০১. ভুমিকা [Introduction]
শিক্ষা ও নৈতিকতা, মুদ্রার এপিঠ ওপিঠের মত। মানবিক নৈতিকতা ছাড়া শিক্ষা কুশিক্ষার নামান্তর, যা মানুষকে পশুর চেয়েও নিম্নস্তরে নামিয়ে ফেলে। আর মানবিক নৈতিকতাপূর্ণ শিক্ষা মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের মযার্দায় অধিষ্ঠিত রাখে। শিল্পের জন্য শিল্প যেমন জীবনের কোন প্রয়োজন মেটায় না তেমনি শিক্ষার জন্য শিক্ষা মানুষকে মনুষ্যত্ব নিয়ে গড়ে উঠতে সহায়তা করে না। স্তর ভিত্তিক জীবনের বিকাশে এ শিক্ষা কোন কাজে আসে না। যে শিক্ষা মানুষকে অন্যের পাশে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করেনা, যে শিক্ষা মানুষকে ভীরুতাকে জয় করতে শিখায় না, যে শিক্ষা জীবনে ও মরণে আলো দিতে পারে না, যে শিক্ষা মানুষকে মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে স্বার্থপরতায় অন্ধ করে তোলে, যে শিক্ষা মানুষকে উগ্র ইন্দ্রিয়সুখের জন্য হত্যার কারণ তৈরি করে, যে শিক্ষা সতীর্থকে নির্মমভাবে খুন করতে উদ্বুদ্ধ করে, যে শিক্ষা ভালবাসার কবর রচনা করে ঘৃণাকে উসকে দিয়ে হিংসা হানাহানির প্রসার ঘটায়, যে শিক্ষা ঐক্যের পরিবর্তে শুধু বিভেদই বাড়ায়, আজ সর্বত্র সে শিক্ষার প্রচার ও প্রসার। এই হচ্ছে বস্ত্তবাদী শিক্ষার দৃষ্টান্ত। যেখানে বস্ত্তই জীবনের শেষকথা, ক্ষমতা কার হাতে সেটাই বড় কথা। Ends justifies the means-পাশ্চাত্যের এ এক বড় শিক্ষা-দর্শন। এমনি ধরণের আরেকটি শিক্ষা দর্শন হলো - Everything is fair in love and war. - পাশ্চাত্যের এই শিক্ষা দর্শনে নৈতিকতাকে সুকৌশলে নির্বাসন দেয়া হয়েছে। ছলে-বলে-কৌশলে বা মারি-অরি-পারি যে উদ্দেশ্য সাধনের শিক্ষাই পাশ্চাত্য বস্ত্তবাদী শিক্ষার নির্যাস। পাশ্চাত্য সভ্যতা, নৈতিকতা নিরপেক্ষ শিক্ষার প্রবক্তা। শিক্ষার ফলে কোন্ ধরণের নৈতিকতা জন্ম নিল সে বিষয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতা উদাসীন। আর ইসলামে মানবিক নৈতিকতা ছাড়া কোন শিক্ষাই নেই। মানবিক নৈতিকতাপূর্ণ শিক্ষাও বস্ত্তবাদী শিক্ষায় পরিণত হতে পারে যদি সে নৈতিকতার প্রয়োগকে পাশ কাটিয়ে চলা হয়, স্বার্থের দ্বন্দ্বে মানবিক নৈতিকতাকে বিসর্জন দেয়া হয়। তখন সেই মানবিক নৈতিকতার প্রবক্তা স্বয়ং নৈতিকতার ধ্বজ্বাধারীতে পরিণত হয়। অর্থাৎ মানবিক নৈতিকতাপূর্ণ শিক্ষাও অর্থহীন হয়ে পড়ে যদি তা বাস্তবে অনুসৃত না হয়। আর মানবিক নৈতিকতার শিকড় হচ্ছে ‘‘কথা ও কাজে মিল’’ রাখা। কথা ও কাজে মিল থাকা ঈমানের অন্যতম প্রকাশ। কথা ও কাজে যার মিল নেই, তার ভেতরে সত্যিকার অর্থে কোন মানবিক নৈতিকতাই নেই। আর এ ধরণের মানুষ ইসলামের দৃষ্টিতে আললাহর নৈকট্য বঞ্চিত। কারণ আল্লাহর নিকট ক্রোধের পাত্র নিশ্চয়ই তাঁর নৈকট্যপ্রাপ্ত হতে পারেনা। শিক্ষা ও নৈতিকতা উভয়টির জন্যই শিক্ষক এক অনিবার্য প্রয়োজন। শিক্ষক ব্যতীত শিক্ষা ও নৈতিকতা উভয়টিই অচল। তাই শিক্ষা ও নৈতিকতার প্রশ্নে শিক্ষকের ভূমিকাই মুখ্য। শিক্ষক, শিক্ষা ও নৈতিকতা এই ত্রিভুজ দিয়েই গড়ে ওঠে কোন জাতির সভ্যতার চূড়া। পৃথিবীর সকল সমাজেই এই তিন উপাদানই ছিল সভ্যতা গড়ার মূল হাতিয়ার। শিক্ষক, শিক্ষা ও নৈতিকতা নিয়ে দৃষ্টিভংগিগত ভিন্নতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন মতামত বিকশিত হয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধের শিরোনাম ‘শিক্ষা ও নৈতিকতা’ হলেও এতে প্রসংগক্রমেই শিক্ষা দর্শন, শিক্ষণ ও শিক্ষকের ভূমিকা নিয়ে আলোচনাও স্থান পেয়েছে।
০২. শিক্ষার প্রচলিত ধারণা [Conventional Conception of Education]
বাংলা ‘শিক্ষা’ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘শাস’ ধাতু থেকে উদ্ভুত। ‘শাস’ ধাতুর অর্থ হচ্ছে ‘শাসন করা’, ‘নিয়ন্ত্রণ করা’ ইত্যাদি। আবার সাধারণভাবে শিক্ষা ‘বিদ্যা অর্জন বা আহরণ’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এই বিদ্যা শব্দটি সংস্কৃত ‘‘বিদ’’ ধাতু হতে আগত। এর অর্থ জানা বা জ্ঞান আহরণ করা। শিক্ষা বলতে জ্ঞান অর্জন, শিক্ষণ ও প্রয়োগকরণ এ তিনের সমন্বয়কে বুঝায়। এছাড়া শিক্ষণ, পঠন ও লেখনে দক্ষতা অর্জন শিক্ষার আরেক পরিচয়। সামাগ্রিকভাবে একজন মানুষের বিকশিত হতে যে অপরিহার্য হাতিয়ার প্রয়োজন তা হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা সৃষ্টিশীল। নতুন নতুন ধারণা ও জ্ঞানের বিকাশে শিক্ষা নিয়তই অবদান রেখে যাচ্ছে। শিক্ষার প্রয়োজন সর্বজনীন, বিশ্বময়। জীবনধারণের জন্য খাদ্যের প্রয়োজনের মতই শিক্ষা মানুষের জীবনে অপরিহার্য। শিক্ষা শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে Education. যার প্রতিটি অক্ষরকে বিশেলষণ করে শিক্ষার এক সামগ্রিক অর্থকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বিশেলষণটি নিম্নরূপঃ
The term EDUCATION stands for-
E-Enlargement of mind [মনের প্রশস্ততা বা সংকীর্ণতার অবসান]
D-Discipline [শৃংখলা]
U-Universal outlook [সর্বজনীনতা]
C-Characterization [ নৈতিক চরিত্র গঠন]
A-Activities [শিক্ষার প্রয়োগ বা কর্মচাঞ্চল্য]
T-Truth worthiness [সত্যানুরাগ]
I-Idealism [আর্দশানুরাগ]
O-Omniscient [প্রজ্ঞার প্রকাশ]
N-Nice tempered [মেজাজের ভারসাম্য]
বিশেলষণটিকে পরখ করলে দেখা যায়, জীবনের সুকুমারবৃত্তিগুলোকে স্পর্শ করেছে শিক্ষা। প্রচলিত ধারণায় অর্থগতভাবে শিক্ষাকে তিনভাবে ভাগ করা হয়েছেঃ
০১. ব্যুৎপত্তিগত অর্থঃ ল্যাটিন শব্দ educere, educare, and educatum হতে উদ্ভুত হয়েছে EDUCATION। যার অর্থ দাড়াচ্ছে 'to learn', 'to know', and to 'lead out'. অর্থাৎ শিক্ষা হচ্ছে মানুষের অন্তর্নিহিত সুপ্ত শক্তিকে উন্মোচিত বা বের করা বা প্রকাশ করার এক অনিবার্য উপায়।
০২. সীমিত পরিসরে অর্থঃ শিক্ষার সাথে রয়েছে শিক্ষাদানের সম্পর্ক। আর শিক্ষাদানের সাথে রয়েছে শিক্ষা দর্শন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, পদ্ধতি, শ্রেণীকক্ষ, শ্রেণী ব্যবস্থাপনা, শিক্ষাদান প্রধান [প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ বা ভাইস চ্যান্সলর ইত্যাদি] , সমাজ, পরিচালনা বডি, পরিচালনার জন্য অফিস ইত্যাদির সম্পর্ক। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষা প্রদান করা হয় তা শিক্ষার সীমিত পরিসরে পরিচয় বহন করে। যেখানে পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে অন্য কোন শিক্ষার স্বীকৃতি গৌণ বিবেচনা করা হয়।
০৩. বৃহত্তর পরিসরে অর্থঃ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি প্রাতিষ্ঠানিক পুঁথিগত শিক্ষার বাইরে অর্জিত শিক্ষাই বৃহত্তর পরিসরে শিক্ষার পরিচয় । স্থান ও সময় নিরপেক্ষ যে কোন শিক্ষা অর্জনই শিক্ষার বৃহত্তর অঙ্গন।
শিক্ষা নিয়ে মানুষের সচেতন চিন্তা-ভাবনার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষার সর্বজনসম্মত কোন সংজ্ঞা নেই। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশে শিক্ষাবিদ ও দার্শনিকরা নিজস্ব চিন্তা-চেতনার আলোকে শিক্ষার বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞা দিয়েছেন। যেমনঃ
০১. দার্শনিক সক্রেটিসের মতে, ‘‘শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের আবিষ্কার।’’
০২. দার্শনিক প্লেটোর মতে, ‘‘শিক্ষা হচ্ছে সেই শক্তি, যার দ্বারা সঠিক সময়ে আনন্দ ও বেদনার অনুভূতিবোধ জন্মায়। এটি শিক্ষার্থীর দেহে ও মনে সকল সুন্দর ও অন্তর্নিহিত শক্তিকে বিকশিত করে তোলে।’’
০৩. দার্শনিক এরিস্টটলের মতে, ‘‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা দেহ-মনের সুষম এবং পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে ব্যক্তির জীবনের প্রকৃত মাধুর্য ও পরম সত্য উপলব্ধিতে সহায়তা করে।’’
০৪. শিক্ষাবিদ কমেনিয়াসের মতে, ‘‘শিক্ষা হচ্ছে মানুষের নৈতিক উন্নতির সাহায্যে ইহলোক ও পরলোকের জন্য পূর্ণ প্রস্ত্ততি। শিক্ষার সাহায্যে মানুষ নিজকে ও বিশ্বকে জানতে পারে।’’
০৫. শিক্ষাবিদ থমসন বলেছেন, ‘‘শিক্ষা বলতে আমরা শিশুর উপর পরিবেশের প্রভাব বুঝি।’’
০৬. জন লকের মতে, ‘‘সুস্থ শরীরে সুস্থ মনের সৃষ্টি হল শিক্ষা।’’
০৭. হেনরিক পেস্তলোজীর মতে, ‘‘শিক্ষা হচ্ছে মানুষের শক্তি ও সামর্থ্যের স্বাভাবিক, প্রগতিশীল ও নিয়মানুগ বর্ধন ও সামঞ্জস্যপূর্ণ বিকাশ।’’
০৮. ফ্রেডারিক হার্বাট এর মতে, ‘‘শিক্ষা হচ্ছে মানুষের বহুমুখী প্রতিভার ও অনুরাগের সুষম প্রকাশ এবং নৈতিক চরিত্র গঠন।’’
০৯. ফ্রেডারিক ফ্রোয়েবেলের মতে, ‘‘সুন্দর বিশ্বস্ত এবং পবিত্র জীবন উপলব্ধি হল শিক্ষা।’’
১০. ফ্রেন্সিস পার্কারের মতে, ‘‘মানুষের সকল প্রকার সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনই শিক্ষা।’’
১১. জন ডিউইর মতে, ‘‘আত্মোপোলব্ধিই হল শিক্ষা।’’
১২. হোয়াইট হিডের মতে, ‘‘শিক্ষা হচ্ছে জ্ঞানার্জন এবং সুষ্ঠু প্রয়োগের একটি পরিকল্পনা এবং কৌশল মাত্র।’’
১৩. দার্শনিক রাসেল-এর মতে, ‘‘শিক্ষা হচ্ছে কতিপয় মানবিক গুণের যথা সাহস, উদ্যম, অনুভীতিশীলতা, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদির বিকাশ সাধন।’’
১৪. কান্টের মতে, ‘‘আদর্শ মনুষ্যত্ব অর্জনই শিক্ষা।’’
১৫. হার্বাট স্পেনসারের ভাষায়, ‘‘পরিপূর্ণ জীবনযাপনই শিক্ষা।’’
১৬. হার্বাট রীডের মতে, ‘‘মানুষকে মানুষ করাই শিক্ষা। স্রষ্টার সৃষ্টির রহস্য সম্যক উপলব্ধি করতে যা সাহায্য করে, তাই শিক্ষা।’’
শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও দার্শনিকদের উপরোক্ত মতামতে শিক্ষার দর্শন ও তাকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু এর প্রায়োগিক দিক নিয়ে শিক্ষাবিদ ও দার্শনিকদের মাঝে বিস্তর মতামতের ভিন্নতা রয়েছে। জন মিল্টন শিক্ষার সংজ্ঞায় ধর্মকে প্রয়োজন মনে করেছেন। তবে এটা কোন্ ধর্ম তা তিনি উল্লেখ করেননি। তিনি খৃষ্ট ধর্মের অনুসারী একজন পাশ্চাত্য শিক্ষাবিদ ছিলেন।
০৩. ইসলামে শিক্ষার ধারণা [Conception of Education In Islam]
‘শিক্ষা’ শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবে ইসলামী শিক্ষায় পাঁচটি শব্দ পাওয়া যায় [এছাড়াও আরো থাকতে পারে] ঃ
০১. তারবীয়াহ [تربية]ঃ তারবীয়াহ [تربية] শব্দটি উদ্ভুত হয়েছে ربو শব্দ হতে। ربو অর্থ : Increase, to grow, to exceed, to raise, rear, bring up, to educate, to teach, instruct, to develop, augment এবং তারবীয়াহ [تربية] অর্থ : Education, up bringing Instruction, Pedagogy, Breeding, Raising.
০২. তালীম [تعليم]ঃ তালীম [تعليم] শব্দটি উদ্ভুত হয়েছে ইলম্ [علم] হতে। তালীম [تعليم] অর্থ: Information, Advice, Instruction, Direction, Teaching, Training, Schooling, Education, Apprenticeship.
০৩. তাদীব [تأديب ]ঃ তাদীব [تأديب ] শব্দটি উদ্ভুত হয়েছে أدب [আদব] শব্দটি হতে, ‘ [أدب] আদব’ অর্থ : Culture, Refinement, Good breeding, Good, manners, Social graces, Decorum.
০৪. তাদরীব [تدريب ]ঃ তাদরীব [تدريب ] -এর আভিধানিক অর্থ : Habitation, Accustoming, Practice, Drill, Schooling, Training, Coaching, Tutoring.
০৫. তাদরীস [تدريس ]ঃ তাদরীস [تدريس ] শব্দটি উদ্ভুত হয়েছে দারস [درس] শব্দটি হতে, তাদরীস-এর আভিধানিক অর্থঃ To study, to learn, to teach, to instruct, to wipe out, to blot out, to thrash out, tution.
সাধারণভাবে শিক্ষা বলতে আমরা পুঁথিগত বিদ্যাকেই বুঝি। পুঁথিগত বিদ্যার মাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জন হয় তাই সাধারণতঃ শিক্ষা বলে বিবেচিত হয়। যিনি যত বেশি পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করতে পারেন, তিনি তত বেশি শিক্ষিত বলে সমাজে আদৃত হন। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা লাভের উপায় হচ্ছে জ্ঞানার্জন। এই জ্ঞান অর্জন আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেও হতে পারে, আবার অনানুষ্ঠানিকভাবেও হতে পারে। মানুষকে খাদ্য, আহার, বাসস্থান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রকার কলাকৌশল, জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হত। প্রজন্ম হতে প্রজন্মে বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে এ সমস্ত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা কনিষ্ঠ ও অনুজদের মাঝে প্রদান করা হত বা তারা অর্জন করে নিত। মানুষের এই সমস্ত অর্জিত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা - এক প্রকার শিক্ষা। নিরক্ষর চাষী চাষবাস সংক্রান্ত বিষয়ে পরিপূর্ণ অভিজ্ঞ, নিরক্ষর তাঁতী সুন্দরভাবে তার কাপড় বোনা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, শ্রমিক বিভিন্ন জিনিষ তৈরি সম্পর্কে, শিল্পী বিভিন্ন প্রকার শিল্পনৈপুণ্য সম্পর্কে অভিজ্ঞ। এরাও এক ধরণের শিক্ষিত। পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়াই এই সমস্ত ব্যক্তি দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় কাজ-কর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে বয়োজ্যেষ্ঠ ও সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিদের নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করছে। নিরক্ষর [উম্মী] মানুষের এইসব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাই পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার রূপ পরিগ্রহ করে শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে পুঁথিগত বিদ্যায় স্থান লাভ করেছে। যেমন, শিকারীর পশু শিকারের কলাকৌশল ও যন্ত্রপাতি, কৃষকের চাষবাস, তাঁতীর বয়ন কাজ, শ্রমিকের শিল্পের কাজ, শিল্পীর নৈপুণ্যের কাজ, জেলের মৎস্য শিকারের কাজ ইত্যাদি। এই সমস্ত লোক নিরক্ষর হলেও তাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, নৈপুণ্য, অধ্যবসায়, ঐকান্তিকতা, বিচারবুদ্ধি ইত্যাদি শিক্ষিতের সমপর্যায়ভুক্ত। ভাষা শেখার আগে কেউ ব্যাকরণ শেখে না। আগে ভাষা তারপর ব্যাকরণের জন্ম। আগে অনানুষ্ঠানিক জ্ঞানের চর্চা, তারপর তার আনুষ্ঠানিক রূপ প্রকাশ পায়। ‘নিরক্ষর’ শব্দটির আরবী আভিধানিক অর্থ উম্মী। অক্ষর জ্ঞানহীন। প্রিয় পাঠক, নিরক্ষর হলেই একজন মানুষ প্রজ্ঞাহীন বা শিক্ষাহীন মূর্খ তা বুঝায় না। একইভাবে অক্ষরজ্ঞান থাকলেই একজন মানুষ প্রজ্ঞাময় হবেন তা যথার্থ নয়। একজন চিকিৎসকের কাছে যদি প্রকৌশলবিদ্যার প্রাথমিক জ্ঞান জানতে চাওয়া হয় অথবা একজন প্রকৌশলীর কাছে যদি চিকিৎসাবিদ্যার প্রাথমিক জ্ঞান জানতে চাওয়া হয় তবে উভয়ের অবস্থা যা হবে তাতে চিকিৎসককে প্রকৌশলবিদ্যার জন্য উম্মী বলা যায় এবং প্রকৌশলীকে চিকিৎসাবিদ্যার জন্য উম্মী বলা যায় অনায়াসে। এভাবে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে আমরা প্রত্যেকেই কোন না কোন বিষয়ে উম্মী। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অক্ষরজ্ঞান বিষয়েই শুধু উম্মী ছিলেন, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা, মানবিকতা ও উদারতা, সুবিচার ও নিরপেক্ষতা, ভ্রুণ বিজ্ঞান হতে পানি বিজ্ঞান পর্যন্ত বিজ্ঞানের সকল বিষয়ের বিচারে তিনি আজও অতুলনীয়। তাঁর প্রতি নাযিলকৃত আল কুরআন বিজ্ঞানময়। আল্লাহ বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই আপনাকে আল-কুরআন দেয়া হয়েছে প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞের নিকট হতে।’’ [আল কুরআন যে প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ আল্লাহর নাযিলকৃত; নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রচিত নয় তাঁর উম্মী হওয়াই এর প্রমাণ এবং তিনি নিজ উদ্যেগে মানবজাতির জন্য কোন বিধান রচনার প্রয়াস চালাননি।] তাঁর প্রতি নাযিলকৃত জীবনবিধানের মুগ্ধতায় বিংশ-একবিংশ শতাব্দীর বহু মনীষী নানা প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছেন। বহু নারী-পুরুষ ইসলামকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিচ্ছেন। আল্লাহ, তাঁর [নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] সম্পর্কে বলছেন, ‘‘তিনিই [আল্লাহতায়ালা] উম্মীদের মধ্যে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য হতে, যে তাদের নিকট আবৃত্তি করে তাঁর [আল্লাহর] আয়াতসমূহ; তাদেরকে পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমাত; ইতিপূর্বে তো এরা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে এবং তাদের অন্যান্যদের জন্যেও যারা এখনও তাদের সাথে মিলিত হয়নি। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’’ অর্থাৎ একজন উম্মী বা নিরক্ষর মানুষকে আল্লাহ মনোনীত করলেন কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়ার জন্য। একজন প্রকৃত শিক্ষিত ব্যক্তি সেই-ই যিনি নিজে কোন্ বিষয়ে উম্মী এবং কোন্ বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন সে সম্পর্কে সচেতন। যিনি রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও বিজ্ঞ তিনি ব্যবসায়িক বিষয়েও বিজ্ঞ হবেন এমনটি ভাবার যৌক্তিক কোন কারণ নেই। স্বতঃসিদ্ধও নয়। ব্যবসা বিষয়ে জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও যিনি ব্যবসা পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেন তিনি কার্যতঃ মূর্খতার পরিচয় দেন। এতে ব্যবসার নামে হয় জগাখিচুড়ি। নষ্ট হয় আমানাতদারী। নিজেকে সবজান্তা ভাবার সমস্যা এখানেই। যে বিষয়ে যিনি উম্মী তিনি সে বিষয়ে উম্মীর সহজ স্বীকৃতি দেয়াই প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের পরিচয়। আর যে ব্যক্তি আমানাতদারী ও সুবিচার জ্ঞানে উম্মী অর্থাৎ যার আমানাতদারী ও সুবিচার জ্ঞানের অভাব রয়েছে তার ব্যবসা - রাজনীতি যে কোন কাজে পরিচালকের ভূমিকা নেয়া মানে সে কাজে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। তাই দায়িত্ব পালনের সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অর্জনের বিষয়টি আল্লাহতায়ালা গভীর গুরুত্ব দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘‘বল, যারা জানে ও যারা জানে না তারা কি সমান?’’ আল্লাহ আরো বলেন, ‘‘তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান এনেছে এবং [ঈমানদারদের মধ্য হতে] যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন।’’ কুরআনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে শিক্ষা বিষয়ে আললাহ যা বলেছেন, তাতে শিক্ষা বিষয়ে ইসলামের দার্শনিক ও প্রায়োগিক উভয়দিকই প্রতিফলিত হয়েছে। কুরআনের কিছু বাছাইকৃত আয়াত হতে নিম্নে তা তুলে ধরা হলঃ
ক. শিক্ষা হল স্রষ্টাকে চেনা ও অজানাকে জানাঃ
আললাহ বলেন,
‘‘পাঠ কর তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন- সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক হতে।
পাঠ কর, আর তোমার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।
শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না।’’
খ. শিক্ষা হল জীবন-জগতের পরিচয় জানাঃ
আললাহ বলেন, ‘‘আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, অতঃপর আদম সকল ফেরেশতাদের সম্মুখে তা প্রকাশ করলেন এবং আল্লাহ বললেন, ‘এই সমুদয়ের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ ফেরেশতারা বলল, ‘আপনি মহান, পবিত্র। আপনি আমাদের যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের তো কোন জ্ঞানই নেই। বস্ত্ততঃ আপনি জ্ঞানময় ও প্রজ্ঞাময়।’’
গ. শিক্ষা হল আল্লাহর দান ঃ
আললাহ বলেন,
‘‘ যা তিনি ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত তাঁর জ্ঞানের কিছুই তারা আয়ত্ত্ব করতে পারে না।’’
‘‘...... আল্লাহ তাকে [দাউদ আ.] রাজত্ব ও হিকমাত দান করলেন এবং যা তিনি ইচ্ছা করলেন তা তাকে শিক্ষা দিলেন। ’’
‘‘...... তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তিনি তোমাদেরকে শিক্ষা দেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সবিশেষ অবহিত।’’
‘‘....... আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব ও হিকমাত অবতীর্ণ করেছেন এবং তুমি যা জানতে না তা তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন, তোমার প্রতি আল্লাহর মহা অনুগ্রহ রয়েছে।’’
ঘ. শিক্ষা হল জ্ঞানের সৃষ্টি ও বৃদ্ধিঃ
‘‘........এবং বল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন।’’’
ঙ. শিক্ষা হল জ্ঞান বিতরণ বা হিকমাত প্রশিক্ষণ দেয়াঃ
‘‘তিনিই [আল্লাহতায়ালা] উম্মীদের মধ্যে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য হতে, যে তাদের নিকট আবৃত্তি করে তাঁর [আল্লাহর] আয়াতসমূহ; তাদেরকে পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমাত; ইতিপূর্বে তো এরা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে এবং তাদের অন্যান্যদের জন্যেও যারা এখনও তাদের সাথে মিলিত হয়নি। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’’
চ. শিক্ষা হল বিশেষ জ্ঞানঃ
‘‘অতঃপর তারা সাক্ষাত পেল আমার বান্দাদের মধ্যে একজনের, যাকে আমি আমার নিকট হতে অনুগ্রহ দান করেছিলাম ও আমার নিকট হতে শিক্ষা দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান।’’
ছ. শিক্ষা হল বোধশক্তিসম্পন্ন হওয়াঃ
‘‘ ......... এবং বোধশক্তিসম্পন্নেরা ব্যতীত অপর কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না।’’
জ. শিক্ষা হল বিশ্বাস অর্জনের সাহস ঃ
‘‘........... আমি যা তোমাদেরকে বলব তা, আমার প্রতিপালক আমাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তা হতে বলব। যে সম্প্রদায় আল্লাহে বিশ্বাস করে না ও আখিরাতে অবিশ্বাসী আমি তাদের মতবাদ বর্জন করেছি।’’
ঝ. শিক্ষা হল মুসলিম হিসেবে মৃত্যুঃ
‘‘হে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা! আপনিই ইহলোক ও পরলোকে আমার অভিভাবক। আপনি আমাকে মুসলিম হিসেবে মৃত্যু দিন এবং আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত করুন।’’
ঞ. শিক্ষা হল প্রতিরক্ষা ও কৃতজ্ঞতাঃ
‘আর আমি তাকে তোমাদের জন্য বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম, যাতে তা তোমাদের যুদ্ধে তোমাদেরকে রক্ষা করে; সুতরাং তোমরা কি কৃতজ্ঞ হবে না ?’
০৪. শিক্ষার সর্বজনীন প্রকার [ Universal Types of Education]
শিক্ষার প্রকার বলতে শিক্ষা অর্জনের উপায়কে বুঝায়। সর্বজনীনভাবেই শিক্ষা অর্জনের প্রকার দুইটিঃ
ক. অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাঃ শিক্ষা বৎসর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, টেক্সট বই, শিক্ষা কারিকুলাম, গ্রেড পদ্ধতি এবং বিভিন্ন শিক্ষাস্তর বর্জিত শিক্ষাই অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা হিসেবে বিবেচিত। একজন প্রাজ্ঞ শিক্ষকের সযত্নে গড়ে ওঠে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার আবহ। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আসহাবে সুফফার শিক্ষা গ্রহণ ছিল অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সক্রেটিসের তত্ত্বাবধানে প্লেটোর এবং প্লেটোর তত্ত্ববধানে এরিস্টটলের বিকাশ, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার দৃষ্টান্ত। অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় কোন সনদ বিতরণ নেই। অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় ছকবাধাঁ কারিকুলামের পরিবর্তে চলমান স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় শিক্ষাকে উপস্থাপন করা হয়। ফলে শিক্ষার্থীর মনে প্রতিটি শিক্ষা হয়ে ওঠে ব্যবহারিক দৃষ্টান্তপূর্ণ। প্লেটো এবং এরিস্টটলের মত, কবি নজরুল ইসলাম ও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার এ উপমহাদেশের দুই দিকপাল।
খ. আনুষ্ঠানিক শিক্ষাঃ শিক্ষা বৎসর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, টেক্সট বই, শিক্ষা কারিকুলাম, গ্রেড পদ্ধতি এবং বিভিন্ন শিক্ষা
স্তর নির্ভর শিক্ষাই আনুষ্ঠানিক শিক্ষা হিসেবে বিবেচিত। সরকারী-বেসরকারী সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই আনুষ্ঠানিক শিক্ষার দৃষ্টান্ত। আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় বিভিন্ন শিক্ষা স্তর শেষে মেধা স্বীকৃতিস্বরূপ সনদ বিতরণ করা হয়।
০৫. ইসলামে শিক্ষার প্রয়োজন [ Needs of Education In Islam]
আনুষ্ঠানিক হোক বা অনানুষ্ঠানিক হোক মানুষের জীবনে শিক্ষার প্রয়োজন মৌলিক। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার মত শিক্ষাও মানুষের মৌলিক চাহিদার একটি। তবে অন্যান্য মৌলিক চাহিদার সাথে শিক্ষার চাহিদার একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসা মানুষের শারিরীক প্রয়োজনকে পূরণ করে। আর শিক্ষা আসল মানুষটির প্রয়োজন পূরণ করে। বিষয়টি আমরা এভাবে বুঝতে পারি - যখন কোন মানুষ মারা যায়, তখন আমরা বলি অমুকের লাশ। আর এই লাশের চোখ, কান, নাক, জিহবা শারীরিক সব কিছুই বিদ্যমান থাকে। শুধু অমুক নেই বা আসল মানুষটিই নেই। সে মানুষটি তার সকল শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা সহ অথবা তার সকল ধরণের মূর্খতাসহ চিরতরে হারিয়ে গেছে। শরীরের ভেতর আসল মানুষটির জন্যই শিক্ষার প্রয়োজন। মানুষ হিসেবে মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যই শিক্ষা দরকার। শিক্ষা ছাড়া মানুষের মত বাঁচার কোন উপায় নেই। আল্লাহ বলেন, ‘যাদের চক্ষু ছিল অন্ধ আমার নিদর্শনের প্রতি এবং যারা শুনতেও ছিল অক্ষম।’ আল্লাহ এখানে আসল মানুষের অন্ধত্ব ও বধিরতা তুলে ধরেছেন, শারীরিক অন্ধত্ব বা বধিরতা নয়। আসল মানুষের অন্ধত্ব ও বধিরতা দূর করার জন্যই শিক্ষার প্রয়োজন অনিবার্য। তা নাহলে মানুষ ও পশুর মাঝে প্রকৃতপক্ষে কোন পার্থক্যই থাকেনা। কোন জাতি যদি শিক্ষার এই মৌলিক চাহিদা পূরণে অক্ষম হয় তবে সে জাতি জংলী জাতি বা অমানবিক বা পাশবিকতায় পরিচালিত জাতি হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। তাই শিক্ষাকে কোন অবস্থাতেই বিলাসী সেবা অর্জনের পর্যায়ে আনা যাবেনা, একে সহজলভ্য করতে হবে। যাতে করে মানুষ শিক্ষার মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়। আর শিক্ষাকে সহজলভ্য করতে রাষ্ট্রের ব্যাপক ভূমিকা রাখার অবকাশ রয়েছে।
০৬. ইসলামে শিক্ষার লক্ষ্য [Aim of Education In Islam]
মানুষের শিক্ষার সাথে মানবজাতি, আকাশ, পানি ও স্থলের সকল প্রাণী ও গোটা পৃথিবীর সার্বিক পরিবেশের কল্যাণ-অকল্যাণের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে বিধায় শিক্ষার লক্ষ্য মানব জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদী শিক্ষার লক্ষ্য হল মানুষকে শ্রেণীশত্রু চিw‎‎হ্নত করতে শেখানো এবং শ্রেণীশত্রু হত্যা কোনো অমানবিক বা অনৈতিক কাজ নয় বরং শ্রেণী শত্রু চি‎‎হ্নত করা এবং খতম করাই দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদী শিক্ষার মূল লক্ষ্য। অন্য দিকে জড়বাদী শিক্ষার মূল লক্ষ্য হচ্ছে অর্থ উপার্জন। এতে নৈতিকতার কোন স্থান নেই। মরহুম আবুল হাশিমের ভাষায়, ‘জড়বাদী পাশ্চাত্যের ধনতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে সমাজতন্ত্রীরা দলবদ্ধ জীব, যাদের একমাত্র বিষয় নিজেদের দলের কল্যাণ সাধন, আর ধনতন্ত্রীরা হচ্ছেন সর্প ও সরীসৃপের মত ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীব এরা একা একা বা জোড়ায় জোড়ায় চলে। এদের কাজ নিজের কিংবা বড়জোর নিজের জোড়ার কল্যাণ সাধন।’ অন্যদিকে ইসলামে শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে, মানুষে মানুষে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা, গাণিতিক সাম্য নয়। আল্লাহ বলেন, ‘‘আমরা মানুষকে এক জাতিরূপে সৃষ্টি করেছি।’’ তাই মানুষে মানুষে যথেচ্ছ ভেদাভেদ সৃষ্টি করার কোন অধিকার মানুষের থাকতে পারে না। একজন মানুষ অন্যজনের মত গাণিতিকভাবে সর্বোতভাবে সমান হতে পারে না। কেউ হয় কালো, কেউ হয় সাদা, কেউ লম্বা, কেউ বেঁটে, কেউ বুদ্ধিমান, কেউ বোকা। অতি স্বাভাবিকভাবেই কেউ কেউ নিজেদের ব্যক্তিগত গুণের কারণে অন্যান্যদের মাঝে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। কিন্তু এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণে মানুষের সামাজিক সাম্যে হস্তক্ষেপ না করাই অর্থাৎ প্রত্যেকের রক্ত, সম্পদ ও ইজ্জতকে সমানভাবে মূল্যায়ন করাই ইসলামের শিক্ষার লক্ষ্য। কেনো প্রতিভাবান ব্যক্তি বুদ্ধির ক্ষেত্রে; কোনো সম্পদশালী ব্যক্তি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অভিজাত বলে গণ্য হতে পারে না। একজন হারকিউলিস, রুস্তম বা ভীম দৈহিক শক্তির ক্ষেত্রে আভিজাত্য অর্জন করতে পারেন কিন্তু ইসলামে সামাজিক আভিজাত্য বলে কিছু নেই।
০৭. ইসলামে শিক্ষার উদ্দেশ্য [Objectives of Education In Islam]
নিত্য পরিবর্তনশীল এই পৃথিবীতে শিক্ষার উদ্দেশ্যকে তিনভাবে উপস্থাপন করা যায়। ক. ব্যক্তি পর্যায় খ. সামাজিক পর্যায় এবং গ. গেলাবাল বা বৈশ্বিক পর্যায়।
ক. ব্যক্তি পর্যায় : ব্যক্তি পর্যায়ে একজন মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখে শিক্ষা। একজন মানুষের মাঝে সমাজ ও বিশ্ব পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে চলার, উন্নত জীবন-যাপনে সক্ষম হওয়া এবং মানব জাতির কল্যাণে অবদান রাখার মত যোগ্যতা সৃষ্টি করাই ইসলামে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।
খ. সামাজিক পর্যায় : শিক্ষা মানুষের মাঝে চিন্তার ঐক্য তৈরি করে। চিন্তার ঐক্য, সামাজিক জীবনে আচরণগত ঐক্যের ভিত্তি। সমাজে শান্তি ও স্থিতি প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে কাজ করে এই চিন্তার ঐক্য। সমাজে ভিন্নমতের আধিক্য বা বাহুল্য শিক্ষার ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ইংরেজি, আরবী ও বাংলা মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন কারিকুলামে সম্পন্ন হচ্ছে, এছাড়া ১৯৭২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক শিক্ষানীতির প্রস্তাবনা ও বাস্তবায়নের ফলে স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাঝে কোনো চিন্তার ঐক্য গড়ে ওঠেনি। ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা থেকে এখনও আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। তাই একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে এখনও কাংখিত মর্যাদার আসন অর্জিত হয়নি।
গ. বৈশ্বিক পর্যায় : বৈশ্বিক পর্যায়ে, পুরো পৃথিবীকে পর্যায়ক্রমে গ্লোবাল ভিলেজ-এ পরিণত করাই ইসলামে শিক্ষার উদ্দেশ্য। প্রযুক্তির উন্নয়ন, বিশ্বব্যাপী ব্যবসার সম্প্রসারণ, পৃথিবীকে পর্যায়ক্রমে গ্লোবাল ভিলেজ-এ পরিণত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। আর ব্যবসার সম্প্রসারণ পুরো বিশ্বে দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা তৈরি করেছে। এই চাহিদা স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে পুরো বিশ্বে নানা দেশের মানুষ ছড়িয়ে পড়েছে। আর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ হল দক্ষ জনশক্তি গড়ার মূল উৎস। এ দক্ষতা, অর্থনৈতিক উপযোগিতার ক্ষেত্রে যেমন সত্য তেমনি ইসলামের মূল্যবোধ তৈরি করে উন্নত নৈতিক চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রেও সত্য। যে কোন মানুষের মাঝে অর্থনৈতিক উপযোগিতা সৃষ্টি করতে যেমন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নেই ঠিক তেমনি ইসলামের মূল্যবোধের ভিত্তিতে উন্নত নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ গড়তেও ইসলামী মূল্যবোধের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নেই।
উপরে উল্লেখিত সকল পর্যায়ে শিক্ষার কিছু সর্বজনীন উদ্দেশ্য রয়েছে। শিক্ষার এ উদ্দেশ্যগুলো পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষের জন্য প্রায় সমভাবে প্রযোজ্য। আবার দেশ-জাতি-জীবনদর্শন ভিত্তিক শিক্ষার উদ্দেশ্যের ভিন্নতাও দেখা যায়। শিক্ষার সর্বজনীন বা সাধারণ উদ্দেশ্য বলতে সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে যে গুণের বিকাশ প্রত্যাশিত তা বুঝায় । যেমনঃ
ক. শিক্ষার সর্বজনীন বা সাধারণ উদ্দেশ্য :
1. পরিপূর্ণ জীবন যাপনের যোগ্যতা অর্জন।
2. নৈতিক চরিত্র অর্জন।
3. বিশ্বভ্রাতৃত্ব বোধ অর্জন।
4. বৃত্তি গ্রহণের যোগ্যতা অর্জন।
5. পরিবেশ ও সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে চলার যোগ্যতা অর্জন।
6. সামাজিক নেতৃত্বের বা পরোপকারের যোগ্যতা অর্জন।
7. সমাজের সংস্কারমূলক ক্ষেত্র চিহ্নিত করার যোগ্যতা অর্জন।
8. ভারসাম্যপূর্ণ এবং পরমতসহিষ্ণু দৃষ্টিভংগি অর্জন।
9. ইহলৌকিক ও পরলৌকিক জীবন সম্পর্কে ধারণা অর্জন।
10. জ্ঞানভিত্তিক পরিশীলিত আচরণ করার যোগ্যতা অর্জন ।
০৮. ইসলামে শিক্ষার কাজ [ Functions of Education In Islam]
শিক্ষা যা করে তাই-ই শিক্ষার কাজ। শিক্ষা কি করে? শিক্ষা মানুষের মনে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে মনের চোখকে দেখতে সাহায্য করে। মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করে। আর এভাবে মানুষের আচরণকে পরিশীলিত করে। মানুষকে যে শিক্ষা দেয়া হয় সেই জ্ঞানের আলো হৃদয়ে জ্বালানোই শিক্ষার কাজ। যেমন, যে জীবনদর্শন মানবজাতিকে পরস্পরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন করে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে এবং যে জীবনদর্শনের শিক্ষা মানুষকে শ্রেণীসংগ্রামের মাধ্যমে একটি মনোনীত শ্রেণী দ্বারা আর সব শ্রেণীকে নির্মূল করে দিয়ে শ্রেণীহীন সমাজ গঠনের পাঠ দেয়, সে জীবনদর্শনের শিক্ষা মানুষের মনে যে ঈর্ষা ও ঘৃণার আলো জ্বালাবে, ভালবাসার নয় তাতে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। এ জাতীয় জীবনদর্শন ঘৃণার দর্শন, প্রেমের দর্শন নয়। এ জাতীয় জীবন-দর্শন ‘মনুষ্যত্বকে’ ধ্বংস করে দিয়ে মানুষের মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তিগুলোর আলো জ্বালাতে থাকে। তখন মানুষ পশু বা তার চেয়েও নিম্নমানের বা নিষ্ঠুর আচরণ অনায়াসে করতে পারে। অন্যদিকে ইসলাম শিক্ষা দিচ্ছে, আত্মীয়, মিসকীন ও মুসাফিরদের অধিকার আদায় করতে হবে। ইংরেজিতে Tax, Charity এবং Rights এই তিনটি শব্দের আভিধানিক ও ব্যবহারিক ব্যবধান বিস্তর। পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষ জীবনদর্শন এবং বস্ত্তবাদী শ্রেণীসংগ্রামের জীবনদর্শনের শিক্ষায় আত্মীয়, মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য কোন ‘অধিকার বা Rights’ বলে কিছু নেই। সেখানে Charity বা দয়া-দাক্ষিণ্য আছে, তবে তা সম্পূর্ণ ব্যক্তির খেয়াল-খুশীর উপর নির্ভরশীল এবং তা ইসলামের বিধানের মত এত সুস্পষ্টভাবে শ্রেণীবদ্ধ বা ক্লাসিফাইড নয়। আর এ কারণেই পাশ্চাত্যে কুকুর-বিড়ালকেও উইল করে সম্পত্তি দেয়ার অসংখ্য দৃষ্টান্ত যেমন রয়েছে; তেমনি অর্ধাহারে-অনাহারে মানুষের দিন গুজরানের দৃষ্টান্তও আছে। অন্যদিকে ইসলামে বিষয়টি শুধু Charity বা দয়া-দাক্ষিণ্যের বিষয় নয়, এটা আত্মীয় মিসকীন ও মুসাফিরের অধিকার। আর ধনী ব্যক্তিদেরকে এ অধিকার আদায় করতে বলা হয়েছে। বিষয়টা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই করতে হবে এবং এর অন্যথা হলে অবশ্যই জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে। জবাবদিহিমূলকভাবে জীবন গড়াই মানবজাতির প্রতি ইসলামের শিক্ষার এপ্রোচ। যাতে করে প্রকৃত জবাবদিহির দিন তা সহজ হয়। পৃথিবীতেও শ্রেণী নির্বিশেষে সকল মানুষ সুখী হয়। ধনী, দরিদ্র, আত্মীয়, মিসকীন, মুসাফির, ধর্ম-বর্ণ-রক্ত-জাত-পাত নির্বিশেষে জনে জনে মমত্ববোধ ছড়িয়ে পড়ে। ইসলাম সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের অস্তিত্বকে স্বাভাবিকভাবেই স্বীকার করেছে; তবে তাদের মাঝে সংগ্রাম বা ঘৃণার অস্তিত্বকে স্বীকার করেনি বরং তাদের মাঝে পরস্পরের প্রতি মমত্ববোধের শিক্ষা দিয়েছে। ইসলামের জীবনদর্শন তাই ঘৃণার নয়, প্রেমের, একের প্রতি অন্যের দায়িত্বশীলতার। জনে জনে মমত্ববোধ ছড়িয়ে দেয়াই ইসলামে শিক্ষার কাজ।
০৯. ইসলামে শিক্ষার পরিধি [ Scope of Education In Islam]
যে কোন সভ্যতা মূলতঃ শিক্ষার ফলশ্রুতি। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইত্যাদি নানা উপাদান নিয়ে পত্তন হয় কোনো সভ্যতার। আর সভ্যতার সেইসব উপাদানের নেপথ্যে রয়েছে শিক্ষার অবদান। আর তাই শিক্ষার পরিধি বলতে সভ্যতায় সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর অবদানগুলোকেই বুঝায়। ইসলামে শিক্ষার পরিধি বা সভ্যতায় ইসলামের অবদানগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলঃ
সামাজিক অবদান
1. একটি মানবিক সোনালী সমাজ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
2. সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে।
3. মানুষকে সামাজিক গুণাবলী অর্জনে সহায়তা করে।
4. সমাজে মুক্ত চিন্তার বিকাশ ঘটায়।
5. সমাজ থেকে নিরক্ষরতা দূর করে।
6. প্রতিটি মানুষকে তার মেধা অনুযায়ী বিকশিত করতে সহায়তা করে।
7. ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনে চিন্তার ঐক্য তৈরি করে।
8. আদর্শের প্রতি প্রত্যয় সৃষ্টি করে।
9. সামাজিক কুসংস্কার দূর করে।
10. সমাজকে সুশৃংখল করে।
11. পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট উপলব্ধিতে এবং কাঙ্খিত সামাজিক পরিবর্তনে সহায়তা করে।
12. পরিশীলিত বা ভদ্রোচিত আচরণ নিশ্চিত করে।
13. সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব গড়ার মাধ্যমে মানুষকে জীবনের বহুমূখী সমস্যা সমাধানে সক্ষম করে তোলে।
14. মানুষের মধ্যে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে।
15. ব্যক্তির চিন্তা চেতনাতে গভীরতা আনতে সাহায্য করে।
16. দলগত মনোভাব তৈরি করে।
17. মানুষের অভিযোজন ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে; যার প্রভাবে সামাজিক জীবনে কাঙ্খিত পরিবর্তন ঘটে।
রাজনৈতিক অবদান
1. জাতীয় ঐক্য ও সম্প্রীতি গড়ে তোলে।
2. দেশ ও উম্মাহর প্রতি মমত্ববোধ জাগ্রত করে।
3. দেশ ও উম্মাহর প্রতি কর্তব্য পরায়ণ করে ।
4. নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।
5. শক্তিশালী উম্মাহ গড়ে তুলতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলে।
6. রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা সৃষ্টি করে।
7. রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলে।
8. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
9. বিচক্ষণ ও বিজয়ী কুটনৈতিক অবদান রাখতে সহায়তা করে।
10. উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের বৈশিষ্ট্যের তুলনায় নিজঅবস্থান পর্যালোচনা করতে সহায়তা করে।
11. দেশ ও জাতিকে উন্নয়নের পথ দেখাতে সহায়তা করে।
12. জাতীয় স্বার্থ উপলব্ধিতে সহায়তা করে।
13. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিস্তৃতি ও সুদৃঢ়করণে সহায়তা করে।
14. বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টিতে সাহায্য করে।
15. রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়।
অর্থনৈতিক অবদান
1. জীবিকা উপার্জনের যোগ্য করে গড়ে তোলে।
2. বৃত্তিমূলক মনোভাব সৃষ্টি করে।
3. জনশক্তিকে সম্পদে পরিণত করে।
4. পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করে।
5. কর্মানুরাগ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
৬. দেশবাসীর জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করে।
৭. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অনুকূল অবস্থা সুদৃঢ় করে।
৮. প্রযুক্তির উন্নয়নে অবদান রাখে।
৯. নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।
১০. অনুদানমূলক কর্মকান্ডে উৎসাহিত করে।
সাংস্কৃতিক অবদান
মানুষের জীবনধারাই মানুষের সংস্কৃতির প্রতিফলন করে। আর জীবনধারা তৈরি হয় শিক্ষার নিরবচ্ছিন্ন প্রভাবে। ইসলামে শিক্ষার সাংস্কৃতিক অবদানগুলো নিম্নরূপঃ
1. খেলাধুলা, শরীরচর্চার প্রচলনের মাধ্যমে শারীরিক বিকাশ সাধন।
2. শিল্প ও সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশ ঘটানো।
3. দৃষ্টিভঙ্গী উদার ও প্রসারিত করা।
4. পরিশীলিত আচরণকে উৎসাহিত করে সমাজে বসবাসযোগ্য যোগ্যতার বিকাশ ঘটানো।
5. গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটানো।
6. মূল্যবোধের চর্চাকে অগ্রাধিকার দেয়া।
7. অবসর যাপনের মানবিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করা।
8. বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি ও আগ্রহের বিস্তার ঘটানো ।
9. দক্ষতা প্রকাশের সুযোগ করে দেয়া।
10. জীবনের সকল স্তরের সৌন্দর্যকে সংস্কৃতিতে গ্রহণযোগ্য উপস্থাপনায় প্রকাশ করা।
11. জীবনধারা নিয়ন্ত্রিত করতে শেখানো।
12. মানুষকে রুচিশীল করে তোলা।
১০. শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষানীতির তুলনামূলক আলোচনা [ Comparative Discussion of Philosophy of Education and Education Policy]
প্রত্যেক জাতি তথা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কতকগুলো সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতির দ্বারা পরিচালিত। শিক্ষাব্যবস্থার এই নিয়মনীতি জাতীয় দর্শনের প্রেক্ষাপটেই রচিত হয়ে থাকে এবং জাতীয় দর্শনের ভিত্তিতে যে কোন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়। শিক্ষাব্যবস্থা সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য এই সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুনগুলোকেই শিক্ষানীতি বলা হয়ে থাকে। স্থান, কাল পাত্র ভেদে শিক্ষানীতির নিয়মকানুনের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। দেশের সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষানীতির ভূমিকা অপরিসীম। পুরো বিষয়টি সরলীকরণ করলে দাঁড়ায়, জাতীয় শিক্ষাদর্শন-শিক্ষানীতি-শিক্ষাব্যবস্থা অর্থাৎ জাতীয় শিক্ষাদর্শন, জাতীয় শিক্ষানীতির ভিত্তি এবং জাতীয় শিক্ষানীতি, জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি। শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার মূলভিত্তি হল জাতীয় শিক্ষাদর্শন।
জীবন ও জগত সম্পর্কে লালিত যে ধারণা বা বিশ্বাস দিয়ে কোনো ব্যক্তি বা জাতি পরিচালিত হয় তাই-ই সে ব্যক্তি বা জাতির জীবন-দর্শন। জাতিতে জাতিতে যেমন জীবন দর্শনের ভিন্নতা আছে তেমনি একই জাতির বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যেও জীবন দর্শনের ভিন্নতা রয়েছে। জীবন দর্শনের ভিন্নতার কারণেই প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা দর্শনের ভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ জীবন ও জগতকে কোনো ব্যক্তি বা জাতি যেভাবে বুঝতে শিখেছে সেই ব্যক্তি বা জাতি তার প্রভাবান্বিত বলয়ে সেই শিক্ষাকেই তুলে ধরেছে। এভাবে গড়ে উঠেছে ভিন্ন ভিন্ন জাতিতে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাদর্শন। মানুষের শিক্ষার জন্য এই জীবন দর্শনকেই শিক্ষা দর্শন বলে। শিক্ষার ক্ষেত্রে দর্শনের বিষয়টি এতই গুরুত্ব বহন করে যে, কোনো অশিক্ষা-কুশিক্ষা, জীবন-দর্শন ভেদে মূল্যবান শিক্ষা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে আবার কোনো মানবিক শিক্ষা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। একাডেমিকেলী দর্শনের যে শাখা শিক্ষাসম্বন্ধীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তাকে শিক্ষাদর্শন বলে। দার্শনিক ‘হল’ [ C.L. Hall ] তাঁর ‘Conflicting Philosophies of Education’ প্রবন্ধে শিক্ষা সম্বন্ধে বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই আলোচনায় শিক্ষাদর্শনের স্বরূপ সম্বন্ধে নানা মতভেদ আলোচিত ও পর্যালেচিত হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, জীবন ও জগত সম্পর্কে ধারণা ও বিশ্বাসকে ভিত্তি করে অর্জিত শিক্ষাকে কেন্দ্র করে অনেক দার্শনিক মতবাদের বা শিক্ষাদর্শনের উদ্ভব হয়েছে। এর মধ্যে দুটি মতবাদ বা শিক্ষাদর্শন উল্লেখযোগ্য। এক. প্রকৃতিবাদ [Naturalism or Materialism] ও দুই. ভাববাদ [Idealism]। আর এই দুই মতবাদের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে প্রয়োগবাদ [Pragmatism] ।
ভাববাদ একটি আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা জীবন ও জগতকে বিশ্লেষণ করে। ভাববাদীদের মতে এই বিশ্ব এক পরম সত্তার প্রকাশ। আমরা যে জীবন ও জগৎ প্রত্যক্ষ করি তা খন্ডিত, সসীম এবং ক্ষণস্থায়ী। এই পরমসত্তাকে ঈশ্বর, ব্র˛া, সৃষ্টিকর্তা, প্রকৃতি নামে অভিহিত করা হয়। মানুষের জৈবিক সত্তাই যে তার একমাত্র পরিচয় নয়, তার উপরে রয়েছে পরমসত্তা - এই শিক্ষাই ভাববাদের মূল বক্তব্য। শিক্ষাদর্শনে ভাববাদের প্রবক্তাদের মধ্যে প্লেটো, কান্ট, কমেনিয়াস, পেস্তালোজী, ফ্রোয়েবেল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
অন্যদিকে প্রকৃতিবাদের মূল বক্তব্য হচ্ছে ‘বিশ্ব প্রকৃতিই হচ্ছে বাস্তব আর সব মিথ্যা। বস্ত্তজগতের বাইরে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই।’ আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক নীতি নির্ধারণে তথা শিক্ষানীতি প্রণয়নে এবং তার প্রয়োগ পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা প্রকৃতিবাদ থেকে গৃহীত। প্রকৃতিবাদীরা প্রকৃতিকে তিনভাগে ভাগ করেছেন - এক. জড় প্রকৃতি বা বস্ত্ত প্রকৃতি। দুই. যান্ত্রিক প্রকৃতি এবং তিন. জৈবিক প্রকৃতি। এই তিন ধরণের ভাগ হতে তিন ধরণের মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে। একদলের মতে মানুষের জীবন জড় প্রকৃতির নিয়মেই পরিচালিত হয়। একে জড় প্রকৃতিবাদ বা বস্ত্তবাদ [ Physical Naturalism or Materialism ] বলা হয়। অপর দল মানুষকে যন্ত্র হিসেবে কল্পনা করেছেন। তাদের মতে আত্মা বলতে কিছু নেই। জড় জগত যেমন যান্ত্রিক নিয়মে চলে, মানুষের মনও তেমনি যান্ত্রিক নিয়মে চলে। এই মতবাদকে যান্ত্রিক প্রকৃতিবাদ [Mechanical Naturalism] বলা হয়। আর একদলের মতে মানুষকে জৈবিক সত্তা হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। তাদের মতে ইতর প্রাণীদের যে সব বৈশিষ্ট্য রয়েছে, মানুষের মধ্যেও সেই সব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। সুতরাং এই সব বৈশিষ্ট্যকে বুঝতে হলে সমজাতীয় প্রাণীর প্রকৃতি অনুশীলণ করতে হবে। এই মতবাদকে জৈবিক মতবাদ [Biological Naturalism ] বলা হয়। এই শিক্ষাদর্শন বা মতবাদে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের কোন সুযোগ নেই। এ দর্শন ইহকাল সর্বস্ব। মানুষের ধর্মবোধ, বিবেকবোধ ও নীতিবোধের কোনো ব্যাখ্যা এ শিক্ষাদর্শনে স্থান পায়নি।
শিক্ষাদর্শনে প্রয়োগবাদ বা Pragmatism মতবাদটি বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। প্রয়োগবাদ বা Pragmatism-এর মূল কথা হলো উপযোগিতা। প্রয়োগবাদীদের মতে কোন কিছুর সত্যতা প্রমাণ করতে হলে তাকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ Seeing is Believing। বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখতে হবে যে কোন কিছুর সত্যতা আছে কি না। বস্ত্তর অন্তর্নিহিত সত্যতা বলে কিছু নেই এবং চিরন্তন সত্য বলেও কিছু নেই। বর্তমানে যা সত্য, অন্য যুগে তা অসত্য বলে পরিচালিত হতে পারে। পরীক্ষণের বা এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে যা সত্য বলে প্রমাণিত হয় তাই গ্রহণযোগ্য। এই শিক্ষাদর্শনেও অদৃশ্যে বিশ্বাস বা নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ ইত্যাদির কোন স্থান নেই। প্রয়োগবাদী শিক্ষাদর্শনের প্রধান প্রবক্তা হচ্ছেন, জন ডিউই। আর এই মতবাদের সমর্থক হচ্ছেন, পায়ার্স, কিলপ্যাট্রিক, উইলিয়াম জেমস, শিলার প্রমুখ বুদ্ধিজীবিগণ।
প্রকৃতিবাদ [Naturalism or Materialism] এবং প্রয়োগবাদ [Pragmatism]-এর শিক্ষাদর্শনের মাঝে অমিলের চেয়ে মিলই বেশি। প্রয়োগবাদ [Pragmatism] অনেকটা প্রকৃতিবাদ [Naturalism or Materialism]-এর উন্নত বা আধুনিক সংস্করণ। জীবন ও জগতের প্রতি প্রকৃতিবাদ [Naturalism or Materialism] এবং প্রয়োগবাদ [Pragmatism]-এর দৃষ্টিভংগির চেয়ে ভিন্নতর দৃষ্টিভংগি মানব ইতিহাসে রয়েছে। যার কোন ব্যাখ্যা প্রকৃতিবাদ [Naturalism or Materialism] বা প্রয়োগবাদ [Pragmatism] দিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। প্রয়োগবাদ [Pragmatism] বা প্রকৃতিবাদ [Naturalism or Materialism]-এ এসব বিষয়ে কোনো আলোচনাই নেই। প্রসংগত সে ভিন্নতর দৃষ্টিভংগি নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক্।
পৃথিবীর বুকে যখন মানুষের প্রথম পদচারণা পড়লো, তখন মানুষ উজ্জ্বল প্রদীপরূপে যে সূর্য আর স্নিগ্ধ আলোর চাঁদ দেখেছিল, আজও তাই-ই আছে। সাগর-নদী, গাছ-পালা, পশু-পাখী, বন-বনানী, সুউচ্চ পর্বতমালা, নয়নাভিরাম সুনীল আকাশের দিগন্তে একাকার হওয়া কিংবা শিহরিত করা শীতল বাতাসে রোমাঞ্চিত হওয়া সবই এখনও আছে, যেমন ছিল শুরুতে। মানবজাতির নিকট সেই একই বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক জগত ও জীবনের মৌলিক চাওয়া-পাওয়া একই থাকা সত্ত্বেও জীবন দর্শন এবং শিক্ষা দর্শনে নানা পার্থক্য সূচিত হয়েছে। বস্ত্তত: গোটা প্রকৃতির মধ্যে মানুষ নিজেকে যেভাবে খুঁজে পেয়েছে সেভাবেই তার জীবন দর্শনকে, শিক্ষা দর্শনকে গড়ে নিয়েছে। আর এভাবেই তৈরি হয়েছে জীবন দর্শন ও শিক্ষা দর্শনের ভিন্নতা। জীবন জিজ্ঞাসার মৌলিক প্রশ্নগুলোর দিশা দিয়েই আললাহ মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। কালক্রমে মানুষ যখন সেই পথের দিশা থেকে সরে এল, তখন মানুষের সামনে প্রকৃতিই ছিল জীবন জিজ্ঞাসার সমাধানের একমাত্র উৎস। প্রকৃতির বিশালত্বের তুলনায় মানুষ নিজের ক্ষুদ্র অস্তিত্ব নিয়ে তখন অসহায়ত্ব বোধ করেছে। ফলে সূর্য, আগুন, সাপ, বৃক্ষ, গরু, সাগর-নদীসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি ও প্রাণীর নিকট মানুষ মাথা নত করা শুরু করেছিল। আর মানুষের যা স্বভাবজাত অর্থাৎ মানুষ যা করে তার পক্ষে যৌক্তিকতা তৈরি করে নেয়। এভাবে প্রাকৃতিক শক্তি বা প্রাণীর পূজা করার পক্ষে একটি জীবন দর্শন বানিয়ে ফেলে। আর তা ক্রমশঃ উৎকর্ষ লাভ করতে করতে একসময় মানুষ তার নিজ হাতে মূর্তি বানিয়ে সেই মূর্তির পূজা করার শিক্ষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছে। প্রকৃতির বিশালত্বের কাছে নিজের ক্ষুদ্রত্বের এই উপলব্ধি নিয়ে মানুষ প্রাকৃতিক শক্তির পূজা করার পক্ষে যুক্তি খুঁজেছে। ফলে হাতড়ে পাওয়া সেসব যুক্তি নিয়ে তৈরি হয়েছে জীবন দর্শন। সৃষ্টি হয়েছে ভাববাদ জাতীয় শিক্ষা দর্শন। প্রকৃতিকে জয় করার শক্তি যখন মানুষ খুuঁজ পেলো তখন জন্ম নিল প্রকৃতিবাদ এবং প্রয়োগবাদ জাতীয় শিক্ষা দর্শন ইত্যাদি। মানুষ ও প্রকৃতির স্রষ্টা ও স্বত্ত্বাধিকারী আল্লাহর নির্দেশিত পথ এড়িয়ে মানুষ যখন নিজের মত করে প্রকৃতিকে বুঝতে চাইল, তখন আসলে কি ঘটল সে কথাই তুলে ধরলেন, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব। তিনি তাঁর লিখিত ‘মুসলিম দার্শনিকদের স্বকীয়তা’ প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন এভাবে ‘‘একথা সত্য যে, প্লেটো ও এরিস্টটলের মত বড় বড় দার্শনিক বিশ্বাস করতেন, আকাশের গ্রহ নক্ষত্র সব জ্যোর্তিময় দেবতা’’ অন্যদিকে পাশ্চাত্য জগতে আব্রাহাম নামে পরিচিত, আল কুরআনে উলেলখিত ইবরাহিম [আলাইহিস সালাম], প্রকৃতিকে বিশেলষণ করে যা পেলেন, কুরআনের ভাষায় তা দেখি : ‘‘অতপর রাত্রির অন্ধকার যখন তাকে আচ্ছন্ন করলো তখন সে নক্ষত্র দেখে বললো, ‘এইতো আমার প্রতিপালক।’ অতপর যখন তা অস্তমিত হল তখন সে বললো, যা অস্তমিত হয় তা আমি পছন্দ করিনা। অতপর যখন সে চন্দ্রকে সমুজ্জ্বলরূপে উদিত হতে দেখলো তখন বললো, ‘এইতো আমার প্রতিপালক।’ যখন এও অস্তমিত হল তখন বললো, আমাকে আমার প্রতিপালক সৎপথ প্রদর্শন না করলে আমি অবশ্যই পথভ্রষ্টদের
অন্তর্ভুক্ত হবো। অতপর যখন সূর্যকে দ্বীপ্তিমানরূপে উদিত হতে দেখলো তখন বললো, ‘এইতো আমার প্রতিপালক, এতো সর্ববৃহৎ।’ যখন এও অস্তমিত হল, তখন সে বললো, ‘হে আমার সম্প্রদায়! যে সকল শক্তিকে আল্লাহর শরীক কর তার সাথে আমার কোন সংস্রব নেই। আমি একনিষ্ঠভাবে তাঁর দিকে মুখ ফিরাচ্ছি যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’’’ ইবরাহিম আলাইহিস সালাম, চুড়ান্তভাবে সকল প্রকার প্রাকৃতিক শক্তির উৎস ও স্বত্ত্বাধিকারী আল্লাহকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর উপলব্ধি ছিল এমনঃ এক. সকল প্রাকৃতিক শক্তি আল্লাহর সৃষ্টি এবং তাঁরই অনুগত। মানুষের কোনো প্রয়োজনই নেই কোনো ধরণের প্রাকৃতিক শক্তিকে পূজা করার বা বিমূর্ত প্রাকৃতিক শক্তির মূর্তরূপ কোনো মূর্তিকে পূজা করার। সকল প্রাকৃতিক শক্তির উৎস আল্লাহ। তাই পূজা বা নত শির পাবার অধিকার একমাত্র আল্লাহরই আছে। দুই. মানুষ আল্লাহর এক অনন্য মর্যাদাসম্পন্ন সৃষ্টি। মানুষ অসহায় নয়। স্বয়ং আল্লাহ তার অভিভাবক। তাই আল্লাহ ছাড়া আর কোনো শক্তিকে ভয় পাবার কোনো যুক্তিসংগত কারণ মানুষের নেই।
নূহ আলাইহিস সালামের সময় পৃথিবীতে ব্যাপক পলাবন, লোহিত সাগরের মধ্যদিয়ে চলাচলের পথ তৈরি করে দিয়ে মূসা আলাইহিস সালাম এবং তাঁর অনুসারীদের নিরাপদে পার করে নিয়ে অত্যাচারী শাসক ফিরাউনকে লোহিত সাগরে ডুবিয়ে মারা, সালিহ আলাইহিস সালামের দু’আ কবুল করে আললাহতায়ালার অনুমতিক্রমে কঠিন পর্বতের ভেতর থেকে গর্ভবতী উষ্ট্রিকে বের করে আনা, মারইয়াম (আ)-এর গর্ভে ঈসা আলাইহিস সালাম-এর জন্মদান এবং সমকামিতায় লিপ্ত লুত আলাইহিস সালাম-এর জনগোষ্ঠীকে সালফার বা গন্ধক বৃষ্টি ঝরিয়ে সমূলে ধ্বংস করা [যা বর্তমানে জর্ডানে অবস্থিত এবং ডেড সী বা মৃত সাগর নামে পরিচিত], সবই ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য। এসব ঐতিহাসিক সত্যের কোন ব্যাখ্যা প্রকৃতিবাদ [Naturalism or Materialism] এবং প্রয়োগবাদ [Pragmatism]-এর শিক্ষাদর্শন দিতে অক্ষম। ফলে এসব শিক্ষাদর্শন মানুষকে নিরেট বস্ত্তবাদী মুর্খতায় অথবা পরীক্ষণের নামে ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করার আহাম্মকে পরিণত করছে। এভাবে বর্তমান পৃথিবীতে বস্ত্তবাদের প্রভাবে একদিকে পাশবিক সমাজ এবং পরীক্ষণের অহংকারে ধর্মনিরপেক্ষতার অন্ধত্ব অর্জন করছে। আললাহতায়ালা যথার্থই বলেছেন, ‘‘তারা কি দেশ ভ্রমণ করেনি? তাহলে তারা জ্ঞান বুদ্ধিসম্পন্ন হৃদয়, শ্রুতিশক্তিসম্পন্ন শ্রবণের অধিকারী হতে পারতো। বস্ত্ততঃ চক্ষুতো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে বক্ষস্থিত হৃদয়।’’
১১. শিক্ষায় প্রভাব বিস্তারকারী সর্বজনীন উপাদান [ Influencing Universal Factors in Education]
শিক্ষা ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্রমবিবর্তন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নিম্নোক্ত উপাদানগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নকে প্রভাবিত করেছে। যেসব উপাদান জাতীয় শিক্ষার উন্নয়নে প্রভাবক হিসেবে চি‎হ্নিত হয়েছে তা তুলে ধরা হলঃ
১১.১. সামাজিক উপাদান : Social Factor
১১.২. সাংস্কৃতিক উপাদান : Cultural Factor
১১.৩. অর্থনৈতিক উপাদান : Economic Factor
১১.৪. রাজনৈতিক উপাদান : Political Factor
১১.৫. ভৌগলিক উপাদান : Geographical Factor
১১.৬. দার্শনিক উপাদান : Philosophical Factor
১১.৭. জাতিগত উপাদান : Racial Factor
১১.১ সামাজিক উপাদান : শিক্ষা যেমন সমাজকে প্রভাবিত করে, সমাজও তেমনিভাবে শিক্ষাকে প্রভাবিত করে। কারণ যে কোন সমাজ ব্যবস্থায় সামাজিক চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, গতি ও প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। তবে যেসব সামাজিক উপাদান সক্রিয়ভাবে শিক্ষাকে প্রভাবিত করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ
ক. জনসংখ্যা : Population.
খ. পরিবার : Family.
গ. সমাজ : Society.
ঘ. গোষ্ঠী/দল : Group.
ঙ. সম্প্রদায় : Community.
চ. জনমত : Public Opinion.
ছ. সামাজিক স্তর : Social Stratification.
১১.২ সাংস্কৃতিক উপাদান : যে কোন জাতির সাংস্কৃতিক উপাদান তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে সক্রিয়ভাবে প্রভাবিত করে। শিক্ষাকে যেসব সাংস্কৃতিক উপাদান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে তার মধ্যে উলেলখযোগ্য হলঃ
ক. প্রথা : Customs.
খ. সামাজিক বিশ্বাস বা লোকাচার : Social belief or Folk behaviour.
গ. মূল্যবোধ : Values.
ঘ. সংস্কৃতি : Culture.
ঙ. সাংস্কৃতিক সংগঠন : Cultural Organization.
চ. কুসংস্কার : Superstition.
ছ. ভাষা ও সাহিত্য : Language and literature.
জ. ধর্ম : Religion.
ঝ. সভ্যতা : Civilization.
১১.৩ অর্থনৈতিক উপাদান : যে কোন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সে দেশের অর্থনৈতিক দর্শন এবং আর্থিক অবস্থার সাথে গভীরভাবে জড়িত। অর্থনৈতিক কার্যাবলীর মাধ্যমে মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়ে থাকে। মানুষের এ জীবিকা নির্বাহের ধরণ ও প্রকৃতি শিক্ষাকে প্রভাবিত করে। শিক্ষাকে প্রভাবিত করে এমন অর্থনৈতিক উপাদানের মধ্যে উলেলখযোগ্য হলঃ
ক. সম্পদ : Wealth.
খ. পেশা : Profession.
গ. চাহিদা : Demand.
ঘ. প্রতিষ্ঠান : Institution.
ঙ. প্রচার মাধ্যম : News Media.
১১.৪ রাজনৈতিক উপাদান : শিক্ষা ছাড়া কোনো ব্যক্তির কাছে রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধান এবং রাজনৈতিক দলের ধারণা আসতে পারে না। শিক্ষাকে প্রভাবিত করে এমন রাজনৈতিক উপাদানগুলো নিম্নরূপঃ
ক. রাষ্ট্র : State.
খ. সরকার : Government.
গ. রাজনৈতিক দল : Political Party or Organization.
ঘ. সংবিধান : Constitution.
১১.৫ ভৌগলিক উপাদান : ভৌগলিক পরিবেশও শিক্ষা ব্যবস্থার উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কৃষি নির্ভর দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কৃষি শিক্ষার দিকে এবং শিল্প প্রধান দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রযুক্তি ও শিল্প বিষয়ের দিকে গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। শিক্ষাক্রমে শীত প্রধান দেশে শীতকালীন দীর্ঘ ছুটি এবং গরম প্রধান দেশে গ্রীষ্মকালীন দীর্ঘ ছুটি সন্নিবেশিত হয়। এভাবে ভৌগলিক পরিবেশের কারণে কোন জাতির সংস্কৃতি, সভ্যতা ও শিক্ষা ব্যবস্থা প্রভাবিত হয়।
১১.৬ দার্শনিক উপাদান : যেহেতু দর্শন জীবনকে প্রভাবিত করে সেহেতু এর দ্বারা শিক্ষাও প্রভাবিত হয়। যেমন প্রাচীন যুগের সক্রেটিস, পেলটো, এরিস্টটল কেন্দ্রিক সেদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের নির্দিষ্ট গ্রীক দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। গণচীনের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি কমিউনিস্ট দর্শন। প্রাচীন ভারতের গুরুকুল [Gurukul] শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি বৈদিক দর্শনের উপর। বৌদ্ধ দর্শনের উপর বৌদ্ধ বিহার ও সন্ন্যাসী মঠ গড়ে ওঠে। বর্তমান ভারতে অনেকে জি. ও. বিনোদাভাব-এর সারাভোদ্য়্যা [Saravodya] দর্শনের উপর শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপনে সহযোগিতা করছে। এছাড়া যেসব সাম্প্রতিক দর্শন জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছে তা হলোঃ
ক. সমাজতন্ত্র : Socialism.
খ. গণতন্ত্র : Democracy.
গ. জাতীয়তাবাদ : Nationalism.
ঘ. মানবতাবাদ : Humanism.
ঙ. আবেগতন্ত্র : Emotionlism.
১১.৭ জাতিগত উপাদান : পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই একাধিক জাতি রয়েছে। এদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দলীয় প্রভাব শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। কার্যতঃ ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব পড়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর। যেমন, ভারতের প্রভাব কাশ্মিরের উপর, ইসরাইলীদের প্রভাব গাজার ফিলিস্তিনিদের উপর, শ্রীলংকানদের প্রভাব তামিলনাড়ুদের উপর এবং বৃটিশদের প্রভাব ছিল তার ঔপনিবেশ-এর উপর। এভাবে জাতিগত উপাদান অনেক সময়ই কোনো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
১২. শিক্ষায় শিক্ষকের ভূমিকা [Teacher’s Role in Education]
শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপদান করেন শিক্ষকগণ। শিক্ষক হচ্ছেন শিক্ষার এক অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। ব্যাপক অর্থে যিনি তাঁর অর্জিত শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা ফলপ্রসূতার সাথে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করতে পারেন তিনিই প্রকৃত শিক্ষক। একজন শিক্ষকের ভূমিকা ও প্রভাব অনেক সময় জাতীয় ও ভৌগলিক সীমারেখা অতিক্রম করতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে উন্নত সভ্যতা ও বিশ্ব শান্তির সহায়ক হতে পারে। মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন তেমনি এক তুলনাহীন শিক্ষক। যার প্রভাব সকল জাতীয় ও ভৌগলিক সীমারেখা অতিক্রম করেছে। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর দৃষ্টিতে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবন ও কর্ম গোটা মানব জাতির সম্পদ, শুধু মুসলিমদের নয়। তাঁর ভাষায়, ‘‘I have read sir Abdullah Suhrawardy’s collections of the sayings of the Prophet with much interest and profit. They are among the treasures of mankind, not merely Muslims.’’
শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকের ভূমিকা নিম্নরূপ :
১২.১ নির্দেশনা দান।
১২.২ উৎসাহ দান।
১২.৩ ব্যাখ্যা দান।
১২.৪ পেশা বা বৃত্তি নির্বাচনে সহায়তা দান।
১২.৫ মূল্যবোধ পরিবেশন বা উপস্থাপন।
১২.৬ পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন।
১২.৭ সমন্বয় সাধন।
১৩. ইসলামে একজন আদর্শ শিক্ষক [An Ideal Teacher In Islam]
আদর্শ শিক্ষক একটি বিস্তৃত ধারণা। আদর্শ শব্দটি শিক্ষকের অগ্রে বা পূর্বে স্থান পাওয়ায় এরূপ অবস্থার অবতারণা হয়। আদর্শ শব্দটি আমাদের সমাজে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। আদর্শ শিক্ষক কে? এ উপলব্ধির জন্য ‘আদর্শ’ কে হবেন সে বিষয়ে ঐকমত্য প্রয়োজন। ‘আদর্শ’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল ‘অনুসরণীয় নমুনা’’ বা Examplary character। অর্থাৎ এমন একটি নমুনা, যা সম্পূর্ণ এবং খুবই উপযুক্ত সকল মানুষের, সকল সময়ে, সকল কাজে অনুসরণের জন্য। সার্বিক অর্থে আদর্শ হল, এমন একটি নমুনা, যা মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনে সকল মানুষের সকল প্রয়োজন পূরণে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘‘তোমাদের জন্য অরশ্যই আল্লাহর রাসূলের [জীরনের] মধ্যে অনুসরেণযোগ্য উত্তম আদর্শ রয়েছে, যে আল্লাহতায়ালার সাক্ষাত প্রত্যাশী ও আখিরাতকে ভয় করে এবং যে বেশি পরিমণে আললাহতায়ালাকে স্মরণ করে।’’
আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘‘তিনিই [আল্লাহ] উম্মীদের মধ্যে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য হতে, যিনি তাদের [মানুষের] কাছে আল্লাহতায়ালার আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনান; তাদের পবিত্র করেন এরং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমাত; ইতোপূর্বে তো তারা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে।’’
আয়াত দুটো থেকে সুস্পষ্টভাবেই উপলব্ধ হয় যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একমাত্র অনুসরণীয় আদর্শ। আর তাঁকে অনুসরণকারী শিক্ষকই হলেন আদর্শ শিক্ষক এবং একজন আদর্শ শিক্ষকের কাজ প্রধানত চারটিঃ
১৩.১ মানুষের নিকট আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শন তুলে ধরে মানুষকে আল্লাহতায়ালা সম্পর্কে সঠিক ধারণা প্রদান করা।
১৩.২ মানুষদেরকে পবিত্রকরণ অর্থাৎ অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারের অন্ধকার দূর করে জীবন ও জগতের প্রকৃত সত্য জ্ঞানের আলোকে মানুষের চরিত্রকে পুনর্গঠন। মানুষের মধ্যে সু-স্বভাবের চর্চা ও লালন এবং কু-স্বভাব নিয়ন্ত্রণ ও বর্জনের মাধ্যমে ইহকালীন শান্তিময় জীবন-যাপন ও পরকালীন জীবনে আল্লাহতায়ালার কঠিন আযাব থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করা।
১৩.৩ কিতাব শিক্ষা অর্থাৎ নাযিলকৃত কুরআনে উল্লেখিত যে কোনো জ্ঞানের বিষয়ে গভীর মর্ম উপলব্ধি করতে সহায়তা করা।
১৩.৪ হিকমাত শিক্ষা, অর্থাৎ অর্জিত জ্ঞান প্রয়োগের কৌশল বা প্রযুক্তির শিক্ষা দান করা যার মাধ্যমে মানুষ বস্ত্তজগতকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম হবে এবং দক্ষতার সাথে [Efficiently] আল্লাহতায়ালার প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হবে।
আয়াতের পর্যালোচনান্তে বলা যায় আদর্শ শিক্ষক হলেন তিনি, যিনি আদর্শতম শিক্ষক মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অনুসরণ করে সূচারুরূপে উপরে বর্ণিত দায়িত্বগুলো পালন করেন। আর কোনো নাস্তিক, মুশরিক ও মুনাফিক যেহেতু মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আদর্শ বলে বিশ্বাস করে না এবং অনুসরণও করে না তাই কোন নাস্তিক, মুশরিক ও মুনাফিক কখনো আদর্শ শিক্ষক হতে পারে না। একজন আদর্শ শিক্ষকের কাছে ছাত্র, অভিভাবক ও সমাজের প্রত্যাশা অনেক। যে প্রত্যাশা পূরণ না হলে হতাশা আছড়ে পড়ে। নিম্নে উল্লেখযোগ্য কিছু প্রত্যাশা তুলে ধরে হলঃ
ক. যথার্থ আদর্শিক জ্ঞানে মন্ডিত হবেন।
খ. নিজস্ব ধর্মীয় দর্শন ও অন্যান্য জীবন দর্শন সম্পর্কে জ্ঞান রাখবেন।
গ. আদর্শের ভিত্তিতে আল্লাহর অনুগত বান্দাহ হিসেবে ছাত্রদেরকে গড়ে তুলবেন।
ঘ. প্রতিটি পাঠ আদর্শের সাথে সম্পৃক্ত করে পড়াবেন।
ঙ. আদর্শ বিরুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি খন্ডন করতে সক্ষম হবেন।
চ. সুন্দর চারিত্রিক গুণাবলী ও ব্যবহারের মাধ্যমে নিজস্ব আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট করবেন।
ছ. কথা ও কাজের মধ্যে মিল রাখবেন।
জ. আদর্শ প্রচারে কুশলী ও সাহসী হবেন।
ঝ. ইবাদাতের concept নিয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণকে সামনে রেখে শিক্ষাদানে ব্রতী হবেন।
১৪. শিক্ষায় মুসলিমদের অবদান [Muslim Contribution in Education]
ইক্রা - এই নির্দেশই ছিল ইসলামের প্রথম শিক্ষা। ইক্রা মানে পড়ুন, পাঠ করুন, উপলব্ধি করুন। মানুষের হৃদয়ে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে মানুষকে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করে ফেরেশতাদের সিজদা পাওয়া মানুষের সঠিক মর্যাদায় তাকে অধিষ্ঠিত করাই ছিল ইসলামের লক্ষ্য। আর মানুষ যেন তার সৃষ্টির প্রক্রিয়া অবহিত হয় এবং চিনে নেয় তার একমাত্র স্রষ্টা আল্লাহকে। আল্লাহ বলেন, ‘‘পাঠ কর তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন- সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ’আলাক হতে। পাঠ কর, আর তোমার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না।’’
শিক্ষার এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলিমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখা-প্রশাখাতে ব্যুৎপত্তি লাভ করে বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে অমূল্য অবদান রেখে গেছে। একদল প্রথিতযশা ঐতিহাসিক, বিজ্ঞান-মনস্ক গবেষক ও তথ্য-উদ্ঘাটক (যেমন: জন উইলিয়াম ড্র্যাপার, গুইজট, জন ডেভেনপোর্ট, স্টেনলি লেন-পুল, এম.পি.ই বার্থেলট এবং অতি উৎসাহী ও নিবেদিত আধুনিককালের ই.জে. হোইয়ার্ড ম্যাক্স মেয়ারহফ, জর্জ সার্টন এবং ফিলিপ কে. হিট্টি) সম্পূর্ণভাবে এই ঐকমত্যে পৌঁছেন এবং স্বীকার করেন যে, ‘‘মুসলিম আরবগণ শুধু প্রাচীন গ্রীক, পার্শী এবং ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞান সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থাই করেননি, বহুলাংশে সে-সবের সমৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। তাদের দূরদর্শী ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য আমরা সে-সব লেখকদের নিকট ব্যক্তিগতভাবে ঋণ স্বীকার করছি, বিশেষ করে শেষোক্ত দু’জন লেখকের (এবং অন্যান্য প্রমিত আরবি উৎস সমূহের নিকট) যাঁরা তাঁদের গ্রন্থসমূহে পর্যাপ্ত তথ্যের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। এমনকি মুসলিম ইতিহাস, কৃতিত্ব, অর্জন এবং মানব সভ্যতার বিকাশে মুসলিমদের অবদান কারো পক্ষেই ভুলে যাবার নয়।’’ অষ্টম শতাব্দীর গোড়া থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত মুসলিমগণ ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের দক্ষতা অর্জনে অত্যন্ত সন্ধিৎসু জাতি। তারা শুধু নিজেরাই জ্ঞান চর্চা ও অনুশীলনে নিরত ছিলো না, বরং জ্ঞানান্বেষু অন্যান্য জাতিকে তাদের অধিত জ্ঞানের অংশীদার করতেও কুণ্ঠিত হয়নি। মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিকগণ জ্ঞান সাধনার পাশাপাশি ধর্মপ্রচারক ও সমরনায়কদের সঙ্গে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছেন।
তারা [এইসব লেখক-সাধক-বিজ্ঞানী] রাজনৈতিক কারণে যখন বিভিন্ন সময়ে শ্রেণীগতভাবে মর্যাদাচ্যুত হয়েছেন, তখনও নতুন প্রজন্মের নিকট জ্ঞানের আলোক ছাড়ানোর কাজে বিভিন্ন ভাবে নিয়োজিত রেখেছেন নিজেদের। মুসলিমদের জ্ঞান ও সংস্কৃতির সংস্পর্শ এসে এভাবেই বন্য দ্যালামাইতস, স্যালজুক, তাতারস এবং বার্বার জাতি
শান্তির সন্ধান খুঁজে পেয়েছে। তবে মুসলিম সভ্যতার জন্য ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলো চেঙ্গিস খান, হালাকু খান নামে মানবতার শত্রুগণ। মামলুক সুলতানদের দ্বারা এইসব মানবতার শত্রুগণ প্রতিহত না হওয়া পর্যন্ত এরা মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের অর্জন ও কৃতিসমূহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে যাচ্ছিলো।
মিশর এবং সিরিয়া চিরদিনই সালাহ আল-দীন (জন্ম তাকরিত ১১৩৮, মৃত্যু মার্চ ১১৯৩) রোকন আল দীন বাবর (১২৬০-৭৭) এবং সাঈফ আল-দীন কালাউন (১২৭৯-৯০), প্রমুখের জন্য গৌরবান্বিত বোধ করবে। এরা যে শুধু ক্রুসেডেই গৌরবজনক ভূমিকা রেখেছিলো তা নয়, বরং জ্ঞান সাধনা, ইসলামের প্রতি গভীর নিষ্ঠা ও আনুগত্য, সুকুমার শিল্পকলা, স্থাপত্য শিল্প, হাসপাতাল স্থাপন এবং খাল খনন প্রভৃতি শিক্ষা ও জনহিতকর কার্যক্রমের জন্য যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আরব থেকে মুসলিম শিক্ষা ও সংস্কৃতি কিভাবে ইউরোপে বিস্তৃতি লাভ করেছে সে ইতিহাস সত্যিই চমকপ্রদ। মূলত: সিসিলি ও স্পেন ছিলো এসব বিস্তৃতির প্রধান উৎসস্থল। সিসিলির ছিলো খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত দু’জন শাসক - এরা হলেন রজার দ্বিতীয় এবং ফ্রেডরিক দ্বিতীয়। এছাড়া ছিলেন হোহেনস্টফেন, বিশেষত: শেষোক্তজন আলপস্ পর্বতমালা অতিক্রম করে আরবের মুসলিম শিক্ষা ও সংস্কৃতি বহন করে নিয়ে আসে ইউরোপে এবং লোথারিঞ্জিয়া [Lotharingia (Lorraine)], লাইজি [Liege], জর্জি [Gorge] এবং কোলন [Cologne] এই স্থানসমূহ ক্রমে আরব থেকে আনীত মুসলিমদের জ্ঞানের লালন কেন্দ্ররূপে পরিচিতি লাভ করে। স্পেন থেকে এই জ্ঞান পিরিনীস [Pyrenees] ডিঙিয়ে ক্রমে ক্রমে পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সে ছড়িয়ে পড়ে। এয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মুসলিমগণ যখন এক পর্যায়ে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও কর্মকান্ডে স্থিত হয়ে যায়, খ্রিস্টিয় ইউরোপ তখন চিকিৎসাবিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, জ্যোর্তিবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা এবং রসায়নশাস্ত্র প্রভৃতি ক্ষেত্রে ক্রমেই অগ্রসরমান। বিশেষ করে কর্ডোভা, টলেডো, সেভিল এবং গ্রানাডার বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ থেকে ডিগ্রী প্রাপ্ত শিক্ষার্থীগণ দেশে ফেরত আসার পর বর্ণিত বিষয় ও ক্ষেত্রসমূহে শনৈ শনৈ অগ্রগতি লাভ করতে থাকে। বিস্ময়করভাবে মুসলিমদের জ্ঞান তখন পরিশ্রমী অনুবাদকদের দ্বারা অনূদিত হয়ে ইউরোপে স্থানান্তরিত হতে থাকে। এসব অনুবাদকদের মধ্যে বিশ্বব্যাপী খ্যাতিমান হয়ে আছেন, জেরার্ড অব ক্রেমোনা, অ্যাডেলার্ড অব বাথ, রবার্ট অব চেস্টার, মাইকেল স্কট, স্টিফেন অব সারাগোসা, ইউলিয়ম অব লিউনিস, ফিলিপ অব ত্রিপোলি। অনুবাদের মাধ্যমে ল্যাটিন জনগণের মধ্যে এসব অনুবাদকরা মুসলিম আরবদের জ্ঞান সহজলভ্য করে তোলে। কিছু বই হিব্রু ভাষাতেও অনূদিত হয়। অপরদিকে কিছু সংখ্যক হিব্রু ও ল্যাটিন গ্রন্থ ইউরোপের নিজস্ব ভাষাতেও অনূদিত হয়। ইউরোপের স্যালার্নোতে চিকিৎসাবিজ্ঞান অধ্যয়ন শুরু হয়।
আফ্রিকার অধিবাসী কনস্টানটাইন চিকিৎসাবিজ্ঞান শেখার জন্য সৌভাগ্যক্রমে সেখানকার মেডিক্যাল কলেজে একজন আরবকে পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে। মন্টপেলিয়ার এবং প্যারিস খুব শিগগরিই এই ধারা অনুসরণ করে নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে। তখনকার দিনে আরবি ভাষাই ছিলো বলতে গেলে সমগ্র বিশ্বের বিদ্যা শিক্ষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম, ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলগুলিতে আরবি ভাষাতেই পড়ানো শুরু হলো। বিশেষতঃ টলেডো, নারবোনে, নেপলস্, বোলোনা এবং প্যারিস প্রভৃতি শহরে আরবি ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে পড়াশোনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল স্থাপন করে।
নির্ভরযোগ্য লেখক ও গবেষকদের মতে, মুসলিম স্পেন থেকে ফ্রান্স ও তার পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে এবং মুসলিম অধ্যুষিত সিসিলি থেকে ইতালিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির চাষাবাদ বিস্তৃতি লাভ করে। স্পেনের মুসলিম শাসকগণ কর্তৃক সে সময়ে যে সেচ পদ্ধতির প্রবর্তন করেন এবং তাদের উদ্যানবিদ্যা তথা কৃষি-বনায়ন পদ্ধতি প্রয়োগ করেন তাতে অচিরেই দেশকে শাক-সবজি ও কৃষিজাত ফসলে স্বনির্ভর এবং সবুজাভ স্পেনে রূপান্তরিত করে। মুসলিমদের এইসব গৌরবময় অতীতের ঘটনাবহুল ইতিহাস এবং ঐতিহ্যময় কর্মকান্ডের কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে আবু যাকারিয়া ইবন মুহাম্মাদ আল-আওয়াম ইশবিলি বিরচিত ‘‘কিতাব আল-ফলাহাত’’ গ্রন্থে। আবু যাকারিয়া বিরচিত গ্রন্থে ন্যূনপক্ষে ৫৮৫টি প্রজাতির উদ্ভিদ নিয়ে আলোচনা সন্নিবিষ্ট হয়েছে। প্রত্যেকটি লেখায় উদ্ভিদসমূহ রোপণ ও নার্সিং করার সুস্পষ্ট নিয়মাবলী সুগ্রন্থিত।
জ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে মুসলিমদের পারদর্শিতা ছিল না। দার্শনিক আল-কিন্দি, আল-ফারাবী, ইবন সিনা ও ইবন রুশদ সমসাময়িককালের ‘জ্ঞানভান্ডার’ নামে পরিচিত হতেন। আল-কিন্দি চক্ষু রোগ, রসায়ন, চিকিৎসা ও দর্শনে অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি শতাধিক পুস্তক প্রণয়ন করেন। ইবন সিনা মাত্র আঠার বছর বয়সে চিকিৎসা শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যে দুটি বিশ্বকোষ ইবন সিনা রচনা করেছিলেন সেসব দ্বাদশ থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত চিকিৎসা জগতে পথপ্রদর্শক গ্রন্থ বলে বিবেচিত হতো। পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত তাঁর বইগুলো ষোলবার পুনঃমুদ্রিত হয়।
রসায়ন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল, ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি সকল বিষয়েই মুসলিম গবেষক ও বিজ্ঞানীদের যথেষ্ট দখল ছিল। আল-খাওয়ারিয্মি, মুসা বিন সাকির, আলবিরুনী, ওমর খৈয়াম, ফেরদৌসী, মাসুদী, আত-তাবারী, ইবন খলদূন - এমন আরো শত শত বিজ্ঞানী ও জ্ঞান তাপস যুগে যুগে জ্ঞান চর্চা করে বিশ্বকে যে আলোকবর্তিকা হাতে দিয়ে গেছেন, তা আজো তথাকথিত পাশ্চাত্য সভ্যতার কাছে অমূল্য অবদান হিসেবে স্বীকৃত। মুসলিমদের জ্ঞানচর্চা চলছিল পাঁচশ বছর, আর এই সময়ই ছিল ইউরোপের ইতিহাসের অন্ধকারতম যুগ। একই সময় ভারতবর্ষ অবনত ছিল প্রতিক্রিয়াশীল ব্রাক্ষ্মণাত্যের অধীন যা বৌদ্ধধর্মকে বিধ্বস্ত কিংবা বিকৃত করেছিল।
মানুষের হৃদয়ে জ্ঞানের আলো জ্বালাবার নির্দেশ - ইকরা দিয়ে শুরু হয়েছিল ইসলামের শিক্ষার সূচনা। তা শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে মানব সভ্যতাকে আলো বিতরণ করে গেছে, কোন ধরণের মানবিক বিকৃতি ছাড়াই। মানুষকে কোনো বস্ত্তর বা প্রাকৃতিক কোনো শক্তির দাসত্বে পরিণত করেনি। মানুষকে যন্ত্র বলে উলেলখ করেনি, যেমন পাশ্চাত্য শিক্ষাদর্শন করেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল বিষয়ে গভীর বিস্তৃতি সত্ত্বেও মানুষের যে মর্যাদা আল্লাহ দান করেছিলেন তা অক্ষুন্ন ছিল। মানুষ শুধু আল্লাহর ইবাদাতকারী অনুগত বান্দাহ হয়ে তাঁর অন্য সকল সৃষ্টির উপর মর্যাদাবান হয়েই ছিল। আল্লাহর সকল সৃষ্টির মধ্যে একমাত্র মানুষই শিক্ষার মাধ্যমে নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার বিকাশ সাধন করতে পারে, স্থান-কাল-পাত্রভেদে উদ্ভূত পরিস্থিতি মুকাবিলা করতে পারে এবং প্রকৃতিকে নিজের আয়ত্তে এনে কাজে লাগাতে পারে। মানুষের এই অনন্য গুণ তাকে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধির মর্যাদায় আসীন করেছে। ফেরেশতাদের মাঝে আদম আ. সৃষ্টির যৌক্তিকতা প্রকাশ করতে গিয়ে আল্লাহ বলেছেন, ‘তিনি আদমকে সবকিছুর নাম [বস্ত্ত জ্ঞান] শিক্ষা দিয়েছেন’। ইসলামী শিক্ষা চায় মানুষের বৈষয়িক ও আত্মিক বিকাশ সাধন হোক এবং এর মধ্য দিয়ে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি বা খিলাফাতের যোগ্য হয়ে গড়ে উঠুক। বস্ত্তজগতের শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামের কোনো সংকীর্ণতা নেই। আল্লাহতায়ালা ওহীর মাধ্যমে যা শিক্ষা দিয়েছেন এবং মানুষ তাদের অর্জিত জ্ঞান ও বুদ্ধির প্রয়োগ করে মানবকল্যাণমুখী যা অর্জন করেছে, সবই ইসলামে শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। ‘প্রকৃতিকে বিচার বিশ্লেষণ করে মানুষ যে সকল জ্ঞানের দুয়ার উন্মোচন করেছে তা কখনো ওহীর জ্ঞানের বিরোধী হতে পারেনা। কারণ এর একটি হল ‘কালামুল্লাহ’ বা আল্লাহর বাণী আর অপরটি হল ‘খালকুল্লাহ’ বা আল্লাহর সৃষ্টি।’ আল্লাহ মানুষকে যে মৌলিক শক্তি দান [অর্থাৎ শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং অন্তর (উপলব্ধির জন্য)] করেছেন, তার সাহায্যে মানুষ যে তার নিজের কল্যাণে চক্ষু, কর্ণ ও হৃদয় বা অন্তরকে কাজে লাগাতে সক্ষম হবে, সে বিষয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘‘এবং আল্লাহ তোমাদেরকে বের করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভ থেকে এমন অবস্থায় যে, তোমরা কিছুই জানতে না, কিন্তু তিনি তোমাদেরকে শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং অন্তর [উপলব্ধির জন্য] দিয়েছেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’’
ইসলামের দৃষ্টিতে দেহ ও মন উভয়টি নিয়েই মানুষ। সুতরাং যে শিক্ষা মানুষের দেহ ও মন উভয়টির বিকাশ সাধন করে, স্রষ্টার সাথে মানুষের পরিচয় ঘটায়, নৈতিকতা ও মাধুর্য বৃদ্ধি করে, কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতার উন্নতি সাধন করে এবং আল্লাহর সৃষ্টিকে মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত করে তা-ই ইসলামী শিক্ষা। আমরা যেটাকে সাধারণ শিক্ষা বলে অভিহিত করি, তার মাঝে যদি আল্লাহর কুদরতের পরিচয় পাওয়া যায় এবং সেটাকে মানবতার কল্যাণে ব্যয় করা হয় তাহলে তাও ইসলামী শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত।
ইসলামের সোনালী যুগে সাধারণ শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষা নামে শিক্ষার বিপরীতমূখী দুটি প্রকরণ ছিল না, বরং যারাই কুরআন ও হাদীসের চর্চা করতেন, তারাই সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ের চর্চা করেছেন। ইবন রুশদ, ইমাম রাজী, গাযালী প্রমুখ মনীষী এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। মুসলিম বিশ্ব যখন সাম্রাজ্যবাদের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছিল তখন সাম্রাজ্যবাদী চক্র ইসলামী চেতনার শিক্ষার ধারাকে গুরুত্বহীন করার লক্ষ্যে মুসলিমদের মাঝে সাধারণ শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষা নামে দুটি ধারা তৈরি করে দিয়ে যায়; যার সুদূরপ্রসারী ফলাফল দাঁড়িয়েছে এই -মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। মুসলিমরা আজ ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। অথচ ইসলাম জ্ঞানকে এভাবে কখনই বিভক্ত করেনি। জ্ঞান মুসলিমদের হারানো সম্পদ। ‘‘আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন : জ্ঞানের কথা বিজ্ঞজনের হারানো সম্পদ। সে যেখানেই তা পাবে সে-ই হবে তার সবচেয়ে বেশি অধিকারী।’’ হাদীসটিতে রাসূলুললাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জ্ঞানকে সাধারণ শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষা নামে কোন বিভেদ করেননি। এভাবে জ্ঞানকে বিভক্ত করা কোনো মুসলিমেরই উচিত নয়। শোভনীয় নয়। এ ধরণের বিভেদ আত্মঘাতি। ঐক্য বিনষ্টকারী। মানুষের কল্যাণে যে জ্ঞানই উপকারী হয় সবই ইসলামী শিক্ষা।
১৫. ইসলামে শিক্ষার ভূমিকা [Role of Education In Islam]
দেহ ও মন দিয়ে আললাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং মানুষের শিক্ষাব্যবস্থায় দেহ ও মনের প্রয়োজন পূরণ হয়, দেহ ও মনের পরিপূর্ণ বিকাশ হয়, সে ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। দেহ ও মন উভয়টির প্রয়োজন না মিটলে শিক্ষা মানুষকে একদেশদর্শীরূপে গড়ে তোলে। বস্ত্তবাদী শিক্ষাকে প্রাধান্য দিলে মানুষ পশুর চেয়েও নিম্নমানের আচরণে বেড়ে ওঠে। আবার শুধু মনের বা আধ্যাত্মিক জাতীয় অর্থাৎ শুধু ঊর্ধ্ব জগত বিষয়ে শিক্ষাকে প্রাধান্য দিলে মানুষ বাস্তব জীবনে কোন কাজেই লাগেনা। বাস্তব জীবন পরিচালনায় সামান্যতম কোনো অবদান রাখতে সক্ষম হয় না। একমাত্র ইসলামী শিক্ষাই এই উভয়ের সমন্বয় করে মানুষের দেহ ও মনের পরিপূর্ণ বিকাশের সহায়ক হবার যোগ্যতা রাখে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে ইসলামী শিক্ষা মানব সমাজে নিম্নোক্ত ভূমিকা রেখে যায়ঃ
1. মানুষের দেহ ও মনের চাহিদা যথার্থভাবে পূরণ করে।
2. সৎ, চরিত্রবান ও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে।
3. মানুষকে তার স্রষ্টা আললাহর সাথে পরিচিত করে।
4. মানুষের ইহকালীন শান্তি [রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি সকল ধরণের সমস্যার সমাধান দিয়ে ] ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করে।
5. মানুষের মাঝে পারস্পরিক মমত্ববোধ ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে।
6. আল্লাহর বিশাল সৃষ্টি প্রাকৃতিক শক্তির গূঢ় রহস্য উদ্ভাবন ও কলাকৌশল আবিস্কার করে মানবতার কল্যাণ সাধন করে।
7. মানুষকে আল্লাহর প্রতিনিধির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে বা থাকতে সহায়তা করে।
8. হক্কুললাহ এবং হক্কুল ইবাদ বা স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে।
9. জাগতিক শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষার সমন্বয়ে ভারসাম্যমূলক জীবন গড়তে সহায়তা করে।
10. মানুষকে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে অকুতোভয় করে তোলে।
১৬. ইসলামী শিক্ষার বৈশিষ্ট্য [Features of Islamic Education]
ক. কল্যাণকর জ্ঞান মাত্রই ইসলামী ঃ
আল্লাহর কাছে মুমিনদের স্বপ্নের চাওয়া, ‘‘হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে দুনিয়ার কল্যাণ দান করুন। আর পরকালের কল্যাণও। আর আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন’’
আবু উমামাহ (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘‘ ..... অবশ্যই আললাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, আসমান ও পৃথিবীর অধিবাসীবৃন্দ, এমন কি গর্তের পিঁপড়া, এমনকি পানির মাছ ঐ ব্যক্তির জন্য দুআ করতে থাকে যে ব্যক্তি লোকদেরকে কল্যাণকর জ্ঞান শিক্ষা দেয়।’’
আল্লাহ ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জ্ঞানকে দুনিয়াবী ও ইসলামী এভাবে কোনো পার্থক্য করেননি। কল্যাণকর জ্ঞান মাত্রই ইসলামী। তা দুনিয়ার হোক বা আখিরাতের কল্যাণ হোক।
খ. মূর্খতার অবসান ও ইসলামের যর্থাথ জ্ঞান অর্জন ঃ
আল্লাহ বলেন, ‘‘ বল, যারা জানে আর যারা জানেনা তারা কি সমান?’’ আল্লাহ আরো বলেন, ‘‘তারা কি দেশ ভ্রমণ করেনি? তাহলে তারা জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও শ্রুতিশক্তিসম্পন্ন শ্রবণের অধিকারী হতে পারতো। বস্ত্তত চক্ষু তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে বক্ষস্থিত হৃদয়। ’’
আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘‘সকল মুসলিমের জন্য জ্ঞান অন্বেষণ করা ফারয’’
উসমান ইবনু আফফান (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে আলকুরআন শেখে এবং অপরকে তা শেখায়।’’
একজন মুসলিমের মূর্খের মত জীবন পরিচালনার অবকাশ নেই। হৃদয়কে অন্ধ রাখা ইসলামের দৃষ্টিতে অসভ্যতা। আল্লাহর আদেশ অমান্যের শামিল। নিজের হৃদয়কে জ্ঞান দিয়ে আলোকিত করে একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে মুমিনকে সমাজে কল্যাণময় ভুমিকা রেখে যেতে হয়।
গ. জ্ঞানের মূল উৎস আল্লাহতায়ালা একমাত্র নির্ভুল জ্ঞানের অধিকারীঃ
আল্লাহ বলেন, ‘‘হে নবী বলুন, আল্লাহই সমস্ত জ্ঞানের মালিক।’’ আল্লাহ আরো বলেন, ‘‘গোপন-প্রকাশ্য, দৃশ্য-অদৃশ্য, মূর্ত-বিমূর্ত সব কিছুর জ্ঞান তাঁর কাছে রয়েছে এবং একমাত্র তাঁরই কাছে আছে।’’
আললাহ বলেন, ‘‘তাঁর জ্ঞাত বিষয়ের কেনো কিছুই মানুষ নিজের আয়ত্বাধীন করতে পারেনা, তবে তিনি যতটুকু চান তা ব্যতীত।’’
আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘‘আমার কাছ থেকে একটি কথা শিখে থাকলেও লোকদের নিকট তা পৌঁছাও।’’
জীবনের প্রয়োজনে যত প্রকার বিদ্যা শিক্ষা করতে হয় তা সবই ওহীর দৃষ্টিকোণ বা ইসলামী দৃষ্টিকোণ হতে শিক্ষা নিতে হবে, দিতেও হবে। কারণ একমাত্র আললাহতায়ালাই নির্ভুল জ্ঞানের অধিকারী ।
ঘ. শুধু আল্লাহর ইবাদাত ও প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা অর্জন ঃ
আল্লাহ বলেন, ‘‘আমি জ্বীন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুধু আমার ইবাদাতের জন্য।’’ আললাহ আরো বলেন, ‘‘আর স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফেরেশতাদের বললেন নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে খালিফা সৃষ্টি করছি।’’
সকল ধরণের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামের সাথে মানব রচিত বিধানের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে ইসলামের যৌক্তিকতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের যোগ্যতা অর্জন করে পৃথিবীর বুকে আল্লাহর যর্থাথ প্রতিনিধিত্ব করা। এ লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থার উচ্চস্তরে মুসলিম বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, শাসক, বিচারক, অর্থনীতিবিদ, সেনাপতি ও রাষ্ট্রদূত সহ উন্নতমানের মুফাস্সির, মুহাদ্দিস, ফকীহ্ ও মুজতাহিদ সৃষ্টির উপযোগী কারিকুলাম তৈরি করা।
ঙ. পরমতসহিষ্ণুতাঃ
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘‘তোমরা সৎকাজ ও তাকওয়ার প্রসারে সহযোগিতা কর। পাপাচার ও সীমা লংঘনের কাজে সহযোগিতা করোনা।’’
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমকে হত্যা করল সে জান্নাতের ঘ্রাণও ভোগ করতে পারবে না। অথচ জান্নাতের সুঘ্রাণ ৪০ বছরের দূরত্ব হতেও অনুভব করা যাবে।’
নিছক ধর্মীয় পার্থক্যের কারণে অমুসলিমদের হত্যা করা, আক্রমণ করা বৈধ নয়। এছাড়া অমুসলিমদের সাথে আলোচনা বা তর্ক-বিতর্ক অনুষ্ঠানে ইসলামের আপত্তি নেই। কিন্তু তা হতে হবে ভদ্রজনোচিত পন্থায়। পরস্পরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। হৃদয়গ্রাহী যুক্তি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘‘আহলে কিতাবের সাথে তর্ক-বির্তক করতে হলে একমাত্র ভদ্রজনোচিত পন্থায় তা কর।’’ অমুসলিমদের সাথে অভদ্র ও অশোভন আচরণকে ইসলাম অনুমোদন দেয়নি। বৈধ করেনি। এমনকি ইসলামের পরিপন্থী আকীদা বিশ্বাস পোষণ করার জন্য তাদেরকে গালিগালাজ করারও অনুমতি দেয়নি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘‘যারা আল্লাহতায়ালাকে ছাড়া অন্যান্য উপাস্যের পূজা করে, তাদেরকে গালি দিও না। তাহলে তারা শত্রুতা ও অজ্ঞতা বশতঃ আল্লাহকে গালি দেবে। ’’
চ. পর্যবেক্ষণ ও চিন্তা গবেষণা করাঃ
আল্লাহ বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিবস ও রাত্রির পরিবর্তনে নিদর্শনাবলী রয়েছে বোধশক্তিসম্পন্ন লোকের জন্য, যারা দাড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে ও বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেননি, আপনি পবিত্র, আপনি আমাদের জাহান্নামের আযাব হতে রক্ষা করুন।’ ’’
আল্লাহ আরো বলেন, ‘‘তুমি কি দেখ না, আল্লাহ আসমান হতে বৃষ্টিপাত করেন; এবং আমি এর সাহায্যে নানা রঙের ফল বের করি। আর পাহাড়ের মধ্যে আছে নানা রঙের পথ - সাদা, লাল ও নিকষ কালো। মানুষ, জীব-জন্তু ও গৃহপালিত পশুগলোরও রয়েছে নানা রঙ। আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই তাঁকে ভয় করে; আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল।’’
পৃথিবী ও মহাবিশ্বে বিরাজমান বহু সংখ্যক সৃষ্টির দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন আল্লাহতায়ালা, যাতে মানুষ তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে। আর চিন্তা-গবেষণা করে আল্লাহর এসব সৃষ্টির তাৎপর্য উপলব্ধিকারীরাই বলতে সক্ষম হয়, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেননি, আপনি পবিত্র।’
ছ. মানবতার মুক্তির জন্য চিন্তা ঃ
আল্লাহ বলেন, ‘‘আমি কি তোমার জন্য তোমার বক্ষ প্রশস্ত করিনি? আর আমি নামিয়ে দিয়েছি তোমার থেকে তোমার বোঝা, যা তোমার পিঠ ভেঙ্গে দিচ্ছিল।’’
আল্লাহ বলেন, ‘‘আমি তো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’’
আল্লাহ আরো বলেন, ‘‘ভালো কাজ এটা নয় যে, তোমরা তোমাদের চেহারা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ফিরাবে; বরং ভালো কাজ হল যে ঈমান আনে আল্ল¬াহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি এবং যে সম্পদ প্রদান করে তার প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও নিকটাত্মীয়গণকে, ইয়াতীম, অসহায়, মুসাফির ও প্রার্থনাকারীকে এবং বন্দিমুক্তিতে এবং যে সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং যারা অঙ্গীকার করে তা পূর্ণ করে, যারা ধৈর্যধারণ করে কষ্ট ও দুর্দশায় ও যুদ্ধের সময়ে। তারাই সত্যবাদী এবং তারাই মুত্তাকী।’’
জাহিলিয়াত তথা মূর্খতার যুগে নৃশংসতাই ছিল মানবতার সংজ্ঞা। সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। সমাধানের প্রত্যাশায় তার হৃদয়টা হয়ে পড়েছিল
ভারাক্রান্ত। অধিক শোকে পাথর। লাঘবহীন ভারী এক কষ্টের বোঝা তাঁকে ক্রমাগত যন্ত্রণাক্লিষ্ট করছিলো। মানুষের মুক্তির দিশার জন্য উচাটন মনে আল্লাহ নাযিল করলেন কুরআন। মানবজাতির মুক্তির সনদ।
জ. অহংকার নয়, বিনয় ও নম্রতা ঃ
মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম সফল হবার পর বিজয় প্রাক্কালে আল্লাহ, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন বিনয়ের এবং ক্ষমা প্রার্থনার। আল্লাহ বলেন, ‘‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং তুমি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দীনে প্রবেশ করতে দেখবে, তখন তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো, তিনি তো তাওবা কবুলকারী।’’
আল্লাহ আরো বলেন, ‘‘ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে বিচরণ করো না; তুমি তো কখনই পদভারে ভূপৃষ্ঠ বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বতপ্রমাণ হতে পারবে না।’’
ঝ. অনুমান নয়, জ্ঞান ও যাচাই
আল্লাহ বলেন, ‘‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই তার অনুসরণ করো না; চক্ষু, কর্ণ, হৃদয় - এসব প্রত্যেকটির সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’’
আল্লাহ আরো বলেন, ‘‘হে মুমিনগণ! যদি কোন পাপাচারী তোমাদের নিকট কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে, পাছে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে বসো এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হয়।’’
মুসলিম মাত্রই জ্ঞান নির্ভর আচরণ করতে হবে। অন্ধত্ব ও মূর্খতা মুসলিমদের জন্য শোভনীয় নয়।
ঞ. তাত্ত্বিক নয়, ব্যবহারিকঃ
আল্লাহ বলেন, ‘‘মু’মিনদের দুই দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হরে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে; আর তাদের একদল অপর দলের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করলে, যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করবে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে - যদি তারা ফিরে আসে তাদের মধ্যে ন্যায়ের সঙ্গে ফায়সালা করবে এবং সুবিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদেরকে ভালবাসেন।’’
আনাস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমার ভাইকে সাহায্য কর। সে যালিম হোক কিংবা মাযলুম। একজন বললো, হে আল্লাহ রাসূল, মাযলুমকে আমরা সাহায্য করবো এটা তো বুঝলাম কিন্তু যালিমকে আমরা কেমন করে সাহায্য করবো? তিনি বললেন, ‘‘তুমি তার [যালিমের] হাত শক্ত করে ধরে রাখবে।’’
ইসলাম তাত্ত্বিক কোনো দর্শন নয়; ইসলাম ব্যবহারিক জীবনের বাস্তব নির্দেশনা। প্রয়োজনে যুদ্ধের অনুমতি দিয়েছে ইসলাম; তবে কোনো অবস্থাতেই সুবিচারকে উপেক্ষা করে নয়।
ইসলামী শিক্ষার বৈশিষ্ট্যের আলোকে শিক্ষিত হওয়া এবং এ শিক্ষার আলোকে একটি জাতি গড়ে তোলায় সবার অংশ গ্রহণের ফলেই কাংখিত পৃথিবীর স্বপ্ন পূরণ হতে পারে। এ কাজে একজন অপর জনের খুঁত ও দোষকে উপেক্ষা করে প্রত্যেকের ইতিবাচক দিকটিকে উৎসাহিত করা এবং প্রত্যেকের নিজ মেধা ও দক্ষতা অনুযায়ী কাজ করা।
১৭. ইসলামী শিক্ষার ভিত্তি [Bases of Islamic Education]
ইসলামী শিক্ষার মূল ভিত্তিগুলো হলঃ
1. তাওহীদঃ মানুষের ইবাদাত পাবার যোগ্যতা ও অধিকার একমাত্র এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহরই আছে।
2. রিসালাত ঃ আল্লাহ মানব জাতিকে সত্য পথ দেখাবার জন্য বিধানসহ নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন।
3. আখিরাতঃ এ পৃথিবীর পরবর্তী জীবনে পৃথিবীর সমুদয় কর্ম সম্পর্কে জবাবাদিহি করতে হবে এবং তার ভিত্তিতে শাস্তি ও পুরস্কার প্রদান করা হবে।
4. খিলাফাতঃ এ পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহতায়ালার নির্দেশ মুতাবিক তাঁরই বিধান ব্যক্তিক, সামষ্টিক ও আন্তর্জাতিক জীবনে বাস্তবায়ন করবে।
5. বিশ্বভ্রাতৃত্বঃ পৃথিবীর সকল মানুষ আদম (আ) ও হাওয়ার (রা) সন্তান। এজন্য তারা পরস্পর ভাই ভাই। কৃত্রিম কোন কারণে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করা যাবেনা।
6. ব্যক্তি-স্বাধীনতাঃ মানুষ স্বাধীন ভাবে জন্ম গ্রহণ করে এবং স্বাধীন ভাবে একমাত্র আল্লাহতায়ালার বান্দা হিসেবে জীবন যাপন করবে।
7. মৌলিক অধিকারঃ অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণ হওয়া।
8. সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধঃ সৎকাজে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং অসৎ কাজে নিষেধ করা।
১৮. ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য [Characteristics of Islamic Education System]
শিক্ষক, ছাত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা নীতি ও শিক্ষা দর্শন নিয়ে কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা এবং ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা উভয়ই কার্যকর রয়েছে। আর চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশ একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির পরিবর্তে একটি দ্বিধাবিভক্ত জাতি হিসেবে বেড়ে উঠছে। বিগত ৪০ বছরেও এর কোনো সমাধান আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ করতে সক্ষম হননি। অবস্থাদৃষ্টে যে কোন বিদগ্ধ ব্যক্তির মনে হতে পারে বাংলাদেশ এক অজানা গন্তব্যের পথে চলছে। এ অবস্থার অবসান হওয়ার প্রত্যাশা সবার। এই প্রত্যাশায় নিম্নে উভয় শিক্ষা ব্যবস্থার একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হলোঃ

ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহের একটি তুলনামূলক চিত্র :
ক্রম. বিষয় ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা
০১. জীবনের লক্ষ্য মানবজীবনের কোন স্থির লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নেই। ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যক্তি তার চিন্তা ও কর্মে সম্পূর্ণ স্বাধীন। কোনো বিশ্বাস বা ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেনা। এখানে মানুষ তার প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হয়ে থাকে। শিক্ষার বিষয়বস্ত্ত জনগণের বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের ইচ্ছামত নির্ধারিত হয়। পার্থিব জগতই সব। এ শিক্ষায় বস্ত্তর ঊর্ধ্বে কোন রকম চিন্তা-চেতনার স্থান নাই। ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থায় জীবনের লক্ষ্য সুনির্ধারিত। প্রবৃত্তি দ্বারা তাড়িত হওয়ার কোন সুযোগ ইসলামে নেই। দুনিয়ার কল্যাণ ও আখিরাতের কল্যাণ উভয়ই ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ। তবে আখিরাতমুখী জীবন পরিচালনাই ইসলামের স্থির লক্ষ্য।
০২. শিক্ষা সুযোগ না অধিকার অর্থই শিক্ষা অর্জনের নিয়ামক। যার অর্থ নেই তার শিক্ষা অর্জনের সুযোগ নেই। শিক্ষা সুযোগ, কোন অধিকার নয়। তবে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যহীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের কর্মসূচি গৃহীত হয়। প্রতিটি নর নারীর ঈমানসহ মৌলিক শিক্ষা অর্জন বাধ্যতা মূলক। শিক্ষা সুযোগ নয় অধিকার। এ অধিকার বাস্তবায়নে রাষ্ট্রকে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে হয়।
০৩. শিক্ষানীতির মৌল ভিত্তি স্থায়ী আদর্শহীন বিধায় বিভিন্ন সময়ে শিক্ষানীতি পরিবর্তিত হতে থাকে। এতে জাতি কোন সুনির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছার সুযোগ পায়না। সর্বদাই ভাঙ্গা-গড়ার মহড়া চলে। শিক্ষনীতির মৌল ভিত্তি বা কাঠামো অপরিবর্তিত থাকে।
০৪.


শিক্ষার সর্বজনীনতা সর্বজনীনতা অস্বীকৃত। জাতীয়তাই মানবতাকে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। রক্ত, বর্ণ, ভাষা, গোত্র, জাতীয়তা ও প্রতিপত্তির জন্য ইসলামে কারও বিশেষ মর্যাদা নেই। বরং রক্ত, বর্ণ, ভাষা, গোত্র, জাতীয়তা ও প্রতিপত্তি নির্বিশেষে ইসলাম মানুষকে সামাজিকভাবে সমান মর্যাদা দিয়েছে। ইসলামে শিক্ষা সর্বজনীন।
০৫. শিক্ষাদর্শন বা শিক্ষাদর্শ শিক্ষা গ্রহণ ও দানের ক্ষেত্রে স্থায়ী আদর্শ নেই । ফলে তা সদা পরিবর্তনশীল।
ইসলাম আল্লাহতায়ালা কর্তৃক নাযিলকৃত ও মনোনীত স্থায়ী জীবনাদর্শ। মৌলিক শিক্ষা অপরিবর্তনীয়।
০৬. আদর্শ চরিত্র কোন আদর্শবাদী মানবিক চরিত্রের উন্মেষ ঘটে না। আর্দশ চরিত্র গঠনই লক্ষ্য।

০৭. মূল্যবোধের ঐক্য মূল্যবোধের ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজ করে। মূল্যবোধের ঐক্য নেই। মূল্যবোধের ঐক্যই ইসলামী মূল্যবোধের পরিচয়। সাংঘর্ষিক কখনই নয়।
০৮. শাসক-শোষক সম্পর্ক ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থায় বিত্তশালী শ্রেণী, শিক্ষার সকল সুযোগ গ্রহণপূর্বক বিত্তহীনদের অধিকতর শোষণের সুযোগ পেয়ে থাকে। ধনী-দরিদ্রের মাঝে সংঘাত বা দ্বন্দ্ব সৃষ্টির মানসিকতা সৃষ্টি করে।
ইসলামে বিত্তবানদেরকে স্বতর্স্ফূতভাবে বিত্তহীনদের অধিকার আদায় করতে হয় বিধায় বিত্তশালী-বিত্তহীন সকলের শিক্ষার সমান সুযোগ। তবে এই সুযোগকে নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকেই ভূমিকা রাখতে হয়। ইসলামে মানুষে-মানুষে শাসক-শোষক সর্ম্পক স্বীকৃত নয়।
০৯. সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ শিক্ষক ছাত্রের মাঝে কেবল আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে জ্ঞান বিতরণ করে বলে সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ দিন দিন নিঃশেষ হতে থাকে। জ্ঞান অর্জন ও বিতরণের ব্যাপারে ইসলামে অর্থ মুখ্য নয়। তাই শিক্ষক ও ছাত্রের মাঝে সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ গভীর হয়ে থাকে।
১০. অবাধ স্বাধীনতা, জাতীয়তা, ও উগ্র ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবোধ মানুষকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। ইসলামে কোন কিছুই অবাধ নয়। সবকিছুই পরিমিত, প্রয়োজন মাফিক। এখানে উগ্রতার কোনো অবকাশ নেই।
১১. ঈমান বা আল্লাহতায়ালার উপর আস্থা ও বিশ্বাস ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা শিরক বা নাস্তিক্যবাদ ভিত্তিক। আল্লাহতায়ালার অস্তিত্বে অবিশ্বাসপূর্ণ শিক্ষাধারা। এ শিক্ষা সম্পূর্ণ বস্ত্তবাদনির্ভর। ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা আল্লাহতায়ালার উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস-কে ঘিরে। এ শিক্ষা বস্ত্তকেন্দ্রিক যেমন নয় আবার বস্ত্তবিবর্জিতও নয়।
১২. পরমতসহিষ্ণুতা এ শিক্ষা শিক্ষার্থীদের বস্ত্তপূজারী ও অহেতুক ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু মনোভাব এবং উগ্র ধর্মবিরোধী করে তোলে। ইসলামী শিক্ষা মানুষকে বস্ত্ত পূজারী করে না। আল্লাহর একনিষ্ঠ ইবাদাতকারীরূপে গড়ে তোলে। সেই সাথে পরধর্মের প্রতি সহিষ্ণুও করে।
১৯. নৈতিকতা কি? [What is morality?]
সহজভাবে বলতে গেলে নৈতিকতা হলো চালক বা ড্রাইভার এবং নিয়ন্ত্রকও। শিক্ষা এ চালকের উৎস। শিক্ষা মানুষের অন্তরে বা প্রাণে বা আত্মায় এ চালক ইনস্টল বা স্থাপন করে। বস্ত্তবাদী ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা হলে চালক বা নৈতিকতা সে শিক্ষার অনুরূপ বস্ত্তবাদী নৈতিকতা হবে। আর শিক্ষা, ইসলামী হলে চালক বা নৈতিকতা মানবিক হবে। কারণ ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষায় মানুষকে যন্ত্র বিবেচনা করা হয়। ফলে এখানে যান্ত্রিক নৈতিকতা সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে ইসলাম মানুষের আত্মাকেই প্রকৃত মানুষ বিবেচনা করে। ফলে ইসলামের নৈতিকতা হয় মানবিক। এ প্রসংগে কম্পিউটারকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করছি। কম্পিউটারের সচলতার জন্য তিনটি উপকরণ প্রয়োজন। এক. হার্ডওয়্যার দুই. অপারেটিং সিস্টেম তিন. ড্রাইভার সফটওয়্যার। মানুষেরও তেমনি। কম্পিউটারে হার্ডওয়্যার হচ্ছে হার্ডডিস্ক, সিপিইউ, মনিটর ইত্যাদি যা খালি চোখে দেখা যায়, স্পর্শ করা যায়। আর মানুষের হার্ডওয়্যার হল তার পুরো শরীর বা বডি, যা খালি চোখে দেখা যায় এবং স্পর্শও করা যায়। কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম হলো Windows XP, Windows 7, Windows vista ইত্যাদি যা খালি চোখে দেখা যায় না এবং স্পর্শও করা যায় না। আর মানুষের অপারেটিং সিস্টেম হলো তার রূহ বা আত্মা বা Soul, যা খালি চোখে দেখা যায় না এবং স্পর্শও করা যায় না। কম্পিউটারের ড্রাইভার সফটওয়্যার হলো কম্পিউটারের চালক ও নিয়ন্ত্রক। একে কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেমে ইন্সটল বা স্থাপন করতে হয়। তারপর ড্রাইভার সফটওয়্যারটি কম্পিটারের অপারেটিং সিস্টেমকে কাজে লাগিয়ে যে সেবার জন্য ড্রাইভার সফটওয়্যার ইন্সটল করা হয়েছে সে কাংখিত সেবাই দেয়। ড্রাইভার সফটওয়্যারও খালি চোখে দেখা যায় না এবং স্পর্শও করা যায় না। তেমনি মানুষের ড্রাইভার সফটওয়্যার হলো তার নৈতিকতা। শিক্ষা বা জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নৈতিকতা মানুষের আত্মা বা প্রাণে ইনস্টল বা স্থাপন হয়, মানুষের আত্মাকে কাজে লাগিয়ে অর্জিত সে নৈতিকতা মানুষকে সে ধরণের সেবাই দেয়, যা সে আত্মায় ইনস্টল বা বপন করেছে। নৈতিকতা মানুষের আত্মার চালক এবং মানুষের ব্যবহার নিয়ন্ত্রক।
২০. আভিধানিক অর্থে নৈতিকতা [Dictionary Meaning of Morality] ঃ
আভিধানিক অর্থে, নৈতিকতা বা Morality, ল্যাটিন শব্দ moralitas [manner, character, proper behavior] হতে উদ্ভুত। উইকিপিডিয়ার ভাষায়, Morality is a sense of behavioral conduct that differentiates intentions, decisions, and actions between those that are good (or right) and bad (or wrong). A moral code is a system of morality (for example, according to a particular philosophy, religion, culture, etc.) and a moral is any one practice or teaching within a moral code. Immorality is the active opposition to morality, while amorality is variously defined as an unawareness of, indifference toward, or disbelief in any set of moral standards or principles.
উইকিপিডিয়ার দৃষ্টিতে নৈতিকতার দু’টি প্রধান অর্থ রয়েছে। একটি বর্ণনামূলক বা "descriptive" অন্যটি "normative" বা শৃংখলামূলক। যার বিস্তারিত নিম্নরূপ :
• In its "descriptive" sense, morality refers to personal or cultural values, codes of conduct or social mores that distinguish between right and wrong in the human society. Describing morality in this way is not making a claim about what is objectively right or wrong, but only referring to what is considered right or wrong by an individual or some group of people (such as a religion). This sense of the term is addressed by descriptive ethics.
• In its "normative" sense, morality refers directly to what is right and wrong, regardless of what specific individuals think. It could be defined as the conduct of the ideal "moral" person in a certain situation. This usage of the term is characterized by "definitive" statements such as "That person is morally responsible" rather than descriptive statements like "Many people believe that person is morally responsible." These ideas are explored in normative ethics. The normative sense of morality is often challenged by moral nihilism (which rejects the existence of any moral truths) and supported by moral realism (which supports the existence of moral truths).
২১. ইসলামে নৈতিকতা, নৈতিকতা তত্ত্ব ও নৈতিকতার মানদন্ড [Morality, Ethics and Moral Standard In Islam] ঃ
আভিধানিকভাবে, morals [নৈতিকতা] are individual principles of right and wrong, and ethics [নৈতিকতা তত্ত্ব] is the philosophical discussion of morality. A system of ethics deals with sets of those moral principles. The terms ethics and morality are often used interchangeably and can mean the same in casual conversation, but morality refers to moral standards or conduct while ethics refers to the formal study of such standards and conduct. For theists [আস্তিক], morality typically comes from gods and ethics is a function of theology; for atheists [নাস্তিক], morality is a natural feature of reality or human society and ethics is a part of philosophy.
ইসলামে নৈতিকতার রূপটি অবিভাজ্য। উইকিপিডিয়া অভিধানের মতে ইসলামে নৈতিকতার দ্বৈত অর্থ নেই। ইসলামে কোন বর্ণনামূলক বা "descriptive" জাতীয় নৈতিকতা নেই। ইসলামে সবই "normative" বা শৃংখলামূলক। তবে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এর প্রয়োগে ভিন্নতা রয়েছে।
আল্লাহ বলেন, وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيمٍ
‘‘নিশ্চয়ই তুমি মহান নৈতিক চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’’
আর আল্লাহর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাঝেই রয়েছে অনুসরনীয় সর্বোত্তম মানবীয় আদর্শ। আল্লাহ আরো বলেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহর সাক্ষাত প্রত্যাশী ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য তো রাসূলুল্লাহর মাঝে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’’ অর্থাৎ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পুরো জীবনটাই অনুসরণীয় এবং তা শৃংখলামূলক।
আয়াত দুটো বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, তাহলো আল্লাহ তাঁর অবতীর্ণ কিতাবে শুধু কিছু বিধান নাযিল করেননি, তা বাস্তবায়নযোগ্য কিনা তার প্রমাণও রেখে দিয়েছেন। সে প্রমাণ হল তাঁর প্রেরিত রাসূল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তাঁর পুরো জীবন অনুসরণীয় সফল আদর্শ হিসেবে এখনও মানবজাতিকে অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে। মাইকেল এইচ হার্টের ভাষায়, ‘‘My choice of Muhammad to lead the list of the world’s most influential persons may surprise some readers and may be questioned by others, but he was the only man in history who was supremely successful on both the religious and secular levels’’
জর্জ বার্ণাড শ বলেন,
If any religion has the chance of ruling over England nay Europe, within the next hundred years, it can only be Islam.
মহাত্মা গান্ধী বলেন,
“Muhammad was a great Prophet. He was brave and feared no man but God alone. He was never found to say one thing and do another. He acted as he felt.’’
মাইকেল এইচ হার্ট, জর্জ বার্নার্ড ‘শ কিংবা মহাত্মা গান্ধী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে কোন বংশীয় আত্মীয়তার সম্পর্কে সম্পর্কিত নন কিংবা অন্য কোনভাবে প্রভাবিতও নন। আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়া-আফ্রিকার এই তিন দিকপালের তিনটে উদ্বৃতিই এতটুকু প্রমাণের জন্য যথেষ্ট যে, গোটা মানব জাতির জন্য মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবন একমাত্র অনুসরণীয় শ্রেষ্ঠ মানবিক নৈতিকতাসম্পন্ন মানদন্ড।
২২. নৈতিকতার প্রকার ও সর্বজনীনতা [Types and Universility of morality]
কিছু কিছু ড্রাইভার সফটওয়্যার কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেমের জন্য ক্ষতিকর। সাধারণতঃ এগুলোকে কম্পিউটার ভাইরাস নামে অভিহিত করা হয়। এসব ড্রাইভার সফটওয়্যার কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেমকে ধ্বংস করে দেয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন। বিকৃত ও কুশিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মাঝেও এমন ধরণের নৈতিকতা ইনস্টল বা প্রোথিত হতে পারে যা তার মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে দিতে পারে। ডারউইনের যোগ্যতমের উদ্বর্তনবাদ [Survival of the fitest] তেমনি ধরণের নৈতিকতা মানুষের মাঝে ইনস্টল বা প্রোথিত করেছিল। যা সূত্রাকারে প্রকাশিত হওয়ার সময় থেকে পশ্চিমা দেশগুলোতে মানুষের মনুষ্যত্বের অধোগতি আরম্ভ হয়। সুতরাং মনুষ্যত্বের জন্য উপকারী বা ধ্বংসকারী উভয় ধরণের নৈতিকতাই আছে। নীট্শের মত বিখ্যাত দার্শনিকরা বললেন, বলবানদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য দুর্বলেরা নীতিতত্ত্ব সৃষ্টি করেছে। যদিও এই মত মূলতঃ ভুল এবং এর উল্টোটাই সত্য। দুর্বলেরা কখনো আইন-কানুন ও নৈতিকতা সৃষ্টি করে না এবং সেগুলি বলবানদের উপর চাপিয়েও দেয় না। অন্যায়ভাবে অর্জিত সম্পদ শান্তিতে উপভোগ করার জন্য এবং অধিকতর শোষণ সহজ করার জন্য সবলেরা আইন-কানুন ও মনুষ্যত্ব ধ্বংসকারী নৈতিকতা তৈরি করে। তাই নৈতিকতা মানেই তা পরম [Absolute] ও সর্বজনীন নয়। যেমন কথিত সভ্য ইউরোপের পাবলিক পার্কে পার্কে যে যথেচ্ছ ব্যভিচার চলে তা ইউরোপীয় নৈতিকতার মানদন্ড। অন্যদিকে ব্যভিচারের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত সংখ্যক স্ত্রী গ্রহণ করা ইসলামের নৈতিক মানদন্ড। উভয়ের মধ্যে কোন্টি মানুষের মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আর কোন্টি পশুর জীবনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তা উপলব্ধি করার ক্ষমতা সে মানুষের হবে না যিনি ইতোমধ্যে মনুষ্যত্ব ধ্বংসকারী নৈতিকতা নিজের মধ্যে ইনস্টল বা বপন করেছেন।
গোটা মানবজাতির জন্য একই রকম নৈতিক বিধান প্রচলন সম্ভব কিনা এ বিষয়ে বলতে গিয়ে মরহুম আবুল হাশিম বলেন, ‘‘সারা মানবজাতির জন্য একই রকম নৈতিক বিধি-বিধানের প্রচলন তখনই সম্ভব হতে পারে যখন মানুষ তার নিজের প্রকৃতির বাস্তব-স্বরূপ উপলব্ধি করার মত প্রজ্ঞা ও একে স্বীকার করার মত সাহস অর্জন করবে এবং নিজের সহজ প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ করার অধিকার স্বীকার করে এবং অন্যের অনুরূপ অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে তার নৈতিকতার তত্ত্ব গড়ে তুলবে। মানব প্রকৃতি মূলতঃ একই রূপ। স্থানীয় জলবায়ুর প্রভাবে বিভিন্ন জাতি বা গোষ্ঠীর মধ্যে প্রকৃতিগত সামান্য পার্থক্য দেখা দেয়। মানব-প্রকৃতির মূলগত ঐক্যের দৃঢ় ভিত্তিতে ইসলাম সমগ্র মানবজাতির জন্য একই নৈতিক বিধান নির্দিষ্ট করেছে এবং জলবায়ুর তারতম্যের ফলে মানব প্রকৃতিতে যে সামান্য পার্থক্য দেখা দেয় তার সঙ্গে মানুষের আচরণকে খাপ খাইয়ে নেয়ারও যথেষ্ট সুযোগ রেখেছে। ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ, সামাজিক বা জাতীয় বিবেক এবং নীতিবোধকে বস্ত্তত অস্বীকার করে। ‘‘সংঘের কোন বিবেক নেই’’ - এটা হলো তাদের প্রিয় স্লোগান। এই অস্বীকার করার নীতিই তাদেরকে অপরাপর জাতির সঙ্গে কাজ-কারবারে কোন সুবিচারমূলক নৈতিক বিধি-বিধান মেনে চলতে দেয় না। তারা মনে করে ন্যায়-অন্যায় যেভাবেই হোক জাতীয় ইচ্ছা বা আকাংখা পরিতৃপ্ত করা পুণ্যের কাজ। যদিও নীতিগতভাবে তারা স্বীকার করে যে, এক জাতির সঙ্গে অন্য জাতির সম্পর্ক এক ব্যক্তির সাথে অন্য ব্যক্তির সম্পর্কের মতই। কিন্তু বাস্তবে অন্য জাতির সাথে ব্যবহারে তার প্রতিফলন হয় না। নীতিবোধের এই মান অনুসারে বিবেচনা করলে জাতি হিসেবে তারা ভয়ংকর অসৎ ও অবিবেচক। কিন্তু ইসলামে যেমন ব্যক্তির জন্য তেমনি জাতির জন্য একই সুবিচারমূলক নৈতিকতা। ইসলাম ব্যক্তির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে। ইসলামী জীবন-দর্শন অনুসারে ব্যক্তির বিবেক দ্বারাই সামাজিক বিবেক সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রিত হয়। শুধু মানুষ নয় অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গেও ইসলাম এই বিবেক অনুসারে আচরণ করতে বাধ্য করে। এইভাবে ইসলাম মানব-সৃষ্ট কৃত্রিম ন্যায়-অন্যায়বোধ বাতিল করে দিয়ে, মূল মানবপ্রকৃতির ভিত্তিতে একইরূপ নৈতিকতার সাহায্যে ব্যক্তি, জাতি, বিশ্ব ও প্রাণীদের ক্ষেত্রেও একই ধরণের আচরণের মাধ্যমে সমগ্রের সঙ্গে অংশের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে।’’
২৩. ইসলামে নৈতিকতার গুরুত্ব ও উপযোগিতা [Importance and Utility Of Ethics In Islam]
ড্রাইভার সফটওয়্যার ব্যতীত কোন কম্পিউটার যেমন অচল, তেমনি নৈতিকতা ব্যতীত কোন জীবিত মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। নৈতিকতার ধরণ বা প্রকার ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু নৈতিকতাবিহীন কোন মানুষ হতে পারে না। আর নৈতিকতা নিরপেক্ষ যেহেতু কোন মানুষ হতে পারে না, তাই মানুষ কোন্ ধরণের নৈতিকতা অর্জন করবে বা ধারণ করবে তা মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে শিক্ষা মনুষ্যত্ব ধ্বংসকারী নৈতিকতা অর্জনের মাধ্যম, তা মানবিকতা অর্জনেচ্ছু কোন মানুষের কাংখিত হতে পারে না। যে নৈতিকতা মানুষকে পশুর চেয়েও নিম্নস্তরের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে সে নৈতিকতা মানুষের কাম্য হতে পারে না। কারণ মানুষ সামাজিক। সমাজে মনুষ্যত্ব ধ্বংসকারী নৈতিকতা সম্বলিত মানুষের প্রাধান্য বিস্তৃত হলে সে সমাজ পশুর সমাজে পরিণত হয়। আর রাষ্ট্র হয়ে ওঠে স্বৈরাচারী। বিশ্বের সকল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর নৈতিকতার চিত্র এরই সাক্ষ্য দেয়। ‘‘এ প্রসঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থার কথা চলে আসে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা নানা রকম বৃত্তিমূলক ও পেশাগত শিক্ষা প্রদান করি বটে কিন্তু ভালো মানুষ হবার যে শিক্ষা, ভালো নাগরিক হবার যে শিক্ষা সে সম্পর্কে আমরা তত মাথা ঘামাই না। অথচ আজকের সমাজে মাদকতা, সন্ত্রাস ইত্যাদির কথা চিন্তা করলে একথা পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, এসবের বিরুদ্ধে যে অভিযান দরকার তার দায়িত্ব শুধু বাবা-মা ও রাষ্ট্রকে দিলে চলবে না; শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও এ দায়িত্ব নিতে হবে এবং নৈতিক শিক্ষাকে আমাদের শিক্ষার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য করতে হবে। ..... নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের চরিত্র গঠন শিক্ষাব্যবস্থার একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে, যে দেশের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ লোকের ধর্ম ইসলাম, সে দেশে এবং যে ইসলাম ধর্মে মাদকতাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে মাদকাসক্তির প্রকোপ কেন বাড়ছে? আমরা কি তবে ধর্ম শিক্ষার দিকে একেবারেই নজর দিচ্ছি না?’’
২৪. ইসলামে আইন ও নৈতিকতা [Law and Morality In Islam]
ইসলামে আইনের উৎস কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস এবং এগুলো সবই মানবিক নৈতিকতার মানদন্ড সম্বলিত। নৈতিকতা নিরপেক্ষ কোন আইন ইসলামে নেই। অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ আইনের উৎস হল প্রচলিত রাষ্ট্রীয় দর্শন। এতে কুরআন, সুন্নাহর কোন স্থান নেই। তবে পুজিঁবাদ, সমাজবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি প্রচলিত যাবতীয় রাষ্ট্রীয় মতবাদ ধর্মনিরপেক্ষ আইনের উৎস। ফলে ধর্মনিরপেক্ষ নৈতিকতা বলতে প্রচলিত উল্লেখিত রাষ্ট্রীয় মতবাদ সৃষ্ট নৈতিকতাই বুঝায়। এসব রাষ্ট্রীয় মতবাদ উদ্ভুত নৈতিকতা, বস্ত্তবাদী ও যান্ত্রিক। মানবিক নয়। প্রতাপ-প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি কেন্দ্রিক। ব্যক্তি নিরপেক্ষ নয়। পরিপূর্ণরূপে জাগতিক। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের কোন স্থান এতে নেই। মৃত্যুর পর আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া এবং সকল কর্মকান্ডের জন্য জবাবদিহি করার অনুভূতির কথা এখানে অপ্রয়োজনীয় বাচালতা। নিরেট জাগতিক তথা বস্ত্তবাদী নৈতিকতা মানুষকে মনুষ্যত্ব বোধে উজ্জীবিত না করে শক্তির ভাষায় বা পাশবিক উন্মত্ততায় বস্ত্তকে অর্জন করার অনুমোদন দেয়। ফলে ধর্মনিরপেক্ষ নৈতিকতা হয়ে দাঁড়ায় সবল কর্তৃক দুর্বলের জাগতিক অবলম্বন বা সম্পদ ছিনিয়ে নেয়ার বা ছিনতাই করার এবং সবল কর্তৃক দুর্বলকে খুন করার কিংবা সবল কর্তৃক দুর্বলের আব্রু লুটে নেয়ার নৈতিকতা। ধর্মনিরপেক্ষ আইন এসব অমানবিক ও পশু প্রবৃত্তির নৈতিকতার নিবিড় পৃষ্ঠপোষক। আর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ আইনের পৃষ্ঠপোষক।
পাশাপাশি কুরআন ও হাদীস হতে ইসলামী আইন ও নৈতিকতার দৃষ্টান্ত দেখা যাক্। আল্লাহ বলেন, ‘‘এ কারণেই আমি বনী ইসরাঈলের উপর এই হুকুম দিলাম, যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করা বা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করা ব্যতীত কাউকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল। আর যে তাকে বাঁচাল, সে যেন সব মানুষকে বাঁচাল।’’
আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘‘পৃথিবীতে যখনই কোন মানুষকে অন্যায়ভাবে খুন করা হবে, তার খুনের শাস্তির একটি অংশ আদম আ.-এর প্রথম সন্তান ভোগ করবে। কেননা সেই প্রথম হত্যাকান্ডের প্রচলন করেছিল।’’
‘‘ ........ আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কোন এক ভাষণে বলেছিলেনঃ ‘ওহে মানব জাতি। আল্লাহ তোমাদের উপর হজ ফরয করেছেন, অতএব তোমরা এটা পালন কর।’ অতপর এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো [জানতে চাইলো] ‘‘হে আল্লাহর রাসূলঃ প্রতি বছর?’’ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিরব রইলেন। লোকটি তার প্রশ্নটি তিনবার পুনরোক্তি করলো। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাব দিলেনঃ ‘‘আমি যদি হ্যঁা সূচক জবাব দেই, তাহলে এটা তোমাদের উপর হবে বাধ্যতামূলক [প্রতি বছর হজ পালন করা]। আর এরূপ কাজ করা বাস্তবিকই তোমাদের ক্ষমতা বহির্ভূত। যে সব বিষয় আমি অনুক্ত বা উহ্য রাখি তাতে তোমরা প্রশ্ন করো না। কারণ তোমাদের পূর্বে [জাতিগুলো] ধ্বংস হয়ে গিয়েছে এজন্যে যে, তারা তাদের নবীদের মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্ন করতো এবং পরে তাঁদের শিক্ষা সমূহকে অমান্য করতো। অতএব আমি যদি তোমাদের কিছু করতে আদেশ করি তা তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী করে যাও এবং আমি যদি কোন কাজ করতে নিষেধ করি তা থেকে বিরত থাকো।’’
উদ্বৃত কুরআনের আয়াতটি হতে ইসলামের মানবিক ও নৈতিক দৃষ্টিভংগি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আর তার পরবর্তী হাদীসটিতে, ইসলামের দৃষ্টিতে যে কোন অমানবিক কাজের নৈতিক ও পারলৌকিক ফলাফলের ভয়াবহতা বলে দেয়া হয়েছে। আর সর্বশেষ হাদীসটি প্রথম থেকে শেষাবধি ধর্মীয় আইনের সকল নীতিকে পরিবেষ্টন করেছে। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে, যে সব বিষয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুক্ত রেখেছেন - করতে আদেশও করেননি বা নিষেধও করেননি - তা অনুমতিপ্রাপ্ত বা মুবাহ। অর্থাৎ সেটা নিষিদ্ধও নয়, বাধ্যতামূলকও নয়। তিনি যা কিছু আদেশ করেছেন তা ফরয বা বাধ্যতামূলক এবং তা আমাদের সামর্থ্য অনুসারে পালন করা বাধ্যতামূলক। যা কিছু নিষেধ করেছেন তা হারাম বা নিষিদ্ধ। এখানে মানবীয় সামর্থ্যের পার্থক্যকে যেভাবে অনুমোদন দেয়া হলো, পৃথিবীর কোনো আইনে এই মানবিকতার নজির নেই।
২৫. নৈতিকতার ইসলামী ও পাশ্চাত্য তুলনামুলক ধারণা [Islamic & Western Comparative Concept of Morality] ঃ
বর্তমান বিশ্বে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলী [১৪৬৯-১৫২৭] রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে এক জনপ্রিয় নাম। তবে এই জনপ্রিয়তা প্রকাশ্যে নয়। নিরবে তার রাষ্ট্রপরিচালনার নৈতিক দর্শন অনুসরণে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কারো কারো মতে ম্যাকিয়াভেলী রাষ্ট্র পরিচালনায় যে নৈতিক দর্শন দিয়েছে তাতে আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে। জাতীয় রাষ্ট্র তত্ত্বের জনক হিসেবে ম্যাকিয়াভেলীকে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে একজন যুগস্রষ্টা চিন্তাবিদ হিসেবে অভিহিত করা হয়। বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রই, রাষ্ট্র পরিচালনায় ম্যাকিয়্যাভেলীর নৈতিক দর্শনকেই নিরবে অনুসরণ করে থাকে। আর তাই প্রতীকি হিসেবে ‘নৈতিকতার পাশ্চাত্য ধারণা’ আলোচনায় ম্যাকিয়াভেলীর প্রসংগ অবতারণা।
১৪৬৯ সালের ৩ মে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলীর জন্ম। ১৪৯৪ সালে ২৭ বছরে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে কেরানি হিসেবে সরকারী চাকরীতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে যোগ্যতা বলে ফ্লোরেন্স প্রজাতন্ত্রের কাউন্সিলের সচিব নিযুক্ত হন। সচিব হিসেবে বহিঃরাষ্ট্রসমূহের সাথে যোগাযোগের সুযোগের ফলে পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনৈতিক বিষয়সমূহে ম্যাকিয়াভেলী বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।
১৫১২ সালে মেডিসি ফ্লোরেন্স দখল করলে তিনি বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এ অভিযোগে তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়। এ সময় তিনি ফ্লোরেন্সের বাইরে এক খামার বাড়িতে নির্বাসিত জীবন-যাপন করেন। নির্বাসিত জীবনে ম্যাকিয়াভেলী একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। ‘‘The Prince’’ তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। ফ্লোরেন্সের নতুন শাসক লোরেঞ্জা ডি মেডিসির নামে গ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন। তিনি আশা করেছিলেন এর মাধ্যমে তাঁর প্রতি মেডিসির দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে এবং তাঁকে পুনরায় রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগ প্রদান করা হবে। ১৫২২ সালে [বাধ্যতামূলক অবসরের ১০ বছর পর] তিনি রাজকীয় অনুগ্রহ লাভ করেন। তবে তাঁকে তাঁর আশানুরূপ রাষ্ট্রীয় পদ দেয়া হয়নি। ১৫২৭ সালে মেডিসি রাজতন্ত্রের পুনরায় পতন হলে ম্যাকিয়াভেলীর বিরুদ্ধে রাজতন্ত্র সমর্থনের অভিযোগ আনা হয় এবং তাঁকে আবারও সরকারী পদ হতে অব্যাহতি দেয়া হয়। ১৫২৭ সালের ২৭ জুন ম্যাকিয়াভেলী মৃত্যুবরণ করেন।
‘‘The Prince’’ গ্রন্থে ম্যাকিয়াভেলী রাষ্ট্রের যে নৈতিক দর্শন প্রচার করেছেন, তার অন্যতম ভিত্তি হলো মানব প্রকৃতি ও মানুষের মনোভাব সম্পর্কে তাঁর ধারণা। তার ধারণা অনুযায়ী মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই খারাপ। মানুষের মধ্যে কোন ভাল গুণ নেই। সাধারণভাবে মানুষ অকৃতজ্ঞ, চঞ্চল, ভীরু, শঠ ও লোভী। আর ভয়, ক্ষমতা লিপ্সা, দম্ভ এবং স্বার্থপরতা মানুষকে যাবতীয় কর্মের প্রেরণা যোগায়। মানুষ সাধারণত ভাল অপেক্ষা মন্দ কাজে বেশি আগ্রহী।
তিনি মনে করেন, যে ব্যক্তি ভালবাসা লাভের অধিকারী এবং যে ব্যক্তি ভীতিপ্রদ তারা উভয়ই প্রভাবশালী। কিন্তু মানুষের আচরণের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো ভীতিপ্রদ মানুষের আনুগত্য স্বীকার করা। ভালোবাসার বন্ধনকে মানুষ নিজের স্বার্থের প্রয়োজনে যে কোন সময় ছিন্ন করতে পারে, কিন্তু ভীতিপ্রদ শাসককে মেনে চলতে মানুষ বাধ্য থাকে। এরূপ আনুগত্য স্থায়ী হয়। ম্যাকিয়াভেলীর মতে নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তির সর্বাধিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারার মধ্যেই শাসকের সর্বাধিক সাফল্য নির্ভর করে। সামাজিক মূল্যবোধের উপর কোন শাসকের সাফল্য নির্ভর করে না। তিনি তাঁর ‘‘The Prince’’ বইতে বলেন, ‘পিতার মৃত্যু শোকও মানুষ অতিসত্বর ভুলে যায়, কিন্তু পৈত্রিক সম্পত্তি হারাবার শোক সে জীবনে কোনদিন ভুলতে পারে না।’ তাই নাগরিকগণ নিরাপত্তার প্রশ্নে একজন শক্তিশালী ও দৃঢ়চেতা শাসকের মাঝে আশ্রয় খোঁজে। মানুষ তার নিজের স্বার্থ ও নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনেই শক্তিশালী শাসকের কাছে আনুগত্য স্বীকার করে।
যেহেতু ম্যাকিয়াভেলীর মতে মানব চরিত্র স্বভাবতই শঠ, অকৃতজ্ঞ ও লোভী এবং নিতান্ত বাধ্য না হলে মানুষ সৎকর্ম করে না, তাই শাসকের ‘ভাল মানুষ’ হয়ে কোন লাভ নেই। যে পাশবিক শক্তির কাছে মানুষ পরাভূত হয় - সেই পাশবিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই মানুষকে অবদমিত রাখতে হবে। শাসককে সর্বদা রাখতে হবে যে, প্রতারণা, নিষ্ঠুরতা যে কোনভাবেই হোক মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করতে হবে। কেননা ভালবাসার মধ্য দিয়ে নয় বরং ভীতি প্রদর্শনই মানুষের বশীভূত করার একমাত্র পথ। তিনি বলেন, প্রেমপ্রীতি, ভালবাসা, দয়া-দাক্ষিণ্যের মাধ্যমে মানুষকে কোনদিন জয় করা যায় না। কেননা মানুষ সব সময়ই ব্যক্তিগত স্বার্থ ও লোভ-লালসা চরিতার্থ করতে চায়। কোন প্রকার সুশিক্ষা, সদুপদেশ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের উন্নতি - কোন কিছু দ্বারাই মানুষের মানসিকতাকে পরিবর্তন করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে মানুষের উপর পাশবিক শক্তি প্রয়োগ করা ছাড়া শাসকের অন্য কোন উপায় থাকে না। এভাবে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তির সর্বাধিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। তাতে শাসকের প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন অব্যাহত থাকবে। ফলশ্রুতিতে শাসনের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হবে। তার মতে, শাসকের মধ্যে ‘ শৃগাল ও সিংহ’ - এ দুয়ের গুণাবলীর সমন্বয় সাধিত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘‘ The Prince must be a Fox, ..... to recognize the traps and a Lion to frighten the wolves.’’ অর্থাৎ শাসক হবেন শৃগালের ন্যায় ধূর্ত এবং সিংহের ন্যায় বলশালী।
রাষ্ট্রনায়কদের গুণাবলী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাষ্ট্রনায়কদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এমন হবে যে, ‘তিনি যেখানে যেমন সেখানে তেমনই দেখা দিতে পারেন।’ রাষ্ট্রের কল্যাণার্থে ও এর স্থিতিস্থাপকতার কারণে রাষ্ট্রনায়কদের যে কোন কর্মসূচি গ্রহণ করার পক্ষপাতিত্ব করেছেন ও ন্যায়সঙ্গত মনে করেছেন। সুতরাং ধর্ম বা নৈতিকতার কথা আদৌ চিন্তা না করে রাষ্ট্র তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য যা কিছু অনুকূল তাই করে যাবে। তাঁর মতে, রাষ্ট্র যদি চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করতে পারে তবে মাধ্যম যতই নিচ বা ঘৃণ্য হোক না কেন অর্জিত সাফল্যই মাধ্যমের যৌক্তিকতা প্রমাণ করবে। তাঁর ভাষায়, লক্ষ্য মাধ্যমের যৌক্তিকতা বিধান করে, মাধ্যম লক্ষ্যের নয় [End Justifies the means, not means the ends]। তার নৈতিকতার মূল বক্তব্য ছিল, রাজনীতি থেকে নীতি ও ধর্মকে পৃথক করা। গির্জা ও ঈশ্বরতত্ত্ব প্রচারিত ধর্ম ও নৈতিকতার সাথে রাষ্ট্রের কোনো সম্পর্ক নেই - It is isolated from morality and religion.
বর্তমান বিশ্বে কার্যত ম্যাকিয়াভেলীর End Justifies the means এবং Life & State is isolated from morality and religion নৈতিক দর্শনই অনুসৃত হচ্ছে। ম্যাকিয়াভেলীর ইতালিতে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আদৌ কোন স্থান ছিল না। মূল্যবোধের রাজ্যে তখন চলছিল এক চরম সংকট। শুধু শাসক গোষ্ঠীর জন্য প্রদর্শিত একদেশদর্শী এই নৈতিকতার একমাত্র সমঝদার হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের গণতন্ত্রের মুখোশধারী সকল স্বৈরাচারীরা।
ম্যাকিয়াভেলীর সৌভাগ্য হয়নি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মত মানুষের সন্ধান পাবার এবং তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নেবার। ইসলাম মানুষকে কতটা মহৎ করতে পারে তা অনুধাবনের লক্ষ্যে সহীহ মুসলিম হতে একটি হাদীস উদ্বৃত করছিঃ হযরত জারীর (রা) বলেন, ‘‘আমরা সকাল বেলায় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে বসেছিলাম। এ সময়ে তাঁর কাছে যুদ্ধ প্রত্যাগত এক দল মুসলিম এল। তাদের গায়ে ছিল ছিন্ন জামা ও কম্বল এবং কোষবদ্ধ তরবারি। তারা সকলেই ছিল মুদার গোত্রীয়। তাদের ক্ষুধাকাতর অবস্থা দেখে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর চেহারা বিমর্ষ রূপ ধারণ করলো। তিনি একবার নিজ গৃহে প্রবেশ করলেন। অতঃপর বেরিয়ে এসে বিলালকে ডাকলেন। তাকে আযান দেয়ার আদেশ দিলেন। বিলাল আযান দিলেন ও ইকামাত দিলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামায পড়ালেন। অতঃপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাষণ দিলেনঃ ‘‘হে লোক সকল, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে একই ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন।’’ [৪ ঃ সূরা আন নিসা, আয়াত-১] ‘‘ হে মুমিনগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং আগামীকালের জন্য কী সঞ্চয় করা হলো তা প্রত্যেকের দেখা উচিত।’’ [৫৯ ঃ সূরা আল হাশর, আয়াত-১৮] ভাষণ শুনে একব্যক্তি এক দিনার দান করলো। অতপর তার দেখাদেখি আর একজন এক সা খেজুর এমনকি কেউ একটা খুরমার এক টুকরোও দান করলো। অতপর আনসার থেকে এক ব্যক্তি বড় এক পাত্র ভর্তি খাবার নিয়ে এল, যা সে বহন করতেই পারছিলোনা। অতপর লোকদের দান করার এমন হিড়িক পড়ে গেল যে, আমি খাদ্য ও কাপড়ের বড় বড় দুটো স্তূপ জমা হতে দেখলাম। তখন দেখলাম, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিমর্ষ হয়ে যাওয়া চেহারা স্বর্ণের মত উজ্জ্বল ও প্রফুল্ল হয়ে উঠেছে। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘‘যে ব্যক্তি ইসলামের জন্য কোন উত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে, সে উক্ত দৃষ্টান্ত স্থাপনের সাওয়াবও পাবে। অথচ অনুকরণকারীদের সাওয়াব কিছুমাত্র কম হবেনা। আর যে ব্যক্তি ইসলামের জন্য কোন খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে, সে ঐ খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপনের শাস্তি তো ভোগ করবেই। উপরন্তু যারা তার অনুকরণে উক্ত খারাপ কাজ করবে, তাদের কর্মফলও সে ভোগ করবে। অথচ সেই অনুকরণকারীদের শাস্তি কিছুমাত্র কম হবেনা।’’
মহত্তম হতে আল্লাহ যে নিদের্শ দিয়েছেন, সে বিষয়েও ম্যাকিয়াভেলী ছিলেন সম্পূর্ণ অনবহিত। আল্লাহ বলেন, ‘‘ভাল ও মন্দ সমান হতে পারেনা। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা; ফলে তোমার সঙ্গে যার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে
অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত।’’
আল্লাহ আরো বলেন, ‘‘মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ এবং যে ক্ষমা করে দেয় ও আপোস-নিষ্পত্তি করে তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট আছে। আল্লাহ যালিমদেরকে পসন্দ করেন না।’’
অন্যায় আচরণের প্রতিরোধ ও পৃথিবীতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ইসলামের সামাজিক শিক্ষার চূড়ান্ত লক্ষ্য। দুঃখজনক হলো, আজকের মুসলিম শাসকদের অনেকেই ম্যাকিয়াভেলীর ‘শৃগাল ও সিংহের’ নৈতিকতা অনুসরণ করছেন। মুসলিম শাসকরা ইসলামের মানবিক নৈতিকতার মূল স্রোত থেকে কতটা দূরে তা ভাবলে অবাক হতে হয়।
২৬. ইসলামে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে নৈতিকতা [Morality In Islam To Build Person, Society and State]ঃ
নৈতিক চরিত্রের পূর্ণতা বিধানই ছিল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে রাসূল হিসেবে প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য। মানব সমাজের সার্বিক কল্যাণের উৎস হচ্ছে সে সমাজের মানুষের উন্নত নৈতিক চরিত্র। নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে যে লোক সর্বোত্তম, ইসলামের দৃষ্টিতে সেই উত্তম ব্যক্তি এবং আখিরাতেও উত্তম নৈতিক চরিত্র হবে পাল্লায় ভারী। আল্লাহ মানব জাতিকে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানই শুধু দেননি, একজন সর্বোত্তম নৈতিকতা সম্পন্ন অনুসরণীয় রাসূলও পাঠিয়েছেন।
আল্লাহ বলেন, ‘‘আমরা এ গ্রন্থে [কুরআনে] কোন কিছুই বাদ রাখিনি।’’
আল্লাহ আরো বলেন, ‘‘আজ আমি তোমাদের জন্যে দীনকে [জীবন বিধান]-কে পূর্ণতা দান করলাম।’’
আর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই তুমি মহান নৈতিক চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’’
একটি উন্নত নৈতিকতাসম্পন্ন ভিত্তির উপর ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে মহান আল্লাহতায়ালা কিছু ডিভাইন ফর্মুলা প্রদান করেছেন। যার উপর ভিত্তি করে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সভ্যতায় এক অতুলনীয় সমাজব্যবস্থা উপহার দিয়েছিলেন। যা মানবসভ্যতাকে অজ্ঞতা ও পাশবিকতার অন্ধকার হতে উন্নত চরিত্র ও মানবিকতার আলোর মুখ দেখিয়েছে। সংক্ষেপে সে সূত্রগুলোই নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ
২৬.১] আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদাত না করা ঃ বস্ত্ততঃ মানুষের মত মর্যাদাবান সত্তার ইবাদাত পাবার যোগ্যতা আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। যদিও মানুষ আগুন, সূর্য, প্রাণী ও গাছ-পাথরের পূজাও করছে। এ ধরণের পূজা মানুষের মর্যাদার অবমাননা। গোটা সৃষ্টির মধ্যে মানুষের মর্যাদার চেয়ে একমাত্র আল্লাহর মর্যাদা উন্নত। সুতরাং মানুষ তার চেয়ে Inferior মর্যাদার কোন সত্তার প্রতি মাথা নত করতে পারে না। যারা তা করে তাদের সেসব কর্মকান্ড অস্বাভাবিকতার শামিল। এটা সেসব মানুষের এক ধরণের বিশ্বাসের বিকৃতি।
২৬.২] বাবা-মায়ের সাথে ভাল ব্যবহার নিশ্চিত করা ঃ পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষ জীবন দর্শন ‘মা দিবস’ ও ‘বাবা দিবস’ উপহার দিয়েছে। আর মা-বাবার সবচেয়ে নাজুক সময়, বৃদ্ধ বয়সের জন্য ওল্ড হোম সংস্কৃতির প্রচলন করেছে। বাবা-মায়ের প্রতি দুর্ব্যবহার, অবহেলা, তাচ্ছিল্য আর ১৮ বছর হলেই বাবা-মাকে আইন দেখানোর অধিকার অর্জন এবং নৈতিক বাঁধনকে ছুড়ে ফেলা, এগুলো হলো ধর্মনিরপেক্ষতার পাশ্চাত্য উপহার। অন্যদিকে ইসলাম সন্তানকে নির্দেশ দিচ্ছে, বাবা-মায়ের সাথে ধমকের সুরে কথা বলা যাবে না। নম্র ভাষায় কথা বলতে হবে। দুর্ব্যবহার তো দূরের কথা; বৃদ্ধ বয়সের অসংলগ্ন কথা ও আচরণের জন্য তাদেরকে ‘উফ’ পর্যন্ত বলা যাবে না এবং ওল্ডহোম নয় তাদেরকে বৃদ্ধ বয়সে নিজেদের কাছে রেখে সেবা করতে হবে। প্রিয় পাঠক, তাহলে কোন্ জীবনদর্শন মানবিক, ধর্মনিরপেক্ষ পাশ্চাত্যের নাকি ইসলামের? অবশ্যই আপনার বিবেকের উত্তর হল মানবিক জীবনাদর্শ ইসলামের পক্ষে। আর প্রকৃতই যদি সন্তানরা তাদের বাবা-মায়ের সাথে তা করে যা ইসলাম বলেছে; তাহলে, সন্তান ও পিতা-মাতার সম্পর্কের গভীরতা কি অতলান্ত হত না? পৃথিবীটা অনির্বচনীয় অনুভূতিতে ভরে উঠতো।
২৬.৩] আত্মীয়, মিসকীন ও মুসাফিরদের অধিকার আদায় করতে হবেঃ ইংরেজিতে Tax, Charity এবং Rights এই তিনটি শব্দের আভিধানিক ও ব্যবহারিক ব্যবধান বিস্তর। পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষ জীবন দর্শনে আত্মীয়, মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য কোন ‘অধিকার বা Rights’ বলে কিছু নেই। সেখানে Charity বা দয়া-দাক্ষিণ্য আছে, তবে তা সম্পূর্ণ ব্যক্তির খেয়াল-খুশীর উপর নির্ভরশীল এবং তা ইসলামের বিধানের মত এত সুস্পষ্টভাবে শ্রেণীবদ্ধ বা ক্লাসিফাইড নয়। আর এ কারণেই পাশ্চাত্যে কুকুর-বিড়ালকেও উইল করে সম্পত্তি দেয়ার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। আর ইসলামে বিষয়টি শুধু Charity বা দয়া-দাক্ষিণ্যের বিষয় নয়, এটা আত্মীয় মিসকীন ও মুসাফিরের অধিকার। আর ধনী ব্যক্তিদেরকে এ অধিকার আদায় করতে বলা হয়েছে। বিষয়টা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই করতে হবে এবং এর অন্যথা হলে অবশ্যই জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে। প্রিয় পাঠক, কতটা মানবিক ইসলামের জীবনবিধান! ইসলামের বিধানটি জ্ঞানভিত্তিক, কোন ব্যক্তির খেয়াল-খুশির বা মর্জির অধীন নয়। অন্যদিকে পাশ্চাত্য বিধানটি অন্ধ, একদেশদর্শী এবং সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তির খেয়াল-খুশির অধীন। পাশ্চাত্য জীবন দর্শনের চেতনায় কাউকে জবাবদিহির প্রয়োজন নেই মর্মে শেখানো হয় আর সেভাবেই মানুষের মধ্যে জবাবদিহির চেতনাহীন ভাবধারা গড়ে উঠে। যদিও সব মানুষকেই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে হবে এবং তার কাজের জন্য জবাবদিহিও করতে হবে। যদি জীবনটা জবাবদিহিমূলকভাবে গড়ে তোলা যেত তবে তাই হতো বুদ্ধিমানের কাজ। জবাবদিহিমূলকভাবে জীবন গড়াই মানবজাতির প্রতি ইসলামের এপ্রোচ। যাতে করে প্রকৃত জবাবদিহির দিন তা সহজ হয়। পৃথিবীতেও মানুষ সুখী হয়। জীবনের অর্থ খুuঁজ পায়। ধনী, দরিদ্র, আত্মীয়, মিসকীন, মুসাফির - জনে জনে মমত্ববোধ ছড়িয়ে পড়ে।
২৬.৪] নম্র ভাষায় ফিরিয়ে দেয়া, দুর্ব্যবহার করে নয়ঃ মানুষ মাত্রই আত্মমর্যাদাবোধ দ্বারা পরিচালিত। আল্লাহ বলেন, ‘‘আমি তো আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি।’’ মানুষের এই মৌলিক প্রকৃতিকে পারস্পরিকভাবে সম্মান করতে ইসলাম আহবান করছে। আত্মীয়দের মধ্যে কেউ অভাবী হলে, কোন মানুষ মিসকীন কিংবা মুসাফির হলে, এমনকি সে যে ধর্মেরই হোক না কেন, তাকে ফিরিয়ে দিতে হলে নম্র ভাষায় ফিরিয়ে দিতে হবে। কোন অবস্থাতেই দুর্ব্যবহার বা কর্কশ ভাষা ব্যবহার করে কারো আত্মমর্যাদায় আঘাত না করা। তার প্রতি অসম্মানজনক আচরণ না করা। এই সর্বজনীনতা ও আর্ন্তজাতিকতা ইসলামের এক অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য। ইসলাম ছাড়া আর কোন জীবনদর্শনে মানুষকে এতটা সম্মানের চোখে বিবেচনা করেনি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের এই অধিকার ঘোষণা করেনি। আল্লাহতায়ালা হুকুম করেছেন; আর তা মানার কাজ তো মানুষের। আর এভাবে মানুষের অধিকার স্বেচ্ছায় প্রদান করা হলে পৃথিবীতে অশান্তি বিরল অনুভূতিতে পরিণত হবে।
২৬.৫] অপচয়কারী শয়তানের ভাই। সম্পদ বা সময় অপচয় না করাঃ অপব্যয় বা অপচয় উভয়টিই ব্যক্তির ব্যক্তিগত খেয়াল বা মর্জির উপর নির্ভরশীল। যে কোন বিচারে লোভ ও অহংকারই অপব্যয় বা অপচয়ের নেপথ্য প্রেরণাদায়ক শক্তি। তাই অপচয় বা অপব্যয়ের জন্য তিনটি শর্ত প্রযোজ্য : ০১. অহংকার ০২. লোভ ০৩. সম্পদের প্রাচুর্য। উক্ত তিনটি শর্তের মধ্যে সম্পদের প্রাচুর্য উল্লেখ করা হলেও সীমিত সম্পদেও অপব্যয় বা অপচয় করা সম্ভব। সম্পদ সীমিত হোক বা প্রাচুর্য থাকুক অহংকার ও লোভ, মানুষকে সম্পদের অপচয় বা অপব্যয়ে অলক্ষ্যে পরিচালিত করে। অপব্যয় বা অপচয় ধনীকে দরিদ্র এবং দরিদ্রকে দরিদ্রতর অবস্থানে উপনীত করে প্রাকৃতিক নিয়মেই। এছাড়া অপব্যয় বা অপচয় সমাজে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানকে কমাতে সাহায্য করে না বরং বাড়িয়ে দেয়। কোনো ব্যক্তি বা জাতিই অপচয়কারী হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছে এমন একটি দৃষ্টান্তও নেই। সম্পদ ও সময়ের সুষ্ঠূ ব্যবহারের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে বিশ্বের সব উল্লেখযোগ্য সভ্যতা। আল্লাহ মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সূত্রই মানবজাতিকে জানিয়ে দিলেন আর সতর্ক করলেন অহংকারী শয়তানের ধ্বংসের পথ, দরিদ্রতার পথ ও পতনের পথকে এড়িয়ে চলতে। অহংকার ও লোভের কারণে অপব্যয় বা অপচয় এবং অপচয়ের ফলাফল দারিদ্রতায় উপনীত হওয়া এ সবকিছু মানুষকে প্রকারান্তরে অকৃতজ্ঞ মানুষে পরিণত হতে সাহায্য করে। অহংকারী শয়তানের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘‘ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করলো; সে অমান্য করলো ও অহংকার করলো। সুতরাং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হলো।’’ আল্লাহ আরো বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু’’ এবং শয়তান ‘‘কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে’’। শয়তান ‘‘দয়াময় আল্লাহর প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ’’। এভাবে অহংকার ও লোভের প্রবৃত্তির প্রশ্রয়ে আর অহংকারী ও অকৃতজ্ঞ শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ হয়ে উঠে অপচয়কারী আর পরিণত হয় ‘শয়তানের সহোদর’-এ।
২৬.৬] অর্থ সম্পদ ব্যয়ে না কৃপণতা, না ছন্নছাড়া বরং মধ্যপন্থা অবলম্বন করাঃ ধন-সম্পদের ব্যাপারে মানুষের দুর্বলতার একটি বস্ত্তনিষ্ঠ চিত্র ফুটে উঠেছে সূরা আত্ তাকাসুর-এ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনীত হও।’’ প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতার মাঝে লুকিয়ে আছে কৃপণতা এবং উপর্যুপরি সম্পদ বৃদ্ধির মানসিকতা। মানসিকতাটি এতই তীব্র যে, কবরে উপনীত হওয়া পর্যন্ত মানুষের এই প্রবণতার স্থায়িত্ব। এই প্রবণতায় সম্পদ খরচের চেয়ে জমা করা বা পুঞ্জিভূত করা বা কৃপণতা করাই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এতে সম্পদ কিছু লোকের মাঝে কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হতে থাকে। ‘‘দারিদ্র কখনো কখনো কুফরি বা সত্য প্রত্যাখ্যানে পরিণত হতে পারে।’’
ইসলাম সে ব্যক্তিকে মুমিন বলে স্বীকার করেনি, যার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে আর সে নিজে পেট পুরে খায়। ‘‘সে ব্যক্তি ঈমানদার নয় যে তার প্রতিবেশী যখন তার নিকটেই ক্ষুধার্ত রয়েছে, তখন সে পেট পুরে খায়।’’ তাই সম্পদ ব্যয়ে আল্লাহতায়ালা মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘‘তুমি তোমার হাত তোমার গ্রীবায় আবদ্ধ করে রেখোনা এবং তা সর্ম্পূণ প্রসারিতও করোনা, তাহলে তুমি তিরস্কৃত ও নিঃস্ব হয়ে পড়বে।’’
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিভিন্ন হাদীস হতে বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘‘প্রতিদিন বান্দাহ যখন সকালে উঠে তখন দু’জন ফেরেশতা আগমন করেন। তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ, খরচকারীর ধন আরো বাড়িয়ে দিন এবং দ্বিতীয়জন বলেন, হে আল্লাহ, কৃপণকে ধ্বংস করে দিন।’’
আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর (রা) থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ইসলামের কোন্ কাজটি সবচেয়ে উত্তম বা কল্যাণকর? তিনি বললেনঃ অভুক্তকে বা ক্ষুধার্তকে আহার করানো এবং চেনা-অচেনা সকলকে সালাম দেয়া।’’
হাকীম ইবন হিযাম (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ ‘‘স্বচ্ছলতা বজায় রেখে যে দান করা হয় সেটাই উত্তম দান। উপরের হাত [দাতা] নিচের হাতের [ভিক্ষাকারী বা প্রার্থনাকারী] চেয়ে উত্তম। তুমি তোমার পোষ্যদের থেকে দান-খয়রাত শুরু করো।’’
আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘‘একটি দীনার তুমি আল্লাহর পথে ব্যয় করলে, একটি দীনার দাস মুক্তির জন্য, একটি দীনার মিসকীনদেরকে দান করলে এবং আর একটি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করলে। এর মধ্যে [সাওয়াবের দিক দিয়ে] ঐ দীনারটিই উত্তম যা তুমি তোমার পরিবারের লোকদের জন্য ব্যয় করলে।’’
মুসাআব ইবন সা’দ (র) থেকে তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘‘আমি একবার মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট সংবাদ পাঠালাম। তিনি আসলে আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে অনুমতি তিন আমার যেখানে ইচ্ছা আমার যাবতীয় সম্পদ বন্টন করে দেই। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিষেধ করলেন। আমি বললাম, তাহলে অর্ধেক বন্টন করে দেই? কিন্তু তাতেও তিনি রাজি হলেন না। আমি বললাম, তাহলে এক-তৃতীয়াংশ বন্টন করি? এবার তিনি নিরব রইলেন। এরপর এক-তৃতীয়াংশ [ওসিয়াত করা] জায়েয হয়ে গেলো।’’
২৬.৭] ছেলে হোক বা মেয়ে হোক দারিদ্রের আশংকায় সন্তান হত্যা না করাঃ আল্লাহ খেলাচ্ছলে বিশ্ব সৃষ্টি করেননি। বিশ্ব সৃষ্টির একটা উদ্দেশ্য আছে। আল্লাহ বলেন, ‘‘আকাশ ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মাঝে যা আছে তা আমি ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি।’’ আল্লাহ আরো বলেন, ‘‘আমি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং এ দু’য়ের মাঝখানে যা কিছু আছে সে সব খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমি সেগুলি সৃষ্টি করেছি সঠিক উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাদের অনেকেই তা বোঝে না।’’ আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন তেমনি এক মহান উদ্দেশ্যে। যারা দারিদ্রের আশংকায় সন্তান হত্যার মত অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তারা একদিকে নিজেদের দায়িত্ব অবহেলার দায় প্রকারান্তরে সন্তানের উপর চাপায়, অন্যদিকে আল্লাহর মহান উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখে। আল্লাহ বলেন, ‘‘তারা আমার কোন ক্ষতি করেনি, তারা নিজেদের ক্ষতি করেছে।’’ তাদের দৃষ্টিতে সন্তান সম্পদ নয়, আপদ। অথচ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষ মাত্রই সম্পদ। মানুষ জন্ম থেকেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। মানুষকে সম্পদে পরিণত করার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদানের এই সামান্য দায়িতবটুকু পালন করতে ব্যর্থ হয়ে আমরা ভ্রুণ পর্যায়ে সন্তান হত্যায় লিপ্ত হই। অভাব বা অস্বচ্ছলতার আশংকায় বা স্বাচ্ছন্দ্যের অভাবকে কেন্দ্র করে যারা এ ধরণের হত্যায় লিপ্ত তাদের অধিকাংশই সম্পদের বিচারে অভাবী নন। এটা শুধুই তাদের মানসিক ভয়। আর এই ভয়ের তাড়নায় তারা ভ্রুণ হত্যার মত পাপে জড়িয়ে পড়েন। তবে মানুষকে সম্পদে পরিণত করার এই কাজটুকু নিঃসন্দেহে ব্যক্তির একার পক্ষে সম্ভব নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের সক্রিয় সহযোগিতায় তা কেবল সম্ভব হতে পারে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘‘বিশ্বাসীরা একে অন্যের নিকট একটা ইমারত [এর অংশ] স্বরূপ, প্রত্যেক অংশ অপর অংশগুলোকে দৃঢ় করে।’’ সুতরাং সন্তান হত্যার মত পাপকর্ম হতে বেঁচে থাকতে ব্যক্তির ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকাও। প্রসংগত রাষ্ট্রের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা উপলব্ধি করতে হযরত উমার (রা) জীবন থেকে কিছু উদ্বৃত করছিঃ হযরত উমার (রা) তাঁর জীবনের শেষ বছরে একাধিকবার বলেছেন, ‘‘আল্লাহ যদি আমাকে পরমায়ূ দেন আমি দেখবো - যাতে করে ‘সানা’ পর্বতমালার নিঃসংগ মেষপালকও জাতির সম্পদে তার অংশ পায়।’’
‘‘হযরত উমারই [রা] ২০ হিজরীতে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর আদমশুমারীর উদ্দেশ্যে ‘দীওয়ান’ নামক একটা বিশেষ সরকারী বিভাগের গোড়াপত্তন করেন। এই আদমশুমারীর ভিত্তিতে কতিপয় শ্রেণীর লোকের জন্য বার্ষিক রাষ্ট্রীয় পেনসন নির্ধারিত হতো। এরা হচ্ছেনঃ ক. বিধবা এবং ইয়াতিমেরা; খ. রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবিতকালে ইসলামের সংগ্রামে যারা পুরোভাগে ছিলেন তাঁদের সকলে, রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিধবা পত্নীগণ, বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকরীদের মধ্যে যাঁরা বেuঁচছিলেন তাঁরা, গোড়ার দিকের মুহাজিরগণ এবং গ. সকল অক্ষম, পংগু, অসুস্থ, বৃদ্ধ লোকেরা। এই পরিকল্পনা মুতাবিক ন্যূনতম বার্ষিক ভাতার পরিমাণ ছিল দু’শত দিরহাম। এমনকি শিশুরা নিজেদের ভরণ-পোষণ করতে অসমর্থ কালে এই নীতির ভিত্তিতে জন্মমুহূর্ত থেকে শুরু করে সাবালকত্ব প্রাপ্তি পর্যন্ত সময়ের জন্য শিশুদের নিয়মিত ভাতারও ব্যবস্থা করা হয়েছিল, আর এই ভাতা দেয়া হতো বাবা-মা অথবা অভিভাবকদেরকে।’’
এমন একটি মানবিক সমাজ আর জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল রাষ্ট্রপ্রধান তো সবারই প্রত্যাশিত। কিন্তু সারা বিশ্বের ম্যাকিয়াভেলীর ভাবশিষ্যরা মানুষকে মানবিক জীবন-যাপন করতে দিতে প্রস্ত্তত নয়। কারণ এরা মানুষকে সিংহ আর শৃগাল-এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে শিখেনি।
২৬.৮] ব্যভিচারের কাছেও না যাওয়াঃ একজন মুসলিমকে আল্লাহতায়ালা ব্যভিচারের কাছে যেতেই নিষেধ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘‘আর ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না, এটি অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।’’ সেই সাথে এও আদেশ করেছেন, ‘‘মুমিনদেরকে বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযাত করে; এটিই তাদের জন্য উত্তম। তারা যা করে নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত।’’ যারা আল্লাহতায়ালার এই আদেশকে অহংকারের সাথে অস্বীকার করে এবং পরিণতির বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ‘‘আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে, অতঃপর আমি তাকে হীনতাগ্রস্তদের হীনতমে পরিণত করি [অর্থাৎ তার কর্মদোষে সে অবনতির
নিম্ন স্তরে পৌঁছে।]’’ আল্লাহ আরো বলেন, ‘‘কিতাবীদের মধ্যে যারা কুফরী করে তারা এবং মুশরিকরা জাহান্নামের অগ্নিতে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে; এরাই সৃষ্টির অধম। যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ।’’ ব্যভিচারের প্রতি এতটা সুস্পষ্ট নৈতিক অবস্থান পৃথিবীর আর কোথাও নেই। নারীর মর্যাদার এই গ্যারান্টি, এই সুরক্ষা আর কে দিয়েছে ইসলাম ছাড়া? বর্তমানে নারীরা সমাজে প্রগতির দোহাই এবং অচলায়তন ভাঙ্গার উছিলায় যেভাবে নিজেদের খোলামেলা উপস্থাপন করছে তাতে একজন পুরুষের এবং একজন নারীর চোখের দৃষ্টি থেকে মস্তিস্কের নির্দেশে ডোপামিন নরএপিনেফ্রিন, ফিনাইল-ইথাল এমাইন এবং অক্সিটোসিন হরমোন নিঃসরণ করে ক্রমাগত। দৃষ্টি ও দর্শন যত বাড়বে হরমোনের নিঃসরণ ততই বাড়বে আর এই হরমোনগুলো নারী-পুরুষের ভেতরে জৈবিক প্রয়োজন সৃষ্টি করবে। মানুষ অনুভব করবে Biological তাড়না। এটি সৃষ্টিগতভাবেই এমন। আল্লাহ যেভাবে তৈরি করেছেন তাকে অস্বীকার করার কোনো ক্ষমতা মানুষের নেই। আর তাই পাশ্চাত্য জগতে নারীকে যতই দর্শনীয় ও আকর্ষণীয় করতে উন্মুক্ত হতে বলা হচ্ছে, ধর্ষণের মাত্রা ততই বাড়ছে। আর ব্যভিচারের মাত্রা তো কল্পনাতীত সংখ্যক। ফ্রি সেক্সের গোটা পাশ্চাত্যের দেশগুলোর দিকে নজর দিলেই এর প্রমাণ মিলবে। গোটা পাশ্চাত্য আজ ব্যভিচারে সয়লাব। অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভুত বিশ্বে আলোড়িত ‘দি ফিমেল ইউনাক’ বইয়ের নারীবাদী লেখিকা ‘জামেইন গৃয়ার’-এর উপর ‘যায়যায়দিন প্রতিদিন’ একটি ফিচার প্রকাশ [৮ এপ্রিল, ১৯৯৯] করেছিল। তাতে লেখিকার ভালবাসার নামে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া এবং পরবর্তীতে তার ধর্ষিতা হবার বর্ণনার ভেতর দিয়ে পাশ্চাত্য সমাজে ব্যভিচার ও ধর্ষণ যে পাল্লা দিয়ে চলছে তার এক নিখুঁত চিত্রই ফুটে উঠেছে। মুসলিম হিসেবে নিজেদের দর্শন [Philosophy], ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে অজ্ঞ এবং পৌরানিক ও পাশ্চাত্য বস্ত্তবাদী সভ্যতার ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনের প্রভাবে হীনমন্যতা রোগে আক্রান্ত বেশকিছু আদমশুমারী ভিত্তিক মুসলিম প্রধান দেশ ব্যাপকভাবে ব্যভিচার ও ধর্ষণ সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের কেউ কেউ ধর্ষণের সেঞ্চুরীও উদযাপন করেছে। দুর্ভিক্ষপীড়িত অনাহারী মানুষ যেমন ক্ষুধার তাড়নায় খাদ্য-অখাদ্য বিবেচনাবোধ হারিয়ে ইতর প্রাণীর সাথে খাদ্য অন্বেষণে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় তেমনি স্খলিত কিছু নারী-পুরুষ যৌন দুর্ভিক্ষে এতটাই আক্রান্ত হয়েছে যে তা বর্ণনার অতীত। ব্যভিচার ও ধর্ষণ দিয়ে কোনো মানবিক ও উচ্চ নৈতিকতার সমাজ গঠন হয় না। ম্যাকিয়াভেলীর শৃগাল ও সিংহের সমাজ হতে পারে।
২৬.৯] আল্লাহতায়ালার বিধান সম্মত নয় এমন কোন হত্যাকান্ড না ঘটানোঃ হত্যার বিষয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘‘যে কোন লোক কোনো মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে, তার প্রতিফল হচ্ছে জাহান্নাম। সে চিরকালই সেখানে থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হন এবং তার প্রতি অভিশাপ করেন এবং তার জন্য কঠিন আযাব প্রস্ত্তত করে রেখেছেন।’’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘‘কোনো মুমিনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার চাইতে দুনিয়াটা ধ্বংস হয়ে যাওয়াই আল্লাহতায়ালার কাছে অধিকতর সহজ।’’ হত্যা প্রধানতঃ তিনভাবে হতে পারে। এক. ইচ্ছাকৃত হত্যা; দুই. ভুলবশতঃ হত্যা; তিন. কারণবশত: হত্যা। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘‘ইচছাকৃত হত্যাতেই কেবল মৃত্যুদন্ড প্রযোজ্য হবে।’’ হত্যাকান্ড কতটা ভয়ানক ক্রোধ ও শাস্তির কারণ তা কুরআনের আয়াত ও হাদীস হতে সুস্পষ্ট। আত্মহত্যা করাকেও আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন হারাম করে দিয়েছেন। ‘‘শুধু পাচঁটি ক্ষেত্রে আল্লাহ হত্যার অনুমতি দিয়েছেন। এক. ইচ্ছাকৃত হত্যাকারীকে কিসাসের দন্ড হিসেবে হত্যা করা। দুই. যুদ্ধের ময়দানে ইসলামের দুশমনকে হত্যা করা। তিন. ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎপাটনের চেষ্টাকারীকে দন্ডস্বরূপ হত্যা করা। চার. বিবাহিত নারী-পুরুষকে, যারা পরস্পর সম্মতিক্রমে ব্যভিচার করেছে; তার দন্ডস্বরূপ রজম করা। পাঁচ. মুরতাদকে দন্ডস্বরূপ হত্যা করা। তবে কোন ব্যক্তি বা দল নিজেই হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকারী নয়। এজন্য ইসলামী আদালতের রায় প্রয়োজন হবে।’’ সার্বিক বিচারে একজন মুসলিম বেপোরোয়া জীবন-যাপন করতে পারে না। একজন মুসলিমকে এতটা সতর্ক থাকতে হবে যে তাকে দিয়ে যেন কোন ইচ্ছাকৃত তো দূরে থাক, কোনো ভুলবশতঃ হত্যাকান্ডও যেন না হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ডারউইনের যোগ্যতমের উদ্বর্তন আর ম্যাকিয়াভেলীর জাতীয় রাষ্ট্রদর্শনের প্রভাবে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সারা বিশ্বে রাজনৈতিক মতপার্থক্যকের ফলে অসহিষ্ণুতার কারণে অন্যায় হত্যাকান্ড মামুলী ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব পাশবিকতার মূল কারণ, আল্লাহর বিধানকে পাশ কাটিয়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধান করার ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ খোঁজা। উপর্যুপরি অন্যায় হত্যাকান্ডে বিবেকবান মানুষের অন্তর আজ অধিক শোকে নির্বাক পাথর হয়ে গেছে।
২৬.১০] ইয়াতিমের সম্পদকে হিফাযাত করা, আত্মসাৎ না করাঃ মৃত্যু ও জীবনকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, পরীক্ষা করে দেখতে কর্মে কে শ্রেষ্ঠ? আল্লাহ বলেন, ‘‘মহামহিমান্বিত তিনি, সর্বময় কর্তৃত্ব যাঁর করায়ত্ত; তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করবার জন্য - কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম?’’ পিতার মৃত্যুর কারণে অভিভাবকহীন সন্তানই ইয়াতিম। আর মৃত্যু আল্লাহতায়ালাই সৃষ্টি করেছেন। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে সন্তান অসহায় ও ইয়াতিম হলো আল্লাহতায়ালা তার দায়িত্ব নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে মানবিক সমাজ গঠনে সমাজ ও রাষ্ট্রের করণীয় কী তা বলে দিলেন। সমাজ বা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কাউকে না কাউকে ইয়াতিমের অভিভাকত্ব গ্রহণ করতে হবে এবং তাকে ইয়াতিমের সম্পদের রক্ষকরূপে দায়িত্ব পালন করতে হবে। যিনি ইয়াতিমের সম্পদের রক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নিলেন, অবশ্যই তিনি উন্নত নৈতিক গুণ আমানাতদারীর পরীক্ষায় পড়ে গেলেন। এই পরীক্ষায় যেন উত্তীর্ণ হওয়া যায়, রক্ষক হয়ে যেন কেউ ভক্ষক না হয় বা ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎ না করে সে কথা আল্লাহতায়ালা স্মরণ করিয়ে দিলেন। অর্থাৎ কেউ যদি রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তবে তা যে নিকৃষ্টতম কর্ম তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। তাই ইয়াতিমের অভিভাবকত্ব গ্রহণ একদিকে যেমন একটি পরীক্ষা অন্যদিকে তা মানবিক সমাজ গড়ার অন্যতম হাতিয়ার।
২৬.১১] ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পালন করাঃ পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক, জীবনের সকল ক্ষেত্রে যখন ওয়াদা পালনকারীকে বোকা এবং ওয়াদা খেলাপকারীকে বাহাদুর মনে করার মত সামাজিক প্রবণতা কোন সমাজে দেখা যায়, তখন বোধগম্য কারণেই সমাজে ওয়াদা খেলাপকারী, ঋণখেলাপকারী ইত্যাদি নানা খেলাপকারীর জ্যামিতিক হারে পয়দা হতে থাকে। আর এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না যে, সে সমাজে শান্তি বায়বীয় পদার্থে পরিণত হয় এবং সে সমাজ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। সমাজকে এতটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে খাবি খেতে দিতে ইসলাম মোটেই পছন্দ করেনি। সমাজের শান্তি বিনষ্টকারী এই কুঅভ্যাসকে ইসলাম কঠোর জবাবদিহির বিষয় বলে আগাম জানিয়ে দিয়েছে। সমাজে নৈরাজ্য উৎপাদনকারী সেই উপকরণকে প্রশ্রয়দানকারী ব্যক্তি ও সমাজ ধর্ম-বর্ণ নিবি©র্শষে মানবতার শত্রু এবং এরা সংখ্যায় কম নয়। এসব ব্যক্তিও সমাজের কাছে ইসলামের প্রতিশ্রুতি পালনের সংস্কৃতি বোকামী সদৃশ এবং এরা এ সংস্কৃতির ঘুণ। প্রতিশ্রুতি পালন যে শান্তিতে জীবন-যাপনের জন্য অপরিহার্য উপাদান সচেতন যে কোন নাগরিককে তা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই।
২৬.১২] মাপে কম না দেয়া, পূর্ণমাপে প্রদান করাঃ মাপে কম না দেয়া বা পূর্ণ মাপে দেয়ার বিষয়টি জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রয়োজন। মাপের বিষয়টি শুধু ব্যবসা সংশ্লিষ্ট নয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক,
আন্তর্জাতিক, ব্যবসায়িক জীবনের সব ক্ষেত্রেই রয়েছে লেনদেন। আর লেনদেন মানেই পরিমাপ। হয় কম বা বেশি। ইসলাম সকল প্রকার লেনদেনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সাথে পূর্ণমাপে তার প্রাপ্য প্রদানের কথা বলেছে। যদি বাস্তবিকই তা আমরা করতে সক্ষম হই তবে পৃথিবীতে সুবিচার এতটা দুস্প্রাপ্য হয়ে উঠবে না; যতটা এখন আমরা পাই। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সাথে পূর্ণমাপে লেনদেন করার বিষয়টি যদি ধরে নেয়া হয় যে
বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে তবে পৃথিবীতে শান্তির দুলর্ভতা দূর হয়ে যেত। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক, আন্তর্জাতিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমরা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছি। মিথ্যাচার করা প্রকৃতপক্ষে এক ধরণের মাপে কম দেয়া, মানুষকে ঠকানো। মিথ্যাচার যেন জীবনের প্রতি বন্দরে বন্দরে নোঙর করা জাহাজ। এভাবে মানুষকে ঠকিয়ে কে কবে শান্তির বিশ্ব গড়ে তুলতে পেরেছে? ইসলাম জীবনের সব ক্ষেত্র হতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে পরিমাপে কম দিয়ে ঠকানোর অনৈতিক অমার্জনীয় অমানবিক গুরুতর অপরাধকে অংকুরেই মিটিয়ে দিতে চায়। মানুষের নৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে এই গুরুতর অমানবিক অপরাধকে মিটিয়ে দিতে পারলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই বিশ্ব কি এক অনির্বচনীয় আত্মার বন্ধনে একসূত্রে গ্রথিত হতো না? ধর্ম-রক্ত-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষকে আত্মার আত্মীয় করার ইসলামের এই সূদুর প্রসারী মনোভংগিটি জাত-পাত দিয়ে মানুষের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর নির্মাণকারীদের কাছে কোনদিন সহনীয় হবে?
২৬.১৩] জ্ঞান ও যাচাইকৃত তথ্যভিত্তিক আচরণ করাঃ তথ্যকে যাচাই না করেই ঘটনার প্রতিকারে লেগে যাওয়া কিংবা তথ্যকে যাচাই না করেই কারো বিরুদ্ধে বা কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বা কোনো জাতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সমাজের জন্য ক্ষতিকর পরিণতি বয়ে আনে। চক্ষু-কর্ণ-হৃদয় দিয়ে যাচাই করে, প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করে বিবেকসম্মত উপযুক্ত মতামত বা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত বা logical। এতে অন্যের সম্মান ও মর্যাদায় অর্বাচীনের মত অহেতুক আঘাত করা থেকে বেঁচে থাকা যায়। বিনা কারণে কারো অধিকারে
হস্তক্ষেপ করার অভদ্রতা ও ইতর সদৃশ আচরণ থেকে দূরে থাকা যায়। একইভাবে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও নাযিলকৃত কিতাব সম্পর্কে না জেনে কোন মন্তব্য করা, চক্ষু-কর্ণ-হৃদয় থাকা সত্বেও এক ধরণের অন্ধত্ব। ইসলাম জ্ঞানভিত্তিক আচরণ বা চক্ষু-কর্ণ-হৃদয় দিয়ে যাচাই করা পরিশীলিত আচরণ করতেই মানুষকে নির্দেশ দিচ্ছে। সমাজে এ ধরণের আচরণের প্রসার ঘটলে সে সমাজ সোনালী সমাজে পরিণত হয়। মুমিনদের মধ্যে এভাবেই নাগরিক অধিকারগুলোর চর্চা হোক এবং বিকশিত হোক - এটাই ইসলামের দাবী।
২৬.১৪] ভূ-পৃষ্ঠে দাম্ভিকতার সাথে চলাফেরা না করাঃ যত বিশাল পরাশক্তির কর্ণধার হউন না কেন, এককভাবে কোন মানুষ তো নয়ই, পৃথিবীর সব মানুষের পদভারেও পৃথিবী বিদীর্ন করা সম্ভব নয়। তাছাড়া মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে, মানুষ আল্লাহর সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ জীব। সুতরাং দম্ভভরে চলার কোন যুক্তিসংগত কারণ মানুষের নেই। তারপরও আমরা অহেতুক গর্ব অহংকারে মত্ত হই। আর এই অহংকারই পৃথিবীতে সকল ধরণের বৈষম্য সৃষ্টির উৎস। সকল ধরণের অনৈক্যের ও অশান্তির কারণ। বিশ্বের দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের কারণও এটি - তৎকালীন পরাশক্তিগুলোর অহংকার। দুই বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বকে বাসের অযোগ্য করে তুলেছিল। এ সবই পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় দর্শনের অসামান্য উপহার। অন্যদিকে ইসলাম মানুষকে আহবান করছে, অনুসরণ করতে বলছে যে, মানুষের অহংকার করার কিছু নেই। আল্লাহই সব মানুষের রব বা প্রতিপালক, মালিক এবং সৃষ্টিকর্তা। অহংকার করার অধিকার আল্লাহর। যোগ্যতা আল্লাহর। মানুষকে বিনয়ী হয়ে চলতে বলা হয়েছে। প্রিয় পাঠক, পরাশক্তিগুলো যদি শক্তির মাদকতায় অহংকারী না হয়ে বাস্তবে বিনয়ী হত; তবে পৃথিবীতে কি বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হওয়া সম্ভব ছিল? পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করার মনোভাব ছাড়া বিনয়ী যে কোন মানুষের সাথে ঝগড়া করা কি সম্ভব? অহংকার পতন আর অশান্তির প্রতীক। বিনয় শান্তি ও মর্যাদার প্রতীক। ইসলাম মানুষকে বিনয়ী হতেই নির্দেশ দিচ্ছে। শান্তি ও মর্যাদার দিকেই ইসলামের আহবান। ব্যক্তি, জাতি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই ইসলামের লক্ষ্য ।
আল্লাহ বলেন, ‘‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। এর পাহারায় নিয়োজিত রয়েছে কঠিন শক্ত ফেরেশতারা। যারা আল্লাহর নির্দেশের অবাধ্যতা করে না। তারা তাই করে যা তাদের প্রতি আদেশ দেয়া হয়ে থাকে।’’
আল্লাহ আরো বলেন, ‘‘ স্থায়ী জান্নাত, তাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তারাও, এবং ফেরেশতাগণ তাদের নিকট উপস্থিত হবে প্রত্যেক দ্বার দিয়ে এবং বলবে ‘ তোমরা ধৈর্য ধারণ করেছো বিধায় তোমাদের প্রতি শান্তি; কত ভাল এই পরিণাম!’।’’
পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার মধ্য দিয়ে একটি উচ্চ নৈতিকতা সম্পন্ন পরিবার গড়ে তোলার মাধ্যমে এক মানবিক সমাজ গড়ে তোলাই ইসলামের লক্ষ্য। সুন্দর ও আকর্ষণীয় উন্নত নৈতিক চরিত্রের ব্যক্তি ও শান্তিপূর্ণ মানবিক সমাজ বিনির্মাণে, উন্নত সভ্যতার গোড়াপত্তনে আল কুরআনে বর্ণিত উপরের ডিভাইন ফর্মুলার বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই।
২৭. উপসংহার [Conclusion]ঃ
যেখানে শিক্ষা সেখানেই নৈতিকতার পাঠ। শিক্ষা যখন অশিক্ষা-কুশিক্ষার নামান্তর হয়; তখন নৈতিকতাও এর ব্যতিক্রম হতে পারে না। নৈতিকতা সব সময়ই শিক্ষার অনুগামী। শিক্ষা নিরপেক্ষ নৈতিকতার কোন অস্তিত্ব নেই। তাই নৈতিকতা আগে না শিক্ষা আগে এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। শিক্ষাই নৈতিকতার উৎস। একটি মানবিক সমাজ গড়তে শিক্ষার গুরুত্ব তাই অপরিসীম।
আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় নৈতিকতার বহুরূপ আমরা দেখতে পাই। আর এর পেছনে রয়েছে শিক্ষার ভূমিকা। পাশ্চাত্য, ভারতীয় ইত্যাদি নানা আদর্শের শিক্ষা নানামুখী নৈতিকতা সৃষ্টিতে নিরলস অবদান রেখে যাচ্ছে এ দেশে। এ শিক্ষা যে শুধু আনুষ্ঠানিক তা নয়, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার অবদান এক্ষেত্রে সিংহভাগ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীরা যতটুকু নৈতিকতার পাঠ পায় তার চেয়ে বেশি পায় টিভি, মুভি, ইন্টারনেট এসব অনানুষ্ঠানিক Education Source হতে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার এই বহুমুখীতায় এমন একটি সমাজ ক্রমশঃ গড়ে উঠছে বা উঠেছে যেখানে নাগরিকদের মাঝে চিন্তার কোনো ঐক্য নেই। নৈতিকতার ঐক্য নেই। এ ধারার শিক্ষায় কোনো শক্তিশালী ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। রক্ত-বংশ-বর্ণ-গোত্র-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মানবিক নৈতিকতা সৃষ্টিতে অবদান রাখতে সক্ষম এমন একটি শিক্ষানীতি গ্রহণ করা হলে তা শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই নমুনা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারতো। ইসলাম নৈতিকতার যে ডিভাইন ফর্মূলা দিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা হলে অনায়াসে একটি উন্নত নৈতিকতাসম্পন্ন মানবিক সমাজ গড়া সম্ভব।
বাংলাদেশে বর্তমানে অনুসৃত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি কার্যতঃ ম্যাকিয়াভেলীর শৃগাল ও সিংহের নৈতিকতাসম্পন্ন পাশবিক সমাজ গঠনের বিকাশ ঘটাবে এবং সমাজে ছড়িয়ে পড়বে নৈরাজ্য, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, খুন-খারাবি, ছিনতাই-রাহাজানি, সম্ভ্রমহানি আর ধনী-দরিদ্রের অর্থনৈতিক বৈষম্যের আকাশ ছোঁয়া ব্যবধান। আর এভাবে দেশের মানুষের জীবন অসহনীয় হয়ে উঠা সময়ের ব্যাপার মাত্র। ইসলামী নৈতিকতার মত একটা মানবিক দিক নির্দেশনা থাকার পরও যারা ভিন্ন শিক্ষাদর্শনের অনুগামী হয়ে মনুষ্যত্ব ধ্বংসকারী নৈতিকতার জনক-জননী হতে আগ্রহী তাদের মনুষ্যত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হতেই পারে। ইসলামী নৈতিকতাগুলো এতটা টেকসই ও স্থিতিস্থাপক যে তা অনায়াসে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র - একই সাথে সবক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা সম্ভব। মানবতার কল্যাণকামী সব বিদগ্ধজনেরা বস্ত্তনিষ্ঠভাবে ইসলামী নৈতিকতাগুলো প্রয়োগ করলে মানবজাতি মুক্তির দিশা ফিরে পেত। কারণ ইসলামী নৈতিকতাতে শুধু মুসলিমদের নয়; গোটা মানবজাতিরই অধিকার রয়েছে।

[প্রবন্ধটি ৩০শে জুলাই, ২০১১ তারিখে বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে উপস্থাপিত হয়।]

 

রেফারেন্সঃ

. সূরা তীন ৯৫ঃ আয়াত নং-৫
. সূরা সাফ ৬১ঃ আয়াত নংঃ ২-৩
. প্রফেসর মোঃ আনসার আলী, শিক্ষা নীতি পরিক্রমা, মিতা ট্রেডার্স, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ৩৮, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০, জুলাই ১৯৯৫, পৃ.৭
. http://education12world.blogspot.com/2010/07/meaning-and-definition-of-education.html
. শিক্ষা নীতি পরিক্রমা, প্রাগুক্ত, পৃ.১১-১২
. আবদুস শহীদ নাসিম, বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষা নীতির রূপরেখা, Islamhouse.com/2009।
. সূরা ইয়াসীন ৩৬ঃ আয়াত নং-০২।
. সূরা নমল ২৭ঃ আয়াত নং- ০৬
. গত বছর ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রীর বোন ‘লরেন বুথ’ ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ঘোষণা দেন। পশ্চিমা গবেষকরা বিভিন্ন মাসজিদে জরিপ করে বের করার চেষ্টা করেন যে গত এক বছরে কতজন নতুন করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। সে হিসেবে ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনে গত এক বছরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন প্রায় ১,৪০০ জন। এর ভিত্তিতে গড় হিসেব করে সারা দেশে এক বছরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের হার দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ২০০ জন। / দৈনিক প্রথম আলো, ৬ জানুয়ারী ২০১১, পৃ-১১। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সাড়া জাগানো অভিনেত্রী ‘প্যারিস হুইটনি হিলটন’-এর মুখপাত্র আয়ান ব্রিঙ্কহাম সিবিএস নিউজকে এ কথা জানিয়েছেন যে ‘প্যারিস হিলটন’ শান্তির ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করেছেন। / দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০১১, পৃ-০১।
সূরা জুমুয়া ঃ ৬২ আয়াত নং- ০২ ও ০৩।
. সূরা আয্-যুমারঃ ৩৯ আয়াত নং-০৯
. সূরা আল-মুজাদিলাঃ ৫৮ আয়াত নং-১১
. সূরা আল ‘আলাক ৯৬ঃ আয়াত নং- ১-৫
. সূরা আল বাকারা ২ঃ আয়াত নং -৩১ ও ৩২
. সূরা আল বাকারা ২ঃ আয়াত নং -২৫৫
. সূরা আল বাকারা ২ঃ আয়াত নং -২৫১
. সূরা আল বাকারা ২ঃ আয়াত নং -২৮২
. সূরা আন নিসা ৪ঃ আয়াত নং- ১১৩
. সূরা তাহা ২০ঃ আয়াত নং-১১৪
. সূরা জুমুয়া ৬২, আয়াত নং- ০২ ও ০৩।
. সূরা কাহাফ ১৮ঃ আয়াত নং-৬৫
. সূরা আলে-ইমরান ০৩ঃ আয়াত নং-০৭।
. সূরা ইউসুফ ১২ঃ আয়াত নং-৩৭।
. সূরা ইউসুফ ১২ঃ আয়াত নং-১০১।
. সূরা আম্বিয়া ২১ঃ আয়াত নং-৮০।
. সূরা কাহফ্ ১৮ঃ আয়াত নং-১০১।
. আবুল হাশিম, ইসলামের মর্মকথা, ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ প্রকাশনা-২০৩, পৃ.৬৯।
. সূরা ইউনুস ১০ঃ আয়াত নং-১৯।
. ইসলামের মর্মকথা, প্রাগুক্ত, পৃ.৭৪।
. সূরা বানী ইসরাঈলঃ ১৭, আয়াত নং- ৩১-৩৮।
. শিক্ষা নীতি পরিক্রমা, প্রাগুক্ত, পৃ. ২।
. সেমিনার স্মারক গ্রন্থ [২০০৩-২০০৫], বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা, জুলাই ২০০৬, পৃ. ৩৯-৪০।
. শিক্ষা নীতি পরিক্রমা, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫-২৮।
. ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুসলিম দার্শনিকদের স্বকীয়তা [ইসলামী দর্শনের রূপরেখা], ইফা প্রকাশন নং-৩৯১, পৃ. ১৬৩।
. সূরা আল আনআম; ০৬ : আয়াত নং- ৭৬-৭৯।
. সূরা আল হাজঃ ২২, আয়াত নং - ৪৬।
. মোঃ আব্দুস সামাদ, তুলনামূলক শিক্ষা, প্রভাতী লাইব্রেরি, ৩৮, বাংলাবাজার, ঢাকা। তৃতীয় প্রকাশ ২০১০, পৃ, ১২৯।
. Gandhi, Mahatma, M.K. in his Introduction to The Sayings of Muhammad by Allama Sir Abdullah Al-Mamun Al-Suhrawardy, Calcutta, March 24, 1938. Islam: What Others Say, Page-96 Sayd Ashraf Ali, Islamic Publications, 1993]
. শিক্ষা নীতি পরিক্রমা, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৯-১৩০।
. সূরা আহযাব ৩৩ঃ আয়াত নং- ২১।
. সূরা জুম’আ ৬২ঃ আয়াত নং- ০২।
. সূরা ‘আলাক ৯৬ঃ আয়াত নং- ১-৫
. মোহাম্মদ সা’দাত আলী, জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমান, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ৭ জিন্দাবাহার ১ম লেন, ঢাকা-১১০০। পৃ. ৩০-৩২।
. জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১০।
. মানবেন্দ্রনাথ রায়,ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকা, অনুবাদক-বদিউর রহমান, ১ম সংস্করণ, ফেব্রুয়ারী, ২০০৬,প্যাপিরাস, বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০, পৃ. ৪৬।
. সূরা বাকার ০২ঃ আয়াত নং- ৩১।
. অধ্যক্ষ মুহাম্মাদ যাইনুল আবেদীন, আদর্শ শিক্ষকের পুঁজি, মিল্লাত পাবলিকেশন্স ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ১ মার্চ ২০০৭, পৃ. ১৪।
. সূরা নাহল ১৬ঃ আয়াত নং- ৭৮।
. আদর্শ শিক্ষকের পুঁজি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫।
. তিরমিযী/ মিশকাত। এন্তেখাবে হাদীস, ১ম ও ২য় খন্ড, আব্দুস শহীদ নাসিম অনূদিত, হাদীস নং-৪২,পৃ. ৫৬।
. সূরা আল বাকারা ০২ঃ আয়াত নং- ২০১।
. সহীহ জামে আত তিরমিযী।
. সূরা আয্ যুমার ৩৯ঃ আয়াত নং- ০৯।
. সূরা হাজ ২২ঃ আয়াত নং- ৪৬।
. মুসনাদে আহমদ।
. সহীহ আল বুখারী ও মুসলিম।
. সূরা মুল্ক ৬৭ঃ আয়াত নং- ২৬।
. সূরা হাশর ৫৯ঃ আয়াত নং- ২২।
. সূরা আল বাকারা ০২ঃ আয়াত নং- ২৫৫।
. সহীহ আল বুখারী।
. সূরা আয যারিয়াত ৫১ঃ আয়াত নং- ৫৬।
. সূরা আল বাকারা ০২ঃ আয়াত নং- ৩০।
. আল-কুরআনুল করীম; সূরা মায়িদা ০৫ঃ আয়াত নং- ০২।
. সহীহ আল বুখারী, কিতাবুল জিয্ইয়া, হাদীস নং - ৩১৬৬।
. সূরা আনকাবুত ২৯ঃ আয়াত নং- ৪৬।
. সূরা আল আন‘আম ০৬ঃ আয়াত নং- ১০৮।
. সূরা আলে-ইমরান ০৩ঃ আয়াত নং- ১৯০ ও ১৯১।
. সূরা ফাতির ৩৫ঃ আয়াত নং- ২৭ ও ২৮।
. সূরা ইনশিরাহ ৯৪ঃ আয়াত নং- ১,২ ও ৩।
. সূরা আম্বিয়া ২১ঃ আয়াত নং- ১০৭।
. সূরা আল বাকারা ০২ঃ আয়াত নং- ১৭৭।
. সূরা নাসর ১১০ঃ আয়াত নং- ১, ২ ও ৩।
. সূরা বনী ইসরাঈল ১৭ঃ আয়াত নং- ৩৭।
. সূরা বনী ইসরাঈল ১৭ঃ আয়াত নং- ৩৬।
. সূরা হুজুরাত ৪৯ঃ আয়াত নং- ০৬।
. সূরা হুজুরাত ৪৯ঃ আয়াত নং- ০৯।
. সহীহ আল বুখারী, হাদীস নং-২২৬৫।
. বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৪০টি বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু স্থায়ী আদর্শ না থাকায় এখনো এদেশের জন্য একটি কাঙ্ক্ষিত শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৪ সনে ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিলো। কিন্তু বাংলাদেশের মুসলিম জাতিসত্ত্বার চিন্তা-চেন্তনার পরিপন্থী হওয়ায় তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। পরবর্তী কালে আরো কয়েকটি শিক্ষা কমিটি গঠিত হয়েছিলো। কিন্তু ড. কুদরাত-ই-খুদা কমিশন প্রণীত শিক্ষানীতি অবলম্বন করে এগুতে গিয়ে সেই কমিটিগুলোও জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি। কিন্তু কুদরাত-ই-খুদা কমিশন কর্তৃক প্রণীত এবং জাতি কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত সেই শিক্ষা নীতিকেই ভিত্তি বানিয়ে সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ২০০৯ কর্তৃক সুপারিশের আলোকে নতুন শিক্ষানীতি সম্প্রতি দেশে চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষানীতির ঐতিহাসিক পটভূমি সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলতে গেলে বলতে হয়, ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের প্রাক্কালে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি অঙ্কশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র ও ব্যাকরণ শিক্ষার প্রচলন ছিল। মুসলিম শাসনের আমলে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। মক্তব ও মাদ্রাসা, মাসজিদ ও মঠ এবং ব্যক্তিগত বাড়িতেও শিক্ষা কর্ম চলতো এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে বর্ণ-গোত্র-ধর্ম নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল। স্থায়ী জীবনাদর্শের ভিত্তিতে সে শিক্ষানীতি পরিচালিত হওয়ায় দীর্ঘ মুসলিম শাসনামলে শিক্ষানীতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন করতে হয়নি। কিন্তু, বৃটিশ শাসনের পত্তন হবার পর হতে এর ইতিহাস সদা পরিবর্তনশীলতার ইতিহাস। তার কিছু নমুনা উল্লেখ করছিঃ এডামস রিপোর্ট (১৮৪৪); উডস ডেসপাস (১৮৫৪); হান্টার কমিশন (১৮৮২); লর্ড কার্জনের শিক্ষা সংস্কার (১৮৯৮); স্যাডলার কমিশন (১৯১৭); সার্জেন্ট পরিকল্পনা (১৯৪৪); আকরাম খান কমিটি (১৯৫২); আতাউর রহমান খান কমিশন (১৯৫৭); শরীফ কমিশন (১৯৫৮); এয়ার মার্শাল নূর খান শিক্ষা কমিশন (১৯৬৯); জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০ এবং সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ২০০৯।

. http://en.wikipedia.org/wiki/Morality
. সূরা কালাম; ৬৮ : আয়াত নং- ০৪।
. সূরা আহ্যাব; ৩৩ : আয়াত নং- ২১।
. Michael H. Hart, The 100, A Ranking of The Most Influential Persons In History, pp-33.
. Sayd Ashraf Ali, Islam: What Others Say, Islamic Publications, 1993, Page-221.
. Ibid, Page-96.
. ইসলামের মর্মকথা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৫-৫৬।
. ড. শমশের আলী, মাদকাসক্তিঃ পারিবারিক মূল্যবোধ ও ইসলামী দর্শন, ইসলামিক স্টাডিজ জার্নাল অব ড. সিরাজুল হক ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, ঢাবি, পৃ.-৪৭।
. সূরা আল-মায়েদাঃ ০৫ আয়াত-৩২।
. সহীহ আল বুখারী ও মুসলিম।
. সহীহ মুসলিম।
. সহীহ মুসলিম।
. সূরা হামীম আস্-সাজদাঃ ৪১ : আয়াত নং-৩৪।
. সূরা শূরাঃ ৪২ : আয়াত নং-৪০।
. সূরা আনআ’মঃ ০৬ : আয়াত নং-৩৮।
. সূরা মায়িদাঃ ০৫ : আয়াত নং-০৩।
. সূরা কালামঃ ৬৮ : আয়াত নং- ০৪।
. সূরা বানী ইসরাঈল ১৭ঃ আয়াত নং-৭০
. সূরা বাকারা ০২ঃ আয়াত নং-৩৪।
. সূরা ইউসুফ ১২ঃ আয়াত নং-০৫।
. সূরা নাস ১১৪ঃ আয়াত নং-০৫।
. সূরা বানী ইসরাঈল ১৭ঃ আয়াত নং-২৭।
. সূরা তাকাসুর ১০২ঃ আয়াত নং-১,২।
. আস-সূয়ুতি, ‘আল-জামী আস-সগীর।’
. আল বাইহাকী, ইবন আববাস বর্ণিত।
. সূরা বানী ইসরাঈল ১৭ঃ আয়াত নং-২৯।
. সহীহ মুসলিম [কিতাবুয্ যাকাত]; হাদীস নং-২৩৩৬/৫৭।
. সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, হাদীস নং-১৬০/৬৩।
. সহীহ মুসলিম, [কিতাবুয্ যাকাত];হাদীস নং-২৩৮৬/৯৫।
. সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ২৩১১/৩৯।
. সহীহ মুসলিম, ফাদাইলুস সাহাবা, হাদীস নং-৬২৩৮/৪৩।
. সূরা আম্বিয়া ২১ঃ আয়াত নং-১৬।
. সূরা দুখান ৪৪ঃ আয়াত নং-৩৮, ৩৯।
. সূরা বাকারা ০২ঃ আয়াত নং-৫৭।
. সহীহ আল বুখারী, আবু মূসা বর্ণিত।
. ইবন সা’দ ৩/১ খন্ড, পৃষ্টা : ২১৪-২১৭।
. মুহাম্মাদ আসাদ, ইসলামে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার মূলনীতি, শাহেদ আলী অনূদিত, পৃ.-১০৫।
. সূরা বানী ইসরাঈল ১৭ঃ আয়াত নং-৩২।
. সূরা নূর ২৪ঃ আয়াত নং-৩০।
. সূরা তীন ৯৫ঃ আয়াত নং- ৪ ও ৫।
. সূরা বায়্যিনা ৯৮ঃ আয়াত নং- ৬ ও ৭।
. সূরা নিসা; ০৪ঃ আয়াত নং-৯৩।
. আত তিরমিযী, [কিতাবুদ দিয়াত], হাদীস নং-১৩৯৫; ইবন মাজাহ, [কিতাবুদ দিয়াত], হাদীস নং- ২৬১৯।
. দারাকুতনী, আস-সুনান, [কিতাবুদ দিয়াত], হাদীস নং-৪৫।
. এ.কে.এম. নাজির আহমদ, দারসুল কুরআন সংকলন-২, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা, পৃষ্ঠা:৩৭-৩৮।
. সূরা মুল্ক ৬৭ঃ আয়াত নং-১ ও ২
. সূরা বানী ইসরাঈল ১৭ঃ আয়াত নং-৭০।
. সূরা তাহরীমঃ ৬৬ : আয়াত নং-০৬।
. সূরা আর রাদ; ১৩ : আয়াত নং-২৩ ও ২৪।