অর্থোৎপাদনের পন্থা
মানুষের জীবন-যাত্রা নির্বাহের জন্য অপরিহার্য দ্রব্য-সামগ্রী এবং সুসভ্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের জন্য অত্রবাশ্যকীয় উপাদান উৎপন্ন করার মৌলিক উপায়সমূহের প্রয়োগ ও ব্যবহার কিভাবে হইতে পারে- পক্ষান্তরে কোন্‌ নিযম-পন্থা অনুযায়ী ঐগুলির প্রয়োগ এ ব্যবহার করিলে সুষ্ঠুরূপে প্রয়োজনীয় সম্পদ উৎপাদন সম্ভব, বর্তমান নিবন্ধে আমি সেই বিষয়ে আলোচনা করিতে চাই।

মানুষের যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য অপরিহার্য দ্রব্য-সামগ্রী আল্লাহ তা’আলা বিশ্ব-প্রকৃতির বুকে স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছেন। এ সম্পর্কে চূড়ান্ত কথা এই যে, মানুষের এমন কোন প্রয়োজনেরই নাম করা যাইতে পারে না, যাহা পূরণের জন্য কোন দ্রব্য যথাযথভাবে কিংবা উহার মূল উপাদান বিশ্বপ্রকৃতির বুকে বর্তমান নাই।

দন-সম্পদের মালিকানা

অর্থোৎপাদনের পর্যায়ে সর্বাধিক ও জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হইল ধন-সম্পদ ও সম্পত্তির মালিকানার প্রশ্ন। এই নিবন্ধের শুরুতেই আমরা এই বিষয়টি লইয়া আলোচনা করা বাঞ্ছনীয় বলিয়া মনে করি।

ধন-সম্পদের মালিকানা সম্পর্কে ইসলামের মৌল ঘোষণা হইল, আল্লাহর নিরঙ্কুশ মালিকত্ব ও সার্বভৌমত্ব। কুরআন মজীদে ঘোষণা করা হইয়াছে।

(আরবী**********)

আকাশমণ্ডলী ও জমিনের মালিকানা একান্তভাবে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট।

বলা হইয়াছে: (আরবী**********)

আকাষমণ্ডলে যাহা কিছু আছে, যাহা কিছু আছে জমিনে, তাহার সব কিছুই আল্লাহর জন্য- আল্লাহর মালিকানাধীন।

এই দুইটি এবং দুই ধরনর অসংখ্য আয়াত হইতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, ধন-সম্পদ ও যাবতীয় কল্যাণকর উপকরণ-সামগ্রী যত কিছুর অস্তিত্ব আছে- তাহা মাটি, জমি, নদী-সমুদ্র, পানি, সূর্যতাপ, চন্দ্রের আলো যাহাই হউক না কেন- সব কিছুই নিরঙ্কুশভাবে আল্লাহর মালিকানাভুক্ত। এই ব্যাপারে কেহই তাঁহার সমতুল্য নাই, কেহ তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী নাই, এই মালিকত্বে কেহ তাঁহার সহিত শরীকও নাই। উপরন্তু আল্লাহর এই মালিকানা ফল ভোগ ও ব্যায় ব্যবহারের দিক দিয়া নয়, তাঁহার এই মালিকানা হইল মৌলিক সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রওণাধিকারের দিক দিয়া। তাহা সত্ত্বেও আল্লাহর মালিকানা সম্পর্কে এইরূপ কথা বলার কি কারণ থাকিতেত পারে? আমরা মনে করি এই কথা বলার মূলে দুইটি উদ্দেশ্য নিহিত:

একটি এই যে, মানুষ যখন ধন-সম্পদ অর্জন করিয়া লয়, তখন তাহার মনে ধন-সম্পত্তির উপর কর্তৃত্ব লাভের দরুন যে অহংকার ও আত্মম্ভরিতা জাগিয়া উঠে, এই আয়াত দ্বারা উহার পথ বন্ধ করা হইয়াছে। কেননা অহংকার- অর্থনৈতিক অহংকার ও গৌরব- সমাজ জীবনে বহু প্রকারের পাপের স্রোত প্রবাহিত করে। কিন্তু ধন-সম্পদের স্বত্বাধিকারী যদি ঈমানদার লোক হয়, তাহা হইলে সে প্রতিমূহূর্তে মনে রাখিবে যে, এই ধন-সম্পদের প্রকৃত মালিক সে নিজে নয়, মালিক হইলেন স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা। এই বিশ্বাসে তাহার মন ভরপুর ও প্রশান্ত হইয়া থাকিবে এবং ধন-সম্পদ লইয়া তাহার মনে কোনরূপ অহঙ্কার ও অহমিকা জাগিবে না।

আর দ্বিতীয হইল, মালিকানার ব্যাপারে আল্লাহর বিধানকে সে পুরাপুরি মানিয়া ও অনুসরণ করিয়া চলিবে এবং আল্লাহর মর্জীর বিপরীত পথে সে একটি কপর্দক আয়- ও করিবে না, ব্যয়-ও করিবেনা।

সম্পদ ও সম্পত্তির মলিকানা পর্যায়ে কুরআন মজীদের দ্বিতীয় ঘোষণা হইল:

(আরবী**********)

তোমাদের জন্য আল্লাহ তা’আলা জলভাগের যানবাহন নিয়ন্ত্রিত করিয়া (চলাচলে যোগ্য করিয়া) দিয়াছেন, যেন উহার তাঁহার নির্দেশ মুতাবিক সমুদ্র বক্ষে যাতায়াত করিতে পারে এবং তিনি তোমাদের জন্য খাল ও নদী-নালাকে নিয়ন্ত্রিতত করিয়াছেন; নিয়ন্ত্রিত করিয়াছেন তোমাদের জন্য সূর্য ও চন্দ্রকে- উহা চির আবর্তনশীল। তিনি তোমাদের জন্য রাত ও দিনকেও নিয়ন্ত্রিত করিয়াছেন।

অপর একটি আয়াতে বলা হইয়াছে:

(আরবী**********)

জমিনে যাহা কিছু আছে তাহা সবই তোমাদের জন্য আল্লাহ তা’আলা নিয়ন্ত্রিত ও কর্মরত করিয়াছেন।

বলিয়াছেন: (আরবী**********)

তিনি তোমাদের জন্য আকাশমন্ডলে যাহা কিছু আছে তাহা সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত করিয়া দিয়াছেন।

এই আয়াতেযে দুনিয়ার সব শক্তি, উপাদান ও দ্রব্য-সামগ্রীকে মানুষের জন্য নিয়ন্ত্রিত করিয়া দেওয়ার কথা ঘোষিত হইয়াছে। এই নিয়ন্ত্রণ বিশ্বলোকের সৃষ্টিকর্তা ও মালিকের তরফ হইতে অনুষ্ঠিত হইয়াছে, এবং নিয়ন্ত্রণ করা হইয়াছে মানুষের জন্য। ইহার বিনিময় তিনি মানুষের নিকট হইতে কোন মূল্য গ্রহণ করেন নাই। নিয়ন্ত্রিত করিয়াছেন মানুষের কাজে ব্যবহৃত হইবার জন্য, মানুষের ভোগ-ব্যবহারে আসার ও তাহাদের সর্বাধিক কল্যাণ সাধনের জন্য।

এই বিশ্বলোককে মানুষের জন্য নিয়ন্ত্রিত করিয়া দেওয়ার এই মৌলিক ঘোষণার দুইটি নিগূঢ় তত্ত্ব নিহিত রহিয়াছে।

প্রথম, এই দুনিয়ার কোন কিছু আয়ত্তাধীন করা মানুষের পক্ষে কঠিন হইলেও অসম্ভব নয়। মানুষের বুদ্ধি-বিবেক, প্রতভা ও কর্ম-শক্তি একাগ্রভাবে নিয়োজিত হইলে আল্লাহর দেওয়া তওফীক অনুযায়ী তাহা সম্ভব ও সহজ। ইহাতে মানুষের ইচ্ছা-সংকল্প ও কর্মপ্রতিভাকে উদ্বুদ্ধ করা হইয়াছে। অতএব আল্লাহ তা’আলা এই সবকে মানুষের জন্য নিয়ন্ত্রিত করিয়া দিলেও মানুষ প্রয়োজনীয় চেষ্টা-সাধনা ও শ্রম নিয়োজিত না করিলে এবং উহা হইতে উপকৃত হইতে ও ফল লাভ করিতে চেষ্টিত না হইলে কোন কিছু লাভ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

আর দ্বিতীয়, আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সমস্ত কল্যাণ লাভ করার ও ভোগ-ব্যবহার করার ব্যাপারে দুনিয়ার সমস্ত মানুষ অভিন্ন ও সমান অধিকার সম্পন্ন। কেননা আল্লাহ তা’আলা এই সবকছিুকে আয়ত্তাধীন হইবার উদ্দেশ্যে নিয়ন্ত্রিত করিয়া দিয়াছেন নির্বিশেষ সমস্ত মানুষের জন্য। ইহাতে বিশেষ কোন ব্যক্তি, বংশ শ্রেণী বা বর্ণের লোকদিগকে সম্বোধন করা হয় নাই এবং এই গুলির উপর কাহাকেও একচেটিয়া কর্তৃত্বের অধিকারীও বানানো হয় নাই।

পরন্তু ধন-সম্পদ ও সম্পত্তি সামগ্রীই মানুষের কোন মুল লক্ষ্যবস্তু নয়। উহা মানুষের জীবন-যাপনের উপকরণ মাত্র। উহা ব্যবহার করিয়া মানুষ নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করে ও কল্যাণ লাভ করে। অতএব, যে লোক উহা এই উদ্দেশ্যে ওএই নিয়মে ব্যবহার করিবে, তাহার হাতে এই সম্পদ ও সম্পত্তি তাহার নিজের ও সমাজের জনগণের সাধারণ কল্যাণে নিয়োজিত থাকিবে। কিন্তু কেহ যদি উহাকে আস্বাদনেই মশগুল হইয়া থাকে, তবে তাহার হাতের এই মাল-সম্পদ তাহার নিজের জন্যও যেমন ধ্বংস টানিয়া আনে, তেমনি ধ্বংসের সৃষ্টি করে গোটা সমাজেরও। সাধারণভাবে সমগ্র মানুষের জন্য তাহা সার্বিক বিপর্যয়ের দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দেয়। ঠিক এই কারণেই ধন-সম্পদ ও বৃত্ত-সম্পত্তিকে কুরআন মজীদে (***) ‘পরম কল্যাণের উৎস’ এবং (*****) ‘আল্লাহর অনুগ্রহ’ নামে অভিহিত করা হইয়াছে।

মালিকানা সম্পর্কে পশ্চিম অর্থনীতিবিদদের উপস্থাপিত ধারণা পুঁজিবাদী অর্থনীতির উৎস। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অস্টিন (Johon Austin) মালিকানার সংজ্ঞা বলিয়াছেন।

মালিকানা মুল অর্থের দিক দিয়া কোন নির্দিষ্ট জিনিসের উপর এক ধরনের অধিকার দেয় যাহা ভোগ-ব্যবহারের দিক দিয়া অসীম এবং ব্যয় ও হস্তান্তর করার ব্যাপারে শর্তহীন। (Leetures on Jurisprudence, Vol. II, P. 790)

মালিকানা অধিকারের এই সংজ্ঞা উহার ইসলামী সংজ্ঞা হইতে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। কেননা এই সংজ্হায় মালিককে অসীম ও শর্তহীন অধিকার দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে এইরূপ ধারণার কোন স্থান নাই।

ইসলামী অর্থনীতিতে মালিকানার যে সংজ্ঞা দেওয়া হইয়াচে, তাহা নিম্নরূপ:

(আরবী**********)

মালিকানা ব্যয়-ব্যবহারের অধিকার বিশেষ, শরীয়ত-দাতার অনুমতি, উহার উৎস, উহার প্রমাণকারী; অবশ্য ইহার কোন নিষেধকারী থাকিলে তাহা অন্য কথা।

মালিকানা অপর এক সংজ্ঞায় বলা হইয়াছে:

(আরবী**********)

ফিকহার পরিভাষায় মালিকানা হইল মানুষ ও কোন জিনিসের পারস্পরিক শরীয়তসম্মত সম্পর্কে; যাহার দরুন মালিক উহার ব্যয়-ব্যবহার করিতে পারে এবং অপর লোকদিগকে উহা ব্যয়-ব্যবহার হইতে নিষেধ করিতে পারে।

শিহাবুদ্দীন আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে উদ্‌রীস মালিকানার সংজ্ঞা দিয়াছেন এই ভাষায়:

(আরবী**********)

মালিকানা হইল কোন জিনিস বা মুনাফা সম্পর্কে শরীয়তভিত্তিক এমন অনুমতি যাহার দরুন মালিক সেই জিনিস নিজে ভোগ-ব্যবহার করার কিংবা উহার মুনাফা নিজে লাভ করা বা উহার বিনিময় লাভ করার অধিকার পাইয়া যায়। কেননা উহার অবস্থা-ই এইরূপ।

এ যুগের একজন প্রখ্যাত চিন্তাবিদ মুস্তফা আহম জুরকা লিখিয়াছেন:

(আরবী**********)

মালিকানা হইল কোন জিনিসকে এমনভঅবে খাস করিয়া লওয়া যাহা শরীয়তের দৃষ্টিতে অন্যদের হস্তক্ষেপ হইতে সুরক্ষিত হয়। এইরূপ যে করিবে সে উহার ব্যয়-ব্যবহার করার অধিকারী হইবে- কোন নিষেধকারী হইলে অন্য কথা।

এই সব সংজ্ঞা মূলত একই জিনিস প্রমাণিত করে। মালিকানা অবশ্যই শরীয়তের বিধান মূতাবিক অর্জন করিতে হইবে। শরীয়ত যেরূপ মালিকানা অধিকার দেয় হাতাই স্বীকৃতব্য। কেননা ইসলামের দৃষ্টিতে মালিকানার মূল উৎস হইল শরীয়তের বিধান-দাতার অনুমতি। শরীয়াত দাতার সুস্পষ্ট অনুমতি ব্যতীত কোনরূপ মালিকানা যে ইসলামে স্বীকৃত নয়, এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নাই।

ইহা হইতে একথাও প্রমাণিত হয় যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ন্যায় ইসলামের মানুষের ক্ষেত্রে ধন-সম্পত্তির মালিকত্বের কোন নিজস্ব বা বিশেষ স্থান বা গুরুত্ব নাই। অন্য কথায় নরংকুশ মালিকানা ইসলামে কোন মানুষের জন্যই স্বীকৃত নয়। উহার কেবল মাত্র আল্লাহর জন্য এবং তাঁহার মুকাবিলা- বান্দার মালিকত্ব মূলত মালিকানায় নয়, ইহা আসলে আল্লাহর মালিকানার খিলাফত- আমানতদারি মাত্র।

পক্ষান্তরে সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় নিরংকুশ মালিকানারও কোন অবকাশ ইসলামে নাই। ব্যক্তি বা রাষ্ট্র কারুর মালিকত্বই আল্লাহর মালিকত্বের সমান নয়।

প্রয়োজনীয় সম্পদের প্রকারভেদ

মানুষের পক্ষে অপরিহার্য দ্রব্যসামগ্রীকে ইসলাম দুইটি শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছে। প্রথম, স্বভাবজাত ও নৈসর্গিক- যাহা প্রস্তুত করিতে মানুষের কোন পরিশ্রমের প্রযোজন হয় নাই। আর দ্বিতীয় হইতেছে মানুষের শ্রমলব্ধ উপাদান এবং শ্রম ও মূলধনের প্রয়োগ উৎপাদিত পণ্যরাজি।

প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার-নীতি

উল্লিখিত দুই প্রকার উপাদানের ভোগ ও ব্যবহারিকাধিকার সম্পর্কেও ইসলামে দুইটি নীতি রহিয়াছে। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রথম প্রকার উপাদানে ভোগ-ব্যবহার করার ব্যাপারে একটি দেশের বা অঞ্চলের সকল মানুষেরই সমান অধিকার রহিয়াছে, উহার উপর বিশেষ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির একচেটিয়া মালিকান-কর্তৃত্ব স্থাপিত হইতে পারে না। সকল নাগরিকই নিজ নিজ প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য মূল্য আায় করিতে কাহাকেও বাধ্য করা যাইতে পারে না।

নদী-পুকুরের পানি, বন-জংগলের কাষ্ঠ, স্বভাবজাত বৃক্ষ-গুল্মোর ফলমূল, ঘাস-তৃণলতা, আলেঅ-বাতাস, অরণ্য ও মরুভূমির উন্মুক্ত জন্তু, পাখী, জমির উপরিবাগস্থ খনিজ সম্পদ- সূর্মা-লবন, ডানবির (Napther) প্রভৃতির উপর কাহারো ব্যক্তিগত মালিকানা স্বত্ব স্বীকৃত হইতে পারে না।

এই ধরনের যাবতীয জিনিসই সকল নাগরিকের সম্মিলিত ও সর্বাধিকার সম্পন্ন সম্পদ। ইহা সকল মানুষের মিলিত ব্যাবস্থাধীন থাকিবে এবং সকলের জন্য ব্যবহৃত হইবে। সকলেই তাহা হইতে উপকৃত হইবার সমান অধিকার লাভ করিবে। হযরত নবী করীম (স) এই শ্রেণীর কয়েকটি প্রধান সামগ্রীর ভোগাধিকার সম্পর্কে ইরশাদ করিয়াছেন:

(আরবী**********)

সকল মানুষই পানি, ঘাস এবং আগুন-উত্তাপের ব্যবহারিধারে সমানভাবে অংশীদার।[এখানে আবিষ্কৃত গ্যাত ও তেল এই পর্যায়ে গণ্য]

রসূলে করীম (স) বলিয়াছেন: (আরবী**********)

প্রয়োজনাতিরিক্ত পানি অপরের জমিতে যাইতে বাধা দেওয়া চলিবে না। কেননা ইহার ফলে পানিহীন জমির মালিককে তাহার জমির ঘাস ও ফসল হইতে বঞ্চিত করা হইবে।

আল্লামা খাত্তাবী একটি হাদীসের ব্যাখ্যা লিখিয়াছেন:

(আরবী**********)

পশুগুলি সাধারণ খাদ্য গ্রহণ হইতে উহাদের কোন মালিককে নিষেধ করা যাইবে না। কেহ মানুষের পশুগুলি বঞ্চিত করিয়া নিজেই একক মালিক হইয়া বসিবে, তাহা জায়েয নয়। এই হাদীস তাহাই প্রমাণ করে।

এতদ্ব্যতীত যেসব জিনিস নির্বিশেষে সকলের পক্ষেই প্রয়োজনীয় এবং যাহা কাহারও ব্যক্তিগত ভোগাধিকার বা ব্যক্তিগত ব্যবস্থাদীনে ছাড়িয়া দিলে সর্ব সাধারণের সমূহ অসুবিধা, কষ্ট বা অনিষ্ট হওয়অর আশংকা রহিয়াছে, অর্থাৎ তাহা সবই সার্বজনীন মালিকানা সামগ্রী হিাবে গণ্য হইবে। ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ এ সম্পর্কে বলিয়াছেন:

(আরবী**********)

সীমানা নির্দিষ্ট করার পর কেহ এই সব জিনিসসের মালিক হইয়া বসিলে সে উহার ভোগাধিকার হইতে অন্য লোকদিগকে বিরত ও বঞ্চিত করিবে এবং জনগণ ভয়ানক অসুবিধা ও কষ্টের সম্মুখীন হইবে। ইহার ফলে আল্লাহ তা’আলা যে জিনিসকে যে কাজের জন্য যে মর্যাদা দিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহা সেই মর্যাদায় বর্তমান থাকিয়া নির্দিষ্ট কাজে ব্যবহৃত হইতে পারিবে না এবং তাহাতে সাধারণ মানুষের প্রয়োজন পূর্ণ করিতে বিশেষ অসুবিধার সৃষ্টি হইবে।

খনিজ-সম্পদ, ভূপৃষ্ঠের উপরস্থ অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ-যে জন্য বিশেষ কোন পরিশ্রমের আবশ্যক হয় না, তাহাও ব্যক্তিগত মালিকানাভুক্ত হইতে পারে না।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ দিহলভী (র) লিখিয়াছেন:

(আরবী**********)

যেসব জমির উপরিভাগস্থ খনিজ-সম্পদ আহরণ করায় বিশেষ কোন শ্রম বা প্রচুর পরিমাণে পুঁজি বিনিয়োগের আবশ্যক হয় না, তাহা কাহারো ব্যক্তিগত মালিকানায় ছাড়িয়া দিরে সর্ব সাধারণ মুসলমানের কষ্ট ও অসুবিধা হইবে।

অতএব, বর্তমান সময়ে সকল প্রকার খনিজ-সম্পদই এই নীতির অন্তর্ভূক্ত্ অন্যথায় জাতীয় বিপর্যস্ত হওয়া অনিবার্য হইয়া পড়িবে।

যে চারণভূমি কোন এলাকারসমস্ত পশুর জন্য নির্দিষ্ট হইবে, ধনী-গরীব, মুসলিম-অমুসলিম সকলেই পশু তাহাতে বিচরণ করিতে পারবে, উহার উপর কাহারো ব্যক্তিগত মালিকানা স্থাপিত হইতে পারে না। নবী করীম (স) বলিয়াছেন:

(আরবী**********)

চারণভূমি আল্লাহ্‌ এবং তাঁহার রাসূলের জন্য নির্দিষ্ট (তাহতে অপর কাহারো মালিকানার একচেটিয়া অধিকারস্বীকৃত নয়)।

আর আল্লাহ এবং তাঁহার রাসূলের প্রদত্ত ব্যবহারাধিকার সর্বসাধারণের জন্য।

মোটকথা, ইসলামী অর্থনীতি সর্বসাধারণের স্বাভাবিক প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য দ্রব্য-সামগ্রীর উপর ব্যক্তি, শ্রেণী বা গোষ্ঠী বিশেষের ব্যক্তিগত ও একচেটিয়া মালিকানা স্থাপনের অধিকার দেয় না। অনুরূপভাবে আধুনিককালের যেসব ভারী শিল্প ও সার্বজনীন কার্য কোন ব্যক্তি বা কোম্পানীর অধিকারে ন্যস্ত করা হইলে জনসাধাণের অসুবিধার আশংকা রহিয়াছে, তাহার উপরও সার্বজনীন মালিকানা স্থাপিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাহা কাহারো ব্যক্তিগত বা দলগত কর্তৃত্বে ছাড়িয়ে দেওয়া অধিকার স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধানের নাই। নবী করীম (স) ইবরাজ ইবনে হাম্বল নামক একজন সাহাবীকে ইয়েমেনে মায়ারিক নামক শহরে একটি নির্দিষ্ট স্থান জায়গীর হিসাবে দান করিয়াছিলেন; কিন্তু পরে তিনি যখন জানিতে পারিলেন যে, এই স্থানটিতে লবণের খনি রহিয়াছে, যাহা সকল মানুষের জন্য অপরিহার্য, তখন তিনি উহা তাঁহার নিকট হইতে ফিরাইয়া লইলেন।[(আরবী**********)] ইহার কারণ প্রসঙ্গে বলা হইয়াছে:

(আরবী************)

কেননা ঘাস, আগুন, উত্তাপ ও পানি ইত্যাদির ব্যাপারে রাসূলে করীমের নীতি হইল, উহাতে নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ সমান অধিকার সম্পন্ন। এই জন্য তিনি এই সব জিনিস সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করিয়া বিশেষ কাহাকেও নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়াকে পছন্দ করিতে পারেন নাই।[ইহা হইতে সহজেই বুঝা যায় যে, জমি বন্টনের ব্যাপারে সরকারের ভুল হইতে পারে, অনপযুক্ত বা অনধিকারী ব্যক্তি উহা পাইয়া পারে কিম্বা যাহা সাধারণ্যে বন্টনীয় নয়, তাহা বন্টন হইয়া যাইতে পারে। এইরূপ অবস্থায় ভুল ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বন্টন প্রত্যাহার করা কর্তব্য।]

এই জন্যই ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন:

(আরবী**********)

যেসব জিনিস সাধারণভাবে সকল মুসলমানের (নাগরিকদের) অত্যাবশ্যকীয়- যেমন খাল, নদী বা সমুদ্র যাহা হইতে সকলেই পানিপান কর কিম্বা লবণের আকর, যাহা সমস্ত এলাকাবাসীর জন্য জরুরী, তাহা কাহারো ব্যক্তিগত মালিকানায় দান করার অধিকার রাষ্ট্রপ্রধানের নাই।

রাষ্ট্রয়ত্তকরণও ব্যক্তিগত মালিকানা

প্রাকৃতিক উপাদানে ব্যক্তিগতভাবে কাহারো মালিক না হওয়া এবং তাহার উপর সকল মানুষের সামগ্রিক অধিকার স্থাপিত হওয়াকে আধুনিক পরিভাষায় বলা হয় রাষ্ট্রায়ত্তকরণ (Nationaliztion) বা রাষ্ট্রীয়করণ।

বর্তমান সময় এই রাষ্ট্রীয়করণ কথাটি এক শ্রেণীর মানুষের অর্থনৈতিক মতাদর্শে পরিণত হইয়াছে। বিশেষতঃ কমিউনিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক মতবাদের ইহাই মুল কথা। এই মতাদর্শে বিশ্বাসী লোকদের দৃষ্টিতে প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক উপাদান-সামগ্রী এবং মানুষের শ্রমলব্ধ সম্পদের মধ্যে মালিকানার দিক দিয়া কোনই পার্থক্য নাই। বরং সকল প্রকার উপায়-উপাদান ও উৎপাদন-উপায়কেই তাহারা সমানভাবে সকল নাগরিকের সম্মিলিত মালিকানা সম্পদ মনে করে। কোন ব্যক্তি স্বতন্ত্রভাবে কোন জিনিসেরই মালিক হইবে না, সব কিছুই রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণাধীন থাকিবে- সাধারণত কমিউনিজমও মার্কসবাদের ধব্জাধারিগণই এই মত পোষণ ও প্রচার করিয়া থঅকে। এই দৃষ্টিতে সমাজের মধ্যে ব্যক্তির কোন স্বতন্ত্র সত্তা স্বীকৃত নয়, ব্যক্তির স্বতন্ত্র সত্তার কোন গুরুত্ব বা মর্যাদাও নাই। নৈতিক প্রাধান্য একান্তভাবেই সমাজেরই করায়ত্ত থাকে ব্যক্তি তথায় খাটিবে, মেহনত করিয়া মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া শ্রম করিয়া অর্থোপার্জন করিবে, কিন্তু উপার্জিত সম্পদের উপর তাহার নিজস্ব ও স্বতন্ত্র কোন স্বত্ব স্বীকৃত হইবে না। ‘আমার’ বলিয়া কোন জিনিসের উপর সে দাবি করিতে পারিবে না। সমাজ তাহাকে এই স্বাভবিক অধিকার হইতে বঞ্চিত রাখিয়া নিজেই উহার উপর নিরংকুশ কর্তৃত্ব স্থাপন করিবে। ব্যক্তি তাহার মেহনত যোগ্যতা ও মননশক্তি ব্যয় করিয়া উপার্জন করিবে এবং তাহার বিনিময়ে সমাজের নিকট হইতে পেটভরা খাদ্য, পরিধানের জন্য বস্ত্র আর সম্ভব হইলে থাকিবার জন্য একটি খুপড়ি লাভ কবে। কেননা প্রকৃতপক্ষে সে সমাজের চাকর, ‘চাকরী’ই তাহার ললাট লিখন, মৃত্যু পর্যন্ত তাহার একমাত রক্ষাকবর। বলা বাহুল্য, কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্রের ইহাই সারকথা।[ইহা কমিউনিজমের তত্ত্বকথা। বাস্তবের সহিত ইহার মিল খুবই কম। কেননা উত্তরকালে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ব্যক্তিদিগকে কিছুটা মালিকানা ভোগের সুযোগ দিয়াছে।]

কিন্তু ইসলামী অর্থনীতি সম্পদ ও সম্পত্তির এই নিরংকুশ রাষ্ট্রীয়করণ নীতিকে একটি জাতীয আদর্শ হিসাবে মাত্রই সমর্থন করে না। ইসলামী অর্থনীতি কোন একক ও বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থা নয়, ইহা মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থার একটি শাখা এবং অর্থনৈতিক সমস্যা মানব-জীবনের অসংখ্য দিক ও বিভাগের একটি দিক মাত্র। কাজেই ইসলাম যেমন অর্থনৈতিক ভিত্তিতে কোন সমাজ গঠন করে না, অনুরূপভাবে ব্যক্তিকে অর্থনৈতিক গোলামীরদুশ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধিয়া সমাজের বেদীমূলে তাহাকে বলি দিতেও ইসলাম মোটেই প্রস্তুত নয়।

ইহার কারণ এই যে, ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার দৃষ্টিতে প্রত্যেকটি জীব-জন্তু ও বস্তুর সর্ববিধ স্বাতন্ত্র্য অনস্বীকার্য। মানুষ প্রধানত ব্যক্তিগতভাবেই আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করিতে বাধ্য। ব্যক্তিতে লইয়াই সমাজ গঠিত হয়। ব্যক্তি হয় সমাজেরই একজন কিন্তু সমাজে ব্যক্তির ভূমিকা সুস্পষ্ট হইয়া থাকে সব সময়ই। ব্যক্তি-সত্তা সেখানে কোন ক্রমেই বিলুপ্ত হইয়া যায় না। নামায পড়া, রোযা রাখা ইত্যাদি ব্যক্তি-মানুষের কর্তব্য বলিয়া গণ্য হইয়াছে, যদিও এই সকল কাজ সম্পাদন করিতে হয় সামাজিকভাবে-সমষ্টিগতভাবে। ইসলামের অর্থনীতিও কখনো ব্যক্তিকে উপেক্ষা করিয়া সমাজের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপন করে না। পক্ষান্তরে, ব্যক্তিকেও সেখানে নিরংকুশ স্বাধনিতা ও স্বেচ্ছাচারিতা করিবার অধিকার দেওয়া হয না। স্বেচ্ছাচারমূলক ব্যক্তিগত মালিকানা-অধিকার ব্যক্তিকে স্চেচ্ছাচারী ও নিরংকুশ স্বাধীন বানাইয়া দেয়। সমাজ ও মানব-সমষ্টিরও কোন গুরুত্ব তাহাতে স্বীকৃত হয় না। সমাজ থাকুক কি ধ্বংস হইয়া যাউক, দেশের কোটি কোটি মানুষ বাঁচুক কি অনাহারে মৃত্যুর মুখে পতিত হউক- স্বেচ্ছাচারমূলক ক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে অর্থাৎ পুঁজিবাদে সে প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর। সে জন্য কাহারো এক বিন্দু মাথা-ব্যাথাও নাই। আর সমাজতান্ত্রিক সমাজে তো ব্যক্তিগত সমস্যা বলিতৈ কিছুই নাই। সেখানে সমাজের সমস্যা রাষ্ট্রের যাহাকিছু মাথাব্যথা।

বস্তুত, মানবসমাজে ব্যষ্টি ও সমষ্টির এই সমস্যা অত্যন্ত জটিল। যেখানেই ব্যক্তিকে অধিকতর স্বাধীনতা দান করা হইয়াছে, সেখানেই মানুষ হিংস্র পশুতে- অর্থনৈতিক গৃধ্মুতে- পরিণত হইয়াছে। আর যেখানেই ব্যক্তিকে উপেক্ষা করিয়া- পুঁজিবাদের এই অবিচারমূলক ব্যবস্থা দূর করার নাম করিয়া- মানুষকে শোষণ-মুক্ত করিবার গালভরা দাবি করা হইয়াছে এবং সমাজকেই সর্বশক্তির আধার করিয়া দেওয়া হইয়াছে, ব্যক্তির অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য ও স্বাভাবিক অধিকার হরণ করিয়া সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্থাপন করা হইয়াছে, সেখানেই সমাজের নামে মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক কোটি কোটি মানুষের শুধু নিরংকুশ মাসকই হয় নাই, একমাত্র হইয়া বসিয়াছে। সেখানে ব্যক্তি-মানুষের কেবল অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্যই বিলুপ্ত হয় না, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার হইতেও মানুষস নির্মমভাবে বঞ্চিত হইয়াছে। ব্যক্তি ও সমাজের এই সমস্যা দুনিয়ার কোন মতাদর্শেই আজ পর্যন্ত সমাধান করিতে পারে নাই। ইহার চূড়ান্ত, বারসাম্যপূর্ণ ও সুবিচারমূলক সমাধান করিয়াছে একমাত্র ‘রিযিকদাতা’ ‘ভাগ্যবিধাতা’- তথা জীবন ও মৃত্যুর একমাত্র মালিক ও ইসলাম। মানব-সমাজের অস্বাভাবিক ও অবিচারমূলক ব্যবস্থার এই দুই সীমান্তের মধ্যখান দিয়া চলিয়া গিয়াছে ইসলামের সুবিচারমূলক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থা। ইসলামী সমাজে- অর্থনীতেও- ব্যক্তিকে সমাজ-শৃঙ্খলার সহিত যুক্ত করিয়া দেওয়া হইয়াছে। সেখানে ব্যক্তি যতখানি সত্য, সমাজ ও রাষ্ট্রও ঠিক ততখানিই সত্য। সেখানে ব্যক্তিকে তাহার জীবন রক্ষার জন্য যাবতীয় প্রয়োজন পুর্ণ করার ততখানি সুযোগ দেওা হইয়াছে, যতখানি দেওয়া হইয়াছে সমাজ ও রাষ্ট্রকে বাঁচাইবার জন্য। ব্যক্তিকে দায়ী বানানো হইয়াছে সমাজ ও রাষ্ট্রকে বাঁচাইবার জন্য। ব্যক্তিকে দায়ী বানানো হইয়াছে সমষ্টির জন্য। আবার সমাজ সমষ্টিকেও দায়ী বানানো হইয়অছে ব্যক্তির জন্য। ব্যক্তি ও সমষ্টি-এর কোনটিই ইসলামে উপেক্ষিত নয়।

অতএব ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় না ব্যক্তি-মালিকানার চরম ও নিরংকুশ অবকাশ রহিয়াছে, না জাতীয়করণ বা রাষ্ট্রীয়করণের নামে সমগ্র সম্পদ ও সম্পত্তির উপর মুষ্টিমেয় শাসক শ্রেণীর একচেটিয়া কর্তৃত্ব ও নির্মম নিষ্পেষণ নীতি স্থাপনের সুযোগ। ব্যক্তির মৌলিক অধিকার রক্ষা এবং সামাজিক শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্য স্থাপনন হইতেছে এই চিরন্ত সমস্যার একমাত্র সমাধান।

ইসলাম স্বাভাবিক, নৈসর্গিক ও সকল মানুষের পক্ষে সাধারণভাবে অপরিহার্য উপাদানসমূহকে ব্যক্তি-মালিকানার অধিকারভুক্ত করে নাই বলিয়া এবং ‘দুনিয়ার সবকিচুর মালিক আল্লাহ’ বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছে দেখিয়া, ব্যক্তিগত ভোগাধিকার ও মালিকানাধিকার হরণ করা আর যাহাই হউক, ইসলামী মতাদর্শ হইতে পারে না। আল্লাহ তা’আলা তো সারেজাহানের প্রত্যেকটি বস্তুরই মালিক, তাহাতে কে সন্দেহ করিতে পারে? কিন্তু আল্লাহর এই ‘মালিকানা’-পূর্বে মেযন বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হইয়াছে- তাঁহার নিজের ভোগ-ব্যবহারের জন্য নয়; আল্লাহ নিজে কোন জিনিসেরই ভোগ বা ব্যবহার করেন না। আল্লাহর মালিকানা তাঁহার প্রবুত্ব ও বিধান পালনের ভিতর দিয়াই স্বীকৃত ও কার্যকর হইয়া থাকে। কাজেই দুনিয়ার সমস্ত জিনিস- যাহা মানুষের জন্য সৃষ্টি করা হইয়াছে- আল্লাহর নিয়ম ও বিধান অনুসারেই ব্যবহার করিতে এবং উৎপাদন ও বন্টন করিতে হইবে। সেজন্য মানুষ নিজেদের মনগড়া কোন বিধান রচনা করিতে পারিবে না, করিলে তাহা অনধিকার চর্চা হহইবে। কেননা মানুষ নিজস্বভাবে ধন-সম্পদের স্রষ্টা, উৎপাদক বা মালিক নহে। প্রকৃত মালিক তো আল্লাহ, আল্লাহর মর্জী ও আল্লাহরই আইন-বিধান পুরাপুরিভাবে তাহাতে কার্যকর হইবে। মানুষ যাহার প্রকৃত স্রষ্টা বা মালিক নয় তাহার উপর নিজের মর্জী চালাইবার ও স্বীয় মনগড়া বিধান ও ব্যবস্থা চালু করার মানুষের কি অধিকার থাকিতে পারে? বস্তুত, ইহাই হইতেছে আল্লাহর মালিকানার প্রকৃত তাৎপর‌্য। কাজেই এই দুইটি নতুন আবিষ্কৃত ছিদ্রপথ হইতে ইসলামী অর্থ-ব্যবস্থায় সমাজতন্ত্রের (Socialism) অনুপ্রবেশ কিছুতেই সম্ভবপর নয়।

পক্ষান্তরে, ইসলামে ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত হইয়াছে বলিয়া ইহার সহিত পুঁজিবাদী মতাদর্শের সামঞ্জস্য খুঁজিয়া বেড়ান ব্যক্তিকে ইনসাফ ও অধিকার আদায়ের বিধি-নিষেধ পালনের অনিবার্যতা হইতে মুক্তি দিয়া চরম পুঁজিতন্ত্রের প্রসার করা কিছুতেই সম্ভব নয়। কারণ ইসলামের সহিত- বিশ্ব-প্রকৃতির স্বাভাবিক ব্যবস্থার সহিত – এই ধরনের কার্যকলাপের কোনই সামঞ্জস্য নাই।

বিশেষত, ইসলমেরধন-স্পদে ব্যক্তিগত মালিকানার কুরআনী মর্যাদা হইল খিলাফত। এই বিশ্ব-প্রকৃতির বুকে মানুষের যাহা আসল মর্যাদা, ধন-সম্পদের ভোগ ও ব্যবহারের অধিকারেও ঠিক সেই মর্যাদা-ই স্বীকৃত। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে ঘোষণা হইল:

(আরবী**********)

তোমরা আল্লাহ এবং তাহার রাসুলের প্রতি ঈমান আনো এবং আল্লাহ তোমাদিগকে যে ধন-সম্পদে খলীফা নিযুক্ত করিয়াছেন তাহা হইতে ব্যয় ব্যবহার কর।

আল্লামা আলূসী এই আয়অতের তাফসীরে লিখিয়াছেন:

(আরবী**********)

আল্লাহ তা’আলা তোমাদিগকে তাঁহার তরফ হইতে ধন-সম্পদে হস্তক্ষেপ, ব্যয় ও ব্যবহার করার জন্য খলীফা বানাইয়াছেন, যদিও তোমরা উহার প্রকৃত মালিক নও।

আয়াতটির বক্তব্য হইল: দুনিয়ার ধন-সম্পদে মানুষকে খলীফা বানানো হইয়াছে। ইহার ব্যয় ও ভোগ ব্যবহার করার অধিকার মানুষকে দেওয়া হইয়াছে আল্লাহর দেওয়া আইন ও বিধানের মধ্যে থাকিয়া। কেননা প্রকৃত মালিক তো আল্লাহ নিজেই। মানুষ তাঁহার ‘খলীফা’ মাত্র এবং আল্লাহর খলীফা হিসাবেই তাহারা আল্লাহর দেওয়া ধন-মালের আমানতদার। এই খিলাফত মর্যাদাকেই অথবা আমানতদারীকেই আমাদের ভাষায় ‘মালিকানা’ বলি। প্রত্যেক ব্যক্তি তাহার এই ধরনের ‘ব্যক্তিগত মালিকান’ এটা সামাজিক দায়িত্ব হিসাবেই প্রয়োগ করিবে। কেননা আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে ব্যক্তিগতভাবে প্রাপ্ত ধন মালকে সামষ্টিক ধন-মাল বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। বলা হইয়াছে:

(আরবী**********)

তোমরা তোমাদের ধন-মালকে পারস্পরিক বাতিল উপায়ে ভক্ষণ বা গ্রহণ করিও না।

বুঝা গেল যে, ব্যক্তিগত আমানতদারীতে রক্ষিত যাবতীয় ধন-মাল সমষ্টির অধিকারের ধন-মাল। সেই ধন-মালে সব ঈমানদার ব্যক্তিরই সমান অধিকার রহিয়াছে।

জাতীয়করণ নীতির অবৈজ্ঞানিকতা

একটি সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মতাদর্শ হিসাবে জাতীয়করণ নীতি (Nationalization) প্রকৃতপক্ষেই অবৈজ্ঞানিক, মানবতা পক্ষে এতদাপেক্ষা মারাত্মক অভিশাপ আর একটিও হইতে পারে না।

বস্তুত, মানুষের মধ্যে স্বভাবগত যে ‘অহম জ্ঞান’ (Ego) রহিয়াছে তাহা ব্যক্তিগত মালিকানা-সম্পর্কিত ভাবধারার উৎসমূল। একটি শিশু যখন নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের কথা অনুভব করে এবং সে তাহার নিজস্ব শক্তি সম্পন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের কথা অনুভব করে এবং সে তাহার নিজস্ব শক্তি সম্পন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরিচালনা করিতে শুরু করে, তখনি তাহার মধ্যে ব্যক্তিগত মালিকানার চেতনা জাগ্রহ হয়। ক্রমশঃ ইহা পরিবর্ধিত হইতে থাকে। যে কারণে মানুষ ‘আমি’, ‘তুমি’ এবং ‘সে’ বলিয়া পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে, ঠিক সেই কারণেই মানুষ ‘আমার’, ‘তোমার’ ও ‘তাহার’ বলিয়া দ্রব্য-সম্পদের উপর অধিকার প্রয়োগের দিক দিয়াও পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য করিতে বাধ্য হয়। ইহারই পরিণামে ‘আমার মালিকানা’ ‘তোমার মালিকানা’ এবং ‘তাহার মালিকানা’র ধারণা মানব-মনে সুস্টষ্ট হইয়া উঠে। এইভাবে মানুষের ‘আমি’ ও ব্যক্তিগত মালিকানার স্বতঃস্ফূর্ত ভাবধারা গোটা সমাজ ও তমুদ্দুনের প্রতি ধমনিতে প্রবাহিত হইতে শুরু করে। মনস্তত্তের বিচারে ইহা এক নির্ভূল ও সর্বজনস্বীকৃত সত্য।

এই স্বভাবগত ভাবধারা শক্তি এত তীব্র যে, ব্যক্তিকে তাহার ব্যক্তিগত মালিকানা অধিকার হইতে বঞ্চিত রাখিয়া হাজার লক্ষগুণ বেশী সুযোগ সুবিধা ও আরাম-আয়েশের সামগ্রী দান করিলেও সে কিছুতেই সন্তুষ্টী হইতে পারিবে না। তাহাকে তাহার নিজ ঘর হইতে বাহির করিয়া কোন উচ্চশ্রেণীর হোটেলে সর্ববিধ আরামের সুবন্দোবস্ত করিয়া দিলেও সে সেখানে at home (বা নিজের বাড়িতে) হওয়ার মত তৃপ্তি কখনও লাভ করিতে পারিবে না। ব্যক্তিগত মালিকানা-সংক্রান্ত ভাবধারা মূলত ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত ক্ষমতা ইখতিয়ার লাভের প্রেরণা হইতেই উৎসারিত হইয়া থাকে। কাজেই ব্যক্তিকে এই স্বাধীনতা ও অধিকার হইতে বঞ্চিত রাখিয়া সমস্ত ধন-সম্পত্তিকে জাতীয় মালিকানার অক্টোপাসে বন্দী করিলে তাহা কোন ক্রমেই স্বাভাবিক ব্যবস্থা হইতে পারে না। একজন ব্যক্তিকে সীমাবদ্ধ অধিকার ও স্বাধীনতা দান করে একজন বক্তির স্বতন্ত্র দেহ ও সত্তার স্বীকৃতির অনুরূপ উহার সীমাবদ্ধ মালিকানাকেও স্বীকার করাই প্রকৃতপক্ষে বৈজ্ঞানিক পন্থা। সমাজ বিজ্ঞানের দিকক দিয়া ইহাই এক সুষ্ঠু ব্যবস্থা।

ব্যক্তিগত মালিকানা হরণ করিয়া সর্বগ্রাসী জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় মালিকানা স্থাপন করা যে মানবতার পক্ষে একান্তই মারাত্মক ব্রব্থা, তাহার জ্বলন্ত প্রমাণ বর্তমান দুনিয়ার শ্রেষ্ট ও সর্ববৃহত সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত রাশিয়া।

জাতযি মালিকানা সাম্যবাদ

বস্তুত, সমস্ত উপার্জন উপায়কে সরকারী কর্তৃত্বে সোপর্দ করিয়া গোটা মানুষকে সরকারে দিন-মজুর বা বেতনভোগী চাকরে পরিণত করিয়া দিলেই মানুষ সুবিচার ও সর্ববিদ দিক দিযা সমান অধিকার লাভ করিবে- এইরূপ মনে করা চরম নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছুই নয়। প্রথম মহাযুদ্ধের সর্বাত্মক ভাঙ্গনের সুযোগ লইয়া রাশিয়ায় ১৯১৭ সনে কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘটিত হইয়াছিল। ইহার ফলে দেশের সকল প্রকার ধন-সম্পদ ও উৎপাদন-উপায় নিরংকুশভাবে কমিউনিস্টদের কুক্ষিগত হইল। এইজন্য সোভিযেত সরকারকে প্রায় উনিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করিতে হইয়াছে। একমাত্র কোল খোজ (Kokho-Co-orerative farming) পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য ছোট জমিদার (Kullaks)-দিগকে যেভাবে হত্যা করা হইয়াছে, তাহা দেখিয়া পৃথিবীর রুশ-সমর্থক কমিউনিস্টরাও চীৎকার করিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু এই অমানুষিক জুলূম ও হত্যাকান্ডের পর যে রাষ্ট্রীয়করণ নীতি কার্যকর করা হইয়াছিল তাহার ফলে সকল মানুষের জন্য সমানাধিকার স্বীকৃত হওয়াই ছিল স্বাভাবিক এবং সুবিচারপূর্ণ ব্যবস্থা। কিন্তু কার্যত এই সাম্য ও সমানাধিকার সেখানে নিতান্ত মায়া-মরীচিকায় পরিণত হইয়াছে। সাম্যবাদের শ্রোগান এখানে সম্পর্ণরূপে ও নির্মমভাবে ব্যর্থ হইয়াছে। রাশিয়অয়- James Bwruhan-এর ভাষায় জাতীয় আয়ের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ শতকরা ১১-১২ জন উচ্চ শ্রেণীর শাসকগণই ভোগ করে। সাধারণ মানুষের মুখের গ্রাস কাড়িয়া লইয়া উচ্চ পর্যায়ের আমলাতের এই নিরংকুশ বোগ-সম্ভোগ কি চরম শোষণও দুর্ণীতির নির্লজ্জ পরাকাষ্ঠা নয়?

একজন প্রসিদ্ধ ফরাসী কমিউনিসট কমরেড Yovn রামিয়ার শ্রেণীগত পার্থক্যের বিবরণ নিম্নলিখিতরূপে পেশ করিয়াছেন:

গার্হস্থ্য মজুরদের বেতন পঞ্চাশ হইতে ষাট রুবল পর্যন্ত- আহার বাসস্থঅন ব্যতীত। সাধারণ মুজর একশত ত্রিশ হইতে দুইশত পঞ্চাশ রুবল পর্যন্ত লাভ করে। দায়িত্বসম্পন্ন ও উচ্চতরের অফিসার মাসিক পনেরো শত রুবল হইতে দশ হাজার রুবল পর্যন্ত এবং ফ্যাক্টরী ডিরেক্টর, শিল্পী, লেখক, অভিনেতা, অভিনেত্রী বিশ হাজার হইতে ত্রিশ হাজার রুবল পর্যন্ত অর্জন করে।

১৯৩৭ সনে রাশিয়ার বিভিন্ন শ্রেণীর শ্রমিকদের জন্য মুজুরী চার্ট নিম্নোরূপ তৈয়ার করা হইয়াছিল:

সাধার শ্রমিক: ১১০ হইতে ৪০০ রুবেল মাসিক

মধ্যম মানের কেরানী : ৩০০ হইতে ১০০০ রুবেল মাসিক

উচ্চমানের অফিসার: ১০০০ হইতে ১০,০০০ রুবেল মাসিক

প্রথম মানের নাগরিক : ২০,০০০ হইতে ৩০,০০০ রুবেল মাসিক

রুশ পত্রিকা TRUD কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য হইতে জানা যায়, একটি খনিতে ১৫৩৫ জন শ্রমিক নিযুক্ত করা হয় এবং তাহাদের মজুরীর হার নিম্নোক্ত রূপ ধার্য করা হয়:

এক হাজার শ্রমিকের বেতন মাসিক ১২৫ রুবল হিসাবে। চারিশত শ্রমিকের বেতন মাসিক ৫০০ রুবল হইতে ৮০০ রুবল করিয়অ। ৭৫ জন শ্রমিকের বেতন প্রতিজন মাসিক ৮০০ হইতে ১০০০ রুবল। ৬০ জন শ্রমিকের বেতন মাথাপ্রতি মাসিক ১০০০ হইতে ৩৫,০০০ রুবল পর্যন্ত।

রাশিয়ার শ্রমিকদের বেতন যে আকাশ-পাতাল পার্থক্র বিরাজিত, তাহা বেতনের উপরোক্ত হার হইতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হইতেছে। এইরূপে বেতনকে কি কোন প্রকারে সাম্যবাদী আদর্শের অনুকুল বলিয়া মনে করা যাইতে পারে?

বস্তুত, রাশিয়ার শতকরা ৭.৯ জন লোক মাসিক ২৪০ রুবলের কম বেতন পায়। আর অবশিষ্ট শতকরা একুশ জন লোক ইহাদের-ই শ্রমলব্ধ মুনাফা দুই হাত শুঁষিয়া নেয় এবং বিলাসিতার পাহাড় সৃষ্টি করে।

রাশিয়ার সামরিক বাহিনীতে বেতনের এই তারতম্য আরো মারাত্মক ধরনের। ১৯৪৩ সনে সাধারণ সৈনিক মাসে দশ রুবল বেতন পাইত। আর লেফ্‌টেন্যান্ট লাভ করিত এক হাজার রুবল এবং কর্ণের পাইত চব্বিশ শত রুবল। – Economist পত্রিকা ৩০শে জুলাই ১৯৪৩ সন।

‘নিউ ইন্টারন্যাশনাল’ পত্রিকার প্রবন্ধকার লেভন সীডো লিখিয়াছেন, রাশিয়ার শ্রমিকদের পরস্পরের মধ্যে বেতনের দিক দিয়া যে পার্থক্য রহিয়াছে তাহা দুনিয়ার কোন সর্বোন্নত পুঁজিবাদী দেশেও বর্তমান নাই। সীডো এই পার্থক্যের যে হার বর্ণনা করিয়াচেন, তাহা হইল:

সাধারণ শ্রমিকের মধ্যে ১-২০

ট্রেনিংপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে ১-৮০

সাধারণ মানুষে ও উচ্চ অফিসারদের মধ্যে ১-১০০ এরও অধিক পার্থক্য বিদ্যমান।

ডিকোস্টা তাঁহার ‘শয়ার অর্থনৈতিক উন্নতি’ নামক গ্রন্থের ৮৬ পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন, রাশিয়ার মোট আয়ের অর্ধেক পরিমাণ অর্থ শতকরা ১১ কিংবা ১২ জন লোকের পকেটস্থ হয। আর অবশিষ্ট অর্থ শতকরা ৮৮ জন লোকের মধ্যে বন্টন করা হয়।

প্রখ্যাত সমাজতন্ত্রী নেতা ডগলাসস জে তাহার Socialism in the new Soviet নাম গ্রন্থ লিখিয়াছেন:

বর্তমানে রুশ সমাজে প্রকৃত আয়ে ট্যাক্‌স বাদ দেওয়ার পর উপর নীচে যে পার্থক্য রহিয়াছে, তাহা বৃটেন ও স্ক্যান্ডেনেভীয় দেশগুলি অপেক্ষা অধিক এবং সম্ভবত আমেরিকায় বিরাজমান পার্থক্যেরই সমান।

এসব যদিও অনেক দিন আগের কথা, বর্তমান অবস্থা এই যে, কারখনার ডাইরেক্টর ও ম্যানেজাররা কারখানায় লব্ধ মুনাফার অংশও লাভ করিয়া থাকে। আর ইহার অধিক মুনাফা লুটিবার উদ্দেশ্যে শ্রমিক-মজুরদের দ্বারা অমানুষিক ধররে শ্রম করায় অথচ নিতান্ত নগণ্য পরিমাণে মজুরী দেওয়া হয়।

সম্পত্তির রাষ্ট্রীয়করণের পর রাশিয়ার শ্রমিকদিগকে সরকার চালিত লংগরখানা হইতে খাবার গ্রহণ করিতে বাধ্য করা হইয়াছে। এইস লংগরখানা হইতে নিকৃষ্ট মানের খাবার পরিবেশন করা হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী কসিগীন-ও এই কথা স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছেন।

১৯৪৮ এবং ৪৯ সনে সরকারীভাবে প্রকাশ করা হইয়াছে যে, একজন খনি-শ্রমিক মাসে ১০ হাজার রুবল উপার্জন করে (৮ই ডিসেম্বর, ১৯৪৮ এ প্রাভ্‌দা এবং ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ এর ইজভেস্তিয়া দ্রষ্টব্য) সরকারী ও অন্যান্য প্রাধাণ্য সূত্র হইতে জানা যায় যে, একজন কলেজের অধ্যাক মাসিক ৪ হইতে ৫ হাজার রুবল এবং গবেষণাগারের কর্মকর্তাগণ মাসিক ৮ হাজার রুবল বেতন লাভ করে। একাডেমী এ সায়েন্সের সদস্যরাও উক্ত সংস্থার সদস্য হিসাবে মাসিক ৫ হাজার রুবল পাইয়া থাকে। একডেমী অব সায়েন্সের সদস্যরা উক্ত সংস্থার সদস্য হিসাবে মাসিক ৪ হাজার রুবল পাইয়া থাকে। একাডেমী অব সায়েন্সের সদ্যসরা সাধারণত বিভিন্ন গবেষণাগারের কর্মকর্তা বলিয়া তাহাদের মাসিক আয় ১৩ হাজার রুবলের কাছাকাছি পৌঁছায় (হ্যারি সোয়াট্‌স্‌ লিখিত রাশিয়ান সোভিয়েট ইকনমি, ৪৬৭ পৃষ্ঠ)’ ১৯৫২ সেনে ‘ইকনমিক উইকলিতে’ একজন সাংবাদিকের লিখিত এক প্রবন্ধে পরিবেশিত তথ্য হইতে জানা যায়, সোভিয়েট চেম্বার অব কমার্ষের সভাপতি মাসিক ১৬ হাজার রুবল, রাষ্ট্রের মন্ত্রীরা মাসিক ২০ হাজার রুবল এবং একাডেমী অব সায়েন্সের সভাপতি মাসিক ৩০ হাজার রুবল বেতন পায়।

রাশিয়ার ‘মজুরদের’ বেতনের এই আকাশছোঁয়া পার্থক্য লক্ষ্য ক রিয়া এবং Webb এর ন্যায় অন্ধ রুশ-সমর্থকও স্বীকার করতে বাধ্য হইয়াছে।

‘ব্যক্তিগণের আমদানীর ক্ষেত্রে রাশিয়ায় যে বৈষম্য লক্ষ্য করা যাইতেছে, উহার চূড়ান্ত নমুনা Extreme instanc আমেরিকায় না হইলেও বৃটেনে নিশ্চয়ই পাওয়া যাইবে। ফল কথা এই যে, ব্যবসায় ও শিল্পের মুনাফঅ বর্তমান সোভিয়েত রাশিয়ার কেবল উঁচুদরের লোকদের মধ্যেই বিভক্ত হয়- পূর্বে যেমন মজুর ও বুর্জোয়া লোকদের মধ্যে বন্টন কর হইত। এই কথায় সত্যতা Soviet Economic System গ্রন্থে উল্লেখিত Income tax Schedule হইতেও সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়। উক্ত গ্রন্থের ৩৮১ পৃষ্ঠা হইতে ৩৮৩ পৃষ্ঠা পর্যন্ত উল্লেখিত হইয়াছে:

রাশিয়ার ১৯৪০ সনের ইনকাম ট্যাক্স শেডুল অনুসারে পাঁচশত রুবল হইতে শুরু করিয়া তিন লক্ষ রুবল পর্যন্ত আয়ের উপর ট্যাক্স ধার্য করা হয়। অর্থাৎ একজন লোকের নিকট তিন লক্ষ রুবল টাকা পুঞ্জীভূত হওয়া সেখানে কোন মতেই আইন বিরোধী নয়, যেখানে সাধারণ শ্রমিক মাসিক বেতন পায় মাত্র ৪ শত রুবল।

কমিউনিস্ট চীন দেশের অবস্থাও ইহা হইতে স্বতন্ত্র ও ভিন্নতর কিছু নয়। সেখানকার শ্রমিকরা মর্মান্তিকভাবে দরিদ্র। ছেঁড়া-ফাটা কাপড় তাহাদের লজ্জা নিবারণ করিতে পারে না। অথচ সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে সেখানে শ্রমিকদিগকে দৈনিক আট ঘন্টা নয়, বারো ঘন্টা করিয়া হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করিতে বাধ্য করা হইয়াছে। কিন্তু মজুরী দেওয়া হইয়াছে খুবই কম পরিমাণ।

জাতীয়করণ নীতির চরম ব্যর্থতার এই মর্মান্তিক ইতিহাস পাঠ করিয়াও কি কেহ উহা সমর্থন করিতে এবং সাম্যবাদের শ্লোগান শুনিয়া অন্ধের ন্যায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ্য হইয়া অনির্দিষ্টের পানে ছুটিতে পারে? [Soviet communism-A New Civili-ation, 12.70P.]

সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির অবস্থাযদি এই হয়, সেখানেও যদি শ্রমিক কৃষকদের মাঝে চরম অসাম্য বিরাজ করে, এমনকি শ্রেষ্ঠ পুঁজিবাদী দেশ আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের অপেক্ষাও অনেক বেশী অসাম্য থাকে- নাই তাহা বলিবার সাহাস কাহারো আছে কি?- তাহা হইলে পুঁজিবাদের ন্যায় সমাজতন্ত্রকেও মানবতার জন্য মারাত্মক শোষণ ও অসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা মনে করা হইবে না কেন? এবং বিশ্ব-মানবতার কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে পুঁজিবাদের ন্যায় সমাজতন্ত্রকেও খতম করার জন্য সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা ও সংগ্রাম চালানো হইবে না কোন্‌ কারণে?…. এই ধ্বংস হইতে বাঁচাইয়া তদপেক্ষাও অধিকতর ধ্বংসে নিরীহ মানবতাকে নিক্ষেপ করা কি কখনো মানবতাবাদী কাজ হইতে পারে?

রাষ্ট্রীয়করণ নীতির ব্যর্থতা

মূলত রাষ্ট্রীয়করণ নীতির পশ্চাতে কোন বাস্তব যুক্তির অস্তিত্ব বর্তমান নাই। ব্যক্তিকে ব্যবহারিকভাবে মালিকানা অধিকার দান করিলে সে সকল অবস্থায় কেবল শোষণ (Exploitation)-ই করিবে, কখনই উহার সুবিচারপূর্ণ ব্যয় ও বন্টন করিবে না বলিয়া পুঁজিবাদ ‍সৃষ্টির পথ উন্মুক্ত হইবে এবং ব্যক্তি-মালিকানা নির্মুল করিয়া রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করিলেই অসাম্য ও শোষণের সব পথ চিরতরে রুদ্ধ হইয়া যাইবে, -রাষ্ট্রীয়করণ নীতির যৌক্তিকতা দেখাইবার জন্য সাধারণত ইহাই বলা হয়। কিন্তু এই কথা যে কতখানি হাস্যকর ও ভিত্তিহীন, তাহা বলাই বাহুল্য। জিজ্ঞাস্য এই যে, ব্যক্তির হাত হইতে মালিকানা অধিকার কাড়িয়া লইয়া উহার কর্তৃত্ব কাহার হাতে সোপর্দ করা হইবে? কোনও মানুষের হাতে, না কোনও অলৌকিক শক্তির হাতে? মানুষের হাতেই উহা সোপর্দ করিতে হইবে, সন্দেহ নাই। জনগণের লক্ষ কোটি স্বতন্ত্র হাত হইতে উহা কাড়িয়া লইয়া মুষ্টিমেয় রাষ্ট্র পরিচালকদের হাতে ন্যস্ত করা হইবে। এই লোক ফেরেশতাজগত হইতে নামিয়া আসিবে না; এই জনগণের মধ্য হইতেই তাহারা নির্বাচিত হইয়া কিংবা বল প্রয়োগ অথবা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করিয়া ক্ষমতাসীন হইবে এবং সমগ্র দেশের সর্বাধিক সম্পদ-বৈভব, উপায়-উপাদান এবং শক্তি ও যন্ত্রপাতি প্রয়োগ ও ব্যবহার করার নিরংকুশ কর্তুত্ব কেবল ইহাদের করায়ত্ত থাকিবে। কিন্তু তখন এই লোকগণই যে শোষণ ও জুলুম পীড়ন করিবে না; বরং উহার সদ্ব্যবহার ও সুবিচারপূর্ণ বন্টন করিবে, তাহার নিশ্চয়তা কিছুই নাই। গতকল্য যে সব ব্যক্তির হাতে সুবিচারপূর্ণ বন্টন করিবে, তাহার নিশ্চয়তা পীড়ন করিবে না; বরং উহার সদ্ব্যবহার ও সুবিচারপূর্ণ বন্টন করিবে, তাহার নিশ্চয়তা কিছুই নাই। গতকল্য যে সব ব্যক্তির হাতে স্বল্প পরিমাণ অর্থ সম্পদ ও উপায়-উপাদান ছিল বলিয়া শোষণ করিত, সেই সব লোক আজ ব্যক্তিগত মালিকানা হইতে বঞ্চিত হইয়অও একদিকে রাষ্ট্র পরিচালনার সীমাহীন সুযোগ ও কর্তৃত্ব লাভ করিয়া এবং অন্যদিকেও সেই সাথে অর্থ সম্পদের উপর নিরংকুশ কর্তৃত্ব লাভ করিয়া শোষণ পরিহার ও জাতীয় সম্পদের সুবিচারপূর্ণ বন্টন করিতে শুরু করিবে- তাহার প্রমাণ কি আছে? ব্যক্তিমালিকানাই হউক, কি জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় মালিকানা, উভয ক্ষেত্রেই অবাধ শোষণের পথ উন্মুক্ত থাকে। অন্য কথায়, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র উভয়ই শোষণমূলক অর্থ ব্যবস্থা্ ইহার কোনটিই সাধারণ ও দুর্বল মানুষকে শোষণ হইতে মুক্ত করিতে পারে না। যদি বলা হয় যে, সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্র পরিচালকগণ খুবই সৎ প্রকৃতির এবং ন্যায়পরায়ণ লোক হইবে বলিয়া তাহারা কোনরূপ শোষণ করিবে না, অতএব জাতীয বা রাষ্ট্রীয়করণে কোন আশংকারই কারণ নাই; তাহা হইল আমি বলিতে চাইঃ প্রথমত সৎ লোকদের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত হওয়া সমাজতান্ত্রিক নীতিতে জরুরী নয়; দ্বিতীয়, নৈতিকতার কোন বালাই থাকে না বলিয়া সেখানে সদস্যদের মধ্যে কোন তারতম্য বিচারও থাকিতে পারে না। আর তহাহা যদি হয়ও তবুও তখন কোনরূপ শোষণ হইবে না বলিয়া যাহা বিশ্বাস করে, তাহারা এই কথা কেন বিশ্বাস করিতে পারে না যে, ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজের জনগণকে অনিবার্যভাবে সৎ দায়িত্ব-জ্ঞানসম্পন্ন এবং আল্লাহভীরু ও আল্লাহ প্রদত্ত আইনের অনুসারীরূপে গড়িয়া তোলা হইবে, ফলে তাহাদের নিকট ব্যক্তিগত মালিকানা অধিকার ন্যাস্ত হইলে সেখানে কোনরূপ শোষণ ও জুলূমের আশংকা কিছুতেই থাকিতে পারিবে না। তাই সমাজতন্ত্র অপেক্ষা ইসলামী সমাজের সীমিত ব্যক্তিমালিকানা অধিক নির্ভরযোগ্য, ন্যয়পরায়ণ ও ইনসাফপূর্ণ বন্টন ব্যবস্থাপক বলিয়া মানিয়া লওয়াই কি অধিক যুক্তিসঙ্গত নয়?

এতদ্ব্যতীত রাষ্ট্রীয়করণ করার পূর্ব ও পরের অবস্থার মধ্যে বস্তুতই কোন মৌলিক পার্থক্য সুচিত হয় না; বরং উন্নতির পরিবর্তে তখন অবস্থার অবনতিই ঘটে বেশী। রাষ্ট্রীয়করণের পূর্বে একটি দেশে যদি দুই শত তিন শত পুঁজিদার থাকে এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার আশ্রয়ে থাকিয়া যাহারা নিরীহ জনগণকে অবাধে শোষণ-পীড়ন করিতে থাকে, তবে রাষ্ট্রীয়করণের পর স্বয়ং রাষ্ট্রই সমগ্র পুঁজিদারকে খতম করিয়া ‘অন্যান্য’ ও ‘সর্বপ্রধান পুঁজিদার হইয়া বসে। এই সর্বশ্রেষ্ঠ পুঁজিদারের নিকট পুলিশ, সি.আই.ডি. প্রভৃতির সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র দেশের সামরিক শক্তি ও জাতীয় উপায়-উৎপাদনও একমাত্র তাহাদেরই নিয়ন্ত্রণাধীন হয়। ফলে এই রাষ্ট্রের হাতে এত অসংখ্য পুঁজিবাদী শক্তি ও উপায়-উপাদানের সমাবেশ ঘটে, যাহার তুলনা ভূপৃষ্ঠের অপর কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ই দেখিতে পাওয়া যায় না। এই সময় এহেন ‘সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র’ জনগণের উপর কোনরূপ অত্যাচার-নিষ্পেষণ ও শোষন-পীড়ন করিবে না- চূড়ান্ত রকমের নির্বুদ্ধিতা না থাকিলে তাহা বিশ্বাস করা কাহারো পক্ষে সম্ভব হইতে পারে না। বরং পৃথিবীর ইতিহাস অনুরূপ শক্তি সম্পন্ন রাষ্ট্র-সম্রাটদেরই সংঘটিত জুলুম-শোষণের নির্মম কাহিনীতে পরিপূল্ণ হইয়া রহিয়াছে। কোথাও এবং কোন কালেই এইরূপ শাসন বা শোষণক্ষমতা মানুষকে বিন্দুমাত্র শান্তি দিতে সমর্থ হয় নাই।

বস্তুত রাষ্ট্রশক্তি ও জাতয় ধন-সম্পদ- এই দুইটিই এক একটি জাতির শক্তি-উৎস। রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা লাভের জন্য এবং সরকার ও জনগণ উভয়ের স্বাতন্ত্র্য ও অধিকার রক্ষার জন্য রাষ্ট্রশক্তি ও ধন-সম্পদের বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য। কোন শে এই উভয় শক্তি সরকারের কুক্ষিগত হইলে সেখানকার জনগণ যে নিষ্পেষিত, নির্যাতিত ও বঞ্চিত হইবে, তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। বর্তমান পৃথিবীর কমিউনিস্ট দেশগুলিল জনগণের অবস্থাই ইহার জ্বলন্ত প্রমাণ।

সম্পদ-সম্পত্তির রাষ্ট্রীয়করণ নীতির ধ্বংসকারিতা কেবল রাজনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণেই প্রকটিত হয় না, নিতান্ত অর্থনীতির দৃষ্টিতেও ইহা একান্তই অযৌক্তিক, গ্রহণ-অযোগ্য এবং সম্পদ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ-রূপে ব্যর্থ প্রমাণিত হইয়াছে। বৃটেনের শ্রমিক সরকারের জাতীয়করণ নীতিই এতদঞ্চলের একশ্রেণীর লোককে জাতীয়করণে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করিয়াছে। কিন্তু এই শ্রেণীর লোক ভুলিয়া যান যে, বহু বৎসরের বেরকারী শৈল্পিক প্রচেষ্টার পরই বৃটিশ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্প-প্রধান ও পুঁজিবাদী জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে। সেখানে জাতীয়করণ নীতির পরীক্ষা করা হইয়াছে বেরকারী শৈল্পিক প্রচেষ্টার দানে সমুন্নত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। কিন্তু যে দেশের অবস্থা অনুরূপ নহে, সেখানে এইরূপ প্রচেষ্টার সাফল্য একেবারেই অনিশ্চিত। বৃটেনের পূর্বতন শ্রমিক সরকার তাহাদের পাঁচ বৎসরের রাজত্বে যে সমগ্র অর্থনীতির ২০ ভাগ জাতীয়করণ করিতে সমর্থ হইয়াছিল তাহাও জনগণের বিন্দুমাত্র কল্যাণ সাধন করিতে সক্ষম হয় নাই; বরং তাহাদের দুঃখ-দুর্দশা বৃদ্ধি করিয়াছে মাত্র। তদুপরী শ্রমিক সরকার যে সমস্ত শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ব করিয়াছিল তাহা পূর্বে বেসরকারী পরিচালনায় যথেষ্ট সাফল্যের পরিচয় দিয়াছিল। জাতীয়করণ নীতির ব্যর্থতা শ্রমিক সরকার স্বীকার না করিলেও প্রকৃতপক্ষে ইহা যে ব্যর্থ হইয়াছে, তাহাতে কাহারো সন্দেহ নাই। এক ঘোষণায় প্রকাশ, বৃটিশ সরকার আর জাতীয়করণের চেষ্টা করিবে না। ইহা প্রকারন্তরে জাতীয়করণের ব্যর্থতারই অকপট স্বীকৃতি মাত্র।[বাংলাদেশেও রাষ্ট্রায়ত্তকরণ নীতি যে চরমভাবে ব্যর্থ হইয়অছে এবং এখানকার জাতীয় অর্থনতিতে নৈতিক তথা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে সর্বাত্মক বিপর্যয় ও সংকট টানিয়া আনিয়াছ, তাহা উল্লেখ করার প্রয়োজন পড়ে না।]

বস্তুত, নীতি হিসাবে জাতীয়করণ যতই জনপ্রিয় হউক না কেন, বাস্তব ক্ষেত্রে উহার সার্থকতার সম্ভাবনা মোটেই নাই। বৃটেনের শ্রমিক সরকার এই নীতি অনুসারে কয়লার খনি জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করিয়াছিল, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যে, বেসরকারী পরিচালনায় যখন উত্তেলিত কয়লার হিসাবে প্রতি টনে ২ শিলিং করিয়া মুনাফা হিইত, সরকারী আমলে তাহাতে হইতে লাগিল গড়ে ১ শিলিং করিয়া লোকসান। উপরন্তু সরকারী আমলে আগের তুলনায় গড়ে বৎসরে ২ কোটি টন কয়লা কম উত্তেলিত হিইতে লাগিল।

কানাডায় বেসরকারী পরিচালনাধীনে কানাডিয়ান প্যাসিফিক রেলওয়ে কোম্পানী এবং সরকারী পরিচালনাধীনে কানাডিয়ান ন্যাশনাল রেলওয়ে- এই দুইটি প্রতিষ্ঠান রহিয়াছে। কিন্তু দেখা গিয়াছে যে, ১৯৩৬ সনে যখন সরকারী প্রতিষ্ঠানটির ৯০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়, সেই বৎসরই বেরকারী প্রতিষ্ঠানটিতে মুনাফা হয় ২ কোটি ৩০ লক্ষ ডলার।

জাতীয়করণ নীতির সর্বশ্রেষ্ঠ হোতা হইতেছে সোভিয়েত রাশিয়া। সেই সোভিয়েত রাশিয়াতেও এই নীতির চরম ব্যর্থতা প্রমাণিত হইয়াছে। সোভিয়েত সরকার কর্তৃক প্রচরিত The New Economic Upsowing of the U.S.S.R নাম রিপোর্ট (১৯৫০) দেখানো হইয়অছে: রাষ্ট্রীয়করণের ফলে চাষাবাদের কাজে শ্রমিকরা ফাঁকি দেয়, চুরিও করে। এই কারণে রাষ্ট্রকে বিপুল পরিমাণ ক্ষতি বহন করিতে হয়। রিপোর্ট বলা হয়: ১,৮২০০০ জন লোক কাজ না করিয়াই বেতন গ্রহণ করে। ১,৪০,০০০ টি পশু ও প্রায় ১,৫০,০০০ রুবল মূল্যের দ্রব্য বেআইনীভাবে কুলখজ হইতে অপহৃত হয়।

শুধু তাহাই নয়, ঐ রিপোর্টের ১৭৭ ও ১৭৮ পৃষ্ঠায় সমষ্টিগত দায়িত্বে উৎপাদন হ্রাস পায় বলিয়া ব্যক্তিগত দায়িত্বের উপর এবং ‘খন্ড কার্য প্রণালীর’ উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে।[একুশ দফর রুপায়ণ- অধ্যাপক আবুল কাসেম] দীর্ঘ ও একটানা পঞ্চাশ বৎসর পর্যন্ত অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াও রাশিয়া এখন পর্যন্ত ক্রমাগত ব্যর্থতারই মুখ দেখিয়া আসিয়াছে। সেখানকার সরকার করায়ত্ব কৃষি-ব্যবস্থা সর্বাধিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হইয়াছে। কৃষি ব্যবস্থার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ ও সমধিক পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা সহেত্ত্বও সেখানকার ফসল উৎপাদন অত্যন্ত নিম্নস্তরের ও নিম্নমানের রহিয়াছে। ১৯৬৩ সনে প্রায় শতকরা ৭০টি কৃষি ফার্মের বিরাট রকমের খেসরত দিতে হইয়অছে। ১৯৬৫ সনের পরিসংখ্যান হইতে জানা যায় যে, সরকারী কৃষি ফার্মে সামগ্রিকভাবে শতকরা ৪০ কোটি পাউন্ড ক্ষতি হইয়াছে। -(সাপ্তাহিক আইন, ২৩ শে মে, ১৯৭৬ সন)

সমাজতান্ত্রিক চীনের কৃষি জাতীয়করণেরও এই নির্মম পরিণতিই দেখা গিয়াছে। তথায় ১৯৫৫ সনে সর্বপ্রথম জমিক্ষেতকে রাষ্ট্রায়ত্ব করা হয়। কৃষকদের নিকট হইতে নানা প্রকারে কৌশল ও ধোঁকাবাজির সাহায্যে সমস্ত জমি সরকারী নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। কিন্তু ইহার পর কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ তীব্রভাবে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। তখনকার চীনা পত্র-পত্রিকায়ও ব্যাপক খাদ্যাভাব ও কঠিন রেশন ব্যবস্থা চালু হওয়ার বিবরণ প্রকাশিত হয়। শহর অঞ্চলে রেশন ব্যবস্থা ক্রমশ কঠোর মূর্তি পরিগ্রহ করে। গামাঞ্চল হইতে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করার ব্যাপারে সরকারকে যেসব সমস্যা অসুবিধার সম্মুখীন হইতে হয়, তাহারও রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশিত হইয়া পড়ে। তাহা হইতে স্পষ্টভাবে বুঝা গিয়াছিল যে জমি জাতীয়করণের ফলে শস্যোৎপাদনের পরিমাণ ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থাধীন উৎপাদন পরিমাণের তুলনায় অনেকখানি হ্রাস পাইয়া গিয়াছে। শুথু তাহাই নয়, কৃষকদের জমি, ক্ষেত সরকার কর্তৃক কাড়িয়া লওয়ার ফলে সাধারণ কৃষকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়াছে, তাহা রাজনৈতিক উপায়ে প্রকাশ পাইবার পথ না থাকার দরুন তাহাদের মধ্যে ধ্বংসাত্মক প্রবণতা বৃদ্ধি পাইয়াছে। ফলে তাহারা চাষের জন্তু ধ্বংস করিয়া এই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে। এই কারণে সেখানে কৃষি জন্তু বহুলাংশে কমিয়া যায়। চীনের পত্রিকা JEN-MIN JEN-POO-তে ১৯৫৭ সনের ২৯শে সংখ্যায় ইহার বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হইয়াছিল।

বাংলাদেশেও জাতীয়করণ নীতির চরম ও মারাত্মক ব্যর্থতার সহিত আমরা প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত হইয়াছি। যাবতীয় বৃহৎ শিল্পকারখানা ও ব্যবসায়-বাণিজ্যে জাতীয়করণ নীতি অর্থনীতির দিক দিয়াই শুধু দেউলিয়াত্ব প্রমাণ করে নাই, বরং জাতীয় ণৈতিকতার ক্ষেত্রেও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করিয়াছে।

ইইসব বাস্তব ও প্রমাণ-ভিত্তিক যুক্তিসমূহ সম্মুখে রাখিয়া জাতীয়করণের ফলে জাতীয় কল্যাণ সাধিত হইবার কোন আশা কি কেহই করিতে পারে?

ইসলামী অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অবকাশ

পূর্বোক্ত বিস্তারিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত মালিকানার তাৎপর্য, গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য অনুধাবনীয়। ব্যক্তিগত ভোগাধিকার ভিত্তিক মালিকানা মানুষের স্বভাব ও মনস্তত্বের সহিত পুরা-পুরিভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ব্যক্তির এই অধিকার হরণ করা মানব-প্রকৃতির সম্পুর্ণ পরিপন্থী। যেখানেই ইহা কার্যকর করা হইয়াছে, সেখানেই মানুষের প্রকৃতি বিদ্রোহী হইয়া উঠিয়াছে- সে বিদ্রোহের বহিঃপ্রকাশ পারিপার্শ্বিক প্রভাবের দরুন যত বিলম্বেই ঘটুক না কেন। এই কারণে ইসলামী অর্থনীতে ব্যক্তির এই অধিকার গোটা অর্থব্যবস্থার অন্যতম বুনিয়াদ। ইহাকে অস্বীকার করা হইলে ইসলামী অর্থব্যবস্থার গোটা প্রাসাদই ধূলিস্‌সাৎ হইতে বাধ্য। যাকাত, হজ্জ, মীরাস, আল্লাহর পথে অর্থব্যয়, সাদকা, পারস্পরিক করয দিয়া সাহায্য করা, ক্রয়-বিক্রয়ের সমতা রক্ষা এবং এই পর্যায়ের কুরআন-হাদীসের যাবতীয় ঘোষণাবলী অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মালিকানা অধিকারের সহিত নিবিড়ভঅবে সম্পৃক্ত। ইহাকে অস্বীকার করার অর্থ জীবন সম্পর্কে ইসলামের ধারণা এবং ইসলাম নির্ধারিত জীবন-লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে অস্বীকার করা। পক্ষান্তরে, ইহাকে সত্য বলিয়া মানিয়া লইলে ব্যক্তিগত ভোগাধিকার ভিত্তিক মালিকানা অধিকারকেও অনিবার্যভাবে মানিয়া লইতে হইবে। কেননা একদিকে উহা মানিয়া লওয়া এবং অপরদিকে ব্যক্তিগত মালিকানাকে অস্বীকার করা মৌলিকভাবেই পরস্পরে বিরোধী। শুধু তাহাই নয়, এই ব্যক্তিগত মালিকানা কুরআন হাদীসের ভিত্তিতে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত এবং এক অনস্বীকার্য সত্যও বটে।

বস্তুত, আল্লাহ তা’আলা মানুষের জন্য যাহা কিছু করিয়াছেন, মানুষ যে পূর্বোক্ত অর্থে উহার মালিক হইতে পারে, নিম্নলিখিত আয়াত হইতে তাহা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়।

(আরবী************)

তাহারা কি ভাবিয়া দেখে নাই যে, আমিই আমার নিজস্ব ক্ষমতায় তাহাদের জন্য জন্তু-জানোয়অর (প্রভৃতি নিয়ামত ও যাবতীয় ধন-সম্পদ) সৃষ্টি করিয়াছি, অতঃপর তাহারা-ই সেই সবের মালিক হইয়াছে। এবং এইগুলিকে তাহারে জন্য অনুগত, অনুকূল ও অধূন বানাইয়া দিয়াছি। ইহার দরুন-ই তাহারা উহা হইতে যানবাহন ও খদ্যবস্তু গ্রহণ করিতে পারিতেছে।

অর্থাৎ গোটা সৃষ্টিলোক ও উহার যাবতীয় দ্রব্য-সামগ্রী, জন্তু জানোয়অর- সব কিছুই একমাত্র আল্লাহর সৃষ্টি। মানুষ এই সবের উপর আল্লাহর নিয়োজিত খলীফা। তাহারা এইসব সৃস্টি জিনিস আল্লাহর দেওয়া আইন-বিধান মুতাবিক উপার্জন করিবে, ভোগ ও ব্যবহার করিবে, খাইবে, পান করিবে, যানবাহন রূপে কাজে লাগাইবে ও ইহা হইতে সত্যকার কল্যাণ লাভ করিবে। আল্লাহর সৃষ্ট জিনিসকে এইরূপে উপার্জন ও ভোগ-ব্যবহার করার অধিকার স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার দেওয়া অধিকার এবং এই হিসাবেই মানুষ এইসবের মালিক। সে মালিক সামষ্টিকভাবে এবং ব্যক্তি সমাজেরই একজন হিসাব ব্যক্তিগতভাবেও।

কুরআনে সর্বজনমান্য তাফসীরকারগণও উপরোক্ত আয়অতের এই অর্থই বুঝিয়াছেন। ইমাম খাজেন এই আয়তের তাফসীর লিখিয়াছেন:

(আরবী************)

আল্লাহ বলেন, আমরা এই সবকিছু মানুষের কল্যাণের জন্যই সৃষ্টি করয়াছি। অতঃপর তাহাদিগকে এই সবকিছুর মালিক বানাইয়া দিয়াছি। অততএব তাহারা মালিকানা অধিকারের ভিত্তিতে এইসবে ভোগ ও ব্যবহার করিতে থাকিবে।

ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিীখয়াছেন:

(আরবী************)

জন্তু-জানোয়অর ইত্যাদি সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহর নিয়ামত দানের কাজ পূর্ণ করার কথাই এই আয়তে বলা হইয়াছে। কেননা আল্লাহ যদি এইসব সৃষ্টি করিতেন আর মানুষ যদি এই সবের ব্যবহারাধিকার হিসাবে মালিক না হইত তাহা হইলে মানুষ আল্লাহর সৃষ্টিধারা হইতে কিছুমাত্র উপকৃত হইতে পারিত না।

ব্যবহারিক হিসাবে মালিকানা লাভের উপায়

প্রাকৃতিক সম্পদের সহিত যখনই মানুষের পরিশ্রমের যোগ হয়, ইসলামী অর্থনীতে তখনই হয় ব্যক্তি মালিকানা অধিকারের সূচনা। স্বভাব জাত কোন উপাদানকে যদি কেহ নিজের পরিশ্রমের সাহায্যে ব্যবহারোপযোগী করিয়া তোলে- কেহ যতি কোন কাঁচা মালকে নিজের শ্রমের বদৌলতে শিল্পপণ্যে পরিণত করে, তবে সে উহার মালিক হইবে। সে উহাকে নিজের দখলে অধিকার রাখিয়া তাহা ভোগ ও ব্যবহার করিতে পারিবে, উহাকে দান করিতে ও বিক্রয় করিতে পারিবে, উহার সাহায্যে আরও অধিক অর্থ উপার্জন ও উৎপাদন করিতে পারিবে। ইসলামের নির্দিষ্ট সীমা ও আইনের মধ্যে থাকিয়া এই অধিকারসমূহ সে ভোগ করিতে পারিবে। বস্তুত ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদ ও সম্পত্তির উপর মানুষের খিলাফত অধিকারের আওতার মধ্যে ইহাই মালিকানা অধিকার। ইহার অধিক অন্য কোন প্রকারের মানবীয় মালিকানা ইসলামে স্বীকৃত নয়। মালিকানার বিভিন্ন রূপ সম্পর্কে ইন্‌সাইক্লোপিডিয়া বৃটানিকার ভাষ্য হেইল:

Common Property and common enjoyment of it, common prorerty and private enjoyment, private property and private enjoyment.

‘সমষ্টিগত মালিকানা এবং ইহার সমষ্টিগত ভোগ ও ব্যবহার; সমষ্টিগত মালিকানা ও ব্যক্তিগত ভোগ-ব্যবহার; আর ব্যক্তিগত মালিকানা ও ব্যক্তিগত ভোগাধিকার’। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে মালিকানার এই সবকয়টি পন্থাই ত্রুটিপূর্ণ ও মারাত্মক। ইহার শেষেরটি বর্তমানের ‍পুঁজিবাদ, দ্বিতীয়টি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং প্রথমটির কোন বাস্তব রূপ কোথাও আছে কিনা জানা নাই। তবে ইসলামের নীতির সহিত ইহার কিছুটা সাদৃশ্য আছে বলিয়া মনে করা যায়। কেননা আল্লাহর সৃষ্টি সম্পদের ক্ষেত্রে সকলেই উহার খলীফ। তবে ভোগ-ব্যবহারের ব্যক্তিগত অধিকার সকলের জন্যই স্বীকৃত। ব্যক্তির নিকট রক্ষিত সম্পদে যেমন সকলেই অধিকার, তেমনি সমষ্টির নিকট রক্ষিত সম্পদেও ব্যক্তির অধিকার স্বীকৃত। তবে তাহা ব্যক্তি ও সমষ্টির অনুমতিক্রমেই লাভ করা সম্ভব। ইসলামের এই মালিকানা-দর্শনের বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট। মালিকানা সম্পর্কে ইসামের এই আদর্শের দরুন-ই স্ত্রী-পুরুষ সকলকেই উপার্জনের ও উপার্জিত সম্পদের মালিকানা হওয়ার অধিকার দেওয়া হইয়াছে, যদিও উহা সমষ্টির নিকট হইতে আল্লাহর বিধান অনুযায়ীই পাইতে হয়। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেন:

(আরবী************)

পুরুষগণ যাহা উপার্জন করে তাহা তাহাদের মালিকানা এবং স্ত্রী-লোকেরা যাহা উপার্জন করে তাহার মালিক তাহারাই।

নদীর পানি প্রাকৃতিক অবদান, ইহা সকল মানুষের জন্য সমান অধিকারের বস্তু; কিন্তু সেই পানি যদি কেহ মশকে ভরিয়া বাজারে বা ঘরে ঘরে বিক্রয়ার্থে লইয়া যয়, তবে সে উহার মালিক বলিয়া বিবেচিত হইবে। এই পানি বিক্রয় করার- ইহা বিনিময়ে মূল্য আদায় করার- তাহা পূর্ণ অধিকার রহিয়াছে। কারণ, সে উহাতে নিজের শ্রম যোগ করিয়অ উহাকে ব্যবহারোযোগী করিয়া তুলিয়াছে, মানুষের পরিশ্রমের সংযোগই হইয়অছে উহার ব্যবহারিক মূল্য Use Value । ঠিক এই জন্যই পড়ো ও অনাবাদী জমিকে যে ব্যক্তি নিজ শ্রমের দ্বারা উর্বর, আবার ও শস্যোৎপাদনের উপযোগী করিয়া তুলিবে, ইতিপূর্বে সে জমির কেহ মালিক না থাকিলে সেই ব্যক্তিই ইহার মালিক হইবে। নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন:

পড়ো জমি- যাহার কেহ মালিক নাই, আল্লাহ এবং তাঁহার রাসুলই উহার মালিক। অতঃপর তাহা সকল মানুষেরই সমানাধিকারে বস্তু। কিন্তু উহার ভোগ ও ব্যবহারাধিকার সেই ব্যক্তিই লাভ করিতে পারিবে যে উহা আবাদ করিবে- চাষোপযোগী ও শস্যোৎপাদক করিয়া তুলিবে।

অপর একটি হাদীসে নবী করীম (স) বলিয়াছেন:

(আরবী************)

যদি কেহ এমন কোন ‘পানি’র নিকট পৌছায় যেখানে ইতিপূর্বে আর কেহই পৌঁছায় নাই, তবে উক্ত ‘পানি’র উপরই তাহারই মালিকানা স্থাপিত হইবে।

এখানে পানি অর্থ কূপ ও জলাশয় সমন্বিত জমি-ক্ষেত। কারণ শুধু পানির উপর কাহারোই ব্যক্তিগত মালিকানা স্থাপিত হইতে পারে না।

কিন্তু বিশেষভাবে মনে রাখিতে হইবে যে, ইসলামের দৃষ্টিতে মালিকানা লাভ করার জন্য শ্রমই একমাত্র উপায় নয়। ‘মানুষ পরিশ্রম করিয়া যাহা উপার্জন করিবে একমাত্র উহার উপর তাহার মালিকানা স্বত্ব স্বীকৃত হইবে, এতদ্ব্যতীত মালিকানা লাভ করার আর কোনই উপায় নাই’ ইসলামী অর্থনীতিতে এই কথাটি মোটেই সত্য নয়। Labour can make value – ‘একমাত্র শ্রমই মূল্য ‍উৎপাদন করিতে পারে’ –কথাটি কার্ল মার্কসের। আর এই কথাটি যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অবাস্তব, তাহা বহু পূর্বেই প্রমাণিত হইয়াছে। কারণ এই কথাটি সত্য হইলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজের যাবতীয় প্রয়োজন একমাত্র নিজের শ্রম দ্বারাই পূর্ণ করিতে হয়’ কিন্তু মানব সমাজের ঐতিহাসিক যুগে ইহা কোনদিনই সম্ভবপর ছিল না, আর কোনদিন তাহা সম্ভবপর হইতেও পারে না। মানুষ সামাজিক জীবন যাপন করিতে বাধ্য হয় এই জন্য যে, তাহার কোন প্রয়োজেই সে একাকী পূর্ণ করিতে সক্ষম হয় না। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কার্ল মার্কসের এই উক্তির অবৈজ্ঞানিকতা সুস্পষ্ট। আর ইসলাম এই মত কিছুতেই স্বীকার করিতে পারে না। কারণ, তাহাকে ক্রয়-বিক্রয়, বিনিময়, দান-উপহার-উপঢৌকন, ভাড়া দেওয়া ও নেওয়া, মূলধন ও মুনাফার অংশীদারিত্বে ব্যবসায়, মীরাস বন্টন ও অসীয়ত প্রভৃতি মানব সকামের হাজার হাজার কাজ একেবারে হারাম হইয়া পড়ে, অথচ ইসলাম এই সকল কাজকে সম্পূল্ণ সঙ্গত বলিয়া ঘোষণা করিয়াছে। কাজেই ‘শ্রম’ ইসলামী অর্থনীতে মালিকানা লাবের একমাত্র সূত্র নয়। ইসলামী অর্থনীতে ব্যক্তিগত মালিকানা লাভের সঙ্গত উপায় মোটামুটিভাবে সাতটি:

১. প্রথম দখল: প্রাকৃতির উপায়-উপাদানের মধ্যে যে যে দ্রব্য ও উপাদানের উপর এখনো কাহারো মালিকানা অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় নাই, তাহা সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি দখল করিয়া লইবে উহার উপর তাহারই মালিকানা স্বীকৃত হইবে। অবশ্য এই মালিকানা সরকার কর্তৃক প্রদত্ত হইতে হইবে। বস্তুত মালিকবিহীন জমি বন্টনের অধিকার সরকারেরই রহিয়াছে। ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ বলিয়াছেন:

(আরবী************)

পড়ো জমি কিংবা যাহা কাহারো মালিকানাধীন নয়, যাহার উপর কাহারোই দখল নাই সেই জমি লোকদের মধ্যে বন্টন করার একমাত্র অধিকার রাষ্ট্রপ্রধানের (অর্থাৎ সরকারের)

২. আবিষ্কার-উদ্ভাবন: মানসিক শক্তি ও প্রতিভার সাহায্যে কোন জিনিস আবিষ্কার করা, কোন যন্ত্র প্রস্তুত করা- তাহা কোন আকস্মিক ঘটনার মধ্য দিয়া হইলেও- ব্যক্তিগত মালিকানা লাভের দ্বিতীয় উপায়। এই উপায়ে উদ্ভাবিত সকল জিনিসই উহার মালিক। উপযুক্ত মূল্যের বিনিময়ে সে উহা বিক্রয় করিতে ও হস্তান্তর করিতে পারিবে।

৩. ইসলামী রাষ্ট্রের সরকারের অনুসৃত বন্টনরীতি অনুযায়ী অংশ লাভ” সরকার কর্তৃক কাহাকেও কোন সম্পত্তি দান। ইসলামের দৃষ্টিতে মালিকানা লাভের ইহাও একটি উপায়। ইহা শুধু একটি উপায়ই নয়। ইহা অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ উপায়। তবে শর্ত এই যে, ঠিক যে উদ্দেশ্যে তাহা দেওয়া হইবে তাহা তাহাতেই প্রয়োগ করিতে হইবে।

৪. শ্রম: ব্যক্তির পরিশ্রমও মালিকানা লাভের একটি উপায়। অতএব মানুষ পরিশ্রম করিয়া এমন সব কাচামাল দ্বারা কোন জিনিস প্রস্তুত করিলে- যাহার উপর ইতিপূর্বে কাহারো ব্যক্তিগত মালিকান স্থাপিত হয় নাই- মেহনতী ব্যক্তি উহার মালিক হইবে। এই কারণে শ্রম ও (Labour) মানুষের ক্রয় ও বিক্রয় যোগ্য একটি সম্পদ। তাই পরিশ্রমলব্ধ অর্থ বা সম্পদের উপর ব্যক্তির মালিকানা স্বীকৃত হইবে। নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন:

(আরবী************)

ব্যক্তির নিজের কাজের ফলে উপার্জিত হয় তাহা তাহার অতীব উত্তম ও পবিত্রতম উপার্জন।[সাধারণ ফিকহ্‌বিদদের মতে পড়ো ও মালিকবিহীন জমি যে লোকই দখল করিয়া আবাদ করিবে, রাষ্ট্র-সরকার অনুমতি দান করুক না-ই করুক, সে উহার মালিক হইবে। অবশ্য ইমাম আবূ হানীফার মতে সরকারের অনুমতি অবশ্যই পাইতে হইবে। অন্যথায় কাহারো মালিকানা স্বীকৃত হইবে না। তিনি ইহার দলীলরূপে এই হাদীসটির উল্লেখ করিয়াছেন:

(আরবী************) যে লোক কোন পড়ো জমি আবাদ করিবে সে উহার মালিক হইবে- যদি রাষ্ট্র উহার অনুমতি দেয়।]

অপর হাদিসে বলা হইয়াছে: (আরবী************)

যে লোক কোন জমি আবাদ করিবে, তাহা কাহারও মালিকানা নয়, তাহা পাইবার বেশী অধিকার তাহার।

৫. উত্তরাধিকার নীতি: উত্তরাধিকার সূত্রে এক এক ব্যক্তি যে সম্পদ ও সম্পত্তি লাভ করে, তাহার উপর সেই ব্যক্তির মালিকানা স্বীকৃত হইবে। শ্রম-মেহনতই যে মালিকানা লাভের একমাত্র উপায় নয়- ইসলামের এই উত্তরাধিকার নীতিই উহার অকাট্য প্রমাণ।

৬. ক্রয় বা বিনিময়: উপযুক্ত মূল্য দিয়া কোন কিছু ক্রয় করা এবং দুইটি পণ্যের পারস্পরিক বিনিময় করাও- এক কথায় ব্যবসায়-বাণিজ্য করাও মালিকানা লাভের সঙ্গত উপায়। ইসলামী ফিকাহ ইহার সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলা হইয়াছে:

(আরবী************)

কোন বস্তুকে জীবিতাবস্থায় কোন কিছুর বিনিময়ে অপরের মালিকানায় হস্তান্তরিত করকেই ক্রয়-বিক্রয় বলে।

৭. উপহার-উপঢৌকন : ইসলামী সমাজে পরস্পরের মধ্যে অর্থ ও উপহার উপঢৌকনের আদান-প্রদান এবং ভালবাসার উপহারও মালিকানা লাভের অন্যতম উপায়। নবী করীম (স) বলিয়াছেন:

(আরবী************)

তোমরা পরস্পর উপহার-উপঢৌকনের আদান-প্রদান কর। ইহার ফলে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা দৃঢ় ও স্থায়ী হইবে।

ফিকাহর পরিভাষায় এই ধরনের দান ও উপঢৌকনকে বলা হয় ‘হেবা’। যাহার জন্য ‘হেবা’ করা হইবে সে উহার মালিক হইবে।

অসীয়ত সূত্রে পাওয়া সম্পদ ও সম্পত্তিতেও ব্যক্তি মালিকানা স্বীকৃত এবং মালিকানা লাভের ইহাও একটি উপায়। কেননা ‘অসীয়ত’ বলা হয় অন্য লোককে কোন কিছুর মালিক বানাইয়া দেওয়াকে। কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী মালিক তাহার মোট সম্পদ ও সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ সম্পর্কে অসীয়ত করিতে পারে। কাজেই যাহার জন্য অসীয়ত করা হইবে সে উহার মালিক হএব। ফিকাহ্‌র কিতাবের অসীয়তের সংজ্হা বলা হইয়াছে:

(আরবী************)

মালিকৈর মৃত্যুর পর তাহার নিজের কোন সম্পদ বা সম্পত্তিকে অপর কাহাকেও দিয়া দেওয়ার কথা মৃত্যুর পূর্বে বলিয়া ও সেই হিসাবে তাহাকে মালিক বানাইয়া দেওয়াই অসীয়ত। ইহার ফলে মূল সম্পদ ও সম্পত্তি এবং উহার মুনাফা সবকিছুর-ই মালিক হইবে সে, যাহাকে উহার মালিক বানাইয়া দেওয়া হইয়াছে।

অতএব এইসব উপয়ে এক ব্যক্তি যে যে জিনিস লাভ করিবে, তাহা সবই তাহার সঙ্গত মালিকানাভুক্ত হইবে।

(আরবী************)

হেবা যাহার জন্য করা হিইবে হেবার জিনিসের উপর তাহার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হইবে।

ব্যক্তি-মালিকানার নিরাপত্তা

ইসলামী বিধান অনুসারে অর্জিত উল্লিখিত মালিকানার উপর হস্তক্সেপ করা বা উহার হরণ করার অধিকার রাষ্ট্র, সরকার ও আইন-পরিষদ-কাহারো নাই। মানুষের রক্ত, মান ও সম্মান- ইহা সবই সংরক্ষিত ও সম্মানার্হ। নবী করীম (স) বিদায় হজ্জের দিন উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করিয়াছেন:

(আরবী************)

তোমাদের রক্ত তোমাদের ধন-মাল এবং তোমাদের ইজ্জত-সম্মান তোমাদের পরস্পরের প্রতি আজিকার দিনের মতোই সম্মানার্হ ও হারাম।

অপর এক হাদীসে নবী করীম (স) বলিয়াছেন:

(আরবী************)

প্রত্যেক মুসলমানের প্রতি অপর মুসলিম ব্যক্তির রক্তপাত, ধন-সম্পত্তি হরণ ও মান-সম্মানের হানি করা সম্পূর্ণ হারাম।

এই হাদীসের নির্দেশ অনুসারে ইমাম আবু ইউসুফ (রহ) ‘কিতাবুল খারাজ’ গ্রন্থে লিখিয়াছেন:

(আরবী************)

কোন প্রমাণি সর্বপরিচিত ও আইনসম্মত কারণ ছাড়া কাহারো ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকারে হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকার নাই বা রাষ্ট্র প্রধানের নাই।

কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানার উপর হস্তক্ষেপ করার জন্য অপরিহার্য ‘প্রমাণিত ও আইনসম্মত কারণ’ কি হইতে পারে? এ সম্পর্কে ইসলামী অর্থনীতি ঘোষণা করিয়াছে যে, মানুষের শ্রমার্জিত সম্পদ বা সম্পত্তির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা ঠিক ততদিন পর্যন্তহ স্থাপিত থাকিবে, যতদিন সে উহাকে কাজে ব্যবহার করিবে, আবাদ করিবে, চাষাবাদ করিয়া উহা হইতে ফসল উৎপন্ন করিতে থাকিবে। কিংবা কারখানা স্থাপন করিয়া উহাকে পূর্ণ মাত্রায় চালূ রাখিবে ও উহা হইতে পণ্যোৎপাদন করিবে। উপার্জিত অর্থ সদ্ভাবে ব্যয় করিবে এবং উহার উপর সরকারের প্রাপ্য সমূহ ‘আল্লাহ নির্ধারিত অধিকার’ মনে করিয় যথারীতি আদায় করিতে থাকে। কিন্তু যতি কেহ তাহার মালিকানা-সম্পত্তি অকেজো করিয়া ফেলে রাখে, জমি চাষবাস না করে এবং তাহা হইতে শস্যোৎপাদন না করে, দোকান কিংবা কারখানা স্থাপন করিয়া ‍উহাকে বন্ধ করিয়া রাখে অথবা কারখানা ও জমি হইতে যথারীতি উৎপাদন চালু রাখিয়া মুনাফা অর্জন করে কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের নির্ধারিত অধিকার আদায় করিতে অস্বীকার করে, তবে তাহার মালিকানা অধিকার বিলুপ্ত হিইবে। কারণ প্রকৃতিজাত কিংবা সাধারণ জনকল্যাণে নিয়োগযোগ্য এই সব সম্পদকে অকেজো করিয়া রাখার কাহারো কোন অধিকার নাই। কিন্তু তবুও যদি কেহ তাহা করে তবে বর্তমান থাকিলে খুব বেী হইলেও তিন বৎসর

********(৮৭ পেইজ এর দুই লাইন স্পষ্ট স্ক্যান হয়নি। তাই টাইপ করা হয়নি)*********

রাখিলে তাহার নিকট হইতে উহা অবশ্যই কাড়িয়া লইতে হইবে। নবী করীম (স) অনাবাদী জমি আবাদ করার অধিকারে মালিকানা লাভের কথা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলিয়াছেন:

(আরবী************)

যে লোক কোন জমি অকেজো করিয়া রাখিবে তিন বৎসর পর এই জরি উপর তাহার কোনই অধিকার থাকিতে পারে না।

ইসরামী রাষ্ট্র তাহার নিকট হইতে জমি- অতএব উহাতে স্থাপিত যে কোন উপাদান-উপায়-কাড়িয়া লইবে। এই জন্য যে সরকার প্রদত্ত কিংবা অন্য কোন উপায়ে লব্ধ কোন এটি উৎপাদন উপায়কে এইরূপ অকেজো করিয়া রাখার ফলে মূলতঃ সমগ্র জাতিরই মারাত্মক ক্ষতি হইয়া থাকে।

হয২রত উমর (রা) এইরূপ একটি মুকদ্দমার রায় দিতে গিয়া বলিয়াছিলেন:

(আরবী************)

কেহ যদি তিন বৎসরকাল পর্যন্ত জমি বেকার ফেলিয়া রাখে, অতঃপর সরকারর অনুমতিক্রমে দ্বিতীয় ব্যক্তি উহা চাষাবাদ করে, তবে এই জমির উপর এই দ্বিতীয় ব্যক্তির মালিকানা স্থাপিত হইবে।

ইহার কারণ এই যে, কোন জমি কেবল দখল করিয়া রাখিলেই উহার মালিকানা স্থায়ী হয় না। বরং কার্যত উহা আবাদ করা এই মালিকানা স্থাপিত হইবে।

ইহার কারণ এই যে, কোন জমি কেবল দখল করিয়া রাখিলেই উহার মালিকানা স্থায়ী হয় না। বরং কার্যত উহা আবাদ করা এই মালিকানার জন্য অবশ্য জরুরী শর্ত। বিশেষতঃ কাহাকেও এই জমির মালিক হইতে দেওয়ার উদ্দেশ্যই হইল এই যে, সে উহা চাষাবাদ করিয়া ও উহাতে ফসল ফলাইয়অ নিজে উপকৃত হইবে ও গোটা সমাজের কল্যাণের ব্যবস্থা করিবে। কিন্তু ইহা যদি সে না করে তবে সে আল্লাহর নিয়ামতের অপমান করিতেছে এবং আল্লাহর নিয়মত হইতে নিজেকে ও জাতিকে বঞ্চিত করিতেছে। এইরূপ যাহারা করে এবং ইহার ফলে যাহারা ধন-সম্পদের অপচয় করে, প্রকৃত পক্ষে তাহারা নির্বোধ, তাহারা একদিকে আল্লাহ প্রদত্ত এই উৎপাদন উপায়ের গুরুত্ব বুঝে না এবং অন্যদিকে ইহাকে অকেজো রাখিয়া নিজের, জাতির, ইসলামী রাষ্ট্রের তথা বিশ্ব-মানবের যে কত মারাত্মক ক্ষতি করে, তাহা তাহারা উপলব্ধি করিতে পারে না। এইরূপ অবস্থায় ইসলামী রাষ্ট্রের কর্মনীতি যাহা হওয়া উচিত তাহা নিম্নলিখিত আয়াতে সুস্পষ্ট ভাষায় বলিয়া দেওয়া হইয়াছে:

(আরবী************)

নির্বোধ ও অবুঝ লোকতের হাতে তোমাদের ধন-সম্পত্তি কখনো ছাড়িয়া দিও না। কারণ এ ধন-সম্পত্তি মানুষের

**** (৮৮ পেইজ এর শেষ লাইনের কিছু অংশ বুঝা যাচ্ছে না।)******

আল্লাহ তা’আলা সৃস্টি করিয়াছেন। কাজেই এইরূপ মালিকদের হাত হইতে তাহা কাড়িয়া লও। অবশ্য তাহাদিগকে জীবিকার খোরাক ও পোশাকের ব্যবস্থা করিয়া দাও এবং তাহাদিগকে প্রকৃত সত্য নীতি শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা কর।

উৎপাদন-উপায়কে যাহারা অকেজো করিয়া রাখিবে ইসলামী রাষ্ট্র তাহা ক্রোক করিয়া লইয়া এমন ব্যক্তিদের মধ্যে উহা বন্টন করিয়া দিবে যাহারা উহাকে আবাদ করিব এবং উহাকে বাস্তবিকিই উৎপাদনের কাজে নিয়োগ করিবে। নবী করীম (স) ‘আকীক’ নামক স্থানের জমির সমস্ত এলাকা বিলাল ইবনে হারিস (রা) কে চাষাবাদের জন্য দান করিয়াছিলেন। হযরত উমর (রা) তাহার খিলাফতকালে তাঁহাকে ডাকিয়া বলিলেন:

(আরবী************)

নবী করীম (স) তোমাকে এই জমি বেকার ফেলিয়া রাখিবার ও জনগণকে উহা হইতে উপকৃত হইতে না দিবার জন্য দান করেনস নাই। বরং দিয়াছেন এই জন্য যে, তুমি উহাকে আবাদ করিবে। (কিন্তু দেখা যায় যে, তুমি তাহা করিতে পার নাই) অতএব যে পরিমাণ জমি আবাদ করিবা সামর্থ্য তোমার আছে, তুমি তাহাই রাখ। আর অবশিষ্ট জমি সরকারের নিকট প্রত্যর্পণ কর।

ইহা হইতে এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম যে ধরনের ব্যক্তিগত মালিকানা সমর্থন করে, তাহা নিরংকুশ নয়, শর্তহীন নয়, পুঁজিবাদী মালিকানাও তাহা নয়। বরং ইসলাম উল্লিখিত শর্তের অধীন সীমাবদ্ধ মালিকানাই সমর্থন করিয়া থাকে ঠিক ততদিন পর্যন্ত, যতদিন পর্যন্ত উক্ত শর্ত যথাযথভাবে রক্ষিত হইতে থাকিবে। এই শর্ত যখনই লংঘন করা হইবে, তখনই ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে এই মালিকানা হরণ করা শুধু সঙ্গতই নয়, অবশ্য কর্তব্রঃও বটে। অতএব কুরআন মজীদের এইরূপ মালিকানাকে ‘আমানতদারী’ বা ‘খিলাফত’ বলিয়া অভিহিত করা যথার্থ হইয়াছে।

ব্যক্তিগত মালিকানায় সরকারী হস্তক্ষেপ

জাতীয়করণ পর্যায়ে ইসলামের নীতি কি? শিল্প-কারখানা, সাধারণ জনকল্যাণমূলক জিনিস, জমি এবং অনুরূপ অন্যান্য জিনিসকে রাষ্ট্রায়ত্ত করার ব্যাপারে ইসলামী অর্থনীতির ভূমিকা কি হইবে?

এই পর্যায়ে আমরা ইতিপূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছি বটে; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও এই পর্যায়ে স্বতন্ত্রভাবে এক তথ্যপূর্ণ আলোচনার অবতারণা জরুরী বলিয়া আমরা মনে করি। বর্তমান আলোচনা এই উদ্দেশ্যেই এখানে সংযোজি হইতেছে।

মালিকানা সম্পর্কে আলোচনা পর্যায়ে আমর ইতিপূর্বে রাসূলে করীম (স)-এর একটি হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছি। হাদীসটি এই:

(আরবী************)

পানি, ঘাস ও আগুন- এই তিনটি জিনিসের সব মানুষ সমান অধিকার সম্পন্ন।

এই হাদীসটি হইতে প্রমাণিত হয় যে, এই তিনটি স্বভাবজাত দ্রব্যবামগ্রী ব্যবহার করার ও উহা হইতে উপকৃত হওয়ার নির্বিশেষ সব মানুষেরই অধিকা রহিয়াছে। কেননা ওইগলি সকল পর্যায়ের মানুষের পক্ষেই অপরিহার্য। এই কারণেই ফিকাহবিদগণ বলিয়াছেন যে, স্বাভাবিক পর্যায়ে এই তিনটি জিনিসের কোন একটিকেও কোন মানুষ অন্য লোকদিগকে বঞ্চিত করিয়া একাকী করায়ত্ব করিয়া লইতে পারে না। কেননা ইহা মানুষের মধ্যে কাহারো ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হইয়অ গেলে অন্যান্য সাধারণ মানুষ তাহা হইতে বঞ্চিত থাকিতে বাধ্য হইবে। আর ইহা মানবতার অধিকার ও মর্যাদার পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। এইরূপ অবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানার উপর হস্তক্ষেপ করা অপরিহার্য হইয়া পড়ে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের এই অধিকার স্বীকৃতব্য।

এই পর্যায়ে মনে রাখিতে হইবে যে, ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিতে হাদীসে উল্লিখিত মাত্র তিনটি জিনিসের মধ্যেই রাষ্ট্রের এই অধিকার সীমাবদ্ধ নয়, বরং অনুরূপ ধরনের সাধারণ মানুষের স্বীকার করিতে হইবে।

ইসলামী শরীয়তে সমাজ-মানুষের প্রয়োজন পূরণ উদ্দেশ্যে ওয়াক্‌ফ করার বিধান রহিয়াছে। শুধু তাহাই নয়, ওয়াক্‌ফ করার ব্যাপারে শরীয়তের যথেষ্ট উৎসাহও দান করা হইয়াছে। ফিকহ শাস্ত্রের সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘ওয়াক্‌ফ’ হইল:

(আরবী************)

কোন নির্দিষ্ট জিনিসকে উহার মালিকের মালিকানা হইতে মুক্ত করিয়া আল্লাহর মালিকানায় অর্পণ করা।….. অর্থাৎ মানব সমাজের কেহই এককভাবে উহার মালিক হইবেনা, যাহাদের জন্য উহা ওয়াক্‌ফ করা হইবে কেবল মাত্র তাহারাই উহার যাবতীয় মুনাফা লাভ করিবে।

বস্তুত, ইহাকে এক প্রকার সম্পত্তির সামাজীকরণ বলা যায়। নবী করীম(স) মদীনার একটি স্থানকে জনগণের গৃহপালিত পশুর চারণভূমি হিসাবে নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছিলেন। উহার নাম ছিল ‘নাকী’ (***) এইরূপে কোন স্থানকে জনসাধারণের জন্য সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়াকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় ‘হিমা’ (****)। অনুরূপভাবে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)‘জুবদা ও উমর ফারূক (রা) রব্‌জা’ নামক স্থানকে নিজ নিজ খিলাফতকালে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন। এইরূপে স্থানের উপর কাহারো ব্যক্তিগত মালিকানা বা কাহারো একচেটিয়া অধিকার স্বীকৃত হইত না। ইহা রাষ্ট্রের ব্যবস্থাধীন সর্বসাধারণের সম্পত্তি হিসাবে ব্যবহৃত হইতেছিল। সর্বসাধরণ মানুষ-ই ইহা ব্যবহার করার অধিকারী ছিল।

হযরত উমর ফারূক (রা) ‘রবজা’ নামক স্থানকে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করিলেন, তখন সেই স্থানের অধিবাসী ও মালিকরা উহার প্রতিবাদে মুখর হইয়া উঠিয়াছিল। তাহারা বলিল, ‘হে আমীরুল মু’মেনীন, আপনি ইহা কি করিলেন? ইহা তো আমাদের বসবাসের স্থান। জাহিলিয়াতের জামানায় উহার জন্য আমরা কত মারপিট ও যুদ্ধ-বিগ্রহ করিয়াছি। আর এই জমীনের অধিবাসী থাকা অবসআয়ই আমরা ইসলাম কবুল করিয়াছি। এইরূপ অবস্থায় আপনি আমদের মালিকানা হরণ করিয়া আমাদের জমিকে রাষ্ট্রয়ত্ত করিয়া লইলেণ এবং সর্বসাধরণের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করিলেন কিভাবে?

হযরত উমর (রা) ইহার সহসা কোন জওয়াব দিতে পারিলেন না। তিনি তাহাদের কথা শুনিয়া কিছু সময় নিশ্চুপ থাকিলেন। অতঃপর বলিলেন:

(আরবী************)

সমস্ত সম্পদ ও সম্পত্তির প্রকৃত মালিকতো আল্লাহ। আর সব মানুষ হইল একচ্ছত্রভাবে আল্লাহর বান্দা। আল্লাহর নামে শপথ, আমি যদি জমীনকে আল্লাহর ওয়াস্তে নির্দিষ্ট না করিতাম তাহা হইলে আমি তাহাদের এক বিঘত পরিমাণ জমিও ‘হিমা’ বা সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করিয়া দিতাম না।

অতঃপর হযরত উমর (রা) এই জমির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এক ব্যক্তি উপর অর্পণ করিলেন। এই সময় তিনি তাহকে যে নসীহত করিয়াছিলেন তাহা ইসলামী অর্থনীতিতে চিরস্মরণ হইয়া রহিয়াছে। তিনি বলিয়াছিলেন:

জনসাধারণের উপর অত্যাচর, অনাচার করিও না, নিপীড়িতের মর্মবিদারী ফরিয়াদকেও ভয় করিও না। কেননা সে ফরিয়াদ আল্লাহর নিকট কবুল হইয়া থাকে। ‍উট ও ছাগল-ভেড়া পালকদিগকে এই স্থানে প্রবেশ করিতে দাও; কিন্তু ইবনে আফ্‌ফান ও ইবনে আওফের পশুগুলিকে প্রবেশ করিতে দিও না। কেননা তাহাদের পশুগুলি যদি খাদ্যাভাবে মরয়াও যায় তাহা হইলে তাহারা খেজুর বাগান ও ফসলের ক্ষেত দ্বারা উহার প্রতিকার ও ক্ষতি পূরণ করিতে পারিবে। কিন্তু এই গরীব অল্পসংখ্যক পশর মালিকদের জন্তুগলি ধ্বংস হইয়া গেলে তাহারা নিজেদের সন্তানাদিসহ আমর নিকট আসিয়অ ‘আমীরুল মু’মিনীন’ বলিয়া চিৎকার করিবে অর্থাৎ তাহারা রাষ্ট্রীয় সাহায্যের দাবি করিবে। কেননা অভাবগ্রস্ত হইয়া পড়িলে বায়তুলমালে তাহাদের অধিকার স্বীকার ****** এইরূপ অবস্থায় কি আমি তাহাদিগকে এমনি অসহায়

**** (৯০ নাম্বর পেইজের শেষের লাইন স্পষ্ট নয়)*****

পশুগুলির জন্য ঘাসের ব্যবস্থা করিয়া দেওয়া আমার পক্ষে সহজ। আর তাহাদের জন্য-ও ইহাই খুশীর বিষয় হইয়া দেখিতে পাইবে, আমি তাহাদের উপর জুলুম করিয়াছি। আর বস্তুত আল্লাহর পথে ভার বহনকারী এই জন্তুগুলি যদি না থাকিত তাহা হিইলে আমি লোকদের নিকট হইতে তাহাদের বসবাস এলাকার জমি গ্রহণ করিয়া সর্বসাধরণের জন্য উন্মুক্ত এলাকা বলিয়া নির্দিষ্ট করিয়া দিতাম না।

উমর ফারূকের এই দীর্ঘ ঘোষণা হইতে স্পষ্ট জানা যায় যে, রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে সরকার ব্যক্তিগত মালিকানাভুক্ত সম্পত্তি দখল করিয়া সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট ও উন্মুক্ত করিয়া দিতে পরে। ধনীদের নিকট হইতে সর্বসাধারণের কল্যাণের উদ্দেশ্যে গৃহীত সম্পত্তি ভোগ-ব্যবহার করার অভাবগ্রস্ত ও কম সম্পদশালী লোকদেরই সর্বাপেক্ষা বেশী অধিকার রহিয়াছে। সমাজে এই ব্যবস্থাপনা থাকিলে দরিদ্র লোকেরা নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে নিপতিত হইতে বাধ্য হইত।

ইসলামী ফিকাহর এ কথা স্পষ্টভাবে বলিয়া দেওয়া হইয়াছে যে, খাদ্যদ্রব্য বা শিল্পপণ্য অধিক মূল্য আদায়েল জন্য মওজুদ করিয়া রাখা নিষিদ্ধ। যে লোক তাহা করিবে তাহার ও তাহার পরিবারবর্গের প্রয়োজনের অতিরিক্ত যাহা, তাহা ন্যায্যমূল্যে বিক্রয় করিয়া দিতে সরকার তাহাকে বাধ্য করিবে। কিংবা যদি কেহ অতিরিক্ত দামে পণ্য বিক্রয় করিতে চেষ্টা করে তবে তাহা ন্যায্য-দামে বিক্রয় করিতে তাহাকে বাধ্য করা হইবে। এই উভয় অবস্থায় পণ্যমালিক যদি সরকারী নির্দেশ মানিয়া লইতে অস্বীকার করে তাহা হইলে তাহার নিকট হইতে পণ্য কাড়িয়া লওয়া হইবে এবং উহাকে ন্যায্য মূল্যে বিক্রয় করিয়া দেওয়া হইবে। কেননা এই উভয় অবস্থাই সাধারণ মানুষের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক হইয়া পড়ে। এই দৃষ্টিতে বলা যায়, কোন জমি বা সম্পত্তির ব্যক্তি-মালিকানা যদি কখনও সাধারণ জন-মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর প্রমাণিত হয় কিংবা সাধারণ জনস্বার্থে কোন জমির ব্যক্তিগত মালিকানা হরণ করিয়া উহাকে রাষ্ট্রায়ত্ব করিয়া লওয়া অপরিহার্য হইয়া পড়ে, তবে উহার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়া তাহা অবশ্যই করা যাইবে।

একজন আনসারীর বাগানে হযরত সামুরা ইবনে জুনদুবের একটি খেজর গাছ ছিল। সেখানে একজন আনসারীর বাগানে হযরত সামুরা ইবনে জুনদুবের একটি খেজুর গাছ ছিল। সেখানে তাহার পরিবারেবর্গের লোকেরা যাতায়াত করিতেন বিধায় আনসাীর বিশেষ অসুবিধা হইত। আনসারী তাহার এই অসুবিদার জন্য নবী করীম (স)-এর নিকট অভিযোগ করিলেন। তখন নবী করীম (স) সামুরাকে উহা বিক্রয় করিতে কিংবা দান করিয়া দিতে অথবা ‍উহাকে উৎপাটন করিয়া ফেলিতে বলিলেন। তিনি মনে করিয়াছিলেন, ইহা নবী করীমের উপদেশ মাত্র, কোন নির্দেশ নয়। তাই তিনি ইহার কোন একটি কথাও মানিয়া লইতে প্রস্তুত হইলেন না। তখন নবী করীম (স) আনসারীকে বলিলেন:

(আরবী************)

নবী করীমের এই নির্দেশ বৈধ ব্যক্তিগত মালিকানর উপর সরাসরি হস্তক্ষেপের অকাট্য প্রমাণ। ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, কোন মালিকানা যখন উহার প্রতিবেশীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বা পীড়া দেয়, তখন ব্যক্তিগত মালিকানা হরণ করা যাইতে পারে এবং ইহার যখন সংগত, তখন কোন মালিকানা যদি সমজ ও সমষ্টির পক্ষে ক্ষতিকর হইয়া পড়ে তাহা সমষ্টির কল্যাণের জন্য হরণ করা যাইবে না কেন?

খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর (রা) তাহার কতিপয় রাজ্য শাসকের অর্জিত ধন-মালের অর্ধেক পরিমাণে রাষ্ট্রায়ত্ব করিয়া লইয়াছিলেন। এই রাজ্য শাসকগণ ছিলেন হযরত আবূ হুরায়রা, আমর ইবনুল আ’স, ইবনে আব্বাস ও সায়াদ ইবনে আবূ ওয়াক্কাস (রা) প্রমুখ বড় বড় সাহাবী। সামাজিক ও জাতীয় কল্যাণ দৃষ্টিতে প্রয়োজন বোধ হইলে ব্যক্তিগত মালিকানার উপর হস্তক্ষেপ করার অবকাশ ইসলামী শরীয়াতে রহিয়াছে, পূর্বোক্ত ঐতিহাসিক ঘটনাবলী হইতে তাহা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়।

ইসলামী শরীয়ত জুলুম প্রতিরোধক ইনসাফ প্রতিষ্ঠাতা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপক এবং সেজন্য দায়িত্বশীল। উহাতে যেমন ব্যক্তির কল্যাণের প্রতি নজর রাখা হইয়াছে, তেমনি সমাজ ও সমষ্টির কল্যাণের প্রতিও। এই দুইয়ের মাঝে যদি কোন দিক দিয়া সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়, তাহা হইলে ইসলামী শরীয়াত উহার প্রতিরোধ করিয়া সেখানে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করিতে বদ্ধ-পরিকর। অতএব, ব্যক্তিগত মালিকানা যদি সমাজ-সংস্কার কিংবা সমাজের অপর কোন ব্যক্তির পক্ষে ক্ষতিকর হইয়া দাড়ায়, তাহা হইলে সামাজিক ইনসাফের ভারসাম্য রক্ষার্থে এই মালিকানা হরণ কিংবা উহাকে নিয়ন্ত্রিত করাও ইসলামী শরীয়তের দায়িত্ব। ইসলামী রাষ্ট্র শরীয়তের এই বিধানের ভিত্তিতেই এইরূপ করার অধিকারী।

বস্তুত, ব্যক্তিগত মালিকানায় সরকারী হস্তক্ষেপ- অন্য কথা ব্যক্তিগত সম্পত্তির রাষ্ট্রায়ত্তকরণ- ইসলামী শরীয়ত সমর্থিত, ইসলামের ইতিহাসে এই ঘটনা বহুবার ঘটিয়াছে। নবী করীম (স) আদালতী ফয়সালা হিসাবে এইরূপ করার নির্দেশ দিয়াছেন। অতএব সাধরণ মানুষের কল্যাণের জন্য এইরূপ করা অপরিহার্য হইলে তাহা অবশ্যই করা যাইবে। অনেক সময় কেবল এই উপায়েই সামাজিক জুলুম ও সামগ্রিক ক্ষতির প্রতিরোধ করা সম্ভব। এই কারণে অনেক ক্ষেত্রে এইরূপ কাজ করা ওয়াজিবও হইতে পারে।

তবে এই ব্যাপারে কাহারো স্বেচ্চাচারিতা করিবার অদিকার নাই। কেননা তাহাতে একটি জুলূম ও সামান্য ক্ষতির প্রতিরোধ করিতে গিয়া আর একটি জুলুম ও বিরাট ক্ষতি হইতে পারে। এইজন্য এই ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্বে সরকারকে অবশ্যৈই নিরপেক্ষ আদালতী ফয়সালা গ্রহণ করিতে হইবে।

কেননা ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত মালিকানা পুরাপুরিভাবে সম্মানার্হ এবং সরকার উহার নিরাপত্তা বিধানের জন্য দায়ী। কেবলমাত্র শরীয়তের বিধানের ভিত্তিতেই এবং ইনসাফের তাকিদেই ন্যায়সঙ্গত পন্থা উহা হরণ করা যাইতে পারে, স্বেচ্চাচারিতা করিয়া নয়।

ব্যক্তিগত মালিকানা সীমিতকরণ

পূর্বে যেমন বলা হইয়াছে, ইসলামী অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত মালিকানা চির সম্মানার্হ তাহাতে পরিমাণ বা সংখ্যার কোন সীমা নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হয় নাই। কিন্তু জনস্বার্থের খাতিরে ও জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে সে মালিকানাকে কোন সময় নিয়ন্ত্রিত কিংবা সীমিত করিয়া দেওয়ার অধিকার আছে কি?

দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারূকের খিলাফতকালে ইরাক, সিরিয়া ও জজীরা মুসলমানদের কর্তৃক বিজিত হইলে এই দেশের কৃষিজমি কি করা হইবে, উহা বিজয়ী মুজাহিদদের মধ্যে বন্টন করা হইবে, কি উহার মালিকদের নিকটেই উহা থাকিতে দেওয়া হইবে, তাহা লইয়অ সাহাবীদের মধ্যে বিশেষ মতভেদ দেয়া দেয়। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শের পর তাহাকে উহার পুরাতন মালিকদের নিকটই থাকিতে দেওয়া হইবে বলিয়া সাব্যস্ত হয়্ ফলে জমি সমূহের পুরাতন মালিকরাই উহা ভোগ-দখল করিতে থাকে, নূতন কাহাকেও উহার মালিক হইতে দেওয়া হয় নাই। অবশ্য ‘খারাজ’ (ভূমিকর) ধার্য করা হয়। এই ভূমিকর নির্ধারণ করা হয় এভাবে যে, জমির ফসল ভাগ করিয়া সম্পূর্ণ আলাদা করিয়া রাখা হইত। এই বন্টনে তাহাদের পরিবারবর্গ এবং তাহাদের সারা বছরে যাবতীয় প্রয়োজনের দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা হইত। এতদ্ব্যতীত বিপদ-আপদে প্রতিরোধের জন্য সঞ্চয় করিয়া রাখার উদ্দেশ্যেও অতিরিক্ত একটা পরিমাণ শস্য তাহাদিগকে দিয়া দেওয়া হইত। অতঃপর যাহা অবশিষ্ট থাকিত, সরকার তাহাই ভূমিকর বাবদ গ্রহণ করিতেন।

হযরত উমর (রা) হুযায়ফা ইবনুল-ইয়ামানকে দজ্‌লা নদীর অপর পাড়ে পাঠাইয়াছিলেন এবং উসমান ইবনে হানীফকে পাঠাইয়াছিলেন অন্য এক অঞ্চলে। তাঁহারা দুইজন তাঁহার নিকট ফিরিয়া আসিলে তিন জিজ্ঞাসা করিলেন:ঢ়

(আরবী***********)

জমির ব্যাপারে তোমরা কি নীতি অবলম্বন করিয়াছ? সম্ভবত তোমরা কৃষিজীবীদের উপর তাহাদের সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপাইয়া দিয়া তাহাদিগকে খুব বেশী কষ্ট দিয়াছ?

জওয়াবে হুযায়ফা বলিলেন: (আরবী***********) অতিরিক্ত যাহা ছিল, তাহা সব তাহাদের জন্যই রাখিয়া আসিয়াছি।’ আর উসমান বলিলেন:

(আরবী***********)

দ্বিগুণ পরিমাণ ফসল তাহাদের জন্য রাখিয়া আসিয়াছি। অবশ্য ইচ্ছা করিলে তাহাও লইয়া আসিতে পারিতাম।

তখন হযরত উমর (রা) বলিলেন:

(আরবী***********)

সাবধান! তোমাদের কৃষিজীবিদের উপর তাহাদের সামর্থ্যের অধিক কর ভার চাপাইয়া দিও না। আল্লাহর নামে শপথ করিয়া বলিতেছি, আমি যদি ইরাকের বিধবাদের খেদমতের জন্য জীবিত থাকি, তাহা হইলে তাহাদিগকে এমন অবস্থায় রাখিয়ে যাইব যে, আমার পরে তাহারা কাহারো মুখাপেক্ষী হইতে বাধ্য হইবে না।

ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, হযরত উমর ও অন্যান্য সাহাবী (রা) ইরাক, সিরিয়া, জজীর ও মিসরের বিজিত অঞ্চলের জমিকেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাধীন রাখিয়াছিলেন এবং কোন ব্যক্তিকেই বিজিত অঞ্চলের জমিকেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাধীন রাখিয়াছিলন এবং কোন ব্যক্তিকেই ইহাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি করিয়া লইবার সুযোগ দেন নাই। ইহা এবং পূর্ব অধ্যায়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করা সম্পর্কে যে আলোচনা আমরা করিয়াছি তাহার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা অনায়াসেই বলা যাইতে পারে যে, প্রয়োজন হইলে কৃষি-জমির মালিকানা সীমিত করা সম্পুর্ণ জায়েয। বিশেষ করিয়া বর্তমানকালে বিভিন্ন দেশে যে বিরাট কৃষি-জমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা রহিয়াছে এবং সেখানে জনস্বার্থ যেভাবে বিপন্ন ও ব্যাহত হইয়া পড়িতেছে, তাহা নানা দিক দিয়াই অত্যন্ত করুণ ও মর্মান্তিক।

সাম্যবাদী ভূমি মালিকানায় এক-একজন লোক বিরাট বিশাল এলাকার বিস্তীর্ণ কৃষি-জমির মালিক হইয়া বসিত। তাহার একার পক্ষে সেই সমস্ত জমির রক্ষণাবেক্ষণ, উন্নয়ন, আবাদকরণ ও উহার ফসল সংগ্রহ সংরক্ষণ স্বাভাবিতভাবে খুবই কঠিন ব্যাপার হইয়া দাড়াইত। এখানে যে সব শ্রমিক মজুর কাজ করিত তাহাদের প্রতিও সুবিচার হওয়ার পরিবর্তে জুলুম ও শোষণ হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। এমন কি অনেক জমি অনাবাদী পড়িয়া থাকাও অস্বাভাবিক ছিল না। ইহাতে জাতীয় খাদ্য সংগ্রহ অভিযান ব্যাহত হইতে এবং তাহার ফলে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেওয়া নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হইত। এই কারণে উত্তরকালে একজন ব্যক্তি মালিকানায় বিরাট বিশাল অঞ্চলের কৃষি-জমি ছাড়িয়া দেওয়ার পরিবর্তে উহার একটি বিশেষ অংশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মালিকানা হইতে মুক্ত করিয়া তাহা ভূমিহীন চাষীদের মধ্যে বন্টন করিয়া দেওয়া-ই সমীচীন বিবেচিত হইতে থাকে। ইসলামের ইনসাফগার দৃষ্টিতে এইভাবে ব্যক্তি-মালিকানা সীমিত করিয়া দেওয়া কিছু মাত্র অন্যায় হইতে পারে না।

ইসলামী ফিকাহয় এইরূপ কার্যক্রম গ্রহণকে বলা (আরবী***********)‘ক্ষতিকর কাজেরপথ বন্ধ করিয়া দেওয়া’। পণ্য মওজুদকারীর অধিক মুনাফা লুণ্ঠনের পথ বন্ধ করা এবং অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রয় করার পথে বাধঅর সৃষ্টি করা সম্পর্কে ইসলামী ফিকাহবিদগণ সম্পূর্ণ রূপে একমত। কেননা এইরূপ করিয়া সমাজ ও জাতির সার্বিক ক্ষতির প্রতিরোধ করা সম্ভব। আর ইসলামী বিধানের লক্ষেই হইল সার্বিক কল্যাণ। একারণে বলা যায়, মুনাফা সীমিতকরণ ও মালিকানা সীমিতকরণে মূলত কোনই পার্থক্য নাই। আর একটি যখন শরীয়তে জায়েয তখন অপরটি অনিবার্যভাবেই জায়েয হইবে।

অনুরূপভাবে এক ব্যক্তির পক্ষে কিছু জমির অংশের মালিক হওয়া ইসলামে সম্পূর্ণ বৈধ। কিন্তু সমাজ ও সরকার যখন লক্ষ্য করিবে যে, তাহাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের অধিক সম্পত্তির মালিক হইতে দিলে সমাজ ও সমষ্টির পক্ষে ক্ষতি হওয়ার এবং বিপুল সংখ্যক ভূমিহীনদের বেকার ও উপার্জন বঞ্চিত হইয়া থাকা আশংকা রহিয়াছে, তখন তাহার অতিরিক্ত জমি সংগ্রহ চেষ্টার পথে বাধা সৃষ্টি করা কোন প্রকারই জুলুম হইতে পারে না। ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে এইরূপ বাধা সৃষ্টি করার ব্যাপারে সরকারের পূর্ণ অধিকার রহিয়াছে।

যে অঞ্চলের লোকেরা আঙুর চাষ করিয়া উহা দ্বারা শরাব তৈয়ার করিতে অভ্যস্ত, মালিকী মাযহাবের ফিকাহবিদদের দৃষ্টিতে সেখানে আঙুর চাষ বন্ধ করিয়া দেওয়া কিংবা উহার অবকাশ সীমিতকণের অধিকার সরকারের রহিয়াছে। স্থানান্তরে গমন করার অধিকার প্রত্যেকটি মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও হযরত উমর(রা) খলীফাতুল –মুসলিমীন হিসাবে একবার বড় বড় সাহাবীগণকে মদীনা ত্যাগ করিয়া অন্যত্র চলিয়া যাইতে নিষেধ করিয়াছিলেন। ব্যক্তির মৌলিক অধিকার ইহাও এক প্র্রকারের হস্তক্ষেপ। কিন্তু জাতীয় কল্যাণের দৃষ্টিতে খলীফাতুল-মুসলিমীনকে তাহা সাময়িকভাবে করিত হইয়াছিল। তাই স্থানান্তরে গমনের স্বাধীনতা হরণ, মাত্রাতিরিক্ত সীমিতকরণের মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য আছে বলিয়া মনে করা যাইতে পারে কি?

আমাদের প্রতিপাদ্য হইল, সমষ্টির কল্যাণ যখন ব্যক্তি মালিকানা সীমিত করার উপর নির্ভরশীল হইবে তখন- কেবলমাত্র তখনি সেই মালিকানকে হরণ বা নিয়ন্ত্রিত কিংবাসীমিত করা ইসলামী শরীয়াতে জায়েয হইবে। আর অনেক সময় শুধু জায়েযই নয়, একান্ত কর্তব্যও হইতে পারে। ইসলামী বিধানে ইহাদের দৃষ্টান্ত ও প্রমাণ কিছুমাত্র বিরল নয়। আমানতী তাৎপর্যে ব্যক্তি মালিকানা ইসলামে সাধারণ স্বীকৃত এক সত্য, এ কথা অনস্বীকার্য, কিন্তু এই কথা-ই চূড়ান্ত নয়। এই মালিকানা কখনও শর্তহীন নিরংকুশ নয় এবং কোন অবস্থায়ই তাহার ব্যতিক্রম করা যাইবে না এমন কথঅও নয়। বরং এই ব্যক্তি-মালিকানা সমাজে ও সমষ্টির কল্যাণের শর্তাধীন। সমাজ ও সমষ্টির কল্যাণের জন্য অপরিহার্য হইয়া দেখা দিলেও ব্যক্তি মালিকানা হরণ বা নিয়ন্ত্রণ করা যাইবে না, কোন মানুষের জন্যই এমন মালিকানা কোন কালেই স্বীকার করা হয় নাই। কেননা ইহা ব্যক্তির নিকট আল্লাহর অর্পিত আমানত মাত্র। তাই আল্লাহ-তা’আলা বিধানেই যখনউহা হরণ বা নিয়ন্ত্রণের দাবি করিবে তখন তাহা অবশ্যই কার্যকর হইবে।

কিন্তু এখানেও মনে রাখিতে হইবে যে, ব্যক্তি-মালিকানা নিয়ন্ত্রণ বা সীমিতকরণের এইসব কাজই কেবলমাত্র সমাজস্বার্থ ও সমষ্টিগত কল্যাণের জন্যই করা সম্ভব। ইসলামে ইহা কোন সাধারণ ও স্থায়ী নীতি বা আদর্শরূপে স্বীকৃত নয়। ইসলামী রাষ্ট্রে এইরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে হইলে সে জন্য নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের নিকট হইতে রায় গ্রহণ করিতে হইবে এবং ইনসাফ মত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণও দিতে হইবে। প্রশাসন কর্তৃপক্ষকে সে জন্য কোনরূপ স্বেচ্ছাচারিতা করার অধিকার দেওয়া যাইতে পারে না।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি