আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
মানব সমাজের শ্রমবিভাগই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গোড়ার কথা। সকল মানুষ যেমন প্রকার কাজ সহজে সম্পন্ন করিতে পারে না, অনুরূপভাবে সব দেশও সকল প্রকার কাজ আঞ্জাম দিতে সমর্থ হয় না। বাংলাদেশের জমিতে যত সহজে পাট উৎপন্ন হয়, অন্যত্র তাহা সম্ভব নয়। অতএব মালয়ে রাবার ও বাংলাদেশের পাট উৎপন্ন করার জন্য চেষ্টা করাই স্বাভাবিক পন্থা। ইহার বিপরীত করিতে গেলে অর্থ এবং শ্রমশক্তির অপচয় অবশ্যম্ভাবী।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গোড়ার কথা

যে দেশে যে জিনিস অপেক্ষাকৃত সহজে জন্মিতে পারে, সেখানে উহারই উৎপাদন করিতে চেষ্টা করা এবং প্রত্যেক দেশের প্রয়োজন অনুসারে অন্যদেশ হইতে পণ্যদ্রব্য আমদানী করার নাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। অতি আদিম কালে যদিও মানব সমাজের পরস্পরের মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিস বিনিময়ের কোন প্রয়োজন হইত না, প্রত্যেকেই নিজের প্রয়োজন নিজের শ্রমশকিতর সাহায্যে পূর্ণ করিয়া লইত। তথাপি মানুষের সমাজ প্রতিষ্ঠার ও উহার সম্প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গ পারস্পরক আদান-প্রদান ও শ্রমোপার্জিত দ্রব্যের পারস্পরক বিনিময় অপরিহার্য হইয়া দেখা দেয়। আজ ব্যক্তি বিশেষ যেমন নিজের সর্ববিধ প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহের জন্য অপরের মুখাপেক্ষী, অনুরূপভাবে প্রত্যেকটি দেশও যাবতীয় প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহের জন্য অন্যান্য দেশের প্রতি মুখাপেক্ষী। কাজেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মারফতে প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যাদির আদান-প্রদান মানব-সভ্যতার এক অপরিহার্য অঙ্গ। যে দেশে যে পণ্য উৎপাদনের স্বাভাবিক সুবিধা আছে, সে দেশে উহা উৎপাদনস করিয়া উহার বিনিময়ে বিদেশ হইতে অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানী করিবে, ইহার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার্য। বস্তুত সমগ্র মানুষ যদি একই পরিবারের লোক হিসাবে বসবাস করিতে পারিত, তাহা হইলে প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহ অসুবিধাজনক হইত না, যাহার যে জিনিসের প্রয়োজন হইত, বিনা দর-দস্তুরে সেখানেই উহা অবাধে সরবরাহ করা চলিতে।

দেশীয় শিল্পপণ্য বিক্রয়

প্রকৃতপক্ষে একটি দেশ উহার উৎপন্ন পণ্য বৈদেশিক বাজারে বিক্রয় করিয়াই সর্বাপেক্ষা অধিক লাভবান হইয়া থাকে। কিন্তু গার্হস্থ্য ও বৃহৎ শিল্পোৎপন্ন পণ্য হইতে ঠিক ততদিন মুনাফা লাভ হইতে পারে, যতদিন (১) উহার কাঁচামাল নিজের দেশ হইতেই সংগৃহীত হইবে, (২) প্রয়োজনীয় কলকারখানা নিজের দেশেই প্রতিষ্ঠিত হইবে এবং (৩) বৈদেশিক পণ্যের আমদানী এমন কড়াকড়িভাবে নিয়ন্ত্রিত হইবে যে, দেশী পণ্যের মুকাবিলায় কোন বৈদেশিক পণ্য দেশের অভ্যন্তরে টিকিতে পারিবে না।

আমদান ও রফতানী

উদাহরণস্বরূপ বলা যাইতে পারে, আমদানী অপেক্ষা রফতানী বেশী হইলে দেশীয় মূলধন বৃদ্ধি পায়, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার উদ্বৃত্তি সম্ভব হয়। কিন্তু ইহার বিপরীত, রফতানী অপেক্ষা আমদানী বেশী হইলে দেশের ধনভান্ডার শূণ্য হইয়া যায় এবং উহার বৈদেশিক মুদ্রা মারাত্মক রূপে হ্রাস পায়্

রফতানী বাণিজ্যে প্রত্যেকটি দেশ সাধারণত তিন প্রকারের পণ্য বিক্রয় করিতে পারে: (১) শিল্পপণ্য, (২) কাঁচামাল ও (৩) বিলাস দ্রব। কিন্তু কোন দেশ যদি কেবল কাঁচামালই বিক্রয় করে, তবে নিজদেশের কোন দিনই শিল্পের উন্নতি সম্ভব হয় না। তখন নিজ দেশের কাঁচামাল বিক্রয় করিয়া বেদেশিক পণ্য ক্রয় করিতে সে স্বতঃই বাধ্য হইবে। কার্পাস উৎপাদনকারী দেশ যদি উৎপন্ন কার্পাসের শতকরা ৯৫ ভাগ বৈদেশিক বাজারে বিক্রয় করিয়া দেশের প্রয়োজনীয বস্ত্র ক্রেতা দেশের নিকট হইতেই খরীদ করিতে থাকে, তাহা হইলে উহার পরিণাম সে দেশের পক্ষে মারাত্মক হইতে বাধ্য। ইহার অন্য অর্থ এই যে, একটি ভিন্ন দেশ কাঁচামাল খরীদ করিয়া বস্ত্র উৎপাদন করে, এবং সেই বস্ত্রই পুনরায় কার্পাস উৎপাদক দেশের নিকট বিক্রয় করিয়া মুনাফা লুটে। এইজন্য প্রত্যেকটি দেশের মৌলিক প্রয়োজনের দিকে দেশবাসীর লক্ষ্য থাকা এবং দেশের অপরিহার্য পণ্য নিজ দেশেই উৎপন্ন করার ব্যবস্থা করা একান্ত আবশ্যক। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত নিজ দেশের যাবতীয় প্রয়োজনীয় পণ্য দেশের অভ্যন্তরে উৎপন্ন কর সম্ভব না হয়, ততদিন বৈদেশিক পণ্য আমদানীর ব্যাপারে এমন নিয়ন্ত্রণ চালু করা প্রয়োজন, যেন দেশী শিল্প-প্রসারের অুকূলে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। সে নিয়ন্ত্রণ নিম্নলিখিত ধারায় হইতে হইবে:

১. কাঁচামাল রফতানী নিয়ন্ত্রিত করিতে হইবে, যেন দেশী শিল্পোৎপাদনের প্রয়োজন অনুপাতে যথেষ্ট পরিমাণ কাঁচামাল সংগ্রহ করিতে কোনরূপ অসুবিধা না হয় নবেং তাহা যেন যথাসম্ভব কমমূল্যে সংগ্র করা যায়।

২. দেশের প্রয়োজনাতিরিক্ত শিল্পপণ্য বৈদেশিক বাজারে বিক্রয় করার সুবন্দোবস্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

৩. দেশের যাবতীয় শিল্পপণ্য যথেষ্ট পরিমাণে উৎপন্ন হওয়া আবশ্যক, যেন তাহা দ্বারা দেশবাসীর প্রয়োজন অনায়অসেই পূর্ণ হইতে পারে।

এইরূপ ব্যবস্থা না করা হইলে- (১) অন্যান্য দেশ এই দেশেরই কাঁচামাল ক্রয় করিয়া অপেক্ষাকৃত সস্তা দরে তাহাদের উৎপন্ন পণ্য এই দেশেই বিক্রয় করিবে। ফলে এই দেশে শিল্পোৎপাদনের অগ্রগতি প্রতি হত হইবে। (২) বৈদেশিক পণ্য নিজ দেশে এইভাবে বিক্রয় হইতে থাকিলে দেশের কারিগর ও শ্রমিক-মজুর বেকার সমস্যার সম্মুখীন হইবে এবং দেশী কাঁচামাল রফতানীরর বিনিময়ে বৈদেশিক পণ্য আমানদানীর ব্যবস্থা করা তখন অপরিহার্য হইয়া পড়িবে।

বিলাস দ্রব্যের রফতানী

বর্তমান যুগের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে বিলাসদ্রব্যের এইজন্য গুরুত্ব রহিয়াছে যে, ইহা অত্যদিখ মুনাফা লাভের দরুন একটি দেশের মূলধন বাড়াইয়া দিতে পারে। এইজন্য প্রত্যেক দেশই নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার উৎকর্ষ সাধনের জন্য বিলাসদ্রব্য রফতানী করিতেই প্রাণপনে চেষ্টা করে। বিলাদ্রব্য রফতানী করিলে দেশের শ্রমিক, মজুর ও ব্যবসায়ীদের প্রচুর মুনাফা হইতে পারে- নিছক এই দৃষ্টিতে যদি চিন্তা করা ও নীতি নির্ধারণ করা হয়, তাহা হইলে উহা এক অপরিহার্য কর্তব্য হইয়া পড়ে, সন্দেহ নাই; কিন্তু ইসলামী অর্থনীতি কোন একটি ব্যাপারে উহার নৈতিক দর্শনকে উপেক্ষা করিতে পার না, নৈতিক নিয়ম-বিধানকে পরিত্যাগ করিতে পারে না। ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থায় মানুষের জীবনের নৈতিক চরিত্র, সর্ববিধ কল্যাণ ও মঙ্গল সাধন করার জন্যই চেষ্টা করা হইবে। এইজন্যই বিলাসদ্রব্যের উৎপাদন ও আমদানী ও রফতানীকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করিতে হইবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, একজন মুসলমান নিজে মদ উৎপাদন করিতে পারে না। তাহাকে প্রথমেই এই কথা চিন্তা করিতে হইবে যে, যে যে দ্রব্য উৎপন্ন করা হইয়াছে, মূলত তাহা মানুষের পক্ষ্যে কল্যাণকর না ক্ষতিকর। কল্যাণকর হইলে উহার উৎপাদন ও ব্যাপক প্রচার করা হইবে আর ক্ষতিকর হইলে তাহা সর্বতোভাবে বর্জন করিতে হইবে। তাহা উৎপন্ন করিয়া বিদেশের বাজারে চালন দিয়া যদি অপরিমিত অর্থ লাভও সম্ভব বা সহজ হয়, তবুও ইসলামী রাষ্ট্র তাহা কিছুতেই করিতে পারে না।

আমদানী নীতি

এক একটি দেশ কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য দ্রব্য এবং বিলাসদ্রব্য আমদানী করিয়া থাকে। আমদানী-নীতি নির্ধারণের সময় তীব্রভাবে লক্ষ্য রাখিতে হইবে যে, প্রকৃতপক্ষে দেশে কোন কোন দ্রব্যের কি কি পরিমাণে অপরিহার্য প্রয়োজন রহিয়াছে।

নিত্য প্রয়োজনীয পণ্য

আমদানী-নীতি নির্ধাণের সময় ইসলামী অর্থনীতিতে প্রথম গুরুত্ব দেওয়া হয় অত্যাবশ্যকীয় উপর। এই ব্যাপারেও দেশের প্রকৃত অবস্থার উপর খুব কড়া নজর রাখা আবশ্যক। কাজেই ঠিক যে জিনিস যতখানি প্রয়োজন তাহা ঠিক সেই পরিমাণেই আমদানী করা সঙ্গত। আর যেসব জিনিস কিছু না কিছু নিজ দেশে উৎপন্ন হয়, সেসব জিনিসের নিজস্ব উৎপাদন অনুপাতে কম আমদানী করা আবশ্যক- যেন দেশের উৎপন্ন পণ্য বিক্রয় হইতে কোনরূপ অসুবিধার সৃষ্টি না হয়। কারণ এইরূপ ব্যবস্থা করা না হইলে এবং তাহার দরুন দেশীর পণ্য বৈদেশিক পণ্যের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী না হইলে একদিকে দেশী শিল্পপণ্যের মৃত্যু ঘটে, অন্যদিকে দেশের কারিগর ও মজুর শ্রমিক বেকার-সমস্যার সম্মুখীন হইতে বাধ্য হয়। এই ভুল আমদানী নীতির ফলে দেশীয় কারিগর ও শ্রমিকদের মধ্যে বেকার সমস্যা সমগ্র দেশে কঠিন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সৃস্টি করে। অতএব (১) অপরিহার্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মধ্যে শুধু তাহাই আমদানী করা আবশ্যক, যাহা দেশীয় কারখানায় প্রস্তুত হয় না। দেশীয় কারখানায় যেসব দ্রব্য উৎপন্ন হয়, কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে হয় না, উহার আমদানী সীমাবদ্ধ ও পরিমিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। (২) এই পণ্যের উপর এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা উচিত যাহাতে দেশীয় শিল্পের বিকাশ ও উৎকর্ষ লাভের সম্ভাবনা যথারীতি বজায় থাকে। এবং (৩) দেশীয় কারখানায় যেসব দ্রব্য প্রয়োজন অনুপাতে যথেষ্ট পরিমাণে প্রস্তুত হয়, সে সবের আমদানী সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা কর্তব্য।

যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল

যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানীর ব্যাপারে ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিতে সর্বপ্রথম সেইসব যন্ত্রপাতি আমদানী চেষ্টা করা বিধেয়, যাহা দেশীয় কাঁচামাল হইতে পণ্যোৎপাদনের জন্য একান্ত অপরিহার্য বলিয়া বিবেচিত হয়। এতদ্ব্যতীত নিম্নলিখিত প্রকারের কাঁচামাল আমদানীর জন্য উৎসাহ দান করা বাঞ্ছনীয়—(১) নিজ দেশে চালু কারখানাসমূহের জন্য যাহা অপরিহার্য, (২) মৌলিক শিল্পোৎপাদনের জন্য যাহা প্রয়োজনীয়, (৩) এবং মৌলিক শিল্পে প্রতিনিয়ত যাহারে প্রয়োজন, শিল্প ও কৃষিকার্যের উৎকর্ষ সাধন এবং এতদসংক্রান্ত মূল বিষয়ের বিশ্লেষণ ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য যাহা অপরিহার্য বলিয়া বিবেচিত হয়।

বিলাস-দ্রব্যের আমদানী

বিলাস-দ্রব্য আমদানী করিয়া দেশের বৈদেশিক মুদ্রা হ্রাস করার ন্যায় নির্বোধের কাজ কোন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সরকারই করিতে পারে না। কারণ ইহাতে ব্যয়িত অর্থ দেশের জনস্বার্থের বিপরীত কাজ করে। জনসাধারণ কখনও বিলাস-দ্রব্য অবাধ ব্যবহার উপযোগী অর্থের মালিক হয় না। যাহাদের নিকট প্রয়োজনাতিরিক্ত মূলধন সঞ্চিত হয়, সাধারণতঃ কেবল তাহারাই বিলাস-দ্রব্য ক্রয় করিয়া থাকে। বর্তমান পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের যুগে শতকরা দুই কিংবা তিনজনের অধিকসংখ্যক লোক ইহা করিতে সমর্থ হয় না। কাজেই যে দেশ এই ধরনের বিলাস-দ্রব্যের অবাধ আমদানী অনুমতি দেয়, সে দেশ গনস্বার্থ ‍উপেক্ষা করিয়া শতকরা মাত্র তিনজনের জন্যই দেশের মুলধন ব্যয় করে। অথচ এই অর্থ দেশের শিল্পোন্নয়নের জন্য অপরিহার্য যন্ত্রপাতি, কাচামাল ও নূতন নূতন আবিষ্কার উদ্ভাবনীর কাজে এবং দেশের সাধারণ অর্থনৈতিক উন্নতি বিধানের জন্য ব্যবহৃত হইতে পারে। কিন্তু তাহা দেশে মুষ্টিমেয় বিলাসী লোকের বিলাস-ব্যসনের লিপ্সা পুরনের জন্য ব্যয়িত হওয়া দেশের পক্ষে মারাত্মক, সন্দেহ নাই।

ব্যবসায়ীর দায়িত্ব

বহির্বাণিজ্যের ব্যাপারে নর্বাপেক্ষা অধিক গুরুত্ব রহিয়াছে ব্যবসায়ীর। ব্যবসায়ী একটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মনীতির কার্যকারিতার জন্য যথেষ্টভাবে সহায়ক ও পৃষ্ঠপোষক হইতে পারে। ব্যবসায়ী যদি নিজের ব্যবসা সংক্রান্ত লাভ-ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে দেশের অপরিহার্য প্রয়োজন, জনগণের প্রয়োজন ও মানুষের সাধারণ কল্যাণ সাধনের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখে- জনগণের কল্যাণ সাধন নিজের ঈমানের অংশ মনে করে, তাহার নিজের স্বার্থের সহিত দেশের গণস্বার্থের নিবিড় সম্পর্ক আছে বলিয়া যদি প্রতিমুহূর্ত অনুভব করে, দেশের ব্যবসায়ী যদি নিজের প্রকৃত মর্য়যাদা বুঝিয়ে লয় এবং ইসলামী অর্থনীতি কার্যকর করার জন্য যেসব বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়,তাহা স্বেচ্ছাপ্রণোদিতগ হইয়া যথাযথভাবেই পালন করিয়া চলে, তবেই একটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়িত হইতে পারে।

প্রত্যেকটি মানুষই নিজের প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার উদ্দেশ্যে অর্থোৎপাদনের জন্য চেষ্টা ও শ্রম করে। বস্তুত অর্থনৈতিক চেষ্টা সাধনার মূল উৎস এইভাবেই নিহিত রহিয়াছে। ফলে প্রত্যেকেইকেবল নিজের স্বার্থ লক্ষ্য করিয়াই কাজ করে, ইহা অনস্বীকার্য সত্য। এমতাবস্থায় সঠিক কর্মনীতি ইহাই হইতে পারে যে, প্রত্যেকেই নিজের স্বার্থ-লাভের জন্য চেষ্টা ও সাধনা করিবে, কিন্তু এই কাজে কেহই যেন অপরের স্বার্থের কোনরূপ ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে, সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখাও কর্তব্য। কারণ তাহার ব্যক্তিগত স্বার্থের সহিত গণস্বার্থেরও নিবিড় যোগ রহিয়াছে।

একজন কৃষক কেবল নিজের খাদ্য প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্যই ভূমি চাষ ক রে না, উৎপন্ন যাবতীয় ফসলই সে নিজের খাদ্য হিমাবে খরচও করে না; অন্যান্য লোক- যাহারা খাদ্যোৎপাদনের পরিবর্তে জীবনযাত্রা নির্বাহের অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনে লিপ্ত রহিয়াছে, তাহাদের খাদ্য-প্রয়োজনও সে উদ্ধৃত্ত শস্য হইতে পূর্ণ করে। এইজন্য সমাজের এইসব লোকের স্বার্থহানি করিয়া কোন কাজ করার সুযোগ কিছুতেই কৃষককে দেওয়া যাইতে পারে না। একজন ব্যবসায়ীরও ঠিক অনুরূপ অবস্থা। পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করার ব্যাপারে ব্যবসায়কে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হইবে- যথেষ্ট মুনাফা লাভেরও তাহাকে সুযোগ দিতে হইবে; কিন্তু পণ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় ও মুনাফার পরিমাণ নির্ধারণ করার সময় জনগণের প্রয়োজন, ক্রয়-ক্ষমতা এবং দেশের সাধারণ অবস্থার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে হইবে। এই সমস্ত কাজে সর্বতোভাবে দেশবাসীর কল্যাণই শোষণ করার কোন অবকাশই ব্যবসায়কে দেওয়া যাইতে পারে না। বিশেষ বিশেষ অবস্থায় পণ্যদ্রব্যের পরিমাণ হ্রাস, কিংবা সঞ্চয় করার ফলে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করিয়া জনগণের শ্রমলব্ধ অর্থ জোকের মত শুষিয়া লওয়ার কোন কৌশলই ইসলাম বরদাশত করে না।

দেশের জন্য কোন প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য যদি বিদেশ হইতে আমদানী করা অপরিহার্য হয়, তবে ইসলামী রাষ্ট্র উহার যথাযথ ব্যবস্থা করিবে। হয় রাষ্ট্র সরাকরী পর্য়ায়ে এই দ্রব্য আমদানী করিবে, অন্যথায় দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য ইহার যথাসম্ভব সুযোগ সুবিধা করিয়া দিবে। এমন ব্যবস্থা করিবে, যেন দেশের আইনের বিধিবন্ধন ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ইহার পথে কোনরূপ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করিতে না পারে। তখন একজনখাঁটি ইসলামপন্থী ব্যবসায়ীদের কর্তব্য হইবে তাহার আমদানী ও রফতানী বাণিজ্যকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত করা এবং ‍উভয়ের মধ্যে এমনবাবে সামঞ্জস্য বিধান কর যে, দেশের সম্পদ যেন কোনরূপেই দেশান্তরিত হইতে না পারে। এইরূপ করিতে গেলে যদিও তাহার নিজের মুনাফার পরিমাণ অনেকখানি হ্রাস পাইবে- ব্যক্তিগতভঅবেব সে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে; কিন্তু তবুও দেশের পক্ষে তাহাই একমাত্র কল্যাণকর নীতি, সন্দেহ নাই।

বৈদেশিক বাজার হইতে পণ্য-ক্রয়

বর্তমান সময় সকল প্রকার ব্যবসায়-বাণিজ্যের মূল ভিত্তিই হইতেছে সুদ। ইহার ধ্বংসকারিতা ও মারাত্মক প্রভাব এত তীব্র ও সর্বগ্রাসী হইয়া দেখা দিয়াছে যে, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদগণও উহার বিলুপ্তির জন্য সুপারিশ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীগণ ইহা পরিত্যাগ করিতে প্রস্তুত নয়। তাহারা বলে যে, সুদ বন্ধ করিলে ব্যবসায়-বাণিজ্যে মারাত্মক অচলাবস্থার সৃষ্টি হইবে। বিশেষতঃ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ইহা অপরিহার্য। বৈদেশিক বাজার হইতে পণ্য ক্রয় করিলে উহার মুল্য আদায় করার দুইটি স্থান হইতে পারে- প্রথমত, যে দেশ হইতে পণ্য ক্রয় করা হইল সেই দেশের বন্দরেই উহার মূল্য আদায় করা হইবে (Advance payment system)। দ্বিতীয়ত, উক্ত পণ্য ক্রেতার নিজ দেশের বন্দরে আসিয়া পৌঁছার পর মাল খালাস করিয়া লওয়ার সময় আদায় করিবে। প্রথম পন্থা গ্রহণ করিলে, পণ্যের কারখানা হৈইতে রওয়ানা হওয়ার সময়ই উহার মূল্য আদায় করিলে সুদ দেওয়া তো দূরের কথা আসল মূল্যের অতিরিক্ত কিছু দেওয়ার মোটেই অবশ্যই হইবে না। ব্যবসায়ী সম্পূর্ণ সাদাসিধা নীতি গ্রহণ করিবে- পণ্যের মূল্য উহার বন্দরেই আদায় করিয়া পণ্যবাহী জাহাজ-কর্তৃপক্ষের নিকট উহা সোপর্দ করিয়া দিবে। জাহাজ কর্তৃপক্ষ উক্ত পণ্য ব্যবসায়ীর বন্দরে পৌছাইয়া দিয়া প্রাপ্য ভাড়া এবং অন্যান্য খরচ আদায় করিয়া লইবে।

বিদেশ হইতে পণ্য ক্রয়ের সুদী লেনদেন

কিন্তু বর্তমান সময়ে ব্যবসায়ীগণ বৈদেশিক পণ্যের বাজারে উহার মূল্য আদায় করার পরিবর্তে সাধারণত তাহার নিজ দেশের বাজারে পণ্য পৌঁছার পর উহা খালাস করিয়া লওয়ার সময় মূল্য আদায় করিয়া থাকে। ফলে তাহাকে পণ্যের আসল মূল্য, ভাড়া ও অন্যান্য খরচ ব্যতীতও। পণ্য মূল্য বিলম্বে আদায় করার কারণে- এই মধ্যবর্তী সময়ের সুদ আদায় করিতে হয়। পণ্যের মোট মূল্যের উপরই এই সুদ ধার্য হয়। ব্যবসায়ীগণ ইহাকে অপরিহার্য উপায় বলিয়া মনে করে। পূর্বেই বলিয়াছি, আন্তর্জাতিক পণ্য ক্রয় ও আমদানী করার প্রথমোল্লিখিত নীতি গ্রহণ করিলে কিছুমাত্র সুদ আদায় করার দরকার হয় না। কিন্তু তাহারা ইহা ত্যাগ করিতে প্রস্তুত নয়। ইহার মূলে একটি কারণ রহিয়াছে।

প্রকৃতপক্ষে এই সদ ব্যবসায়ীকে নিজের তহবিল হইতে আদায় করিতে হয় না। পণ্যের আসল ক্রয়-মূল্যের উপর অন্যান্য খরচের সহিত এই সুদ ও চাপাইয়া দেওয়া হয় এবং মোট ব্যয়িত মূলধনকে ক্রয়-মূল্য হিসাবে ধরা হয়। অতঃপর ইহার উপর আরো অতিরিক্ত পরিমাণ ধার্য করিয়া তবে মুনাফা হাসিল করা হয়। এইরূপ বৈদেশিক বাণিজ্যের বর্তমান রীতিতে দেশের অপরিমেয় মূলধন সুদ বাবদ বিদেশে চলিয়া যায় এবং ইহা হয় একমাত্র ব্যবসায়ীর নিজ স্বার্থপর নীতির দৌলতে। কারণ এই মধ্যবর্তী সময়ে তাহার মূলন দেশী বাজারে মুনাফা লুন্ঠনের কাজে নিযুক্ত থাকে। এই টাকা যদি পণ্য ক্রয়ের জন্য চলিয়া যাইত, তবে সে এই সময়ের অর্জিত মুনাফা কিরূপে লাভ করিতে পারিত?

কেবল এই অবকাশটুকু লাভ ক রার জন্যই সাধারণত ব্যবসায়ীরা পণ্য মূল্য আদায় করিতে এতদূর বিলম্ব করে এবং উহার বিনিময়ে জনগণের নিকট হইতে আদায় করা অর্থ হইতে বিপুল পরিমাণ সুদ দিয়া থাকে। এই ব্যবসায়ীগণ ব্যক্তিগতভাবে ‍মুনাফা লুটিবার জন্য জাতি ও জনগণের অর্থ সম্পদের কি বিরাট ক্ষতি সাধন করিতেছে তাহা প্রত্যেকেই বুঝিতে পারেন। মোট কথা সুদ না দিয়াও আন্তর্জাতিক ব্যবসায়-বাণিজ্য সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন করা যাইতে পারে এবং ইহার ফলে এক একটি দেশের বিপুল অর্থ বাঁচিয়া যাইতে পারে। অন্ততঃ ইসলামী রাষ্ট্র সুদ ব্যতীতই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করিতে একান্তই বাধ্য হইবে। ‘ইসলামী ব্যাংকের পরিকল্পনা’ প্রবন্ধে এ বিষয়ে বাস্তব দৃষ্টিতে আলোচনা করা হইয়াছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা

আন্তর্জাতিক ব্যবসায় ও বাণিজ্য-বৈদেশিক বাজার হইতে পণ্য ক্রয়- হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রার (Exchange currency) সাহায্যে অন্যথায় পণ্যদ্রব্যের প্রত্যক্ষ বিনিময়ের (Bartwr system) মারফতে হইয়া থাকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা সাধারণত দুই প্রকার হইয়া থাকে। প্রথম ষ্টার্লিং আর দ্বিতীয় ডলার। দুনিয়ার কতগুলি রাষ্ট্র ষ্টর্লিং-এর সাহায্যে আন্তরজাতিক ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন করিয়া থাকে, কমনওয়েলথ কিংবা উহার সমর্থক অন্যান্য দেশ ও রাষ্ট্রের অধিকৃত এলাকা ইহার অন্তর্ভুক্ত। আর দ্বিতীয় কতগুলি দেশ ডলারের সাহায্রে আন্তর্জাতিক ক্রয়-বিক্রয় ও লেন-দেন করিয়া থাকে। আমেরিকা, উহার মিত্র দেশসমূহ এবং সেগুলির প্রভাবাধীন অঞ্চল ইহার অন্তর্ভুক্ত।

আন্তর্জাতিক মুদ্রার গুরুত্ব

একটি দেশের নিজস্ব মুদ্রা আন্তর্জাতিক ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যদি সমর্থিত না হয়, তবে এই দেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করা সত্ত্বেও অর্থনীতির দিক দিয়া ইহা অন্যান্য দেশের গোলাম হইয়া থাকিতে বাধ্য। একটি দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বুনিয়াদ যতই মজবুত হউক না কেন, সে অন্যান্য অর্থনৈতিক নীতির প্রভাব হইতে মুক্ত থাকিতে সমর্থ হয় না। কারণ আন্তর্জাতিক মুদ্রাই উহার সকল প্রকার অর্থনৈতিক লেন-দেনের একমাত্র ভিত্তি। অন্যান্য দেশ এই মুদ্রার সাহায্যে মূলধনের আবর্তন ব্যাপারে সাম্প্রতিক বাজারে প্রচলিত সকল প্রকার চালবাজী করিতে পারে। এই চালবাজী কেবল যে ইসলাম বিরোধী তাহাই নয়, এক একটি দেশের পক্ষে ইহা স্বভাবতই মারাত্মক হইয়া থাকে। এইজন্য এইসব দেশের অর্থনৈতিক নীতির আক্রমণ হইতে রক্ষা পাইবার একমাত্র উপায় এই হইতে পারে যে, যতদিন না উহার মুদ্রা আন্তর্জাতিক বাজারে সমর্থিত হইতেছে, ততদিন বিনিময় নীতিতেই আন্তর্জতিক বাণিজ্য ও যাবতীয় লেন-দেন সম্পন্ন করিবে।

পণ্য বিনিময়ে (Barter System)

বর্তমান ‍পৃথিবীর আন্তর্জাতিক শোষণ-লুণ্ঠন হইতে আত্মরক্ষা করার অন্যতম উপায় হইতেছে পণ্যের বিনিময়ে পণ্য গ্রহণ করা। ইহার পরও যদি কোন দেশের নিকট কিছু প্রাপ্য থাকিয়া যায়, তবে উহা সেই মূল্য বাবদ স্বর্ণ গ্রহণ করিতে হইবে। কিন্তু বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পণ্য বিনিমরে এই কাজ সুষ্ঠুরূপে আঞ্জাম দেওয়ার জন্য কয়েকটি দেশের পরস্পর চুক্তিবদ্ধ (Clearing Agreement) হিইয়া একটি ব্লক গঠন করিয়া লওয়া সর্বাপেক্ষা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। এই রাষ্ট্রে জোটের অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেকটি দেশ নিজ নিজ রফতানীযোগ্য পণ্য অন্য দেশের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য প্রেরণ করিবে এবং সে দেশ হইতে উহার মুল্য বাবদ নিজ নিজ প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানী করিবে। যেমন বাংলাদেশ যদি ইরানের নিকট তিন কোটি টাকার পাটজাত দ্রব্য বিক্রয় করে তবে সে উহার বিনিময়ে তিন কোটি টাকার তৈল গ্রহণ করিবে। তুরষ্ক যদি বাংলাদেশের নিকট হইতে দুই কোটি টাকার পাট ক্রয় করে, তবে মূল্য বাবদ সে তিন কোটি টাকার কাচা লৌহ কিংবা লৌহজাত পণ্য প্রেরণ করিবে। পক্ষান্তরে তুরস্ক যদি বাংলাদেশ হইতে দুই কোটি টাকা পাট ক্রয় করে আর বাংলাদেশ যদি উহার নিকট হইতে তিন কোটি টাকার লৌহ বা লৌহজাত পণ্য আমদানী করে,তবে বাংলাদেশ ইরানের নিকট হইতে গৃহীত তৈলের এক কোটটি টাকার পরিমণে তৈল তুরষ্ককে দিয়া পাওনা দেনা সমান করিয়া লইবে। ফলে কাহারো নিকট কাহারো কোন কিছু পাওনা অবশিষ্ট থাকিবে না। কারণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটা স্বসিদ্ধ হইতেছে- EXPORT MUST FOR IMPORTS অর্থাৎ যা আমদানী করা হইবে উাহর ‍মূল্য আদায় করার মত রপ্তানী হওয়া চাই। এই ভাবে ব্যবসায় সয়ক্রান্ত প্রতিনিধি [Trade commisson] প্রেরণ করিয়া বা প্রত্যেক দেশের পক্ষ হইতে বিদেশে প্রেরিত রাষ্ট্রেদূতের মারফতে এইরূপ আন্তর্জাতিক ব্যবসায় অনায়াসেই সুসম্পন্ন করা যাইতে পারে। ফলে কোন দেশে পক্ষেই আন্তর্জাতিক মুদ্রার প্রয়োজন হইবে না এবং বিনা সুদে আন্তর্জাতিক লেন-দেন ও মার চলাচল সুষ্ঠুরূপেই চলিতে পারিবে।

কোন দেশের উৎপন্ন কৃষিপণ্য বা শিল্প-পণ্যের চাহিদা যদি কম হয়- সম্পূর্ণরূপে বিক্রয় না হয়, তখন উক্ত প্রকার কৃষি-পণ্যের পরিবর্তে অন্য কোন প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের চাষ করিতে হইবে। যেমন খাদ্যপণ্যের চাহিদা কিংবা তাহাতে মুনাফা কম হইলেও তখন নিজ দেশে শিল্পসংক্রান্ত ও অন্যা্য প্রয়োজনীয় পণ্যের চাষ ‍বৃদ্ধি করিতে হইবে। অনুরূপভাবে এক প্রকারের শিল্পপণ্যের চাহিদা না থাকিলে তখন উহার পরিবর্তে অন্যান্য প্রয়োজনীয় উৎপাদনের কাজে দেশের কারখানাকে নিযুক্ত করিতে হইবে। এইরূপ করিলেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মন্দভাব হইতে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হইবে।

এই ক্ষেত্রে ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য এমন সব দেশের সহিত নিজ পণ্য বিনিময়ের চুক্তি করা যেখান হইতে আন্তর্জাতিক প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানী করা সম্ভব হইবে। ইহার ফলে একদিকে যেমন উহার নিজের পণ্য বিক্রয় হইবে,অন্যদিকে উহার বিনিময়ে সে এমন পণ্য লাভ করিবে যাহার চাহিদা দুনিয়ার সর্বত্র না হইলেও অধিকাংশ দেশেই বর্তমান। ইহাতে উহার পক্ষে যথেষ্টভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব হইবে। যেমন একটি দেশের নিকট পেট্রোল রহিয়াছে, বহু দেশই উহার খরীদ্দার। এখন অন্য একটি দেশ উহাকে খাদ্য-পণ্য দিয়া যদি পেট্রোল ক্রয় করে, তবে সে এ পেট্রোল হইতে যথেষ্ট মুনাফা লাভ করিতে পারে।

পণ্য বিনিময়ের এই রীতির বহুল প্রচার হইলে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এই অনুসার ব্যাপকভাবে কাজ হইতে শুরু করিলে উহার ফল নানা দিক দিয়াই কল্যাণকর হওয়ার সম্ভাবনা রহিয়াছে। প্রথম ফল হইবে যে, যেসব শক্তিশালী দেশ নিজেদের আন্তর্জাতিক মুদ্রার একচেটিয়া কর্তৃত্বের দরুন অপেক্ষাকৃত দুর্বল হইয়া যাইবে। ইহার দরুন অনেকগুলি দেশ প্রকৃত স্বাধীনতার অধিকার এবং আন্তর্জাতিক সুযোগ-সুবিধা ও স্বতন্ত্র মর্যাদা লাভ করিতে সক্ষম হইবে। মুদ্রা মূলতঃ ক্রয়-বিক্রয়ের সুবিধার জন্যই আবিষ্কৃত হইয়াছে, শোষন ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃ হওয়ার জন্য নয়। কিন্তু বর্তমানে ইহা শেষোক্ত কাজে ব্যবহৃত হইতেছে। এমতাবস্থায় উল্লিখিত উপায় অনুসারে আন্তর্জাতিক ক্রয়-বিক্রয় যদি মুদ্রা ছাড়াও সম্ভব হয় এবং ব্যবসায় বাণিজ্যকে যদি জাতীয় শোষন-পীড়ন ও গোলামীর বন্ধন হইতে মুক্ত করা যায় তবে আর ইহার প্রয়োজনথঅকিবে না। বস্তুতঃ মুদ্রাই তো আসল লক্ষ্য নয় প্রকৃত হইতেছে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয়ের সুবিধা বিধান। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যদি এই মুদ্রা ছাড়াও সুষ্ঠুরূপে চলিতে পারে, তাহা হইলে ইহা লইয়া কাহারো গৌরব করার অবকাশ থাকিবে না।

আন্তর্জাতিক মুদ্রার ক্ষতি

কোন দেশ যদি আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বাণিজ্যের জন্য এমন মুদ্রার সাহায্য গ্রহণ করে, যাহা ভিন্ন কোন দেশের মূলধনের উপর একান্ত ভাবে নির্ভরশীল, তবে এই দেশ উহার সম্মুখে কোনদিন মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে পারে না। কারণ সেদেশে সব সময়ই নিজের সকল প্রকার ক্ষতি লোকসানের বোঝা এই দেশের উপরই চাপাইয়া দেবে। পাকিস্তানের ইতিহাস হইতে একটি ঘটনা ইহার জ্বলন্ত প্রমাণ স্বরূপ উল্লেখযোগ্য। বিগত মহাযুদ্ধ সংক্রান্ত পরিস্থিতি যখন ব্যাংক অব ইংলন্ডের উপর যাবতীয বোঝা চাপাইয়া দিল তখন উহা মুদ্রা মান হ্রাস করিতে বাধ্য হইল। আর এই মুদ্রামান হ্রাসের পরিণামে পাকিস্তানের পাওনার এক তৃতীয়াংশ সঙ্গে সঙ্গ ও আদায় না করিয়াই- বাতিল করিয়া দিল। এমতাবস্থায় পরিস্কার বলা চলে যে, এই নীতি ও উক্ত মুদ্রার মর্যাদা সমর্থন করিয়াও একটি দেশ যদিও রাজনৈতিক গোলামীর বাঁধন ছিন্ন করিতে পারে, কিন্তু অর্থনৈতিক গোলামীর নাগপাশ হইতে মুক্তি লাভ করা উহার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হয় না। আর প্রকৃত পক্ষে উক্ত মুদ্রার সহিত সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন না করা পর্যন্ত সে দেশের আজাদী স্থায়িত্ব লাভ করিতে সমর্থ হইতে পারে না।

পারস্পরিক সাহায্য সংস্থা

অস্বাভাবিক ও চরমবাদী অর্থনীতির একদিক হইতেছে পরিপূর্ণ ব্যষ্টিবাদ এবং অপর দিক হইতেছে, নিরংকুশ সমষ্টিবাদ (Collectivism) এই উভয় চূড়ান্ত সীমারে মধ্যে মধ্যপন্থী যে নীতি একটি সুস্থ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজ গঠন করিতে সমর্থ হয়,তাহা হইতেছে পারস্পরিক সাহয্য সংস্থা। বর্তমান সময়ে দুনিয়া পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক সমাজে এই নামে বহু সংস্থার বাস্তব প্রতিষ্ঠা হইয়াছে এবং উহার ফলাফলও দৃষ্টিগোচর হইয়াছে। এইসব প্রতিষ্ঠানের সর্বাপেক্ষা লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহার সাহায্যে বহুবিধ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন এবং জনগণের জটিল সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা খুব সহজ হইয়া থাকে।

কি পুঁজিবাদী সমাজে, কি সমাজতান্ত্রিক সমাজে- যেখানেই ইহা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। সর্বত্রই নিছক বস্তুবাদী মতবাদ ও দৃষ্টিসঙ্গীই হইতেছে ইহার ভিত্তিপ্রস্তর। কোন না কোন বৈষয়িক স্বার্থলাভই ইহার প্রতিষ্ঠার মূলে বিশেষভাবে সক্রিয় হইয়া রহিয়াছে। জীবনে সর্বদিকে প্রভাবশীল কোন নৈতিক আবেদনই উক্ত সমাজের ব্যক্তিগণকে পারস্পরিক সাহায্য সংস্থা প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করে নাই।

কিন্তু ইসলামী সমাজে এই সংস্থা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নিছক পার্থিক স্বার্থকেই ভিত্তি হিসাবে গণ্য করা হয় না। সেখানে নৈতিক, আধ্যাত্মিক- তথা মানবিক ভাবধারাই হইবে উহার সর্বপধান নিয়ামক পারস্পরিক সাহায্য সংস্থঅর অনুকূল ভাবধারা সৃষ্টির ব্যাপার কোনরুপ কৃত্রিম উপায়ই এখানে অবলম্বন করা হয় না, বরং সমাজের ব্যক্তিদের হৃদয় মনে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এই ভাবধারা ফুটিয়া উঠে এবং রাষ্ট্রশক্তির আনুকুল্যে ইহা বাস্তব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইসলামী সমাজে যেসব মতবাদ ও বিশ্বসের ভিত্তিতে স্থাপিত, তাহা স্বতঃই মানুষের মধ্যে গভীর ভ্রাতৃভাব জাগাইয়া দেয়। এক আল্লাহর বান্দাহ আমরা, এক আদমের সন্তান আমরা, আমাদের এই জনীবন কঠিনতম পরীক্ষার জীবন, যতদূর সম্ভব পরবর্তী অনন্তকালের জন্য কল্যাণেল পুঁজি সংগ্রহ করাই আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য এবং অনন্তর আমাদিগকে একই আদালতের নিকট জবাবাদিহি হইতে হইবে- এই বিশ্বাসই ইসলামী সমাজের বিক্ষিপ্ত লোকদের মধ্যে গভীর ঐক্য, বন্ধুত্ব সহানুভূতিও সহৃদয়তার অন্তঃসলীলা ফল্গুধারা প্রবাহিত করে।

ইসলামী জীবনধঅরা মূলতই সামাজিক ও সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। এই সমাজের কোন ব্যক্তিই নিজেকে একাকী ও নিঃসঙ্গ বলিয়া মনে করে না। প্রত্যেকেই নিজেকে অসংখ্য লোকের একজন এবং প্রত্যেকের জন্য দায়ী বলিয়া অনুভব করে। ইসলামের প্রায় সকল ইবাদাত অনুষ্ঠানই জনগণের মধ্যে এই ভাবধারা প্রতিনিয়ত শক্তিশালী করিয়া তোলে। মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক যে কর্তব্য ও অধিকার নির্ধারণ করা হইয়াছে,তাহা এই ভাবধারা অধিকৃত দৃঢ় করিয়া দেয়।

আধুনিক শিল্পনীতি পুঁজিদার ও শ্রমিক-মজুরদিগকে দুইটি স্থায়ী ও পরস্পর বিরোধী স্বার্থ সম্পন্ন গোষ্ঠীতে পরিণতগ করিয়াছে। ইহার প্রকৃত ইসলামী আদর্শ ও ভাবধারা সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলামী সমাজের কোন অর্থশালী ব্যক্তি মুনাফা লুন্ঠনকেই নিজ জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যরূপে গ্রহণ করিতে পারে না।

পুঁজি ও শ্রমের সংঘর্ষ প্রতিরোধ

বরং নিজের যাবতীয় অর্থ-সম্পদকে স মাজের বৃহত্তর কল্যাণে নিয়োগ করাকেই সে মূলধনের সার্থক প্রয়োগ বলিয়া মনে করে। দেশের শ্রমিক মজুরদের যাবতীয় সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের চেষ্টা করিবে। একক কারখানার প্রচুর উৎপাদন কত মানুষকে বেকার সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের চেষ্টা করিবে। একক কারখানার প্রচুর উৎপাদন কত মানুষকে বেকার সমস্যার সম্মুখীন করিতেছে, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দরুন দেশের রাষ্ট্র-সরকার কি কি জটিলতা বিব্রত হইয়া পড়িতেছে, এবং সমষ্টিগত শান্তি ও সমৃদ্ধি কতখানি ব্যহত হইতেছে- ইসলামী সমাজের প্রত্যেক ধনী ব্যক্তিই এই দিকে গভীর দৃষ্টি রাখিয়া এবং ইহার প্রতিবিধানমূলক পন্থা অবলম্বন করিয়াই তাহার পুঁজি বিনিয়োগ বা নিয়ন্ত্রণ করিবে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে সামগ্রিক ধৈর্য প্রতিষ্ঠার জন্য দেশে শ্রমিক-মজুর রাষ্ট্রসরকার ও দেশবাসীর সহিত পরিপূর্ণ সহযোগিতা করিতে প্রস্তুত থাকিবে।

বস্তুত এই পটভূমিকার ভিত্তিতে ইসলামী সমাজের প্রত্যেক শিল্প এলাকায় পারস্পরিক সাহায্যের এমন একটি সংস্থা গড়িয়া তুলিতে হইবে, যাহাতে কারখানা মালিক, শ্রমিক ও রাষ্ট্র সরকারের প্রতিনিধি সকলেই শরীক থাকিবে। অর্থনীতিতে পারদর্শী ও বিশেষজ্ঞ কয়েকজন লোককেও পরামর্শদাতা হিসাবে এই সংস্থায় নিযুক্ত করা হইবে। এই প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য:

(ক) শ্রমিক মজুরের যাবতীয অভাব-অনটন, সমস্যা ও জটিলতা দূর করা, তাহাদের প্রয়োজন ও দাবি দওয়া পূরণ করা।

(খ) দেশে বেকার-সমস্যা ও ব্যবসায়ের মন্দভাব সূচিত হওয়ার পথ রুদ্ধ করা।

(গ) ব্যবসায় সংক্রান্ত বিপর্যয় (Trade cycles) প্রতিরোধের জন্য জরুরী ব্যবস্থা অবলম্বন করা।

(ঘ) স্বয়ং কারখানা-মালিককে পণ্য রপ্তানী বা কাঁচামালের আমদানীর ব্যাপারে যেসব অসুবিধার সম্মুখীন হইতে হয়, তাহা দূরীভূত করিতে চেষ্টা করা।

(ঙ) সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য রাষ্ট্রসরকারের উপর যেসব দায়িত্ব চাপিয়া বসে, তাহা দূর করিবার ব্যবস্থা করা।

শিল্প প্রতিষ্ঠায় অংশ গ্রহণকারী কোন লোকের কোনরূপ অসুবিধার বা সমস্যার সৃষ্টি হইলে তাহা লইয়া হৈ চৈ করা ধর্মঘট করা বা অন্য কোনরূপ অশান্তিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার পূর্বেই এই প্রতিষ্ঠান উহার অভিযোগ দূর করিবার জন্য অগ্রসর হইবে। মজুর-শ্রমিকদের বেতন ও কাজের সময় সংক্রান্ত অসুবিধা, কারখানা মালিকের কারবারি অসুবিধা ও ট্যাক্সের বোঝা, বৈদেশিক পণ্যের সহিত প্রতিযোগিতার সমস্যা, রাষ্ট্র-সরকার ও শিল্প-সংক্রান্ত কোন প্রতিকূলতা প্রভৃতি পারস্পরিক সাহায্যের উদ্দেশ্যে স্থাপিহ এই কল্যাণকর প্রতিষ্ঠান শান্তিপূর্ণভাবে দূর করিবার চেষ্টা করিবে। এই প্রতিষ্ঠান শুধু অন্তঃস্বারশূন্য নিয়মতান্ত্রিক শক্তিরই ধারক হইবে না, নৈতিক আবেদনের শক্তিও উহার অর্জিত থাকিবে। এই প্রতিষ্ঠান পরিপূরণ সহানুভূতি ও সহৃদয়তার সহিত সমগ্র ব্যাপারের তদন্ত করিবে, অশান্তির মূল কারণ নির্ধারণ করিতে প্রাণপণে চেষ্টা করিবে। বিশ্বাসঘাতকতা, সকল প্রকার বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক সমস্যার পথ রুদ্ধ করিয়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আইন প্রণয়ন ও পরিকল্পনা গ্রহণের ব্যাপারে সহযোগিতা ও পথ-নির্দেশ করিবে।

এই ধরনের প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মতৎপরতাকে স্থায়ী ও সার্বজনীন কল্যাণকর করিয়া গড়িয়া তুলিবার জন্য নিম্নলিখিতরূপ কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বন করা যাইতে পারে:

১. এই সংস্থা ব্যবসায়ের একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করিবে এবং যুক্ত অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কারবার করিবে। এই কারবারে শ্রমজীবীগণও যাহাতে অংশ গ্রহণ করিতে পারে, তাহার অবাধ সুযোগ করিয়া দিবে। মিলিত অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে চালু ব্যবসায়ে শ্রমিকদিগকে বাৎসরিক হিসাবে এক একটি শেয়ার অর্ধমুল্যে ক্রয় করিবার অনুমতি দেওয়া হইবে। আর বাকি অর্ধেক মূল্য কোম্পানী বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বোনাস হিসাবে শ্রমিকের নামে আদায় করিবে। অথবা প্রত্যেক শ্রমিকের মাসিক বেতন হইতে সামান্য পরিমাণ অর্থ জমা করা হইবে। এইভাবে বৎসরের শেষে যে পরিমাণ অর্থ সঞ্চিত হইবে, তত পরিমাণ টাকা স্বয়ং কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠান নিজের তরফ হইতে দিয়া উহার সহিত যোগ করিবে। এবং এই মোট টাকা দ্বারা শ্রমিকের জন্য মূল্য ব্যবসায়ের একটি অংশ ক্রয় করা হইবে। এই পন্থানুসারে একজন শ্রমিক একাধারে দশ বৎসরকাল কাজ করিয়া ২৫টি স্থায়ী শেয়ার লাভ করিতে পারে। এই শেয়ারসমূহ তাহাকে এবং তাহার উত্তরাধিকারীদিগকে বহুদিন পর্যন্ত মুনাফার অংশ দিতে পারিবে। এই কাজে ইসলামী রাষ্ট্র ও উহার যাকাত ফান্ড হইতে প্রয়োজনীয় অর্থ দিয়া শ্রমিকদিগকে স্বাবলম্বী হওয়ার সথেষ্ট সুযোগ করিয়া দিতে পারে।

এই পন্থায় কাজ করিলে ধীরে ধীরে একটি প্রতিষ্ঠানে পুঁজিদার ও শ্রমিকের স্বার্থ সমান ও সংযুক্ত করিয়া তোলা খুবই সহজ হইয়া পড়িবে। ফলে অসহায় মজুরদের শোষণ-নিষ্পেষণ করার, ছাটাই করার কিংবা বেতন হ্রাস করার মত কোন বিপদে তাহাদিগকে নিক্ষেপ করার কোন সুযোগই কেহ পাইবে না।

২. এমন কারখানা ও সংস্থার পক্ষ হইতে স্থাপিহ করা যাইতে পারে, যাহার বিভিন্ন কর্মচারীই হইবে উহর আসল অংশীদার। ইসলামী রাষ্ট্র যাকাত হইতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ যদিও প্রত্যেক বৎসরই এই পারস্পরিক সাহায্য সংস্থার নিযুক্ত করার জন্য দান করে, তবে তাহাতে আরো অধিক কল্যাণ সাধিত হইতে পারে।

৩. দেশের সমগ্র শ্রমজীবী চাকুরীজীবিদিগকে সকল প্রকার আকস্মিক বিপদ হইতে রক্ষা করার জন্য সরকারী নিয়ন্ত্রণ ও পারস্পরিক সাহায্য সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির ব্যবস্থাধীন একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হইবে এবং তাহাতে নিম্নলিখিত উপায়ে মূলধন সংগ্রহ করা যাইতে পারিবে:

(ক) মজুর ও চাকুরীজীবীদের বেতন হইতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ মাসিক চাঁদা হিসাবে গ্রহণ করা হইবে।

(খ) কারখানা মালিক, ব্যবসায়ী কিংবা সরকার যে মজুরদিগকে খাটাইতেছে, সে-ই উল্লিখিত পরিমাণ বা তদপেক্ষা কম পরিমাণ কিছু অর্থ মজুরদের উক্ত ফান্ড প্রতি মাসে জমা করিয়া দিবে।

(গ) কারখানা মালিক, ব্যবসায়ী কি রাষ্ট্র-সরকার কোন কর্মচারীকে কর্মচ্যুত করিলে একমাসের বেতন পরিমাণ অর্থ তাহার নামে এই ফান্ডে জমা করিবার জন্য তাহাকে বাধ্য করা যাইতে পারে। ইহার ফলে মজুর ছাঁটাইর বর্তমান হার অনেকটা হ্রাস পাইবে।

(ঘ) যাকাত ফান্ডের বাৎসরিক বাজেট হইতে একটি বিরাট অংশ এই ফান্ডে জমা করিতে হইবে।

(ঙ) শিল্পোৎপাদনের জন্য যে কারখানাই স্থাপন করা হইবে, উহার উৎপাদন শক্তির হার অনুযায়ী মালিকের প্রতি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অরথ চাঁদা ধার্য করা যাইতে পারে। তাহা সরাসরি বেকার সসস্যা দূরীকরণ ফান্ডে জমা হইতে থাকিবে। অবশ্য এই চাঁদা ধার্যকরণ সরকারী বাধ্যবাধকতা ব্যতীত নিছক নৈতিক ও মানবিক আবেদনের মারফতেই করিতে হইবে।

এই ফান্ড হইতে বেকার শ্রমজীবীদিগকে দুরাবস্থা ও বিপদকালে কেবল বৃত্তিই দেওয়া যাইবে না, ইহা হইতে দেশে গার্হস্থ্য-শিল্পের একটি ব্যাপক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করিয়া বেকার লোকদিগকে উপার্জনশীল করিয়া তোলাও অনেক সহজ হইবে।

এই সংস্থার পক্ষ হইতে বিভিন্ন এলাকায় কর্মসংস্থান কেন্দ্র স্থাপন করা যাইতে পারিবে। সেখানে সমগ্র দেশের বিভিন্ন প্রাইভেট ও সরকারী অফিসাদী সম্পর্কে পূর্ণ তথ্য সংগৃহতি থাকিবে।

৪. এই সংস্থার অধীন এমন একটা সাধারন ফান্ড সংগ্রহ করা যাইতে পারিবে, যাহাতে দেশের শিল্পপতিগণ নিজ নিজ শিল্পগত মনাফার একটা নির্দিষ্ট অংশ জমা করিবে এবং সরকার ও যাকাত ফান্ড হইতে তাহাতে সাহায্য দান করিবে। এই ফান্ড একান্তভাবে নিযুক্ত হইবে এবং দেশের শ্রমিক-মজর ও সাধারণ মেহনীত জনতার জীবন-মান (খাদ্য, বসবাস, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা) উন্নত করার জন্য। সকলের মৌলিক প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখিয়া বিশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ীই এই কাজ সম্পাদন করা হইবে।

কারবারী ইন্সিওরেন্সের জন্য পারস্পরিক সাহায্য সংস্থা

ব্যবসায়ী, কৃষক ও শিল্পপতিকে আকস্মিক বিপদ হইতে উদ্ধার করার জন্য পুঁজিবাদী সমাজে ইন্সিওরেন্সে বা বীমা কোম্পানী স্থাপন করা হয়: কিন্তু ইহাতে সুদ ও জুয়ার প্রাধান্য থাকায় উহার মূল উদ্দেশ্যই সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। ইসলামী সমাজে ‘পারস্পরিক সংস্থার’ মারফতেই এই উদ্দেশ্য হাসিল করা যাইতে পারে, কিন্তু সুদ ও জুয়ার বিন্দুমাত্র অবকাশ তাহাদের থাকিবে না।

উদাহরণস্বরূপ বলা যাইতে পারে, বিশেষ এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীগণ প্রত্যেক শহরেই নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সাহায্যের জন্য এক একটি সংস্থা গঠন করিবে। ইহার একটি ফান্ড থাকিবে, প্রত্যেক ব্যবসায়ী নিজের মোট মূলধন হিসাবে কিংবা আমদানীর হার অনুযায়ী মাসিক কি ত্রৈমাসিক নিয়মে টাকার একটি পরিমাণ আকস্মিক বিপদ হইতে আত্মরক্ষা করার জন্য এই ফান্ড জমা করিবে এবং মূলত ইহা তাহার দান হিসাবেই গণ্য হইবে। অতঃপর এই সংস্থার কোন সদস্যের আমদানীর উপর Source of income যদি আকস্মিক বিপদে পতিত হইয়া যায়, তবে পুনরায় ব্যবসায় শুরু করিবার জন্য এই ফান্ড হইতে তাহাকে নির্দিষ্ট অনুযায়ী এককালীণ দান হিসাবে মূলধন দেওয়া হইবে। এক বৎসর কালের মধ্যে এই ফান্ডকে উক্ত রূপ যত সাহায্য দানই করিতে হইবে কার্যত তাহাতে উহা অপেক্ষা অনেক বেশী টাকা সঞ্চিত হওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা রহিয়াছে। ফলে এই ফান্ড ক্রমশ উন্নতি লাভ করিয়া বিপদগ্রস্ত লোকদের অশেষ কল্যাণ সাধন করিতে পারিবে। এই ফান্ডের অর্থ কোন নির্ভরযোগ্য ব্যবসায়েও বিনিয়োগ করা যাইতে পারিবে। তাহাতে উহার পরিমাণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইবে।

উল্লিখিত উদ্দেশ্য অন্য এক উপায়ে লাভ করা যাইতে পারে। তাহা এই যে, এই সংস্থার প্রত্যেক সদস্য উহার ফান্ডে যে টাকাই জমা করিবে, সে নিজেই উহার মালিক হইবে এবং আকস্কি বিপদকালে নিয়ম অনুযায়ী তাহা হইতে বিনাসুদে ঋণ গ্রহণ করিবে। এই ঋণ তাহাকে সুযোগ সুবিধা মত এক দিন আদায় করিতে হইবে।

পারস্পরিক সাহায্যের এই স্থানীয় সংস্থাসমূহকে মিলাইয়া একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা গঠন করা যাইতে পারে। একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের অধীনে এই কাজ সমগ্র দেশব্যাপী সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন হইতে পার্

স্বল্পমেয়াদী ব্যবসায়ী ঋণের ব্যবস্থা

ইসলামী রাষ্ট্রের ব্যাংকসমূহকে সুদশূন্য করিয়া দেওয়ার পর স্বল্পমেয়াদী ঋণ সম্পর্কে বিশেষ সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রহিয়াছে, বিশেষতঃ

(ক) বিলসমূহের টাকা নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে পাইতে হইলে তখন,

(খ) এবং শিল্পপণ্যের আমদানী কিংবা কাঁচামাল ক্রয়ের জন্য সাময়িক প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্য টাকার রকার হইলে তখন।

কিন্তু ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের ‘পারস্পরিক সাহায্য সংস্থা’ হইতে এই সব স্বল্পমেয়াদী প্রয়োজন সুষ্ঠুরূপে পূর্ণ হইতে পারে এইভঅবে। যে এই ফান্ডের টাকা ইসলামী নিয়ামনুসারে কোন ব্যবসায়ী ব্যাংকে জমা রাখা হইতে এবং প্রয়োজনের সময় উক্ত প্রতিষ্ঠানের মারফতে উহার জমিনে- অথবা নিজেই যদি উহা হইতে প্রত্যক্ষভাবে ঋণ গ্রহণ করিতে চাহে, তবে এই ব্যাংক উহার ‘বিনাসুদে ঋণ দানের’ ফান্ড হইতে ঋণ দান করিবে।

যৌথ কৃষিকার্যের জন্য পারস্পরিক সাহায্য

এক এলাকার সমস্ত ভূমি-মালিক ও কৃষকদের পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য উল্লিখিতরূপে স্থানীয় ও দেশীয় ভিত্তিতে “পারস্পরিক সাহায্য সংস্থা” গঠন করা আবশ্যক। এই প্রতিষ্ঠান দেশের সরকার, ভূমি মালিক এবং বিশেষ করিয়া চাষীদের সকল প্রকার সমস্যার সমাধান করিতে প্রস্তুত থাকিবে। এইসব সাধারণ প্রয়োজন ব্যতীত যৌথ কৃষিকার্যের জন্য পারস্পরিক সাহায্যের একটি নূতন প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তোলার আবশ্যকতা রহিয়াছে।

এক এলাকার দুই-চারশত ভূমি-মালিক ও কৃষক মিলিয়া একটি সংস্থা স্থাপন করিতে পারে। তাহারা সকলেই এলাকার সমস্ত জমি-ক্ষেত এই সংস্থার নিকট অর্পণ করিবে এবং নিজ নিজ অংশের জমির হার অনুযায়ী একটি যুক্ত ফান্ড সংগ্রহ করিবে। এই ফান্ডের অর্থঘ সাহায্যে ব্যাপক ও উন্নত শ্রেণীর কৃষিকার্য শুরু করিতে পারিবে। পারস্পরিক সাহায্যের এই সংস্থার তত্ত্বাবধানে কৃষিকার্যের বাস্তব সমস্যার সমাধান, কৃষিব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ও উন্নতি সাধন এবং শক্তি উর্বরা বর্ধনের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক উপায় শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে তথ্যপূর্ণ পুস্তক ও প্রচার পত্রিকা প্রকাশ করা যাইতে পারে।

এই এলাকায় যাহাতে বেকার সমস্যা দেখা না দেয় এবয় জনগণ কোনরূপ অর্থনৈতিক অসুবিধার সম্মুখীন না হয়, সেদিকে এই সংস্থাকে বিশেষ কড়া দৃষ্টিতে রাখিতে হইবে। রীতিমত ও সুস্পষ্ট প্ল্যান ও পরিকল্পনা অনুযায়ীই ইহা এক একটি এলাকায় কাজ শুরু করিবে। প্রথমে কৃষিজীবীদের জন্য কাজ সংগ্রহ করিবে, তাহাদিগকে যান্ত্রিক কৃষিকার্যের জন্য উপযুক্তভাবে শিক্ষিত করিয়া তুলিবে।

এই সংস্থার নিকট যেসব জমি ছাড়িয়া দেওয়া হইবে, তাহার উপর ব্যক্তিগত মালিকানা যথারীতি বজায় থাকিবে, কিন্তু যৌথ কৃষিনীতির ফলে সেই মালিকানা ভূমির নির্দিষ্ট খন্ডের উপর স্বীকৃত না হইয়া সেই পরিমাণ জমির ফসলের উপর, কিংবা যৌথ ফার্মের মোট উৎপন্নের নির্দিষ্ট অংশের উপর স্বীকৃত হইবে। প্রয়োজন হইলে সে নিজের অংশ বিক্রয় করিতে পারিবে এবং তাহার মৃত্যুর পর মীরাসী আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তাহার অংশ বন্টন করা হইবে। অন্য কথায়, সমগ্র জমি-মালিকানা কেবল কাগজে কলমে ও হিসাবের খাতায়ই স্বীকৃত ও কার্যকর হইবে।

কৃষিসংক্রান্ত দুর্ঘটনার প্রতিরোধ

ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্র অপেক্ষা কৃষিক্ষেত্রে আকস্মিক দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেশী। কাজেই উহার মুকাবিলা করিবার জন্য অুরূপভাবে সমস্ত অব্যবস্থা, জুয়া ও সুদ প্রভাবমুক্ত ‘ইন্সিওরেন্স’ –‘পারস্পরিক সাহায্য সংস্থা’ স্থাপন করা আবশ্যক। অর্থাৎ প্রত্যেক গ্রামে, ইউনিয়নে, এলাকায় ও গোটা দেশে পারস্পরিক সাহায্য সংস্থার অধীন এক একটি ফান্ড স্থাপিত হওয়া আবশ্যক। এই ফান্ডে প্রত্যেক ভূমি-মালিকের আয় কিংবা মালিকানা হিসাবে প্রত্যেক ফসল হইতে চাদা জমা করা হইবে এবং কৃষি সংক্রান্ত প্রত্যেক দুর্ঘটনায়ই এই ফান্ড সাহায্য করিবে।

এই ফান্ড এক স্থায়ী ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি হিসাবেও কাজ করিতে পারে এবং তাহাতে যাহা কিছুই দেওয়া হইবে, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে দান’ হিসাবেই দেওয়া হইবে। আর তাহা হইতে যাহা কিছুই ব্যয় হইবে, তাহা ঋণ হিসাবে নয়, এককালীন দান হিসাবেই খরচ করা হইবে। রাষ্ট্র-সরকার যাকাতের অর্থও এই ফান্ডের মারফতের ব্যয় ও বন্টন করিতে পারে।

কুটিরশিল্প প্রসারকল্পে সাহায্য সংস্থা

গার্হস্থ্য কিংবা কুটির শিল্পের উৎকর্ষ সাধনের ব্যবস্থা না করিয়া কোন সমাজই উন্নতি করিতে এবং অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য ও আত্মনির্ভরশীলতা লাভ করিতে পারে না। ইসলামী সমাজেও ইহার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হইবে এবং ইহার উৎ]কর্ষ সাধনের জন্য পরিপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে। এই উদ্দেশ্যে পারস্পরিক সাহায্য সংস্থা স্থাপন করা হইবে এবং বিশেষ করিয়া নিম্নলিখিত শিল্পগুলিকে গার্হস্থ্য পর্যায়ে সুসংগঠিত করা হইবে:

(১) কার্পাস, সূতা, বস্ত্র ও চট শিল্প, (২) চর্ম শিল্প, (৩) পশম শিল্প, (৪) দেশী ঔষধ প্রস্তুতকরণ প্রভৃতি।

গার্হস্থ্য শিল্পের উৎকর্ষ সাধনের জন্য নিম্নলিখিত উপায় অবলম্বন ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইতে পারে।

১. যন্ত্রশিল্পের সহিত প্রতিদন্দ্বিতায় উহার সংরক্ষণ ব্যবস্থা।

২. শিল্প সম্পর্কীয় শিক্ষাদীক্ষা ও ট্রেনিং দানের ব্যবস্থা।

৩. কাচা মাল সংরক্ষ্যণ।

৪. পুঁজি সংগ্রহকরন।

এইসব সংস্থায় শিল্পোৎপাদনকারী, কাঁচামাল উৎপাদনকারী এবং বাজারে খুচরা ও পাইকারী হিসাবে বিক্রয়কারীদের শরীক হওয়া আবশ্যক।

অভাবী লোকদের সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা

প্রকৃত অভাবী লোকদের সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা করা ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কর্তব্য। বিশেষ করিয়া নিম্নলিখিত অভাবগ্রস্ত লোকদের জন্য অনতিবিলম্বে কোন স্থায়ী ব্যবস্থা করা একান্তই অপরিহার্য-

১. বহু চেষ্টা ও সন্ধান করিয়াও যাহারা কাজ পায় না বলিয়া বেকার হইয়া আছে।

২. অক্ষম ও পঙ্গু লোক- অন্ধ, বধির, বোবা, অঙ্গহীন এবং অসহায় শিশু ও বিধবা।

ইসলামী রা্ট্রর বেকার নাগরিকদিগকে উপার্জনের কাজে নিযুক্ত করা রাষ্ট্র-সরকারের দায়িত্ব। ইসলামী সরকার সেজন্য পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করিবে।

কিন্তু ব্যক্তিগত সাহায্য ও সরকারী-বেসরকারী প্রচেষ্টার পর ও যদি কিছু সংখ্যক লোক বেকার থাকিয়া যায়, তাহা হইলে রাষ্ট্র-সরকার তাহাদের জীবিকার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করিবে। কিন্তু তাহাদিগকে বিনা কাজে বসাইয়অ না রাখিয়া এবং নিছক দান হিসাবেই জীবিকা না দিয়া তাহাদিগকে কোন না কোন পরিশ্রমের কাজে নিয়োগ করা বাঞ্ছনীয়। এই শ্রেণীর লোকদিগকে একটি সংস্থার অধীন সংগঠিত করিয়া তাহাদিগকে কোন কৃষি সম্বন্ধীয়, শৈল্পিক কিংবা ব্যবসায় সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত করা যাইতে পারে।

আর কোন বৃহত্তর কাজে নিযুক্ত হওয়া একান্তই অসম্ভব হইলে অন্ততঃপক্ষে দেশের অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট নির্মাণ, বাঁধ বাঁধা, পুল তৈয়ার করা, অনুর্বর ও অনাবাদী জমি বৈজ্ঞানিক উপায়ে উর্বর ও আবাদ করা, বন-জঙ্গল কাটিয়া পরিষ্কার করা, খাল ও পুকুর খন করা, প্রভৃতি উন্নয়নমূলক কাজে তাহাদিগকে নিযুক্ত করা যাইতে পারে।

পারস্পরিক সাহায্য সংস্থায় ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব

পারস্পরিক সাহায্যের উপরোল্লিখিত মূলনীতির ভিত্তিতে গণজীবনের পূর্ণ শৃংখলা ও সংগঠন সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চালু করা এবং সেগুলিকে পারস্পরিক সাহায্যকারী ও সহানুভূতিশীল করিয়া তোলা প্রথমত একটি উন্নতশীল ও ‍শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র ভিন্ন আদৌ সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত ইসলামী রাষ্ট্রকেও এই দায়িত্ব সুষ্ঠুরূপে পালন করার জন্য ইসলামের মূলনীতি অনুযায়ী ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাহিত নিম্নলিখিত উপায়সমূহ অবশ্যই অবলম্বন করিতে হইবে।

১. পারস্পরিক সাহায্য সংস্থার সূচনা ও প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ।

২. জনসাধারণ ও দেশের বিশিষ্ট লোকদিগকে ‘পারস্পরিক সাহায্য সংস্থা’ সংগঠনের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য নেতৃত্ব ও পরামর্শদান এবং আরদ্ধ কাজ সুষ্ঠুরূরে সম্পন্ন করার জন্য একটি বিশেষ বিভাগ কায়েম করা। ৩. এই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্যদানের ব্যবস্থা করা।

৪. এই কাজ যথোপযুক্তভাবে আঞ্জাম দেওয়ার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী আইন-কানুন ও নিয়ম-প্রণালী রচনা করা।

৫. পারস্পরিক সাহায্য সংস্তায় ইসলামের প্রকৃত ভাবধারা প্রসারের জন্য অুকূল মানসিক ও নৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা।

বর্তমান যুগে অতি আধুনিক মান অনুযায়ী একটি ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য পারস্পরিক সাহায্য সংস্থা’র এই পরিকল্পনা কার্যকর করিয়া তোলা অপরিহার্য। ইহা আমাদের ছোট-বড় –অর্থনৈতিক ও তামাদ্দুনিক সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করার সঙ্গে সঙ্গে সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমের মারাত্মক আক্রমণ হইতেও ইসলামী সমাজকে রক্ষা করিতে পারিবে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি