইমামতি করতেন এবং লোকদের উদ্দেশ্যে খুতবা দিতেন। এখানে যে সামরিক অভিযানের কথা বর্ণনা করা হয়েছে তাঁর অধিনায়কের অভ্যাস ছিল তিনি নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করার পর একান্তভাবেই সূরা ইখলাছ পাঠ করতেন। একথা যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালালহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গোচরে আনা হল এবং তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী ঐ ব্যক্তির কাছে জিজ্ঞেস করার মাধ্যমে এর কারন জানা গেলো তখন তিনি তাঁকে সুসংবাদ দিলেন, তুমি যখন এই সূরা পাঠ করতে এতো পছন্দ করো যে, এতে উত্তম পন্থায় আল্লাহ তায়ালার পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে- তাই আল্লাহ তায়ালাও তোমাকে ভালোবাসেন। পূর্ববর্তী- হাদীসে বলা হয়েছে সূরা ইখলাছ এক তৃতীয়াংশ কুরআনের সমান। আর এখানে বলা হয়েছে- সূরা ইখলাছে সুন্দরভাবে তৌহিদের বর্ণনা থাকার কারনে যে ব্যক্তি এই সুরাকে পছন্দ করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে আল্লাহর প্রিয় হওয়ার সুসংবাদ দিয়েছেন।

দুনিয়ার কোন কিতাবেই এতো সংক্ষিপ্ত বাক্যে তৌহিদকে পূর্ণাংগভাবে বর্ণনা করা হয়নি, যার মাধ্যমে দুনিয়ায় বিরাজমান সমস্ত গোমরাহির মূল শিকড় একই সাথে কেটে ফেলা হয়েছে। এতো সংক্ষিপ্ত বাক্যে এত বড় বিষয়বস্তু এমন পূর্ণাঙ্গভাবে কোন আসমানি কিতাবেই বর্ণিত হয়নি। সমস্ত আসমানি কিতাব যা অল্প বিস্তার বর্তমানে দুনিয়াতে পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এই বিষয়বস্তু অনুপস্থিত। এই ভিত্তিতে যে ব্যক্তি এটাকে বুঝতে চেষ্টা করে, এর প্রানসত্তার সাথে পরিচয় লাভ করেছে সে এই সুরার সাথে গভীর ভালোবাসা রাখে। স্বয়ং এই সুরার নাম সূরা ইখলাছই- এই নিগূঢ় তত্ত্বের প্রতিনিধিত্ব করে যে, এটা সেই সূরা যা খালেছ তৌহিদের শিক্ষা দেয়। তা এমন তৌহিদের শিক্ষা দেয় যার সাথে শিরকের নাম গন্ধ পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে না। এ জন্যে যে ব্যক্তি উল্লেখিত কারনে এই সুরার সাথে মহব্বত রাখে সে আল্লাহ তায়ালারও প্রিয় বান্দাহ হিসাবে গণ্য হয়।

সূরা ইখলাছের প্রতি আকর্ষণ বেহেশতে প্রবেশের কারন
আরবী****

৩৩। হযরত আনাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল- ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি এই সূরা অখলাছকে ভালোবাসি। তিনি বললেন- তোমার এই ভালোবাসা তোমাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবে। ——–( তিরমিযি, বুখারী )

জানা গেলো যে, এই সুরার প্রতি ভালোবাসা একটি স্থিরিকৃত ব্যাপার। কোন ব্যক্তির জান্নাতে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত এই কথার দ্বারাই হয়ে গেছে যে, এই সূরাটি তাঁর প্রিয় ছিল। কিন্তু কোন ব্যক্তির অন্তর শিরকের যাবতীয় মলিনতা থেকে সম্পূর্ণ পাক হওয়া এবং খালেছ তৌহিদ তাঁর মন মগজে বদ্ধমূল হওয়া ছাড়া এই সুরার প্রেমিক হওয়া সম্ভব নয়। অন্তরে খালেছ তৌহিদ বদ্ধমূল হয়ে যাওয়াটাই বেহেশতের চাবি। যদি তৌহিদের ধারনায় ত্রুটি থেকে যায় তাহলে বেহেশতের কোন প্রশ্নই আসে না। মানুষের জীবনে যদি অন্যান্য ত্রুটি- বিচ্চুতি থেকে থাকে তা আল্লাহ তায়ালা মাফ করে দিবেন, কিন্তু তৌহিদের বিশ্বাসের মধ্যে গোলমাল থাকলে তা ক্ষমার অযোগ্য।

যদি কারো মনে নির্ভেজাল তৌহিদ বদ্ধমূল হয়ে যায় তাহলে তাঁর মধ্যে অন্যান্য ত্রুতি-বিচ্চুতি খুব কমই অবশিষ্ট থাকবে। কিন্তু যদিও বা থেকে যায় তাহলে সে তওবা করার সৌভাগ্য লাভ করবে। মনে করুন, যদি তওবা করার সুযোগও না পায় এবং সে তওবা করতে ভুলে গিয়ে থাকে তবুও আল্লাহ তায়ালার দরবারে তাঁর ক্ষমা হয়ে যাবে। কেননা খালেছ তৌহিদ হচ্ছে এমনই এক বাস্তব সত্য- আল্লাহর প্রতি মানুষের বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী হওয়া যার উপর নির্ভরশীল। যে ব্যক্তি খালেছ তৌহিদের অনুসারী- সে আল্লাহর বিশ্বাসভাজনদের অন্তর্ভুক্ত। আর অবিশ্বাসী ও বিশ্বাসঘাতকদের সাথে আল্লাহর আচরন যেমন হয়- তাঁর বিশ্বাসভাজনদের প্রতিও তাঁর আচরন তদ্রূপ নয়। এজন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ ব্যক্তিকে বলেছেন- এই সুরার প্রিয়পাত্র হওয়াটাই তোমার বেহেশতে প্রবেশের ফায়সালা করে দিয়েছে।

সূরা ফালাক ও সূরা নাস- দুটি অতুলনীয় সূরা
আরবী****

৩৪। হযরত উকবা ইবনে আমের ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন- তুমি কি দেখেছো আজ রাতে এমন কতগুলো আয়াত নাযিল হয়েছে যার নযীর কখনো দেখা যায়নি? তা হচ্ছে- “কুল আউউযুবি রাব্বিল ফালাক—এবং কুল আউসু বি রাব্বিন নাস” সূরাদ্বয়। —( সহীহ মুসলিম )

এখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা নাস ও ফালাক সম্পর্কে বলেছেন যে, এ দুটি অতুলনীয় সূরা, যার দৃষ্টান্ত আগে কখনো পাওয়া যায়নি। এর কারন হচ্ছে- পূর্বেকার আসমানি কিতাব গুলোতে এই বিসয়বস্তু সম্বলিত কোন সুরার উল্লেখ নেই। এ সূরাদ্বয়ও অত্যন্ত সংক্ষেপে কিন্তু পূর্ণাংগ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু বিবৃত হয়েছে। আর দ্বিতীয় যে কারনে এ সূরা দুটির বিষয়বস্তু ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করে নেয়া যায় তাহলো- এটা মানুষকে যে কোন ধরনের শংসয়- সন্দেহ, দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দান করে এবং যে কোন ব্যক্তি পূর্ণ নিশ্চিন্ততা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে হকের রাস্তায় চলতে পারে।

প্রথম সূরাটিতে বলা হয়েছে এই কথা বলে দাও যে, আমি সেই মহান রবের আশ্রয় প্রার্থনা করি যিনি ভোরের উন্মেষকারী, সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর অনিষ্ট থেকে হেফাজতকারী, অন্ধকার রাতে আবির্ভাব হওয়া যাবতীয় ভয়-ভীতি ও শংকা থেকে মুক্তি দানকারী এবং যেসব দুষ্ট লোক যাদুটোনা এবং অন্যান্য উপায়ে মানুষের ক্ষতি সাধনে তৎপর তাঁদের আক্রমন থেকে নিরাপত্তা দানকারী। দ্বিতীয় সূরায় বলা হয়েছে, তুমি বলে দাও – সেই মহান সত্তার আশ্রয় গ্রহন করছি যিনি মানুষের রব, মানুষের মালিক এবং মানুষের উপাস্য। যেস মানুষ এবং শয়তানেরা অন্তরের মধ্যে সন্দেহ-শংসয় সৃষ্টি করে- আমি এদের আক্রমন থেকে বাঁচার জন্যে তাঁর আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

কোন ব্যক্তি যদি ‘আইউযুবি রাব্বিল ফালাক’ এবং ‘আউউযুবি রাব্বিন নাস’ বাক্যগুলো নিজের জবানে উচ্চারন করে এবং সে যেসব বিপর্যয় ও অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছে- সেগুলোকে আবার ভয়ও করছে – তাহলে তাঁর মুখ থেকে এই শব্দগুলো বের হওয়া নিরর্থক। যদি সে একনিষ্ঠ এবং হৃদয়ঙ্গম করে একথাগুলো উচ্চারন করে তাহলে তাঁর দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে যাওয়া উচিৎ যে, কেউই তাঁর কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। তাঁর মধ্যে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে যাওয়া উচিৎ যে, এখন কেউই তাঁর কোন বিপর্যয় ঘটাতে পারবে না। কেননা সে মহান আল্লাহর আশ্রয় গ্রহন করেছে, যিনি এই মহা বিশ্বের মালিক এবং সমগ্র মানব কুলেরও একচ্ছত্র অধিপতি। যখন সে তাঁর আশ্রয় গ্রহন করলো এবং ঘোষণা করে দিলো, এখন আমি আর কারো অনিষ্টের আশংকা করি না- এরপর তাঁর আর ভীত- সন্ত্রস্ত্র হওয়ার আর কোন কারন থাকতে পারে না। মানুষ তো কেবল এমন সত্তারই আশ্রয় নিয়ে থাকে যার সম্পর্কে তাঁর আত্মবিশ্বাস রয়েছে যে, সে তাঁকে আশ্রয় দেয়ার শক্তি রাখে। যদি কেউ আশ্রয় দেয়ার শক্তিই না রাখে তাহলে তাঁর কাছে কেবল নির্বোধ ব্যক্তিই আশ্রয় চাইতে পারে। এক ব্যক্তি বিবিধ বিশ্বাসের ভিত্তিতে কারো আশ্রয় গ্রহন করে থাকে। এক, যে তাঁকে আশ্রয় দেয়ার মতো ক্ষমতা রাখে। দুই, যাদের ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার জন্য সে ভেগে এসে তাঁর আচলে আশ্রয় নিচ্ছে- এদের সবার শক্তি ও ক্ষমতা তাঁর কাছে মূল্যহীন। যতক্ষন তাঁর মধ্যে এ দুটি বিষয়ে প্রত্যয় সৃষ্টি না হবে, সে তাঁর আশ্রয় গ্রহন করতে পারে না। সে যদি এই প্রত্যয় সহকারে তাঁর আশ্রয় গ্রহন করে তাহলে তাঁর ভয়-ভীতি ও আশংকা বোধ করার কোন অর্থই হয় না।

যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার এরূপ শক্তি ও ক্ষমতার উপর বিশ্বাস রেখে তাঁর রাস্তায় কাজ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় তাহলে সে কাউকে ভয় করতে পারে না। দুনিয়ার এমন কোন শক্তি নেই- সে যার ভয় করতে পারে। সে সম্পূর্ণভাবে দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে আল্লাহর রাস্তায় কাজ করবে এবং গোটা দুনিয়ার বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবেলায় অবতীর্ণ হবে।

হযরত মুসা আলাইহিস সালাম নিজের ভাইয়ের সাথে ফিরাউনের বিরুদ্ধে লাঠি নিয়ে পৌছে গেলেন। এতোবড় বিরাট শক্তির বিরুদ্ধে মাত্র দুটি প্রান কিভাবে রুখে দাঁড়ালেন? শুধু এই জন্য যে, আল্লাহর আশ্রয়ের উপর তাঁদের আত্মবিশ্বাস ছিল। যখন আল্লাহর আশ্রয় গ্রহন করা হয় তখন পরাশক্তির বিরুদ্ধেও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ানো যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালার কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য সমগ্র দুনিয়ার বিরুদ্ধে কিভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন? কেবল আল্লাহর উপর ভরসা থাকার কারনেই তা সম্ভব হয়েছে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আমার পিছনে আল্লাহর শক্তি রয়েছে, যিনি সমগ্র বিশ্ব এবং সকল শক্তির মালিক। অনুরূপভাবে যেসব লোক আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার জন্য দাঁড়িয়ে গেছেন, আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য সমস্ত শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দৃঢ় সংকল্প রাখে- তাদেরও আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে এবং তাঁর আশ্রয়ের উপর অবিচল আস্থা- বিশ্বাস থাকতে হবে- চাই তাঁদের কাছে উপায়-উপকরন, সৈন্য সামন্ত এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্র থাক বা না থাক। মানুষ এরূপ দুঃসাহস তখনই করতে পারে যখন আল্লাহর আশ্রয় সম্পর্কে তাঁর পূর্ণ ঈমান থাকে। এ জন্যই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- এগুলো অতুলনীয় বাক্য যা এই দুটো সূরায় বর্ণিত হয়েছে। কেননা এতে যে কোনো ধরনের বিপর্যয় এবং বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে কেবল আল্লাহ তায়ালার পক্ষপুটে আশ্রয় নেয়ার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে একজন মুমিনের অন্তরে তাঁর দেয়া আশ্রয় সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়।

কুরআনের শব্দগুলোর মধ্যেও বরকত রয়েছে
আরবী****

৩৫। হযরত আয়েশা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে যখন বিছানায় শুতে যেতেব, নিজের উভয় হাতের তালু একত্রে মিলিয়ে তাতে সূরা “কুল হু আল্লাহু আহাদ—”, “কুল আউউযু বি রাব্বিল ফালাক” এবং “কুল আউউযু বি রাব্বিন নাস” পড়ে ফু দিতেন। অতপর তিনি নিজের হাতের তালুদ্বয় সমস্ত দেহে তা যতদুর পৌছতে সক্ষম ফিরাতেন। প্রথমে মাথায়, অতঃপর মুখমণ্ডলে, তারপর দেহের সামনের ভাগে। তিনি এভাবে তিনবার করতেন। -( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

কালামে ইলাহীর শব্দভাণ্ডারে, তাঁর উচ্চারনে এবং এর বিষয়বস্তু সব কিছুর মধ্যেই কল্যাণ, প্রাচুর্য ও বরকত লুকিয়ে আছে। এর সম্পূর্ণটাই বরকত আর বরকত, কল্যাণ আর প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে আল্লাহর কালাম বুঝতেন এবং তদানুযায়ী কাজ করতেন এবং এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুযায়ী সমগ্র পৃথিবীতে আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য আপ্রান চেষ্টা করতেন, অনুরূপভাবে তিনি কালামে ইলাহীর মধ্যে নিহিত অন্যান্য বরকতও লাভ করার চেষ্টা করতেন। যেমন, কুরআনের আয়াত পড়ে পানিতে ফু দেয়া এবং নিজে পান করা বা অন্নকে পান করানো, তা পড়ে হাতে ফু দেয়া অতঃপর তা দেহে মর্দন করা- এভাবে তিনি কুরআনের বরকতের প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য কোন দিকই ছাড়তেন না। আজো যদি কোন ব্যক্তি এরূপ করে তবে করতে পারে এবং এটাও বরকতের কারন হবে। তবে একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, এই বরকতের ফায়দা কেবল এমন ব্যক্তিই লাভ করতে পারে, যে কুরআনের বাহ্যিক দিকের সাথে সাথে এর বাতেনি দিকের সাথেও সম্পর্ক বজায় রাখে। যদি কোন ব্যক্তি কুরআনের উদ্দেশ্যের বিপরীত জীবন যাপন করে, আবার সূরা ইখলাছ, সূরা ফালাক এবং সূরা নাস পড়ে নিজের বুকে ফুক দেয়, তাহলে প্রশ্ন জাগে- সে অবশেষে কোন ধরনের বিপর্যয় ও অনিষ্ট থেকে পানাহ চাচ্ছে? সে যে সুদ খেয়ে সমাজের অনিষ্ট সাধন করেছে- এখন পুলিশ বাহিনী যেন তাঁকে গ্রেপ্তার না করে- এজন্য আশ্রয় প্রার্থনা করছে? এই জন্য একথা ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে, যে ব্যক্তি বাস্তব ক্ষেত্রে কুরআনের লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করছে কেবল সে-ই এর বরকত ও কল্যাণ লাভ করতে সক্ষম হবে। এরপর কুরআনের শব্দগুলোর মধ্যে যে বরকত রয়েছে তা সে অনায়াসে লাভ করতে পারবে। কিন্তু যে ব্যক্তি রাত দিন কুরআনের বিরুদ্ধে লড়ছে এবং নিজের কথায় ও কাজে কুরআনের নির্দেশের পরিপন্থী কাজ করছে তাঁর জন্য এই বরকত ও কল্যাণ হতে পারে না।

কিয়ামতের দিন পক্ষ অবলম্বনকারী তিনটি জিনিস-

কুরআন, আমানাত ও আত্মীয়তার সম্পর্ক
আরবী****

৩৬। হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কিয়ামতের দিন তিনটি জিনিস আরশের নীচে থাকবে। এক, কুরআন যা বআন্দার পক্ষে বা বিপক্ষে আরজি পেশ করবে। এর বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ দুটি দিক রয়েছে। দুই, আমানত এবং তিন, আত্মীয়তার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক ফরিয়াদ করে বলবে, যে ব্যক্তি আমাকে রক্ষা করেছে- আল্লাহ তায়ালাও তাঁকে রক্ষা করবেন। আর যে ব্যক্তি আমাকে ছিন্ন করেছে- আল্লাহ- তায়ালাও তাঁকে ছিন্ন করবেন। ( ইমাম বাগাবীর শরহে সুন্নাহ)

কিয়ামতের দিন কুরআন মাজীদ, আমানত এবং আত্মীয়তার সম্পর্কের আল্লাহ পাকের আরশের নীচে থাকার অর্থ এই নয় যে, উল্লেখিত জিনিসগুলো সেখানে মানুষের আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। বরং এর অর্থ হচ্ছে- এই তিনটি সেই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যা কিয়ামতের দিন মানুষের মোকদ্দমা সমূহের মীমাংশা করার জন্য সামনেই উপস্থিত থাকবে। এ তিনটি জিনিসকে দৃষ্টান্তের আকারে পেশ করা হয়েছে। যেমন কোন রাষ্ট্র প্রধানের দরবারে তাঁর তিনজন উচ্চপদস্থ প্রিয় ব্যক্তি দণ্ডায়মান হয়ে আছে। এবং তারা বলে দিচ্ছে কোন ব্যক্তি কেমন প্রকৃতির এবং কি ধরনের ব্যবহার পাওয়ার উপযোগী। এভাবে যেন একটি চিত্র ফুতিয়ে তোলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন মানুষের যাবতীয় ব্যাপারে ফায়সালা করার জন্য সর্বপ্রথম যে জিনিসটি সামনে আসবে তা হচ্ছে- আল কুরআন। এই কুরআন সম্পর্কে বলা হয়েছে- “ইউহাজ্জুল ইবাদ”। এর দুটি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ হচ্ছে এই যে, কুরআন বান্দাদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করবে। আর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে এই যে, সে বান্দাদের স্বপক্ষে মামলা পরিচালনা করবে।

এই ধরনের বক্তব্য পূর্বের একটি হাদীসেও এসেছে – “আল কুরআনু উজ্জাতুন লাকা আও আলাইকা”। অর্থাৎ কুরআন হয় তোমার স্বপক্ষে দলীল হবে অথবা তোমার বিপক্ষে দলীল হবে। কুরআন এসে যাওয়ার পর এখন ব্যাপারটি দুই অবস্থা থেকে খালী নয়। যদি তোমরা কুরআনের নির্দেশ মতো কাজ করে থাকো তাহলে এটা তোমাদের অনুকূলে সাক্ষ্য দেবে। আর যদি তোমরা কুরআনের নির্দেশের বিপরীত কাজ করো, তাহলে এটা তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। কোন ব্যক্তিকে যখন আল্লাহর আদালতে পেশ করা হবে তখন যদি এই প্রমান পাওয়া যায় যে, আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদের আকারে যে নির্দেশনামা পাঠিয়ে ছিলেন- সে তদানুযায়ী আমল করার চেষ্টা করেছে, তখন কুরআনই তাঁর পক্ষে প্রমান পেশ করবে এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে আরজ পেশ করবে- এই ব্যক্তি দুনিয়াতে আপনার নির্দেশ মতো জীবন যাপন করে এসেছে। তাই তাঁকে এই পুরস্কার দান করা হোক। কিন্তু যে ব্যক্তি কুরআনের নির্দেশ পাওয়ার পরও তাঁর বিপরীত কাজ করেছে – কুরআন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা চালাবে।

আরো বলা হয়েছে, কুরআনের একটি বাহ্যিক দিক এবং একটি অপ্রকাশ্য দিক রয়েছে। এর তাৎপর্য হচ্ছে- কুরআনের একটি দিক হচ্ছে এর পরিস্কার শব্দমালা যা প্রতিটি ব্যক্তিই পড়তে পারে। আর দ্বিতীয় জিনিস হচ্ছে- এই শব্দমালার অর্থ ও এর লক্ষ্য। কিয়ামতের দিন কুরআনের শব্দও সাক্ষী হবে এবং এর অর্থও সাক্ষী হবে। কুরআন মাজীদে এমনি হুকুম বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে যে, অমুক কাজ নিষিদ্ধ। কোন ব্যক্তি সেই নিষিদ্ধ কাজটি করলো। এই অবস্থায় কুরআনের শব্দ সমূহ তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে।

অনুরূপভাবে কুরআন মাজীদের শব্দমালার মধ্যে সেই তাৎপর্য নিহিত রয়েছে যার মাধ্যমে জানা যায় যে, কুরআন মানুষের মধ্যে কোন প্রকারের নৈতিকতার পরিপুষ্টি সাধন করতে চায় আর কোন ধরনের নৈতিকতার বিলোপ চায় ; কোন ধরনের জিনিস আল্লাহ তায়ালার পছন্দনীয় এবং কোন জিনিস অপছন্দনীয়। এভাবে কুরআন মাজীদ আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় জীবন প্রনালী কি তাঁর নীল নকশাও পেশ করে। এখন কোন ব্যক্তি যদি এর বিপরীত জীবন প্রনালী অনুসরন করে তাহলে গোটা কুরআনই তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে। পুরা কুরআনের প্রানসত্ত্বা এবং তাঁর তাৎপর্য এই ব্যক্তির বিপক্ষে দাঁড়াবে।

কুরআনের পড়ে দ্বিতীয় যে জিনিস আরশের নীচে বান্দাদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে তা হচ্ছে আমানত। এখানে আমানত শব্দটি সীমিত অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। মানুষের মাঝে আমানতের যে সাধারন অর্থ প্রচলিত আছে তা হচ্ছে এই যে, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির কাছে টাকা –পয়সা, অলংকারাদি অথবা অন্য কোন জিনিস একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই বিশ্বাসে জমা রাখলো যে, দাবী করার সাথে সাথে তা পুনরায় ফেরত পাওয়া যাবে। এটা আমানতের একটি সীমিত ধারনা। অন্যথায় আমানতের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে- কোন ব্যক্তি যদি অন্য কোন ব্যক্তিকে নির্ভরযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য মনে করে তাঁর কাছে নিজের কোন অধিকার এই ভরসায় গচ্ছিত রাখে যে, সে তাঁর এই হক আত্মসাৎ করবে না। এটাই হচ্ছে আমানত। যদি কোন ব্যক্তি এই আমানত আত্মসাৎ করে তাহলে কিয়ামতের দিন তা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগকারী হয়ে দাঁড়াবে।

এখন দেখুন আমাদের কাছে সর্বপ্রথম আমানত হচ্ছে আমাদের দেহ যা আমাদের প্রতিপালক আমাদের কাছে সোপর্দ করেছেন। এর চেয়ে মূল্যবান জিনিস দুনিয়াতে কিছু নেই। সমস্ত শরীর কথা তো প্রশ্নাতীত, এর কোন একটি অংগের চেয়ে মূল্যবান জিনিস আর নেই। অনুরূপভাবে আল্লাহর এই যমীন। এখানে আমাদের প্রতিটি লোকের কাছে যতটুকু ক্ষমতা ও কৃতিত্ব রয়েছে- কারো হাতে বেশী আবার কারো হাতে কম, এসবই আমানত। এরপর দেখুন মানবীয় ও সামাজিক সম্পর্কের প্রতিটি ক্ষেত্রেই শুধু আমানত আর আমানত। মানুষের পারস্পরিক জীবনের সম্পর্কের সূচনা বিবাহের মাধ্যমে হয়ে থাকে। সমগ্র মানব সভ্যতার ভিত্তি হচ্ছে একজন পুরুষ এবং একজন স্ত্রীলোকের দাম্পত্য সম্পর্ক। এখান থেকে গোটা মানব সমাজের সূচনা। এ সবই আমাদের কাছে আমানত। নারী একজন পুরুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। এই আত্মবিশ্বাসের ওপর সে নিজেকে তাঁর কাছে সপে দেয় যে, সে একজন ভদ্র এবং সম্ভ্রান্ত পুরুষ। সে তাঁর সাথে ভালো ব্যবহার করবে। অপরদিকে পুরুষ একজন স্ত্রীলোকের দায়িত্ব সাড়া জীবনের জন্য এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে নিজের কাছে তুলে নেয় যে, সে একজন ভদ্র এবং সম্ভ্রান্ত মহিলা। সে তাঁর সাথে সহযোগিতা করবে, সে তাঁর ধন-সম্পদ, মান-ইজ্জত ইত্যাদি যা কিছুই তাঁর তত্ত্বাবধানে রাখবে- সে এর কোনরূপ খেয়ানত করবে না। অনুরূপভাবে সন্তানদের অস্তিত্বও আত্মবিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। পিতা মাতার প্রতি সন্তানদের এই আত্মবিশ্বাস রয়েছে যে, তারা তাঁদের কল্যাণেই ব্রতি হবে। স্বেচ্ছায় এবং স্বজ্ঞানে তাঁদের কোন অমঙ্গল করবে না ও তাঁদের স্বার্থের কোনরূপ ক্ষতি করবে না। সন্তানদের স্বভাব- প্রকৃতির মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস নিহিত রয়েছে। যে সন্তান কেবল ভূমিষ্ঠ হল তাঁর স্বভাবের মধ্যেও এই গুন বর্তমান রয়েছে। মনে হয় যেন তাঁর এবং তাঁর পিতা-মাতার মাঝে অলিখিত চুক্তি হয়ে আছে।

অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি তাঁর কন্যাকে অপরের হাতে তুলে দেয় এই বিশ্বাসে যে, সে ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত। কোন ব্যক্তি ওপর ব্যক্তির কন্যাকে তাঁর বংশের মান- মর্যাদার উপরে ভরসা করেই বিয়ে করে। আত্মীয়তার ব্যাপারটিও এরূপ- একে অপরকে নির্ভরযোগ্য মনে করে। স্বয়ং এক প্রতিবেশী ওপর প্রতিবেশীর উপর নির্ভর করে থাকে। সে বিশ্বাস করে তাঁর প্রতিবেশী দেয়াল ভেঙ্গে অবৈধভাবে তাঁর ঘরে অনুপ্রবেশ করবে না। এভাবে আপনি আপনার গোটা জীবনের প্রতি লক্ষ্য করে দেখবেন যে, সমস্ত মানবীয় সম্পর্ক এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে স্থাপিত হচ্ছে যে, অপর পক্ষ তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।

কোন দেশের পুরা সরকারী ব্যবস্থা একটি আমানত। গোটা জাতি তাঁর আমানত সরকারের হাতে তুলে দেয়। তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ এবং নিজেদের যাবতীয় উপায়- উপকরন জাতীয় সরকারের হাতে সোপর্দ করে দেয়। সরকারের যতো কর্মচারী রয়েছে তাঁদের হাতে জাতির আমানতই তুলে দেয়া হয়। জাতীয় সংসদের সদস্যদের হাতে জাতি তাঁর পুরা আমানতই সপে দেয়। লাখ লাখ সদস্য সমন্বয়ে গঠিত সেনাবাহিনীর কথা চিন্তা করুন। জাতি তাঁদেরকে সুসংগঠিত করে দেশের অভ্যন্তরে রেখে দেয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিসমূহে তাঁদের স্থাপন করে। নিজেদের খরচে তাঁদের অস্ত্র-শস্ত্র কিনে দেয় এবং জাতীয় আয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাঁদের পেছনে ব্যয় করা হয়। তাঁদেরকে এই বিশ্বাসে সংগঠিত করে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে যে, তারা দেশ ও জাতির হেফাজতের দায়িত্ব পালন করবে। এবং তাঁদের উপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা সম্পাদন করার ব্যাপারে খেয়ানত করবে না।

এখন যদি এসব আমানতের চতুর্দিক থেকে খেয়ানত হতে থাকে তাহলে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি চিরতরে শেষ হয়ে যাবে। এজন্য এই আমানত সেই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যা কিয়ামতের দিন মানুষের পক্ষে অথবা বিপক্ষে সাক্ষী দেয়ার জন্যে উপস্থিত হবে। যে যতো বেশী খেয়ানত করেছে সে ততখানী শক্তভাবে পাকড়াও হবে। আর যে ব্যক্তি আমানতের যতো বেশী হক আদায় করেছে সে তত অধিক পরিমানে আল্লাহর তরফ থেকে পুরস্কার লাভের অধিকারী হবে।

তৃতীয় যে জিনিস কিয়ামতের দিন অসাধারন গুরুত্বের অধিকারী হবে তা হচ্ছে ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক’ – রেহেম। আত্মীয়তার সম্পর্ক এমন একটি জিনিস যার উপর মানব সভ্যতার ইমারত গড়ে উঠেছে। মানবীয় সভ্যতার সূচনা এভাবে হয়েছে যে, কোন ব্যক্তির সন্তান-সন্ততি এবং তাঁর সামনে যেসব আত্মীয়- স্বজন রয়েছে তাঁদের সমন্বয়ে একটি বংশ বা গোত্রের সৃষ্টি হয়। এভাবে যখন অসংখ্য বংশ এবং গোত্র একত্রিত হয় তখন একটি জাতির সৃষ্টি হয়। এসব কারনে কুরআন মাজীদে আত্মীয়তার সম্পর্কের উপরে খুবই গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এবং আত্মীয়তার সম্পর্ককে ছিন্ন করাকে মানবীয় সভ্যতা- সংস্কৃতির শিকড় কর্তনকারী জিনিস বলা হয়েছে। এজন্যে বলা হয়েছে রেহেম অর্থাৎ রক্তের সম্পর্ক হচ্ছে সেই তৃতীয় জিনিস যার ভিত্তিতে মানুষের মাঝে ফায়সালা করা হবে। এই দিন আত্মীয়তার সম্পর্ক চিৎকার করে বলবে, যে ব্যক্তি আমাকে অটুট রেখেছে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে অটুট রাখবেন। আর যে ব্যক্তি আমাকে করতন করেছে আল্লাহ তায়ালাও তাঁকে ত্যাগ করবেন। যখন কোন ব্যক্তি নিজের আত্মীয়- স্বজনের প্রতি নির্দয় হয় এবং তাঁদের সাথে শীতল সম্পর্ক বজায় রাখে- সে দুনিয়াতে কারো বন্ধু হতে পারে না। যদি সে কারো বন্ধুরূপে আত্মপ্রকাশ করে তাহলে বুঝতে হবে সে প্রতারনার আশ্রয় নিয়েছে এবং নিজের কোন ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে বন্ধুর বেশ ধারন করেছে। যতক্ষন তাঁর স্বার্থ রক্ষা পাবে ততক্ষণই সে তাঁর বন্ধু হয়ে থাকবে। যেখানে তাঁর স্বার্থে আঘাত লাগবে- সেখানেই সে তাঁর বন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। কেননা, এটা যথার্থই বাস্তব সম্মত যে, যে ব্যক্তি নিজের ভযিকে আপন বলে গ্রহন করে না সে অপরের আপন কিভাবে হতে পারে? এ কারনেই কুরআন মাজীদে আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার উপরে এতো অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং এখানে হাদীসে উল্লেখিত শব্দে এর কিছু বর্ণনা করা হয়েছে।

কুরআনের অধিকারী ব্যক্তির মর্যাদা
আরবী***

৩৭। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কুরআনের সাথে সম্পর্ক রেখেছে ( কিয়ামতের দিন ) তাঁকে বলা হবে, কুরআন পাঠ করো এবং উপরে উঠতে থাকো। তুমি দুনিয়াতে যে গতিতে থেমে থেমে কুরআন পাঠ করেছো- অনুরূপ গতিতে তা পাঠ করতে থাকো। তোমার বাসস্থান হবে সেই সর্বশেষ আয়াত যা তুমি পাঠ করবে। ( আহমাদ, তিরমিযি, আবু দাউদ ও নাসাঈ )

সাহেবে কুরআন বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে যিনি কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক রেখেছেন। যেমন আমরা এমন ব্যক্তিকে মুহাদ্দিস বলি যিনি হাদীসের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখেন এবং এমন ব্যক্তিকে নামাযী বলি যিনি নামাযের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখেন। সুতরাং যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক রেখেছেন, কুরআন পাঠ করা এবং তা হৃদয়ঙ্গম করা এবং তা নিয়ে চিন্তা গবেষণায় মশগুল থেকেছেন- তিনিই হলেন কুরআনের ধারক ও বাহক। কিয়ামতের দিন তাঁকে বলা হবে, তুমি কুরআন পাঠ করতে থাকো এবং উন্নত স্তরের দিকে উন্নিত হতে থাকো। তুমি যেখানে পৌছে কুরআন পাঠ সমাপ্ত করবে, সেখানেই হবে তোমার মনযীল। অর্থাৎ যে স্থানে পৌছে তুমি কুরআনের সর্বশেষ আয়াত পড়বে, সেখানেই হবে তোমার চিরস্থায়ী বাসস্থান। এ জন্যই বলা হয়েছে, তুমি দুনিয়াতে যেভাবে ধীরে সুস্থে থেমে থেমে তা পাঠ করো। তাহলে তুমি সর্বোচ্চ মনযিলে পৌছে যেতে পারবে।

যার স্মৃতিপটে কুরআন নেই সে বিরান ঘর সমতুল্য
আরবী***

৩৮। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ কুরআন যে ব্যক্তিকে আমার যিকির এবং আমার কাছে দোয়া করা থেকে বিরত রেখেছে- আমি দোয়াকারী বা প্রার্থনাকারীদের যা দান করি তাঁর চেয়ে অতি উত্তম জিনিস তাঁকে দান করবো। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কেননা সমস্ত কালামের উপর আল্লাহর কালামের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে- যেভাবে সমস্ত সৃষ্টিকুলের উপর আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। ( তিরমিযি, দারেমী, বায়হাকী )

অর্থাৎ যে ব্যক্তি কুরআনের চর্চায় এতটা মশগুল রয়েছে যে, অন্যান্য উপায়ে আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করার জন্য সে যিকির- আযকার করারও সময় পায় নি, এমনকি তাঁর কাছে দোয়া করারও সুযোগ পায় নি, তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, প্রার্থনাকারীদেরকে আমি যতো বড় জিনিসই দান করি না কেন কুরআন পাঠকারীদের দোয়া করা ছাড়াই কুরআনের বরকতে এর চেয়ে উত্তম জিনিস দান করবো।

এটা হাদীসে কুদসী। হাদীসে কুদসী হচ্ছে- যে হাদীসের মধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেন যে, “আল্লাহ বলেছেন”। হাদীসে কুদসী এবং কুরআনের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এই যে, কুরআনের মতন ও ( মূল পাঠ ) আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে নাযিল হয় এবং এর বিষয়বস্তুও আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব। তা কুরআনের অংশ হিসেবে নাযিল হয়। এ জন্যই জিব্রাঈল ( আঃ ) যখন কুরআন নিয়ে আসতেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে দিতেন যে, এটা কুরআনের আয়াত। এবং তা আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব শব্দে এসেছে। অপরদিকে হাদীসে কুদসির ভাষা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজস্ব, কিন্তু এর ভাব এবং বিষয়বস্তু আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব যা তিনি তাঁর নবীর অন্তরে ঢেলে দিয়েছেন। কখনো কখনো হাদীসে কুদসীর ভাষাও মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এসেছে। কিন্তু তা কুরআনের অংশ হিসেবে আসে নি। যেমন, আল্লাহ তায়ালা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিভিন্ন দোয়া শিখিয়েছেন। নামাযের মধ্যে যেসব যিকির পড়া হয়, তা সবই আল্লাহ তায়ালার শিখানো। কিন্তু তা কুরআনের অংশ বানানোর জন্য শেখানো হয় নি। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাঁরই ভাষায় কোন বিষয়বস্তু নাযিল হলে পরিস্কারভাবে বলে দেয়া হতো যে, তা কুরআনের সাথে যোগ করার জন্য নাযিল করা হয়েছে।

এই হাদীসে কুদসীর অংশ “উতিয়াস সায়েলীন” পর্যন্ত শেষ হয়েছে। অতপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে বলেছেন, সমস্ত সৃষ্টি জগতের উপর আল্লাহ তায়ালার যেরূপ মর্যাদা রয়েছে, যাবতীয় কথার উপরে তাঁর কথার অনুরূপ মর্যাদা রয়েছে- কেননা তা আল্লাহ তায়ালার কালাম। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির তুলনায় যতটা শ্রেষ্ঠ, তাঁর কথাও সৃষ্টির কথার চেয়েও ততটা শ্রেষ্ঠ। উপরের কথার সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইয়াহি ওয়া সাল্লামের এ কথা যোগ করার তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, কুরআন ছাড়া অন্য যে কোন দোয়া- দরূদের কথাই বলা হোক না কেন মানুষের তৈরি কালাম, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার কালাম নয়। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- মানুষের তৈরি কথা যতই উন্নত মানের ও মর্যাদাসম্পন্ন হোক না কেন তা আল্লাহর কালামের সামনে কিছুই নয়। আল্লাহর সামনে মানুষের যেই মর্যাদা, তাঁর কালামের সামনে তাঁদের রচিত এই কালামেরও ততটুকু মর্যাদা। অতএব, তোমরা সবচেয়ে মর্যাদাবান আল্লাহ তায়ালার এই কালামের পিছনে যতটা সময় ব্যয় করেছো- তা অতীব মূল্যবান কাজে ব্যয় হয়েছে। তোমরা যদি দোয়ার মধ্যে তোমাদের সময় ব্যয় করো তাহলে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যবান কাজেই তোমাদের সময় ব্যয় করলে। অতএব, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথা পরিস্কার বলে দিয়েছেন, যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর যিকির করার পরিবর্তে কুরআন পাঠেই তাঁর সময় ব্যয় করে তাহলে তাঁকে দোয়াকারীদের তুলনায় উত্তম জিনিস কেন দেয়া হবে।

কুরআনের প্রতিটি অক্ষরের বিনিময়ে দশ নেকী
আরবী****

৪০। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের একটি হরফ পাঠ করে তাঁর জন্য এর বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে। ( কুরআনে এই মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে যে ) প্রতিটি নেকীর বিনিময়ে দশগুন সওয়াব রয়েছে। আমি একথা বলছি না যে, ‘আলিফ, লাম, মীম’ একটি হরফ। বরং এলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ। ———( তিরমিযি, দারেমী )

অর্থাৎ ‘আলিফ- লাম- মীম’ কয়েকটি হরফের সমন্বয়। প্রতিটি অক্ষরের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে এবং প্রতিটি নেকীর বিনিময়ে দশগুন পুরস্কার রয়েছে।

কুরআন প্রতিটি যুগের ফিতনা থেকে রক্ষাকারী
আরবী****

৪১। তাবেঈ হযরত হারিস আল-অ’ওয়ার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি ( কুফার) মসজিদে বসা লোকদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম লোকেরা- বাজে গল্প-গুজবে মেতে রয়েছে। আমি হযরত আলীর কাছে হাযির হলাম। আমি তাঁকে অবহিত করলাম যে, লোকেরা এভাবে মসজিদে বসে বাজে গল্প-গুজব করছে। তিনি বললেন, বাস্তবিকই লোকেরা তাই করছে? আমি বললাম- হ্যাঁ। তিনি বললেন- আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ খবরদার, অচিরেই এমন যুগ আসবে যাতে বিপর্যয় শুরু হবে। আমি আরজ করলামঃ হে আল্লাহর রাসুল, এই বিপর্যয় থেকে বাঁচার উপায় কি? তিনি বললেন- আল্লাহর কিতাব ( এই বিপর্যয় থেকে আল্লাহর কিতাবের মাধ্যমে আত্মরক্ষা করা সম্ভব )। তোমাদের পূর্ববর্তী জাতি সমূহের কি অবস্থা হয়েছিলো তাও এই কিতাবে আছে। তোমাদের পরে আসা লোকদের উপর কি অতিবাহিত হবে তাও এ কিতাবে আছে। তোমাদের যাবতীয় ব্যাপারে ফায়সালা করার বিধানও এতে বিবৃত হয়েছে। এই কুরআন হচ্ছে সত্য মিথ্যার- মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালাকারী কিতাব। এটা কোন হাসি ঠাট্টার বস্তু নয়। যে অহংকারী তা পরিত্যাগ করবে আল্লাহ তাঁকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবেন। যে ব্যক্তি এই কুরআন পরিত্যাগ করে অন্যত্র হেদায়াত তালাশ করবে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে পথভ্রষ্ট করে দেবেন। এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার মজবুত রশি এবং প্রজ্ঞাময় যিকির ও সত্য সরল পথ। তা অবলম্বন করলে প্রবৃত্তি কখনো বিপথগামী হয় না। তা যবানে উচ্চারন করতে কষ্ট হয় না। জ্ঞানীগণ কখনো এর দ্বারা পরিতৃপ্ত ও বিতৃষ্ণ হয় না। একে যতই পাঠ করে তা পুরাতন হয় না। এর বিস্ময়কর তথ্য সমূহের অন্ত নেই। এটা শুনে জীনেরা স্থির থাকতে পারেনি, এমনকি তারা বলে উঠলো- “আমরা এমন এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি যা সৎ পথের সন্ধান দেয়। অতএব আমরা এর উপরে ঈমান এনেছি”। ( সূরা জীন ; ১, ২ )

যে ব্যক্তি কুরআন মোতাবেক কথা বলে সে সত্য কথা বলে। যে ব্যক্তি তদানুযায়ী কাজ করবে সে পুরস্কার পাবে। যে ব্যক্তি তদানুযায়ী ফায়সালা করবে সে ন্যায়ানুগ ফায়সালা করতে পারবে। যে ব্যক্তি লোকদের এই কুরআন অনুসরনের দিকে ডাকে সে তাঁদের সরল পথেই ডাকে। ( তিরমিযি, দারেমী )

নবী সাল্লালালহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানে কুরআন মাজীদের সর্বপ্রথম সৌন্দর্য এই বলেছেন যে, কুরআনে এটাও বলা হয়েছে যে, অতীত জাতিসমূহ কল্যাণ ও মঙ্গলের পথ অনুসরন করার কারনে তাঁদের পরিনাম কিরূপ হয়েছিলো এবং পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মধ্যে যারা ভ্রান্ত পথে চলেছিল তাঁদেরই বা কি পরিনতি হয়েছিলো। কুরআনে এও বলা হয়েছে যে, ভবিষ্যতে ভ্রান্ত পথের অনুসারীদের কি পরিনতি হবে এবং সঠিক পথের অনুসারীদের ভাগ্যে কি ধরনের কল্যাণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। কুরআনে একথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমাদের মাঝে মতবিরোধ দেখা দেয় তাহলে এর মীমাংসা কিভাবে হওয়া উচিৎ।

‘হুয়াল ফাসলু’- বাক্যাংশের অর্থও হচ্ছে, কুরআন মাজীদ চূড়ান্ত ফায়সালাকারী কথা বলে এবং পূর্ণ গাম্ভীর্যের সাথে বলে, এর মধ্যে হাসি-ঠাট্টা ও উপহাস মূলক এমন কোন কথা বলা হয়নি, যা মানা বা না- মানায় কোন পার্থক্য সূচিত হয় না।

অতঃপর বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কুরআন ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথা থীক হেদায়াত লাভের চেষ্টা করবে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে পথভ্রষ্ট করে দেবেন। এর অর্থও হচ্ছে- এই কিতাব ছাড়া আর কোথাও থেকে এখন আর হেদায়াত লাভ করা যেতে পারে না। যদি অন্য কোন উৎসের দিকে ধাবিত হয়, তাহলে গোমরাহি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না।

আরো বলা হয়েছে- এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার মজবুত রশি। অর্থাৎ কুরআন হচ্ছে- বান্দাহ এবং তাঁর প্রতিপালকের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম। যে ব্যক্তি কুরআনকে শক্তভাবে ধারন করবে, খোদার সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হবে। যে ব্যক্তি কুরআনকে ছেড়ে দিলো, সে আল্লাহ তায়ালার সাথে নিজের সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেললো।

কুরআনের প্রজ্ঞাময় যিকির হওয়ার অর্থ হচ্ছে এই যে, এটা এমন এক নসীহত যার গোটাটাই হিকমত, প্রজ্ঞা ও জ্ঞানে পরিপূর্ণ বক্তব্য পেশ করে।

আরো বলা হয়েছে- কুরআন অবলম্বন করলে প্রবৃত্তি ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হতে পারে না। এর অর্থ হচ্ছে- যদি কোন ব্যক্তি কুরআনকে নিজের পথ প্রদর্শক হিসেবে গ্রহন করে, তা থেকে হেদায়াত লাভের চেষ্টা করে এবং তাঁর জীবনে যেসব সমস্যা ও বিষয়াদি উপস্থিত হয় তাঁর সমাধানের জন্যে যদি সে কুরআনের দিকে প্রত্যাবর্তন করে তাহলে তাঁর প্রবৃত্তি তাঁকে পথভ্রষ্ট করতে পারবে না এবং অন্য কোন চিন্তাধারাও তাঁকে ভ্রান্ত পথে নিতে পারবে না। অবশ্য কোন ব্যক্তি যদি পূর্ব থেকে নিজের চিন্তাধারাকে তাঁর মন-মগজে শক্তভাবে বসিয়ে নেয় এবং কুরআনকেও তাঁর চিন্তাধারা অনুযায়ী ঢালাই করতে চায়- তাহলে এই পন্থা তাঁকে তাঁর আকাশ- কুসুম কল্পনা থেকে মুক্ত করতে পারে না। হ্যাঁ, যদি কোন ব্যক্তি কুরআন থেকেই পথনির্দেশ লাভ করতে চায় এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে, এখানে যা কিছু পাওয়া যাবে তা সে মেনে নিবে এবং যা কিছু এখানে পাওয়া যাবে না তা সে গ্রহন করবে না- তাহলে এমন ব্যক্তিকে তাঁর নিজের কল্পনা বিলাসও পথভ্রষ্ট করতে পারবে না এবং অন্যের চিন্তাধারাও তাঁকে ভ্রান্ত পথে নিতে সক্ষম হবে না।

অতপর বলা হয়েছে, কারো মুখের ভাষা কুরআনের মধ্যে কোনরূপ ভেজাল মেশাতে সক্ষম হবে না। এ ব্যাপারটি একটি সুস্পষ্ট মু’যিযা- আল্লাহ তায়ালা এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই কথা এমন সময়ে বলেছেন, যখন এই কুরআন কেবল পেশ করা শুরু হয়েছে। কিন্তু আজ চৌদ্দশত বছর অতিবাহিত হয়েছে। তারপরও এটা চূড়ান্ত কথা হিসাবে বিরাজ করছে যে, আজ পর্যন্ত কোন ব্যক্তি এর সাথে কোন কিছু সংমিশ্রণ করতে পারে নি। সে সময় আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল ছাড়া আর কেউ উপলব্ধি করতে সক্ষম ছিল না যে, কুরআনে কোনরূপ মিশ্রন ঘটাতে পারবে না। ভবিষ্যৎ বানী হিসেবে একথা বলা হয়েছিলো। আজ শত শত বছরের অভিজ্ঞতায় প্রমানিত হয়েছে যে, যা কিছু বলা হয়েছিলো বাস্তবিক অর্থেই তা ছিল হক। এরই নাম মুযিযা।

আরো বলা হয়েছে- আলেমগন তা থেকে কখনো পরিতৃপ্ত হয় না। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আলেম সে কুরআন তেলাওয়াত, তা অনুধাবন এবং তা নিয়ে চিন্তা গবেষণায় জীবন অতিবাহিত করে দেয় কিন্তু কখনো পরিতৃপ্ত হয় না। তাঁর কাছে এমন কোন সময় আসবে না যখন সে এই সিদ্ধান্তে পৌছতে পারবে যে, কুরআন থেকে তাঁর যা শেখার ছিল সে তা শিখে নিয়েছে এবং বুঝে নিয়েছে এবং এখন তাঁর আর কোন জ্ঞানের দরকার নেই। আজ পর্যন্ত কোন আলেমই বলতে পারেনি যে, সে কুরআন থেকে পরিতৃপ্ত হয়েছে, তাঁর যা কিছু অর্জন করার ছিল তা সে অর্জন করে নিয়েছে, এখন আর তাঁর অতিরিক্ত কিছু শেখার প্রয়োজন নেই।

অতঃপর বলা হয়েছে, কুরআন যতবারই পাঠ করো না কেন তা কখনো পুরান হবে না। যতো উন্নত মানের কিতাবই হোক- আপনি দুই- চার, দশ-বিশবার তা পড়তেই শেষে বিরক্ত হয়ে যাবেন। তারপর আর তা পড়তে মন চাইবে না। কিন্তু কুরআন হচ্ছে এমন এক অনন্য কিতাব যা জীবনভর পাঠ করা হয়, বারবার পাঠ করা হয় তবুও মন পরিতৃপ্ত হয় না। বিশেষ করে সূরা ফাতিহা তো দিনের মধ্যে কয়েকবার পাঠ করা হয় কিন্তু কখনো বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয় না যে, কতদিন ধরে লোক একই জিনিস বারবার পাঠ করছে। এটাও কুরআন মাজীদের এক অনন্য মু’যিযা এবং এর অসাধারন সৌন্দর্যের একটি নিদর্শন।

আরো বলা হয়েছে, কুরআন মাজীদের রহস্য কখনো শেষ হবার নয়। প্রকৃত কথা হচ্ছে এই যে, কুরআন পারহ, এ নিয়ে চিন্তা- গবেষনা করতে এবং তথানুসন্ধান করতে করতে মানুষের জীবন শেষ হয়ে যায়, কিন্তু তাঁর রহস্য কখনো শেষ হয় না। কখনো কখনো এমনও হয় যে, মানুষ একাধারে চল্লিশ পঞ্চাশ- বছর ধরে কুরআনের অধ্যয়নে কাটিয়ে দেয়ার পর কোন একসময় কুরআন খুলে পড়তে থাকে। তখন তাঁর সামনে এমন কোন আয়াত এসে যায় যা পাঠ করে মনে হয় যেন আজই সে এ আয়াতটি প্রথম পাঠ করছে। তা থেকে এমন বিষয়বস্তু তাঁর সামনে বেরিয়ে আসে যা জীবনভর অধ্যয়নেও সে লাভ করতে পারেনি। এ জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এর রহস্য কখনো শেষ হবার নয়।

কুরআন মাজীদের মর্ম বানী শুনে জীনদের ঈমান আনার ঘটনা সূরা জীন এবং সূরা আহকাফে বর্ণিত হয়েছে। এ থেকে জানা গেলো যে, কুরআন এমন প্রভাবশালী বক্তব্য পেশ করে- মানুষ তো মানুষ জীনেরাও যদি একগুঁয়েমি, গোঁড়ামি এবং হঠকারিতা পরিহার করে উন্মুক্ত মন নিয়ে কুরআনের বানী শুনে তাহলে তাদেরও একথা সাক্ষী না দিয়ে উপায় থাকে না যে, কুরআন সঠিক পথের নির্দেশ দান করে এবং এর উপর ঈমান এনে সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া যায়।

কুরআন মাজীদের এসব বৈশিষ্টের ভিত্তিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, অনাগত ভবিষ্যতে যেসব ফিতনা এবং বিপর্যয় দেখা দেবে তা থেকে বাঁচার মাধ্যম এই কুরআন ছাড়া আর কিছুই নয়। একথাও পরিস্কার বলে দেয়া হয়েছে যে, কুরআন মাজীদে এমন জিনিস রয়েছে যার কারনে তা কিয়ামত পর্যন্ত সব সময় মানব জাতিকে যে কোন ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে।

কুরআন চর্চাকারীর পিতামাতাকে
নূরের টুপি পরিধান করানো হবে

আরবী***

৪২। হযরত মুয়াজ বিন জাবাল ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি কুরআন অধ্যয়ন করে এবং তদানুযায়ী কাজ করে- কিয়ামতের দিন তাঁর পিতা-মাতাকে নূরের টুপী পরিয়ে দেয়া হবে। সূর্য যদি দুনিয়াতে তোমাদের ঘরে নেমে আসে তাহলে এর যে আলো হবে- ঐ টুপীতে তাঁর চেয়ে সৌন্দর্যময় আলো হবে। অতএব যে ব্যক্তি কুরআন অনুযায়ী যাবতীয় কাজ করে তাঁর প্রতি আল্লাহ তায়ালার কি পরিমান অনুগ্রহ হতে পারে বলে তোমাদের ধারনা? ( আহমাদ, আবু দাউদ )

এখানে এমন পিতা-মাতার কথা বলা হয় নি যারা নিজেদের সন্তানদের কুরআন অধ্যয়ন করতে বাধা দেয়। এবং কুরআন পাঠকারী ছেলেদেরকে মোল্লা হয়ে গেছে বলে টিটকারি দেয় এবং বলে, এখন সে আর আমাদের কোন কাজে লাগার উপযোগী নয়। এ আর কি পার্থিব কাজ করবে- এতো কুরআন পড়ায় লেগে গেছে। এখানে এমন পিতামাতার কথা বলা হয়েছে যারা নিজেদের সন্তানদের কুরআন পড়িয়েছে। এবং তাঁদের এমন প্রশিক্ষণ দিয়েছে যে, তাঁদের জীবদ্দশায় এবং তাঁদের মৃত্যুর পরও তারা কুরআন পড়তে অভ্যস্ত হয়ে রয়েছে এবং তদানুযায়ী যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দিয়েছে। তাঁর এই কুরআন পাঠ শুধু তাঁর জন্যেই পুরস্কার বয়ে নিয়ে আসবে না বরং তাঁর পিতামাতাকেও পুরস্কৃত করা হবে। আর সেই পুরস্কার হচ্ছে কিয়ামতের দিন তাঁদেরকে মর্যাদাপূর্ণ, গৌরবময় ও আলোক উদ্ভাসিত টুপি পরিয়ে দেয়া হবে। এ থেকেই অনুমান করা যায়, যে ব্যক্তি নিজে এই কুরআন পাঠ করে এবং তদনুযায়ী যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দেয়- তাঁর উপর আল্লাহ তায়ালার কি পরিমান অনুগ্রহ বর্ষিত হবে এবং সে কতো কি পুরস্কার পাবে।

কুরআনের হেফাজত না করা হলে তা দ্রুত ভুলে যাবে
আরবী****

৪৩। হযরত আবু মুসা আশআরী ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কুরআন মাজীদকে স্মৃতিপটে ধরে রাখার এবং সংরক্ষণ করার দিকে লক্ষ্য দাও। সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার জীবন। উট যেভাবে দড়ি ছিড়ে বন্ধন মুক্ত হয়ে পলায়ন করার চেষ্টা করে- কুরআন সেভাবে এবং তাঁর চেয়েও দ্রুত স্মৃতিপট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ———( বুখারী ও মুসলিম )

অর্থাৎ, কোন ব্যক্তি কুরআন মুখস্থ করার পর তা স্মরণ শক্তির আধারে ধরে রাখার জন্যে যদি চিন্তা ভাবনা না করে এবং বারবার অধ্যয়ন না করে তাহলে তা মানুষের মন থেকে পলায়ন করে থাকে- যেভাবে উট তাঁর রশি ছিঁড়ে পলায়ন করার চেষ্টা করে। এর কারন হচ্ছে- মানুষ যতক্ষন সর্বশক্তি নিয়োগ করে তা স্মৃতিপটে ধরে রাখার চেষ্টা না করে ততক্ষন তাঁর আত্মা কুরআনকে গ্রহন করতে পারে না। যদি এটা না করা হয় তাহলে সে কুরআনকে তাঁর স্মৃতিপট থেকে ঢিলা করে দেয় এবং এর ফলে তা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কেননা কুরআন তাঁর উপর যে বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে- তা থেকে মুক্ত হওয়ার দুর্বলতা তাঁর মধ্যে বর্তমান রয়েছে। কুরআন তাঁর জন্যে যে সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে সে তা অতিক্রম করতে চায়। যে ব্যক্তি নফসের গোলাম হয়ে যায় এবং নিজের নফসকে আল্লাহর আনুগত্য করার জন্য বাধ্য করে না সে কখনো কখনো কুরআনের বানী শুনে ঘাবড়িয়ে যায়- না জানি এমন কোন আয়াত এসে যায় যা তাঁকে ভ্রান্ত ও নাজায়েজ কাজ করা থেকে বাঁধা দিয়ে বসে। এ জন্য বলা হয়েছে, কুরআন শরীফ মুখস্থ করার পর তা স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করো। অন্যথায় তা উটের রশি ছিঁড়ে পলায়ন করার ন্যায় তোমার স্মৃতিপট থেকে পলায়ন করবে।

কুরআন মুখস্থ করে তা ভুলে যাওয়া জঘন্য অপরাধ
আরবী***

৪৪। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কোন ব্যক্তির জন্য এটা খুবই খারাপ কথা যে, সে বলে, আমি অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি। ( আসল কথা হচ্ছে তাঁর অবহেলার কারনে ) তাঁকে এটা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। কুরআনকে কণ্ঠস্থ রাখার আপ্রান চেষ্টা করো। কেননা তা পলায়নপর উটের চেয়েও দ্রুত মানুষের বক্ষঃস্থল থেকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে। ——-( বুখারী, মুসলিম- মুসলিমের বর্ণনায় আছে, উট তাঁর বন্ধন থেকে যেভাবে ছুটে পালানোর চেষ্টা করে )।

এখানেও একই কথা ভিন্ন ভংগিতে উপস্থাপন করা হয়েছে, বলা হয়েছে কুরআন মাজীদ মুখস্থ করার পর তা ভুলে যাওয়া এবং এই বলা যে, আমি অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি- এটা খুবই খারাপ কথা। মূলত তাঁর ভুলে যাওয়ার অর্থও হচ্ছে- সে কুরআনের কোন পরোয়া করেনি এবং তা মুখস্থ করার পর সে দিকে আর লক্ষ্য দেয় নি। যেহেতু সে আল্লাহ তায়ালার কালামের প্রতি মনোযোগ দেয়নি এ জন্য আল্লাহ তায়ালাও তাঁকে তা ভুলিয়ে দিয়েছেন। তিনি তাঁর কালাম এমন ব্যক্তির কাছে রাখা পছন্দ করেন না যে তাঁর সমাদরকারী নয়। এই জন্য বলা হয়েছে, কুরআনকে মুখস্থ রাখার চেষ্টা করো এবং তা কণ্ঠস্থ করার পর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করো না। অন্যথায় উট বন্ধনমুক্ত হয়ে যেভাবে পালাবার চেষ্টা করে- অনুরূপভাবে কুরআনও বক্ষস্থল থেকে বের হয়ে চলে যায়।

কুরআন মুখস্থকারীর দৃষ্টান্ত
আরবী****

৪৫। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- কুরআন মুখস্থকারী এমন ব্যক্তি সদৃশ যার কাছে বাঁধা উট রয়েছে। যদি সে তাঁর রক্ষনাবেক্ষন করে তাহলে তা তাঁর কাছে থাকবে। আর যদি সে এটাকে আযাদ করে দেয় তাহলে তা ভেগে যাবে। –( বুখারী ও মুসলিম )

হযরত আবু মুসা আশআরী, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ( রাঃ ) সামান্য শাব্দিক পার্থক্য সহকারে তিনটি বর্ণনার একই বিষয়বস্তু বর্ণনা করেছেন। এ থেকে জানা যায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন সময়ে লোকদের মনে একথা বদ্ধমূল করিয়েছেন যে, যার যতটুকু পরিমান কুরআন মুখস্থ আছে সে যেন তা মুখস্ত রাখার চেষ্টা করে। তা যদি স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করার চেষ্টা না করো এবং বারবার তা পাঠ না করো তাহলে এটা তোমাদের মন থেকে ছুটে যাবে।

আপনি দেখে থাকবেন, যারা কুরআনের হাফেজ তাঁদের সব সময় কুরআন পড়তে হয়। যদি তারা রমযান মাসে কুরআন শুনাতে চায় এ জন্যে তাঁকে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হয়। এর কারন হচ্ছে- মানুষ কুরআন মুখস্ত করার পর যদি তা সংরক্ষিত করার চেষ্টা না করে তাহলে তা খুব দ্রুত তাঁর স্মৃতিপট থেকে বেরিয়ে চলে যায়।
মনোনিবেশ সহকারে ও একাগ্র চিত্তে কুরআন পাঠ করো
আরবী***

৪৬। হযরত জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমাদের দীল যতক্ষন পর্যন্ত কুরআনের সাথে লেগে থাকে ততক্ষন তা পাঠ করো। যখন আর পাঠে মন বসে না তখন উঠে যাও ( অর্থাৎ পড়া বন্ধ করো)। ———— ( বুখারী ও মুসলিম )

এ হাদীসের তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, মানুষ যেন এমনাবস্থায় কুরআন পাঠ না করে যখন তাঁর মন পূর্ণরূপে কুরআনের দিকে নিবিষ্ট হচ্ছে না। সে গভীর মনোযোগের সহকারে এবং আগ্রহের সাথে যতটা সম্ভব কুরআন পাঠ করবে। মূল বিষয় মনযিলের পর মনযিল কুরআন পড়ে যাওয়া নয়। বরং পূর্ণ একাগ্রতা সহকারে এবং অর্থ ও তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করে পড়াই হচ্ছে আসল ব্যাপার। এটা নয় যে, আপনি একপারা কুরআন পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- তখন আপনি এমন অবস্থায় বসে কুরআন পরছেন যে, আপনার মনোযোগ মোটেই সে দিকে নেই। এর চেয়ে বরং আপনি গভীর মনোযোগের সাথে এক রুকু পাঠ করুন। মানুষ যদি তা না করতে পারে তাহলে মনযিলের পর মনযিল কুরআন পাঠ করে কি হবে? এজন্যই বলা হয়েছে- কুরআন পড়ার সময় যদি মন ছুটে যায় তাহলে পড়া বন্ধ করে দাও।

রাসুলুল্লাহর কিরাত পাঠের পদ্ধতি
আরবী***

৪৭। হযরত কাতাদা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আনাস ( রাঃ ) কে জিজ্ঞেস করা হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কিরাত পাঠের ধরন কিরূপ ছিল? তিনি বললেন- তিনি শব্দগুলো টেনে টেনে ( অর্থাৎ পূর্ণাংগ ভাবে উচ্চারন করে ) পড়তেন। অতঃপর আনাস

( রাঃ) “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” পাঠ করে শুনালেন এবং প্রতিটি শব্দ টেনে টেনে আদায় করলেন। বিসমিল্লাহ, আর-রাহমান, আর- রাহীম ( আল্লাহ, রহমান এবং রহীম শব্দক’টি টেনে টেনে পড়লেন )। ——————– ( সহীহ বুখারী )

অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্রুত গতিতে কুরআন পাঠ করতেন না বরং প্রতিটি শব্দ টেনে টেনে পরিস্কার ভাবে উচ্চারন করে পাঠ করতেন। এর অর্থও এই নয় যে, তিনি অস্বাভাবিক পন্থায় কুরআন পাঠ করতেন। বরং এর অর্থ হচ্ছে এই যে, তিনি প্রতিটি শব্দ ধীর স্থিরভাবে এবং পূর্ণাংগভাবে উচ্চারন করে এমন ভঙ্গিতে পাঠ করতেন যে, পড়ার সময় মানুষের মনমগজ পূর্ণভাবে সেদিকে নিয়োজিত হতো যে- কি পাঠ করা হচ্ছে এবং এর তাৎপর্য কি?

মহান নবীর সুললিত কণ্ঠে কুরআন পাঠ
আল্লাহর কাছে খুবই পছন্দনীয়

আরবী***

৪৮। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন – আল্লাহ তায়ালা কোন কথা এতটা মনোযোগ সহকারে শুনেন না যতটা মনোযোগের সাথে কোন নবীর কণ্ঠস্বর শুনে থাকেন- যখন তিনি সুললিত কণ্ঠে কুরআন পাঠ করেন।——– ( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

আরবী***

৪৯। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- একজন নবী যখন সুললিত কণ্ঠে উচ্চ স্বরে কুরআন পাঠ করেন- তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর পাঠ যতটা যত্ন সহকারে শুনেন অন্য কোন কিছু ততটা যত্ন সহকারে শুনেন না। —— ( বুখারী ও মুসলিম )

পূর্ববর্তী হাদীস এবং এ হাদীসের বক্তব্য মূলত একই। এর অর্থ হচ্ছে- সুললিত কণ্ঠে নবীর কুরআন পাঠ এমন এক জিনিস যার প্রতি আল্লাহ তায়ালার সর্বাধিক আকর্ষণ রয়েছে। এ জন্য তিনি নবীর কুরআন পাঠ যতটা মনোযোগ সহকারে শুনেন তদ্রূপ অন্য কিছু শুনেন না।

যে ব্যক্তি কুরআনকে নিয়ে স্বয়ং
সম্পূর্ণ হয় না সে আমাদের নয়

আরবী***

৫০। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি সুমধুর স্বরে কুরআন পাঠ করে না অথবা কুরআনকে পেয়ে অন্য সবকিছু থেকে বিমুখ হয় না সে আমাদের দলভুক্ত নয়। ——- ( সহীহ বুখারী )

এখানে ‘সুমধুর স্বর’- অর্থ কি তা ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করে নেয়া প্রয়োজন। কুরআনকে সুললিত কণ্ঠে পাঠ করা এক কথা, আর তা গানের সুরে পাঠ করা আরেক কথা। সুমধুর কণ্ঠে পড়া হচ্ছে এই যে, মানুষ কুরআনকে উত্তম পদ্ধতিতে, উত্তম সুরে পাঠ করবে। তাহলে কোন শ্রবণকারী উপস্থিত থাকলে তাঁর পাঠ সে মনোযোগের সাথে শুনবে এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হবে। উত্তম সুরে পাঠ করার মধ্যে কেবল কণ্ঠস্বর উত্তম হওয়াই নয়- বরং সে এমন পদ্ধতিতে কুরআন পাঠ করবে- যেন সে নিজেও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। কুরআন পাঠ করার ভঙ্গি এরূপ হওয়া উচিৎ যে, সে যে বিষয়বস্তু সম্বলিত আয়াত পাঠ করছে তদনুযায়ী তাঁর কণ্ঠস্বর ও উচ্চারন ভঙ্গির মধ্যেও পরিবর্তন সাধিত হবে এবং সেই আয়াতের প্রভাবও তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হবে। উদাহরণ স্বরূপ, যদি শাস্তি সম্পর্কিত কোন আয়াত এসে যায় তাহলে তাঁর অবস্থা ও উচ্চারন ভঙ্গিও এমন হবে যেন তাঁর মধ্যে ভীত সন্ত্রস্র অবস্থা ক্রিয়াশীল রয়েছে। যদি সে সওয়াব বা আখিরাতের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কিত কোন আয়াত পাঠ করে, তখন তাঁর মধ্যে আনন্দ ও খুশির ভাব জাগতে হবে। সে যদি কোন প্রশ্নবোধক আয়াত পাঠ করে তখন সে তা প্রশ্নবোধক বাক্যের ধরন অনুযায়ী পাঠ করবে। পাথক কুরআন শরীফ এভাবে নিজে হৃদয়ঙ্গম করবে এবং প্রভাবান্বিত হয়ে পাঠ করবে। শ্রবণকারী যেন শুধু তাঁর মধুর সুরের দ্বারাই প্রভাবিত না হয়, বরং তাঁর প্রভাবও যেন সে গ্রহন করতে পারে- যেমন একজন উন্নত মানের বক্তার বক্তৃতার প্রভাব তাঁর শ্রোতাদের উপর পড়ে থাকে। এদিকে যদি লক্ষ্য দেয়া না হয় এবং গানের সুরে কুরআন পাঠ করা হয়- তাহলে সে কুরআনের সমঝদার নয়। বর্তমান যুগের পরিভাষায় এর নাম সংস্কৃতি তো রাখা যায়, কিন্তু তা প্রকৃত অর্থে কুরআন তেলাওয়াত হতে পারে না। সুর এবং লয়ের মাধ্যমে কুরআন পাঠ সুমধুর স্বরে কুরআন পাঠ করার সংজ্ঞার আওতায় পড়ে না।

‘তাগান্না বিল কুরআন’- এর আরেক অর্থও হচ্ছে এই যে, কুরআনকে নিয়ে মানুষ দুনিয়ার অন্য সবকিছুর মুখাপেক্ষীহীন হয়ে যাবে। সে কুরআন মাজীদকে আয়-উপার্জনের হাতিয়ার পরিনত করবে না। বরং সে কুরআনের ধারক হয়ে- যে মহান খোদার এই কালাম- তাঁর উপরই ভরসা করবে। কারো কাছে সে হাত পাতবে না এবং কারো সামনে তাঁর মাথা নত হবে না। সে কাউকেও ভয় করবে না, কারো কাছে কিছু আশাও করবে না। যদি এটা না হয় তাহলে সে কুরআনকে তো ভিক্ষার পাত্র বানিয়েছে- কিন্তু সে কুরআনকে পেয়েও দুনিয়াতে স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে পারে নি।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি