ত্রয়োদশ অধ্যায়
জামাল আবদুন নাসের বহুরূপী মানুষ। বিচিত্র চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি। আমাদেরকে যখন কারাগার থেকে মুক্ত করা হয়েছিল তখন জামাল আবদুন নাসের প্রস্তাব পেশ করেছিলো যে, জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়দি এবং জটিলতা ও সমস্যা সমূহের সমাধানের জন্য একটা কমিটি গঠন করা হোক। এই কমিটিতে ইখওয়ান ও সামরিক কাউন্সিলের সদস্যগণ অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। ইখওয়ান এবং কাউন্সিলের মধ্যে যদি কোন ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হয় তাহলে এ কমিটি তা নিরসন করার দায়িত্বও পালন করবে। পরিতাপের বিষয় হলো ঠিক এই প্রস্তাবই আমাদের দু’জন সদস্য মুনীরউদ্দৌলা ও সালাহ শাদী ইতিপূর্বে পেশ করেছিলেন। তাতে নাসেরের প্রতিক্রিয়া ছিল এই যে; বিপ্লবী কাউন্সিলের ওপর আমরা কোন উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান চাই না। আমরাই সরকার। সরকারের ওপর কোন প্রতিষ্ঠানের আবশ্যকতা নেই।
এ ব্যাপারে তাকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম যে, এ প্রতিষ্ঠান সরকারের কর্মকাণ্ডে কোন রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। আমরা এই সমঝোতা কমিটি থেকে শুধু পারস্পরিক বুঝা পড়ার কাজ পেতে চাই। আমাদের কদাচ এরূপ কোন উদ্দেশ্য নেই যে, সরকার কোন আইন বা সিদ্ধান্ত ঘোষণার পূর্বেই আমাদের অনুমোদন নিতে বাধ্য থাকবেন। নাসের সে সময় বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। এখন সে নিজেই প্রস্তাব পেশ করছে। যদিও এবারে সে কেবল প্রস্তাব পেশ করার কষ্টই স্বীকার করেছেন। অগ্রসর হয়ে আর কিছুই করেনি।
আমাদের ওপর দোষারোপের পালা আসলে হুঙ্কার ছেড়ে অত্যন্ত জোরেশোরে তীব্র প্রতিবাদী ভাষায় বলা হলো এই ইখওয়ানীরা নিজেদেরকে সরকারের উর্ধে মনে করে। তারা চায় তাদের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়া ছাড়া যেন কোন আইন কার্যকরী না করা হয়। ইখওয়ানীরা চায়, তাদের অনুমতি ছাড়াও যেন কোন একটা পাতাও না নড়ে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের সাথে তার আচরণ তো সর্বদা এমনই হয়েছে যে, প্রয়োজনের সময় আমাদের সহযোগিতা কামনা করেছে আর বিপদ কেটে গেলে বা মতলব হাসিল হয়ে গেরে তখন অভিযোগের পুরস্কার আর দোষারোপ তোহফা হিসেবে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।
বিপ্লবের রোয়েদাদ
বিপ্লবের পূর্বের বর্ণনাও শুনে রাখুন। বিপ্লবের ফায়সালা হয় ইখওয়ানের পরামর্শক্রমে ও সার্বিক সহযোগিতায় কিন্তু বলা হয়, যেহেতু ইখওয়ান বিশ্ব শক্তিসমূহের দৃষ্টিতে একটা শক্তিশালী সংগঠন। বিশেষত ফিলিস্তিন যুদ্ধে ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলো তাদের আত্মনিবেদনের দৃশ্য দেখেছে। সেজন্য প্রকাশ্যে এগিয়ে আসা তাদের জন্য উচিত নয়। কর্মসূচী অনুযায়ী পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপদান করবে সেনাবাহিনী। আর ইখওয়ান পর্দার অন্তরালে থেকে সহযোগিতা করবে। তিনি বলেনঃ এসব ইখওয়ানী যুবক যারা মুহাম্মাদ (সা)-এর আনীত পয়গামের বিশ্বস্ত সংরক্ষক ও পতাকাবাহী। বিশ্বক্তিগুলো তাদের দেখে খুবই আতঙ্কিত এবং ভীত সন্ত্রস্ত। তারা সম্মুখে অগ্রসর হলে ইসলামের সমস্ত দুশমন উঠে দাঁড়াবে। ফলে বিপ্লব সফলতা লাভ করতে পারবে না। আমরা বললামঃ ঠিক আছে, আমাদের উদ্দেশ্য হাসিল করাই মূল লক্ষ্য। সুনাম সুখ্যাতির কোন আকাংখা আমাদের নেই।
পাশ্চাত্য দূতাবাসসমূহ ও ইখওয়ান
মিসরে নাকরাশী পাশার মন্ত্রীত্বের আমলে পাশ্চাত্য দেশসমূহের রাষ্ট্রদূতগণ এক জায়গায় সমবেত হন এবং প্রধান মন্ত্রীকে এক কড়া নোট প্রেরণ করেন। সেই নোটে যেমনি ছিল পীড়াপীড়ি তেমনি ছিল হুমকি যেন ইখওয়ানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এ মসয়ই আযাদ অফিসার বিপ্লবের জন্য একপায়ে দাঁড়িয়েছিল। নাকরাশী পাশা ইখওয়ানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। কঠিন পর্যায়সমূহ ও ত্যাগ স্বীকারের মত ক্ষেত্রসমূহের দাবী পূরণের জন্য ইখওয়ানের ওপরে ভরসা করে বসেছিলো। এই বিধি-নিষেধ আরোপের ফলে সেনাবাহিনী বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু এই তথাকথিত নিষেধাজ্ঞা আন্দোলনকে কি কখনো নিঃশেষ করতে পারে?
নাকরাশী পাশার পক্ষ থেকে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় তা ছিল প্রথম নিষেধাজ্ঞা। তারপর আমাদের ইতিহাস নিষেধাজ্ঞার ইতিহাসে রূপান্তরিত হয়েছে। কথায় বলে এক পন্থা দুই কাজ, কিন্তু মিসর ও ইসলামের দুশসনরা এক পন্থা ও তিন কাজের প্রদর্শনী করে দেখিয়েছিলো। তারা ইখওয়ানের ওপর আঘাত করেন যা ছিল প্রকৃতপক্ষে মিসরের শাসকগোষ্ঠীর ওপর আঘাত এবং সর্বোপরি সমগ্র মিসরীয় জাতির ওপর আঘাত। আমাদের শত্রুরা জানে যে, মিসর আরব বিশ্ব ও ইসলামী দুনিয়ার নেতৃত্ব দিতে পারে। অতএব তারা মিসরকে কখনো ইসলামী রূপ গ্রহণের অনুমতি দেয় না। এভাবে তারা এক তীরে তিন তিনটি শিকার করে চলেছে।
হতে পারে তোমরা যা অপছন্দ করো
তাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর
আমি এখানে এ সত্যটি তুলে ধরাও জরুরী মনে করি যে, নাসেরের নির্যাতন ও দমননীতি ইখওয়ানের পয়গাম মিসরের বাইরে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই সন্ত্রাসী পরিস্থিতির কারণে বহু ইখওয়ান দেশ থেকে হিজরত করে চলে যায়। যেহেতু নাসের নিজেও সর্বদা ইখওয়ানের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত থাকতো। তাই ইখওয়ানের দেশের বাইরে চলে যাওয়ার ব্যাপারে কখনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়নি। সে মনে করতো যে, এরা মিসর থেকে চলে গেলে সে হাফ ছেড়ে বাঁচতে পারে। দেশের বাইরে গমনকারী এসব লোকেরা আন্দোলনের পয়গাম তাদের সংগে নিয়ে যায়। তারা যেখানেই গিয়েছে সেখানেই ইখওয়ানের দাওয়াত প্রসার লাভ করেছে। এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই যে, সুদূর ইউরোপ, প্রাচ্য ও প্রতিচ্যে ইখওয়ানের প্রচেষ্টায় ইসলামের আলো ও জাগরণ ছড়িয়ে পড়া যেন ইতিহাসেরই পুনরাবুত্তি। ফাতেহ মুহাম্মদের হাতে কনষ্টান্টিনোপল বিজয় হয়। তখন ঈসায়ী আলেমগণ সেখান থেকে হিজরত করে। ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং এই মহাদেশ তারা খৃস্টবাদের প্রসার ঘটান। এখন মিসরেও নাসের সত্য পন্থীদের ওপর জুলুম নির্যাতনের অস্ত্র প্রয়োগ করলো। তাই ইসলাম প্রিয় জনতা ইসলামের শাশ্বত বাণী বক্ষে ধারণ করে আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের সাথে ইসলামী আন্দোলনও এসব দেশে প্রসার লাভ করতে থাকে।
জুলুমের রাতের অবসান
আমার স্মৃতি পটে সেই দৃশ্য জীবন্ত হয়ে রয়েছে যখন যখন ১৯৭১ সালে আমাকে কারাগারে থেকে মুক্তি দেয়া হয়। এটা ছিল ৩০শে জুন ১৯৭১ সালের কথা। ইখওয়ানী ভাইয়েরা মাগরিবের নামায সবে মাত্র শেষ করেছেন। আমি তখনও নামায পড়ছিলাম। এরই মধ্যে আমি ইখওয়ানী ভাইদেরকে উচ্চৈস্বরে পরস্পরের সাথে কথাবার্তা বলতে শুনলাম। তাদের আলোচনায় তারা বার বার আমার নাম উল্লেখ করছিলো। আমি সেদিকে তেমন ভ্রুক্ষেপ করলাম না। সালাতুল এশার পর জনৈক অফিসার আমার নিকট আগমন করে বলতে লাগলেন আপনি, উস্তাদ মামুন আল হুদাইবি এবং আপনার অন্যান্য সংগী-সাথীদের মুক্তিদানের নির্দেশ এসেছে। আপনাদের মালপত্র গুছিয়ে নিন এবং বেরিয়ে পড়ুন। আমি তাকে বললাম এটা কি সম্ভব নয় যে আমি এই রাতটি এখানেই অতিবাহিত করি এবং আগামীকাল সকালে চলে যাই। কেননা আমি এত দীর্ঘ সময় কারাগারে অবস্থান করছি যে, কায়রোর রাস্তাঘাট পর্যন্ত ভুলে গেছি। এত বছরের দীর্ঘ সময়ে না জানি কায়রোতে কত পরিবর্তন এসেছে। রাতের বেলায় আমি আমার সবতবাড়ী কিভাবে খুঁজে বের করব?
আমার কথা শুনে কর্মকর্তাটি চোখ কপালে তুলে বলতে লাগলোঃ এটা আপনি কি বলছেন? আপনি কি বন্দী জীবন থেকে মুক্তি লাভ করে উন্মুক্ত আকাশের নীচে বেরিয়ে যেতে চান না?
আমি বললামঃ “জেল থেকে ছাড়া পেতে চাই, কিন্তু আজ রাত এখানেই কাটিয়ে আগামী কাল প্রত্যুষে বেরিয়ে যাওয়া উত্তম বলে মনে করি।”
জেল অফিসার বিস্মিতও হলেন আবার পীড়াপীড়িও করছিলেন যেন আমি শীগ্রই জেলখানার বাইরে চলে যাই। তিনি বললেনঃ যখন আপনার মুক্তির ফরমান আমার হাতে এসে পৌঁছে তখনই আপনার নাম কারাগারের হাজিরা পৃষ্ঠা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এখন আপনি আমাদের হিসেবের অন্তর্ভূক্ত নন। যদি আল্লাহ না করুন আজ রাতে জেলের ভেতর আপনার কিছু হয়ে যায় তাহলে সে দায়িত্ব বহন করবে কে? আমাদের জন্য তা বড়ই বিপদের কারণ হবে। আমাদের আতিথেয়তা এ পর্যন্ত শেষ হয়ে গেছে। আপনি কারা ফটকের বাইরে সানন্দে রাত্রি যাপন করতে পারেন। কিন্তু এ চার দেয়ালের ভেতর এখন আর আপনার অবস্থান সম্ভব নয়।
একদিন কিংবা একদিনের কিছু অংশ
অগত্যা আমি অফিসার মহোদয়কে অনুরোধ করলাম- অবস্থা যদি এই-ই হয় তাহলে আমার জন্য একটা ট্যাক্সি ডেকে দিন।
তিনি একখানা ট্যাক্সি নিয়ে আসলেন। ট্যাক্সিওয়ালা আমাকে আমার বাসগৃহে নিয়ে গেল। এটা কত বিস্ময়ের ব্যাপার যে, আমি আমার বাড়ীর চার দেয়ালের মধ্যে আমার পরিবার পরিজনের মাঝে সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে গিয়ে হাজির হলাম।
আপনি বিস্ময়ে হতবাক হবেন যে, আমি বাড়ীতে কিংবা আমার মন-মগজে কোন বড় পরিবর্তন অনুভব করলাম না। মনে হচ্ছিলো যেন আমি গতকালই আমার বাড়ী থেকে গিয়েছিলাম আর আজ পুনরায় ফিরে এসেছি। অথচ ইতিমধ্যে প্রায় আঠারটি বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। আরো জেনে নিন যে, আমি স্বভাবগতভাবে আমার পরিবার পরিজন ও প্রিয়জনদের খুব বেশী ভালবেসে থাকি। তারপরও কি রহস্যজনক ব্যাপার যে, এ সুদীর্ঘকাল একদিনের বেশী মনে হয়নি। আমি নিজে এ রহস্যের কিছু জানি না। আমার মনে হয় মানুষের শিক্ষার জন্য আল্লাহ তায়ালার অগণিত নিদর্শন সৃষ্টিজগতে বিদ্যমান। এটাও তারই একটা নিদর্শন।
এই উচ্চ মর্যাদা যিনি লাভ করেছেন
আমার নিজের অবস্থার প্রতি লক্ষ করুন। আমি স্বাধীনতার প্রেমিক। অথচ আমি এ সুদীর্ঘ সময় জেলখানায় অতিবাহিত করলাম। কিন্তু সেজন্য অন্তরে কোন দুঃখ কিংবা মনের ওপর কোন বোঝা অনুভব করিনি। আমার চিন্তা-চেতনার প্রতি লক্ষ্য করলে আমার ধৈর্য ও পরিতৃপ্তি এই অবস্থা দেখে আপনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন। আমি যখন পাখীদের ইচ্ছামত আকাশে উড়ে বেড়াতে দেখি তখন তাদের এই অবাধ স্বধীনতা দেখে আকাংকা জাগে- আমার বড় ঈর্ষা হয়। মাছের কথা চিন্তা করি চিরে ওপরে ভেসে ওঠে। তখন তার সৌভাগ্য দেখে হতবাক হয়ে যাই। অথচ আমার নিজের অবস্থা এই যে, সুদীর্ঘ সময় কারাপ্রকোষ্ঠেই কেটে গেল। না ছিল মুখখোলার অনুমতি, না নাড়াচাড়ার স্বাধীনতা। তার পরও আন্তরিক প্রশান্তি! এটা আল্লাহর দ্বীনের কারণেই সম্ভব হয়েছে।
স্বাধীনতা অমূল্য সম্পদ
একথা সত্য যে, ছোট ছোট প্রাণী ও পাখীরা বড় বড় প্রাণী ও পাখীদের শিকারে পরিণত হয়। ছোট ছোট মাছগুলোকে বড় মাছেরা খেয়ে ফেলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও যতদিন তাদের দেহে প্রাণ থাকে ততদিন তারা স্বাধীনতার অর্থ বুঝতে পারে এবং এ মহানেয়ামত পেয়ে সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত থাকে। তারা স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে, মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াতে, সুমিষ্ট স্বরে গান গাইতে, গভীর পানিতে ডুব দিতে ও সাঁতার কাটতে সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছা ও এখতিয়ারকে কাজে লাগাতে পারে। এ ক্ষেত্রে কারো বিধি-নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ আরোপের কোন সুযোগ থাকে না। এসব প্রাণী, পাখী ও মৎস্যের জন্য আল্লাহর এত বড় নিয়ামত যে, তার কোন বিকল্প নেই। মানুষ সৃষ্টির সেরা কিন্তু আফসোস! সে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে না-ওয়াকিফ এবং তার নেয়ামত থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত। মানুষ যদি আইনের সীমানার মধ্যে থেকেই স্বাধীনতা ভোগ করতে পারতো এবং আইনের বিরুদ্ধাচরণ করলে তাকে পাকড়াও করা হতো তাহলে মানবতা কতইনা সৌভাগ্যবান ও সমৃদ্ধ হয়ে যেতো। অথচ এখানে অবস্থা এই ‍যে, ক্ষমতাধররা কেবলমাত্র এমন কথাই বলার অনুমতি দান করেন যা তাদের তোষামোদ এবং প্রশংসার জন্য উচ্চারিত হয়। আবার চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা তার নিকট ততক্ষণই গ্রহণযোগ্য যতক্ষণ তা থাকে তার মর্জির অধীন।
মানব জীবনের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে এই স্বাধীনতা। এজন্য সে কখনো স্বৈরাচার ও একনায়কত্বকে পছন্দ করে না। আমার সুদীর্ঘ কারা জীবনে যে জিনিসটি আমাকে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে তা ছিল আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত তাকদীরের ওপর অবিচল আস্থা এবং অগাধ বিশ্বাস। আমার বলিষ্ঠ ঈমান ছিল যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমার প্রিয় জীবনের একটা অংশ জেলখানায় কাটানোর ফায়সালা করেছেন। তাই আমি তার সন্তুষ্টির ওপর রাজী থাকলাম। আমি আমার অন্তরের অন্তস্থলে এবং আবেগ-অনুভুতিরসূক্ষ্ম তন্ত্রীতে পর্যন্ত আপাদমন্তক আত্মসমর্পিত ও সন্তুষ্ট থাকি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই দোয়ার অর্থও আমার সম্মুখে সুস্পষ্ট-যাতে তিনি রাব্বুল ইজ্জাতের সমীপে আরজ করেছিলেনঃ
“হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট তোমার ফায়সালা পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার জন্য দোয়া করছি না। বরং আমি তোমার নিকট আবেদন করছি তোমার গৃহীত সিদ্ধান্ত সর্বান্তকরণে মেনে নেয়ার জন্য আমাকে মানসিক প্রশান্তি প্রদান কর। আর তা আমার জন্য সহজসাধ্য করে দাও।
আর এটা যখন আল্লাহ তায়ালার ফায়সালা এবং তারই নির্ধারিত তাকদীর যাতে চুল পরিমাণ পরিবর্তন সাধনের ক্ষকমতা কারো নেই। তখন অস্থিরতা ও অধৈর্য হওয়ার কি অর্থ থাকতে পারে? আমার জেলে যাওয়া এবং একটা মেয়াদকাল সেখানে অতিবাহিত করা ছিল আল্লাহ তায়ালারই ফায়সালা। এতে আল্লাহর ইহসান ও করুণা ছিল এই যে, আমি কোন অন্যায় কাজের জন্য কিংবা কোন অপরাধের শাস্তি স্বরূপ জেলে যাইনি। আমি একটি মহৎ উদ্দেশ্য ও পবিত্র লক্ষ্য অর্জনের জন্য শৃংখলাবদ্ধ হয়েছিলাম। আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর পথে আহবান। এজন্য আমি পুরোপুরি আত্মসমর্পণ ও সন্তুষ্টিসহ সকল প্রকার প্রতিকূলতা এবং কষ্ট সহ্য করার জন্য তৈরী ছিলাম এবং এখনও আছি।
প্রবৃত্তির আকাংকা ও তার পূজা
হাসান আল হুদাইবি যখন ইখওয়ানের মুর্শিদে আ’ম নির্বাচিত হন তখন একই সাথে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্যগণের নির্বাচনও সম্পন্ন হয়। তাঁর (মুর্শিদে আ’ম-এর) প্রত্যাশা ছিল নবনির্বাচিত সদস্যগণ উচ্চ শিক্ষিত সাথীদের মধ্য থেকেই যেন নির্বাচিত হয়। কোন কোন ইখওয়ান তাঁর এ মতের সাথে একমত হতে পারেননি। যা হোক নির্বাচন পর্ব সম্পন্ন হয়ে যায়। কিন্তু কিছু সংখ্যক সদদ্যের দৃষ্টিভংগী ও আচার আচরণে এরূপ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল যে, মুর্শিদে আ’ম হয় নির্বাচন কমিশনই বাতিল করে দেবেন নয়তো সদস্যদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনয়ন করবেন। তবে তিনি এখনো এ সম্পর্কে চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেননি। ইত্যবসরে আবদুর রহমান সিদ্ধী যার সম্বন্ধে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে এবং যিনি সাইয়েদ হাসানুল বান্না শহীদের আমলে বিদ্রোহাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন-এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করার অপেক্ষায় ছিলেন। ইমাম শহীদের সময় পরিস্থিতি ভিন্ন রকম ছিল। কিন্তু এখন জামাল আবদুন নাসের আবদুর রহমান সিদ্ধীর মনোভাবের ফলশ্রুতিতে পিঠে হাত বুলাচ্ছিলেন।
উস্তাদ আল বান্না শহীদের জীবদ্দশায় তিনি বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করার সার্বিক অপপ্রয়াস চালিয়ে দেখেছিলেন যে, ইখওয়ানের মিজাজ ও প্রশিক্ষণের শিক্ষা দীক্ষার প্রভাবে তাদেরকে মুর্শিদে আ’মের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো ও উত্তেজিত করা সম্ভব নয়। অথচ সেই তিনিই এখন পুনরায় অনুভব করেন যে, পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তাই এখন তার দূরভিসন্ধি কাজে লাগতে পারে। একদিকে নাসেরের সামগ্রিক পৃষ্ঠপোষকতা অপরদিকে কোন কোন ইখওয়ানের মানসিক অস্থিতিশীলতা সিন্ধী সাহেবকে আবার ভাগ্য পরীক্ষায় ব্রতী হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে তোলে। হাসান আল হুদাইবি ছিলেন অত্যন্ত ধীর স্থির, অনমনীয় এবং প্রবল প্রতাপশালী ব্যক্তি। তিনি কারো কাছে নতি স্বীকার করার লোক ছিরেন না। আবদুর রহমান সিদ্ধী ও তার সাথীরা সেনাবাহিনীর জওয়ানদের সহযোগিতায় একদিন রাতে মুর্শিদে আ’মের বাসগৃহের ওপর আক্রমণ করে বসে। টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং জোরপূর্বক মুর্শিদে আ’মকে গাড়ীতে তুলে নিয়ে যায়। বাড়ী থেকে কিছু দূর এক জায়গায় নিয়ে তাঁকে ইখওয়ানের নেতৃত্ব থেকে ইস্তফা দিতে বলে। এসব নির্বোধদের জানা ছিল না যে, হাসান আল হুদাইবি কারো চাপের মুখে কাবু হওয়ার লোক ছিলেন না। তিনি ছিলেন এমন অনমনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী যে, তার ঘাড়ের ওপর তলোয়ার ধরা হলেও তিনি ইস্তফা দিতেন না।
মুর্শিদে আ’ম-এর আহবান ও আমার উপস্থিতি
হাসান আল হুদাইবির নিকট থেকে ইস্তফা ও পদত্যাগপত্র নিতে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে সেখানেই রেখে এসব ব্যক্তি কেন্দ্রীয় অফিসে এসে তা দখল করে। আমি যেখানে ভাড়ায় থাকতাম সে বাসার অপর অংশে বাড়ীর মালিক বাস করতেন। সেখানে টেলিফোন ছিল। সন্ধ্যায় কে বা কারা আমাকে ফোন করলো। অন্য প্রান্ত থেকে ভাই ফরিদ আবদুল খালেক কথা বলছিলেন। তিনি বললেনঃ আমি মুর্শিদে আ’মের বাড়ীতে আছি আপনি এখনই এখানে চলে আসুন। আপনাকে নিয়ে আসার জন্য একটা মোটর সাইকেল পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
বাড়ীওয়ালাকে আল্লাহ তায়ালা উত্তম পুরস্কার প্রদান করুন। তিনি বললেনঃ আমি আপনাকে এভাবে যেতে দেব না। ফোনকারী কে আর এ মোটর সাইকেল আরোহীর পরিচয় এবং তার মতলব কি তা তো জানা নেই? মোটর সাইকেলওয়ালা আগে আগে যাবে আর আপনি আমার সাথে গাড়ীতে বসুন। আমি আপনাকে মুর্শিদে আ’মের বাড়ীতে পৌঁছে দিয়ে আসবো। এতএব সেই সদয় বন্ধুর গাড়ীতে করেই আমি মুর্শিদে আ’মের বাসভবনে গিয়ে উপনীত হলাম।
মুর্শিদে আ’মের বাড়ীতে তখন কয়েকজন ইখওয়ান বসে ছিলেন। আমি তাদেরকে অস্থির দেখে জিজ্ঞেস করলাম খবর ভাল তো? তারা আমার কাছে সব ঘটনা বর্ণনা করলো। ভাই হারুন মুজাদ্দেদীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তার নিজের প্রাইভেট কার ছিল। আমাকে কেন্দ্রীয় অফিসে পৌছে দেয়ার জন্য আমি তাকে অনুরোধ করলাম। আমরা যখন কেন্দ্রীয় অফিসে গিয়ে দেখতে পেলাম দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। তালাগুলোতে শিকল লাগানো দেখতে পেলাম। এবং ভিতর থেকে এক ভাই “সিদ্ধী সাহেবের সাথী” দেখা শোনার দায়িত্ব পালন করছে। আমার বন্ধু ও সহকর্মী ভাই সালেহ আসমাভীও (নায়েবে মুর্শিদে আ’ম) দফতরে উপস্থিত ছিলেন। প্রহরী আমাকে দেখে বললোঃ আমি আসমাভী সাহেবের অনুমতি নিয়ে তার পর দরজা খুলে দিচ্ছি।
আমি বললাম মা’শায়াল্লাহ, বেশ। এখনই কি সেই সময় এসে গেছে যে, আমি অনুমতি ব্যতীত এই দফতরে প্রবেশ করতে পারবো না। তারপর সে ভিতরে চলে যায় এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দরজা খুলে দেয়। আমি সোজা ভেতরে প্রবেশ করি। মিলনায়তনে আমি প্রায় চল্লিশ জন সরকারী বিভাগের লোককে দেখতে পাই। আমি হল থেকে বেরিয়ে মুর্শিদে আ’মের দফতরে যাই। সেখানে ভাই সালেহ আসমাভী মরহুম বসে ছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ আলহাজ্জ সালেহ, এত উৎসব আয়োজন কিসের? তিনি হেসে বললেন, মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জলসা।
আবদুর রহমান সিন্ধী এই চল্লিশ ব্যক্তির সাহায্যে দফতর দখল করে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। টেলিফোনে আমি তার সাথে যোগাযোগ করি। উস্তাদ আহমদ বিন আবদুল আযীয টেলিফোন ধরেন অনেক দীর্ঘ ও জটিল আলোচনা হয়। গোটা রাতই এই বিতর্কের মধ্যে কেটে যায়, আমি আবদুর রহমান সিন্ধীকে আচ্ছা রকম জব্দ করে বলি যে, তিনি এটা কেমন আচরণ করলেন। আন্দোলনের মধ্যে সমস্ত সমস্যার সমাধান যুক্তি প্রমাণের ভিত্তিতে সমাধান করা হয়ে থাকে। পুলিশ ফোর্সের সাহায্যে নয়। মোদ্দাকথা একদিকে ফজরের আযানের সময় হয়ে যায়, অপর দিকে আবদুর রহমান সিন্ধী সশস্ত্র ব্যক্তিদেরকে দফতর থেকে সরিয়ে নিতে সম্মত হয়।
মুসিবত কেটে গেল
অপরদিকে ইখওয়ানও এক জায়গায় সারারাত পরামর্শ করতে থাকে। পরিশেষে তারা এ সেদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ঢিলের জওয়াব পাটকেল দিয়েই দেয়া হবে। তারা সবাই সুলতান হাসান মসজিদে সমবেত ছিলেন। তারা ফায়সালা করেন যে, কেন্দ্রীয় দফতরে গিয়ে অবরোধকারীদেরকে বহিষ্কার করতে হবে। তবে আল্লাহ তায়ালার শোকর যে, সংঘর্ষের পর্যায়ে যেতে হয়নি। এ লোকদের সেখানে গিয়ে পৌঁছার আগেই সরকারী লোকজন দফতর ছেড়ে চলে যায়। সমস্যাটি ভালোয় ভালোয় সমাধান হয়ে যাওয়ায় আমি আল্লাহর শোকর আদায় করলাম।
পরদিন ইখওয়ান কেন্দ্রীয় দফতরে মুর্শিদে আ’মের সম্মানে এক মহাসমাবেশের আয়োজন করে। উক্ত সমাবেশে হাজার হাজার লোক অংশগ্রহণ করে। সবার কাছে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইখওয়ানের ওপর কারো নেতৃত্ব চাপিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। মুর্শিদে আ’ম তো ইখওয়ানের ইচ্ছা ও পছন্দ অনুযায়ী নির্বাচিত হয়ে থাকে। যার প্রতি থাকে ইখওয়ানের ঐকান্তিক ভালবাসা এবং যার নির্দেশে তারা জীবন বাজি রেখে সম্মুখে অগ্রসর হতে সদা প্রস্তুত।
সিন্ধী সাহেবের পুরস্কর ও পরিণতি
সেদিন থেকেই ইখওয়ানের সাথে আবদুর রহমান সিন্ধীর সকল সম্পর্কের পরিমাপ্তি ঘটে। তারপর সে আর কখনো অগ্রসর হতে পারেনি। তার পরিণতি এবং পরিণামও শিক্ষণীয়। শুধু মাত্র স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য উল্লেখ করছি। জামাল আবদুন নাসের সিন্ধী সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। তার কৃতিত্বের পুরস্কার স্বরূপ তাকে শেল কোম্পানীর উচ্চ পদে নিয়োগ করা হয় এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় বড় জাকজমক পূর্ণ বাংলো প্রদান করা হয়। মহোদয় কিছুদিন বেশ আড়ম্বরপূর্ণ ও বিলাসী জীবন যাপন করেন। কিন্তু কতদিন!
নাসেরের মেজাজ ছির অস্থির প্রকৃতির। ১৯৬৯ সালে আবদুর রহমান সিন্ধীকে গ্রেফতার করা হয়। তার এত সেবা ও আনুগত্য সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনীত হয় যে, ইখওয়ানের সাথে তার গোপন যোগসাজশ রয়েছে। তার সংগী-সাথী যারা ইখওয়ানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল যেমন আবদুল আযীয কামিল প্রমুখও বাদ পড়েনি। আবদুর রহমান সিন্ধীকে এমনভাবে ধোলাই করা হয় যে, জেলখানা থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মারের চোটে বেচারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই অসুস্থই প্রাণঘাতি প্রমাণিত হয় এবং সে এই নশ্বর পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে যায়। আল্লাহ তায়ালা মরহুমকে ক্ষমা করে দিন এবং তার সমস্ত অপরাধ তারঁ রহমত দ্বারা ঢেকে দিন।
আবদুর রহমান সিন্ধী ইখওয়ানের সমস্ত তথ্য নাসেরকে পৌঁছানের দায়িত্ব পালন করতেন। এ কারণেই তিনি নাসেরের একান্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। কিন্তু নাসেরের পৃষ্ঠপোষকতা ইখওয়ানের ওপর আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে তার জন্য সহায়ক হয়নি। তিনি একটা অত্যন্ত মামুলী ধরনের তুফান সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু তা সোডার বোতলের উথলিয়ে ওঠার চেয়ে বেশী কিছু ছিল না। এই ফিতনার খুবই সাধারণ আঁচড় তিনি রেখে যেতে সক্ষম হন। অনতিবিলম্বেই যার প্রতিকার হয়ে যায়। ইখওয়ানের বিরুদ্ধে তার এই গোয়েন্দাগিরী দুনিয়াতেও মরহুমের তেমন কোন কল্যাণ সাধন করতে পারেনি। আবার আখেরাতে তা বড় রকমের কোন পুরস্কার লাভের কারণ হবে না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলেরই ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা করে দিন।
চতুর্দশ অধ্যায়
উস্তাদ আল হুদাইবির ব্যক্তিত্বকে সরকার কিংবা তার দোশরগণ কোনভাবেই ক্ষুন্ন কিংবা ব্যাহত করতে পারেনি। তার সম্মান ও সম্ভ্রমের প্রভাব প্রথম থেকেই ইখওয়ানের ওপর পড়ে অত্যন্ত প্রগাঢ়ভাবে। জামাল আবদুন নাসের সিন্ধী ও তার সাথীদের সাহায্যে অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে গিয়ে দারুণভাবে ব্যর্থ হয়। আল্লাহর নিরপত্তা ও তত্বাবধানের মোকাবিলায় কি কারো কোন জোর-জবরদস্তি চলতে পারে। বাইয়াত গ্রহণকারীগণ জেনে বুঝে আল্লাহকে সাক্ষী রেখেই মুর্শিদে আ’মের হাতে হাত রেখেছেন। কপটতার কূটকৌশল ও দুরভিসন্ধীর দ্বারা কি এ বাইয়াতের গ্রন্থি ছিন্ন হতে পারে। এ বিদ্রোহাত্মক আচরণ ইখওয়ানের শক্তি হ্রাসের পরিবর্তে তা আরো বৃদ্ধি করে। আমাদের এবং বিদ্রোহীদের মাঝে একটা মস্তবড় ফারাক রয়েছে আমরা সর্বোতভাবে তাদের হিতাকাংখী ও কল্যাণকামী। অথচ তারা আমাদের সর্বনাশ সাধনে তৎপর। কল্যাণের পতাকাবাহী এবং শিরকের প্রচারক কখনো সমান হতে পারে না। আমরা তাদের স্থায়িত্ব কামনা করতাম আর তারা ছিল আমাদের ধ্বংসের প্রত্যাশী। লতাপাতা ও খড়কুটো তো পানির স্রোতের সাথে ভেসে যায় বটে। কিন্তু পানি সরে যাওয়ার পর সেখানে আবার দেখা দেয় সবুজের সমারোহ। আর পারিপার্শ্বিকতায় বসন্তের ভরা যৌবনের আমেজ এনে দেয়। নিসন্দেহে এতে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে এমনসব লোকদের জন্য যাদের অন্তর (দৃষ্টিশক্তি) রয়েছে।
ঐতিহাসিক ঘটনা
মানবেতিহাসে এমন কিছু ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যা দেখে দর্শক তাকে সুবিন্যস্ত পরিকল্পনার ফল বলে মনে করে অথচ তা কিন্তু আকস্মিকভাবেই সংঘটিত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ ফরাসী বিপ্লবের ঘটনাবলী নিয়ে চিন্তা করুন। বাস্তীল জেলখানা ভেংগে ফেলার ঘটনা কোন পূর্ব পরিকল্পনার পলে বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করেনি। ঐ সময় শহী জুলুম চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলো। এবং জনসাধারণের মন-মানসে এরূপ একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, বাস্তীলের কারাগার আযাদীর বধ্যভূমি। মানুষের মনে এর বিরুদ্ধে প্রচন্ড ক্ষোভ ও উত্তেজনা ধূমায়িত হয়েছিল। রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে জনসাধারণের ঘৃণা ও ক্রোধ চরমে পৌছলে জনগণ সর্বপ্রথম ঐ জেলখানা ধ্বংস করে। এই ঘটনা মূলত ফরাসী বিপ্লবের পথ সুগম করে। কিন্তু এটা ছিল একটা আকস্মিক ঘটনা।
অনুরূপভাবে মিসরে সামরিক অভ্যুত্থানের পর ১৯৫৪ সালে আবেদীন প্রাসাদের মধ্যে ছাত্রদের যে মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাও কোন পরিকল্পনার ফল ছিল না। প্রকৃত ব্যাপার ছিল এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অনুভব করলো যে, সামরিক সরকার দেশ ও জাতির স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে উদ্যত হয়েছে। ছাত্ররা স্বভাবগতভাবেই স্বাধীনতা প্রিয় হয়ে থাকে এবং সকল প্রকার অন্যায় নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন তাদের অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অতএব ছাত্ররা তাদের মনোভাব প্রকাশের জন্য বিক্ষোভ মিছিল করে। ইতিপূর্বেও মিসরের ইতিহাসে বহুবার এরূপ বিক্ষোভ হয়েছিল। জামাল আবদুন নাসের মনে করে যে, তার ক্ষমতার মসনদ উল্টে দেয়ার জন্যই এই বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। তাই তিনি দেশ মাতৃকার ভবিষ্যত প্রজন্মের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। এরূপ পাশবিক ও বর্বরভাবে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হয় যে, তার তুলনা মেলা ভার। বিশ জন ঘটনাস্থলেই নিহত হয় এবং শত শত আহত হয়। এভাবে শাসকগোষ্ঠী জাতির বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করে।
জেনারেল নাজীবের সাথে নাসের
পন্থীদের দুর্ব্যবহার
জনসাধারণ মনে করে যে, এসব ঘটনা সম্পূর্ণ ঠান্ডা মাথার পূর্ব পরিকল্পনার ফল। নাসের মনে করে যে, এসব বিক্ষোভের পশ্চাতে নাজীবের হাত সক্রিয় রয়েছে। দুই সামরিক নেতার মধ্যে তখন দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে উঠে। এ সম্পর্কে সর্বস্তরের জনগণ সম্পূর্ণভাবে ওয়াকেফহাল ছিল। সাইয়েদ নাজীবের স্মৃতিকথাও ইতিমধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে পরিস্ফূট হয়ে উঠেছে। সেখান থেকেও বিস্তারিত ঘটনা জেনে নেয়া যেতে পারে। এটা বাস্তব যে, মুহাম্মদ নাজীব ছিলেন বহু মৌলিক মানবিক গুণাবলীর অধিকারী। তার মধ্যে ছিল বুঝাপড়া করার গুণ। তিনি ছিলেন একনায়কত্ব, কঠোরতাও জুলুম-নির্যাতনের প্রতি অত্যন্ত পরাঙ্মুখ। এ কারণেই তার প্রতি ইখওয়ানের আগ্রহ ছিল। আর সে কারণেই তারা ছিল তার সফলতার প্রত্যাশী। তার কৃতকার্যতা দেশ ও জাতির জন্যও হতো অধিকতর কল্যাণকর।
জামাল আবদুন নাসের এসব বিক্ষোভ সমাবেশকে ষড়যন্ত্রমূলক বলে অভিহীত করেন।
নাসেরের সমর্থক সৈন্যরা জেনারেল নাজীবকে অপহরণ করে কায়রোর বাইরে নিয়ে গালি ও নির্দয় মার পিঠ দ্বারা তাকে সমাদর কারে। জালিমরা তার সাথে কি জুলুম ও অপমানজনক আচরণ করেন তার বিস্তারিত বিবরণ কোন কোন অফিসার নিজেই তার আত্মকথায় বর্ণনা করেছেন।
নাজীবের অন্তরে ইখওয়ানের প্রতি সম্মান ও মমত্ববোধ ছিল। কেননা তিনি স্বচক্ষে ইখওয়ানের ইসলাম প্রীতি ও সংগঠনের নীতি পদ্ধতির প্রতি চরম আনুগত্যের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ইতিপূর্বে বর্ণিত মিছিলের বর্ণনা হয়তো পড়ে থাকবেন। উক্ত মিছিলে লক্ষ লক্ষ লোক অংশগ্রহণ করেছিল। যারা সরকারের কোন পদক্ষেপেই পশ্চাৎপদও ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু আবদুল কাদের আওদা শহীদের একটি ইংগীতেই ছত্রভঙ্গ করে দেয়। মুহাম্মদ নাজীব এ ঘটনার নাসেরের মত হতভম্ব হয়ে হিংসাতুর ও বিদ্বেষপরায়ণ হওয়ার পরিবর্তে আবদুল কাদের আওদা ও ইখওয়ানের প্রশংসা গুণগ্রাহীতে পরিণত হন। তিনি চাচ্ছিলেন, জাতির মধ্যে এমনসব ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হওয়া উচিত যারা মানুষের আবেগ অনুভূতির নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। যাতে এই আবেগ ও স্পৃহাকে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজে লাগানো যায়। আমি একজন সচেতন মিসরীয় নাগরিক হিসেবে এ ঘটনার বাস্তবতা কোন রকম কম বেশী না করে অকপটে তুলে ধরলাম। আমি আমার মতামত কারো ওপর চাপিয়ে দিতে চাই না। যার ইচ্ছা সে এ কথাকে মেনে নিক আবার যে না চায় মেনে না চলুক।
ইখওয়ান ও আযাদ অফিসার-এর প্রথম পরিচয়
আযাদ অফিসার-এর সাথে ইখওয়ানের প্রথম পরিচয় হয় ইংরেজদের বিরুদ্ধে সুয়েজ খাল নিয়ে বিরোধের সময়। মিসরীয় সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইখওয়ানী মুজাহিদগণও সম্মুখ সমরে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। উস্তাদ হাসান আল আসমাভী মরহুম ইখওয়ানী সেনাদলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। প্রথম পারস্পরিক পরিচয় হয়েছিল তাঁর ও জামাল আবদুল আবদুন নাসেরের। গোড়ার দিকে এই সম্পর্ক ছিল গোপনীয়। ক্রমশ ইখওয়ান ও আযাদ অফিসার-এর মাঝে অধিকতর নৈকট্য এং প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়ে যায়। উস্তাদ আসমাভী ছিলেন এ সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল যোগসূত্র ও সেতুবন্ধন।
উস্তাদ হাসান আল আসমাভী মরহুমের বর্ণনা-যা আমি নিজেও স্বীকার করি তা হচ্ছে, নাসেরের সাথে তার সম্পর্ক ছিল খুবই গভীর। আর তিনি তার সাথে অধিকাংশ সময়ই সাক্ষাত করতে যেতেন। আযাদ অফিসার-এর ব্যাপারে তার অনুযোগ ছিল যে, একদিকে তাদের সাধারণ জ্ঞান ছিল অত্যন্ত কম অন্যদিকে কোন উপযুক্ত ও কাজের লোকের সাথে ছিল না কোন পরিচয়। আর না জানতো কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি তাদের সম্বন্ধে তেমন কিছু। নাসের নিজে এদেরকে “উপস্থিত আত্মাসমূহের জলসা” এবং “ভূত প্রেতের কাহিনী বর্ণনাকারী আসর” থেকে রিক্রুট করেছিলেন। কখনো কখনো তিনি তাদের অবস্থা দেখে ‍কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েতেন। কিন্তু তারপর সে মনে করে যে, এরূপ নির্বোধ এবং পূর্ণ অনুগত লোকজনই তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সর্বোত্তম প্রমাণীত হতে পারে।
একটা মজার অভিজ্ঞতা
উস্তাদ আসমাভীর বর্ণনার সাথে আমি আরও কিছু সংযোজন করতে চাই। ব্যক্তিগতভাবে আমার একবার একটা চিত্তাকর্ষক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। মুহতারাম ভাই আলহাজ্জ মুহাম্মাদ জাওদ (আল্লাহ তাকে সুস্থতা দান করুন) একদা আমাকে তার বাড়ীতে দাওয়াত করেন। আমি উস্তদ আল বাহী আল খাওলীর সাথে তার বাড়ীতে উপস্থিত হই। সেখানে আমরা আযাদ অফিসার-এর সাতজন সদস্যকে উপস্থিত পেলাম। আমি তাদের মধ্য থেকে ইবরাহীম তাহাবী ও আহমাদ তোয়াইমা ব্যতীত অন্য কাউকেই চিনতাম না। সেখানে আমাদের পৌঁছার পর আত্মাসমূহকে হাজির করার কাজ শুরু হয়। আমি তো এ দৃশ্য দেখে অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। একজন মোরাকাবায় (আধ্যাত্মিক ধ্যান) মগ্ন হয়েছিল। সে আত্মাসমূহকে হাজির করেছিল। এভাবে একটা শোরগোল ও হৈ চৈ সৃষ্টি হয়েছিল। এই কর্কশ ও বিরক্তিকর শব্দে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর মুরাকিব (ধ্যানমগ্ন ব্যক্তি) একটি অন্ধকার কামরার মধ্যে প্রবেশ করে। আমার মনে হচ্ছিলো, সম্পূর্ণ বুঝে শুনে ঠান্ডা মস্তিষ্কে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক এ অভিনয় করা হচ্ছিলো, সম্পূর্ণ বুঝে শুনে ঠান্ডা মস্তিষ্কে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক এ অভিনয় করা হচ্ছিল। মুরাকিব এমন বিড় বিড় করতে শুরু করলো যেন উপস্থিত আত্মাসমূহের মধ্য থেকে কোন একটি আত্মা তার প্রতি কথা ইলহাম করছে। এটা কি কাজ ছিল? এটা মুলত ছিল জেনারেল মুহাম্মদ নাজীব এবং উস্তাদ হাসান আল হুদাইবি এই দুইজনের ওপর ব্যক্তিগত আক্রমণ।
এ সময় ইখওয়ান ও আযাদ অফিসার-এর মধ্যে পারস্পরিক অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এমনকি কখনো কখনো একে অন্যের প্রোগ্রামেও সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করতো। কিন্তু ১৯৪৮ সালে আযাদ অফিসার ইখওয়ান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। এজন্য তারা কোন প্রকার বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়নি। বরং তাদের যুক্তি ছিল এই যে, ইখওয়ানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য এতই কড়া মানদন্ড রয়েছে যে, পুরোপুরিভাবে উতরে যাওয়া সকলের সাধ্য-সামর্থের কথা নয়।
নাসের কাপুরুষ না বীর পুরুষ
সুয়েজখাল যুদ্ধের সময়ে ময়দান থেকে পালিয়ে নাসের প্রায়ই ইখওয়ানের নিকট গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করতো। (এটা ১৯৪৮ সালে সংঘটিত লড়াইয়ের কথা ইস্রাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়)। তথাপি সে নির্দোষ লোকদের ওপর সকল প্রকার ঘৃণ্য অভিযোগ আরোপ করার ব্যাপারে ছিল অত্যন্ত কঠোর। পরে সে যখন ইখওয়ানকে ধ্বংস করার কর্মসূচী প্রণয়ন করে এবং নির্যাতনের একশেষ করে ছাড়ে তখন দেশী ও বিদেশী প্রচার যন্ত্রসমূহ তার বীরত্বের এমন গীত গাইতে থাকে যে, তার নিকট প্রকৃতপক্ষে ইখওয়ানকে নিস্পিষ্ট করার কাজকে অত্যন্ত গৌরবজনক এবং কৃতিত্বপূর্ণ বলে বোধ হতে থাকে। এ মহতী কাজের জন্য তার অহংবোধ উপচে পড়ছিল। অবশ্য এটা “বীরত্ব” ই ছিল। কারণ ইখওয়ানের নওজোয়ানদেগরকে জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দী করে তাদের ওপর শক্তি পরীক্ষা করা হয়।
জীবনপাত করার পুরষ্কার
কায়রোতে যে অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটে তার ফলে শহরে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই অগ্নি সংযোগের পর আযাদ অফিসার হাত বোমা, অস্ত্রশস্ত্র এবং যাবতীয় আগ্নেয়াস্ত্রের ভান্ডার যা বিভিন্ন বাড়ীতে তাদের তত্বাবধানে সংরক্ষিত ছিল। সমস্তই কায়রোর বাইরে স্থানান্তর করে ফেলা হলো। একাজও আবার করা হয় অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে। আল আসমাভী এ দায়িত্ব সম্পন্ন করেন। এ কাজ ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তথাপি ইখওয়ানের এই সাথী সকল প্রকার বিপদাশঙ্কা উপেক্ষা করে অত্যন্ত বিপজ্জনক মুহূর্তে এই অফিসারদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। হাসান আল আসমাভী মরহুমের পিতার কায়রোর বাইরে ছিল একটি মস্তবড় প্রাসাদ ও কৃষি খামার। এই ফার্মেই মুনীরুদ্দৌলা মরহুম এবং সালেহ আবু রাকীক (আল্লাহ তায়ালা তাদের দীর্ঘজীবি করুন)-এর ট্রাকযোগে এসব অস্ত্রশস্ত্র স্থানান্তর করা হয়।
১৯৫২ সালের মার্চ মাসের গোড়ার দিকে আবদুন নাসের এবং অন্যান্য কতিপয় আযাদ অফিসার বিপ্লব সাধনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। তখন তারা বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের অব্যবহিত পূর্বে মরহুমের সাথে দীর্ঘ সময় মতামত বিনিময় করেন। পরিশেষে তাদের পরামর্শের আলোকে নীল নকশা প্রণীত হয়--- বিপ্লবের পর।
বিপ্লবী সরকার আসমাভী সাহেবের খেদমতের প্রতিদান এভাবে প্রদান করে যে, জানুয়ারী মাসে যখন কোন ইখওয়ান নেতাকে গ্রেফতার করা হয় তখন তার সাথে এই চার্জশিটও দেয়া হয় যে, আসমাভী ফার্মে এত বিপুল পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ আটক করা হয়েছে যা দিয়ে কায়রো শহরকে দশবার ধ্বংস করা যায়। এই চার্জশীট তৈরী করেছিলেন নাসের সাহেব। এসব অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে তাঁর চেয়ে বেশী জানতো না। আসমাভী এসব লোকের জীবন রক্ষার জন্য এতবড় বিপদের ঝুঁকি নিয়ে ছিলেন। কিন্তু এই নির্লজ্জ লোকগুলোর মন-মানসিকতার প্রতি লক্ষ্য করুন! যে এই সম্মানিত ব্যক্তিটিকে কি পুরুষ্কার দেয়া হলো।
আপনারা বিস্মিত হবেন। কিন্তু এতে বিস্ময়ের কিছুই ছিল না। যে-ই নাসেরের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে অবহিত তার জন্য েএতে বিস্ময়ের কোন কারণ নেই। নাসের ছিল বিচ্ছু আর বিচ্ছুর কাজই হচ্ছে দংশন করা। নাসের বিপ্লবী কাউন্সিলেও তার সংগী সাথীদেরকে এভাবে এক এক করে খতম করেছে। বিশ্বাস ভঙ্গ ও নির্লজ্জতা ছিল তার কাছে উন্নত চরিত্র ও মহৎগুণের পরিচায়ক। আসমাভী মরহুমের বিরুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলার অভিযোগ আরোপ করে নাসের ইখওয়ানের ওপর হস্তক্ষেপ করার পথ সুগম করে।
ক্ষমতার লোভ ও সেনাবাহিনী
উস্তাদ হাসান আল আসমাভী বর্ণনা করেছেন যে, আযাদ অফিসার-এর সাথে তার এই মর্মে মতৈক্য কয়েছিল যে, বিপ্লব সফলতা লাভ করলে আলী মাহেরের নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠিত হবে। তারা দেশে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার বহাল করবে এবং সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাবে।
সামরিক বিপ্লব সম্পর্কে ইখওয়ানের মধ্যে দুই প্রকার দৃষ্টিভংগি ছিল। কেউ কেউ ছিলেন বিপ্লবের বিরোধী, কিন্তু অন্য’মত পোষণকারীদের সংখ্যা ছিল অধিক।
অতএব ফায়সালা হয় যে, বিপ্লব সেনাবাহিনীর সাহায্যেই সাধিত হবে। কিন্তু পরক্ষণেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। আসলে আল্লাহরই কার্যকর হয়। সেনাবাহিনী একবার জাতির ঘাড়ে চেপে বসলে আর তাদেরকে হটানো সহজসাধ্য থাকে না। এ সত্যই বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছিল মিসরে।
নাসের সম্পর্কে প্রথমেই কতিপয় ব্যক্তি মন্তব্য করেছিলেন যে, সে একনায়কসূলভ মেজাজের অধিকারী। সফলতার সুযোগে সে নিজের শাহেন শাহী কায়েম করে বসবে। এ অনুমান সম্পূর্ণ সত্য হয়ে দেখা দিয়েছিল কিন্তু কোন কোন বন্ধুর সুধারণা শুধুমাত্র খোশ খেয়াল বলে প্রমাণিত হলো। নাসের কোন ব্যাপারেই তার মতের বিরুদ্ধে কারো কোন কথা শুনতে আদৌ প্রস্তুত ছিল না। বিপ্লব সফল হওয়ার প্রথম দিনই তিনি ফায়সালা করেন যে, সংগীদের সবাইকে এক এক করে রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এই কাজ তিনি তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত রাখেন।
রক্তই আর্তনাদ করে বলে দেবে খুনীর বাহুর পরিচয়
প্রথম দিকে আযাদ অফিসার সরকারের পরিবর্তনকে বিপ্লব না বলে আন্দোলন বলে অভিহীত করতো। কিন্তু ১৯৫২ সালের আগস্ট মাসে নাসের আলী মাহেরকে তার প্রতিরোধের শিকার বানায় এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আন্দোলনের পরিবর্তে “বিপ্লব” বলা হতে থাকে। আলী মাহেরকে পদচ্যূত করা হয় এবং তার স্থানে জেনারেল নাজীবকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পদে অভিষিক্ত করা হয়। নাসের প্রথম থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল যে, নাজীবকে সরানোর জন্য অনুকুল পরিবেশ তৈরী করতে হবে। যা কার্যত করাও হয়েছিল এবং তার প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল। বৃটিশ দূতাবাসে মিষ্টার ইভান্সের সাথে আমাদের সাক্ষাতের সূচনা হয়েছিল এভাবে যে, দূতাবাসের ইচ্ছা ও বিপ্লবের সরকারী ঐকমত্যে আমাদের বন্ধু মুনীরুদ্দৌলা এবং সালেহ আবু রাকীক মিস্টার ইভান্সের সাথে মিলিত হন। মুর্শিদে আ’মের নির্দেশক্রমে উস্তাদ হাসান আল আসমাভী নাসেরকে আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে সবিস্তারে অবহিত করেন। নারেস ও আবদুল হাকীম আ’মের উভয়েই এই সংলাপকে সাদর আভ্যর্থনা জানান। পরবর্তী সময়ে মিষ্টার ইভান্স আবার মুর্শিদে আ’মের সংগে দেখা করার জন্য আবেদন জানায়। এমনকি তার সাথে মিলিত হওয়ার জন্য তার খেদমতে উপস্থিত হন। হাসান আল আসমাভী নাসেরকে এই সাক্ষাতের খবরও দিয়েছিলেন।
আমাদের এসব সাক্ষাতকে যে বিদ্রোহ ও জাতীয় বৈঈমানী নামে অভিহীত করা হয় তা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। কিন্তু নাসেরের েএসব অভিযোগ ফলাও করে যতই রটানো হতে থাকে জনগণ ততই তার অসত্যতা সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত হতে থাকে, সে তলোয়ার পরীক্ষা করতে থাকে আর আমরা আত্মার পরীক্ষা দিতে থাকি। তার অসির ভাষা নিশ্চুপ হয়ে পড়লেও তার রক্তরঞ্চিত হাত চিৎকার করে বলছে ওগো প্রাচৗ ও প্রতীচ্রের অধিবাসীগণ! তোমাদের মধ্যে কে এখনো এমন আছ যে প্রকৃত সত্যের সন্ধান পাওনি। শোন! মিথ্যার মিথ্যা হওয়াটা প্রমানিত হয়ে গেছে।
বিপ্লবের পর আযাদ অফিসার-এর কারো কারো সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। খান আল খলিলে আমাদের সাথী আলহাজ্জ মুহাম্মাদ জাওদার চাউলের দোকান ছিল। এখানে প্রায় প্রতিদিনই আমাদের পারস্পরিক দেখা সাক্ষাত হতো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিঃল যে, নাসের ইখওয়ানের ওপর যে কোন সময় হস্তক্ষেপ করে বসবে। তথাপি আমার সযত্ন প্রয়াস ছিল যে কোন উপায়ে এই সংঘাত প্রশমিত হয়ে যাক। নাসেরের ব্যাপারে ইখওয়ানের কোন কোন সাথীর দৃষ্টিভংগী ছিল অত্যন্ত কঠোর। তারা ধারণা করছিলো যে, আমিও নাসেরের প্রতি আকৃষ্ট। েএজন্য আমার ওপর তাদের কিচুটা সন্দেহ ছিল। কিন্তু সত্য কথা বলতে কি তার সম্পর্কে আমার ধারণা কখনো ভালো ছিল না। আন্দোলনের স্বার্থের কথা চিন্তা করেই আমি চাচ্ছিলাম যে অপেক্ষাকৃত কোন উত্তম ও সমঝোতামূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক। আমার একান্ত আকাংখা ছিল যে, নাসের একান্তই যদি ইখওয়ানের বিরুদ্ধে কোন দমননীতি গ্রহণ করতে চায় তাহলে অন্যান্য দলসমূহকে সে যেভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে তেমনি আমাদের ওপরও নিষেধাক্ষা যেন আরোপ করে। কারণ আমাদের দাওয়াতী কাজতো বন্ধ হয়ে যাওয়ার নয়।
সেই সময়ে নাসের আরো একটি চক্রান্ত করে। আবদুর রহমান সিন্ধীর কথা আপনারা পড়ে এসেছেন। নাসের তার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করার পূর্বে এক চাল চালতে চায়। আযাদ অফিসার-এর সাহায্যে একটা প্রস্তাব প্রণয়ন করেন এবং তার ওপর ইখওয়ানের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কয়েকজনের স্বাক্ষরও যুক্ত করা হয়। চুক্তিনামার বিষয়বস্তু ছিল, মুর্শিদে আ’মকে নেতৃত্বের পদ থেকে অপসারিত করতে হবে। যদিও তা হোক একান্ত সাময়িকভাবে ও অল্প সময়ের জন্য। এই সন্ধিচুক্তির ব্যাপারে নাসেরের প্রত্যাশা ছিল যে, এতে সকল সদস্যই বরখাস্ত করবেন। কিন্তু তার এই অনুমান ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। আমার নিকটও বার বার এই দস্তাবেজ নিয়ে আসা হয় এবং নানাভাবে অনুরোধ করা হয় যে, এতে সই কর দাও। কিন্তু আমি সর্বদাই কঠোরভাবে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করি। আমি আল্লাহর নামে যে বাইয়াত করেছিলাম তা কিভাবে ভংগ করতে পারি। আর এটা কি করে হতে পারে?
আমি একজন ইখওয়ান হিসেবেই বেঁচে থাকতে চাই এবং এই পরিচয় নিয়েই মৃত্যুর পথে পাড়ি জমাতে চাই। কিয়ামতের দিন যেন দাওয়াতে ইসলামীর নগণ্য একজন কর্মীরূপে উপস্থিত হতে পারি। তাই আমার প্রত্যাশা। এটাই আমার আকাংখা্
যে সময় এ প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা চলছিলো তখন আমাদের নওজোয়অন সাথী ভাই আকেফ জেলখানায় ছিলেন। আমি জানতে পারলাম যে আকেফ ভাইক সামরিক কারাগারে অত্যন্ত পাশবিকভাবে নির্যাতনের শিকার বানানো হয়েছে। ফলে তিনি গুরুতর আহত হয়ে পড়েছেন। একদিকে সালাতুল আসরের পর আলহাজ্জ মুহাম্মাদ জাওদার দোকানে আযাদ অফিসার-এর অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য মুহাম্মাদ আবদুর রহমান নাসিরের সাথে সাক্ষাত হয়ে যায়। নামায শেষে তিনি যখন মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসেন তখন আমি তার কাছে এ ব্যাপারে নালিশ করলাম। আল্লাহ ও নামাযের কসম করে তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিলেন যে, আকেফের ওপর কোন প্রকার জুলুম ও নির্যাতন করা হয়নি। তার গলে কুরআন মজীদ ঝুলছিল। তিনি কুরআন মাথার ওপর রেখে শপথ করে বলেন যে, আকেফের জুলুমের খবর একেবারেই মিথ্যা, তার এরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার পর আমি মনে করলাম যে, খবরটি সম্ভবত ভুল। ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে আমাকেও গ্রেফতার করে সামরিক কয়েদখানায় আটক করা হয়। আমি বন্ধুপ্রতীম আকেফের যে অবস্থা নিজ চোখে দেখতে পেলাম তা ছিল হৃদয়বিদারক। আমার চোখ থেকে অজ্ঞাতেই নেমে আসে অশ্রুর বন্যা। তার সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। কিন্তু আমি আল্লাহর লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করি এই জন্য যে, সত্যের কাফেলায় এই তেজোদীপ্ত যুবক এতসব জুলুম নিপীড়নকে অত্যন্ত শান্ত চিত্তে অনমনীয়ভাবে ও হাসিমুখে বরণ করেছিলেন। তার কোন কথায় ও আচরণে আমি কোন প্রকার আতঙ্ক ও নিরুৎসাহের লক্ষ্যণ দেখতে পাইনি। এই মোহকে কেউ কোনক্রমেই অবদমিত করতে পারে না, পারবে না।
নাসেরের ইখওয়ানুল মুসলিমুনে যোগদানৎ
জামাল আবদুন নাসের আমার স্বাভাব প্রকৃতি ও কোমল হৃদয় হওয়া সম্পর্কে সম্যাক পরিজ্ঞাত ছিল। তথাপি সে আমাকে তার প্রতিশোধের শিকার বানায়। আমি ইতিপূর্বে একটি প্রস্তাবের উল্লেখ করেছি যাতে মুর্শিদে আ’ম-এর পদচ্যুতির ষড়যন্ত্রও ছিল্ আমি তাতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছিলাম। ১৯৫৪ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর নাসের আমাকে তার বাড়ীতে ডেকে পাঠায়। সেখানে পৌঁছার পর সেই কুখ্যাত প্রস্তাবাবলী পুনরায় আমার সম্মুখে পেশ করা হয়। আমি তাতে স্বাক্ষর করতে সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করি। এটাই ছিল মূল কারণ যার ফলে আমাকে সুদীর্ঘ পনেরো বছর বন্দী এবং পরবর্তী সময় অতিরিক্ত আরো দু’বছর নজর বন্দীর শাস্তি ভোগ করতে হয়।
জামাল আবদুন নাসের ইকওয়ানের রুকুনিয়াত তথা সদস্যপদও গ্রণ করেছিলেন। সুধী পাঠকগণকে আমি এ প্রসংগে ভাই জেনারেল সালাহ শাদী বিরচিত গ্রন্থ “ইতিহাসের পাতা” থেকে এ বিষয়ে কিচুটা আলোকপাত করতে চাই।
জেনারেল সালাহর বক্তব্য অনুসারে নারেস সম্ভাব্য সকল উপায়ে তথ্য সংগ্রহ করতে আগ্রহী ছিল। নিজের এই আকাংখার পরিতৃপ্তির জন্য সে ইখওয়ানের আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করে।
ইখওয়ানের সাথে তার সম্পর্ক তিন পর্যায়ে গড়ে ওঠেছিল-সামরিক দায়িত্ব পালনের জন্য নাসেরকে সুদান পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে আসার পর সামরিক অফিসার আবদুল মুনয়েম আবদুর রউফের সাথে তার সাক্ষাত ঘটে। এই অফিসার ছিলেন ইখওয়ানের সদস্য। তিনি নাসেরকে আবদুর রহমান সিন্ধীর নিকট নিয়ে আসেন (এটা ছিল অদ্ভূত ব্যাপার যে নাসেরের প্রথম সাক্ষাত ইখওযানের এমন এক লোকের সাথে হয় যার নিষ্ঠার ভান্ড শীঘ্রই ফেটে পড়ে। পাঠকগণ সে ঘটনা ইতিপূর্বেই পড়েছেন।)
১৯৪৪ সালে মেজর মাহমুদ লাবীব মরহুমের সাথে নাসেরের সাক্ষাত হয়। তিনি তাকে ইখওয়ানের পয়গামের সাথে উত্তমরূপে পরিচিত করে দেন এবং কর্মনীতি ব্যাখ্যা করে শুনান।
তৃতীয পর্যায়ে শুরু হয় ১৯৫০ সালের শেষের দিকে। তখন উস্তাদ মেজর মাহমুদ লাবীব গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অতএব আমি জেনারেল (জেনারেল সালাহ শাদী) নাসের ও অপর অফিসার সালাহ সালেমকে সাথে নিয়ে ইখওয়ানের ঐ ভাইয়ের নিকট গমন করি। তিনি ছিলেন সেনাবাতিনীর মধ্যে ইখওয়ানের আন্দোলনের দায়িত্বশীল। ১৯৫০ সালের শেষের দিকে মরহুম হাসান আল আসমাভীর দপ্তরে এই সাক্ষাতকার অনুষ্ঠিত হয়।
সামরিক বাহিনীর অফিসার ও জোয়ানদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক ছিলেন জনাব মেজর মাহমুদ লাবীব মরহুমের সাথে। ১৯৪৬ সাল থেকেই জামাল আবদুন নাসের তার সমর্থন সেনাদেরকে একান্ত সংগোপনে তার সাথে মিলাতে শুরু করে। বাহ্যত সে তাদের বিশ্বস্ততা ও আস্থা অর্জন করেন এবংনিজের কাজ জারী রাখেন। প্রথম দিকে নাসেরের ব্যাপারে আমার মতামত ছিল এই যে, তিনি অত্যন্ত স্বল্পভাষী এবং দায়িত্বপালনকারী জাগ্রত বিবেক সেনা অফিসার। আলসাগ্ মাহমুদ লাবীবের জীবদ্দশায় সে ইখওয়ানের নিকটে এসে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার ইনতিকালের পর এ সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়। এই সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকে। অস্ত্রশস্ত্র ও ক্রয় ও সরবরাহ এবং অন্যান্য জরুরী সাজসরঞ্জাম যা ফিরিঙ্গি সেনাদের মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন ছিল –তখনই সংগ্রহ করা হয়। খরিদকৃত অস্ত্রশস্ত্রের মজুদ জামাল আবদুন নাসের এবং মাজদী হাসানইনের বাড়ীতে রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময় এ আশাঙ্কায় যে, গোপনীয়তা ফাঁশ হয়ে গেলে এই দুইজন সামরিক অফিসারের ওপরই মুসিবত এসে পড়বে তাই এসব অস্ত্রশস্ত্র আসমাভী ফার্মের সুপ্রশস্ত গ্যারেজে স্থানান্তর করা হয়।
ভাই সালাহ শাদী তার এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে খুবই বিস্ময় ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে, সমস্ত গোলাবারুদ ইখওয়ান তাদের জীবন বিপন্ন করে বিপ্লবের জন্য সংগ্রহ করেছিল এবং আযাদ অফিসারদেরকে বিপদ থেকে রক্ষার জন্য নিজেদের ফার্মে গুদামজাত করেছিল –এ বিষয়কেই ইখওয়ানের ওপর দোষারোপের কারণ এবং তাদের শায়েস্তা করার উপলক্ষ বানানো হয়েছিল। কোন কৃতজ্ঞজন উপকার কর্তাদের ধ্বংস করে তার ইহসানের পুরস্কার দিতে পারে না।
ফারুকের দেশ ত্যাগ
ইখওয়ান ও স্বাধীনতাকামী অফিসারদের মাঝে বিপ্লব সংগঠিত করার পূর্বে কয়েকদফা সাক্ষাত হয়। আলহাজ্জ সালাহ আবু রাকীকের বাড়ীতে অনুষ্ঠিত এসব আলোচনা বৈঠকে স্বাধীনতাকামী অফিসারদের প্রতিনিধিত্ব করতেন জামাল আবদুন নাসের। পক্ষান্তরে ইখওয়ানের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করতেন হাসান আসমাভী মরহুম এবং জেনারেল সালাহ শাদী। নাসেরের ঐকান্তিক অনুরোধ ছিল নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই বিপ্লব সংগঠিত করা হোক। ইত্যবসরে এক বিস্ময়কর ঘটনা সংঘঠিত হয় যার প্রতি সকলেই বিস্ময় বিষ্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে দেখে। তা হচ্ছে, আমেরিকান দূতাবাস শাহ ফারুককে অনুপ্রাণীত করে যেন তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করেন। সে জন্য তাদের পরামর্শ ছিল এই যে, শাহ ফারুক দেশ থেকে চলে যাবেন এবং সেখানেই জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো নিজের সঞ্চিত ধন-সম্পদের সাহায্যে নিশ্চিন্ত কাটিয়ে দিবেন। তথাপি শাহ বিপ্লবের পূর্বে দেশের বাইরে পাড়ি জমাতে পারেননি। বিপ্লবের ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর মহামান্য বাদশাহর কোন বিচার ছাড়াই নিরাপদে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও নাসেরের হাত ছিল সক্রিয়। ১৯৫২ সালের ২০শে জুলাই নাসেরের সাথে মুর্শিদে আ’ম আল হুদাইবি (র)-এর সাক্ষাত হয়। নাসেরের কোন কোন কার্যকলাপে মুর্শিদে আ’ম অষন্তোষ ব্যক্ত করেন। তখন সে নীরবে সবকিছু হজম করতে থাকে। কিন্তু পরে ১৯৫৪ সালের ১৩ই জানুয়ারী তারিখে বিপ্লবী কাউন্সিল ইখওয়ানের ওপর যখন নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেয় তখন তার পশ্চাতে নাসেরের তীব্র ঘৃণা ও ক্রোধ ছিলো। পরে ঘটনাপ্রবাহ যতদূর গড়িয়েছিল তা সকলেরই জানা রয়েছে।
আসল চেহারা
নাসের ছিল সেনা কর্মকর্তাগণের মধ্যে অত্যন্ত কর্মঠ ও সদা তৎপর কর্মী। তার প্রয়াস প্রচেষ্টার ফলে অধিকাংশ লোক তার প্রতি ছিল দুর্বল। কিছু সংখ্যক লোক ছিল তার অন্ধ বিশ্বাসী। দুই জন লেকের মেধা ও বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা আমি সর্বদাই করে থাকি। তারা দুইজন প্রথম দৃষ্টিতেই তাঁকে বুঝতে পেরেছিলেন। উভয়েই নাসেরের দুরভিসন্ধি ও কূটকৌশল যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই দুই ব্যক্তি হচ্ছেন যথাক্রমে ইখওয়ানের মুর্শিদে আ’ম সাইয়েদ হাসান আল হুদাইবি ও ওয়াফদ পার্টির নেতা ফুয়াদ সিরাজ উদ্দীন। আবদুন নাসের শাহেন শাহী লাভের স্বপ্ন দেখছিলো। সে শুধুমাত্র মিসরের ওপরই তার আধিপত্য বিস্তার করতে চাচ্ছিলো না। বরং এতদঞ্চলের সবগুলো দেশের ওপরই তিনি তার কর্তৃত্ব করার অভিলাষ পোষণ করছিলেন। সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ যদিও সে দেখতে পায়নি। কিন্তু তার জন্য সে মিসরের সমস্ত উপায় উপকরণ জাতির সমূদয় যোগ্যতা ও ক্ষমতা এমনকি মিসরীয় সেনাবাহিনী তথা সবকিছুকে জলাঞ্জলী দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি।
কৃতকর্মের ফলশ্রুতি ও নাসের
আমাদেরকে বিপ্লবের শত্রু মনে করা হয়। এটা ছিল একেবারেই মিথ্যা। আল্লাহ তায়ালার অপার অনুগ্রহ ইখওয়ানের সযত্ন প্রয়াস প্রচেষ্টা এবং ঐকান্তিক কুরবানীর বদৌলতেই মূলত বিপ্লবের পথ সুগম হয়। যদি আমাদের সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা সমন্বিত রূপ লাভ না করতো তাহলে নাসের ও তার সংগীদের নাম নিশানাও মিসরের ইতিহাসে পরিলক্ষিত হতো না। মিসর ও মিসরের বাইরের অন্যান্য দেশের সমস্ত প্রচার ও গণমাধ্যম নাসেরের অনুপম ব্যক্তিত্ব ও কৃতিত্বের গুণগান প্রচার করতে লাগলো। তার ভাবমূর্তি এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হলো বাস্তবতার সাথে যার দূরতম সম্পর্কও ছিল না। এই ব্যক্তির নেতৃত্ব মিসরের মর্যাদাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে এবং সকল ক্ষেত্রেই অপমান ও অনগ্রসরতাই আমাদের ললাট লিপি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত সুয়েজ খাল লড়াইয়ের উল্রেখ করা হয় অত্যন্ত গর্ব ভরে। আল্লাহর শোকর যে, তাতে মিসরই বিজয় লাভ করে। তথাপি বিশ্লেষক এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারীগণ এ সত্য সম্পর্কে অনবহিত ছিল না যে, ১৯৫৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেণ্ট আইসেন হাওয়ার বিশ্বরাজনীতিতে সর্বক্ষেত্র আমেরিকার প্রভাব বলয় সৃষ্টির জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রভাব প্রতিষ্ঠার পথে বৃটেন ও ফ্রান্সের উপনিবেশবাদী শক্তি ছিল একটি অন্তরায়। আমেরিকার আকাংখা ছিল হাত ছাড়া করিয়ে দেয়া যাতে সৃষ্ট শূন্যতা আমেরিকা পূরণ করতে পারে। ফলাফলও তাই হলো। এই যুদ্ধে নাসেরের কৃতকার্যতার নিগূঢ় রহস্য উপরোক্ত কার্যকারণের মধ্যে নিহিত ছিল।
১৯৬৭ সালের অপমানজনক পরাজয় নাসেরের নেতৃত্বের উপহার স্বরূপ আমাদের ললাট লিপি হয়ে দাঁড়ায়। সেই অপমানের কথা কি আমরা কোন দিন তুলে যেতে পারি? মিসরের কৃতিসন্তান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিগণকে যে পন্থায় বেইজ্জত করা হয় এবং মিসরের গৌরবজনক ইতিহাসকে যেভাবে কলঙ্কিত করা হয় তাকি কোন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মিসরীয় ভুলে যেতে পারে? আমরা কি নাসেরের গৃহীত এ সমস্ত ন্যাক্কারজনক কৃতিকলাপ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারি- সে তার সংগীদের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যা করেছিল?
এরূপ জঘন্য তৎপরতার পরও তার জন্য কি গৌরবজনক কোন কৃতিত্ব অবশিষ্ট থেকে যায়? আমি তো তার মধ্যে এমন কোন বিষয় দেখতে পাই না যার কারণে তাকে একজন উচ্চ পর্যায়ের নেতা মনে করা যেতে পারে। তবে হাঁ তার প্রতি যেসব বীরত্বগাথা আরোপ করা হয় তাতে কেউ প্রতারিত হতে পারে। এসব স্রষ্টা এমন সব লোক যারা কোন আন্দোলনে কোন দিন অংশগ্রহণ করেনি। এমনকি মিসরের জাতীয় বিপ্ললবেও তাদের কোন অবদান নেই।
বিক্রয়যোগ্য সম্পদ নাকি শিষ্টাচার
মিথ্যা প্রচার প্রপাগান্ডাকারীগণ পয়সার ক্রীতদাস এবং বিক্রয়যোগ্য সম্পদ। তারা সম্মান, গৌরব ও কীর্তিগাথার এমন সব স্মরণীয় কৃতিত্ব রচনা করে। বিক্রয়ের জন্য বাজারজাত করে বাস্তবে যার কোন অস্তিত্বও কোন দিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের এই কাল্পনিক মূর্তিখানা তাদেরকে মহার্ঘ্য বিনিময় প্রদান করে। তারা হাজার হাজার পাউন্ড পুরস্কার লাভ করে এবং যার ফলে এসব শিল্পী কোন বামনকে আসমানে পৌঁছায়। মিসরের অপমানের জন্য আবদুন নাসেরই দায়ী। সে আগে ও পরে সবসময়ই ইসলামী পুনর্জাগরণ এবং ইসলামী আন্দোলনের দুশমন ছিলো। তার কীর্তিকলাপ ইসলামী আন্দোলনের কাজকে কয়েক বছর পিছনে ঠেলে দিয়েছে।
জামাল আবদুন নাসের ইখওয়ানের ওপর এমন সব অত্যাচার চালান যার কল্পনাও কর যায় না।
ছেলেকে বাধ্য করা হতো পিতাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করতে এবং তাদের মুখে থুথু নিক্ষেপ করতে। কারাবন্দীদের সহোদর ভাইকে ডেকে এন বাধ্য করা হতো তাদের ভাইদের মুখের ওপর চপেটাঘাত করতে। অথবা কিল ঘুষি মারতে।
জেলখানার অফিসাররা এমন অনুভূতিহীন ও নির্লজ্জ যে, এটা তাদের চিত্ত বিনোদনের উপকরণ ছিল। আপনি কি কখনো কল্পনা করেছেন যে, মানুষ কখনো এতটা বিবেকহীন হতে পারে?
এই জালিমরা ইখওয়ানের পর্দাশীলা ও পুন্যাত্মা মহিলাদের ছবি অঙ্কন করেছে। অংকন শিল্পীরা তাদের নগ্ন বক্ষ প্রদর্শন করেছে। এমনকি তাদের সম্মুখে মদের বেতাল রেখে এসব চিত্র অংকন করে। তাদের এক হাতে শরাবের পেয়ালা আর অন্য হাতে সিগারেট দেখানো হয়েছে।
আপনি একটু ভেবে দেখুন। যদি কোন মানুষ এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় (আমি আল্লাহ তায়ালার সমীপে দোয়া করছি কোন মানুষকে যেন এমন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে না হয়) তাহলে তার অবস্থা কি দাঁড়াবে? কোন আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন লোকের কন্যা, ভগ্নি অথবা স্ত্রীকে তারই চোখের সামনে বিবস্ত্র করে ফেলা হবে তার সরকারী কুকুররা নির্লজ্জভাবে তাদের উজ্জত আবরু লুণ্ঠন করবে তাহলে কি সেই ব্যক্তি এমন জীবনের তুলনায় মৃত্যুকে অগ্রাধিকার দেবে না? এরূপ অসহ্য অপমানের মোকাবেলায় একজন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ অবশ্যই চাইবে তার দেহ ছিন্নভিন্ন করা হোক তার দেহের মাংস থেঁতলে দেয়া হোক কিন্তু তার স্ত্রী ও মা বোনের সাথে এ আচরণ করা হোক। এত কিছু সত্ত্বেও মিসরে এমন লোক আছে যারা নাসেরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
আমি কখনো কারো কোন অনিষ্ট কামনা করি না। কিন্তু নাসেরের প্রশংসাকারীদের একটু চিন্তা করে দেখা উচিত যে, তাদের ওপর যদি এরূপ বিপর্যয় এসে পড়ে তাহলে তাদের সিদ্ধান্ত কেমন হবে? এটা সত্য যে, সামরিক বন্দীশালায় ইখওয়ানের সাথীদের মধ্যে আমার ওপর সর্বাপেক্ষা কম নির্যাতন চালানো হয়েছে। তারপরও লক্ষ্য কুন আমার সাথে তারা কিরুপ আচরণ করেছে। তাহলে সহজে অনুমান করা যাবে যে, অন্যান্য ভাইদের সাথে আরো কতবেশী অত্যাচার করা হয়েছে।
আমাকে জেলখানার ২৪নং সেলে বন্দী করা হয়। কিছুক্ষণ পর কারাগারের নাপিত আমার চুল কাটতে আসে। আমি আমার মস্তক তার সামনে অবনত করে দিলাম যেন সে সহজে তার কার্য সমাধা করতে পারে। কিন্তু আল্লাহর সেই বান্দা আমার গালে সজোরে চপেটাঘাত করে বলে “কুত্তার বাচ্চা! নীচে মাটির ওপর নেমে বস্!” সে আমার মাথা মুন্ডন করলে আমি দেখতে পাই যে কারা অফিসারগণ লম্বা চওড়া এবং উৎকট দুর্গন্ধযুক্ত রশি নিয়ে আমার কুঠরীতে এসে হাজির হয় এবং আমাকে উঠে দাঁড়াবার নির্দেশ দেয়। আমার উরুদেশ থেকে বক্ষ পর্যন্ত সেই দড়ি আমার শরীরের চারদিকে পেঁচিয়ে শক্তভাবে বাঁধা হয়। অনন্তর আমাকে একটি চেয়ারের ওপর দাঁড় করানো হয় এবং রশির এক মাথা ছাদের খুঁটির সাথে বেঁধে আমার পায়ের নীচে থেকে চেয়ারে সরিয়ে ফেলা হয়। ফলে আমি ছাদ ও মাটির মাঝে রশিতে বাঁধা অবস্থায় ঝুলতে থাকি। আমার ওপর অত্যন্ত অশ্রাব্য গালি ও কোঁড়ার বৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকে। দুঃখে ও ব্যথায় আমার অবস্থা কাহিল করা হয়ে পড়ে। তবুও আমি উহ্ পর্যন্ত করি না। কারণ এই হিংস্র নরপশুরা আমার আত্মচীৎকারে মজা পেতো। আর আমিও চাচ্ছিলাম না যে, তারা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করুক। আমার শরীর যখন পুরোপুরি অবশ হয়ে গেল তখন তারা আমার শরীরের এক জায়গায় কোঁড়ার আঘাতে জর্জরিত করতে আরম্ভ করলো। এক স্থানের পরিবর্তে শরীরের বিভিন্ন অংশে কোঁড়ার আঘা করার জন্য আমি তাদের অনুরোধ করি। কিন্তু তা করতে তারা অস্বীকার করলো।
এই মুহূর্তে আমার নিজের জীবনে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো। এটা ছিল ১৯৩৩ সালের কথা, আমি আমার পুত্র আবেদকে কোন কোন বিষয় পড়াতাম। আমার হাতে থাকতো একটা রোলার সে কোন ভুল করলে আমি উক্ত রোলার দ্বারা তার উপর প্রহার করতাম। একধারে ভুল ভ্রান্তি করতে থাকলে একই জায়গায় মারতে থাকতাম। সে কাঁদতো এবং একই স্থানে বার বার মারার পরিবর্তে শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রহার করার আবেদন জানাতো। কিন্তু আমি বলতাম না তা হবে না। পাঠকদের জন্য এই ঘটনা হয়তো তেমন কোন গুরুত্বের দাবী রাখে না। কিন্তু আমার নিজের জন্য এত বড় শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত রয়েছে। অবশ্য এটা সত্য যে, আমি আমার সন্তানের কল্যাণ ও মঙ্গল চিন্তায়ই শিক্ষামূলকভাবে তাকে শাস্তি দিতাম। কিন্তু তথাপি আল্লাহ তায়ালা আমার জন্য অনুরূপ শাস্তি নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, আমার ওপর জুলুমকারীরাও শাস্তি থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারবে না। দুনিয়াতেও নিশ্চিতই তাদের শাস্তি পেতে হবে আবার আখেরাতের শান্তিও তাদের জন্য স্থির নিশ্চিত।
নিসন্দেহে দুঃখের পর রয়েছে সুখ
আল ওযাহতি জেলখানায় আমাদের বিশেষ স্বাধীনতা ছিল। সেখানে আমরা জেলখানার ভিতর একটা ছোট কৃষি ক্ষেত্র তৈরী করে নিয়েছিলাম। সেখানে আমরা শালগম, বীট, গাজর, মূলা, খরবুজা, তরমুজ এবং অন্যান্য ফল ও সবজির চাষ করতাম। সেখানে আমরা ছোট আকারের একটি মুরগীর খামারও তৈরী করে ফেলেছিলাম। যেখানে আমি মুরগী ও খরগোশ পালতাম। কুরবানীর ঈদদোপলক্ষে জনাব মুহাম্মাদ হামেদ আবুন নাসের আমাদের জন্য বকরী নিয়ে আসেন। অনন্তর আমরা জেলখানাতেই কুরবানী করি। এই কয়েদখানায় আমরা জুমা ও দুই ঈদের নামায ছাড়াও দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাযই জামায়াতের সাথে আদায় করতাম। মংগলবারের দারসে কুরআন যা ইমাম শহীদ হাসানুল বান্নার সময় থেকেই ইখওয়ানের কর্মসূচীর বাধ্যতামূলক অংশে পরিণত হয়েছিল –জেলখানাতেও যথা নিয়মে সে ধারা অব্যাহত থাকে। কয়েকটি বিষয়ে বিষয়ভিত্তিক বক্তৃতা নিয়মিত চলছিলো। এই কারণে আমাদের প্রত্যাশা ছিল যেন আমাদের পুরো বন্দী জীবন এই জেলখানাতেই অতিবাহিত করি। যদিও এখানে গ্রীষ্ম ও শীতকালে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া বিরাজ করতো। উদাহরণ স্বরূপ গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ছায়াতে বায়ান্ন ডিগ্রী পর্যন্ত পৌঁছে যেতো এবং শীতকালে হিমাঙ্কের ছয় ডিগ্রী নীচে নেমে যেতো। এতদ্ব্যাতীত এই জেলখানায় বহু বিষাক্ত সাপ বিচরণ করতো। আপনি শুনে আশ্চর্য হবেন যে, এই বিষাক্ত সাপ সময়ে সময়ে কয়েদীদেরকে দংশন পর্যন্ত করে বসতো। কিন্তু আমাদের অবস্থান কালে আল্লাহ তায়ালা সমস্ত ইখওয়ানীকে সম্পূর্ণ নিরাপদ রাখেন। আবদুন নাসের আমাদের জেলের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হয়ে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে। তারপর তাৎক্ষণিক নির্দেশে আমাদেরকে বিভিন্ন জেলখানায় পাঠিয়ে ছড়িয়ে দেয়া হয়। বছরের পর বছর অতীতের গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে লাগলো। আর আমিও আমার প্রিয় জীবনের সুদীর্ঘ সতেরটি বছর জেলখানার চার দেয়ালের মধ্যে অতিবাহিত করলাম। অত্যাচারের যে ষ্টীমরোলার আমার ওপর পরিচালিত হয় সে জন্য আফসোস নেই। বরং আমার শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরা আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাতের সম্মুখে সদা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। কারণ তিনিই তো আমাকে এসব অত্যাচার উৎপীড়ন সহ্য করার শক্তি ও সাহস যুগিয়েছেন এবং দৃঢ় পদ থাকার সৌভাগ্য দান করেছেন। আমাদের প্রতিপক্ষ চেষ্টা করেছে যেন আমাদের মথা তাদের সামনে নত হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর শুকরিয়া যে এ শির কোন তাগুতের সামনে অবনত হয়নি। যদি কোন ব্যক্তি তার দুশমনের সম্মুখে মস্তক উন্নত রেখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে তাহলে সেটা তার জন্য সেই অবস্থায় চেয়ে সহস্র গুণে শ্রেয় যে সে তার পায়ের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে মৃত্যুর হিমশীতল পেয়ালা পান করবে। কবির ভাষায়:
আমি সময়ের দাবী ও যুগের চাহিদার পাথরের ওপর
কখনো সিজদাবনত হবো না।
মৃত্যুকে সহস্যে বরণ করে নিতে পারি তথাপি কোন মূল্যে
ঈমান কখনো বিক্রি করবো না।
আসমা বিনতে আবি বকর (রা) মুসলিম সমাজে বংশ পরম্পরায় আবর্তিত হয়ে চলে আসছেন। আর এসব ঘটনা প্রবাহে বড়ই হিকমত রয়েছে। হযরত আসমা (রা) তার বৃদ্ধ বয়সে তার মহাপ্রাণ পুত্র আবদুল্লাহ বিন জুবাইর (রা)-কে হাজ্জাজের মোকাবিলায় শৌর্য বীর্য ও বীরত্বের শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেছিলেন:
“ইজ্জাতের সাথে তলোয়ারের আঘাত খেয়ে জান কুরবান করে দেয়া দুশমনের সামনে অপমানের সাথে চাবুকের আঘাতে জর্জরিত হওয়া থেকে হাজার গুণে শ্রেয়।”
ওগো মু’মিন বান্দাহ –তুমিই সৌভাগ্যবান আবার তুমিই হতভাগা
আমার স্মৃতিকথার মধ্যে কিছু মজর সরস ঘটনাবলীও সংরক্ষিত রয়েছে। একবার আমি কানার জেলখানায় বন্দী ছিলাম। এই জেলখানায় অবস্থান করেছিলো একজন অপরাধী। তার নাম ছিল হিজাযী। এই দাগী আসামী বহুবার জেলখানায় এসেছে। এবারে তাকে আশি বছরের শাস্তির কথা শুনানো হয়েছে। জেলখানার সকল ছোট বড় কয়েদী এবং কারারক্ষীগণ তার দুষ্কর্মে অতিষ্ঠ ছিল। সে কাউকে কোন প্রকার তোয়াক্কা করতো না। এমনকি সে প্রত্যেককে সবার সামনে অপমাণিত করে খুবই আনন্দ বোধ করতো। একদিন সে আমার নিকট আগমন করে এবং অত্যন্ত সম্মানের সাথে কথাবার্তা কলতে থাকে। আলোচনা প্রসংগে উম্মেকুলসুমেরসেই নাতিয়া সংগীত যা সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসায় গেয়েছিল- এর উল্লেখ করা হয়। জানি না এই ব্যক্তি আমাকে সম্মান করতো কেন? সে জানতে পেরেছে যে, উম্মে কুলসুমের গান যা রেডিওতে মাঝেমধ্যে প্রচারিত হয়ে থাকে –এর আমি খুবই গুণগ্রাহী ও ভক্ত। এ প্রসংগে কথাবার্তা হলো।
রাত্রিবেলায় আমি হাসপাতালের খাটের ওপর শয্যা করলে অচিরেই নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লাম। নিদ্রিত অবস্থায় আমার মনে হচ্ছিলো উম্মে কুলসুমের গান যেন আমার কর্ণকুহরে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। হঠাৎ আমার চোখ খুলে যায় এবং আমি প্রকৃতই উম্মে কুলসুমের আওয়াজ শুনতে পাই।
আসমা বিনতে আবি বকর (রা)-এর শ্রেষ্ঠত্বের কাহিনী মুসলিম জাতির মধ্যে পুরুষনাক্রমে চলে আসছে। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে বড় রহস্য। বৃদ্ধ বয়সে হযরত আসমা (রা) তাঁর মহান সন্তান আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরকে হাজ্জাজের বিরুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের উপদেশ দিয়েছিলেন।
আপনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন যে এসব তথাকথিত আদালতের সামনে ইখওয়ানদের পেশ করা হতে থাকলো। তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও পেশ করা হতো। ইখওয়ানের আহত স্থানসমূহ থেকে তখনও রক্ত প্রবাহিত হতে থাকতো এবং নির্যাতনের সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ তাদের শরীরে দেখা যেতো। এমতাবস্থায় মনগড়া ও বানোয়াট স্বীকারোক্তিসমূহকে ভিত্তি করে ফায়সালা প্রদান করা হতো। আফসোস! বিষয়টি যদি এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটতো! এরপরও কোন কয়েদী যদি আদালতে পেশকৃত জবানবন্দী অস্বীকার করতো তাহলে তাকে আদালত জেলখানায় ফেরত পাঠিয়ে দিতো যেন আরো নির্যাতন চালিয়ে তাকে স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি সমর্থন করতে বাধ্য করা হয়।
জামাল সালেমের পরিণতি
জামাল সালেম যিনি তথাকথিত এসব আদালতের প্রধান ছিলেন। তিনি আসামীদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে ও কথায় কথায় তাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আদালতের অপর দু’জন সদস্য এই বিচার প্রহসন চলাকালীন সময়ে সম্পূর্ণ চুপচাপ বসে থাকতেন। এই জামাল সালেমের পরিণতিও হয়েছিল অত্যন্ত বিস্ময়কর। সামরিক উর্দি খুলে এখন তিনি সাদা বেসামরিক পোশাক পরিধান করেছেন। পরেছেন গেরুয়া রংগের আবা ও আলখেল্লা। দিনের অধিকাংশ সময় মসজিদে ও সাইয়েদা যয়নাবে অতিবাহিত করেন।
সে কি সভ্যই তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত ছিল। তিনি কি তার কৃত পাপরাশী থেকে তওবা করে নিয়েছিলেন। নিসন্দেহে আল্লাহর রহমত অতিব সুবিস্তৃত। যে কেউই তার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করতে চাইবে সে কোন সংকীর্ণতার শিকার হবে না। অবশ্য তার তওবা হতে হবে খাঁটি ও অকৃত্রিম। এরূপ তাওবাতে অসংখ্য কবিরা গুনাহও মাফ হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালার ক্ষমার তুলনায় কোন গুনাহই বড় নয়। আমি এ ব্যক্তির ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণীর পুনরাবৃত্তি করছি। তিনি বলেছেন: তোমরা তোমাদের মৃতদের গুণাবলী বর্ণনা করে তাদেরকে স্মরণ করো। আমাদের উচিত তাদেরকে আল্লাহর ইনসাফের ওপর ছেড়ে দেয়। কারণ তিনি সর্বাপেক্ষা অধিক ন্যায় ও সুবিচারের নিশ্চয়তা বিধানকারী।
পঞ্চদশ অধ্যায়
মাহফিল পন্ড
আমার স্মৃতিকথার আলোচনা প্রসংগে সাদাতের সেই প্রস্তাবের উল্লেখ ইতিপূর্বে করা হয়েছে যে সম্পর্কে তিনি “পাবলিক প্রোসিকিউটিঙ এজেন্সির” ভিত্তি রাচনা করেছিলেন। পুলিশ বিভাগ তো বিভিন্নভাবে পৃথিবীর সকল দেশেই পাওয়া যায়। তথাপি সাদাত সাহেবের প্রতিষ্ঠিত এই বিভাগটি ছিল সর্বাপেক্ষা ভিন্ন। অন্য কোন দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যার তুলনা খুঁজে পাওয়ার জন্য আমি অপ্রাণ চেষ্টা করি কিন্তু কোথাও পাইনি। এই সংস্থার লোকজন কোন ব্যাপারে তথ্যানুসন্ধানের জন্র আমার সহযোগিতা কামনা করে। প্রথম বৈঠক কোন প্রকার বিরতি ছাড়া একটানা ছয় ঘন্টা স্থায়ী হয়। তারপরও আরো পাঁচবার আমাকে উপস্থিত হওয়ার জন্য ডেকে পাঠানো হয়। কোন অধিবেশনেরই সময়কাল দু’ঘন্টার কম ছিল না। এত দীর্ঘ ও প্রাণান্তকর অনুসন্ধানের পর ফলাফল দাঁড়ায় সম্পূর্ণ শূন্য। পর্বতের মুষিক প্রসব প্রবাদের নির্মম বাস্তব রূপ।
নিকটতম গুপ্তচর বৃত্তি
এই অনুসন্ধান কার্য চলাকালীন সময়ে আমি জানতে পাই যে, এই সংস্থার কর্মকর্তাগণ আমার প্রতিটি গতিবিধি সম্পর্কে সম্যক পরিজ্ঞাত থাকতো। তারা ছায়ার ন্যঅয় আমার পশ্চাদানুসরণ করতো। আমার প্রতিটি শ্বাস গুণে গুণে হিসেব ক ষতো। সাদাতের শাসনামলের শেষের দিকে তিনি িএমনভাবে গুপ্তচর বৃত্তিতে তৎপর হয়ে উঠেন যে, আমি যখন যেখানেই মুখ খুলেছি তারা “কিরামান কাতিবিনের” মত তার সম্পূর্ণ রেকর্ড সংরক্ষণ করেছে। আমি কায়রোর বার এসোসিয়েশনে “ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা” শীর্ষক বিষয়ের ওপর বক্তব্য পেশ করি। যার প্রতিটি শব্দ এই বেচারাদের লিপিবদ্ধ করতে হয়। অনন্তর প্রতিটি শব্দের বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা হয় যে, আমি কোথাও এমন কোন কথা বলেছি কি না যার পরিপ্রেক্ষিতে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এটা ছিল এমন এক প্রশাসনিক ব্যবস্থা যেখানে প্রতিটি নাগরিকের পিছনে সি আই ডি লাগিয়ে রাখা হতো। এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেন কারো ব্যক্তিগত জীবন বলতে কোন কিছুই ছিল না। বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল এই যে, এতদসত্ত্বেও কোন কোন সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবি সাদাতের আমলের প্রশংসায় মুখর।
কোন সরকারেরই এ ধরনের কর্মপন্থা শাসক ও শাসিতের কারো জন্যেই কল্যাণকর হতে পারে না। এতে বরং উভয় পক্ষের মধ্যেই সংশয়-সন্দেহ, ঘৃণা-বিদ্বেষ এবং অবিশ্বাস ও অনাস্থাই সৃষ্টি হয়ে থাকে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত সত্য কথাই বলেছেন: শাসক যখন প্রজা সাধারণের দোষ-ত্রুটি খুঁজতে তাদের পেছনে লেগে যায় তখন সে তাদেরকে খারাপ করে ছাড়ে।
প্রতিটি লোকের পশ্চাতে গোয়েন্দা নিয়োগকারী শাসক নিশ্চিত এই অনুভূতি রাখে যে, জনসাধারণ তার ওপর সন্তুষ্ট নয়। এমনকি তার অনুসৃত পলিসিও গণস্বীকৃতি লাভ করেনি। অন্যথায় প্রত্যেক ব্যক্তির পেছনে সি আই ডি নিযুক্ত করার প্রয়োজন কি?
আমি কতবার বলে এসেছি যে, আমার এই স্মৃতি রোমন্থন করার উদ্দেশ্য কোন প্রকার গর্ব বা অহংকার প্রকাশ করা আদৌ নয়। মিসর ও মিসরের বাহির েথেকে অসংখ্য লোক আমার সাথে সাক্ষাত করার জন্য আমার বাড়ীতে এসে থাকেন। অথচ আমার বাসগৃহের পরিবেশ খুবই অনাড়ম্বর ও সাদাসিধে ধরনের। আমার ঘরের সাজ-সরঞ্জামের প্রায় সবই ১৯২৬ সালের। চেয়ার, সোফা এবং অন্যান্য আসবাবপত্র পুরনো হওয়ার কারনে সেগুলো আসল রং রূপ ও চেহারা হারিয়ে বসেছে। আমার কোন কোন বন্ধু বান্ধবের এ দৃশ্য আদৌ পছন্দ নয়। মিসরের বাহির থেকে আগত আমার কোন হিতাকাংখী প্রস্তাব করেছেন যে, আমার জন্য কোন বিলাস বহুল ও নামীদামী মহল্লায় বাড়ী ক্রয় করে তা উত্তমরূপে অত্যাধুনিক আরাম আয়েশের উপায় উপকরণ দ্বারা সজ্জিত করে দেবে। আমি তাদের এই প্রস্তাব সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেছি। আমি শানশওকাত ও ভোগ বিলাসিতা আদৌ কামনা করি না। যে বাড়ীতে এবং যে অবস্থায় আছি তাতেই আমার মন ও মস্তিষ্ক খুব পরিতৃপ্ত আছে। আমি আল্লাহর শোকর আদায় করছি যে, তিনি আমাকে এভাবে থাকার সুযোগ দিয়েছেন। আমার মনের গভীর কন্দরে কখনো এমন মনোভাব দেখা দেয়নি যে, বর্তমান বাসস্থান ও সাজ-সরঞ্জাম পরিবর্তন করে ফেলতে হবে। আমি আল্লাহ তায়ালার নিকট তার শোকর আদায় করছি এবং তার রহমত ও আশ্রয়ের প্রত্যাশা করছি। আর তা আমি সর্বদা লাভও করেছি। একজন মু’মীন বান্দাহ যখনই আত্মতৃপ্তি ও মানসিক প্রশান্তি নিয়ে দুনিয়ার সুখ সম্ভোগ ও আরাম-আয়েশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সর্বদা তখনই তার সন্তুষ্টি অর্জন এবং তারই নৈকট্য লাভের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে যায় তখনই তার প্রকৃত সাফল্য অর্জনের সকল উপায় উপকরণ পর্যাপ্ত পরিমাণে তার হস্তগত হয়ে যায়।
হে আল্লা! আমাকে এমন অবস্থায় সন্তুষ্ট রাখো- যাতে তোমার সন্তোষ লাভ করতে পারি এবং এই ক্ষণস্থায়ী জগতের বিত্ত-বৈভবের কঠোর পরীক্ষায় তুমি আমাকে ফেলো না।
যেমন রাজা তেমন প্রজা
আমার মতে মুসলিম উম্মাহ আজ যেসব বিপদ ও কঠোর পরীক্ষায় ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে তার কারণ অন্ন বস্ত্র ও বাসস্থানের দুষ্প্রাপ্যতা নয়। বরং প্রকৃত সমস্যা সেসব অদৃশ্য হাতের সৃষ্ট যারা এসব মৌলিক প্রয়োজনের কলকাঠি নিয়ন্ত্রণ করছে। যদি মুসলিম জাহানের প্রতিটি দেশে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব আমানতদার ও বিশ্বস্ত লোকদের হাতে এসে যায় তাহলে ইসলামী দুনিয়া বিশ্বের সব জাতির মোকাবিলায় সর্বাপেক্ষা অধিক মজবুত ও আত্মনির্ভরশীল জাতিতে পরিণত হতে পারবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের সাথেই বলতে হচ্ছে যে, মুসলিম বিশ্বের এরূপ অনুভূতি ও চিন্তা-চেতনাই সম্পূর্ণভাবে লোপ পেয়েছে এবং একান্ত ব্যতিক্রম ছাড়া সর্বত্র উল্টো হাওয়াই প্রবাহিত হচ্ছে। সমাজের অপেক্ষাকৃত নিম্নশ্রেণীর লোকজন উচ্চশ্রেণীর লোকতের প্রতি চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে এবং যদি দেখতে পায় যে, তারা অধপতনের গভীর পংকে নিমজ্জিত হচ্ছে তাহলে এরাও একই অপরাধে অপরাধী হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। এভাবে এই অকল্যাণের চক্র গোটা জাতির দেহে রক্তের ন্যায় প্রবাহিত হতে থাকে। “যেমন রাজা তেমন প্রজা” প্রবাদ বাক্যের সত্যতার ন্যায় সমাজের নীচুস্তরের লোকেরা উঁচুস্তরের লোকদের অনুসরণ করে থাকে। যেহেতু ওপরের তলার লোকদের মধ্যে ও ব্যাধী সংক্রামক রোগের মত বিস্তার লাভ করে আছে। দেশ ও জাতির মংগল ও কল্যাণ কামনার তুলনায় ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সুযোগ সুবিধাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয। তাই প্রত্যেকেই আপনাকে নিয়ে ব্যস্ত আছে।
চেষ্টা দ্বারাই অভ্যাস গড়ে ওঠে
আমি যখন চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম তখন দেখতে পেলাম মসজিগুলোর অবস্থা খুবই রুণ। যে মসজিদেই আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে সেখানেই বয়োবৃদ্ধ, গরীব ও কাংগাল মানুষ দেখতে পেয়েছি। সচ্ছল ও যুব সমাজের কোন সম্পর্ক মসজিদের সাথে নেই বললেই চলে। নিত্য দিনের লেন-দেনে ও সভ্যতা সংস্কৃতিতে ইসলামী মূল্যবোধ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। মানুষ ইসলামী কাজ-কর্ম করতে কোন প্রকার লজ্জা অনুভব করতো না। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াতের সূচনা হলে কিছু দিনের মধ্যেই এর সুফল প্রকাশ পেতে শুরু করে এবং রিস্থিতিতে সুস্পষ্ট পরিবর্তন আসতে থাকে। মসজিদে মসজিদে যুবকশ্রেণীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যার আগমন শুরু হয়। উঠতি বয়সের এসব মুসলিম তরুণ ইবাদাতে নিষ্ঠা ও ইসলামী জ্ঞান চ র্চায় প্রবল ঈমানী প্রবণতা প্রদর্শনী করতে থাকে। সর্বত্র বিরাজমান পরিস্থিতিতে গণমূলক ও সম্ভাবনাময় আমূল পরিবর্তন প্রতিভাত হতে লাগলো। অবস্থা এমন পর্যায়ে উপনীত হলো যে, সাধারণ রাজনৈতিক দল এবং নেতৃবৃন্দও দ্বীনি শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার ধারাবাহিক আলোচনা করতে থাকে। এটা ছির একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তন। ইখওয়ান তো আল্লার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কাজের সূচনা করেছিল। কিন্তু কতিপয় রাজনৈতিক দল ইসলামের প্রতি জনসাধারণের আগ্রহ এবং আল্লাহর প্রতি প্রত্যাবর্তন দেখে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যেই ইসলামের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেযাতে তারাও কিছুতেই ইখওয়ান থেকে পিছিয়ে না পড়ে। যা হোক ভাল কাজের প্রতিযোগিতা করাও উত্তম অবশ্য তজ্জন্য শর্ত হলো নিয়ত সৎ হতে হবে।
আমাদের দুরদৃষ্টিকে ব্যাপকতা দাও
এই দাওয়াতের ফল এই যে, এখন প্রত্যেক রাজনৈতিক দল তাদের ঘোষণাপত্রের শিরোনামে এ বিষয়টি লিপিবদ্ধ করে দেয় যে, বিজয় লাভ করল তারা দেশে ইসলামী শরীয়াত চালু করবে। এটা দাওয়াতে ইসলামীর সফলতার চাক্ষুষ প্রমাণ ইসলামের শত্রুরা এই দ্বীনের বিরুদ্ধে যত চক্রান্ত ও কূটকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেছিল; এক্ষণে তা প্রায় সবটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। খৃস্টান মিশনারীদের সম্মুখে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছে। দাওয়াতের এসব প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে ইসলাম বিদ্বেষী শক্তিগুরো একে নির্মূল করার জন্য তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। সকল দেশেই মিশনারীদের গৃহীত কর্মনীতি হচ্ছে, তারা হাসপাতাল, স্কুল ও অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজকে তাদের বাণী প্রচারের উপলক্ষ বানিয়ে থঅকে। জনগণের সেবায় ছ্দ্মাবরণে মূলত ক্রমে আন্দোলন তার পাঞ্জা শ্ত করে গেড়ে দেয়। এ ব্যাপারে আমি কখনো উদাসীন ছিলাম না। আমার মনে পড়ে শাবীনুল কানাতিরে হারমূল হাসপাতালে সর্বদা রোগীদের ভিড় লেগেই থাকে। আমি জানতে পেরেছি যে, চিকিৎসা ও ঔষধ পথ্যের সাথে সাথে খৃস্টবাদের দাওয়াত দেয়া হয়ে থাকে। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের আন্দোলন এই প্রতিষ্ঠানের মুখোশ উন্মোচন করে এর আসল চেহারা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেয়। তারপর আর যায় কোথায়? হাসপাতাল রোগী শূন্য হয়ে পড়ে এবং সেখানে পেঁচকের দল বাসা বাঁধে। ইখওয়ান গ্রামীন কৃষকদল, পেশাজীবি, শ্রমজীবি এবং সাধারণ বস্তিবাসীদের অবহিত করে যে, মানবীয় সহানুভূতির পর্দার অন্তরারেল হাসপাতালের আমলা ও কর্মচারীরা তাদের দ্বীন ও ঈমানের ওপর কুঠারাঘাত করছে। ফলে এই হাসপাতাল অন্যভাবে বলতে গেলে খৃষ্টবাদ প্রচারের কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়।
ত্রুটিমুক্তি ব্যবস্থা
আমার মনে পড়েছে যে, যখন কোন লোক ইখওয়ানের রাজনৈদিক, অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক দর্শনের উল্লেখ করতো তখন আমার মনে এই “দর্শন” শব্দটি বেশষ খটকা সৃষ্টি করতো। কোন কোন দর্শনশাস্ত্রবিদের মতে “দর্শনের” সংজ্ঞা হচ্ছে, “মানুষের অনুসন্ধান ও ভুল-ভ্রান্তির সমষ্টি, হোঁচট খাওয়া তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং ভবিষ্যতে হোচঁট খাওয়া থেকে আত্মরক্ষা করা” –ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি দর্শনের সংজ্ঞা এই হয় তাহলেতো ইসলামী আকীদা বিশ্বাস এই দর্শন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও অমুখাপেক্ষী। কেননা এখানে হোঁচট খাওয়া এবং ভুলভ্রান্তির পর সংশোধনের না কল্পনা করা যায় আর না তার অবকাশ আছে। এটা আল্লাহ তায়ালার প্রদত্ত জীবন বিধান যা সূর্যের চেয়েও দীপ্তিময়। আমাদের আল্লাহ এক আমাদের শরীয়ত এক আমাদের রাসূল এক আমাদের দ্বীনের সকল বিষয় সুস্পষ্ট, সর্বজনবোধ্য ও কার্যকরী করার যোগ্য। একজন শিক্ষিত ও জ্ঞানী ব্যক্তি। এতে কোন দার্শনিক তত্ব কিংবা তর্কশাস্ত্রের মারপেচের আদৌ কোন আবশ্যকতা নেই।
আমাদের কোন কোন স্বনাম ধন্য ইমা ও আলেম দর্শনের ময়দানে যে সমস্ত তাত্বিক আলোচনা পেশ করেছেন তা কেবলমাত্র গ্রীক এবং অন্যান্য বিজাতীয় দেশ থেকে আনীত যুক্তিবিদ্যার প্রভাব এবং ইসলামের ওপর আরোপিত ভিত্তিহীন অবান্তর আপত্তি ও সমালোচনার যথাযথ প্রতিবাদ জ্ঞানের নিমিত্তেই ছিল। উদাহরণ স্বরূপ ইমাম গায্যালী ও ইবন রুশদ প্রমুখ মনীষীদের গবেষণামূলক গ্রন্থ লক্ষণীয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম জনসমাজের ওপর থেকে অবাঞ্ছিত দর্শনশাস্ত্রের প্রভাব জনিত ভীতি বিদূরিত করা এবং সক্রেটিস, হিপক্রাটিস ও প্লেটো প্রমুখ প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকগনের ভ্রান্ত মতবাদের প্রত্যাখ্রান ছাড়া আর কিছু নয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রাচীন ও আধুনিক এসব দার্শনিক মুসলমানদের অন্তরে সন্দেহ এবং সংশয় সৃষ্টি করার জন্য সযত্ন প্রয়াস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। ওয়াহদাত অযুদ বিষয়ে কালামশাস্ত্র এবং অনুরূপ অন্যান্য বিষয়ের মাথা ঘামানো নিরেট পণ্ডশ্রম মাত্র। এভাবে সময়ের অপচয় ও মস্তিষ্কের ক্ষয় ছাড়া আর কোন লাভ হয় না।
আমি আমার সারা জীবন প্রত্যাশার স্বপ্নে বিভোর হয়ে অতিবাহিত করে দিয়েছি। আমি সর্বদা প্রতিটি জিনিসের উজ্জল দিক দেখে থাকি। হতাশা ও নৈরাশ্য কখনো আমার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারে না। তার কারণ শুধু একটাই আর তা হচ্ছে এই আকীদা বিশ্বাস যে আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ব্যতীত কোন ঘটনা এই পৃথিবীতে সংগঠিত হতে পারে না। আল্লাহর ইচ্ছঅকে কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। তার ইচ্ছা অবশ্যম্ভাবীরূপে কার্যকরী হয়ে থাকে। এ থেকে বাঁচার কোন পথ নেই। আল্লাহ অত্যন্ত দাতা ও দয়ালু। আমাদের কর্তব্র হচ্ছে যেসব বিষয়ে আমাদের মন সন্তুষ্ট হয় না সেগুলোর ব্যাপারে নিম্নে বর্ণিত মূলনীতির আলেঅকে আমাদের কর্মনীতি স্থির কতে হবে:
১-আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাত কি নিরংকুশ বিচারক নন? নিশ্চিত তিনি মহাবিচারক। তাহলে যা কিছু ঘটেছে তাতেও নিশ্চযই কোন নিগঢ় রহস্য লুকায়িত রয়েছে।
২-আল্লাহ কি পরম দয়ালূ নন? অবশ্যই। তবে আর ঐ সমস্ত বিপর্যয় যা বাহ্যত মূসিবতরূপে পরিদৃষ্ট হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে কোন নিগূঢ় জ্ঞানের ওপর ভিত্তিশীল এবং তাতে আল্লাহর রহমত নিহিত। যদিও আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞান তার গভীরে পৌঁতে অপারগ।
৩. আল্লাহ তায়ালা কি সুবিচারক নন? নিশ্চয়ই তাহলে তাঁর এমন কোন ফায়সালা হতে পারে না যার বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করা যেতে পারে।
এরূপ চিন্তাধারা গ্রহণ করলে হতাশা উদাসীনতা, দুশ্চিন্তা ও বিষণ্ণতা কিছুতেই আমাদের অন্তরে শিকর গজাতে পারে না। এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখতে পাই যে, তিনি সর্বদা হাসি মুখ থাকতেন। মানুষকে হতাশা থেকে দূরে রাখার জন্য সুসংবাদ শুনাতেন এবং আল্লাহ তায়ালার ফায়সারার ওপর সন্তুষ্ট থাকতেন। তার পবিত্র চেহারায় অসন্তোষের লক্ষণ ললাটে ভাঁজ শুধু মাত্র এমন অবস্থায় পরিদৃষ্ট হতো যখন আল্লাহ তায়ালা নিষিদ্ধ কার্যাবলীর কোথাও কোন বিরুদ্ধাচরণ হতো। এতদ্ব্যতীত তিনি সর্বদা আনন্দিত থাকতেন।
ইখওয়ানের সমস্ত সাথী জেলখানার দুঃখ জীবনেও সর্বদা হাসিখুশী ও অত্যন্ত আশাবাদী থাকতেন। কারারক্ষীগণ কখনো কখনো আমাদের জিজ্ঞেস করতো তোমরা কি আল হুদাইবির সাথে রয়েছো নাকি আবদুন নাসেরের সাথে? আমাদের মধ্যে কোন এক ভাই জবাব দিতেন- “আমি তো রয়েছি আল্লাহর সাথে।” একথা শ্রবণে সরকারী কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি গালাজ কারতো।
সিরাজের দাওয়াত
আমরা যখন কেন্দ্রীয় অফিসে একাধারে কয়েক ঘন্টার অধিবেশনে মিলিত হতাম তখন সেখানে যা কিছু পাওয়া যেতো সম্মিলিতভাবে খেয়ে নিতাম। আন্দোলনের প্রাথমিক যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে আমাদের এক ভাই আলীর অভ্যাস হচ্ছে, তিনি সম্মেলন চলাকালীন সময়ে লুবনের তরকারী রুটি ও ভূনা কলিজা নিয়ে এসে উপস্থিত সকলের খেদমতে হাজির করতেন। বেশীর ভাগ সময়ই তিনি তার ব্যক্তিগত খরচে এই সব খাদ্য সামগ্রী এনে ইখওয়ানদের খাওয়াতেন। দামের কথা জিজ্ঞেস করা হলে পাশ কাটিয়ে যেতেন। আল্রাহ তায়ালা তাকে বেশী করে পুরস্কৃত করুন। তাকে তার এই খেদমতের সর্বোত্তম বিনিময় দান করুন। তাকে সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ূ প্রদান করুন এবং নেক আমলের তাওফীক প্রদান করুন। আমাদের পারস্পরিক আচরণ সকল প্রকার লৌকিকতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। ইখওয়ানের মধ্য থেকে কোন ভাই যদি কখনো দাওয়াত খেতে আমন্ত্রণ জানায় তখন কম বেশী কিছুটা ধমধাম পড়ে যায়। সারীদ ও গোশত দ্বারা সকলকে আপ্যায়ন করা হয়। কোন কোন ভাই যাকে আল্লাহ তায়ালা পর্যাপ্ত ধন-সম্পদ দান করেছেন তিনি মেহমানদারীর সময় রকমারী সুস্বাধু ও ঘৃতপক্ক খাদ্য হাজির করতেন। এ ব্যাপারে নিয়ম ছিল, সংগীদের মেহমানদারী করার জন্য কোন প্রকার কার্পণ্য করা হতো না। আর কোন রকম বাহুল্য ব্যয়ও পছন্দ করা হতো না। প্রত্যেক ভাই তার দ্বীনি ভাইদেরকে তার সামর্থানুযায়ী সম্মান করতে তৎপর থাকতো। কেননা রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লঅমের একটি বাণীর মর্মার্থ এই যে, “তোমাদের মধ্যে যেই আল্লাহ তায়ালা ও আখেরাতের ওপর ঈমান রাখে তার উচিত মেহমানদের সম্মান করা।”
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল
আমার জীবনের প্রথম দিকে আমার আগ্রহ ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ওয়াফদ পার্টির প্রতি। কিন্তু সমস্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল বন্ধু প্রতীম। এই কারণে অনেক মজার কাহিনীও সংঘটিত হয়েছে। যেমন দু’টো পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক দল একই সময় আমাকে তাদের দলের সদস্য রূপে মনে করেছে। মরহুম আহমদ হামজা পাশা ক্ষমতাসীন ওয়াফদ পার্টির অন্যতম প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন। তার সাথে ছিল আমার ঐকান্তিক সম্পর্ক। আল কালয়ুবিয়া প্রদেমের প্রাদেশিক সংগঠনে তিনি আমার নাম ওয়াফদ পার্টির কমিটির অন্তর্ভুক্ত করিয়েছিলেন। একই সময় শাবিবুল কানাতির অঞ্চল থেকে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য জনাব মুহাম্মাদ আল ফাকী বেগ মরহুম আমার নাম তার পার্টির মধ্যে শামিল করেছিলেন। আমাকে কখনো না ওয়াফদ পার্টির কোন সদস্য কিছু জিজ্ঞেস করেছে না দাস্তুরীগণ। আমিও এতে কোন রকম অসুবিধা মনে করতাম না। কেননা ইখওয়ানের মধ্যে আমাদের মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য জনাব মোহাম্মদ আবদুর রহমান নাসির মরহুম হিজাবে দাস্তুর-এর অন্যতম সদস্য ছিলেন। এমনকি তিনি এই দলের পক্ষ থেকে নাবহা এলাকার পার্লামেন্টের সদস্যও ছিলেন। ইমাম হাসানুল বান্না শহীত তাঁর হিজবে দাস্তুর-এর সদস্য পদের ব্যাপারে কখনো কোন আপত্তি উত্থাপন করেননি।
এই সময় ইখওয়ান সদস্যগণ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্য হতে পারতেন, যদি তাদের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ইখওয়ানের আন্দোলনের পয়গাম সর্বস্তরের জনগণের নিকট পৌঁছানো হতো এবং অন্য সকল বিষয়ই তার কাছে গৌণ বলে বিবেচিত হতো। ইখওয়ানের বেশ কিছু সদস্য ওয়াফদী, দস্তুরী, সা’দী (সা’দ জগলুল পাশার নামানুসারে), মাহাযী, কিংবা হিজুল ওয়াতানী দলের সদস্য ছিলেন। তারা যেখানেই থাকুক না কেন সেই প্লাটফর্ম থেকেই দাওয়াতে হকের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে থাকতেন সদা তৎপর। আর তাদের মূল বিশ্বস্ততা ছিল আল্লাহ ও রাসূলের সাথে।
আমি কখনো কোন দলের সদস্য পদ ও দাওয়াতে হকের মধ্যে সংঘাতের কোন লক্ষণ দেখতে পাইনি। ব্যক্তিগত স্বার্থ কিংবা অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা লাভের জন্য কোন দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ধারণাও আমার ছিল না। অবশ্য আমি শেক্সপিয়ারের কায়জারের কাহিনীর ঐ অংশ সর্বদা পছন্দ করতাম যে কোন অবহেলিত গ্রামের নেতৃস্থানীয় পদ লাভ রোম নগরে দ্বিতীয় পজিশন অপেক্ষা শ্রেয়। এ বাক্যাংশে আমার এজন্য ভাল লাগতো না যে, আমি নাম ও যশের প্রত্যাশী। বরং এর লেশমাত্রও আমি অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখে থাকি। আমি কোন দিনই কোন পদলোভী ছিলাম না। এজন্য কোন প্রকার চেষ্টা তদবীরও করিনি। মাকতাবে ইরশাদের সদস্য পদ থেকে আমি সর্বদা পাশ কাটিয়ে চলতাম। কিন্তু ইমাম হাসানুল বান্না শহীদ আমাকে এর কর্মকর্তা হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারপর যখন ইমাম আল হুদাইবি মুর্শিদে আ’মের দায়িত্বে অভিষিক্ত হন তখন প্রতিষ্ঠা মজলিশের সদস্যগণ আমাকে এই পদে সামাল দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। মিসর কিংবা মিসরের বাহরে যখনই আমাদেরকে কোন কক্ষে বসতে হতো তখন সর্বদা আমার প্রচেষ্টা থাকতো দরজার পাশে বসার যাতে কেউ আমাকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে এরূপ অনুরোধ করার সুযোগ না পায় যে, আমার পাশে বসুন!
আমি কি আর আমার ক্ষমতাই বা কি?
আমি আমার ও পূর্ববর্তী দু’দু’জন মুর্শিদে আ’মের মাঝে আসমান জমিনের ফারাক মনে করি। সত্য করে জেনে রাখুন এটা বিনয় নয় বরং সত্য। আমি আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকেই এরূপ ধারণা পোষণ করি আর এটাই বাস্তব। আমার ওপর এই গুরু দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে এবং ইখওয়ান আমাকে তাদের জ্যেষ্ঠ েভ্রাতা মনে করে থাকে। অথচ আমি নিজেকে এই কঠিন দায়িত্ব পালনের যোগ্য বলে আদৌ মনে করি না। নিজের মর্যাদা যোগ্যতা ও অবস্থান সম্পর্কে আমার ভালভাবেই জানা আছে। আল্লাহ তায়ালা এমন ব্যক্তির ওপরই রহমত নাযিল করেন যিনি তার সম্মান ও আত্মমপরিচয় সম্পর্কে সচেতন থাকেন।
আমার স্মৃতিকথার মধ্যে সর্বাপেক্ষা চিত্তাকর্ষক ও মূল্যবান জিনিস হচ্ছে, আমি ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াতের সাহায্যে আমার নিজেকে জানার সুযোগ পেয়েছি এবং এই জীবনে এমন ব্যক্তিত্ব লাভ করেছি যার অস্তিত্ব ও অবস্থান রয়েছে। এই দাওয়াতের বদৌলতে আমি সাক্ষ্য করেছি যে, আমি খাদ্য গ্রহণ করে থঅকি জীবন ধারণ ও দ্বীনি দায়িত্ব পালন করার জন্য কেবলমাত্র খাওয়ার জন্যই আমি বেঁচে থাকি না।
জীবনটা ধরে রাখতে হলে খেতে হয়; খাওয়ার জন্যই বেঁচে না থাকার নিষ্টুর বাস্তবতা আমার সম্মুখে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের পয়গামই তুলে ধরেছে। যদি আমার যৌবন ফিরে আসে যার জন্য আমার কোন আকাংখা নেই বরং আমার ব্যক্তিত্বের মধ্যেই আমার বার্ধক্যের বিরাট অংশ রয়েছে। এর বদলে আমি পুনরায় যৌবন লাভ করে এই মহাসম্পদ ছাড়া করতে চাই না। যা জীবনভর আমি জমা করছি ---। তা হলে আমি সেই নবযৌবনে কি গতিধারা অবলম্বন করবো? আমাকে যদি এই যৌবন দেখিয়ে বলা হয় যে, তুমি তোমার নিজের জন্য রাস্তা বেছে নাও। তাহলে আমি নির্দ্বিধায় সেই পথই অবলম্বন করবো যে পথে আমি আমার বিগত জীবন অতিবাহিত করেছি। আল্লাহ তায়ালার সাথে এ অপেক্ষা বেশী নৈকট্য আর কি হতে পার যে, জীবন তারই পথে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অতিক্রম হয়েছে। আমার ন্যায় দুর্বল ও অসহায় ব্যক্তির পক্ষে অতসব মুষ্কিল ও কঠিন চড়াই উৎরাই অতিক্রম করা কি করে সম্ভব ছিল যদি আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ ও তার পক্ষ থেকে অবিচল থাকার তাওফীক আমাকে পরিবেষ্টন না করে নিতো এই চড়াই উৎরাই ও উত্থান পতন-যাতে আমার জীবন কেটে গেলো –তার স্মৃতি রোমন্থন করতে আমার খুবই ভাল লাগে। এটাই আমার মূলধন এবং এটাই আমার সম্বল ও পাথেয়। এটাই দুনিয়াতে সম্মান এবং আখেরাতে মংগল ও কল্যাণ। আমি আমার জীবন নিয়ে অত্যন্ত সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত।
বদদোয়া ও তার লক্ষ্য
একবার আমি মিসরের পাহাড়ী অঞ্চলে এক জেলখানায় বন্দী ছিলাম। জেলের কর্মকর্তাদের একজন আমাকে তার অফিসে ডেকে পাঠায় এবং জামাল আবদুন নাসেরের গুণাবলী ও গৌরবজনক কীর্তিগাতা বর্ণনা করতে থাকে। সাথে সাথে ইখওয়ানের সংগঠন মুর্শিদে আ’মের বিরুদ্ধে বিষোধগার করতে থাকে ও তার সপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ পেশ করে। এমন সব মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করে যা মিসরে নিত্যদিনকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এবং যার কোন অস্তিত্ব এই ইখওয়ান বিদ্বেষীদের মনমানস ও কথাবার্তা েএবং আচার আচরণ ব্যতীত আর কোথাও ছিল না। সে অন্যুন আধা ঘন্টা পর্যন্ত ভাষণ দিতে থাকে। আমি পিন পতন নীরবতার সাথে ও নিবিষ্ট মনে তার বক্তৃতা শুনতে থাকি। সে মনে করে যে, তার বক্তব্যেল যাদু আমর ওপর ক্রিয়া করেছে। তারপর সে বলতে লাগলো, “এখন তোমার মতামত কি? তুমি কি আবদুন নাসেরকে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে প্রস্তুত?”
আমি জবাব দিলাম তুমি তোমার মনোভাব ও দৃষ্টিভংগী বর্ণনা করতে নিসন্দেহে কোন কসুর করনি। কিন্তু আমি আমার বিবেককে প্রশ্ন করছি সুদীর্ঘ এতগুলো বছর অত্যাচারের ষ্টিম রোলারে পিষ্ট হওয়ার পর এখন আমি জালিমের পৃষ্ঠপোষকতা করতে আরম্ভ করবো যার অত্যাচারের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হয়ে এসেছি আমি নিজেও? এত বছর ধরে আমি কি একেবারে জ্ঞানহীন ও গন্ডমূর্খ ছিলাম যে, এখন স্বীকৃতি প্রদান করবো নাসের হকের ওপর আছে। আর আমি আছি বাতিলের ওপর? যদি বাস্তবিকই আমার অবস্থা এমন হয়ে থাকে তাহলে তো আমি এর চেয়েও অধিক কঠোর শাস্তি এবং দীর্ঘ কারা জীবনের উপযুক্ত। অতএব আমার পক্ষ থেকে অপারগতা প্রকাশ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমি আপনার দাবী মেনে নিতে পারছি না।
এই কর্মকর্তা আমাকে পুনরায় আমার কুঠরিতে নিয়ে যায় তখন তার মুখ থেকে অভিশাপের বৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছিল। সে কোন রকম বিরতি ছাড়াই বলে যাচ্ছিলো আল্লাহ তোমার বংশ পরিবারকে ধ্বংস কর দিন, আল্লাহ তোমার সর্বনাশ করুন.....। আমি সেই মুহূর্তেই উপলব্ধি করলাম যে, তার বদদোয়া আমর ওপর পতিত হওয়ার পরিবর্তে শূন্যে ঘুর পাক খাচ্ছে এবং কয়েক পলক আবর্তিত হওয়ার পর যোগ্য লোক্ষ্যের ওপর গিয়েই আঘাত হানল। এর লক্ষ্যবস্তু আমি নই বরং কারাগারের এই কর্মকর্তা। আর সুধি পাঠক! আপনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন যে, প্রকৃত অবস্থা তাই পরিদৃষ্ট হলো। সে ব্যক্তি ক্যানসারের শিকার হয়ে মারা যায়। আল্লাহ তাকে তার রহমতের ছায়া তলে স্থান করে দিন এবং আমার ও তার ক্ষমার বিষয়টি বিবেচনা করুন।
জিহাদে অংশগ্রহণের দাবী
১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল নিয়ে যুদ্ধের সময় আমি আল ওয়াহাত জেলখানায় বন্দী ছিলাম। আমরা জেলখানার দারোগার নিকট দরখাস্ত করলাম যেন আমাদেরকে জিহাদে অংশগ্রহণ করার জন্যে রণাঙ্গনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমাদের প্রতিটি বৃদ্ধ ও যুবক দেশ মাতৃকার রক্ষার প্রেরণায় ছিল উজ্জীবিত। জেলখানার দারোগা এই আবেগ দেখে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়ে পড়ে এবং সে বিলক্ষণ বুঝতে পারে যে, এই লোকগুলো যারা শুধুমাত্র এই অপরাধের কারণে কারাগারের শাস্তি বোগ করে যাচ্ছে যে, তারা আল্লাহ তায়ালাকে তাদের রব বলে মনে করে- দেশের জন্য কত পবিত্র আবেগ পোষণ করে। তাই সে আমাদের দাবী সরকারের নিকট প্রেরণ করে দেয়, কিন্তু সেখান থেকে জবাব আসলো, না, এই “অপরাধী”দেরকে কারাগারের অন্ধকার কুঠরিতেই থাকতে দাও। অনুমান করুন, ক্ষমতাশীনদের চিন্তার ধরন কত ভ্রান্ত ও জুলুমমূলক। নাসের ও তার তল্পীবাহকদের অবস্থা ছিল এই যে, তারা ইখওয়ানদের মুখ নিঃসৃত প্রতিটি কথারই প্রবল বিরোধিতা করতো। এমন কি ইখওয়ান যদি বলতো, “সালমুল্লাহ” (তোমাদের উপর আল্লাহর প্রশান্তি নেমে আসুক) তখন তারা প্রত্যুত্তরে বলতো “গাজাবুল্লাহ” (তোমাদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক)।
ইখওয়ানের নামে ব্যাংগ-বিদ্রূপ
মিসরের জাতীয় ইতিহাসে ইখওয়ানের কীর্তিমালা সর্বজন বিদিত। বিশেষত ইখওয়ান ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ দশ বছরে যে ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করেছে তারই আলোকে মিসরের পুরো ইতিহাস এবং এই সমসয়ে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনা ইখওয়াকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে। এতদসত্ত্বেও এই অত্যাচার উৎপীড়নের স্বরূপ দেখুন, যে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া এই সময়ে প্রকাশিত কোন গ্রন্থই ইখওয়ানের কোন আলোচনা স্থান পায়নি। একেই বলা হয়ে থাকে “ক্ষমতাধরদের ইতিহাস রচনা।”
ফিরিঙ্গি সভ্যতার দাস
বৃটেনের বিদেশ মন্ত্রী মিষ্টার ইভেন্স আরব লীগ প্রতিষ্ঠার যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তা বিনা কারণে ছিল না। তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা ও পর্যালোচনা করা হয়েছিল। পাশ্চাত্য শক্তিগুলো উপলব্ধি করেছিলো যে, ইখওয়ান বিশ্বব্যাপী একটি ইসলামী সংগঠন প্রতিষ্ঠার জন্য অপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অতএব তারা ইসলামের পরিবর্তে আরব জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি সংস্থা গড়ে তোলার জন্য তাদের ভক্ত-অনুরক্ত ও দোষরদের উৎসাহিত করে। আমি অত্যন্ত অকপটে বলতে পারি যে, ফিলিস্তিন সমস্যাকে উপলক্ষ বানিয়ে আরব লীগের কাঠামো গড়ে উঠে এবং এই কারণেই তা হিমাগারে নিক্ষিপ্ত হয়। আরবলীগের দ্বারা ফিলিস্তিন যুদ্ধের অসীম ক্ষতি তো সাধিত হয়েছে। লাভ হয়নি মোটেও। এটা ছিল গোটা মুসলিম উম্মাহর সমস্যা। আর নেতৃবৃন্দ নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগির জাতিগত গোঁড়ামি ও নির্বুদ্ধিতার কারণে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। আরবলীগ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, আফগানিস্তান িএবং অন্যান্য অনারব মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে এই জিহাদ তেকে বাইরে রাখে। আমাদের শত্রুরা এটাই একান্তভাবে কামনা করছিলো।
আমি প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নববী ইসমাঈলের সাথে আলোচনা করেছিলাম যে, আমাদেরকে মুসলিম উম্মাহর সম্মিলিত সংগঠন কায়েম করা উচিত। আমার এই আলোচনার পর “মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সম্মিলিত লীগ” সম্পর্কে আলোচনা শোনা যেতে থাকে। এমনকি তা প্রতিষ্ঠার ঘোষণারও দেয়া হয়্ কিন্তু যেহেতু এর ভিত্তি মজবুত ছিল না। ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং ব্যক্তি বিশেষের সুনাম সুখ্যাতি, লাভ করাই ছিল এর পশ্চাতে সক্রিয়। ফলে এই মহতী উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখার সুযোগ পায়নি। যে কাজের পশ্চাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা উদ্দেশ্য থাকে না। তা কখনো ফলপ্রসূ হয় না। ফিলিস্তিনে ইখওয়ানের মুজাহিগণের কৃতিত্ব সোনালী অক্ষরে লিপিবদ্ধ করে রাখার মত। এই জিহাদের পর আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, প্রতিটি আরব রাষ্ট্রে সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যাপক প্রতিযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই বিপ্লব ছিল ধীর স্থির মস্তিষ্ক প্রসূত পরিকল্পনার ফল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, সামরিক সরকারের সাহায্যে এই গজিয়ে ওঠা ইসলামী শক্তি “আল ইখওয়ানুল মুসলিমুন”কে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করে দেয়া। পরবর্তী কালে সংঘটিত ঘটনাবলী আমার এই মতামতের সত্যতা ও যথার্থতার প্রমাণ করেছে। কেউ তা মিথ্যা বলে প্রমাণ করতে পারবে না। কেননা ইতিহাস তার ফায়সালা দিয়ে দিয়েছে। ইসলামী জাগরণ এবং সঠিক ইসলামী বিপ্লবের পথ রোধ করে এই জালিমগণ তাদের প্রভুদের খুশী করেছে। ফলে এই সংস্কার কাজ বহু বছর পিছিয়ে পড়েছে। একে একদিন অবশ্যই সফলতার স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করতে হবে। কিন্তু সেই সুদিন আসবে কবে তা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউই জানে না।
ষষ্ঠদশ অধ্যায়
হাতের কঙ্কন দেখতে আর্শির কি প্রয়োজন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন ইখওয়ানের দাওয়াতের যথার্থ অবদান। নাকরাশী পাশার আমলে কুবরী আব্বাসের ঘটনাবলী এবং ছাত্রসমাজের ত্যাগ ও কুরবানী সবই ইখওয়ানের দাওয়াতকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। ইখওয়ানের দাওয়াতের ইতিবাচক ফলাফল অগণিত। কিন্তু আমাদের দেশের লেখকগণ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত এবং একেবারেই চক্ষু বন্ধ করে রয়েছে। বস্তুত ভাবলে আমার বিস্ময়ের অবধি থাকে না, তারা কোথাও আমাদের আলোচনা করেলেও সে আলোচনায় তাদের প্রবৃত্তি, স্বার্থ ও আকাংখার রং ভাল করেই চড়িয়ে দেয়। এসব তথাকথিত সাহিত্যিক গ্রন্থকার এবং ঐতিহাসিকগণ ইখওয়ানের ইতিহাস বিকৃত করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু তারা জানে না যে, এতে তারা সফলকাম হতে পারবেন। তারা পরস্পরের সাহায্যাকারী ও পৃষ্ঠপোষক হলেও এবং সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই ঘৃণিত কাজের উদ্যোগ নিলেও। এই ব্যর্থ উদ্যোগের পশ্চাতে ইসরাঈলের নাপাক হাত ক্রীয়াশীল রয়েছে। অবশ্য কোন কোন সরল প্রাণ লেখক বিষযটি সম্পর্কে একেবারেই অনবহিত। আবার অনেক জ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবি জেনে বুঝেই এ খেদমতে আত্মনিয়োগ করেছে।
ইখওয়ানের বিরুদ্ধে এসব চক্রান্ত এবং তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য মুছে ফেলার সর্বাত্মক দুরভিসন্ধি সত্ত্বেও এই দাওয়াত মর্তের মাটিতে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে শিকড় গজিয়ে ফেলেছৈ। তার শাকা প্রশাখা ও পত্র পল্লব নিঃসীম আকাশের দিগন্তে আন্দোলিত হচ্ছে। তার সঞ্জীবনী ফল সত্যান্বেষীদেরকে সকল ঋতুতেই সরবরাহ করা হচ্ছে। এই বরকত ও কল্যাণময় বৃক্ষ শরৎ, গ্রীষ্ম এবং বসন্ত ও হেমন্তের মুখাপেক্ষী নয়। তা চির যৌবনা। এই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় বৃক্ষের নীচে বাতিলের মরীচিকায় উল্লসিত িএবং জুলুমের ঝলকানীতে দিশেহারা উদ্ভ্রান্ত প্রতিটি যুবক শীলতার পরশ পেয়ে যায়। কোন সংগছন বা দল কোনও উপলক্ষে যদি কোন সভা সমাবেশ করতে চায় এবং জনসধারণকে আমন্ত্রণ জানায় তখন দেখা যায় যে, নগণ্য সংখ্যক লোক সমবেত হয়। পক্ষান্তরে ইখওয়ানের কোন প্রোগ্রাম যদি করতে হয় এবং সরকার যদি তাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে তাহলে হাজার হাজার জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবেতাতে অংশগ্রহণ করে। ইখওয়ানের প্রতি সর্বসাধারণের এই আগ্রহ ও ভালবাসা শুধু এই কারণে যে, তাদের দৃষ্টিতে এই দাওয়াতের মধ্যে সার্বিক কল্যাণ ও মংগল নিহিত। আমরা কোন প্রকার লোভ ও প্রলোভন ছাড়াই জনগণকে শুধুমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তে তারই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আহ্বান জানাই। এ কাজটাই ইসলামের দুশমনদের চক্ষুশূল এবং অন্তর্জালারও কারণ। তারা অত্যাচার উৎপীড়ন, সন্ত্রাস ও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে হকের এই আওয়াজকে স্তব্ধ করে দিতে চায়। কিন্তু জ্বীন ও ইনসান সকলের সম্মিলিত ও যুগপৎ প্রচেষ্টায়ও এ প্রদীপ নির্বাপিত হবার নয়। আল্লাহ তায়ালার অংগীগার রয়েছে যে, তিনি নিজেই তার দ্বীনের হেফাজত ও রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। আর তিনি কখনো তার ওয়াদা পরিপন্থী কোন কাজ করেন না।
রেকর্ড সংশোধনের জন্যে
এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে, অনেক সম্মানিত ব্যক্তিও ইতিহাসের চোখের সামনে সংঘটিত স্বীকৃত ঘটনাবলীকে বিকৃত করে উপস্থাপন করতে কোন প্রকার লজ্জাবোধ করে না। উদাহরণ স্বরূপ শহীদ ইমাম যখন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। তখন নাহাস পাশা তাঁকে ডেকে পাঠান এবং নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বলেন। কেননা মরহুমের ওপর বৃটেনের চাপ ছিল যে, হাসানুল বান্নাকে যে কোনভাবেই হোক নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করতে হবে। ইমাম তো কারো চাপের মুখে নতি স্বীকার করার মত লোক ছিলেন না। এটা সবারই জানা কথা। এমনকি স্বয়ং নাহাস পাশা মরহুমও এ বিষয়ে ছিলেন সম্যক পরিজ্ঞাত। তিনি ইমাম শহীদের নিকট আবেদন জানান যে, আপনি নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবেন না। বিনিময়ে আপনার সংগঠনকে দাওয়াতী কাজ করার জন্য কিছু সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হবে। তিনি ওয়াদা করেন যে, কেন্দ্রীয অফিস, গণমিলনায়তন এবং সর্বত্র গণকেন্দ্র খোলার শুধু অনুমতিই দেয়া হবে না বরং সহযোগিতাও প্রদান করা হবে। এই সাক্ষাতকারের সময় অন্য যেসব লোক উপস্থিত ছিলেন এবং যারা পরবর্তী সময় নাহাস পাশার মৃত্যু ও ইমাম শহীদের শাহাদাতের পর সংবাদপত্রে তাদের সাক্ষাতকার ছাপেন তারা সকল ঘটনাপ্রবাহকে পরিবর্তন পরিবর্ধন করে পেশ করেন। তারা নাহাস পাশার এই অনুরোধ ও আবেদনকে নিদেনকে ধমকের রংগে রাঙ্গিয়ে তোলেন এবং তার মুখে ইমামকে বলিয়ে দেন যে, তিনি যেন ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করা ছেড়ে দেন। অথচ তাদের উত্তমরূপেই জানা রয়েছে যে, এই বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে আলোচনায় স্থান পেয়েছিল। কিন্তু তারপরও নিজেদের আমলনামায় এরূপ “নেকী” লিপিবদ্ধ করানো তারা জরুরী মনে করেছেন যে, হাসানুল বান্নার মত একজন প্রবিত যশা অনমনীয় ব্যক্তিত্বের কীর্তিকলাপকে অপকীর্তির রূপ দান করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে ইমাম কারো লোব দেখানো (উৎসাহ প্রদান) ও ভীতি প্রদর্শনকে কোন আমলই দিতেন না। তাঁকে যখন অবহিত করা হয় যে, তাঁর নির্বাচনে দাঁড়ানোর ফলে দেশের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখিন হয়ে পড়েছে। তখন তিনি তাঁর প্রার্থী পদ প্রত্যাহার করে নেন। ইতিপূর্বেও এই ঘটনা বর্ণনা করেছি।
“এই আন্দোলন আল্লাহর দ্বীন ও রিাসালাত মুহাম্মাদীয় পয়গামকে সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর অনুকূরে রয়েছে আল্লাহ তায়ালার সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা যা অনন্তকাল পর্যন্ত থাকবে অব্যাহত। একে নির্মূলকারীগণ হারিয়ে ফেলবে তাদের অস্তিত্ব এই মর্তের মাটিতে। নানা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র এর আদৌ কোন ক্ষতি করতে পারবে না। বৈরিতা ও বিরোধিতা এর অগ্রযাত্রার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়। ইখওয়ানের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে ক্ষিপ্ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়। ইখওয়ানের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে ক্ষিপ্ত করতে প্রয়াসী ব্যক্তিরা তো শুরু থেকেই আমাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় ও সোচ্চার রয়েছে। আমরা তাদের সামাল দেয়ার দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালার ওপর সমর্পণ করেছি। আমরা সেই সুদিনের প্রতীক্ষায় আছি যখন আমাদের শাসকদের চোখ খুলে যাবে এবং তারা হেদায়াত লাভ করবে যে, তারা আল্লাহর শরীয়ত কার্যকরী করবে। আমরা এ উদ্দেশ্যেই প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছি। তথাপি মানুষের হৃদয় মনে পরিবর্তন আনার ক্ষমতা রয়েছে আল্লাহরই হাতে। তিনি যেভাবে ইচ্ছা মানুষের মন-মানসিকতাকে পরিবর্তন করে দিতে পারেন। জনৈক সৎব্যক্তির এই উক্তি কতই না যথার্থ যে, “মানুষের অন্তরে পরিবর্তন আনতে মাত্র এক মুহূর্ত সময়ের প্রয়োজন।”
শাহ ফারুকের শাসনকালের প্রাথমিক অধ্যায়
আমার খুব ভালভাবে মনে আছে যে, শাহ ফারুক তার যুবরাজ থাকাকালে শান্তিপ্রিয়তা ও নেক চালচলনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি ছিলেন জনসাধারণের ভবিষ্যত আশা ভরসার স্থল। এই জন্যই তিনি ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হলে সারা দেশে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে উৎসব উদযাপন করা হয়। জনগণ ধারণা করেছিলেন যে, এখন থেকে মিসরের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়েল সূচনা হবে এবং ইসলামী আইন ও ইসলামী মূল্যবোধ সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করবে। ইখওয়ানও অত্যন্ত উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে ফারুককে স্বাগত জানায়। কারণ তার কাছ থেকে কল্যাণধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণের প্রত্যাশা করা হচ্ছিল। ইখওয়ানীগণ ফারুকের মনে একথাও বদ্ধমূল করে দিতে চাচ্ছিলো যে, তার আগমনে দেশময় যে আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে তার ইসলাম প্রীতিরই ফল মাত্র। যদি তিনি সঠিক অর্থে ইসলামের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন তাহলে তিনি দেশবাসীর চোখের মণিতে পরিণত হবেন।
ফারুকের শাসনামলের গোড়ার দিকে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাঃ ইউসুফ ইরশাদ ইমাম শহীদের সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে মিলিত হওয়ার জন্য আগমন করেন। এটা একথারই স্বাক্ষর বহন করেছিলো যে, মিসরের ভবিষ্যতে ইসলামের সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে চলেছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারী অদৃশ্য হস্ত এই সময়ও সুগভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে তৎপর হয়ে ওঠে। তারা ফারুকের মনে ইখওয়ান সম্পর্কে প্রভূত সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি করেন যা পর্যায়ক্রমে ভয়ভীতি ও আতঙ্কের রূপ পরিগ্রহ করে। এমনকি বাদশাহ ইখওয়ানকে তার এক নম্বর শত্রু মনে করতে থাকে। তিনি ইখওয়ান বিরোধীদের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে থাকেনএবং মুর্শিদে আ’ম ও ইখওয়ানকে উৎখাত করার সকল চক্রান্ত শুরু হয়ে যায়। শীগ্রই এই গোপন হস্তের ইংগিত ফারুককে একটা নতুন জ ীবনধারায় অভ্যস্ত করে তোলে যা ছিল তার যুবরাজ থাকাকালীন রাজকীয় জীবনধারা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মিসরীয় জনগণ এখন তার প্রতি ভালবাসার পরিবর্তে ঘৃণা প্রকাশ করতে থাকে। ফারুককে বলা হয় যে, হাসানুল বান্না যেখানেই যায় মানুষ তার চারিপাশে পতংগের ন্যায় সমবেত হয়ে থাকে। তিনি কথা বলতে আরম্ভ করলে তারা তার কথাবার্তা এমন মনোযোগ দিয়ে শুনে যেন তাদের মাথার ওপর পাখী বসে রয়েছে। এ ব্যক্তি বড়ই ভয়ংকর ও বিপজ্জনক।...
ইখওয়ানের আদর্শপ্রীতি
আমার মনে আছে ইসরাঈল সাদফীও ইমামের সাথে সাক্ষাত করতে আসতেন। তার এসব সাক্ষাতকারের ব্যবস্থা তার জামাতা ইবরাহীম পাশা করে দিতেন। এটা ছিল সেই সময়ের কথা যখন ইসমাঈল মিষ্টার বেগিনের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন যা সফলতার মুখ দেখতে পায়নি।
নাকরাশী পাশা জাতিসংঘের অধিবেশনে অংশগ্রহণের জন্য গেলে ইখওয়ান তাকে সমর্থন করেন এবং ওয়াফদ পার্টির মন্ত্রীবর্গ কেন্দ্রীয় গণমিলনায়তনে উপস্থিত হন এবং সকলেই ইখওয়ানের প্রশংসায় বক্তব্য পেশ করেন। আহমদ হামযা, ফুয়াদ সিরাজ উদ্দীন, সবরী আবু ইলম ও সোলায়মান গানাম সকলের সমবেত হওয়া বিশেষভাবে মনে পড়ে। অনুরূপভাবে ফারুকের শাসনামলের প্রথম দিকে প্রাথমিক কবি যার নাম এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে না। জনসমাবেশে আসেন এবং ভাষণও প্রদান করেন। অনন্তর ইখওয়ানের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা করা হয় যে, এই সংগঠন দেশ প্রেমিক নয়। এটা অমুকের এজেন্ট অমুকের দোশর ও দালাল। আফসোস! আমরা কি এমন সব লোকের এজেন্ট ছিলাম যারা এই আমলে আমাদের প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। কিছুটা হলেও তো জ্ঞানবুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করা উচিত। প্রকৃত ব্যাপার ছিল এই যে, ইখওয়ানের জনপ্রিয়তা দেখে প্রতিটি ব্যক্তি তাদেরকে নিজেদের সাথে একাত্ম করতে চাচ্ছিলো। কিন্তু ইখওয়ান ছিল একটি আদর্শবাদী দল। তারা তাদের অনুসৃত পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার জন্য কখনো প্রস্তুত ছিল না। ফল এই দাঁঢ়ালো যে, ঐসব ব্যক্তি ও দল তাদের পারস্পরিক মতবিরোধ সত্ত্বেও একটি বিষয়ে ঐক্যমত্য পোষণ করে যে, ইখওয়ানের বিরোধিতা করতে হবে। অতএব আমাদের প্রতি সকলেই ঢিল ছুঁড়তে থাকে, যে প্রক্রিয়া আজও অব্যাহত গতিতে চলছে।
সপ্তদ্বশ অধ্যায়
অদ্ভূত ঘটনাবলীর মধ্যে আমার একটি ঘটনা সংঘটিত হয় ভাই মোস্তফা মু’মিন ইঞ্জিনিয়ারের সাথে। ইস্রাঈলের সাথে ক্যাম্পডেভিট চুক্তি হয়ে যাওয়ার পর তিনি “আদ দাওয়া” সাময়িকীর বর্তমান অফিসে আমার সাথে দেখা করতে আসেন। এই চুক্তি সম্পর্কে আলাপ হতে থাকে। তিনি বলতে লাগলেন ইখওয়ান লজ্জাবোধসহ শান্তিচুক্তির বিরোধিথা করেছে। একথায় আমি ঈষৎ হেসে ফেললাম। আমি বললাম, এই চুক্তির বিরুদ্ধাচরণ করা কি কোন অপমানজনক কাজ যে, তা করতে গিয়ে আমি লজ্জাবোধ করবো? বরং বাস্তবতা কি এই নয় যে, উপরোল্লিখিত ব্যক্তি আমাদের ভূমিকার সমালোচনা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি লজ্জা বোধ করতে থাকেন।
আমার সমালোচনা পদ্ধতি
সত্য কথা হলো, আমি যখন কোন ব্যাপারে সমালোচনা করেছি তখন একটি ঢেকেই তা করেছি। কেননা একদিকে আমি কারো সম্মুখে এমন কোন বিষয় উপস্থাপন করা আদৌ পছন্দ করি না যা সে পছন্দ করে না। অপর দিকে আমিএমন দাবীও কখনো করি নাই যে, আমার মতামতই সঠিক ও নির্ভুল এবং তার বিপরীতে যত বক্তব্যই আসুক না কেন সবই বাতিল। আমি আমার মতের পক্ষে যুক্তি-প্রমাণ পেশ করতাম ঠিকই কিন্তু কখনো কখনো আমি আমার নিজের মতেরও সমালোচনা করতে কসুর করি না। আমি এই বিসয়ে অত্যন্ত পরিতৃপ্ত যে আমার দৃষ্টিভংগী ঈমান আকীদার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। বাকী থাকে এই বিষয়টি যে, আমি নিজেকে সর্বদা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করবো এরূপ মনোভাব আমার কখনো ছিল না। তবে আলআহ ও তাঁর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক হালাল ও হারাম ঘোষিত জিনিস সম্পর্কে আমার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। কারণ, আল্লাহ ও রাসূলের (স) ফায়সালা মুসলমানদের জ ন্য সনদ যা কখনো চ্যালেঞ্জ করা যায় না। এ ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে আমার কর্মনীতি হচ্ছে, আমার মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেনি যে, আলোচনার টেবিলে আমাকেই বিজয় লাভ করতে হবে। আমার আচরণ ইমাম শাফেয়ী (র)-এর ন্যায়। অর্থাৎ তাঁর উক্তি অনুসারে আমিও চাই যে, যার সাথেই আমার আলোচনার সুযোগ হয় তার সামনেই যেন সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। (এটা জ্ঞানের পরিচায়ক যে, সত্য যদি প্রতিপক্ষের কাছে থাকে তাহলে আপনি তার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে সত্যের পতাকা সমুন্নত রাখার পক্ষ অবলম্বন করতে পারেন। পক্ষান্তরে আপনিই যদি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকেন আর অপর পক্ষতা মেনে নিতে না চায় তাহলে তার ওপর তা চাপিয়ে দিতে পারেন না।)
দাওয়াতে হক ব্যতীত অন্য কোন বিষয়ে কথাবার্তা বলা ও আলাপ আলোচনা করার প্রতি আমার তেমন কোন আকর্ষণই নেই। আর এটাই ইখওয়ানের কর্মপদ্ধতি।
গন্তব্যে তারাই গিয়ে উপনীত হয়েছে যারা সফরে অংশগ্রহণ করেনি
ইখওয়ানুল মুসলিমুন ও আবদুন নাসেরের মধ্যে যত মতানৈক্যই হয়েছে তা পারস্পরিক বুঝা পড়ার মাধ্যমে অবশ্যই দূর করা যেতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা ছিল এই যে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গৃহীত হতো এবং নেপথ্যে থেকে তার পরিচালনাকারী ছিল। বিপ্লবের পূর্বে আমেরিকার রাষ্ট্রদূতগণকে নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন যে, কোন বিদেশী শক্তি অথবা মিসরে বসবাসরত বিদেশী কোন নাগরিক এই অভ্যুত্থানের লক্ষ্যবস্তু হবে না। আমরা আমেরিকা ও তার কূটনৈতিক মিশনের সদস্যদের খুব ভাল করেই জানি যে, তাদের উদ্দেশ্য কেমন হয়ে থাকে এবং কোন প্রকৃতির লোকদের সাথে তাদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বিপ্লব সংঘটিত হলে জানা গেলো নাসেরের লক্ষ্য ছিল ইখওয়ানকে নির্মূল করা। সে এক এক করে সঙ্গী-সাথীদের থেকে নিজেকে মুক্ত করে এবং অবশেষে একনায়কসুলভ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ করার আকাংখা তার অন্তরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। সে ইখওয়ানকে তার পথের একমাত্র প্রতিবন্ধক মনে করতে থাকে। আপন বন্ধুদের মধ্যে সর্বপ্রথম সে ইউসুফ সাদিককে শিকার করে। অথচ বিপ্লবের রাতে ইউসুফ সাদিকই সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন।
অভ্যুত্থাতেনর রাতে জামাল আবদুন নাসের ও আবদুল হাকিম আমের উভয়েই বেসামরিক পোশাক পরিহিত ছিল। তারা কোন এক গোপন স্থানে ছিল যা কারো জানা ছিল না। সেই রাতে সাদাত এক সিনেমা হলে ফিল্ম দেখছিলেন। যেহেতু বিপ্লবের কথা অবশ্য তার জানা ছিল কিন্তু সফলতার ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা ছিল না। এই জন্য সিনেমা হলেই কোন একজনের সাথে মিথ্যা ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে পড়েন এবং পুলিশ স্টেশনে রিপোর্ট করার জন্য চলে যান। যাতে বিপ্লবের সাথে সম্পর্কিত কার্যকলাপের সাথে তার কোন প্রকার সম্পর্ক না থাকার কথা তিনি সহজেই প্রমাণ করতে পারেন। তিনিও বেসামরিক-পোশাক পরিধান করেছিলেন।
নাসেরের সর্প স্বভাব ব্যক্তিত্ব
স্ত্রী সাপ যেভাবে তার বাচ্চাদেরকে এক এক করে খেয়ে ফেলে। কোন সৌভাগ্যবানই কেবল তার গ্রাস থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। অনুরূপ নাসের সাহেবও তার সংগী সাথীদেরকে এক এক করে গলধকরণ করে ফেলে। নাসেরের দ্বিতীয় লক্ষ্যবস্তু ছিল মুহাম্মাদ নাজীব। তারপরই একের পর এক খালেদ মুহীউদ্দীন, বাগদাদী, যাকারিয়া হাসান ইবরাহীম ও কামালুদ্দীন হোসাইন প্রমুখ সকলেই প্রতিশোধের শিকারে পরিণত হয়। তার বিষাক্ত ছোবল থেকে কেবলমাত্র সেই রক্ষা পেয়েছে যে তার পদতলে আত্মসমর্পণ করে তাকে এই মর্মে আশ্বাস প্রদান করেছে যে, তার পূর্ণ আনুগত্য করতে ও বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে কখনো কসুর করবে না।
ইখওয়ানের ভূমিকা সম্পর্কে তো মোটামুটি সকলেরই জানা ছিল। তাদের ওপরও যুগের জঘন্যতম একনায়কের হাত তোলা বোধগম্য হয়। কিন্তু নাসেরের প্রচণ্ড আক্রমণ থেকে আযহার শরীফের ন্যায় একটি অক্ষতিকর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও রক্ষা পায়নি। আল আযহারের শেখ জনাব আল খিদির হোসাইন দ্বীনের বুনিয়াদী শিক্ষা ও নির্দেশাবলীর একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। নাসেরের জন্য তা ছিল অসহনীয়। সম্মানিত শেখের ওপরও তিনি চাপ প্রয়োগ করতে আরম্ভ করেন এবং আল আযহারের কর্তৃত্ব গ্রহণর কয়েক মাস পরই তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। তাঁর স্থলে নতুন শেখ নিযুক্ত হন স্থায়ী রোগ ব্যধি ও বার্ধক্য তাকে কোন কাজের উপযুক্ত রাখেনি। তিনি চিলেন নাসেরের গুণগ্রাহীদের অন্যতম। এই গুণাবলীর ভিত্তিতেই তাকে এই গুরু দায়িত্বের জন্য নির্বাচিত করা হয়।
এই শেখ সাহেবকে আল্লাহ তায়ালা মাফ করুন। তিনি নাসের সম্পর্কে এমন উক্তিও করেছেন যে, এই নওজোয়ানকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ইলহাম প্রদান করা হয়েছে। তিনি তার সকল দুশমনের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবেন।
নাসের ঔদ্ধত্য ও দাম্ভিকতার পথ অবলম্বন করে এবং এতদূর গিয়ে উপনীত হয় যে, সাধারণ সভা সমাবেশে তাঁর মন্ত্রী প্রবরদেরকে মুজরিদান নামে সম্বোধন করতো। তাদের সাথে তার আচরণ ছিল এমন য, তারা যেন তার ব্যক্তিগত সেবাদাস। এরূপ আত্মগর্বী কর্মনীতি সাদাত ও তার আমলের শেষের দিকে অবলম্বন করেছিল। আমার কাছে তো এই বিষয়টি বিস্ময়করই মনে হতো যে, এই মন্ত্রীরা কেমন করে এই স্বৈরাচারের কর্তৃত্ব মেনে চলছিলো। বৃটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার শাসনকর্তারা তাদরে মন্ত্রীদেরকে সম্মানেসর সাথে সম্বোধন করেন। যেমন তারা কোন মন্ত্রীকে আহ্বান করতে গিয়ে মিষ্টার মুঁসিও কিংবা সিনেবার শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। আমাদের শাসকগোষ্ঠীর এরূপ কর্মপদ্ধতির কোন সংগত কারণ হয়ত থেকে থাকবে? মনস্তত্ব বিশারদ ও সমাজ বিজ্ঞানীগণ কি এর কোন কারণ র্দিশ করতে পারবেন? আসল কথা হচ্ছে আমি নিজে এর কোন কারণ জানি না। অতএব এটাই উত্তম হবে যে, যা আমার জানা নেই তা আমাকে জেনে নিতে হবে। অন্যথায় আমার পক্ষ থেকে িএমন সব কথা প্রকাশ পাবে যার কারণে কিছু মানুষ নারাজ হয়ে পড়বে। বস্তুত মনস্তত্ববিদগণই মানসিক রোগীদের ব্যাপারে অধিকতর ওয়াকিফহাল।
গুজবে কান দেয়া বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়
অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রের শাসকদের দৃষ্টিভংগী ইখওয়ান সম্পর্কে মোটেই ভাল নয়। এর কারণ ইখওয়ান সম্পর্কে তাদের সামনে যেসব রিপোর্ট আসে তাতে তাদের সম্পর্কে ভয়ঙ্কর ধারণা দেয়া হয়। তাকে এমন সন্ত্রাসবাদী সংগঠণ বলে আখ্যায়িত করা হয়। যার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যে কোন প্রকার সন্ত্রাস ও শক্তি ব্যবহার করতে সদা প্রস্তুত। এর সমর্থনে যুক্তি হিসেবে তারা ইকাদের ঘটনা পেশ করে থাকে। এতে আমাদের কিছু সরলপ্রঅণ যুবক বল প্রয়োগের জবাবে বল প্রয়োগের নীতি অবলম্বন করে তাকে। এই কর্মপদ্ধতিতে ন্যায় ও সত্যের আন্দোলনের কোন লাভ হয়নি বরং ক্ষতি হয়েছে। এই দায়িত্বশীল ও কর্তাব্যক্তিগণকে আল্লাহ তায়ালা যদি কিছু বুদ্ধি-বিবেচনা ও কান্ডজ্ঞান দিয়ে থাকেন তাহলে তাদের একটু চিন্তা-ভাবনা করা উচিত যে, শোনা কথার ওপর আমল করার পরিবর্ত তারা সরাসরি ইখওয়ানের সাথে যোগাযোগ করে প্রকৃত সত্য জেনে নেয়ার উদ্যোগ কেন গ্রহণ করে না?
ইখওয়ানের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ সঠিক তথ্য লাভ করতে পারেন এবং এতে নিশ্চিতভাবেই দেশ ও জাতির কল্যাণ আসতে পারে এবং বিদ্যমান বেদনাদায়ক পরিস্থিতির প্রতিকার হতে পারে। এরূপ মহতী উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তারা উদ্যোগী হয় না। অথচ এতে তাদের কোন লোকসানের ভয় নেই। ইখওয়ানুল মুসলিমুন তো অন্তরের অন্তস্থল থেকেই এই প্রত্যাশা করে যে, মুসলিম শাসকগণ তাদের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে যাক। এবং দ্বীনি পয়গাম মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়ার মহতী কাজে তাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করুক। যাতে এই বুনিয়াদী ফরজ উত্তমরূপে আদায় হতে পারে। তারা যদি একান্তই সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারিত করতে না পারে তাহলে অন্ততপক্ষে বাধার প্রাচীর দাঁড় করাতে যেন ব্রতী না হয়। আমাদেরকে আমাদের ব্যবস্থার ওপরই যেন ছেড়ে দেয়।
আমি বলছিনা যে, আমরা আজ থেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার ঘোষণা করছি বরং এই দাওয়াতী তৎপরতার প্রথম দিন থেকে এটাই আমাদের ভূমিকা এবং ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের লিখিত ইসলামী সাহিত্যগুলো এই দাবীর সত্যতার প্রমাণ দিয়ে থাকে। ইমাম শহীদ আন্তরিকতা ও ঐকান্তিক নিষ্ঠার সাথে প্রত্যেকের নিকট দাওয়াত পৌঁছাতেন। কিন্তু যারা এই দাওয়াতের বিরোধিতা করে তাদের কারো ব্যাপারে তিনি কখনো ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স)-এর দাওয়াত নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ লোকেরা তো মহব্বতের পয়গামই বন্টন করে থাকে। যারা তাদের দিকে অগ্রসর হয়ে থাকে তারা তাদেরকে বুকে তুলে নেয়। আর যারা তাদের থেকে দূরে থাকে তাদের জন্য প্রাণ খুলে হিদায়াতের দোয়া করতে থাকে। এই বিশ্বস্ত অনুরাগীর দল কারো বিরুদ্ধে কখনো কোন ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করে না। এমনকি যারা তাদের সাথে কোন অশালীন ও অমার্জিত ব্যবহার করে কিংবা তাদের কষ্ট দেয় অথবা তাদেরকে হত্যা করেতারা তাদের সকলের কল্যাণের জন্যই দোয়া করতে থাকে। তারা ভাল করেই জানে যে, এসব দুঃখ মুসিবত তারা আল্লাহর পথেই বরণ করছে এবং এর বিনিময়ও তারা তার নিকট থেকে পেয়ে যাবে।
মাথা উলংগ অথচ পায়ে মাথার রাজমুকুট
ইখওয়ানুল মুসলিমুনের নওজোয়ানগণ সুয়েজের তীরে এবং অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসলামী জিহাদে অংশগ্রহণ করে এবং নিজেদের বুকের তপ্ত লহু ঢেলে ধরিত্রির তৃষ্ণা নিবারণ করে তাতে এ সত্য সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, মুসলিমসমাজে আজও এমন লোক রয়েছে যারা তাদের মর্যাদার নিরাপত্তা বিধান করতে পারেন। ইসলামের শত্রুরা একথা বুঝতে পারে যে, যে জাতিকে তারা ভীরু কাপুরুষ বলে মনে করতো তাদের মধ্যে ত্যাগ স্বীকার করার মত প্রেরণাদীপ্ত লোক এখনো রয়েছে। ইখওয়ানের কোন কোন বন্ধুবান্ধব এরূপ প্রকাশ্য শক্তির মহড়া প্রদর্শন করা পছন্দ করেনি। তাদের ভূমিকা ছিল এই যে, এভাবে শক্তির প্রদর্শনী ছিল হিকমাত, বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার পরিপন্থী। কেননা এতে আন্দোলনের শত্রুগণ এখন থেকেই সতর্ক হয়ে উঠবে। মোটকথা তরংগের আঘাতে জর্জরিত ব্যক্তিও উপকূল থেকে দর্শনকারী লোক কখনো সমান হতে পারে না। এ সময় পরিস্থিতির দাবীই ছিল এই যে, ইখওয়ান নির্বিকার বসে থাকতে পারে না। এটা ছিল কাজের সময় কামান থেকে বেরিয়ে যাওয়া তীর কখনো ফিরে আসে না। আমদের সেই সমস্ত ভক্ত অনুরক্ত যারা বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার শিকার ছিলেন তাদের আপত্তি ছিল শুধুমাত্র তত্বগত। আমি িএররূপ মন্তব্য করছি কয়েকটি কারণে:
১-মিসরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারী সংগঠনের শরীর চর্চা টীম বর্তমান ছিল। স্কাউটিং ও অন্যান্য প্রশিক্ষণমূলক প্রোগ্রাম আইনগতভাবে বৈধ ছিল। ইখওয়ানের জন্য আত্মিক ও দৈহিক প্রশিক্ষণের চিন্তা করা জরুরী ছিল। ইখওয়ান কোন গোপন সংগঠন ছিল না। এর সমস্ত কর্মতৎপরতা প্রকাশ্য দিবালোকে জনসমক্ষে হতো। ট্রেনিংক্যাম্প, ভ্রমণটীম বিভিন্ন প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচী সবকিছুই তখন আইনের দৃষ্টিতে অনুমোদিত ছিল। বিভিন্ন টীম তাদের মান উন্নত করার জন্য পরস্পর প্রতিযোগিতামূলকভাবে অংশগ্রহণ করতো। অধিকন্তু এই সমস্ত কর্মসূচী গোপনে নয় বরং খোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত হতো। পরবর্তী সময়ে সরকার যখন এসব কর্মসূচীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ শুরু করে তখন তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আবার এই বিধিনিষেধও ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি। ইখওয়ানের ভ্রমণটীমকে মিসরের ভেতরে ও বাইরে অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হতো এবং দাওয়াত সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এসব টীম কার্যত খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো।
২-দাওয়াত ইলাল্লাহ বা আল্লাহর পথে আহবান এমন একটা কাজ যা প্রকাশ্যে ও খোলামেলাভাবে করা উচিত। যাতে সর্বসাধারণ তা জানার ও বুঝার সুযোগ লাভ করতে পারে এবং একে গ্রহণ করতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো ওকাজ ও যুলমাজান্না মেলায় গিয়ে উপস্থিত হতেন এবং প্রকাশ্যে ঘোষণা করতেন এখানে কি এমন কোন ব্যক্তি নেই যে আমার সাহায্যের জন্য দাঁড়াতে পারে যাতে আমি আল্লাহর পয়গাম মানুষের নিকট পৌঁছে দিতে পারি। অনন্তর দাওয়াতে হকের এই আহ্বান যে সমস্ত মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং তাদের স্বীকৃতি লাভ করে এবং অধিকাংশ মুসলিম এদিকে ছুটে এস তখনো কি মানুষের নিকট আমরা বলবো: আমাদের দিকে আসবে না আমাদের কথায় কর্ণপাত করবে না কিংবা আমাদের থেকে দূরে থাকো। সত্যের পথে আহ্বানকারীদের জন্য এটা খুবই খুশীল কথা যে, মানুষ তাদের দাওয়াতে সাড়া দেবে। আমরা কখনো শক্তির মহড়া দেইনি এবং প্রদর্শনীও করিনি। আর কখনো গায়ের জোরে কাউকে অবদমিত করতেও চেষ্টা করিনি। কিন্তু দাওয়াতে হক যখন শিকড় মজবুতভাবে গেড়ে বসলো এবং আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহে ফলদায়ক হয়ে উঠলো তখন আপনা থেকেই তার শাক্তিমত্তা প্রকাশ পেতে থাকলো। এটা কোন প্রকার কৃত্রিমতা ছিল না বরং ছিল স্বাভাবিক প্রকাশ।
৩-ইহুদীরা ফিলিস্তিন ভূখন্ডে উড়ে এসে জুড়ে বসে এবং ইংরেজরা তাদেরকে মুসলিমদের ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে দেয়। মযলুম ফিলিস্তিনী মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইহুদীবাদীরা অত্যন্ত জঘণ্য অপরাধ করে চলেছে। বিরাজমান এই বেদানাদায়ক পরিস্থিতির সামনে সমগ্র দুনিয়া মুসলিম সরকার ও জনগণ এমন বেপরোয়া ও উদাসীন কর্মনীতি গ্রহণ করেছে যে সে সম্পর্কে চিন্তা করলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। তবে হ্যাঁ, নিষ্ফল প্রতিবাদ এবং বৃথা শ্লোগানের তোড়জোড় প্রায়শঃই দেখা যায়। এসব বিক্ষোভ মিছিল দ্বারা ফিলিস্তিনবাসীরা কিছুই লাভ করেনি। অবশ্য তাতে তাদেরকে অত্যন্ত নির্মমবাবে হত্যা করার অবাধ সুযোগ ইহুদীরা লাভ করেছে ঠিকই। শরীয়ত ও নৈতিক দিক থেকে ইখওয়ানের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় যে, ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিকে ইহুদীদের নাপাক থাবা থেকে মুক্ত করা। মুসলিমগণ যখন সামষ্টিকভাবে এই ফরজে কেফায়া আদায় করতে অপারগ। তখন ইখওয়ানই সম্মুখে অগ্রসর হয়ে এই গুরুদায়িত্ব আঞ্জাম দিতে ব্রতী হয়। এভাবে তারা গোটা উম্মাতের মাথার ওপর থেকে একটা গুনাহের বোঝা নামিয়ে দেয়। এর পুরস্কার ইখওয়ানগণ এভাবে লাভ করে যে নাকরাশী পাশা মরহুমের মন্ত্রী পরিষদ তাদেরকে জিহাদের ময়দান থেকে ডেকে পাঠিয়ে কারা অভ্যন্তরে পাঠিয়ে দেয়। নাকরাশী পাশার এই আচরণের ওপর আপনি কি মন্তব্য করবেন? তিনি কি ইহুদীদের এজেন্ট ছিলেন? নাকি তিনি মুসলিমদের বিরুদ্ধে সুগভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন যে, এরা ফিলিস্তিনের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য ইহুদীদের সাথে কেন প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে?
৪-এই সময় অবশ্য কর্তব্য ছিল সমস্ত দুনিয়াবাসীকে একথা জানিয়ে দেয়া যে, যে ইসলামকে তারা মৃত মনে করে তা আসলে মৃত নয় বরং জীবিত। আর ইসলামের সন্তানগণ অপমান ও লাঞ্ছনা এবং তাদের রাসূল ও দ্বীনের অসম্মান কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। ইসলামের স্বার্থে তারা তাদের জানমাল ও পরিবার পরিজন সবকিছুই কুরবানী করতে পারে।
৫-ঐ সময় ইহুদীদেরকে এই শিক্ষা দেয়া অত্যাবশ্যক ছিল যে, ফিলিস্তিনকে তারা যেন তাদের মুখের গ্রাস মনে না করে যা কোন প্রকার বাধা বিপত্তি ছাড়াই গলধ-করণ করা তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। এটা তাদের গলায় কাঁটা হয়েও বিদ্ধ হতে পারে।
৬-ইসলামের অনুসারীরা সুদিন ও দুর্দিন সকল অবস্থায়ই দুশমনদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। ইসলামের বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্র হয়ে এসেছে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। ইসলামের বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্র হয়ে এসেছে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। মুসলিমদের এ সামর্থ আছে যে, তারা তাদের অন্তরে আকীদার প্রভাব প্রমাণ করবে। যেহেতু তারা বস্তুগতভাবে দুর্বল। ক্রুসেড যুদ্ধ এবং তাতারদের অভিযানের মুখে তারা সে ক্ষমতা দ্বারা ইংরেজদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে প্রদর্শন করেছে। মুসিলম উম্মাহ আজ অধোপতিত অবস্থায় কালাতিপাত করছে। তা সত্ত্বেও তাদের বীরত্বের ব্যাপারে আমরা কখনো নিরাশ নই।
৭-হোদাইবিয়ার সন্ধির পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম যষন ওমরাহ পালনের জন্য মক্কায় আগমন করেন তখন তিনি সাহাবাদেরকে শক্তি মহড়া প্রদর্শন করার জন্য উৎসাহিত করেন।যদিও কিছু লোক অসুস্থ্যতার কারণে শারীরিকতভাবে দুর্বল ছিলেন। হাদীস বর্ণনাকারীগণ এই প্রসংগে যে সমস্ত বর্ণনা উপাস্থাপন করেছেন তার ভাষা ছিল নিম্নরূপ: “আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির প্রতি রহম করুন যিনি আজ তার শারীরিক শক্তি ইসলামের দুশমনদের সম্মুখে প্রদর্শন করে দেখাবে।”
৮-সিদ্ধান্তকর সময়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন এবং বীরত্ব প্রদর্শন খুবই জরুরী হয়ে থাকে। এই সময় আমাদের গৃহীত ভূমিকায় সরকারের একটা উত্তম আস্থা লাভ হয়েছিল যে, তারা ইহুদীদের মোকাবিলা করতে সক্ষম। নাকরাশীর দুর্ভাগ্যের প্রতি লক্ষ্য করুন যে, এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগানোর পরিবর্ত সে উল্টো ইখওয়ানকেই তার লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করে। সে ইহুদীদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকে। পরবর্তী সময়ে সংঘটিত সমস্ত বিপর্যয় বিপত্তির মূলে নাকরাশী পাশার সেই ভুলই ছিল দায়ী। তার কাছে বাহুবল না থাকলেও অন্তত ইখওয়ানকে জিহাদের ময়দানে কাজ করে যাওয়ার সুযোগ দিতে পারতো। তারপর আপনারা দেখতে পেতেন যে, ইতিহাসের গতি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়েছে।
অষ্টাদশ অধ্যায়
বহুশক্তি ইখওয়ানকে তাদের সংগঠনের নাম পরিবর্তনের ব্যাপারে সম্মত করতে প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এ জন্য এমন কিছু যুক্তি পেশ করা হয়েছে যে, কিছু সংখ্যক ইখওয়ান তা করতেও প্রস্তুত ছিল। কিন্তু অধিকাংশ ইখওয়ানী এ ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছে। সমর্থকদের যুক্তি ছিল, যেহেতু সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে যে, নাম পরিবর্তনের পর ইখওয়ান স্বাধীনভাবে দাওয়াতী তৎপরতা চালিয়েযেতে পারবে। তাই নাম পরিবর্তনে ক্ষতি কি? কিন্তু নাম পরিবর্তনের সত্যিই ক্ষতি ছিল। যেমন:
১-এই প্রস্তাব উত্থাপন যখন ইখওয়ানুল মুসলিমুনের অবাধ তৎপরতার সুযোগ প্রদানের ওয়াদা করেছেন তখন নাম পরিবর্তনের কি অর্থ থাকতে পারে? স্বীয় অবস্থানের ওপর অবিচল থেকে কেবলমাত্র নাম পরিবর্তন করে আমরা কি সেইসব লোকদেরকে সান্ত্বনা দিতে পারবো এই কাজের বিরোধী। প্রকৃতপক্ষে নাম পরিবর্তনের দাবী আন্দোলনের দুশমনদের প্রথম অপপ্রয়াস ও দূরভিসন্ধি। এর পরই পর্যায়ক্রমে অন্যান্যস্তর অতিক্রম করা তাদের উদ্দেশ্য। প্রতারক, চরিত্রহীন ও লম্পট রাজনীতিবিদদের কর্মনীতি ও তৎপরতা এমনই হয়ে থাকে।
২-এ নাম তো কুরআন মজীদ থেকে গৃহীত। কুরআন ঘোষণা করছে (আরবী*****) (নিশ্চয়েই মু’মিনগণ পরস্পরের ভাই)” –তাইতো আমাদের পরিচয় ইখওয়ান (আরবী*******) “আর তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যু বরণ করো না।” অথচ আল্লাহর শোকর যে আমরা সকলেই মুসলিম। অতএব আমরা সকলেই ইখওয়ানুল মুসরিমুন।
৩-এ নাম গোটা মুসলিম জাহানে পরিচয় লাভ করেছে এবং মুসলিম চিন্তাবিদও নেতৃস্থানীয় ইসলামী ব্যক্তিগণ একে বিশ্বস্ত ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। ফলে মুসলিম রাষ্ট্রেই আমাদের ভাইয়েরা এই সংগঠনের ঢংয়ে ইকামাতে দ্বীনের জন্য সুসংগঠিত হয়ে গেছে। মনে করুন ইখওয়ান যদি মিসরে তাদের সংগঠনের নাম পরিবর্তন করতে সম্মত হয়ও তাহলে অন্যান্য আরব রাষ্ট্র পশ্চিমা দেশসমূহে এর কি প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হবে? নাম বদল করার ফলে বিভিন্ন দেশে আমাদের সুসংগঠিত আন্দোলন বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়ে পড়বে। আর আমরাদের দুশমনরা ঐকান্তিকভাবে এটাই চায়। তারা অনেক দুর থেকে এই উদ্দেশ্য হাসিলের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু সফলকাম হতে পারেনি। এখন তারা ভেতর থেকে এই লক্ষ্য অর্জন করতে মেতে উঠেছে। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কোন নিবেদিত প্রাণ কর্মী কি তাদের এই অভিলাষের সামনে মাথা নত করতে পারে?
৪-বিংশ শতাব্দীর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বসমূহের মধ্যে ইমাম হাসানুল বান্নার নাম সমধিক উল্লেখযোগ্য। ইখওয়ান এই অনুভূতি ও সচেতনতার সাথেই তার হাতে বাইয়াত করেন যে, তারা ইসলামী পুনর্জাগরণে ও রেঁনেসা আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হতে যাচ্ছে। ইসলামের পুত-পবিত্র বিধি-বিধানকে কিছু সংখ্যক লোক নির্মূল করতে চায় এবং তার দ্বীপ্তি নির্বাচিত করে ফেলার জন্য ফুঁৎকার দিচ্ছে। কিন্তু এই অশুভ উদ্দেশ্য লাভের ক্ষেত্রে তারা কোন দিন সফলতার মুখ দেখবে না। ইখওয়ান ইমাম শহীদের হাতে এই মর্মে বাইয়াত গ্রহণ করেছিলেন যে, তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমুনের মুর্শিদে আ’ম। তার ইনতিকালের পর কি করে এই বাইয়অতের বিরুদ্ধাচরণ করা যেতে পারে? কোন মুসলিমের দ্বারা এমন কাজ হতে পারে না যে, তার অংগীকার ভংগ করবে এবং অবিশ্বস্ততার পরিচয় দেবে। ইমাম শহীদ আমাদেরকে যে নীতি পদ্ধতির ওপর রেখে তিনি তার রবের রাস্তায় শাহাদাতের মর্যাদায় অভিষিক্ত হন সেইপন্থা ও প্রক্রিয়াতে আমরা কিভাবে পরিবর্তন সাধন করতে পারি?
৫-ইখওয়ানুল মুসলিমুনের আন্দোলন অন্যান্য ইসলামী সংগঠন থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী। এটা শুধুমাত্র একটি দলই নয় বরং প্রশিক্ষণ স্কুল ও আন্দোলন। এখানে ইসলামের পূর্ণাংগ বিধান শিক্ষা দেয়া হয়। এমন কতিপয় সাথী যারা আন্দোলন ত্যাগ করে চলে গেছে এবং নিজেরা অন্য নামে পৃথক দল গঠন করেছে। ইতিহাস এই ফায়সালা দিয়ে রেখেছে যে, তারা তাদের পৃথক সত্তা নিয়ে কোথাও টিকে থাকতে ও আত্মরক্ষা করতে পারেনি। কতিপয় বন্ধু যারা আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে তারাও এই নামের মাহাত্ম উপলব্ধি করে আজও নিজেদেরকে ইখওয়ানুল মুসলিমুন নামেই পরিচয় দিয়ে থাকে।
৬-মুসলিম জাহানে বহু আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এটা আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানী যে, অন্য কোন সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমুনের ন্যায় সমগ্র বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। ইসলাম বৈরী শক্তিগুলো এই আন্দোলনকে সমূলে বিনাশ করার জন্য যত বেশী শক্তি প্রয়োগ করেছে তার দৃষ্টান্ত অন্য কোথাও পরিলক্ষিত হয় না। এত কিছু করা সত্ত্বেও ইখওয়ানকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা সম্ভব হয়নি। তারা অনেক বাধা বিপত্তি ও কণ্টাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছে। ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলোর কাছে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের অস্তিত্ব আজও আতঙ্কের কারণ। এই শতাব্দিতে হাসানুল বান্নাই ছিলেন সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলামী দাওয়াতের ইতিহাস ইলমকে আমলে রূপায়িত করেন। এমনকি ইসলামকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়িত করার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি যে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাই ছিল ইখওয়ানুল মুসলিমুন।
৭-এই আন্দোলন শত সহস্র শহীদানের আত্মত্যাগ ও কুরবানীর নজরানা পেশ করেছে। শাহাদাতের এই মিছিলের সর্বেোগ্র ছিলেন এই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাত নিজে। এসব শহীদ এই জ্ঞান গর্ব, আমলী ও প্রকৃত নামের পশ্চাতে নিজেদের জীবনে নজরানা পেশ করেছেন। তাদের চলে যাবার পর এই নামকে যা এই সালফে সালেহীনগণ তাদের রক্ত দিয়ে লিখে গেছেন পরিবর্তন করা কোন ভাল কাজ হতে পারে না।
৮-ইসলামী দাওয়াতের মধ্যে কোন কোন বিষয় উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম এর মর্যাদা রাখে। ইসলামের প্রথম যুগেও আমরা দেখতে পাই যে, বাইয়াতে রেদওয়ানে অংশগ্রহণকারী এবং বদরযুদ্ধে শরীক সাহাবাদের সম্মান ও মর্যাদা ছিল সর্বাধিক। ইখওয়ানর জন্যও জরুরী যে, মুখের জোরে যারা গাজী সেজে বসেছে তাদের পশ্চাতে চলার পরিবর্তে নিজেদের পরিচয় ও কৃতিত্বের হেফাযত করবে। আমাদের অমংগলকামীদের সকল তৎপরতা নিঃশেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের দল ও তার নাম পবিত্রতা ও মহত্বের সাথে আজও বর্তমান। এই নাম আমাদের ইতিহাসের আমানতদার।
৯-ইসলামের নিজের বৈশিষ্ট রূপ ও পরিচয় আছে। এবং তার রুকনসমূহের জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট শব্দাবলী। এসব শব্দাবলীও অর্থহীন নয় বরং এগুলো বাস্তবতার পরিচয়বাহী। ইসলামের একটা হচ্ছে বুনিয়াদ বা ভিত্তি আর অপরটা হচ্ছে ইমারত। একদিকে রয়েছে চিন্তা অপরদিকে রয়েছে বাহ্যিক রূপ ও আকৃতি, যেমন বুনিয়াদ হচ্ছে: িএক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদাত ও আনুগত্য করা এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা। ইবাদাতের মুল প্রাণসত্তা হচ্ছে নিয়াত-আর নিয়াতের সম্পর্ক অন্তরের সাথে। নিয়াত যদি বিশুদ্ধ হয় এবং যথাযথ পন্থায় ইবাদাত করা হয় তাহলে সেই ইবাদত আল্লাহ তায়ালার নিকট গ্রহণযোগ্য। যে ব্যক্তি ওজর চাড়াই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স)-এর প্রদর্শিত সালাত আদায় করে না সে অমুসলিম। যদিও সে দিবারাত্র মনগড়া পন্থায় সালাত আদায় করতে থাকে।
ইখওয়ানুল মুসলিমুনের নামও এই আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। যা তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রতিনিধিত্ব করছে। এই নামের যৌক্তিকতা ও তাৎপর্য লক্ষ্য করে অগণিত লোক এই দাওয়াতের সাথে সম্পৃক্ত। এই নাম পরিবর্তন করার সকল প্রকার উদ্যোগ আয়োজন এসব বাস্তবতা বদলে দেবারই নামন্তর। এসব এখন পাহাড়ের ন্যায় অনড় এবং বলিষ্ঠভাবে বদ্ধমূল হয়ে গেছে। নাম বদলে ফেললে বহু সংখ্যক মর্মার্থেরও বিলুপ্তির সম্ভাবনা ও আশংকা রয়েছে। সর্বোপরি নাম পরিবর্তন করার প্রয়োজনই বা কি? আমরা কি আল্লাহর পথের ইখওয়ান নই? আমরা কি মুসলিম নই? এই পুত-পবিত্র নামের সাথে কার কি স্বার্থ জড়িত আছে? এমন নয় তো যে, কিছু লোক আমাদর মুসরিম হওয়া এবং ইখওয়ান হওয়াকে আদৌ পছন্দ করে না? গোটা দুনিয়াও যদি আমাদের সাথে এই বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয় তথাপি আমরা এই নাম পরিত্যাগ করবো না।
আমরা কখনো এমন কথা বলিনি যে, শুধু আমরাই মুসলমান। আমরা ছাড়া আর কেউ মুসলমান নয়। আমরা কোন দিন সগীরা এমনকি কবিরা গোনায় লিপ্ত মানুষকে কাফের বলিনি। আমরা সহযোগিতা প্রদান করতেও কখনো অস্বীকার করিনি। যখনই আল্লাহর কোন বান্দাহ আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়াত বাস্তবায়িত করার আহ্বান জানিয়েছে আমরা তাদেরকে সহযোগিতা দান করেছি। তাহলে নাম পরিবর্তনের আসল উদ্দেশ্য কি? হে আল্লাহ! তুমিই উত্তমরূপে জান যে, আমরা তোমারই ভালবাসা, তোমার পথে জিহাদ ও চূড়ান্ত সংগ্রাম সাধনা এবং তোমার দ্বীনের স্বার্থেই পারস্পরিক সম্প্রীতি সৌহার্দ ও বৌভ্রাতৃত্বের জন্যই এই নামকে মজবুতভাবে ধারণ করে আছি। আমরা আমাদের মুর্শিদের পবিত্রতা বর্ণনা করি না। হে আল্লাহ! আমরা তোমার নবী ব্যতীত আর কারো নেতৃত্ব ও অভিভাবকত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত নই। অতএব হে আল্লাহ! তুমি আমাদের ঈমানের হেফাজত করো, আর তোমার সার্বিক সাহায্যের হাত আমাদের জন্য প্রসারিত করে দাও। তুমি ব্যতীত নিশ্চিতই আর কোন উপকারী নেই। সকল প্রকার সাহায্য ও বিজয় শুধু মাত্র তোমার পক্ষ থেকেই লাভ করা যেতে পারে।
১০-সমস্ত বিশ্ববাসী জানে যে, এই নামেই ইখওয়ানের অন্তরে পরস্পরের প্রতি অকৃত্রিম বালবাসা সৃষ্টি হয়েছে। তারা তাদের ভাইদেরকে নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। এই নামের পতাকা উত্তোলন করে ইখওয়ান আল্লাহর পথে শহীদ হয়েছে এবং শহীদি কাফেলার খুন এক জন থেকে অন্য জনের ধমনীতে সঞ্চারিত হয়েছে। যে নাম পরিচয় তাদেরকে শাহাদাতের গৌরবোজ্জ্বল মর্যাদা প্রদান করেছে সেই নামকে আমরা কি করে মুছে ফেলতে পারি?
১১-ইখওয়ানের উজ্জ্বল ও দীপ্তিমান সুদীর্ঘ ইতিহাস ইখওয়ানের দুশমনদেরকেও তাদের বীরত্ব শৌর্যবীর্য, অনমনীয়তা ও দাওয়াতে হকের পথে অসীম ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকৃতি প্রদানে বাধ্য করে। তারা এই নামের আমানতদার। ইখওয়ানের পবিত্র রক্ত যা ফিলিস্তিনের মাটিকে সিক্ত করেছে তা এই আকীদা বিশ্বাসের গভীল প্রভাবের সাক্ষ্য বহন করেছে। তা এমন এক কৃতিত্ব যা আমাদের হৃদয় স্পন্দনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। সুয়েজের তীরের ভূখন্ড তার সাক্ষ্য বহন করছে। আমাদের ইতিহাস এই নামের সাথে সাথে এসব কৃতিত্ব দ্বারা সৌন্দর্যমন্ডিত হয়েছে। যে নাম পরিচয নিয়ে আমরা জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম তা কি ভুলে যেতে পারি?
১২-এই আমের কি দোষ? কোন কোন মানুষ এই নাম শুনামাত্রই হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে এবং নানা প্রকার দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে। এখন তো সরকারের দায়িত্বশীলরাও মাঝে মধ্যে বলে থাকেন, যে নির্যাতন ও সন্ত্রাসের সাথে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের নূন্যতম কোন সম্পর্কও নেই---। কোন ব্যক্তি বিশেষের পক্ষ থেকে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে গোটা দলের মাথায় তা চাপিয়ে দেয়ার যুক্তি কোথায়? প্রতিটি পরিবার সমাজ ও জাতির মধ্যে কি সৎ ও ভুল পথগামী লোক থাকে না? তাহলে ইখওয়ানে কোন ব্যক্তি বিশেষের ভুল-ত্রুটির দায়-দায়িত্ব গোটা দলের ঘাড়ে চাপানোর অর্থ কি?
১৩-এই নামের ত্রুটি কোথায়? এই নাম কি জীবন, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আত্মত্যাগের প্রমাণ বহন করছে না? েএই নাম কি সমস্ত মুসলিম জাহানের দৃষ্টি দ্বীনের অবিচ্ছেদ্য গুরুত্বপূর্ণ অংশের প্রতি আকৃষ্ট করেনি? যা দীর্ঘ দিন থেকে মানুষ বেমালূম ভুলে আছে? এই নামই কি মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে দ্বীনের রাস্তায় ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করেনি?
১৪-মানুষ কি তার উৎসের পবিত্রতা এবং মহত আকাংখার জন্য গর্ববোধ করে না? আমরা কি এই ব্যাপারে আমাদের দায় দায়িত্বের কথা অস্বীকার করে বসবো যে, আমরা সালফী তো বটে কিন্তু সালফেসালেহীনদের সাথে আমাদের আদৌ কোন সম্পর্ক ও যোগসূত্র নেই? আমরা সেই নাম ও পরিচয়েই পরিবর্তন সাধন করে ফেলবো যা যুবকদের অন্তরে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর প্রেরণা উজ্জীবিত করেছে?
১৫-ইখওয়ান একটা বিরাট সংস্কার কর্মসূচী পেশ করেছে। সেই কর্মসূচীর ভিত্তি আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ। এই কর্মসূচী খেলাফতে রাশেদার প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির পতাকাবাহী। কাজেই যে-ই এ নামের পরিবর্তন করতে চায় সে মূলত এই কর্মসূচীতে অসন্তুষ্ট নয়। আমরা কি করে তার কথা শুনতে পারি এবং কিভাবে তার নির্দেশ মেনে নিতে পারি? িএমন জঘন্য কাজ আমাদের দ্বারা কস্মিনকালেও হতে পারে না?
১৬-ইসলামের শত্রুরা যখন এই নাম পরিবর্তনের জন্য অব্যাহতভাবে চাপ সৃষ্টি করে তখন নিশ্চিতই তাদের সম্মুখে এমন সব অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে যাতে মুসলিম সমাজের জন্য কোন কল্যাণ থাকতে পারে না। সুতরাং আমরা কি নির্বুদ্ধিতা ও উদাসীনতার এমন পর্যায়ে গিয়ে উপনতি হতে পারি যেখান থেকে আমাদের বিরুদ্ধবাদীরা অনায়াসেই তাদের উদ্দেশ্য হাসিলকরে নিতে পারে? আমরা যদি আমাদের শত্রুদের ইচ্ছার আনুগত্য করি তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য ও দূরাবস্থা যে কোথায় গিয়ে পৌঁছতে পারে তা কল্পনা করাও সম্ভব নয়।
১৭-বিভিন্ন দলের সফলতার গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তার নামের ওপর পূর্ণ আস্থা। আস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত অর্জিত হতে পারে না যতক্ষণ না এই দলের আহ্বানকারীগণ বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক উভয়ভাবে তার নামের সাথে গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি না করে। নিজেদের দল ও তার কর্মসূচীর ওপর কি আমাদের আস্থা এতই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, আমরা এর নামই পরিবর্তন করে ফেলবো? অন্ততপক্ষে তার যুক্তিসংগত কোন কারণ দেখা দেয়া আবশ্যক?
১৮-মিসরের সমস্ত দল এমনকি কোন কোন ইসলামী সংগঠনও ইখওয়ানুল মুসলিমুনের ওপর আক্রমণ করেছে এবং তাদের সম্পর্কে অবান্তর কথাবার্তা ছড়িয়েছে। তারা মনে করেছিল যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুনও প্রত্যুত্তরে তাদের ওপর অনুরূপ হামলা চালাবে। কিন্তু এই দলটি তাদেরকে অতি বড় রকমের শিক্ষা দিয়ে ছেড়েছে। এই শিক্ষা ছিল তাদের সমালোচনার মোকাবিলায় আমাদের নীরবতা অবলম্বন এবং অন্যায় ও অশ্লীলতার জবাব অন্যায় দ্বারা না দেয়ার নীতি। আমরা মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও দূরত্ব সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকি। কিচু মনে না করা এবং ক্ষমা করে দেযার এই শিক্ষা খুবই কার্যকরী ও ফলপ্রসূ। এই দলের নাম একথাই প্রমাণ করে যে, এটা মুসলিমদেরকে সমবেত করে, বিভেদ সৃষ্টি করে না। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে বিবেচনা করে থাকে- প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে না। আপন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য গভীর মনোনিবেশ সহকারে সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকে। সকলের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা করে। বস্তুত আমাদের সামনে এতবেশী বড় বড় কাজ রয়ছে যে, এসব খুঁটিনাটি ব্যাপারে নাক গলানোর ফুরসতই আমাদের নেই।
১৯-ধরে নিন, আমরা যদি নাম পরিবর্তন করেই ফেলি তাহলে কেউ কি একথা মেনে নেবে যে, আমরা এখন আর ইখওয়ানুল মুসলিমুন নই। এমন অনেক লোক যারা আন্দোলনের রজ্জু নিজেদের গলদেশ থেকে খুলে ফেলে রেখে চলে গেছে তারা এই নামের সাথে তাদের সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছে। কিন্তু তাতে তারা লাভবান হয়নি। যারা এই নামের পরিবর্তন আনয়নের অভিলাষী তারা তাদের সম্পর্কচ্ছেদের সত্যতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে এই হতভাগার দল সংগঠনের সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকার সৌভাগ্য থেকেও বঞ্চিত হয়ে গেছে এবং যেখানে গিয়ে তারা যোগদান করতে চাচ্ছিলো তারাও তাদের প্রত্যাখান করেছে। অতএব আমরা যদি নাম পরিবর্তন করেও ফেলি তবুও এই দাবী উত্থাপনকারীদের মনোভাব ও দৃষ্টিভংগী আমাদের সম্পর্কে থাকবে এক ও অভিন্ন। সমস্ত মানুষ এক বাক্যে যদি এরূপ সাক্ষ্যও প্রদান করে যে, তোমরা ইখওয়ানুল মুসলিম নও-তথাপি তা হবে বাস্তব সত্যের অপলাপ মাত্র। কাজেই এমন কাজের পশ্চাতে আমাদের কালক্ষেপনের কি প্রয়োজন যা আমাদের জন্য কোন উপকারিতা লাভের উপলক্ষ হবে না, হতে পারে না। বরং এটাই কি অধিকতর সম্মানজনক নয় যে, আমরা ইখওয়ানুল মুসলিমুনই থেকে যাই? এটা কোন অহংকার ও অন্ধ অনুসরণের কারণে নয় বরং আত্মস্মান এবং উত্তরাধিকারের নিরাপত্তা বিধানের প্রেরণায়। আর যদি আমরা তাও করতে না পারি তাহলে আমাদের উপমা হবে এমন নির্বোধ উত্তরাধিকারীদের সাথে যারা তাদের পূর্ব পুরুষের উত্তরাধিকারকে বিনষ্ট কর ফেলে।
ঊনবিংশতম অধ্যায়
বৃটিশ দূতাবাস সম্পর্কে আমি ইতিপূর্বেক উল্লেখ করেছি যে, ইখওয়ান সরকারের পরামর্শক্রমেই বৃটিশদের সরে যাওয়অর বিষয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে জামাল আবদুন নারেস ইখওয়ানের ওপর হস্তক্ষেপ করার জন্য আলোচনাকেই অজুহাত হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু তার এই চক্রান্ত আদৌ সফলকাম হয়নি। তারপর নাসের একটা অত্যন্ত জঘন্য নাটক রচনা করে অর্থাৎ সে নিজেই তার অনুচরদের সাহায্যে নিজের ওপর আক্রমণ রচনা করায় এবং এই ষড়যন্ত্রের জন্য ইখওয়ানকেই সম্পূর্ণরূপে দায়ী করে। আমরা সকল প্রচার চক্রান্ত ষড়যন্ত্র থেকে সর্বদা মুক্ত। এই সত্য এখন সর্বস্তরের জনসাধারণের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এই তথাকথিত আক্রমণ সম্পর্কে নিন্মে বর্ণিত বিষয়গুলো বিশেষভাবে ভেবে দেখার বিষয়:
১-মুহাম্মাদ নাজীবতার সামরিক পদমর্যাদা ও সম্মানের শপথ করে এই সাক্ষ্য প্রদান করেছিল যে, “আল মানশিয়ার” ঘটনা একটা বানোয়াট ও মিথ্যা নাটক।
২-সাইয়েদ মুহাম্মাদ আল তিহামীর সাক্ষ্য রোজ আল ইউসুফ সাময়িকীতে ছাপা হয়েছিলো। উল্লেখিত সামযিকীর মে ১৯৭৮ সংখ্যা রেফারেন্স হিসেবে দেখা যেতে পারে। এই নিবন্ধে লেখক দ্ব্যার্থহীনভাবে উল্লেখ করেছেন যে, এই নাটক মঞ্চস্ত করার জন্য সি, আই,িএ-এর একজন বিশেষজ্ঞের সহযোগিতা গ্রহণ করা হয়েছিল।
নাসেরের প্রথম দিকের দু’জন অন্তরংগ সহচর হোসাইন ইসাফেয়ী ও আনোয়ারুস সাদাত মরহুমের সাক্ষ্য ও রেকর্ড বিদ্যমান রয়েছে। এই দুই ব্যক্তির ভাষ্য অনুযায়ী প্রতীয়মান হয় যে, নাসের তার পরিকল্পনাকে গোপন রাখতো। এমনকি তার ঘনিস্ট সহযোগীদেরও বাতাস পর্যন্ত লাগতে দিতো না। আবদুল লতিফ বাদদাদী তার “আল সামেতুনা ইয়াতাকাল্লামূন” (নীরবরা ক থা বলছে) গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে এই বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। হোসাইন আল শাফেয়ীর এই কথাই ছিল যথার্থ যে, জনগণের সম্মুখে যে ভাবে ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে তার প্রতি লক্ষ্য করলে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, ইখওয়ান জামাল আবদুন নাসেরের ওপর গুলি বর্ষণ করেছিলো। আলণ মানশিয়ার সুবিশাল প্রান্তরে এই গুলি চালানো হয় এবং সরকারী প্রভাবাধীন প্রচার মাধ্যম প্রচারণার জোরে মানুষকে একথা বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে, গুলি পরিচালনাকারী ছিল ইখওয়ান।
হোসাইন শাফেয়ীর িএই উক্তি আবদুল লতীফ বাগদাদীর বিশ্লেষণকে সমর্থন করে যে, অব্যাহগতভাবে যদি এক তরফা প্রচারণা চালানো হয় তাহলে একটা ডাহা মিথ্যাও সত্য বলে প্রতিয়মান হতে থাকে।
৩-মুহতারাম মুর্শিদে আ’ম জানতে পারেন যে, ইখওয়ানের কোন কোন যুবক এমন সব সভায় অংশগ্রহণ করেছে। যেখানে আবদুন নাসেরে বক্তৃতা করার কথা থাকে। তিনি আরো অবহিত হন যে, এই যুবকগণ নাসের সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা ও ক্রোধ প্রকাশ করে থাকে। এমনকি নাসেরের ওপর সময় সুযোগ বুঝে আক্রমণ করে বসারও সম্ভাবনা রয়েছে। মুর্শিদে আ’ম তৎক্ষণাৎ ইউসুফ তালাত শহীদকে ডেকে পাঠান এবং এই পরিস্থিতি সম্পর্কে তাকে কঠোরভাবে সাবধান করে দেন। ইউসুফ তালাত শহীদ ছিলেন ইখওয়ানের সামরিক শাখার ইনচার্য। মুর্শিদে আ’ম বলেন- আমি এই ধরনের প্রশিক্ষণের ঘোর বিরোধী যার উদ্দেশ্য থাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করা। আমি কোন অবস্থাতেই হিংসাত্মক কার্যকলাপের ও ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারি না। এরূপ কার্যকলাপের ফলে যদি বিরোধীদের কিংবা নিজেদের যুবকদের রক্তপাতের মত অবস্থা সৃষ্টি হয় তাহলে জেনে রাখুন, সকল প্রকার রক্তপাতের দায় দায়িত্ব থেকে আমি সম্পূর্ণরূপে মুক্ত থাকবো। পর্যালোচনা কালে এসব বিষয় জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল।
৪-এরূপ অভিযোগ আরোপ করা হয়েছিল যে, আমরা মাহমুদ আবদুল লতীফ শহীদকে এই তথাকথিত হামলা পরিচালনার জন্য আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রেরণ করেছিলাম। এটা একেবারেই অযৌক্তিক কথা। মাহমুদ শহীদ আলেকজান্দ্রিয়ার রাস্তা ঘাট সম্বন্ধে সম্পূর্ণ না-ওয়াকিফ চিলেন এবং এ ঘটনা সম্পর্কেও ছিলেন একেবারে অনবহিত। যদি আমাদেরকে িএরূপ কিছু করতে হতো তাহলে আলেকজান্দ্রিয়ার কোন লোককে নিযুক্ত করতাম না কেন। কিংবা যদি মাহমুদ আবদুল লতীফকে দিয়েই এ কাজ করাতে হতো তবে কি কায়রোতে এই কাজ করার সুযোগ পাওয়া যেতো না? কায়রোতেই তো বিস্তর জনসভা অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো। সেখানে সহজেই নাসেরকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা যেতো।
৫-কোন্ জ্ঞানান্ধ এ ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারে যে, একজন মাত্র নিঃসংগ আক্রমণকারীকে পাঠিয়ে দেয়া হবে এবং তার পশ্চাতে বিকল্প লোক থাকবে না। এ ধরনের হামলার ক্ষেত্রে হামলাকারীর পেছনে মজবুত সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েথাকে। এর উদ্দেশ্য থাকে হত্যাকারীর নিরাপত্তা বিধান করা এবং ব্যর্থতার ক্ষেত্রে অর্পিত দায়িত্ব সুসম্পন্ন করা।
৬-পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র সংগে নিয়ে স্পেশাল ব্রাঞ্জ ও সিকিউরিটির লোকদের দৃষ্টি এড়িয়ে তিনি কি করে আলেকজান্দ্রিয়ায় গিয়ে পৌঁছতে সক্ষম হলেন? তারা কি মনে করেছিল যে, আলেকজান্দ্রিয়ায় গিয়ে পৌঁছতে সক্ষম হলেন? তারা কি মনে করেছিল যে, আলেকজান্দ্রিয়ায় গিয়ে পৌঁছতে সক্ষম হলেন? তারা কি মনে করেছিল যে, আলেকজান্দ্রিয়ায় তারা বিভিন্ন উপায়ে সামরিক ব্যারাক এবং নৌবহরের ওপর কবজা করার মত যথেষ্ট শক্তিশালী অবস্থান ছিল। আলেকজান্দ্রিয়ার সামরিক ব্রবস্থা ও নৌবহর সম্পর্কে সরকারের ধারণা ছিল এই যে, কোন বিদেশী শক্তিও তা পদানত করতে পারবে না।
৭-এটা কি অধিকতর বাস্তবসম্মত এবং সহজ হতো না যে, আলেকজান্দ্রিয়ায় এ করার জন্য সেখানকার স্থানীয় সুযোগ-সুবিধাকে ব্যবহার করা হতো। কেননা, তারাইতো তাদের শহর সম্পর্কে অধিকতর অবগত ছিল। এবং তারাই ভালভাবে জানতো কোন অঘটন ঘটানোর পর পশ্চাদ্ধাবনকারীদের কিভাবে ধোঁকা দেয়া যেতে পারে।
৮-এই অভিনয়ের পরদিন আবদুন নাসের প্রত্যুষে কায়রো অভিমুখে প্রত্যাবর্তন করার ইচ্ছা পোষণ করছিলো। নিরাপত্তা বিভাগের লোকজন বুলেট প্রুপ কোর্ট তার খেদমতে এনে হাজির করলে তা দেখে সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো এবং বলতে লাগলো এখনতো এই ব্যাপারটি সমাপ্ত হয়ে গেছে। যেন তার জানা ছিল যে, আগের দিন যে নাটক মঞ্চস্ত করা হয়েছে তার সময় ফুরিয়ে গেছে।
৯- আবদুর রহমান সিন্ধীর কতিপয় অনুসারী যখন মুর্শিদে আ’ম-এর বাড়ীতে আক্রমণ চালায় এবং তাকে পদত্যাগ করতে চাপ দেয় তখন এই ঘটনা ইখওয়ানের জন্যে অত্যন্ত ক্ষোভ ও দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইখওয়ান মুহাম্মাদ ফারাগলী শহীদ ও সাইদ রামাদানকে আবদুন নাসেরের নিকট প্রেরণ করে। তারা উভয়ে যুগপৎ আবদুন নাসেরের নিকট আবেদন জানায় যে, এই পরিস্থিতি সম্পর্কে সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রকাশ করার অনুমতি যেন সে ইখওয়ানকে দিয়ে দেয়। নাসের এই প্রস্তাবে সম্মত হয়, যা হোক এরপর ঘটনা পরিষ্কার হয়ে যায়। হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের কোন কারণ বাকী থাকলো না। কেননা তখন আমাদের ও নাসেরের মাঝে কোন টানাপোড়েন ও ভুল বুঝাবুঝি ছিল না। এর কিছুদিন পরই তখন আমরা এই বানোয়াট হামলার খবর শুনতে পাই তখন খুব উদ্বগ্ন হয়ে পড়ি।
১০- প্রচার মাধ্যমগুলোর সাহায্যে জনগণকে অত্যন্ত হাস্যকর সংবাদ শুনানো হয়। পরিবেশিত খবর অনুযায়ী আদম ফৌজি নামক এক ব্যক্তি আলেকজান্দ্রিয়া থেকে রেল সড়ক ধরে পায়ে হেঁটে কায়রো পৌঁছে। এবার সে জামাল আবদুন নাসেরের খেদমতে সেই রিভলভারটি পেশ করে যা এই ঘটনার সময় ব্যবহার করা হয়েছিল। খবরের বিবরণ অনুযায়ী উল্লেখিত আদম ব্যবহৃত সেই পিস্তলটি কোথাও পড়ে থাকা অবস্থায় পেয়ে যায। নাসের সাহেব খুশী হয়ে তাকে একশত পাউন্ড পুরস্কার প্রদান করেন। এ খবর শুনেই কি আপনি তা বিশ্বাস করতে পারবেন নাকি একে একটা সাজানো নাটক মনে করে হাসবেন? প্রশ্ন হলো আক্রমণকারী ব্যক্তিকে নিরাপত্তা বিভাগের লোকেরা গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় কিন্তু এই ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্রের সন্ধান কেন করেনি? এটা একটা অদ্ভূত ব্যাপার যা নিজে বুঝা কিংবা অপরকে বুঝানো সম্ভব নয়।
১১- আদালত এই অভিযোগ তো আরোপ করে যে, সংশ্লিষ্ট পিস্তল থেকে আটটি গুলি চালানো হয়েছিল যা দেযালের ওপর গিয়ে লেগেছিল। কিন্তু তারা না দেয়ালের ওপর এসব গুলির কোন চিহ্ন দেখায় আর না প্রেসিডেন্টের মঞ্চে-এর কোন লক্ষণ ছিল। এমনকি আশেপাশের কোথাও এমন কোন প্রমাণ পেশ করা যায়নি।
১২-সুদানের জনৈক মন্ত্রী এবং আইনবিদ মিষ্টার বদর যিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং আহত হয়েছিলেন। কিন্তু তার শরীরে কোন গুলিবিদ্ধ হয়ে ছিল না। বরং তা ছিল ব্যালকুনির কাঁচ যা তাঁর শরীরে গিয়ে লেগেছিলো।
১৩- এই মোকদ্দমার তদন্ত চ লাকালে এও প্রমাণিত হয় যে, হিন্দাভী দুওয়াইর একবার পিস্তল পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেন যে কারণে মাহমুদ আর হাওয়াতীকে তাকে জিজ্ঞেস করেন যে, মুর্শিদে আ’ম যখন কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন যেন কোন অস্ত্র কারো ওপর অন্যায় হামলা করার জন্য সংগ্রহ না করা হয়। তথাপি তোমরা পিস্তল কেন চাচ্ছো? প্রত্যুত্তেরে সে জানায় যে, আমি অনুশীলনের জন্য পিস্তল চাচ্ছি। মামহুদ হাওয়াতীকে জবাব দিলেন না এই ব্যাপারে আমি তোমাকে কোন প্রকার সহযোগিতা করতে পারছিনে।
১৪-শূন্যে আটবার গুলির আওয়াজ শুনা যায়, যে ব্যক্তিকে এই গুলি চালাতে দেখা গিয়েছিলো সে আজও বেঁচে আছে এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত রয়েছে। গুলি বর্ষিত হওয়ার সময় এক ব্যক্তি চিৎকার করে বলেছিলো তুমি যেখানে আঘাত হানছো তা তোমার লক্ষ্য বস্তু নয়। তারপর সেই চিৎকারকারী এমনভাবে গা ঢাকা দেয় যে, আজ পর্যন্তও আর তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। যদি সে আত্মপ্রকাশ করতো তাহলে হয়তো এই ষড়যন্ত্রের রহস্য উদঘাটিত হতো।
১৫-নাসের সাহেবের পকেটে একটা বিশেষ কলম ছিল।যাতে রক্ত বর্ণের কালি ভর্তি ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, সে কলমটিকে ভেংগে ফেলেছিল? নাসের সাহেবকে কেউ স্পর্শ পর্যন্ত করেনি। তথাপি জনসাধারণ দেখতে পেয়েছিল যেন নাসেরের বক্ষ থেকে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। আজ পর্যন্তও এই প্রশ্নের কোন জবাব দেওয়া হয়নি যে, কোন আধাহ ছাড়াই রক্ত প্রবাহিত হওয়ার কারণ কি ছিল?
১৬- এই নাটক চলাকালে হিন্দাভীর দুওয়াইরকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাকে মৃত্যু দন্ড প্রদান করা হয়। যখন তাকে ফাঁসির মঞ্চে উঠানো হচ্ছিলো তখন সেখানে উপস্থিত সরকারী কর্মকর্তাদের সামনে সে বলেছিল যে, এই কৌতুকপ্রদ অভিনয়ের পরিসমাপ্তি আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে পূর্ণ পরিণতি লাভ করলো।
১৭- সামরিক বিপ্লবী কাউন্সিলের প্রধানের ওপর প্রণালী আক্রমণ পরিচালিতম হলো অথচ আক্রমণকারী সংস্থার দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণের এ সম্পর্কে কিছুই জানা থাকবে না তা কি করে সম্ভব? এই আক্রমণের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া মোকাবিলার কোন প্রকার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ইখওয়ানের পক্ষথেকে গৃহীত হয়নি। সুস্থ্য বিবেক বুদ্ধি কি একথা মেনে নিতে পারে যে, কোন সংগঠন এতটা অসংগঠিত ও বুদ্ধি-বিবেক শূন্য হবে? তদন্তকালীন সময়ে একথাও প্রমাণিত হয়েছে যে, ইউসুফ তালাত শহীদ, ইনচার্জ স্পেশাল ব্রাঞ্চ, কায়রো শাখা-এই দুর্ঘটনা সম্পর্কে ছিল একেবারেই অনবহিত। তারা এই ঘটনার খবর রেডিওর মাধ্যমে জানতে পারেন।
১৮-হিন্দাভী দুওয়াইর এই মিথ্যা মামলার বলির পাঁঠা হন। এই জালিমরা নাসেরের সর্বজন স্বীকৃত ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির উদ্দেশ্রে এই হ তভাগাকে ফাঁসির কাষ্ঠে চড়িয়ে দেয়। মিসরীয় জনগণের অভ্যাস হলো তার এমন ব্যক্তির প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে যার সম্বন্ধে তারা বুঝতে পারে যে, তার পর জুলুম হয়েছে। এই নাটকের মাধ্যমে জনসাধারণকে এই বিশ্বাস সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছিল যে, জামাল আবদুন নাসেরের প্রাণনাশের জন্য সুগভীর চক্রান্তের জাল বিস্তার করা হচ্ছে।
ইংরেজদের প্রতি আমাদের ঘৃণার কারণ
মানুষের মধ্যে ইখওয়ানের বড় দুশমন ইংরেজ। ইখওয়ানও তাদেরকে নিজেদের বড় শত্রু মনে করে। এই বিষয়টি শুধু কোন আবেগ অনুভূতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ বনয়। বরং বিভিন্ন জাতির জীবনে নানা প্রকার কার্যকারণ কোন সিদ্ধান্তে উপনীতি হওয়ার উপলক্ষ হয়ে থঅকে। ইখওয়ান ও ইংরেজদের মধ্যেকার এই পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষ বিনা কারণে নয়। ইখওয়ানকে যদি কোন বিপ্লবী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয় এবং তজ্জন্য কোথাও থেকে সাহায্য সহযোগিতা চাওয়ার প্রশ্ন দেখা দেয় তাহলে ইংরেজই হবে সর্বশেষ জাতি যাদের সম্পর্কে আমরা চিন্তা করে দেখবো। বরং আমি বলতে চাই যে, ইংরেজদের নিকট থেকে কোন সাহায্য-সহায়তা লাভের প্রত্যাশা করাটা প্রসংগটা আদৌ কোন আলোচনার ব্যাপার নয়। আমার এই মনোভাব পোষণ করার কয়েকটি কারণ আছে:
১- এ জাতি আমাদের দেশের ওপর প্রায় সত্তর বছর ধরে তাদের ঔপনিবেশিক নীতি চাপিয়ে রেখেছে। এই সময়ে তারা অত্যন্ত কঠোরভাবে ইসলামের বাহ্যিক দিকগুলোকে আঘাতের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে রেখেছে। এই ঔপনিবেশিক শক্তি মিসরের দ্বীনি পরিবেশকে অনেক বেশী ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবে আল্লাহর শোকর এবং এই কৃতিত্ব তারই যে, তিনি ইখওয়ানের আন্দোলনের সাহায্যে এ মুসলিম রাষ্ট্রটিকে গভীর পঙ্গে নিমজ্জিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করছেন যা ইংরেজরা খনন করে রেখেছিল। অন্যথায় অলসতা ও উদাসীনতার ব্যাধিতে আক্রান্ত মুসলিমরা সেই গর্তে পতিত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছিল।
২- এই ইংরেজ জাতিই কুখ্যাত বেলফুর চুক্তির সাহায্যে ফিলিস্তিনকে ইহুদীদের পিতৃভূমি বলে ঘোষণা করে। এ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য বিশ্বে বিশাল ভূখণ্ড ছিল। কিন্তু এ জাতির ইসলাম বৈরিতা এবং মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাবই ছিল মূল কারণ, যে জন্য তারা ফিলিস্তিনকে এই উদ্দেশ্য হাসিলের উপযুক্ত স্থান বলে নির্বাচিত করে।
৩- তারাই ফিলিস্তিনের মুসলিমদেরকে সকল প্রকার অস্ত্রশস্ত্র থেকে বঞ্চিত করে ইহুদীদেরকে পুরোপুরি সশস্ত্র বানিয়ে দেয়। ফলে ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদীদের হাতে বার বার ব্যাপক মুসলিম নিধনযজ্ঞ সংঘটিত হয়। দীর ইয়ামিনে মর্মান্তিক গণহত্যার কথা কেউ কি ভুলে যেতে পারে? এই জঘন্য ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকান্ডে ইংরেজদের পর আমেরিকানরা তাদের থেকেও অধিক নির্লজ্জ ভূমিকা গ্রহণ করে। মানুষের ক্ষমতা কতটুকু? সে তো বাতাসের একটি প্রবাহ বরং পানির একটি বুদ্বুদ মাত্র। তথাপি জুলুম-নির্যাতন চালাতে উদ্যত হলে আল্লাহ তায়ালার ভয়ভীতি থকে সম্পূর্ণরূপে উদাসীন হয়েই তা করতে প্রয়াস পেয়ে থাকে।
শহীদ ইবরাহীম আত তীব
শহীদ ইবরাহীম আত তীব পেশায় ছিলেন একজন আইনজীবি। অত্যন্ত চরিত্রবান, মহাপ্রাণ এবং দ্বীনের একনিষ্ঠ সৈনিক। তিনি ইখওয়ানের কায়রোস্থ সামরিক শাখার দায়িত্বশীল ছিলেন। আমরা এই সংগঠন স্থাপন করে ছিলাম ইংরেজ আধিপত্য ও ইহুদী সম্প্রসারণবাদের মোকাবিলা করার জন্য। এটা কোন গোপনীয় বিষয় নয় বরং আমরা আজও বলে থাকি যে, ইসলামের বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র নস্যাত করে দেয়ার জন্য আমরা সদা প্রস্তুত। আর ইহা জীবনের এমন এক মহৎ উদ্দেশ্য যা থেকে অধিকতর গৌরবজনক অপর কোন লক্ষ্য হতে পারে না। আমি ইবরাহীম আত তীব শহীদকে খুব ভাল করেই জানি। তিনি কোন অপরাধে জড়িত কিংবা কোন হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আদৌ কোন চিন্তাই করেননি। এটা ছিল তার ভাগ্যলিপি যে, নাসের কর্তৃক তার বিরুদ্ধে সাজানো এই মিথ্যা অভিযোগের শিকার হয়ে তিনি শাহাদাতের অমৃত সুধা পান করবেন। আমরা ইতিপূর্বে যে নাটকের উল্লেখ করে এসেছি তারই প্রেক্ষিতে শহীদকে মৃত্যুর শাস্তি প্রদান করা হয়। অন্যান্য শহদিদের ন্যায় এই নিষ্পাপ রক্তপাতের সম্পূর্ণ দায় দায়িত্বও নাসের এবং তার অন্যান্য সহযোগীদের ওপরই বর্তায়। এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ হাশরের দিন তার ন্যায় ও পক্ষপাত মুক্ত ফায়সালা ঘোষণা করবেন।
শহীদ হিন্দাভী দুওয়াইর
শহীদ হিন্দাভী দুওয়াইরের ব্যাপারে বলতে হয়- তিনি ছিলেন অত্যন্ত আবেগ প্রবণ যুবক। কোন ঘটনা শোনা মাত্রই তিনি আবেগ আপ্লুত ও উত্তেজিত হয়ে উঠতেন। তাকেও এই ষড়যন্ত্রের জালে আটকানো হয়েছিল। বেচারার সরলতার সুযোগ নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা তাকে নিশ্চয়তা প্রদান করেছিলো যে, ইখওয়ানের হাই কমান্ড এ ব্যাপারে ফায়সালা দিয়েছেন। এমন সব লোক যাদের ব্যাপারে হিন্দাভী দাওয়াইর-এর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তারা ইখওয়ানের নিবেদিত প্রাণ কর্মী তাদেরকেও এই ষড়যন্ত্রে ব্যবহার করা হয়েছিল। হিন্দাভী দুওয়াইরকে সাথে নিয়ে এক ব্যক্তি এই ঘটনার একদিন পূর্বে নাসেরের বাড়ীতে গিয়ে উপনীত হন। সে ব্যক্তি আজও জীবিত আছে। যদিও সুদীর্ঘ দিনর ব্যধি তাকে তার ঘরের চার দেয়ালের মধ্যেই গৃহবন্দী করে রেখেছে। হিন্দাভী দুওয়াইর ঘুণাক্ষরেও জানতো না যে, এটা একটা সাজানো নাটক।
আমার নিকট যদি আরো অতিরিক্ত কিছু তথ্য প্রমাণ থাকতো তাহলে আমি আরও কয়েকটা নাম পেশ করতে পারতাম। যাদের সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, তারাও এই চক্রান্তের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। কিন্তু আমি উপযুক্ত দলীল প্রমাণ ব্যতীত কারো বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন কোন অভিযোগ পেশ করার পক্ষপাতি নই। শোনা থার ওপর না আমি বিশ্বাসও করি আ না তার ভিত্তিতে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করাও সমীচিন মনে করি।
শহীদ আবদুল কাদের আওদার চিঠি
কোন কোন লোক জিজ্ঞেস করে থাকে যে, এমন কি অজুহাদ ছিল যার ভিত্তিতে আবদুর কাদের আওদা শহীদ এই মর্মে আবদুন নাসেরের নিকট চিঠি লিখেছিলেন যাতে তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে, সে যেন ইখওয়ানের বিশেষ ব্যবস্থাকে নিষিদ্ধ করে দিক এবং ইখওয়ানের নিকট যে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে তাও নিয়ে নিক---- আমি আমার পক্ষ থেকে এই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে চাই। এমন কোন পত্র সম্বন্ধে আমার কিছুই জানা নেই। এ সম্পর্কে অন্যরা যেমন রেডিও মারফত খবর শুনতে পেয়েছিল আমিও তেমনি রেডিও মারফতই জানতে পেরেছিলাম। ধরা যাক শহীদ বাস্তবিকই এরূপ চিঠি লিখেছিলেন। সে ক্ষেত্রে আমার নিকট এর মর্মার্থ এই যে, তিনি ইখওয়ানের পক্ষ থেকে সার্বিক সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন এবং নাসেরকে এই ব্যাপারে নিশ্চয়তা প্রদান করতে চাচ্ছিলেন যে, ইখওয়ানের পক্ষথেকে তার জীবনের জন্র কোন আশংকা নেই। আর কোন্ পরিস্থিতিতে কেন এই পত্র লিখা হয়েছিল, তাও তো কেউ জানে না। আবদুল কাদের আওদা শহীদ সকল উত্তেজনা ও অসন্তোষ দূর করে সম্পূর্ণ নিরাপদ ও শান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করেছিলেন।
সামরিক কারাগারে ইখওয়ানের ওপর যে অমানবিক অত্যাচার চালানো হচ্ছিলো জামাল আবদুন নাসের সে সম্পর্কে সম্যকরূপে জ্ঞাত ছিলেন। সে সি আই ডি এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চের ওপরও তার একান্ত গুপ্তচর নিয়োগ করে রেখেছিলো। তাই এই গোয়েন্দা সংস্থা মিসরের আনাচে কানাচে ঘরে ঘরে সকল ছোট বড় কথা তার সমীপে এনে উপস্থাপন করতে থাকতো।
হে দিব্য দৃষ্টির অধিকারীগণ!
শক্তির নেশা বিপজ্জনক
সামরিক কয়েদখানায় যা কিছু ঘটতো মিলিটারী পুলিশের প্রধান আহমদ আনোয়অর তা নিজে চোখে দেখতেন। বিপ্লবী কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য আবদুল হাকিম আমেরও বার বার সেই কয়েদখানার পরিদর্শনে যেতেন। আমরা আজ পর্যন্তও ভুলতে পারিনি যে, একবার আহমদ আনোয়ার জঙ্গী কয়েদখানার দারোগা হামজা আল বুয়ুনিকে হাজার হাজার ইখওয়ান ও সরকারী কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বলেন হে হামজা! এদেরকে খুব শিক্ষা দাও ওদরে হাড্ডি গোশত একাকার করে দাও এবং এ কাজ ঢোল পিটিয়ে করো। হামজা আল বুয়ুনি অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে কুর্ণিশ করে জবাব দেন। জনাব! তাই হবে!
সামরিক বন্দীশালায় আমাদের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছিল তার উদ্দেশ্য শুধু শাস্তি পদ্রানই ছিল না। বরং আমাদেরকে অপমান ও লাঞ্ছিত করার ওপরও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হতো। কারা কর্মকর্তাদের মনে অপমান ও লাঞ্ছনা চিন্তা আপনা থেকে আসেনি। তারা হয়তো কঠোরতা আরোপ করাকেই যথেষ্ট মনে করতো কিন্তু এই ভেবে যে স্বীয় প্রতিপক্ষকে অপমানের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে হবে। এটা এমন এক ব্যক্তির উর্বর মস্তিষ্কের সৃষ্টি যে স্বয়ং অপমান ভোগ করেছিল। ফলে সে আমাদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। এটা একটা মনস্তাত্বিক বিষয় যে অপমাণিত ব্যক্তি প্রতিটি সম্মানিত মানুষ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চায়, এরূপ নীচাশয় মানুষের হাতে ক্ষমতা ও প্রভাব কুক্ষিগত হলে তার প্রতিশোধ দাবানল থেকে কোন সম্মানিত ব্যক্তি বাঁচতে পারে না। তার অহং সম্মানিতদের লাঞ্ছিত করে তৃপ্তি পায়। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না যে, যে আচরণ আমাদের সাথে করা হয়েছে তা কোন অদৃশ্য হস্ত পুরস্কার ও সম্মানী দিয়ে করিয়েছিল না এর পশ্চাতে অন্যকোন কারণ লুকায়িত ছিল। বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। কিন্তু আমার কলম তা লিপিবদ্ধ করতে অক্ষম।
ইখওয়ানের ওপর নির্যাতন চালানোর পুরস্কার
কেউ কেউ বলে, জেলখানায় যা কিছু করা হয়েছে আবদুন নাসের সে ব্যাপারে একেবারেই অনবহিত। আমি একথা মেনে নিতে প্রস্তুত নিই। যে ব্যক্তি আবদুন নাসেরকে জানে তার খুব ভালভাবেই জানা থাকার কথা যে, মিসরে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনা সম্পর্কে সে উত্তমরূপে অবগতছিল। সামরিক কয়েদখানায় সে যা কিছু করিয়েছে তা সে বুঝে শুনে ও সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায়িই করিয়েছে এবং এ কারণেই সে আবদুর নাসের হয়েছে। একথা মনে রাখা দরকার যে, ইকওয়ানকে নির্যাতনের শিকার ও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা আইনের দৃষ্টিতে ছিল বড় রকমের অপরাধ এবং যেসব অফিসার এই অপরাধের পরিণাম ও পরিণতি সম্বন্ধে অবহিত তারা এ ধরনের কাজের দুঃসাহস করতে পারে না। কিন্তু এখানে অবস্থা ছিল এই যে, এসব অফিসারকে পাকা পোক্ত নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছিল যে, এই অপরাধে তাদেরকে কিছুই বলা হবে না শুধু তাই নয় তাদেরকে অনেক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করা হবে। এই গ্যারান্টিও দেওয়া হয়েছিল স্বয়ং নাসের সাহেবের পক্ষ থেকেই। এমনকি কার্যত সেই লোকদের পুরস্কার প্রদান করাও হয়েছিল।
এই ব্যক্তিদেরকে যেসব আর্থিক পুরস্কার প্রদান করা হতো তার বিশেষ নাম দেওয়া হয়েছিল, সেই নাম ছিল “শাস্তিদানের বিনিময়”। এসব টাকা কড়ি কে খরচ করতো? এবং সামরিক বাজেটের কোন খাতে তা দেখানো হতো। জামাল আবদুন নাসের নির্যাতনের বিষদ বিবরণ সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত ছিলেন। তিনি তো ছিলেন রাষ্ট্রের কর্ণধার। সামরিক কয়েদখানা সম্পর্কে তো মিসরের সর্বস্তরের জনসাধারণ সম্যকরূপে ওয়াকিফহাল ছিল। এই জেলখানার নাম শুনা মাত্রই সকল মিসরবাসীর অন্তরে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার ঝড় বয়ে যেতো। এমনকি নাসেরের নিকটতম সাথীও এ কারাগারের নাম শুনে কেঁপে উঠতো যে, যদি কখনো তাকে এরূপ ভাগ্য বরণ করতে হয় এবং এই জিন্দাখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তার জীবনের কি করুন ও মর্মান্তিক পরিণতি হবে। সাথে সাথে একথাও মনে রাখা আবশ্যক যে, এসব নির্যাতনের টেপ ও ফিল্ম তৈরী করা হতো যা নাসেরের খেদমতে পেশ করতে হতো। এসব সে অতীব আগ্রহ ভরে শুনতো ও দেখতো এবং মহা উল্লাসে ফেটে পড়তো।
বাদী নিজেই বিচারক
ইখওয়ানের বিরুদ্ধে সাজানো মামলার মধ্যে সর্বপ্রথম মিথ্যা ছিল এই যে, তারা সরকার উৎখাত করতে চায়। যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, বিচার প্রার্থী এবং বিচারক ছিল স্বয়ং সরকার আর অভিযুক্ত ও আসামী ইখওয়ান। প্রচলিত মানব রচিত কিংবা আসমানী কোন আইনের মধ্রে এমন কথার স্বীকৃতি রয়েছে যে, বাদী নিজেই বিবাদীর ওপর ফয়সালা প্রদান ও ডিক্রী জারী করবে? এই প্রশ্নের জবাব তো সর্বজনবিদিত। সাথে সাথে আইনের একটা সাধারণ মূলনীতি ইহাও যে, অপরাধীর নিকট থেকে জবান বন্দী গ্রহণ করা হবে তা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এবং কোন প্রকার চাপ প্রয়োগ না করেই তার ইচ্ছানুযায়ী লাভ করতে হবে।
আপনি বিস্ময়ে হতবাক হবেন যে, এই তথাকথিত আদালতের সম্মুখে ইখওয়ানকে পেশ করা হতো। তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও পেশ করা হতো। আদালতে আনীত আহত ইখওয়ানদের ক্ষত স্থান থেকে তখনও রক্ত ঝরে পড়তে থাকতো। এবং নির্যাতনের সুস্পষ্ট চিহ্নসমূহ তাদের শরীরে দেখা যেতো। এমতাবস্থায় এইমনগড়া স্বীকারোক্তিসমূহকে ভিত্তি করে রায় প্রদান করা হতো। আফসোস! বিষয়টি যদি এখানেই শেষ হতো! একটু সাহস করে যদি কোন কয়েদীকে আদলতে আনয়নের পর স্বীকৃতি প্রদানে অসম্মতি প্রকাশ করতো তখন আদালত পুনরায় তাকে কারাগারে ফেরত পাঠাতো যেন আরো নির্যাতনের শিকার বানিয়ে স্বীকারোক্তিমূরক বিবৃতি সমর্থন করতে বাধ্য করা হতো।
জামাল সালেমের পরিণতি
জামাল সালেম যিনি তথাকথিত এসব আদালতের প্রধান ছিলেন। তিনি আসামীদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে ও কথায় কথায় তাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আতালদের অপর দু’জন সদস্য এই বিচার প্রহসন চলাকালীন সময়ে সম্পূর্ণ চুপচাপ বসে থাকতেন। এই জামাল সালেমের পরিণতিও হয়েছিল অত্যন্ত বিস্ময়কর। সামরিক উর্দি খুলে এখন তিনি সাদা বেসামরক পোশাক পরিধান করেছেন। পরেছেন গেরুয়া রংগের আবা ও আলখেল্লা। দিনের অধিকাংশ সময় মসজিদে ও সাইয়ৈদা যয়নাবে অতিবাহিত করেন।
সে কি সত্যই তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত ছিল। তিনি কি তার কৃত পাপরাশী থেকে তওবা করে নিয়েছিলেন। নিসন্দে আল্লাহর রহমত অতিব সুবিস্তৃত। যে কেউ তার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করতে চাইবে সে কোন সংকীর্ণতার শিকার হবে না। অবশ্য তার তওবা হতে হবে খাঁটি ও অকৃত্রিম। এরূপ তওবাতে অসংখ্য কবিরা গুনাহও মাফ হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালার ক্ষমার তুলনায় কোন গুনাহই বড় নয়। আমি এ ব্যক্তির ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণীর পুনরাবৃত্তি করছি। তিনি বলেছেন: তোমরা তোমাদের মৃতদের গুণাবলী বর্ণনা করে তাদেরকে স্মরণ করো। আমাদের উচিত তাদেরকে আল্লাহর ইনসাফের ওপর ছেড়ে দেয়া। কারণ তিনি সর্বাপেক্ষা অধিক ন্যায় ও সুবিচারের নিশ্চয়তা বিধানকারী।
বিংশতম অধ্যায়
ইখওয়ানের প্রথম ও দ্বিতীয মুর্শিদে আ’ম উভয়েই অতীব সৎ ও মহৎ গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। দ্বিতীয় মুর্শিদে আ’ম তো অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। উস্তাদ হাসান আল হুদাইবি ইখওয়ানের নেতৃত্বের হক আদায় করার পর আল্লাহর রহমতের ছায়ায় চলে যান। গুরুদায়িত্বসমূহ সামাল দেয়া, আমানত আদায় করা, ত্যাগ ও কুরবানী পেশ করা, বিশ্বস্তততা, ধৈর্য ও স্থৈর্যের প্রদর্শন করা এবং সকল বিপদাপদকে উত্তম প্রতিদান লাভের প্রত্যাশায়অসীম সাহসের সাথে বরদাশত করার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয় মুর্শিদে আ’ম মরহুমের জীবনে প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে প্রিয়তম বান্দাগণের সারিতে শামিল করুন এবং উত্তম মর্যাদায় বিভূষিত করুন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বিদায় হজ্জের ভাষণে মু’মিনদের সম্মান ও মর্যাদার বিষয়টি অতীব গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করেছেন। তাঁর ভাষণের মর্মার্থত ছিল এই যে, মু’মিন বান্দার ইজ্জাত ও সম্মান আলআহ তায়ালার নিকট কা’বা শরীফ এবং মসজিদে হারাম-এর গুরুত্ব অপেক্ষাও বেশী। ইখওয়ান নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেসর আহকামের পুরোপুরি অনুসারী। ইখওয়ানের দৃষ্টিতে কোন মুসলিমের ইজ্জাত আবরু হালাল করা কিংবা তাকে কোন প্রকার কষ্ট দেয়া মারাত্মক অপরাধ। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকল প্রকার সন্ত্রাস ও নির্যাতনের হাত থেকে নিরাপদ রেখেছেন। কেননা আমরা প্রকৃতপক্ষে সালফে সালেহীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলি আর সালফে সালেহীন কোন মুসলিমের রক্তপাত বৈধ বলে স্বীকার করেননি। এমনকি সে চুরি কিংবা মদ্যপান করলেও না। ইখওয়ানে নিকট তাদের দ্বীনের ব্যাপারে দৃষ্টিভংগী অত্যন্ত সুস্পষ্ট। আর তা হচ্ছে এই যে, ইসলাম একাধারে দ্বীন ও এ রাষ্ট্র ব্যবস্থা উভয়টিই। আমাদের এই মনোভাব দ্বীনের দুশমনদেরকে আমাদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে রেখেছে। তারা আমাদরে ওপর এমন সব ভিত্তিহীন অভিযোগ আরোপ করে থাকে যা কোন সম্ভ্রান্ত লোকের কল্পনর জগতেও কখনো স্থান লাভ করতে পারে না। দুনিয়ার সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী প্রচার যন্ত্র ও গণমাধ্যমগুলো এই শ্রেণীর লোকদেরই কুক্ষিগত। এগুলো সদা সর্বদাই আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
ইখওয়ানের নেতৃত্ব
মুর্শিদে আ’ম হাসান আল হুদাইবি মৃত্যু বরণ করলেন। ইখওয়ান আইনগতভাবে ছিল নিষিদ্ধ। ইখওয়ান আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে থাকে এবং নিজেদের বুনিয়াদী আকীদা-বিশ্বাসের অনুসরণও করে থাকে। এই ইখওয়ানের সবাই মিলে নতুন মুর্শিদে আ’ম সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলো। এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, কর্মপরিষদের সদস্যগণের মধ্যে যিনি সর্বাপেক্ষা বায়োজ্যেষ্ঠ তাকেই মুর্শিদে আ’ম বানানো হোক। সংগঠন করা যদিও আইনগতভাবে নিষিদ্ধ কিন্তু ইখওয়ান তো তাদের ছোট বড় সকল ব্যাপারেই মুর্শিদে আ’মের শরনাপন্ন হয়ে থাকে।
ঘটনাক্রমে তখন কর্মপরিষদের সমস্ত সদস্যের মধ্যে আমিই ছিলাম বয়োজ্যেষ্ঠ। অতএব এই গুরু দায়িত্ব স্বীকার করে না। কিন্তু কার্যত সরকারও আমাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে না। সরকারও আমাকে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের নেতা বলে মনে করে এবং এই পর্যায়ে রেখেই আমার সাথে দেখা সাক্ষাত করে এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনাও করে। আমরা তাদেরকে এমন সুযোগ কখনো দেইনি যাতে তারা আমাদের ওপর হস্তক্ষেপ করার আইনগত বৈধতা পেতে পারে। এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, আজও যদি তাদের হাতে এমন কোন সুযোগ এসে যায় তাহলে তারা আমাদেরকে মোকদ্দমায় ফাঁসিয়ে দেবে। সংবাদপত্রের কোন কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি মাঝে মধ্যে এরূপ অনেক কথা বলাবলী করে যে, কার্যত ইখওয়ান মিসরে এখনও বিদ্যমান। এই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কিছু পত্রিকা আমার সৌজন্য সাক্ষাতকার গ্রহণের ব্যবস্থাও করে।
কাকে বিশ্বাস করবেন
এই পরিস্থিতিকে আমরাও মেনে নিয়েছি এবং অনেক ক্ষেত্রে আমি দেশ ও জাতির স্বার্থে কোন কোন ব্যাপারে সরকারের সাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। এই অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করে সন্তব্য করা যেতে পারে যে, বাহ্যিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইখওয়ানের সংগঠন এখনো রয়েছে এবং দেশে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ প্রায়ই আমার মাথে মত বিনিময় করতে আসেন। যখনই আমার সহিত কোন প্রকার যোগাযোগ করার প্রয়োজন পড়ে স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের ছোট বড় সর্বস্তরের কর্মচারীদের জানা আছে যে, তখনই আমি সাক্ষাতকার প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করি না। আমি কখনো এমন হঠকারিতাও প্রদর্শন করিনি যে, তাদেরকেই আমার নিকট আসতে হবে এবং আমি তাদেরকে আগাম জানিয়ে রেখেছি। দেশ ও জাতির কল্যাণ জাড়িত রয়েছে এমন বিষয়ে আমি নিজেই তাদের নিকট যাওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত রয়েছি। আমাকে শুধু টেলিফোন মারফত অবগত করলেই চলবে, আমি মন্ত্রণালয়োর দপ্তরে এসে পৌঁছে যাব। অবশ্য মাঝে মধ্যে আমার শারীকিক দুর্বলতার কারণে কিংবা কোন বিশেষ দিবস উপলক্ষে কোন কোন কর্মকর্তা আমার এখানেও এসে যান। তাদের এই আগমনে আমি যারপরনেই কতৃজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকি। আমার ওপর আল্লাহর বিরাট অনুগ্রহ যে আমি কখনো কোন হাংগামা করার মত অবস্থানে গিয়ে উপনিত হইনি। তবে হাঁ যদি আমি কখনো কাউকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকি এবং তা পূরণ করার জন্য আমাকে যেতে হয়। আমি সবসময় শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার লক্ষ্যই প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বর্তমান কর্মচারীবৃন্দ এ জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশও করে থাকেন। যাদিয়াতুহুল হামরা নামক স্থানে সংঘটিত দুর্ঘটনার ব্যাপারে হাসান আবু পাশা নিজে আমার ভূমিকার ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে যে বিবৃতি প্রদান করেছিলেন তাতে তিনি অকপটে স্বীকার করেন যে, সন্ত্রাস ও ধ্বংসাত্মাক কোন অপতৎপরতার সাথে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কোন সম্পর্কই নেই। তাছাড়া সন্ত্রাসী কোন সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমুনের পৃষ্ঠপোষকাতায় কখনো বেড়ে উঠতে পারে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আভ্যন্তরীন শন্তি-শৃংখলা বিধানকারী এক নম্বর দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তার মুখ থেকেই এই সত্য প্রকাশিত হয়েছে। অথচ ইখওয়ানের দুশমনদের হাতে তাদের ছবি অতিরঞ্জিত হয়ে বড় ভয়ানকভাবে উপস্থাপিত হয়ে থাকে। এক্ষণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত, না প্রচার মাধ্যমগুলোর ওপর?
আবেগের ওপর যুক্তির বিজয়
এ ব্যাপারে আমার স্থির সংকল্প ছিল যে, যখনই “আদ দাওয়া” সাময়িকীতে সম্পাদকীয় লিখবো তখন কোন লোকের ওপর ব্যক্তিগতভাবে কিছুতেই আক্রমণ করবো না। এই নীতি অদ্যাবধি বহাল রয়েছে। লিখনী পরিচালনার সময় আমি বাস্তবসম্মত ও তথ্য সমৃদ্ধ লেখার প্রতি পুরোপুরি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে আমি জনসাধারণের নিকট আবেদন জানিয়ে থাকি যেন তারা তাদের আবেগ অনুভুতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচেষ্ট হয়। ১৯৮১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণকে গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দী করা হয় তখন সেখানে আমরা পরস্পরের একান্ত সান্নিধ্যে আসার সুযোগ লাভ করি। এক দলের একজন সদস্য আমাকে বললো যে, আপনি আমাদের দেশের যুব সমাজকে একেবারে নিস্তেজ ও বলবীর্যহীন বানিয়ে ফেলেছেন এবং শৌর্যবীর্য ও আগ্রহ উদ্দীপনাকে ফ্রিজের মধ্যে ফেলে একেবারে বরফ বানিয়ে ছেড়েছেন।
আমি জানতাম না যে, একথাগুলো দ্বারা ভদ্রলোক আমার সুনাম বর্ণনা করছিল, না দুর্ণাম। যা হোক আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম এবং শুধুমাত্র এতটুকু বললাম যে, এর অর্থ এই যে আমার কথার কিছুটা প্রভাব রয়েছে। এত কিছুর পরও এবং এই দুর্দিনেও সাংবাদিক ও সাহিত্যিকদের হামলা থেকে আমি নিরাপদ থাকতে পরিনি। সেই সন্ত্রাসবাদিতার অভিযোগ যদিও তখন এই হামলা ছিল কিছুটা নমনীয়। তথাপি ইনসাফের দাবী হচ্ছে, সাদাতের বাড়াবাড়ি সত্ত্বেও এ বিষয়টি বর্ণনা করা দরকার যে, তিনি ইখওয়ানকে কিছুটা স্বাধীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। আমাদের সাময়িকী “আদ দাওয়া” ও এই আমলে নতুন করে প্রকাশিত হতে থাকে। এমনকি দ্বীনি পরিবেশে আমরা সারা দেশে কিছু কিছু সভা-সমিতি অনুষ্ঠানের সুযোগ লাভ করি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের ওপর রহম করুন এবং সাদাতের ওপরও। তাকেও ক্ষমা করে দিন আর আমাকেও ক্ষমা করে দিন।
আপন বন্ধুদের সাথে সাক্ষাত
সম্মানিত উস্তাদ আল হুদাইবির জীবদ্দশায় এবং তার ইনতিকালের পর কিছু কিছু ইসলামী সংগঠন ইখওয়ানের ওপর কাঠোর হামলা করতো। মনে হতো যে, ইখওয়ানের ওপর হামলা করা তাদের উদ্দেশ্য। তার আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে, আমরা জিহাদ ছেড়ে দিয়েছি এবং শুধু মাত্র কুরআন নিয়ে বসে গিয়েছি। একবার যখন কোন এক ইখওয়ানী ভাই আমার সম্মুখে এরূপ নিষ্ঠুর হামলার অভিযোগ করে তখন আমি অত্যন্ত ধরিস্থির ও শ্বান্তবাভে জবাব দিলাম যে, আল্লাহ তায়ালার শোকর যে, আমাদের এই ভাইয়েরা আমাদের প্রতি ইনসাফ করেছেন। তারা বলে যে, আমরা শুধু কুরআন অবলম্বন করেছি। খুবই বাল কথা কুরআনের মধ্যে দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ই রয়েছে। শান্তির কথাও আছে আবার জিহাদের কথাও। তারা সম্ববত দোষারোপ করার জন্যই এ মন্তব্য করেছে। কিন্তু তারা যদি তাদের কথার অর্থ হৃদয়ংগম করতে পারতো তাহলে দেখতো যে, এটা আমাদের জন্য একটা সনদ। আমরা এ কথা অস্বীকার করি না যে, আমরা কুরআন মজিদকে খুব মজবুত ভাবে ধারণ করেছি। আর সার্থকতা এতেই নিহিত। যদি সমালোচকদের মুখেই মহৎ কর্মের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। আমাদের তুখো্ড় সমালোচকগণ এটা মেনে নিয়েছেন যে, আমরা কুরআনকেই আমাদের বুকে ধারণ করে রেখেছি।
আপনাদের আনন্দদানের জন্য এও জানিয়ে দিতে চাই যে, আমদের এসব ভাই যারা আমাদের ওপর কুফরের অভিযোগ আরোপ করেন এবং জিহাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার অপবাদ দেন তাদের মামলা মোকদ্দমা ইখওয়ানী আইজীবিগণই আদালতে লড়েছেন এবং বিনা পারিশ্রমিকেই এই খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। কারো নিকট থেকে আমরা প্রতিদানের আশা যেমন করি না তেমনি বাহবাও পেতে চাই না। আমরা আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে যাবো।
আমাদের সামনে রয়েছে একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যপানেই আমরা সর্বদা এগিয়ে চলি। পথিমধ্যে যদি কোন কাঁটা আমাদের পায়ে বিধেঁ কিংবা কোন পাথরের চাঁই আমাদের গতিরোধ করে বসে তাতে আমরা থমকে দাঁড়িয়ে যাই না। আমরা কোন না কোন পন্থা উদ্ভাবন করে আমাদের লক্ষ্যপানে অবিরাম চলতে থাকি। ওপরে যে সমস্ত দলের কথা আলোচনা করা হয়েছে তাদেরকে নিকট থেকে দেখেছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই বলতে পারে যে, এসব দল একটা উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই গঠন করা হয়েছিল। আর সেই উদ্দেশ্যও এছাড়া আর কিছুই ছিল না যে, ইখওয়ানের ওপর একটি নতুন ফ্রন্ট থেকে নতুনভাবে আক্রমণ করতে হবে।
তারা চক্রন্ত করে আর আল্লাহ্ তাদের চক্রন্ত ব্যর্থ করেন
অমুসলিমদের সহযোগিতায় এবং অ-ইসলামী পন্থায় ইখওয়ানের ওপর হামলা করানোর পর আর একটা পন্থাই অবশিষ্ট ছিল অর্থাৎ ইসলামী নামে ইখওয়ানের বিরুদ্ধাচরণ করতে হবে। সুতরাং একটা অদ্ভুত প্রক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। মুসলিমদের ওপর মুসলিমরাই আক্রমণ করছিল। আর দুশমনরা উল্লাসিত ছিল এই ভেবে যে, যে পক্ষই পরাজিত হোক না কেন তাতে আমাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাওফীক দিয়েছেন যে, পাল্টা আক্রমণ করার পরিবর্তে আমরা নীরবতা অবলম্বন করেছি। এত দুশমনবা ছটফট করেছে এবং পরিণামে ইসলামের মুখোশ ধারণ করে আমাদের ওপর আক্রমণ রচনাকারী এসব পরিদৃষ্ট হয়েছে যে, তাদের দলের সমস্যগণ একে অপরের বিরুদ্ধে মারমুখি হয়ে উঠেছে। আর এভাবে প্রত্যেক মানুষ তার আপন কর্মফল ভোগ করে থাকে।
একবিংশতম অধ্যায়
এখন ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াত মিসরের বাইরে বহুদূর ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হচ্ছে অব্যাহতভাবে। এমনকি বিশ্ববাসী আমাকে সুদুর ইউরোপ, আমেরিকা এবং এশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনুষ্ঠিত সভা-সমিতি ও সেমিনার সিম্পোজিয়ামে যোগদান করার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন ক্রমাগতভাবে। আমরা শারীতিক অবস্থা এখন সফরের কষ্ট সহ্য করার উপযুক্ত নয়। বার্ধক্য আমাকে দুর্বল করে ফেলেছে তথাপি আমি এসব সম্মেলনে হাজির হচ্ছি। এসব ভ্রমণের সময় ভ্রাতৃপ্রতীম ইবরাহীম শারফ আমার সফর সংগী হিসেবে থাকেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে উত্তম পুরস্কার প্রদান করুন। কারণ তিনি সর্বদা আমার বিশ্রাম ও আরামের প্রতি পুরোপুরি খেয়াল রাখেন। এসব সম্মেলনে আমি যা দেখেছি তাতে আমার মন খুশীতে ভরে গেছে। ইসলামী দাওয়াতের সম্যক ধারণা ও বাস্তব প্রেরণা যুব সমাজের অন্তরে শিকড় গেড়ে বসেছে এবং সর্বদাই আমি যুবকদেরকে দেখতে পেয়েছে। তারা তাদের মিসরীয় ভাইদেরকে হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা দ্বারা সিক্ত করেছে। এসব সম্মেলনে সারা পৃথিবী থেকে হাজার হাজার লোক অংশগ্রহণ করে থাকে। এভাবে সর্বত্র মুসলিম অপর মুসলিম ভাইদের সাথে হৃদ্যতা ও নৈকট্য সৃষ্টি করে নেয়ার সুযোগ লাভ করে থাকে। এই ইসলামী ভ্রাতৃত্ব মস্তবড় এক নিয়ামত।
কৌশলের জন্য ত্যাগ ও তিতিক্ষা অত্যাবশ্যক
“আদ দাওয়া” সাময়িকী যোগসূত্র স্থাপন এবং ঘনিষ্টতা সৃষ্টির উত্তম মাধ্যম মিসরে এই সাময়িকীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর যখন তা ইউরোপ থেকে প্রকাশিত হতে থাকে তখন তা পাওয়ার জন্য সকল জায়গা থেকে প্রাহকগণ চাঁদা পাঠাতে থাকেন। সুদূর নরওয়ে, সুইডেন, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, জাপান মোটকথা প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ স্বতঃস্ফুতভাবে এর গ্রহক হয়। সাময়িকীটির অফিসে পেশাজীবি সাংবাদিক এবং বিশেষ বুৎপত্তি সম্পন্ন সাহিত্যিক ও যোগ্য সম্পাদক কোনটাই বড় একটা ছিল না। সাময়িকীটির সম্পাদনা, প্রকাশনা ও পরিচালনা এবং পরিবেশনার সার্বিক দায়-দায়িত্ব ছিল যুবকদের ওপর। যারা অতি সম্প্রতি গণসংযোগ বিষয়ক কলেজ থেকে ডিগ্রী লাভ করে বেরিয়ে এসেছে কিংবা শিক্ষারত আছে। লক্ষ্য অর্জনের একাগ্রতার ফলে এসব কৃতিত্ব অর্জিত হয়েছে যা দেখে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা চোখ কপাল তুলতে বাধ্য হয়েছেন।
প্রতি রবিবার সন্ধ্যায় যখন পত্রিকা আমাদের হাতে এসে পৌঁছতো তখন আমরা সকলে একত্রে মিলে বসতাম এবং তাতে থেকে যাওয়া ভুল-ভ্রান্তি ও ক্রটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত করতাম। আপনি বস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন যে, “আদ দাওয়া” ই এ ধরনের একমাত্র পত্রিকা যার কোন নিয়মিত গ্রুপ লিডার ছিল না। কিন্তু তারপরও প্রকাশনা অব্যাহত থাকে। মিসরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পূর্ব পর্যন্ত পত্রিকাটি কায়রো থেকেই প্রকাশিত হতো। এরপর অষ্ট্রিয়া থেকে প্রকাশ হতে থাকে।
কারাগার থেকে আমাদের মুক্তি লাভের সময় থেকে নিয়ে ১৯৮১ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কাল ছিল অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ। যদিও এ সময়েও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মাঝে মধ্যে কোন কোন বিষয়ে আপত্তি করতো। কিন্তু সার্বিকভাবে পত্রিকার প্রকাশনার ক্ষেত্রে কোন অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়নি।
আরব এবং মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ এমনকি অমুসলিম দেশসমূহের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীর প্রতিনিধিগণ “আদ দাওয়ার” দফতরে আসতো। তারা আমার থেকে সংবাদপত্র, রেডিও টেলিভিশন ইত্যাদির জন্য সাক্ষাতকার প্রদানের অনুরোধ জানাতো। এসব লোক অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও নাজুক বিষয়ে আলোচনার অবতারণা করতো এবং আশা করতো যে, আমি বিভিন্ন সরকারের সমালোচনা করাবো। অথবা তাদের গৃহিত পলিসির ওপর হামলা করে বসবো। অথচ আপনারা ভাল করেই জানেন যে, এসব ক্ষেত্রে অসন্তোষের দাবানল প্রজ্জ্বলিত করতে আমি কখনো অভ্যস্ত নই। আমি তাদের সে মানসিকতাকে এড়িয়ে যেতাম। আমার জবাব শুনে তারা সন্তুষ্ট হতে পারতো না। সে যাই হোক আমি নিজেকে কিছুতেই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি করতে চাই না যার ফলে পরক্ষণে শুধু আফসোস অনুতাপ প্রকাশ করা ছাড়া আমার আর কিছুই করার না থাকে।
একবার লন্ডনে জনৈক সাংবাদিক আমাকে এ পর্যন্ত বলে ফেলেন যে, আপনি প্রশ্নাবলীর সুস্পষ্ট জবাব পাশ কাটিয়ে যান। আমি তাকে বললাম, পাশ কাটিয়ে যাওয়া আমার অভ্যাস নয়। দেশের বাইরে গিয়ে সরকারের সামালোচনা করা আমার স্বভাব বিরুদ্ধে। আমি কখনো আমার দেশের সরকারের কোন ভ্রান্ত পদক্ষেপের সমালোচনা করতে চাইলে মিসরের ভেতরে থেকেই সততা ও নিষ্ঠার সাথে তা করতে পারি। দেশের বাইরে গিয়ে নিজ দেশের সরকারের সমালোচনা করা নীতিগতভাবে আমি ঠিক বলে মনে করি না। কিছু লোকের ধারণা, আমি রাজনৈতিক কারণে এরূপ ভূমিকা পালন করে থাকি। কিন্তু তা ঠিক নয়। বরং এটা আমাদের অন্যতম মূলনীতি।
ব্যক্তিত্বের লালন ও খ্যাতির আনন্দ
কিছু লোক যারা নৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে জ্ঞাত নয়- তারা মানুষকে খুশী করার জন্য অধিকাংশ সময় নিজেদের আকীদা-বিশ্বাসের পরিপন্থি কথাবার্তা বলে থাকে। কিন্তু আমার কর্মনীতি এরূপ নয়। সত্য কথা বলার ব্যাপারে আমার মতে কপটতার কোন সুযোগ নেই। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন! সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে ইখওয়ানুল মুসলিমুন কোন দিন কপটতার নীতি গ্রহণ করেনি। মানুষ দেখেছে ভীতি এবং নৈবাজ্যের জঘন্যতম সময়েও আমরা পিছ পা হইনি। আমি আল্লাহর শোকর আদায় করছি যিনি তার অফুরন্ত রহমতের সাহায্যে আমাকে এমন সৌভাগ্য দান করেছেন যে, আমি বাতিলের সম্মুখে মস্তকাবনত করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতে সক্ষম হয়েছি। আবদুন নাসেরের শাসনামলে একটা বিদয়াত প্রসার লাভ করেছিল।
প্রত্যেক ব্যক্তি তার প্রতি বিশ্বস্ততার ঘোষণা দিতো। ইখওয়ানুল মুসলিমুন কারাগারে কঠোর নির্যাতন ভোগ করছেল। ইত্যবসরে সরকারী কর্তাব্যক্তিরা আবদুন নাসেরকে সমর্থনদানের দাবী করেন। এরূপ কঠিন পরিস্থিতিতেও আমি আমার দ্বীন ও নৈতিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আলোকে জালিমের সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিলাম। এর ফলে যা কিছু ভোগ করতে হয়েছে তা সবই হাসি মুখে বরণ করে নিয়েছি। আমি জানতাম কুরআনের বহু পাঠক এমন রয়েছেন যারা না বুঝে শুনেই-এর শাব্দিক তেলাওয়াতে মশগুল থাকেন। অথচ কুরআন তাদের ওপর অভিশাপ দিতে থাকে। তারা পাঠ করে থাকে- জেনে রাখো জালিমদের ওপর আল্লাহ্র লা’নত বর্ষিত হয়ে থাকে। তারপরও হয়তো নিজেই জালিমে কিংবা জালিমদের সহযোগিতা দানকারীতে পরিণত হয়।
এমনিভাবে উভয় অবস্থাতেই তারা এই আয়াতের সত্যতা প্রমাণ করে নিজেদের কর্মে ও আচরণে। এই বিষয়ে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আবদুন নাসের জঘন্যতম জুলুম করে যাচ্ছে। আমি এ ব্যাপারে অত্যন্ত সর্তকতা অবলম্বন করছিলাম যে, আমি যেন নিজেই নিজেকে আল্লাহ্র লা’নতের উপযুক্ত না করে ফেলি। নাসেরের সমর্থন করা ছিল আল্লাহ তায়ালার লা’নতেরই নামান্তর। আল্লাহ্র লা’নতের অর্থ হচ্ছে, মানুষ আরহামুর রাহেমীনের রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়বে। অথচ আমি আল্লাহর রহমতের মুখাপেক্ষী সবচেয়ে বেশী। এতদ্ব্যতীত কোন জালিমের সহযোগিত করা নিজেই নিজেকে তার সামনে অপমাণিত করার সমার্থক। এই পৃথিবীতে এমন কোন জিনিস নেই যা আমাকে দুনিয়ার বিনিময় দ্বীন বিক্রি করতে বাধ্য করতে পারে। জালিমের সম্মুখে কাকুতি মিনতি করা জঘন্যতম অপমানের শামিল। কোন সত্যিকার মুসলমান এত নীচে নামতে পারে বলে আমি মনে করি না। দাওয়াতে হকের পথে আমাকে যত দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তা একথারই প্রমাণ যে, আল্লাহর ব্যাপারে আমি কাউকে ভয় করি না। তা না হলে আমার জন্য কি কঠিন কাজ ছিল যে আমি দাওয়াত ছেড়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে যাওয়া। সে ক্ষেত্রে না কোন মুসিবত ভোগ করতে হতো আর না কোন পরীক্ষা নিরীক্ষার মুখোমুখি হতে হতো।
মু’মিন বান্দা তার মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস থেকে কখনো বিচ্যুত হতে এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে কারো ভয়-ভীতির তোয়াক্কা করতে পারে না। পরিবেশ পরিস্থিতি যত প্রতিকূলই হোক না কেন। জালিম যখন দেখে যে, একজন মু’মিন বান্দা তার দুর্বলতা ও প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তার সামনে মাথা নত করতে প্রস্তুত হচ্ছে না তখন তার স্নায়ু অস্বাড় হয়ে যায়। জালিমের জন্যে এটা চরম পরাজয় যে, সে একজন প্রশান্ত আত্মার মু’মীনের মর্যাদাবোধের সামনে তার শক্তি ও প্রতাপকে অসহায় দেখতে পায়। এই মু’মিন না তীর-তলোয়ারকে ভয় করে, না ধন-দৌলত ও বিত্ত বৈভবের লালসা তাকে প্রলুব্ধ করতে পারে। আমি নিজে দাবী করছি না যে, আমি আমার বীরত্ব শৌর্য বীর্য ও নির্ভীকতার ভিত্তিতে এমন প্রদর্শনী করতে সক্ষম। বস্তুত প্রত্যেক মু’মিন বান্দা সবসময় আল্লাহ তায়ালার প্রদত্ত দৃঢ় চিত্তাত এবং অবিচল ধৈর্যর বদৌলতেই হকের ওপর টিকে থাকতে পারে। আল্লাহ্ বলেনঃ (*******)
ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি
সাদাতের আমলে আমরা শুরু থেকেই ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির বিরোধিতা করেছিলাম। এই বিষয়ে প্রথম থেকেই সাদাতের তৎপরতা ছিল আমাদের মতে অমংগলের কারণ। আমরা তার জেরুজালেম যাওয়ার ব্যাপারে তীব্র বিরোধীতা করেছিলাম। অথচ শুধু আমরা ছাড়া সমগ্র মিসরে তখন আর কেউ মুখ খোলেনি। আমরা একাধারে ক্যাম্প ডেভিড এবং শান্তি চুক্তি উভয়ের বিরুদ্ধেই আমাদের মতামত খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করেছিলাম। এ ব্যাপারে আমাদের অত্যন্ত পরিষ্কার ও সহসিকতাপূর্ণ ভূমিকা কারো অজানা ছিল না। এই সময়ে সাদাতের পদলেহী ও সেবাদাস সাহিত্যিক ও সাঙ্গপাঙ্গরা আমাদের ওপর তীর বর্ষাতে থাকেন। তারা আমাদেরকে রাজনীতিতে অদক্ষ বলে অভিহিত করেন এমনকি শান্তি ও নিরাপত্তার দুশমন বলে অভিযুক্ত করে ছাড়েন।
অনন্তর যখন এসব চুক্তি বাস্তবে রূপায়িত করার উদ্যোগ শুরু হয় তখনও আমরা যথারীতি তাদের প্রতিহত করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যাই। “আদ দাওয়া” সাময়িকীর এক সম্পাদকীয়তে আমি লিখেছিলাম যে, এসব চুক্তি বাস্তবায়ন সার্বিক অকল্যাণ ডেকে আনবে। আমার এই মন্তব্যের স্বপক্ষে আমি ক্রমান্বয়ে বিশটি কারণ উল্লেখ করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে রুকনুল কানাতিরিল খাইরিয়াতে আমার সাথে যখন সাদাতের সাক্ষাত হয় তখন সে আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, আমি কেন এই চুক্তির বিরোধিতা করছে? আমি প্রত্যুত্তরে তাকে বললাম যে, আমি শুধু মাত্র রাজনৈতিক সতপার্থক্যের কারণেই এই চুক্তিগুলোর বিরোধিতা করছি না। কেননা আজকাল জনসাধারণ রাজনীতির যে অর্থ বুঝে থাকেন-এমন রাজনীতির সাথে আমার দূরতম সম্পর্কও নেই। আমি শুধু মাত্র দ্বীনি দৃষ্টিভংগীতেই এই চুক্তিসমুহের বিপক্ষে কথা বলছি। কারণ ইসলাম কখনো স্বীকার করে না যে, কোন অমুসলিম সাম্রাজ্যবাদকে মাথা পেতে মেনে নিক। বরং যখনই মুসলিমদের কোনও অঞ্চলে কোন অমুসলিম ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তখন মুসলিম উম্মার প্রতিটি সক্ষম নরনারীর ওপরই জেহাদের জন্য বেরিয়ে পড়া ওয়াজিব হয়ে যায়।
মুসলমানদের ঘাড়ের শিরা ও ইহুদী থাবা
আমি আল্লাহ্র নামে কছম করে বলতে পারি যে, সাদাত আমার কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় এবং আমাকে বলে যে- “এই ধারায় যত ইচ্ছা লিখে যাও।” এটা সাদাতের মহত্বের পরিচায়ক যা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। সে যতকিছুই করে থাকুক না কেন এ পর্যায়ে আমার মনে হয়েছে সে আস্তরিক ও মানসিকভাবে আমার যুক্তির সাথে সম্পূর্ণ একমত ছিল। সাদাত তার বেশ কিছু সাংবাদিক সম্মেলনে এ ব্যাপারে স্বীকৃতি প্রদান করেছিল যে, ইস্রাঈল মূলত তত্বগত ও বাস্তব উভয় দিক থেকেই শান্তিচুক্তি লংঘন করেছে। তদুপরি রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত কর্ণধারগণও অনুরূপ বক্তৃতা বিবৃতি প্রদান করতে থাকেন। বিরাজমান এই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ইস্রঈলের ঘৃণা সংকল্প উপেক্ষা করার কোন কারণ কি অবশিষ্ট থাকে? ইস্রঈলের তার সীমানা সুদূর মদীনা মনোয়ারা পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার নীল নকশা, পশ্চিম তীর, গাজা ভূখন্ড এবং গোলান মালভূমিকে ইহুদী আগ্রসনের রংগে রাংগিয়ে তোলার অবিরত প্রচেষ্টা, দক্ষিণ লেবাননের ওপর তার জবর দখল সাবেরা ও শাতিলার তার পাশবিক হত্যাকান্ড কি আমাদের চেখ খুলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়?
আমরা অবশ্য এমন কোন কৃতিত্বের দাবী করি না যে, শান্তিচুক্তির ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভংগী ও তার যে বাস্তবতা সময় প্রমাণ করে দিয়েছে-তা আমাদের বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতার প্রমাণ। বরং আমাদের বক্তব্য হলো, আমাদের কাছে এমন একটি দ্বীন রয়েছে যা সরল সঠিক পথের দিকনির্দেশনা দান করে থাকে। আমরা যদি তা মজবুত রশিকে শক্ত হাতে ধারণ করতে পারি তাহলে কিছুতেই পথভ্রষ্ট হওয়া সম্বব নয়। আজ ইসলমী জগতের যে ক্রান্তিকাল চলছে এবং ইরাক ও ইরান যেভাবে একটা অর্থহীন যুদ্ধে নিজেদের শক্তির অপচয় করছে তা দেখে বাস্তবিকেই খুব দুঃখ হয়। এই ভ্রাতৃঘাতি ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের নেপথ্যে আমেরিকা রাশিয়া ও ইস্রাঈলের সক্রিয় হাত রয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানগণ সম্মিলিতভাবে নিজ নিজ দেশে ইসলামী শরীয়াতকে কার্যকরী করেন তাহলেই কেবল মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের ওপর ছেয়ে থাকা বিপদের ঘনঘটা একদম কেটে যাবে। মানুষ যে জিনিসের আকাংখা করে তাই-ই লাভ করা সহজসাধ্য নয়। তথাপি ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় সকল বিপদকেই কাবু করা যায়। এখন তো আল্লাহ্ তায়ালার পরিশুদ্ধ করে দেবেন। আমরা যদি তা দিকে প্রত্যাবর্তন করি তাহলে করি তাহলে এই আকাংখা পূরণ হতে দেরী হওয়ার কথা নয়।
সাংবাদিকতার ইসলামী নীতি
“আদ দাওয়া” সাময়িকীর ডিক্লরেশন ছিল আলহাজ্জ সালেহ আসমাভী মরহুমের নামে। তিনিই ছিলেন এর প্রধান সম্পাদক। সম্পাদক মন্ডলীর মধ্যে আলহাজ্জ মোস্তফা মরহুম শাইখ সালেহ আসমাভী মরহুম ও আমি ছাড়া বাকী সবাই ছিলেন যুবক ছাত্র। আমরা প্রতি রবিবারে সন্ধ্যায় পত্রিকার পান্ডুলিপি শেষবারের মত দেখার জন্য বসতাম। বিষয় ও ভাষাগত ভুল-ভ্রান্তি চিহ্নিত করা হতো। হ্রাস বৃদ্ধি এবং অন্যান্য অনেক বিষয়ই আলোচনায় স্থান পেতো এবং প্রত্যেক বারই পত্রিকার শ্রী বৃদ্ধি ও মানোন্নয়নের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হতো।
মতানৈক্যের পরিবেশ সৃষ্টি হলে অত্যন্ত ধীর স্থির ও শান্ত পরিবেশে আলোচনা অব্যাহত থাকতো। এই আলোচনা চলাকালে আমি স্বভিাবত নীরবতা অবলম্বন করতাম-যাতে কিছু শিখতে পারি। কারণ সাংবাদিকতার ময়দানে আমার কোন অজ্ঞিতা ছিল না। অবশ্য আলোচনার পরিসমাপ্তি টানা যায়। তখন পর্যন্ত আমি হস্তক্ষেপ করতে হতো। যাতে আলোচনার সাময়িকীতে প্রকাশিত লেখার জন্য সম্মানী প্রদান করা হয়ে থাকে। পরবর্তীতে আমি তা জানতে পারি। সংবাদপত্র সেবীদেরকে বিনিময় প্রদান করা হবে এতে আমার অবশ্য কোন প্রকার আপত্তি ছিল না। তথাপি আমি কখনো কোন সাময়িকী ও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত আমার কোন প্রবন্ধের জন্য কোন বিনিময় প্রহণ করিনি। পত্রিকা ও সাময়িকী কোন বিশেষ বিষয়ে আমার নিকট প্রবন্ধ চাইলে আমি বহুবার দিয়েছি কিন্তু তারা আমাকে বিনিময় দিতে চাইলে আমি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছি। কেননা আমি একজন দা’য়ী, সাংবাদিক নই। আমার অভ্যাস হচ্ছে, আমার সাথে সাক্ষাত করার জন্য যখন কেউ সময় চায় তিনি রাষ্ট্রের কর্ণধার কিংবা কোন সাধারণ মনুষ যা-ই হোন না কেন সর্বাবস্থায়ই আমি সেজন্য প্রয়োজনীয় স্থান ও সময় নির্ধারণ করার ইখতিয়ার তার ওপরই ছেড়ে দিয়ে থাকি। এই অভ্যাস আমি আমার জন্য রপ্ত করে নিয়েছি। কারণ, আমি নির্ধারিত স্থানে নির্ধারিত সময়ের কয়েক মিনিট পূর্বেই গিয়ে পৌঁছাতে চাই্ যখন নিরাপত্তা বিভাগের লোকজন“আদ দাওয়া” পত্রিকার অফিসে হামলা করে তখন সবকিছুই তছনছ করে ফেলে। সমস্ত কাগজপত্র ও নথিপত্র সাময়িকীর সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক তার প্র্রতি কোন প্রকার ভ্রুথিপত্র না করেই নিয়ে যায়। আমার বার বার দাবী করা সত্ত্বেও আজ পর্যন্তও ঐ সমস্ত কাগজপত্র ফেরত দানের কোন ব্যবস্থা হয়নি।
স্বৈরাচারীরি সাবধান
আভ্যন্তরীণ শান্তি শৃংখলা রক্ষা কর্তৃপক্ষ পত্রিকার অফিসে হমলা চালানোর সময় কিছু সংখ্যক ইখওয়ানীকেও পাকড়াও করে নিয়ে যায়। তারা আমাকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠায়। আমি তাদের প্রতিটা প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব প্রদান করি। তারা বার বার বলছিলো যে, ইখওয়ান বেআইনিভাবে সংগঠন চালু রেখেছে। এই লোকগুলোর অবস্থা দেখলে আশ্চার্য হতে হয়, যকনই কোন ইখওয়ান অন্য কোন দেশ থেকে ফিরে আসে এবং তার সাথে কোন জরুরী কাগজপত্র থাকে তখন শান্তির এসবচ রক্ষকরা তাদেরকে গ্রেফতার করে হাজতে বন্দী করে। এভবে সপ্তাহর পর সপ্তাহ এবং মাসের পর মাস এই নিরাপরাধদেরকে কোন অভিযোগে অভিযুক্ত না করেই বন্দীশালায় আটক রাখার পর যখন আদালতে হাজির করা হয় তখন আদালত তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বেকসুর খালাস প্রদানের নির্দেশ দেয়। কেননা আদালত এমন কোন সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পায় না যা তাদের শাস্তির উপলক্ষ হতে পারে। তা সত্ত্বেও তারা বার বার এরূপ আচরণ করেছে। এমন কি এই ধারা অব্যাহত রেখেছে আজও। আমি চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে গিয়েছিলাম তখন একটি পত্রিকা এই সংবাদ পরিবেশন করে যে, আমি রণক্ষেত্র থেকে পলিয়ে গেছি। আমি যখন এই সংবাদ পাঠ করি তখন আমার চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখেই চলে আসি। রাত সোয়া নয়টার সময় (প্লেন) বিমান বন্দরে এসে পৌঁছে। ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট অফিসার আমার পারপোর্ট নিয়ে নেয় এবং আমাকে অপেক্ষা করতে বলে। আমি এয়ারপোর্টের অভ্যন্তরের হল রুমে রাত দু’টা পর্যন্ত বসে অপেক্ষা করতে বলে। আমি একবার চিন্তা করলাম যে এই ঘটনার রিপোর্ট লিপিবদ্ধ করাই। কিন্তু পরক্ষণে আমি ভেবে দেখলাম যে, এই পাসপোর্ট অফিসার বেচারার কি দোষ। সে তো হুকুমের দাস মাত্র। তাকে টেলিফোনের হুকুম দেয়া হচ্ছে অথচ পরবর্তী সময় হুকুম দাতা সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে সমূদয় দায়দায়িত্ব অস্বীকার করে বসে। আর যদি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করাও হয় তাহলে কোন দুর্বল শরীর সর্দি কাশির ন্যায় ছোট কর্মচারীকেই পাকড়াও করা যায়। অগত্যা আমি আমার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকি। এই অন্যায় আচরণের কারণ যাই হোক না কেন আমি গোটা ব্যাপারটা আল্লাহ্র ওপর সোপর্দ করে দিয়েছি। আমি আমার বাম হাঁটুর যে চিকিৎসা করিয়েছিলাম এবং যার ফলে অবস্থার কিছুটা উন্নতিও হয়েছিল- এক নাগাড়ে এই সুদীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা সময় প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে পুনরায় তা সফরের পূর্বের মতই হয়ে যায়। আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম- এই লোকগুলো আমার সাথে এমন আচরণ করছে কেন? অথচ তারা খুব ভাল করেই জানে যে, এরূপ অসম্মানজনক আচরণের ফলে নাতো আমি আমার ভুমিকায় কোনরূপ পরিবর্তন সাধনকারী আর না কোন প্রকার আবেগ উত্তেজনা প্রদর্শনকারী। তাদের আরো চিন্তা করে দেখা উচিত যে, আল্লাহ তায়ালার সম্মুখে তাদের নিজেদের এ ধরনের আচার ব্যবহারের কারণে বিপজ্জনক ফলাফল ও মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু তখনকার সেই আক্ষেপ অনুতাপের কোন সুফল তারা ভোগ করতে পারবে না।
বাইশতম অধ্যায়
পরিবার সংগঠন ও তার বাস্তবরূপ
ইখওয়ানুল মুসলিমুনের পরিবার সংগঠন কর্মসূচী শুরু করলে তাতে সফলতা লাভ করে। শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানকারী সংস্থাগুলো অকারণে এই ব্যবস্থার ওপর অত্যন্ত ক্ষ্যাপা ছিল। সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে এই ব্যবস্থাও বন্ধ হয়ে যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোন দায়িত্বশীল পর্যায়ের লোক যখনই আমার সাথে সাক্ষাত করেছেন সর্বদাই আমাকে পারিবারিক ব্যবস্থা সম্পর্কে অবশ্যই প্রশ্ন করেছেন। তার সর্বদাই এরূপ সন্দেহ পোষণ করেছেন যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন এই ব্যবস্থা পুনরায় শুরু করেছে। আমি বার বার তাদেরকে নিশ্চয়তা প্রদান করি যে, এ ব্যবস্থা চালু করা হয়নি। তথাপি তারা কিছুতেই একথা মেনে নিতে প্রস্তুত হয়নি। বিষয়টি যখন তিক্ততার সৃষ্টি করে তখন আমার পক্ষ থেকে তাদেরকে বলতে হয় “যদি তোমরা এই ব্যবস্থা কার্যকরী দেখতে পাও তাহলে তাতে অংশগ্রহণকারী ইখওয়ানের ঘাড় মটকে দাও।”
প্রকৃত ব্যাপার হলো, পরিবার সংগঠনের ব্যাপারে সিকিউরিটিওয়ালাদের উদ্বেগ ও সংশয়ের কোন কারণ আজ পর্যন্তও আমি জানতে পরিনি। সিকিউরিটির জনৈক ব্যাক্তি একবার আমাকে বলেছিল যে, বাহ্যিকভাবে এই ব্যবস্থা বিপদজ্জনক বলে মনে হয় না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা এতই বিপদজ্জনক যে, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে এর সাহায্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেকে সশস্ত্র করে তোলা যেতে পারে- আমি এই ব্যবস্থা সম্পর্কে বলতে চাই যে, যদি দল ও সংগঠনের মধ্যে ইসলামী প্রশিক্ষণের জন্য এ ব্যবস্থা চালূ করা যায় তাহলে সুদূর প্রসারী সুফল পরিদৃষ্ট হবে।
এই ব্যবস্থার পরিচয় করিয়ে দিতে পারলে তা হবে উত্তম। বিভিন্ন পরিবারের যুবক- যারা আত্মীয়তা কিংবা প্রতিবেশী হওয়ার দিক দিয়ে ঘনিষ্টতার দাবী রাখে কোন এক জায়গায় একত্রিত হয়ে বসতো যেখানে কুরআন পাঠ হাদীস মুখস্ত করা রাসূলের জীবনী ফিকাহ্ এবং তাফসীর চর্চা করা তাদের কর্মসূচীর অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। উপস্থিত লোকদের প্রত্যেককে দায়িত্বশীল ব্যক্তি হওয়ার মত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো। সাথে সাথে যুব সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ককে ইসলামী নীতির ওপর মজবুত করে দেয়া হতো। নিজে নিজের পরিবারের সদস্য, নিজের সমাজ এবং সামগ্রিকভাবে নিজের জাতি সম্পর্কে তার ওপর বর্তানো দায়িত্বের অনুভূতি তাদের অন্তরে জাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হতো। কোন কোন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কলেও এ ধরনের ব্যবস্থা চালু ছিল। অতএব আমি বুঝতে পাডির না যে, শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাগুলো কেন ইখওয়ানুল মুসলিমুনের এই ব্যবস্থার বিরোধিতা করে থাকে?
মুসলিম এবং খৃষ্টান নির্বিশেষে আমি মিসরের সকল যুব সমাজ এবং তাদের সকল প্রকার সংগঠন ও দলগুলোকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি যেন তারা এই ব্যবস্থা অধ্যয়ন করে দেখে এবং নিজ নিজ সাংগঠনিক নেতৃত্বের অধীন এবং তাদের সক্রিয় তত্বাবধানে এই অভিজ্ঞতা থেকে লাভবান হতে চেষ্টা করেন। ইখওয়ানের ওপর নিষেধজ্ঞা থাকার কারণে আমি ইখওয়ানকে বলবো, যতদিন পর্যন্ত আল্লাহ্র ইচ্ছায় এই নিষেধাজ্ঞা উঠে না যায় ততদিন তারা যেন এই ব্যবস্থা থেকে বিরত থাকে। অতপর যখন আল্লাহ তায়ালার ফায়সালা হয় এবং এই নিষেধাজ্ঞা উঠে যায় তাহলে তারা যেন এই অনুপম প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচী সোৎসাহে শুরু করে দেয়। আমার ধারণা যদি এ সময় ইখওয়ানের কোন পর্যায় এই পদ্ধতি চালু থাকতো তাহলে আইন শৃংখলার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ নিশ্চিতই তাদেরকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করতো। আমার ভাবতেও অবাক লাগে যে, একদিকে শান্তি ও নিরাপত্তার দায়িতে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ পরিবার সংগঠনকে খতম করে বসে আছে। অপর দিকে সরকার দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন দলের যুব শাখা প্রতিষ্ঠাকে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখছে এবং তাদেরকে সাহায্যও করছে। এ ধরনের গ্রুপ সৃষ্টি করায় মারাত্মক ক্ষতিও আছে। কেননা এভবে ছাত্র সমাজের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে নৈরাজ্য ও সন্ত্রসী তৎপরতাও। এসর গ্রুপের সাথে সংশ্লিষ্ট ছাত্রগণ তাদের শিক্ষা জীবন সমাপনের পর কর্মজীবনেও একে অন্যের বিরুদ্ধে খড়গ হস্ত ও মারমুখী ভূমিকা পালন করে থকে। যে কাজ অন্যদের জন্য অনুমোদনযোগ্য তাই আমাদের জন্য নিষিদ্ধ। আমরা (আমাদের সরকার) কবে নাগাদ যাবতীয় টালবাহানা বাদ দিয়ে সোজা সরল পথ অবলম্বনের উদ্যোগ গ্রহণ করবো।
বলে দিন যে, সেই সুদিন হয়তো খুব বেশী দূরে নয়!
গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের পার্থক্য
আমরা আল্লাহ্ তায়ালার নিকট সর্বদা এই মর্মে দোয়া করছি যেন তিনি মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সরকার প্রধানদেরকে সিরাতুল মুসতাকিমের ওপর সর্বদা অবিচলভাবে চলার প্রয়োজনীয় হোদায়াত দান করেন। আজ পরিস্থিতি এমন পর্যয়ে গিয়ে উপনীত হয়েছে যে, আমাদের দেশগুলোতে সংবাদপত্রগুলোকে লাল ব্যানার হেডে এই সচিত্র সংবাদ ছাপাতে হয় যে, অমুক রাষ্ট্র প্রধান কিংবা সরকারী কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যাক্তিত্ব খোলা গাড়ীতে করে অমুক জায়গায় পরিদর্শনে গিয়েছেন। যেন কোন অস্বাভাবিক ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। যে সম্পর্কে পাঠকদের অবহিত করা জরুরী। মূলত এ শাসকগোষ্ঠী তাদের গৃহীত আচরণ ও কর্মকান্ডের ফলে জনগণের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছে। ফলে তার সর্বদা তাদের জীবন বিপন্ন দেখতে পায়। মিথ্যা ধারণা দেয়ার জন্য কখনো কখানো এমন প্রদর্শনীর মহড়া দেয়া হয়ে থাকে যা অত্যন্ত হাস্যকর এবং কৃত্রিমতার নমুনা বলে মনে হয়। যদি কোন শাসনকর্তা তার দেশবাসীর নিকট নিরাপদ থাকতে না পারে তবে তার জন্য নিরাপত্তার জায়গা কোথায় পাওয়া যাবে?
উন্নত বিশ্বির রাষ্ট্রগুলোতে বড় বড় অফিসার ও রাজকর্মচারীগণ এমন কি রাষ্ট্র প্রধানগণও খোলা গাড়ীতে চড়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়ান অথচ কোন ব্যক্তি তাদের প্রতি একটুখানি বিম্ময় বিস্ফরিত নেত্রে ফিরেও তাকায় না। কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রপতিদের ব্যাপারেতো এতদূর সুখ্যাতি রয়েছে যে, তারা তদের দেশের রাজপথে সাধারণ মানুষের ন্যায় নিশ্চিন্ত মনে মোটর সাইকেলে আরোহণ করে দিবারাত্র ঘোরাফেরা করে থাকেন। যদি কখনো কোন দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়ও তাহলে বলা যায় যে, যতদিন দুনিলা টিকে থাকবে ততদিন এরূপ দুর্ঘটনা ঘটতে থাকবে। রিগানের ওপর প্রাণ নাশী হামলা করা হয়েছিল। বর্তমান রোমান ক্যাথলিক পোপের ওপরও অনুরূপ আক্রমণ করা হয়ছিল এবং জন কেনেডিকে হত্যঅ পর্যন্ত করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও ঐসব দেশের সংবাদপত্রে লাল ব্যানার হেডে কখনো এ খবর প্রকাশিত হয় না যে, অমুক রাষ্ট্র প্রধান খোলা গাড়ীতে করে অমুক শহরে গিয়েছিলেন।
ইখওয়ানুল মুসলিমুন ও অস্ত্র প্রশিক্ষণ
ইখওয়ানুল মুসলিমুন ইয়ামান অথবা জার্মানীতে অস্ত্র ব্যবহারের ট্রেনিং নিচ্ছে এ ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এ ধরনের অপবাদ আরোপকারীদের বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে। আমরা আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলতে চাই যে, এ অপরাধ থেকে আমরা সম্পূর্ণ মুক্ত। ধরা যাক তর্কের খাতিরে আমরা না হয় মেনেই নিলাম যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন অস্ত্র ব্যবহারের ট্রেনিং গ্রহণ করেছে। এই অভিযোগ আরোপকারীরা কি জানে না যে, ইয়ামানে প্রত্যেক ব্যক্তি প্রকাশ্যে তার অস্ত্র নিয়ে চলা ফেরা করে এবং প্রত্যেক ইয়ামানী নিজের কাছে তলোয়ার রাখা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে। যদি কোন ইয়ামানবাসী ইখওয়ানীকে তার দেশের অন্যান্য অধিবাসীদের মত অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করতে দেখা যায় তাহলে এরূপ মন্তব্য করা কি সমীচিন হবে যে, আমরা এসব অস্ত্রশস্ত্রকে মিসরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের নামান্তর বলে অভিহিত করবো? আল্লাহই ভাল জানেন এসব লোক এ ধরনের অবান্তর কথাবার্তা বলে বেড়ানোতে কি ধরনের আনন্দ বোধ করে? যদি দশ বিশ একশ জন ইখওয়ানের নিকট অস্ত্রশস্ত্র থেকেও থাকে তাহলে তা লক্ষ লক্ষ সশস্ত্র সেনা, পুলিশ এবং সিকিউুরিটির বিরুদ্ধে মিসরে কি করতে পারবে? যদি কোন মিসরীয় ইখওয়ানী জীবিকার সন্ধানে ইয়ামানে চলে যায় তাহলে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তার সাথে অত্যন্ত অসৌজন্যমূলক আচরণের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা হয়। অথচ বেচারা সেখানে অতি কষ্টে তার জীবিকা আহরণেল জন্য সময় বের করে। অস্ত্রের ট্রেনিং যার জন্য পর্যপ্ত অবকাশের প্রয়োজন তা কি করে তার জন্য এত সুলভ হতে পারে? আজ পর্যন্ত এরা কোন ইখওয়ানীর বিরুদ্ধে অস্ত্রের ট্রেনিংয়ের ব্যাপারে একটা প্রমাণও কোন আদালতে পেশ করতে সমর্থ হয়নি। তথাপি ঢোল অনবরত বাজিয়ে চলেছেন।
আমি কয়েক বার জার্মানীতে গিয়েছি। আমি সেখানকার সিকিউরিটি অফিসারদেরকে কোনে কোন সময় প্রশ্ন করেছি যে, জার্মানীর জংগলে কি মানুষকে অস্ত্রের ট্রেনিং দেয়ার অনুমতি আছে?” প্রত্যুত্তরে তারা বলেছে কখখনো নয়। কেননা জার্মানীর আইন এটা অপরাধ এবং এ অপরাধের জন্য অত্যন্ত কঠোর মাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।

ভিন্ন ভিন্ন মানদন্ড
মুসলিম জাহানের দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণের জন্য কি সেই সময় আসেনি যখন তারা চোখ খুলে বাস্তবতাকে মেনে নেবে। ইখওয়ানুল মুসলিমুন এ ধরনের কাজ থেকে বহু দূরে থাকে এবং আল্লাহ তাদেরকে এমন বিবেক-বুদ্ধি দান করেছেন যে তারা অবৈধ কর্মকান্ডের সাথে জড়িত হয় না। নিবাপত্তা বিভাগের লোকেরা ইখওয়ান ব্যতীত আর কারো পক্ষ থেকে বিপদ দেখতে পায় না। এমনকি একটি আরব দেশের জনৈক দায়িত্বশীল ব্যক্তি এরূপ মন্তব্য করতেও দ্বিধা করেননি যে, ইখওয়ান ইহুদীবাদীদের চেয়েও অধিক বিপজ্জনক। একটু অনুমান করুন যে, এই লোকদের বিবেক-বুদ্ধি কোন্ পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়েছে? দুনিয়ার কোন প্রত্যন্ত এলাকায়ও যদি কোন মানুষকে কষ্ট দেয়া হয় তাহলে পাশ্চাত্যের তথাকথিত সভ্য জগতে হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু মুসলমান এবং বিশেষ করে ইখওয়ানের ব্যাপারে সভ্যতার ঝান্ডবাহীদের আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদেরকে জঘন্যতম নির্যাতনের শিকার বানানো হলেও কেউ টু শব্দ পর্যন্ত করে না। “ আল আহরার” পত্রিকায় আমি উস্তাদ আল ফারুক আবদুস সালামের একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম যাতে তিনি আমাদের সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন যে, আমরা কারো কোন সাহায্যের মুখাপেক্ষী নই। বরং আমাদের জন্য মহীয়ান গরীয়ান সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাহায্যই যথেস্ট।

তাঁরই সম্মুখে আনুগত্যের মস্তক রয়েছে অবনত
গণপ্রজাতন্ত্রী সুদানের প্রেসিডেন্ট সাইয়েদ জাফর নিমেরী তাঁর দেশে ইসলামী শরীয়াত কার্যতরী করার ঘোষণা দিলে আমরা যারপরনেই উল্লসিত হই। দৈনিক ‘আল আখবারের’ কর্মকর্তাদের একজন আমাকে অনুরোধ জানয় যে, আমি যেন সুদানী পার্লামেন্টের মুখপত্রে প্রকাশ করার জন্য এই বিষয়ে প্রতিবেদন লিখে পাঠাই। সেই সময় কতিপয় লোক এরূপ প্রপাগান্ডা চালাচ্ছিলো যে, নিমেরী সাহেবের নিয়াত পরিষ্কার নয়। তিনি শুধু তার পতনোম্মুখ রাজনৈতিক প্রভাব পুনরুদ্ধার করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরুপ প্রচারণায় আমার অন্তরে বিন্দুমাত্র প্রভাব সৃষ্টি হয়নি। আমি ধারণা করেছিলাম, যদি এই ঘোষণায় কিছু দুর্বলতা থেকেও থাকে তবুও পরবর্তী সময়ে তা সংশোধন করে নেয়া যেতে পারে। অন্ততপক্ষে সঠিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা তো প্রদান করা হয়েছে..............সেই সময়েই প্রেসিডেন্ট জাফর নিমেরীর সাক্ষাতকার কোন কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যা দেখে আমি বিম্ময় বিমূঢ় হয়ে পড়ি। আমাদের সুনাম সুখ্যাতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি এ মন্তব্য করতে কসুর করেননি যে, “ইখওয়ানুল মুসলিমুন” প্রকৃতপক্ষে শয়তানের ভাই। আমি এই খবর পড়ে মনে মনে বলেছিলামঃ
দেখ সে-ও বলছে যে, এরা সম্পূর্ণ চরিত্রহীন। এই যদি আমার জানা থাকতো। তাহলে আমি আমার বাড়ী ঘর বিলিয়ে দিতাম না।
আমাদের ইখওয়ানী ভাইয়েরা সুদানে নিমেরী সাহেবের হাতে বাইয়াত করেছেন এবং সুদানের ইখওয়ানের প্রধান ডাক্তার হাসান আল তুরাবী সদর নিমেরীর উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়েছেন। এরপরও আপনার তার বিবৃতি লক্ষ্য করেছেন যেন তাতে কি ধরনের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আহ! আমাদের শাসকরা যদি নিজেদের এই আচরণের পূর্ণমূল্যায়ন করতো! এই ভারসাম্যহীন কর্মতৎপরতা আর কতদিন অব্যাহত থাকবে। নিয়াতের অবস্থা তো আল্লাহই ভাল জনেন। আর উত্তম পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, আমরা নিয়াতের ফায়সালা সেই মহান সত্তার ওপরই ছেড়ে দেবো যিনি মানুষ ও তার অন্তরের মধ্যে আছেন এবং যার নিকট কোন নিষয়ই গোপন নেই। আর আমার ব্যাপার হলো, আমি কারো সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করি না।
আল আহরাম পত্রিকা আমার সম্পর্কেও একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেই সময় মিসর ও সুদানের মধ্যে ঐক্যের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা চলছিল। প্রতিবেদক আমার সাথে সম্পর্কিত করে লিখেছিল যে, আমি মিসর ও সুদানের পূর্ণাঙ্গ ঐক্যের দাবীদার। আমি বলতে চাই, এই মন্তব্য যথার্থ। দু’টি দেশের সামগ্রিক কল্যাণ-এর মধ্যেই নিহিত যে, তারা একই জাতি ও একই রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যাক। এতে সমগ্র মুসলিম জাহানই লাভবান হবে। এ একটা প্রত্যাশা মাত্র। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার জন্য কিছুই অসম্বব নয়। এই আকাংখাকে তিনি অদূর ভবিষ্যতে বাস্তবে রুপায়িত করে দেবেন।
মিসরেও শরীয়াতেকে সব আইনের উৎস নির্ধারণ করা হয়েছে। অপরদিকে সুদান সরকারও এই উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। নিঃসেন্দেহে দু’টি দেশেই শাসন ব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থাকে শরীয়াতের আলোকে ঢেলে সাজালে ঐক্য ও সংহতির পক্ষে তা হবে শুভ পদক্ষেপ। আমি আল্লাহ তায়ালার নিকট দোয়া করছি তিনি যেন আমার এই মনোবাঞ্চা পূর্ণ করে দেন।
তোমার বাহুতো তাওহীদের শক্তিতে শক্তিশালী
ইসলামই তোমার দেশ আর তুমি মোস্তফারই অনুসারী।

আমেরিকান দূতাবাসের যোগাযোগ
১৯৭৯,১৯৮০ এবং ১৯৮১ সালে কায়রোস্থ আমেরিকান দূতাবাসের প্রেস এটাচি মিষ্টার জোশেফ লরেন্স আমার সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে মিলিত হন। “আদ দাওয়া” পত্রিকার মাধ্যমে তিনি যকন সর্বপ্রথম আমার সহিত মিলিত হন তখন খুবই ভাল আবেগ অনুভুতি প্রকাশ করেন। তাঁর সাথে ছিলেন তারই দোভাষী সিরানাদিয়াতুল কিলানী। এসব সাক্ষাতকার সম্পর্কে আমি তাৎক্ষণিকভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে ছিলাম। কেননা মিষ্টার ইভান্সের ব্যাপারটি আমার তখনো পর্যন্ত মনে ছিল। (ইতিপূর্বে আমিস এই বিষয়ের উল্লেখ করে এসেছি)। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব সাক্ষাতকারের কোন বিরোধিতা করেনি। যদি তারা আপত্তি উত্থাপন করতো তাহলে আমি সাথে সাথে মিষ্টার জোশেফের ব্যাপারে কোন প্রকার সংশয়- সন্দেহ সৃষ্টি হতে দেয়ার পক্ষপাতি ছিলাম না।
১৯৮০ সালের জুন মাসে কায়রোস্থ বৃটিশ দূতাবাসের লোকজন আমার সাথে যোগাযোগ করে এবং আমাকে এই মর্মে অবহিত করে যে, বৃটিনের প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী “আদ দাওয়া” পত্রিকার অফিসে আসতে চান। আমি বললামঃ এই আগমনের উদ্দেশ্য যদি পারস্পরিক পরিচিতি এবং অফিসের কাজকর্ম সম্পর্কে অবগতি লাভ করা ও অন্যান্য প্রশাসনিক বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট হয় তাহলে স্বগতম আর যদি সাক্ষাতের উদ্দেশ্যেই হয় রাজনৈতিক আলোচনা করা তাহলে আমি আমার অক্ষমতা প্রকাশ করছি।” ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আমাদের দপ্তরে আগমনের প্রোগ্রাম বাতিল করে দেয়। তৎকালে পার্লামেন্টের নির্দলীয় সদস্য এবং বিরোধীদলের রাজনৈতিক দলগুলো অধিকাংশ সময় প্রেম কনফারেন্সে মিলিত হতেন এবং সরকারের ওপর এলোপাথাড়ী আক্রমণ চালাতেন। আমরা ছিলাম সম্পূর্ণ নীরব। তা সত্ত্বেও আমাদের ওপর কঠোর প্রহরা লাগানো হয়েছিল। এই কর্মপদ্ধতির কি কোন ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব? সম্ভবত বিষয়টি এতই সুস্পষ্ট যে তা কোন প্রকার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না।....-এমনিতেই আমরা সকল কঠোরতাকে সহ্য করতাম। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, সেদিনটি অবশ্যই আসবে যেদিন কোন রকম কম বেশী ছাড়াই আমাদের সকল কর্মকান্ডের চুলচেরা হিসেবে হবে এবং সত্য ও মিথ্যার মাঝে সীমারেখা টেনে দেয়া হবে।
“আদ দাওয়া” অফিসে ইহুদী বুদ্ধিজীবিদের আগমন

সুধী পাঠক বৃন্দ নিশ্চয়ই বিস্মিত হবেন না যে, তেল আবিব ইউনিভারসিটির চারজন শিক্ষক “আদ দাওয়া” সাময়িকীর দপ্তরে আগমন করেন। তখন আমি ছিলাম দেশের বাইরে। সম্মনিত ও মহামান্য ভ্রাতা মোস্তফা মাশহুরের সাথে তাদের আলাপ হয়। মোস্তফা মশহুর অত্যন্ত বুদ্ধিমাত্তা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা ও ভারসাম্যপূর্ণভাবে এবং ইসলামী শিষ্টাচার ও শালীনতা সৌজন্যের সাথে এই মেহমানদের সাথে কথা বলেন। আলোচনার ফাঁকে ইহুদী অধ্যাপকগণের একজন বলেন “মিসরে শান্তি চুক্তির যে বিরোধিতা করা হচ্ছে তা আমাদের নিকট কোন বিস্ময় উদ্রেককারী ব্যাপার নয়। কেননা ইস্রাঈলেও এই চুক্তির বিরোধিতাকারীঃ “আামদের এখানে এই চুক্তির বিরোধিতা করা হচ্ছে এ জন্যে যে, এ চুক্তির সাহায্যে ফিলিস্তিন জাতির সমস্ত অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে আপনাদের ওখানে এর বিরুদ্ধাচরণ করা হচ্ছে এ জন্য যে, আরো অধিকার কেন কেড়ে নেয়া হলো না? আগত অতিথিগণ পত্যুত্তরে মৃদু হাসির রেখা মুখে ফুটিয়ে তোলা ছাড়া আর কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে সমর্থ হয়নি।
তারা যখন আমাদের দফতরে এসে উপস্থিত হন তখন দপ্তরে উপস্থিত ইখওয়ান ইসলামী রীতি পদ্ধতি অনুযায়ী মার্জিতভাবে তাদেরকে সাদর অর্ভ্যথনা জ্ঞাপন করেন। এবং অনুরূপভাবে তাদের বিদায় অভিবাদনও জানিয়ে বিদায় করেন। কিন্তু এভাবে ইহুদীদের আমাদের দেশে আগমন তাদের উগ্র ও একরোখা মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। তাদের সশরীরের আগমন যেন বাস্তবে একথাই বলছে যে, “আমরা এসে গেছি তোমাদের সরকার সরকারীভাবে ফিলিস্তিনে আমাদের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। আমাদের বিরুদ্ধাচরণ ও স্নায়ু যুদ্ধের সূচনা করে তোমরা আমাদের কি কেড়ে নিতে পেরেছো?
তাদের গর্বিত আচরণ এবং আমাদের দেশে বুক টান করে বেড়ানো আমাদের কাছে বিষসদৃশ্য মনে হয়। তা সত্ত্বেও যখনই তারা আমাদের অফিসে এসে যায় তখন আমরা তাদের সাথে ইসলামী নৈতিক চরিত্র ও শিষ্টাচারের প্রদর্শনী করাকে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব বলে মানে করি। এরূপ পরিস্থিতিতে আমরা কখনো তাদের অপমান করার চেষ্টা করিনি। তবে এটাও ধ্রুব সত্য যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুনের প্রতি যে পরিমাণ বিদ্বেষ ঘৃণা ইস্রাঈলের রয়েছে তেমনটি সারা দুনিয়ায় আর কারো নেই।
ইখওয়ানকে সন্ত্রাসী, রক্ত পিপাসু গোঁড়া এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগীর অধিকারী প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। ইস্রাঈলী রাশিয়ান ও আমেরিকান থেকে প্রতিদিন আমাদের এসব উপাধি প্রচারিত হয়ে থাকে।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের আতিথেয়তা
এখানে গণপ্রজাতন্ত্রী পকিস্তানের পেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হকের কিছু কীর্তিগাথা আলোচনা করাটা জরুরী বলে মনে করি। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের আমন্ত্রণক্রমে তাদের মেহমান হিসেবে আমি পাকিস্তানে গিয়েছিলাম। জেনারেল জিয়াউল হক যখন বিষয়টি জানতে পারেন তখন তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, আমি যতদিন পাকিস্তানে অবস্থান করবো ততদিন যেন তার আতিথেয়তা গ্রহণ করি। আমার জন্য তিনি একটা বিশেষ গাড়ী ও একজন দেহরক্ষী পাঠিয়ে দেন। প্রেসিডেন্ট ভবনে তিনি নিজে আমাকে সাদর অর্ভ্যথনা জ্ঞাপন করেন। আমি যখন তার সাথে মিলিত হওয়ার জন্য যাই তখন জনাব মিয়া তোফায়েল মুহাম্মাদ (আমীর জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান), জনাব খলীল হামেদী এবং দু’জন ইখওয়ানী সাথী জনাব মোস্তফা মাশহুর ও জনাব ইবরাহীম শারফ আমার সাথে ছিলেন। প্রেসিডেন্ট সাহেব আমাদের সাথে আন্তরিকতা এবং সৌভ্রাতৃত্বমূলক আচরণ করেন। পাকিস্তানের অনেক মূল্যবান পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করলেন যার উদ্দেশ্য ইসলামী পুণর্জাগরণ যেমন প্রাইমারী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ স্তব পর্যন্ত বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে আরবী ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করা ইত্যাদি। আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি যে মহামান্য প্রেসিডেন্টকে তার যেসব নিষ্ঠাপূর্ণ প্রয়াস প্রচেষ্টা মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ সাধন করতে উদ্যোগী হয়েছেন তা যেন সফলতা লাভ করে এবং স্বীয় দেশ মাতৃকার মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধির জন্য তাঁর মহৎ আকাংখাগুলোকে বাস্তবরূপ দান করেন।
আফগান জিহাদ এবং ইখওয়ানুল মুসলিমুন
আফগানিস্তানে উদ্ভূত বেদনাদায়ক পরিস্থিতির উল্লেখ করা একান্ত প্রয়োজন। মুসলিম উম্মাহর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের বিরুদ্ধে নিকৃষ্টতম এই পাশবিক হামলা রাশিয়া এবং আমেরিকার মুসলিম জাহানের বিরুদ্ধে সম্মিলিত চক্রান্তের ফল মাত্র। আফগানিস্তানকে জবর দখল করার এ দু’টি দেশের পূর্ণাংগ ঐকমত্যে হয়েছেল। আমেরিকার পক্ষ থেকে মৌখিক জমাখরচ আর মাঝেমধ্যে রাশিয়ার নিন্দায় দু’য়েকটি করে বিবৃতি প্রদান দুনিয়াবাসীর চোখে ধূলা নিক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছু নয়। আমার আফসোস যে, মিসিরীয় জাতি সামষ্টিকভাবে এই নাজুক সমস্যার ব্যাপারে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার কথা তা করেনে। এই জবর দখলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনী মুক্তি সংস্থার ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ নেতিবাচক। তারা জবরদখলকারী রুশ একনায়কত্বকে খোলাখুলি সমর্থন করেছে। যতদূর পর্যন্ত ইখওয়ানুল মুসলিমুন আফগানিস্তানের সমস্যাকে তাদের নিজেদের সমস্যা বলে মনে করে। সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে আমাদের ভূমিকা সর্বদাই ইতিবাচক এবং বাস্তবসম্মত। এই সমস্যার বিশদ আলোচনা-পর্যালোচনার জন্য আমরা আল আযহারে এক কনফারেন্সের আয়োজন করি। এতে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্র থেকে উল্লেখযোগ্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। ইখওয়ানুল মুসলিমুন আফগানিস্তানের জিহাদে কার্যত যোগদান করার জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে আবেদন করেন। যার ফলে যুবকরা উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে “আদ দাওয়া” পত্রিকার অফিসে এসে নিজ নিজ নাম ও ঠিকানা তালিকাভুক্ত করে। জিহাদী প্রেরণায় উজ্জীবিত এসব যুবক তাদের আফগান ভাইদের কাঁধ মিলিয়ে রাশিয়ান সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত মিসর সরকার তাদেরকে দেশের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। ওপরে যে কনফারেন্সের উল্লেক করা হয়েছে তাতে আমি উপস্থিত লোকদেরকে একটা কতা বলেছিলাম, তাহলো মিসর সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণের ভাষ্য অনুযায়ী আফগানিস্তানের মুজাহিদদেরকে মিসর থেকে অস্ত্রশস্ত্র পাঠানো হচ্ছিলো। কর্তা ব্যক্তিদের মুখে যখন আমি এই খবর শুনতে পাই তখন স্বভাবগতভাবেই খুবই আনন্দ বোধ হয়। কিন্তু আমার এটা জানা নেই যে, বাস্তবিকই কথিত এই অস্ত্রশস্ত্র মুজাহিদদের হাতে গিয়ে পৌছছে নাকি মাত্র পাবলিসিটির স্বার্থে আমার নিকট এই বিবৃতি প্রদান করানো হয়েছে।
একথা বলতে আমার কোন বাধা নেই যে, মিসর থেকে অন্যান্য দেশে চলে যাওয়া ইখওয়ান কথায় ও কাজে সকল প্রকারে তাদের আফগান ভাইদেরকে সাধ্যনুযায়ী সাহায্য করছে। তারা ঔষধপত্রও সংগ্রহ করে এবং চিকিৎসকদেরকেও সেখানে প্রেরণ করতে থাকে। এতদ্ব্যতীত তারা বেশ কিছু সংখ্যক ভ্রাম্যমান চিকিৎসা কেন্দ্র ও আফগান মুজাহিদ ও মুহাজিরগণের জন্য খুলেছে.........এসব খিদমত প্রশংসনীয় ও মূল্যবান। কিন্তু একটা সুপার পাওয়ারের সামনে বাঁধা বাঁধার জন্য এসব প্রচেষ্টা মহাসমুদ্রের বিপুল জলরাশির মধ্যে বারি কণা অপেক্ষা বেশি কিছু নয়। এ বিষয়ের অধিক কিছু বলা উদ্দেশ্য নয়। আল্লাহ তায়ালাই ভাল জানেন আফগানিস্তানের জিহাদের ব্যাপারে ইখওয়ানের আবেগ ও অনুভূতি কেমন।
হয়তো আমার কথা তোমার ভাল লাগবে
প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ হোসনী মোবারক কিছু ভাল পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তার প্রেসিডেন্টশীপের শুরু করেন। রাজনৈতিক বন্দী এবং নজরবন্দীদের মুক্তি প্রদান করেন। এবং সংবাদপত্র সাময়িকীকে সমালোচনা করার অধিকার প্রদান করা হয়।
এই মহতি উদ্যেগের সাথে সাথে এমন কতিপয় বিষয় রয়েছে যাতে সংস্কার আনয়ন করা আবশ্যক। উদাহরণ স্বরূপ প্রেসিডেন্ট একই সাথে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলেরও প্রধান। তাঁকে এই দু’টির মধ্যে যে কোন একটা পদই রাখা উচিত।
মানুষ আমাকে একথাও জিজ্ঞেস করে যে, তোমরা রাষ্ট্রপতি হোসনী মোবারকের সাথে এখনো পর্যন্ত সাক্ষাত করতে যাওনি কেন? যেভাবে মেলামেশা করতে পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টগণের সাথে। এর জবাব হচ্ছে, সাক্ষাতের এ বিষয়টি প্রেসিডেন্টের এখতিয়ারাধীন কারো সাথে মিলিত হওয়া না হওয়ায় আমাদের মান-সম্মানের কোন হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না। তথাপি প্রেসিডেন্ট যদি আমার সাথে সাক্ষাত করতে চান তাহলে তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।
নির্বাচনী ময়দানে
১৯৮১ সাথে যখন আমি জেলখানা থেকে মুক্তি লাভ করি তখন ইখওয়ানের ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকার কারণে আমাদের কর্মতৎপরতা কিভাবে গতিদান করতে পারি। ইত্যবসরে আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য রাস্তা খুলে দেন। দেখতে দেখতে পার্লামেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা হয়ে যায়। আমরা এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে চেষ্টা করি। এমনকি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য পথও সুগম করে ফেলি।
প্রথম প্রথম আমাদের ধারণা ছিল যে, পৃথক নির্বাচনী এলাকার ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এটা একদিক থেকে আমাদের জন্য ছিল একটা কঠিন অবস্থা। কেননা এই পদ্ধতিতে নির্বাচনী যুদ্ধে খরচ পড়ে অনেক বেশী। যা বহন করার শক্তি ও সামর্থ আমাদের ছিল না। সরকারী দল তাদের নিজেদের স্বার্থে সারা দেশে এমনভাবে নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ করে যেন তাতে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্যের সাহয্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যদিও এরূপ নির্বাচন প্রক্রিয়া অনুরূপ প্রতিনিধিত্বের মূলনীতি থেকেও ছিল সুস্পষ্ট পদঙ্খলন। কেননা এটা ছিল দুনিয়াতে এ ধরনের একমাত্র নির্বাচন পদ্ধতি। সে যাই হোক এই পদ্ধতির নির্বাচনে বহু কম খরচ নির্বাচনী যুদ্ধে মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল। সরকারী দল বহু প্রপাহান্ডা চালায় যে, বাহির থেকে ইখওয়ানের জন্য লক্ষ লক্ষ পাউন্ড সাহায্য আসছে। আমাদের জানা নেই এই সাহায্য কোথায় চলে গেছে? আমাদের হাতে পর্যন্ত তো এসে পৌছায়নি। নতুন এই নিয়মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যদিও খরচ হয়েছে অপেক্ষাকৃত কম। তথাপি আমরা আজ পর্যন্ত নির্বাচনী খরচের জন্য গৃহীত ঋণের বোঝা টেনে যাচ্ছি।
ইখওয়ানের বাজেট সদস্য ও কর্মীদের এয়ানত দ্বারা পুরো হয়ে থাকে। আমরা কখনো কোন সরকার কিংবা ইখওয়ানী ব্যক্তি এবং সংস্থার নিকট সাহায্যের হস্ত প্রসারিত করিনি। কিংবা গ্রহণ করিনি। নির্বাচনী ঋণও পর্যায়ক্রমে আমরা আমাদের কর্মী ও সদস্যগণের আর্থিক কুরবানীর সাহায্যে ইনশাআল্লাহ পরিশোধ করেত সক্ষম হবো।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি