মুখ্য বিষয়সমূহ
লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
আবদুল জব্বার (জ্যোতির্বিজ্ঞানী)
মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (জন্ম : ১৯১৫ - মৃত্যু : জুলাই ২০, ১৯৯৩) বাংলাদেশে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার অগ্রদূত। তিনিই প্রথম বাংলায় আকাশের তারাসমূহের ছক তৈরি করেন। তার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও পরিকল্পনায়ই বাংলাদেশের প্রথম খ-গোলক নির্মিত হয়। পেশাগত জীবনে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
জীবনী
মোহাম্মদ আবদুল জব্বার ১৯১৫ সালে পাবনা জেলার সুজানগর থানার গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অসাধারণ মেধাশক্তি ও ফলাফলের জন্য তিনি প্রাথমিক শিক্ষা থেকে একেবারে মাধ্যমিক পর্যন্ত বৃত্তি পান। ১৯৩৮ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিশুদ্ধ গণিতে অনার্সসহ এম.এস.সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেছিলেন। এরপর ১৯৩৯ সালে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করতে লন্ডন যান। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তাকে ভারত সরকারের নির্দেশেই ফিরে আসতে হয়। দেশে ফিরে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে প্রভাষক হিসেবে চাকরি করেন। এরপর যোগ দেন চট্টগ্রাম কলেজে এবং সেখান থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজে।
১৯৪৮ সালে গণিত বিভাগের প্রধান হিসেবে তৎকালীন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান বুয়েট) যোগ দেন। এখানে প্রায় পনের বছর গণিত বিভাগের প্রধান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। শিক্ষকতার জীবনের শেষদিকে এসে তিনি প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের দায়িত্ব পান। ১৯৬২ সালে আহসানউল্লাহ ইঞ্জনিয়ারিং কলেজ পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। মোহাম্মদ আবদুল জব্বার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৬৮ সালে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কল্যাণ পরিচালক পদে নিযুক্ত হন এবং এই পদ থেকেই ১৯৮০ সালে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৪ সালে আবার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের (রূপান্তরিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক এম. এ. রশীদের নামে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় ডঃ রশীদ ফাউন্ডেশন। প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ আবদুল জব্বারকেই সর্বপ্রথম 'ড. রশীদ অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল জব্বার পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৩ সালের ২০ জুলাই তারিখে মৃত্যুবরণ করেন।
শিক্ষাজীবন
জন্মস্থান পাবনা জেলার সুজানগর থানার গোপালপুর গ্রাম। দুই বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে আবদুল জব্বার ছিলেন সবার ছোট। মিয়াজান মল্লিক প্রথম জীবনে মাঝি ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি স্বাধীনভাবে ছোট ছোট ব্যবসা শুরু করেন এবং এই ব্যবসার সীমিত আয় দিয়েই সংসার চালাতেন তিনি। মিয়াজান মল্লিক তাঁর বড় ছেলে মোহাম্মদ আবিদ আলীকে প্রথমে গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করান। পাঠশালার হেডপণ্ডিত শশী ভূষণ দাস মেধাবী আবিদ আলীকে বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেন। বৃত্তি পরীক্ষায় আবিদ আলী জেলার সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম হয়ে মাসিক দুই টাকা বৃত্তি লাভ করেন এবং স্কুলে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পান। আবদুল জব্বার এবং তাঁর মেজো ভাই আকবর আলীকেও হেডপণ্ডিত পাঠশালায় বিনাবেতনে পড়ার সুযোগ দেন।
গোপালপুর পাঠশালা থেকে বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মোহাম্মদ আবদুল জব্বার নিশ্চিন্তপুর উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর ১৯৩২ সালে সাতবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসেবে লেটারসহ ম্যাট্রিক পাস করেন। একই বছর তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে আই.এসসি. ভর্তি হন। ১৯৩৪ সালে তিনি এই কলেজ থেকে গণিতে লেটারসহ কৃতিত্বের সঙ্গে আই.এসসি. পাস করেন। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মুসলমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং বৃত্তি লাভ করেন। এরপর গণিতে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে বি.এসসি. ভর্তি হন তিনি। মেজো ভাই আকবর আলীর মতো রসায়নে অনার্স নিয়ে বি.এসসি. পড়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর। কিন্তু আই.এসসি. পরীক্ষায় গণিতে লেটার পাওয়ায় প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন বিভাগের তৎকালীন প্রধান ড. কুদরত-এ-খুদার পরামর্শে তিনি গণিত বিষয়ে অনার্স পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে গণিতে অনার্সসহ বি.এসসি. পাস করেন। মাত্র অল্প কয়েক নম্বরের জন্য তিনি প্রথম বিভাগ পান নি। এরপর গণিত বিষয়ে এম.এসসি. ডিগ্রি লাভের জন্য তিনি পড়াশোনা শুরু করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনিযুক্ত জার্মান অধ্যাপক এফ. ডব্লিউ. লেভি এম.এসসি. শ্রেণিতে মডার্ন অ্যালজেবরা নামে একটি নতুন বিষয় প্রবর্তন করেন। এই নতুন বিষয়ের একমাত্র ছাত্র ছিলেন আবদুল জব্বার। ১৯৩৮ সালে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এসসি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
গবেষণা[সম্পাদনা]
এম.এসসি. পাস করার পর অধ্যাপক লেভির সুপারিশে আবদুল জব্বার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গবেষণা-বৃত্তি লাভ করেন। এ বৃত্তি নিয়ে অধ্যাপক লেভির তত্ত্বাবধানে গবেষণা কাজ শুরু করেন তিনি। একইসঙ্গে তিনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের শুদ্ধ গণিত (পিওর ম্যাথমেটিক্স) বিভাগের প্রভাষক নিযুক্ত হন। সে-সময় তৎকালীন সরকার ফরেন স্কলারশিপ চালু করেন এবং আবদুল জব্বার এই স্কলারশিপ লাভ করেন। এই স্কলারশিপ অর্জনের মধ্য দিয়ে আবদুল জব্বারের বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করে তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ এলো। শুভানুধ্যায়ী অধ্যাপক লেভির পরামর্শে আবদুল জব্বার ডি.এসসি. ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে এমএস ডিগ্রির জন্য ভর্তি হন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে অবস্থিত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে আবদুল জব্বার ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর বোম্বাই থেকে জাহাজে ওঠেন। ইউরোপে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছে। বোম্বাই থেকে তাঁদের জাহাজ ছাড়ার দুইদিন পর ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ-সময় জার্মান যুদ্ধ্বজাহাজের অতর্কিত আক্রমণের আশঙ্কায় জাহাজের যাত্রাপথ পরিবর্তন করতে হয়। সুয়েজ খাল ধরে এগুনোর পরিবর্তে তাঁদের জাহাজ পুরো আফ্রিকা ঘুরে ব্রিটেনে পৌঁছায় নির্দিষ্ট সময়ের অনেকদিন পর। বিশ্বযুদ্ধের সেই অস্থির সময়ে আবদুল জব্বার একজন অধ্যাপকের অধীনে তাঁর পড়াশোনা শুরু করেন। যুদ্ধকালীন নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এক বছর গবেষণা করে তিনি যখন পিএইচডি ডিগ্রির জন্য মনোনীত হলেন, তখনই যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধির কারণে লন্ডনের সকল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে অন্যান্য সক্ষম লোকদের মতো আবদুল জব্বারের অধ্যাপককেও বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়। আবদুল জব্বার তখন অন্য কোনো অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে তাঁর কাজ শেষ করার চেষ্টা করতে থাকেন। এসময় ব্রিটিশ সরকার সব বিদেশীকে ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে যাবার আদেশ জারি করলে আবদুল জব্বার তাঁর উচ্চশিক্ষা অসমাপ্ত রেখেই দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন।
লন্ডন থেকে ফিরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক লেভির তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু করেন। অধ্যাপকের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি গবেষণা-বৃত্তি লাভ করেন তিনি। একইসঙ্গে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অবৈতনিক লেকচারার নিযুক্ত করা হয়। গবেষণা কাজের তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক লেভির সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ক সেমিনারগুলোতে যোগ দেয়ার সুযোগ হয় তাঁর। অধ্যাপকের সঙ্গে মিলিতভাবে কয়েকটি গবেষণা-নিবন্ধও তিনি প্রকাশ করেন এসময়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবৈতনিক প্রভাষক হিসেবে নিযুক্তির সময় তাঁকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে, পদ খালি হলে তাঁকে প্রভাষকের পদে স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হবে। কিন্তু এই আশ্বাস শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে ১৯৪৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে গণিতের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। কিছুদিন পর সেখান থেকে বদলি হয়ে তিনি ফিরে আসেন প্রেসিডেন্সি কলেজে।
কর্মজীবন[সম্পাদনা]
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর আবদুল জব্বার পাকিস্তানের কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য আবেদন করেন। প্রথমে তাঁকে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর কলেজে বদলি করা হয়। কিন্তু এর পরপরই কৃষ্ণনগর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলে তাঁকে রাজশাহী কলেজে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয়। বছরখানেক এই কলেজে থাকার পর ১৯৪৮ সালে তিনি নিযুক্ত হন তৎকালীন ঢাকা আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান হিসেবে। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি এই বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন। সেই বছরই আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হলে তিনি এর রেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন এবং ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত এই পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্রকল্যাণ পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ড. এম. এ. রশীদের নামে সম্মানসূচক পদ (চেয়ার)-এর সূচনা করা হয়। মোহাম্মদ আবদুল জব্বার প্রথমবারের মতো 'ড. রশীদ অধ্যাপক' নিযুক্ত হয়ে পুনরায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা[সম্পাদনা]
বাংলাদেশে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ এবং উপকরণ তিনিউ প্রথম সৃষ্টি করেন। ১৯৬২ - ৮২ সাল পর্যন্ত তার অঙ্কিত তারা চিত্র রাতের আকাশ নামে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হত। তার সার্বিক তত্ত্বাবধান এবং পরিকল্পনায় বাংলাদেশের প্রথম খ-গোলক (celestial globe) নির্মিত হয়। এই খ-গোলকটি বর্তমানে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশনে সংরক্ষিত আছে।
পুরস্কার ও সম্মাননা[সম্পাদনা]
বাংলা একাডেমীর ফেলো নির্বাচিত হন ১৯৮৪ সালে।
ডঃ কুদরত-ই-খুদা স্মৃতি পদক (১৯৮৫)
বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩)
একুশে পদক (১৯৮৫)
কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, অণুসন্ধিৎসু চক্র ও বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন যৌথভাবে তাকে ১৯৯০ সালে ব্রুনো পদকে ভূষিত করে।
রচনাবলী[সম্পাদনা]
বিশ্ব রহস্যে নিউটন ও আইনস্টাইন (১৯৪২)
খ-গোলক পরিচয় (১৯৬৫)
তারা পরিচিতি (১৯৬৭)
প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা (১৯৭৩)
বিশ্ব ও সৌরজগৎ (১৯৮৬)
আকাশ পট (১৯৮৯)
টেক্সট বুক অব ইন্টারমিডিয়েট স্টাটিসটিক্স
টেক্সট বুক অব ইন্টারমিডিয়েট ডাইনামিক্স
টেক্সট বুক অব ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস
টেক্সট বুক অব ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি
সংশ্লিষ্ট বই
তারা-পরিচিতি
লেখকঃ আবদুল জব্বার (জ্যোতির্বিজ্ঞানী)
প্রকাশনীঃ বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন
“তারা-পরিচিতি" মহাকাশ-গ্রন্থমালার দ্বিতীয় গ্রন্থ। অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ গন্তীর ভিতরেই আমার বক্তব্য সীমিত রাখতে হয়েছে। তারামণ্ডল নিয়ে অনেক গল্পকাহিনী প্রচলিত আছে; সেই সমস্ত গল্পের দিক লক্ষ্য রেখেই আমরা বক্তব্য বলবার চেষ্টা করেছি। আকাশের তারা চেনানোই এ বই-এর প্রধান উদ্দেশ্য। সেই প্রসঙ্গে তারার উজ্জ্বলতা, দূরত্ব, বিশেষত্ব এবং স্থানাঙ্ক প্রভৃতি এসে পড়েছে। তারা চিনতে মণ্ডল চেনা দরকার, আর মণ্ডলের প্রচলিত ছবির কাঠামো থেকেই মণ্ডলের অবস্থানের একটা স্থূল ধারণা করা যেতে পারে। কোন তারাটি ছবির কোন অংশে অবস্থিত, এ বিষয়টা জানতে পারলে, মণ্ডল ও তারা চেনা সহজ হয়ে পড়ে। তারাসমূহের নামকরণও অনেক সময় ছবিতে তারার অবস্থান অনুযায়ী করা হয়ে থাকে। যেমন, দেনেব শব্দের অর্থ লেজ, অর্থাৎ পাখীর লেজের তারাটির নামকরণ করা হয়েছে দেনেব। এই তারাটি চিনতে পারলে, পাখীর লেজ চেনা যেতে পারে এবং সেখান থেকে সমস্ত মণ্ডলটির কল্পনা করা সহজ হয়ে পড়ে। যদিও মণ্ডলের নাম এবং তারার নাম, ছবি ও ছবিতে তারার অবস্থান অনুযায়ী করা হয়ে থাকে, কিন্তু প্ৰত্যেকটি মণ্ডলকে কতগুলি রেখা দিয়ে রেখাচিত্রেও চিত্রিত করা হয়। যেমন, সপ্তর্ষিমণ্ডলকে যদিও একটি বড় ভালুক রূপে কল্পনা করা হয়ে থাকে, তথাপি এই মণ্ডলটির প্রধান কয়েকটি তারা যোগ করে, আকাশে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন বা হাতাওয়ালা পেয়ালাররূপে চিত্রিত করা হয়। ক্যাসিওপিয়া মণ্ডলকে যদিও সিংহাসনে উপবিষ্টা ইথিওপিয়ার রানীরূপে কল্পনা করা হয়ে থাকে, তথাপি এ মণ্ডলটিরও প্রধান কয়েকটি তারা যোগ করে M বা W এর মত চিত্রে চিত্রিত করা হয়। স্বভাবত এই দুই ভিন্ন প্রকার চিত্র, একটি কল্পনার ছবি, আর একটি রেখাচিত্র। এদের মধ্যে সম্বন্ধ জানতে এবং তুলনা করতে আগ্রহ হয়। এই আগ্রহ মিটানাের উদ্দেশ্যে এ বইতে এই দুই প্রকার চিত্ৰই পাশাপাশি সন্নিবেশ করা হয়েছে। অনুসন্ধিৎসু পাঠকের আগ্রহ তৃপ্তির এই চেষ্টাতে অবশ্য আমি অনেক জায়গায় সফল হতে পারি নি। কারণ, কোন কোন ক্ষেত্রে প্রাচীন ছবি পাওয়া যায় নি। তারামণ্ডলসমূহের প্রাচীন চিত্র সংগ্রহ করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। গ্ৰীক চারণ-কবিগণের কবিতাতে মণ্ডলসমূহের যে সমস্ত ছবির বর্ণনা দেওয়া আছে, আজকাল সেসমস্ত ছবি পাওয়া সম্ভব নয়। আমেরিকার কর্তৃত্বে আজকাল সমাজ-জীবনের প্রতিটি স্তরে যেমন বিরাট পরিবর্তন দেখা যায়, তারামণ্ডলের ছবিতেও তার স্পষ্ট স্বাক্ষর পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ আকাশের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল তারা লুব্ধক এবং ঐ তারা মণ্ডল মৃগব্যাধ মণ্ডলের উল্লেখ করা যেতে পারে। গ্ৰীক কবিতাতে বর্ণনা দেওয়া আছে, এখানে বড় একটি কুকুর (Canis Major) তার সামনের দুটাে পা উচু করে পিছনের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে, আর লুব্ধক সেই কুকুরের ডান দিকের মুখের তারা। কিন্তু বর্তমানে আমেরিকার তারার ছবিতে এখানে চারপায়ে দাঁড়ায়ে একটি শান্তশিষ্ট কুকুর দেখানো হয়, আর লুব্ধককে দেখানাে হয় তার বুকের তারারূপে। তারামণ্ডলসমূহের প্রাচীন ছবি সংগ্ৰহ করবার অনেক চেষ্টা করেছি। সে চেষ্টা আমার বিশেষ সফল হয় নি। অবশ্য পরে অপ্রত্যাশিতভাবে এই প্রাচীন চিত্ৰসম্বলিত একখানা বই আমার হাতে এসে পড়ে। ঢাকার ভূতপূর্ব নর্মাল স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, আমার অগ্ৰজপ্রতিম জনাব মোজাহার আলী সাহেব, তাদের স্কুলের পরিত্যক্ত কতকগুলি বই-এর স্তুপের ভিতরে Astronomy-র একখানা বই দেখতে পান এবং আমি এ বিষয়ে আগ্রহী জেনে বইখানা তিনি আমাকে দেন। বইখানার নাম School Atlas of Astronomy, লেখক Alex Keith Johnston; প্রকাশকাল ১৮৫৬ খ্রীস্টােব্দ। এই বইখানাতে প্ৰত্যেকটি মণ্ডলের প্রাচীন ছবি দেওয়া আছে, কিন্তু রেখাচিত্র দেওয়া নেই। <&-as f°(i(\o this firC2r, The subject of each illustration has been carefully studied and details have been Wrought Out at such an expense of time and labour as is seldom bestowed on an elementary book.fs scist fris, qê š-iris existric arris বছরেরও বেশী, তার উপরে অনেককাল অযত্নে রাখবার ফলে বইখানার অবস্থা এমন হয়েছে যে, তা থেকে সবগুলো ছবি উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। শিল্পী হাশেম খান সাহেবকে ভার দিয়েছিলাম ঐ সমস্ত অস্পষ্ট ছবিগুলো উদ্ধার করতে। এজন্য তিনি যে পরিশ্রম করেছেন, পারিশ্রমিকে তার শোধ হয় না। প্ৰত্যেকটি ছবি তাকে অনেকবার করে আঁকতে হয়েছে। প্ৰাচীন বিবরণের সঙ্গে মিলিয়ে প্রত্যেকটি ছবির একটা কল্পনা আমি তাকে দিয়েছিলাম, তা থেকেই। Johnston-এর বই-এর অস্পষ্ট ছবির কিছু সংখ্যক তিনি উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছেন। অনেকদিন অযত্নে ফেলে রাখার ফলে এ বই-এর ছবিগুলোর সমস্ত জায়গাতেই সাদা দাগে ভর্তি দেখা যায়। এতে কোনটি তারা আর কোনটি তারা নয়, বুঝতে পারা মুস্কিল। সে জন্য Callatay-এর Atlas of the Sky-এর সঙ্গে মিলিয়ে ছবির বিভিন্ন অংশের তারার অবস্থান আমাকে দেখিয়ে দিতে হয়েছে এবং শিল্পী হাশেম খান সেগুলো সম্পপূৰ্ণ করেছেন। এভাবে সবগুলো ছবি শেষ করতে প্ৰায় এক বছর সময় দরকার হয়েছে। হাশেম খান সাহেব আমার এ বই-এর জন্য যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তার জন্য তাঁকে আমার অশেষ ধন্যবাদ। অবশ্য এভাবেও সমস্ত মণ্ডলের প্রাচীন ছবি উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। মৃগব্যাধ মণ্ডল, কপোত মণ্ডল ইত্যাদি কতগুলো মণ্ডলের ছবি আমেরিকা থেকে প্ৰকাশিত Stars নামের বইখানা থেকে নেয়া হয়েছে। তারামণ্ডলসমূহের রেখাচিত্র নিয়ে নানাপ্রকার মতভেদ দেখা যায়। বিভিন্ন প্রকার তারাচিত্রাবলীতে এই সমস্ত রেখাচিত্র বিভিন্ন। Calatay. Hart, Barton and Balton প্রত্যেকের বইতে এই রেখাচিত্র পৃথক। এদের একটার সঙ্গে অন্যটা যথেষ্ট গরমিল দেখতে পাওয়া যায়। আমার এ বইতে মাসিক তারাচিত্রে আমি Henry Hart-এর বই থেকে রেখাচিত্র নিয়েছি। পৃথক পৃথক মণ্ডলের রেখাচিত্র নিয়েছি। Calatay থেকে এবং আমাদের ছায়াপথের দুই WCés afficife Readers Digest-Ef crisis Great Atlas cers তারাচিত্রের দিকেরও পরিবর্তন করা হয়েছে। উত্তর আকাশের মণ্ডলসমূহের রেখাচিত্রের উপরের দিকে উত্তর এবং বাম দিকে পূর্ব দেখানাে হয়েছে। দক্ষিণ আকাশের মণ্ডলসমূহের রেখাচিত্রের উপরের দিকে দক্ষিণ এবং ডান দিকে পূর্ব দেখানাে হয়েছে। এতে দুই দিকের তারাচিত্রের সাথে আকাশের তারার তুলনা করা একই প্রকার সুবিধা হয়। Callatay-র Atlas of the Sky-তেও তাই করা হয়েছে। ভারতীয় নক্ষত্র, আরবের মনজিল এবং চীনের সিট সম্বন্ধে নানা জায়গায় উল্লেখ পেয়েছি। এরা সবাই যে চাঁদের পরিভ্রমণ-পথের কতকগুলি অংশ, এবিষয়ে একটা অস্পষ্ট ধারণা ছিল। কিন্তু ভারতীয় ২৭টি নক্ষত্র ছাড়া কোন মনজিল বা সিট-এর নামও জানতাম না। চীনের সিট-এর জন্য বিশেষ উৎসাহবোধ কোন দিন করি নি। কিন্তু আরবী মনজিলগুলোর নাম ও ভারতীয় নক্ষত্রের সাথে তাদের সম্বন্ধ জানিবার আগ্রহ অনেকদিন থেকেই ছিলো। কিন্তু ২৭টি মনজিলের নাম জানা অনেক দিন নানা চেষ্টার ফলেও আমার হয়ে ওঠে নাই। অনেক দিন পরে, জিকো প্রেসের মালিক, আমার সোদরোপম কল্যাণীয় মৌলানা আবুল খয়ের আহমদ আলী (মৌমতাজুল মোহাদেসিন) সাহেব তফসিরে কাশসাফ থেকে ২৭টি মনজিলের নাম দেন। কিম্ভ এদের অবস্থান, ভারতীয় নক্ষত্রের সঙ্গে সম্বন্ধ, এসব কিছুই তখনও জানতে পারি নাই.............
- প্রিয়তে যোগ করতে লগিন করুন
- লাইব্রারীতে যোগ করতে লগিন করুন
পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।
দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি