আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রথম বাণীটিই ছিল-‘‘ইকরা বিইসমি রাবিবকাল্লাযি খালাক। ‘‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, পড় দিয়েই শুরু হয়েছে সর্বকালের সেরা মানুষ আমাদের প্রিয় নবী মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ (সা.) এর মিশনের যাত্রা। আল্লাহ তায়ালা আদম থেকে শুরু করে সকল নবী এবং রাসূলদের শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত করেই তাদের পরিচয় তুলে ধরেছেন। আল্লাহ বলেন : ‘হে নবী! আপনাকে আমি এমন সব জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছি যা আপনিও জানতেন না এবং আপনার পূর্বপুরুষও জানতো না।’ (৬:৯২) আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানদক্ষতায় রাসূল (সা.) এতই পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন যে, শিক্ষা সম্প্রসারণে বিশ্বমানবতার মহান শিক্ষকরূপে তার আবির্ভাব হয়েছিল। সেজন্য রাসূল (সা.) নিজেও এ পৃথিবীতে রাষ্ট্র প্রধান, সেনাপতি কোন নামেই নিজের পরিচয় তুলে ধরেননি। বরং তিনি নিজিকে শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে এভাবে গর্ববোধ করেছেন। রাসূল (সা.) বলেন : ‘বুয়েস্ত্ত মোয়াল্লেমান’ ‘আমি মানবতার জন্য শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি।’ আল্লাহ্পাক রাসূল করীম (সা.)-এর পরিচয় দেন এভাবে : ‘‘তিনি (আল্লাহ্) যিনি নিরক্ষর লোকদের মধ্য হতে তাদেরই একজনকে নবী হিসেবে উন্নীত করেছেন যিনি নবী-(সা.) তাদের কাছে আবৃত্তি বা পাঠ করেন তার (আল্লাহ) নিদর্শনসমূহ, তাদের পুত-পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও জ্ঞান; যদিও তারা পূর্বে মিথ্যা বিশ্বাসের অনুসারী ছিল।’’ [৬২:২]

হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন উম্মী। মানব রচিত কিতাব বা গ্রন্থজ্ঞান তিনি আহরণ করেননি। মানব রচিত গ্রন্থের শিক্ষা অর্জন না করার ফলে তিনি কোন লেখক বা গ্রন্থকারের মতবাদ দ্বারা পক্ষপাতদুষ্ট হওয়া থেকে ছিলেন পাক ও পবিত্র। কারণ গোটা বিশ্বের তথা বিশ্বমানবজাতির যিনি শিক্ষক, তিনি কি করে কোন মানুষ বিশেষের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন? তাহলে বিশ্বকে সার্বজনীন শিক্ষা দেবে কে? আর এ কারণেই আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় রাসূল (সা.)-এর শিক্ষার ভার নিজেই গ্রহণ করেছেন। রাসূল (সা.) শিক্ষকসুলভ আচরণের মাধ্যমে আরবদের মাঝে লুক্কায়িত সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার কর্মসূচিতে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছিলেন । শুধু তাই নয় তিনি মানবকুলের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে জ্ঞান কেই আখ্যায়িত করলেন। আল্লাহ্ বলেন : ‘‘কুল, রাববী জ্বিদ্নী ইলমা’’, বল, হে রব আমার, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি কর।’’

কুরআনের বাণী: ‘যাকে জ্ঞান-প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ করা হয়েছে তাকে মহাকল্যাণে ভূষিত করা হয়েছে।’ (২:২৬৯) ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান রাখে আর যে জ্ঞান রাখে না তারা উভয় কি সমান হতে পারে?’ (সূরা জুমার : ৯) রাসূল (সা.)-এর হাদিসেও আমরা দেখতে পাই ‘জ্ঞানান্বেষণ করা প্রত্যেক নর-নারীর ওপর ফরজ হিসেবে বিবেচ্য।’ তিনি জ্ঞানান্বেষণে যুক্ত হতে এত বেশি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন যে তাঁর বাণী শিক্ষাদর্শনের কালোত্তীর্ণ উপমারূপে গণ্য হয়েছে। তিনি আরো বলেছেন : ‘রাতের কিছু সময় জ্ঞানের অনুশীলন করা সারারাত জাগ্রত থেকে ইবাদত করার চেয়েও উত্তম।’ এভাবেই তিনি নিরক্ষরতামুক্ত সমাজ গঠন, শিক্ষা ও জ্ঞানদক্ষতার উন্নয়নের ধারণা গোটা মানব জাতির সামনে তুলে ধরে শিক্ষার মৌলিক নীতিমালা পেশ করেন।

মূলত রাসূল (সা.) এর শিক্ষানীতিতে গোটা মানব জাতির পাঠক্রম হচ্ছে আল-কুরআন এবং এর ভিত্তিতে পাঠ্যসূচি বা ঝুষষধনঁং হচ্ছে রাসূলের জীবন ও কর্ম-পদ্ধতি। মহান স্রষ্টা আল্লাহ্ তা’আলা এই মহান শিক্ষকের জন্য উপহার স্বরূপ প্রদান করেন মহাগ্রন্থ ‘আল-কুরআন’। আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে কে কোন একাডেমিক শিক্ষা দেয়ার জন্য রাসূল (সা.)কে এ পৃথিবীতে পাঠাননি। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, শিক্ষার জন্ম ও এর সার্বিক প্রসারে একমাত্র ইসলাম ছাড়া আর কোন মতবাদ বা ধর্মে অনুরূপ কোন ধারণাই ছিল না। বরং শিক্ষা সংক্রান্ত সব মতবাদ প্রকৃতপক্ষে ইসলামের শিক্ষা হতেই প্রণীত। জাহিলিয়াতের যুগে এ কাবা শরীফই ছিল শিক্ষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির পীঠস্থান। অধ্যাপক পি. কে. হিট্টির কথায়:ুThe fair of Ukaz stood in pre-Islamic days for a kind of academic franchise of Arabia.”

অনেকের মতে রাসূল (সা.) তাঁর নবুয়্যতের অতি শৈশব অবস্থায় মক্কা নগরীতে ঐতিহাসিক সাফা পর্বতের পাদদেশে ‘দারুল আরকাম’ নামেও একটি প্রতিষ্ঠানের সূচনা করেন। বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এটিই ইতিহাসের সর্বপ্রথম শিক্ষালয়। আজকের বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধারণা আধুনিক পৃথিবী এখান থেকেই লাভ করেছে। এ স্থানে তিনি তাঁর নবদীক্ষেত শিষ্যদেরকে গোপনে নামায ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি শিক্ষা দিতেন। পরে তিনি মদীনা শরীফে হিজরত করে ‘কুববা’ নামক স্থানে সর্বপ্রথম একটি ক্ষুদ্র মসজিদ স্বহসেত্ম স্থাপন করেন ও পরে তিনি মদীনায় মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠা করেন। রাসূল (সা.) আসরের নামাযের পরেই অধিকাংশ সময় ও মসজিদে শিক্ষাদানে ব্রত থাকতেন। লক্ষ্যণীয়, নারীদের মধ্যে শিক্ষা দান ও প্রচারের জন্য তিনি সপ্তাহের একটি দিনও ধার্য করে রেখেছিলেন। সে দিনটিতে মহিলাগণ নির্ধারিত কক্ষে জমায়েত হয়ে আল-কুরআনের অমিয় শিক্ষা গ্রহণ করতেন। রাসূলুল্লাহর (সা.) সহধর্মীনি ও সিদ্দিক নন্দিনী হযরত আয়েশা (রা.) সহ অনেকেই নারী শিক্ষার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। নারীর ব্যক্তিসত্তার পরিচর্যা, আত্মিক উন্নয়ন ও নৈতিক গুণাবলীর উৎকর্ষ সাধনের জন্য নবী (স) পুঁথিগত বিদ্যার বাইরেও তিনি জ্ঞানার্জনের পরামর্শ দিতেন। হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, ২রা হিজরীতে (৬২৩ খ্রিস্টাব্দে) মাকরামাহ ইবনে নাওফেল নামক জনৈক আনসারের গৃহে ‘দারুল কারবাহ’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। এ প্রতিষ্ঠানটি ছিল আবাসিক ধরনের। সাহাবীগণ তাঁর গৃহে থেকে জ্ঞানার্জন করতেন।

এভাবে মদিনার আবু উসামা বিন যুবায়ের (রা) বাড়িতে একটি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন। হযরত মুসআব বিন উমায়ের (রা.) কে রাসূল (সা.) এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিযুক্ত করেন। আর এটিই মদিনায় প্রতিষ্ঠিত সর্বপ্রথম শিক্ষালয় । মদিনায় দ্বিতীয় শিক্ষালয়টি হচ্ছে হযরত আবু আইউব আনসারী (রা.) এর ব্যক্তিগত বাসভবন। আনসারীর (রা.) এই ভবনে রাসূল (সা.) দীর্ঘ আট মাস শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। শিক্ষার আলো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে রাসূল (সা.) এভাবে আলোকিত মানুষকে নিয়ে আলোকিত সমাজ গড়ার দৃপ্ত শপথ নেন। সাহাবীগণ কুরআন শরীফের আয়াত মুখস্থ করার জন্য তিনি তিনবার আবৃত্তি করতেন। আল-কুরআন শিক্ষা করা ছাড়াও সাহাবীগণ ধর্মীয় বিধান (rituals), কারুময় হস্তলিপি (calliography), বংশ ইতিহাস (geneology), ঘোড়দৌড়, বিদেশি ভাষা ও তীর নিক্ষেপ শিক্ষা করতেন। একযোগে দ্বীন ও দুনিয়ার শিক্ষা প্রদানের পদ্ধতি ও প্রয়োগ আল্লাহর রাসূল (সা.) এভাবে প্রচলিত করেন। রাসূল করীম (সা.)-এর জীবদ্দশায় ৯টি মসজিদ মদীনায় ছিল। এসব মসজিদে মদীনাও এর নিকটবর্তী অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা শিক্ষা গ্রহণের জন্য সমবেত হতো। আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতির মত তখন ভর্তি পরীক্ষা ও বেতনের দ্বারা শিক্ষার দ্বার সংকুচিত ছিল না। মসজিদ ছিল তখন একটি উন্মুক্ত বিদ্যালয়, যা হতে বর্তমান বিশ্ব Open University- এবং আবাসিক হলের এর ধারণা লাভ করেছে। শিক্ষাদানের বহু প্রজ্ঞাময় ও জ্ঞানী সাহাবী তখন ছিলেন শিক্ষকতায় নিবেদিত। তাঁদেরকে ঘিরে রাখতেন ছাত্রগণ মৌমাছির মত।

দূরবর্তী মেধাবী শিক্ষার্থীদের একত্রিত করে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন। যারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে উন্নত পাঠদানে পারদর্শী হতেন এদের থেকে নির্বাচন করে গ্রুপ ভিত্তিক বিভিন্ন এলাকার শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রেরণ করতেন। হিজরী ১১ সনে হযরত মুআয বিন জাবাল (রা.) কে ইয়ামেনের গভর্নর করে পাঠান। সেখানকার প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র পরিদর্শন করা এবং বিভিন্ন অঙ্গনের শিক্ষাবিষয়ক সমস্যাগুলো সমাধানের নিমিত্তে তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত সাহাবী ছিলেন।

বলা যায় সারা বিশ্বব্যাপী একটি নিরক্ষরতা মুক্ত সমাজ গঠনে রাসূল (সা.) এর এই ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল
রাসূল (সা.) পত্র সাহিত্যের মাধ্যমে শিক্ষা প্রসারে ও নিরক্ষরতা দূরীকরণে যে নবধারা সৃষ্টি করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতায় আজ বিশ্বব্যাপী উন্মুক্ত ও দূরশিক্ষার আইডিয়া লাভ করেছে। পত্রের মাধ্যমে শিক্ষা প্রসারের একটি উল্লেখযোগ্য হাদীস হচ্ছে-‘নবী (সা.) সিরিয়ার সেনাপ্রধানের হাতে পত্র দিয়ে বললেন, তুমি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছার পূর্বে এ পত্রটি পড়বে না। তোমার বাহিনীর জন্য এ পত্রে কিছু শিক্ষণীয় বিষয় আছে। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে সেনাপ্রধান পত্রটি খুললেন’। (বুখারী, পৃ. ১৫) তৎকালীন পারস্য সম্রাট পারভেজ বিন হুরমুয বিন নৌশিরাওয়াঁর কাছে আল্লাহর একাত্ববাদে বিশ্বাস ও সত্য জ্ঞান উপলব্ধি করার আহবান জানানো হয়। হাদীসে এসেছে :‘রাসূল (সা.) এক ব্যক্তির হাতে পত্র দিয়ে বললেন, সে যেন পত্রটি পারস্য সম্রাট কর্তৃক নিয়োজিত বাহরাইনের গভর্নরের কাছে পৌঁছে দেয়। তিনি তার কথামত পত্রটি তার হাতে পৌঁছে দেন’। (বুখারী, পৃ. ১৫) এভাবে পত্রালাপ বা চিঠিপত্রের মাধ্যমে রাসূল (সা.) শিক্ষার আলো বিস্তারে সদা সচেষ্ট ছিলেন।

ঐতিহাসিক খোদা বকশ ‘Islamic Civilization’ গ্রন্থে মসজিদের বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহার সম্পর্কে মন্তব্য করেন নিম্নভাবে:ুFor the Muslims the mosque does not bear the same exclusive character as does a church for the Christians. It is not merely a place of worship. The Muslim indeed honours the mosque but he does not hesitate to use it for any laudab purpose”. রাসূল (সা) কর্তৃক বিদ্যাপীঠ হিসেবে মসজিদের এই সার্বজনীন প্রশংসনীয় ব্যবহারই উত্তরকালে শিক্ষার গণমুখী প্রসার ও সম্প্রসারণে অতি ব্যাপক ও গভীর ভূমিকা পালন করেছে। ঐতিহাসিক ইয়াকুবের মতে বাগদাদে ৩০ হাজার মসজিদ শিক্ষাদানের জন্য ব্যবহৃত হতো; বড় বড় মসজিদগুলোতে পাঠ্য তালিকা ভাগ করা ছিল। শিক্ষকগণ সে পাঠ্যতালিকা অনুযায়ী বিশেষ পাঠ্যসূচির উপর বক্তৃতা দিতেন। পরিব্রাজক নাসির খসরুর মতে (একাদশ শতাব্দীতে) মিসরের রাজধানী কায়রোর মসজিদে প্রত্যহ প্রায় ৫ হাজার লোক দীন ইলম হাসিল করার জন্য সমবেত হতো। সাম্প্রতিককালের মিসরের ‘জামে আযহার’, দিল্লীর ‘জামেয়া মিল্লিয়া’ এবং ‘দেওবন্দ মাদ্রাসা’ মসজিদভিত্তিক শিক্ষারই উত্তর ফসল।

সাইয়েদ সুলায়মান নদভী ‘পয়গামে মুহাম্মদী’তে বলেন, ‘‘নবুয়াত বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ শিক্ষালয় তিনটি তে একই সময়ে এক লক্ষেরও বেশি ছাত্র দেখতে পারেন। তাঁর [রাসূল (সা.)] প্রত্যেকটি ছাত্রের নাম, পরিচয়, অবস্থা, জীবনচরিত, শিক্ষা ও অনুশীলনের ফলাফল, প্রত্যেকটি বিষয় ইসলামের ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে।’’ আধুনিক বিশ্বের শিক্ষা-বিজ্ঞানের পরিভাষায় :Follow up study” বাুCumulative Record”-ও ছাত্রদের জীবন বৃত্তান্ত ততটুকু রাখতে সক্ষম হয়নি, যতটুকু আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর ছাত্রদের ‘‘ইতিহাস বৃত্তান্ত’’ বর্তমানে সংরক্ষেত হয়ে আছে। হযরত উমর (রা) হতে হযরত বিলাল (রা) পর্যন্ত খলীফা, ক্রীতদাস, আরব, অনারব, প্রতিপত্তিশালী, নিরীহ, সবাই এক কাতারে সমমর্যাদার আল্লাহর রাসূলের (সা.) নিকট বিদ্যাশিক্ষা লাভের সমান সুযোগ ও মর্যাদা পেয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষায়তনে সার্বজনীনতার এ দিকটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। এর মধ্যে প্রবেশাধিকার লাভের জন্য বর্ণ ও আকৃতি, দেশ ও রাষ্ট্র, জাতি ও বংশ এবং ভাষা ও উচ্চারণ ভঙ্গিমার কোন প্রাচীরই ছিল না, বরং ঐ সময়ে দুনিয়ার সকল জাতি, সকল বংশ, সকল দেশ ও সকল ভাষাভাষীর জন্য শিক্ষার দ্বার ছিল উন্মুক্ত।

রাসূল (সা.) শিক্ষাকে বিশ্বজনীন করতে বিদেশী ভাষা বোঝার জন্য যায়েদ বিন সাবিত (রা.) কে হিব্রু ভাষা শিক্ষার নির্দেশ দেন। জানা যায়, তিনি মাত্র সতের দিনে এ ভাষা শিখতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাসূল (সা.) শিক্ষানীতির আরো একটি অনুষঙ্গ হচ্ছে-অমুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। মুসলমানদের জন্য নেয়া শিক্ষাকর্মসূচির পাশাপাশি তিনি অমুসলিমদের জন্যও শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। কেননা এটা ছিল তাদের প্রাপ্য মৌলিক অধিকার। তাই দেখা যায় কখনো কখনো ইহুদীগণ রাসূলের (সা.) কাছে আসতো এবং ধর্মীয় জ্ঞানশিক্ষায় অংশগ্রহণ করতো। স্যার উইলিয়াম মূয়ীর : আল্লাহর রাসূলের চারিত্রের প্রভাব ও দীপ্তি তুলে ধরেন এই বলে : ‘‘তিনি মধ্যমাকৃতি অপেক্ষা ঈষৎ দীর্ঘকায় হলেও দেখতে রাজোপম ও তেজস্বী ছিলেন। তিনি মানবকুলের সর্বাপেক্ষা রূপবান, সর্বাপেক্ষা সাহসী, সর্বাপেক্ষা প্রতীপ্ত সুকান্তি বিশিষ্ট ও সর্বাপেক্ষা উদার ছিলেন। তাঁকে দেখলে অনুমিত হত যেন তাঁর মুখমন্ডল হতে স্বর্গীয় জ্যোতি বিচ্ছুতির হচ্ছে।’’

আমরা রাসূল (সা.) এর শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার পূনাঈ ধারনা লাভ করতে পারি আসহাবে সুফহার ৭০ জন সাহাবীর সমষ্টির নিকট থেকে। তাঁরা কৃচ্ছ্রতা সাধন ও জ্ঞান পিপাসা নিবৃত্তির জন্য যে ত্যাগ ও কুরবানীর নজীর রেখে গেছেন তা বিশ্বের প্রলয়দিন পর্যন্ত সমুজ্জ্বল আদর্শ হয়ে থাকবে। তাঁরা দিনের বেলায় জঙ্গলে কাঠ কাটতেন জীবিকা নির্বাহের জন্য, আর রাতভর ইবাদত করতেন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে। অনাগত জ্ঞান পিপাসু নতুন প্রজন্মমের জন্য এর থেকে বড় দৃষ্টান্ত এখনো অনাবিষ্কৃত।
তাই বলা যেতে পারে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব আমাদের প্রিয় নবী মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষানীতি,ছা্ত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, চিন্তা ও কর্মময় জীবনকীর্তি ও অবদান আমাদের জন্য অবিস্মরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে।