بسم الله الرحمن الرحيم
الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله وعلى آله وصحبه ومن والاه , وبعد:
ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ তা‘আলার প্রতি। অতপর দরুদ ও সালাম প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি, যিনি বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত। সর্ব কালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর তেইশ বছরের নবুওয়াতি জীবনে আল্লাহ প্রদত্ত রিসালাতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যা কিছু বলেছেন, করেছেন এবং সমর্থন দিয়েছেন তাই হলো সুন্নাহ। তাঁর কথা, কাজ, মৌন সমর্থন, দৈহিক গঠন প্রকৃতি, নৈতিক গুণাবলী, আচার-আচরণ ও জীবন চরিত সকল কিছুই সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। সুন্নাহর পরিভাষাগত অপর নাম হলো হাদীস। ইসলামী আইন ব্যবস্থায় আল-কুরআনের পরেই্সুন্নাহর স্থান। সুন্নাহ হলো ইসলামী শারী‘আতের দ্বিতীয় মুল উৎস। এটি হল আল্-কুরআনের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। আল-কুরআনে বর্ণিত সংক্ষিপ্ত মৌল নির্দেশনাবলীর প্রায়োগিক রূপ। এটি ব্যতীত আল-কুরআনের উপর ‘আমল করা অসম্ভব। কেননা আল-কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সমগ্র মানব জাতির কাছে উপস্থাপন করাই ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দায়িত্ব। সুন্নাহর দলীল হওয়ার ব্যাপারে আধুনিক যুগের অনেকেই বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন। তাঁদের বিভ্রান্তি নিরসন কল্পে ইসলামী আইন ব্যবস্থায় সুন্নাহর প্রকৃত অবস্থান কোথায় তা তুলে ধরাই এ প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য। বিষয়বস্ত্তর দিকে লক্ষ্য রেখে প্রবন্ধটি নিম্ন বর্ণিত কয়েকটি ভাগে আলোচনা করা হয়েছেঃ-
ক. সুন্নাহর পরিচয় - আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ
খ. কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যে পার্থক্য
গ. সুন্নাহর গুরুত্ব ও তা অনুসরণের অপরিহার্যতা
ঘ. ইসলামী আইনে সুন্নাহর স্থান
ঙ. সুন্নাহকে শারী‘আতের দলীল হিসেবে গ্রহণের ক্ষেত্রে সাহাবী ও মনীষীগণের অবস্থান
চ. সুন্নাহর দলীল হওয়ার ব্যাপারে সংশয় ও তার নিরসন
ছ. উপসংহার।
সুন্নাহর পরিচয়
সুন্নাহর আভিধানিক অর্থঃ সুন্নাহ্ ((السنة একটি আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ : রীতি, পদ্ধতি , পথ, পন্থা, নিয়ম,স্বভাব - তা ভালো হোক বা মন্দ,কর্মধারা ইত্যাদি।
বিখ্যাত অভিধানবিদ ইবনুল মানজুর বলেন:
السُّنَّة وما ةصرف منها والأَصل فيه الطريقة والسِّيرَة
‘‘সুন্নাহ এবং এ শব্দ থেকে গঠিত অন্যান্য শব্দের মূল অর্থ হলো রীতি-পদ্ধতি ও জীবন-চরিত’’ । মূলত: (لسنة ا) শব্দটি ( الطريقة ) এবং (السيرة ) এর প্রতি শব্দ । যার অর্থ রীতি পদ্ধতি। ইসলামী শারী‘আতে ব্যবহারের দিক থেকে সুন্নাহ শব্দের দু’ধরণের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।
ক. সুন্নাহ শব্দের প্রথম প্রয়োগ হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সকল প্রকার নির্দেশ, কথা, কাজ, অনুমোদন - এক কথায় তাঁর সামগ্রিক জীবনাদর্শ অর্থে। এছাড়াও সাহাবায়ে কিরামের আদর্শ ও কর্মকেও সুন্নাহ বলা হয়। সাহাবী্এবং তাবি‘ঈগণের যুগে সুন্নাহ দ্বারা এ অর্থই বুঝানো হতো।
খ. সুন্নাহ শব্দের দ্বিতীয় ও প্রচলিত অর্থ হলো- ইসলামী শারী‘আতে ফরজ ও ওয়াজিব নয় এমন ভালো কাজ যা করা প্রয়োজন বা উত্তম। দ্বিতীয় শতাব্দির ও তৎপরবর্তীকালের ফকীহগণ সুন্নাহর এ অর্থ গ্রহণ করেছেন। এ দু অর্থের মধ্যে মূলত: কোন বৈপরীত্য নেই। প্রথম অর্থে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সামগ্রিক জীবনাদর্শকে সুন্নাহ বলা হয়েছে। আর দ্বিতীয় অর্থে তাঁর সামগ্রিক সুন্নাহকে তাঁর জীবনাদর্শের আলোকে গুরুত্বের বিবেচনায় একটি পর্যায়কে সুন্নাহ নাম দেয়া হয়েছে।
কুরআনুল কারীমে সুন্নাহ শব্দের ব্যবহার:
কুরআনুল কারীমে এ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন:-
قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِكُمْ سُنَنٌ فَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِينَ
‘‘তোমাদের পূর্বে বহু বিধান ব্যবস্থা গত হয়েছে , সুতরাং তোমরা পৃথিবী ভ্রমণ কর এবং দেখ মিথ্যাবাদীদের কি পরিণাম’’। এ আয়াতে সুন্নাহ বিধি-বিধানের অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
يُرِيدُ اللَّهُ لِيُبَيِّنَ لَكُمْ وَيَهْدِيَكُمْ سُنَنَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَيَتُوبَ عَلَيْكُمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
‘‘তোমাদের নিকট তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতি-নীতি বিশদভাবে বর্ণনা করে তোমাদেরকে অবহিত করতে এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করতে আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করেন’’। এ আয়াতে সুন্নাহ রীতি-নীতি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
قُلْ لِلَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ يَنْتَهُوا يُغْفَرْ لَهُمْ مَا قَدْ سَلَفَ وَإِنْ يَعُودُوا فَقَدْ مَضَتْ سُنَّةُ الْأَوَّلِينَ
‘‘যারা কুফরী করে তাদেরকে বল, যদি তারা বিরত হয় তাহলে তাদের অতীতে যা হয়েছে আল্লাহ তা ক্ষমা করবেন। আর যদি তারা অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি করে তাহলে পূর্ববর্তীদের দৃষ্টান্ত তো রয়েছে’’। এ আয়াতে সুন্নাহ দৃষ্টান্ত অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
كَذَلِكَ نَسْلُكُهُ فِي قُلُوبِ الْمُجْرِمِينَ . لَا يُؤْمِنُونَ بِهِ وَقَدْ خَلَتْ سُنَّةُ الْأَوَّلِينَ
‘‘এভাবেই আমি অপরাধীদের অন্তরে তা (বিদ্রুপ প্রবণতা) সঞ্চার করি। তারা কুরআনের প্রতি ঈমান আনবেনা এবং অতীতে পূর্ববর্তীদেরও এ আচরণ ছিল’’। এ আয়াতে সুন্নাহ আচরণ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
سُنَّةَ مَنْ قَدْ أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِنْ رُسُلِنَا وَلَا تَجِدُ لِسُنَّتِنَا تَحْوِيلًا
‘‘আমার রাসূলগণের মধ্যে তোমার পূর্বে যাদেরকে পাঠিয়েছিলাম তাদের ক্ষেত্রেও ছিল এরূপ নিয়ম, আর তুমি আমার নিয়মে কোন পরিবর্তন পাবেনা’’। এ আয়াতে সুন্নাহ নিয়ম-নীতি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
وَمَا مَنَعَ النَّاسَ أَنْ يُؤْمِنُوا إِذْ جَاءَهُمُ الْهُدَى وَيَسْتَغْفِرُوا رَبَّهُمْ إِلَّا أَنْ تَأْتِيَهُمْ سُنَّةُ الْأَوَّلِينَ أَوْ يَأْتِيَهُمُ الْعَذَابُ قُبُلًا
‘‘যখন তাদের নিকট পথনির্দেশ আসে তখন তাদের ঈমান আনা এবং তাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা থেকে বিরত রাখে কেবল এটা যে, তাদের নিকট তাদের পূর্ববর্তীদের বেলায় অনুসৃত (নাফরমানির কারণে ধংস করার) রীতি আসুক অথবা তাদের কাছে সরাসরি আযাব আসুক’’। এ আয়াতে সুন্নাহ নিয়ম-রীতি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
مَا كَانَ عَلَى النَّبِيِّ مِنْ حَرَجٍ فِيمَا فَرَضَ اللَّهُ لَهُ سُنَّةَ اللَّهِ فِي الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلُ وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ قَدَرًا مَقْدُورًا
‘‘আল্লাহ নবীর জন্য যা বিধিসম্মত করেছেন তা করতে তার জন্য কোন বাধা নেই। পূর্বে যে সব নবী অতীত হয়ে গেছে তাদের ক্ষেত্রেও এটাই ছিল আল্লাহর বিধান। আল্লাহর বিধান সুনির্ধারিত’’। এ আয়াতে সুন্নাহ বিধান অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
سُنَّةَ اللَّهِ فِي الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلُ وَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَبْدِيلًا
‘‘পূর্বে যারা অতীত হয়ে গেছে তাদের ব্যাপারে এটাই ছিল আল্লাহর রীতি। তুমি কখনও আল্লাহর রীতিতে কোন পরিবর্তন পাবেনা’’। আয়াতে সুন্নাহ রীতি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
উল্লেখিত আয়াত সমূহে ব্যবহৃত সুন্নাহ শব্দের অর্থের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, কুরআনুল কারীমে সুন্নাহ শব্দটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রীতি-পদ্ধতি, বিধান ও চিরাচরিত নিয়ম ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণীতে সুন্নাহ শব্দের ব্যবহার:
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুখনি:সৃত বাণী হাদীছে সুন্নাহ শব্দটি রীতি-পদ্ধতি,পথ-পন্থা, জীবনাদর্শ, রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান ও রাষ্ট্র পরিচালন নীতি ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন:-
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
مَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ كُتِبَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا وَلَا يَنْقُصُ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْءٌ وَمَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً سَيِّئَةً فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ كُتِبَ عَلَيْهِ مِثْلُ وِزْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا وَلَا يَنْقُصُ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَيْءٌ
‘‘যে ব্যক্তি ইসলামে কোন ভালো রীতি-পদ্ধতি চালু করবে পরবর্তীতে তার ওপরে আমল করা হলে যারা তার ওপর আমল করবে তাদের সমপরিমাণ প্রতিদান তাকেও দেয়া হবে। অথচ তাদের প্রতিদান থেকে কিছুই কমানো হবেনা। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোন খারাপ রীতি-পদ্ধতি চালু করবে পরবর্তীতে তার ওপর আমল করা হলে যারা তার ওপর আমল করবে তাদের সমপরিমাণ প্রতিফল তাকেও দেয়া হবে , অথচ তাদের পাপের বোঝা সামান্য পরিমাণও কম করা হবেনা’’।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অপর এক হাদীছে বলেছেন :
لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ قَبْلَكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ حَتَّى لَوْ سَلَكُوا جُحْرَ ضَبٍّ لَسَلَكْتُمُوهُ
‘‘তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতি-পদ্ধতির হুবহু অনুকরণ করবে- এমনকি তারা এক বিঘৎ পরিমাণ করলে তোমরাও এক বিঘৎ করবে, তারা এক হাত পরিমাণ করলে তোমরাও এক হাত পরিমাণ করবে’’।
উল্লেখিত হাদীছ দুটিতে সুন্নাহ শব্দটি রীতি, পদ্ধতি, পথ ও পন্থা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অপর এক হাদীছে বলেছেন :
َ تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ
‘‘আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে গেলাম, যা আঁকড়ে ধরে থাকলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবেনা। একটি হলো আল্লার কিতাব অপরটি হলো তাঁর নবীর সুন্নাহ’’। এ হাদীছে সুন্নাহ শব্দটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণী ও কর্ম অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অপর এক হাদীছে বলেছেন : النكاح من سنتي . فمن لم يعمل بسنتي فليس منيবিয়ে আমার সুন্নাহ (আদর্শ)। সুতরাং যে আমার এ সুন্নাহর উপর আমল করবেনা সে আমার উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত নয়। এ হাদীছে সুন্নাহ শব্দটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনাদর্শ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
অপর এক হাদীছে সুন্নাহ শব্দটি রাষ্ট্র পরিচালন নীতি ও রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللَّهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِى فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ
আমি তোমাদিগকে আল্লাহকে ভয় করার নির্দেশ দিচিছ। যদি হাবশী গোলামও তোমাদের নেতৃত্বে থাকে তোমাদের কর্তব্য শোনা ও আনুগত্য করা। তোমাদের মধ্য থেকে যারা বেঁচে থাকবে তারা অনেক মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমাদের অবশ্য করণীয় হবে আমার এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহর অনুসরণ করা। তা দাঁতে কামড়ে ধরার মত শক্তভাবে আঁকড়ে ধর।
এ হাদীছে সুন্নাহ বলতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও খুলাফায়ে রাশিদীনের রাষ্ট্রপরিচালনা নীতিকেই বুঝানো হয়েছে। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানে কেবল খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাহ অনুসরণের কথা বলেছেন, অন্য সকল সাহাবীর সুন্নাহ অনুসরণের কথা বলেননি। এথেকে বুঝা যায়, এখানে খুলাফায়ে রাশিদীনের এমন কোন সুন্নাহর কথা বলা হচ্ছে যা অন্য কোন সাহাবীর নেই। সুতরাং নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে,খুলাফায়ে রাশিদীনের সেই বিশেষ সুন্নাহ হলো তাঁদের রাষ্ট্রনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালন পদ্ধতি। অতএব হাদীছটির অর্থ হবে: তখন তোমাদের করণীয় হবে আমার এবং খুলাফায়ে রাশিদীনের রাষ্ট্রনীতি ও পরিচালন পদ্ধতি অনুসরণ করা।
সুন্নাহ শব্দটি ইসলাম পূর্ব যুগে সাধারণত: আদর্শ ও নীতিভিত্তিক সামাজিক প্রথা ও সর্বসম্মত রীতি বা প্রণালী অর্থে ব্যবহৃত হ‘ত। উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, সুন্নাহ শব্দটি আভিধানিক ভাবে আদর্শ, আচরণ, নজির, পদ্ধতি ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে ইসলাম এ শব্দটিকে আভিধানিক অর্থে ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রীতি-পদ্ধতি ও জীবনাদর্শ অর্থেই বিশেষ ভাবে ব্যবহার করেছে।
পারিভাষিক অর্থ :
সুন্নাহর পারিভাষিক অর্থের ব্যাপারে হাদীছবিদ ও ফিক্হবিদগণের মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। প্রত্যেক দলই নিজেদের অধ্যয়নের বিষয় ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অনুযায়ী সুন্নাহর অর্থ নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন।

মুহাদ্দিছগণের পরিভাষায় সুন্না্হ:
كل ما أثر عن النبي صلى الله عليه وسلم من قول أو فعل أو ةقرير أوصفة خلقية أو خلقية أو سيرة ুسواء كان ذلك قبل البعثة أو بعدها
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নবুওয়াত পূ্র্ব অথবা পরবর্তী জীবনের কোন কথা, কাজ, মৌন সমর্থন, দৈহিক গঠন প্রকৃতি, নৈতিক গুণাবলী ও জীবন চরিত সম্পর্কে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে তাই সুন্নাহ। মুহাদ্দিছগণের এরূপ সংগা দেয়ার কারণ হলো তাঁরা তাঁর জীবনের সকল দিক সম্পর্কেই অনুসন্ধান করেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন রাসূলুল্লাহর পূর্ণ জীবনই আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। এজন্য নবুওয়াতের পূর্ববর্তী পরবর্তী সকল কিছুই এমনকি তাঁর দৈহিক গঠন প্রকৃতিও সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। তা দ্বারা কোন শর‘ঈ বিধান প্রতিষ্ঠিত হোক বা না হোক। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নবুওয়াত পূর্ববর্তী সৎগুণাবলীও সুন্নাহ। যেমন- উম্মূল মু’মিনীন খাদিজা (রা) এর উক্তি-
فقالت خديجة كلا والله ما يخزيك الله أبدا إنك لتصل الرحم وتحمل الكل وتكسب المعدوم وتقري الضيف وتعين على نوائب الحق
‘‘খাদিজা (রা) বললেন, না! আল্লার কসম! আল্লাহ আপনাকে অপমান করবেন না। কেননা আপনি আত্মীয়তার হক আদায় করেন, অপরের ক্লান্তি দূর করেন, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দান করেন, মেহমানের মেহমানদারী করেন এবং বিপদগ্রস্তব্যক্তির সাহায্য করেন।’’
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এ সকল গুণ তাঁর নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বের জীবনের। এ সকল গুণ ও সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত যা ঈমানদারদের পালন করা আবশ্যক।
অনেকের মতে এ অর্থে সুন্নাহ হাদীছের সমার্থক। মুহাদ্দিছগণের মতে সুন্নাহ, হাদীছ,খবর এবং আছার সমার্থবোধক।
উছুলবিদদের পরিভাষায় সুন্নাহ:
كل ما صدر عن الرسول صلى الله عليه وسلم من قول أو فعل أو تقرير
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথা অথবা কাজ অথবা মৌন সমর্থন সম্পর্কে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে তা-ই সুন্নাহ।
কথার দৃষ্টান্ত হলো : বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিধি-বিধান সম্বলিত যে সকল কথা বলেছেন। যেমন :
إنما الأعمال بالنيات ‘‘সকল কর্মের ভিত্তি হলো নিয়্যাত’’।

البيعان بالخيار ما لم يتفرقا
‘‘ক্রেতা-বিক্রেতা যতক্ষন পর্যন্ত ক্রয়-বিক্রয়ের স্থান ত্যাগ না করবে ততক্ষণ উভয়ের ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি বহাল রাখা বা না রাখার এখতিয়ার আছে’’।
কাজের দৃষ্টান্ত হলো : সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু তায়ালা ‘আনহুম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইবাদাত বন্দেগী তথা সালাত, সাওম, হাজ্জ, বিচার কার্য ইত্যাদি সম্পর্কে যা কিছু বর্ণনা করেছেন।
মৌন সমর্থনের দৃষ্টান্ত হলো : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সামনে অথবা তাঁর জ্ঞাতসারে কোন সাহাবী কোন কাজ করেছেন কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুপ থেকেছেন। এতে তাঁর সম্মতি আছে তা বুঝা গেছে। অথবা তার প্রতি তিনি সরাসরি সমর্থন প্রকাশ করেছেন। যেমন : বনী কুরাইযার যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামকে বললেন -
لا يصلين أحد العصر إلا في بني قريظة ‘‘তোমাদের কেউই বানু কুরাইযাহ ছাড়া আসরের নামায আদায় করবেনা’’।
সাহাবায়ে কিরামের অনেকেই মনে করলেন এ নিষেধাজ্ঞা আক্ষরিক অর্থেই। সুতরাং তাঁরা যথাসময়ে আসরের নামায আদায় না করে বানু কুরাইযায় পৌঁছে মাগরিবের পর আসর আদায় করলেন। অপর সাহাবীগণ একথার অর্থ এই বুঝলেন যে, যথাসম্ভব দ্রুত সেখানে পৌছতে বলেছেন। তাই তাঁরা যথাসময়ে আসরের নামায আদায় করেন এবং দ্রুত বানু কুরাইযায় পৌঁছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয় দলের কর্মকান্ড সম্পর্কে অবগত হন। কারো কর্মই প্রত্যাখ্যান করেননি বরং মৌনতা অবলম্বনের মাধ্যমে সবার কর্মেরই স্বীকৃতি দান করেন।
উছুলবিদগণের মতে এমন কিছুকেও সুন্নাহ বলা হয় যা কোন শর‘ঈ দলীল দ্বারা প্রমাণিত। সে দলীল আল্-কুরআন হোক অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কোন বাণী বা কর্ম হোক অথবা তা হোক কোন সাহাবীর ইজতিহাদ। যেমন ; আল-কুরআন মাসহাফে একত্রিকরণ, একই নিয়মে মানুষকে কুরআন পাঠের জন্য ঐক্যবদ্ধ করণ,বিভিন্ন দিওয়ান প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। উপরোক্ত সবকিছুই সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত।এর বিপরীত শব্দ হলো বিদ‘আত البدعة) (। এ প্রসংগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণী :
فعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين
‘‘আমার সুন্নাহ ও খুলাফা-ই-রাশিদীনের সুন্নাহ অনুসরণ করা আবশ্যক’’ ।
ফিকহবিদগণের মতে সুন্নাহ:
আর ফকীহদের মতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে ফরয ও ওয়াজিব ছাড়া অন্য যা কিছু প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাই সন্নাহ। আর তাঁদের নিকট এর বিপরীত শব্দ হলো আল-বিদ‘আহ। যেমন : তাঁরা বলেন : طلاق السنة كذا وطلاق البدعة كذا - সুন্নাত তালাক এমন, বিদ‘আত তালাক এমন। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী প্রদত্ত তালাক হলো সুন্নাত তালাক, আর এর বিপরীতটি হলো বিদ‘আত তালাক।
সুন্নাহর পারিভাষিক অর্থে এই ভিন্নতা ‘আলিম ব্যক্তিদের প্রতিটি দলের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ভিন্নতার কারণে হয়েছে। হাদীছ বিশারদগণ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একজন নেতা, সত্যপথের দিশারী, যাঁকে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মানব জাতির জন্য উত্তম আদর্শ বলে ঘোষণা করেছেন, সে হিসেবেই তাঁর জীবন-ইতিহাস অনুসন্ধান ও গবেষণা করেন। সুতরাং তাঁরা তাঁর জীবনী, দৈহিক গঠন, চরিত্র, নৈতিক গুণাবলী, কথা,কাজ ইত্যাদি বর্ণনা করেন। এসব কিছু কোন শর‘ঈ হুকুম প্রমাণ করুক বা না করুক।
আর উছুলবিদগণ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একজন বিধানদাতা . যিনি পরবর্তী কালের মুজতাহিদগণের জন্য মূলনীতির প্রতিষ্ঠাতা এবং মানব জীবনের সংবিধান প্রদানকারী হিসেবে বিবেচনা করেছেন। সুতরাং তাঁরা রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এমন সকল কথা, কাজ ও মৌন সমর্থন বর্ণনা ও গবেষণার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন যা দ্বারা শারী‘আতের কোন বিধান প্রতিষ্ঠিত হয়।
আর ফিক্হবিদগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে এভাবে বিবেচনা করেছেন যে, তাঁর কোন কাজই যেকোন শর‘ঈ হুকুম প্রতিষ্ঠা ও প্রমাণ থেকে বাইরে নয়। তাঁরা বান্দার কাজের ব্যাপারে শর‘ঈ হুকুমকে ওয়াজিব, হারাম, মুবাহ, মাকরুহ ইত্যাদি হিসেবে বিবেচনা করেন।
আবার ফকীহগণের মাযহাবের ভিন্নতার কারণে সুন্নাহর সংগার মধ্যেও কিছুটা তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন: হানাফী ফকীহগণের মতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সকল কাজ সর্বদাই করেছেন, তবে বিনা কারণে কখনো কখনো ছেড়ে দিয়েছেন এমন কাজকে সুন্নাহ বলা হয়।
অধিকাংশ শাফে‘ঈ ফকীহগণের মতে সুন্নাহ হলো মুস্তাহাব, মানদুব, নফল ইত্যাদী শব্দের সমার্থবোধক শব্দ।
মালিকী এবং হাম্বালী ফকীহগণের মতে ঐ সকল কর্ম-কান্ডকে সুন্নাহ বলে ,যা পালন করলে সাওয়াব হয়। কিন্তু পালন না করলে কোন গুনাহ হয়না।
হাদীছবিদ, উছুলবিদ ও ফিক্হবিদগণ নিজ নিজ অধ্যয়নের বিষয় ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অনুযায়ী সুন্নাহর অর্থ নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন। ফলে সুন্নাহর পারিভাষিক অর্থের ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তবে প্রকৃত অর্থে তাঁরা এ ব্যাপারে একমত যে, সুন্নাহ হলো মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসৃত অনুকরণীয় পথ।
মূলত: সুন্নাহ হলো সেই উচ্চতর আইন যা সর্বোচ্চ বিধানদাতার (অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার ) মর্জি ও ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে। এই বিধান মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আমাদের নিকট দুইটি মাধ্যমে পৌঁছেছে। এক, কুরআন মজীদ যা অক্ষরে অক্ষরে মহান আললাহর বিধান ও তাঁর হিদায়াতের সমষ্টি। দুই, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উসওয়া-ই হাসানা (অনুসরণীয় উত্তম আদর্শ), অথবা তাঁর সুন্নাত যা কুরআন মজীদের উদ্দেশ্যের ব্যাখ্যাুবিশ্লেষণ করে। মুহাম্ম্দ সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু আল্লাহর পত্রবাহকই ছিলেন না যে, তাঁর কিতাব পৌঁছে দেয়া ব্যতীত তাঁর আর কোন দায়িত্ব ছিলনা, বরং তিনি তাঁর নিয়োগকৃত পথপ্রদর্শক, আইনপ্রণেতা ও শিক্ষকও ছিলেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল নিজের কথা ও কানুনে ইলাহীর ব্যাখ্যা প্রদান করা, তার সঠিক উদ্দেশ্য বুঝিয়ে দেয়া, তার উদ্দেশ্য অনুযায়ী লোকদের প্রশিক্ষণ দেয়া। অতপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকদের সমন্বয়ে একটি সুসংগঠিত জামায়াতের রূপ দান করে সমাজের সংশোধন ও সংস্কারের উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালানো। অতপর এই সংশোধিত সমাজকে একটি সৎ ও সংশোধনকারী রাষ্ট্রের রূপ দান করে দেখিয়ে দেয়া যে, ইসলামের আদর্শ ও নীতিমালার উপর একটি পূর্ণাংগ সভ্যতা কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এই সমগ্র কাজই হচ্ছে সুন্নাত যা তিনি তেইশ বছরের নবুওয়াতী জীবনে আঞ্জাম দিয়েছেন। তাঁর এই সুন্নাত কুরআনের সাথে মিলিত হয়ে সর্বোচ্চ আইন প্রণেতার উচ্চতর আইনের রূপায়ন ও পূর্ণতা বিধান করে। আর ইসলামী পরিভাষায় এই উচ্চতর আইনের নাম শারীয়াত।

আল্-কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যে পার্থক্য
সুন্নাহ ও আল্-কুরআনের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের পূর্বে কুরআনের পরিচিতি দেয়া প্রয়োজন। কুরআনের পরিচিতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
وَإِنَّهُ لَتَنْزِيلُ رَبِّ الْعَالَمِينَ. نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ . عَلَى قَلْبِكَ لِتَكُونَ مِنَ الْمُنْذِرِينَ . بِلِسَانٍ عَرَبِيٍّ مُبِينٍ.
‘‘আর নিশ্চয় এ কুরআন জগতসমূহের রবেরই নাযিলকৃত। বিশ্বস্ত আত্মা জিবরাঈল এটা নিয়ে অবতরণ করেছে। তোমার হৃদয়ে, যাতে তুমি সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত হও। এটা নাযিল করা হয়েছে সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়’’।
পবিত্র কুরআনের বর্নণা অনুযায়ী এক কথায় কুরআনের সংগা এভাবে দেয়া যেতে পারে-
القرآن هو الكتاب المنزل من الله تعالى على محمد صلى الله عليه وسلم بواسطة جبريل الأمين بلسان عربي مبين .
আল কুরআন হলো সেই মহাগ্রন্থ যা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি জিবরাইল আমীনের মাধ্যমে আরবী ভাষায় নাযিল করা হয়েছে।
আল-কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ:
1. আল-কুরআনুল কারীম ওহী মাতলু - যা তিলাওয়াত করা হয় এবং ছালাতে পাঠ করা হয়। কিন্তু সুন্নাহ ওহী গায়র মাতলু - তিলাওয়াত করা হয়না এবং ছালাতে পাঠ করা হয়না ।
2. আল-কুরআনুল কারীম শব্দ ও অর্থ সহ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি নাযিল করা হয়েছে। যার ভাষা, শব্দ, শৈল্পিক রূপ, অলংকারিক সৌন্দর্য সকল কিছুই আরব অনারব সবার জন্য চ্যালেঞ্জ। এটা কিয়ামাত পর্যন্ত স্থায়ী মু‘জিযা। কিন্তু সুন্নাহর মূল বক্তব্য আল্লাহর তবে ভাষা ও শব্দ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিজস্ব।
3. আল-কুরআনের শব্দ ও অর্থ সবই আল্লাহর, পক্ষান্তরে সুন্নাহর শব্দ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এবং অর্থ আল্লাহর।
4. আল-কুরআন তিলাওয়াত এমন একটি ইবাদাত যার বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা নির্দিষ্ট পরিমাণ ছাওয়াব প্রদান করবেন। সালাতে কুরআন তিলাওয়াত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পক্ষান্তরে সুন্নাহর তিলাওয়াত ইবাদাত নয় এবং সালাতে সুন্নাহর তিলাওয়াত বিধি সম্মত করা হয়নি।
5. আল-কুরআন প্রকাশ্য ওহী ( الوحي الظاهر) আর সুন্নাহ অপ্রকাশ্য ওহী ( الوحي الباطن )।
6. বিনা অযুতে কুরআন স্পর্শ করা এবং নাপাক অবস্থায় আল-কুরআন তিলাওয়াত করা বৈধ নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন- لَا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ ‘‘ পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া কেউ তা স্পর্শ করতে পারবেনা’’। ( সূরা আল ওয়াকি‘আহ : ৭৯)। কিন্তু সুন্নাহর ব্যাপারে এ ধরনের কোন নির্দেশনা নেই। সুন্নাহ অযু ছাড়াও স্পর্শ করা যায়।
7. আল-কুরআনের সকল সূরা ও আয়াত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায়ই আল্লাহর নির্দেশে সুবিন্যস্তভাবে লেখার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সুন্না্হ তাঁর জীবদ্দশায় লিপিবদ্ধ করা হয়নি। কেননা সুন্নাহ লিপিবদ্ধ করতে তিনি নিষেধ করেছেন।
8. আল-কুরআনের কোন আয়াতই ভাবার্থে বর্ণনা করা হয়নি বরং আল্লাহ তা‘আলার নাযিলকৃত শব্দ দ্বারাই তা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সুন্নাহর বর্ণনার ক্ষেত্রে অনেক জায়গায়ই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথিত শব্দের পরিবর্তে তার ভাবার্থে বর্ণনা করা হয়েছে।
সুন্নাহর গুরুত্ব ও তা অনুসরণের অপরিহার্যতা
ইসলামী শারী‘আতের মূল উৎস আল-কুরআন। কেননা তা আল্লাহর বাণী, মহান আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতির হেদায়াতের জন্য, তাদেরকে সিরাতুল মুসতাকীমে পরিচালিত করার জন্য এবং দুনিয়ায় জীবন যাপনের জন্য পথ প্রদর্শক ও আইন বই হিসেবে অবতীর্ণ করেছেন। এটি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপরে নাযিলকৃত একটি বড় মু‘জিযা। যার প্রতিটি শব্দ, বাক্য এমনকি প্রতিটি বর্ণও অবিকৃত অবস্থায় সংরক্ষিত আছে। এটি অবিকৃত অবস্থায় সংরক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহ তা‘আলা নিজেই গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন- إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ ‘‘ নিশ্চয় আমি যিকর (আল-কুরআন) অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষণকারী’’। আর আল-কুরআনের বিস্তারিত বর্ণনার দায়িত্ব আল্লাহ তা‘আলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ
‘‘আমি তোমার প্রতি এ উপদেশবাণী ( আল-কুরআন ) এজন্য অবতীর্ণ করেছি যেন তুমি মানুষের জন্য অবতীর্ণ এ গ্রন্থ তাদের সামনে বর্ণনা কর। এবং তারা এ নিয়ে চিন্তা করে’’।
সুতরাং বলা যেতে পারে যে, আল-কুরআনের বিধান সমূহের বিস্তারিত বর্ণনাই হলো সুন্নাহ। আর এ সুন্নাহর আনুগত্য করা ফরয করা করা হয়েছে। তা অস্বীকার করার কোন রকম কোন সুযোগ নেই। অতএব কুরআনের অনুসরণ করা যেমন অপরিহার্য সুন্নাহর অনুসরণ করা তেমনই অপরিহার্য। কেননা সুন্নাহর পূর্ণাংগ অনুসরণ ছাড়া আল্লাহর আনুগত্য ও কুরআনের অনুসরণ সম্ভব নয়। জীবনের সকল ক্ষেত্রে সুন্নাহর অনুসরণই মুক্তি, সফলতা ও হিদায়াতের মাধ্যম। আল-কুরআনের আয়াত সমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সুন্নাহর গুরুত্ব ও তা অনুসরণের অপরিহার্যতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। আল-কুরআনুল কারীমে বিভিন্নভাবে এ বিষয়ে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সুন্নাহর অপরিহার্যতা সম্পর্কে আল-কুরআনের দলীল :
যেমন-
১. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য ও অনুসরণই মাগফিরাত, নাজাত ও আল্লাহর রহমত লাভের একমাত্র অসীলা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ
‘‘বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমদের পাপ মার্জনা করবেন। আর আল্লাহ ক্ষমাকারী দয়ালু। বল, আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে জেনে রাখ, আল্লাহ কাফিরদেরকে পছন্দ করেননা’’।
এ আয়াতে সুন্নাহর আনুগত্য বর্জন কারীদেরকে কাফির বলা হয়েছে।
২. আল্লাহর রহমত লাভের উপায় হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ‘‘ তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমাদের উপর রহমত করা হয়’’।
৩. জান্নাত লাভের শর্ত হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য। আল্লাহ বলেন-
وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
‘‘কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করলে আল্লাহ তাকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে তারা স্থায়ী হবে আর এটা মহা সাফল্য’’।
৪. ঈমানের শর্ত হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
‘‘হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখ ,তাহলে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের, এবং তাদের যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী। কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধে লিপ্ত হও তাহলে তা প্রত্যর্পণ কর আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি। বস্ত্তত: এটাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর’’।
এ প্রসংগে আল্লাহ আরেক এক আয়াতে বলেন-
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
‘‘ না তোমার পালনকর্তার শপথ! তারা ঈমানদার হবেনা যতক্ষন না তারা তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক হিসেবে গ্রহণ করবে। অত:পর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে তাদের মনে কোন রকম দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্ত:করণে তা মেনে নেয়’’।
বস্ত্তত: এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এমন একজন বিচারক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যাঁর নিকট মীমাংসার জন্য যাওয়া এবং তাঁর সিদ্ধান্ত শুধু বাহ্যত মেনে নেয়া নয়। বরং দ্বিধাহীন চিত্তে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করা ঈমানের শর্ত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন- وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ ‘‘ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর যদি তোমরা মুমিন হও’’।
৫. ঈমানদারদের দলভুক্ত হওয়ার জন্য সু্ন্নাহর অনুসরণ শর্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا
‘‘আর কেউ আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য করলে সে নবী, ছিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণ-যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন - তাদের সংগী হবে। আর তারা কত উত্তম সংগী।
৬. সফলতা লাভের জন্য সুন্নাতে রাসূলের অনুসরণ অপরিহার্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَخْشَ اللَّهَ وَيَتَّقْهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ
‘‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর অবাধ্যতা থেকে সাবধান থাকে তারাই সফলকাম’’।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَوَلَّوْا عَنْهُ وَأَنْتُمْ تَسْمَعُونَ
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। শোনার পর তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিওনা।
৭. হিদায়েতের জন্য সুন্নাহর অনুসরণ শর্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন- ُ
قلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُمْ مَا حُمِّلْتُمْ وَإِنْ تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا وَمَا عَلَىالرَّسُولِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ
‘‘বল! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসুলের আনুগত্য কর। আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তাঁর উপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্য তিনি দায়ী এবং তোমাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্য তোমরা দায়ী। তোমরা যদি তাঁর আনুগত্য কর তাহলে সঠিক পথ পাবে। রাসূলের দায়িত্ব তো কেবল সুস্পষ্টরূপে পৌছে দেয়া’’।
৮. রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর-আদর্শই মুমিনের একমাত্র অনুকরণীয় আদর্শ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآَخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا
‘‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।
৯. সুন্নাহর অনুসরণ ব্যতীত আল্লাহর আনুগত্য হয়না। আল্লাহ বলেন-
مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ وَمَنْ تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا
‘‘যে রাসূলের হুকুম মান্য করল সে আল্লাহরই হুকুম মান্য করল। আর যে মুখ ফিরিয়ে নিল আমি আপনাকে তাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি ’’।
১০. সুন্নাহর অনুসরণ না করা ধ্বংসের কারণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلَا تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। (আনুগত্য থেকে বিমুখ থেকে) তোমাদের ‘আমলসমূহ বিনষ্ট করোনা’’।
১১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিরুদ্ধাচরণের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা কঠোর ভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
‘‘সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক এ ব্যাপারে যে, তাদের উপর আপতিত হবে বিপর্যয় অথবা তাদের উপর আপতিত হবে মর্মন্তুদ শাস্তি’’।
১২. মুমিনদের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সিদ্ধান্ত মানা না মানার কোন এখতিয়ার নেই। আল্লাহ বলেন-
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا
‘‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোন মু’মিন পুরুষ কিংবা মু’মিন নারীর তা মানা না মানার কোন এখতিয়ার নেই।(নির্দ্বিধায় তা মেনে নিতে হবে) কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে স্পষ্টতই পথভ্রষ্ট হবে’’।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হলো যে, সুন্নাহর অনুসরণ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য উম্মাতের জন্য অপরিহার্য। সুন্নাহর অনুসরণ ছাড়া কুরআনের অনুসরণও সম্ভব নয় এবং ইমানদার থাকাও সম্ভব নয়। ইমানদার হিসেবে জীবনযাপন করে পরকালে মুক্তি পেতে হলে অবশ্যই সুন্নাহর অনুসরণ করতে হবে।
সুন্নাহর অপরিহার্যতা সম্পর্কে হাদীছের দলীল :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রাপ্ত সুন্নাহ ইসলামী শারী‘আতের দলীল হওয়ার ব্যাপারে মতবিরোধ করার কোন সুযোগ নেই। কোন মুসলিমের পক্ষে সুন্নাহকে অস্বীকার করা বা তাতে সন্দেহ করার কোন অবকাশ নেই। কেননা ঈমানের অর্থ হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীনের ব্যাপারে যা কিছু নিয়ে এসেছেন তার সকল কিছুকেই সংশয় ও দ্বিধাহীন চিত্তে বিশ্বাস করা এবং তা মেনে নেয়া। তা অস্বীকার করা কুফরী। সুন্নাহ শারী‘আতের দলীল হওয়ার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অসংখ্য হাদীছ রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ নিম্নে কয়েকটি দৃষ্টান্ত পেশ করছি -
১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
عن أبي هريرة قال : - قال رسول الله صلى الله عليه و سلم ( ما أمرتكم به فخذوه . وما نهيتكم عنه فانتهوا )
‘‘আবু হুরাইরাহ (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আমি তোমাদেরকে যা নির্দেশ দিয়েছি তা পালন কর আর যা নিষেধ করেছি তা থেকে বিরত থাক’’।
এ হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদেশ মেনে চলা এবং নিষেধ বর্জন করার হুকুম দেয়া হয়েছে। যদি সুন্নাহ শারী‘আতের দলীল না হয় তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দেয়া কোন হুকুম পালন করার এবং কোন নিষেধ বর্জন করার আবশ্যকতা থাকেনা। যদি বিষয়টি এমনই হয় তাহলে শারী‘আতের কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকবেনা।
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
عن أبي هريرة قال : - قال رسول الله صلى الله عليه و سلم ( ذروني ما تركتكم . فإنما هلك من كان قبلكم بسؤالهم واختلافهم على أنبيائهم . فإذا أمرتكم بشيء فخذوا منه ما استطعتم . وإذا نهيتكم عن شيء فانتهوا )

‘‘আবু হুরাইরাহ (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আমি তোমাদেরকে যে অবস্থায় রেখেছি আমাকে এ অবস্থায়ই থাকতে দাও, কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীগণ (বেশি বেশি) প্রশ্ন করা এবং তাদের নবীদের সাথে মতবিরোধের কারণে ধ্বংস হয়েছে। অতএব আমি যখন তোমাদেরকে কোন নির্দেশ দেই তা তোমাদের সাধ্যানুযায়ী পালন কর। আর কোন কিছু থেকে নিষেধ করি তা বর্জন কর।’’
উক্ত হাদীছে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নির্দেশ দিয়েছেন তা পালন করা এবং যা নিষেধ করেছেন তা বর্জন করা ওয়াজিব। যদি সুন্নাহ শারী‘আতের দলীল না হয় তাহলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে তাঁর নির্দেশ পালন করা এবং নিষেধ বর্জন করার হুকুম দিলেন? মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদেশ-নিষেধ কি সুন্নাহ নয়? এগুলো অস্বীকার করা কি সুন্নাহকে অস্বীকার করা নয়?
৩. অপর দিকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সুন্নাহর অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন, এবং তাঁর আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর নাফরমানী আল্লাহর নাফরমানী বলে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং যদি সুন্নাহ শারী‘আতের দলীল না হতো তাহলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও তাঁর সুন্নাহর আনুগত্যের নির্দেশ দিতেন না। এবং তাঁর আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর নাফরমানী আল্লাহর নাফরমানী বলে উল্লেখ করতেন না। ইবন মাজাহর অপর এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
عن أبي هريرة قال : - قال رسول الله صلى الله عليه و سلم من أطاعني فقد أطاع الله ومن عصاني فقد عصى الله
‘‘আবু হুরাইরাহ (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যে আমার আনুগত্য করলো সে আল্লাহর আনুগত্য করলো। আর যে আমার নাফরমানী করলো সে আল্লাহর নাফরমানী করলো।’’
4. হাদীছে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্-কুর’আন দেয়া হয়েছে এবং তার সাথে অনুরূপ আরেকটি বস্ত্ত দেয়া হয়েছে, তা হলো সুন্নাহ । আর উভয়টিকে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা আল-কুরআনকে আঁকড়ে ধরার মতই আবশ্যক ও গুরুত্বপূর্ণ।
عن المقدام بن معدي كرب عن النبي  أنه قال : ألا إني أوتيت الكتاب ومثله معه ، ألا إني أوتيت القرآن ومثله ، ألا يوشك الرجل شبعان على أريكته ، يقول : عليكم بهذا القرآن ، فما وجدتم فيه من حلال فأحلوه ، وما وجدتم فيه من حرام فحرموه، آلا لايحل لكم الحمارالأهلي ولا كل ذي ناب من السباع ولقطة مال معاهد.
‘মিকদাম বিন মা‘দী কারব (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : সাবধান! আমাকে আল-কিতাব এবং তার সাথে অনুরুপ আরেকটি জিনিষ দেয়া হয়েছে। সাবধান! আমাকে আল-কুরআন এবং তার সাথে অনুরূপ আরেকটি জিনিষ দেয়া হয়েছে। সাবধান !অচিরেই দেখতে পাবে কিছু লোক আরাম কেদারায়া বসে বলতে থাকবে : তোমাদের উচিৎ শুধু এই আল-কুরআনের উপর আমল করা , সুতরাং আল-কুরআনের মধ্যে যা কিছু হালালের বর্ণনা পাবে তাকে হালাল হিসেবে গ্রহণ কর। আর আল-কুরআনের মধ্যে যা কিছু হারামের বর্ণনা পাবে তাকে হারাম হিসেবে বর্জন কর। সাবধান! তোমাদের জন্য গৃহপালিত গাধা, হিংস্র প্রাণী ও কুড়িয়ে পাওয়া বস্ত্ত হারাম করা হয়েছে।’’
প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ ‘আল্লামা খাত্তাবী أوتيت الكتاب ومثله معه এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন- এর অর্থ দুরকম হতে পারে :
ক. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রকাশ্য ওহীয়ে মাতলুর অনুরূপ অপ্রকাশ্য ওহীয়ে গায়রে মাতলু দেয়া হয়েছে।
খ. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অহীয়ে মাতলু হিসেবে আল-কিতাব দেয়া হয়েছে, অনুরূপভাবে তাঁকে এ কিতাবের বর্ণনার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। সুতরাং তিনি কুরআনে বর্ণিত সাধারণ হুকুমকে বিশেষভাবে এবং বিশেষ হুকুমকে সাধারণভাবে বর্ণনা করতে পারবেন। প্রয়োজনবোধে তিনি কুরআনে বর্ণিত কোন বিষয়ের ব্যাখ্যার জন্য কিছু বৃদ্ধি করেও বর্ণনা করতে পারবেন। তখন তা গ্রহণ করা এবং তার উপর ‘আমল করা আবশ্যক হবে। যেমন প্রকাশ্য ওহীয়ে মাতলু আল-কুরআনের উপর ‘আমল করা আবশ্যক।
৫. হাদীছে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা হারাম করেছেন তা আল্লাহ তা‘আলা যা হারাম করেছেন তার অনুরূপ। এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করার কোন সুযোগ নেই। যেমন ইবনে মাজাহর বর্ণনায় পাওয়া যায়-
عن المقدام بن معد يكرب الكندي أن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال :يوشك الرجل متكئا على أريكته يحدث بحديث من حديثي فيقول بيننا وبينكم كتاب الله عز و جل . فما وجدنا فيه من حلال استحللناه . وما وجدنا فيه من حرام استحرمناه . ألا وإن ما حرم رسول الله صلى الله عليه و سلم مثل ما حرم الله.
‘‘মিকদাম বিন মা‘দী কারব (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : শীঘ্রই তোমরা দেখতে পাবে যে, কিছু লোক তার খাটে হেলান দিয়ে বসে আমার হাদীছ সম্পর্কে কথা বলবে। তারা বলবে আমাদের ও তোমাদের মাঝে আল্লাহর কিতাব রয়েছে।(হিদায়াতের জন্য এটাই যথেষ্ট) সুতরাং তার মধ্যে হালালের যে বর্ণনা পাব আমরা তাই হালাল মনে করব। আর তার মধ্যে হারামের যে বর্ণনা পাব আমরা তাই হারাম মনে করব। তবে তোমরা মনে রেখ! নিশ্চই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা হারাম করেছেন তা আল্লাহ যা হারাম করেছেন তার অনুরূপ’’।
৬. মিকদাম বিন মা‘দী কারব (রা) বলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাইবারের দিন এমন অনেক কিছুই হারাম করেছেন যার হারাম হওয়ার ঘোষনা আল-কুরআনে নেই। যেমন- গৃহপালিত গাধা এবং হিংস্র প্রাণী। অতঃপর তিনি বললেন : শীঘ্রই তোমরা দেখতে পাবে যে, কিছু লোক খাটে হেলান দিয়ে বসে আমার হাদীছ সম্পর্কে কথা বলবে। তারা বলবে আমাদের ও তোমাদের মাঝে আল্লাহর কিতাব রয়েছে। (হিদায়াতের জন্য এটাই যথেষ্ট) সুতরাং তার মধ্যে হালালের যে বর্ণনা পাব আমরা তাই হালাল মনে করব। আর তার মধ্যে হারামের যে বর্ণনা পাব আমরা তাই হারাম মনে করব। তবে তোমরা মনে রেখ! নিশ্চই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা হারাম করেছেন তা আল্লাহ যা হারাম করেছেন তার অনুরূপ।
এ প্রসংগে মুহাম্মাদ বিন আবু শুহবাহ বলেন : এসকল হাদীছ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মু‘জিযা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ অতীতে এবং বর্তমানেও এমন অনেক দলের আবির্ভাব হয়েছে, যারা নিকৃষ্ট পথ তথা সুন্নাহকে বাদ দিয়ে শুধু আল-কুরআনের প্রতি মানুষকে আহবান জানায়। তারা বলে আল-কুরআনই যথেষ্ট , সুন্নাহর কোন প্রয়োজন নেই। তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো দ্বীন ইসলামের অর্ধেককে ধবংস করা।
উপরোক্ত হাদীছসমূহ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, শারী‘আতের দলীল হিসেবে গ্রহণের ক্ষেত্রে সুন্নাহ আল-কুরআনের মতই। সুন্নাহকে অস্বীকার করার অর্থ আল-কুরআনকেই অস্বীকার করা। সুতরাং তথাকথিত কুরআনের অনুসারীগণ শারী‘আতের দলীল হিসাবে সুন্নাহকে অস্বীকার করার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে আল-কুরআনকেই অস্বীকার করছে। কেননা আল-কুরআনই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য ও তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে।
৭. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্জের সময় মুসলিম উম্মাহর জন্য দ্ব্যর্থহীন ভাবে ঘোষণা দিয়েছেন তোমাদের হিদায়াতের জন্য কুরআন ও সুন্নাহ সমভাবে প্রযোজ্য। যেমন-
عن أبي هريرة قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم إني قد خلفت فيكم شيئين لن تضلوا بعدهما أبدا كتاب الله وسنتي )أخرجه الحاكم في المستدرك(
‘‘আবু হুরাইরাহ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আমি তোমাদের জন্য এমন দুটি জিনিষ রেখে গেলাম যা ধরে থাকলে কক্ষনো তোমরা পথভ্রষ্ট হবেনা। তা হলো আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ’’। (মুসতাদরাকে আল হাকিম)
عن ابن عباس أن رسول الله صلى الله عليه و سلم خطب الناس في حجة الوداع فقال يا أيها الناس إني قد تركت فيكم ما إن اعتصمتم به فلن تضلوا أبدا كتاب الله وسنتي أخرجه الحاكم
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছেন : হে মানবমন্ডলী! নিশ্চই আমি তোমাদের মধ্যে এমন দুটি জিনিষ রেখে গেলাম যা তোমরা যদি আঁকড়ে ধরে রাখ তাহলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবেনা। আর তা হলো আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাহ। (আল হাকিম)
৮. ইরবাদ ইবনে সারিয়াহ (রা) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, সুন্নাহ শরী‘আতের দলীল। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
أوصيكم بتقوى الله والسمع والطاعة وإن عبد حبشي فإنه من يعش منكم يرى اختلافا كثيرا وإياكم ومحدثات الأمور فإنها ضلالة فمن أدرك ذلك منكم فعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين عضوا عليها بالنواجذ
‘‘আমি তোমাদেরকে আল্লাহকে ভয় করার ও নেতার কথা শোনার, তার আনুগত্য করার নির্দেশ দিচ্ছি, যদিও সে হাবশী গোলাম হয়। তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে তারা অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। তোমরা (দ্বীনের বিষয়ে) নবসৃষ্ট কর্মকান্ড থেকে সাবধান থাকবে, কেননা তা হলো পথভ্রষ্টতা। তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঐ সময় থাকবে তখন অবশ্যই তোমরা আমার সুন্নাহকে এবং খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতকে মজবুত ভাবে আঁকড়ে ধরবে’’।
সুন্নাহ শারী‘আতের দলীল হওয়ার জন্য এ হাদীছটিও সুস্পষ্ট প্রমাণ। কুরআন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিধানসমুহ পালন করা যেমন আবশ্যক, সুন্নাহ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আহকামসমূহ পালন করা তেমনই আবশ্যক। সুতরাং যে ব্যক্তি শুধু আল-কুরআনের উপর নির্ভর করে সুন্নাহকে উপেক্ষা করতে চায় হাদীছের মধ্যে তাকে নিন্দাবাদ করা হয়েছে।
9. ইসলামী বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও সুন্নাহ দলীল। মা‘আয ইবনে জাবাল (রা) এর হাদীছ এ ব্যাপারে অত্যন্ত মজবুত প্রমাণ। আবু দাউদ শরীফে বর্ণিত -
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- لَمَّا أَرَادَ أَنْ يَبْعَثَ مُعَاذًا إِلَى الْيَمَنِ قَال্َর كَيْفَ تَقْضِى إِذَا عَرَضَ لَكَ قَضَاءٌ গ্ধ. قَالَ أَقْضِى بِكِتَابِ اللَّهِ. قَال্َর فَإِنْ لَمْ تَجِدْ فِى كِتَابِ اللَّهِ গ্ধ. قَالَ فَبِسُنَّةِ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم-. قَال্َর فَإِنْ لَمْ تَجِدْ فِى سُنَّةِ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- وَلاَ فِى كِتَابِ اللَّهِ গ্ধ. قَالَ أَجْتَهِدُ رَأْيِى وَلاَ آلُو. فَضَرَبَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- صَدْرَهُ وَقَال্َর الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِى وَفَّقَ رَسُولَ رَسُولِ اللَّهِ لِمَا يُرْضِى رَسُولَ اللَّهِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মু‘আয ইবন জাবাল (রা)কে ইয়ামানে পাঠানোর মনস্থ করলেন, তখন তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন : যখন তোমার কাছে কোন বিচার আসবে তখন তুমি কিভাবে বিচার করবে? তিনি বললেন আমি আল্লাহর কিতাব দ্বারা বিচার করব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- তুমি যদি ঐ বিষয়ের কোন কিছু আল্লাহর কিতাবে না পাও তাহলে কি করবে? তিনি বললেন, তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ দ্বারা বিচার করব। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- তুমি যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ এবং আল্লাহর কিতাবেও না পাও তাহলে কি করবে? তিনি বললেন, তখন আমি নিজের মত অনুসারে ইজতিহাদ করব। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বুক চাপড়িয়ে বাহবা দিয়ে বললেন : সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথীদেরকে এমন বিষয়ের তাওফীক দিয়েছেন যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খুশি করে।
এ হাদীছটি সুন্নাহ শারী‘আতের দলীল হওয়ার বিষয়টি আরোও নিশ্চিত করে। কেননা যদি সুনণাহ দলীল না হয় তাহলে কিভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিচার ফায়সালার ক্ষেত্রে এটাকে উৎস হিসেবে গ্রহণ করার অনুমোদন দিলেন!
ইসলামী আইনে সুন্নাতে রাসূলের স্থান
আস্সুন্নাহ ইসলামী আইনের দ্বিতীয় মূল উৎস। প্রথম মূল ঊৎস আল-কুরআনের পরেই তার স্থান। সকল যুগের ইসলামী চিন্তাবিদগণের মন্তব্য হলো:
أما الشريعة الإسلامية، فإنها ةسةمد أحكامها من القرآن الكريم ، ومن السنة النبوية الشريفة
‘‘ইসলামী শারীআতের সকল বিধান আল্ কুর‘আনুল কারীম এবং সুন্নাতে রাসূলের উপরে নির্ভরশীল’’
ولا خلاف في أن السنة مصدر للتشريع كما قدمنا ولكن رتبتها في ذلك تالية لرتبة الكتاب ، بمعنى أن الاحتجاج بالكتاب مقدم على الاحتجاج بالسنة فإن المجتهد يبحث عن الحكم في الكتاب أولًا فإن وجده أخذ به وإن لم يجده تحول إلى السنة ليتعرف على الحكم فيها دل على هذا الترتيب ما روى عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال لمعاذ :্র كيف تقضي إذا عرض لك قضاء؟ قال أقضي بكتاب الله ، قال : فإن لم تجد في كتاب الله؟ قال : فبسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم গ্ধ الحديث وما روي عن عمر بن الخطاب رضي الله عنه أنه كتب إلى القاضي شريح : ( أن اقض بما في كتاب الله فإن لم يكن في كتاب الله فبسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم ) ولا يعرف مخالف لهذا .
‘‘এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই যে, সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামী শারী‘আতের একটি উৎস। তবে ক্রমধারা অনুসারে আল-কুরআনের পর সুন্নাহর স্থান। অর্থাৎ আল-কুরআনের দলীল সুন্নাহর দলীলের চেয়ে অগ্রগণ্য হবে। মুজতাহিদ যে কোন ফয়সালার জন্য প্রথমে আল-কুরআনের বিধান তালাশ করবে। যদি সেখানে পাওয়া যায় তা গ্রহণ করতে হবে। আর যদি সেখানে পাওয়া না যায় তাহলে ঐ বিধানের জন্য সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। এ ধারাবাহিকতার নির্দেশনা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীছ থেকেই পাওয়া যায়। যেমন তিনি মু‘আয (রা) কে জিজ্ঞাসা করলেন: যখন তোমার নিকট কোন বিচার আসবে তখন তুমি কিভাবে বিচার করবে? উত্তরে তিনি বললেন: আমি আল্লাহর কিতাব দ্বারা বিচার করবো। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন: তুমি যদি আল্লাহর কিতাবে না পাও? তিনি উত্তর দিলেন : তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ দ্বারা বিচার করবো।’’
অপরদিকে ‘উমার (রা) থেকে বর্ণিত আছে য়ে, তিনি কাজী শুরাইহকে লিখে পাঠালেন: ‘‘তুমি আল্লাহর কিতাবে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী বিচার করবে। আর যদি আল্লাহর কিতাবে ঐ বিধান না থাকে তাহলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ দ্বারা বিচার করবে’’। এর বিপরীত কোন বক্তব্যের কথা জানা যায়না।

আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) বলেন:
من عرض له منكم قضاء فليقض بما في كتاب الله , فإن جاءه ما ليس في كتاب الله فليقض بما قضى به نبيه صلى الله عليه وسلم.
‘‘তোমাদের কারো কাছে বিচার কার্য আসলে সে যেন কিতাবুল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার করে। আর যদি তার কাছে এমন বিচার আসে যার বিধান কিতাবুল্লাহতে নেই তাহলে সে যেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিচারের বিধান অনুযায়ী বিচার করে।’’
আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মজীদে সংক্ষিপ্তাকারে যে সকল বিধান ও পথনির্দেশনা দান করেছেন অথবা যে সকল মূলনীতি বর্ণনা করেছেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহর মাধ্যমে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। অথবা নিজের পছন্দ ও অপছন্দের কথা প্রকাশ করে তাঁর রাসূলের উপর এ দায়িত্ব অর্পণ করেছেন যে, তিনি শুধু আক্ষরিকভাবেই এই আইনের বিস্তারিত রূপ দান করবেন না, বরং বাস্তবে তা কার্যকর করে তদনুযায়ী আমল করেও দেখিয়ে দেবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ
‘‘(হে নবী) আমি তোমার প্রতি এ উপদেশবাণী ( আল-কুরআন ) এজন্য অবতীর্ণ করেছি যেন তুমি মানুষের জন্য অবতীর্ণ এ গ্রন্থের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তাদের সামনে তুলে ধরতে পার।’’
আল্লাহ তা‘আলার এ নির্দেশনার পর এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেল যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বক্তব্য ও কর্মমূলক বর্ণনা কুরআন মজীদ থেকে পৃথক কোন জিনিষ নয়। মূলত: তা কুরআনের আলোকে এ আইনেরই একটি অংশ। তা অস্বীকার করা স্বয়ং কুরআনকে এবং আল্লাহর নির্দেশনামাকে অস্বীকার করার
নামান্তর। এ বিষয়টি আরোও স্পষ্ট করার জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক আল-কুরআনুল কারীমের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকৃত আইন প্রণয়নমূলক কাজের কয়েকটি দৃষ্টান্ত পেশ করছি।
সুন্নাহ দ্বারা আইন প্রণয়ন মূলক কাজের কয়েকটি দৃষ্টান্ত:-
আল-কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন-َاللَّهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِينَ ‘‘আল্লাহ তা‘আলা পবিত্রতা অর্জনকারীদের পছন্দ করেন’’। (আত-তাওবাহ : ১০৮) এবং আল্লাহ তা‘আলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর নিজের পোশাক পবিত্র রাখার নির্দেশ দিয়েছেন - وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ ‘‘ তুমি তোমার পোশাক পবিত্র রাখ’’। (আল-মুদ্দাসসির : ৪) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উক্ত আয়াতদ্বয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ পূর্বক তা কার্যে পরিণত করার জন্য পায়খানা-পেশাবের পর পরিচ্ছন্নতা অর্জন এবং দেহ ও পরিধেয় বস্ত্র পবিত্র রাখার ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা দান করেছেন এবং তদনুযায়ী কাজ করে দেখিয়ে দিয়েছেন।
কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা যদি (সহবাস জনিত কারণে) অপবিত্র হয়ে যাও, তাহলে পবিত্রতা অর্জন না করে নামায আদায় করোনা (দ্র. সূরা আন-নিসা: ৪৩; আল-মায়িদা : ৬)। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিস্তারিতভাবে বলে দিয়েছেন যে, এখানে নাপাক অর্থ কি? এ নাপাক কোন অবস্থার উপর প্রযোজ্য আর কোন অবস্থার উপর প্রযোজ্য নয় এবং এ নাপাকি থেকে পাক হওয়ার পন্থা কি?
সালাত আদায়ের পূর্বে পবিত্রতা অর্জনের নিমিত্তে কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা হুকুম করেছেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ
হে ইমানদারগণ! তোমরা যখন নামাযের জন্য উঠো তখন নিজেদের মুখ এবং কনুই পর্যন্ত উভয় হাত ধৌত কর। মাথা মাসেহ কর এবং পদদ্বয় ধৌত কর বা মাসেহ কর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে দেন যে, মুখ ধৌত করার নির্দেশের মধ্যে কুলকুচা করা ও নাক পরিষ্কার করাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কান মাথার একটি অংশ ,তাই মাথার সাথে কানও মাসেহ করতে হবে। পদদ্বয়ে মোজা পরিহিত থাকলে তা মাসেহ করবে এবং মোজা পরিহিত না থাকলে তা ধৌত করবে। সাথে সাথে তিনি এটাও বর্ণনা করেছেন যে, কোন অবস্থায় উযু ছুটে যায় এবং কোন অবস্থায় তা অবশিষ্ট থাকে।
কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, রোযাদার ব্যক্তি রাতের বেলা ফজরের সময় কালো সূতা সাদা সূতা থেকে পৃথক না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত পানাহার করতে পারবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ
‘‘তোমরা পানাহার কর যতক্ষন না ফজরের সময় সাদা সূতা থেকে কালো সূতা পৃথক হয়ে যায়।’’
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, এর অর্থ রাতের অন্ধকার থেকে ভোরের শুভ্র আলো উদ্ভাসিত হওয়া।
আল-কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা পানাহারের জিনিস সমূহের মধ্যে কোন কোন জিনিস হালাল এবং কোন কোন জিনিস হারাম হওয়ার কথা বলার পর অবশিষ্ট জিনিস সমূহের ব্যাপারে এ সাধারণ নির্দেশ দেন যে, ‘‘তোমাদের জন্য পাক জিনিস হালাল এবং নাপাক জিনিস হারাম করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : يَسْأَلُونَكَ مَاذَا أُحِلَّ لَهُمْ قُلْ أُحِلَّ لَكُمُ الطَّيِّبَاتُ
‘‘(হে রাসূল) তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করবে তাদের জন্য কি কি হালাল করা হয়েছে? তুমি বলে দাও তোমাদের জন্য পবিত্র জিনিস সমূহ হালাল করা হয়েছে’’।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় বক্তব্য ও বাস্তব কর্মের মাধ্যমে এর বিস্তারিত বর্ণনা দান করেছেন যে, পাক জিনিস কি যা আমরা খেতে পারি এবং নাপাক জিনিস কি যা থেকে আমাদের দূরে থাকা উচিৎ।
কুরআনুল কারীমে উত্তরাধিকার আইনের বর্ণনা প্রসংগে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ]
অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির যদি কোন পুত্র সন্তান না থাকে এবং একজন মাত্র কন্যা সন্তান থাকে, তবে সে তার পরিত্যক্ত সম্পদের অর্ধেক পাবে এবং তাদের সংখ্যা দুইয়ের অধিক হলে তারা সকলে মিলে পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ পাবে। এখানে এ কথা বলে দেয়া হয়নি যে, যদি দুইজন কন্যা সন্তান থাকে তবে তারা কতটুকু অংশ পাবে? মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যাখ্যা করে বলে দেন যে, দুই কন্যা সন্তানও দুইয়ের অধিক কন্যা সন্তানের সমান অংশ পাবে।

আল্লাহ তা‘আলা একই সময় একই ব্যক্তির বিবাহাধীনে দুই সহোদর বোনকে একত্র করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : وَأَنْ تَجْمَعُوا بَيْنَ الْأُخْتَيْنِ ‘‘আর তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে একত্রে দুই সহোদরাকে বিবাহ করা।’’ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, ফুফু-ভাইঝি এবং খালা - বোনঝিও এই হুকুমের মধ্যে শামিল রয়েছে।
কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা পুরুষদের জন্য একসংগে দুই দুই , তিন তিন অথবা চার চার মহিলাকে বিবাহ করার অনুমতি প্রদান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
فَانْكِحُوا مَا طَابَ لَكُمْ مِنَ النِّسَاءِ مَثْنَى وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ
‘‘অর্থাৎ তোমরা তোমাদের পছন্দ মত দুই দুই, তিন তিন ও চার চারটা করে বিয়ে কর’’। এ আয়াতে চুড়ান্তভাবে সুস্পষ্ট করা হয়নি যে, এক ব্যক্তি একই সময় নিজের বিবাহাধীনে চারের অধিক স্ত্রী রাখতে পারবেনা। হুকুমের এ উদ্দেশ্য ও ব্যাখ্যা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদান করেছেন। যাদের বিবাহাধীনে চারের অধিক স্ত্রী ছিল, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে চারের অধিক স্ত্রীদের তালাক দেয়ার নির্দেশ দেন।
আল্লাহ তা‘আলা হজ্ব ফরজ হওয়া সম্পর্কে সাধারণ নির্দেশ দিয়ে বলেন :
وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا
‘‘যারা বাইতুল্লাহ পর্যন্ত পৌছতে সক্ষম তাদের উপরে আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্ব করা ফরজ’’।
এ আয়াতে হজ্ব ফরজ হওয়া সম্পর্কে সাধারণ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখানে পরিষ্কার ভাবে বলা হয়নি যে, এ ফরজ কার্যকর করার জন্য প্রত্যেক মুসলিমকে প্রতি বছর হজ্ব করতে হবে, নাকি জীবনে একবার হজ্ব করাই যথেষ্ট, অথবা একাধিকবার হজ্বে যাওয়া উচিৎ। এটা আমরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ব্যাখ্যার মাধ্যমে জানতে পারি যে, জীবনে একবার মাত্র হজ্ব করেই কোন ব্যক্তি হজ্বের ফরজিয়াত থেকে অব্যাহতি পেতে পারে। উপর্যুক্ত উদাহরণ সমূহ থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হলো যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার প্রদত্ত আইন প্রণয়ের এখতিয়ার প্রয়োগ করে কুরআন মাজীদের বিধানসমুূহ, পথনির্দেশ, ইশারা-ইংগিত ও অন্তর্নিহিত বিষয়স মূহের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন যা ইসলামের আবশ্যক বিধানের অন্তর্ভুক্ত। তা মেনে নেয়া প্রত্যেক মুসলিমের ঈমানী কর্তব্য। এ বিষয়গুলো যেহেতু কুরআন মাজীদে ক্ষমতা অর্পণের নির্দেশের উপর ভিত্তিশীল, তাই তা কুরআন থেকে স্বতন্ত্র কোন বিধান নয়, বরং কুরআনের বিধানেরই অংশ। অথচ তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ দ্বারা।
আবার কখনো কখনো স্বতন্ত্রভাবেও সুন্নাহ দ্বারা বিধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যার উল্লেখ কুরআনে নেই। যেমন দাদীর উত্তরাধিকারী স্বত্ব। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাদীর জন্য এক ষষ্ঠাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তবে এটাই স্বতসিদ্ধ কথা যে, সুন্নাহ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আইনের মূল উৎসও আল-কুরআন। কুরআনের বিধান অনুধাবন ও তা বাস্তবায়নের জন্য সুন্নাহ অপরিহার্য। সুন্নাহকে বাদ দিয়ে কুরআন বুঝা ও তার উপর আমল করা কখনও সম্ভব নয়।
আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেন মানুষকে দ্বীনের বিধি-বিধান শিক্ষা দিতে পারেন সে জন্য তাঁকে আল-কুরআন ও আল-হিকমাহ দান করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ
‘‘ অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে এমন একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাঁর আয়াতসমূহ তাদের নিকট তিলাওয়াত করেন.তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দেন, যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট পথভ্রষ্ট ছিল’’। এ আয়াতে উল্লেখিত ‘‘হিকমাহ’’ বলতে সুন্নাহ বুঝানো হয়েছে।
এ প্রসংগে ‘আস্ সুন্নাহ ওয়া মাকানাতুহা’ নামক গ্রন্থ প্রণেতা ড.মুস্তাফা আসসিবা‘ঈ বলেন-জামহুর আলিম ও কুরআন বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, আয়াতে উল্লেখিত হিকমাহ হলো কুরআন থেকে ভিন্ন একটি জিনিস। আর তা হলো আল্লাহ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দ্বীনের যে সকল গোপন বিষয় ও শারী‘আতের বিধি-বিধান অবহিত করেছেন তাই। আর ‘আলিমগণ তাকে আস্ সুন্নাহ বলে অভিহিত করে থাকেন। ইমাম আশ-শাফি‘ঈ (রহ) বলেন :
‘‘আল্লাহ ‘‘আল-কিতাব’’ উল্লেখ করেছেন, সেটা হলো আল-কুরআন। তিনি ‘‘আল-হিকমাহ’’ উল্লেখ করেছেন, আমি কুরআন বিশেষজ্ঞদের বলতে শুনেছি আল-হিকমাহ হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ। কেননা আল্-কিতাব উল্লেখ করার পরই আলহিকমাহর উল্লেখ করা হয়েছে। আর আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিকে আল-কিতাব ও আল-হিকমাহ শিক্ষা দানের অনুগ্রহের কথা বলেছেন। সুতরাং এখানে আল-হিকমাহ অর্থ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ ছাড়া আর কিছু বলা সংগত হবেনা। কারণ, আল-হিকমাহ শব্দটি আল-কিতাবের সাথে সংযুক্তভাবে এসেছে। তাছাড়া আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণ ফরজ করেছেন এবং মানুষের জন্য তাঁর আদেশ-নিষেধ মানা অপরিহার্য করেছেন। সুতরাং কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতু রাসূলিল্লাহ ফরজ হওয়ার কথা ছাড়া অন্য কিছু বলা সংগত হবেনা। যেমন আমরা বলেছি আল্লাহ তাঁর উপর ঈমান আনার সাথে তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমানের কথাও বলেছেন।’’
ইমাম শাফি‘ঈর (রহ) উপরোক্ত বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায় যে, আয়াতে উল্লেখিত আল-হিকমাহ দ্বারা যে সুন্নাহ বুঝায় সে ব্যাপারে তিনি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। কারণ আল্লাহ তা‘আলা আল-হিকমাহকে সংযোজক অব্যয়ের মাধ্যমে আল-কিতাবের সাথে যুক্ত করেছেন। ফলে দু’টি যে ভিন্ন জিনিস তা বুঝা যায়। তা কেবল সুন্নাহ ছাড়া আর কিছু হতে পারেনা। কারণ আল্লাহ আমাদেরকে শিক্ষা দানের যে অনুগ্রহের কথা বলেছেন, তার মধ্যে সুন্নাহ একটি। আর সত্য ও সঠিক জিনিস ছাড়া আল্লাহর অনুগ্রহ হতে পারেনা। সুতরাং আল-কুরআনের মত সুন্নাহর অনুসরণও ওয়াজিব। আমাদের উপর কেবল আল-কুরআন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য আবশ্যক করা হয়েছে। অতএব এ কথা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, হিকমাহ হলো আইন ও বিধানের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যে সকল কথা ও সিদ্ধান্ত বর্ণিত হয়েছে তা-ই।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার হলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে আল-কুরআন ও তার সাথে অন্য যে জিনিসটি দান করা হয়েছে (সুন্নাহ) তার আনুগত্য করা ওয়াজিব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা সে কথা এ ভাবে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন :
يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ
‘‘সে (নবী) তাদেরকে সৎকাজের নির্দেশ দেয়, অসৎকাজ করতে নিষেধ করে, তাদের জন্য পবিত্র বস্ত্তসমূহ হালাল করে এবং অপবিত্র বস্ত্তসমুহ হারাম করে’’।
এ আয়াত দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতাও দিয়েছেন। তাঁর ক্ষমতাকে শুধুমাত্র আল-কুরআনের বিধানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পর্যন্ত সীমিত করার কোন কারণ নেই। এ প্রসংগে হযরত মিকদাম ইবন মা‘দিইকারাব (রা) থেকে বর্ণিত হাদিছ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন :
ألا وإني أوتيت الكتاب و مثله معه
‘‘তোমরা জেনে রাখ, আমাকে আল-কিতাব ও আল-কিতাবের অনুরূপ আরেকটি জিনিস দেয়া হয়েছে।’’
আল্লাহ তা‘আলা আরোও বলেন :
وَمَا آَتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
‘‘রাসুল তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে বিরত থাকতে বলেন তা থেকে বিরত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর , নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা কঠিন শাস্তি দাতা।’’
এ আয়াতের মধ্যেও এমন কোন ইংগিত নেই যার দ্বারা একথা বলা যেতে পারে যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের আয়াতের আকারে যা কিছু দেবেন শুধু তাই গ্রহণ করতে হবে। বরং তিনি যা কিছুই দেন তা কুরআনের আয়াত হোক কিংবা কুরআনের আয়াতের কোন ব্যাখ্যা হোক কিংবা কুরআনে নেই এমন কিছু হোক সকল কিছুরই আনুগত্য করা উম্মাতের উপর ওয়াজিব। সুতরাং তাঁর সুন্নাহকে অমান্য করার কোন সুযোগই নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ না মানলে আল-কুরআনও মানা সম্ভব হবে না। কুরআনের অনেক বিষয়ই অজানা থেকে যাবে। কেননা আল-কুরআনে যে বিষয় সংক্ষিপ্ত পরিসরে বর্ণিত হয়েছে সুন্নাহর মাধ্যমেই তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। যেমন-
الَّذِينَ آَمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ
‘‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুলমের সাথে মিশ্রিত করে না তাদের জন্য রযেছে নিরাপত্তা এবং তারাই হিদায়েতপ্রাপ্ত’’।
এ আয়াত নাযিলের পর সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম নাফসের উপর যুলম করা বুঝেছিলেন, ফলে তাঁরা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন এখানে যুলমের অর্থ শিরক। যেমন বুখারী শরীফের এক রিওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে :
لَمَّا نَزَلَتْ} الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ {قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ أَيُّنَا لَايَظْلِمُ نَفْسَهُ قَالَ لَيْسَ كَمَا تَقُولُونَ لَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ بِشِرْكٍ أَوَلَمْ تَسْمَعُوا إِلَى قَوْلِ لُقْمَانَ لِابْنِهِ يَا بُنَيَّ لَاتُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ
‘‘যখনالَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ এ আয়াত নাযিল হ‘ল তখন আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে নিজের নাফসের উপর যুলম করেনা? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এ আয়াতের অর্থ তোমরা যেমন বলছ তেমন নয়। এখানে যুলম অর্থ শিরক। লোকমান তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন, হে প্রিয় বৎস! আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করোনা । নিশ্চয় শিরক হলো বড় যুলম। তোমরা কি এ কথা শোননি?
সুন্নাহ শারী‘আতের দলীল হওয়া সম্পর্কে সাহাবায়ে কিরাম ও মনীষীগণের অবস্থান :
সাহাবায়ে কিরামগণের যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান যুগের সকল মুসলিম এব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন যে, সুন্নাহ সহীহ বলে প্রমাণীত হওয়ার পর তার উপরে ‘আমল করা ওয়াজিব। এজন্যই তাঁরা আল-কুরআনকে যেমন গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছেন সুন্নাহকেও ঠিক তেমন গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছেন। ইসলামের সূচনা লগ্ন থেকেই যেকোন বিষয়ের সমস্যা সমাধানের জন্য কুরআনের পরেই সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা হতো। খুলাফায়ে রাশিদীন থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত মনীষীগণের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সাহাবায়ে কিরাম, তাবে‘ঈন, তাবে তাবে‘ঈন এবং আইম্মায়ে মুজতাহিদীন গণের কেউই শারী‘আতের দলীল হিসেবে সুন্নাহকে অস্বীকার করেননি। বরং তাঁরা সবাই সুন্নাহকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং যারা সুন্নাহকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে তাদের বিরোধিতা করেছেন। তাদের থেকে সাবধান থাকার জন্য সকল মুসলিমকে সতর্ক করেছেন। সুন্নাহর অনুসারীগণকে অত্যধিক মর্যাদা দিয়েছেন এবং সুন্নাহকে সংরক্ষণ করার জন্য তাঁরা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবদ্দশায় সাহাবায়ে কিরাম (রা) হাদীছ শ্রবন, তা মুখস্থকরণ এবং তা বর্ণনা করার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব পোষন করতেন। তাঁরা সবাই চাইতেন যেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কোন কথাই তাঁদের থেকে ছুটে না যায় এবং যথাসাধ্য সুন্নাহর উপর ‘আমল করবেন। তাঁদের এ অবস্থা প্রমাণ করে তাঁরা সুন্নাহকে কত গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছেন এবং সুন্নাহর জন্য তাঁরা কত নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওফাতের পর তাঁরা সুন্নাহর উপর ‘আমল করা এবং জালিয়াতের হাত থেকে সুন্নাহকে হিফাযত করার জন্য অধিকতর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কেননা মুসলিমদের ‘আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদাত-বন্দেগী, সামাজিক ও পারিবারিক আইন-কানুন তথা তাদের জীবনের সকল কর্মকান্ডের সাথেই সুন্নাহর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সুন্নাহ মুতাবেক কোনকিছু সংগঠিত হলে তা গ্রহণযোগ্য পক্ষান্তরে সুন্নাহ মুতাবিক না হলে তা প্রত্যাখ্যাত বলে বিবেচিত হয়। এ থেকে বিষয়টি অধিকতর স্পষ্ট হলো যে, সাহাবায়ে কিরাম (রা) ও পরবর্তী মনীষীগণ সুন্নাহকে শারী‘আতের দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
সাহাবায়ে কিরামের (রা) অবস্থান :
সাহাবায়ে কিরাম (রা) সুন্নাহকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এজন্য তাঁরা সুন্নাহর সংরক্ষণ ও সংকলনের জন্য প্রয়োজনবোধে অনেক দূর-দুরান্তের রাস্তা অতিক্রম করেছেন। কোন বিষয়ে সুন্নাহ পাওয়া গেলে তাঁরা তাঁদের নিজস্ব মত ও ইজতিহাদ পরিত্যাগ করে সুন্নাহর উপর ‘আমল করতেন। উদাহরণ স্বরূপ নিম্নে কয়েকটি দৃষ্টান্ত পেশ করছি:-
হযরত আবু বাকর (রা)-এর অবস্থান :
আবু বাকর (রা)-এর খিলাফাত কালে জনৈকা মহিলা এসে তাঁর নিকট দাদী হিসেবে তার মীরাছ দাবী করলেন। তখন তিনি ঐ মহিলাকে বললেন, আল্লাহর কিতাবে তোমার জন্য কোন অংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুন্নাহয় এ বিষয়ে কিছু আছে কিনা তা আমার জানা নেই। তুমি এখন চলে যাও, আমি এ বিষয়ে অন্যান্যদের কাছে জিজ্ঞাসা করে নিই। তিনি এ সম্পর্কে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলেন। তখন মুগীরা ইবন্ শু‘বাহ (রা) বললেন : আমি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। এমতাবস্থায় এ ধরণের মহিলাকে তিনি এক ষষ্ঠাংশ প্রদান করেছেন। তখন আবু বাকর (রা) বললেন : এ বিষয়ে তুমি ছাড়া আরো কেউ জানে কি? তখন মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ আল-আনছারী দাঁড়িয়ে মুগীরা ইবন্ শু‘বাহর (রা) অনুরূপ বললেন। তখন আবু বাকর ছিদ্দীক (রা) উক্ত মহিলাকে এক ষষ্ঠাংশ প্রদানের নির্দেশ দিলেন। হযরত আবু বাকর (রা) যখন মুগীরা ইবন্ শু‘বাহর (রা) কাছ থেকে জানতে পারলেন যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ধরণের মহিলাকে এক ষষ্ঠাংশ প্রদান করেছেন, এবং মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ আল-আনছারীর (রা) সাক্ষ্যের দ্বারা বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন তখন তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ করে সুন্নাহর উপর ‘আমল করলেন ।
হযরত আবু বাকর (রা) যখন খালীফা হলেন তখন মদীনায় এক নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। সে নাজুক পরিস্থিতিতে মদীনাতে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বেশী প্রয়োজন ছিল। অথচ তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক উসামা ইবনে যায়েদ (রা)-এর নেতৃত্বে সেনা অভিযানের সিদ্ধান্ত বহাল রাখলেন এবং বললেন : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে পতাকা বেঁধে দিয়েছেন আমি তা খুলতে পারবনা।
তিনি আরো বলেন:
لَسْتُ تَارِكًا شَيْئًا كَانَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعْمَلُ بِهِ إِلاَّ عَمِلْتُ بِهِ ، إِنِّي أَخْشَى إِنْ تَرَكْتُ شَيْئًا مِنْ أَمْرِهِ أَنْ أَزِيغَ )مسند أحمد(
‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু করেছেন আমি তার সবই পালন করব, কোন কিছুই বাদ দিবনা। কারণ যদি আমি কোন কিছু বাদ দেই তাহলে আমার পথভ্রষ্ট হওয়ার আশংকা রয়েছে’’।
এ সকল ঘটনা থেকেই বুঝা যায় সুন্নাহকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করা ও সুন্নাহ মুতাবিক আমল করার ক্ষেত্রে হযরত আবু বাকর ছিদ্দীক (রা) কত মজবুত অবস্থানে ছিলেন।!
হযরত উমার (রা) এর অবস্থান :
হযরত উমার (রা) অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদর্শী সাহাবী ছিলেন। তাঁর চাহিদা অনুযায়ী কুরআনুল কারীমের অনেক আয়াত নাযিল হয়েছে। তিনি কোন বিষয় যাচাই বাছাই করা ছাড়া গ্রহণ করতেন না। তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহর সামনে নিজের মতামত ও ইজতিহাদকে কোন গুরুত্বপুর্ণ বিষয়ই মনে করতেন না। তিনি সকল কাজেই সুন্নাহকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করতেন। যেমন- তিনি হাজরে আসওয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে পাথরকে সম্বোধন করে বলেন :
قَالَ إِنَّكَ حَجَرٌ لَا تَنْفَعُ وَلَا تَضُرُّ وَلَوْلَا أَنِّي رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَبَّلَكَ مَا قَبَّلْتُكَ ثُمَّ قَالَ عُمَرُ رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَعَلَ مِثْلَ ذَلِكَ
‘‘হে পাথর আমি জানি তুমি অবশ্যই একটি পাথর। তুমি কোন উপকারও করতে পার না আবার কোন ক্ষতিও করতে পার না। আমি যদি রাসূলুল্লাহকে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাকে চুম্বন করতে না দেখতাম তাহলে আমি কখনও তোমাকে চুম্বন করতাম না। তারপর উমার (রা) বললেন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এভাবেই করতে দেখেছি’’।

হযরত উমার (রা) কুফার বিচারক কাজী শুরাইহের কাছে চিঠি লিখলেন :
عَنْ شُرَيْحٍ أَنَّهُ كَتَبَ إِلَى عُمَرَ يَسْأَلُهُ فَكَتَبَ إِلَيْهِ أَنْ اقْضِ بِمَا فِي كِتَابِ اللَّهِ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِي كِتَابِ اللَّهِ فَبِسُنَّةِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِي كِتَابِ اللَّهِ وَلَا فِي سُنَّةِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاقْضِ بِمَا قَضَى بِهِ الصَّالِحُونَ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِي كِتَابِ اللَّهِ وَلَا فِي سُنَّةِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَمْ يَقْضِ بِهِ الصَّالِحُونَ فَإِنْ شِئْتَ فَتَقَدَّمْ وَإِنْ شِئْتَ فَتَأَخَّرْ وَلَا أَرَى التَّأَخُّرَ إِلَّا خَيْرًا لَكَ وَالسَّلَامُ عَلَيْكُمْ
‘‘শুরাইহ বর্ণনা করেন তিনি উমার (রা)-এর নিকট কিছু জানতে চেয়ে পত্র লিখলেন। জবাবে উমার (রা) তাঁর কাছে লিখলেন: তুমি আল্লাহর কিতাবে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী বিচার ফায়সালা করবে। আর যদি আল্লাহর কিতাবে তা না থাকে তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ দ্বারা ফায়সালা করবে। আর যদি আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহতে তা না থাকে তাহলে ছালেহীনগণের রীতি অনুযায়ী ফায়সালা করবে। আর যদি আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহতে তা না থাকে এবং ছালেহীনগণও এ বিষয়ে কোন ফায়সালা না দিয়ে থাকেন, তাহলে ইচ্ছা করলে তুমি অগ্রসর হতেও পার আবার ইচ্ছা করলে পিছিয়েও আসতে পার। তবে পিছিয়ে আসাই আমি তোমার জন্য কল্যাণকর মনে করি। আস্সালামু আলাইকুম’’।
এভাবেই আমরা দেখতে পাই যে, উমার (রা) বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাত পাওয়ার পর তিনি তাঁর নিজস্ব মত পরিবর্তন করে সুন্নাতকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করে তার উপর আমল করেছেন এবং অন্যান্যদেরকেও সুন্নাহকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করে সে অনুযায়ী বিচার ফায়সালা করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ সকল ঘটনাবলী সুন্নাহকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে তাঁর শক্ত অবস্থানের প্রমাণ।
হযরত ‘উসমান (রা) এর অবস্থান:
সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব বলেন : আমি এক জায়গায় উসমানকে (রা) বসা দেখলাম । তিনি আগুনে রান্না করা কিছু খাবার আনতে বললেন এবং তিনি তা খেলেনে। তারপর তিনি সালাত আদায়ের জন্য উঠে গিয়ে সালাত আদায় করলেন। অতঃপর তিনি বললেন :
قعدت مقعد رسول الله صلى الله عليه وسلم وأكلت طعام رسول الله صلى الله عليه وسلم وصليت صلاة رسول الله صلى الله عليه وسلم.
""আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ন্যায় বসলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ন্যায় খাদ্য খেলাম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ন্যায় সালাত আদায় করলাম’’।
হযরত আলীর (রা) অবস্থানঃ
হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি কোন নবী নই। আমার কাছে ওহী আসেনা। কিন্তু আমি আমার সাধ্যমত আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ মুতাবিক "আমল করি।
তিনি আরো বলেনঃ
لو كان الدين بالرأى لكان باطن الخفين أحق بالمسح من ظاهرهما ولكني رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم يمسح على ظاهرهما .
ّদ্বীনের বিধানসমূহ যদি শুধুমাত্র যুক্তি নির্ভর হত তাহলে মোজার উপরের অংশের চেয়ে নিচের অংশ মাসাহ করাই ছিল অধিকতর যুক্তিযুক্ত। কিন্তু আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছি তিনি মোজার উপরের অংশেই মাসাহ করেছেন’’। (আল বাইহাকী)
হযরত আলী (রা) নিজের যুক্তি বুদ্ধিকে বাদ দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহর উপরে আমল করার ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে ছিলেন।
আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ (রা) এর অবস্থানঃ
হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ (রা) বলেন : কেউ যদি মুসলিম হিসেবে পরকালে আল্লাহর সাথে মিলিত হতে চায় তাহলে সে যেন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত সময়মত আদায় করে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য বিধান দিয়েছেন। আর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আল্লাহর একটি বিধান। আর আমি মনে করি তোমাদের প্রত্যেকেরই মাসজিদ রয়েছে যেখানে সে সালাত আদায় করে এবং বাড়িতেও সালাত আদায় করে। তোমরা যদি কেউ মাসজিদ ছেড়ে বাড়িতে সালাত আদায় কর তাহলে তোমরা তোমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ পরিত্যাগ করলে । আর তোমরা যদি তোমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সুন্নাহ ত্যাগ কর তাহলে অবশ্যই পথভ্রষ্ট হবে।
ইমাম আদ্ দারেমী বর্ণনা করেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন- তোমরা কিতাবুল্লাহর কোন বিষয় সম্পর্কে আমাদেরকে যা জিজ্ঞাসা কর তার জবাব দেব। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ বিষয়ক কোন কিছু জিজ্ঞাসা করলে তারও জবাব দেব। তবে তোমাদের নব সৃষ্ট বিষয় সম্পর্কে জবাব দেয়ার শক্তি আমাদের নেই।
হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) আরো বলেন : সুন্নাহর উপর আমল করার ইচ্ছা করা বিদ'আতের উপর আমল করার চেয়ে উত্তম। তিনি আরো বলেন : সর্বোত্তম কথা হ'ল আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম হেদায়েত হল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হিদায়েত। আর নিকৃষ্ট কাজ হল দ্বীনের ভিতরে নব আবিস্কৃত বিষয়সমূহ। আর তোমাদের জন্য যার ওয়াদা করা হয়েছে তা অবশ্যই আসবে। তোমরা কেউ বাধা দিতে পারবে না।
এভাবেই আমরা দেখতে পাই হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) সুন্নাহকে গ্রহণ করার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর অবসহানে ছিলেন। এ জন্যই তিনি বলেছেন : ولو تركتم سنة نبيكم لضللتم "" তোমরা যদি তোমাদের নবীর সুন্নাহ ত্যাগ কর তাহলে অবশাই প্রথভ্রষ্ট হবে।''
আব্দুল্লাহ ইবন ‘আববাস (রা) এর অবস্থান:
আল বাইহাকী ও আল হাকিম হিশাম ইবন জুবায়ের থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন : ত্বাউস আছরের পর দুরাকাত সালাত আদায় করতেন। ইবন আববাস (রা) তাকে বললেন : তুমি এ অভ্যাস ছেড়ে দাও। তিনি বললেন : আমি ছাড়বনা। ইবন আববাস (রা) আবার বললেন : এ সালাত ছেড়ে দাও। তিনি জবাব দিলেন : আমি ছাড়ব না। তখন ইবন আববাস (রা) বললেন : তুমি ঐ সালাত আদায়ের অভ্যাস ত্যাগ কর। কেননা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আছরের পর সালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন। আমি জানি না এ সালাত আদায়ের কারণে তোমাকে শাস্তিদেয়া হবে না তোমাকে প্রতিদান দেয়া হবে। কেননা আল্লাহ তা'আলা বলেছেন :
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ

‘‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল যখন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন তা গ্রহণ বা বর্জন করার কোন ইখতিয়ার কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর নেই’’। (আল-আহযাব : ৩৬)
ইমাম শাফি"ঈ বলেন : ইবন আববাস (রা) মনে করেন , তিনি ত্বাউসের উপরে দলীল কায়েম করেছেন । মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুন্নাহ দ্বারা এবং কিতাবুল্লাহ তিলাওয়াত করে এ বিষয়ে প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোন সিদ্ধান্ত দেন সে ব্যাপারে কারো কোন এখতিয়ার নেই।
ইবন উমারের (রা) অবস্থানঃ
খালিদ বিন উসাইদ আব্দুল্লাহ ইবন উমারকে (রা) বললেন : আমরা আল্ কুরআনে সালাতুল হাদার ও সালাতুল খাওফের বিধান পাই। কিন্তু মুসাফির অবস্থার সালাতের কোন বিধান তো কুরআনে পাই না । তখন ইবন উমার (রা) বললেন : ভাতিজা ! আল্লাহ তা‘আলা আমাদের কাছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন। আমরা কিছুই জানতাম না । আমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যেভাবে করতে দেখেছি, সেভাবেই করব। ইবন উমার (রা) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহকে হুবহু মেনে নেয়ার ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে ছিলেন । তাঁর উল্লেখিত বক্তব্য এর বড় প্রমাণ ।
ইবন উমার (রা) আরো বলেন : আমরা গোপনভাবে খবর সংগ্রহ করতাম এবং এটা কোন দূষনীয় বিষয় মনে করতাম না। অবশেষে এক রাফে বললেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোপনভাবে খবর সংগ্রহ করতে নিষেধ রেছেন। এ কারণেই আমরা তা ছেড়ে দিলাম। ইমাম শাফিঈ (রঃ) বলেন: ইবন উমার (রা) গোপনভাবে খবর সংগ্রহ করে উপকৃত হতেন এবং এটাকে হালাল মনে করতেন। যখনই তাকে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বরাত দিয়ে বর্ণনা দিলেন যে, তিনি এটা নিষেধ করেছেন। এটা জানার পর তাঁর পক্ষে আর গোপনভাবে খবর সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
এ ঘটনা থেকে এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয় যে, আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) সুন্নাহ পাওয়ার সংগে সংগেই তা গ্রহণ করতেন এবং সে মুতাবিক আমল করতেন। একবার ইবন উমার (রা) বললেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমরা রাতে মহিলাদের মাসজিদে যাওয়ার অনুমতি দেবে। একথা শুনে তাঁর ওয়াকিদ নামের এক ছেলে বললেন : তাহলে তারা তো এটা বিপর্যয় সৃষ্টির সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করবে। ছেলের মুখে এমন কথা শুনে ইবন উমার (রা) তার বুকে আঘাত করে বললেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথা বলছি, আর তুমি "না '' করছ ?
‘ইমরান ইবন হুছাইন (রা) এর অবস্থান:
একবার ‘ইমরান ইবন হুছাইন (রা) শাফা‘আত বিষয়ে আলোচনা করলেন। এক ব্যক্তি বললো : ওহে আবূ নাজিদ! আপনারা এমন সব হাদীছ আমাদের নিকট বর্ণনা করেন যার কোন ভিত্তি আমরা কুরআনে খুঁজে পাইনা। ‘ইমরান (রা) খুব রেগে গেলেন এবং লোকটিকে বললেন : তুমি কি কুরআন পড়েছ? লোকটি বললো : হাঁ পড়েছি। তিনি বললেন : তাতে কি ‘ইশার নামায চার রাক‘আত, মাগরিব তিন রাক‘আত, ফজর দু রাক‘আত ও আসর চার রাক‘আত পড়ার কথা পেয়েছ? সে বললো: না। ‘ইমরান প্রশ্ন করলেন : তাহলে এগুলো কোথায় পেলে? তোমরা কি এসব কিছু আমাদের নিকট থেকে এবং আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট থেকে গ্রহণ করিনি? তোমরা কি কুরআনের কোথাও পেয়েছ যে, চল্লিশটি ছাগলে একটি ছাগল, এতগুলো উটে এতটি উট এবং এত পরিমাণ দিরহামে এত দিরহাম যাকাত দিতে হবে? সে বলল : না। তাহলে এ বিষয়গুলো কার নিকট থেকে পেয়েছো? তোমরা কি আমাদের নিকট থেকে এবং আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট থেকে পাইনি? তোমরা আল্লাহকে তাঁর কিতাবে এ কথা বলতে শোননি : وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا ‘‘ রাসূল তোমাদেরকে যা দান করেছেন তা গ্রহণ কর এবং যা করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাক’’। (সূরা আল হাশর : ৭) অবশেষে ‘ইমরান বললেন : আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট থেকে বহু কিছু গ্রহণ করেছি, যার জ্ঞান তোমাদের নেই।
‘ইমরান ইবন হুছাইন (রা) উক্ত প্রশ্নকারী লোকটিকে বলেন: তুমি একটি নির্বোধ। যোহরের সালাত চার রাকাআত এবং উক্ত সালাতে ক্বিরাআত আস্তে আস্তে পড়তে হবে তুমি তা আল্ কুরআনের কোথায় পেয়েছ? তারপর তিনি যাকাত, হজ্জ ও অন্যান্য ইবাদাতের কথা উল্লেখ করে বললেন এগুলোর বিস্তারিত বিবরণ কি আল্লাহর কিতাবে পাওয়া যাবে? তারপর তিনি মন্তব্য করেন: إن كتاب الله أبهم هذا وأن السنة تفسرذلكআল্লাহর কিতাব এসব বিষয় অস্পষ্ট রেখেছে আর সুন্নাহ এগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছে।
‘ইমরান ইবন হুছাইন (রা) সুন্নাহকে আল্-কিতাবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাতে বুঝা যায় সুন্নাহ ছাড়া কুরআনের উপর আমল করা অসম্ভব। কাজেই সুন্নাহকে অস্বীকারকারী তাঁর দৃষ্টিতে নির্বোধ।
হযরত জাবির (রা) এর অবস্থানঃ
হযরত জাবির (রা) সুন্নাহকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণের মাপকাঠি মনে করতেন । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহর বাইরে কুরআনের কোন ব্যাখ্যা অথবা কোন ‘আমল তিনি করতেন না । হজ্জের বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন :
ورسول الله صلى الله عليه وسلم بين أظهرنا وعليه ينزل القران وهو يعرف تأويله وما عمل به من شيئ عملنا به ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মধ্যে ছিলেন। তাঁর উপর কুরআন নাযিল হচ্ছিল, তিনি তাঁর ব্যাখ্যাও জানতেন। তিনি যেটা যেভাবে ‘আমল করতেন আমরাও সেভাবে আমল করতাম।
হযরত জাবির (রা) এর বক্তব্য থেকে এ বিষয়টি আরো পরিষ্কার হলো যে, সাহাবায়ে কিরাম কুরআনের উপর ‘আমল করার ক্ষেত্রেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহর আশ্রয় গ্রহণ করতেন। তার কারণ আল-কুরআনের-কোন আয়াতের উপর কিভাবে ‘আমল করতে হবে তা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাস্তবে আমল করে দেখিয়ে দিয়েছেন। সাহাবায়ে কিরামগণ কখনো মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদর্শিত সুন্নাহ বাদ দিয়ে নিজেদের মনমত আমল করতেননা।
সুন্নাহকে দলীল হিসেবে গ্রহণের ক্ষেত্রে পরবর্তী মনীষীগণের অবস্থান:
আইম্মায়ে ফুকাহা, তাবি‘ঈন ও তাবে তাবে‘ঈনসহ বিভিন্ন যুগের মনীষীগণের মতামত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তাঁরা সকলেই সুন্নাহ ইসলামী শারী‘আতের দলীল হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন । সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করা ওয়াজিব হওয়ার বিষয় তাঁরা কেউই দ্বিমত পোষণ করেন নি। উদাহরণস্বরূপ আমি তাঁদের কিছু বক্তব্য তুলে ধরতে চাই যেগুলো সুস্পষ্ট প্রমাণ করে যে, সুন্নাহকে গ্রহণ করা এবং তদনুযায়ী আমল করার বিষয়ে তাঁরা খুবই শক্ত অবস্থানে ছিলেন।
আইউব আস-সিখতিয়ানী থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি প্রখ্যাত তাবে‘ঈ মুতারবিফ ইবনে ‘আবদিল্লাহ ইবন আস-শিখখীরকে বললো : আপনারা আমাদের নিকট কুরআন ছাড়া আর কিছু বর্ণনা করবেন না। মুতাররিফ তাকে বললেনঃ আল্লাহর কসম আমরা কুরআনের বিকল্প কিছু চাইনা। তবে আমরা আমাদের চেয়ে কুরআন বিষয়ে যিনি বেশি জ্ঞানী তাঁকে চাই। অর্থাৎ তাঁর কথাই তোমাদের নিকট উপস্থাপন করতে চাই।
আল্লামা আস্ সূয়ূতী (র.) বলেন:
إن من أنكر كون حديث النبي صلى الله عليه وسلم قولا كان أو فعلا بشرطه المعروف في الأصول ু حجة كفر ،وخرج عن دائرة الإسلام وحشر مع اليهود والنصارى أو مع من شاء الله من فرق الكفرة.
‘‘যে ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ (সুন্নাহ) তা কথা হোক বা কাজ এর হুজ্জাত দলীল হওয়াকে অস্বীকার করে সে কাফির হয়ে যায়। সে ইসলামের গন্ডি থেকে বেরিয়ে যায়। হাশরে সে ইহুদী, নাসারা অথবা আল্লাহ কাফিরদের যে উপদলের সাথে চান তাকে উঠাবেন । তবে শর্ত হলো, উছুলের ক্ষেত্রে সে হাদীস প্রসিদ্ধ হতে হবে।
এ প্রসংগে আল-আজিরী বলেন:
جميع فرائض الله التي فرضها في كتابه لا يعلم الحكم فيها إلا بسنن رسول الله صلى الله عليه وسلم .هذا قول علماء المسلمين ، من قال غير هذا خرج عن ملة الإسلام ودخل في ملة الملحدين .

‘‘আল্লাহর সকল ফারয যা তাঁর কিতাবে ফারয করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ ব্যতীত তার যথাযথ বিধান জানা যাবে না । এ হলো মুসলিম আলিমদের কথা । যারা এ ছাড়া অন্য কিছু বলে তারা ইসলামী মিল্লাত থেকে বের হয়ে গেছে এবং অবিশ্বাসীদের দলে ঢুকে গেছে।''
ইবন হাযম (রহ) বলেন:
وقال ابن حزم : لو أن امرأً قال : لا نأخذ إلا ما وجدنا في القرآن لكان كافراً بإجماع الأمة ، ولكان لا يلزمه إلا ركعة ما بين دلوك الشمس إلى غسق الليل ، وأخرى عند الفجر ؛ لأن ذلك هو أقلّ ما يقع عليه اسم صلاة ولا حد للأكثر في ذلك ، وقائل هذا كافر مشرك حلال الدم والمال ، وإنما ذهب إلى هذا بعض غالية الرافضة ممن قد اجتمعت الأمة على كفرهم.

ইবনে হাযম বলেনঃ ‘‘ যদি কোন ব্যক্তি বলে, আমরা কুরআনে যা কিছু পেয়েছি তাছাড়া অতিরিক্ত কোন কিছু গ্রহণ করবনা, তাহলে মুসলিম উম্মাহর ইজমা‘ মতে সে কাফির হয়ে যাবে। তার উপর সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত শুধু মাত্র এক রাক‘আত এবং ফজরের সময় আরেক রাক‘আত সালাত ফরজ হবে। কারণ সালাত শব্দ দ্বারা ন্যূনতম এটাই বুঝায়। এ ক্ষেত্রে বেশির কোন সীমা নেই । আর এমন কথা যে বলে সে কাফির ও মুশরিক। তাকে হত্যা করা ও তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা বৈধ। আর এমন চিন্তা ও মতের অনুসারী হয়েছে চরমপন্থী রাফিজীরা, যাদের কাফির হওয়ার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ইজমা‘ হয়েছে।

শাইখ বিন বায (রহ:) বলেন:
إن ما تفوّه به رشاد خليفة من إنكار السنة والقول بعدم الحاجة إليها كفر وردة عن الإسلام؛ لأن من أنكر السنة فقد أنكر الكتاب، ومن أنكرهما أو أحدهما فهو كافر بالإجماع، ولا يجوز التعامل معه وأمثاله، بل يجب هجره والتحذير من فتنته وبيان كفره وضلاله في كل مناسبة حتى يتوب إلى الله من ذلك ةوبة معلنة في الصحف السيارة، لقول الله عز وجل: { إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنْزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَى مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ أُولَئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا وَأَصْلَحُوا وَبَيَّنُوا فَأُولَئِكَ أَتُوبُ عَلَيْهِمْ وَأَنَا التَّوَّابُ الرَّحِيمُ }

‘‘রাশাদ খালীফা সুন্নাহের কোন প্রয়োজন নেই বলে যে মন্তব্য করেছেন তা কুফরী এবং ইসলাম পরিত্যাগমূলক কথা । কারণ যে সুন্নাহ অস্বীকার করে সে কিতাব অস্বীকার করে। আর যে এ দু‘টি জিনিস অথবা এর যে কোন একটি অস্বীকার করে সে ইজমার ভিত্তিতে কাফির। তার সংগে এবং তার মত অন্যান্যদের সাথে পারস্পরিক কোন রকম কাজ কর্ম বৈধ নয়। প্রতিটি উপলক্ষে তাকে পরিহার করা, তার এই ফিতনা সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করা, তার কুফরী ও পথ ভ্রষ্টতার কথা প্রচার করা ওয়াজিব। এ কাজ ততক্ষণ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তাওবা করে এবং পত্র পত্রিকায় তাওবার ঘোষণা দেয়। কারণ মহান আল্লাহ বলেন : ‘‘নিশ্চয় আমি মানুষের জন্য যে সব স্পষ্ট নিদর্শন ও পথ নির্দেশ নাযিল করেছি, কিতাবে তা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার পরও যারা তা গোপন রাখে আল্লাহ তাদেরকে লা‘নাত দেন এবং অভিশাপকারীগণও তাদেরকে অভিশাপ দেয়। কিন্তু যারা তাওবা করে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করে, আর সত্যকে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে এরা তারাই যাদের তাওবা আমি কবুল করেছি। আমি অতিশয় তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু’’ (আল বাক্বারা : ১৫৯-১৬০)।
তিনি আরো বলেন:
وقال أيضاً: من المعلوم عند جميع أهل العلم أن السنة هي الأصل الثاني من أصول الإسلام وأن مكانتها في الإسلام الصدارة بعد كتاب الله عز وجل، فهي الأصل المعتمد بعد كتاب الله عز وجل بإجماع أهل العلم قاطبة، وهي حجة قائمة مسةقلة على جميع الأمة، من جحدها أو أنكرها أو زعم أنه يجوز الإعراض عنها والاكتفاء بالقرآن فقد ضلّ ضلالاً بعيداً، وكفر كفراً أكبر وارتدّ عن الإسلام بهذا المقال، فإنه بهذا المقال وبهذا الاعتقاد يكون قد كذّب الله ورسوله، وأنكر ما أمر الله به ورسوله، وجحد أصلاً عظيماً فرض الله الرجوع إليه والاعتماد عليه والأخذ به، وأنكر إجماع أهل العلم عليه وكذب به ، وجحده.....

সকল জ্ঞানী ব্যক্তির এ কথা জানা যে, ইসলামের মৌলিক ভিত্তিসমূহের দ্বিতীয় মূল ভিত্তি হলো সুন্নাহ। কিতাবুল্লাহর পরে ইসলামে সুন্নাহর স্থান দ্বিতীয়। সকল জ্ঞানী ব্যক্তির ইজমা হয়েছে যে, কিতাবুল্লাহর পরে সুন্নাহই হলো নির্ভরযোগ্য ভিত্তি এবং সমগ্র উম্মাতের উপর স্বতন্ত্র হুজ্জাত বা দলীল । কেউ যদি অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করে অথবা উপেক্ষা করা সমীচীন মনে করে এবং কেবল কুরআনকেই যথেষ্ট মনে করে তাহলে সে মারাত্মকভাবে পথভ্রষ্ট হবে এবং এটা তার বড় ধরণের কুফরী কাজ হবে। সে তার এ কথার জন্য ইসলাম পরিত্যাগকারীদের মধ্যে গণ্য হবে। কারণ, সে তার এই কথা ও এই বিশ্বাসের দ্বারা আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করে এবং তারা যে নির্দেশ দিয়েছেন তা মানতে অস্বীকার করে। সে অস্বীকার করে একটা বিশাল মূল ভিত্তিকে যার দিকে প্রত্যাবর্তন ও যার উপর নির্ভর করা এবং অাঁকড়ে ধরা আল্লাহ ফারজ করেছেন । সে মুসলিম উম্মাহর ‘আলিমদের ইজমাকেও মানতে অস্বীকার করে।
কাজী শুরাইহ বলেন: إن السنة سبقت قياسكم , فاتبعوا ولا تبتدعوا فإنكم لن تضلوا ما تمسكتم بالأثر
‘‘নিশ্চয় সুন্নাহ তোমাদের কিয়াসের তুলনায় অগ্রগণ্য । সুতরাং তোমরা সুন্নাহর অনুসরণ কর । মনগড়া আমল করোনা । কেননা তোমরা যতক্ষণ সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরে থাকবে ততক্ষণ পথ ভ্রষ্ট হবে না।
আবুল ‘আলিয়াহ বলেন ঃوعليكم بسنة نبيكم صلى الله عليه وسلم والذي كان عليه أصحابه ‘‘ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ ও সাহাবায়ে কিরামের পথ অনুসরণ করা তোমাদের উপর ওয়াজিব।’’
ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এবং ইমাম শাফি‘ঈ (রহ.) ও অন্যান্য ইমামগণ থেকে বর্ণিত: إذا صح الحديث فهو مذهبي ‘‘যখনই ছহীহ হাদীছ (সুন্নাহ) পাওয়া যাবে ঐ হাদীছ অনুযায়ী ‘আমল করাই আমার মাযহাব।
ইমাম শাফি‘ঈ (রহ.) আরো বলেন :
أجمع المسلمون على أن من استبانت له سنة رسول الله صلى الله عليه وسلم لم يكن له أن
يدعها لقول أحد من الناس
‘‘মুসলিমগণ এ ব্যাপারে একমত হয়েছে যে, কেউ যদি স্পষ্টভাবে জানতে পারে যে, এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ, তাহলে কোন মানুষের কথার বিত্তিতে তা ত্যাগ করার অধিকার তার নেই।’’
কাজী শুরাইহ বলেন :إن السنة سبقت قياسكم ، فاتبعوا ولا تبتدعوا فإنكم لن تضلوا ما تمسكتم بالأثر
নিশ্চয় সুন্নাহ তোমাদের কিয়াসের তুলনায় অগ্রগণ্য । সুতরাং তোমরা সুন্নাহর অনুসরণ কর । মনগড়া আমল করোনা । কেননা তোমরা যতক্ষণ সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরে থাকবে ততক্ষণ পথভ্রষ্ট হবে না।
ইমাম ইবনুল কাইয়েম (রহ.) বলেন :
إذا صح عن رسول الله صلى الله عليه وسلم دون معارضة أو نسخ , أن الفرض علينا وعلى الأمة جميعا الأخذ بالحديث وترك ما يخالفه.
যখন কোন হাদীছ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হবে যে, এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদীছ তখন আমাদের ও সমস্ত উম্মাতের উপর ওয়াজিব হলো ঐ সুন্নাহ গ্রহণ করা এবং এর বিপরীত সকল কিছু পরিত্যাগ করা।
মোটকথা সাহাবায়ে কিরাম, তাবি‘ঈন, তাবে‘তাবি‘ঈন এবং আইম্মায়ে ফুকাহাগণের বক্তব্যের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় তাঁরা সবাই সুন্নাহ ইসলামী শারী‘আতের দলীল হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। সুন্নাহকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করে তার উপর ‘আমল করা ওয়াজিব বলেছেন। পূ্র্ববর্তী যুগের উলামায়ে কিরাম এবং পরবর্তী যুগের উলামায়ে কিরামের কেউই এ ব্যাপারে দ্বিমত করেন নি।
সুন্নাহ দলীল হওয়ার ব্যাপারে সংশয় ও তার নিরসন
শারী‘আতের উৎস হিসেবে সুন্নাহর অপরিহার্যতা ও এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্যের বিষয়ে আলোচনার পর এ ব্যাপারে কিছু সংশয়বাদীদের প্রসঙ্গে আলোচনা করতে চাই।
মুসলিম উম্মাহকে দ্বীন থেকে ফিরিয়ে রাখার জন্য কতিপয় নামধারী পন্ডিত ইসলামের মূল উৎস হিসেবে সুন্নাহকে অস্বীকার করে । তারা সাধারণ মানুষকে সংশয়ে ফেলার জন্য কিছু যুক্তির অবতারণা করে । তাদের সে সকল যুক্তি ও তার জবাব নিম্মে প্রদত্ত হলো:
এক. আল¬াহ তা‘আলা বলেন : مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ ‘‘ আমি আল্-কিতাবে (কুরআনে) কোন কিছুই বাদ দেইনি''।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ
‘‘আমি মুসলিমদের জন্য সকল বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ, পথ নির্দেশ, রহমত ও সুসংবাদ স্বরূপ তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি’’।
উপরোক্ত আয়াতদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত হয় যে আল্-কুরআন দ্বীনের সকল বিষয়, সকল হুকুম-আহকাম ধারণ করেছে এবং এমনভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছে যে তা বুঝার জন্য সুন্নাহর মত কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই। অন্যথায় আল-কিতাব অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এবং সব কিছুরই বর্ণনাও সেখানে পাওয়া যাবে না । আর তা হবে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের ঘোষণার পরিপন্থী । যা কোনভাবেই সম্ভব নয় । অতএব, আল-কুরআন ছাড়া সুন্নাতে রাসূলের কোন কিছুই তালাশ করা বা তার উপর ‘আমল করার কোন প্রয়োজন নেই ।
জবাব : আল-কুরআনের এক আয়াতের ব্যাখ্যা আরেক আয়াতের দ্বারা করতে হয়। আল্লাহ তা‘আলা অপর এক আয়াতে বলেছেন : وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ ‘‘ এবং (হে নবী ) ! আমি এ যিকর তোমার উপর এ জন্য নাযিল করেছি, যেন তুমি লোকদের সামনে তাদের উদ্দেশ্যে যা নাযিল করা হয়েছে তা ব্যাখ্যা বিশ্নেষণ করতে পার’’।
উপরোক্ত আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপরে এ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল যে, তিনি আল-কুরআনে বর্ণিত হুকুম আহকাম ও পথ নির্দেশনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দান করবেন। কোন কিতাবের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুধু ঐ কিতাব পাঠ করলেই হয়ে যায় না । বরং মূল পাঠের অতিরিক্ত এমন কিছু বর্ণনা করতে হয় যেন শ্রোতা সহজেই তা বুঝতে পারে। আর কিতাবের কোন বক্তব্য ব্যবহারিক কোন বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত হ‘লে ভাষ্যকার তা বাস্তবে ‘আমল করে বুঝিয়ে দেবেন যে, গ্রন্থকারের মূল উদ্দেশ্য এভাবে কাজ করা। আর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহর মাধ্যমে সে কাজটিই করেছেন। সুতরাং একথা বলার কোন সুযোগ নেই যে, শুধু কুরআনেই সব কিছুর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সহকারে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। উপরোক্ত সংশয় উপস্থাপনকারীদের কথা মেনে নিলে কিতাবের সাথে কিতাব বাস্তবায়নকারী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঠানোর বিষয়টিও একটি অপ্রয়োজনীয় বিষয় বলতে হবে। যা কোন সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষ কল্পনাও করতে পারে না।
অপর দিকে ইমাম কুরতুবী (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন :
ما تركنا شيئا من أمر الدين إلا وقد دللنا عليه في القرآن، إما دلالة مبينة مشروحة، وإما مجملة يتلقى بيانها من الرسول عليه الصلاة والسلام، أو من الإجماع، أو من القياس الذي ثبت بنص الكتاب.
‘‘আমি দ্বীনের কোন কিছুই বাদ দেইনি সব কিছুরই নির্দেশনা আল-কুরআনে দিয়েছি। সেই নির্দেশনা হয় ব্যাখ্য-বিশ্লেষণসহ স্পষ্টভাবে অথবা সংক্ষিপ্তভাবে, যার ব্যাখ্যাও বর্ণনা পাওয়া যাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে অথবা ইজমা‘ বা কিয়াস থেকে যা কিতাব দ্বারা প্রমাণিত’’।
অর্থাৎ আল-কুরআনুল কারীম দ্বীনের মৌলনীতি ও সাধারণ বিধি-বিধানের ভিত্তিসমূহ ধারণ করেছে । তার কিছু স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে আর কিছুর ব্যাখ্যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য ছেড়ে দিয়েছে। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠিয়েছেন মানুষের নিকট দ্বীনের হুকুম-আহকাম বর্ণনা করার জন্য এবং তাদের উপর রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনুগত্য ওয়াজিব করা হয়েছে, তাই তাঁর হুকুম-আহকামের বর্ণনা ও ব্যখ্যা বিশ্লেষণ মূলতঃ কুরআনেরই ব্যাখ্যা । তাই ইসলামী শারী‘আতের যাবতীয় বিধি-বিধান যা কুরআন সুনলাহ এমন কি ইজমা-কিয়াস থেকে উদ্ভূত সবই আসলে কুরআন থেকে উৎসারিত । হয় প্রত্যক্ষ না হয় পরোক্ষভাবে । সুতরাং কুরআন تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ ( সব কিছুর স্পষ্ট ব্যাখ্যা) হওয়া এবং সুন্নাহর হুজ্জাত বা দলীল হওয়ার মধ্যে কোন বিরোধ নেই।
অনেকে মনে করেন : مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ এ আয়াতে উল্লেখিত الْكِتَابِ এর অর্থ আল-কুরআন নয়। বরং এর অর্থ হলো লাওহে মাহফুজ । কারণ লাওহে মাহফুজই সৃষ্টিকুলের ছোট-বড়, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সবিস্তারে সব কিছুই ধারণ করে আছে । যেমন-রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :جف القلم بما هو كائن إلى يوم القيامة ‘‘কিয়ামাত পর্যন্ত কি ঘটবে না ঘটবে তার বিস্তারিত বর্ণনাসহ কলম লিপিবদ্ধ করে ফেলেছে’’।
তাদের যুক্তি খন্ডনার্থে আমাদের আরেকটি জবাব হলো যে, সূরা আল্-আন‘আম মাক্কী সূরা। এ সূরাটি যখন নাযিল হয় তখন কুরআনের সামান্য অংশই নাযিল হয়েছিল। অনেক সূরা, অনেক আয়াত এবং দ্বীনের অনেক মূলনীতি মদীনায় নাযিল হয়েছে। তার পরে পূর্ণ হয়েছে। তাহলে মক্কায় নাযিল হওয়া এ আয়াতে উল্লেখিত الْكِتَابِ এর অর্থ আল-কুরআন হয় কি করে? কারণ তখনো তো আল-কুরআনে অনেক কিছুই ছিলনা। বিশেষ করে ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক জীবনের বিধানসমূহ যথা-মীরাছ, ওছিয়াত, বিবাহ-তালাক ইত্যাদি মদীনায় নায়িলকৃত আয়াত দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুন্নাহর মাধ্যমে তার
বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। সুতরাং উল্লেখিত আল-কিতাব অর্থ কুরআন নয়, লাওহে মাহফুজ।
দ্বিতীয় আয়াত تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍসম্পর্কে এ কথা বলা যা যে, সূরা আন নাহল মাক্কী সূরা এ আয়াতটিও মাক্কী । তখনও শারী‘আতের বিধি-বিধানের অনেক কিছুই নাযিল হয়নি। তাহলে আয়াতে উল্লেখিত আল-কিতাব এর অর্থ আল-&কুরআন বলা সঙ্গত হয় কি করে ?
তা ছাড়া تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ দ্বারা শরী‘আতের যাবতীয় শাখা-প্রশাখা জাতীয় আহকামের বিস্তারিত বিবরণ বুঝায়না বরং এ দ্বারা বিশেষ অর্থও বুঝায় । যেমন আল্লাহ বলেন : تُدَمِّرُ كُلَّ شَيْءٍ بِأَمْرِ رَبِّهَا ‘‘আল্লাহর নির্দেশে সব কিছু ধ্বংস করে দেবে। এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ‘আদ জাতি ও তাদের বাসস্থান সমূহ ধ্বংসের কথা বলেছেন। অথচ আয়াতে এসেছে كُلَّ شَيْءٍ সব কিছু। এখানে যেমন নির্দিষ্ট ও বিশেষ অর্থে كُلَّ شَيْءٍ বলা হয়েছে তেমনি আলোচিত আয়াত দু‘টিতেও كُلَّ شَيْءٍ বিশেষ অর্থে ব্যবহ্নত হয়েছে।
সাহাবায়ে কিরামের (রা.) ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে । তাঁরা ছিলেন ফসীহ তথা বিশুদ্ধ আরবী ভাষী। যেখানে পরবর্তীকালে ‘আলিমগণের কুরআন ব্যাখ্যার জন্য আরোও বহু সহায়ক জ্ঞানের প্রয়োজন হয় সেখানে তাঁদের কোন কিছুর প্রয়োজন ছিলনা। তা সত্ত্বেও তাঁরা বহু আয়াতের ব্যাখ্যার জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুখাপেক্ষী ছিলেন। যেমন- وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْم ‘‘আর তাদের ঈমানকে যুলমের সাথে মিশ্রিত করেনি’’(আল আন‘আম:৮২)। এ আয়াতে যুলম অর্থ শিরক; حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ ‘‘যতক্ষন না কালো সূতা থেকে কালো সূতা পৃথক হয়’’(আল-বাকারা:১৮৭)। এ আয়াতে সাদা সূতা ও কালো সূতা অর্থ দিনের ঔজ্জল্য ও রাতের অন্ধকার; وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى عِنْدَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى ‘‘সিদরাতুল মুনতাহার নিক&&ট তাকে দ্বিতীয়বার দেখলেন’’(আন-নাজম:১৩-১৪)। এ আয়াতে উল্লেখিত সিদরাতুল মুনতাহার নিকটবর্তীসহানে দ্বিতীয়বার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাকে দেখেন তিনি ছিলেন জিবরীল (আ:)أَوْ يَأْتِيَ بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ ‘‘অথবা তোমার রবের কোন নিদর্শন আসবে’’(আল-আন‘আম:১৫৮)। সে নিদর্শন হলো পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া ; ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ ‘‘আল্লাহ দৃষ্টান্ত পেশ করছেন পবিত্র কালিমা পবিত্র গাছের ন্যায়’’(ইবরাহীম:২৪)। এ আয়াতে গাছ অর্থ খেজুর গাছ; يُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ ‘‘আল্লাহ অবিচল রাখেন ঈমানদারগণকে সুদৃঢ় কথা দ্বারা দুনিয়ার জীবনে এবং আখিরাতে’’(ইবরাহীম:২৭)।এ আয়াতে আখিরাত অর্থ কবরে যখন প্রশ্ন করা হবে- তোমার রব কে এবং তোমার দ্বীন কি ?
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ ‘‘আহলি কিতাবগণ তাদের আহবার ও রুহবানকে তাদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে’’(আত তাওবা:৩১)। এর অর্থ তাদের জন্য যা হালাল করা হয়েছিল তা তারা হারাম এবং যা তাদের জন্য হারাম করা হয়েছিল তা তারা হালাল ঘোষণা করে আর এই আহলি কিতাবগণ তাই অনুসরণ করে; لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَى وَزِيَادَةٌ ‘‘যারা ভালো কাজ করে তাদের জন্য রয়েছে শুভ পরিণাম এবং আরও অতিরিক্ত’’(ইউনুস:২৬)। এ আয়াতে উল্লেখিত অতিরিক্ত অর্থ আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের মুখমন্ডলের প্রতি দৃষ্টিপাত করা ।
এ ধরণের বহু আয়াত আছে যা কেবল আরবী ভাষায় দক্ষতা থাকলেই জানা যাবে না। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি তা বলে না যেতেন তাহলে আমরা অন্ধকারেই থেকে যেতাম।
সুতরাং সুন্নাহ হলো কুরআনের সংক্ষিপ্ত কথার ব্যাখ্যা। কুরআনে আরো বলা হয়েছে: وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ ‘‘ছালাত কায়েম কর, যাকাত আদায় কর’’ (আল বাকারা : ৪৩); يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ ‘‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোযা ফরজ করা হয়েছে’’(আল বাকারা : ১৮৩); وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا ‘‘সামর্থবান লোকদের উপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে বাইতুল্লাহর হজ্জ করা-ফরজ’’(আলে ‘ইমরান : ৯৭ ) ইত্যাদি। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথা ও কাজের দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন যে, রাতদিনে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফারয, তিনি ছালাতের রাক‘আত সংখ্যা, শর্ত ও রুকনসমূহ বর্ণনা করেছেন । তিনি বলেছেন :صلوا كما رأيتموني أصلي ‘‘তোমরা আমাকে যেভাবে ছালাত আদায় করতে দেখ সেভাবে ছালাত আদায় কর’’। তিনি আরো বলেছেন ঋতুবতী অবস্থায় আদা কাযা কোনভাবেই ছালাত প্রযোজ্য নয়। এভাবে তিনি যাকাতের প্রকৃতি, কার ওপর ওয়াজিব, তার নিসাব এবং বস্ত্তভেদে তার পরিমাণ কত ইত্যাদি বর্ণনা করেছেন । এভাবে ছাওম ও হাজ্জের নিয়ম পদ্ধতি ও কার্যাবলী বাস্তবে করে দেখিয়েছেন ।
وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُوا أَيْدِيَهُمَا ‘‘পুরুষ চোর ও নারী চোর উভয়ের হাত কেটে দাও’’(আল মায়েদা : ৩৮)। সুন্নাহর মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি যে, সিকি দীনারের কম চুরি করলে হাত কাটা যাবে না এবং হাত কোথা থেকে কাটা হবে তাও আমরা সুন্নাহর মাধ্যমে জানতে পারি। সুতরাং সুন্নাহ ত্যাগ করলে আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা আমরা এ সকল বিধান জানতে পারতাম না। তাই কুরআন বুঝার জন্য সুন্নাহকে উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই।
দুই. তাদের দ্বিতীয় যুক্তি হ‘লো আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের বাণীঃ إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ ]
‘‘ আমি যিকর নাযিল করেছি এবং অবশ্যই আমিই তার সংরক্ষক। এ আয়াতে যিকর অর্থ কুরআন । এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন, সুন্নাহর নয় । সুন্নাহও যদি কুরআনের মত হুজ্জাত ও দলীল হ‘তো তাহলে আল্লাহ তা‘আলা সুন্নাহর সংরক্ষণের দায়িত্বও গ্রহণ করতেন।

জবাবঃ আল্লাহ তা‘আলা ইসলামী শারী‘আতের সকল কিছুরই সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন-কিতাব ও সুন্নাহ উভয়েরই। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী : يُرِيدُونَ أَنْ يُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَيَأْبَى اللَّهُ إِلَّا أَنْ يُتِمَّ نُورَهُ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ
‘‘তারা তাদের মুখের ফুৎকার দিয়ে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নূরকে পূর্ণতা দান করবেনই । যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে’’। এখানে আল্লাহর নূর অর্থ আল্লাহর দ্বীন ও শারী‘আত । যা তার বান্দার জন্য আল্লাহ তা‘আলা মনোনীত করেছেন । এবং তাদের উপযোগী বিধি-বিধান দিয়েছেন । তাঁর রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাছে ওহীর মাধ্যমে পাঠিয়েছেন তা কুরআন হোক বা সুন্নাহ । যা পালনের মধ্যেই ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ নিহিত রয়েছে । আর আয়াতে উল্লেখিত لَهُ এর অর্থের ব্যাপারে ‘উলামায়ে কিরামের দু‘ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়- (ক) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম । তাহলে এ আয়াত দ্বারা সুন্নাহ অস্বীকার করার কোন সুযোগ থাকেনা। (খ) যিকর অর্থ যদি শারী‘আত বুঝানো হয়ে থাকে তাহলেও এ আয়াত দ্বারা তাদের মতের স্বপক্ষে দলীল গ্রহণের সুযোগ নেই। আর যদি যিকর এর অর্থ আল-কুরআন বুঝানো হয় তাহলেও এর অর্থ এটা বুঝায় না যে, আল্লাহ শুধুমাত্র কুরআন হিফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন। কারণ কুরআন ছাড়াও আল্লাহ তা‘আলা অনেক কিছুরই হিফাযত করেন । যেমন- আল্লাহ তা‘আলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কাফিরদের ষড়যন্ত্র থেকে হিফাযত করেছেন, কিয়ামাত পর্যন্ত সময়ের জন্য ‘আরশ, আসমান ও যমিনকে ধ্বংস হওয়া থেকে হিফাযত করবেন। ঠিক তেমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের সাথে সাথে কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকারী সুন্নাহকেও হিফাযত করেছেন।
অপর দিকে আল্লাহ তা‘আলার বাণী : فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ ‘‘তোমরা যদি না জানো তাহলে শারী‘আতের বিষয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা কর’’।(আন-নাহল : ৪৩) এ আয়াতে أَهْلَ الذِّكْرِ এর অর্থ আল্লাহর দ্বীন ও শারী‘আত বিষয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি। আর এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাাহ তা‘আলা যেভাবে কুরআন সংরক্ষণ করেছেন সেভাবেই সংরক্ষণ করেছেন তাঁর রাসূলের সুন্নাহকেও। তিনি এমন অসংখ্য নিবেদিত প্রাণ মানুষ তৈরী করেছেন যাঁরা তাঁদের বক্ষে ও স্মৃতিতে তাঁদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ অত্যন্ত সততার সাথে সংরক্ষণ করেন, পরবর্তী প্রজন্মের নিকট পৌঁছে দেন, নিজেদের মধ্যে পঠন-পাঠন জারী রাখেন। তার মধ্যে অনুপ্রবেশকারী ভেজাল থেকে তার বিশুদ্ধতা রক্ষা করেন। এ কাজে তাঁরা তাঁদের জীবন বিলিয়ে দেন। তাঁরা তাঁদের নবীর সূন্নাহ সংরক্ষণ ও বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য যে শ্রম ও সাধনা নিয়োজিত করেন তার কোন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্য কোন জাতি-গোষ্ঠি উপস্থাপন করতে পারে নি। অতঃপর এভাবেই সকল সুন্নাহ গ্রন্থাবদ্ধ হয়। হাদিস বিশেষজ্ঞগণ বিশেষতঃ ইমাম শাফি‘ঈ (রহ.) বলেন: সকল ‘আলিমই মনে করেন সুন্নাহ সবই বিদ্যমান আছে। কোন কিছুই হারিয়ে যায়নি। হতে পারে তা ব্যক্তি বিশেষের কাছে বেশি বা কম আছে । তবে তাদের সবগুলো একত্র করলে সবই সংরক্ষিত দেখা যায়। প্রত্যেকের সংরক্ষিত সুন্নাহ পৃথক করলে সকলের নিকটই তা ঘাটতি দেখা যাবে। সে ক্ষেত্রে একজনের নিকট যা নেই তা অন্যের নিকট পাওয়া যাবে।
সুতরাং আমরা নিঃসন্দেহে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, ছালাত, যাকাত, হাজ্জ, ছাওম, পারস্পরিক আদান-প্রদান আচরণ ও আবশ্যকীয় কর্মকান্ডসমূহে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহর কোন কিছুই হারিয়ে যায়নি। তাঁর জীবনযাপন প্রণালী ও তাঁর বাণীর সবকিছুই লিখিত আকারে সংরক্ষিত আছে।
ইমাম ইবন হাযম সুন্নাহ বিরোধীদের ধারণা- আয়াতে উল্লেখিত যিকর অর্থ কেবলমাত্র আল-কুরআন, খন্ডন করে বলেন :
هذه دعوى كاذبة مجردة عن البرهان و تخصيص للذكر بلا دليل .
‘‘যিকর এর অর্থ আল-কুরআন বলে নির্দিষ্ট করা কোন প্রকার দলীল প্রমাণ ছাড়া কেবলই একটি মিথ্যা দাবী’’। কেননাالذكر এমন একটি বিশেষ্য যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর যা কিছু নাযিল করেছেন সবই বুঝায়। তার মধ্যে কুরআন ও সুন্নাহ উভয়টিই বিদ্যমান। কারণ, সুন্নাহর মাধ্যমে তিনি কুরআনের ব্যাখ্যা করেছেন । আর সেটিও ওহী । তাছাড়া আল্লাহ তা‘আলা তো বলেছেন: وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন ব্যাখ্যার জন্য আদিষ্ট হয়েছেন। আর কুরআনে বহু সংক্ষিপ্ত বিধান এসেছে যেমন : ছালাত, যাকাত, হাজ্জ ইত্যাদি বিষয়। এ আদেশগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কী তা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ব্যাখ্য ছাড়া জানতে পারিনা। আর কুরআনের এ সকল সংক্ষিপ্ত বিধানের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক ব্যাখ্য যদি সংরক্ষিত ও নিরাপদ না থাকে তাহলে কুরআন দ্বারা মানব জাতির কল্যাণ লাভের উদ্দেশ্য অসম্ভব হবে। এভাবে শারী‘আতের অধিকাংশ বিধান অসারতায় পর্যবসিত হবে। সুতরাং যিকর দ্বারা কেবল কুরআন অর্থ নেয়া শুদ্ধ ও সঠিক হবেনা।
তিন. তাদের তৃতীয় যুক্তি হলো সুন্নাহ যদি সত্যই হুজ্জাত হতো তাহলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবশ্যই তা লিখে রাখার নির্দেশ দিতেন। তাঁর পরে সাহাবা ও তাবি‘ঈন কিরাম তা সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধকরণে উদ্যোগী হতেন। তাতে তা ভুলে যাওয়া, ভুল করা ইত্যাদি সন্দেহ থেকে মুক্ত থাকতো এবং সন্দেহাতীত অবস্থায় সঠিকভাবে তা মানুষের নিকট পৌঁছতো। কারণ সন্দেহযুক্ত জিনিস দ্বারা দলীল পেশ করা যায়না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার অনুসরণ করোনা’’। আল্লাহ তা‘আলা আরোও বলেন: إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ ‘‘ তারা তো শুধু কল্পনারই অনুসরণ করে’’। আর লেখা ছাড়া সুন্নাহর অকাট্যতা প্রমাণিত হয়না। যেমন আল-কুরআনের ক্ষেত্রে হয়েছে।
পক্ষান্তরে একথাও প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা লিখতে নিষেধ করেছেন। এমনকি যারা কিছু লিখেছিলেন তা মুছে ফেলতে নির্দেশ দেন। সহাবী ও তাবি‘ঈন কিরামও এমন করেছেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এরূপ নির্দেশ প্রদান, সাহাবায়ে কিরাম ও তাবি‘ঈনগণের এরূপ কার্যকলাপ প্রমাণ করে যে, সুন্নাহ অকাট্যভাবে সংগৃহীত ও লিপিবদ্ধ থাকুক তা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই চাননি আর তাঁর এরূপ ইচ্ছাই প্রমাণ করে যে, সুন্নাহ শারী‘আতের দলীল নয়।
জবাব : যে সকল হাদীছ দ্বারা বুঝা যায় সুন্নাহ বা হাদীছ লেখার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন নির্দেশ দেননি অথবা নিষেধ করেছেন , তাতে কিন্তু সুন্নাহ হুজ্জাত বা দলীল না হওয়া প্রমাণিত হয়না; বরং এর কারণ হলো তখন মুষ্টিমেয় কিছু লোক লিখতে জানতেন তাঁরা যেন কেবলমাত্র কুরআন লেখার কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাদের সে লেকাতে যেন অন্য কিছুর সংমিশ্রণ না ঘটে এবং মুসলিমগণ যেন কুরআন হিফাযত ও সংরক্ষণে একনিষ্ঠভাবে নিয়োজিত থাকে। তাছাড়া হাদীছ শাস্ত্রের ইতিহাস অধ্যয়নে জানা যায় . রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন লেখার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা ছিল সরকারী ফরমান। হাদীছের ব্যাপারে তেমন সরকারী নির্দেশ ছিলনা। তবে বেসরকারীভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় ও পরবর্তীকালে অনেকে হাদীছ লিপিবদ্ধ করেছেন। অবশেষে ‘উমার ইবন ‘আবদিল ‘আযীয (রহ) হাদীছ লেখার জন্য সরকারী ফরমান জারী করেন। দলীল প্রমাণ হওয়া কেবলমাত্র লেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সুতরাং এ যুক্তি সঠিক নয় যে, সুন্নাহ যদি দলীল হতো তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা লেখার নির্দেশ দিতেন। দলীল হয় অনেক কিছুর ভিত্তিতে যেমন: মুতাওয়াতির হওয়া, ন্যায়পরায়ণ বিশ্বস্তবর্ণনাকারীদের মাধ্যমে বর্ণিত হওয়া. লিপিবদ্ধ হওয়া ইতাদি। এমনকি কুরআনের ক্ষেত্রেও তা কেবল লেখার উপর নির্ভর করা হয়নি বরং সাহাবায়ে কিরাম প্রত্যেকটি আয়াত স্মৃতিতে ধারণ করেছেন এবং অন্যদের নিকট তা পৌছে দিয়েছেন। আর লেখার চেয়ে মুখস্থকরণ কোন অংশে কম নয়। বিশেষত: আরব জাতি যারা তাদের প্রখর স্মৃতিশক্তির জন্য কিংবদন্তীতুল্য, যাদের স্মৃতিশক্তির ব্যাপারে বহু বিস্ময়কর কাহিনী ইতিহাসের পাতায় ছড়িয়ে আছে, তাঁদের স্মৃতিতে সংরক্ষিত বিষয়ের যথার্থতা নিয়ে তো কোনরকম প্রশ্নই উঠতে পারেনা।
চার. তাদের চতুর্থ যুক্তি হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এমন কিছু বাণী বর্ণিত হয়েছে যা দ্বারা বুঝা যায় যে, সুন্নাহ হুজ্জাত ও দলীল নয়। যেমন তিনি বলেন: إن الحديث سيفشو عني فما أتاكم عني يوافق القرآن فهو عني وما أتاكم عني يخالف القرآن فليس عني
‘‘অদূর ভবিষ্যতে আমার নামে হাদিছ ছড়িয়ে পড়বে কুরআনের সামঞ্জস্যশীল যা তোমাদের কাছে পেঁŠছাবে তা হবে আমার আর, যা কুরআন বিরোধী হবে তা আমার নয়।’’
সুতরাং বর্ণিত যে সুন্নাহ দ্বারা নতুন কোন শর‘ঈ বিধান প্রমাণিত হবে, তা অবশ্যই কুরআনের মুওয়াফিক হবে না। আর যদি নতুন কোন বিধান না দেয় তাহলে তা হবে কেবলই তাকীদ তখন কুরআনই হবে মূল দলীল ও হুজ্জাত ।
এ প্রসঙ্গে আরো ব©র্ণত আছে:
" إِذَا حُدِّثْتُمْ عَنِّي حَدِيثًا تَعْرِفُونَهُ وَلَا تُنْكِرُونَهُ، فَصَدِّقُوا بِهِ، قُلْتُهُ، أَوْ لَمْ أَقُلْهُ فَإِنِّي أَقُولُ مَا يُعْرَفُ، وَلَا يُنْكَرُ، وَإِذَا حُدِّثْتُمْ عَنِّي حَدِيثًا تُنْكِرُونَهُ وَلَا تَعْرِفُونَهُ، فَكَذِّبُوهُ، فَإِنِّي لَا أَقُولُ مَا يُنْكَرُ "
‘‘যখন আমার থেকে কোন হাদিছ তোমাদের নিকট বর্ণনা কর হয় যা তোমরা জানো এবং তোমরা অস্বীকার কর না, সে হাদীছ আমি বলি বা না বলি তোমরা তা বিশ্বাস করবে। কারণ , আমি পরিচিত এ্বং অস্বীকার করা হয়না এমন কথাই বলি। আর যখন আমার নামে তোমাদের কাছে এমন কোন হাদীছ বর্ণনা করা হয় যা তোমরা জানো না, সে হাদীছ আমি বলে থাকি বা না বলি, তোমরা তা বিশ্বাস করবে না। কারণ, যা অপরিচিত ও অস্বীকার করা হয় এমন কথা আমি বলিনা।
এ হাদীছ দ্বারা বুঝা যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে যা কিছু বর্ণনা করা হবে তা মুসলমানদের নিকট পরিচিত আল্লাহর হুকুমের সাথে মিলানো ওয়াজিব। সুতরাং সুন্নাহ শারী‘আতের কোন হুজ্জাত নয় মূল উৎস আল কুরআন। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আরেকটি বাণী:
إِنِّى لاَ أُحِلُّ إِلاَّ مَا أَحَلَّ اللَّهُ فِى كِتَابِهِ وَلاَ أُحَرِّمُ إِلاَّ مَا حَرَّمَ اللَّهُ فِى كِتَابِهِ

‘‘আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে যা কিছু হালার করেছেন তা ছাড়া আমি আর কিছু হালাল করিনি এবং আল্লাহ তার কিতাবে যা কিছূ হারাম করেছেন তাছাড়া আর কিছু আমি হারাম করিনা। অতএব কুরআনই হলো শারী‘আতের মূল উৎস, সুন্নাহ নয়।
জবাব : বর্ণিত হাদীছের জবাব নিম্নরূপঃ
إن الحديث سيفشو عني فما أتاكم عني يوافق القرآن فهو عني وما أتاكم عني يخالف القرآن فليس عني
এ হাদীছ সর্ম্পকে ইবনে হাযম আল ইহকাম গ্রন্থে এবং আসসূয়ূতী (রহ:) মিফতাহুল জান্নাহ গ্রন্থে ইমাম বাইহাকীর সূত্রে বর্ণনা করে বলেন : এ হাদীছটি মুনকাতা‘। কারণ এর একজন বর্ণনাকারী খালিদ অজ্ঞাত ব্যক্তি এবং আবু জাফর সাহাবী নন।
ইমাম শাফি‘ঈ (রহ:) বলেন : এটি একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির সূত্রে বর্ণনা। কোন ক্ষেত্রেই আমরা এ ধরণের বর্ণনা গ্রহণ করিনা।
ইবনু ‘আব্দিল বার তার জামি‘ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন: আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী বলেন, যিনদীক ও খারিজীগণ এ হাদীছ বানিয়েছে।
ইমা্ম বাইহাকী (রহ:) বলেন : কুরআনের বিপরীতে হাদীছ উপস্থাপনের ব্যাপারে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা ভিত্তিহীন। তা নিজেই বাতিল বলে প্রমাণিত। অতএব কুরআনের বিপরীতে হাদীছ দাঁড় করানো কুরআন দ্বারা প্রমাণিত নয়।
মোটকথা, ‘আলিমগণ এব্যাপারে একমত যে, সহীহ সুন্নাহ কখনো কিতাবুল্লাহর পরিপন্থী হবে না। কোন বর্ণনায় যদি এমনটি দেখা যায় তাহলে তা পরিত্যাজ্য।
দ্বিতীয় হাদীছ :
" إِذَا حُدِّثْتُمْ عَنِّي حَدِيثًا تَعْرِفُونَهُ وَلَا تُنْكِرُونَهُ، فَصَدِّقُوا بِهِ، قُلْتُهُ، أَوْ لَمْ أَقُلْهُ فَإِنِّي أَقُولُ مَا يُعْرَفُ، وَلَا يُنْكَرُ، وَإِذَا حُدِّثْتُمْ عَنِّي حَدِيثًا تُنْكِرُونَهُ وَلَا تَعْرِفُونَهُ، فَكَذِّبُوهُ، فَإِنِّي لَا أَقُولُ مَا يُنْكَرُ "
হাদীছটির সনদ দুর্বল। ইবনে হাযম বলেছেন, এটি একটি মুরসাল হাদীছ এবং বর্ণনাকারী আলআসবাগ একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি। হাদীছটি যে মিথ্যা ও বানোয়াট তা فَصَدِّقُوا بِهِ، قُلْتُهُ، أَوْ لَمْ أَقُلْه কথা দ্বারা বুঝায়। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো নিজের সর্ম্পকে মিথ্যা বর্ণনার অনুমতি দিতে পারেন না। মুতাওয়াতির হাদীছে এসেছে-
مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ
‘‘যে ইচ্ছাকৃত ভাবে আমার উপর মিথ্যা আরোপ করবে সে যেন জাহান্নামে তার স্থান বানিয়ে নেয়।’’
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কথা বলেননি তা তাঁর প্রতি আরোপ করে যিনদীক ও কাফির ছাড়া কোন মুসলিম বর্ণনা করতে পারেনা।
তৃতীয় হাদীছ : إِنِّى لاَ أُحِلُّ إِلاَّ مَا أَحَلَّ اللَّهُ فِى كِتَابِهِ وَلاَ أُحَرِّمُ إِلاَّ مَا حَرَّمَ اللَّهُ فِى كِتَابِهِ
এ হাদীছ প্রসঙ্গে ইমাম শাফি‘ঈ (রহ:) বলেছেন এ একটি মুনকাতা‘ হাদীছ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনি করেছেন। আললাহ যা আদেশ করেছেন তিনি তা বাস্তবায়ন করেছেন। ইমাম আল বাইহাকী বলেন : হাদীছটির মূল বক্তব্যে فِى كِتَابِهِকথাটি যদি সঠিক হয় তাহলে তার অর্থ হবে আল্লাহ তাঁর প্রতি যা কিছু ওহী করেছেন। আর ওহী দু’প্রকার ১. ওহী মাতলূ ২. ওহী গায়রে মাতলু। সুতরাং এ ক্ষেত্রে হাদীছ সুন্নাহকে অস্বীকার কারীদের দলীল হবে না। কারণ, কিতাব অর্থ কেবল কুরআন নয় সুন্নাহও এর অন্তর্ভুক্ত। এভাবে সুন্নাহ অস্বীকারকারীদের উপস্থাপিত হাদীছগুলো যদি একটি একটি করে পর্যালোচনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে একটি হাদীছও তাদের মত ও যুক্তির পক্ষে দলীল হতে পারেনা।
উপসংহার : পরিশেষে বলতে চাই, সুন্নাহর দলীল হওয়াকে অস্বীকার করা ও এ দাবি করা যে ইসলাম শুধু কুরআন দ্বারাই সাব্যস্ত এমন কথা কোন মুসলিম বলতে পারেনা। এটা বাস্তবতা পরিপন্থী একটি কথা। কেননা দ্বীন ও শারী‘আত সর্ম্পকে যার ন্যূনতম জ্ঞান আছে তিনিও জানেন শারী‘আতের অধিকাংশ হুকুম সুন্নাহ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। কুরআন যে বিধান সংক্ষিপ্তাকারে পেশ করেছে সুন্নাহ তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে। সুতরাং সুন্নাহকে অস্বীকার করার অর্থই হলো আল-কুরআনকে অস্বীকার করা। আর আল-কুরআনকে অস্বীকারকারী মুসলিম থাকতে পারেনা। আল্লাহ আমাদেরকে ও গোটা মুসলিম সমাজকে এ ধরণের ফিতনা থেকে হিফাযত করুন। আমীন।

وَصَلَّى اللَّهُ عَلَى نَبِيِّنَا مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِِهِ وَأَصْحَابِهِ أَجْمَعينَ

 


---০---

 

. ইবনুল মানজুর, লিসানুল আরব, বৈরুত: দারু ইহইয়াউত্ তুরাছিল আরাবী, ২য় সংস্করণ, ১৯৯৩ ইং, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৯৯ ।
. আবদা’ ‘আলী মিহাননা, লিসানুললিসান, বৈরুত: দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ,১৯৯৩ইং, ১ম খন্ড , পৃষ্ঠা-৬৩২।
. লিসানুল ‘আরব, ১৩শ খন্ড, পৃষ্ঠা - ২২০।
. সূরা আলে ‘ইমরান : ১৩৭।
. সূরা আন নিসা : ২৬।
. সূরা আল আনফাল : ৩৮।
. সূরা আল হিজ্বর : ১২-১৩।
. সূরা আল ইসরা : ৭৭।
. সূরা আল কাহাফ : ৫৫।
. সূরা আল আহযাব : ৩৮।
. সূরা আল আহযাব : ৬২।
. সহীহ মুসলিম, আল মাকতাবাতুশ শামিলাহ ,২য় সংস্করণ, বাবু মান সান্না সুন্নাতান হাসানাতান, হাদীছ নং ৪৮৩০।
. সহীহ আল বুখারী, বাবু মা যুকিরা ‘আন বানি ইসরাইল , হাদীছ নং ৩১৯৭।
. আল মুয়াত্তা ইমাম মালিক, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৩১৩, হাদীছ নং-৩৩৩৮।
. সুনানু ইবন মাজাহ, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৫৯২।
. সুনানু আবি দাউদ, বাব ফী লুযুমিস্সুন্নাহ, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-৩২৯, হাদীছ নং- ৪৬০৯।
. ড. মুহাম্মদ আবদুল মাবুদ, সুন্নাতু রাসুলিল্লাহ (সা), ঢাকা: বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ১ম সংস্করণ, পৃষ্ঠা-১৫।
. ড, মুস্তাফা আস-সিবা‘ঈ, আস-সুন্নাহ ওয়া মাকানাতুহা ফীত তাশরী‘ আল ইসলামী, কায়রো : দারুস-সালাম, ৩য় সংস্করণ, ২০০৬ ইং, পৃষ্ঠা- ৫৭।
. আল্লাহ তা‘আলা বলেন- لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ ‘‘নিশ্চয় রাসুলুল্লাহর জীবনের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ’’। সূরা আল আহযাব : ২১।
. সহীহ আল-বুখারী, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা-৪, হাদীস নং- ৩।
. ড. ওহবাহ আয্যুহাইলী, উছুলুল ফিকহিল ইসলামী, দামেশক : দারুল ফিকÿ, ৩য় সংস্করণ, ২০০৫ইং, পৃষ্ঠা-৪৩২।
. সহীহ আল-বুখারী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩।
. সহীহ আল-বুখারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৭৩২।
. সহীহ আল-বুখারী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩২১।
. ড. মুস্তাফা আস-সিবা‘ঈ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৫৭।
. সুনানুত তিরমিযী, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৪, হাদিছ নং- ২৬৭৬।
. ড. মুহাম্মদ আদ্দুল মা‘বুদ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৮।
. ড. মুহাম্মাদ রুহুল আমিন, আস-সুন্নাহ ওয়া ‘আলাকাতুহা বিল কুরআনিল কারীম, ঢাকা : মা‘হাদ বাংলাদেশ লিলফিকরিল ইসলামী, ১ম সংস্করণ, ২০০৮ইং, পৃষ্ঠা-৩৩।
. সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদুদী, সুন্নাতে রাসূলের আইনগত মর্যাদা, ঢাকা : শতাব্দী প্রকাশনী, ৩য় সংস্করণ, ২০০৪ ইং, পৃষ্ঠা-৩২।
. সূরা আশ-শু‘আরা : ১৯২-১৯৫।
. আল্লাহ তা‘আলা বলেন- وَإِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِنْ مِثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَاءَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا وَلَنْ تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ
আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা এর অনুরূপ কোন সূরা তৈরী করে আন য়দি তোমরা সত্যবাদী হও। তবে আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সকল সাহায্যকারীকে আহবান কর। যদি তোমরা তৈরী করতে না পার, আসলে কখনও তৈরী করতে পারবে না, তাহলে সে আগুনকে ভয় কর, মানুষ ও পাথর হবে যার ইন্ধন, যা কাফিরদের জন্য প্রস্ত্তত করে রাখা হয়েছে। (সূরা আল বাকারাহ : ২৩-২৪)
. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ থেকে কোন কথা বলেননি। তিনি যা বলতেন সবই ওহী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন -
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى
‘‘তিনি মনগড়া কোন কথা বলেন না। এ তো ওহী যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়।’’ ( সূরা আন-নাজম : ৩-৪)
. ইবনুস সালাহ , উলুমূল হাদীছ, দামেশক : দারুল ফিকহ, ৩য় সংস্করণ, ১৯৮৪ ইং ,পৃষ্ঠা- ১৯।
. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
من قرأ حرفا من كتاب الله فله به حسنة والحسنة بعشر أمثالها لا أقول آلم حرف ولكن ألف حرف ولام حرف وميم حرف
যে ব্যক্তি কিতাবুল্লাহর একটি অক্ষর পাঠ করবে তার জন্য এর বিনিময়ে রয়েছে নেকী। প্রত্যেকটি নেকী দশগুণ করে দেয়া হবে। আমি এ কথা বলিনা যে, আলিফ-লাম-মীম একটি অক্ষর বরং আলিফ একটি অক্ষর লাম একটি অক্ষর মীম একটি অক্ষর। (ইমাম তিরমিযি ইবন মাসউদ থেকে বর্ণনা করেন। হাদীছ নং-২৯১০)
. আল্লাহ তা‘আলা বলেন- فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآَنِ সুতরাং কুরআনের যতটুকু পাঠ করা তোমাদের জন্য সহজ ততটুকু পাঠ কর। (সুরা আল-মুয্যাম্মিল : ২০)
. সূরা আন-নাহল : ৯।
. সূরা আন্ নাহল : ৪৪।
. সূরা আলে ইমরান : ৩১-৩২।
. সূরা আলে ইমরান : ১৩২।
. সুরা আন-নিসা : ১৩।
. সুরা আন-নিসা : ৫৯।
. সুরা আন-নিসা : ৬৫।
. সুরা আল-আনফাল : ১।
. সুরা আন-নিসা : ৬৯।
. সূরা আন-নূর : ৫২।
. সূরা আল-আনফাল : ২০।
. সূরা আন-নূর : ৫৪।
. সূরা আল-আহযাব : ২১ ।
. সূরা আন-নিসা : ৮০।
. সুরা মুহাম্মাদ : ৩৩।
. সূরা আন-নূর : ৬৩।
. সুরা আল-আহযাব : ৩৬।
. সুনানু ইবনু মাজাহ, বাবু ইত্তিবা‘ই সুন্নাতি রাসূলিল্লাহ, হাদীছ নং-১।
. ইবন মাজাহ, হাদীছ নং -২; সুনানুত তিরমিযি, বৈরুত : দারুল ফিকর, ৩য় সংস্করণ, ১৯৭৮ইং, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠ্-১৫২।
. ইবন মাজাহ, হাদীছ নং -৩।
. সুনানু আবি দাউদ, মিসর : মুসত্মফা আল বাবি আলহালবী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৭৯।
. আল কুরতুবী, আল-জামি‘ লি আহকামিল কুরআন, বৈরূত : দারু ইহইয়ায়িত তুরাছিল ইসলামী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৮।
. সুনানু ইবন মাজাহ, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা-৬।
. আস সুয়ূতি, আবু বকর আবদুর রহমান, মিফতাহুল জান্নাহ, মদীনা আল মুনাওয়ারাহ : আল জামি‘আতুল ইসলামিয়্যাহ. ৩য় সংস্করণ, পৃষ্ঠা- ৯।
. মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আবু শুহবাহ , দিফা‘উন ‘আনিস সুন্নাহ, কায়রো : মাকতাবাতুস সুন্নাহ, প্রথম সংস্করণ, ১৯৮৯ ইং. পৃষ্ঠাু ১৫।
. মিফতাহুল জান্নাহ, পৃষ্ঠা-১২।
. সুনানুত তিরমিযী, হাদীছ নং- ২৬৭৬, বাব আল আখযু বিস্সুন্নাহ।
. সুনানু আবি দাউদ, বাবু ইজতিহাদুর রায় ফিল ক্বাদা, হাদীছ নং-৩৫৯৪।
. মাফাহীম ইসলামিয়্যাহ, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা - ১৮৭&
. আল ফিকহ ওয়াশ শারী‘আহ, ১ম খন্ড, পৃঃ-৩৬।
. ড. ওয়াহবাহ আয যুহাইলী, উছুলুল ফিকহিল ইসলামী, দামেশক :দারুলফিকর, ৩য় সংস্করণ,২০০৫,পৃঃ-৪৪২।
. সূরা আন-নাহল : ৪৪।
. সূরা আল- মায়িদা : ৬।
. সূরা আল-বাকারাহ : ১৮৭।
. সূরা আল-মায়িদাহ : ৪।
. সূরা আন- নিসা : ১১।
. সূরা আন-নিসা : ২৩।
. সূরা আন-নিসা : ৩।
. সূরা আলে- ইমরান : ৯৭।
. দ্রষ্টব্য. সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী, সুন্নাতে রাসূলের আইনগত মর্যাদা, (ঢাকা : শতাব্দি প্রকাশনী, ৩য় সংস্করণ, ২০০৪ইং) , পৃষ্ঠা- ৭৭-৭৯।
. সূরা আলে-ইমরান : ১৬৪।
. দেখুন আস-সুন্না্হ ওয়া মাকানাতুহা, পৃষ্ঠা-৫৯-৬০।
. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ৬০।
. সূরা আল-আ‘রাফ : ১৫৭।
. আস-সুন্না্হ ওয়া মাকানাতুহা : পৃষ্ঠা- ৬০।
. সূরা আল হাশর : ৭ ।
. সূরা আল আন‘আম : ৮২।
. সহীহ আল বুখারী, খন্ড ১১, পৃৃষ্ঠা-১৪৭
. ড. মুহাম্মাদ মুস্তাফা আল আ‘যামী, দিরাসাতুন ফিল হাদীছিন নাবাবী ওয়া তারিখু তাদবীনিহ, বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৯৮৫ইং, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠাু ১৫।
. মুসনাদে আহমাদ , ১মখন্ড, পৃষ্ঠা -৬।
. সুনানুন নাসাঈ, কিতাবু মানাসিকিল হাজ্জ, হাদীছ নং- ২৮৮৯।
. সুনানু নাসাঈ, বাবু আলহুকমু বি ইত্তিফাকি আহলিল ইলম, হাদীছ নং- ৫৩০৪; আল-ফিকহ ওয়াশশারী‘আহ,
. আস্সুন্নাহ ওয়া ‘আলাকাতুহা বিল কুর-আনিল কারীম, পৃষ্ঠা- ৮৬।
. হুজ্জিয়াতুস সুন্নাহ, পৃষ্ঠা- ৩৪৮।
. মুসনাদে আহমাদ, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃঃ- ১৬৬
. হুজ্জিয়াতুস্ সুন্নাহ, পৃঃ- ৩৫০
. হুজ্জিয়াতুস্ সুন্নাহ, পৃঃ- ৩৫৬
. মিফতাহুল জান্নমণাহ, পৃঃ ৩১-৩২
. সালাতুল হাদার হলো মুকীম অবস্থার সালাত এবং সালাতুল খাওফ হলো যুদ্ধের ময়দানের সালাত।
. মুয়াত্তা মালিক, ১ম খন্ড , পৃঃ ১৪৫; সুনান ইবন মাজাহ, ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৩৯ ; ইবনে কাছীর, আলবিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ্, ৫ম খন্ড, পৃঃ ১৫৩; সুনান নাসাঈ, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৯৬
. মিফতাহুল জান্নমণাহ, পৃঃ ৩২
সুন্নাতু রাসুলিল্লাহ, পৃঃ- ৫৭।
. আল মাকদাসী, কিতাবুল ইলম, দামেশক, দারুল কুতুব আজজাহিরিয়্যাহ, পৃঃু ৫১; ইবন আবদিল বার, জাফি বয়সিল ইলম ওয়া ফাদলিহি, মিসর, ইদারাতু মাকতাবাতুল মুনিরিয়্যাহ, পৃঃ ১৯১।
. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং-১২১৮
. সুন্নাতু রাসুলিল্লাহ, পৃঃ ৫৭।
. সুন্নাতু রাসুলিল্লাহ, পৃঃ ৫৯&
. ‘উছমান বিন মু‘আল্লিম, শুবহাতুল কুরআনিয়্যীন, পৃঃ ২০
. প্রাগুক্ত।
. শুববাহাতুল কুরআনিয়্যীন, পৃঃ ২২।
. প্রাগুক্ত।
. হুজ্জিয়াতুস সুন্নাহ, পৃঃ ৩৫৯।
. দিরাসাত ফিল হাদীছ আননাবাভী, ১মখন্ড, পৃঃ-১৯।
. আস্সুন্নাহ ওয়া ‘আলাকাতুহা বিল কুরআনীল কারীম, পৃঃ- ৯০।
. সুন্নাতু রাসুলিল্লাহ,পৃষ্ঠা-৬১।
. হুজ্জিয়াতুস সুন্নাহ, পৃঃ- ৩৫৯।
. আস্সুন্নাহ ওয়া ‘আলাকাতুহা বিল কুরআনীল কারীম, পঃ- ৯৪।
. সূরা আল আন‘আমঃ ৩৮
. সূরা আন-নাহলঃ ৮৯
. দিফাউন ‘আনীম সুন্নাহ, পৃঃ ৩৯৭
. আন-নাহল-৪৪
. কুরতুবী, আল জামি‘ লি আহকামিল কুরআন, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃঃ ৪২০
. সুন্নাতু রাসুলিল্লাহ, পৃঃ ৫৪
. দিফা‘উনআনিস সুন্নাহ, পৃঃ ৩৯
. ‘আবদুর রাজ্জাক ‘আফীফী,শুবহাত হাওলাস্সুন্নাহ, সৌদি ‘আরব: ওযারাতুল আওকাফ,১ম সংস্করণ, ১৪২৫হিঃ, পৃঃ-১৫।
. সূরা আল আহকাফঃ ২৫
. শুবহাত হাওলাস সুন্নাহ, পৃঃ ১৪-১৫; সুন্নাতু রাসুলিল্লাহ, পৃঃ ৫৫
. সুন্নাতু রাসুলিল্লাহ-৫৬
. সূরা আল হিজরঃ ৯
. সূরা আততাওবাহঃ ৩২
. দিফা‘উন ‘আনিস সুন্নাহ, পৃঃ- ৪০৩-৪০৪।
. সুন্নাতু রাসুলিল্লাহ, পৃঃ- ৬৫।
. প্রাগুক্ত পৃঃ- ৬৬।
. সূরা আল ইসরা : ৩৬।
. সূরা আল আন‘আম : ১১৬।
. দিফা‘উন ‘আনিস সুন্নাহ, পৃঃ-৪০৬।
. সুন্নাতু রাসুলিল্লাহ, পৃঃ-৭৭।
. দিফা ‘উন ‘আনিস্সুন্নাহ, পৃঃ- ৪৮৯।
. আস্সুন্নাহ ওয়া মাকানাতুহা, পৃ: ১৫৪; দিফা‘উন ‘আনিস সুন্নাহ, পৃ: ৪৮৯।
. দিফা‘উন ‘আনিস সুন্নাহ, পৃ: ৪৯১।
. আস্সুন্নাহ ওয়া মাকানাতুহা, পৃ: ১৬১।
. দিফা‘উন ‘আনিস সুন্নাহ, পৃ: ৪৯১।
. আস্সুন্নাহ ওয়া মাকানাতুহা, পৃ: ১৬১।