সূচীপত্র

ভূমিকা
অমুসলিমদের প্রকারভেদ
ক. যিম্মী
খ. মু‘আহদ
গ. মুস্তা’মান
ঘ. হারাবী
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের স্থায়ী নাগরিকত্ব লাভের পদ্ধতিঃ
ক. চুক্তি
কাদের সাথে নাগরিকত্বের চুক্তি করা যাবে
চুক্তির শর্তাবলী
খ. সন্তুষ্টিজ্ঞাপক কার্যকলাপ
1. ইসলামী রাষ্ট্রে দীর্ঘ দিন বসবাস করা
2. মুসলিম কিংবা যিম্মীর সাথে হারাবী মহিলার বিয়ে
3. খারাজী জমি ক্রয় করা
গ. অপরের অনুবর্তন
1. ছোট ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী
2. ছিন্নমূল শিশু
ঘ.বিজিত এলাকায় অস্ত্র সংবরণ
অমুসলিম নাগরিকদের অধিকারসমূহঃ
1. জীবন-মাল-ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা
2. স্বাধীনভাবে বসবাস, চলাফেরা ও বিচরণের অধিকার
3. ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা
4. জীবিকা উপার্জন ও চাকুরীর অধিকার
5. অর্থনৈতিক কারবার পরিচালনার সুবিধা
6. জমির মালিকানা ও ব্যবহারের নিরঙ্কুশ অধিকার
7. পারিবারিক আইনে বিচারের অধিকার
8. ভোটাধিকার
9. বাকস্বাধীনতা
10. শিক্ষার অধিকার
ব্যতিক্রমধর্মী বিষয়সমূহঃ
ক. রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের পদ
খ. মজলিসে শূরা বা আইনসভা
গ. দেশ রক্ষার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি
ঘ. মদ ও শুকরের ব্যবসা
ঙ. ক্ষতিপূরণ দান
চ. মুসলিমকে কাজে নিয়োগ করা
ছ. অমুসলিমদের সাক্ষ্য
জ. অমুসলিমের বিয়ে
ঝ. অমুসলিমের যব্হকৃত প্রাণি ভক্ষণ
ঞ. স্বতন্ত্র বেশ-ভূষা

অমুসলিমদের ওপর আরোপিত বিশেষ করসমূহঃ
ক. জিয্ইয়া ( নিরাপত্তা কর)ঃ
খ. খারাজ ( ভূমি কর)ঃ
গ. ‘উশুর (বাণিজ্যিক কর)ঃ
‘উশুর আদায়ের শর্তাবলী :
1. নিসাব পূর্ণ হওয়া
2. বাণিজ্য পণ্যের স্থানান্তর
3. বাণিজ্য পণ্যের এক বছর কাল স্থায়িত্ব
4. ঋণমুক্ত হওয়া
অমুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ কর্মকান্ডঃ
ক. ইসলাম ও মুসলিম সম্পর্কে অযাচিত মন্তব্য
খ. মুসলিম জনপদে প্রকাশ্যে মদ ও শুকরের ব্যবসা
গ.অন্যায়- অশ্লীলতা
অমুসলিমের অপরাধ ও শাস্তির বিধানঃ
ক. হদ্দ জাতীয় অপরাধের শাস্তি
খ. কিসাস জাতীয় অপরাধের শাস্তি
গ. সাধারণ অপরাধের শাস্তি
পাবলিক কোর্টে বিচার
অমুসলিমদের নাগরিকত্ব নষ্টের কারণ
অমুসলিমদের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মহানুভবতাঃ
ক. শত্রুদের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ক্ষমা ও মহানুভবতা
খ. হাদিয়া আদান-প্রদান
গ. কুশলাদি জানা ও দেখা সাক্ষাত করা
ঘ. আতিথেয়তা
ঙ. বেচাকেনা ও লেনদেন করা
চ. অমুসলিমদের অধিকার আদায়ের নির্দেশ
ছ. অমুসলিমদের সাথে সদ্ভাব প্রতিষ্ঠার নির্দেশ
অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণে মুসলিম শাসকগণের ভূমিকা
অমুসলিম গবেষক ও চিন্তাবিদদের মতামত
উপসংহার

 

 

 

 

 


بسم الله الرحمن الرحيم

ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা
ড. আহমদ আলী
ভূমিকা
ইসলামী রাষ্ট্র একটি জনকল্যাণমূলক আদর্শবাদী রাষ্ট্র। এর ধরন ও প্রকৃতি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চাইতে অনেকাংশে ভিন্ন। ইসলামের শাশ্বত আদর্শ ও মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। এ আদর্শ ও মূলনীতির প্রতি কার বিশ্বাস ও আস্থা আছে আর কার নেই - এ হিসেবে ইসলামী রাষ্ট্র তার নাগরিকদেরকে মুসলিম ও অমুসলিম দু শ্রেণীতে ভাগ করে থাকে। রাষ্ট্রের যে সব নাগরিক ইসলামের আদর্শ ও মূলনীতির প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখে- তারাই এর নীতি নির্ধারক ও প্রধান কার্য নির্বাহী হিসেবে ভূমিকা পালন করবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে যে সব নাগরিকের ইসলামের আদর্শ ও মূলনীতির প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা নেই, ইসলামী রাষ্ট্র তাদের শরী‘আত প্রদত্ত অধিকার ও মর্যাদা দিতে বাধ্য। এ সকল অধিকার কেড়ে নেয়ার বা খর্ব করার ইখতিয়ার কারো নেই।
পক্ষান্তরে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোন সুনির্দিষ্ট আদর্শ ও মূলনীতি নেই। শাসকবর্গ কিংবা আইনসভার সদস্যদের মর্জিমত দেশ পরিচালিত হয়। তাই এ ধরনের ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে মুসলিম ও অমুসলিমরূপে বিভক্ত করার প্রয়োজন পড়ে না এবং যে কেউ রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক ও প্রধান কার্যনির্বাহী হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে আদর্শহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কাগজে-কলমে রাষ্ট্রের সকল নাগরিককে এক জাতি আখ্যায়িত করে সমান মর্যাদা ও অধিকারের কথা বলা হলেও কার্যত তা কখনো বাস্তবায়িত হয় নি, ভবিষ্যতেও কখনো হবে কি না তা বলা দুষ্কর। এ শুধু কথার বাগাড়ম্বর। এখানে জাতি, বর্ণ ও দলগত পার্থক্য প্রবলভাবে মাথাচড়া দিয়ে ওঠে। সংখ্যাগুরু কর্তৃক সংখ্যালঘুরা বরাবরই অবহেলা, বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার হয়। এ জন্য প্রখ্যাত রাজনীতি বিজ্ঞানী গধপরাবৎ বলেন, উবসড়পৎধপু রং ধ ভড়ৎস ড়ভ মড়াবৎহসবহঃযধঃ রং হবাবৎ পড়সঢ়ষবঃবষু ধপযরবাবফ. -‘‘ গণতন্ত্র এমন একটি সরকার ব্যবস্থা, যা কখনো পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।’’
বর্তমানে জোরেশোরে প্রচার করা হয় যে, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংখ্যালঘুদেরকে সমানাধিকার ও মর্যাদা দান করে, আর ইসলাম এ ব্যাপারে সংকীর্ণতার পরিচয় দেয়। আর এ কারণেই অমুসলিমরা ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী শাসনের কথা শুনলেই আতঙ্কিত হয়। আবার তাদের অনেকেই দাবী জানাতে থাকে যে, সকলের সমানাধিকার নিশ্চিত করার জন্য ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা উচিত। এটা দীর্ঘ কাল ধরে ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের ফল। তবে এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় যে, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে অমুসলিমদের সার্বিক নিরাপত্তা, অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার সবচেয়ে বড় নিশ্চয়তা এ রাষ্ট্রগুলোকে পরিপূর্ণ ও নির্ভেজাল ইসলামী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা ছাড়া আর কোনভাবে দেয়া সম্ভব নয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সত্যনিষ্ঠ খালীফাগণের যুগে অমুসলিমরা ঠিক মুসলিমদের মতোই ধর্ম, সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে নাগরিক সমঅধিকার ভোগ করত। তাদের জীবন, ধন-সম্পদ, ইজ্জত-আব্রু ও ধর্ম রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপর ন্যস্ত ছিল। তাঁরা অমুসলিমানদের স্ব স্ব ধর্ম পালনে স্বাধীনতা দান করেন এবং স্ব স্ব সংস্কৃতির সেবার অবাধ অধিকার প্রদান করেন। কিন্তু পরবর্তী রাজতন্ত্রের যুগে কোথাও কোথাও তাদের প্রতি অবিচার করা হয় এবং তাদের অধিকার রক্ষার গুরুত্ব হ্রাস পায়। উমাইয়াহ আমলে স্বয়ং মুসলিমদেরকেই শাসকদের গোলাম হয়ে থাকতে হয়েছিল, সে ক্ষেত্রে অমুসলিমদের অধিকার খর্ব হওয়া বিচিত্র কিছু ছিল না। কিন্তু হযরত ‘উমার ইবন ‘আবদুল ‘আযীয (রা.) খালীফা নির্বাচিত হবার পর যখন ইসলামকে হুজরা থেকে বের করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করেন, তখন অমুসলিমরা পুনরায় তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পায়। তিনি অমুসলিমদের রক্তের মূল্য মুসলিমদের রক্তমূল্যের সমান বলে ঘোষণা করেন। তিনি শাহী খান্দানের লোকদের নিকট থেকে অন্যায়ভাবে অধিকৃত যমীনগুলো ফেরত নেন এবং অন্যায়ভাবে বেদখল হওয়া যমীনে তাদের দখল দান করেন।
অমুসলিমদের প্রকারভেদঃ
দেশের বাইরের ও ভেতরের অমুসলিমদেরকে ইসলামী রাষ্ট্রে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যথা-
ক. যিম্মী
যিম্মীরা হল ইসলামী রাষ্ট্রের স্থায়ী অমুসলিম নাগরিক। মুসলিমদের মতো তারাও রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকে। ইসলামী রাষ্ট্রে তাদের জান-মাল-ইজ্জত-আব্রু ঠিক মুসলিম নাগরিকদের জান-মাল-ইজ্জত-আব্রুর মতোই মূল্যবান ও পবিত্র বিবেচিত হয়। ‘যিম্মাহ’ শব্দের অর্থ দায়িত্ব, নিরাপত্তা, অধিকার। ইসলামের পার্থিব আইন-কানুন মেনে নেয়া এবং জিয্ইয়া আদায় করার শর্তে ইসলামী রাষ্ট্র অমুসলিম নাগরিকদের জান-মাল-ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তার দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করে বলে তাদেরকে যিম্মী বলা হয়।
খ. মু‘আহদ
মু‘আহদ অর্থ চুক্তিবদ্ধ। মু‘আহদরা হল দারুল হারবের চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম। সাময়িকভাবে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে আবদ্ধ অমুসলিমদেরকে আহলুল ‘আহদ বা মু‘আহাদূন বলা হয়। মু‘আহদদের সাথে চুক্তি অনুযায়ী আচরণ করা ওয়াজিব, যে পর্যন্ত তারা চুক্তির শর্তসমূহ মেনে চলবে। চুক্তি স্থির হয়ে যাবার পর তা পালন করতে গিয়ে সামান্য পরিমাণও হেরফের করা যাবে না। উভয় পক্ষের অবস্থান, শক্তি ও ক্ষমতায় যতই পরিবর্তন এসে থাক না কেন। ইসলাম এটাকে হারাম মনে করে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,لعلكم تقاتلون قوما فتظهرون عليهم فيتقونكم بأموالهم دون أنفسهم و أبنائهم , (قال سعيد في حديثه : فيصالحونكم على صلح ثم اتفقا) হ فلا تصيبوا منهم شيئا فوق ذلك ؛ فإنه لا يصلح لكم. -‘‘ সম্ভবত তোমরা কোন জাতির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে, বিজয়ীও হবে এবং সে জাতি নিজেদের ও নিজের সন্তান-সন্ততির প্রাণ রক্ষার্থে তোমাদের মুক্তিপণ দিতে চাইবে (সা‘ঈদ (রা.)-এর বর্ণনায় রয়েছে, তারা তোমাদের সাথে কোন চুক্তি সম্পাদন করবে), তাহলে তোমরা নির্ধারিত মুক্তিপণ কিংবা চুক্তির বাইরে সামান্য পরিমাণও বেশি নেবে না। কেননা সেটা তোমাদের জন্য বৈধ হবে না।’’ এ হাদীস থেকে জানা যায় যে, চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমদের সাথে চুক্তিপত্রে যে সব শর্ত নির্ধারিত হবে, তাতে কোন ধরনের হেরফের করা যাবে না, তাদের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপানো যাবে না। তাদের জমিজমাও দখল করা যাবে না। তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতায়ও হস্তক্ষেপ করা যাবে না। তদুপরি তাদের সাথে এমন কোন আচরণ করা যাবে না, যা যুলম, অধিকারহরণ, সামর্থ্যের মাত্রাতিরিক্ত বোঝা চাপানো অথবা সম্মতি ব্যতিরেকে সম্পদ হস্তগত করার পর্যায়ে পড়ে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,ألا من ظلم معاهدا হ أو انةقصه حقه হ أو كلفه فوق طاقةه হ أو أخذ منه شيئا بغير طيب نفس منه فأنا حجيجه يوم القيامة. -‘‘ যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের প্রতি অবিচার করল কিংবা তার অধিকার ক্ষুণ্ণ করল বা তাকে তার সাধ্যের বাইরে কষ্ট দিল অথবা তার সন্তুষ্টি ছাড়াই কোন কিছু তার কাছ থেকে কেড়ে নিল, এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিয়ামাতের দিন (আল্লাহর দরবারে) আমি নিজেই ফরিয়াদী হবো।’’
গ. মুস্তা’মান
মুস্তা’মান অর্থ নিরাপত্তা অর্জনকৃত। মুস্তা’মান হল যে অমুসলিম সাময়িকভাবে রাষ্ট্র প্রধান কিংবা কোন মুসলিম নাগরিকের নিরাপত্তায় ইসলামী রাষ্ট্রে প্রবেশ করে। যিম্মী আর মুস্তা’মানের মধ্যে পার্থক্য হল- যিম্মী হল ইসলামী রাষ্ট্রের স্থায়ী অমুসলিম নাগরিক আর মুস্তা’মান হল ইসলামী রাষ্ট্রে সাময়িক সুবিধাপ্রাপ্ত অমুসলিম শ্রেণী। মুস্তা‘মান চার প্রকারের হতে পারে। যথা- ১.দারুল হারবের দূত বা বাহক, ২.ব্যবসায়ী, ৩. আশ্রয়প্রার্থী ও ৪.দর্শনার্থী, পর্যটক এবং অন্য যে কোন প্রয়োজনে প্রবেশকারী।
ঘ. হারাবী
হারাবী হল দারুল হারাবের অমুসলিম নাগরিক। উপর্যুক্ত তিন শ্রেণীর বাইরে যে সকল অমুসলিম রয়েছে তাদেরকে হারাবী রূপে গণ্য করা হয়।
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের স্থায়ী নাগরিকত্ব লাভের পদ্ধতিঃ
একজন অমুসলিম চুক্তির মাধ্যমে কিংবা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতি সন্তুষ্টি ও আনুগত্য বুঝা যায় - এ ধরনের কোন কাজের মাধ্যমে অথবা কারো অনুবর্তী হিসেবে বা মুসলিমদের হাতে বিজিত অঞ্চলের অধিবাসী হলে স্থায়ী নাগরিকত্ব লাভ করবে।
ক. চুক্তি
অমুসলিমরা ইসলামের সামাজিক ও ফৌজদারী প্রভৃতি আইন-কানুন মেনে নেবে এবং ফি বছর জিয্ইয়া আদায় করবে আর এর বিনিময়ে ইসলামী রাষ্ট্র তাদেরকে স্ব স্ব ধর্ম-কর্ম স্বাধীনভাবে পালনের সুযোগ দেবে এবং তাদের সকল নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করবে- এ মর্মে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে যে কোন অমুসলিম ইসলামী রাষ্ট্রের স্থায়ী নাগরিকত্ব লাভ করতে পারে। এ ধরনের চুক্তির ফলে একদিকে অমুসলিমরা ইসলামী রাষ্ট্রের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কোন রূপ কার্যক্রম চালাতে পারে না। অপরদিকে মুসলিমদের সাথে মেলামেশার সুযোগে ইসলামের সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে তাদের ইসলাম গ্রহণ করার সুযোগ তৈরি হয়। অমুসলিমদের সাথে এ চুক্তি কেবল দীনের পথে তাদেরকে আকৃষ্ট করার মানসে সম্পন্ন করা হবে; কোন রূপ বৈষয়িক স্বার্থ ও অর্থের লোভে নয়। এ চুক্তি মৌখিকভাবেও সম্পন্ন করা যায়। লিখিত করা শর্ত নয়। তবে লিখিতভাবে হওয়া উত্তম, যাতে তা প্রয়োজনে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা যায় এবং কোন পক্ষের অস্বীকারের সুযোগ না থাকে।
অধিকাংশ ইমামের মতে- এ চুক্তি করার একমাত্র বৈধ কর্তৃপক্ষ ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান কিংবা তাঁর প্রতিনিধি। রাষ্ট্রের কল্যাণ ও প্রয়োজন বিবেচনা করে রাষ্ট্রপ্রধান যে কোন অমুসলিমের সাথে উপর্যুক্ত চুক্তি করতে পারবে। এ চুক্তি যেহেতু স্থায়ী নাগরিকত্ব লাভের, তাই তিনি বা তাঁর প্রতিনিধি ছাড়া রাষ্ট্রের অপর কারো জন্য কোন অমুসলিমের সাথে এ রূপ চুক্তি করা বিধেয় নয়। তাঁদের অনুমতি ছাড়া কেউ এ রূপ চুক্তি করলে তা রাষ্ট্র-কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বের অবমাননা বলে শামিল হবে।
কাদের সাথে নাগরিকত্বের চুক্তি করা যাবে ?
আহলে কিতাব (ইয়াহুদী ও খ্রিস্টান) ও অগ্নি উপাসকদের সাথে, অনুরূপভাবে অন্য যে কোন ধর্মাবলম্বীর সাথেও স্থায়ী নাগরিক চুক্তি করা যাবে। তবে হানাফীগণের মতে- আরবের মুশরিকদের সাথে স্থায়ী নাগরিক চুক্তি করা বিধেয় নয়। কারণ, ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ চুক্তির উদ্দেশ্য হল অমুসলিমরা মুসলিমদের সাথে মেলামেশা করে ইসলামের সৌন্দর্যাবলী জানবে এবং এভাবে ইসলাম গ্রহণের সুযোগ তৈরি হবে। এ ধরনের চুক্তির মাধ্যমে আরবের মুশরিকদের ইসলাম গ্রহণের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। কারণ তাদের ভাষায় কুর’আন নাযিল হয়েছে, তারা ইসলামের অনাবিল আদর্শ প্রত্যক্ষ করেছে এবং মুসলিমদের সাথে মেলামেশা করার দীর্ঘ সুযোগও লাভ করেছে। এতদসত্ত্বেও তাদের মধ্যে যারা মুশরিক রয়ে গেছে, তাদের মুসলিম হবার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ বলা চলে। এ কারণে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরবের মুশরিকদের থেকে জিয্ইয়া গ্রহণ করেন নি। শাফি‘ঈ ও হাম্বলীগণের মতে- আহলে কিতাব (ইয়াহুদী ও খ্রিস্টান) ও অগ্নি উপাসক ব্যতীত অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে স্থায়ী নাগরিক চুক্তি করা বিধিসম্মত নয়। তবে মালিকীগণের মতে যে কোন অমুসলিমের সাথে - কিতাবী হোক বা মুশরিক, আরব হোক বা অনারব- নাগরিক চুক্তি করা করা যাবে।
চুক্তির শর্তাবলীঃ
১. অমুসলিমদের নাগরিক চুক্তি স্থায়ী হতে হবে। ইসলামের বাই‘আত যেমন স্থায়ীভাবে করা হয়, তেমনি তার বিকল্প চুক্তিও স্থায়ী সময়ের জন্য হতে হবে। এ চুক্তি মুসলিমরা কোন অবস্থাতেই ভাঙ্গতে পারবে না। এ চুক্তি মেনে চলা তাদের জন্য চিরস্থায়ীভাবে বাধ্যতামলূক। পক্ষান্তরে অমুসলিমদের জন্য ইখতিয়ার রয়েছে যে, তারা যতদিন খুশি তা বহাল রাখতে পারে এবং যখন ইচ্ছে ভাঙ্গতে পারে।
2. ইবাদাত ব্যতীত অর্থনৈতিক লেনদেন ও কারবার এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাদেরকে ইসলামের বিধি বিধান মেনে চলতে হবে।
3. তাদের উপার্জনক্ষম প্রত্যেক পুরুষকে বার্ষিক জিয্ইয়া আদায় করতে হবে।
উপর্যুক্ত শর্তাবলীর ব্যাপারে ইমামগণের মধ্যে কারো কোন দ্বিমত নেই। তবে কোন কোন ইমাম এ শর্তগুলোর বাইরে আরো কিছু শর্ত যোগ করেছেন। যেমন ‘আল্লামা মাওয়ার্দী আরো অতিরিক্ত ছয়টি শর্তের কথা বলেছেন। এগুলো হলঃ
1. কুর’আনের বিরুদ্ধে অযাচিত কোন মন্তব্য বা গালাগাল করবে না এবং তাকে বিকৃত করার কোন প্রয়াস চালাবে না।
2. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি কোন অমর্যাদাকর ও অশালীন বাক্যবাণ ছুঁড়বে না।
3. ইসলামের বিরুদ্ধে কোন অশালীন ও অরুচিকর মন্তব্য করবে না এবং তার বিরুদ্ধে কোন অপপ্রচার চালাতে পারবে না।
4. কোন মুসলিম মহিলার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হবে না, এমনকি বিবাহের নামেও পারবে না।
5. কোন মুসলিমকে দীনের ব্যাপারে বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত করতে পারবে না এবং কারো ধন-সম্পদে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
6. হারাবী (অমুসলিম রাষ্ট্রের অধিবাসী)কে কোন রূপ সহযোগিতা করতে পারবে না এবং তাদের গুপ্তচরদেরকে কোন রূপ আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে পারবে না।
মাওয়ার্দী বলেন, ‘‘ এ সব শর্ত আনুষঙ্গিক। এগুলো স্পষ্টভাবে শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা না হলেও তা মেনে চলা প্রত্যেক অমুসলিম নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক হবে। এতদসত্ত্বেও তাদেরকে অবহিতকরণ এবং চুক্তিকে পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যে এ সব বিষয় শর্তরূপে উল্লেখ করা হবে। শর্তের পরেও এ ধরনের কোন অপরাধে লিপ্ত হলে তা চুক্তি ভঙ্গের মধ্যে শামিল হবে।’’
খ. সন্তুষ্টিজ্ঞাপক কার্যকলাপ
ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতি অমুসলিমের সন্তুষ্টি ও আনুগত্য বুঝা যায় - এ ধরনের কোন কোন কাজের মাধ্যমেও ইসলামী রাষ্ট্রের স্থায়ী নাগরিকত্ব লাভ করা যায়। নিম্নে এ ধরনের কয়েকটি কার্যকলাপের বিবরণ প্রদত্ত হল।
1. ইসলামী রাষ্ট্রে দীর্ঘ দিন বসবাস করা
সাধারণ চুক্তিবিহীন অবস্থায় কোন অমুসলিমকে ইসলামী রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সুযোগ দেয়া হয় না। তবে রাষ্ট্র প্রধান কিংবা কোন মুসলিমের ব্যক্তিগত আশ্রয়ে সাময়িকভাবে কিছু দিনের জন্য অমুসলিমকে ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসের সুযোগ দেবার বিধান রয়েছে। এ ধরনের ব্যক্তিকে ইসলামী আইনের পরিভাষায় ‘মুস্তা’মান’ (নিরাপত্তা অর্জনকৃত) বলা হয়। অধিকাংশ ইমামের মতে ‘মুস্তা’মান’ এক বছরের কম সময়ের জন্য ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারবে।
‘মুস্তা’মান’ পুরো এক বছর কিংবা ততোধিক সময় ধরে ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাস করলে তার ওপর জিয্ইয়া আরোপিত হবে এবং সে ইসলামী রাষ্ট্রের স্থায়ী নাগরিকে পরিণত হবে। কেননা দীর্ঘ সময় ধরে ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাস করলে বুঝা যাবে যে, সে ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাস করতে এবং যিম্মীদের জন্য প্রযোজ্য শর্তাবলী মেনে নিতে সম্মত আছে। এ বিষয়ে হানাফীগণের বক্তব্য হল- কোন অমুসলিম হারাবী যথাযথ উপায়ে নিরাপত্তা নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রে প্রবেশ করলে রাষ্ট্র প্রধান সুবিবেচনাপূর্বক তার বসবাসের জন্য একটি সময় নির্ধারণ করে দেবে এবং বলবে যে, যদি তুমি এ সময় অতিক্রম কর, তা হলে তুমি যিম্মীতে পরিণত হবে। যদি সে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ইসলামী রাষ্ট্র ছেড়ে চলে না যায়, তা হলে সে যিম্মী রূপে পরিগণিত হবে এবং বৎসর শেষে তার ওপর জিয্ইয়া আরোপিত হবে। যদি রাষ্ট্রপ্রধান তার বসবাসের জন্য কোন সময় নির্ধারণ করে না দেয়, তাহলে অধিকাংশ হানাফীর মতে এক বৎসর কাল বসবাসের কারণে সে যিম্মীতে পরিণত হবে। তবে কারো কারো মতে- মুস্তা’মান দীর্ঘ সময় ধরে বসবাস করতে শুরু করলে রাষ্ট্র প্রধান তাকে বেরিয়ে যাবার নির্দেশ দেবে। এর পর যদি সে বৎসর কাল বসবাস করে, তাহলেই তার ওপর জিয্ইয়া আরোপিত হবে। তাঁদের মতানুযায়ী বৎসরের গণনা শুরু হবে রাষ্ট্রপ্রধানের বের হবার নির্দেশ দানের পর থেকে। যদি রাষ্ট্র প্রধান তাকে বেরিয়ে যাবার কোন নির্দেশ না দেয় এবং সেও কয়েক বৎসর ধরে বসবাস করতে থাকে, তাহলে সে যিম্মীতে পরিণত হবে না এবং সে স্বদেশে ফিরে যেতে পারবে।
2. মুসলিম কিংবা যিম্মীর সাথে হারাবী মহিলার বিয়ে করা
কোন হারাবী মুস্তা’মানাহ (নিরাপত্তাপ্রাপ্তা) মহিলা ইসলামী রাষ্ট্রের কোন মুসলিম কিংবা স্থায়ী অমুসলিম নাগরিকের সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হলে সে যিম্মী এবং ইসলামী রাষ্ট্রের স্থায়ী নাগরিকে পরিণত হবে। কেননা ইসলামী আইনে বসবাসের ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীর অনুগামী হয়ে থাকে। এ কারণে সে স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার ঘর থেকে বের হয়ে চলে যেতে পারে না। অতএব ইসলামী রাষ্ট্রের কোন নাগরিকের সাথে তার বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়া থেকে বুঝা যায় যে, সে ইসলামী রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে সম্মত রয়েছে। এ কারণে সে যিম্মীতে পরিণত হবে। পক্ষান্তরে কোন
মুস্তা’মান পুরুষ ইসলামী রাষ্ট্রের কোন অমুসলিম মেয়েকে বিয়ে করলে সে যিম্মীতে পরিণত হবে না। কারণ বসবাসের ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীর অনুগামী হয় না। তাই ইসলামী রাষ্ট্রের কোন মহিলার সাথে তার বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়া থেকে বুঝা যাবে না যে, সে ইসলামী রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে সম্মত রয়েছে। এ কারণে ইসলামী রাষ্ট্রের কোন অমুসলিম মহিলাকে বিয়ে করা সত্ত্বেও সে যিম্মীতে পরিণত হবে না।
3. খারাজী জমি ক্রয় করা
মুস্তা’মান যদি ইসলামী রাষ্ট্রে খারাজী জমি ক্রয় করে চাষাবাদ করে, তাহলে তার ওপর ভূমিকর আরোপিত হবে এবং সে যিম্মীতে পরিণত হবে। কেননা ভূমিকর ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। এমতাবস্থায় মুস্তা’মান ভূমিকর প্রদান করতে রাজি হলে বুঝা যাবে যে, সে ইসলামী রাষ্ট্রের স্থায়ী নিবাসী হতে সম্মত রয়েছে। এ কারণে সে যিম্মীতে পরিণত হবে। তবে ভূমিকর সংগ্রহের আগেই যদি সে জমি বিক্রি করে দেয় তাহলে সে যিম্মীতে পরিণত হবে না। কেননা যদি সে খারাজ আদায় করতে ইচ্ছুক হয়, তাহলেই বুঝা যাবে যে, সে ইসলামী রাষ্ট্রে নিবাসী হতে সম্মত রয়েছে; নিরেট জমি ক্রয় থেকে এটা বুঝা যাবে না। তবে কারো কারো মতে তাকে পূর্বে এ মর্মে সতর্ক করতে হবে যে, সে যদি জায়গা বিক্রি করে স্বদেশে ফিরে না যায়, তা হলে সে যিম্মীতে পরিণত হবে। কেননা কাউকে তার স্পষ্ট সম্মতি জ্ঞাপন কিংবা সন্তুষ্টিসূচক কোন আচরণ ছাড়া যিম্মীতে পরিণত করা বিধেয় নয়। তবে কোন অমুসলিম মুসলিমদের থেকে খারাজী জমি বর্গা নিয়ে চাষ করলে সে যিম্মীতে পরিণত হবে না। কেননা খারাজ বর্গাদানকারীর ওপর বর্তাবে, চাষীর ওপর বর্তাবে না। কিন্তু উৎপন্ন ফসলের অংশ বিশেষ প্রদানের চুক্তিতে জমি নিয়ে চাষ করলে সে যিম্মীতে পরিণত হবে। কারণ জমির উৎপন্ন থেকে খারাজ গ্রহণ করা হয় আর যার নিকট থেকে খারাজ গ্রহণ করা হবে তার ওপরও জিয্ইয়ার বিধানও প্রযোজ্য হবে। ফলে সে যিম্মীতে পরিণত হবে।
গ. অপরের অনুবর্তন
কোন কোন ক্ষেত্রে অপরের সম্পর্ক ও আত্মীয়তার সূত্র ধরেও ইসলামী রাষ্ট্রের স্থায়ী নাগরিকত্ব লাভ করা যায়। এ ধরনের অবস্থাগুলো হল-
1. ছোট ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী
পিতা বা মাতা ইসলামী রাষ্ট্রের স্থায়ী নাগরিক হলে তাদের সন্তান-সন্ততি তাদের অনুবর্তী হিসেবে ইসলামী রাষ্ট্রের স্থায়ী নাগরিক হবে। কেননা ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে পিতামাতার অনুবর্তী হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে ছেলেরা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তাদের থেকে জিয্ইয়া গ্রহণ করা হবে। এ জন্য তাদের সাথে নতুনভাবে চুক্তি করার প্রয়োজন পড়বে না।
সন্তান-সন্ততির মত অমুসলিম স্ত্রীও স্বামীর অনুবর্তী হিসেবে ইসলামী রাষ্ট্রের যিম্মীতে পরিণত হবে, যদি স্বামী মুসলিম কিংবা যিম্মী হয়। অতএব যদি স্বামী-স্ত্রী দুজন হারাবী নিরাপত্তা নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রে প্রবেশ করে কিংবা দুজন অমুসলিম নর-নারী নিরাপত্তা নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রে প্রবেশ করে এবং পরস্পর বিয়ে করে, অতঃপর পুরুষ যিম্মীতে পরিণত হয়, তাহলেও স্বামীর অনুবর্তী হিসেবে স্ত্রীও যিম্মীতে পরিণত হবে। অনুরূপভাবে কোন হারাবী মহিলা নিরাপত্তা নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রে প্রবেশ করে কোন যিম্মীকে বিয়ে করলে সেও স্বামীর অনুবর্তী হিসেবে যিম্মীতে পরিণত হবে।
2. ছিন্নমূল শিশু
ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিম জনপদের অভ্যন্তরে কিংবা তাদের উপাসনালয়ের মধ্যে কোন ছিন্নমূল শিশু পাওয়া গেলে যিম্মীদের অনুবর্তী হিসেবে তাকেও যিম্মী রূপে পরিগণিত করা হবে।
ঘ. বিজিত এলাকায় অস্ত্র সংবরণ
যে সব অমুসলিম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করেছে এবং মুসলিম বাহিনী যখন তাদের সকল প্রতিরোধ ভেঙ্গে তাদের আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করেছে, কেবল তখনই অস্ত্রসংবরণ করেছে, এ ধরনের বিজিতদেরকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হলে তারাও ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকে পরিণত হবে। রাষ্ট্র তাদের নিকট থেকে জিয্ইয়া গ্রহণ করা মাত্রই তারা যিম্মী রূপে পরিগণিত হবে এবং রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার ভোগ করবে। এরপর রাষ্ট্রের কিংবা কোন সাধারণ মুসলিমের এ অধিকার থাকবে না যে, তাদের সম্পত্তি দখল করবে বা তাদেরকে দাস-দাসী বানাবে। হযরত ‘উমার (রা.) হযরত আবূ উবায়দা (রা.)কে নির্দেশ দেন, -‘‘যখন তুমি তাদের নিকট থেকে জিয্ইয়া গ্রহণ করবে, তখন তোমার আর তাদের ওপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার থাকবে না।’’
অমুসলিম নাগরিকদের অধিকারসমূহঃ
অমুসলিমরা ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক। ইসলামী রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও আনুগত্য মেনে নেয়ার পর তাদের মৌলিক নাগরিক অধিকারসমূহ সুনিশ্চিত করা ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য। তারা জীবন-মাল-ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা লাভ করবে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে ও ধর্ম-কর্ম পালন করবে। তদুপরি ইসলামী রাষ্ট্রের মুসলিম নাগরিকরা যে সব নাগরিক অধিকার ভোগ করে অমুসলিমরাও একই রূপ নাগরিক অধিকার (সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) ভোগ করবে। ইসলামী আইনতত্ত্ববিদগণের ভাষায়إن لهم ما للمسلمين হ و عليهم ما علي المسلمين . -‘‘ মুসলিমদের জন্য (রাষ্ট্রে )যে রূপ অধিকার ও সুযোগ-সু&&বধা রয়েছে, তাদের জন্যও ঠিক একই রূপ অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থাকবে। উপরন্তু, মুসলিমরা যে রূপ শাস্তি ও দন্ডের সম্মুখীন হবে, তারাও অনুরূপ শাস্তি ও দন্ডের সম্মুখীন হবে।’’ নিম্নে তাদের অধিকারসমূহ উল্লেখ করা হলঃ
1. জীবন-মাল-ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমের জান-মাল-ইজ্জত-আব্রু মুসলিমের জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রুর মতোই পবিত্র। অন্যায়ভাবে কোন অমুসলিমের জান কিংবা মাল অথবা ইজ্জতের ওপর আঘাত হানা নিষিদ্ধ। কোন মুসলিম যদি কোন অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করে, কিংবা তার সম্পদ নষ্ট করে অথবা তার ইজ্জতের ওপর হস্তক্ষেপ করে, তাহলে একজন মুসলিমের সাথে এরূপ আচরণ করা হলে তার যে ধরনের শাস্তি ও দন্ড হতো, তাকে ঠিক তেমনি শাস্তি ও দন্ড দেয়া হবে। অতএব কোন মুসলিম যদি কোন অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করে তাহলে একজন মুসলিম নাগরিককে হত্যা করলে যেমন তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হত ঠিক তেমনি মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে।
হযরত ‘আলী (রা.)-এর আমলে জনৈক মুসলিম একজন অমুসলিমের হত্যার দায়ে গ্রেফতার হয়। যথারীতি দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর তিনি মৃত্যুদন্ডের নির্দেশ দেন। এ সময় নিহত ব্যক্তির ভাই এসে বললো, ‘‘আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।’’ কিন্তু তিনি সন্তুষ্ট না হয়ে বললেন, ‘‘ওরা বোধ হয় তোমাকে ভয় দেখিয়েছে।’’ সে বললো, ‘‘না, আমি রক্তপণ পেয়েছি এবং আমি বুঝতে পেরেছি যে, ওকে হত্যা করলে আমার ভাই ফিরে আসবে না।’’ তখন তিনি খুনীকে ছেড়ে দিলেন এবং বললেন, إنما قبلوا الجزية لتكون أموالهم كأموالنا হ و دمائهم كدمائنا. -‘‘ তারা জিয্ইয়া দিতে সম্মত হয়েছে এ শর্তে যে, তাদের ধন-সম্পদ ও জীবন আমাদের ধন-সম্পদ ও জীবনের মতোই সমমর্যাদা সম্পন্ন হবে।’’
অনুরূপভাবে কোন অমুসলিম নাগরিক কোন মুসলিমের হাতে ভুলক্রমে নিহত হলে তাকেও অবিকল সেই রক্তপণ দিতে হবে, যা কোন মুসলিমের নিহত হবার ক্ষেত্রে দিতে হয়।
জান-মালের মতো তাদের ইজ্জত-আব্রুও মুসলিমদের ইজ্জত-আব্রুর মতই মর্যাদাসম্পন্ন। কোন মুসলিমকে যেমন মারধর করা, কষ্ট দেয়া, গালি দেয়া, বদনাম করা জায়িয নয়; তেমনি এ সব কাজ অমুসলিমদের ক্ষেত্রেও না জায়িয। ইবনু ‘আবিদীন বলেন,تحرم غيبته كالمسلم لأنه بعقد الذمة وجب له ما لنا হ فإذا حرمت غيبة المسلم حرمت غيبته ؛ بل قالوا : إن ظلم الذمي أشد. -‘‘ তার গীবাত করা মুসলিমের গীবাত করার মতোই হারাম। কেননা চুক্তি করার কারণে আমাদের অনুরূপ সকল অধিকার তার বেলায়ও কার্যকর হবে। অতএব মুসলিমের গীবাত করা হারাম হলে তার গীবাত করাও হারাম হবে। অধিকন্তু ইমামগণ বলেছেন যে, অমুসলিমের প্রতি অবিচার করা অধিকতর জঘন্য। ’’
2. স্বাধীনভাবে বসবাস, চলাফেরা ও বিচরণের অধিকার
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরা স্বাধীনভাবে দেশের যে কোন স্থানে, এমন কি মুসলিম জনপদেও মিলেমিশে বসবাস করতে পারবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য, কাজ-কারবার ও চাকুরী প্রভৃতির প্রয়োজনে রাষ্ট্রের যে কোন স্থানে মুক্তভাবে বিচরণ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে অন্যায়ভাবে কোন রূপ বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। তবে পবিত্র মক্কা ও মদীনা নগরীতে তাদেরকে প্রবেশ, চলাফেরা ও বসবাস করতে দেয়া জায়িয নয়। তবে আরবের অন্যান্য ভূখন্ডে অমুসলিমদেরকে বসবাস ও বিচরণের অধিকার দেয়া যাবে কি না- তা নিয়ে ইমামগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,لا يجتمع دينان في جزيرة العرب. - ‘‘ আরব জাযীরায় দুটি ধর্ম একত্রে থাকতে পারবে না।’’ অন্তিম মুহূর্তে তিনি চূড়ান্ত নির্দেশ দিয়ে বলেন, أخرجوا المشركين من جزيرة العرب. -‘‘ মুশরিকদেরকে তোমরা আরব জাযীরা থেকে বের করে দেবে।’’ এ হাদীসগুলোর প্রেক্ষিতে ইমামগণ বলেছেন, কোন অমুসলিমকে আরব ভূখন্ডে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দেয়া যাবে না। তবে তারা যে কোন প্রয়োজনে সেখানে সরকারের অনুমতি কিংবা সম্মতিক্রমে প্রবেশ করতে পারবে, চলাফেরা করতে পারবে এবং সাময়িকভাবে অবস্থানও করতে পারবে।
উল্লেখ্য যে, আরব ভূখন্ডে অমুসলিমদের প্রবেশ, বিচরণ ও বসবাসের ওপর বিশেষ বিধি-নিষেধের ব্যাপারে কারো কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। আসল কথা হল- আরব ভূখন্ডটি ইসলামের সংরক্ষিত অঞ্চল। এখানে কেবল তারাই সাধারণভাবে প্রবেশ ও বসবাস করতে পারবে, যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে। যেমন প্রত্যেক দেশেই কিছু সংরক্ষিত এলাকা থাকে, যেখানে সে দেশের সাধারণ নাগরিকও প্রবেশ করতে পারে না। দেশের সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশাধিকারের বিধি-নিষেধের ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন যেমন অবান্তর ও অযৌক্তিক, ঠিক তেমনিভাবে আরব ভূখন্ডে অমুসলিমদের প্রবেশ ও বসবাস করার ওপর যে বিধি-নিষেধ আছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করাও নিতান্ত অবান্তর ও অযৌক্তিক।
3. ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরা নিজেদের এলাকা ও পরিমন্ডলে স্বাধীনভাবে স্ব স্ব ধর্ম-কর্ম প্রকাশ্যে ঢাকঢোল পিটিয়ে পালন করতে পারবে। তবে একান্ত মুসলিম জনপদের অভ্যন্তরে প্রকাশ্যে ধর্ম-কর্ম পালন করতে দেয়া থেকে তাদেরকে বাধা দেয়া অসঙ্গত নয়। ইসলামী রাষ্ট্র প্রয়োজন মনে করলে এ ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করতে পারবে। মুসলিম জনপদগুলোতে তাদেরকে কেবল ক্রুশ ও প্রতিমাবাহী শোভাযাত্রা বের করতে এবং প্রকাশ্যে ঢাকঢোল বাজাতে বাজাতে বের হতে নিষেধ করা হবে। তবে মুসলিম জনপদের অভ্যন্তরে অমুসলিমদের প্রাচীন উপাসনালয় থাকলে তার অভ্যন্তরে তারা সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে পারবে। ইসলামী সরকার তাতে কোন রূপ হস্তক্ষেপ করবে না।
তাদেরকে তাদের বিবেকের বিরুদ্ধে কোন চিন্তা অবলম্বনে বাধ্য করা যাবে না। দেশের প্রচলিত আইনের বিরোধী নয় এমন যে কোন কাজ তারা আপন বিবেকের দাবি অনুসারে করতে পারবে। এ কারণে অমুসলিমকে ইসলাম গ্রহণ করার জন্য কোন রূপ চাপ সৃষ্টি করা বিধেয় নয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,لا إكراه في الدين. -‘‘ ধর্মের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই।’’ তবে তাদের কেউ ইসলামের সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তা ভিন্ন কথা। এ কারণে কোন অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করার পর তা ত্যাগ করল এবং যদি প্রমাণিত হয় যে, সে একান্ত চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল, তাহলে তার বেলায় মুরতাদের হুকম প্রযোজ্য হবে না।
মুসলিমরা যে সব কাজকে পাপ ও অপরাধ মনে করে, অমুসলিমরা এ ধরনের কোন কাজকে বৈধ রূপে জানলে (যেমন- মদ সেবন, শুকর পালন ও ক্রয়-বিক্রয়, ক্রুশ বহন ও শঙ্খ ধ্বনি বাজানো এবং রমযানের দিনে পানাহার প্রভৃতি) তা করতে তাদেরকে বাধা দেয়া যাবে না, যদি না তারা তা প্রকাশ্যে মুসলিমদের মধ্যে সম্পাদন করে।
অমুসলিমরা তাদের জনপদের মধ্যে পুরাতন উপাসনালয়গুলোর সংরক্ষণ ও সংস্কারের পাশাপাশি নতুন উপাসনালয়ও তৈরী করতে পারবে। একান্ত মুসলিম জনপদের অভ্যন্তরে নতুনভাবে অমুসলিমদের উপাসনালয় তৈরি করতে দেয়া যাবে না। তবে সেখানে তাদের প্রাচীন উপাসনালয় থাকলে, তাতে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। যদি তা ভেঙ্গে যায়, একই জায়গায় তা পুনঃনির্মাণের অধিকার তাদের রয়েছে। একান্ত মুসলিম জনপদ নয়- এ ধরনের এলাকায় অমুসলিমরা নতুন উপাসনালয় তৈরি করতে পারবে। অনুরূপভাবে যে এলাকা বর্তমানে একান্ত মুসলিম জনপদ নয়, সরকার যেখানে জুম‘আ, ‘ঈদ ও ফৌজদারী দন্ডবিধির প্রচলন বন্ধ করে দিয়েছে, সেখানেও অমুসলিমরা নতুন উপাসনালয় তৈরি এবং প্রকাশ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে পারবে।
মুসলিমদের হাতে যে সব নগরী পত্তন হয়েছে (যেমন- বাগদাদ, কূফা, বসরা, ওয়াসিত প্রভৃতি), সেখানে অমুসলিমদেরকে নতুনভাবে কোন উপাসনালয় তৈরির অনুমতি দেয়া হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,لا تبنى كنيسة في دار الإسلام হ و لا يجدد ما خرب منها. -‘‘ ইসলামী ভূখন্ডে কোন গীর্জা না নির্মাণ করা যাবে, না কোন জীর্ণ গীর্জার সংস্কার করা যাবে।’’ অধিকন্তু, এ ধরনের নগরীতে অমুসলিমদেরকে মদ সেবন ও শুকরের ক্রয়-বিক্রয় করা থেকেও বারণ করা হবে। ইবনু ‘আববাস (রা.) বলেন, ‘‘ যে সব জনপদকে মুসলিমরা বাসযোগ্য বানিয়েছে, সেখানে অমুসলিমদের নতুন মন্দির, গীর্জা ও উপাসনালয় বানানো, বাদ্য বাজানো এবং প্রকাশ্যে শুকরের গোস্ত ও মদ বিক্রি করার অধিকার নেই। তবে অনারবদের হাতে আবাদকৃত, পরে মুসলিমদের হাতে বিজিত এবং মুসলিমদের বশ্যতা স্বীকারকারী জনপদে অমুসলিমদের অধিকার তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির শর্তানুসারে নির্ধারিত হবে। মুসলিমরা তা মেনে চলতে বাধ্য হবে।’’
যুদ্ধের মাধ্যমে হস্তগত অমুসলিম জনপদের উপাসনালয় দখল করার অধিকার ইসলামী সরকারের রয়েছে। তবে সৌজন্য বশত এ অধিকার ভোগ করা থেকে বিরত থাকা এবং উপাসনালয়গুলোকে যে অবস্থায় রয়েছে সে অবস্থায় বহাল রাখা উত্তম। বিশিষ্ট ফকীহ আল-কাসানী বলেন, ‘‘ প্রাচীন উপাসনালয়গুলোকে ধ্বংস করা কোন অবস্থায়ই বৈধ নয়।’’ হযরত ‘উমার (রা.)-এর আমলে যত দেশ বিজিত হয়েছে তার কোথাও কোন উপাসনালয় ভেঙ্গে ফেলা হয় নি বা তাতে কোন ধরনের হস্তক্ষেপ করা হয় নি। হযরত আবূ বাকর (রা.)-এর আমলে হীরাবাসীদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিপত্রে এ কথাও লেখা হয়েছিল যে, ‘‘ তাদের খানকাহ ও গির্জাগুলো ধ্বংস করা হবে না। প্রয়োজনের সময় শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য যে সব ইমারতে তারা আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে সেগুলোও নষ্ট করা হবে না। নাকুশ ও ঘন্টা বাজাতে নিষেধ করা হবে না। আর উৎসবের সময় ক্রুশ বের করার ওপরও কোন বিধি-নিষেধ আরোপ করা হবে না।’’
4. জীবিকা উপার্জন ও চাকুরীর অধিকার
জীবিকা উপার্জনের জন্য অমুসলিমরা তাদের যোগ্যতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী স্বাধীনভাবে যে কোন কর্ম ও পেশা অবলম্বন করতে পারবে। তাদেরকে তাদের বিবেকের বিরুদ্ধে কোন কর্ম ও পেশা অবলম্বনে বাধ্য করা যাবে না। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারিগরি, কৃষি ও চাকুরী প্রভৃতির দ্বার তাদের সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এ সব ক্ষেত্রে মুসলিমরা যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকে, অমুসলিমরাও তা ভোগ করবে। তাদের মধ্যে কোন রূপ বৈষম্য সৃষ্টি করা চলবে না। চাকুরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের যোগ্যতার মাপকাঠি হবে একটিই এবং লোকদেরকে ধর্মীয় পরিচয়ে নয়, একমাত্র যোগ্যতার ভিত্তিতেই নির্বাচন করা হবে। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে যখন রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে অমুসলিমদের নিয়োগ দানের বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তখন তার জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘‘ যোগ্য ব্যক্তিকে যথোপযুক্ত স্থানে নিয়োগ দেয়াই হল ইসলামী শরী‘আহর নীতিমালার দাবী।’’ তাঁর ৫০ বছরের শাসনামলে বহু হিন্দু-অমুসলিম প্রশাসনের উচ্চপদে নিয়োজিত ছিল। যেমন জশবন্ত সিং, রাজা রাজরূপ, কবির সিং, অর্ঘ্যনাথ সিং, প্রেমদেব সিং, দিলীপ রায় ও রসিক লাল প্রমুখ। স্যার মার্ক সাইস খালীফা হারুনুর রশীদের শাসনামলের কথা লেখেন এভাবে-‘‘ খ্রিস্টান, পৌত্তলিক, ইয়াহুদী ও মুসলিমরা ইসলামী সরকারের কর্মচারী হিসেবে সমান অধিকার নিয়ে কর্মরত ছিলেন।’’
তবে রাষ্ট্রের আদর্শ ও নিরাপত্তাগত প্রয়োজনে যে সব দায়িত্ব পালনের জন্য মুসলিম হবার শর্ত রয়েছে ( যেমন- রাষ্ট্রপ্রধান, সেনাধ্যক্ষ, মুসলিম আদালতের কাযী প্রভৃতি), সে সব ক্ষেত্রে অমুসলিমদেরকে নিয়োগ দেয়া যাবে না। এগুলো ছাড়া বাদবাকী সমগ্র প্রশাসনের বড় বড় সকল পদে (যেমন- মহা হিসাব রক্ষক, প্রধান হিসাব নিরীক্ষক, মহাপ্রকৌশলী ও পোষ্ট মাস্টার জেনারেল প্রভৃতি), এমনকি নির্বাহী ক্ষমতাসম্পন্ন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়েও যোগ্যতা সাপেক্ষে অমুসলিমদেরকে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। অনুরূপভাবে সেনাবাহিনীতেও কেবল প্রত্যক্ষ যুদ্ধ সংক্রান্ত দায়িত্বে তাদেরকে নিয়োগ দেয়া যাবে না। তবে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয়- সামরিক বিভাগের এমন সব দায়িত্বে তাদেরকে নিয়োগ দিতে কোন বাধা নেই।
5. অর্থনৈতিক কারবার পরিচালনার সুবিধা
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরা অর্থনৈতিক কারবার পরিচালনার ক্ষেত্রে মুসলিমদের মতো একই রূপ সুবিধা লাভ করবে। তারা ব্যবসার পাশাপাশি ইজারাহ, মুযারা‘আহ, মুদারাবাহ ও মুশারাকাহ প্রভৃতি পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক লেনদেন ও কারবার করতে পারবে। তবে এ সব কারবার ও লেনদেনের ক্ষেত্রে (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া যেমন- মদ ও শুকরের ব্যবসা) তাদেরকে ইসলামী বিধি-বিধান মেনে চলতে হবে। সূদ ও জুয়া এবং ইসলামে নিষিদ্ধ কোন পন্থায় অর্থনৈতিক লেনদেন করতে পারবে না।
6. জমির মালিকানা ও ব্যবহারের নিরঙ্কুশ অধিকার
অমুসলিমরা ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকে পরিণত হয়ে যাওয়ার পর তারা তাদের জমির মালিক হবে। ইসলামী রাষ্ট্র তাদেরকে বেদখল করতে পারবে না। তদুপরি তারা নতুন জমিও ক্রয় করতে পারবে। তাদের জমির মালিকানা উত্তরাধিকার সূত্রে হস্তান্তরিত হবে এবং তারা নিজেদের সম্পত্তি বেচা, কেনা, দান করা ও বন্ধক রাখা ইত্যাদির নিরঙ্কুশ অধিকারী হবে।
7. পারিবারিক আইনে বিচারের অধিকার
অমুসলিমদের পারিবারিক কর্মকান্ড তাদের নিজস্ব পারিবারিক আইন (ঢ়বৎংড়হধষ ষধ)) অনুযায়ী পরিচালিত হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের ওপর ইসলামী বিধি-বিধান কার্যকর করা হবে না। মুসলিমদের পারিবারিক জীবনে যে সব বিষয় অবৈধ, সে সব যদি তাদের ধর্মীয় ও জাতীয় আইনে বৈধ হয়, তাহলে আদালত তাদের আইন অনুসারেই ফায়সালা করবে। উদাহরণ স্বরূপ সাক্ষী ছাড়া বিয়ে, মাহর ব্যতীত বিয়ে, ‘ইদ্দতের মধ্যে পুনরায় বিয়ে অথবা ইসলামে যাদের সাথে বিয়ে নিষিদ্ধ তাদের সাথে বিয়ে প্রভৃতি যদি তাদের আইনে বৈধ হয়ে থাকে, তা হলে তাদের জন্য এ সব কাজ বৈধ বলে মেনে নেয়া হবে।
তবে কোন ক্ষেত্রে যদি বিবদমান উভয় পক্ষ স্বয়ং ইসলামী আদালতে আবেদন জানায় যে, ইসলামী আইন মুতাবিক তাদের বিবাদের ফায়সালা করা হোক, তবেই আদালত তাদের ওপর শরী‘আতের বিধান কার্যকর করবে। তাছাড়া পারিবারিক আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন বিবাদে যদি এক পক্ষ মুসলিম হয়, তাহলে ইসলামী আইন অনুযায়ী ফায়সালা করা হবে। যেমন কোন খ্রিস্টান মহিলার স্বামী যদি মুসলিম হয় এবং সে মারা যায়, তাহলে এ মহিলাকে ইসলামী আইন অনুযায়ী স্বামীর মৃত্যুজনিত ‘ইদ্দত পুরোপুরি পালন করতে হবে। ‘ইদ্দতের মধ্যে বিয়ে করলে সে বিয়ে বাতিল হবে।
8. ভোটাধিকার
ইসলামী রাষ্ট্রের স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে অমুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব ও ভোট দানের পূর্ণ অধিকার দেয়া যেতে পারে। আইন সভায় নিজেদের নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচনেও তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে।
9. বাকস্বাধীনতা
ইসলামী রাষ্ট্রে একজন মুসলিম যেমন বাকস্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা, নিজের মত প্রকাশ ও প্রচারের স্বাধীনতা ভোগ করে, তেমনি অমুসলিমরাও ঠিক একই রূপ স্বাধীনতা ভোগ করবে। এ ক্ষেত্রে যে সব আইনগত বিধিনিষেধ মুসলিমের ওপর থাকবে, তা তাদের ওপরও থাকবে। আইন সঙ্গতভাবে তারা সরকার, আমলা ব্যবস্থা এবং স্বয়ং রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানেরও সমালোচনা করতে পারবে। ধর্মীয় আলোচনা ও গবেষণার যে স্বাধীনতা মুসলিমদের জন্য রয়েছে, তা আইন সঙ্গতভাবে তাদেরও থাকবে।
তারা নিজেদের ধর্ম প্রচারের স্বাধীনতা ভোগ করবে এবং একজন অমুসলিম যে কোন ধর্ম গ্রহণ করলে তাতে সরকারের কোন আপত্তি থাকবে না। তবে কোন মুসলিম ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানার ভেতরে থাকা অবস্থায় আপন ধর্ম পরিত্যাগ করতে পারবে না। তবে এ রূপ ধর্মত্যাগী মুসলিমকে আপন ধর্মত্যাগের ব্যাপারে যে জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে, সেটা তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। যে অমুসলিম ব্যক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সে ইসলাম ত্যাগ করেছে, তাকে এ জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে না।
10. শিক্ষার অধিকার
মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সকলেই ইসলামী রাষ্ট্রে চালু শিক্ষা ব্যবস্থা অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণ করবে। তবে ইসলাম ধর্মীয় বই-পুস্তকাদি পড়তে তাদেরকে বাধ্য করা যাবে না। দেশের সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিংবা তাদের নিজেদের বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজ নিজ ধর্ম শিক্ষার আলাদা ব্যবস্থা করার পূর্ণ স্বাধীনতা তাদের থাকবে।
ব্যতিক্রমধর্মী বিষয়সমূহঃ
ক. রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের পদ
ইসলামী রাষ্ট্র যেহেতু একটি আদর্শবাদী রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের দায়িত্ব হল ইসলামের আদর্শ ও মূলনীতি অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা, তাই ইসলামী আদর্শ ও মূলনীতির প্রতি যাদের বিশ্বাস ও আস্থা নেই, তারা আর যাই হোক রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের পদে কোনক্রমেই অভিষিক্ত হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো সমানাধিকারের কথা বলে সংখ্যালঘুদের ভোটাধিকার নিয়ে যে প্রতারণার আশ্রয় নেয়, ইসলামী রাষ্ট্র তার আশ্রয় নিতে পারে না। জাতীয় রাষ্ট্রগুলো নিজের নীতি নির্ধারণ ও প্রশাসনের কাজে শুধু আপন জাতির লোকদের ওপরই নির্ভর করে, সংখ্যালঘু নাগরিকদেরকে এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য মনে করে না। এ কথা স্পষ্ট করে বলা না হলেও কার্যত এটাই হয়ে থাকে। সংখ্যালঘুদের কাউকে কখনো রাষ্ট্রের শীর্ষ পদ দেয়া হলেও তা নিছক লোক দেখানোর ব্যাপার হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে তার কোন কার্যকর ভূমিকা থাকে না।
খ. মজলিসে শূরা বা আইনসভার সদস্য
ইসলামী রাষ্ট্র একটি আদর্শবাদী রাষ্ট্র হবার কারণে তার মজলিসে শূরার সকল সদস্য মুসলিম হওয়া শর্ত। এখানে অমুসলিম প্রতিনিধিত্ব বিশুদ্ধ নয়। এটাই মূল কথা। তবে বর্তমানে মুসলিম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে সমসাময়িক অবস্থার দাবী অনুযায়ী মজলিসে শূরার মধ্যে এ শর্তে নির্দিষ্ট সংখ্যক অমুসলিম প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে যে, দেশের গঠনতন্ত্রে এ মর্মে সুস্পষ্ট নিশ্চয়তা দিতে হবে যে,
১. দেশের আইনের প্রধান উৎস হবে কুর’আন ও সুন্নাহ।
২. আইন সভা কুর’আন ও সুন্নাহর পরিপন্থী কোন আইন প্রণয়ন করতে পারবে না।
৩. আইনের চূড়ান্ত অনুমোদনের কাজটি যে ব্যক্তি করবেন, তিনি মুসলিম হবেন।
তারা মজলিসে শূরায় তাদের জনগোষ্ঠীর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিতে এবং রাষ্ট্রের পরিচালনা ও শাসন সংক্রান্ত সাধারণ বিষয়সমূহে নিজেদের মতামত পেশ করবে এবং ভোট দেবে। শার‘ঈ বিষয়সমূহে সিদ্ধান্ত নেয়ার বেলায় এবং রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের মতামত গ্রহণ করা হবে না।
তবে এ ধরনের ব্যবস্থাও গ্রহণ করা যেতে পারে যে, তাদের জন্য পৃথক প্রতিনিধি পরিষদ গঠন করে দেয়া হবে। এ পরিষদ দ্বারা তারা নিজেদের সামষ্টিক প্রয়োজনও মেটাতে পারবে এবং দেশের প্রশাসন সংক্রান্ত ব্যাপারেও নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে পারবে এবং সরকার ইনসাফ সহকারে তার পর্যালোচনা করবে। এই পরিষদের সদস্যপদ এবং ভোটাধিকার শুধু অমুসলিমদের জন্য নির্দিষ্ট থাকবে এবং এখানে তাদের মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে।
গ. দেশ রক্ষার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি
অমুসলিমরা দেশ রক্ষার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাবে। শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা এককভাবে শুধু মুসলিমদের দায়িত্ব। কারণ একটা আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেবল তারাই উপযুক্ত বিবেচিত হতে পারে, যারা ঐ আদর্শকে সঠিক বলে মানে। তাছাড়া যুদ্ধের সময় নিজেদের আদর্শ ও মূলনীতি মেনে চলাও তাদের পক্ষেই সম্ভব। অন্যরা দেশ রক্ষার জন্য লড়াই করলে ভাড়াটে সৈন্যের মত লড়বে এবং ইসলামের নির্ধারিত নৈতিক সীমা রক্ষা করে চলতে পারবে না। এ জন্য ইসলাম অমুসলিমদেরকে দেশ রক্ষার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে এবং এর পরিবর্তে দেশ রক্ষার কাজে ব্যয় নির্বাহে নিজেদের অংশ প্রদানকে তাদের কর্তব্য বলে নির্ধারণ করা হয়েছে। এটাই জিয্ইয়ার আসল তাৎপর্য। এটা শুধু যে আনুগত্যের প্রতীক, তা নয়; বরং সামরিক কর্মকান্ড থেকে অব্যাহতি লাভ ও দেশ রক্ষার বিনিময়ও বটে। এ জন্য জিয্ইয়া কেবল যুদ্ধ করতে সক্ষম পুরুষদের ওপরই আরোপ করা হয়। তবে শত্রুদের আক্রমণের সময় দেশের অমুসলিমরা যদি দেশ রক্ষার কাজে অংশ গ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করে, তা হলে ইসলামী সরকার ইচ্ছে করলে তাদেরকেও দেশ রক্ষার কাজে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে তাদের জিয্ইয়া রহিত করতে হবে।
ঘ. মদ ও শুকরের ব্যবসা
মুসলিমদের নিকট মদ ও শুকরের আর্থিক কোন মূল্যমান নেই। তাই মুসলিমের জন্য মদ ও শুকরের বিনিময়ে লেনদেন করা নিষিদ্ধ। কিন্তু অমুসলিমরা যেহেতু এ দুটি বস্ত্তকেই বৈধ বলে জানে এবং এ দুটিই তাদের কাছে আর্থিক মূল্যমান সম্পন্ন, তাই তাদের পরস্পরের মধ্যে মদ ও শুকরের বিনিময়ে লেনদেন করলে তা বিশুদ্ধ হবে। তবে মুসলিম সমাজে প্রকাশ্যে মদের ব্যবসা থেকে তাদেরকে বারণ করা হবে।
ঙ. ক্ষতিপূরণ দান
যদি কোন অমুসলিম কোন মুসলিমের মদ নষ্ট করে কিংবা তার শুকরের কোন রূপ ক্ষতি সাধন করে, তা হলে ইসলামী আইনে মুসলিমদের জন্য এ দুটি বস্ত্তই মূল্যহীন হবার কারণে অমুসলিমকে কোন রূপ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। পক্ষান্তরে কোন মুসলিম কোন অমুসলিমের মদ নষ্ট করলে কিংবা তার শুকরের কোন রূপ ক্ষতি সাধন করলে তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
চ. মুসলিমকে কাজে নিয়োগ করা
ইসলামী রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিক- মুসলিম হোক বা অমুসলিম- পরস্পর একে অপরকে নিজের কাজে বা ফার্মে অথবা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ করতে পারবে। তবে মুসলিমদের জন্য বৈধ নয় ( যেমন- মদ তৈরি ও ব্যবসা, শুকর পালন, সূদী লেনদেন, বাদ্য যন্ত্র নির্মাণ, চিত্র ও ভাস্কর্য তৈরি প্রভৃতি) এ ধরনের কোন কাজে বা ফার্মে কোন মুসলিমকে নিয়োগ দেয়া অমুসলিমের জন্য সঙ্গত নয়।
ছ. অমুসলিমদের সাক্ষ্য
মুসলিমদের বিরুদ্ধে অমুসলিমের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না। ইসলামী আইনে সাক্ষীদের মুসলিম ও ন্যায়-পরায়ণ হবার শর্ত রয়েছে। তবে অমুসলিমরা পরস্পর একে অপরের সাক্ষী হতে পারবে, যদি তারা তাদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী ন্যায়-পরায়ণ রূপে প্রমাণিত হয়। বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের একের বিরুদ্ধে অপরের সাক্ষ্যকে কার্যকর করেছিলেন।
জ. অমুসলিমের বিয়ে
মুসলিমের জন্য ভিন্ন কিতাবের অনুসারী (ইয়াহুদী বা খ্রিস্টান) মহিলাকে বিয়ে করা জায়িয। তবে অন্য কোন ধর্মাবলম্বী মহিলাকে বিয়ে করা বৈধ নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ولا تنكحوا المشركات حتى يؤمنّ.-‘‘ তোমরা মুশরিক মহিলাদের বিয়ে করো না, যে যাবত না তারা ঈমান আনয়ন করে।’’
কোন মুসলিম মহিলার জন্য কোন অমুসলিমকে বিয়ে করা জায়িয নেই। চাই সে আহলে কিতাব হোক কিংবা অন্য কোন ধর্মাবলম্বী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ولا تنكحوا المشركين حتى يؤمنوا.- -‘‘ তোমরা মুশরিকদের বিয়ে করো না, যে যাবত না তারা ঈমান আনবে।’’
ঝ. অমুসলিমের যব্হকৃত প্রাণি ভক্ষণ
অমুসলিমের যব্হকৃত প্রাণি ভক্ষণ করা মুসলিমের জন্য বৈধ নয়; তবে যব্হকারী আহলে কিতাব হলে তাদের যব্হকৃত প্রাণি ভক্ষণ করা জায়িয রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,و طعام الذين أوتوا الكتب حل لكم و طعامكم حل لهم. -‘‘আহলে কিতাবের যব্হকৃত প্রাণি তোমাদের জন্য হালাল আর তোমাদের যব্হকৃত প্রাণি তাদের জন্য হালাল।’’
ঞ. স্বতন্ত্র বেশ-ভূষা
ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিন ও অমুসলিমদের মধ্যে পোশাক ও বেশ-ভূষার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য থাকা প্রয়োজন। নাগরিকদের ওপর রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগ করার জন্য এটা দরকার হয়। যেমন ইসলামী রাষ্ট্রে রমাদান মাসে একজন সুস্থ লোক পানাহাররতঃ অবস্থায় পুলিশের সামনে পড়লে পুলিশের পক্ষে দেখে মুসলিম বা অমুসলিম বুঝা সম্ভব না হলে আইন প্রয়োগ করতে মুশকিলে পড়ে যাবে। অমুসলিম হলে তাকে এ অবস্থায় গ্রেফতার করা যাবে না। তাই ইসলামী রাষ্ট্রে পরিচয় লাভের সুবিধার্থে অমুসলিমদের পোশাক বা বেশভূষা মুসলিমদের থেকে আলাদা হওয়া দরকার। সম্ভবত: এ অসুবিধার কথা বিবেচনা করেই সর্বপ্রথম হযরত ‘উমার ইবন ‘আবদুল ‘আজীজ (রহ.) খ্রিস্টানদেরকে মুসলিমদের মতো পোশাক বা পাগড়ী পরতে নিষেধ করেছিলেন। পরবর্তীতে ‘আববাসীয় খালীফা হারূনুর রশীদ ২য় ‘উমার (রা.)-এর মতো খ্রিস্টানদেরকে মুসলিমদের অনুরূপ পোশাক পরিধান না করার জন্য একটি সাধারণ নির্দেশ জারী করেন। কথিত আছে যে, খালীফা মুতাওয়াক্কিল অমুসলিমদের পোশাকের জন্য হলুদ রং এবং ফাতিমী শাসক হাকিম কালো রং নির্ধারণ করেছিলেন। হিজরী অষ্টম শতাব্দীতে মিসর ও সিরিয়ায় খ্রিস্টানরা নীল, ইয়াহুদীরা হলুদ এবং সামিরারা লাল রং ব্যবহার করত। তারা এই বর্ণের সিল্ক, পাগড়ী ও গলবন্দ ব্যবহার করতে পারত। ফকীহদের মতে, কোন বিশেষ ধরনের পোশাক বা পোশাকের রঙ যদি অমুসলিমদের পরিচয়ের জন্য নির্ধারণ করা হয়, তবে মুসলিমদের জন্য তা ব্যবহার করা জায়িয নয়।
অমুসলিমদের ওপর আরোপিত বিশেষ করসমূহঃ
ইসলামী রাষ্ট্র অমুসলিমদের যে দায়ভার গ্রহণ করে এবং তারা রাষ্ট্রের যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, এর বিনিময় হিসেবে তাদের ওপর কতিপয় বিশেষ কর আরোপ করা হবে। এগুলো হল : জিয্ইয়া, খারাজ ও ‘উশুর।
ক. জিয্ইয়া ( নিরাপত্তা কর)
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের নিরাপদে বসবাস এবং জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা লাভের বিনিময় হিসেবে তাদের ওপর আরোপিত নির্দিষ্ট পরিমাণের সম্পদকে ‘জিয্ইয়া’ বলা হয়। এ কর কেবল যুদ্ধ করতে সক্ষম লোকদের থেকে দেশ রক্ষার দায়িত্ব থেকে তাদেরকে মুক্তি দানের বিনিময় হিসেবে প্রতি বছর আদায় করা হবে। অতএব যারা যুদ্ধ করতে সক্ষম নয় বা যুদ্ধে কোন রূপ অংশ গ্রহণ করে না যেমন- শিশু-কিশোর, নারী, পাগল, দাস-দাসী, প্রতিবন্ধী, উপাসনালয়ের সেবক, সন্যাসী, ভিক্ষ,ু খুনখুনে বৃদ্ধ এবং বছরের বেশির ভাগ সময় রোগে কেটে যায় এমন রোগীকে জিয্ইয়া দিতে হবে না। অধিকন্তু যদি ইসলামী সরকার তাদের জান-মাল-ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা দিতে না পারে, তাহলে তাদের থেকে কোন রূপ জিয্ইয়া আদায় করা যাবে না। বর্ণিত রয়েছে যে, ইয়ারমূকের যুদ্ধে যখন রোমানরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিশাল সমাবেশ ঘটালো এবং মুসলিমরা সিরিয়ার সকল বিজিত এলাকা পরিত্যাগ করে একটি কেন্দ্রে নিজেদের শক্তি কেন্দ্রীভূত করতে বাধ্য হল, তখন হযরত আবূ ‘উবায়দা (রা.) নিজের অধিনস্থ সেনাপতিদের নির্দেশ দিলেন, তোমরা যে সব জিয্ইয়া ও খারাজ অমুসলিমদের নিকট থেকে আদায় করেছিলে তা তাদের ফিরিয়ে দাও এবং বলো যে, ‘‘ এখন আমরা তোমাদের রক্ষা করতে অক্ষম, তাই যে অর্থ তোমাদের রক্ষা করার বিনিময়ে আদায় করেছিলাম তা ফেরত দিচ্ছি।’’ এ নির্দেশ মুতাবিক সকল সেনাপতি আদায় করা অর্থ ফেরত দিলেন। এ সময় অমুসলিম নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে ঐতিহাসিক বালাযূরী লিখেছেন, মুসলিম সেনাপতিগণ যখন সিরিয়ায় হিম্স নগরীতে জিয্ইয়ার অর্থ ফেরত দেন, তখন সেখানকার অধিবাসীরা সমস্বরে বলে ওঠে, لولايتكم و عدلكم أحب إلينا مما كنا فيه من الظلم و الغشم হ و لندفعن جند هرقل عن المدينة مع عاملكم. -‘‘ ইতঃপূর্বে যে যুলম-অত্যাচারে আমরা নিষ্পেষিত হচ্ছিলাম, তার তুলনায় তোমাদের শাসন ও ন্যায়-বিচারকে আমরা বেশি পছন্দ করি। এখন আমরা তোমাদের কর্মচারীদের সাথে যুদ্ধ করে হিরাক্লিয়াসের বাহিনীকে দমন করবো।’’ সেখানকার ইয়াহুদীরা বলে ওঠে, لا يدخل عامل هرقل مدينة إلا أن نغلب و نجهد. -‘‘ আমরা প্রাণপণ যুদ্ধ করে পরাজিত হওয়া ছাড়া কোন ভাবেই হিরাক্লিয়াসের কর্মচারীদেরকে আমাদের শহরে ঢুকতে দেব না।’’
জিয্ইয়ার পরিমাণ তাদের আর্থিক সঙ্গতি অনুযায়ী নির্ধারণ করা হবে। যারা স্বচ্ছল তাদের কাছ থেকে বেশি, যারা মধ্যবিত্ত তাদের কাছ থেকে কিছু কম এবং যারা দরিদ্র তাদের কাছ থেকে অনেক কম নেয়া হবে। আর যার উপার্জনের কোন ব্যবস্থা নেই অথবা যে অন্যের দান-দক্ষিণার ওপর নির্ভর করে বেuঁচ থাকে, তার জিয্ইয়া ক্ষমা করে দেয়া হবে। অধিকাংশ ইমামের মতে জিয্ইয়ার কোন বিশেষ পরিমাণ নির্ধারিত নেই। সরকার তাদের আর্থিক সঙ্গতি বিবেচনা করে যে কোন পরিমাণ নির্ধারণ করবে। তবে তা অবশ্যই এভাবে নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন, যাতে তারা তা সহজে আদায় করতে পারে। এ কর আদায়ে তাদের ওপর কোন রূপ কঠোরতা প্রদর্শন করা নিষিদ্ধ। যা আদায় করা তাদের পক্ষে সহজ নয়, করের এমন বোঝা তাদের ওপর চাপানো যাবে না। হানাফীগণের মতে ধনীদের থেকে বার্ষিক ৪৮ দিরহাম, মধ্যবিত্তদের থেকে ২৪ দিরহাম এবং কর্মক্ষম গরীব লোকদের থেকে ১২ দিরহাম হারে জিয্ইয়া আদায় করা হবে। ইমাম মালিকের মতে- ধনীদের থেকে বার্ষিক ৪০ দিরহাম বা ৪ দীনার এবং গরীব লোকদের থেকে ১০ দিরহাম বা ১ দীনার হারে জিয্ইয়া আদায় করা হবে। শাফি‘ঈগণের মতে- মাথা পিছু এক দীনার আদায় করা বাধ্যতামূলক হবে। জিয্ইয়ার পরিবর্তে তাদের ধন-সম্পদ নীলামে চড়ানো যাবে না, তাদের গরু, গাধা, কাপড়-চোপড় বিক্রি করা যাবে না। হযরত ‘আলী (রা.) তাঁর এক কর্মচারীকে জিয্ইয়া সংগ্রহের উদ্দেশ্য পাঠানোর সময় নির্দেশ দেন, ‘‘ তাদের শীত-গ্রীষ্মের বস্ত্র, খাবারের উপকরণ ও কৃষিকাজের পশু জিয্ইয়া আদায়ের জন্য বিক্রি করবে না, প্রহার করবে না, দাঁড় করিয়ে রেখে শাস্তি দেবে না এবং জিয্ইয়ার বদলায় কোন জিনিস নীলামে চড়াবে না।’’ ইসলামী আইনশাস্ত্রবিদগণের মতে- কোন উপার্জনক্ষম অমুসলিম জিয্ইয়া দিতে অস্বীকার করলে বড় জোর তাকে বিনাশ্রম কারাদন্ড দেয়া যেতে পারে। ইমাম আবূ ইউসূফ (রা.) বলেন, ‘‘ তবে তাদের সাথে সদয় আচরণ করা হবে এবং প্রাপ্য জিয্ইয়া আদায় না করা পর্যন্ত আটক করে রাখা হবে।’’
যে সব অমুসলিম নাগরিক দারিদ্রের শিকার ও পরের ওপর নির্ভর করে চলে, তাদের জিয্ইয়া তো মা‘ফ হবেই, উপরন্তু বাইতুল মাল থেকে তাদের জন্য নিয়মিত সাহায্য ও বরাদ্দ দেয়া হবে। হযরত আবূ বাকর (রা.)-এর আমলে হীরাবাসীদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিপত্রে এ কথাও উল্লেখ করা হয়েছিল যে,أيما شيخ ضعف عن العمل হ أو أصابته آفة من الآفات হ أو كان غنيا فافتقر হ و صار أهل دينه يتصدقون عليه طرحت جزيته হ و عيل من بيت مال المسلمين و عياله ما أقام بدار الهجرة و دار الإسلام . -‘‘ যদি কোন অমুসলিম বৃদ্ধ অকর্মণ্য হয়ে পড়ে, অথবা কোন বিপদে পতিত হয় অথবা কোন সম্পদশালী এমনভাবে দরিদ্র হয়ে পড়ে যে, তার গোত্রের লোকেরা তাকে সাহায্য করতে থাকে এমতাবস্থায় তাকে জিয্ইয়া থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। উপরন্তু মুসলিমদের বাইতুলমাল থেকে তার ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যতদিন সে মদীনায় বা ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে বসবাস করবে।’’
বর্ণিত রয়েছে যে, হযরত ‘উমার (রা.) জনৈক বৃদ্ধ লোককে ভিক্ষা করতে দেখে তার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল, ‘‘ কী আর করবো, জিয্ইয়া দেয়ার জন্য ভিক্ষে করছি।’’ এ কথা শুনে তিনি তৎক্ষণাত তার জিয্ইয়া মাফ করে দিলেন এবং তার ভরণ পোষণের জন্য মাসিক বৃত্তি নির্ধারণ করে দিলেন। তিনি বাইতুল মালের কর্মকর্তাকে লিখলেন,فوالله ما أنصفنا إن أكلنا شبيبتهহ ثم نخذله عند الهرم. -‘‘ আল্লাহর কসম! এটা কখনো ইনসাফ নয় যে, আমরা যৌবনে তার দ্বারা উপকৃত হব, আর বার্ধক্যে তাকে অপমান করব।’’
কোন অমুসলিম নাগরিক মারা গেলে তার কাছে প্রাপ্য বকেয়া জিয্ইয়া তার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে আদায় করা হবে না এবং তার উত্তরাধিকারীদের ওপরও এর দায়ভার চাপানো যাবে না। অনুরূপভাবে কেউ ইসলাম গ্রহণ করলেও তার জিয্ইয়া মাফ হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য যে, জিয্ইয়ার নাম শুনতেই অমুসলিমদের মনে যে আতঙ্ক জন্মে, তা কেবল ইসলামের শত্রুদের দীর্ঘকাল ব্যাপী অপপ্রচারের ফল। অন্যথায় এ আতঙ্কের কোন ভিত্তি নেই। জিয্ইয়া মূলত ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরা যে নিরাপদ ও সুরক্ষিত জীবন যাপনের সুযোগ পায় তারই বিনিময়। ইতঃপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে যে, কেবল সক্ষম ও প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদের কাছ থেকে এটা নেয়া হয়। এটাকে যদি ইসলাম গ্রহণ না করার জরিমানা বলা হয়, তাহলে যাকাতকে কি বলা হবে? যাকাত তো শুধু সক্ষম পুরুষই নয়; বরং নারীর কাছ থেকেও আদায় করা হয়। এটা কি তা হলে ইসলাম গ্রহণের জরিমানা?
খ. খারাজ ( ভূমি কর)
ভূমির ওপর অধিকার এবং তার উৎপাদনের ওপর আরোপিত করকে ‘খারাজ’ বলা হয়। মুসলিমরা যেমন তাদের ভূমি থেকে উৎপন্ন ফসলের ‘উশর আদায় করে থাকে, তেমনি অমুসলিদেরকেও তাদের ভূমি থেকে উৎপন্ন ফসলের একটি নির্ধারিত পরিমাণ শস্য খারাজ হিসেবে আদায় করতে হবে। তবে সরকার ইচ্ছে করলে ভূমির আয়তন ও ফসলের প্রকৃতি বিচার করে বার্ষিক একটা পরিমাণ ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে নির্ধারণও করে দিতে পারে।
উল্লেখ্য যে, খারাজ ভূমির উৎপাদন ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে আরোপ করা হবে। অতএব ঘর-বাড়ি এবং ফসলের অনুপযোগী অনাবাদী জমির ওপর কোন কর আরোপ করা যাবে না। তবে ফসলের উপযোগী ভূমিতে ফসল ফলানো না হলেও খারাজ আদায় করতে হবে। তদুপরি এ কর ছোট-বড়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের বেলায় প্রযোজ্য হবে।
গ. ‘উশুর (বাণিজ্যিক কর)
‘উশুর হল অমুসলিমদের ব্যবসায়িক পণ্যের ওপর আরোপিত কর। মুসলিমদের ওপর যেমন বৎসরে একবার তাদের সম্পদের যাকাত আদায় করা বাধ্যতামূলক, তেমনি অমুসলিমদের ওপরও বৎসরে এক বার তাদের বাণিজ্য পণ্যের কর প্রদান করা বাধ্যতামূলক। তবে তাদের বাণিজ্য পণ্য সামগ্রীর কি হারে কর আদায় করতে হবে তা কুর’আন ও হাদীসের স্পষ্ট বক্তব্য দ্বারা জানা যায় না। এটা নিরেট ইজতিহাদ ও গবেষণালব্ধ বিষয়সমূহের অর্ন্তভুক্ত। তাই এটা নিয়ে ইমামগণের মধ্যে মতবিরোধ দেখা যায়। হানাফী ও হাম্বলীগণের মতে- শতকরা পাঁচ ভাগ হারে কর আদায় করতে হবে। তাদের দলীল হল- হযরত ‘উমার (রা.) শতকরা পাঁচভাগ হারে অমুসলিমদের থেকে কর আদায় করতেন। মালিকীগণের মতে- অমুসলিমদের বাণিজ্য করের পরিমাণ হল শতকরা দশভাগ। শাফি‘ঈগণের মতে, এর জন্য নির্ধারিত কোন পরিমাণ নেই। সরকার ন্যায়নীতির ভিত্তিতে সমসাময়িক পরিস্থিতির চাহিদা অনুসারে তা নির্ধারণ করবে। আমি মনে করি, এ মতটিই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
হানাফীগণের মতে- ব্যবসায়ী মুস্তা’মান হলে তার নিকট থেকে ঠিক সে পরিমাণ কর আদায় করা হবে, যে পরিমাণ কর দারুল হারব বিদেশী ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে আদায় করে থাকে। যেমন দারুল হারব বিদেশী মুসলিম ব্যবসায়ী থেকে শতকরা দশভাগ হারে কর আদায় করলে ইসলামী রাষ্ট্রও ঠিক দশভাগ হারে, আর যদি তারা শতকরা পাঁচভাগ হারে আদায় করে, তাহলে ইসলামী রাষ্ট্রও ঠিক পাঁচ ভাগ হারেই কর আদায় করবে। হযরত ‘উমার (রা.) হযরত আবূ মূসা আল আশ‘আরী (রা.)কে নির্দেশ দিয়ে বলেন, خذ أنت منهم كما يأخذون من تجارنا.-‘‘তুমি তাদের থেকে ঠিক তা-ই গ্রহণ করবে, যা তারা আমাদের ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে গ্রহণ করে থাকে।’’ অন্যান্য ইমামগণের মতে ‘উশুর আদায় করার ক্ষেত্রে যিম্মী ও মুস্তা’মানের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সকলের জন্য একই হার প্রযোজ্য হবে। উল্লেখ্য যে, সরকার প্রয়োজন ও কল্যাণকর মনে করলে যে কোন সময় এবং যে কোন পণ্যের ক্ষেত্রে অমুসলিমদেরকে এ কর থেকে রেহাই দিতে পারে।
‘উশুর আদায়ের শর্তাবলী :
1. নিসাব পূর্ণ হওয়া
যাকাতের নিসাবের মতোই ‘উশুরের নিসাব হল ২০০ দিরহাম কিংবা ২০ দীনার। অর্থাৎ বাণিজ্য পণ্যের মোট মূল্য ২০০ দিরহাম রৌপ্য কিংবা ২০ দীনার স্বর্ণের সমপরিমাণ হলে ‘উশুর ওয়াজিব হবে। এটা হানাফীগণের অভিমত। ইমাম আহমাদ (রহ.) থেকেও এ ধরনের একটি মত বর্ণিত রয়েছে। মালিকীগণের মতে- ‘উশুরের কোন নিসাব নির্ধারিত নেই। কম-বেশি যা-ই হোক তাতে ‘উশুর আদায় বাধ্যতামূলক হবে।
2. বাণিজ্য পণ্যের স্থানান্তর
অনেকের মতে- অমুসলিমরা যখন বাণিজ্য পণ্য নিয়ে দেশের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা গিয়ে ব্যবসা করবে, তখনই ‘উশুর ওয়াজিব হবে। নিজের এলাকায় বসে ব্যবসা করলে এর জন্য ‘উশুর দিতে হবে না।
3. বাণিজ্য পণ্যের এক বছর কাল স্থায়িত্ব
যে সব পণ্যসামগ্রী ন্যূনতম এক বৎসর স্থায়ী থাকে (যেমন-চাল, গম, বস্ত্র ইত্যাদি), তাতে ‘উশুর বাধ্যতামূলক হবে। পক্ষান্তরে যে সব পণ্য এক বছরের কম সময় পর্যন্ত স্থায়ী থাকে (যেমন- শাক-সব্জি ও ফলমূল ইত্যাদি) তাতে ‘উশুর ওয়াজিব হবে না, যদিও তার মূল্য নিসাব পরিমাণ পৌঁছে। এটা ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর অভিমত। তবে ইমাম আবূ ইউসূফ ও মুহাম্মাদ (রহ.) প্রমুখের মতে-‘উশুর ওয়াজিব হবার জন্য এ ধরনের কোন শর্ত নেই। যে কোন পণ্য সামগ্রী তার স্থায়িত্ব কাল যে পরিমাণই হোক তাতে ‘উশুর ওয়াজিব হবে।
4. ঋণমুক্ত হওয়া
ঋণ বাদ দিয়ে পণ্য সামগ্রীর মূল্য নিসাব পরিমাণ পৌঁছলেই ‘উশুর ওয়াজিব হবে। যদি কোন অমুসলিম ঋণগ্রস্ত হয় এবং ঋণের অর্থ বাদ দেয়ার পর তার মজুদ পণ্য সামগ্রীর মূল্য নিসাব পরিমাণ না হয়, তা হলে তার জন্য ‘উশুর প্রদান বাধ্যতামূলক হবে না।
অমুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ কর্মকান্ডঃ
ক. ইসলাম ও মুসলিম সম্পর্কে অযাচিত মন্তব্য
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের জন্য এ ধরনের কোন মন্তব্য করা বিধেয় নয়, যাতে মুসলিমদের জীবন যাত্রায় ব্যাঘাত ঘটে এবং ইসলামের মর্যাদা নষ্ট হয়। এ কারণে আল্লাহ, রাসূল, ইসলাম, কুর’আন...প্রভৃতি বিষয়ে কুরুচিপূর্ণ ও অশালীন মন্তব্য করা থেকে তাদেরকে বারণ করা হবে।
খ. মুসলিম জনপদে প্রকাশ্যে মদ ও শুকরের ব্যবসা
ইসলামী রাষ্ট্রের একান্ত মুসলিম জনপদের মধ্যে বা শহরে প্রকাশ্যে মদ ও শুকরের ব্যবসা করা থেকেও অমুসলিমদের বারণ করা হবে। তবে তাদের একান্ত জনপদে প্রকাশ্যে কিংবা শহরে তাদের নির্দিষ্ট পরিমন্ডলে এগুলোর ব্যবসা করা তাদের জন্য দূষণীয় হবে না।
গ.অন্যায়- অশ্লীলতা
যে সব অন্যায় কর্মকান্ড (যেমন- অশ্লীলতা, ব্যভিচার ও গর্ভপাত প্রভৃতি) অমুসলিম ধর্মমতে নিষিদ্ধ, সে সব কর্মকান্ড পরিচালনা ও সম্পাদন করা থেকে সর্বাবস্থায় তাদেরকে বারণ করা হবে। চাই সেটা মুসলিম জনপদে হোক কিংবা তাদের জনপদে।


অমুসলিমের অপরাধ ও শাস্তির বিধানঃ
ক. হদ্দ জাতীয় অপরাধের শাস্তি
যদি কোন অমুসলিম হদ্দ জাতীয় কোন অপরাধে ( যেমন-চুরি, ডাকাতি, যিনা ও যিনার অপবাদ আরোপ প্রভৃতি) লিপ্ত হয়, তাহলে তাদেরকে ঐ সকল অপরাধের জন্য নির্ধারিত শাস্তি ভোগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের জন্য আইন সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। তবে যেহেতু তারা মদ সেবনকে বৈধ বলে বিশ্বাস করে, তাই তাদের ক্ষেত্রে মদ্যপানের শাস্তি প্রযোজ্য হবে না, যদি তারা খোলামেলাভাবে মদ সেবন না করে। যদি তারা মুসলিম জনপদের মধ্যে প্রকাশ্যে মদ সেবন করে, তা হলে তাদেরকে সাধারণ দন্ড দেয়া যাবে।
অনুরূপভাবে কেউ কোন অমুসলিম- পুরুষ বা নারী-কে যিনার অপবাদ দিলে তার জন্য হদ্দ প্রযোজ্য হবে না; তবে তা‘যীরের আওতায় যে কোন সাধারণ উপযুক্ত দন্ড দেয়া যাবে। চাই অপবাদ দানকারী মুসলিম হোক কিংবা অমুসলিম। কারণ যিনার অপবাদের হদ্দ কার্যকর করার অন্যতম শর্ত হল অপবাদ আরোপিত ব্যক্তিকে মুসলিম হতে হবে।
মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে যে কোন চোরের বেলায় চুরির হদ্দ কার্যকর করা হবে। চাই যার সম্পদ চুরি করা হয়েছে সে মুসলিম হোক কিংবা অমুসলিম। তবে চুরিকৃত মাল মদ কিংবা শুকর হলে তার জন্য চুরির হদ্দ কার্যকর করা যাবে না।
যদি অমুসলিমদের একটি দল মুসলিমদের থেকে আলাদা হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে, তা হলে ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে তাদের কৃত চুক্তি ভেঙ্গে যাবে এবং তাদের নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যাবে।
খ. কিসাস জাতীয় অপরাধের শাস্তি
ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের জন্য হত্যাকান্ডের ক্ষেত্রে কিসাসের বিধান সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। যদি কোন মুসলিম কোন অমুসলিমকে কিংবা কোন অমুসলিম অপর কোন অমুসলিম অথবা কোন মুসলিমকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে, তা হলে হত্যাকারীর শাস্তি হল মৃত্যুদন্ড। এ ক্ষেত্রে মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে কোন রূপ বৈষম্য করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আমলে জনৈক মুসলিম এক অমুসলিমকে হত্যা করলে তিনি খুনীকে মৃত্যুদন্ড দেন। তিনি বলেন,أنا أحق من وفى بذمته. -‘‘ যে অমুসলিম নাগরিক তার চুক্তি রক্ষা করবে, তার রক্তের বদলা নেয়ার দায়িত্ব আমারই।’’ হযরত ‘উমার (রা.)-এর আমলে বাকর ইবন ওয়া’ইল গোত্রের এক ব্যক্তি জনৈক হীরাবাসী অমুসলিমকে হত্যা করে। তিনি খুনীকে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের হাতে সমর্পনের আদেশ দেন। অতঃপর তাকে উত্তরাধিকারীদের হাতে সমর্পন করা হলে তারা তাকে হত্যা করে।’’
তা ছাড়া ভুলবশত ও কারণবশত হত্যার ক্ষেত্রেও অমুসলিমদের জন্য মুসলিমদের মতো একই রূপ দিয়াতের বিধান প্রযোজ্য হবে। তবে যে সকল হত্যার জন্য কাফফারা ওয়াজিব হয় এবং কাফফারার মধ্যে যেহেতু শাস্তির পাশাপাশি ‘ইবাদাতের আমেজ মিশ্রিত থাকে, তাই এ বিধান অমুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য হবে না।
মানবদেহের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের (যেমন- অঙ্গকর্তন, বিচ্ছিন্নকরণ, অকেজোকরণ ও ক্ষতিসাধন এবং বিভিন্ন আঘাত প্রভৃতি) ক্ষেত্রেও মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের জন্য কিসাস ও দিয়াতের বিধান সমানভাবে প্রযোজ্য হবে।
গ. সাধারণ অপরাধের শাস্তি
যে কোন অমুসলিমের সাধারণ অপরাধের জন্য বিচারক অপরাধীর অবস্থা এবং অপরাধের প্রকৃতি ও মাত্রা বিচার-বিশ্লেষণ করে যে কোন রূপ উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের জন্য একই রূপ বিধান সমানভাবে কার্যকর করা হবে। তাদের মধ্যে কোন রূপ বৈষম্য সৃষ্টি করা চলবে না।
পাবলিক কোর্টে বিচার ঃ
মুসলিমদের মতোই অমুসলিমরাও রাষ্ট্রের ইসলামী আদালতে বিচার দায়ের করবে এবং তা মেনে চলবে। তবে অমুসলিমদের জন্য পৃথক বিচারালয় তৈরি, বিশেষ করে তাদের নিজস্ব পারিবারিক আইনের জন্য পৃথক বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং সেখানে অমুসলিম বিচারক কর্তৃক তাদের অপরাধ ও দাবী-দাওয়াসমূহের বিচারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে ইসলামী আদালতে বিচার দায়ের হলে মুসলিম বিচারক কর্তৃক তাদের বিবাদের ফায়সালা করা ওয়াজিব হবে এবং তিনি ইসলামী আইন অনুযায়ী ফায়সালা করবেন। অন্য আইনে ফায়সালা করা তাঁর জন্য বৈধ হবে না। চাই বাদী-বিবাদী দুজনেই অমুসলিম হোক কিংবা একজন অমুসলিম এবং অপরজন মুসলিম হোক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, و أن احكم بينهم بما أنزل الله و لا تتبع أهواءهم و احذرهم أن يفتنوك عن بعض ما أنزل الله إليك. -‘‘ আর আপনি তাদের পারস্পরিক ব্যাপারাদিতে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করুন। তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না এবং তাদের থেকে সতর্ক থাকুন, যেন তারা আপনাকে এমন কোন নির্দেশ থেকে বিচ্যুত না করে, যা আল্লাহ তা‘আলা আপনার প্রতি নাযিল করেছেন।’’
অমুসলিমদের নাগরিকত্ব নষ্টের কারণঃ
অমুসলিম নাগরিকদের নাগরিক মর্যাদা রক্ষা করা এবং তাদের অধিকারসমূহ নিশ্চিত করা ইসলামী রাষ্ট্রের একান্ত দায়িত্ব। তারা যত বড় অপরাধই করুক, এ জন্য তাদের নাগরিকত্ব বাতিল হবে না। এমন কি জিয্ইয়া বন্ধ করে দিলে, কোন মুসলিমকে হত্যা করলে, কোন মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করলে এবং ইসলাম, মুসলিম, আল্লাহ ও মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে আপত্তিকর ও অশোভনীয় মন্তব্য করলেও তাদের নাগরিকত্ব বাতিল হবে না। এ সব অপরাধের জন্য তাকে অবশ্যই শাস্তি দেয়া হবে। তবে নিম্নের দুটি অবস্থায় তাদের নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায়। প্রথমত যদি সে ইসলামী রাষ্ট্র থেকে চলে গিয়ে শত্রুদেশে গিয়ে বসবাস শুরু করে। দ্বিতীয়ত যদি সে ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহে লিপ্ত হয়ে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে। অধিকাংশ ইমামের মতে- অমুসলিমরা চুক্তি মতে জিয্ইয়া আদায় করা থেকে বিরত থাকলে তাদের নাগরিক চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে। তবে হানাফীগণের মতে- এ অবস্থায়ও তাদের নাগরিকত্ব বাতিল হবে না। কেননা এ রূপ অবস্থায় আর্থিক অনটন ও অভাবের কারণে সে জিয্ইয়া আদায় করতে পারছে না, এ ধরনের আশঙ্কা থাকতেই পারে। আর এ রূপ সন্দেহজনক অবস্থায় কারো নাগরিকত্ব বাতিল করা ন্যায়-নীতি বিরোধী হবে।
অমুসলিমদের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মহানুভবতাঃ
অমুসলিমদের প্রতি মহানুভবতা ছিল রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর জীবনের অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তিনি মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকল মানুষের সাথে সমান আচরণ করতেন। সবারই অধিকারের নিশ্চয়তার বিধান রয়েছে তাঁর জীবনাদর্শে। তিনি একই রাষ্ট্রে অমুসলিমদের সাথে পারস্পরিক সৌহার্দ ও সম্প্রীতির সাথে বসবাস করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তিনি জোরপূর্বক কোন অমুসলিমের প্রতি তাঁর প্রচারিত ধর্ম চাপিয়ে দেন নি এবং কারো সংস্কৃতিকে ইসলামী সংস্কৃতি দ্বারা গ্রাস করাবার নীতিও অবলম্বন করেন নি। তিনি কোন দিনও ব্যক্তিগত কারণে কোন অমুসলিমের অপরাধের প্রতিশোধ গ্রহণ করেন নি। তিনি আপন প্রাণের শত্রুকেও ক্ষমা করে দিতেন। তাঁর ক্ষমা, মার্জনা ও মহানুভবতার চারিত্রিক গুণটিই ইসলাম প্রচারে সর্বাধিক অবদান রেখেছে। নিম্নে অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণ এবং তাদের প্রতি তাঁর মহানুভবতার কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলঃ
ক. শত্রুদের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ক্ষমা ও মহানুভবতা
শত্রুদের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ক্ষমা ও মহানুভবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে, মক্কা বিজয়ের পর মক্কাবাসী অমুসলিমদের প্রতি তাঁর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা। শান্তিপূর্ণভাবে মক্কা বিজয় শেষে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করলেন, ‘‘ মুসলিমদের পরিত্যক্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ফেরত নেওয়া হবে না; বরং তা সকল অমুসলিম দখলদারের দখলেই থাকবে।’’ এমনকি তিনি নিজের বাসস্থানটিও পুনঃগ্রহণ করেন নি। এরপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কার সবাইকে বাইতুল্লাহ শরীফে সমবেত হবার জন্য ঘোষণা দিলেন। সবাই সমবেত হলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অমুসলিম মক্কাবাসীদের লক্ষ্য করে তাদের বিগত বিশ বছরের ইসলামের সাথে চরম শত্রুতামূলক আচরণের বর্ণনা দিয়ে জানতে চাইলেন,ما ترون أني فاعل فيكم ؟ -‘‘এখন তোমরা আমরা নিকট কি রূপ আচরণ আশা কর?’’ তখন তারা লজ্জায় শুধু এতটুকু বলল,خيرا হ أخ كريم ابن أخ كريم. -‘‘ আমার আপনার নিকট ভাল আচরণই আশা করি। আপনি তো আমাদের একজন মহানুভব ভাই, একজন বড়ই মহানুভব ভাইয়ের সন্তান।’’ এরপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সে ঐতিহাসিক প্রত্যুত্তর প্রদান করলেন, যা হযরত ইউসূফ (আ.) স্বীয় অপরাধী ভাইদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,لا تثريب عليكم اليوم يغفر الله لكم و هو أرحم الراحمين. اذهبوا فأنتم الطلقاء. ‘‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনিই শ্রেষ্ঠ দয়ালু। যাও! তোমরা মুক্ত।’’
শত্রুদের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ক্ষমা ও মহানুভবতার আরেকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে- ইয়ামামাহর হানীফা গোত্রের সর্দার ছুমামাহ ইবনু উছাল (রা.)। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও মুসলিমদের প্রাণের শত্রু ছিলেন। এ সময় তিনি কয়েকজন সাহাবীকে হাতের নাগালে পেয়ে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে হত্যা করেন। ফলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে হত্যার অনুমতিও দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি যখন মুসলিমদের হাতে বন্দী হন, তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সবাইকে তাঁর সাথে ভাল আচরণ করার নির্দেশ দেন। সে সময় বাড়িতে যা খাবার ছিল তিনি তা একত্রিত করে তাঁর সামনে পরিবেশন করেন। তারপর সকাল-সন্ধ্যায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উট দোহন করে তার দুধ ছুমামাহর নিকট পাঠিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। অবশেষে তাঁকে কাছে পেয়েও কোনরূপ শাস্তি ছাড়াই মুক্ত করে দেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এ আচরণে মুগ্ধ হয়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
খ. হাদিয়া আদান-প্রদান
মানবিক ও সামাজিক আচার-আচরণের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে তারতম্য করতেন না। তিনি অমুসলিমদের উপহার-উপঢৌকন গ্রহণ করতেন এবং তাদের বদলাও দিতেন। তাঁর এ মহানুভবতার সুযোগ নিয়ে খাইবারের ইয়াহুদী সর্দার সাল্লাম ইবন মিশকমের স্ত্রী যায়নব বিনতুল হারিছ তাঁকে বিষ মিশ্রিত গোশত খাওয়াতে সক্ষম হয়। বিশর ইবনুল বারা’ (রা.) নামক এক সাহাবী তা খাওয়ার ফলে প্রাণও হারান।
গ. কুশলাদি জানা ও দেখা সাক্ষাত করা
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অমুসলিমদের খোঁজ-খবর নিতেন, অসুস্থ হলে রোগ শয্যায় গিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করতেন এবং তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানাতেন। কোন অমুসলিম যদি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাঁর সেবা করতে চাইত, তবে তিনি তাকে বাধা দিতেন না। এ সুযোগে অনেক ইয়াহুদী তাঁর সাথে অশোভন আচরণ করত; কিন্তু তিনি সর্বদাই তাদের ক্ষমা করতেন। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ইয়াহুদী বালক রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সেবা করত। একবার সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাuঁক দেখতে যান এবং ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেন।’’
ঘ. আতিথেয়তা
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অমুসলিমদের মেহমানদারী করতে কখনো অনীহা বোধ করেন নি। তাঁর নিকট প্রায়ই অমুসলিম মেহমানদের আগমন ঘটত। তারা অনেক সময় প্রচুর পরিমাণ আহার গ্রহণ করে উদর পূর্তি করত। একবার এক অমুসলিম সাতটি বকরীর দুধ নিঃশেষ করে দিয়েছিল। অমুসলিম মেহমানদের আদর-যত্নে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন ত্রুটি করতেন না। তিনি নিজ হাতে তাদের খাওয়া পরিবেশ করতেন। তাঁর মেহমানদারী ও উদারতায় মুগ্ধ হয়ে বহু অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করে। অনেক সময় অমুসলিম মেহমান মজলিসের শিষ্টাচার ভঙ্গ করত; কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)তাদেরকে ক্ষমা করতেন।
ঙ. বেচাকেনা ও লেনদেন করা
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অমুসলিমদের সাথে বেচাকেনা ও লেনদেন করতেন। হযরত ‘আইশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : ‘‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মৃত্যুর সময় তাঁর লৌহ বর্মটি ৩০ সা‘ যবের পরিবর্তে এক ইয়াহুদীর কাছে বন্ধক ছিল।’’
চ. অমুসলিমদের অধিকার আদায়ের নির্দেশ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিভিন্ন হাদীসে মুসলিমগণকে অমুসলিমদের অধিকারসমূহ যথাযথরূপে আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ألا من ظلم معاهدا হ أو انةقصه حقه হ أو كلفه فوق طاقةه হ أو أخذ منه شيئا بغير طيب نفس منه فأنا حجيجه يوم القيامة. -‘‘ যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের প্রতি অবিচার করল কিংবা তার অধিকার ক্ষুণ্ণ করল বা তাকে তার সাধ্যের বাইরে কষ্ট দিল অথবা তার সন্তুষ্টি ছাড়াই কোন কিছু তার কাছ থেকে কেড়ে নিল, এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিয়ামাতের দিন (আল্লাহর দরবারে) আমি নিজেই ফরিয়াদী হবো।’’ অন্য হাদীসে তিনি তাদের রক্তের পবিত্রতা নষ্টকারীদের কঠোর ভাষায় সতর্ক করে বলেছেন,من قتل معاهدا لم يرح رائحة الجنة و إن ريحها يوجد من مسيرة أربعين عاما. -‘‘যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমকে হত্যা করবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের ঘ্রাণ চল্লিশ বৎসরের দূরত্ব থেকে অনুভব করা যায়।’’
ছ. অমুসলিমদের সাথে সদ্ভাব প্রতিষ্ঠার নির্দেশ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিভিন্ন হাদীসে মুসলিমগণকে অমুসলিমদের সাথে সদ্ভাব প্রতিষ্ঠার ও সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশী অমুসলিম হলেও তাদের সাথে সামাজিক সদ্ভাব রক্ষা করে চলতে হবে। হযরত আসমা’ বিনতে আবী বাকর (রা.)কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) নির্দেশ দেন, صلي أمك.-‘‘ তুমি তোমার মায়ের সাথে সদ্ভাব রাখবে।’’ হযরত মুজাহিদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদিন হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘উমারের (রা) নিকট বসা ছিলাম। পাশে তার এক গোলাম বকরীর চামড়া খসিয়ে ফেলতে ছিল। তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘‘চামড়া খসানো শেষ হবার পর সর্বপ্রথম আমার ইয়াহুদী প্রতিবেশীকে দিয়ে বন্টন শুরু করো। তখন উপস্থিতদের একজন আশ্চর্য হয়ে বলে ওঠল, ইয়াহুদী! আল্লাহ আপনাকে সুস্থ করুন! তখন তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে প্রতিবেশীর ব্যাপারে এভাবেই অসিয়ত করতে শুনেছি যে, আমার তো মনে হয়েছিল যে, তিনি না জানি প্রতিবেশীকে ওয়ারিছ বানিয়ে দেন।’’
অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণে মুসলিম শাসকগণের ভূমিকাঃ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওফাতের পর তাঁর সত্যনিষ্ঠ খালীফাগণ অমুসলিমদের অধিকার আদায়ের প্রতি যত্নবান ছিলেন। তাঁরাও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মত ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের সাথে পারস্পরিক সৌহার্দ ও সম্প্রীতির সাথে বসবাস করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তাঁরা অমুসলিম অধিবাসীদের অধিকার ও স্বাধীনতা এভাবেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে, মানবেতিহাসে তার নজীর অভূতপূর্ব। হযরত ‘উমার (রা.) তাঁর গভর্ণরদেরকে অমুসলিম নাগরিকদের অঙ্গিকার পূরণ করতে, তাদেরকে রক্ষার জন্য লড়াই করতে এবং তাদেরকে সাধ্যের বাইরে কষ্ট না দিতে নির্দেশ দেন।’’ জেরুসালেম যখন খালীফা উমার (রা.)-এর কাছে আত্মসমর্পন করে, তখন এ বিজিত নগরীর অধিবাসীদের ধর্ম ও সম্পদ তাদের হাতেই ছিল এবং তাদের উপাসনার স্বাধীনতাও অক্ষুণ্ণ ছিল। খ্রিস্টানদের এবং তাদের প্রধান যাজক ও তার অনুসারীদের বসবাসের জন্য নগরের একটি এলাকা ছেড়ে দেয়া হল। বিজয়ী মুসলিমরা এ পবিত্র নগরীতে তাদের তীর্থ যাত্রার অধিকার খর্ব তো করলই না বরং উৎসাহিত করল। ৪৬০ বছর পর জেরুসালেম ইউরোপের খ্রিস্টীয় ধর্মযোদ্ধাদের অধীনে খ্রিস্ট শাসনে চলে গেলে প্রাচ্যের খ্রিস্টানরা সদাশয় খালীফাদের শাসনের অবসানে অনুশোচনাই করেছিল। গ্রীস থেকে ওক্সাস পর্যন্ত বিশাল ভূখন্ডের অধিবাসী পার্সীরা তাদের আবহমান কালের ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে মুসলিম বিজয়ীদের ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং আফ্রিকার আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কার্থেজ পর্যন্ত অঞ্চলে ইসলামের প্রসারের সাথে খ্রিস্টান ধর্ম একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এ বিশাল এলাকা জুড়ে এ ধর্ম বিপ্লবের কারণ নতুন ধর্মে সহনশীলতার অভাব নয়, পুরাতন ধর্মবিশ্বাসের জীর্ণদশা আর চরম বিশৃঙ্খলার পরিণতি। ইসলামের দীর্ঘ ইতিহাসে কোথাও কোন অমুসলিমকে স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য জোর করা হয়েছে- এ ধরনের কোন নজীর নেই। টমাস আর্নল্ড বলেছেন, ‘‘অমুসলিমদেরকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবার কোন প্রচেষ্টা কিংবা খ্রিস্টান ধর্ম নির্মূল করবার উদ্দেশ্যে কোন নির্যাতনের কথা আমি শুনি নি।’’ ঐতিহাসিক ফিনলে বলেন, ‘‘ যেখানে আরবরা কোন খ্রিস্টান দেশ জয় করেছে সব ক্ষেত্রে ইতিহাস প্রমাণ করে যে, বিজিত দেশের জনগণ ইসলামের দ্রুত প্রসারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। দুঃখজনক যে, অধিকাংশ খ্রিস্টান সরকারের শাসনব্যবস্থা বিজয়ী আরবদের চেয়ে দুর্বিসহ ছিল। সিরিয়ার জনগণ মুহাম্মাদের অনুসারীদের স্বাগত জানালো। মিশরীয় খ্রিস্টানরা তাদের দেশ আরবদের অধীনে নিয়ে যেতে যথেষ্ট সাহায্য করল। আর আফ্রিকার খ্রিস্টান বার্বাররা তো মুসলিমদের আফ্রিকা বিজয়ে সরাসরি অংশগ্রহণই করেছিল। কনস্টানটিনোপল সরকারের বিরুদ্ধে এ দেশগুলোর তীব্র ঘৃণার জন্য তারা মুসলিম শাসককে বরণ করে নিল।’’
এ কথা অনস্বীকার্য যে, পরবর্তী রাজতন্ত্রের যুগে অমুসলিমরা অনেক জায়গায় যুলম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তবে যখনই কোথাও অমুসলিমদের সাথে অবিচার করা হয়েছে, তাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে, তখন মুসলিম মনীষীগণ সর্বাগ্রে মযলুম অমুসলিমদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
বর্ণিত রয়েছে যে, উমাইয়্যা শাসক ওয়ালীদ ইবন ‘আবদুল মালিক দামেস্কের ইউহান্না গীর্জাকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে মসজিদের অর্ন্তভুক্ত করে নিয়েছিলেন। হযরত ‘উমার ইবন আবদুল ‘আযীয (রা.) ক্ষমতায় এলে খ্রিস্টানরা এ ব্যাপারে তাঁর কাছে অভিযোগ দায়ের করল। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে লিখে পাঠালেন, মসজিদের যে টুকুই অংশ গীর্জার জায়গার ওপর নির্মাণ করা হয়েছে, তা ভেঙ্গে খ্রিস্টানদের হাতে সুপর্দ করে দাও।
অপর একজন অমুসলিম একদিন খালীফা ‘উমার ইবন ‘আবদুল ‘আযীয (রহ.)-এর দরবারে আপীল করে যে, ‘আববাস ইবন ওয়ালীদ অন্যায়ভাবে তার ভূমি দখল করে রেখেছে। খালীফা ‘আববাসকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন : ‘‘এ অমুসলিম ব্যক্তির দাবীর ব্যাপারে তোমার বক্তব্য কি? আববাস জবাব দিল, ‘‘আমার পিতা ওয়ালীদ এ ভূমি আমার জায়গীরদারীতে অর্পন করেছেন।’’ এ কথা শুনে অমুসলিম ব্যক্তিটি বলল, ‘‘আমীরুল মু’মিনীন! আপনি আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ফায়সালা করুন।’’ খালীফা বললেন, ‘‘আববাস! আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী অমুসলিমদের ভূমি জবর দখল করে তাতে কাউকে জায়গীরদারী দেয়া যায় না।’’ ‘আববাস বললো,‘‘আপনার কথা সত্য; কিন্তু আমার নিকট খলীফা ওয়ালীদের প্রমাণপত্র রয়েছে। আপনার পূর্বের একজন খালীফার ফরমান রদ করার কী অধিকার আপনার আছে?’’ খালীফা জবাব দিলেন, نعم হ كتاب الله أحق أن يتبع من كتاب الوليدহ قم فاردد عليه ضيعته.‘‘ ওয়ালীদের প্রমাণপত্রের চাইতে আল্লাহর কিতাব অনেক উর্ধ্বে। ভূমি এ অমুসলিমকে ফেরত দিয়ে দাও।’’
ইমাম আবূ ইউসূফ (রহ.) আববাসীয় খালীফা হারুনুর রশীদকে অসিয়ত করেন, ‘‘অমুসলিম নাগরিকদের সাথে সদয় আচরণ করবেন, তাদের খোঁজ-খবর নেবেন, যাতে তারা কোন রূপ অন্যায়-অবিচারের সম্মুখীন না হয়, কষ্টে পড়ে না যায়, সাধ্যের বাইরে তাদের ওপর যেন কোন বোঝা চাপানো না হয় এবং অন্যায়ভাবে তাদের থেকে কোন সম্পদ যেন গ্রহণ করা না হয়।’’
অমুসলিম গবেষক ও চিন্তাবিদদের মতামতঃ
ক. ইসলামের প্রাথমিক কালে শামের খ্রিস্টানরা হযরত আবূ ‘উবায়দা ইবনুল জররাহ (রা.)কে উদ্দেশ্য করে লিখেন, يا معشر المسلمين أنتم أحب إلينا من الروم وإن كانوا على ديننا أنتم أوفى لنا وأرأف بنا وأكف عن ظلمنا وأحسن ولاية علينا.-‘‘ হে মুসলিম সম্প্রদায়! তোমরা আমাদের কাছে রোমানদের চাইতে অধিকতর প্রিয়, যদিও তারা আমাদের স্বধর্মী। কেননা তোমরা অধিকতর অঙ্গিকার রক্ষাকারী, দয়ালু, যুলম প্রতিহতকারী এবং আমাদের উত্তম শাসক।’’
খ. বিশিষ্ট ঐতিহাসিক টমাস আর্নল্ড বলেন, ‘‘খ্রিস্টানরা মুসলিম সমাজে ধর্মীয় স্বাধীনতার মত জীবন ও ধন-সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা ভোগ করত। বিশেষ করে খিলাফাতের প্রাথমিক কালে শহরগুলোতে তারা সুখ-সাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন যাপন করত।’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা যখন প্রাথমিক যুগে খ্রিস্টান প্রজাদের প্রতি মুসলিম সরকারের এমন বিস্ময়কর ন্যায়বিচার ও ধর্মীয় উদারতা দেখতে পাই, তখন দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তরবারির জোরে ইসলামের প্রচার ও প্রসার সম্পর্কে যে প্রচারণা চালানো হয় তা আদৌ বিশ্বাস ও ভ্রুক্ষেপ করার যোগ্য নয়।’’
গ. প্রখ্যাত জার্মান লেখিকা হঙ্গ বলেন, ‘‘আরবরা বিজিত জাতিগুলোকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে চাপ দেয়নি। অথচ যে সব খ্রিস্টান, যরথুস্ত্রী ও ইয়াহুদীরা ইসলাম পূর্বকালে জঘন্যতর ও ঘৃণ্যতম ধর্মীয় গোঁড়ামী ও সংকীর্ণতার নিগড়ে আবদ্ধ ছিল, ইসলাম তাদের সকলকে কোন বাধা বিঘ্ন ছাড়াই তাদের নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা দান করে। অধিকন্তু মুসলিমরা তাদের উপাসনালয়, গীর্জা, আশ্রমগুলোর কোনরূপ ক্ষতিসাধন করে নি। দুনিয়ার ইতিহাস এ জাতীয় আচরণ ও মহানুভবতা দেখেনি।... নতুন মুসলিম শাসক ও নৃপতিগণ বিজিত জাতিসমূহের কাজ-কারবারে কোন রূপ হস্তক্ষেপ করেনি।’’ খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রধান খ্রিস্টান ধর্মযাজক কনস্টান্টিনোপলের প্রধান ধর্মযাজককে আরবদের সম্পর্কে লিখেন, ‘‘ তারা ন্যায় বিচারক। তারা কখনো কোন রূপ অবিচার করে না এবং আমাদের সাথে কোন ধরনের রূঢ় ও কঠোর আচরণ করে না।’’
ঘ. গুস্তেব লে বন বলেন, ‘‘প্রকৃত পক্ষে আরবদের মত দয়ালু ও মহানুভব বিজেতা জাতি এবং তাদের ধর্মের মত উদার প্রকৃতির কোন ধর্ম সম্পর্কে পৃথিবীবাসী অবহিত নয়।’’ তিনি অমুসলিমদের সাথে মুসলিমদের আচরণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘ আরব স্পেনীয়রা মহান উদারতা ছাড়াও অনুপম সাহসিকতা ও শৌর্য-বীর্যের অধিকারী ছিল। তারা দুর্বলদের প্রতি দয়া করত, বিজিতদের সাথে সদয় আচরণ করত এবং তাদের শর্তগুলো মেনে চলত। এ সকল গুণ পরবর্তীকালে খ্রিস্টান জাতিগুলো তাদের থেকেই গ্রহণ করেছিল।’’
ঙ. ফরাসী সাংবাদিক হেনরী ডি শ্যামবু বলেন, ‘‘শার্ল মার্টিলের বাহিনী যদি ফ্রান্সে আরব মুসলমানদের ওপর বিজয় লাভ না করত, তা হলে আমাদের দেশ মধ্য যুগে তমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়ত না, বড় বড় দুর্যোগের সম্মুখীন হত না এবং চরম ধর্মীয় সংকীর্ণতার কারণে চরম নিধন যজ্ঞ সংঘটিত হত না। যদি বোয়াটিয়ায় মুসলিমদের ওপর বর্বরোচিত বিজয় সংঘটিত না হত, তা হলে স্পেন সর্বদা ইসলামের মহান উদারতা দেখতে পেত এবং তদন্ত বিভাগের লজ্জাকর কলঙ্ক থেকে রেহাই পেত। তদুপরি আট শতাব্দী কাল ধরে সভ্যতার অগ্রযাত্রা পিছিয়ে পড়ত না। আমাদের সে বিজয় সম্পর্কে আমাদের আবেগ-অনুভূতি যা-ই হোক না কেন, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-কলা তথা আমাদের সভ্যতার সব কিছুর জন্য আমরা মুসলিমদের কাছে ঋণী এবং এ কথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, যে সময় আমরা চরম অসভ্য ও মূর্খ ছিলাম তখন তারা ছিল মানব সভ্যতার অনুপম দৃষ্টান্ত।’’
চ. প্রাচ্যবিদ ডোজি বলেন, ‘‘ অমুসলিমদের প্রতি মুসলিমদের উদারতা ও সদয় আচরণ তাদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। তারা ইসলামের মধ্যে এমন সরলতা ও উদারতা দেখতে পেয়েছে, যা তারা তাদের পূর্ববর্তী ধর্মসমূহে কখনো দেখতে পায়নি।’’
ছ. প্রাচ্যবিদ বারটোল্ড বলেন, ‘‘মুসলিম শাসনামলের সময় খ্রিস্টানদের অবস্থা ছিল সর্বোত্তম। মুসলিমরা ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে মানবিক মূল্যবোধ ও উদারতার নীতি মেনে চলত।’’
জ. প্রাচ্যবিদ ডিওর‌্যান্ট বলেন, ‘‘ অমুসলিম খ্রিস্টান, যরথুস্ত্রী, ইয়াহুদী ও সাবীরা উমাইয়্যাহ খিলাফাতের সময় এ ধরনের স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করত, যার নজীর সে সময়ে আমরা খ্রস্টান রাজ্যগুলোতে দেখতে পাইনি।’’
ঝ. আধুনিক কালের প্রখ্যাত আমেরিকান লেখক এ্যান্ড্রু পিটারসন বলেন, ‘‘ইসলামের নামে কঠোরতা প্রদর্শনের কোন স্থান প্রকৃত ইসলামে তো নেই; বরং তা শান্তির পতাকাবাহী ইসলামের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।’’
ঞ. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা লেখক মি. ড্রেপার বলেন, ‘‘খালীফাদের শাসনামলে খ্রিস্টান ও ইয়াহুদী পন্ডিতদের শুধু মুখে মুখেই সম্মান করা হয় নি; তাদেরকে বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে এবং বড় বড় সরকারী দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে।’’
ট. বিশিষ্ট ঐতিহাসিক মি. উইলস ইসলামী শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘‘ ইসলামী শিক্ষা পৃথিবীতে ন্যায়বিচার ও ভদ্রজনোচিত কর্মপদ্ধতির অত্যন্ত চমকপ্রদ ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করেছে। সমাজে সদাচার ও উদারতার মনোভাব চালু করেছে। এ শিক্ষা অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের মানবতার কার্যোপযোগী শিক্ষা। এ শিক্ষা এমন সমাজ গড়ে তুলেছে, যেখানে তার পূর্ববর্তী যে কোন সমাজের তুলনায় নিষ্ঠুরতা ও যুলম ন্যুনতম মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়েছে। ইসলাম আসলে নম্রতা, সহনশীলতা, সুন্দর আচরণ ও সৌভ্রাতৃত্বের বলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’’
উপসংহার
ইসলাম শান্তি ও মানবতার ধর্ম। শ্রেণী ও বর্ণ বৈষম্যহীন একটি আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা ইসলামের উদ্দেশ্য। অন্য ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীর প্রতি সহনশীলতা হচ্ছে এর অনন্য বৈশিষ্ট্য। মদীনার নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রে ইয়াহুদী ও পৌত্তলিক আর অপর দিকে মুসলিম জাতির মধ্যে সম্পাদিত মৈত্রী চুক্তিটি ছিল ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অতঃপর ইসলাম যখন আরবের গন্ডি পার হয়ে বহিঃরাষ্ট্রে ক্রমে ক্রমে বিস্তার লাভ করে তখনও শাসকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, কোন অবস্থাতেই যেন অমুসলিমদের অধিকার ক্ষুণ্ণ না হয়, তাদের জীবন-সম্পত্তি-ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়। ইসলামই প্রকৃত অর্থে মানবিক সভ্যতা। এখানে মানবতার মর্যাদাই সর্বোচ্চ। ইসলামের দৃষ্টিতে চামড়া সাদা না কালো দেখা হয় না, দেখা হয় না কার বর্ণ কি? রাষ্ট্রের সকল নাগরিকই সম অধিকার ও মর্যাদা ভোগ করবে- এই হল ইসলামের সুস্পষ্ট নীতি। রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু অমুসলিমদেরকে ইসলাম যে পরিমাণ অধিকার ও মর্যাদা দান করে এবং ঐতিহাসিকভাবে এর যে প্রমাণ রয়েছে, বর্তমান আধুনিক বিশ্বে তার বাস্তব নজীর খুuঁজ পাওয়া দুষ্কর। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে সকলের সমান অধিকার ও মর্যাদার কথা বলা হয়, তবে তা হল কথার ফুলঝুরি মাত্র। এর
বাস্তব নিদর্শন পৃথিবীবাসী আজো কোথাও দেখেনি। বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে সংখ্যালঘুরা হরহামেশা বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের সম্মুখীন হচ্ছে, যা আজ বলার অপেক্ষা রাখে না। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে যে,ুউবসড়পৎধপু রং রহ ভধপঃ ধারংরড়হধৎু রফবধষ, রসঢ়ড়ংংরনষব ড়ভ ৎবধষরুধঃরড়হ.চ

آخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين হ و الصلوة و السلام على سيدنا محمد و آله وصحبه أجمعين.

গ্রন্থপঞ্জীঃ
আল-কুর’আন
আত-তাফসীরঃ
শফী‘, মুফতী মুহাম্মাদ, মা‘আরিফ আল-কুর’আন, (অনু. ও সম্পা. : মাওলানা মুহীউদ্দীন খান), মদীনা মুনাওয়ারা : খাদেমুল হারামাইন শরীফাইন বাদশাহ ফাহদ কুর’আন মুদ্রণ প্রকল্প, ১৪১৩ হি.
হাদীসঃ
বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমা‘ঈল, আল-জামি‘ , বৈরূতঃ দারু ইবনি কাছীর, ১৯৮৭
মুসলিম, আস-সহীহ, বৈরূতঃ দারু ইহ্য়া’ইত্ তুরাছিল আরবী, তা.বি.
নাসাঈ, আহমাদ, আস-সুনান আল-কুবরা’, বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১৯৯১
আবূ দাউদ, সুলায়মান , আস-সুনান , বৈরূতঃ দারুল ফিকর, তা.বি.
তিরমিযী, আবূ ‘ঈসা মুহাম্মাদ, আল-জামি‘, বৈরূতঃ দারু ইহ্য়া’ইত্ তুরাছিল আরবী, তা.বি.
ইবনু মাজাহ, আবূ ‘আবদুল¬াহ মুহাম্মাদ, আস-সুনান, বৈরূতঃ দারুল ফিকর, তা.বি.
ইমাম মালিক, আল-মুয়াত্তা, মিসরঃ দারু ইহ্য়া’ইত্ তুরাছিল আরবী, তা.বি.
ইবনু আবী শায়বা, ‘আবদুল¬াহ, আল-মুছান্নাফ, রিয়াদঃ মাকতাবাতুর রুশদ, ১৪০৯ হি.
বায়হাকী, আস-সুনান আল- কুবরা’ , মক্কাঃ মাকতাবাতু দারিল বায, ১৯৯৪
দারা কুতনী, আলী, আস-সুনান, বৈরূতঃ দারুল মা‘আরিফাহ, ১৯৬৬
ইবনুল আছীর, মাজুদ্দীন, আন-নিহায়াতু ফী গরীবিল হাদীস, বৈরূত : আল-মাকতাবাতুল ‘ইলমিয়্যাহ, ১৯৭৯
বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ, বৈরূত : দারুল বাশা’ইরিল ইসলামিয়্যাহ, ১৯৮৯
ফিকহঃ
আস-সারাখসী, আবূ বকর মুহাম্মদ, আল-মাবসূত, বৈরূতঃ দারুল মা‘আরিফাহ
আল-কাসানী, ‘আলা উদ্দীন, বদা‘ইয়ুস সনা‘ই, বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ
আল-মারগীনানী, বুরহানুদ্দীন ‘আলী, আল-হিদায়াহ, দেওবন্দঃ কুতুবখানা রহীমিয়্যাহ
ইবনুল হুমাম, কমাল উদ্দীন, ফাতহুল কাদীর শারহুল হিদায়াহ, দারুল ফিকর
যায়ল‘ঈ, ‘উছমান, তাবয়ীনুল হাকা’ইক শারহু কানযিদ দাকা’ইক, দারুল কিতাবিল ইসলামী
ইবনু নুজায়ম, যায়নুদ্দীন, আল-বাহরুর রা’ইক শারহু কানযিদ দাকা’ইক, দারুল কিতাবিল ইসলামী
আল-বাবরতী, মুহাম্মদ, আল-‘ইনায়াহ শারহুল হিদায়াহ, দারুল ফিকর
ইবনু ‘আবিদীন, মুহাম্মদ আমীন, রাদ্দুল মুহতার, বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ
আল-বহুতী, মানছূর, দকা’ইকু উলিন নুহা, ‘আলমুল কুতুব
নববী, ইয়াহইয়া, আল-মাজমূ‘ শারহুল মুহায্যাব, আল-মাত‘বাআতুল মুনীরিয়্যাহ
ইবনু কুদামাহ, মুওয়াফ্ফাকুদ্দীন, আল-মুগনী, বৈরূতঃ দারু ইহ্য়া’ইত্ তুরাছিল আরবী
আল-মাওসু‘আতুল ফিকহিয়্যা, কুয়েত : ওয়াযারাতুল আওকাফ ওয়া আল-শুয়ূন আল-ইসলামিয়্যাহ , ১৯৯৫
আবূ ইউসূফ, কিতাবুল খারাজ, বৈরূতঃ দারুল মা‘আরিফাহ,১৩৯৯
সীরাত ও তারীখঃ
ইবনু হিশাম, আস-সীরাতুন নববীয়্যাহ, বৈরূতঃ দারু ইহ্য়া’ইত্ তুরাছিল আরবী, ১৪১৫হি.
ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, বৈরূতঃ দারুল ফিকর, তা.বি.
ইবনুল কাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ, যাদুল মা‘আদ
আল-কলকশন্দী, সুবহুল আ‘শা ,কায়রোঃ আল-মাতবা‘আতুল আমীরিয়্যাহ, ১৯১৪
আল-বালাযূরী, ফুতুহুল বুলদান , বৈরূতঃ দারুল হিলাল, ১৪০৩হি.
কাযী ইয়াদ, আশ-শিফা
বিবিধঃ
আল-মাওয়াদী, আবুল হাসান ‘আলী, আল-আহকামুস সুলতানিয়্যাহ, বৈরূতঃ দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ
মাওদূদী, সাইয়েদ আবুল আলা,ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান, ১৯৯৭
‘আবদুর রহমান পাশা, সুওয়ারুন মিন হায়াতিত তাবি‘ঈন, কায়রো : দারুল আদাবিল ইসলামী, ১৪১৮হি.
তাওফীক সুলতান, তারীখু আহলিয যিম্মাহ ফিল ‘ইরাক, রিয়াদ : দারুল ‘উলূম, ১৪০৩
আল-লুহায়দান, আবদুল্লাহ, ফিকহুসু সুন্নাহ,
আর্নল্ড, টমাস, আদ-দা‘ওয়াতু ইলাল ইসলাম, মিসর : মাকতাবাতুন নাহদাহ, ১৯৭০
হঙ্গ, জি. গ্রেট, শামসুল আরব তাছতা‘উ ‘আলাল গারব , (অনু.:ফারূক বায়দূন ও কামাল দাসূকী), বৈরূতঃ দারু সাদির, ১৪২৩ হি.
ডিওর‌্যান্ট, ভিল, কিসসাতুল হাদারাতি, বৈরূতঃ দারুল জীল, তা.বি.
ফিন্ডলি, ভি. লা সুকূতা বা‘দাল ইয়াওমি, বৈরূত : শারিকাতুল মাতবূ‘আত,২০০১
আযীয, নসরুল্লাহ, ইসলামের জীবন চিত্র, ঢাকা: প্রবাল প্রকাশন লিঃ,১৯৮৪
সেমিনার স্মারক গ্রন্থ ২০০৮, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা
Le Bon, Dr. Gustave, La Civilisation des Arabes, (Aby. nv`vivZzj Avie)
Finlay, Histoty of the Byzantine
Maciver, R.M., The web of government
Rodee, Dr. C.C., Introduction to political science, Neywork: McGraw Book Company, 2nd ed.

 

ফুটনোটঃ

. গধপরাবৎ, জ.গ., ঞযব বিন ড়ভ মড়াবৎহসবহঃ, ঢ়. ১৩২.
. বর্ণিত রয়েছে যে, একবার হীরার এক মুসলিম একজন ইয়াহুদীকে হত্যা করে। হযরত ‘উমার ইবন আবদুল ‘আযীয (রহ.) ঘটনা জানতে পেরে সেখানকার গভর্ণরকে লেখেন: হত্যাকারীকে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের হাতে সোপর্দ করে দাও। তারা ইচ্ছে করলে তাকে হত্যা করতে পারে কিংবা ক্ষমাও করতে পারে। গভর্ণর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করেন এবং অমুসলিমরা সে ব্যক্তিকে হত্যা করে। (ইবনু আবী শায়বাহ, আল-মুছান্নাফ, হা.নং: ২৭৪৬২)
. বর্ণিত রয়েছে যে, একদিন জনৈক অমুসলিম খালীফা ‘উমর ইবন ‘আবদুল ‘আযীয (রহ.)-এর দরবারে আপীল করে যে, ‘আববাস ইবন ওয়ালীদ অন্যায়ভাবে তার ভূমি দখল করে রেখেছে। খালীফা ‘আববাসকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন : ‘‘ এ অমুসলিম ব্যক্তির দাবীর ব্যাপারে তোমার বক্তব্য কি? আববাস জবাব দিল, ‘‘আমার পিতা ওয়ালীদ এ ভূমি আমার জায়গীরদারীতে অর্পন করেছেন।’’ এ কথা শুনে অমুসলিম ব্যক্তিটি বলল, ‘‘আমীরুল মু’মিনীন! আপনি আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ফায়সালা করুন।’’ খালীফা বললেন, ‘‘আববাস! আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী অমুসলিমদের ভূমি জবর দখল করে তাতে কাউকে জায়গীরদারী দেয়া যায় না।’’ ‘আববাস বললো,‘‘ আপনার কথা সত্য; কিন্তু আমার নিকট খালীফা ওয়ালীদের প্রমাণপত্র রয়েছে। আপনার পূর্বের একজন খালীফার ফরমান রদ করার কী অধিকার আপনার আছে?’’ খালীফা জবাব দিলেন, نعم হ كتاب الله أحق أن يتبع من كتاب الوليدহ قم فاردد عليه ضيعته.‘‘ ওয়ালীদের প্রমাণপত্রের চাইতে আল্লাহর কিতাব অনেক উর্ধ্বে। ভূমি এ অমুসলিমকে ফেরত দিয়ে দাও।’’ (ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, খ.৯,পৃ. ২১৩)
. আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ গ্রন্থে (খ.৭,পৃ. ১০৪) যিম্মীদের সংজ্ঞা এ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, أهل الذمة هم الذين أقروا في دارالإسلام على كفرهم بالتزام الجزية و نفوذ أحكام الإسلام فيهم. -‘‘ জিয্ইয়া আদায় ও ইসলামী বিধি-বিধান মেনে নেয়ার শর্তে ইসলামী রাষ্ট্রে যে সব অমুসলিমকে নিজ নিজ ধর্মের ওপর অবস্থান করতে দেয়া হয় তাদেরকে যিম্মী বলা হয়।’’
. ইবনুল আছীর, আন-নিহায়াতু ফী গরীবিল হাদীস, খ.২,পৃ.১৬৮
. দারুল হারব বলতে এমন অমুসলিম রাষ্ট্রকে বুঝানো হয়, যার সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের সাময়িক বা স্থায়ীভাবে কোন রূপ শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয় নি এবং যেখানে প্রকাশ্যে অনৈসলামী বিধিবিধান চালু রয়েছে। (আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, খ.২০,পৃ. ২১৭)
. আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, খ.৭,পৃ. ১০৪
. আবূ দাউদ, আস-সুনান,(কিতাবুল জিহাদ), হা.নং: ২৬৫৩
. আবূ দাউদ, আস-সুনান, (কিতাবুল জিহাদ), হা.নং: ২৬৫৪
. আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, খ.৩, পৃ.১৬১; খ.৭,পৃ. ১০৫
. আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, খ.৭,পৃ. ১০৫
. আল-বাবরতী, আল-‘ইনায়াহ শারহুল হিদায়াহ, খ.৫,পৃ. ৪৬৬; ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খ.৯ পৃ.২৬৩
. ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খ.৯,পৃ.২৩৯-২৪০, ২৬৯
তবে হানাফী ইমামগণের মতে- ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা তাঁর প্রতিনিধি ছাড়াও রাষ্ট্রের যে কোন মুসলিম নাগরিকের পক্ষে এ ধরনের চুক্তি করা জায়িয হবে। তাঁদের মতে- এ রূপ চুক্তি যেহেতু অমুসলিমদের জন্য ইসলাম গ্রহণের বিকল্প ব্যবস্থা, তাই এটা তাদেরকে ইসলামের প্রতি দা‘ওয়াত দান রূপেই বিবেচনা করা হবে। অধিকন্তু এ চুক্তি যেহেতু জিয্ইয়ার বিনিময়ে হচ্ছে, তাই এক্ষেত্রে মুসলিমদের কোনরূপ স্বার্থহানি হচ্ছে না।
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ. ১১০-১১১; ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খ.৯ পৃ.২৬৩
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ.১১১
এটা অধিকাংশ ইমামের অভিমত। তবে শাফি‘ঈগণের এক বর্ণনা মতে- নির্দিষ্ট সময়ের জন্যও এ চুক্তি করা যেতে পারে।
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ. ১১২-৩
. ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খ.৯ পৃ.২৬৬; আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ.১১১;আস-সারাখসী, আল-মাবসূত, খ.১০,পৃ,৮৭
. আল-মাওয়ার্দী, আল-আহকামুস সুলতানিয়্যাহ, পৃ. ১৮৪-৫
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ. ১১০; আয-যায়ল‘ঈ, তাবয়ীন.., খ.৩,পৃ.২৬৮-৯
. হাম্বলীগণের মতে- এ ধরনের মহিলার বিয়ে করার পরে স্বদেশে ফিরে যেতে চাইলে তাকে বাধা দেয়া যাবে না, যদি স্বামী সম্মত থাকে কিংবা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। (আল-বাহুতী, কাশশাফ.., খ.৩,পৃ. ১১০) কিন্তু হানাফীগণের মতে- এ ধরনের মহিলাকে স্বদেশে ফিরে যেতে বাধা দেয়া হবে।
. আস-সারাখসী, আল-মাবসূত, খ.১০,পৃ.৮৪-৫;আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ. ১১০; আয-যায়ল‘ঈ, তাবয়ীন.., খ.৩,পৃ.২৬৯
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ. ১১০; আয-যায়ল‘ঈ, তাবয়ীন.., খ.৩,পৃ.২৬৯
. ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খ.৯ পৃ.২৭১
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ. ১১০; আয-যায়ল‘ঈ, তাবয়ীন.., খ.৩,পৃ.২৭০
. আস-সারাখসী, আল-মাবসূত, খ,১০,পৃ. ২১৫;ইবনুল হুমাম, ফাতহুল কাদীর, খ.৬,পৃ.১১৪
. আবূ ইউসূফ, কিতাবুল খারাজ, পৃ. ৮২
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ. ২৮৮; আন-নববী, আল-মাজমূ‘ শারহুল মুহাযযাব, খ.১১,পৃ.৩০৬
. আল-মাওয়ার্দী, আল-আহকামুস সুলতানিয়্যাহ, পৃ. ১৮৩
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ. ১১১; ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খ.৯,পৃ.২৮৯
. ইবনু ‘আবিদীন, রাদ্দুল মুহতার, খ.৪,পৃ. ৩৫১
. এটা অধিকাংশ ইমামের অভিমত। হানাফীগণের মতে- মক্কা নগরীতে অমুসলিমরা সরকারের অনুমতিক্রমে কিংবা সমঝোতার ভিত্তিতে প্রবেশ করতে পারবে। আর মদীনা শরীফে ব্যবসা-বাণিজ্য, আসবাবপত্র বহন, সংবাদ দান বা গ্রহণ প্রভৃতি যে কোন প্রয়োজনে অমুসলিমদেরকে প্রবেশ করতে বাধা দেয়া যাবে না।
. হাদীসে ‘আরব জাযীরা’ দ্বারা কি বোঝানো হয়েছে- তা নিয়ে ইমামগণের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। শাফি‘ঈ ও হাম্বলী ইমামগণের মতে- এখানে ‘আরব জাযীরা’ দ্বারা কেবল হিজাজ অর্থাৎ মক্কা ও মদীনা এবং এতদুভয়ের সংলগ্ন অঞ্চলগুলোকে বুঝানো হয়েছে। তবে মালিকী ও হানাফীগণের মতে- কেবল হিজাযই নয়; বরং পুরো আরব ভূখন্ডই জযীরাতুল আরবের মধ্যে শামিল হবে। তাঁদের মতানুসারে জাযীরাতুল আরবের মধ্যে নাজদ, ইয়ামান, তিহামাহ ও ‘আরূদ (ইয়ামামা থেকে বাহরাইন)প্রভৃতি দেশও অন্তর্ভুক্ত হবে। (ইবনু ‘আবিদীন, রাদ্দুল মুহতার, খ.৪,পৃ.৩৯২; ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খ.৯,পৃ.২৮৫-৬)
. ইমাম মালিক, আল-মু’ওয়াত্তা, হা.নং: ১৩৮৮; আল-বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা’, হা.নং:
. সহীহ আল-বুখারী, আস-সহীহ, হা.নং: ২৮২৫, ২৯৩২,৪০৭৮; মুসলিম, আস-সহীহ, হা.নং: ৩০৮৯
. ইবনু ‘আবিদীন, রাদ্দুল মুহতার, খ.৪,পৃ.৩৯২; ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খ.৯,পৃ.২৮৫-৬
. একান্ত মুসলিম জনপদ বলতে সে সব অঞ্চলকে বুঝানো হয়, যে সব এলাকার ভূসম্পত্তি মুসলিমদের মালিকানাভুক্ত এবং সে সব এলাকাকে মুসলিমরা ইসলামী অনুষ্ঠানাদি উদযাপনের জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছে।
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ.১১৩
. আল-কুর’আন, ২ (সূরাতুল বাকারাহ)ঃ ২৫৬
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ.১১৩
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ.১১৪
. ইবনু হাজর ‘আসকালানী, আদ-দিরায়াহ.., হা.নং: ৭৪১; ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খ.৯,পৃ.২৮৫
. ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খ.৯,পৃ.২৮৩
. মাওদূদী, ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান, পৃ. ৩৯৫
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ.১১৪
. আবূ ইউসূফ, কিতাবুল খারাজ, পৃ.১৪৪
. নাজির, শেখ মোহাম্মদ শোয়েব, ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিক, সেমিনার স্মারক গ্রন্থ ২০০৮, বি.আই.সি, ঢাকা, পৃ.২০১
. প্রাগুক্ত, পৃ.২১১
. আল-মাওয়ার্দী, আল-আহকামুস সুলতানিয়্যাহ, পৃ. ৪৪; আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, খ.৭,পৃ. ১৩১
. আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, খ.৭,পৃ. ১৩১
. ইবনুল হুমাম, ফাতহুল কাদীর, খ.৪,পৃ. ৩৫৯
. আস-সারাখসী, আল-মাবসূত, খ.৫,পৃ.৩৮-৪১
. মাওদূদী, ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান, পৃ. ৪০০
. প্রাগুক্ত, পৃ.৩৯৭
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ.১১৩
. আস-সারাখসী,আল-মাবসূত, খ.৫,পৃ.৪৩
. আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, খ.৭,পৃ. ১৩২
. আস-সারাখসী,আল-মাবসূত, খ.৭,পৃ.১২৫
. আল-বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, খ.১০,পৃ. ১২৫
. কিতাবী মেয়েকে মুসলিমের বিয়ে করা জায়িয, যদি সে প্রকৃতই তাঁর ধর্মের অনুসারী হয়। তবে যে ইয়াহুদী বা খ্রিস্টান মহিলা নিজের ধর্মের আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করে না, তাকে বিয়ে করা সমীচীন হবে না। যেমন বর্তমানে ইংরেজদেরকে সাধারণ মানুষ খ্রিস্টান মনে করে; অথচ দেখা যায়, তাদের কেউ কেউ ধর্মদ্রোহী, আবার কেউ নাস্তিক। তাদের অনেকেরই মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাসই নেই। আবার অনেকেই হযরত ঈসা (আ.)-এর নবুওয়াত কিংবা আসমানী গ্রন্থ ইঞ্জিলকেও আসমানী গ্রন্থ বলে স্বীকার করে না। সুতরাং এ ধরনের মহিলাকে ‘কিতাবী মেয়ে’ রূপে বিবেচনা করা এবং বিয়ে করা সঙ্গত হবে না। (শফী, মুফতী মুহাম্মাদ, মা‘আরিফুল কুর’আন, পৃ.১১৯)
. আল-কুর’আন, ২ (সূরাতুল বাকারাহ)ঃ ২২১
. আল-কুর’আন, ২ (সূরাতুল বাকারাহ)ঃ ২২১
. আল-কুর’আন, ৫ (সূরাতুল মা’ইদাহ)ঃ ৫
অমুসলিমদের মধ্য থেকে আহলে কিতাবের যব্হ করা জন্তু হালাল হওয়া এবং তাদের মহিলাকে বিয়ে করা জায়িয হওয়ার কারণ হল এই যে, এ দুটি বিষয়ে তাদের ধর্মমতও ইসলামের হুবহু অনুরূপ। অর্থাৎ আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে জন্তু যব্হ করাকে তারাও বিশ্বাসগতভাবে জরুরী মনে করে। এছাড়া মৃত জন্তুকেও তারা হারাম মনে করে। অনুরূপভাবে ইসলামে যে সব মহিলাকে বিয়ে করা হারাম, তাদের ধর্মেও তাদের বিয়ে করা হারাম। ইসলামে যেমন বিয়ে প্রচার করা, সাক্ষীদের উপস্থিত হওয়া জরুরী, তেমনি তাদের ধর্মেও এ সব বিধি-বিধান জরুরী।
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ.১১৩; ইবনু নুজায়ম, আল-বাহরুর রা’ইক, খ.৫.পৃ. ১২৩
. আল-কলকশন্দী, সুবহুল আ‘শা, খ. ১৩, পৃ. ৩৬৪
. আয-যায়ল‘ঈ, তাবয়ীন.., খ.৩, পৃ. ২৮০-৮১
. হানাফীগণের মতে- উপাসনালয়ের সেবক, সন্যাসী ও ভিক্ষু কর্মক্ষম হলে তাদের ওপর জিয্ইয়া প্রদান বাধ্যতামূলক হবে। (আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ. ১১১)
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ. ১১১; ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খ.৯ পৃ.২৭০-৩; ইবনু নুজায়ম, আল-বাহরুর রা’ইক, খ.৫.পৃ. ১২০-১
. আবূ ইউসূফ, কিতাবুল খারাজ, পৃ. ১১১
. আল-বালাযূরী, ফুতুহুল বুলদান, খ.১,পৃ.১৬২
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ. ১১২; আল-মাওয়ার্দী, আল-আহকামুস সুলতানিয়্যাহ, পৃ.১৮৪; ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খ.৯ পৃ.২৬৭-৮
. আবূ ইউসূফ, কিতাবুল খারাজ, পৃ.৯
. প্রাগুক্ত, পৃ.৭০
. ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খ.৯ পৃ.২৭২
. আবূ ইউসূফ, কিতাবুল খারাজ, পৃ. ১৪৪
. প্রাগুক্ত, পৃ.৭২
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ.১১২; ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খ.৯ পৃ.২৭৩
. আস-সারাখসী, আল-মাবসূত, খ.১০,পৃ.৭৯,৮৩; ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খ.৯ পৃ.৩০৯
. আয-যায়ল‘ঈ, তাবয়ীন.., খ.১,পৃ.২৮৫
. আস-সারাখসী, আল-মাবসূত, খ.২,পৃ.২০০; আয-যায়ল‘ঈ, তাবয়ীন.., খ.১,পৃ.২৮৫; ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খ.৯ পৃ.২৮০
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.২,পৃ.৩৯; আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, খ.৩০,পৃ. ১০৮
. আয-যায়ল‘ঈ, তাবয়ীন.., খ.১,পৃ.২৮৪
. আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, খ.৩০,পৃ. ১০৭
. তদেব
. আয-যায়ল‘ঈ, তাবয়ীন.., খ.১,পৃ.২৮৪
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ.১১৩
. আল-কাসানী, বদা‘ই, খ.৭,পৃ.১১৩-৪
. ‘হদ্দ’ হল কুর’আন ও সুন্নাহতে বর্ণিত বিভিন্ন অপরাধের সুনির্ধারিত শাস্তি । এ ধরনের হদ্দগুলো হলঃ চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার ও ব্যভিচারের অপবাদ ও মদ্যপানের শাস্তি। তবে অনেকেই ধর্মান্তর ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তিকেও হদ্দ বলে উল্লেখ করেছেন।
. এটা অধিকাংশ ইমামের অভিমত। বর্ণিত রয়েছে, ‘‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুজন ইয়াহুদীকে যিনার শাস্তিস্বরূপ প্রস্তর নিক্ষেপ করে হত্যা করেছিলেন।’’ (আবূ দাউদ, আস-সুনান, (কিতাবুল হুদূদ), হা. নং: ৩৮৫৬) তবে ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম মালিক (রহ.)-এর মতে বিবাহিত অমুসলিমের যিনার জন্য ‘রাজম’ (প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যার শাস্তি) প্রযোজ্য হবে না। তাঁদের দৃষ্টিতেও রাজম কার্যকর করার জন্য অপরাধীর মুসলিম হওয়া শর্ত। অনুরূপভাবে তাঁদের দৃষ্টিতে কোন বিবাহিত মুসলিম কোন অমুসলিম মহিলার সাথে ব্যভিচার করলেও মুসলিমের জন্য রাজমের দন্ড প্রযোজ্য হবে না। কারণ রাজমের শাস্তি কার্যকর করার জন্য অপরাধীকে মুসলিম হবার পাশাপাশি ‘মুহসান’ও হতে হবে। তাঁদের মতে ‘মুহসান’ হবার জন্য মুসলিম মহিলার সাথে বিয়ে হবার শর্ত রয়েছে। বর্ণিত রয়েছে যে, হযরত কা‘ব ইবনু মালিক (রা.) যখন জনৈকা ইয়াহুদী কিংবা খ্রিস্টান মহিলাকে বিয়ে করতে মনস্থ করলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)তাuঁক বললেন, ‘‘ এ আশা ছেড়ে দাও। কেননা এ বিয়েতে তুমি ‘মুহসান’ হবে না।’’ (দারাকুতনী, আস-সুনান, হা.নং: ৩৩৪৫)
. কিসাস হল অপরাধীর সাথে তার বাড়াবাড়ির অনুরূপ আচরণ করা। অর্থাৎ অপরাধী কোন ব্যক্তির যেই পরিমাণ দৈহিক ক্ষতি সাধন করবে তারও সে-ই পরিমাণ দৈহিক ক্ষতি সাধন করাই হচ্ছে কিসাস। অপরাধী তাকে হত্যা করলে প্রতিশোধ স্বরূপ সেও মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত হবে এবং যখম করে থাকলে প্রতিশোধ স্বরূপ তাকেও যখম করা হবে।
. এটা হানাফীগণের অভিমত। তবে শাফি‘ঈ ও হাম্বলী স্কুলের ইমামগণের মতে- কোন অমুসলিমকে হত্যার জন্য মুসলিম থেকে কিসাস নেয়া যাবে না। তবে দিয়াত ওয়াজিব হবে। (আস-সারাখসী, আল-মাবসূত, খ.২৬,পৃ.১৩১-২; ইবনু নুজায়ম, আল-বাহরুর রা’ইক, খ.৮,পৃ.৩৩৭)
. ইবনু আবী শায়বাহ, আল-মুছান্নাফ, হা.নং: ২৭৪৬০; আল-বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, হা.নং: ১৫৬৯৯
. ইবনু আবী শায়বাহ, আল-মুছান্নাফ, হা.নং: ২৭৪৭০; আল-বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, হা.নং: ১৫৭০৬
. এটা হানাফীগণের অভিমত। তবে শাফি‘ঈ ও হাম্বলী ইমামগণের মতে- কোন অমুসলিমের অঙ্গের ক্ষতিসাধনের জন্য মুসলিম থেকে কিসাস নেয়া যাবে না। তবে কোন মুসলিমের অঙ্গের ক্ষতিসাধনের জন্য অমুসলিম থেকে কিসাস নেয়া হবে। মালিকীগণের মতে- মানবদেহের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের বেলায় অপরাধী কিংবা আক্রান্ত যে কোন একজন অমুসলিম হলে কিসাসের বিধান প্রযোজ্য হবে না। তবে অমুসলিমরা পরস্পর একে অপরের দেহের বিরুদ্ধে অপরাধ করলে, কিসাসযোগ্য অপরাধের বেলায় সর্বসম্মতভাবে কিসাসের বিধান প্রযোজ্য হবে।
. আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, খ.৭ পৃ. ১৩৭
. আল-কুর’আন, ৫ (সূরাতুল মা’ইদাহ)ঃ ৪৯
. আল-কাসানী,বদা‘ই, খ.৭,পৃ.১১৩; ইবনু নুজায়ম, আল-বাহরুর রা’ইক, খ.৫.পৃ.১২৪-৭;ইবনু কুদামাহ,আল-মুগনী, খ.৯ পৃ.২৮৩
. ইবনু হিশাম, আস-সীরাতুন নববীয়্যাহ, খ.৪,পৃ.৬১; কাদী ইয়াদ, আশ-শিফা, খ.১,পৃ.১১০
. সহীহ আল বুখারী, (কিতাবুল হিবাহ), হা.নং: ২৬১৭; ইবনুল কাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ, যাদুল মা‘আদ, খ.৩,পৃ.২৯৭
. সহীহ মুসলিম, (কিতাবুল জিহাদ),হা.নং: ১৭৬৫
. সহীহ আল বুখারী, (কিতাবুল মরদা), হা.নং:৫৬৫৭
. তিরমিযী, (কিতাবুল আত‘ইমাহ), হা.নং: ১৭৪১
. সহীহ আল বুখারী, (কিতাবুল মাগাযী), হা.নং:৪৪৬৭
. আবূ দাউদ, আস-সুনান, (কিতাবুল জিহাদ), হা.নং: ২৬৫৪
. সহীহ আল বুখারী, (কিতাবুল জিয্ইয়া..), হা. নং: ৩১৬৬
. সহীহ আল বুখারী, (কিতাবুল হিবাহ), হা. নং: ২৬২০
. সহীহ আল বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ, হা.নং: ১২৮
. সহীহ আল বুখারী, (কিতাবুল জানা’ইয), হা.নং:১৩৯২
. আর্নল্ড, আদ-দা‘ওয়াতু ইলাল ইসলাম, পৃ.৯৯
. নাজির, প্রাগুক্ত, পৃ.১৯৮ (ঋরহষধু-এর ঐরংঃড়ঃু ড়ভঃযব ইুুধহঃরহব ঊসঢ়রৎব গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত)
. আল-বালাযূরী, ফুতুহুল বুলদান, খ.১,পৃ.১৪৯
. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, খ.৯,পৃ. ২১৩
. আবূ ইউসূফ, কিতাবুল খারাজ, পৃ.৭১
. আল-বালাযূরী, ফুতুহুল বুলদান, খ.১,পৃ.১৩৯; আর্নল্ড, আদ-দা‘ওয়াতু ইলাল ইসলাম, পৃ.৭৩
. আর্নল্ড, আদ-দা‘ওয়াতু ইলাল ইসলাম, পৃ.৮১
. হঙ্গ, শামসুল আরব তাছতা‘উ ‘আলাল গারব, পৃ. ৩৬৪
. খব ইড়হ, উৎ. এঁংঃধাব, খধ ঈরারষরংধঃরড়হ ফবং অৎধনবং, (অনু. হাদারাতুল আরব) , পৃ. ৭২০
. প্রাগুক্ত, পৃ.৩৪৪
. ‘আবদুর রহমান পাশা, সুওয়ারুন মিন হায়াতিত তাবি‘ঈন, পৃ. ৪২০
. তাওফীক সুলতান, তারীখু আহলিয যিম্মাহ ফিল ‘ইরাক, পৃ.৭০ (ডোজির নযরাত ফী তারীখিল ইসলাম (পৃ.৪১১) থেকে সংগৃহীত)
. তাওফীক সুলতান, তারীখু আহলিয যিম্মাহ ফিল ‘ইরাক, পৃ.১৪০ (বারটোল্ডের আল-হাদারাতুল ইসলামিয়্যাহ (পৃ.১৯) থেকে সংগৃহীত)
. ডিওর‌্যান্ট, কিসসাতুল হাদারাহ, খ.১৩,পৃ. ১৩০
. ফিন্ডলি, লা সুকূতা বা‘দাল ইয়াওমি, পৃ.৯১
. নাজির, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১০
. নাজির, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১০-২১১
. Rodee, Introduction to political science, p.94