চতুর্থ অধ্যায়
পারিবারিক জীবনের বৃহত্তর লক্ষ্য
পারিবারিক জীবন যাপনের মুখ্যতম লক্ষ্য স্ত্রী-পুরুষের যৌন জীবনে পরম শান্তি, নির্লিপ্ততা, নিরবচ্ছিন্নতা, পারস্পরিক অকৃত্রিম নির্ভরতা, উভয়ের মনের স্থায়ী শান্তি ও পরিতৃপ্তি লাভ। কিন্তু একথাই চূড়ান্ত নয়। বরং বংশ সৃষ্টির সদ্যজাত শিশু-সন্তানদের আশ্রয়দান, তাদের সুষ্ঠু লালন-পালন ও পরিধানও এর চরম ও বৃহত্তম লক্ষ্যের অন্যতম। মানব সন্তানের জন্ম হয়ত বা পারিবারিক জীবন ছাড়াও সম্ভব, কিন্তু তার পবিত্রতা বিধান, সুষ্ঠু লালন-পালন, সংরক্ষণ এবং ভবিষ্যৎ সমাজের উপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা পারিবারিক জীবন ব্যতীত আদৌ সম্ভব নয়।

কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে যা কিছু বলা হয়েছে, তা থেকে সুস্পষ্ট মনে হয় যে, স্বামী-স্ত্রী সম্মিলিত জীবন যাপনের মুখ্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্তান জন্মদান। মানুষের বংশ বৃদ্ধি সম্ভবই হয়েছে আদি পিতা ও আদি মাতার স্বামী-স্ত্রী হিসেবে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ফলে।

কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি এ পর্যায়ে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্যঃ

(আরবী*****************************************************************************)

হে মানুষ, তোমরা ভয় করো তোমাদের সেই পরোয়ারদিগারকে, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একটি মাত্র প্রাণী থেকে এবং সৃষ্টি করেছেন তার থেকে জুড়িকে এবং এ দু’জন থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু সংখ্যক পুরুষ ও স্ত্রীলোক।

এখানে মানব সৃষ্টির ইতিহাস ও তত্ত্বকথা খুব সংক্ষেপে বলে দেয়া হয়েছে। দুনিয়ায় মানব জাতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা প্রথম আদমকে সৃষ্টি করলেন। এর পরই তাঁরই থেকে সৃষ্টি করলেন ‘হাওয়া’কে তাঁরই জুড়ি হিসেবে। পরে তাঁরা দু’জন স্বামী-স্ত্রী হিসেবে জীবন যাপন করতে থাকেন। এ স্বামী-স্ত্রীর যৌন মিলনের ফলেই দুনিয়ায় এ বিপুল সংখ্যক মানুষের অস্তিত্ব ও বিস্তার লাভ সম্ভব হয়েছে।

কুরআনের উপস্থাপিত মানুষের এ ইতিহাস প্রথম নরনারী স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পারিবারিক জীবন যাপনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। দ্বিতীয়ত প্রমাণ করে যে, এ পারিবারিক জীবন যাপনও উদ্দেশ্যহীন নয়, পাশবিক লালসাসর্বস্ব নিরুদ্দেশ যৌন চর্চা নয় –বরং তার মূলে বৃহত্তর লক্ষ্য হচ্ছে সন্তান জন্মদান, সন্তানের লালন-পালন, তাদের এমনবাবে যোগ্য করে তোলা, যেন তারা ভবিষ্যৎ সমাজের নাগরিক হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।

বস্তুত প্রথম নর সৃষ্টির পরই তার জুড়ি হিসেবে প্রথম নারী সৃষ্টির তাৎপর্য এই হতে পারে। এই প্রথম মানব পরিবারে বিশজন পুত্র সন্তান এবং বিশজন কন্যা সন্তান (মোট চল্লিশজন) রীতিমত হিসাব করে দেয়া হয়েছিল-[ইসহাক ও ইবনে আসাকির হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেনঃ (আরবী*****************) –আদমের মোট চল্লিশটি সন্তান হয়, তাদের মধ্যে বিশজন ছেলে ও বিশজন মেয়ে।] এ উদ্দেশ্যেই যে, এই প্রথম পরিবারটি পরেও যেন নরনারীর পারিবারিক জীবন যাপন অব্যাহত গতিতে চলতে পারে এবং সে সব পরিবারেও যেন ছেলে ও মেয়ের জন্মের ফলে পারিবারিক জীবন ধারার অগ্রগতি সম্ভব হতে পারে। অপর আয়াতে এদিকে ইঙ্গিত করেই বলা হয়েছেঃ

(আরবী*********************************************************************)

তোমাদের স্ত্রীলোক ক্ষেতস্বরূপ, অতএব তোমরা তোমাদের ক্ষেতে গমন করো যেমন করে তোমরা চাও এবং তোমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ রচনার জন্যে এখনি ব্যবস্থা গ্রহণ করো। আল্লাহকে ভয় করো, ভালোভাবে জেনে রাখো, তোমরা সকলে নিশ্চয়ই একদিন তাঁর সাথে মিলিত হবে। আর ঈমানদার লোকদের সুসংবাদ দাও।

এ আয়াতে প্রথমত স্বামী-স্ত্রীর যৌন জীবনকে লক্ষ্য করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ তোমাদের স্ত্রীরা হচ্ছে তোমাদের ক্ষেতস্বরূপ। কথাটি দৃষ্টান্তমূলক এবং অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কুরআনের শব্দ (আরবী******) এর অর্থ হচ্ছেঃ

(আরবী*************************************************)

জমিনে বীজ বপন করা এবং জমিনকে ফসলের উপযোগী করে তোলা।

আর কুরআনে স্ত্রীদের (আরবী*********) বলা তাৎপর্য এই যেঃ

(আরবী******************************************************************)

মেয়েলোকদের সঙ্গে সম্পর্ক হচ্ছে এমন জিনিস চাষের, যার ওপর মানব বংশের স্থিতি ও রক্ষা নির্ভর করে, যেমন করে জমিনের সাথে সম্পর্ক হচ্ছে এমন জিনিস চাষের, যার ওপর সে ফসলের প্রজাতিকে অস্তিত্ব রক্ষা নির্ভর করে।

মওলানা মওদুদী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় যা লিখেছেন, তা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেনঃ

আল্লাহর কায়েম করা ফিতরাত মেয়েদেরকে পুরুষদের জন্যে বিহার কেন্দ্ররূপে বানায় নি। বরং মেয়ে ও পুরুষদের মাঝে ক্ষেত ও কৃষকের সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। ক্ষেতে কৃষক কেবল স্ফুর্তি করার উদ্দেশ্যে গমন করে না বরং গমন করে এ উদ্দেশ্যে যে, তা থেকে ফসল লাভ করবে। মানব বংশের কৃষককেও মানবতার এ ক্ষেতে যাওয়া দরকার এ উদ্দেশ্য নিয়ে যে, সেখান থেকে মানব বংশের ফসল লাভ করা হবে। আল্লাহর শরীয়ত এ নিয়ে কোনো আলোচনা করে না যে, তোমরা এ ক্ষেতে চাষ কিভাবে করবে, অবশ্য শরীয়তের দাবি এই যে, তোমরা এ ক্ষেতে যাবে এবং এ উদ্দেশ্য নিয়েই যাবে যে, সেখান থেকে তোমাদের ফসল লাভ করতে হবে। (আরবী************************)

স্ত্রী সহবাসের উদ্দেশ্যে যে সন্তান লাভ, তা আয়াতের শেষাংশ “তোমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ রচনার জন্যে এখনি ব্যবস্থা গ্রহণ করো” থেকে প্রমাণিত হয়। কেননা আয়াতের এ অংশের অর্থ আল্লামা পানিপত্তীর ভাষায় নিম্নরূপঃ

(আরবী*************************************************************************)

অর্থাৎ তোমরা বিয়ে দ্বারা উপস্থিত স্বাদ গ্রহণকে উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করো না, বরং তা থেকে এমন কিছু লাভ করতে চেষ্টা করো, যার ফলে দ্বীনের কোনো ফায়দা হবে। যেমন যৌন অঙ্গের পবিত্রতা বিধান এবং নেক ও সৎ স্বভাবের সন্তান লাভ, যার জন্যে আল্লাহর কাছে দো’আ করবে ও মাগফিরাত কামনা করবে।

কুরআন মজীদে স্বামী-স্ত্রী সহবাস সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************************************)

এখন তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সাথে যৌন মিলন সম্পন্ন করো এবং কামনা করো যা আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্যে নির্দিষ্ট করে রেখেছেন।

এখানে ‘মুবাশিরাত’ মানে যৌন মিলন, সঙ্গম-ক্রিয়া। আর ‘আল্লাহ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন’ বলতে বোঝঅনো হয়েছে সন্তানাদি –যা লওহে মাহফুযে সকলের জন্যে ঠিক করে রাখা হয়েছে।

এ আয়াতের লক্ষ্য হচ্ছে স্ত্রী-সহবাস করে সন্তানাদি লাভের জন্যে আল্লাহর কাছে দো’আ করা। হযরত ইবনে আব্বাস, জহাক, মুজাহিদ প্রমুখ তাবেয়ী এ আয়াত থেকে এ অর্থই বুঝেছেন। আল্লামা আ-লুসী এ আয়াত সম্পর্কে লিখেছেনঃ

(আরবী****************************************************************************************)

এ আয়াতে বোঝানো হয়েছে যে, স্ত্রী সঙ্গমকারীর কর্তব্য হচ্ছে, সে বিয়ে ও যৌন ক্রিয়ার মূলে বংশ রক্ষাকে উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করবে –নিছক যৌন-লালসা পূরণ নয়। কেননা আল্লাহ তা’আলা আমাদের প্রজাতীয় অস্তিত্বকে একটা বিশেষ স্তর পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে –যেমন আমাদের মধ্যে খাদ্য গ্রহণ স্পৃহা সৃষ্টি করেছেন আমাদের ব্যক্তিদের জৈব জীবন একটা সময় পর্যন্ত বাচিয়ে রাখার জন্যে। নিছক যৌন স্পৃহা পূরণ তো নিম্নস্তরের পশু ছাড়া আর কারোর কাজ হতে পারে না।

আল্লামা শাওকানী এ আয়াতের অর্থ লিখেছেনঃ

(আরবী***************************************************************************************)

অর্থাৎ তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সাথে যৌন ক্রিয়ার দ্বারা বিয়ের বৃহত্তর উদ্দেশ্য লাভের বাসনা পোষন করো এবং তা হচ্ছে সন্তান ও ভবিষ্যৎ বংশধর লাভ।

ইমাম রাগিব ইসফাহানী লিখেছেনঃ

(আরবী***************************************************************************************)

আয়াতে বিয়ের ইচ্ছা করা সম্পর্কে এক সূক্ষ্ম কথার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর তা এই যে, আল্লাহ তা’আলা আমাদের মধ্যে যৌন স্পৃহা সৃষ্টি করেছেন একটা সময় পর্যন্ত মানব বংশের সংরক্ষণ ও স্থিতির জন্যে, যেমন আমাদের জন্যে খাদ্য স্পৃহা সৃষ্টি করেছেন আমাদের ব্যক্তিদের জৈব সত্তা একটা সময় পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখার জন্যে। অতএব মানুষের কর্তব্য হচ্ছে বিয়ে কের সে উদ্দেশ্য লাভ করা, যা জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক ও ন্যায়পরতার দৃষ্টিতে আল্লাহ তা’আলা ঠিক করে দিয়েছেন। আর যখনি কেউ বিয়ের সাহায্যে শরীয়ত মুতাবিক আত্মসংযম ও সংরক্ষণের কাজ করবে, সে আল্লহার লিখন অনুযায়ী উদ্দেশ্য লাভে নিয়োজিত হলো।

কুরআন মজীদের অপর এক আয়াতে বলা হয়েছেঃ

(আরবী******************************************************************)

আল্লাহ তোমাদের জন্যে তোমাদের মানুষের মধ্য থেকেই জুড়ি বানিয়েছেন। জন্তু জানোয়ারের জন্যেও তাদেরজুড়ি বানিয়েছেন, তিনিই তোমাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন।

অর্থাৎ

(আরবী*****************************************************)

তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মানুষ জাতির মধ্য থেকেই মেয়েলোক এবং মেয়েলোকের জন্যে পুরুষ লোক সৃষ্টি করেছেন।

আর “সংখ্যা বৃদ্ধি করেন” মানেঃ

(আরবী****************************************************************************************)

তোমাদের জোড়ায়-জোড়ায় বানিয়ে তোমাদের সংখ্যা বিপুল করেছেন। কেননা বংশ বৃদ্ধির এই হলো মূল কারণ।

মুজাহিদ বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************************)

অর্থাৎ তোমাদেরকে বংশের পর বংশে ও যুগের পর যুগে ক্রমবর্ধিত করে সৃষ্টি করেছেন।

বস্তুত সন্তান লাভের উদ্দেশ্যে স্বামী-স্ত্রীর যৌন মিলনই হচ্ছে ইসলামের পারিবারিক জীবনের লক্ষ্য এবং যে মিলন এ উদ্দেশ্যে সম্পন্ন হয়, তাই ইসলামসম্মত মিলন। এ মিলনের ফলে সন্তান যখন স্ত্রীর গর্ভে স্থানলাভ করে তখন একাধারে স্বামী ও স্ত্রীর ওপর এক নবতর দায়িত্বর অর্পিত হয়। তখন স্ত্রীর দায়িত্ব এমনভাবে জীবন যাপন ও দিন-রাত অতিবাহিত করা, যাতে করে গর্ভস্থ সন্তান সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে, বেড়ে ওঠার ব্যাপারে কোনোরূপ বিঘ্নের সৃষ্টি না হয় এবং কর্তব্য হচ্ছে এমন সব কাজ ও চাল-চলন থেকে বিরত থাকা, যার ফলে সন্তানের নৈতিকতার ওপর দুষ্ট প্রভাব পড়তে না পারে। এ পর্যায়ে পিতার কর্তব্যও কিছুমাত্র কম নয়। তাকেও স্ত্রীর স্বাস্থ্য, চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া ও বিম্রামের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে এবং মা ও সন্তান –উভয়ের স্বাস্থ্য রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় যত্ন ও ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে।

গর্ভে সন্তান সঞ্চার হওয়ার পর মায়ের কর্তব্য স্বীয় স্বাস্থ্য এবং মন উভয়কেই যথাসাধ্য সুস্থ রাখতে চেষ্টা করা। কেননা গর্ভস্থ ভ্রূণের সাথে মায়ের দেহ-মনের গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। এ সময় মা যদি অধিক মাত্রায় শারীরিক পরিশ্রম করে, তবে গর্ভস্থ সন্তানের শরীর গঠন ও বাড়তির উপর তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি ও নর্তন-কুর্দনও ভ্রূণের পক্ষে বড়ই ক্ষতিকর। শুধু তাই নয়, গর্ভবতী নারীর চাল-চলন, চিন্তা-বিশ্বাস, গতিবিধি ও চরিত্রের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে গর্ভস্থ সন্তানের মন ও চরিত্রের ওপর। এ সময় মা যদি নির্লজ্জভাবে চলাফেরা করে, করে কোনো লজ্জাকর কাজ, তবে তার গর্ভস্থ সন্তানও অনুরপ নির্লজ্জ ও চরিত্রহীন হয়ে গড়ে উঠবে এবং তার বাস্তব প্রকাশ দেখা যাবে তার যৌবনকালে। পক্ষান্তরে এ সময় মা যদি অত্যন্ত চরিত্রবতী নারী হিসাবে শালীনতার সব নিয়ম-কানুন মেনে চলে, তার মন-মগজ যদি এ সময় পূর্ণভাবে ভরে থাকে আল্লাহর বিশ্বাস, পরকাল ভয় এবং চরিত্রের দায়িত্বপূর্ণ অনুভূতিতে, তবে সন্তানও তার জীবনে অনুরূপ দায়িত্ব জ্ঞানসম্পন্ন, চরিত্রবান ও আল্লাহানুগত হয়ে গড়ে উঠবে। ভ্রূণের সঙ্গে মায়ের কেবল দেহেরই নয়, মনেরও যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে, সে দৃষ্টিতে বিচার করলে উপরের কথাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এ জন্যে গর্ভবতী স্ত্রীলোকদের কর্তব্য এ সময় শালীনতা ও লজ্জাশীলতার বাস্তব প্রতিমূর্তি হয়ে সব সময় আল্লহার মনোযোগ রক্ষা করা, কুরআন তিলাওয়াত ও নিয়মিত নামায পড়া। ‘ভালো মা হলে ভালো সন্তান হবে, আমাকে ভালো মা দাও আমি ভালো জাতি গড়ে দেব’ –নেপোলিয়ান বোনাপার্টির সে কথাটির কার্যকারিতা ঠিক এ সময়ই হয়ে থাকে।

সূরা ‘আল-বাকারার’ পূর্বোক্ত আয়াতে (আরবী****************) এবং তোমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ রচনার জন্যে এমনি ব্যবস্থা গ্রহণ করো’ অংশের দুটো অর্থ হতে পারে। একটি হচ্ছেঃ দুনিয়ার বৈষয়িক কাজে-কর্মে এত দূর লিপ্ত হয়ে যেও না, যার ফলে তোমরা দ্বীনের কাজে গাফির হয়ে যেতে পারো। আর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, স্ত্রী-সহবাস করবে তোমরা এ নিয়ত সহকারে যে, তোমরা আল্লাহর মেহেরবানীতে যেন সন্তান লাভ করতে পার এবং দুনিয়ার জীবনে সে সন্তান তোমাদের কাজে লাগতে পারে। তোমরা যখন বৃদ্ধ, অকর্মণ্য ও উপার্জনক্ষমতায় রহিত হয়ে যাবে, তখন যেন তারা তোমাদের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। আর তারা তোমাদের জন্যে –তোমাদের রূহের শান্তি ও মাগফিরাতের জন্যে আল্লারহার কাছে দো’আ করতে পারবে। এভাবেই পিতামাতার মঙ্গলময় ভবিষ্যৎ রচতি হতে পারে। এ ভবিষ্যৎ ইহকালীন যেমন, পরকালীনও ঠিক তেমনি।

সন্তানের বিপদ

গর্ভস্থ সন্তানের ওপর নানারূপ বিপদ আসতে পারে। তার মধ্যে অনেকগুলো নৈসর্গিক, অনেকগুলো গর্ভবতী স্ত্রীলোকের স্বাস্থ্যগত কারণে। আবার পিতামাতার ইচ্ছাকৃত বিপদ আসাও অসম্ভব নয়। সে বিপদ কয়েক রকমের হতে পারে। পিতামাতা গর্ভপাতের ব্যবস্থা করতে পারে, পারে এমন অবস্থা করতে যার ফলে গর্ভের সন্তান অঙ্কুরিতই হতে পারবে না, গর্ভসঞ্চার হওয়াই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

সন্তান যাতে জন্মাতে না পারে তার জন্যে প্রাচীনকাল থেকে নানা প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে, নানা প্রকারের উপায় উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রাচীন কালের লোকেরা এ উদ্দেশ্যেই আজল করত। আজল মানেঃ

(আরবী**************************************************************)

পুরুষাঙ্গ স্ত্রী অঙ্গের ভেতর থেকে বের করে নেয়া, যেন শুক্র স্ত্রী-অঙ্গের ভেতর স্খলিত হওয়ার পরিবর্তে বাইরে স্খলিত হয়।

জাহিলিয়াতের যুগে লোকেরা এ কাজ করত গর্ভ সৃষ্টি না হয় –এ উদ্দেশ্যে। যদিও তার ফলে গর্ভসঞ্চারিত হবে না –তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। জাহিলিয়াতের যুগে সন্তানের আধিক্য কিংবা আদৌ সন্তান হওয়া থেকে বাঁচার জন্যে লোকেরা সন্তান প্রসবের সঙ্গে সঙ্গে অথবা কিছুটা বড় হলে তাকে হত্যা করত। কেবল কন্যা সন্তানই নয়, পুত্র সন্তানকেও এ উদ্দেশ্যে হত্যা করা হতো।

বর্তমানে বৈজ্ঞানিক যুগে এ উদ্দেশ্যে বহু উপায় উদ্ভাবন করা হয়েছে। যৌন অঙ্গে হালকা-পাতলা রবারের টুপি পরাবার রেওয়াজ চলছে। যৌন মিলনের পর নানা কসরত করে গর্ভ সঞ্চারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হচ্ছে, নানা ঔষধ ব্যবহার করে সন্তানকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার ব্যবস্থাও আজ করা হচ্ছে। এক কথায় বলা যায়, গর্ভ নিরোধের প্রাচীন ও আধুনিক যত ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়েছে ও হচ্ছে সবই গর্ভস্থ সন্তানের পক্ষে –তথা মানব বংশের পক্ষে কঠিন বিপদ বিশেষ।

গর্ভনিরোধ, গর্ভপাত, ভ্রূণ হত্যা কিংবা সদ্যপ্রসূত সন্তান হত্যা করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। চিকিৎসা বিজ্হানের দৃষ্টিতে এর প্রয়োজন হলে অন্য কথা এবং তা নেহায়েত ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো দিক দিয়েই এ কাজকে সমর্থন করা হয়নি। নৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক –সর্বোপরি মানবিক সকল দিক দিয়েই এ কাজ শুধু অবাঞ্ছিতই নয়, অত্যন্ত মারাত্মক। যে পিতামাতা নিজেরাই নিজেদের সন্তানের জানের দুশমন হয়ে দাঁড়ায়, তারা যে গোটা মানব জাতির দুশমন এবং কার্যত সে দুশমনি করতে একটুও দ্বিধা করছে না। কেননা নিজ ঔরসজাত, নিজ গর্ভস্থ বা গর্ভজাত সন্তানকে নিজেদের হাতেই হত্যা করার জন্যে প্রথমত নিজেদের মধ্যে অমানুষিক নির্মমতা, কঠোরতা ও নিতান্ত পশুবৃত্তির উদ্ভব হওয়া আবশ্যক, অন্যথায় এ রকম কাজ কারো দ্বারা সম্ভব হতে পারে না, তা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। ব্যক্তির এ নির্মমতা ও কঠোরতাই সংক্রমিত হয়ে গোটা জাতিকে গ্রাস করে, গোটা জাতির প্রতিই তা শেষ পর্যন্ত আরোপিত হয়। বস্তুত নিজেদের সন্তান নিজেরাই ধ্বংস করে –এর দৃষ্টান্ত প্রাণী জগতে কোথাও পাওয়া যায় না।

প্রাচীনকালে আরব সমাজে ‘আজল’ করার যে প্রচলন ছিল, ইসলাম তা সমর্থন করেনি। এ সম্পর্কে হাদীসে বিস্তারিত তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এখানে তার সম্যক আলোচনা পেশ করা যাচ্ছে।

হযরত জাবির (রা) বলেনঃ

(আরবী**********************************************************************)

আমরা রাসূলের জীবদ্দশায় ‘আজল’ করতাম অথচ তখন কুরআন নাযিল হচ্ছিল।

অর্থাৎ কুরআন মজীদে আজল সম্পর্কে কোনো নিষেধবাণী আসেনি। আর রাসূলে করীমও তা নিষেধ করেন নি।

হযরত আবূ সাঈদ বলেনঃ

(আরবী***************************************************************************)

আমরা রাসূলে করীম (স)-এর সঙ্গে বনী মুস্তালিকের যুদ্ধে বের হয়ে গেলাম। সেখানে কিছু সংখ্যক আরবকে বন্দী করে নিলাম, তখন আমাদের মদ্যে স্ত্রীলোকদের প্রতি আকর্ষণ জাগে, যৌন ক্ষুধাও তীব্র হয়ে ওঠে এবং এ অবস্থায় ‘আজল’ করাকেই আমরা ভালো মনে করলাম। তখন এ সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)-এর কাছে জিজ্ঞেস করলাম। জবাবে তিনি বললেনঃ তোমরা যদি তা করো তাতে তোমাদরে ক্ষতি কি? কেননা আল্লাহ তা’আলা কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ সৃষ্টি করবেন তা তিনি নির্দিষ্ট করে রেখেছেন এবং তা অবশ্যই সৃষ্টি করবেন।

নবী করীম (স) ‘আজল’ সম্পর্কে বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************************)

তুমি কি সৃষ্টি করো? তুমি কি রিযিক দাও? তাকে তার আসল স্থানেই রাখো; আসল স্থানে সঠিকভাবে তাকে থাকতে দাও। কেননা এ ব্যাপারে আল্লাহর চূড়ান্ত ফয়সালা রয়েছে।

উপরে বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবূ সাঈদ বর্ণিত হাদীসে যেখানে (আরবী**********) “তোমাদের কি ক্ষতি হয়” বলা হয়েছে, সেস্থলে বুখারী এবং অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে উদ্ধৃত ভাষ্য হচ্ছে (আরবী************) না, তোমাদের এ কাজ না করাই কর্তব্য।

ইবনে সিরীন-এর মতে এ বাক্যে ‘আজল’ সম্পর্কে স্পষ্ট নিষেধ না থাকলেও এ যে নিষেধেরই একেবারে কাছাকাছি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আর হাসানুল বাসরী বলেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************)

আল্লাহর শপথ, রাসূলের এ কথায় আজল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভৎসনা ও হুমকি রয়েছে।

ইমাম কুরতুবী বলেছেনঃ সাহাবিগণ রাসূলে করীম (স)-এর উক্ত কথা থেকে নিষেধই বুঝেছিলেন। ফলে এ অর্থ দাঁড়ায় –রাসূলে করীম (স) যেন বলেছেনঃ

(আরবী***************************************************************************)

তোমরা আজল করো না, তা না করাই তোমাদের কর্তব্য।

বাক্যের শেষাংশে প্রথমাংশের তাগিদস্বরূপ বলা হয়েছে। হযরত জাবির বলেছেনঃ নবী করীম (স)-এর খেদমতে একজন আনসারী এসে বললেনঃ

(আরবী*******************************************************************)

আমার কাছে একটি ক্রীতদাসী রয়েছে এবং আমি তার থেকে আজল করি।

তখন নবী করীম (স) বললেনঃ

(আরবী**********************************************************)

আল্লাহ যা করার ইচ্ছে করেছেন, তা বন্ধ করার সাধ্য আজলের নেই।

জুজামা বর্ণিত হাদীসে নবী করীম (স) ‘আজল’ সম্পর্কে বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************)

নিশ্চয়ই এ হচ্ছে গোপন নরহত্যা।

হযরত আবূ সাঈদ বর্ণিত এক হাদীসে এ কথাটিকে ইহুদীদের উক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ইহুদীদের একথা শুনে নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী******************************************************************)

ইহুদীরা মিথ্যা বলেছে, আল্লাহ যদি কোনো কিছু সৃষ্টি করতেন চান, তবে তাতে বাধা দেবার ক্ষমতা কারো নেই।

হযরত আবূ সাঈদ থেকে বর্ণিত অপর এক হাদীসের শেষাংশে রাসূলে করীম (স)-এর নিম্নোক্ত কথা উদ্ধৃত হয়েছেঃ

(আরবী****************************************************************************************)

কিয়ামত পর্যন্ত যত প্রাণীই জন্ম নেবার রয়েছে, তা অবশ্য অবশ্যই জন্ম নেবে।

ইমাম তাহাভী বলেছেনঃ জুজামার হাদীসে প্রথমকার অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। কেননা প্রথম দিক দিয়ে আহলি কিতাবদের অনুসরণে অনেক কাজ করা হতো, তার পরে প্রকৃত বিষয় সম্পর্কে ওহী নাযিল হলে পরে রাসূলে করীম (স) ইহুদীদের এ কথাকে মিথ্যা বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু ইবনে রুশদ ও ইবন আরাবী বলেছেনঃ নবী করীম (স) ইহুদীদের অনুসরণ করে কোনো জিনিস হারাম করবেন এবং পরে আবার তাদের মিথ্যাবাদী বলবেন, তা বিশ্বাস করা যায় না। জুজামার হাদীসকে অনেক মুহাদ্দিসই সহীহ ও গ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন। আর তার বিপরীত অর্থের হাদীস সনদের দুর্বলতার কারণে দুর্বল বলে অভিহিত করেছেন।

বিশেষত এ কারণেও জুজামার হাদীস গ্রহণ করা দরকার যে, জুজামা মক্কা জয়ের বছর ইসলাম কবুল করেছেন বিধায় তাঁর বর্ণিত হাদীস এ পর্যায়ে সর্বশেষ এবং অন্য হাদীসকে বাতিল করে দিয়েছে।

জুজামা বর্ণিত হাদীসকে ভিত্তি করে ইবরাহীম নখয়ী, সালেম ইবনে আবদুল্লাহ, আসওয়াদ ইবনে ইয়াযিদ এবং তায়ূস প্রমুখ তাবেয়ী মত প্রকাশ করেছেন যে, আজল করা মাকরূহ। এর কারণস্বরূপ তাঁরা বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************************************************)

যেহেতু আজল করাকে রাসূলে করীম (স) হত্যা-অপরাধের সমতুল্য করে দিয়েছেন। তবে পার্থক্য এই যে, তা হচ্ছে গোপন হত্যা। কেননা যে লোক আজল করে, সে তা করেই সন্তান হওয়ার আপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার উদ্দেশ্যে। এ কারণেই ‘আজল’-কে ‘ছোট হত্যা’ বলা হয়েছে। আর ‘বড় হত্যা’ হচ্ছে জীবন্ত অবস্তায় কবরে পুঁতে দেয়া।

আল্লামা ইবনে কাইয়্যেম বলেছেনঃ

আজল করলে আর গর্ভ সঞ্চারে আশংকা থাকে না এবং এতে বংশ বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাওয়া ইহুদীদের এ ধারণাকেই রাসূলে করীম (স) মিথ্যা বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************************)

আল্লাহই যদি সৃষ্টি করতে চান তাহলে আজলের ফলে গর্ভ সঞ্চার হওয়া বন্ধ হতে পারে না। আল্লাহই যদি সৃষ্টি করার ইচ্ছা না করে থাকেন তাহলে ‘আজল’ করলে তাতে গোপন হত্যা হবে না।

‘আজল’ করলে গর্ভ সঞ্চারের পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং গর্ভ সঞ্চার না হওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত হওয়া যায় –একথা যে একেবারেই ঠিক নয়, তা রাসূলে করীম (স)-এর অপর একটি বাণী থেকেও অকাট্য প্রমাণিত হয়। এক ব্যক্তি ‘আজল’ করা সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)-এর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি বললেনঃ

(আরবী****************************************************************)

যে শুক্রে সন্তান হবে তা যদি তুমি প্রস্তরের ওপরও নিক্ষেপ করো, তা হলে আল্লাহ তা’আলা তা দিয়েও সন্তান পয়দা করবেন।

আর জুজামার হাদীসে ‘আজল’কে গোপন হত্যা বলে অভিহিত করার কারণ এই যে, গর্ভ সঞ্চার হওয়ার ভয়ে লোকেরা ‘আজল’ করে। ফলে যা উদ্দেশ্য –সন্তান হওয়া –তাকে সন্তান হত্যার পর্যায়ের কাজ বলে ধরে নেয়া হয়েছে, যদিও এ দুটোর মাঝে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। প্রকাশ্য হত্যার উদ্দেশ্য এবং কাজ এক ও অভিন্ন আর ‘আজল’ ও হত্যায় কেবল উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে ঐক্য রয়েছে।

আজল ও জন্ম নিয়ন্ত্রণ

তবুও ‘আজল’কে স্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে কেউ কেউ জায়েয বলে ঘোষণা করেছেন। তাঁদের দলীল হচ্ছে কেবলমাত্র হযরত জাবির বর্ণিত হাদীস, যাতে বলা হয়েছে, “কুরআন নাযিল হচ্ছিল আর আমরা ‘আজল’ করছিলাম”। তার মানে কুরআনে এ সম্পর্কে কোনো নিষেধবাণী উচ্চারিত হয়নি। আর রাসূলে করীম (স)-ও তা জানতেন; কিন্তু তিনিও নিষেধ করেন নি। কিন্তু একথা যে হাদীসভিত্তিক আলোচনায়ও টেনে না, তা পূর্বেই বলেছি। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, সে কালের ‘আজল’কে জায়েয মনে করে একালের জন্ম নিয়ন্ত্রণ (Birth control)-কে কেউ কেউ জায়েয বলতে চান। তাঁরা বলেনঃ প্রাচীন কালের ‘আজল’ ছিল সেকালেরই উপযোগী জন্ম নিয়ন্ত্রণ পন্থা। একালে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় যা করা হচ্ছে, ঠিক তাই করা হতো সেকালের এ অবৈজ্ঞানিক উপায়ে। কিন্তু এরূপ বলা যা কতখানি ধৃষ্টতা বরং নির্বুদ্ধিতা এবং আল্লাহর শরীয়তের সঙ্গে তামাসা করা, তা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যায়।

প্রথমত দেখা দরকার, এ কালে জন্ম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য কি এবং ঠিক কোন কারণে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে লোকেরা প্রস্তুত হচ্ছে। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, কেবলমাত্র অর্থনৈতিক কারণেই বর্তমান দুনিয়ার লোকেরা জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্তা গ্রহণ করতে চাচ্ছে, অন্তত জোর গলায় তাই প্রচার করা হয়। কখনো কখনো পারিবারিক সুখ-শান্তি ও স্ত্রীর স্বাস্থ্যের দোহাই যে দেয়া হয়, তাও দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে এ এক ব্যাপক সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করেছে। কিন্তু ‘আজল’ কোনো দিহই এমন ছিল না। অর্থনৈতিক কারণে সেকালে আজল করা হতো না।

বড় জোর বলা যায়, সামাজিক ও সাময়িক জটিলতা এড়ানোর উদ্দেশ্যেই তা করা হতো। আর এ কারণের দিক দিয়ে এ দুটোকে কখনই অভিন্ন মনে করা যায় না। বিশেষত খাদ্যভাব ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ‘আজল’ করা সঙ্গত মনে করা হলে তার অর্থ হয়ঃ ‘আজল’কে জায়েয প্রমাণকারী হাদীসসমূহ আল্লাহর রিযিকদাতা হওয়ার বিশ্বাসকে ভিত্তিহীন করে দিচ্ছে। কুরআন মজীদে সন্তান হত্যা নিষেধ করে যে সব আয়াত উদ্ধৃত হয়েছে, তার ভিত্তিই হচ্ছে এ কথার ওপরঃ (আরবী***************) ‘আমিই তাদের রিযিক দেব, তোমাদেরকে আমিই রিযিক দিয়ে থাকি’।

এক্ষণে দারিদ্র্য ও অভাবের ভয়ে ‘আজল’ করা যদি সঙ্গত হয়, তাহলে তার মানে হবে, আল্লাহর রিযিকদাতা হওয়ার বিশ্বাসই খতম হয়ে গেছে এবং যে ভিত্তিতে সন্তান হত্যা নিষেধ করা হয়েছে, তাই চুরমার হয়ে যায় ‘আজল’-কে শরীয়তসম্মত মনে করলে।

আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে লোকদের বিভ্রান্তি ও ভুল বোঝাবুঝিই হচ্ছে এরূপ ধারণার প্রধান কারণ। ‘আজল’-এর অনুমতিকে তার আসল পটভূমি ও পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করে এক স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যাপার মনে করে নিলে এ ভুল হওয়া খুবই স্বাভাবিক –এমন কোনো হাদীসই পাওয়া যাবে না, যাতে দারিদ্র্য ও অভাবের কারণে জন্ম নিয়ন্ত্রণকে ঘৃণা সহকারে হলেও বরদাশত করার কথা বলা হয়েছে। আর নবী করীম (স)-ই বা কেমন করে এমন কাজের অনুমতি দিতে পারেন, যে কাজকে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করে দিয়েছেন? কুরআন মজীদে এ সম্পর্কে স্পষ্ট নিষেধবাণী উচ্চারিত হয়েছে। সূরা ‘আল-আন আম’-এ বলা হয়েছেঃ

(আরবী*****************************************************)

এবং তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না দারিদ্র্যের কারণে, আমিই তোমাদের রিযিক দান করি এবং তাদেরও আমিই করব।

এ আয়াত সুস্পষ্টভাবে উপস্থিত দারিদ্র্যের কারণে সন্তান ‘হত্যা’ করতে নিষেধ করছে। যারা বর্তমানে দারিদ্র্য, অভাবগ্রস্থ, নিজেরাও খাবে সন্তানদেরও খাওয়াবে এমন সম্বল যাদের নেই, তারা আরো সন্তান জন্মদান করতে রীতিমত ভয় পায়; মনে করে আরও সন্তান হলে মারাত্মক দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হতে হবে, দেখা দেবে চরম খাদ্যাভাব। বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো তা হবে একান্তই দুর্বহ। উপরোক্ত আয়াত কিন্তু তাদের সম্পর্কে স্পষ্ট নিষেধবাণী এবং রিযিক দানের নিশ্চয়তাসূচক ওয়াদার সুস্পষ্ট ঘোষণা।

সূরা বনী ইসরাইলে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************************************************)

এবং তোমরা হত্যা করো না তোমাদের সন্তানদের দারিদ্র্যের ভয়ে। আমিই তাদের রিযিক দেব এবং তোমাদেরও; নিশ্চয়ই তাদের হত্যা করা বিরাট ভুল।

ভবিষ্যতে দারিদ্র্য ও অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ার আশংকায় যারা সন্তান জন্মনাদে ভয় পায়, যারা মনে করে আরো অধিক সন্তান হলে জীবনযাত্রার বর্তমান ‘মান’ (Standard) রক্ষা করা সম্ভব হবে না এবং এজন্যে জন্মনিরোধ বা নিয়ন্ত্রণের পন্থা গ্রহণ করে, উপরোক্ত আয়াতে তাদের সম্পর্কেই নিষেধবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে –বর্তমানে তোমাদের যেমন আমিই রিযিক দিচ্ছি, তোমাদের সন্তান হলে ভবিষ্যতে আমিই তাদের রিযক দেব, ভয়ের কোনো কারণ নেই।

কেউ কেউ বলেন, কুরআনে তো সন্তান হত্যা (আরবী*******) করতে নিষেধ করা হয়েছে, নিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ তো নিষিদ্ধ হয়নি, আর ‘আজল’ এবং জন্মনিরোধের আধুনিক প্রক্রিয়ায় গর্ভ সঞ্চার হওয়ার পথই বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তাতে সন্তান হত্যার কোনো প্রশ্নই নেই। তাই কুরআনের এ নিষেধবাণী এ কাজকে নিষিদ্ধ করেনি এবং এ প্রসঙ্গে তা প্রযোজ্য নয়। কিন্তু একথা যে কতখানি ভ্রান্ত, দুর্বল ও অমূলক তা আয়াত দু’টি সম্পর্কে একটা সূক্ষ্ম বিবেচনা করলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ দুটো আয়াতে সর্বাবস্থায়ই সন্তান হত্যা নিষেধ করে দিয়েছে, প্রতিক্রিয়া তার যাই হোক না কেন। আর ‘কতল’ শব্দের অর্থও কোনো জীবন্ত মানুষকে তরবারির আঘাতে হত্যা করাই কেবল নয়। কুরআন অভিধানে এবং তাফসীরে এর বিভিন্ন অর্থ দেখা যায়। আরবী অভিধান ‘আল কামুস’-এ বলা হয়েছে (আরবী*********) মানে (আরবী*************) মেরে ফেল –যে কোনো উপায়েই হোক না কেন। তাফসীর ‘রুহুল বয়ান’-এ বলা হয়েছেঃ (আরবী*******) মানে (আরবী*********) হালাক করে দেয়া, ধ্বংস করা। রাগিব ইসফাহানীর আল মুফরাদাত-এ বলা হয়েছেঃ

(আরবী**************************************************************)

‘কতল’ শব্দের আসল অর্থ দেহ থেকে প্রাণ বের করে দেয়া –যেমন মৃত্যু।

আর উপরোক্ত আয়াদ দু’টোতে যা বলা হয়েছে, রাগিব ইসফাহানীর মতে তা হচ্ছেঃ

(আরবী*************************************************************************)

আজল করে শুক্র বিনষ্ট করা এবং তাকে তার আসল স্থান ছাড়া অপর কোনো স্থানে নিক্ষেপ করা সম্পর্কে সুস্পষ্ট নিষেধ।

এ অর্থ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা যায়, কুরআন মজীদ কেবল আরব জাহিলিয়াতের ন্যায় জীবন্ত সন্তান হত্যা করতেই নিষেধ করেনি বরং যেকোন ভাবেই হত্যা করা হোক না কেন, তাকেই নিষেধ করেছে। শুধু তাই নয়, শুক্র নিষ্ক্রমিত হওয়ার পর তার জন্যে আসল আশ্রয় স্থান হচ্ছে স্ত্রীর জরায়ূ –গর্ভধারা। সেখানে তাকে প্রবেশ করতে না দিলে কিংবা কোনোভঅবে তাকে বিনষ্ট, ব্যর্থ ও নিস্ফল করে দিলেই তা এ নিষেধের আওতায় পড়বে এবং তা হবে সম্পূর্ণ ও সুস্পষ্ট হারাম কাজ। প্রাচীন কালের ‘আজল’ এবং একালের জন্ম নিরোধ বা জন্ম নিয়ন্ত্রণ –সবই এ দৃষ্টিতে হারাম কাজ হয়ে পড়ে। কেননা এ প্রক্রিয়ায় বাহ্যত প্রাণী হত্যা বা জীবন্ত সন্তান হত্যা না হলেও প্রথমত শুক্রকে বিনষ্ট করা হয় এবং দ্বিতীয়ত শুক্রকীট –যা আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে জীবন্ত তাকে তার আসল আশ্রয়স্থলে প্রবেশ করতে না দিয়ে পথিমধ্যেই খতম করে দেয়া হয়। ঠিক যে কারণে জীবিত সন্তান হত্যা নিষিদ্ধ, ঠিক সেই কারণেই জীবিত শুক্রকীট বিনষ্ট করাও নিষিদ্ধ। কেননা এ শুক্রকীটই তো সন্তান জন্মের মৌল উপাদান। তাফসীরে ‘রুহুল বয়ান’-এ একথাই বলা হয়েছেঃ

(আরবী***************************************************************************************)

সন্তান হত্যা করাকে হারাম করা হয়েছে এজন্যে যে, এর ফলে আল্লহার সংস্থাপিত মানব বংশের ভিত্তিই চূর্ণ হয়ে যায়, আর আল্লাহর সংস্থাপিত এ ভিত্তিকে যারা ধ্বংস করে, তারা অভিশপ্ত। কেননা এতে করে আল্লাহর বপিত বৃক্ষের ফল নষ্ট করা, তাকে কেটে নেয়া এবং মানুষের বংশকে শেষ করে দেয়া হয়।

শুধু তাই নয়, এ কাজ তারাই করতে পারে, যারা আল্লাহকে রিযিকদাতা বলে বিশ্বাস করে না, আল্লাহর ওপর নির্ভর করতে পারে না রিযিকের ব্যাপারে। তাফসীরে রুহুল বয়ান-এ এই বলা হয়েছেঃ

এ কাজে রিযিকের ব্যাপারে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল পরিহার করা হয় তার ফলে আল্লাহর ওয়াদাকে অবিশ্বাস করা হয় অথচ তিনি বলেছেনঃ জমিনে কোনো প্রাণীই নেই যার রিযিক সরবরাহের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর অর্পিত নয়।

জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও আজল –এ দুটোর মাঝে এদিক দিয়েও পার্থক্য আছে যে, ‘আজলে’ যেখানে শতকরা নব্বই ভাগই গর্ভ সঞ্চারনের সম্ভাবনা থেকে যায়, সেখানে জন্ম নিয়ন্ত্রণের আধুনকি প্রক্রিয়ায় সম্ভাবনাকে একেবারেই বিলুপ্ত করে দেয়া হয়। রাসূলে করীম (স) থেকে ‘আজল’ সম্পর্কে বর্ণিত প্রায় সব হাদীসেই এ ধরনের একটি কথা পাওয়া যায় যে, আল্লাহ যা সৃষ্টি করতে চান, তা বন্ধ করার ক্ষমতা কারো নেই –চেষ্টা করলেও তা সম্ভব নয়। ফলে ‘আজল’ ও জন্ম নিয়ন্ত্রণের মৌলিক পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কাজেই নিছক বোকা লোক ছাড়া এ দুটো প্রক্রিয়াকে এক ও অভিন্ন –আর বড়জোর সেকাল ও একালের পার্থক্য মাত্র বলে আত্মতৃপ্তি লাভ করতে পারে।

এ সম্পর্কে শেষ কথা এই যে, জন্ম নিয়ন্ত্রণের এমন কোনো প্রক্রিয়া অবলম্বন, যার ফলে সন্তান জন্মের সম্ভাবনা নিয়ন্ত্রিত কিংবা অবরুদ্ধ হয়ে যায় –কোনো দিক দিয়েই বিন্দুমাত্র কল্যাণকর হতে পারে না; না পারিবারিক জীবনে তার ফলে কোনো শান্তি সুখ আসতে পারে, না অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে।

কুরআন মজীদ এ সম্পর্কে স্পষ্টভাষী। বলা হয়েছেঃ

(আরবী***********************************************************************)

যারা নিজেরা নিজেদের সন্তানদের হত্যা করে নির্বুদ্ধিতাবশত কোনো প্রকার জ্ঞান-তথ্যের ভিত্তি ছাড়াই এবং আল্লাহর দেয়া রিযিককে নিজেদের জন্যে হারাম করে নেয় –আল্লাহর ওপর সম্পূর্ন মিথ্যা কথা আরোপ করে –তারা সকলেই ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তারা নিশ্চতই পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং তারা কখনো সঠিক পথে আসবে না।

সন্তান হত্যা –আর আধুনিক পদ্ধতি –জন্ম নিয়ন্ত্রণ, জন্মনিরোধ কোনো বুদ্ধিসম্মত কাজ নয়, চরম নির্বুদ্ধিতার কাজ। কোনো অকাট্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও জ্ঞান-তথ্যের ওপর ভিত্তিশীল নয়, নিছক আবেগ উচ্ছাস মাত্র; এতে করে আল্লাহর দেয়া রিযিক –সন্তানকে –নিজের জন্যে হারাম করে নেয়া হয় –সন্তান হতে দিতে অস্বীকার করা হয় অথবা এ সন্তানের ফলে আল্লাহ যে অতিরিক্ত রিযিক দিতেন তা থেকেও নিজেকে বঞ্চিত করা হয়; আর তা করা হয় আল্লাহর সম্পর্কে সম্পূর্ণ মিথ্যা ধারণা পোষণ করে, আল্লাহর প্রতি মিথ্যা কথা আরোপ করে যে, আরো সন্তান হলে তিনি খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবেন না বা করবেন না। তার ফলে এ কাজ যারা করে তারা ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ ক্ষতি কেবল নৈতিক নয়, বৈষয়িক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিতেও তা অপূরণীয়; ইহকালীন ও পরকালীন সব দিক দিয়েই তার ক্ষতি ভয়াবহ। আর এ ক্ষতির সম্মুখীন তারা হচ্ছে শুধু এ কারণে যে, আল্লাহর দেয়া বিদানকে তারা মেনে চলতে অস্বীকার করছে, এ গুমরাহীর পথকে তারা অনায়াসেই সে পথে চল চিরকল্যাণের দাবিদার হতে পারত। আর সত্যি কথা এই যে, হেদায়েতের সুস্পষ্ট পথ সামনে দেখেও যারা নিজেদের ইচ্ছানুক্রমে সুস্পষ্ট গুমরাহীর পথে অগ্রসর হতে থাকে, তারা যে কোনো দিনই হেদায়েতের পথে একবিন্দু চলতে পারবে –এদিকে ফিরে আসবে, এমন কোনো সম্ভাবনাই নেই। এসব কথাই হচ্ছে উপরোক্ত আয়াতের ভাবধারা। বস্তুত জন্ম নিয়ন্ত্রণের আধুনিক প্রচেস্টা প্রায় সবই যে ব্যর্থতার পর্যবসিত হয় এবং এর জন্যে ব্যয় করা হয় কোটি কোটি টাকা যে একেবারে নিস্ফল হয়ে যায় তা আজকের দুনিয়ায় বিভিন্ন দেশের ব্যর্থ চেষ্টার কাহিনী থেকেই অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়।

দ্বিতীয়ত এরূপ কাজের অর্থ দাঁড়ায় যে, আল্লাহর রিযিকদাতা হওয়ার কথায় কোনো বিশ্বাস নেই। এ কাজ ষোল আনাই বেঈমানী, নিতান্ত লোকদের দ্বারাই সম্ভব এ ধরনের কাজ, তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা, এ কাজ চরম নির্মমতার পরিচায়ক। মুনষ্যত্বের সুকোমল বৃত্তিসমূহ মানুষকে এ কাজ করতে কখনো রাজি হতে দেয় না। তাই কুরআন মজীদের ঘোষণার এ কাজ কেবল মুশরিকদের দ্বারাই সম্ভব বলা হয়েছেঃ

(আরবী**************************************************************************************)

এমনিভাবে বহু মুশরিকের জন্যে তাদের সন্তানকে হত্যা করার কাজকে তাদের শরীক –উপাস্য দেবতা ও শাসক নেতৃবৃন্দ খুবই চাকচিক্যময় ও আকর্ষণীয় কাজ হিসেবে প্রতিভাত করে দিয়েছে, যেন তারা তাদের ধ্বংস করে দিতে পারে এবং তাদের জীবন বিধানকে করে দিতে পারে তাদের নিকট অস্পষ্ট ভ্রান্তিপূর্ণ।

সন্তান হত্যা –জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও নিরোধ যে একটা মন-ভুলানো ও চাকচিক্যময় কাজ। এ কাজের অনিবার্য ফল একটা জাতিকে নৈতিকতার দিক দিয়ে দেউলিয়া করে দেয়া, বংমের দিক দিয়ে নির্বংশ করে যুবশক্তির চরম অভাব ঘটিয়ে সর্বস্বান্ত করে দেয়া ছাড়া আর কিছুই নয়, দুনিয়ার জন্ম নিয়ন্ত্রণকারী জাতিসমূহের অবস্থা চিন্তা করলেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এ পর্যায়ে সূরা আল-আন’আমের আয়াতটি পুনরায় বিবেচ্য। এ বিবেচনা আমাদের সামনে এও পেশ করছে যে, ‘সন্তান হত্যার’ যে কোনো ব্যবস্থারই পরিণতিতে সমাজে ব্যাপক নির্লজ্জতা, অশ্লীলতা ও নৈতিক অধঃপতন দেখা দেয়া অতীব স্বাভাবিক ও অনিবার্য। সম্পূর্ণ আয়াতটি এইঃ

(আরবী*********************************************************************)

বলো হে নবী, তোমরা শোন, তোমাদের জন্যে কি হারাম করেছেন। তা হলোঃ তোমরা তাঁর সাথে এক বিন্দু শিরক করবে না, পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করবে। দারিদ্র্যের কারণে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না। আমরাই তোমাদের রিযিক দিই, তাদেরও দেব। তোমরা নির্লজ্জতার কাছেও যেও না, তা প্রকাশ্যবাবে হোক, কি গোপনীয়। আর তোমরা মানুষ হত্যা করো না যা আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন এই আশায় যে, তোমরা তা অনুধাবন করতে সক্ষম হবে।

পারিবারিক জীবনে সন্তানের গুরুত্ব

ইসলামের দৃষ্টিতে সন্তান হচ্ছে আল্লাহর নিয়ামত, আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের দান। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*******************************************************************************)

আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্যে তোমাদের নিজস্ব প্রজাতি থেকেই জুড়ি সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের এই জুড়ি থেকেই তোমাদের জন্যে সন্তান-সন্তুতি ও পৌত্র-পৌত্রী বানিয়ে দিয়েছেন। বস্তুত সন্তান-সন্তুতি আল্লাহর নিজস্ব দান বৈ কিছু নয়।

আল্লামা শাওকানী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী**************************************************************************************)

আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্যে তোমাদের নিজস্ব প্রজাতি থেকেই জুড়ি সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের এই জুড়ি থেকেই তোমাদের জন্যে সন্তান-সন্তুতি ও পৌত্র-পৌত্রী বানিয়ে দিয়েছেন। বস্তুত সন্তান-সন্তুতি আল্লাহর নিজস্ব দান বৈ কিছু নয়।

আল্লামা শাওকানী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী****************************************************************************)

এ আয়াতের অর্থ এই যে, আল্লাহ তোমাদের জন্যে তোমাদর নিজস্ব প্রজাতির মধ্য থেকেই জুড়ি বানিয়েছেন, যেন তোমরা তাঁর সাথে অন্তরের গভীর সম্পর্কের ভিত্তিতে মিলিত হতে পারো। কেননা প্রত্যেক প্রতাজিই তার স্বজাতির প্রতি মনের আকর্ষণ বোধ করে আর ভিন্ন প্রজাতি থেকে তার মন থাকে বিরূপ। মনের এ আকর্ষনের কারণেই স্ত্রী-পুরুষের মাঝৈ এ সম্পর্ক স্থাপিত ও কার্যকর হয়, যার ফলে বংশবৃদ্ধি হয়ে থাকে, আর তাই হচ্ছে বিয়ের মৌলিক উদ্দেশ্য।

বস্তুত স্বামী-স্ত্রীর আবেগ উচ্ছ্বাসপূর্ণ প্রেম-ভালোবাসা পরিণতি ও পরিপূর্ণতা লাভ করে এ সন্তানের মাধ্যমে। সন্তান হচ্ছে দাম্পত্য জীবনের নিষ্কলংক পুষ্প বিশেষ। সন্তানাদি সম্পর্কে কুরআন মজীদে আরো বলা হয়েছেঃ

(আরবী******************************************************************)

ধন-মাল ও সন্তান-সন্তুতি দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য ও সুখ-শান্তির উপাদান ও বাহন। আল্লামা আলুসী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************************************)

ধন-মাল হচ্ছে প্রাণ বাঁচানোর উপায় আর সন্তান-সন্তুতি হচ্ছে বংশ তথা মানব প্রজাতি রক্ষার মাধ্যম।

বস্তুত দুনিয়ায় কত সহস্র এমন মানুষ রয়েছে, যাদের খাবার কোনো অভাব নেই, কিন্তু কে তা খাবে তার কোনো লোক নেই। মানে, হাজার চেষ্টা সাধনা ও কামনা করেও তারা সন্তান লাভ করতে পারে নি। আবার কত অসংখ্য লোক এমন দেখা যায়, যারা কামনা না করেও বহু সংখ্যক সন্তানের জনক, কিন্তু তাদের কাছে খাবার কিছু নেই কিংবা যথেষ্ট পরিমাণে নেই। তাই বলতে হয়, সন্তান হওয়া না হওয়া একমাত্র আল্লাহর তরফ থেকে এক বিশেষ পরীক্ষা, সন্দেহ নেই।

শুধু তাই নয়, প্রকৃতপক্ষে মানুষের গোটা জীবনই একটা বিশেষ পরীক্ষার স্থল। আল্লাহর দেয়া মাল, সম্পদ, সম্পত্তি আর সন্তান –পরীক্ষার বিষয়সমূহের মধ্যে এ দুটো প্রধান। এ পরীক্ষায় তারাই উত্তীর্ণ হতে পারে, যারা এক্ষেত্রে অত্যধিক বাড়াবাড়ি থেকে দূরে থেকে সুষম ও সামঞ্জস্যসম্পন্ন নীতি গ্রহণ করতে পারে। সন্তানের ব্যাপারে বাড়াবাড়ির একটি দিক হচ্ছে এই যে, তার প্রতি প্রেম-ভালোবাসা ও দরদ মায়া আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য বোধকেও ছাড়িয়ে যাবে এবং তারা আল্লাহর আনুগত্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। পক্ষান্তরে বাড়াবাড়র অপর দিকটি হচ্ছে তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করা, স্নেহ-বাৎসল্য প্রদর্শন ও তাদের হক আদায় করার পরিবর্তে তাদের প্রতি অমানুষিক জুলুম করা, তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রত্যাহার বা প্রত্যাখ্যান করা। কুরআন মজীদে বিশেষ গুরুত্ব সহকারেই মাল ও আওলাদকে ফেতনা বা পরীক্ষার বিষয় কিংবা দ্বীনী জিন্দেগী যাপনের পথে হুমকি স্বরূপ বলেই হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছে। জাহিলিয়াতের যুগে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি অবলম্বিত হতো না। একদিকের বাড়াবাড়ি ছিল –সন্তান সংখ্যার বিপুলতা নিয়ে তারা পারস্পরিক গৌরব ও জনশক্তির ফখর করত, শক্তির দাপট আর ধমক দেখাত, আভিজাত্যের অহংকার স্বীয় প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করত। আর এ কারণে তারা আল্লাহর কাছে প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠারও দাবি জানাত।

কুরআন মজীদ ও প্রেক্ষিতেই বলেছেঃ

(আরবী**************************************************************************************)

তোমরা জেনে রেখো, তোমাদের ধনমাল ও সন্তান-সন্তুতি ফেতনা বিশেষ; আর কেবলমাত্র আল্লাহর নিকটই রয়েছে বিরাট ফল।

বলা হয়েছেঃ

(আরবী**************************************************************************)

তোমাদের মাল এবং তোমাদের আওলাদ –কোনো কিছুই এমন নয় যা তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করে দেবে, সম্মান ও মর্যাদা বাড়িয়ে দেবে। আমার নিকটবর্তী ও আমার নিকট মর্যাদাবান হবে তো কেবল তারা, যারা ঈমান এনেছে ও নেক আমল করেছে। তাদের জন্যেই আমলের দ্বিগুণ ফল রয়েছে এবং বেহেশতের সুসজ্জিত কোঠায় তারাই অবস্থান করবে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ততা ও নিরাপত্তা সহকারে।

আয়াতদ্বয় পূর্বাপর পটভূমিসহ প্রমাণ করছে যে, যেমন করে ধনমাল আল্লাহর দেয়া আমানত, সন্তান-সন্ততিও অনুরূপভাবে আল্লাহর দান। প্রথমটা যেমন একটা পরীক্ষার বিষয়, এ দ্বিতীয়টিও তেমনি একটি পরীক্ষার সামগ্রী। ধনসম্পদ অন্যায় পথে ব্যয় করলে কিংবা যথাযথভাবে ব্যয় না করলে যেমন আমানতে খিয়ানত হয়, সন্তান-সন্ততিকেও ভুল উদ্দেশ্যে ও অন্যায় কাজে নিয়োজিত করলে, বাতিল সমাজ ব্যবস্থার যোগ্য খাদেম হিসেবে তৈরী করলেও তেমনি আল্লাহর আমানতে খিয়ানত হবে। আল্লামা আ-লুসী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী***************************************************************************************)

কেননা সন্তান গুনাহ এবং আযাবে পড়বারকারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং তা হচ্ছে আল্লাহর তরফ থেকে পরীক্ষার একটি সামগ্রী। অতএব, সন্তানের ভালোবাসা যেন তোমাদেরকে খেয়ানতে উদ্ধুদ্ধ না করে।

সূরা আত-তাগাবুন-এ-ও মাল ও আওলাদকে ফেতনা বলা হয়েছে এবং কোনো কোনো সন্তান পিতামাতার ‘দুশমন’ হতে পারে বলেও সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। মনে রাখা দরকার যে, এখানে বৈষয়িক বিষয়ের দুশমনীর কথা বলা হয়নি, আল্লাহর আনুগত্যে ও দ্বীন ইসলাম মুতাবিক জীবন যাপনের পথে সন্তান-সন্তুতির প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ানোইহচ্ছে তাদের দুশমনী। বিশেষত তখন, যখন সন্তানের মায়া আল্লাহর ও রাসূলের প্রতি ভালোবাসা অপেক্ষা তীব্রতর হয়ে ওঠে, তখন তাদের দুশমনী সত্যিই মারাত্মক হয়ে দেখা দিতে পারে। এ কারণেই বলা হয়েছেঃ

(আরবী**********************************************************************************)

তোমরা যদি তাদের মাফ করে দাও, তাদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করো, করো দয়া-দাক্ষিণ্য অনুগ্রহ, তাহলে তা ভালোই হবে। কেননা আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাদের জন্যে মাফকারী ও দয়াবান।

বস্তুত সন্তানদের প্রতি সব সময় ক্ষিপ্ত হয়ে, খড়গহস্ত হয়ে থাকা আর প্রতি কথায় ও কাজে তাদের প্রতি রুঢ় ব্যবহার করা, গালাগাল করা মনুষ্যত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ। ইসলামে যেমন সন্তানের ওপর পিতামাতার হক ধার্য করা হয়েছে, তেমনি পিতামাতার ওপর সন্তানের হক নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছৈ।

সন্তানের প্রতি পিতামাতার হক

সন্তান জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই পিতামাতার প্রতি তাদের প্রাথমিক পর্যায়ের কতক হক কার্যকর হতে শুরু করে এবং তখন থেকেই সে হক অনুযায়ী আমল করা পিতামাতার কর্তব্য হয়ে যায়। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) নবী করীম (স) থেকে এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************************************)

পিতামাতার প্রতি সন্তানের হক হচ্ছে প্রথমত তিনটিঃ জন্মের পরে পরেই তার জন্যে উত্তম একটি নাম রাখতে হবে, জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়রে তাকে কুরআন তথা ইসলাম শিক্ষা দিতে হবে। আর সে যখন পূর্ণবয়ষ্ক হবে, তখন তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

বস্তুত সন্তানের ভালো নাম না রাখা, কুরআন ও ইসলামের শিক্ষাদান না করা এবং পূর্ণ বয়সের কালে তার বিয়ের ব্যবস্থা না করা মাতাপিতার অপরারেধর মধ্যে গণ্য। এসব কাজ না করলে পিতামাতার পারিবারিক দায়িত্ব পালিত হতে পারে না। ভবিষ্যত সমাজও ইসলামী আদর্শ মুতাবিক গড়ে উঠতে পারে না। এ পর্যায়ে একটি ঘটনা উল্লেখ্যঃ একটি লোক হযরত উমর ফারুকের কাছে একটি ছেলেকে সঙ্গে করে উপস্থিত হয়ে বললঃ এ আমার ছেলে; কিন্তু আমার সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তখন হযরত উমর (রা) ছেলেটিকে বললেনঃ তুমি আল্লাহকে ভয় কর না? পিতামাতার সাথে সম্পন্ন ছিন্ন করা বড়ই গুনাহের কাজ তা কি জানো না? সন্তানর ওপর পিতামাতার যে অনেক হক রয়েছে তা তুমি কিভাবে অস্বীকার করতে পার? ছেলেটি বললঃ হে আমীরুল মু’মিনীন, পিতামাতার ওপরও কি সন্তানের কোনো হক আছে? হযরত উমর (রা) বললেনঃ নিশ্চয়ই এবং সেইহক হচ্ছে এই যে, (১) পিতা নিজে সৎ ও ভদ্র মেয়ে বিয়ে করবে, যেন তার সন্তানের মা এমন কোনো নারী না হয়, যার দরুন সন্তানের সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হতে পারে বা লজ্জা অপমানের কারণ হতে পারে। (২) সন্তানের ভালো কোনো নাম রাখ, (৩) সন্তানকে আল্লাহর কিতাব ও দ্বীন-ইসলাম শিক্ষা দেয়া। তখন ছেলেটি বললঃ আল্লাহর শপথ, আমার এ পিতামাতা আমার এ হক গুলোর একটিও আদায় করেন নি। তখন হযরত উমর (রা) সেই লোকটিকে লক্ষ্য করে বললেনঃ

(আরবী***************************************************************)

তুমি বলছ, তোমার ছেলে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, আসলে তো তোমার থেকে তার সম্পর্ক ছিন্ন করার আগে তুমি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছ। (তার হক নষ্ট করেছ)। ওঠো এখান থেকে চলে যাও।

তার মানে, পিতামাতা যদি বাস্তবিকই চান যে, তাদের সন্তান তাদের হক আদায় করুক, তাহলে তাদের কর্তব্য, সর্বাগ্রে সন্তানদের হক আদায় করা এবং তাতে কোনো গাফিলতির প্রশ্রয় না দেয়া।

আকীকাহ

সন্তান জন্মের পরে-পরেই পিতামাতার কর্তব্য হচ্ছে তারু জন্যে আকীকাহ করা। পিতামাতার প্রতি সন্তানের এ হচ্ছে এক বিশেষ হক। রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী**********************************************************************************)

প্রতিটি সদ্যজাত সন্তান তার আকীকার সাথে বন্দী। তার জন্মের সপ্তম দিনে তার নামে পশু যবাই করতে হয় এবং তার মাথা কামিয়ে ময়লা দূর করতে হয়।

অপর এক হাদীসের ভাষা নিম্নরূপঃ

(আরবী***************************************************************************************)

প্রত্যেকটি সদ্যজাত সন্তান তার আকীকার নিকট বন্দী, তার জন্মের সপ্তম দিনে তার নামে পশু যবাই করা হবে, তার নাম রাখা হবে এবং তার মাথার চুল মুণ্ডন করা হবে।

এ হাদীসদ্বয় থেকে জানা গেল যে, সন্তান জন্মের পরে তার নামে একটি জন্তু যবাই করাকেই আকীকাহ বলা হয়। ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী***************************************************************************************)

আকীকাহ বলা হয় সেই জন্তুটিকে, যা সদ্যজাত সন্তানের নামে যবাই করা হয়। এর মূল শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ভাঙা, কেটে ফেলা। আর নবজাত শিশুর মুণ্ডিত চুলকেও আকীকাহ বলা হয়।

“নবজাত সন্তান আকীকার কাছে বন্দী” কথাটির ব্যাখ্যায় ইমাম আহমাদ বলেছেনঃ

(আরবী********************************************************************)

শিশু অবস্থায় কোনো সন্তান যদি মারা যায় এবং তার জন্যে আকীকাহ না হয়, তবে সে তার পিতামাতার জন্যে আল্লাহর কাছে শাফায়াত করবে না।

অন্যান্যেল মতে তার মানে-

(আরবী*****************************************************************)

আকীকাহ করা একান্তই অপরিহার্য, তা না করে কোনোই উপায় নেই।

যেহেতু যে কোনো বন্ধকের জন্যে বন্দকী জিনিসের প্রয়োজন, এমনিভাবে যে কোনো সদ্যজাত সন্তাজের জন্যে আকীকাহ দরকার। এ কারণেই হাদীসে বলা হয়েছেঃ ‘প্রত্যেক নবজাত সন্তান আকীকার নিকট বন্দী’। আবার কেউ কেউ এরূপ মত প্রকাশ করেছেন যে, ‘প্রত্যেক সদ্যজাত সন্তান আকীকার কাছে বন্দী’। -এর অর্থ আকীকাহ করার আগে কোনো সন্তানের না নাম রাখা যাবে, আর না মাথা মুণ্ডন করা হবে।

বস্তুত আকীকাহ করার রেওয়াজ প্রাচীন সমাজে ব্যাপকভাবে চালু ছিল। এর মধ্যে নিহিত ছিল সামাজিক, নাগরিক মনস্তাত্ত্বিক –সর্বপ্রকারের কল্যাণবোধ। এ কারণেই নবী করীম (স) আল্লাহর অনুমতিক্রমে এ প্রথাকে চালু রেখেছিলেন। নিজে আকীকাহ দিয়েছেন এবং অন্যদেরও এ কাজে উৎসাহিত করেছেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর মতে এর উপকারিকতা অনেক। তার মধ্যে বিশেষ উপকারিতা হচ্ছেঃ

(আরবী***************************************************************************************)

আকীকার সাহায্যে খুব সুন্দরভাবেই সন্তান জন্মের ও তার বংশ-সম্পর্কের প্রচার হতে পারে। কেননা বংশ পরিচয়ের প্রচার একান্তই জরুরী, যেন কেউ কারো বংশ সম্পর্কে অবাঞ্ছিত কথা বলতে না পারে। আর সন্তানের পিতার পক্ষে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে তার সন্তান হওয়ার কথা চিৎকার করে বলে বেড়ানোও কোনো সুষ্ঠু ও ভদ্র পন্থা হতে পারে না। অতঃপর আকীকার মাধ্যকেই এ কাজ করা অধিকতর সমীচীন বলে প্রমাণিত হলো। এ ছাড়াও এর আর একটি ফায়দা হচ্ছে এই যে, এতে করে সন্তানের পিতার মধ্যে বদান্যতা ও দানশীলতার ভাবধারা অনুসরণ প্রবল ও কার্পণ্যের ভাবধারা প্রশমিত হতে পারে।

জাহিরী মতের আলিমদের দৃষ্টিতে আকীকাহ করা ওয়াজিব। তবে অধক সংখ্যক ইমাম ও মুজতাহিদের মতে তা করা সুন্নাত। যদিও ইমাম আবূ হানীফার মতে তা ফরয-ওয়াজিবও নয়, আর সুন্নাতও নয়, বরং নফল –অতিরিক্ত সওয়াবের কাজ। তবে পূর্বোদ্ধৃত হাদীস থেকে আকীকাহ করা ওয়াজিব প্রমাণিত হয়। কিন্তু এ সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)-এর নিম্নোদ্ধৃত বাণী থেকে মুবাহ ও মুস্তাহাবই মনে করা যেতে পারে। রাসূলে করীম (স)-কে আকীকাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেনঃ

(আরবী***************************************************************************)

আকি ‘আকীকাহ’ শব্দ ব্যবহার পছন্দ করি না। তবে যার কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করে, সে যেন তার সন্তানের নামে জন্তু জবাই করে।–[‘আকীকাহ’ শব্দটি শাব্দিক অর্থ ছিন্নকরণ, কর্তন বা কেটে ফেলা। এই শাব্দিক অর্থের দিক দিয়ে নবী করীম (স) তাঁর অপছন্দের কথা ব্যক্ত করেছেন মাত্র। কিন্তু তাতে মূল কাজটির গুরুত্ব কিছুমাত্র ব্যাহত হয়নি।-গ্রন্থকার] তা-ই আমি পছন্দ করি।

(আরবী***************************************************************)

এ হাদীসে আকীকাহ করাকে ইচ্ছাধীন করে দেয়া হয়েছে। তার মানে, তা করা ওয়াজিব নয়।

অপর এক হাদীসে রাসূলে করীম (স)-এর নিম্নোক্ত বাণ উদ্ধৃত হয়েছেঃ

(আরবী*******************************************************************************)

প্রত্যেক সদ্যজাত সন্তানের সঙ্গেই আকীকার কার্যটি জড়িত, অতএব তোমরা তার নামে জন্তু যবাই করে রক্ত প্রবাহিত করো এবং তার মণ্ডক মুণ্ডন করে চুল ফেলে দাও।

সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে আকীকাহ করার কথা বলা হয়েছে এজন্যে যে, জন্ম ও তার আকীকার মাঝ সময়ের কিছুটা ব্যবধান হওয়া আবশ্যক। কেননা নতুন শিশুর জন্ম-লাভের ব্যাপারটিও ঘরের সকলের জন্যেই বিশেষ ঝামেলা ও ব্যস্ততার কারণ হয়ে থাকে। এ থেকে অবসর হওয়ার পরই আকীকার প্রস্তুতি করা যেতে পারে। নবী করীম (স) তাঁর দৌহিত্র হাসানের নামে আকীকাহ করলেন এবং বললেনঃ

(আরবী*********************************************************************)

হে ফাতিমা, এর (হাসানের) মস্তক মুণ্ডন করে ফেল এবং তর মাথার চুলের ওজন পরিমাণ রৌপ্য সাদকা করে দাও।

আর ইমাম মালিক বর্ণনা করেছেনঃ

(আরবী***********************************************************************************)

হযরত ফাতিমা হাসান, হুসাইন, জয়নব ও উম্মে কুলসুমের মাথা মুণ্ডন করেছিলেন এবং তাদের চুলের ওজন পরিমাণ রৌপ্য সাদকা করে দিয়েছিলেন।

আকীকাহ তো জন্মের সপ্তম দিনে করার নিয়ম। কিন্তু জন্মের পরে পরে যে কাজটা জরুরী, তা হচ্ছে সদ্যজাত পুরুষ শিশুর কর্ণে আযান দেয়া। হযরত হাসানের জন্ম হলে পর নবী করীম (স) তাঁর কর্ণে আযান ধ্বনি শুনিয়েছিলেন।

হযরত আবূ রাফে বলেনঃ

(আরবী*****************************************************************************)

হযরত ফামিতা যখন হুসাইনকে প্রসব করলেন, তখন নবী করীম (স)-কে তাঁর কানে নামাযের আযান শোনাতে আমি দেখেছি।

সন্তানের নাম রাখা সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীস সময় নির্দেশ করেঃ

(আরবী******************************************************************)

নবী করীম (স) সপ্তম দিনে সন্তানের নাম রাখতে, মস্তক মুণ্ডন করতে এবং আকীকাহ করতে আদেশ করেছেন।

আকীকায় কার জন্যে কয়টি জন্তু যবাই করা হবে, এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীস থেকে স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছেঃ

(আরবী****************************************************************************)

পুরুষ ছেলের জন্যে দু’টি ছাগল এবং মেয়ে সন্তানের জন্যে একটি ছাগল যবাই করাই যথেষ্ট হবে।

নবজাত শিশু সবার কাছেই বড় আদরণীয়। নবী করীম (স)-ও এ ধরনের শিশুদের বড্ড আদর-যত্ন করতেন। হযরত আনাস (রা) বলেনঃ উম্মে সুলাইম যখন একটি পুত্র সন্তান প্রসব করলেন তখন তাঁকে নবী করীম (স)-এর কাছে উপস্থিত করা হয় এবং তার সাথে কিছু খেজুরও পাঠিয়ে দেয়া হয়। তখন নবী করীম (স) সে খেজুর নিজের মুখে পুর চিবিয়ে নরম করে নিলেন ও নিজের মুখ থেকে বের করে তা শিশুর মুখে পুরে দিলেন এবং তার নাম রাখলেন আবদুল্লাহ। -বুখারী, মুসলিম

ইসলামী জ্ঞান ও চরিত্র শিক্ষাদান

অতঃপর পিতাপমাতার প্রতি সন্তানের সবচেয়ে বড় হক হচ্ছে, তারা তাদের সন্তান-সন্তুতিকে পরকালীন জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাবার জন্যে সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কুরআন মজীদে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************************************)

আয়াতে ‘তোমাদের নিজেদেরকে বাঁচাও’ প্রথমে বলার কারণ এই যে, যে লোক নিজেকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে চায় না, সে অপরকে –নিজের সন্তান-সন্তুতি ও পরিজনকে –তা থেকে বাঁচাবার জন্যে কখনো চেষ্টা করতে পারে না। আর ‘আহল’ বলতে স্ত্রীসহ গোটা পরিবারকে –পরিবারস্থ সমস্ত লোককে বোঝায়। একজন লোক যাদেরকে কোনো কথা বলতে পারে এবং তারা তা মেনে চলতে বাধ্য হয় –এমন সব লোকই এ আহল শব্দের অন্তর্ভুক্ত। কুরআনের দৃষ্টিতে স্ত্রীসহ গোটা পরিবারের প্রতি পিতার –পরিবার কর্তার –প্রধান কর্তব্য হচ্ছে তাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাবার জন্যে এ দুনিয়ায়ই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, তাদের মনে পরকালীন জবাবদিহির ভয় জাগিয়ে তোলা এবং এমনভাবে জীবন যাপনে উপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত ও অভ্যস্ত করে তোলা যেন তার পরিণামে তারা কিয়ামতের দিন জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা পেতে পারে। আর জাহান্নাম থেকে বাঁচাবার ও বাঁচাবার উপায় হচ্ছে নিজে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন করা এবং তার পরিবারবর্গকেও এভাবে তৈয়ার করা। এ আয়াতে তফসীরে কুমাতিল ইবনে সুলায়মান বলেছেনঃ

(আরবী***************************************************************************)

এ আয়াতের মানে হচ্ছে, তোমর াতোমাদের নিজেদের পরিবার-পরিজনদের সুশিক্ষা ও ভালো অভ্যাসের সাহায্যে পরকালীন জাহান্নাম থেকে বাঁচাও।

কাতাদাহ ও মুজাহিদ বলেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

তোমরা নিজেদেরকে বাঁচাও তাদেরকে সৎ শিক্ষা ও সদুপদেশ দিয়ে।

ইমামুল মুফাসসিরীন ইবনে জরীর তাবারী লিখেছেনঃ

(আরবী******************************************************************************)

আল্লাহর এ আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, আমরা আমাদের সন্তানদের দ্বীন ইসলাম ও সমস্ত কল্যাণময় জ্ঞান এবং অপরিহার্য ভালো চরিত্র শিক্ষা দেব।

হযরত আলী (রা) এ আয়াতের ভিত্তিতে লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************************)

তোমরা নিজেরা শেখো ও পরিবারবর্গকে শিখাও সমস্ত কল্যাণময় রীতি-নীতি এবং তাদের সে কাজে অভ্যস্ত করে তোল।

সন্তান-সন্ততিকে উন্নতমানের ইসলামী আদর্শ শিক্ষা দান ও ইসলামী আইন-কানুন পালনে আল্লাহকে ভয় ও রাসূলে করীম (স)-কে অনুসরণ করে চলার জন্যে অভ্যস্থ করে তোলাও পিতামাকারই কর্তব্য এব পিতামাতার প্রতি সন্তানের অতি বড় হক। সন্তানকে এই জ্ঞান ও অভ্যাসে উদ্ধুদ্ধ করে দেয়ার তুলনায় অধিক মূল্যবান কোনা দান এমন হতে পারে না, যা তারা সন্তানকে দিয়ে যেতে পারেন।

হযরত লুকমানের নসীহত

এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদে উল্লিখিত হযরত লুকমানের তাঁর পুত্রের প্রতি প্রদত্ত নসীহত বিশেষভাবে স্মরণীয়। সূরা লুকমান-এ নসীহত বিস্তারিতভাবে উদ্ধৃত হয়েছে। সেই নসীহতের কথাগুলো আমরা এখানে ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করছি।

প্রথম কথাঃ

(আরবী***************************************************************************************)

হে প্রিয় পুত্র, আল্লাহর সাথে শিরক করো না, কেননা শিরক হচ্ছে অত্যন্ত বড় জুলুম।

মানুষের জীবন এক বিশেষ আকীদা-বিশ্বাসের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়ে থাকে। এই বিশ্বাসই হচ্ছে সকল কর্মের মূর প্রেরণার উৎস। সেই কারণে হযরত লুকমান তাঁর ছোট্ট বয়সের প্রিয় পুত্রকে যে নসীহত করলেন, তার প্রথম কথাটিই হচ্ছে শিরক পরিহার করে তওহীদ –আল্লাহ সম্পর্কে সর্বতোভাবে একত্বের ধারণা ও বিশ্বাস মনের মধ্যে দৃঢ়মূল ও স্থায়ী করে নেয়ার নির্দেশ। বস্তুত তওহীদের আকীদাহ যেমন ব্যক্তির জীবনে ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য সংস্থাপন করে, তেমনি পরিবার ও সমাজ জীবনেও অনুরূপ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। ইসলামের দিক দিয়ে এ হচ্ছে ঈমানের বুনিয়াদ –প্রাথমিক কথা।

দ্বিতীয় কথাঃ

(আরবী************************************************************************************)

হে পুত্র, একটা পরিমাণ শিরক কোনো জিনিসে ও যদি কোনো প্রস্তরের অভ্যন্তরে কিংবা আসমা-জমিনের কোনো এক নিভৃত কোণেও লুকিয়ে থাকে, তবুও আল্লাহ তা’আলা তা অবশ্যই এনে হাজির করবেন। বস্তুত আল্লাহ বড়ই সূক্ষ্মদর্শী –গোপন জিনিস সম্পর্কেও পূর্ণ ওয়াকিফহাল।

নসীহতের এ অংশে আল্লাহ তা’আলার ইলম ও কুদরতের বিরাটত্ব, ব্যাপকতা ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মতার অকাট্য বর্ণনা দেয়া হয়েছে। পূর্বোক্ত শিরক পরিহার ও তওহীদের আকীদাহ গ্রহণ সংক্রান্ত নসীহতের সঙ্গে এর স্পষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। আল্লাহ সম্পর্কে এ আকীদাহ-ই মানুষকে সকল প্রকার গোপন ও প্রকাশ্য গুনাহ-নাফরমানী থেকে বিরত রাখে এবং পরকালে বিচারের দিনে অনুপরমাণু পরিমাণ আমল-ভালো কিংবা মন্দ –এর ফল ভোগ করার অনিবার্যতা মানুষের মন ও মগজে দৃঢ়মূল করে দেয়।

বরং এরূপ আকীদা মানব ম জাগ্রত ও সক্রিয় প্রভাবশীল হয়ে না থাকলে তা কখনো সম্ভব হতে পারে না।ৱ

আল্লাহ সম্পর্কে এ আকীদা অনুযায়ী বাস্তব জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে যে কাজ একান্তই জরুরী ও সর্বাধিক প্রভাবশালী তা হচ্ছে রীতিমত নামায পড়া। এজন্যে এর পরই বলা হয়েছে-

তৃতীয় কথাঃ (আরবী***************************) –হে পুত্র, নামায কায়েম করো।

আকীদাহ সঠিকরূপে মন-মগজে বসিয়ে দেয়ার পর বাস্তব কর্মের নির্দেশ। আকীদার ক্ষেত্রে তওহীদ যেমন মূল, আমলের ক্ষেত্রে নামায হচ্ছে তেমনি সবকিছুর মূল। নামায হচ্ছে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের এক বাস্তব অনুষ্ঠান। নামায কায়েক ব্যতীত সঠিকরূপে ইসলামী জীবন যাপন সম্ভব নয়। নামায যদিও এক সামগ্রিক ও সমষ্টিগত কাজ, কিন্তু আমলের দৃষ্টিতে নামায একটি কাজ, যা ব্যক্তির নিজ সত্তার পূর্ণত্ব ও পরিপক্কতার বিধান করে। এজন্যে সন্তান-সন্ততির আকীদাহ যেমন দুরস্ত করা প্রথম প্রয়োজন, তেমনি দ্বিতীয় প্রয়োজন হচ্ছে সঠিকভাবে নামায পড়ার কায়দা-কানুন শেখানো, রীতিমত নামায পড়তে অভ্যস্থ করা। এজন্যে সূরা ‘তা-হা’তে আল্লাহ বলেছেনঃ (আরবী***********) অর্থাৎ তোমার পরিবারবর্গ ও সন্তান-সন্ততিদের নামায পড়বার জন্যে আদেশ করো এবং তা রীতিমত আদায় করায় তাদের অভ্যস্ত করে তোলো। (১৩২ আয়াত) যেন তারা আল্লাহর ভয়, আনুগত্য, নতি ও বিনয় সহকারে আল্লাহর বন্দেগী করার কাজে জীবন যাপন করার ব্যাপারে দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব বজায় রাখতে পারে এবং কখনই তা থেকে বিচ্যুত হয়ে না পড়ে।

নামায সম্পর্কে হাদীসেও সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে; নবী করীম (স) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ

(আরবী*****************************************************************)

তোমরা তোমাদের সন্তান-সন্ততিদের নামায পড়তে আদেশ করো যখন তারা সাদ বছর বয়স পর্যন্ত পৌঁছবে এবং নামাযের জন্যেই মারধোর করো –শাসন করো যখন তারা হবে দশ বছর বয়ষ্ক। আর তখন তাদের জন্যে আলাদা শয্যার ব্যবস্থা করাও কর্তব্য।

এখানে ‘সাত বছর’ আর ‘দশ বছর’ বলার কারণ হচ্ছে, আরব অত্যন্ত গরম দেশ বলে সেখানকার বালক-বালিকারা সত বছরেই বালেগ হওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে, আর দশ বছর বয়সে পূর্ণ বালেগ হয়ে যায়। আবহাওয়ার পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন দেশ ও পরিবেশে এই ‘প্রায়-বালেগ’ ও ‘পূর্ণ বালেগ’ হওয়ার বয়সে তারতম্য হতে পারে এবং সে হিসেবেই রাসূলে করীম (স)-এর এ আদেশ কার্যখর করতে হবে। উল্লিখিত ‘সাত’ ও ‘দশ’ সংখ্যাই আসল উদ্দেশ্য নয়, বরং প্রায়-বালেগ ও পূর্ণ-বালেগই মূল লক্ষ্য।

চতুর্থ কথায় বলা হয়েছেঃ

(আরবী*****************************************************************)

এবং ভালো কাজের আদেশ করো আর অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখ।

নসীহতের এ অংশ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ঈমানদার ব্যক্তি কেবলমাত্র নিজেকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকতে পারে না অপর লোকদের –তথা গোটা সমাজ ও জাতির ভালো মন্দ সম্পর্কে দায়িত্ব বোধ করা এবং ভালো কাজের প্রচলন ও অন্যায় ও পাপ কাজের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করাও তার এক অন্যতম প্রধান কর্তব্য। এমন কি কারো ব্যক্তিগতভাবে সৎ পথে চলা ও সৎ কাজ করাও পূর্ণত্ব ও যথার্থতা লাভ করতে পারে না, যতক্ষণ না অপর লোকদেরও হেদায়েত প্রাপ্ত রূপে তৈয়ার করতে চেষ্টা করা হবে। এ কেবল হযরত মুহাম্মদ (স) প্রবর্তিত শরীয়তেরই নীতি নয়, এ হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত সমস্ত ব্যবস্থার প্রাণশক্তি। যে বালক-বালিকা ছোট্ট বয়সেই ন্যায়-অন্যায় ও পাপ-পূণ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে এবং এ সম্পর্কে দায়িত্ববোধ করতে শুরু করবে, আশা করা যায়, ভবিষ্যতে তারা নিজেরাই শুধু ন্যায়বাদী ও সত্যপন্থী হবে না, অন্য মানুষকেও –সমান ও জাতিকেও –ন্যায়বাদী ও সত্যাদর্শী বানাতে সচেষ্ট হবে।

এ প্রসঙ্গেই পঞ্চম নসীহত হচ্ছেঃ

(আরবী**********************************************************************************)

যা কিছু দুঃখ-কষ্ট লাঞ্ছনা আসবে এ কাজে তা উদারভাবে বরদাশত করো, কেননা এ এমন কাজ, যা সম্পন্ন করার একান্তই জরুরী ও অপরিহার্য।

‘ভালো কাজের আদেশ ও অন্যায়-পাপ কাজর নিষেধ’ কোনো ছেলে খেলার ব্যাপার নয়। এ হচ্ছে অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ কাজ, অত্যন্ত কষ্ট ও দুঃখ-লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয় এ কাজ করতে গেলে। কাজেই বালক-বালিকাদের শিক্ষা এমনভাবে দিতে হবে, যাতে তারা শৈশবকাল থেকেই বীর সাহসী হয়ে গড়ে ওঠে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে যেন তারা নির্ভীক হয়, পরম পরাক্রমশালী জালিমের মুখোমুখী দাঁড়াতে যেন একটুও ভয় না পায়। অন্যায়কে নীরবে সহ্য করার মতো কাপুরুষতা যেন তাদের ভিতরে কখনো দেখা না দেয়।

নসীহতের ষষ্ঠ কথা হচ্ছেঃ

(আরবী**********************************************************)

লোকদের প্রতি অহংকার প্রদর্শন করো না, অহংকার করে ঘৃণা করে লোকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না।

এর তাৎপর্য হচ্ছে, তুমি নিজেকে সাধারণ লোক থেকে ভিন্ন, স্বতন্ত্র মনে করো না। নিজেকে তাদের একজন মনে করে তাদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকো।

সপ্তম কথাঃ

(আরবী***********************************************************)

জমিনের ওপর গৌরব-অহংকার স্ফীত হয়ে চলাফেরা করো না কেননা আল্লাহ যে কোনো অহংকারী গৌরবকারীকে মোটেই পছন্দ করেন না, তাতে সন্দেহ নেই।

অহংকারী গৌরবকারী- এ আচরণ সত্যিই অমানুষিক। লোকদের দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকানো, মুখ ফিরিয়ে আর একদিকে তাকিয়ে অবজ্ঞাভরে কারো সাথে কথা বলা, চিৎকার করে বুক ফুলিয়ে কথা বলা ও বাহাদুরী করা এমন আচরণ, যা সামাজিক সুস্থতা ও সমৃদ্ধির দৃষ্টিতে কিছুমাত্র বাঞ্ছনীয় হতে পারে না। অপরদিকে একটু সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে বিবেচনা করলেই বোঝা যাবে যে, এ ধরনের অহংকারপূর্ণ আচরণ ঈমানেরও পরিপন্থী।

এ জন্যে অষ্টম নসীহতে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************************************)

মধ্যম নীতি অবলম্বন করে মাঝামাঝি ধরনের চালচলন অবলম্বন করো।

সাধারণ মানুষের একজন হয়েই সাধারণ জীবন যাপন করতে পূর্বোদ্ধৃত আদেশেরই পরিপূরক নিম্নের নবম এবং শেষ নসীহতটিঃ

(আরবী*******************************************************************************)

তোমার কণ্ঠধ্বনি নিচু করে, সংযত ও নরম করো কেননা সবচেয়ে ঘৃণ্য হচ্ছে গর্দভের কর্কশ আওয়াজ।

চিৎকার করা, চিৎকার করে কথাবার্তা বলা শালীনতা বিরোধী। সাধারণ সভ্যতা-ভব্যতা ও সামাজিকতা উচ্চৈঃস্বরে কথা বলাই যদি জ্ঞান-বুদ্ধির পরিচায়ক হতো, তাহলে বলতে হবে গাধারা সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। যারা উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতে অভ্যস্ত, তাদের মনস্তত্ত্ব সম্ভবত এরূপ যে, আমাদের কথা উচ্চমার্গে ধ্বনিত হচ্ছে। অতএব আমার সম্মান ও মর্যাদাও সকলের কাছে স্বীকৃতব্য।

হযরত লুকমানের এ নয়টি নসীহতের কথা –যা তিনি তাঁর প্রিয় পুত্রকে বলেছিলেন –বালক-বালিকাদের সামাজিক রীতিনীতি শিক্ষাদানের পর্যায়ে –এর গুরুত্ব অপরিসীম। এ হচ্ছে মৌলিক কানবীয় শিক্ষার বিভিন্ন ধারা, যার ভিত্তিতে শৈশবকাল থেকেই বালক-বালিকাদের শিক্ষিত করে তোলা ইসলামের দৃষ্টিতে অপরিহার্য এবং এ কাজ পিতামাতাকেই সঠিকভাবে করতে হবে। পিতামাতা যদি সন্তানকে ভবিষ্যত সমাজের মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে এবং প্রকৃত মানুষ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হতে পারে। এ ধরনের সন্তানই পিতামাতার পক্ষে ইহকাল-পরকাল সর্বত্র কল্যাণময় হয়ে উঠতে পারে। এজন্যে পিতামাতার প্রতি তাদের এভঅবে গড়ে তোলা হচ্ছে সন্তানের অনিবার্য হক। এ হক পিতামাতা আদায় করতে একান্ত বাধ্য।

এজন্যেই নবী করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী***************************************************************)

কোনো পিতামাতা সন্তানকে উত্তম আদব-কায়দা ও স্বভাব-চরিত্র শিক্ষাদান অপেক্ষা ভালো কোনো দান দিতে পারে না।

অন্যত্র বলেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************)

তোমাদের সন্তানদের সম্মান করো এবং তাদের ভালো স্বভাব-চরিত্র শিক্ষা দাও।

সন্তানকে যতদূর সম্ভব চরিত্র সম্পন্ন করে গড়ে তোলার জন্যে চেষ্টা করা পিতামাতার কর্তব্য। এ কর্তব্য পালন তার নিজস্ব চেষ্টা-সাধনা ও যত্নের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল হলে চলবে না। মুমিন লোকদের তো অন্যান্য যাবতীয় ব্যাপারের ন্যায় এক্ষেত্রেও আল্লাহর ওপরই নির্ভরতা স্থাপন করতে হয়। কুরআন মজীদ পিতামাতাকে তাদের সন্তানরে জন্যে আল্লাহর কাছে দো’আ করবার উপদেশ এবং শিক্ষা দিয়েছেন। সূরা আল-ফুরকান-এ আল্লাহর নেক বান্দানের গুণের সঙ্গে এ গুণটিরও উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ

আল্লাহর নেক বান্দা তারাই, যারা সব সময় দো’আ করে এই বলেঃ

(আরবী*************************************************************************)

হে আল্লা, আমাদের স্ত্রীদের ও সন্তানের দিক থেকে চোখের শীতলতা দান করো এবং আমাদেরকে পরহেজগার লোকদের নেতা বানাও।

‘চোখের শীতলতা দান করো’ মানে তুমি তাদের তোমার অনুগত ও আদেশ পালনকারী বানাও, যা দেখে চোখ জুড়াবে, দিল খুশী হবে। ‘আমাদেরকে পরহেজগার লোকদের নেতা বানাও’ মানে তাদেরকে কল্যাণ ও মঙ্গলময় কাজ –আল্লাহ-রাসূলের আনুগত্যের কাজে আমাকে অনুগামী বানাও ও তাদের এমন নেতা বানাও যে, তারা দুনিয়ার মানুষকে সত্যের পথ, কল্যাণ ও মঙ্গলের পথ প্রদর্শন করবে। বস্তুত কারো স্ত্রী ও সন্তান যদি আল্লাহর অনুগত হয়, আল্লাহর দ্বীন পালনে আগ্রহশীল হয় এবং সত্য পথের মুজাহিদ ও অগ্রনেতা হয়, তাহলে মুমিন ব্যক্তির চোখ সত্যিই শীতল হয়, দিল ঠাণ্ডা হয়। কিন্তু ব্যাপার যদি তার বিপরীত হয়, স্ত্রী ও সন্তান হয় যদি আল্লাহর নাফরমান, তাহলে মু’মিন ব্যক্তির পক্ষে তার চেয়ে বড় দুঃখবোধ আর কিছুতেই হতে পারে না। এ কারণে পিতামাতার উচিত সব সময় সন্তানের কল্যাণের জন্যে তারা যাতে আল্লাহর নেক বান্দা হয়ে গড়ে ওঠে তার জন্যে আল্লাহর কাছে দো’আ করা।

ইসলামে পুত্র সন্তান অপেক্ষা কন্যা সন্তানের প্রতি দায়িত্ব এবং কর্তব্য সমধিক। জাহিলিয়াতের যুগে নারী ও কন্যা সন্তানের প্রতি যে অবজ্ঞা-অবহেলা ও ঘৃণার ভাব মানব মনে পুঞ্জীভূত ছিল, তার প্রতিবাদ ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে কন্যা সন্তানদের উন্নত ও ভালো চরিত্র শিক্ষাদানের প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বিশেষত নারীদের স্বাভাবিক দুর্বলতা এবং তাদের মানসিক ও শারীরিক দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে কম শক্তিশালী হওয়ার জন্যে তাদের প্রতি পিতামাতার অধিক লক্ষ্য আরোপ করা কর্তব্য। এজন্যে নবী করীম (স) এক বিশেষ ঘটনা প্রসঙ্গে বলেছিলেনঃ

(আরবী****************************************************************)

যে লোককে এই কন্যা সন্তান দ্বারা পরীক্ষায় ফেলা হবে, সে যদি তাদের প্রতি কল্যাণময় ব্যবহার করে তবে এ কন্যারাই তার জন্যে জাহান্নামের পথে প্রতিবন্ধক হবে।

এ হলো সন্তানের প্রতি পিতামাতার আধ্যাত্মিক ও শিক্ষাগত কর্তব্য; কিন্তু এ ছাড়াও কিছু কর্তব্য রয়েছে। তা হচ্ছে তাদের শিশু বয়সে খেলা ধুলা করার ব্যবস্থা করা এবং একটু বড় হলে তাদের ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী বানাবার জন্যে ব্যায়াব বা শরীর চর্চার শিক্ষা দান।

পাশ্চাত্য সভ্যতার বীভৎস রূপ

বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিই হচ্ছে মূলত জাহিলিয়াতের ভিত্তি। আর যে সভ্যতার ভিত্তিই হয় বস্তুবাদ, সেখানে মানুষ ও পশুতে বড় একটা পার্থক্য থাকতে পারে না। বর্তমান ইউরোপ-আমেরিকার সভ্যতা এ বস্তুবাদী জীবন দর্শন এ দৃষ্টিভঙ্গির ওপরই ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ফলে সেখানকার সমাজ নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। পাশ্চাত্যের পিতামাতা ও সন্তান-সন্তুতির মাঝে ঠিক ততটুকু এবং সে রকমই সম্পর্ক বজায় আছে, সাধারণত যা থাকে বা রয়েছে জন্তু-জানোয়ার আর তার বাচ্চা-বাছুরদের সঙ্গে। সন্তান –সে ছেলেই হোক, আর মেয়েই হোক –পূর্ণবয়স্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পিতামাতা তাদের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে নেয়, তাদের কোনো দায়িত্বই বহন করতে প্রস্তুত হয় না। ঘর থেকে তাদের বের করে দেয়। এমনকি তখনও যদি কোনো সন্তান –ছেলে কিংবা মেয়ে –পিতার ঘরের কোনো অতিরিক্ত অংশ ব্যবহার করে, তাকে তার জন্যে দস্তুরমত ভাড়া দিতে হয় এবং একজন ভাড়াটের মতই তাকে সেখানে থাকতে হয়। শুধু তাই নয়, তাদের বিয়ে শাদীরও কোনো দায়িত্ব পিতামাতা বহন করতে রাজি হয় না। সন্তান –ছেলে ও মেয়ে –যেখানে যার ইচ্ছা এবং যার সাথে যার ইচ্ছা বিয়ে করুক বা না-ই করুক, তাতে পিতামাতার কিছু যায় আসেনা।

একথাটি পুরুষ ছেলেদের সম্পর্কে ধারণা করা গেলেও কন্যা-সন্তানদের সম্পর্কে তো এরূপ ব্যাপার ধারণা মাত্রই করা যায় না। এরূপ আচরণ সত্যিই মনুষ্যত্বের ঘোর অপমৃত্যু ঘটেছে বলে প্রমাণ করে।

বস্তুত ইউরোপ আমেরিকার পারিবারিক জীবনে কিরূপ চরম ও মারাত্মক ভাঙন এসেছে, বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে, নিম্নোদ্ধৃত দুটি খবর থেকে তা স্পষ্ট প্রমাণিত হবে।

লন্ডনে এক বন্ধুর সাথে দেখা হলো, তার পিতামাতা প্রায় ৫০ বছর থেকে এখানের অধিবাসী। সে বিয়েও করেছে এখানে। তার ছেলেমেয়েরাও পুরাপুরি ইংরেজ। কিন্তু বেচারা নিজে নিজেকে নামকাওয়াস্তে মুসলিম বলেই মনে করে। তার পিতার কাছে আমি এখানকার বিয়ে-শাদীর রেওয়াজ (রীতিনীতি) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তাতে জানা গেল যে, প্রত্যেক ছেলেই তার স্ত্রী সে নিজে সন্ধান করে নিজ ইচ্ছামতোই তার সাথে বিয়ে করে। এ ব্যাপারে পিতামাতার কোনো করণীয় নেই। না তারা নিজেরা ছেলেদের বিয়ে দেবার জন্যে কোনো চেষ্টা করে, না করে তার ব্যবস্থাপনা। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ ছেলে কোথায় গিয়ে বউ তালাস করবে, আপনাদের সমাজে বংশীয় বা আত্মীয়তার সম্পর্কও তো তেমন নেই। বন্ধু বললঃ স্কুল, কলেজ কিংবা হোটেল-রেস্তোঁরায় বা মার্কেটেই খুঁজে বেড়ায়। আর মেয়দেরও অবস্থা এরূপই। তারা তো কোনো কোনো ছেলের সন্ধানে ঘোরাফেরা করে থাকে। নিয়ম হলো –ছেলে কোনো মেয়ের সাথে প্রথমত বন্ধুত্ব ও নিবিড় ঘনিষ্টভাবে মেলামেশা শুরু করবে। তারপরে উভয়ে রাজি হলে বিয়ে হওয়ার সিদ্ধান্ত হতে পারে। বন্ধু আরো বললঃ মা-বাপ সন্তানদের মধ্যে প্রকৃত বাৎসল্য ও স্নেহ কখনই গড়ে ওঠে না। ছেলে বড় হতেই তার পিতামাতা তার সন্তানদের মধ্যে প্রকৃত বাৎসল্য ও স্নেহ কখনই গড়ে ওঠে না। ছেলে বড় হতেই তার পিতামাতা তার থেকে পুরা ব্যয়ভার আদায় করে নেয়। ছেলে যদি পিতামাতার ঘরে একই সঙ্গে থাকে, তবে তাকে ঘরের ভাড়াও দিতে হয়। মনে হয়, ছেলে বড় হলেই সে নিতান্ত পর হয়ে যায়, ঠিক পরের মতোই ব্যবহার করা শুরু করে –যেমন জন্তু-জানোয়ার ইতর প্রাণীকুলের মধ্যে হয়ে থাকে।–ফ্রান্সের চিঠি, সাপ্তাহিক ছিদক, ১৯শে আগস্ট, ১৯৬০

আরব জাহিলিয়াতের যুগেও প্রকৃত নৈতিকতা –আধ্যাত্মিকতা ছিল পরাজিত পর্যুদস্ত। কিন্তু বর্তমান নতুন জাহিলিয়াতের স্তরে তো মূল মনুষ্যত্বেরই চিরসমাধি ঘটেছে। এ সভ্যতার দৃষ্টিতে মানুষ ‘ক্রমবিকাশমান ও উন্নত জন্তু ছাড়া আর কিছু নয়। উপরের উদ্ধৃতি কোনো ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।

নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি থেকে জানা যাবে যে, নিতান্ত পাশবিকতা ও নির্মমতার সাথে এর কোনো পার্থক্য নেই বরং এদিক দিয়ে ইউরোপীয় সমাজ অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে।

সিরিয়ার প্রখ্যাত ইসলামবিদ আল্লামা আলী তানতাবী আমেরিকার সমাজ সম্পর্কে লিখেছেনঃ

তাদের সেখানে মেয়ে যখন বয়স্কা হয়, তখন তার বাপ তার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন থেকে নিজের হাত গুটিয়ে নেয় এবং তার ঘরের দুয়ার তার জন্যে বন্ধ করে দেয়।

তাকে বলেঃ এখন যাও উপার্জন করো এবং খাও, আমাদের এখানে আর তোমার জন্যে কোনো জায়গা নেই, কিছুই নেই। সে বেচারী বাধ্য হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায় এবং জীবনের সমস্ত কঠোরতা জটিলতার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। দ্বারে দ্বারে ঘা খেয়ে খেয়ে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু বাপ মার সেজন্যে কোনোই চিন্তা-ভাবনা হয় না। কোন দুঃখ বোধ করে না তাদেরই সন্তানের এই দুর্ভোগ ও লাঞ্ছনার জন্যে। সে বেচারী শেষ পর্যন্ত শ্রম-মেহনত করে রুজি-রোজগার করতে বাধ্য হয় কিংবা দেহ বিক্রি করে রোজগার করে। এ কেবল আমেরিকাতেই নয়, সমগ্র ইউরোপীয় দেশের অবস্থাই এমনি। আমার উস্তাদ ইয়াহইয়া শুমা’ প্রায় ৩৩ বছর পূর্বে যখন প্যারিস থেকে শিক্ষা শেষ করে ফিরে এসেছিলেন, আমাকে বলেছিলেন যে, তিনি সেখানে থাকার জন্যে একটি কামরার সন্ধানে এক বাড়িতে পৌঁছেছিলেন। সেখানে একটি কামরা ভাড়া দেয়ার জন্যে খালি ছিল। সে বাড়িতে পৌঁছবার সময় দুয়ারের কাছ থেকে একটি মেয়েকে বের হয়ে যেতে দেখতে পেলেন। মেয়েটির চোখ দুটি তখন ছিল অশ্রু-ভারাক্রান্ত। ডাঃ ইয়াহইয়া বাড়ির মালিকের কাছে মেয়েটির কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন যে, মেয়েটি বাড়ির মালিকেরই ঔরসজাত সন্তান। এখন সে আলাদাভাবে বসবাস করে এবং এ বাড়ির খালি কামরাটি নেয়ার জন্যে এখানে এসেছিল; কিন্তু মালিক তাকে ভাড়ায় দিতে অস্বীকার করার কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে, মেয়েটি মাত্র দশ ফ্রাঁ (দশ আনা সমান মুদ্রা) ভাড়া দিতে পারে, অথচ সে অন্য লোকের কাছে থেকে এর ভঅড়া ত্রিশ ফ্রাঁ আদায় করতে পারে।–মাসিক রিজওয়ান, লাহোর

এ হচ্ছে বস্তুবাদী সমাজ সভ্যতার মর্মান্তিক পরিণতি। এখন পর্যন্ত প্রাচ্যের সমাজ এ রকম অবস্থার ধারণাও করতে পারে না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে –এরূপ হতে বোধ হয়ে আর বিলম্ব নেই। বস্তুত মানুষের কাজ হচ্ছে তার জীবন সম্পর্কে গৃহীত আকীদা-বিশ্বাসের এবং দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তব ফল। পাশ্চাত্যের লোকেরা নিজেদের ‘পশুমাত্র’ মনে করে নিয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে ঠিক পশুত্বই পূর্ণবৈশিষ্ট্য সহকারে জেগে উঠেছে ও বিকাশ লাভ করেছে।

এর ফলে পাশ্চাত্য নারী সমাক যে কঠিন দুরবস্তার সম্মুখীন হয়েছে, পড়েছে যে জটিল সমস্যার মধ্যে, তার বাস্তব চিত্র অঙ্কিত করেছে উস্তাদ আলী তানতাবী। তিনি লিখেছেনঃ

আমার নিকট শেয়খ বাহজাতুল বেতার (সিরিয়ার প্রখ্যাত আলেম ও ইসলাম বিশেষজ্ঞ ও বর্তমানে দামিশকের অধিবাসী) বলেছেনঃ তিনি আমেরিকায় ‘মুসলিম নারী’ বিষয়ের ওপর এক ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছেন, আমাদের শরীয়তে অর্থনৈতিক ব্যাপারে নারীদের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, তার অর্থে তার স্বামীর –এমনকি তার পিতারও কোনো অধিকার নেই। নারী দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত হলে তার যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব অর্পিত হয় তার পিতা কিংবা ভাইয়ের ওপর। আর তার বাপ বা ভাই বর্তমান না থাকলে তার নিকটাত্মীয়ের ওপর, তার চাচাতো ভাই কিংবা অপর কোনো ভাইর ওপর –যতদিন না বিয়ে হয় কিংবা তার দারিদ্র্য দূর হয়ে যায়, ততদিন তার ভরণ-পোষনের যাবতীয় খরচ বহন করতে থাকবে এসব নিকটাত্মীয়রা। বিয়ের পর তার স্বামী হবে তার যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের জন্যে দায়ী। সে স্বামী একজন গরীব মজুর ব্যক্তিই হোক না কেন আর স্ত্রী কোটিপতিই হোক না কেন।

ভাষণ শেষে এক আমেরিকান মহিলা –যিনি সেখানকার খ্যাতিমান সাহিত্যিক ছিলেন, দাঁড়ালেন এবং বললেনঃ আপনাদের শরীয়তে নারীর যদি আপনার বর্ণনা অনুরূপই অধিকার থেকে থাকে, তাহলে আমাকে আপনাদের সমাজেই নিয়ে চলুন। সেখানে আমি শুধুমাত্র ছয় মাসকাল জীবন যাপন করব। তার পরে আমাকে হত্যা করুন, তাতে আমার কোনো আফসোস থাকবে না। (ইউরোপের মজলুম নারী) এ-ই হচ্ছে ইউরোপীয় সমাজের অবস্থা, এ সমাজের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে নিতান্ত বস্তুতান্ত্রিকতার ওপর মানুষকে একান্ত জন্তু-জানোয়ার মনে করা।

কিন্তু ইসলামী পরিবারে কন্যা-সন্তানের প্রতি অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কন্যা-সন্তানের প্রতি সাধারণভাবে মানুষ অবজ্ঞা প্রদর্শন করে থাকে। নানাভাবে তাদের অধিকার ও মানমর্যাদা নষ্ট করতে থাকে। বিশেষ করে রাসূলে করীম (স) যে সমাজে ইসলামী দাওয়াতের কাজ করেছেন সেখানে কন্যা-সন্তানকে একটি বিপদ, লজ্জা ও অপমানের কারণ বলে মনে করা হতো। সেজন্যে তিনি নানাভাবে এ অবস্থা থেকে কন্যা-সন্তানকে মুক্তি দানের চেষ্টা করেছেন। এখানে এ প্রসঙ্গের কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা যাচ্ছে।

নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী*****************************************************************************)

যে ব্যক্তি তিনটি কন্যা বা তিনটি বোন অথবা দুটি কন্যা লালন-পালন করে এবং তাদের ভালো স্ববাব-চরিত্র শিক্ষা দিয়ে তাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করে, তাদের বিয়ে-শাদীর ব্যবস্থা করে দেবে, তার জন্যে জান্নাত নির্দিষ্ট হয়েছে।

(আরবী**********************************************************************************)

যে ব্যক্তি দুটি কন্যা সন্তানের ভরণ-পোষণ করবে তাদের পূর্ণ বয়স্কা হওয়া পর্যন্ত, কিয়ামতের দিন সে এবং আমি একসঙ্গে থাকব।

বস্তুত কিয়ামতের দিন নবী করীম (স)-এর সঙ্গী হতে পারা অপেক্ষা বড় আনন্দের ও মর্যাদার ব্যাপার মু’মিন ব্যক্তির জণ্যে আর কিছু হতে পারে না।

(আরবী**********************************************************************************)

যার কোনো কন্যা সন্তান থাকবে, সে যদি তাকে জীবিত দাফন না করে এবং তার তুলনায় পুত্র সন্তানকে অগ্রাধিকার না দেয় তাহলে আল্লাম তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন।

তদানীন্তন আরবের লোকেরা কন্যা সন্তান অপেক্ষা পুত্র-সন্তানকে অধিক ভালোবাসত। ইসলাম এ অবিচার ও পক্ষপাত্বের চিরতরে মূলোৎপাটন করতে চেয়েছে। এরূপ অবাঞ্ছনীয় নীতির তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে ইসলামে। পিতামাতাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন ছেলেমেয়েদের মধ্যে কারো প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করে, বরং স্নেহ, যত্ন, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ –সর্বদিক দিয়েই তাদের মধ্যে ইনসাফ করে। রাসূলে করীম (স)-এর শেষোক্ত হাদীসটি এ প্রেক্ষিতেই অনুধাবনীয়।

কন্যা-সন্তানের বিয়ে দিয়ে দিলেই তার প্রতি ভালো ব্যবহারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। তারপরও নানা সময়ে ও নানা অবস্থায় এর প্রয়োজন হতে পারে। আর তখনো তার প্রতি ভালো ব্যবহার করা পিতামাতার কর্তব্য। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী********************************************************************)

তোমাকে সর্বোত্তম দানের কথা বলব কি? তা হলো তোমার কন্যাকে যদি বিয়ের পর তোমার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং তখন তার জন্যে উপার্জন করার তুমি ছাড়া কেউ না থাকে, তাহলে তখন তার প্রতি তোমার কর্তব্য হবে অতীব উত্তম সাদকা।

সন্তানের অধিকার

পিতার প্রতি সন্তানের হক পর্যায়ে যা কিছু আলোচনা করা হয়েছে, তাতে নীতিগতভাবে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে। এ পর্যায়ে সারকথা এখানে বলা যাচ্ছে।

১. সন্তানের প্রথম অধিকার হচ্ছে তার খানাপিনা, থাকা ও পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করা –বিশেষ করে যদ্দিন সে নিজস্বভাবে উপার্জন করতে অক্ষম থাকবে। নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************************)

যাদের ভরণ-পোষনের দায়িত্ব কারো ওপর বর্তে, সে যদি তা যথাযথভাবে পালন না করে তাদের ধ্বংস করে, তাহলে এতেই তার বড় গুনাহ হবে।

অপর হাদীসের ভাষা নিম্নরূপঃ

(আরবী************************************************************)

যাদের খাওয়া-পরার কর্তৃত্ব একজনের হাতে, সে যদি তা বন্ধ করে দেয়, তবে এ কাজই তার বড় গুণাহ হওয়ার জন্যে যথেষ্ট।

অন্য কথায়, এ গুণাহই তার ধ্বংসের জন্যে যথেষ্ট। কেননা তারা তারই বংশ ও পরিবার-পরিজন। তাদের সব কিছু তাদেরই ওপর নির্ভরশীল। এমতাবস্থায় সে যদি তাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থাপনার কাজ না করে, তাহলে সে লোকগুলো ভয়ানক বিপদে পড়ে যাবে। তাদের জীবন হঠাৎ করে কঠিন অসুবিধার সম্মুখীন হবে। (আরবী******)

সন্তানদের জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করাকে ইসলামে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছে। বস্তুত মানুষ তার মনের স্বাভাবিক নির্দেশেই এ কাজ করে থাকে। এজন্যে বিশেষ কোনো যুক্তি বা দলীল পেশ করার প্রয়োজন করে না। তবু এ পর্যায়ে নিম্নোক্ত হাদীস উল্লেখ করা যেতে পারে।

(আরবী*****************************************************************)

ব্যক্তি যে অর্থ ব্যয় করে, তার মধ্যে সবচেয়ে উত্তম অর্থ হচ্ছে সেটি, যা সে ব্যয় করে তার পরিবারবর্গের জন্যে, যা সে ব্যয় করে জিহাদের ঘোড়া সাজানোর জন্যে এবং যা সে ব্যয় করে জিহাদের পথে সঙ্গী-সাথীদের জন্যে। এ হাদীসে প্রথমেই সন্তান-সন্ততির জন্যে যে অর্থ ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে তাই হচ্ছে সর্বোত্তম অর্থ –টাকা-পয়সা।

সন্তান বিশেষ করে পূর্ণ বয়স্ক হয়ে যাওয়ার পরও তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পিতামাতার ওপর বর্তে কিনা –এ এক কঠিন প্রশ্ন।

এ ব্যাপারে অধিকাংশ মনীষীর মত এই যে, পুত্র সন্তানের পূর্ণ বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত এবং কন্যা সন্তানের বিয়ে সম্পূর্ণ হওয়া পর্যণ্তই তাদের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা পিতার কর্তব্য। অবশ্য এক শ্রেণীর মনীষীর মত এই যে, সন্তানের পূর্ণ বয়স্ক হওয়া এবং তাদের প্রয়োজন পরিমাণ ধন-সম্পত্তি অর্জিত হওয়া পর্যন্ত যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব পিতার ওপরই অর্পিত থাকবে। (আরবী******************)

২. শিক্ষার জন্যে অর্থ ব্যয়ঃ ছেলেমেয়েদের কেবল খাওয়া পরা দিয়ে লালন-পালন করলেই পিতার দায়িত্ব পালন হয় না। বরং তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলবার জন্যেও অর্থ ব্যয় করা কর্তব্য। অতীতে শিক্ষা ছিল একটি ধর্মীয় কর্তব্য; কিন্তু বর্তমানে শিক্ষা একটি অর্থনৈতিক প্রয়োজনও বটে। কাজেই সন্তানদেরকে প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে এ উভয় দিক দিয়েই যোগ্য করে তোলা পিতামাতার কর্তব্য। মনীষী আবূ কালাবা বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************************)

যে লোক তার ছোট ছোট শিশু সন্তানদের জন্যে এমনভাবে অর্থ ব্যয় করে, যাতে করে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেবেন, তাদের বৈষয়িক উপকার দেবেন, সে লোক অপেক্ষা পুরস্কার পাওয়ার দিক দিয়ে অধিক অগ্রসর আর কেউ হতে পারে না।

অর্থাৎ সন্তানদের এমন গুণে তৈরী করে তোলা, যা দ্বারা আল্লাহ তাদের অনেক উপকার দেবেন এবং জীবন যাপনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরী ব্যাপার সমূহে তাদেরকে অন্যদের থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও মুখাপেক্ষীহীন করে দেবেন। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কল্যাণকর কাজ এবং এ কাজ যে করবে আল্লাহ তা’আলা তাকে সবচেয়ে বেশি পুরস্কার দান করবেন। এজন্যেই রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************)

জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক স্ত্রী-পুরুষ মুসলিমের পক্ষেই ফরয।

বস্তুত ছেলেমেয়ে হচ্ছে পিতামাতার কাছে আল্লাহর আমানত। তাদের আকীদা-বিশ্বাস, মন ও মগজ, চরিত্র ও অভ্যাস, জীবনযাত্রার ধারা ইত্যাদিকে সঠিকরূপে গড়ে তোলার জন্যে চেষ্টা করা পিতামাতারই কর্তব্য। এমতাবস্থায় সন্তান-সন্ততিকে যদি এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা না হয়, যার ফলে তাদের মন-মগজ সুষ্ঠুরূপে গড়ে উঠতে পারে, তাদের নৈতিক চরিত্র উন্নত হতে পারে, দ্বীন-ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান এবং তদনুযায়ী জীবন যাপন ও কাজকর্ম সম্পাদনে পূর্ণ আগ্রহ ও উৎসাহ বৃদ্ধি পেতে পারে, তাহলে কিছুতেই এ আমানতের হক আদায় হতে পারে না, নিজেদেরও সন্তান-সন্ততিকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।

সন্তানদের মধ্যে সুবিচার স্থাপন

পিতামাতার কর্তব্য হচ্ছে সন্তানদের পরস্পরের সর্বতোভাবে সুবিচার ও ইনসাফ প্রতিস্ঠা করা ও পূর্ণ নিরপেক্ষতা সহকারে প্রত্যেকের অধিকার যথাযথভাবে আদায় করা –প্রয়োজন পূরণ করা এবং তাদের মধ্যে সাম্য কায়েম ও রক্ষা করা। রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ

(আরবী********************************************************************)

তোমরা তোমাদের সন্তানদের মধ্যে সুবিচার করো, তোমরা তোমাদের সন্তানদের মাঝে ন্যায়পরতা সংস্থাপন করো, তোমরা তোমাদের সন্তানদের মাঝেই ইনাসফ করো।

নুমান ইবনে বশীর বলেন –তাঁর পিতা তাকে সঙ্গে নিয়ে রাসূলে করীম (স)-এর নিকট উপস্থত হয়ে বললেনঃ

(আরবী***************************************************************)

আমি আমার এই পুত্রকে একটি ক্রীতদাস দান করেছি।

তখন রাসূলে করীম জিজ্ঞেস করলেনঃ

(আরবী******************************************************************************)

তোমার সব কয়টি সন্তানকে কি এভাবে একটি দাস দান করেছ?

উত্তরে তিনি বললেনঃ “না”। তখন রাসুল (স) বললেনঃ (আরবী********) –এ দান তুমি ফিরিয়ে নাও। (বুখারী, মুসলিম)

অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী********************************************************************)

দানের ব্যাপারে তোমাদের সন্তানদের মধ্যে পূর্ণ সমতা রক্ষা করো।

এসব হাদীসের ভিত্তিতে অনেকে বলেছেন যে, সন্তানদের মধ্যে দানের ব্যাপারে সমতা রক্ষা করা ওয়াজিব। কেননা রাসূলে করীম (স) সেজন্যে স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেন। যদি বিশেষ কোনো কারণ না থাকে, তাহলে এ সমতাকে কিছুতেই ভঙ্গ করা এবং দানের ক্ষেত্রে সন্তানদের মধ্যে তারতম্য করা উচিত হবে না। যদি কোনো সন্তানকে ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে অপর সন্তানকে কিছু দান করা হয় তবে তা বড়ই অন্যায় হবে।

আবার অনেকে রাসূল (স)-এর আদেশকে ‘মুস্তাহাব’ বলে ধরে নিয়েছেন। যদি কেউ কোনো সন্তানকে অপর সন্তান অপেক্ষা বেশি কিছু দান করে, তবে সে দান ঠিকই হবে, তবে তা অবশ্য মাকরূহ হবে। এ পর্যায়ে এক প্রশ্নের জবাবে রাসূলে করীম (স) জিজ্ঞেস করছিলেনঃ

(আরবী*****************************************************************************)

তোমার সাথে সব সন্তান সমানভাবে ভালো ব্যবহার করবে, এতে কি তুমি খুশ হবে না? সাহাবী বললেনঃ হ্যাঁ। তখন নবী করীম (স) বললেনঃ

(আরবী*********************************)

তা হলে কোনো সন্তানকে অন্যদের তুলনায় বেশি দেয়ার অনুমতি দেয়া যেতে পার না। -মুসলিম

এসব হাদীসের ভিত্তিতে ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী****************************************************************)

সত্য কথা এই যে, সন্তানদের মধ্যে দানের ব্যাপারে সমতা রক্ষা করা ওয়াজিব, আর বেশি-কম করা হারাম।

মনে রাখা আবশ্যক যে, এসব হাদীস মিরাস বণ্টন সম্পর্কে বলা হয়নি। কেননা মিরাস বণ্টন হবে পিতার মৃত্যুর পরে, তার জীবদ্দশায় নয়। এসব হাদীস পিতার জীবদ্দশায় সন্তানের বিভিন্ন জিনিস দান করার ব্যাপারেই সমতার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অতএব কোনো পিতার পক্ষেই তার জীবদ্দশায় সন্তানদেরকে যা কিছু দান করবে তাতে তারতম্য ও বেশি-কম করা আদৌ জায়েয নয়।

সন্তানের ওপর পিতা-মাতার হক

উপরে পিতামাতার প্রতি সন্তানের হক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। কিন্তু ইসলামে যেহেতু কোনো ক্ষেত্রেই একতরফা হক ধার্য করা হয়নি বরং সেই সঙ্গে অন্যদের প্রতি কর্তব্যের কথাও বলা হয়েছে, তাই কেবল পিতামাতার ওপরই সন্তানের হক নেই, সন্তানের ওপরও রযেছে পিতামাতার হক এবং এ হক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ –এতদূর গুরত্বপূর্ণ যে, কুরআন মজীদে এ হকের স্থান হচ্ছে মানুষের ওপর আল্লাহর হকের পরে-পরেই।

সূরা বনী ইসরাঈলে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছেঃ

(আরবী******************************************************************************)

আদেশ করেছেন –ফয়সালা করে দিয়েছেন –তোমাদের আল্লাহ যে, তোমরা কেবল সেই আল্লাহ ছাড়া আর কারোই বন্দেগী ও দাসত্ব করবে না। আর পিতামাতার সাথে অবশ্যই ভালো ব্যবহার করবে। তাদের একজন বা দুইজনই যদি তোমাদের কাছে বার্ধক্যে পৌঁছায় তাহলে তখন তাদের ‘উফ’ বলো না এবং তাদের ভৎসনা করো না। বরং তাদের জন্যে সম্মানজনক কথাই বলো। আর তাদের দুজনার জন্যেই দো’আ করো এই বলে যে, হে পরোয়ারদেগার, আমার পিতামাতার প্রতি রহমত নাযিল করো, যেমন করে তারা দুজনই আমাকে আমার ছোট অবস্থায় লালন-পালন করেছে।

এ আয়াত প্রথমে তওহীদ –আল্লাহকে সর্বতোভাবে এক ও লা-শরীক বলে স্বীকার করার নির্দেশ এবং এক আল্লাহ ছাড়া আর কারোর একবিন্দু বন্দেগী করতে সুস্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গেই এবং পরে পরেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করার। এ দুটো নির্দেশ এক সঙ্গে ও পরপর দেয়ার মানেই এই যে, প্রতিপালনের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও পিতামাতা দুজনেরই বিশেষ ক্ষেত্রের মধ্যে বিশেষ অনুগ্রহ রয়েছে। প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা ও লালন-পালনকারী তো আল্লাহ এবং বান্দার ওপর সর্বপ্রথম হক তাঁরই ধার্য হবে। কিন্তু আল্লাহ যেহেতু এ কাজ সরাসরি নিজে করেন না, করেন পিতামাতার মাধ্যমে, কাজেই বান্দার ওপর আল্লাহর হকের পরপরই পিতামাতার হক ধার্য হবে।

অতঃপর পিতামাতার হক সম্পর্কে আরো বিস্তারিত কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ পিতামাতা দুজনই কিংবা তাদের একজনও যদি বার্ধক্যে উপনীত হয়, তখন সন্তান যেন তাঁকে বা তাঁদের দুর্বহ বোঝা বলে মনে না করে এবং তাদের সাথে কথাবার্তা ও ব্যবহারেও যেন কোনো অনমনীয় মনোভাব প্রকাশ না পায়। তাঁদের মনে কোনোরূপ কষ্ট দেয়া চলবে না, তাঁদের সাথে এমন ব্যবহার করা যাবে না যার ফলে তাঁদের মনে কষ্ট বা আঘাত লাগতে পারে। এমন কথাও বলা যাবে না, যাতে করে মনে ব্যাথা পেয়ে বলে উঠবে ‘উহ’। পক্ষান্তরে সন্তানও যেন পিতামাতার কোনো কাজে, কথায় ও ব্যবহারে ‘উহ’ করে না ওঠে, মন আঘাত অনুভব যেন না করে। তেমন কিছু ঘটলেও তা মনে স্থান দেবে না। কোনোরূপ বিরক্তি প্রকাশ করবে না, কোনোরূপ অপমানকর বা বেআদবী সূচক আচরণ তাঁদের প্রতি প্রদর্শন করবে না।

এখানে যেসব কাজ না করতে বলা হয়েছে, কুরআন মজীদ কেবল এ নেতিবাচক কথা বলেই ক্ষান্ত হয়নি –এতটুকু বলাকেই যথেষ্ট মনে করা হয়নি, বরং ইতিবাচক কতগুলো নির্দিষ্ট কাজের নির্দেশও দিয়েছে। বলেছেঃ তাঁদের জন্যে সম্মানজনক কথা বলো, তাঁদের প্রতি বিনয় ও নম্রতা প্রদর্শন করো, তাঁদের খেদমতের জন্য বিনয়-নম্রতা মিশ্রিত দু’খানি হাত নিয়োজিত করে দাও। সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব বলেছেনঃ পিতামাতার সাথে কথা বলোঃ

(আরবী******************************************************************)

যেমন করে অপরাধী ক্রীতদাস কথা বলে রুঢ় ভাষী মনিবের সামনে।

আর মুজাহিদ বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************************************)

পিতামাতা তোমার সামনে বার্ধক্যে পৌঁছলে তাঁদেরকে ময়লার মধ্যে ফেলে রাখবে না এবং যখন তাদের পায়খানা-পেশাব সাফ করবে তখনো তাঁদের প্রতি কোনোরূপ ক্ষোভ দেখাবে না, অপমানকর কথা বলবে না –যেমন করে তাঁরা তোমার শিশু অবস্থায় তোমার পেশাব-পায়খানা সাফ করত, ঠিক তেমনি দরদ দিয়ে করবে।

এরপর বলা হয়েছেঃ পিতামাতার খেদমতের জন্যে তোমাদের বিনয়ের হাত বিছিয়ে দাও। মানে সব সময় বিনয় সহকারে তাদের খেদমতে লেগে থাকো। কোনো সময়ই তা ত্যাগ করো না। তা থেকে বিরত থেকো না। যদি কিছু খেদমত করতে পার, তবে সেজন্যে মনে কোনো গৌরব অহংকার বোধ এবং পিতামাতার ওপর অনুগ্রহ দেকাবার চেষ্টা করো না, বরং মনে অনুভব করতে থাকো যে, যা কিছু খেদমত করছ, তা যথেষ্ট নয়, আরো বেশি খেদমতের প্রয়োজন এবং এ তোমার কর্তব্য। আর তুমি এ খেদমত করে পিতামাতার প্রতি কোনো অনুগ্রহ করছ না, করছ তোমার কর্তব্য পালন। আর তাতেও থেকে যাচ্ছে অসম্পূর্ণতা, থেকে যাচ্ছে ত্রুটি-বিচ্যুতি। ঠিক যেমনটি খেদমত হওয়া উচিত, তা যেন হচ্ছে না, হতে পারছে না, এমনি একটি অনুভূতি থাকাই উচিত। তোমার মনে জাগ্রত থাকবে তাঁদের অপরিসীম স্নেহ-যত্নের কথা এবং তাঁদের বার্ধক্যজনিত অক্ষমতা ও মুখাপেক্ষিতার কথা। এ থেকে তোমাদের এ নসীহত গ্রহণ করা উচিত যে, এককালে তুমি নিজে ছিলে যাদের প্রতি মুখাপেক্ষী, কালের আবর্তনে আজ তারাই আদর যত্নের মুহতাজ হয়ে পড়েছে। এই হচ্ছে আল্লাহর বিধান। এ অমোঘ বিধান অনুযায়ী তোমরাও বার্ধক্যে পড়ে তোমাদের সক্ষম পুত্রদের খেদমতের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়তে পারো।

সূরা আল-বাকারার একটি আয়াতে বলা হয়েছেঃ

(আরবী**************************************************************************************)

আল্লাহ ছাড়া আর কারো দাসত্ব করো না –ইবাদত বন্দেগী করো না এবং পিতামাতার সাথে অবশ্যই ভালো ব্যবহার করবে।

সূরা আল-আনকাবুত-এ বলা হয়েছেঃ

(আরবী****************************************************************************************()

মানুষ সাধারণকে তাদের পিতামাতার সঙ্গে ইহসান করতে নির্দেশ দিয়েছি।

‘ইহসান’ শব্দের মূল হচ্ছে ‘হুসনুন’, মানে (আরবী******************) ‘চরম পর্যায়ের ও পরম মানের সর্বোত্তম ভালো কাজ করা, ভালো ব্যবহার করা’। এ সব আয়াতেই পিতামাতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন, শ্রদ্ধা-ভক্তি রাখা, ভালো ব্যবহার করা ও তাঁদের হক আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং সব জায়গাতেই প্রথমে আল্লাহর প্রতি মানুষের কর্তব্য এবং তারপরই পিতামাতার প্রতি কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে।

সূরা আল-আহকাফ-এ বলা হয়েছেঃ

(আরবী*****************************************************************************************)

এবং আমরা সাধারণভাবে সব মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তাদের পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করবার। কেননা তাদের মায়েরা খুবই কষ্ট সহকারে তাদের গর্ভে ধারণ করেছে, বহন করেছে এবং আরো কষ্ট সহকারে তাদের প্রসব করেছে।

সূরা লুকমান-এ আল্লাহর সঙ্গে শিরক না করতে এবং তা যে মস্ত বড় জুলুম, তা বলার পরই বলা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************************************************)

এবং সব মানুষকে আমরা নির্দেশ দিয়েছি তাদের পিতামাতা সম্পর্কে বিশেষ করে তাদের মায়েরা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাদের গর্ভে ধারণ করেছে ও বহন করেছে। (দুর্বলতার কষ্ট পর পর ভোগ করেছে), আর দু বছরকাল তাদের স্তন দিয়ে দুধ খাওয়ানোর কাজ সম্পন্ন করেছে। অতএব তুমি আমার ও তোমাদের পিতামাতার শোকর আদায় করো, মনে রেখো, শেষ পর্যন্ত আমার কাছেই তোমাদের সকলেরই ফিরে আসতে হবে চূড়ান্ত পণিতির জন্যে।

এসব আয়াতেই একবাক্যে সন্তানের প্রতি পিতামাতার অসীম ও অসাধারণ অনুগ্রহের কথা বলে তাদের প্রতি সর্বতোভাবে ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এ পর্যায়ে শেষ কথা বলা হয়েছে এই যে, এসব এবং এ ধরনের অন্যান্য ক্ষণস্থায়ী ও সাময়িক খেদমতের কাজ করলেই পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন শেষ হয়ে যায় না; বরং তাদের ইহকালীন-পরকালীন কল্যাণের জন্যে আল্লাহর কাছে অবিরত দো’আও করতে থাকতে হবে। সে দো’আর ভাষাও আল্লাহই শিখিয়ে দিয়েছেন। আর তা হচ্ছেঃ

(আরবী****************************************************************************************)

হে আল্লাহ পরোয়ারদিগার, আমার পিতামাতার প্রতি রহমত নাযিল করো, যেমন করে তারা দুজনে আমাকে আমার ছোট অবস্থায় লালন-পালন করেছে।

তার মানেঃ আমি যখন শিশু ছিলাম, তখন আমার কিছুই করবার ক্ষমতা ছিল না, তখন এই পিতামাতাই স্নেহ-যত্নপূর্ণ লালন-পালন আমি লাভ করেছিলাম বলেই এ দুনিয়ায় আমার বেঁচে থাকা সম্ভব হয়েছে। তখন –আমার সে অক্ষমতার সময়ে যেমন তাদের লালন-পালন আমার জন্যে অপরিহার্য ছিল, আজ তারা তেমনি অক্ষম হয়ে পড়েছে, এখন তাদের প্রতি রহমত করা –হে আল্লাহ –তোমারই ক্ষমতাধীন।

রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী****************************************************************************************)

পিতা বেহেশত প্রবেশের মাধ্যম। অতএব তুমি চাইলে তাঁর সেই মধ্যস্থতাকে রক্ষা করতে পার, তাঁকে মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করতে পারো, আর চাইলে তা নষ্টও করে দিতে পারো।

অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী****************************************************)

আল্লাহর সন্তুষ্ট লাভ পিতার সন্তুষ্টির ওপর নির্ভর করে, আর আল্লাহর অসন্তুষ্টি-আক্রোশ ক্রোধ –পিতার অসন্তুষ্টির কারণে হয়ে থাকে।

রাসূলে করীম (স)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ

(আরবী***********************************************************************************)

হে রাসূল, সন্তানের ওপর তাদের পিতামাতার অধিকার কি?

জবাবে তিনি এরশাদ করলেনঃ

(আরবী***************************************************************************)

তারা দু’জনই হচ্ছে তোমার জান্নাত এবং তোমার জাহান্নাম।

মানে জান্নাত কিংবা জাহান্নাম তাদের কারণেই লাভ হওয়া সম্ভব হবে তোমার পক্ষে।

রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী**************************************************************************************)

যে লোক পিতামাতার ব্যাপারে আল্লাহর অনুগত হয় (আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী পিতামাতার খেদমত করে), তার জন্যে বেহেশতের দুটি দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাবে। -একজন হলে একটি দ্বার উন্মুক্ত হবে। আর যদি কেউ পিতামাতার ব্যাপারে আল্লাহর নাফরমান হয়ে যায় (আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে) তবে তার জন্যে জাহান্নামের দুটো দুয়ারই খুলে যাবে আর একজন হলে একটি দুয়ার খুলবে।

অতঃপর এক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! পিতামাতা যদি সন্তানের ওপর জুলুম করে আর তার ফলে সন্তানরা তাদের নাফরমানী করে বা তাদের সম্পর্কচ্ছেদ করে, তবুও কি সন্তানদের জাহান্নামে যেতে হবে?

এর জবাবে রাসূলে করীম (স) বললেনঃ

(আরবী*******************************************************************************)

হ্যাঁ, পিতামাতা যদি সন্তানের ওপর জুলুম করে, তবুও তাদের নাফরমানী করলে জাহান্নামে যেতে হবে।

হযরত আবূ বাকরা বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী*********************************************************************************)

আল্লাহ তা’আলা চাইলে যত গুনাহ এবং যে কোন গুনাহই মাফ করে দেবেন। তবে পিতামাতার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ও তাদের নাফরমানী করলে তিনি তা কখনও মাফ করবেন না। কেননা, এর শাস্তি মৃত্যুর পূর্বেই এ দুনিয়ায়ই শিগগীর করে দেয়া হবে।

তবে এ ব্যাপারে আল্লাহর কাছ থেকে একসঙ্গে একটি সাবধান বাণী ও একটি আশার বাণী শোনানো হয়েছে। কথাটি সূরা বনী ইসরাঈলের প্রথমোদ্ধৃত আয়াতের পরেই বলা হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ

(আরবী**********************************************************************************)

তোমাদের আল্লাহ তোমাদের মনের অবস্থা ও ভাবধারা সম্পর্কে খুব ভালো ও সবচেয়ে বেশি অবহিত রয়েছেন। তোমরা যদি নেককার হও –হতে চাও তাহলে তিনি তওবাকারী ও পিতামাতার হক আদায়ের জন্যে মনে-প্রাণে লোকদের ক্ষমা করে দেবেন।

এখানে এক সঙ্গে দুটি কথা বলা হয়েছে। একটি হচ্ছে সাবধান বাণী, আর তা হচ্ছে, ‘তোমরা যারা পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করো, ভালো সম্পর্ক রেখে চলো, তাদের হক আদায় করো এবং তাদের খেদমত করো, তারা কিরূপ মনোভাব নিয়ে তা করছে, তা আল্লাহর কিছুমাত্র অবিদিত নয়, বরং তিনি খুব ভালোভাবেই তা জানেন। এখন তোমরা যদি আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার ভয়ে এবং আল্লাহর আদেশ পালন একান্তই কর্তব্য –এ বোধ ও বিশ্বাস এবং আন্তরিক অনুভূতি ও নিষ্ঠা সহকারে এ কাজ করো, তাহলে তার উপযুক্ত পুরস্কার অবশ্যই তোমরা আল্লাহর কাছে পাবে। আর আল্লাহও সে পুরস্কার তোমাদের দেবেন তাঁর প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ভিত্তিতে। যদি কোনো বৈষয়িক স্বার্থ বা অসদুদ্দেশ্যে করো, তাহলে আল্লাহর কাছে তাও লুকানো যাবে না –তাঁর কাছে তোমরা কিছুই পাবে না।

আর দ্বিতীয় কথা যা বলা হয়েছে, তা হচ্ছে আশার বাণী এবং এ আশার বাণী উচ্চারিত হয়েছে তাদের জন্যে যারা এদ্দিন ধরে পিতামাতার সাথে খারাপ ব্যবহার করে আসছে, তাদের হক আদায় করেনি। বলা হয়েছে, তোমরা যদি এখন অনুতপ্ত হয়ে থাকো তোমাদের এ অন্যায় ও নাফরমানী কাজের জন্যে এবং এখন তওবা করতে রাযী হও, আল্লাহর নির্দেশ মুতাবিক পিতামাতার সাথে ভাল ব্যবহার করতে ও তাদের হক যথাযথভাবে আদায় করে নেককার ও সদাচারী হতে চাও, তবে আল্লাহ তোমাদের তওবা কবুল করবেন, তোমাদের মাফ করে দেবেন।

সে সঙ্গে একথাও বোঝা যায় যে, ঐকান্তিক নিষ্ঠা সহকারে পিতামাতার খেদমত করলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে যায় এবং যদি তা আদৌ ইচ্ছাকৃত না হয়, তবে আল্লাহ তাও অবশ্যই মাফ করে দেবেন।

সূরা আন-নিসা তে বলা হয়েছেঃ

(আরবী**************************************************************************************)

এবং কেবলমাত্র আল্লহার দাসত্ব করবে তোমরা, তাঁর সাথে একবিন্দু জিনিসকেও শরীক গণ্য করবে না। আর ভালো ব্যবহার করবে পিতামাতার সাথে, নিকটাত্মীয়ের সাথে, ইয়াতীম ও মিসকীনদের সাথে, আত্মীয়-প্রতিবেশীর সাথে, পাশের প্রতিবেশির সাথে এবং পার্শ্বচরের সাথে, পথিক ও দাস-দাসীদের সাথে।

এখানেও বান্দাদের ওপর আল্লাহর হক প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, দাসত্ব কবুল করবে কেবলমাত্র এক আল্লাহর। তার পরে পরেই বলা হয়েছে পিতামাতার হক-এর কথা। শুধু তাই নয়, ইয়াতীম-মিসকীন, নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী, সহায় সম্বলহীন পথিক এবং দাসদাসীদের নিয়ে পিতামাতা যে সমাজ, সে সমাজের প্রতিও বান্দাদের কর্তব্য রয়েছে। তবে এ পর্যায়ে পিতামাতার স্থান সর্বোচ্চ।

হাদীসে এ বিষয়ে বিশেষ তাগিদ রয়েছে। রাসূলে করীম (স)-এর কাছে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ

(আরবী*********************************************************************************)

আল্লাহ তা’আলার কাছে সবচেয়ে প্রিয় কোন কাজ?

জবাবে তিনি বলেছিলেনঃ

(আরবী***************************************************)

ঠিক সময়মত নামায পড়াই তাঁর কাছে অধিক প্রিয় কাজ।

এরপর কোন কাজ অধিক পছন্দনীয় জিজ্ঞেস করা হলে রাসূলে করীম (স) বললেনঃ (আরবী************) –‘পিতামাতার প্রতি ভালো ব্যবহার করা’।

পিতামাতার মধ্যে আবার মা’র অধিকার সম্পর্কে কুরআন হাদীসে অধিক বেশি তাগিদ রয়েছে।

সূরা লুকমান-এ বলা হয়েছে।

এবং মানুষকে আমি নির্দেশ দিয়েছি তার পিতামাতার সম্পর্কে বিশেষ করে তার মা, সে-ই তাকে গর্ভে ধারণ করেছে, প্রসব করেছে দুর্বলতার ওপর আবার এক দুর্বল অবস্থার মধ্যে এবং দু’বছর মেয়াদ পর্যন্ত দুধ সেবন করিয়ে তা সম্পূর্ণ করেছে। কাজেই হে মানুষ! তুমি আমার ও তোমার পিতামাতার শোকর আদায় করো। জেনে রাখো, শেষ পর্যন্ত আমার কাছেই সবাইকে প্রত্যাবর্তন করতে হবেঃ

আর সূরা আল-আহকাফ-এ বলা হয়েছেঃ

এবং মানুষকে তার পিতামাতার প্রতি ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি। বিশেষত তার মা তাকে খুবই কষ্ট সহকারে গর্ভে ধারণ ও বহন করেছে এবং খুবই কষ্ট সহকারে তাকে প্রসব করেছে। এভাবে তাকে গর্ভে ধারণে এবং দুধ খাওয়ায়ে লালন-পালনে ত্রিশটি মাস অতিবাহিত হয়ে থাকে।

এ দুটি আয়াতেই মূলত পিতামাতা –উভয়ের প্রতিই ভারো ব্যবহারের সুস্পষ্ট নির্দেশ উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু তার পরই মা সম্পর্কে বিশেষ তাগিদ এবং সেই সঙ্গে মা’র অপরিসীম কষ্ট ও ত্যাগ-তিতিক্ষার উল্লেখ রয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, মা-বাপ উভয়ের সাথেই সন্তানকে ভালো ব্যবহার করতে হবে, উভয়েরই অনস্বীকার্য হক রয়েছে সন্তানের ওপর। কিন্তু তাদের মায়ের হক অনেক বেশি। মা’র হক-এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ এই যে, সন্তানকে গর্ভে ধারণ, প্রসব করা ও দুধ খাওয়ায়ে লালন পালন করায় মায়ের শ্রম অসীম, অবর্ণনীয় ও প্রত্যক্ষ। হাদীসে মা সম্পর্কে এমনি ধরনের তাগিদ রয়েছে। এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স)-কে জিজ্ঞেস করলঃ

(আরবী*********************************************************************)

হে রাসূল, আমার উত্তম সাহচর্য পাওয়ার সবচেয়ে বেশি অধিকারী কে?

রাসূল বললেনঃ (আরবী****) –তোমার ‘মা’ তার পরে কে –পর পর তিনবার জিজ্ঞেস করা হয় এবং তিনবারই উত্তর হয় –‘তোমার মা’। চতুর্থবার জিজ্ঞেস করলে রাসূল বললেনঃ (আরবী********) ‘তোমার বাবা’। (বুখারী, মুসলিম)

এ হাদীস সম্পর্কে কাযী ইয়াজ লিখেছেনঃ

(আরবী******************************************************************************)

অধিকাংশ মনীষীর মতে সন্তানের কাছে মা বাবার চেয়ে বেশি ভালো ব্যবহার পাওয়ার অধিকারী।

কাজেই-

(আরবী***********************************************************)

মা ও বাবার হক যখন পরস্পর সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়াবে –এক সঙ্গে দু’জনারই হক আদায় করা সম্ভব হবে না তখন মা’র হকই হবে অগ্রবর্তী।

উপরোক্ত হাদীসের ভিত্তিতে মনীষীগণ বলেছেনঃ

(আরবী***************************************************************)

একথা প্রমাণ করে যে, বাবার সন্তুষ্টি অপেক্ষা মা’র সন্তুষ্টি অগ্রবর্তী –সর্বপ্রথম দেখার জিনিস। ইবনে বাত্তাল বলেছেনঃ এর অর্থ এই যে, বাবার যা পাওনা, মা’র পাওনা তার তিন গুণ।

হারেস মুহাসিবী বলেছেনঃ এ মতের ওপরই মুসলিম উম্মতের ইজমা হয়েছে।

অপর এক হাদীসে রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************************************)

যে লোক তার পিতামাতা দুজনকেই কিংবা একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেল অতচ খেদমত করে জান্নাতবাসী হওয়ার অধিকারী হতো না, তার মতো হতভাগ্য আর কেউ নয়।

কেননা এরূপ অবস্থায় দু’জনের বা একজনের আন্তরিকভাবে খেদমত করেই বেহেশত লাভ অনিবার্য হয়ে থাকে।

পিতামাতার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা কবীরা গুনাহ

পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করা সম্পর্কে কুরআন-হাদীসে যেসব তাগিদ বাণী উদ্ধৃত হয়েছে, উপরে তা আমরা মোটামুটি উল্লেখ করেছি। তা থেকে একথাও বোঝা যায় যে, এহেন পিতামাতার সাখে খারাপ ব্যবহার করা, তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা, তাদের মনে কষ্ট দেয়া ও তাদের নাফরমানী করা অত্যন্ত বড় গুনাহ –সন্দেহ নেই। শুধু তাই নয়, যারা তা করে, তাদের ওপর আল্লাহর লা’নত বর্ষিত হয়ে থাকে।

এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে যে মূলনীতি উল্লিখিত হয়েছে তা হচ্ছে এইঃ (১) সূরা মুহাম্মদ-এ বলা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************************************************)

তোমরা কি ভেবে দেখেছ, তোমরা যদি জমিনে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করো এবং রেহেম (রক্ত সম্পর্ক) ছিন্ন করো, তাহলে আল্লাহ তাদের ওপর অভিসম্পাত করবেন এবং এরপর তাদের বধির ও অন্ধ করে দেবেন।

‘রেহেম’ বা রক্তসম্পর্ক ছিন্ন করার মানে অতি নিকটের আত্মীয় –মানে রক্তসম্পর্কের আত্মীয়দের –সাথে কথা ব্যবহার ও আর্থিক সাহায্যদান প্রভৃতির দিক দিয়ে ভালো ব্যবহার না করা। তাদের হক আদায় না করা সাধারণ নিকটাত্মীয়দের সম্পর্কেই এত বড় কঠোর বাণী যে, তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে আল্লাহর অভিশাপ হবে এবং তার ফলে তারা সত্যের আওয়াজ শ্রবণে বধির হবে ও সত্য দর্শনে হবে অন্ধ। তাহলে দুনিয়ায় সবচেয়ে সেরা আত্মীয় –সব আত্মীয়ের মূল আত্মীয় –পিতামাতার সাথে যদি কেউ খারাপ ব্যবহার করে, সম্পর্ক ছিন্ন করে, তাদের অধিকার হরণ করে, তাহলেও যে আল্লাহর লা’নত হবে তাতে আর কি সন্দেহ থাকতে পারে?

সূরাআর রায়াদ-এ-ও এ কথাই বলা হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ

(আরবী******************************************************************************)

যে সব লোক আল্লাহর প্রতিশ্রুতি শক্ত করে বাধার পরে তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ যার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে, আর এরই ফলে দুনিয়ায় বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে, তাদের অভিশাপ এবং তাদের পরিণাম অত্যন্ত খারাপ।

এখানেও আল্লাহর দেয়া অস্বীকৃতি এবং আল্লাহর স্থাপিত সম্পর্ককে বিচ্ছিন্নকরণের পরিণতি স্বরূপ আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হওয়ার কথাই উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে।

এসব আয়াতের পপ্রেক্ষিতে রাসূলে করীম (স)-এর স্মরণীয় একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী**************************************************)

রেহেমের সম্পর্ক কর্তনকারী কখনই বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।

রাসূলে করীম (স) সবচেয়ে বড় গুনাহ কি কি –বলতে গিয়ে প্রথমত উল্লেখ করেছেনঃ

(আরবী****************************************************************************)

আল্লাহর সাথে শিরক করা এবং পিতামাতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা।

অপর এক হাদীসে তা কবীরা গুনাহ বলে উল্লেখ করেছেনঃ

(আরবী******************************************************************************)

কোনো ব্যক্তির পক্ষে তার পিতামাতাকে গালাগাল করাও কবীরা গুনাহ।

সাহাবীগণ একথা শুনে বলেনঃ পিতামাতাকেও কেউ কেউ গালাগাল করে নাকি হে রাসূল? তখন রাসূল (স) বললেনঃ

(আরবী******************************************************************)

এক ব্যক্তি অপর কারো বাপকে গাল দেয়, প্রত্যুত্তরে সে দেয় প্রথম ব্যক্তির বাপকে গাল, এমনিভাবে কেউ অপর ব্যক্তির মাকে গালাগাল করে সে ব্যক্তি প্রথম ব্যক্তির মা’কেই গাল দেয়।

অর্থাৎ সরাসরিভাবে নিজের মা-বাপকে কেউ গালাগাল না করলেও প্রকারান্তরে –অপর লোক দ্বারা নিজ মা-বাপকে গাল খেতে বাধ্য করে। তাও তার নিজেরই গালাগালের সমান হয়ে দাঁড়ায়।

অপর হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী**********************************************************************************)

কারোর নিজের বাপ-মার পর অভিসম্পাত করাও সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ।

পিতামাতাকে গালাগাল ও অভিসম্পাত করার কাজ ঔরসজাত সন্তান নিজেই করে, আবার কখনো অপরের দ্বারা গাল খাওয়ায়। এ দু’অবস্থার ফল একই। এজন্যে এরূপ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে পিতামাতাকে গালাগাল করা ও অভিসম্পাত দেয়া সম্পূর্ণ হারাম। -কবীরা গুনাহের মধ্যেও সবচেয়ে বড়।

একটি হাদীসে বিশেষভাবে মা’র সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************)

নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা মা’দের সাথে সম্পর্কে ছিন্ন করা, তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা ও তাদের হক নষ্ট করাকে চিরদিনের তরে হারাম করে দিয়েছেন।

উপরে পিতামাতার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা, তাদের হক আদায় করা এবং তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা সম্পর্কে কুরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশাবলী উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে তার বিপরীত দিক সম্পর্কে যে কঠোর বাণী উচ্চারিত হয়েছে, তাও বিস্তারিতভাবে উল্লিখিত হয়েছে।

(আরবী*************************************************************)

কিন্তু ব্যাপার এখানেই শেষ নয়। কুরআন-হাদীসের দৃষ্টিতে বাপ-মা’র সাথে তো বটেই, তাদের বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের সাথেও ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ রয়েছে। বলা হয়েছেঃ

(আরবী**************************************************************************************)

প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষে তার পিতার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ভালো ব্যবহার করাও অতি উত্তম নেক কাজ।

অপর এক হাদীসের শেষ কথাটি হচ্ছেঃ (আরবী**************) –পিতামাতার বন্ধুদের সম্মান করাও সেলায়ে রেহমীর কাজ।

কুরআন মজীদের সূরা আল-বাকারায় বলা হয়েছেঃ

(আরবী***************************************************************************)

হে রাসূল, লোকেরা তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, তারা কোথঅয় ধনমাল ব্যয় করবে। তুমি তাদের বলে দাও, তোমরা যা কিছু খরচ করবে, তা করবে পিতামাতার জন্যে, নিকটাত্মীয়দের জন্যে, ইয়াতীম, মিসকীন ও সম্বলহীন পথিকদের জন্যে।

এ আয়াত সন্তানের ধনসম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে পিতামাতার অগ্রাধিকার স্পষ্টভাবে পেশ করছে। নওয়াব সিদ্দীক হাসান এ আয়াতের তাফসীরে লিখেছেনঃ

(আরবী************************************************************************************)

সন্তানের অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারে পিতামাতাকে সর্বপ্রথম উল্লেখ করা হয়েছে এ কারণে যে, সন্তানের ওপর –তার অর্থ সম্পদের ওপর পিতামাতার যে অধিকার রয়েছে, তা আদায় করা সন্তানের জন্যে ওয়াজিব। কেননা এ পিতামাতাই হচ্চে সন্তানের এই দুনিয়ায় অস্তিত্ব লাভের বাহ্যিক কারণ ও মাধ্যম।

সন্তানের ধনসম্পদে পিতামাতার এ অধিকার কেবল সন্তানের মৃত্যুর পর মিরাস হিসেবেই নয়; বরং তার জীবদ্দশায়-ই এ অধিকার স্বীকৃত। রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী************************************************************************************)

সন্তান পিতার অতি উত্তম উপার্জন বিশেষ। অতএব তোমরা –পিতামাতার –সন্তানের ধনসম্পদ থেকে পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ সহকারে পানাহার করো।

এক ব্যক্তি রাসূলের কাছে উপস্থিত হয়ে বললোঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমার মাল-সম্পদ রয়েছে আর সন্তান-সন্ততিও আছে। কিন্তু এমতাবস্থায় আমার বাবা আমার মাল নিতে চায়, এ সম্পর্কে আপনার কি রায়? রাসূলে করীম (স) বললেনঃ

(আরবী***************************************************************)

তুমি আর তোমার মাল-সম্পদ সবই তোমার বাবার।

এ পর্যায়ের কয়েকটি হাদীস উদ্ধৃত করে তার ভিত্তিতে ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী**************************************************************************)

এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, পিতা তার সন্তানের মাল-সম্পদ ন্যায়ত অংশীদার। অতএব সন্তান অনুমতি দিক আর নাই দিক পিতা তার সন্তানের মাল-সম্পদ থেকে পানাহার করতে পারে এবং তা নিজের মালের মতোই ব্যয়-ব্যবহারও করতে পারে –যতক্ষণ না সে ব্যয়-ব্যবহার অযথা, বেহুদা ও নির্বুদ্ধিতার খরচের পর্যায়ে পড়ে।

শুধু তাই নয়, সচ্ছল অবস্থায় সন্তানের কর্তব্য হচ্ছে গরীব পিতামাতাকে আর্থিক সাহায্য দান।

আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী**************************************************************************************)

দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত পিতামাতারজন্যে অর্থ ব্যয় করা যে সচ্ছল অবস্থায় সন্তানের পক্ষে ওয়াজিব –এ সম্পর্কে শরীয়তবিদদের ইজমা হয়েছে।

পিতামাতার ধন-সম্পদ রক্ষা করাও সন্তানের কর্তব্য। রাসূলে করীম (স) বললেনঃ

(আরবী*****************************************************************************)

প্রত্যেক ব্যক্তিই তার পিতার ধনমাল রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে দায়ী। সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা হলো কিনা, সে বিষয়ে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে –জবাবদিহি করতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদের এ কাজ ইহকাল-পরকাল সব জায়গায়ই হতে পারে।

পিতামাতার খেদমত ও জিহাদে যোগদান

পিতামাতার অধিকার সন্তানের ওপর এত বেশি যে, তাদের অনুমতি ছাড়া জিহাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনী কাজেও যোগদান করা জায়েয নয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) বলেনঃ

(আরবী******************************************************************************)

এক ব্যক্তি রাসূল (স)-এর কাছে এসে জিহাদে যোগদান করার অনুমতি চাইলে তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার পিতামাতা জীবিত আছে কি? লোকটি বললঃ জি, বেঁচে আছেন। তখন রাসূলে করীম (স) বললেনঃ তাহলে তুমি তাঁদের খেদমতেই প্রাণপণে লেগে যাও, এটাই তোমার জিহাদ।

অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, হাজেমা নামক এক সাহাবী বলেনঃ আমি রাসূলের কাছে জিহাদে শরীক হওয়া সম্পর্কে পরামর্শ করার জন্যে উপস্থিত হলাম।

তখন রাসূল (স) জিজ্ঞেস করলেনঃ (আরবী***********) –তোমার মা কি জীবিত আছেন?

আমি বললামঃ হ্যাঁ। তখন রাসূলে করীম (স) বললেনঃ

(আরবী*********************************************************************)

তুমি ফিরে যাও এবং তোমার মা’র সম্মান ও খেদমতে লেগে যাও। কেননা তার দুপাযের তলাতেই বেহেশত রয়েছে।

রাসূলে করীম (স) মক্কা ও মদীনার মাঝখানে এক বৃক্ষের তলায় সাহাবীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে বসেছিলেন। সহসা এক দুর্ধর্ষ বেদুঈন এসে উপস্থিত হলো এবং বললঃ

(আরবী************************************************************************************)

হে আল্লাহর রাসূল, আমি আপনার সঙ্গে জিহাদে গমন করতে চাই, আমার মধ্যে শক্তিও আমি পাচ্ছি, আমি আপনার সঙ্গে মিলে শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করতে ভালোবাসি এবং আপনার সম্মুখে নিহত হতেও পছন্দ করি।

তখন রাসূলে করীম (স) জিজ্ঞেস করলেনঃ

(আরবী****************************************)

তোমার কি বাপ-মার মধ্যে কেউ জীবিত আছেন?

লোকটি বললঃ হ্যাঁ। তখন রাসূলে করীম (স) বললেনঃ

(আরবী*****************************************************************************)

তাহলে তুমি ফিরে যাও, পিতামাতার সঙ্গে গিয়ে মিলিত হও এবং তাদের জন্যে কল্যাণকর কাজ করো; আর আল্লাহ ও বাপ-মা’র শোকর আদায় করো।

সে লোকটি বললঃ আমি তো যুদ্ধ করার শক্তি রাখি এবং শত্রুর সাথে লড়াই করতে ভালোবাসি।

তখন রাসূলে করীম (স) আবার নির্দেশ দিলেনঃ

(আরবী******************************************************************)

যাও, তোমার বাপ-মার সাথে গিয়ে বসবাস করতে থাক।

আবূ দাঊদের এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ এক ব্যক্তি ইয়েমেন থেকে হিজরত করে রাসূলের কাছে বসবাস করার ও জিহাদে শরীক হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে মদীনায় এসে উপস্থিত হলো। রাসূলে করীম (স) জিজ্ঞেস করলেনঃ বাড়িতে তোমার কে কে আছে? সে বললঃ বাপ-মা সবই আছেন। তাদের অণুমতি নিয়ে এসেছে কিনা একথা জিজ্ঞেস করলে লোকটি বললঃ না, অনুমতি নিয়ে আসেনি।

তখন নবী করীম (স) বললেনঃ

(আরবী***************************************************************************)

তুমি তাদের কাছে ফিরে যাও এবং তাদের দু’জনের কাছেই অনুমতি চাও। অনুমতি দিলে ফিরে এসে জিহাদে শরীক হবে। আর অনুমতি না দিলে তুমি তাদেরই কল্যাণময় খেদমতের কাজে লেগে থাকবে।

পিতামাতার হক ছেলে-সন্তানের ওপর যে কত বেশি এবং কত তীব্র ও অনিবার্য-অপরিহার্য, তা উপরের দলীলভিত্তিক বিস্তারিত আলোচনা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি