২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ১৪ দলের সশস্ত্ৰ সন্ত্রাসীরা লাগি-বৈঠা-লোহার রাডসহ স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্ৰ নিয়ে হিংস্র হ্যায়েনার মত বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে আয়োজিত জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশে ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের তাজাপ্ৰাণ নেতা-কমীদের। সন্ত্রাসীরা জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্ৰশিবিরের নেতা-কর্মীদের নৃশংসভাবে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদের লাশের উপর উল্লাস নৃত্য করে সৃষ্টি করেছিল। এদেশের ইতিহাসে এক হৃদয় বিদারক কলংকিত ইতিহাস। তাদের বর্বরতা সেদিন আদিম যুগের বর্বরতা ও নৃশংসতাকে হার মানিয়েছিল। হামলাকারী সশস্ত্ৰ সন্ত্রাসীরা সেদিন বায়তুল মোকাররম ও পুরােনা পল্টন এলাকাকে রণক্ষেত্রে পরিনত করে, হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দােকানপাটে অগ্নি সংযোগ এবং লুটতরাজ চালিয়ে সৃষ্টি করেছিল এক ত্ৰাসের রাজত্ব। সেদিনের পৈশাচিক হামলায় নিহত হয়েছিল ইসলামী ছাত্রশিবিরের সদস্য হােসাইন মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম, সাখী গোলাম কিবরিয়া শিপিন ও সাইফুল্লাহ মুহাম্মদ মাসুম, জামায়াতে ইসলামীর কমী হাবিবুর রহমান, জসীমউদ্দিন (লালবাগ), কমী জসীম উদ্দিন (ঢাকা মহানগরী) এবং এক হাজারের অধিক লোক আহত হয়েছিল।
প্রশ্ন হলো কি অপরাধে তাদের হত্যা ও আহত করা হলো ? তাদের অপরাধ তারা ইসলামকে ভালবাসত। তারা এদেশে ইসলামী সমাজ কায়েম করতে চেয়েছিল। তারা মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিত। তারা আল্লাহর রাসূল (সা.) কে ভালবাসত এবং আল্লাহর বিধান মেনে চলত। তারা আধিপত্যবাদী শক্তির তাবেদারদের কবল থেকে এদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মুসলিম জাতিসত্তা ও ইসলামকে হেফাজত করার সংগ্রামে নিয়োজিত ছিল। এ হত্যাকান্ড যারা ঘটিয়েছিল তারা এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও ইসলামের দুশমন। এ ঘটনার মাধ্যমে জাতির সামনে সেদিন পরিস্কার হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসর ১৪ দল ফ্যাসিবাদী শক্তি। তাদের হাতে এদেশের জনগণের জান-মাল, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন কোন কিছুই নিরাপদ নয়। সেদিন বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত হামলা চালিয়ে তারা এক বিভিষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে গোটাজাতিকে আতংকিত করে দিয়েছিল।

আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার লগি-বৈঠা নিয়ে রাজপথ দখলের মত দায়িত্বহীন আহ্বানের কারনেই ২৮ অক্টোবরের ঘঠনার মাধ্যমে সেদিন আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র, মানবতা ও মনুষ্যত্ন ভুলুষ্ঠিত করেছিল। শক্তি নয় যুক্তিই হলো গণতন্ত্রের ভাষা। আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের সম্রাসীরা সেদিন যুক্তির পরিবর্তে পেশী শক্তির মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী কায়দায় শক্তি প্রদর্শন করে মূলত: গণতন্ত্রকেই হত্যা করেছিল। আলীগ ২০০১ সালের অক্টোবর থেকেই নির্বাচিত চারদলীয় জোট সরকারকে গায়ের জোরে ঠেলে ফেলে দেয়ার যে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল ২৮ অক্টোবরের ঘটনা ছিল তারই চূড়ান্ত পর্যায়। গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি তাদের নূ্যনতম শ্রদ্ধা থাকলে কখনো তারা সেদিন লাঠি-বৈঠা দিয়ে এভাবে রাজপথে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করতে পারত না। চারদলীয় জোট সরকার সাফল্যের সাথে ৫ বছরের মেয়াদকাল পূর্ণ করে শান্তিপূর্ণভাবে কেয়ারটেকার কাটিয়ে জোর করে ক্ষমতা দখলের জন্যই তারা সেদিন এ সশস্ত্ৰ মহড়া দিয়েছিল। তারা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে, ভয় দেখিয়ে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের ভীতসন্ত্রস্ত করে গােটা দেশের নিয়ন্ত্রভার গ্রহণ করার ষড়যন্ত্রই বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিল। দেশের উপর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এ নজিরবিহীন সহিংস ঘটনা ঘটাতে তাদের বিবেক এতটুকু বাধেনি। নিরস্ত্ৰ জনতা মানব ঢােল সৃষ্টি করে, শাহাদাত বরণ করে বুহে রচনা করে সেদিন আলীগের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করেছিল। সেদিনের এ ঘটনায় শান্তির পক্ষে সম্রাসের বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এ দেশের নিরীহ শান্তিকামী মানুষ যে নজীর সৃষ্টি করেছিল তা এ দেশের মানুষের নিকট চিরদিন অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে । আলীগ ও ১৪ দলের সেদিনের নৃশংস ঘটনা বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমৰ্যদা ও ইজ্জত সম্মানকে করেছিল ভুলষ্ঠিত। সেদিন আওয়ামী বাকশালীদের নৃশংসতা, বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা বাংলাদেশকে করেছে কলংকিত। তারা সেদিন জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশে হামলা চালিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা চালিয়েছিল। তারা জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্ৰশিবিরের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করে তাদের বিদেশী আধিপত্যবাদ কায়েমের পথের কাটা দূর করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল একটি তাবেদার সরকার। তাদের সে ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি। আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসর কমিউনিস্টরা কখনো গণতন্ত্র ও জনগণের মতামতের তোয়াক্কা করেনা। তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে দেশবাসীকে সদা সতর্ক থাকতে হবে। ২৮ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা প্রমাণ করেছে যে, তারা গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত রয়েছে। দেশ ও জাতির স্বার্থে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির রাজনীতি করে। তারা যে কোন পরিস্থিতি অত্যন্ত ধৈৰ্য্য ও সাহসের সাথে মোকাবেলা করতে সক্ষম। তারা শত উস্কানী ও উত্তেজনার মুখেও আল্লাহর উপর ভরসা ও অবিচল বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে খালি হাতে গুলির সামনে দাঁড়িয়ে সত্য ও ন্যায়ের জন্য জীবন দিতে পারে, নিজেদের অমূল্য জীবনের বিনিময়ে তারা ফ্যাসিবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র বানচাল করার হিম্মত রাখে।
সেদিন যারা আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে নিজেদের জীবন দিয়েছে তারা নিঃসন্দেহে সাচ্চা শহীদ । সেদিন যারা শহীদ হয়েছে তারা ভাগ্যবান। সত্য ও ন্যায়ের জন্য আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার চাইতে সৌভাগ্যের আর কিছুই হতে পারে না। সেদিন যারা শহীদ হয়েছে তাদের অনেক স্বপ্ন ছিল, অনেক আশা ছিল। কিন্তু তারা সব কিছু ছেড়ে আল্লাহর কাছে চলে গিয়েছে। আজকে তারা আমাদের কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে অবস্থান করছে। তাদের রক্তের বদলেই হয়ত আগামী দিনে এদেশে ইসলামী আন্দোলন আরো শক্তিশালী হবে এবং আল্লাহর এ জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েম হবে।
শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব আমরা যারা বেঁচে আছি তাদের সকলের। তাদের হত্যাকারীদের হত্যা করে প্রতিশোধ নেয়ার জিঘাংসার রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করিনা। আমরা চাই, দেশের প্রচলিত আইনে হত্যাকারীদের শাস্তি হােক। তবে হত্যাকারীদের শাস্তিই শেষ কথা নয়। তারা যে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমের স্বপ্ন দেখত সে স্বপ্ন যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলেই তাদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে এবং তারা শান্তি পাবে। তাই সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এদেশে একটি ইসলামী সমাজ কায়েমের আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের সংগ্ৰাম করতে হবে। দেশে একটি শোষণ, জুলুম, বৈষম্যমুক্ত, ইনসাফপূর্ণ ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের সংকল্পগ্রহণের মাধ্যমে ২৮ অক্টোবরের শহীদদের স্মরণ করার জন্য আমি সকলের প্রতি আহবান জানাচ্ছি এবং সেদিনের শহীদদের সাচ্চা শহীদ হিসেবে কবুল করার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছি এবং তাদের পরিবার-পরিজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি ও দোয়া করছি। আল্লাহ যেন তাদের দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ দান করেন।
আমীন।